বাংলাদেশের ইতিহাস – ২য় খণ্ড (মধ্যযুগ) – রমেশচন্দ্র মজুমদার
ভারততত্ত্ব-ভাস্কর শ্ৰীরমেশচন্দ্র মজুমদার এম-এ, পিএই-ডি, ডি-লিট্ সম্পাদিত
.
প্রসঙ্গকথা (বর্তমান সংস্করণ)
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এর বড় কারণ সমকালে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় দরবারী ইতিহাসও লেখা হয়নি। ফলে সাহিত্যের সূত্র, পর্যটকদের বিবরণ এবং সামান্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ব্যবহার করে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখা আধুনিক কালের একটি প্রয়াস বলা যেতে পারে। মধ্যযুগের ইতিহাস লেখায় বাড়তি সুযোগ এসেছে দিল্লিতে বসে সুলতান ও মোগল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা দরবারী ইতিহাস। এসব সূত্র ব্যবহার করে লেখা ইতিহাস রাজনৈতিক ইতিহাসের গণ্ডি পেরুতে পারেনি অনেক কাল পর্যন্ত। সেই অর্থে সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখা একেবারে সাম্প্রতিক কালের প্রয়াস। এমন বাস্তবতার আদি সময়ে অনেকটা শূন্যতার মধ্য দিয়েই রমেশচন্দ্র মজুমদারকে ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ নামে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখার যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। গত শতকের চল্লিশের দশকে রমেশ চন্দ্র মজুমদার যখন বাংলা ভাষায় বাংলার ইতিহাস লেখার পরিকল্পনা করেন তার অনেক বছর আগে অনেকটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে লেখা দুটো মাত্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এর একটি গৌড়রাজমালা। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদ রাম প্রসাদ চন্দের এই বইটি বাংলা ১৩৩৯ সাল অর্থাৎ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি পূর্ণাঙ্গ কোনো বাংলার ইতিহাস নয়। তবু বাংলার ইতিহাস রচনার পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ বলা যায়। এর দুই বছর পর বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষায় রচনা করেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’। এরপর দীর্ঘ বিরতি কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই খণ্ডে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার প্রকল্প গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত হয় গ্রন্থ দুটো হবে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের প্রবন্ধের সংকলন। প্রাচীন যুগের গ্রন্থটি রমেশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় (R. C. Majumdar) The History of Bengal Volume-1, Hindu Period) নামে ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার আশা করেছিলেন গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ব্যক্তিগত আগ্রহে ও দায়বোধ থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রাচীন যুগপর্বের বাংলাদেশের ইতিহাস লেখায় আত্মনিয়োগ করেন।
এই গ্রন্থ রচনায় রমেশচন্দ্র মজুমদার একজন মেধাবি ঐতিহাসিকের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় নিজেই উল্লেখ করেছেন এই গ্রন্থ তিনি টিকা টিপ্পনির ভারে ভারাক্রান্ত করতে চাননি। সহজবোধ্যভাবে যেন পাঠক আত্মস্থ করতে পারে। অথচ তারপরেও নানা তথ্যে সমৃদ্ধ একটি অভিজাত ইতিহাস গ্রন্থই তিনি উপস্থাপন করেছিলেন।
আমরা দেখেছি বিশ শতক পর্যন্ত কালপরিসরের মধ্যে অল্প কয়েকজন ইতিহাসবিদের প্রয়াস ছাড়া প্রায় সকল ইতিহাস গ্রন্থই রাজনৈতিক ইতিহাসে আটকে ছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চ্চা তেমনভাবে অগ্রসর হয়নি। এর বড় কারণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখার মত তথ্য সূত্রের অভাব। সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নসূত্র অনুসন্ধানের সুযোগ তৈরি হওয়ায় নতুন করে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস লেখার ধারা শুরু হয়েছে।
অথচ রমেশচন্দ্র মজুমদারের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা সূত্র-সংকটের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। তাই তাঁর গ্রন্থে (বাংলাদেশের ইতিহাস) অত্যন্ত সার্থকভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি ধারাবাহিকতা উপস্থাপিত হয়েছে অনেকটা স্পষ্টভাবেই।
ইতিহাসে একটি কথা রয়েছে যে ইতিহাস বা ইতিহাসের ঘটনা বার বার ফিরে আসে। এজন্যই হয়তো বলা হয় ইতিহাসে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। শেষ সত্যে পৌঁছা যায় না, তবে নতুন নতুন তথ্যে বার বার সংস্কার করে সত্যের দিকে এগিয়ে চলা যায়। রমেশচন্দ্র মজুমদার যে সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছিলেন তখন প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা থাকলেও নিজ মেধা প্রয়োগ করে তিনি অনেক বাধাই অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।
একারণেই তাঁর গ্রন্থে রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি প্রাচীন বাংলার সমাজ, ধর্ম, শিল্পকলা সকল কিছুই অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন একজন বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ। একজন ইতিহাস পাঠককে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জানানোর জন্য যেভাবে সূচি বিন্যাস করা দরকার তিনি এই গ্রন্থে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা করতে পেরেছেন। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থান বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে পাঠককে পরিচিত করিয়েছেন বাংলাদেশের সাথে। নৃতাত্ত্বিক নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে এই গ্রন্থে। এই জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ ধারা উন্মোচিত হয়েছে। রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাক্রম আলোচনায় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শাসকদের শাসনকালের বর্ণনা করেছেন গ্রন্থকার।
আমরা বলতেই পারি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিশেষ করে শিল্প ইতিহাস রচনার পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার তার গ্রন্থের শেষ পর্বে।
অবশ্য ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ পাঠ করা সমালোচকদের অভিযোগ রয়েছে রমেশচন্দ্র মজুমদারের মধ্যে কিছুটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। কারণ তিনি হিন্দুদের পাশাপাশি সাধারণ মুসলমানদের কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই ম্লেচ্ছ ও যবন বলে অভিহিত করেছেন তাঁর গ্রন্থে। কোনো কোনো জায়গায় ধর্মসম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ বিশ্লেষণে কিছুটা একদেশদর্শিতার সংকট রয়েছে। অবশ্য বঙ্গভঙ্গোত্তর বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে বিরোধের দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল তাতে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির মুসলমান ও একই ধারার হিন্দু-অবস্থান পুরুষানুক্রমে টিকে ছিল। আর. সি. মজুমদারের ইতিহাস চর্চ্চা কখনো কখনো খুব সীমিতভাবে হলেও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে এড়াতে পারেনি। পাঠক যদি সময়ের বাস্তবতা মেনে পাঠ করেন তবে খুব একটা অস্বস্তিতে পরতে হবে না।
এ কথাটি ঠিক রমেশচন্দ্র মজুমদার যখন গবেষণা করেন তখন প্রত্নউপাদানের অনেকটাই আবিষ্কৃত হয়নি। তাই কোনো কোনো ঘটনা বা সন তারিখ সচেতন মানুষের কাছে ভুল মনে হতে পারে। যেমন তিনি বখতিয়ার খলজির নদীয়া আক্রমণের তারিখ ১২০২ বলেছিলেন। এই তারিখ নিয়ে দীর্ঘকাল পর্যন্ত গবেষকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল। প্রায় আড়াই দশক আগে আমরা বখতিয়ার খলজির মুদ্রা শনাক্ত করতে পারি। আর মুদ্রা উত্তীর্ণের তারিখ যাচাই করে বলতে পারি নদীয়া আক্রমণের তারিখটি ছিল ১২০৪। ইতিহাস লিখনের এটিই রীতি। এভাবেই যুগে যুগে সংশোধিত হয় প্রাপ্ত নতুন উপাদান ব্যবহার করে। তাই ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে এজাতীয় তথ্য ভুল না ভেবে নির্দিষ্ট সময়ের সিদ্ধান্ত বলে মানতে হবে।
পাশাপাশি বখতিয়ার খলজি (ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি) প্রসঙ্গে বর্তমান গ্রন্থটিতে আরেকটি বিশ্লেষণ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত প্রকৃত ইতিহাসবিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্ট করছে। ইতিহাসের একটি ভুল ব্যাখ্যা দীর্ঘদিন থেকে আমরা বহন করে আসছিলাম। আর তা হচ্ছে বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়। ১৯৯৬-এ এনসিটিবির পাঠ্য বই, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বই ইত্যাদিতে সংস্কার করে আমরা লিখছি বখতিয়ারের অধিকৃত অঞ্চল বঙ্গ’ নয় নদীয়া ও লখনৌতি। অর্থাৎ প্রাচীন জনপদ বঙ্গে’র সীমানায় বখতিয়ার প্রবেশ করেননি। আবার বখতিয়ারের অনেক পরে মানচিত্রে বাংলা বা বাংলাদেশ নামে একটি ভূখণ্ড চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৩৫২-৫৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ পুরো বাংলাকে একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পর। সুতরাং বখতিয়ার প্রকৃত অর্থে বাংলা বা বঙ্গ বিজেতা নন। বাংলায় মুসলিম বিজয়ের দ্বারোঘাটন করেছিলেন মাত্র। অথচ অত আগে প্রত্নসূত্র না থাকলেও নিজ প্রজ্ঞা দিয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদার একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যায় ইতিহাসের সত্যটিই উপস্থিত করেছিলেন অত্যন্ত সার্থকভাবে। বর্তমান গ্রন্থের পাঠক মাত্রই ড. মজুমদারের অমন পাণ্ডিত্যের ছোঁয়ায় মুগ্ধ হবেন।
মুদ্রণ না থাকায় এই অসাধারণ গ্রন্থটি দীর্ঘকাল সহজলভ্য ছিল না। দিব্যপ্রকাশ ধ্রুপদী ইতিহাস গ্রন্থ পুণঃমুদ্রণ করে, অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করায় একটি প্রতীকী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থটি প্রকাশ করে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলো। দিব্যপ্রকাশের কর্ণধার প্রীতিভাজন সুলেখক মঈনুল আহসান সাবের যখন প্রকাশের পূর্বে এই বইখানির একটি ভূমিকা লিখে দিতে বললেন, তখন আমি বিব্রতবোধ করছিলাম। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত ঐতিহাসিকের গ্রন্থের ভূমিকা লেখা আমার মত অর্ব্বাচীনের সাজে না। কিন্তু সাবের ভাইয়ের অনুরোধ ফেলা মুশকিল। তাই ভূমিকা নয়–গ্রন্থ প্রসঙ্গে দুএকটি কথা বলার সুযোগটুকু নিলাম।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
অধ্যাপক
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
.
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
মালদহ-নিবাসী রজনীকান্ত চক্রবর্তী সর্বপ্রথমে বাংলা ভাষায় বাংলা দেশের মধ্যযুগের ইতিহাস রচনা করেন। কিন্তু তৎপ্রণীত ‘গৌড়ের ইতিহাস’ সেকালে খুব মূল্যবান বলিয়া বিবেচিত হইলেও ইহা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে লিখিত ইতিহাস বলিয়া গণ্য করা যায় না। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ও ১৩২৪ সনে প্রকাশিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস–দ্বিতীয় ভাগ’ এই শ্রেণীর প্রথম গ্রন্থ। ইহার ৩১ বৎসর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ইংরেজী ভাষার মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস প্রবীণ ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় (History of Bengal, Volume II, 1948)। কিন্তু এই দুইখানি গ্রন্থেই কেবল রাজনীতিক ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। রাখালদাসের গ্রন্থে “চৈতন্যদেব ও গৌড়ীয় সাহিত্য’ নামে একটি পরিচ্ছেদ আছে, কিন্তু অন্যান্য সকল পরিচ্ছেদেই কেবল রাজনীতিক ইতিহাসই আলোচিত হইয়াছে। শ্রীসুখময় মুখোপাধ্যায় ‘বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর: স্বাধীন সুলতানদের আমল (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দ)’ নামে একটি ইতিহাসগ্রস্ত লিখিয়াছেন। কিন্তু এই গ্রন্থখানিও প্রধানত রাজনীতিক ইতিহাস।
একুশ বৎসর পূর্বে মৎসম্পাদিত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ইংরেজী ভাষায় লিখিত বাংলার ইতিহাস প্রথম ভাগ (History of Bengal Vol. I. 1943) অবলম্বনে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ লিখিয়াছিলাম। ইংরেজী বইয়ের অনুকরণে এই বাংলা গ্রন্থেও রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক উভয়বিধ ইতিহাসের আলোচনা ছিল। এই গ্রন্থের এ যাবৎচারিটি সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে। ইহা এই শ্রেণীর ইতিহাসের জনপ্রিয়তা ও প্রয়োজনীয়তা সূচিত করে–এই ধারণার বশবর্তী হইয়া আমার পরম স্নেহাস্পদ ভূতপূর্ব ছাত্র এবং পূর্ব্বোক্ত বাংলা দেশের ইতিহাসের প্রকাশক শ্রীমান সুরেশচন্দ্র দাস, এম. এ. আমাকে একখানি পূর্ণাঙ্গ মধ্যযুগের ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ লিখিতে অনুরোধ করে। কিন্তু এই গ্রন্থ লেখা অধিকতর দুরূহ মনে করিয়া আমি নিবৃত্ত হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত বাংলার ইতিহাস-প্রথম ভাগে রাজনীতিক ও সামাজিক ইতিহাস উভয়ই আলোচিত হইয়াছিল –সুতরাং মোটামুটি ঐতিহাসিক উপকরণগুলি সকলই সহজলভ্য ছিল। কিন্তু মধ্যযুগের রাজনীতিক ইতিহাস থাকিলেও সাংস্কৃতিক ইতিহাস এ যাবৎ লিখিত হয় নাই। অতএব তাহা আগাগোড়াই নূতন করিয়া অনুশীলন করিতে হইবে। আমার পক্ষে বৃদ্ধ বয়সে এইরূপ শ্রমসাধ্য কার্যে হস্তক্ষেপ করা যুক্তিযুক্ত নহে বলিয়াই সিদ্ধান্ত করিলাম। কিন্তু শ্রীমান সুরেশের নির্বন্ধাতিশয্যে এবং দুইজন সহযোগী সাগ্রহে আংশিক দায়িত্বভার গ্রহণ করায় আমি এই কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি। একজন আমার ভূতপূর্ব ছাত্র অধ্যাপক শ্রীসুখময় মুখোপাধ্যায়। ইহাদের সহায়তার জন্য আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি।
বর্তমানকালে বাংলা দেশের–তথা ভারতের–মধ্যযুগের সংস্কৃতি বা সমাজের ইতিহাস লেখা খুবই কঠিন। কারণ এ বিষয়ে নানা প্রকার বদ্ধমূল ধারণা ও সংস্কারের প্রভাবে ঐতিহাসিক সত্য উপলব্ধি করা দুঃসাধ্য হইয়াছে। এই শতকের গোড়ার দিকে ভারতের মুক্তিসংগ্রামে যাহাতে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই যোগদান করে, সেই উদ্দেশ্যে হিন্দু রাজনীতিকেরা হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে কতকগুলি সম্পূর্ণ নূতন “তথ্য প্রচার করিয়াছেন। গত ৫০/৬০ বৎসর যাবৎ ইহাদের পুনঃপুনঃ প্রচারের ফলে এ বিষয়ে কতকগুলি বাঁধা গৎ বা বুলি অনেকের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করিয়াছে। ইহার মধ্যে যেটি সর্বাপেক্ষা গুরুতর–অথচ ঐতিহাসিক সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত-ত্রয়োদশ অধ্যায়ের-হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সম্বন্ধ অংশে আলোচনা করিয়াছি। ইহার সারমর্ম এই যে ভারতের প্রাচীন হিন্দু-সংস্কৃতি লোপ পাইয়াছে এবং মধ্যযুগে মুসলিম সংস্কৃতির সহিত সমন্বয়ের ফলে এমন এক সম্পূর্ণ নূতন সংস্কৃতির আবির্ভাব হইয়াছে, যাহা হিন্দুও নহে মুসলমানও নহে। মুসলমানেরা অবশ্য ইহা স্বীকার করেন না এবং ইসলামীয় সংস্কৃতির ভিত্তির উপরই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত, ইহা প্রকাশ্যে ঘোষণা করিয়াছেন। কিন্তু ভারতে হিন্দু-সংস্কৃতি’ এই কথাটি এবং ইহার অন্তর্নিহিত ভাবটি উল্লেখ করিলেই তাহা সংকীর্ণ অনুদার সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির পরিচায়ক বলিয়া গণ্য করা হয়। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা এই মতের সমর্থন করে কিনা তাঁহার কোনরূপ আলোচনা না করিয়াই কেবলমাত্র বর্তমান রাজনীতিক তাগিদে এই সব বুলি বা বাঁধা গৎ ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। একজন সর্বজনমান্য রাজনৈতিক নেতা বলিয়াছেন যে অ্যাংলো-স্যাকসন, জুট, ডেন ও নর্মান প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির মিলনে যেমন ইংরেজ জাতির উদ্ভব হইয়াছে, ঠিক সেইরূপে হিন্দু-মুসলমান একেবারে মিলিয়া (coalesced) একটি ভারতীয় জাতি গঠন করিয়াছে। আদর্শ হিসাবে ইহা যে সম্পূর্ণ কাম্য, তাহাতে সন্দেহ নাই-কিন্তু ইহা কতদূর ঐতিহাসিক সত্য, তাহা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এই জন্যই এই প্রসঙ্গটি এই গ্রন্থে আলোচনা করিতে বাধ্য হইয়াছি। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ঐতিহাসিক প্রণালীতে বিচারের ফলে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি, তাহা অনেকেই হয়ত গ্রহণ করিবেন না। কিন্তু “বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ” একই নীতিবাক্য স্মরণ করিয়া আমি যাহা প্রকৃত সত্য বলিয়া বুঝিয়াছি, তাহা অসঙ্কোচে ব্যক্ত করিয়াছি। এই প্রসঙ্গে ৫১ বৎসর পূর্বে আচার্য যদুনাথ সরকার বর্ধমান সাহিত্য সম্মিলনের ইতিহাস-শাখার সভাপতির ভাষণে যাহা বলিয়াছিলেন, তাঁহার কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি :
“সত্য প্রিয়ই হউক, আর অপ্রিয়ই হউক, সাধারণের গৃহীত হউক আর প্রচলিত মতের বিরোধী হউক, তাহা ভাবিব না। আমার স্বদেশগৌরবকে আঘাত করুক আর না করুক, তাহাতে ভ্রূক্ষেপ করিব না। সত্য প্রচার করিবার জন্য, সমাজের বা বন্ধুবর্গের মধ্যে উপহাস ও গঞ্জনা সহিতে হয়, সহিব। কিন্তু তবুও সত্যকে খুঁজিব, গ্রহণ করিব। ইহাই ঐতিহাসিকের প্রতিজ্ঞা।”
এই আদর্শের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া, হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছি, তাহা অনেকেরই মনঃপূত হইবে না ইহা জানি। তাঁহাদের মধ্যে যাহারা ইহার ঐতিহাসিক সত্য স্বীকার করেন, তাঁহারাও বলিবেন যে এরূপ সত্য প্রচারে হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও জাতীয় একীকরণের (National integration) বাধা জন্মিবে। একথা আমি মানি না। মধ্যযুগের ইতিহাস বিকৃত করিয়া কল্পিত হিন্দু-মুসলমানের ভ্ৰাতৃভাব ও উভয় সংস্কৃতির সমন্বয়ের কথা প্রচার করিয়া বেড়াইলেই ঐ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে না। সত্যের দৃঢ় প্রস্তরময় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা না করিয়া কাল্পনিক মনোহর কাহিনীর বালুকার স্তূপের উপর এইরূপ মিলন-সৌধ প্রস্তুত করিবার প্রয়াস যে কিরূপ ব্যর্থ হয় পাকিস্তান তাঁহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে আমি যাহা লিখিয়াছি-রাজনীতিক দলের বাহিরে অনেকেই তাঁহার সমর্থন করেন–কিন্তু প্রকাশ্যে বলিতে সাহস করেন না। তবে সম্প্রতি ইহার একটি ব্যতিক্রম দেখিয়া সুখী হইয়াছি। এই গ্রন্থের যে অংশে হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতির সমন্বয় সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি তাহা মুদ্রিত হইবার পরে প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি প্রবন্ধ পড়িলাম। বড়বাবু’ নামক গ্রন্থে চারি মাস পূর্বে ইহা প্রকাশিত হইয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই যে কিরূপ নিষ্ঠার সহিত পরস্পরের সংস্কৃতির সহিত কোনও রূপ পরিচয় স্থাপন করিতে বিমুখ ছিল, আলী সাহেব তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গপ্রধান সরস রচনায় তাঁহার বর্ণনা করিয়াছেন। কয়েক পংক্তি উদ্ধৃত করিতেছিঃ
“ষড়দর্শননির্মাতা আর্য্য মনীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান আগমনের পর সাত শত বৎসর ধরে আপন আপন চতুষ্পঠীতে দর্শনচর্চ্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় ঐ সাত শত বৎসর ধরে যে আরবীতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিওপ্লতনিজম্ তথা কিন্দী, ফারাবী বুআলীসিনা (লাতিনে আভিসেনা), অল গাজ্জালী (লাতিনে অল-গাজেল), আবুরুশ (লাতিনে আভের) ইত্যাদি মনীষীগণের দর্শনচর্চ্চা হল তার কোনো সন্ধান পেলেন না। এবং মুসলমান মৌলানারাও কম গাফিলী করলেন না। যে মৌলানা অমুসলমান প্লাতো আরিস্ত তলের দর্শনচর্চ্চায় সোৎসাহে সানন্দে জীবন কাটালেন তিনি এক বারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুষ্পঠীতে কিসের চর্চ্চা হচ্ছে। …এবং সবচেয়ে পরমাশ্চর্য, তিনি যে চরক সুশ্রুতের আরবী অনুবাদে পুষ্ট বুআলীসিনার চিকিৎসাশাস্ত্র..আপন মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, সুলতান বাদশার চিকিৎসার্থে প্রয়োগ করেছেন, সেই চরক সুশ্রুতের মূল পাশের টোলে পড়ান হচ্ছে তারই সন্ধান তিনি পেলেন না।…পক্ষান্তরে ভারতীয় আয়ুর্বেদ মুসলমানদের ইউনানী চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে বিশেষ কিছু নিয়েছে বলে আমার জানা নেই।… শ্রীচৈতন্যদেব নাকি ইসলামের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন…কিন্তু চৈতন্যদেব উভয় ধর্ম্মের শাস্ত্রীয় সম্মেলন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। বস্তুত তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দুধর্ম্মের সংগঠন ও সংস্কার, এবং তাকে ধ্বংসের পথ থেকে নবযৌবনের পথে নিয়ে যাবার।* [*এই গ্রন্থের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে-ধর্ম ও সমাজ অংশে আমিও এই মত ব্যক্তি করিয়াছি।] …মুসলমান যে জ্ঞানবিজ্ঞান ধর্মদর্শন সঙ্গে এনেছিলেন, এবং পরবর্তী যুগে বিশেষ করে মোগল আকবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত মঙ্গোল-জর্জরিত ইরান-তুরান থেকে যেসব সহস্র কবি পণ্ডিত ধর্মজ্ঞ দার্শনিক এদেশে এসে মোগল রাজসভায় আপন আপন কবিত্ব পাণ্ডিত্য নিঃশেষে উজাড় করে দিলেন তার থেকে এ দেশের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, দার্শনিক কণামাত্র লাভবান হন নি।…হিন্দু পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি।’
সৈয়দ মুজতবা আলীর এই উক্তি আমি আমার মতের সমর্থক প্রমাণ স্বরূপ উদ্ধৃত করি নাই। কিন্তু একদিকে যেমন রাজনীতির প্রভাবে হিন্দু মুসলমানের সংস্কৃতির মধ্যে একটি কাল্পনিক মিলনক্ষেত্রের সৃষ্টি হইয়াছে, তেমনি একজন মুসলমান সাহিত্যিকের মানসিক অনুভূতি যে ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করে ইহা দেখানই আমার উদ্দেশ্য। ঐতিহাসিক আলোচনার দ্বারা আমি যে সত্যের সন্ধান পাইয়াছি, তাহা রাজনীতিক বাঁধা বুলির অপেক্ষা এই সাহিত্যিক অনুভূতিরই বেশি সমর্থন করে। আমার মত যে অভ্রান্ত এ কথা বলি না। কিন্তু প্রচলিত মতই যে সত্য তাহাও স্বীকার করি না। বিষয়টি লইয়া নিরপেক্ষভাবে ঐতিহাসিক প্রণালীতে আলোচনা করা প্রয়োজন-এবং এই গ্রন্থে আমি কেবলমাত্র তাহাই চেষ্টা করিয়াছি। আচার্য যদুনাথ ঐতিহাসিক সত্য নির্ধারণের যে আদর্শ আমাদের সম্মুখে ধরিয়াছেন তাহা অনুসরণ করিয়া চলিলে হয়ত প্রকৃত সত্যের সন্ধান মিলিবে। এই গ্রন্থ যদি সেই বিষয়ে সাহায্য করে তাহা হইলেই আমার শ্রম সার্থক মনে করিব।
এই গ্রন্থের ‘শিল্প’ অধ্যায় প্রণয়নে শ্রীযুক্ত শ্রীঅমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রণীত ‘বাঁকুড়ার মন্দির’ হইতে বহু সাহায্য পাইয়াছি। তিনি অনেকগুলি ফটোও দিয়াছেন। এইজন্য তাঁহার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি। আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টও বহু ফটো দিয়াছেন–ইহার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। স্থানান্তরে কোন্ ফটোগুলি কাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত, তাঁহার উল্লেখ করিয়াছি।
মধ্যযুগের বাংলায় মুসলমানদের শিল্প সম্বন্ধে ঢাকা হইতে প্রকাশিত এ এ দানীর গ্রন্থ হইতে বহু সাহায্য পাইয়াছি। এই গ্রন্থে মুসলমানগণের বহুসংখ্যক সৌধের বিস্তৃত বিবরণ ও চিত্র আছে। হিন্দুদের শিল্প সম্বন্ধে এই শ্রেণীর কোন গ্রন্থ নাই–এবং হিন্দু মন্দিরগুলি চিত্র সহজলভ্য নহে। এই কারণে শিল্পের উৎকর্ষ হিসাবে মুসলমান সৌধগুলি অধিকতর মূল্যবান হইলেও হিন্দু মন্দিরের চিত্রগুলি বেশি সংখ্যায় এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।
পূর্বেই বলিয়াছি যে মধ্যযুগের বাংলার সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস ইতিপূর্বে লিখিত হয় নাই। সুতরাং আশা করি এ বিষয়ে এই প্রথম প্রয়াস বহু দোষত্রুটি সত্ত্বেও পাঠকদের সহানুভূতি লাভ করিবে।
মধ্যযুগের ইতিহাসের আকরগ্রন্থগুলিতে সাধারণত হিজরী অব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। পাঠকগণের সুবিধার জন্য এই অব্দগুলির সমকালীন খ্রীষ্টীয় অব্দের তারিখসমূহ পরিশিষ্টে দেওয়া হইয়াছে।
মধ্যযুগে বাংলা দেশে মুসলমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরেও বহুকাল পর্যন্ত কয়েকটি স্বাধীন হিন্দুরাজ্য প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে ত্রিপুরা এবং কোমতা-কোচবিহার এই দুই রাজ্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এক কালে এ দুয়েরই আয়তন বেশ বিস্তৃত ছিল। উভয় রাজ্যেই শাসন কার্যে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হইত এবং বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি হইয়াছিল–হিন্দু ধর্ম্মের প্রাধান্যও অব্যাহত ছিল। ত্রিপুরার রাজকীয় মুদ্রায় বাংলা অক্ষরে রাজা ও রাণী এবং তাঁহাদের ইষ্ট দেবতার নাম লিখিত হইত। মধ্যযুগে হিন্দুর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রতীক স্বরূপ বাংলার ইতিহাসে এই দুই রাজ্যের বিশিষ্ট স্থান আছে। এই জন্য পরিশিষ্টে এই দুই রাজ্য সম্বন্ধে পৃথকভাবে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিয়াছি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী কোচবিহারের ও ত্রিপুরার মুদ্রার বিবরণী ও চিত্র সংযোজন করিয়াছেন, এজন্য আমি তাঁহাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি।
শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
৪নং বিপিন পাল রোড
কলিকাতা-২৬
.
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
এই সংস্করণে নবাবিষ্কৃত ত্রিপুরার কয়েকটি মুদ্রার বিবরণ সংযোজিত হইয়াছে। ত্রিপুরা সরকার একখানি নূতন পুঁথি হইতে ‘রাজমালার নূতন সংস্করণ প্রকাশিত করিয়াছেন। এই গ্রন্থখানি কলিকাতায় না পাওয়ায় ত্রিপুরা সরকারের নিকট ভি. পি. ডাকযোগে পাঠাইতে চিঠি লিখিয়াছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় গ্রন্থখানি তো দূরের কথা চিঠির উত্তরও পাই নাই। গ্রন্থখানি যথাসময়ে পাইলে ত্রিপুরা সম্বন্ধে হয়ত নূতন সংবাদ মিলিত। নিজের দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে এরূপ ঔদাসীন্য দুঃখের বিষয়।
ত্রিপুরার কয়েকটি নূতন মুদ্রার সাহায্যে ড. অমরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী পরিশিষ্টে ত্রিপুরারাজ্যের মুদ্রা সম্বন্ধে যে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন তাহা পূর্বে কোথাও প্রকাশিত হয় নাই।
বর্তমান রাজনীতিক পরিস্থিতিতে এই গ্রন্থের নামকরণ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। ১৯৪৫ সালে এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ইহাতে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ–উভয়েরই ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে। তখন হইতেই ইহার নাম “বাংলা দেশের ইতিহাস”। কিছু দিন পূর্ব পর্যন্ত এই নামের অর্থ তথা এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে কাহারও মনে কোন সন্দেহ বা কোন প্রশ্ন জাগিবার অবকাশ ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া “বাংলাদেশ” নাম গ্রহণ করায় গোলযোগের সৃষ্টি হইয়াছে। কেহ কেহ আমাদিগকে বর্তমান গ্রন্থের নাম পরিবর্তন করিতে অনুরোধ করিয়াছেন। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নাই। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা আবশ্যক যে ইতিহাসের দিক হইতে পূর্ববঙ্গের “বাংলাদেশ” নাম গ্রহণের কোন সমর্থন নাই। “বাংলা”র পূর্বরূপ “বাঙ্গালা” নাম মুসলমানদের দেওয়া-নামটি বাংলার একটি ক্ষুদ্র অংশের নাম “বঙ্গাল” শব্দের অপভ্রংশ, ইহা “বঙ্গ” শব্দের মুসলমান রূপ নহে। মুসলমানেরা প্রথম হইতেই সমগ্র বঙ্গদেশকে মুলুক বাঙ্গালা বলিত। চতুর্দ্দশ শতাব্দী হইতেই “বাঙ্গালা” (Bangalah) শব্দটি গৌড় রাজ্য বা লখনৌতি রাজ্যের প্রতিশব্দরূপে বিভিন্ন সমসাময়িক মুসলিম গ্রন্থে (যেমন ‘সিরাৎ-ই-ফিরোজ শাহী’) ব্যবহৃত হইয়াছে। পরে হিন্দুরাও দেশের এই নাম ব্যবহার করেন। পর্তুগীজরা যখন এদেশে আসেন তখন সমগ্র (পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ) বঙ্গদেশের এই ‘বাঙ্গালা’ নাম গ্রহণ করিয়া ইহাকে বলেন ‘Bengala’ পরে ইংরেজেরা ইহার ঈষৎ পরিবর্তন করিয়া লেখেন ‘Banglah’। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে ইংরেজের আমলে যে দেশ Bengal বলিয়া অভিহিত হইত, মুসলমান শাসনের প্রথম হইতেই সেই সমগ্র দেশের নাম ছিল বাঙ্গালা–বাংলা। সুতরাং বাংলা দেশ ইংরেজ আমলের Bengal প্রদেশের নাম–ইহার কোন এক অংশের নাম নয়। বঙ্গদেশের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সকল অংশের লোকেরাই চিরকাল বাঙালী বলিয়াই নিজেদের পরিচয় দিয়াছে, আজও দেয়। ইহাও সেই প্রাচীন বঙ্গাল ও মুসলমানদের মুলুক ‘বাঙ্গালা’ নামই স্মরণ করাইয়া দেয়। আজ পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা বাঙালী বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে না ইহাও যেমন অদ্ভুত, অসঙ্গত ও হাস্যকর, ‘বাংলাদেশ’ বলিলে কেবল পূর্ববঙ্গ বুঝাইবে ইহাও দ্রুপ অদ্ভুত, অসঙ্গত ও হাস্যকর।
দীর্ঘকাল ধরিয়া বাঙ্গালা, বাংলাদেশ, বাঙালী শব্দগুলি সমগ্র Bengal বা বাংলা অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার পর আজ হঠাৎ কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গকে (যাহা আদিতে মুসলমানদের “বাঙ্গালা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।–”বঙ্গ ওয়া বাঙ্গালাহ” তাঁহার প্রমাণ), “বাংলাদেশ” বলিতে হইবে এরূপ ব্যবস্থা বা ঘোষণা করার অধিকার কোন গভর্নমেন্টের নাই। উপরে উল্লিখিত কারণগুলি ছাড়া আরও একটি কারণে ইহা অযৌক্তিক। অবিভক্ত বাংলা দেশের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির গঠনে যাহারা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী অধিবাসী তাঁহাদের পূর্বপুরুষদের অবদানও যথেষ্ট ছিল। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়া “বাংলাদেশ” ও ইহার অধিবাসীদের বাদ দিয়া “বাঙালী জাতি” কল্পনা করা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য লর্ড কার্জন যখন বাংলাকে দুই ভাগ করিয়াছিলেন, তখন পশ্চিম অংশেরই নাম রাখিয়াছিলেন Bengal অর্থাৎ “বাংলা”। বর্তমান বাংলা দেশ তখন পূর্ববঙ্গ (East Bengal) বলিয়া অভিহিত হইত।
বর্তমান পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রনায়কগণ ইতিহস ও ভূগোলকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হইয়া তাহাদের দেশের “বাংলাদেশ’ নাম গ্রহণ করিয়াছেন। ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইহার কোন প্রতিবাদ করেন নাই–ইহার কারণ সম্ভবত রাজনৈতিক। সাধারণ লোকে কিন্তু বাংলাদেশ” নামের অর্থ পরিবর্তনকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারে নাই। তাঁহার প্রমাণ–এখনও পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা দৈনন্দিন কথাবার্তায় ও লেখায় পশ্চিমবঙ্গকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করে; ভারতের আন্তঃরাজ্য ক্রীড়া-প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী পশ্চিমবঙ্গের দলগুলি “বাংলা দল” নামে আখ্যাত হয় এবং পশ্চিমবঙ্গে হরতাল পালিত হইলে তাহাকে “বাংলা বন্ধ” বলা হয়। আমরাও “বাংলাদেশ” নামের মৌলিক অর্থকে উৎখাত করার বিরোধী। সেইজন্য বর্তমান গ্রন্থের “বাংলা দেশের ইতিহাস” নাম অপরিবর্তিত রাখা হইল। শুধু পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিবঙ্গ নহে–ত্রিপুরা এবং বর্তমান বিহার ও আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বাংলা-ভাষী অঞ্চলগুলিকেও আমরা “বাংলাদেশ”-এর অন্তর্গত বলিয়া গণ্য করিয়াছি এবং এই সমস্ত অঞ্চলেরই ইতিহাস এই গ্রন্থে আলোচিত হইয়াছে।
শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
৩০ শে ভাদ্র, ১৩৮০
৪ নং বিপিন পাল রোড,
কলিকাতা-২৬
Leave a Reply