প্রবঞ্চক
০১. সেজব্রাশের মাঝ দিয়ে
সেজব্রাশের মাঝ দিয়ে সাপের মত এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে সরু রাস্তা, সেই রাস্তা ধরে ধুলো উড়িয়ে লাফাতে লাফাতে ছুটছে একটা স্টেজ কোচ। যাত্রী মাত্র তিন জন। রক বেনন, হিরাম ব্যাগলে আর অপরিচিতা এক বয়স্কা মহিলা। যাত্রাটা দীর্ঘ, তাই পরিশ্রান্ত হয়ে সীটের ওপর গা এলিয়ে চুপ করে বসে আছে সবাই।
তেতে উঠেছে কোচের ছাদ রোদের আঁচে, ভেতরে দম বন্ধ করা ভ্যাপসা গরম। পর্দা ফেলার পরও জানালাগুলো দিয়ে সর্বক্ষণ মিহি ধুলো ঢুকছে। ঘাম আর ধুলোয় চটচট করছে যাত্রীদের শরীর। হাঁসফাঁস একটা অবস্থা। ভোগান্তির ষোলোকলা পূর্ণ করেছে বিরক্তিকর ঝাঁকুনি। হাড়-মাংস সব এক করে ফেলছে।
স্টেজ কোচটা কখনও কখনও একেক লাফে আধমাইল করে পেরিয়ে যাচ্ছে বলে ব্যাগলের ধারণা। এখনও সে ভেবে বের করতে পারেনি মাথার ওপর ওর হ্যাট এখনও বসে থাকছে কি করে। এই ঝুঁকিতে শিরদাঁড়ার খোঁচা খেয়ে খসে পড়ার কথা ওটার। ভ্রু কুঁচকে গেল ব্যাগলের, এই দুঃসাধ্য অভিযানে অংশ নেয়ার পুরস্কার হিসেবে তাকে একটা মেডেল দেয়া উচিত!
ব্যাগলের দুঃখের আরও একটা কারণ হচ্ছে কথা বলতে বেনন তাকে মানা করে দিয়েছে। গোপন একটা কাজে টেইলহল্ট শহরে চলেছে ওরা, পথে যত কম লোকের সঙ্গে পরিচয় হয় ততই ভাল। লোক! কিন্তু মহিলা? উসখুস করে উঠল ব্যাগলে; লোকের বদলে কোন মহিলার সঙ্গে আলাপ জুড়লে অসুবিধা কি? বেনন নিশ্চয়ই রাগ করবে না।
ইতস্তত করে মহিলার দিকে তাকাল ব্যাগলে, কিন্তু কথা বলার মত সাহস জোগাড় করতে পারল না।
বিধবাকে বিয়ের পর জীবনে তিক্ত একটা সত্য নেহায়েত ঠেকায় পড়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে সে। মহিলা জাতির কথা শুনতে হয়, একমত হতে হয়, অথবা চুপ করে থাকতে হয়; কথা বলার চেষ্টা করা বা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলা অর্থহীন: যুক্তি-তর্কের সমস্ত বাঁধ শেষ পর্যন্ত অশ্রুর বাণে কোথায় যেন ভেসে যায়। কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা শেষে মহিলাকে না ঘটানোই স্থির করল ব্যাগলে। তাছাড়া নির্দেশ অমান্য করলে বেননও রেগে যেতে পারে।
বন্ধুর জন্যে ব্যাগলের বুকের মাঝে দরদ উথলে উঠল। বেননই তো ওকে বাঁচিয়েছে ধরাবাঁধা জীবনের অন্ধকার গলি থেকে। মুক্তির স্বাদ না পেলে, ওই ফার্ম আর ভয়াবহ ওই বিচ্ছু দুটোর সংস্পর্শ থেকে দূরে সরতে না পারলে মরেই যেত সে। বউকে যদি সহ্য করা যায় বউয়ের প্রথম পক্ষের বিচ্ছু দুটোকে সহ্য করা কোন সুস্থ মানুষের কম্ম নয়। খড়ের সঙ্গে মদ মিশিয়ে ওর ঘোড়াকে খাইয়েছে ওদুটো। নেশার চোটে দুই দিন দাঁড়াতে পারেনি ঘোড়াটা। সহ্য করেছে ও। বিচ্ছুর দল ওর কালো বুটে খয়েরী পালিশ লাগিয়েছে। কিছু বলেনি সে। এমনকি ঘুমের মধ্যে ওরা নিয়মিত ওর এক পাশের গোঁফ চেঁছে দেয়ার পরও মুখ বুজে মাটি কামড়ে পড়ে ছিল। কিন্তু যেদিন ওর খোঁজ নিতে ফার্মে এলো বেনন, সেদিনই মনের গভীরে সে বুঝে গেল বেরিয়ে পড়ার সময় হয়েছে।
তিনদিনের মাথায় মার্থাকে প্রায় রাজি করিয়ে ফেলল ব্যাগলে, কথা দিল চারপাশটা একটু ঘুরে নিয়েই দু’মাসের মধ্যে ফিরবেই ফিরবে। বেনন বোঝানোয় শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে মার্থা অনিচ্ছাসত্ত্বেও।
খুদে দুই বদমাশ আর কান্নারত মার্থার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে ব্যাগলে দিন পনেরো হলো।
কিন্তু কতক্ষণ আর চুপ করে থাকা যায়। আবার মহিলার দিকে তাকাল ব্যাগলে।
অত্যন্ত রুচি সম্পন্ন পোশাক মহিলার পরনে। বয়স ষাটের বেশি হবে তত কম নয়। ছোটখাট আকৃতি, কিন্তু চেহারা দেখে মনে হয় রীতিমত দৃঢ়চেতা। এক কালে যথেষ্ট সুন্দরী ছিল, নিঃসন্দেহে বহু পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে যৌবনে। শেষপর্যন্ত কোন এক দুর্ভাগা নিশ্চয়ই ফাঁদে পা দিয়ে গলায় বিয়ের দড়ি, অর্থাৎ মালা পরেছে। ফোশ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্যাগলে। আজকাল এমন হয়। বিয়ে যারা করেছে সেই সব দুর্ভাগা হতভাগ্য পুরুষদের দুঃখে বুকটা ভারী হয়ে যায় ওর।
আবার ঝাঁকি খেল স্টেজ। এবারের ঝুঁকিটা অন্যান্যবারের তুলনায় জোরাল।
সিধে হয়ে বসে জানালার দিক থেকে মুখ ফেরালেন মহিলা। স্টীল রিমের চৌকো চশমার ভেতর দিয়ে ব্যাগলের দিকে তাকালেন। বিরক্তি সূচক একটা শব্দ করে বললেন, জঘন্য!
আমাকে জঘন্য বলছেন? ইতঃস্তত করে জানতে চাইল ব্যাগলে।
না। আপনাকে কেন বলব! বলছি পশ্চিমের কথা। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলে ধুলো দেখতে দেখতে বিরক্তি লেগে যায়।
পশ্চিমের অপমান! গায়ে লেগে গেল ব্যাগলের। বেননের নিষেধ ভুলে বলে বসল, এতই যখন জঘন্য লাগছে যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফিরে গেলেই হয়। কে আপনাকে ঠেকাচ্ছে!
অগ্নিদৃষ্টিতে ব্যাগলের দিকে তাকালেন মহিলা। এবং সম্ভবত এই প্রথম ভালমত দেখলেন। ফলে চেহারায় ফুটে উঠল তাচ্ছিল্য।
মহিলাকে দোষ দেয়া যায় না, দেখার মত সাজে সেজেছে ব্যাগলে। যে কেউ দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাতে বাধ্য হবে। না, কানের ঘন লোম আর থুতনি পর্যন্ত ঝুলে থাকা গোঁফের কারণে নয়, ফিরে তাকাতে বাধ্য হবে তারা ব্যাগলের পোশাকের কারণে।
এমনিতে ব্যাগলে হালকা পাতলা মানুষ। দেখে মনে হয় বছর পঞ্চাশেক। জিজ্ঞেস করলে বলে, এই কত আর, হবে বিশ পঞ্চাশ! গোফে আর চুলে হালকা পাক ধরেছে ওর। চেহারাটা সাদামাঠা। জীবনের বেশিরভাগ সময়টা ঘোড়ায় চড়ে কাটানোয় কাঁধ দুটো একটু সামনে ঝুঁকে থাকে।
কিন্তু প্রথম দর্শনে এসব বৈশিষ্ট্য এখন আর কারও চোখে-সে যত বড় ওস্তাদই হোক-ধরা পড়বে না। ওর নিজের মা-ও ওকে চিনতে পারতেন না আজকের এই পোশাকে। আর যদি কপাল দোষে চিনেও ফেলতেন ভুলেও কখনও স্বীকার করতেন না নিজের ছেলে বলে। ভদ্রমহিলার সৌভাগ্য যে মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছেন, ছেলের এরকম খোলতাই রূপ দেখতে হয়নি।
মাথায় ডারবি হ্যাট ব্যাগলের; গায়ে ভালুকের পশমের মত রোঁয়া ওঠা একটা দুই সাইজ বড় ডোরাকাটা কোট। কোটের বোতামগুলো নেই। ভেতরে দেখা যাচ্ছে সাদা-কালো ছোপ দেয়া আঁটো একটা ময়লা ওয়েস্ট কোট। শনের দড়ি দিয়ে প্যান্টটা কোমরে বেঁধে রেখেছে। সুদূর অতীতে কোন এক কালে ওটা কালো রঙের ছিল, শেষ বয়সে পৌঁছে এখন ধূসর হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে অভূতপূর্ব হচ্ছে নিজের হাতে তৈরি ওর জুতো জোড়া। হলুদ বোতাম লাগানো সাদা বুটজুতো ওগুলো। ডান দিকের পাটির খানিকটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। সামনের ফাঁক দিয়ে
বেরিয়ে আছে ব্যাগলের মোজা পরা বুড়ো আঙুল।
পুরোপুরি সার্কাসের ক্লাউন। লোক হাসিয়ে সদ্য বেরিয়ে এসেছে তাঁবু থেকে।
স্যার, ব্যাগলেকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে শীতল কণ্ঠে বললেন মহিলা, আপনার সঙ্গে আগে কোথাও আমার পরিচয় হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না।
তাতে কি, এক্ষুণি পরিচয় হয়ে যাবে। আমি… অপ্রস্তুত চেহারায় চট করে বেননের দিকে তাকাল ব্যাগলে।
স্টার্ন, ও হচ্ছে রিকি স্টার্ন, তাড়াতাড়ি করে বলল বেনন। আরেকটু হলেই নিজের পরিচয় ফাঁস করে দিচ্ছিল ব্যাগলে। বিশেষ একটা কাজে টেইলহল্ট শহরে যাচ্ছে ওরা। এমন একটা কাজ, যে কাজে আছে বিপদ, ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তা। আপাতত নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে হবে। এই এলাকায় ওর নাম শোনেনি এমন লোক নেই বললেই চলে। মাত্র দু’বছর হলো ক্ষমা ঘোষণা করেছেন গভর্নর। চোখের ইশারায় ব্যাগলেকে হুঁশিয়ার করে মহিলাকে নিজের সেরা হাসিটা উপহার দিল বেনন। আপনার পরিচয় জানতে পারি কি?
ভদ্রলোকের পোশাক বেনুনের পরনে, ফলে ব্যাগলের সঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও মহিলার দৃষ্টি একটু নরম হলো। কণ্ঠস্বরেও আগের ধার থাকল না। আমি মিস অ্যানা হ্যাটার। আপনার পরিচয়…
রিচি স্টার্ন। ব্যাগলেকে দেখাল বেনন। ওর ভাই।
অবিশ্বাস্য! একজন যুবক আরেকজন প্রায় বুড়ো! সত্যিই আশ্চর্য! বিড়বিড় করলেন মহিলা, যেন বেননের কথাটা বিশ্বাস করতে পারছেন না।
কিছু বললেন? মুখ গোমড়া করে জানতে চাইল ব্যাগলে।
না।
ও।
কোত্থেকে আসছেন আপনি, মিস হ্যাটার? পরিবেশ হালকা করতে জিজ্ঞেস করল বেনন।
নিউ হ্যাম্পশায়ারের সাউথ নরউইক থেকে। ওখানে তিরিশ বছর হলো একটা স্কুলে ইংরেজি পড়াই আমি।
ছাত্রগুলোর জন্যে দুঃখ হচ্ছে আমার ব্যথিত চেহারায় মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল ব্যাগলে।
আর আপনি কি করেন, মিস্টার রিচি স্টার্নং সার্কাসের ক্লাউন? শুনে ফেলেছেন মহিলা, উত্তরোত্তর ব্যাগলের ওপর রেগে উঠছেন, ক্লাউন কথাটা বলার সময় বিষ-তেতো অবজ্ঞা ঝরল। ঠিক করেছেন পেশাকে হেয় করে অভদ্র লোকটাকে শায়েস্তা করবেন। আমি তো জানি শুধু ঘোলা বুদ্ধির লোকগুলোই ক্লাউনের চাকরি করে।
আপনার ভুল হচ্ছে, গোমড়া মুখে বলল ব্যাগলে। আমি ক্লাউন হতে যাব কেন!
তো? বিজয়ের ঝিলিক টীচারের দু’চোখে।
উড়ে গেল বেননের বাধা। আমি একজন প্রাক্তন আউট-ল, বলল গম্ভীর ব্যাগলে। হৃদয়ের এক কোনে বেদনার তীর খোঁচা লাগাল। মহিলা ওকে বিষাদময় অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যৌবনের অনেকটা সময় আউট-ল দলের সঙ্গে ঘুরেও নিজের ছবিওয়ালা একটা ওয়ান্টেড পোস্টার বাগাতে পারেনি ও নিষ্ঠুর আইন বিভাগের কাছ থেকে। ওকে পাত্তাই দেয়নি আইনের বেকুবগুলো। গুণীর কদর বোঝেনি। অবশ্য এখন অতটা ব্যথা আর নেই ওর মনে, বেননের ক্ষমাপ্রাপ্তির সনদে জালিয়াতি করে নিজের নামটা বসিয়ে নিয়েছে এটা একটা বড় সান্ত্বনা। তবু সামনে বসা এই দজ্জাল মহিলাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারল ব্যাগলে। মহিলা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে দেখে আবারও বলল, বোঝেননি? আমি আউট-ল ছিলাম। জীবনে কখনও ধরা পড়িনি।
তাহলে সুস্থ জীবনে ফিরে এলেন কেন?
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিল বেনন। আপনি এদিকে বেড়াতে এসেছেন, মিস হ্যাটার?
কথা বলার সুযোগ হারিয়ে বেজার হলেও মেনে নিল ব্যাগলে। মুখ ঘুরিয়ে জানালার পর্দা ফাঁক করে বাইরে তাকাল। সেজব্রাশ আর সেজব্রাশ; মিস অ্যানা মিথ্যে বলেননি, উত্তর-পশ্চিমের সেই মন্ট্যানা রকির ফুলে ওঠা উইটিগো প্রান্তর পর্যন্ত চোখে পড়ার মত আর কিছু নেই। ধুলো, পাথর আর সেজব্রাশ।
মিস হ্যাটার বললেন, হ্যাঁ, তা বলতে পারেন, মিস্টার স্টার্ন। টেইলহল্টে যাচ্ছি আমি। বেড়ানো আর কাজ, একসঙ্গে দুটোই হবে। শুনেছেন নিশ্চয়ই এদিকে রেললাইন বসাচ্ছে মন্ট্যানা সেন্ট্রাল রেলরোড? বেড়ানোর ফাঁকে ওদের কাজ তদারক করাও হবে।
আপনি তাহলে রেলরোডের সঙ্গেও জড়িত? জানতে চাইল বেনন।
হা, ও-কথা বললে ভুল হবে না। প্রভাবশালী শেয়ার মালিকদের অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় আছে। কয়েকজন তো আমারই ছাত্র। কোম্পানি চালুর সময় তিনটা শেয়ারও কিনেছিলাম আমি, কাজেই ওদের কাজ কেমন চলছে জানার অধিকার আছে আমার। আপনি কি বলেন, মিস্টার স্টার্ন?
‘অবশ্যই!’ মহিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেখে সায় দিয়ে মাথা দোলাল বেনন।
তাছাড়া শুনছি ওখানে গোলমাল চলছে, বললেন হ্যাটার। আপনার কি মনে হয়, স্পারটা ওরা শেষ করতে পারবে?
স্পারটা ঠিক কোথায় হচ্ছে না জানলে কি করে বলি, মিস হ্যাটার? ভালমতই জানে বেনন কোথায় স্পার তৈরি করছে মন্ট্যানা সেন্ট্রাল। টেইলহল্টে ওরা রেলওয়ের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতেই চলেছে, কিন্তু মহিলাকে তা বলা যাবে না।
‘এত বড় একটা খবর আপনি জানেন না!’ বিস্মিত চেহারায় বেননকে দেখলেন মহিলা। উইটিগোর পরফাইরিতে যাবার জন্যে পথ তৈরি করছে ওরা। পরফাইরির নাম তো শুনেছেন? শোনেননি? বলেন কি! পরফাইরি একটা মাইনিং ক্যাম্প। সবাই মনে করেছিল সোনা শেষ, তাই মরে যাচ্ছিল শহরটা। হঠাৎ আবার সোনা পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে আরও কি কি সব। মাইনগুলোর সঙ্গে দারুণ ব্যবসা করতে পারবে রেলরোড যদি পরফাইরি পর্যন্ত লাইন টেনে নিয়ে যেতে পারে। আমি মিরিন্ডাকে বললাম যাচ্ছি যখন ওদিকে, এক ঢিলে দুই পাখি মেরে আসব, মালিকপক্ষের তরফ থেকে দেখে আসব পার কতদূর এগোল। আপনাকে বোধহয় মিরিন্ডার কথা বলা হয়নি? কি যে হয়েছে। আমার! ইদানীং অনেক কিছুই মনে রাখতে পারি না। মিরিন্ডা হচ্ছে আমাদের স্কুলের টীচার। একই সঙ্গে কলেজে পড়েছি আমরা। স্কুলে ও বোটানি পড়ায়। খুবই মিষ্টি মেয়ে। একনাগাড়ে কথা শোনাবার সুযোগ পেয়ে বড় করে দম নিলেন মহিলা। মনে বোধহয় বৃষ্টিহীন মেঘের মত ভদ্রতার হালকা ছায়া খেলল। এই দেখুন, এত কথা বললাম আর কার কাছে যাচ্ছি তা-ই বলা হয়নি। আপনি আবার বিরক্ত হচ্ছেন না তো, মিস্টার স্টার্ন?
হচ্ছিই তো! মনে মনে বলল বেনন। হাসি হাসি একটা ভঙ্গি করে মুখে বলল, না, না, ছিহ, বিরক্ত হব কেন!
আপনি সত্যি ভদ্রলোক; অনেকের অনেক কিছু শেখার আছে আপনার কাছ থেকে। আড়চোখে ব্যাগলেকে একবার দেখে নিয়ে আবার বেননের দিকে তাকালেন মিস হ্যাটার। এদিকে এসেছি আমি আসলে আমার ফুপাত ভাই লুকাসের নিমন্ত্রণে। বলা যায় জোরাজুরি শুরু করে দিয়েছিল ও। একটু অবাকই লাগছে-দশ বছর পর চিঠি লিখে হঠাৎ এভাবে আবদার… পরপর দুটো চিঠি! লুকাস হচ্ছে আমার মাটিল্ডা ফুপুর বড় ছেলে, তারমানে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ই হবে। মানা করতে পারলাম না।এত করে বলছে যখন! মিরিন্ডাকে বললাম এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চললাম। তারপরেই রওয়ানা হয়ে গেছি।
চুপ করে থাকলে অভদ্রতা হয়ে যায়,বার দুয়েক মনে মনে নিজের কপাল চাপড়ে জিজ্ঞেস করল বেনন, আপনার ভাই টেইলহল্টেই থাকে? স্টেজ কিন্তু টেইলহল্টের পর আর যাবে না।
জানি। না, ও থাকে শহরের আরেক ধারে নিজের র্যাঞ্চে। র্যাঞ্চ আছে ওর। আমাকে নিতে স্টেশনে আসবে। জানি শরীর খারাপ। তবু আসবে। বুঝতে পারছি না একটা স্পারের জন্যে এত উতলা হবার কি আছে। চিঠিতে বারবার করে লিখেছে স্পারটা যেন আমি অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে আসি। অদ্ভুত ব্যাপার!
স্পার, মিস হ্যাটার? রহস্যের গন্ধ পেল বেনন। চোখের কোনে দেখল নড়েচড়ে বসেছে ব্যাগলে।
মাথা দোলালেন টীচার। হ্যাঁ, সাধারণ একটা স্পার। কয়েক বছর ধরেই আছে আমার কাছে। একবার ঘর সাজাব বলে পশ্চিমের একটা স্মৃতিচিহ্ন চেয়েছিলাম লুকাসের কাছে। স্পারটা পাঠিয়েছিল ও।
মাত্র একটা? একটু অবাক লাগল বেননের। স্পার তো জোড়ায় জোড়ায় থাকে?
তাই? না, লুকাস আমাকে ওই একটাই দিয়েছে। পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটা দেখালেন মিস অ্যানা। এই যে এটাতে রেখেছি ওর মহামূল্যবান স্পার।
আর সব মালপত্র স্টেজের মাথায় ওঠালেও এই ব্যাগটা নিজের কাছে রাখার জন্যে ড্রাইভারের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া বাধিয়ে ফেলার উপক্রম করেছিলেন মহিলা, এতক্ষণে তার কারণ জানা গেল।
লুকাস হ্যাটার নামের এক র্যাঞ্চারের কথা আমি উইটিগোতে শুনেছি, বলল ব্যাগলে। লোকে তাকে পাগলা হ্যাটার বলে ডাকত। জানি না সত্যি কিনা, তবে সে নাকি সৌভাগ্যের আশায় দরজার গায়ে একটা স্পার গেঁথে রেখেছিল। একদিন দরজা খুলতেই স্পারটা তার মাথায় পড়ল। মাথায় হ্যাট ছিল না, ফলে সেই আঘাত হ্যাটার সইতে পারল না, জীবনের তরে আধপাগলা হয়ে গেল।
আঁতকে উঠলেন মহিলা। মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে উঠলেন, হায় ঈশ্বর! সত্যি পাগল হয়ে গেছে লুকাস?
আমার জানায় কোন ভুল নেই, জানাল গম্ভীর ব্যাগলে। একটু দুঃখই হচ্ছে ওর, পাগলের কথায় এত দূর পথ এত কষ্ট করে চলে এসেছে মহিলা।
আচ্ছা, বেননের দিকে তাকালেন বৃদ্ধা। আপনার কি মনে হয়, পাগল হয়ে গেছে বলেই স্পারের কথা চিঠিতে ওরকম বারবার করে লিখেছে লুকাস?
সম্ভবত। মাথা দুলিয়ে জবাব দিল ব্যাগলে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল। আমার এক চাচা একবার দিশে হারিয়ে ফেলেছিল। এখনও বেচারা হুঁস ফিরে পায়নি। নিজেকে সে লাইট পোস্ট ভাবত; সারারাত খামোকা দাঁড়িয়ে থাকত রাস্তার ধারে জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়। চাচী তাকে বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে পাহারাদারির কাজটা করিয়ে নিত।
কী ভয়ানক! তারপর? নিজের ভাইয়ের ওরকম পরিণতি কল্পনা করে চমকে উঠলেন মহিলা।
এখনও চাচা জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকে। তবে সারারাত আর পারে না। বয়স হয়েছে তো!
সে-ও আউট-ল ছিল?
আমাদের পরিবারের সবাই আউট-ল।
আপনার ভাই রিকি, ইনিও আউট-ল?
না, ও আমাদের পরিবারের কলঙ্ক।
ইতস্তত করে ব্যাগলের দিকে তাকালেন অ্যানি। একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?
অবশ্যই। একটা কেন, হাজারটা করুন।
আপনি নিজেকে বলেন প্রাক্তন আউট-ল। আচ্ছা, হঠাৎ করে কেন আপনি আইনের পথে ফিরে এলেন?
মানুষের নির্মম অবিবেচনা আমাকে কঠোর এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে, বিষাদগ্রস্ত চেহারায় বলল ব্যাগলে। সততার অভাব আমাকে আইনের গণ্ডীতে ফিরিয়ে এনেছে।
বুঝলাম না। কৌতূহলে চিকচিক করে উঠল মিস হ্যাটারের চোখ। একটু খুলে বলবেনন কি?
বেশ, বলব… আপনি যখন জানতে চাইছেন। জানালার দিকে পিঠ ফিরিয়ে মহিলার মুখোমুখি হলো ব্যাগলে। বারকয়েক কেশে নিয়ে বলতে শুরু করল : এঘটনা হচ্ছে ওয়াইয়োমিঙের ছোট এক শহরের। শহরের নামটা বলব না। আমি তখন আউট-লদের একটা দলের সঙ্গে পাহাড়ে পাহাড়ে মহাফুর্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বেশ কাটছিল দিনগুলো; মূল্যবান যা কিছু ঘোড়ার পিঠে নেয়া যায় নিয়ে চম্পট দিতাম আমরা। লোকালয়ের মানুষ সংবিৎ ফিরে পাবার আগেই আবার পাহাড়ে ফিরে যেতাম। কিন্তু এত সুখ কপালে বেশিদিন সইল না, ডাকাতি করতে গিয়ে পাসির হাতে দু’জন মরতেই কাপুরুষের মত দল ভেঙে দিয়ে আমাকে একা ফেলে চলে গেল সবাই। মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কিন্তু দমলাম না, সিদ্ধান্ত নিলাম আমি একাই একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করব।
মহিলা যাতে দুঃসাহসিকতার মাত্রাটা বোঝে সেজন্যে ঠোঁটে চালিয়াতি হাসি ঝুলিয়ে থামল ব্যাগলে।
একা একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করা কি খুবই কঠিন? বড় বড় চোখ করে জানতে চাইলেন অ্যানি।
তো কঠিন নয়? মানইজ্জত বাঁচাতে জবাবদিহির সুরে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল ব্যাগলে। তাহলে জেসি জেমস ব্যাঙ্ক ডাকাতির সময় তার ভাইকে সঙ্গে রাখত কেন শুনি? ওর প্যান্ট খসে গেলে পরিয়ে দেয়ার জন্যে?
সত্যি আমি দুঃখিত। আসলে এব্যাপারে কিছু জানি না তো! আপনি রাগ করেননি তো, মিস্টার স্টার্ন?
না। মিস হ্যাটারের নরম ব্যবহারে মার্জনাটুকু দয়াবান ব্যাগলে নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিল। একটু জিরিয়ে নেয়ার ভান করে যখন বুঝল মহিলা কৌতূহলে হাঁসফাস করছে তখন বলতে লাগল: ওই ডাকাতির জন্যে খুব সাবধানে পরিকল্পনা করলাম আমি। জানি এই সফলতার ওপর নির্ভর করছে আমার আউট-ল জীবনের ভবিষ্যৎ।…কোথাও কোন খুঁত রাখলাম না। এমন এক জায়গায় ঘোড়াটা রাখলাম, না ব্যাঙ্কের কাছে না দূরে। অপরিচিত একটা ঘোড়া ব্যাঙ্কের সামনে দেখে লোকে যে সন্দেহ করবে সে-উপায় নেই।
তারপর ঠিক সময়ে টুপ করে ঢুকে পড়লাম ব্যাঙ্কে। তখন দুপুর। অর্ধেক কর্মচারী খেতে গেছে। কেউ ভাবতেই পারবে না; মাত্র পাঁচ মিনিটে কাজ সেরে বেরিয়ে এলাম আমি।
একটা গুলি ছুঁড়তে হয়নি, একটা ধমক কাউকে দিতে হয়নি, বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, বিনা বাধায় টাকা ভরা একটা পেট মোটা থলে কাঁধে ফেলে বোর্ডওয়াকে পা রাখলাম আমি। কিন্তু আফসোসের কথা কি বলব, তারপরই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বিনা মেঘে বজ্রপাত হলেও মনে এতটা দুঃখ পেতাম না আমি। হঠাৎ দেখি হিচর্যাকে আমার ঘোড়াটা নেই। ঝুঁকি নিয়ে সৎ ভাবে আমি যখন দুটো পয়সা রোজগার করতে ব্যাঙ্কে ঢুকেছি, তখন কোথাকার কোন এক আত্মসম্মানজ্ঞানহীন নীচমনা ঘোটলোক চোরের বাচ্চা আমার ঘোড়াটা নিয়ে নিশ্চিন্তে চলে গেছে!
তারপর? ভদ্রতার খাতিরে কথার মাঝে উৎসাহ দিলেন ভদ্রমহিলা।
কি আর করব, বাধ্য হয়ে আরেকজনের ঘোড়া ধার করে ওখান থেকে সটকে পড়লাম আমি।
দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকলেন মিস হ্যাটার। জ কুঁচকে রেখেছেন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। বেননের চেহারাটা গম্ভীর। অতিরিক্ত গম্ভীর। হেসে ফেললে খুবই দুঃখ পাবে ব্যাগলে।
আমি দুঃখিত, অবশেষে মুখ খুললেন টীচার। আপনার গল্প বিশ্বাসযোগ্য নয়। যতই চেষ্টা করুন ছাপাবে না কেউ। বলা উচিত নয়, তবুও বলি, সাহিত্য জগতে আমার নাম অনেকেই জানে। কাগজে আমার কবিতা ছাপা হয়। দু’একটা হয়তো পড়েওছেন। ‘শিশুর হাসি মায়ের খুশি’ কবিতাটা খুব প্রশংসিত হয়েছিল। যাই হোক, আপনার গল্পে কাকতালীয় ঘটনা বেশি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
গল্প? কাকতালীয় ঘটনা? খাবি খেল ব্যাগলে। অবুঝের সঙ্গে একমত হতে পারছে না এমন ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। না, মিস হ্যাটার, গল্প নয়; আমার এ ঘটনা পুরোপুরি সত্য। আমি যদি এক বিন্দু মিথ্যে বলে থাকি এই স্টেজ এখনই এই মুহূর্তে এত দ্রুত থেমে যাক যে আমি যেন হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে যাই।
দুর্ভাগ্য ব্যাগলের, হঠাৎ করেই জায়গায় থেমে দাঁড়াল স্টেজ। কথা শেষ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ব্যাগলে।
স্টেজ কেন থেমেছে দেখতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল বেনন। গলা বাড়িয়ে দেখল রাস্তার ধুলোতে সুটকেস রেখে তার ওপর বসে আছে এক চাইনিজ।
সুটকেস সহ এগিয়ে এলো লোকটা। ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ সেরে দু’মিনিটের মাথায় উঠে পড়ল স্টেজে।
চিনদেশের মানুষ! বেননের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে নিচু গলায় বললেন মিস হ্যাটার।
মাথা দোলাল বেনন। মন্ট্যানা রেলওয়েতে মজুরের কাজ করছে ওদেশের অনেক লোক।
কিন্তু বেননের ধারণা ভুল। এই লোক আর যাই হোক কুলি মজুর নয়। চৌকো চোয়াল লোকটার। পাতলা বেঁটেখাট শরীর। পরনে কালো রঙের একটা দামী কাপড়ের অক্সিডেন্টাল সুট। হলদে চেহারায় প্রখর বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
সুটকেসটা মেঝেতে রেখে মিস অ্যানা হ্যাটারের পাশেই বসল সে। ক্ষমা প্রার্থনার হাসি ঠোঁটে নিয়ে সবাইকে দেখল। কোমল বিনয়ী স্বরে বলল, হঠাৎ করে মাঝ রাস্তায় আপনাদের এভাবে বিরক্ত করার জন্যে আমি দুঃখিত। আসলে পশ্চিমা কৌতুকের শিকার হয়েছি আমি। শেষ স্টপেজে ওরা বলল হাঁটতে থাকলেই কিছুক্ষণের মধ্যে টেইলহল্টে পৌঁছে যাব। ওদের বিশ্বাস করা মোটেই উচিত হয়নি আমার।
আছে কিছু বদমাশ, বলল ব্যাগলে। এই মাত্র মেঝে থেকে উঠে গায়ের ধুলো ঝেড়ে সীটে এসে বসেছে। কতক্ষণ ধরে হাঁটছেন?
তা প্রায় আড়াই ঘণ্টা। হাত বাড়িয়ে দিল চাইনিজ। আমি ডক্টর ওয়াং।
ডাক্তার? হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে ছেড়ে দিল ব্যাগলে! দু’চোখে সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইল, যদি ডাক্তারই হতে তোমার কালো ব্যাগটা থাকত; ওটা কই?
আমি ওষুধের ডাক্তার নই। প্যালানটোলজিস্ট। ব্যাগলেকে বোকার মত তাকিয়ে থাকতে দেখে ওয়াঙের হাসিটা দীর্ঘস্থায়ী হলো। আমি ডায়নোসরের ফসিল খুঁজতে টেইলহল্ট যাচ্ছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওখানে অনুসন্ধান করলে ফসিল পাওয়া যাবে।
বুঝলাম, কথাটা বললেও ব্যাগলের চেহারা দেখে বোঝা গেল কিছুই বোঝেনি।
দুলে উঠে সামনে বাড়ল স্টেজ। আবার শুরু হলো ধুলো ঢোকা। কথা ছাপিয়ে উঠল চাকা গড়ানোর গড়গড় আর কোচের ক্যাচ-কোচ ককানি।
ডক্টর ওয়াং কোচে ওঠার পর হঠাৎ করেই পরিবেশ পাল্টে গেছে। চুপ করে গেল সবাই। অস্বস্তিকর একটা নীরবতা নামল কোচের ভেতর। ভদ্রবেশী ওয়াংকে বিপজ্জনক মনে করার কোন কারণ নেই, তবু লোকটার উপস্থিতি বেননকে সতর্ক করে তুলল। লোকটার অমায়িক হাসির আড়ালে আরও কি যেন আছে আবছা ভাবে অনুভব করতে পারছে ও।
আউট-ল জীবনে অনেকবার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছে বেনন। সাহস, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আর বুদ্ধির বলে বেঁচে গেছে বারবার। ও জানে অনুভূতিকে গুরুত্ব না দেয়া বোকামি। সতর্ক নজর রাখল বেনন চাইনিজের ওপর। আপনমনে কি যেন ভাবছে লোকটা। কোন দিকে খেয়াল নেই, আর কারও অস্তিত্ব যেন ভুলেই গেছে।
মাইলের পর মাইল পেছনে পড়ে যাচ্ছে, পেছনে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে একটানা এগিয়ে চলেছে স্টেজ। সূর্যটা ডিমের কুসুমের মত রং ধরে হেলে পড়েছে পশ্চিমে, তবে গরম এখনও কমেনি। মাঝে মাঝেই রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছছে বেনন। ওর দেখাদেখি সিল্কের একটা সাদা রুমাল বের করে হলুদ মুখটা মুছল ডক্টর ওয়াং। তারপর রুমাল সহ হাতটা কোলের ওপর রেখে আবার ভাবনায় তলিয়ে গেল।
আধঘণ্টা পর ঝিমাতে লাগলেন মিস হ্যাটার। পাঁচ মিনিট পর ঘুমিয়েও পড়লেন। আরও কিছুক্ষণ পর ব্যাগলেও চোখ বুজল। হেলে পড়ল মাথা। ঘুমন্ত মিস হ্যাটারের কাঁধটা বালিশের মত ব্যবহার করছে ও। ব্যাগলের নাক ডাকার আওয়াজে কোচের আওয়াজ চাপা পড়ে গেল। ঘুম জিনিসটা ছোঁয়াচে রোগের মত। তন্দ্রায় পেয়ে বসল বেননকে। মিনিট দশেক নিদ্রা দেবীর আরাধনা করে চোখ মেলল ও, দেখল আর সবাই ঘুমাচ্ছে। মস্ত একটা কালো মাকড়সার মত সীটের ওপর পড়ে আছে ডক্টর ওয়াং।
জানালা দিয়ে মাথা বের করল বেনন। উইটিগো রেঞ্জের ওপর ঝুলে আছে অস্তগামী সূর্য। ছায়া নেমে আসছে চারপাশে। দূরের ওই নীলচে টিলাগুলোর গায়ে কালচে ছোপ লেগেছে। যদিও অনেক দূরে, তবুও মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেয়া যাবে ওগুলোকে। টেইলহল্ট–এখনও অনেক দূরে, ওখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেশ রাত হয়ে যাবে।
সীটের ওপর পিঠ সোজা করে বসে চোখ কচলে ঘুম তাড়াতে চাইল ও। স্টেজ থেকে নেমে হাত-পায়ের খিল ছাড়াতে পারলে বেশ হত, কিন্তু তার কোন উপায় নেই। স্টেজ থামবে না, টেইলহন্টের আগের শেষ স্টেশনটা বেশ কয়েক মাইল পেছনে ফেলে এসেছে ওরা।
একটা ব্লাফের পাশ ঘেঁষে এগোচ্ছে স্টেজ কোচ। সেজব্রাশ এখানে উঁচু ব্লাফটাকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। আঁধার হয়ে আসছে। চারপাশ। ঝোঁপগুলোকে দেখাচ্ছে কালো স্তুপের মত। ব্লাফটা
পেরলে আবার দেখা যাবে শেষ বিকেলের আলো।
বাঁক ঘুরল স্টেজ, পরমুহূর্তে কর্কশ আওয়াজ তুলে থেমে দাড়াল। কষে ব্রেক টেনেছে ড্রাইভার।
জানালা দিয়ে বেনন দেখল রাস্তা আটকে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে তিনজন অশ্বারোহী। চেহারা চেনার উপায় নেই, মুখে রুমাল বেঁধে রেখেছে সবাই। প্রত্যেকের হাতে উদ্যত অস্ত্র। ড্রাইভারকে হুঁশিয়ার করার ভঙ্গিতে অস্ত্র নাড়ছে সামনের জন।
ঘুম ভেঙে যাওয়ায় স্টেজ কেন থেমেছে বুঝতে জানালা দিয়ে গলা বের করলেন মিস হ্যাটার, সামনের দৃশ্য দেখে ফুপিয়ে উঠলেন। চোখে প্রশ্ন নিয়ে পরামর্শের আশায় বেননের দিকে তাকাল ব্যাগলে।
হায় ঈশ্বর! ডাকাত! চট করে ব্যাগলের দিকে ফিরলেন টীচার। কে ওরা! নিশ্চয়ই তোমার বন্ধু?
বিরস চেহারায় মাথা নাড়ল ব্যাগলে। হলে খুশি হতাম!
ড্রাইভার নিশ্চয়ই মাথার ওপর হাত তুলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছে-ওদিক থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না, বলল বেনন। তাকিয়ে দেখল কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে কোলের ওপর রুমাল ফেলে তার ওপর দু’হাত রেখে বসে আছে ডক্টর ওয়াং। চেহারায় ভয়ের লেশমাত্র নেই। আবার ডাকাতদের দিকে চোখ ফেরাল সে। একজন থেকে আরেকজনকে আলাদা করার উপায় নেই, প্রত্যেকের পরনে রেঞ্জের সাধারণ পোশাক; ইচ্ছে করলে মুহূর্তে মিশে যেতে পারবে ভিড়ের মাঝে। অবশ্য তেমন ইচ্ছে যে তাদের নেই তা পরিষ্কার বোঝা গেল। সামনের লোকটা ঘোড়া থেকে নেমে স্টেজের পাশে এসে মিস ্যাটারের জানালায় দাঁড়াল।
অ্যাই যে তুমি! টীচারের দিকে আঙুল তাক করে বিকট এক ধমক দিল লোকটা। স্পারটা কোথায়?
আ…আমি জানি না। ভালয় ভালয় বের করো, নাহলে খুন করে ফেলব।
গলার কাছে চলে গেল মিস হ্যাটারের দু’হাত। ফিসফিস করে জানতে চাইলেন, লুকাসের স্পার নিয়ে কি করবে তোমরা?
আরে বুড়ি, সেটা তোমার না জানলেও চলবে। অস্ত্রটা প্রৌঢ়ার নাকের সামনে ধরে নাড়ল দুবৃত্ত। যা চাইছি জলদি বের করে দাও বাঁচতে চাইলে।
মুখ কালো হয়ে গেল মিস অ্যানির। বোঝা গেল মূল্য যাই হোক স্পারটা তাঁর কাছে নগণ্য নয়, হুমকির মুখে ডাকাতদের ওটা দিয়ে দিতে হলে মনে সাংঘাতিক কষ্ট পাবেন তিনি।
বেনন জানে না কেন, তবে ডক্টর ওয়াং স্টেজে ওঠার পর থেকেই এরকম কোন অঘটন ঘটবে বলে মনে হচ্ছিল ওর। লোকটার আচরণে যদিও অস্বাভাবিক কিছু নেই; এপর্যন্ত ডাকাত দলের উদ্দেশে কোন আকার ইঙ্গিতও করেনি, তবু কেন যেন মনে হচ্ছে চোখে পড়া উচিত ছিল এমন কিছু একটা ওর নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।
মনস্থির করে নিল বেনন, এখন এসব ভেবে নষ্ট করার সময় নেই, এখন বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। একজন ভদ্রমহিলার সম্মান এখানে ধূলিস্যাৎ হতে যাচ্ছে। যথেষ্ট অপমান হয়েছেন মহিলা। আর সহ্য করা যায় না।
০২. বেনন বসেছে
বেনন বসেছে মিস হ্যাটারের খানিকটা পেছনে। বাইরে দাঁড়ানো ডাকাতকে দেখতে পাচ্ছে না ও, তারমানে ওই লোকটাও ওকে দেখতে পাচ্ছে না। সুযোগটা নিল বেনন। একলাফে পৌঁছে গেল কোচের শেষ প্রান্তের দরজার কাছে। হ্যাচকা টানে দরজাটা খুলেই লাফিয়ে পড়ল নিচে। গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, ব্যাগলে, ভেতরে চোখ রাখো!
কথা শেষ হওয়ার আগেই কোচের কোনা ঘুরল ও, পথ আটকে রাখা অশ্বারোহী দুই ডাকাতকে ভড়কে দেয়ার জন্যে গুলি পাঠাল।
ঘোড়াগুলোর নাকের সামনে ধুলো ছিটিয়ে মাটিতে গাঁথল বুলেট। চমকে উঠে উন্মত্ত লাফঝাপ শুরু করল জন্তুগুলো, বেসামাল করে তুলল আরোহীদের।
লোকগুলোকে এক পলক দেখে নিয়ে কোচের আরেক পাশে উঁকি দিল বেনন। আচমকা আক্রমণে হুমকি-ধামকি বন্ধ করে হতচকিত হয়ে পিছু হটছে তৃতীয় আউট-ল। সঙ্গীদের সহায়তা পাবে না বুঝতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝেড়ে দৌড় দিল লোকটা। দু’কানের দু’পাশে দুটো গুলি পাঠিয়ে তার দৌড়ের গতি আরও বাড়িয়ে তুলল বেনন।
গালাগালের তুফান ছোটাচ্ছে লোকগুলো। বোধহয় এরকম ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে ভাবেনি। বিহ্বল অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে একাজে একেবারেই আনকোরা আমদানী হয়েছে।
এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পেল বুড়ো ড্রাইভার, আউট-লদের মনোযোগ অন্যদিকে দেখে শটগান তুলে নিয়ে আকাশের গায়ে গুলি করল সে।
শটগানের গুরুগম্ভীর আওয়াজে বিশৃঙ্খলতা আরও বাড়ল, আঁতকে উঠে পিছু হটল ঘোড়াগুলো। এবার ওগুলোকে ফেরাবার চেষ্টা না করে তাড়া দিল দুবৃত্তরা, পালাতে পারলে বাঁচে এখন। যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে চাইছে এখান থেকে।
তৃতীয় আউট-ল ঘোড়ায় চড়ে চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়াও! দাঁড়াও!! আমাকে ফেলে যেয়ো না!
তীর বেগে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াগুলো, তাদের উৎসাহ দেয়ার জন্যে স্টেজের ভেতর থেকে ঘোড়ার খুর লক্ষ্য করে অস্ত্র খালি করল ব্যাগলে। দ্রুত আবার ভরে নিল টাটকা বুলেট। কোন কার্পণ্য নেই ব্যাগলের মধ্যে; তস্করের দল আওতার বাইরে চলে যাওয়ার পর ইচ্ছে না থাকলেও থামল সে, জানালা দিয়ে মুখ বের করে খুশি খুশি গলায় বলল, ওদের আমরা ভয় পাইয়ে দিয়েছি, বেনন!
জবাবে মাথা দুলিয়ে স্টেজ ড্রাইভারের দিকে তাকাল বেনন। দীর্ঘদিন ঘোড়া চালিয়ে ঘোড়ার মতই চেহারা বাগিয়েছে মুষকো লোকটা। এখন সে বন্দুক নামিয়ে রেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘোড়া সামলাচ্ছে।
বার কয়েক চাবুকের আওয়াজ তুলে দক্ষ হাতে ভীত জন্তুগুলোকে বশ করে ফেলল লোকটা। তারপর বড় বড় হলদে দাঁত বের করে বেননের দিকে চেয়ে হাসল। আগের জামানায় ডাকাতগুলোর বুকে সাহস ছিল–পালাত না; লড়াই করে জিততে চাইত ওরা আগে হলে।
মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে কোচে উঠল চিন্তিত বেনন। গোটা ব্যাপারটাই ওর কাছে মস্ত এক ধাঁধার মত লাগছে। সাধারণ
প্রবঞ্চক
একটা স্পারের জন্যে লোকে কেন এত ঝুঁকি নেবে ভেবে পেল না ও। ভাববে সেই অবকাশও মিলল না, ওকে দেখেই মিস হ্যাটার বলে উঠলেন, দারুণ দেখালেন, মিস্টার স্টার্ন; আর কখনও কারও জিনিস কেড়ে নেয়ার কথা ভুলেও ভাববে না ওরা। ক্লাসে আমি বলব কিভাবে আপনার সাহসী, সময়োপযোগী পদক্ষেপের জন্যে ভয়ঙ্কর একদল দস্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি আমরা।
এর চেয়েও কত ভয়ঙ্কর বিপদ যে আমরা মোকাবিলা করেছি…’ কথা শেষ না করে তাচ্ছিল্য ভরে হাসল ব্যাগলে।
ম্লান হয়ে গেল ওর হাসি। ওকে উপেক্ষা করে বেননের উদ্দেশে বললেন মিস হ্যাটার, জানেন, সারাটা বিকেল আমার মাথা ব্যথা করছিল, এই উত্তেজনার পর দেখছি ব্যথাটা আর নেই।জ কুঁচকে পলায়নরত দুবৃত্তদের ওড়ানো ধুলো দেখলেন তিনি। তারপর আবার তাকালেন বেননের দিকে। আচ্ছা, লোকজন নিয়ে ওরা আবার ফিরে আসবে না তো?
আসবে বলে আমার মনে হয় না, ম্যাম।
একটু নিশ্চিন্ত হলেন টীচার। কপালে জমে ওঠা ঘাম মুছে নিয়ে বললেন, না এলেই ভাল।
ডক্টর ওয়াং বলল, শিক্ষা হয়ে গেছে ওদের। বেননের দিকে চেয়ে হাসল লোকটা। আমি কৃতজ্ঞ, মিস্টার স্টার্ন। আপনি না থাকলে সামান্য যা কিছু আছে খোয়াতে হত আমাকে।
ও কিছু না। সীটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল বেনন। অস্ত্রটা ফেলে রেখেছে কোলের ওপর।
ঝাঁকি খেয়ে সামনে বাড়ল স্টেজ। মিস হ্যাটারকে মুখে সান্তনা দিলেও সতর্কতায় ঢিল দেয়নি বেনন, সন্ধে নামার পর জানালার পর্দা ফেলল ও, খাপে ভরে রাখল অস্ত্র। বাইরের মত কোচের ভেতরটাও ঘুটঘুঁটে আঁধার, কেউ কারও চেহারা দেখতে পাচ্ছে না, ফলে আলাপ আর জমল না। কিছুক্ষণ পর নাক ডাকাতে লাগল ব্যাগলে। মিহি সুরে তার সঙ্গে সঙ্গত জুড়লেন স্কুল মিসট্রেস। চুপ করে বসে থাকল বেনন। চেষ্টা করে দেখল, কিন্তু কালো কোট পরা ওয়াংকে কালি গোলা অন্ধকার থেকে আলাদা করতে পারল না।
মাঝরাতের খানিক আগে টেইলহল্টে পৌঁছল স্টেজ। ডিপোতে ঢুকে শেষ একটা ঝাঁকি দিয়ে এযাত্রায় ওদের মুক্তি দিল ওটা।
জেগে উঠে বাইরেটা দেখলেন মিস হ্যাটার। হাই তুলে ঘুম জড়ানো স্বরে বললেন, এটাই তাহলে টেইলহল্ট? শেষ পর্যন্ত পৌঁছলাম তাহলে!
ব্যাগলেও জানালা দিয়ে উঁকি দিল।
আহামরি কোন শহর নয় টেইলহল্ট। তবে সাধারণ কাউটাউনও নয়। রেল কোম্পানি এসে অফিস খোলায় শহরের কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে অনেক গুণ। বোর্ডওয়াকে এত রাতেও লোক সমাগম কম নয়। বেশিরভাগই এসেছে শহরের বাইরে থেকে। দু’তিনটে করে ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যেকটা হিচর্যাকে। চাকার ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে ধুলোময় একমাত্র সরু রাস্তাটা ধরে যাওয়া-আসা করছে বাকবোর্ড আর বিরাট বিরাট ফ্রেইট ওয়্যাগন।
রাস্তার দু’ধারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ফলস্ ফ্রন্ট দেয়া দু’সারি কাঠের বাড়ি; কোনটা একতলা, কোনটা বা দোতলা; তিনতলাও যে নেই তা নয়; আছে দু’একটা, তবে একই স্থপতির অবহেলার কারণেই বোধহয় সবগুলো বাড়ির চেহারা একইরকম। কিন্তু তাই বলে পশ্চিমের অন্যান্য শহরের মত টেইলহল্টে জায়গা খালি পড়ে নেই, নতুন করে আবিষ্কৃত খনি আর রেলওয়ের কারণে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট ব্যবসা। একটা দোকান হলেই যেখানে চলে সেখানে একই জিনিস বেচার জন্যে প্রতিযোগিতা করছে অনেক দোকানি।
রেলওয়ের মজুরদের হৈ-হল্লায় গমগম করছে শহরটা। রাস্তায় চিনেদের সংখ্যাই বেশি, কাজ শেষে শহরে জুয়া খেলতে, আমোদ-ফুর্তি করতে এসেছে। পকেট খালি করে ফিরে যাবে সন্তুষ্ট মনে।
এখানে থাকলে লোকে পাগল হয়ে যাবে, অসন্তুষ্ট হয়ে বিড়বিড় করল ব্যাগলে। মিস হ্যাটারকে বোর্ডওয়াকে উঠতে সাহায্য করার জন্যে মহিলার ব্যাগ হাতে পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। নিজের ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিয়েছে কাঁধে।
বেনন নামার পর কোচ থেকে নামল ডক্টর ওয়াং, সবাইকে চওড়া একটা হাসি উপহার দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে চাইনিজদের ভিড়ে হারিয়ে গেল। লোকটাকে আর একবারের জন্যেও দেখতে পেল না বেনন।
চারপাশে চোখ বুলিয়ে অসহায় মুখখভঙ্গি করলেন মিস হ্যাটার। বেননের দিকে তাকিয়ে বললেন, নাহ, কেউ তো দেখছি নিতে আসেনি আমাকে!
চোখের ইশারায় দেখাল বেনন। রাস্তার ওপারেই হোটেল, চলুন ওখানে পৌঁছে দিই আপনাকে।
রাস্তা পার হতে গিয়ে রীতিমত মেধা খরচ করতে হলো ওদের। যখন তখন তেড়ে এসে গায়ের ওপর পড়তে চাইছে ওয়্যাগনগুলো। ক্ষিপ্ত ড্রাইভারদের গালাগালের মাত্রা ব্যাগলেকেও অবাক করল। একবার থেমে দাঁড়িয়ে নতুন কয়েকটা গালি আত্মস্থ করে নিল ও।
হোটেলে ঢুকে আর দেরি করলেন না মিস হ্যাটার, কোনমতে রেজিস্ট্রারে নামটা সই করেই ওদের শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে।
নাম লিখে ডেস্ক ক্লার্কের দিকে তাকাল বেনন। ব্যাগটা ঘরে রেখে দিয়ো। বাইরে যাচ্ছি আমরা, একটু দেরি হবে আসতে।…আচ্ছা, বলতে পারো মার্লোন ব্র্যান্ডনকে কোথায় পাওয়া যাবে?
শহরে যদি থাকে তো রেলওয়ের অফিসে থাকবে। সবচেয়ে বড় দোতলা বাড়িটাই রেলের অফিস। আর সেখানে যদি না পাও তাহলে তাকে পাবে এন্ড অভ স্টীলে। ওখানেই এখন লাইন পাতছে ওরা।
আবার রাস্তায় বেরিয়ে এলো ওরা। জুতোটার ফুটো বড় হয়ে যাওয়ায় খোড়াচ্ছে ব্যাগলে, বুড়ো আঙুল মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, সর্বক্ষণ ভাগ্যকে অভিশাপ দিচ্ছে ও বিড়বিড় করে।
রেলওয়ের অফিসটার কাছাকাছি এসে অবাক হয়ে থেমে দাঁড়াতে হলো ওদের। দড়াম করে খুলে গেছে পাশের সেলুনটার দরজা। হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো এক দল লোক নিজেদের মধ্যে কথা বলছে না কেউ। সামনের জনের হাতে ফাঁসির দড়ি। রেঞ্জের মোটা কাপড়ের পোশাক সবার পরনে। প্রত্যেকের পা হাঁটুর কাছ থেকে একটু বাঁকা, দীর্ঘদিন ঘোড়ায় চড়ে গরু সামলানোর ফল। কালো কোট পরা একজন লোককে টেনে হিচড়ে আনছে তারা। অসহায় লোকটার পা দুটো বালিতে গভীর দাগ কাটছে; হাল ছেড়ে দিয়েছে বোধহয়, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে না। কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও, মানুষটাকে ছেড়ে নিয়ে রাস্তার শেষ প্রান্তে একটা বড় কটনউড গাছের দিকে চলেছে সবাই।
লিঞ্চিং মব! ফিসফিস করে বলল উত্তেজিত ব্যাগলে, ওরা লোকটাকে ঝুলিয়ে দিচ্ছে!
এসো! হাত আঁকড়ে ধরে টানল বেনন। ঠেকাতে হবে ওদের। এভাবে কাউকে মরতে দেয়া যায় না।
অনেক খানি এগিয়ে গেছে লোকগুলো। দৌড়াতে শুরু করল বেনন। খোঁড়াতে খোড়াতে তাকে অনুসরণ করল ব্যাগলে। রাস্তা পেরতে গিয়ে থামতে হলো ওদের। সামনে দিয়ে বিদ্যুদ্বেগে ছুটে গেল পরপর কয়েকটা ফ্রেইট ওয়্যাগন। ওগুলো চলে যাবার পর র্যাঞ্চারদের আবার দেখতে পেল ওরা। শহরের শেষ মাথায় শাখা প্রশাখা বিস্তার করে রাতের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল সেই কালো কটনউডের কাছে পৌঁছে গেছে খেপা লোকগুলো; জটলা করে এখন ফাঁসির আয়োজন করছে।
বেনন আর ব্যাগলে পৌঁছাবার আগেই নিচের একটা ডালে দড়ি ঝুলিয়ে দেয়া হলো। ওরা দেখল লটকে দেয়া হয়েছে মানুষটাকে। আঁধারে দড়িটা দেখতে পাচ্ছে না বলে গুলি করে ছিঁড়ে দিতে পারল না বেনন।
দেরি হয়ে গেল, বেনন! আফসোস করে বলল ব্যাগলে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে ওরা। লোকগুলো এখনও ফুট বিশেক দূরে; ঝুলন্ত দেহটা দেখছে সবাই। উদ্যত অস্ত্র হাতে তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা।
নামাও ওকে! খেপাটে চেহারায় গর্জন ছাড়ল ব্যাগলে। পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে সে, বারকয়েক দ্রুত শ্বাস নিয়ে আবার বলল, যা বলছি করো তাড়াতাড়ি! বলে দিচ্ছি গুলি করব কিন্তু আমি…
মাঝপথেই থেমে গেল ওর হুমকি, থতমত খেয়ে চুপ করে গেল ব্যাগলে। এই প্রথম তাকিয়েছে ও ঝুলন্ত দেহটার দিকে। এতক্ষণে বুঝতে পারল অস্ত্র বের করেও বেনন নিচুপ হয়ে থোকার মত দাঁড়িয়ে আছে কেন।
খড় দিয়ে বানানো একটা পুতুলকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে র্যাঞ্চাররা। ঝোলানোর আগে পুতুলটাকে পরিয়ে নিয়েছে কালো কোট-প্যান্ট।
কে এই লোকটা? সবাই ওকে দেখছে বুঝতে পেরে ঢোক গিলে জানতে চাইল ব্যাগলে।
ফিলিপ হারমান, জবাব দিল রাগী চেহারার বয়স্ক একজন মোটাসোটা লোক।
কি করেছিল সে?
ওই লোকটা, আঙুল তুলে পুতুলটাকে দেখাল র্যাঞ্চার, ওইটা হচ্ছে ফিলিপ হারমানের প্রতিকৃতি-টেইলহল্টের ব্যাঙ্কার ছিল লোকটা, আমরা ওকে বিশ্বাস করে টাকা জমা রেখেছিলাম; বিশ্বাসের মর্যাদা না রেখে পালিয়ে গেছে সে সমস্ত টাকা নিয়ে। ধরা পড়লে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতাম, কিন্তু ধরা পড়েনি; তাই গত তেরো বছর ধরে ওকে সেরাতের স্মরণে লটকে দিয়ে সান্ত্বনা পাচ্ছি। একটু থামল সে, তারপর জানতে চাইল কুঁচকে, তোমার কোন অসুবিধা করেছি নাকি আমরা?
ভিড়ের মধ্যে আরও কয়েকজনের দৃষ্টিতে রাগের ছাপ দেখতে পেল বেনন। উড়ে এসে জুড়ে বসা উটকো এই আগন্তুকদের মোটেই পছন্দ হয়নি, মারমুখী একটা ভঙ্গি তাদের আচরণে। মানে মানে সরে পড়ার জন্যে মিষ্টি একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ব্যাগলেকে চোখ টিপল বেনন। হাতে টান দিয়ে বলল, চলো, ব্যাগলে, বুড়ো খোকা, বোকা বনেছি আমরা।
কৌতূহল মেটেনি, তবু বিপদ বুঝতে পেরে সরে এলো ব্যাগলে। লোকগুলোকে হয়তো অস্ত্রের মুখে ঠেকিয়ে দেয়া যেত, কিন্তু ফাস হয়ে যেত ওদের উপস্থিতি, সেক্ষেত্রে রেলওয়ের হয়ে গোপনে কাজ করার আশা ছাড়তে হত।
একবারও পেছনে না তাকিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগল ওরা। রেল দালানের কাছে এসে দেখল অফিস বন্ধ। জানালা থেকে আলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। অগত্যা, বাধ্য হয়ে হোটেলে ফিরল ওরা। একটা কথাও বলছে না, গম্ভীর চেহারায় কি যেন ভাবছে বেনন। বোকা বনে ব্যাগলে এত মুষড়ে পড়েছে যে সেলুনে ঢুকে দু’ঢোক গেলার কথাও ভুলে গেল।
ওদের ঘরটা পশ্চিমের আর সব কমদামী হোটেলের মতই সাদামাঠা। ঘরের দুপাশে দেয়াল ঘেঁষে দুটো নড়বড়ে খাট পড়ে যাবার অপেক্ষায় দিন গুনছে। চেয়ার দুটোর বয়স আরও বেশি, ওগুলো খাটের দাদার বয়সী। দরজার পাশে একটা ব্যুরো, সেটার ওপর রাখা আছে একটা পিচার আর হাজারো ট্যাপ খাওয়া একটা ছাতাপড়া গামলা। ঘরে একটা টেবিল রাখার জায়গা ছিল, কিন্তু হোটেল মালিকের বদান্যতায় সেটা নেই।
বাতি জ্বেলে খাটের দিকে পা বাড়িয়েও থেমে যেতে হলো বেননকে। জুতোর ফিতে খোলার জন্যে ঝুঁকেও থমকে গেল ব্যাগলে। রীতিমত বিস্ফোরিত হয়েছে দরজাটা ওদের পেছনে। চমকে ঘুরে তাকাল ওরা। ভাবতেও পারেনি এদৃশ্য দেখতে হবে।
বিরাট লম্বা এক চাবুক উঁচিয়ে দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে রণরঙ্গিণী এক যুবতী। খুবই বেমানান লাগছে চাবুকটা ওই পেলব হাতে, কিন্তু প্রথম দর্শনে ওটা কেউ খেয়াল করবে না। অপরূপা বলতে যা বোঝায় মেয়েটা আসলেই তাই। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সবকিছু ধীরেসুস্থে অতি যত্নে অবসর সময়ে তৈরি করেছেন ঈশ্বর; তৈরি করার পর নির্ঘাত শিল্পটিকে দেখেছেন বিভোর হয়ে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকল ওরাও।
প্রেমে পড়েনি বেনন কখনও, এতদিন একা কাটিয়েছে, হাজারো বিপদের মোকাবিলা করেছে, তোয়াক্কা করেনি বন্ধুদের টিটকারির, ভেবে এসেছে প্রেম ব্যাপারটা সবার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ার মতই লজ্জাজনক; প্রেমে মানুষ পড়ে, কিন্তু ওঠেনি কেউ আজ পর্যন্ত; অন্তত উঠেছে বলে বেননের জানা নেই। কিন্ত বেনন আজ, এই মুহূর্তে, নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে; হ্যাঁ, এই মেয়ের জন্যে এক মুহূর্তের একটি সিদ্ধান্তে, হাসিমুখে জীবন দিয়ে দেয়া যায়।
একমাথা অবিন্যস্ত কালো চুল, ধনুকের মত ভ্রূ; অচিন্তনীয় আঁখি পল্লব, সাগরের মত গভীর মায়াবী কালো দু’চোখে অতল জলের রহস্যময়তা; নিখুঁত পান পাতার মত মুখে কঠোরতা লজ্জা পেয়ে কোথায় কোন্ অজানায় লুকিয়ে গেছে স্বয়ং ঈশ্বরও বুঝি তা বলতে পারবেন না। কমলার কোয়ার মত দু’ঠোঁটে হাসি ফুটলে বিশ্বসেরা হীরের মত দ্যুতি ছড়াত, কিন্তু দেবীর দয়া হয়নি, যে কারণেই হোক, এমুহূর্তে ভীষণ রেগে আছে সে। ছোটবেলায় একটা মেয়েকে পছন্দ করত, মন দিয়ে চাইত বেনন; সাধনা করত; আজ ওর হঠাৎ করেই কেন কে জানে মনে হলো সেই মেয়েটা বড় হয়ে ঠিক এমনি করেই শাসন করত ওকে, কিছুতেই নষ্ট হয়ে যেতে দিত না, সমাজের মুখে থুতু দিয়ে দখল করে নিত ভালবাসার মানুষটিকে। কোনদিন সাহস করে বলার সুযোগ পায়নি বেনন সেই মেয়েটিকে নিজের ভাল লাগার কথা; অপরাধীর ছেলে হিসেবে সমাজে ও নিজেও ছিল বিনা দোষে অপরাধী, জানত প্রেম নিবেদন করলে অবহেলা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। করুণা চায়নি বেনন, সান্তনা চায়নি; নীরবে দেখেছে প্রতিষ্ঠিত মানুষের ছেলেরা কিভাবে মেয়েটিকে অর্থ-বিত্ত প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখিয়ে প্রভাবিত করে। রাতের পর রাত কেঁদেছে বেনন, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাকাই যদি সব হয় তাহলে অনেক টাকা রোজগার করবে ও, তারপর ফিরে গিয়ে দাঁড়াবে মেয়েটির মুখোমুখি, তখনও যদি অবিবাহিত থাকে তো বলবে ওকে সে ভালবাসে, শত ভুলের পরেও নিজেকে শুধরে নিয়েছে ও শুধু ওরই জন্যে; আর যদি ফিরে গিয়ে দেখে মেয়েটি ঘর-সংসার করছে, একটি কথাও বলবে না ও, দূরে সরে যাবে নীরবে, ভাববে এই পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর।
বেশ। বাতাসে ফুটল চাবুক। জিনিসটা কোথায়?
কি জিনিস? চমক কাটিয়ে উঠে সমস্বরে জানতে চাইল বেনন আর ব্যাগলে।
আবার কথা! কণ্ঠ অতি সুরেলা হলেও কড়া এক ধমক দিল অপ্সরী। স্পারটা কোথায়?
কিসের স্পার?
গোঁফে তা দিতে গিয়ে তাড়াতাড়ি হাত ফিরিয়ে নিল ব্যাগলে। ওর নাকের পাশ ঘেঁষে বাতাসে শিস কেটে ঘুরে গেল চাবুকটা।
আমি ডেইজি হ্যাটার, বলল যুবতী, শহরে এসে জানতে পারলাম আমার খালার কাছ থেকে স্পারটা তোমরা চুরি করেছ। স্টেজ কোচে ছিলে তোমরা তাঁর সঙ্গে; তোমরাই ব্যাগ খুলে ওটা সরিয়েছ। আমি জানি তোমাদের মধ্যে একজন আউট-ল ছিলে।
ডক্টর ওয়াং, তিক্ত চেহারায় বলল বেনন।
আমার ধারণা কাজটা তোমাদের। একজন ডক্টর কখনোই বয়স্কা কোন অসহায় ভদ্রমহিলার সঙ্গে এধরনের নোংরা রসিকতা করবে না। আঘাত হানার জন্যে চাবুকটা গুটিয়ে নিল মেয়েটা। স্পারটা এতই দরকার ছিল যে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও ডাকাতদের ঠেকিয়েছ তোমরা। কড়া চোখে বেননকে দেখল যুবতী। লজ্জা করে না মেয়েমানুষের জিনিস কেড়ে নাও? বেনন, কথা বলার জন্যে হাঁ করতেই হাত তুলে থামিয়ে দিল। শেষ একটা সুযোগ দিচ্ছি, স্পারটা ফেরত দাও, নইলে চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেব।
আরে, আরে করে কি! আঁতকে উঠল ব্যাগলে মেয়েটাকে চাবুক তুলতে দেখে।
০৩. ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা নিয়েছেন
ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা নিয়েছেন তারা জানেন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সবসময় সমঝোতা হয় না, এমন, একটা সময় আসে যখন কামানের গর্জনই বিবাদ মীমাংসার একমাত্র উপায়। বেনন যদিও ইতিহাসের ইতিবৃত্তে কখনও নাক গলায়নি, তবুও এই মুহূর্তে বুঝতে ওর দেরি হলো না যে এখনই সেই কামান গর্জে ওঠার মুহূর্ত। এই মেয়ে দুই আর দুইয়ে চার মিলিয়ে বসেছে, যুক্তি-তর্কে কোন কাজ হবে না; তিন আর একেও যে চার হয় তা কে বোঝাবে একে।
অন্তরের গভীর থেকে চামড়া বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করল বেনন। মেয়েটাকে একবার দেখে নিয়ে চোখে চোখে ব্যাগলের সঙ্গে কথা সেরেই ব্যুরোর ওপর রাখা লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিতে ঝাপিয়ে পড়ল সে। শপাং করে ওর শার্টের পিঠ থেকে ধুলো ওড়াল ডেইজির চাবুক। দাঁতে দাঁত চেপে, জ্বলুনি সহ্য করে ফু দিয়ে ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল বেনন। ঘর অন্ধকার হয়ে যেতেই গড়িয়ে সরে গেল ব্যুরোর কাছ থেকে। ধুপধাপ আওয়াজে বুঝল ব্যাগলেও পৈত্রিক প্রাণটা বাঁচাতে অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাতাসে শিস কেটে এখানে ওখানে ছোবল মারছে ডেইজির চাবুক।
শব্দ লক্ষ্য করে লাফ দিল বেনন; মেয়েটার দু’পা আঁকড়ে ধরে হ্যাচকা টানে ফেলে দিল ছালবাকলা ওঠা কার্পেটের ওপর। এক হাতে পতনের গতি কমাল সে। খেয়াল রাখল যাতে মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যথা না পায়। মুঠোর মধ্যে ডেইজির দু’হাত আটকে ফেলে কেড়ে নিল চাবুক। তারপর মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বাতিটা জ্বালো, ব্যাগলে!
তুমি ঠিক জানো, বিপদ হবে না তো? অন্ধকার থেকে ব্যাগলের সাবধানী প্রশ্ন ভেসে এলো। আমার কিন্তু কয়েকটা গোঁফ কেটে নিয়েছে ওই মেয়ে!
জ্বালো।
বাতি জ্বলে ওঠার পর এলোচুল ডেইজির দিকে তাকাল বেনন। শক্ত হাতে মেয়েটাকে ধরে রেখেছে যাতে নড়াচড়া করতে না পারে।
দেখো, তোমার খালার স্পার আমরা নিইনি। কোচে আরও একজন ছিল, কাজটা তার হতে পারে। আঁধার নামার পর হয়তো ব্যাগ হাতড়ে জিনিসটা নিয়ে নিয়েছে। ব্যাগলে মেঝে থেকে চাবুকটা তুলে হাতে নেয়ার পর মেয়েটাকে ছেড়ে দিল বেনন। পিঠ জ্বলছে এখনও, তবু যতটা সম্ভব নরম গলায় বলল, মিস ডেইজি, আশা করি তুমি আমাদের সমস্যা বুঝতে পেরেছ; যে জিনিস নেই তা আমরা দেব কোত্থেকে। তুমি চাইলে আমার স্পার তোমাকে দিতে পারি, কিন্তু তাতে তোমার কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না। জানোই তো অনেক দূর থেকে এসেছি, আমাদের বিশ্রাম প্রয়োজন, তুমি বিদায় না নিলে আমরা ঘুমাতে পারছি না…তুমি কি স্বেচ্ছায় যাবে, না হোটেল কর্তৃপক্ষকে ডাকতে হবে?
বেশ, এবার তোমরা জিতলে, চোরের দল, হিসহিস করে বলল ডেইজি। অপমানে জল চলে এসেছে দু’চোখে।
ব্যাগলে, চাবুকটা জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দাও, নির্দেশ দিল বেনন। আমাদের ভদ্রমহিলা বাড়ি যাওয়ার পথে ওটা কুড়িয়ে নিতে পারবে।
বিনা বাক্যব্যয়ে নির্দেশ পালন করল ব্যাগলে। জ্বলন্ত চোখে ওদের দুজনকে একবার দেখে নিয়ে বাতাসে ঝড় তুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ডেইজি হ্যাটার।
আমাদের উইটিগোতে আসা উচিৎ হয়নি, বেনন। গোঁফে হাত বুলিয়ে আফসোস করে বলল ব্যাগলে। এশহরে মহিলা জাতিও হিংস্র হয়ে উঠেছে।
কিছুক্ষণ চিন্তা শেষে ব্যাগলের দিকে তাকাল বেনন। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি। তুমি ঘুমোবার চেষ্টা করো, বুড়ো শেয়াল।
আমি সাংঘাতিক দুঃখ পাব পরে যদি জানি আমাকে না জানিয়ে গোপনে তুমি মেয়েটার পিছু নিয়েছ। তেমন কিছু করার কথা তোমার মাথায় নেই তো, বেনন? আমার কেন যেন মনে হলো মেয়েটাকে তুমি দরকারের চেয়ে বেশি সময় ধরে রেখেছিলে।
অত সাহস নেই আমার, ওই মেয়েকে দশ ফুটের মধ্যে দেখলেও দৌড়ে গিয়ে সবচেয়ে উঁচু কটনউড গাছের মাথায় উঠব। নির্বিকার চেহারায় মিথ্যে বলে দরজার দিকে পা বাড়াল বেনন। আসলে ডেইজিকে দেখার সুযোগ পেলে দু’চোখ ভরে দেখে নেবে ও। ঘুমাও তুমি। আমি যাচ্ছি স্টেজ স্টেশনে; দেখি স্পার রহস্যের সমাধান করা যায় কিনা।
আধঘণ্টা পর ঘরে ফিরল বেনন। ডাকছে ব্যাগলের নাক। অর্ধেকের বেশি বিছানা জুড়ে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে ঘুমে বিভোর হয়ে। জাগাল না ওকে বেনন। বাতি নিভিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা সারার পর ব্যাগলেকে বলল ও কোথায় গিয়েছিল কাল রাতে।
তাহলে স্টেজ স্টেশনে গিয়ে স্টেজটা পেলে তুমি; জানালার চৌকাঠে একটা ফাঁক ছিল, সেখানে পাওয়া গেল সাদা সিল্কের রুমাল, তো কি হলো? বেনন থামার পর জানতে চাইল ব্যাগলে।
মনে নেই ডক্টর ওয়াঙের হাতে একটা সাদা রুমাল ছিল?
তারমানে জানালা দিয়ে হাত বের করে ডাকাতদের ইশারা করছিল লোকটা?
অবশ্যই। ওয়াং এত বোকা নয় যে যার-তার কথা বিশ্বাস করে মাইলের পর মাইল হাঁটবে। আমার ধারণা কোচে মিস হ্যাটার আছে নিশ্চিত হতে বদমাশগুলোর সঙ্গেই ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে এসেছে সে, তারপর কোচ থামিয়ে ভান করেছে যে ঠকিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। ওয়াঙের সঙ্গীরা আরও সামনে অপেক্ষা করছিল, সে ইশারা করতেই এসে হাজির হয়েছে তারা।
তারপর আমরা যখন ওদের তাড়িয়ে দিলাম বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে স্পারটা গায়েব করে দিল ওয়াং।
সায় দিল বেনন। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ, কোচের দিকে কোন গুলি ছোড়েনি ওরা। আমার কাছে খটকা লাগলেও তখন গোলমালের মধ্যে ঠাহর করতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি কোচের মধ্যে ওয়াং ছিল বলেই ওরা পাল্টা আক্রমণ করেনি।
ওয়াং এখন কোথায় বলে তোমার ধারণা? ছেড়া গোঁফের প্রান্তে আলতো করে আঙুল বোলাল ব্যাগলে। ওর দু’চারটা যা দাড়ি আছে মুঠো করে ছিঁড়ে ফেলব আমি।
জানি না, খোঁজ নিয়ে দেখেছি, অন্তত এই হোটেলে ওঠেনি। কাঁধ চাপড়ে ব্যাগলেকে সান্ত্বনা দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল বেনন। ওয়াংকে হাতে পাবার চিন্তা বাদ দিয়ে চলে এসো রেল অফিসে যেতে হবে আমাদের।
পাঁচ মিনিটের মাথায় কাঠের বিল্ডিঙের দোতলায় উঠে এলো ওরা। সিঁড়ির গোড়াতেই অ্যান্টিরূম। সেখানে একটা ডেস্ক ফেলে নিজের চেয়ে বেশি ওজনের চশমা নাকে চাপিয়ে বসে আছে রুগ্ন এক ফ্যাকাসে ক্লার্ক। চেহারায় তার রাজ্যের উদাসীনতা; মশা মাছি দেখছে এমন অবহেলার ভঙ্গিতে ওদের দেখল লোকটা।
মার্লোন ব্র্যান্ডন অফিসে আছে? জানতে চাইল বেনন। কনফারেন্স চলছে, পরে আসতে হবে তোমাদের।
ধন্যবাদ। ক্লার্ককে পাত্তা না দিয়ে ঘরের ভেতর দিকের দরজা লক্ষ্য করে পা চালাল বেনন। লোকটা চমক সামলে বাধা দেয়ার আগেই ব্যাগলেকে পাশে নিয়ে পৌঁছে গেল সে দরজার কাছে। দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
চল্লিশ বাই বিশ ফুট একটা ঘর। মাঝখানে লম্বা একটা কনফারেন্স টেবিল। চলছে কনফারেন্স; টেবিলের এক মাথায় বসেছে কালো মখমলের লর্ড ফন্টলরয় স্যুট পরা দেবতার মত সুন্দর একটা বাচ্চা ছেলে; আরেক মাথায় পেটমোটা এক টাকমাথা মাঝবয়সী লোক নতুন চেয়ারটার বারোটা বাজাচ্ছে। টেবিলের দু’পাশে বসেছে আরও দু’জন লোক। তাদের একজন। যুবক; গায়ের রং রোদে পোড়া বাদামী, পরনে চমৎকার স্যুট, দেখতেও সুদর্শন; অপরজন চোয়ালের হাড় বের হওয়া লম্বাটে চেহারার রোগা এক লোক। কাঁধ দুটো ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে, চুলগুলো পাতলা হয়ে আসায় দেখতে তাকে প্রায় কুৎসিত দেখাচ্ছে।
যুবকের ওপর স্থির হলো বেননের দৃষ্টি। এই মুহূর্তে বিরক্ত হয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেও যুবকের আচরণে একটা সহজ স্বাভাবিকতা আছে, লোকটাকে ভাল লাগল ওর। আগে কখনও দেখেনি, আন্দাজ করল এই লোকই মার্লোন ব্র্যান্ডন।
আমি রক বেনন, তার সামনে দাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিল বেনন। ব্যাগলেকে দেখিয়ে বলল, এ আমার বন্ধু হিরাম ব্যাগলে।
কালকের পোশাকটাই আজও পরে আছে ব্যাগলে। সেই হ্যাট-কোট-প্যান্ট আর হলুদ বোতাম লাগানো সাদা বুট জুতো। জুতোর ফাঁকটা আজ আরও বড় হয়েছে; শার্টটা খানিক ময়লা।
অসম্ভব! এ লোক হিরাম ব্যাগলে হতে পারে না, বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলল মার্লোন।
আমি নিজেই কি আর বিশ্বাস করতে পারছি? দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্যাগলে। বাধ্য হয়ে আমাকে এই বেশ ধরতে হয়েছে, নইলে পেছনে মেয়েদের মিছিল দেখতে পেতেন।
স্যার, দরজার কাছ থেকে ব্র্যান্ডনকে ডাক দিল ক্লার্ক। এখন তার গলায় মধু ঝরছে। স্যার, এরা আপনার পরিচিত? আমি নিষেধ করার পরও জোর করে ঢুকে পড়েছে।
হ্যাঁ, পরিচিত। হাতের ইশারায় ক্লার্ককে বিদায় করে ব্যাগলের দিকে তাকাল ব্র্যান্ডন। ব্যাপার কি?
জবাব দিল বেনন, ওরা ছদ্মবেশে আসতে বলেছিল, তাই ছদ্মবেশ নিয়েছে ব্যাগলে।
অমানুষিক…মানে অবিশ্বাস্য, সশব্দে শ্বাস ছেড়ে মার্লোনের দিকে তাকাল টাকমাথা। কারা এরা, ব্র্যান্ডন?
উঠে দাঁড়াল যুবক। এতক্ষণে বোঝা গেল সুঠাম দেহ তার। লম্বায় প্রায় বেননের সমান। পরিচয়ের পালাটা সেরে ফেলা যাক। হাত বাড়িয়ে বেনন আর ব্যাগলের সঙ্গে করমর্দন করল সে। আমি মার্লোন ব্র্যান্ডন। টাকমাথাকে দেখিয়ে বলল, ইনি হচ্ছেন ভাউবয়েস সি. ভাউবয়েস নোয়াক; মন্ট্যানা সেন্ট্রালের তৃতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাঁর বিশেষ দয়া, আমাদের সমস্যা বুঝতে নিজেই চলে এসেছেন। এবার টাকমাথার দিকে তাকাল মার্লোন। মিস্টার ভাউবয়েস, গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে লোক দরকার। আমরা আলোচনা করেছিলাম; আপনি সম্মতি দিয়েছিলেন; এরাই সেই লোক।
ভাউবয়েসের উল্টোদিকে বসে থাকা ছেলেটার বয়স খুব বেশি হলে বারো। এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার নাক সিঁটকে তাকাল; চেহারা থেকে খসে পড়ল দেবতা সুলভ পবিত্রতা। বলল, নাহ, এদের গোয়েন্দা হবার উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে না!
ছিহ্, ফ্র্যাঙ্ক! ভদ্রতার খাতিরে ছেলেকে ধমক দিল ভাউবয়েস, তারপর বেননের দিকে মোটা গর্দানটা ফেরাল। ফ্র্যাঙ্কের ব্যবহারে আমি দুঃখিত, জেন্টেলমেন।
আপনার ছেলে বুঝি? জানতে চাইল ব্যাগলে।
হ্যাঁ, রেলওয়ের কাজ দেখাতে ওকে নিয়ে এসেছি; একদিন আমার চেয়ারে বসে মন্ট্যানা সেন্ট্রালকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ও।
তার আগেই ওকে ভদ্রতা শেখানো দরকার, মন্তব্য করল গম্ভীর ব্যাগলে।
অস্বস্তির ছাপ পড়ল ভাইস প্রেসিডেন্টের চেহারায়। মিস্টার ব্যাগলে, আমি আর আমার স্ত্রী বিশ্বাস করি বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে বাধা দেয়া উচিত নয়।
এই দুই ভদ্রলোক আসলেই আমাদের কাজে আসবেন কিনা বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি, এই প্রথম মুখ খুলল রোগা ভদ্রলোক।
ইনি হচ্ছেন হ্যারি হুলাহান; টেইলহল্টের ব্যাঙ্কার, তাড়াতাড়ি করে বলল ব্র্যান্ডন, ইনি সাহায্য না করলে স্পার তৈরির কথা চিন্তাও করতে পারতাম না আমরা। আর মিস্টার হুলাহান, আপনি বোধহয় নাম শুনেছেন; আমাদের সামনে দাঁড়ানো এই ভদ্রলোক স্বনামখ্যাত রক বেনন। আর তার সঙ্গী ভদ্রলোক হিরাম ব্যাগলে, একসঙ্গে কাজ করেন তাঁরা।
হ্যাঁ, নাম শুনেছি; ছবিও দেখেছি ডাকঘরে, ধীরে ধীরে বলল ব্যাঙ্কার। ওয়ান্টেড পোস্টার ছিল রক বেননের নামে। হিরাম ব্যাগলের পোস্টার যদিও দেখিনি, আমার ধারণা সে-ও একই পথের পথিক। কেউ যদি আমার ব্যক্তিগত অভিমত চায়, আমি বলব গভর্নর ক্ষমা করলেও আউট-লদের কাজে নেয়াটা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না।
আউট-ল? কৌতূহলে চকচক করে উঠল কিশোর ফ্র্যাঙ্কের চোখ। তাই যদি হবে তাহলে ওদের মুখোশ কোথায়?
দেখো, ব্র্যান্ডন, এখানে আমরা মানুষের সমালোচনা শুনতে আসিনি, খানিকটা অধৈর্য হয়ে বলল বেনন। এদের মনোভাব মোটেই পছন্দ হচ্ছে না ওর; এসেছিল খাতির করে কাজে নেয়া হবে আশা করে, এখন দেখা যাচ্ছে ওদের যোগ্যতা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছে, খাতির করা দূরের কথা। ব্র্যান্ডন হাঁ করতেই হাত তুলে খামিয়ে দিল বেনন। ল্যাটিগো বেসিনে আমাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মন্ট্যানা রেলের কর্মকর্তা ম্যাকমিলানের; তার অনুরোধেই আমরা এসেছি; তোমাদের যদি ধারণা হয়ে থাকে ঠেকায় পড়ে চাকরি খুঁজছি, তাহলে ভুল ভেবেছ। ঘুরে দাঁড়াল বেনন। চলো, ব্যাগলে, আমাদেরকে এদের দরকার নেই।
দাঁড়াও! পেছন থেকে চেঁচাল ব্র্যান্ডন। চট করে একবার দেখে নিল ব্যাঙ্কারকে। বলল, আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, মিস্টার হুলাহান; বিশেষ করে পাগলা হ্যাটারকে জমির ব্যাপারে রাজি করানো আপনাকে ছাড়া ছিল অসম্ভব, আমি আপনার সহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে চাই না; তবে…
আমি সাহায্য করছি কারণ রেল চললে উইটিগোর উন্নতি হবে, সেই সঙ্গে বাড়বে আমার ব্যাঙ্ক ব্যবসা, বলল হ্যারি হুলাহান। আপনাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে নাক গলাতে চাই না, শুধু এটুকু বলব, মাত্র ক’দিন আগেও যারা বেআইনী কুকীর্তি করে বেড়াত, তাদেরকে বিশ্বাস করে কাজে নেয়া উচিৎ হবে কিনা এব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
আমরা এখানে আইন বিরোধী একদল বদমাশের মোকাবিলা করছি, শান্ত স্বরে বলল ব্র্যান্ডন। ম্যাকমিলানের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে ও বেনন আর ব্যাগলেকে পাঠিয়েছে। ওদের যদি এখন আমরা চলে যেতে দিই পরে পস্তাতে হবে এ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। মজুরদের বেতন কেড়ে নিচ্ছে ডাকাতের দল, রাত বিরাতে হামলা করে ভয় দেখাচ্ছে, বিনা বাধায় নষ্ট করছে আমাদের সম্পত্তি-এসব বন্ধ করতে হবে। কে করবে বন্ধ? ডাকাতদের হটিয়ে দেয়া কোন দুধে ধোয়া তুলসী পাতার কাজ নয়; বেনন আর ব্যাগলের এধরনের কাজে অভিজ্ঞতা আছে, ওদের মত মানুষই আমাদের প্রয়োজন। বেননের দিকে তাকাল ব্র্যান্ডন। একটানা কথা বলার পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে মৃদু মৃদু। একটু থেমে বলল, ম্যাকমিলানের কাছে আমি কৃতজ্ঞ কারণ সে তোমাদের পাঠিয়েছে; তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ কারণ তোমরা দয়া করে এসেছ। এখন যদি কাজটা তোমরা দয়া করে নাও আমি ঋণী হয়ে থাকব।
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল ভাউবয়েস। আমি বুঝতে পারছি না কি করা উচিত। মিস্টার হুলাহানের কথায় কিন্তু যুক্তি আছে।
এবার সত্যিই রেগে গেল মার্লোন ব্র্যান্ডন। থমথমে গলায় বলল, দেখুন মিস্টার ভাউবয়েস, এটা আপনার শিকাগোর অফিস নয় যে ডেস্কে বসে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আপনি আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবে ওদের আমি নিয়োগ দিতে চাই… অবশ্য ওরা যদি চাকরি নিতে রাজি থাকে।
সিদ্ধান্ত নিতে কোনদিনই দেরি করে না বেনন, এবারও দেরি হলো না। ব্যাগলে ভ্রূ কুঁচকে চেহারায় অসম্মতি নিয়ে চেয়ে আছে দেখেও বলল, আমি রাজি। আজ থেকেই কাজে লেগে পড়ব আমরা।
ব্যাঙ্কারের চেহারায় কোন পরিবর্তন আসে কিনা লক্ষ করে দেখল বেনন। এ কাজটা নিত না ও কিছুতেই, নিয়েছে শুধু ব্যাঙ্কারের বিরোধিতা, করার জন্যে। লোকটা ওদের অপমান করেছে, কাজেই পাত্তা না দিয়ে পাল্টা অপমান করার অদম্য ইচ্ছে চাপতে পারেনি বেনন। এখন একটু হতাশই লাগল ওর; হ্যারি হুলাহানের লম্বাটে চেহারায় কোনরকমের কোন অভিব্যক্তি নেই।
তাহলে আমরা এখন একই নৌকার যাত্রী, নীরবতা ভাঙল ব্যাঙ্কার। মিস্টার ব্র্যান্ডন চাকরি দিলে আমার কাছ থেকে সহায়তা পাবে তোমরা।
তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, শুকনো গলায় বলল বেনন।
ব্যাটার লম্বা নাকটা মেঝেতে ঘষে দেয়ার জন্যে কাজ নেয়ার কোন দরকার ছিল না, নিচু গলায় জানাল ব্যাগলে।
ব্র্যান্ডনের উদ্দেশে বলল বেনন, এখানে কি ধরনের গোলমাল চলছে তার মোটামুটি একটা ধারণা দিয়েছেন আপনি; বুঝতে পারছি কাজ এগিয়ে নিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। আমাদের সুবিধা হবে তেমন আর কোন তথ্য আছে আপনাদের কাছে?
একটা ব্যাপার… শুরু করেও থেমে গেল ব্র্যান্ডন।
কি?
‘ডায়নোসর।’ হঠাৎ খুব ক্লান্ত দেখাল যুবককে। চেয়ারে বসে পড়ল ধপ করে। বেননের চোখে বিস্ময় দেখে ধীরে ধীরে মাথা দোলাল। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, না; পাগল হয়ে যাইনি, সত্যি একপাল ডায়নোসর আমাদের পাগল করে ফেলার জোগাড় করেছে। কি করব কেউ কিছু বুঝতে পারছি না…এই যুগে ডায়নোসর…
০৪. বড় একটা ম্যাপ টেবিলের ওপর
বড় একটা ম্যাপ টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিল ব্র্যান্ডন। এক জায়গায় আঙুল ঠুকে বলল, এই যে এখানে দেখুন।
রেলওয়ের ম্যাপ ওটা; দেখাচ্ছে দক্ষিণ-পুব দিক থেকে ঢুকেছে লাইন, টেইলহল্ট পেরিয়ে চলে গেছে উত্তর-পশ্চিমে পাহাড়ের দিকে।
উত্তর-পশ্চিমে এই জায়গাতে আছে অনেকগুলো ক্যানিয়ন, বলে চলল ব্র্যান্ডন। আপাতত এখানে লাইন বসাচ্ছি আমরা। এর পরে আসবে হ্যাটারের র্যাঞ্চ; তারপরে উইটিগো আর পরফাইরি। হ্যাটার মন্ট্যানা সেন্ট্রালের কাছে জমি বেচবে না বলে হুমকি দিচ্ছে, তবে এটা আমাদের বড় সমস্যা নয়; মিস্টার হুলাহান কথা দিয়েছেন তিনি হ্যাটারকে রাজি করাবেনন। আমাদের আসল সমস্যা ক্যানিয়ন পেরনোয়। ওখানে হামলা করছে ডায়নোসর।
হ্যাটারের র্যাঞ্চের ধার ঘেঁষে এই গোল চিহ্নটা কিসের? ম্যাপে চোখ বুলিয়ে নিয়ে জানতে চাইল বেনন।
ওটা একটা টিলা। চিহ্নের ওপর আঙুল রাখল ব্র্যান্ডন। ওই টিলাই হচ্ছে উইটিগো যাবার পথে শেষ বড় বাধা। আমাদের এঞ্জিনিয়াররা অবশ্য মাসখানেক আগেই ঠিক করে ফেলেছে কি করবে। টিলার মাঝ দিয়ে টানেল খুঁড়ে লাইন এগিয়ে নিয়ে যাব আমরা।
অসম্মতির সঙ্গে মাথা নেড়ে হ্যারি হুলাহান বলল, আমার মনে। হয় না কাজটা উচিত হবে। এঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে আমার ধারণা নেই; তবে হ্যাটারকে আমি চিনি; যতই বোঝাই না কেন ঝামেলা করবে লোকটা। সবচেয়ে ভাল হয় যদি হ্যাটারের র্যাঞ্চ আর ওই টিলাটা এড়িয়ে যাওয়া যায়।
তাতে আমাদের খরচ অনেক বেশি পড়বে, আপত্তির সুরে বলল ভাউবয়েস সি ভাউবয়েস নোয়ক,
তারপরও আমি বলব সেটাই ভাল হবে।
আচ্ছা, প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল বেনন, এই ডায়নোসরগুলো কি ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে?
ওগুলোর ভয়ে কাজ ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে আমাদের চাইনিজ শ্রমিকরা, থমথমে চেহারায় বলল ব্র্যান্ডন। নিরক্ষর কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকগুলোর ধারণা এলাকাটা অশুভ, ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে ওদের যদি ড্রাগন দেবতার রোষে পড়ে। দেবতা চাইছেন না ওখানে ওরা কাজ করুক, তাই বারবার এমন করে দেখা দিচ্ছেন; ঝড়ের রাতে এসে বুঝিয়ে দিচ্ছেন প্রলয়ঙ্করী কাণ্ড ঘটবে ওরা তাঁর নির্দেশের অবাধ্য হলে। প্রথমে আমি পাত্তা দিইনি গুজব মনে করে, কিন্তু আমার কন্সট্রাকশন বস মার্ক ল্যান্সেলো যখন বলল সে-ও দানবগুলোকে দেখেছে তখন গুরুত্ব দিতেই হলো। মার্ক শিক্ষিত সাহসী লোক, তারওপর মারাত্মক গোয়ার, চট করে তাকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়।…একটা স্কেচ এঁকে দিয়েছে সে আমাকে। স্কেচটা দেখে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়েছে আমার। একটা টাইরানোসরাস এঁকেছে লোকটা! কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গেও আলাপ করেছি; ওদের বর্ণনা শুনে মনে হলো ওরা দেখেছে ব্রনটোসরাস।
মাথা থেকে ডারবি হ্যাট নামিয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল ব্যাগলে। এই মাত্র বলছিলে ডায়নোসরের কথা, এখন আবার বলছ অন্য কি সব ব্রনটো টাইরানো আরও কি কি যেন; ব্যাপারটা কি, বোকা মনে করেছ আমাদের? মনে করেছ একটা কিছু বুঝিয়ে দিলেই চলবে?
মেসোযোয়িক যুগের অতিকায় সরীসৃপদের বলে ডায়নোসর, বিরক্তির সঙ্গে বলল পিচ্চি ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক। শব্দটা এসেছে গ্রীক ভাষা থেকে; মানে হচ্ছে ভয়াবহ গিরগিটি। ডায়নোসর অনেক ধরনের আছে; যেমন, কারনিভোরাস বাইপেডসদের মধ্যে টাইরানোসরাস, হারবিভোরাস কোয়াড্রপেডসদের মধ্যে ব্রনটোসরাস, তারপর ইগুয়াডন, আঁশওয়ালা স্টেগোসরাস, ডাইমেট্রোডন আরও কত রকমের সরীসৃপ যে আছে বলে শেষ করা যাবে না।
সর্বনাশ! ফিসফিস করে বেননকে বলল ব্যাগলে, শুনেছ। অতটুকু একটা বাচ্চার মুখ থেকে কি ভয়ানক কঠিন সব শব্দ বের হচ্ছে!
ফ্র্যাঙ্ক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। খুকখুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল তার বাবা। পুত্রের গুণে গর্বিত যেমন মনে হচ্ছে, তেমনিই খানিকটা বিপর্যস্ত বলেও মনে হলো ভাউবয়েসকে। মাত্র সাত বছর বয়সে ডায়নোসরের ওপর আঠারো পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ লিখেছিল ফ্র্যাঙ্ক।
ও, ওইটা, অবহেলা ভরে বাতাসে হাতের ঝাঁপটা মারল ছেলেটা। ওটা খুব কাঁচা হাতের কাজ ছিল। তার বছর খানেক আগে টোঙ্গাল্যান্ডের জঙ্গল আর বাইবেলের ইডেন বাগান নিয়ে যেটা লিখেছিলাম সেটা বরং মানোত্তীর্ণ হয়েছে বলে আমার ধারণা।
রেলওয়ের সব মজুরই কি চাইনিজ? কাজের কথায় এলো বেনন।
না, বলল ব্র্যান্ডন। বেশির ভাগই চাইনিজ; তবে আইরিশও আছে কিছু। আইরিশদের নিয়ে চিন্তা করি না; ডায়নোসর দেখলে মদের নেশা ছুটে যায় ওদের, আতঙ্ক ভুলতে যত দ্রুত পারে আবার বোতল খালি করে ফেলে। মজুরদের মধ্যে চাইনিজদের সংখ্যাই বেশি; যত চিন্তা ওদের নিয়ে। চাইনিজদের কিংবদন্তী ড্রাগনে ভরা, ডায়নোসর দেখে ড্রাগন মনে করে দল বেঁধে পালাচ্ছে ওরা।
সব মহাদেশেই ডায়নোসর ছিল, তথ্য যোগাল ফ্র্যাঙ্ক। আদিকাল থেকে লোকে শুনে আসছে ওদের গল্প। ভয় পাওয়া স্বাভাবিক, ওগুলোর কোন কোনটা চার-পাঁচ তলা বাড়ির সমান উঁচু ছিল।
তাই বলে কাজে বাগড়া দেবে তা হতে পারে না, ওগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে কোন একটা করালে আটকে রাখা উচিত, মন্তব্য করল গম্ভীর ব্যাগলে।
হাই তুলল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক। দু আঙুলে তুড়ি বাজাল মুখের সামনে হাত এনে। তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে ব্যাগলেকে দেখে বলল, আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ডায়নোসর। কেন ওরা টিকতে পারল না তার ব্যাখ্যা অনেকে অনেক ভাবে দিয়েছে, কেউ বলেছে হিমযুগ এসে শেষ করে দিয়েছে ওদের, কেউ বলেছে প্রকাণ্ড উল্কাপাতের ফলে মরে গেছে ওরা। আমার ধারণা ওরা মরেছে ক্রিটেশিয়াস কালে হঠাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশ বদলে যাওয়ায়। ওই পরিবর্তনের পরপরই শেষ হয়ে যায় মেসোযোয়িক যুগ।
বয়স যদিও কম ছিল…তবু ওই সময়ের কথা কিছু কিছু মনে আছে আমার, অজ্ঞতা ঢাকতে গিয়ে বলল ব্যাগলে মাথা দুলিয়ে।
দু’চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের। জানতে চাইল, আপনার মাথাটা জাদুঘরে দান করার ব্যাপারে কখনও কিছু ভেবেছেন, মিস্টার ব্যাগলে?
কেন? ঘোর সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইল ব্যাগলে।
আপনার মগজ পরীক্ষার সুযোগ পেলে সুযোগটা লুফে নেবে ওরা। এত আগের মগজ! বানরের সঙ্গে আপনার মগজের তুলনা থেকে বোঝা যাবে আসলেই আমরা বাঁদরের উত্তরপুরুষ কিনা!
কড়া চোখে ছোঁকরাকে দেখল ব্যাগলে, রাগের চোটে কথা বলতে পারল না।
ভাবনায় ডুবে আছে বেনন। উইটিগোতে আসার পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত শুনতে হলো ডায়নোসরের কথা। প্রথমবার শুনেছিল স্টেজ কোচে, ডক্টর ওয়াঙের কাছে। রেল কোম্পানির ঝামেলা আর ডক্টর ওয়ার্ডের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই তো?
আচ্ছা ডায়নোসর ছাড়া আরও যে সব ঝামেলা হচ্ছে; যেমন বেতন ডাকাতি, গোলাগুলি, হুমকি, এগুলো যারা করছে তাদের ব্যাপারে কিছু জানেন? খানিক পরে জানতে চাইল বেনন।
মাথা নাড়ল ব্র্যান্ডন। না। জানলে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেরি করতাম? এখন এন্ড অভ স্টীলে কাজ চলছে, ওখানে গেলেই মার্ক ল্যান্সেলোর কাছ থেকে সব জানতে পারবেন। ঝামেলা লেগেই আছে, কেউ একজন চাইছে আমাদের কাজ থেমে যাক। প্রতিদিন মজুরদের ওপর গুলি ছোঁড়া হচ্ছে আড়াল থেকে। এরকম চলতে থাকলে বেশি বেতন দিয়েও কাউকে রাখা যাবে না।
আপনাদের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে লাভটা কার হবে। আর কোন রেল কোম্পানি পরফাইরিতে লাইন বসাতে চাইছে?
না। এদিকে অন্যদের মেইন লাইন নেই, লাইন বসিয়ে পরফাইরিতে যাওয়া লাভজনক হবে না যে ওরা উৎসাহী হবে। হতাশ ভঙ্গিতে বলল ব্র্যান্ডন। বিপদ বাধাবে আমাদের নিজেদের কোম্পানি; কাজ না এগোলে সবকিছু গুটিয়ে ফেলতে হবে হেড অফিসের নির্দেশে, ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হবে আমাকে। তার মানে দাঁড়াবে আমার পদোন্নতি…
অ্যান্টি রূমে চেঁচামেচি শুনে কথা শেষ না করেই থেমে গেল ব্র্যান্ডন। তারস্বরে কাকে যেন বোঝাবার চেষ্টা করছে ক্লার্ক; কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না, তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরের তলায় বারবার চাপা পড়ে যাচ্ছে তার ফাঁসফেঁসে গলার আওয়াজ। তারপর দড়াম করে খুলে গেল কনফারেন্স রূমের দরজা। ঝড়ের বেগে ঘরে প্রবেশ করল, মিস হ্যাটার আর তার ভাতিজী। স্টীল রিমের চশমার পেছনে রাগে জ্বলছে টীচারের দু’চোখ, ফুলে ফুলে উঠছে নাকের পাটা। মুখটা করমচার মত লাল। ভাতিজি রত্নটিকে তার চেয়ে কম বিপজ্জনক মনে করার কোন কারণ দেখল না ব্যাগলে। ডেইজি হ্যাটারের হাতে এখনও আছে সেই মোষের চামড়ার বিপজ্জনক চাবুক। ফুটন্ত তেলের মত মেজাজটা ঠাণ্ডা হয়েছে বলেও মনে হলো না।
মিস হ্যাটার! দাড়িয়ে পড়ল বিস্মিত ব্যান্ডন: কথা বলছে অ্যানা হ্যাটারের সঙ্গে, কিন্তু দৃষ্টি সেঁটে থাকল তন্বী ডেইজির ওপর। হঠাৎ এভাবে… কি ব্যাপার, মিস হ্যাটার?
কি ব্যাপার জানেন না আপনারা? উপস্থিত সবার দিকে হাড্ডিসার তর্জনী নাচালেন মহিলা। ভেবেছেন কী, কোম্পানির একজন মালিকের সঙ্গে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করে পার পাওয়া যাবে? নালিশ জানাব আমি শিকাগো অফিসে! আমি অ্যানা হ্যাটার আসতে চাইছি আর বাধা দিচ্ছে একটা দু’পয়সা দামের ক্লার্ক! আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না সেই অফিসে যেই অফিসের আসবাবপত্র সম্ভবত এই আমার পয়সাতেই কেনা হয়েছে!
উঠে দাঁড়াল হ্যারি হুলাহান। ঠোঁটে ঝুলছে ব্যাঙ্কারের মাপা বিগলিত হাসি। বুঝে গেছে বাস্তব বুদ্ধির অভাব আছে মহিলার, নাহলে এভাবে মীটিঙের মাঝে জোর করে এসে উপস্থিত হত না। আমাদের কি সৌভাগ্য, মিস হ্যাটার, যে ডেকে না পাঠিয়ে আপনি নিজেই চলে এসেছেন। টেবিলের তলা থেকে পাশের চেয়ারটা টেনে বের করল সে। বসুন, মিস হ্যাটার, দয়া করে আমাদের সম্মানিত করুন। তুমিও বসো, ডেইজি। সুস্থির হয়ে বলো দেখি সমস্যাটা কি।
আমার স্পার, দাড়িয়েই রইলেন টীচার। কড়া চোখে বেনন আর ব্যাগলেকে একবার দেখে নিয়ে বললেন, ওরাই আমার স্পারটা চুরি করেছে। হ্যাঁ এই দু’জন ছাড়া কাজটা আর কারও নয়! ওই স্পার ছাড়া ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার মুখ নেই আমার। চিঠিতে হাজার বার করে ওটা নিয়ে আসতে বলেছে ও। আমি এই মুহূর্তে তদন্ত দাবি করছি; ওদের তল্লাসী করে বের করে দেয়া, হোক আমার স্পার।
বিশ্বাস করুন, মিস হ্যাটার, স্পারটা নেই আমাদের কাছে, বলল বেনন। ওটা নিইনি আমরা।
আপনারা দয়া করে বসুন, বলল ভাউবয়েস। পরিস্থিতিটা আমাকে একটু ব্যাখ্যা করতে দিন।
একটু না, বাবা; তুমি বলতে চাইছ পরিস্থিতির পুরো ব্যাখ্যা দেবে। ভুলটা ধরিয়ে দিল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক।
চুপ! গলা ফাটিয়ে এক ধমক লাগাল ভাইবয়েস ছেলেকে। তারপর মহিলাদের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার হাসি হাসল। হ্যাঁ, কি বলতে চান বলুন এবার আপনারা। আপনাদের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর দেখব কি করা যায়।
স্টেজ কোচ যাত্রা থেকে শুরু করে ডক্টর ওয়াঙের দুর্ভাগ্যজনক পথ পরিক্রমা, ডাকাতের হামলা, বেনন আর ব্যাগলের দুঃসাহসিকতায় পরিত্রাণ-নিজেকে সামলে নিয়ে সবই একে একে বললেন অ্যানা হ্যাটার। শেষে যোগ করলেন স্পারের কথা। তিনি নিজে ছাড়া শুধু স্টার্ন ভাইরাই জানত, সুতরাং কাজটা তাদের না হয়ে যায় না।
ডেইজিকে বলতেই ও-ও আমার সঙ্গে একমত হয়েছে। কাল রাতে স্পারটা চাইতে হোটেলে গিয়েছিল ডেইজি, কিন্তু কেন জানি কিসের লোভে কিছুতেই এরা ওটা ফেরত দিতে রাজি নয়। কথা শেষে আরেক বার আঙুল তাক করে হতভাগ্য গোয়েন্দাদের দেখালেন তিনি।
যা নিইনি তা ফেরত দেব কোত্থেকে! প্রতিবাদ করল ব্যাগলে।
দেখুন মিস অ্যানা, বলল ব্র্যান্ডন, আপনাকে জানানো আমার কর্তব্য যে এরা আমাদের লোক; অনুরোধ রক্ষা করতে ছদ্মবেশে এখানে এসেছেন। অত্যন্ত উঁচু পর্যায় থেকে এদেরকে গোয়েন্দাগিরির কাজে নেয়ার জন্যে সুপারিশ করা হয়েছে। যদি বলে থাকেন যে আপনার স্পার নেননি তাহলে আসলেও নেননি। নিশ্চয়ই কোথাও কোন ভুল হচ্ছে আপনাদের।
বেশ, আগের চেয়ে অনেক শান্ত শোনাল মিস হ্যাটারের কণ্ঠস্বর। সেক্ষেত্রে আমি আশা করব রেলরোড আমার হয়ে স্পারটা খুঁজে বের করে দেবে। অনেকগুলো শেয়ারের একজন মালিক হিসেবে এটুকু দাবি আমি করতেই পারি।
অবশ্যই, সায় দিল ব্র্যান্ডন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আমাদের চেষ্টায় কোন ত্রুটি থাকবে না। বেনন, ব্যাগলে, মনে রাখবেন আপনাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে যেভাবেই হোক মিস হ্যাটারের সম্পত্তি উদ্ধার করা।
কিন্তু…প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল ব্যাগলে। বেশ, মনে থাকবে আমাদের।
প্রসন্ন হলেন মিস হ্যাটার, বললেন, এটুকু সহযোগিতাই আমি আপনাদের কাছ থেকে আশা করেছিলাম। ভাতিজীর দিকে ফিরলেন তিনি। চলো, ডেইজি, এঁরা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসবেনন; এদের আর বিরক্ত করা ঠিক নয়।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগে বেননের চোখে তাকাল ডেইজি, ধীরেসুস্থে বলল, আমার এখনও ধারণা বেচারি অ্যানা আন্টির স্পারটা তোমরাই সরিয়েছ। ভেবো না এত সহজে পার পাবে। ঠিকই তোমাদের মুখোশ খুলে দেব আমি।
আমি তোমাদের র্যাঞ্চে এসে এব্যাপারে আলাপ করব; তোমার আন্টিকে বোলো চিন্তা না করতে বলল মার্লোন ব্র্যান্ডন।
বাবার গুলি খেয়ে মরবে তাহলে। বাবা রেলরোডের লোকজনকে দেখতে পারে না। সতর্ক করার সুরে কথাটা বলে চলে গেল ডেইজি।
মেয়েটা চলে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ব্র্যান্ড। চেহারা দেখে মনে হলো ঘোরের মধ্যে আছে। তাকে কল্পনার স্বর্গ থেকে টেনে নামাল বেনন। বিরক্তি চেপে বলল, আমি এখানে রেলওয়ের হয়ে গোয়েন্দার কাজ করতে এসেছি, মিস্টার ব্র্যান্ডন; কোন মহিলার হারানো স্পার খুঁজতে হবে এমন তো কথা ছিল না। আপনি বরং অন্য লোক দেখুন।
আঁ…? বাস্তবে ফিরে কি বিষয়ে কথা হচ্ছে কিছু বুঝতে পারল না ব্র্যান্ডন। কিছুক্ষণ পর সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, আমি জানি আপনারা আমাকে হতাশ করবেন না। পাগলা হ্যাটারের প্রিয়পাত্র হবার এটাই আমাদের মোক্ষম সুযোগ। স্পার যখন আনতে বলেছে নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে তার। আমরা যদি ওটা উদ্ধার করে ফেরত দিতে পারি খুশি হবে সে, জমির ব্যাপারে নিশ্চয়ই আর ঝামেলা করবে না। আমি আপনাদের স্পার খুঁজতে বলছি না, আপনারা শুধু চোখ ভোলা রাখবেন; রেলরোডের কাজের ফাঁকে যদি উদ্ধার করতে পারেন তো মহিলাকে ফিরিয়ে দেবেনন। কী, রাজি?
বেশ, ব্যাগলে আপত্তি জানাবার আগেই বলে দিল বেনন। স্পার খোঁজা, প্রধান দায়িত্ব হবে না এই শর্তে কাজটা আমরা নিচ্ছি। আজই আমি এন্ড অভ স্টীলে যাব বিগ জিমি নর্টনের সঙ্গে কথা বলতে পারলে নিজের চোখে দেখে আসব নিশাচর সেই সব অতিকায় ডায়নোসরদের।
আমিও যাচ্ছি, জানাল ব্যাগলে।
ওর কোটের হাতা ধরে টান দিল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক। মিস্টার ব্যাগলে, আপনি ডায়নোসর দেখতে পাবেন না বাজি ধরতে পারেন। ওরা দুইশো মিলিয়ন বছর আগেই মরে সাফ হয়ে গেছে।
গোটা ব্যাপারটাই আমাদের অতি কল্পনা নয়তো? জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করল ভাউবয়েস। নিজেই উত্তর দিল, এ যুগে ডায়নোসর আসবে জ্বালাতে এ একেবারেই অবিশ্বাস্য। এটাও মনে হচ্ছে না একদল সংঘবদ্ধ লোক কোন স্বার্থ ছাড়া এভাবে রেলওয়ের কাজে বাধা দেবে। এমনও তো হতে পারে স্রেফ মজা করেছে কাউহ্যান্ডরা? ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখলে মনে হয় না যে…
মনের কথা মনেই থাকল, আর একটা কথাও উচ্চারণ করার সুযোগ পেল না ভাউবয়েস। মস্ত ভুড়িতে জোর এক ঠেলা দিয়ে তাকে মেঝেতে চিতপটাং করে ফেলে দিল বেনন। নিজেও ঝাপিয়ে পড়ল ভাউবয়েসের পাশে। একই সঙ্গে বাকিদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, মাটিতে শুয়ে পড়ো সবাই! বাঁচতে চাইলে মাটিতে!
বিরক্ত বোধ করায় ভাউবয়েসের কথার ফাঁকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছে ও; দেখেছে রাস্তার ওপারের একটা সেলুনের দোতলার জানালা দিয়ে এঘরের দিকে রাইফেল তাক করেছে কে যেন।
বেনন মেঝে ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল রাইফেল। টুকরো টুকরো হয়ে গেল জানালার কাচ। বাতাসে বোলতার গুঞ্জন তুলে উল্টোপাশের দেয়ালে গিয়ে বিধল বুলেট। হুলস্থুলের মাঝে কে কার আগে লাফিয়ে মেঝেতে পড়তে পারে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল ঘরের মধ্যে।
০৫. সবার আগে উঠে দাঁড়াল বেনন
সবার আগে উঠে দাঁড়াল বেনন। অস্ত্র হাতে একলাফে পৌঁছে গেল জানালার পাশে। দেয়ালের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে উঁকি দিল বাইরে। দুই সেকেন্ড পরেই ব্যাগলেকে আরেক পাশে এসে অবস্থান নিতে দেখল ও। বিদঘুঁটে কোটের ভেতর থেকে অস্ত্র বের করে ফেলেছে ব্যাগলে।
বাকিরা এখনও আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা। ব্যাঙ্কার গিয়ে ঢুকেছে টেবিলের তলায়, আপ্রাণ চেষ্টা করছে কার্পেটের সঙ্গে মিশে যেতে। গলা চিরে বেরিয়ে আসছে চিৎকার। তার ধারণা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করছে কেউ। চার হাত-পা মুড়িয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ছেলেকে আগলে বসে আছে মস্ত মোটা ভাউবয়েস সি ভাউবয়েস নোয়াক। তাদের দুজনকে গুলির কবল থেকে বাঁচাতে গিয়েই হয়তো সামনে মাথা নিচু করে আধবসা হয়ে আছে মার্লোন ব্র্যান্ডন।
ষাঁড়ের মত চেঁচিয়ো না, ব্যাঙ্কারের উদ্দেশে চেঁচাল বেনন, তোমার ব্যাঙ্ক ডাকাতি করছে না কেউ।
শিকাগো অফিসের গাধাগুলোকে আমি দেখে নেব! গর্জন ছাড়ল ভাউবয়েস। ওরা পেয়েছে কি, মানুষকে এভাবে আততায়ীর সামনে ঠেলে দেবে! আমি ওদের দিয়ে মিলিটারি পাহারার ব্যবস্থা করাব! মাশাল-ল জারি করাব আমি এই স্টেটে!।
উত্তেজিত হয়ো না,বাবা, সাবধান করল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক। ভুলে যেয়ো না ডাক্তার বলেছে মাথা গরম করলে তোমার হাঁপানি বাড়বে।
দ্বিতীয় কোন গুলি হয়নি আর। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল বেনন, তারপর কয়েক লাফে পৌঁছে গেল কনফারেন্স রূমের দরজার কাছে। ব্যাগলে অনুসরণ করল ওকে। মিস হ্যাটারের সঙ্গে সাক্ষাতের ধকল এখনও সইতে পারেনি বিধ্বস্ত ক্লার্ক, টেবিলের তলা থেকে উঁকি দিল লোকটা, ব্যাগলে আর বেনন সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে দেখে ভাঙা গলায় জানতে চাইল, মরেছে কেউ ভেতরে?
না, লোকটাকে আশ্বস্ত করে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে এলো বেনন।
সাগরে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি যেমন কিছুই নয়, তেমনি টেইলহল্টেও গুলির মাত্র একটা শব্দ বিন্দু মাত্র চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেনি। বিস্ফোরণের আওয়াজ শহরের হৈ-চৈ, কোলাহলেই হারিয়ে গেছে।
ফ্রেইট ওয়্যাগনের ফাঁকফোকর দিয়ে এক দৌড়ে রাস্তা পেরল বেনন। ওর পেছনেই ব্যাগলে; সর্বক্ষণ অভিশাপ দিচ্ছে সাদা বুটজুতো জোড়াকে। সেলুনের দরজা খুলে ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকল ওরা, চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো দোতলার করিডরে। যে ঘর থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে সে ঘরের দরজাটা বন্ধ। অস্ত্র বাগিয়ে ধরে কাঁধের ধাক্কায় দরজা খুলে ফেলল বেনন। যা আশা করেছিল তাই দেখল, ঘর খালি, নেই কেউ। বাতাসে ভাসছে পোড়া করডাইটের নীলচে ধোয়া আর কটু গন্ধ। জানালার সামনে পড়ে আছে গুলির একটা খালি খোসা।
চলো, বারটেন্ডারের সঙ্গে কথা বলে দেখি। ব্যাগলেকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো বেনন।
তেমন কোন তথ্য যোগাতে পারল না বারটেন্ডার, শুধু জানাল একদল চাইনিজ তাস খেলার জন্যে ঘরটা ভাড়া নিয়েছিল। রেলওয়ের মজুররা প্রায়ই বিনোদনের জন্যে এই সেলুনের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে।
আবার ডক্টর ওয়াং? বাইরে এসে নিজেকেই প্রশ্ন করল বেনন।
যদি তাই হয় তাহলে কাকে মারার জন্যে? জানতে চাইল। ব্যাগলে।
জানি না, বলল বেনন, হয়তো ভাউবয়েস বা হয়তো আর কেউ। আবার এমনও হতে পারে শুধুই ভয় দেখাতে চেয়েছে কাউকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য ছিল না। চাইনিজরা এমনিতে শান্তিপ্রিয়। সেই জন্যেই কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে এসবের পেছনে ওয়াঙের হাত আছে।
চলো অফিসে গিয়ে ওদের জানিয়ে আসি যে লোকটা ধরা পড়েনি।
ওরা নিজেরাই এতক্ষণে জেনে গেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবল বেনন, তারপর বলল, আমরা এখান থেকেই আলাদা হয়ে যাব, ব্যাগলে। আমি যাব এন্ড অভ স্টীলে বিগ জিমি নর্টনের সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি বুঝতে; তুমি টেইলহল্টেই থাকবে, চেষ্টা করবে ডক্টর ওয়াংকে খুঁজে বের করে স্পারটা কেড়ে নিতে।
তুমি একা মজা মেরে দেবার তাল করছ, বেনন, অনুযোগ করল ব্যাগলে।
উঁহু, স্রেফ সাবধানতা অবলম্বন করছি। চিন্তা করে দেখো, দুজনেই যদি আমরা এন্ড অভ স্টীলে যাই আর এই সুযোগে কেউ যদি ভাউবয়েসের ঢাউস পেটটা গুলি করে ফাঁসিয়ে দেয় তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের আর কাজ দেবে কেউ?
ওই লোকটার দেখভাল করতে মোটেই ভাল লাগবে না আমার।
কিন্তু চিন্তা করে দেখো, ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের ধারেকাছে থাকলে কতকিছু শিখতে পারবে তুমি!
ওই ছেড়া ফাজলামো করলে ওর কান ছিঁড়ে নেব আমি, হুমকি দিল ব্যাগলে। পরমুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল চেহারা। আচ্ছা, শহরে থাকলে ছদ্মবেশ ছাড়া থাকতে পারব আমি?
নিশ্চিন্তে। আমার তো ধারণা ওই লোকটা তোমাকেই গুলি করেছিল তোমার ছদ্মবেশের কষ্ট দূর করতে…আমি তাহলে যাচ্ছি, ব্যাগলে, বড় রকমের কোন বিপদ দেখলেই তোমাকে ডেকে পাঠাব।
সাবধানে থেকো, বেনন।
বিদায় নিয়ে রেল স্টেশনে চলে এলো বেনন। প্ল্যাটফর্ম ধরে একশো ফুট দৌড়াতে হলো ওকে। আজকের শেষ ট্রেন এন্ড অভ স্টীলের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ওটাতে গিয়ে উঠল ও। কোচের ভেতরে গাদাগাদি করে বসে আছে রেলওয়ের শ্রমিকরা। চাইনিজ আর আইরিশ। আইরিশরা রোদে কাজ করায় চামড়ার রং টুকটুকে লাল। উঁচু বুট আর লিপট্টি মারা প্যান্ট সবার পরনে; গায়ে রংজ্বলা ফ্লানেলের শার্ট। সর্বক্ষণ নেশা করে আছে লোকগুলো। ঢুলু ঢুলু চোখে ঝিমাচ্ছে। চাইনিজরা উদাস; ভাবনায় ডুবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে।
বাইরে তাকাল বেননও। শহর ছাড়ার কয়েক মাইল পর থেকেই বদলে গেল প্রাকৃতিক দৃশ্য। সবুজের পরিমাণ কমতে লাগল, জমি হয়ে উঠল রুক্ষ আর পাথুরে। গভীর একটা গিরিখাদের ওপর দিয়ে ব্রিজ, সেই ব্রিজ ধরে এগিয়েছে ট্রাক উইটিগোর দিকে। ঘুরে ঘুরে উঠছে ট্রেন পাহাড়ের ওপর।
কিছুক্ষণ পর শুরু হলো ক্যানিয়নের রহস্যময়তা। অন্তহীন খাদগুলোর পাশ দিয়ে চলেছে এখন ওরা; কখনও বা ধবধবে সাদা দেয়ালের পাশ দিয়ে। সবগুলো ক্যানিয়ন এসে মিশেছে মস্ত বড় একটা ক্যানিয়নে। নিচের দিকে তাকালে তলা দেখা যায় না। বাতাস এখানে স্থির আর শীতল। পরিবেশটা ভূতুড়ে আর প্রাচীন। বিচিত্র আকৃতির পাথরের ছড়াছড়ি চারধারে। একেকটার একেক রং। কোনটা সাদা, কোনটা লাল আবার কোনটা কুচকুচে কালো। অজানা একটা অনুভূতির ছোঁয়ায় শিউরে উঠল বেনন। অস্বাভাবিক নয় যদি দুর্গম এই আদিমতায় ডায়নোসরের দল আজও বেঁচে থাকে।
টেইলহল্ট ছাড়ার দুই ঘণ্টা পর এন্ড অভ স্টীলে পৌঁছে গেল ফ্রেইট ট্রেন। আর এগোয়নি লাইনের কাজ।
এন্ড অভ স্টীলেই ক্যানিয়নটা সবচেয়ে চওড়া। ধুলো-বৃষ্টিতে মলিন তাঁবু, যন্ত্রপাতি রাখার কাঠের ঘর আর ছড়ানো ছিটানো সাজ সরঞ্জামে ভরে উঠেছে ক্যানিয়নের মেঝে। ওগুলোর চারধারে পিপড়ের মত গিজগিজ করছে অসংখ্য মজুর। সুশৃঙ্খল ভাবে যার যার কাজ করছে সবাই। একধারে পাহাড়ের মত উঁচু করে রাখা আছে অব্যবহৃত রেইল। ঝনঝন শব্দে স্লেজ হাতুড়ি পড়ছে অবিরত। রেইলগুলোকে লাইনে বসানোর উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। এগিয়ে চলেছে রেলরোডের কাজ। একেকটা রেইল বসানো হচ্ছে আর পরফাইরির দিকে আটাশ ফুট করে এগিয়ে যাচ্ছে লাইন। ব্রিজের শ্রমিকরা কাজ করছে সামনে। আরও দূরে পিঠ কুঁজো সেই টিলার কাছে আছে টানেল শ্রমিকরা।
ট্রেন থামতেই হুড়মুড় করে নেমে গেল সবাই। টেলিগ্রাফ বসানো হয়েছে একটা ছোট ঘরে। অনবরত টক-টক টিক-টিক আওয়াজ করছে যন্ত্রটা। সেদিকে এগোল বেনন। তারপর দিক বদলাল। বাড়তি একটা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে সুদৃশ্য একটা বগি। ওটাই অফিশিয়ালদের কার্যালয়। ওখানেই থাকবে বিগ জিমি নর্টন।
লোকটা থাকবে জানত বেনন, কিন্তু সে যে এই আকৃতির লোক হবে তা বেনন কল্পনাও করতে পারেনি। বিগ জিমি নর্টন ল্যাটিগোর হাতুড়ি মাথা ডবসনকেও লম্বা-চওড়ায় হার মানিয়ে দিয়েছে। বেনন নিজেও ছয় ফুট লম্বা, কিন্তু জ্বলজ্যান্ত এই পাহাড়টার মাথা ওর চেয়েও দেড় ফুট ওপরে। বুকের ছাতি আটচল্লিশ ইঞ্চির কম হবে না। বাইসেপ দুটো বেননের উরুর চেয়েও মোটা, অথচ দেহে বিন্দুমাত্র চর্বি নেই। সারা শরীরে পেশি কিলবিল করছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভরা হাঁড়ির মত চেহারায় বদ রাগের ছাপ। রেলরোড নির্মাণ কর্মকর্তারা আইরিশ হবে এই চিরাচরিত নিয়মটিকে কাঁচকলা দেখিয়ে মেজাজের গুণেই বোধহয় চাকরিটা পেয়ে গেছে স্কটিশ লোকটা।
কী ব্যাপার, ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হচ্ছেটা কী, সবচেয়ে বদখত চেহারার বুলডগকে হার মানিয়ে দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বেননকে দেখল লোকটা। মনে করেছে বেনন নতুন শ্রমিকদের কেউ হবে।
একগাদা অফিশিয়াল কাগজ সামনে নিয়ে একটা ডেস্কের পেছনে বসে আছে সে, ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে টেবিলটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে এখনই তেড়ে আসবে টুটি চেপে ধরতে।
আমি রক বেনন, তাড়াতাড়ি করে বলল রক। আজই আমাকে গোয়েন্দার চাকরি দিয়েছে মার্লোন ব্র্যান্ডন। আপাতত তোমাদের সমস্যা সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা দাও আমাকে। কোথা থেকে কাজ শুরু করলে সুবিধা হয় তোমাদের?
সমস্যার কি শেষ আছে? খেকিয়ে উঠল দানব। বেনামী হুমকি, মালের ভাণ্ডারে লুটপাট, শ্রমিকদের বেতন ডাকাতি, দূর থেকে লুকিয়ে গুলি করা কোন সমস্যাটা নেই! কেউ একজন চাইছে না স্পারটা শেষ হোক। তবে আপাতত সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পাগলা হ্যাটার নামের এক র্যাঞ্চার। আমাদের ক্রুরা ওর জমি পর্যন্ত প্রায় পৌঁছে গেছে; আর যাতে না এগোতে পারে সেজন্যে রাইফেলে তেল দিয়ে নতুন বুলেট ভরে রেখেছে লোকটা। বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে মানিয়ে নেয়া তোমার প্রথম কাজ হতে পারে, সংশয়ের দৃষ্টিতে বেননকে দেখল নর্টন; অবশ্য তোমার যদি ওই লোকের মুখোমুখি হবার সাহস থাকে। আমি যখন গিয়েছিলাম ভাগ্যিস হ্যাটার ছিল না। দেখা হলো মেয়েটার সঙ্গে। দারুণ সুন্দরী মেয়ে! কিন্তু হাতে চুমু দেব বলে এগোতেই চাবুক নিয়ে ধাওয়া করল! কালো হয়ে গেল স্কটিশের মুখটা। বললে বিশ্বাস করবে না পিঠে দুই দুইবার চাবুক মেরেছে মেয়েটা!
বাড়তি ঘোড়া আছে? জানতে চাইল বেনন। হ্যাটারের র্যাঞ্চে যাব আমি, চেষ্টা করে দেখব লোকটার মত পরিবর্তন করতে পারি কিনা।
যাচ্ছ যাও, পরে দোষ দিতে পারবে না। করালে গিয়ে আমার নাম করে চাইলেই দিয়ে দেবে ওরা আমাদের সেরা ঘোড়াটা।
হাত বাড়িয়ে দিল বেনন। আন্তরিকতার সঙ্গে করমর্দন করল দৈত্য। বেননের হাতের হাড় প্রায় চুরচুর করে দিয়ে বলল, দোয়া করি যাতে আস্ত ফিরতে পারো।
হাসল বেনন, বেরিয়ে যাবার জন্যে ঘুরেছে এমন সময় বগিতে এসে ঢুকল সবুজ ভাইজার পরা টেলিগ্রাফার। কড়া চোখে বেননকে একবার দেখে নিয়ে নর্টনের হাতে গুঁজে দিল হলুদ একটুকরো কাগজ।
আপনার টেলিগ্রাম, চীফ; এইমাত্র এলো।
নিশ্চই কাজ শেষ করার জন্যে তাড়া দিয়েছে। কাগজে মনোনিবেশ করল বিগ জিমি। ধীরে ধীরে কুঁচকে জোড়া লেগে গেল শুয়োপোকার মত মোটা ভ্রূ। টকটকে লাল হয়ে উঠল হাঁড়ির মত মুখটা। হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সে, প্রকাণ্ড হাতের থাবায় আঁকড়ে ধরল বেননের কাঁধ।
কী ব্যাপার? জানতে চাইল বিস্মিত বেনন।
জবাবে দুকাঁধ ধরে এক ঝাঁকিতে ওকে শূন্যে তুলে ফেলল দৈত্য। রাগের চোটে ঘনঘন ঝাঁকি দিল। দুলে উঠল ট্রেনের বগি। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে দেখল বেনন। অসম্ভব একটা কাজ। ছটফট করাই সার হলো। হাড়ের ওপর চেপে বসেছে দানবের লোহার আঁকশির মত দু’হাত। এখনই কাঁধের হাড় মুড়মুড় করে ভেঙে যাবে বলে মনে হলো ওর। তীব্র ব্যথা অবশ করে তুলল ওকে।
আরও কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে গর্জন ছাড়ল নর্টন। মনে করেছ জিমি নর্টনকে ঠকিয়ে পার পাওয়া যাবে? না! হাড় গুড়ো করে ফেলব আমি তোমার!
কেন…
ওর নাকের সামনে টেলিগ্রামটা ধরল নর্টন। পা দুটো মাটি থেকে আধফুট উঁচুতে, বেড়াল ছানার মত ঝুলছে বেনন। টেলিগ্রাম পড়ানোর জন্যে কাঁধ ছেড়ে দিয়ে ওর ঘাড় ধরে ওপরে তুলেছে। দৈত্যটা।
কাগজে চোখ বোলাল অপমানিত বেনন। ওতে লেখা :
রক বেনন নামের এক লোকের ব্যাপারে চোখ খোলা রাখো। আউট-ল ছিল লোকটা। কোনএকটা বদ মতলবে এদিকে ঘুরঘুর করছে, নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে রেলরোডের ট্রাবল শুটার বলে।মিথ্যুকটাকে ধরতে পারলে আটক করে রাখবে বা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।
মার্লোন ব্র্যান্ডন
মুখ খুলে লাভ হবে না বুঝে গেল বেনন জিমি নর্টনের চেহারা দেখে। ওর কথায় প্রভাবিত হওয়ার বান্দা নয় লোকটা। টেলিগ্রামটা বিশ্বাস তো করেইছে, ভীষণ রেগে গেছে ঠকে, গিয়েছিল চিন্তা করে।
মুখ বুজে চুপ করে থাকল বেনন। ঝড়ের গতিতে চিন্তা চলছে মাথায়। টেলিগ্রামটা ভুয়া তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভুল ভেঙে গেলে ছেড়ে দেবে ওকে নর্টন। কিন্তু তার আগেই ছাড়া পেতে হবে। যেই ওকে বন্দী করাক না কেন নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে তার, চাইছে না ও মুক্ত ঘুরে বেড়াক। তদন্ত করুক। জানতে হবে কে সেই লোক।
০৬. মনের মধ্যে মিশ্র একটা অনুভূতি
মনের মধ্যে মিশ্র একটা অনুভূতি নিয়ে বেননকে যেতে দেখল ব্যাগলে। দেখল টেইলহল্ট ছেড়ে এন্ড অভ স্টীলের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেল ফ্রেইট ট্রেন। দীর্ঘশ্বাস গোপন করল ও। বেননের সঙ্গে মজা আর উত্তেজনাও যায় পিছু পিছু। ভাগ্যটা ওর সঙ্গে সৎ মায়ের মত আচরণ করে।
দু’চোখে বিতৃষ্ণা নিয়ে কর্মব্যস্ত সড়কের ওপর চোখ বোলাল ও। সব ব্যাটার তাড়া আছে, সুস্থির হয়ে চলার ইচ্ছে নেই কারও। সবাই বিনা কাজে ছুটছে বলে ওর মনে হলো। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে রেল বিল্ডিঙের দোতলায় উঠে এলো ও। কনফারেন্স রূমে ঢুকে দেখল উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে সবাই।
নাহ, গিয়ে দেখি পালিয়েছে, সেলুনে ব্যর্থ অভিযানের কথা জানাল ব্যাগলে। তারপর বলল, বেনন গেছে এন্ড অভ স্টীলে। আমাকে রেখে গেছে যাতে তোমাদের কোন বিপদ না হয়।
তারমানে আপনি আমাদের বডিগার্ড? নীরিহ চেহারায় জানতে চাইল ফ্র্যাঙ্ক।
ঠিক ধরেছ। মাথা দোলাল ব্যাগলে।
হা! হা! হা! ওকে একবার তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে দু’হাতে পেট চেপে ধরল ইচড়ে পাকা ছোঁকরা।
দেখো ছেলে… কথা শুরু করেও থেমে গেল ব্যাগলে। রক্ত ওর গরম হয়ে উঠেছে রাগে, কিন্তু আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। হঠাৎ করেই হাসি থামিয়ে নিষ্পাপ কোতূহলী চোখে তাকিয়েছে ফ্র্যাঙ্ক। চেনে ব্যাগলে এই ভঙ্গি, বেনন ওকে ঠকিয়ে দেয়ার আগে চেহারায় এরকম ভালমানুষী ফুটিয়ে তোলে।
স্পারটা খুঁজে বের করতে আমি আপনাকে সাহায্য করব, ভরসা দিয়ে বলল ফ্র্যাঙ্ক।
কারও সাহায্য লাগবে না, গম্ভীর হয়ে গেল ব্যাগলে, এসব আমার বাঁ হাতের কাজ।
এই রহস্যের সমাধান বের করা খুবই সোজা। ফ্র্যাঙ্ক নোয়ক হাল ছাড়ল না। প্রথমে, আমরা ধরেই নিতে পারি যে সস্তা যতই মনে হোক, কারও না কারও কাছে স্পারটার গুরুত্ত্ব অপরিসীম। এটাও ধারণা করা যায় যে স্টেজ কোচে উঠে স্পারটা গায়েব করে দিয়েছে ডক্টর ওয়াং। এখন আমাদের ভেবে বের করতে হবে ওটা দিয়ে সে করবেটা কি। এটাও আন্দাজ করা সোজা, তবে সে প্রসঙ্গে আপাতত আমি এই মুহূর্তে যাচ্ছি না। আসল কথায় আসি, যেহেতু আমরা ধরেই নিয়েছি স্পারটা মূল্যবান, সেহেতু জিনিসটা ওয়াং কাছ ছাড়া করবে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে ডক্টর ওয়াংকে আমরা খুঁজে পেলেই তার কাছ থেকে ওই স্পার উদ্ধার করতে পারব।
আমিও তাই ভেবেছি, চাপা মেরে নিজের মান বাঁচাতে চাইল ব্যাগলে।
আজকের আলোচনা তাহলে এখানেই শেষ, মাঝখান থেকে বলল ব্র্যান্ডন। আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে, এন্ড অভ স্টীলে অন্তত এক ডজন টেলিগ্রাম না পাঠালে কাজ থামিয়ে বসে থাকবে ওরা।
আমারও ব্যাঙ্কে যাওয়া উচিত। চেয়ার ছাড়ল হ্যারি হুলাহান। ব্যাগলের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, কি করতে হবে বেনন তোমাকে বলে গেছে নিশ্চয়ই? দেখো, খামোকা ঘুরে আবার বেতন নিয়ো না।
কঙ্কালসার প্রৌঢ় ব্যাঙ্কারের খাড়া নাকে দড়াম করে এক ঘুসি বসিয়ে দিল ব্যাগলে মনে মনে। মুখে বলল, বেতনটা তুমি দিচ্ছ না যে তোমাকে ভাবতে হবে। নিজের কাজ আমি ভালই বুঝি। আমিই দলের অভিজ্ঞ সদস্য, সেজন্যেই তোমাদের নিরাপদে রাখার বিপজ্জনক কাজটা আমাকে দেয়া হয়েছে।
হা! হা! হা! আবার ফাঁকা হাসিতে ফেটে পড়ল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক।
রাগ চেপে দরজার দিকে পা বাড়াল ব্যাগলে। এখানে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়। হাতের তালু চুলবুল করছে ওর, রাগ আরও বাড়লে চাপড়ে পিচ্চি ছোড়ার পাছার ছাল তুলে ফেলবে। সেটা ঠিক হবে না, এমনিতেই বদমাশ ব্যাঙ্কার শত্রুতা করছে, তারওপর ভাইস প্রেসিডেন্টের ছেলের গায়ে হাত তুললে চাকরি থেকে বিতাড়িত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। বোকামি করতে ব্যাগলে রাজি নয়, দরকার হলে গায়ে তেল মেখে নেবে যাতে অপমানগুলো পিছলে যায়।
দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে গিয়েও ফিরে তাকাল দায়িত্ব সচেতন ব্যাগলে। রাশভারী ভঙ্গিতে বিশেষজ্ঞ মতামত দিল, ঘরের বাইরে খুব একটা না বেরোনোই ভাল। আমি যতক্ষণ সাথে আছি চিন্তা নেই; কিন্তু যখন থাকব না, তখন খুব সাবধান। ভুলে গেলে চলবে না যে ভয়ঙ্কর এক খুনী ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইরে।
হা! হা! হা! হাসল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক।
বিড়বিড় করতে করতে রাস্তায় নেমে এসে ঠোঁট ভাঙা কাঠ ঠোকরার মত অসহায় দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল ব্যাগলে। ওপারের সেলুনটা চোখে পড়তেই কাল রাতের তৃষ্ণা চাগা দিয়ে উঠল ওর বুকে। বেনন নেই যে বাধা দেবে, এখনই হচ্ছে সুড়ত করে দু’ঢোক মেরে দেবার উপযুক্ত সময়। এরকম সুযোগ পরে আর না–ও আসতে পারে। যাব? দু’টুকরো হয়ে গেছে ব্যাগলের মনটা; এক টুকরো বলছে সামনে কঠিন কাজ, অত পরিশ্রমের আগে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয়া দরকার; আরেক টুকরো বলছে সামনে পরিশ্রমের কাজ, এখন আনন্দ করার সময় নয়, শরীর মন তরতাজা রাখতে হবে এখন।
না, বাজে জিনিস ছোঁয়া চলবে না, কঠোর চেহারায় সিদ্ধান্ত নিল ব্যাগলে। আগে কাজ পরে মজা। বাবার কথা মনে পড়ল ওর। ওই মৃত ভদ্রলোকই ওকে এই মহৎ শিক্ষা দিয়ে গেছেন। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেও টাকা দিয়ে তাঁকে নেশা বিরোধী সভা সমাবেশে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে যাওয়া হত, আলোচনার মাঝে আঙুল তুলে তাকে দেখিয়ে বলা হত, দেখো মদ খেলে তার শেষ পরিণতি কি ভয়ানক করুণ-কাজেই তার অভিজ্ঞতাকে তুচ্ছ করার উপায় নেই।
রাস্তায় চোখ বোলাল ব্যাগলে। শহরের লোক, র্যাঞ্চ থেকে আসা কাউবয়, দাড়িওয়ালা রেলরোড মজুর, পরফাইরির মাইনার আর চিনেদের মাঝে দামী অক্সিডেন্টাল স্যট পরা ডক্টর ওয়াংকে খুঁজল ও। তারপর মনে পড়ল কথাটা। ওয়াং এত বোকা নয় যে ওই পোশাকে এখনও ঘুরে বেড়াবে। নিশ্চয়ই কাপড় পাল্টে কুলিদের ভিড়ে মিশে গেছে লোকটা! তারমানে ওয়াংকে খুঁজে পাওয়া খড়ের গাদায় সুই খোজার চেয়েও কঠিন হবে। চাইনিজদের চেহারা আলাদা করে মনে রাখা প্রায় অসম্ভব। একমাত্র হেলেনার চোরা কারবারি চ্যাং টোয়াংকে শুধু আলাদা করে চিনতে পারে ব্যাগলে। লোকটা ওর বন্ধু, আদম ব্যাপারির লাভজনক ব্যবসা করে, চায়না থেকে লোক এনে গোপনে বর্ডার পার করিয়ে ঢুকিয়ে দেয়।
চ্যাং টোয়াঙের মাথায় বেণী আছে। ডক্টর ওয়াঙের মাথায় বেণী ছিল কিনা মনে করার চেষ্টা করল ও। মনে পড়ল না। যদি থেকেও থাকে নিশ্চয়ই হ্যাটের তলায় ছিল। এবার পাশ দিয়ে যাওয়া চিনেদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল ব্যাগলে। একটু পরই সব ক’জনকে ডক্টর ওয়াং বলে মনে হতে লাগল ওর। সেই রহস্যময় অমায়িক হাসি, সেই একইরকম সরু চোখ! ব্যর্থতার হতাশা রাগিয়ে তুলল ওকে। অসহায় হয়ে গেল ও মাত্রা ছাড়া রাগে। শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে সামলাতে পারল না, আঁকড়ে ধরল পাশ দিয়ে যাওয়া এক চিনেম্যানের হাত। লোকটা বিস্ময় সামলে নেয়ার আগেই তাকে টেনে নিয়ে দুই বিল্ডিঙের মাঝের সরু একটা গলিতে চলে এলো ও। সার্চ করে দেখল। প্রথমে হকচকিয়ে গিয়ে ভয়ে কাঁপছিল চিনা কুলি; এবার সে মোরগের তাড়া খাওয়া মুরগির মত ক-কক করে কি যেন বলতে লাগল। সেই সঙ্গে শুরু হলো হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি। মহা বিরক্ত হয়ে লোকটাকে ছেড়ে দিল ব্যাগলে। নেই ব্যাটার কাছে স্পারটা।
লোকটা চলে যাবার পরেও জায়গাটা পছন্দ হয়ে যাওয়ায় খাপ পেতে দাঁড়িয়ে থাকল ব্যাগলে। হতাশা আর রাগ দুটোই বেড়েছে ওর, তবে মনকে প্রবোধ দিল: প্রথম চিনে ব্যাটার কাছ থেকেই স্পার উদ্ধার হয়ে যাবে এমন কোন কথা নেই।
দ্বিতীয় লোকটাকে পেল ও মিনিট খানেক পরে। কোন লাভ হলো না, স্পার নেই তার কাছে। তৃতীয় আর চতুর্থ লোকটাও ওকে হতাশ করল। কথায় আছে লোকে কচু গাছ কাটা শিখতে শিখতে মানুষের গলা কাটা শেখে। ব্যাগলেও একই কাজ বারবার করতে করতে চালাক হয়ে উঠল। গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে চাইনিজদের পাকড়াও করা সময়ের ব্যাপার। এবার শিকার ধরার জন্যে একটা বাড়ির কোনায় ওঁৎ পাতল সে। ফুটপাথ ধরে কোন চাইনিজ গেলেই হলো, খপ করে তাকে ধরে বসতে লাগল। কাউহ্যান্ড আর পথচারীরা চোখে বিস্ময় নিয়ে ঘটনা দেখছে সেসব পাত্তাই দিল না। পাঁচ আর ছয় নম্বরকে এভাবেই পেল সে। টের পেল না যে এক নম্বর আর ছয় নম্বর আসলে একই লোক।
আধ ঘণ্টা পর হাল ছেড়ে দিয়ে হোটেলে ফিরল হতদ্যম ব্যাগলে। দোতলায় উঠে চমকে গেল ও পরিচিত চেহারা দেখতে পেয়ে। থমকে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কি চাও তুমি এখানে?
কেন? জানতেন না বাবা আর আমি এই হোটেলে উঠেছি? পাল্টা প্রশ্ন করল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক।
না, জানতাম না। সামনে বাড়ল ব্যাগলে। পথ ছাড়ো, ঘরে যাব আমি।
সামনে থেকে সরে জায়গা করে দিল ছেলেটা।
ঘরে ঢুকে অগোছাল বিছানা আর পাশে রাখা কার্পেট ব্যাগের দিকে তাকাল ব্যাগলে। একবার ভাবল খাওয়া-দাওয়া সেরে সেঁটে ঘুম দেয়। কিন্তু দায়িত্ববোধ ওকে বাধা দিল। ঠিক করল প্রথমে কাপড় পাল্টে নেবে, তারপর আবার যাবে স্পারের খোঁজে। কিন্তু, বিছানাটা যেন ডাকছে! হালকা বিশ্রাম নিলে মাথাটা খুলে যাবে বলে হঠাৎ মনে হলো ওর। মুহূর্তের নোটিশে নিজেকে বুঝিয়ে ফেলল এতক্ষণ শুধু বিশ্রাম নেয়নি বলেই স্পারটা খুঁজে পায়নি। এরকম একটা যুক্তির পর সময় নষ্ট করার কোর অর্থই হয় না, খাওয়া-দাওয়ার কথা পরেও ভাবা যাবে।
মনস্থির করে নিয়ে ঘৃণ্য বুট জুতো আর ভাড়ের পোশাক খুলে ফেলল ব্যাগলে। লম্বা আন্ডারপ্যান্ট পরা অবস্থায় আনমনে খাটে বিছানো কম্বলের ওপর বসল। পর মুহূর্তেই কাটার খোঁচা খেয়ে তিন হাত লাফিয়ে উঠতে হলো ওকে। হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেঝেতে। গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো আর্তচিৎকার। হাত দুটো চলে গেল পেছনে। চমক সামলে কম্বল সরিয়ে দেখল তলায় সাজিয়ে রাখা আছে অন্তত ডজন খানেক স্পার।
মুখটা টকটকে লাল হয়ে উঠল হতবিহ্বল ব্যাগলের। করিডরে খিকখিক করে হাসছে ফ্র্যাঙ্ক নোয়ক!
যথেষ্ট সহ্য করেছে ও। আর না। ওই নোয়াক ছোঁড়ার নাক গলানোর নোংরা অভ্যেসটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আচ্ছা মত শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে। ছোটখাট একটা গর্জন ছেড়ে ঘর থেকে ছিটকে বেরল ব্যাগলে।
ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক এত চটজলদি শত্রু পক্ষের আক্রমণ আশা করেনি, ফলে একটু হকচকিয়ে গেল। ছুটতে শুরু করার আগেই তার চুলের গোছা মুঠো করে ধরে ফেলল ব্যাগলে। করিডরে, দৌড়ের আওয়াজ আর ফ্র্যাঙ্কের আতঙ্কিত চিৎকারে পাশের একটা দরজা খুলে গেল। পুরো চৌকাঠ জুড়ে দেখা দিল মন্ট্যানা সেন্ট্রালের ভাইস প্রেসিডেন্ট, গুণী পুত্রের গর্বিত পিতা, ভাউবয়েস সি ভাউবয়েস নোয়ক।
কী ব্যাপার। কী হচ্ছে? জানতে চাইল সে।
স্পার! প্রায় গর্জে উঠল ব্যাগলে। আপনার ছেলে আমার বিছানায় একগাদা স্পার বিছিয়ে রেখেছে! খুন করে ফেলেছিল আরেকটু হলে!
আমি শুধু সাহায্য করতে চাইছিলাম, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক। মিস্টার ব্যাগলের কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। ওই স্পারগুলো জোগাড় করতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার!
পেলে কোথায়? জানতে চাইল ভাউবয়েস।
সেলুন ঘুরে ঘুরে মাতাল কাউবয়দের পা থেকে খুলে এনেছি।
ও! খুকখুক করে কাশল ভাউবয়েস। ব্যাগলের দিকে তাকাল। সত্যি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে চাইছিল ফ্র্যাঙ্ক।
তাহলে আমার বিছানায় কেন
যদি ওগুলোর কোনটা সেই মূল্যবান স্পার হয়, সেজন্যে আমি খোলা জায়গায় রাখতে সাহস পাইনি, যুক্তি দিল ফ্র্যাঙ্ক। এমনকি ডেস্ক ক্লার্কও বলতে পারবে না কখন চাবি সরিয়ে ঘর খুলে স্পারগুলো রেখে আবার ওটা ফিরিয়ে দিয়েছি।
ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাও না। চড় তুলল ক্ষীপ্ত ব্যাগলে। উঁহু, পাছাটা একেবারে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে!
আহাহা, ব্যাগলেকে থামতে ইশারা করল ভাউবয়েস। চেহারায় অস্বস্তি। খুকখুক করে কাশল। থেমে থেমে বলল, আমার মনে হয় এবারের মত ওকে আপনার সন্দেহের অবকাশে মুক্তি দেয়া উচিত, ব্যাগলে। কোন বিপদ হয়ে গেলে ওর মা আমাকে দুষবে। আমি কথা দিয়েছি ওর গায়ে ফুলের টোকাও পড়বে না।
ভাউবয়েসের চোখে নীরব অনুরোধ দেখে নিজেকে ব্যাগলে সামলে নিল। বিবাহিত মানুষ হয়ে আরেকজন বিবাহিত মানুষের জীবন থেকে সুখ কেড়ে নিতে সায় দিল না ওর মন। ভাউবয়েসের দৃষ্টিতে যে আবেদন ছিল সে আবেদনে পাথর গলে যেত আর এ তো মানুষের মন। হঠাৎ ব্যাগলের খেয়াল হলো সে আন্ডারপ্যান্ট পরে করিডরে দাঁড়িয়ে আছে। হৈ-চৈ শুনে খুলে গেছে কয়েকটা দরজা। কৌতূহলী মুখ উঁকি মারছে সেখান থেকে।
নীরবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াল ও। আফসোসের সঙ্গে মাথা নেড়ে ভাবল আজ সারাদিনের অনর্থক ভোগান্তির কথা। মনে মনে একটু ঈর্ষাই অনুভব করল, ওর এদিকে এই দুরবস্থা আর বাঁধনহারা পাখির মত মজা করে এন্ড অভ স্টীলে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেনন।
০৭. ঠকানোর সাধ
ঠকানোর সাধ জীবনের তরে মিটিয়ে ছেড়ে দেব! হুঙ্কার ছেড়ে আরেক ঝাঁকি দিল বেননকে বিগ জিমি। উত্তোরোত্তর রেগে উঠছে লোকটা।
একবার মার্লোন ব্র্যান্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখো, বাধ্য হয়ে মত পাল্টে চেঁচাল বেনন। হাড়গোড় আস্ত থাকতে থাকতেই বিগ জিমিকে থামানো দরকার। ওই টেলিগ্রামটা মিথ্যা!
তাই নাকি! দাঁত খিচিয়ে টিটকারি মারল নর্টন। বেননকে মেঝেতে নামিয়ে টেলিগ্রাফারকে ইশারা করল। বেননের অস্ত্র নিয়ে নিল লোকটা। আরও বার দুয়েক ওর ঘাড়ে ঝাঁকি দিয়ে নর্টন বলল, মার্লোন ব্র্যান্ডন আজকে রাতেই এন্ড অভ স্টীলে আসবে, তোমাকে দেখে সে যদি ছেড়ে দিতে বলে তো ছেড়ে দেব। টেলিগ্রাফারের দিকে ফিরল সে। একে নিয়ে আটকে রাখো, বস এলে তখন দেখা যাবে।
পা নাড়াও! ওরই সিক্সগান দিয়ে পিঠে এক খোঁচা লাগিয়ে বেননকে ধমক মারল টেলিগ্রাফার।
একটা টুল শেডে ওকে নিয়ে এলো লোকটা। ধাক্কা দিয়ে ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজায় তালা মেরে চলে গেল।
ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। কিছুক্ষণ পর চোখ সয়ে এলো, আবছা ভাবে সবকিছু দেখতে পেল বেনন। ঘর বোঝাই বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি। শাবল, স্লেজ হাতুড়ি, পেরেক, ক্রোবার, ডিনামাইট, ফিউজ, কোন কিছু বাদ নেই। এঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া কোন সমস্যাই নয়। জীবনে কোন জেলখানায় পালাবার এত ভাল ব্যবস্থা দেখেনি বেনন।
জামাকাপড় ঠিক করে নিয়ে পেটমোটা একটা বস্তার ওপর বসল ও, তিক্ততায় ছেয়ে গেল মনটা; এরকম ব্যবহার পাবে জানলে কে আসত এখানে! জামাই আদর না পেলেও মনে মনে খাতির পাবে আশা করেছিল ও। সেকারণেই খারাপটা লাগছে বেশি।
মনটা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যে ভাবতে লাগল ও টেলিগ্রামটার কথা। কে পাঠিয়েছে ওটা? ওকে ছোট করে কার কি লাভ? ভাউবয়েস আর চিমসে ব্যাঙ্কারের চেহারা ভেসে উঠল ওর মনের পর্দায়। ওদেরকে কাজে নেয়ার ব্যাপারে আপত্তি ছিল ওই দু’জনের। কিন্তু তাই বলে কিছুই নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ব্র্যান্ডনকে ঠেকাতে পারত ভাউবয়েস। তা সে করেনি। আর ব্যাঙ্কার লোকটা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে কথা দিয়েছে সর্বোতভাবে সাহায্য করবে। তাহলে? ডক্টর ওয়াং কিন্তু রেলরোডের টেলিগ্রাফ ব্যবহার করতে পারবে লোকটা?
চিন্তা কোন সমাধান দিচ্ছে না দেখে অন্য দিকে মন দিল ও। এভাবে বসে বসে বেতন নেয়ার কোন মানেই হয় না। অনেক কাজ পড়ে আছে, পালাতে হবে এখান থেকে। ঘরের কোণা থেকে একটা ক্রোবার তুলে দরজা আর চৌকাঠের ফাঁকে ঢুকিয়ে চাড় দিল ও। চড়চড় আওয়াজ তুলল দরজা। ককিয়ে উঠল কজা। উৎসাহ বোধ করলেও থেমে যেতে হলো ওকে।
দরজার ওপাশ থেকে পাথরের মত ভারী গলায় কথা বলে উঠেছে এক লোক। আবার চেষ্টা করে দেখো, এক বাড়িতে তোমার মাথায় স্লেজ হ্যামারের হাতল বাকা করব আমি।
গার্ড আছে তাহলে! ক্রোবার নামিয়ে রেখে আবার সেই বস্তাটার ওপর বসল বেনন। নাহ্, মার্লোন ব্র্যান্ডন আসার আগে এখান থেকে মুক্তি পাবার কোন আশা নেই। বাধ্য হয়ে অন্যদিকে মনোযোগ ফেরাল ও, শুনতে লাগল রেলরোড কর্মীদের কাজের শব্দ। একটা থেকে আরেকটা শব্দকে আলাদা করতে লাগল। গড়গড়িয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফ্রেইট ওয়্যাগন, ঘণ্টি বাজাচ্ছে একটা লোকোমোটিভ এঞ্জিন, ঢংঢং করে স্লেজ হাতুড়ি পড়ছে রেল লাইনের পাতের ওপর; দূর থেকে ভেসে আসছে মেঘ গর্জনের মত গুরুগম্ভীর আওয়াজ, ডিনামাইট ফাটিয়ে ক্যানিয়নের মাঝে পথ করছে শ্রমিকরা।
হঠাৎ খুব কাছেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটল। আওয়াজের প্রচণ্ডতায় চমকে গেল বেনন। ডিনামাইট নয়, এ-শব্দ বাজ পড়ার। মনে পড়ল এন্ড অভ স্টীলে আসার সময় উইটিগোর পাহাড় চূড়োর মাথায় ঘন কালো মেঘ ঝুলতে দেখেছিল ও।
একটু পরই গুমোট গরম হয়ে গেল ঘরের ভেতরটা। একটাও জানালা নেই। দরজার ফাঁক দিয়ে সামান্য একটু ফ্যাকাসে আলোর রেখা আসছে। বসে বসে ঘামতে লাগল বেনন। অতি ধীরে পেরচ্ছে সময়, কটা বাজে এখন জানার উপায় নেই। আলো কমে আসার অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে ওর মনে হলো অনন্ত কাল পেরিয়ে যাচ্ছে।
সন্ধের পর দরজা খুলে গেল, এক বাটি গরম স্ট্যু নিয়ে ভেতরে ঢুকল একজন আইরিশ কুলি। বাটিটা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, খেয়ে নাও, জোর ফিরে পাবে।
বেশ সুস্বাদু, কয়েক চামচ খেয়ে দেখল বেনন। তারপর চামচ নামিয়ে জানতে চাইল, মার্লোন ব্র্যান্ডন এখনও আসেনি?
না। কৌতূহল ফুটল কুলির চেহারায়। কেন, তার কাছে কি দরকার তোমার?
প্রসঙ্গ পাল্টাল বেনন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে?
হবে। এদিকে ধেয়ে আসছে ঝড়।
আর কোন কথা হলো না, বেননের খাওয়া শেষ হতেই বাটি নিয়ে দরজায় তালা মেরে চলে গেল লোকটা।
বাইরে গার্ডের নড়াচড়ার শব্দ পাচ্ছে ও। করার কিছু নেই, চুপ করে বসে থাকল বেনন। সন্ধে নেমেছে বাইরে। আরও ভ্যাপসা হয়ে উঠেছে কুঁড়ের ভেতরটা। গুড়গুড় শব্দে ডাকছে বাজ। ছাদে বৃষ্টি পড়তে লাগল ফোঁটা ফোঁটা। এখনও মার্লোন ব্র্যান্ডনের দেখা নেই।
রাতটা ভীষণ বিরক্তিকর আর দীর্ঘ হবে, বিরক্তির সঙ্গে ভাবল বেনন। শহরে চলে গেল মনটা। কি করছে এখন ব্যাগলে? মজা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিশ্চয়ই? নাকি কোন সেলুনে বসে গলা পর্যন্ত গিলে চলেছে?
অস্বাভাবিক একটা শব্দ ওঁকে বাস্তবে নিয়ে এলো। কান পাতল ও, বাইরের কোলাহল ছাপিয়ে উঠছে ক্যানিয়নের পাথুরে মেঝেতে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। প্রথমে কম ছিল, তারপর বাড়তে লাগল; শেষে ছাপিয়ে উঠল সমস্তকিছু। দ্রুত কাছে চলে আসছে ঘোড়াগুলো। বেগ বেড়েছে বৃষ্টির, ঘনঘন ঝিলিক মেরে গর্জন ছাড়ছে বাজ; তারপরও শুনতে পেল ও পরিচিত আওয়াজটা। গুলি করছে কারা যেন!
চিৎকার চেঁচামেচি হৈ-হুলস্থূল শুরু হয়ে গেল চারপাশে। ঘোড়ার যাত্রাপথ থেকে হুড়মুড় করে সরে যাচ্ছে চাইনিজ কুলিরা। আইরিশ আর স্কটিশরা পাল্টা জবার দিচ্ছে।
ক্যাম্পে হানা দিয়েছে দুবৃত্তের দল, বুঝতে দেরি হলো না বেননের। আমাকে বেরতে দাও! দরজার সামনে গিয়ে চেঁচাল ও। বাইরে থেকে কোন সাড়া এলো না। লোকটা বোধহয় বদমাশদের প্রতিহত করতে গেছে।
দরজা ফুটো করে বেননের মাথার এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে শিস কেটে ঘরে ঢুকল একটা বুলেট। গুলি করতে করতে বিদ্যুদ্বেগে কেবিনটা পেরিয়ে গেল প্রথম ঘোড়সওয়ারী। এটা নিশ্চিত যে কেবিনের সামনে গার্ড নেই এখন। একটা ক্রোবার তুলে নিয়ে দরজার কিনারায় চাড় দিল বেনন। এবার ধমক খেতে হলো না ওকে। কজা ভেঙে খুলে গেল দরজা।
বাইরে বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা। উন্মত্তের মত আচরণ করছে মানুষগুলো আচমকা বিপদের মুখোমুখি হয়ে। অন্তত দশজন হানাদার হামলা চালিয়েছে ক্যাম্পে। একটানা এলোপাতাড়ি গুলি করছে লোকগুলো। আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে একটা কেবিনে। বৃষ্টির মধ্যেও দাউ দাউ করে জ্বলছে কেবিনটা। বেননকে পাশ কাটাল এক ঘোড়সওয়ার, সামনে এক আইবিশ শ্রমিক পেয়ে মাথা ফাটিয়ে দিল পিস্তলের বাড়িতে। পড়ে গেল আইরিশ। মুহূর্তের জন্যে সওয়ারীর চেহারাটা দেখতে পেল বেনন। আগেও লোকটাকে দেখেছে ও, ঘোড়ায় বসার ভঙ্গিটা পরিচিত, স্টেজকোচ ডাকাতি করতে আসা সেই তিনজনের মধ্যে এই লোকও ছিল। এ-ই এগিয়ে এসে মিস হ্যাটারের কাছে স্পারটা চেয়েছিল। একটা কথাই মনে এলো বেননের, ডক্টর ওয়াং!
চমকে উঠে লাফ দিয়ে সরে গেল বেনন। দ্বিতীয় অশ্বারোহী ততক্ষণে চলে এসেছে প্রায় ওর ঘাড়ের কাছে। রাইফেলের ব্যারেলটা ওর মাথা লক্ষ্য করে তলোয়ারের মত চালাল লোকটা। ঝুঁকে মাথা বাঁচাল বেনন, পরমুহূর্তে সামনে বাড়ল, কাঁধ আঁকড়ে ধরে ঘোড়া থেকে টেনে নামাল লোকটাকে। পাকা কুস্তিগীরের মত বেননকে নিয়ে মাটিতে পড়ল লোকটা। একসঙ্গে আছাড় খেল দু’জন। আগে সামলে নিল বেনন, নাক সই করে গায়ের জোরে একটা ঘুসি বসিয়ে দিয়েই লোকটার হোলস্টার স্ট্র্যাপ খুলে অস্ত্র বের করে নিল। এদিকে প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে উঠে ওর গলা টিপে ধরেছে শত্রু। শ্বাস নেয়া যাচ্ছে না। হাতের চাপ বাড়ছে ক্রমেই। উপায়ান্তর না দেখে লোকটার মাথায় সিক্সগানের বাট নামিয়ে আনল ও। অনুভব করল হঠাৎ করেই শিথিল হয়ে গেছে গলায় চেপে বসা দু’হাত।
উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল ও। এদিকে কারও মনোযোগ নেই। জান বাঁচাতে ব্যস্ত সবাই। দুবৃত্তের ঘোড়াটার ওপর চোখ পড়ল ওর। বিধ্বস্ত একটা তাবুর দড়িদড়ায় আটকে গিয়ে পালাতে পারেনি জন্তুটা। সুযোগ চিনতে ভুল করল না বেনন, দৌড়ে গিয়ে দড়ির জট ছাড়িয়ে উঠে পড়ল স্যাডলে। মাথায় একটা চিন্তাই কাজ করছে, ও পালিয়েছে এটা বিগ জিমি নর্টন টের পাওয়ার আগেই যত দ্রুত সম্ভব সরে যেতে হবে এখান থেকে। ওই চুলোর মত গরম কেবিনে বন্দী হয়ে সারারাত কাটানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর। রাশে দোলা পড়ায় পশ্চিমে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াটা। সামনে আরও কয়েকটা ঘোড়ার আবছা আকৃতি দেখতে পেল বেনন। হামলা শেষ করে ফিরতি পথ ধরেছে হানাদারের দল। আচম্বিতে আক্রমণ করে ক্যাম্প তছনছ করে দেয়াই তাহলে ছিল লোকগুলোর উদ্দেশ্য! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল বেনন, ঝুঁকি যতই থাক, হারামিগুলোকে অনুসরণ করবে ও, খুঁজে বের করবে তাদের আস্তানা।
আগের চেয়ে বাতাসের বেগ বেড়েছে, অঝোর ধারায় ঝরছে। বৃষ্টি; ভিজতে ভিজতে ডাকাত দলের পিছু নিল ও। একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল জলের ছিটায় নিভে যাচ্ছে ক্যাম্পের আগুন। আর কিছুক্ষণ পর ক্যাম্পটা দেখাই যাবে না। এগিয়ে চলল বেনন।
অন্ধকার চিরে হাজার হাজার নীলচে সাপের মত ঝিকিয়ে উঠছে বিদ্যুৎ। পরক্ষণেই শোনা যাচ্ছে ভারী কামানের মত বজ্রপাতের আওয়াজ। ক্যানিয়নের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে বারবার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সে-আওয়াজ।
সামনের দিকে নজর থাকায় চারপাশে চোখ বোলানোর সুযোগ পায়নি বেনন। হঠাৎ চমকে উঠল ও ডানধারে জিমি নর্টনের বিরাট আকৃতি দেখতে পেয়ে। বিজলির আলোয় ওকেও দেখে ফেলেছে লোকটা, কারণ ‘ধরো, ধরো’ বলে আশেপাশের শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়ল সে। হায়হায় করে উঠল যখন দেখল ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে পালাবার তাল করছে বেনন। গেল, গেল বলে আকাশ মাথায় করল লোকটা। তারপর বেনন সত্যিই যখন আঁধারে মিলিয়ে গেল; হতাশার চোটে মনের ভুলে ধপ করে কাদামাটিতে বসে পড়ল সে। তার দৃঢ় বিশ্বাস আজকের হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল রক বেনন নামের ধুরন্ধর আউট-লকে মুক্ত করে নিয়ে যাওয়া। একটুর জন্যে ফস্কে গেল শয়তানটা। রাগে মাথার চুল খামচে ধরল জিমি নর্টন।
দানবটাকে এড়াতে পেরে স্বস্তির শ্বাস ফেলে সামনে মনোযোগ দিল বেনন। বিদ্যুৎ চমকের আলোয় দেখতে পেল অশ্বারোহীরা একজন একজন করে ঢুকছে সরু একটা ক্যানিয়নে। গতি আরও বাড়াল ও। বিপদের সম্ভাবনা আছে, কিন্তু তোয়াক্কা করছে না মোটেও। দু’বার হোঁচট খেল ঘোড়াটা, পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিল। শেষ অশ্বারোহীর সঙ্গে দুশো গজ দূরত্ব বজায় রেখে ক্যানিয়নে ঢুকল বেনন। বুঝতে পারছে উভয় সঙ্কটে পড়েছে। বেশি এগিয়ে গেলে বদমাশগুলো বুঝে যাবে সে ওদের দলের লোক নয়। এতক্ষণে বুঝেই গেছে কিনা কে জানে! আবার পিছিয়ে থাকলেও রেলরোড শ্রমিকদের হাতে ধরা পড়ার ভয় আছে। নিয়মিত অত্যাচারে খেপে উঠেছে লোকগুলো। গলার আওয়াজ, হাঁকডাক আসছে পেছন থেকে; ক্রুরা এখনও হাল ছেড়ে দেয়নি, এগোচ্ছে দল বেঁধে, দু’একটাকে ভাগ্যক্রমে ধরতে পারলে গণপিটুনি দিয়ে মেরেই ফেলবে।
দম আটকে এলো ওর এই ক্যানিয়নেও রেল রোডাররা আছে বুঝতে পেরে। আঁধারে পরস্পারের নাম ধরে ডাকাডাকি করছে তারা। গ্রেডার আর ট্র্যাক লেয়াররা জানতে চাইছে ক্যাম্পের ওদিকে এত গোলমাল কিসের। অন্তরের গভীরে ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে ছুটে পালাবার তাগিদ অনুভব করল বেনন। অনুভূতিটাকে গলা টিপে মারল ও। যতই সামনে এগিয়েছে, আরও সরু হয়ে গেছে ক্যানিয়ন। ছোট বড় অজস্র বোল্ডার পড়ে আছে মেঝেতে। তাড়াহুড়োর পরিণতি এখন নিশ্চিত দুর্ঘটনা।
বিপদের ওপর বিপদ; হঠাৎ টের পেল ও চারপাশ থেকে চেপে আসছে লোকগুলো। বিজলির আলোয় চাইনিজ কুলিদের একজনকে এতই কাছে দেখল ও যে ইচ্ছে করলে ছুঁয়ে দিতে পারত লোকটার কাঁধ। কি যেন জিজ্ঞেস করল লোকটা ওকে। কিছু একটা বুঝ দেয়ার জন্যে মুখ খুলতে গিয়েও বোবা বনে গেল বেনন। আবার চমকে উঠেছে বিদাত স্ফুলিঙ্গ। এবারের ঝিলিকটা অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক উজ্জ্বল। সেই চকিত আলোয় মুহূর্তের জন্যে দেখা গেল বিশালকায় এক বিকট প্রাণী বিরাট লেজটা দুলিয়ে সামনে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। অপলক তাকিয়ে থাকল বেনন। ঢোক গিলতে গিয়ে বিষম খেল। শরীরের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেল ভয়ে। ওটা যে ডায়নোসর জানে না বেনন; শুধু জানে এদৃশ্য দেখার পর পাগল হয়ে গেলেও ওকে দোষ দেয়া যায় না।
মাত্র এক মুহূর্ত, তারপাই আঁধারে ঢেকে গেল সবকিছু। আর্তনাদ করে উঠল কুলি-মজুরের দল। আতঙ্কে ছুটতে লাগল ক্যাম্পের দিকে। ওরাও দেখেছে, তারমানে ওর মাথাটা আসলেই নষ্ট হয়ে যায়নি, একটু স্বস্তি বোধ করল বেনন। পরক্ষণেই উড়ে গেল ওর স্বস্তি। কুলিদের তুলনায় কম ভয় পায়নি ওর ঘোড়াটা; কিন্তু কুলিদের মত বুদ্ধি করে উল্টো দিকে না গিয়ে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে সোজা ছুটে গেল ওটা যেখানে একটু আগে ছিল সেই ভয়াবহ সরীসৃপ।
চোখ বন্ধ করে ঘোড়ার গলা জড়িয়ে ধরে দাঁতে-দাঁত চেপে বসে থাকল বেনন। ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। কপালে যদি গিরগিটির পেটে যাওয়া থাকে তো ঠেকাবে কে! এই বৃষ্টিতে ভেজা পিছলা ক্যানিয়নে ভীত-উন্মত্ত ঘোড়াটাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ করতে যাওয়া আর সেধে আত্মহত্যা করতে যাওয়া একই কথা।
০৮. আফসোস করে আর লাভ নেই
হায়-আফসোস করে আর লাভ নেই, ভাবল বেনন। আজকে এই মুহূর্তে ও মর্মে মর্মে বুঝতে পারছে সুখে থাকতে ভূতে কিলায় কথাটার অর্থ কি। ঘাড় ধাক্কা, পেছন থেকে ঠেলা গুঁতো আর অন্যান্য অপমানের মাঝে বেশ ছিল সে জিমি নর্টনের ক্যাম্পে। কিন্তু এখন? এবার চারতলা বাড়ির সমান ওই গিরগিটির বিরুদ্ধে কি করবে ও একটা সিক্সগান দিয়ে! কামান থাকলেও ওটাকে ঘায়েল করা যাবে কিনা কে জানে!
বাস্তববাদী একজন মানুষ বলে নিজেকে মনে করে বেনন। কই ব্যাগলের মত ভূতে বিশ্বাস করে ও করে না। নিজের চোখে না দেখে বিশ্বাস করেছে ও কোনদিন কোন কিছু? না, করেনি। আজকেও ডায়নোসর না দেখলে বিশ্বাস করত না যে ওই অতিকায় প্রাণী বাস্তবিকই আছে। পত্রিকার পাতায় ডায়নোসরের ছবি দেখেছে ও, শুনেছে লক্ষ লক্ষ বছর আগে মরে ভূত হয়ে গেছে ওগুলো। একটা কথাও বিশ্বাস করেনি, ভেবেছে গুল মারছে ব্যাটারা পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্যে; অতবড় প্রাণী কস্মিনকালেও ছিল না এই পৃথিবীতে। কিন্তু আজকে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে দিশেহারা লাগছে ওর। টের পেল ভয়ে কাঁপছে। আদিম একটা ভীতি জড়িয়ে ধরেছে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে। বুঝতে পারছে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, অথচ আতঙ্ক ঠেকাবার কোন উপায় ওর জানা নেই। মনে মনে প্রার্থনা করল যাতে এক্ষুণি এই দুঃস্বপ্ন ভেঙে যায়, যাতে এক্ষুণি ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায় পাশে শুয়ে বেঘোরে নাক ডাকাচ্ছে ব্যাগলে।
আবার ঝিলিক দিল নীলচে আলো। ফুট বিশেক দূরে বাজ পড়ল, পুড়ে কয়লা হয়ে গেল ক্যানিয়নের দেয়ালের গায়ে মাথা জাগানো একটা সিডার গাছ। পলকের জন্যে ক্যানিয়নের কালো দেয়াল দেখতে পেল বেনন। হোঁচট খেতে খেতে ছুটছে ওর ঘোড়াটা। কোথাও নেই সেই অপার্থিব বিভীষিকা। যেন স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা শ্বাস টানল বেনন। ডায়নোসরটা দেখা না দিলে হয়তো ক্ষিপ্ত কুলিদের হাতে ধরা পড়ে যেত, ছিঁড়ে ফেলত লোকগুলো ওকে ডাকাত দলের সহযোগী মনে করে।
ঘোড়াটা নিজের ইচ্ছেয় চলছে। কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতে পারল না ও। তবু আপাতত রক্ষা পেয়েছে বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল। এতক্ষণে কিছুটা সামলে নিয়েছে। এক ফোঁটা লজ্জা লাগছে না ভয় পেয়েছিল বলে। অতি বড় সাহসীরও আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে ওই দৃশ্য দেখলে।
আঁধার রাত, ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে একাকী এগিয়ে চলল ও; জানে না গন্তব্য কোথায়। একসময় পরিশ্রান্ত হয়ে গতি কমাল ঘোড়াটা। ঠাহর করে দেখল বেনন, ডায়নোসরের ক্যানিয়ন পেছনে ফেলে এসেছে ও। হামলাকারীদের কোন চিহ্ন নেই কোথাও। এই মেঘলা রাতের ঘুটঘুঁটে আঁধারে তাদের অনুসরণ করতে পারবে সেই আশাও নেই, তবে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে ওর মাথায়। ঘোড়াটা হয়তো অভ্যেস বশে ওকে নিয়ে যাবে লোকগুলোর গোপন আস্তানায়। অপেক্ষা করে কি ঘটে দেখার সিদ্ধান্ত নিল সে।
ঘণ্টা দুয়েক পরে বৃষ্টির বেগ কমে এলো। এখনও পড়ছে, তবে ঝিরিঝিরি। কালো মেঘের আড়াল থেকে ক্যানিয়নের ভেতর তাকাল একটুকরো ফ্যাকাসে চাঁদ। পুরোপুরি দিকভ্রান্ত হয়ে গেছে বেনন, শুধু এটুকু জানে উত্তর-পশ্চিমের দিকে যাচ্ছিল ও ডায়নোসরের ভয়ে ঘোড়াটা ছুটতে শুরু করার আগে।
ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে ও। শীত করছে। ক্লান্তিতে মনে হচ্ছে এখনই পড়ে যাবে ঘোড়া থেকে। একটু বিশ্রাম নিতে পারলে হত। তবু এগিয়ে চলল বেনন। অন্তত সকাল হওয়ার আগে থামতে চাইছে না। হাঁটছে ঘোড়াটা। নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরছে। এখনই ওটাকে থামানো উচিত হবে না।
শেষ পর্যন্ত ভোরের আগে দিয়ে ক্লান্তির কাছে হার মানল ও। ঘোড়া থামিয়ে পাথুরে একটা জমিতে নামল। স্যাডল আর কম্বল খুলে নিয়ে বিছিয়ে দিল ভেজা মাটিতে। ঘোড়ার যত্ন নেয় দুবৃত্ত, স্যাডল ব্যাগের পাশে ঝোলানো গানিস্যাকে ভেজা ছোলা পাওয়া গেল। জানোয়ারটাকে খাইয়ে কম্বলের ওপর চিৎ হলো বেনন, বালিশ বানাল স্যাডল দিয়ে। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ল নিজেও বলতে পারবে না।
ঘুম যখন ভাঙল ওর মনে হলো চোখ দুটো বুজেছে এক মিনিটও হয়নি। চোখ না খুলেও বুঝতে পারল চারদিকে প্রখর সূর্যের আলো। তারপর কষ্টেসৃষ্টে চোখ যখন খুলল, ওর মনে হলো ব্যাগলের মতন হাজার দশেক গালিগালাজ মুখস্থ থাকলে ভাল হত। পালিয়েছে ঘোড়াটা ও যখন ঘুমাচ্ছিল। নিশ্চয়ই ফিরে গেছে ওটা দস্যুদের আস্তানায়। কোথায় আছে জানে না বেনন, ইচ্ছে হলো কান মুচড়ে দেয় নিজের। অজস্র ক্যানিয়নে ভরা অচেনা এই এলাকায় লোকালয় কত দূরে কে জানে! পায়ে হেঁটে আশ্রয়ের সন্ধানে বেরতে হবে এখন।
পাথরের খাজে জমে থাকা পানি দিয়ে তৃষ্ণা মেটাল ও। কিন্তু খিদে পেটের ভেতর ছুঁয়ে নাচছে। সেই কাল সন্ধেয় এক বাটি স্টু, তারপর থেকে পেটে আর কিছুই পড়েনি। চারপাশটা ঘুরে দেখল ও, উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম, কিছুই বুঝতে পারল না। মাঝ-সকাল পেরিয়েছে, সূর্যটা ঝুলছে প্রায় মাথার ওপর। দিনের আলোয় কাল রাতে দেখা সেই ডায়নোসরের কথা মনে পড়ায় গোটা ব্যাপারটা স্বপ্ন বলে মনে হলো ওর। কোনদিকে যাবে স্থির করতে পারল না বেনন। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে হাঁটতে শুরু করল। ভাঁজ করে কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছে কম্বল আর স্যাডল।
প্রায় মিনিট বিশেক একটানা হাঁটার পর ভাগ্যদেবী ওর দিকে মুখ তুলে চাইল। বহুদূর থেকে ভেসে এলো ট্রেনের হুইসল। আওয়াজটা এসেছে দক্ষিণ-পুব থেকে, তারমানে ওদিকেই আছে রেল রোড়ারদের ক্যাম্প।
মাইল খানেক গিয়ে একটা রিজের গোড়ায় শেষ হয়ে এলো গভীর ক্যানিয়নটা। হাঁপাতে হাঁপাতে রিজ বেয়ে উঠে এলো ও। মনে আশা ছিল জনবসতি দেখতে পাবে। কিন্তু দপ করে নিভে গেল বুক ভরা আশা। সামনে আছে শুধুই আদিগন্ত প্রসারিত ঘাসজমি। জায়গায় জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ একটা দুটো সিডার আর কটনউড।
এক জায়গায় সিডার-কটনউডের ঘনত্ব বেশি দেখে সেদিকে মনোযোগ দিল ও। জঙ্গলের পেছনে দেখা যাচ্ছে একটা বাড়ির চিমনি। ধোঁয়া উঠছে চিমনি থেকে। গাছগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে আরও কয়েকটা কাঠের তৈরি কাঠামো। বাঙ্ক হাউজ, করাল, কুক শ্যাক আর বার্ন হবে ওগুলো, আন্দাজ করল বেনন। র্যাঞ্চ হাউজের পেছনে বিশাল জায়গা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা গোল টিলা। আরও দূরে দেখা যাচ্ছে উইটিগোর ঢেউ খেলানো মেঘাবৃত পর্বত শ্রেণী।
মার্লোন ব্র্যান্ডনের দেখানো মানচিত্রটা মনে পড়ল ওর। বুঝতে পারল ক্যানিয়নের গোলকধাঁধা পেরিয়ে হ্যাটারদের র্যাঞ্চের কাছে অজান্তেই পৌঁছে গেছে ও। বিরাট ওই গোল টিলাটা হচ্ছে কুঁজো পিঠ টিলা; খনি ছিল ওখানে, র্যাঞ্চারের অনুমতি পেলে ওটার ভেতর দিয়েই টানেল খুঁড়ে রেল লাইন করবে ব্র্যান্ডন।
ভাগ্যটা এখনও পুরোপুরি বিমুখ হয়নি। শ্রাগ করল বেনন; ক্লান্ত দেহ টেনে এগিয়ে চলল র্যাঞ্চ হাউজের দিকে। সমতলে পৌঁছে বুঝল যতটা সমান ভেবেছিল জমি এখানে ততটা সমতল নয়, জমিতে বড় বড় ঢেউ; নিচু জায়গায় দাঁড়ালে দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যায় র্যাঞ্চটা। খনির টিলাটা ওকে দিক ঠিক রাখতে সাহায্য করল। ওর মনে হলো অনন্তকাল ধরে হাঁটছে তো হাঁটছেই। দুপুর গড়িয়ে এলো। একটা ক্ৰীকের ধারে খানিক বিশ্রাম নিল ও। তৃষ্ণা মিটিয়ে রওয়ানা হলো আবার। জমিতে চরছে মোটাতাজা চমৎকার গরুর পাল; কিন্তু কোন কাউবয় দেখতে পেল না ও, ফলে বাকি পথটাও হাঁটতে হলো।
উইটিগো থেকে মোটা মোটা কাঠের গুঁড়ি এনে মজবুত করে বানানো হয়েছে র্যাঞ্চ হাউজ, বাঙ্ক হাউজ, কুক শ্যাক, বার্ন আর করাল; সবই পরিকল্পিত, শত্রুর হামলা এলে প্রতিহত করার চিন্তা মাথায় রেখেছে পাগলা হাটার। র্যাঞ্চ হাউজটা সৈনিকদের ব্যারাকের মত লম্বা আর নিচু। তিন দিকে বারান্দা, বেশ কয়েকটা করে জানালা আছে বাড়ির সব দিকে। বাড়ির মালিক সতর্ক থাকলে তিনশো গজের মধ্যে জানান না দিয়ে আসতে পারবে না কেউ।
বেননের অবশ্য তাতে কোন অসুবিধা হলো না। বাঙ্ক হাউজ খালি, কুরা সবাই বাইরে, রেঞ্জে গেছে রাউন্ডআপের কাজে। করালে লেজ নেড়ে মাছি তাড়াচ্ছে তাদের রেখে যাওয়া আট-দশটা ঘোড়া-এছাড়া জীবনের আর কোন স্পন্দন চোখে পড়ল না ওর। তবে লোক আছে বুঝতে পারল গলার আওয়াজ শুনে।
র্যাঞ্চ হাউজ থেকে ভেসে আসছে কথাবার্তার অস্পষ্ট শব্দ।
থেমে দাঁড়িয়ে ভাবল বেনন এরা কিভাবে নেবে এখানে ওর উপস্থিতি। পাগলা হ্যাটার এক কথার লোক, বলে দিয়েছে রেল রোডের কেউ এলে দেখামাত্র গুলি করবে। হুমকিটা হেসে উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। পাগলে কি না করে। সাহস করে বারান্দায় উঠে পড়ল বেনন। পশ্চিমের নাম আছে আতিথেয়তার জন্যে। অনেক পথ হেঁটে আশ্রয় চাইতে এসেছে সে। ক্লান্ত ক্ষুধার্ত একজন আশ্রয় প্রার্থীকে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবে না পাগলটা। অনিশ্চয়তায় দুলছে। ওর মন। লোকটা সাধারণ পাগল না হয়ে ঘোর উন্মাদ হলে বলা যায় না গুলি করেও দিতে পারে। এমুহূর্তে খাবার খেতে চায় ও, গুলি খাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।
বারান্দার কোণায় এসে আবার থেমে দাঁড়াতে হলো ওকে ওপাশে যে লোকটা কথা বলছে তার কণ্ঠস্বর ওর খুবই পরিচিত।
তারপর ডেইজির গলা শোনা গেল। খুবই রেগে আছে মেয়েটা। বলছে: আবার আমার সামনে পড়লে এবার আমি ওকে খুন করে ফেলব!
কার কথা বলে! আমার কথা? ভ্রূ কোঁচকাল বেনন।
আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝি, ডেইজি, গলায় মাখন ঢেলে বলল হ্যারি হুলাহান। কিন্তু ভেবে দেখো, যা হবার হয়েছে, ওসব ভেবে শুধু কষ্টই পাবে; তার চেয়ে চেষ্টা করে দেখো না ভুলে যেতে পারে কিনা। মনে রেখো তুমি একা নও, আমিও আছি, তোমার পাশে। যখনই ডাকবে, যত কাজই থাকুক চলে আসব আমি।
বুড়ো হাবড়া করেটা কী!! পটাচ্ছে মনে হচ্ছে না! এক পা এগিয়ে গেল বেনন।
ভুলে যাব? ফোঁস করে উঠল ডেইজি। কক্ষনো না। প্রতি বছর লোকটার পুতুল বানিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে টেইলহল্টের র্যাঞ্চাররা!
মানুষের রাগ পড়তে সময় লাগে, বলল হুলাহান। ফিলিপ হারমান ব্যাঙ্ক খালি করে দিয়ে চলে যাবার পর তেরো বছর পেরিয়েছে বটে, তবে বেশির ভাগ র্যাঞ্চারই এখনও ধকল সামলে উঠতে পারেনি। আর কিছুদিন যেতে দাও, রেল লাইন চালু হয়ে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, আয়-রোজকার ঠিক মত হলে দু’তিন বছরের মাথায় ভুলে যাবে ওরা ওই নামে কোন মানুষ ছিল।
আমি ভুলব না, দৃঢ় স্বরে সিদ্ধান্ত জানাল ডেইজি। সে ব্যাঙ্কারদের ঠকিয়ে ফতুর করে দিয়ে গেছে সেজন্যে নয়, ওই লোকটাকে আমি ভুলতে পারব না কারণ সে আমাকে এমন একটা পিতৃ পরিচয় দিয়ে গেছে যে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। আমি…আমি দেখামাত্র লোকটাকে খুন করব।
পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে বেনন। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কথোপকথন শুনছে। এখন ও জানে কার কথা আলাপ করছে ওরা দু’জন। উইটিগোর র্যাঞ্চাররা যে লোকটার প্রতিকৃতি কটনউড গাছে ঝুলিয়েছিল সেই ফিলিপ হারমান তাহলে ডেইজির বাবা? তাহলে পাগলা হ্যাটার কে!
বাবাকে তোমার মনে পড়ে ডেইজি? জানতে চাইল ব্যাঙ্কার। চেহারাটা অস্পষ্ট ভাবে মনে আছে।
তাই থাকার কথা। তুমি তখন ছ’বছরের ছিলে।
সে চলে যাওয়ার সেই রাতের কথা আমার আজও মনে আছে, থমথমে স্বরে বলল মেয়েটা। সেরাতে লোকটা বাইরে যাবার আগে আমাকে কোলে তুলে আদর করেছিল। ভাবতেও ঘেন্না হয় লোকটা আমার বাবা। বাবা হিসেবে কোন একটা দায়িত্ব সে পালন করেনি। আজ আমি কোথায় থাকতাম মিস্টার হ্যাটার যদি আমাকে আশ্রয় না দিতেন?
খুবই বড় মনের মানুষ হ্যাটার, একমত হলো হুলাহান। ব্যাঙ্ক লাটে ওঠায় আর সবার মত ওর অবস্থাও খুব খারাপ যাচ্ছিল তখন। আমি জানি, সেসময় তোমার বাবার ব্যাঙ্কে ক্যাশিয়ার ছিলাম আমি।
শুধু আশ্রয় নয়, আমাকে উনি একটা নাম দিয়েছেন। এমন একটা নাম যে নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে নিজেকে ছোট মনে হয় না। আমি চাই লোকে আমাকে চোরের মেয়ে নয়, হ্যাটারের মেয়ে বলে জানুক।
কোণায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিল বেনন। মখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে হ্যারি হুলাহান আর ডেইজি। হুলাহানের হাতে ঘোড়ার দড়ি। খানিক আগে পৌঁছেছে। ঘোড়ার মুখের ফেনা শুকায়নি এখনও। নিজের অতীত মনে পড়ল ওর। বুঝতে পারছে মেয়েটার মানসিক অবস্থা। কোন দোষ না করেও সমাজের বাঁকা দৃষ্টি সহ্য করা কতটা কঠিন জানতে বাকি নেই ওর। বিনা দোষে দোষী হলে কষ্টটা বুকে বাজে বেশি। সহানুভূতি অনুভব করল ও ডেইজির প্রতি।
তুমি কি কখনও আমার বউ হওয়ার কথা ভেবেছ, ডেইজি? মোলায়েম সুরে জানতে চাইল ব্যাঙ্কার।
ব্যাটা বলে কী! দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরল বেনন। বয়সের দিক থেকে ডেইজির বাবার চেয়েও বড় হবে লোকটা!
আবার শুরু করেছ তুমি! বলল ডেইজি। আমি মনে করেছিলাম রেল রোডের ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথা বলতে এসেছ।
সেটাও একটা কারণ। তবে আসল কারণ তুমি। তুমি কি বোঝ না কেন আমি বারবার ছুটে আসি? ব্যাঙ্কারের গলায় আবেগ। কণ্ঠস্বর কাঁপছে অল্প অল্প। আচ্ছা ডেইজি, তুমি কি মার্লোন ব্র্যান্ডনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছ? কি আছে ওর মধ্যে যা আমার মধ্যে নেই?
ওর হাসিটা মিষ্টি। ডেইজির চেহারা গম্ভীর। ঠাট্টা করছে। কিনা বোঝার উপায় নেই।
এই মেয়ে উটকো আপদ ঘাড় থেকে নামাতে ওস্তাদ, সিদ্ধান্তে পৌঁছল বেনন।
কিন্তু ডেইজি, ও তোমাকে সুখী করতে পারবে না, মরিয়া হয়ে বলল হুলাহান। ব্র্যান্ডনকে সারা বছর এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হবে। তোমাকে সে সময় দিতে পারবে না। আমার কথা একটু ভেবে দেখো। টেইল হল্টে বিরাট বাড়ি আছে আমার। বুক ভরা ভালবাসা আছে তোমার জন্যে।
থাকা উচিত। আমি তোমার মেয়ের বয়সী।
হতে পারি বয়সে বড়, মাথা দোলাল ব্যাঙ্কার, কিন্তু আমাদের সম্পর্কে বয়স কোন প্রভাব ফেলবে না। তোমাকে ছোটবেলা থেকে চিনি আমি। তুমিও আমাকে চেনো। দেখো, আমরা ঠিকই মানিয়ে নিতে পারব। সবাই হিংসে করবে আমাদের সুখ দেখে।
বয়স কত তোমার?
বেয়াল্লিশ।
তুমি বাবার চেয়ে বড় না? লাল হয়ে গেল ব্যাঙ্কারের চেহারা।
না, ফিলিপ আমার চেয়ে বড়। বয়সের পার্থক্য নিয়ে চিন্তা কোরো না তুমি, এসব কোন ব্যাপারই নয়, কেউ মনেই রাখবে না আমি তোমার চেয়ে বড়।
তোমার দয়া চাই না আমি।
কিন্তু…ডেইজি…
এ প্রসঙ্গে আর একটা কথাও নয়। ব্যাঙ্কারকে থামিয়ে দিল ডেইজি। আমি বিয়ের ব্যাপারে এখনই কিছু ভাবছি না। তুমি যদি এভাবে আমাকে বিরক্ত করো তোমাকে চলে যেতে বলতে বাধ্য হব আমি।
রাগ প্রকাশ পেল হুলাহানের কণ্ঠে। মার্লোন ব্র্যান্ডন আসার আগে তোমার মনোভাব এতটা কঠোর ছিল না।
ব্র্যান্ডনের চুল কোঁকড়া। জবাবে স্বপ্নালু হয়ে গেল ডেইজি।
আড়াল থেকে বাহাবা দিল বেনন। ভাল অভিনয় জানে মেয়েটা। এমন একটা ভাব করছে যেন ব্র্যান্ডন ছাড়া ওর দুনিয়াতে আর কেউ নেই। হ্যারি হুলাহানের বুড়ো কলজেয় ছ্যাকা দেয়ার কাজটা ডেইজি ভালই চালিয়ে নিচ্ছে।
কিছুক্ষণ –কুঁচকে চুপ করে থাকল ব্যাঙ্কার। তারপর ধীরে ধীরে বলল, একটা কথা তোমাকে আমি কখনও বলিনি, ডেইজি। আর কাউকেও বলা উচিত হবে বলে মনে করিনি। আমি জানি তোমার বাবা কোথায় আছে।
আড়ষ্ট হয়ে গেল ডেইজি। তুমি জানো!
হ্যাঁ, জানি। এতগুলো বছর মুখ বুজে আমি বিবেকের দংশন সহ্য করেছি। বারবার মনে হয়েছে র্যাঞ্চারদের সব বলে দিই। কিন্তু বলিনি। তুমি তো জানো তোমার বাবা একাধারে আমার বন্ধু আর নিয়োগকর্তা ছিল। তাকে ধরিয়ে দিতে মন সায় দেয়নি আমার। বন্ধুত্বের খাতিরে চেপে গেছি সব কথা। ক্ষমা করে দিয়েছি। তুমি বোধহয় জানো না আমারও বেশ কিছু টাকা ছিল ব্যাঙ্কে। সেগুলোও সে নিয়ে গেছে যাবার সময়।…তারপর ব্যাঙ্কটা যখন আমার হলো পশুর মত খেটেছি আমি যাতে র্যাঞ্চারদের আর্থিক অবস্থা ভাল হয়, যাতে ওরা ক্ষমা করে দিতে পারে তোমার বাবাকে। আশা করি পাঁচ বছর পর ওরা ভুলে যাবে যে ফিলিপ হারমান বলে এ অঞ্চলে কেউ ছিল।
কোথায় আছে লোকটা? অস্বাভাবিক শান্ত সুরে জানতে চাইল ডেইজি।
দক্ষিণ আমেরিকায়। ফিলিপ ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে পালিয়ে যাবার মাস ছয়েক পরে একটা চিঠি দেয়। লিখেছিল ভাল আছে। তবে চিঠির ভাষা পড়ে আমার মনে হয়েছিল অনুশোচনায় পুড়ছে ওর অন্তর। জানতে চেয়েছিল তুমি কেমন আছ। রাতের পর রাত আমি পায়চারি করেছি চিঠিটা আইনের হাতে তুলে দেব কি দেব না ভেবে। শেরিফের কাছে চিঠিটা দেয়া মানে একজন বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। শেষে গেলাম। শেরিফের অফিসে, খোঁজ নিয়ে জানলাম যে দেশে হারমান আছে সেখান থেকে তাকে ধরে আনা আইনের পক্ষে অসম্ভব। ওদের সঙ্গে আমাদের অপরাধী-বিনিময়-চুক্তি নেই। যেহেতু খবরটা পেলেও কারও উপকার হচ্ছে না তাই চুপ করে থাকাই ভাল মনে হলো। এতদিন পর আজই প্রথম তোমাকে বললাম কথাটা।
একদিন তোমার মুখ থেকে আমি বের করব কোথায় আছে সে, পায়চারি শুরু করল ডেইজি, দরকার হলে দুনিয়ার, আরেক প্রান্তে যাব আমি, তবুও তাকে খুঁজে বের করব।
একদিন তুমি অতীত ভুলে যাবে। আমি বুঝি না কেন তুমি এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ।
তোমার বোঝার কথা নয়।
র্যাঞ্চ হাউজের ভেতর থেকে কাশির আওয়াজ এলো।
বাবা ঘুম থেকে উঠেছে, বলল মেয়েটা। তুমি কি দেখা করবে?
হ্যাঁ। দেখা না করলেই নয়। এবার দেখা দেয়ার সময় হয়েছে, সিদ্ধান্তে এলো বেনন। স্পারের প্রসঙ্গ উঠবে এই আশায় আরও অপেক্ষা করত ও, কিন্তু পাগলা হ্যাটার জেগে ওঠায় আলাপ থামিয়ে ভেতরে চলে গেছে ডেইজি হ্যাটার।
মাঝারি মাপের একটা গলা খাকারি দিয়ে গটগট করে কোণা ঘুরে ব্যাঙ্কারের দিকে এগোল বেনন। ও ভাবতেও পারেনি ওকে দেখামাত্র অস্ত্র বের করবে লোকটা। কোল্ট ৪৫ এর কালো নলটা এক চোখো দানবের মত চেয়ে আছে দেখে অজান্তেই ঢোক গিলল ও। লোকটার চোখে খুনীর দৃষ্টি চিনতে ভুল হয়নি ওর।
ড্র করার চেষ্টা করবে? একটু দেরি হলে…
তাহলে এখানে এসে হাজির হয়েছ তুমি, খুনে কোথাকার! খেঁকিয়ে উঠল ব্যাঙ্কার।
র্যাঞ্চ হাউজের দরজা থেকে ভারী একটা কণ্ঠ নির্দেশ দিল, থামো বলছি, হুলাহান! আমার র্যাঞ্চে কাউকে যদি মারতে হয় তো আমি মারব!
শিরশির করে উঠল বেননের মেরুদণ্ড। বলে কী পাগলা হ্যাটার!
০৯. পাগলা হাটারকে দেখে অবাক
পাগলা হাটারকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না বেনন। ওর ধারণা ছিল লোকটা নোংরা পোশাক পরে থাকবে। ভ্রূ হবে টুথব্রাশের মত পুরু। করমচার মত লাল চোখে থাকবে ঘোলাটে দৃষ্টি। পেট পর্যন্ত লম্বা দাড়িতে চেহারাটা হবে ভয়ঙ্কর। কিন্তু পাগলা হ্যাটার মোটেই তেমন নয়। পাগলামির কোন লক্ষণ নেই তার মধ্যে। অন্তত বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই।
হ্যাঁ, লোকটা বিশালকায়। বয়স ষাটের ওপরে। শরীরে একফোঁটা চর্বি নেই। লম্বা লম্বা পাকা চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। প্রথম দর্শনেই বোঝা যায় হ্যাটার অত্যন্ত কর্তৃত্বপরায়ণ লোক, পরিবেশটা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। সাধারণ একটা মোটা কাপড়ের রেঞ্জ পোশাক পরে আছে সে।
আমি কি বলেছি তুমি শুনেছ, হুলাহান, শান্ত স্বরে বলল নিরস্ত্র র্যাঞ্চার। বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু পস্তাবে।
আস্তে আস্তে অস্ত্রটা নামিয়ে নিল ব্যাঙ্কার। ধিকিধিকি জ্বলছে। দু’চোখ। স্পষ্ট বুঝতে পারল বেনন, এ যাত্রা বেঁচে গেল শুধু পাগলা হ্যাটার এসে হাজির হওয়ায়। হ্যাটারের প্রচ্ছন্ন হুমকিতে ব্যাঙ্কার গুরুত্ব না দিলে এতক্ষণে সম্ভবত ওপারে পৌঁছে যেত সে।
খুনের অভিযোগে একে খোঁজা হচ্ছে, হ্যাটার, বলল হুলাহান। এই লোক রেল রোডে চাকরি নিয়ে সবার সর্বনাশ করতে এসেছে।
কি রকম? বেনন মুখ খুলতে যাচ্ছিল, তার আগেই জানতে চাইল হ্যাটার।
কালকে একে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বন্দী করা হয়। লোকটা ডাকাতদের কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে রাতেই তারা হামলা করে, ক্যাম্প থেকে একে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। তাদের ছোড়া গুলিতে কয়েকজন মজুর মারাও গেছে। সকালে আমি এন্ড অভ স্টীলে পৌঁছাই। অবাক হয়ে গেছি; না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, ক্যাম্পটা লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে কুকুরের দল।
রেল রোডের সমস্যা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই, ভ্র কুঁচকে বলল হ্যাটার। আমি চাই না ওই লোহার ঘোড়া আমার রেঞ্জের ওপর দিয়ে যাক। ওগুলো বাতাসে ধোয়া ছেড়ে পরিবেশ দূষিত করে। আমার গরুগুলো ভয় পেয়ে শুকিয়ে যাবে সেটা আমি হতে দেব না।
বুঝলাম। কিন্তু খুনীকেও তো তুমি প্রশ্রয় দিতে পারো না! মাথাটা খাটাও, লুকাস, খুনীকে বাঁচানো আর নিজে খুন করা প্রায় একই কথা। আবার অস্ত্র তুলে বেননের বুকে তাক করল ব্যাঙ্কার। বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই এর।
সেটা বিচার করার তুমি কে! তুমিই বা কোন্ অধিকারে একই সঙ্গে জাজ, জুরি আর জল্লাদ হয়ে বসেছ, হ্যাঁ?
পিছলা লোক এই রক বেনন। একবার ফস্কে বেরিয়ে গেলে আর একে ধরা যাবে না। আমি যা করছি বুঝেশুনেই করছি, ক্যাম্পটা একবার ঘুরে এলে একে খুন করার জন্যে কেউ আমার দোষ ধরবে না।
হুলাহানের দু’চোখে র্যাটল স্নেকের শীতল দৃষ্টি দেখে বুঝে নিল বেনন র্যাঞ্চারের কথায় আর কাজ হবে না, মনস্থির করে ফেলেছে লোকটা ওকে বাঁচতে দেবে না। হুলাহানকে ঠেকাতে পারবে না নিরস্ত্র হ্যাটার, যা করার ওকেই করতে হবে। সেক্ষেত্রে সময় নষ্ট করার অর্থ ঝুঁকির পরিমাণ আরও বাড়ানো। ডান পা তুলে দড়াম করে লাথি মারল বেনন শুটকি ব্যাঙ্কারের কোল্ট ধরা হাতে। দুম করে গুলি বেরল অস্ত্র থেকে। বারান্দার ছাদে গিয়ে বিধল গুলি। কোল্টটা মাটিতে পড়ার আগেই হুলাহানের ওপর ঝাঁপ দিল বেনন। রেলিং টপকে মাটিতে আছড়ে পড়ল দু’জন। রুগ্ন দেখালেও দড়ির মত পাকানো শরীর লোকটার, লড়তে গিয়ে বুঝল বেনন। অতিকায় পাইথনের মত ওর শরীরের তলায় মোচড় মারছে লোকটা। সুযোগ পেলেই ঘুসি মারছে বুক আর পেটে।
হুলাহানের ঘোড়াটা হঠাৎ করে পায়ের কাছে দু’জনকে গড়াগড়ি খেতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। উত্তেজিত হয়ে লাফঝাপ শুরু করল জানোয়ারটা। যেকোন সময় খুরের তলায় পড়ে যেতে পারে ওরা। একবার দুর্ঘটনা ঘটে গেলে বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
মরিয়া হয়ে কৌশলের বদলে গায়ের জোরকে কাজে লাগাল বেনন। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কোটের কলার ধরে হ্যাচকা টানে তুলে ফেলল সে হ্যারি হুলাহানকে। টেনে চড় লাগাল কয়েকটা। তারপর টানতে টানতে নিয়ে চলল ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াবার চৌবাচ্চার দিকে। ব্যাঙ্কার বাধা দেবার আগেই তার ঘাড় চেপে ধরে মাথাটা ঠেসে ধরল পানিতে। ঘন সবুজ পানিতে তিন দফায় আড়াই মিনিট লোকটাকে চুবিয়ে তারপর ছাড়ল ও। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, জানে বাচতে চাইলে ভাগো এখান থেকে।
জবাব দিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো হুলাহান। মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এলো সের খানেক আধপচা পানি। টলতে টলতে ঘোড়ায় গিয়ে উঠল লোকটা। বারান্দা থেকে তার অস্ত্রটা তুলে গুলি বের করে নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল বেনন। বলল, পরের বার এটা আমার ওপর ব্যবহার করার চেষ্টা করলে খুন হয়ে যাবে কথাটা মনে রেখো।
রক্ত লাল চোখে বেননের দিকে তাকিয়ে থাকল ব্যাঙ্কার। হুঁশ ফিরতে পারের খোঁচায় সামনে বাড়াল ঘোড়াটাকে। পেছন থেকে তাকিয়ে থাকল বেনন। লোকটা সাপের মত বিপজ্জনক বুঝতে দেরি হয়নি ওর। সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে হ্যারি হুলাহান। সুযোগ পেলেই ছোবল দেবে।
লোকটা চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার পর হ্যাটারের দিকে ফিরল বেনন। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে র্যাঞ্চার। ডেইজির চোখে উত্তেজনা। কমলার কোয়ার মত ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে আছে।
পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠার আগেই হাসল বেনন। বলল, খাবার চাইতে এসে শত্রুতা পাব জানতাম না।
চুপ করে থাকল র্যাঞ্চার। চেহারা দেখে বোঝা গেল লোকটা ওকে শত্রু না মিত্র ভাববে এখনও ঠিক করতে পারেনি। তারপর ত্যাগ করল সে। ডেইজিকে বলল, এর জন্যে নাস্তার ব্যবস্থা করো।
দ্বিধা কাটিয়ে উঠে বেননকে ইশারায় পিছু নিতে বলল ডেইজি।
লিভিং রুমটা তিরিশ বাই তিরিশ ফুট। আসবাবপত্রের বাহুল্য নেই। কয়েকটা চামড়ায় মোড়া চেয়ার। গোল একটা টেবিল। মেঝেয় বাড়িতে বানানো কার্পেট। দেয়ালে শিংওয়ালা হরিণের। মাথা। সবকিছুতে পাগলা হ্যাটারের রুচি আর ব্যক্তিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট।
একটা চেয়ারে বসে হ্যাটারের দিকে তাকাল বেনন। ওর অস্তিত্ব ভুলে গেছে লোকটা। একটা ক্যাটল ম্যান জার্নালের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছে, কিন্তু কিছু বুঝছে বলে মনে হয় না দু’চোখের শূন্য দৃষ্টি দেখে। একবার দাড়ি চুলকাল খানিকক্ষণ; আরেকবার চুলে আঙুল চালাল। বিড় বিড় করে বলল কি যেন।
চুল সরতেই র্যাঞ্চারের মাথার একপাশে গভীর একটা কাটা দাগ দেখতে পেল ও। ব্যাগলের কথা মনে পড়ল ওর। ব্যাগলে বলেছিল হ্যাটহীন হ্যাটারের মাথায় ঘোড়ার নাল পড়েছিল। কিন্তু এই ক্ষত চিহ্নটা নিঃসন্দেহে বুলেটের। এই আঘাতের ফলেই কি অস্বাভাবিক হয়ে গেছে লোকটা? কে গুলি করেছিল হ্যাটারকে? কেন?
খেতে চাইলে এসো, নাহলে তোমার বদলে শুয়োরগুলোকে দিয়ে দিচ্ছি! পাশের কিচেন থেকে ডেইজি ডাক দেয়ায় ভাবনা চিন্তার সুযোগ পেল না বেনন। অপমানটুকু গায়ে না মেখে এগোল কিচেনের দিকে।
ডেইজির বিস্মিত দৃষ্টিকে পাত্তাই দিল না বেনন, ধস নামিয়ে দিল বেকন, ডিম আর রুটির পাহাড়ে। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, তোমার ফুপু এখনও আসেননি, মিস?
না, স্পারটা উদ্ধার না করে আসবে না বলেছে। কড়া চোখে বেননকে দেখল মেয়েটা। তুমি ভাল করেই জানো উনি আমার ফুপু নন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও জেনে ফেলেছি। কাঁটাচামচ নামিয়ে রাখল বেনন। দেখো, তুমি কে তাতে আর কারও কিছু বলার নেই। আমি মনে করি না একজনের দোষে আরেকজনকে শাস্তি দেয়া যায়। তোমার জীবনটা তোমার। নিজের ওপর অন্যের প্রভাব পড়তে দিয়ো না, তাহলেই দেখবে কষ্ট কম পাবে।
একটু নরম হলো ডেইজি। বলল, আজকে কাজটা তুমি ভাল করোনি। হ্যারি হুলাহান সহজে তোমাকে ছাড়বে না।
একটা ধন্যবাদ পাওনা হয়েছে তোমার, বলল বেনন। লোকটা গুলি করতে যাচ্ছে দেখে থামানোর জন্যে এগিয়েছ তুমি।
আমি চাইনি বাড়ির উঠান নোংরা হোক। ডেইজির চেহারা গম্ভীর হলেও বেনন বুঝল কথাটা সত্যি নয়।
কফিতে চুমুক দিল ও, তারপর জানতে চাইল, রেল রোডের ব্যাপারে হ্যাটারের সঙ্গে কথা বলা যাবে?
তারমানে তুমি রেলওয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করোনি?
না। ব্যাঙ্কার লোকটা আমাকে ভুল বুঝেছে। চেয়ার ছাড়ল বেনন। যাই, দেখি রেলওয়েকে জমি ছাড়ার ব্যাপারে হ্যাটারকে রাজি করানো যায় কি না।
রেগে যাবে কিন্তু, পেছন থেকে বলল ডেইজি।
লিভিং রুমে এসে বেনন দেখল চলে গেছে হ্যাটার। বারান্দায় বেরিয়ে এলো ও। উত্তর-পশ্চিমে যাচ্ছে র্যাঞ্চার ঘোড়ায় চড়ে। বেশ অনেক দূরে চলে গেছে লোকটা। তবু কয়েকবার ডাকল বেনন। শুনতে পেল না হ্যাটার। পাশ থেকে ডেইজি বলল, কাঁটা তারের বেড়া মেরামত করছে ওদিকে ক্রুরা। বাবা যাচ্ছে তদারকি করতে। ফিরতে দেরি হবে। ইচ্ছে করলে অপেক্ষা করতে পারো। ওখানে ভুলেও যেয়ো না, কাজের সময় বিরক্ত করলে বাবা সাঙ্ঘাতিক রেগে যায়।
কার্ড খেলতে পারো তুমি? সময় কাটানোর জন্যে জানতে চাইল বেনন।
কাজ আছে আমার, জবাবটা এড়িয়ে গেল ডেইজি। টেইল হল্টে যেতে হবে আমাকে।
চলে গেল মেয়েটা বেনন কিছু বলার আগেই। লিভিং রূমে ফিরে ক্যাটল ম্যানস জার্নাল নিয়ে বসল বেনন। একটু পরে ঘোড়ার খুরের শব্দ পেয়ে বুঝল শহরে যাচ্ছে ডেইজি।
করার কিছু নেই। ভাবনা চিন্তা করে অলস দুপুরটা কাটাল বেনন। স্টেজ ডাকাতি থেকে শুরু করে ডায়নোসর-কোন যোগ সূত্র খুঁজে পেল না ও। রেল রোডের কাজ বন্ধ করতে চাইছে কেউ একজন। কিন্তু কেন? টেইল হন্টে রেলের অফিসে গুলি আর ক্যানিয়নে ডায়নোসর-মিলটা কোথায়? হ্যাটার চায় না রেল রোড চালু হোক। কিন্তু লোকটাকে সন্দেহ করতে পারল না বেনন। হ্যাটার পিঠে ছুরি মারার লোক নয়।
সন্ধের পর ফিরল ডেইজি। নীরবে সাপার সারল ওরা। দেখা নেই পাগলা হ্যাটার আর তার ক্রুদের।
নীরবতা ভাঙল ডেইজি। আমার মনে হয় তোমার চলে যাওয়াই উচিত। চাইলে একটা ঘোড়া ধার নিতে পারো।
হ্যাটারের সঙ্গে কথা শেষ না করে যাব না।
দেখো, বোঝাবার সুরে বলল ডেইজি, আসার সময় হ্যারি হুলাহানের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। আজকে তাকে তুমি হাসির পাত্রে পরিণত করেছ। এত সহজে তোমাকে ক্ষমা করবে না সে। এখনও লোকটা ধারেকাছেই ঘুরঘুর করছে।
ওর ভয়ে দায়িত্ব ফেলে চলে যাবার লোক নই আমি।
তাছাড়া বাবার সঙ্গে তোমার দেখা না হওয়াই ভাল। যাবার সময় দেখলাম মন ভাল নেই। রেল রোডের ব্যাপারে কথা বলতে রয়ে গেছ দেখলে অনৰ্থ বাধিয়ে দিতে পারে।
আশা করি তাকে আমি বোঝাতে পারব।
তুমি বাবাকে চেনো না। আমি চাই না তুমি থাকো।
এত স্পষ্ট করে কথাটা বলার পর আর থাকা যায় না। ঠিক আছে তাহলে একটা ঘোড়া দাও, বলল অপমানিত বেনন।
পাঁচ মিনিট পরে ঘোড়া দাবড়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেই টিলাটার দিকে এগোল ও। সত্যি সত্যি চলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই মোটেও। দূরে গিয়ে অপেক্ষা করবে, নজর রাখবে র্যাঞ্চ হাউজের ওপর। হ্যাটার র্যাঞ্চে ফিরলেই গিয়ে হাজির হবে। লোকটার সঙ্গে অন্তত কথা বলে দেখা দরকার। বলা যায় না হয়তো জমি বেচতে রাজি করিয়ে ফেলবে।
চাঁদ ওঠেনি এখনও। রিজের গোড়ায় পৌঁছে আঁধারে চুপ করে বসে থাকল ও। অনেক দূরে র্যাঞ্চ হাউজের মিটমিটে আলো দেখা যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকল সেদিকে। পাগলা হ্যাটারের শোবার ঘরটা বিকেলে চিনে রেখেছে। ওই ঘরে আলো জ্বলে উঠলেই বোঝা যাবে ফিরেছে লোকটা।
একটা চুরুট ধরাবে কিনা ভাবল ও। লোভটা সামলানো কঠিন। তাছাড়া আশেপাশে কেউ নেই যে ও এখানে আছে বুঝে ফেলবে। চুরুট আর ম্যাচ বের করে ফেলল সে। চুরুটটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে ম্যাচের কাঠি জ্বালতে গিয়েও পাথর হয়ে গেল। সোধ্বনি করেছে একটা ঘোড়া। খুবই কাছে। ওরটা নয় এটা নিশ্চিত। তাড়াতাড়ি নিজের ঘোড়াটার নাকে হাতচাপা দিল বেনন। ঘোড়াটা স্বজাতির ডাকে সাড়া দিলে ফাঁস হয়ে যাবে ওর অস্তিত্ব।
কে লোকটা? কি করছে এখানে? হ্যারি হুলাহান? ওকে অনুসরণ করে খুন করতে এসেছে? এক সেকেন্ডের মধ্যে প্রশ্নগুলো খেলে গেল বেননের মাথায়। পরমুহূর্তেই চারপাশে নুড়ি পাথর গড়ানোর আওয়াজে ওর ভুল ভাঙল। একজন নয়, অশ্বারোহী অন্তত সাত-আটজন। এগিয়ে আসছে লোকগুলো ওরই দিকে।
জেনেশুনে আসছে, নাকি না জেনে? নিশ্চিত হতে পারল না বেনন। লোকগুলো কারা তা এই আঁধারে বোঝার কোন উপায় নেই। হ্যাটারের ক্রু? তা কি করে হয়, হ্যাটার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে গেছে। রেলওয়ের ক্রুরা এখনও ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে? ওর নিজের কাছেই সম্ভাবনাটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো না। এত দূরে আসবে না তারা। একটা সম্ভাবনাই বাকি থাকল; এরা ক্যাম্পে হানা দেয়া সেই বদমাশের দল! কপালের লিখন খণ্ডাবে কে, আবার লোকগুলোর দেখা পেয়ে গেছে ও!
বেননের ঘোড়ার গায়ে ঘসা লাগাল আরেকটা ঘোড়া। নিচু স্বরে গাল বকল আরোহী। বেনন বুঝল ওর উপস্থিতি আর গোপন নেই।
১০. কাল রাতে ডাকাতটার কাছ
কাল রাতে ডাকাতটার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া অস্ত্রে ছয়টা গুলি আছে, কিন্তু লড়াই করে জেতা বা না করে পালিয়ে যাওয়া দুটোই এখন অসম্ভব। ঘেরাও হয়ে গেছে ও। শ্বাস আটকে বসে থাকল বেনন, কাকের মত ভাবছে, ও যখন দেখতে পাচ্ছে না তখন অন্য কেউ ওকে দেখবে কেন!
আরে দাড়িয়ে পড়লে কেন, এগোও! বিরক্ত স্বরে বলল পাশ দিয়ে যাওয়া লোকটা। আঁধারে চিনতে পারেনি ওকে। নিজেদের লোক ভেবে নিয়েছে।
সুযোগটা নিল বেনন। আস্তে করে স্পার ছোঁয়াতেই তস্করের পিছু নিল ঘোড়াটা। হ্যাটারের র্যাঞ্চের দিকে যাচ্ছে।
আবছা ভাবে দেখতে পাচ্ছে ও সামনের লোকটার ঢালু কাঁধ। এই লোকটাই মিস হ্যাটারের নাকের সামনে পিস্তল ধরেছিল। কালকে রাতেও একে ক্যাম্পে দেখেছে ও। মন থেকে সমস্ত সন্দেহ দূর হয়ে গেল। ভাল গ্যাড়াকলেই পড়া গেছে! সামনে পেছনে শত্রুর দল; মাঝখানে ও! প্রেইরির আঁধারে ওকে লোকগুলো চিনতে পারছে না বটে, কিন্তু আস্তানায় ফিরলেই চোখ বুজে চিনে যাবে।
খুব সাবধানে গতি কমিয়ে দলের পেছনে চলে এলো ও। লোকগুলোর সঙ্গে যেতে চায় না ও, অনুসরণ করতে চায়। ঘোড়া থেকে নেমে ভান করল যেন ঢিলে স্যাডল টাইট করছে। মনে মনে আশা করছে ওকে থামতে দেখেও এগিয়ে যাবে সবাই।
একজনকে দাঁড়াতে দেখে থেমে গেল বাকিরাও। বেননের পাশের লোকটা অধৈর্য হয়ে বলল, তাড়াতাড়ি করো, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের।
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আবার ঘোড়ায় উঠল বেনন। পালাবার চেষ্টা করতে গিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়নি ও। নিজেকে ভীমরুলের চাকে হাত ঢুকিয়ে বসা বোকা ভালুক বলে মনে হচ্ছে ওর। একটু পরেই চাঁদ উঠবে। তখন আর লুকোচুরি খেলা লাগবে না। কিন্তু করার কিছু নেই ওর।
ভরসার কথা লোকগুলো পরস্পারের সঙ্গেও বোধহয় ভাল মত পরিচিত নয়। বাড়তি কথা বলছে না কেউ। মন্ট্যানা সেন্ট্রাল রেল রোডকে থামানোর জন্যে এদেরকে সম্ভবত দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা হয়েছে।
হ্যাটারের র্যাঞ্চটা ওরা পাঁচশো গজ দূর দিয়ে পার হলো। বাঙ্ক হাউজ আর বাড়ির জানালায় আলো দেখে হ্যাটার আর ক্রুরা ফিরেছে বুঝতে পারল বেনন।
সামনে থেকে দলনেতা বলল, হ্যাটারের এখানে কয়েকটা গুলি খরচ করে গেলে কেমন হয়? লোকটা ভাববে রেল রোডের লোক শত্রুতা করছে। আরও খেপে উঠবে।
কাজটা ঠিক হবে না, কাসি, দ্বিমত পোষণ করল আরেকজন। ব্যাটারা ক্ষ্যাপা কুকুরের মত লড়াকু। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী, এমনিতেই অনেক কাজ পড়ে আছে।
মিথ্যে বলোনি, বলল নেতা। এমনিই ভাবছিলাম। চলো সবাই, আগের কাজ আগে।
র্যাঞ্চটাকে পাশ কাটিয়ে এগোল সবাই। সমব্রেরো হ্যাট মাথার ওপর টেনে বসাল বেনন। বুকের সঙ্গে ঠেকিয়ে রাখল চিবুক। পাশের লোকটা যতবার কথা বলল হুঁ-হাঁ করে জবাব দেয়ার দায় সারল। ভাবনায় ডুবে আছে ও। এদের টাকা দিচ্ছে কে? ডক্টর ওয়াং, নাকি আর কেউ? কি স্বার্থ ডক্টর ওয়াঙের? আর কেউ আছে এসবের পেছনে? কে সেই লোক? কিসের শত্রুতা রেল রোডের সঙ্গে?
কিছুক্ষণ পর হাল ছেড়ে দিল বেনন। মনে প্রশ্ন আসছে একের পর এক অথচ একটা প্রশ্নেরও জবাব জানা নেই।
পশ্চিমে, কুঁজো পিঠ সেই টিলার দিকে যাচ্ছে এখন দলটা। আগের চেয়ে গতি বাড়িয়েছে।
ক্যানিয়নের গোলকধাঁধার পেছন থেকে অবশেষে মুখ বের করল বাকা একটুকরো ম্লান চাঁদ। আবছা আলোয় ভূতুড়ে দেখাল চারপাশ। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল বেনন। টিলার গোড়ায়, ঘন জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়েছে ওরা। আরেকটু আগে চাঁদ তার চাঁদমুখ দেখালেই সেরেছিল, নির্ঘাত ধরা পড়ে যেত ও।
আঁকাবাকা সরু ট্রেইল ধরে একজনের পেছনে আরেকজন এগোল ওরা। দলের শেষ মাথায় থাকলে বেনন আলগোছে সরে পড়তে পারত, কিন্তু দুর্ভাগ্য ওর; পেছনে আরও কয়েকজন আছে।
খাড়া উঠে গেছে ট্রেইল। জায়গায় জায়গায় ঘোড়া থেকে নেমে হাঁটতে হলো। আরও ঘন হয়ে ট্রেইলের দিকে চেপে এসেছে জঙ্গল; দু’দিকের মাঝখানের ফাঁকটা বড়জোর ফুট তিনেক। এখন একটা ডায়নোসর এসে হাজির হলে হয়, ভাবল বেনন।
কিছুক্ষণ পর পাহাড়ের কাঁধে একটা খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলো ওরা। টিলার পুব দিকে পাথুরে জমিতে একটা তাঁবু খাটানো হয়েছে। পেছনে টিলাটা খাড়া হয়ে উঠে গেছে আরও অনেকদূর। জঙ্গল বেষ্টিত এই আস্তানা সুরক্ষিত। সরু ট্রেইলটা ছাড়া এখানে পৌঁছানোর কোন উপায় নেই। জঙ্গল যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে দশজন সশস্ত্র লোক অবস্থান নিলে ঠেকিয়ে দিতে পারবে একশো লোকের আক্রমণ।
আগুন জ্বলছে তাঁবুর সামনে। মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ব্ল্যাংকেট আর স্যাডল গিয়ার। কোন লোক দেখল না বেনন। পাহারায় কাউকে রাখা জরুরী মনে করেনি কাসি।
আগুনের পাশে পৌঁছে মৃদু স্বরে শিস দিল লোকটা। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আবছা একটা আকৃতি। আগুনের সামনে এসে দাঁড়াতেই তাকে চেনা গেল। ডক্টর ওয়াং!
কি খবর! হাসল লোকটা তার চোখ-না-ছোঁয়া হাসি।
লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নামল কাসি। উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, দারুণ অবাক একটা খবর আছে, বস্! কালকে রাতে কারা যেন কন্ট্রাকশন ক্যাম্পে হামলা করেছে। ওরা কয়েকজন কুলিকে মেরে ফেলেছে, তছনছ করে দিয়েছে ক্যাম্পটা। দারুণ কাজ দেখিয়েছে লোকগুলো, কি বললো, বস?
মাথা দোলাল চাইনিজ।
কুলিরা অবশ্য ধাওয়া করেছিল। কিন্তু একটা দানব বের হয়ে ওদের এমন ভয় দেখিয়েছে যে বাপ বাপ করে পালিয়েছে সবাই।
রোনাল্ডোকে দেখছি না কেন? ডক্টর ওয়াং জানতে চাইল।
কালকে রাতে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল। কোনমতে পালিয়েছে। ভোর বেলা ফিরেছে এখানে। ওকে টেইলহল্টে পাঠিয়েছি বিশ্রাম নেয়ার জন্যে।
বেশ, বেশ, খুশি খুশি দেখাল ডক্টরকে।
ঘোড়া থেকে নামছে সবাই। স্যাডল ইত্যাদি খুলে ঘোড়াগুলোকে রোপ করালে রেখে আগুনের ধারে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রমাদ গুণল বেনন। একা আলাদা দাঁড়িয়ে থাকলে সন্দেহ করবে লোকগুলো, আবার আলোয় যাওয়া মানেও ধরা পড়ে যাওয়া। যতটা সম্ভব দেরি করতে লাগল ও স্যাডল খুলতে। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘোড়াটাকে ঢুকিয়ে দিল করালে। স্যাডল মাটিতে রেখে ছায়ায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল মুক্তির উপায়।
এবার আমাদের কাজ কি হবে, বস? জানতে চাইল কাসি।
মাইনিং। সবার ওপর চোখ বুলিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল চাইনিজ। তোমরা দিন কয়েকের জন্যে মাইনার হয়ে যাবে। প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে আমার কাছে–গাইতি, শাবল, কোদাল, সবই আছে; কোন অসুবিধা হবে না তোমাদের।
কিন্তু, বস, লড়াই করার জন্যে রাখা হয়েছে আমাদের, অসন্তুষ্ট চেহারায় বলল কাসি।
চিন্তার কিছু নেই, লড়াই করলে যে টাকা পেতে তাই পাবে, আশ্বস্ত করল ওয়াং। ভাল কথা, কালকে রাতের চমৎকার কাজটির জন্যে পুরস্কার পাওনা হয়েছে তোমাদের। টাকা আমার সঙ্গেই আছে, লাইন করে দাড়িয়ে যে যারটা নিয়ে নিতে পারো ইচ্ছে করলে।
হৈ-হৈ করে উঠল গানফাইটারের দল। মুখ শুকিয়ে গেল, বেননের।
তাঁবুর ভেতর থেকে ভারী একটা ক্যানভাসের ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলো ওয়াং। দ্রুত লাইনে দাঁড়িয়ে গেল সবাই কাসির পেছনে। বাধ্য হয়ে বেননও লাইনে দাঁড়াল। বুকটা দুরুদুরু করছে। ওর। আবার সেই একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। টাকা নিতে লাইনে না দাঁড়ালে সেটা খুবই অস্বাভাবিক ঠেকবে সবার চোখে। আবার ওয়াঙের সামনে টাকা নিতে গেলেও ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। ওয়াং এত ঘোলা বুদ্ধির লোক নয় যে দু’দিন আগের সহযাত্রীকে ভুলে যাবে।
বেতো রুগির মত চেহারা করে লাইনের শেষে এগোল বেনন। জীবনে কখনও কখনও এমন কিছু সময় আসে যখন মনে হয় দুনিয়ার সবকিছুই বিপক্ষে চলছে। তারপর হঠাৎ করেই যদি বাধাগুলো দূর হয়ে যায় তাহলে বুকটা ভরে ওঠে কৃতজ্ঞতায়। বেননেরও তেমন হলো। মাত্র দু’পা বেড়েছে ও আগুনের দিকে, এমন সময় জঙ্গলের প্রান্ত থেকে কথা বলে উঠল একজন লোক। গানফাইটাররা আড়ষ্ট হয়ে গেল। অস্ত্রের দিকে হাত বাড়াল কেউ কেউ। বোঝা গেল লোকটা তাদের পরিচিত নয়। শুধু স্বাভাবিক রইল ডক্টর ওয়াং। তার ভাব দেখে মনে হলো লোকটা আসবে আশা করছিল সে।
ওয়াং! ঝোঁপের আড়াল থেকে আবার ডাক দিল হ্যারি হুলাহান। আমার হাতে একটা অস্ত্র আছে, ওয়াং। ইচ্ছা করলে তোমাকে আমি মেরে ফেলতে পারি যেকোন সময়। তেমন কিছু করার ইচ্ছে নেই আমার। আমি শুধু কথা বলতে চাই।
অবশ্যই! হাসল ওয়াং। তোমার জন্যে আমাদের দ্বার সব সময় অবারিত।
ঠাট্টা নয়, ওয়াং, আমি মশকরা করতে আসিনি।
চলে এসো, ভাবছ কেন তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি? আমার ঘাড়ে কটা মাথা?
খালি হাতে বেরিয়ে এসে ওয়াঙের মুখোমুখি দাঁড়াল ব্যাঙ্কার। রাগে লাল হয়ে আছে সরু মুখটা। চড়া গলায় বলল, বাজে কথায় সময় নষ্ট করতে আমি আসিনি, ওয়াং। স্পারটা পেয়েছ?
ছোট্ট করে বো করল ওয়াং। হ্যাঁ। ক্যানভাসের ব্যাগ নামিয়ে রেখে পকেট থেকে সেই সিল্কের রুমাল বের করল লোকটা। কি যেন মুড়িয়ে রেখেছে রুমালে। জাদুকরের ভঙ্গিতে হাতের তালু থেকে রুমালটা সরিয়ে নিল সে। দেখা গেল আগুনের আভায় স্পারটা চকচক করছে।
একটু সামনে ঝুঁকল ব্যগ্র বেনন। অন্যান্য স্পারের সঙ্গে কোন তফাত খুঁজে পেল না। সাধারণ একটা স্পার; হাজার হাজার এরকম স্পার দেখেছে ও জীবনে। অথচ দেখার মত হয়েছে ব্যাঙ্কারের মুখভঙ্গি। সম্মোহিতের মত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পারটার দিকে। নিজেকে বসে আনতে পাক্কা দু’মিনিট লাগল লোকটার। তারপর ফাঁসফেঁসে স্বরে জানতে চাইল, কত দিতে হবে?
শ্রাগ করল ওয়াং। দরদাম করব কী, আমি কি জিনিসটার আসল দাম জানি? ঠকে গেলে তখন? মাথা নাড়ল সে। তবু আমি বেশি চাইব না। যা ন্যায্য তাই দিয়ো। ধরো হাজার পঞ্চাশেক হলেই চলবে।
তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ! রাগে চেঁচাল হুলাহান।
তাই? আমি বরং তাহলে আর কেউ কিনতে চায় কিনা খোঁজ নিই।
এবার কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলল ব্যাঙ্কার। ওয়াঙের উদ্দেশে পা বাড়িয়ে চোখ পাকিয়ে গাল দিল। দে! দিয়ে দে আমার স্পার, হলুদমুখো নোংরা বেঁটে বানর কোথাকার! দে বলছি!
চট করে কয়েক পা পিছিয়ে গেল ওয়াং। উত্তেজনার কোন চিহ্ন নেই মুখে। রাগেনি একফোঁটা। কথা যখন বলল কণ্ঠস্বর থাকল একদম শান্ত। দেখো, হুলাহান, বলল সে, তেড়িবেড়ি করার অবস্থানে তুমি নেই। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোমারই ক্ষতি হবে। ভুলে যেয়ো না তোমার আদেশেই এই লোকগুলোকে ভাড়া করা হয়েছে যাতে মন্ট্যানা সেন্ট্রাল রেল রোডের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। নিঃশব্দে হাসল ওয়াং। দরদামের উপায় নেই তোমার, হুলাহান।
কুঁজো কাঁধ আরও ঝুলে পড়ল ব্যাঙ্কারের। থমকে দাঁড়াল লোকটা। অপেক্ষাকৃত সুস্থির দেখাচ্ছে তাকে এখন। বলল, আমার দিকটা একটু বোঝো, ওয়াং; পঞ্চাশ হাজার ডলার দেয়ার সাধ্য নেই আমার।
কথাটা মিথ্যে বললে। তুমি তো স্পারটা হ্যাটারকে ফিরিয়ে দিয়ে রেলওয়ের জন্যে জমির ব্যবস্থা করবে। ভাল কথা, রেল ওয়ের কাছ থেকে কত টাকা কমিশন খাচ্ছ তুমি? নিশ্চয়ই এক লাখ ডলারের কম নয়?
তুমি ভুল ভাবছ, এক পয়সাও নিচ্ছি না আমি।
বিশ্বাস করতে পারলাম না। তোমাকে যতটুকু চিনি মরা মায়ের হাত কেটে চুড়ি বের করে নেবে তুমি।
এই তাহলে ব্যাপার! এতক্ষণে স্পার রহস্য পরিষ্কার হলো বেননের কাছে। পাগলা হ্যাটার স্পার নিয়ে পাগলামি করছে জানতে পেরে ওটা চুরি করিয়েছে হুলাহান, যাতে রেল রোডের কাছে লোকটা জমি বেচে। হয়তো ব্যাঙ্কার নিশ্চিত জানে যে স্পার পেলে হ্যাটার জমি বেচতে আর আপত্তি করবে না। দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে কোন কষ্ট হলো না বেননের। হুলাহান নিশ্চয়ই রেল রোডের সঙ্গে কোন চুক্তি করেছে। জমি পেলেই মন্ট্যানা সেন্ট্রাল লোকটাকে টাকা দিয়ে দেবে। এরমধ্যে বাগড়া দিয়ে বসেছে চতুর ওয়াং। ফাঁক তালে কামিয়ে নিতে চাইছে পঞ্চাশ হাজার ডলার।
দৌড়ে গিয়ে ওয়াঙের হাত থেকে স্পারটা কেড়ে নেবে কিনা ভাবল বেনন। কাজটা সোজা, কিন্তু তারপর পালানো প্রায় অসম্ভব। দেখবে একবার চেষ্টা করে? যদি কপালটা সহায়তা করে…
উত্তেজনার বশে অজান্তেই একটু সামনে বাড়ল ও। চলে এলো আলোর আওতায়। সেই একই মুহূর্তে সামনে দাঁড়ানো লোকটা ওর কাঁধের গুঁতো খেয়ে বিরক্ত হয়ে ফিরে তাকাল। এক বাড়িতে ওর মাথা থেকে ফেলে দিল সমব্রেরো হ্যাট। পরক্ষণেই বাঁশ-ফাটা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, আরে আরে… কোত্থেকে… কে তুমি!
বিপদ বুঝে গায়ের জোরে ঘুসি হাঁকাল বেনন। লাগল না। ওর গায়ে সেঁটে এলো প্রতিপক্ষ। মরিয়া হয়ে লোকটাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে করালের দিকে দৌড় দিল ও। চারপাশে একবার তাকিয়েই বুঝে গেল জালে আটকা পড়া মাছের মত অবস্থা হয়েছে ওর। ওকে ধরতে সবদিক থেকে ছুটে আসছে লোকগুলো। দশ পা যাওয়ার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ল কয়েকজন।
১১. টেইল হল্টে পা রাখার দ্বিতীয় দিন
টেইল হল্টে পা রাখার দ্বিতীয় দিন। মহা আরামে অড ফেলো বিল্ডিঙে, মন্ট্যানা সেন্ট্রালের অফিসে বসে আছে ব্যাগলে। কালকের পোশাক বদলে ফেলেছে। পরনে অতি ব্যবহারে মলিন একটা ধুলো মাখা শার্ট। লিভাইটা অন্তত বছর খানেক পানির স্পর্শ পায়নি। খুলে রাখলে দাঁড়িয়ে থাকে। তলি ক্ষয়ে যাওয়া বুটের চামড়া মাখনের মত নরম। স্পারের রাওয়েলসগুলো এতই বড় যে দেখলে মনে হয় ওয়্যাগনের চাকা বানাতে গিয়ে মনের ভুলে ওগুলো বানিয়ে ফেলেছে কারিগর।
টেবিলের কোনায় স্পার বাধিয়ে চেয়ারটা পেছনে হেলিয়ে বসে আছে সে। বুক ভরা প্রশান্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে মার্লোন ব্র্যান্ডনের দিকে।
উদ্বিগ্ন চেহারায় টেবিল আর জানালা করছে লোকটা। মাঝে মাঝে পায়চারি থামিয়ে জানালা দিয়ে নিচের রাস্তায় তাকাচ্ছে। একই সমান চিন্তিত দেখাচ্ছে ভাউবয়েস সি ভাউবয়েস নোয়াককে। ঘরে ফ্র্যাঙ্ক নোয়াকও উপস্থিত। একটা বইয়ে নাক ডুবিয়ে তন্ময় হয়ে আছে সে। ব্যাগলের সুখে থাকার এটাই প্রধান কারণ। বিছের মত হারামি এই ছোঁড়াটার সঙ্গে বুদ্ধিতে ঠিক পেরে উঠছে না ও। সিদ্ধান্ত নিয়েছে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলবে।
হাই তুলে বইটা পাশে নামিয়ে রাখল ফ্র্যাঙ্ক। চসার, বলল ধীরে ধীরে, বেশ রসিক লোক ছিলেন। তবে প্রায় শিশুসুলভ। ব্যাগলের দিকে তাকাল সে। আমার অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে রাবেলাইকেই বেশি পছন্দ। আপনার কাকে ভাল লাগে, মিস্টার ব্যাগলে?
তোমার আবার তর্ক করার শখ হয়েছে? হার মানার পাত্র নয়, প্রায় রুখে উঠল ব্যাগলে। ও কিছু জানে না টের পেলেই খোঁচাতে শুরু করবে ছোঁড়াটা।
তর্কের কি আছে, আমি শুধু আপনার বিজ্ঞ মতামত জানতে চাইছিলাম।
থামুন আপনারা, কড়া গলায় দু’জনকে থামিয়ে দিল ব্র্যান্ডন। মিস্টার ব্যাগলে, একটু এদিকে আসুন।
জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ব্যাগলে। এন্ড অভ স্টীল থেকে সদ্য আসা ট্রেন থেমেছে স্টেশনে। পিলপিল করে নামছে কুলি মজুর। গুনে শেষ করা যাবে না। মিছিলের মত বেরিয়ে আসছে স্টেশন থেকে।
সবাই চলে গেলে আমি স্পার বানাব কি করে! হতাশ হয়ে বলল ব্র্যান্ডন। যাকেই কিছু জিজ্ঞেস করি সে-ই বলে ড্রাগন! জানের ভয়ে পালাচ্ছে লোকগুলো। দ্বিগুণ মজুরিতেও থাকতে চাইছে না!
জিমি নর্টন বা রক বেনন কেন খবর পাঠাচ্ছে না! কপালে আট-দশটা ভাঁজ তুলে বললেন ভাউবয়েস। নিশ্চয়ই কাল রাতে কিছু একটা ঘটেছে ওখানে। ওদের বোঝা উচিত কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা ওদের কর্তব্য।
যাই ঘটুক বেনন এতক্ষণে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। নিজের মনেই সন্দেহ থাকলেও বন্ধুর সমর্থনে বলল ব্যাগলে।
সকালে হ্যারি হুলাহান এন্ড অভ স্টীলে গেছে, বলল ব্র্যান্ডন। সে ফিরলে ওদিকের খবর জানা যাবে।
টেলিগ্রাফ করেই জেনে নেয়া যায়, পরামর্শ দিল ফ্র্যাঙ্ক। ভাউবয়েসকে তাকাতে দেখে মাথা নাড়ল ব্র্যান্ডন। কাল রাতের ঝড়ে লাইন ছিঁড়ে গেছে কোথাও। মেরামত করতে সময় লাগবে। লাইন নষ্ট হওয়ার আগে খুব সংক্ষিপ্ত একটা টেলিগ্রাম করেছিল জিমি নর্টন। লিখেছে, আবার ঝড়… দানবের দেখা। ব্যস এটুকুই।
এখবর শিকাগো অফিস জানলে বোধহয় কাজ থামিয়ে ফিরে যেতে নির্দেশ দেবে, বলল ভাউবয়েস। চেহারায় সহানুভূতি নিয়ে ব্র্যান্ডনকে দেখল। অথচ ওদেরকে জানাতেই হবে। নতুন করে কুলি জোগাড় করতে অন্তত এক সপ্তাহ লাগবে। শিকাগো যদি কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় তবুও তোমার আর আমার এ-জীবনে পদোন্নতির আশা না করাই ভাল।
শান্ত হও, বাবা, উপদেশ দিল ফ্র্যাঙ্ক। চাকরি যদি চলেও যায় তিরিশ বছর খাটুনির বিনিময়ে ওরা তোমাকে যে সুন্দর ঘড়িটা দিয়েছে ওটা তো থাকবে। আমার বিশ্বাস ওরা যখন তোমাকে বের করে দেবে ঘড়িটা ওরা ফেরত নেবে না।
চোপ! ছেলেকে শাসন করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ভাউবয়েস। একটু পর বললেন, আমি আজই শিকাগো চলে যাব। চেষ্টা করব যত তাড়াতাড়ি পারি কুলি-মজুর জোগাড় করে ফিরে আসতে।
আমি বোধহয় লোকের ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য করতে পারব, বলল ব্যাগলে। হঠাৎ করেই চ্যাং টোয়াঙের কথা মনে পড়ে গেছে ওর।
হা! হা! হা! ফ্র্যাঙ্কের অবিশ্বাস ভরা ফাঁকা হাসি বুলেটের মত বিধল ব্যাগলের বুকে।
লোকের ব্যাপারে! ডুবন্ত মানুষের বাঁচার আকুতি নিয়ে তাকাল ভাউবয়েস। বলুন শুনি।
কিন্তু ব্যাগলে মুখ খোলার আগেই পাশের অ্যান্টিরূমে হৈ হুলস্থূল লেগে গেল। উঁচু কাঁপা কাঁপা গলায় কাকে যেন কি বোঝাচ্ছে ক্লার্ক। ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা আগের সেই একই ঘটনা ঘটল। দড়াম করে খুলে গেল দরজা। ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকলেন মিস অ্যানা হ্যাটার। সেই স্টীল রিমের চশমাটা ঝুলছে নাকের ওপর। সেই একই রাগান্বিত দৃষ্টি দু’চোখে। আজ শুধু সঙ্গে ডেইজি নেই, নাহলে কে বলবে কালকের দিনটা আসলে আজকে নয়!
ছিহ, ছিহ, ছিহ, ঘরে পা রেখেই তিরস্কার শুরু করলেন তিনি। আপনাদের কি লজ্জা বলতে কিছু নেই! আমি ভাবতেও পারি না…
আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, ম্যাম…
ভাউবয়েসকেও মাঝপথে থেমে যেতে হলো। আমি মনে করেছিলাম আপনারা ভদ্রলোক! তার নাকের সামনে আঙুল তুলে নাড়লেন টীচার। আপনাদের কোন কথা আর বিশ্বাস করি না আমি। কী ভেবেছেন, চোখ বুজে, কানে হাত চাপা দিয়ে বসে আছে সবাই? রেল রোড এই শহরে দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়াবে তা আমি একজন স্টক হোল্ডার হিসেবে কিছুতেই মেনে নেব না!
আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি যাতে আপনার স্পার…
থামুন! স্পার? ও, হ্যাঁ, ওটা খুঁজে বের করাও জরুরী। পরে আসছি ওকথায়। আগে আমি বলতে চাই সবার নাকের সামনে এ-শহরে যে দুঃসহ নীতিহীনতা চলছে সেটার কথা। কী দায়িত্ব পালন করছেন আপনারা শুনি? প্রতি দুটো বাড়ি পরপর একটা করে বাড়িতে মদ বেচা হচ্ছে! ভাবতে পারেন রেলের শ্রমিকদের জন্যে চলছে এই জঘন্য ব্যবসা! মদের যোগান দেয়ার জন্যে প্রতিদিন একটা করে সেলুন ভোলা হচ্ছে! আমি আপনাকে বলছি, স্যার, আপনি যদি ব্যবস্থা না নেন আপনার বিরুদ্ধে হেড অফিসে নালিশ করব আমি। আপনাকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না যে ওখানে আমার প্রভাবশালী বন্ধু-বান্ধব আছে।
কিন্তু, ম্যাডাম, আমার কি করার আছে? আরও কিছু বলতে হাঁ করেও চুপ হয়ে গেল ভাউবয়েস। আসলেই ভাল প্রভাব আছে। মহিলার শিকাগো অফিসে।
হাতের ঝাঁপটায় তাকে থামিয়ে দিয়েছেন টীচার। আপনি আপনার লোকদের মানা করুন যাতে ওসব জায়গায় না যায় কেউ, বললেন তিনি। তারা যদি না যায় ঈশ্বর অভিশপ্ত সেলুনগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাবে।
বুঝলাম। মাথা দোলাল ভাউবয়েস। কিন্তু আপনি আমার দিকটাও একটু বুঝুন। চাইনিজরা পালাচ্ছে ড্রাগনের ভয়ে। এখন আপনি বলছেন মদের দোকান বন্ধ করার কথা। এবার তো আইরিশরাও রাগ করে চলে যাবে। সবাই চলে গেলে সমস্ত কাজই তো বন্ধ হয়ে যাবে!
হয়ে যদি যায় তো যাক। তা-ও ভাল। তবু নোংরামিকে প্রশ্রয় দেবে না কেউ পাগল না হলে। আমি ভাবতেই পারি না আমার টাকা এমন একটা প্রতিষ্ঠানে খাটছে যাদের নীতির কোন বালাই নেই। আপনি এখুনি উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে আজই আমি শিকাগোতে চিঠি লিখব।
হাল ছেড়ে দিল ভাউবয়েস। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, বেশ, মিস হ্যাটার, আমার সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করব আমি। আপনি দয়া করে চিঠি লিখবেনন না। এতে আমাদের অসুবিধা ছাড়া সুবিধা হবে না।
সে আমি জানি। দুষ্টুমির একটুকরো হাসি ফুটল টীচারের ঠোঁটে। তাহলে আপনি কথা দিচ্ছেন মদ বিক্রি ঠেকাবেনন?
দিচ্ছি।
বাবা খুবই বুদ্ধিমান, নিচু গলায় ব্যাগলেকে বলল ফ্র্যাঙ্ক। আপোস রফায় পাকা।
উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাওয়ায় দরজার দিকে পা বাড়ালেন মিস হ্যাটার। বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, আমি ঘুরে ঘুরে দেখব আপনারা কথা রাখছেন কিনা।
মহিলা খুবই অভদ্র, টীচার চলে যাওয়ার পর মন্তব্য করল ব্যাগলে।
বাদ দিন ওই পাগল বুড়ির কথা। কপালের ঘাম মুছল ভাউবয়েস। মস্ত ভুঁড়ি বাগিয়ে ব্যাগলের সামনে এসে দাঁড়াল। মদ বিক্রি বন্ধ করা তো তুচ্ছ, দজ্জাল বুড়িটা চাইলে আকাশের চাঁদ পেড়ে এনে দেবার শপথ করতেও দ্বিধা করতাম না। আসল কথা বলুন। লোক আনার ব্যাপারে কি যেন বলছিলেন না, আপদটা এসে বাগড়া দেবার আগে?
চ্যাং টোয়াং।
আঁ! কী বললেন?
চ্যাং টোয়াং চাইনিজ। আমার বন্ধু। হেলেনায় থাকে। কানাডা থেকে চোরাই পথে এদেশে চাইনিজদের নিয়ে আসার ব্যবসা করে ও।
আপনি ভাবছেন সে আমাদের লোক জুটিয়ে দিতে পারবে? উজ্জ্বল হয়ে উঠল ভাউবয়েসের চাহনি। কতদিন লাগবে লোক জোগাড় করতে? তাড়াতাড়ি হলে শিকাগোতে যাব না আমি। এদিকের ঘটনাও কাউকে জানাব না।
আশা করি হেলেনা যেতে আসতে যতটুকু সময় লাগবে তার বেশি লাগবে না লোক নিয়ে আসতে। টোয়াং প্রতি মাসে কম করেও শ’পাঁচেক লোক পার করে।
ওরা বেআইনি অভিবাসী, বলল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক। তোমাদের কোম্পানি ফেঁসে যাবে শেষে।
ছোঁকরার জ্ঞানের বহর দেখে অবাক হলো ব্যাগলে।
ছেলের কথায় মাথা নাড়ল ভাউবয়েস। সরকারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করলে কোন সমস্যা দেখা দেবে না। চুক্তি করব স্পারের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন লোকগুলোকে এদেশে থাকতে দেয়া হয়। সিনেটর আছে কয়েকজন পরিচিত। কোন অসুবিধা হবে না। ব্যাগলের দিকে তাকাল সে। আমি কথা দিচ্ছি আপনার সেই বন্ধুর নাম প্রকাশ পাবে না। দেখুন একবার চেষ্টা করে আমাদের বাঁচাতে পারেন কিনা।
আশা করি পারব। জোর দিয়ে বলল ব্যাগলে।
হা! হা! হা! হাসল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক। ব্র্যান্ডনের দিকে মোটা দেহটা ফেরাল ভাইস প্রেসিডেন্ট। বলল, মার্লোন, এক্ষুণি মিস্টার ব্যাগলের জন্যে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করো। খবর পাঠাও আর সব ট্রেন যেন লাইন ছেড়ে দেয়। আমি চাই সন্ধের আগেই মিস্টার ব্যাগলে যেন হেলেনায় পৌঁছায়। এবার ব্যাগলের দিকে মনোযোগ দিল সে। মিস্টার ব্যাগলে, আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন আপনার সাফল্যের ওপর স্পারের নির্মাণ নির্ভর করছে? মনে রাখবেন আপনি যদি সফল হন চির কৃতজ্ঞ থাকবে মন্ট্যানা রেল রোড। যা চাইবেন তা-ই পাবেন।
ভ্রূ কুঁচকে চোখ পাকিয়ে ফ্যাঙ্ক নোয়কের দিকে তাকাল ব্যাগলে। চোখের দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিল কি সে চাইতে পারে। মুখ শুকিয়ে গেল ফ্র্যাঙ্কের। মনে পড়েছে গত দুদিনের তাচ্ছিল্য আর বিশেষ করে বিছানায় স্পার রাখার ঘটনাটা। ছোঁড়াটাকে ভয় পাইয়ে দেয়া গেছে, আত্মতৃপ্তির সঙ্গে ভাবল ব্যাগলে। ও জানে না কি আছে ওর কপালে।
তাহলে ট্রেনের ব্যবস্থা করে দিয়েই এন্ড অভ স্টীলে যাব আমি, বলল মার্লোন। জানা দরকার আসলেই কি হচ্ছে ওখানে।
লাইন যাতে খোলা থাকে, সাবধান করল ব্যাগলে, আমার লোহার ঘোড়া যখন ছুটবে এমন জোরেই ছুটবে যে সামনে কিছু পড়লে একবারে চুরমার করে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
হা! হা! হা! হাসল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক। ব্যাগলের ইচ্ছে হলো ছোড়ার কান টেনে ছিঁড়ে নেয়। নিজেকে বোঝাল ও, পরে হবে ওসব; আগে সবাইকে উদ্ধার করে নিই, তারপর। কল্পনায় নিজেকে দেখতে পেল ও বিজয়ী বীরের বেশে। যুদ্ধ জয় (!) করে ফিরছে ও। চারপাশে ভক্তের দল, মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে; একজন আরেকজনকে দেখাচ্ছে, ওই যে দেখো ব্যাগলে, মন্ট্যানা সেন্ট্রাল রেল রোডকে ও একাই বাঁচিয়েছে মস্ত বিপদ থেকে। পুলকে কেঁপে উঠল ব্যাগলে। বেনন ওকে সঙ্গে নেয়নি, উত্তেজনার ভাগ দেয়নি, নিষ্ঠুর ভাবে বঞ্চিত করেছে, তবু নির্দ্বিধায় বেননকে ক্ষমা করে দিল ও। এমনকি ফ্র্যাঙ্ক নোয়াককেও ক্ষমা করে দিত, কিন্তু পারল না পেছন দিকটা এখনও ব্যথা করছে বলে।
একঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে গেল একটা এঞ্জিন। মন্ট্যানা রেল রোডকে উদ্ধার করতে বুক টান টান করে ক্যাবে উঠে পড়ল ব্যাগলে। নিজেকে সম্রাট বলে মনে হচ্ছে ওর। কে জানত এত সৌভাগ্য ছিল কপালে! শুধু ওরই জন্যে হেলেনা যাচ্ছে একটা ট্রেন!
এঞ্জিন ড্রাইভার আর ফায়ারম্যানকে হাতের ইশারায় রওয়ানা হতে বলল ও। ছুটি থেকে ডেকে আনা হয়েছে, ফলে বিরক্ত চেহারায় নির্দেশ পালন করল লোকগুলো। হিসহিস আওয়াজ তুলে ঘুরতে শুরু করল চাকা। দ্রুত বাড়ছে গতি, তবু ব্যাগলের মনে হলো লোহার ঘোড়াটা যথেষ্ট জোরে ছুটছে না।
আগুনে আরও কয়লা ঢালো, সময় কম, শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে বলেই ফেলল ও।
ভ্রূ কুঁচকে গেল ফায়ারম্যানের। জবাব দিল না। ব্যাগলেকে তার মোটেও পছন্দ হয়নি। লোকটার গা থেকে এখনও ঘোড়ার গন্ধ বের হচ্ছে! কি বোঝে লোকটা রেল এঞ্জিনের? বয়লার ফাটলে তখন?
লোকটা কথার অবাধ্য হয়েছে দেখেও একজন মহান নেতার মত তাকে ক্ষমা করে দিল ব্যাগলে। এসব গায়ে মাখলে চলে না। পল রিভিয়েরা যখন তার ঐতিহাসিক যাত্রায় বের হলো তখনও মানুষ তাকে সমালোচনা করেছে। ওকেও বাধার সম্মুখীন হতে হবে, ধরেই নিয়েছে ব্যাগলে। আজ এই ফায়ারম্যান বুঝছে না কার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। একদিন যখন লোকটা বুড়ো হবে, নাতি-নাতনীদের গর্ব করে গল্প শোনাবে: জানিস, আমি হিরাম ব্যাগলেকে খুব ভাল করে চিনতাম। আমিও ছিলাম ব্যাগলের সেই ঐতিহাসিক হেলেনা যাত্রায়। অবাক হয়ে যেতি তোরা তাঁকে সামনে থেকে দেখলে। বিশ্বাসই করতে পারতি না পুরোনো জুতোর মত অতি সাধারণ চেহারার সেই মানুষটার ভেতর লুকিয়ে আছে দুজয় দুঃসাহসী একজন মহানায়ক।
দুলতে দুলতে পূর্ণ গতিতে ছুটছে ট্রেন। দ্রুত পেছনে চলে যাচ্ছে গাছপালা, পাহাড়-টিলা, মাঠ-ঘাট; তবু সন্তুষ্টি হচ্ছে না ব্যাগলের। কল্পনার ফাঁকে ফাঁকে বারবার ভ্ৰ কুঁচকে উঠছে ওর।
একঘণ্টা পরে ছোট একটা বসতি পার হলো ওরা। ওদের জন্যে সাইড লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে একটা ফ্রেইট ট্রেন। পাশ কাটানোর সময় ওটার অধৈর্য এঞ্জিনিয়ারকে হাত নাড়ল গর্বিত ব্যাগলে। টেইল হল্টের অসমান লাইন শেষ হয়ে মেইন লাইন চলে এলো। গতি বাড়ার কথা, কিন্তু কমে গেল আরও। পাহাড় বেয়ে উঠছে ট্রেন। চিমনি দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
একহাতে হুইলের কর্ড ধরে সীটে বসে জানালা দিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে এঞ্জিনিয়ার। প্রয়োজন মত বয়লারে কয়লা দিচ্ছে। ফায়ারম্যান। কথা বলছে না কেউ কারও সঙ্গে। অনেকক্ষণ পার হলো এভাবে। তারপর থাকতে না পেরে মুখ খুলল ব্যাগলে।
আরও জোরে যাওয়া যায় না?
অত তাড়া থাকলে তুমিও একটা কোদাল নিয়ে নেমে পড়ো, জানাল ফায়ারম্যান।
চালিয়াতি হাসি হাসল ব্যাগলে। দুনিয়ায় দু’রকমের লোক আছে। একদল গতরে খাটে, আরেক দল মগজ খাটিয়ে তাদেরকে খাটায়। আমি হচ্ছি শেষ দলের।
বিকেল গড়ানোর পর ঢালের চড়াই পার হলো ওরা। নামার সময় ট্রেনের গতি বেড়ে গেল। সামনের আলো জ্বেলে দিল এঞ্জিনিয়ার। আঁধারের বুক চিরে ঝড়ের গতিতে ছুটছে যন্ত্রদানব।
গুনগুন করে গান গেয়ে উঠল ব্যাগলে। হ্যাঁ, এইবার বেশ জোরে চলছে লোহার ঘোড়া। এভাবে চললে দেরি হবে না হেলেনা পৌঁছতে।
একটু পরেই থেমে গেল ওর গান। এঞ্জিনিয়ার দুঃসংবাদ দিল, থামতে হবে। সামনে লাল লাইট। পাশের ট্র্যাকে সরিয়ে দিয়েছে। আমাদের।
লোহায় লোহায় ঘসা খাওয়ার কর্কশ আওয়াজ তুলে ছোট একটা ডিপোর সামনে থেমে গেল ট্রেন। অস্থির ব্যাগলের চোখের সামনে এঞ্জিনিয়ারকে একটুকরো কাগজে ট্রেন অর্ডার দিয়ে গেল লোকাল ডেসপ্যাচার।
আমাদের জন্যে ট্র্যাক পরিষ্কার রাখার কথা ছিল! অভিমান করে বলল ব্যাগলে। তোমরাই যদি চাও মন্ট্যানা রেল রোড ধ্বংস হয়ে যাক তো আমার একার কি করার আছে?
এই লাইনটা আমাদের না; আমরা এখন নর্দান প্যাসিফিকের বসানো ট্র্যাকে আছি, বলল এঞ্জিনিয়ার। আমাদের অফিস বোধহয় ওদের কাছ থেকে অনুমতি পায়নি। অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই।
ওই যে একটা লোকোমোটিভ আসছে। আঙুল তুলে পেছনদিক দেখাল ফায়ারম্যান।
মাটি কাঁপিয়ে ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল একটা ট্রেন। সিগনালের আলো মিটমিট করে সঙ্কেত দিল। এবার যেতে পারে ওরা।
উত্তেজনায় টুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ব্যাগলে। গোঁফে তা দিতে দিতে বলল, তাড়াতাড়ি করো; নষ্ট হওয়া সময়টা পুষিয়ে নিতে হবে আমাদের।
ট্র্যাক বদলে আবার রওয়ানা হতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেল আরও পনেরো মিনিট। ধমক-ধামক আর অনুরোধ-উপরোধে ট্রেনের গতি বাড়ছে না দেখে শেষ পর্যন্ত আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কোদাল তুলে নিল ব্যাগলে। বয়লারে কয়লা ঢালতে লাগল। পাত্তাই দিল না ফায়ারম্যানের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি।
ট্রেন হেলেনার প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে পুরোপুরি থামার আগেই লাফ দিয়ে নেমে পড়ল ও। কালি ঝুলি মেখে ভূত হয়ে আছে। দিশেহারা ভয়ঙ্কর এক উন্মাদের মত দেখাচ্ছে ওকে। রাস্তার লোকজন সভয়ে দূরত্ব বজায় রাখছে, সেদিকে কোন খেয়াল নেই; মন্ট্যানার রাজধানীর গলিঘুচি দিয়ে দক্ষিণে, লাস্ট চান্স গালশের দিকে এগোল ব্যাগলে। থামল এক কানাগলির শেষে। ওখানে সাইনবোর্ড ঝুলছে। চ্যাং টোয়াং, জেড এবং চায়ের ডিলার।
দোকানে ঢুকতে গিয়েও আচমকা ভয়াবহ একটা সম্ভাবনা মনে আসতেই থমকে গেল ব্যাগলে। অনেকদিন হলো যোগাযোগ নেই; চ্যাং টোয়াং যদি এখানে না থাকে? যদি বর্ডারে থাকে বা চায়নায় আত্মীয়দের দেখতে যায়? বুক টানটান করে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলল ব্যাগলে। চ্যাং টোয়াংকে থাকতেই হবে। ভাগ্য একজনকে সুযোগ দিয়েও প্রবঞ্চিত করবে তেমন হতেই পারে না! কেন, জর্জ ওয়াশিংটন…
দোকানে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাল ব্যাগলে। আশা করেছিল কাউন্টারের পেছনে টোয়াঙের চাঁদের মত গোল মুখটা দেখতে পাবে। সে নেই। চ্যাং টোয়াঙের বদলে কাউন্টারে বসে আছে। শীর্ণকায় এক চাইনিজ।
চ্যাং টোয়াং কোথায়? দম আটকে জানতে চাইল ব্যাগলে।
ওখানে। হাতের ইশারায় পর্দা দেয়া একটা দরজা দেখাল লোকটা। ব্যাগলে সেদিকে পা বাড়াতেই বলল, সে এখন দেখা করবে না, সম্মানিত একজন অতিথিকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত আছে।
জরুরী কাজে এসেছি আমি, বোঝাবার সুরে বলল ব্যাগলে। রেল রোডের জন্যে কয়েকশো লোক লাগবে। সেজন্যেই ওর সঙ্গে আমার দেখা হওয়াটা জরুরী।
বাতাসে হলুদ হাতটা নাড়ল চাইনিজ। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
আঁ! ককী! হয়ে গেছে? চোখ বড় বড় হয়ে গেল ব্যাগলের। সংবিৎ ফিরে পেয়েই আর দেরি করল না, প্রায় দৌডে ঢুকে পড়ল। ও পাশের ঘরে। মহা বিস্ময় অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। চমৎকারর আসবাপত্র সজ্জিত ঘরে সম্মানিত অতিথিকে ডিভানে বসিয়ে আপ্যায়ন করছে চ্যাং টোয়াং। মাথা গরম হয়ে গেল ব্যাগলের। সম্মানিত অতিথিটি আর কেউ নয়, ডেপো বদমাশ সেই নীচ ছোটলোক ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক!
ব্যাগলের সারা শরীরে টগবগ করে রক্ত ফুটতে লাগল। একবার ভাবল ছুটে গিয়ে এক কামড়ে ছোড়ার কান কেড়ে নেয়। রাগে চিড়বিড় করছে ওর সারাশরীর।
ওর অকস্মাৎ অনুপ্রবেশে ফিরে তাকাল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক আর চ্যাং টোয়াং। চওড়া হাসিতে মুখ ভরিয়ে উঠে দাঁড়াল চাইনিজ। দু’হাত বাড়িয়ে বলল, হিরাম ব্যাগলে! আরে এসো এসো! কতদিন পর দেখা বলো তো দোস্ত!
কথা বলতে গিয়ে রাগের চোটে বলতে পারল না ব্যাগলে।
আরে, মিস্টার ব্যাগলে যে! দুধের বাটিতে বিস্কুট ফেলে বলল ফ্র্যাঙ্ক।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ব্যাগলে অতি চালাক ছোঁড়াটার দিকে। ওদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া সেই ট্রেনটার কথা মনে পড়ল ওর। হঠাৎ ও বুঝে ফেলল কি ঘটেছে।
১২. সরে পড়ার কোন উপায়
এখান থেকে সরে পড়ার কোন উপায় দেখল না বেনন। যতটুকু চিবাতে পারবে তার চেয়ে বেশি মুখে দিয়ে ফেলেছে ও এবার। শত্রু যদি দু’জন হত তাহলেও একবার চেষ্টা করে দেখত, কিন্তু সুদক্ষ দশ-বারো জন গানফাইটারের বিরুদ্ধে একা কি করার আছে ওর! এগিয়ে আসছে লোকগুলো, এরইমধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে গেছে কে কার আগে ওর ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়বে। অস্ত্র বের করেও গুলি করছে না কেউ কেউ সঙ্গীর গায়ে লাগতে পারে ভেবে।
যে লোকটা ওর হ্যাট ছুঁড়ে ফেলেছে তাকে লক্ষ্য করে ঘুসি ছুঁড়ল বেনন। লাগল না। মাথা সরিয়ে নিল লোকটা। গায়ের কাছে সেঁটে এসে হাঁটু তুলল বেননের তলপেটে মারার জন্যে। চোখের পলকে পা-টা ওপরে ঠেলে দিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল বেনন। ঠিক করে ফেলেছে মরতে যদি হয় তো লড়ে মরবে।
মাটিতে পড়েই লাথি মারল আউট-ল। পড়ে গেল ও। পরমুহূর্তেই ছেড়ে দেয়া স্পিঙের মত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাতের পটভূমিকায় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ও ক্যাম্পটা। ছোট্ট আগুন, তার পেছনে টাঙানো তাবু, দূরের কালো জঙ্গল আর চারপাশের ঝোঁপঝাড়, রাতের আকাশে তারার ঝিকিমিকি বিশ্বাস হতে চায় না এসবই থাকবে, শুধু থাকবে না সে নিজে। এখন হোক একটু পরে হোক লোকগুলো মেরে ফেলবে ওকে। ওই যে তাঁবুর সামনে ছটফট করছে উত্তেজিত ওয়াং; চোখে নিষ্পলক প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে হ্যারি হুলাহান-ওরা শেষ করে দিতে চায় ওকে!
লোকগুলোর নেতা নিশ্চয়ই ব্যাঙ্কার আর ডক্টর ওয়াং। ওই দু’জনকে হুমকি দিলে থেমে যাবে আর সবাই। চেষ্টা করেও অস্ত্র বের করতে পারল না বেনন। কে যেন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। মোচড় দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল ও। না পেরে খামচি দিয়ে গানবেল্ট থেকে তুলে নিল একমুঠো কার্তুজ। আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিল।
জড়িয়ে ধরা লোকটা আশা করছে বাকিরা এসে বেননকে কাবু করবে। সে-সুযোগ দিল না ও। লোকটাকে নিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। গড়াতে লাগল দু’জন। একেবারে আগুনের ধারে চলে এলো। পিঠে তাপ লাগতেই চামড়া বাঁচাতে বেননকে ছেড়ে দিল লোকটা। তার পাছায় কষে এক লাথি মেরে লাফ দিয়ে সরে গেল বেনন। ব্যস্ত মৌমাছির মত একে ওকে এড়িয়ে করালের দিকে দৌড় দিল।
গেল গেল করে উঠল ডক্টর ওয়াং।
ধাওয়া করল সবাই। লোকগুলো কাছে চলে এসেছে বুঝতে পেরে ঘুরে দাঁড়াল বেনন। সুবিধেই হলো ওর; সবাই একসঙ্গে হামলে পড়ায় কেউ মোক্ষম আঘাত করতে পারছে না। ওয়াঙের গলা শুনতে পেল ও। লোকটা চেঁচাচ্ছে: গুলি করো! গুলি করো!
আর মাত্র এক সেকেন্ড আগে হলে তার নির্দেশ পালিত হত, কিন্তু এরই মধ্যে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাসি আর আরেকজন গানম্যান। দুজন মিলে কাধ আঁকড়ে ধরে বেননকে মাটিতে শোয়ানোর চেষ্টা করছে। গায়ে গা লেগে যাওয়ায় সুবিধা করতে পারছে না কেউ। অন্যরা ওদের ওপর দিয়ে ফোকটে মারার চেষ্টা করছে। গুলি করলে কাসি আর তার সঙ্গীর গায়ে লাগবে।
কাসিকে প্রচণ্ড এক ঘুসি মারল বেনন তলপেটে। ভুস করে বুক থেকে সমস্ত দম বেরিয়ে গেল লোকটার। সামনে ঝুঁকে এলো মাথা। তাকে পেছনে ঠেলে দিয়ে বুকে লাথি মেরে ফেলে দিল বেনন। হুড়মুড় করে কয়েকজনকে নিয়ে মাটিতে চিতপটাং হলো কাসি। এদিকে বেননকে জাপটে ধরে প্রায় ঝুলে পড়েছে কাসির সঙ্গী।
আচমকা বেননকে ছেড়ে দিগ্বিদিক হারিয়ে দৌড় দিল লোকটা। আগুনের তাপে ফুটছে কার্তুজ। বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা ক্যাম্পে। আবছায়ায় কেউ খেয়াল করেনি ঝাঁপটাঝাপটির ফাঁকে বেনন কখন আগুনে গুলি ফেলেছে, ফলে সবাই আতঙ্কিত; চোরের মন পুলিশ পুলিশ; প্রত্যেকে ধারণা করেছে রাতের আঁধারে দল বেঁধে হানা দিয়েছে কেউ তাদের ওপর।
একেকজন দিশে হারিয়ে একেক দিকে ছুটতে লাগল।
আমি আহত হয়েছি! আর্তনাদ করল একজন।
অবাক হয়ে দেখল বেনন, সত্যিই একজন আউট-ল বাহু খামচে ধরেছে, রক্ত গড়াচ্ছে লোকটার আঙুলের ফাঁক দিয়ে। কপালের জোরে গুলি লেগে গেছে? হঠাৎ ও বুঝতে পারল আঁধারে লুকিয়ে কেউ একজন সত্যি সত্যিই ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। ব্যাগলে? খামোকা ভাবনা-চিন্তা করে সময় নষ্ট করল না বেনন। সুযোগ চিনতে দেরি হয়নি ওর। চমকে গিয়ে বোকার মত ছুটোছুটি করছে লোকগুলো; পালাবার এটাই সময়! তার আগে স্পারটা দরকার!
ওয়াং কোথায় আছে দেখে নিয়ে আগুনে লাথি মারল বেনন। ছড়িয়ে গেল জ্বলন্ত কাঠ-কয়লা। ধোঁয়ায় আবছা হয়ে এলো আগুনের আভা। আলাদা করে ওকে চিনতে পারবে না এখন কেউ। মাটি থেকে হ্যাটটা তুলে নিয়ে ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে দৃঢ় পায়ে এগোল ও ওয়াঙের দিকে।
লোকটাকে বজ্রমুষ্ঠিতে ধরতেই ফাঁদে পড়া বিড়ালের মত ছটফট করে উঠে চাইনিজ ভাষায় কি যেন বলল। বুঝে গেল বেনন ঠিক লোককেই ধরেছে। ওয়াঙের কব্জি মুচড়ে দিল ও। স্পারটা হাত থেকে পড়ে যেতেই ধাক্কা দিয়ে ওয়াংকে দূরে সরিয়ে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগল ওটা। হাতে ধাতুর স্পর্শ লাগতেই বুঝল জিনিসটা পাওয়া গেছে।
স্পার পকেটে পুরে হামাগুড়ি দিয়ে ক্যাম্প থেকে সরে যেতে লাগল ও। ঝোঁপের ভেতর ঢুকে সিধে হলো। চারপাশে সিক্সগানের মাজুল ফ্ল্যাশ। অচেনা আক্রমণকারীকে লক্ষ্য করে আন্দাজে গুলি করছে লোকগুলো। বারুদের ক্ষণিক ঝিলিক ছাড়া আর কোন আলো নেই। দৌড়াদৌড়ির সময় পায়ের তলায় চাপ। খেয়ে নিভে গেছে আগুন।
ক্যাম্প থেকে দূরে সরে যেতে লাগল বেনন। টিলার গায়ে ঘন জঙ্গল। তার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল ও। ট্রেইল খুঁজছে। জানে কিছুক্ষণের মধ্যেই ধাওয়া করবে ওয়াঙের গুণ্ডারা। পঞ্চাশ হাজার ডলারের সেই স্পার এখন ওর পকেটে। সহজে হাল ছাড়বে না ডক্টর ওয়াং। লোকটার আওতার বাইরে চলে যাওয়া দরকার, অথচ ঘোড়া নেই ওর সঙ্গে।
ক্যাম্পে এখনও গোলাগুলি চলছে শুনতে পেল ও। হ্যারি হুলাহান কি ওয়াঙের বিরুদ্ধে যোগ দিয়েছে? ব্যাঙ্কারের চিমসে চেহারা মনে পড়ল ওর। না, ওই লোক নিজের স্বার্থের বাইরে এক পা ফেলবে না। তারমানে শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে লড়াই। মাত্র একজন লোক গানফাইটারদের বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারবে না। এতক্ষণে সম্ভবত সরেও গেছে লোকটা।
হঠাৎ থেমে দাঁড়াল বেনন। সামনে ঝোঁপের মধ্যে নড়ছে একটা ঘোড়া। ওয়াঙের লোক খুঁজছে ওকে! ওর চেয়ে অনেক ভাল ভাবে এই অঞ্চলটা চেনে ওরা। রেল রোডকে জ্বালাতে গিয়ে চিনেছে। টিলার ওপর থেকে কাসির গলা শোনা গেল। সবাইকে জঙ্গলটা ঘিরে ফেলতে নির্দেশ দিচ্ছে। গাছের বিস্তার খুব বেশি নয়। যে লুকিয়ে থাকতে পারবে বেনন। আস্তে আস্তে ঘের ছোট করে আনবে লোকগুলো। আগে হোক পরে হোক ধরা ওকে পড়তেই হবে।
রাতটা হয়তো ঝোঁপ ঝাড়ে লুকিয়ে পার পাওয়া যাবে, কিন্তু দিনের আলো ফুটলেই সর্বনাশ। কিছুই করতে হবে না লোকগুলোকে, খিদে আর তৃষ্ণার জ্বালায় বেরতে ওকে হবেই। তার চেয়ে রাতের আঁধারে এদের ঘেরাটোপ থেকে বেরনোর চেষ্টা করাই ভাল, সিদ্ধান্ত নিল বেনন। একবার হ্যাটারের র্যাঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে আর চিন্তার কিছু নেই। ব্যবস্থা একটা হয়েই যাবে। আরেকটা ঘোড়া ধার করতে পারবে সে; শহরে গিয়ে ব্র্যান্ডনকে জানাতে পারবে এখানে কি ঘটছে।
ঝোঁপের মাঝ দিয়ে বেশ এগোচ্ছিল বেনন। হঠাৎ শেষ হয়ে গেল ঝোঁপের জঙ্গল। সামনে ঢালু হয়ে নেমে গেছে ন্যাড়া টিলা। ঢালে পড়ে আছে ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির পাথর। কিছুদিন আগে পাথর ধস হয়েছিল; তখন সব গাছপালা ভেঙেচুরে নিয়ে গেছে-এখনও জন্মায়নি। ফাঁকা জায়গাটার দিকে চেয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করল বেনন। ফিরে গেলে ওয়াঙের লোকদের হাতে পড়ার সম্ভাবনা, আর নামতে গেলে ওকে দেখে ফেলতে পারে লোকগুলো। সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে গুলি করা হবে। তবে একবার যদি ঢালের শেষে ঝোঁপের মধ্যে ও ঢুকতে পারে তাহলে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারবে। ঢালটা এমনই যে সাবধান থাকলে নামতে পারবে একজন মানুষ, কিন্তু কোন ঘোড়া-সে যতই সাহসী হোক-আরোহী নিয়ে নামতে পারবে না।
চাঁদটা মেঘের আড়ালে মুখ লুকাতেই কর্তব্য স্থির করা সোজা হয়ে গেল; হোঁচট খেতে খেতে পাথরের ফাঁক দিয়ে নামতে লাগল বেনন। একটু ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাড়াহুড়ো করছে। ওয়াঙের লোকদের বোকা ভাবার কোন কারণ নেই। পাথর ধসের জায়গাটায় এসে কেউ কেউ হয়তো ঘোড়া রেখে ওকে অনুসরণ করবে। তার আগেই নিচের ওই জঙ্গলে ঢুকে যাওয়া দরকার।
বড় বড় পাথরগুলোকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে নামছে ও। আশেপাশে মানুষের উপস্থিতি টের পাচ্ছে। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে খুঁজছে ওকে ওয়াঙের লোকজন।
চলার গতি বাড়াল বেনন। দ্রুত নামছে। পরপর কয়েকটা পাথর পাশ কাটিয়ে একটা বোল্ডার ঘুরতেই ঘাপটি মেরে থাকা এক লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেল ও। বিপদ! ধরা পড়লেই মরতে হবে! সামলে নিতে দেরি হলো না ওর। লোকটা চমক কাটানোর আগেই সিক্সগান বের করে তার বুকে ঠেসে ধরল ও। ফিসফিস করে বলল, টু শব্দ করলেও খুন হয়ে যাবে।
বুকে খোঁচা লাগায় গুঙিয়ে উঠল লোকটা। কণ্ঠস্বর পরিচিত।
কে? ব্র্যান্ডন, তুমি? জানতে চাইল বেনন।
ঈশ্বর! আমি ভেবেছিলাম তুমিও ওদের একজন! জবাব দিল চীফ এঞ্জিনিয়ার।
আমিও তাই ভেবেছিলাম। অস্ত্রটা খাপে পুরল বেনন। হঠাৎ এখানে কেন? ওয়াঙের ক্যাম্পে তুমিই হামলা করেছ?
লম্বা কাহিনী। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্র্যান্ডন। গলা সামান্য উঁচিয়ে ডাকল, ডেইজি, কোথায় তুমি!
এইযে এখানে। আরেকটা বোল্ডারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো মেয়েটা।
পা বাড়াল ব্র্যান্ডন। চলো, সরে যেতে হবে এখান থেকে।
যাচ্ছি কোথায়?
ঢালের শেষ মাথায় ঘোড়া লুকিয়ে রেখে এসেছি আমরা। ওই খনির কাছে।
খনি?
লোকে যেটাকে সোবার সুয়েড বলে, বলল ডেইজি। অনেকদিন আগেই পরিত্যক্ত হয়ে গেছে।
ডক্টর ওয়াং তার লোকদের কি বলেছিল মনে পড়ল বেননের লোকটার তাড়া খেয়ে খনির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল ও। ডক্টর ওয়াং গানফাইটারদের দিয়ে মাইনারের কাজ করাতে চায় কেন? তাহলে কি খনিতে সোনার খোঁজ পেয়েছে লোকটা?
এখন এসব প্রশ্ন করার সময় নয়, পরে এব্যাপারে আলাপ করবে ভেবে চুপ করে রইল বেনন।
কিছুক্ষণ পর খনি-মুখের কাছে চলে এলো ওরা। ঝোঁপের ভেতর থেকে ঘোড়া বের করে একটায় চাপল ডেইজি, অন্যটায় ব্র্যান্ডন আর বেনন। বনের মাঝ দিয়ে টিলা থেকে নামতে লাগল ওরা। কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছে বেনন। ওয়াঙের লোকরা ঢালের দিকে খুঁজবে, খনির দিকে তাদের আসার সম্ভাবনা কম। যখন তারা বুঝবে পাখি উড়ে গেছে ততক্ষণে অনেক দূরে চলে যেতে পারবে ওরা।
একবারে ঠিক সময়ে এসে হাজির হয়েছিলে ভাগ্যিস, নীরবতা ভাঙল বেনন।
ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়, বলল ব্র্যান্ডন। জিমি নর্টনের কাছ থেকে কাল রাতে একটা টেলিগ্রাম পাই। জানতে পারি ক্যাম্পে হামলা হয়েছে। তারপরই তোমার সঙ্গীকে জরুরী কাজে হেলেনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে রওয়ানা হয়ে যাই। এড অভ স্টীলে পৌঁছে জানলাম একটা ভুয়া টেলিগ্রাম পেয়ে তোমাকে নর্টন বন্দী করেছিল।
টেলিগ্রামটা কে পাঠিয়েছে বলে তোমার ধারণা?
শ্রাগ করল ব্র্যান্ডন। যে কেউ পাঠাতে পারে। টেলিগ্রাফারের অফিসে কয়েকটা মেসেজ রেখে এসেছিলাম; সেগুলোর সঙ্গে নিজের মেসেজটা রেখে যেতে পারবে যে কেউ। আর কাজটা যদি ভেতরের কারও হয়ে থাকে তো আরও সোজা। তাকে শুধু অপেক্ষা করতে হবে টেলিগ্রাফার কখন বাইরে যায়। লোকটা সরলেই শুধু মেসেজটা পাঠিয়ে দেয়া।
নর্টনকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি, লোকটা একরোখা, ক্ষোভ প্রকাশ করল বেনন।
মাথা দোলাল ব্র্যান্ডন। খবরটা জেনেই তোমাকে খুঁজতে বেরলাম আমি। ক্যানিয়ন পেরিয়ে সন্ধের দিকে পৌঁছালাম হ্যাটারের র্যাঞ্চে। ডেইজি বলল একটু আগে চলে গেছ তুমি। এলাকাটা চিনি না তাই আমার আসার কারণ শুনে সঙ্গে এলো ও। আবছা আঁধারে ডেইজিকে চোরা চোখে একবার দেখে নিল এঞ্জিনিয়ার। টিলার দিকে কিছুদূর এগোতেই দেখতে পেলাম একদল লোক ঘোড়ায় চেপে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। তুমিও তাদের মধ্যে আছ তা জানতাম না, কিন্তু বুঝতে পারলাম এরাই রেল ক্যাম্পে হানা দিচ্ছে। ওদের অনুসরণ করলাম আমরা, খনির কাছে ঘোড়া রেখে ক্যাম্পে গিয়ে আড়ালে লুকিয়ে থাকলাম। আগুনের আলোয় তখনই প্রথম দেখতে পেলাম তোমাকে। লড়াই করছ দেখে বুঝতে পারলাম নর্টনের ধারণা ভুল, আসলে রেল রোডের সঙ্গে বাটপাড়ি করোনি তুমি। তারপরের ঘটনা তো তুমি জানোই। তোমাকে অনুসরণ করে পাথর ধসের জায়গাটায় এসে হারিয়ে ফেললাম। তারপর কপাল ভাল যে তুমি আমার গায়ে এসে পড়লে। আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছিল তোমাকে ওয়াঙের লোক মনে করে।
সব ভাল যার শেষ ভাল, দার্শনিকের মত উদাস গলায় বলল বেনন। হ্যাটারের র্যাঞ্চে ভালয় ভালয় পৌঁছে গেলে হয় এখন।
দুবার জঙ্গলের মধ্যে থামতে হলো ওদের। ছড়িয়ে গিয়ে খুঁজছে ওয়াঙের লোকরা। কাছে চলে এসেছিল। ঘোড়ার নাকে হাত চাপা দিয়ে রাখল ওরা। শত্রুর দল দূরে চলে যাওয়ার পর এগোল আবার। সাবধানে এগোতে হচ্ছে, ফলে সময় লাগল বেশি। ঢাল পেরিয়ে সমতল জমিতে যখন পৌঁছল পুব আকাশে দেখা দিয়েছে ধূসর একটা রেখা।
সকালের প্রথম আলোয় পুবদিকে, হ্যাটারের র্যাঞ্চের উদ্দেশে ঘোড়া ছোটাল ওরা। মাঝে মাঝেই পেছনে তাকিয়ে দেখল। ওয়াঙের লোকজনের কোন চিহ্ন নেই। পাহাড়ে পাহাড়ে খুঁজে প্রবঞ্চক মরছে ব্যাটারা। স্বস্তির শ্বাস ফেলল বেনন। বুকে খোঁচা লাগতেই ওর মনে পড়ল স্পারটার কথা। ভাবল, রাতটা একেবারে নিষ্ফল যায়নি।
১৩. হ্যাটারের র্যাঞ্চে
হ্যাটারের র্যাঞ্চে গতকাল সময়টা বেননের ভাল কাটেনি। প্রথমে গুলি করতে যাচ্ছিল ব্যাঙ্কার। তারপর প্রায় খেদিয়েই দিল ডেইজি। তবু এখন র্যাঞ্চ বাড়িটা চোখে পড়তেই খুশি হয়ে উঠল বেনন। সারারাত উত্তেজনার পর বাড়িটা দেখে ওর মনে হলো ঘুমের স্বর্গ। হ্যাঁ, ওখানে আছে আরামের সমস্ত উপকরণ। খাওয়া, গোসল আর বিছানা। একবার বিছানায় গিয়ে পড়তে পারলে আঠারো ঘণ্টার আগে ঘুম থেকে উঠবে না ও।
বেননের মত অতটা খুশি দেখাচ্ছে না ব্র্যান্ডনকে। দেখে মনে হচ্ছে র্যাঞ্চে না যেতে হলেই ভাল হত। কিছুটা যেন অনিচ্ছুক একটা ভাব চেহারায়।
কৌতূহল বোধ করল বেনন।
ডেইজির দিকে তাকাল ব্র্যান্ডন। পাশে ঘোড়া ছোটাচ্ছে মেয়েটা। আচ্ছা, ডেইজি, কালকে রাতে আমি যখন আসি ঘুমিয়ে ছিল হ্যাটার। এখন নিশ্চয়ই ঘুম ভেঙেছে তার? রেল রোডের লোক আমি, যদি দেখে খেপে ওঠে? গুলি করে দেয় যদি
কুঁচকে তাকাল ডেইজি। দু’চোখে খেলা করছে কৌতুক।
গুলি করলে আমি অবাক হব না, বলল ও। তুমি সারারাত আমাকে নিয়ে বাইরে কাটিয়েছ। বাবা চাইবে তুমি আমাকে বিয়ে করো।
লজ্জা পেল এঞ্জিনিয়ার। কথা বলতে গিয়ে তোতলামিতে পেয়ে বসল। দেখো, আ…আ…ডেইজি..ইচ্ছে করে…আমি… ভাবিনি…আহহা, আমি বলতে চাইছি…তো…তোমাকে…আমি… ধূর! আমি বলতে চাই তোমাকে বিয়ে করার জন্যে আমার পিঠে কারও শটগান ধরতে হবে না।
থাক, তোমার মিথ্যে না বললেও চলবে। মুখ ঝামটা দিল ডেইজি।
মিথ্যে নয় মিথ্যে নয়, প্রায় হাহাকার করে উঠল ব্র্যান্ডন। চুপ করে থাকল ডেইজি।
বেনন বলল, হ্যাটারকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। স্পারটা এখন আমার পকেটে। আমাদের মাথায় তুলে নাচবে সে। স্পারটা বের করে তালুতে রেখে দেখল বেনন। সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে রূপোর স্পার। গায়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা। মেক্সিকান কারিগরের তৈরি যত্নের জিনিস। হিল-ব্র্যান্ডে অদ্ভুত একটা নক্সা আঁকা। এতই সুন্দর, একবার নক্সাটা দেখলে মনে থাকবে যে-কারও।
সবার মনোযোগ স্পারের ওপর, না তাকিয়েও বুঝতে পারছে বেনন। ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে ব্র্যান্ডন। ঘোড়াটা আরও কাছে সরিয়ে এনেছে ডেইজি।
এটাই তাহলে সেই স্পার যেটার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছে অনেকে! হ্যারি হুলাহানের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবি করেছে ওয়াং এটারই জন্যে! কি রহস্য লুকিয়ে আছে স্পারটার মধ্যে? উল্টেপাল্টে জিনিসটা দেখল বেনন। মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারল না। নক্সাটা ছুটন্ত বুনো মহিষের না হয়ে মানচিত্র জাতীয় কিছু হলেও না হয় ধরে নেয়া যেত গুপ্তধনের হদিস আছে বা আর কিছু? খুঁত খুঁত করছে বেননের মন। কি যেন একটা দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে!
তুমিই তাহলে চুরি করেছিলে ওটা! অগ্নিদৃষ্টিতে বেননকে দেখল ডেইজি।
ভুল বুঝছ। মেয়েটা দৃষ্টি নামিয়ে নিতে বাধ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত চোখে চোখে তাকিয়ে থাকল বেনন। তারপর বলল, কালকে রাতে ডক্টর ওয়াঙের কাছ থেকে এটা উদ্ধার করেছি। সে-ই চুরি করেছিল মিস অ্যানা হ্যাটারের কাছ থেকে।
তোমার সম্বন্ধে আমার ধারণাটা বোধহয় ভুল ছিল, অকপটে স্বীকার করল ডেইজি।
ব্র্যান্ডন বলল, তারপরও নিশ্চিত হচ্ছি কি করে যে আমাদের দেখা মাত্র হ্যাটার গুলি করবে না?
আগে যাই তো, তারপর দেখা যাবে। স্পারটা পকেটে পুরল বেনন।
আধঘণ্টার মধ্যে র্যাঞ্চের উঠানে পৌঁছে গেল ওরা। আস্তাবলের সামনে ঘোড়া থেকে নামল। সকাল হয়ে গেছে, বাঙ্ক হাউজ আর কুক শ্যাকে লোকজনের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কারা এসেছে দেখতে বেরিয়ে এলো কয়েকজন কাউহ্যান্ড। ডেইজি সঙ্গে থাকায় কেউ কিছু বলল না। যে চৌবাচ্চায় বেনন হ্যারি হুলাহানকে চুবিয়েছিল সেটাকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির বারান্দায় উঠল ওরা।
ঘরে ঢুকে অবাক হলো বেনন। একটা সোফায় আরাম করে বসে আছে ব্যাঙ্কার!
লোকটাকে দেখেই সরে দাঁড়াল বেনন। হাত চলে গেল হোলস্টারের পাশে। একবার লোকটাকে অবহেলা করে বিপদে পড়েছে; সেই একই ভুল আবারও করতে চায় না। ওর সতর্ক হয়ে ওঠা ব্যাঙ্কারের নজর এড়াল না। হাত তুলল লোকটা, নরম গলায় বলল, তোমার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা নেই, বেনন। তোমাকে ভুল ভেবেছিলাম আমি।
তোমার সেই ভুল ধারণা পাল্টাল কি করে? জানতে চাইল বেনন। একবিন্দু বিশ্বাস করে না ও লোকটাকে। অনেকগুলো প্রশ্ন ভীড় করে আসছে ওর মনে। সবগুলো প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পেলে হুলাহানের বদলে ছোবল দিতে উদ্যত কোন র্যাটল স্নেককে বেশি বিশ্বাস করবে ও।
জিমি নর্টনের মুখে তোমার ব্যাপারে খারাপ মন্তব্য শুনেই আমি ভুল বুঝেছিলাম, বলল হুলাহান। তারপর কাল রাতে, তোমাকে যখন ওয়াঙের ক্যাম্পে দেখলাম তখন আরও নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে তুমি আসলে রেল রোডের শত্রু। কিন্তু যখন তুমি লড়তে লাগলে, আমার চোখ খুলে গেল। বুঝলাম তুমি আমাদেরই একজন। তখনই আড়ালে সরে এসে কয়েকটা গুলি ছুঁড়লাম যাতে তোমার সুবিধে হয়। আমি আমার সাধ্য মত করেছি।
চিন্তিত চোখে লোকটাকে দেখল বেনন। ওয়াঙকে কোথায় পাওয়া যাবে জানলে কি করে?
জানতাম না। ওর লোকগুলোকে ট্রেইল করে ওখানে পৌঁছাই।
কোন সাহসে তুমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সেটা আমার জানার কৌতূহল হচ্ছে।
লোকটাকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি। আগেও এই এলাকায় কিছুদিন ঘুরঘুর করে গেছে। নিজের পরিচয় দেয় প্যালান্টোলজিস্ট বলে, তবে আমার ধারণা লোকটা সাধারণ মাপের একটা প্রতারক ছাড়া আর কিছুই নয়। শুনেছি টাকা দিয়ে লোকটাকে কেনা যায়।
সেজন্যেই ওর কাছ থেকে স্পারটা কিনতে চেয়েছিলে?
আমি চেয়েছিলাম ওটা হ্যাটারকে ফিরিয়ে দিতে। বলতে লজ্জা নেই, ভেবেছিলাম স্পারটা পেলে হ্যাটার খুশি হবে, রেল রোডের ব্যাপারে ওকে রাজি করাতে পারলে আমারও লাভ হবে। হাসল ব্যাঙ্কার। উকিলের মত একের পর এক প্রশ্ন করছ কেন? এবার আমার প্রশ্নের জবাব দাও; স্পারটা পেয়েছ?
হ্যাঁ।
কি ব্যাপার, কি নিয়ে কথা হচ্ছে এখানে? শোবার ঘরের দরজার কাছ থেকে জানতে চাইল হাটার। সবার অলক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে সে কখন যেন। লোকটার দৃষ্টি এক এক করে সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ব্র্যান্ডনকে দেখে ভ্ৰ কুঁচকে উঠল। বেনন দেখল আড়ষ্ট হয়ে গেছে ডেইজি। আশঙ্কা করছে এক্ষুণি বিস্ফোরিত হবে হ্যাটার। কিন্তু কিছু বলল না র্যাঞ্চার। সবার শেষে হলো বেননের ওপর।
এই যে এটা তোমার জিনিস। তাড়াতাড়ি করে স্পারটা বের করে হ্যাটারের দিকে বাড়িয়ে দিল বেনন। পাগলের সঙ্গে চালিয়াতি চলে না। ঝুঁকি নেয় শুধু নির্বোধরা। ওর অভিজ্ঞতা বলে তেড়ে আসা উন্মাদের চেয়ে শান্ত পাগল বেশি বিপজ্জনক।
স্পারটা নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে উল্টেপাল্টে দেখল হ্যাটার। চেহারা দেখে বোঝা যায় তাকিয়েই আছে শুধু; দেখছে না কিছুই। বিড় বিড় করে কি যেন বলল। তলিয়ে গেছে ভাবনার অতলে। কপালে গভীর কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। আশেপাশে কারও উপস্থিতি সম্বন্ধে যেন সচেতন নয়; বুটের কাছে স্পারটা ধরে দেখল কেমন মানাবে। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা কথাও না বলে ফিরে গেল নিজের শোবার ঘরে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল হ্যারি হুলাহান। নিস্তব্ধতায় আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পেল সবাই।
যাই, তোমাদের নাস্তার জোগাড় করি গে। কিচেনের দিকে পা বাড়াল ডেইজি।
বিশ মিনিট পর টেবিলে বসল সবাই। বেনন, ব্র্যান্ডন, ডেইজি আর হ্যারি হুলাহান। নাস্তার পর ডেইজি চলে গেল হ্যাটারের ঘরে। ফিরল একটু পরেই। ভীত আর চিন্তিত দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। বলল, কিছুই বলছে না বাবা। স্পারটা হাতে নিয়ে শুধু পায়চারি করছে। মাঝে মাঝে এমন হয়। তখন পাগলামি শুরু করে বাবা।
আবার এসে লিভিং রুমে বসল ওরা। করার কিছু নেই, কাজেই স্টকম্যানস জার্নাল নিয়ে পড়তে লাগল বেনন। ব্র্যান্ডন আর হ্যারি হুলাহানও যে যার ভাবনায় ডুবে চুপ করে বসে আছে। পাশের ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে পায়চারিরত হ্যাটারের বুটের আওয়াজ। একই ছন্দে হাঁটছে র্যাঞ্চার। গতির কোন বাড়া-কমা নেই। কাঠের মেঝেতে ঠকঠক শব্দ করছে বুট জুতো। এতই একঘেয়ে যে বিরক্তি লেগে যায়।
অনেকক্ষণ পর হাতঘড়িতে সময় দেখল ব্র্যান্ডন। ক্যাম্পে ফিরে যাওয়া উচিত। যাওয়ার আগে হ্যাটারের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভাল হত।
মাথা নাড়ল ডেইজি। বাবাকে এখন বিরক্ত না করাই ভাল।
এতক্ষণে ওয়াঙের দল পালিয়েছে, নাহলে ক্যাম্প থেকে লোক নিয়ে শয়তানগুলোকে ধরা যেত, আপনমনে বলল ব্র্যান্ডন।
দরকার থাকলে চলে যেতে পারো তুমি, বলল ব্যাঙ্কার, আমি থাকছি, হ্যাটারের মনমেজাজ ভাল দেখলে কোম্পানির হয়ে আলোচনাটা সেরে নেব।
আমিও অপেক্ষা করে দেখি কিছুক্ষণ। একটা স্টকম্যানস জার্নাল কোলের ওপর টেনে নিল ব্র্যান্ডন।
বেড রূমের বন্ধ দরজার দিকে তাকাল বেনন। এখনও পায়চারি করছে লোকটা। হাটার স্পারটা পেয়েই চিন্তায় পড়ে গেছে, বলল ও। আমার ধারণা সে বেরিয়ে এলেই সমস্ত রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে।
কিন্তু বেলা গড়িয়ে গেল হ্যাটার আর বের হয় না। অপেক্ষা জিনিসটা মানুষের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। একেকটা মিনিট যেন একেকটা বছর। পরিবেশটা ধীরে ধীরে হয়ে উঠল ধনুকের ছিলার মত টানটান। কৌতূহল এমন দুর্বার যে কেউ ঘর ছেড়ে নড়ছে না। চলে যাবার কথা আর একবারও বলেনি ব্র্যান্ডন। স্পারটাকে ঘিরে যে রহস্য তৈরি হয়েছে সেটা ভেদ করতে পারে একমাত্র পাগলা হ্যাটার। কি আছে লোকটার অসুস্থ মনে সেটা জানার ইচ্ছে সময়ের সঙ্গে প্রবল হয়ে উঠছে সবার।
সন্ধে নামতে ঘরে বাতি জ্বালতে গেল ডেইজি। ফিরেও এলো। এখনও ঘরের মধ্যে বিরামহীন হাঁটছে হ্যাটার। আমি সাপার তৈরি করতে গেলাম, একসময় অধৈর্য হয়ে বলল ডেইজি।
আমরা বরং কুকশ্যাকে গিয়ে কাউহ্যান্ডদের সঙ্গে খেয়ে নেব, দ্রতা করে বলল ব্র্যান্ডন।
নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যেই সাপারটা বানাব আমি। মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল ডেইজি।
বিয়ের পর বউয়ের বকা শুনতে শুনতেই জীবনটা কাটবে ব্র্যান্ডনের, ভাবল বেনন।
একটু পরেই চুলায় হাঁড়ি-কড়াইয়ের শব্দ উঠল। কাচকোচ করে প্রতিবাদ জানাল বেসিনের পাম্প। কিচেনের দরজা দিয়ে ভাজা স্টেকের সুগন্ধ ভেসে আসতে লাগল। গন্ধটা নাকে আসতেই হঠাৎ করে বেনন অনুভব করল ভীষণ খিদে পেয়েছে ওর।
আধঘণ্টা বাদে আবার কিচেনে হাজির হলো সবাই।
দেখি বাবা কিছু খাবে কিনা। ওদেরকে টেবিলে বসিয়ে দিয়ে দরজার দিকে এগোল ডেইজি। ফিরে এসে ওদের সঙ্গে খেতে বসল। আগের চেয়ে কম চিন্তিত দেখাচ্ছে, এখন তাকে। বলল, বাবাকে দেখে মনে হলো আজ সারাদিন খুব কষ্টে কেটেছে। বোধহয় অনেক আগের টুকরো টুকরো স্মৃতি মনে পড়ছে। বলল সবাইকে থাকতে। কি যেন বলতে চায়; মনের মধ্যে সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে, তারপর বলবে।
সাপার সেরে লিভিং রূমে ফিরে এলো ওরা। এখনও দেখা নেই পাগলা হ্যাটারের। হাঁটছে তো হাঁটছেই লোকটা। খামোকা। ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি না করে যে কোন একদিকে রওয়ানা হয়ে গেলে এতক্ষণে এই কাউন্টি ছাড়িয়ে যেত, ভাবল বিরক্ত বেনন।
এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। অস্থির হয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে অধৈর্য ব্র্যান্ডন। নির্বিকার চেহারায় বসে আছে ডেইজি। বেনন লক্ষ করল মাঝে মাঝেই দু’হাত মুঠো করছে মেয়েটা। যত চেষ্টাই করুক উদ্বেগ লুকাতে পারছে না। ব্যাঙ্কার একটা সিগার ধরিয়ে ঘর আর বারান্দা করছে। লোকটা বারান্দায় গিয়ে দাড়ালেও সিগারের সুগন্ধি ধোয়া ভেসে আসছে দরজা দিয়ে।
হঠাৎ করেই ওদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার ইতি ঘটল। চমকে গেল সবাই। বাইরে গুলির প্রচণ্ড আওয়াজ! প্রথম গুলির জবাবে আরও কয়েকবার গুলি হলো। লাফ দিয়ে সোফা ছাড়ল বেনন। বুঝতে পারছে বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুলি করছে ব্যাঙ্কার। গুলির ফাঁকে চেঁচিয়ে ওদের নাম ধরে ডাকছে লোকটা। এদিকে পাশের ঘরে হ্যাটারেব পায়চারি থেমে গেছে। ধপ করে কি যেন একটা পড়ার শব্দ হলো।
বারান্দায় যাওয়ার দরজার কাছে একই সঙ্গে পৌঁছল বেনন আর ব্র্যান্ডন। কাঁধে কাঁধ ঠেকে গেল দু’জনের। ধাক্কা দিয়ে এঞ্জিনিয়ারকে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো বেনন। দেখল রেলিং টপকে অন্ধকারে ধেয়ে যাচ্ছে হ্যারি হুলাহান। দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ফেরাল লোকটা। ওদেরকে হাতের ইশারা করে চেঁচাল। ওয়াং! তাড়াতাড়ি আসো, এখানেই লুকিয়েছে ওয়াং!
আমাদের বোঝা উচিত ছিল স্পার হারিয়ে এত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না লোকটা, দাঁতের ফাঁকে বলল ব্র্যান্ডন।
তুমি ওর সঙ্গে যাও। অপসৃয়মান ব্যাঙ্কারকে দেখাল বেনন। আমি ভেতরে যাচ্ছি হ্যাটারের অবস্থা দেখতে।
দৌড়ে লিভিং রূমে ফিরে এলো বেনন। হ্যাটারের দরজায় দাঁড়িয়ে মনে মনে প্রার্থনা করল যাতে তালা মারা না থাকে। উইলো কাঠের পুরু দরজাটা ভাঙতে হলে কুঠার লাগবে। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকে বেনন দেখল মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে পাগলা হ্যাটার। হাতে এখনও সেই স্পার। অজ্ঞান হয়ে গেছে র্যাঞ্চার। সাদা দাড়িতে লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। বেননের পেছনে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে তাকাল ডেইজি। জানালার কাঁচে নিখুঁত একটা গোল গর্ত।
আমাকে একটু সাহায্য করো, বলল বেনন। ওর কথায় চমক কাটিয়ে উঠল ডেইজি। বেননের সঙ্গে হাত লাগাল। দু’জন মিলে ওরা হ্যাটারকে তুলে শুইয়ে দিল বিছানায়। আহত লোকটার বুকে কান রেখে দেখল বেনন হৃৎস্পন্দন আছে। শ্বাস নিচ্ছে। ভাগ্যিস হুলাহান বারান্দায় ছিল। জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে স্পারটা নেয়ার সুযোগ পায়নি ওয়াং। ডেইজির দিকে তাকাল বেনন। তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ আর গরম পানির ব্যবস্থা করো।
বাবার জ্ঞান ফিরছে, ফিসফিস করে বলল ডেইজি।
তাকাল বেনন। চোখ মেলে ছাদের দিকে চেয়ে আছে র্যাঞ্চার। ঘোলা দৃষ্টিতে ভাবের কোন প্রকাশ নেই। এটাই হয়তো অন্তিম মুহূর্ত! হ্যাটারের ওপর ঝুঁকে পড়ল বেনন। শেষ চেষ্টা করে দেখবে কিছু জানা যায় কিনা।
স্পারটা, হ্যাটার। ওটা অত মূল্যবান কেন?
ঠোঁট নড়ল র্যাঞ্চারের। অস্পষ্ট আওয়াজ বেরল। ভাল মত বোঝা গেল না কথা। তারপরই চোখ বুজল হ্যাটার।
কি বলল বাবা? শ্বাস আটকে জানতে চাইল ডেইজি।
মাথা নাড়ল হতাশ বেনন। যদি ভুল শুনে না থাকি তো বলেছে সোবার সুয়েড। বুঝলাম না কি বলতে চায়।
১৪. ব্যান্ডেজের জন্যে পুরানো কাপড়
ব্যান্ডেজের জন্যে পুরানো কাপড় আর গরম পানি আনতে গেল ডেইজি। আহত হ্যাটারের পাশে দাঁড়িয়ে বেনন। হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়। সর্বক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে রেখেছে। সোবর সুয়েড? কেন বলল র্যাঞ্চার কথাটা? কি আছে ওখানে? ওয়াং কেন তার লোকদের কয়েকদিনের জন্যে মাইনার হতে বলেছিল?
প্রশ্নই আছে শুধু, কোন জবাব জানা নেই। ডেইজি যখন ফিরল আঁধার রাতে গিটারের ভেতর ঢুকে পড়া দিশে হারানো পোকার মত অসহায় লাগছে ওর।
ডেইজি কাপড় ছিঁড়ে ফালি ফালি করছে। বেননও হাত লাগাল। ভেজা কাপড় দিয়ে ক্ষতটা পরিষ্কার করতে লাগল ও। আততায়ীর বুলেট হ্যাটারের মাথায় লেগেছে। পুরানো ক্ষতটা থেকে খুব একটা দূরে নয়।
সোবার সুয়েড, আপন মনে বলল বেনন। পাথর ধস নেমেছে যে টিলায় সেটার গোড়ায় খনিটা। হ্যাটার কি বলতে চেয়েছিল? এমন কি হতে পারে ওখানে সোনা রয়ে গেছে? স্পারের সঙ্গে খনিটার কোন না কোন সম্পর্ক আছে, তা নাহলে এত ঝুঁকি নিয়ে র্যাঞ্চে এসে হামলা করত না ওয়াং।
দক্ষ হাতে ব্যান্ডেজ বাধছে ডেইজি। বেনন দেখল হাত কাঁপছে মেয়েটার। তবে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রেখেছে। বেননের কথা শুনে মাথা নাড়ল। ওখানে সোনা নেই এটা নিশ্চিত। আমার জন্মের আগেই খনি বন্ধ হয়ে গেছে। সোনা ছিলই না আসলে। সোবার সুয়েড নামকরণ হয়েছে কেন তা জানো? কাজ না থামিয়েই বলে চলল ডেইজি। চাইছে মনটা অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে। কয়েকজন ঠগবাজ মিলে সোনার লোভ দেখিয়ে এক মাতাল সুইডিশের কাছে খনিটা বেচে দেয়। তারপর লোকটা যখন মাইনিং করতে এসে দেখল কি ঠকাটা ঠকেছে, এক পলকে নেশা ছুটে গেল তার। আবার কে কখন ঠকিয়ে দেয় সেই ভয়ে দেরি না করে অবশিষ্ট টাকা নিয়ে, তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে গেল সে। তারপর থেকে পড়ে আছে খনি, কেউ আর ভুলেও ওটা কেনেনি। আমার বয়স যখন ছয় কি সাত, পাথর ধস নেমে বন্ধ হয়ে গেল খনি-মুখ।
ডেইজি ঠিকই বলেছে, দরজার কাছ থেকে বলল হুলাহান। ওয়াংকে না পেয়ে ফিরে এসেছে ব্র্যান্ডন আর সে। খাটের পাশে এসে দাঁড়াল দু’জন। বাইরে এখনও খোঁজাখুঁজি করছে। কাউহ্যান্ডরা। হ্যাটারের ওপর থেকে বেননের ওপর স্থির হলো ব্যাঙ্কারের দৃষ্টি। কি অবস্থা ওর?
আঘাতটা মারাত্মক। ওয়াংকে ধরতে পারলে তোমরা?
কথা বলল ব্র্যান্ডন। না, পালিয়ে গেছে। সম্ভবত একা এসেছিল, দলবল নিয়ে এলে কাউকে না কাউকে ধরা যেত। হ্যাটারের খোঁজ নিতে আমরা চলে এলাম। কাউহ্যান্ডরা এখনও খুঁজছে।
ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ হতেই এক এক করে সবাইকে দেখল ডেইজি। চেহারায় ফুটে উঠল দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। শান্ত স্বরে বলল, আজকেই বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে, নাহলে বাঁচানো যাবে না।
সবচেয়ে কাছের ডাক্তার আছে টেইল হল্টে, জানাল ব্র্যান্ডন।
আমরা ওকে ওয়্যাগনে করে এন্ড অভ স্টীলে নিয়ে যাব, বলল হুলাহান, সেখান থেকে ট্রেনে করে টেইল হল্টে।
মাথা ঝাঁকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ব্র্যান্ডন। ডেইজি অনুসরণ করল তাকে। দিনটা খুব খারাপ কাটল। আড়মোড়া ভেঙে ব্যাঙ্কারের দিকে তাকাল বেনন। সারাদিন অপেক্ষা করেছে ও স্পারের রহস্যটা জানতে পারবে আশা করে। যখন জানার সময় হলো একটা বুলেট মুখ বন্ধ করে দিল হ্যাটারের। কোনদিন আর কিছু জানা যাবে কিনা সন্দেহ। হ্যাটারের অবস্থা গুরুতর। না-ও বাঁচতে পারে। বিপজ্জনক ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে লোকটাকে নিয়ে এখন যেতে হবে এন্ড অভ স্টীলে। পথে ওয়াং তার গুণ্ডাদের নিয়ে হামলা করলে সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হবে।
একই চিন্তা খেলছে ব্যাঙ্কারের মাথায়, কারণ লোকটা বলল, হ্যাটারের ক্রুদের সঙ্গে করে নিয়ে গেলে পথে বিপদ ঘটবে না আশা করি।
র্যাঞ্চটা খালি রেখে যাওয়া যাবে না, কালকে রাতে কাসি র্যাঞ্চে হামলা করতে চেয়ে ছিল সে-কথা মনে পড়তেই দ্বিমত পোষণ করল বেনন। ব্র্যান্ডনের দেরি দেখে অধৈর্য হয়ে বলল, একটা ওয়্যাগনে ঘোড়া জুড়তে আর কতক্ষণ লাগাবে!
সোবার সুয়েডের ব্যাপারে কি যেন বলছিলে শুনলাম? জানতে চাইল হুলাহান।
জ্ঞান ফিরে পেয়ে খনিটার নাম নিয়েছে হ্যাটার।
আশ্চর্য! খনির সঙ্গে হ্যাটারের কি সম্পর্ক?
শ্রাগ করল বেনন। সেটা বলতে পারবে ডক্টর ওয়াং।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো বেনন। বাড়ির কোণা ঘুরে বার্নের দিকে এগোল। সচেতন হয়ে আছে। জানে, আঁধারে লুকিয়ে থাকতে পারে সশস্ত্র ওয়াং। হাল ছেড়ে খোজাখুঁজি বাদ দিয়ে উঠানে জড়ো হচ্ছে কাউহ্যান্ডরা। অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে সুযোগ বুঝে ওয়াং ফিরে এলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। লোকটা দুঃসাহসী।
ছায়ার মত বার্নের দরজায় এসে হাজির হলো বেনন। বার্নের দরজা খোলা। ভেতরে লণ্ঠনের হলুদ আলো দেখা যাচ্ছে। হালকা একটা ওয়্যাগনে ঘোড়া জুতছে ব্র্যান্ডন। ডেইজি দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। সরে আসতে গিয়েও থেমে গেল বেনন। গাঢ় স্বরে কথা বলে উঠেছে ব্র্যান্ডন।
ডেইজি, আমি ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। জানি এখন এসব বার সময় নয়, তবু আমি ঠিক করেছি আজই তোমার মতামত জানতে চাইব। আমি তোমাকে ভালবাসি, ডেইজি। তুমি চাইলে টেইল হল্টে গিয়ে আমরা বিয়েটা সেরে নিতে পারি।
কোন জবাব দিল না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল ডেইজি।
মেয়েটার মনের অবস্থা বুঝে কাশি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আলোর বৃত্তে এসে দাঁড়াল বেনন। ও মুখ খোলার আগেই ঝট করে ওর দিকে ফিরল ডেইজি। দু’চোখে আগুন ঝরছে। চেহারায় অসহায় রাগ।
বলো! বলে দাও ওকে যে হ্যাটার আমার বাবা নয়! বলে দাও কেন আমি ওকে বিয়ে করতে পারব না! বলছ না কেন যে আমি আসলে চোরের মেয়ে? গতকালও হুলাহান বলেছে আমি আমার বাবার মত হয়েছি!
আলতো করে মেয়েটার কাঁধে হাত রাখল বেনন। অনুভব করল বাঁশপাতার মত থরথর করে কাঁপছে ডেইজি। দু’চোখে জল। মৃদু স্বরে ও বলল, গত দু’দিন তোমার ওপর দিয়ে খুব চাপ গেছে, ম্যাম। চলো, তোমার বাবাকে নিয়ে শহরে যেতে হবে আমাদের। তোমারও বিশ্রাম দরকার।
সহানুভূতির ছোঁয়ায় সহজ বোধ করল ডেইজি। আস্তে করে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। চোখের জল মুছে বলল, ঠিকই বলেছ তুমি।
একটা শেড থেকে চাবুকটা নিয়ে ওয়্যাগনের ড্রাইভিং সীটে বসল ডেইজি। ওয়্যাগন থামাল বারান্দার সামনে। কাউহ্যান্ডদের জড়ো করে নির্দেশ দিল বেনন যাতে সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থা করা হয় র্যাঞ্চে। হ্যারি হুলাহান সঙ্গে কয়েকজনকে নেয়ার কথা বলতেই নাকচ করে দিল ও। যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিল র্যাঞ্চ রক্ষা করাটাই বেশি প্রয়োজন, এমনিতেও আঁধারে তেমন কোন কাজে আসবে না কাউহ্যান্ডদের প্রহরা। বরং বাড়তি লোক সঙ্গে গেলে ওয়াঙের দৃষ্টি আকর্ষণের ভয় বাড়বে।
বেননের পরামর্শে কয়েকজন একটা পুরু ম্যাট্রেস এনে বিছিয়ে দিল ওয়াগন বক্সে। তিনজন কাউহ্যান্ড ধরাধরি করে সেটার ওপর আহত হ্যাটারকে শোয়াল। স্পারটা নিয়ে ব্র্যান্ডনের হাতে দিল বেনন।
এটা তোমার কাছে রাখো। রেল অফিসে সিন্দুক থাকলে ভেতরে রেখে তালা দিয়ে রেখো। জিনিসটা সবাই চাইছে।
আমার কাছে নিরাপদেই থাকবে। স্পারটা পকেটে পুরল ব্র্যান্ডন।
আমিও যাচ্ছি তোমাদের সঙ্গে, বলল ব্যাঙ্কার।
আমিই বা বাদ পড়ি কেন! শ্রাগ করে আঁধারের দিকে তাকাল বেনন। ওর ইচ্ছে ওয়াঙের ট্রেইল খুঁজে নিয়ে অনুসরণ করে, কিন্তু এটাও বুঝতে পারছে যে নিকষ কালো এই বিপদসংকুল রাতে ডেইজিদের সঙ্গে থাকাটাই বেশি জরুরী। ডেইজির দিকে তাকাল বেনন। আমাকে অবশ্য আরেকটা ঘোড়া ধার দিতে হবে।
বলতে ভুলে গেছিলাম তোমার নেয়া ঘোড়াটা আজকে বিকেলে ফিরে এসেছে। করালের গেটে দাঁড়িয়ে ছিল। কাউহ্যান্ডরা দেখতে পেয়ে ধরেছে।
তারমানে আস্তানা ছেড়ে চলে গেছে ওয়াং, বলল বেনন। যাওয়ার সময় বাড়তি ঘোড়াটা নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। ব্র্যান্ডনের দিকে ফিরল সে। তোমার তাহলে আর ক্রুদের নিয়ে খুঁজতে বেরনোর মানে হয় না। আমাদের পাখি উড়ে গেছে।
তুমি ইচ্ছে করলে আমার পাশে বসতে পারো, বেনন; বলল ডেইজি।
ওয়াগন চালাবার ব্যাপারে বিড়বিড় করে কি যেন বলল বেনন। জবাবে ডেইজি জানাল এলাকাটা সে ভাল চেনে। তার পক্ষেই দ্রুত এগোনো সহজ হবে। অগত্যা উঠে বসল বেনন ডেইজির পাশে। ঘোড়াগুলোর কানের পাশে চাবুক হাকাল ডেইজি। গড়গড়িয়ে চলতে লাগল ওয়্যাগন। শিগগিরই বেরিয়ে এলো উঠান থেকে। ওয়্যাগনের দু’পাশে ঘোড়ায় চড়ে ওদের পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে ব্র্যান্ডন আর হ্যারি হুলাহান। একটু পরেই অনেক পিছনে পড়ে গেল র্যাঞ্চের আলো।
সরু একটা রাস্তা দিয়ে দক্ষ হাতে দ্রুত ওয়্যাগন ছোটাল ডেইজি। রাস্তাটা গেছে অপেক্ষাকৃত সমতল জমির ওপর দিয়ে। টিলাটক্কর পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়েছে, তারপর ঢুকেছে ক্যানিয়নের গোলকধাঁধায়।
ক্যানিয়নে ঢুকতেই আরও ঘন হয়ে এলো আঁধার। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল বেনন, ভাগ্যিস ডেইজির রাস্তা চেনা, তা নাহলে ক্যানিয়নের ভেতর ঘুরপাক খেতে হত; দেরি হয়ে যেত অনেক।
পাথুরে মেঝেতে ওয়্যাগনের চাকা আর ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠছে; দু’পাশের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে শতগুণ জোরাল শোনাচ্ছে প্রতিধ্বনি। মনে হচ্ছে চারদিক থেকে ছুটে আসছে অসংখ্য ওয়্যাগন। যত এগোচ্ছে চিন্তা বাড়ছে বেননের, কাছেই কোথাও আছে ওয়াং। হয়তো দলবল নিয়ে সুবিধেজনক জায়গায় অপেক্ষা করছে, সুযোগ মত অ্যাম্বুশ করবে ওদের।
গা ছমছমে একটা পরিবেশ। চাঁদ ওঠেনি আজ রাতে। তারাগুলো ঢেকে দিয়েছে কুচকুচে কালো মেঘ। বাতাস স্তব্ধ। গুমোট। আসন্ন ঝড়ের আভাস সুস্পষ্ট। ক্যানিয়নে ঝড় হলেই বের হয় সেই অতিকায় দানব!
ওয়াঙের তরফ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা আছে, সে-কথা বেননের মতই ব্র্যান্ডনও বুঝেছে। স্কাউটিং করার জন্যে ঘোড়া দাবড়ে আঁধারে মিলিয়ে গেল সে। কিছুক্ষণ পরপর ফিরে এসে জানাতে লাগল সামনের ট্রেইলে কেউ নেই। খানিকটা নিশ্চিন্ত হলো ওরা।
মাঝে মাঝে ওয়াগন চালাবার দায়িত্ব বেননকে দিয়ে হ্যাটারকে দেখতে গেল ডেইজি। প্রত্যেকবার ফিরল আরও গম্ভীর হয়ে। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল, এখনও বাবার জ্ঞান ফেরেনি। কিছুক্ষণ পর বেনন টের পেল নিঃশব্দে কাঁদছে মেয়েটা। বুঝল বেনন ডেইজির দুঃখ। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে মেয়েটা। মানুষ হয়েছে হ্যাটারের কাছে। বাবার স্নেহ-যত্ন দিয়ে ওকে বড় করে তুলেছে যে মানুষটা সে এখন আহত হয়ে পড়ে আছে; বাঁচবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। বেনন চাইল ডেইজির কাঁধ জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়; কিন্তু একটু চিন্তা করে মত পাল্টাল। যার কাজ তাকেই সাজে।
পরেরবার ব্র্যান্ডন ফিরতেই ও বলল, এবার তুমি সীটে বসে বিশ্রাম নাও, আমি কিছুক্ষণ ঘোড়ায় চড়ে শরীরের জং ছাড়িয়ে নিই।
ওয়্যাগনটাকে পেছনে ফেলে সিকি মাইল এগিয়ে গেল বেনন। থামল তারপর। কান পেতে শুনল অস্বাভাবিক কোন শব্দ পাওয়া যায় কিনা। না, আগুয়ান ওয়্যাগনের একটানা ঘড়ঘড়ানি ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। আবার ফিরে এলো বেনন ওয়্যাগনের কাছে।
এভাবেই মাইলের পর মাইল পেরিয়ে চলল ওরা। কখনও সখনও স্যাডলে বসেই ঝিমিয়ে নিল বেনন। প্রায় দু’রাত হয়ে গেল ঘুমায় না ও।
একঘেয়ে যাত্রা। সবগুলো ক্যানিয়ন দেখতে একইরকম। সেই অন্ধকার আর দু’পাশে খাড়া উঠে যাওয়া সুউচ্চ দেয়াল। সরু খাদের ভেতর দিয়ে এগোনোর সময় মনে হয় কোথাও কোন গন্তব্যে কখনও পৌঁছানো যাবে না। তার ওপর হ্যাটার যাতে অযথা ঝাঁকি না খায় সেজন্যে আস্তে আস্তে ওয়্যাগন চালাচ্ছে ডেইজি। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরে চলতে হচ্ছে বেননকে। ফলে সময় লাগছে অনেক বেশি।
মাঝরাত পেরনোর অনেকক্ষণ পর চওড়া হয়ে এলো ক্যানিয়ন। জায়গাটা পরিচিত লাগায় চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর বোলাল বেনন। অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে, বুঝতে চেষ্টা করল এ-পথেই ডায়নোসরের তাড়া খেয়েছিল কিনা দু’রাত আগে। ঘোড়া থেকে নেমে ম্যাচের কাঠি জ্বেলে বালুতে ঘোড়ার খুরের দাগ খুঁজল বেনন। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করতেই চোখ কপালে উঠল। একটা নয়, অসংখ্য ঘোড়া যাতায়াত করেছে এই পথে। তারমানে এই ক্যানিয়ন ধরেই রেল রোডের ক্যাম্পে হানা দেয় ওয়াঙের ভাড়াটে আততায়ীরা।
নিশ্চিত হতে আরও সামনে বাড়ল ও। পাথর হয়ে গেল ধুলোয় কয়েকটা অতিকায় পায়ের ছাপ দেখে। পা যদি এই আকৃতির হয় তাহলে আস্ত জন্তুটা কত বড়! ম্যাচের কাঠি ফেলে দিল ও আগুনের ছ্যাকা খেয়ে। টের পেল ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে গেছে সমস্ত চুল। মেরুদণ্ড বেয়ে সরসর করে নামছে ঘামের ফোঁটা। স্থাণুর মত চুপ করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল বেনন, তারপর ওয়্যাগনের কাছে ফিরে এলো। ব্র্যান্ডনের উদ্দেশে বলল, ক্যাম্পের কাছে চলে এসেছি আমরা। ডায়নোসরের তাড়া খেয়ে দু’রাত আগে এখান দিয়েই পালিয়েছিল আমার ঘোড়াটা।
তুমিও দেখেছ ওটাকে! বিস্ময়ে চমকে গেল ব্র্যান্ডন। সামলে নিয়ে একটু পরে বলল, আমি বিকেলে একবার ভেবেছিলাম তোমাকে জিজ্ঞেস করি, তারপর তুমি চোখ বুজে আছ দেখে আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। জিমি নর্টন আর ক্রুরাও দেখেছে। দেখতে কেমন ওটা, বেনন?
চারতলা বাড়ির সমান বা তার চেয়েও বড় হবে। ভালমত দেখার সুযোগ পাইনি, একবার বিজলি চমকে উঠল তারপরেই আঁধারে মিলিয়ে গেল দানব। ছুটতে শুরু করল আমার ঘোড়াটা। …স্কাউটিং করতে গিয়ে একটু আগেই–ওটার পায়ের ছাপ দেখলাম। সে-রাতের সেই গা শিরশিরে অনুভূতি আবার ওকে জড়িয়ে ধরছে স্পষ্ট অনুভব করল বেনন। দিনের বেলা ভাবলে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়, কিন্তু এরকম থমথমে আঁধার রাতে সেই দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর বাস্তব। অসহায় লাগে নিজেকে।
কে জানে সামনেই হয়তো কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই দানবটা।
১৫. পথে কোন বিপদ হলে না
পথে কোন বিপদ হলে না, সকালের প্রথম আলোয় নিরাপদেই ক্যাম্পে পৌঁছল ওরা। অবাক হয়ে গেল বেনন। গত দু’দিনে এক মাইল এগিয়ে এসেছে ক্যাম্প। প্রতিদিন আধ মাইল করে লাইন বসাচ্ছে জিমি নর্টনের শ্রমিক দল। আগের মতই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাবু আর কাঠের ছোট ছোট গুদাম-ঘর। দেখে মনে হচ্ছে প্রবল কোন ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে চারপাশ। ক্যাম্পের মাঝখানে জ্বলছে মস্ত একটা আগুন। বড় বড় কয়েকটা কড়াইতে নাস্তার আয়োজন হচ্ছে। ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে ক্রুরা। এটা নিশ্চিত যে রাতে ওয়াঙের লোকরা হামলা করেনি। ওয়াং এখন কোথায় আন্দাজ করতে পারল বেনন।
পরের চিন্তা পরে করা যাবে। ঘোড়া রেখে আগে বাড়ল বেনন। হ্যাটারকে ওয়াগন থেকে নামাতে লোক ডাকতে হবে, খবর দিতে হবে জিমি নর্টনকে, যাতে করে তাড়াতাড়ি একটা ট্রেনের ব্যবস্থা করে আহত র্যাঞ্চারকে শহরে পাঠানো যায়।
মাত্র হাত পাঁচেক গিয়েই ধরা পড়ে গেল বেচারা। ভাবতেও পারেনি এরকম বিপদ ঘাড়ে এসে পড়তে পারে। পেছন থেকে ভারী একটা হাত এসে চেপে ধরল ওর ঘেঁটি। কানের লতিতে পুরু ব্রাশের মত কর্কশ গোঁফের খোঁচা খেল বেনন। বোমার মত ফেটে পড়ল জিমি নর্টনের মোটা গলা: তাহলে তুমি আবার এসেছ! সাহস তো কম নয়! এইবার ঘুসিয়ে ভর্তা করে ফেলব!
শূন্যে পা ঝুলছে ওর, মরিয়া হয়ে রাগে-দুঃখে চেঁচাল বেনন, আমি তোমাকে আগেও বলেছি ওই টেলিগ্রামটা ভুয়া!
কথাটা ঠিক, ওকে সমর্থন করল ব্র্যান্ডন। ওয়্যাগন নিয়ে এসে পড়েছে ওরা। থেমেছে ঝুলন্ত বেননের পাশে।
বিদঘুঁটে চেহারা করে ওকে ছেড়ে দিল নর্টন। ক্ষোভের সঙ্গে বলল, ওকে দেখলেই আমার ঝামেলাবাজ বলে মনে হয়!
আমারও তাই মনে হত, বলল হ্যারি হুলাহান। কিন্তু আসলে ও মন্ট্যানা সেন্ট্রালের লোক। আমাদের হয়ে লড়তে ওকে আমি নিজের চোখে দেখেছি।
ওয়্যাগনটাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে কৌতূহলী রেল রোডারা। হাতের ইশারায় তাদের চলে যেতে বলল ব্র্যান্ডন। লোকগুলো সরতে লেগেছে এমন সময় হুইসল বাজিয়ে ক্যাম্পের অস্থায়ী স্টেশনে থামল একটা লোকোমোটিভ। ওটা থেকে নামল চ্যাং টোয়াঙের পাঠানো নতুন শ্রমিকরা। সবার শেষে নামল মিস অ্যানা হ্যাটার, ব্যাগলে, ধোপদুরস্ত পোশাক পরা ভাউবয়েস সি. ভাউবয়েস নোয়াক আর এমব্রয়ডারি করা নাইটগাউন জড়ানো ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক। দলটার মধ্যে সবার নজর কাড়ল ব্যাগলে তার দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা প্যান্টটার জন্যে।
ব্যাগলে কাছে আসতেই হাত বাড়িয়ে দিল উচ্ছ্বসিত নেন।
কেমন আছ, বুড়ো ঘোড়া?
কি করে বলি! উদাস হয়ে গেল ব্যাগলে। সামনে ভদ্রমহিলা আছে যে!
মিস্টার ব্যাগলে সদ্য হেলেনা ঘুরে এসেছেন; তারপর থেকেই এরকম উদাস হয়ে যাচ্ছেন তিনি, জানাল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক।
বাবাকে দেখতে শুকনো মুখে ওয়্যাগন বক্সে গিয়ে উঠেছে ডেইজি আর মিস হ্যাটার। এদিকে ব্র্যান্ডন আর হুলাহান পাগলা হ্যাটারের আহত হওয়ার ব্যাপারটা ভাউবয়েসকে জানাচ্ছে। মাঝপথেই তাদেরকে থামিয়ে দিল ভাউবয়েস। বলল, এখন নয়, পরে শোনা যাবে বাকিটা। এখন হচ্ছে দায়িত্ব পালনের সময়। আহত মানুষটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। টেইল হল্টে ভাল ডাক্তার আছে?
আছে, বলল ডেইজি, যদি কোন ঘোড়া অসুস্থ হয়ে পড়ে।
মানে?
পশু চিকিৎসক।
ব্র্যান্ডন, এক্ষুণি হেলেনায় টেলিগ্রাফ করো, এঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকিয়ে ষাঁড়ের মত গর্জন ছাড়ল ভাউবয়েস। সেরা ডাক্তারকে পাঠাতে বলবে। লোকটা পৌঁছনোর আগেই হ্যাটারকে নিয়ে টেইল হল্টে পৌঁছে যাব আমরা। আমার ব্যক্তিগত কোচে করে যাবে হ্যাটার। চট করে মিস অ্যানা হ্যাটারকে এবার দেখে নিল ভাউবয়েস। আমরা আমাদের হ্যাটারকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করব; আমরা বুঝিয়ে দেব যে মন্ট্যানা সেন্ট্রাল রেল রোড হৃদয়হীন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়; আমরা শুধু মানুষের উপকারের জন্যেই মন-প্রাণ ঢেলে সেবা করব বলে ব্রতী হয়েছি।
মিস্টার হ্যাটার জমি না বেচলে রেল রোডের খরচ অনেক বেশি পড়বে সে-কথা তোমার মনেই নেই, তাই না, বাবা? নীরিহ ভঙ্গিতে জানতে চাইল ফ্র্যাঙ্ক। চোখ পিটপিট করে বাবাকে দেখছে।
চুপ করো, ফ্র্যাঙ্ক, ধমক দিল ভাউবয়েস। কাছে দাঁড়ানো উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল, এই তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ, কয়েকজন মিলে মিস্টার হ্যাটারকে আমার কোচে তুলে দাও।
ওয়্যাগন থেকে নেমে কাজটা তদারকি করতে শুরু করলেন মিস হ্যাটার। আপনি জেনে খুশি হবেনন সেই স্পারটা আমরা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করতে পেরেছি, তাঁকে এক ফাঁকে বলল বেনন। ওটা এখন ব্র্যান্ডনের কাছে আছে।
বাহ, চমৎকার! বললেন অ্যানি। তদারকি থামিয়ে বেননকে পাকড়াও করলেন। অনেকক্ষণ কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলেননি। বুঝলেন, মিস্টার বেনন, দারুণ একটা সুসংবাদ দিলেন। স্পারটা না পেলে কাজিন লুকাসের সঙ্গে দেখা করার মুখ থাকত না আমার। অথচ কী যে বিরক্তিকর একটা শহর টেইল হল্ট! ওটা ছাড়া আসতেও পারছি না, আবার শহরেও মন টিকছে না! শেষ পর্যন্ত এন্ড অভ স্টীল পরিদর্শনের জন্যে মিস্টার ভাউবয়েসকে অনুরোধটা করেই ফেললাম। ভাগ্যিস আমি এসেছিলাম! ভাগ্য ভাল শেয়ার হোল্ডারদের। বিশ্বাসই করতে পারবেন না এখানে কি পরিমাণ অরাজকতা চলছে। এই ক’দিনে মিস্টার ব্র্যান্ডনের জন্যে ছিয়াত্তরটা উপদেশ লিখে আমি লিস্টি বানিয়েছি।
ওটা পেলে খুবই খুশি হবেনন মিস্টার ব্র্যান্ডন, গম্ভীর চেহারা করে বলল বেনন। আমার ধারণা ততটাই খুশি হবেনন যতটা খুশি হতেন জুতোর তলায় একটা কেন্নোকে পিষে ফেলতে পারলে।
জুতোর তলায় একটা কেন্নোকে পিষে ফেলতে পারলে? ভ্রূ কুঁচকে কথাটার তাৎপর্য বুঝতে চাইলেন মিস হ্যাটার। তারপর বোধহয় ভাবলেন ব্যাগলের ভাই আর কী তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলবে। অসন্তুষ্ট চেহারায় মাথা নাড়লেন তিনি। বললেন, খামোকা একটা নীরিহ কেন্নোকে পিষে দিয়ে মিস্টার ব্র্যান্ডন খুশি হতে যাবে কেন?
কয়েকজন লোক ধরাধরি করে হ্যাটারকে নিয়ে ভাউবয়েসের কোচের দিকে চলল। পাশে ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছে ডেইজি। এছাড়া দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে সারারাত ওয়্যাগন চালিয়ে এখানে পৌঁছেছে মেয়েটা।
নির্দেশের পর নির্দেশ দিয়ে চারদিক সরগরম করে রেখেছে ভাউবয়েস। মস্ত বস্তু নিয়ে এখানে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে সে। তার কোচের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে একটা লোকোমোটিভ। ওদিকে টেলিগ্রাফারের অফিসে চলছে মহা ব্যস্ততা। ডাক্তারের জন্যে খবর পাঠানো হচ্ছে হেলেনায়।
কি করলে গত দু’দিন? পাশেই ব্যাগলেকে দেখে জিজ্ঞেস করল বেনন।
কি করেছি সেটা বড় কথা নয়, কি করব সেটাই আসল, শীতল স্বরে বলল গম্ভীর ব্যাগলে। আচ্ছা বেনন, আইনের চোখে আমি কতখানি অপরাধী চিহ্নিত হব যদি পিচ্ছি ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের সমান কাউকে অ্যাম্বুশ করি?
হঠাৎ এপ্রশ্ন কেন? কি হয়েছে?
খুলে বলল ব্যাগলে। কথা শেষে চেহারা দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে।
সান্ত্বনা দিল না বেনন। জানে লাভ নেই। এই শোক কাটিয়ে উঠতে অনেকদিন লেগে যাবে বেচারার। জিজ্ঞেস করল, চ্যাং টোয়াং তাহলে চেনে ডক্টর ওয়াংকে?
তাহলে একটু আগে কি বললাম? পাল্টা প্রশ্ন করল ব্যাগলে। নিজেই আবার জবাব দিল, বলিনি বুঝি? কি করে বলব, ওই ফ্র্যাঙ্ক ছোড়া আমার মাথাটা খেয়ে ফেলেছে!…ডক্টর ওয়াং হচ্ছে বদমাশের হাড্ডি এক ভাড়াটে খুনে। টোয়াংকে ঠকিয়েছে লোকটা। ওর মত আর যারা ব্যবসা করে তাদেরও অনেক ক্ষতি করেছে। চায়না টাউনে ওকে ধরতে পারলে মেরেই ফেলবে। ছয়জন ব্যবসায়ী ওর মাথার ওপর চড়া দাম ঘোষণা করেছে।
ভ্রূ কুঁচকে খানিক চিন্তা করল বেনন। তারপর আনমনে বলল, ওয়াং তাহলে ভাড়াটে খুনী! এবার কে ওকে ভাড়া করেছে জানি না; তবে লোকটা হ্যাটারের ক্ষতি চায়। ব্যাগলের দিকে তাকাল সে। ব্যাগলে, তুমি হ্যাটারকে পাহারা দিয়ে টেইল হল্টে নিয়ে যাবে। আমি এখানেই থাকছি; সেটে ঘুম দেব; তারপর যাব সোবার সুয়েড নামের সেই খনিটাতে। আমার বিশ্বাস সব রহস্যের সমাধান আছে ওখানে। ইচ্ছে করলে হ্যাটারকে টেইল হল্টে পৌঁছে দিয়ে আমার খোঁজে ওখানে চলে আসতে পারো তুমি। জায়গাটা হ্যাটারের র্যাঞ্চের কাছেই।
মাথা কাত করে সায় দিল বিষণ্ণ ব্যাগলে। গত কদিন ধরে জেগে জেগে ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের দুঃস্বপ্ন দেখছে ও। সর্বক্ষণ ভয়াবহ একটা ভূতের মত পেছনে লেগে আছে ছোঁড়াটা!
কাছেই দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্কার। বেননের কথা শুনে বলল, আমিও শহরে ফিরছি। ওয়াংকে কখনও বিপজ্জনক মনে হয়নি যদিও, তবু মিস্টার ব্যাগলের সঙ্গে আমিও হ্যাটারকে পাহারা দেব। হতাশ একটা ভঙ্গি করে কাঁধ ঝাঁকাল সে। বুঝতে পারছি না সোবার সুয়েডের ব্যাপারে ওয়াঙের এত আগ্রহ কিসের। কিছু নেই ওই খনিতে! এক তিল সোনাও নেই। আমার মনে হয় না ওখানে গিয়ে সময় নষ্ট করবে বুদ্ধিমান কোন লোক।
চুপ করে থাকল বেনন। একমত হতে পারেনি লোকটার সঙ্গে।
হ্যাটারকে ভাউবয়েসের কোচে তোলা হলো। একই কোচে উঠল ডেইজি, হ্যারি হুলাহান, ব্যাগলে, ভাউবয়েস আর তার সুপুত্র। স্বেচ্ছাসেবী উপদেষ্টা মিস হ্যাটারকে কোথাও দেখতে পেল না বেনন। এতক্ষণে বোধহয় ক্যাম্পের খুঁত ধরতে বেরিয়ে পড়েছেন।
তাঁর কথা ভেবে সময় নষ্ট করল না বেনন। ঘুম দরকার ওর। নির্বিঘ্ন গভীর একটা ঘুম।
ঘুরতে ঘুরতে টেলিগ্রাফারের ঘরে আশ্রয় মিলল ওর। হাড়ের মত শক্ত বাঙ্কে পিঠ ছোঁয়ানো মাত্র ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল বেনন; চারপাশের ধাতব আওয়াজ বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটাল না ওর ঘুমে।
দুপুরে জেগে উঠল বেনন। শেভ, গোসল সারার পর ঝরঝরে লাগল নিজেকে। বিগ জিমি নর্টনকে খুঁজে বের করে একটা ঘোড়া ধার চাইল ও। ব্র্যান্ডনের ঘোড়াটা দেয়া হলো ওকে।
দেরি না করে রওয়ানা হয়ে গেল বেনন। ডেইজি যে পথে ওয়্যাগন চালিয়ে এনেছে সেই পথটা খুঁজে নিয়ে এগিয়ে চলল ও হ্যাটারের র্যাঞ্চের দিকে। মেঘলা হয়ে আছে আকাশ। তাকিয়ে দেখল কালচে মেঘের তলায় ঘুরে ঘুরে উড়ছে একটা বাজ। বৃষ্টি নামতে দেরি আছে। তার আগেই বাড়ি ফিরে যাবে পাখিটা।
বিকেলে পৌঁছে গেল সেই টিলাটার গোড়ায় যেখানে ওয়াঙের লোকদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিল ও। আরও সামনে, ঢেউ খেলানো ঘাসে ছাওয়া প্রান্তরের মাঝে দেখা যাচ্ছে হ্যাটারের র্যাঞ্চ। আধঘণ্টার মধ্যে ওখানে হাজির হয়ে গেল ও। কাউহ্যান্ডদের হ্যাটারের খবর জানিয়ে ওখানেই খাওয়ার পালাটা চুকিয়ে নিল। তারপর এগোল আবার।
হ্যাটারের গরুগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘাস খাচ্ছে। ওগুলোর মাঝ দিয়ে পথ করে হাঁটার গতিতে চলল ওর ঘোড়াটা। তাড়া দিল না বেনন। সন্ধের আগে সোবার সুয়েডে পৌঁছতে চাইছে না, কাজেই সময়ের অভাব নেই ওর হাতে। সতর্ক দৃষ্টি রাখল চারপাশে। চায় না হঠাৎ করে ওয়াঙের লোকদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাক। কাউকে দেখা গেল না। লোকগুলো হ্যাটারের ওপর হামলা করতে গেছে ভেবে দুশ্চিন্তা হলো ওর। তারপর আবার খানিকটা স্বস্তি পেল, ব্যাগলে আছে হ্যাটারের দায়িত্বে, দরকারে জীবন দিয়ে হলেও দায়িত্ব পালন করবে মানুষটা।
সূর্যটা মেঘের আড়ালে আড়ালে মুখ লুকিয়ে ডুবে যেতেই আঁধার নামল ধীরে ধীরে। টিলার গোড়ায় বনের প্রান্তে পৌঁছে গেল বেনন। উত্তেজনা বোধ করছে। গত কয়েকদিন অনেক ভেবেও স্পার রহস্য আর রেল ক্যাম্পে হামলার কোন যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পারেনি ও। কোথা থেকে শুরু করলে কূল-কিনারা করতে পারবে তা-ই বুঝতে পারেনি। কিন্তু গতকাল আহত হ্যাটারের মুখে খুনিটার নাম শোনার পর থেকেই ওর মনে হচ্ছে কিছু একটা আছে ওখানে। এমন কিছু যা জানলে সমাধান হয়ে যাবে সব রহস্যের।
ঘোড়া হাঁটিয়ে পাথর ধসের জায়গাটায় চলে এলো বেনন। সামনে বেশ কিছু ঝোঁপঝাড়, ওগুলো পেরলেই দেখতে পাবে ও বড় বড় পাথর পড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া খনিমুখ। জায়গাটা আর বিশগজও নয়।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল বেনন। সামনে আওয়াজ হচ্ছে। কিসের শব্দ বুঝতে পারল না ও। পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকি। কিন্তু এত জোরাল হয় কি করে! পাথর ধস? না! তাহলে আগেই শুনতে পেত ও। আওয়াজটা একটানা নয়। আবার হলো শব্দটা; এবার সঙ্গে ধাতব ক্যাঁচকোচও আছে।
বড় একটা বোল্ডারের আড়ালে ঘোড়া বেঁধে সাবধানে এগোল কৌতূহলী বেনন। খনি থেকে বের করা পাথর আর ধুলোর স্তুপের আকৃতি দেখে বুঝল খনির ভেতর অনেকদূর পর্যন্ত সুড়ঙ্গ খোড়া হয়েছে। বোল্ডারের ফাঁক ফোকর দিয়ে আরও কিছুদূর এগোল বেনন। তারপর একটা পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দিল।
খনিমুখের সামনে আর বোল্ডার নেই। একমনে একা কাজ করে যাচ্ছে ডক্টর ওয়াং! নিশ্চয়ই সারাদিন ধরে খাটছে। আঁধার ঘনিয়েছে সেদিকেও কোন খেয়াল নেই।
তিনটা গাছ কেটে একটা তেপায়া বানিয়েছে লোকটা। তাতে একটা পুলি ঝুলিয়ে দিয়েছে। সরিয়ে ফেলেছে বেশির ভাগ পাথর।
শেষ বোল্ডারটাকে সরিয়ে কোদাল হাতে নুড়ি পাথর সরাতে ব্যস্ত হয়ে গেল লোকটা। ভ্রূ কুঁচকে ওয়াঙের কাজ দেখছে বেনন। মনটা এখানে নেই ওর। ভাবছে কোথায় গেল ওয়াঙের সঙ্গীরা। দু’রাত আগে লোকটা কাসিদের বলেছিল খনিতে সবাই মিলে কাজ করবে। হঠাৎ মত পরিবর্তন করল কেন? মত বদলেছে, নাকি হ্যাটারকে মারার জন্যে ওদের পাঠিয়েছে বলে একা খাটতে বাধ্য হচ্ছে?
ঘটনা যাই হোক, অপেক্ষা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল বেনন। ওয়াঙের মতই ওরও জানা প্রয়োজন কি আছে ওই খনির মধ্যে। লোকটা খনিমুখ পরিষ্কার না করলে কাজটা ওকে করতে হত ভাবতেই মনটা ভাল হয়ে গেল ওর। লোকটা হাড় ভাঙা পরিশ্রম করছে। ওয়াঙের খাটনির ফসল ওর ঘরেও উঠবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জঞ্জাল সরিয়ে চিপা একটা টানেল দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল ওয়াং। অনুসরণ করল বেনন। খনিমুখের কাছে চলে এসেছে এমন সময় ওর পায়ের তলায় পড়ে গড়িয়ে গেল ছোট একটা নুড়ি। স্তব্ধ পরিবেশে আওয়াজটা এত জোরাল শোনাল যে থেমে গেল ও। অপেক্ষা করল। ওয়াঙের তরফ থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। টের পায়নি লোকটা তাহলে! বোধহয় এতক্ষণে সুড়ঙ্গের গভীরে চলে গেছে। উবু হয়ে বসে জুতো খুলে ফেলল বেনন। তারপর মোজা পরা পায়ে সতর্কতার সঙ্গে এগোল। নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল আঁধার টানেলে। টানেলটা দু’মানুষ চওড়া। ছাদটা নিচু। হামাগুড়ি দিতে হচ্ছে। একটু পরই অবশ্য ছাদের উচ্চতা বেড়ে গেল। কয়েক পা-এগিয়ে চোখ সইয়ে নিতে থামল বেনন। শিউরে উঠল তারপর। খুব কাছেই কাপড়ের খসখস শব্দ! সরে গেল ওয়াং! লোকটা জানে সুড়ঙ্গে ঢুকেছে ও।
অন্ধকারে প্রাচীন খনির ভেতর গমগম করে উঠল ওয়াঙের গলা: তুমি এসেছ আমি খুশি হয়েছি, বেনন। মৃত্যুর জন্যে তৈরি হও। আমার হাতে একটা পিস্তল আছে; নলটা তোমার বুকে তাক করা। বাইরে পাথরের স্তুপে বোকার মত আওয়াজ করাটা তোমার উচিত হয়নি।
নিজের ওপর রাগে, তিক্ততায় ছেয়ে গেল বেননের অন্তর। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। ঠিকই বলেছে ওয়াং, নিজের বোকামিতেই বিপদে পড়েছে ও।
শরীর শক্ত করল বেনন। ঝাঁপ দেবে। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। এখন হাল ছেড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া।
১৬. বেনন যখন টেলিগ্রাফারের বাঙ্কে
বেনন যখন টেলিগ্রাফারের বাঙ্কে মহা আরামে ঘুমাচ্ছে, বিষ তেতো চেহারা করে ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের পিছু পিছু টেইল হল্টের স্টেশনে ট্রেন থেকে নামল ব্যাগলে। ভেবেছিল ট্রেনে হামলা হবে, সবাইকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার একটা সুযোগ আসবে; কিন্তু তেমনটি হয়নি, মাইলের পর মাইল ঠায় বসে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছে সে। তার ওপর আছে ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের অত্যাচার। ছেড়া সারাটা পথ জ্ঞান দান করে হাড় কালি করে ছেড়েছে ওর। টেইল হল্টে পা দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছল ব্যাগলে, সেদ্ধ পুরানো বুট জুতো চিবালে যতটুকু স্বাদ পাওয়া যাবে ততটুকু আইনের বিচারও নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে নেই।
তাই বলে দায়িত্ব পালনে কোন কার্পণ্য নেই ওর। হ্যাটারকে ট্রেন থেকে নামানোর ব্যাপারে সাহায্য করতে চাইলেও পারল না। অনেক বেশি লোক আগেই উপস্থিত হয়ে গেছে, ভাউবয়েসের নির্দেশে হ্যাটারকে তারাই নামাল; বয়ে নিয়ে চলল ট্রাভেলার্স রেস্ট-এ। আকারে সবার ছোট হওয়ায় কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে অপমানিত চেহারায় সরে যেতে হলো ওকে।
ট্রাভেলার্স রেস্টেপৌঁছে জানা গেল ডাক্তার হেলেনা থেকে এখনও এসে পৌঁছায়নি। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল ভাউবয়েস। ধমকের পর ধমক দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল সবাইকে। টেলিগ্রাফার তার ঝাড়ি খেয়ে হেলেনার লাইন গরম করে তুলল। জানা গেল রওয়ানা হয়েছে ডাক্তার। হ্যাটার ভাউবয়েসের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস; অক্কা পেলেই বেমক্কা বিপদে পড়ে যাবে সে। হ্যাটারের র্যাঞ্চ মর্টগেজ করা নেই যে সে মরলে ব্যাংকের সঙ্গে কাগজ-পত্র পাকা করে লাইন পাতা যাবে। আর লোকটা কোন উইল করেছে কিনা কে জানে! না করে থাকলে কোর্ট তার উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করতে যতদিন লাগাবে অত সময় অপেক্ষা করা অসম্ভব। অতএব কোন ঝুঁকি নিতে ভাউবয়েস রাজি নয়।
নাস্তা সেরে হোটেলের লাউঞ্জে ফিরে ব্যাগলে দেখল এসে গেছে ডাক্তার।
বেশ বেশ, তা কে অসুস্থ হয়েছে বলে আমাকে এত জরুরী তলব? পাশে দাঁড়ানো ব্যাগলেকে না দেখার ভান করে ভাউবয়েসকে জিজ্ঞেস করল ডাক্তার। ঘাড় বাঁকা লোক, প্রথম দর্শনেই বুঝে গেল ব্যাগলে।
আসুন, ডক্টর হকিন্স।
অষুধের গন্ধমাখা ছোটখাট আকৃতির ডাক্তারকে পথ দেখিয়ে দোতলায় নিয়ে এলো ভাউবয়েস। দীর্ঘ সময় নিয়ে রোগীকে দেখল ডাক্তার। মহিলারা উদগ্রীব হয়ে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে। খাটের পাশে ফ্র্যাঙ্ক; চেহারা উৎসুক; ভাবছে ডাক্তারকে কোন উপদেশ দেয়া যায় কিনা। অবশেষে মুখ তুলে তাকাল ডাক্তার। দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে ছাদের দিকে চেয়ে বলল, নতুন ক্ষতটা গুরুতর কিছু না। আমাকে কৌতূহলী করে তুলছে পুরানোটা। দুটোই বুলেটের, তবে পুরানোটাই আসল। আমার ধারণা করোটি ডাবিয়ে দেয়া ওই ক্ষতটা মগজের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ভাউবয়েসের দিকে তাকাল সে। রোগী কখনও অস্বাভাবিক আচরণ করে? ধরুন এটা ওটা ভুলে যায় বা আর কিছু?
করে, বলল ডেইজি।
অস্ত্রপচার করতে হবে। ভ্রূ উঁচিয়ে ডেইজির অনুমতি চাইল ডাক্তার হকিন্স।
করুন, ডাক্তার। বাবা বাঁচবে তো?
বাঁচা-মরা খোদার হাতে, তার আমি কি জানি? নার্সটা নাস্তা খেয়ে এলেই খুলি কাটব আমি। মাছি তাড়ানোর মত করে হাতের ঝাপ্টা মেরে দরজা দেখাল ডাক্তার। বেরোন এখন সবাই এ-ঘর থেকে।
ডেইজির কাঁধে আলতো করে হাত রাখল ব্র্যান্ডন। ধরে ধরে নিয়ে এলো বাইরে। ডাক্তারের কথায় ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। শক্ত করে ধরে রেখেছে এঞ্জিনিয়ারের হাত।
সবাই যে যার কাজে একেক দিকে চলে যেতেই নিজেকে তলাহীন বালতির মত অকেজো মনে হলো ব্যাগলের। রাস্তায় বেরিয়ে এলো ও। স্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানল এন্ড অভ স্টীলের ট্রেন ছাড়তে এক ঘণ্টা দেরি আছে। খানিক উদ্দেশ্যহীন এদিক ওদিক ঘোরার পর বাবার কথা মনে এলো ওর। আর বাবার কথা মনে আসতেই মনে পড়ল মদ্যপানের কথা। মদে চুবে থাকা সেই মানুষটার স্মৃতির প্রতি সামান্য শ্রদ্ধা জানাতে হলেও অন্তত দু’ঢোক গিলে ফেলা উচিত।
কিন্তু অনেক কাজ পড়ে আছে। এন্ড অভ স্টীলে যেতে হবে। বেননের সাহায্য লাগতে পারে। তাছাড়া এখানে ওর দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে; শহরে এসে হ্যাটারের কোন ক্ষতি করার সাহস ওয়াঙের চেলারা পাবে না। কোথায় যেন যাবে বলেছিল বেনন? টিলার গোড়ায় খনি… টিলার গোড়ায় খনি… সোবার সুয়েড! হ্যাঁ, এই তো মনে পড়েছে। কী বিদঘুটে নাম! কেন ডংকি ডাচম্যান বা হাংরি হাঙ্গেরিয়ান নাম রাখলেই বা ঠেকাচ্ছিল কে!
বিরক্তির চরমে পৌঁছে একটা সেলুনে ঢুকে পড়ল ব্যাগলে। বার কাউন্টারে পেট ঠেকাতেই কাঁদো কাঁদো চেহারার এক মুহ্যমান ছোঁকরা এসে জিজ্ঞেস করল, কি চাও, মিস্টার?
কড়া কিছু থাকলে দাও।
অন্যমনস্ক ব্যাগলে খেয়াল করল না কাউন্টারে রাখা একটা জগ থেকে আস্ত এক গ্লাস ঘোলা তরল তার সামনে রেখেছে বারকীপ। গ্লাসটা মুখে তুলে চুমুক দিল ও। পরমুহূর্তে শিউরে উঠল আতঙ্কে। চোখ জোড়া কপালে উঠে গেল; থুহ থুহ্ করে মুখ থেকে ফেলে দিল পানীয়টুকু। বিষ ছাড়া এতখানি বাজে স্বাদ আর কিছুর হতে পারে বলে ব্যাগলের ধারণা ছিল না। চোখ পাকিয়ে তাকাল ও তরুণের দিকে। এটা কী হলো, আঁ?
এটাই… লেমোনেড। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল বারকীপ। অন্যকিছু আমরা বেচছি না। মিস্টার ভাউবয়েস ওই জালেম বুড়ির কথায় আমাদের বারণ করে দিয়েছেন। কথা না শুনলে রেল রোডের কেউ আসবে না। ব্যবসা বন্ধ করে না খেয়ে মরতে হবে।
মিস অ্যানা হ্যাটারের চেহারাটা মনে পড়ে গেল ব্যাগলের। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কে জানত একজন মহিলার মন এত পাষাণের মত কঠিন হতে পারে!
একটু… কয়েক ফোঁটাও কি নেই? শেষ চেষ্টা করল ব্যাগলে। মনে আশা, ওর কাকুতি শুনে যদি বারকীপের দয়া হয়, গোপন কোন কুঠুরি থেকে যদি বের করে আনে একটা হুইস্কির বোতল।
হতাশ হতে হলো ওকে। মাথা নাড়ল যুবক। নেই। ছায়া ঘনাল ব্যাগলের মুখে।
তবে একটা উপায় আছে, দয়া হলো বারকীপের। সাপের কামড়।
আছে? কোথায়? সাপটা কোথায়? খুশিতে দু’চোখ চকচক করে উঠল ব্যাগলের।
আমার এখানে না। খোঁজ নিলেই পেয়ে যাবে। শুনলাম কয়েকজন মিলে একটা র্যাটল স্নেক ধরে এনেছে। গতকাল নাকি ওটার কামড় খাওয়ার জন্যে আধমাইল লম্বা লাইন হয়েছিল। লাইনে দাঁড়ালে তুমিও সুযোগ পেয়ে যাবে।
না… থাক্। মাথা নাড়ল ব্যাগলে। কপালের যে হাল তাতে সাপের কামড় খাওয়ার সৌভাগ্য ওর হবে না এ-ব্যাপারে ও নিশ্চিত। ওর পালা আসার আগেই কামড় দিতে দিতে সাপটা এত বেশি পরিশ্রান্ত হয়ে যাবে যে বেচারা আর মাথাই তুলতে পারবে না।
আধখালি গ্লাসটা ভরে দিল তরুণ উপদেষ্টা। সান্তনা দিয়ে বলল, আরেকবার চেষ্টা করে দেখো। অতটা খারাপ কিন্তু না। প্রথমবার ওরকম লাগে। নাক টিপে এক ঢোকে খেয়ে দেখো ঠিকই সহ্য করতে পারবে।
তুমি খেয়ে দেখো মরতে চাইলে। রাগের চোটে পয়সা দেয়ার কথা ভুলেই গেল ব্যাগলে। দুপদাপ পা ফেলে বেরিয়ে এলো সেলুন থেকে।
হোটেলে ফিরতেই করিডরে দেখা হয়ে গেল ওর পিচ্চি ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে।
আপনার মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে কেন, মিস্টার ব্যাগলে?
এমনি।
বলুন না।
বললাম তো, এমনি।
আমি হয়তো কোন সাহায্যে আসতেও পারি। স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে অন্য পথ ধরল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক।
এই প্রথম মনোযোগ দিয়ে ছেলেটাকে দেখল ব্যাগলে। হতে পারে নোয়াক ছোঁড়াটা বদমাশের ওস্তাদ; হতে পারে পাহাড়ীকাঁকড়া বিছের চেয়েও জঘন্য রকমের বাজে; কিন্তু মগজ আছে একথাটা স্বীকার করতেই হবে। ছোঁড়াটাকে ভজিয়ে ভাজিয়ে দলে টানতে পারলে বলা যায় না উদ্দেশ্য হাসিল হয়েও যেতে পারে। জোর করে মুখে হাসি টেনে আনল ব্যাগলে। বড় বড় দাঁতগুলো দেখানো শেষ করে বলল, দারুণ একটা বিপদে পড়ে গেছি ফ্র্যাঙ্ক। তুমি কি জানো কোথায় গেলে আমি একটু… ইয়ে পাব?
ইয়ে? কোতুহলী হয়ে উঠল ফ্র্যাঙ্ক।
ওই…ইয়ে। অত সহজে বলতে রাজি নয় ব্যাগলে। ওতে কথার গুরুত্ব কমে যাবে। ছোড়ার কাছে দায়িত্বটা আর বিরাট বলে মনে হবে না।
ওই ইয়ে? কাজে দিচ্ছে ব্যাগলের বুদ্ধি।
ইয়ে…মদ।
মদ! দু’চোখ বিস্ফারিত করে ব্যাগলেকে দেখল ফ্র্যাঙ্ক।
পিঠে গুলির একটা ক্ষত আছে; ব্যথাটা কমাতে কাজে দেয় খুব।
কিন্তু, মিস্টার ব্যাগলে, জিনিসটা তো খুবই ক্ষতিকর!
আমি জানি। চেহারাটা করুণ করে তুলল ব্যাগলে। কী করব বলো, ডাক্তারের আদেশ।
নিচের ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ চিন্তা করল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক। তারপর আনমনে বলল, শহরে ও-জিনিস বিক্রি হয় না।
আমিও তাই শুনেছি। সেলুনের ঘটনাটা চেপে গেল ব্যাগলে।
একটাই মাত্র উপায় দেখতে পাচ্ছি আমি, মিস্টার ব্যাগলে!
পাচ্ছ? উপায় দেখতে পাচ্ছ? এবার উদগ্রীব হওয়ার পালা ব্যাগলের।
বাবার সিগার। একেকটার দাম এক ডলার। রামে চোবানো। দুপুরে খাবারের পর ওগুলোর একটা খায় বাবা। গান ধরে আরামকেদারায় বসে। তারপর ঘুমিয়েও পড়ে। ভ্রূ উঁচিয়ে ব্যাগলের দিকে তাকাল ফ্র্যাঙ্ক। ওরকম একটা সিগার হলে চলবে আপনার, মিস্টার ব্যাগলে?
একেকটার দাম এক ডলার! ওই দামে আমি চল্লিশটা কিনি। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী!
আসুন তাহলে। সাবধান, বাবা যাতে না জানে।
তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো জানবে না।
ওকে করিডরে দাড় করিয়ে ঘরের ভেতর রেখে ঢুকে গেল ফ্র্যাঙ্ক। ফিরল একটা সিগার বক্স হাতে। ব্যাগলেকে দিয়ে বলল, নিন, দেখুন চেষ্টা করে।
জীবনে কোনদিন ধোয়া গিলে মদের নেশা করেনি ব্যাগলে। ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল ও। কৃতজ্ঞতা বোধে ছেয়ে গেল অন্তর। এখন নিজের ভুল বুঝতে পারছে, আসলে যতটা ভেবেছিল অতটা খারাপ নয় দেখা যাচ্ছে ছেলেটা। ঠোঁটে বন্ধুত্বের হাসি নিয়ে বাক্সটা খুলল ব্যাগলে। ওর গলা চিরে বেরিয়ে এলো হাহাকার। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল দু’চোখ। আর একটু জোরে লাফ দিলে ছাদে মাথা ঠুকে যেত। বাক্সটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে তিড়িং তিড়িং লাফাতে লাগল ব্যাগলে। প্রাণপণে চেঁচিয়ে চলল, মারো! মারো!! কাউকে কামড়ানোর আগেই জুতো চাপা দাও ওটাকে!
তারপর হঠাৎ ব্যাগলের কানে এলো ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের খিকখিক হাসি। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে গেল ওর। সেই খুলে যাওয়া চোখে সত্যি ধরা পড়ে গেল। মেঝেতে ওটা জ্যান্ত কোন বিষাক্ত সাপ নয়। কাপড়ের তৈরি। ভেতরে তুলো বা আর কিছু দিয়ে ফোলানো হয়েছে। পাকা হাতের কাজ। দেখে বোঝার উপায় নেই আসল নয়।-তারওপর বাক্সেও কারিগরী আছে। খুললেই কিলবিল করে ছিটকে ওঠে সবুজ সাপ। ভয় পেয়েছে বলে লজ্জার বদলে রাগ অনুভব করল ব্যাগলে। সেই রাগ গিয়ে পড়ল ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের ওপর। তেড়ে গেল ব্যাগলে।
আগেরবার ধরা পড়েছিল মনে আছে; এবার আর আগের ভুল করল না; তৈরি হয়েই ছিল, ব্যাগলেকে নড়তে দেখেই পাই পাই করে ছুটল ফ্র্যাঙ্ক। পেছনে ব্যাগলে। বন্য সিংহের মত গর্জন ছাড়ছে।
প্রায় ধরেই ফেলেছে, এমন সময় সাহায্যের আশায় তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা।
দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ভাউবয়েস সি, ভাউবয়েস নোয়াক। সেই সুযোগে দরজা খোলা পেয়ে বাবাকে পাশ কাটিয়ে সুড়ৎ করে ভেতরে, ব্যাগলের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল ফ্র্যাঙ্ক।
ব্যাগলে আঙুল নাচিয়ে কিছু বলতে যেতেই হাত উঁচিয়ে বাধা দিল ভাউবয়েস। ছিহ্ মিস্টার ব্যাগলে! আপনার জানা উচিত পাশের ঘরে মুমূর্ষ হ্যাটারের ওপর অস্ত্রপচার করছে ডাক্তার। কী শুরু করেছেন আপনি!
ওই…ওই ছেলেটা, রাগের চোটে তোতলাল ব্যাগলে। ও আমার গায়ে সাপ ছুঁড়ে দিয়েছে!
দুঃখিত চেহারায় মাথা ওপর-নিচ দোলালেন ভাউবয়েস। তাই করেছে ও? জিনিসটা বানানোর পর আমার ওপরই প্রথম পরীক্ষা করে সে। সেই স্মৃতি মনে পড়তেই কঠোর হয়ে গেল গোলগাল মুখটা। আমি ওর হয়ে দুঃখ প্রকাশ করছি, মিস্টার ব্যাগলে! এবার কণ্ঠে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ফুটে উঠল। আসন্ন আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল দু’চোখ। আপনি ইচ্ছে করলে ওকে… বিশ্বাস করুন বুকটা ফেটে যাবে আমার…কিন্তু আমি অসহায়…খুবই অন্যায় করেছে ও আপনার সঙ্গে।
বাবা! তীরে এসে তরী ডোবার আশঙ্কায় মরিয়া হয়ে উঠল ফ্র্যাঙ্ক। তুমি ভুলে যেয়ো না আমিই হেলেনায় গিয়ে তোমাদের জন্যে কুলি নিয়ে এসেছি। তুমি যদি মার খাওয়াও মাকে বলে দেব আমি। শিকাগোতে চিঠি লিখে হেড অফিসকে জানিয়ে দেব এতবড় সাহায্য করার পরও আমার সঙ্গে কি ব্যবহার করা হয়েছে।
অসহায় চোখে নীরব আকুতি আর আক্ষেপ নিয়ে তাকাল ভাউবয়েস। একজন বিবাহিত অত্যাচারিত মানুষ হিসেবে লোকটার দুঃখটা বুঝতে পারল ব্যাগলে।
কথাটা সত্যি, বলল ভাউবয়েস, তবে আমাদের অনেক ক্ষতিও হয়েছে, টেলিগ্রাফ করে তুমি আমাদের এক সপ্তাহের সিডিউল এলোমেলো করে দিয়েছ। হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে ব্যাগলের দিকে তাকাল সে। মিস্টার ব্যাগলে, আমি আবারও ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি। ও চিঠি লিখলে সত্যি আমরা বিপদে পড়ে যাব। নিজের প্রশংসা করে বিরাট এক চিঠি লিখেছে ফ্র্যাঙ্ক হেড অফিসে। এই মুহূর্তে আমি দু’চোখে অন্ধকার দেখছি, বিশ্বাস করুন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। সাপটা খেয়াল করে ভাল মত দেখল ব্যাগলে। দিনের আলোয় ধরা পড়ে যাবে যে নকল, নাহলে বারটেন্ডারকে দেখিয়ে বলা যেত সাপের কামড় খেতে পেরেছে। সে। আর এখানে সময় নষ্ট করার মানে হয় না, শেষ বারের মত কড়া চোখে ফ্র্যাঙ্ক নোয়ককে দেখে নিয়ে হোটেল, ছেড়ে বেরিয়ে এলো ব্যাগলে।
ট্রেন ছাড়তে আরও দশ মিনিট, তবুও স্টেশনে এসে ট্রেনে চেপে বসল ও। নিজের দুঃখে এতই মশগুল যে টের পেল না পেছনের সীটে হ্যারি হুলাহান বসে আছে।
ব্যাগলেকে দেখে লোকটা ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করল, সিগার, মিস্টার ব্যাগলে?
চমকে সীটে সোজা হয়ে বসল ব্যাগলে। ঘাড় ফিরিয়ে কিছুক্ষণ ব্যাঙ্কারকে দেখল। তারপর লোকটার বাড়িয়ে ধরা সিগার কেসটা চোখে পড়তেই ওর গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো ছোটখাট একটা গর্জন। হাতের ঝাঁপটায় বুঝিয়ে দিল চাই না তার সিগার।
একটু পরেই রওয়ানা হলো ট্রেন। উদাস দৃষ্টি মেলে বাইরে তাকাল ব্যাগলে জানালা দিয়ে। পিছিয়ে যাচ্ছে শহরটা, দূরে সরে যাচ্ছে ও ওই কালো অভিশাপ ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের কাছ থেকে। এগিয়ে আসছে উইটিগোর সাদা মেঘে ঢাকা পাহাড় চুড়ো। পাহাড়ের নিচের অংশে জমছে ঘন কালো মেঘ। বৃষ্টি হবে বোধহয়। গতবার বৃষ্টির সময় ডায়নোসর বেরিয়েছিল। বৃষ্টি হলে আজকেও বেরতে পারে। ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের দেয়া জ্ঞান মনে পড়ল ব্যাগলের। সাপ আর ডায়নোসর দুটোই সরীসৃপ। আচ্ছা, সাপের কামড়ে যদি মানুষের নেশা হয় তাহলে ডায়নোসর কামড়ালে হবে কেন? একবাটি দুধ নিয়ে যদি আদর করে ডাকা যায় “ডাইনী, ডাইনী” তাহলে একটা কামড় কি পেতে পারে না ও বিনিময়ে?
ক্যানিয়নের ওপর তৈরি করা সেই উঁচু ব্রিজটা পার হওয়ার সময় জানালা দিয়ে অতল কালো গহ্বরটা দেখল ব্যাগলে। ভাবল এখান থেকে ওই খাদের মধ্যে ফ্র্যাঙ্ক নোয়ককে ছেড়ে দিলে কেমন লাগবে ছোড়াটার। আরও ভাল হত যদি মিস অ্যানা হ্যাটারকেও সঙ্গে দিয়ে দেয়া যেত।
এক ধাক্কায় দু’জনকেই ফেলে দিল ব্যাগলে কল্পনায়। তারপর কল্পনার রাশ টেনে ধরে কামরার ভেতরে নজর বোলাল। হুলাহান ছাড়া পরিচিত কোন মুখ ওর চোখে পড়ল না। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল ও।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এন্ড অভ স্টীলে পৌঁছে যাবে ট্রেন। জিমি নর্টনের কাছ থেকে একটা ঘোড়া ধার করবে ও। তারপর বেননের খোঁজে যাবে সেই টিলাটায়। আশা করা যায় বৃষ্টি না নামলে সন্ধের আগেই পৌঁছে যেতে পারবে ও সোবার সুয়েডে।
১৭. গা ছমছমে ঘুটঘুটে আঁধারে
গা ছমছমে ঘুটঘুটে আঁধারে দাঁড়িয়ে ওয়াঙের হুমকির ধ্বনি প্রতিধ্বনি শুনল বেনন। গুহার দেয়ালে বাড়ি খেয়ে মিলিয়ে গেল আওয়াজটা। আতঙ্কের একটা শিরশিরে অনুভূতি নেমে গেল বেননের শিরদাঁড়া বেয়ে। অন্ধকারে ওকে শিকার করার জন্য ওঁৎ পেতে আছে ওয়াং। লোকটা এখনও গুলি করেনি কেন ভেবে পেল না ও। যে রহস্য এই খনি লুকিয়ে রেখেছে সেটার ভাগ আর কাউকে ওয়াং পেতে দেবে না এটা নিশ্চিত। সুযোগ খুঁজছে লোকটা। পেলেই খুন করবে ওকে।
মৃত্যুপথযাত্রীকে সবসময় শেষ-কথা বলার একটা সুযোগ দেয়া হয়, আবার গম গম করে উঠল ওয়াঙের গলা। তোমার কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো, বেনন।
নিঃশব্দে হাসল বেনন। বুটজুতো বাইরে খুলে রেখে এসেছে বলে ভাগ্যকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিল। বুঝে ফেলেছে ও ওয়াঙের চালাকি। খনির বাইরে পাথর গড়ানোর শব্দে ওয়াং টের পেয়েছে কেউ একজন ঢুকছে সুড়ঙ্গে। ও যখন খনিমুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকল সেসময় পেছনে আলো ছিল, ক্ষণিকের জন্যে ওর অবয়ব দেখতে পাবার কথা; কিন্তু সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেনি লোকটা। এখন চাইছে ও কথা বলে উঠুক। কথা বললেই অন্ধকারে ওর অবস্থান ফাস হয়ে যাবে। নিশ্চিত হয়ে গুলি করবে লোকটা।
ফাঁদে পা দিল না বেনন। সরে গেল কয়েক কদম। তারপর অস্ত্র বের করে হামাগুড়ি দিয়ে বসল। অপেক্ষা করতে ও অভ্যস্ত। আউট-ল জীবনে ধৈর্য ওকে বারবার বাঁচিয়েছে মৃত্যুর হাত থেকে। আরেকবার কথা বলুক ওয়াং বুঝে যাবে কৌশলটা তার নিজের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা যায়।
আর কোন হুমকির মধ্যে গেল না ওয়াং। বেনন তার চালাকি ধরে ফেলেছে বুঝতে পেরেছে।
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চুপ করে বসে আছে বেনন। টের পেল কাঁপছে দেয়ালটা থরথর করে। পরমুহূর্তে গুরুগম্ভীর আওয়াজে কানে তালা লেগে গেল। টিলার ওপর বাজ পড়েছে। অনেকদিনের পুরানো খনি, টানেলের ছাদটা খসে পড়বে না তো? কবরে আটকে পড়েছে বলে মনে হলো ওর।
পায়ের শব্দ শোনার আশায় কান খাড়া করল বেনন। মেঘের গর্জন থেমে গেছে। পিনপতন নীরবতা। মানুষ শিকারের খেলায় মেতেছে ওয়াং। কোন ভুল করছে না।
খনিমুখ থেকে একটা গলা ভেসে এলো। চিনতে পেরে চমকে উঠল বেনন।
ব্যাগলের গলা। বলছে: বেনন…? তুমি কি ভেতরে…?
ব্যাগলেকে ভেতরে আসতে মানা করতে গিয়েও মুখ বন্ধ করে ফেলল বেনন। শাঁখের করাতে পড়েছে ও। আওয়াজ করলে ওর নিজের গুলি খাবার ভয়, আর ব্যাগলেকে সতর্ক না করলে খনিতে ঢুকতে গিয়ে মরবে মানুষটা। একবার করেছে বলেই বারবার একই ভুল করবে না ওয়াং। সুড়ঙ্গে ব্যাগলে ঢুকলেই ফেলে দেবে গুলি করে। বাইরে এখনও সামান্য আলো থাকার কথা। গর্তের মুখ দিয়ে কেউ ঢুকলে অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাবে।
অন্ধ পাগলের মত মেঝে হাতড়াল বেনন। দুশ্চিন্তা আর ভয়ে ঘামছে দরদর করে। যা খুঁজছিল পেয়ে গেল। ছোট্ট একটুকরো পাথর। টানেলের গভীরে ওটা ছুঁড়ে দিল বেনন। আশা করল পুরানো এই কৌশলে কাজ দেবে।
ছিলার মত টানটান হয়ে আছে ওয়াং উত্তেজনায়। পেছনে গিয়ে পাথরটা পড়তেই চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল সে। মনে করল পাশ কাটিয়ে নিঃশব্দে পেছনে চলে এসেছে বেনন। রাগে বিকৃত চেহারায় গুলি করল সে শব্দ লক্ষ্য করে। শতগুণ জোরাল শোনাল আওয়াজ বদ্ধ সুড়ঙ্গে।
হলদেটে কমলা আগুনের ঝিলিকে লোকটাকে ক্ষণিকের জন্যে দেখতে পেল বেনন। সঙ্গে সঙ্গে ও-ও গুলি করল। ও তরফ থেকে কোন আর্তনাদ হলো না। মিস করেছে বেনন তাড়াহুড়োয়! লাফ দিয়ে ফুট ছয়েক সরে গেল ও। তারপর ক্রল করে আরও ফুট তিনেক। কাঁপা কাঁপা শ্বাস ফেলল। সন্তুষ্ট ব্যাগলেকে সতর্ক করে দিতে পেরে।
গুড়গুড় করে ডাক ছাড়ল আকাশ; যেন এই লড়াইয়ে অংশ নিতে চায়।
সুড়ঙ্গে ঢোকার সরু ফাঁকটার দিকে তাকাল বেনন। ক্ষীণ একটু আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। আগ্রাসী রাতের কাছে হেরে যাচ্ছে সন্ধে। ব্যাগলের কোন চিহ্ন নেই কোথাও। তাতে করে খনির মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে তা নয়। এখনও ওঁৎ পেতে লুকিয়ে আছে খুনে চাইনিজ। লোকটা এখন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
হঠাৎ অন্ধকারে ঝটাপটির শব্দ শুনতে পেল বেনন। তারপরই শোনা গেল ওয়াঙের চিৎকার। মহা উত্তেজিত হয়ে চাইনিজ ভাষায় কি যেন বলছে।
আমি ওকে ধরেছি, বেনন! হুঙ্কার ছাড়ল ব্যাগলে। আমি ওকে ধরেছি!
গোলাগুলির সুযোগে সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েছে ব্যাগলে! নিশ্চয়ই গুলির আগুনে ওয়াঙকে দেখেছে!
শব্দ লক্ষ্য করে হাতড়ে হাতড়ে এগোল বেনন। কাছে গিয়ে ম্যাচের কাঠি জ্বেলে দেখল সাহায্যের দরকার নেই ব্যাগলের।
চাইনিজকে মেঝেতে পেড়ে ফেলে ঠেসে ধরেছে ব্যাগলে। বসে আছে বুকের ওপর। বড় বড় দাঁত বের করে একমুখ হাসি নিয়ে তাকাল। একেবারে গেঁথে ফেলেছি।
ঘৃণায় বিকৃত হলদে মুখে মহা আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে আছে ওয়াং। মেঝেতে চাইনিজের অস্ত্রটা দেখতে পেয়ে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল বেনন। লোকটাকে সার্চ করে তারই বেল্ট দিয়ে বেঁধে ফেলতে দু’মিনিটের বেশি লাগল না ওর। কোটের পকেটে পাওয়া গেল কয়েকটা মোমবাতি জ্বালাত; কিন্তু বেননের আসার শব্দ পেয়ে জ্বালায়নি ওয়াং। একটা জ্বালল বেনন।
ওয়াঙের ওপর থেকে উঠে দাঁড়াল ব্যাগলে। শরীর মুচড়ে বাঁধন ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে দেখল চাইনিজ, না পেরে দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে ড্যাব ড্যাব করে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকল। হিসহিস আওয়াজ বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে।
বাইরে ডাক ছাড়ল আকাশ। টানেলের প্রবেশপথে বিজলির চকিত নীলচে ঝিলিক। বেননের ইচ্ছে হলো একছুটে বেরিয়ে যায় এখান থেকে। পুরানো সুড়ঙ্গ। কাঠের বীমগুলো পচে গেছে কিনা কে জানে। গতবার যখন টিলার মাথায় বাজ পড়ল খুঁটিগুলোকে মড়মড় আওয়াজ করতে শুনেছে ও। শুধু অদম্য একটা কৌতূহল আটকে রেখেছে ওকে। দেখতে হবে কি রহস্য লুকিয়ে রেখেছে এই প্রাচীন খনি।
আরেকটা মোমবাতি ধরাল ব্যাগলে। উঁচু করে ধরল। কাঁপা আলোয় দেখা গেল দেয়ালের গায়ে নাচছে বেনন আর ওর ছায়া। ছায়াগুলোর বুকের কাছে দেয়ালে সাজিয়ে রাখা আছে কয়েকটা বাক্স।
বেননের শার্টের হাতা ধরে টান দিল ব্যাগলে। ডিনামাইট, বেনন? ওই দেখো ফিউজ আর কয়েলও আছে।
বাক্সগুলোর ওপরে জমে আছে ধুলোর পুরু আস্তরণ। মাকড়সার জাল ঘিরে রেখেছে ফিউজ আর ক্যাপের বান্ডিল। পাথর ধস নামায় ভেতরে রয়ে গিয়েছিল এগুলো, আন্দাজ করল বেনন।
আমার বাঁধন খুলে দাও, নাহলে ক্ষমা করব না আমি তোমাদের, হুমকি দিল ওয়াং।
চুপ করে থাকো, বন্দী! গর্জন ছাড়ল, ব্যাগলে। ওয়াঙকে পাকড়াও করার পর বুকের ছাতি ফুলে উঠেছে ওর। পাল্টে গেছে তাকানোর ভঙ্গি। ওয়াঙকে তাচ্ছিল্য ভরা অবহেলার দৃষ্টিতে দেখল সে। বেশি কথা বললে তোমার জুতো তোমারই মুখে পুরে দেব।
গাধা! গরগর করল ওয়াং।
ওয়াং, তুমি জাতির কলঙ্ক। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে চাইনিজদের আমি শ্রদ্ধা করতাম। পশ্চিমের আদর্শ নাগরিক; পরিশ্রমী, সৎ, বিনীত, অনুগত আর ধার্মিক। সত্যিকার সাহসী লোকজন। ওরা না থাকলে রেল রোড বলে পশ্চিমে কিছু থাকত না। ব্যাগলে বিক্ষুব্ধ। তাছাড়া ওরা না থাকলে কাপড় ধোয়া হত না। ভেবে দেখেছ একটা লন্ড্রী থাকত না পশ্চিমে!
তোমার বক্তৃতা থামাও। মোমের আলোয় চকচক করছে ওয়াঙের চোখ। দৃষ্টিতে অনিষ্ট নিয়ে পালা করে দেখছে বেনন আর ব্যাগলেকে।
লোকটাকে উপেক্ষা করল বেনন। ব্যাগলের কাঁধে হাত রেখে বলল, তুমি না এলে বিপদে পড়ে যেতাম, পুরানো টুথব্রাশ।…হঠাৎ কি করে এলে এখানে তোমার না টেইল হল্টে থাকার কথা?
বয়েসে পার্থক্য সত্ত্বেও ওদের বন্ধুত্ব অটুট থেকেছে। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করে ওরা মানুষ হিসেবে। এ ওর পাগলামি সহ্য করে নেয় হাসিমুখে। কিন্তু বেননের প্রশ্ন শুনে এই মুহূর্তে ব্যাগলের মুখ থেকে এক পলকে হাসি দূর হয়ে গেল। খুলে বলল ও ফ্র্যাঙ্ক নোয়কের শয়তানি।
তারপর মনে এক বুক দুঃখ নিয়ে এন্ড অভ স্টীলে এলাম আমি। সেখান থেকে ঘোড়া ধার করে হ্যাটারের র্যাঞ্চে। ওরা বলল এখানে এসেছ তুমি। চলে এলাম। এসে দেখি খনির মুখ খোলা। প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, তারপর ভাবলাম এন্ড অভ স্টীল থেকে যন্ত্রপাতি এনে তুমিই পাথর সরিয়েছ। মন থেকে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ডাক দিলাম তোমাকে। তারপরের ঘটনা তো তুমি জানোই।…ও, আসল কথা বলতে ভুলেই গেছি, এন্ড অভ স্টীলে পৌঁছে জানলাম টেলিগ্রাফ এসেছে; অস্ত্রপচার হয়ে গেছে, হ্যাটার সুস্থ হয়ে উঠবে। ওকে আজকের শেষ ট্রেনে বাসায় নিয়ে আসবে ডেইজি। নার্সের ওপর ভরসা করতে পারছে না।
ব্যাগলের কথা শেষ হতেই হাসতে লাগল চাইনিজ। লোকটার গলা দিয়ে উঠে আসছে অদ্ভুত একটা খকখক শব্দ। গুহার ভেতর পৈশাচিক শোনাল আওয়াজটা। বেনন আর ব্যাগলেকে অস্বস্তিতে ভুগিয়ে তারপর হাসি থামাল। বলল, তোমরা জানো না কী বিপদ ঘটতে যাচ্ছে। আমাকে ছেড়ে দাও, নাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মরবে, হাটার মরবে!
মারবে কে, তুমি তো আমাদের হাতে বন্দী।
কোন চাল খাটবে না, ওয়াং।
বলব আমি। আগে আমার বাঁধন খুলে দাও।
এমনিতেও বলতে হবে তোমাকে, বলল বেনন। আগে আমি জানতে চাই এই খনিতে কি আছে যে হঠাৎ এত জরুরী হয়ে উঠল এখানে ঢোকা। না, তোমাকে জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করব আমি। আগে খুঁজে দেখি, নিজে যদি বুঝতে না পারি তাহলে তোমার মুখ আমি খুলিয়ে ছাড়ব মনে রেখো।
ওয়াঙের হাত-পায়ের বাঁধুনি পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়ে বেননের পিছু নিল ব্যাগলের। খনির ভেতর টানেলটা সরু হয়ে এসেছে। পাশাপাশি হাঁটতে পারছে না ওরা। কিছুদূর যাওয়ার পর আবার চওড়া হলো দু’পাশের দেয়াল। একটা প্রাকৃতিক গুহা মত জায়গায় এসে ঢুকল ওরা। মোমের আলো গুহার ছাদ পর্যন্ত পৌঁছয়নি। চারপাশে ফুট দশেক দৃষ্টি চলে। থমকে দাঁড়াল বেনন। আঙুল তুলে একদিকের দেয়াল দেখাল।
আধবসা হয়ে দেয়ালের গায়ে বেকায়দা পড়ে আছে একটা নর কঙ্কাল। খনি অভ্যন্তরের ভ্যাপসা পরিবেশে পচে গেছে গায়ের কাপড়। ছেড়া ন্যাকড়াগুলো লেপ্টে আছে হাড়ের গায়ে। শূন্য অক্ষিকোটর চেয়ে আছে ওদের দিকে। দাঁতগুলো ভেঙচি কাটছে, চকচক করছে মোমের আলোয়।
কী করুণ পরিণতি! ভূতুড়ে পরিবেশে ফিসফিস করল ব্যাগলে।
অনেক দিন আগে মারা গেছে লোকটা, বলল বেনন।
আস্তে করে মাথা দোলাল ব্যাগলে। হ্যাটারের ক্রুদের মুখে শুনেছি অনেক বছর আগে পাথর ধসে বন্ধ হয়ে গেছে খনিটা। সেই সময় নিশ্চয়ই ভেতরে আটকা পড়ে গিয়েছিল লোকটা। আর বেরতে পারেনি। কী ভয়ঙ্কর! খিদে আর তৃষ্ণায় ধুকে ধুকে মরেছে।
না। দ্বিমত পোষণ করল বেনন। খুলির দিকে তাকিয়ে দেখো। মাঝখানটা ভারী কিছুর আঘাতে ডেবে গেছে। ধীরে ধীরে কষ্ট পেয়ে মরেনি লোকটা। একে মেরে খনির ভেতরে ফেলে গিয়েছিল কেউ। তারপর যখন পাথর ধস হলো এই খনি হয়ে গেল ওর কবর।
বেচারা! দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্যাগলে।
এগিয়ে গিয়ে কঙ্কালের সামনে দাঁড়াল বেনন। লোকটাকে চেনার মত কোনকিছু পাবার আশায় মেঝেতে চোখ বোল। বেল্টের বাকল, ঘড়ি বা আর কিছু যদি পাওয়া যায়। হতাশ হতে হলো ওকে। খুনী কোন চিহ্ন ফেলে যায়নি। লাশের একপায়ে আছে শুধু একটা স্পার। পচে যাওয়া বুটজুতো থেকে স্পারটা খুলে নিল বেনন। উল্টেপাল্টে দেখে ব্যাগলের হাতে দিল।
এটা দেখো তো চিনতে পারো কিনা!
ভ্র কুঁচকে দেখল ব্যাগলে। তারপর বলল, লোকটা মাত্র একটা স্পার পরে ছিল?
আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে, তুমি মিস অ্যানা হ্যাটারের স্পারটা দেখোনি। বেননের কণ্ঠে উত্তেজনা চাপা থাকল না। এটা হচ্ছে ওটারই জোড়া। আন্দাজ করতে পারছ কী ঘটেছে?
না। আরও কুঁচকে গেল ব্যাগলের ভ্রূ।
আমি পারছি, বলল গম্ভীর বেনন। হতভাগ্য এই মানুষটা ডেইজির বাবা, ফিলিপ হারমান; যার পুতুল বানিয়ে প্রতি বছর কটনউড গাছে ঝোলায় টেইল হল্টের র্যাঞ্চাররা। খুন করা হয়েছিল তাকে। তারপর লাশটা এখানে এনে খনিতে ঢোকার মুখ পাথর ধস নামিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে খুনী।
কী ভয়ঙ্কর!
আবার বাজ পড়ল কাছেই কোথাও। বিকট শব্দটা মিলিয়ে যেতেই ডক্টর ওয়াঙের হাসি শুনতে পেল ওরা। লোকটা বলছে: এবার আমাকে ছাড়বে, গাধার দল, নাকি এখানে সময় নষ্ট করে পাগলা হ্যাটারকে মরতে দেয়ার ইচ্ছে আছে?
আরেকটা আওয়াজ পেয়ে অজান্তেই ব্যাগলের বাহু আঁকড়ে ধরল বেনন। ওটা কিসের আওয়াজ?
বাজ পড়েছে মনে হয়।
এসো! ব্যাগলেকে প্রায় টানতে টানতে ফিরে চলল বেনন। ডক্টর ওয়াঙকে পাশ কাটিয়ে খনি-মুখের কাছে চলে এলো ওরা। জ্বলন্ত মোম হাতে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল বেনন। তারপর আঁতকে উঠল। বোল্ডার দিয়ে বেরোনোর পথটা বন্ধ করে দিয়েছে কে যেন।
ব্যাগলে, হাত লাগাও! আমার পাশে এসে ঠেলা দাও। পাথরটা সরাতে না পারলে দম আটকে মারা যাব আমরা!
নির্দেশ পালন করল ব্যাগলে। বেননের কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর গায়ের জোরে ঠেলতে লাগল পাথরটা।
একচুল নড়ল না বোল্ডার
হবে না। হাল ছেড়ে দিল ব্যাগলে। কণ্ঠতালু শুকিয়ে কাঠ। পেছনে আরও পাথর রেখে ঠেকা দিয়ে গেছে লোকটা! জীবন্ত কবর দিয়ে গেছে আমাদের। বেরতে যদি না পারি এই খনিতে চারটে কঙ্কাল থাকবে, বেনন! বুড়ো হয়ে গেছি; মরতে ভয় পাই না; তাই বলে এভাবে!
চুপ করে থাকল বেনন।
১৮. হ্যারি হুলাহানকে শেষবার
ব্যাগলে, হ্যারি হুলাহানকে শেষবার কোথায় দেখেছ তুমি? জিজ্ঞেস করল বেনন।
দেয়ালে হেলান দিয়ে পাশাপাশি বসে আছে বেনন স্মার ব্যাগলে। ব্যর্থ হয়েছে ওরা, একচুল নড়াতে পারেনি পাথর।
কেন, আমার সঙ্গে একই ট্রেনে এন্ড অভ স্টীলে এসেছে লোকটা!
হ্যাটার যে সুস্থ হয়ে উঠছে, আজকের শেষ ট্রেনে ডেইজি তাকে র্যাঞ্চে নিয়ে আসছে, সে-খবর সে জানে?
আস্তে করে মাথা ঝাঁকাল ব্যাগলে। জানে। টেলিগ্রাফটা আসার সময় জিমি নর্টনের সঙ্গেই ছিল সে। তারপর লোকটাকে আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
ডক্টর ওয়াঙের কাছে ফিরে এলো বেনন। ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছে ওকে। বলল, এবার তোমাকে কথা বলার সময় এসেছে, ওয়াং।
নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকল চাইনিজ।
আমাদের সঙ্গে তোমাকেও মরতে হবে, ওয়াং।
কাঁধ ঝাঁকাল ওয়াং। আমি তোমাদের একটা সুযোগ দিয়েছিলাম, সুযোগটা তোমরা নাওনি। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আমি আমাদের কথা বলছি না। বেননের কণ্ঠে অধৈর্য প্রকাশ পেল। আমি জানতে চাই ঠিক কোথায় আর কখন হ্যাটারের ওপর আঘাত হানবে হ্যারি হুলাহান।
ও, তাহলে তুমিও ধরে ফেলেছ? হাসির ভঙ্গিতে ঠোঁট প্রসারিত করল চাইনিজ।
খনির ভেতরে ঢুকে লাশটা ফিলিপ হারমানের বোঝার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কার মরলে লাভটা কার ভাবতেই জবাবটা পেয়ে গেছি। বসকে মেরে টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করে মালিক সেজে বসেছে হুলাহান। সবাই যখন হারমানের খোঁজ করছে তখন তাদেরই নাকের ডগায় বসে চোরাই টাকা দিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করেছে লোকটা। কঠোর চেহারায় চাইনিজকে দেখল বেনন। আমি জানি তুমি হুলাহানের হয়ে কুকীর্তি করতে এসে তাকেই ব্ল্যাকমেইল করছিলে। কালকে রাতে তার শোধ নিয়েছে সে। বারান্দা থেকে হ্যাটারকে গুলি করে তারপর চেঁচিয়ে বলেছে যে তুমি র্যাঞ্চারকে গুলি করে পালিয়েছ। চেষ্টা করেও হ্যাটারকে মারতে পারেনি লোকটা… এবার বলো কোথায় কখন আবার আক্রমণ করবে সে হ্যাটারের ওপর।
তাহলে আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছে হুলো বেড়ালটা, আপন মনে বলল ওয়াং।
আগেই তুমি ফেঁসে বসে আছ, বলল বেঁনন। কন্সট্রাকশন ক্যাম্পে হামলা করে কয়েকজনকে মেরে ফেলেছে ওর লোকরা। হুলাহান শুধু তোমার নাম ভাঙিয়ে নিজের পিঠ বাঁচাচ্ছে।
রাগে জ্বলে উঠল চাইনিজের চোখ জোড়া। টেইল হল্ট আর এন্ড অভ স্টীলের মাঝে বিরাট একটা উঁচু ব্রিজ আছে মনে পড়ে? বেশ কয়েক মাস আগে হুলাহান বলেছিল কেউ যদি রেল রোডের কাজ বন্ধ করতে চায় তাহলে ব্রিজটা উড়িয়ে দেবে। বলেছিল কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ, বাধ্য না হলে ওপথে যাব না আমরা। বেননের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে দেয়ালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল ওয়াং। আজকে হুলাহানের জায়গায় আমি থাকলে ব্রিজটা উড়িয়ে দিতাম আমি। হ্যাটারের অপারেশন হয়ে গেছে। লোকটা স্মৃতি শক্তি ফিরে পেলে মহাবিপদ। আমি জানি শেষ ট্রেনে এন্ড অভ স্টীলে আসছে লোকটা। ব্রিজ না থাকলে খাদে পড়ে চুরমার হয়ে যাবে ট্রেন। একজনও বাঁচবে না। বেননের চোখে চোখ রাখল ওয়াং। হ্যাটারের মুখ বন্ধ করতে ঠিক তাই করবে হ্যারি হুলাহান।
শিউরে উঠল বেনন যাত্রীদের পরিণতি কল্পনা করে। ডেইজি, আহত হ্যাটার, ব্র্যান্ডন, ভাউবয়েস আর তার বাচ্চা ছেলে-সবাই থাকবে ওই ট্রেনে। বেননের ইচ্ছে হলো খামচে মাথার চুল টেনে ছেড়ে। সবই বুঝতে পারছে ও; তবে বড় দেরিতে। এখন ও জানে। পাথর দিয়ে খনি থেকে বেরবার মুখটা কে বন্ধ করে দিয়ে গেছে। সোবার সুয়েডে আসব সে-কথাটা আমি হ্যারি হুলাহানের সামনে বলেছিলাম! ফিসফিস করে বলল বেনন। লোকটা আমাকে নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছিল!
ডিনামাইট! বেনন; ডিনামাইট! হঠাৎ লাফিয়ে উঠল ব্যাগলে।
উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিল বেনন ডিনামাইটের কথা। ব্যাগলের কথায় মনে পড়ল। ফিলিপ হারমান ডিনামাইট ব্যবহারের সুযোগ পায়নি। কিন্তু ওদের সেই সুযোগ আছে। বেঁচে আছে ওরা এখনও।
বাক্স থেকে ডিনামাইটের একটা স্টিক বের করল বেনন। ছোট একটা ফিউজ ছিঁড়ে নিল। দাঁতে কামড়ে সংকুচিত করল একটা ফালমিনেট ক্যাপ। তারপর ব্যাগলেকে ইশারায় দাঁড়াতে বলল।
এত পুরানো ডিনামাইট ফাটলে হয় এখন! সংশয় প্রকাশ করল ব্যাগলে।
ফাটবে। যত পুরানোই যোক ডিনামাইট কখনও অকেজো হয়েছে বলে শুনিনি। টানেলের প্রবেশ পথে এসে বোল্ডারের তলায় স্টিকটা জল বেনন। ফিউজে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যতটা সম্ভব দ্রুত ফিরে এলো ব্যাগলের কাছে। দু’জন মিলে ওয়াংকে তুলে দৌড়াল টানেলের ভেতর। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল বেনন আঁধারে মিটমিট করে জ্বলছে ফিউজ। ব্যাগলেকে বলল, শক ওয়েভের ধাক্কায় ছাদটা ধসে না যায়। নিজের কানেই নিজের গলা অপরিচিত লাগল ওর।
হারমানের সমাধি-গম্বুজের ভেতর এসে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল ওরা। রোমশ কানে দু’হাত চাপা দিয়ে ব্যাগলে বলল, ওয়াংটা লম্বা-চওড়া হলে ভাল হত। আমরা ওকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারতাম।
ভয়ানক গুরুগম্ভীর আওয়াজে থরথর করে কেঁপে উঠল টানেল। প্রতিবাদ জানাল কাঠের খুঁটিগুলো। ছাদ থেকে খসে পড়ল ঝুরঝুরে ধুলো। তারপর এলো শকওয়েভ। আরেক দফা ঝড় উঠল টানেল শ্যাফটে। ছাদ নেমে আসছে। ভেঙে গেল কয়েকটা খুঁটি। গরম দমকা হাওয়ার ধাক্কায় দেয়ালের গায়ে সেটে গেল ওরা। নিভে গেল মোম। সব ক’জনের নাক কুঁচকে গেল বিস্ফোরকের কটু ঝাঁঝাল গন্ধে।
শক ওয়েভ ওদের পার হয়ে যেতেই অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ছুটল ওরা। যে কোন মুহূর্তে ছাদ খসে পড়বে ওদের মাথার ওপর। মাথার ওপর ছাদ থাকাটা সবসময় যে স্বস্তিদায়ক নয় এই প্রথম বুঝতে পারল বেনন।
সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় এসে ওরা দেখল বিস্ফোরণের ফলে সরে গেছে বোল্ডার। খুলে গেছে, খোকা! এবারের মত মরতে হচ্ছে না আমাদের।
আমার, স্বস্তির শ্বাস ফেলে গম্ভীর চেহারায় ব্যাগলের কথা সংশোধন করল বেনন। তোমাকে মরতে হচ্ছে। টেইল হল্টে আমাদের দায়িত্ব শেষ হলেই তোমার দুই ছেলে-মেয়ের কাছে যেতে হবে তোমাকে।
মনে করিয়ে দিয়ো না। গুঙিয়ে উঠল ব্যাগলে।
বাইরে চলো। হ্যারি হুলাহান আমাদের জন্যে আঁধারে অপেক্ষা করছে না। পা বাড়াল বেনন।
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বাতাস নেই একফোঁটা। মাঝে মাঝেই সাপের মতো ছোবল দিচ্ছে বিজলি। নীলচে আলোর ঝিলিকের পরপরই কড়াৎ করে বাজ পড়ছে।
সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়েই পাথর-বালুর জঞ্জালের মধ্যে জুতো খুঁজতে লাগল বেনন। টুকরো টুকরো পাথরের তলায় চাপা পড়েছে ওগুলো।
কি খুঁজছ? জানতে চাইল ব্যাগলে।
জুতো। এই যে পেয়েছি এক পাটি। আরেকটা গেল কোথায়…
আরেক পাটি খুঁজে পেল ব্যাগলে। বেননকে দিয়ে বলল, আমার ঘোড়াটা ডিনামাইটের আওয়াজে ভেগেছে কিনা কে জানে!
একই দুশ্চিন্তা বেননকেও পেয়ে বসেছে। ওয়াঙকে ব্যাগলের পাহারায় রেখে দেখতে গেল সে। নাহ, বোল্ডারের পেছনে, এখনও আছে ঘোড়াটা। ফেরার পথে ব্যাগলেরটাও খুঁজে নিয়ে এলো ও। থামল মাটিতে পড়ে থাকা ওয়াঙের সামনে। তোমার ঘোড়া কাছেই কোথাও থাকার কথা। পেলাম না। কোথায় ওটা?
কি করে ভাবলে বলে দিয়ে নিজের ধ্বংস ডেকে আনব আমি?
দু’হাতে লোকটার কাধ ধরে কঁকি দিল বেনন। তোমার পেছনে নষ্ট করার সময় নেই আমার। তাড়াতাড়ি বলে ফেলো, নইলে খনির মধ্যে রেখে পাথর চাপা দিয়ে চলে যাব; আমরা ফিরে আসার আগে আর বেরতে পারবে না। আর যদি আমাদের কিছু হয় তো বোঝোই তো কি ঘটবে তোমার কপালে।
কপালে ভাঁজ তুলে চিন্তা করল ওয়াং। পুরানো মাইনে আটকা পড়ে থাকতে মন সায় দিল না। বলল, তোমরা যেরকম নির্বোধ তাতে যেকোন সময় মরে যেতে পারো। না, আমি ঝুঁকি নেব না। কারাবন্দী হওয়া অনেক ভাল। ঘাড় কাত করে ডানদিকের ঝোঁপ দেখাল সে। ঘোড়াটা ওগুলোর পেছনে আছে।
পাঁচ মিনিটের মাথায় পুবদিকে রওয়ানা হয়ে গেল ওরা। হ্যাটারের র্যাঞ্চে যাচ্ছে।
অস্বাভাবিক ঝুঁকি নিয়ে ঘোড়া দাবড়াল বেনন। ওয়াঙের ঘোড়ার দড়ি ধরে রেখেছে। চেঁচিয়ে সর্বক্ষণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে লোকটা। ব্যাগলে ছুটছে তার পাশে। দু’চোখ বুজে রাখার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমিয়ে রেখেছে। ওরকম বিপজ্জনক ভাবে ছুটছে দুঃস্বপ্নের মধ্যে দেখলে যেকোন লোক ঘুম ভেঙে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে, আবিষ্কার করবে ঘামে তার সারাশরীর ভিজে গেছে।
মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমক। সেই ক্ষণিক হলুদ-সাদা অপার্থির আলোয় তীরের মত ছুটছে ওরা। বেননের মাথায় একটা চিন্তাই কাজ করছে। যে করে হোক প্রলয়ঙ্করী দুর্ঘটনা ঠেকাতে হবে। এতগুলো নিরীহ মানুষকে এভাবে মরতে দেয়া যায় না।
অঝোর ধারায় নেমেছে বৃষ্টি; চারপাশ ধোয়াটে হয়ে গেছে। দূর থেকে ওর হ্যাটারের র্যাঞ্চের টিমটিমে আলো দেখতে পেল। মাটি পিচ্ছিল; তবু গতি কমাল না ওরা। কয়েকবার হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল বেননের ঘোড়াটা।
শেষ পর্যন্ত নিরাপদেই-পৌছল ওরা হাটারের র্যাঞ্চে। ওদের আসার শব্দে হুড়মুড় করে বাঙ্কহাউজ থেকে বেরিয়ে এলো, কাউহ্যান্ডরা। সময় নষ্ট না করে ওয়াঙকে তাদের হাতে গছিয়ে দিল বেনন। ফোরম্যানকে বলল, একে আটকে রাখবে আমরা কাউকে না পাঠানো পর্যন্ত। সাবধান, লোকটা কিন্তু পিছলা, একটু সুযোগ পেলেই ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে পালাবে।
ওদেরগুলো রেখে করাল থেকে নতুন ঘোড়া নিল বেনন আর ব্যাগলে। রওয়ানা হওয়ার আগে ফোরম্যানের সামনে থামল বেনন।
হ্যাটারের সঙ্গে অনেকদিন আছ?
প্রায় বিশ বছর।
মনে পড়ে আহত সে হয়েছিল কবে?
তা দশ-পনেরো বছর তো হবেই। কে যেন ঝোঁপের আড়াল থেকে গুলি করেছিল। ধরা যায়নি লোকটাকে। যতদূর মনে পড়ে সেটা ছিল ব্যাঙ্ক ডাকাতির পরের বছর। একের পর এক দুর্ভাগ্য… খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল তখন আমাদের।
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল বেনন। হ্যারি হুলাহান এসেছিল আজকে?
হ্যাঁ। এই তো কিছুক্ষণ আগেই এসেছিল। খুব খুশি দেখলাম। ওর কাছেই শুনলাম আজ রাতের ট্রেনে ফিরছে হ্যাটার। বলল রেল রোডের কি একটা কাজে যেন তাড়া আছে। ঘোড়া নিয়েই রওয়ানা হয়ে গেছে।
ধন্যবাদ, রাফায়েল।
ঘোড়া ছোটাল ওরা। ব্যাগলে জিজ্ঞেস করল, ওয়াংকে নিয়ে কি করবে? তুলে দেবে চ্যাং টোয়াঙের হাতে?
না। চাইনিজরা ওকে পেলে খুন করবে। আমি ওকে শেরিফের হাতে তুলে দেব।
আগেরবারের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকি নিচ্ছে এবার বেনন। ঘোড়ার পা মাটিতে ছুঁচ্ছে না বললেই চলে। আকাশ ভারী হয়ে আছে কালো মেঘে। এখনও সমান তালে বৃষ্টি পড়ছে। কর্দমাক্ত জমিতে জায়গায় জায়গায় জমে আছে পানির ছোট ছোট পুকুর। ওগুলো লাফিয়ে পেরচ্ছে ঘোড়া। কোনটা বেশি বড় হলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। বাঁক ঘোরার সময় পিছলাচ্ছে খুর। কোনমতে রাশ আঁকড়ে স্যাডলে টিকে আছে ওরা। আধঘণ্টার মধ্যে ক্যানিয়নে প্রবেশ করল ওদের ঘোড়া। ডেইজির পথটা ধরে এগিয়ে চলল বেনন। ব্যাগলে অনুসরণ করল ওকে। এখন ওর মনে হচ্ছে বাসায় থাকলেই ভাল হত, অতটা খারাপ আসলে নয় ছেলে-মেয়ে দুটো। এরকম রাতেই বেরোয় ডায়নোসর। একটার সামনে পড়লে আর দেখতে হবে না।
কন্সট্রাকশন ক্যাম্পটা কোথায়? চেঁচিয়ে জানতে চাইল ব্যাগলে।
অ্যাই থামো তোমরা! জবাবে সামনে থেকে নির্দেশ দিল একজন লোক। না থামলে গুলি করছি!
রাশ টেনে ঘোড়া থামাল ওরা। নিজের পরিচয় দিল বেনন। রাইফেল কাঁধে এগিয়ে এসে ওদের দেখল লোকটা। তারপর চিনতে পেরে রাইফেল নামিয়ে বলল, যাও।
বিগ জিমি নর্টনকে কোথায় পাব?
আগে বাড়ো। ক্যাম্পে আছে সে।
একমাইল পেরিয়ে আগুনের ধারে শ্রমিকদের জটলা দেখে থামল ওরা। সবার চেয়ে উড়তে দেখা গেল জিমি নর্টনের মাথা।
ওদের আগমনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে ভীড়ের মধ্যে। কয়েকজনকে ঠেলে বেরিয়ে এলো স্কটিশ।
হুলাহান এসেছিল? লোকটা মুখ খোলার আগেই জিজ্ঞেস করল বেনন।
ব্যাঙ্কার? এই তো খানিক আগে দেখলাম। চলে গেছে লোকটা। তাকে খুঁজছ কেন?
বুঝতে পারল বেনন, ডিনামাইট সংগ্রহ করতে ক্যাম্পে এসেছিল হারি হুলাহান। বেল রোডের গার্ডরা তাকে চেনে, বাধা দেবে না তারা লোকটাকে; মনোযোগ দেবে না; এখানে ওখানে পড়ে আছে যন্ত্রপাতি আর কলকজা; স্টোর রুমেও পর্যাপ্ত গার্ড নেই; ইচ্ছে করলেই হুলাহানের পক্ষে ডিনামাইট চুরি করা সম্ভব। আজকে ডিনামাইট লাগবে লোকটার।
টেইল হল্ট থেকে ট্রেনটা রওয়ানা হয়ে গেছে? জানতে চাইল গম্ভীর বেনন।
হ্যাঁ। স্বয়ং ভাউবয়েস টেলিগ্রাম করে বলেছেন ওই ট্রেনে আসছেন তিনি। তাঁকে অভ্যর্থনা করতেই এখানে অপেক্ষা করছি আমরা। ভ্রূ উঁচিয়ে তাকাল নর্টন। কি ব্যাপার, হঠাৎ এসেই এতো জেরা কিসের?
ব্রিজটা উড়িয়ে দেবে হুলাহান। অদ্ভুত শান্ত স্বরে বলল বেনন, নর্টন, এক্ষুণি একটা লোকোমোটিভের ব্যবস্থা করো। আমাদের বোধহয় দেরি হয়ে গেল। হুলাহানের আগেই ব্রিজের কাছে পৌঁছতে হবে; নাহলে বাচানো যাবে না একজনকেও। ভাউবয়েসের ট্রেনটা খাদের মধ্যে ফেলে দিতে যাচ্ছে হুলাহান; সেজন্যেই ডিনামাইট চুরি করতে এখানে এসেছিল লোকটা।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল স্কটিশ। তাকে তাড়া দিল বেনন। দাঁড়িয়ে আছ কেন। যাও ট্রেনের ব্যবস্থা করো; প্রত্যেকটা মুহূর্ত এখন মূল্যবান।
পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোকোমোটিভের দিকে দৌড়াল নর্টন। পেছন পেছন বেনন আর ব্যাগলে। তিন মিনিটের মাথায় এঞ্জিন ক্যাবে গিয়ে উঠল ওরা। জিমি নর্টন আগেই ড্রাইভারকে নিয়ে পৌঁছে গেছে। বেননের দিকে সংশয় নিয়ে তাকাল সে। তুমি ঠিক জানো তো? আমরা কিন্তু মারাত্মক ঝুঁকি নিচ্ছি। উল্টোদিক থেকে আসবে ভাউবয়েসের ট্রেন। দুটোর সংঘর্ষ হলে আর হ্যারি হুলাহানকে কষ্ট করে ব্রিজ ধ্বংস করতে হবে না। ব্রিজের এপারে কোন সিগনাল দেবার ব্যবস্থা নেই যে টেইল হল্ট থেকে আসা ট্রেনটা থামানো যাবে।
আমি নিশ্চিত, সামনের অন্ধকারে তাকিয়ে বলল বেনন। নর্টনের দ্বিধার কারণ বুঝতে পারছে, কিন্তু ঝুঁকিটা না নিয়ে কোন উপায় নেই।
আমরা একটা ফ্ল্যাট কার পেছনে আটকে নিই না কেন, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল নর্টন। আমার অর্ধেক ক্রু সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারব।
না,মানা করল বেনন। ওদের এখানেই থাকা প্রয়োজন।
কাসির লোকজন ক্যাম্পে হামলা করতে পারে।
ব্যাগলে বলল, একটা কোদাল দাও, লোহার ঘোড়াটাকে জোরে ছুটিয়ে দিচ্ছি।
হালকা পাতলা ব্যাগলের দিকে কড়া চোখে তাকাল ফায়ারম্যান। ব্যাগলের সেই ঐতিহাসিক হেলেনা যাত্রার কথা ভোলেনি, সেই একই ট্রেনের ক্রু লোকটা। বলল, আবার তুমি! কী বিপদ!!
এত কথা কিসের! ভ্রূ কোঁচকাল ব্যাগলে। একটা কোদাল দাও, দেখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে কিভাবে বয়লারে কয়লা ঠাসতে হয়।
অনুমতির অপেক্ষা না করে কাজে লেগে গেল ব্যাগলে। গনগনে আগুনের মধ্যে কয়লা গলতে লাগল। ধাতব শব্দে পিছলে গিয়ে তারপর ঘুরতে লাগল চাকা। নড়ে উঠল লোকোমোটিভ। আধার চিরে সামনে ছুটল। হেড ল্যাম্পের আলোয় ফুট বিশেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। থেকে থেকে চমকে উঠছে বিজলি।
ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে এলো ট্রেন। একটানা হুইল বাজাচ্ছে ড্রাইভার। সবাই নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে, বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। সামনেটা দেখার চেষ্টা করছে। ওদিক থেকেই আসবে এন্ড অভ স্টীলগামী ট্রেন। নর্টনের কাছ থেকে সময় জেনে নিল বেনন। ট্রেনের গতি আন্দাজ করে বুঝতে চাইল কতদূর এগিয়েছে ওরা।
ঘোড়ায় চড়ে আসছে হুলাহান। তার আগেই পৌঁছতে হবে ব্রিজের কাছে। কে জানে হুলাহান ক্যাম্পে ঘোড়া বদলেছে কিনা। সেক্ষেত্রে আগেই পৌঁছে যাবে লোকটা!
১৯. বেননের কানের কাছে মুখ
আধ ঘণ্টা পর বেননের কানের কাছে মুখ নিয়ে এলো জিমি।
আমরা কিন্তু ব্রিজের কাছে চলে এসেছি!
জিমি নর্টন ড্রাইভারের দিকে তাকাতেই ট্রেনের গতি কমিয়ে আনল লোকটা। শেষ একটা ঝাঁকি খেয়ে থেমে দাঁড়াল ট্রেন। লাফ দিয়ে ক্যাব থেকে নামল বেনন আর ব্যাগলে। না তাকিয়েও বেনন টের পেল ওদের অনুসরণ করছে কন্সট্রাকশন চীফ। লাইন ধরে ছুটল ওরা। ব্রিজের ওপর উঠতেই দৌড়ানোর গতি কমে গেল। রেল লাইনের স্লিপারগুলোর মাঝখানের ফাঁকগুলোয় আঁধার তুলনামূলক ভাবে গাঢ়। একবার পা ফসকালেই গভীর খাদে গিয়ে পড়তে হবে। নিচের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না কেউ। সবার নজর দুপাশের রেলিঙের দিকে।
বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গে ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে একজন লোককে দেখতে পেল বেনন। ব্রিজ থেকে ছুটে নেমে গেল লোকটা, মিলিয়ে গেল আঁধারে।
ওই যে হ্যারি হুলাহান! গলা ফাটিয়ে চেঁচাল ব্যাগলে।
অন্ধকারে দুই বার ঝিকিয়ে উঠল কমলা আগুন। গুলি করছে হুলাহান। দূরত্ব অনেক, লাগল না কারও গায়ে।
আমরা চেষ্টা করলে এখনও ওকে ধরতে পারি, বলল ব্যাগলে।
দরকার নেই। দৌড়ের গতি বাড়াল বেনন। যেতে দাও ওকে। ধরা পড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি চলো।
সামনেই জ্বলছে মিটমিটে একটা আলো। ফিউজে আগুন ধরিয়ে গেছে হুলাহান।
আতঙ্কে জমে যেতে চাইল বেননের হাত-পা। কতটা লম্বা ফিউজ ব্যবহার করেছে হুলাহান? পাশাপাশি এগোল বেনন আর ব্যাগলে। দুরু দুরু বুকে আশা করছে বিস্ফোরণের আগে যথেষ্ট সময় আছে। ব্যাঙ্কার নিশ্চয়ই ট্রেন আসার আগেই ব্রিজ ধ্বংস করতে চায়নি। ট্রেনের ড্রাইভার হেড লাইটের আলোয় দেখে ফেললে দুর্ঘটনা ঘটবে না, সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হবে লোকটার উদ্দেশ্য।
দূর থেকে আগুয়ান ট্রেনের ঝিকঝিক আওয়াজ শুনতে পেল বেনন। এসে পড়েছে ভাউবয়েসের ট্রেন! হুলাহান ওদের ট্রেনের বাতি দেখে ব্রিজ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হয়েছে। যাওয়ার আগে কি ফিউজটা ছোট করে দিয়ে গেছে লোকটা?
হুলাহানকে ধাওয়া করে কোন লাভ নেই। লোকটা নিশ্চয়ই ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে ঘোড়া লুকিয়ে রেখেছিল, এতক্ষণে ঘোড়ায় উঠে ভেগেছে নিঃসন্দেহে। তার পেছনে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
ট্রেনের বাতি দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে দ্রুত। কুউউউ! হুইসল বাজাল ড্রাইভার। আর বড় জোর দুই মিনিট, তারপরই সেতুর ওপরে উঠে আসবে ট্রেন।
ব্রিজের মাঝখানে পৌঁছে গেছে বেনন। ব্যাগলেকে এগিয়ে যেতে বলল। দড়ি দিয়ে এক বান্ডিল ডিনামাইট বেঁধে রেখে গেছে হুলাহান। দড়ি ছিঁড়ে হ্যাচকা টানে ট্র্যাক থেকে বান্ডিলটা তুলে নিল বেনন; ফিউজ খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল খাদের অন্তহীন গভীরে। দ্রুতগতি ট্রেনের কারণে কাঁপতে শুরু করেছে রেললাইন। ব্যাগলে চলে গেছে ব্রিজ পেরিয়ে। লাইনের ওপরে দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়ছে ব্যাগলে। এঞ্জিনের আলো এসে পড়েছে ওর ওপর। যন্ত্র দানব আর বড়জোর একশো গজ দূরে, তারপরই ব্রিজে উঠে পড়বে।
রেইলের সঙ্গে লোহার চাকা ঘষা খেয়ে আগুনের ফুলকি ছুটল চারদিকে। কর্কশ আওয়াজ তুলে গতি কমল ট্রেনের। ব্যাগলের পাঁচ ফুটের মধ্যে এসে থেমে গেল। লাফ দিয়ে নামল ভাউবয়েস।
কী ব্যাপার, কী হচ্ছে এখানে।
বুক ফুলিয়ে তার সামনে দাঁড়াল ব্যাগলে। এই মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছে বিশ্ব জয় করেছে।
ওর পাশে এসে থামল বেনন। দু’এক কথায় পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলল, ট্রেনে চলো, বৃষ্টিতে ভিজে কোন লাভ নেই।
দু’খণ্ডে বিভক্ত ভাউবয়েসের ব্যক্তিগত বগিটা বেশ বড়। ভেতরটা দামী আসবাব পত্রে সাজানো। মাঝখানে পর্দা দেয়া। পর্দার ওপাশে আছে আহত হ্যাটার। ওদিকে তাকাল বেনন, এখন কি অবস্থা?
আগের চেয়ে ভাল। ডাক্তার বলেছে কয়েক সপ্তাহ বিশ্রাম নিলেই সুস্থ হয়ে উঠবে। সোফায় বসল ভাউবয়েস। এখনও কৌতূহল মেটেনি তার। জানতে চাইল, এবার একটু খুলে বলো কি ঘটেছে।
বিরাট লম্বা কাহিনী, শুরু করল বেনন। বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই আজ থেকে তেরো বছর আগে। সেসময় টেইল হল্টের ব্যাঙ্কার ছিল ফিলিপ হারমান বলে এক লোক। আজকের ব্যাঙ্কার হুলাহান তখন তার ক্যাশিয়ার। ফিলিপ হারমানকে খুন করে সে, রেখে আসে সোবার সুয়েডের গহ্বরে। চমৎকার বুদ্ধি। লোকে টের পাবে তার কোন উপায়ই সে রাখেনি, ডিনামাইট ফাটিয়ে বন্ধ করে দেয় খনি-মুখ। কিভাবে সে খুন করেছিল তা আমরা জানি, কিন্তু কি করে ব্যাঙ্কারকে পটিয়ে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল তা জানি না। যাই হোক, পর্দা ঠেলে পাংশু মুখে বেরিয়ে এসেছে ডেইজি, মেয়েটির দিকে চেয়ে হাসল বেনন। বলল, ব্র্যান্ডনকে বিয়ে করতে তোমার আর কোন অসুবিধা নেই, ডেইজি। তোমার বাবা চোর নয়। চোরের মেয়ে নও তুমি।
ডেইজির কাঁধ জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিল ব্র্যান্ডন। আস্তে করে বসিয়ে দিল একটা সোফায়। তারপর জিজ্ঞেস করল, কিন্তু সে লোক রেল লাইনের পিছনে লেগেছে কেন, টেইল হল্টে ব্যবসা করলে তারই লাভ।
কারণ তোমরা সোবার সুয়েডের ভেতর দিয়ে টানেল খুঁড়তে চেয়েছিলে। ঠেকানোর জন্যে ওয়াংকে ভাড়া করল সে। বিরাট একটা ভুল করে ফেলল হিসেবে। ওয়াং যে উল্টে তাকেই চুষে খেতে চাইবে এটা সে ভাবতেই পারেনি। যাই হোক, কথা সেখানে নয়; আরেকটা বড় ভুল করে রেখেছিল সে। খনির ভেতর লাশ ঢুকানোর সময় পরিচয় চেনা যাবে এমন সব কিছু খুলে নিলেও স্পারটা খুলতে ভুলে গিয়েছিল। হ্যারি হুলাহানের দুর্ভাগ্য যে লাশ সরানোর সময় একটা স্পার আগেই মাটিতে পড়ে যায়। হ্যাঁটার সেটা কুড়িয়ে পেল।
আর পেয়েই চিনে ফেলল? জানতে চাইল ব্র্যান্ডন।
মাথা নাড়ল বেনন। না, চিনতে পারেনি। কুড়িয়ে পেয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই সেখানে ওটা দেখে ফেলে হুলাহান। কখন হ্যাটার জিনিসটা চিনে ফেলে ভেবে চিন্তায় পড়ে যায়। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে একটা খুনকে ধামাচাপা দিতে হলে আরেকটা খুন করতে হবেই। ফলাফল? সবার ওপর নজর বুলিয়ে নিল বেনন। ফলাফল ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে হ্যাটারকে হত্যার চেষ্টা। আজকেই র্যাঞ্চারের ফোরম্যানকে জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল ব্যাঙ্ক ডাকাতির কিছুদিন পরই গুলিতে আহত হয় হ্যাটার। লোকটা মরল না বটে, কিন্তু হারিয়ে গেল স্মৃতিশক্তি। হ্যাটারকে আর ঘাটাল না হুলাহান, ভাবল র্যাঞ্চার তার আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
ভ্রূ কোঁচকাল ভাউবয়েস। কিন্তু স্পারটা তো মিস অ্যানার কাছে পূর্বে পাঠিয়ে দিয়েছিল হ্যাটার।
তা নাহলে নির্ঘাত ওটা চুরি করত হুলাহান। আমার ধারণা জিনিসটা পশ্চিমে চলে গেছে জানতে পেরে খুশিই হয়েছিল সে।
হ্যাটারের র্যাঞ্চে হুলাহান বলেছিল ওয়াংকে চিনত, বলল ব্র্যান্ডন।
তারপর, আবার শুরু করল বেনন, হুলাহান যখন টের পেল তোমরা সোবার সুয়েডের ভেতর দিয়ে টানেল খুঁড়তে চাইছ তখন মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হলো তার। মনে পড়ল টানেলের ভেতর রয়ে গেছে হারমান। লাশ উদ্ধার করা হলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। লাশের পায়ের স্পারটা দেখে চিনে ফেলতে পারে হ্যাটার। রেল রোডের অগ্রগতি ঠেকানোর জন্যে উঠে পড়ে লাগল হুলাহান। একই সঙ্গে আরেকটা কাজ করল। মিস অ্যানাকে হ্যাটারের নামে চিঠি পাঠাল যাতে স্পারটা নিয়ে মহিলা চলে আসে। সে ভেবেছিল জিনিসটা গায়েব করে দিলে খানিকটা বিপদমুক্ত হওয়া যাবে। ডেইজির সঙ্গে দেখা করার ছুতোয় হ্যাটারের র্যাঞ্চে সে-ই চিঠি পত্র আনা নেয়া করত, কাজেই চিঠি খুলে মিস হ্যাটার কবে আসছেন জেনে নেয়া ছিল তার জন্যে সহজ। হুলাহানের নির্দেশেই স্টেজ কোচের উপর হামলা করা হয়। কিন্তু ওই যে বলেছি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চাইল ওয়াং। রেল অফিসে হুলাহান উপস্থিত থাকা অবস্থায় গুলি করে বুঝিয়ে দিল যে তাকে হেলাফেলা করা চলবে না। নিজেই সে সোবার সুয়েড খুঁড়ে দেখতে চাইল। লোকটা বুঝেছিল ওই স্পারের বিনিময়ে যা চাইবে তাই পেতে পারবে সে ব্যাঙ্কারের কাছ থেকে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিল হুলাহান, ওয়াংকে সুদ্ধ আমাদেরও আটকে দিল খনির ভেতর।
বুঝলাম না, বলল ব্র্যান্ডন। উদ্ধার পেলে কি করে? তাছাড়া যে স্পার লুকানোর জন্যে এতকিছু সেটা তো ওয়াঙের কাছ থেকে তুমি উদ্ধার করলেই, তাহলে?
সংক্ষেপে সারল বেনন, বলল, হ্যাটারের হাতে তুলে দিলাম। আমি জানতাম না যে বিপদ ডেকে আনলাম তার। গুলি করল হ্যারি হুলাহান। কাজটা ওয়াঙের বলে চালিয়ে দিল। মারতে যখন পারল না, তক্কে তক্কে থাকল, ছায়ার মত গেল তার সঙ্গে টেইল হল্ট পর্যন্ত। ভাগ্যিস শেষ পর্যন্ত তার উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি।
তারমানে ডাক্তার যখন অস্ত্রপচার করল তখন ভয়ে কাঁপছে লোকটার অন্তর, মন্তব্য করল ব্র্যান্ডন।
অবশ্যই, একমত হলো বেনন। আমার ধারণা, বলল পিচ্চি ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক, আমিও এব্যাপারে আপনার চেয়ে ভাল করতে পারতাম না।
আমি জানি তুমি পারতে না, জবাবটা দিল ব্যাগলে। তারপরই ফ্র্যাঙ্ক নোয়াকের অনুকরণে অবহেলা ভরে হেসে উঠল, হাহ্! হাহ! হাহ্!
লোকটা এখন কি করবে? বেননের দিকে চাইল ভাউবয়েস।
এখন পালাবে সে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নিতে এতক্ষণে হয়তো শহরের দিকে ছুটেছে। এন্ড অভ স্টীলে গিয়ে ওখানে একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে। শেরিফকে জানাতে হবে দেখামাত্র যেন গ্রেফতার করা হয়।
রেইডাররা আর হামলা করবে বলে মনে হয়?
না। ওদের বেতন দেয়ার কেউ নেই যে থাকবে ওরা। আজ রাতেই সমস্ত লোক নিয়ে ক্যানিয়নে চিরুনি চালাব আমরা।
একটু থামল বেনন। তারপর বলল, আমার ধারণা আজকের মধ্যেই ডায়নোসর পাকড়াও করতে পারব আমি।
চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল ব্যাগলে ছাড়া আর সবাই। কথা সরল না কারও মুখে। নাক ডাকাচ্ছে ব্যাগলে।
কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল বেনন। মিস হ্যাটার কোথায়, তাঁকে দেখছি না যে?
মুখ কালো হয়ে গেল ভাউবয়েসের। বলল, আর বলবেনন না, কোথায় কোন সেলুনে যেন অ্যালকোহলহীন বিয়ার বেচছে বলে গুজব শুনেছে। মহিলা তাতে মহাখাপ্পা; ব্যস, ওমনি রয়ে গেছে; অপেক্ষা করছে কখন ধরতে পারবে। একবার ধরতে পারলেই দেবে আমাকে নালিশ করে। বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে আমাকে।
ঝকঝক ঝকঝক আওয়াজ তুলে এন্ড অভ স্টীলে এসে ঢুকল রেল গাড়ি। ইতিমধ্যেই পাশের একটা লাইনে লোকোমোটিভ এঞ্জিন সরিয়ে নিয়েছে বিগ জিমি নর্টন। প্রতিদিন এখন প্রায় এক মাইল করে এগোচ্ছে লাইন। দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ শহরটা। বৃষ্টিঝরা রাতে দাউদাউ করে জ্বলছে ক্যাম্পের আগুন। পানির ফোঁটাগুলো হিসহিস আওয়াজ তুলে বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। কাঠের বাক্স আর প্যাকিং কেস ফেলে শিখা আরও উস্কে দিচ্ছে শ্রমিকেরা। দ্বিতীয় ট্রেনটির আগমনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। চারদিকে। লোকজন এগিয়ে এলো লাইনের ধারে।
ট্রেন থামতেই সোফা ছেড়ে তড়িঘড়ি উঠতে গেল ব্যাগলে। দু’হাত শূন্যে উঠে গেল ওর। তারপর ভারসাম্য হারাচ্ছে বুঝতেই টলমল পায়ে সামনে বেড়ে দেহের ভর রক্ষা করতে চাইল। কোন লাভ হলো না। দু ইঞ্চি পুরু কার্পেটের ওপর হুড়মুড় করে আছাড় খেলো ব্যাগলে। হামাগুড়ি দিয়ে উঠে বসে রাগের চোটে গর্জন ছাড়ল, কে একসাথে করে বেঁধেছে আমার জুতোর ফিতে!
সবাই এ ওর দিকে তাকাল। বেননই প্রথম লক্ষ করল ট্রেন থামতেই নিঃশব্দে নেমে গেছে ফ্রাঙ্ক নোয়াক।
আমি অত্যন্ত দুঃখিত। হাত ধরে ব্যাগলেকে টেনে তুলল ভাউবয়েস। ছেলেটা এই একই কীর্তি করেছিল মন্ট্যানা সেন্ট্রালের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। জানেন, সেবার আমার সেকেন্ড ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রমোশন হওয়ার কথা ছিল! প্রেসিডেন্টকে ডিনারের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এলাম। টেবিলের তলায় ঢুকে ফ্র্যাঙ্ক তাকে আছাড় খাওয়াল। টেবিল ভেঙে পাকা তালের মত খসে পড়ল প্রেসিডেন্ট। সেই যে আমার প্রমোশনের সম্ভাবনা দূর হলো আজও কোন কূল-কিনারা করতে পারলাম না।
কাঁচা চামড়া দিয়ে স্পার দুটো বেঁধেছে ফ্র্যাঙ্ক। বাঁধনটা খুলতে খুলতে গরগর করে উঠল ব্যাগলে। যেদিন রেলের চাকরি ছাড়ব সেদিন ওর পিঠের ছাল যদি না তুলে নিয়েছি তো আমার নাম হিরাম ব্যাগলে না!
এসো, ব্যাগলে। কোচ থেকে নেমে গেল বেনন।
প্রথমে ওরা টেলিগ্রাফারের কুটিরে এলো। কপাল ভাল ওদের, খুনে লোকটা টেলিগ্রাফের লাইন কাটতে পারেনি। টেইল হল্টে খবর পাঠানো হলো যাতে ওখানে গিয়ে ব্যাঙ্ক খালি করে টাকা তুলে পালাতে না পারে হ্যারি হুলাহান। ওরা কুটির থেকে বেরতেই দেখা হয়ে গেল ব্র্যান্ডনের সঙ্গে। তার মুখে জানা গেল হ্যাটারের জ্ঞান ফিরেছে। রেল রোডের কাছে জমি বেচতে রাজি হয়ে গেছে র্যাঞ্চার। ওদিকে বিগ জিমি নর্টনকে নির্দেশ ঝাড়ছে। ভাউবয়েস। লোক জড়ো করতে বলছে লোকটাকে। বৃষ্টির মধ্যে ছুটোছুটি করছে শ্রমিকরা। আবার বেড়েছে বাতাসের বেগ। ঘন ঘন ঝিলিক দিচ্ছে বিজলি।
হ্যাটার জমি দেবে বলতেই গলা খাকারি দিয়ে পেট চিতিয়ে দাঁড়াল ভাউবয়েস, গলা কাঁপিয়ে আবেগ ভরে বলতে লাগল
বন্ধুরা প্রগতির কোন সীমাবদ্ধতা নেই। দুর্লঙ্ঘ্য বাধা পেরিয়ে উন্নতির চরম শিখরে মানুষকেই পৌঁছুতে হয়। আজ একটা মহান দিন। আমরা সম্মুখের বাধা দূর করে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। শুধু তাই নয়, আমরা…
অনেক কাজ পড়ে রয়েছে, বাধা দিল বেনন। ক্যাম্পের প্রহরায় যেকজন লাগে তারা বাদে বাকি সবাইকে ক্যানিয়নে যেতে তৈরি হতে বলুন।
দ্বিধার ছাপ পড়ল ভাউবয়েসের চেহারায়। কিন্তু ঝড়ের রাত। যদি ডায়নোসর দেখা দেয়? একজন চাইনিজও কিন্তু থাকবে না।
আমিও আশা করছি ডায়নোসর দেখা দেবে, বলল বেনন। আজকেই একটাকে ধরব আমরা।
যেন পাগলের দিকে তাকাচ্ছে এমন দৃষ্টিতে তাকাল ভাউবয়েস।
কি মনে হয়? প্রশ্ন করল বেনন।
অসন্তুষ্ট চেহারায় মাথা ঝাঁকাল ভাউবয়েস। কি বোঝাতে চাইল সে-ই জানে। দশ মিনিটের মাথায় সরগরম হয়ে উঠল ক্যাম্প। গলা উঁচিয়ে হাঁকডাক দিতে থাকল ভাউবয়েস আর জিমি নর্টন। লাঠি-সোটা, স্লেজ হ্যামার নিয়ে লণ্ঠন হাতে তৈরি হয়ে গেল একশো শ্রমিক। মার্চ করে এগোল ক্যানিয়নের ভেতরে। সবার আগে বেনন আর ব্যাগলে। ক্যানিয়নের পাথুরে মেঝেতে সারি বেঁধে আগে বাড়ল সবাই। তৈরি হয়ে আছে, বিপদ দেখলেই রুখে দাঁড়াবে। যতটা পারে আওয়াজ করছে ওরা। মুখে যে যাই বলুক ভয়ে কাঁপছে সবার বুক। চেপে আসছে ক্যানিয়নের দেয়াল। ঝুঁকে পড়ছে দু’দিক থেকে। ডায়নোসরের মত অতিকায় একটা জন্তু যদি বের হয়; ধেয়ে যদি আসে, তাহলে পায়ের তলায় চাপা পড়ে প্রথম চোটেই মরবে বিশ-পঁচিশ জন।
ঘোড়া নিয়ে বেননের পাশে চলে এলো ব্র্যান্ডন। আমার মনে হয় এভাবে সারা জীবন খুঁজলেও ওদের দেখা পাওয়া যাবে না।
ওরা নিজেরাই দেখা দেবে। ওয়াং ওদের দিয়ে খনিতে কাজ করাতে চেয়েও করায়নি। কাছেই আছে তারা। ওয়াং ঝড় আসছে দেখে নিশ্চয়ই কাসিকে ক্যানিয়নে পাঠিয়েছে। লোকটা এখন অপেক্ষা করছে, জানে অনেক নতুন চাইনিজ এসেছে; এখন ঝড় বাদলের মধ্যে হামলা করলে লোকগুলোকে ভয় দেখিয়ে রেল রোডের কাজ বন্ধ করে দেয়া যাবে।
সংঘবদ্ধ লোকদের বিরুদ্ধে ঝুঁকি নেবে ওরা?
নেবে, মাথা কাত করে সায় দিল বেনন। ডায়নোসর দেখলেই প্রাণের ভয়ে পালাবে সবাই।
তুমি বলতে চাইছ ওরা ইচ্ছে করলেই ডায়নোসর হাজির করতে পারবে?
চলো দেখা যাক পারে কিনা।
ইতিমধ্যে ক্যাম্প অনেক পেছনে ফেলে এসেছে ওরা। পেছন ফিরলে দূরে দেখা যায় ক্যাম্পের আবছা আগুন। সমবেত স্বরে গান গাইছে চাইনিজরা। ভরাট নিচু সুর। গম্ভীর গুঞ্জনে ভরে উঠেছে ক্যানিয়নের বুক। একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল বেনন, এখানেই গতরাতে ডায়নোসরের পায়ের ছাপ দেখেছিল।
সবাইকে দাঁড়াতে ইশারা করে অস্ত্র বের করল ও। গুলি করল আকাশের দিকে। পাশে দাড়িয়ে হাসছে ব্যাগলে। তারস্বরে এক চিৎকার দিয়ে বলল,মনে হয় ভাল জমবে ডায়নোসর শিকার। আমরা… থেমে গেল ব্যাগলে। হ বন্ধ করতে পারল না।
তিরতির করে এঁকেবেঁকে নেমে এলো তীব্র নীলচে আলো। প্রচণ্ড শব্দে ক্যানিয়নের দেয়ালে বাজ পড়ল। সেই অত্যুজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল ভয়াল বিভীষিকার মত প্রকাণ্ড দানবটাকে। বৃষ্টির মাঝে ঝাঁপসা একটা আকৃতি। পলকের জন্যে দেখা গেল। হেলে-দুলে এগিয়ে আসছে। তারপরই আঁধার হয়ে এলো চারপাশ।
লাঠি-সোটা লণ্ঠন ফেলে পিছু হটল চাইনিজরা। হৈ-চৈ পড়ে গেল চারদিকে। কে কার আগে পিছু হটবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। বাধ্য হয়ে পরপর কয়েকবার গুলি ছুঁড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল বেনন। ওর সঙ্গে যোগ দিল ব্যাগলে আর ব্র্যান্ডন। গরুর স্ট্যাম্পিডের মত বেহাল হয়ে ছুটতে চাইছে সবাই পারছে কেবল ক্যানিয়নের মাঝখানটা সরু হওয়ায়।
বেশ কিছুক্ষণ ঐকান্তিক চেষ্টার পর আতঙ্কিত লোকগুলোকে কোনমতে ফেরাল ব্র্যান্ডন আর ব্যাগলে। দ্রুত নিয়ন্ত্রণে ফিরে এলো পরিস্থিতি। আবার এগোল সবাই। বেনন ততক্ষণে চলে গেছে ডায়নোসরটাকে যেদিকে যেতে দেখেছে তার উল্টো দিকে। ক্যানিয়নের দেয়ালের গা বেয়ে একটা তাক উঠে গেছে, ওপরের সমতল জমি থেকে ফুট বিশেক নিচে চওড়া একটা মিডৌতে। কারও মনে সন্দেহ না জাগলে দিনের আলোতেও কেউ খুঁজে পাবে পথটা। দৌড়ে উপরে উঠে এলো বেনন। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ ঝিলিকে দেখতে পেল যা দেখতে পাবে বলে আশা করেছিল। এক কোনে আগুন জ্বালিয়েছে কাসি আর তার দলবল। যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্যাম্পে হামলা করবে! অস্ত্র বের করে চেঁচাল ও, ওরা এখানে!
হুড়মুড় করে উঠে এলো ক্ষিপ্ত চাইনিজ কুলিরা। তাদের আগে আগে আসছে ব্র্যান্ডন, ডেইজি আর ভাউবয়েস। ডেইজির হাতে সেই মহিষের চামড়ার দীর্ঘ চাবুক। বাতাসে চাবুক ফোঁটাচ্ছে। মেয়েটা। গোপন আস্তানায় পাল্টা হামলা হয়েছে বুঝতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কাসি আর দুবৃত্তের দল। থমকে গেল অস্ত্র বের করতে গিয়ে। এত লোকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলল। আস্তে করে গানবেল্ট খুলে মাটিতে ফেলে দিল কাসি। তার দেখাদেখি বাকি সবাই। আলো ছায়ায় একটা আবছা আকৃতিকে নড়ে উঠতে দেখল বেনন-। বুঝে ফেলল ও কে হতে পারে লোকটা। ছুটতে শুরু করল তার পেছনে। দশ গজ পেরতেই ধরে ফেলল। ওর ল্যাং খেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল লোকটা কাকর মেশানো মাটিতে। হাঁচড়-পাচড় করে উঠতে চেষ্টা করল তারপর পড়ে গেল আবার। বুকের উপর চেপে বসেছে বেনন।
দৌড়ে এলো ব্যাগলে। চাপা সুরে শিস দিয়ে উঠল চিতপাত হ্যারি হুলাহানকে দেখতে পেয়ে।
তাহলে এভাবেই ধরা পড়ল আমাদের বিখ্যাত প্রবঞ্চক!
পড়েছে মানে? ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ছে বেনন পরিশ্রমে। একেবারে আছাড় খেয়ে।
লোকটাকে বেঁধে ফেলল বেনন আর ব্যাগলে।
মিডোর ধারে কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে ছোট একটা বাক্স। ভেতরে লণ্ঠন জ্বলছে। বাক্সের সামনে একটা কাঁচের স্লাইড। বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে কম্বল পরিয়ে নেয়া হত। হাতল ধরে বাক্সটা নাড়াত একজন। ক্যানিয়নের দেয়ালে পড়ত ছবি। পলকের জন্যে দেখা যেতে নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে ডায়নোসর। বুদ্ধিমান বাটপাড় ডক্টর ওয়াং। জিনিসটা প্রসংশার দৃষ্টিতে নেড়েচেড়ে দেখে নামিয়ে রাখল বেনন। ফিরে এল ওয়ার্ডের কাছে।
ডায়নোসরটা গেল কই? বিরাট পেটটা নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হলো ভাউবয়েস সি ভাউবয়েস নোয়ক। পেটের দোলা থামতে না থামতেই আবার জিজ্ঞেস করল, আরে, হ্যারি হুলাহান এখানে কোত্থেকে এলো!
এখানেই ছিল, বলল বেনন। হ্যাটারকে মারতে না পেরে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। সকাল হলেই পালাত। ওর জানা হয়ে গেছে ধরা পড়লে বাঁচোয়া নেই, হারমানকে খুনের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে ওকে।
পারলে প্রমাণ করো আমি ব্যাঙ্কারকে খুন করেছি, ঘোৎ করে উঠল হুলাহান। ঠোঁট সরে গিয়ে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে তার। উপুড় হয়ে আছে। ঘাড় বাকা করে বেননের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল। পারবে না!
ভেবো না পার পাবে। ওয়াং নিজের গলা বাচাতে মুখটা খুললেই ফেঁসে যাবে তুমি। আর নিশ্চিত থাকতে পারো মুখ ওয়াং খুলবেই। বেশ কয়েক জন কুলি মারা গেছে তোমার ভাড়া করা গুণ্ডাদের হাতে।
ক্যাম্পফায়ারের ধারে গিয়ে থামল বেনন। ভেবেছিল ইতিমধ্যে বেঁধে ফেলা হয়েছে সবাইকে। সব শেষে বাঁধা হলো হ্যারি হুলাহানকে। বুকের ছাতি ফুলে উঠেছে চাইনিজদের। ক্যাম্পের দিকে ফেরার সময় চড়া গলায় গান ধরল ওরা। সামনে হাঁটছে পিছমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় এতদিনের অত্যাচারী রেইডারদের দল।
কন্ট্রাকশন ক্যাম্পে এসে তাদের ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াল সবাই। বক্তৃতার তোড় এসে গেল ভাউবয়েসের। নিজেকে সামলে নিল কোনমতে। তবু বেনন আর ব্যাগলের সম্বন্ধে যা বলল ওরা তা নিজেরাও এতদিন জানত না। সব শেষে আমি বলতে চাই, যারা এতকিছুর পরও নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছে, তারা অবশ্যই কৃতজ্ঞতা পাবার যোগ্য। আমাদের শিকাগো অফিস তাদের পুরস্কৃত করার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। বেননের দিকে তাকাল সে। কার কি চাওয়ার আছে বলো।
আমার ধারণা ধন্যবাদটা ব্যাগলের প্রাপ্য, পাশে সরে জায়গা ছেড়ে দিল বেনন। ও-ই খনির মধ্যে ডক্টর ওয়াংকে ধরেছিল। কিছু পাওনা হলে ওরই হয়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ-বলে ফেলো, বলে ফেলো! সবাই চেঁচাল।
বিনীত একটা হাসি দেখা গেল ব্যাগলের মুখে। লজ্জিত ভঙ্গিতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু চোখ পড়ল ফ্র্যাঙ্ক নোয়াকের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে কুঁচকে গিয়ে চেহারাটা ভয়ঙ্কর হয়ে গেল। বড় বড় দাঁত বের করে বিকট হেসে হাত বাড়াল ছেলেটার দিকে। ফ্র্যাঙ্ক নোয়াক এবার পালাবার সুযোগ পেল না, খপ করে তার কাধ চেপে ধরল ব্যাগলে। তারপর আস্তে করে কাছে টেনে নিয়ে পিঠ চাপড়ে ছেড়ে দিল।
ভেবেছিলাম, এই ছোঁড়ার পিঠের চামড়া ছাড়াতে চাইব। কিন্তু, না; দোয়া করি বড় হও। অনেক অনেক বড়। যতদিন বড় হচ্ছ সবার জান জ্বালিয়ে খাও–আমারটা ছাড়া।
২০. টেইল হল্ট শহর
টেইল হল্ট শহর।-সূর্য রাঙা সকাল। সেলুনে বসে আছে বেনন আর ব্যাগলে। টেবিলের ওপর দুটো লেমোনেডের বোতল। তরল পদার্থটির স্বাদ ভুলে গেলে মাঝে মাঝে উদাস ভঙ্গিতে মুখে তুলে চুমুক দিচ্ছে ওরা। পরমুহূর্তে বিকৃত করে ফেলছে চেহারা।
অনেকক্ষণ পর বিরস চেহারায় মুখ খুলল ব্যাগলে, এখানের কাজ তো শেষ হলো, এবার কি করব আমরা? ফার্মে বেটির কাছে ফিরে যেতে হবে ভাবলেই ভয় করছে। ছেলেটার জ্বালাতন সহ্য করা যায়, কিন্তু মেয়েটা মারাত্মক দজ্জাল। বিশ্বাস করবে না মেয়েটাই ছোঁকরাকে বদ বুদ্ধি দিয়ে মাথাটা খেয়েছে। এরা ব্র্যান্ডন বুঝবে মজা।
কিন্তু যেতে তোমাকে হবেই। এক চুমুক লেমোনেড খেয়ে মুখ বকাল বেনন। বিয়ে করেছ যখন, দায়িত্ব পালন তো করতেই হবে।
তা বুঝবে। কদিন পরই ওর বিয়ে।
আমরা থাকছি না?
না।
বাইরে শহরের নানা শব্দ। বোর্ড ওয়াক ধরে হাঁটাহাঁটি করছে গ্রেডার আর ট্র্যাক লেয়াররা। পূর্ণোদ্যমে কাজ চলছে রেল রোডের। শেরিফের সেলে বন্দী হয়ে আছে ডক্টর ওয়াং, হ্যারি হুলাহান আর রেল রোড রেইডারের দল। মাস দুয়েকের মধ্যেই আসবে সার্কিট জাজ, তারপর তাদের বিচার হবে। আপাতত বেকার হয়ে গেছে ওরা। অলস সময় কাটাচ্ছে গত কয়েকদিন ধরে।
সেলুনের ব্যাট উইং দরজা খুলে গেছে। লেমোনেডের গ্লাস হাতে নিয়েও নামিয়ে রাখল ব্যাগলে। শহরে আগুন লেগেছে আর একমাত্র বালতিটি তারই হাতে এমন ভঙ্গিতে ঝড়ের মত প্রবেশ করল ভাউবয়েস। এই কদিনের অত্যাচারে একটু উষ্কখুষ্ক হয়ে গেছে বেচারা। বেনন মুখ তুলতেই টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। টেবিলের ওপর ঘুরে এলো তার দৃষ্টি।
আপনারা জানেন কি ঘটছে এই শহরে? মিস হ্যাটার আমাদের সর্বনাশ করে ছাড়বে। মহিলা এবার পেছনে লেগেছে যাতে জুয়ার আড্ডা বন্ধ করে দেয়া হয়। চাইনিজরা নাকি বউ বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে সব টাকা উড়িয়ে দিচ্ছে। এবার আর কাউকে ধরে রাখা যাবে না। মহিলার অত্যাচারে পালাবে সবাই।
কি করতে বলেন, ভাউবয়েসের চোখে তাকাল বেনন। আমাদের দায়িত্ব শেষ, কাজ ফুরিয়েছে। এখন আর কেউ পরফাইরি পর্যন্ত লাইন নিয়ে যেতে আপনাদের বাধা দেবে না।
তা দেবে না। কিন্তু মহিলা একাই একশো। ব্যাকুল চোখে তাকাল ভাউবয়েস। কি করা যায়?
আমি নিরুপায়। কাঁধ ঝাঁকাল বেনন। তাছাড়া ভাল কোন কাজে বাধা দেয়া আমার স্বভাব নয়।
অগত্যা ব্যাগলের দিকে তাকাল ভাউবয়েস।
আমি একটা উপকার করতে পারি, বলল ব্যাগলে। মাটিল্ডা বলে মিস হ্যাটারের এক বান্ধবী আছে। তার নামে মহিলার কাছে একটা টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে দাও। লিখো স্কুল কমিটির নতুন সিদ্ধান্তে ঠিক হয়েছে আগামী সাত দিনের মধ্যে ফিরতে না পারলে বরখাস্ত করা হবে।
অবাক হয়ে তাকাল বেনন। তোমার তো কিছুই মনে থাকে না, ব্যাগলে! মাটিল্ডা নামটা মনে থাকল কি করে?
অনেক বছর আগে বার-জে নামে একটা র্যাঞ্চে কাজ করতাম। ওখানে একটা ঘোড়ীকে কিছুতেই বশ করতে পারিনি। ওটাকে সবাই মাটিল্ডা বলে ডাকত।
জানি না কাজ হবে কিনা, তবে তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। আশার আলো জ্বলে উঠল ভাউবয়েসের দু’চোখে। বেনন আর ব্যাগলের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে করমর্দন করল সে। তারপর হুঁড়ি নাচাতে নাচাতে বেরিয়ে গেল দ্রুত পায়ে।
ভালই তো করছিল মিস হ্যাটার, অসন্তুষ্ট চেহারায় বলল বেনন।
তা করছিল, একমত হলো ব্যাগলে, কিন্তু তুমি বিয়ে করোনি তাই জানো না কতখানি অত্যাচার করে ওরা আমাদের ওপর। তোমার কি ধারণা চাইনিজরা এমনি এমনি দেশ ছেড়ে এখানে কাজ খুঁজতে এসেছে? একজন বিবাহিত বোদ্ধা হিসেবে মাথা নাড়ল ব্যাগলে। ওরা অতিষ্ঠ হয়ে একটু শান্তির খোঁজে এসেছে। কাজটা আসলে ছুতো। ভাঁওতা দিয়ে পালিয়েছে ওরা।
কিন্তু তোমার পালানো চলবে না। লেমোনেড শেষ করে উঠে দাড়াল বেনন। চলো, আমি তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম, আমিই তোমাকে ফেরত পাঠাচ্ছি। তোমার পনেরো দিন শেষ হওয়ার আগেই সংসারে ফিরতে হবে।
বিকেল বেলা। পড়ন্ত সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ধবধবে সাদা আলকালি ধুলোয় লালচে ছোপ। দ্রুত ছুটছে স্টেজ কোচ। দুলছে অল্প অল্প। যাত্রী মাত্র দু’জন। বেনন আর ব্যাগলে। চুপ করে বাইরে তাকিয়ে আছে ওরা। টেইল হল্ট পিছিয়ে গেছে। সামনে দীর্ঘ যাত্রা। দু’জনেরই মন খারাপ। ব্যাগলেকে ফিরতে হবে ফার্মে। বেনন যাবে আরও দূরে, গভর্নরের কাছে। কি একটা কাজে যেন ওকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন বিপদ আর রোমাঞ্চ ভালবাসে তেমন একজন সাহসী লোক তার দরকার।
Leave a Reply