বাংলাদেশ
অবতরণিকা
০১.
এই নয় মাসে যা ঘটেছে সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে তুলনাহীন। পাঠক সাধারণ যেন না ভাবেন এটা একটা কথার কথা মাত্র। ঠিক দু মাস পূর্বে ১৫ জানুয়ারিতে আমি এখানে এসেছি। দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস ধরে আমার অগণিত আত্মীয় আত্মজনের আপন আপন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা দিনের পর দিন শুনে গিয়েছি। এমন একটি মাত্র প্রাণী পাইনি যার কোনও কিছু বলার নেই। মাত্র চার বছরের শিশুরও তার আপন গল্প আছে। সে আদৌ বুঝতে পারেনি ব্যাপারটার কারবার জীবন-মৃত্যু নিয়ে। আমাকে বললে, মা আমার হাত চেপে ধরে চানের ঘরে নিয়ে গিয়ে ফিস্-ফিস্ করে বললে, চুপ করে থাক, কথা বলিসনি, টু শব্দটি করবিনি। সমস্তক্ষণ কানে আসছে বোমা ফাটার শব্দ। আমি ভেবেছি, একসঙ্গে অনেকগুলি বিয়ের আতশবাজি ফাটছে। মা এত ভয় পাচ্ছে কেন? …প্রাচীন দিনের এক বন্ধু তাঁর বাড়ি নিয়ে গেলেন– তাঁর আত্মীয়েরা আমার সঙ্গে পরিচিত হতে চান। গিয়ে দেখি, প্রাচীনতর দিনের সখা আমার প্রিয় কবি আবুল হোসেন বৈঠকখানার তক্তপোশে বসে আত্মচিন্তায় মগ্ন। আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন, এই যে। যেন ইহসংসারে এই ন-মাসে বলার মতো কিছুই ঘটেনি। আর পাঁচজন আশ-কথা পাশ-কথা বলছিলেন। বর্বর না-পাকদের সম্বন্ধে মামুলি কথা। আমি কেন জানিনে কবির দিকে একবার তাকালুম। তারই পাশে আমি একটি কৌচে বসেছিলুম। অতি শান্তকণ্ঠে ধীরে ধীরে বললেন, আমার চুয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ আব্বা গাঁয়ের বাড়ির বৈঠকখানায় চুপচাপ বসেছিলেন। জানতেন না-পাকরা গায়ে ঢুকেছে। তিনি ভেবেছেন, আমি চুয়াত্তর বছরের বুড়ো। আমার সঙ্গে কারওরই তো কোনও দুশমনি নেই।… না-পাকরা ঘরে ঢুকে তাকে টেনে রাস্তায় বের করে গুলি করে মারল।
আমি কোনও প্রশ্ন শুধোইনি। কোনওকিছু জানতে চাইনি।
আমার নির্বাক স্তম্ভিত ভাব দেখে আর সবাই আপন আপন কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিলেন। কিছুক্ষণ পরে সে জড় নিস্তব্ধতা ভাঙবার জন্য আমিই প্রথম কথা বলেছিলুম। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণে এনে প্রার্থনা করছি, হে আল্লাতালা, এ সন্ধ্যাটা তুমি আমাকে কাটিয়ে দিতে দাও, কোনও গতিকে।
আমার বিহ্বলতা খানিকটে কেটে গিয়েছে ভেবে–আল্লা জানেন, এ বিহ্বলতা কালধর্মে ক্রমে ক্রমে ক্ষীণতর হবে কিন্তু এটাকে সমূলে উৎপাটিত করার মতো যোগীশ্বর আমি কখনও হতে পারব না– এক দরদি শুধোল, আপনারও এ ন-মাস নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তায় কেটেছে। আপনার স্ত্রী আর দুটি ছেলে তো ছিল ঢাকায়।
আমি বললুম, আপনাদের তুলনায় সে আর তেমন কী? সেকথা না হয় উপস্থিত মুলতুবি থাক।
নানা জাতের আলোচনা ভিড় জমাল। তবে ইয়েহইয়ার আহাম্মখী, ভুট্টোর বাঁদরামি, পাকিস্তানের (বাংলাদেশ রাহুমুক্ত হওয়াতে পাকিস্তানের যে অংশটুকু বাকি আছে তাই নিয়ে এখন বাকিস্তান) ভবিষ্যৎ মাঝে মাঝে ঘাই মেরে যাচ্ছিল। কথাবার্তার মাঝখানে আমার মনে হল, এঁরা যেন আমাকে স্পেয়ার করতে চান বলে আপন আপন বীভৎস অভিজ্ঞতার কথা চেপে যাচ্ছেন।
এমন সময় গৃহকর্তা আমার সখা এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার ছোট বোনটি আপনাকে দেখতে চায়। আমি একগাল হেসে বললুম, বিলক্ষণ, বিলক্ষণ! নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমি যে অত্যন্ত গ্যালান্ট সে তো সবাই জানে।
সাদামাটা গলায় বন্ধু যোগ করলেন, এর উনিশ বছরের ছেলেটিকে পাকসেনারা গুলি করে মেরেছে।
.
পাঠক ভাববেন না, আমি বেছে বেছে কতকগুলি বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত উদাহরণ দিয়ে ন-মাসের নির্মমতার ছবি আঁকছি। তা নয়। এ মন্বন্তর এ মহাপ্রলয় এমনই সর্বব্যাপী, এমনই কল্পনাতীত বহুমুখী, প্রত্যেকটি মানুষের হৃৎপিণ্ডে এমনই গভীরে প্রবেশ করেছে, এক একটা শাণিত শর, যেন এক বিরাট প্রাবন সমস্ত দেশটাকে ডুবিয়ে দিয়ে সর্বনরনারীর হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি র কর্দমাক্ত জলে ভরে নিরন্ধ করে দিয়ে এই দুখিনী সোনার বাংলাকে এমনই এক প্রেত-প্রেতিনী গুশৃগালের সানন্দ হুহুঙ্কার ভূমিতে পরিণত করে দিয়ে গিয়েছে, যে তার সর্বব্যাপী সর্বাত্মক বহুবিচিত্র রূপ আপন চৈতন্যে সম্পূর্ণরূপে সংহরণ করতে পারেন এমন মহাকবি মহাত্মা কোনও যুগে জন্মাননি। এরই খণ্ডরূপ আয়ত্ত করে প্রাচীনকালে কবি-সম্রাটগণ মহাকাব্য রচনা করেছেন। আমার মনে হয় একমাত্র মধুসূদন যদি এ যুগের কবি হতেন তবে তিনি মেঘনাদবধ না লিখে যে মহাকাব্য রচনা করতে পারতেন তার তুলনায় মেঘনাদ ঝিল্লিধ্বনির ন্যায় শোনাত।
হয়তো বহুযুগ পরে, মহাকালের পরিপ্রেক্ষিতে, চক্রনেমির পূর্ণাবর্তন সম্পূর্ণ হলে মানুষ পুনরায় মহাকাব্য রচনা করতে সক্ষম হবে। যদি হয়, তবে সে মহাকাব্যের সম্মুখে অন্য সর্ব মহাকাব্য নিষ্প্রভ জ্যোতিহীন হয়ে যাবে। একমাত্র মহাভারতই তখনও ভাস্বর থাকবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে বলি সম্পূর্ণ নিরর্থক পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় বাংলাদেশের সে মহাকাব্য পরবর্তী সর্ব মহাকাব্যের অগ্রজরূপে পূজিত হবে।
জানি, ভীমসেন দুঃশাসনের রক্তপান করেছিলেন। কিন্তু সেটা প্রতীক। এস্থলে পাকসেনারা নিরীহ বালকের আধখানা গলা কেটে ছেড়ে দিয়েছে। বালক ছুটেছে প্রাণরক্ষার্থে, হুমড়ি খেয়েছে, পড়েছে মাটিতে, আবার উঠেছে আবার ছুটেছে। বধ্যভূমি অতিক্রম করার পূর্বেই তার শেষ পতন।
খান সেনারা প্রতি পতন, প্রতি উত্থানে খল-খল করে অট্টহাস্য করেছে।
শুনেছি কে কজনকে এ পদ্ধতিতে নিধন করা হয়েছে তার রেকর্ড রাখা হত এবং পদোন্নতি তারই ওপর নির্ভর করত।
.
মহাকাব্য লেখা হোক, আর না-ই হোক, এদেশের দাদি নানী এখনও রূপকথা বলেন। মরণোন্মুখ রাক্ষসী পাগলিনী প্রেতিনীপারা, দক্ষিণে বামে সর্ব লোকালয় জনপদ বিনাশ করতে করতে ছুটে আসছে যে-ভোমরাতে তার প্রাণ লুক্কায়িত আছে সেটাকে বাঁচাতে। এসব রূপকথা ভবিষ্যতের কপ-কথার সামনে নিতান্তই তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে মনে হবে। যে চার বছরের মেয়েটির কথা বলেছিলাম সে যেদিন দাদি নানী হবে–ইতোমধ্যে সমস্ত জীবন ধরে বিকট বিকট দুঃখ-দুর্দৈবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বয়ান যার জীবনে জমে জমে হয়ে উঠবে পর্বতপ্রমাণ– সে যে রাক্ষসীর বর্ণনা দেবে সে রাক্ষসী সংখ্যায় ক্রমবর্ধমান অগণিত। মান্ধাতার আমলের সাদা-মাটা রাক্ষসী রাস্তায় দাঁড়াত না–এসব রাক্ষস ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের আধখানা গলা কেটে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে, গ্রামের মসজিদ দেউলের সামনে ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে ভস্মশয্যায় গড়াগড়ি দেবে। অঋতুপ্রাপ্তা শিশুকন্যাকে পাশবিক অত্যাচারে অত্যাচারে নিহত করে প্রেতার্চনার থালা সাজাবে নরখাদক পিশাচরাজ ইয়েহিয়ার পদপ্রান্তে।
অন্তরীক্ষে শঙ্কর স্তম্ভিত হয়ে তাণ্ডবনৃত্য বন্ধ করবেন।
লক্ষ বিষাণে ফুঙ্কারে ফুঙ্কারে কর্ণপটহবিদারক ধ্বনিতে ধ্বনিতে আহ্বান জানাবেন লক্ষ লক্ষ চক্রপাণিকে– এবারে মাত্র একটি সতীদেহ খণ্ডন নয়।
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত পিশাচ বহির্গত বন্দিশালা হতে
মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি ফুকারি উড়ায়ে চলে পথে—
সে নিধন ভবিষ্যতের পুরাণে কী রূপ নেবে সে তো এ যুগের নরনারীর দৃষ্টিচক্রবালের বহু সুদূরে।
পুরাণের উপাদান যখন নির্মিত হয়েছিল তখন কি সেকালের মানুষ জানত ভবিষ্যতের মহাকবি পুরাণে তাকে কীভাবে বর্ণাবেন?
পুরাণ পড়ে একদা আমার মনে হত এসব সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। শুধু প্রশংসা করেছি পুরাণকারের কল্পনাশক্তির। আজ জানি, নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছিল যার জন্য কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়নি।
.
আগামী দিনের রূপকথার প্রসঙ্গে এসে গেল পুরাণের–নব-ভবিষ্যপুরাণের স্বরূপ-কাহিনী। কিন্তু এ দুই ইতিহাস কাব্যের সংমিশ্রণ একই উপাদানে নির্মিত হয়। একটি সম্মান পায় সাহিত্যের সিংহাসনে, অন্যটি আদর পায় ঠাকুরমার কোলে।
সাধারণজনের বিশ্বাস, মুসলমানদের পুরাণ নেই। আছে :–
রাণীর আকৃতি দেখি বিদরে পরাণ।
নাকের শোয়াস যেন বৈশাখী তুফান ॥
দুধে জলে দশ মণ করি জলপান।
আশী মণী খানা ফের খায় সোনাভান ॥
শৃঙ্গার করিয়া বিবি বামে বান্ধে খোঁপা।
তার পরে খুঁজে দিল গন্ধরাজ চাপা।
যে রানির শ্বাস কালবৈশাখীর মতো, যিনি নাশতা করেন দশমণ ওজনের দুধ-জল দিয়ে এবং মধ্যাহ্নভোজনের ওজন যার আশি মণ, তিনি যদি পুরাণের নায়িকা না হন তবে কিসের? তাই সোনাভানের পুঁথি কেচ্ছা-সাহিত্যের অনবদ্য কুতুবমিনার।
আর রূপকথা? তার তো ছড়াছড়ি। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি!
গালেবুতুরুম বাশশা (বাদশাহ)–পাঠক, গালেবুতুরুম নামটার দিকে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করি– অবশ্য বস্তুতান্ত্রিক সমালোচক আপত্তি জানিয়ে বলবেন, গালেবুতুরুম্ গাল-ভরা নাম; এটা শোনার জিনিস, দেখার নয়–অতএব পাঠকের কর্ণ আকর্ষণ কর। কিন্তু করি কী প্রকারে? ব্যাকরণসম্মত বাক্যই যে সুজনসম্মত কর্ম হবে শাস্ত্রে তো সেরকম কোনও নির্দেশ নেই।
গালেবুতুরুম বাশশা; মক্কাশশর (মক্কা শহরে) তার বারি (বাড়ি)। পাঠক সাবধান, আরবভূমির প্রামাণিক ইতিহাস অনুসন্ধান করতে যেয়ো না। এ বাশশা, এ মককাশশর বাস্তব জগৎ ছাড়িয়ে চিন্ময় দুলোকের চিরঞ্জীব আকাশকুসুম রূপে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে।
এবং এ ন-মাসের কাহিনী তার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ পাবে ভাটিয়ালি গীতে। কত বিচিত্র রূপ নেবে সে আমার কল্পনার বাইরে। একটা মোতিফ যে বার বার ঘুরেফিরে আসবে সে বিষয়ে আমার মনে কোনও দ্বিধা নেই।
মুক্তিফৌজে ডাকে মোরে,
থাকুম্ ক্যামনে কও!
গামছা দিয়া পরানডারে
বাইন্ধা তুমি লও।
পাঠক আমার অনধিকার চর্চা ক্ষমা কর।
কিন্তু যেসব সমসাময়িক সাহিত্যস্রষ্টা এ যুগের ক্ষুধা এ যুগের চাহিদা মেটাতে পারতেন তাঁদের অনেকেই তো আজ আর নেই। হায়দার কোথায়, কোথায় মনির? আমি শুধু আমার অন্তরঙ্গজনের কথাই বলছি। এসব বাংলাদেশী-সাহিত্যিকদের প্রতিই তো ছিল ইয়েহিয়ার বিকটতম আসুরিক জিঘাংসাবৃত্তি।
আমার পিঠুয়া ছোট বোনের ছেলে একটি চাটগাঁয়ে ব্যবসা করত। ভালো ব্যবসা করত। সে যত না সাহিত্য সৃষ্টি করত, তার চেয়ে বেশি করত সাহিত্যসেবা। ব্যবসা থেকে দু পয়সা বাঁচাতে পারলেই বের করত ত্রৈমাসিক– প্রাচী।
এপ্রিলের গোড়ার দিকে না-পাকরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারে।
.
০২.
না-পাক অফিসারদের ভিতর এক ধরনের চটি ত্রৈমাসিক বিলি করা হয়। আষ্টেপৃষ্ঠে কড়া পাঠনাই জবানে ছাপা থাকে অনধিকারীর হস্তে এ কেতাব যেন কস্মিনকালেও না পড়ে; ফালতো কপি যেন ফলানা ঠিকানায় পাঠানো হয়। কিন্তু প্রাণের ভয়ে যখন মোগল পাঠান তুর্ক আফগান (অবশ্য পাকিস্তানিরা) মুক্তকচ্ছ হয়ে বাপ্পো-বাপ্পো রব ছেড়ে পালাচ্ছেন তখন টপসিক্রেটই হয়ে যায় বটমলেস। শুনেছি, শেষ খালাসি লাইফবোটের শরণ না পাওয়া পর্যন্ত মাল জাহাজ এমনকি আধা-বোটের কাপ্তেন তক্ জাহাজ ছাড়ে না– মানওয়ারি জাহাজের কথা বাদ দিন। আর এসব কাপ্তেন-রা জোয়ানদেরও না জানিয়ে রেতের অন্ধকারে, অ্যারোপ্লেন হেলিকপটার যা পান তাই চুরি করে বর্মা বাগে পাড়ি দেন– এগুলো যুদ্ধের কাজে এমনকি আহত সৈন্যদের সরাবার জন্যও যে দরকার হতে পারে সেকথা মনের কোণেও ঠাই না দিয়ে। জোয়ানরা তাই টপসিক্রেট চোখের মণি এইসব বুলেটিন ঠোঙাওলাদের কাছে বিক্রি করেছিল কি না জানিনে* কিন্তু পাকেচক্রে এরই দু চারখানা আমার হাতে ঠেকেছে। যে খায় চিনি তাদের যোগায় চিন্তামণি।
[*সেবারে (১৯৭১-এ) ঈদ পড়েছিল ২০/২১ নভেম্বরে। সেই বাহানায় পাঞ্জাবি মহিলারা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু কিছু অফিসারও সময় থেকে গা-ঢাকা দেবার প্র্যাকটিস রপ্ত করতে থাকেন। ১৬ ডিসেম্বর না-পাক আঁদরেলরা আত্মসমর্পণ করেন। আপিসরেরা তার আগের থেকেই দুই দল নারায়ণগঞ্জ খুলনা থেকে জেলেনৌকোয় করে, তৃতীয় দল প্লেনে করে পালাতে শুরু করেছেন দেখে তাদের বাড়ির পাহারাওলা সেপাইরা হুজুরদের মালপত্র বিক্রি করতে থাকে। পরে আত্মসমর্পণ করার প্রাক্কালে কেউ কেউ গাদা গাদা নোট বাঙালিদের সামনে পোড়ায়– বরঞ্চ যমকে সোয়ামি দেব, তবু সতীনকে না ভাবনা অনেকটা ওই। অন্যরা গোপন জায়গায় পুঁতে রেখে গেছে। শান্তি তো একদিন ফিরে আসবেই; তখন কাবুলিওলার ছদ্মবেশে কিংবা তীর্থযাত্রী রূপে মরে যাই, কী ধর্মপ্রাণ! এদেশে এসে উদ্ধার করবে।]
যেমন আপিসরকে উপদেশ দেওয়া সেই টপসিক্রেট চোখের মণিতে তুমি যদি কোনও নদীপারে পোস্টেড হও তবে জোয়ানদের সাঁতার শেখাবে। ওহ! কী জ্ঞানগর্ভ উপদেশ!
এক ওকিবহাল গুণী ব্যক্তিকে সাঁতার কাটা সম্বন্ধে সেই সদুপদেশের উল্লেখ করতে তিনি মৃদু হেসে বললেন, অইছে, অইছে– জানতি পারেন না। এই যে আপনাদের বাড়ির পিছনে ছোট একটি নালা এসে ঝিলের মতো হয়ে গিয়েছে ওইটে ঈসট পাকিস্তান রাইফেলসের হেড-কোয়ার্টার। ২৫ মার্চের গভীর রাত্রে না-পাকরা কেন্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাঙ্ক মর্টার মেশিনগান কামান দিয়ে আক্রমণ করে বাঙালি জোয়ানদের। ওরাও রুখে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ওরা পারবে কী করে? ওদের ফায়ার পাওয়ার কোথায়? আট আনা পরিমাণ কচুকাটা হয়– ভাগ্যিস বাকিরা পেছন বাগে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে বুড়িগঙ্গা সাঁতার কেটে পেরিয়ে–
সাঁতার কেটে?
এজ্ঞে হ্যাঁ। তার থেকেও না-পাকদের শিক্ষে হয়, এদেশে সাঁতার না-জানাটা কত বড় বেকুবি– রীতিমতো বেয়াদবি!!
আমি তাড়াতাড়ি বললুম, তা বটেই তো, তা বটেই তো! তবে ভাগ্যিস চলে গিয়েছিল বললেন কেন?
গুণী বিরক্তির সুরে বললেন, ঝকমারি! ঝকমারি– আপনাকে এ ন মাসের ইতিহাস শেখানো। এ বি সি দিয়ে তাবৎ বাৎ আরম্ভ করতে হয়। এদেশের শিশুটি পর্যন্ত জানে, এরা এবং (দুই) পুলিশের যে কটি লোক ওই একই ধরনের কিন্তু অনেক মোক্ষমতর হামলা থেকে গা বাঁচাতে পেরেছিল, (তিন) বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে যারা এসে জুটল– এরাই ট্রেনিং দিল ছাত্রদের– তারাও ইতোমধ্যে এসে জুটে গিয়েছে এদের সঙ্গে, খুঁজে বের করেছে ওদের। আর কস্মিনকালেও চাষাভূষো, জেলে-হেলেদের কথা ভুলবেন না। ওদের সাহায্য না পেলে ওই যে তেসরা ডিসেম্বরে মরণকামড় দিলে তিন দল, মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় সেনা, পেছনে-সামনে চাষাভূষোর মদত–সেটা না থাকলে সেটা তেরো দিন না হয়ে কত দিন ধরে চলত কে জানে!
আমি সোল্লাসে বললুম, বর হ বর হ! একদম খাঁটি কথা। এটা মেনে নিতে আমার রক্তিভর অসুবিধা হচ্ছে না। এই ফেব্রুয়ারিতে দেখা হয় আমাদের সিলটা কর্নেল রব-এর সঙ্গে। ইনি ছিলেন জেনারেল ওসমানির চিফ অৰ্ব স্টাফ। এর ওপর ছিল চাটগা-নোয়াখালি-সিলেটের ভার। প্রধান কাজ ছিল, চাটগাঁ বন্দরে না-পাকরা জাহাজ থেকে যেসব জঙ্গি মাল-রসদ নামাবে সেগুলো যেন ঢাকা না পৌঁছাতে পারে। সে কর্মটি এঁর নেতৃত্বে সুষ্ঠুরূপে ন-মাস ধরে সুসম্পন্ন হয়। বিদেশি সাংবাদিকরা একবাক্যে স্বীকার করেছে, মার্চ থেকে ডিসেম্বর না-পাকরা জখমি রেল-লাইন মেরামত করতে না করতেই এঁরা উড়িয়ে দিতেন আবার রেলের ব্রিজ।… তিনি আমাকে বলেছিলেন, ২৬-২৭ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত গেছে সবচেয়ে সঙ্গিন সময়। স্বাধীন-বাংলাদেশ সরকার তখনও তৈরি হয়নি। দেশের ভবিষ্যৎ কোন দিকে, প্রত্যেকের আপন কর্তব্য কী সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকা সত্ত্বেও সেই দিনাজপুর থেকে সিলেট চাটগাঁ বরিশালের লোক অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে যদি সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জান কবুল করে শয়তানের মোকাবেলা না করত তবে পরিস্থিতিটা কী রূপ নিত কে জানে?
তা সে কথা থাক। আপনি বলছিলেন–
হুঁ! সেকথা থাক। তবে এ বিশ-বাইশ দিনের ইতিহাস তার পরিপূর্ণ সম্মান তার পরিপূর্ণ মাহাত্ম্য দিয়ে লেখা উচিত। আমি বিশেষ করে জানতে চাই, তারা এ মনোবল পেল কী করে, কোথা থেকে?
না, না। সাতারের কথা বলছিলম। হারামিরা স্পষ্ট চোখে দেখতে পেল, বাঙালি সমুচা বন্দুক হাতে নিয়ে গপাগপ ডুবসাঁতার দিয়ে বুড়িগঙ্গার জল পেরুল তথাপি বাবুদের কানে জল গেল না। কে জানে, কে বোধহয় হুকুম দিয়েছিল–-ব্যবস্থা করা হল, জোয়ানরা সাঁতার কাটা শেখবেন! আরে মশয়, কাঁচায় না নুইলে বাশ! তদুপরি আরেক গেরো। যে আপিসর হুজুররা ডেঙায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হুকুম কপচাচ্ছেন, তেনারাই যে জলে নাবলে পাথরবাটি। বাজি ছুঁড়ি পয়লা পোয়াতিকে শেখাচ্ছে বাচ্চা বিয়োবার কৌশল।
তদুপরি আরেক মুশকিল, জল পদার্থটা বড় ভেজা।
আমি বললুম, হ্যাঁ, আইরিশম্যান রবারের দস্তানা দেখে বলেছিল, খাসা ব্যবস্থা। দিব্য হাত ধোওয়া যায় জলে হাত না ভিজিয়ে।
গুণী বললেন, আইরিশম্যানের হেড-আপিসে বিস্তর ঘিলু। এদের আণ্ডা সাইজের মাথাভর্তি ঠকঠকে খুঁটে। এদের বেশ কিছু জোয়ান অনেকদিন ধরে এদেশে আছে কিন্তু কোনওপ্রকারের কৌতূহল নেই। শোনেননি বুঝি সেই কুট্টি রসিকতা? ওদিকে কখন যে গুলির ঘায়ে ঘায়েল হবে সে খেয়াল আছে ন সিকে, এদিকে কিন্তু মশকরা না করতে পারলে পেটের ভাত চালভাজা হয়ে যায়।… কুট্টির গণিভাই বাড়ি থেকে বেরুতে ভয় পাচ্ছে। মোগলাই কণ্ঠ বললে, পাঠানগো অত ডরাইস ক্যান– বুদু, বুদু, বেবাক লাইন বুদু। হোন্ কথা। কাইল আমাগো আটকাইছে ইস্কাটনের ধারে। একেক জনরে জিগায়, নাম কিয়া হ্যায়? হিন্দু নাম। অইলেই সর্বনাশ তার লাইগ্যা সাক্ষাৎ কিয়াম (মহাপ্রলয়)। পয়লা তারে দিয়া কবর খোরাইবো। তার বাদে একড়া গুলি। যদি না মরে– বাবুগো হাতের নিশানা, হালা আইনুধারে তেলা হাতে বিল্লির নেঙ্গুর ধরার মতো তো বন্দুকের কোন্দা দিয়া ঠ্যাঙাইয়া ঠ্যাঙাইয়া মারে, নাইলে হালা জিন্দা মানুষ কবরে পুত্যা দেয়।… আমার পিছে আছিল আমাগো মহল্লার বরজো। মনে মনে কই, ইয়াল্লা, এর তো কিয়ামৎ আইয়া গেল আইজই। আলিশা করলুম, দেহি, না, হালা, আমাগো পাঠান সম্বন্ধী কোন পয়লা নম্বরি পাক মুসলমান হিন্দু মাইরা দাবরাইয়া বেরাইতাছে?– আমাকে যে ওক্তে জিগাইল তুমারা নাম কিয়া হ্যায়? আমি কইলাম- কিয়ামৎ মির্জা বুক চিতাইয়া! হোনো কথা– কিয়ামৎ বুঝি নাম অয়? কইল, বোহৎ ঠিক হ্যায়। যাও! তার বাদে আইল বরজো– বিবি শিরনির পাঠিটার মতোন কাঁপতে কাঁপতে। আমি তার চেহারার বাগে মুখ তুল্যা চাইতা পারলাম না। ক্যা নাম হ্যায়? আরে মুসলমান নাম কইলে কী হয়? না ডরের তাইশে আচম্বিতে কইয়া ফালাইছে ব্রজবিহারী বসাক। খান সায়েব খুশি অইয়া কইল, বিহারি হ্যায়? তো যাও, যাও। বাচ্যা গেল বরজো হালা। তারে কইলাম, আ মে বরজা, বিহারি হইয়া বাচ্চা গেল।… গল্প শেষ করে গুণী বললেন, কিন্তু মাঝে মাঝে বিপদও আসে প্রদেশের নামে। সাজের ঝোঁকে মসজিদে ঢুকছে এক মোল্লাজি। পাশের পকেটটা বড় ফোলা-ফোলা দেখাচ্ছে বলে খানের মনে হল সন্দেহের উদয়। হাঁক ছেড়ে শুধোল, জেবমে ক্যা হ্যায়। থতমত খেয়ে বললে, কুছ নহি হুজুর, একটু পাঞ্জাবি হয়। খান তো রেগে খান খান। কী! তোর এত গোস্তাকি! পাঞ্জাবের খানদানি একজন মনিষ্যিকে তুই পুরেছিস জেবে! মসজিদের ইমাম তখন ছুটে এসে এক হ্যাঁচকা টানে বের করলেন পাঞ্জাবিটা। খানকে বললেন, হুজুর, আপনারা পাঞ্জাবিরা– প্রথম আমাদের কুর্তা পরতে শিখিয়েছিলেন কি না, তাই আমরা সব কুর্তাকেই পাঞ্জাবি বলি– আপনাদের ফখরের তরে।
গুণী বললেন, আপনি খবর নিন, জানতে পারবেন, শুধু যে পাঠানরা, পাঞ্জাবিরা, বেলুচরা এদেশ সম্বন্ধে কিছুই জানত না তা নয়, এদেরকে দিনের পর দিন শেখানো হয়েছিল, বাঙালিরা পাকিস্তানি নয়, এবং তার চেয়েও বড় কথা মুসলমান নয়। এরা হিন্দুদের জারজ সন্তান। এরা আল্লা-রসুল মানে না, নামাজ-রোজার ধার ধারে না–
আমি বললুম, বা রে! এ আবার কী কথা! শুধু বললেই হল। পাঞ্জাবি-পাঠান কি মসজিদও চেনে না। গম্বুজ রয়েছে, মিনার রয়েছে, ভিতরে মিহরাব রয়েছে, বাইরে ওজু করার জন্য জলের ব্যবস্থা রয়েছে, জানি, ওদের দেশে বাংলার তুলনায় মসজিদ অনেক কম। তাই বলে মসজিদ চিনবে না।
বললেন, মসজিদ চেনার কী বালাই ওরা শুনেছে, এককালে এগুলো মসজিদ ছিল কিন্তু ইন্ডিয়ানদের পাল্লায় পড়ে ওসব জায়গায় এখন নামাজটামাজ আর পড়া হয় না। শুধু কী করে পাকিস্তান ধ্বংস করতে হবে তাই নিয়ে ইন্ডিয়ান এজেন্টদের সঙ্গে আলোচনা হয় ওইখানে। উত্তর বাংলার এক টাউনে এক প্রৌঢ়া মহিলা সন্ধ্যার আধা-অন্ধকারে বেরিয়েছেন তার কিশোরী কন্যার সন্ধানে। পাড়ার মসজিদ পেরিয়ে কিছুটা যেতে না যেতেই– সামনে খান সেনা, জনা পাঁচেক! মহিলা পিছন ফিরে ছুটলেন বাড়ির দিকে। মসজিদের পাশ দিয়ে ছুটে যাবার সময় করলেন চিৎকার। মুসল্লিদের নামাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারা ছুটে এল বাইরে। খান সেনাদের বাধা দেবার চেষ্টা করতেই তারা চালাল গুলি। কয়েকজন পড়ে গেল রাস্তার উপর। বাকিরা দৌড়ে ঢুকল মসজিদের ভিতর। না-পাকরা সেখানে ঢুকে সবাইকে খতম করল। ইমাম সাহেবও বাদ যাননি।
আমি বললুম, আমার কাছে তো এসব কথা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ঠেকছে।
গুণী বললেন, কিন্তু এত শত বজ্র-বাঁধন দিয়ে বাঁধা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে ফাটল ধরত।
গাঁ থেকে জোয়ান জোয়ান চাষাদের ধরে আনা হচ্ছে একসঙ্গে গুলি করে খতম করে না-পাকরা গাজি হবেন। একটি ছোকরাকে ধরে এনেছিল, সঠিক বলতে গেলে, প্রায় তার মায়ের আঁচল থেকে। সে কান্নাকাটি চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই করেনি। শুধু যখন তাকে না-পাকরা দাঁড় করাতে যাচ্ছে, গুলি করার জন্য, তখন ফিসফিস করে সেপাইটাকে বললে, আমার আম্মাকে বল, আমার রুহ (আত্মা)-র মগফিরাতের (সদৃগতির) জন্য দোয়া (প্রার্থনা) করতে। রুহ, মগফিরাত, (যেমন সাধনোচিত ধামে প্রস্থান) এগুলো প্রায় টেকনিকাল কথা, সব ধর্মেই থাকে। সেপাই আম্মা, রুহ, দোয়া কথাগুলো বুঝতে পেরে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর সামনে অতিশয় পাষণ্ডও তো ঝুটমুট কুট কথা বলে তার পরকাল নষ্ট করতে চায় না। আবার জিগ্যেস করে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাকে নিয়ে গেল অফিসারের সামনে। বললে, এ তো মুসলমান। অফিসার সরকারি নির্দেশমতো ইসলামের স্বরূপ সম্বন্ধে তাঁর তোতার বুলি কপচাবার পূর্বেই হই হই রব উঠেছে, মুক্তি (গ্রামের লোক মুক্তিফৌজ মুক্তিবাহিনী বলে না, বলে মুক্তি) এসে গেছে, মুক্তি এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভাগে ভাগো চিৎকার। আর ধনাধন একই সাথে সে কী সাম্যবাদ। আপিসরকে ধাক্কা মেরে জোয়ান দেয় ছুট, জোয়ানকে ঠেলা মারে অল্-বদর, তাদের ঘাড়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে অশৃশস্। এস্থলে রণমুখো বাঙালি আর ঘরমুখো সেপাই।
ছোঁড়াটাকে আখেরে অফিসার মুক্তি দিত কি না সে সমস্যার সমাধান হল না বটে কিন্তু সে যাত্রায় সে সুঘ্ন বেঁচে গিয়েছিল বেশ কয়েকজন।
এ তো গেল মামুলি উদাহরণ।
আরেক জায়গায় না-পাকরা মেরেছে গাঁয়ের কয়েকজন মুরুব্বিকে। তার পর এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেসব মৃতের আত্মার সদ্গতির জন্য শেষ উপাসনা (জানাজা) করার সাহস কার? মৃতদেহগুলো সামনে রেখে সারি বেঁধে সে জানাজার নামাজ পড়তে হয়। খানেরা তৈরি, জড় মাল পটপট গুলি করে ঝটপট গাজি হয়ে যাবে। কিন্তু তবু জনাদশেক সার বেঁধে নামাজ আরম্ভ করে দিল।
পাঞ্জাবি, পাঠান, বেলুচে পাঁচ ওকতো দৈনন্দিন নিত্য নামাজের বড় একটা ধার ধারে না। চোদ্দ আনা পরিমাণ নামাজের সংক্ষিপ্ততম মন্ত্রও জানে না। বাঙালি মুসলমান ওদের তুলনায় কোটিগুণে ইনফিনিটি পার্সেন্ট আচারনিষ্ঠ। কিন্তু পাঠান-বেলুচ আর কিছু জানুক আর নাই জানুক, মৃতের জন্য শেষ উপাসনায় সে যাবেই যাবে। তার মন্ত্র জানুক আর না জানুক। ইহসংসারে সর্ব পাপকর্মে সে বিশ্বপাপীকে হার মানায়। তাই এই নামাজে তার শেষ ভরসা। নামাজিদের দোওয়ায় সে যদি প্রাণ প্রায়।
গুলি করার আগেই তারা লক্ষ করল, এ নামাজ তো বড় চেনা লাগছে। এ নামাজ নিয়ে তো কেউ কখনও মশকরা করে না। জানের মায়া ত্যাগ করে যারা এ নামাজে এসেছে তারা তো নিশ্চয়ই মুসলমান। মৃতের জন্য মৃত্যুভয় ত্যাগ!
এরা সেদিন গুলি করেনি।
কিন্তু তাই বলে ওরা যে সেদিন থেকে প্রহ্লাদপালে পরিণত হল সেটা বিশ্বাস করার মতো অতখানি বুড়বক আমি নই। এটা নিতান্তই রাঙা শুক্কবারের, ওয়ানস্ ইন এ ব্লু মুনের ব্যত্যয়।
লুটতরাজ খুন-খারাপির সময় কে হিন্দু কেবা মুসলমান!
কাশ্মিরে ঢোকার পূর্বেই তো পাঠানরা আপন দেশে লুটতরাজ করেছে। আর কাশ্মিরের মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের তো কথাই নেই। ওদিকে লেট জিন্নাহ তো ওদের দিব্যি দিলিশা দিয়েছিলেন, কসমফতোয়া ঝেড়েছিলেন– পাঠানরাই দুনিয়ার সবচেয়ে বহিয়া মুসলমান, তাদের ওপরই পড়ল নিরীহ কাশ্মিরিদের জান-মান বাঁচাবার দায়িত্ব। আমেন! আমেন!!
.
০৩.
মার্চ থেকে ডিসেম্বরের কাহিনী এমনই অবিশ্বাস্য, এমনই অভূতপূর্ব যে সে কালটা বুঝতে গেলে তার পূর্বেকার ইতিহাস পড়ে খুব একটা লাভ হয় না। কারণ এটা তো এমন নয় যে তার পূর্বে দু বছর হোক পাঁচ বছর হোক বেশ কিছু কাল ধরে পূর্ব বাংলায় মোতায়েন পাঞ্জাবি-পাঠান পাক সেনা আর সে-দেশবাসী বাঙালিতে আজ এখানে কাল সেখানে হাতাহাতি মারামারি করছিল এবং একদিন সেটা চরমে পৌঁছে যাওয়াতে এক বিরাট বিকট নরহত্যা নারীধর্ষণ আরম্ভ হয়ে গেল। বস্তুত যে দু তিন হাজার পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য বাংলাদেশে বাস করত তাদের সঙ্গে কখনও কোনও মনোমালিন্য হয়েছিল বলে শুনিনি। আমি এদেশে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে একবার পূর্ব পাকিস্তান দেখতে আসি এবং ১৯৫১ থেকে ১৯৭০ অবধি পারিবারিক কারণে প্রতি বৎসর দু একবার এসেছি এবং প্রতিবারই একটানা কয়েক মাস কাটিয়ে গিয়েছি। আমার গুষ্টিকুটুমে তাবৎ বাংলাদেশ ভর্তি। তাই রাজশাহী থেকে চাটগাঁ-কাপ্তাই, সিলেট থেকে খুলনা অবধি মাকু মেরেছি। মাত্র একবার দু জন পশ্চিম পাকিস্তানি জোয়ানকে রাজশাহীতে পদ্মর একটা শাড়ির পারে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি– অতি অবশ্য পাড় থেকে হাত দশেক দূরে জল থেকে খুব সন্তর্পণে গা বাঁচিয়ে; একটি কিশোর সেখানে জলে ডুবে মরেছে শুনে সে তামাশা দেখতে এসেছিল।
আরেকবার ট্রেনে ঢাকা থেকে মৈমনসিং যাবার সময় ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে দু জন সুবেদার উঠেছিল। তার একজন মৈমনসিংহ-এর লোক, অন্যজন বেলুচ। এটা ১৯৬৬ সালের কথা। মৈমনসিংহি আর পাঁচজনের সঙ্গে গালগল্প জুড়ে দিল এবং স্বভাবতই ৬৫-র যুদ্ধের কথা উঠল। বাঙালরা তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কীরকম জোর লড়াই দিয়েছিল সে কাহিনী সে যেমন-যেমন দফে দফে বলে যায়, সঙ্গে সঙ্গে বেলুচ ঠিক বাত, বিলকুল সহি বাত ম্যায় ভি তো থা, ম্যায় নে ভি দেখা মন্তব্য করে। এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে উল্লেখ করি, ওই যুদ্ধে বাঙালি রেজিমেন্টই আর সব রেজিমেন্টের চেয়ে বেশি মেডল ডেকরেশন পায়। এবং অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ করি, ১৯৭১-এর গরমিকালে রাজশাহীতে বেলুচ জোয়ানদের এক বাঙালি প্রসেশনের উপর গুলি চালাবার হুকুম হলে অগ্রবর্তী জোয়ানরা শূন্যে গুলি মারে, আর জনতাকে বার বার বলতে থাকে, ভাগো, ভাগো।… সে যাত্রায় বিস্তর লোক বেঁচে গিয়েছিল।
মোদ্দা কথা সেপাইদের সঙ্গে এদেশবাসীর কোনও যোগসূত্র ছিল না। কোনও প্রকারের মনোমালিন্যও ছিল না। সেটা হয়েছিল মার্চ মাসের গোড়ার দিকে সে কাহিনী যথাস্থানে হবে।
আর আর্মি অফিসারদের তো কথাই নেই। যে সামান্য কজন আপন মিলিটারি গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এদের সিভিলিয়ান অফিসারদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন তারা ছিলেন ভদ্র, খামোখা গায়ের জোরে যেখানে কমন ল্যাঙুজ ইংরেজিতে কথাবার্তা হচ্ছে সেখানে উর্দু ভাষা চালিয়ে উঁচু ঘোড়া চড়তে যেতেন না।
অভদ্র ইতর ছিল পাঞ্জাবিরা এবং তৎসঙ্গে যোগ করতে হয় দম্ভ, অহংকার, গায়ে পড়ে অপমান করার প্রবৃত্তি। বেহারিদের– এরা অসামরিক। ভাবখানা, এনারা খানদানি মনিষ্যি, কুরানশরিফের আরবি, রুমি-হাফিজের ভাষা ফার্সি এগুলোকে প্রায় ছাড়িয়ে যায় তেনাদের নিকষ্যি কুলীন উর্দু ভাষা। পাটনা, বেহারে এনাদের অন্য রূপ! ঢাকাতে একদা এক বাঙালির ড্রইংরুমে যখন উর্দু নিয়ে এনাদের এক প্যাকম্বর বড় বেশি বড়ফাট্টাই করতে করতে থামতেই চান না তখন আমি তার নভলোকে উড্ডীয়মান বেলুনটিকে চুবসে দেবার জন্য মাত্রাধিক মোলায়েম কণ্ঠে শুধুলুম, আচ্ছা আপনার সঠিক মাতৃভাষাটি কী? ভোজপুরি মৈথিলি না নগৃহই? আর যাবে কোথায়? ছাতুখোর তো ফায়ার! হাজার দুই ফারেনহাইট।… উপস্থিত সেটা থাক।
তাই পঁচিশের পিচেশিমির পয়লা নম্বরি মদ্দি ছিলেন এঁরাই। অল-বদর, অশ-শমস এবং প্রধানত রাজাকরদের সম্মানিত সভ্য ছিল এরাই। পঁচিশের পিচেশিমির পটভূমি অধ্যয়ন করলে মাত্র এইটুকু আমাদের কাজে লাগে। কিন্তু ভুললে চলবে না, এহ বাহ্য। কারণ গণনিধনের প্রধান পাণ্ডা-পুরুত না-পাক সেনা এবং ইসলামবাদ-নশিন ফৌজি জাঁদরেলরা।* এঁরা যদি পুরো মিলিটারি তাগদ খাঁটিয়ে নিরস্ত্র সিভিলিয়ানদের কচুকাটা (কল-ই-আম) কর্মে সমস্ত শক্তি নিয়োগ না করতেন তবে এ দেশের নুন নেমক খেয়ো পোস্টাইপেট জারজ বিহারিদের (আমি বিহার বাসিন্দা, বিহারি বা কলকাতাবাসী বিহারিদের কথা আদৌ ভাবছি না, এবং বাংলার বিহারিদের ভিতরও যে আদৌ কোনও ভদ্রসন্তান ছিলেন না সেকথা বলছিনে) কী সাধ্য ছিল বাংলাদেশীর সঙ্গে মোকাবেলা করে!
[*এঁদের নাম টুকে রাখলে পশ্চিমবঙ্গীয় পাঠক রেসকোর্সে না গিয়ে, রক-এ বসেই বাজি খেলতে পারবেন শ্ৰীযুত ভুট্টোর পর কোন বাজিরাজ পাকিস্তানের গদিতে সোওয়ার হবেন– বাংলাদেশে এঁদের নাম ডাল-ভাত, থুড়ি!– ছাইভস্ম। লেফ-জেনারেল রিজাদা হামিদ খান টিক্কা খান (এর গৌরবাৰ্জিত খেতাব বমর অব বেলুচিস্তান), (বুচর অব বেঙ্গল) মেজর জেনারেল আকবর খান, মেজর জেনারেল উমর খান, লেফ-জেনারেল গুল হাসান।]
এটা নিয়তির পরিহাসই বলতে হবে, যে জোয়ান, যে অপিসারদের সঙ্গে বঙ্গজনের কোনও দুশমনি ছিল না তারাই নাচল তাণ্ডব নৃত্য, বেহারিরা শুধু বাজাল শিঙে। বেঙ্গল অর্ডিনেনস বঙ্গদেশের ওপর চাপানোর সময় রবীন্দ্রনাথ শিখেছিলেন :
হিমালয়ের যোগীশ্বরের রোষের কথা জানি
অনুঙ্গেরে জ্বালিয়েছিলেন চোখের আগুন হানি।
এবার নাকি সেই ভূধরে কলির ভূদেব যারা
বাংলাদেশের যৌবনেরে জ্বালিয়ে করবে সারা!
সিমলে নাকি দারুণ গরম, শুনছি দার্জিলিঙে
নকল শিবের তাণ্ডবে আজ পুলিশ বাজায় শিঙে।
এই অগ্নিগর্ভ মৃত্যুঞ্জয় কবিতাটি থেকে এ প্রবন্ধে আরও উদ্ধৃতি দিতে হবে। কিন্তু এটি এতই অনাদৃত যে আমি অভিমানভরে তার নির্দেশ দিই না। রচনাবলি থেকে খুলে বের করুন।
পটভূমি নির্মাণের জন্য একাধিক চিন্তাশীল লেখক অন্যান্য কারণ দেখান। সেগুলো একটা জাত একটা দেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে, এমনকি ক্ষেপিয়ে তুলতেও যথেষ্ট। প্রত্যুত্তরে দমননীতি বরণ করে শোষকরা। এমনতরো কাণ্ড তো বার বার সহস্রবার হয়েছে পৃথিবী জুড়ে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে পিচেশিমির যে উলঙ্গনৃত্য হল তার হদিস তো বড় একটা পাওয়া যায় না আমি কোথাও পাইনি। মাত্র একবার একজন একটা প্ল্যান করেছিলেন যার সঙ্গে ইয়েহিয়ার প্ল্যান মিলে যায় কিন্তু সেই পূর্বসূরিও সেটা কার্যে পরিণত করার জন্য এতখানি পিচেশিমি করার মতো বুক বাঁধতে পারেননি। কিন্তু সে প্ল্যান এ ভূমিকার অঙ্গ নয়। সেটা ঘটনাবলির ক্রমবিকাশের সঙ্গে এমনই অঙ্গাঙ্গী বিজড়িত যে সেটাকে বিচ্ছিন্ন করে এস্থলে সুষ্ঠুভাবে পরিবেশন করার মতো শক্তি আমার নেই– সহিষ্ণুতম পাঠক পর্যন্ত বিরক্ত হবেন। সেটি যথাস্থলে নিবেদন করব।
পূর্ব বাঙলাকে পশ্চিম পাকের একুশটি কোটিপতি পরিবার কী মারাত্মকভাবে শোষণ করেছে সে সম্বন্ধে প্রামাণিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দু জন লোক অসীম সাহস দেখিয়ে আইয়ুব-ইয়েহিয়ার আমলেই সরকারি তথ্যের ওপর নির্ভর করে যেসব রচনা প্রকাশ করেন সেগুলো পড়ে আমার মনে ভয় জেগেছিল এঁদের ধরে ধরে না ইয়েহিয়ার চেলা-চামুণ্ডারা ফাঁসি দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদের প্রকৃত মূল্য উত্তমরূপেই হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন বলে ভণ্ড ইয়েহিয়া যখন আলাপ-আলোচনার নাম করে আসলে টিক্কা খান যাতে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরও না-পাক সেনা ঢাকায় আনতে পারার ফুরসত পায়– মার্চের মাঝামাঝি ঢাকা আসেন, তখন বঙ্গবন্ধু জনাব তাজউদ্দীনের সঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সুবহান ও ড. কামাল হুসেনকে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন।
এই ভণ্ডামির চমৎকার বয়ান বহুল প্রচারিত একখানি জর্মন সাপ্তাহিক নির্ভয়ে প্রকাশ করে। নির্ভয়ে এই কারণে বললুম, এই প্রবন্ধের জন্য যে জর্মন লেখক জিম্মাদার তার নাম, ইসলামাবাদে তার বাসস্থান, ফোন নম্বর ইত্যাদি সবই ভালোভাবে দেওয়া ছিল। ভাবখানা অনেকটা এই : ওহে হেইয়া খান। আমার মতে, তুমি রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে যে ভণ্ডামির ভেল্কিবাজিটি দেখালে তার হাঁড়িটি আমি হাটের মধ্যিখানে ফাটালুম। যে ভণ্ডামিটি তুমি করলে সেটা কোনও কূটনৈতিক রাষ্ট্রদূতও ইজ্জতের ভয়ে করত না কারণ দু-দিন বাদেই তো ভণ্ডামিটা ধরা পড়ে যেত। আর কেউ না হোক, আমি তো বাপু এ ব্র্যান্ডের ফক্কিকারি বিলক্ষণ চিনি। মাত্র আরেকজন রাষ্ট্রপ্রধান এ ধরনের ত্যাদড়ামি করতেন তিনি আমারই দ্যাশের লোক– নাম তার হিটলার। তা অত সব ধানাই-পানাই ক্যান? করো না আমার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা, না হয় তাড়িয়ে দাও আমাকে তোমার সাতিশয় পাক মুলুক থেকে। হই হই পড়ে যাবে দুনিয়ার সর্বত্র। দেখি, তোমার কতখানি মুরদ!
অতি অবশ্য ভারিক্কি ওজনের ইয়েহিয়া অনভ্যাসের (ফোঁটা) অসামরিক ড্রেস পরে উড়োজাহাজে করে পৌঁছলেন পুব-দেশের রাজধানী ঢাকায় (সে আরেক মিনি ধাপ্পা; ভাবখানা, আমি মিলিটারি ডিকটেটর নই, আমি সাদামাটা নাগরিক মাত্র।–শেখ মুজিবের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার জন্য। কিন্তু প্রকৃত সত্য, ওই আসাটাই ছিল দীর্ঘসূত্রতার কৌশল। পূর্ব প্রদেশ কেটে পড়তে চায়; তাকে তখনকার মতো কোনও গতিকে ঠেকিয়ে পরে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করা।
কারণ, পাঠান জাদরেল (ইয়েহিয়া পাঠান নন। তিনি জাতে কিজিলবাশ এবং সুন্নিবৈরী শিয়া সম্প্রদায়ের লোক* কিন্তু তিনি পাঠানদের ভাষা পশতু অনর্গল বলতে পারেন বলে অতি অল্প লোকেই জানেন যে, তিনি পাঠান নন–অনুবাদক) যে কটা দিন জেনেশুনে তিনি হাবিজাবি এ-প্যারাগ্রাফ ও-প্যারাগ্রাফ নিয়ে বাংলার জননেতার সঙ্গে বেকার আলোচনা চালাচ্ছিলেন ঠিক সেই সময়ে বেসামরিক পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনালের উড়োজাহাজ নিরবচ্ছিন্ন ধারায় বাংলাদেশে নিয়ে আসছিল উচ্চদেহ বাছাই বাছাই যুবক–পরনে একদম একই ধরনের বেসামরিক বেশ।
[*পাকিস্তানের সৌভাগ্য বলুন, দুর্ভাগ্যই বলুন, তার জন্মদাতা মরহুম জিন্না শিয়া, ইসকন্দর মির্জা ও ইয়েহিয়াও শিয়া। ইসকন্দর মির্জা ও ইয়েহিয়া পীরিত করতেন শিয়া ইরানের সঙ্গে এবং তাচ্ছিল্য করতেন সুন্নি আফগানিস্তানকে। ডিসেম্বর ১৯৭১-এর প্রথমার্ধে যখন পশ্চিম পাকবাসী জেনে গেল, পুব পাক যায়-যায়, তখন ইয়েহিয়ার চরিত্র-দোষ, কুলদোষ এসবের সন্ধান অকস্মাৎ আরম্ভ হল। তখন— যদিও ইয়েহিয়া কখনও সেটা গোপন করেনি– সবাই চেঁচাতে আরম্ভ করল, ব্যাটা ইয়েহিয়া শিয়া। তাই আমাদের আজ এই দুর্গতি। সে পাপ স্খলনের জন্য তিনি এক শুকুরবারে জাতধর্ম খুইয়ে সুন্নিদের মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ পড়লেন। এ যেন কোনও পরম নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব রক্ষাকালীর মন্দিরে পাঁঠা বলি দিলেন! কিন্তু হায়, সবাই জানেন জাত গেল, পেটও ভরল না…ভুট্টো সুন্নি, তাই তিনি ক্ষুদে হিটলার দি থার্ড হয়েই ছুটলেন সুন্নি কাবুল বাগে।
পাকিস্তানের ফরেন পলিটিকস অধ্যায়ে এর সবিস্তার বয়ান দেব। এই শিয়া, সুন্নি, কাদিয়ানি (স্যর জফরুল্লা কাদিয়ানি এবং সাধারণ কাদিয়ানিজন সুন্নি-শিয়া উভয়কে কাফির বিবেচনা করে) বোরা, খোঁজা, মেমনদের মতবাদ সম্বন্ধে কি দিশি কি বিদেশি সর্ব রিপোর্টার উদাসীন। এ যেন আইয়ার, আয়েঙ্গার, ব্রামিন, নব্রামিন সম্বন্ধে খবর না নিয়ে দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি আলোচনা করা।]
(এদের ভয়ে পাসপোর্টও দেওয়া হয়েছিল। কারণ সিংহলে উড়োজাহাজে তেল নেবার সময় পালের পর পাল জঙ্গি-ইউনিফর্ম পরা সৈন্যবাহিনী যাচ্ছে দেখলে সিংহল কর্তৃপক্ষ যুদ্ধের প্রস্তুতি বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু না-পাক জাঁদরেলদের আজব হস্তীবুদ্ধি দেখে তাজ্জব মানতে হয়! সক্কলেরই একই কাপড়ের একই কাটের একই জামা-জোড়া যদি হয় তবে সেটাও তো একটা ইউনিফর্ম। হোক না সে সিভিল। বস্তুত যে ঢাকার লোককে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করা হয় তারা– খানদানি উর্দু ভাষায়– ফৌরনকে পাঁচ মিনিট পহলে অর্থাৎ তদ্দণ্ডেই বিলক্ষণ হুঁশিয়ার হয়ে যায় এসব ভেড়ার-ছাল-পরা নেকড়ের পাল)।
শেখ সাহেব চাণক্য মাকিয়াভেরি স্কুলে-পড়া কূটনৈতিক নন। কিন্তু গাঁয়ের লোক– ক-সের ধানে ক-সের চাল হয় অন্তত সে হিসাবটুকু তার আছে। পাঞ্জাবি পাঠানদের এই হাতি-মার্কা স্থূল প্যাঁচটি বোঝবার জন্য তাঁকে মার্কিন কমপুটারের শরণ নিতে হয়নি। কিন্তু তিনি তার দিকটা সাফসুরো রাখতে চেয়েছিলেন; ঘরে বাইরে কেউ যেন পরে না বলে তিনি অভিমানভরে গোসাঘরে খিল দিয়েছিলেন।
তাই তিনি দুই অর্থশাস্ত্রবিশারদ সুবহান, কামালকে তাজউদ্দীনের সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে তাদের কাজটি খুব কঠিন ছিল না। কারণ ক্ষুদে হিটলার দি সেকেন্ড হওয়ার কয়েক মাস পরেই ইয়েহিয়া সর্বজন সমক্ষে (বেতার ও টেলিতে) দরদি গলায় স্বীকার করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানিদের অসন্তুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট ন্যায়সঙ্গত কারণ আছে। রাষ্ট্রের যে উচ্চ পর্যায়ে মীমাংসা গ্রহণ করা হয় এবং আরও কতকগুলি জাতীয় কার্যকলাপে তাদের পুরো সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। এখন তা হলে দাঁড়াল এঁরা পিণ্ডির চেলাচামুণ্ডাদের হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে দফে দুফে বোঝাবেন শিল্পে-বাণিজ্যে সর্বক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা স্বাধীনতার চব্বিশ বছর পরও কী মারাত্মকরকম পঙ্গু হয়ে আছে।
কী কথাবার্তা হয়েছিল, বস্তুত তারা আদৌ সে সুযোগ পেয়েছিলেন কি না, জানিনে। তবে আজ আমি এ প্রসঙ্গ তুলছি কেন?
হ্যাঁ, আজই তুলছি। আজ জষ্টি মাসের পয়লা তারিখ আপনি যান ঢাকার নিউ মার্কেটে। সেখানে জলজ্যান্ত পষ্ট দেখতে পাবেন এই দুই পণ্ডিতের গভীর গবেষণা কীভাবে জলজ্যান্ত চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। শুনেছি, বিলেতের কোন এক কোম্পানি ছুঁচ থেকে আরম্ভ করে হাতি পর্যন্ত বিক্রি করে। এখানে করে না। একদা করত। আজ কোনওকিছু চাইলেই সে এক পেটেন্ট উত্তর পশ্চিম পাকিস্তানে তৈরি হত : এখন আর আসছে না। বিশ্বাস করবেন পকেট সংস্করণ শোভন গীতাঞ্জলি হাতে নিয়ে বললুম ইটি একটু ধুলোমাখা। তাজা হলে ভালো হয়। বলল এই শেষ কপি; লাহোরে ছাপা, আর আসবে না। পাঁচমেশালির দোকানেও নেই, নেই শুনে বিরক্ত হয়ে বললুম, আরে মিঞা মধু মধু চাইছি। সে তো আসত সেঁদর বন থেকে, বোতলে পোরা হত ঢাকায়… লালবাগ না কোথায় যেন? কাঁচুমাচু উত্তর, জি, ঠিক বলেছেন। তবে না, কারখানার মালিক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। তিনি হাওয়া। দোকানে তালা পড়েছে। মনে মনে কাষ্ঠহাসি হেসে বললুম, পাট তো এদেশের ডাল ভাত। মশকরা করে এক গাঁট পাট চাইলে হয়তো বলবে, জী আদমজি দাউদ মিলের কর্তা তো ভাগ গিয়া; গুদোম বন্ধ।
শেষটায় খাস ঢাকায় তৈরি ঢাকাই মালিকানায়– কী পেলুম জানেন? ওটার আমার দরকার ছিল না। মার্কিং ইন। লনড্রিতে যে কালি দিয়ে কাপড়ে নম্বর লেখে। এদেশের ধোপানি যেটা আপন কুঁড়েঘরে বানায়। প্যোর কটিজ ইনডাসট্রি!
কান্না পেল।
হ্যাঁ, একদা এরাই দুনিয়ার সেরা মসলিন– যার তরে দুনিয়ার সবচেয়ে ডাঙর বাদশা চীনের বাদশা এদেশে রাজদূত পাঠিয়েছিলেন।
.
০৪.
গোড়াতেই সরল সাধুতা ও সহজ ভাষায় পুনরায় স্বীকার করে নিই, বাংলাদেশের অনবিস্মরণীয় ন মাসের ইতিহাস লেখার মতো পাণ্ডিত্য, তথ্যানুসন্ধান করার মতো শক্তি, দূর তথা গভীর দৃষ্টিনিক্ষেপজনিত দার্শনিক বিজ্ঞতা আমার নেই। বস্তুত এদেশের স্কুলবয় পর্যন্ত হেন কর্ম করার মতো দুরাকাক্ষী জনকে বলে দিতে পারবে, দিনাজপুর থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে রবিশাল জুড়ে ন মাস ধরে যে ভূতের নৃত্য হয়ে গিয়েছে তার সাক্ষ্যস্বরূপ মানুষের মনে, মাটির উপর-নিচে যেসব সরঞ্জাম-নিদর্শন সঞ্চিত হয়ে আছে সেগুলো আংশিকভাবে সংগ্রহ করাও কঠিন কর্ম। গুণীজন বলবেন, করতে পারলেও অতঃপর শিখাগ্রে আরোহণ করে তার প্রতি সিংহাবলোকন* নিক্ষেপ দ্বারা সেগুলো আপনার অন্তরে সংহরণ করে তার প্রতি ঐতিহাসিক তথা দার্শনিক সুবিচার করা অসম্ভব উপস্থিত। বলা বাহুল্য আমা দ্বারা কস্মিনকালেও এহেন কর্ম সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। শতায়ু হলে না সহস্ৰায়ু হলেও না। তবু কেন যে যে-টুকু পারি লিখছি সেটা ধীরে ধীরে স্বপ্রকাশ হবে। উপস্থিত পাঠকের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, এ বয়ান থেকে কেউ যেন প্রামাণিকতা প্রত্যাশা না করেন। একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে শুনেছি। খুঁটিনাটিতে পার্থক্য থাকার কথা। সাজানো মিথ্যা সাক্ষ্যের বেলাতেই খুঁটিনাটিতেও কোনও হেরফের থাকে না। সত্য সাক্ষ্যে মূল ঘটনাতে নড়চড় হয় না; ডিটেলে বেশকিছুটা থাকবেই। এছাড়া যেসব কাহিনী-কেচ্ছা মুখে মুখে এখনও বিচরণ করছে তার অনেকগুলিই কবিজনের কল্পনাবিলাস বা আকাশকুসুম। কিন্তু তারও মূল্য আছে। ব্রজবিহারীকে সত্য সত্যই বিহারবাসী মনে করে রামপঠা পাঠান ছেড়ে দিয়েছিল কি না তাতে বিন্দুমাত্র আসে-যায় না– আসল তত্ত্বকথা এই : গল্পটা ক্যারেক্টারিস্টিক কি না, অর্থাৎ গল্পটাতে পাঠান ক্যারেকটারের নির্যাস, তার রাম পন্টকামি ফুটে উঠেছে কি না। কাঠবেরালি সত্য সত্যই সর্বাঙ্গে ধুলো মেখে সেতুবন্ধের উপর সে-ধুলো ঝেড়ে রামচন্দ্রকে সাহায্য করেছিল কি না সেটা বিলকুল অবান্তর। গল্পটা বোঝাতে চায়, রাবণের ডিকটেটরির বিরুদ্ধে তখন জনসাধারণ কী রকম উঠেপড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। অবশ্য সেটা যদি সত্য হয় তবে তো প্ল্যাটিনামে ডায়মন্ড! নিয়াজির কোলে ফরমান আলী, পিছনে দাঁড়িয়ে পাখা দোলাচ্ছেন, যশোবন্ত শ্রীমান গভর্নর ড. (?) মালিক!
[*গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধে যেখানে ফুটনোট অবর্জনীয় সে স্থলেও ওই প্রতিষ্ঠানটি আকছারই পীড়াদায়ক। আমার আটপৌরে হাবিজাবির বেলা তো কথাই নেই। তাই সরল পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, তিনি আমার রচনার ফুটনোট না পড়লে মোটেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না– (আসল না পড়লেও হবেন কি না সেটাও বিতর্কাতীত নয়)। আসলে ফুটনোটে এমন কিছু থাকা অনুচিত যেটা না পড়লে পরের মূল লেখা বুঝতে অসুবিধা হয়। অবশ্য মূলে (টেকসটে) কোনও তারাচিহ্ন দেখে যদি পাঠকের মনে হয় এই বিষয়ে কিঞ্চিৎ আশকথা-পাশকথা শুনতে চান তবে সেটি সাধু প্রস্তাব। কিংবা আপনি রোক্কা একটি টাকা খরচা করেছেন বলে পত্রিকার বিজ্ঞাপন তক বাদ দিতে চান না তবে সেটা সাধুতর প্রস্তাব। কিন্তু পুনরপি হা–ফি–জ! ফুটনোট পড়ার বাধ্যবাধকতা নেই। সার্ভে শব্দের গুজরাতি অনুবাদ সিংহাবলোকন। সিংহ যেরকম পাহাড়ের উপরে উঠে মাথা এদিকে-ওদিকে ঘুরিয়ে চতুর্দিকে বিস্তৃত দৃষ্টিনিক্ষেপ করে সবকিছু দেখে নেয়। শব্দটি পর্যবেক্ষণজাত এবং সুন্দও বটে, বাঙলায় চালু হলে ভালো হয়।]
১৯৬৯ সালের ২৫/২৬ মার্চ সকালবেলা পূর্ব পশ্চিম উত্তর পাকিস্তানের জনসাধারণ শুনতে পেল ছোট হিটলার ডিনেস্টির পয়লা চোট্টা-ওয়ালা হিটলার স্বপ্রশংসিত স্বনির্বাচিত উপাধি ফিল্ড মার্শাল বিভূষিত, পৃথিবীর অন্যতম কোটিপতি, মার্কিন প্রেসিডেন্টের দোস্ত, মহামহিম শ্ৰীযুত আইয়ুব খানের পশ্চাদ্দেশে একখানি সরেস পদাঘাত দিয়ে জেনারেল আগা মুহম্মদ ইয়েহিয়া খান সুবে পাকিস্তানের চোটা হিটলার দি সেকেন্ড রূপে গদিনশিন হয়েছেন। কিন্তু বিসমিল্লাতেই গয়লৎ (গলৎ)। আগা উপাধি সচরাচর ধারণ করেন ইরানবাসী শিয়ারা– খান উপাধিধারী হয় সুন্নি পাঠানেরা। এ যেন সোনার পাথরবাটি। কিন্তু খান অনেক সময় সম্মানার্থে সকলের নামের পিছনেই জুড়ে দেওয়া হয়– কাবুলে আমার এক জনপ্রিয় সখা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের নামের পিছনে কাবুলিরা খান জুড়ে দিত। সেটা কিছু আশ্চর্য নয়। এই সোনার বাংলাতেই পশুপতি খান গয়রহ আছেন।
আইয়ুবের পতনে পূর্ব বাংলায় যে মহরমের চোখের পানি ঝরেনি সেটা বলা বাহুল্য। একে তো তিনি আহাম্মুখের মতো কতকগুলি মিলিটারি ইডিয়টের পাল্লায় পড়ে শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে একটা সম্পূর্ণ মনগড়া ষড়যন্ত্রের মামলা খাড়া করার হুকুম দেন, তদুপরি বিশ্বাসভাজন এক মার্কিন পত্রিকা হাটের মধ্যিখানে একটি প্রকাণ্ড বিষ্ঠাভাণ্ড ফাটিয়ে দিয়ে প্রকাশ করে দেয় যে মাত্র সাত বছর রাজত্বকালের মধ্যেই (১৯৬৫) তিনি কুল্লে পঁচিশ কোটি টাকার ধনদৌলত, ইতালির একটা দ্বীপে বিশাল জমিদারি (ওই অঞ্চলে টুরিজম-এর জন্য ইতালীয় সরকারের বিস্তর কড়ি ঢালার মতলব ছিল যার ফলে ধূলি-মুষ্টি রেডিয়াম-মুষ্টিতে পরিণত হত) সাপটে নিয়েছেন আর ইওরো-মার্কিন ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে কত ডলার পাউন্ড, সুইস ফ্রাঁ জমা আছে তার হিসাব বের করা অসম্ভব। কোনও কোনও দেশের ব্যাঙ্ক সে-দেশের ইনকাম ট্যাক্স বিভাগ, অর্থাৎ স্বয়ং সার্বভৌম সরকার জানতে চাইলেও ঠোঁট সেলাই করে বসে থাকে।… ইয়েহিয়া রাজা হয়ে আইয়ুবের দৌলতের খোঁজে বেরিয়েছিলেন বলে কোনও খবর অন্তত আমি পাইনি। এটা পশ্চিম পাকের একটা সাদা-কালিতে লেখা আইন; ইসকন্দর মির্জাকে গদিচ্যুত করার পর আইয়ুব তাঁর ধনদৌলতের সন্ধান নেননি। ইয়েহিয়াও আইয়ুবের হাঁড়ির চাল হাঁড়িতেই রাখতে দিলেন। শুধু তাই নয়। আগাপাশতলা হাতের কজায় পোরা পাকিস্তানি প্রেসকে জবানি হুকুম দেওয়া হল, আইয়ুব খানের খেলাপে যেন উচ্চবাচ্য না করা হয়। ইনি মিলিটারির জাদরেল, উনিও মিলিটারি আঁদরেল– কাকে কাকের মাংস খায় না বাংলা কথা।
ইয়েহিয়া জাতে কিজিলবাশ। তিনি দাবি ধরেন, তিনি নাদিরের বংশধর। ওই নিয়ে গবেষণা করার মতো দলিল-দস্তাবেজ আমার নেই। তাঁর আদত পিতৃভূমি নাকি নাদিরের দেশে! ভুট্টোর বাস্তুভিটে লারখানাতে। তার অতি কাছে মোন-জো-দড়ো।* তিনি যদি আজ দুম করে দাবি জানান মোন-জো দড়োতে গলকম্বল দাড়িওলা যে রাজপানা চেহারার মূর্তিটি আবিষ্কৃত হয়েছে তিনি তার বংশধর, তবে ওই মোন-জো দড়োর আবিষ্কর্তা স্বয়ং রাখালদাস বাঁড়ুয্যে কি ধরাতলে অবতীর্ণ হয়ে বুক ঠুকে প্রমাণ করতে পারবেন তিনি আর পাঁচটা সিন্ধির মতো সাড়ে বত্রিশ ভাজার বর্ণসঙ্কর।
[*টীকা-পাঠ-নীতি উপেক্ষা করে যারা এটি পড়ছেন তাঁদের জানাই, শব্দটা এমনি ভিন্ন ভিন্ন। বিদকুটে ঢঙে উচ্চারিত হয় যে তার শুদ্ধ উচ্চারণ নিয়ে আলোচনা সম্পূর্ণ অবান্তর নয়। সিন্ধি ভাষায় মো=মৃত (সংস্কৃত মৃ বাংলা মৃত) মোন-এর ন বহুবচন বোঝায়। জা= –দের (S)। দড়ো=টিলা। একুনে মৃতদের টিলা। এক অত্যুৎসাহী সংস্কৃতজ্ঞ এটা লিখেছেন মহেন্দ্রদ্বার।]
কিন্তু কিজিলবাশ শব্দটি বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ অপরিচিত নয়। ভারতচন্দ্র লিখেছেন, রাজা বসে আছেন; তার চতুর্দিকে কিজিলবাশ। টীকাকার ভেবেছেন কিজিল কথাটা কাজল হবে– লিপিকারের ভুল। আর বাস মানে তো কাপড়। কালো পর্দার মাঝখানে রাজা বসে আছেন। আসলে কিজিল-বাশ মানে লাল টুপি (আমি যদূর জানি, চুগতাই তুর্কি ভাষায়)। কিজিল-বাশরা লাল টুপি পরত এবং ভারতবর্ষে প্রধানত দেহরক্ষী বা দরোয়ানের কাজ করত। আজ আমরা যেরকম ভোজপুরি বা নেপালি দরওয়ান রাখি, বিদেশি বলে এ দেশের চোর-চোট্টারা চট করে এদের সঙ্গে দোস্তি জমাতে পারবে না বলে। কিজিল-বারা শিয়া। এ দেশের সুন্নিদের ঘেন্না করে। ষড়যন্ত্রকারী বা চোর-চোট্টাদের পাত্তা দেবে না।
ইয়েহিয়া বাপ-পিতেম-র ব্যবসাটি ডোবালেন। পাকিস্তানের রক্ষক ভক্ষক হলেন। বদহজমি হল। কবরেজ ভুট্টো তাকে প্যাঁজ পয়জারের জোলাপ বড়ি দিলেন ঠেসে। ইয়েহিয়ার ব্যক্তিগত চরিত্র বয়ান একটু পরে আসছে।
.
ইয়েহিয়া অবতীর্ণ হলেন মূর্তিমান কল্কিরূপে। একহস্তে গণতন্ত্র অন্যহস্তে পুব বাংলার প্রতি বরাভয় মুদ্রা। পূর্বেই নিবেদন করেছি, তিনি স্বীকার করলেন, পুব বাংলার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে তাবৎ মুশকিল আসান করে দেবেন। যেসব মিলিটারি পিচেশ তাঁকে গদিতে বসিয়েছিল তারা ঘেন্নার সুরে বললে, বটে!
বহু লোকের বিশ্বাস ইয়েহিয়া সেপাই; সেপাই মাত্রই বুদ্ধ হয়, অন্তত সরল তো বটে। তদুপরি তিনি মদ্যপান করেন প্রচুরতম। একবার নাকি সন্ধ্যাবেলা তার একটা বেতার ভাষণ দেবার কথা ছিল। ইংরেজ বলে, গড় মেড় সিক্স ও ক্লক ফর হুইস্কি। সে সিক্স সন্ধ্যার ছটা। ইয়েহিয়া ঘুলিয়ে ফেলে সেটা সকাল ছটায় সরিয়ে এনেছেন। তদুপরি তখন বাস করেন পাঞ্জাবে এবং পঞ্চনদভূমি যে পঞ্চম-কারের পীঠস্থল সেকথা ক্রমে ক্রমে ঢাকা চাটগাঁর ধর্মভীরু মুসলমান পর্যন্ত জেনে গিয়েছিল ক্লাবে ক্লাবে পাঞ্জাবি সিভিলিয়ান অফিসারদের মেয়েমদ্দে হইহই বেলেল্লাপনা করা দেখে। বিস্ময় মেনে একে অন্যকে শুধিয়েছে এরাও মুসলমান? সেকথা উপস্থিত থাক। সাঁঝের ঝোঁকে ইয়েহিয়ার বেতার ভাষণ দেবার কথা। কিন্তু তিনি তখন এমনই বে-এক্তেয়ার যে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। মুলতবি করা হল ঘণ্টা দুয়েকের তরে। তখনও অবস্থা তদবৎ। শেষটায় রাত দশটা না বারোটায়, বার দুই মুলতবি রাখার পর আমি সঠিক জানিনে– মাই-ডিয়ার-মাই-ডিয়ার জড়ানো গলায় তিনি লিখিত ভাষণের পঠন কর্মটি সমাধান করে পাক বেতার কর্তৃপক্ষকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে বন্ধন করলেন।
অথচ লোকটা অতিশয় ঘড়েল, কুচক্রী, বিবেকহীন এবং পাশবিকতম অত্যাচারের ব্যবস্থা করাতে অদ্বিতীয়। আমি ভেবে-চিন্তেই অদ্বিতীয় বললুম। একাধিক ফ্রয়েডিয়ান ঐতিহাসিকের মুখে আমি শুনেছি–আর নিজে তো পড়েছি ভূরি ভূরি তাদের জানা মতে, কিংবদন্তীর ওপর বরাত না দিয়ে, কেবলমাত্র প্রামাণিক ইতিহাসের ওপর নির্ভর করে বলতে গেলে পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় হাইনরিষ হিমলার অদ্বিতীয়। ১৯৭১-এর পর এদের সঙ্গে দেখা হয়নি। আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই, এখন তারা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করবেন ইয়েহিয়ার তুলনায় হিমলার দুগ্ধপোষ্য শিশু শিশু শিশু।
কারণ হিমলারের বিরুদ্ধে কি ন্যুর্নবের্গ, কি হল্যান্ড বেলজিয়ম বা অন্যত্র এ অভিযোগ কস্মিনকালেও উত্থাপিত হয়নি যে তার চেলাচামুণ্ডারা নারীধর্ষণ করেছে। তাদের স্তনকর্তন, দেহে উত্তপ্ত লৌহ দ্বারা লাঞ্ছন-অঙ্কন এবং অবর্ণনীয় অন্যান্য অত্যাচারের কথাই ওঠে না।
ইয়েহিয়ার পৈশুন্য গ্রামে এ আইটেম ছিল। এবং সর্বপ্রকার পৈশাচিক ক্রুরতায় দক্ষতা লাভের জন্য কোনও এক দেশে বিশেষ একটা প্রতিষ্ঠান আছে। ইয়েহিয়া তার জোয়ান এবং অফিসারের বাছাই বাছাই স্যাডিস্টদের সেখানে পাঠায়।
কিছুদিন পূর্বে ভুট্টো প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশে ইয়েহিয়ার মিলিটারি বলপ্রয়োগে আমার সম্মতি ছিল তবে অ-ত খানি না।
.
ইস্তের
পূর্ব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের পয়লা নম্বরি নটবর ছিলেন– এখানে সীমিতভাবে আছেন– ইয়েহিয়া খান। তিনি তাঁর হারেমের জন্য জড়ো করেছিলেন দেশ-বিদেশ থেকে হরেক রকম চিড়িয়া। এরকম একটা আজব কলেকশন কে না একবারের তরে নয়ন ভরে দেখতে চায়? ইয়েহিয়ার কাবেল ব্যাটাও দেখলেন, এবং একটিতে মজেও গেলেন। কুলোকে বলে বাপ-ব্যাটাতে নাকি তাকে নিয়ে রীতিমতো ঝগড়া-কাজিয়া হয়। আখেরে বাপই নাকি জিতেছিলেন। এই নিয়ে পাকিস্তান বাংলাদেশ উভয় মুল্লুকের সংবাদপত্রে মেলা রগরগে কেচ্ছা বেরোয়। আমাকে এক সাংবাদিক শুধোলেন, মেয়েটা এ লড়ায়ে নিল কোন পক্ষ? আমি বললুম, দুটো কুকুর যখন একটা হাড্ডির জন্য লড়ে তখন হাড্ডিটা তো কোনও পক্ষ নেয় না। এটা আপ্তবাক্য; আমার আবিষ্কার নয়। সাংবাদিক তখন আরও বিস্তর নয়া কেচ্ছাকাহিনী শোনালেন।
তবে হ্যাঁ, একথা নাকি কেউই অস্বীকার করেনি যে তার হারেমের মুকুটমণি নাকি পুব বাঙলার একটি মেয়ে। তিনি শ্যামা। তাই তার পদবি ব্ল্যাক বিউটি–কালো মানিকও বলতে পারেন। তাঁর স্বামী একদা পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ অফিসার ছিলেন এবং ইয়েহিয়া একবার সে শহর পরিদর্শন করতে গেলে তার গৌরবে চিরপ্রথানুযায়ী বিরাট এক পার্টি দেওয়া হয়–কিংবা তিনিই দেন। সে পার্টির প্রাণ ছিলেন ব্ল্যাক বিউটি। বর্ণনাতীত স্মার্ট। ইয়েহিয়া মুগ্ধ হলেন। উভয়কে ইসলামাবাদে বদলি করা হয়। পুলিশম্যানকে অস্ট্রিয়া না কোথায় যেন রাজদূতরূপে পাঠানো হল। এটা কিছু নতুন পদ্ধতি নয়। তিন-চার হাজার বছর পূর্বে ইহুদিদের রাজা ডেভিড এক বিবাহিত রমণীতে মুগ্ধ হয়ে তাকে গর্ভদান করেন। এবং যে রণাঙ্গনে তখন যুদ্ধ চলছিল সেখানে (বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি) দায়ূদ মোয়ারের নিকটে (সেনাপতিকে) এক পত্র লিখিয়া উরিয়ের (ওই রমণীর স্বামীর হাতে দিয়া পাঠাইলেন। পত্রখানিতে তিনি লিখিয়াছিলেন, তোমরা এই উরিয়কে তুমুল যুদ্ধের সম্মুখে নিযুক্ত কর, পরে ইহার পশ্চাৎ হইতে সরিয়া যাও, যেন এ আহত হইয়া মারা পড়ে। (শমুয়েল ১১, ৮-২৪)।
ইয়েহিয়া উপরে উল্লিখিত চালের দ্বিতীয়ার্ধ সুসম্পন্ন করেননি, তবে এস্থলে কালো মানিক কাহিনীর কালানুক্রমিক ক্রমবিকাশ ছিন্ন করে পরবর্তী একটি ঘটনার উল্লেখ করলে কাহিনীটির পরম্পরা অক্ষুণ্ণ থাকে : ভুট্টো রাজা হয়ে ইয়েহিয়ার চরিত্রদোষ নিয়ে গবেষণা করার জন্য পরশ্রীকাতরদের যে সময় লেলিয়ে দিলেন ঠিক সেই সময়ে ব্ল্যাক বিউটির কাবিননামা-সম্মত স্বামী অস্ট্রিয়ার পদস্থলে অকস্মাৎ হার্টফেল করে সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করেন। বিবির ওপর সে ঘটনা কী প্রকারের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল সে বিষয়ে সমসাময়িক ইতিহাস নীরব।
তবে তিনি তার বহু পূর্বেই ইয়েহিয়ার গৌরবসূর্যের মধ্যগগনকালে মাদাম পম্পাদুরে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছেন।
যে বাড়ির উপরের তলায় বসে ইয়েহিয়া দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করতেন তার নিচের তলায় বসতেন আর্মির হোমরা-চোমরারা। তারা সরকারি তাবৎ কাগজপত্র, বিশেষ করে সরকারি বেসরকারি স্পাইদের রিপোর্ট পড়তেন, আপসে আলোচনা করে সিদ্ধান্তগুলো পেশ করতেন হুজুরের কাছে দোতলায়, তার শেষ হুকুমের জন্য সে বাবদে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। নিচের তলায় আঁদরেলদের মোড়ল ছিলেন ইয়েহিয়ার সর্বোচ্চ পদধারী স্টাফ অফিসার লেফটেনেন্ট-জেনারেল পিরজাদা। ইনিই ছিলেন রাজা ইয়েহিয়ার চাণক্য– কদর্থে।
কিন্তু যে-ই হোন, আর যা-ই হোন, সব্বাইকে প্রথম যেতে হত কালো মানিকের খাস-কামরায়– এস্তেক পিরজাদাকেও। সে যাওয়াটা নিতান্ত একটা লৌকিকতা ছিল বলে মনে হয় না। তবে কি তিনি ইয়েহিয়াকে ততখানি গ্রাস করতে পেরেছিলেন, যতখানি সেক্রেটারি বরমান নাটকের শেষাঙ্কে হিটলারকে কজায় এনেছিলেন? এ বিষয়ে আমার অসীম কৌতূহল। কারণ যে বাইবেল থেকে আমি অল্পক্ষণ আগে একটি উদাহরণ দিয়েছি সেই বাইবেলেই আরেকটা উদাহরণ আছে সেটা কালো মানিকের সঙ্গে টায় টায় মিলে যায়। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি হতে পারে, কিন্তু আমি নিরুপায়। রগরগে কেলেঙ্কারি কেচ্ছার কাহিনী লেখার জন্য আমার চেয়ে যোগ্যতর অনেক গুণী আছেন। অধম সর্বক্ষণ সর্ব ঘটনার পূর্ব উদাহরণ খোঁজে ধর্মের তুলনাত্মক ইতিহাসে।
ইরানের দিগ্বিজয়ী সম্রাট অশ্বেরশ- Artaxerxes আপন রানির ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হয়ে অন্য রানির সন্ধানে রাজপ্রাসাদে অসংখ্য সুন্দরী সমবেত করলেন তাঁর বিশাল রাজত্বের ভিন্ন। ভিন্ন প্রদেশ থেকে। এঁদেরই একজন ইহুদি তরুণী সুন্দরী ইস্তের। নম্র স্বভাব ধরে ও অল্পে সন্তুষ্ট। রাজা স্বয়ং বিশুদ্ধ আর্য বংশীয়; পক্ষান্তরে ইহুদিদেরও জাত্যাভিমান কিছুমাত্র কম নয়– তারা সদাপ্রভু যেহোভার স্বনির্বাচিত সর্বশ্রেষ্ঠ জাত। ইস্তেরের সৌন্দর্যে ও আচরণে মুগ্ধ হয়ে রাজা স্বহস্তে তার মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিলেন।
রাজার প্রধানমন্ত্রী হামন ইহুদিদের প্রতি এতই বিরূপ ছিলেন যে, সে জাতকে সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করার উদ্দেশ্যে রাজার সম্মুখে নিবেদন করলেন :
(বাইবেলের ভাষায়) আপনার রাজ্যের সমস্ত প্রদেশস্থ জাতিগণের মধ্যে বিকীর্ণ অথচ পৃথককৃত এক জাতি আছে (বাঙালরা সর্বত্র বিকীর্ণ না হলেও তারা যে অত্যন্ত পৃথককৃত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই– লেখক); অন্য সকল জাতির ব্যবস্থা হইতে তাহাদের ব্যবস্থা ভিন্ন (পাঞ্জাবি পাঠান বেলুচদের ব্যবস্থা থেকে বাঙালির ব্যবস্থা যে ভিন্ন সে-কথা তারাও জানে, আমরাও জানি। হামন বলেননি, কিন্তু এস্থলে আমরা, বাঙালিরা বলি, এবং তাই নিয়ে আমরা গর্ব অনুভব করি লেখক); এবং তাহারা মহারাজের ব্যবস্থা পালন করেন না। হামনের মতে এইটেই তাদের সর্বপ্রধান পাপ। আমরা বাঙালিরা বলি, পালন করেছি, পালন করেছি– সাধ্যমতো পালন করেছি, ঝাড়া তেইশটি বছর ধরে। নিতান্ত যখন সহ্যের সীমানা পেরিয়ে গিয়েছে তখন আপত্তি জানিয়েছি অত্যন্ত অহিংসভাবে; খানরা যখন নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে।
হামন তাই সর্বশেষে সম্রাট অহরেশের সামনে নিবেদন করলেন :
যদি মহারাজের অভিমত হয়, তবে তাহাদিগকে বিনষ্ট করিতে লেখা হউক।
ম্রাট সেই আদেশ দিলেন। এবং যেহেতু তিনি সম্রাট তাই লুকোচুরির ধার ধারেন না। তাই তার লিখিত আদেশ ধাবকগণ দ্বারা রাজার অধীন সমস্ত প্রদেশে প্রেরিত হইল যে একই দিনে, অদর মাসের ত্রয়োদশ দিনে যুবা ও বৃদ্ধ, শিশু ও স্ত্রী সুদ্ধ সমস্ত ইহুদি লোককে সংহার, বধ ও বিনাশ এবং তাহাদের দ্রব্য লুট করিতে হইবে।
ইয়েহিয়া রাজা নয়। দারওয়ান বংশের দাস। সে ২৫ মার্চ শেখ মুজিব এমনকি তার ইয়ার ভুট্টোকে না জানিয়ে– ভুট্টোকেও বিশ্বাস নেই, পাছে সে ফাঁস করে দেয়– ঢাকা থেকে পালিয়ে যাবার সময় তার কসাই টিক্কা খানকে আদেশ দিয়ে যায়, আমি নির্বিঘ্নে করাচি গিয়ে পৌঁছই– বলা তো যায় না, দ্যাট উয়োমেনের হুকুমে ইন্ডিয়ানরা আমার প্লেনে বঙ্গোপসাগরে বা আরব সাগরে হামলা করতে পারে। করাচি গিয়ে মাত্র তিনটি শব্দের একটি কোড রেডিয়োগ্রাম পাঠাব–সর্ট দেম আউট- টেনে টেনে বের কর বাছাই বাছাই মাল। বাকিটা যথাস্থানে হবে। ইস্তেরের কাহিনীতে ফিরে যাই।
বলা বাহুল্য, ইহুদিদের ভিতর হাহাকার পড়ে গেল।
ইস্তেরের পিতৃব্য তখন রাজার কঠোর আদেশ তাঁকে জানালেন এবং তিনি যেন রাজার নিকটে প্রবেশ করিয়া তাহার কাছে বিনতি ও স্বজাতির জন্য অনুরোধ করেন, এমন আদেশ করিতে বলিলেন।
ইস্তের রাজার সম্মুখে উপস্থিত হলেন। রাজা বললেন, ইস্তের রানি, তোমার নিবেদন কী? রাজ্যের অর্ধেক পর্যন্ত হইলেও তাহা সিদ্ধ করা যাইবে। ইস্তের বললেন, যদি মহারাজের ভালো বোধ হয় তবে ইহুদিদিগকে বিনষ্ট করণার্থে যে সকল পত্র লিখিত হইয়াছে সে সকল ব্যর্থ করিবার জন্য লেখা হউক। কেননা আমার জাতির প্রতি যে অমঙ্গল ঘটিবে, তাহা দেখিয়া আমি কীরূপে সহ্য করিতে পারি? আর আপন জ্ঞাতি কুটুম্বের বিনাশ দেখিয়া কীরূপে সহ্য করিতে পারি?
রাজা তদণ্ডেই ইহুদিদিগকে অভয় দিলেন। তার সে পত্র অহশ্বেরশ রাজার নামে লিখিত ও রাজার অঙ্গুরীয়ে মুদ্রাঙ্কিত হইল, পরে দ্রুতগামী বাহনারূঢ় অর্থাৎ বড়রাজার রাজকীয় অশ্বে আরূঢ় ধাবকগণের হস্তদ্বারা সেই সকল পত্র প্রেরিত হইল। (ধর্মপুস্তক অর্থাৎ পুরাতন ও নতুন নিয়ম, এস্টের, ১– ৮; ২-১৩)।
.
দুষ্ট মন্ত্রীর চক্রান্ত বুঝতে পেরে রাজা গণনিধনের মতো মহাপাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হন। বাংলাদেশের এই ন মাস-জোড়া গণনিধন প্রচেষ্টা বিশ্বজন শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল– সাহায্য করল একমাত্র ভারত। সে তার ধর্মবুদ্ধি বাইবেল থেকে সগ্রহ করে না। শুনেছি, রাষ্ট্রপতি নিকসন খ্রিস্টান; তাই বিবেচনা করি তিনি বাইবেল পড়েননি। কিন্তু এহ বাহ্য।
আমার মনে প্রশ্ন জাগে, ইয়েহিয়া যখন ব্ল্যাক বিউটির স্বজাতি, জ্ঞাতি কুটুম্বের সর্বনাশ করেছিলেন তখন তিনি কি একবারের তরেও ভাবেননি–ইস্তেরের আপন ভাষায় আপন জ্ঞাতি কুটুম্বের বিনাশ দেখিয়া কী করিয়া সহ্য করিতে পারি?
এ কাহিনীর একটি ঘটনার উল্লেখ আমি এতক্ষণ করিনি।
পিতৃব্য যখন ইস্তেরকে আদেশ দেন তিনি যেন রাজার নিকটে প্রবেশ করেন, তখন ইস্তের প্রথমটায় ভয় পেয়েছিলেন, কারণ, প্রজারা সকলেই জানে, পুরুষ কি স্ত্রী, যে কেহ আহত না হইয়া ভিতরের প্রাঙ্গণে রাজার নিকট যায়, তাহার জন্যে একমাত্র ব্যবস্থা এই যে, তাহার প্রাণদণ্ড হইবে।
পিতৃব্য ইস্তেরের ভীতির কথা শুনে তাঁকে জানান :
সমস্ত ইহুদির মধ্যে কেবল তুমি রাজবাটিতে থাকাতে রক্ষা পাইবে, তাহা মনে করিও না। ফলে যদি তুমি এ সময়ে সর্বতোভাবে নীরব হইয়া থাক তবে অন্য কোনও স্থান হইতে ইহুদিদের উপকার ও নিস্তার ঘটিবে (বাংলাদেশের বেলা তাই হল– লেখক), কিন্তু তুমি আপন পিতৃকুলের সহিত বিনষ্ট হইবে; আর কে জানে যে, তুমি এইপ্রকার সময়ের জন্যই রাজ্ঞীপদ পাও নাই (এস্থলে রাজবল্লভা হও নাই?)
বাঙালির উপকার ও নিস্তার ঘটেছে, এখন প্রশ্ন ব্ল্যাক বিউটি কি নিস্তার পেয়েছেন? কিন্তু এই সর্ব বাক্য বাহ্য।
ব্ল্যাক বিউটি গৌণ, তার বৈধব্যপ্রাপ্তি গৌণ, তাঁর সর্বৈব গৌণ।
পৃথিবীর গণনিধন ইতিহাসে ইস্তেরে তার প্রথম প্রামাণিক উল্লেখ।
অধম যখন তার প্রথম অবতরণিকায় বলেছিল, এ ন মাসের বহু বিচিত্র ঘটনা থেকে সৃষ্ট হবে পুরাণ, এপিক, রূপকথা, লোকগীতি তখন সে ক্ষণতরে বিস্মৃত হয়েছিল যে রচিত হবে সর্বোপরি নবীন শাস্ত্রগ্রন্থ।
.
শেখের জয়
সাধারণ নির্বাচন তথা গণতন্ত্রের আশ্বাস দিয়ে পরে সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে কেউ যে কখনও, এমনকি এ যুগে, সঁটে রাজত্ব করেননি এমন নয়। কিন্তু ইয়েহিয়া জানতেন, রাজত্ব তিনি করতে পারবেন তবে সে রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হবে না– অতখানি দূরদৃষ্টি তাঁর ছিল। তদুপরি উভয় পাকিস্তানের লোক ঝাড়া সাড়ে দশটি বচ্ছর ধরে স্বাধিকারপ্রমত্ত ডিকটেটরি শাসনের চাবুক খেয়ে খেয়ে হন্যে হয়ে উঠে আইয়ুবের পতন ঘটিয়েছে; ইয়েহিয়াও যদি ডিকটেটরি করতে চান তবে তাকেও মোটামুটি আইয়ুবের প্যাটার্নই বুনতে হবে এবং জোলাপ দিতে হবে আরও বড়া এবং কড়া ডোজে। কারণ ইতোমধ্যে জনসাধারণ ডিকটেটরি ফন্দিফিকির খাসা বুঝে গিয়েছে এবং সেগুলোকে কী কৌশলে বানচাল করতে হয় সেটাও বিলক্ষণ রপ্ত করে। নিয়েছে। একটি সামান্য সরেস উদাহরণ দিই। যারা সুদুমাত্র আলা ভিনসেন্ট স্মিৎ এবং তাঁর গুরুকুল মোগল অ্যাডমিনিসট্রেশনের ওয়াকেআ-নবিস (waknis) পর্চা-নবিস সম্প্রদায়ের নিছক সন তারিখসহ ঘটনার ফিরিস্তি সর্বোৎকৃষ্ট পাঠ্যবস্তু বলে বিশ্বাস করেন আমি তাদের সেবা করার মতো এলেম পেটে ধরিনে। আমি বরঞ্চ সেইসব মোগল লেখকেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করি যারা ইতিহাসের বাহানায় গালগল্প শোনাতেন, মাঝেমিশেলে গুল তক মারতেন! অর্থাৎ ঘুমন্ত ইতিহাসের হাত দিয়ে গাঁজা খেয়ে নিতেন।
লোকটি আমার ভায়রা। গাদাগোব্দা ইয়া লাশ! রসবোধ প্রচুর। তিনি তখন মৈমনসিংয়ের সিভিল সার্জন। কী একটা ছোট্ট চাকরি খালি পড়েছে। এমন সময় আইয়ুবের প্যারা গবর্নর মোনেম খান করলেন ডাক্তারকে ট্রাঙ্ক-কল। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, অমুককে চাকরিটা দেবে। পরিচয় যৎসামান্য কিন্তু সুবেদার মোনেম বাপের বয়সী লোককেও তুমি তুই করতেন।
ডাক্তার ফোনের ক্রেডলকে বাও বাও করতে করতে সবিনয় বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়।
পরের দিনেই ফাইনাল ডিসিশন। ডাক্তার গবর্নরের প্যারাকে নোকরি দিলেন না।
সন্ধ্যার সময় ঢাকা থেকে ফের ট্রাঙ্ক-কল।
কী, তোমার এত আস্পদ্দা! আমার হুকুম অমান্যি করলে? জানো, আমি তোমার চাকরি খেতে পারি
এইটে ছিল তাঁর হট্টফেভূরেট হুমকি! জাতে ছিলেন মাছি-মারা বটতলীয় সিকি কড়ির উকিল। কাজ ছিল আদালতকে হুজুর হুজুর-এর প্রচুর তৈলমর্দন করে দু চারটে জামিন মঞ্জুর করিয়ে নিয়ে হুমা গাঁয়ের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ানো কড়ি কামানো। এসব আমার শোনা কথা। তবে মোনেম সম্বন্ধে দশের মুখ যা বলছে তার থেকে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, স্বয়ং হিটলারও এমন তাঁবেদার খিদমৎগার মোসায়েব কপালে নিয়ে ডিকটেটর হননি- আইয়ুবের কপালে যা নেচেছিল।
সুবেদারের হুঙ্কার শুনে ডাক্তার বললেন, একশো বার পারেন, স্যর, একশত বার পারেন। কিন্তু লোকটা
আমি কিছু জানতে চাইনে–
আমার কথাটা শুনুনই না, স্যর। ছেলেটাকে আমি শুধালুম, আমাদের লাট সায়েবের নাম কি? বলে কী না, মুহম্মদ মুফিজ চৌধুরী! তার পর—
ডাক্তার বললেন, দড়াম করে শব্দ হল। ডেড কট অফফ!
আমি অবাক হয়ে বললুম, আপনার বুকের পাটা তো কম নয়!
ডাক্তার অতিশয় সবিনয় : কী যে বলেন, ভাই সায়েব। আপনি জানেন না যে যত ছোটা হিটলারের ক্ষুদে বাচ্চা হয় তার দেমাক-রওয়াব তত টনটনে। সেখানে মোকা মাফিক খোঁচা মারতে পারলেই তিনি বন-ফায়ার! কী! আমার নামটা পর্যন্ত জানে না যে বুড়বক– ইত্যাদি।
.
এরকম আরও বিস্তর কায়দা রপ্ত করে নিয়েছিল বাংলাদেশের অতিশয় নিরীহজনও– তবে হিউমার দিয়েও যে হিটলারি হুকুম বানচাল করা যায়, আমার কাছে এই তার প্রথম ও শেষ উদাহরণ।
তাই ইয়েহিয়া স্থির করলেন, ভিন্ন মুষ্টিযোগ প্রয়োগ করতে হবে। দাও গণতন্ত্র, হাতে। রাখ কলকাঠি।
বয়স্ক পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, ইংরেজের কাছে স্বরাজের কথা তুললেই সে বলত, আলবাৎ স্বরাজ দেব। হিন্দু চায় অখণ্ড ভারত, মুসলমান চায় পাকিস্তান, আর নেটিভ স্টেটের মহারাজারা চান যেমন আছে তেমনি থাক, তোমাদের সঙ্গে সন্ধির শর্ত ছিল, আমরা তোমাদের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার স্বার্থে হাত দেব না, আর তোমরা আমাদের রক্ষা করবে। তোমরা চলে গেলে আমাদের রক্ষা করার জিন্মেদারি নেবে কে? তাই তোমরা তিন দল একমত হয়ে এক গলায় বল, কোন ঢঙের, কোন সাইজের কোন রঙের স্বরাজ চাও তোমরা। একমত হলেই আমরা খালাস।
এটা ডিভাইড অ্যান্ড রুল নয়, এটা ডিভাইড অ্যান্ড ডোন্ট কুইট ইন্ডিয়া।
ইয়েহিয়া সেই মতলবই আঁটলেন। ইংরেজ তাঁর ফাদার মাদার গর্ভস্রাব জারজ-সন্তানও প্রকৃত পিতার হদিস পেলে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। আর কে না জানে, তাবৎ নৃতত্ত্ববিদ একবাক্যে বলেন, ইয়েহিয়ার যে অঞ্চলে জন্মভূমি সেখানে বিস্তর জাত-বেজাত এসে মিশেছে দেদার বর্ণসঙ্কর।
ইয়েহিয়া হিসাব করে দেখলেন, গণনির্বাচনে কোনও দলই সংখ্যাগুরু হবে না। পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান তো এক হতেই পারে না। এক পশ্চিম পাকিস্তানি ওয়াকিফহাল সজ্জন বলেছেন, পাকিস্তানের দুটো ডানা (উইং)- পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। আমি দুটো পাখাই দেখেছি, কিন্তু পাখিটাকে কখনও দেখতে পাইনি। তাই যে পাখিটা আদৌ নেই তার দুটো ডানা পলিটিকাল পার্টি মাফিক টুকরো টুকরো করতে কোনও অসুবিধা তো নেই। ইংরেজের মতো তিনিও বহুধা বিভক্ত উভয় পাকিস্তানের ওপর বহুকাল ধরে রাজত্ব করে যাবেন। ইনশাল্লা সুবহানাল্লা!
গুপ্তচরদের শুধোলেন, পাকা খবর নিয়ে বল দেখি, কোন পার্টি কত ভোট পাবে বলে অনুমান করা যায়।
এস্থলে ওয়াকিফহাল মহলে নানা মত প্রচলিত। এক দল বলেন, ডিকটেটরদের সঙ্গে যারাই কাজকারবার করেছে তারাই জানে, ডিকটেটররা শুনতে চান সেই রিপোর্ট যেটা আপন মনের মাধুরীর সঙ্গে মিশে যায়। ডিকটেটররা চিরকালই দাবি করেন তারা এক অলৌকিক যষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা দেখতে পান। গুপ্তচরের রিপোর্ট যদি সেই ভবিষ্যৎকে সায় দেয় তবে উত্তম, নইলে সেটা গডড্যাম অবজেকটিভ, বাস্তব কিন্তু বর্তমানের বাস্তব। আখেরে ভোটের ফলাফল কী হবে সেটা এ রিপোর্ট প্রতিবিম্বিত করছে না। তবে গুপ্তচরদের। কাছ থেকে রিপোর্ট চাওয়ার প্রয়োজনটা কী? সেটা শুধু সন্দেহপিচেশ দু একটা মূর্খ জেনারেলদের বোঝাবার জন্য যে কোনও পার্টিই মেজরিটি পাবে না।
১৯৭০-এর মাঝামাঝি– আমার মতো কিংবা হেমন্তে-শীতে যারাই এদেশে বেড়াতে এসেছেন তাদের মনে কোনও সন্দেহ হয়নি যে শেখ না-ও জিততে পারেন। তবে তিনি যে আখেরে গণতন্ত্রের ইতিহাসে অভূতপূর্ব এরকম একটা থান্ডারিং মেজরিটি পেয়ে যাবেন সেটা বোধহয় কেউই কল্পনা করতে পারেননি। তৎসত্ত্বেও ইয়েহিয়ার টিকটিকিরা নির্বাচনের শেষ ফল কী হবে সে সম্বন্ধে যে ভবিষ্যৎ রাশি গণনা পাঠালেন সেটা ইয়েহিয়ার দোস্ত-দুশমন উভয়কেই আজ অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে বেকুব বানিয়ে দেবে।
অ্যাসেমব্লিতে সিট ৩০০টি। তদুপরি আরও তেরোটি সিট বেগমসায়েবাদের জন্য সংরক্ষিত; ইয়েহিয়ার স্টাটিসটিশিয়ান বা বৈজ্ঞানিক গণৎকার টিকটিকিরা নিম্নের ছক কেটে দিলেন। উভয় পাকিস্তান মিলে সিট পাবেন–
আওয়ামী লীগ–৮০
কয়ুমের মুসলিম লীগ–৭০
মুসলিম লীগ (দৌলতনা দল)–৪০
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি দল)–৩৫
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (ভুট্টো)–২৫
বাদবাকি সিটগুলো মোটামুটি এই হারেই হবে– আভাস দিলেন ফলিত জ্যোতিষীরা।
ইয়েহিয়া উর্দু বলার সময় হনুকরণ* করেন যুক্তপ্রদেশের (সেটা ইন্ডিয়ায় তওবা, তওবা!) উর্দুভাষীদের। সেই উচ্চারণে সানন্দে হুঙ্কার ছাড়লেন ইয়েহিয়া ইয়েছ! নামের সঙ্গে আনন্দসূচক বিস্ময়বোধক ধ্বনি হুবহু মিলে গেল।
[*১. রবীন্দ্রনাথের সর্বগজ দ্বিজেন্দ্র একদা লেখেন : টু ইমিটেট = অনুকরণ : টু এপ (ape) = হনুকরণ। ইংরেজি ধ্বনি-তাত্ত্বিকরা এই ককনি H হ-টি লক্ষ করবেন।]
কিন্তু হায়, কাশীরাম দাস এই গৌড়ভূমিতেই আপ্তবাক্য বলে গিয়েছিলেন :
কতক্ষণ জলের তিলক থাকে ভালে?
কতক্ষণ থাকে শিলা শূন্যে মারিলে?
ভোটাভুটির শেষ ফল যখন বেরুল তখন দেখা গেল :
আওয়ামী লীগ–১৬০
ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি–৮১
কয়ুমের মুসলিম লীগ–৯
মুসলিম লীগ (দৌলতনা দল)–৭
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি দল)–৬
পাঁচটা ভিন্ন ভিন্ন পার্টিতে সর্বসাকুল্যে–২১
ইনডিপেনডেন্ট–১৬
—————————–
মোট–৩০০
দুই হিসাব মেলালে কার না চক্ষু স্থির হয়!
মহিলাদের সংরক্ষিত তেরোটি সিট থেকে আওয়ামী লীগ পেল আরও সাতটি সিট–একুনে ১৬৭। পূর্ব বাঙলায় সিট ছিল সর্বসমেত ১৬৯; অর্থাৎ মাত্র দুটি সিট আওয়ামী লীগ পায়নি।
বিগলিতাৰ্থ অ্যাসেমব্লিতে ভুট্টোকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সব দল এক গোয়ালে ঢুকলেও আওয়ামী লীগকে হারাতে পারবে না।
লেগে গেল ধুন্দুমার। ইয়েহিয়া স্পষ্ট দেখতে পেলেন অ্যাসেমব্লিতে এখন তিনি গোটা পাঁচেক দলকে বাদর নাচ নাচিয়ে আপন ডিকটেটরি অক্ষুণ্ণ রেখে ভারতের সঙ্গে হাজার বছর ব্যাপী মোকাবেলা করে যেতে পারবেন না।
আইনত ভুট্টো কেবলমাত্র বিরোধী দলের নেতৃত্ব করতে পারেন। কিন্তু তিনি উচ্চকণ্ঠে বলে বেড়াতে লাগলেন, মুজিব যে রকম পূর্ব পাকিস্তানের নেতা, তিনিও তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা। এখন এসে গেছে দুই পাকিস্তানের মোকাবেলার লগ্ন।
এস্থলে প্রথমেই বলতে হবে, উভয় পাকিস্তানের মোকাবেলা বা সংঘর্ষের আশা বা আশঙ্কার কথা শেখ সাহেব কখনও তোলেননি। ভোটাভুটিতে বিরাট সংখ্যাধিক্য পাওয়ার পরও তিনি কখনও বলেননি– এইবারে আমরা তাবৎ সমুচা পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর রাজত্ব করব– যদিও সেটা বলার আইনত ধৰ্মত সর্ব হক্ক আওয়ামী লীগের ছিল। ভুটো যদি এখনও বলেন পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়নি, জিন্দাবাদ অখণ্ড পাকিস্তান তবে আওয়ামী লীগের এখনও সেকথা বলার হক আছে।
বস্তুত জনাব ভুট্টো যদি নিজের জীবন্ত-সমাধির তামাসা নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে চান, তবে অখণ্ড পাকিস্তান সরকারের কানুন অনুযায়ী তিনি ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লির অধিবেশন ডাকুন ঢাকায়, যেটা ৩ মার্চ ১৯৭১ হওয়ার কথা ছিল। তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কি না সেটা সাংবিধানিক আইনে যদিও বিতর্কাধীন– আমরা না হয় তাঁকে আবু হোসেনের মতো একদিনের তরে খলিফে বানিয়ে দিলুম। ভয় নেই পাঠক, পশ্চিম পাকিস্তানের বিস্তর মেম্বরও গুঁড়ি গুঁড়ি হামাগুড়ি দিয়ে আসবেন– সে ব্যবস্থা সেই হারাধনের একুশটি পরিবার পরমানন্দে করে দেবেন। পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, ৩ মার্চের অধিবেশনে পশ্চিম পাক থেকে কোনও সদস্য যদি ঢাকা আসার চেষ্টা করেন, তবে ভুট্টো তাদের ঠ্যাং ভেঙে দেবার হুমকি দেন। তৎসত্ত্বেও বেশ কয়েকজন অক্ষত ঠ্যাং নিয়েই এসেছিলেন। বাকিরা আসতে পারেননি– প্লেনে সিট পাননি বলে। বস্তুত বঙ্গবন্ধু ওই সময়ে, ৩ মার্চ ১৯৭১-এ বলেন, এটাকে ট্র্যাজিক বলতে হয় যখন প্লেনগুলো (মিলিটারি প্লেন নয়– লেখক) পশ্চিম পাকের সদস্যদের নিয়ে আসার কথা তখন সেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে মিলিটারি আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসাতে। আসবেন আসবেন, মেলা সদস্য আসবেন। ওখানে তো প্রাণের ভয়ে কাঁপছেন। এখানে সদস্য হিসেবে অন্তত জান-মাল সে। চাকরির তরে তদ্বিরও করা যাবে। সত্য বটে বন্ধুবন্ধু বলেছেন, এখন আর তদ্বির চলবে না। অধম সক্কলের কাছে মাপ চেয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে একটি সমসাময়িক নীতিবাক্য স্মরণ করে : একদা বসুন্ধরা ছিলেন বীরভোগ্যা– এখন তিনি তদ্বির-ভোগ্যা।
এবং বিশেষ করে দর্শক হিসেবে নিমন্ত্রণ জানাতে হবে বার অব বেলুচিস্তান বুচার অব বেঙ্গলকে। তার যথেষ্ট কারণ আছে। মুক্তিযুদ্ধ যখন চরমে, তখন টিক্কা খান ফরমান জারি করে স্বাধীন বাংলাদেশের কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল আতাউল গনী মুহম্মদ ওসমানীকে তার সম্মুখে ঢাকাতে উপস্থিত হবার হুকুম ঝাড়েন। ওসমানী সাহেব ভদ্রসন্তান। অতিশয় ভদ্র ভাষায় উত্তর দেন– যদূর মনে পড়ে কে কাকে ডেকে পাঠাবে সেটা না হয়… (অর্থাৎ বিতর্কাধীন, কিংবা ওসমানীরই বেশি, কিংবা উপস্থিত সেটা মুলতুবি থাক; আমার সঠিক মনে নেই বলে দুঃখিত- লেখক)। তবে আমি ঢাকা আসছি, কিন্তু প্রশ্ন, মহাশয় কি সে সময় ঢাকায় থাকবেন?
এই উত্তরটি গেরিলারা ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেয়।
বলা বাহুল্য জেনারেল ওসমানী এক কথার সেপাই। তিনি ঢাকা এসেছিলেন, কিন্তু টিক্কা তখন সেখানে নেই।
বেধড়ক মার খেয়ে ইংরেজ সৈন্য যখন ডানকার্ক থেকে নিম্নপুচ্ছ হয়ে সবেগে পলায়ন করে তখন বিবিসি-র পাঠান সংবাদদাতা বুখারি বলেন, হমারে সিপাহি বাহাদুরিকে সাথ হট গয়ে। বাহাদুরির সঙ্গে হটনা– সোনার পাথরবাটি।
টিক্কা খান বাহাদুরিকে সাথ হটতে হট্টতে পৌঁছে গেলেন রাওয়ালপিণ্ডি।
ব্লদেভুটা মিস করার জন্য টিক্কার ক্ষোভ থাকতে পারে। যাদের নিমন্ত্রণ করা হবে তার মধ্যে টিক্কা একজন মাস বইকি!
অধিবেশনের কর্মসূচি (আজেন্ডা) এবং সেটা কীভাবে রূপায়িত হবে তার ভার, কল্পনাবিলাসী পাঠক, তোমার হাতে ছেড়ে দিলুম। কিন্তু এটা শুধু কল্পনা-বিলাসই হবে না। পাঠক পরের সংখ্যায় দেখতে পাবেন, ভুট্টো সাহেব এই যে মুসলিম জগতে সফর করে এলেন সেখানে কোন পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে শেখ সাহেবের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে এলেন। একদিকে নিদারুণ হাহাকার, আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র নষ্ট করেছে; অন্যদিকে নিদারুণতর হাহাকার যে বাইশটি ধনপতির অর্থানুকূল্যে তিনি ছোটা হিটলার দি থার্ড হলেন তাদের দোকানপাট বন্ধ। তারা যে রদ্দিমাল পূর্ব বাঙলায় চড়া দরে ডাম্প করত সেগুলো এখন করাচির পেভমেন্টে নেমেছে; আরবরা যদি দয়া করে কেনে।
যে অধিবেশনে ভুট্টো শেষের আইটেম না বললেও প্রথমটা বলবেনই বলবেন। তা তিনি যা-বলুন যা-করুন কোনও আপত্তি নেই। শুধু একটা শর্ত যেন থাকে। তিনি গত বছর ইউনাইটেড নেশনে যেরকম গোসসাভরে কাগজপত্র ছিঁড়ে দুমদুম করে সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন, এখানে যেন সেরকমটা না করেন।
.
ইয়েহিয়া-ভুট্টো
আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের ৩১শে। কাজেই আষাঢ়স্য প্রথম দিবস বলতেও বাধা নেই। অন্তত আষাঢ়ের প্রথম দিবসে বর্ষা আগমনের যেসব লক্ষণ নিয়ে আবির্ভূত হয় আজ ঢাকাতে সেই বর্ষা এসেছেন বৃষ্য সর্বলক্ষণসম্পন্না শ্যামা সুন্দরীর ন্যায়। তাহাজ্জুদ নামাজের ওয়াকত থেকেই শুনতে পাচ্ছি বাড়ির পাশের নিমগাছ, বাংলাদেশ রাইফেলসের চাঁদমারি ঘিরে যে ঘন বাঁশবন, গ্রীষ্মের অত্যাচারে ফিকে বেগুনি রঙের পুস্পরিক্ত জারুল এবং কৃষ্ণের চূড়ার পর অবিরল রিমঝিম রিমঝিম বারিপতনের মৃদু মর্মরধ্বনি। আর
মেঘের ছায়া অন্ধকারে
রেখেছে ঢেকে ঢাকা-রে—
এতদিনে ঢাকা ছিল খোলা রৌদ্রতপ্ত বিবর্ণ আকাশের নিচে। আজ ক্ষীণ বরিষণে জলকলকলে নাম তার সার্থক হল।
এমন দিনে নমো ইলিশায়
খিচুড়ি তার সাথে এ ঢাকায় ॥
গত বৎসর এইদিনে কার সাধ্য ছিল এ বাড়িতে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে কবিত্ব করে? বাড়ির বাগানের শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটি নালা বয়ে গিয়ে একটু দূরে একটা ঝিলের রূপ নিয়েছে। গজ তিনেক চওড়া নালার পরেই খাড়া উঁচু টিলার উপর বাঁশবন ঘেরা চাঁদমারির পাঁচিল। এ বাড়ি থেকে ধানমণ্ডি নিবাসিক অঞ্চলের আরম্ভ। ধানমণ্ডির ঘন বসতিতে মুক্তির দু পাঁচজন হেথা-হোথা সর্বত্রই আত্মগোপন করে থাকত। চাঁদমারি ঘিরে টিক্কার না-পাকদের অহরহ ছিল ভয়, রাতের অন্ধকারে মুক্তি-রা হঠাৎ কখন না পাকিস্তানের রাইফেলসের হেড-কোয়ার্টারের ওপর হামলা চালায়। নালার পাশেই তাই খুঁড়েছিল বিরাট এক বাঙ্কার। তার ভিতরে বিজলিবাতি ফ্যান রেডিয়ো, রমণী, উত্তম উত্তম শয্যা সবকিছুই ছিল। আর টিলাটার সানুদেশে বাঁশবনের ভিতরে আড়ালে সুবো-শাম রাইফেল হাতে পাহারা দিত–পাকরা। সামান্যতম প্রদীপ-রশি দেখতে পেলেই সঙ্গে সঙ্গেই ফায়ার! এমনকি দূরের কোনও মিলিটারি জিপের হেড-লাইট বাড়ির কোনও শার্সির উপর অতি সামান্য চিলিক মারলেই জাস্ট টু বি শ্যোর, চালাও ধনাধন গোলি– কাপুরুষের লক্ষণ ওই, বুকের ভিতর বলা তো যায় না; ক্যা মালুম ক্যা হ্যায়-এর ধুপুস-ধাপুস ছুঁচোর নৃত্য, ঘামের ফোঁটায় দেখে সোঁদরবনের কেঁদো কুমির!
এই বাড়ির ঘরের ভিতরে দুটো বুলেটের ইঞ্চি তিনেক গভীর ফুটো। জানালার শার্সি পর্দা ফুটো করে থানা গেড়েছে। আরেকটা জানালার চৌকাঠে লেগে সেটার ইঞ্চি দুয়েক উড়িয়ে টাল খেয়ে কঁহা কঁহা মুল্লুকে চলে গিয়েছে।
কোথায় গেল সেসব রোয়াব, বড়-ফাট্টাই!
এ বাড়ির বাগানের কোণে কিন্তু নববরিষণের সঙ্গে সঙ্গে ফুটছে লাজুক জুঁই!
ইংরেজের অত্যাচারের সময় রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন,
টুটল কত বিজয় তোরণ, লুটল প্রাসাদ চুড়ো,
কত রাজার কত গারদ ধুলোয় হল গুঁড়ো।
আলিপুরের জেলখানাও মিলিয়ে যাবে যবে
তখনো এই বিশ্ব-দুলাল ফুলের সবুর সবে।
রঙিন কুর্তি, সঙিন মূর্তি রইবে না কিছুই,
তখনো এই বনের কোণে ফুটবে লাজুক জুঁই।
মাত্র তিন গজের তফাৎ। এদিকে ফুটছে লাজুক ভূঁই। ওদিকে কোথায় রঙিন কুর্তি সঙিন। মূর্তি হেইয়া খানের ভুই?
অবিরত বৃষ্টিধারা ঝরছে।
এ বাড়ির নিচের তলাটা জোরদখল করেছিল এক পাঞ্জাবি মেজর। আমার ছোট ছেলে বললে মেজর হুজুর বাড়ি ফিরবেন কখন ঠিক নেই। তার ব্যাটমেনের মাথার টুপিতে পড়েছিল প্রথম আষাঢ়ের আড়াই ফোঁটা জল। কোঁকাতে কোঁকাতে চারপাইয়ে কুকুরকুণ্ডলী হয়ে শুয়ে পড়ে বলে তার বহুৎ জুকাম (সর্দি) হুয়া, জোরসে খাসি হুই এবং জবরদস্ত বুখার চড়হা। কিন্তু তখনও তিনি এদেশের রাজা। পুনর্মুষিক হলেন কী প্রকারে সে কাহিনী অন্য অনুচ্ছেদে আসবে এ ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে ততদিন এ পরিবারের সসৰ্প-গৃহে বাস, সে কাহিনী তার সঙ্গে বিজড়িত।
আমার পরিকল্পিত এসেমব্লির সেশনটা উপস্থিত মুলতুবি আছে। কারণ ভুট্টো এখন অন্তত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। শুনলুম, হিটলার ডিনেস্টির চতুর্থ ছোটা হিটলার তাঁকে যখন গদিচ্যুত করবেন তখন তার কপালে অবশিষ্ট রইবে শুধু ওই এসেমব্লির সদস্যপদ। তারই হক্কে তিনি দাবি জানাবেন তখন এসেমব্লির সেশন। এখনও তিনি রাজা। তবে হিটলার নাটকের সর্বশেষ অঙ্ককে যেমন বলা হয়, দি কিং উইদাউট হিজ রোবৃস। সেই যে হুলুধ্বনি মুখরিত জনতার মাঝখান থেকে পুঁচকে একটা ছোঁড়া চেঁচিয়ে উঠেছিল, কিন্তু রাজামশাইয়ের পরনে যে কিচ্ছুটি নেই!
পূর্বেই বলেছি, ডিসেম্বরের গণ-নির্বাচনের ফলে ইয়েহিয়া যখন দেখতে পেলেন যে এসেব্লিতে তিনি গোটা পাঁচ-সাত দলকে একে অন্যের বিরুদ্ধে নাচাতে পারবেন না তখন তিনি লক্ষ করলেন যে, আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে কোনও সিট পায়নি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টো পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে কোনও সিট পায়নি।
অতএব পাঁচ-সাতটা পার্টি না নাচিয়ে তিনি নাচাবেন– দুই পার্টিকে নয়-দুই উইংকে। দুই পাকিস্তানে লাগিয়ে দেবেন মোষের লড়াই। অতএব তার হাতের কাছে আছে যে পশ্চিম পাকিস্তান সেটাকে তৎপূর্বে বেশ ভালো করে তাতাতে হবে।
দুই পাক-এর সাধারণজন ইয়েহিয়ার কূটবুদ্ধির খবর রাখত না। তাই তারা অবাক হল যখন গণনির্বাচনের পরই ইসলামাবাদ ছেড়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন শীতের মরসুমি হিমালয় সাইবেরিয়াতে হংসবলাকা নিধনে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের রাজসিক শিকারে তিনি জনসাধারণের সংস্রবে আসবেন না– তা তিনি চান না। তাকে আপ্যায়িত করবেন বড় বড় জমিদার যেন জ্যাক অব কেন্ট বা নবাব খঞ্জা খা এবং কেঁদে কেঁদো টাকার কুমির আদমজি ইস্পাহানিদের পাল– এঁদের একজনের নাম আবার ফাঁসি! ইয়েহিয়া বাগাবেন এদের।
পয়লা প্রেমের শিকার ছোঁড়াটা যেরকম নাক-বরাবর প্রিয়া-রাদেভু পানে সবেগে ধাওয়া করে না, এদিকে টু ওদিকে টক্কর খাওয়ার কামুক্লাজ করে মোকামে পৌঁছয়, ইয়েহিয়া শিকারি সেই রীতিতে হেথা-হোথা শিকার করতে করতে পৌঁছলেন তাঁর বল্লভ ভুট্টোভবনে। সেখানে তিনি যা খাতিরযত্ন পেলেন সে শুধু হলিউডেই হয়ে থাকে। কিংবা আইয়ুব যেরকম প্রফুমো সকাশে মিস কিলার সান্নিধ্যে পেয়েছিলেন। আইয়ুব তখন গদিতে; তাই সে সময়ে সদাশয় ব্রিটিশ সরকার আইয়ুবের সেই নিশাভিসারও বার্থডে-সুট পরে মধ্যযামিনীতে হুরীপরীদের সঙ্গে সন্তরণকেলি তার পরিপূর্ণ বাহার অসদ্ব্যবহারসহ প্রকাশ করেননি।
ইয়েহিয়া-ভুট্টোতে নিঃসন্দেহে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু খবরের কাগজে সেটা কামুক্লাজ করে প্রকাশিত হল, নিতান্ত যোগাযোগবশত উভয়ের মধ্যে কিঞ্চিৎ ভাবের আদান-প্রদান হয়। তা সে যে ভাষাতেই প্রকাশ করা হোক, গণনির্বাচনের পরই রাষ্ট্রপ্রধান সংখ্যাগুরু আওয়ামী নেতার সঙ্গে সর্বপ্রথম আলাপ-আলোচনা না করে নিজের থেকে প্রথম গেলেন সংখ্যালঘুর বাড়িতে। এটা কূটনৈতিক জগতে সর্ব প্রটোকলবিরোধী, সখৎ বেআদবি। এতে করে আওয়ামী লীগের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হল না, তিনি হলেন হাস্যাস্পদ এবং বিড়ম্বিত। বলা বাহুল্য, এ মশকরাটা আওয়ামী লীগের দৃষ্টি এড়ায়নি, কিন্তু লীগজন যে বিচলিত হয়েছেন সেরকম কোনও লক্ষণই দেখা গেল না।
একটা বিষয়ের প্রতি আমি কিন্তু পাঠকের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
পূর্ববঙ্গের সুদীর্ঘ ইতিহাসের এই অধ্যায়ের প্রধান নায়ক তিন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের তিনজন লোক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, (বর্তমান) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট পদচ্যুত, লাঞ্ছিত আগা মুহম্মদ ইয়েহিয়া খান।
১৯৭১ আগস্ট/সেপ্টেম্বরে জনাব ভুট্টোর আপন জবানেই পূর্ববঙ্গের অবস্থা যখন অত্যন্ত সঙ্কটজনক, অখণ্ড পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয় তখন তিনি একখানি চটি বই লেখেন।*[* ZULFIKAR ALI BHUTTO, The Great Tragedy, Sept. 71, pp. 107, Karachi.]
এই বইখানি কত শত বৎসর ধরে ঐতিহাসিক মাত্রেরই গবেষণার প্রামাণিক কাঁচামালরূপে গণ্য হবে, আজ সেকথা বলা কঠিন।
আগস্ট মাসেই ভুট্টো বুঝে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত হওয়া থেকে আর বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। ওদিকে পশ্চিম পাকে আরও বহু লোক, বিশেষ করে ধনপতিরাও সে তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছিলেন এবং সেই সঙ্কটের জন্য ইয়েহিয়া এবং তার দুষ্টবুদ্ধিদাতা ভুট্টো যে তার চেয়েও বেশি দায়ী সে অভিমত প্রকাশ্যে ব্যক্ত করতে আরম্ভ করলেন।
তখন আপন সাফাই গাইবার জন্য ভুট্টো এ বই লেখেন।
আজ পর্যন্ত এমন কোনও সাংবাদিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বলতে কসুর করেননি যে, ভুট্টোর প্রতিটি রক্তবিন্দুতে, তাঁর ধ্যানে স্বপ্নে সুষুপ্তিতে সদাজাগ্রত থাকে মাত্র একটি রিপু উন্মত্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যেটাকে প্রায় নীতিবিগর্হিত জনসমাজ বিনাশী পাপাভিলাষ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
তাই সাফাই গাইতে গিয়েও আগা-পাশ-তলা জুড়ে বার বার তাঁর একই আবদারের ধুয়ো, একই সদম্ভ জিগির :
এখনও সময় আছে। এখনও ত্রাণ আছে। আমাকে রাজ্যচালনা করতে দাও। মন্ত্র উচ্চারণ কর হে প্রতি পাপী তাপী পাকী :
ভুট্টোং শরণং গচ্ছামি ॥
.
ভুট্টাঙ্গ পুরাণ
রবীন্দ্রনাথ মূলটা বাংলায় না ইংরেজিতে লিখেছিলেন, সেটা এস্থলে না জানলেও চলবে, কারণ ইংরেজিটাও অটোগ্রাফের খাতাতে লেখা, ফুলিঙ্গটি উতরেছে অত্যুকৃষ্ট রূপ নিয়ে।
হোয়াইল দি রোজ সেড টু দি সান আই শ্যাল রিমেন ইটার্নেলি ফেৎফুল টু দি, ইটস পেটালস ড্রপট!
ইতোমধ্যে আপনাদের আশীর্বাদে বাংলাটাও মনে পড়ে গেল–
চাহিয়া প্রভাত রবির নয়নে
গোলাপ উঠিল ফুটে।
রাখিব তোমারে চিরকাল মনে
বলিয়া পড়িল টুটে।
সমসাময়িক প্রায়-ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার বেলা ওই একই বিপদ! কালি শুকোতে না শুকোতেই অন্য আরেকটা ঘটনা এসে সেটাকে বাতিল করে দেয় গোলাপবালার অনন্তকালীন প্রেমাঙ্গীকার বলা শেষ হওয়ার পূর্বেই ঝুরঝুর করে পাপড়িগুলো ঝরে পড়ে গেল।
ভুট্টোং শরণং গচ্ছামি
বলা শেষ করতে না করতেই তারই কণ্ঠে শুনি, উঁহু! হল না। তার চেয়ে বরঞ্চ বল,
সঙ্ং শরণং গচ্ছামি।
অর্থাৎ তিনি ইন্দিরাজির সঙ্গে যদি কোনও ফৈসালা করে ফেলেন (আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস তিনি কোনও ফৈসালাই চান না, কারণ অবগাহি কল্পনার সীমান্ত অবধি আমি এমন কোনও সামান্যতম ফৈসালার সন্ধান পাচ্ছিনে যেটা যুগপৎ পাকিস্তানের জনগণমন প্রসন্ন করবে এবং তিনিও গদিনশিন থাকবেন। তবে তিনি সেটি এসেমব্লির সম্মুখে পেশ করবেন। ওদিকে আসন্ন মূলাকাতের পূর্বাহ্র পর্যন্ত তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের জিগির লাগাতার গেয়ে যাচ্ছেন।
এসেমব্লি শব্দের সংস্কৃত বলুন, পালি বলুন, প্রতিশব্দ সঙ্ঘ।
ওদিকে তিনি গত এপ্রিলে যে একটা টেম্পরারি জো-শো সংবিধান নির্মাণ করেছেন সেটাতে পূর্ব পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রাংশের হাওয়ার কোমরে রশি বেঁধে সেটাকে আটকে রেখেছেন। আমি সে একটিনি সংবিধান পড়িনি; তাই আন্দেশা করে ঠাওরাতে পারছিনে সে এসেমব্লিতে আওয়ামী লীগের সাবেক ১৬৭ জন সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হবে কি না, এবং রাঁদেভু হবে কোথায়? ঢাকার রোকেয়া হল হস্টেলে, যেখানে ইয়েহিয়ার পিশাচরা মিলিটারি অ্যাকশন নিয়ে, যে অ্যাকশনে ভুট্টোর সম্মতি ছিল, অসহায় ছাত্রীদের নির্যাতিত ও পরে নিহত করে? না ইসলামাবাদের সেই আইয়ুব-হল-এর বারান্দায় যেখানে গণতান্ত্রিক জুলফিকার আলী সুবো-শাম ডিকটেটর প্রভু আইয়ুবের কলিংবেলের সুমধুর টিংটিংয়ের জন্য টুলে বসে ঢুলতেন?
গত সপ্তাহে আমি এসেমব্লি নাকচ করতে না করতেই আমার পাপড়ি খসে গেল! আবার সেই এসেমব্লি! সমস্ত রাত, এস্থলে পুরো পাক্কা একটি হপ্তা– নৌকা বেয়ে ভোরে দেখি সেই বাড়ির ঘাটে! খুঁটি থেকে বাধা নৌকোর দড়ি খুলতে ভুলে গিয়েছিলুম।
.
আবার ভুট্টো সায়েবের কেতাবখানার কথা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই। সে পুস্তিকা এমনই তুলনাহীন যে খুদ বইয়ের তো কথাই নেই, আমার অক্ষম লেখনী মারফত তার সামান্য যেটুকু আমি প্রকাশ করতে পারব সেটা পড়ে পাঠক রোমাঞ্চিত হবেন, তার দেহ মুহুর্মুহু শিহরিত হবে, তিনি ক্ষণে ক্ষণে দিশেহারা হবেন এবং সর্বশেষে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কোনটা গণ্ডমূখের জড়ত্ব, কোনটা অতি ধূর্তের কপটতম ধাপ্পা সেগুলো বুঝতে গিয়ে কঠিন শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত হবেন– হয়তো-বা অর্ধোন্মাদ হয়ে যাবেন। ঈশ্বর রক্ষতু!
আমি কসম খেয়ে বলতে পারি, এ পুস্তক একাধিকবার অধ্যয়ন না করে স্বয়ং চিত্রগুপ্তও ছাব্বিশ (মার্চ) থেকে ষোল (ডিসেম্বর)র খতিয়ান লিখতে পারবেন না। দুই শরিক ইয়েহিয়া এবং ভুট্টো। কার পাপ কোন খাতে লিখবেন সঠিক ঠাউরে উঠতে পারবেন না। সান্তনা এইটুকু : পুণ্যের মূল তহবিলে স্রেফ ব্ল্যাঙ্কো! সেখানে তিনি নিশ্চিন্দি।
.
পূর্বেই নিবেদন করেছি, কেতাবের ধুয়া ভুট্টোং শরণং গচ্ছামি। (এদানির : সংঘং শরণং গচ্ছামি), তাই এ কেতাবের বৃহদংশ নিয়েছে ভুট্টোদেবের গুণ-কীর্তনে বা সাফাই গাওয়াতে। বস্তুত এটা পড়ে সরল বিদগ্ধ তাবজ্জন তাজ্জব মেনে মাথা চুলকোবেন : তাই তো! এমন সত্যবাদী, নিরহঙ্কার, আত্মত্যাগী, পুরদুঃখকাতর দয়ার সাগর, যিনি ভাজা মাছটি উল্টে খেতে পারেন না তাকে নিয়তি রাজনীতিতে নামালেন কেন? কূটনীতির দাবা খেলা তো তার জন্য নয়– তাঁর কথা বিশ্বাস করলে তো নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই প্রাপ্ত বয়সেও তিনি যদি লারকানার রাস্তার ছোঁড়াদের সঙ্গে মার্বেল খেলতে নাবেন তবে তারা তাঁকে বেমালুম বোকা বানিয়ে পকেটের সব কটা মার্বেল গাড়া মেরে দেবে।
তবে কি না, নিতান্ত আপন-ভোলা সজ্জন এই লোকটি। মাঝে-মিশেলে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সত্য কথা বলতে তিনি ভুলে যান ইস্তক ইতি গজঃটুকু। পূর্ববর্তী সংখ্যায় বলেছিলুম কী কৌশলে এদিক-ওদিক বুনোহাঁস শিকার করতে করতে ইয়েহিয়া তাঁর ব্লদেভু ভুট্টার মোকামে পৌঁছে সেখানে তার সঙ্গে ভবিষ্যতের প্ল্যান কষলেন। এই পিয়া মিলনকো অবশ্যই হানিমুন অব দি টু- দু জনার মধুচন্দ্রমা বলা যেতে পারে। হানিমুন অব্ দি টু বাক্যটি আমি শ্রীভুট্টোর গ্রন্থ থেকে নিয়েছি। তিনি লিখেছেন আমাতে-মুজিবেতে (ঢাকাতে, পরবর্তীকালে– লেখক) বারান্দায় কথাবার্তা বলার পর আমি যখন ইয়েহিয়াকে সেটার রিপোর্ট দিতে গেলুম তখন তিনি সবিস্ময়ে আমাদের ভেটকে হানিমুন বিটউইন দি টু অব ইউ বলে উল্লেখ করলেন। কিন্তু এহ বাহ্য।
আসল কথা এই : ভুট্টো তাঁর কেতাব আরম্ভ করেছেন লেট জিন্নার পাকিস্তান স্থাপনা করা থেকে! তার পর অনেকানেক ঘটনার কালানুক্রমিক নির্ঘণ্ট তথা বিবৃতি দেওয়ার পর তিনি বলছেন তেসরা জানুয়ারি ১৯৭১-এ শেখ মুজিবুর রহমান তার বিখ্যাত ভাষণ দেওয়ার অল্প কিছুদিন পর প্রেসিডেন্ট ইয়েহিয়া তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীসহ ঢাকা গেলেন। ঢাকা থেকে ফেরার পর প্রেসিডেন্ট ইয়েহিয়া ও তার কিছু উপদেষ্টা ১৭ জানুয়ারি তারিখে আমার হোম টাউন লারকানাতে এলেন। প্রেসিডেন্ট আমাকে মুজিবের সঙ্গে ঢাকাতে তার আলোচনার বিষয় জানালেন… ইত্যাদি।
আশ্চর্য এই সত্য গোপন! ইয়েহিয়ার সঙ্গে প্রায় মাসখানেক পূর্বে, অর্থাৎ ইয়েহিয়ার সঙ্গে ঢাকাতে মুজিবের মোলাকাত হওয়ার পূর্বেই যে তিনি (ভুট্টো) ইয়েহিয়ার সঙ্গে ওই লারকানাতেই দুহুঁ দুহুঁ কুহুঁ কুহুঁ করেছেন সেটা একদম চেপে গেলেন।
কেন চেপে গেলেন?
কারণ ওই সময়েই সেই শয়তানি প্ল্যান আঁটা হয়, কী পদ্ধতিতে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রচেষ্টা (অটোনমি স্বাধীনতা নয়) নস্যাৎ করা যায়। (কে কাকে কতখানি দুষ্টবুদ্ধি যুগিয়েছিলেন সেটা আজও আমরা জানিনে– একদিন হয়তো প্রকাশ পাবে) এই প্রাথমিক প্ল্যান নির্মাণকাহিনী যাতে করে ধামাচাপা পড়ে যায় তার জন্যই এই সত্য গোপনের প্রয়োজন।
ওদিকে ইয়েহিয়াই তার তিন দিন পূর্বে, ১৪ জানুয়ারিতে ঢাকা শহরে ফাঁস করে বসে আছেন যে মুজিবের সঙ্গে তাঁর প্রথম মোলাকাতের পূর্বেই ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর আলাপচারি হয়ে গিয়েছে।
ঘটনাটি এইরূপ : পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে, নানাবিধ হাঁস, তন্মধ্যে ভুট্টো চিড়িয়া শিকার করার পর তিনি রওনা হলেন ঢাকা। এ সম্বন্ধে ভুট্টো মন্তব্য করেছেন, গণ-নির্বাচনের পর মুজিবকে বার বার আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোথাও যেতে রাজি হননি। জনৈক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, গেলে ভালো হত। তিনি অতি অবশ্য সেখানে বিস্তর লোকের চিত্তজয় করতে সমর্থ হতেন ও ফলে ডবল জোরে ভুট্টো-ইয়েহিয়া-আঁতাৎ-এর মোকাবেলা করতে পারতেন। আমি নগণ্য প্রাণী, আমার মতের কিবা মূল্য! তবু বলি (আহা, বেড়ালটাও কাইজারের দিকে তাকাবার হক্ক ধরে) না গিয়ে ভালোই করেছেন। শেখ সাহেবেরও জান মাত্র একটি।
তা সে যাই হোক– শেখ-ইয়েহিয়া ভেটের পর পিণ্ডি প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে ১৪ জানুয়ারি তারিখে, ঢাকা অ্যারপোর্টে সাতিশয় সদাশয় চিত্তে ইয়েহিয়া সাংবাদিকদের নানাবিধ প্রশ্নের দিল-দরিয়া উত্তর দিলেন।
তন্মধ্যে সেই ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ উত্তর আছে : শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন।
এ উত্তরে কতখানি আন্তরিকতা ছিল বিচার করবে ইতিহাস! কিন্তু এহ বাহ্য।
এক সাংবাদিক শুধালেন, আপনি কি এবারে (দিস টাইম) মি. ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করবেন? এই দিস টাইমটি পাঠক লক্ষ করবেন। যেন ইঙ্গিত রয়েছে, আমরা তো ভালো করেই জানি, একবার তার সঙ্গে আপনার কথাবর্তা হয়ে গিয়েছে। এখন যখন শেখ সায়েবকে প্রধানমন্ত্রী করবেন বলে মনস্থির করে ফেলেছেন, এ বারেও কি তার সঙ্গে দেখা করবেন?
উদার-হৃদয় ইয়েহিয়া বললেন আমি প্রত্যেক জনের সঙ্গে দেখা করি। তার (ভুট্টোর) সঙ্গে আমার অলরেডি একবার দেখা হয়ে গিয়েছে। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত। আমি পাখি শিকার করতে যাচ্ছি সিন্ধু দেশে– ওটা ভুট্টোর এলাকায়। তিনি সেখানে থাকলে তার সঙ্গে দেখা হবে।
ন্যাকরা! তিনি সেখানে থাকলে–। ইয়েহিয়া তো ওয়াইলড ডাক খ্যাদাতে বেরুবেন না। এবং ভুট্টোও একদম সিটিং ডাক।
আগস্ট মাসে বই লেখার সময় ভুট্টো আশা করেছেন, ডিসেম্বরের ভেট লোকে স্মরণে না-ও আনতে পারে। এ বাবদে সর্বশেষ মন্তব্য এই করা যেতে পারে যে, ভুট্টো উকিল। তিনি জানেন, আসামি তার সাফাই গাইবার সময় এমন কিছু বলতে বাধ্য নয় যা তার বিরুদ্ধে যেতে পারে!
.
এ ধরনের বিস্তরে বিস্তরে সত্যগোপন, মিথ্যাভাষণ, গুজবের আড়াল থেকে কুৎসা রটনা অনেক কিছু আছে এই মহামূল্যবান ভুটাঙ্গ-পুরাণে। এবারের মতো শেষ একটি পেশ করি :
(শেখ মুজিবের) ছয় দফার নির্মাতা কে, সে নিয়ে প্রচুর কৌতূহল দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, আইয়ুব খানের ঘনিষ্ঠ কোনও বুরোক্রেট এই ফরমুলাটি বানিয়ে দেন (ফ্রেমড দ্য ফরমুলা)। উদ্দেশ্য ছিল, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে দুইভাগে বিভক্ত করে আইয়ুবকে বাঁচানো তথা জনগণের দৃষ্টি তাশখন্দ প্রহসন থেকে অন্যদিকে সরানো।
দুই পাকিস্তানকে লড়িয়ে দিয়ে ইয়েহিয়া গদিচ্যুত হলেন, আর আইয়ুব বাঁচতেন এই পন্থায়? এ যুক্তি শুধু উকিলের উর্বর মস্তিষ্কেই স্থান পেতে পারে!
এবং তার পর ভুট্টো বলছেন, একটা জনরব এখনও প্রচলিত আছে যে, ওই ছয় দফা মুশাবিদা করাতে একটা বিদেশি হাতও ছিল।
দুষ্টবুদ্ধি প্ররোচিত প্যাচালো দলিলের মুশাবিদা করার জন্য ঘড়েল নায়েব ঝানু উকিলের শরণাপন্ন হয়। আওয়ামী লীগের ছয় দফাতে আছে স্বাধীনতাকামী জনসাধারণের মৌলিক সরল দাবি। এর মুশাবিদা করতে পারলেন না জনাব তাজউদ্দীন বা রেহমান সুবহান? এই সাদামাটা দাবির কর্মসূচি তৈরি করার জন্য দরকার হল ফরেন হ্যান্ড! পেটের ভাত আর গায়ের কাপড় চাই এ কথা কটি তো গায়ের চাষাও জমিদারের সামনে আকছারই বলে– আপন সরল গাঁইয়া ভাষায়। তবে কি মি. ভুট্টো বলতে চান, এ দুটো যে তার চাই-ই চাই সেকথাটা পূর্ব বাঙলার লোকের মাথায় খেলেনি? সেটা টুইয়ে দেবার জন্য কুটিলস্য কুটিল ফরেন হ্যান্ডের প্রয়োজন হয়েছিল? আল্লায় মালুম, মি. ভুট্টোর মাথায় কী খেলে?
হিটলার ডিকটেটর হওয়ার পর একাধিকবার আপসোস করেছেন, তাঁর মাইন কাম্পফ প্রকাশ না করলেই সুবিবেচনার কাজ হত। মি. ভুট্টো ছোটা হিটলার দি থার্ড হওয়ার পর সে। আপসোস করেছেন কি না, বলা যায় না। তবে ভবিষ্য যুগের কারসিক পাঠক হয়তো বইখানার নাম দি গ্রেট ট্র্যাজেডি পাল্টে দি স্মল কমেডিয়ান নয়া নামকরণ করতে পারে।
.
‘বিচিত্র ছলনাজাল’
মৃগয়া সমাপনান্তে প্রেসিডেন্ট ইয়েহিয়া রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলেন। সেই সুবাদে একটি প্রাচীন চুটকিলা পুনর্জীবন পেল।
জনৈক পেশাদার শিকারি হুজুরকে শিকারের ফন্দি-ফিকির বালাবার জন্য সঙ্গে গিয়েছিল। তাকে তার এক চেলা শুধাল, শিকারি হিসেবে হুজুর কীরকম? ওস্তাদ আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাশাল্লা! একদম উদাসে উদা, বেনজির। কিন্তু হুজুরের ব্যাগ খালি রইল, আল্লা পাখিদের প্রতি মেহেরবান ছিলেন।
প্রচুরতম মদ্যপান করার পর উষসূদেবীর প্রথম আলোয় চরণধ্বনির শুভলগ্নে হস্তযুগল নিষ্কম্প প্রদীপ শিখাবৎ ধীর স্থির অচঞ্চল থাকে না।
প্রেসিডেন্ট ঢাকা যাত্রা করলেন।
.
এদিকে পুব বাঙলা অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ চঞ্চলিত হয়ে উঠেছে। দেশের লোক দলে দলে শেখ সায়েবের পতাকার তলে জমায়েত হচ্ছে কিন্তু ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যুরোক্রেসি ধনপতির গোষ্ঠী এবং সর্বোপরি মিলিটারি জুন্টা উঠেপড়ে লেগেছে, কী করে আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করা যায়, গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত না হয়। কাঁড়া কাঁড়া টাকা আসতে লাগল সোনার বাংলায় স্পাই, গুণ্ডা এবং ভ্রষ্ট রাজনৈতিক কেনার জন্য। অবাঙালিরা তাদের সাহায্য করেছে প্রকাশ্যে। গায়ের জোরে বাহানা তৈরি করে পেটাচ্ছে আওয়ামী লীগের কর্মীদের। আওয়ামী লীগের পাবনার এমএলএ এবং খুলনার একজন লীগ কর্মীকে গুমখুন করা হল। স্বয়ং শেখকে গুপ্তহত্যা করার চেষ্টা করা হল– সে চেষ্টা চালু রইল।
অবাঙালিদের জিঘাংসা চরমে উঠল। গণনির্বাচনে তাদের ইসলামি লিডারদের শোচনীয় পরাজয় তারা ভোলবার, ঢাকবার চেষ্টা করছে তাদের দম্ভ ঔদ্ধত্য চরমে চড়িয়ে, প্রকাশ্যে নিরীহ বাঙালিমাত্রকেই মৃত্যুভয় দেখাচ্ছে। উচ্চকণ্ঠে বলে বেড়াচ্ছে, দেখি তোমরা কী করে তোমাদের স্বায়ত্তশাসন পাও। মিলিটারি আমাদের পিছনে। তোমাদের ঠেঙিয়ে লম্বা করে ছাড়বে পয়লা, তার পর অন্য কথা। ওদেরই প্ররোচনায় ওনারাও তৈরি ছিলেন পশ্চিম পাকের একাধিক কাগজে শেখ সায়েবের প্রচুর কুৎসাসহ খবর বেরুতে লাগল– শেখ এমনই দম্ভী, ছলেবলে নির্বাচনে জয়লাভ করে এমনই উদ্ধত হয়েছে যে, সে বলে বেড়াচ্ছে যে, সে পশ্চিম পাকে তো আসবেই না, এমনকি আমাদের সদর-উস-সদর জিল্লা (এ দুনিয়ায় আল্লার ছায়া) সুলতান-ই-আজম (কাইদ-ই-আজম জিন্নার পদবি মিলিয়ে তিনি সর্বশক্তিমান সুলতান) নিতান্ত যদি কর্তব্যের দায়ে অখণ্ড পাকিস্তানের একখানা ডানা যাতে কাটা না যায় যে, ইসলাম ইন ডেনজার সে ইসলামকে ত্রাণ করতে এবং সর্বোপরি জান্-কা দুশমন ইন্ডিয়াকে প্রাণের ভয়ে থরহরি কম্পমান করার জন্য তিনি যদি সেই রদ্দি ওচা ঢাকা শহরে যান (আল্লাতালার অসীম করুণা যে সুবুদ্ধিমানের মতো অধুনা প্রলয়ঙ্কর বন্যাবিধ্বস্ত পুব পাকের না-পাক অঞ্চল তিনি পরিদর্শন করতে গিয়ে তার দূষিত বায়ু এবং বিষাক্ত পানি সেবন করে অকালমৃত্যু বরণ করে শহিদ হননি), তবে নাকি ওই গুমরাহ শেখ তার পূর্ণেন্দু-বদন দর্শন করে অক্ষয় বেহেশত হাসিল করার জন্য জনাব ইয়েহিয়ার বাসস্থল লাটভবনে যাবে না। সে বলেছে, প্রেসিডেন্টকে তার বাড়িতে যেতে হবে, তবে সে কথা কইবে। ওয়াস্তাগফিরুল্লা!
মিথ্যা নিন্দা প্রচার করার নানাবিধ পন্থা বিশ্বের ইতিহাসে ভূরি ভূরি মেলে। এ যুগের দুই ওস্তাদ দুটি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে যশস্বী হয়েছেন। একজন ড. গ্যোবেলস। তিনি ধূলিপরিমাণ সত্যকথা নিয়ে তার ওপর নির্মাণ করতেন অভ্রংলিহ অকাট্য মিথ্যার অ্যাফেল-স্তম্ভ। এক্ষেত্রেও তাই : গণনির্বাচনের পর থেকেই পশ্চিম পাকের সর্বত্র শেখের বিরুদ্ধে যেসব চক্রান্ত করা হয়েছিল তার থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে সেখানে যেতে তার অনিচ্ছা ছিল। ধরে নেওয়া যাক এটুকু সত্য, কিংবা তিনি সত্যই সেখানে যাবার অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তার ওপর মিথ্যা গড়ে তোলা কঠিন নয়, ইয়েহিয়া স্বয়ং যদি ঢাকা আসেন তবে শেখ তাঁর সঙ্গে আদৌ দেখা করবেন না। সে মিথ্যার ওপর আরেকটা মিথ্যা চাপানো মোটেই কঠিন নয়; ইয়েহিয়াকে শুধু-পায়ে দাঁতে কুটা কেটে যেতে হবে শেখ-ভবনে (এস্থলে দুই প্রকারের প্রোপাগান্ডা করা যায় (ক) জরাজীর্ণ জলঝড় দুর্গন্ধময় বস্তিঘরে খেতে হবে মহামহিম রাষ্ট্রপতিকে কিংবা (খ) প্রাসাদোপম রাজসিক বিরাট অট্টালিকা ভবনে–যেটা নির্মাণের অফুরন্ত ঐশ্বর্য তিনি পেয়েছেন ইন্দিরা-বিড়লার কাছ থেকে। শেষোক্ত অংশটি পশ্চিম পাকবাসীর জন্য : সেখান থেকে কে ঢাকায় এসে যাচাই করতে যাচ্ছে, সত্য কোন হিরন্ময় কিংবা মৃন্ময় পাত্রে লুক্কায়িত আছেন?
তাই বোধহয় কবি বায়রন গেয়েছিলেন :
শেষ হিসেবেতে তবে
মিথ্যাই বা কী?
মুখোশ পরিয়া সত্য
যবে দেয় ফাঁকি।
And, after all, what is a lier
Tis but
The truth in masquerade
পক্ষান্তরে হিটলার মারি তো হাতি পন্থায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ মাইন কামপুফে তিনি বলেছেন :
ক্ষুদ্রাকার মিথ্যার চেয়ে বিরাট কলেবর মিথ্যাকে জনসাধারণ অনেক অনায়াসে মেনে নেয়।
তার আড়াই হাজার বছর পূর্বে রাষ্ট্রের স্বরূপ সম্বন্ধে আত্মচিন্তা করতে গিয়ে প্লাতো প্রশ্ন শুধোচ্ছেন, এমন একটা জাজ্বল্যমান মহৎ মিথ্যা কী কৌশলে নির্মাণ করা যায় না যেটা এমনই স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে হবে যে সমাজের তাবজ্জন সেটা মেনে নেবে।
ইয়েহিয়া ডিকটেটর। হিটলারের তুলনায় যদিও তার উচ্চতা ব্যাঙের হাতে সাত হাত। তাই তিনি হিটলারি পন্থায় গণনিধন পর্ব আরম্ভ হওয়ার পর তার নীতির সাফাই গাইতে গিয়ে একাধিক কারণের সঙ্গে এটাও উল্লেখ করেন যে, তিনি ঢাকাতে থাকাকালীন শেখ মুজিব তাঁকে বন্দি করার চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণজন এ বাক্যটি লেখার পর অতি অবশ্যই বিস্ময়বোধক চিহ্ন দেবেন। আমি দিইনি কারণ বুদ্ধিমান না হয়েও নিতান্ত যোগাযোগবশত আমি হিটলারি কায়দা-কেতার সঙ্গে সুপরিচিত। এমনকি এরকম একটা প্লীহাচমকানিয়া বম্বশেল ফাটানোর পর আরও এক কদম এগিয়ে গিয়ে ইয়েহিয়া যে আধুলি দামের টিকটিকির উপন্যাসকে টেক্কা মারার জন্য বলেননি, তার পর আওয়ামী লীগের কসাইরা আমাকে নিয়ে কী করত সেটার কল্পনাতেই আমার গা শিউরে উঠে; আমি অতিশয় বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হই, শেখ ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হিনড় গডেস-এর সামনে কিরে কেটেছে সে আপন আঙুল দিয়ে আমার চোখ দুটি ওপড়াবে, বেঙ্গলি উয়োমেনস মাছকাটার বিগ নাইফ দিয়ে আমার কলিজা বের করে গয়রহ, ইয়াল্লা আল্লা বাঁচানেওলা –এসব যে বলেননি তাতেও আমি বিস্মিত হইনি। কারণ আমি জানি, ইয়েহিয়া নিতান্তই একটা ছ্যামড়া ডিকটেটর, এবং সে-ও নির্জলা ভেজাল ডিকটেটর। হত হিটলার, হত মুসসোলিনি তবে জানত কী করে মিথ্যের পুরা-পাক্কা মনোয়ারি জাহাজ বোঝাই করতে হয়, আলিফ বে থেকে ইয়া ইয়ে তক।
সন্দেহপিচাশ পাঠক এস্থলে আপত্তি জানিয়ে বলবে, এ-ও কখনও হয়? ঢাকাতে তাঁর লোক-লশকর গিসগিস করছে। কমপক্ষে ষাট হাজার খাস পশ্চিম পাকের সেপাই রয়েছে। সর্বোপরি টিক্কা খানের পাক্কা পাহারা।
ঘড়েল সবজান্তা : ওইখানেই তো সরল রহস্য। এত শতের মধ্যেখান থেকে। যদি ইয়েহিয়া হাওয়া হয়ে যান তবে সন্দেহটা অর্সাবে সর্বপ্রথম এবং একমাত্র মিলিটারি জুন্টার ওপর। ওরা মুজিবের সঙ্গে ইয়েহিয়ার ঢলাঢলিতে তখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মার্চের পয়লা থেকে পঁচিশ অবধি পূর্ব পাকের রাজা ছিল কে? ইয়েহিয়া, না টিক্কা না– রাজা তখন কে? মুজিব।
কিন্তু বৃথা তর্ক। মোদ্দা কথা এই, পশ্চিম পাকের লোক ইয়েহিয়ার রহস্য-লহরি সিরিজের নবতম অবদান বিশ্বাস করেছিল।
বস্তুত ব্যাপারটা ছিল ঠিক উল্টো। প্লট করা হয়েছিল ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর মুজিব-ভুট্টোতে মোলাকাত হবে আলাপ-আলোচনার জন্য। পরদিন ২৬ মার্চ সকালে তারা দু জন যাবেন গভর্নর ভবনে ইয়েহিয়ার সঙ্গে সে আলোচনার ফলাফল জানাতে। ভুট্টোর শকুনি মামা মি. Khar* নানা অজুহাতে শেখকে রাজি করাবেন, এবারের (শেষবারের মতো?) তিনি যেন ভুট্টোর আস্তানা ইন্টেরকন্টিনেনটলে আসেন। পথমধ্যে টিক্কার গেরিল্লা স্কোয়াডের গুপ্তঘাতকরা তাকে খুন করবে। ওদিকে ইয়েহিয়া বেলা পাঁচটায় সঙ্গোপনে প্লেনে উড়বেন করাচি বাগে। যদি প্ল্যানটা উৎরে যায় তবে ইয়েহিয়ার নিষ্ক্রমণক্ষণ সাড়ম্বরে প্রচার করে তাঁর জন্য নিরঙ্ক এলিবাই স্থাপনা করা যাবে। ওদিকে বলা হবে মুজিব-বিরোধী কোনও রাজনৈতিক দল তাকে খুন করেছে।
[*শব্দটার উচ্চারণ যদি খার হয় তবে অর্থ কাঁটা; যদি খ হয় তবে অর্থ গর্দভ। বাংলা খড় হওয়ার সম্ভাবনা কম।]
এ প্ল্যান তো খাঁটি হিটলারি প্ল্যানের ঝাঁ চকচকে পয়লা কার্বন কপি।
গ্যোরিং হিটলারে মিলে পোড়ালেন রাইষসটাগ। পুরো দোষটা চাপালেন কমুনিস্টদের স্কন্ধে।
গ্যোরিং হিটলার হিমলারে মিলে রোম, এনসট আর্দি, ব্রাউনশার্টকে করলেন খতম। প্রচার করলেন ব্রাউন শার্টরা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করেছিল, হিটলার এবং নাৎসি পার্টিকে খতম করে চতুর্থ রাইষ প্রতিষ্ঠা করার।
তবে কিজিলবাশ দারওয়ান আর অস্ট্রিয়ান করপরলে পার্থক্য কোথায়? করপরল হিটলার দুশমনকে ঘায়েল করে, তার পর কেচ্ছা রটায়। দারওয়ান সেটা আদৌ করে উঠতে পারেনি। কেন? কারণ সে প্রোমোশন পেয়ে ডিকটেটর হয়। ক্লিনার যেরকম প্রোমোশন পেয়ে হ্যাঁন্ডিমেন হয়। আইয়ুবের শূন্য গদিতে জুন্টা তাকে প্রোমোশন দিয়ে ডিকটেটর বানিয়েছিল। হিটলার, মুসোলিনি, স্তালিন বিস্তর যুঝে, প্রচুর আত্মত্যাগ করে, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে তবে তারা ডিকটেটর হয়েছিল। আর্ম-চেয়ার পলিশিয়ানের মতো ইয়েহিয়া আর্ম-চেয়ার ডিকটেটর। কদু কুমড়ার কুরবানি হয় না।
ভেজাল, ভেজাল, কুল্লে মাল ভেজাল। ইয়েহিয়া ভেজাল হিটলার, টিক্কা ভেজাল হিমলার, পিরজাদা ভেজাল গ্যোরিং।
কিন্তু কি ভেজাল কি খাঁটি মাল এদের পরমাগতি একই;
ওই হেরো, ঘৃণ্য শব
পাপাচারী দুরাত্মার
রোস্ট করে শয়তান
খাবে তার গোস্তের ডিনার!
Here lies the carcass
of a cursed sinner.
Doomed to be roasted
for the Devils dinner.
.
‘বীরের সবুর সয়।’
মহাড়ম্বরে প্রেসিডেন্ট ইয়েহিয়া খান ঢাকায় পৌঁছলেন।
শেখ সাহেব ইতোপূর্বেই প্রকাশ্যে একাধিকবার বলে রেখেছিলেন, প্রেসিডেন্ট পুব। বাঙলায় আসছেন সম্মানিত মেহমান রূপে।
কাজেই উভয়ের মধ্যে মতবিনিময় এবং ছয় দফা নিয়ে আলোচনা হার্দিক বাতাবরণের ভিতর দ্রুতগতিতে একদিনের ভিতর সুসম্পন্ন হল। এস্থলে স্মরণ রাখা ভালো যে এ মোলাকাতের প্রায় দু মাস পর ইয়েহিয়া যখন ফের শেখের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য ৮/৯ মার্চে ঢাকা আসেন তখন আলোচনার সময় লেগেছিল প্রায় ষোল দিন। পুরো পাক্কা পক্ষাধিক কাল। এই বৈষম্যের কারণটি অতি সরল। প্রথম ভেটে ইয়েহিয়ার উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবকে মাত্র একটি সরল ধাপ্পা দেওয়া : আমি আপনার ছয় দফা কর্মসূচিতে আপত্তিকর কিছুই দেখতে পাচ্ছিনে তবে কি না ভুট্টোর সঙ্গে… ইত্যাদি। অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে ভুট্টোর সঙ্গে একটা ফয়সালা করে নিলে ভালো হয়।
এটা ১৩/১৪ জানুয়ারি ১৯৭১-এর ঘটনা।
১৪ তারিখে ইয়েহিয়া রওনা দিলেন পিণ্ডিপানে। ঢাকা অ্যারপোর্টে তিনি যে, খোলাখুলি দিলদরিয়া মেজাজে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালেন তার একটুকরো– ভুট্টো সংক্রান্ত– পূর্বেই উল্লেখ করেছি। বাকির আরও কিছুটা এস্থলে কীর্তনীয়। যথা :
ইয়েহিয়া : শেখ সাহেব আমাদের আলোচনা সম্বন্ধে যা বলেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে (এবসটলি) সত্য। তিনিই এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন।
জনৈক সাংবাদিক : আপনি এখন দেশের প্রেসিডেন্ট। শেখ মুজিবের সঙ্গে আপনার যে আলোচনা হল, সে সম্বন্ধে আপনার ধারণার কিছুটা আমরা শুনতে চাই।
ইয়েহিয়া : শেখ সাহেব যখন কর্মভার গ্রহণ করবেন (টেকস্ ওভার) আমি তখন থাকব না (আই উনট বি দ্যার)। শিগগিরই এটা তার গভর্নমেন্ট হবে।
জনৈক রিপোর্টার : শেখ মুজিব বলেছেন, আপনার সঙ্গে আলোচনা করে তিনি সন্তুষ্ট। আপনিও কি সন্তুষ্ট।
ইয়েহিয়া : হ্যাঁ।
এ সখী-সংবাদ পড়ে যে কোনও গৌড়ীয় বৈষ্ণবজন উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করবেন। তাই বলা একান্তই নিষ্প্রয়োজন যে পুর্ব বাঙলার লোক তখন উল্লাসে আত্মহারা। দু-শো বছরের পরাধীনতা শেষ হতে চলল। জয় বাংলা, জয় আওয়ামী লীগ।
এই উদ্দাম আনন্দনৃত্য দেখে কেমন যেন মনে হয়, আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা যেন ঈষৎ বিচলিত হন। তারা তো রাতারাতি ভুলে যাননি, পশ্চিম পাকের শকুনি মামারা কী প্রকারে শের-ই-বাংলা ফজলুল হককে পর্যন্ত বিড়ম্বিত করেছে। আর আজ? হঠাৎ
পরবর্তীকালে এটা পরিষ্কার হল। ইয়েহিয়া পঁচিশে মার্চ তার মুখোশ খুলে উৎকট প্রেতনৃত্য আরম্ভ করার পর যে বাংলাদেশ সরকার নির্মিত হল তার প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ সেদিনই, ১৭ এপ্রিল এক প্রেস কনফারেনসে ইয়েহিয়া-মুজিব ভেট বাবদে যা বলেন তার একাংশের মোটামুটি সারমর্ম এই :
লীগের ছয় দফা বাবদে ইয়েহিয়ার যে বিশেষ কোনও গুরুতর আপত্তি আছে তার আভাসও তিনি দেননি। লীগ কিন্তু প্রত্যাশা করেছিল, (ছ-দফাতে ইয়েহিয়া যখন কোনও আপত্তি তুলছেন না, এবং এই ছ-দফার ভিত্তির ওপরই লীগ অ্যাসেমব্লিতে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান নির্মাণ করবেন তখন) ইয়েহিয়া ভবিষ্যৎ সংবিধানের স্বরূপ সম্বন্ধে আপন ধারণা প্রকাশ করবেন। তা না করে তিনি শুধু ইচ্ছা প্রকাশ করলেন লীগ যেন ভুট্টোর পার্টির সঙ্গে একটা সমঝোতা করে নেয়।
তাজউদ্দীন সাহেবের এই বিবৃতিটি উল্লেখযোগ্য। ভবিষ্যৎ যুগের ঐতিহাসিকরা স্থির করবেন, হে আওয়ামী লীগ, ভুট্টোর সঙ্গে একটা সমঝোতা কর-ইয়েহিয়ার এই নির্দেশের মধ্যে তোমারে মারিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে-র মারণাস্ত্রটা লুকিয়ে রেখে গেলেন কি না?
কারণ মোটামুটি ওই সময়েই, খুব সম্ভব ১২ জানুয়ারি, জনৈক সাংবাদিক ইয়েহিয়াকে জিগ্যেস করেন, পুব পাকিস্তান যদি অ্যাসেমব্লিতে এমন একটা সংবিধান নির্মাণ করে সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে না হয় তবে ইয়েহিয়া কি সে সংবিধানে সম্মতি দেবেন? ইয়েহিয়া উত্তরে বলেন, এটা একটা কাল্পনিক (হাইপথেটিকাল) প্রশ্ন; এর উত্তর তিনি দেবেন না।
মোটেই হাইপথেটিকাল প্রশ্ন নয়।
আজ যদি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কেউ প্রশ্ন শুধোয়, কাল যদি রাশা বিনা নোটিশে ব্রিটেন আক্রমণ করে তবে প্রধানমন্ত্রী তার জন্য কোন কোন প্রস্তুতি কী কী ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন তবে প্রধানমন্ত্রী স্মিতহাস্য সহকারে বলবেন, এটা কাল্পনিক প্রশ্ন; কারণ বিশ্বসংসার জানে, রাশার সঙ্গে ব্রিটেনের এমন কোনও দুর্বার শক্রতা হঠাৎ গজিয়ে ওঠেনি, বা রাশার কি দোস্ত কি দুশমন কেউই হালফিল ঘুণাক্ষরে একথা বলেননি যে রাশা গোপনে গোপনে এমনই প্রস্তুতি করেছে যে দু একদিনের ভিতর বিলেতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। অতএব এ প্রশ্নটা অবাস্তব হাইপথেটিকাল।
কারণ যদিও মি. ভুট্টো তখন পর্যন্ত তাঁর সবকটা রঙের তাস টেবিলের উপর বিছিয়ে দিয়ে হুমকি ছাড়েননি যে যারা অ্যাসেমব্লিতে যাবে তিনি তাদের ঠ্যাং ভেঙে দেবেন তথাপি কোনও রাজনৈতিক, বিশেষ করে ইয়েহিয়া জানতেন না যে ভুট্টো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তীব্রতম বৈরীভাব অবলম্বন করেছেন? নইলে স্বয়ং ইয়েহিয়াই বা কেন ওই সময়েই লীগকে নির্দেশ দিতে গেলেন, ভুট্টোর সঙ্গে একটা ফয়সালা করে নিতে? তা হলে পূর্বোক্ত প্রশ্নটি হাইপথেটিকাল আকাশকুসুম গোত্র লাভ করল কী করে?
তবু যদি ইয়েহিয়া জেদ ধরে বলেন, না, তিনি ভুট্টোর কোনও বৈরীভাবের কথা জানেন না, তা হলে তো জনাব তাজ অনায়াসে বলতে পারেন, তবে তো হুজুরের নির্দেশ একদম খাঁটি হাইপথেটিকাল নির্দেশ। আপনি যখন বলতে পারবেন না, ভুট্টো দুশমনির অমুক অমুক স্টেপ নিয়েছেন (পূর্বের উদাহরণ অনুযায়ী কেউ যখন আদৌ কোনও খবর পায়নি যে রাশা কাল ব্রিটেন আক্রমণ করবে) তা হলে আমরা, মেজরিটি পার্টি অযথা কান-না-লেনেওয়ালা চিলের পিছনে ছুটে ছুটে শেষটায় মিনরিটির হাওয়াই কোমরে রশি বাঁধতে যাব কোন হাইপথেটিকাল ত্রাসের তাড়নায়? ও করে কাল আমার চারখানা হাতও গজাবে না, তার জন্য আজ চারখানা দস্তানাও কিনব না।
.
ওদিকে বাংলাদেশের যুব-সমাজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে বিশেষ করে যখন বার বার প্রশ্ন করা সত্ত্বেও ইয়েহিয়া ঢাকাতে কখন অ্যাসেমব্লি ডাকবেন সে সম্বন্ধে কোনও উত্তর দিতে কিছুতেই সম্মত হলেন না। ওদের বক্তব্য তাদের ছয় পয়েন্টের বিরুদ্ধে ইয়েহিয়া যখন কোনও আপত্তি তোলেননি– আর এ-খ-ন তুললেই বা কী— তবে অ্যাসেমব্লি ডাকতে এত দেরি হচ্ছে কেন?
যুগ যুগ ধরে ইতিহাসে বার বার এ ঘটনা ঘটেছে। জনতা অসহিষ্ণু; নেতারা দেখছেন, আঘাত করার মতো সময় এখন আসেনি। বিকল্পে : নেতা আহ্বান করছেন, ওঠো, জাগো; জনতা তন্দ্রাচ্ছন্ন।
মূল কথা, মূল তত্ত্ব টাইমিং। বহু ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে পরিষ্কার ধরা পড়ে, সমস্ত পরিকল্পনাটা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল টাইমিঙের গোলমালে।
ইংরাজিতে তাই বলে :
লোহা গনগনে থাকতে থাকতেই মারো হাতুড়ির ঘা।
সংস্কৃত সুভাষিত বলে :
যৌবন থাকতেই কর বিয়ে। পিত্তি চটিয়ে খেয়ো না।
কিন্তু যে নেতার মনে দৃঢ় প্রত্যয় আছে যে তার কাছে অগ্নি নির্মাণের যথেষ্ট সামগ্রী সঞ্চিত আছে, যদৃচ্ছ লৌহখণ্ডকে তপ্তাতিতপ্ত করতে পারেন তার তনুহূর্তেই হাতুড়ির আঘাত হানবার কী প্রয়োজন?
এবং বিজ্ঞজন মৃদু হাস্য করে বলেন, তড়িঘড়ি মামেলা খতম করাই যদি সবচাইতে ভালো কায়দা হত তবে (বাইবেলে) সদাপ্রভু সৃষ্টি নির্মাণে পুরো ছটি দিন খর্চা করলেন কেন? তিনি তো আঁখির এক পলকে শতলক্ষ গুণে বৃহত্তর লক্ষ কোটি সৃষ্টি নির্মাণ করতে পারতেন।
কিন্তু প্রবাদ, ঐতিহাসিক নজির, গুণীজনের জ্ঞানগর্ভ উপদেশবাণীর ওপর নির্ভর করেই তো জননেতা সবসময় আপন পথ বেছে নেন না। তবে এ স্থলে আমরা একটি উত্তম কাব্য-কমপাস পাচ্ছি।
যাকে বলে ডে টু ডে পলিটিকস, তার কোনও গাইড-বুক শেখ-গুরু কবিগুরু রেখে যাননি। তবে যখন চিরন্তন রাষ্ট্রনীতিতে বাহুর দম্ভ, ক্রুদ্ধ প্রভু, রাজার প্রতাপ চিৎকার করে। দুঃখ দেবার বড়াই করে তখন তিনি তাঁর সর্বাগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র, তাঁর গানের ভাণ্ডারী দিনেন্দ্রনাথকে বেঙ্গল অর্ডিনেনসের জুলুম মদোন্মত্ত জনের আস্ফালনের মতো কত যে হেয়-বিড়ম্বিত ক্ষণস্থায়ী, পক্ষান্তরে সত্য যে নিত্যকালের সোনার রঙের লিখা তিলক ধারণ করে আছেন সে বাণী ছন্দে প্রকাশ করে বলেন :
জানি, তুমি বলবে আমায়
থামো একটুখানি,
বেণুবীণার লগ্ন এ নয়,
শিকল ঝমঝমানি।
শুনে আমি রাগবো মনে,
করো না সেই ভয়,
সময় আমার কাছে বলেই
এখন সময় নয়।
তাই দেখতে পাই,
সময়েরে ছিনিয়ে নিলে
হয় সে অসময়
ক্রুদ্ধ প্রভুর সয় না সবুর
প্রেমের সবুর সয়।
রাজপ্রতাপের দম্ভ সে তো
এক দমকের বায়ু
সবুর করতে পারে এমন
নাই তো তাহার আয়ু।
ধৈর্য বীর্য ক্ষমা দয়া
ন্যায়ের বেড়া টুটে
লোভের ক্ষোভের ক্রোধের তাড়ায়
বেড়ায় ছুটে ছুটে।
ইয়েহিয়া আর তার জুন্টা জানে পুব বাঙলায় তাদের আয়ু প্রায় শেষ,
আজ আছে কাল নাই বলে তাই
তাড়াতাড়ির তালে
কড়া মেজাজ দাপিয়ে বেড়ায়
বাড়াবাড়ির চালে!
পাকা রাস্তা বানিয়ে বসে
দুঃখীর বুক জুড়ি*
ভগবানের ব্যথার পরে
হাঁকায় সে চার-ঘুড়ি।
[*এ যেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ঋষির বাণী : ঢাকার রাস্তায় নিরীহজনের বুকের উপর দিয়ে পিশাচপাল ট্রাঙ্ক চালাবে।]
পুব বাঙলার লোকের সঙ্গে তারা তো কখনও মৈত্রীর ডোর বাঁধতে চায়নি, তারা চেয়েছিল পলে পলে তিলে তিলে রক্তশোষণ করতে :
তাই তো প্রেমের মাল্যগাঁথার
নাইকো অবকাশ।
হাতকড়ারই কড়াক্কড়ি,
— দড়াদড়ির ফাঁস।
রক্ত রঙের ফসল ফলে।
তাড়াতাড়ির বীজে,
বিনাশ তারে আপন গোলায়
বোঝাই করে নিজে।
কাণ্ড দেখে পশুপক্ষী।
ফুকরে ওঠে ভয়ে,
অনন্তদেব শান্ত থাকেন,
ক্ষণিক অপচয়ে।
আদি কবি বাল্মীকি রাবণের রাক্ষস-রাজ্যের বীভৎসতা মূর্তমান করার জন্য কাব্যলোকের প্রথম প্রভাতে কাঠবেড়ালি মোতিফ অবতারণা করেছিলেন, কবিগুরু তাই সেই পন্থায় চললেন রাজেন্দ্রসঙ্গমে।
কোনও প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আত্মপ্রত্যয় যার আছে সে আত্মসংযম করতেও জানে বলে, শেখজি একমাস সময় দিলেন ইয়েহিয়াকে। একমাস পরে ডাকো এসেমব্লির অধিবেশন।
.
যক্ষ রক্ষ গুপ্ত
এইবারে সেই বিষয়টির অবতারণা করতে হয় যেটি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ আমরা পাইনি।
কোনও সন্দেহ নেই, ভবিষ্যকালের ঐতিহাসিকরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে এই গুরুতর বিষয়টি নিয়ে বিস্তর মাথা-ফাটাফাটি করবেন। খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য ইহুদিরা দায়ী, না অন্য কেউ, সে নিয়ে যেরকম দু হাজার বছর ধরে শব্দার্থে প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে পণ্ডিতে পণ্ডিতে অকৃপণ মাথা-ফাটাফাটি হয়েছে এবং হবে, তথা পরোক্ষভাবে হিটলারের গ্যাস চেম্বার নির্মাণে যার পরিণাম। এস্থলে সমস্যা, একাত্তরের মধু ঋতুতে বাংলাদেশকে ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য দায়ী কে? এস্থলে লক্ষণীয় প্রায় ওই একই ঋতুতে খ্রিস্টকে হত্যা করা হয়। এবং চরম লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশটাকে জবাই করা হয় মহরম মাসে যে মাসে তেরশো বছর পূর্বে, হজরত ইমাম হুসেনকে ইয়েজিদের জল্লাদরা কারবালাতে জবাই করে। বস্তৃত আমার আচারনিষ্ঠ ছোটবোনকে ২৫ মার্চের উল্লেখ করতে বললে, আমাদের মধ্যে তখন বলাবলি হয়েছিল, ইয়েহিয়া শিয়া। শিয়ারা আপ্রাণ চেষ্টা দেয় পাক মহরমের চাদে যেন কোনওপ্রকারের অপকর্ম, গুনাহ না করে আর ইয়েহিয়া শিয়া হয়ে এই পবিত্র মাসেই যে কবিরা গুনাহ। (মহাপাপ) করলেন সেটা যে সুন্নি ইয়েজিদকেও নৃশংসতায় ছাড়িয়ে গেল।
অবশ্য সে সময়ে সামান্যতম মুষ্টিমেয় বাঙলাবাসী জানত যে ইয়েহিয়া শিয়া এবং ভিতরে ভিতরে কট্টরতম শিয়া।
কিন্তু ৭১-এর মার্চে ওই বৎসর সূর্য ও চন্দ্রের এক বিপরীত যোগাযোগের ফলে উভয়ের মধ্যে এক সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। সে সংঘাতের কাহিনী অতি সংক্ষেপে এই :
ধর্মকর্মের পালপার্বণ, তাবৎ অনুষ্ঠান ইরান-তুর্কমান মাত্রই চান্দ্রমাস পঞ্জিকা অনুযায়ী সুন্নিদের মতোই পালন করে। কিন্তু নিত্যদিনের মৃত লবণ তৈল তণ্ডুল বস্ত্র ইন্ধন সমস্যার সমাধান করে সৌর গণনা অনুসারে। ফলে চান্দ্রমাস, শোকাশ্রুসিক্ত মহরম, বছর তিরিশেকের মধ্যে একবার না একবার মোটামুটি একই সময়ে হাজির হবেন ইরানিদের জাতীয়, দ্বিসহস্র বৎসরাধিক কালের ঐতিহ্য-সম্বলিত নওরোজ = নববর্ষ পর্বের সময়। সেটা আসে মোটামুটি ২১ মার্চ নাগাদ। সেদিন ইরান তুরানে যা আনন্দোৎসব হয় তার সঙ্গে বড়দিন বা হোলি পাল্লা দিতে পারে না। বিশেষ করে তামাম দেশটা জুড়ে সেদিন যে শরাবের বান জাগে তার মুখে দাঁড়ায় কোন পরবের সাধ্যি!
সর্বশেষে, প্রকাশ থাকে যে ইয়েহিয়ার চেলাচামুণ্ডা টিক্কা নিয়াজি, এস্তেক তেনার এক ভাড়ের ইয়ার মিস্টার ভুট্টো জগঝম্পসহ হুহুঙ্কারে যেটিকে ঘোষণা করতেন সর্বপ্রথম ঠিক ২৫ মার্চ তারিখে, দু-বৎসর পূর্বে ১৯৬৯ সালে আইয়ুবের স্থলে কাফির নিধনাৰ্থে কল্কিরূপে ইসলামাবাদ সিংহাসন আরোহণ করেন শিয়া পোপ ইয়েহিয়া। অকৃপণ প্রসাদপ্রাপ্ত ওয়াকিফহাল মহল আজও সে মহালগনের স্মরণে বলেন, সেদিন পাক ইসলামাবাদে যে পাকনাপাকাতীত শ্যামপেন বুদ্বুদ উত্থিত হয়ে আসমান-জমিন ত-র-র-র করে দিয়েছিল তারই ফলে রাওয়ালপিণ্ডির আবহাওয়া দফতর সবিস্ময়ে প্রচার করে যে নর্মাল ১০% থেকে সে রাত্রে বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা ৯৯%-এ পৌঁছেছিল এবং পূর্বাভাসে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে আগামী চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে শ্যামপেন-বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এটা অবশ্য ১৯৬৯-এর মার্চের কথা।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চে কিন্তু ইয়েহিয়া খান যখন পিণ্ডি যাবার জন্য বেলা পাঁচটায় ঢাকা বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠেন, তখন সে প্লেনের দরজা বন্ধ হতে না হতেই প্লেন টেক্-অফের কড়া কানুন হেলা-ভরে উপেক্ষা করে অ্যার হোসটেস প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিলেন হুইস্কি সোডা। ঝটপট দ্বিতীয়টা। এবারে শ্যামপেন নয়। সে সুধা মোলায়েম। এবারে রুদ্রাগ্নি হুইস্কি।
শুনেছি, রোম ভস্মীভূত করার আদেশ দেবার সময় নিরোর এক হাতে ছিল বেহালা অন্য হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পদনিম্নের ভূমির দিকে অবনত করে প্রচলিত রুদ্রমুদ্রা দেখান, যার অর্থ ভস্মীভূত কর রোম!
কিন্তু এখন যেটা বলছি সেটা শোনা কথা নয়। নিরেট সত্য।
ইয়েহিয়ার এক হাতে ছিল হারাম শরাব, অন্য হাত দিয়ে কৃতান্ত মুদ্রা দেখালেন জল্লাদকে কল-ই-আম্ চালাও বাঙ্গালমে। সট দেম আউট।
কোথায় গেল শোকাশ্রুসিক্ত মহরমের অশৌচ, কোথায় গেল ধর্মের বিধিনিষেধ? হে হবু পলিটিশিয়ান, শিখে নাও তবে দক্ষযজ্ঞের উচাটন মন্ত্রারম্ভের পূর্বে ইয়েহিয়ার নর্ম ললিতা গীতি।
বিধিবিধানের শীত-পরিধান
ফাগুন আগুনে দহন কর
বিহঙ্গযানে মোরা দুই জান্
ফাগুন আগুন দহন কর।
ইরানের শীতকালে প্রকৃতি অতিশয় অকরুণ– অসংখ্য প্রাণী মৃত্যুবরণ করে। তাই ধর্মের বিধিবিধানকে দুর্বিষহ শীতবস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তার পর আসে নবজীবনদায়িনী ফাগুন আগুন। তাই নিবন্ধারম্ভে চিন্তা করেই বলেছি, মধু ঋতুতে বাংলাদেশকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়।
বাংলাদেশের ৯৯% নরনারীর দৃঢ়বিশ্বাস এই কুশপর্বের কাঁপালিক ইয়েহিয়া এবং তার মিলিটারি জুন্টা। পাকিস্তানের ওয়াকিফহাল মহলের এক নাতিবৃহৎ অংশ ভিন্নমত পোষণ করেন।
নিরপেক্ষ জনৈক ভারতীয় চিন্তাশীল সেনাপতি গত এপ্রিলে পরলোকগত লেফটেনেন্ট জেনরেল ব. ম. কল (B, M. Kaul) সদ্যোক্ত ওয়াকিফহালদের মতোই ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন জুলাই ১৯৭১-এ প্রকাশিত তাঁর উত্তম গ্রন্থ কনটেশন উইদ পাকিস্তান-এ। পিণ্ডি ইসলামাবাদের মিলিটারি জুন্টার বহু সিনিয়ারতম শিকরে পাখিকে তিনি অতি ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন। তিনি বলেন :
১৯৭০-এর গণনির্বাচনের পর একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেল শেখ মুজিব এবং ইয়েহিয়া খানের মধ্যেই এই মর্মে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা হয়ে গিয়েছে যে, শেখ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণ করবেন এবং ইয়েহিয়া পূর্বের ন্যায় প্রেসিডেন্ট থাকবেন।
সেনাপতি কল তার পর বলছেন, কিন্তু যখন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তখন দুই নেতার কেউই ভুট্টোর দুষ্ট চক্রান্ত করার সামর্থ্য যে কতখানি সেটা হিসাবে ধরেননি (মেক এলাওয়েনস্ ফর দি মিস-চিফ-মেকিং কেপাসিটি অব ভুট্টো।)
কী সে মিসচিফ বা নষ্টামি? তার পটভূমি কী?
গণনির্বাচনের প্রায় দুই মাস পূর্বে, অক্টোবর ১৯৭০ সালেই পশ্চিম পাকবাসী অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তান অ্যারফর্সের প্রধান, অ্যার মার্শাল নূর খান লাহোরের নিকটে এক জনসভায় বলেন, মি. ভুট্টো দীর্ঘকাল ধরে সরকারি মহলের সঙ্গে দহরম মহরম জমিয়ে এখন চেষ্টা করছেন পাকিস্তানে যেন ডিক্টেটরি শাসন কায়েম থাকে এবং চালবাজি মারফত তিনি যাতে করে খিড়কির দরজা দিয়ে ক্ষমতা লাভ করে ফেলেন। একদম খাঁটি কথা। কিন্তু এর পর নূর খান যে প্রশ্ন শুধোচ্ছেন সেটির দিকে আমি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
ভূতপ্রাপ্ত এক ডিক্টেটরের এই শাগরেদ ভুট্টো যবে থেকে তার প্রভুকে গুত্তা মেরে নর্দমায় ফেলে দেওয়া হল সেই থেকে নাগাড়ে ঝাড়া আঠারোটি মাস ইয়েহিয়া শাসনের সবকিছু ধৈর্যসহ বরদাস্ত করার পর এখন আচমকা কেন আর কুছতি বরদাস্ত করতে চাইছেন না? এ প্রশ্ন শুধোবেন যে কোনও স্থিতধী জন।
নূর এ-প্রশ্নের উত্তর জানতেন।
আমরাও কিছুটা জানি।
আইয়ুবের পতনের পর এক পশ্চিম পাকি কাষ্ঠরসিক ঠোঁট-কাটা মন্তব্য করেন, বহুবার কোটিপতি, সার্ডিনিয়ার গোপন গহ্বর ধনপতি আলিবাবা তো গেল, কিন্তু চল্লিশটে চোর রেখে গেল যে। এরা ছড়িয়ে আছেন সর্বত্র। ব্যুরোক্রেট ব্যাঙ্কপতি সদাগর ইত্যাদি করে করে খুদ আর্মি তক্। এই গেল পয়লা নম্বর।
দোসরা : সর্বদেশপ্রেমী দ্বারা অভিশপ্ত বাইশটি শোষক পরিবার।
হরেদরে গলাজল হয়ে একুনে দাঁড়ায় কিন্তু এক বিকট ত্রিমূর্তি।
যজ্ঞ (ধনপতি- বিশেষ করে সেই ২২), রক্ষ (আর্মি) এবং চিত্রগুপ্ত (আমরা পাল)।
ইয়েহিয়া আসনে বসামাত্রই ভুট্টো মারলেন ডুব। তার লক্ষ্য ছিল দুটি : আয়ুবকে সরিয়ে জিন্না দিয়ে সেকেন্ড হওয়ার পথ সুগম করা। দুই : কিন্তু জিন্না ছিলেন পুব-পশ্চিম দুই পাক-ডানার উপর সওয়ার ফাদার অব দি নেশন। এর একটি ডানা অটনমি পেয়ে গেলে তিনি হয়ে যাবেন এজমালি জুনিয়ার ফাদার অব দি নেশন। অতএব ঘায়েল করতে হবে আওয়ামী লীগকে। মূলত ভুট্টো-পার্টির একটা শাখা পূর্ব পাকেও ছিল। তার চেয়ারম্যান ছিলেন মুসলিম শাস্ত্রে সুপণ্ডিত বাঙালি মৌলানা নুরজ্জমান। ভুট্টো দেখলেন, বাংলাদেশের সর্বনাশ করে তাকে পশ্চিম পাকের চিরন্তন ক্রীতদাস বানাতে হলে তার পার্টিতে পুব পাকের কোনও সদস্য রাখলে সে তার হুকুমমতো নেমকহারাম কুইজলিং সাজতে রাজি না-ও হতে পারে। তাই তিনি তাঁর পার্টিকে নবরূপে দিলেন- আপন প্রদেশ সিন্ধুর কোনও নগরে নয় তাঁর আরাধ্যা, বলুভা নগরী পাঞ্জাবি লাহোরে। মৌলানা নুরজ্জমান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ভুট্টোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন এবং স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ভুট্টো লাহোরে তাঁর পার্টিকে নবরূপ দেবার সময় পুব পাকের কোনও নেতা বা সাধারণ জনকে আহ্বান জানাননি; তার একমাত্র উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা।
ভুট্টোর যে নিষ্ক্রিয় আঠারো মাস সম্বন্ধে অর্থপূর্ণ কুটিল প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন অ্যার মার্শাল নূর খান সে আঠারো মাস ভুট্টো ছিলেন নীরব কর্মী; তিনি তখন ষোড়শোপচারে পূর্বোক্ত ত্রিমূর্তির পূজার্চনায় নিরতিশয় নিমগ্ন। ভুল করলুম, ষোড়শ নয়, সপ্তদশ– বোতলবাসিনী তরলা-ভৈরবী। আর কে না জানে, সপ্তদশেই বঙ্গজয় সম্ভবে।
প্রথমেই নমো যক্ষায়। ধনপতিদের বোঝতে রত্তিভর সময় লাগল না– পুব পাক হাতছাড়া হয়ে গেলে তুমি খাবে কী? কা তব কান্তা নয়–কা তব পন্থা হবে তখন?
যে অর্থপ্লাবন ধেয়ে এল ভুট্টো ব্যাঙ্কের দিকে, কোথায় লাগে তার কাছে হিমাদ্রি শৃঙ্গ থেকে নেবে আসা পঞ্চনদের বন্যা!
এখানে হিটলারের সঙ্গে ভুট্টোর একটা সাদৃশ্য আছে। এদিকে হিটলারের পার্টির নাম ওয়ার্কারস্ পার্টি, ওদিকে কড়ি ঢালল কলোনের যক্ষ ব্যাঙ্কাররা! ওয়ার্কারসদের বুঝিয়েছেন, তোমাদের বাঁচাব ধনপতিদের শোষণ থেকে, আর ধনপতিদের সমঝালেন, তোমাদের বাঁচাব শ্রমিকদের ইউনিয়ন-নামক নুইসেন্স্ থেকে। ভুট্টো কী দিয়ে না-পাক ধনপতিদের বাগালেন সে তো বলেছি, তাঁর পিপলস পার্টির পিপলকে বোঝালেন হুবহু হিটলারি কায়দায় গরম গরম লেকচার ঝেড়ে! পিপলকে অবহেলা করা চলে না, কারণ তার পার্টি-ইষ্টমন্ত্র।
ইসলাম আমাদের ধর্ম।
গণতন্ত্র আমাদের রাষ্ট্রনীতি।
সমাজতন্ত্র আমাদের অর্থনীতি।
সর্বপ্রভুত্ব জনগণের।
হায় রে পূর্ব বাংলার জনগণ।
ব্যুরোক্রেটদের বললেন, ইংরেজ আইসিএসের চেয়েও রাজার হালে আছ পূর্ব পাকে। পশ্চিম পাকের কড়িটাও আসে পুব পাক থেকে। বাঙালরা অটনমি পেলে যাবে কোথায়?
আর্মিকে শুধোলেন, তোমাদের সৌরী-সেনীয় শ্বেতহস্তীর মিলিটারি বাজেটের টাকাটা যে পুবালি চিড়িয়া সোনার ডিম পেড়ে সামলায় তার যে উড়ু উড়ুক্কু ভাব! সে পালালে পট্টি মারবে কী দিয়ে?
এবং এদের আরও মোলায়েম করার জন্য তাদের পদপ্রান্তে রাখলেন পঞ্চমকারের বহিয়া বঢ়হিয়া সওগাত। ধনপতিগণ প্রসাদাৎ পূর্বলব্ধ অর্থদ্বারা।
ঝাড়া আঠারোটি মাস ভুট্টো করলেন এই তপস্যা। এবারে অ্যার মার্শাল নূর (= জ্যোতি)-এর রহস্যান্ধকারময় বঙ্কিম প্রশ্নের উপর সরল জ্যোতি বর্ষিত হল।
তপস্যান্তে যক্ষ রক্ষ গুপ্ত সমন্বিত ত্রিমূর্তি বদ্ধমুষ্টিতে ধারণ করে তিনি বেরুলেন জয়যাত্রায়।
যে সম্প্রদায় মনে করেন বাংলাদেশকে ক্রুশে চড়াবার চড়ক-বাদ্যে ইয়েহিয়া মূল গায়েন নন তিনি মাত্র দোহার, বিলিতি বাদ্যে সেকন্ড ফিড় তারা বলেন ভুট্টো যখন আজ হেথায় ব্যুরোক্রেট হুতোমদের ব্যানকুয়েট খাওয়াচ্ছেন, কাল হোথায় জাদরেল কর্নেলদের নৃত্য সম্বলিত ককটেল পার্টি দিচ্ছেন, পরশু খোঁজা-বোরো-মেমন ধনপতিদের গোপন জলসাতে তার পিপলস পার্টি পিপলদের কুরবানি দিচ্ছেন যক্ষদের দরগাহতে–ইয়েহিয়া তখনও এসব পূজা-আচ্চা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন। কারণ এসব গুণীনদের মতে ইয়েহিয়ার তখনও সঙ্কল্প আওয়ামী লীগকে তার ন্যায্য প্রাপ্য যথাসময়ে দিয়ে দেবেন। অর্থাৎ কূটনৈতিক ভুবনে তার তরে তখন গভীর নিস্তব্ধ তৃতীয় যান। তিনি গভীর নিদ্রায় সুষুপ্ত চতুর্দিকে অবশ্য হুরী পরীরা তাঁর সেবাতে লিপ্ত।
এহেন সময়ে ভুট্টো দেবের আবির্ভাব।
.
সংখ্যালঘুর অনধিকারমত্ততা
জেনারেল কল-এর পুস্তকখানি প্রধানত রণনীতি সম্বন্ধে। তাই সেখানে রাজনীতির উল্লেখ কম– নিতান্ত যেটুকু পটভূমি হিসেবে বলতেই হয়, আছে মাত্র সেইটুকু। কারণ রণপণ্ডিত ক্লাউজেভিৎস তার প্রামাণিক গ্রন্থে বলেছেন, পলিটিকস যখন আর এগোতে না পেরে অন্য বস্তুর সাহায্যে এগিয়ে চলে তখনই তার নাম যুদ্ধ।
কল বললেন ইয়েহিয়া-মুজিবে মিলে গণতন্ত্রের যে কচি কোমল চারাটি পুঁতলেন সেটাকে উপড়ে ফেললেন ভুট্টো। তিনি তখন পশ্চিমা সেনাবাহিনীর আদরের দুলাল। তার আপন ক্ষমতার নেশা তখন মাথায় চড়েছে। তিনি এখন আর এসেম্বলিতে বিরোধী দলের পাণ্ডা সেজে মুজিব মূল গায়েনের পিছনে পিছনে দোহার গাইতে রাজি নন।
তবু তিনি এলেন ঢাকায়। তার একমাত্র কারণ, তার দৃঢ় বিশ্বাস, শেষটায় রাষ্ট্রের কর্ণধার হবেন তিনি– এদ্দিন যা ছিল, ঠিক তেমনি, পুব পাক থাকবে তার তাবেতে কলোনি রূপে। ইংলন্ডের রাজা যে রকম সমুদ্রের ওপারের ডমিনিয়নসেরও ম্রাট। এবং দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা যেরকম কখনও-সখনও ভারতে এসে রাজানুগ্রহ দেখাতেন, ভুট্টোকেও তো সেরকম ঢাকাতে আসতে হবে মাঝেমিশেলে। তখন যেন তাঁর পূর্ব পাকিস্তানের কোনও বেয়াড়া প্রজা না বলতে পারে, তিনি মুজিবকে তার মুখারবিন্দ দর্শন লাভ থেকে অকারণ তাচ্ছিল্যে বঞ্চিত করেছিলেন।
ভুট্টোদেব ঢাকা এলেন বিস্তর সাঙ্গোপাঙ্গ সঙ্গে নিয়ে। প্রিনস অব ওয়েলস যেরকম পাত্রমিত্র নিয়ে দিল্লি আসতেন।
ইয়েহিয়া যখন ভুট্টোর পূর্বে ঢাকা আসেন তখন তার সে আসাটা আন্তরিক শুভেচ্ছাবশত ছিল কি না সে বিষয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু এ বিষয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, ভুট্টোর আগমনটা ছিল নির্ভেজাল ধাপ্পা। কোনওপ্রকারের সমঝোতাই তার কাম্য ছিল না। তাই মারাত্মক রকমের সিরিয়াস কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার ভড়ং চালালেন তিনি পাক্কা তিনটি দিন ধরে যে আলোচনা তিন মিনিটেই শেষ হয়ে যাবার কথা। একবার তো তিনি সে থিয়েডারিটাকে প্রায় ফার্সের পর্যায়ে নাবিয়ে আনলেন একটানা ঝাড়া আটটি ঘণ্টা শুধু তিনি আর শেখ সলা পরামর্শ করে। ও হো হো! সে কী টপমোস্ট সিক্রেসির ভান! মিঞা তাজ, নজরেরও সেখানে প্রবেশ নাস্তি। ভাবখানা এই, ভুট্টোদেব এমনই প্রলয়ঙ্করী প্রস্তাব প্রতিপ্রস্তাব পরিকল্পনা সুপারপ্ল্যানিং পেশ করবেন যে তার সামান্যতম রেশও যদি তৃতীয় ব্যক্তি শুনে ফেলে তবে ইন্ডিয়া সেই রেশের ওপর নির্ভর করে তদণ্ডেই পাকিস্তান এটাক করবে, ওয়ালস্ট্রিট, ফট করে কলাপস করবে, ইংলন্ডের মহারানি তার চাচা উইন্ডসরকে কোল-পাজা করে তুলে এনে তার হ্যাটে কোহ-ই-নূরটি পরিয়ে দেবেন।
কিবা হবে, কেবা জানে।
সৃষ্টি হবে ফট
সংক্ষেপে বলিতে গেলে
হি টিং ছট।
বিশেষ বিবেচনার পর আমি এস্থলে হি টিং ছটটি ব্যবহার করেছি কবিগুরু যে অর্থে ব্যবহার করেছিলেন ঠিক সেই অর্থে। আপাতদৃষ্টিতে অসাধারণ রহস্যময় কতকগুলি বুজরুকিকে যখন গভীর আধ্যাত্মিক তত্ত্বময় তান্ত্রিক ধ্বনির মুখোশ পরানো হয় তখন সেটা হিং টিং ছট; সায়েবি ভাষায় আবরাকাডাবরা মাম্বোজাম্বো হাকাস পোকাস।
ভুট্টো শেখের এ রাঁদেভূতে লাভবান হলেন কে?
নিঃসন্দেহে ভুট্টো।
চাঁড়াল ভুট্টো শেখের সঙ্গে একাসনে বসতে পেয়ে পৈতে পেয়ে গেলেন।
ইয়েহিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি আইয়ুবের স্বৈরতন্ত্র হটিয়ে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করবেন। তার প্রথম পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল শেখ মুজিব নিরঙ্কুশ সংখ্যাগুরুত্ব লাভ করেছেন। তিনি স্বচ্ছন্দে একটি নিষ্কণ্টক সরকার নির্মাণ করতে পারেন। ইতোমধ্যে ময়দানের এক কোণ থেকে একটা লোক সার্কাসের ক্লাউন যেরকম ওস্তাদের কেরামতি খেল দেখে চেঁচাতে আরম্ভ করে, আমি পারি, আম্মো আছি–আমাকে ভুললে চলবে না, ঠিক সেইরকম একটা লোক হাত পা ছুঁড়ে বিকট চেল্লাচেল্পি আরম্ভ করল, শেখের পরেই আমি, আমাকে ছাড়া চলবে না। সার্কাসের ম্যানেজার সদয় মশকরার মুচকি হেসে হেসে তো, আও বেটা, বাতাও তুমহারা খেল। ম্যানেজার ইয়েহিয়া বললেন, শাবাশ বেটা ভুট্টো।
কিন্তু দীর্ঘ তৈইশ বৎসর ধরে সর্বপ্রকারের অত্যাচার অবিচারের পর এই হয়েছে গণতন্ত্রের গোড়াপত্তন। তাই গোড়া থেকেই চলতে হবে অত্যন্ত সন্তর্পণে, আইনের পথে ন্যায়ের পথে– গণতন্ত্রের নাতিদীর্ঘ ইতিহাসে ভিন্ন ভিন্ন দেশে যেসব উদাহরণ সৃষ্ট হয়েছে, নজির নির্মিত হয়েছে, সেগুলো প্রতি পদে সসম্ভ্রমে মেনে নিয়ে। এটা তো সার্কাস নয়। গণতন্ত্রে ভাড়ামির স্থান নেই– সে ছিল আইয়ুবের বেসিক ডেমোক্রাসিতে।
কে এই লোকটা?
আমি ভুট্টো; গণনির্বাচনে আমি দুই নম্বরের সংখ্যাগুরু। মুজিবের পরেই আমি। আমার সঙ্গে একটা রফারফি না করে সংবিধান বানালে চলবে না।
বা রে! এ তো বড়ি তাজ্জবকি বাত! মুজিবের পরেই তুমি! তা– সৃষ্টির ইতিহাস পড়লেই দেখি সদাপ্রভুর পরেই শয়তান। তাই বলে গড় যখন সেরাফি চেরাবি, গেব্রিয়েল নিয়ে ভগবানবাদে তার ক্যাবিনেট নির্মাণ করলেন সেখানে তো শয়তানকে ডাকা হয়নি। এসব তাবৎ জঞ্জাল জড়ো করে তিনি বানাতেন কী? ঢাকা মিরপুরের চিড়িয়াখানা?
আর, বাই দি উয়ে, তোমার পর তো সংখ্যাগুরুতে ইনডিপেনডেন্ট ক্যানডিডেটস। তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতা করে নিয়ে তার পর এখানে এসেছ তো? তুমি যেমন আমার ঠিক ঠিক নিচে বলে আমার সঙ্গে একটা রফারফির দাবি জানাচ্ছ, ঠিক তেমনি ওরাও তোমার উপর সেই দাবি চাপাচ্ছে না তো? করে করে তার পরের দলের দাবি তার উপরের দলের ওপর চাপাবে এবং লিস্টের সর্বনিম্নে যে চোরউল আমিন লিলি করছে তাকে পর্যন্ত ভজতে পূজতে হবে। তার নামখানা থেকেই বুঝতে পারছ, ওর খাই মেটানো তোমার-আমার কম নয়– থুড়ি, আমার কম্ম নয়, কিন্তু তুমি পারবে! তুমি যখন মহামান্য সুচতুর ইয়েহিয়াকে বোঝাতে পেরেছ যে, গণতন্ত্রের পয়লা আইন হচ্ছে, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগুরুর প্রথম কর্তব্য সে যেন সংখ্যালঘুর ন্যাকরা বয়নাক্কার তোয়াজ করে করে কাজকর্মের ভার নেয়, ক্লাসের ফার্স্ট বয় যেন সেকেন্ড বয়ের সঙ্গে আলোচনা করে তার মর্জিমাফিক আসছে পরীক্ষায় (সংবিধান নির্মাণে) অ্যানসার বুক লেখে– এ রকম ভেল্কিবাজি যখন দেখাতে পেরেছ, তখন না হয় বলে দিয়ে চোর উল আমিনকে যে তুমি তাকে তোমার বাড়ির পাশের মোনজোদভোর সুলতান বানিয়ে দেবে। হ্যাঁ, আরেকটা কথা। তুমি এরকম হ্যাংলার মতো ট্যাংস্ ট্যাংস করে ঘস্টাতে ঘস্টাতে ঢাকা এলে কেন? ওই যে, তোমার হয় তো, বাপু, চেনা, শয়তান– সে-ও তো ভগবানবাদে গিয়ে গডের কাছে বায়না ধরেনি, আমাকে তোমার কেবিনেটে নাও। সে। জানে হোয়াট ইজ হোয়াট। সে তার আপন শয়তান বাদে (মাস তিনেক পরের ঘটনা জানা থাকলে এস্থলে অক্লেশে বলা যেত, টিক্কা বাদে) দিব্য তার মিতা ডেভিল, ইবলিস, বি এল জেবাব নিয়াজি, ইরফানকে নিয়ে তার আপন সংবিধান বানিয়ে নিয়েছে এবং বললে নিশ্চয়ই পেত্যয় যাবে, তার সরকার তেমন কিছু মন্দ চলছে না। তুমি বানাও না তোমার সংবিধান তোমার প্যারা ত্রিমূর্তি নিয়ে যক্ষ রক্ষ গুপ্ত দিয়ে। এরা এক-এক খানা আস্ত আস্ত চিজ। ওদের ঠেলায় দেখতে হবে না, শয়তান বাবাজিকে রাতারাতি ব্যবসা গুটিয়ে লারকানার হাইকোর্টে দেউলে হওয়ার নোটিশ টাঙাতে হবে।
মশকরাটার বাড়াবাড়ি হচ্ছে? মোটেই না। পাঠক, একটু পরেই বুঝতে পারবেন! আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে কতখানি জীবন-মরণ সিরিয়াস। আচ্ছা, তা হলে না হয় আমি একটা সিরিয়াস উদাহরণ নিচ্ছি। মনে করুন, বছর কয়েক পূর্বে উইলসনের পরিবর্তে মি. ভুট্টো ছিলেন বিলেতের প্রধানমন্ত্রী। উইলসন-ভুট্টো নির্বাচনে হেরে গেলেন মি. হিথের কাছে। বিশ্বসংসার জানে চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে উইলসন প্রধানমন্ত্রী ভবন ১০নং ডাউনিং স্ট্রিট থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে সরে পড়লেন। ভুট্টো সে স্থলে কী করতেন? নিশ্চয়ই আবদার ধরতেন, হিথের পরেই আমার ভোটাধিক্য। ও পেয়েছে ইংলন্ডে সবচেয়ে বেশি ভোট, আমি পেয়েছি স্কটল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি ভোট (ইংলন্ড স্কটল্যান্ড আমি কথার কথা কইছি)। আমার সঙ্গে একটা সমঝোতা না করে দেখি হিথ কী করে ১০ নম্বরে ঢোকে? আমি বলছি কী, সে যদি নেয় ডাইনিংরুম আমি নেব ড্রইংরুম, তাকে দেব গাইয়ের মুখের দিকটা আমি বাঁটের দিকটা, সে নেবে কল্কে সাজানোর দিকটা আমি মুখে পুরব গড়গড়ার নলটা। সে কী! পূর্ব পাক কি আমার পর– একেই বলে সত্যকারের অনেট ব্রাদারলি ডিভিশন।
.
ভুট্টো জানতেন, বিলক্ষণ জানতেন, গণতন্ত্রের কি আইনত (ডি জুরে) কি কার্যত (ডি ফাঁকটো) আওয়ামী লীগের গণদরবারে (ভিজা আ ভি) পয়লা সারিতে তার কোনও আসন (লকাস স্টেভি) নেই। তাই তাঁর ছিল আপ্রাণ চেষ্টা, কোনও গতিকে আওয়ামী লীগের দরবারের এক কোণেও যেন একটা আসন যোগাড় করে নিতে পারেন। তাই যদিও তিনি এলেন ঢাকঢোল বাজিয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে, ভিতরে ভিতরে তিনি এলেন আতুর ভিখিরির মতো হামাগুড়ি দিতে দিতে।
পাঠক, আপনি যতই অতিষ্ঠ হয়ে থাকুন না কেন, আমি এই লিগেল, মরাল, সাংবিধানিক প্রতোকলীয় পয়েন্টটি কেচে ধুয়ে ইস্ত্রি চালিয়ে ভাঁজ করে পকেটে না ঢোকানো পর্যন্ত ছাড়ছিনে। কারণ এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক অশিব মূর্তি নিয়ে বার বার দেখা দেবে। যারা বাংলাদেশের মঙ্গল কামনা করেন তাদের এ বিষয়ে পরিপূর্ণ সচেতন হওয়া উচিত। আমার অজানা নয়, বিষয়টি অত্যন্ত নিরস কিন্তু সে কারণে আমি যদি এটা এড়িয়ে যাই তবে উভয় বাঙলার যে দু-একজনের সঙ্গে আমি এ নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি করেছি তারা আমাকে আস্তো একটা এসকেপিস্ট, ভঁড়ামি ভিন্ন অন্য কোনও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চায় না বলে আমাকে প্রাগুক্ত সার্কাসের ওই ক্লাউনের সঙ্গে তুলনা করে পাকিস্তানে নির্বাসিত করবেন। আমি যে ভঁড় ক্লাউন সেটা আমি অতীব শ্লাঘার বিষয় বলে মনে করি, কিন্তু একটি নিবেদন এস্থলে আমাকে পেশ করতেই হল : সার্কাসের ক্লাউন তো এসকেপিস্ট হয় না– সে তো কুল্লে ওস্তাদের তাবৎ কেরামতি দেখাবার জন্যে সদাই শশব্যস্ত।
তা সেকথা থাক। আমি এ প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছি গুণীদের মুখ থেকে সুদ্ধমাত্র শোনবার জন্য, গণনির্বাচনে নিষ্কণ্টক সংখ্যাগুরুত্ব লাভ করার পর বিজয়ী পার্টির কি কোনও দায় আছে, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় পার্টির সঙ্গে সলাপরামর্শ করার-জাহান্নমে যাক তাদের সঙ্গে সমঝোতা করার। অতি অবশ্য একথা সত্য, ভুট্টো যদি তাঁর পার্টির প্রতিভূ হিসেবে আমি ভোটে দুই নম্বরি হয়েছি বা আমি সমুচা পশ্চিম পাকিস্তানের মোড়ল সে হিসেবে নয়– আওয়ামী লীগ প্রধানের কাছ থেকে একটা ইন্টারভিউর প্রার্থনা জানান তবে শেখ-চরিত্র আমরা যতখানি চিনতে পেরেছি তার থেকে বলতে পারি তিনি বদান্যতার সঙ্গে সেটা মঞ্জুর করবেন।
কিন্তু সেটা হবে শেখের ব-দা-ন্যতা।
মি. ভুট্টোর হ-ক নয় ॥
.
পিণ্ডির পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে
রোমান সেনাপতি কুইনটু ফাবিয়ুস যখন হানিবালের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত তখন তার রণকৌশল ছিল সম্মুখযুদ্ধে মরণ-বাচন লড়াই না লড়ে ক্রমাগত সুযোগের অপেক্ষায় দেরি করে করে যখন সুযোগ আসত তখন মুখোমুখি না লড়ে শত্রু-সেনার বাজুতে যেখানে সে দুর্বল সেখানে আঘাত হানা কিন্তু সে আঘাতটা হত মোক্ষমতম। তাই সুযোগের অপেক্ষা করে আখেরে দুশমনকে ঘায়েল করার চাল বা স্ট্র্যাটেজিকে আজও বলা হয় ফেবিয়ান পদ্ধতি। মারাঠারা হুবহু, ওই একই পদ্ধতিতে ঔরংজেবকে রণক্লান্ত ও পরবর্তীকালে মোগলবাহিনীকে পরাজিত করে। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ওই নীতির অবলম্বন করে সফলকাম হন।
এস্থলে কিছুটা অবান্তর হলেও ইংলন্ডের ফেবিয়ান সোসাইটির উল্লেখ করতে হয়। মার্কস-এঙেলস যখন আসন্ন রক্তাক্ত শ্রেণি-সংগ্রামের প্রোপাগান্ডা করে যাচ্ছেন তখন তার শেষের দিকে বিলেতে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে (১৮৮৪) ওই নাম নিয়ে। এঁদের নীতি নির্দেশ আছে : হানিবালের সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সময় ফাবিয়ুস যে নীতি অবলম্বন করেছিলেন তোমাকে অসীম ধৈর্যসহকারে সুযোগের সেই শুভ লগ্নের জন্য প্রতীক্ষা করতে হবে– যদিও বহু লোক তখন ফাবিয়ুসের সেই দীর্ঘসূত্রতাকে নিন্দাবাদ করেছিল; কিন্তু সে লগ্ন যখন আসবে তখন হানবে বেধড়ক মোক্ষম ঘা— নইলে তোমার সর্ব প্রতীক্ষা সবরের (সবুরতার সমাপ্তি ঘটবে হাহাকার ভরা নিষ্ফলতায়।
আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত তার রণনীতি ছিল ফেবিয়ান– একথা বললে মোটামুটি ঠিক কথাই বলা হয়। বিশেষ করে ১৯৭০ ডিসেম্বরে নিষ্কন্টক মেজরিটি পাওয়ার পর থেকে ১৯৭১-র ২৫ মার্চ পর্যন্ত।
আরেকটি নীতিতে ফেবিয়ানরা দৃঢ় বিশ্বাস ধরতেন। গণতন্ত্রের গর্ভে থাকে সমাজতন্ত্র। গণতন্ত্রের অর্থনৈতিক রূপ সমাজতন্ত্র (সোশ্যালিজম)।
আওয়ামী লীগ চিরকালই এ-নীতিতে বিশ্বাস করেছে–আজও করে। তবে সেখানেও সে ফেবিয়ান। আকস্মিক শ্রেণি-সগ্রামের মাধ্যমে সে সমাজতন্ত্র (অর্থ বণ্টনের সাম্য) রূপায়িত হবে না– হবে প্রগতিশীল সংবিধান নির্মাণ, আইনকানুন প্রণয়ন দ্বারা ক্রমবিকাশমান সমাজচেতনার শুভ বুদ্ধিকে উৎসাহিত করে, সমাজবিরোধী শোষণ নীতিকে পলে পলে নিষ্পেষিত করে।
সোশ্যালিস্ট মাত্রই বিশ্বাস করে মানবসমাজ ক্রমশ সর্বপ্রকার সাম্যের দিকে এগিয়ে চলেছে- ধনবণ্টনে সাম্য, রাষ্ট্রচালনায় সাম্য, ধর্মকর্মে সাম্য, ভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে পদমর্যাদায় সাম্য (নেশনালিজম)–দুর্বল রাষ্ট্রকে যখন বৃহত্তর, বলীয়ান পশুরাষ্ট্র শোষণ-উৎপীড়ন করে, তাকে তার ন্যায্য সাম্য থেকে বঞ্চিত করতে চায়, তখন তাকে সর্বপ্রকারে সাহায্য করে দেওয়া তার রাষ্ট্রসাম্য–। প্রকৃত সোশ্যালিস্ট মাত্রই সেই আগ্রাসী গতিবেগকে সংবিধানসম্মত নিরস্ত্র পদ্ধতিতে সাহায্য করে।
আজকাল আমরা মোক্ষ, নিজাত, ফান-বাক্য, নির্বাণ ইত্যাদিতে বড় একটা বিশ্বাস করিনে। তবু একটা সমান্তরাল উদাহরণ দেখালে তথাকথিত সংস্কারমুক্ত ন-সিকে রেশনাল জনও হয়তো কিঞ্চিৎ বিস্মিত তথা আকৃষ্ট হতে পারেন। খ্রিস্টান মিশনারি, যার প্রচার করেন, মুসলমান নারীর আত্মা নেই, তারা বলেন, প্রভু বুদ্ধ নৈরাশ্যবাদী। আমরা বিশ্বাস করি তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ আশাবাদী। তিনি বলেছেন, বিশ্বমানব এগিয়ে চলেছে নির্বাণের দিকে। আখেরে নির্বাণ পাবে সর্বজন– সর্ব মানব থেকে আরম্ভ করে সর্ব কীটপতঙ্গ। এরা চলেছে যেন নদীর ভাটার স্রোত ধেয়ে। তাকে উজানে চালানো অসম্ভব। কিন্তু স্রোতগামী কাঠের টুকরোটাকে বৃহত্তর কাষ্ঠখণ্ড দ্বারা যেরকম সেটাকে কিঞ্চিৎ ডাইনে-বাঁয়ে সরানো যায় কিংবা তার গতিবেগ বাড়ানো যায়, মানুষ ধর্মসাধনা দ্বারা ঠিক সেইরকম নির্বাণের দিকে তার গতিবেগ বাড়িয়ে দিতে পারে। এককথায়, কি ফেবিয়ান, কি কম্যুনিস্ট, কি বৌদ্ধ সকলেই চরম গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে আশাবাদী।
.
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, শেখ সাহেব এবং আওয়ামী লীগের প্রধানগণ ফেবিয়ান ঘেঁষা সোশ্যালিস্ট। পক্ষান্তরে প্রকৃত বামপন্থি ছিলেন মৌলানা ভাসানী। ওদিকে লেফটেনেন্ট কমান্ডার মুয়াজ্জম হুসেন যে মতবাদ পোষণ করতেন সেটা অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করা যায়– ছয় দফা বনাম এক দফা। তিনি বলতেন, আমি পশ্চিম পাকিদের খুব ভালো করেই চিনি। ওদের সঙ্গে বাঙালির কস্মিনকালেও মনের মিল স্বার্থের ঐক্য হবে না। ছয় পয়েন্টের ধানাই-পানাই না করে সোজাসুজি এক দফায় বলে দাও, চাই স্বরাজ, পুব বাঙলায় সম্পূর্ণ স্বাধীন সবশক্তির স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। আইয়ুব এবং ইয়েহিয়া দু জনাই মুয়াজ্জমের এককাট্টা জাতীয়তাবাদের কথা ভালো করেই জানতেন। তাই কুখ্যাত আগরতলা মামলার যে নথিপত্র আইয়ুবের আদেশে স্বয়ং ইয়েহিয়া তৈরি করেন তার আসামির ফিরিস্তিতে অন্যতম প্রধান ছিলেন মরহুম মুয়াজ্জম। টিক্কা খানও সেকথা ভোলেননি। তাই ২৬ মার্চ ভোরবেলা তাঁকে নৃশংসভাবে, তাঁর স্ত্রীর চোখের সামনে হত্যা করা হয়। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী সে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের কথা আমার সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই সর্বপ্রথম উল্লেখ করেন। সে কাহিনী এমনই পাশবিক যে তার বর্ণনা দেবার মতো শক্তি আমার নেই। যেটুকু পারি যথাসময়ে দেব।
অথচ মি. ভুট্টোর বিবরণী মাফিক শেখ পয়লা নম্বরি ফ্যাসিস্ট। মনে হয়, ভুট্টো প্রথম একখানি প্রামাণিক অভিধান খুলে ফ্যাশিসমো শব্দটির অর্থ দফে দফে টুকে নিয়েছেন। তার পর মুসোলিনি এবং হিটলার দুই পাড় ফ্যাসির কর্মপন্থার তসবিরের নিচে রেখেছেন একখান আনকোরা কার্বন পেপার। উপরে বুলিয়েছেন একটা দড় বলপয়েন্ট। হো প্রেন্তে! ভানুমতীকা খেল– তলার থেকে বেরিয়ে এল, মুজিবের ছবি।
যথা :
হিটলার ধনপতিদের কাছ থেকে পেতেন টাকা।
মুজিব পেতে লাগলেন অঢেল টাকা এবং অন্যান্য উপাদান। (ম্যাসিড মানিটারি অ্যান্ড মেটিরিয়াল এসিসটেন্স্)- ব্যাঙ্কার এবং ধনপতিদের কাছ থেকে (ব্যাঙ্কারস অ্যান্ড বিগ বিজনেস)। উবাচ ভুট্টো।
এই একটিমাত্র বাক্য যেন একটি জুয়েল। ন্যাড়খানাগত উজ্জ্বল নীলমণি।
যেন এক্কেবারে খাঁটি যোগশাস্ত্রের সূত্রে বাধা আস্ত একটি কণকমঞ্জরী :
যক্ষকুবের প্রসাদাত অর্থং চ বিত্তং চ।
ন-ন-নাঃ। যে ভুট্টো মিঞা বাঙলা ভাষার নামেই ফ্যাকচুরিয়াস তার পাক জবানে কাফেরি কালাম। তওবা, তওবা!
বরঞ্চ সিন্ধিভাষা ফারসির হনুকরণ করে। যেমন মি. ভুট্টোর সম্পূর্ণ অপরিচিত নয় এমন এক সম্প্রদায়কে আহ্বান করতে গিয়ে ইরানি কবি যে চারিটি শব্দ ব্যবহার করেছেন সিন্ধি ভাষাতে সেগুলো সুবো-শাম– বিশেষ করে শাম সন্ধেবেলা– এস্তেমাল হয়– রিন্দ, ম, দেওয়ানা, শাবি। তাই ফারসিতেই না হয় দোহা গাঁথি :
অমদ জর ওরা আমদ সরঞ্জাম,
আজ সররাফ ওয়াজ নিমকহারাম।
ভাণ্ড ভাণ্ড স্বর্ণ আর সর্ব অবদান।
ঢেলে দিন সুদখোর আর বিত্তবান ॥
–পাঠান্তর
ঢেলে দিল ব্যাঙ্কার, নেমকহারাম ॥
এ তো হল সূত্র নির্মাণ কিন্তু এই আজব ভুটাঙ্গপুরাণের মল্লিনাথ হবার মতো পেটে এলেম ধরেন হেন জন তো এ ঘোর কলিকালে দেখতে পাচ্ছিনে। অতঃ মধ্বভাবে গুড়ং দদ্যাৎ!
(ক) ব্যাঙ্করা নাকি টাকা দিত, আওয়ামী লীগকে– ভুট্টো বলেছেন, শেখকে পার্সনেলি।
এষ স্য অবতরণিকা : শেখের পূর্বপুরুষ সর্ব শুযুখ নিশ্চয়ই বহু পুণ্য সঞ্চয় করে গিয়েছিলেন যে সিন্ধুর কল্কি ভুট্টাবতার শেখকে সিন্ধি কলমা পড়িয়ে ভুট্টো-ইয়েহিয়া গোত্রে অন্তর্ভুক্ত করে এ আপ্তবাক্য ঝাড়েননি যে, তারা যে কায়দায় পঞ্চমকারের সাধনায় পয়সা ওড়ান শেখও ওই প্রাণাভিরাম পদ্ধতিতে পার্টি ফান্ডের কড়ি উড়িয়েছেন!
বলা বাহুল্য, শেখের জেবে ক-কড়ি ক-ক্রান্তি ছুঁচোর নৃত্যের কেত্তন চালাচ্ছে সে তত্ত্ব ভুট্টো তার ভুবন-জোড়া টিকটিকি প্রসাদাৎ উত্তমরূপেই জানতেন। সেখানে কানাকড়ির গড়বড় থাকলে ব্যারিস্টার ভুট্টো কি ছেড়ে কথা কইতেন? ঢাকার বাঙাল হাইকোর্টের চিলকোঠায় উঠে চিল-চাঁচানোর কর্কশ কণ্ঠে সে কেলেঙ্কারিটা প্রচার করতেন না?
মূল টীকা : ব্যাঙ্কারেরা শেখকে টাকা দিয়েছিল। এস্থলে সেই প্রাচীন প্রবাদ মনে আসে মোটেই মা দ্যায় না খেতে– তার আবার কাড়া-আকাড়া। উভয় পাকিস্তান মিলিয়ে বাঙালি ব্যাঙ্ক ছিল সর্বসাকুল্যে কটা? দুটো! তাদেরই-বা রেস্ত ছিল কতটুকু যে রাজনীতির ঘোড়দৌড় ব্যাক করতে যাবে? আওয়ামী লীগের মতো ডার্ক হর্সকে বিশেষ করে সবজান্তা সরকারি মহল থেকে ফিসফিসেনি কানাঘুষো যখন চতুর্দিকে চক্কর খেয়ে বেড়াচ্ছে শেখ মেরে-কেটে ৮০টা ভোট পায় কি না পায়?… আর পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যাঙ্কগুলো টাকা দেবে লীগকে? এর উত্তরে শুধু ঢাকাইয়া উত্তর একমাত্র সম্বল : আস্তে কয়েন কর্তা— ঘোরায় হাসব।
কতকগুলো লোফার বোম্বেটে পিক-পকেট একদা কলকাতায় এসে নেমেছিল বাণিজ্যের নামে হয় মুর্শিদাবাদ-দিল্লিতে ভিখ মাঙতে নয় শান্ত সরল অতিথিবৎসল বাঙালির সর্বস্ব লুট করতে। তার পর কিস্মাৎ, পতন-অভ্যুদয়ের অলঙ্ বিধানই বলুন, পূর্বজন্মের কর্মফলেই বলুন,
বণিকের মানদণ্ড
পোহালে শর্বরী
দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে।
যে দাঁড়িপাল্লার ঘামে ভেজা তেলচিটে ভঁটটায় হাত দিতে গা ঘিনঘিন করে সেটা দেখি আঁধারে গুঁড়িগুড়ি সিংহাসন বেয়ে উঠে রাজদণ্ডরূপ ধরে বেনের পোলাডার হাতে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে।
যে বোহরার পো পরশুদিন তক্ বোম্বায়ের রাস্তায় রাস্তায় ভাঙা ছাতা মেরামত করে দিনগুজরান করত, যে খোঁজার ব্যাটা বটতলায় ইটের উপর খদ্দের বসিয়ে নোয়ার ড্যাঁটার ইটালিয়ান চশমা বেচত, যে যেমন উদয়াস্ত কেনেস্তরার তৈরি ঝাঁঝরি বদনা ফেরি করে বেড়াত আর যে কচ্ছি ভূগুকচ্ছের গলিতে গলিতে তালা কুঞ্জিনা ধান্দা করে চাপাতি শাক খেত তারা ফাদার অব দি নেশনের কেরপায় ঢাকায় এসে রাতারাতি হয়ে গেল শেঠিয়া, মালিক, শিল্পপতি, আঁতরপ্রবর, চেম্বার অব কমার্সের চেয়ারমেন এবং সর্বোপরি বিশ্বজুটের সর্বাধিকারী হর্তা-কর্তা বিধাতা। আর ছাপরা ইস্টিশানের বেহারি মুটে হল ট্রাফিক ম্যানেজার।
এবং এদের তুলনায় ইসপাহানি গোষ্ঠী তো রীতিমতো খানদানি মনিষ্যি, শরিফ আশরাফ। এদের ঠাকুর্দার বাবা এসেছিলেন ঘোড়া খচ্চর বিক্রি করতে ইরান থেকে শ্রীরঙ্গপট্টমে, টিপু সুলতানের আস্তাবলে।
তালাকুঞ্জির ফেরিওলা থেকে ইটে বৈঠানওলা পরকলা বেচনেওলার দাপট তখন দেখে কে?–নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-টঙ্গি জুড়ে! দম্ভে দেমাকে যব চার্নক থেকে গলস্টনকে তারা তখন তুড়ি দিয়ে নাচাতে পারে। সুবে পাকিস্তানের ফাদার মাদার পিএএস (সিভিল সার্ভিস) তাদের নাম স্মরণে এনে ঢাকার সেকেন্ড ক্যাপিট্যাল আইয়ুব নগরে প্রবেশ করে।
সুবে পাকিস্তানের এইসব শাহ্-ই-শাহরা দাঁতে কুটো কেটে, ভেটের ডালি মাথায় করে যাবেন কোথাকার সেই ফরিদ-পুরা গাঁইয়া মছলিখোরকে পাস?
আর এঁদের তল্পিদার, যদ্যপি জমিদার তথাপি মন্ত্রণাদাতা জুলফিকার ভাই-আলিজি ভুট্টোওয়ালা তখনও কি তাঁদের হুশিয়ার করে দেননি, ওরে, তোরা যাচ্ছিস কোন বাগে? ওই লোকটাই তো কসম খেয়েছে, বাঙালিকে ফি বাঙলার রাজা বানাবে।
আর টাকা দিয়েই যদি দেশের দশের সম্মতি মহব্বত কেনা যেত তবে টাকার কুমির ভুট্টো তাঁর আপন দেশ সিন্ধুর দক্ষিণাঞ্চলের ভোটগুলো পাইকিরি হিসেবে কিনলেন না কেন? বেলুচিস্তানে ব্লাঙ্কো, আর সীমান্তে কুল্লে একটা ভোট পেলেন কেন?
গাঁয়ের ছেলে মুজিবের তরে ছিল দেশের দশের দরদ মহব্বত। তাকে তো কড়ি দিয়ে কিনলেম রেওয়াজ নিরিখে শুঁটকি হাটের কায়দাকেতায় ভোট কিনতে হয় না।
.
মি. ভুট্টোর আরেক কুৎসা : সদাগরদের কাছ থেকে যে টাকা পায় তাই দিয়ে মুজিব অস্ত্র সংগ্রহ করেছিল।
হায়, হায়, হায়! মাথা থাবড়াতে ইচ্ছে করে। তা হলে পশ্চিম পাকি পিশাচেরা এদের ন মাস ভূতের নাচ না নেচে ন দিনেই খতম হত।
কুৎসার কত ফিরিস্তি দেব? এ যে অন্তহীন।
ভুট্টো যে আজও ভুবনময় দাবড়ে বেড়াচ্ছেন সেটা বহু পূর্বেই উবে যেত যদি এই শেষ মেছোহাটার বদবোলা গালটার এক কড়িও সাচ্চা হত : মুজিব ভাড়াটে গুণ্ডাদের মদদ দ্বারা ঘায়েল করতেন নিরীহ নাগরিককে।
পুনরপি হায়, হায়। তাই যদি হত তবে স্বয়ং ভুট্টো সাহেব ২৬ মার্চ মুক্তকচ্ছ হয়ে, পড়িমড়ি করে, ইয়েহিয়ার পাইলটদের কোমর জাবড়ে ধরে ঢাকা থেকে পালিয়ে জানটি বাঁচাবার ছোটাসে ছোটা মোকাটা পেতেন কি?
এবং এটা যে কতবড় নির্লজ্জ মিথ্যা সেটা আর সবার চেয়ে স্বয়ং ভুট্টোই জানেন সবচেয়ে বেশি। নইলে তিনি দু দুবার পা ঘষ্টাতে ঘষ্টাতে ঢাকা আসতেন না, নিছক মুজিবের উঠোনে কল্টো পেতে।… আসরে টাকাটা সাপটেছিলেন কোন গোঁসাই ভুট্টো মিঞা। তাই লোকে বলে, খেলেন দই রমাকান্ত, বিকেরের বেলা গোবদ্দন।
কিন্তু এ সবের সবকিছু ছাড়িয়ে যায় যে ঘৃণ্য, ন্যক্কারজনক আচরণ যেটা মানুষ জীবনভর ভুলতে পারে না সেটা :
সবাই জানত, ভুট্টো জানতেন মুজিব তখন পশ্চিম পাকে কারারুদ্ধ। তিনি কোনও কুৎসা, কোনও নিন্দা, কোনও অভিযোগ, কোনও অবমাননার উত্তর দিতে পারবেন না। তার প্রাণবায়ু অনিশ্চয়।
নিতান্ত ইতরজনও এ অবস্থায় তার দুশমনকেও গাল দেয় না।
কিন্তু বিলেতের ব্যারিস্টার, ল একপার্ট ভুট্টো জানেন আইনে সেটা বাধে না।
তাই ভাবি, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হতে হলে কত না এলেমের প্রয়োজন।
.
‘দুঃখ সহার তপস্যাতেই/ হোক বাঙালির জয়—’
মধুঋতু। ২৭ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে জমিদার ভুট্টো অবতীর্ণ হলেন ঢাকা নগরীতে।
নেমেই নাকি বললেন, আমি আমার বড়দার সঙ্গে কথা কইতে এসেছি।
সুবে পুব পাকিস্তান পরিতৃপ্তিসহকারে উচ্চধ্বনি করলে, হো হো হো, কী বিনয়, কী বিনয়। জুনাগড় রাজ্যের পরম প্রতাপশালী ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রীর ঔরসে তথা বহু কলায়, বিশেষত সঙ্গীতে পারদর্শিনী অনন্যা প্রিয়দর্শিনীর গর্ভে যার জন্ম তিনি কি না আমাদের গায়ের সাদামাটা মুসল্লি মিয়া সাবের পোলাডারে বড় ভাইসাব কইলেন! খানদানি ঘরের মনিষ্যি অইব না ক্যান?
আসলে কিন্তু এটা কি সেই বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ-র নায়েবজির উদয়াস্ত নারায়ণ নারায়ণ! হরি হে তুমিই সত্য বুলি আওড়ানোর মতো নয়? দুটোই আগাপাশতলা নির্ভেজাল ভণ্ডামির প্রহসন।
এ তামাশার দশ-বারো বৎসর আগের থেকেই পশ্চিম বাংলায় প্রকাশিত পুঁথি-কেতাব পুব বাংলায় আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে–মায় রবীন্দ্রনাথের কাব্য। তাই সেই বহুল প্রচারিত কবিতাটির নীতিবাক্য যদি ঢাকাইয়ারা ভুট্টোর দাদা, দাদা সম্বোধনের সময় স্মরণে না এনে থাকেন তবে উত্মা প্রকাশ করা অনুচিত।
কুটুম্বিতা বিচার
কেরোসিন-শিখা বলে
মাটির প্রদীপে
ভাই বলে ডাক যদি
দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে
উঠিলেন চাঁদা–
কেরোসিন বলি উঠে,
এস মোর দাদা!
পূর্বেই বলেছি, মি. ভুট্টো আমাদের শেখের বর্ণে উঠতে চেয়েছিলেন, এখন তিনি তার ভাই হতে চান! তিনি এদানির আসমানে ওড়ান ইসলামি ঝাণ্ডা; ইসলাম অনুযায়ী ভাইয়ে ভাইয়ে সমান বখরা। পশ্চিম পাকের জনসংখ্যা পুব বাংলার চেয়ে কম। অতএব ভুট্টো-ভাই পুব বাংলারও একটা হিস্যে পাবেন।
দীর্ঘ তিন দিন ধরে শেখ সম্প্রদায় আপ্রাণ চেষ্টা দিলেন ভুটো কী চান সেটা জানতে। বাংলাদেশ কী চায় সে তো জানা কথা। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। ভুট্টোও তাতে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তা হলে গেরোটা কোথায়?
ভুট্টোর মনের গভীরে দৃঢ়তর বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ ভিতরে ভিতরে শুধু তক্কে তক্কে আছে, কী করে আখেরে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সর্ব সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পারে। ভুট্টো তার কেতাবে স্বীকার করেছেন যে, ওই সময়ের কিছু আগে ইয়েহিয়ার প্রধান উপদেষ্টা পিরজাদা যখন তাকে জিগ্যেস করেন আওয়ামী লীগ। চায় কী? তখন তিনি মাত্র একটি শব্দে তার উত্তর দেন, সিসেশন। কেটে পড়তে চায়।… পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশকে না দেয় খেতে না দেয় পরতে, অথচ তিনি কিল মারার গোঁসাই। সেই খসমের কাছ থেকে সে চায় তালাক– এইভাবে বললে পুব পশ্চিম উভয় বাংলার হিন্দু-মুসলমান তত্ত্বটা স্পষ্ট বুঝতে পাবে।
এ কথা অতিশয় সত্য, সেই বখতিয়ার খিলজির আমল থেকে এবং আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস তার পূর্বে, বৌদ্ধ হিন্দুযুগে, এক কথায় অনাদি অনন্তকাল থেকে বাংলাদেশ কস্মিনকালেও দিল্লির বশ্যতা স্বীকার করতে চায়নি। বার বার স্বাধীন হওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছে। বাজারে চালু ইতিহাসে কিন্তু পাবেন, বুদু ঐতিহাসিকরা প্রতি অনুচ্ছেদে লিখছেন, এর পর বেঙ্গল রেবেল এগেনস্ট দি (দিল্লি) এমপেরর। যেন ঐতিহাসিক দিল্লি রাজদরবারের বেতনভোগী, হিজ মেজেস্টিজ মোস্ট অবিডিয়েন্ট স্লেভ, দিল্লির হুজুরের সাম্রাজ্যলোভী ইমপিরিয়ালিস্ট কলোনিয়ালিস্ট চশমা পরে সত্যমিথ্যা ন্যায়-অন্যায় বিচার করে ইতিহাস লিখেছেন– ইংরেজ যেরকম ১৮৫৭-র স্বাধীনতা সংগ্রামকে যতখানি অপমান করতে পারে সেই বদ মতলব নিয়ে তার নাম দিয়েছে সিপয় টিনি। ইন্ডিয়ান রেবেলিয়ান নাম দিলেও যে আন্দোলনের খানিকটে ন্যায্যতা স্বীকার করে নেওয়া হয়।
মোটেই ধান ভানতে শিবের গীত নয়।
এই বেলাই আমরা যেন এই ন মাসের দুঃখদহনের মূল তত্ত্বটি পরিপূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করে নিই। এই তত্ত্বটি একমাত্র তত্ত্ব অখণ্ড শাশ্বত সত্য। রাজনীতির ক্ষেত্রে একমাত্র কলমা, একমাত্র ইমান। এটা সর্বক্ষণ হৃদয়ে পোষণ না করলে কোনও দরকার নেই ওই ন মাস নিয়ে বিন্দুমাত্র কালির অপব্যয় করা। আমরা যেন ঘুণাক্ষরেও আমাদের আরামপিয়াসি মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই, এ ন মাস একটা দুঃস্বপ্ন, স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মাঝখানে একটা উটকো ব্যত্যয়– এটা গেছে, এখন থেকে আমরা চলব গোলাপের পাপড়ি বিছানো শস্যশ্যামল সোনার বাংলার জনপদভূমির উপর দিয়ে এবং পথের শেষে পাব কোরমা-পোলাওয়ের খুশবাই ভরা পদ্মাসাইজের ইয়া বিরাট দাওয়াত-বাড়ি, ভোজনান্তে তার চেয়েও বিরাট জলসাঘর, সেখানে অন্তহীন সঙ্গীত, নৃত্য, মধুচন্দ্রিকা।
না, না, না।
স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন তার চরমে তখন কে একজন জেনারেল আতাউল গনী ওসমানীকে শুধিয়েছিলেন, এ লড়াই আর কতদিন চলবে? ক্ষণতরে চিন্তা না করে তিনি বলেছিলেন, ফর ডিকেডস,–দশাধিক বৎসর, দশং দশং বৎসর– তার পর তিনি মে বি হতেও পারে বলছিলেন কি না সেটা নিতান্তই বাহ্য।
কারণ জেনারেল (এর চেয়ে কত অল্পে কত সেপাই ফিল্ড মার্শাল হয়েছে!) ওসমানী বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাস উত্তমরূপে অধ্যয়ন করেছেন। তিনি খাঁটি বাঙাল। তাই তিনি শুধু জর্মন ক্লাউজেভিৎসের রণনীতি, আউস্টরলিস, ওয়াটারলু, স্তালিনগ্রাদ, নরমাদিই পড়েননি– তাঁর স্মৃতিতে আছে বাংলাদেশের পৌনঃপুনিক শতশত বর্ষব্যাপী মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। যে কারণে পশ্চিমপাকের মিলিটারি বড়কর্তারা তাঁকে সামনাসামনি বলেছেন তিনি শভিনিস্ট; পেরোকিয়াল।
তিনি জানতেন, যে দেশ সাতশো বছর ধরে সেটুকুর ইতিহাস তো দিল্লিতে লেখা একচোখে ফারসি কেতাবেই আছে– ক্রমাগত স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছে তার পক্ষে এক ডিকেড, দু ডিকেড-ই তো স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী। কে জানে, আরও বেশি হতে পারে।
আজ না হয় বাংলাদেশের দুঃখদৈন্য চরমে পৌঁছেছে কিন্তু এটা তো এমন কিছু নিত্যকালের তত্ত্বকথা নয়। প্রাচুর্য আর সৌন্দর্য এদেশের সর্বত্র। সেই তার চিরন্তন স্বরূপ। তাই তার দিকে সকলেরই লোলুপ দৃষ্টি। পাঠান মোগল বাদশাদের তোষাখানাতে দু পয়সা জমে গেলেই তাঁদের নজর যেত এই উপমহাদেশের পূর্বাচলের দিকে সে রমণী সুজলা সুফলা। এস্থলে ধর্ম নিয়ে বাদানুবাদ করা ধর্মকে বিড়ম্বিত করা মাত্র। দিল্লির বাদশারা ছিলেন মুসলমান; গোড়ার দিকে না হোক, পরে বাংলার অধিবাসীর অধিকাংশই ছিল মুসলমান। এদের কতল করতে তবু তাদের বাধেনি। তাদের কিন্তু কিছুটা শালীনতাবোধ ছিল। বিংশ শতাব্দীর লাহোরি মোল্লাদের মতো দিল্লির মোল্লারা অতখানি জাহান্নমের অধঃপাতে যায়নি; তারা বাংলাদেশের বিদ্রোহ দমনের সময় ইসলাম ইন ডেঞ্জার জিগির তুলে বাঙালি মুসলমানকে কাফির ফতওয়া দিয়ে, জাল জেহাদ চালিয়ে নিজেদের পরকাল খোওয়ায়নি। রাজ্য বিস্তারে কলোনি শোষণের সময় ধর্ম অবাস্তর, দেশটার প্রাচুর্য বাস্তব সত্য।
বাংলাদেশের ছিল। যেমন এককালে ইতালির সৌন্দর্য ও প্রাচুর্য দুই-ই ছিল বলে তার দিকে ছিল বহু জাতের লুব্ধ দৃষ্টি। তাই ইতালির কবি ফিলিকাজা একদা কেঁদেছিলেন :
ইতালি, ইতালি, এত রূপ তুমি
কেন ধরেছিলে, হায়!
অনন্ত ক্লেশ লেখা ও ললাটে
নিরাশায় কালিমায়!
নইলে কবিগুরুই-বা বাঙালির জন্য এমন মর্মান্তিক প্রার্থনা করতে যাবেন কেন?
প্রতাপ যখন চেঁচিয়ে করে
দুঃখ দেবার বড়াই,*
জেনো মনে, তখন তাহার
বিধির সঙ্গে লড়াই।
দুঃখ সহার তপস্যাতেই
হোক বাঙালির জয়!
কী বাঙালিকে চিরকাল করতে হবে দুঃখের তপস্যা! এ কী আশীর্বাদ, না অভিসম্পাত।
[*এস্থলে টিক্কা যখন চেঁচিয়ে করে/ দুঃখ দেবার বড়াই
বললে টিক্কা ও দুঃখ-এর একটা/ মধ্যানুপ্রাস পাই।]
সাতশো বছরের ঐতিহ্য তোমার, হে বাঙালি স্বাধীনতার জন্য বার বার বিদ্রোহ করা, রক্তাক্ত সংগ্রামে আত্মবিসর্জন দেওয়া-না হয় তুমি সে ঐতিহ্য সম্বন্ধে আজ সচেতন নও, কিন্তু ওই যে নয় মাসের সংগ্রাম- মাতার অশ্রুজল, বধূর হাহাকার– সে কি তুমি কখনও ভুলতে পারবে?
তোমার কি মুহূর্তের তরে মনে হয়, অদ্বিতীয় এই পাশবিক নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করলেও চলত?
তোমার কি চিত্তদৌর্বল্য দেখা দিয়েছিল কতু, ক্ষণতরে এ দুঃসহ সংগ্রাম আর কতকাল ধরে লড়ব?
তুমি কি ভয় পেয়েছিলে?
না।
দুঃখ সহার তপস্যাতেই
হোক বাঙালির জয়।
ভয়কে যারা মানে
তারাই জাগিয়ে রাখে ভয়।
আর সর্বোত্তম অমূল্য কী শিক্ষা তুমি লাভ করলে?
তোমার দেশকে যখন সর্বসমক্ষে ক্রুশবিদ্ধ করা হল তখন বিশ্বনায়কগণ ক্লীব নপুংসকের মতো কী ঘৃণ্য আচরণ করলেন। তারা তোমার মৃত্যুযন্ত্রণা পলে পলে দেখলেন। কিন্তু তুমি যে প্রভু খ্রিস্টের মতো দুঃখ সহার তপস্যা দ্বারা নবজীবন লাভ করবে সে আশঙ্কা তারা করেননি।
কিন্তু তুমি যে একেবারে হতভাগ্য মিত্রহীন নও সে অপ্রত্যাশিত বৈভবও তুমি লাভ করলে সংগ্রামের অপরাহ্নবেলা।
এইবারে মূল সত্য, শেষ সত্য।
আবার আসবে নব দুর্যোগ। ওইসব ক্লীব নপুংসকদের শবদেহেই সঞ্চারিত হবে প্রেতাত্মা বেতাল। আবার আসবে দুঃখের তপস্যা। তাই জয়ধ্বনি কর :
দুঃখ সহার তপস্যাতেই
হোক বাঙালির জয় ॥
.
আব্রু দিয়ে, ইজ্জৎ দিয়ে, ইমান দিয়ে–
পলাশির যুদ্ধের পর বাংলাদেশের জীবন-মরণ সঙ্কট আসে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ। তার পূর্বের দু মাস ফেব্রুয়ারি ও মার্চ ধরে পুব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তান যেন গ্রিক ট্র্যাজেডির নিয়তির অলঙ্্য নির্দেশে দুর্বার গতিতে ধাবমান হল কোনও এক করাল অস্তাচলের দিকে। আবার সেই নিয়তিরই প্রসন্ন নির্দেশেই এক শুভপ্রভাতে জয়ধ্বনি উঠল,
হোক, জয় হোক
নব অরুণোদয়।
পূর্ব দিগল।
হোক জ্যোতির্ময় ॥
আর্য সভ্যতার পূর্বতম প্রান্ত, পূর্বাচল পূর্ব দিগঞ্চল বাংলাদেশ।
ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের সর্বশেষ শ্লোকেও আছে :
রাত্রি প্রভাতিল,
উদিল রবিচ্ছবি
পূর্ব-উদয়গিরি ভালে—
বাংলাদেশই পূর্ব উদয়গিরি। সে তার ভালে কী টিকা এঁকেছে সেটি রবিচ্ছবি, কবি রবির আঁকা ছবি, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত– আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
কবি আরও বলছেন, ওরা বেরিয়ে পড়েছে; এদের কপালে লেগেছে সকালের আলো, ওদের পারানির কড়ি এখনও ফুরোয়নি; ওদের জন্য পথের ধারের জানালায় জানালায় কালো চোখের করুণ কামনা অনিমেষে চেয়ে আছে : রাস্তা ওদের সামনে নিমন্ত্রণের রাঙা চিঠি খুলে ধরলে, বললে, তোমাদের জন্য সব প্রস্তুত।
ওদের হৃৎপিণ্ডের রক্তের তালে তালে জয়ভেরি বেজে উঠল।
.
আর পশ্চিম পাকিস্তান? তার জন্য নিয়তি কী নির্ধারিত করছেন? আমি তো দেখছি, তাদের সম্মুখে অন্ধকার। বিপাকের বিভীষিকা রজনীর পরে ওদের জন্য কোনও শুভ্র উষার শুকতারা আমি তো দেখতে পাচ্ছিনে।
কবি যেন ওদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ইঙ্গিত দিচ্ছেন মাত্র–
এখানে সবাই ধূসর আলোয় দিনের শেষে পান্থশালার আঙিনায় কাঁথা বিছিয়েছে; কেউ-বা একলা, কারও বা সঙ্গী ক্লান্ত; সামনে পথে কী আছে অন্ধকারে দেখা গেল না, পিছনের পথে কী ছিল কানে কানে বলাবলি করছে; বলতে বলতে কথা বেধে যায়, তার পরে চুপ করে থাকে।
.
সেই দু মাসের কাহিনী; জানুয়ারি ২৯ থেকে মার্চ ২৫।
২৯-১-৭১ ভুট্টো ঢাকা থেকে বিদায় নেবার সময় গুডবাই ফেয়ার-ওয়েল না বলে যে। ইচ্ছা প্রকাশ করলেন সেটাকে ফরাসিতে বলা হয় ও-রভোয়া অর্থাৎ আবার দেখা হবে। আরও বললেন, আমাদের ডিফিকালটিজ আছে বইকি। ২৩ বত্সরের সমস্যাগুলো তো তিন দিনে সমাধান করা যায় না। তাই বলে আলোচনার দ্বার তো বন্ধ হয়ে যায়নি। যখন প্রয়োজন হবে আমি আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাবার জন্য আবার আসব।
সাংবাদিক শুধোলেন, শেখ মুজিব যে এসেমব্লির তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারির জন্য প্রস্তাব করেছেন সে সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য কী? উত্তরে তিনি সোজাসুজি রামগঙ্গা কোনও কিছু না বলে (রিমেনড নন-কমিটল) মন্তব্য করলেন, অন্তত ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত যদি আমাদের সময় লাগে তবে তাতেও তো কোনও দোষ নেই।
এবং বললেন, সংবিধান বাবদে সবকিছু আগেভাগে ফৈসালা করে নিয়ে তার পর সংবিধান এসেমব্লিতে প্রবেশ করব তার তো কোনও প্রয়োজন নেই। এসেম্বলির বৈঠক চালু থাকাকালীনও ওই নিয়ে আলোচনা (নিগোসিয়েশন) চলতে পারে।
প্রশ্ন : আপনি কি এসেমব্লির বৈঠক-তারিখ পিছিয়ে দিতে চান?
উত্তর : না।
সাংবাদিকদের আরও বিস্তর প্রশ্নের বিস্তর উত্তর দিয়ে আরেকটি মোক্ষম কথা কইলেন রাজনীতিক ভুট্টো।
শেখ আমার দৃষ্টিবিন্দু বুঝতে পেরেছেন, আমিও তার দৃষ্টিবিন্দু বুঝতে পেরেছি।
ভুট্টো যে বুঝতে পেরেছিলেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ভুট্টো কেন, উভয় পাকের সবাই জানত শেখ এবং আওয়ামী লীগ কী চান, এবং আজও সেটা পড়ে শোনালে স্কুলবয়ও সেটা বুঝতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন, শেখ-তাজ-নজর কি বুঝতে পেরেছিলেন ভুট্টোর দৃষ্টিবিন্দু কী? কারণ পাকা পোকার জুয়াড়ির মতো তিনি তার তাস চেপে ধরে রেখেছিলেন তাঁর টাইয়ের উপর। আর সঙ্গে সঙ্গে ছয় দফার এটা-ওটা সেটার মূল তাৎপর্য কী, এটা মানলে ওটার সঙ্গে যে তার দ্বন্দ্ব বাধে, ওই যে আরেকটা, সেটা– সেটা কি পশ্চিম পাকের লোক মানবে ইত্যাদি ইত্যাদি দুনিয়ার কুল্লে হাবিজাবি প্রশ্নতে আনুষঙ্গিক যতপ্রকারের সেই সনাতন হাইপথেটিকাল মার্কা অবাস্তব আকাশকুসুম সওয়াল!
কিন্তু তিনি একবারের তরেও তার আপন দৃষ্টিবিন্দুর একটি মলিকুলও এক লহমার তরেও দেখতে দেননি। অন্য জনের বোঝা তো দূরের কথা। শেখের ঝানু ঝানু বিচক্ষণ জনেরা বার বার– যখনই ভুট্টো কোনও আপত্তি তুলেছেন তখনই ভালো করে আগাপাশতলা বুঝিয়ে দিয়ে শুধিয়েছেন, বার বার শুধিয়েছেন, আচ্ছা এতেও যদি আপনার মনে ধোকা থাকে, এটা গ্রহণ করতে যদি আপনার কোনও আপত্তি থাকে তবে আপনি বলুন আপনি কী চান, আপনার প্রস্তাব কী? আমাদের দু-দফা কাঠামোর ভিতর আমরা তো সর্বদাই রদবদল করতে প্রস্তুত আছি। নইলে আপনিই-বা এত তকলিফ বরদাস্ত করে আসবেন কেন এখানে আর আমরাই বা বসতে যাব কেন বৈঠকের পর বৈঠকে?
একদম হক কথা।
আওয়ামী লীগের দু-দফা কর্মসূচি কেনার তরে লারকানার তালুকমুলুক ডকে তুলতে হয় না এবং সেগুলো বোঝার জন্যে ধানমণ্ডির গুরুগৃহে প্রবেশকরতঃ চতুর্দশ বর্ষব্যাপী কঠোর আত্মসংযমসহ ব্রহ্মচর্য পালনও করতে হয় না।
আলোচনার সময় নিতান্ত কোণঠাসা হয়ে গেলে হরবকতই মি. ভুট্টোর পেটেন্ট উত্তর ছিল, হেঁ হেঁ হেঁ, বিলক্ষণ বিলক্ষণ! আমি দেশে ফিরে গিয়ে পার্টি মেম্বারদের সঙ্গে সলাপরামর্শ না করে পাকা উত্তর দি কী করে?
সেন্ট পিটারের স্বর্গ আর শয়তানের নরকের মধ্যিখানে ছিল একটি এজমালি পাঁচিল। চুক্তি ছিল পাচিল এ-বছর সারাবেন ইনি, ও-বছর সারাবেন শয়তান। ওই মাফিক পিটার তো সারালেন প্রথম বছর পাঁচিলটা তার পর এক বছর নেই নেই করে ঝাড়া তিনটি বছর শয়তানের আর দেখা নেই। পিটার তো শয়তানকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। শেষটায় হঠাৎ একদিন পথিমধ্যে উভয়ের কলিশন। পিটার তো শয়তানকে চেপে ধরলেন, পাকা কথা দাও, পাঁচিল মেরামত করবে কবে? শয়তান দণ্ডাধিককাল ঘাড় চুলকে শেষটায় বললে, তা-তা-তা আমি ঝটপট উত্তর দিই কী প্রকারে? আমি নরকে ফিরে যাই, আমার উকিলদের সঙ্গে পরামর্শ করি, তবেই না পাকা উত্তর দিতে পারি।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পিটার খেদোক্তি করলেন, ওইখানেই তো তুই ব্যাটা মেরেছিস আমাকে। সাকুল্যে সব-কটাই যে পেয়ে গেছিস তুই।
উকিলরা আমার ওপর গোস্সা করবেন না। আমি মুর্শিদমুখে যেভাবে আপ্তবাক্যটি শুনেছি হুবহু সেভাবেই নিবেদন করলুম। … ভুট্টো যদিও স্বয়ং উকিল তবু তারও তো একসপার্ট অপিনিয়নের দরকার। মুফরাস মরে গেলে থোড়াই আপন লাশ টানে।
কিন্তু মোদ্দাকথা এই যে ভুট্টো নানাবিধ কীর্তন গাইলেন, পূর্ব পাক-এর প্রতি অনেক অবিচার করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, নীতিগতভাবে আমি শেখের অধিকাংশ দফাই মেনে নিচ্ছি, বাদবাকিগুলো দেশে ফিরে গিয়ে আলোচনা করে ফের আসব। আমাদের সলাপরামর্শের দোর তো আর বন্ধ হয়ে যায়নি (নো ডেডলক!)। তাবৎ বাতের ফৈসালা করে ধোপদুরস্ত একটা রেডিমেড সংবিধান বাটন-হোলে না পরে যে সংবিধান-মনজিলে প্রবেশ করব না– এমন মাথার দিব্যি তো কেউ দেয়নি, এসেমব্লির বৈঠক চলাকালীনও তো লবি-তে আমরা বিস্তর কাঁচা কাপড় ইস্ত্রি করে নিতে পারব– রাধে মেয়ে কি চুল বাধে না- এসেমব্লির বৈঠক কবে শুরু হবে? সে তো এমন কোনও একটা বড় কথা নয়। হতে হতে ধর, এই ফেব্রুয়ারির আখের তকই যদি হয়ে যায় তাতেই-বা দোষ কী? –এগুলোর কতখানি আওয়ামী লীগের কর্তারা বিশ্বাস করেছিলেন? কারণ হয় মানতে হয়, তাঁরা ভুট্টোর ধূর্তামি ধরতে পেরেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী এমন সব কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিলেন যাতে করে ম্যাজিশিয়ান ভুট্টো শেষমুহূর্তে যেন তাঁর হ্যাট থেকে এমন কোনও মারাত্মক পিচেশ না বের করতে পারেন যার বিষ্ঠা নিক্ষেপে এসেমব্লি সংবিধান নির্মাণ, স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে ক্ষমতা হস্তান্তর সবকিছু রসাতলে যায়। নয় বিশ্বাস করতে হয়, জেনারেল কল-এর রোগনির্ণয়ই ঠিক : ইয়েহিয়া এবং মুজিব যখন ক্ষমতা হস্তান্তর সম্বন্ধে একমত হচ্ছিলেন তখন তাঁদের কেউই মি. ভুট্টোর নষ্টামি (মিসচিফ) করার দক্ষতাটা হিসাবে নেননি। বাংলাদেশের এক অতিশয় উচ্চপদস্থ ফৌজি অফিসারও আমাকে সংক্ষেপে বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন ইয়েহিয়া গোড়ার দিকে সত্যই গণতন্ত্র প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এই অফিসারও কল-এর মতো টিক্কা, পিরজাদা গয়রহ মিলিটারি হনুমানদের ব্যক্তিগতভাবে উত্তমরূপেই চেনেন।
এস্থলে আগামীকালের সন্দেহপিচেশ ঐতিহাসিক হয়তো বলবেন, ইয়েহিয়া মিলিটারির গণ্যমান্য ব্যক্তি। কল ও উপরে উল্লিখিত বাংলাদেশের ফৌজি অফিসার দু জনাই আর্মির লোক। তারা যে মিলিটারি রাষ্ট্রপতি ইয়েহিয়ার কলঙ্কভার যতখানি পারেন কমাতে চেষ্টা করবেন সেটাই তো স্বাভাবিক।
নিরপেক্ষ হরিপদ কেরানি তার স্বভাবজাত সরলতাসহ বলবে, পশ্চিমপাকের মিলিটারি কলঙ্কভার লাঘব করা কি আদৌ সম্ভব? হিটলারের ফৌজি জাদরেলরা বর্বরতায় ইয়েহিয়া ও তার পাষণ্ডদের তুলনায় দানো মলি শিশুখাদ্য। এবং তার পূর্বেকার, স্বনামধন্য না বলে স্বনির্বাচিত উপাধি ফিল্ড মার্শাল প্রাপ্ত। আইয়ুব যিনি মার্শাল ল চালিয়ে হলেন ফিল্ড মার্শাল, তিনি তো একটা আস্ত চোর। ক-কোটি টাকা জমিয়েছেন তার খোঁজ নিতে এক কাকের ভাই আরেক কাক ইয়েহিয়া কিছুতেই রাজি হল না। পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মি সম্বন্ধে যত কম কথা কওয়া যায় ততই বুদু পাঠান-বেলুচ সেপাইদের ভক্তি তাদের প্রতি বাড়বে।
এসব কেলেঙ্কারি ধূর্তামি ভণ্ডামির পাক কে ঘটতে চায় অথচ না ঘেঁটেও উপায় নেই। হিমালয়ের বর্ণনা দিতে হলে শুধু গৌরীশঙ্কর আর কাঞ্চনজঙ্র অভ্রংলিহ সৌন্দর্য বর্ণনা করলে চলে না, তার গভীর উপত্যকা এমনকি কন্টকাকীর্ণ গুহাগহ্বর খানাখন্দেরও বয়ান দিতে হয়।
এ দু মাসের বয়ান দফে দফে না দিলে কোনও বাঙলার পাঠকই সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন না, পূর্ব বাঙলার নেতারা ছাত্রসমাজ-বেঙ্গল রেজিমেন্ট-পাকিস্তান রাইফলস পুলিশ সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে চিন্তাশীলজন কতখানি ধৈর্য ধারণ করে অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হয়েছিলেন।
তাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে মৌলানা ভাসানীর মতো প্রাচীন তথা জনপ্রিয় নেতার সঙ্গে। এরা কোনওপ্রকারের ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে সরাসরি যা বলতেন তার সারার্থ এই, ১৯১৯/১৯২০ থেকে আমরা ধূর্ত ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়েছি কংগ্রেস-খিলাফতের সঙ্গে যোগ দিয়ে। সেই সময় থেকেই আমরা পরোক্ষভাবে পাঞ্জাবি সিন্ধি বেলুচ পাঠানকে চিনতে শিখেছি। আদর্শ এক হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু মহাসভার সঙ্গে আমাদের মতানৈক্য ঘটেছে, এদের এবং কমুনিস্টদের সঙ্গে কখনও দোস্তি কখনও-বা দুশমনি হয়েছে এবং সর্বশেষে চিনেছি, হাড়ে হাড়ে চিনেছি আইয়ুবের আমল থেকে পাঞ্জাবি মিলিটারি জুন্টাকে। এদের মতো পাজির পা-ঝাড়া হাড়েটক হা– জা ইহসংসারে নেই। এদের সঙ্গে কস্মিনকালেও জয়গুরু দিয়েও রফারফি করতে পারবে না। কষে প্যাদানো ছাড়া এদের জন্য অন্য কোনও ওষুধ নেই। এবং যত তুরন সেটা নির্মমতমভাবে প্রয়োগ করা যায় ততই মঙ্গল। খুদ পশ্চিম পাকেই সুপ্রচলিত প্রবাদ আছে, একই গুহায় তুমি যদি দৈবাৎ সঙ্গ পাও, এক ব্যাটা পাঞ্জাবি আর একটা গোখরোর, তবে ক্ষণতরে চিন্তা না করে প্রথম গলা কাটবে পাঞ্জাবিটার তার পর ধীরেসুস্থে মারবে গোখরোটাকে।
পাঠান্তর : গোখরোটাকে ছেড়ে দিলে দিতেও পার।
এবং লীগের মধ্যেই ছিল একদল ফায়ার-ইটিং ছাত্রছাত্রী যারা কালবিলম্ব না করে চেয়েছিল সম্মুখসগ্রাম। বিশেষ করে ছাত্রীদের যেন কেউ না ভোলে। গত সংগ্রামে স্বাধীনতার জন্য যে চরম মূল্য এরা দিয়েছে তার তুলনা পৃথিবীর সভ্য অসভ্য প্রাচীন অর্বাচীন কোনও দেশে কোনও সমাজে পাবেন না। একমাত্র তারাই এখনও শব্দার্থে রক্তবিন্দু ক্ষরিয়ে ক্ষরিয়ে সে মূল্য শোধ করে যাচ্ছে– লোকচক্ষুর অন্তরালে, নির্বাসনে কোন দানবের অশোকবনে–কীভাবে?
বন্ধন পীড়ন দুঃখ অসম্মান মাঝে ভয়াবহ অত্যাচারে জর্জরিতা জীবনূতাদের যেমন দিব্যদৃষ্ট দিয়ে দেখতে পেয়ে ব্যথিত কবিগুরু নির্দেশ দিচ্ছেন কী দিয়ে তারা চরম মূল্য শোধ করছে সে উত্তর আসছে কোথা থেকে :
শশ্মান থেকে মশান থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় হাহা করে উত্তর আসছে, আব্রু দিয়ে ইজ্জৎ দিয়ে ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়েও।
না, ইমান তাদের আছে। আর সবকিছু দিয়ে ইমান তারা বাঁচিয়েছে!
.
রক্ষী বনাম নর্তকী
বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায়, ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে যখন পূর্ব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে কী পদ্ধতিতে পার্লামেন্টকেন্দ্রিক গণতন্ত্র স্থাপিত হবে সেই নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল ওই সময় একদিন তিনটি বাজপাখি দুম দুম করে ঢুকল প্রেসিডেন্ট ইয়েহিয়ার খাস কামরায়। এই শিকরে পাখিগুলো পাকিস্তানি ফৌজের পয়লা কাতারের জাদরেলের পাল। লেফটেনেন্ট জেনারেল পিরজাদা, কার্যত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, লেফটেনেন্ট জেনারেল গুল হাসান এবং মেজর জেনারেল আকবর খান। টেবিল থাবড়াতে থাবড়াতে তারা দাবি জানালেন, ৩ মার্চ ১৯৭১ সালে ইয়েহিয়া যে ঘোষণা দ্বারা ঢাকাতে পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন সেটা অ-নির্দিষ্ট কালের অন্য মুলতুবি করে দিতে হবে।
লিখেছেন জেনারেল কল জুলাই ১৯৭১ সালে তাঁর কনটেশন উইদ পাকিস্তান পুস্তকে।
এবং এর পর কল যে মন্তব্যটি করেছেন, পাকিস্তানের পঁচিশ বৎসরের ইতিহাসে সেইটে সবচেয়ে গুরুত্বব্যঞ্জক ভাগ্য পরিবর্তন নিয়ে।
এবং তিনটে শিকরেই ইয়েহিয়াকে বাধ্য করালে পুব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কণ্ঠবোধ করার জন্য কঠোরতম ব্যবস্থা মেনে নিতে।
নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে ওই দিনই।
আকাশ বিদ্যুৎ বহ্নি
অভিশাপ গেল লেখি—
ওই দিনই মিলিটারি জুন্টা স্থির করলেন পুব বাংলাকে এমনই একটা শিক্ষা দিতে হবে, যে শিক্ষা আত্তিলা, চেঙ্গিস, নাদির, এ যুগে হিটলার কেউই কখনও বাংলার যে কটা মানুষের নামে পশু বেঁচে থাকবে তারা যেন এক হাজার বৎসরের ভিতর মাথা তুলে খাড়া না হতে পারে। কারণ, জুন্টার মুনিব বলুন, চাকর বলুন, শিখণ্ডী বলুন মি. ভুট্টো একাধিকবার বলেছেন, তিনি এক হাজার বত্সর ধরে ভারতের সঙ্গে লড়াই করে যাবেন। কিন্তু ওই পুব বাংলাটার কোনওপ্রকারের রাজনৈতিক অস্তিত্ব যদি বজায় থাকে তবে বাঙালরা নিশ্চয়ই সেই ভারত বিজয়ে বাধা দেবে বিশেষ করে তাদের ছ-দফা দাবি নামঞ্জুর করার পর।
এ স্থলে ভবিষ্যঙ্কালের ঐতিহাসিক প্রশ্ন তুলবেন, বাংলাদেশের সর্বনাশ সাধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কি একমাত্র মিলিটারি জুন্টাই দায়ী?
আপাতদৃষ্টিতে আশ্চর্যজনক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু একথা তবুও সত্য যে বাংলাদেশের সাধারণজন আজ আর এসব বিষয়ে বিশেষ কৌতূহলী নয়। এটা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আমার ইতালির তথা জর্মন বন্ধুদের বিস্তর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ডিকটেটরদ্বয় সম্বন্ধে খবর বের করতে হয়। ওরা কেটে যাওয়া দুঃস্বপ্নের প্রসঙ্গ তুলতে চাইত না। তবু বাংলাদেশের খবরের কাগজ মাঝে মাঝে যেসব রহস্য পশ্চিম পাকে উদ্ঘাটিত হচ্ছে তার খবর দেয়।
জেনারেল কল প্রভৃতি বিশেষজ্ঞরা যে প্রকৃত সত্যের অনেকখানি সন্ধান দেবেন এ তো জানা কথা, কিন্তু যখন কোনও নর্তকীও নিতান্ত বাধ্য হয়ে নিঃস্বার্থ সেসব সত্যের সমর্থন জানায় তখন সত্য নিরূপণ অনেকখানি সহজ ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে যায়।
গত ১৫/২০ বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সরকারি-বেসরকারি নেতারা এমনই বর্বর পশ্বাচারে লিপ্ত থাকাকালীন দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন যে সেসব পুরীষাবর্তের নিকটবর্তী হতে কোনও ঐতিহাসিক বা সত্যান্বেষীজন সহজে রাজি হবেন না। পৃথিবীর ইতিহাসে নারীজাতি অনেক ক্ষেত্রেই যবনিকান্তরালে শিবাশিব রাজনৈতিক কর্ম সমাধান করেছেন। তাঁদের মধ্যে মাদাম পাদুর, লোলা মনতে (জ) বিদগ্ধা রোমান্টিক রমণী। এঁদের ললাটে পঙ্কতিলকের লাঞ্জন আছে বটে কিন্তু সেখানে অশ্লীলতার নোংরামি নগণ্য। এঁদের বুদ্ধিমত্তা রাজনৈতিক মতবাদ পর্যবেক্ষণ করে ঐতিহাসিক অনেক ক্ষেত্রেই উপকৃত হন ও শুষ্ক ইতিহাস কিঞ্চিৎ সরস হয়ে ওঠে।
কিন্তু পশ্চিম পাকে নিছক নোংরামি। তাই সংক্ষেপে সারছি।
ইয়েহিয়া সিপাহসালার, প্রেসিডেন্ট হওয়ার বহু আগের থেকেই নর্তকী আকলিম আখতরকে রক্ষিতারূপে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে তিনি বেসরকারি জেনারেল উপাধি দেন ও তিনি সুবে সিন্ধু পাঞ্জাবে জেনারেল রানি রূপে সুপরিচিতা ছিলেন। সম্প্রতি লাহোরের শব্দার্থে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। কিন্তু অল্প পরেই লাহোরের দায়রা জজ তার জামিন মঞ্জুর করেছেন মি. ভুট্টোর শাসন যে নিরন্ধ্র নয় একথাটা এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর নয়। আখতর সাংবাদিকদের বলেন, ইয়েহিয়ার উত্থান-পতন সম্বন্ধে একখানি পুস্তক রচনা করার জন্য তিনি এক প্রকাশকের সঙ্গে মৌখিক চুক্তি করছেন; তিনি সে পুস্তকে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রকৃত কারণ উল্লেখ করবেন। তিনি আরও বলেন দ্বিখণ্ডিত হওয়ার জন্য সামরিক জুন্টারাই একমাত্র দায়ী নয়, এর পিছনে বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কতিপয় ব্যক্তির ষড়যন্ত্র আছে; তার কাছে এ ষড়যন্ত্রের প্রমাণ আছে।
প্রেসিডেন্ট ভুট্টো সম্বন্ধে মন্তব্য উহ্য রেখে তিনি বলেন, তাঁকে গ্রেফতার করার প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, সর্বোচ্চ সরকারি ক্ষমতায় আসীন কয়েকজনের আতঙ্ক ও ভয়ের জন্যই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কারণ তারা মনে করেন, তার কাছে তাদের অপকীর্তি ও গোপন কার্যকলাপের এমন সব তথ্য-প্রমাণ ও ছবি আছে যা প্রকাশিত হলে তাঁদের সুনাম নষ্ট হবে এবং দেশে তাদের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটিত হবে।
উপসংহারে তিনি বলেন, কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি যে, আমি তা প্রকাশ করব না। কারণ, তা প্রকাশিত হলে দেশের সম্মান বলতে আর কিছুই থাকবে না।
এর পর মহিলাটি– আমি ইচ্ছে করেই মহিলা বলছি, কারণ পাকিস্তানের অতিশয় অল্প দ্র পুরুষও এ তত্ত্ব বলতে সাহস ধরেন, যা এ নর্তকী বলেছে—
এমনিতেই দেশের সম্মানের আজ যা অবনতি ঘটেছে তাই যথেষ্ট।
.
মি. ভুট্টো যে বেইমানি করেছিলেন তার ফল পরে শাপেবর হয়েছিল। বাংলাদেশ দু-শো বছর পর পুনরায় স্বাধীন হল। কিন্তু সে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য তার যে রক্তক্ষয় হল আব্রু দিয়ে ইজ্জত দিয়ে কোনও গতিকে ইমান বাঁচাল তারা, তার জন্য দায়ী কে? সে অনুসন্ধান আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে করতেই হবে। আমি মনে করি এটা আমার কর্তব্য। পাঠক যদি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তবে আমি নাচার। আমি আমার আইষমানকে চাই-ই চাই!
মি. ভুট্টো বিলক্ষণ অবগত ছিলেন বাংলাদেশে পশ্চিম পাকের শোচনীয় পরাজয়ের জন্য তার আপন দেশের লোক একদিন তাকে দায়ী করবে। বিশেষ করে এই কারণে যে, ডিসেম্বর ১৯৭০-এর গণনির্বাচনে তিনি পশ্চিম পাকে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়ার গৌরবে দু হাত দিয়ে কিং কং-এর মতো সর্বত্র বুক দাবড়ে প্রচার করে বেড়াচ্ছিলেন, তিনি তাবৎ পশ্চিম পাকের প্রতিভূ ফরাসি রাজার মতো লে সে মোওয়া, (আমি যা, রাষ্ট্রও তা), পুব বাংলায় পরাজয়ের পর তিনি হঠাৎ করে চটসে পালাবেন কী করে? তাই তিনি স্থির করলেন, এখন আমি প্রেসিডেন্ট, এই বেলা একটা অনুসন্ধান কমিটি বসিয়ে আমি সর্বদোষ চাপাব ইয়েহিয়ার স্কন্ধে। দরকার হলে মিলিটারি জুন্টাকেও তার সঙ্গে জড়াব।
সতেরো বছরের স্বৈরাচারের পর দিনকে রাত, রাতকে দিন করা সবকিছুই সম্ভব। কিন্তু সতেরো বছর বলি কেন? পাকিস্তানের জন্মদিন থেকেই তো স্বৈরতন্ত্র। কু-ইদ-ই আজম মুহম্মদ আলি ভাই ঝিভাড়াই (জিন্নাহ) পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তিনি ছিলেন সর্বত্র বিরাজমান, সর্বশক্তির আধার। তার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইংরেজ ক্যামবেল-জনসন বলেছেন, এখানে, এইখানে পশ্য, পশ্য, পাকিস্তানের রাজাধিরাজ ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ একাধারে পার্লামেন্টের সভাপতি তথা প্রধানমন্ত্রী সর্ব ভিন্ন ভিন্ন সত্তা এক কেন্দ্রে সম্মিলিত করে বিরাটকার এই কাইদ-ই-আজম। Here indeed is Pakistans King Emperor, Archbishop of Canterbury, Speaker and Prime Minister concentrated into one formidable Quaid-i-Azam. পাকিস্তানের জন্মকালে ও মরহুম জিন্নার জীবিতাবস্থায় কোনওপ্রকারের পার্লামেন্ট বিরোধী দল ছিল না, থাকলে অতি অবশ্যই তিনি আরও বড় নেতা হতেন।
সেই শুভ ঐতিহ্যের গোড়াপত্তন থেকে সর্ব-মরহুম কি লিয়াকত আলী, কি ইসকনদার মির্জা সবাই ছিলেন এক-একটি চোটা হিটলার। এমনকি আইয়ুবের ন্যাজ, পূর্ব পাকের গবর্নর মোনায়েম খান পর্যন্ত সার্কাসের ক্লাউনের মতো মনিবের কীর্তিকলাপের ভডং করে যেতেন রাত দুটো-তিনটে অবধি তাঁর ছিল অনিন্দ্রা রোগ। আশ্চর্য! দুই প্রত্যন্ত– একসট্রিম কী জানি কী করে দোহাদুহু হয়ে যায়– হিটলারের ছিল ইনসমনিয়া, দু জনারই ছিল মদ্যে অনীহা।
এদের তুলনায় ভুট্টো কম যান কিসে?
বস্তুত তিনি প্রথম রাউন্ড তারই আদেশমতো করিয়ে নিয়েছেন। পূর্বোক্ত কমিশন আগস্টের মাঝামাঝি নির্দেশ দিয়েছেন– অবশ্য প্রভু ভুট্টোর অনুমোদন সাপেক্ষে ইয়েহিয়াকে আসামিরূপে মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের সমুখে দাঁড়াতে হবে।
মিলিটারি ট্রাইবুনালের কাজকারবার হয় সাতিশয় গোপনে। জনসমাজে যেটুকু মি. ভুট্টোর ফেবারে যায় মাত্র ওইটুকুই প্রকাশ পাবে।
কিন্তু ভয় নেই পাঠক, আমরা আখেরে সবকিছুই জানতে পাব। মূল তত্ত্বগুলো নিশ্চয়ই বহুকাল ধরে জানি। অবশ্য নর্তকী জানেন অনেক বেশি।
.
মুজিব আউট!
ভুট্টোর স্বগতোক্তি
যেথা যাই সকলেই
বলে, ‘রাজা হবে?’
‘রাজা হবে?’– এ বড়ো
আশ্চর্য কাণ্ড। একা
বসে থাকি, তবু শুনি
কে যেন বলিছে–
রাজা হবে? রাজা হবে?
দুই কানে যেন
বাসা করিয়াছে দুই
টিয়ে পাখি, এক
বুলি জানে শুধু–
রাজা হবে। রাজা হবে।
সেই ভালো বাপু, তাই হব।
কবিগুরুর বিসর্জন থেকে। হ্যাঁ, বিসর্জন বইকি? এর তিনপক্ষ পরেই আইনানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান সরকার বিসর্জন দিল সর্ব আইন, জলাঞ্জলি দিল সর্ব ধর্মাচার, ন্যায়বিচার।
এস্থলে অবশ্য দুটি নিরীহ টিয়ে নয়। এখানে তিনটে ঘৃণ্য গৃধ্র– পিরজাদা, গুল আর আকবর। তাঁরা ভুট্টোকে বললেন, তুমিই রাজা হবে।
এই ‘ই’টার অর্থ কী?
অর্থ এই : ইয়েহিয়া যখন সবরকমের রাজনৈতিক ক্ষমতা মুজিবকে হাতে তুলে দেবেন বলে স্থির করেছিলেন তার বিগলিতাৰ্থ এই, তিনি ডিকটেটর রূপে অখণ্ড ক্ষমতার অধিকারী হয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করতে চান না। তিনি চান সুন্দুমাত্র দুটি জিনিস– মদ্য এবং মৈথুন। এবং পাকেচক্রে নিতান্তই যখন ডিকটেটর হয়েই গিয়েছেন তখন অন্ততপক্ষে তিনি প্রেসিডেন্টরূপে বিরাজ করতে চাইবেন বইকি। কিন্তু ক্ষমতালোভী যখন নন তখন রাষ্ট্রচালনার ভার মুজিবকে দেওয়া যা তোমাকে দেওয়াও তা।
অতএব তুমিই রাজা হবে।
জেনারেল কল-এর ভাষ্যে যারা বিশ্বাস করেন তারা স্বচ্ছন্দে মেনে নিতে পারেন যে উপরের সবকটি যুক্তিই দ্ব্যর্থহীন সত্য। বাদশাহ জাহাঁগির একাধিকবার বলেছেন, আমার কয়েক পাত্র মদ্য আর রুটি-মাংস মিললেই ব্যস– রাজত্ব চালান না মহারানি নূরজঁহা। বিস্তরে বিস্তরে এ হেন দৃষ্টান্ত আছে। বস্তুত আমি জনৈক পাকিস্তানির মুখে শুনেছি, ১৯৬৮-৬৯-এর আইয়ুব যখন যমের (আজরাইলের সঙ্গে যুঝছেন তখন জাদরেলকুল ইয়েহিয়ার সমুখে প্রস্তাব করেন, তিনি যেন তদ্দশ্যেই রাজ্যভার গ্রহণ করেন, পাছে আইয়ুব হঠাৎ গত হলে কোনও সিভিলিয়ান না প্রেসিডেন্ট হয়ে পুনরায় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে মিলিটারি শাসনের অবসান ঘটায়, তখন ইয়েহিয়া স্রেফ কবুল জবাব দেন। … তাই বলে পাঠক অবশ্য অন্য একসট্রিমে গিয়ে ভাববেন না যে রাষ্ট্রপতি হওয়ার লোভ তাঁর আদৌ ছিল না। নিশ্চয়ই ছিল। আর কিছু না হোক, ওই পদে অধিষ্ঠিত হলে তাঁর যে দুটো জিনিসে শখ সেগুলো তিনি নির্ভাবনায় পর্যাপ্ত পরিমাণে আমৃত্যু উপভোগ করতে পারবেন।
১১/১২ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো পিণ্ডিতে উড়ে এসে ইয়েহিয়ার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা ধরে দীর্ঘ আলোচনা করেন। বিবেচনা করি তাকে বোঝাবার শেষ চেষ্টা দিলেন মুজিবকে তার প্রস্তাবমতো সবকিছু যদি দিয়ে দাও তবে তোমার, আমার, পাকিস্তানের সর্বনাশ হবে। খুব সম্ভব এ প্রস্তাবও করেছিলেন, টালবাহানা দিয়ে অ্যাসেমব্লিটা অন্তত মুলতুবি রাখ।
অনুমান করা যেতে পারে ইয়েহিয়া তখন ভুট্টোকে কোনও পাকা কথা দেননি।
ভুট্টো নিশ্চয় তখন তাঁর নিষ্ফলতার কাহিনী মিলিটারি জুন্টার পিরজাদা, গুল ইত্যাদিকে বলেছিলেন।
১৩.২.৭২- ইয়েহিয়া ঘোষণা করলেন, ৩ মার্চ অ্যাসেমব্লির অধিবেশন হবে। সরকারি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি বেরুল,
The President, General A.M. Yahya Khan, has been pleased to summon the National Assembly of Pakistan to meet on Wednesday, March 3, 1971, at 9 a.m. in the Provincial Assembly Building, Dacca, for the purpose of forming a Constitution for Pakistan.
অনুমান করি ওইদিনই জুন্টা গিয়ে থাবড়ালেন ইয়েহিয়ার টেবিল! দাবি করলেন অনির্দিষ্টকালের জন্য অ্যাসেমব্লি মুলতুবি রাখতে হবে। ইয়েহিয়াকে সম্মতি দিতে হল বাধ্য হয়ে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তো ঝটপট সে মত পরিবর্তন আরেকটা গেজেট একস্ট্রা-অরডিনারিতে রাতারাতি প্রকাশ করতে পারে না। তাই সে কর্ম করা হল ঠিক এক পক্ষ পরে।
সেইদিনই বিজয়গর্বে উফুল্ল জুন্টা মি. ভুট্টোকে জানালেন,
তুমি রাজা হবে।
অর্থাৎ মুজিব আর লীগের নেতাদের জেলে পুরব। লীগ পার্টিকে বে-আইনি বলে ঘোষণা করার ফলে তোমার পাটিই হবে সংখ্যাগুরু। তুমিই হবে প্রধানমন্ত্রী।
ভুট্টো উল্লাসে নৃত্য করতে করতে ফ্লাই করলেন পেশোয়ারবাগে। এবারে পশ্চিম পাকের বাকি পার্টিগুলোকে বশে আনা যাবে অতি সহজে। তাঁর কেবিনেটে তিনি নেবেন অন্য পার্টি থেকে কিছু মন্ত্রী, উপমন্ত্রী গয়রহ, গয়রহ। সেই প্রলোভনই যথেষ্ট।
১৩.২.৭১–১৪.২.৭১ টেবিল থাবড়ানোর দিন সন্ধেবেলা পেশওয়ারের বিশ্ববিদ্যালয় নগরীর এক বাঙলোতে বসল জমজমাট আঁদরেল ককটেল পার্টি। তিনি যে অখণ্ড পাকিস্তানের রাজা হতে চললেন সে সুসমাচার তিনি কি অত সহজে চেপে যাবেন– অতি অবশ্যই দু চারজন অন্তরঙ্গ বন্ধুকে সে আনন্দের হিস্যেদার করেছিলেন। কিন্তু অল্পে সুখ কোথায়? সুখ। ভূমাতে। ইতোমধ্যে পিপলস পার্টির রাজা হয়ে গিয়েছেন ককটেল পার্টির রাজা। পাকিস্তানের পলিটিক্যাল পার্টি এবং ককটেল পার্টিতে অবশ্য কোনওকালেই বিশেষ কোনও পার্থক্য ছিল না এমন উপবাসের মাস রমজানের দিনে (!), লাঞ্চ পার্টিতেও না।
প্রখ্যাত সাংবাদিক এন্টনি বলেছেন, গেলাস– পাঠক, নিম্বুপানির গেলাস ভেবে আপন কল্পনাশক্তিকে বিড়ম্বিত কর না–হাতে করে সে ককটেল পার্টির চক্রবর্তী হবু রাজা মি. ভুট্টো রসে নিমজ্জ সর্বজনকে ইলেকট্রিফাই করলেন মাত্র কয়েকটি ঐতিহাসিক লবজো মারফত ভুট্টো আবার ঘোড়ার জিনে সোয়ার। এ ঘটনা ঘটল যারা শক্তিধর তাদেরই মীমাংসা দ্বারা। মুজিব আউট (মুজিব ইজ আউট!)! আমি প্রধানমন্ত্রী হব।
মুজিব আউট! লেগ বিফোর উইকেট? সেইটেই তো ধাপ্পার হেডাপিস। ইয়েস, অ্যান্ড নো। টসে (গণনির্বাচনে জিতেছিলেন লীগের ক্যাপটেন শেখজি। তিনিই ওপনিং ব্যাটসমেন। কী এ ক্রিকেট খেলাতে কুদরতে কী খেল! ফার্স্ট ইনিংসে নামবার পূর্বে পেভিলিয়নে যখন শেখ লেগিং পরছেন তখনই তিনি লেগ বিফোর উইকেট, ইন দি পেভিলিয়ন।
বাকি খেলোয়াড়দের যে কটিকে আমপারার–বুচারের দু আঁসলা বেটা টিক্কা পাকড়াতে পেরেছিলেন তাদের নিয়ে সেই টিক্কা-এলেভন হানড্রেড-হানড্রেডের ব্লাডি ইনিংস-এ আমরা এখনও পৌঁছইনি।
.
অখণ্ড পাকের চাঁই/ ভুট্টো বিনে কেউ নেই
প্রেসিডেন্ট ইয়েহিয়া, জুন্টা আর ভুট্টোতে ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এর মাঝামাঝি থেকে আর কোনও মতভেদ রইল না– ভুট্টো সামলাবেন সিভিলিয়ান দিক অর্থাৎ পশ্চিম পাকের যে-কটা রাজনৈতিক দল আছে তার যে কজন লিডারকে তিনি পারেন আপন দলে টানবেন, প্রলোভন দেখিয়ে।
পলিটিশিয়ান আর স্টেটমেনে তফাত কী? পলিটিশিয়ান জনগণকে একত্র করে পার্টি বানিয়ে তাদের চালায় আর স্টেটসম্যান সেই ব্যক্তি যে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের ভিন্ন ভিন্ন পলিটিশিয়ানকে একজোট করে রাষ্ট্র নির্মাণকর্মে অগ্রসর হয়। কাষ্ঠরসিকরা বলেন, পলিটিশিয়ান ম্যাস (জনগণকে) বুদ্ধ বানায় আর স্টেটসম্যান পলিটিশিয়ানদের বুদ্ধ বানায়।
এইবারে পলিটিশিয়ান ভুট্টো পরলেন স্টেটসম্যানের মুখোশ। সেটা যে কতখানি বেমানান বদখদ বেঢপ হল সেটা জানেন মি. ভুট্টো সবচেয়ে বেশি। যাঁকে পশ্চিম পাকের জনগণ ডিকটেটর আইয়ুবের ডেমোক্রাটিক ন্যাজ খেতাব বহু পূর্বেই দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছে, যাঁর কাজ– পূর্বেই উল্লেখ করেছি, দীর্ঘ আঠারো মাস ধরে ছিল পর্দার আড়ালে গুঁড়িগুড়ি হামাগুড়ি দিতে দিতে একে ভজা ওকে প্যার করা, মাঝে মাঝে চিত্রিতা গর্দভীর ন্যায় ক্ষণতরে আত্মপ্রকাশ করা, সে রাতারাতি পেয়ে গেল ডবল প্রমোশন (এদানির ঢাকার অটোপ্রমোশনের চেয়ে দু কাঠি সরেস); পলিটিশিয়ান না হয়েই সরাসরি স্টেটসমেন!
দিগ্বিজয়ে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গেই পয়লা মনজিলেই খেলেন পয়লা থাপ্পড়।
প্যাভিলিয়নে বসেই মুজিব এলবি ডাবলু হওয়ার ইলেকট্রিক শকসন্দেশ দেওয়ার পরদিন বীর ভুট্টা গেলেন ফ্রন্টিয়ার নেতা খান ওয়ালি খানের কাছে। তাঁকে খবর দিলেন, পাকিস্তান টাট্টুর পিঠে ভুট্টো আসওয়ার। এসো, ভাই, দুই বেরাদরে মিলে লঙ্কাটা ভাগ করে নিই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝাণ্ডু সিন্ধু-পাণ্ডা ভুট্টো পোশতুভাষীর সঙ্গে কুস্তি লড়লেন জুডোর সর্ব প্যাঁচ চালিয়ে কিন্তু ওয়ালি খালি এক কথা বলে না। পলিটিকস ব্যাপারটা ধোয়া তুলসীপাতা নয় সে তত্ত্বটা পেশাওয়ারেও অজানা নয়, কিন্তু এতখানি হীন হবার মতো পাঠান ওয়ালি খান নন। শেষটায় ভুট্টো সঙ্গোপনে ওয়ালিকে জানালেন, এসেমব্লি অধিবেশনে আমি ঢাকা যাব না। আমার এ সিদ্ধান্ত আমার পার্টি মেম্বাররা পর্যন্ত জানে না। এটা ১৪ ফেব্রুয়ারির কথা।
তার পরদিন ১৫/২-এ সর্বজনসমক্ষে বম ফাটালেন মি. ভুট্টো ভাবার্থে। এরই ফলে ঠিক চল্লিশ দিন পরে হাজার হাজার বম ফাটল ঢাকাতে সশব্দে, শব্দার্থে রাত এগারোটায়। এ বমটা তিনি কেন ফাটালেন, কার নির্দেশে ফাটালেন তার আলোচনা হবে ১ মার্চের পরিপ্রেক্ষিতে, যেদিন ইয়েহিয়া জুন্টার আদেশমাফিক ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবি করে দিলেন।
পনেরো তারিখের তাঁর সেই দীর্ঘ বিবৃতি এতই পরস্পরবিরোধী, দ্ব্যর্থসূচক, ঝাপসা এবং ইংরেজিতে যাকে বলে বিটিং এবাউট দি বুশ যে তার সারমর্ম দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। এতে আমার লজ্জিত হওয়া উচিত, কিন্তু যখন দেখি, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (এর কার্যকলাপ পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিল বেশি) নসরুল্লা খান, মি. ভুট্টোর বম মারার দু দিন পর নিম্নের বিবৃতিটি দিচ্ছেন তখন মন সান্তনা মানে :
মি. ভুট্টোর পরিষদ বয়কট করার সিদ্ধান্ত যে গণতন্ত্রবিরোধী সে মন্তব্য করার পর খান সাহেব বলেছেন : মি. ভুট্টোর পরিষদ বয়কট করার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যতে (এর ফলস্বরূপ– লেখক) কী হবে সে সম্বন্ধে কোনওকিছু একটা বলা শক্ত। কারণ পিপলস পার্টির চেয়ারম্যানের স্বভাবই হচ্ছে অতিশয় দ্রুতবেগে তাঁর মল্লভূমি পরিবর্তন করা (চেনজিং হিজ স্ট্যান্ডস উইদ গ্রেট রেপিডিটি)। মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি বলেছিলেন যে, পরিষদ অধিবেশনে সভা মধ্যে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন।
পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে আমরা ২ সেপ্টেম্বরের দেশ পত্রিকায় মি. ভুট্টোর একটি বিবৃতি থেকে তার সারাংশ উদ্ধৃত করি। তিনি তখন (১৯.১.৭১) বলেছিলেন, ইট ইজ নট নেসারারি টু এনটার ইনটু দি কনসটিচুয়েন্ট এসেম্বব্লি উইদ অ্যান এগ্রিমেন্ট অন ডিফারেন্ট ইস্যুজ বিকজ নিগোসিয়েশন কুড কন্টিন ইভন হোয়েন দি হাউজ ইজ ইন সেশন।
তা হলে এক পক্ষকাল সময় যেতে না যেতে আজ (১৫.২.৭১) হঠাৎ ভুট্টোজি এ বোমাটা ফাটালেন কেন?– যে, আমার সঙ্গে আগেভাগে সমঝোতা না করলে আমরা এসেম্বব্লি করতে ঢাকা যাব না।
ঠিক এই প্রশ্নটিই শুধোলেন নসরুল্লার সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টো-বিবৃতি পাঠমাত্র পশ্চিম পাকের নেতা সলাহ উদ্দিন খান, ভুট্টো এসেমব্লি বয়কটের ঘোষণা করার জন্য যে সময়টা বেছে নিলেন সেটা ভারি হেঁয়ালিভরা (ভেরি ইনট্রিগিং)। তিনি ঢাকাতে যখন শেখ মুজিবের সঙ্গে দফে দফে চুলচেরা (থ্রেডবেয়ার) আলোচনা করেছিলেন তখনই তো শেখের মতিগতি তিনি অতি অবশ্যই বুঝে নিয়েছিলেন। কারণ শেখ তো তখন তাঁর সাকুল্যে তাস টেবিলের উপর রেখে সর্বসংশয় নিরসন করেছিলেন।
এটা তো প্রহেলিকা (ব্যাফলিং) যে, মি. ভুট্টো সেই সময়ই তার আপন মনের গতি বুঝিয়ে বলেননি কেন?
এই এক পক্ষকাল মধ্যে তো আওয়ামী লীগ তার প্রোগ্রামে কণামাত্র রদবদল, কাটাই-ছাঁটাই, ডলাই-মলাই কিছুই করেননি তবে কেন আজ মন্থরার মুখে যেন নবান্নের বিনে-ধানের খই ফুটতে আরম্ভ করল?
কিছু না। সেই টেবিল-থাবড়ানোর ফলশ্রুতি যেন জুন্টা কর্তৃক মি. ভুট্টোর পিঠ থাবড়ানোর শামিল। যেন পিতামহ ভীষ্ম শঙ্খধ্বনি ফুকলেন–দুর্যোধনের মন থেকে সর্ব দ্বিধা অন্তর্ধান করেছে– কারণ সৈন্য পর্যাপ্ত, কারই-বা অপর্যাপ্ত, কে নেয় তার খবর!
.
জনাব ভুট্টোর বক্তব্য এতই দীর্ঘ যে, যে ছেলে তার প্রেসি লিখতে পারবে সে হেসে খেলে বিএ, এমএ-তে ফাস্ট হবে। সংক্ষেপে যতখানি পারি তারই নিষ্ফল চেষ্টা দেব। না করে উপায় নেই। কারণ হিটলারের মতো মি. ভুট্টো ইতিহাসের বিচার-সিদ্ধান্তে বিশ্বাস করেন। মি. ভুট্টোর কেতাবে আছে– একদা শেখ মুজিব আমাকে হুঁশিয়ার করে বলেন, আমি যেন মিলিটারিকে বিশ্বাস না করি। শেখ বলেন, মিলিটারি যদি তাকে (মুজিবকে) প্রথম বিনষ্ট করে তবে আমাকেও তারা বিনষ্ট করবে।* আমি বললাম, মিলিটারি বরঞ্চ আমাকে বিনষ্ট করে করুক, কিন্তু ইতিহাসের হাতে আমি বিনষ্ট হতে চাইনে।
[*১২.১২.৭১ নাগাদ শ্রীভুট্টো আমেরিকায় নিরাপত্তা পরিষদে বক্তৃতা দেন। ইয়েহিয়া তাকে আমেরিকা পাঠাবার পূর্বে হুকুম দিয়েছিলেন তিনি যেন ফেরার পথে প্লেনে করে প্রথম কাবুল আসেন। সেখান থেকে মোটরে করে পেশাওয়ার। ইয়েহিয়ার প্ল্যান ছিল পথমধ্যে ভুট্টোকে গুমখুন করা, কারণ ইয়েহিয়ার সিংহাসন তখন টলমল। তিনি বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হয়েছিলেন, দেশে ফিরে ভুট্টো তাকে আসন থেকে সরাবেন।… কিন্তু ভুট্টোকে ডেকে নিয়ে নিকসন তাঁকে বলেন, ইয়েহিয়াকে দিয়ে আর কিছু হবে না। তিনি (নিকসন) হুকুম দিয়েছেন, ইয়েহিয়া যেন বিনাবাধায় ভুট্টোকে আসন ছেড়ে দেন। ভুট্টো তাই সরাসরি করাচি পৌঁছন। যারা ভুট্টোর মহানুভবতায় পঞ্চমুখ তারা শুনে বেজার হবেন, নিকনের হুকুম মাফিক মি. ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেন।]
উপস্থিত তিনি যতখানি পারেন ইতিহাস বিনষ্ট করছেন। অন্তত বিকৃত করছেন তাঁর আপন তবেতে নিরপেক্ষ কমিশন বসিয়ে। এ কর্মে তিনি বুচার অব বেঙ্গল-এর পরিপূর্ণ সহায়তা পাবেন। তিনি এখন পাকিস্তানের জঙ্গিলাট। কু-লোকে বলে, যে টিক্কা প্রভু ইয়েহিয়ার আদেশে বাংলাদেশ দহন-ধর্ষণ করলেন তাকে খাস করে জঙ্গিলাট বানালেন মি. ভুট্টো, ওকিবহাল টিক্কা এস্-প্রভুর সর্বাঙ্গে যেন উত্তমরূপে কর্দম লেপন করতে পারেন।
তা তারা ইতিহাস নিয়ে যা খুশি করুন, প্রামাণিক সমসাময়িক ইতিহাস বলেন :
( ) মুজিব আমার সঙ্গে সমঝোতা না করলে আমার পার্টি ঢাকা যাবে না।
সাংবাদিকের প্রশ্ন : আপনি কি তবে এসেমব্লি বয়কট করছেন?
ভুট্টো : (দৃঢ়কণ্ঠে) না।
এ ঘটনার আট মাস পরে মি. ভুট্টো অক্টোবর ১৯৭১-এ আপন পুস্তিকা দি গ্রেট ট্রাডেজিতে লিখেছেন, তিনি এসেমব্লিতে যাবার পূর্বে যে শর্ত দিয়েছেন সেটা না মানা হলে তিনি ঢাকা যাবেন না, জানালে পর, হুয়েন আস্কড বাই করেসপনডেনটস হুয়েদার পিপলস পার্টি উয়োজ বয়কটিং দি এসেমব্লি আই কেটেগরিক্যালি ডিনাইড ইট।*[* দি গ্রেট ট্র্যাজেডি, পৃ. ২৮।]
পাঠক চিন্তা করে নিজেই মনস্থির করে নিন, এটাকে বয়কট না করলে বয়কট বলে কাকে?
এ তথ্য কি বলার প্রয়োজন আছে যে পূর্ব-পশ্চিম উভয় পাকের রাজনীতিক নেতারা মি. ভুট্টোর দোস্ত-দুশমন দুই-ই ভুট্টোর এই আচরণকে বয়কট নাম দেন, কেউ কেউ এটাকে ব্ল্যাকমেলও বলেন।
কট্টর মুসলিম অখণ্ড পাকিস্তান বিশ্বাসী জমাৎ-ই-ইসলামীর আমির (খলিফা) মৌলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদি কড়া ভাষায় ভুট্টোর এই মনোভাবকে অসঙ্গত আচরণ বলে নিন্দা করেন। এমনকি এসেমব্লির বাইরে ভুট্টো-মুজিবে সংবিধান বাবদে সমঝোতা করার প্রচেষ্টাকেও তিনি নিন্দনীয় মনে করেন। যা-কিছু হবার তা হোক এসেমব্লির ভিতরে এই তাঁর সুচিন্তিত মত।
অথচ এর দু তিন দিন পূর্বেই স্বয়ং ভুট্টোই এই মওলানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সর্বজনসম্মত সংবিধান নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন!
মওলানা ছাড়া পশ্চিম পাকের অন্যান্য নেতারাও একবাক্যে এই বয়কট-এ প্রতিবাদ নিন্দা অসম্মতি জানান নিতান্ত সরকারের ধামাধরা কাইয়ুম জাতীয় দুটি দল ছাড়া। আর পূর্ব পাকের আওয়ামী লীগবিরোধী নেতারাও ভুট্টোর সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের পক্ষে ক্ষতিকর বলে দৃঢ়মত প্রকাশ করেন।
পাকিস্তান-প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর বর্তমান ভাইস-প্রেসিডেন্ট পুব পাকের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী বাঙালি নুরুল আমিন* ভুট্টোর আচরণ হেস্টি এবং আনহেলপফুল আখ্যা দিয়ে পুব বাঙলার প্রতি ভুট্টোর আচরণের নিন্দা করেন। তথা ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান বলেন, ভুট্টো এসেমব্লি বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন পাকিস্তানকে দু খণ্ডে বিভক্ত করার জন্য!
[*অধুনা যে কয়েকজন বাঙালি পাকিস্তান থেকে কাবুল হয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন তারা কাগজে প্রকাশ করেছেন, তন্মধ্যে আমার এক আত্মীয় আমাকে বলেছেন, নূর মিঞা বন্দি বাঙালিদের জন্য কড়ে আঙুলটি পর্যন্ত তো তুলছেনই না, তদুপরি বাঙালিরা যাতে করে দেশে ফিরতে না পারে সে ব্যাপারে দারুণ উৎসাহী। বস ভুট্টো সমীপে আপন কিমকদর বাড়াবার জন্য। ফোনে বাংলা শুনলে আঁতকে ওঠেন।]
এখনও মাঝে মাঝে কানে আসে ভুট্টোর স্তুতিগান তিনি চেয়েছিলেন অখণ্ড পাকিস্তান! তা হলে বলতে হয়, আওয়ামী লীগ থেকে আরম্ভ করে ওয়ালি খান, নসরুল্লা, সলাহ্ উদ্দিন, চোর উল আমিন এস্তেক মৌলানা মওদুদি– সব্বাই সব্বাই লিপ্ত হয়েছিলেন গভীর এক ষড়যন্ত্রে, পাকিস্তানকে কী প্রকারে দ্বিখণ্ডিত করা যায়! সামনে উজ্জ্বল উদাহরণ, লেট জিন্নাহ ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করেন।
.
সাত জর্মন
এক জগাই
তবু জগাই লড়ে!
গয়নার নৌকা চেনে না কে? বিশেষ করে পুব-বাঙলায়। বারোইয়ারি নৌকা, পাঁচো ইয়ারে ভাড়া করে গুষ্টিসুখ অনুভব করতে করতে যে যার আপন মনজিলে নেমে যান। অবশ্য পাঁচো ইয়ার নৌকো ইশটিশন ঘাটে পৌঁছনো মাত্রই হুড়মুড়িয়ে একে অন্যের ঘাড়ে পড়ে চড়ে, নৌকোর ভেতর ঢোকেন– নৌকোর গর্ভ থেকে আগের যাত্রীদের নামবার পূর্বেই। অবশ্য তখনও তারা পাচো ইয়ার নয়, বরঞ্চ পঞ্চভূত বলতে পারেন। জায়গা দখল করার তরে তখন ভূতের নৃত্য। তার পর ধীরেসুস্থে জিরিয়ে-জুরিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ হয়। যথা :
মহাশয়ের নাম?
এজ্ঞে, নেতাই হালদার। মহাশয়ের?
এজ্ঞে, হরিপদ পাল।… ওই যে কত্তা, আপনার?
আমার নাম? নেপালচন্দ্র গুণ।
তার পর নানাবিধ অভিজ্ঞান জিজ্ঞাসা। এমন সময় একজনের খেয়াল গেল, ছইয়ের বাইরের ওই ঠা ঠা রোদ্দুরে একটা লোক উদাস মুখে বসে আছে। চাষাভূষা হবে। এর তো পরিচয় নেওয়া হয়নি। উনিই গলা চড়িয়ে মুরুব্বি মেকদারে জিজ্ঞাসিলেন, তোমার পরিচয়টা তো জানা হল না হে। অতি বিনয়কণ্ঠে লোকটি, আইগা, আমার নাম আব্দুর রহিম বৈঠা। গয়নার পাঁচো ইয়ার তাজ্জব। তার পর কলবর। বৈঠা! সে কী, হে? মুসলমানের এ পদবিও হয় নাকি?
সবিনয় উত্তর : আইগা, অয় না, অখন অইছে। ঠেকায় পইড়া আপনারা কেউ হালদার, কেউ পাল, কেউ গুণ। বেবাক গুলাইন যদি ছইয়ের মধ্যে বইয়া থাহেন তয় নাও চলব কেমতে? তাই আমি বৈঠা অইয়া একলা একলা নাও বাইতেছি।
তা সে একা একাই নাও বাইয়া যাউক কোনও আপত্তি নেই, কারণ কবিগুরুও গেয়েছেন,
হেরো নিদ্রাহারা শশী।
স্বপ্ন পারাবারের খেয়া
একলা চালায় বসি।
তবে কি না আব্দুর রহিম বৈঠা না হয়ে লোকটার নাম জুলফিকার (দুলফিক্কার) আলি বৈঠা হলেই ১৫/১৬/১৭ ফেব্রুয়ারির হালটা বিম্বিত হয়ে মানাত ভালো।
এই সুবাদে জুলফিকার অর্ধসমাসটির কিঞ্চিৎ অর্থনিরূপণ করলে সেটাকে বহু পাঠক দীর্ঘসূত্রতারূপে অগ্রাহ্য করবেন না। কারণ যত দিন যাচ্ছে, ততই দেখতে পাচ্ছি, বহু হিন্দু প্রতিবেশী মুসলমানদের কায়দা-কানুন রীতিরেওয়াজ সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। কেচ্ছা-সাহিত্যে আছে,
আলীর হিম্মৎ দেখ্যা
নবী চমৎকার।
আদরে দিলাইন তানে
তেজি জুলফিকার ॥
হজরত আলীর দস্তে
ঠাটা* তলওয়ার।
আসমানে বিজুলি পারা
নাচে চারিধার ॥
[*ঠাটা ডাট্টা দৃঢ় = বজ্র]
পয়গম্বর হজরত আলিকে যে জুলফিকার নামক তরবারি দেন সেটি খুব সম্ভব সিরিয়া দেশের দিমিশকে (ডামাস্কস নগরে) তৈরি। কিন্তু অতখানি এলেম আমার পেটে নেই যে তার পাকা খবর সবজান্তা পাঠকের পাতে দিতে পারি।
তা সে যাই হোক, ১৫/১৬/১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে জুলফিকার আলি বৈঠা সগর্বে তথা সকরুণ কণ্ঠে প্রচার করলেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকার নেশনেল এসেমব্লি অধিবেশনে যে যাক সে যাক, তিনি যাবেন না, তিনি জুলফিকার আলি বৈঠা নিমজ্জমান পশ্চিম পাকিস্তানের তরণি একাই বৈঠা চালিয়ে অগ্রগামী হবেন। কারণ তিনি পাকা খবর পেয়েছেন, উত্তর কাশ্মিরের হিন্দুকুশ থেকে আরম্ভ করে কচ্ছের রান অবধি দুশমন ইন্ডিয়া সৈন্য সমাবেশ করছে। এবং সেটা বেইমান ইন্ডিয়ানরা এমনই সুচতুরতাসহ সমাধান করছে যে অতি অল্প লোকই তার খবর রাখে। এখানে বরঞ্চ সুচতুর ভুট্টো এমন একটা সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দিলেন যার ভাবার্থ তোমাদের কেউ কেউ তো অন্তত জানো, মিলিটারির সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ দোস্তি হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ অর্থাৎ তিনি, ভুট্টো, খবরটা পেয়েছেন নিতান্তই মিলিটারি প্রসাদাৎ। কিন্তু প্রশ্ন, ইন্ডিয়া ঠিক এই সময়ই সৈন্য সমাবেশ করছে কেন? কারণ ধুরন্ধর ইন্ডিয়া জানে, পশ্চিম পাকের বিস্তর রাজনৈতিক নেতা মার্চের পয়লা সপ্তাহে ঢাকা গিয়ে জড়ো হচ্ছেন। সেই সুযোগে ইন্ডিয়া পাকিস্তান আক্রমণ করলে তারা সবাই আটকা পড়ে যাবেন ঢাকায়। দেশের জনগণকে লিডারশিপ দিয়ে মাতৃভূমি রক্ষার্থে জিহাদ লড়বার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারবেন না।
এই ইন্ডিয়া জুজুর বিভীষিকা দেখানো- যখন তখন, মোকা-বেমোকায় ওইটেই মি. জুলফিকার আলি ভুট্টোর জুলফিকার তলওয়ার। তার সম্মানিত নামে (ইসমে শারিফে) আলি যখন রয়েছে তখন এই জুলফিকার তলওয়ারে তাঁরই হক সর্বাধিক। এই বেতাল-অসিতে ভানুমতী মন্ত্র আউড়ে ইন্দ্রজাল-রাজ ভুট্টো দিবা দ্বিপ্রহরে প্রাণসঞ্চার করতে সক্ষম।
সাতিশয় মনস্তাপের বিষয়, এই পোড়ার সংসারে আর যে অভাব থাক থাক, সন্দেহপিশাচের অভাব হয় না। তাদেরই দু-একজন মৃদুকণ্ঠে আপত্তি জানালে পর ভুট্টো যে উত্তর দিলেন সেটি পরশুরাম ক্লাসিক পর্যায়ে তুলে লিপিবদ্ধ করে গেছেন :
তারিণী (স্যান, কবরেজ)। প্রাতিক্কালে বোমি হয়?
নন্দ। আজ্ঞে না।
তারিণী। হয়, জানতি পার না।
কিন্তু এই বাহ্য।
এরপর মি. ভুট্টো যে ভয় দেখালেন সেটা আরও প্রাণঘাতী। তিনি বললেন, আমি আমার পার্টি সদস্যদের ঢাকা পাঠিয়ে সেখানে ওদেরকে ডবল হস্টেজে পরিণত করতে পারিনে। একদিকে তারা পশ্চিম পাকে ফিরতে পারবেন না (ইন্ডিয়া ফিরতে দেবে না) অতএব তারা হয়ে যাবেন ইন্ডিয়ার হস্টেজ, এবং তারা আওয়ামী লীগের দুদফা মানতে পারবেন না বলে তারা হয়ে যাবেন লীগেরও হস্টেজ। অর্থাৎ ইন্ডিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করে কতকগুলি অপমানজনক দাবি তুলবে পাকিস্তানের কাছে এবং সেগুলো না মানা পর্যন্ত সেই আমানতি সদস্যদের জলপথে, শূন্যমার্গে পশ্চিম পাকে ফিরতে দেবে না। আর আওয়ামী লীগও তাদের পুব পাক থেকে বেরুতে দেবে না।
সর্বনাশ! তা হলে এই দুধের ছাওয়ালদের হালটা হবে কী?
সব জেনেশুনে সদস্যরা যদি ঢাকা যান তবে, তবে কী আর হবে– এসেমব্লি হল কসাইখানাতে (মি. ভুট্টোর আপন জবানিতে স্লটার হাউস-এ) পরিবর্তিত হবে!
সাংবাদিকরা যে সাতিশয় বিদগ্ধান্ত (হার্ড বয়েলড এগস) সে তত্ত্বটি বিশ্বজন সম্যকরূপে অবগত আছে। তথাপি তারাও নাকি আঁতকে উঠেছিলেন। শকটা সামলে নিয়ে সমস্বরে তারা নানান প্রশ্ন শুধালেন। কিন্তু মি. ভুট্টো চুপ মেরে গেলেন। হি ডিড নট এলাবরেট অন দিস পয়েন্ট–সবিস্তর স্বপ্রকাশ হতে সম্মত হলেন না।
কী জানি? কে জানে? হয়তো তিনি তখন বৃহত্তর ব্যাপকতর স্লটার-ভূমির স্বপ্ন দেখছিলেন।
.
বুড়িগঙ্গা
ঢাকা শহরের সৌন্দর্য আর মাধুর্য শুধু এ শহরের আপনজনই হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে পারে। ঢাকার আবহাওয়ার সঙ্গে, ধরুন বর্ধমানের কণামাত্র সাদৃশ্য নেই–যদিও দুটিই বিশাল বঙ্গের দুই নগর। বর্ধমান-বীরভূমের সৌন্দর্যে রুদ্রের প্রচণ্ড প্রখরতা– ঢাকার সৌন্দর্য তার লাবণ্যে।
ঢাকা, মৈমনসিং, সিলেট খাঁটি বাংলা কিন্তু তার আস বাঁশ তার আমজাম তার রিমঝিম বারিপাত তার একান্ত নিজস্ব। অথচ এ-ও জানি এ দেশের লতা-পাতা ফল-ফুল পশু-পক্ষী কেমন যেন মণিপুর, আরাকান, বর্মার সঙ্গে সম্পর্ক ধরে বেশি। এসব দেশের সঙ্গে ঢাকা-চাটগার পরিচয় বহুদিনের কিন্তু আমার মনে হয় মাত্র এক শতাব্দী হয় কি না হয় ঢাকার শৌখিন লোকের খেয়াল গেল, বৰ্মা-মালয় থেকে অচেনা গাছপালা, তরুলতা এনে এখানে বাঁচানো যায় কি না। কারণ এতদিন এরা পশ্চিম থেকেই এনেছে এসব, এবং এদেশের বড় বেশি সঁতসেঁতে আবহাওয়াতে সেগুলোর অনেকেই মারা যেত কিংবা মুমূর্ষরূপে মানুষের হৃদয়ের করুণা জাগাত মাত্র। পক্ষান্তরে আশ্চর্য সুফল পেল ঢাকার তরুবিলাসী জন বর্মা-মালয়ের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনা করে। তার পর এল আরও নানান দেশ থেকে নানান রকমের গাছ।
বসন্তকাল মিটফোর্ড পাড়ার বারান্দায় বসে আছি সন্ধেবেলা। বাঁশের ফ্রেমে লতিয়ে উঠেছে পল্লবজাল। স্নান গোধূলিটি অন্ধকারে গা-ঢাকা দিতে না দিতেই অচেনা এক মৃদু গন্ধ যেন ভীরু মাধবীর মতো আসিবে কি থামিবে কি করে করে হঠাৎ সমস্ত বারান্দাটায় যেন জোয়ার লাগিয়ে দিল। হায়, আমি বটানির কিছুই জানিনে। গৃহলক্ষ্মী ক্ষণতরে বাইরে এসেছিলেন। নামটা বললেন। সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গেলুম।
অন্ধকার ঘনিয়ে এল। বুড়িগঙ্গার জল আর দেখা যাচ্ছে না। ওপারে একটি-দুটি তারাও ফুটতে আরম্ভ করেছে– যেন সমস্ত রাত ধরে এপারের ফুলকে সঙ্গ দেবে বলে। একমাত্র ওই তারাগুলোই তো সব দেশের উপর দিয়ে প্রতি রাত্রে আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি পাড়ি দেয়। তারা চেনে সব ফুল, সব গাছ, সব মানুষ। মনে পড়ল, একদা বহু বহু বৎসর পূর্বে কাবুলের এক পান্থশালায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল প্রায় প্রথম আলোর চরণধ্বনির সঙ্গে, একবুক অচেনা ফুলের গন্ধ নিয়ে ঝাপসা ঝাপসা দেখেছিলুম অচেনা গাছ, অজানা পল্লব, বিচিত্র ভঙ্গির ভবন অলিন্দ, সম্পূর্ণ অপরিচিত পাখির কুহু কেকার অনুকরণ। আমার। অধঃচেতন একাধিক ইন্দ্রিয়ের ওপর অচেনার এই আকস্মিক অভিযান যেন বিহ্বল বিকল করে দিয়েছিল আমাকে। দেশের কথা মায়ের কথা সঙ্গে সঙ্গে মনে এল। ঠিক এই সময়ে দেশের বাড়িতে ঘুম ভাঙলে শুনতে পেতুম মা আঙিনায় গোলাপঝাড়ের নিচে জলচৌকিতে বসে বদনার পানি ঢেলে ঢেলে ওজু করছে। কখনও-সখনও চুড়ির ঠুংঠুংও শুনেছি। একেবারে অবশ হয়ে গেল সমস্ত দেহমন।
এমন সময় আল্লার মেহেরবানিতে চোখ দুটি গেল ঊর্ধ্বাকাশের দিকে। দেখি, অবাক হয়ে দেখি, সেই পরিচিত অতিপরিচিত এ জীবনে আমার প্রথম কৈশোরের প্রথম পরিচয়ের নক্ষত্রপুঞ্জ— কৃত্তিকা। সেটা কিন্তু তোলা নাম। তার আটপৌরে ডাকনাম সাত ভাই চম্পা। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের কাব্যেই পেয়েছি সে জনপদবধূর প্রিয় নাম,
–ওরে, এতক্ষণে বুঝি
তারা ঝরা নিঝরের স্রোতঃপথে।
পথ খুঁজি খুঁজি
গেছে সাত ভাই চম্পা—
সাত ভাই চম্পা চলেছে ছায়াপথ বা আকাশগঙ্গার পিছে পিছে– তারই উল্লেখ করলেন কবি তারা ঝরা নিঝরের স্রোতঃপথ বর্ণনা দিয়ে। আর এই যে-দেশে এসেছি গ্রহ তারকার যোগাযোগে, সে দেশের রাজা আমানুল্লার রানির নাম সুরাইয়া, কৃত্তিকার আরবি নাম। তাঁকে ধরবে বলে পিছনে ছুটেছে রোহিণী, আরবদের জ্যোতিষশাস্ত্রে আল-দাবরান। কাবুলে সে দেখা দিল দু বৎসর পরে।
সাত ভাই চম্পা আমাকে চেনে আর বুড়িগঙ্গার পারে নির্বাসিতা ওই বিদেশি ফুলকেও চেনে।
না, ভুল করেছি। দু-একটি তারা যে নড়তে-চড়তে আরম্ভ করেছে। এগুলো ওপারের নৌকোর আলো। অথচ ওই আলোগুলোর একটু উপরের দিকে তাকালেই দেখি, আকাশের তারা। অন্ধকার এত নিবিড় যে এই মাটির আলো আর আকাশের আলোর মিতালি ছাড়া আর-কিছু চোখে পড়ে না।
এ পাড় থেকে মাঝে মাঝে কানে আসছে কে যেন কাকে ডাকছে। সাড়াও পাচ্ছে। রাত ঘনিয়ে আসছে। হাটবাজার শেষ হতে চলল। এইবারে বাড়ি ফেরার পালা। চারদিকে গভীর নৈস্তব্ধ্য।
দিনের কোলাহলে
ঢাকা সে যে রইবে
হৃদয়তলে।
কবি এখানে ঢাকা অন্য অর্থে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু নগর অর্থে নিলেও কোনও আপত্তি নেই। কারণ তার পরই কবির কথামতো।
রাতের তারা উঠবে যবে
সুরের মালা বদল হবে।
ওই তো হচ্ছে, ওই ওপারে, তারা প্রদীপের মালার বদল। স্বর্গের দেয়ালির গন্ধে পৃথিবীর দেয়ালিতে মিলে আলোক শিখীর আলিম্পন।
নিবিড় অন্ধকারে যখন মানুষ ভরা চোখ টাটিয়েও কিছুই দেখতে পায় না, এমনকি পাকা মাঝির ছুঁচের মতো ধারালো চোখও হার মানে, তখন নদীর ঘাটে-অঘাটে একে অন্যকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ক্ষণে ক্ষণে যে ডাকাডাকি কানে আসে সেটা ছেলেবেলা থেকেই আমার কাছে। অত্যন্ত অকারণে অজানা রহস্যভরা রূপে ধরা দিত। তার সঙ্গে থাকত কিছুটা অহেতুক ভীতির ছোঁয়াচ। যদি এরা একে অন্যকে খুঁজে না পায়। ওই যে মাঝির গলা মিলিয়ে যাবার আগেই যেন কাতর এক নারীকণ্ঠ– তবে কি মা তার ছেলেকে ডাকছে? তাকে যদি না পায়।
পরবর্তীকালে বুঝেছি ওই একই ডাক অন্যরূপে :
পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে
পিছিয়ে পড়েছি আমি,
যাব যে কী করে ॥
এসেছে নিবিড় নিশি,
পথরেখা গেছে মিশি–
সাড়া দাও, সাড়া দাও।
আঁধারের ঘোরে ॥
এই তো বুড়িগঙ্গার পাড়। এখানে জলরেখা গেছে মিশি। কতজন কাতর কণ্ঠে বার বার মিনতি জানাচ্ছে, সাড়া দাও, সাড়া দাও।
তার পর একদিন আসে যখন আর সে সাড়া দেয় না।
কতশত নিরীহ প্রাণী অকালে এই বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে গেল মাত্র সেদিন।
এখনও কত শত পাগলিনী মাতা, সাড়া দাও, সাড়া দাও রবে ডাকছে।
আরও কত মাতা গৃহকোণে বসে আশায় আশায় আছে, একদিন সাড়া পাবে।
আমি খুব ভালো করেই জানি, কোন দিন কোন প্রহরে তাকে গুলি করে মেরে বুড়িগঙ্গার গভীরে তাকে জানাজার নামাজ না শুনিয়ে গোর দেয়!
কিন্তু কী করে সেকথাটা তার মাকে বলি?
আর না বলে কী করে প্রতিদিন তার সাড়ার আশাটা মায়ের বন্ধ চোখে দেখি?
.
.
Leave a Reply