বজ্রগোলাপ – অনীশ দেব
৷৷এক৷৷
ঘিয়া নদীর পাড়ে রাহুলের সঙ্গে কোকোর প্রথম দেখা হয়েছিল৷ ভিজে জামা-কাপড়ে একটা বটগাছের নীচে কোকো অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল৷
সেদিন আকাশে অনেক মেঘ ছিল৷ তাই বৃষ্টির আশায়-আশায় ছিল সবাই৷ কিন্তু সন্ধে পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা মেলেনি৷ অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা থোকা-থোকা ঘন মেঘ মাথার ওপরে ঝুলছিল৷ আর তারই ফাঁকে-ফাঁকে বিদ্যুতের আলো ঝলসে উঠছিল৷ আলোর পরই গুড়-গুড়াম৷ মেঘের ডম্বরু বাজছিল৷
মোহনকুমার স্মৃতি চ্যালেঞ্জ শিল্ড-এর ফাইনাল ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল রাহুল৷ সঙ্গে তিন বন্ধু—গোপাল, নিধু, আর দীপায়ন৷ খেলাটা ছিল ওদের পাশের গ্রামে—যে-গ্রামটার নাম ভারী অদ্ভুত : তিনমাইল৷ এই নামটার কারণ বাপির কাছে জানতে চেয়েছিল রাহুল৷ সে বেশ কয়েকবছর আগে—যখন ও ক্লাস ফাইভে পড়ত৷ তখন বাপি বলেছিল, ‘সাত বছর আগেও গ্রামটার কোনও নাম ছিল না৷ সবাই বলত মণিমেলার পাশের গ্রাম৷ তারপর ঘিয়া নদীতে নতুন ব্রিজ তৈরি হল৷ সেটা থেকে ওই গ্রামটার দূরত্ব মোটামুটি তিনমাইল৷ লোকের মুখে-মুখে ওই তিনমাইল দূরত্বের ব্যাপারটা ঘুরতে-ঘুরতে তা থেকে শেষ পর্যন্ত ওটা গ্রামের নাম হয়ে গেছে৷’
তিনমাইলের ফুটবল খেলায় রাহুলরা কোনও দলের সাপোর্টার ছিল না৷ স্রেফ ফুটবল খেলার নেশাতেই ওরা চারজন ফাইনাল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল৷ ম্যাচ শেষ করে ফেরার সময় আকাশের অবস্থা ঠিক যেন বৃষ্টি হব-হব৷ তাই কখনও হেঁটে কখনও ছুটে ওরা মণিমেলার দিকে ফিরছিল৷
একটু পরেই ওরা ঘিয়া নদীর পাড়ে পৌঁছে গেল৷ এবার নদী পেরোলেই মণিমেলা৷ উঁচু পাড় থেকে মাটির ঢাল জলের দিকে নেমে গেছে৷ নদীতে জল এখন বেশি নেই৷ গত দু-সপ্তাহে দু-তিনদিন বৃষ্টি হলেও বর্ষা সেরকমভাবে এখনও শুরু হয়নি৷ তাই ঘিয়া এখন শান্ত, নিরীহ৷ বর্ষার দাপটে এই শান্তশিষ্ট নদীটার রূপ বদলে যায়৷ তখন ঘিয়ার এত স্রোত থাকে যে, সাঁতরে এপার-ওপার করতেও ভয় হয়৷
রাহুলরা নদীর পাড়ে যেখানটায় এসে দাঁড়াল সেখানে কোনও ব্রিজ নেই৷ তবে খেয়া পারাপারের ব্যবস্থা আছে৷ ছোট ডিঙিনৌকো—বড়জোর দশ-বারোজন দাঁড়াতে পারে৷ খেয়া পার হয়ে গেলে রাহুলদের বাড়িটা কাছাকাছি হয়৷ ব্রিজ দিয়ে ঘিয়া পেরোতে হলে অনেকটা ঘুরপথ হয়ে যায়৷
রাহুল-গোপালরা সবাই সাঁতার জানে৷ তাই বেশ সহজভাবে ওরা নৌকোর ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল আর ফাইনাল খেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল৷
কথা বলতে-বলতে রাহুল বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল৷ যদি বৃষ্টি নামে তা হলে আর রক্ষে নেই৷ না, বৃষ্টিতে ভেজার ভয় ও করছে না৷ আসলে স্কুল-লাইব্রেরির দুটো গল্পের বই ও টেবিলের খোলা জানলার কাছে রেখে এসেছে৷ ওগুলো যদি ভিজে যায়!
ঘিয়া পার হয়ে ওরা চারজন নদীর পাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল৷ ঠিক তখনই আচমকা ঝড় উঠল৷ ঠান্ডা বাতাস ওদের ঘিরে পাক খেতে লাগল আর কালো আকাশ থেকে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি টপাটপ করে পড়তে শুরু করল৷
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটা বড়-বড় গাছ ঝোড়ো বাতাসে হেলে পড়েছিল৷ ওদের ডালপালা-পাতা পতাকার মতো উড়ছিল৷
চোখে হাত চাপা দিয়ে রাহুল ধুলো আটকাচ্ছিল৷ সেই অবস্থায় পা হড়কে গিয়ে ও বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়ল৷ ততক্ষণে নিধু, গোপাল আর দীপায়ন নদীর ঢাল পেরিয়ে ওপরের কাঁচা রাস্তায় উঠে পড়েছে৷
নিধু একবার চেঁচিয়ে রাহুলকে ডাকল, ‘জলদি আয়৷ এখুনি জোরে বৃষ্টি আসবে…৷’
সেই চেষ্টাই করছিল রাহুল৷ এছাড়া খোলা জানলার কাছাকাছি রাখা বইগুলো ভিজে যাবে, এই ব্যাপারটাও মাথায় ছিল৷ তাই আরও জোরে পা চালাল৷ আর ঠিক সেই সময়েই সীসের মতো আকাশে নীলচে সাদা বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ পলকের জন্য চারপাশটা আলোয় আলো হয়ে গেল৷ আর তখনই লোকটাকে দেখতে পেল ও৷ সঙ্গে-সঙ্গে বিকট শব্দে বাজ পড়ল৷
নদীর পাড়ে দাঁড়ানো ঝুরি-নামা একটা বটগাছের নীচে পড়ে আছে একটা মানুষ৷ রাহুলের কাছ থেকে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ফুট দূরে৷ এই মেঘলা কমজোরি আলোয় লোকটাকে হয়তো চোখেই পড়ত না যদি না ওর শরীর থেকে চকচকে কিছু একটা বিদ্যুতের আলোয় ঝিলিক মেরে উঠত৷
রাহুলের পথ বেঁকে গেল৷ ও পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল লোকটার কাছে৷ ওর ওপরে ঝুঁকে পড়ল৷
বৃষ্টি এখনও না পড়ার মতন, অথচ মানুষটার জামা-প্যান্ট সব জলে ভিজে সপসপে৷ পায়ে জুতো নেই৷ গায়ের রং ফরসা৷ তাই শরীরের কাটা দাগগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ছে৷ ছুরির ডগা দিয়ে কেউ যেন ওর হাত-পায়ে দাগ কেটেছে৷ সেই চেরা জায়গাগুলো থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে৷
পাশ ফিরে মাটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে অসাড়ভাবে পড়ে আছে লোকটা৷ বেঁচে আছে না মরে গেছে বোঝার উপায় নেই৷
যে-জিনিসটা বিদ্যুতের আলোয় ঝিলিক মেরে উঠেছিল এবার সেটার দিকে তাকাল রাহুল৷ গলায় আটকানো একটা মেটাল ব্যান্ড৷ অনেকটা কুকুরের বকলসের মতো৷ এক কি দেড় সেন্টিমিটার চওড়া৷
রাহুলের একবার মনে হল, লোকটা কি নেশা করে পড়ে আছে? আবার মনে হল, লোকটা ঘিয়া নদীর জলে ভেসে আসেনি তো? ও ঝুঁকে পড়ে লোকটাকে ডাকল : ‘এই যে, শুনছেন! এই যে—৷’
কোনও সাড়া নেই৷
লোকটা কি মরে গেছে? নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছে?
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে মরিয়া হয়ে লোকটাকে ঠেলা মারল রাহুল : ‘এই যে, শুনছেন!’
না, কোনও সাড়া নেই৷ শুধু বাতাসের সোঁ-সোঁ শব্দ আর গাছের পাতার ছটফটানির আওয়াজ৷
এদিকে রাহুলকে পিছনে দেখতে না পেয়ে নিধু-গোপালরা ফিরে আসছিল৷ রাহুলের নাম ধরে বারবার ডাকছিল৷
দু-হাতে লোকটার ডানকাঁধ ধরে টান মারল রাহুল৷ লোকটার শরীরটা আধপাক ঘুরে চিত হয়ে গেল৷
লোকটাকে ভালো করে দেখল রাহুল৷
বয়েস কত হবে, বড়জোর সাতাশ-আটাশ৷ মাথায় কদমছাঁট চুল৷ ছোট-ছোট চোখ৷ নাকটা সামান্য থ্যাবড়া৷ ঠোঁটজোড়া একটু ফাঁক হয়ে থাকায় দাঁত দেখা যাচ্ছিল৷
রাহুল লক্ষ করল, লোকটার দু-গালে নতুন দশ পয়সার মাপের তিনটে কালচে গোল দাগ৷ কেউ যেন কড়ে আঙুল দিয়ে কাজলের টিপ পরিয়ে দিয়েছে৷
লোকটার মুখে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল৷ একইসঙ্গে রাহুল ওকে ধাক্কা দিচ্ছিল, ডাকাডাকি করছিল৷
এমন সময় গোপালরা রাহুলের কাছে পৌঁছে গেল৷ লোকটাকে দেখে ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিল, তর্ক জুড়ে দিল৷ আর লোকটার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল৷ থুতনি ধরে এপাশ-ওপাশ নাড়তে লাগল৷ বুকে হাত দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল৷
ওরা এটুকু বুঝল, জামা-প্যান্ট ভিজে থাকলেও লোকটার শরীরে তাপ আছে৷ বুকে কান পেতে ধরলে ধুকপুকুনি দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে৷ লোকটা যে বেঁচে আছে তাদে কোনও সন্দেহ নেই৷ কিন্তু ওর শরীরের কাটা দাগগুলো এল কেমন করে? আর ওর গলার মেটাল ব্যান্ডটাই বা কী?
এর মধ্যেই ঝড় কিছুটা কমে গেছে৷ বৃষ্টি একটু জোরালো হয়েছে৷ গাছের পাতার খসখসানি শব্দও খানিকটা স্তিমিত৷ ওরা তখনও লোকটাকে জাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল৷
হয়তো বৃষ্টির জল মুখে পড়ার জন্যই হঠাৎ লোকটা চোখ খুলে তাকাল৷ চারটে মুখ ওর ওপরে ঝুঁকে রয়েছে দেখে ভয়ের একটা চাপা চিৎকার করে উঠল৷
নিধু ওকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘ভয় পেয়ো না৷ কোনও ভয় নেই৷’
দীপায়ন জিগ্যেস করল, ‘তুমি কে? নদীর পাড়ে এখানে কোত্থেকে এলে?’
লোকটা ভয়ের চোখে ওদের মুখগুলোর ওপরে একবার নজর বুলিয়ে নিল৷ তারপর ডানহাতটা শূন্যে তুলে নদীর দিকে দেখাল৷ যেদিক থেকে ঘিয়া নদী বয়ে আসছে সেদিকে৷ রাহুল লক্ষ করল, লোকটার হাত কাঁপছে৷
রাহুল তাকাল নদীর উজানের দিকে৷ তা হলে কি লোকটা নদীর জলে ভেসে এসেছে?
রাহুল জিগ্যেস করল, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’
লোকটা সরল চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল রাহুলের দিকে৷ তারপর দু-হাতের আঙুল এমনভাবে ঘোরাল যার মানে কোথায় যাবে ও জানে না৷
‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ গোপাল জানতে চাইল৷
লোকটা কোনও উত্তর দিল না৷ শূন্য চোখে গোপালের দিকে তাকিয়ে রইল৷
‘আপনার সঙ্গে আর কেউ আছে?’ রাহুল জিগ্যেস করল৷
ভাঙা কর্কশ গলায় লোকটা টেনে-টেনে জবাব দিল, ‘কেউ…নেই৷’ মনে হচ্ছিল ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে৷
রাহুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই লোকটা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল৷
‘কেউ…নেই৷ কেউ…নেই৷’ বলতে লাগল বারবার এবং হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷ রাহুলের পায়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ পাগলের মতো পায়ে মাথা ঘষতে লাগল আর কাঁদতে লাগল৷
রাহুল কোনওরকমে এক পা পিছিয়ে এল৷ সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে দাঁড় করাল৷ লোকটা তখনও মুখ বিকৃত করে কাঁদছে৷ গুঙিয়ে-গুঙিয়ে কী বলছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না৷
রাহুল অবাক হয়ে লোকটার সরল কান্না-ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷
দীপায়ন, নিধু আর গোপাল তখন নিজেদের মধ্যে কথাবলাবলি করতে লাগল৷
কী করা যায় লোকটাকে নিয়ে?
কেউ বলল, ‘ছাড় তো৷ ও এখানেই পড়ে থাক৷ পরে যেখানে যায় যাবে৷’
একজন বলল, ‘চল, আমরা গিয়ে থানায় খবর দিই…৷’
আর-একজন বলল, ‘দাদাদের ক্লাবে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলে হত৷’
‘না, তার চেয়ে বরং পার্টি অফিসে নিয়ে চল৷ ওরা থানা-পুলিশ যা করার করবে৷’
বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ এরকম এলোমেলো কথাবার্তা শোনার পর রাহুল ফস করে বলে উঠল, ‘আমি ওকে বাড়িতে নিয়ে যাব৷’
সঙ্গে-সঙ্গে নিধু, গোপাল আর দীপায়ন চুপ করে গেল৷ ওরা এমন চোখে রাহুলের দিকে তাকাল যেন রাহুলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷
রাহুল ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া আহত লোকটার দিকে তাকাল৷ হাত বাড়াল ওর দিকে৷ সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা এমনভাবে ওর হাতটা আঁকড়ে ধরল যেন এটা ছেড়ে দিলে ও আর বাঁচবে না৷ ভয়ের চোখে রাহুলের দিকে তাকাল৷
রাহুল চাপা গলায় ওকে বলল, ‘কোনও ভয় নেই৷’
নিধু, গোপাল আর দীপায়নের সঙ্গে তর্ক করতে-করতে রাহুল এগোল৷ ওর হাত আঁকড়ে ধরে মাথা নীচু করে লোকটাও এগোল৷
বৃষ্টি আরও বেড়ে গেছে৷ ওদের জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে৷ গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ হচ্ছে৷ ভেজা মাটি থেকে বৃষ্টির অদ্ভুত গন্ধ উঠছে৷
দীপায়নদের নানান উপদেশ আর খোঁচার জবাবে রাহুল বলল, ‘আজ রাতটা তো ও আমাদের বাড়িতে থাক৷ কাল সকালে বাপি যা করার করবে…৷’
কাঁচা রাস্তায় বৃষ্টির জল পড়ে কাদা তৈরি হচ্ছিল৷ তার ওপরে ওরা ছপছপ শব্দে পা ফেলে এগোচ্ছিল৷ খালি পায়ে চলার জন্য লোকটার বেশ অসুবিধে হচ্ছিল৷ কারণ, পথের নানা জায়গায় ইট-পাথরের টুকরো, গাছের ভাঙা ডাল মাড়িয়ে চলতে হচ্ছিল৷ কিন্তু লোকটা মুখে টুঁ শব্দটিও করছিল না৷ সরল মুখে মাথা নীচু করে হাঁটছিল৷
একটা পুকুরের কাছে এসে রাহুলের পথ আলাদা হয়ে গেল৷ ও লোকটাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল৷ গোপালদের বলল যে, কাল কী হয় না হয় সেটা কাল ওদের জানাবে৷
রাহুল বৃষ্টিতে বেশ ভিজে গেছে৷ ও বাঁ-হাতের পাতা কপালের সামনে গাড়িবারান্দার মতো রেখে বৃষ্টির ছাট আটকাতে চেষ্টা করছিল৷ লক্ষ করল, এতটা পথ আসার সময় লোকটা একবারও বৃষ্টি আড়াল করার চেষ্টা করেনি৷ বরং এমনভাবে ও পথ চলছে যেন বৃষ্টি পড়ছেই না৷
রাহুল হঠাৎই ওকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
লোকটা ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল৷ ভাবলেশহীন নিষ্পাপ মুখ৷ কোনও উত্তর দিল না৷
রাহুল আবার একই কথা জিগ্যেস করল৷
কোনও উত্তর নেই৷
তবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রাহুলের মনে হল, ও যেন তীব্রভাবে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করছে৷ হয়তো ওর নামটাই মনে করার চেষ্টা করছে৷
রাহুল হাল ছাড়ল না৷ তৃতীয়বার ওর নাম জানতে চাইল৷
এবার লোকটা ভাঙা কর্কশ গলায় টেনে-টেনে জবাব দিল, ‘কোকো৷ আমার নাম কোকো৷ কো-কো…৷’
কোকো! কী অদ্ভুত নাম! আপন-মনেই ভাবল রাহুল৷
কালচে আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ তারপরই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷
বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিল রাহুল৷ বাউন্ডারির গ্রিলের গেটের হুড়কো খুলে ভেতরে ঢুকল৷ ওর হাত আঁকড়ে থাকা কোকোও ঢুকে পড়ল ওর সঙ্গে৷
বাউন্ডারির গেট থেকে ইট-পাতা পথ চলে গেছে একতলা বাড়িটা পর্যন্ত৷ বাড়ির বাঁ-দিকটায় বেশ কয়েকটা গাছপালা৷ অযত্নে বেড়ে ওঠা বাগান৷ তার একটা ছোট অংশে অনেক ফুলগাছ৷ আর তার পাশে একটা টিউবওয়েল৷
ইট-পাতা পথ ধরে এগোতে-এগোতেই রাহুল চেঁচিয়ে মা-কে ডাকল, ‘মাম, শিগগির দরজা খোল৷ একেবারে ভিজে গেছি৷’
বাড়ির দরজায় পৌঁছে মা-কে আরও একবার ডাকল রাহুল৷ একইসঙ্গে কলিংবেল টিপল৷
দরজা খুলে গেল৷ মা দরজায় দাঁড়িয়ে৷ ওকে দেখেই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘ঠিক জানতাম আজ তুই বৃষ্টিতে ভিজবি৷ তোর বাপিকে বলছিলাম…’ মায়ের কথা মাঝপথেই থেমে গেল, কারণ কোকোকে তিনি এইমাত্র খেয়াল করেছেন৷
রাহুলের মা গলা নামিয়ে ছেলেকে জিগ্যেস করলেন, ‘এ কাকে সঙ্গে এনেছিস?’
রাহুল বলল, ‘মাম, ওর নাম কোকো৷ ওর খুব বিপদ৷ ঘিয়ার পাড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল…৷’
৷৷দুই৷৷
পরদিনটা ছিল রবিবার৷ রবিবারটা সবসময়েই রাহুলের কাছে কেমন যেন অন্যরকম দিন বলে মনে হয়৷ সেদিন সকালে যে-সূর্যটা ওঠে সেটা অন্যরকম৷ সকালে যে-পাখিগুলো ডাকে তাদের ডাকগুলো আলাদা৷ ওদের বাগানে যে-ফুলগুলো ফোটে রবিবার তাদের একটু বেশি হাসিখুশি বলে মনে হয়৷
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে রাহুল সেই ‘অন্যরকম’ সকালটাকে অনুভব করল৷ তারপরই ওর মনে পড়ে গেল কোকোর কথা৷
জানলা দিয়ে আকাশ দেখল রাহুল৷ ছেঁড়া-ছেঁড়া ছাই-রঙা মেঘ৷ তার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ভোরের খবর পাঠাচ্ছে পৃথিবীতে৷ গাছের চকচকে সবুজ পাতায় সেই আলো ঠিকরে যাচ্ছে৷ কাল সন্ধের বৃষ্টিতে পাতাগুলো স্নান-টান সেরে আজ একেবারে ঝক-ঝকে হয়ে সেজে উঠেছে৷ তারই ফাঁকে-ফাঁকে ভেসে বেড়াচ্ছে পাখির ডাক৷
আজ সকালটাকে দেখে মনেই হয় না কাল সন্ধেয় ওরকম ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল৷
বিছানা ছেড়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল রাহুল৷ আর তখনই কোকোকে দেখতে পেল৷
বারান্দার ডানদিকে ফুলের বাগান৷ সেখানে অনেকগুলো সূর্যমুখী ফুলের গাছ৷ এখন দু-চারটে ফুল ফুটেছে—বাকি সব কুঁড়ি৷ তার পাশেই কয়েকটা বেলফুল আর গোলাপের গাছ৷ তাতে সাদা আর গোলাপি ফুল৷ নাকে না হলেও মনে-মনে ফুলের গন্ধ পেল রাহুল৷ নাক টেনে চোখ বুজল ও৷
চোখ খুলতেই কোকোকে দেখতে পেল৷ একটা জামগাছের আড়াল থেকে ছুটে বেরিয়ে এল৷ তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে নেচে-নেচে ছুটে বেড়াতে লাগল আর একই সঙ্গে হাততালি দিতে লাগল৷
ভালো করে খেয়াল করতেই রাহুল একটা হলদে-কালো প্রজাপতিকে দেখতে পেল৷ প্রজাপতিটা ফুলের বাগানে এলোমেলো উড়ে বেড়াচ্ছে আর কোকো তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওটার পিছন-পিছন ছুটছে৷
না, প্রজাপতিটা ধরার জন্য ও মোটেই ছুটছে না৷ বরং এক বিচিত্র উল্লাসে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ওটাকে অনুসরণ করছে৷
সাতাশ-আটাশ বছরের ছেলেটাকে একটা বাচ্চা ছেলে বলে মনে হল রাহুলের৷ সরল ভোলাভালা চোখ, শরীরের কাটা-ছেঁড়া সম্পর্কে উদাসীন, কোথা থেকে ও এসেছে, কোথায় যাবে, সে-সম্পর্কে ওর চিত্ত ভাবনাহীন৷
বারান্দার গ্রিলের দরজা ঠেলে সরিয়ে দু-ধাপ সিঁড়ি নামল রাহুল৷ পায়ে-পায়ে বাগানের দিকে এগোল৷
বাগানের মাটি ভেজা৷ কোথাও-কোথাও কাদা প্যাচপেচে হয়ে আছে৷
ফুলগাছগুলোর দিকে তাকাল রাহুল৷ হলদে-কালো প্রজাপতিটা ছাড়াও কয়েকটা ফড়িং ওড়াউড়ি করছে সেখানে৷ কিন্তু কোকোর যত আগ্রহ প্রজাপতিটাকে নিয়ে৷
রাহুলকে দেখতে পেয়েই খুশিতে উজ্জ্বল হল কোকোর মুখ৷ ও চেঁচিয়ে বলল, ‘এই…দ্যাখো৷ প্রজা…পতি৷ হলুদ…আর…কালো৷ প্রজা…পতি৷’
একইরকম কর্কশ স্বর আর টেনে-টেনে কথা বলা৷ যেন ঠান্ডা লেগে বরাবরের জন্য গলা ভেঙে গেছে৷
কোকোর উৎসাহ, খুশি, আর কথা বলার ঢং রাহুলের সমবয়েসি কোনও বন্ধুর মতন৷ কাল সন্ধে থেকেই ব্যাপারটা রাহুল লক্ষ করেছে৷ তাতে ও বেশ মজাও পেয়েছে৷
প্রথমটায় কোকোকে দেখে রাহুলের মাম আর বাপি খুব অবাক হয়েছিলেন৷ কোকোকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ভেতরের ঘরে রাহুলকে ডেকে নিয়ে মাম ওকে অনেক প্রশ্নও করেছেন৷
সেসব কথা শুনতে পেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বাপিও সেখানে এসে হাজির হয়েছেন৷ দুজনের প্রশ্নের ঠেলায় রাহুলের তো অবস্থা কাহিল!
বাপি বললেন, ‘বোঝোই তো…দিন-কাল ভীষণ খারাপ৷ ওকে তুমি চেনো না, জানো না…৷’
সেইসঙ্গে মাম যোগ করলেন : ‘তা ছাড়া ওর গায়ে অত জায়গায় কাটা…রক্ত পড়ছে৷ কে জানে খুন-টুন করে পালিয়ে এসেছে কি না৷ তারপর থানা-পুলিশ হয়ে একেবারে কেলেংকারি হবে৷’
রাহুল অবাক হয়ে বলল, ‘তা হলে কোকো এখন কোথায় যাবে, মাম? ওর তো কেউ নেই! ও মনে হয় ঘিয়ার জলে ভেসে এসেছে৷ বললাম তো, ভিজে জামাকাপড়ে একটা গাছের তলায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল…৷’
বাপি কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, ‘কাল থেকে সবাই তো ওর কথা জিগ্যেস করবে৷ তখন কী জবাব দেব?’
‘কেন বাপি, যা সত্যি তাই বলবে!’ রাহুল সঙ্গে-সঙ্গে সমাধান জুগিয়ে দিল, ‘কোকো আমাদের কাছে থাকলে তাতে কার কী!’
‘এভাবে বলতে নেই, রাহুল৷’ মাম ওকে শাসনের গলায় বললেন, ‘তা ছাড়া তুমি তো জানো, এখন চার-পাশে যা চলছে তাতে কোনও অচেনা লোককে এভাবে শেলটার দেওয়া ঠিক নয়৷ কে বলতে পারে যে, লোকটা চোর কিংবা ডাকাত নয়! কাল বরং থানায়…৷’
‘আমি…চোর…না৷ আমি…ভালো৷’
এ-কথা শুনে তিনজনেই চমকে ঘুরে তাকিয়েছে৷
কোকো বাইরের ঘর ছেড়ে কখন যেন ঢুকে পড়েছে ভেতরের ঘরে৷ তারপর ওর ভাঙা গলায় নিজের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট নিজেই প্রচার করে চলেছে৷
‘বিশ্বাস…করো৷ আমি…চোর…না৷ আমি…খুব…ভালো৷’
ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া সরল ছেলেটার মুখে এ-কথা শুনে বাপি হেসে ফেললেন৷
রাহুল ছুটে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরে বলল, ‘কোকো, তুমি খুব ভালো৷ গুড বয়৷’
কোকো হাসল : ‘আমি…গুড…বয়৷ আমি…গুড…বয়৷’
মাম কোকোর দিকে চেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না৷
রাহুল মামের কাছে এল আবার৷ মামের হাত ধরে আবদারের গলায় বলল, ‘মাম, ওকে শিগগির শুকনো জামাকাপড় দাও৷ ওর যে ঠান্ডা লেগে যাবে!’
মাম চমকে উঠে ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠলেন৷
বাপিও বললেন, ‘রাহুল ঠিক বলেছে৷ ওকে আগে শুকনো জামা-প্যান্ট দাও৷ রাহুলেরটা ওর গায়ে হবে না—আমার একটা পাজামা আর শার্ট দাও৷ তারপর ওর কাটা জায়গাগুলোয় লাল ওষুধ আর ব্যান্ড-এইড লাগিয়ে দিচ্ছি৷’
রাহুল কৃতজ্ঞতার চোখে বাপির দিকে তাকাল৷
বাপি বললেন, ‘শোন, ওকে আগে ড্রেস-ট্রেস দিয়ে ট্রিটমেন্ট করে কিছু খাওয়াই৷ বোধহয় বেচারা অনেকক্ষণ না খেয়ে আছে৷ তারপর…৷’
রাহুল অবাক চোখে বাপির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘তারপর কী?’
‘তারপর ওকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে৷ ওর হিস্ট্রিটা জানার চেষ্টা করতে হবে, বুঝলি?’
রাহুল কী বুঝল কে জানে! কিন্তু ও আলতো করে ঘাড় নাড়ল৷
কোকো রাহুলের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি…গুড… গুড…বয়…৷ ভেরি…গুড…বয়৷’
রাহুল হেসে বলল, ‘ভেরি গুড বয়৷’
সেই ‘ভেরি গুড বয়’ এখন বাপির একটা নীল হাফশার্ট আর পাজামা পরে বাগানে প্রজাপতির পিছনে ছুটছে৷
বাপি কাল রাতেই কোকোর ‘হিস্ট্রি’ জানার চেষ্টা করেছেন৷ যেটা নিয়ে বাপির বিশেষ কৌতূহল ছিল সেটা নিয়েও ওকে প্রশ্ন করেছেন৷ সেই জিনিসটা নিয়ে মাম আর রাহুলেরও ভীষণ কৌতূহল ছিল৷ তাই রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ওরা তিনজনে কোকোকে নিয়ে বসেছে৷
কোকো বসবার ঘরের একটা চেয়ারে হাঁটু মুড়ে বাবু হয়ে বসেছিল৷ ও আরামের শব্দ করে কয়েকবার ঢেঁকুর তুলল৷ রাহুল, বাপি আর মামের মুখের দিকে একবার করে তাকাল৷
রাহুলরা তিনজন কোকোকে প্রায় ঘিরে বসেছিল৷ ওকে কিছুক্ষণ লক্ষ করার পর বাপি জিগ্যেস করলেন, ‘কোকো, তোমার গলায় ওটা কীসের ব্যান্ড?’
কোকো কোনও জবাব দিল না৷ ওর ডানহাতটা গলার কাছে চলে গেল৷ স্টিলের ব্যান্ডটার ওপরে ও আঙুল বোলাতে লাগল৷
বাপি আবার জিগ্যেস করলেন, ‘ওটা কীসের বেল্ট, কোকো? বলো—কোনও ভয় নেই৷ তুমি তো গুড বয়৷’
অল্প হাসল কোকো৷ অস্পষ্টভাবে বলল, ‘আমি তো…গুড বয়৷’
এবার রাহুল ওকে জিগ্যেস করল, তোমার গলার এই ব্যান্ডটা কীসের, কোকো?’
কোকো তেরছা চোখে সিলিং-এর দিকে তাকাল৷ একমনে কী যেন ভাবার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ৷ তারপর হঠাৎ খুশির সুরে বলে উঠল, ‘মনে…পড়েছে৷ এটা কন্ট্রোল…ব্যান্ড৷ আমি..গুড…বয়৷’
কন্ট্রোল ব্যান্ড! কীসের কন্ট্রোল ব্যান্ড? রাহুল অবাক চোখে কোকোর গলার ব্যান্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল৷
জিনিসটা চেহারায় অনেকটা ঘড়ির ব্যান্ডের মতো৷ তবে মসৃণ গোল নয়৷ চার জায়গায় কবজার জোড় রয়েছে৷ আর ব্যান্ডটার ডানদিকে—মানে, কোকোর বাঁ-কানের ঠিক নীচে—একটা চ্যাপটা চৌকোনা মেটাল বক্স লাগানো রয়েছে৷ বক্সটার মাপ অনেকটা দেশলাইয়ের বাক্সের মতো৷ তবে মাত্র পাঁচ কি ছ’মিলিমিটার পুরু৷ সেই বাক্সের ওপরে চারটে খুদে এল. ই. ডি. ল্যাম্প৷ এখন নিভে আছে৷
‘এই কন্ট্রোল ব্যান্ডটা তুমি কী জন্যে গলায় পরে আছ?’ রাহুল জিগ্যেস করল, ‘কে তোমার গলায় এটা পরিয়ে দিয়েছে?’
আবার চিন্তায় পড়ে গেল কোকো৷ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বলল, ‘মনে পড়েছে৷ এটা মাস্টারজি…পরিয়ে…দিয়েছে৷ মাস্টারজি…দিয়েছে৷’
‘কে মাস্টারজি?’ মাম জিগ্যেস করলেন৷
কোকো একগাল হেসে বলল, ‘মাস্টারজি৷ মাস্টারজি৷’
বাপি আর রাহুলও বারকয়েক একই প্রশ্ন করল কিন্তু কোকোর সেই একই উত্তর৷
তখন বাপি জিগ্যেস করলেন, ‘এটা তুমি গলায় পরেছ কেন?’
কোকো দু-পাশে মাথা নাড়ল৷ ও জানে না৷
‘এটার নাম কন্ট্রোল ব্যান্ড কে বলল?’
‘মাস্টারজি—’
‘মাস্টারজির নাম কী?’
‘মাস্টারজি৷’
‘মাস্টারজি কোথায় থাকেন?’
‘অনেক…দূরে৷ অনেক…দূরে৷’
বাপি কী মনে করে কোকোর গলার ব্যান্ডটার দিকে হাত বাড়ালেন : ‘তোমার ব্যান্ডটা একটু দেখি তো…৷’
সঙ্গে-সঙ্গে সাপের ছোবল খাওয়া মানুষের মতো পিছনে ছিটকে গেল কোকো৷ ভয় পাওয়া চোখে বাপির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না…না৷ এটায়…কেউ…হাত দেবে না৷ মাস্টারজির বারণ৷’
‘মাস্টারজির বারণ’ শব্দ দুটো বারবার আওড়াতে লাগল কোকো৷ ঠিক যেন পুজোর মন্ত্র পড়ছে৷
বাপি, মাম, আর রাহুল চোখ চাওয়াচাওয়ি করল৷ মাম চাপা গলায় বাপিকে বললেন, ‘ছেড়ে দাও৷ মনে হয় ব্যান্ডটা নিয়ে ওর কোনও মেন্টাল প্রবলেম আছে৷ পরে কখনও সুযোগ পেলে ওটা দেখো…৷’
বাপি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন৷
রাহুল কোকোর হাত-পায়ে লাগানো ব্যান্ড-এইডগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘তোমার হাতে-পায়ে কেটে গেল কী করে?’
রাহুলের কথায় আবার সোজা হয়ে বসল কোকো৷ পায়ের ভাঁজ খুলে মেঝের দিকে পা ঝুলিয়ে দিল৷ তারপর অবাক হয়ে নিজের হাতে আর পায়ে লাগানো ব্যান্ড-এইডগুলোর দিকে দেখল, সেগুলোর ওপরে আঙুল বোলাল৷ কিন্তু কোনও উত্তর দিল না৷
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রাহুল আবার একই প্রশ্ন করল৷
রাহুলের দিকে সরল চোখে তাকাল কোকো৷ ধীরে-ধীরে বলল, ‘মাস্টারজি মেরেছে৷ খুব…মেরেছে৷’
রাহুলের মনে কষ্ট হল৷ ও মাম আর বাপির দিকে তাকাল৷
মাম বললেন, ‘আহা রে, এভাবে কেউ মারে?’
বাপি বিড়বিড় করে বললেন, ‘ব্যাপারটা আমার তো খুব মিস্টিরিয়াস লাগছে৷ যাকে ও ‘‘মাস্টারজি’’ বলছে সে কোথাকার মাস্টার? স্কুল- কলেজের, না অন্য কিছুর?’
রাহুল এবার কোকোর গালের চাকা-চাকা দাগগুলোর দিকে দেখাল৷ আঙুল বাড়িয়ে একটা দাগ সামান্য ছুঁতেই কোকো ‘উঃ!’ করে উঠল৷
‘কোকো, এই দাগগুলো কী করে হয়েছে? এখানে ব্যথা নাকি?’
কোকো নিষ্পাপ সরল চোখে কয়েক মুহূর্ত রাহুলের দিকে তাকিয়ে রইল৷ তারপর কী বুঝল কে জানে! আলতো করে বলল, মাস্টারজি৷ সিগারেট খায়৷ সিগারেটের ডগায়…আগুন থাকে৷ সেই আগুন দিয়ে…ছ্যাঁকা দিয়েছে৷ ছ্যাঁকা৷ তিনবার৷ আরও দিত৷ আমি…আমি…৷’
‘‘‘আমি’’ কী?’ রাহুল ওকে কথা ধরিয়ে দিতে চাইল৷
‘আমি কেউ না৷ আমার…কেউ…নেই৷ মা…নেই৷ বাবা…নেই৷’
কোকো হঠাৎই কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়ল৷ বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল৷
সেটা লক্ষ করে বাপি বললেন, ‘রাহুল, ওকে এবার রেস্ট নিতে দাও৷ আমার মনে হচ্ছে, ও বেশ ট্রাবলড৷ মেন্টালি আপসেট হয়ে আছে৷ তা ছাড়া ওর বুদ্ধির ব্যাপারটাও বোধহয় স্বাভাবিক নয়৷’
মাম বাপিকে বললেন, ‘ও ক’টা-দিন আমাদের কাছে থাকুক৷ একটু সেরে-টেরে উঠুক—তারপর পুলিশে খবর দিয়ে ওর বাড়ির খোঁজখবর করা যাবে৷ এখন ওকে থানা-পুলিশে দিলে ওকে পাগলদের হোমে পাঠিয়ে দেবে৷’
‘না, না, ওখানে কিছুতেই ওকে পাঠিয়ো না, বাপি!’ রাহুল প্রায় অনুনয়ের সুরে বলল৷
খবরের কাগজ আর টিভি দেখে রাহুল জানে ওই সব সরকারি হোমে আবাসিকদের কী দুরবস্থার মধ্যে রাখা হয়৷ কেউ চরম হেনস্থা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে, আর কেউ-বা ওই হোম থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়৷
বাপি রাহুলের পিঠে আশ্বাসের হাত রেখে বললেন, ‘তুই কি খেপেছিস? ওকে ওই নরকে পাঠাব! ওর বাড়ি আর রিলেটিভদের ঠিকঠাক খবর না পাওয়া পর্যন্ত কোকোকে আমরা ছাড়ছি না৷’
রাহুল বাপির হাতটা জড়িয়ে ধরল৷ ভাবল মনে-মনে, বাপি কী ভালো!
কোকো ধীরে-ধীরে শান্ত হয়ে আসছিল৷ রাহুল ওর দিকে লক্ষ রাখছিল৷ দেখল, ওর শ্বাস-প্রশ্বাস আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে৷ মুখটা যেন চার-পাঁচ বছরের কোনও শিশুর মুখ৷ সেই ফরসা টুকটুকে মুখে সিগারেটের ছ্যাঁকা! মাস্টারজির কাছে কী অন্যায় করেছিল কোকো যে ওকে এমন করে নৃশংসভাবে শাস্তি দিয়েছে? রাহুলের টিচাররা তো রাহুলকে কত ভালোবাসেন৷ ওঁদের সঙ্গে থাকতে রাহুলের কত ভালো লাগে!
কোকো হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি টিভি দেখব৷’
এ-কথায় বাপি আর মাম হেসে উঠলেন৷ বাপি বললেন, ‘হ্যাঁ, ওকে এবার ছেড়ে দাও৷ একটু টিভি-ঠিভি দেখুক—রিল্যাক্স করুক৷ রাহুল—’ রাহুলের কাঁধে হাত রাখলেন বাপি : ‘ওকে নিয়ে টিভি দ্যাখো৷ ওর সঙ্গে থাকো৷ তবে বেশি রাত কোরো না…৷’
কাল রাতে কোকোর সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছে রাহুল৷ ওর সঙ্গে টিভি দেখেছে৷ তারপর কয়েকটা রঙিন কমিকস-এর বই ওকে দেখতে দিয়েছে৷ শেষে ক্লান্ত হয়ে কোকো যখন হাই তুলছিল তখন ওরা শুয়ে পড়েছে৷
রাহুলের ঘরেই মাম কোকোর জন্য বিছানা পেতে দিয়েছিল৷ সেখানে গা এলিয়ে দেওয়ামাত্রই কোকো নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ অথচ কোকোর কথা ভেবে-ভেবে রাহুলের ঘুম এসেছে অনেক দেরিতে৷
এখন সেই শিশু-যুবক একগাল খুশি নিয়ে হলদে-কালো প্রজাপতির পিছনে নেচে-নেচে ছুটে বেড়াচ্ছে৷
রাহুলকে কাছে আসতে দেখে কোকো আবার বলে উঠল, ‘রাহুল, এই দ্যাখো…প্রজাপতি৷ প্রজা…পতি৷’
রাহুল হেসে ঘাড় নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ, প্রজাপতি৷ প্রজাপতি…সুন্দর৷’
‘প্রজাপতি…সুন্দর৷’ রাহুলের কথার প্রতিধ্বনি তুলল কোকো৷
৷৷তিন৷৷
বাজারের থলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বাপি রাহুলকে ডাকলেন৷
রাহুল ওর ঘরে কোকোকে নিয়ে বসেছিল৷ ওর বইপত্র, ক্রিকেটের ব্যাট-বল, এটা-সেটা কোকোকে দেখাচ্ছিল৷ সেই সময় বাপি দরজায় এসে হাজির হলেন৷
‘কী রে, রাহুল—আমার সঙ্গে বাজারে যাবি তো!’
প্রত্যেক রবিবারে রাহুল বাপির সঙ্গে বাজারে যায়৷ এমনিতে বাপির সঙ্গে ঘুরে-ঘুরে বাজার করতে রাহুলের ভালো লাগে৷ তা ছাড়া রবিবারে বাপি একটু বেশি করে বাজার করেন—যাতে পরের তিনদিন বাজারে না গেলেও চলে৷ সেইজন্য রবিবারে বাপি তিনটে থলে নিয়ে বেরোন৷ ফেরার সময় থলেগুলো বেশ ভারীও হয়৷ রাহুল সঙ্গে থাকলে সবচেয়ে কম ওজনের থলেটা বয়ে বাপিকে সাহায্য করে৷
রাহুল কোকোকে ছেড়ে চটপট উঠে পড়ল৷ হাতে তালি দিয়ে হাত ঝেড়ে নিয়ে বলল, ‘চলো, বাপি—’ দরজার দিকে এগোতে-এগোতে কোকোকে লক্ষ করে বলল, ‘কোকো, তুমি এগুলো নিয়ে খেলা করো, আমি বাপির সঙ্গে বাজার করে এক্ষুনি ফিরে আসছি৷’
কোকো কিন্তু ততক্ষণে মেঝে থেকে উঠে পড়েছে৷ রাহুলের দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বলে উঠেছে, ‘আমিও তোমার সঙ্গে যাব৷’
কোকো ওদের সঙ্গে গেলে রাস্তায় পাঁচজন পাঁচকথা জিগ্যেস করবে৷ সে-কথা ভেবেই রাহুল সাততাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, কোকো—এরকম জেদ করতে নেই৷ তুমি না গুড বয়?’
‘আমি…গুড…বয়৷ কিন্তু তোমাদের সঙ্গে…বাজারে…যাব৷’ গোমড়া মুখ করে কোকো বলে উঠল৷
বাপি এবার বললেন, ‘না, কোকো৷ গুড বয়রা কথা শোনে৷ তুমি এখানে থাকো—খেলা করো—আমরা এক্ষুনি ফিরে আসব৷’
কোকো পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো অভিমানী মুখ করে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আমি…বাজারে…যাব৷ আমি…বাজারে…যাব…৷’
রাহুলের মাথায় হঠাৎই একটা বুদ্ধি খেলে গেল৷ শেষ অস্ত্র হিসেবে সেটা প্রয়োগ করল ও৷
‘তোমার তো চটি-জুতো কিচ্ছু নেই—আমাদের সঙ্গে তুমি যাবে কেমন করে! বাজারে ভীষণ জল-কাদা…৷’
এ-কথা শোনামাত্রই কোকোর মুখে হাসি ফুটে উঠল৷ ও রাহুল আর রাহুলের বাপিকে অবাক করে দিয়ে ‘চটি…আছে! চটি…আছে!’ বলে গ্রিল দেওয়া বারান্দার দিকে ছুট লাগাল৷
রাহুল আর বাপিও ওর পিছন-পিছন এগোল৷
গ্রিল ঘেরা বারান্দার একপাশে রাহুলদের সবার চটি-জুতো থাকে৷ সেটা গতকালই বোধহয় কোকোর নজরে পড়েছে৷ রাহুলরা যখন বারান্দায় এসে পৌঁছল ততক্ষণে রাহুলের মায়ের একজোড়া চটি পায়ে দিয়ে কোকো একেবারে বাউন্ডারির গেটে পৌঁছে গেছে৷ সেখান থেকে কোকো দু-হাতে হাতছানি দিয়ে রাহুলকে ডাকছে : ‘এই তো চটি পরেছি! রাহুল, তাড়াতাড়ি এসো…তাড়াতাড়ি…৷ আমি… বাজারে…যাব৷ বাজারে…৷’
ওর কাণ্ড দেখে রাহুল হেসে ফেলল৷ বাপিও আর হাসি চেপে রাখতে পারলেন না৷ রাহুলের মা কখন যেন রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন৷ কোকোর কাণ্ড দেখে হেসে বললেন, ‘ওইটুকু বাচ্চা! ও কখনও বোঝে কোন চটিটা ছেলেদের আর কোনটা মেয়েদের!’
‘ওইটুকু বাচ্চা!’ বাপি অবাক হয়ে মামের দিকে তাকালেন : ‘কী বলছ তুমি? ওর বয়েস কম করেও পঁচিশ কি ছাবিবশ হবে৷’
মাম কেমন একটা অদ্ভুত গলায় বললেন, ‘সে হোক গে৷ ক্যালেন্ডার দিয়ে কি সবসময় বয়েস মাপা যায় নাকি! ও আসলে একটা বাচ্চা ছেলে…৷’
তো সেই পঁচিশ-ছাবিবশ বছরের ‘বাচ্চা’ ছেলেটা রাহুল আর বাপির সঙ্গে বাজারের পথ ধরল৷ রাহুল লক্ষ করল, চলার পথে কোকো অবাক হয়ে সব কিছু দেখছে৷ যেন ও সদ্য পৃথিবীতে এসে একের পর এক নতুন আবিষ্কার করে চলেছে৷ চকচকে উদগ্রীব চোখে ও দেখছে আকাশ, সূর্য, গাছপালা, ফুল, পাখি, সাইকেল রিকশা, গোরুর গাড়ি, সাইকেল, মোটরবাইক, ভ্যান-রিকশা, টালির দোচালা-চারচালা ঘর, জল-কাদা, ঘাস, মানুষজন—আরও কত কী!
কোকোর চোখের দিকে তাকিয়ে রাহুলের মনে অনেক প্রশ্ন জাগছিল৷ মাস্টারজি, সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ, হাত-পায়ের ক্ষতচিহ্ন, কন্ট্রোল ব্যান্ড, ঘিয়া নদীর জলে ভেসে আসা একটা মানুষ…আরও কত বিষয় ঘিরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন৷ আবার একইসঙ্গে মনে পড়ছিল গতকালের সেই হাহাকার : ‘আমার…কেউ…নেই৷ মা…নেই৷ বাবা…নেই৷’ শিশু-যুবকটির তখনকার সর্বহারা অসহায় মুখের কথা মনে করে রাহুলের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল৷ ও তাকাল কোকোর দিকে৷ ওর মুখে এখন নতুন পৃথিবীর নতুন-নতুন জিনিস আবিষ্কারের আনন্দ৷
বাজারে পৌঁছে অন্যান্য রবিবারের মতো বাপি প্রথমে আনাজপাতি কিনতে শুরু করলেন৷ সরু-সরু বাঁশের ডগায় পলিথিনের ছাউনি খাটিয়ে দোকানিরা বসেছে৷ কেউ রাস্তার ধারে, কেউ-বা রাস্তার লাগোয়া মাঠে৷ চারদিকের নানারকম শব্দ বলে দিচ্ছিল এটা একটা ব্যস্ত জায়গা৷ লোকজনের কথাবার্তা, সাইকেলের ঘণ্টি, ভ্যান-রিকশার প্যাঁক-প্যাঁক, মোটরবাইকের আওয়াজ—কতরকমের শব্দ! তিন-চাররকম সবজি কেনা হতেই কোকো জেদ করে, বায়না করে, সেই থলেটা বাপির হাত থেকে নিয়ে নিল৷ বলল, বাজারের একটা থলে ও বইবে, কারণ, ওর গায়ে জোর আছে৷
এ-কথায় রাহুল যখন হেসে বলেছে, ‘তোমার গায়ে জোর আছে মানে?’
তখন কোকো জবাব দিয়েছে, ‘মাস্টারজি বলে৷ আমার…গায়ে খুব…জোর৷’
রাহুল তখন অবাক হয়ে কোকোর দিকে তাকিয়েছে শুধু—কোনও কথা বলেনি৷
ঘুরে-ঘুরে বাজার করার কাজ শেষ হল একসময়৷ বাপি, রাহুল আর কোকো বাড়ির পথ ধরল৷ অন্যান্য রবিবার রাহুল আর বাপি সাইকেল-রিকশায় ফেরেন৷ কিন্তু আজ কোকো সঙ্গে আছে—রিকশায় তিনজন আঁটবে না৷ তার ওপর তিন-তিনটে থলে৷
ফেরার পথে রাহুল আর কোকো গল্প করছিল৷ রাহুল বলছিল, কোকো অবাক হয়ে শুনছিল৷ আর মাঝে-মাঝে চারপাশটা দেখছিল৷
হঠাৎই দূরে একটা গোরুর গাড়ি দেখতে পেল রাহুল৷ অনেকগুলো বস্তা বোঝাই করে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে৷ রাস্তার খানাখন্দে পড়ে চাকাগুলো একবার ডানদিকে একবার বাঁ-দিকে হেলে যাচ্ছে৷
রাহুল আঙুল তুলে গোরুর গাড়িটা কোকোকে দেখাল, বলল, ‘ওই দ্যাখো, গোরুর গাড়ি…৷’
‘আমি…আগে…গোরুর গাড়ি…দেখেছি৷’ স্মৃতি খুঁজে পাওয়ার আনন্দে কোকোর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷
বাপি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন৷ নীল আকাশে ছোট-ছোট মেঘ ভেসে আসছে সূর্যের কাছাকাছি৷ কয়েকটা লম্বা-লম্বা গাছ মাথা তুলে রয়েছে আকাশের দিকে৷ বাতাসে অল্প-অল্প নড়ছে৷
বাপি মুগ্ধ চোখে আকাশটাকে দেখছিলেন৷ রাহুল বুঝতে পারছিল বাপির এখনই রং-তুলি নিয়ে বসে পড়তে ইচ্ছে করছে৷ ছবি আঁকা বাপির একমাত্র শখ৷ সময় পেলেই জল রং আর তুলি নিয়ে বসে পড়েন৷ মাঠ, ঘাট, নদী, গাছপালা আঁকেন৷ বাপির কাছে রাহুল শুনেছে, এ ধরনের ছবিকে ল্যান্ডস্কেপ বলে৷
রাহুল একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল৷ হঠাৎই লোকজনের হইচই চিৎকারে ও চমকে উঠল৷ আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল সামনের দিকে৷
গোরুর গাড়িটার একটা চাকা আচমকা ভেঙে কাত হয়ে গেছে৷ ফলে বস্তা-বোঝাই গাড়িটা হেলে পড়েছে রাস্তার ধারের নালার দিকে৷ কয়েকটা বস্তা ধীরে-ধীরে গড়িয়ে পড়ছে নালার গর্তে৷ মাথায় গামছা জড়ানো গাড়োয়ান হাতের ছিপটি ছুড়ে ফেলে লাফ দিয়েছে রাস্তায়৷ বলদ দুটো ঘাড় কাত করে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে৷
লোকজন ছুটে যাচ্ছিল বিপজ্জনক-ভাবে হেলে পড়া গাড়িটার দিকে৷ মনে হচ্ছিল, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোরুর গাড়িটা বস্তাসমেত নালায় গড়িয়ে পড়বে৷ গতকালের বৃষ্টির জল নালায় জমে আছে৷ এর মধ্যেই গড়িয়ে পড়া তিনটে বস্তা জলে ভিজে একসা৷ ভেজা বস্তা দেখে রাহুল বুঝল, বস্তায় আলু আছে৷
হাতের থলেটা রাস্তায় নামিয়ে রেখে কোকো কখন যেন ছুট লাগিয়েছিল৷
রাহুল পিছন থেকে ‘কোকো! কোকো!’ বলে চিৎকার করে ওকে ডাকতে লাগল৷ কিন্তু ছেলেটা শুনলে তো!
রাহুল দেখল, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কোকো হেলে পড়া গোরুর গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল৷ ঝুঁকে পড়ে গাড়িটার লম্বা বাঁশের কাঠামোর নীচে কাঁধ লাগিয়ে প্রাণপণে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল৷ ওর ফরসা মুখ লাল হয়ে গেল, চোখ-মুখ বিকৃত হয়ে গেল৷ মরিয়া হয়ে ও হেলে পড়া গাড়িটাকে চাগিয়ে তুলতে লাগল৷
রাস্তার একপাশে বাজারের থলে নামিয়ে রেখে বাপির দিকে একবার তাকিয়েই রাহুল ছুটতে শুরু করেছিল৷ ও যখন গোরুর গাড়িটার কাছে এসে পৌঁছল তখন গাড়ির হেলে পড়া দিকটা অনেকটা সোজা হয়ে গেছে৷ কোকোর হাতের শিরা ফুলে উঠেছে, গলার শিরা ফুলে উঠেছে৷ ও দম বন্ধ করে অবাক করা শক্তিতে গাড়িটাকে ঠেলে তুলে একটু-একটু করে সোজা করছে৷
ততক্ষণে রাস্তায় ভিড় জমে গেছে৷ লোকজন হইহই চিৎকার করে কোকোর এই অলৌকিক কাণ্ড দেখছে৷ বলদ দুটোর ঘাড়ের যন্ত্রণা কমে যাওয়ায় ওরা চিৎকার বন্ধ করেছে৷
ভিড়ের মধ্যে কে একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘সবাই কাঁধ লাগাও, ভাই—এসো!’
সঙ্গে-সঙ্গে শোরগোল উঠল৷ পাঁচ-ছ’জন মানুষ ছুটে গিয়ে কোকোর পাশাপাশি কাঁধ লাগাল৷ আওয়াজ তুলল, ‘মারো জোয়ান হেঁইয়ো…৷’
গাড়ির বিশাল চাকাটা নালার ঢালে কাত হয়ে পড়েছিল৷ কয়েকজন সেটা তুলে এনে গাড়ির পাশ থেকে বেরিয়ে থাকা রডে লাগিয়ে দিল৷ গোরুর গাড়িটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ওটার চাকার হুড়কোটা ভেঙে গিয়েছিল৷ তাই নতুন একটা লোহার হুড়কো জোগাড় করতে দুজন সাইকেল চেপে রওনা হয়ে গেল৷
কোকো গাড়িটা ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিল৷ হাঁপাচ্ছিল আর গাড়িটার দিকে তাকিয়ে দু-হাত জামায় ঘষে-ঘষে মুছছিল৷
রাহুল চেঁচিয়ে ওকে ডাকল, ‘কোকো…এদিকে এসো…৷’
কোকো ফিরে তাকাল৷ রাহুলকে দেখতে পেল৷ হেসে হাত নাড়ল৷ তারপর রাহুলের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷
কিন্তু ও আসবে কী! লোকজন ওকে ঘিরে ধরে সাবাশ দিতে লাগল৷
‘বাব্বাঃ, তোমার গায়ে তো হেভি জোর!’
‘তুমি কে হে? তোমার নাম কী? তোমাকে তো এ এলাকায় আগে দেখিনি! তবে হ্যাঁ, তোমার হিম্মত আছে বটে!’
‘সাবাশ, ভাই! একটা দারুণ জিনিস দেখালে৷’
‘ওকে একটা প্রাইজ দেওয়া উচিত৷’
‘তোমার গলায় ওটা কী বলো তো? এরকম পিকিউলিয়ার হার তো আগে দেখিনি…৷’
রাহুল তাড়াতাড়ি জটলার মধ্যে ঢুকে পড়ে কোকোর হাত ধরল৷ ওকে টেনে নিয়ে এল বাইরে৷ জনতার মধ্যে থেকে উৎসাহী কয়েকজন হাত বাড়িয়ে কোকোর পিঠ চাপড়ে দিল৷
বাপি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওদের কাছাকাছি এসে পড়েছিলেন৷ রাহুলকে বললেন, ‘শিগগির বাজারের থলে দুটো তুলে নিয়ে চল৷ এক্ষুনি নানানজন এসে কোকোকে নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন করবে…তখন মুশকিল হবে…৷’
রাহুল আর কোকো চটপট ওদের থলে দুটো তুলে নিয়ে এল৷ তারপর ওরা তিনজনে জলদি পায়ে হাঁটা লাগাল বাড়ির দিকে৷
কিন্তু নিরাপদে বাড়ি পৌঁছনো হল না৷
গোরুর গাড়ির ঘটনার জায়গা ছেড়ে বিশ-পঁচিশ পা যেতে না যেতেই রথপতি গুপ্তর সঙ্গে দেখা৷ ভদ্রলোক একসময়ে পঞ্চায়েতের সদস্য ছিলেন৷ এখন আর নেই৷ রেডিমেড জামা-কাপড়ের ব্যবসা করেন৷ কলকাতার কয়েকটা নামী দোকানে ছেলেমেয়েদের শৌখিন পোশাক সাপ্লাই করেন৷
রাহুলের বাপির সঙ্গে রথপতির বেশ ভালোই আলাপ৷ ভদ্রলোক সবসময় পাড়াপড়শির হাঁড়ির খবরের খোঁজ করে বেড়ান৷ সেটা বিরক্তিকর হলেও লোকজনের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ান৷ বিপদে আন্তরিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন৷
রাহুলের বাপির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন রথপতি৷ হেসে জিগ্যেস করলেন, ‘কেমন আছেন, কল্যাণবাবু?’
‘ভালো৷ আপনি কেমন আছেন?’
‘চলে যাচ্ছে আর কী!’ কোকোর দিকে তাকালেন রথপতি৷ আঙুল নেড়ে বললেন, ‘এই ছেলেটির জন্যে আজ গর্বে বুক ফুলে উঠছে৷ আমি ওই রিকশা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি৷ ওর সাহস আর শক্তির প্রশংসা করতে হয়৷ পরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া একটা বিশাল গুণ৷ কী নাম তোমার?’
কোকো কর্কশ গলায় বলল, ‘কোকো…৷’
‘সাবাশ, কোকো!’ কোকোর পিঠ চাপড়ে দিলেন রথপতি৷ তারপর চোখ সরু করে কল্যাণবাবুর দিকে তাকালেন : ‘কোকো আপনার কে হয়? ওকে তো আগে কখনও মণিমেলায়…মানে, আমাদের এ-গাঁয়ে দেখিনি—৷’
কল্যাণবাবু উত্তর দিতে একটুও দেরি করলেন না৷ গতকাল রাতে ভেবে-ভেবে তিনি গল্পটা তৈরি করে নিয়েছেন৷
‘ও আমার পিসতুতো দাদার ছেলে—শ্রীরামপুরে থাকে৷ ওর একটু সাইকিয়াট্রিক প্রবলেম আছে৷ ওখানে ডক্টরের ট্রিটমেন্টে আছে৷ তিনিই বলেছেন, কিছুদিন গ্রামের হাওয়া খেয়ে আসতে৷ মানে, গাছপালা মাঠঘাটের কাছাকাছি থাকলে ওর প্রবলেমটা তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে…৷’
‘কী প্রবলেম ওর?’
এতটা খোঁচানো কোশ্চেন রাহুলের বাপি আশা করেননি৷ তাই একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘এই…মানে…ওর মধ্যে একটা বাচ্চা-বাচ্চা ভাব আছে৷ যদিও ওর বয়েস প্রায় সাতাশ৷ তা ছাড়া গলাটা কেমন হোর্স… ধীরে-ধীরে কথা বলে…৷’
রথপতি গুপ্ত ভুরু কোঁচকালেন৷ আজব প্রাণী দেখার দৃষ্টিতে কোকোর দিকে তাকালেন : ‘ওর গলার ওই লোহার বালাটা কীসের?’
কল্যাণবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘ওটা একটা মেডিক্যাল ইলেকট্রনিক ব্যান্ড৷ ট্রিটমেন্টের জন্যে ওর ডক্টর দিয়েছেন৷’
‘বাব্বা! এসব তো বাপের জন্মে কখনও দেখিনি৷ এ আবার কী ধরনের রোগ?’
‘অ্যাকিউট মালটিপল সাইকো-প্যাথলজিক্যাল চাইল্ড সিনড্রোম৷ মানে, ওর সাইকিয়াট্রিস্ট তাই বলেছেন…৷’
এত লম্বা-চওড়া নামে রথপতি বেশ ঘাবড়ে গেলেন৷ আর কোনও প্রশ্ন করলেন না৷
কল্যাণ জানতেন যে, রথপতি বেশিদূর লেখাপড়া শেখেননি৷ তাই ওঁর অন্তর-খোঁচানো প্রশ্নমালা ঠেকানোর জন্য যা পেরেছেন বানিয়ে একটা খটমট রোগের নাম বলে দিয়েছেন৷ এ-নামে সত্যিই কোনও রোগ হয় কি না তিনি জানেন না৷
‘ও, আচ্ছা৷ তা ও তাড়াতাড়ি সেরে উঠুক৷’ আবার কোকোর পিঠ চাপড়ে দিলেন রথপতি : ‘তুমি বড় ভালো ছেলে, বাবা৷ তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো৷’
সামান্য হেসে রথপতি গুপ্ত চলে গেলেন৷
রাহুল বলল, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো, বাপি৷ নইলে কোকোকে নিয়ে আরও সবাই প্রশ্ন করবে৷’
বাপি ‘হ্যাঁ—চল৷’ বলে তাড়াতাড়ি পা চালালেন বটে, কিন্তু ওঁর মনে উদ্বেগ থেকেই গেল৷
বাজারে কয়েকজন কোকোর কথা জিগ্যেস করেছে৷ তখন মোটামুটি এরকম সাফাই দিয়েই ম্যানেজ করেছেন কল্যাণ৷ কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন, এই উত্তরে বেশিদিন চলবে না, কারণ, কোকোকে যে ঘিয়া নদীর পাড়ে পাওয়া গেছে এ-কথা আজ নয় কাল জানাজানি হবেই৷ তখন কী হবে?
বাপি আর ভাবতে পারছিলেন না৷ আনমনা ভাবে পা ফেলতে লাগলেন৷
রাহুল আর কোকো পাশাপাশি হাঁটছিল৷ কোকো হঠাৎই রাহুলকে লক্ষ করে বলল, ‘রাহুল আমার অ্যাকিউট…চাইল্ড হয়েছে৷ আমার সাইকিয়া…বলেছে৷’
ওর দিকে তাকিয়ে রাহুল আর বাপি দুজনেই হেসে ফেললেন৷
কোকো বাঁ-হাতটা পেটে দিয়ে বলল, ‘আমার খিদে পেয়েছে…৷’
‘হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি চলো, বাড়ি গিয়ে খাবে৷’ রাহুল বলল৷
কোকো খুশিতে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল : ‘কী মজা! আমি…বাড়ি…গিয়ে খাব…খাব৷’
৷৷চার৷৷
কোকোকে নিয়ে ভীষণ মুশকিলে পড়ে গেল রাহুল৷ ও কিছুতেই রাহুলকে কাছ-ছাড়া করতে চায় না৷ সোমবার রাহুল স্কুলে যাওয়া শুরু করতেই কোকোরও বায়না শুরু হয়ে গেল : ‘আমি রাহুলের সঙ্গে যাব৷ আমি…যাব৷’
শেষ পর্যন্ত ব্যাপার এমন দাঁড়াল যে, কোকো বাচ্চা ছেলের মতো কান্নাকাটি দাপাদাপি শুরু করে দিল৷
বাপি আগেই অফিসে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ বেগতিক দেখে রাহুলের মা কল্যাণবাবুকে ফোন করলেন৷
সব শুনে বাপি বললেন, ‘ঠিক আছে, বায়না করছে যখন তুমি আর ও রাহুলের সঙ্গে যাও৷ রাহুলকে স্কুলে দিয়ে তোমরা আবার ফিরে এসো৷ কোকো তো আসলে বাচ্চা ছেলে৷ শুধু দেখতেই যা বড়সড়৷ ও কি অত বোঝে?’
অগত্যা তাই হল৷ মাম, কোকো আর রাহুল স্কুলের পথ ধরল৷
স্কুল বেশি দূরে নয়৷ হাঁটা পথে স্কুলে যেতে-যেতে রাহুল কোকোকে অনেক গল্প বলছিল৷ স্কুলের গল্প, ফুটবল খেলার গল্প, গাঁয়ের মেলার গল্প, দুর্গাপুজোর সময় যে বিশাল উৎসব হয় তার গল্প৷
কোকোর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ও অন্য কোনও গ্রহের প্রাণী৷ এসব ব্যাপার যেন ও প্রথম জানছে রাহুলের কাছে৷
রাহুলকে স্কুলে দিয়ে মাম কোকোকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন৷ কোকো বারবার জিগ্যেস করতে লাগল, রাহুল কখন ফিরবে৷ মাম ওকে কোনওরকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করলেন৷
কোকো কিন্তু বাড়িতে বসে-বসে সময় কাটাল না৷ রাহুলের মা-কে সাহায্য করার জন্য পাগল হয়ে উঠল৷ মামের কোনও বারণ শুনল না৷
টিউবওয়েল পাম্প করে-করে ও বালতি-বালতি জলের জোগান দিতে লাগল৷ কাচা জামাকাপড় দড়িতে ছড়াতে লাগল৷ ঘরোয়া ফাইফরমাশ খাটতে লাগল৷ এ ছাড়া বাকি সময়টা কোকো বাগানে ঘুরে কাটাল৷ কখনও ফুল দেখতে লাগল, আবার কখনও পাখির খোঁজে হাঁ করে গাছের ঘন পাতার দিকে চেয়ে রইল৷ বিকেলের দিকে ও বাগানের একপাশে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম সেরে নিল৷
রাহুলের মা কোকোর ‘কীর্তি’ দেখছিলেন৷
দেখছিলেন কত সহজে আর কত তাড়াতাড়ি ও টিউবওয়েল পাম্প করে জল তুলছে৷ ওর সহজ ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন ও একটা খেলনা টিউবওয়েল পাম্প করছে৷ এ ছাড়া ঘরের ভেতর থেকে কোকোর ব্যায়ামও দেখছিলেন৷ জামা খুলে খালি গায়ে ও দাঁড়িয়ে ছিল৷ তারিফ করার মতো ঝকঝকে স্বাস্থ্য—সিনেমায় যেমন দেখা যায়৷ শুধু ফরসা বুকে কয়েকটা সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ৷ মাম বুঝলেন, মাস্টারজি মানুষটি এই ভোলাভালা শিশু-যুবকের ওপরে কম অত্যাচার করেননি!
কোকো প্রথমে খালি হাতে ব্যায়াম শুরু করল৷ ডন-বৈঠক ইত্যাদি শেষ করার পর ও বাগানের পাঁচিলের পাশ থেকে শ্যাওলা পড়া দুটো থান ইট তুলে নিল৷ সেগুলোকে ডাম্বেলের মতো ব্যবহার করে ও আবার শরীরচর্চা শুরু করল৷ ওর সারা গা ঘেমে উঠল, শরীরটা চকচক করতে লাগল৷
রাহুল স্কুল থেকে ফেরার পর কোকো আবার ওর ল্যাংবোট হয়ে ঘুরতে শুরু করল৷ ওর সঙ্গে খেলার মাঠে গেল৷ তারপর ওর সঙ্গে পড়তে বসে গেল৷ রাহুল একটা খাতা দিয়ে ওকে ‘অ-আ-ক-খ’ লিখতে বলল৷ কোকো অনভ্যস্ত হাতে আঁকাবাঁকা রেখায় বর্ণগুলো লিখে চলল৷
কয়েকদিনের মধ্যেই কোকো রাহুলের স্কুল ভালোমতন চিনে নিল৷ এখন আর মামকে ওর সঙ্গে যেতে হয় না৷ কোকো যদি সুস্থ স্বাভাবিক হত তা হলে বলা যেত ও-ই রাহুলকে স্কুলে দিয়ে আসে, আবার ছুটির সময় নিয়ে আসে৷ রাহুলের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলতে যায়, তারপর সন্ধেবেলা পড়তে বসে৷ ‘অ-আ-ক-খ’, ‘এ-বি-সি-ডি’ কিংবা ‘১ থেকে ১০০’ লিখতে শেখে৷ ওর লেখাপড়ার ধরন দেখে বোঝা যায়, কোকো কয়েক বছর স্কুলে গিয়েছিল৷ তারপর কোনও কারণে ওর পড়াশোনা থেমে যায়৷
কখনও-কখনও কোকো রাহুলের বাপি কিংবা মামের কাছেও পড়তে বসে৷ আবার বাপি যখন জল রং সাজিয়ে নিয়ে ছবি আঁকতে বসেন তখন কোকো বাপির পাশে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে৷ মুগ্ধ হয়ে ছবি আঁকা দ্যাখে৷
একদিন ছবি আঁকতে-আঁকতে বাপি ওকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি ছোটবেলায় ছবি আঁকতে?’
‘না…আমি…আঁকতাম না৷’
তুলি হাতে নিয়ে হ্যান্ডমেড পেপারে হালকা নীলের ওয়াশ টেনে বাপি বললেন, ‘তুমি ছবি ভালোবাসো?’
‘হ্যাঁ৷’ ঘাড় কাত করে কোকো বলল৷
‘তুমি ছবি আঁকা শিখবে?’
আবার ঘাড় কাত করল কোকো৷ হ্যাঁ, ও ছবি আঁকা শিখবে৷
‘গুড বয়৷ কাল থেকে তোমাকে আমি আঁকা শেখাব৷’
‘আমার…মা…আমাকে ছবি আঁকা…শেখাত৷ মা খুব সুন্দর ছবি…আঁকত৷ মা…আর…নেই৷’
বাপি অবাক হয়ে দেখলেন কোকোর চোখে জল৷
ওকে কাছে টেনে নিলেন কল্যাণবাবু৷ গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোমার মা-কে মনে আছে?’
কোকো বিহ্বলভাবে মাথা নাড়ল৷ বলল, ‘না…মনে নেই৷ শুধু ছবি আঁকা…মনে আছে৷’
তারপরই কোকো চুপ করে গেল৷ গুম হয়ে বসে রইল৷ অনেক প্রশ্ন করেও কল্যাণবাবু ওর কাছ থেকে আর কোনও কথা বের করতে পারলেন না৷
এর আগেও কোকোকে ওর বাড়ির কথা, বাবা-মায়ের কথা অনেকবার জিগ্যেস করেছেন, কিন্তু কোনও স্পষ্ট উত্তর পাননি৷ রাহুল আর ওর মা-ও বহুবার সরাসরি অথবা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কোকোকে ওর বাড়ির কথা জিগ্যেস করেছেন, বাবা-মায়ের কথা জিগ্যেস করেছেন, কিন্তু কোনও জবাব পাননি৷
আজ প্রথম বাপি জানতে পারলেন, কোকোর মা ছবি আঁকতেন৷
হয় সবকিছু কোকোর ধীরে-ধীরে মনে পড়ছে, অথবা, ও ধীরে-ধীরে নিজেকে মেলে ধরছে৷ ঠিক যেভাবে একটা গোলাপ কুঁড়ি থেকে ধীরে-ধীরে পাপড়ি মেলে ধরে৷
রাহুলের বাপি আর মাম কোকোকে ওঁদের স্বাভাবিক জীবনে মিশিয়ে নিলেন৷ কেন জানি না, ওঁদের মনে হয়েছিল, এতে কোকো তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে৷ যদি কোনও পুরোনো স্মৃতি ওর হারিয়েও গিয়ে থাকে, তা হলে সেটা ফিরে আসবে৷
কোকো ওঁদের কথা শুনে চলত বটে তবে দুটি ব্যাপার ছাড়া৷ প্রথমটা হল, রাহুলের পাশে-পাশে ছায়ার মতো ঘোরা৷ আর দ্বিতীয়টা ঘরের নানান কাজে মাম এবং বাপিকে সাহায্য করা৷
একদিন রাহুলের সঙ্গে মাঠে খেলতে গিয়ে এক কাণ্ড হল৷
এমনিতে রোজ যে কোকো যায় ও কিন্তু খেলতে নামে না৷ মাঠের ধারে চুপচাপ বসে রাহুলদের ফুটবল খেলা দ্যাখে৷ আর গোল-টোল হলে হাততালি দেয়৷ হাত ছুড়ে চেঁচামেচি করে৷
কিন্তু সেদিন ওর কী খেয়াল চাপল, ও রাহুলের কাছে বায়না করে বসল৷
‘রাহুল, আমি…তোমার মতো…বল খেলব৷’
ওর বায়নার ধরন রাহুল জানে৷ একটা কিছু মাথায় ঢুকলে ও সেটাই ঘ্যানঘ্যান করে যাবে৷ তাই ও বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে কোকোকে নিজের দলে নিল৷ ও ভেবেছিল, মিনিট পাঁচ-দশ খেলানোর পর কোকোকে ঠান্ডা করে বসিয়ে দেবে৷ কিন্তু কাজে সেটা করা গেল না৷ কারণ, কোকোর খেলা রাহুলকে অবাক করে দিল৷
না, কোকো ফুটবল খেলতে জানে না৷ তবে কচ্চিৎ কখনও পায়ে বল পেয়ে গেলে ও যে-অসম্ভব জোরে শট মারছে তা দেখে সকলের চোখ ছানাবড়া৷
কোকোর একটা জোরালো শট কোমরে লেগে নিধু ছিটকে পড়ে গেল৷ পড়ে ছটফট করতে লাগল৷
রাহুলরা সবাই ছুটে গেল ওর তদারকি করতে৷
গোপাল, রাহুল বেশ অবাক হয়ে গেল৷ নিধু ফুটবল খেলে ভালো৷ চেহারাও গাঁট্টাগোঁট্টা, পেটানো, সহজে ওকে কেউ কাবু হতে দেখেনি৷ কিন্তু আজ ওর অবস্থা ভেজা তুলোর মতো৷
নিধুকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল৷ কোকো একাই ওকে চাগিয়ে কাঁধে তুলে নিল৷ মাঠের ধারে ওকে শুইয়ে দিয়ে সবাই মিলে পরিচর্যা করতে লাগল৷
একটু পরে খেলা আবার শুরু হল৷
কোকো হঠাৎ পায়ে বল পেয়ে তিরবেগে ছুটতে শুরু করল৷ সেরকম অভ্যাস স্বাভাবিকভাবেই না থাকায় বল ওর পা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু ও একছুটে বলের কাছে পৌঁছে গেল৷ এবং শট মারল৷
বলটা গোলে ঢুকল৷ শুধু ঢুকল নয়, একেবারে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল৷
গোলপোস্টের দশ-বারো হাত পিছনেই ছিল স্বদেশ মণ্ডলদের বাঁখারির বেড়া৷ জাল ছিঁড়ে বেরোনো বলের ধাক্কায় সেই বেড়াটাও কাত হয়ে গেল৷
গোলের আনন্দে রাহুলদের দলের সবাই হইহই করে উঠেছিল৷ কিন্তু দেখা গেল গোল খাওয়া দলের বন্ধুরাও স্তম্ভিত ভাবটা কাটিয়ে কোকোকে ঘিরে উৎসব শুরু করে দিল৷ কারণ, এরকম ভয়ংকর তীব্র শট মণিমেলায় আগে কেউ কখনও দেখেনি৷ মণিমেলায় শট মারার একটা প্লেয়ার পাওয়া গেল বটে! কোকো ফুটবল খেলতে না জানুক, শট তো মারতে পারে! ওকে রাহুলরা প্র্যাকটিস করিয়ে-করিয়ে খেলাটা একটু-আধটু রপ্ত করিয়ে দেবে৷ তারপর ও দু-চারটে শট মেরে বাজিমাত করবে৷ মণিমেলার ফুটবল টিমে ওকে খেলাতে হবেই৷
খেলার শেষে রাহুল, দীপায়ন আর কোকো বাড়ির দিকে ফিরছিল৷
মাঠ ছেড়ে ওরা পিচের রাস্তা ধরে যাচ্ছিল৷ হঠাৎই একটা বিশাল মোটর-বাইক গাঁক-গাঁক শব্দ তুলে ওদের পাশ দিয়ে ছুটে গেল৷ বাইকে তিনটে ছেলে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিল৷ তিনজনেরই গায়ে স্লিভলেস ভেস্ট, আর বারমুডা৷ কী এক উল্লাসে চিৎকার করছে৷
বাইকটা যেভাবে কাত করে-করে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ওরা চালিয়ে গেল তাতে রাহুল ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷ ওর মানে হল, এক্ষুনি বুঝি বাইকটা উলটে যাবে৷
দীপায়ন বলে উঠল, ‘কী রাফ চালাচ্ছে! আর-একটু হলেই অ্যাকসিডেন্ট করত৷’
রাহুল বলল, ‘মাকুর বাইক৷ বাইকে মাকু, ওর ভাই নেনে, আর বর্মনবাড়ির ছোটছেলেটা—কী নাম যেন—ওটা বসে আছে৷ মাকু তো এভাবেই বাইক চালায়—৷’
‘মাকু’ নামটা শোনামাত্রই দীপায়ন চুপ করে গেল৷ কোনও এলাকায় যে-নাম শোনামাত্র সবাই মুখে কুলুপ আঁটে ‘মাকু’ সেরকমই একটা নাম৷ ওর চ্যাংড়া ছোটলোক সাঙ্গোপাঙ্গদের সবাই এড়িয়ে চলে৷ বর্মনবাড়ির ছোটছেলেটা এ-দলে নতুন জুটেছে৷ ছেলেটা এখনও স্কুলে যায়, তবে চালচলন বড়লোকের বখাটে ছেলের মতন৷
রাহুল আর দীপায়ন নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় মাকুর সমালোচনা করছিল৷ তার সঙ্গে বলছিল নেনের কীর্তিকথা৷ ওরা খেয়াল করেনি, কোকো হাঁ করে ওদের কথাগুলো গিলছিল৷
বিকেল ফুরিয়ে এলেও আলো ফুরোয়নি৷ খেলা শেষ করে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ির দিকে ফিরছে৷ নিজেদের মধ্যে ওরা যেরকম কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে সন্ধেবেলা বটগাছের আশ্রয়ে ফেরার পর পাখির ঝাঁক কিচিরমিচির করে ঝগড়া করছে৷
হঠাৎই মোটরবাইকটা আবার ফিরে এল৷ মনে হল, বাইকটা একই রাস্তা ধরে চক্কর কাটছে৷ সেই সাপের মতো আঁকাবাঁকা গতি৷ সঙ্গে হইহই চিৎকার৷
বাইকটার বিকট হর্ন বাজছিল৷
ওটা আচমকা এসে পড়ায় বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পারল ছিটকে গেল৷ বাইকটার সর্পিল গতি ওদের ভয় পাইয়ে দিল৷ ওরা মিহি গলায় চিৎকার করতে লাগল৷
বাইকটা একটা বাচ্চা মেয়েকে প্রায় চাপা দিয়ে ফেলছিল৷ একেবারে শেষ মুহূর্তে মাকু ব্রেক কষে বাইকটাকে থামাল৷
বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়ে টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল৷ চিত হয়ে বাইকটার চাকার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে ফেলল৷
বাচ্চাদের ভয় পেয়ে দৌড়োদৌড়ির কাণ্ড দেখে আর কান্না শুনে মাকুরা বোধহয় মজা পেল৷ ওরা তিনজনে বাইকে বসে-বসেই হাসতে শুরু করল৷ তারই মাঝে মাকু রাস্তায় পড়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটাকে লক্ষ করে হাত নেড়ে বলে উঠল, ‘কাঁদে না, খুকু৷ তোমার কিচ্ছু হয়নি৷ তুমি মিছিমিছি কাঁদছ৷ এসো…হাত ধরো৷ উঠে পড়ো…৷’
বাচ্চা মেয়েটা ভ্যাবাচ্যাকা মুখে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল৷ নিজের হাত-পা জামা ঝাড়তে লাগল৷
মাকুদের হাসি রাহুলের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল৷ ও তেমন করে কিছু না ভেবেই বাইকটার কাছে এগিয়ে গেল৷ মাকুকে লক্ষ করে জেহাদি প্রশ্ন ছুড়ে দিল৷
‘এসব কী হচ্ছে?’
‘তোর বাপের বিয়ে হচ্ছে৷’ বলেই বাইকে বসা অবস্থাতেই রাহুলের বুকে পা তুলে দিল মাকু৷ সজোরে এক ঠেলা মারল৷
লাথি খেয়ে রাহুল ছিটকে পড়ল রাস্তায়৷ মাথা ঠুকে গেল৷ যন্ত্রণার একটা চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে৷
রাহুল উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল৷ দীপায়ন তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে ওকে হাত ধরে টেনে তুলতে লাগল৷
মাকুরা বাইকে বসে মজা দেখছিল৷ ওদের বাইকের ইঞ্জিন ভটভট শব্দ করছিল৷ রাহুল উঠে দাঁড়াতেই মাকু আর নেনে ওকে নোংরা ভাষায় গালাগাল দিল৷ তারপর মাকু বলল, ‘এই আজব ভেড়াটাকে মেপে রাখ৷ পরে একে কড়া পালিশ দেব৷ সালার এত হিম্মত যে, আমার সঙ্গে মুখ লাগাতে আসে!’
রাহুল হাত-পায়ের ধুলো ঝাড়ছিল আর ঘেন্না-মেশানো প্রতিবাদের চোখে মাকুর দিকে দেখছিল৷
সেটা লক্ষ করে ভাইয়ের দিকে ঘাড় ঘোরাল মাকু : ‘অ্যাই নেনে, নাম তো বাইক থেকে৷ দ্যাখ, ব্যাটা ড্যাবড্যাব করে কেমন তাকাচ্ছে! মালটাকে একটু পাঁচালি পড়ে দে…৷’
নেনে হাসল৷ হাসতে-হাসতেই বাইক থেকে নামল৷ তারপর রাহুলের দিকে পা বাড়াল৷
কোকো এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল৷ খানিকটা বিভ্রান্তভাবে সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল৷ যেন কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না৷
কিন্তু নেনে রাহুলের দিকে আক্রমণের ভঙ্গিতে এগোতেই কোকো নড়েচড়ে উঠল৷ একছুটে নেনের সামনে গিয়ে ওর পথ আগলে দাঁড়াল৷ কর্কশ গলায় টেনে-টেনে বলল, ‘রাহুলকে…মারবে না৷’
‘তাই?’ বলে নেনে ডানহাতে সপাটে এক ঘুসি বসিয়ে দিল কোকোর মুখে৷
কোকো ঘুসির অভিঘাতটা নিল, কিন্তু জায়গা থেকে নড়ল না—দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মতো৷ ওর ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল৷
ও আবার বলল, ‘রাহুলকে…মারবে না৷’
রাহুল ‘কোকো! কোকো, চলে এসো—’ বলে অস্থিরভাবে ওকে ডাকছিল৷ কিন্তু কোকো তাতে এতটুকু কান দিল বলে মনে হল না৷
‘রাহুলকে…মারবে না৷’ একঘেয়েভাবে আবার বলল কোকো৷
ওর অদ্ভুত কথা বলার ঢঙে নেনে হেসে উঠল : ‘কে রে আমার তোতলা কাত্তিক?’ তারপর ভেংচিয়ে বলল, ‘রাহুলকে মাবব না, ছোনা?’
কথা বলতে-বলতেই নেনে হাত তুলেছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই৷
রাহুলরা অবাক হয়ে কোকোর কাণ্ড দেখতে লাগল৷
এক ঝটকায় নেনের কোমর জাপটে ধরল কোকো৷ তারপর অবলীলায় ওকে শূন্যে তুলে ফেলল৷
নেনে দাপাদাপি করছিল৷ কোকোকে কিল-চড়-ঘুসি মারছিল৷ কিন্তু কোকো সেসব গ্রাহ্য করছিল না৷ ও অনায়াস ভঙ্গিতে হেঁটে গেল রাস্তার কিনারায়৷ তারপর নেনেকে স্রেফ ছুড়ে দিল নালার ওপারে৷ নেনে গিয়ে আছড়ে পড়ল একটা পরিত্যক্ত জমিতে৷
বাইকে বসে মাকু গর্জন করে উঠল৷ সেইসঙ্গে গালাগালের ফোয়ারা ছোটাল৷ কিন্তু ও বাইক থেকে নামেনি৷ বোধহয় শত্রুর এইরকম ভয়ংকর শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কি না সে-কথাই ভাবছিল৷ আর বাইকের পিছনে বসে থাকা বড়লোকের বখাটে ছেলেটা ভয়ের চোখে কোকোর দিকে তাকিয়ে ছিল৷
কোকো অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় মাকুর বাইকের সামনে এসে দাঁড়াল৷
মাকু গিয়ার বদল করে বাইক ছুটিয়ে দিল৷ ওর বোধহয় কোকোকে চাপা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল৷ কিন্তু সেটা হল না৷
কারণ, কোকো শক্ত দু-হাতে বাইকের হাতল চেপে ধরেছে৷ মাকুর হাতের পাশেই কোকোর নীল শিরা ওঠা দুটো হাত৷
বাইকটা গোঁ-গোঁ গর্জন করছিল, কিন্তু নড়তে পারছিল না৷ কোকো সামনে ঝুঁকে পড়ে চোয়ালে চোয়াল চেপে বাইকের অশ্বশক্তির টক্কর নিচ্ছিল৷ রাহুল আর দীপায়ন স্তম্ভিত হয়ে কোকোর কাণ্ড দেখছিল৷
রাস্তায় ভিড় জমছিল৷ বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো তো ছিলই, তার সঙ্গে জুটে গেল পথচারীরা৷ কেউ হেঁটে যাচ্ছিল, কেউ-বা সাইকেলে৷
বাইকটাকে ক্ষমতার শেষ সীমায় নিয়ে গেল মাকু৷ আকাশফাটানো গোঁ-গোঁ গর্জন৷ ধোঁয়া৷ পেট্রলের গন্ধ৷
কিন্তু কোকো অবিচল৷ সবার চোখের সামনে ও যেন এক রূপকথার সার্কাস দেখাচ্ছে৷
ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘বাইকের…স্টার্ট বন্ধ…করো৷ নইলে বাইক…উলটে…দেব…৷’
ওর কথায় বোধহয় ম্যাজিক ছিল, কারণ, মাকু কী একটা সুইচ ঘোরাতেই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাইকের ইঞ্জিন থেমে গেল৷ কোকো বাইকের হ্যান্ডেল ধরে হাঁপাতে লাগল৷
নেনে কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু নালা পেরিয়ে কোকোর আক্রমণের আওতায় আসতে ভয় পাচ্ছিল৷ আর বর্মনবাড়ির ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছিল এখুনি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাবে৷
রাহুলই প্রথম সংবিৎ ফিরে পেল৷ ও ‘কোকো! কোকো!’ বলে চিৎকার করে ছুটে এল ওর ‘অলৌকিক’ বন্ধুর কাছে৷ ওকে পিছন থেকে একেবারে জাপটে ধরল৷
‘কোকো! কোকো!’ আবেগে রাহুলের চোখে জল এসে গেল৷
কোকো বাইক ছেড়ে দিয়ে রাহুলের দিকে ঘুরে দাঁড়াল৷ ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমাকে যে মারবে…তাকে ছাড়ব না৷ ছাড়ব না৷’
কোকোকে অন্যমনস্ক দেখে নেনে সামান্য খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে নালা পেরোল৷ তারপর চট করে বাইকে উঠে বসল৷ সুযোগ বুঝে মাকুও বাইকে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিল৷ তবে যাওয়ার আগে কোকো আর রাহুলকে লক্ষ করে গালাগাল দিয়ে গেল৷ চিৎকার করে বলে গেল, ‘ওয়েট কর—তোদের হিসেব হবে৷’
রাহুল আর কোকো মাকুদের চলে যাওয়া দেখল৷
রাস্তার লোকজন এতক্ষণ যেন রুদ্ধশ্বাসে কোনও সিনেমা দেখছিল৷ বাইকটা চলে যেতেই সবাই কোকোর কাছে ছুটে এল৷ আলোচনা করতে লাগল, হইচই করতে লাগল, কোকোর সাহস আর শক্তির তারিফ করতে লাগল৷
কোকোকে নিয়ে প্রশ্নও করতে লাগল কেউ-কেউ৷
‘একে তো এ-গাঁয়ে আগে দেখিনি!’
‘ছেলেটার গলায় ওটা কী?’
‘ও কাদের বাড়িতে এসেছে?’
‘ওর নাম কী?’
কোকো কোনও কথায় কর্ণপাত করছিল না৷ ও এমনভাবে রাহুলের একটা হাত জড়িয়ে ধরে ছিল যেন হাতটা ছেড়ে দিলেই ও হারিয়ে যাবে৷ দীপায়নও রাহুলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল৷ ও রাহুলকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া লাগাচ্ছিল৷
রাহুল কোকোর দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘তুমি একেবারে ছেলেমানুষ, কোকো৷ ওই বাজে ছেলেগুলোর সঙ্গে ঝামেলায় জড়ালে কেন? জানো, ওরা গুন্ডা-মাস্তান?’
‘গুন্ডা কাকে বলে? মাস্তান…কী?’ সরল মুখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল কোকো৷
রাহুল ওকে হাত ধরে টানল৷ হাঁটতে শুরু করল৷ পিছনে দীপায়ন৷
হাঁটতে-হাঁটতেই রাহুল বলল, ‘গুন্ডা৷ মাস্তান৷ ওদের সঙ্গে ছোরা থাকে, রিভলভার থাকে৷ ওরা খারাপ৷’
কোকো রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাস্টারজির কাছে…রিভলভার আছে৷ মাস্টারজি…খারাপ৷’
রাহুল অবাক হলেও কোনও কথা বলল না৷ ওকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে লাগল৷
দীপায়ন রাহুলকে জিগ্যেস করল, ‘মাস্টারজি আবার কে?’
ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার জন্য রাহুল ঠোঁট উলটে বলল, ‘কী জানি! ও মাঝে-মাঝে ওরকম উলটোপালটা কথা বলে৷’
দীপায়ন বলল, ‘আমার তো চিন্তা হচ্ছে রে৷ মাকুরা সহজে ছাড়বে না৷’
চিন্তা রাহুলেরও হচ্ছিল৷ মাকু, নেনে ওরা মোটেই সুবিধের নয়৷ ওরা দোকানদারদের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে তোলা আদায় করে৷ সুযোগ পেলে ছিনতাই করে, ওয়াগন ভাঙে৷ রেল-লাইনের ধারে ওদের আসল ঠেক৷ সেখানে রাতে ওরা নেশা-ভাং-এ চুর হয়ে হইহুল্লোড় করে৷
রাহুল আপনমনেই বলল, ‘আমিই ভুল করলাম৷ কেন যে প্রোটেস্ট করতে গেলাম!’
দীপায়ন বলল, ‘তুই লাথিটা খাওয়ার পর চেপে গেলেও হত৷’
‘আমি তো চেপেই গেছিলাম৷ এই যে কোকোটা!’ কোকোর দিকে আঙুল দেখিয়ে রাহুল কপট রাগের গলায় বলল, ‘কোকোটাই তো নেনের সঙ্গে ঝামেলা করল!’
কোকো নির্বিকার সুরে বলল, ‘ছেলেটা তোমাকে…মারতে যাচ্ছিল…৷’
দীপায়ন বলল, ‘হ্যাঁ—তা যাচ্ছিল৷ কিন্তু…৷’
দীপায়নের কথা শেষ হওয়ার আগেই কোকো বলে উঠল, ‘রাহুলকে যে…মারবে তাকে আমি…ছাড়ব না৷ কিছুতেই ছাড়ব না৷’
বিকেলের শেষ আলো এসে পড়েছিল কোকোর মুখে৷ ও এক অদ্ভুত মমতা মাখা সরল চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ একটা আন্তরিক টান টের পেল রাহুল৷ এই বোকা-হাবা ভোলাভালা ছেলেটা মাত্র দু-সপ্তাহে বিচিত্র এক আত্মীয়তার অদৃশ্য সুতোয় রাহুলদের কখন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে৷
রাহুলের মনে হচ্ছিল, ঢলে পড়া সূর্যের আলো পড়ে নয়—কোকোর মুখটা এমনিই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে৷
৷৷পাঁচ৷৷
দু-সপ্তাহে কোকোর কথা গ্রামের যে-ক’জন জেনেছিল, মাকুদের সঙ্গে মোকাবিলার পর সেই সংখ্যাটা প্রায় পঞ্চাশ গুণ হয়ে গেল৷
যে-বাচ্চা মেয়েটা মাকুর বাইকের তলায় আর-একটু হলেই চাপা পড়ছিল, তার বাবা-মা ঘটনার পরদিন সন্ধেবেলা রাহুলদের বাড়িতে এলেন—সঙ্গে মেয়েটি৷ ওঁদের খুব সাধ জেগেছে রাহুল আর কোকোকে স্বচক্ষে একবার দেখেন৷ ঘোর কলিযুগে এখনও এমন লোক আছে যারা অচেনা-অজানা কাউকে বাঁচানোর তাগিদে প্রতিবাদ করে, ঝুঁকি নেয়!
ওঁদের সঙ্গে গল্প করে কোকো দারুণ খুশি৷ ওর কথাবার্তা শুনে রাহুল অবাক হল৷ ওর মনে হল, কোকো যেন প্রথমদিককার তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে৷
প্রতিদিন বিকেলে ফুটবল খেলতে-খেলতে কোকো রাহুলদের ক্লাবে নিয়মিত ফুটবল প্লেয়ার হয়ে উঠল৷ শুধু রাহুলরা ওকে অনেক করে অনুরোধ করেছে ও যেন জোরে শট না মারে৷ কারণ, রোজ-রোজ ফুটবল ফেটে গেলে ফুটবল কেনার পয়সা জোগাবে কে!
মাকুদের সঙ্গে এনকাউন্টারের ব্যাপারটা রাহুল ইচ্ছে করেই মাম কিংবা বাপিকে প্রথমে বলেনি৷ ভুল একটা যখন হয়ে গেছে তখন শুধু-শুধু ওঁদের টেনশান বাড়িয়ে লাভ কী! কিন্তু বাপি পরদিন সকালে খবরটা পেয়ে গিয়েছিলেন৷ ফলে সেদিন রাতে রাহুলকে মাম আর বাপির জেরার মুখে পড়তে হল৷
রাহুল লুকোচুরি না করে সব কথা খুলে বলল৷
শুনে বাপি ওকে বললেন, খুব সাবধানে চলাফেরা করতে৷ সবসময় কেউ না কেউ যেন সঙ্গে থাকে—একা-একা রাহুল যেন কোথাও না যায়—বিশেষ করে রেললাইনের দিকে৷
কোকো একবার বলে উঠল, ‘আমি তো রাহুলের সঙ্গে সবসময় থাকি…৷’
বাপি আর মাম স্নেহভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ মাম বললেন, ‘তোমারও তো বিপদের ভয়, কোকো৷ রাহুল স্কুলে যাওয়ার সময় আর ফেরার সময় আমিও তোমাদের সঙ্গে থাকব৷ আর খেলার মাঠ থেকে ফেরার সময়—’ রাহুলের দিকে তাকালেন মাম : ‘দু-চারজন বন্ধু-বান্ধবকে সঙ্গে নিবি৷ বলবি একটু বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে৷’
কোকো কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রাহুল হাত নেড়ে ওকে থামিয়ে দিল৷
এই নিয়মেই কয়েকদিন চলল৷ মাকু বা ওর দলের ছেলেদের সঙ্গে রাহুলদের দেখা হয়, কিন্তু ওরা কিছু বলে না৷ সাইকেল, বাইক নিয়ে রাহুলদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়৷ তবে আড়চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে৷
রাহুলের মনে হয়, কোকোর সুখ্যাতির জন্যই মাকুর দলবল ‘বদলা’ নেওয়ার ব্যাপারে পিছিয়ে পড়ছে৷
কোকোর কথা এখন মণিমেলার প্রায় সবাই জানে৷ তা ছাড়া মাকুদের কাজকর্ম কেউই পছন্দ করে না৷ ওদের ওপর সবাই বিরক্ত৷ সুতরাং এরকম পরিস্থিতিতে যদি কোকো বা রাহুলের গায়ে হাত পড়ে তা হলে মাকুদের বিপদ হতে পারে৷
এসব কথা ভেবেই মাকু অপেক্ষা করছিল৷ আর একইসঙ্গে সুযোগ খুঁজছিল৷
রাহুল কোকোর জন্য দুশ্চিন্তা করলেও কোকো একেবারে চিন্তাভাবনাহীন৷ ও ওর মতোই দিন কাটাতে লাগল৷ টিউবওয়েল পাম্প করে জল তোলা, বাগানে পাখি কিংবা প্রজাপতির পিছনে ছুটোছুটি, ব্যায়াম করা, রাহুলের স্কুলে যাওয়া-আসা, কখনও-কখনও বাপির সঙ্গে বাজারে যাওয়া, বিকেলে মাঠে গিয়ে খেলা, আর বাপির সময় হলেই বাপির কাছে বসে ছবি আঁকা শেখা৷
কোকোর দিকে তাকিয়ে মাম আর বাপি অবাক হয়ে ভাবেন৷ ছেলেটা কেমন শিশুর মতো নিশ্চিন্ত আরামে রয়েছে! ওকে দেখে মাঝে-মাঝে মনে হয়, ও যেন প্রকৃতিরই একটা অংশ৷
রাহুলরা বহুদিন ধরেই ভাবছিল ওদের ক্লাব থেকে একটা লাইব্রেরি তৈরি করবে৷ এবার ওরা একটা ঘরের সন্ধান পেয়েছে৷ মণিমেলার সবচেয়ে পুরোনো ডাক্তার ডক্টর পরমেশ হালদার ওঁর দোতলা বাড়ির একতলার একটা ঘর রাহুলদের ছেড়ে দিয়েছেন৷ সেখানে ওদের লাইব্রেরি হবে—‘মণিমেলা সাধারণ পাঠাগার’৷
ঘর হাতে পাওয়ার পর রাহুলরা চাঁদা তুলতে শুরু করেছে৷ তারপর সেই টাকায় ঘর সারানোর কাজেও হাত দিয়েছে৷ একইসঙ্গে রাহুলরা রবিবার বা ছুটির দিনে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে গল্পের বইয়ের খোঁজ করছে৷ বলছে, ‘আমাদের লাইব্রেরিতে গল্পের বই ডোনেট করুন৷’
ওদের উদ্যোগে বহু মানুষ সাড়া দিয়েছে৷ চাঁদার পাশাপাশি বইও পাওয়া যাচ্ছে অনেক৷
এসব কাজে রাহুলদের সঙ্গে কোকোও টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ ডোনেশানে পাওয়া বইয়ে থলে ভরতি করে দু-হাতে দুটো থলে ঝুলিয়ে ও রাহুলদের সঙ্গে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি অক্লান্তভাবে হেঁটে চলেছে৷
এরকমই এক রবিবার৷ বেলা প্রায় একটা বাজে৷ মাথার ওপরে গনগনে সূর্য৷ চারপাশে গরম বাতাস বইছে৷ রাহুলরা দল বেঁধে বাড়ি-বাড়ি ঘুরছে৷ ওদের দলে রাহুল, নিধু, গোপাল আর কোকো ছাড়া ছিল ওদের ক্লাবের সেক্রেটারি ঝন্টুদা৷ ঝন্টুদা ওদের মধ্যে সবচেয়ে বড়৷ চাকরি করে৷
একসময় ক্লান্ত হয়ে ওরা ক্ষান্ত হল৷ একটা বটগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে দাঁড়াল৷ কোকো হাতের ভারী থলে দুটো নামিয়ে রাখল মাটিতে৷ বটগাছের লাগোয়া একটা বড়-সড় পানের দোকান৷ দোকানের বাইরে থরে-থরে সাজানো কোল্ড ড্রিঙ্কের পেটি৷
ঝন্টুদা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘অ্যাই, তোরা সবাই একটা করে পেপসি খা৷ আমি খাওয়াচ্ছি৷’
রাহুলরা সবাই মিলে ‘ঝন্টুদা, জিন্দাবাদ’ বলে চেঁচিয়ে উঠল৷ তারপর দোকানদারের কাছ থেকে পাঁচটা ঠান্ডা পেপসি নিল৷ একটা বোতলে স্ট্র ঢুকিয়ে কোকোর হাতে দিল রাহুল : ‘নাও, পেপসি খাও—৷’
কোকো বোতলটা নিয়ে অনভ্যস্ত ঢঙে সিপ করতে শুরু করল৷
সবার আগে কোকোর পেপসি খাওয়া শেষ হল৷ পরপর দুটো ঢেঁকুর তুলল ও৷
রাহুলের কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়া শেষ হলে কোকো বলল, ‘রাহুল… পেপসি…খেতে খুব ভালো৷ মিষ্টি৷ ভালো৷’
ঝন্টুদা ওকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি আর-একটা খাবে?’
কোকো মাথা হেলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ…খাব৷’
আর-একটা পেপসির বোতল নিয়ে কোকোর হাতে দিল রাহুল৷ কোকো পরম উৎসাহে স্ট্র মুখে চেপে ধরে পেপসি খাওয়ায় মন দিল৷ আর রাহুলরা লাইব্রেরির নানান পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল৷
এমন সময় মাকুর বাইক দেখা গেল৷ ভটভট আওয়াজ তুলে ধুলো উড়িয়ে আসছে৷
রাহুলদের কাছে এসে বাইকটা থামাল মাকু৷ ওর পিছনে বসে আছে নেনে৷ মাকুর গায়ে টি-শার্ট আর জিনসের প্যান্ট৷ আর নেনে একটা হলুদ শার্ট আর কালচে প্যান্ট পরে আছে৷
মাকু বাইকের স্টার্ট বন্ধ করেনি৷ বরং মাঝে-মাঝে হাতল ঘুরিয়ে ইঞ্জিন রেস করছে৷
নেনের আঙুলে সিগারেট ধরা ছিল৷ ঝন্টুদাকে দেখে ও উদ্ধত রুক্ষ ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিতে লাগল৷ ঝন্টুদা অস্বস্তিতে মুখটা ঘুরিয়ে নিল৷
নেনে বাইক থেকে নেমে পড়ল৷ চোখ সরু করে সিগারেটে টান মারতে-মারতে এগিয়ে এল রাহুলদের দিকে—অথবা পানের দোকানের দিকে৷
রাহুল চট করে তাকাল কোকোর দিকে৷ ওর বুক কেঁপে উঠল৷ যদি আগের দিনের মতো কিছু একটা হয়! রাহুলের ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি নেনে ওর বুকের ভেতরে হওয়া ধড়াস-ধড়াস শব্দ শুনতে পাবে৷
ঝন্টুদা, নিধু, গোপাল পানের দোকানের সামনে থেকে পায়ে-পায়ে সরে যেতে লাগল৷ রাহুলও সেই চেষ্টাই করল৷ নেনের নজর এড়িয়ে কোকোর জামা ধরে চোরা টান মারল৷ কিন্তু কোকো সেটা টের পেলে তো! ও তখন পেপসি খেতে মশগুল৷ স্ট্র-এর টানে বোতলের তরলে চড়বড়-চড়বড় শব্দ হচ্ছে৷
নেনে ঝন্টুদার সামনে এসে দাঁড়াল৷ ওর বাঁ-হাতে সিগারেট, ডানহাতটা পকেটে গোঁজা৷
ঝন্টুদার মুখে পরপর দুবার ধোঁয়া ছুড়ে দিল নেনে৷ ঝন্টুদা মুখে কিছু বলল না—শুধু নাক টিপে এক ঝটকায় মুখটা পাশে ফেরাল৷
‘কী, সেক্রেটারিবাবু! শুনলাম, ডাক্তার হালদারের একতলার ঘরটা তোমরা লপকে নিয়েছ—লাইব্রেরি না কীসব করবে৷’
মুখটা ঘুরিয়ে রেখেই চাপা গলায় ঝন্টুদা জবাব দিল, ‘আমাদের গ্রামে একটা লাইব্রেরি হওয়া খুব দরকার৷ অনেকদিন ধরে সবাই বলছে…তাই ডক্টর হালদারের কাছে আমরা রিকোয়েস্ট করেছিলাম৷ লাইব্রেরিটার নাম হবে ‘‘মণিমেলা সাধারণ পাঠাগার’’৷ ডক্টর হালদার বলেছেন…৷’
‘ওসব ঢপের কেত্তন ছাড়ো!’ নেনে খিঁচিয়ে উঠল, ‘পাঠাগার হবে না কাঁচকলা হবে৷ ও-ঘরটা আমরা টার্গেট করেছিলাম…ক্লাবঘর করব৷ তো বুড়োটাকে তোমরা টুপি দিয়ে ঘরটা হড়কে নিলে?’
নিধু ভয় পেলেও মিনমিন করে পাশ থেকে বলল, ‘সত্যি বলছি—লাইব্রেরি হবে৷ এই তো—’ গাছতলায় রাখা বইভরতি থলে দুটো দেখাল : ‘আমরা সবার কাছ থেকে চেয়ে-চেয়ে গল্পের বই জোগাড় করছি…৷’
নেনে সিগারেট ফেলে দিয়ে বাঁ-হাতে খপ করে নিধুর কলার চেপে ধরল : ‘তুই কি সালা ঝন্টুর উকিল না কি?’
মাকু বাইকে গরগর আওয়াজ তুলে এগিয়ে এল নেনের কাছে৷ বাইক থামাল৷
নেনের কথায় রাহুলের গা জ্বালা করছিল৷ কিন্তু মাকুদের সঙ্গে ওদের লড়ার ক্ষমতা কতটুকু! তা ছাড়া মাম আর বাপি বলেছেন, এসব ঝামেলা এড়িয়ে থাকতে৷
রাহুল মারপিটকে ভয় পায়৷ তাই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল৷ নেনেরা বোধহয় এক্ষুনি গায়ে পড়ে একটা গন্ডগোল তৈরি করবে৷
ও কোকোর দিকে তাকাল৷ নির্বিকারভাবে পেপসি খেয়ে চলেছে৷
নিধুকে কলার ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছিল নেনে৷ আর মাকু দাঁত বের করে হাসছিল৷
রাহুল ভয় পেলেও প্রতিবাদ না করে থাকতে পারল না৷
‘নিধুকে ছেড়ে দাও!’ ও চেঁচিয়ে বলল৷
সঙ্গে-সঙ্গে নিধুকে ছেড়ে দিল নেনে৷ এবং রাহুলের দিকে ঘুরল৷ কিন্তু রাহুলের দিকে এক পা এগিয়েই থেমে গেল ও৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কোকোর দিকে৷ ও তখন পেপসি খাওয়া শেষ করে খালি বোতলটা দোকানির হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছে৷
‘এই তোতলা কাত্তিক!’ বাজেভাবে হাত নেড়ে কোকোকে কাছে ডাকল নেনে৷ তারপর রাহুলকে লক্ষ করে বলল, ‘তোর গায়ে হাত তুললেই তো আবার ওই ক্যালানে কাত্তিক রুখতে আসবে৷ এলে আজ ওকে মজা দেখাব৷ সেদিন কিছু বলিনি…৷’
কোকো নেনের কাছে এগিয়ে আসছিল৷ তাই দেখে রাহুল আর থাকতে পারল না৷ ও নেনের হাত চেপে ধরে অনুনয় করে বলল, ‘ওকে কিছু বোলো না৷ ওর অসুখ আছে…৷’
‘সব অসুখ আজ ঝেড়ে সারিয়ে দেব৷’ ঠোঁট বেঁকিয়ে কথাটা বলে এক ঝটকায় রাহুলের হাত ছাড়িয়ে নিল৷ শব্দ করে হেসে উঠল : ‘সেদিন মওকা পেয়ে আমাকে হেভি বেইজ্জত করেছিস…৷’
মাকু বাইকে বসা অবস্থাতেই চেঁচিয়ে বলল, ‘মালকে একটু বাইক দিয়ে চেটে দেব নাকি?’
ঝন্টুদা নেনের কাছে এগিয়ে এল : ‘এসব কী হচ্ছে? কেন পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছ, ভাই? তোমাদের ক্লাবঘরের জন্যে অন্য আর-একটা ঘর…৷’
ঝন্টুদার মুখে থুতু ছুড়ে দিল নেনে৷ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ধমকে উঠল, ‘ফোট সালা! কাঁঠালের আঠা মারতে এসেছে! এখুনি বডি নামিয়ে দেব৷ ফোট!’
ঝন্টুদার মুখ-চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল৷ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল৷ ঘৃণার চোখে নেনেকে দেখল৷ তারপর এক-পা পিছিয়ে এল৷
কোকোকে আদুরে গলায় কাছে ডাকল নেনে৷ ডানহাতটা পকেট থেকে বের করে নিল৷
সঙ্গে-সঙ্গে রাহুল ভয়ে কাঠ হয়ে গেল৷
নেনের হাতে প্রায় ছ’ইঞ্চি ফলার একটা চকচকে ছুরি৷ বাতাসে ফলাটা ধরে সাপের ফণার মতো নাচাচ্ছে৷
ছুরিটা দেখামাত্রই কোকো কেমন যেন হয়ে গেল৷ কাতর চোখে নেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার…সঙ্গে…আমি মারপিট করব না…৷’
‘কেন রে, তোতলা কাত্তিক? লড়বি না কেন?’
এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল কোকো : ‘আমি…আর কাউকে…মারব না৷ কাউকে…কষ্ট দেব না৷ আমি…আর মারপিট…করব না৷ কাউকে… কষ্ট…দেব না৷’
এ-কথায় মাকু আর নেনে হো-হো করে হেসে উঠল৷
রাহুল বিপন্ন মরিয়া চোখে চারপাশে তাকাচ্ছিল৷ যদি কারও কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যায়৷ কিন্তু এই দুপুরে পথে তেমন লোকজন নেই৷ আর যে-দু-একজন পথচারী চোখে পড়ছে তারা মাকুর মার্কামারা মোটরবাইক দেখেই সটকে পড়ছে৷ সেইসঙ্গে রাহুল এটাও লক্ষ করল যে, পানের দোকানের দোকানদার তার বসার জায়গা ছেড়ে মেঝেতে নেমে পড়েছে৷ ধীরে-ধীরে পা বাড়াচ্ছে দোকানের খিড়কি-দরজার দিকে৷ এই জায়গাটাকে সে আর নিরাপদ মনে করছে না৷
নেনে কোকোর দিকে আরও এক-পা এগিয়ে যেতেই কোকো দু-পা পিছিয়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠল : ‘আমি আর কাউকে…মারব না৷ কাউকে কষ্ট দেব না৷ মাস্টারজিকে আমি বলেছি৷ মারপিট করতে আমার ভালো লাগে না৷ আমি…বাড়ি…যাব৷’
অন্য সবার কাছে কোকোর কথাগুলো পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছিল৷ কিন্তু রাহুল যেন কিছু-কিছু বুঝতে পারছিল৷
কোকো পিছোতে-পিছোতে একটা গাছে গিয়ে ধাক্কা খেল৷ তারপর চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে গাছের গুঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল৷
মাকু আর নেনে এই পাগলামি দেখে আবার হেসে উঠল৷ আর রাহুলরা কোকোর কাণ্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল৷
যে-ছেলেটার গায়ে এত শক্তি সে কি না এরকম ভয় পেয়ে গেছে!
রাহুল আন্দাজ করল, কোকোর ভয়টা আসলে নেনের হাতের ছুরিটার জন্য৷ এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়৷
কোকো তখন গাছের একটা ডালে বসে আপনমনে বলে চলেছে, ‘আমি আর লড়ব না৷ কাউকে মারব না৷ কষ্ট দেব…না৷ মারব…না৷’
নেনে হাতের ছুরিটা শূন্যে নাচিয়ে কোকোকে দু-চারবার নকল ভয় দেখাল৷ যেন এই ও কোকোর গায়ে ছুরি বসাল বলে৷ কোকো সেই ভয় দেখানোর তালে-তালে সিঁটিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল৷ সেটা দেখে নেনে আর ওর দাদা বেশ মজা পাচ্ছিল৷
রাহুল কোকোর হেনস্থা আর সহ্য করতে না পেরে বলে উঠল, ‘ওকে শুধু-শুধু ভয় দেখাচ্ছ কেন? ছেড়ে দাও—৷’
সঙ্গে-সঙ্গে নেনের হাসিটা বদলে গেল হিংস্র কুটিল মান-চিত্রে৷ ও চট করে চলে এল রাহুলের কাছে৷ ছুরির ডগাটা ছুঁইয়ে দিল ওর গলায়৷ নোংরা গালাগাল দিয়ে বলল, ‘একদম চুপ৷ নইলে…৷’
নইলে কী হবে সেটা আর নেনের বলা হল না৷
কারণ, চোখের পলকে গাছ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে পড়েছে কোকো৷ একটা ডিগবাজি খেয়ে শরীরটা গড়িয়ে নিয়ে এসেছে নেনের কাছে৷ দু-হাতে ওর দুটো পা ধরে প্রচণ্ড এক হ্যাঁচকা টান মেরেছে৷
নেনে উপুড় হয়ে উলটে পড়ল মাটিতে৷ কোকো একলাফে চড়ে বসল ওর শরীরের ওপরে৷ ছুরি-ধরা হাতটাকে মোচড় দিয়ে চেপে ধরল পিঠের দিকে৷ তারপর জোরে একটা ঝটকা দিল৷ ছুরি খসে পড়ল নেনের মুঠো থেকে৷ ও যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল৷
কোকো চিৎকার করে বলল, ‘রাহুলকে…মারবে না৷ যে মারবে তাকে আমি…মেরে ফেলব৷’
কথা শেষ করেই নেনের চুলের মুঠি খামচে ধরল ও৷ মাথাটা টেনে শূন্যে তুলল৷ তারপর ভয়ংকর জোরে ঠুকে দিল মাটিতে৷
নেনে গোঁ-গোঁ করতে লাগল৷ মাকু বাইকে বসে হতবুদ্ধি হয়ে ভাইয়ের করুণ অবস্থা দেখতে লাগল৷
‘রাহুলকে মারবে না৷ রাহুলকে…’ নেনের দিকে আগুন-ঝরা চোখে তাকিয়ে ছিল কোকো৷ নেনের চুলের মুঠিটা ওর হাতে ধরা ছিল৷ সেই অবস্থাতেই বিড়বিড় করে কথাগুলো বলছিল৷
রাহুল ছুটে গিয়ে কোকোর হাত চেপে ধরল : ‘কোকো! কোকো! কী করছ! ছাড়ো—ও যে মরে যাবে!’
রাহুলের দেখাদেখি ঝন্টুদা, নিধু, গোপাল ওরাও কোকোর কাছে ছুটে এসেছিল৷ কোকোকে থামাতে চেষ্টা করছিল, ওকে হাত ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করছিল৷
অনেক কষ্টে কোকোকে শান্ত করা গেল৷ নেনেকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও৷ তারপর রাহুলের একটা হাত চেপে ধরল৷ ভাবটা এমন যেন এই হাতটা ও আর ছাড়বে না৷
রাহুল ওকে নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল৷
কোকো হাঁপাচ্ছিল৷ নেনের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ ঝন্টুদারা তখন নেনেকে ধরে তুলে দাঁড় করাচ্ছে৷
নেনে বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল৷ ওর কপালে রক্ত৷ কোকোর দিকে ও এমনভাবে চেয়ে আছে যেন অন্য গ্রহের প্রাণী দেখছে৷
ঝন্টুদা পকেট থেকে রুমাল বের করে নেনের কপালের রক্ত মুছে দিল৷ বলল, ‘ফেরার পথে একটু ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ো—৷’
নেনে কোনও জবাব দিল না৷
ঝন্টুদারা নেনের জামাকাপড় হাত দিয়ে ঝেড়েঝুড়ে ওকে মাকুর বাইকের দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল৷
মাকু বাইক থেকে নামেনি৷ আগের দিনের মতো ও আর তর্জন-গর্জন করছিল না৷ নেনেও একেবারে চুপ৷ ভালো করে কারও দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত৷
ঝন্টুদা মাকুকে বলল, ‘মাকু, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে৷ কোকো তো অত বোঝে না৷ আসলে রাহুলকে ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে৷ রাহুলকে কেউ কিছু করলে ও কেমন পাগলের মতো হয়ে যায়৷ যাকগে, তুমি ব্যাপারটা ভুলে যাও৷ আর একটা কথা : এটা নিয়ে থানা-পুলিশ কোরো না৷ আমরাও ব্যাপারটা আর মনে রাখব না৷’
মাকু ছোট্ট করে ঘাড় নাড়ল৷
ঝন্টুদা আর নিধু নেনেকে ধরে বাইকে বসাল৷ ঝন্টুদা মাকুর পিঠে হাত দিয়ে বলল, ‘তোমরা তো ক্লাব-ঘর করবে৷ আমি দেখছি—সুটেবল কোনও ঘর পাওয়া যায় কি না৷ আর শোনো…’ মাকু তাকাল ঝন্টুদার দিকে৷ ঝন্টুদা বলল, ‘আমরা তোমার শত্রু নই৷ প্লিজ, আজকের ব্যাপারটা ভুলে যেয়ো৷’
মাকু আর নেনে চলে গেল৷ ওদের ছুটন্ত বাইকের পিছনে ধুলোর মেঘ তৈরি হল৷
ঝন্টুদা, নিধু, গোপাল নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল৷ আর রাহুল কোকোর হাত ধরা অবস্থায় ভাবছিল ওর অদ্ভুত আচরণের কথা৷ এই বলছে, ‘আমি আর লড়ব না৷ কাউকে মারব না৷ কষ্ট দেব…না৷ মারব…না৷’ আবার পরক্ষণেই রাহুলকে ‘রক্ষা’ করতে সে পেশাদার যোদ্ধার তৎপরতায় শত্রুকে ঘায়েল করছে!
কোকোর লড়াই দেখে রাহুলের মনে হচ্ছিল শুধু সিনেমায় এরকম লড়াই দেখা যায়৷ তা ছাড়া বহুদিন প্র্যাকটিস না করলে কারও পক্ষে এরকম দক্ষতায় পৌঁছনো সম্ভব নয়৷
বাড়ি ফেরার পথে রাহুল কোকোকে জিগ্যেস করল, ‘কোকো, এরকম ফাইটিং তুমি কোথায় শিখলে?’
‘শিখেছি ভগবতীপ্রসাদের কাছে৷’
‘কে ভগবতীপ্রসাদ?’
‘আমার ট্রেনার৷ আট বছর…আমি ট্রেনিং নিয়েছি৷ তারপর…৷’ হঠাৎ চুপ করে গেল কোকো৷ ওকে দেখে রাহুলের মনে হল, ও কী যেন ভাবছে৷ বোধহয় কোনও কিছু মনে করার চেষ্টা করছে৷
‘আট বছর ট্রেনিং নেওয়ার পর কী করেছ? তারপর কী?’
কোকো রাহুলের দিকে তাকাল৷ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘তারপর অনেক ফাইট করেছি৷ অনেক লড়াই…করেছি৷ অনেক জিতেছি৷ অনেক ফাইট করেছি…৷’
রাহুল অবাক হয়ে কোকোর দিকে তাকিয়ে রইল৷
৷৷ছয়৷৷
কয়েকদিন পর এক অদ্ভুত ঘটনায় মাঝরাতে রাহুলের ঘুম ভেঙে গেল৷
ও অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পাচ্ছিল৷ যন্ত্রণার শব্দ—তার সঙ্গে কথা৷
‘ওঃ! ওঃ! মাস্টারজি! ছেড়ে দাও! আমি…আর…করব না৷ আমাকে…ছেড়ে দাও৷ ওঃ…৷’
দু-হাতে চোখ ডলে অন্ধকার মেঝের দিকে তাকাল রাহুল৷ চাপা কর্কশ গলায় টুকরো কথাগুলো কে বলছে ও ভালোই বুঝতে পারল৷ কিন্তু ও অন্ধকারে কোকোর শরীরটা ভালো করে ঠাহর করতে পারছিল না৷
লাল আর সবুজ রঙের আলোর ঝিলিক চোখে পড়ল রাহুলের৷ ছোট-ছোট রঙিন আলোর বিন্দু জোনাকির মতো জ্বলছে-নিভছে৷
রাহুলের ঘুম ছুটে গেল৷ ভালো করে চোখ রগড়ে বিছানায় উঠে বসল ও৷ চাপা গলায় ডাকল, ‘কোকো! কোকো! কী হয়েছে?’
কোকোর কাছ থেকে কোনও উত্তর এল না৷ ওর যন্ত্রণার আর্তনাদ আর টুকরো কথা চলতেই লাগল৷
রাহুল এবার বিছানা থেকে নেমে পড়ল৷ বহুদিনের অভ্যাসে ওর ডানহাত সহজেই পৌঁছে গেল আলোর সুইচের কাছে৷ আলো জ্বালতেই কোকোকে দেখতে পেল ও৷
কোকোর দু-চোখ বোজা৷ শরীরটা মেঝের বিছানা থেকে গড়িয়ে চলে এসেছে বাইরে৷ গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে ও ছটফট করছে, গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ কন্ট্রোল ব্যান্ডের গায়ে লাল আর সবুজ আলো দপদপ করে জ্বলছে৷ ইলেকট্রনিক খেলনায় যেমন ছোট-ছোট রঙিন বাতি থাকে সেইরকম৷
রাহুল ছুটে গেল কোকোর কাছে৷ ঝুঁকে পড়ে ওকে জোরে ধাক্কা দিল : ‘কোকো! কোকো!’
কয়েকবার ধাক্কা দিতেই কোকো চোখ খুলল৷ ওর ছটফটানি থেমে গেল৷ রাহুল দেখল, ও কুলকুল করে ঘামছে৷
কোকো উঠে বসল৷ বড়-বড় শ্বাস ফেলছে৷ চোখে-মুখে ভয়৷ কন্ট্রোল ব্যান্ডটা এখনও দু-হাতে আঁকড়ে ধরে আছে৷ ওটার লাল-সবুজ বাতি এখন নিভে গেছে৷
রাহুল বসে পড়ল ওর পাশে৷
‘কী হয়েছে, কোকো? কী হয়েছে?’ ওর ঘামে ভেজা গালে হাত বোলাতে-বোলাতে রাহুল বলল, ‘কোনও বাজে স্বপ্ন দেখেছ?’
কোকো ভয়ার্ত চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাস্টারজি… আসছে৷ কাছে…এসে গেছে৷’
‘তোমার গলার ওই ব্যান্ডটাতে আলো জ্বলছিল৷ লাল…সবুজ…৷’
কোকো ব্যান্ডটা ছেড়ে দিল৷ হাত দিয়ে মুখ মুছল৷ চাপা গলায় বলল, ‘মাস্টারজি…কাছে এসে গেলে ওরকম…আলো জ্বলে৷ আর…মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়…৷’
কোকোর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রাহুল৷ এই শিশু-যুবকের আতঙ্ক আর কষ্ট দেখে ওর মায়া হচ্ছিল৷ ‘মাস্টারজি…আসছে৷ কাছে…এসে গেছে৷’ এর মানে কী? মাস্টারজি কাছে এসে গেলে ওই লাল-সবুজ আলোগুলো জ্বলে, কোকোর মাথায় যন্ত্রণা হয়?
ভেবে-ভেবে কোনও থই পাচ্ছিল না রাহুল৷ ও উঠে গিয়ে জলের বোতল নিয়ে এল৷ ছিপি খুলে বোতলটা এগিয়ে দিল কোকোর হাতে : ‘নাও—জল খাও৷’
ঢকঢক করে অনেকটা জল খেল কোকো৷ তখনও ও অল্প-অল্প হাঁপাচ্ছে৷ বোধহয় মাস্টারজির আতঙ্কের রেশ এখনও কাটেনি৷
বেশ কিছুক্ষণ পর কোকো শান্ত-স্বাভাবিক হল৷ তখন রাহুল আলো নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়ল৷
কোকো আপনমনে ছবি আঁকছিল৷ রাহুল ওর পাশে বসে ছবি আঁকা দেখছিল৷
যে-ছবিটা কোকো আঁকতে চেষ্টা করছিল সেটা রাহুলদের স্কুল৷ যদিও ছবিটা দেখে সেটা বোঝা খুব শক্ত৷ তবে রাহুল যে স্কুলটাকে একটু-একটু চিনতে পারছিল তার কারণ, ওদের স্কুল বিল্ডিং-এর পাশে চারটে বড়-বড় গাছ আছে৷ আর তার পাশ ঘেঁষেই একটা বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং৷ কোকোর ছবিতে—বিমূর্ত এবং বিকৃত চেহারায় হলেও—সেগুলো আঁকা আছে৷ যদি তারপরেও কারও বুঝতে অসুবিধে হয় সেইজন্য ছবির মাথায় আঁকাবাঁকা হরফে লেখা আছে : ‘রাহুলের ইশকুল৷’
রাহুলের আজ স্কুল ছুটি৷ স্কুলের ফাউন্ডেশান ডে৷ তাই দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর ও কোকোর সঙ্গে গল্প করতে বসেছে৷ ওর ইচ্ছে, কোকোর মাস্টারজি সম্পর্কে আরও কিছু খবর জেনে নেয়৷
কিছুক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে কথা বলার পর কোকো ছবি আঁকার বায়না ধরল৷ তখন রাহুল ওকে জল রং আর কাগজ দিয়ে ছবি আঁকতে বসিয়েছে৷ আর ছবি আঁকা নিয়ে টুকটাক কথা বলার ফাঁকে মাস্টারজি সম্পর্কে দু-চারটে প্রশ্ন করেছে৷ কোকো ওর খেয়াল মতো কখনও প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, কখনও দিচ্ছে না৷ ও মেঝেতে ‘বাবু’ হয়ে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কাগজের ওপরে রং বুলিয়ে চলেছে৷
রাহুল ওর আঁকা ছবিটা দেখছিল৷ কোকোর আঁকা দেখে বোঝা অসম্ভব যে, ওর মা ভালো ছবি আঁকত৷
রাহুল বলল, ‘কোকো, লাল রংটায় আর-একটু জল মেশাও—হালকা করে নাও৷ মাস্টারজি কোথায় থাকে?’
‘অনেক দূরে৷ এখন…কাছে…এসে গেছে৷ এইখানটায় সবুজ রং দিই?’
রাহুল ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল৷ ওর মনে পড়ল, শুরু থেকে কোকো সবসময় বলে এসেছে মাস্টারজি দূরে থাকে৷ কিন্তু ইদানীং ও বলছে, মাস্টারজি কাছে এসে গেছে৷ সেই কাছে এসে যাওয়াটা কি কোকোর গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডে ধরা পড়েছে?
‘না, না—নীল রং দিয়ো না৷ তুমি তো জানো গাছের পাতা সবুজ হয়৷’
কোকো ছবি থেকে মুখ তুলে তাকাল রাহুলের দিকে৷ হেসে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ৷ গাছের…পাতা…সবুজ হয়৷ সবুজ…৷’
‘মাস্টারজির কাছে আর কে-কে আছে, কোকো?’
‘আকাশ তো নীল৷ তাই…না, রাহুল?’
‘হ্যাঁ, নীল৷ আর কে-কে আছে মাস্টারজির কাছে?’ রাহুল আবার জানতে চাইল৷
‘আকাশ নীল৷ আকাশ…নীল৷ রাহুল বলেছে৷’ আপনমনেই খুশি হয়ে মাথা নাড়ল৷ তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘সুলতানদা আছে৷ রামুদা…আছে৷ ময়না…আছে৷’
অবাক হল রাহুল৷ সুলতানদা, রামুদা, ময়না—এরা কারা?
বারবার প্রশ্ন করেও কোকোর কাছ থেকে আর কোনও সূত্র পাওয়া গেল না৷
‘এটা তো গাছের গুঁড়ি৷ এটা ব্রাউন রং দাও৷ বাদামি৷’
কোকো গাছের গুঁড়িতে সবুজ রং দিতে যাচ্ছিল৷ রাহুলের কথায় ও নতুন উৎসাহে বাদামি রং গুলতে শুরু করল৷
‘এই গাছের গুঁড়িটাও বাদামি রং হবে৷’ ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল রাহুল, ‘আচ্ছা কোকো, মাস্টারজি তো বলছ কাছে এসে গেছে৷ যদি তোমার একেবারে সামনে এসে পড়ে তা হলে কী হবে?’
ছবি আঁকা থামিয়ে দিল কোকো৷ চোখ বড়-বড় করে তাকাল রাহুলের দিকে : ‘আমার…তখন…খুব ভয় করবে৷’ বাঁ-হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিল ও৷ রাহুলের দুটো আঙুল চেপে ধরে আস্তে-আস্তে বলল, ‘কিন্তু…রাহুলকে ছেড়ে…আমি যাব না৷ মাস্টারজি ভয় দেখালেও… না৷ যাব না৷’
রাহুল কোকোর মুঠোর মধ্যে অদ্ভুত এক উষ্ণতা খুঁজে পেল৷ ও আঙুল দুটো ছাড়িয়ে নিল না৷ কোকোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷
কিছুক্ষণ পর রাহুলের হাত ছেড়ে দিল ও৷ আবার ছবি আঁকায় মন দিল৷
গত একসপ্তাহে চারবার কোকোর কন্ট্রোল ব্যান্ডের লাল-সবুজ এল. ই. ডি. বাতি জ্বলে উঠেছে৷ আর একইসঙ্গে কোন এক রহস্যময় যন্ত্রণায় কোকো ছটফটিয়ে উঠেছে৷ রাহুল ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না৷ কেনই বা আলো জ্বলছে, আর কেনই বা কোকো ছটফট করে উঠছে? মাস্টারজির সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্কই বা কী?
কোকো যে ধীরে-ধীরে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সেটা রাহুল বেশ বুঝতে পারছিল৷ ঘিয়া নদীর পাড়ে কোকোকে প্রথম যখন রাহুল দেখেছিল তখন ওকে দিগভ্রান্ত, জড়বুদ্ধি, মানসিক রোগী বলে মনে হয়েছিল৷ এখন ও কত পালটে গেছে! সবসময় হাসিখুশি৷ হাসিমুখে কত না পরিশ্রমের কাজ করে ও! ওর গায়ের জোর গ্রামে একরকম কিংবদন্তী হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ গ্রামের সবাই কোকোকে ভালোবাসে৷ ঝন্টুদা দেখা হলেই কোকোকে আইসক্রিম কিংবা পেপসি খাওয়ায়৷ ঝন্টুদা লাইব্রেরির কোনও কাজের কথা বললেই কোকো একপায়ে খাড়া৷ তবে ওকে বুদ্ধির কাজ কেউ দেয় না—দেয় শক্তির কাজ৷
কোকো সবসময় রাহুলের পিছন-পিছন ঘোরে৷ রাহুলকে চোখের আড়াল হতে দেয় না৷ রাহুল কখনও বারণ করলেও ও শোনে না৷ রাহুলকে মাকু আর নেনের কথা বলে৷ বলে, ‘আমি সঙ্গে থাকলে… তোমাকে কেউ কিছু করবে না৷ আমার গায়ে…জোর আছে৷’
ওর কথায় রাহুল হাসে৷
এর মধ্যে বেশ কয়েকদিন নেনে আর মাকুর সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছে৷ কিন্তু মাকুরা গায়ে পড়ে কোনও কথা বলেনি৷ চুপচাপ এড়িয়ে গেছে৷
কোকোকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে রাহুল একদিন চলে এসেছিল ঘিয়া নদীর পাড়ে৷
বর্ষা কবেই এসে গেছে৷ সেই বর্ষার জলে নদী ফুলে উঠেছে৷ দুপাশের গাছপালার দল সবুজে-সবুজে মাতোয়ারা৷
রাহুল কোকোকে নিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করল৷ নদীর ঘোলাটে জল ওদের পাশে-পাশে ছুটছে৷
রাহুল বলল, ‘কোকো, মনে পড়ে, এই নদীতে তুমি ভেসে এসেছিলে? ওই গাছটার নীচে—’ আঙুল তুলে গাছটা দেখাল রাহুল : ‘—তুমি পড়ে ছিলে৷’
কোকো নদী বরাবর তাকাল৷ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল৷ তারপর আস্তে-আস্তে বলল, ‘মনে…আছে৷ আমি…সাঁতার…জানি…৷’
‘আমিও সাঁতার জানি৷’ বলল রাহুল, ‘তুমি কি মাস্টারজির কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিলে?’
রাহুলের দিকে তাকাল কোকো৷ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ৷
‘কেন, পালিয়ে এসেছ কেন?’
কোকো চুপ করে রইল৷ ওর শূন্য চোখ নদীর জলের দিকে তাকিয়ে রইল৷ কিন্তু রাহুল বুঝতে পারল ও নদীর জল দেখছে না—অন্য কিছু ভাবছে৷
আকাশ মেঘলা৷ বৃষ্টি নেই৷ কিন্তু শেষ বৃষ্টির জল এখনও মাটি ভিজিয়ে রেখেছে৷ গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে কোথায় যেন বুলবুলি আর দোয়েল ডাকছে৷ নদীর সঙ্গে বয়ে আসা এক অদ্ভুত হাওয়া রাহুলের মনখারাপ করে দিচ্ছিল৷
কোকো হঠাৎ নদীর পাড়ে বসে পড়ল৷ নদীর জলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল৷
রাহুলও বসে পড়ল ওর পাশে৷ ওর পিঠে হাত রাখল : ‘কোকো, তুমি পালিয়ে এসেছিলে কেন?’
কোকো আলতো ফিসফিসে গলায় বলল, ‘মাস্টারজি…আমাকে…মারত৷ সিগারেটের…ছ্যাঁকা দিত৷ তাই নদীতে…ঝাঁপ দিয়ে…পালিয়ে এসেছি৷’
‘তোমাকে মারত কেন মাস্টারজি?’
‘আমি আর লড়তে চাইনি…তাই৷’ কথাটা বলে কোকো বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল৷
‘কার সঙ্গে লড়তে চাওনি?’ রাহুলের ভেতরে কৌতূহলের ঘূর্ণিপাক শুরু হয়ে গিয়েছিল৷
‘কারও সঙ্গে না৷ আমি বলেছি…আমি আর…লড়ব না৷ কাউকে…মারব না৷ কষ্ট…দেব না৷’
রাহুল আবার ওকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কার সঙ্গে লড়তে চাওনি?’
কোকো কোনও জবাব দিল না৷ শুধু রাহুলের হাতটা পিঠ থেকে নামিয়ে জোরে আঁকড়ে ধরল৷ ফিসফিস করে বলল, ‘আমার মা নেই৷ বাবা নেই৷ কেউ…নেই৷’
একই কথা বারবার বলতে লাগল কোকো৷ বলতে-বলতে ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ রাহুলের দিকে আর্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না, রাহুল৷’
রাহুল ছোট বাচ্চাটাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল৷
কোকোকে নিয়ে রথের মেলায় গিয়েছিল রাহুল৷ রেললাইন পেরিয়ে আরও বেশ খানিকটা গেলে একটা বিশাল মাঠ৷ মাঠটার নাম ‘শকুন্তলার মাঠ’৷ কেন যে এরকম নাম কেউ জানে না৷ সেই মাঠে প্রতি বছরেই রথের মেলা বসে৷
মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ দৈত্যের মতো নাগরদোলা৷ এ ছাড়া রয়েছে অনেক মণিহারী দোকান, খাবারের স্টল, খেলনাপাতির দোকান, পাঁপড়ভাজা আর তেলেভাজার দোকান৷ এসবের সঙ্গে এই মেলা উপলক্ষ্যেই থাকে পাখির হাট৷ নানান ধরনের রঙিন পাখির পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা৷ টিয়া, চন্দনা, বদ্রিকা থেকে শুরু করে আরও কতরকম পাখি!
চারপাশে লোকজনের হইচই, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চার কান্না, মাইকের হিন্দি গান, সবমিলিয়ে এক অদ্ভুত শব্দব্রহ্ম তৈরি হয়েছিল৷ তারই মধ্যে কোকো আর রাহুল মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷
বাপি আর মামের কাছে বায়না করে রাহুল কোকোকে নিয়ে মেলায় এসেছে৷ বাপিকে ও বোঝানোর চেষ্টা করেছে কোকো যত স্বাভাবিক জীবনে মিশবে তত তাড়াতাড়ি ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে৷ মেলায় আসার সময় বাপি রাহুলের হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন৷
এখন সেই পঞ্চাশ টাকা ভাঙিয়েই ওরা মেলার আনন্দ কুড়োচ্ছিল৷ নাগরদোলায় চড়া, তেলেভাজা আর পাঁপড়ভাজা খাওয়া, তার সঙ্গে কোকোর প্রিয় পেপসি—একের পর এক চলছিল৷
একটা খেলার দোকানে বল ছুড়ে ন’টা কাঠের পুতুলকে কাত করে দেওয়ার কমপিটিশান হচ্ছিল৷ তিনবারের চেষ্টায় ন’টা পুতুলকে শুইয়ে দিতে পারলেই পাওয়া যাবে পুরস্কার—মাঝারি মাপের স্টেইনলেস স্টিলের একটা বাটি৷
রাহুল পাঁচ টাকা দিয়ে কমপিটিশানে নাম দিল৷ তিনবার বল ছুড়ে ও সাতটা পুতুলকে কাত করে দিল বটে কিন্তু পুরস্কার জিততে পারল না৷
রাহুল বল ছোড়ায় নাম দেওয়ার জন্য কোকোকে বলল৷ কিন্তু কোকো বারবার মাথা নেড়ে জানাল যে, ওর হাতে একদম টিপ নেই৷
এরপর ওরা এয়ারগান শুটিং-এর স্টলে গেল৷ দেওয়ালে লাগানো নানা রঙের বেলুন৷ তারই একপাশে বেলুন লাগানো চক্র ঘুরছে, সুতোয় বাঁধা প্লাস্টিকের বাঘ-সিংহ, এমনকি জ্বলন্ত মোমবাতি আর পেরেকও ঝুলছে৷
রাহুল পাঁচবার ফায়ার করে দুটো বেলুন ফাটাতে পারল৷ কিন্তু কোকো এবারেও রাজি হল না৷ মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার…হাতে টিপ নেই৷’
মেলায় ঘুরতে-ঘুরতে কখন যেন সন্ধে নেমে এসেছে৷ চারপাশের খুঁটিতে লাগানো হ্যালোজেন আলো জ্বলে উঠেছে৷ স্টলে জ্বলে উঠেছে বালব আর টিউবলাইট৷ লোকের ভিড় আরও বাড়ছে৷ মাইকে মেলার কর্তৃপক্ষ কীসব যেন ঘোষণা করছে৷
একটা স্টলের সামনে বহু মানুষের ভিড় দেখে রাহুল দাঁড়িয়ে পড়ল৷ কোকোকেও হাত ধরে টেনে থামাল৷
ভিড় ঠেলে রাহুল আর কোকো কয়েকটা স্তর এগিয়ে গেল৷ দেখল, স্টলে একটা বিচিত্র কমপিটিশানের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
স্টলের ঠিক মধ্যিখানে একটা পুরোনো টিউবওয়েল পোঁতা আছে৷ টিউবওয়েলের কলের মুখে একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের বালতি বসানো৷ আর টিউবওয়েলের গায়ে, হাতলে, ফুলের মালা জড়ানো৷ স্টলের কাপড়ের দেওয়ালে বেশ কয়েকটা পোস্টার আঁটা৷ পোস্টারে যা লেখা আছে তার সারমর্ম হল : এই টিউবওয়েলটা পাম্প করে সহজে জল তোলা যায় না; যদি কেউ দশবার পাম্প করে তার মধ্যে এই কল থেকে জল বের করতে পারে তা হলে পুরস্কার একশো টাকা৷
প্রতিযোগিতায় নাম দেওয়ার এন্ট্রি ফি দশ টাকা৷
স্টলের মালিক চিৎকার করে চ্যালেঞ্জারকে আহ্বান জানাচ্ছিল : ‘আসুন, দেখিয়ে দিন আপনার গায়ে কত জোর! এই বেয়াদব টিপকলটাকে শায়েস্তা করুন—!’
রাহুল দেখল, গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারার অনেকেই বেশ আশা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে নামছে, কিন্তু হার মেনে ফিরে আসছে৷ কলের মুখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল বেরোচ্ছে না৷
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন বলল, ‘তোমার এই টিপকল থেকে জল আদৌ বেরোয় তো?’
অমনি স্টলের মালিক তার পাশে দাঁড়ানো লোকজনের মধ্যে কাকে যেন ইশারা করল৷ স্যান্ডো গেঞ্জি পরা স্বাস্থ্যবান একটি ছেলে কলের সামনে এগিয়ে গেল৷ মালিকের নির্দেশে জোরালো হ্যাঁচকা দিয়ে টিউবওয়েলটা পাম্প করতে লাগল৷ আর মালিক চিৎকার করে এক থেকে দশ গুনতে লাগল৷ তার সঙ্গে-সঙ্গে পাবলিকও হইহই করে গলা মেলাল৷
আটবারের বার কলের মুখ থেকে সরু সুতোর মতো জল বেরোল৷ তারপরের দুবারে জলের ধারাটা লাঠির মতো মোটা হল৷
তারপর ছেলেটা থামল৷ জনতা চিৎকারে ফেটে পড়ল৷
রাহুল কোকোকে ঠেলা মারল : ‘কোকো নাও—এবার নাম দাও…৷’
কোকো কিন্তু মাথা নাড়ল৷ বলল, ‘না, রাহুল—না৷’
রাহুল ওকে ছাড়ল না৷ বলল, ‘কেন, ‘‘না’’ কেন? এবারে তো আর টিপের ব্যাপার না—গায়ের জোরের ব্যাপার৷ তুমি যে বল তোমার গায়ে অনেক জোর! তা হলে ‘‘না’’ বলছ কেন?’
‘না, সেজন্যে না—৷’ আলতো করে বলল কোকো৷
‘তা হলে কী জন্যে?’
‘দোকানদারের একশো টাকা…মার যাবে৷ তাই—৷’
রাহুল হেসে ফেলল৷ কোকোকে বোঝাল যে, দোকানদার ইতিমধ্যেই অনেক টাকা লাভ করেছে৷ এখন একশো টাকা গেলে তার কোনও ক্ষতি হবে না৷
রাহুল কোকোর হয়ে এন্ট্রি ফি জমা দিল৷ তারপর কোকোকে ঠেলে টিউবওয়েলটার দিকে এগিয়ে দিল৷
কোকো টিউবওয়েলের হাতলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পাবলিক হইহই করে উঠল৷ কোকো হাতলটা ধরে সামান্য ঝুঁকে পজিশন নিল৷
দোকানদার চিৎকার করে প্রতিযোগিতার ব্যাপারে নানান ঘোষণা করছিল৷ কোকো হাতলটা ধরে দাঁড়াতেই সে বলল, ‘আপনি রেডি? এ—ক৷’
কোকো টিউবওয়েল পাম্প করা শুরু করল, আর দোকানদারও গোনা শুরু করল৷
কোকো যেটা করছিল সেটা হাই স্পিড সিনেমার মতো৷ ওর তিন নম্বর পাম্পের সঙ্গে-সঙ্গে জল বেরোতে শুরু করল৷ কিন্তু কোকো না থেমে পাম্প করে চলল৷ ছ’নম্বর পাম্পে জলের ধারাটা ময়াল সাপের মতো মোটা হয়ে গেল৷
রাহুল চিৎকার করছিল, ‘কোকো৷ থামো! থামো!’ কিন্তু পাবলিকের হল্লায় ওর কথা চাপা পড়ে গেল৷
দোকানদার ব্যস্তভাবে কোকোর কাছে গিয়ে ওকে থামাল৷ ওকে শাবাশ দিয়ে একশো টাকা পুরস্কার তুলে দিল ওর হাতে৷ তারপর চেঁচিয়ে বলতে লাগল কোকোর কৃতিত্বের কথা : ‘এইমাত্র একজন পালোয়ান জিতে নিয়েছেন এ-ক-শো টাকা৷ ভাইসব, আমার এই কমপিটিশানে কোনও কারচুপি নেই, কোনও চিটিংবাজি নেই৷ আপনারা এগিয়ে আসুন…৷’
কোকো আর রাহুল ভিড় ঠেলে বাইরে এল৷ রাহুল কোকোর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘কনগ্র্যাচুলেশান, কোকো—শাবাশ!’
কোকো একশো টাকার নোটটা রাহুলের দিকে এগিয়ে দিল : ‘এটা রেখে দাও৷’
রাহুল টাকাটা পকেটে রেখে বলল, ‘এই টাকাটা মাম আর বাপিকে দেব৷ বলব, কী সহজে তুমি প্রাইজ জিতেছ—৷’
ওরা দুজনে গল্প করতে-করতে ‘শকুন্তলার মাঠ’ ছেড়ে বেরিয়ে এল৷
ফেরার পথে রেললাইনটা পেরোতেই ওরা মাকুদের দেখতে পেল৷ আগাছার ঝোপের পাশে একটা টালির ছাউনি দেওয়া ঘর৷ তার ভেতরে বসে মাকুরা তাস খেলছে৷ ঘরের ভেতর থেকে টিভির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷
‘তাড়াতাড়ি পা চালাও’ বলে রাহুল কোকোর হাত ধরে টানল৷ মাকুদের বিশ্বাস নেই৷ যখন-তখন ঝামেলা বাধাতে পারে৷
ওরা যখন বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে তখন কোকো হঠাৎই এক অদ্ভুত কাণ্ড করল৷
রাস্তার ওপরেই সদানন্দদার চায়ের দোকান৷ বেড়া আর খুঁটির মাথায় টিনের চাল৷ দোকানের সামনে দুপাশে দুটো বেঞ্চি৷ তাতে জনা-চারেক খদ্দের—খবরের কাগজ পড়ছে, চা খাচ্ছে৷
সদানন্দদার দোকানের পাশেই নীলুকাকুর লন্ড্রি৷ নীলুকাকুর চোখে হাই পাওয়ারের চশমা৷ রোগা দুর্বল চেহারা৷ গায়ে ফুলশার্ট আর পাজামা৷ ওর দোকানটার চেহারা ওর মতোই পুরোনো৷ শোকেসের কাঠ কালচে হয়ে গেছে৷ কাচের ওপরে বাদামি ছোপ পড়েছে৷ দোকানের শাটার রং চটা, জং ধরা৷
দোকান বন্ধ করার জন্য সেই শাটারটাই টেনে নামাতে চেষ্টা করছিল নীলুকাকু৷ কিন্তু পারছিল না৷ সেইজন্য চেঁচিয়ে সদানন্দদাকে ডাকছিল—যদি সে একটু হাত লাগিয়ে দেয়৷ কিন্তু সদানন্দদা চা তৈরিতে ব্যস্ত—নীলুকাকুর ডাকে সাড়া দিয়ে সে বারবার বলছিল, ‘একটু সবুর করো, কাকা—যাচ্ছি৷’
পথ চলতে-চলতে কোকো এসব দেখছিল, শুনছিল৷ হঠাৎই ও রাহুলের পাশ থেকে ছুট লাগল নীলুকাকুর লন্ড্রির দিকে৷ কর্কশ গলায় বলল, ‘সরে দাঁড়াও, কাকা৷ আমি…আমি শাটার নামিয়ে…দিচ্ছি৷’
কথাগুলো বলতে যতক্ষণ লাগল তার অনেক কম সময়ে শাটারের কাছে পৌঁছে গেল কোকো৷ বাঁ-হাতে শাটার ধরে অনায়াসে টান মারল৷ প্রতিবাদের ধাতব জিগির তুলে জং ধরা শাটার অটোমেটিক এলিভেটরের মতো নেমে এল৷ শাটারের ঘর্ঘর শব্দে চায়ের দোকানের খদ্দেররা মুখ ফিরিয়ে তাকাল৷
নীলুকাকু তখন কোকোর থুতনিতে আঙুল দিয়ে ওকে আহ্লাদ করছে৷ বলছে, ‘ও, তুই! তোকে আগে দেখতে পাইনি রে৷ পেলে তোকেই বলতাম৷ লক্ষ্মী ছেলে! তোর ভালো হোক৷’
কোকো হেসে ‘আসি’ বলল৷ তারপর ছুট্টে চলে এল রাহুলের কাছে৷
রাহুল বলল, ‘কোকো, তোমাকে নিয়ে আর পারি না! বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ছুট লাগালে?’
‘নীলুকাকুর শাটারটা…খুব শক্ত৷ আগেও দু-দিন আমি…ওটা টেনে নামিয়ে দিয়েছি…৷’
রাহুল অবাক হয়ে কোকোর মুখের দিকে তাকাল৷
বেশ কিছুদিন ধরেই কোকো একা-একা রাস্তায় বেরোয়, মামের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মুদিখানার জিনিস কিনতে যায়৷ বলতে গেলে মণিমেলার সব রাস্তাই ও এখন চিনে গেছে৷ তা ছাড়া ওকে এলাকার সবাই ভালো করে চেনে, ভালোও বাসে৷
আবার রাহুলের পাশে-পাশে হাঁটতে লাগল কোকো৷ ওদের পাশ দিয়ে প্যাঁক-প্যাঁক হর্ন বাজিয়ে একটা সাইকেল রিকশা চলে গেল৷ একটা সাইকেল ভ্যান নানারকম শাকসবজি নিয়ে রাস্তার ধারের লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার পাশেই একটা টাইমকল৷ তার সামনে ভিড়৷ জল নেওয়ার জন্য চার-পাঁচজন লোক কলসি, বালতি, জলের বোতল নিয়ে লাইন দিয়ে আছে৷ আকাশে মেঘের পাতলা ঝালর৷ তার আড়ালে অসম্পূর্ণ চাঁদ৷
আজ বিকেল থেকে গুমোট ভাব ছিল৷ এখন হঠাৎ যেন হাওয়ার সুড়সুড়ি টের পেল রাহুল৷ ওর মনটা খুশি-খুশি হয়ে উঠল৷ ও ভাবছিল, বাড়িতে ঢুকে বাপি আর মামকে ঠিক কীভাবে কোকোর টিউবওয়েল কমপিটিশান জেতার খবরটা জানাবে৷
ঠিক তখনই একটা অশ্বত্থগাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা ছায়া৷ কোকোর নাম ধরে ডাকল৷
‘অ্যাই, কোকো!’
রাহুল আর কোকো দুজনেই চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল সেদিকে৷
জায়গাটা অন্ধকার৷ রাস্তার আলো ভালো করে পৌঁছয়নি সেখানে৷ গাছের কালো গুঁড়ির পাশে অস্পষ্ট একটা কালো ছায়া৷
‘কোকো—’ আবার ডাকল সেই ছায়া৷
কোকো এগিয়ে গেল অশ্বত্থগাছটার কাছে৷ পিছনে রাহুল৷
ছায়াকে চিনতে পারল কোকো : ‘সুলতানদা! তুমি!’
‘হ্যাঁ—আমি৷’ বলে সুলতান ওকে জড়িয়ে ধরল : ‘তুই কেমন আছিস?’ ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর মুখটা ভালো করে দেখতে লাগল সুলতান৷
‘ভালো…আছি৷’ কোকো বলল৷
‘শোন—তোর খুব বিপদ৷ মাস্টারজি তোকে খুঁজছে৷’
সঙ্গে-সঙ্গে কোকোর গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডের লাল আর সবুজ আলো জ্বলে উঠল৷ এবং কোকো যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল৷ ব্যান্ডটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে ও অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে লাগল৷ ছটফট করতে-করতে ওর শরীরটা মাটিতে পড়ে গেল৷ যন্ত্রণার টুকরো শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল ওর মুখ থেকে৷
৷৷সাত৷৷
সে-রাতটা রাহুলদের বলতে গেলে না ঘুমিয়েই কাটল৷ কারণ সুলতান যে-কাহিনি শোনাল তারপর রাহুল, ওর বাপি আর মামের দুশ্চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক৷
কোকোকে সামলে নিয়ে ধরে-ধরে বাড়ির দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল রাহুল—সঙ্গে সুলতান৷ যেতে-যেতে সুলতান রাহুলের সঙ্গে অল্প-অল্প কথা বলছিল৷
‘কোকো হারিয়ে যাওয়ার পর মাস্টারজি খেপে একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল৷ তখন আমাদের পাঁচজনকে পাঁচদিকে খুঁজতে পাঠায়৷ সে তার রাগ কী! রেগে একেবারে আগুন৷ আমাকে বলে কি ‘‘জাহান্নম থেকে হলেও ওই মেড়াটাকে খুঁজে নিয়ে আয়৷’’ রাগে একদম গরগর করছিল৷’
‘এখন কী হবে?’ ভয় পেয়ে জিগ্যেস করল রাহুল৷
‘দেখি কী হয়৷’ চিন্তার সুরে বলল সুলতান৷ কোকোর কাঁধে আলতো চাপড় মেরে হাসল : ‘আসলে এই খোকাটাকে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি৷ ও খুব ভালো ছেলে৷ কিন্তু ওই কন্ট্রোল ব্যান্ড…৷’
‘কন্ট্রোল ব্যান্ড কী?’
‘ওই…মাস্টারজির কন্ট্রোল৷’
ওরা ততক্ষণে রাহুলদের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল৷
একটু পরে ওরা সবাই বসবার ঘরে গুছিয়ে বসল৷ কল্যাণবাবু বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিলেন৷ রাস্তার দিকের জানালাগুলোও ভেজিয়ে দিলেন৷ তারপর সুলতানের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন৷ রাহুলের মাম স্বামীকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় ফিসফিস করে বললেন, ‘আমার তো বুক কাঁপছে৷ রাহুল এই লোকটাকে কোথা থেকে জুটিয়ে নিয়ে এল? কী হবে এখন? তুমি বরং পুলিশে খবর দাও—৷’
কল্যাণবাবু স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘এখন না৷ আগে এর সঙ্গে কথা বলে দেখি৷ লোকটা এমনিতে খারাপ না৷ কোকোকে খুব ভালোবাসে—’ স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে কল্যাণবাবু অনুরোধ করলেন, ‘আমাদের একটু চা-টা খাওয়াবে না?’
রাহুলের মাম ‘নিয়ে আসছি’ বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন৷
কল্যাণবাবু সুলতানের মুখোমুখি বসলেন৷ ভাবলেন, লোকটাকে দেখে তো শয়তান বলে মনে হচ্ছে না৷ একটু কথা বলে দেখা যাক না৷ কোকোকে সহজে আমরা ছাড়ব না৷
সুলতানের বয়েস চল্লিশ-বিয়াল্লিশ৷ চেহারা মাঝারি৷ রং ময়লা৷ গাল বসা৷ থুতনিতে কাঁচাপাকা দাড়ি৷ কথা বলার সময় মাঝে-মাঝেই ভুরুজোড়া ওপরদিকে তোলে৷ গায়ে হালকা সবুজ হাফশার্ট আর ময়লা হয়ে যাওয়া জিনসের প্যান্ট৷
একটু পরেই মাম চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন৷ বাপিকে চা দিলেন৷ সুলতানকে দিলেন৷ নিজেও নিলেন৷ তারপর কোকোর পাশে গিয়ে বসলেন৷
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুলতান মাস্টারজির কাহিনি বলতে শুরু করল৷
‘স্যার, কলকাতার কাছাকাছি খড়দায় মাস্টারজির একটা অনাথ আশ্রম আছে৷ ‘‘করুণাময়ী’’ নাম৷ সেখানে বাপ-মা মরা হ্যান্ডিক্যাপ ছেলেরা থাকে৷ মাস্টারজি ওদের দু-বেলা খেতে দেয়, থাকতে দেয়—আর কাজ শেখায়৷ কাজ তো সব নানারকমের : রাজমিস্ত্রির কাজ, ছুতোরমিস্ত্রির কাজ, লেদ কারখানার কাজ, গেঞ্জির কল চালানোর কাজ, আরও কতরকম৷
‘মাস্টারজির অনেক কলকারখানা আছে, ব্যবসা আছে, কলকাতার সল্টলেকে তিনতলা জমকালো একটা বাড়ি আছে৷ লোক বলে, মাস্টারজি বহুরকম দু-নম্বরি ব্যবসার সঙ্গে মিলেজুলে আছে৷ একবার জাল নোট মার্কেটে ছাড়তে গিয়ে গোয়েন্দা-পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল৷ তিনমাস জেলও খেটেছিল৷ তারপর জেল থেকে বেরিয়ে কীভাবে যেন পুলিশের সঙ্গে লাইন করে নিয়েছিল৷’
বাপি জিগ্যেস করলেন, ‘কোকো ওই ‘‘করুণাময়ী’’-তে গেল কীভাবে?’
‘কীভাবে আবার! ওর নসিব৷’ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল সুলতান৷ একটু উসখুস করল৷ তারপর : ‘মাস্টারজির দলে অনেক আড়কাঠি আছে—দালাল৷ ওরা সব হ্যান্ডিক্যাপ ছেলের খবর আনে৷ তারপর ওই আশ্রমে ওদের ভরতি করে মাস্টারজি কমসেকম একটা বছর ঠিকঠাক চালায়৷ দ্যাখে যে, কেউ ওই ছেলেগুলোর খোঁজখবর করতে আসছে কি না৷ মানে, বাবা, মা, রিলেটিভ কেউ আসছে কি না৷ তারপর কেউ না এলে তখন মাস্টারজি নিশ্চিন্ত হয়৷ নিজের মতো করে ওদের ট্রেনিং চালু করে৷’
‘কীসের ট্রেনিং?’ রাহুল জিগ্যেস করল৷
উত্তরে মলিন হাসল সুলতান৷ বলল, ‘ওই হরেকরকম কাজ শেখানোর ট্রেনিং৷ কলকারখানার কাজের ট্রেনিং৷ এ ছাড়া আছে ফাইটিং-এর ট্রেনিং…৷’
‘ফাইটিং-এর ট্রেনিং!’ মাম অবাক হয়ে বললেন৷
‘হ্যাঁ৷ অনাথ আশ্রমে মাস্টারজির একটা ইল্লিগাল ক্লাব আছে৷ নাম ‘‘ফাইট ক্লাব’’৷ এই ক্লাবের কথা অনেকে জানে৷ পুলিশও জানে৷ তবে ওই টাকাপয়সা দিয়ে সেখানে মাস্টারজি লাইন করে রেখেছে আর কী! তো ওই ক্লাবে সপ্তাহে দু-দিন কি তিনদিন ফাইট কমপিটিশান হয়৷ দুজন ফাইটার বাজি ধরে লড়াই করে৷ সে-লড়াই নিয়ে দর্শকরাও বাজি ধরে৷ লড়াইয়ের পর ফাইটারদের টাকা দেওয়া হয়৷ যে জেতে সে পায় বেশি৷ যে হারে সে পায় কম৷ তবে কম পেলেও সে-টাকা অনেক৷ এর লোভে অনেকেই লড়াইয়ে নাম দেয়৷
‘আশ্রমের ছেলেদের বাচ্চা বয়েস থেকেই মাস্টারজি ট্রেনিং করায়৷ রেগুলার ব্যায়াম শেখায়, মারপিটের হরেক টেকনিক শেখায়৷ একজন ট্রেনার তাই-কোন্ডো শেখায়৷ নাম ভগবতীপ্রসাদ৷ ব্ল্যাক বেল্ট৷ একবার শুনেছি এশিয়ার চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল৷ কোকো ওর খুব ফেবারিট ছাত্র৷ আট বছর ধরে কোকোকে লড়াই শেখাচ্ছে৷’
সুলতান একবার কোকোর দিকে তাকাল৷ কোকো শূন্য দৃষ্টি নিয়ে সরল মুখে বসে আছে৷ ওর চোখ সুলতানের দিকে৷
সুলতান আপনমনে মাথা ঝাঁকাল৷ সকলের মুখের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল৷ একটা বড় শ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করল৷
‘ট্রেনিং দেওয়া ছেলেগুলোর মধ্যে থেকে মাস্টারজি ‘‘ফাইটার বয়’’-দের বেছে নেয়৷ তারপর ওদের খালি হাতে লড়াইয়ের স্পেশাল ট্রেনিং করায়৷ তারপর…তারপর ওরা ওই ‘‘ফাইট ক্লাব’’-এর জুয়ায় নাম দেয়৷ সেখান থেকে মেলা টাকা ইনকাম করে৷ ওদের সামান্য হাতখরচা দিয়ে বাকি টাকা মাস্টারজি চোট করে দেয়৷ তাই ‘‘ফাইটার বয়’’-দের মাস্টারজি সহজে হাতছাড়া করে না৷
‘আর কোকো?’ কোকোর দিকে ইশারা করে আক্ষেপের হাসি হাসল সুলতান : ‘ও এ পর্যন্ত একটাও লড়াই হারেনি৷ ও হচ্ছে ‘‘ফাইটার বয়’’-দের মধ্যে গোল্ডেন বয়৷ জুয়েল৷ সুপার হিরো৷ ওকে লড়াইয়ে নামিয়ে মাস্টারজি লক্ষ-লক্ষ টাকা ইনকাম করেছে৷ তাই কোনও অবস্থাতেই ওকে হারাতে চায় না মাস্টারজি৷ ওর খোঁজে মাস্টারজি আমাদের পাঁচজনকে লড়িয়ে দিয়েছে৷ আমিই সবার আগে কোকোকে খুঁজে পেলাম…কিন্তু মাস্টারজিকে সে-কথা কেমন করে জানাব! এই ছেলেটাকে আমি যে বড় ভালোবাসি…৷’ কথা বলতে-বলতে কোকোর দিকে তাকাল সুলতান৷ ওর চোখে স্নেহ আর আদর ঝরে পড়ছিল৷
হঠাৎই মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷ আচমকা এই সুরেলা আওয়াজে সবাই চমকে উঠল৷
সুলতান তড়িঘড়ি পকেটে হাত ঢোকাল, ফোন বের করল৷ ইনকামিং কলের নম্বরটা দেখার পর ও এমনভাবে ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল যেন হাতের মুঠোয় একটা ঝুমঝুমি সাপ ধরে আছে৷
ওর হাবভাব দেখে কারও আর বুঝতে বাকি রইল না যে, ফোনটা কে করেছে৷
বাপির মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল সুলতান৷ চোখে জিজ্ঞাসা : এখন কী করবে?
বাপি ইশারায় ওকে ফোনটা ধরতে বললেন৷
‘হ্যালো—৷’ ফোনটা ধরেই সুলতান লাউডস্পিকার অন করে দিল—যাতে সবাই ও-প্রান্তের কথা শুনতে পায়৷
‘কে, সুলতান? মেড়াটাকে খুঁজে পেলি?’ মাস্টারজির ক্ষিপ্ত গলা৷
‘না, মানে…এখনও পাইনি৷ খুঁজছি৷’ ইতস্তত করে বলল সুলতান৷
‘তুই এখন কোথায়?’
‘মণিমেলায়…৷’
ও-প্রান্ত কিছুক্ষণ চুপ৷ তারপর : ‘আমরা মণিমেলা থেকে বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার মতো দূরে আছি৷ আমার গাড়িতে একজন লোকাল লোককে তুলে নিয়েছি—লোকটা ঘিয়া নদীর আশপাশের গ্রামগুলো সব চেনে৷ তুই ভালো করে বিচ্ছুটাকে খোঁজ৷ ওটাকে পেলে আর লড়াব না৷ ‘‘করুণাময়ী’’-তে এনে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেব—যাতে আর কোনও ‘‘ফাইটার বয়’’ এরকম বেয়াদপি না করে৷’
মাস্টারজির শাস্তির কথাটা শুনে মামের মুখ থেকে ভয়ে একটা হেঁচকির শব্দ বেরিয়ে এল৷ সঙ্গে-সঙ্গে মাম মুখে হাত চাপা দিলেন—পাছে আবার কোনও শব্দ হয় এবং সেটা ফোনে শোনা যায়৷
সুলতানের মোবাইল সেটটা নিশ্চয়ই বেশ দামি, কারণ মাস্টারজি যে মামের চাপা আর্তনাদটা ফোনে শুনতে পেয়েছে সেটা পরের কথাতেই বোঝা গেল৷
‘সুলতান, তুই এখন কোথায়? কার বাড়িতে, উঁ?’ প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটু ব্যঙ্গের খোঁচা৷
‘না, না—কারও বাড়িতে নয়৷ একটা…চায়ের দোকানে…৷’
‘হুঁ—বুঝেছি৷’
ফোন ছেড়ে দিল মাস্টারজি৷
সুলতান ভয় পেয়ে গেল : ‘এখন কী হবে? মাস্টারজি যদি এখানে চলে আসে?’
মাম বললেন, ‘শিগগির পুলিশে খবর দাও৷’
‘দাঁড়াও৷’ হাতের ইশারা করলেন বাপি : ‘আমাকে একটু ভাবতে দাও—৷’
কোকো এবার কথা বলল : ‘না, আমি এ-বাড়ি ছেড়ে…কোথাও যাব না…৷’
বাপি ওর দিকে একবার তাকালেন শুধু—কোনও কথা বললেন না৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করলেন৷
মাম বললেন, ‘মণিমেলায় মাস্টারজি যদি আসেও আমাদের বাড়ি কেমন করে খুঁজে পাবে? কোকো এখানেই থাক৷ যদি কোনও বিপদ-আপদ হয় তখন বরং থানায় খবর দেওয়া যাবে৷’
সুলতান মাথা চুলকোচ্ছিল৷ কী যেন ভাবছিল৷
রাহুল এতক্ষণ চুপ করে ছিল৷ কোকোকে দেখছিল৷ ও বাপিকে লক্ষ করে বলে উঠল, ‘কোকোকে আমরা ছাড়ব না, বাপি৷ ও আমাদের কাছে থাকবে৷’
বাপি পায়চারি করতে-করতে থুতনিতে কয়েকবার আঙুল বোলালেন৷ থানা-পুলিশ করলে ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে ওরা কী করবে কে জানে! হয়তো জেলখানাতে রেখে দেবে৷ নয়তো ফাইল চালাচালি করে কোনও পাগলা-গারদেই পাঠিয়ে দেবে৷
বাপি আর ভাবতে পারছিলেন না৷
সুলতান বলল, ‘স্যার, আমি পাপী-তাপী মানুষ৷ মাস্টারজির পয়সা খেয়ে বেঁচে আছি৷ কিন্তু এই ছেলেটা বড় ভালো৷ মানে, ওকে আমার খুব ভালো লাগে৷ ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি৷ আপনারা ওকে কাছছাড়া করবেন না৷ মাস্টারজি এখানে আসে আসুক৷ তখন দেখা যাবে৷ যা হয় হবে…৷’
সুলতানের কথাটা সবার মনে ধরল৷ মামের মুখে হাসি ফুটে উঠল৷ রাহুলও ওর খুশির ভাবটা চেপে রাখতে পারছিল না৷
বাপি চেয়ারে বসে পড়লেন আবার৷ সুলতানকে বললেন, ‘আচ্ছা, ওই মাস্টারজি তো আমাদের বাড়িটা খুঁজে নাও পেতে পারে…৷’
মাথা নেড়ে হাসল সুলতান : ‘উঁহু—সেটা হওয়ার জো নেই৷ ওই যে, ওর গলার ওই কন্ট্রোল ব্যান্ড৷ মাস্টারজির কাছে একটা রিমোট আছে৷ ওটার রেঞ্জ প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার৷ ওই রিমোট দিয়ে কন্ট্রোল ব্যান্ডটাকে কন্ট্রোল করা যায়৷ ওই ব্যান্ডটা যদি কারও গলায় পরানো থাকে তা হলে ওই রিমোটের বোতাম টিপে বোঝা যায় লোকটা কত দূরে আছে৷ আর যার গলায় ওটা পরানো থাকে তাকে ওই রিমোটের বোতাম টিপে শায়েস্তা করা যায়…৷’
‘শায়েস্তা মানে?’ বাপি জিগ্যেস করলেন৷
‘মানে, রিমোটের বোতাম টিপলে কোকোর বডির ভেতর দিয়ে কীসব ওয়েভ যাবে৷ তাতে কোকোর যন্ত্রণা হবে, ও কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করবে৷ আর-একটা লাল রঙের বোতাম আছে—সেটা টিপলে মাথা ধরবে, মাথার যন্ত্রণা হবে, মাথা ঘুরবে৷ মাস্টারজি ফরেন থেকে এরকম মেশিন বেশি কয়েকটা আনিয়েছে৷ ‘‘ফাইটার বয়’’-দের মধ্যে যারা একটু বেয়াড়া, এই মেশিনগুলো তাদের জন্যে৷ গলার ওই ব্যান্ডগুলো এমন যে, রিমোটের ঠিকঠাক বোতাম না টিপে ওগুলো গলা থেকে খুলতে গেলে অসহ্য পেইন হবে৷ যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাবে…৷’
রাহুলের মনে পড়ল, কোকো ওর গলার ওই ব্যান্ডটায় কাউকে কখনও হাত দিতে দেয় না৷ মরিয়া হয়ে বাধা দেয়৷
‘কোকোকে নিয়ে মাস্টারজির কি প্রবলেম হচ্ছিল যে, ওর গলায় কন্ট্রোল ব্যান্ড পরিয়ে দিয়েছে?’ মাম সুলতানকে জিগ্যেস করলেন৷
সায় দিয়ে মাথা নাড়ল সুলতান : ‘হ্যাঁ—প্রবলেম হচ্ছিল৷’ কোকোর দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ও৷ নরম গলায় বলল, ‘কোকো ‘‘ফাইট ক্লাব’’-এ আর লড়তে চাইছিল না৷ ও আমাকে আড়ালে বলত ওর মনের কথা৷ বলত, ‘‘আমি আর লড়ব না৷ কাউকে আর মারব না৷ কষ্ট দেব না৷’’ এইসব কথা বলত সবসময়…৷
‘একদিন ও বেঁকে বসল৷ বলল, কিছুতেই ও আর লড়বে না৷ মারপিট করতে ওর আর ভালো লাগে না৷ মাস্টারজির সামনে রুখে দাঁড়াল৷ সেদিন থেকেই মাস্টারজি ছেলেটার ওপরে টরচার শুরু করল৷ মারধোর…সিগারেটের ছ্যাঁকা…কী না সয়েছে এই ভোলাভালা ছেলেটা…৷’ কথা বলতে-বলতে উঠে দাঁড়াল সুলতান৷ কোকোর কাছে এগিয়ে গেল৷ ওর মাথায় হাত রাখল : ‘মাস্টারজির চামচেগিরি করে আমিও ওকে কম টরচার করেছি! কিন্তু আশ্রমে একদিন দেখি ছেলেটা আমার ঘরে ঢুকে আমার মায়ের ফটো বুকে জড়িয়ে কাঁদছে৷ আমার আম্মি বহুদিন আগেই মারা গেছে৷ কোকো সেটা জানত৷
তো আমি তাজ্জব হয়ে ওকে জিগ্যেস করলাম, ‘‘কী রে, কী ব্যাপার? আমার মায়ের ফটো নিয়ে কাঁদছিস কেন?’’
‘ছেলেটা…এই হ্যান্ডিক্যাপ পাগলটা…আমাকে কী বলল জানেন, স্যার? বলল, ‘‘সুলতানদা, আমার মা নেই৷ মায়ের কোনও ফটোও নেই৷ তাই তোমার মায়ের ফটোটা নিয়েছি…৷’’
‘সেইদিন থেকে…সেইদিন থেকে, স্যার…আমি ওকে আমার ‘‘ভাই’’ ডেকেছি৷’ সুলতান চোখে কিছু একটা পড়েছে এমন ভান করে চোখ মুছল৷ একটু বসা গলায় বলল, ‘জানেন স্যার, অনেকবার ভেবেছি মাস্টারজির দল ছেড়ে দেব৷ কোকোকে নিয়ে কোথাও চলে যাব—কিন্তু পারিনি৷ পাপী পেট কা সওয়াল৷ ক’টা টাকার লোভে মাস্টারজির দলে পড়ে থেকেছি৷ মাস্টারজির আর-পাঁচটা পোষা গুন্ডার মধ্যে আমিও একটা হয়ে গেছি৷ কোকোকে সেভ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি৷ ওর ব্যাপারে মাস্টারজি আমাকে সন্দেহ করত৷ তাই কোকো নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর পর মাস্টারজি আমার সঙ্গে-সঙ্গে আরও চারজনকে কোকোর খোঁজে লড়িয়ে দিয়েছে৷’
মাম জিগ্যেস করলেন, ‘কোকো নদীতে ঝাঁপ দিল কেমন করে?’
সুলতান ফিরে এসে ওর চেয়ারে বসল৷ একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, ‘কয়েকজনের টিম নিয়ে মাস্টারজি বর্ধমানের একটা ফাইট কমপিটিশানে যাচ্ছিল৷ যারা গান-টান গায় তারা যেমন ফাংশান-টাংশান করতে যায় সেরকম মাস্টারজিও ‘‘ফাইট বয়’’-দের নিয়ে মাঝে-মাঝে গ্রামে-গঞ্জে যেত৷ বড়-বড় টাকার বাজি হত সেখানে৷ কোকো যেতে চায়নি, কিন্তু ওকে জোর করে গাড়িতে তুলেছিল মাস্টারজি৷ গাড়িতে আমিও ছিলাম৷ শিবাইচণ্ডীর কাছে—একটা নদীর ব্রিজ সবে পেরিয়েছি—আমাদের গাড়ির টায়ার পাংচার হল৷ তো আমরা কয়েকজন গাড়ি থেকে নেমে নদীর ধারে পায়চারি করছিলাম৷ আগের দিন রাতে মাস্টারজি আর ওর পোষা গুন্ডাগুলো কোকোকে কয়েকঘণ্টা ধরে টরচার করেছিল৷ কারণ সেই একই—ও আর লড়তে চাইছিল না৷ এমনি-এমনি কাউকে ও আর মারতে চাইছিল না৷
‘তো আমরা কয়েকজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম৷ মাস্টারজি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে টায়ার পালটানো দেখছিল৷ তখন কোকো হঠাৎ নদীতে ঝাঁপ দেয়৷ সেটা খেয়াল করতেই আমরা চেঁচিয়ে উঠি৷ মাস্টারজি ছুটে আসে নদীর পাড়ে৷ তারপর দৌড়ে গিয়ে গাড়ি থেকে রিমোটটা নিয়ে আসে৷ পাগলের মতো এ-বোতাম সে-বোতাম টিপতে থাকে৷ কিন্তু কোনও লাভ হয়নি৷ কোকো ততক্ষণে নজরের বাইরে চলে গেছে৷
‘ওকে হারিয়ে আমি দুঃখ পেয়েছিলাম ঠিকই৷ দুশ্চিন্তাও হয়েছিল৷ কোথায় না কোথায় গিয়ে পড়বে হ্যান্ডিক্যাপ ছেলেটা! দু-বেলা কীভাবে ওর খাবার জুটবে! আবার খুশিও হয়েছিলাম, স্যার৷ যে মাস্টারজির হাত থেকে খোকাটা আজাদ হতে পেরেছে…৷’
সুলতান উঠে দাঁড়াল৷ চারপাশে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলল, ‘এখানে দেখছি কোকো খুব ভালো আছে৷ আপনারা ওকে ঘরের একজন করে নিয়েছেন…৷’ কোকোর কাছে এগিয়ে গেল সুলতান৷ ওর গালে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, ‘কোকো, তুই এখানে থেকে যা৷ এখান থেকে আর কোথাও যাস না৷ এটা জন্নত৷’
কোকো হেসে বলল, ‘রাহুলকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না৷’
মাম উঠে দাঁড়ালেন৷ কোকোর মাথাটা মাতৃস্নেহে কাছে টেনে নিলেন৷ বললেন, ‘তোকে আমরা কিছুতেই ছাড়তে পারব না৷ তুই এত ভালো৷ এ-গ্রামের সবাই তোকে ভালোবাসে…৷’
কথায়-কথায় রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল৷ সুলতান হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘স্যার, সব তো আপনাদের খুলে বললাম—এবারে বলুন আপনারা কী করবেন…৷ আমি কি চলে যাব—না আপনারা আমাকে পুলিশে দেবেন?’
মাম আর বাপি মুখচাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন৷
সুলতান আক্ষেপের গলায় বলল, ‘লাইফে অনেক পাপ করেছি৷ কিন্তু এই অনাথ ছেলেটার হেনস্থা আমার আর সহ্য হচ্ছে না৷ মাস্টারজি আমাকে পেলে হয়তো মার্ডারই করে ফেলবে৷ সে করুক৷ কিন্তু কোকোর…৷’
রাহুল আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘না, সুলতানদা, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকো৷ মাস্টারজি এলে আমরা মাস্টারজিকে বোঝাব…বলো না, বাপি—৷’ বলে বাপির দিকে তাকাল রাহুল৷
বাপি বললেন, ‘হ্যাঁ—রাহুল ঠিকই বলেছে৷ মাস্টারজিকে আমরা বোঝাব…বলব যে…’, স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকালেন : ‘বলব যে, কোকো আমাদের সঙ্গে থাকুক৷ দরকার হয় মাস্টারজিকে আমি টাকা অফার করব…৷’
মাম মাথা নেড়ে বাপির কথায় সায় দিলেন৷ বললেন, ‘মাস্টারজি আসা অবধি সুলতানভাইয়ের থাকা দরকার৷’ সুলতানের দিকে তাকিয়ে মাম বললেন, ‘আপনি আজকের রাতটা আমাদের কাছে থেকে যান—৷’
সুলতান হেসে বলল, ‘থ্যাংকস—৷’
রাহুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কোকো যন্ত্রণায় ছটফট করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল৷ ওর গলার ব্যান্ডের লাল আর সবুজ বাতি দপদপ করে জ্বলতে শুরু করেছে৷
বাপি আর মাম ওকে জাপটে ধরলেন৷ সামলাতে চেষ্টা করলেন৷ রাহুল অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল৷
সুলতান চাপা গলায় বলল, ‘মাস্টারজি মনে হয় আরও কাছে এসে গেছে৷’
সঙ্গে-সঙ্গে সুলতানের মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করল৷
৷৷আট৷৷
গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন রাহুলকে জাগিয়ে দিল৷ তখন সবে রাতের আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে৷ আকাশে চাপ-চাপ মেঘ থাকায় জায়গায়-জায়গায় গাঢ় ছাই রং জমাট বেঁধে ছিল৷ তা ছাড়া বৃষ্টির শব্দ পাচ্ছিল রাহুল৷ পাশের বাড়ির টিনের চালে আর গাছের পাতায় একই বৃষ্টি দুরকমের আওয়াজ তুলছিল৷ ব্যাপারটা অনেকটা যুগল-বন্দির মতো শোনাচ্ছিল৷
কাল রাতে খাওয়া-দাওয়ার পাট সেরে রাহুলরা যখন বিছানায় শুয়েছে তখন রাত অনেক গড়িয়ে গেছে৷ তারপর অন্ধকার ঘরে টেনশানে জেগে ছিল তিনটি মানুষ : রাহুল, সুলতান, আর কোকো৷ কিছুতেই ওরা দু-চোখের পাতা এক করতে পারছিল না৷
পাশের ঘরে বাপি আর মামেরও একই অবস্থা৷ কোকোকে নিয়ে টানাপোড়েনের যন্ত্রণা ওঁদের দু-জনকেই কষ্ট দিচ্ছিল৷ কোকোকে হারানোর আতঙ্কে মাম ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন৷
রাহুল এখন শুধু ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনেনি, হেডলাইটের আলোও দেখতে পেয়েছিল৷ কারণ, খোলা জানলার পরদা ভেদ করে আলোর ছটা ঢুকে পড়েছিল ঘরের ভেতরে৷ তারপর গাড়ির চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলোর জ্যামিতিটা দেওয়ালে ধীরে-ধীরে সরে গিয়ে রাহুলের বুককেসের ওপরে থেমেছে৷ এবং পরক্ষণেই নিভে গেছে৷
রাহুলের বুকের ভেতরটা ধড়াস-ধড়াস করে উঠল৷ আবছা আলোয় ও তাকাল মেঝেতে শুয়ে থাকা সুলতান আর কোকোর দিকে৷ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে-থেকে ওরা এখন ঘুমোচ্ছে৷ বোধহয় ক্লান্তিতে আর জেগে থাকতে পারেনি৷ শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছে৷
ইঞ্জিনের শব্দটা বাড়ির কাছ ঘেঁষে এসে থামল৷
রাহুল বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল৷ বেশ টের পেল ওর হাত-পা কাঁপছে৷
ও সুলতানের কাছে গেল৷ ঝুঁকে পড়ে জোরে ঠেলা মরাল ওকে : ‘সুলতানদা! সুলতানদা! ওঠো—ওঠো!’
সুলতান ধড়মড়িয়ে জেগে উঠল৷ অন্ধকারে রাহুলকে ঠাহর করতে চেষ্টা করল৷
‘শ-শ-শ-শ’ শব্দ করে সুলতানকে চুপ করে থাকতে ইশারা করল রাহুল৷ তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘জানলা দিয়ে দ্যাখো তো৷ একটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম—৷’
ঘুম কেটে গেল সুলতানের৷ ও চট করে উঠে দাঁড়াল৷ খুব সাবধানে জানলার কাছে গেল৷ দু-চোখে হাত ঘষে পরদা সরিয়ে উঁকি মারল৷
রাহুলদের বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটা কোয়ালিস গাড়ি৷ হালকা আলোয় গাড়ির রংটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ তবে সাদা, কি ছাই, অথবা রুপোলি রঙের হতে পারে৷
বুকটা ধক করে উঠল সুলতানের৷ মাস্টারজির রুপোলি রঙের একটা কোয়ালিস গাড়ি আছে!
রাহুল সুলতানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল৷ দেখল, গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল চারজন লোক৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই ওরা ব্যস্ত-ভাবে রাহুলদের গ্রিলের গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল৷ চার-জনের মধ্যে একজনের হাঁটার ভঙ্গিটা কেমন যেন চেনা মনে হল রাহুলের৷
আর দেরি করল না রাহুল৷ ছুটে চলে গেল ঘরের দরজার কাছে৷ এক্ষুনি বাপি আর মামের ঘরে গিয়ে ডাকা দরকার৷
দরজা খুলতেই বাপি আর মামকে দেখতে পেল ও৷ লোহার গেটের শব্দে ওঁরা জেগে উঠেছেন৷ জানলা দিয়ে লোকগুলোকে দেখেওছেন৷
চাপা গলায় দ্রুত পরামর্শ করল সবাই৷ মাম বাপিকে বললেন, ‘কী হবে এখন? থানায় ফোন করবে?’
বাপি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু তার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল৷
দু-তিন সেকেন্ড চুপ করে থেকে বাপি চোয়াল শক্ত করে বললেন, ‘আর কিছু করার নেই৷ মোকাবিলা করতে হবে৷’
কথাগুলো বলেই বাপি সুইচবোর্ডের কাছে গেলেন৷ আলোর সব ক’টা সুইচ জ্বেলে দিলেন৷ রাহুলকে বললেন, ‘বাড়ির সব আলো এক্ষুনি জ্বেলে দে৷ আর কোকো কোথায়?’
‘ঘুমোচ্ছে৷’
‘ওকে শিগগির ডেকে তোল—৷’
রাহুল ব্যস্তভাবে ছুট লাগাল৷ ওর সঙ্গে-সঙ্গে সুলতানও ছুটল৷
এর মধ্যেই কলিংবেল আরও তিনবার বেজে উঠেছে৷ বেল বাজানোর ঢঙেই বোঝা গেল যারা এসেছে তারা বেশ অধৈর্য হয়ে উঠেছে৷
এবার বন্ধ দরজায় ধাক্কা পড়ল—পরপর তিনবার৷
তার একটু পরেই রাহুলের নাম ধরে কে ডেকে উঠল : ‘রাহুল! রাহুল!’
রাহুল চমকে উঠল৷ চেনা গলা৷ কিন্তু কে যেন?
এর মধ্যেই ও কোকোকে ধাক্কা দিয়ে ডেকে ঘুম থেকে তুলেছে৷
সব আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়িটা আলোয় আলোময়৷ বন্ধ দরজা থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সবাই৷ যেন কোনও একটা মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছিল৷
আবার ধাক্কা৷ আবার ‘রাহুল৷ রাহুল৷’
কোকো ভয় পেয়ে রাহুলের হাত জড়িয়ে ধরল৷
বাপি কেমন যেন মরিয়া হয়ে উঠলেন৷ বললেন, ‘খুলে দিই৷ নইলে ওরা দরজা ভেঙে ফেলবে৷’
দরজা খুলতেই ওপিঠ থেকে জোরালো ধাক্কা মারল কেউ৷ একটা পাল্লা দেওয়ালে বাড়ি খেল৷ আর বাপি ছিটকে গেল একপাশে৷ একঝলক জোলো বাতাস ছুটে এল ভেতরে৷
বাপিকে তাচ্ছিল্যের ধাক্কায় সরিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল চারজন৷
চারজনের শরীরই জলে ভেজা৷ তার মধ্যে শুধু প্রথমজনকে চিনতে পারল রাহুল৷ মাকু৷ ভিজে চুল কপালে নেমে এসেছে৷ মুখে-চোখে বৃষ্টির জল পড়লেও ঘুমের ছাপ এখনও মুছে যায়নি৷ ওর চোয়াল নড়ছে৷ কী যেন চিবোচ্ছে৷
দ্বিতীয় লোকটা টাকমাথা৷ বেঁটে৷ দাড়ি-গোঁফ কামানো৷ ময়লা রোগাটে চেহারা৷ কুতকুতে চোখ৷ কালো প্যান্টের ওপরে একটা ঢোলা খয়েরি শার্ট৷ শার্টটা জলে ভিজে গাঢ় রঙের দেখাচ্ছে৷ হাতে সোনালি ব্যান্ডের একটা ঘড়ি৷
লোকটার সামনের ওপরের পাটির দাঁতগুলো উঁচু৷ ফলে একটা খরগোশ-খরগোশ ভাব এসেছে৷ হঠাৎ করে দেখলে মজার কমেডিয়ান বলে মনে হয়৷
কিন্তু আসলে যে তা নয় সেটা ওর হাতের গাঢ় নীল পিস্তলটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷
মাকু দ্বিতীয় লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাস্টারজি—ওই যে রাহুল৷’ একইসঙ্গে রাহুলের দিকে চোখের ইশারা করল ও৷
মাস্টারজি কাশল দুবার৷ বাঁ-হাত দিয়ে বৃষ্টি-ভেজা মুখ মুছল৷ তারপর রাহুলদের দিকে চোখ রেখেই খেঁকিয়ে উঠে হুকুম দিল, ‘শিকলি, দরজাটা ভালো করে এঁটে দে৷ যেন পাবলিক ডিসটারবেন্স না হয়…৷’
হুকুমটা শোনামাত্রই সবচেয়ে পিছনে যে ছিল—শিকলি—সে দরজাটা বন্ধ করে খিল আর ছিটকিনি ভালো করে এঁটে দিল৷
মাস্টারজি ভেতরে ঢুকে এল৷ সুলতানের কাছে এসে দাঁতে দাঁত চেপে নীচু গলায় একটা গালাগাল দিল৷ তারপর ওর থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে চওড়া হেসে বলল, ‘সালা, এটা তোর চায়ের দোকান?’ পরক্ষণেই গলা মিহি করে সুলতানকে নাটুকে ঢঙে ভেংচাল : ‘কোকোকে এখনও পাইনি, মাস্টারজি—খুঁজছি৷’
একটু থেমে শাসানির গলায় মাস্টারজি বলল, ‘‘করুণাময়ী’’-তে চল—তোর হিসেব নিচ্ছি৷’
সুলতান কাঁচুমাচু মুখে হাতজোড় করে বলল, ‘মাস্টারজি, মাপ করে দিন৷ গলতি হয়ে গেছে৷ প্লিজ, মাস্টারজি…৷’
মাস্টারজি দাঁত বের করে হাসল, বলল, ‘মাপ করে দেব—অ্যাঁ? এতবড় গুস্তাকি মাপ করে দেব?’
চোখের পলকে হাতের পিস্তলটা সাঁ করে ঘুরিয়ে সুলতানের গালে বসিয়ে দিল মাস্টারজি৷
কালীপটকা ফাটার মতো শব্দ হল৷ সুলতানের গালে রক্তের রেখা দেখা দিল৷ সুলতান ‘ইয়া আল্লা’ বলে দু-হাতে মুখ চেপে মেঝেতে বসে পড়ল৷
মাম আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন৷ মাকুর চোখে-মুখে ভয়ের ছায়া৷ আর বাপি তো পাথর!
রাহুল স্পষ্ট টের পেল কোকোর হাতটা থরথর করে কাঁপছে৷ ও মনে-মনে চাইছিল, মামের চিৎকারটা যেন প্রতিবেশীদের কেউ শুনতে পায়, যেন তারা সাহায্যের জন্য ছুটে আসে৷
কিন্তু কাকভোরে এই বৃষ্টির মধ্যে কে আসবে!
মাস্টারজি পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিল৷ অস্ত্রটা ঢোলা শার্টের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল৷
পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বের করল হিংস্র লোকটা৷ ঘাড় কাত করে সিগারেট ধরাল৷ ‘উঁ-উঁ’ করে শব্দ করল মুখে৷ তারপর ধোঁয়া ছাড়ল৷ সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাইয়ের বাক্স পকেটে ভরে কয়েকবার হেঁচকি তুলে হাসল৷
হঠাৎই যেন মাকুর কথা মনে পড়ে গেছে এমন ভাব করে পিছনে তাকাল মাস্টারজি৷ তারপর ওর কাছে এগিয়ে গেল৷ যেতে-যেতে পিস্তলটা আবার বের করে নিল৷
সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে মাকুর পিঠ চাপড়ে দিল মাস্টারজি : ‘ভাগ্যিস রেললাইনের ধারে এই ছোঁড়াটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ ওরা বসে-বসে তাস পিটছিল…’ পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করল মাস্টারজি৷ ওটা মাকুর হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নাও, ভাই—তোমার প্রাইজ মানি৷ তাস খেলায় তুমি জিতছিলে—আমার সঙ্গে এসে তোমার তো লস হয়ে গেছে৷ তো এই নোটটা দিয়ে পুষিয়ে নিয়ো—কেমন?’
মাকু টাকাটা পকেটে ভরে কাঠ-কাঠভাবে হেসে ঘাড় কাত করল : ‘থ্যাংকস—৷’
শুরুতে মাস্টারজির পিস্তলটা দেখামাত্রই বাপি আর মাম ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ ওঁদের ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি মাস্টারজি রাহুল কিংবা কোকোকে লক্ষ্য করে গুলি করে বসবে৷
কিন্তু এতক্ষণে বোধহয় বাপি একটু সাহস জুগিয়ে উঠেছিলেন৷ কোনও-রকমে আমতা-আমতা করে বললেন, ‘মাস্টারজি, আসুন—ঘরে এসে বসুন…৷’
‘হ্যাঁ, যাব…যাব৷’ সিগারেটে টান দিল৷ তারপর কোকোর দিকে তাকিয়ে : ‘কী, কোকো, কেমন আছিস?’
‘ভালো৷’ রাহুলের হাতটা পেঁচিয়ে ধরে থাকা অবস্থাতেই কর্কশ গলায় বলল কোকো৷ অনুভবে রাহুলের মনে হল, কোকোর কাঁপুনিটা এখনও রয়েছে৷
কোকোর দিকে এগোতে শুরু করল মাস্টারজি৷ সুলতান তখনও মেঝেতে বসে গোঙাচ্ছিল৷ মাকু, শিকলি, আর নাম-না-জানা একজন শাগরেদ বন্ধ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল৷
কোকোর গালে দুবার আদরের আলতো চাপড় মেরে মাস্টারজি বলল, ‘কোকো, মাই ডার্লিং৷ অ্যাদ্দিন পালিয়ে থেকে তোর কত লস হয়ে গেল বল তো! আমারও তো বহুত টাকা লোকসান হয়ে গেল৷ এখন চল, ওই লস পুষিয়ে দিবি…৷’
বাপি মাস্টারজির কাছে এসে অনুনয় করে বললেন, ‘আপনি প্লিজ ঘরে এসে বসুন৷ কোকোর ব্যাপারটা আপনাকে খুলে বলছি…৷’
কৌতুকের চোখে বাপির দিকে তাকাল : ‘কোকোর ব্যাপার খুলে বলবেন? আমাকে?’ শব্দ করে হাসিতে ফেটে পড়ল মাস্টারজি৷ সিগারেটে ঘন-ঘন টান মারল৷ সিগারেটের আগুনটা সেই টানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল৷
‘না, না, আমাকে কিছু খুলে বলতে হবে না৷ আমি শুধু কোকোকে নিয়ে যেতে এসেছি৷ ও আমার৷’
মাস্টারজির কথার শেষে ‘ও আমার’ শব্দ দুটো মাম আর বাপিকে ভীষণ ধাক্কা দিল৷ রাহুলকেও৷ একইসঙ্গে ওর হাতের ওপরে কোকোর হাতের চাপ যে বেড়ে উঠল সেটাও রাহুল টের পেল৷
মাম প্রায় কান্না-কান্না গলায় মাস্টারজিকে বললেন, ‘ঘরে একটু বসুন৷ কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই৷ কোকোর…৷’
হাতের ইশারায় মামকে থামিয়ে দিল মাস্টারজি৷ পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিয়ে বলল, ‘বুঝেছি কী বলবেন৷ চলুন, ঘরে বসছি৷ কিন্তু আমার তাড়া আছে৷ বেশিক্ষণ টাইম দিতে পারব না৷’
বসবার ঘরে এসে বসল মাস্টারজি৷ বাপি সিলিং পাখাটা অন করে মাস্টারজির মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেন৷ মাম বাপির পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ রাহুল আর কোকো হাত-ধরাধরি করে ঘরে ঢুকল৷ দরজার কাছটিতে দাঁড়িয়ে রইল৷
খোলা দরজার দিকে একবার তাকাল মাস্টারজি৷ শিকলি, মাকু, সুলতান—ওদের দেখা যাচ্ছে৷ সুলতান এখনও বসে আছে, তবে গালে একটা রুমাল চেপে ধরেছে৷
জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরোটা ঘরের এককোণে ছুড়ে দিল মাস্টারজি৷ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘জলদি বলুন—কী বলবেন৷’
‘কোকো আমাদের কাছে এই তিনমাস হল…’ বাপি শুরু করলেন, ‘ওকে আমরা…মানে…৷’
‘থাক, আর বলতে হবে না৷ বুঝেছি৷’ জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল মাস্টারজি৷ একগোছা পাঁচশো টাকার নোট মুঠো করে বের করে নিয়ে এল৷
টাকাগুলো দেখেই বাপির মুখ লাল হয়ে উঠল৷ মাম ঘেন্নায় বলে উঠলেন, ‘ছিঃ! ছিঃ!’ তারপর আর সামলাতে পারলেন না—কেঁদে ফেললেন৷
বাপি এবার চোয়াল শক্ত করলেন৷ সুলতানের কাছ থেকে শোনা কথাগুলো এবার বোধহয় মাস্টারজিকে বলা দরকার৷ মাস্টারজির কাছে যতই পিস্তল থাকে, ‘করুণাময়ী’র ওই নরকে কোকো কিছুতেই ফিরে যাবে না৷
‘আপনি কোকোকে নিয়ে গিয়ে কী করবেন আমরা জানি…’ এইটুকু বলার পরই সুলতানের দিকে চোখ পড়ল বাপির৷ সুলতান তখন বাপিকে কিছু না বলার জন্য কাতরভাবে ইশারা করছে৷
মাস্টারজি মামের দিকে দেখছিল, তাই সুলতানের সূক্ষ্ম ইশারা খেয়াল করেনি৷ বিরক্তভাবে উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে : ‘এখন এসব সেন্টিমেন্টাল নাটক দেখার টাইম নেই৷’ হাতঘড়ির দিকে তাকাল৷ তারপর কোকোর দিকে : ‘অ্যাই! চল৷ ফালতু দেরি হচ্ছে—৷’
‘না, কোকো যাবে না৷’ রাহুলের মুখ দিয়ে কথাগুলো ফস করে বেরিয়ে এল৷
মাস্টারজি অবাক হয়ে রাহুলের দিকে তাকাল৷ সাপের মতো ঠান্ডা চোখে ওকে কিছুক্ষণ দেখল৷ তারপর ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘কোকো তোমার কে হয়, খোকা? বন্ধু? ওর সঙ্গে ভালোবাসা হয়েছে? লাভ স্টোরি?’ বলেই হো হো করে হেসে উঠল মাস্টারজি৷
সেই হাসি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কোকো কর্কশ গলায় বলে উঠেছে, ‘আমি যাব না৷ রাহুলকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না—৷’
কোকোর কথায় মাস্টারজি হতবাক হয়ে গেল৷ চোখ গোল-গোল করে কোকোর দিকে তাকিয়ে রইল—যেন ভূত দেখছে৷
‘জানোয়ারটা দেখি কথা বলতে শিখে গেছে!’ চিবিয়ে-চিবিয়ে কথাগুলো বলল মাস্টারজি৷ নোটের গোছা আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখল৷ তারপর পায়ে-পায়ে কোকো আর রাহুলের দিকে এগোল৷
খোলা জানলা দিয়ে সকালের আলো দেখা যাচ্ছে৷ বৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক জোরে পড়ছে৷ সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে হাওয়ার ঝাপটা৷ কোথাও একটা খোলা জানলার পাল্লা দেওয়ালে মাথা কুটছিল৷ বৃষ্টির জলের রেণু বাতাসের তোড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছিল৷
রাহুলের কাছে এসে ওর মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে এল৷ রাহুল সিগারেটের কড়া গন্ধ পেল৷ সেইসঙ্গে মদের হালকা অপবাস৷
ও মুখ সরিয়ে নিতে গেল৷ তখন মাস্টারজি হিংস্র চাপা গলায় বলল, ‘কোকো আমার৷ ও আমার সঙ্গে যাবে৷ তুই ‘‘না’’ বলার কে রে?’
রাহুল একটুও দমল না৷ জেদি বাচ্চার মতো আবার বলল, ‘না, কোকো যাবে না!’
মাস্টারজি মাথা পিছিয়ে নিল৷ ভয়ংকর একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল রাহুলের গালে৷
সাইকেলের টায়ার ফাটার মতো শব্দ হল৷ রাহুল কাত হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে৷
মাম চিৎকার করে উঠলেন৷ সেইসঙ্গে বাপিও৷
আর কোকোর হাত বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠল৷ পলকে মাস্টারজির টুঁটি চেপে ধরল৷ মাস্টারজি জলে তলিয়ে যাওয়া মানুষের মতো দু-হাত শূন্যে ছুড়ে খাবি খেতে লাগল৷
‘রাহুলকে মারবে না!’ কোকো পশুর মতো গর্জন করে উঠল৷
‘শিকলি! শিকলি!’ মাস্টারজি চেঁচিয়ে উঠতে চাইল : ‘রানা! রানা! জানোয়ারটাকে ধর!’
ব্যাঙের ডাকের মতো আওয়াজ বেরোল মাস্টারজির গলা থেকে৷ শিকলি আর তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা শাগরেদ ছুটে এল মাস্টারজির দিকে৷ শিকলির হাতে একটা লিকলিকে ফলার ছুরি ঝিকিয়ে উঠল৷
বাপি আর মাম ততক্ষণে রাহুলকে ধরে মেঝে থেকে তুলেছেন৷ রাহুলের ফরসা গালে পাঁচ আঙুলের লালচে দাগ বসে গেছে৷
শিকলি কোকোকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছিল বুলেটের মতো৷ আর কোকো মাস্টারজির টুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ ও চকিতে একটা পা ভাঁজ করে শূন্যে তুলল—ঠিক একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারসের মতো৷ এবং পরমুহূর্তে সেই পা-টা ছুটে আসা শিকলিকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল৷
শিকলির শরীরটা আবার বুলেটের গতিতেই ছিটকে গেল পিছনদিকে৷ দেওয়ালে গিয়ে সপাটে বাড়ি খেল৷ তারপর খসে পড়ল মেঝেতে৷ ছুরিটা ওর হাত থেকে কোথায় যেন ঠিকরে পড়ল৷
রাহুল ওর স্তম্ভিত ভাবটা কাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল৷ মাম তখন হাউহাউ করে কাঁদছেন আর কোকোর নাম ধরে ডাকছেন৷
রানা নামের পাবলিক বোধহয় নিজেকে একটু বেশি বুদ্ধিমান ভেবেছিল৷ কারণ, ও কোকোর দিকে ছুটে আসতে-আসতে আচমকা মেঝেতে শুয়ে পড়ল৷ ফলে ওর দেহটা মসৃণ মেঝেতে পড়ে কোকোর পা লক্ষ্য করে দ্রুতগতিতে পিছলে এল৷
সংঘর্ষটা যদি ঠিকঠাক হত তা হলে কোকো নির্ঘাত উলটে পড়ত৷
কিন্তু কোকোর তৎপরতায় সেটা ঠিকঠাক হল না৷
ও মাস্টারজিকে এক ধাক্কা দিয়ে পিছনে ফেলে দিল৷ এবং বেড়ালের ক্ষিপ্রতায় শূন্যে লাফিয়ে উঠল৷
যখন কোকো নীচে পড়ল তখন ওর পায়ের নীচে রানা৷ ঢেঁকির পাড় দেওয়ার মতো কোকোর পা রানার শরীরে বারবার আছড়ে পড়ল৷ তারপর ওকে চুলের মুঠি ধরে এক ঝটকায় কোকো দাঁড় করিয়ে দিল৷ নিজের মাথা ঠুকে দিল ওর মাথায়৷
পাথরে-পাথরে ঠোকাঠুকি হল যেন৷ একটা ‘আঁক’ শব্দ করে রানা গোড়াকাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল৷ বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেল৷
রাহুলরা অবাক হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রটা দেখছিল৷ মাস্টারজি, রানা আর শিকলি—তিনজন তিনদিকে পড়ে আছে৷ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোকো লড়াকু সিংহের মতো ফোঁস-ফোঁস করে হাঁপাচ্ছে৷ ওর চোখমুখ লাল হয়ে গেছে৷ এক অদ্ভুত ভালোবাসার চোখে ও রাহুলের দিকে তাকিয়ে আছে৷
ওদিকে সুলতান এখনও মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে৷ মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ও যে কী করবে সেটা ঠিক ভেবে উঠতে পারছে না৷
মাকু নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে৷ ভাবলেশহীন মুখ৷ চোয়াল নড়ছে৷ চুয়িংগাম বা কিছু একটা চিবোচ্ছে৷ রাহুল আর কোকোর সর্বনাশ দেখার জন্য ও যেন অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারে৷
কোকো রাহুলের দিকে এক পা এগিয়ে এল৷ হাঁপাতে-হাঁপাতে জিগ্যেস করল : ‘রাহুল, তোমার লাগেনি তো? তোমাকে ছেড়ে আমি যাব না৷’
কথা শেষ হতে না হতেই কোকো যন্ত্রণায় লাফিয়ে উঠল৷ পাগলের মতো ছটফট করতে লাগল৷ ওর গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডে লাল আর সবুজ আলো দপদপ করে জ্বলতে লাগল৷
রাহুল দেখল, মাস্টারজি কখন যেন উঠে বসেছে৷ বাঁ-হাতে একটা চেয়ার ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে৷ সোনালি ব্যান্ডের হাতঘড়িটা ছিটকে পড়ে আছে দূরে৷
কিন্তু রাহুলের নজর কাড়ল মাস্টারজির ডানহাতে ধরা জিনিসটা৷ একটা কালো রঙের রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট৷ কোকোর দিকে তাক করে মাস্টারজি বোতাম টিপে ধরেছে৷ আর তাতেই কোকোর শরীরে বৈদ্যুতিক মরণযন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে৷
কোকো ছটফট করতে-করতে মেঝেতে পড়ে গেল৷ ওর শরীরটা এমনভাবে ঝটকা দিয়ে বেঁকেচুরে যাচ্ছিল যেন কেউ ওকে হাই ভোল্টেজ শক দিচ্ছে৷ একইসঙ্গে ও যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল৷ মনে হচ্ছিল, ও বোধহয় এখনই মরে যাবে৷
বাপি আর রাহুল কোকোর নাম ধরে বারবার ডাকছিল৷ মাম কোকোর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করতে চাইছিলেন৷ আর কোকোর শরীরটা ঘন-ঘন ঝটকা মেরে ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছিল৷
মাস্টারজি তখন হিংস্রভাবে হাসছে৷ পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসেছে কোকোর কাছে৷ রিমোটটা স্থির লক্ষ্যে কোকোর দিকে তাক করা৷
রিমোটটা বাঁ-হাতে নিল মাস্টারজি৷ তারপর ডানহাত শার্টের নীচে ঢুকিয়ে পিস্তলটা বের করে নিল৷ কোকোর মাথার দিকে পিস্তলের নলটা তাক করে চাপা গর্জন করে উঠল : ‘সালা, পাগলা কুত্তা! তোকে আর রেখে লাভ নেই৷ বড্ড বাড় বেড়েছিস৷ এবার খতম!’
মাস্টারজি হয়তো ট্রিগার টিপতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না৷
বাইরে কোথাও বিকট শব্দে বাজ পড়ল৷ একইসঙ্গে মাম হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন৷ বাপি আর রাহুল ‘না! না!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল৷ আর আহত সুলতান ছুটে এসে মাস্টারজির পা জড়িয়ে ধরল৷ কুকুরের মতো কাতর ‘কেঁউকেঁউ’ শব্দে কোকোর প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগল৷
মাকু পায়ে-পায়ে ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে এসেছিল৷ ও অবাক হয়ে দেখছিল, একটা সহজ-সরল প্রতিবন্ধী ছেলেকে বাঁচানোর জন্য চার-চারটে মানুষ কেমন আকুলি-বিকুলি করছে৷ তার মধ্যে একটা আবার মুসলমান!
অথচ এই চারজন কোকোর কেউ নয়!
মাকু এই সমীকরণটা বুঝতে পারছিল না৷ রক্তের সম্পর্কের বাইরের সম্পর্কটা ওকে অবাক করে দিয়েছিল৷ ওর মনের ভেতরে অন্যরকম একটা ঝড় উঠেছিল৷
একটা টাকমাথা বেঁটে শয়তান আমাদের গ্রাম থেকে একজনকে এভাবে তুলে নিয়ে যাবে! নয়তো লাশ ফেলে দেবে বলছে! আর আমি চুড়ি পরে বসে থাকব! এটা না আমার গ্রাম! আমাদের গ্রাম!
এই কথাগুলো মনে-মনে ভাবল মাকু৷ একইসঙ্গে ওর মনে হল, এতক্ষণ ধরে ও ভেবেছে অনেক কিন্তু কিছু করেনি—এবার কিছু করা দরকার৷
মাকু যে-দৌড়টা শুরু করল সেটা বোধহয় ওর বাইককে হারানোর মতন৷ শূন্য গতিবেগ থেকে এক অদ্ভুত ত্বরণ তৈরি করল ও৷ এবং যখন ওর শরীরটা মাস্টারজির শরীরে গিয়ে ধাক্কা খেল তখন মাস্টারজির মনে হল একটা প্রকাণ্ড উল্কার সঙ্গে তার সংঘর্ষ হয়েছে৷
মাস্টারজির শরীরটা দেওয়াল ঘেঁষে রাখা একটা বুককেসে গিয়ে ধাক্কা খেল৷ ঝনঝন শব্দে বুককেসের কাচ ভেঙে পড়ল৷ মাস্টারজির হাতের পিস্তল আর রিমোট দু-দিকে ছিটকে পড়ল৷ আর মাকু হাত-পা মুড়ে কাত হয়ে পড়ে গেল চেয়ার-টেবিলের ওপরে৷
মাস্টারজির জীবনীশক্তির তারিফ করতে হয়৷ কারণ, ভাঙা কাচের ওপরে সে স্থির হয়ে পড়ে রইল মাত্র কয়েক সেকেন্ড৷ তারপরই দু-দিকে নজর চেলে দেখে নিল পিস্তল আর রিমোটটাকে৷ চট করে যে কোনও একটাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নেওয়া যায়৷ কিন্তু কোনটা?
পিস্তলটাই বেছে নিল মাস্টারজি৷ এবং সেখানেই ভুল হয়ে গেল৷
‘ফাইটার’ বয় কোকো এই কয়েক সেকেন্ড সময়ের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়েছিল৷ মাস্টারজি যখন পিস্তল আর রিমোটের দিকে নজর চালিয়েছে তখনই ও মেঝেতে পড়ে থাকা রানাকে মাথার ওপরে তুলে নিয়েছে৷ মাস্টারজির হাত পিস্তলের দিকে এগোনোমাত্রই ও রানার দেহটা মাস্টারজিকে লক্ষ্য করে স্রেফ ছুড়ে দিয়েছে৷
সংঘর্ষের শব্দ হল৷ আর কোকো একইসঙ্গে লাফিয়ে পড়েছে মাস্টারজির ওপরে৷ রানার শরীরের নীচ থেকে মাস্টারজিকে টেনে বের করেছে৷ জামার কলার ধরে তার মুখটা তুলে এনেছে নিজের মুখের কাছে৷
হাপরের মতো হাঁপাতে-হাঁপাতে কোকো বলল, ‘রাহুলকে ছেড়ে আমি যাব না৷’ তারপর একটা ভয়ংকর হেডবাট৷ নিজের মাথাটা মাস্টারজির মাথায় ও সাংঘাতিক জোরে ঠুকে দিয়েছে৷
‘রাহুলকে ছেড়ে…আমি কোথাও যাব না৷’ আবার বলল কোকো৷
আবার হেডবাট৷
‘রাহুলকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না৷ কিছুতেই না৷’
আবার মাথায়-মাথায় সংঘর্ষ৷
কোকো যেন সত্যিই পাগল হয়ে গেছে৷ বারবার ও একই কথা বলছে আর ওর মাথাটা ঠুকছে মাস্টারজির টাকমাথায়৷ মাস্টারজির কপাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷
‘কোকো! কোকো, থামো!’ চেঁচিয়ে উঠল রাহুল৷ ছুটে গেল ওর কাছে৷ ওকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল৷
বাপি, মাম আর সুলতানও ওকে থামাতে চেষ্টা করল৷
কোকো মাস্টারজির শরীরটা ছেড়ে দিতেই সেটা জাপানি পাখার মতো ভাঁজ হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল৷
মাকু খোঁড়াতে-খোঁড়াতে ওদের কাছে এসে বলল, ‘আমি থানায় খবর দিচ্ছি—৷’
বাপি ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, ‘চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি—৷’
ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও থমকে গেল মাকু৷ মেঝেতে পড়ে থাকা শিকলি, রানা আর মাস্টারজির দিকে দেখল৷ বলল, ‘আমরা দুজনেই যাব? এখানে যদি কিছু হয়?’
হাসলেন বাপি৷ কোকোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘কোনও ভয় নেই৷ কোকো আছে৷’
ওরা দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেল৷
Leave a Reply