ফেরারি প্রেমিকা – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ – জুলাই ২০০৪
উৎসর্গ
স্নেহের বড় মেয়ে ও জামাই
ফাতেমা ও ফারুক
১. “যে আল্লাহর উপর এবং কুয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাস রাখে, আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তাহার জন্য মুক্তির পথ বাহির করিয়া দেন। আর তাহাকে এমন স্থান হইতে রিক্ক পৌঁছাইয়া থাকেন, যাহা তাহার ধারনাও হয় না।”
–আল-কুরআন, সূরা- তালাকৃ, ২নং আয়াতের শেষের অংশ ও ৩নং আয়াতের প্রথম অংশ। পারা-২৮
২. “মানুষ তার পরিবারসম্পদ ও প্রতিবেশীর ব্যাপারে যে ভুল-ত্রুটি করে, তার সালাত, সাওম এবং সাদকা দ্বারা সেগুলোর কাফফারা হয়ে যায়।”–বুখারী।
৩. “অন্যের মুখে হাসি ফোঁটানোর উদ্দেশ্যে নিজের খুশি উৎসর্গ করার নামই মনুষ্যত্ব।”–তুসী
১
রাত ন’টা। ইশতিয়াক শাহজাহানপুরের মোড়ে আসতে না আসতে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। সে শান্তিবাগে এস. এস. সি. ও এইচ. এস. সি’র দু’টো ছেলেমেয়েকে প্রাইভেট পড়ায়। প্রতিদিন দেড় ঘণ্টা করে পড়ানোর জন্য আড়াই হাজার টাকা পায়। থাকে বাসাবোর একটা মেসে। সকালের দিকে মেসের কাছাকাছি এইট ও নাইনের দু’টো ছেলেকে পড়িয়ে পায় দেড় হাজার টাকা। এই চার হাজার টাকা তার মাসিক আয়।
আজ শাহজাহানপুরে পড়াবার সময় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। প্রতিদিন ছাত্র পড়িয়ে ন’টার সময় ফেরার পথে রাস্তার মোড়ের মসজিদে এশার নামায পড়ে মেসে ফেরে। আজ ফেরার সময় মেঘের ঘনঘটা দেখে ভেবেছিল, মেসে গিয়ে পড়বে; কিন্তু মসজিদের কাছে এসে বৃষ্টি নামতে মসজিদে ঢুকল নামায পড়ার জন্য। নামায শেষ হওয়ার পরও বেরোতে পারল না। বসে বসে তসবীহ পড়তে লাগল।
বৃষ্টি থামার নাম নেই। একটানা ঝমঝম করে হচ্ছে। প্রায় সাড়ে দশটার সময় বৃষ্টি একেবারে থামতে রওয়ানা দিল। ভাবল, ছাতা থাকলে গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে আধ ঘণ্টা আগে বাসায় ফেরা যেত। সামনে বর্ষাকাল, একটা ছাতা না কিনলেই নয়।
ইশতিয়াক খুব মিতব্যয়ী। প্রয়োজন ছাড়া টাকা খরচ করে না। মেসের ভাড়া ও খাওয়া খরচ বাদে সামান্য কিছু হাত খরচ রেখে বাকিটা ব্যাংকে জমা রাখে। প্রায় তিন বছর হতে চলল শাহজাহানপুরে প্রাইভেট পড়াচ্ছে। রিকশায় বা টেম্পুতে করে যাতায়াতের সুবিধা থাকলেও টাকা বাঁচাবার জন্য হেঁটে যাতায়াত করে।
বাসাবো টেম্পুস্ট্যাণ্ড থেকে এক কিলোমিটার পূর্ব-উত্তর দিকে তার মেস। মেসটা তিনতলা। তিনতলার দু’রুমের ফ্লাটে বাড়িওয়ালা আকবর হোসেন থাকেন। বয়স পঞ্চাশের মতো। এখনও বিয়ে করেন নি। ভবিষ্যতে করবেন কিনা তারও কোনো ঠিক নেই। গাউসিয়া মার্কেটে তিনটে দোকান। সেগুলো ভাড়া দিয়েছেন।
মেসটা মেইন রোড থেকে পঞ্চাশ গজ গলির ভিতরে। গলিটা আট ফুট চওড়া। রিকশা ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি ঢুকতে পারে না। ইশতিয়াক যখন গলির মোড়ে এল তখন যাকিয়াহর মতো একটা বোরখাপরা মেয়েকে গলি থেকে মেন রোডে উঠে দ্রুত হাঁটতে দেখল। ভাবল, এত রাতে যাকিয়াহ কোথায় যাচ্ছে? গলির মুখে লাইট পোস্ট থাকলেও আলো জ্বলে নি। তাই নিশ্চিত হতে পারল না মেয়েটি যাকিয়াহ, না অন্য কেউ? দো’মনা হয়ে মেসের দিকে এগোল।
রুমে ঢুকে যাকিয়াহদের বাসায় গোলমাল শুনে জানালা খুলে দেখল, অনেক লোকের ভীড় আর যাকিয়াহর নানি চিৎকার করে কাঁদছেন। ইশতিয়াকের বুক ধক করে উঠল আতঙ্কে। তা হলে কি রাস্তায় যাকিয়াহকেই দেখেছে? তাড়াতাড়ি তাদের বাসায় গিয়ে দেখল, প্রতিবেশী মেয়েরা নানিকে ঘিরে রয়েছে আর অনেক মেয়ে-পুরুষ যাকিয়াহর রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
ইশতিয়াক ঘটনা জানার জন্য এগিয়ে এলে নানি তাকে দেখে কান্না থামিয়ে বললেন, কি সাংঘাতিক কাণ্ড দেখ না ভাই, জজ সাহেবের ছেলে জাহাঙ্গীর যাকিয়াহর ঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কে যেন তার পিঠে ইয়া বড় ছুরী ঢুকিয়ে দিয়েছে।
আতঙ্কিত স্বরে ইশতিয়াক বলল, সেকি? যাকিয়াহ কোথায়?
তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই বলছে সে-ই নাকি জাহাঙ্গীরের পিঠে ছুরী বসিয়ে পালিয়ে গেছে।
আসার সময় যাকিয়াহকেই দেখেছে নিশ্চিত হয়ে ইশতিয়াক জিজ্ঞেস করল, জাহাঙ্গীর এত রাতে এসেছিল কেন?
তা আমি কি করে বলব? তবে বেশ কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরের মা যাকিয়াহর সঙ্গে ছেলের বিয়ের পয়গাম নিয়ে এসেছিল। আমি কিছু বলার আগে যাকিয়াহ না করে দিয়েছিল। তারপর আমার ছেলেরা এই বাড়ি বিক্রি করে দেবে শুনে জাহাঙ্গীর তাদের কাছে অনেক টাকা চাঁদা দাবি করেছে।
জাহাঙ্গীর কি ধরনের ছেলে ইশতিয়াক জানে। তাই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ওকে খুঁজতে যাচ্ছি বলে যাকিয়াহর রুমে ঢুকে জাহাঙ্গীরের নাকের কাছে হাত রেখে বুঝতে পারল বেঁচে আছে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে মেসে এসে তিন তলায় আকবর হোসেনের কাছে গেল।
আকবর হোসেন তখন ঘুমাবার আয়োজন করছিলেন। তাকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে?
ইশতিয়াক বলল, হাজার খানেক টাকা দিন তো, সামনের মাসের ভাড়ার সঙ্গে দিয়ে দেব।
এর আগেও ইশতিয়াক ওনার কাছ থেকে অনেকবার টাকা নিয়েছে এবং কথামতো দিয়েও দিয়েছে। তাই দ্বিরুক্তি না করে টাকাটা দেয়ার সময় আকবর হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার বললে না যে?
জজ সাহেবের ছেলে জাহাঙ্গীর যাকিয়াহর ঘরে ঢুকেছিল। যাকিয়াহ তার। পিঠে ছুরী বসিয়ে পালিয়ে গেছে। তাকে খুঁজতে যাচ্ছি। জাহাঙ্গীর বেঁচে আছে। আপনি যাকিয়াহর মামাদের খবরটা জানিয়ে জাহাঙ্গীরকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। কথা শেষ করে ইশতিয়াক মেস থেকে বেরিয়ে এল। মেইন রোডে যাকিয়াহকে পশ্চিম দিকে যেতে দেখেছে। তাই ঐ দিকে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, জাহাঙ্গীর নিশ্চয় যাকিয়াহর উপর হামলা করেছিল। তাই তাকে ছুরী মেরে আহত করে পালিয়ে গেছে।
প্রথমে ইশতিয়াক মেসে কম্বাইণ্ড রুমে থাকত। মেসে বেশিরভাগ চাকরিজীবী। তারা এশার নামাযের পর খেয়েদেয়ে ন’টার মধ্যে দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ইশতিয়াকের ফিরতে অনেক সময় সাড়ে দশটা এগারটা বেজে যায়। কাউকে না কাউকে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিতে হয়। তা ছাড়া টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে সে বারটা-একটা পর্যন্ত পড়াশোনা করে। তাতে অন্যদের ঘুমের ব্যাঘাতও হয়। তাই। তারা একদিন বাড়িওয়ালা আকবর হোসেনকে কথাটা জানাল।
আকবর হোসেন শিক্ষিত। লোক হিসাবেও ভালো। কিন্তু নামায রোযা করেন না। ওনার ধারণা পঞ্চাশ ষাট বছরের আগে যারা নামায, রোযা ও ধর্মের অন্যান্য নিয়ম কানুন মেনে চলে তারা ভণ্ড। যারা যত বেশি পাপ করে, তারা তত বেশি ধর্মের মুখোশ পরে হালাল হারামের বাদ বিচার না করে রুজী রোজগার করে। তারা ধর্মের কাজ করে যেমন সওয়াব কামাই করে, তেমনি অসৎ পথে উপার্জন করে বাড়ি গাড়ি করে। শেষ বয়সে হজ্ব করে এসে মনে করে তাদের সব গুনাহ মাফ হয়ে গেছে। অসৎ পথে যত কিছু উপার্জন করেছে, তা সব হালাল হয়ে গেছে। এইসব কারণে যুবক বয়সের ছেলেদের মধ্যে যারা ধর্ম-কর্ম করে তাদেরকে মোটেই দেখতে পারেন না। ইশতিয়াক মেসে আসার কয়েক মাসের মধ্যে ওনার ধারণা যে ভুল, তা বুঝতে পারেন এবং ধর্মের সবকিছু মেনে চলার চেষ্টা করছেন।
তিনি যখন প্রথম ঢাকায় এসে বাসা ভাড়া নিতে চান তখন ব্যাচেলার জেনে কেউ ওনাকে বাসা ভাড়া দেয় নি। তাই তিনি বাসাবোতে জমি কিনে তিনতলা বাড়ি করেছেন শুধু ব্যাচেলারদের জন্য। এ বাড়িতে কোনো ফ্যামিলি ভাড়া দেন নি।
ইশতিয়াককে ঠিকমতো নামায রোযা করতে দেখে তিনি প্রথম দিকে তাকেও পছন্দ করতেন না। তিন চার মাসের মধ্যে তার চাল-চলন ও আচার ব্যবহার দেখে ওনার ধারণায় চিড় ধরে।
মেসের মেম্বাররা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পর একদিন তাকে নিজের রুমে ডেকে অভিযোগ সত্য কিনা জানতে চাইলেন।
ইশতিয়াক অভিযোগ স্বীকার করতে বললেন, আপনি কি এমন কাজ করেন যে, ফিরতে রাত দশটা এগারটা বেজে যায়?
দিনে চাকরির চেষ্টা করি। রাতে এক জায়গায় টিউশনী করি। তাই ফিরতে দেরি হয়।
কতদূর লেখাপড়া করেছেন?
মাস্টার্স করার জন্য ভার্সিটিতে এ্যাডমিশন নিয়েছি।
চাকরি কি পাবেন? আজকাল চাকরি সোনার হরিণের মতো। তবে সুপারিশ করার লোক থাকলে অথবা টাকার জোর থাকলে পাওয়া যায়। আপনার কি কোনোটাই নেই?
না।
গাউসিয়ায় আমার তিনটে দোকান আছে। সেগুলো ভাড়ায় দিয়েছি। যে কোনো একটায় সেলসম্যানের কাজে লাগিয়ে দিতে পারি, করবেন? বেতন তিন হাজার টাকা।
না।
কেন?
ঐ চাকরি করলে ভালো চাকরির চেষ্টা করার সময় পাব না। সেলসম্যানের বার ঘণ্টা ডিউটি। আমার দ্বারা বার ঘণ্টা ডিউটি করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া পড়াশোনা করার সময়ও পাব না।
টিউশনী করে কত পান।
চার হাজার।
তা হলে তো ভালোই। আরও তো টিউশনী করতে পারেন? আপনি চাইলে আমি দু’চারটে ছাত্র জোগাড় করে দিতে পারি।
টিউশনী পড়াতে আমার ভালো লাগে না। তবু করছি নিজের খরচ চালাবার জন্য।
বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় না?
না। আপনাকে ধার্মিক ছেলে মনে হয়, মা বাবাকে সাহায্য করা তো ধর্মের আইন, তা মানেন নি কেন?
শুধু মা বাবা না, আমার অন্য কোনো আত্মীয়ও নেই।
আপনি তা হলে একেবারে এতিম?
এতিম ছিলাম, তবে এখন না।
বুঝলাম না।
আপনি বোধ হয় জানেন না, ছোটবেলায় যে ছেলেমেয়ের মা বাবা মারা যায় তাকে এতিম বলে; কিন্তু সেই ছেলেমেয়ে যখন সাবালক হয় তখন আর এতিম থাকে না।
কথাটা জানতাম না। আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
কক্সবাজার জেলার চকরিয়ায়।
আপনি মানুষ হয়েছেন কার কাছে? কে আপনাকে এত লেখাপড়া করাল?
সে অনেক কথা। বলতে অনেক সময় লাগবে।
লাগুক, তবু আমি শুনব।
ইশতিয়াক কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলতে শুরু করল। আমার জন্মের আগে থেকে পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে জ্ঞাতীদের সঙ্গে বাবার মামলা চলছিল। মামলায় জিতে গিয়ে সম্পত্তির দখল নিতে যায় বাবা। সেখানেই জ্ঞাতীরা বাবাকে খুন করে। তারপর আমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমার বয়স তখন এক বছর। মা ও দাদা দাদি আগুনে পুড়ে মারা গেলেও আমি বেঁচে যাই। আমি মায়ের কোলে ছিলাম। কি করে বেঁচে যাই কেউ বলতে পারে নি। বড় হয়ে শুনেছি আমি নাকি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছি। আমাদের গ্রামে একজন উকিল ছিলেন। নাম আলতাফ হোসেন। তিনি ও ওনার স্ত্রী আমাকে লালন পালন ও লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেন।
আকবর হোসেন বললেন, ওনারা মহৎ। ওনাদের জন্য কিছু করা উচিত নয় কি আপনার?
হ্যাঁ, উচিত। যখন সামর্থ হবে তখন করব।
আপনার রুমমেটদের অভিযোগের কারণে আপনাকে মেস ছেড়ে দেয়ার কথা বলার জন্য ডেকেছিলাম; কিন্তু আপনার সবকিছু জানার পর বলতে পারছি না। দোতলায় একটা রুম খালি করে দেব। সামনের মাস থেকে ঐ রুমে আপনি একলা থাকবেন। কম্বাইন্ড রুমে যে ভাড়া দেন, সেই ভাড়াই দেবেন। ভাববেন না, আপনাকে দয়া দেখাচ্ছি। পড়াশোনা শেষ করে যখন ভালো উপার্জন করবেন তখন বকেয়া পুরো ভাড়া শোধ করবেন।
ইশতিয়াক বলল, আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমার নেই। শুধু এতটুকু বলব, আল্লাহ যেন আপনাকে তার প্রিয় বান্দাদের একজন হওয়ার তওফিক দান করেন।
ইশতিয়াকের কথা শুনে আকবর হোসেনের মনের মধ্যে এক আলোড়ন অনুভব করলেন। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এবার আপনি আসুন। এরপর থেকে ধর্মের অনুশীলন করতে শুরু করেন।
২
আলতাফ হোসেন ও ওনার স্ত্রী সমীরণ বিবির ইশতিয়াককে লালন পালন করার কারণ ছিল। সমীরণ বিবি ছিলেন বন্ধা। বন্ধা মেয়ের মতো দুঃখী মেয়ে আর নেই। তাই এক বছরের ইশতিয়াককে পেয়ে ওনার দুঃখের অবসান হয়। তাকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে লালন-পালন করেন। ইশতিয়াক বড় হওয়ার পর সেই স্নেহ ও ভালবাসা আরও বেড়ে যায়। এমন কি স্বামীর চেয়ে ইশতিয়াকের ভালো মন্দের দিকে বেশি লক্ষ্য রাখতেন। ইশতিয়াক ওনাকে বড় মা আর উকিল সাহেবকে বড় বাবা বলে ডাকে।
ইশতিয়াক যখন ছোট ছিল তখন আলতাফ হোসেনও তাকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করতেন; কিন্তু বড় হওয়ার পর তার প্রতি স্ত্রীর বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। তাই ইশতিয়াককে উপলক্ষ্য করে প্রায় দিন স্ত্রীকে রাগারাগি করতেন। বলতেন, পরের ছেলেকে নিয়ে অত বাড়াবাড়ি ভালো না, যে কোনো সময়ে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।
সমীরণ বিবি বলতেন, তুমি ওকে পরের ছেলে ভাবলেও আমি ভাবি না। আর ও যে আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবে, এটাও বিশ্বাস করি না।
আলতাফ হোসেন রাতে মদ খেয়ে মাঝে মাঝে স্ত্রীকে মারধর করতেন। একরাতে মাতাল হয়ে ইশতিয়াককে নিয়ে স্ত্রীর চরিত্রের উপর কুৎসীত অপবাদ দিয়ে ভীষণ মারেন। ফলে সমীরণ বিবি চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। তারপর থেকে তিনি হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন।
ইশতিয়াক বি. এ. পাশ করে মাস্টার্স করার কথা চিন্তা করছিল। ঘটনা জানতে পেরে লজ্জায় ও অপমানে ঢাকা চলে আসে। তারপর এই মেসে থেকে অনেক কষ্ট স্বীকার করে এম. এ. পাশ করে।
এর কিছুদিন পর আলতাফ হোসেন হার্ট এ্যাটাকে মারা যান। ওনার নগদ টাকা পয়সা না থাকলেও জমি জায়গা ভালই ছিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর পঙ্গু সমীরণ বিবি সেই সব জমি জায়গা বর্গা দিয়েছেন। যা ফসল পায়, তাতে বেশ ভালোভাবেই চলে যায়। দূর-সম্পর্কের ভাইপো সাগীরকে নিয়ে তার কাছে রেখেছেন। সে বাজার হাট করা থেকে অন্যান্য সবকিছু দেখাশোনা করে।
সাগীর ত্রিশ বছর বয়সের তাগড়া যুবক। এখনও বিয়ে করেনি। দাড়ি নেই, তবে ইয়া মোচ। দিনের মধ্যে কয়েকবার মোচে তেল দিয়ে চকচকে রাখে। ধান গোলায় তোলার সময় দু’চার বস্তা সরিয়ে ফেলে, বাজার করতে গিয়ে টাকা চুরি করে, গোপনে বাগানের ফল বিক্রি করে। এইসব করে সে মোটামোটি ভালো আয় করে।
সমীরণ বিবি ভাইপোর সবকিছু বুঝতে পারেন। কোনো উপায় না পেয়ে তাকে কিছু বলেন না। আগে তিন চারজন কাজের মেয়ে ছিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর যখন সংসারে স্বচ্ছলতা কমে গেল তখন সব থেকে পুরোনো কুলসুমের মাকে রেখে বাকি তিনজনকে সমীরণ বিবি বিদায় করে দেন।
কুলসুমের মায়ের নাম আলেকজান। তার স্বামী জয়নাল চোরাই মাল বিক্রি করত। তাদের একমাত্র মেয়ে কুলসুম। চার বছরের কুলসুম পানিতে ডুবে মারা যায়। তারপর আর তাদের ছেলে মেয়ে হয় নি। গ্রামের লোক বলে আলতাফ হোসেন জয়নালকে ঐ কাজ করতে অনেকবার নিষেধ করেছেন; শোনে নি। কয়েকবার পুলিশ এ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। আলেজানের কান্নাকাটিতে আলতাফ হোসেন তাকে ছাড়িয়েছেন। শেষবারে ধরা পড়ে পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
আলেফজান আলতাফ হোসেনের স্ত্রীর পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে বলে আমি এখন কোথায় যাব? কি খাব? আপনারা আমাকে বাঁচান।
সমীরণ বিবি জয়নালের সবকিছু জানেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তিনটে কাজের মেয়ে আছে, আর একটা না হয় বাড়ল। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বল?
আলতাফ হোসেন বললেন, তুমি তো দয়ার সাগর। কারো দুঃখ সহ্য করতে পার না। কি আর করা, রাখতে চাইলে রাখ।
সমীরণ বিবি আলেফজানকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর নাম কি?
আলেকজান।
এটা আবার একটা নাম হল না কি? এই নামে তোমাকে ডাকতে পারব না। আমি তোকে জয়নালের বৌ বলে ডাকব।
সেই থেকে আলেকজান বিবি জয়নালের বৌ হয়ে আলতাফ হোসেনের বাড়িতে আছে।
আলতাফ হোসেনের ইচ্ছা ছিল, জয়নালের বৌ-এর আবার বিয়ে দেবেন। সেকথা স্ত্রীকেও বলেছিলেন। কিন্তু জয়নালের বৌ রাজি হয় নি। তা ছাড়া তখন জয়নালের বৌ-এর বয়স চল্লিশের উপর। এখন পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হলেও স্বাস্থ্য ভালো। খুব কর্মঠ। সংসারের অন্যান্য সব কাজ ও সমীরণ বিবির খিদমত করে। গোসল, খাওয়া-দাওয়া, পায়ে হাতে তেল মালিশ করে, হুইল চেয়ারে বসিয়ে এখানে সেখানে ঠেলে নিয়ে যায়। প্রতিদিন বাড়ির সামনে যে ফলের বাগান আছে, সেখানেও নিয়ে যায়।
ভাইপো সাগীর ফুফুকে বাগানে নিয়ে যেতে চাইলে সমীরণ বিবি না করে দেন। তিনি সাগীরকে সুনজরে দেখেন না। সমীরণ বিবির সব সময় মনে হয় ইশতিয়াক যদি থাকত, তা হলে এই সংসারের অনেক উন্নতি হত। ইশতিয়াকের জন্য ওনার মন সব সময় কাঁদে। রাতেরবেলা ঘুমানোর সময় তার কথা বেশি মনে পড়ে। তখন চোখের পানিতে বালিশ ভেজান। আর ভাবেন, সেই যে গেল আর এল না। আর আসবেই বা কি করে? যে অপবাদ মাথায় নিয়ে গেছে, তারপর ফিরে আসার কথা নয়। যদি তার ঠিকানা জানা থাকত, তা হলে স্বামীর মারা যাওয়ার কথা জানিয়ে ফিরে আসার জন্য চিঠি দিতেন।
দু’বছর পর গ্রামের একজন লোকের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়েছিল ইশতিয়াকের। তার মুখে আলতাফ হোসেনের মৃত্যুর খবর শুনে বাড়িতে এসে সমীরণ বিবির অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে দু’পা জড়িয়ে ধরে ইশতিয়াক বলল, বড় মা, এরকম অবস্থা হল কি করে?
সমীরণ বিবির চোখ দিয়েও পানি পড়তে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে বললেন, এটা তোর বড় বাবার উপহার। তারপর বড় গলায় বললেন, জয়নালের বৌ, কোথায় গেলিরে, শীঘ্রি এদিকে আয়, কে এসেছে দেখ।
জয়নালের বৌ বাথরুম সারতে গিয়েছিল, সমীরণ বিবির গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুম সেরে এসে ইশতিয়াককে দেখে খুশি হল। বলল, এতদিন পরে বড় মার কথা মনে পড়ল?
ইশতিয়াক কিছু বলার আগে সমীরণ বিবি বললেন, সে কথা তোর জানার দরকার নেই। তুই খাওয়ার ব্যবস্থা করে ওর রুমটা পরিস্কার করে দে।
সেবারে ইশতিয়াক এক সপ্তাহ থেকে ঢাকায় ফিরে আসে। অবশ্য সমীরণ বিবি তাকে নিষেধ করে বলেছিলেন, আমারতো কেউ নেই, এসব ভোগ দখল করবে কে? ঢাকায় যাওয়ার দরকার নেই।’
ইশতিয়াক রাজি না হয়ে বলল, সামনে আমার এম. এ. ফাইন্যাল পরীক্ষা। পরীক্ষার পর আবার আসব। আসার কথা বলে এলেও এই চার বছরের মধ্যে আর মাত্র একবার গিয়েছিল। সেবারেও সমীরণ বিবি ঢাকায় ফিরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। তারই কারণে সমীরণ বিবি দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন ভেবে ইশতিয়াক নিজের কাছে নিজে খুব ছোট হয়ে যায়। তাই থাকতে রাজি না হয়ে ঢাকায় ফিরে আসে।
ইশতিয়াক যে মেসে থাকে তার পিছনের একতলা তিন কামরা বাড়িটা যাকিয়াহর মামাদের। নানি বেঁচে থাকলেও নানা অনেক আগে মারা গেছেন। যাকিয়াহ ঐ বাড়িতে থেকে মামাদের সাহায্যে লেখাপড়া করছে। তার নানার নাম আব্দুল লতিফ। ওনার চার ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেরা লেখা পড়া শেষ করে কেউ ব্যবসা, কেউ চাকরি করার পর আব্দুল লতিফ একে একে তাদের বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দেন। শুধু আলাদা নয়, তাদেরকে বাড়িতে থাকতে না দিয়ে ভাড়া বাসায় চলে যেতে বলেন। বাবার কথায় ছেলেরা মনে কষ্ট পেলেও বাবার হুকুম মেনে নিয়েছে। বড় ছেলে আরামবাগে, মেজ ছেলে, মালিবাগে, সেজ ছেলে খিলগাঁও ও ছোট ছেলে মোহাম্মদপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। মেয়ে মাজেদা সবার ছোট। সে যখন বি. এ. পড়ছিল তখন গোলাম মোস্তফা নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিয়ে দেন। বিয়ের এক বছর পর আব্দুল লতিফ মারা যান।
গোলাম মোস্তফা দাউদকান্দির এক মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। ভাগ্যগুণে ও নিজের চেষ্টায় আজ ঢাকায় একজন বড় ব্যবসায়ী। খুব ছোট অবস্থা থেকে নিজের চেষ্টায় ধনী হওয়া মানুষদের মতই তিনি নানান জটিল মানসিক রোগে ভুগতেন। ওনার ইচ্ছা ছিল কোনো ধনীর ললনাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু সে ইচ্ছা ওনার পূরণ হওয়ার আগে অপরূপ সুন্দরী মাজেদাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর বুঝতে পারলেন, মাজেদার শুধু চোখ ধাঁধান রূপই নয় এমন কিছু অমূল্য মানবিক সম্পদ আছে, যা দিয়ে খুব সহজেই অন্যকে কিনে ফেলা যায়।
গোলাম মোস্তফা দুনিয়ার নির্মম পথে পা ফেলে হাঁটতে শুরু করেন বিশ বছর বয়সে একটা মেসিন টুলসের ফ্যাক্টরিতে এ্যাপ্রেন্ট্রিস হিসাবে। পয়তাল্লিশ বছর বয়সে যখন নিজে মেসিন টুলসের ফ্যাক্টরি গড়ে তুললেন তখন অনন্যা সুন্দরী মাজেদাকে বিয়ে করে ঘরে এনেন। বিয়ের পর জীবনের এই প্রথম অনুভব করলেন, পঁচিশ বছরের উপার্জনের সাথে সাথে বিসর্জনও কম নয়। পঁচিশ ত্রিশ বছরের যুবকের যে যৌন ক্ষমতা তার অনেকখানি ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। এই শরীরে ব্যবসা দেখাশোনা করা গেলেও মাজেদার যৌবন তরঙ্গে নৃত্যরত নারীকে নিয়ে মধুর দাম্পত্যে বিভোর হওয়া যায় না। একথা ইউনিভার্সাল টুথ, ভালবাসতে গেলে ভালো মনের পাশাপাশি ভালো শরীরও চাই। দূর্ভাগ্য গোলাম মোস্তফার। বাসর রাতে বুঝতে পারলেন, তিনি পুরুষতৃহীন পর্যায়ের কাছাকাছি। তাই স্ত্রীর স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে শুধু হাত দিলেন। আসল কাজ করতে পারলেন না।
পরদিন একই ঘটনা ঘটতে দেখে মাজেদা লজ্জায় কিছু করতে বা বলতে পারলেন না। তৃতীয় দিনেও স্বামীর একই অবস্থা দেখে মাজেদা লজ্জার মাথা খেয়ে নিজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু পরক্ষণে জানতে পারলেন স্বামীর অক্ষমতার কথা। তখন কড়াতে মাছ ভাজার মতো অবস্থা মাজেদার। তারপর ঘুম আর জাগরণের মধ্যে চেনা আগুনে পুড়তে পুড়তে সুখের, আনন্দের ও পরিপূর্ণতার স্বপ্ন দেখেন মাজেদা। এভাবে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস কেটে যায় মাজেদার।
শরীর ও মনে সুখ শান্তি না থাকলেও সমাজকে ভয় পান মাজেদা। আত্মীয়, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সামনে তাকে সুখী দম্পতির অভিনয় করতে হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে গোলাম মোস্তফার সাহায্য অফুরন্ত। মাজেদা যদি এক পা বাড়িয়ে দেন, তিনি বাড়িয়ে দেন দু’পা। টিভির বিজ্ঞাপনের শাড়ি ও গহনা দেখে মাজেদা যদি ঐ সবের প্রশংসা করেন, পরের দিন অফিস থেকে ফেরার সময় কিনে নিয়ে আসেন গোলাম মোস্তফা। স্ত্রীকে সুখে রাখার জন্য প্রত্যেক রুমে এয়ারকণ্ডিশনার লাগিয়েছেন।
মাজেদাও বড় বড় ডাক্তারের পরামর্শ মতো স্বামীর পুরুষত্ব বাড়ানোর জন্য চিকিৎসা করাতে লাগলেন। তার ফলে গোলাম মোস্তফার রতিক্রিয়ার সামান্য উন্নতি হলেও পূর্ণ যুবতী মাজেদাকে তৃপ্তি দিতে পারেন না।
সুখ-দুঃখ ও স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে হয়তো জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন মাজেদা। কিন্তু ভাগ্য তাদের ওলট-পালট করে দিল। বিয়ের তিন বছর পরও যখন মাজেদা পেটে সন্তান এল না তখন গোলাম মোস্তফা ঢাকার বড় বড় সেরা ক্লিনিকে দু’জনেরই কয়েক দফা প্যাথলজিক্যাল টেষ্ট করালেন। বড় বড় চার পাঁচজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের বোর্ড বসালেন। তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন, আপনাদের শরীরে কোনো সমস্যা নেই। যে কোনো সময়ে সন্তান আশা করতে পারেন।
আরও দু’তিন বছর কেটে গেলেও তাদের আশা পুরা হল না। এই সময় এক দূর্ঘটনা ঘটল। গোলাম মোস্তফা ব্যবসায়িক কাজে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। যাওয়ার পরেরদিন ওনার চাচাত ভাই মুশতাক গোলাম মোস্তফার কাছে আসে। মুশতাকের আর্থিক অবস্থা খারাপ। গোলাম মোস্তফা মাঝে মাঝে তাকে আর্থিক সাহায্য করেন। এবারেও টাকার জন্য এসেছে। প্রতিবারে যেদিন আসে টাকা নিয়ে সেদিনই রাতের বাসে চলে যায়। চাচাত দেবর হিসাবে মাজেদা তাকে খাতির যত্ন করেন, তার কাছে গ্রামের গল্প শোনেন।
এবারে মুশতাক এসে যখন শুনল বড় ভাইয়া সিঙ্গাপুর গেছে তখন ভাবিকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া ফিরবে কবে?
মাজেদা জানেন মুশতাক কেন এসেছে। তাই বললেন, তোমার ভাইয়া এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরবে বলে গেছে। আজ পাঁচ দিন হয়ে গেল। দুদিন থেকে যাও, টাকা নিয়ে যাবে।
এক সপ্তাহের মধ্যে গোলাম মোস্তফার ফেরার কথা বলে গেলেও ফিরতে আরও এক সপ্তাহ দেরি হল।
এদিকে পরমা সুন্দরী ভাবির সঙ্গে এই কয়েকদিন গল্প গুজব ও মেলামেশা করে মুশতাক তার প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়ল। তার মনে হল, এত বিত্তবৈভবের মধ্যে থেকেও ভাবির মনে যেন শান্তি নেই। বড় দুঃখী সে। কারণটাও বুঝতে পারল। ভাবির বয়স বড় জোর চব্বিশ পঁচিশ আর বড় ভাইয়ার বয়স পঞ্চাশের কম হবে না। তার দৃঢ় ধারণা হল, নিশ্চয় ভাবি দাম্পত্য জীবনে অসুখী।
একদিন অপরাহ্নে গল্প করতে করতে দু’জনে খুব হাসাহাসি করছিল। হঠাৎ মুশতাক ভাবিকে জড়িয়ে ধরে বলল, বড় ভাইয়া ঐশ্বর্যে ডুবিয়ে রাখলেও বয়সের কারণে যে সুখ দিতে পারে নি, সেই সুখ আমি তোমাকে দেব।
মুশতাক যে হঠাৎ এরকম করবে মাজেদা ভাবতেই পারেন নি। মুশতাকের আলিঙ্গনে ও তার কথায় মাজেদার শরীরে কামনার আগুন জ্বলে উঠল। পরমুহূর্তে সামলে নিয়ে ছটফট করতে করতে বলল, একি করছ? ছেড়ে দাও। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল; কিন্তু সফল হল না। মোস্তাকের বলিষ্ঠ বাহু দু’টো তখন অক্টোপাশের মতো মাজেদাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছে।
মাজেদা বলল, প্লীজ মুশতাক ভাই, ছেড়ে দাও বলছি। নচেৎ চিৎকার করব।
মুশতাকের শরীরের রক্তে তখন আগুন জ্বলছে। তার কথায় কর্ণপাত না করে ব্লাউজ টান দিয়ে ছিঁড়ে তাকে শোয়াবার চেষ্টা করল।
হঠাৎ মাজেদার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। শান্ত গলায় বলল, ঠিক আছে ছাড়। দরজা খোলা, কেউ এসে পড়তে পারে, লাগিয়ে দিয়ে আসি।
মুশতাক তাকে ছেড়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলল, এই ব্যাপারে সব মেয়েরাই প্রথমে আপত্তি করে।
মাজেদা চিন্তা করেছিল, রুম থেকে বেরিয়ে দরজা আটকে দেবেন। তাই মুশতাক তাকে ছেড়ে দিতে গায়ে শাড়িটা জড়াতে জড়াতে দরজার কাছে এসে পর্দা ফাঁক করতেই স্বামীকে দেখে পাথরের মতো জমে গেল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, কখন এলে?
গোলাম মোস্তফা স্ত্রীর জন্য সিঙ্গাপুর থেকে অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন। তাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য আসার কথা জানান নি। বাসায় এসে মাজেদাকে দেখতে না পেয়ে বুয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের বেগম সাহেব কোথায়?
বুয়া বলল, আপনাগো দেশ থ্যাইকা মেহমান আইছে, বেগম সাহেব ওনার লগে কথা কইতেছেন।
ঠিক আছে, তুমি যাও বলে গোলাম মোস্তফা চিন্তা করলেন, কে আসতে পারে? মুশতাক নয় তো? সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেস্টরুমে আসার সময় তাদের হাসির শব্দ শুনতে পেলেন। দরজার কাছে এসেছেন এমন সময় মাজেদা পর্দা সরান। তার মুখের দিকে তাকিয়ে গোলাম মোস্তফা সব ভুলে গেলেন। স্ত্রী সুন্দরী, তবু তার আনন্দ সুন্দর, সিঁদুর রাঙা মুখ তিনি কখনও দেখেন নি। এলোমেলো শাড়িটা কোনো রকমে তার শরীরে জড়ান। সামলে নিয়ে বললেন, এই তো কিছুক্ষণ হল এসেছি। বুয়াকে জিজ্ঞেস করতে বলল, দেশ থেকে মেহমান এসেছে, তার সঙ্গে গল্প করছ। তারপর ভিতরে ঢুকে মুশতাককে জিজ্ঞেস করলেন, কবে এলি? বাড়ির খবর সব ভালো?
মুশতাক খাটে শুয়েছিল। বড় ভাইয়াকে দেখে ভয়ে কাঠ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
কিরে? কিছু বলছিস না কেন, শরীর খারাপ?
মুশতাক ভেবেছিল, ভাবিকে ঐ অবস্থায় দেখে ভাইয়া নিশ্চয় খুব রেগে তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে। কিন্তু তা না করে এমন ভাবে কথা বলছে যেন কিছুই দেখে নি। তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে বলল, না ভাইয়া, আমার কিছু হয় নি, আমি ভালো আছি। দেশের খবর ওসব ভালো।
কবে এলি বললি না যে?
সপ্তাহ খানেক আগে।
পার্স থেকে টাকা নিয়ে তার হাতে দিয়ে গোলাম মোস্তফা বললেন, আজ নাইট কোচে চলে যাবি। তারপর স্ত্রীকে এস বলে দোতলার নিজের রুমে চলে গেলেন।
মাজেদা স্বামীর পিছনে পিছনে এলেন।
গোলাম মোস্তফা বললেন, খুব ক্ষিধে পেয়েছে, খাবার রেডি কর।
মাজেদা মনে করেছিলেন, স্বামী তাকে খুব রাগারাগি করে যা তা বলে অপমান করবে। তাকে ঠাণ্ডা মেজাজে কথা বলতে শুনে খুব অবাক হলেন। কিছু না বলে টেবিলে খাবার রেডি করলেন।
খাওয়ার পর গোলাম মোস্তফা স্ত্রীর জন্য সিঙ্গাপুর থেকে যে সব দামী দামী অরনামেন্ট, শাড়ি ও প্রসাধন সামগ্রী এনেছিলেন সেগুলো ব্রীফকেস থেকে বার করে বললেন, দেখতো, এগুলো তোমার পছন্দ হয় কিনা?
এর আগেও স্বামী যেখানে গেছে সেখান থেকে এরকম অনেক জিনিস এনেছে। দৈহিক সুখ দিতে পারেনি বলে স্বামী যে তাকে অন্যভাবে সুখি করতে চায়, তা মাজেদা বোঝেন। তাই প্রতিবারই দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রেখে আদুরে গলায় বলেন, শুধু শুধু এত টাকা খরচ করে এসব আনতে গেলে কেন? আমার তো অনেক আছে? এবারেও তাই বললেন।
গোলাম মোস্তফা বললেন, তা থাক, এগুলো পছন্দ হয়েছে কিনা বল?
মাজেদা বললেন, তোমার সবকিছু আমার পছন্দ। তুমি যখন পছন্দ করে এনেছ তখন আমার পছন্দ তো হবেই।
তা হলে এগুলো তুলে রাখ।
বেশ চলছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। মাস দুয়েক পরে যখন মাজেদার অন্তঃসত্ত্বার লক্ষণ দেখা গেল তখন গোলাম মোস্তফার দৃঢ় ধারণা হল, স্ত্রীর পেটে মোশতাকের সন্তান। তারপর থেকে তিনি স্ত্রীর বিছানা ছেড়ে অন্য রুমে থাকতে লাগলেন। কিন্তু তার সঙ্গে কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না।
মাজেদা স্বামীর মনোভাব বুঝতে পেরে পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি মুশতাককে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো মনে করে সেদিন রুমে গল্প করছিলাম। তারপর ঘটনাটা বলে আল্লাহর কসম খেয়ে বললেন, আমার পেটে তোমার সন্তান।
গোলাম মোস্তফা অনেকক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলেন। সে দিন তিনি স্ত্রীকে বিবস্ত্র অবস্থায় ও মুশতাককে খাটে লুঙ্গি পরে শুয়ে থাকতে দেখে যা অনুমান করার করেছিলেন। কিন্তু তা প্রকাশ করেন নি। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা না হলে হয়তো বাকি জীবনেও প্রকাশ করতেন না। অন্তঃসত্ত্বার কথা জানার পর থেকে মাথায় আগুন জ্বলছে। কারণ ওনার ধারণা, সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা ওনার নেই। স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে বললেন, কেউ যদি বলে অমুক লোক মারা যাওয়ার পর কবর থেকে উঠে এসেছে, তা অবিশ্বাস্য হলেও আমি বিশ্বাস করব। কিন্তু তোমার পেটে আমার সন্তান এ কথা বিশ্বাস করব না।
স্বামী থেমে যেতে মাজেদা অনেক অনুনয় বিনয় করে ও অনেক রকম কসম খেয়ে স্বামীরই সন্তান পেটে আছে বললেন।
গোলাম মোস্তফা কিছুই বললেন না। চুপচাপ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
এরপর থেকে গভীর রাতে বাসায় ফিরে নিজের রুমে চলে যান।
মাজেদা এমনই কিছু খেতে পারেন না। জোর করে কিছু খেলে বমি হয়ে যায়। তাই এর মধ্যে তিনি খুবই দুর্বল হয়ে পড়লেন। তবু প্রতিদিন স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় জেগে থাকেন। কোনো কোনো দিন ডাইনীং টেবিলে খাবার নিয়ে বসে থাকতে থাকতে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়েন। ঐ অবস্থায় সকাল হয়ে যায়।
একদিন সকালে গোলাম মোস্তফা যখন অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন মাজেদা এসে বললেন, তুমি বিশ্বাস কর আর নাই কর, আমার সন্তানের বাবা তুমিই। সন্তানকে বাবার অধিকার থেকে কি বঞ্চিত করতে চাও? না, চাই না। কিন্তু তুমি যে আচরণ করছ, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আমাকে নিয়ে তুমি সংসার করতে চাচ্ছ না। এভাবে তো সংসার করা চলে না। কত দিন তোমার আত্মীয়-স্বজনদের ও বাসায় কাজের বুয়াদের কাছে গোপন রাখতে পারবে? সত্যি করে বলতো, তুমি ডিভোর্স চাও কিনা।
না, চাই না।
তা হলে এভাবে সারাজীবন আমাকে কষ্ট দিবে আর নিজেও কষ্ট পাবে?
আমার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না, আমি ঠিক করেছি তোমাকে কুষ্টিয়ায় তোমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেব। তোমার আর তোমার সন্তানের সব খরচ আমি দেব।
তার মানে?
মানে এখন থেকে তুমি কুষ্টিয়ায় মায়ের কাছে থাকবে। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তোমার সমস্ত ব্যায়ভার আমি বহন করব। যাকে বলে লিগ্যাল সেপারেশন। আর সন্তান লেখাপড়া শেষে করে যতদিন না রোজগারী হচ্ছে ততদিন তারও সমস্ত ব্যায়ভার বহন করব।
মাজেদা ছলছল চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
গোলাম মোস্তফা জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু বলবে?
মাজেদা কিছু না বলে চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে নিজের রুমে এসে একটা চামড়ার সুটকেসে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নিলেন। স্বামী অফিসে চলে যাওয়ার পর বেরিয়ে পড়লেন কুষ্ঠিয়ার উদ্দেশ্যে।
গোলাম মোস্তফা কুষ্টিয়ায় বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসে মাজেদাকে দেখে খুব মুগ্ধ হন। এত সুন্দরী মেয়ে জীবনে দেখেন নি। এতদিন টাকার পেছনে ছুটেছেন। কখন যে যৌবন পার হয়ে গেছে খেয়াল করেন নি। মাজেদাকে দেখে বিয়ে করার কথা মনে পড়ে। সে কথা জানিয়ে বন্ধুকে মাজেদাকে বিয়ে করার কথা বলেন। বন্ধুর সাহায্যে বিয়ে করে সেই যে মাজেদাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন তারপর দীর্ঘ পাঁচ ছয় বছর যেমন নিজে যান নি তেমনি স্ত্রীকেও পাঠান নি।
২
এতবছর পর মেয়েকে একা আসতে দেখে আফিয়া খাতুন মনে হোঁচট খেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুই একা এলি যে, জামাই আসে নি?
মাজেদা বললেন, না, আসে নি। আমি একাই এসেছি। এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করো না, উত্তর দিতে পারব না। সময় মতো পরে বলব।
আফিয়া খাতুন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণতার ছাপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জামাই-এর সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছিস বুঝি?
মাজেদা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, এখন কিছু জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করলাম। তবু করছো কেন?
বারে, এতদিন পর এলি আর কিছু জিজ্ঞেস করব না?
তা হলে শোন, তোমাদের জামাই-এর সঙ্গে কোনো রাগারাগি হয় নি। তবু সে আমাকে এখানে চলে আসতে বাধ্য করেছে। আমি আর কোনো দিন সেখানে ফিরে যাব না।
আফিয়া খাতুন মেয়ের কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে, পরে না হয় সবকিছু শুনব, এখন কাপড় পাল্টে মুখ হাত ধুয়ে কিছু মুখে দে।
আব্দুল লতিফের চার ছেলে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকায় চাকরি করছে। তারা বিয়ে করে স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকাতেই থাকে। বাবা মারা যাওয়ার আগে প্রতি মাসে চার ছেলের যে কোনো একজন মা বাবার কাছে আসত, খরচপাতি যা লাগে দিত। বাবা মারা যাওয়ার পরও তার ব্যতিক্রম হল না। মাজেদার স্বামী খুব বড়লোক ও নামী-দামী মানুষ বলে কোনো ভাই-ই ওনার বাড়িতে যায় না। এমন কি বোনের খোঁজ খবরও নেয় না।
রাতে খাওয়ার পর আফিয়া খাতুন মেয়ের মুখে ঘটনা শুনে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞেস করলেন, জামাই যদি ভুল বুঝতে পেরে তোকে নিয়ে যেতে আসে, তবু যাবি না?
মাজেদা কঠিন গলায় বললেন, না, এখান থেকে আমৃত্যু যাব না। তুমি ও ভাইয়ারা যদি জোর করে পাঠাও, তা হলে আমাকে নয়, আমার লাশকে পাঠাবে।
আফিয়া খাতুন পেটের মেয়ের রাগ ভালভাবেই জানেন, তাই আর কিছু বললেন না।
ভাইদের এখন অবস্থা ভালো। তারা ঘটনাটা জেনে বোনকে বলল, তুই কোনো চিন্তা করিস না। আমরা কোর্ট থেকে ডিভোর্স করিয়ে তোর আবার বিয়ে দেব।
তাদের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মাজেদা শুধু চোখের পানি ফেলেছেন।
পরের মাস থেকে প্রতি মাসে গোলাম মোস্তফা পাঁচ হাজার টাকা মনি অর্ডার করে পাঠান স্ত্রীর নামে। মাজেদা সেই টাকা গ্রহণ করেন নি। ফেরৎ গেছে। দিনের পর দিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে মাজেদা খুব দুর্বল হয়ে পড়ল।
আফিয়া খাতুন মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। মাজেদা রাজি হয় নি। ফলে মায়ের অনেক বকাঝকা খেতে হয়েছে। সন্তান দুর্বল বা পঙ্গু হতে পারে ও প্রসবের সময় বিপদ হতে পারে বলে কত বুঝিয়েছেন। মাত্র বিশ বছর বয়সে তোর বিয়ে হয়েছে। এখন পঁচিশ ছাব্বিশ হবে। এত ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? তোর ভাইদের সঙ্গে আমিও এক মত। বাচ্চা হওয়ার পর নতুন জীবন শুরু করবি। কেন নিজেকে শেষ করে দিতে চাচ্ছিস?
মাজেদা মায়ের কথারও প্রতিবাদ করে নি, শুধু চোখের পানি ফেলেছেন আর দিন কাটিয়েছেন।
এক ভোর রাতে মাজেদা একটা মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েই মারা যান। একনজর মেয়েকে দেখার অবসরও পান নি।
মেয়েটি তখন নানির কোলে ডাগর ডাগর চোখ মেলে তাকিয়েছিল। মায়ের মৃতদেহ যখন বার করে নিয়ে যাচ্ছিল তখন নানির কোলে ঘুমিয়েছিল মেয়েটি। আফিয়া খাতুন নাতনির নাম রাখলেন যাকিয়াহ খাতুন।
মাজেদার মৃত্যুর ছয় সাত দিন পর গোলাম মোস্তফা এক লাখ টাকার চেক, স্ত্রীর জন্য অনেক রকমের খাবার ও কাপড়-চোপড়, মেয়ের জন্য কয়েক পদের বেবী সুট, বেবী ফুড ও খেলনা নিয়ে শ্বশুর বাড়ি এসেছিলেন। তিনি জানতেন না মাজেদা মারা গেছেন। মাজেদার গর্ভবতী হওয়ার হিসাব রেখেছিলেন। সেই হিসাব করে এসেছেন। আফিয়া খাতুনের মেয়ের চেয়ে কম অভিমান ছিল না। কোনো কিছু তো গ্রহণ করলেন না, এমন কি নাতনিকে দেখতেও দিলেন না। জামাই যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ নাতনিকে নিয়ে ঘরের ভিতরে ছিলেন।
ছেলেরা মায়ের কাছে সেসব জেনে মাকে বলল, তুমি উচিত কাজ করেছ। যে লোক স্ত্রী বেঁচে থাকতে খোঁজ খবর নেয় নি, সে কিনা মারা যাওয়ার পর দয়া দেখাতে এসেছে।
যাকিয়াহ চার পাঁচ বছর হতে আফিয়া খাতুন তাকে মাদ্রাসায় পড়তে পাঠান। যাকিয়াহ মায়ের মতো অপুর্ব সুন্দরী। তার মেধা খুব প্রখর। তিন বছরে কুরআনের হাফেজা হয়ে গেল।
যাকিয়াহর নানা যখন ঢাকায় চাকরি করতেন। তখন বাসাবোতে তিন কাঠা জমি খুব সস্তায় কিনেছিলেন। যাকিয়াহর মামারা তিন কামরা পাকা টিনসেড বাড়ি করার পরামর্শ করল, গ্রামের জায়গা-জমি বেঁচে মাকে নিয়ে এসে সেই বাড়িতে রাখবে। পরামর্শ মতো চার ভাই গ্রামের বাড়িতে এসে মাকে কথাটা জানাল।
আফিয়া খাতুন প্রথমে স্বামীর ভিটে বিক্রি করে ঢাকায় আসতে চাইলেন না। ছেলেরা বুঝিয়ে সুজিয়ে সবকিছু বিক্রি করে মাকে নিয়ে ঢাকার বাড়িতে চলে আসে।
যাকিয়াহ হাফেজ হয়েছে শুনে ও তার মেধার কথা জানতে পেরে মামারা তাকে স্কুলে ভর্তি করতে চাইল।
আফিয়া খাতুন বললেন, আমি ওকে মাদরাসায় পড়িয়ে আলেমা করব। তোরা সব স্কুল কলেজে পড়ে যেমন ধর্মের কিছু জানিস না তেমনি ধর্মের কোনো কিছু মানিস না। আমি ওকে তোদের মতো হতে দেব না।
ছেলেরা মায়ের কথার অবাধ্য কখনও হয় নি, এখনও হল না। যাকিয়াহকে এক মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিল। প্রখর মেধার কারণে যাকিয়াহ এইটে বৃত্তি পেল। তারপর দাখিলে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হয়ে পাশ করল। পাশ করার পর মামাদেরকে জানাল, সে কলেজে ভর্তি হবে।
মামারা খুশি হয়ে তাকে কমলাপুর স্কুল এণ্ড কলেজে ভর্তি করে দিল। কলেজের শিক্ষকরা যাকিয়াহর মেধার পরিচয় পেয়ে তাকে সুনজরে দেখতে লাগলেন। যাকিয়াহ এইচ. এস. সি’তে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান পেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্সে ভর্তি হল। তারপর অনার্সেও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে যখন মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার কথা ভাবছিল তখন একদিন নানির ঘরে এসে দেখল, তার মন খুব খারাপ। জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে নানি?
আফিয়া খাতুন বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, কিছু হয় নি, তুই এখন আমার কাছ থেকে যা, দুপুর হয়ে গেছে গোসল করেনে।
যাকিয়াহ নানির গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় বলল, বড় মামা সকালে এসেছিলো নিশ্চয় তিনি কিছু বলেছেন।
হ্যাঁ, বলেছে। তোর মামারা এক্ষুনি এসে পড়বে। এখানে মিটিং হবে। ওরা চলে যাওয়ার পর সব বলব। এখন যা গোসল করে খেয়ে নে। তুই তো আবার মামাদের সঙ্গে খেতে লজ্জা পাস।
যাকিয়াহ গোসল করার সময় চিন্তা করতে লাগল, কি এমন ব্যাপারে মামারা মিটিং করবে, যা নানি এখন বলতে পারলেন না? গোসল সেরে জোহরের নামায পড়ে খেয়ে নিজের রুমে এসে মামাদের আসার অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরে প্রথমে বড় মামা তারপর তিন মামা এলেন।
আফিয়া খাতুন ছেলেদের বললেন, আগে খাওয়া-দাওয়া করেনে, তারপর আলাপ করবি।
খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই যখন নানির ঘরে ঢুকল তখন যাকিয়াহ উদ্বিগ্ন চিত্তে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল।
প্রথমে আফিয়া খাতুন বললেন, তোরা এই ঘর ও জমি বিক্রি করতে চাচ্ছিস কেন বলতো?
বড় ছেলে ঈদরীশ বলল, আমরা চার ভাই মীরপুরে আড়াই কাঠা করে দশ কাঠা জমি কিনেছি। বাড়ি করার মতো টাকা আমাদের নেই। তাই এটা বিক্রি করে বাড়ি করব।
আফিয়া খাতুন চার ছেলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, এটা বিক্রি করলে আমি ও যাকিয়াহ কোথায় থাকব?
ঈদরীশ বলল, তুমি আমার কাছে থাকবে।
আফিয়া খাতুন ভ্রুকুচকে বললেন, আর যাকিয়াহ?
বড় ভাইয়া কিছু বলার আগে মেজ মিজান বলল, কেন? ওকে ওর বাবার কাছে পাঠিয়ে দেব। তুমি ওকে সন্তানের মতো মানুষ করেছ, তাই প্রথম দিকে তোমার হয়তো একটু কষ্ট হবে। তা ছাড়া মেয়েদেরকে তো একদিন না একদিন বিয়ের পর স্বামীর ঘরে যেতেই হয়।
সেজ ইউনুস বলল, মেজ ভাই ঠিক কথা বলেছে। তোমার সঙ্গে আমি একমত।
ছোট রশিদ বলল, আমি এটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না। যাকিয়াহর নিজস্ব মতামত থাকতে পারে। সে যদি বাবার কাছে যেতে রাজি না হয়, তখন কি হবে?
ঈদরীশ বলল, ওর প্রতি যখন তোর এতই টান তখন তুই ওকে নিয়ে যা।
চার ভাইদের মধ্যে রশিদের আয় কম। বেতনের টাকায় কোনোরকমে টেনে টুনে সংসার চালায়। বড় ভাইদের কথা শুনে বলল, তোমাদের মতো স্বচ্ছলতা থাকলে ওকে আমিই নিয়ে যেতাম।
আফিয়া খাতুন এতক্ষণ চুপ করে চার ছেলের কথা শুনছিলেন। এবার বললেন, তোদের মতো মাজেদাও আমার পেটের সন্তান। যাকিয়াহ তারই মেয়ে। তাকে তার অংশ মতো বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে দিবি।
ঈদরীশ বলল, মা, কথাটা তুমি ঠিক বলনি। যাকিয়াহর বাবা কেন মাজেদাকে গ্রহণ করে নি, কেন বিখ্যাত ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা একমাত্র বংশধর যাকিয়াহকে গ্রহণ করেনি তাও জানি। তাই বলছি, ওসব কথা বলে লাভ নেই। তবে হ্যাঁ, মাজেদা বেঁচে থাকলে তার অংশ সে পেত। কিন্তু যাকিয়াহকে আমরা কিছুই দেব না। তাকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছি, বড় জোর তার বিয়েটাও দিতে পারি।
বড়মামার কথা শুনে যাকিয়াহ চমকে উঠে ভাবল, সে তা হলে জারজ সন্তান? কিন্তু নানি তো বলেছিলেন, সে তার বাবা গোলাম মোস্তফারই সন্তান? তিনি কখনও মিথ্যা বলতে পারেন না। সেখানে আর তার দাঁড়াতে ইচ্ছা করল না। তার ইচ্ছা হল, এক্ষুনি এই বাড়ি, এ শহর ছেড়ে এমন জায়গায় চলে যেতে যেখানে কেউ তাকে চিনবে না, তার পরিচয় জানবে না। ইচ্ছাকে দমন করে মিটিং-এ শেষ মেষ কি হয় জানার জন্য দাঁড়িয়ে থাকল।
বড় ভাই থেমে যেতে মেজ মিজান বলল, আমি কিন্তু আগেই বলে রাখছি, ওর বিয়ের খরচ দিতে পারব না। জমি কিনতে গিয়ে অনেক টাকা দেনা করতে হয়েছে।
আফিয়া খাতুন গর্জন করে উঠলেন, তোরা আসল ঘটনা জেনেও টাকার। ভাগ দিতে হবে বলে নিজের মায়ের পেটের বোনের উপর কলঙ্ক দিতে পারলি? তোদেরকে আমার ও যাকিয়াহর চিন্তা করতে হবে না। বাড়ি বিক্রি করতে চাস কর। আমি যাকিয়াহকে নিয়ে যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাব। আল্লাহ তাঁর এত বড় দুনিয়াতে আমাদেরকে কোথাও না কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন।
ঈদরীশ বলল, তুমি শুধু শুধু আমাদের উপর রাগ করছে। যাকিয়াহর ভালোর জন্য তাকে তার বাবার কাছে পাঠাবার কথা বলেছি। ওর বাবা তো যাকিয়ার সব খরচ দিতে চেয়েছিলেন, তুমি নাওনি। তিনি একবার নিয়ে যেতে এসেছিলেন, তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ। তাই বলছিলাম যাকিয়াহ বাবার কাছে গেলে আরো উচ্চশিক্ষা নিতে পারবে। আমরা যতই ভালো ছেলে ও ভালো ঘরে ওর বিয়ে দিই না কেন ওর বাবা আরও ভালো ছেলে ও ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারবেন।
আফিয়া খাতুন রাগের সঙ্গে দৃঢ়স্বরে বললেন, তবু আমি ওকে ওর বাবার কাছে পাঠাব না। তা ছাড়া যাকিয়াহ ওর বাবাকে ঘৃণা করে। কিছুতেই তার কাছে যেতে রাজি হবে না।
ঈদরীশ বলল, ঠিক আছে, আপাতত তোমার সঙ্গে যাকিয়াহ আমার বাসাতেই থাকবে। আমি ওর বাবার সঙ্গে দেখা করব। তিনি যদি মেয়ে গ্রহণ করতে রাজি থাকেন, তা হলে ওনাকেই নিয়ে যেতে বলব। আর যাকিয়াহ যদি যেতে একান্ত রাজি না হয় তখন উনি নিশ্চয় কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন।
অন্য তিন ভাই বড় ভাইকে সমর্থন করল। কিন্তু আফিয়া খাতুন অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, তোরা কাজটা ভালো করছিস না। আরও কয়েকদিন চিন্তা করে দেখ।
মিজান বলল, চিন্তা করার সময় নেই। এই জায়গা রেজেস্ট্রী হয়ে গেছে। উনি তাড়াতাড়ি দখল নিতে চান। আর এখানকার সন্ত্রাসীরা কেমন করে জানি খবরটা জেনে গেছে। গতকাল ওদের লীডার জাহাঙ্গীর অফিসে গিয়ে আমাদের কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। না দিলে যাকিয়াহকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে।
আফিয়া খাতুন ভয়ার্তস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তুই তাকে কি বলেছিস?
বলেছি, অন্য ভাইদের সঙ্গে আলাপ করে দু’তিন দিনের মধ্যে জানাব।
তোর ভাইয়েদেরকে কথাটা বলেছিস?
মিজান বলার আগে ঈদরীশ বলল, হ্যাঁ, বলেছে। আমরা ঠিক করেছি, দু’একদিনের মধ্যে গোপনে তোমাদেরকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব।
কিন্তু ওরা তো মিজানের অফিস চেনে। ওদেরকে চাঁদা না দিয়ে চলে গেলে ওকেই যদি হাইজ্যাক করে? তার চেয়ে পুলিশকে সবকিছু জানিয়ে তাদের কাছে সাহায্য চা।
আজকাল পুলিশরা সন্ত্রাসীদের দলে ভিড়ে মোটা টাকা কামাচ্ছে। তাই ওদের জানিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং জানালে আমাদের আরও বড় বিপদ হবে।
তা হলে তো খুব চিন্তার কথা।
ঈদরীশ বলল, চিন্তার কিছু নেই। মতিঝিল থানার ওসি আমার ক্লাসমেট ছিল। তাকে সন্ত্রাসীদের চাঁদার দাবি করার কথা জানিয়েছি। সে ওদের সঙ্গে আলাপ করে অল্প কিছু দিয়ে রফা করে দেবে বলেছে। আরও বলেছে, দু’একদিনের মধ্যে যেন তোমাদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাই।
কবে আমাদেরকে নিয়ে যেতে চাস?
কাল আমার অফিসে কাজের চাপ আছে। পরশু নিয়ে যাব। এখন জিনিসপত্র কিছু নেয়া যাবে না। নিলে সন্ত্রাসীরা জানতে পারবে। এদের সঙ্গে মিটমাট হয়ে যাওয়ার পর নিয়ে যাব। শুধু পরার জন্য দু’তিনটে জামা কাপড় নেবে।
যাকিয়াহ আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করল না। রুমে এসে সিদ্ধান্ত নিল। আজ রাতেই পালিয়ে যাবে। নানিকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে মনকে বোঝাল, যে মামারা তাকে জারজ সন্তান। মনে করে, তাদের কাছে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
তার মন বলে উঠল, কিন্তু তুমি যাবে কোথায়? তোমার মতো যুবতী মেয়েদের একা একা বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশের পথে যাওয়া কি উচিত হবে? তার চেয়ে ইশতিয়াককে তোমার বিপদের কথা বলো। সে তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে, নিশ্চয় তোমাকে সাহায্য করবে।
মেসে আসার মাস খানেক পর যাকিয়াহর সঙ্গে ইশতিয়াকের প্রথম আলাপ হয় একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। একদিন ইশতিয়াক দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমাতে গেল। কিন্তু প্রচন্ড গরমের কারণে ঘুমাতে পারল না। হাত পাখা টানতে টানতে উঠে জানালার কাছে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছিল মেঘ আছে কিনা। বেশ কিছুদিন ধরে প্রচন্ড গরম পড়েছে। মানুষ, পশু, পাখি গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ইশতিয়াকের মনে হল, মানুষের মতো পশু পাখিরাও নিশ্চয় আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য ফরিয়াদ করছে। একটা শিলিং ফ্যান কেনার খুব প্রয়োজন হলেও ইশতিয়াকের সামর্থ নেই। তাই একটা তালপাতার পাখা কিনে এনেছে। সেই পাখাটা নাড়ছে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ঐসব চিন্তা করছিল।
হঠাৎ পাশের একতলা বাড়ির ছাদে ঝঝাল মেয়েলী কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ‘আকবর চাচাকে বলতে হবে মেস তুলে দিয়ে ফ্যামিলী ভাড়া দিতে। মেসে যারা থাকে, তারা সব ছোট লোক। তা না হলে কি আর জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে? যতসব ছোটলোক, অভদ্র কোথাকার। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা করে না।
ইশতিয়াক দিনের বেলা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কোনো বাড়ির দিকে না তাকালেও মাঝে মধ্যে রাতে ঘুমাবার আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল সম্বদ্ধে চিন্তা করে। সে একটা হাদিসের বাংলা অনুবাদে পড়েছিল, রাত্রিবেলা কিছুক্ষণের জন্য আল্লাহর সৃষ্টি কৌশলের চিন্তা করা সারারাত ইবাদত করার চেয়ে উত্তম। আজ গরমে টিকতে না পেরে আকাশে মেঘ আছে কিনা দেখছিল।
মেয়েটির গালাগালি শুনে সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হল। কোনো মেয়ে যে এত সুন্দরী হয়, তা তার জানা ছিল না। চোখে চোখ পড়তে মেয়েটি কড়াস্বরে বলল, হা করে কি দেখছেন, ঘরে কি মা বোন নেই?
ইশতিয়াক নিজের অজান্তে বলে ফেলল, আছে, তবে আপনি তো তাদের দলে নন।
ইডিয়েটের মতো কথা বলছেন কেন?
ইডিয়েটের মতো কথা বললেও যা সত্য তাই বলেছি। ঘরের মা বোন ঘরে আছে; কিন্তু বাইরের মেয়েদের সেই রকম মনে করলে বিয়ে করব কাকে? আর কুমারী মেয়েদেরকে তো তা হলে চিরকুমারী থাকতে হবে।
আপনি শুধু ইডিয়েট নন, অভদ্র ছোটলোকও। কথা শেষ করে যাকিয়াহ সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
পরের দিন মেসের মালিক আকবর হোসেন ইশতিয়াককে ডেকে বললেন, আপনি গতকাল অপরাহ্নে নাকি পাশের বাড়ির যাকিয়াহকে খুব খারাপ খারাপ কথা বলেছেন? আপনার মতো ছেলের কাছ থেকে এরকম আশা করিনি।
ইশতিয়াক জানতে পারল মেয়েটির নাম যাকিয়াহ। আকবর হোসেনের কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। তখন তার যাকিয়াহর অপূর্ব সুন্দর গোলগাল মুখটা মনের পাতায় ভেসে উঠল।
আকবর হোসেন বললেন, কিছু বলছেন না কেন? মৌন থাকাটাই কিন্তু স্বীকৃতি।
কথাটা কে আপনাকে বলেছে?
কে আবার বলবে? যাকিয়াহ নিজে এসে বলে গেছে।
অন্যায় স্বীকার করছি। সেই সাথে ওয়াদা করছি, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর কখনও হবে না।
ঠিক আছে, তবে মনে রাখবেন ওয়াদা ভঙ্গ করলে আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। তারপর আকবর হোসেন কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বললেন, যাকিয়াহ পাঁচ ছয় বছর বয়স থেকে এখানে নানির সঙ্গে আছে। ওর চারজন মামা থাকলেও তারা ফ্যামিলি নিয়ে অন্য জায়গায় থাকে। তারা ওদের দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য আমাকে বলে রেখেছেন। ধরতে গেলে আমিই ওদের গার্জেন। অবশ্য প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো মামা এসে তদারকি করে। তারপর যাকিয়াহর কোয়ালিফিকেশন দেখে বললেন, আপনাকে ভালো জানি বলে কিছু বললাম না, নচেৎ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এখনই বিদায় করে দিতাম।
ইশতিয়াক বলল, ইনশাআল্লাহ আমি কখনও ওয়াদা ভঙ্গ করব না। এবার আসি তা হলে?
আসুন।
ইশতিয়াক চলে যাওয়ার পর আকবর হোসেন চিন্তা করতে লাগলেন, শুধু শুধু যাকিয়াহকে ইশতিয়াক খারাপ খারাপ কথা বলতে যাবে কেন? নিশ্চয় এর পিছনে কোনো কারণ আছে। আবার চিন্তা করলেন, কারণ থাকলে ইশতিয়াক প্রতিবাদ করে নিজের সাফাই গাইল না কেন? তা হলে এর পিছনে কি কোনো কারণ আছে? হঠাৎ কারণগুলো বুঝতে পেরে হেসে উঠলেন। নিশ্চয় দু’জনের মনে প্রেমের অঙ্কুর গজাতে শুরু করেছে। আর এই বয়সেই তো মনের মতো। মানুষ পেলে প্রেমের অঙ্কুর গজায়।
এরপর থেকে যতই গরম লাগুক দিনের বেলা ঐ জানালা বন্ধ রাখে ইশতিয়াক।
একদিন ইশতিয়াক সকালে টিউশনী সেরে ফিরে আসার পর আকবর হোসেন তাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, যাকিয়াহর নানির খুব জ্বর। যাকিয়াহর পরীক্ষা আজ থেকে শুরু। তাই আমাকে সেকথা বলে ডাক্তার দেখাতে বলে পরীক্ষা দিতে চলে গেছে। আমি আপনার ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। তারপর কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন, ডাক্তারের ফি ও ওষুধ বাবদ দিলাম। জানেন তো বিপদগ্রস্থকে সাহায্য করা সওয়াবের কাজ।
ইশতিয়াক কিছু না বলে চলে যেতে উদ্যত হতে আবার বললেন, উনি কেমন থাকেন না থাকেন প্রতিদিন খোঁজ নেবেন।
পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরে যাকিয়াহ দেখল, মেসের সেই ছেলেটা নানির মাথায় পানি ঢালছে।
তাকে দেখে ইশতিয়াক সালাম জানিয়ে বলল, একশ চারের উরপ টেম্পারেচার। ডাক্তার তিনের নিচে না নামা পর্যন্ত পানি দিতে বলেছেন।
তাকে দেখেই যাকিয়াহ প্রথমে রেগে গিয়েছিল। পরে সবকিছু শুনে রাগ পড়ে গেল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ডাক্তার কখন এসেছিলেন?
দশটার সময়।
তখন থেকে আপনি পানি ঢালছেন?
ইশতিয়াক কিছু না বলে চুপ করে রইল।
এখন দু’টো বাজে, আপনার খাওয়া হয় নি নিশ্চয়? এবার আপনি যান, আমি নানির মাথায় পানি ঢালছি।
ইশতিয়াক তবু পানি ঢালতেই থাকল।
কি হল? আমার কথা শুনতে পাননি?
আপনি হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে আসুন তারপর যাব।
আমার কথা ভাবতে হবে না, আপনি যান।
আমি যদি আপনার কথাটাই বলি?
আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
ছাড়িয়ে যাই নি, সবে মাত্র আজই সীমার ভিতরে ঢুকলাম।
আপনার মতলব আমি বুঝতে পারিনি মনে করেছেন? নানির অসুখের ছুতোয় আমার সঙ্গে প্রেম করার ফাঁদ পাততে চান।
আপনার ব্রেনকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। মনে হচ্ছে আমি খুব বোকা। তা না হলে সেদিন অত গালাগালি খেয়েও আপনাদের সাহায্য করতে এলাম কেন?
আপনি বোকা হলেও চতুর বোকা। গালাগালি খেয়েও প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন।
কথাটা ফিফটি পার্সেন্ট কারেক্ট। বাকি ফিফটি পার্সেন্ট মানবতা।
যাকিয়াহ তার হাত থেকে বদনা কেড়ে নিয়ে বলল, বাঁচালের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। যান, কেটে পড়ন।
এখন কেটে পড়লেও জোড়া লাগাবার জন্য আবার আসব বলে ইশতিয়াক সেখান থেকে চলে এল।
তারপর নানির অসুখ ভালো হওয়া পর্যন্ত ইশতিয়াক অনেকবার গেছে। প্রতিবারে যাকিয়ার সঙ্গে প্রেম নিয়ে বাক যুদ্ধ হলেও তার নানি আফিয়া খাতুন তাকে খুব ভালবেসে ফেলেন। একদিন সেকথা যাকিয়াহর সামনে বলেও ফেললেন।
ইশতিয়াক হেসে উঠে বলেছিল, আপনি ভালবাসলে কি হবে, আপনাকে নিয়ে তো সংসার গড়তে পারব না। আপনার নাতনি যদি বাসতো, তা হলে ধন্য হয়ে যেতাম।
যাকিয়াহ শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেছিল, বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে লজ্জা করে না আপনার? আপনাকে ভালবাসতে যাব কোন দুঃখে? কি আছে আপনার? একমাত্র ডিগ্রী ছাড়া না আছে সম্পদ, না আছে একটা ভালো চাকরি, কাউকে ভালবাসতে হলে তার উপযুক্ত হতে হয়।
নানি রেগে উঠে নাতনিকে বলেছিলেন, শুধু সম্পদ আর অর্থ দেখলে হয় না, ভালো মনও হতে হয়। ভালো মন না হলে অর্থ ও সম্পদ থাকলেও দাম্পত্য জীবনে শান্তি আসে না।
এই ভাবেই তিন সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেলেও যাকিয়াহ ইশতিয়াককে ভালবাসতে পারে নি।
সেই ইশতিয়াকের কথা মনে পড়তে যাকিয়াহ একটু স্বস্তি পেল। কিন্তু যাকে যা তা করে বলে অসংখ্যবার অপমান করেছি, সে কি সাহায্য করবে? সুযোগ বুঝে সেও যদি প্রতিশোধ নেয়?
তার মন বলল, যারা সত্যিকার প্রেমিক তারা প্রতিশোধ নেয়ার কথা কোনো দিন চিন্তা করে না। চিন্তা করে, কি করে প্রেমিকাকে সুখী করবে। হঠাৎ মেজ মামার মুখে শোনা জাহাঙ্গীরের কথা মনে পড়ল। সেও অসংখ্যবার প্রেম নিবেদন করে চিঠি দিয়েছে। যাকিয়াহ উত্তর দেয় নি। শেষে একদিন রাস্তা আগলে বলেছিল, তুমি পড়াশোনা করছ, তাই এখন কিছু করব না। কিন্তু পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তোমাকে আমি বিয়ে যদি না করি তো আমি মহিম জজ সাহেবের ছেলেই নই। কথা শেষ করে পথ ছেড়ে দিয়েছিল।
৩
জাহাঙ্গীর এই মহল্লারই ছেলে। তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা। যাকিয়াহ বোরখা পরে যাতায়াত করার আগে তাকে দেখেছে জাহাঙ্গীর। তখন। থেকে যাকিয়াহর রূপ দেখে তাকে ভালবেসে ফেলে। তাই বড় হওয়ার পর যাকিয়াহ বোরখা পরে যাতায়াত করলেও জাহাঙ্গীর তাকে চিনতে পারে।
জাহাঙ্গীর মা বাবার একমাত্র সন্তান। তার বাবা মহিম সাহেব ডিস্ট্রিক জজ ছিলেন। জাহাঙ্গীর যখন বি. এ. পাশ করে তখন হঠাৎ একদিন হার্ট এ্যাটাকে মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর মহল্লার কয়েকটা বাজে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করে খারাপ হয়ে যায়। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে একটা দল করেছে। সে দলের লীডার। তার কথামতো বন্ধুরা চাঁদাবাজি করে।
এসব করলেও মেয়েদেরকে সে যেমন এড়িয়ে চলে, তেমনি বন্ধুদেরকেও মেয়েদের এড়িয়ে চলতে বলে।
জাহাঙ্গীরের মা তামান্না বেগম ছেলের এসব কুকীর্তির কথা জানেন না। একদিন ছেলেকে বললেন, সারাদিন কোথায় থাকিস, কি করিস? এভাবে কতদিন চলবি? মাস্টার্সটা কমপ্লিট করে ফেল।
জাহাঙ্গীর বলল, পড়াশোনা করতে আর ভালো লাগে না।
তা হলে যা ভালো লাগে তাই কর। ভাগ্যবণ্ড হয়ে কতদিন থাকবি?
ভেবে দেখি কি করা যায়।
ভাববার কি আছে? পড়াশোনা করতে যখন ভালো লাগে না তখন চাকরির চেষ্টাও তো করতে পারিস?
আমার চেয়ে কত উচ্চশিক্ষিত ছেলে চাকরি পাচ্ছে না, আর আমি তো মাত্র বি. এ. পাশ। আমাকে কে চাকরি দেবে? তাই ভাবছি ব্যবসা করব।
আজকাল ব্যবসা করতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন। অত টাকা তোর বাবা রেখে যাই নি।
তা আমিও জানি। বন্ধুদের অনেকের বাবা ধনী। তাদের সঙ্গে পার্টনারশীপে ব্যবসা করব ভাবছি।
তা করতে পারিস; কিন্তু ব্যবসায় ফেল করলে তোর বন্ধুরা যদি ক্ষতিপূরণ দাবি করে তখন কি হবে?
ক্ষতিপূরণ যাতে দাবি করতে না পারে সে ব্যবস্থা আগেই করে নেব।
তাই যদি হয়, তা হলে ব্যবসায় নেমে পড়। দেরি করছিস কেন?
হ্যাঁ, কথাবার্তা ঠিক হয়ে গেছে। তাড়াতাড়িই ব্যবসা শুরু করব।
কিন্তু পার্টনারশীপ ব্যবসা করতে হলে তোকেও তো কিছু টাকা পয়সা দিতে হবে।
তা তো দিতে হবে। ভাবছি, গাড়িটা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করব। তোমার কি মৃত বলো।
গাড়ি বিক্রি করলে তোর বাবার সম্মানের হানি হবে। আমি তোকে লাখ দুয়েক টাকা দেব। এতে হবে না?
হবে, কিন্তু তুমি তো এক্ষুনি বললে টাকা নেই, দেবে কোথা থেকে?
তোর বাবা বেঁচে থাকতে আমি বাড়ি ভাড়া থেকে কিছু কিছু জমিয়েছিলাম। একা ব্যবসা করলে ঐ টাকায় হবে না বলে বলেছি।
মিথ্যা করে ব্যবসা করার কথা বলে জাহাঙ্গীর মায়ের কাছ থেকে দু’লাখ টাকা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করে বেড়াতে লাগল। সেই সাথে চাঁদাবাজিও চালিয়ে যাচ্ছে।
তামান্না বেগম ব্যবসার খোঁজ খবর জানতে চাইলে বলে, নতুন ব্যবসা মোটামুটি চলছে। এক বছর না হলে লাভ ক্ষতি বোঝা যাচ্ছে না। তারপর বলল, জান মা, আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি। তাকে দেখলে তোমারও পছন্দ হবে।
তামান্না বেগম বুঝতে পারলেন, ছেলের বিয়ে করার মন হয়েছে। মৃদু হেসে বললেন, আমারও ইচ্ছা এবার তোর বিয়ে দেব। মেয়েটির ঠিকানা দে, আমি তার মা বাবার সঙ্গে কথা বলব।
ঠিকানা লাগবে না। তুমিও তাকে চেনেনা। আমাদের বাড়ির তিন চারটে বাড়ির পরে একতলা টিনসেড বাড়ির মেয়ে নাম যাকিয়াহ।
যাকিয়াহ বোরখা ধরার আগে তামান্না বেগম তাকে দেখেছেন। ফুটফুটে গোলাপের মতো। এত সুন্দর মেয়ে তিনি জীবনে দেখেন নি। একদিন তাকে ডেকে আলাপও করেছেন। ছেলের মুখে তার কথা শুনে অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, তোর পছন্দ ঠিক আছে; কিন্তু ওর তো মা বাবা নেই। নানির কাছে থাকে, মামারা লেখাপড়া করাচ্ছে। মেয়েটি খুব সুন্দরী হলেও এবাড়ির বৌ হওয়ার যোগ্য নয়। শুনেছি, ওর মামারা ছোট খাট চাকরি করে। এই মহল্লায় তোর বাবার একটা মর্যাদা আছে। ওকে বৌ করলে সেই মর্যাদা ধূলোয় মিশে যাবে। আমি ভালো মেয়ে দেখে তোর উঁচু সোসাইটিতে বিয়ে দেব।
আমি যে ওকে অনেক আগে থেকে ভালবাসি। ওকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না।
তামান্না বেগম গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটিও কি তোকে ভালবাসে?
তা জানি না, তবে মনে হয় ভালবাসে।
তুই যে তাকে ভালবাসিস ও তাকে বিয়ে করতে চাস, সে কথা সে জানে?
হ্যাঁ, জানে।
নিশ্চয় তুই তাকে বলেছিস?
হ্যাঁ, বলেছি।
শুনে মেয়েটি কিছু বলেনি?
না, চুপ করেছিল।
কতদিন আগের ঘটনা?
তা দু’বছরের বেশি হবে।
তামান্না বেগম একমাত্র ছেলের স্বভাব জানেন। অমত করলে বিগড়ে যাবে। তাই বললেন, ঠিক আছে, তুই যখন অন্য কোনো মেয়ে বিয়ে করতে চাচ্ছিস না তখন ওর নানির কাছে একদিন প্রস্তাব নিয়ে যাব।
জাহাঙ্গীর আনন্দে উচ্ছাসিত হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, জাস্ট লাইক এ গুড গার্ল।
তামান্না বেগম বললেন, না করে দিলে তো ব্যাড গার্ল বলতিস, তাই না? ঠিক আছে, যাকিয়াহর নানির সঙ্গে কথা বলব। এখন অফিসে যা।
তামান্না বেগমের মর্যাদাবোধ প্রখর। তাই কাজের বুয়াকে দিয়ে যাকিয়াহর নানিকে ডেকে পাঠালেন।
একই মহল্লায় দীর্ঘদিন আছেন। তাই আফিয়া খাতুন জজ সাহেবকে চিনতেন। জজ সাহেব মারা গেছেন তাও জানেন, জাহাঙ্গীরকেও চিনেন। জজ সাহেবের বৌ ডেকে পাঠিয়েছে শুনে চিন্তিত হলেন। তা প্রকাশ না করে কাজের বুয়াকে বললেন, ওনাকে বলবে কাল যাব।
বুয়া চলে যাওয়ার পর ভাবলেন, দীর্ঘ বিশ বাইশ বছর পর আজ হঠাৎ ডেকে পাঠাল কেন?
এমন সময় যাকিয়াহ ভার্সিটি থেকে ফিরে নানির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে কিছু যেন চিন্তা করছেন?
আফিয়া খাতুন বললেন, একটু আগে জজ সাহেবের বৌ বুয়াকে পাঠিয়েছিল আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাই চিন্তা করছি, হঠাৎ কি জন্য আমাকে ডেকে পাঠাল।
যাকিয়াহ বুঝতে পারল, এটা জাহাঙ্গীরের কলকাঠি। বলল, এ নিয়ে চিন্তার কি আছে। হয় তো কোনো দরকারে আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কাল ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় আমি ওনার কাছ থেকে জেনে আসব কেন আপনাকে ডেকেছেন।
তুই জজ সাহেবের বাসায় কখনও গেছিস?
অনেক আগে একদিন জজ সাহেবের বৌ আমাকে বাসার ভিতর নিয়ে আলাপ করেছিল। তখন জজ সাহেব বেঁচে ছিলেন। সেই একবারই যা গিয়েছিলাম।
পরের দিন যাকিয়াহ যখন জজ সাহেবের বাসায় গেল তখন তামান্না বেগম দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। বোরখাপরা যাকিয়াহকে দেখে ভাবলেন, তার নানি এসেছেন। বুয়াকে ডেকে বললেন, ওনাকে উপরে নিয়ে আয়।
বুয়ার সঙ্গে উপরে এসে যাকিয়াহ মুখের নেকাব খুলে সালাম দিল।
অনেক আগে কিশোরী যাকিয়াহকে দেখলেও তামান্না বেগম চিনতে পারলেন। সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তুমি যাকিয়াহ না?
জি, বলে যাকিয়াহ মুখ নিচু করে নিল।
তামান্না বেগম হাসি মুখে বললেন, তোমাকে অনেক আগে দেখেছিলাম। তখনকার থেকে এখন আরও অনেক বেশি সুন্দরী হয়েছ।
যাকিয়াহ লজ্জিতস্বরে বলল, নানির বাতের ব্যাথা রাত থেকে বেড়েছে। তাই আসতে পারেন নি। ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় আপনার সঙ্গে দেখা করে যেতে বলেছেন।
ঠিক আছে, তুমি এসে ভালই করেছ। এস আমার সঙ্গে। তারপর ড্রইংরুমে এসে বসতে বলে বললেন, ভার্সিটি থেকে আসছ বললে, নিশ্চয় ক্ষিধে পেয়েছে। আগে কিছু খেয়ে নাও তারপর আলাপ করা যাবে।
নাস্তা খাওয়ার পর যাকিয়াহ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, কি আলাপ করবেন বললেন বলুন।
আমার ছেলে জাহাঙ্গীরকে তুমি চেন?
জি, চিনি।
কতদিন থেকে চেন?
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে চিনি।
আমি কিন্তু ঐ চেনার কথা বলিনি।
ঠিক বুঝলাম না।
তামান্না বেগম মৃদু হেসে বললেন, আমি জানতে চাচ্ছি, জাহাঙ্গীরকে তুমি কতদিন থেকে ভালবাস?
একই মহল্লার জজ সাহেবের ছেলে হিসাবে তাকে চিনি, ভালবাসি এ কথা কে বলেছে আপনাকে?
যেই বলুক, তাকে ভালবাস কিনা আমি জানতে চাই।
না।
জাহাঙ্গীর তোমাকে ভালবাসে, একথা তুমি জান?
দু’তিন বছর আগে একদিন আমার পথ আগলে বলেছিল, আমাকে সে ভালবাসে এবং আমার পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে করবে।
তার কথা শুনে তুমি কিছু বল নি?
জি না।
তাকে ভালবাসতে ইচ্ছা করে নি?
জি না।
কেন বল তো?
কোনো চাদাবাজ সন্ত্রাসীকে কোনো ভালো মেয়ে ভালবাসতে পারে না।
এই মেয়ে, মুখ সামলে কথা বলো। আমার ছেলে চাদাবাজি করে না, ব্যবসা করে।
আমাকে রাগ দেখাবেন না, আমি আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করি না। আপনার ছেলে ব্যবসা করে কখন? তাকে তো সব সময় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখি। তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন। যদি অস্বীকার করে বলবেন, আমি বলেছি।
তামান্না বেগমের মনে হল, যাকিয়াহ মিথ্যা বলার মতো মেয়ে নয়। তা হলে দু’লাখ টাকা বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে? কথাটা ভেবে খুব দুঃখ পেলেন। তবু বললেন, হয় তো সঙ্গদোষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, চাঁদাবাজি করে, এখন সে তোমাকে বিয়ে করতে চায়। আমার বিশ্বাস, বিয়ের পর তার চরিত্রের সবকিছু তুমি বদলে দিতে পারবে।
আপনারা বোধ হয় জানেন না। আমি ছোটবেলায় কুরআন হেফজ করে মাদ্রাসায় পড়ে দাখিল পাশ করেছি। তারপর কলেজে ভর্তি হয়ে এইচ. এস. সি. পাশ করে ভার্সিটিতে পড়ছি। তা ছাড়া আমি ধর্মের প্রতিটি বিধি নিষেধ মেনে চলি। আপনিই বলুন, আপনার ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া কি উচিত?
না উচিত নয়। তবু বলব, তোমার মতো মেয়েকে এ বাড়ির বৌ করতে চাই। কারণ তোমাদের মতো বৌ অধার্মিক স্বামীকে ধার্মিক করতে পারবে।
আমি আপনার ইচ্ছা পূরণ করতে পারছি না বলে দুঃখিত। এবার যাবার অনুমতি দিন।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে রেখে তামান্না বেগম বললেন, ঠিক আছে, যাও। তবে আমার প্রস্তাবটা আরও ভালো করে ভেবে দেখো।
মাফ করবেন, ভেবে চিন্তেই আমার মতামত জানিয়েছি। কথা শেষ করে যাকিয়াহ চলে গেল।
কেউ তার প্রস্তাব মেনে নেবে না, তামান্না বেগম ভাবতেই পারেন নি। তাই যাকিয়াহ ডিনাই করে চলে যেতে নিজেকে যেমন খুব অপমানিত বোধ করলেন, তেমনি রেগেও গেলেন। ছেলে চাঁদাবাজি করে, ব্যবসার কথা বলে টাকা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করে শুনে তার উপরও খুব রেগে রইলেন।
রাত দশটায় জাহাঙ্গীর বাসায় ফিরলে তামান্না বেগম জিজ্ঞেস করলেন, প্রতিদিন এত দেরি করে ফিরিস কেন? এতরাত পর্যন্ত অফিসে কাজ করছিলি?
জাহাঙ্গীর বলল, নতুন ব্যবসা, কাজ একটু বেশি তো করতেই হবে।
তামান্না বেগম গম্ভীরস্বরে বললেন, আর কত মিথ্যে বলবি? ব্যবসা করিস, না দু’লাখ টাকা আমার কাছ থেকে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করে বেড়াস?
জাহাঙ্গীর ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিয়ে বলল, তুমি তোমার ছেলেকে বিশ্বাস কর না?
বিশ্বাস করতাম বলেই তো ব্যবসা করার জন্য টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই সেই বিশ্বাস চুরমার করে দিয়েছিস। তোর মতো ছেলেকে জন্ম দিয়েছি জেনে মরে যেতে ইচ্ছা করছে। যে ছেলে মায়ের বিশ্বাস নষ্ট করে তাকে ছেলে বলে ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে।
তোমাকে এসব কথা কে বলেছে?
যেই বলুক, কথাটা অস্বীকার করতে পারবি?
সব মিথ্যে কথা, কেউ শত্রুতা করে তোমাকে এই সব বলেছে।
তোর তা হলে শত্রুও আছে?
জাহাঙ্গীর চিন্তা করতে লাগল, কে মাকে এসব কথা বলতে পারে? বন্ধুদের মধ্যে তো সে রকম কেউ নেই! তা হলে?
কিরে, চুপ করে আছিস কেন? বল না তোর শত্রু আছে কি না।
জানামতে তেমন কেউ নেই। তাইতো চিন্তা করছি।
তুই না জানলেও আমি জানি। তবে সে তোর শত্রু নয়, বরং তোর শুভাকাঙ্ক্ষি।
কে বলতো।
যাকিয়াহ।
জাহাঙ্গীর খুব অবাক হয়ে বলল, যাকিয়াহ?
হ্যাঁ, বিয়ের প্রস্তাব দেব বলে তার নানিকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। উনি অসুস্থ, তাই যাকিয়াহকে পাঠিয়েছিলেন কেন ডেকেছি জানার জন্য। তাকে তোর বৌ করব বলে মতামত জানতে চাইলাম। তারপর যাকিয়াহ যা কিছু বলেছিল তামান্না বেগম বলে বললেন, ওর মতো মেয়ে কখনও মিথ্যে বলতে পারে না।
নিজেকে আড়াল করার জন্য জাহাঙ্গীর শেষ চেষ্টা করল। হো হো করে হেসে উঠে বলল, আমি কি করছি না করছি যাকিয়াহ জানবে কি করে? কেন যে শুধু শুধু আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যে করে বলল, বুঝতে পারছি না।
ছেলের চালাকি বুঝতে পেরে তামান্না বেগম রাগের সঙ্গে বললেন, যাকিয়াহ মিথ্যে বলেছে আর তুই বুঝি সত্যি বলছিস? তা হলে শুনে রাখ, তোর বাবা মারা যাওয়ার আগে তোর জন্য গর্ব অনুভব করতাম আর এখন তোকে আমি ঘৃণা না করি। যে ছেলে মায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে আমি ছেলে বলে স্বীকার করি না। তোকে কসম দিয়ে বলছি, যতদিন না তোর বন্ধুদের সঙ্গ না ছাড়বি ততদিন আমাকে মা বলে ডাকবি না। তারপর ফুঁপিয়ে উঠে চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেলেন।
যাকিয়াহর উপর জাহাঙ্গীর প্রচন্ড রেগে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করল, যেমন করে হোক প্রতিশোধ নেবে। তারপর মায়ের পিছন পিছন এসে তার পা জড়িয়ে ধরে বলল, আমি অন্যায় স্বীকার করে প্রতিজ্ঞা করছি, বন্ধুদের সঙ্গ ছেড়ে দেব আর কখনও তোমার কাছে মিথ্যে বলব না। তুমি কসম ফিরিয়ে নাও। তারপর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, বাবা নেই, তুমিই আমার মা বাবা। তোমাকে মা বলে না ডেকে থাকতে পারব না। এত বড় শাস্তি তুমি আমাকে দিও না। এটা ছাড়া যা মনে চায় শাস্তি দাও মাথা পেতে নেব; কিন্তু মা বলে ডাকতে নিষেধ করো না। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে ভালো হওয়ার সুযোগ দাও মা। ছেলের কাতরুক্তি শুনে তামান্না বেগমের মন নরম হল। তাকে জড়িয়ে। ঘরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুই আমার একমাত্র নয়নের মনি। তোর মুখে মা ডাক শুনলে কলজে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তোকে অন্যায়ের পথ থেকে ফেরাবার জন্য কসম দিয়েছি। কসম ফেরান যায় না। তাই বলছি যত তাড়াতাড়ি অন্যায় পথ থেকে ফিরে আসবি তত তাড়াতাড়ি কসম কেটে যাবে।
জাহাঙ্গীর মাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে বলল, ঠিক আছে, তাই করব। তবে কথা দাও, কসম কেটে যাওয়ার পর যাকিয়াহর সঙ্গে আমার বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবে?
ব্যবস্থা নয়, চেষ্টা করার কথা দিলাম। তবে যতদূর মনে হয় যাকিয়াহ রাজি হবে না। কারণ তুই শুধু বি. এ. পাশ আর সে কুরআনের হাফেজা ও মাদ্রাসায় দাখিল পর্যন্ত পড়েছে। একজন আলেমা বলা যায়। তার উপর ইসলামিক স্ট্যাডিতে অনার্স করছে। এখন মাস্টার্স করার আশা রাখে। তুই-ই বল না, হাফেজা আলেমা ও অনার্স পাওয়া মেয়ে কি তোকে বিয়ে করতে রাজি হবে? হবে না। তবু তোর জন্য চেষ্টা করব। আল্লাহ যদি তোদেরকে জোড়া করে থাকেন, তা হলে আমার চেষ্টা সার্থক হবে। আর যদি জোড়া করে না থাকেন, তা হলে শত চেষ্টা করলেও হবে না। এবার যা, কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে আয় খেতে দেব।
এরপর থেকে জাহাঙ্গীর সত্যি সত্যি বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা ছেড়ে দিল। মদ খাওয়াও ছেড়ে দিল। দু’লাখ টাকা আগেই বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করে উড়িয়েছে। তাই চেষ্টা চরিত্র করে মাস তিনেকের মধ্যে এক লাক্সারী বাস সার্ভিসের অফিসে চাকরি জোগাড় করল। বেতন পাঁচ হাজার টাকা।
তামান্না বেগম যাকিয়াহর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছিলেন, জাহাঙ্গীরকে কিছুতেই সে বিয়ে করতে রাজি হবে না। তবু ছেলেকে চেষ্টা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন তাকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনার জন্য।
মাস দুয়েকের মধ্যে জাহাঙ্গীরের আমুল পরিবর্তন দেখে সন্তুষ্ট হলেন। একদিন তাকে মিথ্যে করে বললেন, আজ যাকিয়াহ ও তার নানির সঙ্গে দেখা করে তোর পরিবর্তনের কথা বলে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। নানি কিছু বলার আগে যাকিয়াহ রাগের সঙ্গে বলল, আপনার ছেলের বিয়ে অন্য কোথাও দেয়ার ব্যবস্থা। করুন। আমি তো সেদিনই আপনাকে আমার মতামত জানিয়েছি। যে ছেলে মায়ের কাছে মিথ্যে বলে, চাঁদাবাজি করে, মদ খায়, তাকে বিয়ে করার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। তারপর আরো কত কি বলে অপমান করে চলে যেতে বলল। যেদিন মেয়েটা আমাদের বাসায় এসেছিল, সেদিন তার আচরণ দেখে তাকে ভালো মনে করেছিলাম। কিন্তু আজ যা করল, তা তোকে বলতে পারব না। মেয়েটার মন যে কত ছোট তা বুঝতে পেরেছি। ওরকম মেয়েকে নিয়ে তুই যেমন অশান্তি ভোগ করবি, তেমনি আমিও পাব। নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সেই বাড়ির মেয়ের কি অহঙ্কার। শিক্ষিত হয়েছে বলে দেমাগে যেন মাটিতে পা পড়ে না। তোর জন্য দু-দু’বার অপমান হলাম মেয়েটার কাছে।
মায়ের কথা শুনতে শুনতে জাহাঙ্গীর খুব রেগে উঠেছে। মা থেমে যেতে বলল, তোমাকে অপমান করার প্রতিশোধ আমি নেবই। ওর শিক্ষার দেমাগ না ভেঙ্গেছি তো আমার নাম জাহাঙ্গীর নয়।
তামান্না বেগম আতঙ্কিতস্বরে বললেন, ছি বাবা, ওরকম চিন্তা কখনও করবি না। কারো ক্ষতি করলে নিজের ক্ষতি হয়। ওকথা মন থেকে মুছে ফেল। যাকিয়াহ কি সুন্দরী, আমি ওর থেকে বেশি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব।
সে তুমি যা ইচ্ছা কর; কিন্তু আমি প্রতিশোধ নেবই, এই কথা বলে মায়ের কাছ থেকে নিজের রুমে চলে গেল জাহাঙ্গীর।
পরের দিনই জাহাঙ্গীর মহল্লার জসিম নামে একটা সতের আঠার বছরের গরিব ছেলেকে মাসিক বেতন ভিত্তিতে যাকিয়াহর দিকে লক্ষ্য রাখার জন্য নিযুক্ত করল।
জসিম প্রায় দু’মাস হতে চলল যাকিয়াহকে ছায়ার মতো অনুস্বরণ করছে। যাকিয়াহ বাসায় থাকলে সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আত্মগোপন করে বাসার দিকে লক্ষ্য রাখে।
আজ যাকিয়াহর চার মামাকে আসতে দেখে বাড়ির পিছন দিকের জানালার কাছে এসে তাদের আলাপ শুনে। তারপর ফিরে এসে জাহাঙ্গীরকে সবকিছু জানাল।
জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে রাগ সামলাল। তারপর বলল, তুই তোর, কাজে যা।
জসিম চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করে একটা প্ল্যান ঠিক করল।
তখন বর্ষাকাল। পরের দিন সন্ধ্যের পর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। জাহাঙ্গীর দশটার সময় মায়ের সঙ্গে খেয়ে রুমে এসে টিভি’তে হিন্দি ছবি দেখতে লাগল। আর মাঝে মাঝে মায়ের রুমের দিকে তাকাতে লাগল।
তামান্না বেগম পৌনে এগারটায় বেডরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়েন।
মায়ের রুমের লাইট অফ হওয়ার পরও পাঁচ মিনিট টি.ভি, দেখল। তারপর টি.ভি. অফ করে লাইট অফ করল। তারপর আস্তে করে দরজা বন্ধ করে বাসা থেকে বেরিয়ে এল। রাস্তায় এসে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে নিশ্চিত হল ম্যাজিক ছুরীটা নিতে ভুলে গেছে কিনা।
৪
আফিয়া খাতুন বয়স্ক মহিলা। তাই রাত ন’টায় খেয়ে দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। ছোটবেলা থেকে যাকিয়াহরও ঐ সময়ে খাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে। খাওয়ার পর রাত এগার সাড়ে এগারটা পর্যন্ত পড়াশোনা করে ঘুমায়। অনার্স করার পর সময় কাটানোর জন্য গল্পের বই পড়ে। আজ জিম কর্বেটের শীকার কাহিনী পড়ছিল। তখন তার সময়ের জ্ঞান ছিল না। বৃষ্টি হচ্ছে বলে জানালা লাগিয়ে দরজা এমনি ভিড়িয়ে রেখেছিল। দরজা খোলার সময় ও লাগাবার সময় কাঁক করে শব্দ হয়। সেই শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, একজন মুখোশ পরা বলিষ্ঠ যুবক তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার হাতে একটা প্রায় ছ’ইঞ্চির মতো ছুরীর ফলা।
যাকিয়াহ সমাজের যুবকদের চরিত্রের অবক্ষয় দেখে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ক্যারাতের প্রশিক্ষণ নিয়েছে স্টাইফাণ্ডের টাকা খরচ করে। সে কথা তার নানি জানলেও মামারা জানে না। মুখোশ পরা যুবককে দেখে ভয় পেলেও সামলে নিয়ে আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য নিজেকে তৈরি করল। তারপর কড়া মেজাজে জিজ্ঞেস করল, কে আপনি?
মুখোশধারী যুবক তার কথার উত্তর না দিয়ে পা-পা করে এগিয়ে আসতে লাগল।
যাকিয়াহ কঠিন স্বরে বলল, খবরদার, কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। করলে পরিণতি ভালো হবে না।
জাহাঙ্গীরও ক্যারাতের প্রশিক্ষণ নিয়েছে; কিন্তু যাকিয়াহও নিয়েছে তা জানে। তাই তার কথা অগ্রাহ্য করে একইভাবে এগিয়ে আসতে লাগল।
যাকিয়াহ আগরবাতির সুগন্ধ খুব পছন্দ করে। তাই দিনে হোক রাতে হোক যখন পড়তে বসে তখন একটা সিলবারের বাটিতে বালি ভর্তি করে টেবিলের একপাশে রেখে তাতে আগরবাতির গোড়াটা গেঁথে দেয়। আগন্তুক থামছে না দেখে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তাড়াতাড়ি বাটিটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে একমুঠো বালি নিয়ে তার চোখে ছুঁড়ে মারার আগেই জাহাঙ্গীর তার কাছে পৌঁছে ছুরীটা গলায় চেপে ধরে বলল, তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসে ছিলাম, তাই বিয়ের প্রস্তাব দিতে মাকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমার ভালবাসাকে যেমন অপমান করেছ, তেমনি মাকেও অপমান করেছ। তাই প্রতিশোধ নিতে এসেছি। ভয় নেই তোমাকে খুন করব না। একবার ভোগ করে আমার ভালবাসার আগুন নেভাব। তাকে নড়ে ওঠতে দেখে আবার বলল, চিৎকার করলে ধড় থেকে মাথা আলাদা…. কথাটা শেষ করতে পারল না। ঠিক ঐ মুহূর্তে যাকিয়াহ তার চোখে বালি ছুঁড়ে মারল। জাহাঙ্গীর চোখ রগড়াতে লাগল।
সেই সুযোগে যাকিয়াহ ক্যারাতের চাপ মারল ছুরীধরা হাতে। ছুরীটা পড়ে যেতে পা চালাল তার তলপেটে।
জাহাঙ্গীর ছিটকে কয়েক পা পিছিয়ে পেট ধরে বসে পড়ল।
যাকিয়াহ তড়িৎ গতিতে ছুরীটা কুড়িয়ে নিয়ে তার পিঠে পুরো ফলাটা ঢুকিয়ে দিল।
তলপেটে যাকিয়াহর লার্থী খেয়ে জাহাঙ্গীরের জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয়েছিল। পিঠে ছুরীর ফলা ঢুকে যেতে উপুড় হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান হারাল।
কথা শুনেই যাকিয়াহ অনুমান করেছিল আগম্ভক জাহাঙ্গীর। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য টান দিয়ে মুখোশটা খুলে ফেলল। তারপর মুখোশটা ফেলে দিয়ে চিন্তা করতে লাগল, এখন তার কি করা উচিত। যদি জাহাঙ্গীর মরে যায়, তা হলে থানা পুলিশ হবে। জাহাঙ্গীরের মা ভাইদের খবর দিয়ে মামলা করবেন। মামলায় তার ফাঁসি হতে পারে। কি করবে না করবে ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। এক সময় নিজের অজান্তে বোরখা পরে বাসা থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।
কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে জানতে পারল আগামী কাল সকাল সাতটার আগে ছাড়া রাতে আর কোনো ট্রেন নেই।
কয়েকজন টাউট সব সময় রেলস্টেশনে ও বাসস্ট্যাণ্ডে থাকে। তারা কোনো অসহায় যাত্রি পেলে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। রাত প্রায় সাড়ে এগারটার সময় যাকিয়াহকে একা দেখে তাদের একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আপা কোথায় যাবেন? রাতে আর কোনো ট্রেন নেই। তবে বাস হয়তো পেতে পারেন, চলুন আপনাকে বাসে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করি।
যাকিয়াহ তাদের দিকে তাকিয়ে দেখল, তিনজন লোলুপ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বোরখা পরে থাকলেও যাকিয়াহর মুখে তখন নেকাব ছিল না। তাদের মতলব বুঝতে পেরে ভয় পেলেও ঘাবড়াল না। মুখে নেকাব দিয়ে বলল, ধন্যবাদ। আপনাদেরকে কষ্ট করতে হবে না। আমি নিজেই বাসস্ট্যাণ্ডে যেতে পারব। তারপর হাঁটতে শুরু করল।
টাউটরা তার পিছন পিছন আসতে আসতে বলল, আপা, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, বাস না পেলে আমরা আপনাকে আপনার বাসায় পৌঁছে দেব।
যাকিয়াহ তাদের কথা ভ্রূক্ষেপ না করে আরও দ্রুত হেঁটে বাসস্ট্যাণ্ডের কাউন্টারে গিয়ে কোনো জায়গার বাস এখন ছাড়বে কিনা জিজ্ঞেস করল।
কাউন্টারে বসে দু’জন লোক হিসাবপত্র করছিল। তাদের একজন মুখ না তুলে বলল, এগারটায় লাস্ট বাস ছেড়ে গেছে। আগামীকাল সকাল সাড়ে সাতটায় দিনাজপুরের বাস প্রথম ছাড়বে।
টাউট তিনজন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাদের একজন বলল, চলুন না আপা, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিই। এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আপনার মতো মেয়ের বিপদ হতে পারে।
যাকিয়াহর তখন মাথা ঠিক নেই। এখন সে কি করবে বুঝতে পারল না। একবার ভাবল, কোনো হোটেলে গিয়ে রুম ভাড়া নিয়ে থাকবে। সকালে ট্রেনে হোক বা বাসে হোক দূরে কোথাও চলে যাবে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, এক কাপড়ে খালি হাতে বেরিয়ে এসেছে, কাছে একটা টাকাও নেই। হোটেলের রুম ভাড়া দিবে কি করে? ভ্যানিটি ব্যাগে কিছু টাকা ছিল, সেটা যদি নিয়ে আসত।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে টাউটদের একজন তার একটা হাত ধরে বলল, কোনো ভয় করবেন না আপা, আসুন আমাদের সঙ্গে।
ঠিক সেই সময়ে ইশতিয়াককে দেখতে পেয়ে যাকিয়াহর ধড়ে যেন জান ফিরে এল। তাকে বাস ডিপোর গেটের দিকে যেতে দেখে মুখের নেকাব সরিয়ে উচ গলায় বলল, ইশতিয়াক ভাই, আমি এখানে।
ইশতিয়াক আসার আগে কাউন্টারের লোক দু’জন যাকিয়াহকে টানাটানি করছে দেখে বেরিয়ে এসে বলল, এই, আপনারা কারা? ইনাকে টানাটানি করছেন কেন?
যে যাকিয়াহর হাত ধরে টানছিল, সে ছেড়ে দিয়ে বলল, না, মানে ওনাকে ওনার বাসায় পৌঁছে দিতে চাচ্ছিলাম।
ততক্ষণে ইশতিয়াক পৌঁছে গেল। তার কথা শুনে বলল, ওনাকে পৌঁছে দিতে হবে না। আপনারা যান এখান থেকে।
কাউন্টারের লোক দু’জনের একজন জিজ্ঞেস করল, ইনি আপনার কে?
আমার স্ত্রী। তূর্ণা নিশীতে আমাদের চিটাগাং যাওয়ার কথা। আমি জরুরী কাজে একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় ওকে দশটার সময় স্টেশনে আসতে বলেছিলাম। বন্ধুটা বাসায় ছিল না। তার অপেক্ষায় দেরি হয়ে গেছে। স্টেশনে এসে দেখি গাড়ি চলে গেছে। কথা ছিল, ট্রেন মিস করলে বাসে যাব। তাই প্রথমে স্টেশনে গিয়ে না পেয়ে ভাবলাম, এখানে আসতে পারে।
ঠিক আছে, আপনার স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় যান। তারপর টাউটদের বলল, আপনারা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান এখান থেকে।
ইশতিয়াক যাকিয়াহর একটা হাত ধরে বলল, অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইছি। তারপর হাতটা টান দিয়ে বলল, চল বাসায় যাই। কাল সকালের ট্রেনে চিটাগাং যাব।
ইশতিয়াক তাকে স্ত্রী বলে পরিচয় দিতে অন্য সময় হলে যাকিয়াহ তাকে অপমান করে ছাড়ত। কিন্তু সে এখন পরিস্থিতির স্বীকার। তাই রাগের পরিবর্তে তার উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে খুশি হয়েছে। যেতে যেতে বলল, তুমি নিশ্চয় সবকিছু জেনে আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছ?
হ্যাঁ।
তা হলে আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে চাচ্ছ কেন?
বলার প্রয়োজন ছিল, তাই বলেছি। দেখ না কোথায় নিয়ে যাই। এমন সময় বৃষ্টি শুরু হল। সামনে একটা খালি রিকশা পেয়ে ইশতিয়াক বলল, তাড়াতাড়ি উঠ।
ঢাকার রিকশার সীট ছোট। চিকন দু’জন লোক বসতে পারে, তাও ঘেঁষাঘেষি করে। এদের দু’জনের স্বাস্থ্য ভালো। এক রিকশায় উঠা উচিত নয় ভেবে যাকিয়াহ কি করবে চিন্তা করতে লাগল।
তার মনের কথা বুঝতে পেরে ইশতিয়াক বলল, বিপদের সময় উচিত অনুচিত কিছু করলে আল্লাহ মাফ করে দেবেন। লোকগুলো আমাদের দিকে এখনও তাকিয়ে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদ হতে পারে। তা ছাড়া বৃষ্টিতে বেশি ভিজলে অসুখ হবে। এমন সময় একটা খালি সি.এন.জি. আসতে দেখে হাত বাড়িয়ে দাঁড় করাল। তারপর উঠে বসে যাকিয়াহকেও উঠতে বলল।
যাকিয়াহ উঠে বসার পর ড্রাইভার জিজ্ঞেসা করল, কোথায় যাবেন?
ইশতিয়াক যাকিয়াহকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে, বাসায়? তাকে মাথা নাড়তে দেখে ড্রাইভারকে বলল, নবাবপুর রোডে চলুন।
সি. এন. জি. চলতে শুরু করলে যাকিয়াহকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যেতে চেয়েছিলে?
যাকিয়াহ উত্তর না দিয়ে শুধু একটু হাসল।
এতে হাসির কি হল? ইশতিয়াকের কণ্ঠে বিরক্তি।
ইশতিয়াক ভাই রাগ করো না, এই বৃষ্টির রাতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা, আমি যে কমলাপুর বাসস্ট্যাণ্ডে আসব জানলে কি করে?
একটু রাগের সঙ্গে ইশতিয়াক বলল, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
তুমি আমার উপর রেগে যাচ্ছ কেন? ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর আমার মাথা ঠিক ছিল না। ধরা পড়লে জেল-ফাঁসি হতে পারে, তাই পালাতে হবে ভেবে বেরিয়ে পড়ি। তারপর কেমন করে জানি স্টেশনে এসে পড়ি। তবে একথা ঠিক, ট্রেন পেলে আমাকে পেতে না। আচ্ছা, জাহাঙ্গীর বেঁচে আছে, না মারা গেছে। বলতে পার?
বেঁচে আছে। আকবর হোসেনকে বলে এসেছি তাকে যেন হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।
জাহাঙ্গীর বেঁচে আছে শুনে যাকিয়াহর জেল-ফাঁসি হওয়ার ভয়টা কেটে গেল। জিজ্ঞেস করল, নবাবপুর রোডে নিয়ে যাচ্ছ কেন? যদি ভেবে থাক, স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে আমাকে নিয়ে কোনো হোটেলে রাত কাটাবে, তা হলে সকালেই আমার মরা মুখ দেখবে।
খুব আহত স্বরে ইশতিয়াক বলল, দীর্ঘদিন ধরে তুমি আমাকে চেনো, তা ছাড়া এত শিক্ষিত হয়েও আমাকে এত নীচ ভাবতে পারলে? এ কথা শোনার আগে আমার মৃত্যু হল না কেন? ঠিক আছে, আমার কাছে হাজার খানেক টাকা আছে। তোমার কাছে না থাকলে নিতে পার। তোমার যেখানে মন চায় যাও। আমি নেমে যাচ্ছি বলে ইশতিয়াক ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল।
কথাটা বলা যে মারাত্বক ভুল হয়েছে, বলার পরপরই বুঝতে পেরেছিল যাকিয়াহ। তারপর ইশতিয়াকের কথা শুনে ড্রাইভারকে থামাতে নিষেধ করে তার দু’টো হাত ধরে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, আমার ভীষণ অন্যায় হয়েছে, মাফ করে দাও। তুমি যদি মাফ না কর, তা হলে সত্যি সত্যি কাল সকালে আমার মরা মুখ দেখবে।
ইশতিয়াক কিছু না বলে হাত ছাড়িয়ে নিতে গেল।
যাকিয়াহ জোর করে ধরে রেখে ভিজে গলায় বলল, বল, মাফ করে দিয়েছ? নচেৎ ছাড়ব না।
তুমি যত বড় অন্যায় কর না কেন, সব সময় ক্ষমা পাবে। এখন তুমি যদি অন্য কোথাও যেতে চাও যাও। তবে একটাই শর্ত, তোমাকে আমি পৌঁছে দেব।
যাকিয়াহ চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, একটু আগে বললাম না, কোনো নিদিষ্ট জায়গা ঠিক করে বেরোইনি?
তা হলে সব কিছু আমার হাতে ছেড়ে দাও। যতদিন না জাহাঙ্গীরের ব্যাপারটা মিটমাট হচ্ছে ততদিন তোমাকে এমন জায়গায় হেফাজতে রাখব, মানুষজন তো দূরের কথা, পশু পাখিরাও জানতে পারবে না। তারপর জিজ্ঞেস করল, কি আমার কথায় রাজি তো?
রাজি।
ভালো করে ভেবে বলল।
যাকিয়াহ চোখ মুছে বলল, ভেবেই বলেছি। এবার বলো নবাবপুর রোডে তোমার কেউ আছে, না ……..
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ইশতিয়াক বলল, না কেউ নেই, হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালে আমার নির্বাচিত স্থানে নিয়ে যাব।
ঢাকা হোটেলের এ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার ইকবাল ও ইশতিয়াক এক সঙ্গে মাস্টার্স করেছে। দু’জনের মধ্যে খুব সখ্যতা। ইশতিয়াক মাঝে মাঝে দেখা করতে এলে ইকবাল না খাইয়ে ছাড়ে না। রাত আটটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত তার ডিউটি। রিসেপশানে বসে মিলটনের প্যারাডাইজ লস্ট পড়ছিল। কাউন্টারের পাশে টুলে বসে একটা চৌদ্দ পনের বছরের বয় ঝিমোচ্ছিল।
ইশতিয়াক সালাম দিয়ে বলল, দোস্ত, কেমন আছিস?
ইকবাল বই থেকে মুখ তুলে বোরখাপরা একটা মেয়ের সঙ্গে ইশতিয়াককে দেখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
কিরে, অমন করে তাকিয়ে রয়েছিস কেন? সালামের উত্তরও দিলি না?
ইকবাল সালামের উত্তর দিয়ে চোখ রগড়ে বলল, স্বপ্ন দেখছি না তো?
আরে না, স্বপ্ন নয়, সত্য।
কিন্তু এত রাতে একজন …..
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ইশতিয়াক বলল, এই দ্র মহিলা খুব বড় বিপদে পড়েছেন জেনে ওনাকে নিয়ে তোর কাছে আসতে বাধ্য হয়েছি। শোন, একটা ভালো এটাচড বাথ সিঙ্গেল রুমে ওনার থাকার ব্যবস্থা কর। চিন্তা করিস না, ভাড়া পাবি। একটু তাড়াতাড়ি কর দোস্ত, উনি খুব ক্লান্ত।
ততক্ষণে বয়-এর ঝিমোনি ছুটে গেছে। দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিল। ইকবাল তাকে একটা চাবি দিয়ে বলল, চারশ পাঁচ নম্বর রুমে ওনাকে নিয়ে যাও। তারপর যাকিয়াহর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ওর সঙ্গে গিয়ে রেষ্ট নেন, কিছুক্ষণের মধ্যে বয় ডিনার দিয়ে আসবে।
যাকিয়াহ বলল, আর ইশতিয়াক ভাই?
ইকবাল বলল, আমাদের কথা শুনে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন আমাদের সম্পর্কের কথা? আপনারা দুজনেই বেশ ভিজে গেছেন দেখছি। কারো কাছে ব্যাগ-ট্যাগও কিছু দেখছি না। ঠিক আছে, রুমে যান, দেখি কি করতে পারি।
যাকিয়াহ এক পলক ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বয়ের পিছনে এগোল।
যাকিয়াহ কখনও কোনো হোটেলে থাকে নি। রুমে ঢুকে বেশ অবাক হল। সিঙ্গেল রুম হলেও বেশ বড়। একপাশে খাট। খাটের গদীর উপর সাদা ধবধবে চাদর বিছান। একটা মাথার বালিশ ও একটা কোল বালিশ জায়গা মতো রয়েছে। মাথার দিকে খাটের পাশে একটা টেবিল ও একটা চেয়ার। টেবিলের উপর টেলিফোন সেট। খাটের পায়ের দিকে দেয়ালের গা ঘেঁসে স্টীলের আলনা। তার পাশে ড্রেসিং টেবিল। তার সামনে ছোট গদীমোড়া টুল। রুমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে দরজা লাগিয়ে বাথরুমে ঢুকল। বাথরুমটাও খুব সুন্দর। বাথরুমের কাজ সেরে বেরিয়ে ভাবল, পরণের কাপড় এখনও আধা ভিজে। পাল্টান উচিত। নচেৎ জ্বর হতে পারে। এমন সময় দরজা নক হতে মনে করল, ইশতিয়াক এসেছে। দরজা খুলতে বয়ের হাতে পাজামা, পাঞ্জাবী দেখতে পেল।
বয় বলল, ম্যানেজার সাহেব পাঠিয়েছেন। আপনি এগুলো, পরে ভিজে কাপড় আলনায় রেখে ফ্যান ছেড়ে দেন শুকিয়ে যাবে। আমি ততক্ষণে আপনার খানা নিয়ে আসছি।
যাকিয়াহ ভিজে কাপড় চেঞ্জ করে স্টীলের আলনাটা ফ্যানের নিচে এনে ভিজে শালওয়ার কামিজ ও বোরখা রেখে ফ্যান ছেড়ে দিল।
খাওয়ার পর ঘুমাবার সময় নানা চিন্তা যাকিয়াহর মাথায় ভর করল। নানি। নিশ্চয় খুব কান্না কাটি করছে, এতক্ষণে মামারা নিশ্চয় খবর পেয়ে এসেছে। তারা কি আমাকে নিয়ে ভাবছে? মনে হয় ভাবে নি। বরং নিজের থেকে আপদ বিদায় হয়েছে জেনে খুশিই হয়েছে। আরও চিন্তা করতে লাগল, ইশতিয়াক তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? আসার সময় কথাগুলো বলে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে। মনে ভীষণ ব্যাথা পেলেও আমাকে খুব ভালবাসে বলে মাফ করেছে। মনে হয় ওর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবে। সেখানে কে কে আছে কাল জানতে হবে। এই সব ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
যাকিয়াহ বয়-এর সঙ্গে রুমে চলে যাওয়ার পর ইকবাল ইশতিয়াককে বলল, এবার বল, ঐ ভদ্র মহিলার পাল্লায় পড়লি কি করে? আজকাল অনেক শিক্ষিত মেয়ে টাকা রোজগার করার জন্য নিশীচারিণীর মতো রাস্তায় ঘুরে। তুই সে রকম কোনো মেয়ের পাল্লায় পড়িস নি তো?
আরে না, তুই আমাকে কি মনে করিস? তারপর যাকিয়াহর পরিচয় ও জাহাঙ্গীরের ঘটনাটা খুলে বলল।
তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু ওকে নিয়ে তুই কোথায় যাবি? জাহাঙ্গীরের মা নিশ্চয় মামলা করবেন। যাকিয়াহ তো ফেরারী হবে। তুই ওকে কতদিন লুকিয়ে রাখতে পারবি?
তোকে আসল কথাটাই বলা হয় নি। যাকিয়াহকে আমি চার বছর ধরে ভালবাসি। ওকে না পেলে আমি বিয়েই করব না। ওর জন্য যদি অসাধ্য কিছু করতে হয় তাও করব।
যাকিয়াহও তোকে ভালবাসে?
জানি না। তবে মনে হয় ভালবাসে।
সে কিরে, যাকে চার বছর ধরে ভালবাসিস, তার মনের খবর জানিস না। এ কেমন কথা? তুই তো আমার থেকে অনেক চালাক, তবু জানতে পারলি না?
একদম যে জানতে পারিনি তা নয়। আমার বিশ্বাস, বাইরে বাইরে আমাকে সহ্য করতে না পারলেও মনে মনে ঠিকই ভালবাসে।
তোর বিশ্বাস যদি ঠিক হয়, তা হলে ভালো। নচেৎ তোর জীবনে দুঃখ আছে।
ভাগ্যে দুঃখ থাকলে তা ভোগ করতেই হবে। বাদ দে এসব কথা, তোর লুঙ্গী থাকলে দে, কাপড়টা বদলাই। তারপর খাওয়ার ব্যবস্থা কর খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
এস, আলমের লাক্সারী কোচ ডাইরেক্ট চিটাগাং হয়ে কক্সবাজার যায়। পরের দিন সকাল সাতটার বাসে ইশতিয়াক যাকিয়াহকে নিয়ে উঠল।
বাস ছেড়ে দেয়ার পর যাকিয়াহ দেখল, রাতের বৃষ্টির চিহ্ন লেগে রয়েছে রাস্তায়। আকাশ পরিস্কার হলেও তুলোর মতো সাদা মেঘমালা ভেসে বেড়াচ্ছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। রাতে মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাসের ঝাঁকানিতে ঘুমে চোখ ভারি হয়ে এল।
লাক্সারী কোচের সীটগুলো বেশ বড়। দু’সীটের মাঝখানে ফাঁক আছে। তাই তারা পাশাপাশি দুই সীটে বসলেও কারো গায়ে গা ঠেকছে না। তবু ইশতিয়াক গুটিগুটি হয়ে বসেছে হঠাৎ কোনো কারণেই যেন যাকিয়াহর গায়ে গা না লেগে যায়।
যাকিয়াহ ঘুম তাড়াবার জন্য আকাশের দিক থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ইশতিয়াকের দিকে তাকাল। তার চোখেও রাত জাগার চিহ্ন। অনেক কষ্ট করেছে বেচারা। শুধু এই ব্যাপারেই নয়, তার জন্য ও নানির জন্য প্রায় কিছু না কিছু কষ্ট স্বীকার করে। বদলে আমার কাছ থেকে পেয়েছে অবহেলা। গত রাত্রের কষ্টটা আগের থেকে অনেক বেশি। তাই বুঝি একটু দয়া হল। অনুচ্চস্বরে ডাকল, ইশতিয়াক ভাই।
ইশতিয়াক পরবর্তি কর্মসূচির চিন্তা করছিল, যাকিয়াহর ডাকে ছিন্ন হয়ে গেল। বলল, বলল।
আমার জন্য তুমি কেন এত কষ্ট কর বলতে পার?
পারি। তবে জেনে তোমার কোনো লাভ হবে না।
লাভ নাই হোক, তবু জানতে চাই।
আমিও ঐ একই কারণে বলতে চাই না। যদি একান্তই জানতে চাও, উত্তর একটা দিতে পারি। যেমন কাউকে সাহায্য করা সওয়াবের কাজ। বিশেষ করে প্রতিবেশীকে। তুমি অন্য কিছু না হলেও প্রতিবেশী। একথা কি অস্বীকার করতে পারবে?
না, পারব না। তুমি শুধু প্রতিবেশী নও, সুপ্রতিবেশীও। আজকাল সুপ্রতিবেশীর খুব অভাব। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে, শুধু প্রতিবেশীর উপকার করার জন্য এত কষ্ট স্বীকার করছ না। সেই সঙ্গে বড় কিছু আশা করছ।
ইশতিয়াক হেসে ফেলে বলল, হঠাৎ এরকম মনে হল কেন?
হঠাৎ নয়, অনেক আগেই মনে হয়েছে।
তাই যদি হয়, তা হলে আশাটাও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
হ্যাঁ, পেরেছি। তবে অনুমান মাত্র। অনুমান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঠিক হয় না। তাই জানতে চাই।
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে ইশতিয়াক বলল, বিগত চার বছর আমরা একে অপরকে আপনি বলে সম্বোধন করলেও গতরাত থেকে কিন্তু তুমি চালিয়ে যাচ্ছি।
যাকিয়াহ মৃদু হেসে বলল, তুমি আমার থেকে চালাক। তাই আমার কথার উত্তর না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানছ।
ইশতিয়াকও মৃদু হেসে বলল, টেনেই যখন ফেলেছি, প্রসঙ্গটা শেষ কর।
আমরা মনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। দূরত্ব কমে গেলে অটোমেটিকভাবে আপনি থেকে তুমি এসে যায়। এবার আমার কথার উত্তর দাও।
তোমার অনুমানই ঠিক।
বললাম না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুমান সঠিক হয় না। আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “হে মুমিনগন, অনেক অনুমান হইতে বাঁচিয়া থাক, কেননা কোনো কোন অনুমান পাপজনক হইয়া থাকে।” [সূরা হুজরাত, পারা–২৬, ১২নং আয়াতের প্রথম অংশ।]
তোমার অনুমান ঠিক এজন্য বলেছি, তুমি জান, তোমাকে আমি অনেক দিন থেকে ভালবাসি।
হ্যাঁ, তা জানি; কিন্তু আজকালকার ভালবাসাকে আমি ঘৃণা করি। তা ছাড়া ইসলামে ছেলেমেয়ের মধ্যে ভালবাসা-বাসি নিষিদ্ধ।
কিন্তু আমি তো জানি ইসলাম ছেলে মেয়েকে পাত্র-পাত্রী পছন্দ করার অধিকার দিয়েছে।
হ্যাঁ, দিয়েছে; কিন্তু ভালবাসা-বাসির অধিকার শুধু দেয় নি, নিষিদ্ধও করেছে। ওকথা রেখে বল, কোথায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছ।
চকরিয়া।
কক্সবাজারের টিকিট কাটলে, চকরিয়া আবার কোথায়?
চকরিয়া একটা জায়গার নাম। কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত।
যাকিয়াহ হেসে ফেলে বলল, তা হলে ওখানে তোমাদের বাড়ি? কে কে আছে বাড়িতে?
তোমার তবু নানি ও মামা-মামিরা আছেন, আমার কেউই নেই। এমন কি বাড়িও নেই।
যাকিয়াহ খুব অবাক হয়ে বলল, তা হলে ওখানে নিয়ে যাচ্ছ কেন?
এক বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছি। প্রতিবেশী এক উকিল ও ওনার স্ত্রী আমাকে ছেলের মতো লালন-পালন করেন ও বি. এ. পর্যন্ত পড়িয়েছেন। উকিলের স্ত্রীকে আমি বড়মা বলে ডাকি। উকিল মারা গেছেন। বড়মা বেঁচে আছেন। এর বেশি কিছু জানতে চেয়ো না, বলতে পারব না।
আরও অনেক কিছু জানতে যাকিয়াহর ইচ্ছা থাকলেও ইশতিয়াকের কথা শুনে করল না। ভাবল, জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করল কেন? তা হলে কি এমন কিছু ওর ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, যা জানাতে চায় না। ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে পারলে ভালো হত। এই সব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।
ওরা ড্রাইভারের পিছনে প্রথম সারিতে বসেছে। ইশতিয়াক গাড়ির সামনের কাঁচ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ যাকিয়াহ চুপ করে রয়েছে। দেখে তার দিকে তাকাল-গাড়ির বডিতে ঠেস দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে আর মাথা জানালার গ্লাসে বাড়ি খাচ্ছে।
খুব মায়া লাগল ইশতিয়াকের। মাথাটা ধরে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে বুঝতে পারল, যাকিয়াহ ঘুমের ঘোরে তার গায়ে হেলান দিয়ে মাথা কাঁধে রেখেছে। গাড়ির আঁকানীতে মাঝে মাঝে কাঁধ থেকে সরে যেতে বারবার কাঁধে তুলে রাখছে। শেষে ইশতিয়াক একটা হাত দিয়ে মাথাটা নিজের কাঁধে ধরে রাখল।
প্রায় ঘণ্টা দুই পরে ঘুম ভাঙ্গল যাকিয়াহর। চমকে উঠে দ্রুত ইশতিয়াকের হাতটি সরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, হায় আল্লাহ, একি করেছি?
জান না, ঘুমন্ত ও পাগল লোকের গুণাহ নাই?
যাকিয়াহ লজ্জারাঙা হয়ে ঘড়ি দেখে বলল, জানি। তাই বলে প্রায় দু’ঘণ্টা তোমাকে কষ্ট দেয়া উচিত হয়নি। নিশ্চয় তোমার ঘাড় অবশ হয়ে গেছে। বাধা
থাকলে ঘাড়টা ম্যাসেজ করে দিতাম।
থাক, ঘাড় ম্যাসেজ করে দিতে হবে না। তোমার কথা শুনে এমনই ঠিক হয়ে গেছে।
বাজে কথা।
বাজে কথা নয় যাকিয়াহ, শুধু দু’ঘণ্টা কেন, সারাদিন তুমি এ ভাবে থাকলেও এতটুকু কষ্ট অনুভব করতাম না।
আমার মন জয় করার জন্য আরও কত কি বলবে বা করবে তার ঠিক আছে?
কথাটা বুঝতে পারার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
একটা সত্য কথা বলবে?
আমি কখনও মিথ্যা বলি না।
তুমি আমাকে ভালবাস জানি, কিন্তু আমি যে তোমাকে ভালবাসি না এবং ভবিষ্যতে কখনও ভালবাসতে পারব না, তা কি জান?
জানি।
তবু আমার পেছনে চার বছর লেগে রয়েছ কেন? আমার জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করছ কেন? আমার তো মনে হয় আঙ্গুর ফল টক জেনে শেয়ালের মতো ভেগে যাওয়া উচিত ছিল তোমার।
তা উচিত ছিল, কিন্তু আমি তো শেয়াল নই, মানুষ। আর মানুষরাই চেষ্টা, ধৈর্য ও সাধনার দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভব করে থাকে।
তুমি ঠিক বললেও মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। তাই অনেকে চেষ্টা, ধৈর্য ও সাধনার দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করতে পারে না।
এতক্ষণে খুব খাঁটি কথা বলেছ। ভাগ্যে যদি আল্লাহ তোমার আমার জোড়া। লিখে রাখেন, তা হলে তোমাকে আমি পাবই।
আর যদি আল্লাহ ভাগ্যে আমাদের জোড়া লিখে না রাখেন?
ভাগ্যে কি লেখা আছে মানুষ জানে না, জানতেও পারে না। তাই মানুষকে আল্লাহ শুধু ভাগ্যের উপর নির্ভর করে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে বলেন নি। বরং বলেছেন, ধৈর্য ধরে চেষ্টা ও সাধনা করতে। আমি আল্লাহর কথা মতো কাজ করছি।
ততক্ষণে চট্টগ্রাম বাসস্ট্যাণ্ড এসে গেল। ইশতিয়াক বলল, এখানে লাঞ্চ করার জন্য এক ঘণ্টা বিরতি। চল তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে আমাদের দু’এক সেট জামা কাপড় কিনব। দু’জনেই তো এক কাপড়েই বেরিয়েছি।
৫
তারা যখন চকরিয়া পৌঁছাল তখন বেলা তিনটে। বাস থেকে নেমে ইশতিয়াক স্কুটার নিয়ে সাড়ে তিনটের সময় বাড়ির কাছে এসে নামল।
যাকিয়াহর গাছ গাছালিভরা জায়গাটা খুব ভালো লাগল; কিন্তু বাড়িটা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। অনেক পুরোনো পাকা চার কামরা বাড়ি। প্লাস্টার খসে গিয়ে নোনা লেগেছে। আশপাশে আরও বাড়ি থাকলেও এখানটা নিরিবিলি। ঘন গাছপালা থাকায় ভূতুড়ে বাড়ির মতো লাগছে। জিজ্ঞেস করল, এটাই তোমাদের বাড়ি?
অসন্তুষ্ট গলায় ইশতিয়াক বলল, আমার নয়, মরহুম আলতাফ হোসেন উকিলের বাড়ি। এখানে ছোটবেলা থেকে মানুষ হয়েছি। বাসে সে কথা তো বলেছি, মনে নেই বুঝি?
তোমার নিজের যখন বাড়িঘর নেই তখন এটাই তোমাদের বাড়ি।
ওসব কথা বাদ দিয়ে চিন্তা কর, বড়মা কিছু জিজ্ঞেস করলে কি বলবে? কথাটা যাকিয়াহকে বললেও ইশতিয়াক নিজেও কিছু চিন্তা করেনি। বিশ্বাসযোগ্য কিছু চিন্তা করে রাখা উচিত ছিল। এখন যে কিছু চিন্তা করবে তার আর সময় পেল না।
লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী পরা এক যুবক গেট খুলে বেরিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
ইশতিয়াক এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ সাগীর ভাই?
স্কুটারে উঠে যাকিয়াহ মুখের নেকাব খুলে ফেলেছে। সাগীর একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। এবার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। কথা শেষ করে আবার যাকিয়াহর দিকে তাকিয়ে রইল।
সাগীরকে যাকিয়াহর ভালো লাগল না। তার দৃষ্টিতে লোলুপতা দেখতে পেল। যেন কতকাল মেয়ে মানুষ দেখেনি। পারলে যেন গিলে খাবে। হঠাৎ তার মনে হল, চান্স পেলে তার উপর হামলা করতে ছাড়বে না। সে খুব অসস্তি বোধ করে মুখে নেকাব দিল।
যাকিয়াহর অবস্থা ইশতিয়াক বুঝতে পেরে তাকে অভয় দেয়ার জন্য সাগীরের দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে সাগীর ভাই, বড়মা কেমন আছেন?
যাকিয়াহর মুখে নেকাব দিতে দুেখে সাগীর ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে বলল, ফুফুমা ভালো আছেন। অনেকদিন পর হঠাৎ এলে যে? এদিকে ফুফুমা তোমার কথা প্রায় বলেন।
যাকিয়াহকে দেখিয়ে ইশতিয়াক বলল, এই মেয়েটাকে নিয়ে হঠাৎ-ই আসতে হল। ওর নাম যাকিয়াহ।
তাচ্ছিল্যের স্বরে সাগীর বলল, নাম জেনে কি করব? ভিতরে গিয়ে ফুফুমার সঙ্গে দেখা কর। তুমি যে এসেছ, তাতেই উনি খুশি হবেন।
ঘরের ভেতর থেকে সমীরণ বিবি সাগীর কারো সঙ্গে কথা বলছে শুনতে পেয়ে ঝাঁঝাল গলায় বললেন, সাগীর, তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস?
ফুফুমার গলা পেয়ে সাগীর চুপসে গেল। যথাসম্ভব মোলায়েম স্বরে বলল, আপনার আসল ছেলে এসেছে। আপনি তাকে কাজের বেটি আনতে বলেছিলেন না, তাই একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে।
তার কথা শুনে ইশতিয়াক খুব বিব্রতবোধ করল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে যাকিয়াহর দিকে তাকিয়ে বলল, সাগীর ভাই-এর কথায় মনে কিছু করো না। গতবারে যখন এসেছিলাম তখন বড়মা একটা কাজের বেটি নিয়ে আসতে বলেছিলেন। স্বামীর আমলে চার পাঁচজন কাজের বেটি ছিল, জমি জায়গা দেখার জন্য ও বাজার হাট করার জন্য তিন চারজন কাজের লোক ছিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর তারা কেউ নেই। বড়মা পঙ্গু। হুইল চেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। ওনার কোনো সন্তান নেই। তাই দূর সম্পর্কের ভাইপো সাগীর ভাইকে এনে রেখেছেন।
তারপর সাগীরকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি ভুল করছ। ও ঢাকার শিক্ষিত মেয়ে, কাজের বেটি নয়, কাজের বেটিরা বোরখা পরে কখনও শুনেছ?
সাগীর থমমত খেয়ে বলল, একি বলছ ইশতিয়াক ভাই? তা হলে তো ওনাকে কাজের বেটি বলে মস্ত বড় অন্যায় করে ফেলেছি। তারপর যাকিয়াহর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলল, মাফ করে দিন।
একটু আগে জয়নালের বৌ হুইল চেয়ার ঠেলে সমীরণ বিবিকে গেটের কাছে নিয়ে এসেছে। তিনি সাগীরের কথা শুনে বললেন, তোর মাথায় গোবর আছে। বয়স হল এখনও মানুষ চিনলি না। যা এখান থেকে।
সাগীর মাথা নিচু করে বাইরে চলে গেল।
ইশতিয়াক সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে কদমবুসি করে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন বড়মা?
সাগীর চলে যেতে যাকিয়াহ মুখের নেবাক সরিয়ে দিল।
সমীরণ বিবি সালামের উত্তর দিয়ে মাথায় চুমু খেয়ে বললেন, দেখতেই তো পাচ্ছিস কেমন আছি। জীবনে আর কোনোদিন যে উঠে দাঁড়াতে পারব না, তাতো জানিস? তুই কেমন আছিস?
ভালো।
সমীরণ বিবি যাকিয়াহর দিকে তাকিয়ে বললেন, এমন পূর্ণিমার চাঁদের মতো মেয়েকে কোথায় পেলি? এই মেয়ে, কাছে এস।
যাকিয়াহও সালাম দিয়ে কাছে এসে কদমবুসি করল।
থাক মা থাক, বেঁচে থাক। আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক বলে তার মুখে হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, ভারি মিষ্টি মেয়ে তো, কি নাম তোমার?
যাকিয়াহ খাতুন।
বাহ! নামটা তোমার মতই সুন্দর। নামের অর্থ জান?
জি, বিশুদ্ধ।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আল্লাহ তোমাকে নামের সার্থকতা রাখার তওফিক দিক।
হঠাৎ সমীরণ বিবির মনে হল, ইশতিয়াক একে বিয়ে করে নিয়ে আসেনি তো? বললেন, ঘরে চল।
ঘরে ঢুকে যাকিয়াহর ভালো লাগল। বেশ বড় রুম, একটা ডবল খাট, একটা আলনা, একটা ইজি চেয়ার, একটা কাঠের আলমারি। সেটাতে মোটা সোটা বই ভর্তি। আর একটা টেবিলের দু’পাশে দু’টো চেয়ার। খাটের সামনের মেঝেতে একটা চমৎকার কার্পেট পাতা। কার্পেটের রঙের সঙ্গে ম্যাচ করা ছাপা। পর্দা ঝুলছে জানালা দরজায়। তবে সব কিছুতে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট।
সমীরণ বিবি জয়নালের বৌকে ইশতিয়াকের রুমটা ঠিক ঠাক করে রান্নার জোগাড়ে যেতে বললেন।
ইশতিয়াক জয়নালের বৌকে বলল, এখন রান্না করা লাগবে না। আমরা হোটেলে খেয়ে এসেছি। চা-নাস্তার ব্যবস্থা কর। একেবারে রাতে খাব।
জয়নালের বৌ চলে যাওয়ার পর সমীরণ বিবি ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা কি বিয়ে করেছিস?
ইশতিয়াক খুব লজ্জা পেল। একবার যাকিয়াহর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, আপনি ভুল করছেন বড় মা। তারপর যাকিয়াহ পরিচয় ও বিপদের কথা সবিস্ত রে বলে বলল, জানি এখানে ওকে আনা উচিত হয়নি। কিন্তু ওকে বাঁচাবার আর কোনো উপায় না পেয়ে এক রকম বাধ্য হয়ে নিয়ে এসেছি। বিপদ কেটে গেলে ওকে ওর নানির কাছে পৌঁছে দেব।
সমীরণ বিবির কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যাকিয়াহকে জিজ্ঞেস করলেন, ইশতিয়াককে তুমি কত দিন থেকে চেনো?
প্রায় চার বছর।
যদিও জানি ইশতিয়াক আমার কাছে কখনও মিথ্যা বলে নি, তবু জানতে চাই, ও যা বলল সে সব কি সত্য?
জি, সত্য।
সমীরণ বিবি ইশতিয়াককে বললেন, তোদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, অনেক ধকল গেছে। তোরা গোসল করবি নাকি?
ইশতিয়াক বলল, হ্যাঁ, গোসল করব। আমি পুকুর থেকে গোসল করে আসি, আপনি জয়নালের বৌকে যাকিয়াহর গোসলের ব্যবস্থা করতে বলে দিন।
সমীরণ বিবি বললেন, তুই তোর রুমে থাকবি। আমি জয়নালের বৌকে আমার পাশের রুমে যাকিয়াহর থাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলব।
চা-নাস্তা খেয়ে দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আসরের আযান শুনে ইশতিয়াকের ঘুম ভেঙ্গে যেতে মসজিদে নামায পড়তে গেল।
আযান শুনে যাকিয়াহরও ঘুম ভেঙ্গে যেতে কলতলা থেকে অজু করে এসে নামায পড়ে রান্না ঘরে গেল। রান্না ঘর অপরিচ্ছন্ন ও অগোছাল দেখে গা ঘিন ঘিন করে উঠল।
জয়নালের বৌ-এর বয়স পঞ্চাশের উপর। বিধবা হওয়ার পর থেকে এ বাড়িতে কাজ করছে। যাকিয়াহ এসেছে বলে সমীরণ বিবির কথামতো রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত ছিল। যাকিয়াহকে দেখে বলল, আপনি আবার এখানে এলেন কেন? যান, বড় মার কাছে গিয়ে বসুন।
যাকিয়াহ বলল, তুমি উঠ, আমি রান্না করব। তার আগে ঘরটা পরিস্কার করে গোছাতে হবে। তা না হলে এই অবস্থায় রান্না করতে বসলে আমার বমি হয়ে যাবে।
জয়নালের বৌ অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি কি বলছেন বুঝতে পারছি না।
তোমাকে বুঝতে হবে না। এখন এলোমেলো জিনিসগুলো বাইরে বারান্দায় রাখ। তারপর যাকিয়াহ কোমরে ওড়না জড়িয়ে কাজে লেগে গেল।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে জয়নালের বৌকে নিয়ে ঝাড়ামোছা করে চা বানিয়ে দু’টো কাপে চা ঢেলে বলল, বড় মা ও ইশতিয়াক ভাইকে দিয়ে এস। আর সাগীর ভাই যদি ফিরে এসে থাকে তার জন্যও এক কাপ নিয়ে যাবে।
সাগীর বোরখা পরা অবস্থায় যাকিয়াহর শুধু মুখ দেখেছিল। এখন অল্পক্ষণ আগে এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বোরখা ও ওড়না ছাড়া যাকিয়াহকে দেখে তার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হল। লোভাতুর দৃষ্টিতে অঙ্গসৌষ্ঠবের রূপসুধা পান করছিল। জয়নালের বৌকে তার জন্য চা নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে ভিতরে ঢুকে বলল, আমি এসে গেছি, আমাকে এখানেই চা দাও। আপনি এসেই রান্নাঘর শোয়ার ঘরের মতো চকচকে করে ফেলেছেন। জয়নালের বৌ তো এতদিন জঙ্গল করে রেখেছিল।
যাকিয়াহ তাকে দেখে তাড়াতাড়ি কোমর থেকে ওড়না টা খুলে গায়ে মাথায় দিয়ে বলল, একি? আপনি এখানে এসেছেন কেন? যান, বড়মার ঘরে গিয়ে বসুন, জয়নালের বৌ চা নিয়ে যাচ্ছে। আর কোনোদিন এখানে আসবেন না। জানেন না, রান্নাঘর শুধু মেয়েদের জন্য, ছেলেদের আসা নিষেধ?
সাগীর বত্রিশপাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, কি যে বলেন আপা, আমি হলাম এ বাড়ির কেয়ার টেকার। আমার অবাধ গতি। আপনি নিষেধ করার কে? আর আমিই বা আপনার নিষেধ শুনব কেন?
যাকিয়াহ ভাবল, সত্যিই তো, সে এবাড়ির কে? তার নিষেধই বা কেউ শুনবে কেন? তবু বলল, আমি এবাড়ির কেউ না হলেও যে কয়েকটা দিন থাকব, এখানে আসবেন না। যদি আমার কথা না শোনেন, তা হলে বড়মাকে দিয়ে বলাব।
এখানে আসার আগে বাড়িতে সাগীরকে বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ করতে হত। সে খুব কুড়ে। কৃষি কাজ করতে ইচ্ছা করত না। বাবা তাকে বকাঝকা করে করাত। এখানে আসার পর নবাবের মতো গায়ে হাওয়া দিয়ে বেড়ায়। জমির ফসল ও বাগানের ফলমুল যা বিক্রি করে তার অর্ধেক মেরে দেয়। এমন কি বাজারের পয়সাও চুরি করে।
সমীরণ বিবি যে এসব জানতে পারেন না, তা নয়। কিন্তু নিজে পঙ্গু অপারগ। তাই সাগীরের স্বভাব চরিত্রের কথা জেনেও কিছু বলেন না। তবে মাঝে মধ্যে যে রাগারাগি করেন না তা নয়। বলেন, বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোকে বাড়ি পাঠিয়ে তোর ছোট ভাই বসিরকে এনে রাখব।
এই কথা শুনলে সাগীর ঘাবড়ে যায়। ভাবে বাড়িতে গেলে বাবা তাকে দিয়ে আবার কৃষি কাজ করাবে। তাই ফুফুকে খুব ভয় পায়। এখন যাকিয়াহর কথা শুনে ভাবল, সত্যি সত্যি যদি সে কথাটা জানায়, তা হলে ফুফু তাকে আস্ত রাখবে না। খুব রেগে গিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, তোমার রূপসূধা যদি পান করেছি তো আমার নাম সাগীর না।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যাকিয়াহ বিরক্ত কণ্ঠে বলল, কি হল, যান বলছি, নচেৎ এক্ষুনি বড়মার কাছে নালিশ করব।
সাগীর একবার কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে নিয়ে জয়নালের বৌকে বলল, আমি বাইরের ঘরে যাচ্ছি, তুমি চা নিয়ে আস। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল।
ইশতিয়াক নামায পড়ে এসে সমীরণ বিবির রুমে গিয়ে বলল, জয়নালের বৌ কোথায়? একটু চা খেতে পারলে ভালো হত।
এমন সময় জয়নালের বৌকে দু’কাপ চা নিয়ে ঢুকতে দেখে বলল, চায়ের জন্য তোমার কথা বড়মাকে জিজ্ঞেস করছিলাম। যাকিয়াহ বোধ হয় এখনও ঘুমাচ্ছে। জাগিয়ে তাকেও এক কাপ চা দাও।
জয়নালের বৌ বলল, তিনি ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে গেছেন, সেখানেই চা খাচ্ছেন।
সমীরণ বিবি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, এ চা তুই করেছিস?
জয়নালের বৌ মাথা নিচু করে বলল, চা বুঝি ভালো হয় নি?
রেগে উঠে সমীরণ বিবি বললেন, যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দে?
আমি ছাড়া কে আর আছে বানাবে?
এমন সময় চায়ের কাপ হাতে যাকিয়াহ এসে জয়নালের বৌকে বলল, চা কাপে ঢেলে রেখে এসেছি, সাগীর ভাইকে দিয়ে এস। আর শোন, তুমি রান্না চাপিও না। মাগরিবের নামায পড়ে আমি চাপাব।
সমীরণ বিবি বুঝতে পারলেন, চা যাকিয়াহ বানিয়েছে। প্রসঙ্গটা না তুলে জয়নালের বৌকে বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সাগীরকে চা দিবি না? জয়নালের বৌ চলে যেতে যাকিয়াহকে বললেন, তোমার হাতের চা খেয়ে বুঝতে পারছি, রান্নার হাতও ভালো। জয়নালের বৌ-এর হাতের রান্না মোটেই ভালো না। কিন্তু কি করব মা, না খেয়ে উপায় নেই। তোমার হাতের চা খেয়ে রাতের। খাবার খেতে খুব ইচ্ছা করছে। তুমি মেহম ন বলে তোমাকে কষ্ট দিতেও বিবেকে বাধছে।
যাকিয়াহ বলল, না না, আমার রান্না করা অভ্যাস আছে। এতটুকু কষ্ট হবে না। যে ক’দিন থাকব আমিই রান্না করব।
যাকিয়াহকে যত দেখছেন, যত জানছেন সমীরণ বিবি তত মুগ্ধ হচ্ছেন। বললেন, আল্লাহ তোমাকে যেমন রূপসী করেছেন, তেমনি গুণবতীও করেছেন। কি জান মা, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দা-বান্দিদের বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন। দোয়া করি, তিনি যেন তোমাকে তাড়াতাড়ি সব রকমের বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
রাতে খাওয়ার সময় সমীরণ বিবি আর এক দফা যাকিয়াহকে দোয়া করলেন। তারপর জয়নালের বৌকে বললেন, বুড়ি হয়ে গেলি, তবু ভালো রান্না করতে শিখলি না। মেয়েটা যে কদিন থাকে, ওর কাছে রান্না করা শিখেনে। এতদিন তোর হাতের রান্না খেয়ে পেটে হদ পড়ে গেছে।
তাদের সঙ্গে সাগীর ও খাচ্ছিল। সমীরণ বিবি থেমে যেতে বলল, আপনি। ঠিক কথা বলেছেন ফুফু। জয়নালের বৌ-এর রান্না যেন গলা থেকে নামতে চায় না। এখানে আসার আগে সেই কবে মায়ের হাতে রান্না পেট পুরে যা খেয়েছিলাম। তারপর আজ পেট পুরে খেলাম। ঢাকার মেয়েরা এত ভালো রান্না করে জানতাম না।
সমীরণ বিবি বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, তোকে অত দালালী করতে হবে না, চুপ চাপ খেয়ে উঠে শুতে যা। কাল এক ব্যাপারী আসবে সুপারী কিনতে, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবি।
খাওয়া শেষ হতে যাকিয়াহ ইশতিয়াককে বলল, তুমি বড়মার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প কর, জয়নালের মাকে নিয়ে আমি ওনার ঘরটা গুছিয়ে দিই।
আধা ঘন্টা পরে ফিরে এসে জয়নালের বৌকে বলল, ঝুটো সব কিছু ধুয়ে গুছিয়ে রাখ, আমি বড়মাকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।
ঘরে এস সমীরণ বিবি অবাক হয়ে বললেন, তোমার হাতে কি যাদু আছে? এত অল্প সময়ের মধ্যে ঘরের সবকিছু পরিস্কার করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে ফেলেছ? তুমি যে বাড়ির বৌ হবে, তারা ধন্য হয়ে যাবে।
যাকিয়াহ লজ্জা পেয়ে বলল, কি যে বলেন বড়মা, মেয়েরা ইচ্ছা করলে সবকিছু করতে পারে। তারপর জিজ্ঞেস করল, জয়নালের বৌ ঘুমায় কোথায়?
তোমার চাচা যখন ছিলেন তখন অন্যরুমে ঘুমাতো। এখন এই ঘরের মেঝেয় ঘুমায়। এবার ঘুমাতে যাও। কাল থেকে তোমার উপর অনেক ধকল গেছে, এখানে আসার পর থেকে অনেক খাটাখাটনি করেছ।
যাকিয়াহ ঘর পরিস্কার করার সময় বুক সেলফ অনেক বই দেখে একটা গল্পের বই বের করে টেবিলের উপর রেখেছিল। সেটা নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, পড়া হয়ে গেলে জায়গামতো রেখে দেব।
রুমে এসে ক্লান্তি বোধ করে যাকিয়াহ ঘুমাতে গেল। শরীর ক্লান্ত থাকলেও চোখে ঘুম এল না। চোখ বন্ধ করতে নানির কথা মনে পড়ল, জাহাঙ্গীরের মা থানায় কেস করল কিনা, মামারাই বা কি করছে? এইসব চিন্তা করতে করতে রাত কত হল খেয়াল নেই। ডিম লাইট জ্বেলে ঘুমিয়েছিল। ঘুম না আসতে উঠে বড় লাইট জ্বেলে গল্পের বইটা পড়তে লাগল। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে আবার শব্দ হচ্ছে শুনে ভাবল, নিশ্চয় ইশতিয়াক। দরজা খুলে সাগীরকে দেখে কড়াস্বরে বলল, এত রাতে এসেছেন কেন?
সাগীর দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, আপনার কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি না জানতে এলাম।
না, কোনো অসুবিধে হয়নি বলে যাকিয়াহ দরজা ভিড়িয়ে দিতে গেল।
সাগীর হাত দিয়ে ঠেলে রেখে বলল, আপনি শহরের মেয়ে। মনে হল। এখানে ভয়ে ঘুমাতে পারছেন না, তাই সাহস দিতে এলাম।
যাকিয়াহ খুব রেখে উঠে বলল, চলে যান বলছি, নচেৎ চিৎকার করব।
সাগীর লোভাতুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, রাগ করছেন কেন? কেয়ারটেকার হিসাবে সবাইয়ের সুবিধে অসুবিধের দিকে লক্ষ্য রাখা আমার কর্তব্য। বিশেষ করে আপনি এখন এ বাড়ির মেহমান, আপনার দিকে আরও বেশি লক্ষ্য রাখতে হবে।
রাগ সামলে নিয়ে যাকিয়াহ নরমস্বরে বলল, ঠিক আছে, আপনি এখন যান। আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।
তা হলে আসি। যতদিন থাকবেন, এ সময়ে এসে খোঁজ নেব।
না, আসবেন না। কোনো অসুবিধা হলে আমিই আপনাকে জানাব।
সাগীর আবার দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, কথাটা শুনে খুশি হলাম। যাওয়ার আগে দু’একটা কথা বলে যাই, ইশতিয়াক খুব খারাপ ছেলে। তাকে এতটুকু প্রশ্রয় দেবেন না। এখানে অনেক মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলে তাদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে ঢাকায় পালিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য সেসব মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। এসব কথা আবার তাকে জিজ্ঞেস করবেন না যেন। আর একটা কথা, আমাকে হেলাফেলা ভাববেন না। এখানকার সবাই আমাকে ভয় পায়। কাল আবার দেখা হবে বলে চলে গেল।
দরজা লাগিয়ে খিল এটে যাকিয়াহ ঘুমাবার সময় চিন্তা করল, সুযোগ পেলেই সাগীর তার উপর হামলা করবে। তারপর হেসে উঠে বিড় বিড় করে বলল, হামলা করলে এমন শিক্ষা দেব, জীবনে আর কোনো মেয়ের দিকে নজর দিতে যেন না পারে।
সুবে সাদেকের সময় কাছাকাছি কোনো বাড়ির মোরগের ককরের …. কক ডাকে যাকিয়াহর ঘুম ভেঙে গেল। তখন তার মনে পড়ল, ছোটবেলায় কুষ্টিয়ায় নানির বাড়িতে মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙ যেত। নানির কাছে শুনেছে, মোরগরা নাকি ঐ সময়ে আজান দেয় মানুষের ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য, যাতে তারা ফজরের নামায পড়ে। এমন সময় মসজিদের মাইকে আজান শুনতে পেল। আজান শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ গতকালের ঘটনা চিন্তা করল, ইশতিয়াক যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিত, তা হলে বাস স্টশান্ডের লোকগুলো তাকে নিয়ে সারারাত কি করত ভেবে শিউরে উঠল। বিত্তবান বাবা থেকেও নেই। জ্ঞান হওয়ার পর নানির কাছে শুনেছে,মা বাবার উপর অভিমান করে এক কাপড়ে যখন চলে সেছিল, সে তখন মায়ের পেটে।
তার পরের ঘটনা শুনে বাবার প্রতি যাকিয়াহর প্রচন্ড ঘৃণা হল। হঠাৎ বড় মামার কথা মনে পড়তে শিউরে উঠল। যদি বড় মামার কথা সত্য হয়, তা হলে সে তো জারজ সন্তান। সঙ্গে সঙ্গে নানির প্রতিবাদের কথাও মনে পড়ল, “তোরা সব কিছু জেনেও মায়ের পেঠের বোনের উপর কলঙ্ক চাপাচ্ছিস?” আবার ইশতিয়াকের কথা মনে পড়ল, সে তাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু যখন জানবে আমি জারজ তখন কি করবে? নিশ্চয় ঘৃণা করে দুরে সরে যাবে। ভাবল, কথাটা তাকে জানিয়ে দেখবে সে কি করে।
পাশের রুমটাই ইশতিয়াকের। দরজা খোলার শব্দ শুনে যাকিয়াহ বুঝতে পারল, সে নামায পড়তে মসজিদে যাবে। এমন সময় দরজার কড়া নাড়ার শব্দের সাথে তার গলা শুনতে পেল, যাকিয়াহ উঠে পড়, নামাযের সময় হয়ে গেছে।
যাকিয়াহ কিছু না বলে চুপ করে রইল। তারপর যখন বুঝতে পারল সে চলে গেছে তখন বাথরুমের কাজ সেরে কলতলা থেকে অজু করে এসে নামায পড়ল। তারপর প্রতিদিনের মতো দু’পারা মুখস্থ কুরআন পড়ল।
ততক্ষণে জয়নালের বৌ উঠে পড়েছে। যাকিয়াহ তাকে বলল, ঘর দুয়ার ঝাড় দিয়ে রান্না ঘরে যাও, আমি আসছি। তারপর বড়মা’র ঘরে ঢুকল।
সমীরণ বিবি তখনও ঘুমাচ্ছিলেন। যাকিয়াহ জাগিয়ে বলল, বড়মা, একটা কথা বলব, রাগ করবেন না বলুন।
সমীরণ বিবি কাল যাকিয়াহর বিধ্বস্ত চেহারা দেখলেও রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আজ তার স্বাভাবিক চেহারা দেখে আরও মুগ্ধ হলেন। বললেন, না। মা রাগ করব না, কি বলতে চাও বল।
আপনি নিশ্চয় জানেন, আল্লাহ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য নামাযকে ফরয করেছেন। কাল থেকে আপনাকে নামায পড়তে দেখি নি।
হ্যাঁ মা, তুমি ঠিক কথা বলেছ। আগে ঠিকমতো নামায পড়তাম, এই অবস্থা হওয়ার পর আর পড়তে পারি নি। তুমিই বল, এই অবস্থায় কি নামায পড়া সম্ভব?
হ্যাঁ, সম্ভব। মেয়েদের নির্দিষ্ট কয়েকদিন প্রাকৃতিক কারণ ছাড়া কোনো অবস্থাতেই নামায ত্যাগ করা চলবে না। এমন কি নাবালক ছেলেমেয়েদেরকে নামায পড়ার অভ্যস গড়ে তুলবে মা বাবা। হাদিসে আছে আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন “সন্তানের সাত বৎসর বয়সে নামায পড়িতে বলিবে এবং দশ বৎসর বয়সে নামাযের জন্য প্রয়োজনে বেত্রাঘাত করিবে এবং বিছানা পৃথক করিবে।” [মুসনাদে আহমদ] শুধু নামায নয়, পাগল ছাড়া প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীকে ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চলতেই হবে। আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আর আমি কাহাকেও তাহার সাধ্যের অতীত কাজ করিতে বলি না।” [সুরা–মমিনুন,পারা ১৮, আয়াতের ৬২ প্রথম অংশ]
সে কথা আমিও জানি, তাই নামায পড়তে পারিনি বলে নিজের কাছে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু কি করব মা, আমি জমিনে সিজদা দিতে পারি না। তা ছাড়া অযু করব কি করে?
কেন, জয়নালের বৌ অযু করিয়ে দেবে। আর জমিনে সিজদা দিতে না পারলে রুকু করার সময় যতটা ঝুঁকবেন, সিজদা করার সময় তার চেয়ে আরও একটু বেশি ঝুঁকে সিজদার তসবি পড়বেন।
জয়নালের বৌকে তো কখনও নামায পড়তে দেখিনি। অযু করতে ও নামায পড়তে জানে কি না তাও জানি না।
না জানলে আমি তাকে শিখিয়ে দেব। সে যাতে ঠিকমতো নামায পড়ে সে কথাও বলব। দাঁড়ান, এক্ষুনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করছি।
.
নাস্তা খাওয়ার সময় সমীরণ বিবি ইশতিয়াককে বললেন, তুই একটু বাজারে যা। ঢাকার মেয়ে নিয়ে এসেছিস, কাল থেকে কি খাচ্ছে না খাচ্ছে, ভালো বাজার করে নিয়ে আয়।
ইশতিয়াক বলল, ঢাকায় ফোন করার জন্যে চিরিঙ্গা যাব। সেই সাথে বাজার করে নিয়ে আসব।
যাকিয়াহ সেখানে ছিল না, চা নিয়ে আসতে রান্না ঘরে গিয়েছিল। তিন কাপ চা নিয়ে ফিরে এসে ইশতিয়াক বাজারে যাবে শুনে বলল, অনেক কিছু নেই। আমি একটা লিস্ট দেব, সেগুলোও নিয়ে আসবে।
চা খেয়ে ইশতিয়াক রুমে এসে কাপড় চেঞ্জ করছিল। যাকিয়াহ এসে লিস্টটা তার হাতে দিল।
ইশতিয়াক জিজ্ঞেস করল, রাতে ঘুমাতে পেরেছিলে?
কেন পারব না? তবে একজন একটু ডিস্টার্ব করেছিল
ইশতিয়াক হেসে ফেলে বলল, কে আবার ডিস্টার্ব করল? আমি তো এক ঘুমে ফজর।
তুমি ছাড়া আর কেউ নেই বুঝি?
ইশতিয়াক ভাবল, তা হলে কি সাগীর?
কি ভাবছ? আর কে হতে পারে ধরতে পার নি?
নিশ্চয় সাগীর? দাঁড়াও বড়মাকে বলে ওকে মজা দেখাচ্ছি বলে ইশতিয়াক যেতে উদ্দ্যত হলে যাকিয়াহ তার একটা হাত খপ করে ধরে বলল, একি পাগলামী করছ? ও তেমন কিছু করেনি। যদি তেমন কিছু করার চেষ্টা করে তখন যা করার আমিই করব। বড়মাকে কিছু জানাবার দরকার নেই।
কি বলছ তুমি? ও যদি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, পারবে সামলাতে?
ইনশাআল্লাহ পারব। ওকে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। নিজেকে রক্ষা করার কৌশল আমার জানা আছে। জাহাঙ্গীরের মতো ছেলের কাছ থেকে যখন নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি তখন সাগীরের কাছ থেকেও পারব।
মনে হচ্ছে কুংফু বা ক্যারাটের প্রশিক্ষণ নিয়েছ?
হ্যাঁ, নিয়েছি। ব্যাপারটা আগেই বোঝা উচিত ছিল তোমার। যাক, এখন নিশ্চিত হয়ে বাজারে যাওতো।
চিরিঙ্গায় এসে ইশতিয়াক প্রথমে ঢাকায় আকবর হোসেনকে ফোন করল।
আকবর হোসেন ফোন ধরে বললেন, কে বলছেন?
ইশতিয়াক সালাম বিনিময় করে নাম বলল।
কোথায় থেকে ফোন করেছেন? যাকিয়াহর খোঁজ পেয়েছেন?
আমি চিরিঙ্গি থেকে বলছি। যাকিয়াহকে এখানে নিয়ে এসেছি। আমাদের বাড়িতে আছে। ওর নানিকে সেকথা জানিয়ে চিন্তা করতে মানা করবেন। মামাদেরকে কিছু জানাবেন না। ওখানকার খবর বলুন।
খবর ভালো। হাসপাতালে জাহাঙ্গীরের জ্ঞান ফিরেছে। শুনলাম, ওর মা। নাকি থানায় কেস করেছে। মনে হয়, কেস করলেও তেমন সুবিধে করতে পারবে না। আমি থানায় ওসির সঙ্গে কথা বলেছি। উনি বললেন, “যাকিয়াহ যা করেছে, নিজের ইজ্জত রক্ষার জন্য করেছে। মামলা করলেও যাকিয়াহর কিছু হবে না।” মামলায় হয়তো আপনাকেও জড়াতে পারে। সেজন্য কোনো দুশ্চিন্ত করবেন না। আমি ও মেসের সবাই জানি ঘটনার পর আপনি মেসে ফিরেছেন। তারপর ওদের বাসায় গেছেন। তা ছাড়া প্রতিবেশীরাও জানে ঘটনার পর ওদের বাসায় গেছেন। দু’ একদিনের মধ্যে ঢাকায় আসুন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবেন, যাকিয়াকে খুঁজতে গিয়েছিলেন, না পেয়ে ফিরে এসেছেন। থানার ওসিকে আমি বলেছি, আপনি ওকে খুঁজতে গেছেন।
যাকিয়াহর নানি কি এখনও ঐ বাসায় আছেন।
হ্যাঁ, আছেন।
ঠিক আছে, কাল পরশু আসছি বলে সালাম বিনিময় করে ইশতিয়াক লাইন কেটে দিল। তারপর বাজার করে বাড়িতে ফিরল।
সমীরণ বিবি বাজারের বহর দেখে বললেন, অনেক টাকার বাজার করেছিস। দেখছি। টাকা না নিয়ে চলে গেলি যে? টাকাটা ধর বলে পাচঁশ টাকার একটা নোট দিতে গেলেন।
ইশতিয়াক বলল, টাকা দিচ্ছেন কেন?
বেশি কথা বলবি না তো, নে বলছি। কখন কি দরকার পড়ে বলা যায়? চাকরি করলে আলাদা কথা ছিল। ছেলেমেয়ে পড়িয়ে কত আর পাস? তারপর নিজেই তার হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ঢাকায় ফোন করেছিলি?
হ্যাঁ, করেছি। ওখানকার খবর ভালো।
যাকিয়াহ রান্না ঘরে ছিল। ইশতিয়াক ফিরেছে বুঝতে পেরে একটু আগে এসেছে। ঢাকায় ফোন করার কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, কার কাছে ফোন করেছিলে?
আকবর হোসেনের কাছে। তারপর ওনার সঙ্গে যা কিছু কথা হয়েছে বলল।
যাকিয়াহর আরও কিছু কথা জানার ইচ্ছে হলেও চুপ করে রইল।
সমীরণ বিবি জিজ্ঞেস করলেন, কবে যাবি?
ভাবছি কাল যাব।
আকবর হোসেন কে?
ওনার বিল্ডিং-এ ভাড়া থাকি।
উনি ভালো লোক?
ওনার মতো ভালো লোক বর্তমান যুগে আছে কি না জানি না। আমাকে ছেলের মতো দেখেন।
ওনার ছেলেমেয়ে নেই?
উনি এখনও বিয়ে করেন নি।
সমীরণ বিবি এবার যাকিয়াহকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আকবর হোসেনকে। চেন?
জি, চিনি। ইশতিয়াক ভাই ঠিকই বলেছে। ওনার মতো লোক হয় না। আমার চার মামা ফেমিলী নিয়ে ঢাকাতে অন্য জায়গায় ভাড়া বাসায় থাকেন। আকবর হোসেন আমাদের একজন গার্জেনের মতো।
সমীরণ বিবি ইশতিয়াককে বললেন, কয়েকদিন পরে না হয় যাবি। বলাতো যায় না পুলিশ যদি এ্যারেষ্ট করে?
ইশতিয়াক বলল, শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, পুলিশ এ্যারেষ্ট করবে কেন? কিছু হলে আকবর হোসেন আমাকে যেতে বলতেন না।
দেখ, যা ভালো বুঝিস কর, আমি আর নিষেধ করব না।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে যাকিয়াহ ইশতিয়াকের রুমে এসে বলল, বড়মার কথামতো কয়েকদিন পরে গেলে হয় না? আমারও কেন জানি মন সায় দিচ্ছে না। এমনই আমার জন্য যা করছ, সে ঋণ শোধ করতে পারব কি না জানি না। সব সময় নিজেকে অপরাধী মনে হয়। তারপর ঢাকায় গেলে যদি সত্যি সত্যি পুলিশ তোমাকে এ্যারেষ্ট করে, তা হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।
ইশতিয়াক হেসে উঠে বলল, আমি এমন কিছু মূল্যবান নই যে, আমার কিছু হলে তুমি অপরাধী হবে। শোন, আমি ফজরের নামায পড়েই রওয়ানা হব। ফিরতে হয়তো কয়েকদিন দেরি হতে পারে। সাগীরের কাছ থেকে সাবধান থেকো। আমি চাই না, জাহাঙ্গীরের মতো ঘটনা এখানেও ঘটুক।
যাকিয়াহ কপট রাগ দেখিয়ে বলল, সাগীর যদি জাহাঙ্গীরের মতো হামলা করে, তা হলেও কি চুপ করে থাকব?
ইশতিয়াক আবার হেসে উঠে বলল, আমি তা বলি নি। বলেছি, সাগীর হামলা করার সুযোগ যেন না পায়, সে ব্যাপারে এলার্ট থাকতে।
ঠিক আছে, তাই হবে। তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবে। দেরি করলে খুব দুশ্চিন্তা হবে। তুমি থাকবে না ভাবতে কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।
ওটা সাময়িক। বড়মা রয়েছেন, তিনি নিশ্চয় তোমার দিকে লক্ষ্য রাখবেন। আর তুমি তো দু দিনেই ওনাকে যাদু করে ফেলছ। আমার কাছে সব সময় তোমার গুণাগুন করেন।
সত্যিই, বড়মার জন্য খুব দুঃখ হয়। কি এমন বয়স? এই বয়সেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। কি করে এরকম হলেন জানতে খুব ইচ্ছে করে।
ইচ্ছে করলে বড়মার কাছেই জেনে নিও।
কেন, তুমি জান না?
জানি, তবে বলতে পারব না।
এমন সময় জয়নালের বৌ দরজার বাইরে থেকে বলল, আপাকে বড়মা ডাকতেছেন।
যাকিয়াহ আসি বলে সালাম বিনিময় করে ইশতিয়াকের রুম থেকে চলে গেল।
.
পরের দিন ইশতিয়াক ঢাকায় যাওয়ার কথা বললেও দুদিন পর ভোরে রওয়ানা দিল। ঢাকায় পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। আসরের নামায পড়ে আকবর হোসেনের কাছে গিয়ে সালামও কুশল বিনিময় করল।
আকবর হোসেন তাকে বসতে বলে বললেন, এখানকার পরিস্থিতির কথা তোমাকে ফোনে যা বলেছি তার বেশি কিছু বলার নেই। শুনলাম, জাহাঙ্গীরের মা থানা থেকে কেস তুলে নিয়েছেন। আর একটা দারুণ খবর আছে। সেটা বলার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, আপনি কি যাকিয়াহর বাবার পরিচয় জানেন?
ইশতিয়াক বলল, না।
তা হলে বলছি শোনেন, ঢাকার বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফার একমাত্র সন্তান যাকিয়াহ।
ইশতিয়াক খুব অবাক হয়ে বলল, কি বলেছেন আপনি?
যা সত্য তাই বললাম। তবে এত বড় ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র সন্তান হয়েও কেন নানির কাছে মানুষ হল, কেন মামাদের সাহায্যে লেখাপড়া করল, তা জানি না।
আপনি একথা আগে জানতেন?
না। গতকাল বিকেলে একজন উকিল এসেছিলেন যাকিয়াহর খোঁজে তার নানির কাছে। যাকিয়াহকে না পেয়ে ঠিকানা দিয়ে বলে গেছেন, যাকিয়াহ ফিরলে যেন ওনার সঙ্গে দেখা করে। আরও বলেছেন যাকিয়াহর বাবা গোলাম মোস্তফা মারা যাওয়া আগে ওনার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি মেয়ের নামে উইল করে দিয়েছেন। আজ সকালে ছেলেরা এসে মাকে নিয়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে যাকিয়াহর নানি আমার কাছে এসে উকিলের কথাগুলো বলে তার ঠিকানা লেখা কাগজটা দিয়ে বললেন, ছোটবেলা থেকে যাকিয়াহকে আপনি মেয়ের মতো দেখে আসছেন। ভবিষ্যতে সে যেন সুখী হয়, সে ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে। আশা করি, আমার এই অনুরোধ রাখবেন। আল্লাহ আপনার ভালো করবেন। তারপর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, যাকিয়াহর খোঁজ পেলে আমাকে জানাবেন।
আমি তখন যাকিয়াহ কোথায় কার কাছে আছে বলে বললাম, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, ওর জন্য যা কিছু করার করব।
আকবর হোসেন থেমে যেতে ইশতিয়াক বলল, একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না, যাকিয়াহ একমাত্র সন্তান সত্ত্বেও গোলাম মোস্তফা সাহেব এতদিন কোনো খোঁজ খবর রাখেন নি কেন? আর মৃত্যুর আগে কেনই বা সবকিছু মেয়ের নামে উইল করে দিলেন?
এসব বড় লোকদের ব্যাপার, আমাদের মতো লোকের বোঝা কঠিন। তবে আমার মনে হয় যাকিয়াহর নানি হয়তো জানেন।
আচ্ছা, যাকিয়াহ কি তার বাবার পরিচয় জানে?
তাও জানি না, হয়তো জানতে পারবে। আপনি যাকিয়াহকে বা তার নানির কাছ থেকে পরে জেনে নিতে পারবেন। এখন যা বলছি শুনুন, তারপর ঠিকানা লেখা কাগজটা তার হাতে দিয়ে বললেন, কাল সকালে উকিল সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। উনি কি বলেন না বলেন ফিরে এসে আমাকে জানাবেন।
ইশতিয়াক বলল, ঠিক আছে, এখন আসি তা হলে?
আর একটু বসুন, দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করব। অবশ্য কথাগুলো আপনার ব্যক্তিগত, বলা না বলা আপনার ইচ্ছা।
আপনি নিশ্চিন্তে জিজ্ঞেস করুন।
যাকিয়াহকে কি আপনি ভালবাসেন?
জি।
তাকে কি বিয়ে করতে চান?
চাই, তবে ওর সম্পূর্ণ সম্মতিতে।
ওকি আপনার মনের কথা জানে?
জানে।
ওর মনের কথা আপনি জানেন না অথবা বঝুতে পারেন নি?
আমার মনের কথা জানতে পেরে আগে অসংখ্যবার অপমান করেছে। ইদানিং এই ঘটনার পর ক্ষমা চেয়েছে। তাতেই বুঝেছি, সেও আমাকে ভালবাসতে শুরু করেছে। তবে সিওর না। হয়তো উপকারীর প্রতি এটা তার কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। তবে বাবার সম্পত্তির মালিক হয়েছে জেনে কি করবে। জানি না।
আর কিছু জানার নেই এবার আপনি আসুন।
পরের দিন বেলা ন’টার সময় ইশতিয়াক উকিল সাহেবের বাসায় গেল। উকিল সাহেব তখন চেম্বারে দু’জন মক্কেলের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাকে দেখে হাত ইশারা করে বসতে বললেন। প্রায় আধাঘন্টা পর মক্কেল দু’জনকে বিদায় করে ইশতিয়াককে বললেন, কেন এসেছেন বলুন।
ইশতিয়াক বলল, আপনি আকবর হোসেনকে চেনেন?
উকিল সাহেব কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে চিন্তা করে বললেন, ঐ নামে তো কয়েকজনকে চিনি। আপনি কোন আকবর হোসেনের কথা বলছেন?
আপনি বিখ্যাত ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফার মেয়ে যাকিয়াহর খোঁজে যে বাসায় গিয়েছিলেন, ঠিক তার উল্টো দিকের বাড়িটা আকবর হোসেনের। ধরতে গেলে উনি একরকম যাকিয়াহর গার্জেন। আপনি ওকে খুঁজছেন জেনে উনি আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আপনাকে পাঠিয়েছেন কেন?
যাকিয়াহ কোথায় আছে আমি জানি। তাই…
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে উকিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে?
আমি ইশতিয়াক। আকবর হোসেনের বাড়ির দোতালার একটা রুমে ভাড়া থাকি।
যাকিয়াহ কোথায় আছে?
চকরিয়ায় আমাদের বাড়িতে।
সেতো কক্সবাজারের কাছে, ওখানে গেলেন কি করে?
আমি নিয়ে গেছি।
কেন?
সে সব জানতে হলে আকবর হোসেনের সঙ্গে আপনাকে কথা বলতে হবে। ঠিক আছে, আজ বারটার সময় একটা কেসের ব্যাপারে হিয়ারিং হবে। আপনি গিয়ে আকবর হোসেনকে বলবেন, আমি পাচঁটার দিকে আসব।
ইশতিয়াক সালাম বিনিমিয় করে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল।
.
হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর জাহাঙ্গীরের মনের পরিবর্তন হয়। মায়ের কাছে কোনো অন্যায় করবে না বলে ওয়াদা করার পর যাকিয়াহর ইজ্জত লুণ্ঠন করতে গিয়ে যে অন্যায় করেছে, তার শাস্তি আল্লাহ তাকে দিয়েছেন বলে তার মনে হয়েছে। তাই মাকে ছলছল চোখে তার মুখের উপর ঝুঁকে থাকতে দেখে তার চোখেও পানি এসে গেল। মায়ের দুটো হাত ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল, আমার মতো পাপী ছেলের জন্য কাঁদছ কেন? যাকিয়াহ আল্লাহর খাস বান্দি। তাই আল্লাহ তার ইজ্জত রক্ষার জন্য ও তোমার কথা অমান্য করার জন্য আমাকে শাস্তি দিলেন। এটা আমার কর্মের ফল। আল্লাহ আমাকে সুস্থ করার পর যাকিয়াহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। তুমি দোয়া কর মা, “আল্লাহ যেন সে সুযোগ আমাকে দেন।”
তামান্না বেগম নিজের চোখ মুছে ছেলের চোখও মুছে দিয়ে বললেন, তুই ঠিক কথা বলেছিস। যাকিয়াহ খুব ভালো মেয়ে। সেদিন তার সম্পকে খারাপ যা কিছু বলেছিলাম তা মিথ্যে। তোর মন যাতে ওর উপর চটে যায় সেজন্যে বলেছিলাম। মিথ্যে বলে আমিও অন্যায় করেছি। তুই সুস্থ হয়ে গেলে তোর সঙ্গে আমিও যাব ক্ষমা চাওয়ার জন্য। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, শুনলাম যাকিয়াহ ঐ রাতেই কোথায় চলে গেছে, আজও তার খোঁজ পাওয়া যাইনি।
এমন সময় ডাক্তার এসে তামান্না বেগমকে চলে যেতে বলে জাহাঙ্গীরকে। ইঞ্জেকসান দিলেন।
চার পাঁচ দিন পর তামান্না বেগম আজ বেলা এগারটার সময় ছেলেকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। ডাক্তাররা আরও কয়েকদিন রাখার জন্য বলেছিলেন, তিনি রাজি হন নি। নিজের অসুবিধার কথা বলে বন্ড সই করে নিয়ে এসেছেন।
ইশতিয়াক যখন উকিল সাহেবের বাসা থেকে ফিরছিল তখন জাহাঙ্গীর বারান্দায় বসে ছিল। তাকে দেখতে পেয়ে ডাক দিল, ইশতিয়াক ভাই, এদিকে একটু আসবেন, আপনার সঙ্গে কথা আছে।
জাহাঙ্গীরকে অহংকারী ও বাজে ছেলে হিসাবে জানে ইশতিয়াক। দেখা হলে কথাই বলে না। আজ তার মিনতিভরা কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হলেও থমকে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকাল।
জাহাঙ্গীর বলল, গেট দিয়ে ঢুকে সোজা উপরে চলে আসুন।
ইশতিয়াক চিন্তা করল, নিশ্চয় যাকিয়াহর কথা জিজ্ঞেস করবে। যাবে কি যাবে না ভাবতে লাগল।
কি হল ইশতিয়াক ভাই, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
ইশতিয়াক উপরে উঠে এসে সালাম দিয়ে বলল, এখন কেমন আছেন?
জাহাঙ্গীর সালামের উত্তর দিয়ে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে বলল, ভালো আছি, আজই হাসপাতাল থেকে এসেছি।
কেন ডাকলেন বলুন?
শুনলাম যাকিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি তো ওদের বাসায় প্রায় যান, ওদের অনেক উপকারও করেন। যাকিয়াহকে খোঁজেন না কেন?
ইশতিয়াক সত্য কথাটা বলবে কি না চিন্তা করতে লাগল?
জাহাঙ্গীর বলল, আপনি কি ভাবছেন জানি না, আমার সম্পর্কে হয়তো আপনি অনেক কিছু জানেন। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, যাকিয়াহ আমার অন্তরের কলুষতা দূর করে দিয়ে আলোর পথ দেখিয়েছে। তাই তার কাছে যে অন্যায় করেছি, ক্ষমা না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাব না। আপনার কাছে অনুরোধ, ওকে আপনি খুঁজে বের করে নিয়ে আসবেন। আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইব।
ইশতিয়াক জাহাঙ্গীরের পরিবর্তন দেখে খুব অবাক হল। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আপনার অনুরোধ রাখার চেষ্টা করব। এবার আসি তা হলে?
আরও কিছুক্ষণ বসুন, চা খেয়ে যাবেন। মা বাসায় নেই, এক্ষুনি এসে পড়বে।
আমার একটু তাড়া আছে, অন্য একদিন আসব। তারপর আসি বলে ইশতিয়াক সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে চলে এল। মেসে এসে আকবর হোসেনকে উকিলের কথা জালাল।
বিকেলে আসরের নামায পড়ে মসজিদ থেকে মেসের কাছে এসেছে এমন সময় উকিল সাহেবের গাড়ি দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ি থেকে নামতে ইশতিয়াক সালাম বিনিময় করে বলল, আসুন, আকবর হোসেন তিন তলায় থাকেন।
আলাপ পরিচয়ের পর আকবর হোসেন বললেন, আমি যাকিয়াহর বাবা গোলাম মোস্তফার সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। যাকিয়াহর নানির মুখেই গতপরশু শুনেছি। আরও শুনেছি গোলাম মোস্তফা মারা যাওয়ার আগে ওনার সমস্ত সম্পত্তি যাকিয়াহর নামে উইল করে দিয়েছেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, যাকিয়াহকে কেন পাওয়া যাচ্ছে না, তার নানির কাছে নিশ্চয় শুনেছেন?
উকিল সাহেব বললেন, হ্যাঁ শুনেছি।
আকবর হোসেন ইশতিয়াককে দেখিয়া বললেন, চকরিয়ায় ওদের বাসায় আছে। আপনি ওর সঙ্গে সেখানে গেলে যাকিয়াহকে পাবেন।
আমার কয়েকটা কেসের প্রায় প্রতিদিনই হিয়ারিং চলছে, এখন আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। উনি যাকিয়াহকে ঢাকায় নিয়ে আসুক।
কিন্তু যাকিয়াহ এসে থাকবে কোথায়? ওর মামারা এখাকার বাড়ি বিক্রি করে মাকে নিয়ে চলে গেছে।
তাতে কি হয়েছে? যাকিয়াহর বাবার প্রাসাদসম বাড়ি। এখন ঐতো বাড়ির মালিক। ওখানে থাকবেন।
ও হ্যাঁ তাইতো। কথাটা আমার খেয়ালই হয়নি। ঠিক আছে, ইশতিয়াকই ওকে নিয়ে আসবেন।
তা হলে এখন আসি। তারপর ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওকে নিয়ে এসে সরাসরি আমার বাসায় উঠবেন। কথা শেষ করে উকিল সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন।
আকবর হোসেন বললেন, প্লীজ, আর একটু বসুন। তারপর আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিলেন।
৬
ইশতিয়াক ঢাকায় যাওয়ার পরের দিন দুপুরে খাওয়ার পর যাকিয়াহ বিশ্রাম নেয়ার সময় ভাবতে লাগল, ঢাকায় পৌঁছানোর পর ইশতিয়াককে যদি পুলিশ এ্যারেষ্ট করে, তা হলে তার কি করা উচিত?
দুপুর থেকে লোড শেডিং। আকাশে মেঘ থাকলেও বৃষ্টি হচ্ছে না। তাই খুব গুমোট। হাত পাখার বাতাসও গরম। এই গরমে ঘুম আসবে না ভেবে যাকিয়াহ পুকুর ঘাটে এল। সান বাধান ঘাট, তবে বহু আগের। নোনা লেগে বেশিরভাগ ইট বেরিয়ে পড়েছে। ঘাটের উপরে বসার জন্য দু’পাশে দুটো পাকা রক। রকের অবস্থাও একই রকম। ফুঁ দিয়ে ধুলা বালি ঝেড়ে বসল। পুকুরটা বড়, কিন্তু অধেক জলজ উদ্ভিদে ভর্তি। ভাবল, পুকুরটা পরিস্কার করে মাছের চাষ করার কথা বড়মাকে বলতে হবে। এমন সময় কারো লঘু পায়ের শব্দ পেয়ে। পিছন দিকে তাকাল।
সাগীর সুযোগের অপেক্ষায় ট্যাকে ট্যাকে ছিল। সে বৈঠক খানায় থাকে। যাকিয়াহকে ঘাটের দিকে যেতে দেখে তার পিছু নিয়েছে। তাকে এক মনে কিছু ভাবতে দেখে ভাবল, এটাই মোক্ষম সুযোগ। পিছন থেকে একবার জাপটে ধরে মুখ চেপে ধরলে রা করতে পারবে না। পা টিপে টিপে খুব ধীরে ধীরে পিছন দিক থেকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরার আগেই তাকে ঘাড় ঘোরাতে দেখেও জাপটে ধরতে গেল।
সাগীর যে এরকম কিছু করবে, যাকিয়াহ এখানে এসেই বঝুতে পেরেছিল। তবে এত তাড়াতাড়ি করবে ভাবতে পারেনি। তাকে জাপটে ধরার আগেই দাঁড়িয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দুই কনুই দিয়ে বুকে আঘাত করল। সেই সাথে তার থুতনিতে কষে একটা লাথি মারল।
সাগীরের মনে হল, ফুসফুস থেকে একসঙ্গে সব বাতাস বেরিয়ে গেছে। দু’টো পাঁজর বুঝি ভেঙ্গে গেছে। দু’তিনটি দাঁতও বুঝি ভেঙ্গে গেছে। ঠোঁঠ কেটে রক্ত পড়ছে। কনুইয়ের গুতো ও মুখে লাথি খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে হাঁপাতে লাগল। সে ভাবতেই পারেনি, যাকিয়াহর গায়ে এত শক্তি থাকতে পারে।
যাকিয়াহ পা পা করে এগিয়ে আসার সময় বলল, এই ওষুধেই কাজ হবে, না আরও লাগবে?
বুকের যন্ত্রনায় সাগীরের খুব কষ্ট হচ্ছিল। কথা বলার শক্তি নেই বললেই চলে। তবু দলা করে মুখের রক্ত ফেলে ভয়ার্ত স্বরে বলল, মাফ করে দেন আপা, নচেৎ আর কিছু করলে একেবারে মরেই যাব। তারপর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বসে বসে হাঁপাতে লাগল।
যাকিয়াহ ওড়না ছিঁড়ে পুকুর থেকে ভিজিয়ে এনে তার মুখের রক্ত পরিস্কার করতে করতে বলল, আপনাকে আমি বড় ভাইয়ের মতো মনে করি। সে জন্য শ্রদ্ধাও করি। মনে হয় আজ আপনার ঘাড়ে শয়তান চেপেছিল। তাই ঘাড় থেকে শয়তানকে নামাবার জন্য এরকম করতে হল। আশা করি, শয়তান আর কোনোদিন আপনার ধারে কাছে আসতে সাহস পাবে না। আপনার এরকম অবস্থা দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। ছোট বোন হিসাবে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
যাকিয়াহর দু’রকম চরিত্র দেখে সাগীর এত বেশি অবাক হল যে, যন্ত্রনার কথা ভুলে একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
যাকিয়াহ তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল, সুস্থবোধ করার পর চিরিঙ্গায় গিয়ে ডাক্তারের কাছে ঠোঠটা সেলাই করে নেবেন। আর ওষুধ যা যা দেবেন কিনে নিয়ে আসবেন। টাকা না থাকলে ইশতিয়াকের কিছু টাকা আমার কাছে আছে, নিতে পারেন। তারপর রক্তমাখা ওড়না ঘেঁড়াটা পুকুরে ফেলে দিয়ে চলে আসার সময় বলল, বড়মা জিজ্ঞেস করলে সত্য ঘটনা বলতে না পারলে যা মনে চায় বলবেন।
সাগির সেখানে অনেকক্ষণ যাকিয়াহর কথা চিন্তা করতে লাগল, সে অন্য সব মেয়েদের মতো নয়। শুনেছে ঢাকায় নাকি ছেলেদের মতো মেয়েদেরও মারামারি শেখার স্কুল আছে। যাকিয়াহ নিশ্চয় সেই স্কুলে মারামারি শিখেছে। তা না হলে আমার মতো ছেলেকে এভাবে আঘাত করতে পারত না। প্রতিশোধ নেয়ার কথা ভাবতেই তার মন বলে উঠল, খবরদার, ওকথা মন থেকে মুছে ফেল, নচেৎ যাকিয়াহর হাতে জানটাই হারাবি। দাঁত ও ঠোঠের যন্ত্রনায় চিন্তা ছিন্ন হয়ে গেল। বৈঠকখানায় এসে গায়ে জামা দিয়ে চিরিঙ্গা রওনা দিল।
ডাক্তার তার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এরকম হল কি করে?
সাগীর বলল, সুপারি পাড়তে গাছে উঠে ছিলাম। গাছটা ভেঙ্গে যেতে পড়ে গেছি, বুকেও খুব আঘাত পেয়েছি।
যাকিয়াহ আসরের নামায পড়ে সমীরণ বিবিকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে পুকুর ঘাটে নিয়ে এসে বলল, পুকুরটাকে এভাবে ফেলে রেখেছেন কেন? পরিস্কার করে মাছ চাষ করলে অনেক টাকা আয় হবে।
সমীরণ বিবি দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে রেখে বললেন, তা হবে; কিন্তু কে এসব করবে? আমার এরকম অবস্থা না হলে বলে থেমে গেলেন।
যাকিয়াহ বলল, কেন? সাগীর ভাই তো রয়েছে। তাকে দিয়ে করাবেন?
ওতো একটা ছাগল। বুদ্ধি-শুদ্ধি কিছু নেই, আছে শুধু চুরিচামারির তালে। ইশতিয়াককে কত করে বলি, তোর ঢাকায় যাওয়ার দরকার নেই। এখানে যা কিছু আছে, দেখাশোনা করলে আরও অনেক বাড়াতে পারবি। কেন যে ছেলেটা আমার কথা কানে তোলে না বঝুতে পারি না। তারপর যাকিয়াহর দুটো হাত ধরে মিনতিস্বরে বললেন, তোমাকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না বল?
যাকিয়াহ অনুমান করতে পারল, সমীরণ বিবি কি বলবেন। মনে মনে খুশি হয়ে বলল, জন্মের পরপর মাকে হারিয়েছি। মা কি জিনিস জানি না। এখানে এসে আপনাকে মায়ের মতো পেয়েছি। আমি কিছু মনে করব না, আপনি কি বলবেন বলুন।
তাই যদি হয়, তা হলে বলতে বাধা নেই। ইশতিয়াকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তোমাদেরকে এখানে রাখ দিতে চাই। আমার স্বামী নগদ টাকা ছাড়া অনেক সম্পত্তি রেখে গেছে। সাগীর আর কতটুকু দেখাশোনা করে? বারো ভূতে সব লুটপুটে খাচ্ছে।
যাকিয়াহ লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিল। তখন তার তনু মনুতে আনন্দের জোয়ার, তা ছাড়া সে আর ঢাকায় ফিরে যেতে চায় না।
তাকে মুখ নিচু করে চুপ করে থাকতে দেখে সমীরণ বিবি বললেন, তুমি শহরের লেখাপড়া জানা মেয়ে, হা-না কিছু একটা বল। তুমি না চাইলে জোর করব না।
ইশতিয়াক ভাইকে এ ব্যাপারে কিছু বলেছেন?
না, বলি নি, তোমার মতামত নিয়ে জানাতে চাই।
ও যদি অমত করে?
অমত করলে তাকেও জোর করব না। তবে কি জান মা, তোমাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ইশতিয়াকের বিয়ে দিয়ে তাকে আর ঢাকা যেতে দেব না। তোমাকে দেখে সেই ইচ্ছাটা খুব বেড়ে গেছে। কেবলই মনে হয় আল্লাহ সেই ইচ্ছা পূরণ করার জন্য তোমাকে পাঠিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, তুমি তাকে এখানে রাখতে পারবে।
ঠিক আছে, আপনি আগে ইশতিয়াক ভাইয়ের মতামত নেন, তারপর আমার মতামত জানাব।
যাকিয়াহ পুকুর ঘাটে আসার আগে জয়নালের বৌকে দু’জনের চা-নাস্তা নিয়ে আসতে বলেছিল।
সমীরণ বিবি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, জয়নালের বৌকে ট্রেতে করে চা-নাস্তা নিয়ে আসতে দেখে থেমে গেলেন। কাছে এলে বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, তুই আবার এসব করতে গেলি কেন? খেতে পারব না, নিয়ে যা।
জয়নালের বৌ বলার আগে যাকিয়াহ বলল, নামাযের আগে আমি করে রেখে ওকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। তারপর জয়নালের বৌকে বলল, তুমি গিয়ে রান্নার জোগাড় কর, মাগরিবের নামাযের পর রান্না চাপাব।
নাস্তা খেয়ে যখন তারা চা খাচ্ছিল তখন সাগীরকে বাজারের রাস্তা দিয়ে আসতে দেখে সমীরণ বিবি ডাক দিলেন, সাগীর এদিকে আয়।
সাগীর কাছে এসে এক পলক যাকিয়াহর দিকে তাকিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
সমীরণ বিবি তার মুখের ও ঠোঁটের অবস্থা দেখে আতঙ্কিতস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোর এই অবস্থা করল? ওমা, ঠোঁট সেলাই করতে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল বুঝি? নিশ্চয় কারো সঙ্গে মারামারি করেছিস?
সাগীর ডাক্তারের কাছে যা বলেছিল, সে কথাই বলল। তবে মিনমিনে গলায়।
সমীরণ বিবি গর্জে উঠলেন, ঠিক হয়েছে। চুরি করে সুপারি বেঁচতে গিয়েছিলি, তাই আল্লাহ তোকে শাস্তি দিয়েছেন। এবার যদি চুরি করার অভ্যাস ছাড়তে পারিস। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে?
সাগীর মাথা নেড়ে সায় দিল।
যা, ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাক। মনে হচ্ছে, রাতে ভাত খেতে পারবি না। জয়নালের বৌকে জাও করে দিতে বলব।
সাগীরের ঠোঁট ও গোটা মুখ ফুলে ঢোল হয়ে গেছে দেখে যাকিয়াহর মায়া হল। ভাবল, শাস্তিটা একটু বেশি দেয়া হয়ে গেছে। সাগীর চলে যাওয়ার পর বলল, বেচারা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কত কষ্ট পাচ্ছে, আপনি আবার বকাবকি করলেন।
সমীরণ বিবি বললেন, বকবোনাতো আদর করব? আজ প্রথম নয়, এর আগেও শুধু সুপারী নয়, আম, কাঁঠাল, লিচু, ডাব, নারকেল চুরি করে বেঁচতে গিয়ে গাছ থেকে কতবার পড়ে গেছে। তবে এবারের মতো এত বেশি আঘাত পাই নি। এই যে দুদিন আগে সুপারি বেচল, তাতেও চুরি করেছে। ও খদ্দেরের সঙ্গে বেশি দাম করে আমাকে কম দামের কথা বলে হিসেব দেয়। এক এক সময় মনে হয়, ওকে তাড়িয়ে দেব; কিন্তু কি করব মা, আমি যে নাচার। ওকে তাড়িয়ে দিলে যা পাচ্ছি তাও পাব না। পাড়ার লোকেরা সব চুরি করে নিয়ে যাবে।
রাতে খাওয়ার সময় সমীরণ বিবি জয়নালের বৌকে বললেন, সাগীরকে জাও করে খাইয়েছিস?
জয়নালের বৌ বলল, জাও নিয়ে গিয়েছিলাম।সাগীর ভাইয়ের খুব জ্বর, দু’ এক চামচ খেয়ে আর খেল না।
সমীরণ বিবি যাকিয়াহর দিকে তাকিয়ে বললেন, ছেলেটার জন্য মায়াও হয়। হাজার হোক দূর সম্পকে হলেও ভাইপো তো? ওষুধ ঠিকমতো খেয়েছে কি না কে জানে।
ঘুমাবার সময় যাকিয়াহর চোখে ঘুম এল না। কেবলই মনে হতে লাগল, সাগীরকে শাস্তিটা বেশি দেয়া হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ঘুমাবার চেষ্টা করেও যখন ঘুম এল না তখন সাগীরের কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারল খুব জ্বর। ফিরে এসে ছেঁড়া ওড়না থেকে খানিকটা ছিঁড়ে নিল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে একটা জামবাটিতে পানি নিয়ে এসে সাগীরের মাথায় জলপট্টি লাগিয়ে পাখার বাতাস দিতে লাগল। প্রায় ঘন্টা খানেক পর সাগীর চোখ মেলে তাকাতে জিজ্ঞেস করল, খাওয়ার পর ওষুধ খেয়েছিলেন?
জলপট্টি ও বাতাস দেয়ার ফলে জ্বর একটু কমতে সাগীরের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। চোখ খুলে যাকিয়াহকে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
কি হল? ওষুধ খেয়েছেন কিনা বললেন না যে?
সাগীর মাথা নাড়ল।
যাকিয়াহ প্রেশক্রীশান দেখে ওষুধ খাইয়ে বলল, খাওয়ার পর ওষুধ খেলে জ্বর এত বেশি উঠত না। তারপর জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার এটি এস, ইঞ্জেকসান দিয়েছিলেন?
সাগীর হাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
ঠিক আছে, জ্বর একটু কমেছে, এবার ঘুমিয়ে পড়ুন বলে যাকিয়াহ সেখান থেকে এসে ঘুমিয়ে পড়ল।
সাগীর তিন দিন জ্বরে ভুগল। আজ জ্বর উঠেনি। এই ক’দিন যাকিয়াহ তাকে দেখাশোনা করেছে। নাস্তা খাওয়ার পর যখন সে ওষুধ খাওয়াতে এল তখন সাগীর বলল, আমি অন্যায় করেছিলাম তাই শাস্তি দিলেন, কিন্তু সুস্থ করার জন্য সেবা যত্ন করেছেন কেন বুঝতে পারছি না,
বললে বুঝবেন কিনা জানি না, মানবতার কারণে করছি? এবার কয়েকটা কথা বলছি শুনুন, আপনি তো মুসলমান তাই না?
সাগীর বলল, হ্যাঁ।
মুসলমান কাদেরকে বলে জানেন?
বলতে না পেরে সাগীর চুপ করে রইল।
মুসলমান তাদেরকে বলে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) এর হুকুম মেনে চলে সব রকমের পাপ বা অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকে। যদি কেউ শয়তানের প্ররোচনায় কোনো পাপ কাজ করে ফেলে, সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ঠিকমতো নামায রোযা করে, মিথ্যে কথা বলে না, অসৎ পথে রুজী রোজগার করে না, কারও নিন্দা করে না। এই কদিন আপনাকে নামায পড়তে দেখলাম না। সমস্ত ইবাদতের মধ্যে নামায শ্রেষ্ঠ, এটা হাদিসের কথা। হাদিসে আরো আছে, রসুলল্লাহ (সঃ) বলিয়াছেন, “তাহাদের মধ্যে এবং আমাদের মধ্যে নামাযই পার্থক্যের বিষয়। যে ইহা ত্যাগ করে, সে কাফির।” [বর্ণনায় : হযরত বোরায়দা (রাঃ) তিরমিযী; নেসায়ী।] তা হলে বঝুতে পারছেন, মুসলমান হয়ে যদি কেউ নামায না পড়ে, তা হলে সে কোন পর্যায়ে পড়ে? তাই প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীকে নামায পড়তেই হবে। তারপর জিজ্ঞেস করল, নামায পড়তে জানেন তো?
হ্যাঁ, জানি। মক্তবে পড়ার সময় ওস্তাদজি শিখিয়েছেন। ঠিকমতো নামায না পড়লে ওস্তাদজী বেত দিয়ে পিটাতেন। বড় হয়ে আর পড়িনি। সে জন্য আব্বা খুব বকাবকি করে।
এখন থেকে নামায পড়বেন। আর একটা কথা, আপনার ফুফুর কাছে শুনলাম, ধান ও বাগানের সব রকমের ফসল আপনি চুরি করে বেচেন। ঐ কাজ আর করবেন না। টাকার দরকার হলে ফুফুর কাছে চেয়ে নেবেন। কি, যা বললাম, করবেন তো?
চুরির কথা শুনে সাগীর লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিল, কিছু বলল না।
কি হল? করবেন কি না বললেন না যে?
হ্যাঁ, করব।
হা করব না বলে বলুন, ইনশাআল্লাহ করব।
ইনশাআল্লাহ করব।
হ্যাঁ, এবার ঠিক বলেছেন। মনে রাখবেন ভবিষ্যতে কোনো কাজ করার কথা বলার আগে ইনশাআল্লাহ বলতে হয়।
আপা, আমি গ্রামের অল্প শিক্ষিত ছেলে। কুরআন হাদিসে কি আছে জানি না, আপনার কাছে অনেক বড় অন্যায় করেছি, আমাকে মাফ করে দেন।
আল্লাহ আপনাকে মাফ করুক, আপনাকে শাস্তি দিতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। সেজন্য আমিও আপনার কাছে মাফ চাইছি।
না-না আপনি মাফ চাইছেন কেন? যা করছেন ঠিক করেছেন। নচেৎ কোনোদিন আমার ভুল ভাঙতো না।
যাকিয়াহ অসুস্থ সাগীররের সেবা-যত্ন করছে জেনে সমীরণ বিবি খুশি হয়েছেন। আজ নাস্তা খাওয়ার পর তাকে সাগীররে রুমের দিকে যেতে দেখে জয়নালের বৌকে বললেন, আমাকে সাগীরের ঘরে নিয়ে চল।
জয়নালের বৌ হুইল চেয়ার ঠেলে দরজার কাছে নিয়ে এলে সমীরণ বিবি তাকে থামতে বললেন। সেখানে থেকে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিলেন। সাগীরকে মাফ চাইতে শুনে ভেবেছিলেন, যাকিযাহর কাছে নিশ্চয় বড় কোনো অন্যায় করেছে। তারপর যাকিয়াহকেও সাগীরের কাছে মাফ চাওয়ার কারণ শুনে ভাবলেন, তা হলে কি যাকিয়াহ ওর এরকম অবস্থা করেছে? গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার কথা সত্য নয়? আর সেই জন্যই যাকিয়াহই ওর সেবা যত্ম করছে? যাই হোক না কেন, পরে যাকিয়াহকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। এখন ওদের কাছে যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে জয়নালের বৌকে বললেন, ফিরে চল।
৭
তিন চার দিনের মধ্যে ইশতিয়াকের ফেরার ইচ্ছা থাকলেও দশ বার দিন দেরি হল টিউশনীর বেতনের টাকা পাওয়ার জন্য। টাকা পেয়ে আকবর হোসেনের পাওনা এক হাজার টাকা ও রুমের ভাড়া দিয়ে তারপর এসেছে।
বাড়িতে ঢুকে সমীরণ বিবির সামনে পড়ে গেল ইশতিয়াক। তিনি তখন বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে জয়নালের বৌকে কিছু বলছিলেন। ইশতিয়াক সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন বড়মা? সমীরণ বিবি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোর কি আক্কেল বলতে কিছু নেই? প্রায় পনের দিন হতে চলল কোনো খোঁজ খবর নেই। এদিকে আমরা চিন্তায় অস্থির। ওখানকার খবর কি বল?
খবর ভালো। জাহাঙ্গীরের মা থানায় কেস করলেও দুদিন পর তুলে নিয়েছেন। জাহাঙ্গীর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে। আরও খবর আছে আসরের নামাযের পর নাস্তা খাওয়ার সময় বলব।
যাকিয়াহ খাওয়ার পর ঘুমিয়েছিল, আসরের আজান শুনে জেগে গেছে। উঠি উঠি করেও শুয়ে শুয়ে ইশতিয়াকের কথা চিন্তা করছিল, এত দিন হয়ে গেল ফিরছে না কেন? তা হলে কি কোনো বিপদে পড়ল? এমন সময় সমীরণ বিবির কথা শুনে বুঝতে পারল, ইশতিয়াক এসেছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে তাড়িতাড়ি খাট থেকে নেমে গায়ে মাথায় ভালো করে কাপড় দিয়ে দরজার এসে দাঁড়িয়ে ঢাকার খবর শুনছিল। ইশতিয়াক নামায পড়ার কথা বলতে এগিয়ে এসে সালাম দিল।
ইশতিয়াক সালামের উত্তর দিয়ে মৃদু হেসে বলল, তুমিও বড়মার মতো বকাবকি করবে না কি?
যাকিয়াহও মৃদু হেসে বলল, করাইতো উচিত। বড়মা তোমার চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।
সাগীরের সঙ্গে গিয়ে তুমিও তো চিরিঙ্গা থেকে আকবর হোসেনের কাছে ফোন করতে পারতে?
তা পারতাম, ইচ্ছাও হয়েছিল; কিন্তু এই ক’দিন কাজে ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। তাই সম্ভব হয়নি। তবে আজ যদি না আসতে, তা হলে কাল নিশ্চয় ফোন করতাম।
ইশতিয়াক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি এমন কাজে ব্যস্ত ছিলে যে, ফোন করার জন্য চিরিঙ্গা যাওয়ার সময় পাওনি? শুধু তো রান্না আর বড়মার সঙ্গে গল্প করা?
যাকিয়াহ কিছু না বলে মিটি মিটি হাসতে লাগল।
তাকে হাসতে দেখে ইশতিয়াক বড়মার দিকে তাকাতে দেখল, তিনিও মিটি মিটি হাসছেন। তারপর জয়নালের বৌকেও মিটি মিটি হাসতে দেখে অবাক হয়ে বলল, কি ব্যপার বলুন তো বড়মা, আপনারা সবাই হাসছেন কেন?
সমীরণ বিবি বললেন, ঘরের চার পাশের পরিবেশ দেখিস নি তা হলে? দেখলে বুঝতে পারতিস কেন আমরা হাসছি আর যাকিয়াহ কেন চিরিঙ্গায় ফোন করতে যাওয়ার সময় পাইনি।
বড় মার কথা শুনে ইশতিয়াক বাড়ির চারপাশের পরিবেশ দেখে অবাক হল। বাড়ির সবকিছু যেমন ঝকঝক করছে তেমনি আশপাশের সব কিছু পরিস্কার। কোথাও এতটুকু আর্বজনা নেই। গাছের শুকনো পাতা ও শুকনো ডালপালা এখানে সেখানে জমা হয়ে থাকে, সে সবের চিহ্ন নেই। যেন যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় মূহুর্তে উধাও হয়ে গেছে।
সমীরণ বিবি বললেন, শুধু বাড়ির পরিবেশ দেখে অবাক হলি, পুকুর দেখলে কি করবি? চারজন কামলা নিয়ে তিন দিন ধরে পুকুরের সব জঞ্জাল পরিষ্কার করিয়েছে। ওর ধারণা, এতবড় পুকুরে মাছের চাষ করলে অনেক টাকা আয় হবে।
ইশতিয়াক বলল, তাই না কি?
তবে আর বলছি কি? আরও অনেক কিছু করেছে, সে সব পরে শুনিস, এখন কাপড় পাল্টে নামায পড়ে আয়।
ইশতিয়াক মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে সাগীরকে দেখে আর একবার অবাক হল। ভাবল, তা হলে কি যাকিয়াহ তাকে নামায ধরিয়েছে?
মসজিদ থেকে বেরিয়ে সাগীর ইশতিয়াককে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কখন এলে?
এই তো কিছুক্ষণ আগে। তোমাকে নামায পড়তে দেখে খুশি হয়েছি।
দোয়া করো, জীবনে কোনোদিন যেন নামায না ছাড়ি।
তা হঠাৎ নামায ধরলে যে?
ঐ যে ঢাকার আপা, উনি শুধু আমাকে নয়, ফুফুমা ও জয়নালের বৌকেও নামায ধরিয়েছেন।
হঠাৎ সাগীরের ঠেঠের দিকে লক্ষ্য পড়তে ইশতিয়াক বলল, তোমার নিচের ঠোঁঠে সেলাই এর মতো দাগ দেখা যাচ্ছে, কি ব্যপার বলতো?
সাগীর বলল, ঠোঁঠ কেটে গিয়েছিল, তাই সেলাই করতে হয়েছিল।
নিশ্চয় কোনো গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলে?
সাগীর কিছু না বলে চুপ করে হাঁটতে লাগল।
ইশতিয়াক তার চুরি স্বভাবের কথা জানে। তাই বলল, নামায যখন ধরেছ তখন গাছে উঠার স্বভাবটা ছেড়ে দাও।
ততক্ষণে তারা ঘরে চলে এল।
চা-নাস্তা খাওয়ার পর সমীরণ বিবি ইশতিয়াককে বললেন, ঢাকার আরও কি খবর বলবি বলেছিলি বল।
ইশতিয়াক বলল, জান বড়মা, যাকিয়াহ যে ঢাকার বিখ্যাত ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফার একমাত্র সন্তান জানতাম না।
তবে তুই যে বললি, ও এতিম, মা-বাবা কেউ নেই, নানির কাছে মানুষ হয়েছে, মামারা লেখাপড়া করিয়েছে।
হ্যাঁ, আগে তাই জানতাম। এবারে ঢাকায় গিয়ে ওর বাবার পরিচয় পেলাম। তিনি কিছুদিন আগে মারা গেছেন। মারা যাওয়ার আগে ওনার বিপুল সম্পত্তি যাকিয়াহর নামে উইল করে দিয়েছেন। যে উকিলের দ্বারা উইল করিয়েছিলেন, আমি যাকিয়াহকে এখানে নিয়ে আসার দু’দিন পর তিনি ওর খোঁজে ওদের বাসায় এসেছিলেন। তারপর কিভাবে উকিল সাহেবের সঙ্গে দেখা করল সেসব বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাকিয়াহকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উকিল সাহেব আমাকে বলেছেন। কথা শেষ করে ইশতিয়াক যাকিয়াহর মুখের দিকে তাকাল। দেখল, সেও তার মুখের দিকে রাগের সঙ্গে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, কি ব্যাপার? কথাটা শুনে রেগে গেছ কেন? বরং খুশি হওয়াই তো উচিত।
যাকিয়াহ রাগের সঙ্গে বলল, তোমার ধারণা ভুল, আমি একবিন্দু খুশি হইনি।
ইশতিয়াক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কারণটা জানতে পারি?
কারণ অনেক, সে সব বলতে পারব না। আমার সাফ কথা, আমি ঢাকাও যাব না, বাবার সম্পত্তিও নেব না।
তুমি ভুল করছ যাকিয়াহ, আল্লাহ তোমাকে সৌভাগ্যের চাবি দিতে চাচ্ছেন আর তুমি নিতে চাচ্ছ না, এ কেমন কথা?
কথা যেমন থোক, আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না।
কিন্তু তোমার জিনিস বারো ভুতে লুটে পুটে খাবে সেটা কি উচিত হবে?
আমার কোনো জিনিস নেই, ওসব মরহুম গোলাম মোস্তফার। আমি তাকে বাবা বলে স্বীকার করি না, বরং ঘৃণা করি।
ইশতিয়াক বুঝতে পারল, বাবাকে অস্বীকারও ঘৃনা করার পিছনে নিশ্চয় বড় কোনো কারণ আছে, যা প্রকাশ করতে চাচ্ছে না।
সে কিছু বলার আগে সমীরণ বিবি বললেন, ছি মা, তুমি কুরআনের হাফেজ ও শিক্ষিত মেয়ে, বাবার সম্পকে এরকম কথা বলা কি উচিত?
উচিত নয়, তা আমি জানি। তবু কেন বলছি, সে কথা জানলে আমাকে দোষ দিতে পারতেন না।
সমীরণ বিবি বললেন, ঠিক আছে, এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আমি পরে আলাপ করব। তারপর ইশতিয়াককে বললেন, তুই সাগীরকে নিয়ে জেলে পাড়ায় গিয়ে সুজন জেলেকে বলবি, কাল যেন দলবল নিয়ে আসে। পুকুরে বেড়জাল দিয়ে সব বড় মাছ বিক্রি করব। তারপর মাছের পোনা ছাড়ব।
রাতে খাওয়ার পর সমীরণ বিবির ঘুমাবার আয়োজন করে দিয়ে যাকিয়াহ চলে যেতে উদ্দ্যত হলে সমীরণ বিবি বললেন, বস, কথা আছে। বসার পর বললেন, বাবার প্রতি তোমার এত বিদ্বেষ কেন বলতো মা?
যাকিয়াহ বলল, এ ব্যাপারে কথা বলতে আমার ইচ্ছা করছে না। অন্য কোনো কথা থাকলে বলুন, নচেৎ আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিন।
সমীরণ বিবি বললেন, তুমি এখানে থেকে যেতে চাও শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। কেন হয়েছি, তুমিও জান। কেন তুমি ফিরে যেতে চাচ্ছ না, কেন বাবাকে ঘৃণা কর আর কেনই বা তার বিপুল সম্পত্তি নিতে চাচ্ছ না, এসব জানলে আরও অনেক বেশি খুশি হতাম। নচেৎ আজীবন শান্তি পাব না। সব সময় মনে হবে, নিজের খুশির জন্য বাবার সম্পত্তি থেকে তোমাকে বঞ্চিত করেছি। এজন্য নিজের কাছে ও তোমার কাছে চিরকাল ছোট হয়ে থাকব, তুমি কি তাই চাও?
যাকিয়াহ বলল, না, তা চাই না। তারপর নানির কাছে বাবার সম্পকে যা কিছু শুনেছিল বলল, মাকে কেন বাবা নানির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সুদীর্ঘ বাইশ বছর মেয়ের কেন খোঁজ করেননি, মারা যাওয়ার আগে কেন সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে উইল করে দিলেন, সেসব আমি জানি না। এখন আপনিই বলুন, ঐ রকম বাবার সম্পত্তি গ্রহণ করা কি আমার উচিত?
সমীরণ বিবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, না উচিত নয়। তবু বলব, তোমার এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে উচিত হবে, ঢাকায় গিয়ে ঐ সব বিষয়গুলো অনুসন্ধান করা। আর এটাই হবে তোমার মতো শিক্ষিত মেয়ের একান্ত কর্তব্য। আমার আর কিছু বলার নেই, ভেবে চিন্তে আমাকে বলো। এবার যাও ইশতিয়াককে আমার কাছে আসতে বলে ঘুমিয়ে পড়।
ইশতিয়াক জানে যাকিয়াহ বড়মার ঘর থেকে বেরিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার কাছে আসবে। তাই শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল আর একবার করে দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। তাকে আসতে দেখে বইটা বালিশের নিচে রেখে উঠে বসল।
বড়মা তোমাকে ডাকছেন বলে যাকিয়াহ দরজার বাইরে থেকে কথাটা বলে চলে গেল।
ইশতিয়াককে ঢুকতে দেখে সমীরণ বিবি বললেন, বস, কয়েকটা কথা বলব। বসার পর বললেন, আমি ঠিক করেছি, যাকিয়াহর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তোদেরকে এখানেই রেখে দেব। এ ব্যাপারে তোর মতামতা কি?
অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে ইশতিয়াক বলল, বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করে জানাব। তার আগে যাকিয়াহর মতামত জানা দরকার।
আমি যাকিয়াহকেও কথাটা বলেছি। তুই যা বললি, সেও তাই বলল। আমি তার কথায় বুঝতে পারলাম, তুই রাজি থাকলে সেও রাজি। তুই রাজি আছিস কি না বল?
যাকিয়াহর সঙ্গে এ ব্যাপারে যখন আপনি আলাপ করেন তখন সে বিপদগ্রস্ত ও অসহায় ছিল। তাই হয়তো রাজি হয়েছিল। কিন্তু এখন তার বিপদ কেটে গেছে, অসহায়ও নয়, বাবার বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছে। এখন রাজি নাও হতে পারে। আর এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু ওতো, এসব জেনেও তোর সামনেই বলল, সে ঢাকা ফিরেও যেতে চায় না আর বাবার সম্পত্তিও চায় না?
ওটা হয়তো তার মুখের কথা, মনের কথা নয়। এত বছর তার খোঁজ নেয়নি বলে, বাবার উপর রাগ অভিমান করে বলেছে।
শোন, রাগ বা অভিমান যাই করুক না কেন, আমি ওর মনের ভাব বুঝতে পেরেছি, ও এখানেই থেকে যেতে চায়। একটু আগে ওর সঙ্গে আলাপ করার সময় যখন বলল, যিনি স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি এক তিল পরিমাণ কর্তব্য পালন করেন নি, তার সম্পত্তি কিছুতেই গ্রহণ করবে না তখন আমি বললাম, তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ, তবে শিক্ষিত মেয়ে হিসাবে তোমার উচিত হবে, স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি কর্তব্য কেন পালন করেন নি, তা ঢাকায় গিয়ে অনুসন্ধান করে সিদ্ধান্ত নেয়া।
ইশতিয়াক জিজ্ঞেস করল, আপনার কথা শোনার পর যাকিয়াহ কিছু বলে নি।
ও কিছু বলার আগে আমি বলেছি, ভেবেচিন্তে উত্তর দিতে। এবার তোর মতামতা বল।
জন্মের পর থেকে আপনি মায়ের স্নেহ মমতা দিয়ে লালন-পালন করে মানুষ করেছেন। সেই ঋণ কোনো কিছুর বিনিময়ে শোধ করতে পারব না। শোধ করা সম্ভব ও নয়। বড় হওয়ার পর আপনার জন্য কিছুই করতে পারি নি। এখন যদি আপনার ইচ্ছাটুকু পুরণ করতে পারি, তা হলে এই অধম ধন্য হয়ে যাব। তবে তার আগে ওকে ঢাকা নিয়ে গিয়ে উকিলের কাছে পৌঁছে দেব। আমার বাড়িওয়ালা আকবর হোসেন ওর এরকম গার্জেন। ওনার সঙ্গেও যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে। ওনাকে ও উকিল সাহেবকে কথা দিয়েছি ওকে ঢাকা পৌঁছে দেব। তা ছাড়া ওর নানিকেও কথা দিয়েছিলাম যেমন করে হোক যাকিয়াহকে খুঁজে বের করে ওনার কাছে নিয়ে আসব।
সমীরণ বিবির ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠল। বললেন, এরকমই তোর কাছে আশা করেছিলাম। আমি যে কথা বলে ওকে বুঝিয়েছি, তুইও সে কথা বলে বোঝালে মনে হয় ঢাকা যেতে রাজি হয়ে যাবে। এবার যা ঘুমিয়ে পড়।
.
পরের দিন বেলা আটটার সময় সকলের নাস্তা খাওয়া শেষ হয়েছে, এমন সময় সুজন জেলে দলবলসহ বেড়জাল নিয়ে হাজির হল।
ইশতিয়াক বড়মাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে পুকুর পাড়ে নিয়ে এল। সঙ্গে যাকিয়াহ গায়ে চাদর জড়িয়ে এসেছে। সাগীর আগেই জেলেদের সঙ্গে এসেছে।
সমীরণ বিবি সুজনকে বললেন, আমি মাছের চাষ করব। ছোট ছোট মাছ ছাড়া বড় মাছ যেন একটাও না থাকে।
সুজন বলল, এবার একটা কাজের কাজ করবেন। এতদিন ফেলে না রেখে মাছ চাষ করলে বছর বছর অনেক টাকা আয় হত।
এতদিন দেখাশোনা করার লোক ছিল না। এখন থেকে ইশতিয়াক সবকিছু করবে।
কয়েকদফা বেড়জাল টানতে প্রায় চার পাঁচ মণ বড় বড় মাছ ধরা পড়ল। রুই-কাতল ও মৃগেল মণ খানেক বাকি সব জিওল মাছ।
এত বড় বড় মাছ যাকিয়াহ কখনও দেখেনি। দেখে মুগ্ধ হল। সমীরণ বিবি বড় বড় দুটো রুই ও কাতল মাছ রেখে বাকি সব মাছ দরদাম করে সুজন জেলের কাছে বিক্রি করে দিলেন। শেষে তাকেই বললেন, পুকুরে পোনা মাছ ছাড়ার ব্যবস্থা করতে।
সারাদিন মাছ কুটা রান্না ও খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিল যাকিয়াহ। ঢাকা যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপারে ইশতিয়াকের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা থাকলেও সময় হয়নি। তাই রাতে ঘুমাবার আগে তার রুমের দরজায় নক করল।
গতরাতে বড় মার রুম থেকে ফেরার সময় ইশতিয়াক ভেবেছিল,যাকিয়াহ তার কাছে আসবে, কিন্তু আসে নি। আজ যে আসবে নাইনটি পার্সেন্ট সিওর ছিল। তাই দরজা ভিড়িয়ে শুয়ে শুয়ে নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করছিল। দরজায় নক হতে বলল, ভিতরে এস।
যাকিয়াহ ভিতরে এসে চেয়ারে বসে বলল, বড়মা কাল রাতে তোমাকে ডেকেছিলেন কেন?
সে কথা পরে বলছি। যে কথাটা তোমাকে বলা হয়নি সেটা আগে বলে নিই। তারপর জাহাঙ্গীর তাকে যে কথা বলেছে বলল।
যাকিয়াহ আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, তাই নাকি?
তবে আর বলছি কি? তার কথা শুনে আমিও খুব অবাক হয়েছি।
আমিও কম অবাক হয়নি। তারপর বলল, বড়মা কি বলেছেন বল।
তোমাকে কাল ঢাকায় নিয়ে যেতে বললেন।
আর কিছু বলেন নি?
তুমি যেতে চাও নি, সেজন্য খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
তুমি হও নি?
বিপদে পড়ছিলে সাহায্য করেছি। বিপদ কেটে গেছে, তোমাকে তোমার জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার কর্তব্য।
এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।
সন্তুষ্ট না অসন্তুষ্ট হয়েছি বলতে পারব না। তবে বড়মা যা চান, আমিও তাই চাই।
জানতাম, যারা সত্যিকার প্রেমিক তারা স্বার্থ দেখে না। তোমাকেও তাই জানতাম; কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আমার জানাটা ভুল।
কি করে বুঝলে?
আমি পৈত্রিক সম্পত্তি নিতে চাচ্ছি না আর বড়মা ও তুমি নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছ। এতেই কি বোঝা যায় না, আমাকে এ বাড়ির বৌ করার সাথে সাথে আমার বাবার বিপুল ঐশ্বর্যও হস্তগত করতে চাও? বড়মার কথা না হয় বাদ দিলাম; কিন্তু তুমি কি করে এরকম ভাবলে? এতদিন তোমাকে যতটা ভালো মনে করতাম, এখন তার থেকে হাজার গুণ বেশি ঘৃণা করি। ছি ছি, তুমি এত লোভী, তোমার মন এত ছোট? কালই ঢাকা চলে যাব বলে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিল।
তার কথা শুনে ইশতিয়াক মনে খুব আঘাত পেলেও চিন্তা করল, আমাকে ভুল বুঝলেও এটাই ভালো হল। নচেৎ কিছুতেই ঢাকা যেতে রাজি হত না।
পরেরদিন সকালে রওয়ানা হওয়ার সময় যাকিয়াহ সমীরণ বিবিকে বলল, আপনার কাছে হয়তো অনেক বেয়াদবি করে ফেলেছি, অনেক কষ্টও দিয়েছি মাফ করে দেবেন। মায়ের স্নেহ মমতা কি জিনিস জানতাম না, এখানে এসে জানলাম। সে জন্য আপনার কাছে ঋণী। ইনশাআল্লাহ যতটুকু পারি সেই ঋণ শোধ করার চেষ্টা করব।
সমীরণ বিবি বললেন, আল্লাহ আমাকে কোনো সন্তান দেননি। সন্তানহীনা মেয়ের যে কত দুঃখ তা শুধু তারাই বোঝে। সেই দুঃখের মরুভূমিতে তুমি এক পশলা বৃষ্টির মতো এসেছিলে। দোয়া করি, “আল্লাহ তোমার ভবিষ্যৎ জীবন সুখের করুক, শান্তির করুক।”
বিকেল পাঁচটায় ইশতিয়াক যাকিয়াহকে নিয়ে উকিল সাহেবের বাসায় পৌঁছাল।
উকিল সাহেব চেম্বারে ছিলেন, সালাম বিনিময়ের পর তাদেরকে বসতে বললেন।
বসার পর ইশতিয়াক যাকিয়াহকে দেখিয়ে বলল, ইনি গোলাম মোস্তফার মেয়ে।
উকিল সাহেব যাকিয়াহকে বললেন, আপনার মুখের নেকাব সরান তো মা।
যাকিয়াহ নেকাব সরিয়ে বলল, আমি তো আপনার মেয়ের বয়সী, আমাকে তুমি করেই বলবেন।
উকিল সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে তাই বলব। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা পাসপোর্ট সাইজ ফটো বের করে মিলিয়ে দেখে ফটোটা ড্রয়ারে রেখে দিয়ে বললেন, চল, তোমার বাড়িতে গিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে দেব। তারপর আকবর হোসেনকে ফোন করে ইশতিয়াক ও যাকিয়াহর আসার কথা জানিয়ে বললেন, আপনি তৈরি থাকুন, আমরা মরহুম গোলাম মোস্তফার বাড়িতে রওয়ানা হচ্ছি, আপনাকে তুলে নেব।
আকবর হোসেন বললেন, আমি গলির মুখে মেইন রাস্তায় থাকব।
লাইন কেটে দিয়ে উকিল সাহেব যাকিয়াহর দিকে তাকিয়ে বললেন, বাই দা বাই, তোমরা কি খাওয়া-দাওয়া করেছ?
যাকিয়াহ বলল, জি, করেছি।
উকিল সাহেব বললেন, তা হলে এখনি রওয়ানা হওয়া যাক।
গোলাম মোস্তফা মারা যাওয়ার বছর তিনেক আগে বনানীতে একবিঘে জায়গার মাঝখানে দোতলা বাড়ি করে সেখানে থাকতেন। নিচতলায় দু’পাশে দুটো গেষ্টরুম আর মাঝখানটা বিরাট হলরুম। হলরুমের পুরো মেঝেয় দামি কার্পেট বিছান। মধ্যখানে একটা গোল টেবিল। টেবিলের চারপাশে গদী লাগান চেয়ার। টেবিলের উপর ছাদে বিরাট কাঁচের ঝাড়। তিন পাশের দেয়াল ঘেষে বড় বড় শোকেস ও বইয়ের আলমারী। আর এক পাশে টি.ভি। ঐ হলরুমের একপাশে দোতলায় উঠার সিঁড়িতেও দামি কার্পেট বিছানো। দোতলায় তিন রুমের দু’টো ফ্লাট। বাড়িটা জমির মাঝখানে, তাই চারপাশে ফল ও ফুলের বাগান। সামনের দিকে ফুলের বাগানের মাঝখান দিয়ে দশ ফুট চওড়া কংক্রীটের রাস্তা গেট থেকে বারান্দা পর্যন্ত।
গোলাম মোস্তফা সাহেব তিনজন লোক রেখেছিলেন বাগান পরিচর্যা করার জন্য। আর বাসায় সব কিছু করার জন্য এক আধা বয়সী দম্পত্তিকে রেখেছিলেন। তারা সবাই এখনও আছে। উকিল সাহেব গোলাম মোস্তফার বন্ধু ছিলেন। তিনি ওনার সব কিছু জানতেন। দু’একদিন অন্তর গোলাম মোস্তফার সঙ্গে আসতেন। কিছুক্ষণ গল্প করে খাওয়া-দাওয়া করে চলে যেতেন। তাই বাসার লোকজন সবাই তাকে চিনে।
উকিল সাহেব সবাইকে নিয়ে গেটের কাছে এলে দারোয়ান চিনতে পেরে তাড়াতাড়ি গেট খুলে দিয়ে সালাম জানাল।
উকিল সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, গেট বন্ধ করে হলরুমে এস। তারপর গাড়ি বারান্দায় এসে গাড়ি পার্ক করে সবাইকে নিয়ে হলরুমে বসলেন।
দারোয়ান আসার পর তাকে বললেন, সবাইকে আসতে বল।
কিছুক্ষণের মধ্যে দারোয়ান সবাইকে নিয়ে ফিরে এল।
উকিল সাহেব যাকিয়াহকে দেখিয়ে তাদেরকে বললেন, তোমাদের সাহেবের মেয়ে। এতদিন অন্য জায়গায় থেকে লেখাপড়া করছিল। এখন থেকে এখানেই থাকবে। তোমাদের সাহেব তার সবকিছু মেয়ের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। ওর কথামতো তোমরা চলবে। আমি মাঝে মাঝে আসব। এবার তোমরা যে যার কাজে যাও। তারপর বয়স্ক দম্পতিকে বললেন, তোমরা আমাদের জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা কর।
সবাই চলে যাওয়ার পর উকিল সাহেব ব্রীফকেস খুলে দলিলপত্র ও ব্যাংকের কাগজপত্র বের করে যাকিয়াহর হাতে দিয়ে বললেন, এগুলো ভালো করে পড়বে। আর যে বুড়োবুড়িকে চা নাস্তার কথা বললাম তারা খুব বিশ্বাসী। বুড়ির কাছে সব রুমের চাবি আছে, চেয়ে নিও। উত্তরায় ছয়তলা একটা বাড়ি আছে, আগে তোমার বাবা সেখানেই থাকত। মাত্র তিন বছর হল এই বাড়িটা করে এখানে ছিল। এই বাড়িটা করার সময় থেকে ব্যবসায় খুব লস যাচ্ছিল। তাই এই বাড়িটা করতে গিয়ে অনেক টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ করেছে। জানি না, তুমি কি করে সেই ঋণ শোধ করবে। যাই হোক, এ ব্যাপারে পরে তোমার সঙ্গে আলাপ করব। আর একটা কথা, তোমার বাবার আসল বাড়ি ফরিদপুর। মুশতাক নামে তার এক চাচাতো ভাই আছে। তাকে কখনও না দেখলেও তার কথা তোমার বাবা একদিন আমাকে বলেছিল। তিন চার দিন আগে আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি নাকি তোমার সব কিছু জানেন। তোমার কাছে নিশ্চয় আসবেন। খুব বুঝে শুনে ওনার কথার উত্তর দেবে। তারপর একটা কার্ড তার হাতে দিয়ে বললেন, দরকার মনে করলে আমাকে ফোন করবে। তোমার বাবার রুমে ফোন আছে।
এমন সময় বুড়ো দম্পতি চা নাস্তা নিয়ে এলে বললেন, আজ আর বেশি কিছু আলাপের দরকার নেই, আমি তো মাঝে মাঝে আসবই তখন করা যাবে।
চা নাস্তা খাওয়ার পর চলে যাওয়ার সময় আকবর হোসেন যাকিয়াহকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার ফোন নাম্বার তো তুমি জান, যখনই দরকার মনে হবে আমাকে ফোন করবে। তারপর আবার বললেন, একা থাকতে যদি ভয় পাও এবং ইশতিয়াক থাকলে ভালো হয় মনে কর, তা হলে বল, উনি না হয়। কয়েকটা দিন এখানে থাকবেন।
এতবড় বাড়িতে একা থাকতে হবে জেনে যাকিয়াহর ভয় ভয় করছিল। তবু বলল, না, আমার ভয় করবে না।
তা হলে তো কোনো চিন্তা নেই বলে আকবর হোসেন উকিল সাহেবকে বললেন, চলুন আমরা যাই।
.
ইশতিয়াক গতবার ঢাকায় এসে আর পড়াতে পারবে না বলে ছাত্রদের গার্জেনদের জানিয়েছিল। আকবর হোসেনকেও বলেছিল, সে আর ঢাকায় থাকবে না, বাড়িতে থেকে চাষবাস দেখাশোনা করবে। তাই মেস থেকে বেডিংপত্র ও অন্যান্য সবকিছু নিয়ে আজ রাতের বাসে বাড়ি রওয়ানা দিল।
আকবর হোসেন মনে করেছিলেন। যাকিয়াহ এতদিন ইশতিয়াকদের বাড়িতে থাকার ফলে তাদের সম্পর্ক আরও গম্ভীর হয়েছে। তাই ইশতিয়াককে রাখার কথা যাকিয়াহকে বলেছিলেন। যাকিয়াহ না করে দিতে ভাবলেন, তা হলে কি বাবার ঐশ্বর্য পেয়ে যাকিয়াহর মন ঘুরে গেল? ইশতিয়াক গরিব বলে তাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে? মেস থেকে ইশতিয়াক বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় সে কথা ভেবে তাকে কিছু বলতে পারলেন না। ভাবলেন, আর কখনও হয়তো ইশতিয়াকের সঙ্গে দেখা হবে না।
যে দম্পতি বাসার সব কাজ করে তাদের বয়স পঞ্চাশের উপর হলেও বেশ স্বাস্থ্যবান ও কর্মঠ। বুড়ির নাম জমিলা আর বুড়োর নাম হারেস।
সবাই চলে যাওয়ার পর যাকিয়াহ নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করছিল।
জমিলা এসে বলল, এখানে বসে আছেন কেন মা, উপরে চলুন।
যাকিয়াহ ওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, চল, আসরের নামায পড়তে হবে।
উপরে এসে জমিলা একটা রুম খুলে চাবির গোছা তার হাতে দিয়ে বলল, এই রুমে আপনার বাবা থাকতেন। আমরা সারাদিন দোতলায় রান্না বান্না করি, সব ঘর দুয়ার পরিষ্কার করি। রাতে নিচের একটা গেষ্ট রুমে থাকি। আপনি নামায পড়ান, আমি কিছুক্ষণ পরে আসছি। কথা শেষ করে চলে গেল।
রুমে ঢুকে যাকিয়াহ আসবাবপত্র দেখে অবাক হল। এত দামি আসবাবপত্র জীবনে দেখেনি। নামাযের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে ভেবে বাথরুমের কাজ সেরে নামায পড়ল। তারপর অন্য ফ্ল্যাটের রুমগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। সেটারও আসবাবপত্র একই রকম। কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের সময় হতে নামায পড়ল।
নামায শেষ করে উঠেছে, এমন সময় জমিলা এসে বলল, চা বা অন্য কিছু খাবেন?
যাকিয়াহ বলল, এখন আর কিছু খাব না, দশটার সময় ভাত খাব। আপনি কি কি খেতে ভালবাসেন?
আল্লাহ বান্দাদের জন্য যা কিছু হালাল করেছেন, সব কিছুই খেতে ভালবাসি। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি কত রকম রান্না জান?
আমি বেশি জানি না, শফির বাপ বিদেশের হোটেলের বাবুর্চি ছিল। সে অনেক রকম রান্না করতে জানে। সাহেব বিদেশে গিয়ে শফির বাপের হাতের রান্না খেয়ে তাকে বিদেশ থেকে নিয়ে আসেন। তারপর আমাকেও দেশ থেকে নিয়ে আসেন। আমি রান্না করি না। সবকিছু জোগাড় করে দিই, শফির বাপ রান্না করে।
শফির বাপ তা হলে তোমার স্বামী।
জি।
শফি কোথায় থাকে?
পাঁচ বছর বয়সে পানিতে ডুবে মারা গেছে বলে জমিলা চোখ মুছল।
তোমাদের আর কোনো ছেলেমেয়ে নেই?
না, এব্রার যাই, শফির বাপ রান্না চাপাবে। তাকে সব কিছু এগিয়ে দিতে হবে। টেবিলের পাশে দেয়ালে যে বোতামের মতো দেখছেন, ওটা কলিং বেলের সুইচ, ওটাতে চাপ দিলে আমি বা শফির বাপ আসব।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
খাওয়া দাওয়ার পর যাকিয়াহ রুমে এসে চেয়ারে বসল। প্রথমে যখন জমিলার সঙ্গে আসে তখন টেবিলের একপাশে কয়েকটা বই সাজানো রয়েছে দেখেছিল। একটা বই দেখার জন্য উপরের বইটা নিয়ে খুলে দেখল, সেটা বই নয় ডায়েরী। পাতা উল্টে তারিখ দেখে বুঝতে পারল, এটা এবছরের। সেটা রেখে অন্য একটা বই নিয়ে দেখল, সেটাও ডায়েরী এবং গত বছরের। কৌতূহলী হয়ে একের পর এক দেখতে লাগল, সবগুলোই বিগত বছরগুলোর ডায়েরী। গুনে দেখল, মোট তেইশটা। ভাবল, বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী হয়ে ডায়েরী লেখার সময় পেতেন কখন? তেইশ বছর আগের ডায়েরী পড়ে জানতে পারল, মাকে বিয়ে করার পর ডায়েরী লিখতে শুরু করে। আরও জানতে পারল, বাবার যৌন অক্ষমতার কথা আর সেজন্য মা কোনোদিন দৈহিক শান্তি পায়নি। হঠাৎ দুর্ঘটনার দিন বড় মামা যে কথা নানিকে বলেছিল, সে কথা মনে পড়তে চমকে উঠে ভাবল, তা হলে সত্যি সত্যি সে কি জারজ সন্তান? তারপর একের পর এক ডায়েরীগুলো পড়তে লাগল। পাঁচ নাম্বার ডায়েরীতে চাচা মুশতাকের সঙ্গে মায়ের ঘটনা পড়ে সিওর হল, সে জারজ সন্তান।
তখন তার মায়ের ওপর যেমন প্রচন্ড ঘৃণা হল তেমনি নিজের উপরও হল। এতদিন বাবার উপর যে প্রচন্ড ঘৃণা ছিল অনুভব করল, এখন সেটা নেই। বরং বাবা উচিত কাজ করেছিল বলে মনে হল। হঠাৎ মনের ভিতর কে যেন বলে উঠল, তোর বাবা যদি উচিত কাজ করেছিলেন, তা হলে জারজ সন্তানকে এত বিপুল সম্পত্তি দিয়ে অনুচিতের মতো কাজ করলেন কেন? এত অস্থির না হয়ে সব ডায়েরীগুলো পড়ে জানো, তিনি কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত কাজ করেছেন।
যাকিয়াহর পড়তে ইচ্ছা করল না। তবু অন্যগুলো সরিয়ে এ বছরের ডায়েরী পড়তে শুরু করল–
প্রায় দু’ যুগ পর আজ মুস্তাকিম এসেছিল। যে মুশতাক কখনও নামায, রোযা করেনি, যে চরিত্রহীন, তাকে দাড়ি-টুপিওয়ালা দেখে আমি প্রচন্ড রেগে গিয়ে কটমট করে তাকিয়ে বললাম, তোকে না আর কখনও আসতে নিষেধ করেছিলাম, তবু এসেছিস কেন? এক্ষুনি চলে যা, নচেৎ সেদিন তোকে কিছু না বললেও, আজ খুন করে ফেলব।
মুশতাক হুমড়ি খেয়ে আমার পায়ের উপর পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তাই করো ভাইয়া তাই করো। তার আগে কেন এসেছি তোমাকে শুনতেই হবে। সেদিন শয়তান আমার ঘাড়ে চেপেছিল। তাই সুযোগ পেয়ে ভাবির শালীনতা হানী করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সফল হতে পারিনি। সতী নারীর ইজ্জৎ আল্লাহ রক্ষা করেন। ভাবি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো মনে করত। তা কল্পনাও করেনি আমি তার ইজ্জতের উপর হামলা করব। যখন বুঝতে পারল তখন দরজা বন্ধ করার কথা বলে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। তার আগেই আমি তাকে অর্ধনগ্ন করে ফেলেছিলাম। ঐ অবস্থায় দরজা বন্ধ করার কথা বলে যখন। দরজার কাছে এসে পর্দা সরিয়ে পালাতে যাবে ঠিক তখনই তুমি এসে পড়। আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, ভাবি নির্দোষ। যাকিয়াহ তোমার ঔরসজাত সন্তান। বছর খানেক আগে আমাদের মসজিদে তবলীগ জামাত আসে। তাদের কাছে কুরআন হাদিসের কথা শুনে ও তাদের সংস্পর্শে থাকার ফলে আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন। তারপর থেকে কেবলই মনে হয়, আমার জন্য ভাবিকে তুমি দূরে সরিয়ে দিয়েছ, ভাবির পেটে আমার ঔরসের সন্তান এসেছে ভেবে নিজে যেমন কষ্ট পেয়েছ তেমনি তুমি তাকে অসতী মেয়ে মনে করেছ জেনে ভাবি দুঃখের জীবন বেছে নিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। আমার কথা যদি বিশ্বাস না কর, তা হলে কুরআন শরীফ মাথায় নিয়ে শপথ করে বলব, ভাবি পুত পবিত্র সতী নারী। যাকিয়াহ আমার নয়, তোমার ঔরসজাত সন্তান। তারপর আমার পায়ে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলল, আমাকে মাফ করে দাও ভাইয়া, তুমি মাফ না করলে আল্লাহও আমাকে মাফ করবেন না।
তার কথা শুনে মাজেদা চলে যাওয়ার আগে যেসব কথা বলেছিল মনে পড়ল। বুঝতে পারলাম, তার প্রতি কি সাংঘাতিক অন্যায় আচরণ করেছি? কত বড় দুঃখ নিয়ে সে নিজেই আমার কাছ থেকে চলে গেছে? তখন মুশতাকের উপর আমার রাগ আরও বেড়ে গেল। ধৈর্য ধরতে পারলাম না, কোমরের বেল্ট খুলে তাকে মারতে মারতে বললাম, এ কথা এতদিন বলিস নি কেন? তোকে আজ মেরেই ফেলব।
মুশতাক চিৎকার বা কোনো প্রতিবাদ তো করলই না, বরং বলল, এর থেকে আরও কঠিন শাস্তি দাও ভাইয়া, তা হলে হয়তো আল্লাহ আমার গুনাহ মাফ করে দেবেন, পরকালে হয়তো আমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই দেবেন।
মার খেতে খেতে যখন অজ্ঞান হয়ে গেল তখন হারেস এসে আমার হাত থেকে বেল্টটা কেড়ে নিয়ে বলল, আর মারবেন না সাহেব, আরও মারলে মরে যাবে। তখন আবার পুলিশের হাঙ্গামা হবে।
হারেস বাসার চাকর। তার সাহস দেখে তার উপরও রেগে গেলাম। কিন্তু কিছু বলবো করতে পারলাম না। কারণ মুশতাককে অনেকক্ষণ ধরে মারার ফলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে হ্যাঁরেসে ডাক্তারকে আসার জন্য ফোন করে।
ডাঃ কবির আমার বন্ধু। কারণে অকারণে অসংখ্য বার বাসায় এসেছে। বাসার সবাইকে সে যেমন চেনে, বাসার সবাই তাকে চেনে। ডাক্তার আসার আগে আমারও রাগ পড়ে গেল। মুশতাককের মুখ থেকে তখন ফেনা বেরোচ্ছে। জামা কাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছে। তার অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগল। ভাবলাম, ঘাড়ে শয়তান চেপেছিল বলে অল্প শিক্ষিত মুশতাক অন্যায় কিছু করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি শিক্ষিত হয়ে কি করে এত নির্মম হতে পারলাম?
ডাক্তার এসে রক্তাক্ত মুশতাককে দেখে জিজ্ঞেস করল, এরকম অবস্থা করল কে?
বললাম, আমি করেছি। পরে তোকে সব কথা বলব, এখন তাড়াতাড়ি ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা কর।
ডাক্তার বলল, এখানে কিছু করা যাবে না। আমার ক্লিনিকে নিয়ে যেতে হবে। তোর চাকরদের বল গাড়িতে তুলে দিতে।
এক সপ্তাহ ক্লিনিকে থেকে সুস্থ্য হয়ে কাউকে কিছু না বলে মুশতাক দেশে চলে যায়। আমি প্রায় প্রতিদিন ক্লিনিকে ওকে দেখতে যেতাম। জ্ঞান ফেরার পর থেকে আমাকে দেখলেই চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলতো, আমাকে মাফ করে দিয়েছে তো ভাইয়া?
ডাক্তার ও নার্স থাকত বলে তাকে ধমকের স্বরে বলতাম, পাগলের মতো কি যা তা বকছিস? চুপ কর।
ওর চলে যাওয়ার কথা ডাক্তার আমাকে ফোন করে জানায়। আমি বেশ কিছু টাকা ওর নামে মনি অর্ডার করি। টাকাটা নেয়নি। ফেরৎ এসেছে। একটা চিঠি লিখে ওকে আসতে বলি। উত্তরে জানাল, তাকে মাফ করে দিয়েছি জানলে আসবে। আমি তাই করলাম।
এরপর ডায়েরীতে আর কিছু নেই। ডাইরী পড়তে পড়তে যাকিয়াহর চোখ থেকে পানি পড়ছিল। সে জারজ সন্তান নয় জেনে যেমন আনন্দিত হল তেমনি মা বাবার সবকিছু জেনে দুঃখও অনুভব করল। বুঝতে পারল বাবা কেন দীর্ঘ এত বছর তার খোঁজ করে নি এবং কেন মারা যাওয়ার আগে সব কিছু তার নামে উইল করে দিয়েছে। ওয়াল ঘড়িতে টং টং করে দুটো বাজতে ডায়েরী গুছিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
সাড়ে পাঁচটায় উঠে ফজরের নামায পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল, জমিলা। দরজায় বার বার নক করতে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে বলল, কি ব্যাপার, বার বার নক করছ কেন?
জমিলা বলল, বেলা নটা বাজে, আপনি নাস্তা খাওয়ার পর আমরা খাব।
নাস্তা খেয়ে যাকিয়াহ প্রথমে উইলটা পড়ল তারপর ব্যবসার ও ব্যাংকের কাগজপত্র দেখতে লাগল। বেশিরভাগ বুঝতে পারল না। হঠাৎ ইশতিয়াকের কথা মনে পড়ল। ভাবল, সে থাকলে নিশ্চয় সাহায্য করত। তাকে যেতে দেয়া উচিত হয়নি। ডাকলে আসবে কি? এবারে অপমানটা বেশি হয়ে গেছে। তবু। আসতে পারে ভেবে আকবর হোসেনকে ফোন করল। আকবর হোসেন ফোন ধরার পর সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, চাচা, কেমন আছেন?
ভালো, তুমি কেমন আছ? রাতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?
না চাচা, কোনো অসুবিধে হয়নি। একটু ইশতিয়াক ভাইকে দিতে পারেন?
ওতো নেই, তোমার ওখান থেকে এসে রাতের বাসে চকরিয়া ফিরে গেছে।
মনে হোঁচটে খেল যাকিয়াহ। বলল, তাই না কি?
হ্যাঁ, গতবারে এসে ফিরে যাওয়ার সময় বলেছিল, সে আর ঢাকায় থাকবে না, বাড়িতে থেকে চাষবাস করবে।
এমন সময় হারেস এসে বলল, উকিল সাহেব নিচে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
যাকিয়াহ তাকে হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে আকবর হোসেনকে বলল, এখন রাখি চাচা, উকিল সাহেব এসেছেন।
ঠিক আছে, দরকার মনে করলেই ফোন করবে বলে আকবর হোসেন লাইন কেটে দিলেন।
যাকিয়াহ কাগজপত্র নিয়ে নেমে এসে উকিল সাহেবের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, অনেক কিছু বুঝতে পারছি না।
উকিল সাহেব বললেন, একদিনেই কি সবকিছু বোঝা যায়? আস্তে ধীরে পড়তে থাক, ঠিকই বুঝতে পারবে। একান্ত যেগুলো পারবে না আমাকে বলো বুঝিয়ে দেব।
ঠিক আছে, এবার একটা কথা বলব।
উকিল সাহেব মৃদু হেসে বললেন, আমার তো মনে হচ্ছে, শুধু এটাই নয়, আরও অনেক কিছু বলবে। বল, কি বলতে চাও।
বাবার বন্ধু হিসাবে আপনাকে আমি চাচা বলে ডাকব।
বেশতো ডাকবে। আর এটাই তো স্বাভাবিক। তারপর ব্যবসা ও ঋণের ব্যাপারে আলাপ করার পর উকিল সাহেব চলে গেলেন।
যাকিয়াহ সেখানে বসেই ইশতিয়াকের কথা ভাবতে লাগল। ও তা হলে বাবার উইলের কথা জেনেও গ্রামের বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেদিন তাকে লোভী, স্বার্থপর বলা উচিত হয় নি। বড়মা সম্পকেও ওরকম ভাবা ঠিক হয় নি।
দু’দিন পর যাকিয়াহর চার মামা মাকে সঙ্গে নিয়ে এল।
যাকিয়াহ সালাম ও কুশল বিনিময় করে নানিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
নাতনির কান্না দেখে আফিয়া খাতুনের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে গায়ে হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিতে দিতে বললেন, জন্মের পর থেকে অনেক দুঃখ পেয়েছিস, এবার আল্লাহ তোকে সুখের মুখ দেখিয়েছে, কাঁদবি কেন?
বড় মামা ঈদরীশ বলল, তোকে শক্ত হতে হবে মা। তা না হলে বাবার এত কিছু সামলাবি কি করে?
মেজ মামা মিজান বলল, ও মেয়েছেলে, একা সব কিছু সামলাতে পারবে না। আমরা ওকে সাহায্য করব।
সেজ মামা ইউনুস বলল, হ্যাঁ মেজ ভাই, তুমি ঠিক কথা বলেছ। ওকে একা পেয়ে কত লোক ওর পেছনে লাগবে। আমাদেরকে ওর সঙ্গে এখানেই থাকতে হবে। নচেৎ তাদেরকে ঠেকাবে কে?
ততক্ষণে যাকিয়াহ সামলে নিয়ে নানিকে বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসেছে। সেজ মামা থেমে যেতে ছোট মামা রশিদকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি, কিছু বলবেন না? যাকিয়াহ ছোট মামাকে অন্য মামাদের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করে।
চার মামার মধ্যে ছোট মামা রসিদ যাকিয়াহকে ছোটবেলা থেকে বেশি ভালবাসে। ইনকাম কম বলে যাকিয়াহর পড়ার খরচ তেমন দিতে না পারলেও তার আবদার পূরণ করে, ঢাকার দর্শনীয় জায়গাগুলোতে বেড়াতে নিয়ে গেছে। অন্য ভাইয়েরা যাকিয়াহকে জারজ মনে করলেও সে করে না। মায়ের কাছে যা শুনেছে সেটাই বিশ্বাস করে। যাকিয়াহর কথা শুনে বলল, আমি শুধু একটা কথা বলব, যদি কখনও প্রয়োজন হয় আমাকে জানাস, যতটুক পারি সাহায্য করব।
ঈদরীশ রেগে উঠে বলল, প্রয়োজন হলে খবর দেবে কেন? আমরা এখানে থেকে সব কিছু দেখা শোনা করব। তোদের যদি কারো থাকতে অসুবিধে হয় আমি থাকব।
মিজান ও ইউনুস বলে উঠল, আমরা বলেছি নাকি এখানে থাকতে অসুবিধে হবে?
বড় তিন মামার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে যাকিয়াহ বলল, আপনারা চুপ করুন। এবার আমি যা বলছি শুনুন? ছোট মামা ঠিক কথা বলেছেন, এখানে কাউকে থাকতে হবে না। যদি কখনও কোনো প্রয়োজন হয়, আমি আপনাদের জানাব। নানি আমার কাছে থাকবেন।
বড় তিন মামা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর প্রথমে বড় মামা বলল, এতবড় বাড়িতে কাজের লোক ছাড়া তুই একা থাকিস, কত রকম বিপদ হতে পারে সামলাবি কি করে?
যাকিয়াহ বলল, ওসব নিয়ে আপনাদের দুশ্চিন্তা করতে হবে না। ইনশাআল্লাহ সামলাতে পারব। তবু যদি প্রয়োজন হয় আপনাদেরকে জানাব। তারপর আপ্যায়ন করিয়ে তাদেরকে বিদায় দিল।
আফিয়া খাতুন বড় তিন ছেলের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলেন। তারা চলে যাওয়ার পর বললেন, তুই ঠিক কাজ করেছিস, রসিদ ছাড়া সবাই তোর সবকিছু লুটেপুটে খেতে চেয়েছিল। তা হ্যাঁরে, জাহাঙ্গীরকে ছুরী মেরে কোথায় চলে গিয়েছিল? ইশতিয়াক তোকে খুঁজে পেল কি করে? জানিস, তোর জন্য কত কেঁদেছি আর তোর ভালোর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি।
যাকিয়াহ সংক্ষেপে সবকিছু বলল, ইশতিয়াক যদি ঐ দিন খুজঁতে না যেতো, তা হলে হয়তো আমাকে আর কোনোদিন পেতে না।
ইশতিয়াক তোর খোঁজ নিতে আসে?
সে তো ঢাকায় নেই, আমাকে এখানে পৌঁছে দিয়ে ঐ দিন রাতের বাসে বাড়ি চলে গেছে।
তুই তাকে থাকতে বলিস নি?
না।
খুব ভুল করেছিস। সে তোর জন্য কি না করেছে। তাকে থাকতে বলা তোর উচিত ছিল।
হাঁ, ভুল করেছি। ভুলটা বুঝতে পেরে পরেরদিন আকবর হোসেন চাচাকে ফোন করে তা খোঁজ করেছিলাম। উনিই তার বাড়ি চলে যাওয়ার কথা বললেন।
তুই তার বাড়ির ঠিকানা জানিস?
জানি।
তা হলে চিঠি দিয়ে আসতে বল। চিঠিতে আমিও তাকে আসতে বলেছি লিখবি।
নানি যে ইশতিয়াককে নাত জামাই করতে চান, সে কথা যাকিয়াহ অনেক আগেই জানে। তাই মৃদু হেসে বলল, যদি না আসে?
তুই তার সঙ্গে যে ব্যবহার করিস, তোর কথায় নাও আসতে পারে। তাই তো আমার কথা লিখতে বললাম।
চিঠি দেয়ার ইচ্ছা না থাকলেও নানিকে খুশি করার জন্য বলল, ঠিক আছে, লিখব।
আরও দুদিন পর গোলাম মোস্তফার চাচাত ভাই মোস্তাক এল। আলাপ পরিচয়ের পর বাবার ডায়েরীতে লেখা কথাগুলো যাকিয়াহর মনে পড়ল। ভাবল, এই লোকের কারণে বাবা মাকে চলে যেতে বাধ্য করে। সুফি দরবেশের মতো লেবাস দেখে রাগতে গিয়েও রাগতে পারল না। আপ্যায়ন করানোর পর জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছেন বলুন।
আমার কারণে তোমার মা বাবার বিচ্ছেদ হয় আর তুমিও বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
যাকিয়াহ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ওসব কথা বাবার ডায়েরী পড়ে জেনেছি। শুধু তাই নয়, আপনি যে বাবা মারা যাওয়ার আগে সবকিছু জানিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং বাবা আপনাকে মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছিলেন, তাও ডায়েরী পড়ে জেনেছি। ওসব কথা বাদ দিয়ে কেন এসেছেন বলুন।
মোশতাক চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি মা।
যাকিয়াহ বলল, একটা হাদিস বলছি শুনুন, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে নিজের পাপের জন্য অনুতপ্ত, সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে সেই পাপ করে নাই।” [বর্নণায় : হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) – ইবনে মাসা।]
আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম, আর হাদিস মোতাবেক আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করেছেন।
আল্লাহ তোমাকে দো’ জাহানে সুখী করুক মা। তারপর বিদায় নিয়ে মোশতাক চলে গেল।
৮
বেডিংপত্র নিয়ে ইশতিয়াক ফিরে এলে সমীরণ বিবি খুশি হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, যাকিয়াহকে ঠিক জায়গামতো পৌঁছে দিয়েছিস তো?
ইশতিয়াক বলল, হ্যাঁ, একেবারে তার বাবার রাজপ্রাসাদে। সে এখন রাজকন্যা।
দোয়া করি, আল্লাহ তাকে রাজরানী করুক। আসার সময় তোকে কিছু বলেনি?
ইশতিয়াকের মুখে করুন হাসি ফুটে উঠল। বলল, রাজকন্যা কি আর আমার মতো হতভাগার সঙ্গে কথা বলবে?
সমীরণ বিবি রেগে উঠে বললেন, তুই হতভাগা কিসের? আমি রয়েছি না? আমার সবকিছু তোকে লিখে দেব। তুই শুধু দেখাশোনা কর, তা হলে কয়েক বছরের মধ্যে তুইও রাজপুত্র হতে পারবি।
রাতে খাওয়ার সময় সমীরণ বিবি জয়নালের বৌকে একচোট নিলেন। এসব খাবার মুখে দেয়া যায়? কত করে বললাম, যাকিয়াহর কাছে রান্না করা শিখে নে। কানেই তুললি না কথাটা। তারপর ইশতিয়াককে বললেন, আমি এবার তোর বিয়ে দিয়ে এমন মেয়ে নিয়ে আসব, যে নাকি ভালো রান্না বান্না করতে পারে।
বিয়ের কথা শুনে ইশতিয়াকের যাকিয়াহর কথা মনে পড়তে মন খারাপ হয়ে গেল। বড়মা যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য মাথা নিচু করে চুপচাপ খেতে লাগল।
কি রে, কিছু বলছিস না কেন? তোর কোনো অজুহাত শুনব না। যাকিয়াহর হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে জয়নালের বৌ-এর হাতের রান্না গলা থেকে নামতে চায় না। যদি রাজি না হস, তা হলে না খেয়ে মরব, তবু জয়নালের বৌ-এর হাতের রান্না খাব না।
রাজি হব না কেন? কিন্তু বৌও যদি ভালো রান্না করতে না পারে তখন কি হবে?
বৌ করার আগে ভালো রান্না করতে পারে কি না জেনে পাত্রী ঠিক করব।
তা হলে তো ঐ মেয়ের হাতের রান্না তোমাকে খেতে হবে আর সে জন্যে মেয়ের বাড়িতে তোমাকে দু’একদিন থাকতে হবে।
হ্যাঁ, তাই থাকব।
সাগীর ও তাদের সাথে খাচ্ছিল। বলে উঠল, কক্সবাজারে আমার একটা খালাত বোন আছে, সে খুব ভালো রান্না করতে পারে। মাগার বেশি লেখাপড়া করেনি।
সমীরণ বিবি বললেন, তাকে তোর বৌ করব। ইশতিয়াকের জন্য অন্তত বি.এ. পাশ মেয়ে দরকার।
নিজের বিয়ের কথা শুনে সাগীর খুশি হলেও লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল।
ইশতিয়াক বলল, বড়মা, একটা কথা বলব, রাগ করবেন না বলুন?
করব না, বল কি বলবি।
চার বছর ছাত্র পড়িয়ে কিছু টাকা জমিয়েছি। সেই টাকা দিয়ে চকরিয়ায় কাঠের ব্যবসা করতে চাই। ব্যবসা একটু দাঁড়ানোর পর বিয়ে করব।
তুই কি তা হলে এত দিন আমাকে না খাইয়ে মেরে ফেলতে চাস?
তা কেন? সাগীর বলল না, তার খালাত বোন ভালো রান্না করতে পারে? তাকে সাগীরের বৌ করে আনলে তো আর কোনো সমস্যা থাকবে না?
কিন্তু ছেলে পড়িয়ে কত টাকা আর জমিয়েছিস? ঐ টাকায় কি আর কাঠের ব্যবসা করতে পারবি? আমার কাছে থাকলে না হয় দিতাম।
আপনি অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। ভাবছি, কাউকে পার্টনার নেব। আল্লাহ রাজি থাকলে কাউকে না কাউকে পেয়ে যাব।
তুই তো বলেছিলি চাষবাস ও আগান-বাগান দেখাশোনা করবি, পুকুরে মাছের চাষ করবি, ব্যবসা করবি বলছিস কেন?
ওসব তো করবই,বার মাস তো ওসব কাজ হচ্ছে না। শুধু শুধু বসে না থেকে ব্যবসা করতে দোষ কি? তা ছাড়া সাগীরকে সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে নেব। ওর বিয়ে দেবেন বলছেন, ওকেও তো রোজগার করার পথ দেখাতে হবে।
কথাটা মন্দ বলিস নি, ওরও রুজী রোজগারের ব্যবস্থা করা দরকার।
মাস দুয়েক চেষ্টা করে আমজাদ হোসেন নামে রামুর এক ধনাঢ্য লোক কাঠের ব্যবসা করার জন্য টাকা দিতে রাজি হলেন। তবে তিনি দু’টো শর্ত দিলেন, প্রথম শর্ত হল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চকরিয়ায় নয়, রামুতে হবে আর দ্বিতীয় শর্ত হল, লভ্যাংশ তিন ভাগের দুই ভাগ ওনাকে দিতে হবে। সে ব্যাপারে দলিলপত্র করার জন্য আজ বেলা তিনটার দিকে ইশতিয়াক রামু রওয়ানা হল। সেখানে গিয়ে শুনল, আমজাদ হোসেন গতকাল ঢাকা গেছেন, আজ বিকেলে ফিরবেন। কাজটা সেরে ফিরবে ভেবে সন্ধ্যে পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন আমজাদ হোসেন ফিরলেন না তখন মাগরিবের নামায পড়ে বাড়ি ফেরার কথা ভেবে মসজিদে গেল।
নামায শেষ হওয়ার আগেই বৃষ্টি নামল। প্রায় একঘন্টা পর বৃষ্টি থামতে ইশতিয়াক বাসে উঠল।
গতকাল পূর্ণিমা গেছে। ইশতিয়াক যখন চকরিয়ায় বাস থেকে নামল তখন। আকাশে খন্ড খন্ড মেঘরাশি উড়ে বেড়াচ্ছে আর তারই ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ উঁকি দিয়ে জ্যোত্মা ছড়াচ্ছে। মসজিদে এশার জামাত হচ্ছে দেখে ইশতিয়াক জামাতে সামিল হয়ে নামায আদায় করল। তারপর বাড়িতে এসে যখন পৌঁছাল তখন রাত দশটা।
রামু যাওয়ার জন্য ইশতিয়াক বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পরে সাগীর পুকুরে সার ছড়াচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তার দিকে তাকাতে যাকিয়াহকে একটা ছোট চামড়ার সুটকেস কোলে নিয়ে রিকশায় আসতে দেখে যেমন অবাক হল তেমনি খুশি হল। সে যে আর কোনোদিন এখানে আসবে না, সে কথা ফুফুর কাছে শুনে খুব দুঃখ পেয়েছিল। এখন তাকে দেখে সারের ধামাটা পুকুরপাড়ে রেখে ছুটে ঘরে এসে ফুফুকে বলল, যাকিয়াহ আপাকে আসতে দেখলাম।
সমীরণ বিবি বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসেছিলেন আর জয়নালের বৌ মাথায় নারকেল তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল।
সাগীরের কথা শুনে বললেন, দূর হতভাগা, সে আসবে কেন? কাকে বলতে কাকে দেখেছিস? তুই তো পুকুরের সার ফেলতে গিয়েছিলি, ফেলা হয়ে গেছে?
অর্ধেক ফেলা হয়েছে, যাকিয়াহ আপাকে আসতে দেখে খবরটা দিতে এলাম। সত্যি বলছি ফুফু, আমি ঠিকই দেখেছি।
ঠিক আছে, তুই তোর কাজে যা।
সাগীর পুকুরপাড়ে না গিয়ে বৈঠকখানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল।
পুকুরপাড় থেকে রাস্তাটা দেখা গেলেও বেশ কয়েকটা বাড়ি পার হয়ে আসতে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বৈঠক খানার সামনে এসে রিকশা থামতে সাগীর এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন আপা?
যাকিয়াহ সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো না থাকলে এলাম কি করে? তারপর রিকশা বিদায় করে জিজ্ঞেস করল, আপনারা সবাই কেমন আছেন?
আমরা ভালো আছি। আমি পুকুরপাড় থেকে আপনাকে দেখতে পেয়ে ঘরে গিয়ে ফুফুকে বললাম। তারপর ফুফু যা বলেছিলেন, সে সব বলল, আমাকে সুটকেসটা দেন।
না-না, নিতে হবে না, এটাতে ভারি কিছু নেই।
তা হলে আমি আগে গিয়ে ফুফুকে বলি, সত্যিই আপনি এসেছেন। এই কথা বলে সাগীর দ্রুত হেঁটে ঘরে এল।
তাকে দেখে সমীরণ বিবি রাগের সঙ্গে বললেন, কি রে, এখনও সার ফেলতে যাস নি? তোকে নিয়ে আর পারা গেল না, একটা কাজ যদি ঠিক মতো করিস।
এমন সময় যাকিয়াহকে আসতে দেখে আবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সাগীর ফুফুকে উদ্দেশ্য করে আনন্দিতস্বরে বলল, এবার আমার কথা বিশ্বাস হল তো?
যাকিয়াহ কাছে এসে সালাম দিয়ে সমীরণ বিবিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনার স্নেহ মমতা বাবার ঐশ্বর্যের পাঁচিল বন্দি করে রাখতে পারেনি। তাই সেই পাঁচিল ভেঙ্গে চলে এসেছি আপনার কাছে। আপনি আমাকে স্নেহ মমতার আঁচলের নিচে আশ্রয় দেবেন না?
তার কথা শুনে সমীরণ বিবির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। তাকে বুকে চেপে ধরে ভিজে গলায় বললেন, আল্লাহ তোমাকে দান করবেন, তাই আমাকে কোনো সন্তান দেন নি। তোমার মতো মেয়ে পেয়ে আমি ধন্য। কথায় আছে, সবরের গাছ বড় তীতা, ফল বড় মিষ্টি। আল্লাহ কথাটা আমার জীবনে প্রমাণ করে দেখালেন। সে জন্য তাঁর দরবারে জানাই লাখ লাখ শুকরিয়া। এবার জামা কাপড় পাল্টে অযু করে নামায পড়ে নাও। জয়নালের বৌ ততক্ষণ তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করুক।
যাকিয়াহ বলল, ইশতিয়াক ভাই কোথায়?
সমীরণ বিবি বললেন, কাঠের ব্যবসা করার জন্য এতদিন পার্টনার খুঁজছিল। রামুর একজন লোক রাজি হয়েছে। তার সঙ্গে দেখা করতে গেছে, ফিরতে দেরি হবে।
যাকিয়াহ কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, বড় মা, আমি এসেছি তাকে জানাবেন না। তারপর জয়নালের বৌ ও সাগীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমারা ও জানাবে না।
সমীরণ বিবি মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে মা, তাই হবে। তারপর সাগীরকে বললেন, হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? পুকুরে সার ছিটাতে যাবি না?
.
এশার নামাযের পর সমীরণ বিবি বারান্দায় বসে যাকিয়াহ কেন সবকিছু ছেড়ে চলে এল তার কাছে শুনছিলেন। এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, কটা, বেজেছে বলতো?
যাকিয়াহ বলল, প্রায় দশটা বাজে।
সমীরণ বিবি চিন্তিত মুখে বললেন, ইশতিয়াক এখনও আসছে না কেন? ওতো এত রাত অবধি বাইরে থাকে না। যেখানেই যাক না কেন এশার আজানের সময় চলে আসে।
যাকিয়াহ বলল, যে লোকের সঙ্গে দেখা করতে গেছে, তিনি হয়তো বাড়িতে ছিলেন না। তাই ওনার ফেরার অপেক্ষায় আছে। এতে চিন্তার কি আছে?
বাড়িতে না থাকলে চলে আসবে, কাল না হয় আবার যাবে? তাই বলে এত রাত পর্যন্ত থাকবে? দিনকাল ভালো না, কার মনে কি আছে বলাতো যায় না।
এমন সময় সদর দরজায় কড়া নাড়ার সাথে সাথে ইশতিয়াকের গলা শোনা গেল, সাগীর ভাই, দরজা খোল।
সমীরণ বিবি জয়নালের বৌকে বললেন, তুই গিয়ে দরজা খুলে দে, সাগীর নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর যা ঘুম, ঢাক ঢোল বাজালেও ভাঙ্গবে না।
জয়নালের বৌ যেতে উদ্যত হলে যাকিয়াহ তাকে বলল, খবরদার, আমার কথা বলবে না। তারপর ইশতিয়াকের রুমে ঢুকে পড়ল।
তাই দেখে সমীরণ বিবির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুঠে উঠে মিলিয়ে গেল।
ইশতিয়াক জানে বড় মা খাওয়া দাওয়া করে নটা সাড়ে ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। তাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে বলল, আপনি এখনও ঘুমান নি? লোকটা বাড়িতে ছিল না, তার ফেরার অপেক্ষায় বসে ছিলাম। ফিরে না দেখে চলে আসব এমন সময় বৃষ্টি শুরু হল, তাই দেরি হয়ে গেল। আপনি ঘুমিয়ে পড়তে পারতেন? জয়নালের বৌ আমাকে খেতে দিত। যান ঘুমিয়ে পড়ুন।
সমীরণ বিবি বললেন, এখনও তো খাই নি। না খেয়েই ঘুমাব না কি? তাড়াতাড়ি কাপড় ছেড়ে হাত পা ধুয়ে আয়, একসঙ্গে খাব।
যাকিয়াহ রুমে এসে ডিম লাইট জ্বেলে কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। ইশতিয়াক রুমে ঢুকে বড় লাইট জ্বালাবার জন্য সুইচ বোর্ডের দিকে হাত বাড়াতে বলে উঠল, প্লীজ, বড় লাইট জ্বালাবে না। তারপর দরজা ভিড়িয়ে সালাম দিল।
ইশতিয়াক ভূত দেখার মতো চমকে উঠে হাত নামিয়ে তার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
যাকিয়াহ মৃদু হেসে বলল, আমি ভূত-পেত্নী না, তোমার মানসি যাকিয়াহ।
ইশতিয়াক ডিম লাইটের গাড় সবুজ আলোতে তাকে চিনতে পারলেও নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পরল না। একইভাবে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
তার মনের অবস্থা বঝুতে পেরে যাকিয়াহ এগিয়ে এসে একটা হাতে চিমটি কেটে হাতটা ধরে রেখে বলল, কি, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আমি ভূত-পেত্নী না, মানুষ? তারপর আবার বলল, তুমি কিন্তু সালামের উত্তর দাও নি।
ইশতিয়াক সম্বিত ফিরে পেয়ে সালামের উত্তর দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, তুমি আমার মানসি এ কথা ঠিক; কিন্তু আমি তোমার কাছে একটা অপদার্থ ও লোভী ছেলে। নিশ্চয় কোনো প্রয়োজনে এসেছ?
যদি বলি তোমার ধারণা ভুল? তুমি আমার কাছে অনেক কিছু?
অনেক কিছু তো হতেই পারি না। বড় জোর উপকারী বন্ধু হতে পারি। তবে আমাকে তুমি যাই মনে কর না কেন, সারাজীবন তুমি মানষি হয়ে আমার বুকের মধ্যে থাকবে। সেখানে অন্য কোনো মেয়ের স্থান মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হবে না। মনে হচ্ছে, বাবার সম্পত্তি নিয়ে বিপদে জড়িয়ে পড়েছ তাই এসেছ। কি বিপদ বল, উদ্ধার করার জন্য প্রাণ উৎস্বর্গ করতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করব না। মানসিকে উদ্ধার করতে পেরেছি জেনে হাসি মুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করব।
ইশতিয়াক তাকে ভালবাসে যাকিয়াহ জানত; কিন্তু এত ভালবাসে জানত না। এখন বুঝতে পেরে নিজেকে সম্বরণ করতে পারল না। ধর্মের বিধি নিষেধ ভুলে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, অজ্ঞানতার কারণে বুঝতে না পেরে তোমাকে অসংখ্যবার অপমান করেছি। তোমার ভালবাসাই আমার জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছে। তাই তো এবারে উপকারী বন্ধুর কাছে আসি নি, এসেছি ভালবাসার কাঙ্গাল হয়ে তোমার পায়ে নিজেকে সোপর্দ করতে। আর সম্পত্তি নিয়ে বিপদে জড়িয়ে পড়েছিলাম ঠিক, তবে সে সব বিক্রি করে দিয়ে বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে চিরকালের জন্য তোমার কাছে চলে এসেছি। দয়া করে আমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে আমাকে গ্রহণ কর।
যাকিয়াহ এত তাড়াতাড়ি এভাবে ধরা দেবে ইশতিয়াক কল্পনাও করেনি। আনন্দে তার চোখও পানি এসে গেল। সেও ধর্মের বিধি নিষেধ ভুলে তাকে বুকে চেপে ধরে বলল, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?
যাকিয়াহ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, না ইশতিয়াক ভাই না, স্বপ্ন নয়, বাস্তব। পরক্ষণে সচকিত হয়ে উঠে বলল, প্লীজ ছেড়ে দাও। বিয়ের আগে যা করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ, আবেগের বশে আমরা দু’জনে তা করে কঠিন গুণাহ করে ফেললাম।
ইশতিয়াক আর একবার চমকে উঠে তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমি ঠিক কথা বলেছ। এরজন্য দু’জনকেই তওবা পড়ে আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে হবে। তারপর জিজ্ঞেস করল, কখন এসেছ?
তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পর।
বুঝতে পারছি না, তোমার আসার কথা আমাকে কেউ জানাল না কেন?
তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য সবাইকে জানাতে নিষেধ করেছিলাম।
আমাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজে যেমন বড় গুণাহর কাজ করে ফেললে, তেমনি আমাকেও করালে।
আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করুক, এরকম পরিস্থিতিতে পড়ব ভাবিনি।
তা হলে আবার যাতে এই পরিস্থিতে পড়তে না হয়, সে জন্য বড়মাকে বলি। কালকেই আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে?
সে তুমি জান বলে যাকিয়াহ বসে তার পায়ে হাত রেখে বলল, আমার সব অন্যায় ক্ষমা করে দিয়েছ বল?
ইশতিয়াক ঘাঁড় ফিরিয়ে তার মুখ অঞ্জলী করে ধরে বলল, তুমি যত কিছু অন্যায় করে থাক না কেন, ক্ষমা করে দিয়েছি এবং ভষ্যিতে করলেও দেব। তুমি জান না যাকিয়াহ, আগুনে ঘী ঢাললে যেমন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে, তোমার অপমান ও অবহেলা আমার ভালবাসার আগুনকে তেমনি আরও তীব্র করেছে। তোমাকে যদি না পেতাম, তবে সেই আগুনে পুড়ে বেহেস্তের সুখ অনুভব করতাম।
যাকিয়াহ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, এবার তুমি চুপ কর ইশতিয়াক ভাই, চুপ করো। আরও কিছু বললে হয়তো সহ্য করতে না পেরে হার্টফেল করে মরে যাব। তুমি যে আমাকে এত ভালবাস, এই হতভাগী জানতাম না। আমি তোমার ভালবাসার কতটুকু প্রতিদান দিতে পারব জানি না। শুধু, এতটুকু বলতে পারি, আমার সমস্ত অণুপরমাণু দিয়ে আমৃত্যু তোমাকে সুখী করার চেষ্টা করব। আর সেই জন্যেই সবকিছু বিক্রি করে বাবার ঋণ শোধ করার পর অবশিষ্ট কয়েক লাখ টাকা নিয়ে চলে এসেছি।
টাকা নিয়ে আসার কথা শুনে ইশতিয়াক অসন্তুষ্ট গলায় বলল, টাকা না নিয়ে এসে কোনো মাদ্রাসার এতিমখানায় দান করে দেয়া উচিত ছিল। তুমি কি। ভেবেছ, ঐ টাকা আমি নেব?
যাকিয়াহ চোখ মুছে বলল না, তা ভাবিনি।
তা হলে নিয়ে এলে কেন?
উম্মুল মু’মেনীন হযরত খাদিজুল কুবরা (রাঃ) বাসর রাতে তাঁর বিপুল ঐশ্বর্য স্বামী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) কে দিয়ে স্বামী ভক্তির যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, আমি আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) কে খুশি করার জন্য তাঁকে অনুস্বরণ করতে চাই। তাই আমার যা কিছু ছিল, সব নিয়ে এসেছি। ঘুর্ণাক্ষরেও মনে করো না, আমরা সুখে থাকব বলে এনেছি। ইচ্ছা করলে ঐ টাকা তুমি এখানকার মাদ্রাসার এতিমখানায় দান করতে পার অথবা অন্য যে কোনো ভালো কাজে খরচ করতে পার। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ঐ টাকা দাবি করব না, অথবা কিসে খরচ করলে সে কৈফিয়তও চাইব না।
এমন সময় সমীরণ বিবির গলা শুনতে পেল, তোরা আর কত দেরি করবি? সারারাত সবাইকে না খাইয়ে রাখতে চাস না কি?
Leave a Reply