প্রেম ও স্বপ্ন – কাসেম বিন আবুবাকার
০১.
মাহবুব সাঁতার প্রতিযোগীতায় তিনটে স্বর্ণপদক পেয়ে স্টেডিয়াম থেকে বেরোবার সময় গেটে প্রচণ্ড ভীড়ের সম্মুখীন হল। কয়েকশো ছেলে-মেয়ে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য তাকে ঘিরে ধরেছে। বন্ধু মাসুমের সাহায্যে অটোগ্রাফ দিতে দিতে কোনো রকমে ভীড় ঠেলে যখন রাস্তায় এসে রিকশায় উঠবে, ঠিক তখনই মাহবুবা নোটবুক খুলে এগিয়ে ধরল।
মাহবুব তার মুখের দিকে এক পলক তাকাতে গিয়ে দৃষ্টি আটকে গেল। এত সুন্দর মুখ আর কখনো দেখেনি। মাসুমের কুনুইয়ের গুঁতো খেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অটোগ্রাফ দিল।
প্লীজ, বাসার ঠিকানাটা দিন।
মাহবুব রাগতে গিয়ে পারল না। তার মনে হল কেউ যেন কানে মধু ঢেলে দিল। মুখের দিকে না তাকিয়ে পারল না। ফলে চোখে চোখ পড়ে গেল। চোখ নয় যেন প্রেমের সাগর। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, আমি মেসে থাকি।
মেসের ঠিকানাই দিন।
মেয়েটার কণ্ঠস্বর বার-বার মাহবুবের কানে যেন মধু ঢেলে দিচ্ছে। নিজের অজান্তেই ঠিকানা লিখে দিল।
মাহবুবা নোট বুক নেওয়ার সময় ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, যদি কিছু মনে না করেন, আমি আপনাদেরকে লিস্ট দিতে চাই।
মাহবুব স্মিত হাস্যে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, মাফ করবেন, আমি আপনার অফার গ্রহণ করতে পারছি না। তারপর রিকশায় উঠে বসল।
মাসুম আগেই উঠে বসেছিল, মাহবুব বসার পর রিকশাওয়ালাকে যেতে বলল।
রিকশা কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর মাসুম পিছন দিকে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটা তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে কুনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে কথাটা মাহবুবকে বলে বলল, মনে হয় মাইণ্ড করেছে।
মাহবুব বলল, তা করতে পারে। তাই বলে তার কথা আমাকে শুনতে হবে না কি?
মাসুম বলল, যাই বলিস, মেয়েটা দেখতে কিন্তু দারুণ। এত সুন্দরী মেয়ে জীবনে আর কোনো দিন দেখিনি। মেয়েটার কথা শুনে ও ড্রেস দেখে মনে হচ্ছে, নিশ্চয় ধনীর দুলালী।
মাহবুব একটু বিরক্ত হয়ে বলল, তাতে আমার কি? তুইও তো ধনী পুত্র। যদি মনে ধরে থাকে ফিরে গিয়ে আলাপ কর।
আমি তো আর তোর মতো সুঠাম দেহের অধীকারী সুপার স্টার নই, আর সাঁতারে তিনটে স্বর্ণপদকও পাইনি।
তুই চুপ করবি, না রিকশা থেকে নামিয়ে দেব?
ঠিক আছে, এই চুপ করলাম বলে মাসুম গম্ভীর হয়ে বসে রইল। কিন্তু বেশিক্ষন চুপ করে থাকতে পারল না। বলে উঠল, দোস্ত, সত্যি বলছি, আমার দিকে কোনো মেয়ে ঐ ভাবে তাকালে নির্ঘাৎ মোমের মতো গলে যেতাম। তোর দিলটা আল্লাহ যে কী দিয়ে। তৈরী করেছে না, তা তিনিই জানেন।
মাহবুব রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই যে ভাই থামান।
মাসুম রিকশাওয়ালাকে থামাতে নিষেধ করে মাহবুবের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, এত নির্দয় হসনি দোস্ত। কি জানিস, মেয়েটা তোর দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখছে। আর তুইও তো বাপু তার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলি।
মাহবুব খুব বিরক্ত বোধ করলেও হেসে ফেলল। বলল, তুই কখনো পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করেছিস? তুই তো কেমেস্ট্রির ছাত্র, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠার ঘন্টা বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকিস, চাঁদের সৌন্দর্য দেখার সময় তোর কোথায়?
তা ঠিক, তবে পূর্ণিমার চাঁদ অনেকবার দেখেছি। সত্যি বলতে কি, মেয়েটার মুখটাও ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতো।
মাহবুব আবার হেসে ফেলে বলল, কেমেস্ট্রির ফরমূলা মুখস্থ করতে করতে সত্যিই তোর ব্রেন আউট হয়ে গেছে। নচেৎ একবার আমাকে আবার একবার মেয়েটাকে পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে তুলনা করতিস না। লুকিং গ্লাসে নিজের মুখ ভালো করে দেখবি। নিজের মুখকেও তাই মনে হবে।
মাসুমের গায়ের রং শ্যামলা। তাই মুখ ভার করে বলল, আমি কালো, তাই কোনো মেয়ে আমার দিকে তাকায় না। কিন্তু তুই একথা বলতে পারলি?
মাহবুব বলল, কথা প্রসঙ্গে রসিকতা করে বললাম, তুই মাইণ্ড করবি জানলে বলতাম না। ঠিক আছে, আর কখনো এরকম রসিকতা করব না মাফ করে দে।
মাসুম ভনিতা করে কথাটা বলেছিল। মাহবুবের কথা শুনে বলল, মাফ করতে পারি, যদি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিস।
বল কি জানতে চাস।
মেয়েটা অত্যন্ত সুন্দরী এটা ঠিক কিনা তোকে বলতে হবে?
মাহবুব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ তোর কথাই ঠিক, মেয়েটার মুখ যেন পূর্ণিমার চাঁদের মতো।
মাসুম তার পিঠ চাপড়ে বলল, এইতো দোস্ত, সেই ঘাটের পানি খেলি, তবে ঘোলা করে।
ততক্ষনে তারা মেসে পৌঁছে গেল।
তারা দয়াগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশে স্বামী বাগে একটা মেসে থাকে। মেসটার মোট ছয়টা রুম। প্রত্যেক রুমে চারটে করে সিট। এখানে যারা থাকে তারা সবাই চাকরি করে। শুধু মাসুম ও মাহবুব ছাত্র। তারা দু বন্ধুতে মিলে একটা রুমে থাকে। মাহবুব ইংলিশে আর মাসুম কেমেস্ট্রিতে মাষ্টার্স করছে।
রুমে ঢুকে মাসুম বলল, মেয়েটা তোর ঠিকানা কেন নিল কিছু বুঝতে পারছিস?
কেন পারব না? মনে করেছিল আমি হয়তো কোনো বড় লোকের ছেলে। মেসে থাকি শুনে তো আর না করতে পারে না তাই সেটাই দিতে বলল।
আমার কিন্তু অন্য কথা মনে হচ্ছে।
কি কথা শুনি।
তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য।
তুই বড় ফালতু কথা বলিস।
দেখিস আমার ফালতু কথাটাই একদিন তোর কাছে দামি হয়ে দাঁড়াবে।
যখনকার কথা তখন ভাবা যাবে এবার তুই থাম, সেই কখন থেকে বক বক করছিস।
.
পরের দিন কাগজে কষ্টিউম পরা ও মেডেল গলায় মাহবুবের ফটো ছাপা হয়েছে। মাহবুবা অনেক্ষণ ফটোর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বাবার রুমে গেল।
আনিস সাহেব অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলেন। শামীমা বেগম স্বামীর গায়ে কোট পরিয়ে দিচ্ছিলেন। মেয়েকে দেখে বললেন, কিছু বলবি?
মাহবুবা কাগজটা খুলে তাদের সামনে ধরে বলল, যে ছেলেটার কথা তোমাদের সঙ্গে প্রায় আলাপ করি, এই সেই ছেলে। জান বাবা, সাঁতারে তিনটে স্বর্ণ পদক পেয়েছে।
আনিস সাহেব কাগজটা নিয়ে মাহবুবের ছবির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, ছেলেটাতো দেখতে দারুন। তা ওকে একদিন বাসায় নিয়ে আয় আলাপ করা যাবে।
শামীমা বেগম স্বামীর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে ভালো করে দেখে বললেন, বাহ, খুব সুন্দর ছেলেতো, হ্যাঁ, তাই নিয়ে আসিস।
কি যে বল না তোমরা, ওর সঙ্গে এখনো ভালভাবে পরিচয়ই হয়নি, নিয়ে আসব কি করে?
পরিচয় করিসনি কেন?
ওর পাত্তাই পাওয়া যায় না।
তুই তো বলেছিলি ও ভার্সিটিতে পড়ে, তা হলে পাত্তা পাচ্ছিসনা কেন?
ভার্সিটিতে কত হাজার হাজার ছেলে মেয়ে পড়ে তাদের মধ্যে একজনের পাত্তা পাওয়া কঠিন নই কি?
তা কঠিন, তবে চেষ্টার দ্বারা কঠিনকে সহজ করা যায়।
চেষ্টার ত্রুটি করছি না। কাল চান্সও পেয়েছিলাম; কিন্তু সফল হতে পারিনি।
কেন?
মাহবুবা কালকের ঘটনাটা বলল।
আনিস সাহেব বললেন, ছবি দেখেই মনে হচ্ছে ছেলেটার একটা ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট রয়েছে। এই ধরনের ছেলেরা খুব সেন্টিমেন্টাল হয়। এখন যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
শামীমা বেগমও ব্রীফকেসটা হাতে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় বয়স্ক ড্রাইবার দাঁড়িয়েছিল। বেগম সাহেবের হাত থেকে ব্রীফকেসটা নিয়ে আগে আগে চলে গেল। শামীমা বেগম বললেন, ছেলেটা কিন্তু দারুন, মাহবুবার সঙ্গে যা মানাবে না?
আনিস সাহেব মৃদু হেসে বললেন, তোমার সঙ্গে আমিও একমত। তবে আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, অল দ্যাট গীটার ইজ নট গোল্ড।
তাতো বটেই। আমরা যাচাই করেই এগোবো। তারপর স্বামী গাড়িতে উঠে বসার পর বিদায় সম্ভাসন জানালেন। গাড়ি গেট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ফিরে এলেন।
মাহবুবাও তাদের পিছনে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মা-বাবার দিকে তাকিয়েছিল। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে, প্রতিদিন মা বাবাকে গাড়িতে তুলে বিদায় দেওয়ার দৃশ্য। কখনো মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া, কথা কাটা-কাটি তো দুরের কথা, মাকে অভিমান করতেও দেখেনি। তার মনে হল মা-বাবার মতো সুখী দম্পত্তি বোধ হয়। সারা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
শামীমা বেগম ফিরে এসে মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, কিরে কি ভাবছিস? চল ঘরে চল। তারপর যেতে যেতে বললেন, ছেলেটার খোঁজ খবর নিয়ে পরিচয় কর। তারপর একদিন নিয়ে আসবি।
চেষ্টার ত্রুটি করব না বলে মাহবুবা নিজের রুমে চলে গেল।
.
রাত্রে ঘুমোবার সময় মাহবুবের হঠাৎ রিকশায় ওঠার সময় যে মেয়েটা অটোগ্রাফ নিয়ে লিফট অফার করেছিল, তার কথা মনে পড়ল। ফেরার পথে রিকশায় মাসুমের কথা শুনে বিরক্ত ভাব দেখালেও মনে মনে খুশি হয়েছিল। এখন সেই সব কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরের দিকে স্বপ্ন দেখল, সে ক্লাস শেষে বাস ধরবে বলে ফুটপাত ধরে হেঁটে নীলক্ষেতে যাচ্ছিল। এমন সময় একটা প্রাইভেট কার তার সামনে ফুটপাত ঘেঁসে দাঁড়াল। মাহবুব সে দিকে না তাকিয়ে চলে যেতে লাগল। গাড়িটা ক্রস করে যাওয়ার সময় শুনতে পেল, মাহবুব সাহেব একটু দাঁড়ান।
মাহবুব অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটছিল বলে গলার স্বর চিনতে পারল না। চার বছর ভার্সিটিতে পড়ছে, কোনো মেয়ের সঙ্গে পরিচয় নেই। তাই আজ হঠাৎ কোনো মেয়েকে তার নাম ধরে ডাকতে শুনে অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
মাহবুবা ততক্ষনে গাড়ি থেকে নেমে মাহবুবের সামনে এসে বলল, চিনতে পারছেন?
মাহবুব তার মুখের দিকে তাকিয়ে চিনতে পেরে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
কোথায় যাবেন? আসুন না আপনাকে পৌঁছে দিই।
ধন্যবাদ বলে মাহবুব হাঁটতে শুরু করল।
মাহবুবা পথ আগলে বলল, আপনি আচ্ছা ছেলে তো, আমি আপনাকে লিফট দিতে চাইলাম, আর আপনি কিছু না বলে শুধু ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন?
মাহবুব থমকে দাঁড়িয়ে বলল, এভাবে কতজনকে লিফট দিয়েছেন?
মাহবুবা মাহবুবের মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ছল ছল চোখে বলল, বললে বিশ্বাস করবেন?
সেটা আমার ব্যাপার, বলেই দেখুন।
আপনাকেই প্রথম।
এমন সময় ফজরের আযান শুনে মাহবুবের ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্বপ্নের আমেজ নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল। তারপর উঠে বাথরুমের কাজ সেরে মাসুমকে জাগিয়ে নামাজের কথা বলে মসজিদে গেল।
.
বেশ কিছু দিন পরের ঘটনা মেয়েটির কথা মাহবুব এক রকম ভুলেই গিয়েছিল। আজ ভার্সিটিতে ক্লাস করে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে আসার সময় মুখোমুখি দেখা।
কয়েক সেকেণ্ড একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রথমে মাহবুবা সালাম দিয়ে। বলল, চিনতে পারছেন?
মাহবুবের তখন স্বপ্নের কথা মনে পড়ল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ পারছি।
আর বোধ হয় ক্লাস নেই?
এবারে মাহবুব ঘাড় নেড়ে না সূচক সায় দিল।
আমারও নেই। চলুন আপনাকে পৌঁছে দিই।
ধন্যবাদ বলে মাহবুব হাঁটতে শুরু করল।
মাহবুবা পথ আগলে বলল, আপনি আচ্ছা ছেলেতো, আমি আপনাকে লিফট দিতে চাইলাম, আর আপনি কিছু না বলে শুধু ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন?
মাহবুব থমকে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এর আগে কতজনকে লিফট দিয়েছেন?
মাহবুবাও তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেইভাবে আরো কয়েক সেকেন্ড থেকে ছল ছল চোখে বলল, বললে বিশ্বাস করবেন?
সেটা আমার ব্যাপার, বলেই দেখুন।
আপনাকেই প্রথম। তারপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে জিজ্ঞেস করল বিশ্বাস হল কিনা বলবেন না?
গত রাতের স্বপ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে যেতে দেখে মাহবুব আরো বেশি অবাক হল। চোখে পানি দেখে বুঝতে পারল, মেয়েটা সত্য বলেছে। বলল, হয়েছে।
তা হলে লিফটা নিশ্চয় গ্রহণ করবেন?
মাহবুব চলতে শুরু করে বলল, কিন্তু আমি তো এখন বাসায় যাব না।
মাহবুবাও তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, যেখানে যাবেন সেখানেই লিফট দেব। আমাকে লিফট দিয়ে আপনার কি লাভ? তা ছাড়া আপনি বললেই যে আমি গ্রহন করব, তা ভাবলেন কি করে?
গ্রহন করা না করা আপনার ব্যাপার, আর লাভের কথা যে বললেন, তা জানতে হলে আপনাকে আমার প্রস্তাব গ্রহন করতে হবে।
মাহবুব ক্ষণকাল চিন্তা করে বলল, একজন অপরিচিতকে গাড়িতে তোলা কী ঠিক হবে?
সেটা আমার ব্যাপার। এভাবে কথা না বলে গাড়িতে যেতে যেতে বললে ভালো হত না? আমি তো আর সন্ত্রাসী নই যে, আপনাকে কীডন্যাপ করব।
মাহবুবার কথাবার্তায় মাহবুব অভিভূত হল। জিজ্ঞেস করল, আমার পরিচয় জানেন?
না, জানার জন্যই তো চেষ্টা করছি।
কেন জিজ্ঞেস করতে পারি?
আগে গাড়িতে উঠুন তারপর বলব।
যদি বলি না?
মাহবুবা ম্লান মুখে বলল, তাহলে বুঝব আমার দুর্ভাগ্য।
তার ম্লান মুখ দেখে মাহবুবের দিলটা মোচড় দিয়ে উঠল। বলল, ঠিক আছে চলুন।
মালিক কন্যার সাথে একজনকে আসতে দেখে ড্রাইভার নেমে পিছনের গেট খুলে দিল। মাহবুব বসার পর বন্ধ করে অন্য পাশের গেট খুলে দিল। মাহবুবা বসে ড্রাইভারকে বলল, বাসায় চলুন।
মাহবুব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, বাসায় মানে?
মাহবুবা মৃদু হেসে বলল, বাসায় মানে আমাদের বাসায়। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কীড ন্যাপ করলেও মুক্তিপণ দাবি করব না।
মাহবুব রেগে গিয়ে গম্ভীর হয়ে রইল।
মাহবুবা তা বুঝতে পেরে বলল, প্লীজ আমাকে ভুল বুঝে রাগ করবেন না।
আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন?
অনেক কিছুই করতাম, কারণ আমি মেয়ে। আর আপনি——-
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মাহবুব বলল,থাক আর বলতে হবে না। তারপর বলল, এখন পর্যন্ত নামটাও বললেন না।
ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দিন। মাহবুবা সুলতানা। সবাই মাহবুবা বলে ডাকে।
নাম শুনে মাহবুবের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল, জিজ্ঞেস করল, নামের অর্থ জানেন।
না।
এ কেমন কথা, নিজের নামের অর্থ জানেন না।
আপনার জানা থাকলে প্লীজ বলে দিন না।
মাহবুবার অর্থ প্রেমিকা বা প্রীয়া, আর সুলতানার অর্থ সম্রাজ্ঞী।
আপনার পুরো নামটা বলুন। সেদিন অটোগ্রাফ দেখে ঠিক বুঝতে পারিনি।
মাহবুব হাসান।
কি বললেন।
মাহবুব হাসান।
সত্যি বললেন, না জোক করছেন?
আমি কখনো মিথ্যা বলি না। এমন কি মিথ্যা জোকও করি না। কারণ মিথ্যা বলা মহাপাপ। মুসলমানদের জন্য হারাম।
ঠিক আছে রাগ করবেন না। নামের অর্থ বলুন।
মাহবুব অর্থ প্রেমাষ্পদ বা প্রেমিক, আর হাসান অর্থ সুন্দর।
মাহবুবা নামের অর্থ শুনে আনন্দিত হলেও লজ্জা পেয়ে আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
মাহবুব সামনে একটা মসজিদ দেখতে পেয়ে হাত ঘড়িতে টাইম দেখে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ঐ মসজিদের কাছে গাড়ি থামাবেন।
ড্রাইভার থামাবার পর গাড়ি থেকে নেমে মাহবুবার দিকে তাকিয়ে নামায পড়ে আসছি বলে চলে গেল।
মাহবুবা মাহবুবকে নিয়ে যখন বাসায় পৌঁছাল তখন প্রায় আড়াইটা। বাবা যে লাঞ্চ খেতে ফিরেছে তার গাড়ি দেখে বুঝতে পারল। মাহবুবকে ড্রইংরুমে বসিয়ে এক্ষুণী আসছি বলে মাহবুবা ভিতরে চলে গেল।
মাহবুব অনুমান করেছিল, মাহবুবা ধনী কন্যা। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে বাড়ি ও বাড়ির চার পাশের পরিবেশ ও ড্রইং রুমের আসবাব পত্র দেখে মনে হল শুধু ধনী নয়, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ধনীদের অন্যতম। ড্রইংরুমটা বেশ বড়। চার পাশের দেওয়ালে শ্রেষ্ঠ মনিষিদের তৈল চিত্র আর বেশ কিছু বিদেশের সিন-সিনারী।
মাহবুবা বাবার ঘরে গিয়ে দেখল, বাবা ড্রেস চেঞ্জ করছে, আর মা পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
শামীমা বেগম মেয়েকে দেখে বললেন, তুই ফিরেছিস, যা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে আয়। বাবার সঙ্গে খেয়ে নিবি।
মাহবুবা বলল, চেঞ্জ পরে করব। আগে ড্রইংরুমে চল। তোমাদেরকে যে ছেলেটার কথা বলেছিলাম, তাকে নিয়ে এসেছি।
আনিস সাহেব বললেন, তাই নাকি? তার খোঁজ পেলি কি ভাবে?
সে কথা পরে শোনো, এখন ড্রইংরুমে চলো, পরিচয় করিয়ে দিই। তারপর খাওয়া দাওয়া করা যাবে।
মিনিট পাঁচেক পরে মাহবুবা মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ড্রইংরুমে এল।
মাহবুব দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
আনিস সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে নিজেরাও বসলেন। তারপর মাহবুবের থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে চিন্তা করলেন, এরকম ছেলেই এ বাড়ির জামাই হওয়ার উপযুক্ত। বললেন, আমরা মাহবুবার মা-বাবা। তারপর জিজ্ঞেস করলেন কি নাম আপনার?
মাহবুব হাসান।
দেশের বাড়ী?
রং পুর—-
কে কে আছেন?
শুধু মা-বাবা। এক বোন ছিল তার বিয়ে হয়ে গেছে।
পড়াশোনা শেষ করার পর কি করবেন ভেবেছেন?
গ্রামের অবহেলিত দরিদ্র জনসাধারনের উন্নতি করাই আমার জীবনের লক্ষ্য।
নিজের উন্নতির কথা চিন্তা করেন না।
যারা দশের চিন্তা করে, আল্লাহ পাক তাদের উন্নতির পথ করে দেন।
আল্লাহ তো মানুষকে চেষ্টা করতে বলেছেন।
দেখুন উন্নতি বলতে আপনারা ব্যবসা-বানিজ্য, বাড়ি-গাড়ি ও ভোগ-বিলাস বোঝেন। আর এ জন্য দেশ ও দশের সার্থের দিকে না তাকিয়ে শুধু নিজের সার্থ সিদ্ধির জন্য যে কোনো অন্যায়ের প্রশ্রয়ও নিয়ে থাকেন। আমি কিন্তু বুঝি, মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা এবং অশিক্ষিতদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। আর এটা করাই প্রত্যেক শিক্ষিত ও সামর্থবানদের উচিত বলে আমি মনে করি।
আনিস সাহেব অসন্তুষ্ট হলেও মুখে প্রসন্ন ভাব বজায় রেখে বললেন, আপনার কথাগুলো খুব ভালো, তবে তা শুধু বই পুস্তকের পাতাতেই মানায়। বাস্তবে এর কোনো নজীর আছে বলে মনে হয় না। এ কথাটা বোধ হয় চিন্তা করেন নি, ব্যবসায়ীরা ও মিল মালিকেরা তাদের প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে চাকরী দিয়ে তাদের জিবীকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন, এটা করে তারা কি দেশের ও দশের উপকার করছেন না?
মাহবুব বলল, নিশ্চয় করছেন, তবে তা শহর ভিত্তিক ও শিক্ষিত মানুষের জন্য। শহরের চেয়ে গ্রামে অধীক মানুষ বাস করে। তারা দরিদ্র ও অশিক্ষিত। তাদের জন্যও তো কিছু করা উচিত।
তা উচিত, তবে সে জন্যে প্রচুর অর্থের দরকার। আপনার কী তা আছে?
গ্রামের সাধারন মানুষের যা থাকে আল্লাহর রহমতে আমারও তাই আছে। একটু আগে বললাম না, এ সব কাজে যারা অগ্রসর হয়, তাদেরকে আল্লাহ সব দিক থেকে সাহায্য করেন।
শুনেছি গ্রামের ভীলেজ পলিটিকস খুব প্রখর। তাদের ফাঁদে পড়ে অনেক ভালো ভালো লোক সর্বশান্ত হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বসবাস করছে।
আপনি ঠিক কথা, বলেছেন। পলিটিকস সবখানে আছে। তবে গ্রামের সহজ সরল ও সাধারন মানুষকে কিছু সংখ্যক লোক হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছে। তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই। ধনীরা তাদের রক্ত চুষে নিচ্ছে। আমি তাদেরকে উদ্ধার করতে চাই।
আটষট্টি হাজার গ্রামের কয়টা মানুষকে আপনি উদ্ধার করবেন?
তা জানি না, তবে নিজের গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে জন্ম সার্থক হয়েছে মনে করব।
মাহবুবার সঙ্গে আপনার পরিচয় কত দিনের?
কত দিনের মানে? এখনো ভালোভাবে পরিচয়ই হয়নি।
একটা অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে তাদের বাসায় এলেন কি করে?
মাহবুব সাঁতার প্রতিযোগীতার দিনের ও আজকের ঘটনার কথা বলে ঘড়ি দেখে বলল, মাফ করবেন, এবার আমাকে উঠতে হবে। এই কথা বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আনিস সাহেব ও শামীমা বেগম এক সঙ্গে বলে উঠলেন, সে কি? না খেয়ে যাবেন? না না তা হতে পারে না। আপনি এসেছেন শুনে আমরা না খেয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম। আমাদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে তারপর যাবেন।
মাফ করবেন তা সম্ভব নয়। তার পর বলল, আপনাদের মেয়ের মাথায় একটু গোলমাল আছে। বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। কথা শেষ করে সালাম দিয়ে চলে গেল।
মাহবুবা তার পিছনে যেতে যেতে বলল, প্লীজ মাহবুব সাহেব, যাবেন না, দাঁড়ান।
আনিস সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওকে যেতে দে।
মাহবুবা মা-বাবার কথা কোনো দিন অমান্য করেনি। আজও করল না। ফিরে এসে ছল ছল চোখে ভিজে গলায় বলল, ওঁর এখনো খাওয়া হয়নি বাবা। ক্লাস শেষে ভার্সিটি থেকে ধরে এনেছিলাম।
আনিস সাহেব মেয়েকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তাতে কি হয়েছে মা? বাসায় গিয়ে খাবেন। আমরাওতো এখনো খাইনি। ছেলেটা ঠিকই বলে গেল, তোকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াই উচিত। তারপর স্ত্রীকে বললেন, চল। খেতে দেবে।
খেতে বসে মাহবুবা যে সামান্য খেয়ে উঠে গেল, তা আনিস সাহেব দেখেও দেখলেন না। শামীমা বেগম মেয়েকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন আনিস সাহেব ইশারা করে থামিয়ে দিলেন।
মেয়ে চলে যাওয়ার পর বললেন, ছেলেটা না খেয়ে চলে গেছে তাই মাহবুবা খেতে পারল না, এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারলে না?
তা আর পারিনি। কিন্তু তাই বলে মেয়েকে খাওয়ার কথা বলব না? তারপর সামান্য খেয়ে তিনিও উঠে পড়লেন।
আনিস সাহেব গাড়ি ও গাড়ির পার্ডসের ইম্পোর্টের ব্যবসা করেন, দেশের বিভিন্ন শহরে অফিস ও শোরুম। মতিঝিলে হেড অফিস, মাহবুবাই তার এক মাত্র সন্তান। তিনি এমন একটা ছেলের সন্ধানে আছেন, যাকে জামাই করে এই ব্যবসার দায়িত্ব দেবেন। তাই মেয়ে মাহবুবের মতো সুন্দর ছেলেকে পছন্দ করেছে জেনে প্রথমে খুব খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যখন জানতে পারলেন, সে আদর্শবান ও ধামকি তখন খুব চিন্তিত হলেন। খাওয়া দাওয়ার পর অফিসে এসে চিন্তা করতে লাগলেন, মাহবুবা যাকে পছন্দ করেছে তাকে ডিনাই করা কিছুতেই চলবে না। কিন্তু ঐ ছেলে কি আমাদের কথা মতো চলবে? বিয়ে করে মাহবুবাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবে। মাহবুবা কি সেখানে থাকতে পারবে? তার চেয়ে গালিবই ভালো।
গালিব ম্যানেজারের ছেলে। বিদেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ারীং পাশ করে ফিরেছে। দেখতে খুব সুন্দর। স্বাস্থ্যও ভালো। খুব স্মার্ট ছেলে। আনিস সাহেব তাকে খুলনা অফিসের ম্যানেজার পদে নিয়োগ করেছেন। ভেবে রাখলেন, গালিবের কথা বলে মেয়ের মন তার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করবেন।
বিকেলে চায়ের টেবিলে মাহবুবা মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, মাহবুবকে দেখে তোমাদের কেমন মনে হল। তারপর বলল, জান বাবা, উনি শুধু ভালো সাঁতারু নন, একজন দক্ষ সুটার ও ফাইটারও।
শামীমা বেগমের মাহবুবকে দেখে ভীষন পছন্দ হয়েছিল? কিন্তু সে গ্রামের এক সাধারন ঘরের ছেলে জেনে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তাই স্বামী কি বলে শোনার জন্য অপেক্ষা করুতে লাগলেন।
আনিস সাহেব গালিবের কথা ভাবছিলেন, কিভাবে তার কথা ওঠাবেন চিন্তা করতে লাগলেন।
মা-বাবা কিছু বলছে না দেখে মাহবুবা অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, তোমরা কিছু বলছ না কেন? মেয়ের কথা শুনে আনিস সাহেব বললেন, ছেলেটার সব কিছু ভালো, তবে খুব আদর্শবান। ধার্মিক বলেও মনে হল। দেখলি না, কথায় কথায় আল্লাহর নাম নেয়। এই। ধরনের ছেলেরা জীবনে উন্নতি করতে পারে না।
স্বামী থেমে যেতে শামীমা বেগম বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে এক মত। তা ছাড়া ও গ্রামের একটা সাধারন ঘরের ছেলে। আমাদের জামাই হওয়ার মোটেই উপযুক্ত নয়।
আনিস সাহেব বললেন, ওর থেকে আমাদের ম্যানেজারের ছেলে গালিব অনেক ভালো।
শামীমা বেগম বললেন, গালিবের সব কিছু ভালো হলেও তার চোখ আমার একদম পছন্দ নয়। শরীরের তুলনায় চোখ দুটো খুব ছোট। এরকম হাতি চোখা ছেলেকে আমি একদম পছন্দ করি না।
মাহবুবা বলল, আমি তোমাদের কথা অস্বীকার করছি না। তোমাদের মতের বিরুদ্ধেও কিছু করব না, তবে মাহবুবকে যদি আমাদের ফ্যামীলির উপযুক্ত করে নিতে পারি, তা হলে?
আনিস সাহেব মৃদু হেসে বললেন, তা হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।
মাহবুবা বলল, তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। আমি মাহবুবকে তোমাদের উপযুক্ত করে নেবই। আমি যা বলি তা যে করেই থাকি, তা তো তোমরা জানই।
.
০২.
বেলা প্রায় একটা। তখন আষাড়ের শেষ। সুলতান খাঁন ছাতা মাথায় দিয়ে জমির আলের উপর বসে আছেন। দশ বার জন কামলা জমিতে আমন ধানের চারা বপন করছে। হাত ঘড়ি দেখে কামলাদের উদ্দেশ্যে বললেন, এবার কাজ রেখে দিন। একটু পরে আজান হবে। বাড়ি গিয়ে নামাজ ও খাওয়া দাওয়ার পর এসে কাজ করবেন। কথা শেষ করে তিনি বাড়ির পথে রওয়ানা দিলেন।
সুলতান খাঁনের যারা কাজ করে, তারা জানে তিনি সব সময় তাদের কাজের। তদারকি করলেও নামাযের সময় হলে সবাইকে নামায পড়তে বলে নিজেও পড়বেন। যদি জানতে পারেন কামলাদের মধ্যে কেউ বেনামাযী আছে, তা হলে তাকে নামায না পড়লে কি হয় এবং পড়লে কি হয় প্রথমে বোঝাবেন। তারপরও যদি সে না পড়ে তা। হলে কাজ থেকে ছাটাই করবেন। এই ভাবে তিনি অনেক অশিক্ষিত কামলাদের নামায ধরিয়েছেন।
সুলতান খাঁন বাড়িতে ঢুকে জমিরনকে দেখে বললেন, তোর চাচি কোথায় রে মা?
জমিরন এই গ্রামেরই মেয়ে। তার স্বামী জব্বার খেটে খাওয়া মানুষ ছিল। তাদের একটাই মেয়ে। পাশের গ্রামে বিয়ে হয়েছে। বছর পাঁচেক আগে জব্বার জন্ডিসে মারা গেছে। জব্বার সুলতান খাঁনের কাছে বার মাস কামলা খাটত। স্বামী মারা যাওয়ার পর জমিরন যখন সুলতান খাঁনের পা জড়িয়ে বলল, চাচা, আমার যে কেউ রইল না, আমি কেমন করে দিন গুজরান করব। তখন সুলতান খাঁন বললেন, আল্লাহ তাঁর সমস্ত জীবকে আহার দিয়ে থাকেন। এটা কোরআন পাকের কথা। আজ থেকে তুই আমার কাছে থাকবি। সেই থেকে জমিরন এ বাড়িতে রয়েছে।
চাচার কথা শুনে জমিরন বলল, চাচি রান্না করছে, আমি ডেকে দিচ্ছি।
মরিয়ম খাতুন প্রাইমারী পাশ মেয়ে হলেও স্বামীর সহচার্যে অনেক শিক্ষা পেয়েছেন। স্বামীর সাহায্যে মুসলিম মনিষি ও মনিষাদের জীবনী ও অন্যান্য ইসলামিক বই পড়ে আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ গৃহিনী ও আদর্শ মা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। তাই স্বামীর কখন কি প্রয়োজন সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখেন। প্রতিদিনের মতো আজও যোহরের আযান শুনে হাত পাখা, সর্ষের তেলের বাটি, লুঙ্গি ও গামছা হাতের কাছে। রেখে রান্না করছিলেন। স্বামীর গলার আওয়াজ পেয়ে সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় জমিরনকে দেখে বললেন, তরকারীটা হতে একটু বাকি, নুন চেখে নামিয়ে নিস। তারপর স্বামীর কাছে এসে সালাম দিলেন।
সুলতান খাঁন ততক্ষণে বারান্দায় চেয়ারে বসেছেন। সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে কোনোদিন আগে সালাম দিতে পারলাম না। আগন্তুক আগে সালাম দিবে এটাই ইসলামের নিয়ম।
মরিয়ম খাতুন মৃদু হেসে বললেন, তা আমিও জানি। আরো জানি, যে আগে সালাম দিবে, তার সওয়াব উত্তর দাতার চেয়ে নব্বইগুন বেশি। তারপর হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বললেন, ঐ দিন কোরআনের তফসীর পড়ার সময় দেখলাম
আল্লাহ পাক বলিয়াছে, তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে অগ্রসর হও।
সুবহান আল্লাহ বলে সুলতান খাঁন বললেন, তুমি এত বখীল যে, প্রায়ই সে সওয়াব থেকে আমাকে বঞ্চিত কর।
মরিয়ম খাতুন বললেন, হাদিসে পড়েছি, সওয়াব হাসিলের জন্য কোনো কাজে অগ্রভূমিকা নিলে বখীলতা হয় না। এখন ওসব কথা থাক, গোসল করে আসুন। আজান হয়ে গেছে। আপনার তো আবার কিছুক্ষন সাঁতার না কাটলে গোসলই হয় না। কথা শেষ করে তেলের বাটিটা সামনে ধরলেন।
সূলতান খান ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুল তেলের বাটিতে ডুবিয়ে প্রথমে নাকে, কানে ও নাভিতে দিলেন। তারপর হাতের চেটোতে তেল ঢেলে মাথার চাঁদিতে ঘষতে ঘষতে অন্য হাতে লুঙ্গি ও গামছা নিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে চলে গেলেন।
এই পুকুরটা খুব বড়। লম্বায় দুশ হাত, আর চওড়ায় একশো হাত। এটা সূলতান খানের দাদা বাদশা খান কাটিয়েছিলেন। আশ-পাশের পাঁচ-দশ গ্রামের মধ্যে খুব ধামিক ও দানশীল হিসাবে তার খুব সুনাম ছিল। দেখতেও খুব সুপুরুষ ছিলেন। ছয় ফুট লম্বা বিয়াল্লিশ ইঞ্চি ছাতি, গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা, মুখভরা চাপদাড়ি নিয়ে যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন দরবেশের মতো মনে হত। অবাল বৃদ্ধ বনিতা সালাম দিয়ে পথ ছেড়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। তিনি সালামের উত্তর দিতে দিতে প্রত্যেকের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতেন। নিঃস্ব ও গরিবদের প্রকাশ্যে ও গোপনে অকাতরে দান করতেন। কয়েকবার হজ্ব করেছেন। একশো বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করত না, এত বয়স হয়েছে। মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে পর্যন্ত যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন তখন মনে হত একজন বলিষ্ঠ যুবক যাচ্ছেন। এই বয়সেও দেড়মনি ধানের বস্তা একা মাথায় তুলে নিতে পারতেন। সামান্য কয়েক দিনের জ্বরে মারা যান। আর্থিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। গ্রামের লোকজন গ্রীষ্মকালে পানির খুব কষ্ট পেত। তাই বেশ কিছু জমি বিক্রি করে এই পুকুর কাটান এবং পাড়ের চার দিকে চারটে পাকা ঘাট করেছেন। ফলে আর্থিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। তাতে তিনি কখনো দুঃখ অনুভব করেন নি। বরং যখন সমবয়সিরা বলতেন, বাদশা খান, এই পুকুর কাটাতে গিয়ে তুমি অভাব গ্রস্থ হয়ে পড়লে, কাজটা ঠিক করনি। এসব জমিদারের কাজ। তখন তিনি মৃদু হেসে বলতেন, কেন আমি একাজ করলাম তা যদি জানতে, তা। হলে এ কথা বলতে পারতে না। তোমরা তো জান না, মানুষের উপকারের জন্য কিছু করলে আল্লাহ খুশি হন। হাদিসে আছে আল্লাহর ভালবাসা পেতে হলে তাঁর সৃষ্ট জীবকে ভালবাসতে হবে।
পুকুরের চার দিকের পাড়ে নানারকম ফলের বাগান। বাদশা খান প্রতি বছর যখন পুকুরের মাছ ধরে বিক্রি করতেন তখন গ্রামের ধনী গরিব সকলের বাড়িতে মাছের ভেট পাঠাতেন। আর প্রতি মৌসুমে বাগানের ফল মূলও সবাইকে দিতেন। ছেলে রুস্তম খানও তাই করতেন। সুলতান খাঁনও বাপ দাদার প্রথা চালু রেখেছেন। বাদশা খানের লাঠি খেলার ভীষন সখ ছিল। প্রতি বছর বসন্তকালে বিভিন্ন গ্রাম থেকে লাঠিয়ালদের দাওয়াত দিয়ে আনিয়ে লাঠি খেলা প্রতিযোগীতার আয়োজন করতেন। যিনি বিজয়ী হতেন, তাকে বেশ মোটা টাকা পুরস্কার দিতেন। তিনি নিজেও খুব ভালো লাঠিয়াল ছিলেন। তার আর একটা সখ ছিল সাঁতার কাটা। প্রতি বছর লাঠি খেলা প্রতিযোগীতার পর সাঁতারের প্রতিযোগীতার ব্যবস্থা করতেন। তিনি নিজেও দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। ছেলে রুস্তম খানকেও লাঠিখেলা ও সাঁতারে দক্ষ করেছিলেন। রুস্তম খানের একমাত্র ছেলে সুলতান খাঁন, তিনি সুলতান খাঁনকেও লাঠিখেলা ও সাঁতারে দক্ষ করেছেন।
সুলতান খাঁন দাদা বাদশা খানের মত সুপুরুষ। লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের অধীকারি, গায়ের রংও দাদার মতো। গ্রামের মুরুব্বিরা তাকে দ্বিতীয় বাদশা খান বলে ডাকেন। সুলতান খাঁনের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে বড়, নাম মাহফুজা। মাহফুজার ছয় বছরের ছোট মাহবুব। সুলতান খাঁনও ছেলে মেয়েকে লাঠিখেলা ও সাঁতার শিখিয়েছেন, মাহবুব ছোটবেলা থেকে দক্ষ সাঁতারু। একটু দুরন্ত ধরনের ছেলে। ছোট বেলা থেকেই এত বড় পুকুর একা একা সাঁতার কেটে এপার ওপার করত। সুলতান খাঁন যখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সাঁতার কাটতেন তখন পাড়ার অবাল বৃদ্ধ বণিতা চার পাশে পাড় থেকে দেখত। মাহবুব ছিল পানির পোকা। ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কাটত। তার বয়স যখন পনের তখন থেকে সুলতান খাঁন ছেলের সঙ্গে সাঁতারে পাল্লা দিতে পারতেন না। ঢাকার ভার্সিটিতে পড়তে এসে প্রতিবছর সাঁতার প্রতিযোগীতায় ফাষ্ট হয়। সেই সাথে স্যুটিং ও কুংফুতে পারদর্শী হয়েছে। ছাত্র হিসাবেও খুব ভালো। তাই সুলতান খাঁন। তাকে উচ্চ ডিগ্রী নিতে ঢাকায় পাঠিয়েছেন। মেয়ে মাহফুজা ও ভালো ছাত্রী। এস.এস. সি, পান করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কলেজ বাড়ী থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে। সাত আট মাইল দূরের গ্রামের একটা ভালো ছেলের সন্ধান পেয়ে সুলতান খাঁন তার বিয়ে দিয়ে দেন। তিনিও ছিলেন দাদার মতো দানি। তাই কোনো সঞ্চয় না থাকায় মেয়ের বিয়ের সময় কিছু জমি বিক্রি করেন। বংশ পরম্পরায় ফসলী জমি বারবার বিক্রি হওয়ায় সুলতান খাঁনের আগের মতো স্বচ্ছলতা নেই।
এই গ্রামের মীরেদের অবস্থা আগে খুব খারাপ ছিল। তারা এক সময় বাদশা খানের প্রজা ছিল। সেই বংশের আলাউদ্দিন মীরের অবস্থা এখন খুব ভালো। তার পাঁচ ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা সবার ছোট। নাম তাহেরা। আলাউদ্দিন মীরের পাঁচ ছেলের তিন ছেলে বিদেশে চাকুরী করে। তিনিই এখন গ্রামের সেরা ধনী। সুলতান খাঁনের জমি তিনিই কিনেছেন। তার পুকুরটার দিকে আলাউদ্দিন মীরের অনেক দিনের লোভ। খানেদের অবস্থার অবনতি দেখে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন।
একই গ্রামের ছেলে মেয়ে হিসাবে মাহবুব ও তাহেরা একে অপরকে ছোটবেলা থেকে চিনত। বড় হওয়ার পর তাহেরা মাহবুবকে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে সে কথা তাকে জানাতে পারেনি। মাহবুব যখন ইন্টারে তখন তাহেরা নাইনে পড়ে।
এক গ্রীষ্মের অপরাহ্নে চারিদিক রোদে খাঁ খাঁ করছে। চারিদিক নিস্তব্দ। লোক জন রাস্তা ঘাটে নেই। যে যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। লিচু গাছের তলায় একটা দুধেল গাই শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে। তার সাত দিনের বাচ্চাটা একবার ছুটে রাস্তায় যাচ্ছে, আবার ছুটে মায়ের কাছে ফিরে আসছে। একটা ঘুঘু পাখি শিরিশ গাছের উঁচু ডালে বসে অনেকক্ষণ ধরে ডেকে চলেছে। একটা কাঠ ঠোকরা বড় আম গাছের গুঁড়িতে বসে ঠোঁট দিয়ে গাছের গুঁড়িতে ঠক ঠক করে ঠোকর দিচ্ছে। তাহেরা তাদের কাঁচারী বাড়ির জানালার ধারে বসে এই সব দেখছে। আর একবার করে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। সময় পেলে প্রায় প্রতিদিনই সে এখানে বসে ভাবে, মাহবুবকে একা যেতে দেখলে ডেকে মনের কথা জানাবে। কিন্তু সব দিনই কেউ না কেউ তার সঙ্গে থাকে। মাহবুব তাদের কাঁচারী বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কলেজে যাতায়াত করে। আজ তাকে একা দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে রাস্তার ধারে দাঁড়াল। কাছে এলে বলল, মাহবুব ভাই তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
মাহবুব বলল, কি কথা?
কাচারী বাড়িতে এসে বস, তারপর বলব।
মাহবুব সরল মনে তার সঙ্গে কাঁচারী বাড়িতে গিয়ে বসে বলল, এবার বল কি বলবে।
তাহেরা একটুখানি বস আসছি বলে ছুটে ভিতর বাড়িতে চলে গেল। পাঁচ মিনিট পরে দুতিন পদের মিষ্টি চানাচুর ও এক গ্লাস সরবত নিয়ে এসে বলল, তুমি কলেজ থেকে ফিরছ, এগুলো আগে খেয়ে নাও তারপর বলছি।
মাহবুব ভাবল, ওর কোনো ভাইয়ার হয়ত বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। মৃদু হেসে বলল, কি ব্যাপার? কোনো শুভ সংবাদ না কি?
তাহেরা সলাজ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি যা ভাবছ তা নয়; তবে বলে থেমে গেল।
কি হল থেমে গেলে কেন? তবে কি বলবে তো।
বলছি এগুলো আগে খেয়ে নাও।
মাহবুব প্রথমে সরবত খেল। তারপর দুটো মিষ্টি খেয়ে বলল, নাও এবার বল।
মাহবুব ভাই, একটা কথা তোমাকে জানাব বলে অনেক দিন থেকে অপেক্ষা করছি, কিন্তু তোমাকে একাকি না পেয়ে বলতে পারিনি। অবশ্য চিঠি দিয়েও জানাতে পারতাম; কিন্তু সাহস হয়নি।
মাহবুব তাহেরার মনের কথা বুঝতে না পেরে বলল, বেশতো এখন বল।
তাহেরা লজ্জায় সরাসরি কথাটা বলতে না পেরে বলল, কি বলব, তুমি কী বুঝতে পারছ না?
মাহবুব অবাক হয়ে বলল, তুমি কী বলবে, আমি কিভাবে বুঝব?
তাহেরা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাকে ক্লাস এইটে পড়ার সময় থেকে ভালবাসি। কথা শেষ করে আবার মাথা নিচু করে নিল।
তরুণ মাহবুব ভালবাসা কি জিনিস জানে না। মেয়েদের নিয়েও কখনো চিন্তা করেনি। তাহেরার কথা শুনে অবাক হল। কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তাহেরা মোটামুটি সুন্দরী। গায়ের রং শ্যামলা, স্বাস্থ্য দোহারা, লম্বায় পাঁচ ফুট, চোখ দুটো বেশ বড় বড়। নাকটা খাড়াও নয় ধ্যাবড়াও নয় মধ্যম। মাথার চুল যে খুব লম্বা, তা খোঁপা দেখেই বোঝা যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর তাহেরা মাথা তুলে মাহবুবের দিকে তাকাতে গেলে চোখে চোখ পড়ে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কাঁপা গলায় বলল, কিছু বলছ না কেন মাহবুব ভাই?
অজান্তেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মাহবুব বলল, ভালবাসা কি জিনিস আমি জানি না। তবে শুনেছি ভালবাসা মনের ব্যাপার। আমার মনে সেরকম কিছু এখনো হয়নি। তা ছাড়া মেয়েদের নিয়ে আমি কখনো চিন্তা করিনি। আরো শুনেছি ভালো লাগা থেকে ভালবাসা জন্মায়। আমাকে তোমার হয়তো ভালো লেগেছে। তাই তোমার মনে ভালবাসা জন্মেছে।
আমাকে তোমার ভালো লাগেনি?
তোমাকে আমি গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের নজরে দেখি। যখন ভালো লাগবে এবং মনে ভালোবাসা জন্মাবে তখন তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব। এখন চলি বলে মাহবুব চলে এসেছিল। তারপর আর কোনো দিন তাহেরার সামনে যায়নি। এমন কি তাহেরা তাদের চাকরের হাতে অনেকবার ডেকে পাঠালেও যায়নি।
মাহবুব এইচ. এস. সি.তে পাঁচটা লেটার নিয়ে পাস করার পর যখন ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তে চাইল তখন কোনো উপায় না পেয়ে সুলতান খাঁন আলাউদ্দিন মীরের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা হাউলাত নিয়েছিলেন। তারপর মাসে মাসে যখন মাহবুবকে টাকা পাঠাবার দরকার হল তখনও তার কাছে আবার যান।
আলাউদ্দিন মীর এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। বললেন, ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছেন ভালো কথা; কিন্তু তার পড়াশোনা শেষ করতে যেমন অনেক সময় লাগবে তেমনি অনেক টাকা পয়সাও লাগবে। এত টাকা আপনি পাবেন কোথায়? আর আমিও শুধু শুধু আপনাকে এত টাকা হাউলাত দেব কেন? তা ছাড়া টাকাটা কিভাবে ফেরৎ দেবেন তা ভেবেছেন কি?
সুলতান খাঁন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আপনি খুব ভালো কথা বলেছেন। আমিও যে এ ব্যাপারে কিছু চিন্তা করিনি তা নয়। ভেবেছি, বাস্তু সংলগ্ন যে জমিটা আছে সেটা আপনার কাছে পাঁচ বছরের জন্য বন্ধক রাখব।
আলাউদ্দিন মীর বললেন, জমি রাখলে আপনাদের সংসার চলবে কি করে? তার চেয়ে এক কাজ করুন, পুকুরটা পাঁচ বছর নয় সাত বছরের জন্য সাফকবলা রাখুন। এক লাখ টাকার দলিল হবে। টাকাটা একসঙ্গে নেন আর দফায় দফায় নেন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। অবশ্য পুকুরের আসল দাম দুতিন লাখ টাকা। বেশি নিলে পুকুর ফেরাবেন কি করে? তাই এক লাখের কথা বললাম। সাত বছরের মধ্যে যখনই টাকা ফেরৎ দেবেন তখনই দলিল ফেরৎ দিয়ে দেব। পুকুর আপনার দখলেই থাকবে। তবে সাত বছরের মধ্যে টাকা ফেরৎ দিতে না পারলে দলিল মোতাবেক পুকুরের স্বত্ব আমার হয়ে যাবে।
সুলতান খাঁন বললেন, আজ কিছু টাকা দেন, মাহবুবকে পাঠাতে হবে। চিন্তা ভাবনা করে কয়েক দিন পরে কাগজ পত্র নিয়ে আসব।
সেদিন রাতে সুলতান খাঁন স্ত্রীকে আলাউদ্দিন মীরের কথা জানালেন।
মরিয়ম খাতুন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আল্লাহর মহিমা তিনিই জানেন। আপনার মতই আমার মত। তবে আমার মনে হয় মাহবুবের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
সে কথা আমিও ভেবেছি; কিন্তু জানালে সে যদি পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়? কিভাবে পড়াচ্ছি তাও তো জানে না। চার পাঁচ বছরের মধ্যে ওঁর পড়াশোনা শেষ হবে। তারপর চাকরী করে দুতিন বছরের মধ্যে নিশ্চয় টাকাটা ফেরৎ দিতে পারবে। তারপর বললেন, আল্লাহ যা তকদিরে রেখেছেন, তা হবেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে আমরা আর কি করব?
মরিয়ম খাতুন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ আপনি যা ভালো বুঝেন করেন।
সুলতান খাঁন কয়েক দিন পরে আলাউদ্দিন মীরকে দলিল রেজিষ্ট্রি করে দিলেন।
.
চার বছর হতে চলল, আলাউদ্দিন মীরের টকায় সুলতান খাঁন ছেলেকে পড়াচ্ছেন। মাহবুব এসব ব্যাপার কিছুই জানে না। সব সময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অবসর সময়ে সুইমিং পুলে গিয়ে সাঁতার কাটে। ভোরে উঠে একা একা কুংফু কারাত প্র্যাকটিস করে। যখন টাকার দরকার হয় আব্বাকে চিঠি লিখে। সময় মতো পেয়ে যায়। ভার্সিটি বন্ধ থাকলে বাড়ি যায়।
আজ সুলতান খাঁন মসজিদ থেকে যোহরের নামায পড়ে ফেরার পথে পিয়ন একটা চিঠি দিল। ঠিকানা দেখে বুঝতে পারলেন মাহবুবের চিঠি। বাড়িতে এসে পড়ে স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, মাহবুব সামনের মাসে আসবে লিখেছে, নাও পড়।
মরিয়ম খাতুন পড়তে লাগলেন,
শ্রদ্ধেয় আব্বা ও আম্মা,
বহুৎ বহুৎ সালাম পাক কদমে পৌঁছে। আশা করি আল্লাহ পাকের অপার করুনায় আপনারা ভালো আছেন। আমিও তারই করুনায় ও আপনাদের নেক দোয়ার বরকতে ভালো আছি। বাদ আরজ এই যে, দীর্ঘ চার মাস আপনাদেরকে না দেখে মন বড় উতলা হয়ে উঠেছে। এই নাদান ছেলেকে এতদিন না দেখে আপনাদেরও যে মন উতলা হয়ে আছে তা জাণি। পড়ার চাপে বাড়ী আসতে পারিনি। আশা করি সামনের মাসের সাত আট তারিখে ইনশাআল্লাহ আসব। আপনারা দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমাকে সহি সালামতে আপনাদের মোবারক কদমে সালাম করার তওফিক দেন। আপনারা শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখবেন। আমার জন্য কোন দুঃচিন্তা করবেন না। আল্লাহর রহমত এবং আপনাদের দোয়া আমার এক মাত্র কাম্য। আমি যেন আল্লাহ ও তার রসুলের (দঃ) বিধান মোতাবেক চলতে পারি সেই দোয়া করবেন। আল্লাহ পাকের দরবারে আপনাদের সহি সালামত কামনা করে এবং আপনাদের মোবারক কদমে আর একবার সালাম জানিয়ে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি আপনাদের নালায়েক সন্তান
মাহবুব।
চিঠি পড়তে পড়তে মরিয়ম খাতুনের চোখে পানি এসে গেল। আজ চার মাস কলিজার টুকরাকে দেখেন নি। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দুহাত তুলে দোয়া করলেন, আল্লাহ গো, তুমি আমাদের লালকে সহিসালামতে রেখ। তার মনের বাসনা পূরণ করো।
সুলতান খাঁনেরও একই অবস্থা। স্ত্রী থেমে যেতে ভিজে গলায় বললেন, আমিন।
মরিয়ম খাতুন আঁচলে চোখ মুছে বললেন, চলুন খাবেন।
.
০৩.
মাহবুব মাহবুবাদের বাসা থেকে মেসে ফিরে এলে মাসুম জিজ্ঞেস করল, কিরে এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তোর জন্য অপেক্ষা করে করে এই একটু আগে খেলাম।
মাহবুব বলল, পরে শুনিস, এখন খিদেয় পেট চো চো করছে।
নামায পড়েছিস? না তাও পড়িস নি।
কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে মাহবুব বলল, নামায জামাতেই পড়েছি। আর কোনো কথা বলবি না, ভীষণ রেগে আছি। তারপর কলতলা থেকে হাত মুখ ধূয়ে এসে খেতে বসল।
মাসুম চৌকিতে পা ঝুলিয়ে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখল, গোগ্রাসে গিলছে। বলল, একটু আস্তে খা, গলায় আটকে যাবে তো।
মাহবুব কোনো রা না করে খাওয়া শেষ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তারপর বিছানায় বসে বলল, জানিস, ক্লাস শেষে বেরিয়েই আজ সেই মেয়েটির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা।
কার সঙ্গে দেখা?
আরে ঐ যে সাঁতার প্রতিযোগিতার দিন যে মেয়েটা আমাদেরকে লিফট দিতে চেয়েছিল।
মাসুম তড়াক করে উঠে বসে বলল, তাই নাকি? তা তারপর কি হল বলবি তো?
কি আর হবে? আজও লিফট দিতে চাইল। আমি রাজি হলাম না। শেষে অনেক জেদা- জেদির পর গাড়িতে উঠলাম।
তা হলে তো অনেক আগেই ফেরার কথা।
আমাকে শেষ করতে দে, তারপর প্রশ্ন করিস। গাড়িতে উঠার পর মেয়েটা ড্রাইভারকে তাদের বাসায় যেতে বলল। শুনে আমি খুব রেগে গেলাম। ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি থামান, আমি নেমে যাব। মেয়েটা ড্রাইভারকে নিষেধ করে আমাকে বলল, ভয় পাচ্ছেন কেন? কীডন্যাপ করলেও মুক্তিপণ চাইব না। তারপর যা কিছু ঘটেছে সব খুলে বলে বলল, আমার কি মনে হয় জানিস মেয়েটার মাথায় একটু গোলমাল আছে।
মাসুম হেসে উঠে বলল, আমার কিন্তু ঠিক উল্টো মনে হচ্ছে।
মাহবুব অবাক কণ্ঠে বলল, মানে?
মানে পরে বলছি, তার আগে আমার কথার উত্তর দে। মেয়েটির বাবা নিশ্চয় ভীষণ বড় লোক?
সবকিছু দেখে তো তাই মনে হল।
নিশ্চয় মেয়েটি মা-বাবার এক মাত্র সন্তান?
ঠিক বলতে পারছি না তবে মনে হয় তোর কথা ঠিক।
এবার মানেটা বলছি শোন, এমনি বড় লোকের ছেলেমেয়েরা খুব এক রোখা হয়। তার উপর ঐ মেয়েটি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাই একটু বেশি একরোখা ও জেদি। এই রকম ছেলেমেয়েরা যা পেতে চাই, তা যেমন করে হোক পাওয়ার চেষ্টা করে।
কি জানি, তোর কথা হয়তো ঠিক। তুইওতো বড়লোকের ছেলে, কই তোর তো একরোখা স্বভাব না?
আর তুই বুঝি গরিবের ছেলে? আসলে কি জানিস, আমরা হলাম গ্রামের বড় লোকের ছেলে। তা ছাড়া আমাদের ভাই-বোন আছে। আমি কিন্তু শহরের বড় লোকের ছেলে মেয়েদের কথা বলছি।
তুই যাই বলিস, আমি কিন্তু জানি জোর করে অথবা টাকার জোরে সব কিছু পাওয়া গেলেও মন পাওয়া যায় না।
আর এটা জানিস না, মনকে প্রেম-ভালবাসা দিয়ে জয় করা যায়?
জানি, তবে মনের মতো মন হতে হবে।
তাতো নিশ্চয়, তুই কি মেয়েটার মনের খবর জানতে পারিস নি?
একদম যে পারিনি তা নয়। কিন্তু যা শুধু অসম্ভব নয় অবাস্তবও। তাকে নিয়ে চিন্তা করাও পাপ।
তবে তুই কি করে বললি, মেয়েটার মাথায় গোলমাল আছে?
কারণ মেয়েটি অসম্ভব ও অবাস্তব জিনিসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
আমার মনে হয় মেয়েটা তোকে ভীষণ পছন্দ করে এবং ভীষণ ভালবেসে ফেলেছে। আর ভালবাসা অসম্ভব ও অবাস্তবকে সম্ভব ও বাস্তবে পরিণত করে।
তোর যত উদ্ভট কথা। বাদ দে এসব প্রসঙ্গ।
আমি বাদ দিলে কি হবে, মেয়েটি তোকে কিন্তু ছাড়বে না, কথাটা মনে রাখিস।
মনে রাখতে আমার বয়েই গেছে। তোর যদি এতই গরজ, তুই তার পেছনে লাইন লাগাতে পারিস। তুই আমার চেয়ে বড় লোকের ছেলে। তোদের মধ্যে আত্মীয়তা মিলবে ভালো।
দেখ, বারবার বড় লোক বড় লোক বলবি না বলছি। তুইও কম কিসে?
মাহবুব হেসে উঠে বলল, বনে শিয়াল রাজার গল্প পড়েছিস।
ক্লাস টুয়ের বই এ পড়েছি। তুই যাই বলিস না কেন? তোদের সব কিছু আমার জানতে বাকি নেই।
জেনেছিস ভালো করেছিস। এখন বকবকানি থামাবি, না রুম থেকে বেরিয়ে যাব।
ঠিক আছে, আর একটা কথা বলে চুপ করব। আমার দৃঢ় ধারণা কয়েক দিনের মধ্যে তোর সঙ্গে দেখা না হলে, মেয়েটি এখানে এসে পড়বে। মাহবুবকে রেগে যেতে দেখে দুহাত জোড়ো করে বলল, রাগ করিস আর যাই করিস, কয়েক দিনের মধ্যে আমার কথার প্রমাণ পেয়ে যাবি।
এমন সময় আসরের আযান শুনে মাহবুব বলল, এখন প্রমাণ রেখে নামায পড়ে আসি চল।
মাসুম বলল, তাতো যাবই। তার আগে বল, মেয়েটাকে তোর পছন্দ হয় কিনা?
তোর কি মনে হয়?
আমার তো মনে হচ্ছে হয়েছে। তা না হলে সেদিন হ্যাংলার মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতিস না।
.
মাহবুবা নাম মাত্র দুএক লোকমা খেয়ে নিজের রুমে এসে চিন্তা করল, ছিঃ ছিঃ কাজটা ভালো করিনি। এরপর মাহবুবের কাছে মুখ দেখাব কি করে? ভেবে রাখল, কাল দেখা করে মাফ চেয়ে নেবে।
পরের দিন খোঁজ করেও মাহবুবের দেখা পেল না। তারপর আরো চার পাঁচ দিন দেখা না পেয়ে একদিন তার মেসে রওয়ানা দিল।
বঙ্গোপসাগরে লঘু চাপের ফলে আবহাওয়া দুদিন পর্যন্ত গুমোট ছিল। আজ ভোরে এক পশলা বৃষ্টি হলেও গুমোট কাটেনি। আকাশে মেঘ রয়েছে। যে কোন সময়ে আবার বৃষ্টি হতে পারে। সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। চার পাঁচ দিন থেকে মাহবুবের খুব জ্বর। মাসুম ডাক্তার এনে দেখিয়ে চিকিৎসা করছে। গত রাত থেকে মাহবুবের জ্ঞান নেই। মাসুম আজ সকালেও ডাক্তার এনেছিল। উনি পরীক্ষা করে বলেছেন, মনে হয়। টাইফয়েডের দিকে টার্ন নিয়েছে। মাথায় বরফ দিতে হবে। ভালো শুশ্রূষা দরকার। আপনি তা পারবেন না। মেডিকেলে অথবা কোনো ক্লিনিকে ভর্তি করে দিন।
মাসুম ডাক্তারকে বিদায় করে মেডিকেলে এম্বুলেন্সের জন্য যেন করেছিল। তারা জানিয়েছে ঘন্টা দুই দেরি হবে। তাই মাহবুবের মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে অপেক্ষা করতে লাগল।
ওদের মেসটা গলির মধ্যে। সেখানে গাড়ি যেতে পারে না। তবে বড় রাস্তা থেকে অল্প ভিতরে। ড্রাইভার গলির পাশে গাড়ি পার্ক করে মাহবুবাকে বলল, ঠিকানাটা আমাকে দিন খুঁজে দেখি।
মাহবুবা বলল, আপনি গাড়িতেই থাকুন আমি দেখছি। তারপর গাড়ি থেকে নেমে গলির মুখের পাশে একটা ওষুধের দোকানে গিয়ে একজন সেলসম্যানকে ঠিকানা লেখা কাগজটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কোথায় বলতে পারেন?
সেলসম্যান মাসুম ও মাহবুবকে চেনে। বললেন, গলির ভিতরে আমাদের বিল্ডিং এর তিনটে বিল্ডিং পরে একতলা বিল্ডিংটা। মাহবুব সাহেবের কয়েকদিন যাবৎ খুব জ্বর। গতরাত থেকে জ্ঞান নেই। কিছুক্ষণ আগে ওঁর রুমমেট মাসুম সাহেব মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের এখান থেকে এ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করে গেলেন।
শুনে মাহবুবা চমকে উঠলেও সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিল। তারপর ধন্যবাদ জানিয়ে গলির ভিতর ঢুকে পড়ল। গেটের কাছে এসে নাম্বার মিলিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখল শেষ মাথার রুম ছাড়া সব রুমে তালা ঝুলছে। খোলা রুমটার দরজার কাছে এসে দেখল একজন খাটে শুয়ে আছে অন্যজন তার মাথায় পানি ঢালছে। ভিতরে ঢুকে কয়েক সেকেণ্ড মাহবুবের পাণ্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মাসুমের দিকে চেয়ে চিনতে পারল। সাঁতার প্রতিযোগীতার দিন এই ছেলেটাই মাহবুবের সঙ্গে ছিল। সালাম দিয়ে বলল, চিনতে পারছেন?
মাসুমের দরজার দিকে পিঠ ছিল। তাই মাহবুবার আগমন টের পায়নি। মেয়েলী কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে চিনতে পেরে সালামের উত্তর দিয়ে অবাক কণ্ঠে বলল, আপনি?
চিনতে পেরেছেন তা হলে?
আপনার মতো মেয়েদের একবার দেখলেই চেনা যায়।
তাই নাকি? তা হলে পানি ঢালা বন্ধ করে ওঁকে তাড়াতাড়ি ক্লিনিকে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন, আমার গাড়ি আছে।
কিন্তু আমি যে মেডিকেলে এ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে————–।
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মাহবুবা বলল, আবার ফোন করে নিষেধ করে দিলেই হবে। নিন তাড়াতাড়ি করুন, হ্যারি আপ। তারপর আলনায় ঝাড়ন দেখতে পেয়ে সেটা নিয়ে নিজেই মাহবুবের মাথা মুছিয়ে দেওয়ার সময় বলল, গলির মুখে ওষুধের দোকানে বাসার লোকেশ্যান জানতে গিয়ে সব কিছু শুনেছি। তারপর ঝাড়নটা তার হাতে দিয়ে বলল, গলিতে গাড়ি ঢুকবে না। আপনি তৈরী হয়ে নিন, আমি ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে আসছি। কথা শেষ করে মাসুমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল।
ধানমণ্ডীর একটা ক্লিনিকে মাহবুব আজ দশ দিন আছে। এখন ভালোর দিকে। ক্লিনিকে না আনলে হয়তো মাহবুব মারাই যেত। দুদিন আশঙ্কাজনক অবস্থায় কেটেছে। সব সময় মাথায় বরফ দেওয়ার পর জ্বর কমে এবং সেই সাথে জ্ঞানও ফিরে। তার টাইফয়েড হয়েছে। এখনো জ্বর ১০২ এর মধ্যে ওঠা নামা করছে। জ্ঞান ফেরার পর মাহবুবাকে দেখে মাহবুব যেমন খুব অবাক হয়েছিল তেমনি আনন্দিতও হয়েছিল। কিন্তু কিছু বলেনি। শুধু তার দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়েছে। পরে মাসুমের কাছে সব কিছু শুনে আরো বেশি আনন্দিত হয়েছে; কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ করে নি। তারপর সকাল-বিকাল এসে সেবা যত্ন করতে দেখে একদিন বলল, আপনি আমার জন্য যা কিছু করেছেন এবং এখনো করছেন, তা আজকাল কোন আপনজনও করে না। আপনার ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারব না।
মাহবুবা বলল, আপনি বুঝি এই সব চিন্তা করছেন? আর আমি চিন্তা করছি, সেদিন আপনি আমাদের বাসায় গিয়ে আমাকে চিরঋণী করে রেখেছেন। সেই ঋণ এই সামান্য সেবাযত্নে কি আর শোধ হয়েছে? তা ছাড়া আমি আর আপনার কতটুকু করেছি, মাসুম সাহেব যা করেছেন এবং করছেন, সে তুলনায় আমারটা নগন্য। ঋণী হলে তার কাছে হয়েছেন?
হ্যাঁ, মাসুমের ঋণও আমি কোনো দিন শোধ করতে পারব না। আপনারা দুজনে না থাকলে অনেক আগেই হয়তো কবরে চলে যেতাম।
মাহবুবা আপেল ও কমলা ছাড়িয়ে সামনে দিয়ে বলল, এখন ঋনের কথা রেখে এগুলো খান। তারপর খাইয়ে দিতে লাগল।
মাহবুব খেতে খেতে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
মাহবুবা লজ্জা পেয়ে বলল, ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
মাহবুব সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আপনি আমার জন্য এতকিছু করছেন কেন বলবেন?
একটু আগে বললাম না, ঋণ শোধ করছি। বিশ্বাস হয় না।
কেন?
সেদিন না খেয়ে আপনাদের বাসা থেকে চলে আসায় এমন কিছু ঋণী হন নি, যে জন্য এতকিছু করার প্রয়োজন আছে। নিশ্চয় অন্য কোনো কারণ আছে।
তাও থাকতে পারে।
সেটাই জানতে চাই।
ততক্ষণে খাওয়ান শেষ হয়েছে। প্লেটটা রেখে মাহবুবা নিজের রুমালে মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, আমার তো মনে হয় আপনি জানেন। তবু জানতে চাচ্ছেন কেন?
সিওর হওয়ার জন্য।
যদি বলি যা জেনেছেন, তা সত্য?
মাহবুব অনেক্ষণ চুপ করে রইল।
কিছু বলছেন না যে?
কি বলব বলুন, আমার খুব ভয় হচ্ছে।
আপনি পুরুষ, ভয় পাবেন কেন? বরং আমারই ভয় পাওয়ার কথা।
আপনার ভয় লাগছে না?
একটুও না।
আপনি একটা ডেঞ্জারাস মেয়ে।
আর আপনি বুঝি গোবেচারা?
তা ছাড়া আর কি?
আপনি যে আমার থেকে ডেঞ্জারেস, তা অনেক আগেই জানি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। জানেন, প্রায় বছর খানেক আগে যেদিন সুটিং-এ আপনি ফাক্ট হলেন, সেদিন আমিও সেখানে ছিলাম। আপনাকে দেখেই ভালবেসে ফেলি। ঐদিন আপনার সঙ্গে পরিচয় করার জন্য অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারিনি। সেবা মেয়েদের সাঁতার প্রতিযোগীতায় আমিও অংশ নিই। কিন্তু কোনো পদক পাইনি। তারপর ছেলেদের প্রতিযোগীতা দেখতে গিয়ে আপনাকে পাই। তবে তার আগে দুএকবার ভার্সিটিতে দেখেছি। আলাপ করার জন্য আপনার পিছুও নিয়েছি। কিন্তু কিভাবে একজন অচেনা ছেলের সঙ্গে আলাপ শুরু করব ভেবে ঠিক করতে না পেরে ফিরে এসেছি।
এমন সময় মাসুমকে আসতে দেখে মাহবুবা চুপ করে গেল।
মাসুম কাছে এসে সালাম দিয়ে মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে বলল, কিরে আজ কেমন আছিস?
মাহাবুব সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর তার হাতে টিফিন বাক্স দেখে বলল, ওটা এখন রেখে দে, পরে খাব।
মাসুম ঘড়ি দেখে বলল, সে কিরে, বেলা দুটো বাজে খিদে পায়নি?
পেয়েছিল। তারপর মাহবুবাকে দেখিয়ে বলল, উনি একটু আগে কি সব খাওয়ালেন।
মাসুম মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কী আরো কিছুক্ষণ থাকবেন?
কেন বলুন তো?
আমার একটু কাজ আছে। এক্ষুণী যেতে হবে। ওকে খাইয়ে যাব মনে করেছিলাম; কিন্তু ওতো এখন খাবেনা বলছে।
ঠিক আছে আপনি যান, আমি খাইয়ে তারপর যাব।
মাসুম সালাম বিনিময় করে যাওয়ার সময় মাহবুবকে বলল, যাই দোস্ত, রাতে তো আসছি। তারপর চলে গেল।
মাসুম চলে যাওয়ার পর মাহবুব বলল, আপনার খিদে পায়নি?
পেলেও মেয়েদের সহ্য করার ক্ষমতা আছে। এবার আপনার মা বাবার কথা বলুন।
জানতে খুব ইচ্ছা করছে বুঝি?
না হলে বললাম কেন?
ওঁরা গ্রামের সহজ সরল মানুষ, বলার মতো কিছু নেই।
তবু বলুন শুনব।
মায়ের কথা আর কি বলব, মাতো মাই-ই। আর বাবাও তাই। তবে বাবার কিছু এক্সট্রা কোয়ালিফিকেশন আছে। যেমন তিনি একজন দক্ষ সাঁতারু ও লাঠিয়াল। অবশ্য কোনো দিন প্রতিযোগীতায় যোগ দেননি। আমার দাদা এবং তার বাবাও তাই ছিলেন।
মাহবুবা বলে উঠল,তাই বোধ হয় আপনিও দক্ষ সাতারু?
হ্যাঁ, বাবার কাছ থেকেই শিক্ষা পেয়েছি। বাবাতো এখনো প্রতিদিন গোসল করার সময় অনেকক্ষণ সাঁতার কাটেন।
আপনাদের বাড়ির কাছে নিশ্চয় নদী আছে?
আমাদের গ্রাম থেকে নদী অনেক দূরে। তবে আমাদের একটা খুব বড় পুকুর আছে। গ্রামের লোকের পানির কষ্ট দূর করার জন্য আমার পরদাদা, মানে দাদার বাবা পুকুরটা কাটিয়েছিলেন। তার চার পাশে চারটে পাকা ঘাটও করে দিয়েছিলেন। আর চারদিকের পাড়ে নানারকম ফলের বাগান। বাগানের ফল ও পুকুরের মাছ বিক্রি করে আমাদের প্রচুর আয় হয়। পুকুরটা এতবড় যে, গ্রামের ছেলে, বুড়ো কেউ পারাপার হওয়ার সাহস পায় না। তাই আমি, বুবু ও আব্বা যখন সাঁতার কেটে পুকুরের এপার ওপার হতাম তখন গ্রামের ছোট বড় সব মেয়ে পুরুষ চারপাশের পাড়ে এসে ভীড় করতো।
আপনার বুবুও তাহলে আপনার মতো ডেঞ্জারেস?
সাঁতার কাটলে কেউ ডেঞ্জারেস হয় না। বরং সাঁতার কাটা শরীরের জন্য খুব। উপকারী। তাই তো ইংরেজীতে একটা কথা আছে, সুইমীং ইজ দা বেষ্ট এক্সাসাইজ গুড ফর হেলথ। যাকগে, এবার ওসব কথা থাক। খেতে দেন, প্রায় তিনটে বাজে। আপনিতো আবার না খেয়ে আছেন। আমাকে খাইয়ে বাসায় গিয়ে খাবেন।
মাহবুবকে খাইয়ে মাহবুবা সাড়ে তিনটের সময় বাসায় ফিরল।
এই কয়েক দিনের মধ্যে মাসুমের সঙ্গে মাহবুবার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ক্লিনিকে মাহবুবকে আনার পর দুতিন দিন মাসুম সব সময় ছিল। আশঙ্কাজনক অবস্থা কেটে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে বাসায় গিয়ে গোসল ও খাওয়া দাওয়া করে এসেছে। এক সপ্তাহ পর থেকে ক্লাসও করছে।
মাহবুবাও এক সপ্তাহ ক্লাস করেনি। সারাদিন মাহবুবের কাছে থেকেছে।
মেয়ের মুখে মাহবুবের অসুখের কথা শোনার পর আনিস সাহেব প্রতিদিন একবার এসে দেখে গেছেন। মাঝে মাঝে শামীমা বেগমও এসে দেখে গেছেন।
মাহবুব প্রায় পনের দিন ক্লিনিকে থেকে সুস্থ হয়ে আজ তিন দিন হল মেসে ফিরে এসেছে। সুস্থ হলেও সম্পূর্ণ হয়নি। বেশি হাঁটা চলা করতে পারে না। মেসের কাজের বেটিদের হাতের রান্না খেতে পারে না। তাই নিজেরা রান্না করে খায়। সকালে মাসুম নাস্তা বানিয়ে দুজনে এক সঙ্গে খেয়ে ভার্সিটি যাওয়ার সময় বলল, ক্লাস করে এসে রান্না করব, তুই যেন আবার কিছু করতে যাস না।
মাসুম চলে যাওয়ার পর মাহবুব বই নিয়ে বসল। পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হল, বাড়িতে চিঠি দেওয়া দরকার। এই মাসে যাবে বলে চিঠি দিয়েছিল। অসুখ হওয়ায় যেতে পারেনি। মা-বাবা নিশ্চয় দুশ্চিন্তায় আছে। বই বন্ধ করে এক পাশে রেখে চিঠি লিখছিল।
এমন সময় মাহবুবা এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসতে পারি?
ক্লিনিক থেকে ফেরার পর প্রতিদিন মাহবুব তাকে আশা করেছে। আসেনি দেখে ভেবেছে, নিশ্চয় কিছু কারণ আছে। নচেৎ যে নাকি অক্লান্ত সেবা যত্ন করে তাকে বাঁচাল, সে না এসে থাকতে পারে না। মাহবুবার গলার শব্দ শুনে মাহবুবের সারা শরীরে আনন্দের শিহরণ বইতে শুরু করল। কলম থামিয়ে সালামের উত্তর দিল। তারপর তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারল না। এতদিন যে মাহবুবাকে দেখেছে আজকের মাহবুবা যেন সে নয়। সাদা ধপধপে শ্যালওয়ার কামিজ পরনে, চিকন ওড়না কাঁধের দুপাশ দিয়ে বক্ষযুগল ঢাকা। পিনোন্নত বক্ষ যুগল ওড়নাকে ঠেলে রেখেছে। ঠোঁটে মেরুন রং এর হালকা লিপিস্টিক। একটা গোলাপ চুলের খোঁপাতে গোঁজা। বাম হাতে এক গুচ্ছ রজনী গন্ধা আর ডান হাতে একটা লাল গোলাপ। মাহবুব সব কিছু ভুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
মাহবুবা এতদিন লক্ষ্য করেছে, মাহবুব কথা বলার সময় তার মুখের দিকে তাকালেও সব সময় তার দৃষ্টিতে যেন অচেনা ভাব। সে জন্যে খুব কষ্ট পেত। তবু তার প্রতি অসন্তুষ্ট হতে পারেনি। মনে হত মাহবুব তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। ক্লিনিকে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে সাড়া পাইনি। আজ তাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে লজ্জিত স্বরে বলল, বি ব্যাপার ওভাবে কি দেখছেন? আসার অনুমতিও দিচ্ছেন না?
মাহবুব এতক্ষণ বাস্তবে ছিল না, তার কথা শুনে বাস্তবে ফিরে এসে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, অনুমতি চাচ্ছেন কেন? প্রথম দিনতো নেননি? ঠিক আছে আসুন।
মাহবুবা ভিতরে ঢুকে বলল, সেদিন আপনার জ্ঞান ছিল না। নচেৎ নিশ্চয় নিতাম, তারপর বলল, কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে ভালো। আপনি?
আমিও ভালো। কিছু লিখছিলেন মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, মা-বাবাকে চিঠি লিখছিলাম।
পলিথিন ব্যাগে মাহবুবা দুতিন পদের ফল ও বিস্কুট নিয়ে এসেছে, সেগুলো খাটের উপর রেখে বলল, ছুরি আছে?
ছুরি কি হবে?
ভয় নেই খুন করব না।
মাহবুর ড্রয়ার থেকে একটা বড় চাকু বের করে দিল।
ওমা, এযে দেখছি মানুষ খুন করার ছুরি।
মাহবুব মৃদু হেসে বলল,হ্যাঁ, প্রয়োজন হতে পারে ভেবেই এটা সব সময় কাছে রাখি।
মাহবুবা অনেক চেষ্টা করেও খুলতে না পেরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, এর ভিতরে অনেক রকমের ফলা রয়েছে। খুলেন কি করে?
মাহবুব তার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে বলল, এতে দুপাশে বারটা ফলা আছে, তারপর এক একটা খুলে তার কার্যকারীতা বলে জিজ্ঞেস করল, আপনার কোনটা দরকার?
মাহবুবা বলল, কিছু কাটার জন্য।
মাহবুব সেই ফলাটা রেখে অন্য গুলো ঢুকিয়ে দিয়ে তার হাতে দিল।
মাহবুবা আপেল কেটে তাকে খেতে দিয়ে বিস্কুটের প্যাকেট বের করে বলল, এগুলো কোথায় রাখব বলুন।
মাহবুব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আর কত অপমান করবেন?
মাহবুবা অবাক কণ্ঠে বলল, অপমান করছি মানে?
দেখুন কিছু মনে করবেন না, এতদিন যা কিছু করেছেন একজন বিপন্ন রুগীর জন্য করেছেন; কিন্তু এখন অপমান করা হচ্ছে না?
কখনই নয়, যে কেউ কোনো রুগীকে দেখতে গেলে কিছু না কিছু নিয়ে যায়।
কিন্তু আমি তো এখন সুস্থ।
সুস্থ হলেও সম্পূর্ণ নন। তর্ক বাদ দিয়ে বলুন না কোথায় রাখব?
এটাই কিন্তু লাস্ট বলে মাহবুব খাটের নিচে ইঙ্গিত করে বলল, ওখানে একটা পাঁচ পাউন্ডের ডানো দুধের ডিবে আছে।
মাহবুবা বিস্কুট গুলো ডিবেয় রেখে বলল, এবার ফলগুলো খেয়ে নিন।
বারে আমি একা খাব নাকি?
মাহবুবা দুপিস খেয়ে বলল, চা খাওয়ার ইচ্ছা করছে।
আমারও, দাঁড়ান বানাচ্ছি।
না না, আপনাকে বানাতে হবে না, আমি বানাব।
তা হলে সেটা খাওয়াতো দুরের কথা মুখেও দেওয়া যাবে না।
কেন?
আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর আপনি কখনো রান্না ঘরের ধারে কাছেও যাননি।
মাহবুবা কোটিপতির একমাত্র মেয়ে। চা বানিয়ে খাওয়া কল্পনাও করা যায় না। মাহবুব অসুস্থ, তাই কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলেছে। মাহবুবের কথা শুনে বলল, আপনার কথা ঠিক, তবে চেস্টা করতে বাধা কোথায়?
মাহবুব বলল, বাধা নিশ্চয় আছে, কারণ ষ্টোভ ধরাতে গিয়ে বিপদ ঘটাতে পারেন। তার চেয়ে আপনি বসুন আমি বানাচ্ছি। তারপর দুকাপ চা বানিয়ে মাহবুবাকে এক কাপ দিয়ে নিজেও এক কাপ নিল।
চায়ে চুমুক দিয়ে মাহবুবা বলল, বাহ, বেশ সুন্দর বানিয়েছেন তো? তারপর জিজ্ঞেস করল রান্না-বান্না কে করে দেয়?
কে আবার? দুবন্ধুতে মিলে মিশে করি। কাজের বুয়ার হাতের রান্না আমরা খেতে পারি না।
তা হলে আপনারা বেশ কষ্ট স্বীকার করে লেখাপড়া করছেন?
কষ্ট আবার কি? ফরেনে নারী পুরুষ অফিসে কাজ করার পর বাসায় ফিরে মিলে মিশে সব কাজ করে। এখন ওসব কথা থাক, কয়েক দিন থেকে আপনাকে একটা কথা বলব ভাবছিলাম।
মাহবুবা মনে করল, মাহবুব নিশ্চয় বলবে, আমি আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি। তাই আনন্দিত স্বরে বলল, বেশতো বলুন।
আমার পিছনে লেগেছেন কেন?
মাহবুবা মনে হোঁচট খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
কিছু বলছেন না যে?
কেন লেগেছি বুঝতে পারেননি?
সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা পেরেছি।
যতটুকু পেরেছেন, যদি বলি সেটাই সম্পূর্ণ।
মাহবুব আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মাহবুবা বলল, কি হল চুপ করে আছেন কেন?
আপনার মা-বাবা জানেন?
হ্যাঁ, জানেন। তাই তারা তোমার, সরি আপনার অসুখের কথা শুনে ক্লিনিকে কয়েক বার দেখতে গেছেন।
কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না।
কেন?
অনেক কারন আছে, কয়টা বলব।
কারন যতই থাকুক আমি শুধু একটাই শুনতে চাই, আপনি কোনো মেয়েকে ভালবাসেন কিনা বা আপনার কোন বাধা আছে কিনা?
আমি এসব ব্যাপার নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি, তবে বলে থেমে গেল।
কি হল, তবেটা শেষ না করে থেমে গেলেন কেন?
মাহবুব তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছুদিন হল একটা মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে কিন্তু মেয়েটার সব কিছু জানার পর নিরাশ হয়েছি।
মেয়েটা কি জানে, আপনি তাকে ভালবাসেন?
আমিতো ভালবাসার কথা বলিনি, বলেছি পছন্দ হয়েছে।
ঠিক আছে ঐ কথাটাই সে জানে কিনা?
তা আমি কি করে বলব? তবে তার আচার আচরন দেখে কিছুটা বুঝতে পেরেছি।
কথাটা তাকে জানান নি কেন?
উচিত নয় বলে?
এখানে আবার উচিত অনুচিতের কথা থাকবে কেন? আসলে আপনি খুব চাপা। কোনো কথা খোলাখুলি বলতে পারেন না?
পারি। বলছি শুনুন, মেয়েটা কোটিপতির একমাত্র সন্তান। আমি হলাম পল্লী গ্রামের এক মধ্যবিত্ত লোকের ছেলে। আপনিই বলুন, মেয়েটার দিকে কি এগোনো আমার উচিত?
মাহবুবের পছন্দ করা মেয়েটা যে সে, তা মাহবুবা বুঝতে পেরে বলল, কিন্তু মেয়েটা ও তার মা-বাবা যদি আপনাকে পছন্দ করে সানন্দে গ্রহন করতে চায়, তা হলে কী করবেন?
তবু আমার অনেক বাধা আছে।
যেমন?
প্রথম বাধা হল, সমাজ, শহরের সমাজ আর গ্রামের সমাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। দ্বিতীয় বাধা হল, মেয়েটা ভোগ বিলাসে মানুষ হয়েছে। অপর পক্ষে আমি পল্লী গ্রামে সংযমী ও রক্ষণশীল পরিবারে মানুষ হয়েছি। তৃতীয় বাধা হল, মেয়েটা নিশ্চয় শহরের পরিবেশ ছেড়ে গ্রামের পরিবেশে যেতে চাইবে না। আবেগের বসে গেলেও বেশি দিন টিকতে পারবে না। চতুর্থ বাধা হল, গ্রামের খাওয়া-দাওয়া পোশাক-পরিচ্ছদ তার নিশ্চয় পছন্দ। হবে না। অবশ্য না হওয়াটাই স্বাভাবিক। সব থেকে বড় বাধা, আমি ও আমাদের ফ্যামিলীর সবাই ধর্মীয় বিধি নিষেধ যথা সম্ভব মেনে চলি। মেয়েটা শহরের উচ্চ ফ্যামিলীর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। তার পক্ষে সেসব মেনে চলা কী সম্ভব? এরকম আরো অনেক বাধা আছে কয়টা আর তোমাকে, সরি আপনাকে বলব। এখন আপনিই বলুন, আপনাকে যদি কোনো পল্লী গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে পছন্দ করে,তা হলে আপনি কী করবেন?
করব কী, করেইতো ফেলেছি।
মানে?
মানেটা বলতে হবে?
মাহবুব বুঝতে পেরেও ভনিতা করে বলল, না বললে বুঝব কী করে?
আপনি স্কলার ছাত্র হলে কি হবে, বড় বোকা।
তাই বুঝি?
শুধু তাই নও, ভীতুও। নচেৎ নিজের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে এতো ভনিতা করতে না।
বাস, শুধু বোকা ও ভীতু? আর কিছু নই?
মাহবুবা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে চিন্তার ভান করে বলল, আপাততঃ কিছু দেখছি।, তবে বিয়ের পর সবকিছু বলতে পারব।
মাহবুব চমকে উঠে বলল, বিয়ের পর?
কথাটা হঠাৎ মাহবুবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল।
মাহবুব অনেক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার সব কিছু না জেনে এতটা এগোনো তোমার, সরি আপনার উচিত হয়নি।
মাহবুবা চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, আমি এগোইনি, মন এগিয়েছে। এবার একটা অনুরোধ করি?
করুন।
এখন থেকে আমাকে তুমি করে বলবেন, সরি বলে সংসোধন করতে হবে না।
তার আগে আমার সবকিছু শোনা আপনার দরকার। বলছি শুনুন।
তাকে বাধা দিয়ে মাহবুবা বলল, সেদিন মা-বাবার কাছে ও ক্লিনিকে আমার কাছে যতটুকু বলেছেন, তার বেশি শোনার আমার দরকার নেই। আমি আপনার কোন কিছু না জেনেই ভালবেসেছি। আপনি যদি গরিব ঘরের ছেলেও হতেন, তবু ভালবাসা কমতো না। আর মা-বাবাও আপনাকে ভীষণ পছন্দ করে। সে কথা তো আগেই বলেছি।
কিন্তু আমি যে মা-বাবার কথার অবাধ্য কোনো দিন হইনি। তাদের মতামত না নিয়ে কখনো কিছু করিনি?
বেশতো, মা-বাবাকে জানাবেন। প্রয়োজনে তাদেরকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবেন।
আমি মা-বাবাকে চিনি, তারা কোটিপতির মেয়েকে পূত্রবধু করতে কিছুতেই রাজি হবে না। যে সমস্ত বাধার কথা বললাম, তারাও তাই বলবেন।
আপনি বোধ হয় জানেন, আগের যুগে অনেক রাজকন্যা রাজ প্রসাদ ছেড়ে প্রেমিককে বিয়ে করে তার পর্ণকুটীরে বাস করেছে।
তখনকার প্রেমের সঙ্গে আজকালের প্রেমের কোনো তুলনাই হয় না। এখনকার প্রেম, ভোগ-বিলাস আর আনন্দ ফুর্তি করার জন্য। যেখানে ঐশ্বৰ্য্য সেখানেই প্রেম। ঐশ্বৰ্য নেই প্রেমও নেই। ঐ যে প্রবাদ বাক্য আছে সংসারে অভাব প্রবেশ করলে, প্রেম জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। তা ছাড়া এযুগের মেয়েরা বলে থাকে, সহধর্মিনীর যুগ চলে গেছে। এখন সখিত্বের যুগ। আমি সখীত্ব চাইনা, সহধর্মিনী চাই।
আপনার কথা অস্বীকার করব না, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঐ রকম হলেও এখনো কিছু কিছু আগের যুগের মতো প্রেমের ঘটনা যে আছে, তা অস্বীকার করতে পারবেন? আর সহধর্মিনীর কথা যে বললেন, এখনও অনেক মেয়ে সহধর্মিনী হতে চায়।
তবে তাদের সংখ্যা খুব নগন্য।
আমি যদি সেই নগন্যদের একজন হই?
এটা আবেগের কথা, বাস্তবে প্রবেশ করলে আবেগ কর্পূরের মতো উড়ে যাবে। অবাস্তব কোনো দিন বাস্তব হয় না।
আপনার কথাটা বাস্তব। আমি ঐ নগন্যদের দলে, তাই অবাস্তবকে বাস্তব করে দেখাব। অবশ্য সব কিছু নির্ভর করছে আপনার উপর।
আমার উপর মানে?
মানে আপনার প্রেম ভালবাসা ও সহযোগীতা পেলে আমি অবাস্তবকে বাস্তবে পরিনত করতে পারব।
ঠিক আছে, এবারে বাড়িতে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করব। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি কিসে পড়ছেন?
বাংলায় অনার্স করছি।
সেদিন আপনাদের বাসায় কথা বলার সময় আপনার মা-বাবা যে আমার আদর্শকে মেনে নিতে পারেন নি, তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন?
তা পারব না কেন?
তাদের মতামতের বাইরে কিছু করতে পারবেন?
আপনার মতো আমিও মা-বাবার কথার অবাধ্য কখনো হইনি। তাদের মতামত না নিয়ে কোনো কিছু করিনিও।
তা হলে?
তা হলে আবার কি? আপনি কি ভেবেছেন, তাদের মতামত না নিয়েই এতটা অগ্রসর হয়েছি? যদি তাই ভেবে থাকেন, তা হলে ভুল করেছেন। আপনি চলে আসার পর তাদের মতামত আদায় করে ছেড়েছি। তাই তারা কয়েকবার আপনাকে ক্লিনীকে দেখতে গেছেন।
সবকিছু শুনে মাহবুবের বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
মাহবুবাও তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। বলল, কী বিশ্বাস হচ্ছেনা?
আনন্দে চোখে পানি এসে যেতে মাহবুব মাথা নিচু করে নিল।
মাহবুবা বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে বলল, আমি কখনো মিথ্যা বলি না। এবার নিশ্চয় আমার অনুরোধটা রাখবেন?
মাসুমের দুটো ক্লাস ছিল, ক্লাস করে ফেরার সময় বড় রাস্তায় গাড়ি দেখে বুঝতে পারল, মাহবুবা এসেছে। রুমে ঢুকে মাহবুবার অনুরোধের কথা শুনে সালাম দিয়ে বলল, রাখবে না মানে, নিশ্চয় রাখবে। ও না রাখলেও আমি জোর করে রাখাব। বলুন কি অনুরোধ করছেন।
মাসুমের গলা পেয়ে মাহবুব চোখ মুছে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তুই আবার আমাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছিস কেন? তাড়াতাড়ি রান্নার ব্যবস্থা কর।
মাসুম মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলেন ভাবী, তারপর জিবকেটে বলল, সরি, কথাটা হঠাৎ বেরিয়ে গেছে। মাফ করে দিন।
মাহবুবা লজ্জা পেলেও হাসতে হাসতে বলল, ঠিক আছে, কি বলছিলেন বলুন।
মাসুম বলল, ওর সঙ্গে কোনো ব্যাপারেই পেরে উঠি না। সব সময় আমাকে বিয়ে করা বৌ এর মতো হুকুম করে।
মাহবুবা হাসতে হাসতেই বলল, তাই নাকি? তা হলে তো খুব বিপদে আছেন?
বিপদ মানে মহাবিপদে দিন কাটাচ্ছি। পড়তে পড়তে যখন তখন বলবে, দোস্ত এক কাপ চা খাওয়া। শুধু কি তাই, বলছি শুনুন, এক ঝড় বৃষ্টির রাত্রে দুজনে পড়ছিলাম। রাত দুটোর সময় বলল, দোস্ত খিচুড়ী রান্না কর, খেতে বড় ইচ্ছা করছে। কি আর করি খিচুড়ী রান্না করলাম।
মাহবুব একটু রাগের সঙ্গে বলল, আর আমি যে তোকে সহযোগীতা করি তা বললি না যে?
তাতো করিস; কিন্তু প্রথমে যে ভাবে হুকুম করিস, সেটা সহ্য করতে পারি না।
মাহবুব কিছু বলার আগে মাহবুবা বলল, আপনি ওঁর হুকুম মানেন কেন?
ওরে বাবা, তা হলেই হয়েছে। এক সপ্তাহ কথা বলা বন্ধ করে দেবে। আমাকে কিছুই করতে দেবে না, একা একা রান্না করবে। অবশ্য দুজনের জন্যই করবে। একমাত্র আপনিই আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন।
কি করে?
ভাবী হয়ে।
মাহবুবা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কিছু বলতে পারল না।
মাহবুব রাগের সঙ্গে মাসুমকে বলল, তুই কিন্তু ভীষণ বাড়াবাড়ি করছিস, শাস্তির কথা মনে রাখিস।
মাহবুবের দিকে তাকিয়ে মাহবুবা বলল, ওমা ওনাকে মারেনও নাকি?
সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করুন।
মাহবুবা জিজ্ঞেস করার আগেই মাসুম বলল, মারার থেকে বেশি।
ঐ যে বললাম না, এক সপ্তাহ কথা বন্ধ করে দিয়ে একা একা সবকিছু করবে।
এখন উনি অসুস্থ, ওসব করতে পারবেন না।
আপনি ওকে চেনেন না, ও সব পারে। একবার দুজনেরই ভীষণ সর্দিজ্বর হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আমার থেকে ওর বেশি হয়েছিল। সে সময় বললাম, কয়েক দিনের জন্য না হয় কাজের বুয়া ঠিকেয় রাখি। বলল, না। তুই শুয়ে থাকবি, আমি সব কিছু করব। করলও তাই। আমি কিছু করতে গেলে তাড়িয়ে দিয়েছে।
মাহবুব গম্ভীর কণ্ঠে মাসুমকে বলল, খুব হয়েছে। এবার বাজে প্যাচাল বন্ধ করে রান্না কর। কত বেলা হয়েছে খেয়াল করেছিস?
মাসুম বলল, আজ রান্না করব না, হোটেল থেকে বিরানী এনে তিনজনে খাব। তারপর মাহবুবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি বোধ হয় অনেক্ষণ এসেছেন?
মাহবুবা ঘড়ি দেখে বলল, হ্যাঁ তা প্রায় ঘন্টা দুই হবে।
এতক্ষণে নিশ্চয় গলা শুকিয়ে গেছে। দাঁড়ান, চা তৈরী করি। দোকানের চা উনি খেতে পারেন না বলে মাহবুবকে ঈঙ্গিতে দেখাল।
মাহবুবা বলল, আপনার বন্ধু চা করে খাইয়েছে। এখন আর খেতে ইচ্ছা করছে না। তবে আপনারা খেলে করতে পারেন।
মাসুম বলল, তা হলে থাক। আপনার জন্যই বলেছিলাম। ঠিক আছে, আমি হোটেল থেকে বিরানী নিয়ে আসি। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল।
মাহবুবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার অনুরোধের কথাটা মনে রাখলে খুশি হব।
মাহবুব বলল, আপনি যদি আমারও ঐ একই অনুরোধ রাখেন, তা হলে আমিও খুশি হব।
ঠিক আছে, আমি রাজি
তা হলে আমিও রাজি।
একটা কথা বলব?
বল।
প্রতিদিন এলে কোনো অসুবিধা হবে?
নিশ্চয় হবে। কারন এটা মেস, আর আমাদেরকে আশপাশের সবাই চেনে। তোমাকে প্রতিদিন আসতে দেখলে সবার কাছে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।
মাহবুব তুমি করে বলতে শুরু করেছে দেখে, মাহবুবাও শুরু করল। বলল, তোমাকে না দেখে যে থাকতে পারব না।
আর একটু সুস্থ হয়ে কয়েক দিনের মধ্যে ভার্সিটি যাব। তখন দেখা হবে।
তাতো হবেই; কিন্তু যতদিন না যাচ্ছ, ততদিন কি হবে?
কি আবার হবে, ধৈৰ্য্য ধরবে।
পারব না, একদিনও থাকতে পারব না।
গত দুদিন ছিলে কি করে?
বাবার সঙ্গে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম, যা কষ্ট হয়েছে না?
দেখ, ছেলে মানুষি করো না, ধৈৰ্য্য তোমাকে ধরতেই হবে।
মাসুম ফিরে এসে মাহবুবের কথা শুনতে পেয়ে বলল, সবকিছুতে ধৈর্য ধরা গেলেও প্রেমের ব্যাপারে ধরা যায় না। আর একটা ব্যাপারেও ধরা যায় না, সেটা হল পেটের কান্না। এখন সেই কান্না থামাবার উপকরণ হাজির। অতএব দেরি না করে শুরু করা যাক। খালি পেটে প্রেমালাপ জমে না।
মাহবুব বেশ রাগের সঙ্গে বলল মাসুম তুই কিন্তু সীমার বাইরে চলে যাচ্ছিস। পরিনতির কথা চিন্তা করে আর একটা কথাও বলবি না।
দেখেছেন ভাবী, থুড়ি, কি বলে ডাকব বলে দেবেন তো?
কেন, আমার নাম ধরে ডাকবেন।
আপনার নামের অর্থ প্রেমিকা। তাই ঐ নামে মাহবুব ডাকতে পারলেও আমি পারব না। আচ্ছা, আপনার আর কোনো নাম নেই? মানে ডাক নাম।
না নেই। তবে সুলতানা বলে ডাকতে পারেন। আমার পুরো নাম মাহবুবা সুলতানা।
দারুন নাম তো। সুলতানা মানে ম্রাজ্ঞী। ঠিক আছে সুলতানা বলেই ডাকব। কিন্তু শুধু নাম ধরে ডাকা কি ঠিক হবে?
কেন ঠিক হবে না? আপনি সুলতানা বলেই ডাকবেন।
কিরে তুই আবার মাইন্ড করবি না তো বলে মাসুম মাহবুবের দিকে তাকাল। তাকে বড় বড় চোখে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে কাচুমাচু হয়ে বলল, মাফ করেদে দোস্ত, এই চুপ করলাম। তারপর তাদের দুজনকে দুটো বিরানীর প্যাকেট দিয়ে নিজেও একটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিল।
মাহবুব বলল, আমরা খাব আর ড্রাইভার—–।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মাসুম বলল, তার হয়তো এতক্ষণে খাওয়া শেষ।
যাক এতক্ষণ বুদ্ধর মতো কাজ করে শেষ কালে বুদ্ধিমানের পরিচয় দিলি। সে জন্যে আজকের সব অপরাধ মাফ করে দিলাম।
মাসুম খেতে খেতে বলল, ধন্যবাদ।
খাওয়া দাওয়া করে মাহবুবা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর মাসুম খাটের উপর আরাম করে শুয়ে বলল, একেই বলে ভাগ্য, রাজ কন্যার সাথে রাজ্যও পেয়ে যাবি।
মাহবুব বলল, ভাগ্যের কথা একমাত্র আল্লাহ মালুম। আমি রাজ্য পাওয়ার আশা করিনি। শুধু রাজকন্যাকে পেলেই ভাগ্যবান মনে করব। ব্যাস আর কোনো কথা বলবি না। হয় পড়, নচেৎ চুপ করে শুয়ে থাক। আমি এখন পড়ব। অসুখ করে অনেক ক্ষতি হয়েছে।
.
০৪.
মাহবুব সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর বাড়ি গেল। অসুখে খুব রোগা হয়ে গিয়েছিল। এই কয়েক দিনে কিছুটা ইম্প্রভ হয়েছে। তবু মরিয়ম খাতুন ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, অসুখ হয়ে বেশ রোগা হয়ে গেছিস। কিছু দিন থেকে ভালো করে খাওয়া দাওয়া করে স্বাস্থ্য ভালো হলে তারপর যাবি।
সুলতান খাঁন সেখানে ছিলেন। বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথা বলেছ।
মাহবুব বলল, অনেক দিন আসিনি, তাই দুএক দিনের জন্য এসেছি।
মরিয়ম খাতুন বললেন, সে কিরে, এতদিন পর এসে মাত্র দুদিন থাকবি? না বাবা না, অন্তত দশ পনের দিন থেকে শরীরটা ভালো হলে তারপর যাবি।–
মাহবুব বলল, এক সপ্তাহের বেশি থাকতে পারব না। অসুখ করে পড়ার অনেক ক্ষতি হয়েছে। পরীক্ষারও বেশি দেরি নেই। পড়াশোনা করতে হবে। নচেৎ রেজাল্ট ভালো হবে না।
সুলতান খাঁন বললেন, ঠিক আছে, তুমি যা ভালো বুঝো করো।
মাহবুব ক্লাস করতে না যাওয়া পর্যন্ত মাহবুবা দুতিন দিন অন্তর মেসে এসেছে। তারপর ভার্সিটিতে দেখা করত। তিন চার দিন দেখা না পেয়ে একদিন মেসে গেল।
মাসুম তখনও ফেরেনি। রুমে তালা দেখে ফিরে আসছিল। এমন সময় মাসুমকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মাসুম কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, রুমে তালা দেখে নিশ্চয় ফিরে যাচ্ছিলেন?
মাহবুবা বলল, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনার বন্ধু নিখোঁজ কেন?
সে কথা জানতে হলে আসুন আমার সঙ্গে। তারপর রুমে এসে বসতে বলে বলল, কেমন আছেন আগে বলুন।
ভালো। আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভালো, তবে বন্ধু বিহনে, ভালো করে পড়াশোনা করতে পারছি না।
তা কেন? একা একা পড়াশোনা তো ভালো হওয়ার কথা।
আপনার কাছে ভালো হলেও আমি একা একা পড়তে পারি না।
প্রাইমারীতে পড়ার সময় একজন শিক্ষকের কাছে শুনে ছিলাম।
একে গুন গুন, দুয়ে ঠিক।
তিনে গন্ড গোল, চারে হাট।
মাহবুবা হেসে উঠে বলল, আরে ভাই, ওটা তো প্রাইমারী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নয়? থাক আপনার বন্ধুর নিখোঁজের খবর বলুন।
সেতো চার পাঁচ দিন আগে বাড়ি গেছে, কেন আপনাকে জানাইনি?
জানালে কি আর খোঁজ নিতে আসতাম? কদিন থাকবে কিছু বলে গেছে?
বলে তো গেল দুদিন থাকবে। চার পাঁচ দিন হয়ে গেল এল না। মনে হয় আজ কালের মধ্যে চলে আসবে।
ঠিক আছে চলি তা হলে?
সে কি? কিছু না খাইয়ে ছাড়ছি না। বসুন চা করি, ঘরে বিস্কুট চানাচুর আছে।
চা খেয়ে মাহবুবা বিদায় নিয়ে ফিরে এল।
.
মাহবুব বাড়িতে আসার পাঁচ দিন পর সুলতান খাঁনের ভীষণ জ্বর হল। মাহবুব ডাক্তার নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। কিন্তু কোনো কাজ হল না। দিনে রাতে চার পাঁচবার জ্বর ১০৪ ডিগ্রী উঠে। মাথায় পানি দিলে, ঔষুধ খাওয়ালে কমে। ওষুধের এ্যাকসান কেটে গেলে আবার উঠে।
তিন চার দিনের মধ্যে কোনো উন্নতি না হতে মাহবুব টাউন থেকে বড় ডক্তার নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতে লাগল। আট দশ দিন পর জ্বর ভাল হল। আরো দুদিন পর। মাহবুব মায়ের সামনে আব্বাকে বলল, ডাক্তার বললেন, আপনি কয়েক দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। তাই বলছিলাম এবার আমি ঢাকা যেতে চাই, আমার পড়া শোনার খুব ক্ষতি হচ্ছে। এমনি অসুখ হয়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে।
সুলতান খাঁন বললেন, হাঁ বাবা, তুমি কালকেই রওয়ানা দাও। আল্লাহ চাহেতো আমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাব।
মাহবুব বলল, আমার হাজার বার টাকা লাগবে।
সুলতান খাঁন খুব অবাক হয়ে বললেন, এত টাকা কি দরকার?
আমার টাইফয়েড হয়েছিল। বন্ধু মাসুম, যে গত বছর বেড়াতে এসেছিল, আমরা তো মেসে একরুমে থাকি। প্রথমে সে ডাক্তার এনে চিকিৎসা করায়। তিন দিনের দিন জ্বরে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ডাক্তার মেডিকেলে নিতে বলেন। মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার আগে মাহবুবা নামে আমাদের একটা জানাশোনা মেয়ে তাদের গাড়িতে করে ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসা করায়। সেখানে প্রায় পনের দিন ছিলাম। দশ হাজার টাকা বিল। হয়েছিল। আমার বা মাসুমের কাছে অত টাকা ছিল না। মাহবুবা দিয়েছে তাকে দিতে হবে।
সুলতান খাঁন বললেন, ঠিক আছে, যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।
একটা মেয়ে এত টাকা দিয়েছে শুনে মরিয়ম খাতুনের মনে সন্দেহ হল। ছেলেকে পাশের রুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একটা মেয়ে শুধু শুধু তোর জন্য এতকিছু করল কেন?
মাহবুব মায়ের কথার উত্তর এড়াবার জন্য বলল, জান আম্মা, মাসুম আর মাহবুবা না থাকলে হয় তো এবার মারা যেতাম। ওদের দুজনের ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।
মরিয়ম খাতুন বললেন, মাহবুবা বুঝি খুব বড় লোকের মেয়ে?
বড় লোকের মানে, ওর বাবা ভীষণ বড়লোক। বাংলাদেশের যে কয়েকজন বড় লোক আছেন, তাদের মধ্যে উনিও একজন।
মরিয়ম খাতুন অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু সে তোর জন্য অত কিছু করল কেন বলবি তো?
মাহবুব কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।
কিরে বলছিস না কেন?
মাহবুব আমতা আমতা করে বলল, মেয়েটাও ভার্সিটিতে পড়ে। চেনা পরিচয় ছিল। আমার অসুখ হয়েছে জেনে করেছে।
মরিয়ম খাতুন বুঝতে পারলেন, মেয়েটা হয়তো মাহবুবকে পছন্দ করে। বললেন, আল্লাহ মেয়েটার ভালো করুক, তাকে সুখী করুক, তার মনের নেক কামনা পূরণ করুক।
মাহবুব মনে মনে বলল, আমিন।
সুলতান খাঁন আলাউদ্দিন মীরের কাছ থেকে শুধু মাহবুবের লেখাপড়ার খরচের জন্য টাকা নেন। এবারে টাকা আনার আগেই জ্বরে পড়েছেন। এক সময় ছেলেকে ডেকে বললেন, তুমি আলাউদ্দিন মীরের কাছে যাও। তাকে বলবে আব্বা বার হাজার টাকা দিতে বলেছে।
মাহবুব কখনো আব্বার কথার উপর কথা বলেনি। তাই বেশ অবাক হলেও আলাউদ্দিন মীরের কাছে কেন টাকা চাইতে বলছেন, জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সামলে নিল। বলল ঠিক আছে, এক্ষুণী যাচ্ছি।
সুলতান খাঁন বললেন, তাকে বলবে আমি অসুস্থ তাই তোমাকে পাঠিয়েছি।
জ্বি বলব বলে মাহবুব বেরিয়ে গেল।
আলাউদ্দিন মীর প্রথম জীবনে একজন সাধারণ গৃহস্থ ছিলেন। নিজে সামান্য লেখাপড়া জানেন। অর্থাভাবে পাঁচ ছেলেকেও প্রাইমারী পর্যন্ত পড়িয়ে আর পড়াতে পারেন নি। তা ছাড়া ছেলেগুলোর মোটা বুদ্ধি। কিন্তু মেয়ে তাহেরা যেমন চালাক চতুর তেমনি বুদ্ধিমান। তাই সব ভাইয়েরা তাকে যেমন খুব ভালবাসে তেমনি তার আব্দারও পূরণ করে। আলাউদ্দিন মীরও মেয়েকে অত্যন্ত ভালবাসেন। মেয়ের পড়া শোনার ঝোঁক দেখে পড়া বন্ধ করেননি। দূরে কলেজ বলে যাতায়াতের জন্য বাঁধা রিক্সার ব্যবস্থা করেছেন। তাহেরা গত বছর বি.এ. পাস করেছে। এস.এস.সি. করার পর থেকে অনেক জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। আলাউদ্দিন মীরও চেয়েছিলেন বিয়ে দিতে; কিন্তু তাহেরা রাজি হয়নি। বলেছে এম.এ.পাস না করা পর্যন্ত তোমরা আমার বিয়ের কথা চিন্তা করবে না। আলাউদ্দিন মীর আদরের মেয়ের কথার প্রতিবাদ করেনি।
তাহেরা মাহবুবকে আজও ভুলতে পারেনি। তাই সে যতবার বাড়ি এসেছে ততবারই চাকর রহিমকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে। আসেনি বলে মনে আঘাত পেলেও তার প্রতি বিদ্বেষ জন্মায়নি বরং তার জন্যে আরো পাগল হয়ে উঠেছে। এবারে, তার আসার খবর পেয়ে ডেকে পাঠিয়েছিল। মাহবুব আসেনি।
আলাউদ্দিন মীরের পূর্ব পূরুষদের ও তাদের বর্তমান অবস্থার কথা মাহবুব আব্বার কাছে শুনেছিল। আরো শুনেছিল, তাদের পারিবারিক পরিবেশ খুব নিচু শ্রেণীর। তাই কলেজে পড়ার সময় তাহেরা যেদিন তাকে ডেকে ভালবাসার কথা জানায় সেদিন মনের কথা না জানালেও পরে যখন চাকরের হাতে বার বার ডেকে পাঠিয়েছে তখন আব্বার কথা স্মরণ করে তার সঙ্গে দেখা করেনি। আজ তার বাবার কাছে টাকা চাইতে আসার সময় চিন্তা করতে লাগল, তাহেরা কত দিন ডেকে পাঠিয়েছে, সে একদিনও যাইনি। আজ তার সঙ্গে দেখা হলে যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, তা হলে কি বলবে। এই সব ভাবতে ভাবতে আলাউদ্দিন মীরের কাঁচারী বাড়ির সামনে এসে চাকর রহিমকে দেখে জিজ্ঞেস করল, মীর চাচা ঘরে আছেন?
রহিম চোদ্দ পনের বছরের এতিম ছেলে। সাত আট বছর বয়সের সময় থেকে এদের বাড়িতে চাকরের কাজ করছে। সে মাহবুবকে চিনে। তাকে দিয়েই তাহেরা মাহবুবকে ডেকে পাঠায়। বলল, দাঁড়ান দেখে আসি। তারপর বাড়ির ভিতর চলে গেল।
তাহেরা নাস্তা খেয়ে বারান্দায় এসে কুলি ফেলল। তারপরে রহিমকে দেখে বলল, কিরে কিছু বলবি নাকি?
রহিম বলল, আপা, আপনি যাকে ডেকে আনার জন্য আমাকে পাঠান, তিনি চাচার খোঁজ করছেন।
তাহেরা চমকে উঠে বলল, কি বললি? মাহবুব ভাই এসেছে?
হ্যাঁ আপা, আমি কাঁচারী ঘরের সামনে গরুর জন্য খড় কাটছিলাম। চাচা ঘরে আছে কিনা জিজ্ঞেস করল। চাচাকে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। সেকথা বললে যদি চলে যান, তাই একটু দাঁড়াতে বলে আপনার কাছে এলাম।
তাহেরা বলল, খুব ভালো করেছিস। যা ওকে কাঁচারী বাড়িতে বস, আমি আসছি। আর শোন, আব্বার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি উনি একটু পরে আসছেন।
জ্বি আচ্ছা বলে রহিম চলে গেল।
তাহেরা তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে কাপড় পাল্টে সামান্য প্রসাধন করল। তারপর কাঁচারী বাড়িতে এসে মাহবুবকে সালাম দিয়ে বলল, আজ আমার কি সৌভাগ্য, যাকে পাঁচ-ছ-বছর ধরে ডেকেও দেখা পাওয়া যায় নাই হঠাৎ তার আগমন? তা কেমন আছ?
এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে পারে মাহবুব চিন্তা করেছিল। তাই কুণ্ঠিত হলেও সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তুমি কেমন আছ?
ভালো মন্দ জেনে কি হবে? আমার কথা কী তোমার মনে আছে?
মনে থাকবে না কেন?
তা হলে পাঁচ-ছ-বছর দেখা করনি কেন? ডেকে পাঠালেও আসনি কেন?
মাহবুব উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।
আমার কথার উত্তর তুমি যে দিতে পারবে না, তা আমি জানি। তবু কয়েকটা কথা না বলে থাকতে পারছি না। পাঁচ-ছ-বছর আগে একদিন এখানেই তোমাকে যে কথা বলেছিলাম, তার উত্তর শোনার জন্য আজও তোমার প্রত্যাশায় আছি। সেদিন তুমি বলেছিলে প্রেম ভালবাসা মনের ব্যাপার। যেদিন মন থেকে সাড়া পাব সেদিন। জানাব। আজও কী তোমার মনে সেই সাড়া জাগেনি?
এই কথারও উত্তর দিতে না পেরে মাহবুব চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাহেরা বসে পড়ে মাহবুবের পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে ভিজে গলায় বলল, তুমি বলতে না পারলেও আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার মনে আমার জায়গা কখনো হবে না। তোমার কথাই ঠিক প্রেম ভালবাসা কখনো জোর করে আদায় করা যায় না, ওটা মনের ব্যাপার। তবে একটা কথা মনে রেখ, বি. এ. পাশ করার পর থেকে অনেক জায়গা থেকে ভালো ভালো সম্বন্ধ এসেছে; তোমার জন্য তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আর একটা কথাও মনে রেখ, তোমার মনে আমার জায়গা না হলেও আজীবন তুমি আমার মনি কোঠায় বিরাজ করবে। দোয়া করি, আল্লাহ তোমার ভবিষ্যৎ জীবন সুখের ও শান্তির করুক। তারপর চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল।
তাহেরার মা রোশনী বিবি রহিম তাহেরাকে যা কিছু বলেছে, খাওয়ার ঘর থেকে সব শুনেছেন। তারপর মেয়ের কথা শুনে ও তাকে সাজ-গোজ করে কাঁচারী বাড়িতে যেতে দেখে ভাবলেন, কে এই মাহবুব? তাকে তাহেরা ডেকেই বা পাঠায় কেন? এখন আবার তার কাছে গেলই বা কেন? তা হলে কী একেই তাহেরা পছন্দ করে? আর সেই জন্যই কী নানা ছুতায় বিয়ে করতে রাজি হয়নি? ছেলেটা কে দেখার ইচ্ছা দমন করতে না পেরে কাঁচারী বাড়ির পূর্ব পাশের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ তাদের সব কিছু দেখছিলেন ও শুনছিলেন। মেয়েকে চোখ মুছতে মুছতে চলে যেতে দেখে তিনিও চলে গেলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে আলাউদ্দিন মীর বাইরে থেকে এসে কাঁচারী বাড়িতে মাহবুবকে বসে থাকতে দেখে তার কাছে গেলেন।
মাহবুব দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
আলাউদ্দিন মীর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, দাঁড়ালে কেন বস। তারপর নিজেও বসে বললেন, কয়েক দিন আগে তোমার আব্বার অসুখের কথা শুনেছিলাম। যাই যাই করেও কাজের চাপে যেতে পারিনি। এখন কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে এখন ভালোর দিকে। বার হাজার টাকার জন্য আব্বা আমাকে পাঠালেন।
ঠিক আছে, তুমি বস, আমি আসছি। কথা শেষ করে আলাউদ্দিন মীর বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন।
রোশনী বিবি বারান্দায় ছিলেন। স্বামী কাছে এলে বললেন, কে ছেলেটা? চেনা চেনা মনে হলেও চিনতে পারছি না।
আলাউদ্দিন মীর বললেন, চল ঘরে গিয়ে বলছি। ঘরে এসে বললেন, সুলতান খাঁনের ছেলে মাহবুব। তার অসুখ তাই ছেলেকে বার হাজার টাকার জন্য পাঠিয়েছে।
রোশনী বিবি টাকার ব্যাপারটা জানেন, তাই আর কিছু জিজ্ঞেস না করে বললেন, টাকাটা দিয়ে এস. কথা আছে।
আলাউদ্দিন মীর টাকা নিয়ে মাহবুবের কাছে এসে দেওয়ার সময় বললেন, তোমার আব্বাকে বলো, এই বার হাজারই শেষ। আমার কাছে তার আর কোনো টাকা পাওনা নেই।
মাহবুব যে কথা আব্বাকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি, সে কথা জানার আগ্রহ চেপে রাখতে পারল না। বলল, আব্বা আপনার কাছে কিসের টাকা পেতেন?
তোমার আব্বা কি তোমাকে কিছুই বলেন নি?
জ্বি না।
আলাউদ্দিন মীর চিন্তা করলেন, ছেলে অমত করবে বলে হয়তো সুলতান খাঁন তাকে জানাইনি। সুযোগ যখন এসেছে তখন আমারই জানিয়ে দেওয়া উচিত। নচেৎ পরে এই ছেলে আমাকে দোষ দিতে পারে। বললেন, তোমাকে লেখাপড়া করাবার জন্য বড় পুকুরটা সাত বছরের জন্য এক লাখ টাকায় সাফকবলা রেখেছেন। এই সময়ের মধ্যে টাকা ফেরৎ দিলে তোমাদের পুকুর তোমাদের থেকে যাবে। আর না দিতে পারলে সাত বছর পর আমাদের হয়ে যাবে।
কথাটা শুনে মাহবুবের মনে হল, তাকে যেন কেউ সূউচ্চ পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। অনেক্ষণ মাথানিচু করে চুপ করে রইল। তখন তার একটা হাদিসের কথা মনে পড়ল, আল্লাহ যখন কোনো লোককে অপমানিত করতে চান, তখন তার ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেন। হাদিসটা মনে পড়তে আব্বার উপর প্রচন্ড অভিমান হল। এক সময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
আলাউদ্দিন মীর তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, এতে তুমি এত চিন্তা করছ কেন? তোমার আব্বা তোমাকে উচ্চ শিক্ষিত করে মানুষ করার জন্য যা করেছেন, তা অত্যন্ত ভালো কাজই করেছেন। তার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। এই বছরই তো তুমি পাশ করে বেরোবে। এখনো দুবছর সময় আছে, এর মধ্যে তুমি রোজগার পাতি করে টাকাটা দিয়ে দিও। তা হলে তো কোনো সমস্যা নেই।
মাহবুব চোখ মুছে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসি চাচা। তারপর মাতালের মতো টলতে টলতে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
আলাউদ্দিন মীরের ঠোঁটে ক্রুর হাসি ফুঠে উঠে মিলিয়ে গেল। তারপর স্ত্রীর কাছে ফিরে এসে বললেন, বলো কি বলবে।
রোশনী বিবি বললেন, তুমি তো সুলতান খাঁনের পুকুর নেওয়ার তালে আছ। আর তোমার মেয়ে যে তার ছেলেকে ভালবাসে, তার কী হবে?
আলাউদ্দিন মীর চমকে উঠে বললেন, কি বাজে কথা বলছ?
বাজে কথা নয় সত্য। তারপর তাহেরা ও মাহবুবের সঙ্গে যা কিছু কথাবার্তা হয়েছে। খুলে বলে বললেন, আমার কি মনে হয় জান, তাহেরা মাহবুবের জন্যই এতদিন বিয়েতে রাজি হয়নি।
স্ত্রীর কথা শুনে আলাউদ্দিন মীর অনেক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর বললেন, ব্যাপারটা অনেক আগেই আমার বোঝা উচিত ছিল।
তোমার এসব বোঝার সময় কোথায়? সব সময় তো চিন্তা কর, কি করে সম্পত্তি বাড়াবে। এখন আমি একটা কথা বলি শোন, তোমার মুখেই খানেদের অনেক গুণাগুণ শুনেছি। মাহবুবের গুণাগুণও তুমি আমার কাছে অনেক করেছ। এখন তাকে জামাই করার ব্যবস্থা কর।
আলাউদ্দিন মীর হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, তুমি দারুন কথা বলেছ। মাহবুবের মতো সোনার টুকরো ছেলের জন্য এক লাখ কেন, কয়েক লাখ খরচ করলেও পাওয়া যাবে না। আমি দুএক দিনের মধ্যে সুলতান খাঁনের সঙ্গে আলাপ করব। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু সুলতান খাঁন কি আমাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে রাজি হবেন। হাজার হোক আমাদের পূর্ব পুরুষরা এক সময় তাদের প্রজা ছিল।
রোশনী বিবি বললেন, সে সব অনেক আগের কথা। তা ছাড়া তাহেরার কথাটা আমাদের চিন্তা করতে হবে না?
ঠিক আছে তাই হবে। এখন যাই পাশের গ্রামে একটু যেতে হবে। কথা শেষ করে আলাউদ্দিন মীর বেরিয়ে গেলেন।
মাহবুব ফেরার পথে মনকে শক্ত করল। ভাবল, আব্বা আমাকে না জানিয়ে ভুল করলেও আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য করেছেন। এখন কিছু বলে তার মনে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। সিদ্ধান্ত নিল, আব্বার সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলাপ করবে না। আরো সিদ্ধান্ত নিল, পরীক্ষার পর যেমন করে তোক উপার্জন করে আলাউদ্দিন মীরের এক লক্ষ টাকা পরিশোধ করতেই হবে। তারপর মনে মনে আল্লাহকে জানাল, আল্লাহ পাক, তুমি আমাকে এই টাকা পরিশোধ করার তওফিক দিও।
ঘরে এসে যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে আব্বাকে টাকা নিয়ে আসার কথা ও আলাউদ্দিন মীর যা বলতে বলেছিলেন বলল। তারপর পাঁচশো টাকা মায়ের হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখ, আমার সাড়ে এগার হাজার টাকা হলেই চলবে।
মরিয়ম খাতুন টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, আমাদের লাগবে না, তুই নিয়ে যা। তোর অসুবিধা হলে কোথায় পাবি?
মাহবুবের শুধু কান্না পাচ্ছে। মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এল।
মাহবুব চৌদ্দ দিন বাড়িতে থেকে ঢাকা ফিরে এল। আসবার সময় মাকে বলে এল, আমি টাকা চেয়ে না পাঠালে, তোমরা পাঠিও না।
মাসুম মেসেই ছিল। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করল, কিরে দুদিনের কথা বলে দুসপ্তাহ পার করে এলি যে?
মাহবুব আব্বার অসুখের কথা বলল।
একটা চিঠিও তো দিতে পারতিস। এদিকে তোর মাহবুবা প্রতিদিন এসে আমার উপর ঝাল ঝাড়ছেন। তুই তাকে না জানিয়ে গেলি, আর সেই রাগটা আমার উপর দেখাচ্ছেন। প্রেম ও স্বপ্ন/৪
সে কথা আমাকে বলছিস কেন? তাকে বললেই পারতিস।
তা আর বলিনি; কিন্তু কে শোনে কার কথা। তার ধারণা, তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমার সঙ্গে পরামর্শ করে তুই না জানিয়ে গেছিস।
কেউ যদি ভুল ধারণা করে, সেজন্যে তুই আমাকে দোষী করছিস কেন? যাক, যা হওয়ার হয়েছে। তারপর টাকার বান্ডিল বের করে তা থেকে দুহাজার নিয়ে বাকি টাকা মাসুমের হাতে দিয়ে বলল, ক্লিনিকের বিলের টাকা। মাহবুবা এলে দিয়ে দিবি।
মাসুম বলল, আমি দেব কেন? তুই দিবি।
আমি দিলে নেবে না।
আর আমি দিলে বুঝি নেবে?
আমি যখন থাকবো না তখন দিবি। না নিতে চাইলে যুক্তি দেখিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবি।
মাসুম চিন্তা করে দেখল, মাহবুবের কথাটা ঠিক। বলল, ঠিক আছে, চেস্টা করব। না নিলে আমাকে দোষী করবি না বলে রাখছি।
মাহবুব আর কিছু বলল না।
পরের দিন ক্লাস করে মাহবুব মেসে ফিরল না। প্রায় ঘন্টা তিনেক লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করল। তারপর কয়েকজন জানা শোনা ছেলের সঙ্গে দেখা করে প্রাইভেট ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করে দিতে বলে সন্ধ্যের সময় ফিরল।
মাসুম জিজ্ঞেস করল, সারাদিন কোথায় ছিলি?
একটা কাজে কয়েক জায়গায় যেতে হয়েছিল।
কাজটা কি শুনি?
পরে শুনিস, এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবি না।
তোর কি হয়েছে বলতো?
এবারে বাড়ি থেকে ফিরে তোকে যেন কেমন মনে হচ্ছে। তোর বাবার অবস্থা কী ভালো নয়?
নারে আব্বা ভাল আছেন। মন খারাপ অন্য কারনে।
সেই কারণটা বলছিস না কেন?
বলার মতো হলে তুই জিজ্ঞেস করার আগেই বলতাম। এখন আমার কথা বাদ দিয়ে নিজের চরকায় তেল দে।
তা না হয় দেব; কিন্তু তোর মাহবুবা কাল এলে কি বলব? আজ প্রায় দুঘন্টা তোর জন্য অপেক্ষা করে গেছে। টাকা দিতে গিয়েছিলাম, নিল না। জিজ্ঞেস করল, কিসের টাকা? বললাম, মাহবুবের ক্লিনিকের বিল। বলল, যার টাকা সে দিলে নেব। কাল এই সময় আসব, আপনার বন্ধুকে থাকতে বলবেন। তারপর আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল।
তাকে বলিস, কয়েকদিন আমি খুব ব্যস্ত থাকব, সে যেন না আসে। পরে আমিই তার সঙ্গে দেখা করব। তারপর মাসুমের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে ব্রীফকেসে তুলে রাখল।
তুই কি আমাকে অবিশ্বাস করিস?
একথা বলতে পারলি?
তা হলে কি হয়েছে বলছিস না কেন?
বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করবি না। বললাম না, বলার মতো হলে আগেই বলতাম? তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। একটু সামলাতে দে, তারপর বলব। তোকে বলব না তো কাকে বলব। তোর কাছে একান্ত অনুরোধ, আমি না বলা পর্যন্ত কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবি না।
মাসুম আহত স্বরে বলল, ঠিক আছে তাই হবে।
পরের দিন বেলা তিনটের সময় মাহবুবা মেসে এসে মাসুমকে একা দেখে সালাম দিয়ে বলল, এখনো মাহবুব ফেরেনি?
মাসুম বলল, না ফেরেনি।
আমি যে প্রতিদিন আসি, সে কথা তাকে বলেন নি?
বলেছি। তারপর মাহবুব যা বলতে বলেছিল, বলল।
ব্যস্ততার কারণ আপনাকে কিছু বলেনি?
না। জিজ্ঞেস করতে বলল, ব্যস্ততা কমলে নিজেই বলবে। তার আগে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করেছে।
ঠিক আছে, কয়েক দিন পরে আসব বলে মাহবুবা ভারাক্রান্ত মনে সেখান থেকে। ফেরার পথে চিন্তা করতে লাগল, বাড়িতে গিয়ে মাহবুবের কী এমন হল, যে কারণে আমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করছে না।
আট দশ দিনের মধ্যে মাহবুব এক সহপাঠির মাধ্যমে এলিফেন্ট রোডে নাইন টেনের দুটো ছাত্র-ছাত্রী পেল। সপ্তাহে চারদিন পড়াতে হবে। বেতন দুহাজার টাকা। দুতিন মাসের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনার উন্নতি দেখাতে পারলে আরো এক হাজার বাড়িয়ে দেবে।
মাহবুব সহপাঠিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিয়ে মসজিদে গিয়ে দুরাকাত শোকরানার নামায পড়ল, তারপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর আজিমপুরে এক মেসে থাকার ব্যবস্তা করে রাত আটটায় ফিরে এল।
মাসুম পড়ছিল। পড়া বন্ধ করে বলল, আর কতদিন ব্যস্ত থাকবি?
আল্লাহর রহমতে আজই শেষ বলে মাহবুব বই পত্র গুছিয়ে বাঁধতে শুরু করল।
কিরে এসব কি করছিস?
কি করছি দেখতেই তো পাচ্ছিস।
কিন্তু কেন বলবি তো?
আমি এখানে আর থাকব না, অন্যখানে আজই চলে যাব।
মাসুম খুব অবাক হয়ে বলল, কী পাগলামী করছিস?
আমি যে কখনো পাগলামী করিনি তা নিশ্চয় জানিস?
কিন্তু কেন যাবি বলবিতো? আমি কি এমন দোষ করেছি? যে জন্যে তুই আজ দশ বার দিন আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলিসনি, এখন আবার চলে যেতে চাচ্ছিস?
তুই কোনো দোষ করিসনি। আমার তকদির আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।
তা হলে মাহবুবার কারণে তুই পালাতে চাচ্ছিস? তারপর তার দুটো হাত ধরে ভিজে গলায় বলল, না বললে কিছুতেই যেতে দেব না।
মাহবুব বলল, ঠিক আছে বলছি, তবে তার আগে তোকে ওয়াদা করতে হবে, যা বলব, কোনো দিন কাউকে বলবি না। মাহবুবাকে তো নই-ই।
করলাম।
হাত ছেড়ে বস, বলছি। তারপর আব্বা তাকে না জানিয়ে কি ভাবে লেখাপড়া করাচ্ছে এবং দুবছরের মধ্যে আলাউদ্দিন মীরের এক লাখ টাকা ফেরৎ দিতে না পারলে কি হবে, সব কিছু খুলে বলে বলল, যেমন করে থোক এই সময়ের মধ্যে আমাকে এক লাখ টাকা যোগাড় করতেই হবে।
মাসুম বলল, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু এখান থেকে চলে যাবি কেন?
এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারলি না? আরে বোকা, এখানে থাকলে মাহবুবার সঙ্গে যোগাযোগ হবে। এখন আর তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা আমার উচিত হবে না।
কেন? সে আবার দোষ কি করল, যে জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা উচিত হবে না?
আসলে তুই শুধু বোকা নস, নীরেট বোকা। আরে নীরেট বোকা গাধা, আমার এখন দুটো সাধনা। একটা হল, রেজাল্ট ভালো করা। আর অন্যটা হল, আব্বার ঋন পরিশোধ করা। এর মধ্যে মাহবুবার সঙ্গে যোগাযোগ, রাখার সময় কোথায়? যদি আল্লাহ পাকের দয়ায় এই দুটো সাধনায় সফল হতে পারি, তখন যোগাযোগ করার চেষ্টা করব।
আমি যত বড়ই নিরেট বোকা গাধা হইনা কেন; আমার তো মনে হচ্ছে তুই তার থেকে আরো বেশি। কারণ আমি মাহবুবাকে যতটুকু জেনেছি তাতে হলফ করে বলতে পারি তুই যদি তার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখিস, সে আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে।
আরে না, আত্মহত্যা কি এতই সোজা। মাহবুবা আমাকে ভীষণ ভালবাসে তা জানি। তাই বলে এরকম কাজ সে কিছুতেই করতে পারবে না। আর আমার জানা যদি সত্য হয়, তবে আজীবন অপেক্ষা করবে।
মাসুম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু সে তো আমাকে খেয়ে ফেলবে। অন্ততঃ ঠিকানাটা দে।
মাহবুব হেসে উঠে বলল, খেয়ে ফেললে তো ভালই। সে আর জ্বালাতন করতে পারবে না। আর ঠিকানাই যদি দেব তা হলে ঠিকানা বদলাচ্ছি কেন?
তোর মতলব যে কি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তোকে কিছু বুঝতে হবে না। তুই রান্নার কাজটা সেরে ফেল, আমি সব কিছু বেঁধে হেঁদে রেডি করি। খেয়ে তারপর যাব।
ঐ রাতেই দশটার সময় মাহবুব একটা রিকশাভ্যানে করে আজিমপুর মেসে চলে গেল। যাওয়ার সময় মাসুমকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, তোকে অনেক জ্বালিয়েছি মাফ করে দে। তারপর বলল, তুই চিন্তা করিস না, মাঝে মাঝে আসব। আর শোন, মাহবুবাকে বলিস, আমি খুব বাজে ছেলে। সামান্য ব্যাপারে তোর সঙ্গে রাগারাগি করে চলে গেছি। তাকে ভুলে যাওয়াই আপনার উচিত।
মাসুম বিশ্বাসই করতে পারল না, মাহবুব সত্যি সত্যি চলে যাবে। তাই কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।
মাহবুব চলে যাওয়ার পর দুটো কারণে বেশ কয়েক দিন মাসুম সকালে পান্তা খেয়ে বেরিয়ে যায়। ফিরে মাগরিবের নামাযের পর। প্রথম কারণ হল, চার বছর দুজনে এক সঙ্গে ছিল। একা একা থাকতে মন চাইত না। দ্বিতীয় কারণ হল, মাহবুবা এসে মাহবুবের কথা জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দিবে।
এর মধ্যে মাহবুবা দুদিন এসে রুমে তালা দেখে ফিরে গেছে। তৃতীয় দিন এসেও তাই দেখে গলির মোড়ের ওষুধের দোকানের একজন সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করল, মাহবুব সাহেব ও মাসুম সাহেব কি আর এখানে থাকেন না?
সেলসম্যান বললেন, মাসুম সাহেবকে প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যেতে দেখি। ফেরেন সন্ধ্যের পর। ওঁর মুখেই শুনেছি, মাহবুব সাহেব কিছু দিন আগে এখান থেকে। চলে গেছেন।
ধন্যবাদ জানিয়ে মাহবুবা ফেরার সময় চিন্তা করল মাহবুব কেনই বা তার সঙ্গে দেখা করছে না, কেনই বা এখান থেকে চলে গেল? মাসুম ভাই-ই বা সারাদিন বাইরে থাকেন কেন? কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিল, আজ সন্ধ্যার পর আবার আসবে। বাসায় পৌঁছে ড্রাইভারকে বলল, এখন যেখান থেকে এলাম সন্ধ্যার পর সেখানে আবার যাব।
মসজিদে মাগরিবের নামায পড়ে মাসুম যখন গলির মুখে এল তখন ওষুধের দোকানের সেই সেলসম্যান তাকে ডেকে বললেন, যে মেয়েটি আপনাদের কাছে আসেন, তিনি দু তিন দিন এসে আপনাকে না পেয়ে ফিরে গেছেন। আজও এসেছিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় আপনাদের কথা জিজ্ঞেস করে গেলেন।
মাহবুবা যে আসবে তা মাসুম জানে। তাই ঠিক আছে বলে রুমে এসে পড়তে বসল। কিছুক্ষণ পরে মেয়েলি কণ্ঠ শুনতে পেল, মাসুম ভাই আসতে পারি?
মাসুম গলা চিনতে পেরে চমকে উঠে পরমহুর্তে সামলে নিয়ে বলল, আসুন।
মাহবুবা সালাম দিয়ে ভিতরে এল।
মাসুম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, খাটেই বসুন।
বসতে আসিনি মাসুম ভাই, শুধু জানতে এসেছি, আমি কি এমন অপরাধ করেছি, যে জন্য মাহবুব এখান থেকে পালাল। আর আপনিও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এরকম পরিস্থিতিতে একদিন না একদিন পড়তে হবে তা মাসুম জানত। তাই কি বল ব ভেবে রেখেছে। কিন্তু রাত্রে মাহবুবা আসবে এবং এত তাড়াতাড়ি এই পরিস্থিতিতে পড়বে ভাবেনি। বলল, আপনি আগে বসুন তো।
না বসব না। এটা মেস, এমনি দিনে আসি বলে মেসের লোকজন যে সব কমেন্ট করেন, তার কিছু কিছু আমার মনে পড়ে। আজ রাতে এসেছি, সেজন্য হয় তো আরো কিছু বলবেন। আমার প্রশ্নের উত্তর পেলেই চলে যাব।
মাসুম মাহবুবের শেখান কথাগুলো বলে বলল, ও যে এত নীচ তা কল্পনাও করিনি। আর বন্ধুর নীচতার কথা কী করে আপনাকে বলব, সে কথা ভেবে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
– শুধু শুধু মিথ্যে বলে নিজেকে ছোট করবেন না মাসুম ভাই। আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না সরাসরি বললেই পারতেন। যাক, আপনাকে আর বিরক্ত করতে কখনো আসব না। আপনাকে পালিয়েও বেড়াতে হবে না। মাহবুবের ঠিকানা দিলে বাধিত হতাম।
মাসুম মাথা নিচু করে বলল, ঠিকানা চেয়েছিলাম দেয়নি।
মাহবুবা বলল, এই কথাটা অবশ্য সত্যি বলেছেন। তারপর কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, ওর গ্রামের ঠিকানা জানেন?
মাসুম জানে। বলবে কিনা চিন্তা করতে লাগল।
কি হল? চুপ করে আছেন কেন? জানা থাকলে লিখে দিন। ঢাকার ঠিকানা জানাতে নিষেধ করলেও গ্রামেরটা দিতেতো নিষেধ করেনি?
মাসুম একটা কাগজে লিখে তার হাতে দিল।
চলি বলে সালাম দিয়ে মাহবুবা বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল।
মাসুম সালামের উত্তর দিতে ভুলে গিয়ে হাঁ করে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
০৫.
আলাউদ্দিন মীর একদিন সুলতান খাঁনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন।
সুলতান খাঁন এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হননি। কাঁচারীতে বসে একজন কামলাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আলাউদ্দিন মীরকে আসতে দেখে তাকে কাজ করতে যেতে বললেন।
আলাউদ্দিন মীর কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বললেন, আপনার অসুখের কথা শুনেছিলাম, কাজের ব্যস্ততায় আসতে পারিনি। এখন কেমন আছেন?
সুলতান খাঁন তাকে বসতে বলে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভাল। আপনি কেমন আছেন?
সংসারের ঝামেলায় ভালো আর থাকতে পারছি কই। নানান ঝামেলায় একরকম কেটে যাচ্ছে। তা মাহবুব কোথায়?
সে তো কয়েকদিন আগে ঢাকা চলে গেছে। টাকার ব্যাপারে মাহবুব কী আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল?
প্রথমে করেনি। আমি যখন টাকা দিয়ে বললাম, তোমার আব্বাকে বলো এটাই শেষ। আমার কাছে তার আর কোনো টাকা পাওনা নেই। তখন জিজ্ঞেস করল, আপনার কাছে আব্বার কিসের টাকা পাওনা ছিল? আমি আপনার পুকুর সাফকবলা রাখার কথা বললাম। আমার কথা শুনে মাহবুবকে খুব অবাক হতে দেখলাম। সে কী ব্যাপারটা জানত না?
সুলতান খাঁন চিন্তিত মুখে বললেন, জানালে লেখাপড়া করত না ভেবে জানাইনি। তারপর বললেন, জানানটা ঠিক হয়নি আপনার। কয়েক মাস পরে পরীক্ষা। আমার তো ভয় হচ্ছে লেখাপড়া বন্ধ করে না দেয়।
আপনার কথাই ঠিক, এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে। তবে আপনি যা ভাবছেন তা নাও করতে পারে। কয়েক মাস পরে যখন পরীক্ষা বললেন, তখন পরীক্ষা সে দেবেই। তারপর হয়তো বন্ধ করে দিতে পারে। মাহবুব হিরের টুকরো ছেলে। দেখবেন, এবারেও ভালো রেজাল্ট করবে।
আপনি টাকা দিয়ে সাহায্য না করলে ওকে এতদূর লেখাপড়া করাতে পারতাম না।
কি যে বলেন, টাকা পয়সা থাকলেই যদি লেখা পড়া হত, তা হলে আমার ছেলেদের কেন হল না? আসলে মাথা ভালো হতে হবে। এই দেখুন না, আমার মেয়ে। তাহেরা, তার মাথা ভালো, তাই এক চান্সে বি. এ. পাস করে ফেলল। এবার বিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
তা দিচ্ছেন না কেন? ওর মতো মেয়ের পাত্রের অভাব আছে নাকি? ভালো ছেলে দেখে এবার ব্যবস্থা করুন।
পাত্রের তো অভাব নেই। রোজ একটা না একটা সম্বন্ধ আসছেই। কিন্তু মা আমার রাজি হচ্ছে না।
সে কি? রাজি হচ্ছে না কেন জিজ্ঞেস করেন নি?
বাবা হয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করি কি করে? ওর মা জিজ্ঞেস করতে বলেছে, সে মাহবুবকে পছন্দ করে। কথাটা কয়েকদিন আগে ওর মা আমাকে বলল। এখন আপনাদের উপর সব কিছু নির্ভর করছে। আগে জানতে পারলে মাহবুবের লেখাপড়ার সব খরচ আমিই দিতাম। আপনাকে দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে হত না। যা হওয়ার হয়েছে। আপনাদের মতামত পেলে দুএক দিনের মধ্যে দলিল ফিরিয়ে দেব। আর মাহবুবের লেখাপড়া শেষ করতে যা লাগবে সব দেব। জানেন তো, তাহেরা পাঁচ ভাইয়ের এক বোন। মাহবুব শিক্ষিত বলে তারা তাকে খুব সম্মান করে। ছোট বোনের স্বামী হলে মাথায় করে রাখবে। বিয়ের সময় যৌতুক যা দেওয়ার তা তো দেবই, তা ছাড়াও দশ বিঘে জমি মাহবুবের নামে লিখে দেব।
সুলতান খাঁন আলাউদ্দিন মীরের সাহস দেখে খুব রেগে গেলেন। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না করে অনেক্ষণ চুপ করে রইলেন।
আলাউদ্দিন মীর তার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, আমার কথায় আপনি মনে কিছু নেবেন না। আমার মনে হয় প্রস্তাবটা মেনে নিলে আমাদের উভয়েরই মঙ্গল হবে। তবু যখন সুলতান খাঁন কিছু বললেন না তখন আবার বললেন, এখন কিছু বলার দরকার নেই, মাহবুবের মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে এক সময় জানাবেন। এখন আমি তা হলে আসি বলে সালাম দিয়ে চলে গেলেন।
সুলতান খাঁন সালামের উত্তর দিয়ে আরো কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর বাড়ির ভিতরে এসে স্ত্রীকে আলাউদ্দিন মীরের কথাগুলো বললেন।
মরিয়ম খাতুন খুব বুদ্ধিমতী মহিলা। স্বামী রেগে আছেন বুঝতে পেরে বললেন, ছেলে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে পাঁচ জায়গা থেকে তো সম্বন্ধ আসবেই। এতে কিছু মনে করার কি আছে। আর আলাউদ্দিন মীরের মেয়েকে দোষ দেওয়া যায় না। বরং মাহবুবকে পছন্দ করে সে বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখলে জানা যাবে, এই গ্রামে আরো কত মেয়ে বা তাদের মা-বাবা মাহবুবকে পছন্দ করে। তারা হয়তো সাহস করে প্রস্তাব দিতে পারছেন না। আর একটা কথা, আজকাল শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করে। তাহেরা শিক্ষিত মেয়ে। সে হয়তো মাহবুবকে এ ব্যাপারে কিছু জানাতে পারে। অথবা আগের থেকে তাদের দুজনের মধ্যে মন দেওয়া নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। নচেৎ তাহেরা তার মাকে পছন্দের কথা বলতে পারত না।
সুলতান খাঁন ভারি গলায় বললেন, তোমার কথা যুক্তি সঙ্গত। কিন্তু মন দেওয়া নেওয়ার কথা যে বললে, তা বিশ্বাস হয় না। মাহবুব এরকম কাজ করতেই পারে না। এসব আলাউদ্দিন মীরের চালাকি। ওযে কত ঘুঘু তা আমার বুঝতে বাকি নেই। আমাকে সম্পত্তি ও টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে সমাজে বড় হতে চায়।
আমিও তোমার সঙ্গে একমত। আমি শুধু সম্ভাবনার কথা বলেছি। যাক, এখন এ ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। মাহবুব এবারে এলে আমি তার সঙ্গে আলাপ করব। আলাউদ্দিন মীরকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। জিজ্ঞেস করলে বলো, আগে মাহবুব লেখা পড়া শেষ করুক তারপর তার সঙ্গে পরামর্শ করে জানাবে।
মরিয়ম যে খুব বুদ্ধিমতী তা সুলতান খাঁন জানেন। তাই তার কথার কোনো প্রতি উত্তর না করে চুপ করে রইলেন।
.
মাহবুবা মাসুমের কাছ থেকে ফিরে বাসায় ঢুকে দেখল, মা-বাবা কোথায় যেন বেরোচ্ছেন।
আনিস সাহেব মেয়েকে দেখে একটু রাগের সঙ্গে বললেন, সারাদিন কি ক্লাস হয়?
মাহবুবের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় কিছুদিন থেকে মাহবুবার মন খুব খারাপ। আজ আবার মাসুমের কথা শুনে আরো মুষড়ে পড়েছে। এখন বাবা রাগের সঙ্গে কথা বলছে দেখে নিজেকে সামলাতে পারল না। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, তুমি। আমাকে বকছ কেন বাবা? আমি কি এমন অন্যায় করেছি? বরং ইদানিং তুমিই তো আমার খোঁজ কর না।
আনিস সাহেব কয়েক দিন ব্যবসার কাজে খুব ব্যস্ত ছিলেন। মেয়ের খোঁজ নিতে পারেননি। আজ এক বন্ধুর পার্টিতে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন বলে কয়েকবার খোঁজ করে পাননি। তাই যাওয়ার সময় তাকে বাইরে থেকে আসতে দেখে রাগের সঙ্গে কথাটা বলে ফেলেছেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই কোনো দোষ করিস নি। আমিই ভুল করেছি। তোকে নিয়ে একটা পার্টিতে যাব ভেবেছিলাম। না পেয়ে একটু রেগে গেছি। তারপর তার চোখ মুখ মুছে দিয়ে বললেন, তৈরি হয়ে আয় আমরা গাড়িতে অপেক্ষা করছি।
আনিস সাহেব সচরাচর মেয়েকে কোনো পার্টিতে নিয়ে যান না। আজ নিয়ে যাওয়ার পিছনে একটা উদ্দেশ্য আছে। সে কথা স্ত্রীকে বলেছেন। উদ্দেশ্যটা হল, বন্ধু নাজিমের ছেলে প্রিন্সের সঙ্গে মাহবুবার পরিচয় করিয়ে দেওয়া। প্রিন্স সম্প্রতি ফরেন। থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টের উপর উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে এসে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা ফরছে। সে মা-বাবার একমাত্র সন্তান। সুন্দর স্বাস্থ্যবান যুবক। পার্টিতে গিয়ে আনিস সাহেব সবার সঙ্গে মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় প্রিন্সের সঙ্গেও করালেন।
প্রিন্স মাহবুবাকে দেখে মুগ্ধ হল। একসময়ে বলল, ফরেনের মেয়েদের রঙই শুধু ফর্সা। আপনার সঙ্গে তাদের কোনো তুলনাই হয় না। সত্যি বলতে কি আপনার মতো বিউটিফুল মেয়ে আর কখনো দেখিনি। আপনি অদ্বিতীয়া।
মাহবুবা তোষামোদী মোটেই পছন্দ করে না। প্রিন্সের কথা শুনে বিরক্ত হলেও সৌজন্য রক্ষা করার জন্য মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা, ছেলেরা এত হ্যাংলা কেন বলতে পারেন? সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তার গুণ গাইতে শুরু করে দেয়।
বিদ্রূপটা প্রিন্স গায়ে মাখল না। হেসে উঠে বলল, ছেলেদের কাছ থেকে প্রশংসা শোনার জন্য মেয়েরা উদগ্রীব হয়ে থাকে। রূপের প্রশংসা না করলে, মেয়েরা ছেলেদেরকে আন-কালচার্ড-আন সোশ্যাল বলে গালাগালি করে। চলুন না নিরিবিলিতে বসে একটু আলাপ করি। তারপর একজন বেয়ারাকে দুগ্লাস ব্র্যান্ডি নিয়ে আসতে বলল।
মাহবুবা বুঝতে পারল, প্রিন্স ফরেন থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসার সাথে সাথে মদ ও মেয়ে মানুষের নেশা রপ্ত করে এসেছে। বলল, ধন্যবাদ আমি ড্রিঙ্ক করি না। আর আলাপ তো হলই। নিরিবিলিতে আবার কি আলাপ করবেন? কথা শেষ করে তার কাছ। থেকে চলে যেতে উদ্যত হলে প্রিন্স বলল, দাঁড়ান, যাবেন না। তারপর বলল, আপনার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আশা করিনি।
মাহবুবা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, আমি কী আপনার সঙ্গে কোনো রকম খারাপ ব্যবহার কিছু করেছি? শুধু শুধু দোষ দিচ্ছেন কেন? তারপর আর সেখানে। দাঁড়াল না।
পার্টি থেকে বাসায় ফিরে আনিস সাহেব মেয়েকে বললেন, জানিস মা, আমার বন্ধু কয়েকটা ইন্ড্রাস্ট্রির মালিক। গ্রামের বাড়িতেও অনেক জমি জায়গা। প্রিন্সই তার একমাত্র ছেলে। ফরেন থেকে বিজনেস ম্যানেজম্যান্টে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এসে বাবার বিজনেস চালাচ্ছে। খুব হ্যান্ডসাম ও স্মার্ট ছেলে। ওর বাবা-মা তো ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বললেন, প্রিন্স ছয় মাস হল ফরেন থেকে ফিরে এসে ব্যবসাতে লেগেছে। এরই মধ্যে অনেক উন্নতি করেছে। প্রিন্সকে আমার দারুন পছন্দ।
স্বামী থেমে যেতে শামীমা বেগম বললেন, আমারও। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কিছু বলছিস না যে?
পার্টিতে নিয়ে যাওয়ার মতবল মাহবুবা গিয়েই বুঝতে পেরেছিল। বলল, আমার কাছেও সবকিছু ভালো মনে হল। তবে প্রিন্সকে খুব একটা ভালো মনে হয়নি।
শামীমা বেগম বললেন, কেন রে-মা? অমন সুন্দর ছেলেকে তোর ভালো লাগল না কেন?
আমি তো বলিনি সে অসুন্দর। তার সঙ্গে আলাপ করে আমার ভালো লাগেনি, তাই বললাম।
আনিস সাহেব বললেন, একবার আলাপ করে কি আর ভালোমন্দ বুঝবি? ভাবছি, প্রিন্সকে বাসায় আসতে বলব। ভালো করে আলাপ কর। দেখবি আমার কথা সত্য কি না।
না বাবা আসতে বলো না। একবার আলাপ করে তার চরিত্র জানা হয়ে গেছে। আর আলাপ করার দরকার নেই। মাহবুবের কথা তোমাদেরকে বলেছি, তারপরও তোমরা কেন এসব কথা বলছ?
কিন্তু মা, তুই ছেলে মানুষ। এখনো সবকিছু বুঝতে শিখিসনি। তোর ছেলেমানুষি কথা শুনে আমরা তো চুপ করে বসে থাকতে পারি না। একটা কথা জানিস না, সমানে সমানে না হলে যেমন আত্মীয়তা মানায় না, তেমনি সাংসারিক জীবনও সুখের হয় না। প্রিন্সকে তোর পছন্দ হয়নি তো কি হয়েছে আমরা অন্য ছেলের সন্ধান করব।
শোন বাবা, তোমাদেরকে বলেছি মাহবুবকে আমি ভালবাসি। তাকে আমাদের সমাজের মতো করে বিয়ে করব। তারপরও কেন যে তোমরা ওসব কথা বলছ বুঝতে পারছি না। শেষের দিকের কথাগুলো কান্নার মতো শোনাল।
আনিস সাহেব স্ত্রীকে কিছু না বলার জন্য ইশারা করে বললেন, কিন্তু মা, এই কাজ খুব কঠিন। যেমন সময়ের দরকার তেমনি ধৈর্য্যেরও দরকার। তুই কী পারবি?
আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর পারব। তোমরা এত শিঘ্রী আমার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছ কেন? মাস্টার্স না করে আমি বিয়েই করব না। ততদিনে মাহবুবকে তৈরি করে নেব।
ঠিক আছে, আমরাতো বলেছি তোর অমতে কিছু করব না।
মাহবুবা ভিজে গলায় বলল, কথাটা মনে রাখলে খুশি হব। তারপর চোখ মুছতে মুছতে নিজের রুমে এসে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, মাহবুব দুদিনের জন্য দেশে। গিয়ে দুই সপ্তাহ ছিল, ফিরে আসার পর আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ে ঘা ঢাকা দিল। তা হলে কী মা-বাবার কথা রাখতে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে? তাই বোধ হয় মাসুম। ভাইকে কোনো কথা জানাতে নিষেধ করে পালিয়েছে। আবার ভাবল, মাহবুবের মতো ছেলে এরম কাজ কিছুতেই করতে পারে না। যদি দৈব ঘটনায় বিয়ে করেই থাকে সে। কথা জানাবার সৎ সাহস তার আছে। তবু কেন দেখা না করে পালাল? তা হলে কি অন্য কোনো সমস্যায় পড়েছে? সিদ্ধান্ত নিল যেমন করে হোক তাকে খুঁজে বের করবেই। প্রয়োজনে তার গ্রামের বাড়িতে যাবে।
.
মাহবুব আজিমপুর আসার পর দাড়ি রেখেছে। বাইরে বেরোবার সময় সানগ্লাস ব্যবহার করে, যাতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলেও যেন মাহবুবা চিনতে না পারে। প্রায় মাসখানেক পর একদিন বিকেল চারটার দিকে মাসুমের সঙ্গে দেখা করতে গেল। রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, কিরে কেমন আছিস? চিনতে পারছিস তো?
মাসুম সালামের উত্তর দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, কেমন আছি বলব না। তবে চিনতে, পারার কথা যে বললি, তার উত্তরে বলব, তুই যতই ভেশ বদল করিস না কেন, আমার
চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি না। তারপর বলল, তুই একদিন আমাকে নীরেট বোকা গাধা বলেছিলি। তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেদিন আমিও তোকে তাই বলেছিলাম। কিন্তু আজ তোকে দেখে সত্যি সত্যি তাই মনে হচ্ছে। আরে নীরেট বোকা গাধা, মাহবুবাকে তুই ভালবাসলেও তাকে সম্পূর্ণ চিনতে পারিসনি। পারলে তার কাছ থেকে পালাতিস না। আমি তাকে যতটুকু জেনেছি তাতেই বুঝেছি তুই তার সারা মন-প্রাণ জুড়ে রয়েছিস। আজীবন সে তোর প্রত্যাশায় থাকবে। তার সঙ্গে দেখা করা তোর একান্ত উচিত। তুই চলে যাওয়ার পর কিভাবে যে আমার দিন কেটেছে তা আল্লাহ পাক জানেন। এক সপ্তাহ দিনে রুমে থাকতাম না। সকালে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে রাতে ফিরে আসতাম। আর এদিকে মাহবুবা প্রায় প্রতিদিন এসে রুমে তালা দেখে ফিরে গেছে। একদিন সন্ধ্যার পর এসে হাজির। তারপর যেসব কথাবার্তা হয়েছিল বলে বলল, সেদিন মাহবুবার মুখের অবস্থা দেখে তোর প্রতি আমার যতটা রাগ হয়েছিল। এখন তোকে দেখে সেই রাগ আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। তুই এক্ষুণী আমার সামনে থেকে চলে যা নচেৎ কিছু একটা করে ফেলব।
মাহবুব খুব অবাক হয়ে বলল, মাসুম, এ তুই কী বলছিস?
মাসুম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কানে নিশ্চয় কম শুনিস না। যা বললাম তাই কর। তোর মতো কাপুরুষের মুখ আমি দেখতে চাই না। এই মুহূর্তে চলে যা, আর কখনো আসবি না।
মাহবুব আহত স্বরে বলল, ঠিক আছে চলে যাচ্ছি, তবে একটা কথা মনে রাখিস, আমি যা কিছু করছি মাহবুবার ভালোর জন্য। তুই আমাকে ভুল বুঝবি তা কোনোদিন ভাবিনি।
তোর কোনো কথাই শুনতে চাই না, তুই চলে যা।
মাহবুবের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে বেরিয়ে এল। বড় রাস্তায় এসে একটা খালি স্কুটার দেখতে পেয়ে আজিমপুর যেতে বলে উঠে বসল।
মাহবুবা এই একমাস মাহবুবকে ভার্সিটিতে, লাইব্রেরীতে, স্টেডিয়ামে ও বিভিন্ন। জায়গায় খুঁজে বেড়িয়েছে। আজ হঠাৎ তার মনে হল, মাসুমের কাছে হয়ত মাঝে মাঝে যায়। সেখানে একবার খোঁজ নিলে কেমন হয়। ভাগ্য ভালো হলে দেখাও হয়ে যেতে পারে। এই কথা চিন্তা করে আজ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে স্বামীবাগ রওয়ানা দিল।
মাহবুবার গাড়ি যখন হাটখোলা পার হয়ে টিপুসুলতান ও নারিন্দা রোডের মোড়ে এল তখন মাহবুবের স্কুটার নারিন্দা রোড থেকে টিপুসুলতান রোডে মোড় নিচ্ছে। সে সামনে বসেছিল। মাহবুবের মুখে দাড়ি ও চোখে সানগ্লাস থাকা সত্বেও চিনতে পেরে চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে মাহবুবের স্কুটারের দিকে নির্দেশ করে ড্রাইভারকে বলল, ঐ মুখে দাড়ি ও চোখে সানগ্লাস পরা ছেলেটার স্কুটারকে ফলো করুন।
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে স্কুটারকে ফলো করে চলল।
মেসের কাছে পৌঁছে মাহবুব স্কুটার থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে হাঁটতে লাগল।
মাহবুবার ড্রাইভার অল্প দূরে গাড়ি থামিয়েছে। মাহবুবা ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি থেকে নেমে মাহবুবকে ফলো করে তার রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল।
মাহবুব মাসুমের কাছে এমন দুর্ব্যবহার পাবে কল্পনাও করেনি। সারা পথ উদভ্রান্তের মতো এসেছে। রুমে ঢুকে চুপ করে বসে চিন্তা করতে লাগল, মাহবুবা নিশ্চয় তাকে এমন কিছু বলেছে যে জন্য মাসুম তার সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করল।
মাহবুবের চিন্তাক্লিস্ট মলিন মুখ দেখে মাহবুবার মন বিচলিত হলেও কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
এমন সময় আসরের আযান শুনে মাহবুব দাঁড়িয়ে দরজার দিকে নজর পড়তে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, তুমি?
মাহবুবা চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, হ্যাঁ আমি। তা চমকে উঠলে কেন? ভয়ে, না অবিশ্বাস্য কিছু দেখে?
মাহবুব কিছু না বলে মুখ নিচু করে নিল।
মাহবুবা আবার বলল, ভেবেছ ভেশ বদলে আমাকে ফাঁকি দেবে। তা কখনোই পারবে না। যার নাম আমার শরীরের রক্ত কণিকার সঙ্গে চব্বিশ ঘন্টা প্রবাহিত হচ্ছে, সে আমাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য যা কিছু করুক না কেন, পারবে না। একটু বসতেও বলবে না?
মাহবুব তার কথার উত্তর না দিয়ে ব্রীফকেস খুলে টাকার বান্ডিল এনে তার দিকে বাড়িয়ে বলল, অসুখের সময় যা কিছু করেছ সে জন্য চির কৃতজ্ঞ থাকব। ক্লিনিকের বিলটা নিয়ে চলে গেলে খুশি হব।
মাহবুবা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, মাহবুব তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারলে? তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি যে নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
মাহবুবার অবস্থা দেখে মাহবুবের মন বিচলিত হয়ে উঠল। নিজেকে কঠোরভাবে। সামলে নিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল, টাকাটা নিয়ে চলে যাও, আর কখনো এস না।
মাহবুবা শরাহত হংসের মতো ককিয়ে উঠল, কিন্তু কেন মাহবুব কেন? আমি কি এমন অন্যায় তোমার কাছে করেছি?
অন্যায় করেছ সে কথা তো বলিনি। বলেছি চলে যেতে, কারণ যাওয়াটাই তোমার জন্য মঙ্গল।
আর যদি বলি অমঙ্গল?
মাহবুবা ভিজে গলায় বলল, বেশ চলে গেলে যদি খুশি হও, তা হলে শুধু এখান থেকে নয়, এই পৃথিবী থেকে একেবারে চিরজীবনের জন্য চলে যাব।
মাহবুব আবার চমকে আতঙ্কিত স্বরে বলল, ছিঃ মাহবুবা, এমন কথা মুখে উচ্চারণ করাও পাপ। আমি একটা কাপুরুষ! একটা কাপুরুষের জন্য তুমি নিজের সর্বনাশ করবে কেন?
নিজেকে কাপুরুষ বলতে বিবেকে বাধল না?
বিবেক নেই বলেই যে বললাম এই কথাটা বুঝতে পারছ না কেন? প্লীজ চলে যাও। এটা মেস এখানে কত রকমের লোক আছে। এতক্ষণে হয় তো উঁকি ঝুঁকি মারছে? নানা রকম মন্তব্য করছে।
তুমি কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছ বললেই চলে যাব।
সেকথা বলতে পারব না বলেই তো পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
ঠিক আছে, আজ চলে যাচ্ছি কিন্তু যতদিন কারণটা না বলবে ততদিন বারবার আসব। তারপর চোখ মুখ মুছে বেরিয়ে এসে দেখতে পেল, বেশ কয়েকজন দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রূক্ষেপ না করে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বাসায় যেতে বলল।
যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা এবার রুমে ঢুকে মাহবুবকে ঘিরে ধরে বলল, কি ব্যাপার ব্রাদার? ঘটনা দেখে শুনে মনে হচ্ছে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়?
মাহবুব বুঝতে পারল এতক্ষণ এরা আড়াল থেকে তাদের কথাবার্তা শুনেছে। তাই বিরক্ত না হয়ে বলল, বড় লোকের মেয়ের খামখেয়ালী আরকি। দেখুন না, শহরের এত কোটিপতির ছেলে থাকতে কিনা অজ পাড়াগাঁয়ের এই হতভাগার পিছু লেগেছে।
তাদের মধ্যে নজুমিয়া নামে এক বয়স্ক লোক ছিলেন। তাকে সবাই দাদু বলে ডাকে। খুব রসিক মানুষ। তিনি বললেন, আরে ভাই পিছু লেগেছে যখন ঝুলে পড়ুন। কোটিপতির মেয়েকে বিয়ে করে আপনিও কোটিপতি হয়ে যান। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনারা যাই বলুন, নাত বৌ কিন্তু খুব সুন্দরী। মাহবুব দাদুর সঙ্গে মানাবে ভালো।
মাহবুবের মনের অবস্থা খুব খারাপ। হাতজোড় করে বলল, আপনারা দয়া করে এখন যান, আমি নামায পড়তে যাব।
মাহবুবের কথা শুনে সবাই চলে গেল। নজুমিয়া সবার শেষে যাওয়ার সময়। বললেন, এভাবে মেয়েটিকে ফিরিয়ে দেওয়া আপনার উচিত হয়নি।
মাহবুব কোনো কথা না বলে রুমে তালা দিয়ে মসজিদে গেল।
রাতে ঘুমাবার সময় চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল, দুএক দিনের মধ্যে অন্য কোনো মেসে চলে যাবে।
পরের দিন সকালে প্রাইভেট পড়াতে এলিফেন্ট রোডে গেল। ছাত্রটির নাম রাসেল, সে নাইনে পড়ে। ছাত্রীটির নাম রুনা। সে টেনে পড়ে। আজ পড়ানো হয়ে যেতে রুনা বলল, স্যার একটু বসুন। তারপর বইপত্র গুছিয়ে রেখে চলে গেল। একটু পরে রুনার সঙ্গে তার মা এসে বেতনের টাকা দেওয়ার সময় বললেন, আপনার টিচিং খুব ভালো। মাত্র এক মাসের মধ্যে ওদের পড়ার খুব উন্নতি হয়েছে তাই আমরা খুশি হয়ে এই মাস। থেকেই তিন হাজার টাকা দিলাম। তারপর বললেন, রুনার আব্বার কাছে শুনলাম। আপনি ইংলিশে মাস্টার্স করছেন। আরো শুনলাম মেসে থাকেন। মেসে বিভিন্ন রকমের মানুষ থাকে। সেখানে নিশ্চয় ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারেন না। তাই বলছিলাম কি আপনার অসুবিধা না থাকলে এখানে থাকুন। ছেলেমেয়ে দুটো আপনার খুব ভক্ত। হয়ে পড়েছে। আপনাকে কথাটা বলার জন্য প্রতিদিন তাগিদ দেয়। ফাস্ট ফ্লোরে। দুতিনটে গেস্ট রুম আছে। পছন্দ মতো যে কোনো একটায় থাকতে পারেন। আমাদের সঙ্গেই খাবেন।
এত তাড়াতাড়ি এমন সূবর্ণ সুযোগ আল্লাহ পাইয়ে দেবেন মাহবুব কল্পনা করতে পারেনি। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করার সময় চোখে পানি আসার উপক্রম হল। মুখ নিচু করে সামলে নিয়ে বলল, আমার আপত্তি নেই, তবে আমি পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকব।
সে ব্যাপারে রুনার আব্বার সঙ্গে কথা বলবেন। আপনি দুএক দিনের মধ্যে চলে আসুন।
ঠিক আছে, এখন আসি বলে মাহবুব সালাম বিনিময় করে চলে এল।
মাহবুব যে মেসে থাকে সে মেসের পুরো দায়িত্ব নজু মিয়ার উপর। ঐদিনই মাহবুব নজুমিয়াকে ডেকে চলতি মাসের ভাড়া দিয়ে বলল, আমি কাল এখান থেকে চলে যাব। নজুমিয়া অবাক হয়ে বললেন, আপনি কী আমাদের উপর রাগ করে চলে যাচ্ছেন?
না দাদু রাগ করব কেন? আমি এক বাড়িতে দুটো ছাত্রকে প্রাইভেট পড়াই। সেখানে লজিং পেয়ে গেছি।
নজুমিয়া ম্লান মুখে বললেন, তা হলে তো বাধা দিতে পারি না। এই একমাস এসে আপনি আমাদেরকে কোরআন হাদিস শুনিয়ে নামায ধরিয়েছেন। অনেককে কোরআন পড়তে শিখিয়েছেন। আপনাকে পেয়ে আমরা ধন্য হয়েছি। চলে যাবেন শুনে খুব খারাপ লাগছে।
মাহবুব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কি করব দাদু মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। ভাগ্যই আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। মনে রাখবেন দাদু, দুনিয়াটা মুসাফির খানা। দুদিন আগে পরে সবাইকে চলে যেতে হবে।
হ্যাঁ ভাই, আপনি খুব দামি কথা বলেছেন। মাঝে মাঝে এলে সবাই খুশি হব।
ইনশাল্লাহ আসব।
দুদিন পর মাহবুব মেস ছেড়ে দিয়ে রুনাদের বাসায় চলে এল।
.
মাহবুবা তিন চার দিন পর মাহবুবের সঙ্গে দেখা করার জন্য আজিমপুর মেসে গেল।
নজুমিয়ার শরীর খারাপ থাকায় আজ অফিসে যাননি। আসরের নামায পড়ার জন্য অজু করছিলেন। মাহবুবাকে দেখে বললেন, দুদিন আগে এলে দেখা পেতেন। পাখী পরশু উড়াল দিয়েছে।
মাহবুবা চমকে উঠে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ঠিকানা জানেন?
উড়াল দেওয়া পাখির ঠিকানা জানব কি করে?
ধন্যবাদ জানিয়ে মাহবুবা ফিরে এল। তারপর কয়েক দিন চিন্তা করে ঠিক করল, মাহবুবের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আসল ঘটনা জানবে।
একদিন খাওয়ার টেবিলে আনিস সাহেব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে মা, তোর কি কোনো অসুখ বিসুখ করেছে? বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি সব সময় মন খারাপ করে থাকিস। খাওয়া দাওয়াও ভালোভাবে করিস না।
মাহবুবা বল, অসুখ বিসুখ করেনি, তবে একটা প্রবলেমে পড়েছি। সলভ করতে পারছিলাম না। এতদিন চেষ্টা করে ফরমুলাটা মাথায় এসেছে।
তা হলে দেরি করছিস কেন?
সবে মাত্র কাল এসেছে। বাবা, আমি মাহবুবের গ্রামের বাড়িতে একবার যেতে চাই।
আনিস সাহেব বেশ অবাক হয়ে বললেন কেন?
প্রবলেম সল্ভ করার জন্য।
আমার মনে হয় তোর ফরমুলাটা রং প্রবলেমটা বল, অন্য ফরমুলায় সলভ করার ব্যবস্থা করব।
মাহবুব সুস্থ হয়ে মাস দুয়েক আগে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় আমাকে বলে যাই নি। পনের দিন পরে ফিরে আসে। তারপর থেকে আমার সাথে দেখা করেনি। আমি তার মেসে গিয়েও দেখা পাইনি। সপ্তাহ খানেক পরে ঐ মেস ছেড়ে চলে যায়। অনেক চেষ্টা করেও তার ঠিকানা পাইনি। কয়েক দিন আগে দৈবক্রমে তার ঠিকানা পেয়ে দেখা করি। কিন্তু কেন সে আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাইনি। দুতিন দিন আগে আবার তার কাছে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারলাম ওখান থেকেও পালিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে বাড়িতে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যে জন্য আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
আনিস সাহেবের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বললেন, আমার মতে তোর সেখানে না যাওয়াই ভালো। গিয়ে হয়তো নতুন বৌ দেখতে পাবি। গ্রামের ছেলেরা শহরের মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করলেও গ্রামের মেয়েকেই বিয়ে করে। এ রকম ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়।
তোমার কথা হয়তো ঠিক। তবু একবার গিয়ে আমি আসল ঘটনা জানতে চাই।
কিন্তু মা, দূরের পথ, একা একা যাওয়া কি ঠিক হবে? তা ছাড়া তুই কখনো গ্রামে যাসনি। কতরকমের অসুবিধা হবে। কোথায় উঠবি, কোথায় থাকবি, চিন্তা করবি না? গ্রামে তো আর আবাসিক হোটেল নেই যে থাকবি। গ্রামের রাস্তায় গাড়ি যাবে কি না তারও ঠিক নেই। অনেক অসুবিধায় পড়বি।
সেখানে শামীমা বেগম ছিলেন। স্বামী থেমে যেতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, পাগলামী করিস না মা। তোর বাবা ঠিক কথাই বলেছেন, কোনো বিপদ হলে কে। তোকে সাহায্য করবে?
তোমরা ওসব নিয়ে চিন্তা করো না। মাহবুব যখন ক্লিনিকে ছিল তখন তার কাছে। শুনেছি গ্রামের লোকজন খুব সরল-সোজা। একে অন্যের বিপদে সাহায্য করে। ওর মা-বাবা খুব ভালো। ওদের কাঁচারী বাড়ির সামনে দিয়ে বড় রাস্তা। গাড়ি সরাসরি ওদের বাড়ি পর্যন্ত যাবে। তোমরা দেখ আমার কোনো অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া ড্রাইভার চাচাতো থাকবেন। তিনিও তো গ্রামের মানুষ।
আনিস সাহেব বললেন, নিষেধ যখন শুনবি না তখন আর বাধা দেব না। তবে কথা দে, আমাদের অনুমান যদি সত্য হয় তা হলে আমাদের কথা মেনে নিবি?
আমি কি কোনো দিন তোমাদের কথার অবাধ্য হয়েছি?
তা হস্নি, শুধু এই ব্যাপারটা ছাড়া। তারপর হেসে উঠে বললেন, আই উইশ ইউর। গুড লাক। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি মাহবুবদের বাড়িতেই উঠবি?
হ্যাঁ বাবা।
কবে যেতে চাস?
দুএক দিনের মধ্যে।
আমি ড্রাইভারকে কে যা বলার বলে দেব।
.
০৬.
মাহবুবা যখন মাহবুবদের কাঁচারী বাড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছাল তখন সুলতান খাঁন আসরের নামায পড়ে মসজিদ থেকে ফিরছেন। দুর থেকে কাঁচারী বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামতে দেখে বেশ অবাক হলেন। আজ দুপুরে মাহবুবের চিঠি পেয়েছেন। লিখেছে সে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ জোগাড় করছে তাকে আর টাকা পাঠাতে হবে না।
সুলতান খাঁন গাড়ির কাছে আসার আগে মাহবুবা ও ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমেছে। মাহবুবা জীবনে এই প্রথম কোনো গ্রামে এল। মাহবুবের কাছে গ্রামের বাড়ি ও বাড়ির চারপাশের বর্ণনা শুনেছিল। আসার সময় গাড়ি থেকে মাঠ-ঘাট, বাড়ি-ঘর ও গাছপালা দেখে তার মন আনন্দে ভরে গেছে। এখন গাড়ি থেকে নেমে চারপাশের গাছ-গাছালি ও গ্রাম্য পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হল। তন্ময় হয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল। লুংগী-পাঞ্জাবী ও মাথায় টুপি পরা সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান একজন প্রৌঢ় লোককে তাদের দিকে আসতে দেখে ফটো তোলার লোভ সামলাতে পারল না। গ্রামের সিনারী তোলার জন্য ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। সেটা কাঁধে ঝুলিয়েই গাড়ি থেকে নেমেছে। তাড়াতাড়ি ক্যামেরা ফিট করে একটা সর্ট নিল।
সুলতান খাঁন কাছে এসে ড্রাইভারের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বললেন, কে আপনারা? যাবেন কোথায়?
মাহবুবা মাহবুবের মুখে তার মা ও বাবা দেখতে কেমন তাও শুনেছিল। সট নেওয়ার পর ভালোভাবে দেখে বুঝতে পারল, ইনিই মাহবুবের বাবা। তাই ড্রাইভার বলার আগে সালাম দিয়ে বলল, আমরা ঢাকা থেকে মাহবুবদের বাড়ি বেড়াতে এসেছি।
সুলতান খাঁন খুব অবাক হয়ে সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মাহবুবকে চেনেন?
জ্বি চিনি। আপনি নিশ্চয় মাহবুবের বাবা?
হা মা ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনাদেরকে তো চিনতে পারছি না?
আমাদেরকে তো কখনো দেখেননি, চিনবেন কি করে? আমার বাবার নাম আনিসুর রহমান। উনি একজন ব্যবসায়ী। ঢাকাতেই আমাদের বাড়ি। তারপর ড্রাইভারকে দেখিয়ে বলল, উনি অনেক বছর ধরে আমাদের গাড়ি চালান। আমি ভার্সিটিতে পড়ি। মাহবুবের সঙ্গে ভালোভাবে জানা শোনা আছে।
সুলতান খাঁন ভাবলেন, তা হলে কি এই মেয়েটাই মাহবুবের অসুখের সময় টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল? তারপর ড্রাইভারকে বললেন, আপনি কাঁচারী ঘরের ভিতরে গিয়ে বসুন, আমি আসছি। তারপর মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আসুন।
মাহবুবা যেতে যেতে বলল, আমি তা আপনার মেয়ের বয়সি, আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমার নাম মাহবুবা। নাম ধরে তুমি করে বলবেন।
ততক্ষণে তারা বাড়ির উঠোনে এসে পড়েছেন। সুলতান খাঁন একটু জোরে বললেন, জমিরন কোথায়রে মা, তোর চাচিকে ডাক।
জমিরন চাচির সঙ্গে নামায পড়ছিল। মোনাজাতের পর চাচার গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে সঙ্গে একটা আপটুডেট মেয়ে দেখে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
সুলতান খাঁন হেসে উঠে বললেন, কিরে মা, কি দেখছিস? ঢাকার খুব বড় লোকের মেয়ে। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। তোর চাচি কোথায়?
ততক্ষণে মরিয়ম খাতুন নামায শেষ করে বেরিয়ে এসেছেন। স্ত্রীকে দেখে বললেন, মা আমার ঢাকা থেকে এসেছে। কিছু খেতে দাও। তারপর জমিরনকে বললেন, তুই মুখ হাত ধোয়ার পানি দে। আমি কাঁচারী বাড়িতে ড্রাইভারের কাছে যাচ্ছি।
নাস্তা খেতে দিয়ে মরিয়ম খাতুন মাহবুবার সঙ্গে আলাপ করার সময় তার নাম শুনে বুঝতে পারলেন, এই মেয়েই মাহবুবকে চিকিৎসা করিয়ে ভালো করেছে। মনে মনে খুব খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মাহবুবের সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?
তা প্রায় আট নয় মাস হবে।
তুমি আসবে মাহবুব জানে?
জ্বি না।
তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে না কেন?
মাহবুবা বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, আমি একটা বিশেষ কাজে পাশের গ্রামে এসেছিলাম। মাহবুবের কাছে আপনাদের কথা শুনেছি। তাই ভাবলাম, দেখা করে একদিন বেড়িয়ে যাই।
খুব ভালো করেছ মা। আমরা খুব খুশি হয়েছি। আমাদের মাহবুব ও মাহফুজা ছাড়া কেউ নেই। এতবড় বাড়িটা খা খা করে। কারো সঙ্গে দুটো কথা বলতেও পাই না। জমিরনটা আছে বলে তবু রক্ষে।
মাহফুজা কে চাচি আম্মা?
আমার বড় মেয়ে। মাহবুবের চেয়ে ছয় বছরের বড়। অনেক দূরের গ্রামে বিয়ে হয়েছে। বছরে একবার এসে যে কয়েক দিন থাকে, সেই কয়েক দিন বেশ ভালই কাটে। তারপর খুব খারাপ লাগে।
ছেলের বিয়ে দিয়ে বৌ আনুন। তাহলে তো আর খারাপ লাগবে না।
সময় হলে তাতো আনবই। এখন ওকে বিয়ের কথা বলাই যাবে না।
কেন? আপনার কষ্ট হচ্ছে, সেকথা জানিয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা বললে কিছু শুনবে না?
ও আমাদের কথার কখনো অবাধ্যতা করেনি। বললে বরং মাথা হেঁট করে মেনে নেবে। তাই বলে পড়াশোনা বন্ধ করে কী বিয়ে দেওয়া উচিত? তা ছাড়া পড়াশোনা শেষ করে রুজী রোজগার করুক, তারপর আর দেরি করব না।
কথা বলতে বলতে মাগরীবের আযান হতে মরিয়ম খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি। কী নামাজ পড়বে?
মাহবুবা লজ্জা পেয়ে বলল, আমি নামায পড়তে জানি না।
ঠিক আছে তুমি বস, আমরা নামায পড়ে নিই।
মাহবুবের বিয়ে হয়নি শুনে মাহবুবার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। বসে বসে চিন্তা করতে লাগল, তা হলে কেন সে আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? ভেবে রাখল বুদ্ধি করে তার মায়ের কাছ থেকে জেনে নেবে।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর মরিয়ম খাতুন মাহবুবাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি অন্য। রুমে একা ঘুমাবে, না আমার রুমে ঘুমাবে?
গ্রামের রাতের নিস্তব্ধতা মাহবুবা কখনো অনুভব করেনি। সন্ধ্যার পর আশ পাশের। বাড়ির কিছু কোলাহল শোনা গেলেও রাত যত বাড়ছে, নিস্তব্ধতাও তত বাড়ছে। দুবছর আগে বিদ্যুৎ এলেও বাড়ির বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। বারান্দায় একটা ষাট পাওয়ারের বাল্বের আলোয় উঠোনের অর্ধেক দেখা যায়। মাহবুবা আলো ঝলমলে শহরে মানুষ। সন্ধ্যার পর থেকে তার গা ছমছম করছে। এতবড় বাড়িতে তাদের দুজনকে নিয়ে মাত্র পাঁচ জন মানুষ। মরিয়ম খাতুনের কথা শুনে বলল, আমি আপনার রুমে ঘুমাব। আপনার কাছে গ্রামের গল্প শুনব।
সুলতান খাঁনের এক তলা ছয় কামরা পাকা বাড়ি। আর সদরের দিকের টিন সেড একটা কাঁচারী বাড়ি। এ বাড়িটা তার দাদা বাদশা খান করেছিলেন। সুলতান খাঁনের বাবা রুস্তম খান একবার সংস্কার করেছিলেন। অর্থাভাবে সুলতান খাঁন করাতে পারেন। নি। তাই বাইরের দিকে দেওয়ালে অনেক জায়গায় প্লাস্টার উঠে ইট বেরিয়ে পড়েছে। ভিতর সাইড ভালো থাকলেও অনেক জায়গায় চুন উঠে গেছে। তবে যে তিনটে রুম ব্যবহার হয়, সেগুলোর ভিতরসাইড চুনকাম করেন। এই তিনটে রুমের একটায় সুলতান খাঁন ও তার স্ত্রী থাকেন। বাকি দুটোর একটাতে মাহবুব আর অন্যটা মেয়ে জামায় এলে থাকে। অন্য সময় তালামারা থাকে। অন্য তিনটে রুমের একটায় জমিরণ থাকে। বাকি দুটো খালি পড়ে থাকে।
মাহবুবার পরিচয় জেনে মরিয়ম খাতুন নিশ্চিত হয়েছেন, এই মেয়েই মাহবুবকে পছন্দ করে এবং সেই জন্য তার অসুখের সময় সাহায্য করেছে। তাই হয়তো আমাদের সব কিছু দেখার জন্য এসেছে। তবু রাত্রে ঘুমাবার আগে গল্প করতে করতে এক সময় মরিয়ম খাতুন বললেন, তুমিই তো মাহবুবকে ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ভালো করেছ, তাই না মা?
মাহবুবা বলল, আপনার ছেলে বুঝি তাই বলেছে?
শুধু তাই বলেনি, তুমি যে দিন রাত সেবা যত্ন করেছ, ক্লিনিকের টাকা দিয়েছ সব বলেছে। শুনে আমি তোমার জন্য অনেক দোয়া করেছি।
চাচি আম্মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, উত্তর দেবেন তো?
ওমা, মেয়ের কথা শোন, উত্তর দেব না কেন? কি জানতে চাও বল।
এবারে মাহবুব বাড়িতে আসার পর কি এমন ঘটনা ঘটেছে, যে জন্য তার মন খুব খারাপ। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু কিছু বলেনি।
মরিয়ম খাতুন স্বামীর কাছে জেনেছেন, পুকুর রেখে টাকা নেওয়ার কথা আলাউদ্দিন মীরের কাছ থেকে মাহবুব শুনেছে। মাহবুবার কথা শুনে ভাবলেন, তাই হয়তো মন খারাপ। বললেন, না কোনো কিছুই ঘটেনি।
তা হলে মাহবুব সব সময় মন খারাপ করে থাকে কেন? আমার মনে হয় আপনি আমার কাছে গোপন করছেন।
মরিয়ম খাতুনের হঠাৎ মনে পড়ল, আলাউদ্দিন মীরের মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথা। ভাবলেন তা হলে কি আলাউদ্দিন মীর তাহেরাকে বিয়ে করার জন্য। মাহবুবকেও কিছু বলেছেন? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাহেরার কথা চাপা দিয়ে বললেন, তোমার অনুমান ঠিক। ব্যাপারটা আমাদের পারিবারিক, তোমার না শোনাই ভালো। ঘরের কথা বাইরে কারো কাছে বলা নিষেধ। এটা হাদিসের কথা।
মাহবুবা মরিয়ম খাতুনকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে নিজের মেয়ে মনে করে বলুন।
মরিয়ম খাতুন বলাটা ঠিক হবে কি না চিন্তা করতে লাগলেন।
মাহবুবা কাঁদ-কাঁদ স্বরে বলল, আমি যদি আপনাদের মেয়ে হতে চাই, তবু বলবেন না?
মরিয়ম খাতুন আবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, অতবড় ভাগ্য আমাদের কী হবে মা? মাহবুবের মুখে শুনেছি তুমি কোটিপতির একমাত্র মেয়ে। তুমি বললেও তোমার মা-বাবা রাজি হবেন কেন?
আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি তাদের মতামত নিয়েই এসেছি। আর তখন পাশের গ্রামে কাজের কথা যে বলেছি, তা সত্য নয়। মাহবুবের মন কেন খারাপ। তা জানার জন্যই এসেছি।
প্রথম থেকেই মাহবুবার কথাবার্তা ও আচার আচরনে মরিয়ম খাতুন অবাক হয়েছিলেন। এখন তার কথা শুনে যেমন আরো বেশি অবাক হলেন, তেমনি আনন্দিতও হলেন। তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় ও দুগালে চুমো খেয়ে বললেন, আল্লাহ গো, এই ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ের মনের বাসনা পুরণ করো। তারপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, এখন আর তোমাকে বলতে বাধা নেই। তারপর আলাউদ্দিন মীরের পরিচয় ও পুকুর সাফকবলা রেখে তার কাছ থেকে একলাখ টাকা নেওয়ার কথা বলে বললেন, আল্লাহর রহমতে আমাদের সংসার বেশ ভাল ভাবেই চলে যায়। মাহবুবকে উচ্চ শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার চাচা টাকাটা নেন। তাকে জানালে রাজি হত না। তাই তখন জানান হয়নি। এবারে তোমার চাচা অসুখের জন্য টাকা আনতে যেতে পারেন নি। মাহবুবকে পাঠিয়ে ছিলেন। আলাউদ্দিন মীর তাকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছে। ঐ পুকুরের ও পুকর পাড়ের বাগানের আয়ে আমাদের সংসার চলে। পুকুর ফেরৎ নেওয়ার আর মাত্র দুবছর সময় আছে। এর মধ্যে টাকা না দিতে পারলে পুকুর আলাউদ্দিন মীরের হয়ে যাবে। এই কথা চিন্তা করে মাহবুব হয়তো মন খারাপ করে থাকে।
এতক্ষণে মাহবুবার কাছে সব কিছু ক্লিয়ার হল। বলল, আমাকে যখন মেয়ে বলে গ্রহণ করে পরিবারের গোপন কথা জানালেন তখন মেয়ে হিসেবে আমিও আমার কর্তব্য করব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। চাচাকেও চিন্তা করতে নিষেধ করবেন। আমি কালই ঢাকা ফিরে যাব।
সেকি হয় মা? মেয়ে হয়ে যখন এসেছ তখন মায়ের বাড়িতে এসেই কি যাওয়া যায়? তা ছাড়া যখন তোমার মা-বাবাকে বলেই এসেছ তখন আর দুচার দিন থাকতে অসুবিধা কোথায়?
ঠিক আছে, দুদিন থেকে তারপরের দিন যাব।
পরের দিন সকালে এক ফাঁকে মরিয়ম খাতুন স্বামীকে সব কথা জানালেন।
সুলতান খাঁন বললেন, আমি এরকমই অনুমান করেছিলাম। এই নিয়ে আর চিন্তা করে কি হবে? আল্লাহ যা তকদিরে রেখেছে হবে।
নাস্তা খাওয়ার সময় মাহবুবা সুলতান খাঁনকে বলল, চাচা, মাহবুবের কাছে শুনেছি আপনাদের একটা খুব বড় পুকুর আছে। আরো শুনেছি আপনি খুব ভালো সাঁতারু। এখনো অনেক্ষণ সাঁতার কাটেন। আমি আপনার সাঁতার কাটা দেখব।
সুলতান খাঁন হেসে উঠে বললেন, হ্যাঁ মা প্রতিদিন সাঁতার না কাটলে মনে শান্তি পাই না। জান মা, আমার আব্বা ও দাদা দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। শুধু তাই নয় খুব ভালো লাঠিয়ালও ছিলেন। মাহবুবকে আমিই সাঁতার ও লাঠিখেলা শিখিয়েছি। ওকে সাঁতারে ও লাঠি খেলাতে কেউ হারাতে পারে না।
মাহবুবা বলল, একথা আমিও জানি। ঢাকায় সাঁতার প্রতিযোগীতায় প্রতি বছর ফার্স্ট হয়। এবছরও তিনটে স্বর্ণ পদক পেয়েছে। তবে লাঠিখেলা জানে জানতাম না।
সুলতান খাঁন আর কিছু না বলে খাওয়া শেষ করলেন। তারপর বললেন, তুমি ড্রাইভারের সঙ্গে গ্রামটা ঘুরে দেখ। দুপুরে গোসল করার সময় তোমাকে নিয়ে যাব। তারপর স্ত্রীকে বললেন, বাজারের ব্যাগ দাও। কিছু মাংস নিয়ে আসি। গোসল করার সময় পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার চেষ্টা করব। মেয়ের ভাগ্যে থাকলে দুএকটা পড়ে যেতে পারে। শহরের বড়লোকের মেয়েকে তো আর ডাল ভাত খাওয়াতে পারি না।
সুলতান খাঁন বাজারে চলে যাওয়ার পর মাহবুবা মরিয়ম খাতুনকে বলল, চাচা ড্রাইভারের সঙ্গে গ্রাম দেখতে যাওয়ার কথা বললেন, যাব চাচি আম্মা?
মরিয়ম খাতুন বললেন, বিকেলে যেও। এখন তোমার সঙ্গে কিছু আলাপ করব।
ঠিক আছে, তাই যাব।
মরিয়ম খাতুন জমিরনকে ডেকে বললেন, চাল বেছে চুলো জ্বালা। তোর চাচা বাজার থেকে ফিরলে আমি তরকারী রান্না করব।
জমিরন চলে যাওয়ার পর মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি যখন আমাদের মেয়ে হতে চাও তখন তোমাকে কয়েকটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো মা?
মাহবুবা বলল, চাচি আম্মা কি যে বলেন, আপনার কথায় কিছু মনে করব কেন? আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।
মরিয়ম খাতুন বললেন, আমাদের বংশের একটা আলাদা সুনাম আছে। এই বংশের মেয়েরা বেপর্দায় বাইরে চলাফেরা করে না। আর বেপর্দায় চলতে আল্লাহ ও তার রাসূল (দঃ) নিষেধ করেছেন। তিনি তাঁর পেয়ারা হাবীবকে উদ্দেশ্য করে কোরআনে বলিয়াছেন, হে নবী (দঃ) আপনার স্ত্রীগণকে ও আপনার কন্যাগণকে এবং অন্যান্য মুমেনদের নারীদিগকেও বলিয়া দিন যে, তাহারা যেন স্ব-স্ব চাদরগুলি নিজেদের (মুখমণ্ডলের) উপর (মাথা হইতে) নিম্নদিকে একটু ঝুলাইয়া লয়; ইহাতে শীঘ্রই তাহারা পরিচিত হইবে, ফলতঃ তাহারা নির্যাতিত হইবে না; এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
মেয়েরা যদি আল্লাহর হুকুম মতো পর্দার সঙ্গে চলাফেরা করত, তা হলে রাস্তা-ঘাটে এত নির্যাতীত হত না। তুমি শহরের মেয়ে সেখানকার পোশাক-আশাক, চাল-চলন আলাদা। তুমি গ্রাম দেখবে তাতে কোনো বাধা নেই। তবে যাওযার সময় তোমাকে। বোরখা পরে অথবা বড় চাদর গায়ে দিয়ে যেতে হবে। শোন মা, আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে অন্যায় ও অশালীন ছাড়া সবকিছু করার হুকুম দিয়েছেন। তিনি কোরআনে বলিয়াছেন, হে বনী আদম, প্রত্যেকবার মসজিদে উপস্থিত হওয়ার কালে নিজেদের পোশাক পরিদান করিয়া লইও এবং খুব খাও ও পান কর। আর সীমার বাইরে যাইও না। নিশ্চয় আল্লাহতালা সীমা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না।
হাদিসে আছে, আল্লাহর রাসূল (দঃ) বলিয়াছেন, আহার কর, পান কর, দান কর এবং পরিধান কর, যে পর্যন্ত অমিতব্যয়িতা এবং অহঙ্কার উহাতে মিশ্রিত না হয়। হাদিসে আরো আছে, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, যাহা ইচ্ছা ভক্ষণ কর এবং যাহা ইচ্ছা পরিধান কর; কিন্তু অমিতব্যয়িতা এবং অহঙ্কার যেন তোমাকে পথভ্রষ্ট না করে।
আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ। সেই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব জাতির উচিত সৃষ্টিকর্তার বিধান মেনে চলা। সেই বিধান তিনি তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। তুমিই বলো না মা, মানুষের কি উচিত নয়, বিশ্ব প্রভু আল্লাহর বিধান মেনে চলা?
মাহবুবা তন্ময় হয়ে মরিয়ম খাতুনের কথা শুনছিল। এ রকম কথা আগে কখনো শোনেনি। বলল, হ্যাঁ চাচি আম্মা মেনে চলাই তো উচিত।
মরিয়ম খাতুন বললেন, তোমাকে আমি হেজবুন-নেশওয়ান, তাহারাতুন-নেশওয়ান ও একটা নামায শিক্ষার বই দেব। সেগুলো পড়ে সেইসব মেনে চলার চেষ্টা করবে। আর কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও ইসলামের উপর বিভিন্ন বই পড়বে। তা হলে ইসলামকে যেমন জানতে পারবে তেমনি সেইসব মেনে চলারও প্রেরণা পাবে। আর সাংসারিক জীবনে যেমন সুখ-শান্তি পাবে তেমনি আখেরাতেও পাবে। আমি অল্প শিক্ষিত মেয়ে। যখন এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসি তখন ধর্মীয় বিধি-বিধান যেমন জানতাম না তেমনি মেনেও চলতাম না। তোমার চাচা আমাকে সবকিছু শিখিয়েছেন। ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়বার অভ্যাস করিয়েছেন। সেই সব পড়ে জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে মেনে চলারও প্রেরণা পেয়েছি। আর এটাও জেনেছি, যার মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞান নেই, তাকে সেই জ্ঞান দান করা কর্তব্য। তুমি শিক্ষিত মেয়ে হলেও তোমার ধর্মীয় জ্ঞান নেই। তাই আমি আমার কর্তব্য পালন করলাম। শিক্ষিত মেয়ে হিসাবে তুমি আমার কথাগুলো নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
মাহবুবা মরিয়ম খাতুনকে কদমবুসি করে বলল, আপনি দোয়া করুন, আমি যেন আপনার কথা মতো কাজ করতে পারি।
মরিয়ম খাতুন তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করলেন, আল্লাহ তোমাকে দ্বীনকে বোঝার ও সেইমতো চলার তওফিক দেন। তারপর বললেন, মাহবুবকে তুমি কতটা জেনেছ জানি না, ও কিন্তু ধর্মীয় বিধানের বাইরে কোনো কিছু। করে না।
মাহবুবা বলল, তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরপরই তা আমি বুঝতে পেরেছি।
এমন সময় স্বামীকে বাজার থেকে ফিরতে দেখে মরিয়ম খাতুন বললেন, তুমি বস। আমি দেখি তোমার চাচা কী বাজার করে এনেছেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে স্বামীর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বললেন, আপনি বারান্দায় গিয়ে বসুন, আমি আসছি। কথা শেষ করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
সুলতান খাঁন সালামের উত্তর দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বরান্দায় এসে মাহবুবার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন, গ্রাম দেখতে যাওনি?
মাহবুবা বলল, চাচি আম্মার সঙ্গে ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম, বিকেলে যাব।
সুলতান খাঁন বললেন, জান মা, তোমার চাচি অল্প শিক্ষিত মেয়ে। ধর্ম সম্বন্ধে একরকম কিছুই জানত না। কিন্তু এ বাড়িতে আশার পর বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়ে আমার থেকে অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করেছে। মাঝে মাঝে আমার ভুল-ত্রুটি হলে সংশোধন করে দেয়।
মাহবুবা বলল, চাচি আম্মা সে কথা বলেছেন। ওঁনার মতো মহিলা কখনো দেখা তো দূরের কথা, কোনো বই-পুস্তকেও পড়িনি।
সুলতান খাঁন বললেন, মুসলিম মনিষাদের জীবনী পড়ো, তা হলে তোমার চাচির থেকে আরো ভালো মহিলাদের কথা জানতে পারবে।
আচ্ছা চাচা, মাহবুব কি কলেজে পড়ার আগে মাদ্রাসায় পড়েছে?
ছোটবেলায় মক্তবে কোরআন ও নামায পড়া শিখেছে। তারপর মাদ্রাসায় ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়ে হাই স্কুলে ভর্তি করে দিই। তবে ঘরে প্রচুর ধর্মীয় বই পড়েছে। আর এর পিছনে তোমার চাচির অবদান শতকরা নব্বই ভাগ। জেনে রেখ মা, একমাত্র মা-ই পারে ছেলেমেয়েকে সব বিষয়ে আদর্শবান করে গড়তে। তাই তো মাকে সব। বিষয়ে আদর্শবর্তী হতে হয়।
আপনি অতি মূল্যবান কথা বলেছেন। এখানে না এলে আমি এসব জানতে পারতাম না।
এমন সময় মরিয়ম খাতুন এসে হাত পাখা দিয়ে স্বামীকে বাতাস করতে করতে বললেন, মেয়ের সঙ্গে কী এত কথা হচ্ছে?
সুলতান খাঁন বললেন, মাহবুবাকে আমরা মেয়ে হিসাবে পাব, এত বড় সৌভাগ্য। কী আমাদের কপালে আল্লাহ রেখেছেন?
মরিয়ম খাতুন বললেন, সে কথা আল্লাহপাক জানেন। কপালে রাখলে নিশ্চয় পাব। তারপর বললেন, আমি চারের মসলা ভেজে রেখেছি। বেলা হয়েছে, মাছ ধরার কথা বলেছিলেন না?
সুলতান খাঁন ঘড়ি দেখে বললেন, ঘন্টাখানেক পরে যাব। কামলাদের কাছ থেকে একটু ঘুরে আসি। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেলেন।
ঘন্টাখানেক পর ফিরে এসে গোসল করতে যাওয়ার সময় সুলতান খাঁন ড্রাইভার ও মাহবুবাকে পুকুর দেখাতে নিয়ে এলেন। মাছ ধরার জন্য কাঁধে করে খেয়া জালও নিয়ে এলেন।
পুকুর দেখে মাহবুবা বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। একবার নবাব বাড়ি দেখতে গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী দেখেছিল। বেড়াতে গিয়ে রমনা পার্কের লেকও কলাবাগানের লেক দেখেছে; কিন্তু এতবড় পুকুর কখনো দেখেনি। চারদিকের পাড়ে নানা রকম ফলের গাছ পালা দেখে মুগ্ধ হল। চারটে ঘাটেই মেয়ে পুরুষ গোসল করছে, অনেকে কাপড় কাঁচছে।
সুলতান খাঁন বাজার থেকে কয়েক পদের সুগন্ধি মসলা কিনে এনেছিলেন। সেগুলো কুড়া ও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে পুকুরে তিন জায়গায় ফেলে মাহবুবাকে বললেন, চল মা, তোমাকে বাগানের গাছপালা দেখাই। তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনিও চলুন।
যেতে যেতে মাহবুবা বলল, আপনি পুকুরে দুতিন জায়গায় কি যেন ফেললেন।
সুলতান খাঁন বললেন, এতবড় পুকুরে খেয়াজালে মাছধরা খুব শক্ত। তাই সুগন্ধী মসলা দিয়ে মাছের খাবার তৈরি করে ফেললাম। সুগন্ধ পেয়ে মাছ যখন খেতে আসবে তখন জাল ফেলব। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কবে ফিরে যেতে চাও?
মাহবুবা বলল, পরশু দিন।
তা হলে কাল ছিপ ফেলব। আল্লাহ রাজি থাকলে যদি বড় মাছ ধরতে পারি, তা হলে তোমার মা-বাবার জন্য নিয়ে যাবে।
না চাচা, এত দূর থেকে মাছ নিয়ে যাওয়ার কী দরকার? ঢাকাতেই কত বড় মাছ পাওয়া যায়।
তা যাবে না কেন? কিন্তু সে সব নদীর মাছ। পুকুরের মাছের স্বাদই আলাদা। তারপর বললেন, তোমরা ঘুরে দেখ আমি যাই। বেশি দেরি করলে মাছ খাবার খেয়ে চলে যাবে।
মাহবুবা জাল ফেলে মাছ ধরা কখনো দেখেনি। বলল, অন্য সময় বাগানের গাছ। পালা দেখতে আসব, এখন আপনার মাছ ধরা দেখব।
সুলতান খাঁন প্রথমে যে জায়গায় মাছের খাবার ফেলেছিলেন, সেখানে জাল ফেললেন। কিন্তু মাছ পড়ল না। তারপর দ্বিতীয় জায়গায় ফেলতে একটা চার পাঁচ কেজি কাতলা মাছ পড়ল।
মাছ দেখে মাহবুবা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বলল, এর থেকেও বড় মাছ আছে?
সুলতান খাঁন হাসিমুখে বললেন হ্যাঁ মা আছে। প্রতি বছর একবার বেড়াজাল দিয়ে মাছ ধরে বিক্রি করা হয়। সে সময় ধরা পড়ে। তার মধ্যে দশ থেকে বিশ ত্রিশ কেজি ওজনেরও মাছ থাকে।
মাহবুবা অবাক হয়ে বলল, এতবড় মাছও আছে?
হা-মা, ওর থেকেও বড় মাছ আছে। গতবারে পঞ্চাশ কেজি ওজনের একটা ভেটকী মাছ পড়েছিল।
মাহবুবা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল, ওমা, তাই নাকি? অতবড় মাছ আমি। কখনো দেখিনি।
সুলতান খাঁন বললেন, তুমি চৈত্র মাসে মাহবুবের সঙ্গে এস, ঐ সময় মাছ ধরে বিক্রি করা হয়। বড় বড় মাছ দেখতে পাবে। তারপর বললেন, তুমি ঘাটে গাছের ছায়ায় বস, আমি গোসল করে নিই। মাছসহ জালটা ঘাটের উপর রেখে সুলতান খাঁন পুকুরে নেমে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে গোসল করে উঠে এসে বললেন, চল মা, এবার ফেরা যাক। ততক্ষণে ড্রাইভার সেখানে এসেছে।
পুকুরের বিশালতা ও পানি দেখে মাহবুবা প্রথমে ভয় পেয়েছিল। সুলতান খাঁন সাঁতার কাটতে কাটতে যখন পুকুরের মাঝখানে গেলেন তখন আরো বেশি ভয় পেয়েছিল। ফেরার সময় জিজ্ঞেস করল, সাঁতার কাটার সময় আপনার ভয় লাগেনি?
সুলতান খাঁন হেসে উঠে বললেন, ভয় লাগবে কেন? তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সাঁতার জান?
জ্বি জানি। স্টেডিয়ামের সুইমং পুলে সাঁতার কাটি।
তা হলে ভয়ের কথা বলছ কেন?
সুইমং পুল তো এত বড় না। তা ছাড়া তাতে কোনো বড় মাছ নেই। আচ্ছা চাচা, এই পুকুরে কুমীরওতো থাকতে পারে?
নদীতে বা সাগরে যে সব বড় বড় কুমীর থাকে সে সব নেই। তবে ছোট খাট মেছোকুমীর থাকতে পারে?
মেছো কুমীর কী চাচা? তারা কী মানুষকে মেরে ফেলে?
না মা, তারা শুধু মাছ খায়। তাই তাদেরকে মেছো কুমির বলে।
পরের দিন সুলতান খাঁন দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর সুগন্ধিযুক্ত মাছের আদার (টোপ) ও হুইল ছিপ নিয়ে পুকুর ঘাটে এলেন।
ছিপে মাছ ধরা দেখার জন্য জমিরনের সঙ্গে মাহবুবাও এসেছে। জমিরন দুটো জলচৌকি ও দুটো ছাতা এনেছে।
মাহবুবাকে ঘাটের উপর ছাতা খাটিয়ে একটা জলকৌচিতে বসতে দিল। তারপর সুলতান খাঁনের কাছে গেল।
সুলতান খাঁন ততক্ষণে বঁড়শীতে টোপ গেঁথে পানিতে ফেলেছেন। জমিরনের কাছ থেকে জলচৌকি নিয়ে ছাতা খাটিয়ে বসলেন।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্রায় দেড় কেজী ওজনের দুটো মিরগেল মাছ ধরে ছেড়ে দিলেন। তারপর একটা বড় মাছ বঁড়শীর টোপ গিলল। অনেকক্ষণ মাছটা খেলিয়ে সুলতান খাঁন ঘাটের কিনারে নিয়ে এলেন। মাছটাকে যখন খেলাচ্ছিলেন তখন জমিরনকে ছাকনিজাল নিয়ে আসতে বলেছিলেন। মাছ কিনারে আনার পর তাকে বললেন, এবার ছাঁকনিজালে করে তুলে নে।
জমিরন মাছটা ছাঁকনি জালে তুলে ঘাটের উপরে নিয়ে এল। প্রায় ছয় সাত কেজি ওজনের রুইমাছ।
মাছটা যখন খেলছিল তখন কয়েকবার লাফ দিয়েছে। মাহবুবা দেখে যেমন আনন্দ পেয়েছে তেমনি ভয়ও পেয়েছে। জমিরন উপরে নিয়ে এসে পাকার উপর রাখতে মাছটা চটাং চটাং শব্দ করে লাফাতে লাগল। মাহবুবা জীবন্ত মাছ কখনো দেখেণি। এখন দেখে খুব আনন্দ পেল।
ঘরে এসে সুলতান খাঁন স্ত্রীকে বললেন, মাছটা ভালো করে জ্বাল দিয়ে রাখ। কাল মাহবুবার সঙ্গে তার মা-বাবার জন্য পাঠাব।
পরের দিন রওয়ানা হওয়ার সময় মাহবুবা জিজ্ঞেস করল, দুচার দিনের মধ্যে কি মাহবুবের চিঠি পেয়েছেন?
সুলতান খাঁন বললেন, তোমরা যেদিন এসেছ, সেদিনই পেয়েছি।
তার ঠিকানা দিন তো।
ঠিকানা দেয়নি তো মা।
মাহবুবা একটা কাগজে নিজের ঠিকানা লিখে তার হাতে দিয়ে বলল পরের চিঠিতে যদি ঠিকানা দেয়, আমাকে জানাবেন। চার পাঁচ দিন আগে আমাকে না জানিয়ে বাসা পাল্টেছে।
তাই নাকি? ঠিক আছে মা জানাব। তুমি মাহবুবের সঙ্গে আবার এস।
জ্বি আসব বলে মাহবুবা-মরিয়ম খাতুন ও সুলতান খাঁনকে কদমবুসি করে গাড়িতে উঠল।
———–
প্রেম ও স্বপ্নের সমাপ্তি অংশ “তোমার প্রত্যাশায়”
Leave a Reply