উৎসর্গ
“ইংরেজ কবল হইতে ভারতবর্ষকে উদ্ধার করিবার জন্য যে-সব বাঙালী ছেলে-মেয়ে একদিন জীবনপণ করিয়াছিল, যাহারা দলে দলে জেল ভরতি করিয়াছিল, ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়াছিল, দ্বীপান্তরে গিয়াছিল, পুলিশের অত্যাচারে জর্জরিত হইয়াছিল, যাহাদের ঘরে-বাহিরে কোথাও শান্তি ছিল না, মা-বাপ আত্মীয়-বন্ধুরাও যাহাদের আপনার লোক বলিয়া স্বীকার করিতে ভয় পাইতেন, একটা বিরাট আদর্শের প্রেরণায় যাহারা নিজেদের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়াছিল, কিন্তু সর্বহারার গান গাহিয়া পথে পথে ঘুরিয়া বেড়ায় নাই, বরং যাহারা নিজেদের সর্বতোভাবে লুকাইয়া রাখিয়াই লোকচক্ষুর আড়ালে বিলীন হইয়া গিয়াছে”
তাহাদের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে
জন্মভূমির ইতিহাসের এই শেষ খণ্ড
উৎসর্গ করিয়া কৃতার্থ হইলাম।
–শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
প্রসঙ্গকথা (বর্তমান সংস্করণ)
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এর বড় কারণ সমকালে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় দরবারী ইতিহাসও লেখা হয়নি। ফলে সাহিত্যের সূত্র, পর্যটকদের বিবরণ এবং সামান্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ব্যবহার করে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখা আধুনিক কালের একটি প্রয়াস বলা যেতে পারে। মধ্যযুগের ইতিহাস লেখায় বাড়তি সুযোগ এসেছে দিল্লিতে বসে সুলতান ও মোগল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা দরবারী ইতিহাস। এসব সূত্র ব্যবহার করে লেখা ইতিহাস রাজনৈতিক ইতিহাসের গণ্ডি পেরুতে পারেনি অনেক কাল পর্যন্ত। সেই অর্থে সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখা একেবারে সাম্প্রতিককালের প্রয়াস। এমন বাস্তবতার আদি সময়ে অনেকটা শূন্যতার মধ্য দিয়েই রমেশচন্দ্র মজুমদারকে ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ নামে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখার যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। গত শতকের চল্লিশের দশকে রমেশ চন্দ্র মজুমদার যখন বাংলা ভাষায় বাংলার ইতিহাস লেখার পরিকল্পনা করেন তার অনেক বছর আগে অনেকটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে লেখা দুটো মাত্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এর একটি ‘গৌড়রাজমালা’। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদ রাম প্রসাদ চন্দের এই বইটি বাংলা ১৩৩৯ সাল অর্থাৎ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি পূর্ণাঙ্গ কোনো বাংলার ইতিহাস নয়। তবু বাংলার ইতিহাস রচনার পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ বলা যায়। এর দুই বছর পর বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষায় রচনা করেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’। এরপর দীর্ঘ বিরতি কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই খণ্ডে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার প্রকল্প গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত হয় গ্রন্থ দুটো হবে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের প্রবন্ধের সংকলন। প্রাচীন যুগের গ্রন্থটি রমেশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় (R. c. Majumdar) The History of Bengal-Volume-1, Hindu Period) নামে ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার আশা করেছিলেন গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ব্যক্তিগত আগ্রহে ও দায়বোধ থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রাচীন যুগপর্বের বাংলাদেশের ইতিহাস লেখায় আত্মনিয়োগ করেন।
এই গ্রন্থ রচনায় রমেশচন্দ্র মজুমদার একজন মেধাবি ঐতিহাসিকের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় নিজেই উল্লেখ করেছেন এই গ্রন্থ তিনি টিকা টিপ্পনির ভারে ভারাক্রান্ত করতে চাননি। সহজবোধ্যভাবে যেন পাঠক আত্মস্থ করতে পারে। অথচ তারপরেও নানা তথ্যে সমৃদ্ধ একটি অভিজাত ইতিহাস গ্রন্থই তিনি উপস্থাপন করেছিলেন।
আমরা দেখেছি বিশ শতক পর্যন্ত কালপরিসরের মধ্যে অল্প কয়েকজন ইতিহাসবিদের প্রয়াস ছাড়া প্রায় সকল ইতিহাস গ্রন্থই রাজনৈতিক ইতিহাসে আটকে ছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চা তেমনভাবে অগ্রসর হয়নি। এর বড় কারণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখার মত তথ্য সূত্রের অভাব। সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নসূত্র অনুসন্ধানের সুযোগ তৈরি হওয়ায় নতুন করে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস লেখার ধারা শুরু হয়েছে।
অথচ রমেশচন্দ্র মজুমদারের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা সূত্র-সংকটের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। তাই তাঁর গ্রন্থে (বাংলাদেশের ইতিহাস) অত্যন্ত সার্থকভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি ধারাবাহিকতা উপস্থাপিত হয়েছে অনেকটা স্পষ্টভাবেই।
ইতিহাসে একটি কথা রয়েছে যে ইতিহাস বা ইতিহাসের ঘটনা বার বার ফিরে আসে। এজন্যই হয়তো বলা হয় ইতিহাসে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। শেষ সত্যে পৌঁছা যায় না, তবে নতুন নতুন তথ্যে বার বার সংস্কার করে সত্যের দিকে এগিয়ে চলা যায়। রমেশচন্দ্র মজুমদার যে সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছিলেন তখন প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা থাকলেও নিজ মেধা প্রয়োগ করে তিনি অনেক বাধাই অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।
একারণেই তাঁর গ্রন্থে রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি প্রাচীন বাংলার সমাজ, ধর্ম, শিল্পকলা সকল কিছুই অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন একজন বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ। একজন ইতিহাস পাঠককে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জানানোর জন্য যেভাবে সূচি বিন্যাস করা দরকার তিনি এই গ্রন্থে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা করতে পেরেছেন। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থান বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে পাঠককে পরিচিত করিয়েছেন বাংলাদেশের সাথে। নৃতাত্ত্বিক নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে এই গ্রন্থে। এই জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ ধারা উন্মোচিত হয়েছে। রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাক্রম আলোচনায় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শাসকদের শাসনকালের বর্ণনা করেছেন গ্রন্থকার।
আমরা বলতেই পারি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিশেষ করে শিল্প ইতিহাস রচনার পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর গ্রন্থের শেষ পর্বে।
অবশ্য বাংলা দেশের ইতিহাস পাঠ করা সমালোচকদের অভিযোগ রয়েছে রমেশচন্দ্র মজুমদারের মধ্যে কিছুটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। কারণ তিনি হিন্দুদের পাশাপাশি সাধারণ মুসলমানদের কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই ম্লেচ্ছ ও যবন বলে অভিহিত করেছেন তাঁর গ্রন্থে। কোনো কোনো জায়গায় ধর্মসম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ বিশ্লেষণে কিছুটা একদেশদর্শিতার সংকট রয়েছে। অবশ্য বঙ্গভঙ্গোত্তর বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে বিরোধের দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল তাতে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির মুসলমান ও একই ধারার হিন্দু-অবস্থান পুরুষানুক্রমে টিকে ছিল। আর. সি. মজুমদারের ইতিহাস চর্চা কখনো কখনো খুব সীমিতভাবে হলেও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে এড়াতে পারেনি। পাঠক যদি সময়ের বাস্তবতা মেনে পাঠ করেন তবে খুব একটা অস্বস্তিতে পরতে হবে না।
এ কথাটি ঠিক রমেশচন্দ্র মজুমদার যখন গবেষণা করেন তখন প্রত্নউপাদানের অনেকটাই আবিষ্কৃত হয়নি। তাই কোনো কোনো ঘটনা বা সন তারিখ সচেতন মানুষের কাছে ভুল মনে হতে পারে। যেমন তিনি বখতিয়ার খলজির নদীয়া আক্রমণের তারিখ ১২০২ বলেছিলেন। এই তারিখ নিয়ে দীর্ঘকাল পর্যন্ত গবেষকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল। প্রায় আড়াই দশক আগে আমরা বখতিয়ার খলজির মুদ্রা শনাক্ত করতে পারি। আর মুদ্রা উৎকীর্ণের তারিখ যাচাই করে বলতে পারি নদীয়া আক্রমণের তারিখটি ছিল ১২০৪। ইতিহাস লিখনের এটিই রীতি। এভাবেই যুগে যুগে সংশোধিত হয় প্রাপ্ত নতুন উপাদান ব্যবহার করে। তাই ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে এজাতীয় তথ্য ভুল না ভেবে নির্দিষ্ট সময়ের সিদ্ধান্ত বলে মানতে হবে।
পাশাপাশি বখতিয়ার খলজি (ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি) প্রসঙ্গে বর্তমান গ্রন্থটিতে আরেকটি বিশ্লেষণ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত প্রকৃত ইতিহাসবিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্ট করছে। ইতিহাসের একটি ভুল ব্যাখ্যা দীর্ঘদিন থেকে আমরা বহন করে আসছিলাম। আর তা হচ্ছে ‘বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়’। ১৯৯৬-এ এনসিটিবির পাঠ্য বই, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বই ইত্যাদিতে সংস্কার করে আমরা লিখছি বখতিয়ারের অধিকৃত অঞ্চল ‘বঙ্গ’ নয় নদীয়া ও লখনৌতি। অর্থাৎ ‘প্রাচীন জনপদ বঙ্গে’র সীমানায় বখতিয়ার প্রবেশ করেননি। আবার বখতিয়ারের অনেক পরে মানচিত্রে বাংলা বা বাংলাদেশ নামে একটি ভূখণ্ড চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৩৫২-৫৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ পুরো বাংলাকে একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পর। সুতরাং বখতিয়ার প্রকৃত অর্থে বাংলা বা বঙ্গ বিজেতা নন। বাংলায় মুসলিম বিজয়ের দ্বারোঘাটন করেছিলেন মাত্র। অথচ অত আগে প্রত্নসূত্র না থাকলেও নিজ প্রজ্ঞা দিয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদার একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যায় ইতিহাসের সত্যটিই উপস্থিত করেছিলেন অত্যন্ত সার্থকভাবে। বর্তমান গ্রন্থের পাঠক মাত্রই ড. মজুমদারের অমন পাণ্ডিত্যের ছোঁয়ায় মুগ্ধ হবেন।
মুদ্রণ না থাকায় এই অসাধারণ গ্রন্থটি দীর্ঘকাল সহজলভ্য ছিল না। দিব্যপ্রকাশ ধ্রুপদী ইতিহাস গ্রন্থ পুণঃমুদ্রণ করে, অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করায় একটি প্রতীকী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলো। দিব্যপ্রকাশের কর্ণধার প্রীতিভাজন সুলেখক মঈনুল আহসান সাবের যখন প্রকাশের পূর্বে এই বইখানির একটি ভূমিকা লিখে দিতে বললেন, তখন আমি বিব্রতবোধ করছিলাম। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত ঐতিহাসিকের গ্রন্থের ভূমিকা লেখা আমার মত অর্বাচীনের সাজে না। কিন্তু সাবের ভাইয়ের অনুরোধ ফেলা মুশকিল। তাই ভূমিকা নয়- গ্রন্থ প্রসঙ্গে দুএকটি কথা বলার সুযোগটুকু নিলাম।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
অধ্যাপক
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply