প্রত্যন্ত বাংলায় গুপ্তবিদ্যা – প্রবোধকুমার ভৌমিক
প্রবোধকুমার ভৌমিক প্রণীত ‘অকালটিজম ইন ফ্রিনজ বেংগল’ এর বঙ্গানুবাদ ‘প্রত্যন্ত বাংলায় গুপ্তবিদ্যা’ / ভাষান্তর- ডঃ দেবব্রত ভট্টাচার্য
PRATYANTA BANGLAY GUPTABIDYA By: Prabodh Kumar Bhowmick M Sc. Ph D. D Sc.
প্রথম প্রকাশ: বইমেলা। জানুয়ারি ১৯৯৪
.
উৎসর্গ
অধ্যাপক নির্মল কুমার বসুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে
.
গ্রন্থ প্রসঙ্গে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী ডক্টর প্রবোধকুমার ভৌমিক প্রণীত বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থের তালিকায় তার “অকালটিজম ইন ফ্রিজ বেংগল” গ্রন্থটিই বোধহয় আকারে সবথেকে ছোট। কিন্তু গুপ্তবিদ্যা-বিষয়ক তথ্যের পরিবেশনার দিক থেকে চিন্তা করে এটিকে স্বচ্ছন্দে মস্ত বড় গ্রন্থ বলা যায়। আর ঠিক এই কারণেই বোধকরি, বহু নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও লোকাচার বিদ্যায় পণ্ডিত ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে এই ছোট্ট গ্রন্থটি। বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের এখানে অকালটিজম-এর ওপর লেখা ইংরেজি গ্রন্থ হিসেবে এটিই প্রথম, আজ থেকে পনেরো বছর আগে প্রকাশিত হয়। অকালটিজম সংক্রান্ত যে-কোন বিষয়ের গবেষণার ক্ষেত্রে গ্রন্থখানি যে খুবই প্রয়োজনীয়, তা বলা বাহুল্য।
এখন, গুপ্তবিদ্যা নামে নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের উল্লেখ করা যায় না। কারণ, এমন অনেক বিষয় আছে যেমন, ডাকিনী বিদ্যা (Witchcraft), মায়াবিদ্যা (sorcery), শাকুনবিদ্যা (augury), সম্মোহনবিদ্যা (hypnotism) ইত্যাদি সবই গুপ্তবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত। এই সব বিদ্যার অধিকাংশ ক্রিয়াকর্ম আচার অনুষ্ঠান কঠিন গোপনীয়তার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে গুপ্তবিদ্যার যাবতীয় চর্চা বা অনুশীলন (occult practices) যে প্রত্যন্ত বাংলার মাটিতেই কেবল সীমাবদ্ধ একথা কেউ যেন ভুলেও না মনে করেন। এ বিদ্যাচর্চার ইতিহাস অতি প্রাচীন। চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের নানা জাতি উপজাতির সমাজ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত হয়ে। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এটা পরিষ্কার যে, গুপ্তবিদ্যার চর্চা কোন আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, নিছক অন্ধবিশ্বাস নয়, আবার পুরোপুরি দুষ্ট বা কুবিদ্যাও নয়; বরং গুপ্তবিদ্যা বা রহস্যবিদ্যার বিভিন্ন আচার বিচার উৎসব অনুষ্ঠান, মন্ত্রতন্ত্র, দেবদেবী, পূজা-পার্বণ বিধিবিধান ইত্যাদি ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতিরই (Socio-cultural) কতকগুলি একান্ত প্রয়োজনীয় ও প্রচলিত দিক। এ প্রসঙ্গে সব থেকে লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, গুপ্তবিদ্যা বিষয়ক যাবতীয় প্রচলিত বিশ্বাস লোকমানসে (Flok-mind) এমনভাবেই প্রোথিত হয়ে এসেছে নানান সংস্কারের মধ্য দিয়ে, যা অপসারণ করা কোন ভাবেই কখন সম্ভব হয়নি। তাই এই অকালট-চৰ্চা ভারতের আদিম মানবগোষ্ঠীর জীবনে বংশ পরম্পরায় চলে এসেছে অটল অনড় এক ঐতিহ্য (a persisting tradition) হিসেবে। প্রাচীনতার ভিত্তি থেকে উদ্ভূত ও ধর্মবিশ্বাস থেকে গড়ে ওঠা বহু বিচিত্র মানসিক ধ্যানধারণাকে সম্বল করেই ভারতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ তাদের এই ঐতিহ্যকে যে সমানে বহন করে এসেছে বা আসছে, তা কোন মানববিজ্ঞানী বা সমাজবিজ্ঞানী অস্বীকার করতে পারেন না।
প্রাচীন এই উপমহাদেশের সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুপ্তবিদ্যা সম্পর্কীয় বহুল প্রচলিত ক্রিয়াকর্মের সত্যতা যে অস্বীকার করা যায় না তা আমাদের বৈদিক যুগ ও তার পরবর্তীকালের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে প্রবেশ করতে পারলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে গ্রন্থকার তার ইংরেজী গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন যে,…
“these practices have a reality at the folk level and it may be traced in the sacred text as well.”
কিন্তু দুঃখের বিষয়, কিছু কিছু ভারতীয় বুদ্ধিজীবী (Indian intellectuals) পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে প্রতিষ্ঠানগত গুপ্তবিদ্যাচর্চার যে কোন রকম গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে, তা তারা চিন্তা করতেও প্রস্তুত নন। তবে তাঁদের কেউ কেউ অকাল্ট বিদ্যার গভীরে যদি একটু দৃষ্টি সঞ্চালন করার প্রয়াসী হন, তাহলে গুপ্তবিদ্যাচর্চার গুরুত্ব কিছুটা হয়ত উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। গ্রন্থকার তাই বলেছেন যে,
“…a close scrutiny of the operations of the institution of allegedly occult practices reflects how different regional, religious and caste-groups interact and coalesce through these occult practices.”
এরপর আমার আর কিছু বলার না থাকলেও একটা কথা না বলেই পারছি না। সেটা হল এই যে, সাধারণ পাঠক-পাঠিকার কাছে এই গ্রন্থটি যাতে সুখপাঠ্য হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য আমি আমার সাধ্যমত সহজ সরল বাংলায় দুরূহ ইংরেজি গ্রন্থটির ভাষান্তরের কাজ করেছি। অবশ্য, বিভিন্ন ইংরেজিতে পরিবেশিত মন্ত্রগুলির সরল বঙ্গানুবাদ করতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। বিচিত্র ভাষা ভাব ও অর্থের সমন্বয়েই যখন এক একটি মন্ত্রের ত্রিবেণী সঙ্গম তখন ঐ সঙ্গমের পবিত্রতা যথাযথভাবে বজায় রাখতে চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। কিন্তু সত্ত্বেও ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে গিয়ে থাকা কিছু বিচিত্র নয়। সহৃদয় পাঠক মাত্রেই এরকম দোষত্রুটি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবেন বলেই আশা রাখি।
গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদ করার ইচ্ছে প্রকাশ করা মাত্র গ্রন্থকার নিঃসংকোচ চিত্তে যেভাবে অনুমতি দেন তাতে তাঁর কাছে আমি একান্তই কৃতজ্ঞ। গ্রন্থাকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মাইতি একাজে আমাকে যথেষ্টই সাহায্য করেছেন, সে জন্যে তার প্রতিও আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। বঙ্গানুবাদের কাজ আরম্ভ করার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমার ভ্রাতৃবধূ সুলেখিকা শ্রীমতী সোমা ভট্টাচার্য যে কি পরিমাণ সাহায্য করেছে তা আর বলার নয়। সুতরাং তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা নয়, রইল অন্তরের আশীর্বাদ। এরই সংগে গ্রন্থকারের লেখা ধর্ম বিশ্বাসের পটভূমিকায় আচার অনুষ্ঠান প্রবন্ধটি বক্তব্য পত্রিকা থেকে পুনর্মুদ্রিত করা হল।
দেবব্রত ভট্টাচার্য
.
প্রাক কথা
ভারতীয় নৃবিজ্ঞান বিশারদ অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতার এক নার্সিংহোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর এই কঠিন ব্যাধি ধরা পড়ার সময় থেকেই তিনি চরম পরিণতির জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন। তবে বড়ই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন কিছু অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার চিন্তায়। কিছুটা অবশ্য এ ব্যাপারে সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু যে গ্রন্থের বিষয়বস্তু তার হৃদয় স্পর্শ করেছিল এবং যার জন্যে তিনি প্রচুর উপাদান সযত্নে সংগ্রহ করেছিলেন, সেই পরিকল্পিত ‘টেমপলস অব ইণ্ডিয়া’ নামক ইংরিজী গ্রন্থটি শেষ করে যেতে পারলেন না।
তিনি যে নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন ছিলেন আমি সেখানে প্রথম দিন গিয়ে দেখি যে, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত একদল গুণীজ্ঞানী ব্যক্তি তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন, নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলছেন। তাঁদের সামনেই তিনি আমার সঙ্গে তার নানান ধ্যানধারণা অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বেশ কিছু সময় আলোচনা করেন। দেখে মনে হল তিনি যেন আমার সঙ্গে আলোচনা করতে পেরে খুবই আনন্দ পেয়েছেন। তবে সেখানে উপস্থিত অভ্যাগতগণ রীতিমত অবাক হয়েছিলেন শেষ শয্যায় শায়িত এই পণ্ডিত প্রবরের জ্ঞানের গভীরতা ও বৌদ্ধিক অবদানের পরিচয়ে। আমি তারপর থেকে ঘন ঘন নার্সিংহোমে গিয়ে তার পাশে বহুসময় বসে থাকতাম এবং তার চিকিৎসক তাঁকে নিদ্রা যেতে না বলা পর্যন্ত আমি উঠতাম না।
এইভাবে আমি আমার পেশাগত বহুরকমের শিক্ষনীয় বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে নিশ্চিন্তে আলোচনা করার অবকাশ পেয়েছি। একটানা দু যুগেরও বেশী সময় ধরে আমি তার সঙ্গে যুক্ত থেকেছি এবং আমার পি. এইচ. ডি ডিগ্রী লাভের ক্ষেত্রে তিনি যে আমাকে তাঁর প্রথম ছাত্র হিসেবে পরিচালনা করেছেন সেজন্যে আমি যথার্থই গর্ব অনুভব করি। অধ্যাপক বসু লৌকিকতা পরিহার করে চলতেন বটে কিন্তু বৌদ্ধিক শৃঙ্খলা ও সততার প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ দৃষ্টি। গবেষণা কাজের নির্দেশক হিসেবে তিনি অতিশয় কঠোর ছিলেন বলে অনেক গবেষক ছাত্রই তাঁর কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে সে যাই হোক, আমার সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক অটুট ছিল এবং আমি সেজন্যে যথেষ্ট পরিমাণে উপকৃতও হয়েছি। আমি সত্যিই চেয়েছিলাম যে, তাঁর মত একজন একাগ্র চিত্ত প্রচারবিমুখ পণ্ডিত ব্যক্তির পতাকাবাহী বৈজয়ন্তিক যেন হয়ে উঠতে পারি।
চণ্ডীগড়ে ১৯৭৩ সনের ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের হীরক জয়ন্তী অধিবেশনে আমাকেই যে নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগে সভাপতি নির্বাচন করা হচ্ছে সে সংবাদ আমি প্রায় বছর খানেক আগেই পেয়েছিলাম। সভাপতির ভাষণে আমি কোন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব তা নিয়েও অধ্যাপক বসুর সঙ্গে গভীর ভাবে আলাপ আলোচনা করেছিলাম। এবং স্থির হয় যে, জাতপাতের কিছু কিছু দিককেই বক্তৃতার বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া উচিত। বহু সমাজবিজ্ঞানী ভারতীয় জাতিপ্রথা নিয়ে অনেক কিছুই লিখেছেন। এ প্রথা সংক্রান্ত নানান বিচিত্রতা, বংশানুক্রমিক ধারা, জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে প্রকাশিত বৈবাহিক সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি ও তার সংশ্লিষ্ট শুদ্ধতা অশুদ্ধতার কল্পিত ধ্যানধারণা ইত্যাদি পরিকল্পনা মাফিক তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন রচনায় যথাসাধ্য উপস্থিতও করেছেন। আর অধ্যাপক বসু দেখিয়েছেন যে, ভারতীয় জাতিপ্রথা হল অনৈক্য ও উৎপীড়নেরই নামান্তর; এবং গোষ্ঠী স্বার্থের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে জাতিপ্রথা আমাদের জাতীয় ও রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সব সময়ই সক্রিয় হয়ে আছে। তিনি এ বিষয়ে জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেন যে।
“Its non-competitive hereditary guilds saturated by status consciousness created the hierarchical system in India.”
তবে এই জাতি প্রথা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অবশ্যই দিয়েছিল; এবং এই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেশের আইন ও প্রচলিত প্রথা বা রীতিনীতি উভয়ে মিলে দান করেছিল।
অধ্যাপক এটা সব সময়ই স্মরণ করতেন যে, ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে এমন কিছু উপাদান আছে যা বিশ্বমানবতার মূল্যায়নে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। সমষ্টির স্বার্থের মধ্যে ব্যষ্টির বিলোপ সাধনই ভারতীয় জাতি প্রথার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। অধ্যাপক বসুর মতে, প্রাচীন ভারতের দুটি জিনিষ যা নাকি আজ অবধি চলে আসছে, তা ভবিষ্যতের পক্ষেও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। প্রথমটি হল, পুজোপাঠের স্বাধীনতা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, একটি মাত্র নিয়ম বা প্রথাকে আশ্রয় করে বিভিন্ন দলীয় মানুষের মধ্যে মৈত্রী বন্ধন আর সে নিয়মটি হল, হিন্দুয়ানি, আর এই নিয়মের রক্ষা কবচ হিসেবে হিন্দুধর্ম যা সৃষ্টি করেছে তা হচ্ছে, সন্ন্যাস। হিন্দুধর্মের সামাজিক গঠন ব্যবস্থায় জাতি প্রথার বন্ধন অতিশয় কঠোর বলে যখনই কারো কাছে বোধ হয়েছে তখনই সে এই বন্ধন ছিন্ন করে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। সামাজিক জীবনের সুখ সুবিধা স্বাচ্ছন্দ একেবারে বিসর্জন দিয়ে যখন কোন ব্যক্তি বৈরাগ্য সাধনায় নিমগ্ন হয় তখন সে আর কোন প্রচলিত প্রথার অধীন থাকে না; বরং সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মহান মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হয়। এই সমস্ত কথা আলোচনার মাঝপথে অধ্যাপক বসু এক টুকরো কাগজে খুব কষ্ট করে আস্তে আস্তে সংস্কৃতে দুটি ছত্র লিখলেন :
তীর্থাশ্রম বনারণ্য গিরি পর্বত সাগর
সরস্বতী ভারতী চৈব পরী নামানি বৈ দশ।।
অর্থাৎ এই দশটি পথ (The ten orders) সন্ন্যাস মার্গ বলে অভিহিত হয়। এই পথের পথিক হয়ে সন্ন্যাসী নিখিল বিশ্বের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করে এবং জাতিপ্রথা সংক্রান্ত যাবতীয় বাধ্যবাধকতা ও লৌকিকতার গণ্ডী উত্তীর্ণ হয়।
অধ্যাপক বসুর সঙ্গে এই সমস্ত আলোচনা করে আমি বহু কিছু নিরীক্ষণ ও উপলব্ধি করার শক্তি সঞ্চয় করেছিলাম। আমার চিন্তায় জাতিপ্রথার প্রকৃতি একদিক দিয়ে যেমন আত্মবিরোধী অথচ সত্য বলে বোধ হয়েছে, অন্য আর একদিকে তেমনি এর প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হয়েছে। লক্ষ্য করেছি যে, জাতি প্রথাকে সক্রিয় ভাবে টিকিয়ে এবং এই প্রথার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন বর্ণের মানুষ বংশানুক্রমিকভাবে বহুরকমের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করেছে, আর সেই সঙ্গে প্রথাগত পবিত্রতা ও অপবিত্রতার সীমানা নির্ধারণ করে দুঃখদায়ক পথ পরিহার করার কলা কৌশলও দেখিয়েছে। আমি আরো একটি জিনিষ বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করি। সেটি হল এই যে, সন্ন্যাস গ্রহণ ছাড়া আরো দু একটি এমন পথ আছে যার মাধ্যমে একজন নিম্নবর্ণের মানুষ উচ্চমর্যাদার অধিকারী হতে পারে। সমাজের এই বাস্তব সত্যের প্রতি অধ্যাপক বসুর দৃষ্টি আমি আকর্ষণ করি। এ ব্যাপারে আমি জনৈক নমশূদ্রের (পশ্চিমবঙ্গে যাকে সব থেকে ছোট জাত খাদাল বা চণ্ডাল বলে কিছু লোক মনে করে) দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখাই যে, ঐ ব্যক্তি গুপ্তবিদ্যা আয়ত্ত করে জাতিপ্রথার ঐতিহ্যগত সমস্ত রকম বাধা নিষেধকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছিল। সাপে কাটা রুগীকে বাঁচানোর নানান ক্রিয়াকর্মে সে ছিল বিশেষ পারদর্শী। এক পাত্র জলে কয়েকটি ফুঁ দিয়ে এবং উচ্চস্বরে বেশ কিছু মন্ত্র পাঠ করে পাত্রের জল মন্ত্রপূত করাই ছিল গুপ্তক্রিয়ার এক বিশেষ পদ্ধতি। আবার এই পদ্ধতিকে খুব শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ করার জন্যে মন্ত্রপূত জলের সঙ্গে সে যে বেশ কিছু পরিমাণ নিজের মুখ থেকে থুতুর মিশেল দিত সে কথা কারোরই অজানা ছিল না। কিন্তু অ সত্বেও উচ্চ বর্ণের বহু মানুষই অতিশয় ভক্তি করে এই জল পান করত বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে। আসল কথা হল, যে-সব লোকেরা গুপ্তবিদ্যার তালিম নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুপ্ত ক্রিয়া প্রক্রিয়ার সার্থক প্রয়োগ করতে পারে বলে নিজেদের জাহির করে, সেই সব লোকেরা ভারতীয় সমাজে বিশিষ্ট স্থান ও বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকে। নিম্ন বর্ণের বহু মানুষকেই ভবিষ্যৎ কথনের চর্চা করতে দেখা যায় এবং এই রকম আরো অনেক কলা-কৌশলের সাহায্যে ভারতীয় গ্রাম্য মানুষের জীবনের বহু সমস্যার সমাধান যে অহরহ হয়ে থাকে তা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। গ্রাম্য সমাজ জীবনের ক্ষেত্রে এটি হল খুবই স্বাভাবিক চিত্র। অবশ্য এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করার আছে। সেটা হল এই যে, যে সমস্ত গুপ্তকার্য প্রণালী বিশেষ কোন রীতিনীতি কঠিন শৃঙ্খলায় বাঁধা নয়, সে-সমস্ত প্রণালী স্থান কাল ও গুপ্তবিদ্যা চর্চাকারী দল হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে বা হয়ে থাকে। কিন্তু গুপ্তবিদ্যা সংক্রান্ত কিছু কিছু নিয়ম কানুন, আচার বিচার ইত্যাদির ক্ষেত্র এতই জটিল যে এগুলিকে আয়ত্ত করতে হলে বিশেষ রকমের ক্ষমতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। তবে যে কোন গুপ্তক্রিয়া কুশলীই হোক না কেন, সে সব সময়ই নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে প্রতিপন্ন করতে চায়, বিপদগ্রস্ত বা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কাছে। এই সব মানুষই গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীর অলৌকিকতায় অবিচল আস্থা স্থাপন করে এবং তারা দৃঢ় চিত্তে বিশ্বাস করে যে, অদৃশ্য দুষ্ট শক্তির দেওয়া যে কোন রকমের দুর্যোগ, দুর্বিপাক, জ্বালা যন্ত্রণার হাত থেকে একমাত্র গুপ্তক্রিয়া কুশলীই বাঁচাতে পারে। গুপ্তবিদ্যা সংক্রান্ত এই সমস্ত কথা শুনে অধ্যাপক বসু অত্যন্ত খুশী হন। অনেক প্রশংসা করেন পরে এ ব্যাপারে গভীর অনুসন্ধান চালিয়ে যাবার কাজে আরো বেশী করে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন।
আমি তাই সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বীকার করি যে, এই গ্রন্থটি রচনার সূত্রপাত আমার পরম পূজনীয় শিক্ষাগুরুর সঙ্গে তার অন্তিম শয্যার মাত্র কয়েক মাসের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই হয়েছে।
আমি এখানে চেষ্টা করেছি সামাজিক কার্যকারিতার দিক থেকে নির্দিষ্ট এই বিষয়ের অম্ভর্ভুক্ত নিম্নলিখিত বিশেষ বিশেষ দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করার–
১) অতীত কাল থেকে গুপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলি বংশানুক্রমিক ভাবে কি করে সমানে চলে আসছে।
২) উচ্চবর্ণের মানুষ গুপ্তবিদ্যাচর্চায় অনীহা প্রকাশ করে কি করে না।
৩) এটা লক্ষ্য করা যায় যে, বিভিন্ন অঞ্চলের অনুন্নত সম্প্রদায় ও সংস্কৃতি ভুক্ত কিছু কিছু মানুষ গুপ্তবিদ্যাচর্চায় আসক্ত হয় সমাজে বিশেষ মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা পাবার আকাঙ্খায়।
৪) গুপ্ত প্রতিষ্ঠানে যোগদান করা কোন কোন জাতির ব্যক্তি বিশেষের কাছে সময় সময় খুবই সম্মানজনক কাজ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
৫) ওপরে যে সমস্ত বিষয় বস্তুর উল্লেখ করা হল সে সমস্ত খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের এমন একটি ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পৌঁছে দেয় যা নাকি, তার অদ্ভুত সৃজনীশক্তি ও সামর্থের বলে অন্যান্য সংস্কৃতির নানান অস্বাভাবিক উপাদান নিজের মধ্যে খুব সহজেই মিশিয়ে নিয়েছিল। তার ফলে, এমনি এক আকর্ষণীয় ও কৌতূহলের ক্ষেত্র আমাদের সামনে প্রস্তুত হয়ে যায়, যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা অনায়াসেই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে অন্তত এটা বোঝার অবকাশ পাই যে, কেমন করে, কি রকম অবস্থা বা পরিস্থিতি ও পটভূমিতে নানা ধরণের আঞ্চলিক সংস্কৃতির সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। আরো একটি আকর্ষণীয় বিষয় হল এই যে, অনেক সময়ই গুপ্ত সংস্থার সভ্যরা হয় সমস্ত রকম ধর্মীয় বাধানিষেধের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, নাহয় তো প্রচলিত ধর্মমতকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছে। এবং এরই জন্যে যে সাধারণ ঘনিষ্ঠতা ও আদানপ্রদান সম্ভব হয়েছিল তা আমরা স্পষ্টই জানতে পারি। এ ছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর ধর্মীয় মিথস্ক্রিয়া যে কিভাবে সম্ভব হয়েছিল তার ব্যাখ্যাও আমাদের কাছে খুব একটা অস্পষ্ট থাকে
৬) আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যে, এই সমস্ত গুপ্ত প্রতিষ্ঠান ও এগুলির সংশ্লিষ্ট নানান বিশ্বাস যেমন একদিক দিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্য ও অপ্রাধান্যের পরিচয় বহন করে অন্যদিকে তেমনি বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, প্রথা, উপপ্রথা ইত্যাদির বিভিন্নতাও আমাদের সামনে তুলে ধরে।
৭) আরো লক্ষ্য করা যায় যে, গুপ্ত প্রতিষ্ঠান ও গুপ্তবিদ্যাচর্চা ওতঃপ্রোত, ভাবে জড়িত হওয়ায় এর একদিকে রয়েছে একটি ধর্মীয় চরিত্র, আর এক দিকে ধর্মাতীত এক বৈশিষ্ট্যের অভিব্যক্তি। তবে লক্ষ্যনীয় যে, সমস্ত গুপ্ত প্রতিষ্ঠান গুলির কাজ হলো, সহজ সরল গ্রাম্য লোকের মনে বিভিন্ন ভাবে নানাবিধ রহস্যের উদ্রেক করা, যাতে নাকি সরল বিশ্বাসী মানুষরা রহস্যবিদ্যা চর্চাকারীদের রহস্যজনক ক্রিয়াকৌশলের সত্যতা নির্বিচারে স্বীকার করে এবং নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে গুপ্তচর্চাকারীদের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়।
গুপ্ত সমিতিগুলির অতিশয় গোপন ও রহস্যময় কার্যপ্রণালীর প্রকৃতি পরিচয় পাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি মেদিনীপুর জেলায় নানান অঞ্চলের বহু যাদুকর অর্থাৎ যারা নাকি স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে গুণিন নামে খ্যাত তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত হয়ে যে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করি, সে সমস্তই এই গ্রন্থের বিভিন্ন পর্যায়ে উপস্থিত করেছি।
প্রবোধকুমার ভৌমিক
৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৮
বিদিশা মেদিনীপুর
Leave a Reply