বড় আপা – কাসেম বিন আবুবাকার
উৎসর্গ
আমার অতি প্রিয় একজন
হাফেজ ও মুফতী দেলওয়ার হোসেন
“আল্লাহ যাহাকে ইচ্ছা জ্ঞান দান করেন। আর যে ব্যক্তি ধর্মজ্ঞান প্রাপ্ত হয়, সে অতি কল্যাণের বস্তু প্রাপ্ত হইল। বস্তুত ও নসীহত তাহারাই কবুল করে যাহারা বুদ্ধিমান।”
(২) “কারও শত্রু জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমান হওয়া তার জন্য একটি সৌভাগ্য।”
.
১
আশ্বিনের আধা-আধি। গ্রামের পুকুর-ডোবা, খাল-বিল, নদী-নালা, মাঠ-ঘাট পানিতে থৈ-থৈ করছে। মাঠে মাঠে সবুজের সমারোহ। ধানগাছগুলো বাতাসে ঢেউ তুলে মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি করছে। ধান গাছের এখন ভরা যৌবন। চাষীরা বলে ধান গাছ পোয়াতি হতে শুরু করেছে। দু’দিন খুব গুমোট ছিল। আজ বিকেল থেকে আকাশে কুচকুচে কালো মেঘ সাজতে শুরু করল। তাই দেখে গ্রামের বৌড়ী-ঝিউড়ীরা হাঁস-মুরগী খোয়াড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যাদের হাঁস খাবারের সন্ধানে মাঠে ছিল, তারা মাঠের ধারে এসে চই-চই শব্দ করে ডাকতে লাগল। রাখালেরা গরু-বাছুর গোয়ালে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ঠিক মাগরিবের আজানের আগে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। সে কি ভীষণ ঝড়। বহু গাছ-পালা উপড়ে পড়ল। অনেক কাঁচা বাড়ি নষ্ট হল। অনেকের ঘরের টিনের চাল। উড়ে গেল। মাগরিব ও এশার নামায পড়তে কেউ মসজিদে যেতে পারল না। মসজিদের পাশে ইমাম সাহেব ও মোয়াজ্জেন সাহেবের থাকার ঘর। তারাও মসজিদে যেতে পারলেন না। থাকার ঘরের ভিতরেই আজান দিয়ে নামায পড়লেন।
গোপালগঞ্জ জেলার বাহিরবাগ গ্রামের আব্দুল মতিন চৌধুরী খুব অবস্থাপন্ন। গৃহস্থ। তার দাদাজী আব্দুস সাত্তারের নানারা ছিলেন পাঁচ ভাই। তাদের কোনো বোন ছিল না। তারা ছিলেন জমিদার। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাইয়ের এক ছেলে ও সেজ ভাইয়ের এক মেয়ে ছাড়া আর কারো সন্তানাদি হয়নি। সব ভাই একান্নবর্তী পরিবারে বাস করতেন। পাঁচ ভাই ও তাদের বৌয়েদের মধ্যে খুব মিলমিশ ছিল। যা কিছু করতেন সব ভাই পরামর্শ করে করতেন। ছোট ভাইয়েরা বড় ভাইকে বাবার মতো সম্মান করতেন। জায়েরাও সংসারের কাজ-কর্ম মিলে মিশে করতেন। ছোট জায়েরা বড় জাকে মায়ের মতো সম্মান করতেন। পাঁচ ভাই ও পাঁচ জা ঐ ছেলে মেয়ে দু’টোকে চোখের মনি মনে করতেন। তারা বড় হওয়ার পর চাচাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে দেন এবং সব বিষয় সম্পত্তি তাদের নামে লিখে দেন। জমিদাররা সাধারণত প্রজাদের শোষণ করে থাকেন। কিন্তু তারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন। প্রজাদের ভালো-মন্দের দিকে খুব লক্ষ্য রাখতেন। কোনো গরিব প্রজার অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসকের ব্যবস্থা করতেন। এক এক ভাই যখন খাজনা উসুলের সময় গোমস্তার সঙ্গে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেতেন তখন সেখানকার প্রজাদের সঙ্গে তাদের সুবিধা-অসুবিধা আলাপ করতেন এবং অসুবিধাগুলো দূর করার ব্যবস্থা করতেন। যেখানে স্কুল-মাদ্রাসা নেই, সেখানে করে দিয়েছেন। সে সব চালাবার দায়িত্ব নিজেরা বহন করতেন। তখন ইংরেজরা এই দেশ শাসন করত। তারা যখন জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে তখন তাদের জমিদারী চলে যায়। তবু জমি জায়গা তাদের প্রচুর ছিল। সেই সময় আব্দুস সাত্তারের জন্ম হয়। তিনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাদের সব সম্পত্তির মালিক হন। আব্দুস সাত্তারের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে বড়। নাম আব্দুস সালাম। আর মেয়ের নাম খাদিজা। খাদিজা বার বছর বয়সে মারা যায়। আব্দুস সালামের এক মাত্র সন্তান আব্দুল মতিন।
আব্দুল মতিন যে বছর এইচ. এস. সি. পাশ করেন সেই বছর তার বাবা আব্দুস সালাম মারা যান। আব্দুস সাত্তার নাতিকে আরো পড়াতে চাইলেন। কিন্তু আব্দুল মতিন বাবা মারা যাওয়ার পর পড়াশোনাতে মন বসাতে পারলেন না। সে কথা দাদীজীকে জানিয়ে বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করতে লাগলেন।
আব্দুস সাত্তার নাতির বিয়ের বয়স হলে আজিজা বেগম নামে এক আলেমের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন। আজিজা বেগম মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেছেন। তাদের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। প্রথমে দুই মেয়ে, রুকসানা ও ফারজানা। ফারজানা চার বছর বয়সে মারা গেছে। তারপর পরপর তিন ছেলে, আব্দুর রসিদ, আব্দুস সামাদ ও আব্দুল করিম। সবার ছোট মেয়ে মনিরা। যে বছর মনিরার জন্ম হয় সেই বছর আব্দুস সাত্তার মারা যান। তার এক বছর পর তার স্ত্রীও মারা যান।
আজ পাঁচ বছর হতে চলল স্ট্রোক করে আব্দুল মতিনের ডান হাত ও ডান পা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। চলাফেরা করতে পারেন না। তাই হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন।
রুকসানা দেখতে ভালো হলেও চোখ দুটো খুব বড় ও বেমানান। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তার চোখের দিকে তাকালে ভয় পায়। বড়রা ভয় না পেলেও খারাপ মন্তব্য করে। সবাই বলাবলি করে, “চৌধুরী বাড়ির বড় মেয়ের চোখ গরুর চোখের চেয়ে বড়। এতবড় চোখ তারা আর কোনো মানুষের দেখেনি।” তাই আজিজা বেগম তাকে পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে দিতেন না। বাহিরবাগে হাই স্কুল থাকায় প্রাইমারী পাশ করার পর রুকসানা প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি. পাশ করে। তারপর গোপালগঞ্জে হোস্টেলে থেকে গোপালগঞ্জ কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেছে। তার তিন ভাইও ঐ কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেছে। বড় আব্দুর রসিদ চাষ-বাস দেখাশোনা করে। মেজ আব্দুস সামাদ বাড়ির কাছা-কাছি বাজারে তিন চার জন কর্মচারী নিয়ে বিরাট একটা মুদিখানা দোকান চালায়। আর ছোট আব্দুল করিম একটা রাইস মিল দেখাশোনা করে। তিন ভাইয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড় জনের দু’টো ছেলেমেয়ে। মেজ ও ঘোটর এখনো কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি।
সংসারের সব দায়-দায়িত্ব রুকসানার উপর। তার এখনও বিয়ে হয়নি। অবশ্য বি.এ. পাশ করার পর আব্দুল মতিন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রুকসানা রাজি হয়নি। তিন ভাইয়ের বৌয়েরা শিক্ষিতা। ভাইয়েরা ও তাদের বৌয়েরা রুকসানাকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে। চৌধুরী বাড়ির প্রথম সন্তান হিসাবে রুকসানাকে সবাই বড় আপা বলে। তার কথার এতটুকু অমান্য করার সাহস কারো নেই। তিন ভাই ও তিন জা বড় আপার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও সফল হয়নি।
আজিজা বেগম নিজে যেমন ধর্মীয় সবকিছু মেনে চলেন, ছেলে-মেয়েদেরকেও তেমনি ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছেন। তাই তারা স্কুল কলেজে পড়লেও ধর্মীয় সবকিছু মেনে চলে।
রুকসানা বি.এ. পাশ করার পর সমাজ কল্যাণের কাজ করছে। বোরখা পরে গ্রামের সহায় সম্বলহীন দুস্থ নারী-পুরুষদের খোঁজ নিয়ে যাকে যেভাবে সাহায্য করা দরকার, সেইভাবে তাকে সাহায্য করে। গরিব ঘরের যে সব মেয়েদের টাকার জন্য বিয়ে হয়নি, তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। বিধবা ও গরিব ঘরের বৌয়েদের এবং শিক্ষিত-অশিক্ষিত ছেলেদের কর্মসংস্থানের জন্য কুটিরশিল্পের একটা কারখানা করেছে। সকাল বিকেল সেটা দেখা-শোনা করে। বাড়ির নিচতলার একটা বড় রুমে নাইট স্কুল খুলেছে। রুমটা পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। মাঝখানে হার্ডবোর্ডের পার্টিশন করা। একপাশে মেয়েরা বসে আর একপাশে পুরুষরা। তাদেরকে রুকসানা প্রথমে বাংলা ও কুরআন শিক্ষা দেয়। পরে ইসলামের মৌলিক নিয়ম-কানুন ও মসলা-মাসায়েল শিক্ষা দেয়। গ্রামের ছোট বড় সবার কাছে রুকসানা বড় আপা নামে সুপরিচিত। যে কেউ যে কোনো সমস্যায় পড়লে বড় আপার কাছে আসে। রুকসানা যথাসাধ্য তাদের সমস্যা সমাধান করে দেয়।
চৌধুরী বাড়িতে সুখ-স্বাচ্ছন্দের কোনো অভাব নেই। কিন্তু রুকসানা বিয়ে করতে রাজি না হয়ে ক্রমশ সমাজ কল্যাণের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে দেখে তার মা-বাবা, ভাই ও তাদের বৌয়েরা অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছে। আজ যোহরের নামাযের পর তিন জা পরামর্শ করল, বড় আপা কেন বিয়ে করতে চায় না জানতে হবে।
বড় জা সুরাইয়া বলল, আমার মনে হয় বড় আপা কলেজে পড়ার সময় কাউকে ভালবেসেছিল, সে হয়তো বিট্টে করেছে।
মেজ আরেফা বলল, আমারও তাই মনে হয়।
ছোট মমতাজ বলল, তা হয়তো হতে পারে। তবে আমার মনে হয়, বড় আপা। স্কুলে পড়ার সময় গ্রামের কোনো গরিব ছেলেকে ভালবেসেছিল, সাহস করে আব্বা আম্মাকে জানাতে পারেনি। তাই বিয়ে করেনি।
সুরাইয়া বলল, তোমার কথা শুনে এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে। কারণ আমি তাকে প্রায়ই দিন আসরের নামাযের পর বাগানে যেতে দেখে একদিন করিমন বুয়াকে পাঠিয়েছিলাম। সে ফিরে এসে বলল, বড় আপা বাগানের দক্ষিণ দিকে যে দালান আছে, সেখানে বসে আছে, আর তার চোখ থেকে পানি পড়ছে।
সুরাইয়া থেমে যেতে আরেফা বলল, তোমার আগে আমিও একদিন চর লাগিয়ে সেকথা জেনেছি। তাই তো ঐ কথা বললাম।
মমতাজ বড় জাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমাদের দুজনের চেয়ে বড় আপার সঙ্গে তোমার বেশি ভাব। তুমিই এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আলাপ কর।
আরেফা বলল, আমিও কথাটা বলব ভাবছিলাম।
সুরাইয়া বলল, ঠিক আছে, সময় সুযোগ পেলে দু’একদিনের মধ্যে আলাপ করব।
আজ যখন ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল তখন মাগরিবের নামাযের পর চা-নাস্তা খাওয়ার। জন্য একে একে সবাই ডাইনিংরুমে এসে মেঝেয় বিছানো কার্পেটের উপর দস্তরখানের চারপাশে বসল। তিন জা চায়ের ফ্লাক্স ও নাস্তার প্লেট নিয়ে এল। কিন্তু পরিবেশন করল না। আব্দুল মতিন শুধু হুইল চেয়ারে বসে আছেন। তাই তার সামনে একটা ছোট টেবিল। আগে চেয়ার-টেবিলে খাওয়া হত। সুন্নাতের বরখেলাপ বলে রুকসানাই মেঝেয় বসে খাওয়ার নিয়ম চালু করেছে। তার জন্যেই সবাই অপেক্ষা করছে।
রুকসানা প্রত্যেক নামাযের পর কিছুক্ষণ অজিফা পড়ে। তাই তার আসতে দেরি হয়। অজিফা শেষ করে এসে মনিরার পাশে বসল।
তিন জা নাস্তা পরিবেশন করে নিজেরাও বসল।
রুকসানা বলল, তোমাদেরকে কত দিন বলেছি, আমার জন্যে অপেক্ষা না করে খেতে শুরু করবে। তবু যে কেন তোমরা আমার জন্য বসে থাক বুঝতে পারি না।
কেউ কিছু বলার আগে ছোট ভাই আব্দুল করিম বলল, বড় আপা, তোমাকে ছাড়া আমরা আগে খাব, একথা ভাবলে কী করে? আব্বা আম্মা ছাড়া এ বাড়ির ঘাড়ে কারো রক্ত আছে তোমার আগে খাবে?
রুকসানা বলল, এ কথা বলছিস কেন রে? আগে খেলে আমি তোদের ঘাড় মটকে দেব নাকি?
মনিরা একটু ঠোঁটকাটা। তা ছাড়া সবার ছোট বলে সকলে তাকে আদর করে। বলল, বড় আপা অজিফাটা একটু কম করলেই হয়।
মেজ ভাই আব্দুস সামাদ মনিরার অন্য পাশে বসেছে। তাকে ধমকের সুরে বলল, বেয়াদবের মতো কথা বলবি না। দেব এক থাপ্পড়।
মনিরা বলল, বড় আপার সামনে কই মারতো দেখি?
রুকসানা বলল, তোমরা সব থামতো। খাওয়ার সময় বেশি কথা বলতে নেই। আমি না হয় এবার থেকে একটু আগেই আসব।
এরপর আর কেউ কোনো কথা বলল না।
চা খাওয়ার সময় রুকসানা মনিরাকে বলল, কিরে, পড়াশোনা ঠিকমতো করছিস তো?
মনিরা গাল ফুলিয়ে বলল, তোমাদেরকে কবে থেকে বলছি একজন অঙ্কের টিচারের ব্যবস্থা কর। তোমরা আমার কথা কানেই তোলো না। দেখে নিও এবারে নির্ঘাৎ ফেল করব। তারপর চায়ের খালি কাপটা শব্দ করে রেখে চলে গেল।
ছোট ভাই আব্দুল করিম ও মনিরা কোলে পিঠে। তাই ছোটবেলা থেকে দু’জনের মধ্যে ঠকরা-মকরি লেগেই থাকে। মনিরাকে ঐ ভাবে চলে যেতে দেখে বলল, দেখলে বড় আপা, ও কতবড় বেয়াদব?
এতক্ষণ আজিজা বেগম ও আব্দুল মতিন কোনো কথা বলেন নি। আব্দুল করিমের কথা শেষ হতে আজিজা বেগম বললেন, রুকসানাই তো ওকে ঐ রকম করেছে। সবার ভুল ত্রুটি হলে রুকসানা রাগারাগি করে, আর মনিরা যত দোষই করুক না কেন তাকে একটুও কিছু বলে না।
আব্দুল মতিন এসব কথায় কান দিলেন না। রুকসানার দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা মাস্টার ঠিক করে দেনা মা, যদি সত্যি সত্যি এবছর ফেল করে?
রুকসানা তিন ভাইয়ের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, তোমরা তো নিজেদের কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাক। ওরই ফাঁকে একটা ভালো মাস্টার ঠিক করতে পার না?
বড় ভাই আব্দুর রশিদ বলল, এ বছর তিন চারজন মাস্টার ঠিক করলাম। তাদের কাছে চার পাঁচ দিন করে পড়ে বিদায় করে দিয়েছে। আমাদের দোষ কোথায়?
আজিজা বেগম রুকসানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মনিরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে, তুই ওকে একটু শাসন কর।
রুকসানা আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, মনিরার কত বয়স হল আব্বা?
আব্দুল মতিন বললেন, আমার কি আর অত মনে আছে। তুইই বল না। তোর তো সব কিছু নখদর্পণে।
রুকসানা বলল, মনিরার বয়স চৌদ্দ চলছে। এই বয়সে সব ছেলে মেয়েরাই একটু আধটু ওরকম হয়। ও একটু চঞ্চল। তাই ঐ রকম। দু’চার বছর পর ঠিক হয়ে যাবে।
সেজ ভাই আব্দুস সামাদ বলল, জান বড় আপা, কিছুদিন হল মনিরাদের স্কুলে ঢাকা থেকে একটা ভালো টিচার জয়েন করেছেন। এরই মধ্যে চারপাশের গ্রামে। সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। শুনেছি খুব কড়া টিচার। বেয়াদবি করলে বড় বড় ছাত্রীদেরকেও বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে রাখেন।
বড় ভাই আব্দুর রশিদ বলল, এই রকম টিচারই মনিরার জন্য দরকার।
রুকসানা মৃদু হেসে আব্দুল করিমকে বলল, ওঁকে একদিন সঙ্গে করে নিয়ে আসিস, কথা শেষ করে নিজের রুমে চলে এল। তখনও সমানে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। রুকসানা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চিন্তা করতে লাগল, এই দুর্যোগে কত গরিব লোকের ঘর বাড়ি তছনছ হয়ে যাচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টিতে ছেলে মেয়ে নিয়ে লোকজন কষ্ট পাচ্ছে। মনে মনে আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলল, “হে গফুরুর রহিম, তোমার ভেদ তুমিই জান। তুমি সবাইকে হেফাজত কর।” আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে। এইরকম ঝড় তুফানের কথা মনে পড়তে তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। এমন সময় বড় বৌ সুরাইয়াকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সোজা হয়ে বসল। কাছে এলে বসতে বলে বলল, কিছু বলবে মনে হচ্ছে?
সুরাইয়া টেবিলের কাছ থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এসে তার পাশে রেখে বসে বলল, মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে যাই, যখন তুমি আমাদের মনের কথা টেনে বল। আমার মনে হয়, তুমি আল্লাহর খাস বান্দি। সে ছাড়া অন্য দু’জা রুকসানার সঙ্গে আপনি সম্বোধনে কথা বলে।
রুকসানা বলল, থাক অত আর ফোলাতে হবে না। যা বলতে এসেছ বল।
সুরাইয়া বলল, অনেক দিন থেকে একটা কথা বলতে চাই; কিন্তু সাহসে কুলায় না। তুমি যদি অভয় দাও, তা হলে বলতে পারি।
রুকসানা বলল, আচ্ছা তোমরা সবাই আমাকে এত ভয় কর কেন? এত সম্মান কর কেন? আমি তো এক হতভাগিনী। এতদিন ছেলেমেয়ে স্বামী নিয়ে আমার সংসার করার কথা। তা না হয়ে তোমাদের ঘাড়ে বসে খাচ্ছি, পরছি, আবার এতবড় সংসারের দায়িত্বও বয়ে বেড়াচ্ছি।
সুরাইয়া বলল, বড় আপা, এসব কথা বলে আমাদের মনে আঘাত দিও না। তুমি যে আমাদের কাছে কতখানি তা আল্লাহপাক জানেন।
ওসব কথা থাক, কোনো দ্বিধা না করে আসল কথা বল।
এত ব্যস্ততার মধ্যেও তুমি মাঝে মাঝে আসরের নামায পড়ে বাগানে বেড়াতে গিয়ে খালের দিকে যে দালান রয়েছে, সেখানে বসে চোখের পানি ফেল। এর কারণ জানতে চাই।
রুকসানা চমকে উঠে বলল, কে তোমাকে একথা বলেছে?
কে বলেছে বলব না, কথাটা যে সত্য তা অস্বীকার করতে পারবে?
রুকসানা কিছু না বলে তার মুখের দিকে কটমট করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
সে দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে সুরাইয়া মুখ নিচু করে বলল, আমার দৃঢ় ধারণা, তোমার জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে তুমি বিয়ে করতে চাও না। কথা শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলে দেখল, যার কথা মতো এতবড় সংসার চলছে, যার কথা বাড়ির সবাই বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়, যাকে আব্বা আম্মা ছাড়া সবাই ভয় করে, সেই বড় আপা ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে আর তার বড় বড় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গাল বেয়ে টপ টপ করে পড়ছে। সুরাইয়ার মনে হল তার ধারণাই ঠিক। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের আঁচলে চোখ মুখ মুছে দেওয়ার সময় বলল, নিজের দুঃখের কথা অন্যকে বললে, সম্পূর্ণ না হলেও দুঃখের বোঝা কিছুটা হালকা হয়। বড় আপা, আল্লাহর দোহাই লাগে, ঘটনাটা আমাকে বল। তুমি বিয়ে করতে রাজি হওনি বলে আব্বা, আম্মা ও আমরা সবাই খুব অশান্তি ভোগ করছি। যেদিন থেকে তোমার বিরহ অভিসারের কথা জেনেছি, সেদিন থেকে সেই অশান্তি আরো বেশি ভোগ করছি।
রুকসানা তার হাত ধরে বসিয়ে বলল, বলব, তবে তোমাকে ওয়াদা করতে হবে কাউকে বলবে না।
সুরাইয়া ওয়াদা করে বলল, এবার বল।
রুকসানা বলতে শুরু করল।
আমাদের বাগানের এখন যে দারোয়ান আছে, তার আগে ছিল কাজেম সেখ। দাদির মুখে শুনেছি কাজেম সেখের বাবার নাম সাজ্জাদ সেখ। সেও আমাদের দারোয়ান ছিল। সাজ্জাদ সেখের বাড়ি ছিল দক্ষিণ ফুকরা গ্রামে। সে দরিদ্র কৃষক হলেও সংসারে অভাব ছিল না। লম্বা চওড়া, শক্ত সমর্থ সুপুরুষ ছিল। একা তিন চারজন কামলার সমান কাজ করত। তাই তার কাজের অভাব হত না। কাজেমের বয়স যখন চার বছর তখন তার মা মারা যায়। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সাজ্জাদ ছেলেকে নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ে। তাকে কার কাছে রেখে কাজে যাবে? মাঝে মাঝে পাড়া-পড়শীর কাছে রেখে কাজ করতে গেলে কাজেম সারাদিন মায়ের জন্য কান্না কাটি করত। অনেকে তাকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দেয়। সাজ্জাদ স্ত্রীকে খুব ভালবাসত। তা ছাড়া স্ত্রী মৃত্যু শয্যায় তাকে বলেছিল, আমি মরে গেলে তুমি আবার বিয়ে করলেও কাজেমের দিকে লক্ষ্য রেখ। তাকে সত্য যেন কষ্ট না দেয়। সাজ্জাদ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেছিল, আবার বিয়ে করব কিনা জানি না। তবে আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন ওর এতটুকু কষ্ট হতে দেব না। তাই পাড়া পড়শি যখন তাকে আবার বিয়ের কথা বলে তখন স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। পরে যাকে বিয়ে করব, সে যদি কাজেমকে দেখতে না পারে? আমি কাজ করতে চলে যাওয়ার পর যদি তাকে কষ্ট দেয়? এইসব চিন্তা করে আর বিয়ে করেনি। পরের বছর দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সাজ্জাদ কাজ পায় না। ঘরে যা কিছু ছিল বেঁচে কিনে খেয়ে শেষ করে ফেলে। তারপর একদিন কাজের চেষ্টায় কাজেমকে নিয়ে দাদাজীর কাছে এসে বলল, হুজুর, এই ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে কাজ দেন। আজ দু’দিন পানি ছাড়া কিছু খেতে দিতে পারিনি।
কাজেমের মুখের দিকে তাকিয়ে দাদাজীর দয়া হল। একজন চাকরকে ডেকে কিছু খাবার এনে বাপ বেটাকে দিতে বললেন। তারপর নাম ধাম জেনে ম্যানেজারকে ডেকে বললেন, এই লোকটার থাকার ও কাজের ব্যবস্থা করে দেন। সবকিছু দেখা শোনা করার জন্য দাদাজী একজন ম্যানেজার রেখেছিলেন।
ম্যানেজার তাকে বাগানের দারোয়ানের কাজে লাগিয়ে দিলেন। আর থাকার জন্য বাগানের পাশে একটা ঘর করে দিলেন।
সাজ্জাদ খুব পরিশ্রমী। তার কাজ কাম দেখে দাদাজী খুব খুশী হলেন। বছর খানেক পর একদিন দাদাজী তাকে বললেন, কাজেমকে স্কুলে ভর্তি করে দাও। খরচ যা লাগে আমি দেব। প্রত্যেক মানুষের অল্প কিছু হলেও লেখাপড়া করা উচিত।
দাদাজীর কথা মতো সাজ্জাদ কাজেমকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়। একবার সাজ্জাদের কঠিন অসুখ হয়। দাদাজী চিকিৎসা করালেন। সুস্থ হওয়ার পর বললেন, তোমার বিয়ে করা উচিত। এই যে অসুখে এতদিন কষ্ট পেলে, বৌ থাকলে সেবা যত্ন করত, ছেলেটাকেও মানুষ করত। তা ছাড়া বৌ না থাকলে পুরুষদের অনেক রকম অসুবিধা হয়। তুমি রাজি থাকলে আমি ব্যবস্থা করব।
সাজ্জাদ বলল, হুজুর, আপনি আমার ভালোর জন্য বলছেন; কিন্তু কাজেমের ভালো মন্দ চিন্তা করে আমি আর বিয়ে করব না বলে ঠিক করেছি। মাফ করবেন। হুজুর, এ ব্যাপারে আর কিছু বলবেন না। এরপর দাদাজী তাকে আর বিয়ে করার কথা বলেন নি।
কাজেম যখন এইটে পড়ে তখন সাজ্জাদ মারা যায়। সাজ্জাদ মারা যাওয়ার পর কাজেম আর লেখাপড়া করল না। দাদাজী তাকে তার বাবার কাজে নিয়োগ করেন।
কাজেমও বাপের মতো সুন্দর ও স্বাস্থবান ছিল। তখন তার বয়স চৌদ্দ পনের বছর হলেও লম্বা চওড়া হওয়ার কারণে তাকে পূর্ণ যুবকের মতো দেখাত। সেও বাপের মতো পরিশ্রমী ছিল। তার কাজকর্মেও দাদাজী খুশী হলেন। আট দশ বছর পর তার বিয়ে দেন। বিয়ের প্রায় ছয় সাত বছর পর কাজেমের স্ত্রী এক পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। দাদাজী তার নাম রাখলেন ইকবাল হোসেন।
ইকবাল দেখতে শুনতে তার বাবার চেয়ে সুন্দর। পাঁচ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত সে একা একা বাগানে খেলা করত।
ছোটবেলায় আম্মা আমাকে বাইরে বেরোতে দিত না। বাইরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করার জন্য আমার মন খুব ছটফট করত। আমাদের বাড়ির পিছনের গেট দিয়ে বাগানে যাওয়ার পথ খুব কাছে। তাই মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঐ পথে বাগানে গিয়ে ইকবালের সঙ্গে খেলা করতাম। ইকবালের বাবাকে আমি কাজেম চাচা বলে ডাকতাম। তার মাকেও চাচি বলে ডাকতাম। ইকবালের মা আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। আমাকে খুব স্নেহ করত। চাচা যখন বাগানের গাছে পানি দিত, নতুন গাছ লাগাত অথবা বাগান পরিষ্কার করত তখন আমরা তার কাজে দুষ্টমী করে বাধা দিতাম। কাজেম চাচা একটুও রাগ করত না। আমাদের মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে অন্য জায়গায় খেলতে বলত।
ইকবাল আমার চেয়ে হয়তো দু’বছরের বড়। কাজেম চাচা তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়। সে যে বছর টুয়ে উঠল, সে বছর আমি স্কুলে ভর্তি হই। ছোটবেলা থেকে বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় আম্মা আমাকে কালো চশমা পরিয়ে রাখত। চশমার কাঁচ কালো হলেও দিনে অথবা রাতে সমান দেখতে পেতাম। সে সময় আম্মা আমাকে বলে দিয়েছিল কেউ যদি চশমা খোলার কথা বলে, তা হলে বলবি, চোখের অসুখ, ডাক্তার খুলতে নিষেধ করেছে। বাগানে ইকবালের সঙ্গে খেলতে ও স্কুলে যাওয়ার সময় চশমা পরতাম। স্কুলে ইকবাল ছাড়া ক্লাসের কোনো ছেলে মেয়ের সঙ্গে খেলতাম না। কারো সঙ্গে মেলামেশাও করতাম না। ইকবাল সব সময় আমাকে কালো চশমা পরতে দেখলেও ছেলে মানুষ বলে হয়তো কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়ার মাস ছয়েক পর একদিন বাগানে খেলা করার সময় বলল, তুমি সব সময় কালো চশমা পর কেন? আমি তখন মায়ের শেখানো কথা বললাম। ইকবাল সরল মনে তাই বিশ্বাস করল। দীর্ঘ চার বছর এক সঙ্গে খেলাধুলা ও স্কুলে যাতায়াতের ফলে আমাদের মধ্যে শিশুসুলভ ভালবাসার জন্ম হয়। ইকবাল ফাঁইভে টেলেন্টপুল বৃত্তি পেয়ে হাই স্কুলে ভর্তি হল। পরের বছর আমিও টেলেন্টপুল বৃত্তি পেয়ে সিক্সে ভর্তি হলাম। ইকবালের তখন ক্লাস সেভেন। সেই বছর আশ্বিন মাসের আজকের তারিখে ঠিক এই রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছিল। সেদিন স্কুল থেকে। ফিরে নাস্তা খেয়ে বাগানে খেলতে গেলাম। ইকবাল তখনও আসেনি। আমি একটা পেয়ারা গাছে উঠে ঝসাল দেখে বড় বড় দুটো পেয়ারা পাড়লাম। তারপর গাছের গোড়ায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পর ইকবাল আসার সময় দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে পিছন থেকে এসে দু’হাতে আমার চোখ টিপে ধরল। ১. প্রথমে ভয় পেলেও হাতের উপর হাত রেখে বুঝতে পারলাম, ইকবাল। দেরি করে এসেছে বলে একটু রাগের সঙ্গে গাল ফুলিয়ে বললাম, যাও, তোমার সঙ্গে কথা বলব না। সেই কখন থেকে দুটো পেয়ারা পেড়ে বসে আছি।
চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ইকবালও গাল ফুলিয়ে বলল, ঠিক আছে, তা হলে আমিও চলোম। কথা শেষ করে হাঁটতে শুরু করল।
আমি দৌড়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে পথ রোধ করে ছলছল চোখে ভিজে গলায় বললাম, তুমি দেরি করে এলে দোষ হল না। আর আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষা। করছি বলতে দোষ হয়ে গেল?
আমার চোখের পানি দেখে ইকবালের রাগ পড়ে গেল। বলল, আজ দেরিতে স্কুলের ছুটি হয়েছে, সে কথা বলার আগেই তুমি আমার উপর রাগ করে কথা বললে। তাই আমিও রেগে গেলাম। কই আমার ভাগের পেয়ারাটা দাও।
ও যেমন একটুতেই রেগে যেত, তেমনি একটুতেই রাগ পড়ে যেত। আমি একটা পেয়ারা তার হাতে দিয়ে নিজেরটায় কামড় বসালাম। তুমিতো কখনো বাগান বাড়িতে যাও নি। বাগানের দক্ষিণ দিকে একটা বেশ বড় খাল আছে। পুরো বাগানটা বেড়া দিয়ে ঘেরা। খালের দিকে বাগানের ভিতর আমাদের খেলার জায়গা। সেখানে তিন চারটে ঢালাইকরা পাকা বেঞ্চ ও একটা পাকা দালান আছে। দালানটার তিন দিকের দেওয়ালে তিনটে জানালা। কিন্তু সামনের দিকে দেওয়াল নেই। তিন দিকের দেওয়ালের গা ঘেঁষে পাকা বেঞ্চ। বাবা আমাকে যত রকমের খেলনা কিনে দিয়েছিলেন, সে সব আমি ঐ দালানে এনে রেখেছিলাম। ওর কোনো খেলনা ছিল না। ও বেড়ার ফাঁক গলে খালের কিনার থেকে কাদামাটি এনে আমার খেলনার মতো খেলনা বানাত। পেয়ারা খেতে খেতে দু’জনে দালানের কাছে এসে ইকবাল বলল, আজ একটা পালতোলা জাহাজ বানাব। যাও তোমার কাঠের জাহাজটা নিয়ে এস। তারপর বেড়ার ফাঁক গলে কাদা আনতে গেল।
আমার সব খেলনা দালানের একটা বেঞ্চের উপর সাজান থাকত। প্রতিদিন সেগুলো ঝেড়ে-পুছে রাখতাম। আমি সেগুলো ঝাড়ামোছা করছি। একটু পরে ইকবাল কাদা নিয়ে এসে বলল, ঝাড়ামোছা পরে করো আগে জাহাজটা দিয়ে যাও। আমি জাহাজটা নিয়ে তার কাছে বসলাম। ইকবাল সেটা দেখে দেখে জাহাজ বানাতে লাগল, আর আমি তাকে সাহায্য করতে লাগলাম।
আকাশে মেঘ করে অন্ধকার হয়ে এলে আমি বললাম, এই ইকবাল, এবার ঘরে যাই চল। কাল বানাবে। দেখছ না, মেঘে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে?
ইকবাল বলল, হোকগে, আর অল্প বাকি। এটুকু শেষ করে যাব।
তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে মুহূর্তের মধ্যে ভীষণ ঝড় উঠল। বাগানের অনেক গাছপালা মড় মড় শব্দে ভেঙ্গে পড়তে লাগল। ইকবাল তাড়াতাড়ি আমার একটা হাত ধরে বেঞ্চের নিচে ঢুকে আমাকেও টেনে নিল। ঠিক সেই সময় একটা বড় আম গাছ উপড়ে দালানের সামনে পড়ল। তার ডালপালাতে দালানের মেঝে ঢেকে গেল। ইকবাল বলল, আর একটু হলে আমাদের ঘাড়ে পড়ত। এমন সময় কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়তে আমি ভয় পেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ইকবালও ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কেউ আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল। আম গাছের ডালপালা থাকা সত্ত্বেও ঝাঁপটায় আমরা ভিজে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঠাণ্ডায় কাঁপতে লাগলাম।
ইকবালদের ঘর বাগানের উত্তর পাশে। তার বাবা কাজেম চাচা জানে প্রতিদিনের মতো আজও ইকবাল বাগানের দালানে আমার সঙ্গে খেলতে গেছে। ঝড় শুরু হওয়ার পরও যখন সে ফিরল না তখন খুব চিন্তিত হল। ভাবল, হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হতে আমরা হয়তো দালানেই রয়ে গেছি। একটু কমলে গিয়ে নিয়ে আসবে। তবু আমার। কথা চিন্তা করে কয়েকবার হারিকেন নিয়ে বেরোবার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘর থেকে বেরোন মাত্রই প্রতিবারেই ঝড়বৃষ্টির দাপটে হারিকেন নিভে যায়। শেষে এশার নামায পড়ে স্বামী-স্ত্রী আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকে।
এদিকে আম্মা জানে আমি বাগানে ইকবালের সঙ্গে খেলতে গেছি। ঝড় বৃষ্টি শুরু হল অথচ আমি ফিরলাম না দেখে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। আব্বাকে কথাটা সাহস করে জানাতে না পেরে দাদিকে জানাল। দাদি আব্বাকে জানাল। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে যখন ইকবালের সঙ্গে খেলা করতাম তখন আব্বা জানতে পেরে একদিন আম্মাকে রাগারাগি করে বলেছিল, আমাদের মেয়ে হয়ে চাকরের ছেলের সঙ্গে খেলাধুলা করা কি ঠিক হচ্ছে? লোক জানতে পারলে কী বলবে? আম্মা বলেছিল, এতে রাগ করছ কেন? রুকসানার চোখ খুব বড় বড় বলে, আমিই তাকে বাইরের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে দিইনি।ইকবাল চাকরের ছেলে হলে তো কি হয়েছে? ওরা বাগানের ভিতর খেলাধুলা করে। বাইরের লোকজন জানবে কেমন করে? সেখানে দাদি ছিলেন। তিনি বললেন, বৌমা ঠিক কথা বলেছে। তাছাড়া ছোট ছোট ছেলে মেয়ে ফেরেস্তার মতো। চাকরের ছেলেকে ঘৃণা করা উচিত নয়। এরপর আব্বা আর কিছু বলেনি।
ঝড় বৃষ্টির দিনে আসার কথা দাদির মুখে শুনে আব্বা আতঙ্কিত স্বরে বললেন, সেকি? তারপর বললেন, ঝড় বৃষ্টির জন্য আসতে না পেরে ইকবালের সঙ্গে ওদের ঘরে উঠেছে মনে হয়।
দাদি বললেন, তবু তুই কাউকে কাজেমের ঘরে পাঠা।
সামসু ও জাবেদ নামে দুজন লোক বারমাস আমাদের বাড়িতে থেকে কাজ করত। আব্বা তাদেরকে পাঁচ ব্যাটারী টর্চ লাইট দিয়ে বললেন, তোমরা কাজেমের ঘরে যাও। সেখানে রুকসানা থাকলে নিয়ে আসবে।
সামসু ও জাবেদ দুটো ছাতা নিয়ে কাজেমের ঘরে এসে আমি আছি কিনা জিজ্ঞেস করল।
কাজেম বলল, না নেই। বিকেলে ইকবাল ও রুকসানা বাগানের ভিতরে খেলতে গিয়েছিল। মনে হয় ঝড় বৃষ্টিতে আসতে না পেরে দালানে রয়ে গেছে। আমি কয়েকবার যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঝড়ের দাপটে যেতে পারিনি। চল, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাই।
তিনজনে এসে দেখল, আম গাছ পড়ে দালানের সামনেটা বন্ধ হয়ে গেছে। সামসু টর্চ লাইট জ্বেলে আমার ও ইকবালের নাম ধরে ডেকে বলল, তোমরা এখানে থাকলে বেরিয়ে এস, আমরা নিয়ে যেতে এসেছি।
বেঞ্চের নিচে ঘাড় নিচু করে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল এবং ভয়ে ও ঠাণ্ডায় কাপছিলাম বলে আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলাম। টর্চ লাইটের আলো দেখে ও সামসুর গলা পেয়ে আমি বললাম, আব্বা আমাদের খোঁজ করতে লোক পাঠিয়েছে।
ইকবালও তা বুঝতে পেরে আমাকে ছেড়ে দিয়ে জোর গলায় বলল, হ্যাঁ, আমরা এখানে আছি। টর্চ লাইট এদিকে জ্বালিয়ে রাখুন। তারপর আমরা ডাল পালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলাম। তখনও আমরা ঠাণ্ডায় কাঁপছিলাম।
কাজেম চাচাও ইকবালকে তাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে সামসু ও জাবেদ আমাকে নিয়ে ফিরে এল।
ঘরের সবাই নিচের বারান্দায় অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে রেগে গেলেও ঠাণ্ডায় কাঁপতে দেখে কিছু বলল না। শুধু দাদি আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে গা মুছিয়ে গরম তেল মালিশ করে দাও।
আম্মা আমার একটা হাত ধরে উপরের রুমে এনে প্রথমে কাপড় পাল্টে দিল। তারপর গায়ে তেল মালিশ করে দেওয়ার সময় যখন বুকের উপর হাত পড়ল তখন আমি হাত সরিয়ে দিয়ে উহ করে উঠলাম।
আম্মা আতঙ্কিতস্বরে বললেন, বুকে আঘাত পেয়েছিস নাকি?
আমি বললাম, না। ঝড় বৃষ্টি শুরু হতে আমরা দালানের বেঞ্চের নিচে ঢুকে গিয়েছিলাম। তারপর ঝাঁপটায় ভিজে গিয়ে ও ঠাণ্ডায় যখন কাপছিলাম তখন ইকবাল আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ আমার বুক টিপেছে। আমি নিষেধ করতে বলল, এটা করলে তোমার শীত কমে যাবে। তাই খুব ব্যথা হয়ে গেছে।
আমার কথা শুনে আম্মা খুব রেগে গিয়ে তেল মালিশ বন্ধ করে কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমার তখন সেক্স সম্পর্কে কোনো জ্ঞান হয়নি। তাই আম্মার রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে না পেরে বললাম, তুমি আমার দিকে অমন করে চেয়ে রয়েছ কেন? ভয় করছে তো?
আম্মা রাগ সামলে নিয়ে তেল মালিশ করতে করতে বলল, ইকবাল যে কতবড় অন্যায় করেছে তা বোঝার মতো বয়স তোর হয়নি। তোর আব্বাকে বলে এর বিহিত করতে বলব। তারপর তেল মালিশ শেষ করে এক গ্লাস গরম দুধ এনে আমাকে। খেতে দিয়ে চলে গেল।
ঐ রাত্রেই বোধ হয় আম্মা আব্বাকে কথাটা জানিয়েছিল। রাত্রের মধ্যেই ঝড় বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। পরেরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে আব্বাকে শঙ্কর মাছের চাবুক হাতে বেরিয়ে যেতে দেখে আমিও তার পিছু নিলাম। কেন জানি আমার মনে হল, আব্বা আমাকে দেখলে আসতে নিষেধ করবে। তাই ইকবালদের ঘরের অল্প দূরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়ালাম।
আব্বা কাজেম চাচার ঘরের কাছে এসে নাম ধরে ডাকল।
কাজেম চাচা ঘরের ভিতর ছেলেকে নিয়ে চা-মুড়ি খাচ্ছিল। আব্বার গলা পেয়ে। বেরিয়ে এসে তার হাতে শঙ্কর মাছের চাবুক দেখে ভয় পেল। চাকর-বাকর বা গ্রামের কেউ কোনো গুরুতর অন্যায় করলে সাহেব ও তার বাবাকে এই চাবুক ব্যবহার করতে দেখেছে। ভাবল, কালকের ঘটনায় ইকবালকে দোষী ভেবে কী শাসন করতে। এসেছে? কাচুমাচু হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
আব্বা গম্ভীর স্বরে ইকবালের কুকীর্তির কথা বলে বললেন, ওকে তুমি শাস্তি দিবে, না আমি দিব?
নাবালক ছেলের কুকীর্তির কথা শুনে খুব রেগে গেলেও শাস্তি দেওয়ার কথা শুনে ভয়ে কাজেম চাচার গলা শুকিয়ে গেল। কয়েক সেকেণ্ড কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর আমতা আমতা করে কোনো রকমে বলল, আপনি নিজের হাতে ওকে শাস্তি দিয়ে মেরে ফেলুন সাহেব। এমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। কথা শেষ করে ঘর থেকে ইকবালকে টেনে হিঁচড়ে এনে আব্বার পায়ের কাছে ছেড়ে দিল।
আব্বা চাবুকটা কাজেম চাচার হাতে দিয়ে বলল, তোমার ছেলেকে তুমিই শাস্তি। দাও।
কাজেম চাচা এমন মার মারতে লাগল যে, মারের চোটে ইকবালের সমস্ত শরীর কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। কাটা মুরগীর মতো মাটিতে গড়াতে গড়াতে। একসময় আজ্ঞান হয়ে নিথর হয়ে গেল।
আব্বা তার হাত থেকে চাবুকটা কেড়ে নিয়ে হনহন করে চলে এল।
গাছের আড়াল থেকে মারের দৃশ্য দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে গাছের তলায় পড়েছিলাম। ফেরার সময় আব্বা আমাকে গাছতলায় পড়ে থাকতে দেখে পাঁজাকোলা করে তুলে ঘরে নিয়ে আসে। তারপর দাদিকে ও আম্মাকে ঘটনা বলে বলল, ইকবালের শাস্তি দেখে রুকসানা অজ্ঞান হয়ে গেছে। তারপর আম্মা মাথায় পানি ঢেলে আমার জ্ঞান ফেরায়।
আব্বা চলে আসার পর ইকবালের মা নাজমা চাচি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলের অবস্থা দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীকে বলল, ছেলেমানুষী। খেয়ালে কি করেছে না করেছে, তাই বলে বাপ হয়ে এভাবে কেউ মারে। তুমি বাপ না দুষমন। ছেলের কিছু হলে আমিও বিষ খেয়ে মরব। তারপর ঘরে নিয়ে গিয়ে মাথায় পানি ঢালতে থাকে।
কাজেম ছেলেকে কখনো কোনো অন্যায় করতে দেখেনি। তাই তাকে মারাতো দূরের কথা কোনোদিন শাসন করার কথাও ভাবেনি। আজ তার অন্যায়ের কথা শুনে যতটা না শাস্তি দিত, সাহেবকে খুশি করার জন্য তার চেয়ে বেশি শাস্তি দিয়ে ফেলেছে। এখন স্ত্রীর কথা শুনে খুব অনুশোচনা হল। সত্যি যদি ছেলেটার কিছু হয়ে যায়। কথাটা মনে হতে ডাক্তার নিয়ে আসে। চব্বিশ ঘণ্টা পর ইকবালের জ্ঞান ফিরে আসে। এর কয়েকদিন পর সুস্থ হয়ে কোথায় চলে যায়। কাজেম চাচা ও নাজমা চাচি আব্বার পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সে কথা জানায়।
আব্বা তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, তোমরা ঘরে যাও, আমি ইকবালকে খোঁজার ব্যবস্থা করছি। আব্বা সামসু ও জাবেদকে ইকবালকে খুঁজতে বললেন। তারা বেশ কয়েকদিন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে খোঁজ করল, কিন্তু ইকবালকে পাওয়া গেল না।
কাজেম চাচা একমাত্র ছেলের ভালোমন্দ চিন্তা করে খুব ভেঙ্গে পড়ে। প্রায় আব্বার কাছে এসে কান্নাকাটি করে বলত, আমি ইকবালকে মেরে ফেলেছি। আব্বা তাকে বোঝাতো, ইকবাল রাগ করে কোথাও চলে গেছে। রাগ পড়ে গেলে ফিরে আসবে।
ছমাস পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন ইকবাল ফিরে এল না তখন একদিন কাজেম চাচা চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাচিকে নিয়ে নিজের গ্রামে চলে যায়। আমি দাদিকে ইকবালকে মারার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। দাদি বলেছিলেন, স্বামী ছাড়া মেয়েদের বুকে হাত দেওয়া অন্য পুরুষের জন্য খুব বড় অপরাধ। তখন কথাটার মূল্য বুঝতে না পারলেও বড় হয়ে বুঝেছি। তবু তখন আমার কেবলই মনে হত, বুকে হাত দেওয়ার কথাটা আম্মাকে বলা ঠিক হয়নি। আমার কারণে ইকবাল এতবড় শাস্তি পাবে ভাবিনি। তখন তাকে শিশুসুলভ ভালবাসলেও মার খেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর। আমার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। তারপর যত বড় হয়েছি তত বেশি তাকে ভালবেসে ফেলেছি।
কাজেম চাচার বাড়ি দক্ষিণ ফুকরা গ্রামে। আমার সই আসমার বাড়িও ঐ গ্রামে। আর সয়া দাইহান হল কাজেম চাচার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। তখন অবশ্য ওসব কথা জানতাম না। আসমার সঙ্গে সই পাতাই ক্লাস সেভেনে। ওর কাছে কাজেম চাচার খোঁজ নিতাম। নিজের বাড়িতে গিয়ে কাজেম চাচা ছেলের শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিল। নাজমা চাচি এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করে সংসার চালাত। একদিন কি কারণে যেন এক পিরিয়ডের পর ছুটি হয়ে যায়। সেদিন আসমার সঙ্গে কাজেম। চাচাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে কাজেম চাচা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি ইকবালের সাথে খেলা করতে এসেছ? সে তো নেই। অনেক দিন হল আমার উপর রাগ করে কোথায় চলে গেছে। নাজমা চাচিও আমাকে জড়িয়ে ধরে। অনেক কেঁদেছিল। তারপর আর তাদের বাড়ি যাইনি। মাঝে মধ্যে আসমার হাতে। কিছু কিছু টাকা নাজমা চাচিকে পাঠাতাম। এইটে পড়ার সময় আসমা একদিন বলল, কাজেম চাচা মারা গেছে। শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। নাইনে পড়ার সময় নাজমা চাচিও মারা যায়। ক্লাস টেনে পড়ার সময় আসমা যেদিন বলল, সে তাদের গ্রামের দাইহান নামে একটা গরিব ছেলেকে ভালবাসে, সেদিন আমিও তাকে ইকবালের ও আমার ছেলেবেলার ঘটনা বলে বললাম, আমিও ইকবালকে ভীষণ ভালবাসি। তার কথা মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ভুলতে পারব না। এরপর থেকে আসমা দাইহানের সঙ্গে যেদিন যা কথাবার্তা হত, স্কুলে এসে আমাকে বলত। হাফইয়ার্লি পরীক্ষার কয়েকদিন পর একদিন বলল, ইকবাল কয়েকটা বিষয়ে স্টারমার্ক পেয়ে ফার্স্ট ডিভিসনে এস.এস.সি পাশ করে মা-বাবার খোঁজে এসেছে। কথাটা শোনার পর মনে আনন্দের ঝড় বইতে শুরু করল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে বললাম, তাকে বলবি, সে যেন কাল স্কুল ছুটির সময় আমার সঙ্গে দেখা করতে। আসে। আসমা বলল, ঠিক আছে, স্কুল থেকে গিয়ে আজই বলব। পরের দিন স্কুলে। আসার পর জিজ্ঞেস করলাম, কিরে কথাটা ইকবালকে বলেছিলি? বলল, হ্যাঁ বলেছি। শুনে বলল, আমি হলাম তার বাবার দারোয়ানের ছেলে, দেখা করা কী ঠিক হবে? শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তার দু’দিন পর আসমা স্কুলে এসে বলল, ইকবাল ঢাকা চলে গেছে। আমি আসমাকে বললাম, ওর চাচাত ভাই দাইহানের কাছে ঢাকার। ঠিকানা দিয়ে গেছে কিনা জেনে, আমাকে জানাবি। পরের দিন বলল, ঠিকানা দিয়ে যাইনি। এস.এস.সি পাশ করার পর কলেজে পড়ার জন্য গোপালগঞ্জ চলে যাই। আর আসমার বিয়ে হয়ে যায় দাইহানের সঙ্গে। আমার প্রায়ই মনে হয়, আমার কারণেই কাজেম চাচা ছেলের শোকে পাগল হয়ে মারা যায়। আর নাজমা চাচিও বিনা। চিকিৎসায় মারা যায়। তাদের এই পরিণতির জন্য সব সময় নিজেকে অপরাধী মনে। হয়।
তোমাকে যা কিছু বললাম, এসবের বেশিরভাগ দাদির কাছে শোনা। জান সুরাইয়া, আজ পর্যন্ত ইকবালকে মারার দৃশ্য ভুলতে পারিনি। যখন সেই দৃশ্য মনে পড়ে তখন খুব কষ্ট অনুভব করি, চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসে। তাই আমাকে কে যেন ঐ বাগানের দালানে টেনে নিয়ে যায়। আমার চোখ দেখে সবাই কম বেশি ভয় পায় বা অসন্তুষ্ট হয়; কিন্তু ইকবাল যখন আমার চোখ দেখেছিল তখন তাকে খুব খুশী হতে দেখেছিলাম। যদিও সে মাত্র একবারই দেখেছিল এবং আমরা দুজনেই তখন ছোট ছিলাম।
সুরাইয়া বলল, তুমি তো বললে, খুব ছোটবেলা থেকে আম্মা তোমাকে কালো চশমা পরিয়ে রাখতেন, ইকবাল তোমার চোখ দেখল কি করে?
রুকসানা মৃদু হেসে বলল, ঐ ঘটনার দিন কাদা-মাটি দিয়ে জাহাজ বানাবার সময় হঠাৎ করে আমার চশমা খুলে ফেলেছিল। আমি মুখ নিচু করে নিতে চিবুক ধরে তুলে চশমা পরিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, চশমা ছাড়া তোমাকে খুব সুন্দর দেখায়। কাল থেকে এখানে এসে চশমা খুলে রাখবে। ইকবাল ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ এই কথা বলেনি। তাই এইসব কথা চিন্তা করে বিয়ে করতে ইচ্ছা করেনি।
সুরাইয়া বলল, ছোটবেলার ঘটনায় অনুশোচনা হতে পারে, তাই বলে এভাবে জীবন কাটান কী ঠিক হচ্ছে? তাছাড়া সে হয়তো এতদিনে বিয়ে করে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার করছে। তোমার কথা কী মনে রেখেছে?
রুকসানা বলল, আমিও যে সেকথা ভাবিনি, তা নয়; কিন্তু মন সায় দেয় না। বলে, সেও তোমার জন্য বিয়ে না করে জীবন কাটাচ্ছে।
তাই যদি হয়, তাহলে এত বছর কোনো যোগাযোগ করেনি কেন? আচ্ছা, আসমা আপা তো মাঝে মধ্যে আসে, ইকবাল ভাইয়ের কথা তার কাছে জিজ্ঞেস কর নি?
করি নি আবার, যখনই আসে তখনই জিজ্ঞেস করি। বলে সেই যে এস. এস. সি. পাশ করে এসেছিল তারপর আর আসা তো দূরের কথা, একটা চিঠিও দেয়নি।
এমন সময় করিমন এসে সুরাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, বড় ভাই আপনাকে ডাকছেন।
রুকসানা তাকে বলল, তুমি যাও, ও যাচ্ছে। করিমন চলে যাওয়ার পর রুকসানা বলল, ওয়াদার কথা মনে আছে তো?
সুরাইয়া বলল, ওয়াদা যখন করেছি, মনে তো থাকবেই। তবে এ ব্যাপারে আরো কিছু জানার আছে। সময় মতো জানব বলে চলে গেল।
২
পূর্ব পুরুষদের কাঁচারি বাড়িটা মূল বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। সেটা এতদিন এমনি পড়েছিল। রুকসানা সেখানে কুটির শিল্পের কারখানা করেছে। কাঁচারী বাড়ির সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা বন জঙ্গলে ভরেছিল। কারখানায় শ্রমিকদের নিয়ে পরিষ্কার করে ফুলের বাগান করেছে। কারখানার প্রায় পঞ্চাশ ষাটজন কাজ করে। তাদের মধ্যে অর্ধেক মেয়ে। তারা সবাই একই কারখানায় কাজ করলেও মেয়েদের বিভাগ আলাদা। সেখানে কোনো পুরুষ কাজ করে না। দুই বিভাগের মাঝখানে তিনটে অফিস রুম। মাঝ খানের রুমে রুকসানা বসে। অন্য দুটোর একটায় মেয়েদের পরিচালক রাবিয়া ও অন্যটায় পুরুষদের পরিচালক কায়সার বসে। দুজনেই একই গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। কলেজে পড়ার সময় মন দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করেছে। তারা রুকসানার সহপাঠী ছিল। গ্রামে ফিরে তিন জনে মিলে সমাজ কল্যাণে নেমেছে। রাবিয়াও কায়সার আর্থিক সহযোগিতাও করেছে। যা কিছু করেছে তিন জনে পরামর্শ করেই করেছে।
আজ রুকসানা অফিসে আসার ঘণ্টাখানেক পরে রাবিয়া এসে বলল, পলাশপুরের সাজেদা তিন দিন কাজে আসেনি। কাল ঐ গ্রামের আনোয়ারকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম? কিছুক্ষণ আগে সে বলল, সাজেদার খুব অসুখ।
রুকসানা বলল, তাই নাকি? তা হলে তো তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। বিকেলে তুই ও কায়সার আলতাফ ডাক্তারকে নিয়ে যাস।
রাবিয়া বলল, ও তো আজ আসেনি। বিকেলে আমার ননদকে দেখার জন্য ছয় সাতজন লোক আসবে। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। তুই না হয় ডাক্তার নিয়ে যাস।
রুকসানা বলল, ঠিক আছে, তাই যাব।
বিকেলে রুকসানা আলতাফ ডাক্তারকে নিয়ে পলাশপুর গেল। আলতাফ ডাক্তার। সাজেদাকে দেখে প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে পাশের গ্রামে রুগী দেখার জন্য চলে গেল।
সাজেদা বিয়ের পাঁচ বছর পর বিধবা হয়ে দুটো ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। বাবা আবেদ খেটে খাওয়া মানুষ। তার তিন ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার করেছে। আবেদের বয়স হয়েছে। তেমন খাটা খাটনি করতে পারে না। তাছাড়া। বছরের প্রায় অর্ধেক দিন গ্রামে কাজ পাওয়া যায় না। কোনো রকমে এক বেলা এক সন্ধ্যে খেয়ে দিন কাটাচ্ছিল। সাজেদা দুটো ছেলে নিয়ে বিধবা হয়ে আসার পর সংসারে আরো বেশি অভাব দেখা দেয়। রুকসানা জানতে পেরে সাজেদাকে। কারখানায় লাগিয়েছে।
সাজেদার কাছ থেকে ফেরার পথে রুকসানা রাস্তার পাশে একটা বাঁধা ষাঁড়কে পাশ কেটে কিছুটা এগিয়েছে এমন সময় হঠাৎ ষাঁড়টা বোরখা পরা রুকসানাকে দেখে গোঁ গোঁ করে উঠে লাফালাফি করে রশি ছেঁড়ার চেষ্টা করল। রুকসানা তা বুঝতে। পেরে ভয় পেয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল, আর একবার করে পিছন ফিরে ষাঁড়টার দিকে তাকাতে লাগল। কয়েক সেকেণ্ডর মধ্যে ষাঁড়টা রশি ছিঁড়ে তার দিকে দৌড়ে আসছে দেখে ভয় পেয়ে রুকসানাও প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। কিন্তু বোরখা পরে থাকার কারণে ষাঁড়টার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারল না।
হাসান রুকসানার বিপরীত দিক থেকে আসছিল। দূর থেকে একটা ষাঁড়কে বোরখা পরা একটা মেয়েকে তাড়া করছে দেখতে পেয়ে খুব দ্রুত দৌড়ে আসতে লাগল।
ষাঁড়টা যখন রুকসানার খুব কাছাকাছি এসে গেল তখন হাসানও সেখানে পৌঁছে গেল। রোকসানাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তা থেকে ক্ষেতে ফেলে দিয়ে ষাঁড়টার দুটো শিং ধরে প্রাণপণ শক্তিতে ঝাঁকি দিল।
ষাঁড়টা তাতেও দমল না। হাসানকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে চলল। হাসান এবার একটা হাতে শিং ধরে রেখে অন্য হাতের আঙ্গুলগুলো দু’নাকের ভিতর ঢুকিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘাড়ে মোচড় দিয়ে ষাঁড়টাকে মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। ষাঁড়টা বোধ হয় প্রতিপক্ষের শক্তি বুঝতে পেরে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখার চেষ্টা করল।
ততক্ষণ পথচারীরা যে যা পেল, তাই দিয়ে আঁড়টাকে মারতে লাগল। আর দু তিন জন রশি ধরে টানতে লাগল।
ষাঁড়টা বেগতিক দেখে কয়েক পা পিছিয়ে এল। এমন সময় ষাড়ের মালিক জহুর এসে ষাঁড়টাকে আদর করে রশি ধরে হাসানকে বলল, এবার ছেড়ে দিন স্যার।
হাসান ছেড়ে দিয়ে বলল, এরকম মার কুত্তো ষাঁড়কে রাস্তায় বেঁধে রাখা আপনার ঠিক হয়নি।
জহুর বলল, এ আমার ঘরের গাইয়ের বাছুর। খুব শান্ত। কখনো কাউকে গুতোয়। তারপর রুকসানার দিকে তাকিয়ে বলল, বোরখা পরা মেয়েকে দেখে হয়তো আজ এই কাণ্ড করল। আমার ছোট ছেলেটা দূর থেকে দেখে আমাকে ডাকার জন্য ঘরে গিয়েছিল। আমি ও পাড়ায় গিয়েছিলাম। ফিরে এসে শুনে ছুটে এসেছি।
ষাঁড়টাকে তার পিছনে ছুটতে দেখে রুকসানা ছুটার সময় দেওয়া ইউনুছ পড়ছিল, ষাঁড়টা যখন তার খুব কাছে এসে গিয়েছিল তখন তার মনে হয়েছিল, ষাঁড়টা তাকে শিং দিয়ে গুতিয়ে ফালা ফালা করে ফেলবে। তাই মনে মনে বলেছিল, আল্লাহ গো, তুমি আমাকে রক্ষা কর। হাসান ধাক্কা দেওয়ার আগেই জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয়েছিল। ক্ষেতে পড়ে হাতে পায়ে কিছু আঘাত পেলেও তার মনে হল, যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে কেউ বাঁচাল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে এতক্ষণ ষাঁড় ও মানুষের লড়াই দেখছিল। আর হাসান স্যারের সাহস ও শক্তি দেখে খুব অবাক হল। জহুর ষাঁড় নিয়ে চলে যাওয়ার পর তাদের একজন জিজ্ঞেস করল, আপনার কোথাও লাগেনি তো স্যার?
হাসান বলল, না আমার কিছু হয়নি। আপনারা এবার যান। তারপর রুকসানার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে ধাক্কা দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তবু ক্ষমা চাইছি। তারপর জিজ্ঞেস করল, পড়ে গিয়ে নিশ্চয় আঘাত পেয়েছেন?
রুকসানা বলল, আঘাত পেলেও তা সামান্য। আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা আমার নেই। শুধু এটুকু বলব, আপনি আমাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। ভাবছি আঘাত পেয়েছেন কিনা?
হাসান সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়েছেন, আমি ওসিলা মাত্র। তারপর বলল, একা যেতে পারবেন, না পৌঁছে দেব?
রুকসানা বলল, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না, একাই যেতে পারব।
ঠিক আছে, আসি তা হলে বলে হাসান হাঁটতে শুরু করল।
ততক্ষণে লোকজন সব চলে গেছে। রুকসানা বলল, শুনুন।
হাসান কিছুটা চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, কিছু বলবেন?
রুকসানা বলল, লোকজন আপনাকে স্যার বলছিল। আপনি কী স্কুলের টিচার?
হাসান বলল, হ্যাঁ।
আপনার নামটা বললে খুশি হতাম।
হাসান।
বাড়ি?
হাসান কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আমি ঢাকা থেকে এসে কয়েক মাস হল এখানকার গার্লস হাই স্কুলে জয়েন করেছি।
রুকসানার তখন সামাদের কথা মনে পড়ল। ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ঢাকা থেকে একটা ভালো টিচার এসেছেন। ভাবল, ইনিই সেই টিচার ননতো? বলল, আপনি ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক?
জ্বি।
আমি আব্দুল মতিন চৌধুরীর বড় মেয়ে রুকসানা। একদিন আমাদের বাড়িতে আসুন না। বাহিরবাগ গ্রামে গিয়ে যে কাউকে চৌধুরী বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেবে।
হাসান কয়েক সেকেণ্ড একদৃষ্টে তার কালো চশমা পরা চোখের দিকে চেয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, আসব। এবার আসি, তারপর আল্লাহ হাফেজ বলে হাঁটতে লাগল।
রুকসানাও আল্লাহ হাফেজ বলে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ফেরার পথে ভাবতে লাগল, ভদ্রলোক যেমন শক্তিশালী তেমনি সাহসী। উনি যদি ঠিক সময়ে এসে না পড়তেন, তা হলে কি হত ভেবে শিউরে উঠল। ঘরে এসে আব্বা আম্মাকে ঘটনাটা জানাল।
আজিজা বেগম বললেন আল্লাহ লোকটার ভালো করুক। তোকে কতবার বলেছি একা কোথাও যাবি না, কাউকে সঙ্গে নিবি।
আব্দুল মতিন বললেন, লোকটাকে চিনিস?
রুকসানা বলল, না। তবে পরিচয় জেনেছি। নাম হাসান। সেদিন সামাদ মনিরাদের স্কুলের যে একজন ভালো টিচারের কথা বলেছিল, মনে হয় উনিই তিনি।
আব্দুল মতিন বেশ অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি? একটা শহরের লোক ষাঁড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোকে বাঁচাল, খুব আশ্চর্য ব্যাপার তো?
হ্যাঁ আব্বা, শুধু আমি নই, রাস্তার যত লোক ছিল সবাই খুব অবাক হয়েছে।
তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলি না কেন?
উনি আমাকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, আমি না করেছি? তবে একদিন আসতে বলেছি।
সামাদ যার কথা বলেছিল, উনি যদি তিনি হন, তা হলে এলে মনিরাকে পড়াবার ব্যবস্থা করিস।
ঠিক আছে, তাই করব বলে, রুকসানা নিজের রুমে এসে কাপড় পাল্টে মনিরাকে ডেকে বলল, তোদের স্কুলে ঢাকা থেকে একজন ভালো টিচার এসেছে। শুনলাম, তার নাম কি বলতো?
মনিরা বলল, পুরো নামতো জানি না। সবাই হাসান স্যার বলে। জান বড় আপা, স্যার খুব ভালো পড়ায়; কিন্তু ভীষণ কড়া, কোনো ছাত্রী যদি বেয়াদবি করে অথবা। পড়া না করে আসে তা হলে আর রক্ষে নেই। সে যত বড় লোকের মেয়ে হোক না। কেন, সারা পিরিয়ড বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে রাখেন।
রুকসানা বলল, ভাবছি, তোকে পড়াবার জন্য ওঁকেই রাখার ব্যবস্থা করব।
ওরে বাবা, উনি যা কড়া টিচার। ওঁর দিকে তাকালেই ভয় লাগে। পড়ব কি করে? না বাবা না, আমি ওঁর কাছে পড়ব না।
তুই তো নিজেই বললি, উনি খুব ভালো টিচার। শোন, ভালো টিচাররা একটু কড়া হন। বেয়াদবি মোটেই পছন্দ করেন না। তুই ওঁর সঙ্গে বেয়াদবি না করলে তোকে কিছু বলবেন না।
মনিরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, মাগরিবের আজান হচ্ছে শুনে রুকসানা বলল, যা নামায পড়তে যা, আমিও পড়ব।
পরের দিন রুকসানা অফিসে কাজ করছিল। পিয়ন আতাহার এসে একটা স্লিপ দিয়ে বলল, এই ভদ্র লোক আপনার সাথে দেখা করতে চান।
রুকসানা স্লিপের উপর চোখ বুলিয়ে বলল, নিয়ে এস।
হাসান রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে বলল, ভালো আপনি?
আমিও ভালো বলে হাসান পকেট থেকে একটা ছোট ওষুধের প্যাকেট বার করে। টেবিলের উপর রেখে বলল, দিনে কয়েক ফোঁটা করে চারবার খাবেন। প্যাকেটের ভিতর ড্রপারও আছে।
রুকসানা অবাক কণ্ঠে বলল, ওষুধ খাব কেন?
কাল পড়ে গিয়ে নিশ্চয় আঘাত পেয়েছিলেন। লজ্জায় আমার কাছে স্বীকার করেন নি। এটা পঞ্চাশ হাজার পাওয়ারের আরনিকা। খেলে যে কোনো আঘাতের ব্যথা সেরে যায়।
আমি তো তেমন আঘাত পাইনি, তবু খেতে হবে?
হ্যাঁ, তবু খেতে হবে। কারণ আঘাত পাওয়া জায়গাটা বেশি বয়সে অসুবিধা সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে যদি কেউ ছোট বেলায় অথবা বড় বেলায় মাথায় আঘাত পায়। তাহলে বয়সকালে সে পাগলও হয়ে যেতে পারে।
রুকসানা আরো অবাক হয়ে বলল, আপনি ডাক্তার নাকি?
এই একটু-আধটু প্র্যাকটিস করি আর কি।
তাই বলুন। আপনার কথা শুনে মনে করেছিলাম, আপনি পাশ করা ডাক্তার। তারপর বলল, আপনি এসে ভালই করেছেন। নচেৎ আমাকেই আপনার কাছে যেতে হত।
তাই নাকি? তা হলে কারণটা বলুন।
মনিরাকে চেনেন? আপনার স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রী।
ছাত্রীকে চিনব না কেন?
কতটা চেনেন?
ভালো ছাত্রী, তবে অঙ্কে একটু কাঁচা। আর একটু চঞ্চল।
মনিরা আমার ছোট বোন। আপনি ঠিকই বলেছেন, ও অঙ্কে একটু কাঁচা, পাকা করার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য আপনার কাছে একদিন যাব ভাবছিলাম।
দেখুন, আমি কোনো ছাত্র ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াই না। তা ছাড়া এখান থেকে দক্ষিণ ফুকরা প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের কম না?
বাড়িতে এসে পড়াবেন, একথা তো বলিনি। ছুটির পর স্কুলেই পড়াবেন।
তাও সম্ভব নয়।
কেন?
স্কুলের টাইমের আগে ও পরে ডাক্তারী করি। পড়াবার সময় কোথায় বলুন।
ডাক্তারী করে মাসে কত আয় করেন?
আয় করার জন্য আমি ডাক্তারী করি না।
মানে?
মানে গ্রামের অভাবী লোকদের সেবা করা।
বাড়িতে কে কে আছে আপনার?
কেউ নেই।
রুকসানা কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে মনে হচ্ছে কোথাও যেন দেখেছি, আপনার বাড়ি কোথায়?
হাসান দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রেখে বলল, হয়তো আমার মতো কাউকে কোথাও দেখেছেন। এবার আসি তাহলে?
রুকসানা বলল, প্লিজ, আর একটু বসুন। তারপর মেয়ে পিয়ন আসিয়াকে ডেকে বলল, দু’কাপ চা করে নিয়ে এস। তারপর হাসানকে বলল, বাড়ি কোথায় বললেন না যে?
বাড়ি থাকলে তো বলব।
ঠাট্টা করছেন?
ঠাট্টা করব কেন? যা সত্য তাই তো বললাম।
জন্মস্থানের নাম নিশ্চয় জানেন।
জানি।
সেটাই বলুন।
বলতে পারব না।
কেন?
মাফ করবেন, তাও বলতে পারব না।
এমন সময় আসিয়া দু’কাপ চা নিয়ে এলে রুকসানা এক কাপ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন। তারপর অন্য কাপটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, মনিরাকে তাহলে সাহায্য করতে পাবেন না?
হাসান কোনো কথা না বলে চা খাওয়া শেষ করে কাপ পিরিচ টেবিলের উপর রেখে বলল, ঠিক আছে, ছুটির পর স্কুলেই ঘণ্টাখানেক পড়াতে পারি। অবশ্য মনিরা যদি পড়তে চায়।
সে ব্যবস্থা আমি করব। আপনি থাকেন কোথায়?
ফুকরা স্কুলে জয়েন করার পর কিছু দিন সেক্রেটারীর কাঁচারী বাড়িতে ছিলাম। তারপর দক্ষিণ ফুকরা গ্রামের মরহুম কাজেম সেখের ভিটায় দু’টো ঘর তুলে আছি। একটা ডিসপেন্সারী আর অন্যটাতে আমি থাকি।
কাজেম সেখের নাম শুনে রুকসানা চমকে উঠল। সেই সাথে ইকবালের কথা মনে পড়ল। হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে হল, ইকবালের মুখের সঙ্গে অনেক মিল। ভাবল, তাই বোধ হয় হোসেনকে চেনাচেনা মনে হচ্ছে। বলল, ঠিক আছে মনিরা ছুটির পর স্কুলেই আপনার কাছে পড়বে।
এবার তাহলে আসি। ওষুধটা ঠিক মতো খাবেন বলে, ইকবাল যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।
রুকসানা বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি। কাল ঘরে এসে আব্বা-আম্মাকে আমার বিপদের কথা বলে আপনি কিভাবে। আমাকে রক্ষা করলেন বললাম। শুনে তারা আপনাকে অনেক দোয়া করলেন। তারপর আমাকে বললেন, আবার দেখা হলে নিয়ে আসবি। চলুন না, আমাদের বাড়িতে।
ইকবাল বলল, আজ সম্ভব নয়, অন্য একদিন আমি নিজেই যাব। তারপর সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
হাসান স্যার বেরিয়ে যাওয়ার পর রুকসানার কেন যেন মনে হল, উনি ইকবাল নয় তো? প্রায় বিশ বছর তাকে দেখিনি, তার উপর দাড়ি রেখেছে। তাই হয়তো চিনতে পারিনি। তা না হলে স্কুল থেকে তিন চার কিলোমিটার দূর দক্ষিণ ফুকরায় কাজেম চাচার ভিটেয় ঘর তুলে থাকতে যাবে কেন? হঠাৎ আসমার কথা মনে পড়ল। দাইহানের সঙ্গে বিয়ে হয়ে সে তো কাজেম চাচার ঘরের পাশে আছে। খবর দিলে দু’জনেই আসবে। তাদের কাছে হাসান স্যারের পরিচয় নিশ্চয় জানা যাবে। আমি তাদের বিয়ের ব্যাপারে যে সাহায্য করেছি সে কথা মনে রাখলে তারাও আমাকে সাহায্য না করে পারবে না। তখন তাদের বিয়ের ঘটনা রুকসানার মনের পাতায় ভেসে উঠল।
এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হওয়ার মাস খানেক পর একদিন আসমার ভাইয়া শাকিল রুকসানাদের সদর বাড়িতে এসে একজন লোককে বলল, আমি দক্ষিণ ফুকরা থেকে এসেছি, চৌধুরী হুজুরের বড় মেয়ে রুকসানার কাছে।
লোকটা সামসু। জিজ্ঞেস করল তোমার নাম কি?
শাকিল।
কার ছেলে তুমি?
গেঁদু মুন্সীর।
তোমাদের নাম বললে বড় আপা চিনবেন?
জি চিনবেন।
ঠিক আছে, বস, আমি খবর দিচ্ছি। তারপর ভিতর বাড়িতে গিয়ে রুকসানাকে বলল, দক্ষিণ ফুকরা থেকে গেঁদু মুন্সীর ছেলে শাকিল আপনার কাছে এসেছে।
রুকসানা বলল, নিচে ড্রইংরুমে বসাও আমি আসছি।
শাকিলও দাইহান সময় পেলেই মাঝে মধ্যে ছুটির সময় স্কুলে এসে আসমাকে নিয়ে যেত। প্রথম যেদিন আসে, সেদিনই আসমা রুকসানার সঙ্গে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাই শাকিল এসেছে শুনে ভাবল, নিশ্চয় আসমা পাঠিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে ড্রইংরুমে এল।
শাকিল সালাম দিল।
রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কী ব্যাপার শাকীল ভাই, হঠাৎ এলে যে?
শাকিল বলল, আব্বা দাইহান ও আসমার সম্পর্কের কথা জানতে পেরে গুপিনাথপুরে আসমার বিয়ের সব কিছু ঠিকঠাক করে ফেলেছে। তারপর পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, তুমি তো ওদের কথা সবই জান। তাই আসমা তোমার কাছে সাহায্য চেয়ে এটা দিয়েছে।
আসমার চিঠিটা নিয়ে বলল, তুমি বস, আমি আসছি। তারপর যাওয়ার সময় সামসুকে বলল, চাচা, একে নাস্তা দাও। উপরে নিজের রুমে এসে চিঠি পড়তে লাগল–
সই,
সালামান্তে আন্তরিক ভালোবাসা নিস। আশা করি, আল্লাহর রহমতে ভালো আছিস। কামনাও তাই। তারই কৃপায় আমিও ভালো আছি। পরে জানাই যে, আব্বা আমার ও দাইহানের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়ে একদিন আমাকে খুব রাগারাগি করে। তারপর গোপনে গুপিনাথপুরে বিয়ের ব্যবস্থা করেছে। কিছু দিন আগে ঐ পাত্র দেখতে এসে অনেক কিছু দাবি করেছিল বলে আব্বা, রাজি হয়নি। এখন তাদের সব। দাবি মেনে নিয়েছে। তুই তো জানিস দাইহান ভাইয়ার বন্ধু। আর ভাইয়া যে আমাকে কত ভালবাসে তাও জানিস। তাই অনেক সময় আমাদের দেখা সাক্ষাৎ ভাইয়া দেখে ফেললেও কখনো কিছু বলেনি। বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে জেনে ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করল, আব্বা যে তোর বিয়ে ঠিক করেছে, জানিস? আমি বললাম না। তারপর ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। ভাইয়া বন্ধুর হাতে আমাকে দিতে চায়। তাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিতে দিতে বলল, আমি যদি আগে জানতে পারতাম, তাহলে আব্বাকে এটা করতে দিতাম না। আমাকে যখন আব্বা জানাল তখন অনেক কিছু সুবিধা অসুবিধার কথা বলে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে দাইহানের সঙ্গে বিয়ে দিতে বললাম। শুনে আব্বা ভাইয়াকে খুব রাগারাগি করে বলল, তুই মূর্খ। লেখাপড়া না করে একটা গাধা হয়েছিস। নচেৎ নিজের শিক্ষিত বোনকে একটা মূর্খ কামলার সাথে বিয়ে দিতে চাইতিস না। বংশের মান ইজ্জতের জ্ঞান ও তোর। নেই। যদি থাকত, তাহলে তুই কামলার পুত কামলার সঙ্গে বন্ধুত্বও করতিস না। তাকে আমার সীমানায় আসতে নিষেধ করে দিস। কামলার পুতের এতবড় সাহস, আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। এ ব্যাপারে যদি আর একটা কথা বলিস, তাহলে তোকে ত্যাজ্যপুত্র করব। এই পর্যন্ত বলে ভাইয়া চোখ মুছে বলল, আমি তোদের জন্য বোধহয় কিছুই করতে পারব না। হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ল, ভাবলাম, আমার বিপদের কথা শুনে তুই নিশ্চয় সাহায্য করবি। তাই এই চিঠি লিখে ভাইয়াকে পাঠালাম। তুই তো জানিস, দাইহানকে ছাড়া আমি বাঁচব না। অন্য জায়গায় বিয়ে। হওয়ার আগে বিষ খাব। আমি আত্মঘাতী হব, এটা সই হয়ে নিশ্চয় চাইবি না। তাই যা কিছু করার একটু তাড়াতাড়ি করিস। একজন আত্মঘাতাঁকে বাঁচালে আল্লাহ নিশ্চয়। তোকে সুখী করবেন। আমি ক্রমশ মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছি। কি লিখলাম না লিখলাম বুঝতে পারছি না। ভাইয়ার হাতে যা হোক কিছু দু’লাইন লিখে দিস। জীবনে তোর সাথে আর দেখা হবে কিনা আল্লাহ মালুম। আর কলম চলছে না আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোর প্রাণপ্রিয় সই
আসমা।
চিঠি পড়ে রুকসানা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে চিন্তা করল, কিভাবে আসমাকে বাঁচাবে। কিন্তু কোনো কিছুই মাথায় এলনা। হঠাৎ মনে হল, আব্বাকে জানালে কেমন হয়? আসমাকে ভালোভাবেই চিনে। নিশ্চয় কিছু একটা ব্যবস্থা করবে। চিঠিটা হাতে নিয়ে আব্বার ঘরে গেল।
আব্দুল মতিন স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। মেয়েকে দেখে বললেন, আয় বস।
রুকসানা আব্বার পাশে বসে বলল, একটা ব্যাপারে তোমার কাছে পরামর্শ নিতে এসেছি শুনে রেগে যাবে না বল?
প্রথম সন্তান বলে আব্দুল মতিন রুকসানাকে অন্য ছেলেমেয়েদের চেয়ে একটু বেশি ভালোবাসেন। অবশ্য সব মা বাবাই তা করে থাকেন। আব্দুল মতিন মৃদু হেসে বললেন, পরামর্শ চাইবি এতে রাগ করব কেন? তাছাড়া আমি বা তোর মা। কোনোদিন তোকে রাগারাগি করেছি?
রুকসানা মা-বাবা দুজনকেই উদ্দেশ্য করে বলল, আমার সই আসমার কথা তোমাদের মনে আছে?
আজিজা বেগম বললেন, মনে থাকবে না কেন? সে তো অনেকবার তোর সঙ্গে এসেছে। পরীক্ষার কয়েকদিন আগে এসে আমাদেরকে সালাম করে দোয়া নিয়ে গেল।
স্ত্রী থেমে যেতে আব্দুল মতিন বললেন, আমারও মনে আছে, দক্ষিণ ফুকরার কৃপন গেঁদু মুন্সীর মেয়ে তো?
রুকসানা বলল, হ্যাঁ আব্বা।
আব্দুল মতিন বললেন, পরামর্শ নিতে এসে তার কথা বলছিস কেন?
রুকসানা বলল, সে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। পড়ে শোনাচ্ছি। শোনার পর তোমরা পরামর্শ দেবে। তারপর চিঠিটা পড়ে শোনাল।
পড়া শেষ হওয়ার পর আব্দুল মতিন ও আজিজা বেগম অনেক্ষণ চুপ করে রইলেন।
রুকসানা বলল, তোমরা কিছু বলছ না কেন?
আব্দুল মতিন সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিলেন। সোজা হয়ে বসে বললেন, আজকালের ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার আগেই এমন কিছু ছেলেমানুষি কাজ করে ফেলে, যা তাদের করা মোটেই উচিত নয়।
কিন্তু আব্বা ছোটরাই তো ছেলেমানুষি করে। তাছাড়া বড়রাও অনেক সময় ভুল করে থাকে।
তোর কথা অস্বীকার করব না, তবে কি জানিস মা, বড়রা যা ভুল করে, তা সংশোধনের চেষ্টাও তারা করে। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্করা তাদের ভুল যেমন স্বীকার করে না, তেমনি সংশোধন করার কথা মানতেই চায় না।
তা হয়তো ঠিক। এখন আমি কিভাবে আমার সইকে বাঁচাব তার পরামর্শ দাও।
খুব চিন্তায় ফেলে দিলি মা, ভেবে চিন্তে দেখি কি করা যায়। আচ্ছা, চিঠিটা তুই পেলি কি করে? ডাকে এসেছে?
না, আসমা তার ভাইয়ার হাতে পাঠিয়েছে। তার হাতে দুলাইন লিখে দিতেও বলেছে। তাই নিচে বসিয়ে রেখেছি।
তার ভাইয়াকে তুই চিনিস?
হ্যাঁ।
গেঁদু মুন্সীর ছেলেমেয়ে কটা?
এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে বড়।
তাকে নাস্তা দিতে কাউকে বলেছিস?
হ্যাঁ সামসু চাচাকে বলেছি।
আব্দুল মতিন চিন্তা করলেন কিছু একটা করা উচিত। নচেৎ চিঠিটা যেভাবে লিখেছে, যদি সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে বসে? বললেন, চলতো তার সঙ্গে কথা। বলে দেখি।
শাকিল আব্বার মুখে বাহিরবাগ গ্রামের চৌধুরীদের পূর্বপুরুষদের দূর-দবার কথা অনেক শুনেছিল। জমিদারী চলে গেলেও এখনো তাদের প্রতিপত্তি যে কমেনি তাও। শুনেছে, আব্দুল মতিন চৌধুরী যে দশ গ্রামের বিচার আচার করেন তাও জানে। নাস্তা খেয়ে ঘরের দামি দামি আসবাবপত্র দেখছিল। রুকসানার সঙ্গে একজন লোককে আসতে দেখে অনুমান করল, নিশ্চয় ওর আব্বা আব্দুল মতিন চৌধুরী। দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
আব্দুল মতিন সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, আমি রুকসানার আব্বা, ওর মুখে তোমার পরিচয় পেয়েছি। তুমি কতদূর। লেখাপড়া করেছ?
শাকিল লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, প্রাইমারী পর্যন্ত পড়ে আর পড়িনি। আমার মাথা মোটা, তাই আব্বাও পড়ায় নি।
বড় ভাই হয়ে ছোটবোনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে কেন?
শাকিল উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।
তোমার বন্ধুর কি নাম যেন?
দাইহান। সে কতদূর লেখাপড়া করেছে?
সেও প্রাইমারী পর্যন্ত পড়েছে।
তোমাদের বন্ধুত্ব কতদিনের?
ছোট বেলা থেকে।
দাইহান কার ছেলে?
ফজল শেখের।
তার অবস্থা কেমন?
ভালো না। জমি জায়গা অল্প।
তোমার আব্বা তো ঠিক কথা বলেছেন, দাইহান তোমার বন্ধু হতে পারে, তাই বলে জেনে শুনে নিজের শিক্ষিত বোনকে একটা অল্প শিক্ষিত গরিব ছেলের সঙ্গে তুমি বিয়ে দিতে চাও কেন? তা ছাড়া তোমার বাবার অবস্থা ভালো। তার মান সম্মান আছে।
শাকিল বলল, আমি ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বুঝি না। আমার একটাই বোন। তাকে খুব ভালোবাসি। সে যাকে পেয়ে সুখী হতে চায়, তার হাতেই দিতে চাই। আর দাইহান গরিব অশিক্ষিত হলেও তার মতো ভালো ছেলে আমি দেখিনি। তাছাড়া আব্বার সম্পত্তি অনেক। আব্বা অন্য ছেলেকে যা কিছু দিতে চাচ্ছে, তা দাইহানকে দিলে সে আর গরিব থাকবে না।
আব্দুল মতিন বুঝতে পারলেন শাকিলের সত্যি মাথা মোটা, আর খুব সহজ সরল। বললেন, কিন্তু তোমার আব্বা তো দাইহানকে পছন্দ করেন না। মা-বাবারা ছেলে মেয়েদের ভালো চান। তোমার আব্বার কথা তোমাদের মেনে নেয়াই তো উচিত।
উচিত অনুচিত বোঝার জ্ঞান থাকলে আপনাদের কাছে আসতাম না। তারপর উঠে এসে আব্দুল মতিন চৌধুরীর পায়ে হাত দিয়ে বলল, আপনি আমার বোনকে বাঁচান। তার কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারব না।
আব্দুল মতিন তার হাত ধরে তুলে বসতে বলে বললেন, আসমা আমার মেয়ের সই। তাকে আমিও মেয়ের মতো মনে করি। তুমি এখন যাও। আমি কাল তোমার আব্বার সঙ্গে দেখা করব।
শাকিল সালাম বিনিময় করে চলে এল। ঘরে এসে আসমাকে সব কথা জানিয়ে বলল, চিন্তা করিস না। আমার মনে হয়, চৌধুরী হুজুর আব্বাকে রাজি করাতে পারবেন।
পরের দিন আব্দুল মতিন দক্ষিণ ফুকরায় গিয়ে গেঁদু মুন্সীকে কি বলেছিলেন তা রুকসানা জানে না। ফিরে এসে শুধু বলেছিলেন, এমন ব্যবস্থা করে এসেছি গেঁদু মুন্সী গুপিনাথপুরের সম্বন্ধ ভেঙ্গে দিয়ে দাইহানকে জামাই করতে রাজি হয়েছে।
মাস খানেক পরে গেঁদু মুন্সী নিজে এসে আব্বাকে দাইহানের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গিয়েছিলেন। আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। আব্বা নিয়েও গিয়েছিলেন। এক সময় আসমাকে জিজ্ঞেস করলাম, আব্বা এসে তোর আব্বাকে কি করে রাজি করাল বলতো।
আসমা বলল, আমি জানিনি। ভাইয়া বলল, চৌধুরী চাচা খুব নামি দামি লোক। উনি যা যা বললেন আব্বা সব মেনে নিলেন।
রুকসানা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে এইসব ভাবছিল। এমন সময় রাবেয়া এসে তাকে ঐভাবে বসে থাকতে দেখে কপালে একটা হাত রেখে বলল, কিরে শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
রুকসানার মনে হল এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল, রাবেয়ার কথায় তা ভেঙ্গে গেল। তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, না শরীর ভালো আছে। এমনি একটু তন্দ্ৰামতো এসেছিল আর কি? তুই বস।
রাবেয়া বসে বলল, ডাক্তার নিয়ে পলাশপুর গিয়েছিলি?
হ্যাঁ গিয়েছিলাম। গিয়ে খুব বড় বিপদে পড়েছিলাম। নেহাৎ হায়াৎ ছিল বলে আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
রাবেয়া ভয়ার্তস্বরে বলল, তাই নাকি? কি হয়েছিল বলতে শুনি।
রুকসানা ষাঁড়ের ঘটনাটা বলে বলল, ঠিক সময় মতো হাসান স্যার যদি না এসে পড়তেন, তা হলে ষাঁড়টা শিং দিয়ে গুতিয়ে মেরেই ফেলত।
রাবেয়া আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এইজন্যে লোকে বলে, “রাখে। আল্লাহ মারে কে?” তারপর বলল, কায়সারের মুখে শুনেছি, হাসান স্যার শুধু খুব ভালো টিচারই নন, এই কয়েক মাসের মধ্যে ডাক্তার হিসাবে গরিবদের মা বাপ হয়ে গেছেন। তা তোর কেমন মনে হল?
আমার দৃষ্টিতে ওঁর মতো লোক পৃথিবীতে খুব কমই আছে।
প্রশংসার মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেল না?
তা জানি না। যা মনে হয়েছে তাই বললাম।
মনে হচ্ছে ভদ্রলোক তোকে বিপদ থেকে রক্ষা করে তোর মনের গহীনে ঢুকে পড়েছেন।
কি যা তা বকছিস? যা সিটে গিয়ে কাজ কর।
তা যাচ্ছি বলে রাবেয়া জিজ্ঞেস করল, আসিয়া বলল, কে একজন দাড়িওয়ালা দ্রলোক নাকি এসেছিলেন?
রুকসানা বলল, হ্যাঁ ঐ ভদ্রলোকই গতকাল বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। তারপর টেবিলের উপর প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল, আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। তাই আঘাত পেয়েছি মনে করে ওষুধ দিতে এসেছিলেন।
তাই নাকি? তা হলে তো ভদ্রলোকের মনেও তুই ঢুকে পড়েছিস?
দেখ, বেশি বাজে কথা বলবি না বেরো এখান থেকে।
রাবেয়া যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে বলল, দেখবি, বাজে কথাটাই একদিন সত্য হয়ে দাঁড়াবে।
রুকসানা কয়েক সেকেণ্ড তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কাজে মন দিল।
৩
কিশোর ইকবাল আব্বার হাতে মার খেয়ে সুস্থ হওয়ার পর প্রতিজ্ঞা করল, যেমন করে হোক রুকসানাকে বিয়ে করে এর প্রতিশোধ নেবে। তাই সুস্থ হওয়ার পর মায়ের জমানো সামান্য কিছু টাকা নিয়ে বাবা মাকে না জানিয়ে ঢাকা চলে এল। শহরে কয়েকটা বাসায় লজিং এর চেষ্টা করে বিফল হয়ে ভাবল, শহরের কাছাকাছি কোনো গ্রামে চেষ্টা করতে হবে। তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে মাণ্ডা হায়দার আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে বারান্দায় বসেছিল।
স্কুলের ঘণ্টা পড়ার পর যখন ছেলেরা সব ক্লাসে গেল তখন হেড মাস্টারের কাছে গিয়ে বলল, আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার রোল নাম্বার এক। ফাঁইভে বৃত্তি পেয়েছি। সব ক্লাসেই আমার রোল নাম্বার এক ছিল। আমার আব্বা খুব গরিব। আমাকে পড়াতে চায় না। তাই পড়াশোনা করার জন্য বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আপনি দয়া করে আমাকে স্কুলে ভর্তি করে নিন। তারপর হেডমাস্টারের দু’পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।
হেডমাস্টারের মনে দয়া হল। ভাবলেন, রোল নাম্বার যখন এক এবং ফাঁইভে বৃত্তি পেয়েছে তখন নিশ্চয় ভালো ছাত্র। বললেন, কাঁদছ কেন উঠে দাঁড়াও।
ইকবাল দাঁড়িয়ে চোখ মুছল।
হেড মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?
ইকবাল হোসেন।
বাড়ি কোথায়?
গোপালগঞ্জ জেলায়।
কোন স্কুলে পড়তে?
ফুকরা হাইস্কুলে।
স্কুলে না হয় ভর্তি করে নিলাম; কিন্তু তুমি থাকবে কোথায়?
কয়েক দিন স্কুলে থাকার অনুমতি দিন, তারপর লজিং খুঁজে নেব।
হেড মাস্টার তাকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষকদের কমনরুমে এলেন। তখনও তারা ক্লাসে যায় নাই। ইকবালকে দেখিয়ে তাদেরকে বললেন, গোপালগঞ্জ জেলার ফুকরা হাই। স্কুলের সেভেনে পড়ে। বাবা খুব গরিব। পড়াতে চায় না। তাই ঢাকায় এসেছে। পড়াশোনা করার জন্য। রোল নাম্বার এক এবং ফাঁইভে বৃত্তি পেয়েছে বলছে। আমরা যদি ওকে একটু সাহায্য করি, তাহলে হয়তো ছেলেটা উন্নতি করবে।
কেউ কিছু বলার আগে এ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার বললেন, এরকম ছেলেকে সাহায্য করা আমাদের সকলের কর্তব্য। আপনি ওকে ভর্তি করে নেন।
হেড মাস্টার বললেন, শুনে খুশি হলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ও থাকবে কোথায়? খাবে কি?
সেখানে দপ্তরী খালেক ছিল, বলল, ও আমার কাছে আপাতত থাকুক। পরে একটা লজিং ঠিক করে দেব।
হেডমাস্টার হাসানকে ভর্তি করে বই খাতার ব্যবস্থা করে দিলেন।
দপ্তরী খালেকের অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল। রাস্তার ধারে চার পাঁচটা দোকানের ভাড়া পায়। পৈত্রিক সূত্রে যে জায়গা পেয়েছে সেখানে টিন সেডে চার কামরা ঘর করেছে। দু’কামরা ভাড়া দিয়েছে। বাকি দু’কামরায় নিজেরা থাকে। তার স্ত্রী ফরিদা একটু মুখরা হলেও আচার ব্যবহার ভালো। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা বড়। নাম রেফাত। মেয়ের নাম মালেকা। রেফাত ফোরে আর মালেকা টুয়ে পড়ে।
ছুটির পর খালেক ইকবালকে বাড়িতে নিয়ে এসে ছেলেদের পড়ার রুমে বসাল। তারপর স্ত্রীর কাছে গিয়ে ইকবালের সব কথা বলে বলল, পোলাডা খুব ভালা, তাই। লইয়া আইলাম। রেফাত ও মালেকাকে পড়াইব আর আমাদের লগে থাকবো। তুমি। তো ওদের লাইগ্যা মাস্টার রাখনের কথা কইছিলা। পাঁচশ টাকার কমে কেউ বাড়িতে পড়াইবার আইত চায় না। লজিং মাস্টার বাড়িতে রাখলে তিন বেলা ভালামন্দ খাওন দেওয়া লাগবো, থাকনের রুম লাগবো। এই পোলাড়া কতই বা আর খাইবো? রেফাতের লগে একরুমে থাকবারও পারবো।
স্বামীর কথা শুনে ফরিদা বলল, কইলাতো ভালাই, চলো তো দেহি। তারপর স্বামীর সঙ্গে এসে ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আহারে, পোলাডা বুঝি হারাদিন খায় নাই। মুখ শুকিয়ে তুলসী পাতার ল্যাহান হইছে। তারপর স্বামীকে বলল, তুমি পোলাডারে কলতলায় লইয়া যাও। হাতে পায়ে পানি দিয়া নিয়া আইস, আমি ভাত নিয়া আহি।
সেইদিন থেকে ইকবাল খালেকের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে লাগল। সেই সাথে রেফাত ও মালেকার সাথে প্রতিদিন সকালে ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় কুরআন পড়া শিখতে লাগল। খালেক ও ফরিদা তাকে ছেলের মতো দেখে। আর ইকবালও তাদেরকে চাচা চাচির মতো দেখে। রেফাত ও মালেকাকে নিজের ভাইবোনের মতো দেখে। ক্রমশ সে বাড়ির ছেলের মতো হয়ে গেল। সেভেন থেকে ফার্স্ট হয়ে এইটে উঠার পর মাস্টারদের নজরে পড়ে গেল। পরের বছর এইটে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে টেলেন্টপুল বৃত্তি পাওয়ার পর সবার কাছে প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল। ইকবালকে রাখার ফলে মালেকের ছেলে মেয়ে রেফাত ও মালেকা ভালো রেজাল্ট করতে লাগল। নাইনে উঠার পর ইকবাল বিকেলে খেলাধুলা না করে ক্লাস সিক্সের দুটো ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়ে যা পেত তা খরচ না করে জমাতে লাগল। ব্যাপারটা খালেকরা কেউ জানতে পারল না। তারপর এস. এস. সিতে পাঁচটা বিষয়ে স্টার মার্ক নিয়ে ফার্স্ট ডিভিসনে। পাশ করল।
খালেক ও ফরিদা এতদিন তার সমস্ত পড়ার খরচ জুগিয়েছে। খালেক স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেছে ইকবালকে উচ্চ শিক্ষা দিয়ে জামাই করবে। তাই এস. এস. সি পাশ করার পর বলল, তুমি কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা কর, টাকা পয়সার চিন্তা করো না, আমরা দেব।
ইকবাল বলল, কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে আমি আব্বা আম্মার সঙ্গে দেখা। করার জন্য দেশে যাব।
খালেক বলল, এটা তো খুব ভালো কথা। যাতায়াতের খরচ আমার কাছ থেকে নিও।
.
প্রায় আড়াই বছর প্রাইভেট পড়িয়ে ইকবাল প্রায় পাঁচ হাজার টাকা জমিয়েছিল। সেই টাকা নিয়ে একদিন দেশের বাড়ি রওয়ানা হল। গোপালগঞ্জে বাস থেকে নেমে চৌধুরীদের বাগান বাড়িতে গিয়ে নতুন দারোয়ানের কাছে জানতে পারল, প্রায় চার পাঁচ বছর আগে তার আব্বা চাকরি ছেড়ে দিয়ে আম্মাকে নিয়ে নিজেদের গ্রামে দক্ষিণ ফুকরায় চলে গেছে। ইকবাল চৌধুরী বাড়ির সবার অলক্ষে যেমনভাবে বাগান বাড়িতে গিয়েছিল, তেমনিভাবে সবার অলক্ষে সেখান থেকে দক্ষিণ ফুকরা গ্রামে এসে একজন লোককে জিজ্ঞেস করল কাজেম শেখের বাড়ি কোনটা বলতে পারেন?
লোকটার নাম গেঁদু মুন্সী। বললেন, কাজেম ছেলের শোকে পাগল হয়ে দু’বছর আগে মারা গেছে। তার বৌও বছর খানেক হল মারা গেছে। তার ঘরে কাজেমের এক বুড়ি চাচি তার নাতিকে নিয়ে থাকে। এমন সময় একটা যুবককে খালি গায়ে গামছা কাঁধে আসতে দেখে বললেন, ঐ তো বুড়ির নাতি দাইহান আসছে। কাছে এলে গেঁদু মুন্সী ইকবালকে দেখিয়ে তাকে বললেন, এই ছেলেটা তোমার কাজেম চাচার খোঁজ করছে। তারপর কাজ আছে চলি বলে চলে গেলেন।
দাইহানের বাবা ফজল কাজেমের চাচাতো ভাই। দাইহানকে ছোট রেখে তার মা মারা গেছে। ফজল আবার বিয়ে করেছে। সেই স্ত্রীর গর্ভে পাঁচ ছটা ছেলে মেয়ে হয়েছে। দাইহানকে সত্য একদম দেখতে পারে না। ফজলের মা রহিমন নাতিকে মানুষ করে। যখন কাজেম ও তার স্ত্রী মারা যায় তখন দাইহান পূর্ণ যুবক। সৎ মায়ের সঙ্গে তার প্রায় ঝগড়া হত। তাই কাজেম ও তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তাদের ঘরে দাদিকে নিয়ে থাকে।
গেঁদু মুন্সী যাওয়ার পর দাইহান ইকবালের দিকে তাকিয়ে তার জামা কাপড় দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কে তুমি? কোথা থেকে আসছ?
আমি ইকবাল ঢাকা থেকে আসছি।
কাজেম চাচা যে তার ছেলে ইকবালকে হারিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল তা জানে। তাই নাম শুনে চমকে উঠল বলল, তুমিই তাহলে কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল?
হ্যাঁ লেখা পড়া করার জন্য আমি ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম। ঐ লোকটা বলল, তারা দু’তিন বছর আগে মারা গেছে। কথা শেষ করে মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
দাইহান বলল, কেঁদে আর কী করবে? চল ঘরে চল।
তারপর যেতে যেতে বলল, তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর চাচা চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাচিকে নিয়ে চলে আসে। তারপর কিভাবে তারা মারা গেল বলে বলল, আমি তোমার আব্বার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। দাদিকে নিয়ে এখন তোমাদের ঘরে থাকি। তুমি ঢাকায় এতদিন কি করতে?
একজনের বাড়িতে থেকে এস.এস.সি পাশ করেছি।
তাই নাকি? তাহলে তো খুব ভালো কথা। দাদি তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে। ঘরের উঠানে এসে দাইহান বড় গলায় বলল, দাদি কে এসেছে দেখবে এস।
কাজেমের ঝুপড়ির মতো একটা ঘর ছিল। দাইহান সেটাকে মেরামত করে দাদিকে নিয়ে থাকে। ঘরের বাইরে দরজার পাশে তালপাতার বেড়া দিয়ে অল্প একটু জায়গা ঘিরে দিয়েছে। সেখানে রহিমন দাদি মাটির চুলোতে রান্না করে। একটু আগে মোড়লদের পুকুর থেকে কলমী শাক তুলে এনে চুলোর কাছে বসে কুটছিল। নাতির গলা পেয়ে মুখ বাড়িয়ে সাথে একটা ভালো জামা কাপড় পড়া ছেলে দেখে বলল, কে রে ছেলেটা?
ততক্ষণ তারা তার কাছে চলে এল। দাইহান বলল, যে ছেলের শোকে কাজেম চাচা পাগল হয়ে মারা গেল, এই সেই ইকবাল।
রহিমন কী বললি বলে বেরিয়ে এসে ইকবালের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ তাই তো, দেখতে ঠিক কাজেমেরই মতো? তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দাইহানকে জিজ্ঞেস করল, তুই একে পেলি কোথায়?
দাইহান বলল, কাজ না পেয়ে ফিরে আসছিলাম। দেখি মুন্সী চাচার সঙ্গে কথা বলছে। সে ইকবালকে চাচা চাচির মরণের কথা বলেছে। আমাকে দেখে মুন্সী চাচা বললেন, “এই ছেলেটা কাজেমের খোঁজ করছে।” আমি ওর সঙ্গে কথা বলে কাজেম চাচার ছেলে জেনে নিয়ে এলাম।
রহিমন আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছে বলল, এতদিন কোথায় ছিলিরে ভাই? দু’তিন বছর আগে এলে মা-বাপকে দেখতে পেতিস।
ইকবাল কিছু বলার আগে দাইহান বলল, জান দাদি, ওনা ঢাকায় একজনের বাড়িতে থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছে।
আহারে কাজেম ও তার বৌ বেঁচে থাকলে কত্তো খুশি হত। তারপর ঘরে বসিয়ে মুড়ি খেতে দিয়ে বলল, আমরা ভাই গরিব মানুষ, এগুলো খেতে খেতে দাইহানের সাথে গল্প কর। ও তোমার বড় ভাই লাগে, আর আমি তোমার দাদি। যাই রান্না করি বলে রহিমন বেরিয়ে এসে শাক কুটতে লাগল।
কাজেমের ছেলে ইকবাল এসেছে শুনে গ্রামের ছোট বড় সব ধরনের মেয়ে পুরুষ তাকে দেখে যেতে লাগল।
ইকবাল আব্বার হাতে মার খেয়ে যে প্রতিজ্ঞা করে ঢাকা চলে গিয়েছিল, সে কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলেনি। তাই আল্লাহর দেওয়া মেধাকে কাজে লাগিয়ে এত ভালো রেজাল্ট করেছে। গ্রামের বাড়িতে এসে মা-বাবার পরিণতির কথা শুনে যত দুঃখ পেয়েছে সেই প্রতিজ্ঞার প্রতি ততো কঠোর হয়েছে। তাই রুকসানার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য কয়েকদিন থাকার মনস্থ করল। তারপর হিসাব করে দেখল, রুকসানা। এ বছর টেনে উঠেছে।
ইকবাল যে পাঁচ হাজার টাকা এনেছিল, তা থেকে আব্বা আম্মার রুহের মাগ ফেরাতের জন্য পাঁচশ টাকা মসজিদে ও পাঁচশ মাদ্রাসায় দান করল। আর দাইহানের সামনে দাদিকে এক হাজার টাকা দিয়ে বলল, আমি ছাত্র পড়িয়ে কিছু টাকা রোজগার করে এনেছিলাম আব্বা আম্মাকে দেওয়ার জন্য। তাদেরকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছে। সেই টাকা থেকে কিছু টাকা আব্বা আম্মার নামে মসজিদে ও মাদ্রাসায় দিয়েছি, এটা আপনারা রাখুন। আমি চার পাঁচদিন পর চলে যাব।
রহিমন ইকবালের মাথায় চুমো খেয়ে ভিজে গলায় দোয়া করল, আল্লাহ তোকে সহি সালামতে রাখুক। আমার মাথায় যত চুল, তত হায়াৎ দিক। তারপর দাইহানকে টাকাগুলো দিয়ে বলল, তুলে রাখ।
গেঁদু মুন্সীর অবস্থা খুব ভালো। গ্রামে প্রতিপত্তিও আছে। কিন্তু ভীষণ কৃপণ। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের নাম শাকিল। মোটা বুদ্ধির কারণে ফেল করে করে ফাঁইভ পর্যন্ত পড়ে আর পড়েনি। বাপের বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করে। দাইহানের সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব। দাইহান বছরের বেশির ভাগ সময় তাদের ক্ষেত খামারের কাজ করে। মেয়ে আসমা দেখতে তেমন ভালো না, গায়ের রং কালো, নাক ও ঠোঁট মোটা। স্থূল দেহ। চোখ দুটো ছোট। কিন্তু খুব গুণবতী। যেমন লেখাপড়াতে ভালো তেমনি সংসারের কাজে খুব পটু। নামায রোয়া ঠিকমতো করে। প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত করে ও ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়াশোনা করে।
মেয়ে দেখতে ভালো না, বিয়েতে অনেক যৌতুক দিতে হবে। তাই গেঁদু মুন্সী কৃপণ হওয়া সত্ত্বেও মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন এই ভেবে যে, যদি শিক্ষিত করাতে পারে, তাহলে যৌতুক ছাড়াই মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন।
অবশ্য আসমার বাড়ন্ত চেহারা দেখে এইটে পড়ার সময় থেকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নাইনে ওঠার পর বোরখা কিনে দিয়েছেন। কিন্তু পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখে মোটা টাকা দাবি করে। তাই আজ বিয়ে দিতে পারেন নি।
আসমা দাইহানকে কিশোর বয়স থেকে ভালবাসে। বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখল, দাইহান গরিবের ছেলে লেখাপড়াও বেশি করেনি, সংসারে সত্য তখন চিন্তা করল, আব্বা জানতে পারলে যা রাগী মানুষ মেয়ে বলে ছেড়ে দেবে না। কেটে দু’টুকরো করে ফেলবে। এইসব চিন্তা করে ও দাইহানকে ভুলতে পারেনি। সুযোগ পেলেই তার সঙ্গে কথা বলে। দাইহানও আসমাকে ভালবাসে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোনোদিন সেকথা তাকে জানতে দেয়নি। যেদিন আসমা তাকে মনের কথা জানায়, সেদিন ভয়। পেয়ে বলেছিল, একথা ভুলেও আর মুখে এনো না। তোমার আব্বা জানতে পারলে আমাকে তো জানে শেষ করে ফেলবেই, তোমাকেও ছেড়ে কথা বলবে না। তারপর থেকে দাইহান খুব সজাগ থাকে, আসমা যেন একাকী তার সঙ্গে দেখা করতে না পারে। তবু আসমা সতর্কতার সাথে দাইহানের সঙ্গে দেখা করে। দাইহান নিষেধ করলে বলে, তুমি পুরুষ হয়ে এত ভয় পাও কেন? একটা কথা মনে রেখ, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তাতে যদি আব্বার হাতে মরতে হয় তাতেও রাজি। এই কথায় দাইহান আরো ভয় পেয়ে অনেক কিছু বলে বোঝাবার চেষ্টা করে। তখন আসমা আরো রেগে গিয়ে বলে, আমাকে বুঝিয়ে কোনো লাভ হবে না। তবে যেদিন। শুনব তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছ, সেদিন বৌ দেখতে গিয়ে তোমাদের দু’জনের সামনে বিষ খাব।
এইকথা শোনার পর থেকে দাইহান আসমাকে এড়িয়ে চলে। যখন সে গোপনে দেখা করে তখন কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
কিছুদিন আগে বোধহয় তার মা ফজিলা বেগম টের পেয়ে স্বামীকে দাইহানের কথা না বলে শুধু বলেছিলেন, মেয়েকে বেশি লেখাপড়া করিয়ে কি হবে? তাছাড়া দিন দিন যে ভাবে গা-গতরে বেড়ে যাচ্ছে, বেশি দিন ঘরে রাখা ঠিক হবে না। দিনকালও ভালো না। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।
গেঁদু মুন্সী বললেন, সে কথা আমিও চিন্তা করেছি। কিন্তু ভালো ছেলে পাওয়া। যাচ্ছে না।
ফজিলা বেগম কৃপণ স্বামীর স্বভাবের কথা ভালো ভাবেই জানেন। বললেন, তুমি সোনা-দানা টাকা-পয়সা ছাড়া মেয়ের বিয়ে দিতে চাও। আজকাল ঐ সব না দিলে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে? তাছাড়া মেয়ে দেখতেও তেমন সুন্দরী না।
গেঁদু মুন্সী রেগে উঠে বললো, আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। ঐ সব ছাড়াই মেয়ের বিয়ে দিতে পারি কিনা দেখিয়ে দেব। তারপর গজগজ করতে করতে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন।
দাইহানকে ফজিলা বেগমের খুব পছন্দ, কিন্তু তাই বলে কামলার ছেলে কামলাকে তো আর জামাই করতে পারেন না। মেয়েকে একদিন সন্ধ্যের পর বৈঠকখানার পিছনে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে ও তাদের কথা বার্তা আড়াল থেকে শুনে বুঝতে পেরেছিলেন। দুজনের সম্পর্কের কথা। তাই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য স্বামীকে বলেছিলেন স্বামীর কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে চিন্তা করলেন, আল্লাহ না করুক, যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়, তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই মেয়েকে একদিন দাইহানের কাছে যেতে নিষেধ করে চোখে চোখে রাখেন। কিন্তু আসমা অশিক্ষিত মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দাইহানের সঙ্গে দেখা করে।
ইকবাল দু’দিন দাইহানের সঙ্গে গ্রাম দেখে বেড়াল। তার পরের দিন খুব সকালে দাইহান বাসি ভাত খেয়ে কাজে গেল। একটু বেলাতে রহিমন ইকবালকে নাস্তা খাওয়াচ্ছিল। এমন সময় আসমা এসে রহিমনকে বলল, দাদি, আব্বা আপনাকে দেখা করতে বলেছে।
রহিমন বলল, বলিস বিকেলে যাব।
কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল এসেছে শুনে আসমা কাল সকালে এসেছিল। কিন্তু ইকবাল ঘরে ছিল না। তাই দেখা হয়নি। রহিমন দাদির কাছে তার সব কিছু শুনে স্কুলে গিয়ে রুকসানাকে বলল, জানিস, কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল এস.এস.সি পাশ করে মা-বাবাকে দেখার জন্য কাল এসেছে। রহিমন দাদি বলল, মা-বাবা মারা গেছে শুনে নাকি খুব কেঁদেছে। দু’চার দিন থেকে চলে যাবে।
রুকসানা চমকে উঠে বলল, সত্যি বলছিস? হারে সত্যি।
আমি তাকে দেখব বলে আজ সকালে গিয়েছিলাম, তখন ঘরে ছিল না, তাই দেখা হয়নি।
ইকবাল এস.এস.সি পাশ করে এসেছে শোনার পর থেকে রুকসানার সমস্ত শরীরে এক ধরনের অজানা আনন্দের স্রোত বইতে শুরু করল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুই তার সঙ্গে দেখা করে বলবি, কাল স্কুল ছুটির সময় এসে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।
আসমা বলল, ঠিক আছে বলব।
তাই আজ রহিমন দাদিকে আব্বার কথা বলতে এসে অচেনা একটা ছেলেকে দেখে ভাবল, এ নিশ্চয় ইকবাল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগল; কিভাবে রুকসানার কথাটা তাকে বলবে।
আসমাকে ইকবালের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রহিমন বলল, তোর কাজেম চাচার ছেলে। এর কথাই কাল তোকে বলেছি। তারপর ইকবালকে বলল, এ হল গেঁদু মুন্সীর মেয়ে আসমা।
ইকবাল একবার আসমার দিকে চেয়ে নিয়ে খেতে লাগল।
রহিমন আসমাকে বলল, তুই একটু বস, আমি পুকুরঘাট থেকে আসছি।
রহিমন চলে যাওয়ার পর আসমা ইকবালের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে বাহিরবাগ গ্রামের চৌধুরীদের রুকসানা কাল স্কুল ছুটির সময় দেখা করতে বলেছে।
ইকবাল চমকে উঠে খাওয়া বন্ধ করে তার দিকে একদৃষ্টে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলল, বাহিরবাগ গ্রাম তো অনেক দূর, আমি এসেছি রুকসানা জানল কেমন করে? আর তোমাকে বললই বা কেমন করে?
ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আমরা একই ক্লাসে পড়ি। রুকসানা আমার সই। কাল আমিই তাকে বলেছি।
ইকবাল বুঝতে পারল, রুকসানা হয়তো আমাদের সবকিছু আসমাকে বলেছে। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে বলল, রুকসানাকে বলল, “আমি তাদের দারোয়ানের ছেলে। তার সঙ্গে দেখা করা আমার উচিত হবে না।” তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে। গেল।
আসমা তার পিছন দিকে তাকিয়ে ভাবল, রুকসানার কারণে মার খেয়েছিল বলে হয়তো তার উপর এখনো রেগে আছে। তাই ঐ কথা বলল।
একটু পরে রহিমন ফিরে এলে আসমা ঘরে চলে গেল।
ইকবাল আসমাকে ঐ কথা বললেও গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, রুকসানা দেখা করতে বলল, কেন? এটা তার কৌতূহল, না অন্য কিছু? বিড়বিড় করে বলল, তুমি না ডাকলেও আজ যেতাম।
আজ আসমা স্কুলে আসার পর রুকসানা জিজ্ঞেস করল, কিরে, ইকবালের সাথে দেখা হয়েছিল?
আসমা বলল, হ্যাঁ।
আমার কথা বলেছিস?
বলেছি। শুনে বলল, “আমি তাদের দারোয়ানের ছেলে, তার সঙ্গে দেখা করা আমার উচিত হবে না।”
কথাটা শুনে রুকসানার মুখটা মলিন হয়ে গেল। কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
আসমা তার মুখের অবস্থা দেখে বলল, তুই মন খারাপ করছিস কেন? সে তো আর জানে না, সেদিনের ঘটনার জন্য তুই দায়ী না। আমার মনে হয় তোকে দায়ী ভেবে তোর প্রতি আজও রেগে আছে।
তবু যখন রুকসানা কিছু বলল না তখন বলল, কিরে কী ভাবছিস?
কি আর ভাববো? বাদ দে তার কথা, তোর দাইহানের কথা বল।
তার কথা নতুন করে আর কি বলব? জানি না আল্লাহ আমার তকদিরে কি রেখেছে।
এমন সময় স্যারকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে রুকসানা কুনয়ের গুঁতো দিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই চুপ কর, স্যার এসে গেছেন।
.
দুপুরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ইকবাল স্কুলের পথে রওয়ানা দিল। যখন স্কুলের কাছে পৌঁছাল তখনও ছুটি হতে আধঘণ্টা দেরি। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক বেরিয়ে বাহিরবাগ যাওয়ার রাস্তার মোড়ে একটা মোটা কাঁঠাল গাছের তলায় বসে অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পর ছুটির ঘণ্টা পড়তে শুনে দাঁড়িয়ে স্কুলের গেটের দিকে তাকিয়ে রইল। গেট খুলে যাওয়ার পর প্রথমে নিচের ক্লাসের মেয়েরা হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসতে লাগল। তারপর বড় বড় মেয়েদের বেরোতে দেখে সতর্ক দৃষ্টিতে রুকসানাকে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ কয়েকজন মেয়ের মধ্যে দু’টো বোরখা পরা মেয়েকে বেরোতে দেখে তাদের দিকে লক্ষ রাখল। বোরখা পরা থাকলেও দুজনেরই মুখে নেকাব নেই। তাদের একজনকে চিনতে পারল, আসমা। পাশের মেয়েটার চোখে বিশেষ ধরনের সানগ্লাস দেখে অনুমান করল, নিশ্চয় রুকসানা। কথা বলতে বলতে দু’জনে রাস্তার মোড়ের দিকে কিছুটা এসে আসমাকে নিজের গ্রামের পথে চলে যেতে দেখল। আর রুকসানাকে কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে দক্ষিণ ফুকরা গ্রামের রাস্তার দিকে এগিয়ে আসার সময় এদিক ওদিক তাকাতে দেখে ইকবাল নিজেকে গাছের আড়ালে রেখে দেখতে লাগল।
কাঁঠাল গাছের কাছাকাছি এসে রুকসানার সাথের একটা মেয়ে বলে উঠল, কিরে রুকসানা, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিস কেন? কেউ আসার কথা ছিল নাকি?
আসমার মুখে ইকবালের কথা শোনার পর থেকে রুকসানার মন খারাপ হয়েছিল। মেয়েটার কথা শুনে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, দেখ সালেহা, ফাজলামী করবি না।
তারপর তাদের আর কোনো কথা ইকবাল শুনতে পেল না। কারণ তারা কিছুটা দূরে চলে গেছে। রুকসানাকে যতক্ষণ দেখা গেল তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরে ফিরে আসতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, রুকসানা বেশ বড় হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যও খুব সুন্দর হয়েছে। আল্লাহকে জানাল, “আল্লাহ গো তুমি, আমার বাসনা পূরণ করো।”
.
বিকেলে রহিমন গেঁদু মুন্সীর কাছে গিয়ে বলল, কেন ডেকেছেন বলুন?
গেঁদু মুন্সী বললেন, শুনলাম, কাজেমের ছেলে নাকি ম্যাট্রিক পাশ করে ফিরে এসেছে।
রহিমন বলল, দাইহান তাই তো বলল।
কেন এসেছে?
মা-বাপের কাছে ছেলে আসবে না তো কার কাছে আসবে?
মা-বাপ মরে গেছে শুনে কি বলল?
কি আবার বলবে, কান্নাকাটি করল। মা বাপের নামে মসজিদ মাদ্রাসায় এক হাজার টাকা দান করেছে।
তা শুনেছি। এখানেই থাকবে নাকি?
আমি থাকতে বলেছিলাম। বলল, “আরো পড়াশোনা করবে। তাই দু’চার দিন পরে ঢাকা চলে যাবে। আল্লাহ যদি কোনোদিন আবার আনায় তখন থাকবে।”
কাজেম যখন ছেলের শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিল তখন গেঁদু মুন্সী তাদের ভিটেটা নেওয়ার জন্য তাকে মাঝে মধ্যে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। কাজেম পাগল অবস্থায় হঠাৎ একদিন মারা যাওয়ায় রেজেস্ট্রি করার সুযোগ পাইনি। তারপর একদিন তার স্ত্রীকে বলেন, কাজেম ভিটেটা আমার নামে লিখে দেওয়ার কথা বলে যে টাকা নিয়েছিল, তা তুমিও জান। আর টাকাটা তুমি নিজের হাতে নিয়েছ। এখন তুমি তার সম্পত্তির মালিক। আরো কিছু টাকা দিচ্ছি, ভিটাটা আমার নামে রেজিস্ট্রি করে দাও। তোমাকে কিছু করতে হবে না, যা করার আমিই করব।
নাজমা বলল, আমার স্বামী পাগল হয়ে গিয়েছিল। আপনাকে কি বলেছে না বলেছে আমি জানি না। তবে টাকা আমার হাতে দিয়েছেন এটা ঠিক। তখন আমি মনে করেছিলাম আপনি দয়া করে আমার স্বামীর চিকিৎসার জন্য দিচ্ছেন। তার ভিটে বেঁচলে আমি থাকব কোথায়?
গেঁদু মুন্সী বললেন, তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন এখানেই থাকবে। তারপর আমি দখল নেব।
আপনি তো জানেন, আমার একটা মাত্র ছেলে ইকবাল দু’বছর হল কোথা চলে গেছে। সে যদি ফিরে আসে?
যখন ফিরে আসবে তখন যা করার করা যাবে।
না-না ভিটে আমি বেঁচব না। আপনি চলে যান। তারপর নাজমা ফুঁপিয়ে উঠে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফোপাতে লাগল।
গেঁদু মুন্সী বললেন, ঠিক আছে এখন আমি যাচ্ছি। ভেবে চিন্তে পরে না হয় আমার কাছে যেও। কথা শেষ করে চলে গেলেন।
নাজমা এক সময় চাচাতো দেবর ফজলের কাছে গেঁদু মুন্সীর কথাটা জানাল।
ফজল বলল, গেঁদু মুন্সী কাজেম ভাইকে কত টাকা দিয়েছিল মনে আছে?
নাজমা বলল, এমনি দয়া করে দিচ্ছে ভেবে হিসেব রাখিনি। তবে যতটা মনে পড়ে শ পাঁচেক হবে।
ফজল বলল, মুন্সী ব্যাটা খুব ঘুঘু। মনে করেছিল, পাগলকে সামান্য কিছু দিয়ে ভিটেটা লিখে নিবে। যা বলছি শোন ভাবি, ইকবালকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে একদিন না একদিন ফিরে আসবেই। তুমি কারো কোনো কাগজে টিপ সই দিও না। কেউ যদি ভয় টয় দেখায়, আমাকে জানাবে।
তারপর নাজমার অসুখের সময় গেঁদু মুন্সী টাকা সেধে টিপ সই নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু নাজমা টাকাও নেয়নি আর টিপ সইও দেয়নি। চাচাতো দেবর ফজল গরিব। তবু যতটুকু পেরেছে চাচাতো ভাবিকে সাহায্য করেছে। নাজমা মারা যাওয়ার পর ফজলই প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ছেলে দাইহানকে ও তার মা রহিমনকে কাজেমের ভিটেয় থাকার কথা বলে।
সে কথা জেনে গেঁদু মুন্সী ফজলকে ধমক দিয়ে বললেন, কাজেম ভিটে বিক্রি করার কথা বলে আমার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছিল। পাগল হয়ে যাওয়ার কারণে রেজেস্ট্রি করে দেয়নি। তোমরা দখল নিয়েছ কেন? ঐ ভিটে তো আমার।
ফজল বলল, কাজেমকে যে টাকা দিয়েছিলেন তার কোনো সাক্ষী আছে? যদি থাকে মামলা করে ডিগ্রি নিয়ে আসুন।
গেঁদু মুন্সী রেগে উঠে বললেন, ঠিক আছে ডিগ্রি নিয়েই আসব। তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল।
কথাটা রাগের মাথায় বললেও গেঁদু মুন্সী টাকা খরচ হওয়ার ভয়ে মামলা করেন নি। এতদিন পরে কাজেমের ছেলে ইকবাল এসে মসজিদ মাদ্রাসায় বাপ মার নামে দান করছে শুনে মনে করেছেন, ইকবাল তা হলে অনেক টাকা এনেছে। তাই চিন্তা করলেন প্রথমে ইকবালকে দিয়ে ওদেরকে ভিটে থেকে তাড়াবে, তারপর তার বাপকে যে টাকা দিয়েছে তার তিন গুণ টাকার কথা বলে শোধ করতে বলবেন, আর টাকা দিতে না পারলে ভিটেটা লিখে দিতে বলবেন। তাই আজ রহিমনকে ডেকে পাঠিয়েছেন ইকবালের খবর জানার জন্য। এখন রহিমনের কাছে ইকবাল ঢাকায় পড়তে চলে যাবে শুনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ইকবালকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।
রহিমন বলল, তা বলব। এবার যাই তাহলে?
গেঁদু মুন্সী বললেন, ঠিক আছে যাও।
রাত্রে খাওয়ার সময় ইকবাল বলল, আমি সকালে চলে যাব।
দাইহান বলল, আর কটা দিন থাক না।
ইকবাল বলল, থাকতে পারব না, কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে হবে।
রহিমন ইকবালের দিকে চেয়ে বলল, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। গেঁদু মুন্সী তোমাকে দেখা করতে বলেছে। দু’একদিন পরে গেলে হয় না?
ইকবাল বলল, না দাদি থাকা সম্ভব নয়। আবার যখন আল্লাহ নিয়ে আসবে তখন গেঁদু মুন্সীর সঙ্গে দেখা করব।
রুকসানা আজ স্কুলে আসার সময় ভেবেছিল, আসমার মুখে আমার কথা শুনে ইকবাল নিশ্চয় আসবে। কিন্তু আসমা যখন ঐ কথা বলল, তখন মন খারাপ হলেও কেন জানি তার মনে হয়েছিল ইকবাল আসবে। তাই ছুটির পর গেট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকে। হঠাৎ মোড়ের কাছে কাঁঠাল গাছের তলায় একটা ছেলেকে স্কুলের গেটের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইকবাল বলে সন্দেহ করে। তারপর কাছে এসে তাকে আর দেখতে পায়নি। কারণ ইকবাল খুব সতর্কতার সাথে গাছের আড়ালে ছিল। তাই রুকসানা গাছের কাছে এসে বারবার সেদিকে দেখেছে। আর সেটাই দেখে সালেহা বলে কিরে রুকসানা কারো আসার কথা ছিল নাকি? উত্তরে ফাজলামী করতে নিষেধ করলেও গাছটার কাছে এসে ছেলেটাকে দেখার ইচ্ছা প্রবল হয়েছিল। কিন্তু সাথে মেয়েরা থাকায় তা সম্ভব হয়নি। ঘরে এসে চিন্তা করল, কাঁঠাল গাছের তলার ছেলেটা যদি ইকবাল হয় তা হলে আসমাকে ঐকথা বলার পরও এল কেন? আর এলই যদি আমার সামনে এল না কেন? তা হলে কী ছেলেটা ইকবাল নয়। এইসব চিন্তা করে রাত্রে ভালো করে পড়তে পারল না। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতেও পারল না। চোখ বন্ধ করলে ইকবালের কথা মনে পড়তে লাগল।
পরের দিন স্কুলে আসমা বলল, আজ সকালে ইকবাল ঢাকা চলে গেছে।
রুকসানা বলল, তোর দাইহান ভাইকে ঠিকানা দিয়ে গেছে কিনা জিজ্ঞেস করবি। যদি দিয়ে যায়, লিখে নিয়ে আসবি।
আসমা বলল, দাইহান ভাই যদি জিজ্ঞেস করে ইকবালের ঠিকানা তুমি কী করবে?
রুকসানা বলল, তুই বুদ্ধি খাঁটিয়ে পটিয়ে আদায় করবি। তারপর বলল, কিরে পিরীতের মানুষকে পটাতে পারবি না?
আসমা হেসে উঠে বলল, পারব।
ঐদিন ঘরে ফিরে নাস্তা খেয়ে আসমা দাইহানের ঘরে গেল।
দাইহান ঘরে ছিল না। আসমা জানার ভান করে রহিমন দাদিকে না বলল, দাদি, আপনার নতুন নাতিকে দেখছি না কেন?
রহিমন তার ও দাইহানের সম্পর্কের কথা জানে। তাই হেসে উঠে বলল, নতুন নাতির খোঁজ কেন লো? মনে ধরেছে নাকি? পুরোন নাতির কি হবে তাহলে?
আসমাও কম গেল না। সেও হেসে উঠে বলল, পুরোনো নাতি বেশি লেখাপড়া জানে না। তার উপর খেটে খাওয়া মানুষ। কোনোদিন ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে যেতে পারবে না। নতুন নাতি শিক্ষিত, ঢাকায় থাকে। তাই পুরোনটাকে ছেড়ে নতুনকে ধরব। ভাবছি।
আসমা রসিকতা করছে রহিমন বুঝতে পেরে বলল, তোর কপাল খারাপ, নূতন নাতি সকালেই উড়াল দিছে।
আসমা মেকি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ম্লান মুখে বলল, কপাল যখন খারাপ তখন পুরানটাকে আঁকড়ে ধরব। সে আবার না অন্য মেয়ের জন্য উড়াল দেয়। কথা শেষ করে হাসিতে ফেটে পড়ল।
রহিমন হাসতে হাসতে বলল, বেশি লেখাপড়া করে তুই খচরী হয়ে গেছিস। দাঁড়া তোর বাপকে শায়েস্তা করতে বলব।
আসমা দাদির গলা জড়িয়ে বলল, জানি আপনি এসব কথা বলতে পারবেন না। শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছেন কেন? তাছাড়া আব্বা জেনে গেলে আপনার নাতিও পার পাবে না।
রহিমন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ লো বুন, তোদের দু’জনের কথা ভেবে রাতে নিদ আসে না। তোর বাপ কী দাইহানের হাতে তোকে দেবে?
এবার আসমা দাদিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাদের জন্য আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আল্লাহ তকদিরে যা রেখেছে হবেই। আপনি শুধু আমাদের জন্য দোয়া। করবেন। আচ্ছা দাদি, ইকবাল ভাই ঢাকার ঠিকানা দাইহান ভাইয়ের কাছে দিয়ে গেছে কিনা জানেন?
রহিমন বলল, দাইহান ঠিকানা লিখে দিতে বলেছিল। ইকবাল দেয়নি। বলল, আমি যাদের বাড়িতে থাকি তারা ঠিকানা দিতে নিষেধ করেছে।
এখন আসি দাদি স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে বলে আসমা ঘরে ফিরে এল। ঐদিন স্কুলে গিয়ে রুকসানাকে বলল, আজ সাকলে দাইহানের কাছে গেছলাম। সে ঘরে ছিল না। তারপর ইকবালের ঠিকানার ব্যাপারে দাদি যা বলেছে বলল।
রুকসানা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার যেটুকু আশা ছিল, তাও শেষ হয়ে গেল।
আসমা বলল, ইকবাল ভাইকে তোর ভুলে যাওয়া উচিত। ছোটবেলার কোনো দুর্ঘটনার জন্য তাকে নিয়ে সারাজীবন চিন্তা করা ঠিক নয়।
তুই দাইহানকে ভুলে যেতে পারবি?
আমাদের সঙ্গে তোদের তুলনা করা যায় না। কারণ আমরা ছোটবেলা থেকে একে অপরকে ভালবাসি। তোদের তো সেরকম না।
তাকে থামিয়ে দিয়ে রুকসানা বলল, ওসব কথা আর বলিসনি। আমার ভালো লাগছে না।
৪
?
৫
ইংলিশে অনার্স থাকায় ইকবাল আমেরিকা গিয়ে খুব ভালো চাকরি পেল। সেখানে একটানা দশ বছর থেকে প্রচুর টাকা উপার্জন করে দেশে ফিরল। অবশ্য এর মধ্যে খালেককে মাঝে মাঝে বেশ কিছু টাকা পাঠিয়েছে। খালেক সেই টাকা দিয়ে প্রথমে চার কামরা করে আট কামরার দোতলা বাড়ি করেছে। তারপর মালেকার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মালেকা কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হল না, বলল, আমি এম.এ. পাশ করে শিক্ষকতা করব। এম.এ পাশ করা পর্যন্ত খালেক ও ফরিদা মেয়েকে বোঝাল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। বড় ভাই হিসাবে রেফাতও বোনকে বোঝাতে কম করল না। তার কথাও শুনল না। তারা বুঝতে পারল, মালেকা ইকবালকে ভুলতে পারে নি। সে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তাই তার বিয়ের চেষ্টা বাদ দিয়ে রেফাতের বিয়ে দিয়েছে। অবশ্য খালেক রেফাতের বিয়ের আগে মালেকার বিয়েতে অমত ও পড়াশোনা করার কথা জানিয়ে রেফাতের বিয়েতে আসবার জন্য ইকবালকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল। চিঠি পড়ে ইকবাল ভাবল, নিশ্চয় আমার জন্যই মালেকা বিয়েতে অমত করেছে। রেফাতের বিয়েতে কয়েকদিনের জন্য আসার ইচ্ছা থাকলেও মালেকার কথা জেনে আসেনি।
ইকবাল ঢাকায় পৌঁছে খালেক চাচার বাড়িতে উঠল।
খালেক, ফরিদা ও রেফাত খুব সমাদর করল। পরিচয় হওয়ার পর রেফাতের স্ত্রীও তাকে সম্মানের সাথে খাতির যত্ন করল।
মালেকাকে দেখতে না পেয়ে এক সময় ইকবাল রেফাতের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, মালেকা কি কোথাও গেছে? তাকে দেখছি না যে?
রেফাতের স্ত্রী বলল, মালেকা বছর দুয়েক হল ফরিদপুর মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করছে। সেখানেই মেয়েদের হোস্টেলে থাকে। কলেজ বন্ধ থাকলে মাঝে মাঝে আসে। আপনার চিঠি এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করে। আপনার চিঠি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে।
আপনারা তার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন নি?
এমন সময় খালেক সেখানে এসে কথাটা শুনতে পেয়ে বলল, তা আর করিনি বাবা, কিন্তু সে রাজি হয়নি। তারপর বলল, মালেকা যে ফরিদপুর মহিলা কলেজে। অধ্যাপনা করছে, তা নিশ্চয় বৌমার কাছে শুনেছ?
ইকবাল বলল, জ্বি। মালেকা কেন বিয়ে করতে চায় না তা বুঝতে পেরে ইকবাল নিজের কাছে খুব ছোট হয়ে গেল। বলল, ঠিকানাটা দিন, কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামের বাড়িতে যাব, আমি সময় করে তার সাথে দেখা করব।
খালেক বলল, হ্যাঁ বাবা তাই করো। তাকে একটু বুঝিয়ে বলো তো, পুরুষই হোক আর মেয়েই হোক, বিয়ে না করলে জীবনে সুখ-শান্তি পাওয়া যায় না। তুমি। বোঝালে নিশ্চয় শুনবে।
ইকবাল বলল, ঠিক আছে চাচা, যা বলার আমি বলব, আপনারা আর চিন্তা করবেন না।
দিন দুয়েক পর খালেক স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে ইকবালকে বলল, আমরা ছাড়া তোমার কোনো গার্জেন নেই। তোমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। হাদিসে আছে, সামর্থবান অবস্থায় বিয়ের বয়স হলে বিয়ে করা সুন্নত। তুমিও বোধহয়, হাদিসটা জান। তাই আমরা তোমার বিয়ে দিতে চাই। তুমি ঘুরে এস, এদিকে আমরা মেয়ে দেখি।
ইকবাল বলল, আমিও ভেবেছি এবার বিয়ে করব। আর আমি গ্রামের বাড়িতে থাকতে চাই, তাই গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করার আমার ইচ্ছা। মেয়ে পছন্দ হওয়ার পর আপনাদের খবর দেব। আপনারা ছাড়া আমার যখন কেউ নেই তখন আপনারা গিয়ে বিয়ের কাজ সমাধা করবেন। ফরিদপুর থেকে মালেকাকেও নিয়ে আসব।
খালেক বলল, তুমি যা ভালো বুঝবে করবে। তাতে আমরাও খুশি।
পাঁচদিন থেকে ইকবাল গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা দিল। যখন বাড়িতে এসে পৌঁছাল তখন বিকেল পাঁচটা।
গেঁদু মুন্সীর মেয়ে আসমাকে বিয়ে করে দাইহানের অবস্থা ফিরে গেছে। গেঁদু মুন্সী বিয়ের সময় মেয়েকে পাঁচ বিঘে জমি দিয়েছেন। কাজেমের ভিটের পাশে নিজের জায়গায় দু’কামরা ঘর করে দিয়েছেন। হালের গরুও দিয়েছেন। তাছাড়া সমন্ধী শাকিল বোনকে সুখি করার জন্য সবদিক থেকে দাইহানকে সাহায্য করে। দাইহান খুব কর্মঠ ছেলে। শ্বশুর ও সমন্ধির সাহায্য সহযোগিতায় অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছে। শ্বশুরের কথা মতো কাজেম সেখের ভিটেয় তরি-তরকারি চাষ করে।
ইকবাল গ্রামে পৌঁছে আসরের আজান শুনে মসজিদে গেল। ব্রীফকেস ও চামড়ার ব্যাগটা বারান্দায় রেখে অযু করে মসজিদে ঢুকে দেখল, মসজিদের অবস্থা খুব জরাজীর্ণ। তার মনে হল, পনের বছর আগে যখন একবার এসেছিল তখন এতটা জরাজীর্ণ ছিল না। মোটামুটি নামায পড়ার যোগ্য ছিল। কিন্তু এখন পাকা মেঝে চটা উঠে খাবলা খাবলা হয়ে গেছে। বেড়াগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। টিনের চালটা মর্চে পড়ে অনেক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। দরজা ও জানালার একটারও পাল্লা নেই। ছেঁড়া খেজুর চাটাই বিছিয়ে পাঁচ-ছজন ছেলে বুড়ো মুসুল্লীকে জামাত করে নামায পড়তে দেখে সেও তাদের সঙ্গে জামাতে সামিল হল।
মুসুল্লীদের মধ্যে কাজেমের চাচাতো ভাই ফজল ছিল। তার ছেলে দাইহান ও গেঁদু মুন্সীও ছিল। নামাযের পর দাড়ি রাখা ইকবালকে তারা চিনতে পারল না। গেঁদু মুন্সী জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোন গ্রামের মানুষ?
ইকবাল বলল, আমি ঢাকা থেকে গ্রাম দেখতে এসেছি। আপনারা কেউ যদি আমাকে কয়েক দিন থাকার জায়গা দেন, তাহলে খুব উপকার হত।
পনের ষোল বছর আগে দাইহান চার পাঁচ দিন ইকবালের সঙ্গে থেকেছে। তাই ইকবালের মুখে দাড়ি থাকা সত্ত্বেও চেনা চেনা মনে হল। বলল, আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।
ইকবাল দু’জনকে ছাড়া সবাইকে চিনতে পেরেছে। দাইহান থেমে যেতে তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বলল, আপনাকেও আমার চেনা চেনা লাগছে। যদি দয়া করে কয়েক দিন আপনাদের বাড়িতে রাখেন, তাহলে আমার ইচ্ছাটা পূরণ হত। অবশ্য যে কয়েকদিন থাকব, খরচাপাতি দিয়েই থাকব।
ইকবাল চোখ টিপ দিতে ও তার কথা শুনে দাইহান চিনতে পারল। সেই সাথে বুঝতে পারল, ইকবাল পরিচয় গোপন করতে চায়। তাই সেও ইকবালকে চোখ টিপে জানিয়ে দিল তাকে চিনতে পেরেছে। তারপর কৃপণ শ্বশুরকে খুশি করার জন্য তার দিকে তাকিয়ে বলল, উনি যখন খরচপাতি দিয়ে থাকতে চাচ্ছেন তখন আমাদের বাড়িতে না হয় ক’টা দিন থাকুক আপনি কি বলেন আব্বা?
খরচপাতি দিয়ে থাকবে শুনে গেঁদু মুন্সী না করতে পারলেন না। তবু জামাইকে একটু দুরে নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, রাখতে চাও রাখ। কিন্তু খুব, সাবধানে থেক। অনেকে ডাকাতি করার জন্য এরকম ভালো মানুষ সেজে আসে।
দাইহানের হাসি পেল। চেপে রেখে বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। তবে ওনাকে দেখে সে রকম মনে হচ্ছে না। তবু খুব সাবধানে থাকব। তারপর শ্বশুরকে নিয়ে ফিরে এসে ইকবালকে বলল, চলুন আমার কাছে থাকবেন।
দাইহান ইকবালকে সঙ্গে নিয়ে যেতে যেতে বলল, প্রথমে তোমাকে চিনতে পারিনি। তুমি যখন চোখ টিপ দিলে তখন চিনতে পারলাম। তারপর বলল, দাদি তোমার কথা প্রায় বলে। মাঝে মাঝে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলে, কাজেমের ছেলে থাকতে তার ভিটে শূন্য হয়ে পড়ে আছে।
ইকবাল বলল, ভিটে শূন্য থাকবে কেন? তোমরা তো রয়েছ?
দাইহান বলল, সে অনেক কথা, পরে সব বলব। এখন শুধু এটুকু জেনে রাখ, আমি মুন্সী চাচার মেয়ে আসমাকে বিয়ে করেছি। তারপর জমিও ঘর করে দেওয়ার কথা বলে বলল, তোমাদের ভিটের পাশেই আমরা থাকি। তবে তোমাদের ভিটেতে আমি তরি-তরকারির চাষ করি।
আসমার কথা শুনে ইকবালের রুকসানাকে মনে পড়ল। সেই সাথে মনের মধ্যে একটা আলোড়ন অনুভব করল। ভাবল, ওর কাছে নিশ্চয় রুকসানার খবর জানা যাবে। মনের ভাব গোপন করে বলল, তাই নাকি? তাহলে তো তোমার ভাগ্য খুলে গেছে?
হ্যাঁ তা খুলেছে। আল্লাহর রহমতে আমাদের কোনো অভাব নেই।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ইকবাল বলল, দাইহান ভাই, তোমাকে আমার একটা উপকার করতে হবে। কাজটা তেমন কঠিন না হলেও কঠিন।
তুমি বল ইকবাল, যদি অন্যায় কোনো কিছু না হয়, তবে ইনশাআল্লাহ যত কঠিন কাজ হোক না কেন করে দেব।
পরে তোমাকে সব কিছু বলব, এখন শুধু এতটুকু বলছি, আমি এখানে থাকার জন্য এসেছি। আর আমি যে কাজেম সেখের ছেলে ইকবাল, তা গ্রামের কোনো লোক যেন জানতে না পারে।
দাদি ও আসমার কাছেও কি গোপন রাখতে হবে?
তাদেরকে যা বলার আমি বলব। আর তোমার শ্বশুর মুন্সী চাচা ও তোমার আব্বাকে বলব। নচেৎ বেশি দিন থাকতে দেখলে গ্রামের পাঁচজন পাঁচ কথা বলবে। কেউ কিছু বললে ওঁরাই তাদেরকে যা বলার বলবেন।
ততক্ষণে তারা দাইহানের ঘরে পৌঁছে গেল।
রহিমন ঘরের বারান্দায় নামায পড়ে দাইহানের আট মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে মসল্লার উপর বসে তসবীহ পড়ছিল। আর আসমা উঠোনের একপাশে মুরগী হাঁসকে কুঁড়ো ফ্যানের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াচ্ছিল। সাড়া শব্দ না দিয়ে স্বামীকে একজন দাড়িওয়ালা লোককে নিয়ে আসতে দেখে রেগে গিয়ে বাঁ হাতে ঘোমটা টেনে তাড়াতাড়ি রান্না ঘরের পিছনে চলে গেল।
রহিমন ঐ একই কারণে ঘোমটা টেনে রেগে গেল।
দাইহান হেসে উঠে বলল, তোমরা কাকে দেখে ঘোমটা দিচ্ছ, এত আমাদের। কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল।
দাদি ঘোমটা সরিয়ে দাইহানকে বলল, তাই বল, সাড়া শব্দ না দিয়ে বেগানা লোককে নিয়ে আসতে দেখে আমি তো রেগে গিয়েছিলাম।
ইকবাল দাদিকে সালাম করে বলল, কেমন আছেন?
রহিমন তার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বলল, আল্লাহ খুব ভালো রেখেছে। ভাই। তুমি কেমন আছ? এতদিন আসনি কেন? তোমার কথা মনে পড়লে চোখে পানি আসে।
আর পানি আসবে না। এখানে থাকব বলে একেবারে চলে এসেছি। তারপর তার কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে বলল, বাহ! খুব সুন্দর মেয়ে তো? তারপর দাইহানের। দিকে তাকিয়ে বলল, নিশ্চয় তোমার মেয়ে? কি নাম রেখেছ?
দাইহান হাসি মুখে বলল, ও আসমার মেয়ে। নাম যয়নাব বিনতে দাইহান। আর ছেলেটা আমার। তার নাম ইব্রাহীম বিন দাইহান। দু’টো নামই আসমা রেখেছে।
ইকবাল হেসে উঠে বলল, নাম অনুযায়ী ছেলে মেয়ে দুটোই তো তোমার। আসমার বলছ কেন?
তা জানি না। আসমা সব সময় ঐ কথা বলে, তাই বললাম।
তা তোমার ছেলেকে দেখছি না কেন?
আমার সমন্ধীর কোনো সন্তান হয়নি। যয়নাব হওয়ার পর থেকে সে মামা-মামীর কাছেই থাকে।
দাদি দাইহানকে বলল, ইকবালকে বসার জায়গা দিবিতো। তারপর ইকবালকে বলল, যয়নাবকে আমার কোলে দাও ভাই, তোমার কাপড়ে পেশাব করে দেবে।
আসমা ইকবালকে চিনতে পেরে হাত ধুয়ে এসে আড়াল থেকে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। এবার ঘর থেকে একটা চেয়ার এনে বারান্দায় রেখে ঘোমটার ভেতর থেকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন ইকবাল ভাই?
ইকবাল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তারপর বলল, দাইহান ভাইয়ের কাছে তোমার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছি।
আপনি বসুন ইকবাল ভাই, আমি নাস্তার ব্যবস্থা করি। কথা শেষ করে ঘরে ঢুকে গেল।
ইকবাল চেয়ারে না বসে দাদির পাশে মসল্লায় বসতে গেলে রহিমন বলল, এখানে বসছ কেন? চেয়ারে বস।
ইকবাল বলল, আপনি মুরুব্বি মানুষ। মুরুব্বিকে নিচে বসিয়ে চেয়ারে বসা আদবের বরখেলাপ। তারপর দাইহানকে বলল, আসার পর থেকে তোমাদের অনেক। কিছু পরিবর্তন দেখছি। তার মধ্যে তোমাকে নামায পড়তে দেখলাম, আসমাকেও পর্দা করতে দেখলাম।
দাইহান বলার আগে দাদি বলল, যা কিছু দেখছ সব আসমার জন্য হয়েছে। আর পর্দার কথা যে বললে, আসমার ভাবি আমাদেরকে তবলীগ করে। শুধু আমাদেরকে নয়, গ্রামের সব মেয়েদেরকে কুরআন হাদিসের কথা বলে পর্দা করতে শিখিয়েছে। আসমাও এখন তার সাথে তবলীগ করে। আসমার ভাবির মা-বাবা একবার এসেছিল। তারাও তবলীগ করে নামায পড়তে ও নামায রোযার অনেক মসলাও শিখিয়েছে। শাকিলের সমন্ধি ঢাকায় বিয়ে করেছে। সেই মেয়ের স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়িকে তবলীগে ভিড়িয়েছে।
শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলে ইকবাল বলল, খুব ভালো কথা শুনলাম। প্রতিটি গ্রামে যদি এরকম মেয়ে একজনও থাকত, তাহলে কতই না ভালো হত।
নাস্তা খেতে খেতে মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গেল। মসজিদে যাওয়ার সময় ইকবাল দাইহানকে বলল, নামায পড়ে ফেরার সময় তোমার সমন্ধি শ্বশুর ও তোমার আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। ওঁদের সামনেই সবকিছু বলতে চাই। কারণ ওঁদেরও সাহায্য আমার দরকার।
দাইহান বলল, বেশ তাই হবে। মাগরিবের নামাযে চৌদ্দ পনের জন মুসুল্লী নামায পড়তে এল।
আসরের সময় যারা এসেছিল, তারা ছাড়া সবাই দাইহানকে ইকবালের কথা জিজ্ঞেস করল।
ইকবাল আসরের সময় যা বলেছিল, দাইহান সেই কথা বলে বলল, উনি কয়েকদিন আমার কাছে থাকবেন। তারপর সমন্ধি, শ্বশুর ও আব্বাকে দরকার আছে। বলে ঘরে নিয়ে এল।
দাইহান স্ত্রী ও মেয়ে নিয়ে একরুমে থাকে। অন্য রুমে দাদি থাকে। আসমা মাগরিবের নামায পড়ে দাদির রুমের এক পাশে ইকবালের থাকার ব্যবস্থা করছে।
দাইহান সবাইকে নিয়ে সেই রুমে বসল।
ইকবাল দাইহানের কানে কানে বলল, তুমি দাদিকে ও আসমাকে ডেকে নিয়ে এস।
দাইহান পাশের রুমে গিয়ে তাদেরকে ইকবালের কথা জানাল।
আসমা দাদিকে বলল, তুমি যয়নাবকে নিয়ে যাও। আমি চা-এর ব্যবস্থা করে আসছি।
কিছুক্ষণের মধ্যে আসমা চোখ দুটো ছাড়া গায়ে মাথায় চার জড়িয়ে চা বিস্কুট নিয়ে এসে সবাইকে পরিবেশন করে চলে গেল। একটু পরে একটা বড় পিরিচে পান, সুপুরি, চুন ও জর্দা নিয়ে ফিরে এসে সবার সামনে রাখল।
গেঁদু মুন্সী ও ফজল আসমাকে ঢাকার লোকের সামনে আসতে দেখে বেশ অবাক হলেন। ভাবলেন, একটা পরপুরুষের সামনে আসা কী তার ঠিক হল?
চা-খাওয়ার পর পান মুখে দিয়ে গেঁদু মুন্সী জামাইকে বললেন, কি দরকারে ডেকে আনলে বল।
দাইহান কিছু বলার আগে ইকবাল বলল, আমি আপনাদের ডেকে আনতে বলেছিলাম। তারপর বলল, আসরের সময় মসজিদে যে কথা বলেছিলাম, তা ঠিক নয়। আমি কাজেমের ছেলে ইকবাল। প্রায় পনের বছর আগে এস.এস.সি. পাশ করে একবার এসে পাঁচদিন ছিলাম। সে কথা নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে। তারপর ঢাকায় গিয়ে আরো লেখাপড়া করে চাকরি নিয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিলাম। চাকরি করার সাথে সাথে হোমিওপ্যাথিক কলেজে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়েছি। সেখানে দশ বছর থেকে কয়েকদিন হল ফিরেছি। আমার আব্বা-আম্মা একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। তাই ঠিক করেছি, তাদের নামে প্রথমে একটা দাঁতব্য চিকিৎসালয় খুলে গ্রামের গরিব লোকদের চিকিৎসা করব। তারপর আল্লাহ রাজি থাকলে, একটা হাসপাতাল খুলব। সেখানেও গরীবদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা হবে। আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা না পেলে আমার একার দ্বারা কিছুই সম্ভব হবে না। আশা করি, আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন।
ইকবালের কথা শুনে সকলে অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলতে পারল না।
ইকবাল বলল, আপনারা কিছু বলছেন না কেন?
গেঁদু মুন্সী বললেন, কিন্তু বাবাজি, তুমি যা বললে তা করতে তো প্রচুর টাকা লাগবে, এতটাকা তোমাকে কে দেবে?
ইকবাল বলল, আল্লাহ দেবেন। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) কে খুশি করার উদ্দেশ্যে যে কোনো মহৎ কাজে হাত দিলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। আমার বেশ কিছু টাকা আছে। তারপর আপনাদের উৎসাহ ও সহযোগিতা পেলে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সাহায্য চাইব। আপনারা রাজি আছেন কিনা বলুন।
গেঁদু মুন্সী বলল, ভালো কাজে রাজি হব না কেন?
ফজল, শাকিল ও দাইহান এক সঙ্গে বলে উঠল, আমরাও রাজি।
আসমা বলল, ইকবাল ভাই, তুমি আল্লাহর নাম নিয়ে কাজে নেমে পড়। আমিও ভাবি বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেয়েদের কাছ থেকে সাহায্য চাইব।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ইকবাল বলল, এবার এখানে যে কয়জন আছেন, সবাইয়ের কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ, আমি যে মরহুম কাজেম সেখের ছেলে ইকবাল, একথা গোপন রাখতে হবে। আপনারা এই কয়েকজন ছাড়া একটা পশু পাখিও যেন আমার পরিচয় জানতে না পারে। আমার কথা শুনে আপনারা খুব অবাক হচ্ছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু কেন আমার পরিচয় গোপন করতে বললাম, সে কথা ইনশাআল্লাহ সময় মতো একদিন সবাই জানতে পারবেন। আর একটা কথা আসবার সময় বাসে ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের হেড মাস্টারের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম, ঐ স্কুলের জন্য একজন ইংলিশের টিচার দরকার। আমি ঐ স্কুলে জয়েন করতে চাই। সে কথা হেডমাস্টারকে জানাতে উনি বললেন, আপনার কাগজপত্র নিয়ে কবে আসছেন বলুন। আমি কমিটিকে জানিয়ে সেদিন থাকতে বলব। পরশু বৃহস্পতিবার যাব বলেছি। স্কুলে মাস্টারীটা পেলে সেখানে কিছুদিন থেকে আমাদের ভিটেয় দু’কামরা ঘর তুলব। একটায় আমি থাকব, আর অন্যটায় ডিসপেন্সরী করব। তারপর ধীরে সুস্থে হাসপাতালের কাজে হাত দেব। অবশ্য তার আগে হাসপাতালের জন্য জমি কিনব। তারপর এই গ্রামের ও আশপাশের গ্রামের লোকজন নিয়ে একটা সভা করব। এখন আপনাদেরকে কথা দিতে হবে, আমার পরিচয় গোপন রাখবেন।
সবাই আরো বেশি অবাক হল। প্রথমে গেঁদু মুন্সীই বলল, তুমি আমাদের কাজেমের ছেলে। গ্রামের মানুষের জন্য যখন এতকিছু করতে চাচ্ছ তখন তোমার কথা রাখাইতো আমাদের উচিত। তারপর ফজলের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী। বল ফজল?
ফজল বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। ও আমার চাচাতো ভাই এর ছেলে। ওর কথা রাখব না তো কার কথা রাখব। তারপর ইকবালকে বলল, আমরা থাকতে তুমি অন্য জায়গায় থাকবে কেন? যতদিন না ঘর তৈরি হচ্ছে ততদিন তুমি দাইহানের কাছেই থাকবে।
ইকবাল বলল, পরিচয় গোপন রাখার জন্য কিছুদিন অন্য জায়গায় থাকা দরকার।
ফজল বলল, ঠিক আছে, তুমি যা ভালো বুঝো করো।
ফজল থেমে যেতে শাকিলও বলল, আমরাও তোমার পরিচয় গোপন রাখব।
আসমা বলল, ইকবাল ভাই, তুমি নিশ্চিত থাক, আমি সবাইকে ম্যানেজ করব।
ইকবাল আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, আর একটা কথা, আমার পুরোনাম ইকবাল হোসেন, এখন থেকে হোসেন বলে ডাকবেন। ভুলেও ইকবাল নামে ডাকবেন না।
সবার আগে আসমা বলল, এব্যাপারেও ও আমি সবাইকে সামলাব।
এমন সময় এশার আজান হতে গেঁদু মুন্সী বলল, চলো সবাই মসজিদে যাই।
যেতে যেতে ইকবাল বলল, মসজিদের অবস্থা দেখে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। গ্রামে এতলোক বাস করে, মসজিদের দিকে কারো লক্ষ্য নেই। আল্লাহ রাজি থাকলে আব্বা আম্মার রুহের মাগফেরাতর জন্য সবকিছুর আগে মসজিদটা পাকা করব।
দাইহান বলল, তুমি খুব সুন্দর কথা বলেছ। তুমি শুরু কর, আমরাও যতটা পারি সাহায্য করব।
নামায পড়ে ইকবালকে নিয়ে দাইহান ফিরে এলে আসমা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি ইকবাল ভাইকে, থুড়ি, হোসেন ভাইকে নিয়ে গল্প কর। রান্না এখনো শেষ হয়নি। হলে খাওয়ার ব্যবস্থা করব।
দাইহান হেসে বলল, তখন তুমিই সব কিছু সামলাবে বলে নিজেই এখন ভুল করে ফেললে।
হোসেন বলল, প্রথম প্রথম সবারই এরকম ভুল হয়।
পরের দিন সকালে দাইহান পান্তা খেয়ে স্ত্রীকে বলল, আমি কামলাদের নিয়ে ক্ষেতে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হতে পারে। হোসেন ফিরলে নাস্তা খাইয়ে দিও।
আসমা বলল, হোসেন ভাই কোথায়?
সে নামায পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে বলল, প্রতিদিন সকালে ঘণ্টা খানেক হাঁটা তার অভ্যাস। হাঁটতে গেছে।
ঠিক আছে, আমি নাস্তা বানাই, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরো।
হোসেন হাঁটতে হাঁটতে ফুকরা গ্রামে এসে একজনকে হেড মাস্টার লতিফ স্যারের বাড়ি কোনখানে জিজ্ঞেস করল।
লতিফ স্যারও ফজরের নামায পড়ে প্রতিদিন কিছুক্ষণ হাঁটেন। আজও হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ফেরার সময় গতকালের বাসে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাকে একজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখে সালাম দিয়ে বললেন, এত সকালে আপনি?
হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে বলল, প্রতিদিন ভোরে হাঁটা আমার অভ্যাস। তাই হাঁটতে হাঁটতে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম, কয়েকটা কথা বলব বলে।
লতিফ স্যার বললেন, আমিও প্রতিদিন ভোরে হাঁটি। চলুন বাসায় গিয়ে আলাপ করি।
লতিফ স্যারের বাড়ি চন্দ্র দিঘলিয়া গ্রামে। উনি প্রায় পনের বছর ফুকরা বালিকা। উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন। স্কুল থেকে অল্প দূরে বিঘে খানেক। জমি কিনে বাড়ি করে সপরিবারে থাকেন। ওঁর স্ত্রী ও ফুকরা সরকারী প্রাইমারী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। তাদের দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে দুটো হাইস্কুলে আর মেয়েটা প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। পুরো বাস্তুটা বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাড়ির চার পাশে। সুপারী ও অন্যান্য ফলের গাছ। দুই রুমের টিন সেড বাড়ি। একটা বেড়ার বৈঠকখানা। বেশ ছিমছাম পরিবেশ।
লতিফ স্যার হোসেনকে সঙ্গে করে বৈঠকখানায় এসে বসতে বলে বললেন, আমি একটু আসছি।
হোসেন বলল, স্যার, কিছু মনে করবেন না। যদি কোনো প্রয়োজন থাকে যান। আর যদি আমাকে উপলক্ষ্য করে যান, তাহলে বসুন। মনিং ওয়াকের সময় আমি কিছু। খাই না। দু’একটা কথা বলেই চলে যাব। আল্লাহ রাজি থাকলে আপ্যায়নের দিনতো পালিয়ে যাচ্ছে না।
লতিফ স্যার বসে মৃদু হেসে বললেন, আপনি দেখছি আমার মতো। আমিও এই সময়ে কিছুই খাই না। যাক কি বলবেন বলে এসেছেন বলুন।
হোসেন বলল, স্কুল কমিটি যদি আমাকে পছন্দ করেন, তা হলে দু’একমাস কারো বাড়ির সদরে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলবেন। আব্বা-আম্মা মারা যাওয়ার পর এক আত্মীয় আমাদের ঘরে থাকত। কয়েক বছর হল তারা নেই। তাই শূন্য ভিটেয় ঘর করার জন্য দু’এক মাস থাকতে চাই।
লতিফ স্যার বললেন, ঠিক আছে আমি চেষ্টা করব। তারপর বললেন, স্কুলের সেক্রেটারী শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন লোক। আমার মনে হয়, আমি বললে উনি না করতে পারবেন না।
তাহলে আসি স্যার বলে হোসেন সালাম বিনিময় করে বিদায় নিয়ে চলে এল। ঘরে ফিরে এলে আসমা বলল, হাত মুখ ধুয়ে এস, আমি নাস্তা নিয়ে আসি। হোসেন বলল, দাইহান ভাই কোথায়? কামলাদের নিয়ে ক্ষেতে গেছে। সে আসুক এক সঙ্গে খাব।
সে পান্তা খেয়ে গেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে তোমাকে নাস্তা দিতে। তার ফিরতে দেরি হবে।
নাস্তা খেতে দিয়ে আসমা বলল, হোসেন ভাই দু’একটা কথা বলব। কিছু মনে করবে না বল।
হোসেন বলল, কিছু মনে করব কেন? কি বলতে চাও বল।
বাহিরবাগের রুকসানার কথা তোমার মনে আছে?
হোসেন মুখে খাবার তুলেছিল, আসমার কথা শুনে চমকে উঠে হাত নামিয়ে নিয়ে কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়। এত বছর যার সঙ্গে যোগাযোগ নেই, তার কথা তো ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। তারপর খেতে শুরু করল।
সে কিন্তু তোমাকে ভুলেনি।
হোসেন আবার চমকে উঠে বলল, এটা তোমার ভুল কথা।
ভুল নয় হোসেন ভাই, চন্দ্র-সূর্যের মতো সত্য।
তাই যদি হয়, সেটা আমার সৌভাগ্য।
তোমার সৌভাগ্য রুকসানার দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছে।
তা কেন? সে ধনী কন্যা। নিশ্চয় স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছে?
তাই যদি হতো, তা হলে তার কথা তোমার কাছে তুলতাম না। সে তোমার স্মৃতিকে আঁকড়ে মা-বাবা, ভাই-ভাবিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দিনের পর দিন নিজেকে ক্ষয় করে চলেছে।
সে কি? এখনো বিয়ে করেনি?
তাহলে ঐ কথা বললাম কেন?
তুমি তার সম্পর্কে কতটা জান?
শুধু তার সম্পর্কে নয়, আমাদের দুজনের মধ্যে এত গভীর সম্পর্ক যে, একে অপরের কাছে কোনো কিছু গোপন নেই। তাই আমার জীবনে ঝড় তুফানের কথা সে যেমন জানে। আমিও তার জীবনের ঝড় তুফানের কথা জানি। রুকসানা যদি আমার ঝড় তুফানে হস্তক্ষেপ না করত, তাহলে তোমার দাইহান ভাইকে পেতাম না। বিষ খেয়ে জীবন দিতে হত। এই যে সুখের সংসার দেখছ, তা স্বপ্নই থেকে যেত। তারপর রুকসানা কিভাবে তাকে সাহায্য করেছিল বলে বলল, যে আমাকে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপ থেকে বাঁচাল, যে আমার স্বপ্নকে সফল করল, তার জন্য এতদিন কিছু করার অপেক্ষায় ছিলাম। নামায পড়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতাম “আল্লাহ গো, আমার সই যেমন তোমার দয়ার আমার স্বপ্নকে সফল করিয়েছে, তোমার দয়ায় আমিও যেন তার স্বপ্ন সফল করাতে পারি, সেই সুযোগ আমাকে দাও।”
আল্লাহ এতদিনে আমার দোয়া কবুল করেছেন। তাই তুমি এসেছ। পনের ষোল বছর আগে যখন তুমি এসেছিলে তখন সেকথা আমার মুখে শুনে রুকসানার মুখে যে আনন্দের ঝলক দেখেছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তারপর আমাকে দিয়ে তোমাকে দেখা করতে বলেছিল। তুমি না গিয়ে যে কথা বলেছিলে, সেকথা শুনে তার মুখে যে বেদনার ছাপ ফুটে উঠতে দেখেছিলাম, তাও ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তারপর কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বলল, আল্লাহর কসম করে বলত, রুকসানার কথা তুমি ভুলে গেছ?
আসমার কথা শুনতে শুনতে হোসেনের মনে আনন্দের বান ডাকতে শুরু করেছে। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, তার কথা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভুলতে পারব না।
তাহলে আমার ভাবা কি অন্যায় হবে। তার জন্যেই আজও তুমি বিয়ে করনি?
না অন্যায় হবে না, বরং সেটাই সত্য।
আল হামদুলিল্লাহ বলে আসমা বলল, আজই আমি রুকসানাকে নিয়ে আসার জন্য ইব্রাহীমের আব্বাকে পাঠাব।
হোসেন বলল, এত ব্যস্ত হয়ো না। তুমি যখন আমাদের সবকিছু জান, তখন তোমার কাছে কোনো কিছু গোপন করব না। যা বলছি মন দিয়ে শোন, এখন এসব কথা এতটুকু চিন্তা করো না। যখন সময় হবে তখন আমিই তোমাকে বলব। আল্লাহ রাজি থাকলে তোমার আমার ও রুকসানার স্বপ্ন একদিন সফল হবেই। তারপর জিজ্ঞেস করল, দাইহান ভাই কী আমার ও রুকসানার ব্যাপারটা জানে?
হ্যাঁ জানে। আমি তাকে একদিন তোমাদের দুজনের সব কথা বলে ঢাকায় খোঁজ নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বিনা ঠিকানায় অতবড় শহরে কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তাই কয়েকদিন পরে বিফল হয়ে ফিরে আসে।
এখন দাইহান ভাইকে কিছু বলো না।
কিন্তু সে যদি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে?
করলে সংক্ষেপে আমার মতামত জানাবে।
মেয়ের কান্না শুনে আসমা বলল, যয়নাব দোলায় ঘুমিয়েছিল। উঠে পড়েছে। কথা বলতে বলতে চায়ের কথা ভুলে গেছি। কথা শেষ করে আসমা চলে গেল। একটু পরে যয়নাবকে কোলে নিয়ে চা হাতে করে ফিরে এল।
৬
ইকবাল আজ আট-দশ মাস হতে চলল হোসেন স্যার নামে পরিচিত হয়ে ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। স্কুলে জয়েন করার পর সেক্রেটারীর সদরে মাস দুয়েক থেকে নিজের ভিটেয় দুইরুমের বাড়ি করে সেখান থেকে চলে এসেছে। তারপর শিক্ষকতার সাথে সাথে ডাক্তারী শুরু করেছে। বাড়ি করার সময় গ্রামের লোকজন আপত্তি করে বলেছিল, ঢাকার লোক গ্রাম দেখতে এসে ফুকরা মেয়েদের। স্কুলে মাস্টারী করত, সেখানে থাকত, ভালো কথা। কিন্তু মরহুম কাজেম সেখের। ভিটেয় বাড়ি করবে কেন? তখন ফজল সেখ ও গেঁদু মুন্সী তাদেরকে বলেছেন, উনি শুধু শিক্ষিত নন, একজন বড় হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারও। গ্রামের গরিবদের অসুখ বিসুখে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করবেন। পরে জমি-জায়গা কিনে একটা হাসপাতালও করবেন। সেখানেও গরিবদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করা হবে। আর উনি যে আমাদের মসজিদ পাকা করে দিয়েছেন, তা তো আপনারা জানেন। তাছাড়া উনি ফজলের কাছে স্টাম্পের উপর লিখে দিয়েছেন, মরহুম কাজেমের ছেলে যদি কখনও ফিরে আসে, তাকে তার বাপের ভিটে ছেড়ে দেবেন।
এই কথা শোনার পর গ্রামের লোকজন আর কোনো আপত্তি করেনি।
ইন্টারভিউ নেয়ার পর স্কুল কমিটি যখন ইকবালকে সিলেক্ট করল তখন সে হেড মাস্টারকে চুপি চুপি বলল, সার্টিফিকেটে আমার পুরো নাম ইকবাল হোসেন আছে। আমি সবার কাছে শুধু হোসেন নামে পরিচিত হতে চাই।
লতিফ স্যার মৃদু হেসে বললেন, মনে হচ্ছে এর পিছনে কোনো কারণ আছে?
ইকবালও মৃদু হেসে বলেছিল, আপনার অনুমান ঠিক।
স্কুলে ও আশ-পাশের গ্রামের লোকজনের কাছে ইকবাল যেমন হোসেন স্যার নামে পরিচিত তেমনি একজন ভালো শিক্ষক ও ভালো ডাক্তার হিসেবেও প্রশংসিত। গরিবরা হোসেন ডাক্তারকে আল্লাহর রহমত মনে করে।
গতকাল পাশের গ্রাম থেকে একটা বুড়ো রুগীকে দেখে ফেরার সময় হোসেন স্যার রুকসানাকে যখন ষাড়ের কবল থেকে রক্ষা করেছিল তখন তার মুখ দেখেই চিনতে পেরেছিল। তাই আজ ওষুধ দেওয়ার অসিলায় আলাপ করতে গিয়েছিল। ফেরার পথে চিন্তা করল, এত বছর না দেখার ফলে গতকাল রুকসানা আমাকে। চিনতে পারেনি। আজ আব্বার ভিটেয় ঘর করে আছি শুনে চমকে উঠেছিল। তাছাড়া আলাপের সময় যেসব কথা বলেছি; আশা করি মনে সন্দেহ জাগাতে সক্ষম হয়েছি। দেখা যাক আল্লাহর কি মর্জি।
আজ যখন সবাই একসঙ্গে খাওয়ার টেবিলে এসে বসল তখন রুকসানা বলল, কাল পলাশপুরের আমাদের কারখানার একজন অসুস্থ শ্রমিককে চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তার নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর ফেরার পথে বিপদে পড়ার ও বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার ঘটনা বলে বলল, যিনি আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন, তার সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম, তিনি মনিরাদের স্কুলে ইংলিশের টিচার। ঘরে এসে শুধু আব্বা আম্মাকে কথাটা বলেছিলাম। পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছি মনে করে আজ ওষুধ নিয়ে আমাদের কারখানায় এসেছিলেন। আলাপ করে জানতে পারলাম উনি টিচারীর সাথে সাথে হোমিও প্র্যাকটিস করেন। যাই হোক, এক সময় আমি তাকে মনিরাকে পড়াবার কথা বলি। প্রথমে সময়ের অজুহাত দেখালেও পরে ছুটির পর ঘণ্টাখানেক পড়াতে রাজি হয়েছেন। তারপর মনিরার দিকে তাকিয়ে বলল, কাল থেকে ওঁর কাছে পড়বি। সামসু চাচা তোর জন্য অপেক্ষা করবে। সামুস মনিরাকে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যায় ও নিয়ে আসে।
আব্দুল মতিন রুকসানার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল বললাম না, দেখা হলে নিয়ে আসবি? দ্রলোক তোকে কত বড় বিপদ থেকে রক্ষা করলেন, তাকে কৃতজ্ঞতা
জানান আমাদের উচিত।
রুকসানা বলল, আসতে বলেছিলাম, বললেন, “আজ সময় নেই অন্য দিন আসবেন।”
এরপর আর কেউ কোনো কথা বলল না, খাওয়া দাওয়ায় মন দিল।
পরের দিন হোসেন ক্লাস নিতে এসে মনিরাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, তোমার আপা তোমাকে কিছু বলেছেন।
জ্বি, ছুটির পর আপনার কাছে পড়তে বলেছেন।
ছুটির পর ক্লাসেই থেক কেমন?
জ্বি, থাকব।
প্রায় দিন পনের পর পড়ার সময় মনিরা বলল, আপনি যেদিন বড় আপার কারখানায় গিয়েছিলেন, সেদিন তাকে বলেছিলেন, একদিন আমাদের বাড়িতে যাবেন। যান নি কেন?
হোসেন বলল, সেকথা কী তোমার বড় আপা তোমাকে বলেছেন?
আমাকে বলেননি। ঐ দিন রাত্রে খাওয়ার সময় বাড়ির সবার সামনে বলেছে। আমিও সেখানে ছিলাম। আজ আব্বা বললেন, “তোর স্যারকে আমার কথা বলে আসতে বলবি।”
হোসেন অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সময় করে উঠতে পারিনি। সকাল বিকাল রুগীর খুব ভীড় থাকে। ঠিক আছে, তোমার আব্বাকে বলো শুক্রবার সকালে যাব।
মনিরা ঘরে ফিরে স্যারের আসার কথা আম্মা-আব্বা ও বড় আপাকে জানাল।
শুনে রুকসানা ভাবল, হোসেন স্যার ইকবাল কিনা আমি চিনতে না পারলেও আব্বা হয়তো পারবে। যদি চিনতে পারে, তাহলে আব্বা কি করবে ভেবে বেশ চিন্তিত হল।
বৃহস্পতিবার পড়াবার সময় হোসেন মনিরাকে বলল, অত্যন্ত জরুরী কিছু ওষুধ কেনার জন্য কাল সকালে আমি ঢাকা যাব। তাই তোমাদের বাড়িতে যেতে পারব না। তোমার আব্বাকে বলো, কথা দিয়ে রাখতে পারলাম না, তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন।
মনিরা বলল, শনিবার ঢাকা গেলে হয় না স্যার?
না হয় না। ওষুধগুলো মুমূর্ষ রুগীর। যে কোনো সময়ে দরকার হতে পারে। ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ এই গুরুত্বের কথা বুঝবে না।
তাহলে কবে যাবেন বলুন?
এবার আর নির্দিষ্ট তারিখ দিতে পারব না। দেখলে তো, একবার দিয়ে রাখতে পারলাম না। তাই আর কবে যাব ওয়াদা করব না। তবে ইনশাআল্লাহ একদিন যাব।
ঘরে এসে মনিরা কথাটা প্রথমে আব্বা আম্মাকে জানাল। তারপর বড় আপার রুমে এসে তাকেও জানাল।
কথাটা শুনে রুকসানা ভাবল, আব্বা চিনে ফেলতে পারে ভেবে এলেন না? না সত্যিই জরুরী ওষুধ কিনতে ঢাকা যাবেন? মনিরাকে চলে যেতে দেখে বলল, এই শোন।
মনিরা ফিরে এসে বলল, কি বলবে তাড়াতাড়ি বল, খুব খিদে পেয়েছে।
তোদের ক্লাসে দক্ষিণ ফুকরার কোনো মেয়ে পড়ে না?
আমাদের ক্লাসে পড়ে না, তবে আমার বান্ধবীর মামাতো বোনের বাড়ি দক্ষিণ ফুকরায়। সে এইটে পড়ে।
তোর বান্ধবীকে ও তার মামাতো বোনকে একদিন নিয়ে আসিস তো।
কেন বড় আপা?
কেন আবার, দরকার আছে।
ঠিক আছে নিয়ে আসব, এবার যাই?
যা।
মনিরার সব কিছু বোঝার মতো জ্ঞান হয়েছে। যেতে যেতে ভাবল, হোসেন স্যার আসবে শুনে বড় আপার মুখে আনন্দের আভা দেখেছিলাম। আজ আসবে না শুনে মুখটা মলিন হতে দেখলাম। তাহলে কি স্যারের প্রতি বড় আপা….., ছিঃ ছিঃ বড় আপাকে নিয়ে একি ভাবছি? চিন্তাটা দূর করে দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, খেতে দাও।
মনিরা শনিবার স্কুলে গিয়ে বান্ধবী জয়তুনকে বলল, আমি তোদের বাড়িতে কতবার গেছি? তুই যাবি যাবি করে একদিনও গেলি না। আজ যাবি।
জয়তুন বলল, ছুটির পর তুই হোসেন স্যারের কাছে পড়িস। তারপর গিয়ে ফিরে আসতে রাত হয়ে যাবে না?
তুই যেতে চাইলে আজ পড়ব না। কী যাবিতো?
আজ নয় কাল যাব।
কেন আজ গেলে কি হয়?
বারে, মাকে বলে আসতে হবে না?
তাহলে কাল যাবি তো?
হ্যাঁ যাব। সঙ্গে আনোয়ারাকেও নেব। তা না হলে ফেরার সময় একা একা খারাপ লাগবে। আজ ওকে বলে দেব, কাল আসার সময় বাড়িতে যেন বলে আসে, কাল আমাদের বাড়িতে থাকবে।
.
ইকবাল প্রায় এক বছরের মতো হল গ্রামের বাড়িতে এসেছে। এর মধ্যে একবারও ঢাকায় না গেলেও শত ব্যস্ততার মধ্যে খালেক চাচাকে মাঝে মধ্যে চিঠি দিয়েছে। খালেকও চিঠির উত্তর দিয়েছে। মালেকার সঙ্গে দেখা করার জন্য একবার ফরিদপুর গিয়েছিল। সে সময় একমাস কলেজ বন্ধ থাকায় মালেকা ঢাকায় চলে গিয়েছিল। তাই তার সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে সময়ের অভাবে আর যেতে পারেনি। এবারেও ওষুধ কিনতে ঢাকায় এসে খালেক চাচার বাড়িতে উঠল। এক সময় খালেক। বলল, মালেকা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, সে যখন ছুটিতে এখানে ছিল তখন তুমি নাকি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে। যাওয়ার সময় তোমার ঠিকানা নিয়ে গেছে তোমাকে চিঠি দেবে বলে। দিয়েছিল চিঠি?
ইকবাল বলল, কই আমি তো তার কোনো চিঠি পাইনি। তারপর বলল, গ্রাম দেশে অনেক চিঠি মার যায়। কাজের চাপে আমিও আর যেতে পারিনি। এবারে ফিরে গিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।
সেখানে ফরিদা ছিল। স্বামীকে কী যেন ইশারা করল। খালেক বুঝতে পেরে বলল, আমরা তোমার বিয়ে দেওয়ার কথা বলতে তুমি বলেছিলে গ্রামের মেয়ে বিয়ে করবে। সে ব্যাপারে কতদূর কি করলে? তোমার বিয়ের বয়স তো পার হয়ে যাচ্ছে।
ইকবাল চাচির ইশারা দেখে ফেলে, তারপর চাচার কথা শুনে বুঝতে পারল, তারা তাকে জামাই করার আশা এখনো ছাড়েনি। বলল, আব্বা আম্মার নামে একটা হাসপাতালের কাজে হাত দিয়েছি। সেটা সম্পূর্ণ হয়ে গেলে তারপর যা করার করব।
খালেক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, কি জানি বাবা। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কেন যে সময় মতো বিয়ে করতে চায় না, তা তারাই জানে।
ইকবাল দুদিন পরে ফিরে যাবে মনে করেছিল। কিন্তু মিটিং এ স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেক্রেটারিয়েটে বেশ কয়েকদিন ছুটাছুটি করতে হল। তবু মিটিংএ আনার ব্যবস্থা করতে পারল না। তবে উনি কথা দিয়েছেন, হাসপাতাল উদ্বোধন করতে যাবেন।
.
এদিকে পরের দিন মনিরা স্কুল ছুটির পর বান্ধবী জয়তুন ও তার মামাতো বোন আনোয়ারাকে নিয়ে বাড়িতে এল।
আলাপ পরিচয় ও আপ্যায়নের পর রুকসানা আনোয়ারাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি গেঁদু মুন্সীকে চেন?
আনোয়ারা বলল, আমাদের ঘর থেকে ওনাদের ঘর দূরে। তবু চিনি। তারপর হেসে ফেলে বলল, ছেলেবেলায় রাস্তায় দেখলে আমরা কিরপীন চাচা বলে দৌড়ে পালিয়ে যেতাম।
ওঁর মেয়ে আসমাকে চেন?
জ্বি বড় আপা, আসমা আপাকে সব মেয়েরাই চিনে। উনি ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদেরকে তবলীগ করেন। কুরআন ও নামায পড়া শেখান। আমিও শিখি।
রুকসানা একটা মুখ বন্ধ খাম তার হাতে দিয়ে বলল, এটা তোমার আসমা আপাকে দিয়ে বলবে, সেও যেন এরকম একটা খাম তোমার হাতে দেয়। দিলে তুমি স্কুলে মনিরাকে দিও। তাহলে আমি পাব। তারপর বলল, তোমরা গল্প কর আমি যাই।
বড় আপা চলে যাওয়ার পর মনিরা ওদেরকে বলল, আসমা আপা বড় আপার সই। অনেক দিন খোঁজ খবর পাইনি তাই চিঠি দিল।
ফেরার পথে আনোয়ারা জয়তুনকে বলল, আচ্ছা আপা, মনিরার বড় আপা ঘরের ভিতরেও সানগ্লাস পরেছিল কেন?
জয়তুন বলল, আমি জানব কি করে? তোর মতো আমিও আজ প্রথম ওদের ঘরে গেলাম। আমার মনে হয়, ওনার চোখে কোনো ডিফেক্ট আছে।
আনোয়ারা বলল, তোমার অনুমান বোধ হয় ঠিক। আমারও তাই মনে হয়েছে। তারপর বলল, ওরা খুব বড়লোক তাই না আপা?
জয়তুন বলল, হ্যাঁ। আব্বার মুখে শুনেছি, ওদের পূর্বপুরুষরা নাকি জমিদার ছিল।
ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল বলে জয়তুন আনোয়ারাকে ঘরে যেতে দিল না।
পরের দিন স্কুল থেকে ঘরে ফেরার পথে আনোয়ারা আসমাদের ঘরে গিয়ে খামটা তার হাতে দিয়ে বলল, এটা মনিরা আপার বড় আপা আপনাকে দিয়েছে।
বিয়ের পর আসমা মাঝে মধ্যে রুকসানাকে ডাকে চিঠি দেয়। রুকসানাও উত্তর দেয়। বছরে দু’একবার স্বামীকে নিয়ে বেড়িয়ে আসে। বছর খানেক হল ইকবাল ভাই আসার ফলে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। তাই যোগাযোগ রাখতে পারেনি। মনিরাকে আসমা চিনে। আনোয়ারার কথা শুনে বলল, তোমাকে কী মনিরা এটা দিয়েছে?
আনোয়ারা বলল, না। আমার ফুপাতো বোন জয়তুন আপা মনিরা আপার বান্ধবী। জয়তুন আপা ও আমি কাল মনিরা আপাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। এক সময় মনিরা আপার বড় আপা এই খামটা দিয়ে বললেন, আপনিও যেন এরকম একটা খাম আমার হাতে দেন এবং আমিও যেন সেটা স্কুলে মনিরা, আপাকে দিই।
আসমা বলল, ঠিক আছে, তুমি কাল স্কুলে যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।
তাই নিয়ে যাব। এবার আসি আপা বলে আনোয়ারা চলে গেল।
আসমা খামটা খুলে চিঠিটা পড়ল।
সই,
আশা করি, আল্লাহর রহমতে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছিস। অবশ্য। আমার কামনাও তাই। মনে হয় আমাকে ভুলে গেছিস। তা না হলে এক বছরের। মধ্যে একটা চিঠি দিয়েও খোঁজ নিলি না কেন? যাই হোক, কর্মব্যস্ততায় আমার দিন একরকম কেটে যাচ্ছে। তবে রাতের একাকীত্ব বড় পীড়া দেয়। আর ইকবালের কথা। মনে পড়লে সেই পীড়া হাজারগুণ বেড়ে যায়। যাকে বার তের বয়সের পর থেকে। আজ বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত একবার চোখের দেখাও দেখলাম না। তার স্মৃতি কেন। আমাকে এত পীড়া দেয় বলতে পারিস? সেই স্কুল লাইফ থেকে তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য তুই আমাকে অনেক উপদেশ দিয়ে বুঝিয়েছিস। আমিও অনেক সময় চিন্তা করেছি যার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি সে তো জানে না, আমি তাকে কত ভালবাসি, তার অপেক্ষায় জীবন যৌবন পার করে দিচ্ছি। সে হয়তো বিয়ে করে স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে। তবু কেন যে তাকে ভুলতে পারিনি, তা আমি নিজেই জানি না। এটাই আমার তকৃদিরের লিখন ভেবে মনকে বোধ দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। মনের আবেগে অনেক কিছু লিখলাম। এবার আসল কথায় আসি।
ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের হোসেন স্যার নামে ঢাকার এক ভদ্রলোক নাকি কাজেম চাচার ভিটেয় দু’কামরা ঘর তুলে বসবাস করছেন। আর ডাক্তারখানা খুলে। গবিরদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করছেন। ব্যাপারটা আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না। অবশ্য কিছু দিন আগে হঠাৎ একদিন দৈব দুর্ঘটনার মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। চিঠিটা বড় হয়ে যাবে ভেবে দুর্ঘটনাটা লিখলাম না। তোর চিঠি পাওয়ার পর জানাব। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছি ভেবে পরের দিন কারখানায় এসে ওষুধ দিয়ে যান। সেই সময়। তাকে ছুটির পরে স্কুলে মনিরাকে পড়াবার ব্যবস্থা করি; কিন্তু উনি যে পরিচয় আমাকে দিয়েছেন এবং লোক মুখে যা কিছু শুনেছি তাতে ওঁকে ইকবাল বলে সন্দেহ হচ্ছে। তোদের ঘর যখন ওঁর ঘরের কাছে তখন নিশ্চয় তুই ও দাইহান ভাই ওঁকে। ভালোভাবে জেনেছিস? যা জেনেছিস দু’কলম লিখে পত্রবাহকের হাতে দিলে আমি পাব। একটা কথা জেনে রাখ, আমি এইট্টি পারসেন্ট সিওর, হোসেন স্যারই ইকবাল। কালকেই উত্তর দেওয়া চাই।
আল্লাহপাকের দরবারে তোদের সবার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করে আজকের মতো বিদায় নিলাম।
ইতি
তোর সই
রুকসানা।
চিঠিটা পড়ে আসমা বালিসের তলায় রেখে দিয়ে সংসারের কাজে লেগে গেল।
মাগরিবের নামায পড়ে দাইহান ঘরে এলে চা-মুড়ি খেতে দিয়ে চিঠিটা এনে। তার হাতে দিয়ে বলল, পড়ে দেখ। রুকসানা ও পাড়ার আনোয়ারার হাতে পাঠিয়েছে।
দাইহান ফাঁইভ পর্যন্ত পড়লেও বিয়ের পরে আসমা তাকে পুরো একটা বছর ঘুমাবার আগে উঁচু ক্লাসের বাংলা ও ইংলিশ পড়িয়েছে। এখন দাইহান যেকোনো বাংলা ও ইংরেজি বই ভালোভাবে পড়তে পারে।
দাইহান চিঠিটা পড়ে বলল, হোসেন তার সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করেছে। এখন উত্তরে কী লিখবে?
আসমা বলল, চিঠি পড়ার পর থেকে চিন্তা করছি, কিন্তু আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না।
দাইহান বলল, এক কাজ কর, চিঠিটা হোসেনকে দাও, সে কী বলে দেখ।
আসমা বলল, তুমি ঠিক বলেছ। এমন সহজ বুদ্ধিটা আমার মাথায় এল না কেন বলতে পার?
পারি?
বলতে শুনি?
বিয়ের আগে মেয়েদের বুদ্ধি বেশি থাকে; বিয়ের পরে সেই বুদ্ধি সংসার, স্বামী ও ছেলেমেয়েদের পিছনে খরচ করতে করতে কমে যায়। তোমারও তাই হয়েছে।
আসমা হেসে উঠে বলল, আর ছেলেদের বিয়ের আগে বুদ্ধি কম থাকে। বিয়ের পর স্ত্রীর উপর সবকিছু ছেড়ে দেয় বলে ছেলেদের বুদ্ধি বাড়তে থাকে তাই না?
নিশ্চয় বলে দাইহানও হাসতে লাগল।
এখন ইয়ার্কি রেখে যা বলছি শোন, এশার নামাযের পর হোসেন ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।
দাইহান বলল, সে তো দু’তিন দিন হল ঢাকা গেছে। ফিরে এলে ডেকে নিয়ে আসব।
পরের দিন আনোয়ারা স্কুলে যাওয়ার সময় আসমার কাছে এল।
তাকে দেখে আসমা বলল, কাজের জন্য চিঠিটা লিখতে সময় পাইনি। মনিরাকে বলিস, কয়েকদিন পরে তার বড় আপার চিঠির উত্তর দেব।
আনোয়ারা স্কুলে গিয়ে আসমা আপা যা বলতে বলেছিল মনিরাকে বলল।
মনিরার মুখে কথাটা শুনে রুকসানার প্রথমে আসমার উপর দুঃখ হল। ভাবল, এত কি কাজে ব্যস্ত যে দু কলম লিখবার সময়ও পেল না। পরক্ষণে মনে হল, কাজের ব্যস্ততা অজুহাত নয় তো? অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে? কয়েকদিন অপেক্ষা করেই দেখা যাক।
হোসেন আটদিন ঢাকায় থেকে যেদিন ফিরে এল, সেইদিন এশার নামাযের পর দাইহান তাকে ঘরে নিয়ে এল।
আসমা সালাম ও কুশল বিনিময় করে চিঠিটা দিয়ে বলল, আমার কথা সত্য কিনা পড়ে দেখ। পাঁচ দিন আগে পেয়েছি, কি জানাব ভেবে না পেয়ে উত্তর দিইনি। কয়েকদিন পরে দেব বলে জানিয়েছি।
হোসেন চিঠি পড়ে ভীষণ আনন্দিত হল। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে চিঠিটা পকেটে রেখে বলল, তোমাকে উত্তর দিতে হবে না। ইনশাআল্লাহ, আমিই কাল তার সঙ্গে দেখা করব। এখন আসি কেমন?
আসমা বলল, এক মুঠো খেয়ে যাও তোমার জন্য রান্না করেছি।
খাওয়ার পর আসমা বলল, দেখা করার পর সই কি বলল, আমাকে জানাবে তো ভাই?
জানাব বলে হোসেন বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত রুকসানার সঙ্গে কিভাবে আলাপ করবে চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
হাসপাতালের জন্য জমি কেনার পর গেঁদু মুন্সী, ফজল, দাইহান ও গ্রামের চার পাঁচজন গণ্যমান্য লোক নিয়ে হোসেন একটা কমিটি গঠন করেছে। তারা হাসপাতাল বিল্ডিং তৈরির কাজের তদারকি করছেন। ইতিমধ্যে বিল্ডিং এর কাজ অনেক এগিয়ে গেছে। পরের দিন সকালে ফজরের নামায পড়ে হোসেন কমিটির সদস্যদের নিয়ে মিটিং করে কাজের অগ্রগতি শুনল। তারপর তাদেরকে বলল, আমি ঢাকায় গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। উনি আগামী মাসের পঁচিশ তারিখে হাসপাতাল উদ্বোধন করতে আসবেন। আজ দশ তারিখ, আমরা দেড় মাস সময় পাচ্ছি। এর মধ্যে হাসপাতালের কাজ কমপ্লিট করে ফেলতে হবে। আর আগামী সপ্তাহে একটা বড় ধরনের মিটিং ডাকুন। মিটিং এ যাতে আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন আসে সেজন্য যে ব্যবস্থা করা দরকার করবেন। তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে রুগীদের বিদায় করে স্কুলে রওয়ানা দিল। আজ বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটি হওয়ার পর হোসেন মনিরাকে বলল, আজ পড়াব না, চল, তোমাদের বাড়িতে যাব।
মনিরা বলল, তাই চলুন স্যার। এই কয়েকদিন আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে বড় আপা প্রতিদিন আপনি ঢাকা থেকে ফিরেছেন কিনা জিজ্ঞেস করে। আব্বাও মাঝে মাঝে বলেন, তোর স্যারকে আসতে বলিস।
হোসেন কিছু না বলে তাকে নিয়ে হাঁটতে লাগল। কাঁচারী বাড়ির কাছে এসে হোসেন মনিরাকে বলল, তুমি যাও, আমি তোমার বড় আপার সঙ্গে দেখা করে তাকে নিয়ে আসছি।
পাঁচ ছয়দিন পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন আসমার চিঠি পেল না তখন রুকসানা ভাবল, হোসেন স্যার যদি ইকবাল হয়, তাহলে আসমার তো জানার কথা। আর দাইহান ইকবালের বাবার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। তারও জানার কথা, তাছাড়া পাশা-পাশি ঘর। নিশ্চয় ঘনিষ্ঠতা আছে। তবু কেন আসমা চিঠি দিয়ে জানাচ্ছে না? তাহলে কি এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে।
আজ ঢাকা থেকে মাল কেনার জন্য ট্রাক নিয়ে এক পার্টি এসেছিল। মাল ডেলেভারী দিয়ে বিদায় করতে তিনটে বেজে গেল। রুকসানা অফিসেই যোহরের নামায পড়ে খাওয়ার পর চেয়ারে বসে এইসব ভাবছিল। এমন সময় পিয়ন আতাহার এসে বলল, কিছুদিন আগে যে একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক এসেছিলেন, উনি এসেছেন।
রুকসানা চমকে উঠতে গিয়েও সামলে নিল। বলল, আসতে বল।
হোসেন পর্দা ঠেলে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর বসতে বলে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তখন তার হার্টবিট বেড়ে গেল।
হোসেন বসে মৃদু হেসে বলল, কী দেখছেন?
রুকসানা সামলে নিয়ে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ব্যথা সারার ওষুধ দিয়ে। গিয়েছিলেন, এতদিন পরে সারল কিনা খোঁজ নিতে এসেছেন বুঝি?
ঠাট্টা করছেন?
যদি তাই মনে করেন, তাহলে তাই। কী দেখছিলেন, বললেন না যে?
হাদিসে আছে, “মানুষের মুখটা হল দীলের আয়না।” দীলে কি আছে মানুষের মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায়।
আমারটা কী বুঝলেন?
আপনি খুব শক্ত দীলের মানুষ, তাই বুঝতে পারিনি। যাক গে, ঢাকা থেকে ফিরলেন কবে?
গতকাল।
জরুরী ওষুধ কিনতে আটদিন সময় লাগে, তা আমার জানা ছিল না।
অন্য একটা জরুরী কাজে আটকা পড়েছিলাম।
কাজটা বলতে অসুবিধা আছে?
না নেই। বলছি শুনুন, আমি একটা হাসপাতাল করার চেষ্টা করছি। সে ব্যাপারে মিটিং-এ স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে নিয়ে আসার জন্য তার কাছে ছুটাছুটি করতে হয়েছে।
তাই নাকি? শুনে খুশি হলাম। তা স্বাস্থ্য মন্ত্রী আসবেন?
মিটিং-এ আসতে পারবেন না। তবে হাসাপাতাল উদ্বোধন করতে আসবেন। মিটিং-এ আসার জন্য আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার আব্বাকেও জানাব।
ইনশাআল্লাহ আসব। এবার দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
করুন।
দাইহান ও আসমাকে চেনেন?
চিনি।
কতটা চেনেন?
দাইহান ফজল সেখের ছেলে, আর আসমা গেঁদু মুন্সীর মেয়ে। বর্তমানে তারা স্বামী-স্ত্রী। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। আরো কিছু বলা লাগবে?
ওদের সাথে আপনার ঘনিষ্ঠতা আছে?
গ্রামের সকলের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। তবে পাশা-পাশি বাড়ি হিসাবে ওদের সঙ্গে একটু বেশি আর কি। এবার আমি একটা কথা বলব, মাইণ্ড করবেন না বলুন?
না, বলুন কী বলবেন।
অনেকে রোদের কারণে সানগ্লাস পরে, আপনি রুমের ভিতর পরেন কেন?
রুকসানা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আমার চোখের অসুখ। তাই ডাক্তার সব সময় সানগ্লাস পরে থাকতে বলেছেন।
ডাক্তার হিসাবে আমি যদি আপনার চোখটা একটু পরীক্ষা করতে চাই, তাহলে কি অন্যায় হবে?
না হবে না, তবে আমি আপনাকে চোখ দেখাব না।
কেন?
সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
এবার নিশ্চয় পারবেন বলে রুকসানা যে চিঠিটা আসমাকে দিয়েছিল সেটা পকেট থেকে বার করে হোসেন টেবিলের উপর তার সামনে রাখল।
রুকসানা চিঠিটা দেখেই চমকে উঠে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। এক সময় সানগ্লাসের পাশ দিয়ে গাল বেয়ে চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগল।
হোসেন তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। তারও চোখে পানি আসার উপক্রম হল। সামলে নিয়ে ভিজে গলায় বলল, আমাকে মনে রেখে এত কষ্ট সহ্য করা তোমার উচিত হয়নি। ছেলেবেলায় ছেলেমানুষি খেয়ালে যে অন্যায় করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি শাস্তি পেয়েছিলাম। তাই সেই সময় তোমাকে দায়ী ভেবে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেমন করে হোক তোমাকে বিয়ে করে প্রতিশোধ নেব। বড় হওয়ার পর। আল্লাহ যখন মেহেরবানী করে ধর্মীয় জ্ঞান দিলেন তখন সেই প্রতিজ্ঞা মন থেকে দূর করে দিই। তবে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতাম, “তোমার উপযুক্ত হওয়ার তওফিক যেন তিনি আমাকে দেন এবং তোমাকে আমার জন্য কবুল করেন।” তাই এত বছর। কষ্ট করে সাধনা করে এতদূর পৌঁছেছি। তারপর গ্রামে এসে আত্মগোপন করে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যখন আসমার কাছে জানতে পারলাম তুমি আমার জন্য অপেক্ষায় আছ তখন খুব আনন্দিত হলেও বিশ্বাস করিনি। কাল আসমা যখন এই চিঠি দিল তখন পড়ে আনন্দ পেয়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানিয়েছি। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। তাই আজ না এসে থাকতে পারলাম না। আল্লাহপাকই জানেন এর পর কি হবে। যেদিন পথে তোমাকে আঁড় তাড়া করেছিল, সেদিন তোমাকে দেখেই আমি চিনেছি। তুমি হয়তো চিনতে পারনি। আসমার মুখে তোমার সব কথা শোনার পর সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্য তোমার কাছে ছুটে আসতে মন চেয়েছিল, কিন্তু আসিনি। আসমা ও দাইহানকেও আমার কথা তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছি। তাই আসমা তোমার চিঠির উত্তর দিতে পারেনি। যে বুকভরা আশা নিয়ে এসেছিলাম, তা আল্লাহর দয়ায় সত্য প্রমাণিত হল। কিন্তু সেই আশা সফল হওয়ার কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না। তুমি যদি পেয়ে থাক বল।
হোসেন স্যারের কথা শুনতে শুনতে রুকসানার চোখ থেকে আরো বেশি পানি পড়ছিল। সে থেমে যেতে প্রথমে মুখের নেকাব সরাল। তারপর সানগ্লাস খুলে চোখ মুখ মুছে ভিজে গলায় বলল, আল্লাহর কসম, তখন আমার সেক্স সম্পর্কে কোনো জ্ঞান হয়নি। তাই আম্মা যখন বুকে তেল মালিশ করে দিচ্ছিল তখন ব্যথা পেয়ে উহ করে উঠেছিলাম। মা ব্যথার কারণ জিজ্ঞেস করতে বলেছিলাম, তুমি বুকে হাত দিয়েছিলে। এই কথায় আম্মা যে আব্বাকে দিয়ে তোমাকে ঐরকম শাস্তি দেওয়াবে, তা যদি জানতাম, তাহলে কিছুতেই বলতাম না। তোমাকে যখন শাস্তি দেয় তখন আমি গাছের আড়াল থেকে দেখেছি। তখন মনে হয়েছে তোমার গায়ে যতগুলো চাবুক পড়েছে তার সবগুলো আমার গায়েও পড়েছে। সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গাছতলায় পড়েছিলাম আব্বা কোলে করে ঘরে নিয়ে আসে। সেই থেকে তোমার স্মৃতি আজ ও আমার মনকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তারপর ফুঁপিয়ে উঠে দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, আমিও তো কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
হোসেন বলল, আমি জানি রুকসানা, তোমাদের বংশ মর্যাদা, তোমার বাবার মান সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে তুমি যেমন আমাকে গ্রহণ করতে পারবে না, একজন দারোয়ানের ছেলে হয়ে তোমাদের মান মর্যাদা ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে মালিক কন্যাকে গ্রহণ করতে আমিও পারব না। হয়তো ইহকালে আমাদের মিলন কুদিরে নেই। তাই বলব, এত বছর যখন আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি, আর কিছুদিন তারই উপর ভরসা করে ধৈর্য ধরে থাকি এস। তকদিরে মিলন থাকলে তিনিই কোনো না কোনো পথ দেখিয়ে দিবেন। আর না থাকলে সবর করে এভাবেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এত ভেঙ্গে পড়ছ কেন? জানত, ধৈর্যই সাফল্যের চাবি? এবার সংযত হও, তোমাকে নিয়ে তোমার আব্বার সঙ্গে দেখা করতে যাব।
রুকসানা সামলে নিয়ে চোখ মুখ মুছে চোখে চশমা পরে বলল, আর একটু বস চা খেয়ে যাব।
প্রতিদিন অফিস ছুটির কিছুক্ষণ আগে রাবেয়া ও কায়সার কারখানার কাজ কর্ম সম্পর্কে রুকসানার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করে। আজ রুমে ঢুকে অচেনা একজন ভদ্রলোককে দেখে দুজনেই সালাম দিল।
হোসেন সালামের উত্তর দিল।
রুকসানা তাদেরকে বসতে বলে বলল, পরিচয় করিয়ে দিই। হোসেনকে দেখিয়ে বলল, ইনি হোসেন স্যার ফুকরা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ইংলিশের টিচার। শুধু তাই নয়, একজন ভালো হোমিও ডাক্তারও।
তারপর ওদের দুজনকে দেখিয়ে হোসেনকে বলল, এরা হল একে অপরের জীবনসাথী রাবেয়া ও কায়সার। আমরা তিনজনই এই কারখানার মালিক। তারপর মেয়ে পিয়ন আসিয়াকে ডেকে চা দিতে বলল।
চা খাওয়ার সময় কায়সার হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাল টিচার ও ডাক্তার হিসাবে আপনার অনেক সুনাম শুনেছি। আজ পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। তারপর বলল, শুনলাম আপনি নাকি একটা হাসপাতাল করার জন্য চেষ্টা করছেন?
হোসেন বলল, হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। তবে এতবড় কাজ আমার একার দ্বারা কি সম্ভব? তাই আশ-পাশের গ্রামের মানুষের কাছে সাহায্য সহযোগিতার আশা নিয়ে এই কাজে হাত দিয়েছি।
রুকসানা ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, সেই জন্য উনি আব্বার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আজ আর আমাদের আলাপ আলোচনা হবে না। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ছুটির সময় পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে। তোরা যা, আমি ওঁকে নিয়ে যাব।
রাবেয়া ও কায়সার বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর রুকসানা হোসেনকে বলল, চল আমরাও যাই।
যেতে যেতে রাবেয়া বলল, জান, কিছুদিন আগে ঐ ভদ্রলোক রুকসানাকে ষাড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন।
কায়সার বলল, তাই নাকি? ঘটনাটা বলত?
রাবেয়া ঘটনাটা বলে বলল, রুকসানার কথাবার্তায় মনে হল, ভদ্রলোকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
কায়সার বলল, কই আমিতো তেমন কিছু আভাস পেলাম না।
তুমি না পেলেও আমি পেয়েছি।
দেখা যাক সময় কি বলে।
৭
বছর পাঁচেক আগে স্ট্রোক করে আব্দুল মতিনের ডান হাত ও পা প্যারালাইজ হওয়ার পর একা নিচে নামতে পারেন না। তাই লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্যে উপরের তলাতে একটা ড্রইংরুম করেছেন। যারা দেখা করতে আসেন, তাদেরকে প্রথমে নিচের তলার ড্রইংরুমে বসিয়ে, আব্দুল মতিনকে খুরর দেওয়া হয়। উনি হুইল চেয়ারে করে উপরের ড্রইংরুমে আসার পর লোকজনকে উপরে নিয়ে আসা হয়।
রুকসানা হোসেন স্যারকে নিচের ড্রইংরুমে বসিয়ে উপরে গিয়ে আব্বাকে বলল, হোসেন স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
আব্দুল মতিন আনন্দিত হয়ে বললেন, কোথায় বসিয়েছিস?
নিচের ড্রইংরুমে।
যা উপরে নিয়ে আয়, আমি আসছি।
রুকসানা আব্বার রুম থেকে বেরিয়ে মনিরাকে দেখতে পেয়ে বলল, হোসেন স্যার নিচে বসে আছেন, উপরে নিয়ে আয়।
মনিরা চলে যাওয়ার পর রুকসানা সুরাইয়ার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে তার নাম ধরে ডাকল।
সুরাইয়া কিচেনে যাবে ভাবছিল? বড় আপার গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল।
রুকসানা বলল, হোসেন স্যার এসেছেন, আরেফা ও মমতাজকে নিয়ে নাস্তার ব্যবস্থা কর। তারপর আব্বার রুমে ফিরে এল।
আজিজা বেগম স্বামীর ড্রেস পাল্টে দিচ্ছিলেন। বললেন, স্যারকে উপরে এনেছিস?
রুকসানা বলল, মনিরাকে পাঠিয়েছি। এতক্ষণে হয়তো নিয়ে এসেছে।
মনিরা নিচে এসে স্যারকে বলল, আমার সঙ্গে আসুন।
হোসেন স্যার মনিরার সঙ্গে উপরের ড্রইং রুমে এসে বসেছে, এমন সময় রুকসানা আব্বার হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে ঢুকল।
হোসেন স্যার সালাম দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, ওঁর এই অবস্থার কথা মনিরা বা রুকসানা তো জানায় নি?
আব্দুল মতিন সালামের উত্তর দিয়ে তাকে বসতে বলে বললেন, মনে হচ্ছে, আপনি আমার এই অবস্থার কথা জানতেন না?
হোসেন স্যার দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, জি না জানতাম না। তারপর বলল, বেয়াদবি নেবেন না, বিশেষ কারণে আমি বসতে পারছি না। আর আমি আপনার ছেলের বয়েসি, আমাকে তুমি করে বলুন।
আব্দুল মতিন বললেন, ঠিক আছে। তারপর বললেন, তুমি আমার মেয়েকে খুব বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছ। সেজন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বিপদের ঘটনা শোনার পর তোমাকে দেখার জন্য রুকসানাকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। অনেক পরে এলেও আমি খুশি হয়েছি। মানুষের কল্যাণের জন্য তুমি যা কিছু করছ, তার কিছু কিছু আমি শুনেছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, “তিনি যেন তোমাকে আরো মানুষের কল্যাণকর কাজ করার তওফিক দিন।” তোমার মতো ছেলে প্রতি গ্রামে জন্ম। নিলে দেশের অনেক উন্নতি হত।
হোসেন স্যার বলল, আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা। আমাকে অতবড় করে বলবেন না। কাজের ব্যস্ততায় কথা দিয়েও আসতে পারিনি। সেজন্য ক্ষমা চাইছি। তারপর হাসপাতালের ব্যাপারে যা প্লন প্রোগ্রাম করেছে বলে বলল, আমি আপনার সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করি। আব্দুল মতিন বললেন, নিশ্চয় পাবে। এমন মহৎ কাজে সাহায্য সহযোগিতা করা সকলেরই উচিত। তবে মিটিং এ যাওয়ার কথা যে বললে, তা সম্ভব নয়। কারণটা তো দেখতেই পাচ্ছ।
এমন সময় কাজের মেয়ে করিমন চা-নাস্তা নিয়ে এলে আব্দুল মতিন মনিরাকে বললেন, তোর স্যারকে নাস্তা খাওয়া।
হোসেন স্যার কেন বসল না রুকসানা তা বুঝতে পেরেছে। তাই আব্বা যখন মনিরাকে নাস্তা খাওয়াতে বলল তখন ভাবল, হোসেন স্যার আব্বার সামনে বসে কিছুতেই নাস্তা খাবে না। আবার না খেলে আব্বা হোসেন স্যারকে দাম্ভিক ভাববে। তাই কি বলে আব্বাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ ওষুধ খাওয়াবার কথা মনে পড়ল। ঘড়ি দেখে আব্বাকে সে কথা বলে বলল, তোমাকে নিয়ে যাই?
আব্দুল মতিন বললেন, একটু পরে যাবখন।
রুকসানা বলল, ওষুধ সময় মতো খেতে ডাক্তার বারবার বলে দিয়েছেন।
আব্দুল মতিন হোসেন স্যারকে বললেন, জান বাবা, এই মেয়েটা নিজে যেমন নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলে তেমনি এ বাড়ির সবাইকে মেনে চলতে বাধ্য করে। কারো এতটুকু ক্ষমতা নেই ওর কথার অবাধ্য হয়। তুমি সময় করে মাঝে মাঝে এস।
রুকসানা বলল, আব্বা যেন কী? ওঁর সামনে এসব কথা বলছ কেন? তারপর হুইল চেয়ার ঠেলে আব্বাকে নিয়ে চলে গেল।
হোসেন স্যার চা-নাস্তা খেয়ে মনিরাকে বলল, এবার আসি।
মনিরা বলল, বড় আপার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যাবেন? একটু বসুন, বড় আপাকে ডেকে নিয়ে আসি।
আবার যখন আসব তখন দেখা তো হবেই, এখন আর ডাকার দরকার নেই বলে হোসেন স্যার বিদায় নিয়ে চলে গেল।
মনিরা ভাবল, বড় আপা আসেনি বলে স্যার হয়তো মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ঐ কথা বললেন। হনহন করে আব্বার রুমে এসে তাকে না পেয়ে তার রুমে গেল।
রুকসানা ইচ্ছা করে হোসেন স্যারকে বিদায় দিতে যায়নি। মনিরা যা চালাক, কথা-বার্তা একটু এদিক ওদিক হলেই অন্য কিছু ভাবতে পারে। তাই আব্বাকে, ওষুধ খাইয়ে নিজের রুমে এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সদরের দিকে তাকিয়েছিল হোসেন স্যারকে দেখার জন্য।
মনিরা রুমে ঢুকে তাকে দেখতে পেয়ে বলল, বড় আপা, স্যার চলে গেছেন। তুমি আব্বাকে ওষুধ খাইয়ে গেলে না কেন? স্যার কি মনে করলেন? আমি তোমাকে ডাকতে চেয়েছিলাম। স্যার নিষেধ করে বললেন, “আবার যখন আসব তখন তো দেখা হবেই।”
রুকসানা বলল, স্যার তো ঠিক কথাই বলেছেন, তুই না থাকলে বরং উনি কিছু মনে করতেন। আসরের আযান হয়ে গেছে। যা নামায পড়ে নে। আমিও পড়ব।
মনিরা আর কিছু বলতে না পেরে সেখান থেকে চলে গেল।
হোসেন ফিরে এসে রুকসানা ও তার মধ্যে যে সব কথাবার্তা হয়েছে সে সবের যতটা বলা সম্ভব, আসমা ও দাইহানকে বলে বলল, এখন তোমারাই চিন্তা কর, কিভাবে আমাদের মনের আশা পূরণ হতে পারে?
আসমা বলল, আমি আব্বাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাব।
হোসেন হেসে উঠে বলল, তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন? আমি তাদের দারোয়ানের ছেলে। কোনো ধনী ও উচ্চ বংশের বাবা কী তাদের দারোয়ানের ছেলেকে জামাই করতে পারে?
আসমা বলল, আমারও তোমার ভাইয়ার তো প্রায় একই রকম ব্যাপার ছিল। রোকসানার আব্বাই যখন আমাদের ব্যাপারটা সমাধান করলেন, তখন নিজের মেয়ের বেলায় করবেন না কেন?
হোসেন বলল, মানুষ অপরের কোনো বিষয় সমাধান করে ঠিক; কিন্তু ঐ একই বিষয়ে নিজেরটা করে না। এটাই দুনিয়ার রীতি।
আসমা বলল, রুকসানা আমাকে আত্মঘাতী থেকে বাঁচিয়েছে। আমিও তার জন্য জানের বাজী রাখব। চৌধুরী চাচার পায়ে ধরে কেঁদে হলেও রাজি করাব।
হোসেন বলল, তা হয় না। আমি তোমাকে তা করতে দেব না। মুসলমান হিসাবে তকদিরকে বিশ্বাস করি। আর তকদির আল্লাহপাক লিখেছেন। তাই আমি তকদিরের উপর নির্ভর করে এতবছর যখন ধৈর্য ধরে আছি তখন বাকি জীবনটাও থাকব। তবু চৌধুরী বংশের এতটুকু অসম্মান করতে পারব না। শোনো, তুমি যদি আমার ও রুকসানার উপকার করতে চাও, তাহলে এই ব্যাপারে কোনো রকম তদবীর করবে না। ধৈর্য ধরে দেখ, আল্লাহ আমাদের কুদিরে কি লিখেছেন।
আসমা বলল, তকদীরের উপর বিশ্বাস করা যে প্রত্যেক মুসলমান নরনারীর উপর ফরয, একথা জানি। কিন্তু তিনি তো তকূদীরের উপর নির্ভর করে বসে থাকতে বলেন। নি। বরং চেষ্টা করে তকুবীর করতে বলেছেন।
হোসেন বলল, তা আমিও জানি। কিন্তু চেষ্টা তদবীরের সঙ্গে যেখানে মান সম্মান ও অসম্ভব কিছু জড়িত থাকে, সেখানে চেষ্টা তদবীর করা শুধু ভুল নয়, অন্যায়ও।
আসমা বলল, তোমার সঙ্গে তর্কে পারব না। আর তুমি যতই নিষেধ কর না কেন, চেষ্টা তদবীর আমি করবই।
দাইহান এতক্ষণ চুপ করেছিল। স্ত্রী থেমে যেতে বলল, আসমা ঠিক কথা বলেছে। রুকসানা আমাদের যা উপকার করেছে, তার প্রতিদান হিসেবে, আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবই ইনশাআল্লাহ।
হোসেন ভাবল, এদেরকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না। বলল, তোমরা যখন আমার কথা শুনবেই না তখন যা ইচ্ছা কর। কিন্তু মনে রেখ, যদি রুকসানার কিছু। হয়, তাহলে তোমাদের সঙ্গে চিরকালের জন্য সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।
আসমা বলল, এটা তুমি ঠিক বললে না হোসেন ভাই। হাদিছে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে ইচ্ছা করে যে তাহার উপার্জন বৃদ্ধি হউক এবং তাহার মৃত্যু বিলম্বে হউক, সে যেন আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।” [বর্ণনায়- হযরত আনাস (রাঃ) বুখারী-মুসলীম]
হাদিছে আরো আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে, সে বেহেশতে যাইবে না।” [বর্ণনায় হযরত জাবেরবীন মোতয়েম- বুখারী, মুসলীম]
তুমি নিশ্চয় এই হাদিসগুলো জান। তারপরও এই কথা বলতে পারলে?
হোসেন তওবা আস্তাগফির পড়ে বলল, আল্লাহ মাফ করুন। হাদিসগুলো আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাকে উপলক্ষ করে আল্লাহ আমাকে অনেক বড় গোনাহ থেকে রক্ষা করলেন। সে জন্যে তার পাক দরবারে জানাই লাখোকোটি শুকরিয়া। তারপর বিদায় নিয়ে চলে এল।
.
কমিটির লোকজন মাইক দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মিটিং এর কথা প্রচার করিয়েছেন।
আজ মিটিং এর দিন। তিনটের সময় মিটিং শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুরের পর থেকে লোকজন আসতে শুরু করল। হাসপাতালের সামনে অনেক খানি মাঠ। সেখানে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা অতিথি হয়ে আসবেন তাদের জন্য ও বক্তাদের জন্য আলাদা কোনো স্টেজ করা হয়নি। হাসপাতালের বারান্দাতে চেয়ার টেবিল দেওয়া হয়েছে। তিনটের পর থেকে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও তিনটে ওয়ার্ডের আটজন মেম্বার একে একে আসতে আরম্ভ করলেন। হোসেন নিজে গিয়ে আব্দুল মতিনকে গাড়ি করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তিনি অপারগতার কথা বলে বড় ছেলে আব্দুর রশিদকে পাঠাবার কথা বলেছিলেন। সেও এসেছে। সাড়ে তিনটের সময় চেয়ারম্যান আজিজুল হককে সভাপতি করে মিটিং এর কাজ শুরু হল। প্রথমে একটা চৌদ্দ পনের বছরের ছেলে কুরআন তেলাওয়াত করল। তারপর অতিথি বৃন্দের অনেকে হোসেন স্যারের এই মহৎ কাজের প্রশংসা করে কিছু বক্তব্য রেখে সব রকমের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আব্দুল মতিনের বড় ছেলে আব্দুল রশিদ বক্তৃতা করার সময় আব্বার কথামত পঁচিশ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিল।
সব শেষে সভাপতি চেয়ারম্যান আজিজুল হক সমাপ্তির ভাষণে বললেন, যিনি একা নিজের চেষ্টায় এতবড় মহৎ কাজে হাত দিয়েছেন এবং কাজও প্রায় শেষ করে এনেছেন। সেই মহান লোকটিকে আমরা একজন ভালো শিক্ষক, ভালো ডাক্তার ও একজন জনদরদী হিসাবে জানি। আমরা তার কাজ-কর্মে ও আচার ব্যবহারে এতই অভিভূত হয়েছি যে, তার পরিচয় জানতে পর্যন্ত ভুলে গেছি। যেদিন উনি আমাকে এই মিটিং-এ আসার জন্য অনুরোধ করতে গিয়েছিলেন, সেদিন আমি তার পরিচয় জানতে চাইলে যা বললেন, তা শুনে ভীষণ অবাক হয়ে দোয়া করেছি। এখন তার পরিচয় বলছি শুনুন, তারপর হোসেনের আসল পরিচয় ও কিভাবে লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে গ্রামে ফিরে এল বলে বললেন, হোসেন স্যার আসল পরিচয় বলার পর আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, কথাটা গোপন রাখার জন্য। আমি রাজি না হয়ে বলেছিলাম, আপনি আমাদের দেশের কৃতী সন্তান। আপনার আসল পরিচয় সকলের জানা উচিত। তাই আপনাদেরকে জানালাম। ইনশাআল্লাহ আমিও যতটা সম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করব। জনসাধারণের কাছে অনুরোধ করছি, আপনারাও এই মহৎ কাজে যে যা পারেন, তাই দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোক, এই দোয়া করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করে মিটিং-এর সমাপ্তি ঘোষণা করছি। আল্লাহ হাফেজ।
গ্রামের লোকজন হোসেন স্যার মরহুম কাজেম সেখের ছেলে জেনে যেমন অবাক হল তেমনি আনন্দিতও হল।
বাহিরবাগ গ্রাম থেকে অনেকে এসেছিল। তাদের মধ্যে রুকসানা, রাবেয়া ও কায়সার ছিল। রুকসানা ভেবেছিল, মিটিং-এর পরে আসমার সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাড়িতে যাবে। সঙ্গে রাবেয়া ও কায়সার থাকায় সম্ভব হল না। তাছাড়া বেলাও বেশি ছিল না। তাই তাদের সঙ্গে ফিরে আসতে লাগল।
এক সময় রাবেয়া রুকসানাকে জিজ্ঞেস করল, তুই কাজেম সেখকে দেখেছিস?
রুকসানা বলল, হ্যাঁ দেখেছি। আমি যখন সিক্সে পড়তাম তখন ইকবাল পালিয়ে যায়। তার মাস ছয়েক পর কাজেম সেখ চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যায়।
তোর সঙ্গে তো হোসেন স্যারের দু’তিন বার আলাপ হয়েছে, চিনতে পারিস নি?
প্রায় বিশ একুশ বছর পর কাউকে দেখলে কি আর চেনা যায়? তবে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয়েছে।
কায়সার বলল, আমি কিন্তু ওঁর সম্পর্কে আগেই জেনেছি।
রুকসানা জিজ্ঞেস করল, কার কাছে জেনেছ? হোসেন স্যার বলেছেন?
কায়সার বলল, না, আমার মামাত ভাই আশরাফ ভাইয়ের কাছে। তিনি আর হোসেন স্যার ভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়তেন। আশরাফ ভাই কিছুদিন আগে এসেছিলেন। আসার সময় পথে হোসেন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বাড়িতে এসে সেকথা আমাকে বললেন। তার কাছে আরো যা কিছু শুনেছিলাম চেয়ারম্যানের কথার নঙ্গে মিলে গেছে।
রুকসানা আর কিছু না বলে হাঁটতে লাগল।
গ্রামে ঢুকে কায়সার-রাবেয়ার ও রুকসানার পথ আলাদা। সেখানে পৌঁছে রুকসানা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর রাবেয়া স্বামীকে বলল, তুমি হোসেন স্যারের আসল পরিচয় জেনেও আমাকে এতদিন বলনি কেন?
কায়সার বলল, ভেবেছিলাম, হোসেন স্যার যখন আত্মগোপন করে আছেন তখন নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। তাই একজন জ্ঞানী-গুনী লোকের পরিচয় প্রকাশ করা উচিত হবে না ভেবে বলিনি।
রাবেয়া অভিমানভরা কণ্ঠে বলল, আমি বুঝি ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তার পরিচয় বলে বেড়াতাম?
তা হয়তো করতে না, তবে মেয়েদের পেটে কোনো কথা হজম হয় না। এক কান দু’কান করে একদিন প্রচার হয়ে যেতই।
থাক, কথাটা জিজ্ঞেস করাই আমার অন্যায় হয়েছে।
আহ, রাগ করছ কেন? ঠিক আছে, তোমাকে না জানিয়ে আমিই অন্যায় করেছি। মাফ করে দাও।
রাবেয়া স্বামীর পিঠে একটা আদরের কিল দিয়ে বলল, এই মাফ চেয়ে আমাকে গোনাহগার করছ কেন? রাগ দেখিয়ে আমিও অন্যায় করেছি। আমারই মাফ চাওয়া উচিত। বল মাফ করে দিয়েছ?
কায়সার মৃদু হেসে বলল, মেয়েদের মন বোঝা মুশকিল। এই রাগ, এই পানি। তারপর বলল, অন্যায় কেউ-ই করেনি। অতএব এ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা না। বলাই ভালো।
.
আব্দুর রসিদ ঘরে ফিরে আব্বাকে বলল, জান আব্বা, হোসেন স্যার দক্ষিণ ফুকরার কাজেম সেখের ছেলে। তারপর চেয়ারম্যান হোসেন স্যারের সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন বলল।
আব্দুল মতিন খুব অবাক হয়ে চমকে উঠে বললেন, কী বলছ তুমি? এটাও কি সম্ভব? তখন তার বিশ-একুশ বছর আগের ঘটনা মনে পড়ল, “এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে রুকসানার বুকে হাত দিয়েছিল বলে তার বাপকে দিয়ে শংকর মাছের চাবুক মেরে শাস্তি দিয়েছিলেন।”
আব্বাকে চুপ করে থাকতে দেখে আব্দুর রসিদ বলল, আমি এখন যাই আব্বা?
আব্দুল মতিন বললেন, হ্যাঁ যাও।
আজিজা বেগম সেখানে ছিলেন। কথাটা শুনে তিনিও খুব অবাক হয়েছেন। বড় ছেলে চলে যাওয়ার পর বললেন, আল্লাহ কখন কাকে কি করেন, তা তিনিই জানেন। হোসেন স্যার কাজেম সেখের ছেলে, ভাবতেই পারছি না।
আব্দুল মতিন বললেন, আমারও খুব অবাক লাগছে। যাকগে, মনিরাকে একটু ডাকতো?
আজিজা বেগম বাইরে এসে ছোট বৌ মমতাজকে দেখতে পেয়ে বললেন, মনিরাকে ডেকে দাও।
আব্দুর রশিদ আব্বার কাছ থেকে এসে স্ত্রীকে হোসেন স্যারের আসল পরিচয় বলছিল। মনিরাও সেখানে ছিল। ছোট ভাবির ডাক শুনে তার কাছে এসে বলল, কেন ডাকলে?
মমতাজ বলল, আম্মা ডাকছেন।
মনিরা রুমে ঢুকে বলল, আম্মা ডেকেছ?
আজিজা বেগম বলার আগে, আব্দুল মতিন বললেন, হোসেন স্যারের আসল পরিচয় শুনেছিস?
আগে জানতাম না, এখন বড় ভাইয়ার কাছে শুনলাম।
আব্দুল মতিন গম্ভীর স্বরে বললেন, ছুটির পর তার কাছে আর পড়বি না।
মনিরা খুব স্পষ্টভাষিনী। তাই আব্বাকে ভয় করলেও বলল, কেন?
আব্দুল মতিন রাগের সঙ্গে বললেন, কেন আবার। নিষেধ করলাম পড়বি না। কাজেম সেখ ও তার বাবা আমাদের বাগানের দারোয়ান ছিল। জেনে শুনে দারোয়ানের ছেলের কাছে তোকে পড়তে দিতে পারি না। শোন, আমাদের বংশের মান সম্মান আছে। লোকে শুনলে কী বলবে?”
মনিরা বলল, আব্বা তোমার কথা মানতে পারব না। সেজন্য ক্ষমা চাইছি। হোসেন স্যারের বাপ-দাদারা হয়তো গরিব ছিল, তাই তারা তোমাদের কাছে দারোয়ানীর চাকরি করেছে। তাই বলে তাদের ছেলেকে ঘৃণা করা কি ঠিক হচ্ছে? তা ছাড়া হোসেন স্যার আমার শিক্ষক। বড় আপার কাছে শুনেছি, হাদিসে আছে, “আল্লাহ ও তার রাসূলের পরে মা-বাবার স্থান, তার পরেই শিক্ষকের স্থান। উনি আমার শিক্ষক, আমি তার কাছে পড়বই। কথা শেষ করে হনহন করে চলে গেল।
আব্দুল মতিন ছোট মেয়ের স্বভাব জানেন, তবু বললেন, আব্দুল করিম ঠিকই বলে, মনিরা সত্যিই দিন দিন, বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। তারপর চোখ বন্ধ করে ইকবালের কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
রুকসানা ঘরে ফিরে ওষুধ খাওয়ার জন্য আব্বার রুমে এল। তাকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে আব্বা বলে ডাকল।
আব্দুল মতিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আয় বস।
রুকসানা বলল, আগে ওষুধ খেয়ে নাও, তারপর বসছি। তারপর ওষুধ খাইয়ে আব্বার পাশে বসে বলল, কিছু বলবে আব্বা?
তুই কী দক্ষিণ ফুকরায় মিটিংএ গিয়েছিলি?
হ্যাঁ, আমাদের অফিসের রাবেয়া ও কায়সারের সঙ্গে গিয়েছিলাম।
আব্দুল করিম একটু আগে এসে যখন বলল, হোসেন স্যার কাজেমের ছেলে তখন বিশ্বাস করতে পারিনি। তারপর চেয়ারম্যান সাহেবের কথা বলতে বিশ্বাস হল। এখন বুঝতে পারছি, সেদিন তাকে বসতে বলার পরও কেন বসল না। চাকরের ছেলে হয়ে কি মনিবের সামনে সোফায় বসতে পারে? আগে যদি জানতাম হোসেন স্যার আমাদের দারোয়ানের ছেলে, তা হলে তোকে নিয়ে আসতে বলতাম না। আর মনিরাকেও তার কাছে পড়তে দিতাম না। শোন, একটু আগে মনিরাকে তার কাছে পড়তে নিষেধ করেছি; কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। তাকে তুই নিষেধ করে দিস। আমার বিশ্বাস, তোর কথা সে শুনবে।
তুমি তাকে পড়তে নিষেধ করলেন কেন আব্বা?
আব্দুল মতিন বিরক্ত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আশ্চর্য? কারণট বোঝা তোর উচিত ছিল। ভুলে যাচ্ছিস কেন, কয়লা হাজারবার ধুলেও তার কালো র যায় না। একটা চরিত্রহীন লম্পটের কাছে মনিরার পড়া কি…..
রুকসানা আর সহ্য করতে না পেরে আব্বার কথা শেষ করার আগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই আব্বা, এখনও কাপড় পাল্টাইনি। কথা শেষ করে চলে গেল।
আব্দুল মতিন অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, মনিরাকে যা বলতে বললাম, বলে দিস।
আব্বার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তার কথাগুলো রুকসানার মনে তীরের মতো বিধেছে। তার সামনে এতক্ষণ সহ্য করতে পারলেও নিজের রুমে এসে আর পারল না। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের আজান হচ্ছে শুনে উঠে কাপড় পাল্টে বাথরুম থেকে অযু করে এল। তারপর নামায ও অজিফা পড়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মোনাজাতের সময় আল্লাহর কাছে জানাল, “হে মহান প্রভু আল্লাহ, তুমি সর্বজ্ঞ। সারা সৃষ্টি জগৎ তোমার জ্ঞানের পরিধির মধ্যে। তুমি সমস্ত সৃষ্টি জীবের মনের খবর জান। আমি তোমার একজন নাদান বান্দী। আমার মনের নেক বাসনাগুলো তুমি পূরণ করো। তুমি তো জান, আমি ইকবালের জন্য কত বছর ধৈর্য ধরে রয়েছি। ইকবালও আমার জন্য এতবছর ধৈর্য ধরে আমার উপযুক্ত হয়ে ফিরে এসেছে। আমাদেরকে জোড়া হিসাবে কবুল কর। আমাদের মিলনের পথে যে বাধা, তা দূর করে দাও। তোমার পেয়ারা হাবিবের উপর শতকোটি দরুদ ও সালাম পেশ করছি। তোমার রহমতে ও তোমার পেয়ারা হাবিবের অসিলায় আমার গোনাহ খাতা মাফ করে দিয়ে আমার স্বপ্ন সফল করে দাও, আমিন।” তারপর বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে গেল।
নাস্তা খেয়ে ফিরে আসার সময় রুকসানা মনিরাকে বলল, আমার রুমে আয়।
মনিরা তখন চা খাচ্ছিল। খাওয়া শেষ হতে কাপটা নামিয়ে রেখে বড় আপার রুমে এসে বলল, কেন ডেকেছ বল।
আব্বা তোকে হোসেন স্যারের কাছে পড়তে নিষেধ করা সত্ত্বেও তুই নাকি বলেছিস, তার কাছে পড়বি?
হ্যাঁ বলেছি। আচ্ছা বড় আপা, তুমিই বল তো, স্যারের বাবা আমাদের দারোয়ান ছিল, তাতে স্যারের কাছে পড়তে দোষ কোথায়? বড় বড় মনিষীদের বাবারাও অনেকে গরিব ছিলেন, অনেকে চাষী ছিলেন। আবার অনেকে ছোটখাট চাকরিও করতেন।
তোর কথা ঠিক, তবে আব্বা যখন নিষেধ করেছে তখন না পড়াই ভালো।
বড় আপা, তুমিও নিষেধ করবে ভাবতে পারিনি। স্যার দারোয়ানের ছেলে বলে যদি তুমিও নিষেধ কর, তোমার নিষেধও শুনব না বলে মনিরা হনহন করে চলে গেল।
তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুকসানার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
এরপর থেকে রুকসানা দিনের পর দিন মুষড়ে পড়তে লাগল।
৮
হোসেন স্যারের আসল পরিচয় চৌধুরী বাড়ির সবাই জেনে অবাক হলেও কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাল না। কিন্তু বড় বৌ সুরাইয়া মাথা না ঘামিয়ে পারল না। এক ছুটির দিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর রুকসানার রুমে গেল।
রুকসানা শুয়ে শুয়ে ভাগ্যের কথা চিন্তা করছিল। তাকে দেখে উঠে বসে বলল, কি ব্যাপার? এমন সময় তো তুমি আমার রুমে কখনো আসনি? কিছু দরকার থাকলে বলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়।
সুরাইয়া তার পাশে বসে বলল, বড় আপা, তুমি কাকে সব থেকে বেশি ভালবাস বলবে?
রুকসানা বলল, তাহলে কোনো দরকারে আসনি? করিম বুঝি ঘরে নেই? তাই ফাজলামী করতে এসেছ? যাও ভাগো। আমার শরীর ভালো না, একটু ঘুমাব।
আমার কথার জওয়াব না দিলে যাব না।
তুমি একটা আস্ত পাগল, তাই পাগলের মতো কথা বলছ। তোমাকে সবার। থেকে বেশি ভালবাসি বললে মনিরা মমতাজ ও আরেফা কি মনে করবে ভেবে দেখেছ?
আমি কিন্তু তা জানতে চাইনি। শোন বড় আপা, তোমার ভাইয়ের কাছে ইকবাল হোসেন স্যারের সব কথা শুনেছি। তোমার কাছে ওয়াদা করেছিলাম বলে আজও কাউকে বলিনি। কিন্তু এখন আর সেই ওয়াদা রাখতে পারব না। তাই অনুমতি নিতে এসেছি, তুমি যে ইকবাল হোসেন স্যারের জন্য আজও অপেক্ষা করে আছ, সে কথা তোমার ভাইকে জানিয়ে বিহিত করার জন্য।
এমন সময় করিমন বুয়া এসে রুকসানকে বলল, আপনার সই এসেছেন। তিনি চৌধুরী হুজুরের সঙ্গে কথা বলছেন। আম্মা আপনাকে খবরটা দিতে বললেন।
রুকসানা তাকে বলল, তুমি যাও, আমি আসছি। করিমন চলে যাওয়ার পর সুরাইয়াকে বলল, এখন যাও। তোমার সঙ্গে পরে আলাপ করব। তারপর দুজনে একসঙ্গে রুম থেকে বেরিয়ে এসে রুকসানা আব্বার রুমে গেল।
আসমা স্বামীকে নিচে ড্রইংরুমে বসিয়ে উপরে উঠে আজিজা বেগমকে দেখে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল। তারপর বলল, চাচি আম্মা আপনারা কেমন আছেন?
আজিজা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, বেঁচে থাক মা, আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক। তারপর বললেন, আল্লাহর রহমতে আমি এক রকম আছি মা; কিন্তু তোমার চাচার সেই একই অবস্থা। এতবছর চিকিৎসা চলছে কোনো উন্নতিই নেই।
আসমা বলল, চলুন চাচার কাছে যাব।
আজিজা বেগম করিমনকে ডেকে বললেন, রুকসানাকে বল, তার সই এসেছে। তারপর আমাকে বললেন এস মা। রুমে ঢুকে আজিজা বেগম স্বামীকে বললেন, দক্ষিণ ফুকরা থেকে রুকসানার সই তোমাকে দেখতে এসেছে।
আসমা সালাম দিয়ে কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে চুমো খেয়ে বলল, চাচা কেমন আছেন?
আব্দুল মতিন সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, আমার আর থাকা না থাকা মা। তোমার আব্বা ভালো আছেন?
জ্বি, ভালো আছেন।
এমন সময় আব্দুল মতিন বড় মেয়েকে আসতে দেখে বললেন, রুকসানা আসছে। যাও মা তার ঘরে গিয়ে গল্প কর।
দরজার দিকে আসমার পিঠ ছিল, তাই রুকসানাকে আসতে দেখেনি। চাচার কথা শুনে ঘুরে তাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, সই, কেমন আছিস?
রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। তারপর একটা হাত ধরে বলল, আমার রুমে চল। যেতে যেতে বলল, এবারে প্রায় দেড় বছর পর এলি। সয়াকে বলে এক সপ্তাহ রেখে দেব।
বিয়ের পর আসমা প্রতি বছর এসে দু’তিন দিন বেড়িয়ে যায়। চৌধুরী বাড়ির সবাই তাকে চিনে। বাচ্চা হওয়ায় ও ইকবাল আসার ফলে দেড় বছর আসতে পারেনি। রুকসানার কথা শুনে বলল, পাগলামী করবি না। এবারে একদিনও থাকতে পারব না। কোলের বাচ্চাকে রেখে এসেছি এক্ষুনি চলে যাব। তাই তোর সয়াকে নিচে বসিয়ে রেখেছি।
তুই বড় স্বার্থপর। কোলের বাচ্চাকে নিয়ে এলি না কেন? দেখতাম কেমন হয়েছে।
আজ বিশেষ কাজে এসেছি। কয়েকদিন পর আবার যখন আসব তখন বাচ্চাকে নিয়ে এসে এক সপ্তাহ থাকব।
কি নাম রেখেছিস?
যয়নাব বিনতে দাইহান।
বাহ! খুব সুন্দর নাম তো!
বড় আপা, আব্বার রুমে ঢুকে যেতে সুরাইয়া ফিরে এসে তার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। তাকে দেখে আসমা সালাম বিনিময় করে বলল, ভাবি কেমন আছেন।
সুরাইয়া বলল, ভালো আপনি ভালো আছেন?
আসমা বলল, ভালো না থাকলে এলাম কি করে?
রুকসানা সুরাইয়াকে বলল, নিচে মেহমান আছে। করিমনের হাতে নাস্তা পাঠিয়ে আমাদের জন্যও পাঠাবে। তারপর রুমে ঢুকে বলল, মিটিং এর পরে তোর কাছে যাব ভেবেছিলাম, অফিসের দু’জন সঙ্গে ছিল তাই যেতে পারিনি।
আসমা বলল, আমি মনে করেছিলাম তুই মিটিং-এ আসিসনি। তারপর খাটের উপর পা ঝুলিয়ে দু’জনে পাশাপাশি বসল। প্রথমে আসমা বলল, তুই যে বললি, ভালো আছিস, আমিতো ভালোর কিছু দেখছি না। কত রোগা হয়ে গেছিস আয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে দেখিসনি?
রুকসানা বলল, কিছুদিন থেকে একদম খেতে পারছি না, রাত্রেও চোখে এক ফোঁটা ঘুম আসে না। আমার কথা বাদ দে। তোদের দিন কেমন কাটছে বল।
আল্লাহর রহমতে ভালই। কিন্তু তোর অবস্থা দেখে আমার কান্না পাচ্ছে। তুই যে উপকার করেছিস, আমার গায়ের চামড়া দিয়ে তোর পায়ের জুতো বানিয়ে দিলেও। সেই ঋণ শোধ হবে না। তুই-ই বল, কিভাবে আমি তোকে সাহায্য করতে পারি? বছর খানেক আগে ইকবাল ভাই যেদিন আসে, সেদিনই আমি তাকে তোর কথা মনে আছে কিনা জিজ্ঞেস করি। তারপর তখন থেকে রুকসানার চিঠি পড়া পর্যন্ত এবং চিঠি নিয়ে পরের দিন রুকসানার সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসে যা কিছু কথাবার্তা হয়েছে সবকিছু বলে বলল, তাই আজ এলাম তোর সাথে পরামর্শ করতে, কিভাবে তোদের স্বপ্ন সফল করা যায়।
সুরাইয়া করিমনকে নাস্তার কথা বলে ফিরে এসে দরজার বাইরে থেকে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। করিমন নাস্তা নিয়ে এলে তার সাথে রুমে ঢুকে আসমাকে। উদ্দেশ্য করে বলল, আগে নাস্তা খেয়ে নিন, তারপর স্বপ্ন সফল করার পরামর্শে আমিও অংশগ্রহণ করব।
করিমন টেবিলের উপর নাস্তা রেখে জগ থেকে দু’টো গ্লাসে পানি ঢেলে রেখে চলে গেল।
সুরাইয়া ভাবির কথা শুনে আসমা রুকসানার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।
করিমন চলে যেতে রুকসানা তাকে বলল, সুরাইয়া ছাড়া এ বাড়ির আর কেউ এসব কথা জানে না। নে নাস্তা খা। তারপর সুরাইয়াকে বলল, তুমিও বস।
নাস্তা খাওয়ার পর করিমন তিন কাপ চা দিয়ে গেল।
চা খাওয়ার সময় সুরাইয়া রুকসানার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি। তারপর আসমার দিকে তাকিয়ে বলল, একটু আগে আমরা ঐ ব্যাপারে কথা বলছিলাম। আপনি এসে ভালই হল। তিনজনে পরামর্শ করে ওদের দুজনের স্বপ্ন। সফল করার উপায় বার করব।
রুকসানা কিছু বলতে যাচ্ছিল, আসমা তাকে থামিয়ে দিয়ে সুরাইয়াকে বলল, আপনি এ বাড়ির বড় বৌ। উপায়টা আপনাকেই বার করতে হবে।
সুরাইয়া বলল, আমি ভেবেছি, প্রথমে আপনার ভাইকে ওদের দুজনের সম্পর্কের কথা বলে রাজি করাব। তারপর দুজনে মিলে আব্বা-আম্মাকে জানিয়ে রাজি করাবার চেষ্টা করব।
এবার সুরাইয়া বাধা দেওয়া সত্ত্বেও রুকসানা বলল, তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? এসর কথা…..।
আসমা তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, তুই চুপ কর। সুরাইয়া ভাবি ঠিক কথা বলেছেন। ওদের আগে আজই আমি চাচি আম্মা ও চাচাকে সবকিছু বলে রাজি করাব। সেই জন্যে তো এলাম। হোসেন ভাইও অনেক নিষেধ করে আমাকে ভয় দেখিয়েছে। তার নিষেধ না শুনে এসেছি, তোর নিষেধও শুনব না।
রুকসানা ফুঁপিয়ে উঠে বলল, তোরা যদি আব্বা-আম্মাকে কিছু বলিস, তাহলে। কাল সকালে আমার মরা মুখ দেখবি।
সুরাইয়া চমকে উঠে বলল, তুমি ধার্মিক মেয়ে হয়ে এমন কথা বলতে পারলে বড় আপা?
আসমাও চমকে উঠেছিল। সুরাইয়া থেমে বলল, সই, তুই আমাকে এত কঠিন কথা শোনাতে পারলি? তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, জানিস না, একথা মুখে উচ্চারণ করাও গোনাহ? তারপর সামলে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, আজ আমি কিছু বলব না; কিন্তু দু’একদিনের মধ্যে আব্বাকে পাঠাব। সে নিশ্চয় চাচাকে রাজি করাতে পারবে। তারপর সুরাইয়াকে বলল, আপনি এখন কিছু করতে যাবেন না। আব্বা এসে যদি রাজি করাতে না পারে, তখন আমি আপনার সঙ্গে পরামর্শ করে যা করার করব।
সুরাইয়া বলল, বেশ তাই হবে।
এমন সময় করিমন এসে নাস্তার প্লেট ও চায়ের কাপ নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় সুরাইয়াকে বলল, আপনাকে আম্মা ডাকছেন।
সুরাইয়া বলল, তুমি যাও, আমি আসছি।
রুকসানা ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। বলল, তোদেরকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, এই ব্যাপার নিয়ে কোনো কিছু করিসনি। আব্বা এমনিই স্ট্রোক করে কত বছর পঙ্গু হয়ে আছে। এসব কথা শুনলে হয়তো হার্টফেল করবে। তাই তোদের কাছে হাত জোড় করে বলছি, আমাকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দে। ভাগ্যে যা আছে, তা তো তোরা বদলাতে পারবি না।
রুকসানার কথা শুনে সুরাইয়া ও আসমা আর কোনো কথা বলতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সুরাইয়া বলল, আমি যাই আম্মা ডাকছেন।
সুরাইয়া চলে যাওয়ার পর আসমা ভিজে গলায় বলল, তোর শত নিষেধ মানতাম না, শুধু চাচার কথা চিন্তা করে আজ চলে যাচ্ছি। তবে শুনে রাখ, ভাগ্যে যা থাকে তা নিশ্চয় হবেই, তবু মানুষকে চেষ্টা করতে আল্লাহ বলেছেন। তাই আমি আমার প্রাণের বিনিময়ে হলেও চেষ্টা চালিয়ে যাব। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তুই আমার মুখ বন্ধ করে দিলি এটাই আমার দুঃখ।
রুকসানার চোখেও পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, দুঃখ কেন দিলাম বুঝলি না? তুই-ই বল না, আমি চৌধুরী বংশের বড় মেয়ে। গ্রামের ছোট বড় সবাই আমাকে শ্ৰেণীমতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে। ছোট ভাইবোনেরা আমাকে সম্মান করে এবং আব্বা আম্মা কত স্নেহ করে, কত বিশ্বাস করে। স্বপ্ন সার্থক করতে গেলে তাদের কাছে কত ছোট হয়ে যাব চিন্তা করে দেখ। তাছাড়া চৌধুরী বংশের যে গৌরব রয়েছে তা ধূলায় মিশে যাবে। সবকিছু চিন্তা করে আমি নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। তোরাও তাই কর। তারপর নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে আসমার চোখ মুখ মুছে দেওয়ার সময় বলল, থাকতে যখন পারবি না তখন আর দেরি করিসনি। যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। চল সয়ার সঙ্গে দেখা করি।
আসমা চাচা-চাচির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুকসানার সঙ্গে নিচে এল।
বিয়ের পর দাইহান যখন আসমাকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে প্রথম আসে তখন রুকসানাকে সবাই বড় আপা বলতে শুনে সেও তাকে বড় আপা বলে সম্বোধন করে ছিল। শুনে রুকসানা বলেছিল, দাইহান ভাই, তুমি আমার থেকে বড় ও আমার সইয়ের স্বামী। আমাকে তুমি বড় আপা বলছ কেন? নাম ধরে ডাকবে। দাইহান বলেছিল তুমি বয়সে ছোট হলেও সব দিক থেকে আমার থেকে অনেক বড়। তাই তোমাকে বড় আপাই বলব।
দাইহান স্ত্রীর অপেক্ষায় বসেছিল। আসমার সঙ্গে এসে রুকসানা সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ দাইহান ভাই?
দাইহান বলল, ভালো আছি বড় আপা, কিন্তু তুমি তো দেখছি একদম শুকিয়ে গেছ।
রুকসানা মৃদু হেসে বলল, মানুষ সব সময় কি একরকম থাকে? কোলের বাচ্চাকে রেখে না এলে আজ তোমাদেরকে যেতে দিতাম না। বেশি বেলাও নেই, তাই দেরি করাব না। আবার যখন আসবে তখন বাচ্চাকে নিয়ে আসবে।
ফেরার পথে রুকসানার সঙ্গে যা কিছু আলাপ হয়েছে আসমা স্বামীকে বলল।
দাইহান বলল, আমরা যে এখানে এসেছি হোসেন জানে না। তাই বলছিলাম, এসব কথা তাকে এখন জানাবার দরকার নেই।
আসমা বলল, আমিও তাই ভেবেছি। এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে অন্য কোনো উপায় আছে কিনা।
দাইহান বলল, তাতো করতেই হবে।
.
রুকসানা মরামুখ দেখার ভয় দেখিয়ে নিষেধ করা সত্ত্বেও সুরাইয়া একদিন স্বামী, দুই দেবর ও দুই জাকে নিয়ে বৈঠক করল।
সবাই আসার পর বলল, আব্বা অসুস্থ। আম্মা তাকে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। এ সংসারে সমস্ত দায়-দায়িত্ব বড় আপার উপর। তার পরেও সে সমাজ কল্যাণের কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের কি উচিত না, তার ভাল মন্দের দিকে লক্ষ্য রাখা?
বড় আব্দুর রশিদ বলল, নিশ্চয় উচিত।
তাহলে সে যে দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে, কই তোমরা তো কোনো লক্ষ্য করনি?
ছোট আব্দুল করিম বলল, আমরা আর কতক্ষণ ঘরে থাকি। খাওয়ার সময় ছাড়া বড় আপার সঙ্গে তেমন দেখা হয় না। এ বাড়ির বড় বৌ হিসাবে সকলের দিকে তোমারই তো লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব। তুমি বললে আমরা ডাক্তার নিয়ে আসব।
মেজ আব্দুস সামাদ বলল, করিম ঠিক কথা বলেছে।
সুরাইয়া বলল, তাই যদি হয়, তাহলে বড় আপার অসুখের ও তার চিকিৎসা করার ব্যাপারে যা বলব, তা মেনে নেবে তো?
আব্দুর রশিদ বলল, অসুখ হলে চিকিৎসা করাবে এতে মানা না মানার প্রশ্ন তুলছ কেন?
সুরাইয়া বলল, প্রশ্ন আছে বলেই তুলেছি।
মেজ জা আরেফা বড় আপার রোগ অনুমান করতে পেরে বলল, বড় আপাকে সুস্থ করার জন্য যে চিকিৎসার দরকার তা করাতে আমাদের কারো আপত্তি থাকা উচিত নয়। তুমি কিভাবে চিকিৎসা করাতে চাও বল বুবু।
মেজ আব্দুল করিম বলল, আরেফা ঠিক কথা বলেছে। তুমি বল।
সুরাইয়া বলল, আমরা সবাই মনে করতাম বড় আপার চোখ খুব বড় বড় বলে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়। আসল ঘটনা হল, বড় আপা ছোটবেলা থেকে একটা ছেলেকে ভালবাসে। ছেলেটা খুব ছোট ঘরের। কিন্তু প্রতিভা ও অধ্যাবসায়ের দ্বারা সে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে এবং বিদেশে চাকরি করে প্রচুর টাকা পয়সা উপার্জন করে ফিরে এসেছে। এখন সে প্রতিষ্ঠিত ও সুনামের অধিকারী। দীর্ঘ একুশ বাইশ বছর ছেলেটার সঙ্গে বড় আপার যোগাযোগ না থাকলেও তার প্রতীক্ষায় ছিল। তাই বিয়ে করতে রাজি হয়নি। আর ছেলেটাও ছোটবেলা থেকে বড় আপাকে ভালবাসে। তাই আজও সে বিয়ে করেনি। এখন সে প্রতিষ্ঠিত হলেও ছোট ঘরের ছেলে বলে বড় আপার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি এবং বিয়ের প্রস্তাব দিতেও সাহস করেনি। কিছুদিন আগে দৈব দুর্ঘটনার মধ্যে ছেলেটার সঙ্গে বড় আপার দেখা। প্রথমে বড় আপা তাকে চিনতে না পারলেও পরে আলাপের মাধ্যমে চিনতে পারে এবং জানতে পারে ছেলেটাও তার প্রতিক্ষায় আজও বিয়ে করেনি। নিজের ও তোমাদের মান সম্মান ও বংশ মর্যাদার কথা চিন্তা করে বড় আপা মনের কথা কাউকে প্রকাশ করতে না পেরে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। তাই দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, কথাটা আমি অনেক চেষ্টা করে জেনেছি। বড় আপাকে কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে হলে তোমাদের বংশের মান সম্মানের দিকে না তাকিয়ে সেই ছেলের সঙ্গে বড় আপার বিয়ে দিতে হবে। এখন সবাই চিন্তা করে বল, কি করবে। আমার মতামত আগেই বলছি, বড় আপাকে সুস্থ ও সুখী করার জন্য এই কাজ করতে আমি রাজি।
অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।
সুরইয়া বলল, কি হল? তোমরা কিছু বলছ না কেন?
বড় আব্দুর রশিদ গম্ভীর স্বরে বলল, ছেলেটার পরিচয় নিশ্চয় তুমি জান?
হ্যাঁ জানি।
তাহলে বলছ না কেন?
ইকবাল ওরফে হোসেন স্যার।
নাম শুনে সবাই চমকে উঠলেও কেউ কিছু বলল না।
সুরাইয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল নাম শুনে সবাই বোবা হয়ে গেলে নাকি? শোন, কথাটা জানার পর আমি যখন বললাম, তোমার ভাইকে জানিয়ে আমি আব্বাকে আম্মাকে রাজি করাব তখন বড় আপা বলল, যেদিন জানাবে তার পরের দিন আমার মরা মুখ দেখবে। তবু আমি তোমাদেরকে জানালাম। তোমাদের সবাইয়ের কাছে আমার মিনতি তোমরা যদি হোসেন স্যারকে এ বাড়ির জামাই করতে না চাও, তাহলে এমন কিছু করো না যার ফলে আপা যেন বুঝে না ফেলে যে, তোমরা তার ব্যাপারটা জেনে গেছ।
সব ভাই শিক্ষিত, তাদের বৌ-রাও শিক্ষিত। তারাও হোসেন স্যারের পরিচয়। জেনেছে। ছোট বৌ মমতাজ অন্য দুজনের চেয়ে বেশি শিক্ষিত। সে ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে। সেই প্রথম বলল, বংশ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা মোটেই ঠিক নয়। উচ্চ বংশের ছেলেরা চরিত্রহীন হলে যেমন বংশের দুর্নাম হয়, নিচ বংশের ছেলেরা চরিত্রবান হলে তেমনি বংশের সুনাম হয়। কোনো এক মনীষী বলেছেন “জন্ম হউক যথা তথা-কর্ম হউক ভালো।” ইকবালের সম্পর্কে যতটুকু শুনেছি তার বাপ দাদা গরিব ছিল। তাই আমাদের বাগানের দারোয়ান ছিল। কিন্তু তারা কোনোদিন এতটুকু অন্যায় করেনি। বরং তারা ভালো লোক ছিল বলে তাদেরকে আমাদের মুরুব্বিরা ভালো চোখে দেখতেন। তারা ভালো ছিল, তাই তাদের বংশে ইকবালের মতো ভালো ছেলে জন্মেছে। আমি বড় বুবুর সঙ্গে একমত।
মেজ বৌ আরেফা বলল, আমিও বড় বুবু ও ছোটর সঙ্গে একমত।
বড় আব্দুর রশিদ প্রথমে রেগে গেলেও তিন জায়ের কথা শুনে রাগ পুড়ে গেছে। ছোট দু’ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা কি বল?
তাদেরও বড় ভাইয়ের মতো অবস্থা। প্রথমে মেজ আব্দুস সামাদ বলল, বড় আপার ভালোর জন্য আমি সব কিছুতে রাজি।
ছোট আব্দুল করিম বলল, মেজ ভাই যা বলল, আমিও তাই বলব। তবে তোমার মতামতই চূড়ান্ত।
আব্দুর রশিদ বলল, তোমাদের কথাই ঠিক। সব কিছুর বিনিময়ে হলেও বড় আপাকে মানষীক কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু আম্মা আব্ব কিছুতেই রাজি হবেন না। তাদেরকে নিয়েই সমস্যা। আর আব্বার যে অবস্থা, শুনে যদি উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তাহলে হার্ট এ্যাটাক করতে পারে।
ছোট আব্দুল করিম সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, আব্বা আমাদের সবার চেয়ে বড় আপাকে বেশি ভালবাসলেও তোমার স্থান তার পরেই। তুমিই কথাটা আব্বাকে। জানাও। আব্বা যদি আমাদেরকে ডেকে কিছু বলেন, তখন আমরা আমাদের মতামত জানাব।
সুরাইয়া বলল, বেশ আজ রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর আমি আব্বাকে জানাব। তোমরা আমার ঘরে থাকবে।
খাওয়া দাওয়ার পর রুকসানা আব্বাকে ওষুধ খাইয়ে চলে যাওয়ার পর আজিজা বেগম স্বামীর পায়ে হাতে সর্ষের তেল মালিশ করছিলেন। বড় বৌকে আসতে দেখে বললেন, কিছু বলবে মা?
জ্বি বলব বলে সুরাইয়া ভয় পেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
আজিজা বেগম বললেন, বল মা কি বলবে?
সুরাইয়া সাহস করে বলল, আমি বড় আপার বিয়ের ব্যাপারে দু’একটা কথা বলতে চাই।
বি.এ পাশ করার পর থেকে যে মেয়ে কত ভালো ভালো পাত্র ফিরিয়ে দিয়েছে, সেই মেয়ের বিয়ের কথা বড় বৌকে বলতে শুনে আব্দুল মতিন ও আজিজা বেগম যেমন খুব অবাক হলেন তেমনি আনন্দিতও হলেন। স্ত্রী কিছু বলার আগে আব্দুল মতিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যে কথা বলতে এসেছ রুকসানা জানে?
জ্বি না আব্বা। বড় আপা কেন বিয়ে করতে চায় না, আমি তা জানতে পেরে আপনাদেরকে বলতে এসেছি।
বেশ কি জেনেছ বল।
বড় আপা দক্ষিণ ফুকরার মরহুম কাজেম সেখের ছেলে ইকবালকে বলে চুপ করে গেল। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এল। তাই কথাটা শেষ করতে পারল না।
ইকবালের নাম শুনে আব্দুল মতিন খুব রেগে গিয়ে ধমকের সুরে বললেন, থামলে কেন? ইকবাল কি?
সুরাইয়া আরো বেশি ভয় পেয়ে ঢোক গিলে কাঁপাস্বরে বলল, তাকে ছোটবেলা থেকে বড় আপা ভালবাসে। আর ইকবালও বড় আপাকে ভালবাসে। তাই বড় আপা যেমন বিয়ে করতে চায় না, তেমনি ইকবালও বিয়ে করেনি।
বিনা মেঘে ঘরে বাজ পড়লেও বোধ হয় আব্দুল মতিন অতটা চমকে উঠতেন না। ভীষণ চমকে উঠে নির্বাক দৃষ্টিতে সুরাইয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাগে ফুলতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, কথাটা কার কাছে জেনেছ? রুকসানা তোমাকে বলেছে?
শ্বশুরের অবস্থা দেখে সুরাইয়া খুব ভয় পেলেও বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল, না আব্বা। একদিন অনেক রাত্রে বড় আপার ঘরে আলো জ্বলতে দেখে ভাবলাম, বড় আপাতো প্রতিদিন এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। আজ এত রাতে কেন জেগে আছে জানার জন্য জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম, ডাইরীতে কি যেন লিখছে। পরের দিন সেকথা। মনে পড়তে বড় আপা কারখানায় চলে যাওয়ার পর কৌতূহলবশতঃ তার ঘরে গিয়ে ডাইরিটা বালিশের তলায় পাই। তারপর সেটা পড়ে জানতে পারি। পরে একসময় তাকে ডাইরি পড়ার কথা বলি। শুনে বড় আপা খুব রেগে যায়। আমি তার কাছে মাফ চাইতে বলল, ডাইরি পড়ে যা কিছু জেনেছ, তা যদি আমার জীবিতকাল পর্যন্ত গোপন রাখার ওয়াদা কর, তাহলে মাফ পাবে। আর যদি ওয়াদা খেলাপ কর, তাহলে পরের দিন আমার লাশ দেখবে।
আব্দুল মতিন আরো গম্ভীর স্বরে বললেন, ওয়াদা খেলাপের পরিণতি জেনেও ওয়াদা খেলাপ করলে কেন? তা ছাড়া তুমি কী জান না, ওয়াদা খেলাপ অতি জঘন্য অপরাধ?
জানি আব্বা।
আব্দুল মতিন গর্জন করে উঠলেন, তবু খেলাপ করলে কেন?
সুরাইয়া শ্বশুরের ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলল, ফেঁপাতে ফেঁপাতে বলল, ইকবাল হোসেন স্যার হিসাবে যখন এসেছিল তখন থেকে বড় আপার পরিবর্তন লক্ষ্য করি। খুব কম খাওয়া দাওয়া করে। আমাদের সঙ্গে আগের মতো কথাও বলে না। ইদানিং বড় আপা সারারাত জেগে নামায পড়ে, কুরআন পড়ে, ডাইরি লেখে। দিন দিন খুব। রোগা হয়ে যাচ্ছে। আমার কেবলই মনে হয়, বড় আপা অল্প দিনের মধ্যে কঠিন
অসুখে পড়বে। তাই আমি ভয় পেয়ে–।
আব্দুল মতিন আবার ধমক দিয়ে গর্জে বললেন, তুমি এ বাড়ির বৌ হয়ে মাত্র কয়েক বছর এসেছ। আমাদের বংশের মান ইজ্জত কত, তা এখনো জাননি। তোমার সাহস দেখে আমি খুব অবাক হচ্ছি। একটা কথা জেনে রেখ, বংশের মান ইজ্জৎ রক্ষার জন্য শুধু একটা রুকসানাকে নয়, দশটা রুকসানা থাকলেও সবাইকে দু’টুকরো করে উঠোনে পুঁতে ফেলতাম। আর একটা কথা, তুমি কি এই ব্যাপারটা কাউকে জানিয়েছ?
শ্বশুরের কথা শুনে সুরাইয়া ভয় পেয়ে কাঁপছিল। তাই আপনা থেকে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, জি না আব্বা, কাউকেই বলিনি।
আব্দুল মতিন কর্কশ স্বরে বললেন, জীবনে কোনোদিন কাউকেই বলবে না। আর তুমি রুকসানার ডাইরি পড়ে যা জেনেছ, তা ভুলে যাও। সাবধান করে দিচ্ছি, এর পরও যদি কোনো কিছু কানে আসে, তাহলে এ বাড়িতে তোমার স্থান হবে না। যাও, এবার তুমি যেতে পার।
সুরাইয়া চোখ মুছতে মুছতে ফিরে এসে সবাইকে শ্বশুর যা কিছু বলেছেন বলে বলল, তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই লাগে, এসব কথা নিয়ে আর কোনোদিন কানাকানি কর না। কিছুদিন চুপচাপ থাক, আব্বার রাগ পড়লে উনি হয়তো তোমাদেরকে ডাকতে পারেন। তখন যা বলার বলো।
রুকসানা আব্বার রুম থেকে এসে বাথ রুমে গিয়েছিল। ফেরার সময় সুরাইয়াকে আব্বার রুমে যেতে দেখে সন্দেহ হল। দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমে সুরাইয়ার কথা শুনে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। তারপর আব্বার কথা শুনে মনে হল, জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কোনো রকমে টলতে টলতে এসে বিছানায় শুয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। অনেকক্ষণ কাদার পর হঠাৎ তার মন বলে উঠল, কাল সকালে মা বাপের কাছে মুখ দেখাবে কী করে? তার চেয়ে মরণ ভালো। ইকবালকে পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। তাকে জীবনেও পাবে না। বেঁচে থেকে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। তোমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। বেঁচে থাকলে তোমার আব্বা হয়তো ইকবালকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে। তাই আজ রাতেই তুমি গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাও। রুকসানা উদভ্রান্তের মতো ঘরময় পায়চারী করতে লাগল। হঠাৎ আবার কে যেন তার মনের ভিতর থেকে বলে উঠল, তুমি না ধার্মিক মেয়ে, তুমি কি জান না, আত্মহত্যা করা মহাপাপ? আত্মহত্যাকারী চিরকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে?
এবার রুকসানা খুব ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় পড়ে গেল।
রুকসানা প্রতিদিন সকালে ফজরের আজানের সময় উঠে সবাইয়ের দরজা নক করে জাগিয়ে বলে, ফজরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে নামায পড়।
আজিজা বেগম অবশ্য আযানের সাথে সাথে উঠে প্রথমে স্বামীকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যান। বাথরুমের কাজ শেষ হলে বাইরে এনে অজু করিয়ে ঘরে এনে মসল্লা বিছিয়ে বসিয়ে দেন। আব্দুল মতিন বসে নামায পড়েন। স্বামীকে মসল্লায় বসিয়ে নিজে অজু করে এসে নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করেন। আজও সময় মতো উঠে নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হল, আজ রুকসানার গলা পেলাম না কেন? তাহলে কি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি? কুরআন বন্ধ করে রুকসানার রুমের দিকে যাওয়ার সময় ভেন্টিলেটরের দিকে লক্ষ্য পড়তে বুঝতে পারলেন, রুমে আলো জ্বলছে। ভাবলেন, ঘুমোবার সময় হয়তো, আলো নেভাতে ভুলে গেছে। কাছে এসে তাকে জাগাবার জন্য দরজা নক করতে যেতে দরজা খুলে গেল। ভিতরে তাকাতে দেখতে পেলেন, আলুথালু বেশে রুকসানা ঘরের মেঝেয় শুয়ে আছে। আতঙ্কিত হয়ে তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে গায়ে হাত রেখে নাড়া দিয়ে বললেন, এই রুকসানা, মেঝেয় শুয়ে আছিস কেন? কয়েকবার নাড়া দিয়ে ডেকে সাড়া না পেয়ে মুখে হাত দিয়ে জানতে পারলেন, অজ্ঞান হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি জগ থেকে হাতে পানি নিয়ে মুখে ঝাঁপটা দিয়ে নাম ধরে কয়েকবার ডাকলেন। কাজ না হতে আব্দুর রশিদ ও সুরাইয়াকে তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়ে এলেন।
তারা এসে রুকসানাকে খাটে শুইয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগল।
আজিজা বেগম অন্য দু’ছেলে ও বৌকে ঘটনা জানিয়ে যেতে বলে স্বামীর কাছে এলেন।
আব্দুল মতিন বললেন, কি ব্যাপার? কুরআন পড়া বন্ধ করে এদিক ওদিক করছ কেন?
আজিজা বেগম রুকসানার কথা বলে স্বামীকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে এলেন।
সবকিছু দেখে শুনে আব্দুল মতিনের সন্দেহ হল। ভাবলেন, তাহলে কী রুকসনা আমার ও বৌমার কথা শুনে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় পড়েছিল?
বেশ কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর রুকসানার জ্ঞান ফিরল। সুরাইয়া পানি ঢালা বন্ধ করে ঝাড়ন দিয়ে মাথার চুল মুছে দিল।
আব্দুল মতিন জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছিল মা? মেঝেয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলি কেন?
রুকসানা উঠে বসে প্রথমে পরিস্থিতি উপলব্ধি করল। তারপর বলল, এক ঘুমের পর বাথরুমে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাই। তারপর। আর কিছু মনে নেই।
আজিজা বেগম বললেন, ফজরের নামায পড়ে তোর সাড়া না পেয়ে এসে দেখি তুই মেঝেয় পড়ে আছিস। তারপর যা কিছু হয়েছে বললেন।
সুরাইয়া ঘড়ি দেখে বলল, তোমরা সব যাও, আমি এখন ফজরের কাযা নামায পড়ব।
সেখান থেকে এসে সুরাইয়া স্বামী, দেবর ও জায়েদেরকে বলল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বড় আপা আমার ও আব্বার কথা-বার্তা শুনে রুমে এসে অজ্ঞান হয়ে সারারাত মেঝেয় পড়েছিল।
আব্দুর রসিদ বলল, আমারও তাই মনে হয়। তারপর বলল, এবার তোমরা সব যাও, অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের এখন কিছু করার নেই।
এরপর থেকে যতদিন যেতে লাগল, রুকসানা তত শুকিয়ে যেতে লাগল। মাস খানেকের মধ্যে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। আব্দুর মতিন মেয়ের পরিণতির কথা বুঝতে পেরেও এতটুকু নরম হলেন না। ছেলেদেরকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালের একজন বড় ডাক্তারকে নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতে বললেন।
৯
হাসপাতালের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর নির্দিষ্ট তারিখে স্বাস্থ্য মন্ত্রী আসতে পারবেন কিনা জানার জন্য হোসেন ঢাকায় খালেক চাচার বাড়িতে এসে উঠল। সবার সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, আল্লাহর রহমতে ও আপনাদের দোয়ার বরকতে হাসপাতালের কাজ শেষ হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করাবার জন্য ওঁকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে এসেছি।
খালেক বলল, শুনে খুব খুশী হলাম। দোয়া করি, “আল্লাহ তোমার সব নেক মকসুদ পূরণ করুক, তোমাকে সুখী করুক, তোমার হায়াত দারাজ করুক।” তারপর স্ত্রীকে বলল, ইকবালকে নাস্তা দাও।
মালেকা কয়েকদিনের ছুটিতে গতকাল বাড়িতে এসেছে। সে তখন বাড়িতে ছিল না। কিছু কেনা-কাটা করতে মার্কেটে গিয়েছিল। হোসেন আসার কিছুক্ষণ পর ফিরল।
মেয়েকে ফিরতে দেখে খালেক বলল, ইকবাল এসেছে। তারপর কেন এসেছে। বলল।
মালেকা বলল, স্যার কোথায়?
খালেক বলল, গেষ্ট রুমে তার থাকার ব্যবস্থা করেছি। সেখানে নাস্তা খাচ্ছে।
মালেকা উপরে গিয়ে মার্কেটিং জিনিসগুলো রেখে বোরখা খুলে কাপড় পাল্টাল। তারপর মুখে হাতে পানি দিয়ে ওড়না জড়িয়ে যখন গেষ্টরুমে এল তখন ইকবাল নাস্তা খেয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল।
মালেকা সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন স্যার?
আজ প্রায় এগার বছরের বেশি হয়ে গেছে মালেকার সঙ্গে হোসেনের যোগাযোগ নেই। তার কথা যে মনে পড়ে না তা নয়। তাকে ভালবেসে মালেকা বিয়ে করেনি মনে পড়লে বেশ কষ্ট অনুভব করে। ভাবে রুকসানাকে যদি ভুলতে পারত, তাহলে মালেকাকে গ্রহণ করত।
এত বছর পর আজ তার কণ্ঠস্বর শুনে হোসেন চমকে উঠল। সামলে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে মৃদু হেসে বলল, এখনো স্যার বলে সম্বোধন করবে?
তা হলে কি বলে করব?
কেন? ইকবাল ভাই বলবে।
তা আমার পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। কেন?
যাকে ছোটবেলা থেকে স্যার বলে এসেছি, তার নামের সঙ্গে ভাই বলা আর কারো পক্ষে সম্ভব হলেও আমার পক্ষে নয়। তা কেমন আছেন বললেন না যে?
বস না, দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসার পর বলল, আল্লাহ এক রকম ভালই রেখেছেন। তুমি কেমন আছ বল?
আমাকেও আল্লাহ একরকম ভাল রেখেছেন। শুনলাম, হাসপাতাল করেছেন। হাসপাতাল উদ্বোধন করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে এসেছেন?
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। তারপর বলল, তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য একবার ফরিদপুর গিয়েছিলাম, চাচার কাছে নিশ্চয় শুনেছ?
হ্যাঁ শুনেছি।
অধ্যাপনা কেমন লাগছে।
মন্দ না; তবে বলে থেমে গেল।
থামলে কেন বল?
না থাক।
ঠিক আছে, বলতে অসুবিধা থাকলে বলার দরকার নেই। একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবে না তো?
আপনি আমার স্যার, নিশ্চয় মনে করার মতো কিছু বলবেন না। বলুন কি বলবেন।
তুমি একজন ধার্মিক ও শিক্ষিতা মেয়ে হয়ে মা-বাবার মনে অশান্তি দেওয়া কী ঠিক হচ্ছে?
মালেকা ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে অবাক কণ্ঠে বলল, আমি আবার তাদের মনে কি অশান্তি দিচ্ছি?
আমার তো মনে হচ্ছে, কথাটা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করছ। তবু বলছি, প্রত্যেক মা-বাবা মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে চান। তুমি বিয়ে করতে রাজি না হয়ে তাদেরকে অশান্তি দিচ্ছ না কী?
আপনার কথা অবশ্য ঠিক। তবে আমারও মনে হচ্ছে, বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ বুবতে পেরেও না বোঝার ভান করছেন। তবু বলছি, রাজি না হওয়ার কারণ একমাত্র আল্লাহপাক জানেন। আমার কথা থাক, এবার আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করব। অবশ্য ছাত্রী হয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করা বেয়াদবি হবে। তাই অনুমতি চাচ্ছি।
অনুমতি দিলাম।
হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “বিবাহ করা আমার সুন্নত যে ইহাকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করিবে, সে আমার দলভুক্ত নহে।” [বেহেশতী জেওর ৪র্থ খণ্ড- ৬৫ পৃষ্ঠা]
হাদিসে আরো আছে, “বিবাহ করা ইন্দ্রিয়ের আধিক্যে ফরয, ওয়াজীব ও সুন্নত। হইয়া থাকে।” [বেহেশতী জেওর ৪র্থ খণ্ড- ৬৫ পৃষ্ঠা]
এই হাদিসগুলো আপনিও নিশ্চয় জানেন। তবু কেন বিয়ে করছেন না?
হ্যাঁ জানি। আর তাই বিয়ে করব না, এরকম সিদ্ধান্ত নিইনি। এবার আমিও যদি ঐ হাদিসগুলোর রেফারেন্স টেনে তোমাকে জিজ্ঞেস করি?
উত্তরে আপনার কথাটাই বলব। তারপর বলল, এতদিনে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমার অনুমান সত্য।
তা হলে এবার মা-বাবার ইচ্ছা নিশ্চয় পূরণ করবে?
সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব, যদি অনুমতি দেন।
বল, কি জানতে চাও।
কে সেই ভাগ্যবতী? যার প্রতীক্ষায় এত বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন?
তার কথা বলতে পারব না। তাকে সারা জীবনে পাব কিনা তাও জানি না। এ পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নেই। মা-বাবাকে হারাব বলে হয়তো আল্লাহ আমাকে তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তোমাদেরকেই আপন বলে জানি। তাই তোমাদের কারো দুঃখ দেখলে আমিও দুঃখ পাই। তুমি বিয়ে করে সংসার করছ শুনলে, চাচা-চাচির চেয়ে আমিও কম শান্তি পাব না।
স্বার্থপরের মতো আপনি শুধু নিজের শান্তির কথা বলছেন, কিন্তু কখনও কী ভেবেছেন, যার জন্য আপনি দুঃখ পাচ্ছেন সেও আপনার জন্য দুঃখ পাচ্ছে? তারপর কান্না সামলাতে না পেরে মালেকা সেখান থেকে চলে গেল। হোসেন চিন্তা করল জেনেশুনে প্রসঙ্গটা তোলা খুব ভুল হয়েছে।
ঢাকায় দু’তিন দিন থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রী নির্দিষ্ট দিনে আসবেন সিওর হয়ে আজ দশ দিন হল হোসেন ফিরে এসেছে। আসার সময় চাচা-চাচিকে সে কথা জানিয়ে উদ্বোধনের চার পাঁচ দিন আগে সবাইকে নিয়ে আসতে বলে এসেছে। এক ফাঁকে মালেকাকেও বলেছে, তুমি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আসবে। মালেকা হা-না কিছু না বলে তার কাছে থেকে চলে গেছে।
গ্রামে ফিরে হোসেন তাদের আসার কথা বলে দাইহানকে একটা ঘর বানাবার দায়িত্ব দিয়েছিল। দাইহান এক সপ্তাহের মধ্যে ঘরটা কমপ্লিট করে বলল, এবার তো ঘরের আসবাবপত্র লাগবে। হোসেন তাকে কিছু টাকা দিয়ে বুলল, যা কিছু দরকার তুমিই ব্যবস্থা কর।
এর মধ্যে একদিন আসমা হোসেনকে জিজ্ঞেস করল, রুকসানার খোঁজ খবর রাখ?
হোসেন বলল, কয়েকদিন আগে স্কুলে মনিরার কাছে শুনেছি, বেশ কিছুদিন থেকে রুকসানা অসুস্থ। শোনার পর দেখতে যাব মনে করেছিলাম, চৌধুরী সাহেবের কথা। চিন্তা করে যাইনি। মনিরাও এই কয়েকদিন স্কুলে আসছে না। তাই কিছু বলতে পারছি না।
আসমা বলল, আমি তোমার ভাইকে নিয়ে কাল একবার যাব ভাবছি।
তাই যাও। দেখে এসে জানাবে কেমন আছে। এদিকে হাসপাতাল উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। খুব ব্যস্ত রয়েছি।
ঢাকা থেকে কারা যেন আসবেন বলেছিলে, কই তারা তো এলেন না?
দু’এক দিনের মধ্যে আসতে পারে।
আসমা রাত্রে স্বামীকে রুকসানার অসুখের কথা জানিয়ে বলল, কাল দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর তাকে দেখতে যাব। তুমি মাঠ থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে।
পরের দিন হোসেন স্কুলে যাওয়ার সময় ভাবল, আজ যদি মনিরা আসে, রুকসানার খবর জানা যাবে। স্কুলে পৌঁছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, সে আসেনি। মনিরা না আসার কারণ ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, রুকসনার অসুখ বাড়বাড়ি হয়নি তো? তারপর আজ আসমার যাওয়ার কথা মনে পড়তে ভাবল, সে ফিরে এলে জানা যাবে।
বেলা তিনটের দিকে আসমা ও দাইহান যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে এমন সময় লম্বা কোর্তাপরা একজন টুপি দাড়িওয়ালা লোকের সঙ্গে দু’জন বোরখাপরা মেয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।
দাইহান বলল, লোকটাকে অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে, ঢাকা থেকে যাদের আসার কথা হোসেন বলেছিল, এরা তারাই।
আসমা বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক।
খালেক স্ত্রীকে নিয়ে পরশু ফরিদপুরে এসে মেয়ের কাছে ছিল। মালেকা কাল কলেজে গিয়ে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আজ সকালে মা বাবাকে নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে। বাস থেকে নেমে রিকশা নিয়ে দক্ষিণ ফুকরা গ্রামে এসে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে হেঁটে আসছিল। আসমা ও দাইহানকে তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে খালেক সালাম দিল।
দাইহান সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনারা কোথায় যাবেন?
খালেক বলল, আমরা ঢাকা থেকে আসছি। মরহুম কাজেম সেখের ছেলে ইকবালের বাড়িতে যাব।
আসমা স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, আজ আর যাওয়া হবে না, কাল যাব। ইনাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
দাইহান খালেকের দিকে তাকিয়ে বলল, আসুন আমাদের সঙ্গে। তারপর যেতে যেতে বলল, ইকবাল আমার চাচাতো ভাই। তার বাড়ির পাশেই আমাদের বাড়ি। সে এখনো স্কুল থেকে ফেরেনি।
বাড়ি করে ডাক্তারী শুরু করার পর হোসেন রশিদা নামে একজন বয়স্কা বিধবা গরিব মেয়েকে ঘরের সব কাম-কাজ করার জন্যে রেখেছে। তাকে সবাই রশিচাচি বলে ডাকে। সে সারাদিন থাকে। এশার নামাযের পর হোসেনকে খাইয়ে নিজে খায়। তারপর ঘরে চলে যায়। আগে সে ভিক্ষা করে দিন গুজরান করত। আর রাজ্জাক, নামে একজন লোককে কম্পাউন্ডার রেখেছে। সে আগে হোমিও বই দেখে দেখে ডাক্তারী করত। ইকবাল তাকে বেতন দিয়ে রেখেছে।
হোসেন যে নতুন ঘর বানিয়েছে, মেহমানদেরকে সেই ঘরে নিয়ে এসে বসতে বলল। তারপর আসমা স্বামীকে বলল, রশিচাচি বোধ হয় হোসেন ভাইয়ের ঘরের মেঝেয় পাটি মেলে ঘুমাচ্ছে, তাকে ডেকে নিয়ে এস। মেহমানদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে।
দাইহান বলল, আমি রশিচাচিকে ডেকে দিয়ে ঘর থেকে একটু ঘুরে আসি।
আসমা বলল, তাই এস। তারপর মেহমানদেরকে বলল, উনি আমার স্বামী। হোসেন ভাইয়ের আব্বা আর আমার শ্বশুর চাচাতো ভাই। এই ভিটের উত্তর পাশে আমাদের বাড়ি। আপনাদের বোধহয় জোহরের নামায পড়া হয়নি। কাপড় পাল্টে নামায পড়ে নিন। অজুর ব্যবস্থা করছি।
মালেকা বোরখা খুলতে খুলতে বলল, আপনারা কোথাও যাচ্ছিলেন মনে হয়।
আসমা বলল, হ্যাঁ, এক আত্মীয়ের বাড়ি যাব বলে বেরিয়েছিলাম। আপনাদেরকে ফেলে তো আর যেতে পারি না, অন্য দিন যাব। আপনারা যে আসবেন, হোসেন ভাই আমাদের বলেছে।
মালেকা বলল, স্যার আমাদের আসার কথা বললেও পরিচয় তো জানেন না। বলছি শুনুন, আমি মালেকা। ফরিদপুর মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করি। আর ওঁরা হলেন আমার আব্বা আম্মা। আমাদের বাড়িতে থেকে স্যার লেখাপড়া করেছেন।
ততক্ষণে রশিচাচি এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখিয়ে আসমা বলল, ইনি হোসেন ভাইয়ের সংসারের সব কাজ করে। তারপর রশিচাচিকে বলল, মেহমানদের অজুর পানি দিয়ে রান্নাঘরে এস, রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে। কথা শেষ করে চলে গেল।
আসমা তাড়াতাড়ি করে আলুভাতে ডাল রান্না করল। তারপর ডিম ভাজি করে মেহমানদের খেতে দিয়ে বলল, এত অল্প সময়ে বেশি কিছু করতে পারিনি। এই দিয়েই একমুঠো খান।
খাওয়া শেষ করে মেহমানরা উঠে বসেছে। এমন সময় রহিমন এসে আসমাকে বলল, যয়নাব খুব কাঁদছে। তাকে দুধ খাইয়ে এস। আমি ততক্ষণ এখানে আছি।
আসমা রশিচাচিকে থালা-বাসন ধুতে বলে ঘরে চলে গেল।
রহিমন আলাপ পরিচয় করে বলল, হোসেনের মুখে আপনাদের কথা অনেক শুনেছি। তাই দেখতে এলাম। আপনারা ইকবালকে মানুষ না করলে আজ এতবড় হতে পারত না। এর বদলা আল্লাহ আপনাদেরকে দেবে। আজ যদি ওর মা-বাপ বেঁচে থাকত, তাহলে কতই না খুশী হত। আল্লাহ তাদের বেহেশত নসীব করুক।
ফরিদা জিজ্ঞেস করল, আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন।
রহিমন বলল, এক ছেলে তিন মেয়ে। ছেলের প্রথম স্ত্রীর একটা ছেলে রেখে মারা গেছে। সেই নাতিকে আমি মানুষ করি। এখন তার কাছেই আছি। আমার ছেলে আবার বিয়ে করেছে। তার ঘরে চার পাঁচটা ছেলে মেয়ে হয়েছে।
মালেকা বলল, আসমা আপা তা হলে আপনার নাত বৌ?
রহিমন বলল, হ্যাঁ। আসমার মতো নাতবৌ পেয়ে আল্লাহ আমাকে খুব সুখে রেখেছে।
এমন সময় আসমা ফিরে এসে বলল, দাদি আপনি এবার যান। যয়নাবকে ওর বাপের কাছে দিয়ে এসেছি। সে যেন কোথায় যাবে।
রহিমন মেহমানদের উদ্দেশ্যে বলল, এখন যাই। পরে আবার আসব।
রহিমন চলে যাওয়ার পর হোসেন স্কুল থেকে ফিরে মেহমানদের দেখে খুশী হল। সালাম ও কুশল বিনিময় করে চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কখন এলেন? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
খালেক বলল, তিনটের দিকে এসেছি। তারপর বলল, মালেকা সঙ্গে না থাকলে অসুবিধা একটু হত। আমরা পরশু মালেকার কাছে এসে ছিলাম।
স্যারকে দেখে মালেকা ওড়নাটা নাকের উপর দিয়ে মুখ ঢেকে দিল।
হোসেন আসমাকে বলল, মেহমানদের খাওয়া-দাওয়া করিয়েছ?
হ্যাঁ, ঘরে যা ছিল তাই রান্না করে খাইয়েছি। তুমি খাবে চল।
আমি এমন সময় কিছু খাই না। তোমাদের আজ বাহিরবাগ যাওয়ার কথা ছিল না?
আমরা যাওয়ার জন্য বেরিয়ে রাস্তায় এসে ওঁদের সঙ্গে দেখা। তাই আর যাওয়া হল না। ইনশাআল্লাহ কাল যাব।
দাইহান ভাই কোথায়?
মেহমানদের সঙ্গে এসেছিল। এখন ঘরে আছে। কোথায় যেন যাবে বলছিল।
তুমি গিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে এস বাজারে যাব।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর হোসেন আসমাকে বলল, মেহমানদের ঘুমাবার ব্যবস্থা করে তারপর যেও। আমি দাইহানকে নিয়ে তোমার আব্বার ওখানে যাচ্ছি। সেখানে কমিটির মেম্বাররা আসবেন। তাদেরকে নিয়ে উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করব। কথা শেষ করে দাইহানকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
হোসেনের ঘরেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তারা চলে যাওয়ার পর আসমা মেহমানদেরকে বলল, আপনারা এখানেই বসুন, আমি বিছানা করে দিয়ে আসছি।
কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, এবার আপনারা ওঘরে যান।
মালেকা আব্বা-আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা যাও, আমি আসছি। তারা যাওয়ার পর আসমাকে বলল, আপনি বসুন, কিছুক্ষণ গল্প করি।
আসমা বসে বলল, আমি গ্রামের মেয়ে কি আর গল্প করব, তার চেয়ে আপনি শহরের গল্প করুন।
গল্প করতে করতে একসময় কথা প্রসঙ্গে মালেকা বলল, স্যার আপনাকে বাহিরবাগ যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন, সেখানে ওঁর কেউ আছেন নাকি?
আসমা উত্তরটা একটু পাশ কেটে বলল, বাহিরবাগের চৌধুরীদের মেয়ে রুকসানা আমার সই। তার অসুখ। তাকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মাইণ্ড করবেন না তো?
মালেকা প্রথম থেকে আসমার কথা-বার্তা ও আচার-আচরণে বুঝতে পেরেছে সে শিক্ষিত। বলল, মাইণ্ড করার কি আছে? আপনি বলুন।
ছাত্র জীবনে না হয় হোসেন ভাইকে স্যার বলতেন, এখনও বলেন কেন?
দুঃখিত বলতে পারব না। তবে আমার মতে ছাত্র-ছাত্রীর বয়স যতই হোক না কেন, শিক্ষককে স্যার বলাই উচিত। আচ্ছা, স্যারের বয়স তো অনেক হয়েছে, বিয়ে করেন না কেন?
আসমা বুঝতে পারল, হোসেন ভাই ও রুকসানার সম্পর্কের কথা এরা জানে না। বলল, হোসেন ভাই ছোটবেলা থেকে আপনাদের কাছে অনেক বছর ছিল, আপনাদেরই তো জানার কথা।
তা অবশ্য ঠিক, স্যার আমেরিকা যাওয়ার আগে আম্মা-আব্বা বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। স্যার তখন রাজি হননি। আমেরিকা থেকে ফেরার পরও তারা বিয়ে করাতে চেয়েছিলেন। স্যার বললেন, গ্রামে থাকবেন এবং গ্রামের মেয়ে বিয়ে করবেন। প্রায় এক বছর হতে চলল গ্রামে এসেছেন। এখনও করেনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম। আর একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে, স্যারের নাম তো ইকবাল, আপনারা হোসেন বলছেন কেন?
ওর পুরো নাম ইকবাল হোসেন। এখানে হোসেন নামেই পরিচিত।
আপনারা তো স্যারের নিকট আত্মীয়, তাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কিছু বলেন নি?
আসমা গ্রামের মেয়ে। তার ধারণা নেই, শহরের শিক্ষিত মেয়েদের পঁচিশ ত্রিশ বছরের আগে বিয়ে হয় না। তাই মালেকাকে বিবাহিত মনে করে বললেন, হোসেন ভাই ঢাকায় যাওয়ার আগে কিশোর বয়সেই একটা মেয়েকে ভালবাসত। সেই মেয়েটাও হোসেন ভাইকে ভালবাসত। তার কথা আজও ভুলতে পারেনি। তাই বিয়ে করেনি।
মালেকা খুব অবাক হয়ে বলল, সে তো ছোটবেলার ঘটনা। মেয়েটি নিশ্চয় এতদিনে স্বামী ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করছে?
আপনার ধারণা ভুল। মেয়েটিও একই কারণে এখনও বিয়ে করেনি।
মালেকা আরো বেশি অবাক হয়ে বলল, তা কি করে সম্ভব। আমি যতদূর জানি, স্যার ঢাকায় যাওয়ার পর একেবারে এস.এস.সি পাশ করে চার-পাঁচ বছর পর গ্রামে মাত্র একবার এসে তিন চার দিন ছিলেন। তারপর প্রায় পনের ষোল বছর পর গ্রামে এসেছেন। এরমধ্যে মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কি করে ভাবতে খুব অবাক লাগছে।
আসমা মৃদু হেসে বলল, শুনলে আরো অবাক হবেন, হোসেন ভাই ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে তিন চার মাস আগে পর্যন্ত তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া তো দূরের কথা, চিঠি-পত্রও আদান-প্রদান হয়নি এবং দু’জনেই একে অপরকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে ভাবত।
মালেকা বলল, সত্যিই এটা একটা অকল্পনীয় ঘটনা। তারপর বলল, আপনার কথায় বোঝা যাচ্ছে, এখন দেখা-সাক্ষাৎ হয় এবং একে অপরের বিয়ে না করার কারণও নিশ্চয় জেনেছেন?
হ্যাঁ জেনেছে।
তা হলে বিয়ে করছেন না কেন?
কারণ তারা দু’জনেই জানে, বিয়ে হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কেন?
দুঃখিত, এর থেকে আর বেশি কিছু বলতে পারব না।
মালেকা খুব আশ্চর্য হয়ে আসমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, মেয়েটির বাড়ি কোথায় বলতে নিশ্চয় বাধা নেই?
না, তা নেই।
তা হলে বলুন।
এই গ্রাম থেকে প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার পূর্ব দিকে বাহিরবাগ গ্রামে।
আপনি যখন এতকিছু জানেন তখন মেয়েটির মা-বাবাকে নিশ্চয় চেনেন?
হ্যাঁ, তাদের সবাইকে চিনি।
আমরা এক সপ্তাহ থাকব। আমি মেয়েটির মা-বাবার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। তবে স্যার যেন জানতে না পারেন। আপনি কী এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন?
আসমার সন্দেহ হল। ভাবল, মালেকা এতকিছু জানতে চাচ্ছে কেন? কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, এক্ষুনি কথা দিতে পারছি না। আপনি তো কয়েকদিন থাকবেন বললেন, আমার স্বামীর সঙ্গে আলাপ করে জানাব। এবার আমি দু’একটা প্রশ্ন করব। কিছু মনে করতে পারবেন না কিন্তু।
বেশ তো কি জানতে চান বলুন।
আপনি অধ্যাপনা করেন, আপনার স্বামী কি করেন?
মালেকা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আব্বা-আম্মা বিয়ে দিতে চেয়েছেন, আমি রাজি হইনি।
আসমার সন্দেহটা বেড়ে গেল। বলল, কেন রাজি হননি বলবেন?
দুঃখিত বলতে পারব না।
যদি বলি আপনার কথা-বার্তায় বোঝা যাচ্ছে, আপনি হোসেন ভাইকে ভালবাসেন। তাই বিয়ে করেন নি; তাহলে কী অস্বীকার করবেন?
মালেকা কিছু বলতে না পেরে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আসমা বলল, কিছু বলছেন না যে?
আপনি শিক্ষিতা, জিজ্ঞেস না করে বুঝে নেওয়া উচিত ছিল।
হোসেন ভাই জানেন?
একথা তাকেই জিজ্ঞেস করবেন।
এমন সময় হোসেন এসে আসমাকে বলল, এখনো তুমি ঘরে যাওনি? দাইহান ভাই তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে। যয়নাব খুব কাঁদছে।
আসমা বলল, মালেকা আপার সঙ্গে গল্প করতে করতে দেরি হয়ে গেল। এক্ষুনি যাচ্ছি। তারপর মালেকাকে বলল, ইনশাআল্লাহ কাল দেখা হবে। কথা শেষ করে বাইরে এসে স্বামীকে বলল, চল।
পরের দিন আসমা স্বামীকে নিয়ে রুকসানাকে দেখতে বাহিরবাগ গেল। স্বামীকে নিচে ড্রইংরুমে বসিয়ে আসমা উপরে গেল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় বারান্দায় উঠে সুরাইয়া ভাবিকে দেখে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, সই কেমন আছে?
সূরাইয়া বলল, ভালো নয়। তারপর জিজ্ঞেস করল, দাইহান ভাইয়ের সঙ্গে এসেছেন নিশ্চয়?
হ্যাঁ, উনি নিচে বসে আছেন। আমি সই-এর রুমে যাই।
বড় আপা নেই। গতকাল তাকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এমন সময় করিমনকে আসতে দেখে সুরাইয়া তাকে বলল, নিচে মেহমান আছে, চা-নাস্তা দিয়ে এসে আমার ঘরেও আসমা আপার জন্য নিয়ে আসবে। তারপর আসমাকে বলল, আপনি আমার ঘরে চলুন, কথা আছে।
ঘরে এসে আসমাকে বসতে বলে নিজেও বসল। তারপর বলল, বড় আপার শরীর দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছিল দেখে আমি আপনার ভাইদেরকে একদিন বড় আপার বিয়ে না করার কারণ ও হোসেন স্যারের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলে কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় পরামর্শ করলাম। তারপর যা কিছু ঘটেছে সব বলে বলল, আমার দৃঢ় ধারণা, বড় আপা আমার ও আব্বার সব কথা-বার্তা শুনেছে। কারণ সেই রাতেই বড় আপা ঘরের মেঝেয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। তারপর থেকে বড় আপার অবস্থা এমন হল যে, কয়েকদিনের মধ্যে বিছানায় পড়ে গেল। গোপালগঞ্জ থেকে বড় ডাক্তার আনিয়ে চিকিৎসা করিয়েও কোনো কাজ হয়নি। শেষে সেই ডাক্তারের কথামতো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, আমার কেবলই মনে হয়, বড় আপার এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী। আমি যদি সেদিন আব্বাকে ওদের সম্পর্কের কথা না বলতাম, তাহলে বড় আপার অবস্থা এরকম হত না।
আসমা বলল, সবর করুন সুরাইয়া ভাবি। তকদিরে যা লেখা আছে, তা যে কোনো অসিলায় হবেই। আজ আর চাচা-চাচির সাথে দেখা করব না। ঢাকা থেকে হোসেন ভাইয়ের বাড়িতে তিনজন মেহমান এসেছেন। আমাকেই সবকিছু দেখাশোনা করতে হচ্ছে। পরশু হাসপাতাল উদ্বোধন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রী আসবেন। হোসেন ভাইও খুব ব্যস্ত। ইনশাআল্লাহ উদ্বোধনের পরের দিন এসে চাচার হাতে পায়ে ধরে রাজি করাব। এখন যাই, সইকে হাসপাতালে দেখে বাড়ি যাব।
এমন সময় করিমন নাস্তা নিয়ে এলে সুরাইয়া বলল, একটু মুখে দিয়ে যান।
নাস্তা খেয়ে আসমা বিদায় নিয়ে নিচে এসে স্বামীকে বলল, সই গোপালগঞ্জ হাসপাতালে। চল, তাকে দেখে তারপর ফিরব।
হাসপাতালে এসে রুকসানাকে দেখে আসমা ও দাইহান চোখের পানি রোধ করতে পারল না। বেডে যেন একটা কঙ্কাল পড়ে আছে। আসমা সেই কঙ্কালকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, এ তোর কি হাল হয়েছে সই? কাউকে দিয়ে আমাকে একটা খবরও দিলি না? তারপর ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আল্লাহগো, তুমি আমার সই-এর উপর রহম কর।
একজন নার্স দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এসে আসমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে রাগের সঙ্গে বললেন, এ কী করছেন আপনি? রুগীর অবস্থা খুব খারাপ। একটু উত্তেজিত হলে হার্টফেল করবেন। যান, চলে যান এখান থেকে।
রুকসানা ক্ষীণ স্বরে নার্সকে বলল, সিস্টার ওকে থাকতে দিন। চলে গেলেই বরং আমি হার্টফেল করব। আপনি যান, ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলব।
নার্স বলল, কিন্তু স্যারের অর্ডার, কেউ যেন আপনাকে এতটুকু ডিস্টার্ব না করে।
রুকসানা বলল ও তো ডিস্টার্ব করছে না, বরং ওকে দেখে বেশ সুস্থ বোধ করছি। প্লিজ, আপনি একটু যান।
নার্স বিরক্ত হয়ে চলে গেল।
রুকসানা দাইহানের দিকে তাকিয়ে বলল,তোমাদের হাসপাতাল উদ্বোধন হয়ে গেছে?
না বড় আপা, পরশু হবে। তারপর ভিজে গলায় বলল, বড় আপা, আপনার অবস্থা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি আমাদের যে উপকার করেছেন, আজীবন ভুলতে পারব না। সব থেকে বড় দুঃখ, আমরা আপনার কোনো উপকার করতে। পারলাম না। কথা শেষ করে চোখ মুছল।
সুরাইয়া বলল, তোমরা অত বিচলিত হচ্ছ কেন? জান না, সারা বিশ্ব জগতে যা কিছু হচ্ছে, আল্লাহপাকের ইশারাতেই হচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। দুঃখ করো না দাইহান ভাই, আল্লাহর ইচ্ছাকে মেনে নেওয়াই প্রকৃত মুমীনের লক্ষণ। তারপর আসমাকে বলল, সই, তোরা আমার জন্য দোয়া করিম, “আল্লাহ যেন ঈমানের সঙ্গে আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নেন।” আর হোসেনকে বলবি, হাসপাতাল উদ্বোধনের পরের দিন যেন অতি অবশ্যই আসে। তোরাও আসবি। শেষ বারের মতো তোদের সবাইকে একবার দেখতে চাই। দুনিয়াতে বোধ হয় আমাদের মিলন আল্লাহর ইচ্ছা নয়। তাই আমাকে তুলে নিচ্ছেন। অনেকবার ভেবেছি, গোপনে হোসেনের কাছে গিয়ে বলব, চল, আমরা বিয়ে করে আমেরিকা চলে যাই। কিন্তু আব্বার কথা ভেবে তা না করে সবর করেছি।
এমন সময় নার্সের কাছে খবর পেয়ে ডাক্তার এসে আসমা ও দাইহানকে একপাশে ডেকে নিয়ে এমন কিছু কথা বললেন, যা শুনে তারা এক্ষুনি চলে যেতে রাজি হল। তারপর আসমা একা এসে বলল, সই, কিছু মনে করিস নি, তোর ভালোর জন্যে চলে যেতে হচ্ছে। এই কথা বলে চোখ মুছতে মুছতে স্বামীর কাছে এসে বলল, চল।
হাসপাতাল থেকে ফিরে আসমা যখন হোসেনের ঘরে এল তখন সে রুগীদের ওষুধ দিচ্ছিল। তাকে দেখে হোসেন রুগীদের একটু বসতে বলে আসমার কাছে এসে বলল, রুকসানার খবর কি বল।
আসমা বলল, তোমার ঘরে চল।
ঘরে এসে তাকে বসতে বলে নিজেও বসল।
আসমা বসে বলল, সই-এর অবস্থা খুব খারাপ। গতকাল গোপালগঞ্জের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমি বাহিরবাগে গিয়ে সেকথা জেনে হাসপাতালে সইকে দেখে এসেছি। তারপর সুরাইয়া ভাবি ও রুকসানা যা কিছু বলেছে, তা বলে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আল্লাহ না করুক, আমার মনে হচ্ছে, সই বেশি দিন বাঁচবে না।
আসমার কথা শুনে ইকবালের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, কেঁদে কী হবে? রুকসানা ঠিক কথা বলেছে, “সারা বিশ্ব জগতে যা কিছু ঘটছে, আল্লাহর ইশারাতেই ঘটছে। কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না।” আমারও মনে হচ্ছে দুনিয়াতে আমাদের মিলন আল্লাহর ইচ্ছা নয়। এখন যাই, রুগীরা বসে আছে বলে ইকবাল চলে গেল।
.
আজ সকাল থেকে আসমাকে না দেখে মালেকা বুঝতে পারল, সে বাহিরবাগ গেছে। দুপুরে খাওয়ার পর সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন মালেকা বিছানায় শুয়ে চিন্তা করছিল, স্যার যখন আমাদের বাড়িতে যায় তখন সেভেনে পড়তেন। সে সময় তার বয়সই বা কত ছিল? বড় জোর তের চৌদ্দ। আর মেয়েটিরও হয়তো তাই অথবা দু’এক বছর কম। অত ছোটবেলার ভালবাসা দীর্ঘ বিশ-একুশ বছর যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও এত গম্ভীর হল কি করে? যদি আসমার কথা সত্য হয়, তাহলে এটা একটা অলৌকিক ঘটনা। এই সব চিন্তা করতে করতে শুয়ে থাকতে ভালো লাগল না। উঠে হোসেনের ঘরে গেল। ভিতরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে দেখল, বুকসেলফের বইগুলো এলোমেলো। টেবিলের উপরেও কয়েকটা বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, আলনার জামা-কাপড়গুলোর অবস্থাও ঐ একই রকম। বিছানার চাদর অর্ধেক গুটান, বালিশ দুটো জায়গামতো নেই। শাড়ীর আঁচল কোমরে গুঁজে সবকিছু গুছাল। তারপর ঘরে ঝাট দেবে বলে ঝাটার খোঁজ করল। না পেয়ে বাইরে এসে রান্না ঘরের বেড়ায় ঠেস দেওয়া একটা ঝাটা দেখতে পেয়ে সেখানে গেল। এমন সময় আসমাকে ডিসপেন্সারীর দরজার বাইরে থেকে স্যারকে পাশের ঘরে যাওয়ার কথা বলতে শুনে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তাদেরকে ঘরে ঢুকে যেতে দেখে পিছনের দিকের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। তাদের কথা-বার্তা শুনে যখন বুঝতে পারল, আসমার সই-ই স্যারের প্রেমিকা তখন সেখান থেকে চলে এল।
রাত্রে খাওয়ার পর মালেকা গল্প করার কথা বলতে পারে ভেবে আসমা যয়নাবের শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে ঘরে চলে গেল।
পরের দিন আসমা এক ফাঁকে হোসেনকে বলল, মালেকা আপার সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পেরেছি, উনি এখনও বিয়ে করেন নি। কেন করেন নি তুমি জান?
হোসেন বলল, আমি জানব কি করে? তাকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।
জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, দুঃখিত, বলতে পারব না। আমার মনে হয় তিনি তোমাকে ভালবাসেন। তাই বিয়ে না করে আজও তোমার প্রতীক্ষায় রয়েছেন।
এখন এসব কথা আলাপ করার সময় নেই বলে হোসেন তার কাছে থেকে চলে গেল।
আসমা তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল। হোসেন ভাই নিশ্চয় মালেকা আপার মনের কথা জানে।
.
আজ হাসপাতাল উদ্বোধন হবে। সকাল থেকে হোসেন খুব ব্যস্ত। বেলা দশটার সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রী পাঁচ-ছয়জন সঙ্গী নিয়ে এসে গেলেন। এগারটার সময় তিনি ফিতে কেটে হাসপাতাল উদ্বোধন করলেন।
দাইহান উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসার সময় আসমা, মালেকা ও তার মা-বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।
কুরআন তেলাওয়াতের পর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বক্তৃতা দিলেন। সব শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসপাতাল চালু রাখার কর্মসূচীর ব্যাপারে বক্তৃতা দিয়ে বললেন, এই হাসপাতাল যাতে সরকারী অনুমোদিত হয় এবং অনুদান পায়, সে ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় করব। তারপর জনসাধারণের উদ্দেশ্যে আরো অনেক কিছু বলে অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণার পর আসমা ও মেহমানদেরকে দাইহান ঘরে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। তারা বড় রাস্তায় উঠেছে, এমন সময় একটা লোক রিকশা থেকে। নেমে একটা ভাঁজ করা কাগজের উপর লেখা ঠিকানা দেখিয়ে দাইহানকে বলল, এই মহিলার বাড়িটা দেখিয়ে দিন তো।
কাগজটায় আসমার নাম ঠিকানা দেখে দাইহান জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথা থেকে আসছেন?
গোপালগঞ্জ হাসপাতাল থেকে।
দাইহান বলল, এটা আমার স্ত্রীর নাম। তারপর কাগজটা আসমার হাতে দিল।
লোকটা বিদায় নিয়ে ঐ রিকশাতেই চলে গেল।
আসমা কাগজটা খুলে পড়ে স্বামীকে বলল, সুরাইয়া ভাবি চিঠি দিয়েছেন। সই-এর অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। এক্ষুনি যেতে হবে। তুমি হোসেন ভাইকে ডেবে নিয়ে এস। আমি ইনাদের নিয়ে ঘরে যাচ্ছি।
হোসেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও তার সফর সঙ্গীদের বিদায় করে কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করছিল।
দাইহান এসে তাকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে আসমার কথাগুলো বলল।
হোসেন শুনে চমকে উঠল। তারপর কমিটির সদস্যদের কাছে ফিরে এসে বলল, বিশেষ প্রয়োজনে ঘরে যেতে হচ্ছে। পরে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করব। তারপর সালাম বিনিময় করে দাইহানের সঙ্গে ঘরে এল।
আসমা চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বলল, হাসপাতাল থেকে সুরাইয়া ভাবি পাঠিয়েছেন। পড়ে দেখ।
হোসেন পড়তে শুরু করল,
আসমা আপা,
সালামান্তে জানাই যে, বড় আপার অবস্থার অবনতি জেনে আমরা সবাই এসেছি। শুধু আব্বা আসেননি। এখানে আসার পর আমরা ডাক্তারকে বললাম, রুগীকে ঢাকায় নিয়ে যাব। ডাক্তার বললেন, “কোনো লাভ হবে না। রুগী ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। আপনারা নিশ্চয় কারণটা জানেন। তা যদি বলেন, তাহলে বাঁচাব চেষ্টা করতে পারি।” আমি তোমার ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে সেই ছোটবেলার ঘটনা থেকে শয্যাশায়ী হওয়ার আগে পর্যন্ত সব ঘটনা খুলে বললাম। শুনে ডাক্তার বললেন, “কথাটা চেপে রেখে আপনারা খুবই অন্যায় করেছেন। আমরা এতদিন যত চিকিৎসা করেছি, সব ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে। যা বলছি শুনুন, আপনারা রুগীর বাবাকে ও সেই ছেলেকে অতি সত্বর নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। আল্লাহ যদি ওঁর হায়াত রেখে থাকেন, তাহলে ওদেরকে কাছে পেলে রুগীর মানসিক যন্ত্রণা কমবে এবং আমাদের চিকিৎসায় কাজও হবে।” ডাক্তারের কথা শোনার পর আমরা আম্মাও আব্দুল করিমকে আব্বাকে নিয়ে আসার জন্য পাঠিয়েছিলাম, উনি আসেন নি। বড় আপা হোসেন স্যারকে দেখার জন্য খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। তাকে ডেকে আনার জন্য বার বার তাগিদ দিচ্ছে। বলছে “আমি আর বাঁচব না। শেষ বারের মতো একবার তাকে দেখতে চাই।” চিঠি পাওয়া মাত্র আপনি তাকে নিয়ে আসবেন। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন।
ইতি
আপনার সুরাইয়া ভাবি
চিঠি পড়ে হোসেনের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে আসমার দিকে তাকাল।
আসমা বলল, আমি তোমার ভাইকে নিয়ে বাহিরবাগ যাচ্ছি। চাচাকে যেমন করে হোক হাসপাতালে নিয়ে আসব। তুমি মালেকা আপাকে নিয়ে যাও। তারপর মালেকাকে বলল, আপনি যাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, হোসেন ভাইয়ের সঙ্গে গেলে তাদের সঙ্গে দেখা হবে।
আসমার কথা শুনে হোসেন অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
আসমা বলল, হোসেন ভাই, আমার কথা শুনে খুব অবাক হচ্ছ তাই না? পরে সব কিছু বলব, এখন ওঁকে নিয়ে রওয়ানা দাও। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে চল আমরা যাই বলে হাঁটতে শুরু করল।
চিঠি পাওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত খালেক সবকিছু লক্ষ্য করছে। দাইহান ও আসমা চলে যাওয়ার পর হোসেনকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার বলতো বাবা, তোমাদেরকে খুব পেরেশান দেখাচ্ছে? হাসপাতালে কে আছে?
হোসেন বলল, বাহিরবাগের চৌধুরীদের মেয়ে রুকসানা আসমার সই। সে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছে। এখন তার অবস্থা খুব খারাপ। তারপর মালেকার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী যাবে?
চিঠি পড়ে আসমা যখন হোসেনকে ডেকে নিয়ে আসার কথা দাইহানকে বলে তখন থেকে মালেকা চিন্তা করছিল, আসমার সই-এর অসুখ, সে দেখতে যাবে; কিন্তু স্যারকে ডেকে পাঠাল কেন? তারপর চিঠি পড়ে স্যারের চোখে পানি দেখে আসমার সই-ই স্যারের ভালোবাসার পাত্রী হোসেনের কথার উত্তরে বলল, হ্যাঁ যাব, চলুন।
সবকিছু দেখে শুনে খালেকেরও কেমন যেন সন্দেহ হল। ভাবল, তাহলে কি এই মেয়ের জন্য হোসেন এখনও বিয়ে করেনি? মেয়ের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলল, চল মা, আমরাও তোদের সঙ্গে যাব।
.
আসমা ও দাইহান বড় রাস্তায় এসে একটা স্কুটার নিয়ে বাহিরবাগ এল। আসমা স্বামীকে নিচে ড্রইংরুমে বসতে বলে উপরে এসে দেখল, চাচা বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে আছেন। কাছে এসে সালাম দিল।
আব্দুল মতিন চৌধুরীর আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর। তার উপর রুকসানা তাদের দারোয়ানের চরিত্রহীন ছেলেকে ভালবেসে এতদিন বিয়ে করতে চায়নি জানার পর থেকে মেয়ের উপর ভীষণ রেগে আছেন। তাই সে যতদিন ঘরে শয্যাশায়ী ছিল, একদিনও তার কাছে যায়নি। এমন কি কারো কাছে তার ভালো-মন্দ জিজ্ঞেসও করেন নি। মেয়ের অবস্থার অবনতি জেনে সবাই হাসপাতালে গেলেও তিনি যাননি। কিছুক্ষণ আগে স্ত্রীও ছোট ছেলে এসে ডাক্তারের কথা বলে নিয়ে যেতে চাইলেও যাননি। এখন আসমা ও দাইহানকে উঠোন পার হয়ে আসতে দেখে ভাবলেন, মেয়েটা বুঝি শেষ পর্যন্ত মরেই গেল। নিজের অজান্তে চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। হাজার হোক বাবা তো। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেললেন। আসমা সালাম দিতে গম্ভীর স্বরে উত্তর দিয়ে বললেন, কেন এসেছ?
আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সই-এর অবস্থা খুব খারাপ।
আব্দুল মতিন গর্জন করে উঠলেন, যে মেয়ের আত্মমর্যাদাবোধ নেই, যে মেয়ে বংশের মান-সম্মান ডুবিয়ে দিতে চায়, সে মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। তুমি চলে যাও, আমি যাব না।
আব্দুল মতিনের দু’পা জড়িয়ে ধরে আসমা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, তাহলে আপনি কেন আমার আব্বার মান-সম্মান ডুবিয়ে দিয়ে একটা কামলার ছেলে কামলা, যে নাকি আমাদের কামলা ছিল, তার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন? আমি আপনার মেয়ের সই, আমাকে বাঁচাতে পারলেন অথচ নিজের মেয়েকে পারছেন না কেন? সন্তানের চেয়ে আপনার আত্মমর্যাদা ও বংশের মান-সম্মান বড় হল?
আব্দুল মতিন রাগের সঙ্গেই বললেন, শুধু মান-সম্মান ও বংশ মর্যাদাই নয়, এমন আরো একটা কারণ আছে, যা তুমি জানলে তার জন্য সুপারিশ করতে আসতে না।
আসমা বলল, কারণটা আমি জানতে চাই।
সে একটা চরিত্রহীন লম্পট ছেলে। জেনেশুনে তাকে জামাই করতে পারি না।
এবার আসমা রেগে উঠে বলল, হোসেন ভাইকে আপনি কতটা চেনেন জানি না। আমরা তো জানি, তার মতো চরিত্রবান ছেলে এ যুগে বিরল।
আব্দুল মতিন বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, তোমরা তার বর্তমান দেখেছ, অতীতটা দেখনি।
চাচার কথা শুনে আসমা অনুমান করে বলল, আপনি কী সেই ছেলেবেলার ঘটনার জন্য তাকে চরিত্রহীন বলছেন? তাই যদি হয়, বলব, আপনি বিরাট ভুল করছেন।
আব্দুল মতিন কুচকে বললেন, তুমি কী বলতে চাচ্ছ?
আসমা বলল, তখন যা ঘটেছিল সেটা যে অন্যায়, তা বোঝার মতো বয়স তাদের কারই হয়নি। তবু হোসেন ভাই শাস্তি পেয়েছিল। আমি যতটুকু জানি, ঐ শাস্তির কারণেই সেই সময় হোসেন ভাই রুকসানাকে বিয়ে করার প্রতিজ্ঞা করে তার উপযুক্ত হওয়ার জন্য পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে আসমা আবার বলল, সে যদি চরিত্রহীন হত, তাহলে ঢাকায় কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ার সময় অনেক কিছু করতে পারত। তাছাড়াও আমেরিকায় দীর্ঘ দশ বছর চাকরি করে প্রচুর টাকা রোজগার করেছে। সেখানেও ফুর্তি-আমোদ করে টাকা নষ্ট করে ফেলতে পারত। অথবা বিয়ে করে সেখানে থেকে যেতেও পারত। কিন্তু সেসব কিছু না করে রুকসানার উপযুক্ত হয়ে তারই জন্য গ্রামে ফিরে এসেছে। তারপরও আপনাদের মান সম্মান ও বংশ গৌরবের কথা চিন্তা করে আত্মগোপন করেছিল। এমন কি সই-এর কাছেও। ষাড়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় উভয়কে চিনতে পারে এবং একে অপরের মনের কথা জানতে পারে। তবু তারা দুজনে আপনার কথা চিন্তা করে ধৈর্য ধরে ছিল। সুরাইয়া ভাবি ও আপনার মধ্যে যে সব কথাবার্তা হয়েছিল, সেসব শুনেই সই এর এই পরিনতি। এই পর্যন্ত বলে আসমা চাচার চোখের দিকে চেয়ে বলল, সই তো আপনারই মেয়ে। সে একটা চরিত্রহীন ছেলেকে ভালবেসে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে, একথা ভাবলেন কী করে?
আসমার কথা শুনে আব্দুল মতিনের ভুল ভাঙ্গল। কিন্তু তা স্বীকার করতে না পেরে চুপ করে রইলেন।
আসমা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ডাক্তার যে কথা বলেছেন, তা বলে বলল, এরপরও যদি আপনি হাসপাতালে গিয়ে সইকে বাঁচাতে না চান, তাহলে আপনার সামনেই মাথা ঠুকে জান দিয়ে দেব। এই কথা বলে মেঝেয় মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলল, আমি আত্মঘাতী হব জেনে আমাকে রক্ষা করেছিলেন। এখন সইকে বাঁচাবার জন্য আপনার সামনেই আত্মঘাতী হব। দেখব, আপনার ভুল ধারণাটাই বড়, না। আমার ও আমার সই-এর জীবন বড়? বারবার পাকা মেঝেয় মাথা ঠুকার ফলে আসমার কপাল কেটে গিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।
তাকে মাথা ঠুকতে ও তার রক্তাক্ত মুখ দেখে আব্দুল মতিন স্থির থাকতে পারলেন না। এক হাতে মাথা ধরে কোলে টেনে নিয়ে ভিজে গলায় বললেন, তুমি আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়েছ মা। আমি তোমার সব কথা মেনে নিচ্ছি। আমাকে রুকসানার কাছে নিয়ে চল।
আসমা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে করতে চাচার কোলে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ কাদল। তারপর বাথরুম থেকে রক্তধুয়ে এসে বলল, আপনার কাপড়ে রক্ত লেগে গেছে, পাল্টাতে হবে।
আব্দুল মতিন বললেন, লাগুক। তুমি করিমনকে ডেকে নিয়ে এস।
করিমন অল্প দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। শুনতে পেয়ে এগিয়ে এল।
তাকে দেখে আব্দুল মতিন বললেন, সামসুকে একটা স্কুটার ডেকে নিয়ে আসতে বল।
আসমা বলল, আমরা স্কুটার নিয়ে এসেছি। তারপর করিমনকে বলল, ইব্রাহিমের আব্বা নিচে বসে আছেন, তাকে ডেকে নিয়ে এস। চাচাকে ধরে নিয়ে যাবে।
.
হোসেন মালেকা ও তার মা-বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে বারান্দায় পাঁচ ছয়জন মেয়ে-পুরুষকে নীরবে কাঁদতে দেখে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। কাছে এসে আব্দুর রসিদকে চিনতে পেরে সালাম দিল।
আব্দুর রশিদ ও হোসেনকে চিনতে পারল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আসমা আপা কী আব্বাকে আনতে গেছে?
হ্যাঁ বলে হোসেন জিজ্ঞেস করল, রুকসানা কেমন আছে?
আব্দুর রশিদ বলল, ভালো না। ডাক্তার আমাদেরকে বার করে দিয়েছে। সূরাইয়া ও আম্মা আছেন। তারপর খালেক ও বোরখা পরা মালেকা ও তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ইনারা?
হোসেন বলল, ঢাকা থেকে এসেছেন। ইনাদের কাছে থেকে আমি মানুষ হয়েছি।
আব্দুর রশিদ খালেকের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, আপনারা এখানেই থাকুন। ডাক্তার কাউকেই ভিতরে যেতে দিচ্ছেন না। তারপর হোসেনকে বলল, আসুন। আমার সঙ্গে। যেতে যেতে বলল, বড় আপাকে কেবিনে রাখা হয়েছে। মেয়েরা কান্নাকাটি করছিল, তাই ডাক্তার বার করে দিয়েছেন।
ডাক্তার রুকসানাকে ইঞ্জেকসান দিয়ে অবজার্ভ করছিলেন। আব্দুর রশিদ ও ইকবালকে ঢুকতে দেখে বিরক্ত প্রকাশ করে হাত দিয়ে ইশারা করে বেরিয়ে যেতে বললেন।
আব্দুর রশিদ কাছে এসে হোসেনকে দেখিয়ে বলল, আপনি যাকে নিয়ে আসতে বলেছিলেন, উনি সেই।
ডাক্তার এগিয়ে এলে ইকবাল সালাম দিল।
ডাক্তার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন। আপনি এসেছেন খুব ভালো হয়েছে। পেসেন্টের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আপনার নাম বার বার বলছিলেন। আর খুব অস্থিরতা অনুভব করছিলেন। তাই কিছুক্ষণ আগে ইঞ্জেকশান দিয়েছি। ঘণ্টা খানেক ঘুমাবেন। তবে তার আগেও ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। আপনি এখানেই থাকুন, কোথাও যাবেন না। ঘুম ভাঙ্গার পর আপনাকে দেখে পেসেন্টের অবস্থা ভালো-মন্দ দুটোই হতে পারে। আশা করি, ভালই হবে। আর যদি মন্দ কিছুর লক্ষণ দেখা যায়, আমাকে খবর দেবেন। তারপর আজিজা বেগম ও সুরাইয়াকে দেখিয়ে আব্দুর রশিদকে বললেন, ইনাদেরকে নিয়ে আপনি বাইরে থাকুন। কথা শেষ করে নার্সকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আজিজা বেগম হোসেনকে চিনতে না পারলেও ছেলের কথা শুনে বুঝতে পারলেন এই সেই ইকবাল।
ডাক্তার বেরিয়ে যাওয়ার পর আব্দুর রশিদ মা ও স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এসে দরজার পাশে দাঁড়াল।
অন্যরা দেখতে পেয়ে তাদের কাছে এল।
সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর রুকসানার দিকে তাকিয়ে হোসেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। মুখটা ছাড়া সারা শরীর চাঁদরে ঢাকা। তবু তার মনে হল শরীরে এতটুকু মাংস নেই। হাড়ের সঙ্গে শুধু চামড়া লেগে রয়েছে। পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখ মুছে সংযত হওয়ার চেষ্টা করল।
ঠিক আধ ঘণ্টা পর রুকসানা একটু নড়ে উঠে চোখ মেলে তাকাল। হোসেনকে দেখে চমকে উঠে কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চারপাশে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। অল্পক্ষণ পর আবার চোখ মেলে ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল; কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বার হল না। দু’চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। আর সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।
হোসেন বুঝতে পারল, রুকসানা তাকে দেখে এত খুশী হয়েছে যে, কথা বলতে পারছে না। বলল, বিশ্বাস কর রুকসানা, তোমার অবস্থা যে এ রকম হয়েছে তা জানতাম না। এই কথা বলার পর তাকে আরো বেশি কাঁপতে দেখে বিপদ হতে পারে ভেবে ডাক্তারকে খবর জানাবার জন্য কেবিন থেকে বেরিয়ে এল।
সবেমাত্র আব্দুল মতিন আসমা ও দাইহানের সঙ্গে এসে আব্দুর রশিদকে। রুকসানার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। হোসেন স্যারকে দেখে সকলের সঙ্গে তিনিও তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
হোসেন আব্দুল মতিনের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে আব্দুর রশিদকে বলল, শিগগির ডাক্তার নিয়ে আসুন, রুকসানা কেমন করছে। তারপর রুকসানার কাছে ফিরে এল।
আব্দুর রশিদ তাড়াতাড়ি করে ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য চলে গেল। আর ওরা সবাই ঢুকে রুকসানার বেডের কাছে এসে দাঁড়াল।
রুকসানা তখনও হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। সবাই আসার পর তাদের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার হোসেনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ঘন ঘন মাথা এপাশ ওপাশ করতে লাগল। আর খুব জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল।
হোসেন বলল, তুমি এরকম করছ কেন রুকসানা? প্লিজ, শান্ত হও। তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমার কাছে থাকব। দেখ না, আসমা ও দাইহান ভাই তোমার আব্বাকে নিয়ে এসেছে। বাড়ির অন্যান্য সকলে ও আমি ঢাকায় যাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করেছি, তারাও এসেছেন।
হোসেনের কথা শুনে রুকসানা আর একবার সকলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে শান্ত হল। সেই সাথে তার কপালে ঘাম দেখা দিল।
হোসেন হাদিসে পড়েছে, “মুমীন বান্দা-বান্দীর মউতের সময় কপালে ঘাম দেয়। সেই সময় কাছে যে থাকবে সে কালেমা তৈয়েব ও কালেমা শাহাদাৎ শব্দ করে পড়বে। ভুলেও মুমূর্ষ ব্যক্তিকে কলেমা পড়ার জন্য তাগিদ দেবে না।” রুকসানার কপালে ঘাম দেখে হোসেনের হাদিসটা মনে পড়ল। রুমাল বার করে ঘাম মুছতে যাবে এমন সময় মালেকা এগিয়ে এসে বলল, আপনি সরে আসুন, যা করার আমি করছি।
এই কয়েকদিনে মালেকা যা অনুমান করেছে, এখানে এসে সবকিছু দেখেশুনে তা নিশ্চিত হয়েছে। সেও ঐ হাদিস জানে। আরো জানে স্যার যা করতে যাচ্ছেন, গায়ের মোহাররম লোক হিসাবে তা করা উচিত নয়। তাই তাকে সরে যেতে বলল।
মালেকার কথা শুনে হোসেনেরও কথাটা খেয়াল হল। রুমালটা তার হাতে দিয়ে সরে দাঁড়াল।
মালেকা রুমাল দিয়ে রুকসানার ঘাম মুছে দেওয়ার সময় শব্দ করে কলেমা তৈয়েব ও কালেমা শাহাদাৎ পড়তে লাগল। তারপর চামচে পানি নিয়ে তার মুখে দিতে গেল।
ঠোঁটে চামচ ঠেকতে রুকসানা মালেকার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দু’তিন চামচ পানি খেল। তারপর ঠোঁট নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করার সময় মাথাটা একপাশে কাৎ হয়ে গেল।
রুকসানা মারা গেছে বুঝতে পেরে মালেকা ভিজে গলায় “ইন্নালিল্লাহে—– রাজেউন” পড়ে বলল, উনি ইন্তেকাল করেছেন।
হোসেন কিছুক্ষণ রুকসানার নাড়ী ধরে পরীক্ষা করল। তারপর নিশ্চিত হয়ে ইন্নালিল্লাহে— রাজেউন পড়ে যখন গায়ের চাদরটা টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দিচ্ছিল তখন তার চোখের পানি টপ টপ করে রুকসানার বুকের উপর পড়তে লাগল।
অন্য সবাই বুঝে উঠার আগেই আব্দুর রশিদের সঙ্গে ডাক্তার এসে ভীড় দেখে রাগের সঙ্গে বললেন, নিষেধ করা সত্ত্বেও আপনারা এসেছেন? যান শিগগির বেরিয়ে যান। আব্দুল মতিনকে দেখতে পেয়ে বললেন, ঠিক আছে, আপনি থাকুন। তারপর বেডের কাছে এগিয়ে এলে হোসেন বলল, পরীক্ষা করার দরকার নেই, সী ইজ ডেড।
ডাক্তার তার কথায় কান না দিয়ে চাদর সরাবার জন্য হাত বাড়ালেন।
হোসেন হাতটা ধরে ফেলে বলল, প্লিজ ডক্টর, ডোন্ট টাচ দা ডেডবডি।
ডাক্তার রেগে উঠে বললেন, হাত ছাড়ন, আমাকে আমার কর্তব্য করতে দিন।
হোসেন এবার তার দুটো হাত ধরে ছলছল চোখে ভিজে গলায় বলল, বিলীভ মী, আই এম অলসো এ ডক্টর। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছল।
হোসেনের কথা শুনে ও তার চোখে পানি দেখে ডাক্তারের রাগ পড়ে গেল। বললেন, এক্সট্রমলি সরি। প্লিজ, এক্সকিউজ মী।
একটা অনুরোধ করব রাখতেই হবে।
বলুন, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।
পোষ্টমর্টম না করে ডেডবডি নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
তা কি করে সম্ভব? ডাক্তার হিসাবে আপনিও তো হাসপাতালের নিয়ম কানুন জানেন।
জানি। আর এটাও জানি, ক্ষেত্র বিশেষে সব আইনের ব্যতিক্রম আছে। আমার মতে এরকম ক্ষেত্রে মেয়েদের বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের পোস্টমটম না করে লাশ দিয়ে দেওয়াই উচিত। শুধু শুধু মেয়েদের লাশের বেইজ্জতী করা ঠিক নয়।
আপনার সঙ্গে আমিও একমত। ঠিক আছে, আমি সেই ব্যবস্থা করছি। আপনি একটু পরে আমার রুমে আসুন। কথা শেষ করে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন।
কেবিনে ঢোকার পর থেকে হোসেনের ও মালেকার কাজ-কর্ম ও কথা-বার্তা শুনে সবাই এত অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে, তারা যেন এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সকলের হুশ হল। মেয়েরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আসমা রুকসানার লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সই, তুই আমাকে মাফ করে দে, আমি তোর জন্যে কিছুই করতে পারলাম না।
হোসেন দাইহানকে বলল, ওকে সরিয়ে নাও। তারপর আসমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি কী হাদিসে পড়নি? আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “উচ্চস্বরে যাহার জন্য বিলাপ করা হয়, বিচার দিবসে তাহার দ্বারা তাহাকে শাস্তি দেওয়া হউবে।” [বর্ণনায় : হযরত মুগীরাহ বিন শোবাহ (রাঃ) বুখারী মুসলিম]
তিন ভাই আব্বাকে ধরে কাঁদছিল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে বলে উঠল, বড় আপা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল আব্বা। তারপর আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আব্দুল মতিন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, তোমাদের বড় আপা তোমাদেরকে ছেড়ে যায়নি, আমিই তাকে থাকতে দিলাম না। তোমরা আমাকে মাফ করে দাও। তারপর মেয়ের লাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহ আমাকে মাফ করবে কিনা জানি না, তুই আমাকে মাফ করে দে মা। এই কথা বলে ছেলেদের গায়ের উপর এলিয়ে পড়লেন।
আব্দুর রশিদ আব্বা আব্বা বলে কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে অন্য দু’ভাইকে বলল, আব্বা বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। তারপর ধরাধরি করে অন্য বেডে শুইয়ে দিল। হোসেন এগিয়ে এসে নাড়ি ধরে বলল, হ্যাঁ, অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আপনাদের কেউ একজন গিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসুন।
Leave a Reply