বাংলাদেশের ইতিহাস – ১ম খণ্ড (প্রাচীন যুগ) – রমেশচন্দ্র মজুমদার
উৎসর্গপত্র
অতি শৈশবেই যাহার ক্রোড়চ্যুত হইয়াছিলাম সেই পরমারাধ্যা পুণ্যফলে স্বর্গগতা জননী বিধুমুখী দেবী ও মাতৃহীন হইয়াও যাহার করুণায় মাতৃস্নেহ হইতে বঞ্চিত হই নাই সেই পুত-চরিত্রা স্বর্গীয়া মাতৃকল্পা গঙ্গামণি দেবীর পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে জন্মভূমির এই ক্ষুদ্র ইতিহাস উৎসর্গ করিয়া কৃতার্থ হইলাম।
জননী ও জন্মভূমি স্বর্গ হইতেও শ্রেষ্ঠ
.
প্রসঙ্গকথা (বর্ত্তমান সংস্করণ)
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এর বড় কারণ সমকালে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় দরবারী ইতিহাসও লেখা হয়নি। ফলে সাহিত্যের সূত্র, পর্যটকদের বিবরণ এবং সামান্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ব্যবহার করে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখা আধুনিক কালের একটি প্রয়াস বলা যেতে পারে। মধ্যযুগের ইতিহাস লেখায় বাড়তি সুযোগ এসেছে দিল্লিতে বসে সুলতান ও মোগল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা দরবারী ইতিহাস। এসব সূত্র ব্যবহার করে লেখা ইতিহাস রাজনৈতিক ইতিহাসের গণ্ডি পেরুতে পারেনি অনেক কাল পর্য্যন্ত। সেই অর্থে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখা একেবারে সাম্প্রতিক কালের প্রয়াস। এমন বাস্তবতার আদি সময়ে অনেকটা শূন্যতার মধ্য দিয়েই রমেশচন্দ্র মজুমদারকে বাংলা দেশের ইতিহাস নামে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখার যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। গত শতকের চল্লিশের দশকে রমেশ চন্দ্র মজুমদার যখন বাংলা ভাষায় বাংলার ইতিহাস লেখার পরিকল্পনা করেন তার অনেক বছর আগে অনেকটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে লেখা দুটো মাত্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এর একটি গৌড়রাজমালা। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদ রাম প্রসাদ চন্দের এই বইটি বাংলা ১৩৩৯ সাল অর্থাৎ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি পূর্ণাঙ্গ কোনো বাংলার ইতিহাস নয়। তবু বাংলার ইতিহাস রচনার পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ বলা যায়। এর দুই বছর পর বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষায় রচনা করেন বাঙ্গালার ইতিহাস। এরপর দীর্ঘ বিরতি কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই খণ্ডে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার প্রকল্প গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত হয় গ্রন্থ দুটো হবে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের প্রবন্ধের সংকলন। প্রাচীন যুগের গ্রন্থটি রমেশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় (R.C. Majumdar) The History of Bengal Volume-1, Hindu Period) নামে ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার আশা করেছিলেন গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ব্যক্তিগত আগ্রহে ও দায়বোধ থেকে শেষ পর্য্যন্ত তিনি প্রাচীন যুগপর্বের বাংলাদেশের ইতিহাস লেখায় আত্মনিয়োগ করেন।
এই গ্রন্থ রচনায় রমেশচন্দ্র মজুমদার একজন মেধাবি ঐতিহাসিকের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় নিজেই উল্লেখ করেছেন এই গ্রন্থ তিনি টিকা টিপ্পনির ভারে ভারাক্রান্ত করতে চাননি। সহজবোধ্যভাবে যেন পাঠক আত্মস্থ করতে পারে। অথচ তারপরেও নানা তথ্যে সমৃদ্ধ একটি অভিজাত ইতিহাস গ্রন্থই তিনি উপস্থাপন করেছিলেন।
আমরা দেখেছি বিশ শতক পর্য্যন্ত কালপরিসরের মধ্যে অল্প কয়েকজন ইতিহাসবিদের প্রয়াস ছাড়া প্রায় সকল ইতিহাস গ্রন্থই রাজনৈতিক ইতিহাসে আটকে ছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চ্চা তেমনভাবে অগ্রসর হয়নি। এর বড় কারণ সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখার মত তথ্য সূত্রের অভাব। সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নসূত্র অনুসন্ধানের সুযোগ তৈরি হওয়ায় নতুন করে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস লেখার ধারা শুরু হয়েছে।
অথচ রমেশচন্দ্র মজুমদারের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা সূত্র সংকটের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। তাই তাঁর গ্রন্থে (বাংলাদেশের ইতিহাস) অত্যন্ত সার্থকভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি ধারাবাহিকতা উপস্থাপিত হয়েছে অনেকটা স্পষ্টভাবেই।
ইতিহাসে একটি কথা রয়েছে যে ইতিহাস বা ইতিহাসের ঘটনা বার বার ফিরে আসে। এজন্যই হয়তো বলা হয় ইতিহাসে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। শেষ সত্যে পৌঁছা যায় না, তবে নতুন নতুন তথ্যে বার বার সংস্কার করে সত্যের দিকে এগিয়ে চলা যায়। রমেশচন্দ্র মজুমদার যে সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছিলেন তখন প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা থাকলেও নিজ মেধা প্রয়োগ করে তিনি অনেক বাধাই অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।
একারণেই তাঁর গ্রন্থে রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি প্রাচীন বাংলার সমাজ, ধর্ম্ম, শিল্পকলা সকল কিছুই অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার ছিলেন একজন বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ। একজন ইতিহাস পাঠককে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস জানানোর জন্য যেভাবে সূচি বিন্যাস করা দরকার তিনি এই গ্রন্থে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা করতে পেরেছেন। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থান বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে পাঠককে পরিচিত করিয়েছেন বাংলাদেশের সাথে। নৃতাত্ত্বিক নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে এই গ্রন্থে। এই জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ ধারা উন্মোচিত হয়েছে। রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাক্রম আলোচনায় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শাসকদের শাসনকালের বর্ণনা করেছেন গ্রন্থকার।
আমরা বলতেই পারি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিশেষ করে শিল্প ইতিহাস রচনার পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার তার গ্রন্থের শেষ পর্বে।
অবশ্য বাংলা দেশের ইতিহাস পাঠ করা সমালোচকদের অভিযোগ রয়েছে রমেশচন্দ্র মজুমদারের মধ্যে কিছুটা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। কারণ তিনি হিন্দুদের পাশাপাশি সাধারণ মুসলমানদের কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই ম্লেচ্ছ ও যবন বলে অভিহিত করেছেন তাঁর গ্রন্থে। কোনো কোনো জায়গায় ধর্ম্মসম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ বিশ্লেষণে কিছুটা একদেশদর্শিতার সংকট রয়েছে। অবশ্য বঙ্গভঙ্গোত্তর বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে বিরোধের দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল তাতে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির মুসলমান ও একই ধারার হিন্দু অবস্থান পুরুষানুক্রমে টিকে ছিল। আর. সি. মজুমদারের ইতিহাস চর্চ্চা কখনো কখনো খুব সীমিতভাবে হলেও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে এড়াতে পারেনি। পাঠক যদি সময়ের বাস্তবতা মেনে পাঠ করেন তবে খুব একটা অস্বস্তিতে পরতে হবে না।
এ কথাটি ঠিক রমেশচন্দ্র মজুমদার যখন গবেষণা করেন তখন প্রত্নউপাদানের অনেকটাই আবিষ্কৃত হয়নি। তাই কোনো কোনো ঘটনা বা সন তারিখ সচেতন মানুষের কাছে ভুল মনে হতে পারে। যেমন তিনি বখতিয়ার খলজির নদীয়া আক্রমণের তারিখ ১২০২ বলেছিলেন। এই তারিখ নিয়ে দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত গবেষকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল। প্রায় আড়াই দশক আগে আমরা বখতিয়ার খলজির মুদ্রা শনাক্ত করতে পারি। আর মুদ্রা উত্তীর্ণের তারিখ যাচাই করে বলতে পারি নদীয়া আক্রমণের তারিখটি ছিল ১২০৪। ইতিহাস লিখনের এটিই রীতি। এভাবেই যুগে যুগে সংশোধিত হয় প্রাপ্ত নতুন উপাদান ব্যবহার করে। তাই ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে এজাতীয় তথ্য ভুল না ভেবে নির্দিষ্ট সময়ের সিদ্ধান্ত বলে মানতে হবে।
পাশাপাশি বখতিয়ার খলজি (ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি) প্রসঙ্গে বর্ত্তমান গ্রন্থটিতে আরেকটি বিশ্লেষণ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত প্রকৃত ইতিহাসবিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্ট করছে। ইতিহাসের একটি ভুল ব্যাখ্যা দীর্ঘদিন থেকে আমরা বহন করে আসছিলাম। আর তা হচ্ছে ‘বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয়’। ১৯৯৬-এ এনসিটিবির পাঠ্য বই, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বই ইত্যাদিতে সংস্কার করে আমরা লিখছি বখতিয়ারের অধিকৃত অঞ্চল ‘বঙ্গ’ নয় নদীয়া ও লখনৌতি। অর্থাৎ প্রাচীন জনপদ বঙ্গের সীমানায় বখতিয়ার প্রবেশ করেননি। আবার বখতিয়ারের অনেক পরে মানচিত্রে বাংলা বা বাংলাদেশ নামে একটি ভূখণ্ড চিহ্নিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৩৫২-৫৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ পুরো বাংলাকে একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পর। সুতরাং বখতিয়ার প্রকৃত অর্থে বাংলা বা বঙ্গ বিজেতা নন। বাংলায় মুসলিম বিজয়ের দ্বারোঘাটন করেছিলেন মাত্র। অথচ অত আগে প্রত্নসূত্র না থাকলেও নিজ প্রজ্ঞা দিয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদার একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যায় ইতিহাসের সত্যটিই উপস্থিত করেছিলেন অত্যন্ত সার্থকভাবে। বর্ত্তমান গ্রন্থের পাঠক মাত্রই ড. মজুমদারের অমন পাণ্ডিত্যের ছোঁয়ায় মুগ্ধ হবেন।
মুদ্রণ না থাকায় এই অসাধারণ গ্রন্থটি দীর্ঘকাল সহজলভ্য ছিল না। দিব্যপ্রকাশ ধ্রুপদী ইতিহাস গ্রন্থ পুণঃমুদ্রণ করে, অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করায় একটি প্রতীকী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাংলা দেশের ইতিহাস গ্রন্থটি প্রকাশ করে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলো। দিব্যপ্রকাশের কর্ণধার প্রীতিভাজন সুলেখক মঈনুল আহসান সাবের যখন প্রকাশের পূর্ব্বে এই বইখানির একটি ভূমিকা লিখে দিতে বললেন, তখন আমি বিব্রতবোধ করছিলাম। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত ঐতিহাসিকের গ্রন্থের ভূমিকা লেখা আমার মত অর্ব্বাচীনের সাজে না। কিন্তু সাবের ভাইয়ের অনুরোধ ফেলা মুশকিল। তাই ভূমিকা নয়–গ্রন্থ প্রসঙ্গে দুএকটি কথা বলার সুযোগটুকু নিলাম।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
অধ্যাপক
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
.
প্রথম সংস্কর
প্রাচীন ভারতবাসিগণ সাহিত্যের নানা বিভাগে বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন, কিন্তু নিজেদের দেশের অতীত কাহিনী লিপিবদ্ধ করিবার জন্য তাঁহাদের কোনো আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না। পণ্ডিতপ্রবর কহলণ রাজতরঙ্গিণী নামক গ্রন্থে কাশ্মীরের ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করিয়াছেন। কিন্তু এই শ্রেণীর আর কোনো গ্রন্থ অদ্যাবধি ভারতবর্ষে আবিষ্কৃত হয় নাই। ইহার ফলে ভারতের প্রাচীন যুগের ইতিহাস একরকম বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ ভারতের প্রাচীন লিপি, মুদ্রা ও অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করিয়া হিন্দু যুগের ইতিহাস উদ্ধারের সূচনা করেন। কালক্রমে অনেক ভারতবাসীও তাঁহাদের প্রবর্তিত পথে অনুসন্ধান-কার্যে অগ্রসর হইয়াছেন। ইহাদের সমবেত চেষ্টার ফলে যে সমুদয় তথ্য আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাতে প্রাচীন যুগের ইতিহাসের কাঠামো রচনা করা সম্ভবপর হইয়াছে।
বাংলা দেশের প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা যে কতদূর গভীর ছিল, ১৮০৮ খৃষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় শর্মা রচিত রাজতরঙ্গ’ অথবা রাজাবলী’ গ্রন্থই তাঁহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বাংলার প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে বাঙ্গালী জাতির স্মৃতি ও জনশ্রুতি যে কতদূর বিকৃত হইয়াছিল, এবং পাঁচ-ছয় শত বৎসরের মধ্যে বাঙ্গালী জাতির ঐতিহাসিক সূত্র কিরূপে সমূলে ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল, এই গ্রন্থখানি পড়িলেই তাহা বেশ বোঝা যায়।
পরবর্ত্তী একশত বৎসরে পুরাতত্ত্ব আলোচনার ফলে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান যে কতদূর অগ্রসর হইয়াছিল, স্বর্গীয় রামপ্রসাদ চন্দ প্রণীত ‘গৌড়রাজমালা’ গ্রন্থখানি তাঁহার প্রমাণস্বরূপ গ্রহণ করা যাইতে পারে। এদেশের অনেকে বিশেষত প্রাচীণপন্থিগণ পুরাতত্ত্বকে ‘পাথুরে প্রমাণ’ বলিয়া উপহাস অথবা অবজ্ঞা করিয়া থাকেন। কিন্তু প্রাচীন ইতিহাসের উদ্ধারে ইহার মূল্য যে কত বেশী, ‘রাজাবলী’র সহিত ‘গৌড়রাজমালা’র তুলনা করিলেই তাহা বুঝা যাইবে।
‘গৌড়রাজমালা’ আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে লিখিত বাংলার প্রথম ইতিহাস। ১৩৩৯ সনে ইহা প্রকাশিত হয়। ইহার দুই বৎসর পরে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাণীত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ প্রকাশিত হয়। নামে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ হইলেও, ইহা প্রকৃতপক্ষে বাংলা ও মগধের ইতিহাস।
উল্লিখিত দুইখানি গ্রন্থেই কেবলমাত্র রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। বাংলার একখানি পূর্ণাঙ্গ লিখিবার কল্পনা অনেকবার হইয়াছে। ১৯১২ খৃষ্টাব্দে বাংলার গভর্ণর লর্ড কারমাইকেল ইহার সূত্রপাত করেন, এবং পরবর্ত্তী ত্রিশ বৎসরে আরও দুই-একজন এইরূপ চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা ফলবতী হয় নাই। স্বর্গীয় দীনশেচন্দ্র সেন এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ‘বৃহৎ বঙ্গ’ নামে দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ একখানি বৃহৎ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন (১৩৪১ সন)। কিন্তু, অনেক মূল্যবান তথ্য থাকিলেও এই গ্রন্থ বাংলার ঐতিহাসিক বিবরণ হিসাবে বিদ্বজ্জনের নিকট সমাদর লাভ করে নাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতেই সর্বপ্রথমে বাংলার একখানি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস প্রকাশিত হয়। আমার সম্পাদনায় তিন বৎসর হইল ইহার প্রথম খণ্ড বাহির হইয়াছে। ইহাতে হিন্দু যুগের শেষ পর্য্যন্ত বাংলার ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। এই গ্রন্থ ইংরেজিতে লিখিত। যখন ইহার প্রথম পরিকল্পনা হয়, তখন আমার ইচ্ছা ছিল যে, ইংরেজী গ্রন্থ বাহির হইবার পরই ইহার একখানি বাংলা অনুবাদ প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এই গ্রন্থ রচনায় বহু বিলম্ব হওয়ার ফলে, ইহার প্রকাশের পূর্ব্বেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে অবসর গ্রহণ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ত্তমান কর্তৃপক্ষগণ যে সত্বর ইহার বঙ্গানুবাদের কোনো ব্যবস্থা করিবেন, তাঁহার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে না। সুতরাং বাংলা ভাষায় বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস এবং বাঙ্গালীর ধৰ্ম্ম, শিল্প ও জীবনযাত্রার অন্যান্য বিভাগের মোটামুটি বিবরণসংবলিত একখানি ক্ষুদ্র গ্রন্থের বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করিয়া এই ইতিহাস লিখিতে প্রবৃত্ত হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত বাংলার ইতিহাস যে এই গ্রন্থের আদর্শ ও প্রধান উপাদান, তাহা বলাই বাহুল্য।
এই গ্রন্থ সাধারণ বাঙ্গালী পাঠকের জন্য, সুতরাং ইহাতে যুক্তি-তর্ক দ্বারা ভিন্ন ভিন্নমতের নিরাস ও প্রমাণপঞ্জীযুক্ত পাদটীকা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করিয়াছি। যাহারা এই সমুদয় জানিতে চাহেন, তাঁহারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ইংরেজী গ্রন্থখানি পাঠ করিতে পারেন। ইংরেজী ভাষায় অনভিজ্ঞ পাঠকের পক্ষে এই সমুদয় অনাবশ্যক, কারণ এ সম্বন্ধে প্রবন্ধ ও গ্রন্থগুলি প্রায় সবই ইংরেজী ভাষায় লিখিত।
হিন্দু যুগের বাংলা দেশ সম্বন্ধে যে সমুদয় তথ্য এ যাবৎ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাঁহারই সারমর্ম সংক্ষিপ্ত আকারে বাঙ্গালী পাঠকের নিকট উপস্থিত করিতেছি। যাঁহারা ইংরেজী ইতিহাসখানি পাঠ করিয়াছেন বা করিবেন, তাঁহাদের পক্ষে এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। কিন্তু যাঁহাদের ঐ গ্রন্থ পাঠের সুযোগ, সুবিধা অথবা সময় নাই, তাঁহারা ইহা পাঠ করিলে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করিতে পারিবেন। অবশ্য এই ইতিহাসের অতি সামান্যই আমরা জানি। কিন্তু এই গ্রন্থপাঠে যদি বাঙ্গালীর মনে দেশের প্রাচীন গৌরব সম্বন্ধে ক্ষীণ ধারণাও জন্মে এবং বাঙ্গালী জাতির অতীত ইতিহাস জানিবার জন্য কৌতূহল ও আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, তাহা হইলে আমার শ্রম সার্থক মনে করিব।
শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
৪নং বিপিন পাল রোড, কলিকাতা পৌষ, ১৩৫২
.
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হইয়াছে। ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, বাঙ্গালীর মনে অতীত ইতিহাস জানিবার আগ্রহ জন্মিয়াছে। সাত শত বৎসর পরে বাঙ্গালী হিন্দু পরাধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইয়াছে। সুতরাং যে যুগের ইতিহাস এই গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা জানিবার আগ্রহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাইবে, এরূপ ভরসা করা যায়। এই জন্যই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি করিয়া এই নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হইল।
এই সংস্করণে গ্রন্থখানি আদ্যোপান্ত পরিশোধিত করা হইয়াছে। প্রথম সংস্করণ মুদ্রিত হইবার পর বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে যে সমুদয় নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাও ইহাতে সন্নিবেশিত হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ হরিকেল ও চন্দ্রদ্বীপের অবস্থান, রাত উপাধিধারী নতুন এক রাজবংশ, ভবদের ভট্টের বালবলভীভুজঙ্গ উপাধির অর্থ, বল্লালসেনের গ্রন্থালয় এবং তাঁহার রচিত নূতন একখানি গ্রন্থ, ময়নামতী পাহাড়ে আবিষ্কৃত ভাস্কর্যের নিদর্শন, নূতন বাঙ্গালী বৈদ্যক গ্রন্থাকার প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে। ২৫ খানি নূতন ছবিও যোগ করা হইয়াছে।
তিন বৎসর পূর্ব্বে যখন এই গ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন গ্রন্থারম্ভে বাংলা দেশের নাম ও সীমা সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছিলাম, “পরিবর্ত্তনশীল রাজনৈতিক বিভাগের উপর নির্ভর করিয়া কোনো প্রদেশের সীমা ও সংজ্ঞা নির্ণয় করা যুক্তিযুক্ত নহে।” এই নীতির অনুসরণ করিয়া বঙ্গ-বিভাগ সত্ত্বেও এই ইতিহাসে বাংলা দেশের নাম ও সীমা সম্বন্ধে কোনো পরিবর্ত্তন করি নাই। যেখানে কোনো জিলা বা বিভাগের উল্লেখ আছে, সেখানেও অবিভক্ত বঙ্গে ইহা যেরূপ ছিল তাহাই বুঝিতে হইবে।
কিরূপে সুদূর প্রাচীনকাল, হইতে নানাবিধ বিবর্ত্তন ও পরিবর্ত্তনের ফলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা এক জাতিতে পরিণত হইয়াছিল, গ্রন্থশেষে তাঁহার আলোচনা করিয়াছি। বর্ত্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও এই অংশের কোনো পরিবর্ত্তন করি নাই। কারণ অতীতকালের বাঙ্গালী যে এক জাতি ছিল, ইহা ঐতিহাসিক সত্য। ভবিষ্যতের গর্ভে কী নিহিত আছে, তাহা কেহই বলিতে পারে না। যদি বর্ত্তমান বিভাগ চিরস্থায়ী হইয়া দুই বাংলার অধিবাসীর মধ্যে আচার, কৃষ্টি ও ভাষাগত গুরুতর প্রভেদেরও সৃষ্টি হয়, তথাপি বাঙ্গালীর এক জাতীয়তার ঐতিহ্য চিরদিনই বাঙ্গালীর স্মৃতির ভাণ্ডারে সমুজ্জ্বল থাকিবে। হয়তো অতীতেও এই স্মৃতি ভবিষ্যতের পথ-নির্ণয়ে সহায়তা করিবে। এই হিসাবে গ্রন্থের এই অংশ পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকতর প্রয়োজনীয় বলিয়াই মনে করি। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব্বেই গ্রন্থের এই অংশ রচিত হইয়াছিল। সুতরাং আশা করি কেহ ইহাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আন্দোলন বা প্রচারকাৰ্য্য বলিয়া মনে করিবেন না।
ভট্টপল্লী-নিবাসী শ্ৰীযুক্ত ভবতোষ ভট্টাচার্য মহাশয় বল্লালসেন-রচিত ব্রতসাগর গ্রন্থের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন। এই জন্য আমি তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি।
গ্রন্থোক্ত অনেক মন্দির, মূর্ত্তি ও চিত্রের প্রতিকৃতি দেওয়া সম্ভবপর হয় নাই। ইহাতে এই সমুদয়ের বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করা কষ্টসাধ্য হইবে। যে সকল পাঠক এই সমুদয় প্রতিকৃতি, দেখিতে চান, তাহারা ঢাকা, রাজসাহী ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের চিত্রশালার এবং কলিকাতা ও আশুতোষ যাদুঘরের মুদ্রিত মূর্ত্তি-তালিকা, স্বর্গীয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত “Eastern Indian School of Mediaevel Sculpture’, কাশীনাত দীক্ষিতের “Excavations at Pahaarpur’, cat ক্র্যামরিস প্রণীত “Pala and Sena Sculptures of Bengal”. শ্রীসরসীকুমার সরস্বতী রচিত “Early Sculpture of Bengal” এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত “History of Bengal, Vol. I” প্রভৃতি গ্রন্থে প্রায় সমুদয় শিল্প-নিদর্শনের প্রতিকৃতিই পাইবেন। এই গ্রন্থে বর্ণনার সাহায্যে ঐ সমুদয় গ্রন্থের চিত্রগুলি আলোচনা করিলে, ইংরেজী-অনভিজ্ঞ পাঠকও বাংলার প্রাচীন সভ্যতা ও কৃষ্টির সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাঁহার অতীত শিল্পকলা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করিতে পারিবেন। সাধারণত যে সমুদয় চিত্র সুপরিচিত নহে-যেমন গোবিন্দভিটা ও ময়নামতীর পোড়া-ইট, চট্টগ্রামের বুদ্ধমূর্ত্তি প্রভৃতি-তাহাই অধিকসংখ্যায় এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করিয়াছি। এই জন্য অনেক অধিকতর সুন্দর কিন্তু সুপরিচিত মূৰ্ত্তি বাদ গিয়াছে।
ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ ১৮, ২৬, ১৫ (খ), ৩০ ও ৩১ সংখ্যক চিত্রের ব্লক ও ৪, ১০, ১৪, ১৬, ২৪, ২৫ সংখ্যক চিত্রের ফটো দিয়াছেন। আশুতোষ যাদুঘর কাশীপুরের সূৰ্য্যমূর্ত্তি এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কোটালিপাড়ার সূৰ্য্যমূৰ্ত্তির ব্লক দিয়াছেন। ইহাদের সকলের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি।
শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
৪নং বিপিন লাল রোড
কলিকাতা
চৈত্র ১৩৫৫
.
প্রথম পরিচ্ছেদ : বাংলা দেশ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : বাঙ্গালী জাতি
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : প্রাচীন ইতিহাস
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : গুপ্ত-যুগ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায়
যষ্ঠ পরিচ্ছেদ : পালসাম্রাজ্য
সপ্তম পরিচ্ছেদ : পালসাম্রাজ্যের পতন
অষ্টম পরিচ্ছেদ : দ্বিতীয় পালসাম্রাজ্য
নবম পরিচ্ছেদ : তৃতীয় পালসাম্রাজ্য
দশম পরিচ্ছেদ : পালরাজ্যের ধ্বংস
একাদশ পরিচ্ছেদ : বৰ্ম্মরাজবংশ
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : সেনরাজবংশ
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : পাল ও সেনরাজগণের কাল-নির্ণয়
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : বাংলার শেষ স্বাধীন রাজ্য
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : রাজ্যশাসনপদ্ধতি
ষোড়শ পরিচ্ছেদ : ভাষা ও সাহিত্য
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : প্রথম খণ্ড-ধৰ্ম্মমত
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : সমাজের কথা
উনবিংশ পরিচ্ছেদ : অর্থনৈতিক অবস্থা
বিংশ পরিচ্ছেদ : শিল্পকলা
একবিংশ পরিচ্ছেদ : বাংলার বাহিরে বাঙ্গালী
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বাংলার ইতিহাস ও বাঙ্গালীজাতি
নিবেদনং
বাংলা লিপির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
.
Mohammad Ekramul Haque Khan
Very nice & fruitful books.