প্রাচীন চীনা দর্শন : লাওসি ও কনফুসিয়াস – হেলাল উদ্দিন আহমেদ
প্রথম প্রকাশ – ফাল্গুন ১৪২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
প্রকাশক – ওসমান গনি, আগামী প্রকাশনী ৩৬ বাংলাবাজার
প্রচ্ছদ : শিবু কুমার শীল
Prachin China Darshan: Laozi O Confucius :: Ancient Chinese Philosophy: Laozi and Confucius by Dr. Helal Uddin Ahmed
Published by Osman Gani of Agamee Prakashani
উৎসর্গ
প্রবহমান স্রোতের বিপরীতে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-জনতার বিজয়ের প্রত্যাশায়
মুখবন্ধ
দার্শনিকদের মতে, মুক্তি হলো অপসৃয়মাণ এক মরীচিকার মতো। বস্তুত মানুষের মুক্তিলাভের প্রয়াস তাকে কেবল এক দাসত্ব থেকে অন্য দাসত্বেই নিপতিত করে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে মানব-জীবনে মুক্তি ও দাসত্বের সহ-অবস্থান হলো একটি স্বাভাবিক পরিণতি; এটা আসলে প্রকৃতির বৈপরীত্বেরই একটি বহিঃপ্রকাশ। ইসলাম ধর্মে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল মহাজগতের কথা বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মের সক্রিয় ও অক্রিয় গুণাবলীর কথা বিধৃত আছে। জরথুস্ত্র ধর্ম এবং প্রাচীন সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় ভাল ও মন্দ পরস্পরবিরোধী শক্তির উৎস হিসেবে ঈশ্বরকে চিত্রিত করা হয়েছে। মানুষের মধ্যেও এই বিপরীত শক্তির সংঘাত রয়েছে এবং অমঙ্গলের বিরুদ্ধে মঙ্গলের জয়েই তার মুক্তি নিহিত। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চীনের প্রকৃতিবাদী দার্শনিকেরাও দাবি করেছিলেন যে প্রকৃতির বৈপরীত্বের কারণেই দু’টি পরিপূরক ও ভারসাম্য কায়েমকারী যুগপৎ ক্রিয়াশীল শক্তি-’ইয়্যাং’ ও ‘ইন’-কার্যকর আছে; ঠিক যেমন দিন ও রাতের ক্রমপরিবর্তনশীল সুর ও ছন্দ, নারী ও পুরুষের বিপরীত বৈশিষ্ট্য, উষ্ণতা ও শীতলতা, আলো ও আঁধার, সংকোচন ও প্রসারণ, ঘৃণা ও ভালোবাসা, সুখ ও দুঃখ, হাসি ও কান্না, জোয়ার ও ভাটা, সম্পদ ও দায়ের সহ-অবস্থান। এই চীনা দার্শনিকেরা পুরুষসুলভ গুণকে ‘ইয়্যাং’ আর নারীসুলভ গুণকে ‘ইন’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তাদের মতে, একজন ব্যক্তির মধ্যে এ-দু’টি বিপরীতমুখী গুণের ভারসাম্য থাকলে তার জীবন স্বাস্থ্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ হয়।
প্রকৃতপক্ষে ‘ইয়্যাং’ ও ‘ইন’ প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বেকার চীনা দর্শনের একটি মৌলিক ধারণা। এই ধারণার ভিত্তিতে প্রবর্তিত তাওবাদ চীনে অনুসৃত বৌদ্ধ ও জাপানের শিন্টো ধর্মকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রকৃতির বৈপরীত্য ও বিপরীতমুখী স্রোতের মধ্যে থেকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সমতা ও ভারসাম্য আনয়নের পথ অনুসন্ধান করাই ছিল তাওবাদের মূল উপজীব্য।
উপরে বর্ণিত প্রেক্ষাপটে প্রাচীন চীনা দর্শনের মূল স্রোতধারা তাওবাদ ও কনফুসীয় মতবাদের ব্যাপারে আমার আগ্রহের সূত্রপাত। ২০০৫ সালে বেইজিং ভ্রমণকালে আধুনিক চীনের উত্থান ও চীনাদের জীবন-প্রণালী ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে আমার এ আগ্রহ আরো ঘনীভূত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তথ্য মহাসড়ক তথা ইন্টারনেটের সহায়তায় তাওবাদের মূল গ্রন্থ ‘তাও তে চিং’এর চারটি ইংরেজি অনুবাদ (ম্যাকক্যারল, মুনরো, কিয়া ফু ফেং ও জেন ইংলিশ, এবং মিচেল কর্তৃক অনূদিত) এবং তাওবাদ সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি লেখা সংগ্রহ করি। এগুলোর উপর ভিত্তি করে ২০০৬-০৭ সালে তাও তে চিং গ্রন্থটি অনুবাদ ও প্রকাশ করি।
প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে এর আগে অন্য কেউ উপরোক্ত গ্রন্থটি অনুবাদ করেন নি, যদিও ভারতে নয়া দিল্লীর সাহিত্য অকাদেমী ১৯৬০ সালে অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছিল। তবে সে বইটির সাথে বর্তমান অনুবাদকের অনুবাদের আঙ্গিক ও উপস্থাপনায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্যের কারণ হলো মূল চীনা থেকে অনুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদকেরা সকল বিষয়ে সবসময় ঐকমত্য পোষণ করেন নি। তাই আমার অনুবাদে যেমন অর্থ পরিষ্কার করার জন্য চারটি ভিন্ন জাতীয় অনুবাদের সাহায্য নেওয়া হয়েছে, তেমনি প্রয়োজন অনুযায়ী অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা অনুবাদের সাথেও মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে শেষোক্ত অনুবাদে যেখানে মূলত পদ্যের ছাঁচ অনুসরণ করা হয়েছে সেখানে আমার অনুবাদটি গদ্য ঢং-এর। বর্তমান গ্রন্থের প্রথম অংশে আমার অনূদিত তাও তে চিং-এর পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ সন্নিবেশিত হয়েছে।
এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রাচীন চীনা দর্শনের অপর প্রধান গুরু কনফুসিয়াসের প্রতিনিধিত্বমূলক লেখার অনুবাদের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের পাশাপাশি অক্সফোর্ডের ‘এ কম্প্যানিয়ন টু ফিলসফার্স সহ বেশ কিছু গ্রন্থের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। তাও তে চিং-এর সাথে কনফুসীয় দর্শন যুক্ত করে বর্তমান গ্রন্থে প্রাচীন চীনা দর্শনের মূল স্রোতধারার সাথে বাঙালি পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালানো হয়েছে।
এ বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য শ্রদ্ধেয় ওসমান গনি ভাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। ধারণা করা হয়, প্রাচীন চীনা দার্শনিক লাওসি ও কনফুসিয়াসের রচনা বাইবেলের পর বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি অনূদিত হয়েছে। আশা করি অতীত ও বর্তমান যুগে মানব-সমাজের আচার-আচরণ ব্যাখ্যা এবং উন্নততর জীবন যাপনের বিশ্বজনীন সূত্র খুঁজে পেতে এ অনুবাদ গ্রন্থটি বাঙালি ও বাংলাদেশিদেরকে কিছুটা হলেও সহায়তা করবে।
ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ
৩/১১, বেলালাবাদ কলোনী,
মগবাজার, ঢাকা-১০০০।
Leave a Reply