প্রবন্ধ সংগ্রহ – অম্লান দত্ত
সম্পাদনা : আরতি সেন / গৌরকিশোর ঘোষ
.
অর্থনীতির অধ্যাপনা দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা, কিন্তু, আমাদের সৌভাগ্য, অম্লান দত্তের তৎপর লেখনী এই বিশেষ গণ্ডীতেই শুধু আবর্তিত হয়নি। প্রায় চার দশককাল ধরে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজদর্শন, শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি জাতীয় নানান বিষয়ে তাঁর বিভিন্ন মননদীপ্ত রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এ-কালের একজন অগ্রণী চিন্তাবিদ হিসেবে অচিরেই চিহ্নিত হয়েছেন তিনি। অম্লান দত্তের চিন্তায় রাজনীতি এসেছে অর্থনীতির হাত ধরে, রাজনীতি-অর্থনীতির সমস্যাবলি পর্যালোচিত হয়েছে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে। ধাপে-ধাপে তাঁর রচনায় যুক্ত হয়েছে নতুনতর মাত্রা। চিন্তার স্পষ্টতায়, ভাষার স্বচ্ছতায়, বিশ্লেষণের ব্যাপকতায়, উপলব্ধির গূঢ়তায়, প্রত্যয়ের দৃঢ়তায় অম্লান দত্তের প্রবন্ধাবলি আক্ষরিক অর্থেই প্রবন্ধ। তাঁর একটি লেখাকেও অস্বীকার করা যায় না, এক কথায় নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না তাঁর মুক্ত চিন্তার। যুক্তি-পরম্পরাকে। তিনি সেই বিরল প্রাবন্ধিকদের অন্যতম যাঁর রচনা পরবর্তীকালেও হারায় না। প্রাসঙ্গিকতা, যাঁর চিন্তা আমাদের বহু ভাবনাচিন্তা, সমস্যা-সংকটের জট ছাড়াতে, কর্মপন্থা নির্বাচন। করতে সহায়ক হয়ে ওঠে। সম্ভ্রান্ত ও স্বমহিম সেই অম্লান দত্তের এ-যাবৎকাল রচিত সমূহ প্রবন্ধকে দু-মলাটের মধ্যে এনে অখণ্ড একটি সংগ্রহে পরিবেশন করার এক সানন্দ পরিকল্পনারই ফসল এই গ্রন্থ। শুধু ‘শতাব্দীর প্রেক্ষিতে ভারতের আর্থিক বিকাশ’ নামে তাঁর যে-গ্রন্থটি অর্থনীতি-গ্রন্থমালায় প্রকাশিত, সেটিকে এই সংকলনের বাইরে রাখা হয়েছে। অম্লান। দত্তের সুলভ-দুর্লভ যাবতীয় গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ নয় এই সংগ্রহ, আরও বড়-কিছু বেশি কিছু। এই সংগ্রহের স্বেচ্ছাব্রতী দুই সম্পাদক প্রগাঢ় নিষ্ঠায় ও প্রভূত পরিশ্রমে বিষয়-অনুসারী বিন্যাসে পুরোপুরি নতুনভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন অম্লান দত্তের সমগ্র প্রবন্ধবলিকে। স্বতন্ত্র ও স্বয়ম্প্রভ দুটি ভূমিকায়। পৃথকভাবে জানিয়েছেন এ-সংকলনের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যের কথা, বিস্তৃতভাবে চিহ্নিত করেছেন প্রাবন্ধিক-রূপে অম্লান দত্তের বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যের, স্বাতন্ত্র্য ও সার্থকতার ক্ষেত্রটিকে। বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন রূপে গণ্য হবে এই সংকলন।
.
জন্ম কুমিল্লায়, ১৯২৪ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। ১৯৪৭ সালে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। গান্ধী বিদ্যা সংস্থানের পরিচালনা করেছেন ১৯৭৮-৭৯ সালে। উপাচার্য ছিলেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিশ্বভারতীতে। আমেরিকার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন ও পড়িয়েছেন। গান্ধী সম্বন্ধে বলেছেন অস্ট্রেলিয়ায়, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে চীন দেশে। আর্থিক উন্নয়ন এবং শিক্ষার সমস্যা নিয়ে বলেছেন দেশে-বিদেশের নানান জায়গায়। যেমন, জাপানে, ডেনমার্কে, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে। আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন Quest পত্রিকার। ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন রাষ্ট্রসংঘের সমাজ উন্নয়ন বিষয়ক কমিশনে ১৯৭৯ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে কমলা বক্তৃতামালা প্রদান করেন ১৯৮২ সালে। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম বই : ‘For Democracy’। পরবর্তীকালে বাংলা ও ইংরেজীতে বহু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
.
স্মরণীয় বন্ধু আবু সয়ীদ আইয়ুবের স্মরণে
.
সম্পাদনার কথা
অম্লান দত্ত এ কালের একজন অগ্রণী চিন্তক, বিনা তর্কেই এটা মেনে নেওয়া যায়। চিন্তার প্রকাশ ঘটে ভাষাকে আশ্রয় করে। অম্লান তাঁর ভাবনা চিন্তা প্রকাশ করেন ইংরাজি এবং বাংলা ভাষার মাধ্যমে। উভয় ভাষাতেই তাঁর সমান দখল। আমরা অম্লানের বাংলা রচনা, এপর্যন্ত তিনি যা লিখেছেন, তার একটা সুষ্ঠু পরিচয় এ কালের পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে এই প্রবন্ধ সংগ্ৰহ সংকলন করার প্রয়াস করেছি। অম্লান তিন দশকের অধিককাল তাঁর ভাবনা-চিন্তা বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে অক্লান্তভাবে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলি গ্রন্থবদ্ধও হয়েছে। কিছু রচনা এখনও পত্রপত্রিকাতেই ছড়ান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অধুনা যাঁদের বয়স হল ত্রিশ, তাঁদের চেষ্টা থাকলেও অম্লান কি বলেছিলেন তিন দশক কি দুই দশক আগে, সেটা তাঁদের পক্ষে জানবার কোনও উপায় নেই।
কারণ অম্লানের কম গ্রন্থই এখন বাজারে পাওয়া যায়। যেহেতু অম্লানের রচনাদির প্রাসঙ্গিকতা সব সময়েই বর্তমান, কারণ তাঁর ভাবনা-চিন্তার ভিত্তিতে আছে আবেগবিহীন। মৌল বিচার, অম্লানের রচনাদির সঙ্গে বাংলা ভাষার পাঠকদের পরিচয় না থাকাটা সেই হেতুই এক বড় ক্ষতি, এমন একটি অনুভবই আমাকে এবং আরতি সেনকে অম্লানের প্রবন্ধ সংকলনের কাজে এগিয়ে আসতে উৎসাহ দিয়েছে। স্বীকার করে নেওয়া ভাল অম্লান। আমাদের দুজনেরই বন্ধু। কিন্তু এই প্রবন্ধ সংগ্রহ যে নিছক বন্ধুকৃত্য নয়, সেটা ছাপিয়ে আরও কিছু, সে সংবাদ এই সংগ্রহ থেকেই পাঠক পেয়ে যাবেন।
অম্লান যুক্তির সীমা কোথায় তা জানেন। তা সত্ত্বেও মানুষ সমাজ এবং জগৎকে বিচার করতে অম্লান যুক্তির বাইরে পা বাড়ান না। অম্লান মনে করেন, মমতা ও মননের বৈপরীত্যে মানুষের বিশিষ্ট পরিচয়। এ দুইয়ের মিশ্রণে ও ঘাত প্রতিঘাতে মানুষের চৈতন্যের বিবর্তন। অম্লান জানেন যে, “যুক্তি কখনও শ্রেণী ও সংঘবদ্ধ স্বার্থের সহায়ক, আবার কখনও সে এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার পরামর্শদাতা। মানবতাবাদের দিকে প্রসারিত এই যে যাত্রা, যুক্তি তাতে পথপ্রদর্শক।”
অম্লান এক সময় অর্থনীতির অধ্যাপক হিসাবেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, তিনি অচিরেই অর্থনীতির যান্ত্রিক অভ্যাসের দাসত্ব থেকে নিজের ভাবনা-চিন্তাকে মুক্ত করে নিতে পেরেছিলেন। এই গ্রন্থটিতে সংকলিত অম্লানের যে সকল রচনার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটবে, সেগুলির বৈশিষ্ট্য এই যে, সেগুলি মুক্তচিন্তার ফসল। অম্লানের বিচার বিশ্লেষণ কোনও মত থেকে কোনও মতবাদে পৌঁছবার ছক কষা কোনও মানচিত্র নয়। অম্লান জানেন, মানুষের সমাজ এবং মানুষ যখন কোনও সমস্যায় পীড়িত হয় বা সংকটে পড়ে, তার থেকে উত্তীর্ণ হবার কোনও একটা নির্দিষ্ট পথ নেই। সমস্যায় যাঁরা পীড়িত অথবা সংকটে যাঁরা পতিত হয়েছেন, নিজ নিজ অভিজ্ঞতা এবং চেতনা সম্বল করে সমস্যা বা সংকট থেকে বেরিয়ে যাবার পথ তাঁদেরই আবিষ্কার করে নিতে হয়। এই ভাবেই মানুষ সৃষ্টির ঊষাকালের প্রাকৃত সরল জীবন থেকে আজকের জটিলতম সমাজ সংগঠনে এসে পোঁচেছে। পথে আসতে আসতে মানুষ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়, সংকট থেকে ত্রাণের বিভিন্নমুখী পথ আবিষ্কার করতে করতে এগিয়ে এসেছে। এ বোধটি অম্লানের মৌল বোধ। দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই মানুষের উত্তরণ ঘটে, এই নত্য মেনে নেওয়ার সুবিধা এই যে, মানুষ বিপরীত মত ও পথকে শ্রদ্ধা করতে শেখে। পরস্পর-বিরোধী মত ও পথকে শ্রদ্ধা জানাবার পূর্বশর্ত হল, বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেগুলির অন্তর্নিহিত সত্যকে যত্ন সহকারে খুঁজে বার করা। যে মানুষ এই প্রচেষ্টায় রত, সে দ্বন্দ্বকে স্বীকার করে নেয়, কিন্তু বৈরিতাকে অস্বীকার করে। কারণ দ্বন্দ্ব ও বৈরিতার যোগ বিভ্রম মাত্র। দ্বন্দ্বের মধ্যে বৈরিতা নেই, যাঁরা স্বমতে নিধনং শ্রেয় বিবেচনা করেন, তাঁদের অহং প্রবল, অহং প্রবল হয়ে উঠলেই বৈরিতার জন্ম হয়। দ্বন্দ্ব উত্তরণের উপায়, বৈরিতা ধ্বংস ডেকে আনে। অম্লান এই সত্যের প্রতি বারে বারে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন।
এই দিকে লক্ষ্য রেখে আমি আর আরতি অম্লানের রচনাগুলিকে এই গ্রন্থে বিন্যস্ত করেছি। এর আগে অম্লানের একই বিষয়ের রচনা বিভিন্ন গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট ছিল। এই প্রবন্ধ সংগ্রহে আমরা অম্লানের রচনাবলীকে বিষয় অনুসারে পুনর্বিন্যস্ত করেছি। যথা ১) রাজনীতি, ২) অর্থনীতি, ৩) সমাজদর্শন, ৪) শিক্ষা, ৫) ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন, ৬) স্মৃতি এবং ৭) হে মহাজীবন হে মহামরণ।
এবারে কিছু কৈফিয়ৎ। বলেছিলাম, অম্লানের বিভিন্ন ধরনের রচনা, এ পর্যন্ত যা প্রকাশিত হয়েছে, সে সমুদয় এই সংগ্রহভুক্ত হবে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও একখানা গ্রন্থকে সংগ্রহভুক্ত করা গেল না। গ্রন্থটির নাম ‘শতাব্দীর প্রেক্ষিতে ভারতের আর্থিক বিকাশ। এই গ্রন্থটি যেহেতু অর্থনীতি গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত সেই হেতু এটিকে ছাড় দেওয়া হল।
‘কমলা বক্তৃতা ও অন্যান্য ভাষণ’ গ্রন্থটির মধ্যে ‘আহরিত তৃতীয় চরণ’ শীর্ষক বক্তৃতাটি অম্লান দিয়েছিলেন ইংরাজি ভাষায়। ওইটিই ‘কমলা বক্তৃতা। মানসী দাশগুপ্ত ওটির বাংলা তর্জমা করেছেন। তর্জমাটি সুলিখিত হলেও অম্লানের নিজস্ব বাংলা শৈলীর সঙ্গে মিশ খায় না। পাঠক পাছে বিভ্রান্ত বোধ করেন, সেই কারণে মানসীর তর্জমাটি এই সংগ্রহের পরিশিষ্টে স্থান দেওয়া হল। এই গ্রন্থভুক্ত অন্যান্য ভাষণগুলি যেহেতু অম্লানের নিজেরই রচনা, তাই সেগুলিকে মূল গ্রন্থের ভিতরে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। অম্লানের কয়েকটি রচনা এক গ্রন্থে মুদ্রিত হবার পরে পরবর্তী সময়ে কিঞ্চিৎ সংশোধিত কখনও বা কিছুটা পরিবর্ধিত হয়ে অন্য গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা পরবর্তী পাঠকেই এই সংগ্রহে স্থান দিয়েছি। কারণ সেটাকেই আমরা লেখকের পরিণত মনের প্রকাশ বলে ধরে নিয়েছি।
একটি সতর্কতা। অম্লানের ভাষা অতুলনীয়। তাঁর শৈলী স্বকীয়। গভীর ভাবকে এবং চিন্তাকে এক আশ্চর্য প্রাঞ্জলতায় অম্লান মনোযোগী পাঠকের মনে অনায়াসে প্রবিষ্ট করে দিতে পারেন। তাঁর ভাষা ভাবালুতা এবং অলঙ্কার বর্জিত এবং উদ্ধৃতি কণ্টকিত নয়। এই ভাষা মেদহীন, ঋজু এবং যথার্থ অর্থবহ। অথচ নিরস নয়। বয়সে যতই তিনি পরিণত হয়েছেন, ততই তাঁর ভাব গাঢ় এবং ভাষা যথাযথ হয়েছে। এত কথা বলতে হচ্ছে। এই কারণে, অম্লানের রচনাকে বিষয়ানুযায়ী সাজাবার সময় রচনাকালের ক্রম মেনে চলা সম্ভব হয়নি। বিষয়গুলিতে যাতে ভাবগত ঐক্য বজায় থাকে সম্পাদকদ্বয় সেদিকেই নজর রেখেছিলেন। আশা করি পাঠক সম্পাদকদ্বয়ের সমস্যা হৃদয়ঙ্গম করবেন।
এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করার কালে মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সারদারঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় অক্লান্ত সাহায্য করেছেন। তাদের ধন্যবাদ জানাই।
গৌরকিশোর ঘোষ
কলকাতা
.
ভূমিকা
‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ১৯৪১ সালে, তাঁর আশি বছরের জম্মদিনে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। সেই প্রবন্ধে তিনি মানবপীড়নকারী সাম্রাজ্যবাদের নখদন্তের বিস্তার দেখেছিলেন। তারপরে পঞ্চাশ বছর পার হল বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে কবেই, কিন্তু শেষ হয়নি ঠাণ্ডা লড়াই-এর উদ্বেগ আর গরম লড়াই-এর আতঙ্ক। উদাহরণ–অতি সাম্প্রতিক গালফ-ওয়ার। ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ, শক্তিশালী মারণাস্ত্রের সহযোগে যা ভয়াবহ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অতিব্যবহার, অপব্যবহার আর অব্যবহার, রাজনৈতিক শক্তির অতিকেন্দ্রিকতা, সম্পদ আর দারিদ্র্যের অরুচিকর বৈপরীত্য, প্রাকৃতিক সম্পদ আর মানব সম্বন্ধের দ্রুত অবক্ষয়, নেশাসক্তি ও উন্মার্গগামিতা–এসব মিলে গত পঞ্চাশ বছর ধরে মানবসমাজকে এমন একটা অবস্থায় এনে ফেলেছে, যেখানে শুধু সভ্যতার নয়, অস্তিত্বেরই সংকট। সমস্ত সামাজিক রোগ ও সামাজিক অন্যায়ের প্রতিকারের পন্থা বলে নিজেকে দাবি করে এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে অভ্যুদয় হয়েছিল মার্ক্সবাদের। ভূমণ্ডলের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের বৃহৎসংখ্যক মানুষের মনে জাগিয়েছিল মুক্তির স্বপ্ন। গড়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আজ দেখা যাচ্ছে যে সে স্বপ্নও ধূলিসাৎ হতে চলেছে। হিংসাশ্রয়ী শ্রেণীসংগ্রামের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি আর্থিক ব্যবস্থায় সামান্য সুরাহা করলেও মুক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারেনি মানুষকে, বরং আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে বারোধকারী নির্যাতনের শৃংখলে। তা থেকে মুক্ত হবার জন্য মরীয়া হয়ে উঠেছে সেসব দেশের মানুষ। এই যেমন একদিকে, তেমনি অতিসাম্প্রতিককালের আর এক উদ্বেগজনক ঘটনা হল এই যে, নানা দেশে মানুষ যুক্তিবর্জিত মধ্যযুগীয় ধমোদনায় ফিরে যেতে চাইছে। রাজনৈতিক বলে বলীয়ান। সাম্প্রদায়িক ধর্মের দাম্ভিক আত্মঘোষণা আজ পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তবুদ্ধি কল্যাণকামী মানুষের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এইরকম জাগতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে যখন বিভ্রান্ত কিম্বা উদ্ভ্রান্ত লাগে, যখন মনে হয় ‘ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’, তখন কিছু অনুত্তেজিত স্থিরবুদ্ধি মানুষের সুচিন্তিত বাক্য কান পেতে শুনতে ইচ্ছে। করে। যাঁরা জাগতিক ঘটনাপারম্পর্যের নৈর্ব্যক্তিক পরিচ্ছন্ন যুক্তিধর্মী বিশ্লেষণ করতে শিখেছেন, যাঁরা কল্যাণবুদ্ধিকে বাণিজ্যবুদ্ধির উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন এবং যাঁদের বোধশক্তি সূক্ষ্ম আর জাগ্রত, অম্লান দত্ত নিঃসন্দেহে সেই দু-চারজন লেখকের মধ্যে প্রধান একজন। তাঁর চিন্তা আমাদের ভাবনাচিন্তার জট ছাড়াতে, কর্মপন্থা নির্বাচন করতে সাহায্য করে।
ধাপে ধাপে তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। স্পষ্ট চিন্তা, স্বচ্ছ ভাষা, গাঢ় উপলব্ধি, দৃঢ় প্রত্যয় এইসব নিয়ে তাঁর প্রবন্ধগুলি আক্ষরিক অর্থেই প্রবন্ধ। ঘটনাকে অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের মূল্যায়ন, নতুন তত্ত্ব গঠন, ঘটনা পারস্পর্যের মধ্যে তত্ত্বের প্রয়োগ, পরস্পর বিরোধী তত্ত্বকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সমন্বয়সাধন এবং অবশেষে কল্যাণমুখী কর্মসূচীর খসড়া রচনা-প্রবন্ধলেখক হিসেবে এইটাই তাঁর স্বাভাবিক চলন। শৈলী। বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে অম্লান যা দেখেন, বোঝেন এবং অনুভব করেন, সবই তাঁর তত্ত্বগঠন প্রণালীর অন্তর্গত হয়ে যায়। এইভাবে জীবনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমস্ত অভিজ্ঞতাগুলি গাঁথা হয় তাঁর ব্যাক্তসত্তার সুতোয়, রচনা হয় একটি ক্রমবিকাশশীল। জীবনদর্শন।
অর্থনীতির বিজ্ঞানী হিসেবে অম্লানের রচনায় অর্থনীতিক চিন্তা স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা গুরুত্ব পেয়েছে, সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে এমন বলা যায় না বোধহয় তাঁর চিন্তায় রাজনীতি অর্থনীতির হাত ধরে চলে। সর্বদাই তিনি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রাজনীতি অর্থনীতির সমস্যাগুলি পর্যালোচনা করেন। আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য সমাজে যে মূল্যবোধের পরিবর্তন দেখা দেয়, পরিবর্তনশীল সেই মূল্যবোধের সঙ্গে চিরন্তন মূল্যবোধের বিরোধ ও বিরোধজাত দ্বন্দ্ব-বেদনা, এগুলি তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপযযাগিতা আর বিপদ–এই দুইই তাঁর। চিন্তাকে আলোড়িত করে। আর্থিক ও আত্মিক উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা এবং ভারতবর্ষে শিক্ষার সমস্যা নিয়ে প্রচুর ভেবেছেন তিনি। শিল্প সাহিত্যের অধ্যয়ন, আস্বাদন ও উপলব্ধি এবং জীবনে শিল্পের ভূমিকা সম্বন্ধে যে সৃজনী চিন্তার প্রকাশ দেখি তাঁর লেখায়, তা বিস্ময়কর। নরনারী সম্পর্ক ও সে বিষয়ে সমাজের প্রতিক্রিয়া, স্ত্রী-পুরুষে সাম্য, নারীমুক্তি প্রভৃতি একালের বিতর্কিত বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে তাঁর ভাবনায়। সংস্কারমুক্ত কল্যাণবুদ্ধি নিয়ে, সংবেদনশীল মন নিয়ে, তিনি বিষয়গুলি বুঝেছেন আর সমাধানের পথ খুঁজেছেন।
অম্লান দত্ত প্রধানত যুক্তিবাদী। কিন্তু যুক্তিবিরোধী নয় অথচ যুক্তির ঊর্ধ্বে মানুষের যেসব সুক্ষ্ম অনুভূতি ও উপলব্ধি, সেগুলি সম্পর্কে তাঁর মন অসাড় তো নয়ই, বরং তাদের অস্তিত্ব ও অপরিহার্যতা বিষয়ে তিনি নিঃসংশয়। মানবসংস্কৃতিতে ধর্মের স্থান ও প্রভাব নিয়ে তিনি দীর্ঘকাল ধরে ভাবনা চিন্তা করেছেন ও লিখেছেন। একটা মানব-ঐক্যের আদর্শ নিয়ে অম্লান মানুষকে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিচয়ের মধ্য দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন। যেসব বিদ্যার মধ্যে মানুষের চিন্তা ও কর্মের বিচিত্র প্রকাশ, সেই সবের প্রতিই তাঁর গভীর আগ্রহ। মানুষের কর্ম ও অবসর, মমতা ও নির্মমতা, স্বার্থ ও স্বার্থত্যাগ নিয়ে যে দ্বন্দ্বাত্বক কাহিনী বিশ্বইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা হয়ে চলেছে, তাইতেই জীবনভর মগ্ন হয়ে আছেন তিনি, ঘটনা পরম্পরা অনুসরণ করে মানুষের আত্মপ্রকাশের ধারাটির প্রকৃতি বুঝতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শুধুমাত্র জানা এবং বোঝাই তাঁর লক্ষ্য নয়। এই ধারাটির শুভনিয়ন্ত্রণে বিবেকী মানুষের সজাগ ও সক্রিয় ভূমিকাটিও চিনে নেওয়া এবং পালন করার উপায় সম্বন্ধে ভেবেছেন। এটাই তাঁর জীবনের কাজ, লেখার মধ্য দিয়ে এটাই তিনি করতে চেয়েছেন। তাঁর লেখা বিশ্লেষণে তীক্ষ্ণ, বেদনায় কোমল। লেখার মধ্যে অতিবিস্তার নেই, আধিক্য নেই, ততটাই লেখেন যতটা না লিখলে হয় না। নিবিড় অধ্যয়নের আভাস একটা মৃদু সৌরভের মত অন্তরালে থেকে তাঁর প্রকাশকে সমৃদ্ধ করে। যুক্তিবাদী হিসেবে একটা প্রাথমিক অবিশ্বাসপ্রবণতাই তাঁর মনের ধর্ম, কিন্তু এহ বাহ্য। গভীর নৈরাশ্যের পরিস্থিতিতেও মানুষের প্রতি বিশ্বাস এবং নৈরাশ্য-উত্তীর্ণ আশাবাদের মানসিকতাই তিনি জাগিয়ে রাখেন শেষ পর্যন্ত, যার ফলে তিক্ততা প্রায় কখনোই দেখা যায় না লেখায়।
অম্লান দত্তের রাজনীতিবিষয়ক লেখায় যে চিন্তাগুলি প্রাধান্য পেয়েছে তা হল সাম্যবাদ ও গণতন্ত্র, হিংসাশ্রয়ী ও অহিংস রাজনীতি, রাজনীতিতে অতিকেন্দ্ৰন ও বিকেন্দ্ৰন, সংখ্যালঘু সমস্যা, জাতীয় সংহতি ও সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ ও বিশ্ববাদ, বিশ্বশান্তি ইত্যাদি। প্রথম থেকেই গণতন্ত্রের প্রতি অম্লানের একনিষ্ঠ প্রেম, কেবল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হিসেবে নয়, জীবনদর্শন হিসেবে। ভ্রাতৃত্বের আদর্শকে সামনে রেখে নিজের কথা বলবার স্বাধীনতা ও অপরের কথা শোনবার সহিষ্ণুতা–এই দুটি জরুরী মূল্যবোধকে লালন করা একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই কিছুটা সম্ভব বলে তিনি মনে। করেন। অম্লান দেখেছেন যে একনায়কতন্ত্র অথবা প্রশাসনের অতিকেন্দ্রিকতাই ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রধান শত্রু। সেদিক থেকে ফ্যাসীবাদ-নাৎসীবাদ-সাম্যবাদ সবই একগোত্রের। অম্লান দত্তকে সাম্যবাদ-বিরোধী বলে মনে করাটা নিতান্তই ভুল। সাম্যে তিনি বিশ্বাসী, প্রীতি ও সহযোগিতার সূত্রে বাঁধা এক অখণ্ড মানবজাতি তাঁর স্বপ্ন। বর্ণ বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, নারী পুরুষে অসাম্য, জাতিভেদ, সম্পদ ও দারিদ্রের মধ্যে অসঙ্গতি–এসবের বিরুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠভাবে সোচ্চার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হিসেবে। একনায়কতন্ত্রের, তা এমন কি সর্বহারা একনায়কতন্ত্র হলেও, তিনি ঘোর বিরোধী। সাম্যবাদী একনায়কতন্ত্রে আর্থিক ব্যবস্থা ধনতন্ত্রের তুলনায় অধিক হিতকর এটা প্রমাণ করবার জন্য কমিউনিস্টরা যেসব যুক্তি ব্যবহার করেন, তার গলদ তাঁর কাছে খুব স্পষ্ট। একদলশাসিত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের অতিকেন্দ্রিত আমলাতন্ত্রের বিপদ সম্বন্ধে অম্লান দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে যেসব কথা অক্লান্তভাবে বলে আসছেন, তা এদেশের বাম বুদ্ধিজীবী মহলে যথেষ্ট বিরূপতা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আজ সাম্যবাদী দুনিয়ার ব্যাপক প্রতিবাদী আন্দোলন ও তার সফলতা প্রমাণ করছে যে অম্লান দত্তের বক্তব্যের মূলে সত্যদৃষ্টি ছিল। ব্যক্তিগত মালিকানা ঘুচিয়ে উৎপাদনের প্রধান প্রধান উপকরণের উপর সমাজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে সাম্যবাদী আদর্শ একদা বহু মানুষকে প্রেরণা যুগিয়েছিল, সে আদর্শের প্রতি তাঁর পূর্ণ শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে গণতান্ত্রিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ফিরে পাবার যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তা বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন যে অন্নবস্ত্রের চাহিদার মতনই ব্যক্তিস্বাধীনতাও মানুষের মৌল চাহিদা।
মার্ক্সবাদ ও জাতীয়তাবাদ-এর অভ্যুত্থানের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করে অম্লান দেখিয়েছেন কীভাবে প্রাথমিক বিরোধিতা অতিক্রম করে পরবর্তী পর্যায়ে মার্ক্সবাদ জাতীয়তাবাদের কাছাকাছি এসে গেছে। যেমন মার্ক্সবাদের বিপদ, তেমনি জাতীয়তাবাদের বিপদ সম্বন্ধেও তিনি পূর্ণ সচেতন, বিশেষত ভারতের রাজনীতিতে। একাধিক প্রবন্ধে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, যদিও দেশের স্বাধীনতার জন্য, পুনরুজ্জীবনের জন্য জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রে ঐক্যের ভিত্তি আক্রমণধর্মী জাতীয়তাবাদের ওপর নয়, বরং সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের দ্বারা বহুর মধ্যে একের প্রতিষ্ঠায়। এই গ্রহণশীল উদারতার পথটি পরিত্যাগ করা ভারতবর্ষের সংহতির পক্ষে মারাত্মক হবে এই তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়। উদ্বেগের সঙ্গে তিনি লক্ষ করেছেন কীভাবে ধর্মীয় ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িকতা ভারতবর্ষে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ও এদেশের রাজনীতিকে এক হিংসাশ্রয়ী অসহিষ্ণুতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
শুধু সাম্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত দূর্বলতা, বিকৃতি ও বিপদ সম্বন্ধে অম্লান পূর্ণ সচেতন। সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যেও যে আমলাতান্ত্রিক প্রবণতা, দলসর্বস্বতা এবং ব্যাপক দুর্নীতির প্রাদুভাব ঘটেছে, তাতে একে তিনি ভবিষ্যৎ সমাজের জন্য উপযোগী রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে মেনে নিতে রাজী নন। মানবেন্দ্র বা জয়প্রকাশ কথিত নির্দলীয় গণতন্ত্রের পথে হয়তো ভবিষ্যৎ সমাজের মুক্তির যাত্রা, এইরকম ভেবেছেন তিনি।
অর্থনীতি বিষয়ক লেখাগুলিতে অম্লান আর্থিক উন্নয়নের শর্তগুলি খুঁজে বার করতে চেয়েছেন; গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও মিশ্র আর্থিব্যবস্থার ভাল মন্দ দিকগুলি আলোচনা করেছেন। ভারতের আর্থিক বিকাশের ইতিহাস চর্চা করেছেন। এবং ভারতের ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আর্থিক উন্নয়নের কিছু পথেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আর্থিক উন্নয়নের প্রসঙ্গে তিনি একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা, অন্যদিকে কঠোর পরিশ্রমের অভ্যাস–আর্থিক উন্নয়নের এই যুগ্ম ভিত্তির উপর জোর দিয়েছেন। খেতে, খামারে, কলকারখানায়, চাষী-মজুরের ঘরে ঘরে বিজ্ঞানের প্রবেশ চেয়েছেন। আর্থিক উন্নয়নের জন্য মূলধন গঠনও একটা প্রধান আলোচ্য বিষয়। মূলধন ও তৎসংক্রান্ত সমস্যাগুলির প্রসঙ্গে স্বভাবতই ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার কথা এসে গেছে। এই দুই ব্যবস্থার সব সুবিধা, সব বুটি গলদ নিয়ে অম্লান পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে মূলধন গঠন, উদ্বৃত্ত, শোষণতত্ত্ব, শ্রেণী সংঘাত, বাজার অর্থনীতি, শিল্পের ব্যক্তিগত অথবা রাষ্ট্রীয় মালিকানা যৌথ অথবা পারিবারিক অথবা মিশ্র চাষ প্রথা–এইসব বিষয়গুলির চিত্তাকর্ষক আলোচনা করেছেন। এখানেও আমলাতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান দাপট, অতিকেন্দ্রিকতা ও বিকেন্দ্রীকরণ–এইসব বিষয়গুলি উপস্থাপিত করেছেন। সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির আর্থিক অব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ প্রসঙ্গে যেসব বিষয়গুলির অবতারণা করেছেন তার কয়েকটি হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, উন্নততর প্রযুক্তি, যথাযথ প্রযুক্তি, যন্ত্রশক্তি ও শ্রমশক্তি, গ্রাম ও নগরের পারস্পরিক সম্পর্ক, বেকার সমস্যা, দুর্নীতি, ভোগবাদিতা, সাম্য ও অসাম্য ইত্যাদি। তাঁর আলোচনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, মানবাধিকারের সাম্য, পরিমিত ভোগ, শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহযোগিতা ও অহিংসাভিত্তিক জীবনযাপনের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ নৈতিক সমর্থন। যদিও তিনি মানেন যে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাভিত্তিক উচ্চাভিলাষ ও ধনাকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর্থিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয় না, তবুও সমাজজীবনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সন্তোষের সমম্বয়সাধনের পক্ষপাতী তিনি। সেদিক থেকে কোনমতেই তাঁকে সাবেকী ধনতন্ত্রের সমর্থক বলা যাবে না বরং ওঁর জীবনদর্শনকে অনেকটা সমাজতন্ত্রের দ্বারাই প্রভাবিত বলা যাবে। কিন্তু তিনি মনে করেন না যে, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারা ব্যক্তিস্বাধীনতা অপহরণের পথে কোনোমতেই সমাজতন্ত্রের মতো একটি মহৎ মূল্যবোধ মানুষের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। মার্ক্সবাদকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ না করলেও তিনি মনে করেন যে ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার প্রকৃতি বিশ্লেষণে মার্ক্সীয় পদ্ধতি কিছুটা বৈজ্ঞানিক এবং এক্ষেত্রে মার্ক্সের চিন্তা মূল্যবান। কিন্তু বহু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘটনার বিশ্লেষণে মার্ক্সবাদীদের অন্ধ ও গোঁড়ামীকে বৈজ্ঞানি মনের পরিপন্থী বলে মনে করেন তিনি।
ভারতের আর্থিক সমস্যা প্রসঙ্গে অম্লান দত্ত গ্রাম ও শহরের অসম-সম্পর্কের ব্যাপারটিকে খুব গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে গ্রাম এবং শহরকে নিয়ে একটা সামগ্রিক চিন্তার প্রতিফলন আমাদের পরিকল্পনায় থাকা দরকার। কুটীর শিল্পের মাধ্যমে গ্রামপুনর্গঠন ও গ্রামের স্বয়ম্ভরতাকে নীতিগতভাবে মেনে নিলেও ওঁর মতে এটাই যথেষ্ট নয়। গ্রাম, মাঝারি শহর এবং কেন্দ্রীয় শহর এই তিনের পারস্পরিক নির্ভরতার কথা আলোচনা করেছেন। আর্থিক উন্নয়নের পরিপন্থী শক্তিগুলিকে চিহিত করেছেন তিনি এবং এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর শিক্ষাচিন্তা ও পল্লীসংগঠন চিন্তাকে উল্লেখ করেছেন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে।
সবশেষে, অম্লান দত্তের আর্থিক চিন্তা সম্বন্ধে একটা কথা না বললে কিছুই বলা হয় না। সেটা এই যে অর্থবিজ্ঞানকে আলাদাভাবে দেখলে হবে না, একে জীবনদর্শনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। তিনি দেখিয়েছেন যে ধনতান্ত্রিক সংস্কৃতি আর সমাজতন্ত্র–এই দুটোই মানুষের সমাজকে সঙ্কটের মুখোমুখি এনে দিয়েছে–ঐ দুটোর কোনোটা থেকেই আর মুক্তির আশা নেই। ভবিষ্যৎ সমাজগঠন সম্পর্কে যে কল্পনা ও দূরদৃষ্টি দরকার তার পরিচয় মিলবে তাঁর বর্ণিত ভবিষ্যৎ সমাজের ছবিতে।
ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ যেমন অপরিহার্য, তেমনি অপরিহার্য ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে তার সামাজিক পরিবেশের নিত্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে এটাই অম্লান দত্তের প্রত্যয়। মানুষের ব্যক্তিসত্তার পরিচয় যেমন তার চেতনাবিকাশের স্তরে স্তরে, তেমনি সমান্তরালভাবে চলেছে তার সামজিক প্রতিষ্ঠানের বিবর্তন। ব্যক্তিকে বুঝতে গেলে ঐ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে। ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করে অম্লান মানুষের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিবর্তনের স্বরূপ বুঝতে চেষ্টা করেছেন, আর চেষ্টা করেছেন এমন একটি সমাজদর্শন গড়ে তুলতে, যা এ যুগের নৈতিক বিভ্রান্তির লক্ষণাক্রান্ত সমাজে মানুষকে খানিকটা আত্মস্থ হতে ও কর্তব্য-অকর্তব্য বুঝে নিতে সাহায্য করবে।
সমাজদর্শন চিন্তার প্রতিটি পর্যায়ে অম্লান আজকের মানুষের সমাজজীবনের গভীরতর আকাঙ্ক্ষাগুলি উপলব্ধি করেছেন, সেই প্রসঙ্গে আজকের মানুষের সঙ্কটের স্বরূপ নির্ণয় করেছেন ও সেই সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজেছেন। তাঁর সমাজসম্পর্কিত রচনাগুলিতে একদিকে যেমন ইতিহাসের তথ্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, অন্যদিকে আদর্শ সমাজ গঠনের পথের অনুসন্ধান। সমাজ বিবর্তন ও সমাজবিপ্লব সম্পর্কিত সুপরিচিত তত্ত্বগুলি পর্যালোচনা করে তিনি একটা সমন্বয়ভিত্তিক সৃজনধর্মী তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন।
অম্লানের সমাজসম্পর্কিত রচনাগুলির কয়েকটি পর্যায় আছে। উনি শুরু করেছিলেন ভারতবর্ষের সামাজিক সমস্যা নিয়ে। সেই প্রসঙ্গে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, জাতিভেদ প্রভৃতি সামাজিক সংগঠনের সমস্যাগুলির পর্যালোচনা করেছেন, আবার বিজ্ঞানবিমুখতা, অন্ধ কুসংস্কার, শ্রমবিমুখতা, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ প্রভৃতি প্রগতি ও উন্নয়নের পরিপন্থী সামাজিক অভ্যাস ও মনোভঙ্গিগুলিও চিহ্নিত করেছেন।
সামাজিক সমস্যার কারণ খুঁজতে খুঁজতে ক্রমে তিনি সমাজবিজ্ঞানের সুপ্রচলিত তত্ত্বে চলে এসেছেন, ঘটনার সঙ্গে তত্ত্ব মিলিয়ে তার প্রান্তি বা যাথার্থ বিচার করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে আসে স্যাঁ সিম বা বেকনের কথা, মিল এবং বেন্থামের কথা, ফিরে ফিরে আসে। মার্ক্সবাদের কথা। এদেশে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, মানবেন্দ্রনাথ, জয়প্রকাশের সমাজচিন্তাও এসেছে আলোচনা প্রসঙ্গে। এদেশের সামাজিক সমস্যার। ব্যাখ্যা ও সমাধান প্রসঙ্গে অম্লান দত্তের বেশ কিছু মৌলিক চিন্তার সঙ্গেও আমরা পরিচিত হই।
ভারতবর্ষের সমাজে ধর্মসম্প্রদায়গত অনৈক্য, হিন্দু সমাজে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা, উপজাতীয় সমাজ ও তার সমস্যা–এইসব নিয়ে ইতিহাস-অর্থনীতি-সমাজতত্ত্ব-আশ্রিত বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর স্বকীয় রীতিতে। নারীমুক্তি ও স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্ক প্রসঙ্গে পুরুষ ও নারীর অসাম্য, বিরোধ ও দ্বন্দ্বের ভিত্তি, সহযোগিতার সূত্র, বিবাহবিচ্ছেদ, মাতৃত্ব, একগামিতা ও বহুগামিতা, স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের ভিত্তি–এইসব বিতর্কিত ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলি নিয়ে সংস্কারমুক্ত সহানুভূতিশীল ও কল্যাণবুদ্ধি-আশ্রিত আলোচনা করেছেন।
স্বদেশের সামাজিক সমস্যাগুলি বিশ্লেষণ করতে করতে অম্লান ক্রমে চলে গেছেন। সমাজতত্ত্বের মূল বিষয়গুলির আলোচনায়। ব্যক্তিচেতনা ও প্রতিষ্ঠানের বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। একদিকে তিনি মানুষের চেতনাবিকাশের সমান্তরাল সামাজিক প্রতিষ্ঠানেরও বিবর্তন লক্ষ করেছেন। সমাজবিবর্তনের দ্বন্দ্ব ও সহযোগিতার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা প্রসঙ্গে নানাভাবে আলোচনা করেছেন। শ্রেণীদ্বন্দ্বের তত্ত্বকে সাধারণভাবে স্বীকার করে নিলেও দ্বন্দ্বের আরো যে নানা চেহারা আছে সেগুলিকেও গৌণভাবে দেখতে তিনি রাজি নন। যেমন, এ প্রসঙ্গে ধর্মভিত্তিক বা ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, স্বাদেশিক ঐক্যবোধ প্রভৃতি বিষয়গুলির দীর্ঘ আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে দ্বন্দ্বের উৎস কত বিচিত্র।
দেশে আর বিদেশে যেসব মহান ব্যক্তির চিন্তাধারা আর কর্ম অম্লান দত্তের চিন্তা ও ব্যক্তিত্বের ওপর যথেষ্ট ছাপ ফেলেছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি তাঁদের কয়েকজনের মূল্যায়ন। করেছেন। এই আলোচনা অনেক সময়েই করা হয়েছে তুলনামূলকভাবে এবং যুগের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা রেখে। এঁরা হলেন রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, রাসেল, মানবেন্দ্রনাথ ও বিনয়কুমার সরকার ও আম্বেদকর। এঁদের মধ্যে মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি তরুণ বয়স থেকে শুধু চিন্তাগতভাবে নয় ব্যক্তিগতভাবেও ঘনিষ্ঠ, আর বিনয়কুমার সরকারের তো। তিনি স্নেহাস্পদ ছাত্র।
যেসব ভাবনাচিন্তা প্রসঙ্গে এইসব মনস্বীদের কথা আলোচনা করা হয়েছে, তা হল স্বাধীনতা ও সাম্য, গণতন্ত্র ও মানবতাবাদ, বিশ্ববোধ প্রেম ও নিয়ম, দ্বন্দ্ব ও অহিংসা, যুক্তি ও ধর্ম, সবকিছু নিয়ে সামাজিক প্রগতি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক মুক্তি।
রামমোহনকে দিয়ে শুরু করে দেখিয়েছেন যে এ দেশে নবজাগরণের পথিকৃৎ রামমোহন কিভাবে প্রথম জীবনে যুক্তিনিষ্ঠভাবে সব ধর্মকে বাইরে রেখে বিচার করেছেন ও পরবর্তী জীবনে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠ অংশগুলি আবিষ্কার করে তারই আলোয় হিন্দুধর্মকে সংস্কারের প্রয়াসী হয়েছেন। যুক্তি ও আধ্যাত্মিকতার যে সমন্বয় রামমোহনের চিন্তায় প্রকাশিত হয়েছিল, অম্লান দত্তকে তা কতটা প্রভাবিত করেছিল তার কিছুটা পরিচয় পাই ওঁর পরবর্তী কালের লেখা ‘ধর্ম ও যুক্তি’ নামে গ্রন্থটিতে।
রামমোহনের পরেই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ হলেন রামমোহন এবং নবজাগরণের সোজাসুজি উত্তরাধিকারী। রবীন্দ্রনাথের কাছে অম্লান যা পেয়েছেন তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার মিলবে তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি রচনার মধ্যে। ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা, স্বাধীনতা ও স্ব-নির্ভরতা, বিশ্ববোধ ও মানবতা, পল্লী পুনগঠন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রসঙ্গে তিনি যা লিখেছেন সবতাতেই অতি স্বাভাবিকভাবে রবীন্দ্রনাথের কথা এসে গেছে। সেই সঙ্গে গান্ধীর। রবীন্দ্রনাথ বাঙ্গালী মাত্রেরই প্রাণের মানুষ, কিন্তু গান্ধীকে সাধারণভাবে বাঙালী নানা কারণে কখনোই প্রাণের মধ্যে গ্রহণ করতে পারেনি। অম্লান দত্ত একজন বাঙালী রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী যাঁকে সমানভাবে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছেন। তিনি মনে করেন যে এ দেশে জাতীয় জীবনের ও জাতীয় চরিত্রের উন্নয়নে দেশের এই দুই শ্রেষ্ঠ সন্তানের ভূমিকা পরস্পরের পরিপূরক। এঁদের চিন্তার মধ্যে মিল যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি অমিলের দিকটাও বিশ্লেষণ করেছেন অম্লান। এই অমিল হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, বৃহৎ যন্ত্র ও বৃহৎ শিল্পের ব্যবহার, পল্লীর সঙ্গে নগরের সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে। তা ছাড়া মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসা যদিও এই দুজনেরই আত্মিক শক্তির একটা প্রধান উৎস ছিল, কিন্তু জীবনের মূল সুর ও মূল ঝোঁকের ব্যাপারে দুজনের অনেকখানি অমিল ছিল। এই মিল ও অমিল অম্লানের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ঠিকমত অনুধাবন করতে পারলে তবেই আমরা জাতীয় জীবনে এঁদের বাণীকে সফল করে তুলতে পারবো। বাঙালী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীকে যুগপৎ গ্রহণ করার মধ্যে অম্লানের চিন্তার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তারও চেয়ে উল্লেখযোগ্য এই যে গান্ধীর সঙ্গে রাসেলকেও, তিনি নিজের জীবনদর্শন গড়ার কাজে তুল্যভাবে গ্রহণ করেছেন।
রাসেলের কথা লেখা হয়েছে যে প্রবন্ধে তার নাম “আনন্দের সন্ধানে রাসেল”। আনন্দের কথা উঠলে প্রথমেই আমাদের মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে। অথচ রাসেল ও রবীন্দ্রনাথ দুজনের ব্যক্তিত্বের ও জীবনদর্শনের কত তফাত! আনন্দের একটা সহজ ও নিত্য আনাগোনা ছিল রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতে, যা সব সংশয়, সব বেদনার মধ্যেও তাঁকে। নিয়ত রক্ষা করত, স্নিগ্ধ করত। রাসেলের যাত্রাপথ আরও দুর্গম, কারণ তাঁর যাত্রা শুরু সংশয়, অস্থিরতা আর নৈরাশ্য থেকে। গভীর চিন্তার পর রাসেল জীবন সম্পর্কে কয়েকটি প্রত্যয়ে পৌঁছেছিলেন যেগুলি এত মৌলিক, প্রচলিত সংস্কার ও নৈতিক বিশ্বাস থেকে এত স্বতন্ত্র যে সমকালে সাধারণ মানুষকে অনেক সময় বিচলিত ও বিক্ষুব্ধ করেছে। রাসেলের জীবন-প্রত্যয়ের সঙ্গে অম্লানের নিজের জীবন-প্রত্যয়ের অনেক জায়গাতেই গভীর মিল আছে। অম্লান নিজেও একজন মৌলিক চিন্তার মানুষ। তিনি নিজেও সংশয় থেকে আনন্দের উপলব্ধিতে পৌঁছবার চেষ্টা করেছেন। তাই অনেক সময়ই রাসেলের সঙ্গে তিনি একাত্মতা বোধ করেছেন। রাসেলের জীবনে যন্ত্রণা থেকে আনন্দের দিকে যাত্রার অভিজ্ঞতা যেন তাঁর নিজের অনুভবে মিলেমিশে গেছে।
কার্ল মার্ক্স এমন একজন ব্যক্তি, যাঁর লক্ষ্য সম্বন্ধে অম্লানের অগাধ শ্রদ্ধা, যাঁর ব্যাপক প্রভাব ও অবদান সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন; যাঁর মতকে তিনি গ্রহণ করেছেন আংশিকভাবে; এবং যাঁর পথকে কখনোই অন্তরের সঙ্গে গ্রহণ করেননি। তিনি জানেন যে এযুগের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক রূপান্তর, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর চেহারা–এসব বুঝতে গেলে মার্ক্সকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকা চলবে না বা পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না। মার্ক্সবাদের শুভ-অশুভ কোন অবদানকেই উপেক্ষা করলে চলবে না। কীভাবে মার্ক্স-এর সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব তার বিশদ আলোচনা আছে তাঁর লেখায়।
মানবেন্দ্রনাথ তরুণ অম্লান দত্তের ওপরে অনেকটাই প্রভাব ফেলেছিলেন, যদিও বিশ্লেষণের কয়েকটি ত্রুটি তিনি লক্ষ করেছেন এবং মানবেন্দ্রনাথের জীবনদর্শনকেও তিনি সর্বতোভাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন। ভোগবাদ-বিরোধী-দর্শন সম্বন্ধে বা ধর্ম সম্বন্ধে মানবেন্দ্রনাথের চিন্তা এবং অম্লান দত্তের চিন্তায় হয়ত পার্থক্য থাকবে। কিন্তু মানবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারায় যে লক্ষণগুলি তাঁকে সবচেয়ে আকৃষ্ট ও শ্রদ্ধাশীল করেছে তা হল এর গভীরতা, এর বিবর্তন, এর ধারাবাহিকতা। একদা সহিংস জাতীয়তাবাদী মানবেন্দ্রনাথ মার্ক্সবাদকে গ্রহণ করেও যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাকে পরিত্যাগ করলেন, শ্রেণীসংঘাত তত্ত্বের ঊর্ধ্বে উঠে নবমানবতাবাদে পৌঁছলেন, সমষ্টিশক্তির উর্ধ্বে ব্যক্তিমানুষের পূর্ণতাকে অধিকতর মূল্যবান বলে প্রতিষ্ঠিত করলেন, দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে নির্দলীয় গণতন্ত্রের চিন্তায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তাকে সবাধিক মূল্যবান বলে গ্রহণ করলেন, সেই বিবর্তনের সুনিপুণ সশ্রদ্ধ বিশ্লেষণ রয়েছে অম্লান দত্তের মানবেন্দ্রনাথ বিষয়ে প্রবন্ধটির মধ্যে।
হিন্দুসমাজে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার সমস্যা, এই প্রসঙ্গে বি. আর. আম্বেডকরের আন্দোলন, ভারতের রাজনীতিতে ও সামাজিক পরিবর্তনে সেই আন্দোলনের ভূমিকা–এসব নিয়ে অম্লান দীর্ঘকাল ধরে ভাবনাচিন্তা করেছেন। আম্বেডকরের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর সাম্প্রতিকতম লেখাটিতে এই শক্তিশালী, বিদ্রোহী ও বিতর্কিত মানুষটিকে ও তাঁর আন্দোলনকে একটি বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতে রেখে বোঝাবার চেষ্টা। করেছেন তিনি। লাঞ্ছনা-অপমান ও তজ্জনিত দুঃখবেদনার মধ্যে বলিষ্ঠভাবে মাথা তুলে দাঁড়ানো এই আপোষহীন অহিংস-সংগ্রামী মানুষটিকে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও সমর্থনের সঙ্গে তুলে ধরেছেন তিনি, দেখিয়েছেন যে বিভক্ত ভারত নয়, সমান অধিকারের ভিত্তিতে স্থাপিত ঐক্যবদ্ধ ভারতই ছিল তাঁর কাম্য।
.
শিক্ষা সম্বন্ধে বিশেষ করে এদেশের উচ্চশিক্ষার সমস্যা সম্বন্ধে অম্লান দত্ত বহু বছর ধরে ভাবনা চিন্তা করছেন। তিনি দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন, উপাচার্য হিসাবে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন, গবেষণা সংস্থার পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। ফলে দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার পরিবেশ সম্বন্ধে তাঁর ব্যাপক ও গভীর অভিজ্ঞতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাঁর অন্তদৃষ্টি। শিক্ষা বিষয়ে অম্লানের ধারণাগুলি এ দেশের জনপ্রিয় শিক্ষাধারণা থেকে অনেকটাই পৃথক। কিন্তু যা তিনি যুক্তিযুক্ত ও সঠিক বলে জেনেছেন তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে কখনও দ্বিধা বা সংকোচ করেননি। উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষা, ইংরেজী ভাষা ও হিন্দীভাষা সম্বন্ধে তাঁর অভিমত যথেষ্ট বিতর্কিত। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, কারিগরী শিক্ষা ও বৃত্তিশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার যতদূর সম্ভব প্রসার ও সার্বজনীনতা তাঁর কাম্য। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রসারের চেয়ে গুণগত মান উন্নয়নকে তিনি অধিক জরুরি বলে মনে করেন। প্রসার ও গুণগত মানোন্নয়ন এই দুই এর আপেক্ষিক গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর মতামত বিতর্কিত। তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সক্রিয় রাজনীতি ও দলীয় রাজনীতির চর্চা সম্পর্কে তাঁর মতামতও হয়তো ছাত্র-শিক্ষকদের অনেকেরই মনোমত না হওয়ার সম্ভাবনা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বশাসন এবং দায়বদ্ধতা তাঁর অভিপ্রেত। এইসব সমস্যাগুলি নিয়েই আলোচনা করেছেন তাঁর শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে।
সমসাময়িক শিক্ষা সম্বন্ধে আলোচনা করা ছাড়াও সমসাময়িক কালের পরিপ্রেক্ষিতে ও ভবিষ্যৎকালের চাহিদার কথা ভেবে শিক্ষার লক্ষ্য পাঠক্রম প্রণালী ও পরিচালনা সম্বন্ধে মৌলিক অনেক চিন্তা পাই তাঁর লেখা থেকে। তাঁর শিক্ষাচিন্তায় রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর প্রভাব অনেকটাই দেখা যাবে। শিক্ষার সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে অম্লান গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে, অর্থাৎ প্রধানত অসংগঠিত অর্থনীতির সঙ্গে শিক্ষার সপর্কস্থাপনের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ও গান্ধীর শিক্ষাদর্শের মূল সূত্রগুলিকে বর্তমান অবস্থায় এদেশের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন তিনি।
শিক্ষার আরো যে দুটি গুরুতর সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন তার একটি হল ব্রেনড্রেনের সমস্যা। অন্য যে সমস্যাটি তিনি লক্ষ করেছেন এবং উদ্বিগ্ন হয়েছেন তা হল আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাধীন চিন্তার বিকাশ সম্বন্ধে অবহেলা। শিক্ষা বিষয়ে তাঁর লেখাগুলি সংখ্যায় কম হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়াও, তাঁর অন্যান্য আলোচনার মধ্যেও নানা প্রসঙ্গে শিক্ষার কথা ও শিক্ষাগত তাৎপর্যের কথা এসে গেছে, এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য যার মূল্য অপরিসীম।
.
যে প্রবন্ধগুলিকে এই সংকলন গ্রন্থে “হে মহাজীবন, হে মহামরণ’ শীর্ষের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলিতে মননের সঙ্গে উপলব্ধির এক অসাধারণ রাসায়নিক সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে একটি সম্পূর্ণ জীবনবোধ। মানুষ সম্পর্কে, জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে, প্রেম সম্বন্ধে, জীবনের মহত্তর মূল্যবোধ সম্বন্ধে এই রচনাগুলি। এর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে একদিকে সাধনালব্ধ নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্ত দৃষ্টি, অন্য দিকে সহানুভব ও স্বার্থহীন প্রীতি। সব মিলিয়ে এক ব্যাপক বিশ্বদৃষ্টি ও নিগঢ় জীবনবোধ।
প্রচলিত অর্থে ধর্মবিশ্বাসী না হয়েও ধর্মচিন্তা বা ধর্মবোধের প্রসঙ্গটা অম্লান কখনও এড়িয়ে চলেননি। সমাজের এবং ব্যক্তির বিকাশে ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে বলেই। তিনি মনে করেন। ধর্মের শুভ-অশুভ দুই প্রভাব সম্পর্কেই পূর্ণ সজাগ হয়ে তিনি শ্রদ্ধা ও সতর্কতার সঙ্গে ধর্ম বিষয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হন। অন্যের চিন্তাকে বিশ্লেষণ করেই নয়, বরং প্রধানত নিজের চিন্তা ও উপলব্ধির উপর ভিত্তি করেই অম্লান ধর্ম সম্পর্কে এমন কিছু মূল্যবান সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছেন যা ধার্মিক ও অধার্মিক উভয় শ্রেণীর মানুষের কাছেই বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ওঁর নানা রচনার মধ্যেই প্রসঙ্গক্রমে ধর্মের উল্লেখ আছে। ‘পল্লী ও নগর’ গ্রন্থে ধর্ম বিষয়ক একটি প্রবন্ধ আছে। কিন্তু ‘ধর্ম ও যুক্তি’ নামে অতিসাম্প্রতিক গ্রন্থটিতে আছে এই বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা। এই গ্রন্থ অম্লান উৎসর্গ। করেছেন তাঁর দুই বন্ধুকে, যাঁদের একজন হলেন ঘোষিতভাবে নাস্তিক যুক্তিবাদী, অন্যজন উদার মতাবলম্বী ধার্মিক সন্ন্যাসী। সম্ভবত লেখকের বাসনা এই যে, দুই প্রত্যন্তবাদী দুই সৎ মানুষের তথা সৎচিন্তার মধ্যে এই গ্রন্থ এক ডায়ালগের সেতু তৈরী করুক।
ধর্ম ও আধ্যাত্মবোধ বিষয়ক রচনাগুলিতে অম্লান নিজে বুঝেছেন এবং পাঠকদের বোঝাতে চেয়েছেন যে জীবনধারণের অসংখ্য গ্লানি, তুচ্ছতা, ব্যর্থতা, মৃত্যু ও শোক এসবকে সহনীয় করে তোলার জন্য এবং এ থেকে উর্ধ্বে ওঠার জন্য মানুষের জীবনে অন্য এক উপলব্ধি দরকার। যে বিশ্ববোধ, অহেতুকী প্রীতি, অপার বিস্ময়বোধ ও আনন্দবোধ এবং অভয়বোধের সমাবেশকে অম্লান অধ্যাত্মবোধ বলে চিহ্নিত করেছেন, প্রার্থনায় বিশ্বাসী সাবেকী ধার্মিকেরা তাতে সন্তুষ্ট হবেন কিনা সন্দেহ। যুক্তিবাদীরাও ঐ ধরনের মানসিক অবস্থাটিকে একধরনের নৈতিক এবং শৈল্পিক অনুভূতির অধিক কিছু মনে করবেন কিনা জানি না। অধ্যাত্ম উপলব্ধির খুব কাছাকাছি যে শিল্প-উপলব্ধি, তার স্বরূপ এবং তার সঙ্গে অধ্যাত্ম উপলব্ধির মিল-অমিল নিয়েও আলোচনা করেছেন অম্লান। ঐসব আলোচনা থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, শুধু তত্ত্বকে মস্তিষ্কজাত করা নয়, উপলব্ধিরও গভীরে গিয়ে পৌঁছেছেন তিনি হে মহাজীবন, হে মহামরণ’ নামে ছোটো রচনাটিতে তাঁর বিশ্ববোধ ও জীবনবোধের গাঢ়তম প্রকাশ দেখে বিস্মিত হতে হয়।
এই গভীর উপলব্ধির পরেও আবার তিনি সংসারের ছোটো বড়ো সমস্যার মধ্যে অবতরণ করবেন, লিখবেন ভারতের জাতিভেদ বা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে, চীনের ছাত্র-আন্দোলন, পূর্ব ইয়োরাপের কালান্তর বা আর্থিক উন্নয়নের সমস্যা নিয়ে। কিন্তু অনুমান করি যে, যে জীবনবোধ ও বিশ্ববোধে তিনি পৌঁছেছেন এবার থেকে তার সুর কখনও প্রচ্ছন্ন কখনও পরিস্ফুটভাবে তাঁর সব রচনার মধ্যেই অবিরাম বাজতে থাকবে, বাজতেই থাকবে।
আরতি সেন
শান্তিনিকেতন
Leave a Reply