বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড (রক্তের ঋণ) – অ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস
বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড-এর ভাষান্তর –
অনুবাদক : মোহাম্মদ শাহজাহান
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮
অনুবাদকের কথা
অ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস সাংবাদিকতার জগতে আন্তর্জাতিকভাবে একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্বের নাম। তাঁর সৃষ্ট ‘বাংলাদেশ : লেগ্যাসি অব ব্লাড’ এরই এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তিনি আজ ইহ- জগতে নেই ঠিকই, কিন্তু তাঁর এই সৃষ্টি তাঁকে ইতিহাস-পিপাসু মানুষের মনে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। মান্যবর প্রকাশকের সঙ্গে তাঁর ছিলো গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। জীবদ্দশায় তিনি বইটিকে বাংলায় ভাষান্তরিত দেখার জন্যে প্রকাশকের কাছে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার সেই সাধ পূরণ না হতেই তিনি নিয়তির অমোঘ নির্দেশে পাড়ি জমালেন অনন্তের পথে। মরণের পরপারে বসেও তাঁর বিদেহী আত্মা আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াসে কিছুটা হলেও পরিতৃপ্তি পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
বইটি বহু তথ্য সমৃদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল। এই সকল তথ্যের কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি যেন না ঘটে, ভাষান্তরের সময় সেদিকে সযত্নে নজর রাখা হয়েছে। অ্যান্থনী সাহেবের কথাগুলোই আমি আমার ভাষায় ব্যক্ত করতে চেষ্টা করেছি। তবে, অনুবাদ / ভাষান্তর করতে গিয়ে বইটির কোন অধ্যায়েরই আসল রস এবং সুরের যেন একটুও পরিবর্তন না ঘটে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। বইটিতে ব্যবহৃত অনেক ইংরেজী শব্দ, নাম ইত্যাদিকে আক্ষরিক অর্থে অনুবাদ না করে, বইটির সহজবোধ্যতা এবং গতি ঠিক রাখার জন্যে সেগুলোর ইংরেজী উচ্চারণকেই বাংলায় লিখে দেয়া হয়েছে।
বইটির অনুবাদ করার সকল প্রয়াসে আমি ব্যক্তিগতভাবে জনাব এ. কে. এম. শফিকুল ইসলামের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। তিনি আমার এ কাজে সক্রিয় সহযোগিতা এবং প্রচুর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
আমার এ অনুবাদটি যদি পাঠকের একটুও তৃপ্তি দিতে পারে, আমি আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করবো।
মোহাম্মদ শাহজাহান
.
ভূমিকা
লেখকের কথা
এটি একটি সত্য কাহিনী। অনেক দিক থেকেই এটি স্থায়ী বিশ্বের মোহমুক্তির এক অনন্য পাঠ্যপুস্তক।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের পর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নূতন রাষ্ট্রের জন্ম হলো। ঐ সংগ্রামে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দশ লক্ষাধিক বাঙ্গালী পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়। বিংশ শতাব্দীর বিরাট এক মানবসৃষ্ট দুর্যোগ হলেও, এরই মাধ্যমে জাতীয় স্বাধিকারের পথে মানবতার জন্যে এক সর্বোত্তম বিজয় অর্জিত হয়েছিল। চরম বিপর্যস্তকারী বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজের ভাগ্যকে গড়ার প্রচেষ্টায় বাঙ্গালী জাতির সম্মিলিত আত্মদান বিশ্ববাসীর কল্পনাকে নাড়া দিতে পেরেছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তাদের উপর বর্ষিত হলো অভূতপূর্ব সহানুভূতি আর সাহায্যের বন্যা। এ সাহায্য আর সহানুভূতিতে সক্রিয় রাজনৈতিক ও বাস্তব সমর্থন থেকে শুরু করে হৃদয়গ্রাহী ব্যক্তিগত বদান্যতা পর্যন্ত স্থান পেয়েছিল। ১৯৭১ সালে নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশের সাহায্যার্থে পপ তারকাদের সঙ্গীতানুষ্ঠান, আফ্রিকার ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ-তৎপরতার এক আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু বাঙ্গালীদের অসংখ্য জীবন উৎসর্গের কোন তুলনা মেলে না। সুদীর্ঘ দিনের লালিত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে এ উৎসর্গ সেদিন করতে হয়েছিল তাদেরকে। প্রতিটা বাঙ্গালীর হৃদয়ের প্রিয় অনুভূতিতে অনুরঞ্জিত সমতা, ন্যায় বিচার, সমাাজিক ঐক্য আর সাংস্কৃতিক দীপ্তির উপর ভিত্তি করে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন-সাধ ছিল তাদের মনে। কিন্তু তা আর হলো না। সব উৎসর্গই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। স্বপ্ন পরিণত হলো দুঃস্বপ্নে। বাংলাদেশ আবদ্ধ হলো রক্তের ঋণে।
শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ আর জেনারেল জিয়াউর রহমান- এর মত বাংলাদেশের গোড়ার দিকের নেতৃবৃন্দ যে হারে তাদের জাতির প্রত্যাশায় কুঠারাঘাত করেছিলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজির বিরল। তারা একের পর এক দেশটির ক্ষতিপূরণের চাইতে অধিকতর বিনাশের দিকে ঠেলে দিতে লাগলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের অতি প্রিয় একনাম, ‘শেখ মুজিব’ যে নামের যাদুস্পর্শে অনেক অসম্ভবও সম্ভব হয়ে যেতো; সেই শেখ মুজিব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরে মধ্যে সবচাইতে ঘৃণিত ব্যক্তি বলে পরিগণিত হলেন। তার ফলশ্রুতিতে একদিন সপরিবারে নিহত হলেন তিনি। কিন্তু প্রতিহিংসার আগুন যেন জ্বলতেই থাকল। মুজিব মৃত্যুর দশ বছর পরেও আত্মীয়-পরিজনদের মতানৈক্যের জন্যে তাদের গ্রামের বাড়ী টুঙ্গীপাড়ায় মুজিবের সমাধির উপর একটি সুযোগ্য স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারেননি বলে, তাঁর কন্যা হাসিনা, আমাকে জানান। ‘আসলে ক্ষমতায় না থাকলে সকলেই এড়িয়ে চলে’, কথাচ্ছলে হাসিনা বলছিলেন এবং মুজিব আর জেনারেল জিয়া উভয়ের সমাধি পাশে তা খোদাই করে রাখার যোগ্য। শেখ মুজিবের পরে ক্ষমতা দখলকারী মোশতাক আহমেদ-এর নাম বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসেবে প্রচলিত হয়ে যায়। তৎপরবর্তী জেনারেল জিয়া প্রথম দিক দিয়ে সেনাবাহিনীর ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করলেও পরে তার নিজরূপে আত্মপ্রকাশ করেন, যার জন্যে পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি ২০টি বিদ্রোহ আর সামরিক অভ্যুত্থানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। একুশতম সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন।
এই বইটি বাংলাদেশের প্রথম দশ বছরের দুঃখজন কাহিনীগুলোকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। প্রধান নায়কদের সঙ্গে আমার নিবিড় ব্যক্তিগত জানাশুনা, নাটকীয় ঘটনা প্রবাহের সহিত জড়িতদের সঙ্গে পৃথকভাবে ১২০টিরও বেশী সাক্ষাৎকার এবং সরকারী ঐতিহাসিক নথিপত্র আর দলিল-দস্তাবেজ ব্যক্তিগতভাবে পরিদর্শন সাপেক্ষে এর ভিত রচিত হয়েছে। মুদ্রিত কথোপকথনে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্যতা রক্ষিত হয়েছে। এভাবে মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ শেখ মুজিবকে কেন এবং কিভাবে হত্যা করেছেন তার বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী বলেছেন; ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাজউদ্দিন এবং তার সঙ্গীতের হত্যা রহস্য পরিকল্পনাকারী ও নির্বাহকারীরা নিজেরাই বর্ণনা করেছেন। জেনারেল জিয়া সম্বন্ধে বলছেন, তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও সমালোচকগণ। তাঁর হত্যাকারীরা বলেছেন, কিভাবে তাকে হত্যা করা হয়। শহীদদের ঢেলে দেয়া রক্তের কাহিনীতে একটি শিক্ষাই বেরিয়ে আসছে যে, যখন প্রত্যাশার দীপশিখা নির্বাপিত হয়, বাধ্যবাধকতা পালনের দায়িত্ব যখন অস্বীকৃত হয়, জনগণের হারাবার যখন আর কিছুই বাকী না থাকে, তখন তারা তাদের ভুল সংশোধনের জন্যে আক্রমণের পন্থাই বেছে নেয়। শেকসপিয়ার বলেছেন, ‘মানুষ যে অনিষ্টসাধন করে, তা তাদের মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকে। আর সাধিত মঙ্গল প্রায়শঃই তাদের অস্থিমজ্জার সঙ্গেই কবরস্থ হয়ে যায়।’ শেখ মুজিব আর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বেলায়ও তাই ঘটেছে। তাঁরা তাদের একগুয়ে কর্মকান্ড আর স্বার্থপর উচ্চাভিলাষের কারণে বাংলাদেশকে রক্তের ঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। এমতাবস্থায়, বইটি অনিবার্য কারণেই অঙ্গুলি নিৰ্দেশ করছে ঐ নেতাদের কৃত ভুলের দিকে। আমি সেজন্যে কোন ক্ষমা প্রার্থনা করছি না। জনগণের তাদের নেতৃবৃন্দের ভুল সম্বন্ধে অবশ্যই জানা উচিত; আর আমরাও তাদের কৃত ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস
নভেম্বর, ১৯৮৫
.
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার দায়ে সাধারণ (জেনারেল) কোর্ট মার্শাল-এ অভিযুক্ত হলে যাদের ফাঁসি দেয়া হয়, ঐ সকল অফিসারদের তালিকা :
১। বিএ-১৮৫ ব্রিগেডিয়ার মোহসিনউদ্দিন আহমেদ, কমান্ডার, ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড।
২। বিএ-২০০ কর্ণেল মোহাম্মদ নোয়াজেশউদ্দিন, কমান্ডার, ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেড।
৩। বিএ-২১২ কর্ণেল মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, কমান্ডার, ৬৫ পদাতিক ব্রিগেড।
৪। বিএসএস-৬৭৫ লেঃ কর্নেল শাহ্ মোহাম্মদ ফজলে হোসেন, অধিনায়ক, ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
৫। বিএ-৩০১ লেঃ কর্ণেল এ, ওয়াই, এম মাহফুজুর রহমান সর্বাধিনায়কের সচিবালয় থেকে প্রেসিডেন্ট-এর একান্ত সচিব।
৬। বিএ-৪০০ লেঃ কর্ণেল মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, সহকারী পরিচালক, অর্ডন্যান্স সার্ভিসেস ২৪ পদাতিক ডিভিশন, চট্টগ্রাম।
৭। বিএসএস-৭২২ মেজর গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, উপ-অধিনায়ক, ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
৮। বিএসএস-৮৩৯ মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁঞা ব্রিগেড মেজর, ৬৫ পদাতিক ডিভিশন।
৯। বিএ-১১৬৭ মেজর মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান অধিনায়ক, ১১২ সিগন্যাল কোঃ।
১০। বিএসএস-১০৭০ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুস সাত্তার ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
১১। বিএসএস-৮৬২ মেজর কাজী মুমিনুল হক উপ-অধিনায়ক, ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
১২। বিএসএস-১৫২৬ ক্যাপ্টেন জামিল হক ২১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
১৩। বিএসএস-১৭৪২ লেঃ মোহাম্মদ রফিকুল হাসান খান ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
salim
book pls
Mehedi
This the real story