প্রতিবেশিনী – কাসেম বিন আবুবাকার
০১.
হামিদ সাহেব কক্সবাজার জেলার কৃতী সন্তান। তিনি আমেরিকায় সেটেল্ড। সেখানকার বিরাট ব্যবসায়ী। তারা দুভাই এক বোন। বোনের বিয়ে হয়েছে চকরিয়ায় এক ধনাঢ্য পরিবারে। বড় ভাই দেশে থাকেন। হামিদ সাহেব দুএক বছর অন্তর দেশে এসে বেড়িয়ে যান। অনেক বছর আমেরিকায় বসবাস করলেও নিজে যেমন ধর্মের আইন-কানুন মেনে চলেন, তেমনি পরিবারের সবাইকে ধর্মীয় অনুকরণে পরিচালনা করেন। এবারে মা-বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে স্বপরিবারে দেশে আসেন। তাদের রুহের মাগফেরাতের জন্য পঞ্চাশ বেডের একটা দাঁতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠান করেন। মা বাবার নামে হাসপাতালের নাম দিয়েছেন, রহিম আফরোজা দাঁতব্য হাসপাতাল। এখানে সব শ্রেণীর মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়। হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর ধার্মীক ও চরিত্রবান ডাক্তার, নার্স ও অফিস স্টাফ নিয়োগ করার জন্য কাগজে বিজ্ঞপ্তী দেন। তাদের ইন্টারভিউ নিজে নিয়েছেন। সমুদ্র সৈকতের প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর পূর্ব দিকে বিশ একর জমির উপর এই হাসপাতাল। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য যেমন অতি মনোরম, তেমনি রাতের সমুদ্রের গর্জন মনকে উতলা করে তোলে। পুরো হাসপাতাল পাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এর মধ্যেই ডাক্তার নার্স ও অফিস স্টাফদের থাকার কোয়ার্টার। এটার দুটো গেট। একটা পূর্ব দিকে। আর অন্যটা পশ্চিম দিকে। পূর্ব দিকের গেটের রাস্তা শহরের রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। পশ্চিম গেটের রাস্তা সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত গিয়েছে।
ডাক্তার মাহবুবা এখানকার সুপারিন্টেন্ডেন্ট। তার উপরেই পুরো হাসপাতালের দায়িত্ব। তিনি একজন ধার্মীক পর্দানশীল মহিলা। হাতে পায়ে মোজা ও বোরখা পরে ডিউটি করেন।
বেলা তখন দুটো। ডাঃ মাহবুবা যোহরের নামায পড়ে খেয়ে উঠে সবেমাত্র অফিসে এসে বসেছেন, এমন সময় নার্স ইয়াসমীন হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ম্যাডাম, একটা মুমূর্ষ রুগীকে নিয়ে একজন এসেছেন। কোনো ডাক্তার এখনো লাঞ্চ থেকে ফেরেন নি। আপনি যদি—–।
ডাঃ মাহবুবা তাকে কথাটা শেষ করতে দিলেন না। স্টেথিস্কোপটা গলায় ঝুলিয়ে বললেন, চলুন।
বেডের কাছে এসে ডাঃ মাহবুবা রুগী দেখে চমকে উঠে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। টোপরের কঙ্কালসার শরীরের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না।
টোপর তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
ইয়াসমীন ডাঃ মাহবুবার পরিবর্তন দেখে বেশ অবাক হয়ে বলল, ম্যাডাম, রুগীর অবস্থা খুব সঙ্গিন। দেখছেন না, কি রকম ছটফট করছেন?
ডাঃ মাহবুবা নার্সের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে টোপরকে পরীক্ষা করে চার্টে ব্যবস্থাপত্র লিখলেন। তারপর ঘুমের ইঞ্জেকসান দেওয়ার সময় বললেন, ইনাকে কেবিনে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
ইঞ্জেকসান দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে টোপর নিথর হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ডাঃ মাহবুবা নিজের রুমে ফিরে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে আগের জীবনের স্মৃতিচারণে ডুবে গেলেন।
টোপর এস.এস.সি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে পাঁচটা লেটার নিয়ে ষ্টার মার্ক পেয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হল। অল্প দিনের মধ্যে ভালো ছাত্র হিসাবে তার সুনাম সারা কলেজে ছড়িয়ে পড়ল। কলেজ ইলেকশনের সময় এক পার্টির নেতা সাগর তাকে কৌশলে পার্টির মধ্যে টেনে নিল। টোপর প্রথমে খুব আপত্তি করে বলেছিল, পার্টি করলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। সাগর তাকে কথা দিয়েছিল, পার্টির কাজ করতে গিয়ে তোমার যাতে পড়াশোনার ক্ষতি না হয়, সে দায়িত্ব আমি নিলাম। এরপর টোপর আর আপত্তি করতে পারেনি। অবশ্য সাগর তার কথা রেখেছে। তাই তার সঙ্গে টোপরের বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
টোপর এইচ.এস.সি.তেও পাঁচটি লেটার সহ স্টার মার্ক পেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে বি.এস.সি. অনার্সে এ্যাডমিশন নিল। সাগরও পাশ করে ঢাকা ভার্সিটিতে বাংলায় অর্নাস নিয়ে এ্যাডমিশন নিল। ভার্সিটিতেও সাগর টাকার জোরে পার্টির নেতা হল। টোপর পার্টিকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও সাগর তাকে ছাড়ল না।
সাগর খুব বড় লোকের একমাত্র ছেলে। তাদের দুটো গাড়ি। একটা তার, অন্যটা তার বাবার। পার্টির পিছনে প্রচুর টাকা খরচ করে। কলেজের বড় লোকের মেয়েদের অনেকে এবং উঁচু সোসাইটির আত্মীয় অনাত্মীয় অনেক মেয়ে তার গার্লফ্রেন্ড। তাদের পিছনে ও বন্ধুদের পিছনে পানির মতো টাকা খরচ করে। টোপরের সঙ্গে সাগরের একটু বেশি অন্তরঙ্গতা। তাই সাগর তাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে মা বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে টোপর সময় অসময়ে তাদের বাসায় যায়। টোপরের সঙ্গে টিকলীর সম্পর্ক এবং তাদের দুই ফ্যামিলীর মনোমালিন্যের কথাও সাগর জানে। আর টোপর ও সাগরের অনেক কিছু জানে। তার যে দুতিন জন বান্ধবীদের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক আছে তাও জানে।
একদিন কথায় কথায় সাগর টোপরকে জিজ্ঞেস করল, তোর প্রেমিকার সঙ্গে তোর দৈহিক সম্পর্ক আছে?
টোপর বলল, না।
সে কিরে, যাকে এত বছর ধরে ভালবাসিস, তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক হয় নি, কথাটা কি সত্যি বললি?
হ্যাঁ সাগর সত্যি। আমাদের দুজনের দৈহিক সম্পর্ক করার কথা কখনো মনে হয় নি।
আরে তুই নপুংসক না কি? মেয়েরা এ ব্যাপারে অগ্রভূমিকা নেয় না। পুরুষদের নিতে হয়। টিকলীকে তুই কখনো জড়িয়ে ধরে চুমোও খাসনি?
না।
কেন, খেতে ইচ্ছা করে না?
করে, তবে টিকলী আমাকে খারাপ ভাবতে পারে মনে করে সংযত থাকি।
আরে বোকা, সে তোকে খারাপ ভাববে কেন? বরং খুশিই হবে। তুই কি জানিস, একটা যুবক তার প্রেমিকার কাছে যা চায়, একজন যুবতীও তার প্রেমিকের কাছে তাই চায়? আমার কথা সত্য না মিথ্যা যাচাই করে দেখ। একদিন তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খা, দেখবি সেও প্রতিদানে মেতে উঠবে।
টিকলী খুব ধার্মীক, হিতে বিপরীত হতে পারে।
আরে রাখ তোর ধার্মীক। এই বয়সে কে কতটা ধার্মীক তা আমার জানা আছে। যা বললাম, তা যদি করতে পারিস, তা হলে দেখবি অল্পদিনের মধ্যে তোদের দৈহিক সম্পর্কও গড়ে উঠবে। আর তা যদি না পারিস, তা হলে বুঝবো সত্যি সত্যি নপুংসক।
টোপর উঠতি বয়সের যুবক। তার উপর ধর্মের জ্ঞান নেই। সিনেমা ও ভি.সি.আর দেখে নায়ক নায়িকাদের মতো তারও টিকলীকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সাহসে কুলায় না। আজ সাগরের মুখে নাপুসংক কথাটা শুনে পৌরুষে আঘাত লাগল, নিজেকে অপমানিত বোধ করল। ভাবল, কাল ওকে কোনো পার্কে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমো খাবে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সাগর বলল, কিরে, কিছু বলছিস না কেন? তা হলে সত্যিই কি তুই নপুংসক।
টোপর রেগে উঠে বলল, দেখ, বারবার নপুংসক বলবি না।
সাগর হেসে উঠে বলল, তা যদি না হস, তা হলে কাজ করে দেখা।
নিশ্চয় দেখাব, বলে টোপর রাগে ফুলতে ফুলতে সেখান থেকে চলে যেতে লাগল।
সাগর হাসতে হাসতেই বলল, এই টোপর দাঁড়া যাসনি, আরো কথা আছে।
টোপর কিন্তু দাঁড়াল না।
যেখানে প্রতিদিন টিকলীর সঙ্গে দেখা করে, কলেজ ছুটির পরে টোপর আজ সেখানে যাচ্ছিল। পথে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন?
টিকলী বলল, আজ মা কলেজে আসতে নিষেধ করেছিল। রাজশাহী থেকে খালা, খালু ও খালাত ভাই কাল এসেছেন। খালাত ভাই আমেরিকায় থাকেন। আজ চলে যাবেন। তাকে সি-অফ করতে এয়ারপোর্টে যেতে বলেছিল। আজ আমাদের কলেজে বিজ্ঞানের উপর সেমিনার ছিল। সে কথা জানিয়ে বললাম, আমাকে কলেজে যেতেই হবে। মা বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি ফিরিস। তাই তোকে কথাটা জানাব বলে এখানে অপেক্ষা করছিলাম।
তুই এখন বাসায় গিয়ে এয়ারপোর্টে যাবি?
এগারটায় প্লেন ফ্লাই করার কথা, এতক্ষণে সবাই বাসায় চলে এসেছে।
তা হলে এখন বাসায় গিয়ে কাজ নেই, চল আজ কোনো পার্কে বেড়াতে যাই।
আমি যে মাকে কথা দিয়ে এসেছি তাড়াতাড়ি ফিরব।
তাতে কি হয়েছে, বলবি সেমিনার শেষ হতে দেরি হয়েছে।
আমি কখনো মিথ্যা বলি না।
আজ আমার জন্য না হয় বলবি।
টিকলী জানে টোপরের কথা না রাখলে রেগে গিয়ে পনের দিক দেখা করবে না। এরকম ছোট বেলা থেকে অনেক বার ঘটেছে। একটু চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে চল।
টোপর বলল, খিদে পেয়েছে, আগে কোনো হোটেলে খেয়ে তারপর পার্কে যাব।
হোটেলে খেয়ে ওরা রমনা পার্কে এসে ঝোঁপের আড়ালে একটা পাকা বেঞ্চে বসল।
বসার পর টোপর অনেক্ষণ টিকলীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
টিকলী বোরখা ব্যবহার করে। রাস্তায় চলা ফেরা করার সময় চোখ দুটো ছাড়া নেকাব দিয়ে মুখ পেঁচিয়ে ঢেকে রাখে। তবে টোপরের সঙ্গে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সম্পূর্ণ মুখ খোলা রাখে। তাকে অনেকক্ষণ মুখের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে বলল, চুপচাপ কি দেখছিস?
তোকে।
এত দেখছিস তবু সাধ মেটেনি?
না, তোকে যত দেখি তত দেখতে ইচ্ছা করে।
টিকলী লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বলল, আমারও।
তা হলে বোঝা যাচ্ছে আমরা দুজন দুজনকে ভীষণ ভালবাসি, তাই না?
শুধু ভালবাসি বললে ভুল হবে, আমরা দুজন দুজনের জন্য উৎসর্গকৃত।
তুই ঠিক কথা বলেছিস। সেই ভালবাসার দাবিতে আজ তোর কাছে কিছু চাইব, দিবি তো?
অফকোর্স। তোকে অদেয় আমার কিছু নেই। তবে এমন কিছু চাইবি না, যা ইসলামের পরিপন্থি।
ইসলামের পরিপন্থি হবে কিনা জানি না, তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনো লোকজন নেই দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে গেল।
টিকলী কল্পনাও করেনি, টোপর এই কাজ করবে। তাড়াতাড়ি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বেশ রাগের সঙ্গে বলল, এ-তুই কি করলি? এত বড় গোনাহর কাজ করতে পারলি! পবিত্র ভালবাসার মধ্যে পাপ ঢুকিয়ে দিলি। তুই জানিস না, বিয়ের আগে এসব করা জঘন্যতর অন্যায়? তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
তার কান্না দেখে ও কথা শুনে টোপর খুব অবাক হয়ে বলল, এটা আর এমন কি অন্যায়, আমি বুঝতে পারছি না। এত কাঁদছিস বা কেন? বিয়ে না হলেও তুই তো এক্ষুণী বললি, আমরা দুজন দুজনের জন্য উৎসর্গকৃত।
টিকলী কান্না থামিয়ে চোখ মুখ মুছতে মুছতে বলল, তুই তো ধর্মীয় বই পুস্তক একদম পড়িসনি, পড়লে জানতে পারতিস, এটা কত বড় অন্যায়।
টোপর বলল, আমার বন্ধু সাগর তার গার্লফ্রেন্ডদেরকে এভাবে কত আদর করে। কই তারা তো তোর মতো কান্নাকাটি করে না। বরং তারাও সাগরকে আদরের প্রতিদান দেয়।
টিকলী বুঝতে পারল, বন্ধুর পাল্লায় পড়ে টোপর আজ এই রকম করেছে। বলল, তোর বন্ধু ও তার গার্লফ্রেন্ডরা ধর্মের কিছু যেমন জানে না, তেমনি মানে না। তারা যে সমাজের, সে সমাজে ধর্ম নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। প্রথম বার বলে মাফ করে দিলাম। ভবিষ্যতে বিয়ের আগে এরকম আর কখনো করবি না। আর শোন, ঐ বন্ধুর সঙ্গে একদম মেলামেশা করবি না। কথা দে, যা যা বললাম, করবি?
কিন্তু তোকে আদর করতে আমার যে খুব ইচ্ছা করে। তোর করে না?
হ্যাঁ করে। তাই বলে যা গোনাহ, তা করা কারো উচিত নয়। তোকে কতবার বলেছি, অবসর সময়ে কিছু কিছু ধর্মীয় বই পড়বি, তুই আমার কথা শুনলে এরকম করতে পারতিস না।
টোপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বিয়ের আগে যদি ধর্মে এসব নিষেধ থাকে, তবে কালই কাজী অফিস গিয়ে বিয়ে করে ফেলি চল।
টিকলী কান্না মুখে হেসে ফেলে বলল, বিয়ে কি দোকানের সদাই, মনে কইল আর কিনে ফেললাম।
দেখ টিকলী কথা ঘোরাবিনা। যা বললাম রাজি আছিস কিনা বল!
টিকলী থমথমে গলায় বলল, রাজি হব কিনা তুই জানিস না? জিজ্ঞেস করছিস কেন?
তা হলে শোন, কাল বেলা এগারটার সময় শান্তিনগরের মোড়ে থাকবি। আমি এসে কাজি অফিসে নিয়ে যাব।
এর পরিণতির কথা ভেবেছিস?
পরিণতির কথা ভেবে আমি কোনো কাজ করিনি।
শিক্ষিত ছেলে হয়ে এরকম কথা বলতে পারলি?
দেখ, আমাকে, রাগাবি না বলছি। যা বললাম, তা করবি কিনা বল।
টিকলী টোপরকে রেগে যেতে দেখে হা না কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
কিরে কিছু বলছিস না যে? তা হলে কি ভাববো, তুই আমাকে শুধু মুখেই ভালবাসিস।
টিকলী চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, এ কথা বলতে পারলি?
তা না হলে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিস না কেন?
অরাজির কথা কখন বললাম, আমি তো পরিণতির কথা চিন্তা করতে বলেছি।
পরিণতির যা হয় হবে, কালই কাজি অফিসে আমাদের বিয়ে হবে। আমার বন্ধুরা প্রেমিকাদের কত আদর করে। আমি এমনই হতভাগা, তোকে একটু আদরও করতে পারি না। বিয়ের পর তো আর কোনো বাধা থাকবে না। তখন তোকে ইচ্ছামত আদর করব। তুইও আমাকে আদর করবি। বল, কাল এগারটার সময় আসবি?
টিকলী বুঝতে পারল, বন্ধুদের সাথে মিশে টোপর নষ্ট হওয়ার পথে এগোচ্ছে। বিয়ে করলে শুধু আদর নয় আরো কিছু করতে চাইবে। বলল, তুই তা হলে শুধু আদর করার জন্য বিয়ে করতে চাচ্ছিস, ভালবেসে নয়?
ভালবাসি কিনা জানিস না?
জানি; কিন্তু সে ভালবাসা তো আদর করার জন্য বিয়ে করে না।
কি করে তা হলে?
ভালবাসা হল পবিত্র জিনিস, তা পাওয়ার জন্য ধৈর্য্য ধরতে হয়, উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এখনো আমাদের সেই সময় আসেনি। তুই পড়াশোনা শেষ করে উপার্জন কর। আমিও ততদিন পড়াশোনা শেষ করি। তারপর বিয়ে। বিয়ের পর দুজন ভালবাসার সাগরে হাবুডুবু খাব।
টোপর রেগে উঠে বলল, তুই কিন্তু ভালবাসার দর্শন আওড়াচ্ছিস। দর্শন আমি বুঝি না। বুঝতে চাইও না। তুই কাল কাজি অফিসে বিয়ে করতে রাজি আছিস কিনা স্পষ্ট করে বল।
টিকলী মিনতি স্বরে বলল, তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? যে কোনো কাজ করার আগে ভেবে চিন্তে করতে হয়। আমাদের এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। ভালোমন্দ বিবেচনা করার জ্ঞানও তেমন হয় নি। তুই বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা ছেড়ে দে। পার্টিও ছেড়ে দে। ধর্মীয় বইপত্র পড়। দেখবি, যা করতে চাচ্ছিস, তা ঠিক নয়।
টোপর আরো রেগে গিয়ে বলল, তোর ধর্মের বুলি শোনার মত মন মানসিকতা আমার নেই। আমার কথার উত্তর দে।
তুই বার বার একই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন? এখন আমাদের পড়াশোনা করার সময়। বিয়ে করলে তা হবে না। শুধু আমি কেন, এই পরিস্থিতিতে কোনো মেয়েই বিয়ে করতে চাইবে না। তোকে আমি নিজের থেকে বেশি ভালবাসি। তোর সর্বনাশ আমি করতে পারি না। তুই আমার কথাগুলো ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখ।
থাক, তোকে আর উপদেশ দিতে হবে না, আজ থেকে তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ। কথা শেষ করে টোপর হন হন করে পার্কের গেটের দিকে হাঁটতে লাগল।
টিকলী তার পিছনে আসতে আসতে বলল, টোপর রাগ করে চলে যাসনি। আমার ভালবাসার কসম লাগে, দাঁড়া বলছি।
টোপর দাঁড়াল না। রাগে ফুলতে ফুলতে গেটের বাইরে এসে একটা রিকশায় উঠে চলে গেল।
টিকলী দ্রুত হেঁটে এসেও তাকে ধরতে পারল না। কিছুক্ষণ তার রিকশার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলল। তারপর সেও একটা রিকশায় উঠে বাসার ঠিকানা বলল।
এরপর প্রায় পনের দিন টোপর টিকলীর সঙ্গে দেখা করল না। একদিন নিউমার্কেট থেকে একটা বই কিনে গেটের কাছে এসেছে এমন সময় টিকলীকে হকারের কাছে চুলের ক্লীপ কিনতে দেখে পাশ কেটে চলে যাচ্ছিল।
টিকলী দেখতে পেয়ে ক্লীপ না কিনে তাড়াতাড়ি তার পিছনে আসতে আসতে বলল, টোপর, এই টোপর, দাঁড়া বলছি।
টোপর গেটের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
টিকলী কাছে এসে ভিজে গলায় বলল, আজ পনের দিন আমার সঙ্গে দেখা করিসনি। এখন আবার দেখেও চলে যাচ্ছিস।
কেন যাচ্ছি জেনেও জিজ্ঞেস করছিস কেন? কথা শেষ করে টোপর গাড়ির দিকে এগোল।
টিকলীও তার সঙ্গে গাড়ির কাছে এসে বলল, তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
টোপর গাড়িতে উঠবে বলে গেট খুলেছিল, বন্ধ করে বলল, বল কি বলবি।
তুই তা হলে এখনো আমার উপর খুব রেগে আছিস?
আর কিছু বলবি?
টিকলী ছল ছল চোখে ভিজে গলায় বলল, আমার কথাগুলো চিন্তা করলে এতদিনে তোর রাগ পড়ে যেত। বিশ্বাস কর, তোর ভালোর জন্য আমি বিয়েতে রাজি হইনি। আমার জন্য তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাক, তা আমি চাই না। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। কোনো জিনিসই গোপন থাকে না। একদিন না একদিন তোর আর আমার মা-বাবা জানতে পারবেই। তখন কি হবে ভেবে দেখ। তা ছাড়া আমি মেয়ে আর তুই পুরুষ। পুরুষরা যা পারে মেয়েরা কি তা পারে?
কেন পারবে না? আজ কাল তো নারী পুরুষের সমান অধিকার। নারীরা আগের যুগের মতো ঘরে থাকে না। এখন তাদের বিচরণ সর্বত্র।
কিছু কিছু বিষয়ে সমান অধিকার পেলেও সব বিষয়ে এখনো পাইনি। যেমন ছেলেরা একাকি দূরে কোথাও যেতে পারলেও মেয়েরা পারে না। ছেলেরা লুঙ্গি, ফুল প্যান্ট বা হাফ প্যান্টের উপর স্যান্ডো গেঞ্জী পরে অথবা খালি গায়ে চলাফেরা করতে পারে; কিন্তু মেয়েরা তা পারে না।
কে বলেছে পারে না। বিদেশের সি-সোরে মেয়েরা দ্বিগম্বরী হয়ে সূর্য স্নান করছে। অলিম্পিক গেমসে মেয়েরা কি পোষাক পরে দেখিস নি? আসলে তুই আমাকে মনে প্রাণে ভালবাসিস না।
এরকম কথা বলতে পারলি? জানিস তোর জন্য আমি জান দিতে পারি?
টোপর বিদ্রূপ কণ্ঠে বলল, যে একটু আদর করতে দেয় না, যে বিয়েও করতে চায়, সে নাকি জান দেবে।
টিকলী বিদ্রূপটা গায়ে মাখল না। বলল, এ দুটো জিনিস ছাড়া তুই যা প্রমাণ চাইবি তাই দেব। দুবছর আগের কথা মনে করে দেখ, যখন আমাদের মা-বাবা আমাদেরকে মেলামেশা করতে নিষেধ করেছিল তখন আমরা কি বলেছিলাম। এখন যদি গোপনে বিয়ে করি, তা হলে একদিকে যেমন আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে, তেমনি দুই ফ্যামিলীর মধ্যে রক্তারক্তি হবে, মামলা হবে। তুই তো এরকম ছিলি না টোপর। বন্ধুরাই তোকে এরকম করেছে। ওদের সাথে মেলামেশা ছেড়ে দে টোপর, ছেড়ে দে। কথা শেষ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
টোপর বলল, থাক তোকে আর প্রমাণ দিতে হবে না, আর লেকচারও দিতে হবে না। তুই আর কোনো দিন আমার সামনে আসবি না। আমিও তোর কাছে আসব না, তারপর গাড়িতে উঠে ষ্টার্ট দিল।
টিকলী চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। অদৃশ্য হয়ে যেতে চোখ মুখ মুছে নিজের গাড়ির দিকে এগোল।
.
০২.
টিকলী আর টোপরের বাড়ি সিদ্ধেশরী রোডে। একজনের বাড়ি থেকে অন্য জনের বাড়ির দূরত্ব এক মিনিটের পথ। দুই বাড়ির মধ্যে ছুরি-কাটারী সম্পর্ক থাকলেও ওরা দুজনে ছোটবেলা থেকে এক সাথে খেলাধুলা করে মানুষ হয়েছে। টোপরের বাবা কাহহার সাহেব ব্যবসায়ী। ভীষণ হিংসুটি, কৃপণ ও শক্ত দিলের মানুষ। দেশের বাড়ি মনোহরদি। প্রথম স্ত্রী চার বছরের একটা ছেলে রেখে মারা যাওয়ার পর শাফিয়া বেগমকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে এক ছেলে ও এক মেয়ে হয়েছে। কাহহার সাহেবের আগের স্ত্রীর গর্ভে যে ছেলে, সেই টোপর। তার ভালো নাম হাসান। স্বামীর স্বভাব চরিত্র শাফিয়া বেগমকে কষ্ট দিলেও টোপরকে পেয়ে সেসব ভুলে থাকেন। নিজের পেটের ছেলে-মেয়ের চেয়ে তাকে বেশি আদর যত্ন করেন। ছেলে মেয়ে দুটির নাম শাহিন ও নিশাত। শাহিন নাইনে ও নিশাত সিক্সে পড়ে।
টিকলীর আসল নাম আজরা মাহবুবা। ওরা চার ভাই দুই বোন। বড় তিন ভাই ও এক বোন শিশুকালে মারা গেছে। টিকলী আর তার দুবছরের বড় ভাই আলী বেঁচে আছে। টিকলী সিদ্বেশরী মহিলা কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। আর আলী ঢাকা ভার্সিটিতে ম্যানেজমেন্টে অনার্স করছে। এ বছর পার্ট-টু পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের বাবা হালিম সাহেব মিষ্ট্ৰিী অফ হেলথে আছেন। খুব এক রোখা লোক। তবে অত্যন্ত সৎ ও আদর্শবান। প্রথম দিকের তিন ছেলে ও এক মেয়ে মারা যাওয়ায় শেষের দুছেলে মেয়েকে একটু বেশি আদর করলেও নিজের মত সৎ ও আদর্শবান করে গড়েছেন।
হালিম সাহেবের সিদ্বেশরী রোডে দুটো বাড়ি। যে বাড়িতে থাকেন, সেটা অনেক আগে করেছেন। আর যে বাড়িটা ভাড়া দিয়েছেন, সেটার পাশে কাহহার সাহেবের আগে জায়গা কিনলেও বাড়ি করেছেন পরে। কাহহার সাহেব ফ্যামিলী নিয়ে মধুবাগে থাকতেন। একই দাগ ও খতিয়ানের জমি কেনার সময় বেশ কয়েকবার হালিম সাহেবের বাসায় এসে পরামর্শ করেছেন। কাগজ পত্র দেখেছেন। যে সময় হালিম সাহেব আদর আপ্যায়ণ করিয়েছেন। গন্ডগোল বাধল কাহহার সাহেব যখন মাত্র দুফুট ছাড় দিয়ে চার তলার ফাউন্ডেশন দিলেন। তাও আবার দুফুটের মধ্যে হালিম সাহেবের দশ ইঞ্চি জায়গা। হালিম সাহেব আমিন এনে জায়গা মাপাতে গিয়ে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে বেশ ঝগড়া হয়। শেষে মহল্লার লোকজন মিমাংসা করে দেন। কাহহার সাহেব হালিম সাহেবের বাড়ীর দিকে ঘরের জানালা দিলেও পাল্লা ভিতরে দেবেন এবং কোনো সানসেড দিতে পারবেন না। কিন্তু কাহহার সাহেব তখন সবার কথা মেনে নিলেও বাড়ি করার সময় মানেন নি। জানালার পাল্লা বাইরেই দিয়েছেন এবং সানসেডও দিয়েছেন। তখন আর একবার ওঁদের ঝগড়া হয়। মহল্লার অনেকে হালিম সাহেবকে বলেছেন, আপনি ডি.আই.টি.তে অবজেকসান দেন। হালিম সাহেব দেওয়ার মনস্থ করলেও শেষ পর্যন্ত দেননি। ভেবেছিলেন, চিরকাল যখন প্রতিবেশী হয়ে বাস করব তখন আর অবজেকসান দিয়ে কি হবে? বাড়ি থেকে বেরোলেই একে অপরের সঙ্গে দেখা হবে। অবজেকসান দিলে হয়তো ওঁর বাড়ি করাই। বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সাত পাঁচ ভেবে দেননি। কিন্তু কাহহার সাহেবের আচার ব্যবহারে কৃতজ্ঞতার লেশ মাত্র নেই। যখন তখন সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি করেন। কয়েকবার একই রকম ঘটনা ঘটার ফলে তার উপর হালিম সাহেবের মন বিষিয়ে গেছে। তাই আজ এত বছর পর্যন্ত প্রতিবেশী হিসাবে বাস করলেও দুই ফ্যামিলীর ঠান্ডা লড়াইয়ের মধ্যে দিন কাটছিল। হঠাৎ সেই মনোমালিন্য আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল টিকলি আর টোপরকে নিয়ে। ছোট বেলায় যখন তারা একসঙ্গে স্কুলে যেত ও খেলাধুলা করত তখন দুজনের মা-বাবা ছেলে মেয়েকে প্রথমে বোঝাতেন। কাজ না হতে পরে মারধর করতেন। কিন্তু টিকলী বা টোপর কোনো শাসনই মানত না। একটু বড় হয়ে তারা মা-বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মেলামেশা করত। তারপর যখন কলেজে ভর্তি হল তখন আর তারা গার্জেনদের পরওয়া না করে প্রকাশ্যে মেলামেশা করতে লাগল। ব্যাপারটা তাদের গার্জেনরা সহ্য করতে পারলেন না। ছেলে মেয়েকে যথেষ্ট রাগারাগি ও তিরস্কার করলেন। টিকলী বা টোপর সে সব গ্রাহ্য না করে যে যার মা-বাবাকে জানাল, আমরা ছোটবেলা থেকে দুজন দুজনকে ভালবাসি এবং সময় মতো বিয়েও করব। এই নিয়ে দুই ফ্যামিলীর মধ্যে মনোমালিন্য আগের থেকে অনেক বেশি বেড়ে গেল। তবে প্রকাশ্যে তেমন কিছু হল না। কিন্তু তাদেরকে রাগারাগি ও তিরস্কার করতে ছাড়লেন না। তারাও স্পষ্ট জানিয়ে দিল, তোমরা যদি বেশি বাড়াবাড়ি কর, তা হলে কাজি অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করে ফেলব। গার্জেনরা বললেন, তা হলে তোদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেব। তাই টোপর আজ যখন বলল, চল কাল কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি। তখন টিকলীর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাজি না হয়ে এত কিছু বলে বোঝাল।
টিকলীর ভাই আলির ফুলের খুব সখ। সেই জন্যে বাসার পশ্চিম পাশে একটা ফুলের বাগান করেছে। মা-বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নার্সারী থেকে নানান ধরনের ফুলের গাছ কিনে এনে লাগিয়েছে। জুঁই, চামেলী, বকুল, জবা, নিশিপদ্ম, রজনিগন্ধা, গোলাপ ও জিনিয়া এবং আরো অনেক নাম না জানা ফুলের গাছ লাগিয়েছে। বাবাকে বলে একজন মালীও রেখেছে। নিজেও এই সব গাছের পিছনে অনেক পরিশ্রম করে। স্কুল জীবন পর্যন্ত টিকলীর সঙ্গে আলির মোটেই পড়ত না। আলি টিকলীর দুবছরের বড়। তাই তার উপর গার্জেনী ফলাত। টিকলী তা মোটেই সহ্য করতে পারত না। সামান্য একটা কিছু নিয়ে সব সময় টক-ঝক লেগেই থাকত। তুই তোকারী করত। কলেজে ঢোকার পরে টিকলী তুমি করে বললেও টক-ঝক লাগে। কেউ কারো কথা একদম সহ্য করতে পারে না। কিন্তু ফুল বাগান করা নিয়ে দুজনের খুব ভাব। টিকলীও ফুল খুব ভালবাসে। পড়তে পড়তে যখন ভালো লাগে না অথবা টোপরের সাথে কোনো ব্যাপারে মনোমালিন্য হয় তখন ঘন্টার পর ঘন্টা ফুল বাগানে বেড়ায়, বসে থাকে। ফুলের উপর আদরের হাত বুলোতে বুলোতে তাদের সঙ্গে কথা বলে।
আজ নিউ মার্কেট থেকে ফেরার সময় টোপরের সঙ্গে কথা বলে টিকলীর মন খুব খারাপ লাগতে লাগল। জানালার পর্দা সরিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল। ফুটন্ত ফুলগুলো রোদে ঝলসে যাচ্ছে। দুপরের রোদ সহ্য করতে পারছে না। তার ইচ্ছা হল বাগানে গিয়ে ফুলগুলোকে আদর করে বলে আর কিছুক্ষণ কষ্ট কর, একটু পরে সাবুদের বিল্ডিং এর আড়ালে সূর্য চলে যাবে। তখন তোমরা আরাম পাবে। যখনই টিকলীর মন খারাপ হয় তখনই হয় বাগানে যাবে, নচেৎ এই জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকবে। এখন প্রচন্ড রোদ, তাই বাগানে না গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
টিকলী প্রতিদিন দুবার গোসল করে। একবার সকালে কলেজে যাওয়ার আগে। আর একবার কলেজ থেকে ফিরে। যেদিন বেশি গরম পড়ে অথবা বিকেলে কোথাও বেড়াতে যায়, সেদিন সন্ধ্যের পরেও একবার গোসল করে। আজ মন খারাপ থাকায় গোসলের কথা ভুলে গেছে।
মেয়েকে ফিরতে সাজেদা বেগম দেখেছেন, ডাইনিং টেবিলে তাকে দেখতে না পেয়ে কাজের বুয়াকে বললেন, দেখত আসমার মা, টিকলী আসছে না কেন?
আসমার মা টিকলীর রুমে এসে বলল, আপা, আপনাকে বেগম সাহেব খেতে ডাকছেন।
টিকলী তখন ফুল বাগানের দিকে তাকিয়ে চার বছর আগের কথা চিন্তা করছিল। তখন সে নাইনে, আর টোপর ইন্টারে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখল, টোপর দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতে বলল, তোর টিকলী নামটা কে রেখেছিল বলত? নামটা কিন্তু দারুণ।
টিকলী বলল, কেন, আজরা মাহবুবা নামটা কি খারাপ? জানিস, নানা একদিন আমাকে আমার নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলেন, আমি বললাম, জানিনা, আপনি বলে দিন। নানা বললেন, তোর নামের অর্থ হলো, কুমারী প্রিয়া। তারপর হেসে উঠে বললেন, আমার ধারনা তুই বিয়ের আগেই কারো প্রিয়া হবি। শুনে আমি মনে মনে খুব খুশি হলাম। কারণ তার অনেক আগে থেকেই আমি তোর প্রিয়া। আমার মুখে বোধ হয় হাসি ফুটে উঠেছিল। নানা বুঝতে পেরে বললেন, কিরে হাসছিস যে? আমি তখন লজ্জা পেলাম। তবু বললাম, নামের অর্থ শুনে হাসি পাচ্ছে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা। নানা, হাসান শব্দের অর্থ জানেন? নানা বললেন, তা আর জানব না। হাসান অর্থ সুদর্শন। তারপর মিটি মিটি হাসতে হাসতে বললেন, হাসান নামে কোনো ছেলের সঙ্গে
তোর পরিচয় আছে নাকি? বললাম, আমাদের কয়েকটা বাড়ির পরের বাড়ীর একটা ছেলের নাম হাসান। তারপর আবার কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেন ভেবে তার কাছ থেকে চলে এলাম।
টোপর বলল, তোর আসল নামের অর্থ জানতাম না, জানার পর মনে হচ্ছে, দুটো নামই খুব সুন্দর।
টিকলী বলল, আর তোর নাম দুটো বুঝি খারাপ? আমার কাছে আমার নামের চেয়ে তোর নাম দুটো বেশি সুন্দর।
টোপর বলল, হাসান নামটা ভালো হলেও টোপর নামটা বিশ্রি লাগে।
টিকলী হেসে উঠে বলল, কেন, বিশ্রি লাগবে কেন? তুই টোপর পরে বিয়ে করতে আসবি, আর আমি টিকলী পরে কনে সাজবো।
টোপরও হেসে উঠে বলল, কথাটা অবশ্য মন্দ বলিস নি।
টিকলী ফুলবাগানের দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবছিল, আসমার মায়ের কথা শুনে সম্বিত ফিরে পেয়ে তার দিকে ঘুরে বলল, তুমি যাও, আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি।
কাহহার সাহেবের ফ্যামিলী খুব আলৰ্টা মর্ডান। ধর্ম সম্পর্কে কেউ কোনো মাথা ঘামায় না। মহল্লার কোনো বাড়ির লোকজনদের সঙ্গেও তেমন মেলামেশা নেই। যাকে বলে আত্মকেন্দ্রিক ও আন-শোসাল মানুষ। নিজেও যেমন কারো সঙ্গে মেলামেশা করেন না, তেমনি ছেলে মেয়েদেরকেও করতে দেন না। কিন্তু তার স্ত্রী শাফিয়া বেগম ঠিক তার উল্টো। স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও তার অগোচরে পাড়া-পড়শী মেয়েদের সঙ্গে মাঝে। মাঝে মেলামেশা করেন। এমন কি হালিম সাহেবের স্ত্রী সাজেদা বেগমের সঙ্গেও আলাপ করেন। শাফিয়া বেগম উচ্চ ফ্যামিলীর শিক্ষিত মেয়ে। মা-বাবার পছন্দ করা ছেলেকে সানন্দে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন। বিয়ের পর স্বামীর আচার-আচরণে খুশি হতে না পারলেও ভাগ্যকে মেনে নেন। তারপর যখন প্রতিবেশী হালিম সাহেবদের সঙ্গে মনোমালিন্যের কথা জানতে পারেন তখন স্বামীকে মিমাংসা করার কথা অনেকবার বলেছেন। কিন্তু কাহহার সাহেব স্ত্রীর কথা গ্রাহ্য করেন নি।
টিকলী রক্ষণশীল ফ্যামিলীর মেয়ে হয়েও টোপরের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য মা-বাবার সঙ্গে অনেক সময় মিথ্যা বলে। আলি বোনের সব কিছু জানলেও সবার সামনে কিছু বলে না। কারণ সে যে টিকলীর বান্ধবী জিনিয়াকে ভালবাসে, সে কথা টিকলী জানে। তাই একা পেলে বলে, তুই যে জন্যে মা-বাবাকে মিথ্যা কথা বলিস, তা আমি জানি। তখন টিকলী গাল ফুলিয়ে বলে, জান তো কি হয়েছে? আমিও তোমার প্রেম কাহিনী জানি। তুমি মা-বাবাকে আমার কথা বলে দিলে, আমিও তোমার কথা বলে দেব। আলি জানে, মা-বাবা টিকলীর ব্যাপারটা নিয়ে এমনিই রেগে আছে। তারপর যদি তার ব্যাপারটা জেনে যায়। তা হলে কি ঘটবে ভেবে টিকলীর কথা শুনে চুপ করে যায়।
টিকলী কয়েক দিন চেষ্টা করেও টোপরের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে আজও কলেজ যাওয়ার সময় রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে আসতে দেখে সালাম দিয়ে পথ আগলে তার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
টোপর ও সালামের উত্তর দিয়ে তার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনের চোখে পানি এসে গেল।
প্রথমে টিকলী চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, এই কয়েক দিন তুই আমাকে না দেখে থাকতে পারলি? জানিস, আমি শুধু কেঁদেছি। একটুও পড়াতে মন বসাতে পারিনি।
টিকলী যেদিন প্রথম সালাম দেয়, সেদিন টোপর জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে আজ সালাম দিলি যে?
টিকলী বলেছিল, কাল আব্বা একটা হাদিস পড়ে শোনালেন, মুসলমানদের পরস্পরে সাক্ষাত হইলে একজন অন্যজনকে বলিবে, আসোলামু আলাইকুম (তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হউক)। ইহা বলা সুন্নত। কেহ সালাম দিলে তদুত্তরে বলিবে ওয়াআলাইকুম আসোলাম (তোমাদের উপর ও শান্তি বর্ষিত হউক)। ইহা বলা ওয়াজিব। সালাম সাম্য শিক্ষার অন্যতম নিদর্শন। সালাম আদান প্রদানের নিয়ম। হল, ছোটরা সালাম দিবে বড়দের, আরোহী সালাম দিবে উপবিষ্টকে, যানবাহনের আরোহী সালাম দিবে পথি-পার্শ্বস্থ লোককে। কোনো অসুমলিম কোনো মুসলিমকে প্রথমে সালাম দ্বারা সম্ভাষণ করিলে তাহার উত্তরে বলিবে হাদা কাল্লাহ (আল্লাহ তোমাকে হেদায়েৎ দান করুন)। রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, প্রথমে যে ব্যক্তি সালাম দেয়। মানুষের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে-ই উত্তম। [বর্ণনায় : হযরত আবু ওসামাহ (রাঃ)-তিরমিজী, আবু দাউদ।]
টিকলী থেমে যেতে টোপর বলল, তোর বাবা তোদেরকে বেশ ধর্মীয় শিক্ষা দেন, আর আমার বাবা শুধু টাকা রোজগারের চিন্তায় সব সময় ব্যস্ত থাকেন।
আমি মাঝে মাঝে ধর্মীয় বই কিছু কিছু দেব, পড়িস। তা হলে ধর্মীয় জ্ঞান পাওয়ার সাথে সাথে সে সর্ব মেনে চলারও প্রেরণা পাবি।
এখন ওসব পড়ার সময় কোথায়? ক্লাশের পড়া করতেই সময় কুলোয় না।
কেন, যখন অবসর সময়ে ঘোরাঘুরি করিস, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিস তখন পড়বি? আমিও তাই করি।
ঠিক আছে দিস তা হলে, পড়ব।
সেদিন টিকলীর উপর রাগ করে চলে এসে এই কয়েকদিন সেও মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। তার কথা শুনে চোখ মুছে বলল, রাগের মাথায় সেদিন তোর মনে ব্যথা দিয়ে আমিও কম ব্যথা পাইনি। বল, মাফ করে দিয়েছিস?
টিকলী মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তুই একা অন্যায় করিসনি, তোর কথা না শুনে আমিও করেছি। তা হলে আমাকেও তুই মাফ করে দে।
টোপর বলল, ঠিক আছে চল, যেতে যেতে কথা বলি। তারপর হাঁটতে শুরু করে বলল, আজ আর কলেজে গিয়ে দরকার নেই, কোথাও গিয়ে বসি চল। তোর সঙ্গে কিছু জরুরী কথা আছে।
টিকলী বলল, আমার আপত্তি নেই। কোথায় যাবি বল দেখি?
টোপর একটু চিন্তা করে বলল, ওসমানী উদ্যানে। এ সময়ে ওখানে তেমন ভীড় থাকে না।
টিকলী বলল, বেশ তাই চল।
ওরা একটা চলন্ত স্কুটার থামিয়ে উঠে বসে যেতে বলল।
ওসমানী উদ্যানে এসে একটা গাছের তলায় বসে দুজন দুজনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
এক সময় টিকলী বলল, কি জরুরী কথা বলবি বলে নিয়ে এলি বলবি না?
টোপর বলল, ভেবে দেখলাম, তোর কথাই ঠিক। বাবা বলছিলেন অনার্সটা নেওয়ার পর ফরেনে পাঠাবেন। যাওয়ার আগে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলব কি বলিস?
কথাটা শুনে টিকলী অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
টোপর অধৈর্য গলায় বলল, কিরে চুপ করে আছিস যে?
টিকলী ম্লান মুখে বলল, ফরেনে গেলে তুই আমাকে ভুলে যাবি। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
টোপর তার হাত সরিয়ে দিয়ে চিবুক ধরে বলল, তোকে ভুলে যাব একথা ভাবতে পারলি? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতো, অবিশ্বাসের কিছু দেখতে পাস কি না?
তুই যে আমাকে কত ভালবাসিস তা জানি; ফরেনের ফ্রি মিক্সিং-এর কথা ভেবে হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু অতদিন তোকে না দেখে থাকতে পারব না। তুইও কি পারবি?
না পারলেও তোর জন্যে আমাকে পারতেই হবে। এখানে থাকলে আমাদেরকে দুই ফ্যামিলীর কেউ মেনে নেবে না। বরং শত্রুতা আরো বাড়বে। তাই ভেবেছি, ফরেনে গিয়ে পড়া শোনার সাথে সাথে চাকরিও করব। আর যেমন করে হোক গ্রীন কার্ড নেওয়ার চেষ্টা করব। গ্রীন কার্ড পেয়ে গেলে স্ত্রীকে মানে তোকে নিয়ে চলে যাব। তারপর বলল, কিরে প্ল্যানটা মনে ধরেছে?
ধরেছে, তবে আল্লাহ কতটা সাকসেসফুল করাবেন, তা তিনিই জানেন?
তা হলে এবার একটু হাসতো দেখি, এই কয়েক দিন তোর হাসি মুখ না দেখে আমিও পড়াতে একদম মন দিতে পারিনি।
টিকলী কান্না মুখে হাসি দিয়ে বলল, তুইও এবার হাস, তোর হাসি মুখ দেখলে মন দিয়ে পড়তে পারব।
টোপর হেসে উঠে বলল, আমরা আগের মতো গোপনে দেখা করব, আর বাসায় এমন ভাব দেখাব, যেন সবাই মনে করে আমাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
টিকলী বলল, বেশ তাই হবে।
.
০৩.
পরের বছর টোপর অনার্স পাশ করার পর কাহহার সাহেব বললেন, ভার্সিটি থেকে। মাস্টার্সটা কমপ্লীট কর, তারপর ফরেনে পাঠাবার ব্যবস্থা করব।
টোপর বলল, তুমি তো বলেছিলে অনার্স নেওয়ার পর পাঠাবে?
তা বলেছিলাম, এখন চিন্তা করে দেখলাম, মাষ্টার্স করে যাওয়াই ভাল।
টোপর খুব অসন্তুষ্ট হলেও প্রতিবাদ করল না। ভাবল, ভালই হল, এর মধ্যে টিকলীকে বিয়ে করে ফেলবে।
ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে একদিন টিকলীকে ঘটনাটা বলে বলল, মাষ্টার্স নিতে এক বছরের কোর্স হলেও সেশন জটের কারণে দুই আড়াই বছর লেগে যাবে। তারপর ফরেনে গিয়ে তোকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে আরো দুতিন বছর লেগে যাবে। এতদিন তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। তার চেয়ে আমরা গোপনে কাজি অফিসে বিয়ে করে ফেলি চল। ব্যাপারটা গোপন রাখব। কোথাও কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়ার নাম করে হানিমুনের কাজটা সেরে ফেলব।
টিকলী এইচ, এস, সিতে ভালো রেজাল্ট করে ঢাকা ও রাজশাহী মেডিকেলে এ্যাডমিশান টেষ্ট দিয়েছিল। ঢাকায় না টিকলেও রাজশাহীতে টিকেছে। সেও টোপরকে আপন করে পেতে চায়। কিন্তু টোপর যেভাবে চাইছে, সেভাবে নয়। তাই কি বলবে চুপ করে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করতে লাগল।
কিরে কিছু বলছিস না কেন?
এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? ছেলেরা চট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেও মেয়েরা পারে। আমাকে কিছুদিন ভাববার সময় দে।
এতে ভাববার কি আছে?
তোকে তো আসল কথাটাই বলা হয় নি। আমি রাজশাহী মেডিকেলে এ্যাডমিশান টেস্টে টিকে গেছি। কয়েকদিনের মধ্যে ভর্তি হব। আমার বড় খালা খালু ওখানে থাকেন। তাদের কাছে থেকে লেখাপড়া করব।
তাই নাকি? তা হলে তো ভালই হল। যখনই মন চাইবে তখনই তোর কাছে যেতে পারব। এখন বল, কবে কাজি অফিসে যাবি?
কাজি অফিসের কাজটা রাজশাহীতে হবে। আমি তোকে চিঠি দিয়ে জানাব।
কথাটা ঠিকই বলেছিস, ওখানে করলে কোনো হোটেলে মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে পারব।
টিকলী হেসে উঠে বলল, তুই তো দেখছি মধুচন্দ্রিমার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিস।
আর তুই বুঝি হসনি? ঠিক আছে, বিয়ের রাতে আমি একাই মধুচন্দ্রিমা যাপন করব।
টিকলী হেসে উঠে বলল, একা একা আবার মধুচন্দ্রিমা রাত যাপন করা যায় বুঝি?
টোপর বলল, যায় কিনা যায়, সেই রাতে দেখিয়ে দেব।
টিকলী হাসতে হাসতেই বলল, তাই দেখাস, কিন্তু বাছাধন, আমি তো বড় খালাদের বাসায় থাকব। হোটেলে মধুচন্দ্রিমা যাপন করবি কি করে?
তোর খালাদের বাসা থাকতে হোটেলে থাকব কোন দুঃখে। কাজি অফিসে বিয়ে করে এসে খালা-খালুকে সালাম করে দোওয়া নিতে যাব। দেখবি তখন তারাই বাসাতে মধুচন্দ্রিমা যাপনের ব্যবস্থা করে দেবেন।
আর যদি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেন?
তা হয় তো দিতে পারেন; তবে আমার মনে হয় তা করবেন না। হাজার হোক। ভাগ্নি জামাই তো। তারপর বলল, আগে সেই সময় আসুক তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।
টিকলী বলল, ঠিক আছে, এমন বাসায় ফিরি চল।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজে এ্যাডমিশান নিয়ে টিকলী বড় খালাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে লাগল। আসার আগে অনেক চেষ্টা করেও টোপরের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। কারণ সে তার মাকে নিয়ে দেশের বাড়ি মনোহরদি গিয়েছিল। তাই আসার আগের দিন একটা চিঠি লিখল
টোপর,
প্রথমে আমার সালাম ও ভালবাসা নিবি। পরে জানাই যে, তোর সাথে দেখা না করে চলে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কোনো উপায় নেই। তাই আমাদের বুয়ার মেয়ে আসমার হাতে এই চিঠি দিলাম। চিঠি পেয়ে তুইও যে খুব কষ্ট পাবি, তা জানি। আমি কয়েক দিনের মধ্যে তোকে চিঠি দেব। তাতে ঠিকানা থাকবে। চিঠি পেয়ে অতি অবশ্যই আসবি। আর বিয়ের ব্যাপারে যদি প্রস্তুতি নিয়ে আসতে গিয়ে দেরি হয়, তা হলে আমার চিঠি পাওয়া মাত্র একদিনের জন্য হলেও দেখা দিয়ে আসবি। তারপর তোর সময় সুযোগ মতো মধুচন্দ্রিমা যাপন করার জন্য আসবি। আর বেশি কিছু লিখতে পারছি না, শুধু কান্না পাচ্ছে। তাই এখানেই শেষ করছি।
–তোর টিকলী
চিঠিটা একটা সাদা খামে ভরে গাম দিয়ে মুখ এঁটে দিল। তারপর আসমাকে ডেকে তার হাতে দিয়ে বলল, এটা ও বাড়ীর টোপরকে দিবি। সে দেশের বাড়ি গেছে। ফিরে এলে গোপনে দিবি। আর শোন, এখন এটা তোর সুটকেসে রেখে দে। খবরদার, কেউ যেন না জানে। তোর মাও যেন জানতে না পারে।
স্বামী পরিত্যাক্তা আনোয়ারা এক বছরের আসমাকে নিয়ে এ বাড়িতে কাজ করছে। আসমার বয়স এখন প্রায় দশ বছর। বেশ চালাক চতুর মেয়ে। টিকলী তাকে কোরান ও নামাজ পড়তে শিখিয়েছে। বাংলা-ইংরেজীও এখন পড়ায়। তাই আসমা টিকলীর খুব বাধ্য। এখন তার কথা শুনে বলল, ঠিক আছে আপা, চিঠির কথা কেউ জানবে না।
টিকলী রাজশাহী চলে যাওয়ার তিন দিন পর টোপর ফিরল। পরের দিন আসমা জানতে পেরে চিঠিটা দিতে যাওয়ার সময় টোপরদের গেটের ভিতরে ঢুকে কাহহার সাহেবের সামনে পড়ে গেল। কাহহার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি?
আসমা কাহহার সাহবেকে দেখেই চিঠিসহ হাতটা জামার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বলল, আমি হালিম সাহেবের বাসার কাজের বুয়ার মেয়ে।
কাহহার সাহেব বললেন, এখানে কেন এসেছ? তারপর হঠাৎ তার একটা হাত জামার ভেতরে দেখে বললেন, তোমার হাতে কি আছে দেখি?
আসমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল।
কাহহার সাহেবের কেমন যেন সন্দেহ হল। বললেন, হাতে কি আছে দেখাও।
তবু আসমা চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইল।
কাহহার সাহেবের সন্দেহটা দৃঢ় হল। এগিয়ে এসে জামার ভেতর থেকে হাতটা বের করতে সাদা খাম দেখে অবাক হয়ে বললেন, এটা কাকে দিতে যাচ্ছিলে? তাকে ভয়ে কাঁপতে দেখে খামটা হাতে নিয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, এটা নিয়ে তোমাকে কে পাঠিয়েছে?
আসমা কেঁদে ফেলল।
কাহহার সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কাঁদছ কেন? তোমার কোনো ভয় নেই। এটা দিতে কে পাঠিয়েছে? আর কাকে দিতে বলেছে বলতো।
আসমা চোখ মুছতে মুছতে বলল, আপা রাজশাহী যাওয়ার আগের দিন ওটা আমাকে দিয়ে বলল, ও বাড়ির টোপর ভাই গ্রামের বাড়িতে গেছে, ফিরে এলে দিস। কাল টোপর ভাইকে দেখলাম, তাই দিতে এসেছি।
কাহহার সাহেব বললেন, ঠিক আছে তুমি যাও, আমি টোপরকে এটা দিয়ে দিব। তারপর রুমে এসে চিঠি পড়ে খুব রেগে গেলেন।
নাস্তা খাওয়ার সময় শাফিয়া বেগম স্বামীর গম্ভীর মুখ দেখে বুঝতে পারলেন, নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। তাই নাস্তা সামান্য খেয়ে চা দিতে বলায় কিছু বললেন না।
কাহহার সাহেব অফিসে চলে গেলেন।
দুপুরেও ভাত খাওয়ার সময় সামান্য খেয়ে উঠে যেতে দেখে বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ?
কাহহার সাহেব কোনো কথা না বলে হাত মুখ ধুয়ে চলে গেলেন।
কাহহার সাহেবের সিগারেট খাওয়ার নেশা না থাকলেও কিছু খাওয়ার পর পান খান।
শাফিয়া বেগম পান সেজে স্বামীর রুমে এসে দেওয়ার সময় বললেন, শরীর খারাপ কিনা কিছু বললে না যে?
কাহহার সাহেব বালিসের তলা থেকে চিঠিটা বার করে স্ত্রীর হাত দিয়ে বললেন, হালিম সাহেবের বাসার কাজের মেয়ে টোপরকে দিতে এসেছিল।
শাফিয়া বেগম চিঠি পড়ে মনে মনে খুশি হলেন। কারণ উনি চান না প্রতিবেশির সঙ্গে শত্রুরা রাখতে। ওদের বিয়ের মাধ্যমে যদি শত্রুতার অবসান হয়, তা হলে ভালই হয়। সেই জন্য প্রথম যখন ওদের মেলামেশা নিয়ে স্বামী ছেলেকে রাগারাগি করে তখন তিনি ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, তুই এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর। সময় মতো তোর বাবাকে বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করাব। কিন্তু ওরা যে এত শিঘ্রী বিয়ে করবে এটা মেনে নিতে পারলেন না। আতঙ্কিত স্বরে বললেন, কি সর্বনাশ, ওরা এতদূর এগিয়েছে?
কাহহার সাহেব গম্ভির স্বরে বললেন, টোপর যে এরকম হবে তা ভাবতেই পারছি না। তুমি আস্কারা দিয়ে ওর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছ।
শাফিয়া বেগম একটু রাগের সঙ্গে বললেন, তা না হয় স্বীকার করলাম; কিন্তু তুমি তো তার বাবা, আমাকে শুধু দোষ দিচ্ছ কেন?
দোষ দিচ্ছি এই জন্যে যে, ছেলে-মেয়েদেরকে লালন-পালন করার দায়িত্ব মায়ের। মা যেভাবে তাদেরকে শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে মানুষ করবে, তারা সেই ভাবে মানুষ হবে।
শাফিয়া বেগম বললেন, আমি আমার দায়িত্ব যথাসাধ্য পালন করেছি। এখন সে বড় হয়েছে, ভার্সিটিতে পড়ছে, বাইরে কি করছে না করছে তা জানব কি করে?
কাহহার সাহেব বললেন, ওসব কথা রেখে এখন কি করা যায় তাই বল। আমি ভাবছি, চিঠিটা হালিম সাহেবকে দিয়ে এর একটা বিহিত করতে।
সেটা বোধ হয় ঠিক হবে না। উনি হয়তো বলবেন, আপনারা আপনাদের ছেলেকে সামলান। আপনার ছেলেই আমার মেয়েকে নষ্ট করেছে। শেষ-মেস ঝগড়ার সৃষ্টি হবে।
তা বলতে পারেন, তবু আমি চিঠিটা দিতে চাই। বুঝতে পারছ না কেন, চিঠি তো টোপর দেয় নি, দিয়েছে তার মেয়ে। চিঠি পড়ে তারা তাদের মেয়ের ব্যাপারটা জানতে পারবেন।
ঠিক আছে, তা হলে দাও। তবে তুমিও একটা কাগজে লিখে দাও, কিভাবে চিঠিটা পেলে। আরো লিখে দাও, আমরা আমাদের ছেলেকে সামলাব, আপনারা আপনাদের মেয়েকে সামলাবেন। নচেৎ পরিণতির জন্য আপনারাই দায়ী হবেন।
তুমি খুব ভালো কথা বলেছ বলে কাহহার সাহেব একটা কাগজে কথাগুলো লিখে নিজের নামও লিখলেন। তারপর খামের ভিতর দুটো চিঠি ভরে কাজের মেয়ে দুলারীকে ডেকে বললেন, এটা টিকলীর বাঘা হালিম সাহেবকে দিয়ে এস। তাকে যদি না পাও, তার স্ত্রীর হাতে দিবে। খবরদার, অন্য কাউকে দেবে না।
দুলারী যখন চিঠিটা দিতে এল তখন হালিম সাহেব সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন। দুলারী খামটা তার হাতে দিয়ে বলল, আমার সাহেব এটা দিয়েছেন।
হালিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন বাসায় কাজ কর?
দুলারী বলল, টোপরদের বাসায়।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
দুলারী ফিরে এলে কাহহার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কিরে হালিম সাহেবের হাতে দিয়েছিস তো?
জ্বী।
দুলারী চলে যাওয়ার পর শাফিয়া বেগম বললেন, মেয়েটা তো কয়েক দিনের মধ্যে ডাকে চিঠি দেবে। তখন যদি টোপর এই চিঠির কথা জানতে পেরে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কি বলব?
টোপর তার চিঠি যাতে না পায়, সে ব্যবস্থা করব
শাফিয়া বেগম আর কিছু বললেন না।
কাহহার সাহেব ঐদিন ডাকঘরে গিয়ে পিয়নকে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, টোপরের নামে কোনো চিঠি পত্র এলে তাকে না দিয়ে আমাকে দেবেন।
পিয়ন বলল, ঠিক আছে সাহেব তাই হবে।
হালিম সাহেবও চিঠি পড়ে মেয়ের উপর খুব রেগে গেলেন।
সাজেদা বেগম চা-নাস্তা নিয়ে এসে স্বামীর মুখ গম্ভীর দেখে বললেন, কি ব্যাপার কিছু হয়েছে না কি?
হালিম সাহেব চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বললেন, পড়ে দেখ তোমার মেয়ের কান্ড। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করে সোফায় বসে স্ত্রীর দিকে রাগের সঙ্গে তাকিয়ে রইলেন।
সাজেদা বেগম চিঠি পড়ে যেমন অবাক হলেন তেমনি রেগেও গেলেন। তিনিও প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা রাখতে চাননি; কিন্তু তাই বলে তাদের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন একথা কখনো চিন্তা করেন নি। স্বামীকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগ সামলালেন, তারপর চিঠিটা খামে ভরে বুকসেলফে রেখে বললেন, টিকলী ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে যে ভুল করছে, তা আমাদেরকে কৌশলে সংশোধন করে দিতে হবে। রাগের বশে কিছু করা ঠিক হবে না। মেয়ে বড় হয়েছে, লেখাপড়া করছে। আমরা বাধা দিলে ওরা অন্য পথ বেছে নেবে। এখন নাস্তা খেয়ে নাও। পরে ভেবে চিন্তে যা হয় করা যাবে।
হালিম সাহেব খেতে শুরু করে বললেন, আমার মাথায় তো, কিছু আসছে না। টিকলী চিঠিতে লিখেছে কয়েক দিনের মধ্যে আবার টোপরকে দেবে। চিঠি পেয়ে টোপর গিয়ে যদি সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেলে, তা হলে কি হবে?
সাজেদা বেগম বললেন, আমি আলীকে নিয়ে দুএক দিনের মধ্যে টিকলীর সঙ্গে দেখা করে যা বলার তাকে বুঝিয়ে বলব।
আলীকে নিয়ে যাবে কেন? আমিই তোমার সঙ্গে যাব।
তুমি পরে এক সময় যেও। এবারে আলীকে নিয়ে যাব। আমি বুবু ও দুলাভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ওকে বোঝাব।
ঠিক আছে, তা হলে কালই তোমরা যাও।
ঐদিন রাত্রে সাজেদা বেগম রাজশাহীতে বোনকে ফোন করলেন। সাজেদা বেগমের বড় বোনের নাম মাজেদা বেগম। আর দুলাভাইয়ের নাম রহমান সাহেব। তিনি নাটোরের লোক। কন্ট্রাকটারী করেন। রাজশাহী টাউনে বাড়ি করেছেন। বেশ ধনী ব্যক্তি। গাড়িও আছে। ওঁদের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে বড়। বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে ইকবাল আমেরিকায় বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে।
মাজেদা বেগম এশার নামায পড়ে উঠেছেন, এমন সময় ফোন বাজতে ধরে বললেন, হ্যালো, কে বলছেন?
বুবু আমি ঢাকা থেকে সাজেদা বলছি।
সাজেদা, কি খরব রে? তোরা সব ভালো আছিস?
সাজেদা বেগম সালাম দিয়ে বললেন, হ্যাঁ বুবু আমরা সবাই ভালো। তোমরা কেমন আছ?
মাজেদা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আমরা ও ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ফোন করেছিস কেন?
আমি আলীকে নিয়ে কাল আসছি। দুলাভাই নেই?
না, এখনো ফেরেনি। হঠাৎ আসছিস যে। এইতো কয়েক দিন আগে টিকলীকে নিয়ে হালিম এসেছিল?
তোমাদের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করার জন্য যাব। এখন রাখি তা হলে?
টিকলীর সঙ্গে কথা বলবি না?
না, কাল তো আসছি।
পরামর্শ করার জন্য আসবি বললি, হালিমকে না নিয়ে আলীকে নিয়ে আসছিস কেন?
সে কথা কাল গিয়ে বলব। এখন রাখছি। তারপর সালাম বিনিময় করে সাজেদা বেগম ফোন ছেড়ে দিলেন।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর মাজেদা বেগম স্বামীকে বললেন, কিছুক্ষণ আগে সাজেদা ফোন করেছিল। কাল আলীকে নিয়ে আসছে।
রহমান সাহেব বললেন, তিন চার বছরেও যার আসার সময় হয় না, সে কিনা মেয়ে আসতে না আসতেই আসছে। কেন আসছে কিছু বলেছে?
মাজেদা বেগম বললেন, আমাদের সঙ্গে কি ব্যাপারে যেন পরামর্শ করবে।
পরের দিন সাজেদা বেগম আলীকে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে করে এলেও ফেরীর গোলমালের জন্য রাজশাহী পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল।
টিকলী মাগরিবের নামায পড়ার জন্য অজু করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে মা ও ভাইয়া এসেছে দেখে বেশ অবাক হলেও আতঙ্কিত হল। তা প্রকাশ না করে সালাম দিয়ে মাকে কদমবুসি করে বলল, তোমরা হঠাৎ এলে যে?
সাজেদা বেগম জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোওয়া করে বললেন, পরে শুনিস। এখন নামাযের সময় হয়ে গেছে, নামায পড়ে নিই চল।
নামাযের পর চা-নাস্তা খাওয়ার সময় সাজেদা বেগম মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোকে ছেড়ে কখনো থাকিনি, তাই হঠাৎ চলে এলাম।
টিকলী মায়ের কথা বিশ্বাস করতে পারল না। ভাইয়াকে তার রুমে আসার জন্য ঈশারা করে মাকে বলল, তোমরা গল্প কর, আমার পড়া আছে বলে চলে গেল।
একটু পরে টিকলীর রুমে যাচ্ছি বলে আলী ও চলে গেল।
এমন সময় রহমান সাহেব বাসায় ফিরলেন।
সাজেদা বেগম সালাম দিয়ে বললেন, দুলাভাই কেমন আছেন?
রহমান সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তবু যা হোক, মেয়েটার অছিলায় শ্যালিকা এসে দুলাভাইয়ের খোঁজ খরব নিচ্ছে। তা ভাইরা ভাইয়ের খবর কি?
ভালো আছে।
এল না কেন?
কয়েক দিন আগে টিকলীকে নিয়ে যখন এসেছিল তখন আমাকে আনেনি। তাই আমিও তাকে আনিনি।
এই কথায় তিন জনেই হেসে উঠল।
মাজেদা বেগম স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি জামা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে এস, আমি চা নাস্তা নিয়ে আসছি।
নাস্তা খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে রহমান সাহেব শ্যালিকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হঠাৎ আগমনের কারণটা শুনিয়ে এ্যাংজাইটি দুর কর।
সাজেদা বেগম বললেন, আপনাদের রুমে চলুন, কথাটা গোপনীয়।
মাজেদা বেগম বললেন, তা হলে তাই চল।
রুমে এসে সাজেদা বেগম চিঠিটা মাজেদা বেগমের হাতে দিয়ে বলল, বুবু তুমি পড়ে দুলাভাইকে দাও।
চিঠি পড়ে রহমান সাহেব শ্যালিকাকে বললেন, ছেলেটার পরিচয় বল।
সাজেদা বেগম বললেন, প্রতিবেশীর ছেলে। নাম হাসান। ডাক নাম টোপর। বি.এস.সিতে অনার্স নিয়ে মাষ্টার্স করছে।
তা হলে তো ভালই, তোমরা চাচ্ছ না কেন? ছেলেটা কি দেখতে শুনতে ভালো না, গরিবের ছেলে?
ওসব কিছু নয়।
তা হলে বাধা কোথায়?
আমরা যে বাড়িটা ভাড়া দিয়েছি। তার পাশের বাড়ির ছেলে। তার বাবা বাড়ি করার সময় থেকে আমাদের সঙ্গে শত্রুতা।
তোমরা কি জান না, রাসুলুল্লাহ (দঃ) এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সঙ্গে শত্রুতা রাখতে নিষেধ করেছেন। আর প্রতিবেশীর সম্বন্ধে বলিয়াছেন, প্রতিবেশীর কি হক তাহা কি জান? সে তোমার সাহায্য চাহিলে তাহাকে অভয় দিবে, সে ঋণ চাহিলে তাহাকে ঋণ দিবে, সে নিঃস্ব হইলে তাহাকে দান করিবে, সে পিড়িত হইলে তাহার শুশ্রূষা করিবে, তাহার মৃত্যু হইলে জানাজাতে যোগ দিবে, তাহার সুসংবাদে সন্তোষ প্রকাশ করিবে, তোমার অট্টালিকা তাহার অনুমতি ব্যাতীত এত দূর উঁচু করিও না। যাহাতে বায়ু চলাচল বন্ধ হয় এবং তাহার কষ্ট হয়, তাহার বিপদে আপদে সহানুভূতি প্রকাশ করিবে। যখন তুমি কোনো ফল ক্রয় কর তাহাকে কিছু দিবে, যদি না দাও তবে গোপনে তাহা ঘরে আনিবে এবং তোমার সন্তানগণ, তাহার সন্তানগণের বিরক্তি উৎপাদনের জন্য যেন বাহিরে না আসে। [বর্ণনায় ও হ্যরত অমর (রাঃ) মেশকাত]
সাজেদা বেগম বললেন, প্রতিবেশীর সম্বন্ধের হাসিটা না জানলেও এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সঙ্গে যে শত্রুতা রাখতে নেই তা জানি। আপনার ভাইতো টোপরের বাবার সঙ্গে দেখা হলে সালাম দেয়। কিন্তু লোকটা ভালভাবে সালামের উত্তরও দেন না। শুধু একটু মাথা নেড়ে দেন। ওদের বাসার কেউ নামায রোযাও করে না। আপনিই বলুন ওদের সঙ্গে কি আমরা সম্বন্ধ করতে পারি? সব থেকে বড় কথা টিকলী, এ বছর মেডিকেল ভর্তি হয়েছে। এখন ওর বিয়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। ওর আব্বা তো চিঠি পড়ে রেগে আগুন। আমি অনেক বুঝিয়ে ঠান্ডা করে আপনাদের কাছে পরামর্শ করতে এসেছি।
রহমান সাহেব বললেন, আমার ধারণা ওদের ব্যাপারটা অনেক দিনের। তোমরা আগে টের পাও নি?
আপনার ধারণা ঠিক। ছেলে বেলায় ওরা এক সাথে স্কুলে যাতায়াত করত, খেলা ধুলা করত। তখন অতটা আমরা খেয়াল করিনি। চার পাঁচ বছর আগে টের পেয়ে টিকলিকে আমরা অনেক বুঝিয়েছি, শাসনও করেছি। তারপর থেকে ওরা চালাক হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে মেলামেশা না করে গোপনে করত। তখন আমরা মনে করেছিলাম, ওদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক নেই। এত বছর পর এই চিঠি পেয়ে জানতে পারলাম, ওরা তলে তলে ঠিকই মেলামেশা করেছে।
আচ্ছা, চিঠিটা তো টোপরকে দিয়েছে, তোমরা পেলে কি করে?
কি ভাবে পেলেন, সাজেদা বেগম খুলে বললেন।
রহমান সাহেব বললেন, তা হলে বোঝা যাচ্ছে, চিঠির কথা ছেলেটা জানে না।
না, জানে না। তাইতো টিকলী ছেলেটাকে আবার চিঠি দেওয়ার আগেই এলাম আপনার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য।
রহমান সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আমার মনে হয় ওদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে কোনো কাজ হবে না। তার চেয়ে তুমি একাকি টিকলীকে বুঝিয়ে বল, টোপর লেখাপড়া শেষ করে কিছু করুক। ততদিনে তুই ডাক্তারী পাশ করে ফেল। তারপর আমরাই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। এখন বিয়ে করলে তোদের দুজনেরই যেমন পড়াশোনার ক্ষতি হবে, তেমনি ভবিষ্যৎ জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে।
সাজেদ বেগম বললেন, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমিও ঐ রকম ভেবেছি।
মাজেদা বেগম এতক্ষণ কোনো কথা বলেন নি। এবার সাজেদাকে উদ্দেশ্য করে। বললেন, ছেলের মা-বাবা কি বলেন?
সাজেদা বেগম বললেন, ছেলের মায়ের কথা বলতে পারব না। তিনি খুব ভালো। শিক্ষিতাও। ছেলের বাবা এমন অদ্র, স্ত্রীকে পাড়া প্রতিবেশীর বাসায় যেতে দেন না। তিনি এ ব্যাপারে ছেলেকে বলেই দিয়েছেন, টিকলীকে বিয়ে করলে ঘর থেকে বার করে দেবেন। চিঠিটা ছেলের বাবার হাতে পড়েছিল। তিনিই কাজের মেয়ের হাতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই সাথে কি লিখেছেন, তা তো পড়েছ।
রহমান সাহেব বললেন, আমি যা বললাম তাই কর। যদি ছেলেটা এখানে আসে, তা হলে যা বলার আমি তাকে বলব।
টিকলী রুমে এসে ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। একটু পরে আসার পর বলল, তোমরা কেন এসেছে বলত ভাইয়া। আম্মা যা বলল, তা আসল কারণ নয় বলে আমার মনে হচ্ছে।
আলী বলল, আম্মা তো আমাকে ঐ কথাই বলে নিয়ে এল। আসল কারণ আবার কি থাকবে? তারপর তার একটা বই নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগল।
খাওয়া দাওয়ার পর সাজেদা বেগম মেয়ের রুমে এলেন।
মা ও ভাইয়ার আসার পর থেকে টিকলীর মনে হচ্ছে চিঠির কথা ফাঁস হয়ে গেছে। এখন মাকে আসতে দেখে ভয়ে ভয়ে বলল, কিছু বলবে আম্মা?
সাজেদা বেগম বললেন, তুই এখানে আসার আগে যে চিঠিটা টোপরকে দিয়েছিলি, সেটা তার বাবার হাতে পড়ে। তিনি খুব রেগে গেছেন। তোর চিঠির সঙ্গে এটা লিখে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারপর কাহহার সাহেবের লেখাটা তার হাতে দিলেন।
টিকলী চিঠির কথা ভেবে এমনিই ভয় পেয়েছিল। তারপর কাহহার সাহেবের লেখাটা পড়ে আরো বেশি ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।
সাজেদা বেগম বললেন, তোর বাবা কি রকম লোক তা তো জানিস। চিঠি পড়ে ভীষণ রেগে গিয়েছিল। আমি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এসেছি। এখন যা বলছি শোন, তোদের ভালবাসায় বাধা দেব না। তবে এখন বিয়ের কথা একদম ভুলে যা। তুই মন দিয়ে পড়াশোনা করে ডাক্তারীটা পাশ কর। টোপরও ততদিনে লেখাপড়া শেষ করে কিছু উপার্জন করুক। তারপর আমি তোর বাবাকে ম্যানেজ করে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। আর তোর বাবা যদি একান্ত রাজি না হয় অথবা টোপরের মা-বাবাও যদি রাজি না হন, তা হলে তোরা নিজেরা নিজেদের কাজ সমাধান করবি। তখন টোপরের বাবা তোকে ঘরে না তুললেও তোদের ব্যবস্থা তোরা করে নিতে পারবি। তারপর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, লক্ষী মা আমার, এখন বিয়ে করলে তোদের দুজনেরই লাইফটা নষ্ট হয়ে যাবে। তুই টোপরকে আমার কথাগুলো বুদ্ধি করে গুছিয়ে লিখে চিঠি দিয়ে জানা। সে তোকে যদি সত্যিকার ভালবেসে থাকে, তা হলে তোর চিঠি পেয়ে খুশি হবে। আর তা যদি না হয়, তা হলে বুঝবি তার ভালবাসায় খাদ আছে।
টিকলী ভেবেছিল, মা তাকে চিঠির কথা বলে খুব রাগারাগি করবে। তাই প্রথমে খুব ভয় পেয়েছিল। এখন মায়ের কথা শুনতে ভয় কেটে গিয়ে মনে মনে খুশি হল। কি বলবে না বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।
সাজেদা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, ওয়াদা কর, আমার কথা রাখবি?
টিকলী মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
সাজেদা বেগম বললেন, কাঁদছিস কেন? যা কিছু বললাম, তোর ভালোর জন্য বললাম। ওয়াদা কর, এখন কিছু করবি না।
টিকলী জানে এখন বিয়ে করলে তাদের দুজনেরই ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাই সেও এখন বিয়ে করতে চায় না। শুধু টোপরের জিদে রাজি হয়েছিল। মায়ের কথা শুনে চোখ মুছে সে কথা জানিয়ে বলল, ঠিক আছে আম্মা, আমি ওয়াদা করলাম তোমার কথা রাখব। তুমি দোওয়া কর, আল্লাহ যেন আমাকে ওয়াদা পূরণ করার তওফিক দেন।
সাজেদা বেগম আলহামুলিল্লাহ বলে বললেন, আল্লাহ তোর সমস্ত নেক বাসনা পূরণ করুক, তোকে ওয়াদা পূরণ করার তওফিক দিক।
পরের দিন সাজেদা বেগম বুবু ও দুলাভাইকে মেয়ের সঙ্গে যে সব কথা-বার্তা হয়েছে বললেন।
রহমান সাহেব বললেন, টিকলী খুব বুদ্ধিমতী। মনিষিরা বলেছেন, আকেলমন্দ কো ঈশরাই কাফি, অর্থাৎ যারা বুদ্ধিমান, অল্প কথাতেই তারা সব কিছু বুঝতে পারে।
দুদিন থেকে সাজেদা বেগম আলীকে নিয়ে ঢাকা ফিরে এসে স্বামীকে সব কিছু বললেন।
হালিম সাহেব শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এই বয়সটা ছেলে মেয়েদের জন্য খুব ডেঞ্জারেস। টোপর যোগাযোগ করলে টিকলী কি ঠিক থাকতে পারবে?
সাজেদা বেগম বললেন, টিকলীর পেটে দ্বিনী এলেম আছে, আর যাই করুক ওয়াদা খেলাপ করবে না। দুলাভাই বলেছেন, তোমরা কোনো দুশ্চিন্তা করো না। আমি টিকলীর দিকে লক্ষ্য রাখব।
কিন্তু তুমি যে তাকে বলে এলে, ভবিষ্যতে আমরা তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব, তার কি হবে?
ভবিষ্যতে কি হবে না হবে তা আল্লাহ জানেন। তা ছাড়া একটা কথা ভুলে যাচ্ছ। কেন, আল্লাহ ওদেরকে জোড়া করে পয়দা করে থাকলে আমরা বাধা দিয়ে কি কিছু করতে পারব? ভবিষ্যতের কথা নিয়ে দুচিন্তা করার কোনো মানে হয় না। আল্লাহর যা মর্জি তাই হবে।
.
০৪.
মা ফিরে যাওয়ার পর টিকলী টোপরকে চিঠি লিখল
প্রিয়তম টোপর,
পত্রে আমার অন্তরের সবটুকু ভালবাসা ও সালাম নিবে। পরে জানাই যে, এখানে আসার আগে তুমি ঢাকায় ছিলে না। তাই একটা চিঠি লিখে আমাদের কাজে মেয়ের হাতে দিয়ে এসে ছিলাম তোমাকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সে চিঠি দিতে গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত তোমার বাবার সামনে পড়ে যায়। তিনি তার কাছে থেকে চিঠি নিয়ে আমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দেন। চিঠি পড়ে মা এসেছিল। ঐ চিঠিতে কি লিখেছিলাম, তুমি এখানে এলে জানাব। এই চিঠি পেয়ে অতি শিঘ্র এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে। আসার সময় তোমার সঙ্গে দেখা হল না বলে শুধু কান্না পেয়েছে। আল্লাহর রহমতে শারীরিক ভালো, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি। তোমাকে না দেখা পর্যন্ত যন্ত্রণার উপশম হবে না। পত্র পাওয়া মাত্র আশা চাই কিন্তু। সবশেষে আল্লাহ পাকের দরবারে তোমার সার্বিক কুশল কামনা করে শেষ করছি।
আল্লাহ হাফেজ
ইতি
তোমার প্রিয়তমা
টিকলী
চিঠি লেখা শেষ করে খামে ঠিকানা লিখতে গিয়ে চিন্তা করল, এটাও যদি ওর বাবার হাতে পড়ে, তা হলে কি হবে? হঠাৎ বান্ধবী জিনিয়ার কথা মনে পড়ল। ভাবল, ওতো আমাদের সব খবর জানে। ওর ঠিকানায় দিলে নিশ্চয় টোপরকে দিবে। এই কথা চিন্তা করে জিনিয়াকেও একটা চিঠি লিখল।
জিনিয়া,
আমার ভালবাসা নিস। আশা করি, আল্লাহর পাকের রহমতে ভালো আছিস। আমিও তাঁরই কৃপায় ভালো আছি। ভাইয়ার সঙ্গে সম্পর্ক কতদুর এগোল জানাবি। এদিকে একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। বলছি শোন, আমার ও টোপরের সব কিছু তো তুই জানিস। ও ঢাকায় কাজী অফিসে বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, রাজশাহীতে হবে। আসার সময় টোপর দেশের বাড়ি গিয়েছিল। তাই একটা চিঠিতে রাজশাহীতে আসতে লিখে আমাদের কাজের বুয়ার মেয়ের হাতে দিয়ে বলেছিলাম টোপরকে দিতে। সে চিঠিটা দিতে গিয়ে তার বাবার সামনে পড়ে যায় এবং চিঠিটা তিনি নিয়ে নেন। তারপর আমার মা বাবার কাছে পাঠিয়ে দেন। চিঠি পড়ে মা এসে আমাকে এখন বিয়ে করতে নিষেধ করে বলল, পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তারাই আমাদের বিয়ে দেবে। সে কথা জানাবার জন্য টোপরকে আসার কথা লিখে এই চিঠি দিলাম। ওর ঠিকানায় দিলে ওর বাবার হাতে পড়তে পারে ভেবে তোর চিঠির সঙ্গে পাঠালাম। তুই চিঠিটা ওকে অতি অবশ্যই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিবি। বিশেষ আর কি লিখব, চিঠির উত্তর দিস, আর টোপরকে বলিস, তোর ঠিকানাতে তাকে চিঠি দেব। খবরদার, ভাইয়াকে চিঠির কথা জানাবি না। আল্লাহ পাকের কাছে তোর সর্বাঙ্গীন কুশল কামনায়
বান্ধবী টিকলী
লেখা শেষ করে দুটো চিঠি একটা খামে ভরে পোস্ট করে দিল।
দেশের বাড়ি থেকে ফিরে টোপর টিকলীর সঙ্গে যেখানে সব সময় দেখা করে, সেখানে কয়েক দিন অপেক্ষা করে তাকে আসতে না দেখে ভাবল, তা হলে কি রাজশাহী চলে গেছে। একদিন ভার্সিটি যাওয়ার সময় রাস্তার মোড়ে মুদি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে টিকলীর কথা ভাবছিল। এমন সময় আসমাকে দোকানে সদাই করে ফিরে যেতে দেখে বলল, এই আসমা শোন।
টোপরকে দেখে আসমার চিঠির কথা মনে পড়ল। ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
টোপর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল তোর আপা কি রাজশাহী চলে গেছে।
আসমা মাথা নিচু করেই বলল, হ্যাঁ সাত আট দিন হল গেছে।
ঠিক আছে তুই যা বলে টোপর ভার্সিটিতে চলে গেল।
আসমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে লাগল।
যখন পনের দিন পার হয়ে গেল অথচ টিকলীর চিঠি পেল না তখন টোপর খুব অস্থির হয়ে পড়ল। ভাবল আর এক সপ্তাহের মধ্যে যদি চিঠি না আসে, তা হলে রাজশাহীতে গিয়ে মেডিকেল কলেজে তার সঙ্গে দেখা করবে।
বিশ দিনের মাথায় টোপর ক্লাস করে বেরিয়ে রাস্তায় এসে রিক্সায় উঠতে যাবে, এমন সময় একটা মেয়ের গলা শুনতে পেল, টোপর ভাই রিক্সায় উঠবেন না, একটু দাঁড়ান কথা আছে।
টোপর ঘাড় বাঁকিয়ে জিনিয়াকে দেখতে পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। সে জিনিয়াকে চিনে। টিকলী তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
জিনিয়া কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, আপনি আচ্ছা ছেলে তো, আজ তিন চার দিন সারা ভার্সিটিতে চষে ফেলছি, তবু আপনাকে পাইনি।
টোপর বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই।
কেন বলতো?
টিকলী রাজশাহী থেকে আমাকে চিঠি দিয়েছে। সেই সাথে আপনাকেও দিয়েছে। এই নিন বলে চিঠিটা তার হাতে দিল। তারপর বলল, আপনাদের বাসার ঠিকানায় দিলে যদি অন্য কারো হাতে পড়ে, তাই আমার ঠিাকনায় দিয়েছে।
টিকলীর চিঠির জন্য টোপর অস্থির ছিল। বলল, তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
আমি এখন যাই বলে জিনিয়া চলে গেল।
টোপর চিঠি পড়ে বাসায় ফেরার সময় চিন্তা করল, তাই বাবা এই কয়েক দিন আমার সঙ্গে তেমন কথা বলেনি। চিঠির কথা এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। রাজশাহী থেকে ফিরে যা বলার বলা যাবে। বাসায় ফিরে মাকে বলল, আমাকে হাজার পাঁচেক টাকা দিতে হবে।
শাফিয়া বেগম বলেন, তা হলে কি টিকলীর কোনো চিঠি পেয়ে রাজশাহী যাবে? জিজ্ঞেস করলেন, এখন এত টাকার কি দরকার পড়ল?
তুমি দেবে কিনা বল?
কি দরকার না বললে দেব না।
আগে তো কোনো দিন জানতে চাও নি।
এত টাকা এক সঙ্গে তুই আগে কোনো দিন চাস নি।
টোপর রেগে গিয়ে বলল, আগে দরকার হয় নি, তাই চাইনি। তুমি টাকা দেবে। কিনা বল।
শাফিয়া বেগম ছেলের জীদ জানেন। বললেন, রেগে যাচ্ছিস কেন? মা হয়ে জিজ্ঞেস করা কি উচিত নয়?
আমি কাল বন্ধুদের সঙ্গে রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারে বেড়াতে যাব।
শাফিয়া বেগমের সন্দেহ কেটে গেল। হাসি মুখে বললেন, সে কথা প্রথমে বললেই পারতিস। ঠিক আছে যাওয়ার সময় নিস।
টোপর বলল, তুমি বাবাকে বেড়াতে যাওয়ার কথাটা বলো।
শাফিয়া বেগম বললেন, আচ্ছা বলব।
রাতে খাওয়ার টেবিলে শাফিয়া বেগম স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, টোপর কাল বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি বেড়াতে যাবে। কিছু টাকা চাইছে।
কাহহার সাহেব কয়েক দিন পিয়নকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়েছেন, রাজশাহী থেকে অথবা অন্য কোথাও থেকে টোপরের নামে কোনো চিঠি আসেনি। তাই কোনো সন্দেহ না করে জিজ্ঞেস করলেন, কত দিন পরে ফিরবে?
শাফিয়া বেগম বললেন, ও তো বলল, এক সপ্তাহ।
কাহহার সাহেব বললেন, এভাবে টাকা পয়সা নষ্ট করা উচিত নয়।
বাবা যে খুব কৃপণ টোপর তা জানে। সে না দিলেও মা দেবেই। তাই চুপ করে খেয়ে যেতে লাগল।
শাফিয়া বেগম বললেন, বন্ধুদের সঙ্গে কয়েক দিন বেড়িয়ে আসবে এতে আর কি এমন খরচ হবে। তা ছাড়া এটাই তো ওদের বেড়াবার বয়স। সংসারে ঢুকলে ওসব খেয়াল কি আর থাকবে?
কাহহার সাহেব বললেন, টাকা যে উপার্জন করে, সেই বুঝে টাকা কি জিনিস।
শাফিয়া বেগম বললেন, তুমি যে এত উপার্জন করছ, কার জন্য? ছেলেমেয়েদের জন্য তো?
কাহহার সাহেবের ততক্ষণে খাওয়া শেষ হয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে বললেন, তোমার আস্কারা পেয়ে, ও আজ এই রকম হয়েছে। কথা শেষ করে চলে গেলেন।
পরের দিন সকালে টোপর কমলাপুর স্টেশনে আটটা চল্লিশে পদ্মা এক্সপ্রেসে রওয়ানা দিল। রাত প্রায় নটার রাজশাহী পৌঁছে একটা হোটেলে রাত কাটিয়ে সকাল আটটায় টিকলীর দেওয়া ঠিকানা মতো মেডিকেল কলেজের গেটে অপেক্ষা করতে লাগল।
সাড়ে আটটায় ক্লাস শুরু হয়। টিকলী প্রতিদিন সোয়া আটটায় আসে। আজ রিক্সা থেকে নেমে টোপরকে দেখে খুব খুশি হল। এগিয়ে এস সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ?
টোপর সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আর থাকতে দিলি কই, তুই কেমন আছিস?
আমি এক রকম আছি। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। চলো কোথাও গিয়ে বসি। আজ আর ক্লাস করব না। তারপর যেতে যেতে বলল, এবার থেকে তুই করে বলবে না, তুমি করে বলবে। দেখছ না আমি তুমি করে বলছি।
কথাটা মন্দ বলিসনি। ঠিক আছে তাই হবে।
টিকলী হেসে উঠে বলল, এক্ষুণী তো বলে ফেললে।
টোপরও হেসে উঠে বলল, এত বছরের অভ্যাস বদলাতে একটু সময় লাগবে।
ওরা একটা হোটেলের কেবিনে বসল। তারপর টিকলী জিজ্ঞেস করল, কি খাবে বল?
টোপর বলল, নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছি, শুধু চা। তুমি কিছু খেলে খেতে পার।
টিকলী বলল, আমিও তাই। তারপর বেয়ারাকে দুকাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বলল, আমরা কিছুক্ষণ পরে নাস্তা করব।
বেয়ারা চা দিয়ে চলে যাওয়ার পর টোপর বলল, পরশু চিঠি না পেলে দুএক দিনের মধ্যে চলে আসতাম। এবার বল, যে চিঠিটা দিয়ে এসেছিলে তাতে কি লিখেছিলে।
টিকলী সব কিছু বলে বলল, তোমার মা-বাবা তোমাকে কিছু বলেন নি?
না। তবে আমার সঙ্গে বাবা কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।
উনি চিঠি পেয়ে আমার বাবার কাছে ফেরৎ দেওয়ার পরের দিন মা ভাইয়াকে সাথে নিয়ে এসেছিল।
তোমাকে নিশ্চয় খুব বকাবকি করে গেছেন?
তাদেরকে দেখে আমি তাই মনে করে খুব ভয় পেয়ে ছিলাম; কিন্তু না বকাবকি না করে বুঝিয়ে বললেন, তোদের ভালবাসায় বাধা দেব না। তবে তোরা এখন বিয়ে করবি না। টোপর পাশ করে উপার্জন করুক, আর তুইও ততদিনে ডাক্তারী পাশ কর। তারপর তোদের বিয়ের ব্যবস্থা আমরাই করব।
তুমি কি বললে?
আমি আবার কি বলব? মা তো খুব ভালো কথা বলেছে।
টোপর অসন্তুষ্ট গলায় বলল, আর আমি যে বিয়ে করব বলে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি তার কি হবে?
টোপর তুমি ভেবে দেখ, এখন বিয়ে করা কি উচিত হবে? এর পরিনামের কথা। আগে যা বলেছি, আবার এখনও তাই বলব।
টোপর রেগে গিয়ে বলল, এই কথা শোনাবার জন্য কি ডেকেছিস? আমাকে তো তুই চিনিস, যা বলি তা করেই ছাড়ি। আমি তোর কোনো কথাই শুনব না। চল, এক্ষুণি। কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি।
টিকলী বুঝতে পারল, টোপর খুব রেগে গেছে। তাই তুই করে বলতে শুরু করেছে। বলল, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? মা-বাবা রাজি ছিল না বলে আমি গোপনে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। এখন তারা যখন রাজি তখন করা কি ঠিক হবে? মা ঐ সব। বলে আমাকে ওয়াদা করিয়েছে, এখন যেন বিয়ে না করি। আমি মায়ের কাছে যা। ওয়াদা করেছি, তা খেলাপ করতে পারব না। ওয়াদা খেলাপ করা কবিরা গোনাহ। এটা হাদিসের কথা।
আর তুই যে আমাকে বলেছিলি, রাজশাহীতে গিয়ে বিয়ে হবে। সেই ওয়াদা খেলাপ করলে গোনাহ হবে না?
সেটার পিছনে কারণ ছিল। এখন কারণটা যখন নেই তখন আমাদের দুজনের মধ্যে সমঝোতা হওয়া উচিত।
উচিত অনুচিত আমি বুঝি না। আমি আজ এক্ষুণী তোকে বিয়ে করতে চাই।
তা হয় না টোপর, তুমি ভুল করতে যাচ্ছ। জেনে শুনে আমি তা করতে দিতে পারি না। আমি তোমার ভালো চাই। কতবার বলেছি এখন বিয়ে করলে তোমার উজ্জ্বল। ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাবে। আমাদের সুখ-শান্তির স্বপ্ন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে।
টোপর রাগ সহ্য করতে পারল না। দাঁড়িয়ে উঠে বলল, তোর মনে যদি এই ছিল, তা হলে ডেকে এনে আশা দিয়ে নিরাশ করলি কেন? চিঠিতেই তো জানাতে পারতিস। তুই বেঈমান, তোর সাথে আমার সম্পর্ক চিরদিনের জন্য শেষ। আমাকে আর কোনো দিন চিঠি দিবি না। কথা শেষ করে কেবিন থেকে বেরিয়ে হন হন করে চলে যেতে লাগল।
টিকলী ওর পিছনে আসতে আসতে বলল, প্লীজ টোপর যেও না, দাঁড়াও। তারপর বেয়ারাকে দেখতে পেয়ে তার হাতে দশ টাকার একটা নোট দিয়ে দ্রুত হোটেল থেকে বেরিয়ে এল।
ততক্ষণে টোপর একটা রিক্সায় উঠে ঠিকানা বলল।
টিকলী তাড়াতাড়ি করে রিক্সার কাছে যখন এল তখন রিক্সা চলতে শুরু করেছে।
টিকলী রিক্সার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, টোপর তোমাকে আল্লাহর দোহাই লাগে, দাঁড়াও।
টোপরের চোখে তখন পানি এসে গেছে। চোখ মুছতে মুছতে রিক্সাওয়ালাকে বলল, জৈারে চালাও।
টিকলীকে পিছনে ফেলে রিক্সা চলে গেল।
টিকলী যতক্ষণ রিক্সা দেখা পেল ততক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল। তখন তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। তারপর অদৃশ্য হয়ে যেতে চোখ মুখ মুছে একটা খালি রিক্সা দেখতে পেয়ে উঠে বসে বাসার ঠিকানা বলল।
ভাগ্নীকে অসময়ে বাসায় ফিরতে দেখে মাজেদা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, , চলে এলি যে, ক্লাস হয় নি? তারপর তার মুখ থমথমে দেখে বললেন, তোর কি শরীর খারাপ?
টিকলীর শুধু কান্না পাচ্ছে। অনেক কষ্টে সংযত হয়ে বলল, ভীষণ মাথা ধরেছে, তাই চলে এলাম। তারপর তাড়াতাড়ি নিজের রুমে এসে খাটে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
মাজেদা বেগম ভাগ্নীর মাথা ধরার কথা শুনে রুমে এসে তাকে কাঁদতে দেখে আতঙ্কিত স্বরে বললেন, খুব বেশি কি যন্ত্রণা হচ্ছে মা? কাউকে দিয়ে ডাক্তার আনাব?
টিকলী সামলে নিয়ে বলল, না, ডাক্তার আনতে হবে না। প্যারাসিটামল খেয়েছি। একটু পরে কমে যাবে। আপনি যান, আমি একটু ঘুমাব।
মাজেদা বেগম বললেন, তাই ঘুমা। ঘুমালে মাথার যন্ত্রণা কমে যাবে। তারপর? তিনি সেখান থেকে চলে এলেন।
.
০৫.
জিনিয়াদের বাসা নয়া পল্টনে, সে দেখতে শুনতে খুব ভালো। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় টিকলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। অনেকবার তাদের বাসায় গেছে। টেনে পড়ার সময় টিকলী যেদিন তার ভাইয়া আলীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, সেদিন তাকে জিনিয়ার খুব ভালো লাগে। তারপর একদিন কথায় কথায় টিকলীকে বলে ফেলে, তোর ভাইয়া কিন্তু দারুন হ্যাঁন্ডসাম।
টিকলী হেসে উঠে বলেছিল, তাই নাকি? তা ভাইয়ার পিছনে লাইন লাগাবি নাকি?
জিনিয়া লজ্জা পেয়ে মৃদু হেসে বলেছিল, ধেৎ, কি বাজে কথা বলছিস?
ওমা, এটা আবার বাজে কথা হবে কেন? তুই-ই তো বললি, ভাইয়া দারুন হ্যাঁন্ডসাম। মেয়েরা তো ঐ রকম ছেলেকেই পছন্দ করে। আমি যতদুর জানি, ভাইয়া এখনো কোনো মেয়ের দিকে নজর দেয়নি। তুই চাইলে এ ব্যাপারে আমি তোকে হেল্প করতে পারি।
তোর ভাইয়া যদি আমাকে পছন্দ না করে?
তোর মতো মেয়েকে কোনো ছেলেই অপছন্দ করতে পারে না। তুই আমার থেকে অনেক বেশি সুন্দরী।
জিনিয়া যে অসামান্য সুন্দরী সে কথা ছোট বেলা থেকে শুনে আসছে। তাই লজ্জা পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুইও কিন্তু কম না। তা না হলে টোপর ভাইয়ের মতো ছেলের মন কাড়তে পারতিস না।
আমাদের ব্যাপারটা আলাদা, আমরা ছোটবেলা থেকে একে অপরকে ভালবাসি। আসল কথাটা এবার বলে ফেলতো দেখি।
তুই টোপরের সঙ্গে প্রেম করে একেবারে গোল্লায় গেছিস। আমাকেও ঐ পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিস।
তা না হয় হল। এবার কথা না ঘুরিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দে।
তোর ভাইয়ার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করি, তারপর বলব।
টিকলী বলল, ঠিক আছে তাই বলিস।
প্রায় বছর দেড়েক পর ইন্টারে ভর্তি হয়ে জিনিয়া নিজের বার্থডে পার্টিতে টিকলীকে নিমন্ত্রণ করার সময় আলীকেও করল।
আলী বলল, মাফ করবেন ঐদিন আমার একটা প্রোগ্রাম আছে।
জিনিয়া অপমান বোধ করে মাথা নিচু করে নিল।
সেখানে টিকলী ছিল। জিনিয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, ভাইয়া, আমার বান্ধবী তোমাকে নিমন্ত্রণ করল, আর তুমি ডিনাই করে অপমান করলে। কাজটা কি উচিত হল?
আলী বলল, আমি অপারগতার কথা বলে মাফ চেয়েছি, এতে অপমান করার কি হল? তারপর জিনিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি আমার বোনের বান্ধবী, আপনাকে অপমান করার উদ্দেশ্য নিয়ে কথাটা বলিনি। যদি সত্যি সত্যি অপমান বোধ করে থাকেন, তা হলে আমি দুঃখিত এবং সে জন্য আবার মাফ চাইছি।
জিনিয়ার বদলে টিকলী বলল, তুমি বড় হলে কি হবে, আমার থেকে জ্ঞান তোমার অনেক কম। তারপর জিনিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ভাইয়া প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে নিমন্ত্রণ গ্রহণ না করা পর্যন্ত তুই মাফ করবি না।
জিনিয়া বলল, আমি তোর ভাইয়ার কে যে, আমার জন্য প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করবেন। তারপর আলীর দিকে চেয়ে বলল, দয়া করে প্রোগ্রামের পর যদি আসেন, তা হলেও কৃতার্থ হব। কথা শেষ করে টিকলীকে বলল, এখন চলি রে, আরো কয়েক জায়গায় যেতে হবে।
জিনিয়া চলে যাওয়ার পর টিকলী বলল, ও তোমার উপর খুব মনে কষ্ট পেয়েছে। আলী বলল, উনি যদি শুধু শুধু মনে কষ্ট পান আমি কি করব?
তুমি এখনো টিনার এজে রয়ে গেছ। ভার্সিটিতে পড়ছ, অথচ একটা মেয়ের মন বুঝতে পারলে না।
আলী রেগে উঠে বলল, দেখ, আজে বাজে কথা বলবি না। দেব এক থাপ্পড়।
টিকলী একটু দূরে সরে গিয়ে বলল, ঐ একটা কথাই শুধু জান দেব এক থাপ্পড়। আর একটা মেয়ে যে তোমাকে কেন নিমন্ত্রণ করল, তা জানতে পারলে না।
আলী আরো বেশি রেগে গিয়ে ওকে মারার জন্য এগিয়ে আসার উপক্রম করলে, টিকলী হাত তুলে বলল, দাঁড়াও, আগে আমাকে কথা শেষ করতে দাও, তারপর না হয় মেরো। জিনিয়া তোমাকে খুব পছন্দ করে, বলে ছুটে পালিয়ে গেল।
ছোট বোনের বান্ধবী হিসাবে আলী তাকে এতদিন দেখে এসেছে। আজ টিকলীর কথা শুনে রেগে গেলেও তার শেষের কথা শুনে মনে হোঁচট খেল। ভাবল, তাই বোধ হয় জিনিয়া যখনই বাসায় আসে তখনই আমার সঙ্গে দেখা করে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস। করে, চোখে চোখ পড়লেই ফর্সা মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সে সময় মনে কিছু না। হলেও এখন সেই সব কথা চিন্তা করে জীবনে এই প্রথম মনের মধ্যে কি রকম এক রকমের আনন্দ অনুভব করল। ভেবে রাখল, ওর জন্মদিনে যাবে। যাবে না বলে মিথ্যে প্রোগ্রামের কথা বলেছিল।
জিনিয়ার বার্থডে পার্টির দিন সকালে নাস্তার টেবিলে বাবাকে উদ্দেশ্য করে টিকলী বলল, আজ জিনিয়ার বার্থডে পার্টিতে যাব। একটা প্রেজেন্টেশান কিনতে কিছু টাকা লাগবে। আর গাড়িটাও নেব।
হালিম সাহেব বললেন, বার্থডে পার্টি করা যে ইসলামিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে নাজায়েজ, সে কথা তো তুই জানিস, তবু যাবি কেন? তোর তো তাকে এসব করতে নিষেধ করা উচিত ছিল।
টিকলী বলল, আমি নিষেধ করেছি, জিনিয়াও এসব করতে চায় না। সে কথা ওর মা-বাবা শুনে বললেন, এসব এখন সভ্য সমাজের ফ্যাশন। এসবের সঙ্গে প্রেস্টিজের প্রশ্ন রয়েছে। তা ছাড়া এটাতো কোনো অন্যায় কাজ না যে, গোনাহ হবে।
হালিম সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হায়রে সভ্য সমাজ, মুসলমান হয়ে নিজের দ্বীনকে না জেনে বিধর্মীদের রীতিনীতি মেনে নিজেদেরকে বড় মনে করছে। আজকাল লোকের টাকা হলেই পাশ্চাত্যের জীবন-ধারায় চলতে শুরু করছে। সভা সমিতি বা বাসায় যে কোনো ফাংসানে সাংস্কৃতির নামে যে নাচ গান হচ্ছে, সে সবও ইসলামের দৃষ্টিতে নাজায়েজ। মুসলমানরা আজকাল ধর্মীয় শিক্ষাকে এড়িয়ে কলেজ। ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আল্লাহ ও তার রসুল (দঃ) এর আদেশ নিষেধ মেনে চলছে না। আর সেই জন্য সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা অত্যাচারিত নিপীড়িত হচ্ছে। তবু তাদের জ্ঞান ফিরছে না। মুসলমানদের পরিণতি আরো যে কত অবনতি হবে তা আল্লাহকেই মালুম। যেতে চাস যা, তবে নাচ গান হওয়ার আগে চলে আসবি।
সাজেদা বেগম বললেন, ধর্মের বিধি নিষেধ আজকাল কয়জনে আর মেনে চলে। যারা জানে না তারা তো মানেই না। আর যারা জানে, তারাও মানে না। তারপর বললেন, তোমার অফিস যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
হালিম সাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ও তাইতো, তারপর ড্রেস চেঞ্জ করার জন্য রুমে চলে গেলেন।
সাজেদা বেগম স্বামীকে অনুসরণ করলেন।
মা বাবা চলে যাওয়ার পর টিকলী ভাইয়াকে বলল, বিকেলে তোমাকে নিয়ে মার্কেটে যাব, তাড়াতাড়ি ফিরো।
সে দেখা যাবে, বলে আলী নিজের রুমে চলে গেল।
বিকেলে টিকলী ভাইয়াকে নিয়ে নিউ মার্কেটে এসে দেশী বিদেশী তিন চারটে গল্পের ও একটা হাদিসের বই কিনল। তারপর ভাইয়াকে বলল, তুমি কিছু কিনবে না?
আলী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু কিনতে চায়। তবু বলল, আমি কিনে কি করব?
কেন, তুমি যাবে না?
সেদিন যাব না বললাম, আজ যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
কেন, সেদিন তো জিনিয়া তোমার প্রোগ্রামের পরও যেতে বলল।
আলী একটা বিশ্বনবী কিনল। তারপর ফেরার সময় কাঁটাবন থেকে একগুচ্ছ রজনী গন্ধা ও একটা গোলাপের তোড়া কিনে বাসায় ফিরল।
মাগরিবের নামায পড়ে দুভাই বোন জিনিয়াদের বাসায় রওয়ানা দিল।
জিনিয়া মা বাবার একমাত্র সন্তান। তার বাবা মোয়াজ্জাম সাহেব হার্ট স্পেশালিস্ট। সরওয়ার্দি হাসপাতালে আছেন। এলিফেন্ট রোডে বাড়ি করেছেন। বাড়ির নিচ তলায় চেম্বার।
জিনিয়া ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বান্ধবী টিকলীদের বাসায় যেত। সেই সময় তার ভাইয়ার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু সে কথা কাউকে বলে নি। ক্লাস টেনে উঠার পর টিকলী বুঝতে পারে। তাই একদিন চাপাচাপি করতে স্বীকার করে। জিনিয়া আজ বার্থডে পার্টির নিমন্ত্রণ করে এসে, বাবাকে বলল, ঐদিন একটা ছেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। তার ইন্টারভিউ নিবে। যদি পাশ করে, তা হলে তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব। অবশ্য ছেলেটা যদি আসে।
মোয়াজ্জাম সাহেব মৃদু হেসে বললেন, কিন্তু মা, চেম্বারের জন্য যে বিজ্ঞপ্তী দিয়েছিলাম, তার ইন্টারভিউ হয়ে গেছে। দুই জনকে এ্যাপয়েন্টমেন্টও দেওয়া হয়ে গেছে।
জিনিয়া বলল; আমি তো তোমার চেম্বারের জন্য কারো ইন্টারভিউ নিতে বলছি না। মোয়াজ্জাম সাহেব বেশ অবাক হয়ে বললেন, তবে কিসের জন্য? আগে ইন্টারভিউ নাও, পরে বলব।
মোয়াজ্জাম সাহেব মেয়ের মনের খবর একটু টের পেলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, জিনিয়া তোর বয়স কত হল বলতে পারিস?
তা পারব না কেন? উনিশ পেরিয়ে বিশে পড়েছে। তোমরা আদর করে ঘরে বসিয়ে না রেখে যদি আমাকে ঠিক সময়ে স্কুলে ভর্তি করতে, তা হলে এতদিনে বি.এ. পাশ করে এম.এ. পড়তাম।
মেয়েরা ম্যাচিওর হয় কত বছরে জানিস?
তোমাদের ডাক্তারী মতে তো কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের তারতম্য অনুসারে পনের থেকে আঠার বছর, তাই না বাবা?
তুই কি আউট বই অনেক পড়িস?
অনেক পড়ার সময় কোথায়? তবু কিছু কিছু পড়ি। এত কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? শোন, যা বললাম মনে রাখবে কিন্তু।
তোর মাকে ছেলেটার ইন্টারভিউ নিতে বলবি না?
জিনিয়া হেসে উঠে বলল, বলব, তবে তোমার কাছে পাশ করার পর। তারপর আমি এখন যাই বলে চলে গেল।
মোয়াজ্জাম সাহেব এতদিন মেয়ের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করেন নি। আজ তার কথা শুনে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, সে ম্যাচিওর হয়েছে।
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে নিমন্ত্রিত অতিথিরা এসে যাওয়ার পর জিনিয়ার মা মুকাররামা বেগম মেয়েকে বললেন, দেরি করছিস কেন? কেক কেটে পার্টির কাজ শুরু কর।
জিনিয়া বলল, টিকলীর জন্য অপেক্ষা করছি।
মুকাররামা বেগম জানেন, টিকলী ওর খুব অন্তরঙ্গ। অনেক বার এসেছে। অন্যান্য বান্ধবীদের চেয়ে সে যে অনেক ভালো তাও জানেন। তাই বললেন, ঠিক আছে, আর একটু অপেক্ষা কর।
প্রায় দশ মিনিট পর টিকলী ও আলী এসে পৌঁছাল।
আলীকে দেখে জিনিয়ার মন আনন্দে ছলকে উঠল। এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে টিকলীকে উদ্দেশ্য করে বলল, দেরি করলি কেন?
টিকলী সালামের উত্তর দিয়ে বই ও রজনীগন্ধার প্যাকেট তার হাতে দিয়ে বলল, ট্রাফিক জামে পড়েছিলাম।
জিনিয়া সেগুলো একজনের হাতে দিয়ে আলীর দিকে তাকিয়ে বলল, আসুন।
আলী জিনিয়াকে আগে অনেক বার দেখলেও আজকের অপরূপ সাজে সজ্জিতা জিনিয়া যেন অন্যজন। এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। বাস্তবে ছিল না। জিনিয়ার কথায় বাস্তবে ফিরে এসে বইয়ের প্যাকেট ও গোলাপের তোড়াটা তার হাতে দেওয়ার সময় বলল, দোওয়া করি, আল্লাহ যেন এই দিন আপনার জীবনে শতবার পার করান।
ধন্যবাদ বলে জিনিয়া তাদেরকে নিয়ে কেকের টেবিলের কাছে এল।
নাস্তা খাওয়ার পর জিনিয়ার বান্ধবীদের দুএকজন গান গেয়ে শোনাল। জিনিয়া একটা নজরুল সংগীত গাইল। এক ফাঁকে জিনিয়া বাবাকে ঈশারা করে আলীকে চিনিয়ে দিয়ে বলল, আমার বান্ধবী টিকলীর ভাইয়া।
ফাংসান শেষে সবাই চলে গেলে। টিকলী চলে যেতে চাইলে জিনিয়া বলল, আর একটু বস। তোর ভাইয়া আজ প্রথম এলেন, মা বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। তারপর মা-বাবাকে ডেকে নিয়ে এসে আলীকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার মা-বাবা।
আলী ওদের দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
মোয়াজ্জাম সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে আলীকে বসতে বলে নিজেরাও বসলেন।
তোমরা গল্প কর আমরা এক্ষুণী আসছি বলে জিনিয়া টিকলীর হাত ধরে তাকে। নিয়ে ভিতরে চলে গেল।
ওরা চলে যাওয়ার পর মোয়াজ্জাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি, বাবা?
আলী নাম বলল।
পড়াশোনা নিশ্চয় করছ?
জ্বী ম্যানেজমেন্টে অনার্স করছি?
তোমার বাবার নাম?
হালিম সাহেব।
উনি কি করেন?
সেক্রেটারীয়েটে চাকরী করেন।
আমি এক হালিম সাহেবকে চিনি। উনি মিনিষ্ট্ৰী অব হেলথে আছেন। তোমার বাবা কিসে আছেন?
জ্বী উনিই আমার বাবা।
তাই নাকি? জান বাবা, আমি স্কলারসিপ নিয়ে ডাক্তারী পাশ করার পর ফরেনে উচ্চ ডিগ্রী নিতে যাওয়ার ব্যাপারে উনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। একদিন যাব তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে। আলী বলল, বেশ তো যাবেন।
এমন সময় জিনিয়া টিকলীকে নিয়ে ফিরে এসে বলল, তোমাদের আলাপ শেষ হয়েছে?
মোয়াজ্জাম সাহেব কিছু বলার আগে আলী দাঁড়িয়ে উঠে বলল, এবার আসি।
মোয়াজ্জাম সাহেব বললেন, আবার এস।
জ্বী আসব বলে আলী সালাম বিনিময় করে টিকলীকে বলল, চলরে অনেক দেরী হয়ে গেল।
জিনিয়া ওদেরকে গাড়িতে তুলে দিতে গেল।
মোয়াজ্জাম সাহেব স্ত্রীকে বললেন, দুতিন দিন আগে জিনিয়া আমাকে বলেছিল, বার্থডে পার্টিতে একটা ছেলেকে আসতে বলেছি, এলে তার ইন্টারভিউ নিও। ছেলেটা যে টিকলীর ভাই সে কথা বলেনি। আমার মনে হচ্ছে, ছেলেটাকে জিনিয়া পছন্দ করে।
মুকাররামা বেগম বললেন, ছেলেটাকে তো বেশ সুন্দর বলে মনে হল। জিনিয়ার সঙ্গে মানাবে ভাল। তোমার কি মনে হয়?
আমার ও খুব পছন্দ। কিন্তু——?
এমন সময় জিনিয়াকে ফিরে আসতে দেখে মোয়াজ্জাম সাহেব থেমে গেলেন।
বাবার পাশে বসে জিনিয়া জিজ্ঞেস করল, ইন্টারভিউ নিয়েছ?
মোয়াজ্জাম সাহেব মেকী রাগ দেখিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ।
রেজাল্ট বল।
ফুল মার্ক পেয়ে ফেল।
জিনিয়া বুঝতে পারল বাবা জোক করছে। হেসে উঠে বলল, ফুল মার্ক পেয়ে কেউ ফেল করে বুঝি?
করে করে, আর কেউ না করলেও এই ছেলেটা করেছে।
কোন ডিভিশানে?
ফেলের আবার ডিভিশান আছে নাকি?
ফুল মার্ক পেয়ে যদি কেউ ফেল করে, তা হলে সেই ফেলের ডিভিশানও আছে। এবার সত্যি করে রেজাল্টের খবরটা বলত?
ফুল মার্ক যখন পেয়েছে তখন রেজাল্ট ভালো। ওর বাবাকে চিনি। তোকে তো একদিন আমার বাবার দুরাবস্থার কথা বলেছিলাম। আমি যে কত কষ্ট করে ডাক্তারী পাশ করেছি, তাও বলেছি। স্কলারশীপ পেয়ে ফরেনে পড়তে যাওয়ার জন্য অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। ওর বাবা সে সময় সাহায্য না করলে আমার যাওয়াই হত না। ঘটনাটা বলছি শোন, আমাদের সঙ্গে এক মন্ত্রীর মেয়ে পাশ করেছিল। সেই মন্ত্রী নিজের মেয়েকে পাঠাবার জন্য মিস্ত্রিী অব হেলথে ফোন করে আমার যাওয়া ক্যান্সেল করে দিয়েছিলেন। হালিম সাহেব, মানে ঐ ছেলেটার বাবা হেলথ মিনিষ্ট্রারের সঙ্গে এক রকম যুদ্ধ করে আমাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেন। আমি ওর ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারব না। আজ আমি যে এত বড় হয়েছি তা ওরই দয়াতে।
জিনিয়া খুব আনন্দিত হল। বলল, ফরেন থেকে এসে ওঁর সঙ্গে দেখা করনি?
তা আবার করিনি। তবে কাজের ব্যস্ততায় পরে আর অনেক বছর হল দেখা করতে পারিনি। আমি তো বাসা চিনি না। একদিন তোর সাথে যাব। এবার বল ছেলেটা তোকে পছন্দ করে কিনা?
তা কি করে বলব? টিকলীর সঙ্গে ওদের বাসায় অনেক বার গেলেও ওর সঙ্গে তেমন একটা আলাপ হয়নি বললেই চলে।
তুই ওদের বাসায় অনেকবার গেছিস বললি, ওরা যে খুব ধার্মীক তা নিশ্চয় জেনেছিস।
হ্যাঁ জেনেছি।
ধার্মীকরা কিন্তু মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার উপর খুব কড়াকড়ি করে থাকে। মেয়েরা নিজের ইচ্ছায় কোথাও যেতে পারে না। তুই স্বাধীন ভাবে মানুষ হচ্ছিস। ওদের ফ্যামিলীতে গিয়ে কি এ্যাডজাষ্ট করতে পারবি? ঐ ধরনের লোকেরা গোড়া প্রকৃতির।
তোমার অনুমানটা ভুল। ধর্ম মানুষকে সঠিক পথে চলার নির্দেশ দেয়। মানুষ ধর্ম থেকে দূরে সরে গেছে বলেই না, আজকাল মানুষ যত রকমের অসৎকাজ লিপ্ত হয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবীর সমাজে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে হলে কড়াকড়ি কিছু নিয়ম-কানুন তো থাকবেই। তবে গোঁড়ামির স্থান যে ইসলামে নেই, তা জানি। আর সুবিধাবাদিরা স্বার্থের কারণে ঐ কড়াকড়ি নিয়ম কানুনকেই গোঁড়ামী বলে থাকে। এটা তাদের একটা অহমিকা অথবা অজ্ঞতা।
মোয়াজ্জাম সাহেব মেয়ের কথা শুনে খুব অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ইসলাম সম্বন্ধে তুই এত কথা জানলি কি ভাবে?
জিনিয়া মৃদু হেসে বলল, টিকলীর কাছ থেকে। মাঝে মাঝে ওর থেকে ইসলামিক বই নিয়ে পড়াশোনা করি।
তোর কথা শুনে খুব খুশি হলাম মা। আমরা ধর্ম কর্ম যেমন জানি না তেমনি মানি না। আর তোকেও আমরা ঐসব শিক্ষা দিইনি। তুই যদি ঐ ফ্যামিলীতে গিয়ে সুখি হবি মনে করিস, তা হলে আমি হালিম সাহেবের সঙ্গে কথা বলব।
জিনিয়া বলল, না বাবা, এখন কিছু বলার দরকার নেই। আগে আলীর মতামতটা আমাকে জানতে দাও। যদি পজিটিভ হয়, তা হলে আমি তোমাদের জানাব। তারপর যা করার তোমরা করবে। তবে ও পাশ করার পর।
মোয়াজ্জাম সাহেব বললেন, ঠিক আছে, তুই আমাদের একমাত্র সন্তান। তোর অমতে কিছু করব না।
ঐদিন ফেরার পথে টিকলী ভাইয়াকে বলল, তুমি জিনিয়াদের বাসায় ঢুকেই, যেভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিলে যেন কখনো তাকে দেখনি।
আলী তার মাথায় আদরের একটা চাঁটি মেরে বলল, ভাইয়ার সঙ্গে ফাজলামী করছিস?
টিকলী গাল ফুলিয়ে বলল, সত্যি কথা বলতে মারলে,, এবার মিথ্যা কথা বলি তা হলে? আমার বান্ধবীকে অপরূপ সাজে সজ্জিত দেখে তুমি মুগ্ধ হয়ে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে।
আলী আবার তাকে মারতে গেল।
টিকলী হাতটা ধরে ফেলে বলল, আমি জিনিয়াকে ভাবি হিসাবে পেতে চাই। আর আজই মা-বাবাকে সে কথা জানাব।
আলী বলল, হাতটা ছাড়।
না, ছাড়লেই মারবে।
আলী মৃদু হেসে বলল, নারে মারব না। তোর সঙ্গে আমি একমত। এবার ছেড়ে দে, এক হাতে গাড়ি চালাতে অসুবিধা হচ্ছে, এ্যাকসিডেন্ট করে ফেলব।
টিকলী হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, ও তোমাকে স্কুল লাইফ থেকে ভালবাসে।
আলী কিছু বলল না, শুধু মৃদু হেসে গাড়ি চালাতে লাগল। তখন তার মন অজানা এক আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে।
কিছু বললে না যে?
কি বলব?
জিনিয়া তোমাকে স্কুল লাইফ থেকে ভালবাসে শুনে কিছু একটা তো বলবে।
আমি তো তা জানতাম না; কি বলব?
এখন তো জানলে।
আগে অনেকবার দেখলেও আজ দেখে সত্যিই আমি খুব মুগ্ধ হয়েছি।
শুধু মুগ্ধ হলে? ভালবাসতে ইচ্ছা করছে না?
তুই টোপরকে ভালবেসে খুব পেকে গেছিস। এবার চুপ কর নচেৎ আবার চাটি খাবি।
বাসায় ফিরে আলী কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারল না। জিনিয়া স্কুল লাইফ থেকে তাকে ভালবাসে শোনার পর থেকে কেবলই তার অনিন্দ্য সুন্দর মুখের ছবি মনে পড়তে লাগল। হঠাৎ কবিতা লেখার প্রেরণা পেল। যদিও জীবনে কোনো দিন কবিতা লেখেনি। মনের আবেগ চেপে রাখতে না পেরে খাতা কলম নিয়ে লিখতে শুরু করল।
তুমি চতুর্দশীর চাঁদ
অথবা সূর্য,
যা কিছু হওনা কেন
তোমার তুলনা শুধু তুমি।
তুমি শুকতারা
অথবা সন্ধ্যা তারা,
যা কিছু হওনা কেন।
তোমার তুলনা শুধু তুমি।
তুমি উষা লগ্নে পূব আকাশের রক্তিম আভা
অথবা পশ্চিম আকাশের সূর্যাস্তের গোধুলী লগ্ন,
যা কিছু হওনা কেন
তোমার তুলনা শুধু তুমি।
তুমি বিশ্বের শেষ্ঠা সুন্দরী।
অথবা বেহেস্তের হুর,
যা কিছু হওনা কেন।
তোমার তুলনা শুধু তুমি।
তুমি অতি মূল্যবান কোহীনুর হীরক খন্ড
যা শোভিত হয়েছিল শাজাহানের ময়ূর সিংহাসনে,
যা কিছু হওনা কেন।
তোমার তুলনা শুধু তুমি।
কবিতাটা লিখে বারবার পড়ে ও আলীর বিশ্বাস হচ্ছে না, এটা তার নিজের লেখা। ভাবল, মানুষ প্রেমে পড়লে বোধ হয়, অসাধ্য সাধনও করতে পারে। আরো কয়েকবার। পড়ে নিচে নিজের নাম ও তারিখ লিখল। তারপর কাগজটা খাতা থেকে কেটে ভাঁজ করে রেখে দিয়ে ভাবল, সময় সুযোগ মতো জিনিয়াকে দেবে।
পরেদিন কলেজে অফ পিরিয়ডে গল্প করতে করতে এক সময় টিকলী জিনিয়াকে। বলল, তোকে একটা সুখবর দেব, কি প্রেজেন্ট করবি বল।
জিনিয়া বলল, সেটা নির্ভর করছে সুখবরটার গুরুত্বের উপর।
এর থেকে গুরুত্ব তোর জীবনে আর কিছু নেই।
তা হলে মূল্যবান কিছু একটা দেব। এবার সুখবরটা বল।
ভাইয়া এতদিন তোকে দেখলেও কাল দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছে।
সত্যি বলছিস?
হারে সত্যি। মিথ্যে করেই বা বলব কেন? আমিও তো তোকে ভাবি করতে চাই।
যাহ্ গুল মারছিস।
আমার কথা বিশ্বাস না হলে আজই আমাদের বাসায় গিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করলেই সত্যি মিথ্যা প্রমাণ পেয়ে যাবি।
ঠিক আছে তাই যাব; তবে আজ নয়, কয়েক দিন পরে। এবার চল ক্লাসে যাই। সময় হয়ে গেছে।
টিকলীর কাছে কথাটা শোনার পর থেকে জিনিয়া আলীর সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। কয়েকদিনের কথা বললেও দুদিন পর টিকলী যখন বলল, চল না আজ আমাদের বাসায়, তখন প্রতিবাদ না করে তার সঙ্গে এল।
জিনিয়া প্রায় আসে টিকলীর সঙ্গে কলেজ থেকে। এলে খাওয়া দাওয়াও করে। সাজেদা বেগম তাকে মেয়ের মতই দেখেন। জিনিয়াকে তার খুব পছন্দ। তাই একদিন স্বামীকে সে কথা বলে বৌ করার কথা বলেছিলেন। হালিম সাহেব বলেছিলেন, মেয়েটাকে আমারও পছন্দ। তবে আলী এখন পড়াশোনা করছে। তাছাড়া এখনো ওদের বিয়ের বয়স হয়নি। এখন ওসব চিন্তা মাথায় এনো না। আল্লাহ ওদেরকে জোড়া করে থাকলে, আলীর পড়াশোনা শেষ করার পরও হবে।
আজ এসে প্রতিবারের মতো জিনিয়া সাজেদা বেগমকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন খালাআম্মা?
সাজেদা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছ? তোমার মা বাবা ভালো আছেন?
জিনিয়া বলল, আমরা সবাই ভালো আছি।
সাজেদা বেগম বললেন, যাও মা তোমরা মুখ হাত ধুয়ে এস, খেতে দেব।
খেতে বসে টিকলী মাকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া ফিরেছে?
হা ফিরেছে। এই তো কিছুক্ষণ আগে খেয়ে গেল।
খাওয়ার পর রুমে এসে টিকলী জিনিয়াকে বলল, আমার কথাটা সত্য মিথ্যা যাচাই করতে চাইলে ভাইয়ার রুমে যা।
জিনিয়া তাই চাচ্ছিল। তবু লজ্জা পেয়ে বলল, তোর ভাইয়া যদি কিছু মনে করে?
তা করতে পারে, তবে খারাপ কিছু করবে না, বরং ভালো কিছু করবে।
যদি খারাপ কিছু ভাবেন?
যদির কথা ভেবে প্রেমের পথে এগোন যায় না, তুই যা তো। তারপর তার একটা হাত ধরে ভাইয়ার রুমের দরজার কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, তেমন খারাপ কিছু হলে, আমি সামলাব। কথা শেষ করে টিকলী ফিরে এল।
জিনিয়া দুরু দুরু বুকে পর্দা ফাঁক করে বলল, আসতে পারি।
আলী খেয়ে এসে খাটে শুয়ে জিনিয়াকে কিভাবে কবিতাটা দিবে চিন্তা করতে করতে তার তন্দ্রামত এসেছিল। হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠে আসতে পারি শুনে তন্দ্রা ছুটে গেল। চোখ খুলে দরজায় জিনিয়াকে দেখে চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলল, আপনি?
জিনিয়া সালাম দিয়ে কয়েক সেকেন্ড তার চোখের দিকে তাকিয়ে রাগের বদলে। অনুরাগ দেখে ভিতরে ঢুকে বলল, কেন আসতে নেই বুঝি?
আলী সালামের উত্তর দিয়ে বলল, না, মানে আপনি কখনো আমার রুমে আসেন নি তো, তাই আর কি? তারপর একটা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, বসুন।
জিনিয়া বসে বলল, ধন্যবাদ। তারপর বলল, আপনার বিরুদ্ধে দুটো নালিশ আছে।
আলী বেশ অবাক হয়ে বলল, নালিশ?
হা নালিশ। প্রথমটা হল, আমি আপনার ছোট বোনের বান্ধবী তবু আপনি করে বলেন। দ্বিতীয়টা হল, আপনি আমাকে খুব এড়িয়ে চলেন।
আলী কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জিনিয়া বলল, কিছু বলছেন না যে?
আলী বুঝতে পারল, টিকলী নিশ্চয় আমার কথা ওকে বলেছে। আর আজ সেই-ই একে পাঠিয়েছে। বলল, ঠিক আছে, এবার থেকে তুমি করে বলব। তারপর কবিতাটা একটা বইয়ের ভিতর থেকে বার করে এনে তার হাতে দিয়ে বলল, এবার থেকে এড়িয়ে চলব না বলে এটা লিখেছি।
জিনিয়া ভাবল, নিশ্চয় এটা প্রেমপত্র। আনন্দে কেঁপে উঠল। কাঁপা গলায় বলল, এখনই পড়তে পারি?
পার।
কবিতাটা পড়তে পড়তে জিনিয়ার হার্টবিট বেড়ে গেল। আনন্দে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
তাই দেখে আলী ভয় পেয়ে বলল, কি হল কাঁপছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
জিনিয়া সামলে নিয়ে এগিয়ে এসে তার দুটো হাত ধরে বলল, তুমি আমাকে এত ভালবাস, এযে আমি ভাবতেই পারছি না। আনন্দের চোটে তার চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, অসাবধানে তুমি করে বলে ফেললাম। মাফ করে দিন।
আলী আলহামদুলিল্লাহ বলে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, চেয়ারে বস।
বসার পর বলল, মাফ চাইছ কেন? এটাই তো স্বাভাবিক। এবার থেকে তুমি করেই বলবে।
এরপর থেকে তাদের বিভিন্ন পার্কে অভিসার চলতে থাকে। জিনিয়া আলীকে মাঝে। মাঝে বাসায় নিয়ে আসে। মা বাবাকে যা জানাবার জানিয়েছে। মোয়াজ্জাম সাহেব ও মোকাররমা বেগম আলীর বাবার সঙ্গে দেখা করে কাবিন করে রাখতে চেয়েছিলেন; কিন্তু জিনিয়া তা করতে দেয়নি। বলেছে, আগে আলী পড়াশোনা শেষ করুক তারপর।
এই ঘটনা এক বছর আগের। এর মধ্যে আলী ও জিনিয়ার সম্পর্ক আরো অনেক গম্ভীর হয়েছে।
যেদিন জিনিয়া ভার্সিটিতে টিকলীর চিঠি টোপরকে দেয়, সেদিন দূর থেকে হঠাৎ আলীর নজরে পড়ে। টোপর চলে যাওয়ার পর আলী জিনিয়ার কাছে এসে বলল, টোপরকে কি যেন দিলে দেখলাম।
জিনিয়া মৃদু হেসে বলল, চিঠি দিলাম।
আলী চমকে উঠে বলল, চিঠি?
হ্যাঁ চিঠি। একজন দিতে দিয়েছিল।
একজনটা কে শুনি?
বলা যাবে না।
কেন?
তাও বলা যাবে না।
এমনি টোপরকে চিঠি দিতে দেখে আলীর জেলাস হয়েছিল। এখন জিনিয়াকে টাল বাহানা করতে দেখে সন্দেহ হল। বলল, না বললে, মাইন্ড করব কিন্তু।
দুঃখিত, তবু বলতে পারব না।
আলীর সন্দেহটা আরো দৃঢ় হল। একটু রাগের সংগে বলল, মনীষীরা যে বলেছেন, নারীরা ছলনাময়ী, তার প্রমাণ পেলাম।
জিনিয়া আহত স্বরে বলল, মনীষীদের কথা সব নারীর জন্য প্রযোজ্য নয়।
তা হয় তো হবে, তবে তুমিই তো তার প্রমাণ দেখালে।
জিনিয়ার চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করছ?
আগে করতাম না, এখন করতে বাধ্য হলাম।
সামান্য একটা চিঠির জন্য তুমি আমাকে অবিশ্বাস করতে পারলে? স্কুল জীবন থেকে যাকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসি, যার জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করতে পারি, সে কিনা এই সামান্য কারণে আমাকে অবিশ্বাস করল। আল্লাগো এ কথা জানার আগে আমার মৃত্যু দিলে না কেন? কথা শেষ করে জিনিয়া চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল।
আলী তার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল, টোপর ছোটবেলা থেকে টিকলীকে ভালবাসে। এখন আবার জিনিয়ার সঙ্গে কি ভালবাসায় মেতেছে? কথাটা বিশ্বাস করতে পারল না। তবু সিদ্ধান্ত নিল, প্রথমে চিঠির রহস্য উদঘাটন করবে, তারপর জিনিয়ার সঙ্গে দেখা করবে।
.
০৬.
টিকলীর উপর প্রচন্ড রাগ ও অভিমান করে টোপর সেই দিন রাতেই নাইট কোচে ঢাকা রওয়ানা দিয়ে পরের দিন বেলা দশটায় বাসায় পৌঁছাল।
শাফিয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কিরে এত শিগ্রী ফিরে এলি যে? তারপর তার মুখের অবস্থা দেখে আতঙ্কিত স্বরে বললেন, অসুখ বিসুখ করেনি তো?
টোপর ফেরার পথে চিন্তা করেছে টিকলীর চিঠিটা যদি মা বাবা তার মা-বাবার কাছে না দিত, তা হলে টিকলীর মা রাজশাহী যেত না, আর টিকলীও বিয়েতে অমত করত না। এই কথা ভেবে টিকলীর চেয়ে নিজের মা বাবার উপর রাগটা বেশি হল। তাই এখন মায়ের কথা শুনে রাগে ফেটে পড়ল। বলল, টিকলীর চিঠি তোমরা আমাকে দিয়ে তার মা-বাবাকে দিলে কেন?
শাফিয়া বেগম বললেন, তুই এসব কি বলছিস? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
যা বলছি তা বুঝেও না বোঝার ভান করছ কেন? টিকলী রাজশাহী যাওয়ার আগে তাদের বুয়ার মেয়ের হাতে আমাকে দেওয়ার জন্য যে চিঠি দিয়েছিল, সেটা তোমরা নিয়ে আমাকে না দিয়ে তার মা-বাবার কাছে দিয়েছ, এ কথা অস্বীকার করতে পারবে?
তোকে একথা কে বলেছে?
কে আবার বলবে? আমি কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে রাজশাহী গিয়ে টিকলীর সাথে দেখা করেছি। বাবা না হয় রাগি মানুষ। কিন্তু তুমি জেনে শুনেও এমন কাজ করতে পারলে? এ জন্যেই বোধ হয় লোকে বলে, সৎ মা কখনো আপন মায়ের মতো হয় না।
শাফিয়া বেগম আহত স্বরে ভিজে গলায় বললেন, এমন কথা তুই বলতে পারলি? আমি কি তোকে সৎ ছেলের নজরে দেখি? তোকে নিজের পেটের ছেলেমেয়ের চেয়ে বেশি ভালবাসি। যখন যা আবদার করেছিস, তোর বাবার বকুনী খেয়েও তা পূরণ করেছি। কথা শেষ করে আঁচলে চোখ মুছলেন।
তাই যদি হয়, তবে আজই বাবাকে বলে টিকলীর সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যবস্থা কর।
তা না হয় করলাম, কিন্তু তুই তো জানিস ওদের সঙ্গে আমাদের অনেক দিন থেকে মনোমালিন্য। ওরা কি রাজি হবে? তা ছাড়া টিকলী ডাক্তারী পড়ার জন্য মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে।
বিয়ের পরও টিকলী পড়বে। তোমরা ওর মা বাবার কাছে প্রস্তাব দাও। রাজি না হলে অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।
ঠিক আছে, তোর বাবা ফিরে এলে বলব, এখন যা জামা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে আয়, আমি নাস্তা রেডি করছি।
কাহহার সাহেব অফিস থেকে বিকেলে ফিরলেন।
শাফিয়া বেগম চা-নাস্তা দিয়ে বললেন, টোপর ফিরেছে।
কাহহার সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরল যে?
ও বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যায় নি।
কোথায় গিয়েছিল তা হলে?
রাজশাহী।
রাজশাহী?
হ্যাঁ আমাদের কাছে মিথ্যে করে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে হালিম সাহেবের মেয়ে টিকলীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তার কাছে চিঠির কথা জেনে এসে আমাদেরকে দোষি করে যা-তা বলল। আরো বলল, আমরা যেন হালিম সাহেবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিই।
কাহহার সাহেব রেগে উঠে চিৎকার করে বললেন, ওর এত বড় সাহস? দুষমনের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়? নিজেকে কি মনে করে? কোথায় মন দিয়ে লেখাপড়া করবে, তা না করে বিয়ে করতে চায়। আমি ওর বিয়ে করা বের করছি, ওকি এখন। বাসায় আছে?
তুমি অত চেঁচাচ্ছ কেন? যা বলার আস্তে বল।
কি বললে, আমি চেঁচাচ্ছি। তুমি, হ্যাঁ তুমিই তো ওর মাথা খেয়েছ। তোমার, আস্কারাতেই ওর এত সাহস। তারপর হন হন করে টোপরের রুমে গিয়ে তাকে শুয়ে থাকতে দেখে বললেন, তুই নাকি হালিম সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করতে চাস?
টোপর উঠে বসে মাথা নিচু করে রইল।
চুপ করে আছিস কেন উত্তর দে।
টোপর ভয় পেলেও সামলে নিয়ে বলল, মাকে তো সে কথা বলেছি।
ওদের সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের মনোমালিন্য। সে জন্য যখন তুই তার মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করতিস তখন নিষেধ করেছি। তবু ঐ মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস?
প্রতিবেশির সঙ্গে মনোমালিন্য কি চিরকাল রাখতে হবে?
খুব তো উপদেশ দিচ্ছিস, এখন বিয়ে করলে বৌকে পালবি কি করে? মনে করেছিস, বাবার টাকা আছে চিন্তা কি? শোন, এখন বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে মাষ্টার্স শেষ কর। তারপর তোকে যে ফরেনে পাঠাব, সে কথা তো বলেছি। ফরেন থেকে ফিরে এসে উপার্জন করতে শেখ। তারপর বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করবি।
শোন বাবা, আমি কয়েক দিনের মধ্যে হালিম সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। বিয়ের পর সে যেমন পড়ছে পড়বে। আর আমার ব্যাপারে তুমি যা বললে তাই হবে। ফরেন থেকে এসে উপার্জন করতে শিখে ওকে ঘরে তুলব।
কাহহার সাহেব আরো বেশি রেগে গিয়ে বললেন, খুব সেয়ানা হয়ে গেছিস তাই? নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করেছিস। আরে মুখে বলা আর কাজে পরিণত করা যে। কত দুঃসাধ্য, তাতো জানিস না।
আমি দুঃসাধ্যকে সাধন করে দেখাব।
খুব বড় বড় কথা বলতে শিখেছিস দেখছি। তুই আমার কথা শুনবি, না আমি তোর কথা শুনব? লেখাপড়া করে বাবার সঙ্গে তর্ক করতে তোর লজ্জা করছে না? আমার শেষ কথা, এখন বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে লেখাপড়া কর। আর যদি নিজে কিছু কর, তা হলে এ বাড়িতে তোমার জায়গা হবে না। তারপর তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।
শাফিয়া বেগম এতক্ষণ দরজার আড়ালে ছিলেন। এবার ভিতরে এসে বললেন, তুই পাগলামী করিসনি বাবা। তোর বাবাকে তো চিনিস, যা এক রোখা মানুষ, রাগের মাথায় কি করতে না কি করে বসে।
টোপর বলল, তুমি এখন যাও, তোমরা কেউ আমাকে বোঝার চেষ্টা করনি। আমিও বলে রাখছি, ঐ মেয়েকেই আমি এ বাড়ির বৌ করে নিয়ে আনবই।
তিন চার দিন টোপর বাসা থেকে বের হল না। শুয়ে বসে কি করবে না করবে ভেবে কাটাল। ভেবেছিল, বিয়ে করে টিকলীকে নিয়ে এক সপ্তাহ হোটেলে আনন্দ ফুর্তি করবে। তার বদলে, টিকলী তাকে ফিরিয়ে দিল?
শাফিয়া বেগম বার বার কি হয়েছে জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর না পেয়ে স্বামীকে কথাটা জানাল।
কাহহার সাহেব ছেলের রুমে এসে বললেন, তোর কি হয়েছে? অসুখ বিসুখ হলে ডাক্তার দেখা। চুপচাপ বাসায় বসে শুয়ে থাকলে অসুখ সারবে।
টোপর মিথ্যে করে বলল, তেমন কিছু হয়নি, ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ এনে খাচ্ছি।
ওষুধে কাজ না হলে ডাক্তারকে রিপোর্ট দে।
ঠিক আছে যাব।
যাব বলছিস কেন? এক্ষুণী যা, তারপর তিনি চলে গেলেন।
বাবা চলে যাওয়ার পর টোপর ড্রেস চেঞ্জ করে সাগরের বাসায় গেল।
সাগর বাসায় ছিল। তাকে দেখে বলল, কি ব্যাপার, কদিন পাত্তা নেই যে? মনে হচ্ছে অসুখ-বিসুখ করেছিল।
টোপর বলল, না ওসব কিছু হয়নি। তোকে একদিন বলেছিলাম না, খুব শিঘ্রী আমি টিকলীকে গোপনে কাজি অফিসে বিয়ে করব।
হ্যাঁ, বলেছিলি তা হল না বুঝি?
হয়নি। টিকলী রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়ছে। সেখানে যাওয়ার আগে এখানে করতে চাইলে বলেছিল, রাজশাহীতে করবে। তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে এক সপ্তাহ আগে গিয়েছিলাম। তারপর যা কিছু ঘটেছে সব বলল।
সাগর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুই বড় বদরাগী। আরে বাবা, প্রেমের ব্যাপারে বদরাগী হলে সাকসেসফুল হওয়া যায় না। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হয়। টিকলীর কথা শোনার পর তার কথায় রাজি হয়ে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করা তোর উচিত ছিল। যদি করতিস, তা হলে বিয়েতে সে নিজেই রাজি হয়ে যেত। তোকে একটা কথা বলি শোন, আজকাল প্রায় সব ছেলেরই একাধিক প্রেমিকা থাকে। আরে এক টিকলীকে নিয়ে অত দুর্ভাবনা করছিস কেন? আরো কতো টিকলী রয়েছে। তাদের দিকে মন দে। দেখবি তখন আর আগের টিকলীর কথা মনে পড়ছে না। আর মেয়েরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। তাদেরও একাধিক প্রেমিক আছে। অবশ্য মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে চালাক। কয়েকজনের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে যার বাবার আর্থিক অবস্থা সব থেকে ভালো, তাকে বিয়ে করে।
টোপর বিরক্ত কণ্ঠে বলল, আমরা ওদের দলে নই। আমাদের ব্যাপারটা তো তোকে বলেছি।
ওদের দলে এতদিন ছিলি না তো কি হয়েছে? এখন হয়ে যা।
তা সম্ভব নয় সাগর।
তা হলে আর কি করবি, টিকলীর ডাক্তারী পাশ করা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর তুই যদি চাস, তা হলে আমরা, মানে বন্ধু বান্ধবরা রাজশাহী গিয়ে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করে আসতে পারি।
ভেবে দেখি, তারপর তোকে জানাব।
তাই ভেবেই জানাস। এখন শোন, পরশু আমরা ভার্সিটিতে হরতাল ডেকেছি। ভিসির বাসাও ঘেরাও করা হবে। মিছিল মিটিং হবে। তুইও থাকবি। তারপর একটা পিস্তল এনে তার হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখ, কাজে লাগতে পারে।
টোপর আতঙ্কিত স্বরে বলল, না না, এটা লাগবে না।
আরে রাখতো, কখন কি হয় বলা যায়। তারপর জোর করে প্যান্টের পকেটে দিয়ে বলল, তুই একদম কাপুরুষ।
সাগরের কথা শুনে টোপরের রক্ত গরম হয়ে গেল। বলল, দেখ কাপুরুষ বলবি।
কাপুরুষ নয় তো কি? তা না হলে প্রেমিকার কথা শুনে ফিরে আসতিস না। এখন দেখছি তোদের ব্যাপারটা আমাকেই মেটাতে হবে।
এমন সময় একটা কাজের মেয়ে চা-নাস্তা দিয়ে গেল। সাগর বলল, এখন ওসব কথা বাদ দিয়ে নাস্তা খেয়ে নিই আয়, আমাকে একটু বেরোতে হবে।
হরতালের দিন সাগরের পার্টির ছেলেরা ক্যাম্পাস ঘিরে রেখেছিল। বিপক্ষ পার্টির ছেলেরা হরতাল করতে দেবে না বলে শ্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করলে দুদলে যুদ্ধ বেধে গেল। বোমা ও গোলাগুলির শব্দের ভার্সিটি কেঁপে উঠল। পুলিশরা আগের থেকে পাহারায় ছিল। তারা প্রথমে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করল। শেষে রাঠি চার্জ শুরু করল। ছাত্ররা অনেকে আহত হয়ে ধরা পড়ল। পুলিশরাও অনেকে আহত হল। অনেক ছাত্র পালাতে পারলেও টোপর পারল না। কারণ সে আহত হয়ে পড়েছিল। পুলিশ তাকে এ্যারেস্ট করে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে গেল। সার্চ করে তার কাছে পিস্তল পেয়ে হাজতে পাঠিয়ে দিল।
সাগর তাকে ছাড়াবার জন্যে অনেক চেষ্টা করল। কাহহার সাহেবও অনেক চেষ্টা; করলেন। কিন্তু কোনো কাজ হল না।
অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে টোপরের তিন মাসের জেল হল।
শাফিয়া বেগম জানতে পেরে স্বামীর উপর খুব রেগে গেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, লোক কৃপণ হয় শুনেছি, তাই বলে টাকা খরচের ভয়ে নিজের ছেলেকে থানা থেকে ছাড়াবার ব্যবস্তা করবে না, একথা কখনো শুনিনি।
শাফিয়া বেগমের অনুমান ঠিক, থানা কাহ্হার সাহেবের কাছে এক লাখ টাকা চেয়েছিল। কাহ্হার সাহেব রাজি হননি। তাই স্ত্রীর কথায় কিছু না বলে চুপ করে। রইলেন।
জেলে টোপরের সঙ্গে আসলাম নামে একটা ছেলের পরিচয় হল। সে বড় লোকের শিক্ষিত ছেলে। চাকরী না পেয়ে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মিশে খুন, ছিনতাই ও রাহাজানী করে বেড়াত। কিছুদিন আগে ধরা পড়ে জেলে এসেছে। সে হিরোইনের নেশা করে। জেলের মধ্যেও গার্ডদের একজনকে হাত করে প্রতিদিন নেশা করে। আগে সন্ত্রাসী করে বেড়ালেও হিরোইনের নেশা ছিল না। একটা মেয়ে কয়েক বছর তার সঙ্গে প্রেম করে অন্য ছেলেকে বিয়ে করে। তাকে ভুলে থাকার জন্য হিরোইন নেশা শুরু করে।
টোপর একদিন তাকে নেশা করতে দেখে ফেলে। সে কথা জানিয়ে আসলামকে নিষেধ করল।
আসলাম তাকে তার সব কথা বলল। তারপর টোপরের সবকিছু জানতে চাইল।
টোপরও অকপটে সব কিছু বলল।
আসলাম বলল, আপনার সঙ্গে আমার অনেক মিল। আপনার বাবার মত আমার বাবাও কৃপণ। আপনিও প্রেমে ছ্যাক খেয়েছেন, আমিও খেয়েছি। সব কিছু ভুলে থাকার জন্যে আমি হিরোইনের নেশা করি। আপনি একদিন একটু করে দেখুন, কিভাবে সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।
টোপরের তখন টিকলীর কথা মনে পড়ল। সে কি সত্যি সত্যি আমাকে ছ্যাক দিবে। তার মন বলে উঠল, না না তা দিতে পারে না। টিকলী সেরকম মেয়েই নয়। আবার ভাবল, ডাক্তারী পাশ করতে পাঁচ-ছ-বছর সময় লাগবে। এতদিন তার অপেক্ষায় থাকব কি করে?
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আসলাম বলল, কি এত ভাবছেন? হিরোইনের নেশা করলে সব রকমের চিন্তা ভাবনা হারিয়ে যাবে। মনে অনাবিল শান্তি পাবেন।
টোপর কোন কথা না বলে তার কাছ থেকে চলে গেল। কয়েকদিন ধরে টোপর চিন্তা করল, বাবা ইচ্ছা করলে থানায় টাকা দিয়ে তাকে ছাড়াতে পারত; কিন্তু অনেক টাকা দিতে হবে ভেবে ছাড়ায়নি। আর সৎ মা না হয়ে যদি নিজের মা হত, তা হলে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে হলেও ছাড়াবার ব্যবস্থা করত। সে জন্যে মা বাবার ওপর প্রচণ্ড অভিমান হল। টিকলীও তার সঙ্গে বেইমানী করল। প্রাণের বন্ধু হয়েও সাগর তাকে ছাড়াল না। দিনের পর দিন এইসব চিন্তায় তার মনে ক্ষত বিক্ষত হয়ে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। সেই জ্বল সহ্য করতে না পেরে একদিন আসলামকে বলল, আমি হিরোইনের নেশা করব।
আসলাম মৃদু হেসে তার পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, আমাদের গ্রাম দেশে একটা কথা প্রচলন আছে, পেঁকি যতই মাথা চালাক, গড়ে তাকে পড়তেই হবে। আমি জানতাম, আপনি হিরোইনের নেশা করতে বাধ্য হবেন।
সেদিন থেকে টোপর হিরোইনের নেশা শুরু করলো। সেই সাথে আসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠল। মা-বাবা দেখা করতে এলেও দেখা করল না।
টোপর রাগ করে চলে যাওয়ার পর টিকলীর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কয়েক দিন গোপনে কান্নাকাটি করল। তারপর সব কিছু জানিয়ে জিনিয়াকে চিঠি লিখল। সেই সাথে টোপরকে লিখল
প্রিয়তম টোপর,
হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা পাঠালাম, গ্রহণ করে ধন্য করো। সেদিন তুমি রাগ করে চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যে অন্তরজ্বালায় জ্বলছি, তা কবে নিভবে জানি না। তুমি হয়তো মনে করেছ, আমি তোমার সঙ্গে বেঈমানী করেছি। এটা সত্য কিনা উপরের মালিক জানেন। তুমি আগেও যেমন আমার মন প্রাণ জুড়ে ছিলে, এখনো তেমনি আছ এবং আমৃত্যু পর্যন্তও থাকবে। তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কোনো ছেলের কথা ভাবা তো দূরের কথা, প্রয়োজন ছাড়া কারো দিক মুখ তুলে তাকাইনি। মায়ের কাছে ওয়াদা না করলে তোমাকে সেদিন ফিরিয়ে দিতাম না। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। কারণ আমি আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তোমাকে ভালোবাসি। আমার বিশ্বাস তুমিও আমাকে একইরকম ভালবাস এবং আমাকে ছাড়া তুমিও বাঁচবে না। সেই বিম্বাসের জোরে আমি ক্ষমা চাইছি। আশা করি তা পাব। আবার বলছি তুমি বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করো না, পার্টির কাজও। করো না। ওসব বাদ দিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আর প্রতি মাসে অন্তত একবার হলেও এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে। বেশি কিছু লিখে তোমাকে বিরক্ত করব না। চিঠি পাওয়া মাত্র উত্তর দিবে। আর কবে আসবে জানাবে।
আল্লাহ পাকের দরবারে তোমার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে আর একবার হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা জানিয়ে ইতি টানলাম।
তোমার প্রিয়তমা
টিকলী
লেখা শেষ করে দুটো চিঠি একসঙ্গে একটা খামে ভরে পোস্ট করে দিল।
জিনিয়া যেদিন চিঠি পেল সেদিন ভার্সিটিতে গোলমাল হয়ে টোপর এ্যারেস্ট হয়েছে। পরের দিন কাগজে অন্যান্যদের সঙ্গে তার ছবি দেখে ও ঘটনা পড়ে যেমন অবাক হল, তেমনি দুঃখও পেল। ভাবল, টিকলীও নিশ্চয় কাগজে খবরটা পড়েছে। কয়েক দিন অপেক্ষা করা যাক। টোপর ভাইকে নিশ্চয় তার বাবা থানা থেকে ছাড়িয়ে আনবেন। তারপর তাকে চিঠি দেবে।
হালিম সাহেব কাগজে টোপরের কির্তীকলাপের কথা পড়ে স্ত্রীকে ডেকে কাগজে ছবি ও লেখাটা দেখিয়ে বললেন, পড়ে দেখ।
সাজেদা বেগম পড়ে আতঙ্কিত স্বরে বললেন, ভাগ্যিস আমি গিয়ে টিকলীকে বুঝিয়ে বলে এসেছিলাম। নচেৎ সর্বনাশ হয়ে যেত। শুনেছিলাম, কাহহার সাহেবের ছেলেটা ভালো ছাত্র। এটাই বুঝি তার প্রমাণ। তারপর বললেন, আল্লাহ যা করেন সবার ভালর জন্যই করেন। এবার টিকলীর ভুল ভাঙ্গবে।
টিকলী খবরটা পড়ে খুব দুঃখ পেলেও বিশ্বাস করল না। ভাবল, মিছিলে ছিল বলে আহত হয়ে এ্যারেস্ট হয়েছে। তার বাবা ছাড়িয়ে নেবে। মনে হয় চিঠিটা পাইনি। পেলে নিশ্চয় মিছিলে যেত না। জিনিয়া নিশ্চয় চিঠি দিয়ে সব কিছু জানাবে। এইসব চিন্তা করে তার চিঠির অপেক্ষায় রইল।
বেশ কিছু দিনের জন্য ভার্সিটি বন্ধ দিয়েছে। টোপরকে চিঠি দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে আলি জিনিয়ার ধারে কাছে আসে না। জিনিয়া ভার্সিটিতে কয়েকবার তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু আলি তাকে পাত্তা না দিয়ে সরে গেছে। আজ থাকতে না পেরে জিনিয়া আলিদের বাসায় এল।
সাজেদা বেগম ছাড়া বাসায় কেউ নেই। হালিম সাহেব অফিসে চলে গেছেন। আলি বেশ কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। সাজেদা বেগম জিনিয়াকে দেখে হাসিমুখে বললেন, বান্ধবী নেই বলে আসতে নেই বুঝি?
জিনিয়া সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, বাবা একা একা কোথাও যেতে দেন। আজ বাবাকে এখানে আসার কথা বলে গাড়ি নিয়ে এসেছি। টিকলীর চিঠি পেয়েছেন? ও কেমন আছে?
সাজেদা বেগম বললেন, চিঠি দেয় না। দুএকদিন ছাড়া ফোন করে। কালও করেছিল, ভালো আছে।
জিনিয়া আলির কথা জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পেল। তাই বলল, খালুজান বুঝি অফিসে গেছেন?
হ্যাঁ মা, আলিও নেই। বেশ কিছুক্ষণ হল বাইরে গেছে।
এখন আসি খালাআম্মা।
ওমা সেকি? আসতে না আসতে যাবে কি? বস, নাস্তা খেয়ে যাবে।
না খালাআম্মা, নাস্তা খেয়ে এসেছি।
খেয়ে এসেছ তো কি হয়েছে? খালাআম্মার কাছে এসে শুধু মুখে ফিরে যেতে নাই। এমন সময় আলিকে আসতে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, টিকলী নেই বলে জিনিয়া এতদিন পরে এল। এখন আবার কিছু না খেয়ে চলে যেতে চাচ্ছে। তুই ওর সঙ্গে গল্প কর, আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। কথা শেষ করে চলে গেলেন।
জিনিয়া সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ?
আলি গম্ভীর স্বরে সালামের উত্তর দিয়ে একটা সোফায় বসল।
জিনিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, কেমন আছ বললে না যে?
আমার ভালো মন্দ জেনে আর কি হবে? টোপরের তিন মাসের জেল হয়েছে। শুনেছ?
জিনিয়া চমকে উঠে বলল, না শুনিনি।
কি ব্যাপার চমকে উঠলে যে? মনে হচ্ছে টোপরের কথা শুনে খুব দুঃখ পেয়েছ?
তা পেয়েছি, তবে তুমি যা ভাবছ তা সত্য নয়। আচ্ছা, তুমি আমাকে এত নীচ ভাবতে পারলে কি করে? একটা কথা মনে রেখ, সেই ক্লাস নাইন থেকে তুমি আমার হৃদয়ে আসন গেড়ে বসে আছ। সেখানে আর কারো স্থান নেই। সেদিন টোপরকে যে চিঠিটা দিতে দেখেছ, সেটা আমার নয়। অন্য একটা মেয়ের। তারপরও তুমি আমাকে অবিশ্বাস করতে পারলে?
আলি চিন্তা করল, টোপর কি তা হলে টিকলীকে বাদ দিয়ে অন্য মেয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বলল, তাই যদি হয়, তা হলে মেয়েটির পরিচয় বল।
সে কাউকে বলতে নিষেধ করেছে।
আমি কথা দিচ্ছি, এ ব্যাপারে সবকিছু গোপন রাখব।
কিন্তু শুনে তুমি খুব রেগে যাবে।
তবু তুমি বল। টিকলীর সঙ্গে টোপরের সম্পর্কের কথা জেনেও গোপন করছ কেন? তুমি কি টিকলীর ভালো চাও না?
আগে কথা দাও রাগবে না।
ঠিক আছে রাগব না।
চিঠিটা টিকলীর। রাজশাহী থেকে আমার চিঠির সাথে টোপরকেও দেয়। আমাকে লিখেছে চিঠিটা যেন অবশ্যই তাকে দিই। টোপরের চিঠি তুমি পড়েছিলে?
না। টিকলী তোমাকে কি লিখেছে?
জিনিয়া সব চিঠি সঙ্গে এনেছে। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে নিজের দুটো বার করে তার হাতে দিয়ে বলল, টিকলী তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছিল। তাই সেদিন বলিনি, আজ তুমি বলতে বাধ্য করালে।
আলি চিঠি দুটো পড়ে বুঝতে পারল, মা কেন তাকে নিয়ে রাজশাহী গিয়েছিল। সে ওদের সম্পর্কে একদম রাজি না থাকলেও ছোট বোনের মনে আঘাত লাগবে ভেবে জানা সত্ত্বেও বাধা দেয়নি। তবে এক্ষুণী তারা বিয়ে করতে চেয়েছিল জেনে রেগে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।
জিনিয়া তা বুঝতে পেরে ভয়ে ভয়ে বলল, তুমি কিন্তু কথা দিয়েছ, রাগ করবে না।
আলি রাগ সামলে নিয়ে বলল, টিকলী আমার একমাত্র বোন। আমিও যেমন তাকে ভালবাসি, সেও তেমনি আমাকে ভালবাসে। তাই ওদের ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে না পারলেও বাধা দিইনি। তা ছাড়া টোপরকে ভালো ছাত্র বলে জানতাম, কিন্তু সে যে পার্টির খারাপ ছেলেদের সঙ্গে এইসব করত, তা জানতাম না। এখন আর বাধা না দিয়ে থাকতে পারছি না। ভাবছি, রাজশাহী গিয়ে তার সবকিছু জানিয়ে ওকে বুঝিয়ে বলে আসব। আর তুমিও চিঠি দিয়ে জানাও, টোপরের সঙ্গে যেন কোন সম্পর্ক না রাখে।
টিকলী যে চিঠিটা টোপরকে দিয়েছিল, সেটা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বার করার সময় বলল, টিকলী টোপরের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাকে আমিও ভালো ছাত্র হিসাবে জানতাম। তারপর চিঠিটা দিয়ে বলল, যে দিন এটা পায়, তার পরের দিন পেপারে টোপরের ঘটনা পড়ে সেই থেকে মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। এখন আবার তোমার কাছে তার তিন মাসের জেল হয়েছে শুনে আরো বেশী খারাপ লাগছে।
এমন সময় মাকে নাস্তা নিয়ে আসতে দেখে আলি চিঠিটা পকেটে রেখে দিল।
সাজেদা বেগম কিন্তু দেখে ফেলেছেন। ভাবলেন, ওরা হয়তো প্রেমপত্র বিনিময় করছে। মুচকি হেসে নাস্তা খেতে বলে আয়াকে নিয়ে চলে গেলেন।
আলি চিঠি পড়তে গেলে জিনিয়া বাধা দিয়ে বলল, আগে নাস্তা খেয়ে নাও তারপর পড়ো।
আমি নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছিলাম, তুমি খাও। আমাকে শুধু চা দাও বলে আলি চিঠি খুলে পড়তে লাগল।
জিনিয়া তাকে চা দিয়ে অল্প নাস্তা খেয়ে চা খেল।
চিঠি পড়তে পড়তে আলি চা খাওয়ার কথা ভুলে গেল। পড়া শেষ করে টোপরের প্রতি বোনের গভীর ভালবাসার কথা জানতে পেরে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
জিনিয়া বলল, চা খেলে না যে, ঠান্ডা হয়ে গেল তো। তারপর সেই চা ফেলে দিয়ে কেতলী থেকে আর এক কাপ ঢেলে দিল।
আলি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, টিকলীর কপালে দুঃখ আছে। আল্লাহ ওকে তুমি হেফাজত কর। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, টোপরকে আগে চিনতে পারলে টিকলীকে এতটা এগোতে দিতাম না। কি জানি, আল্লাহ ওর তকদিরে কি লিখেছে।
জিনিয়া ম্লান মুখে বলল, এতদিন টিকলী নিশ্চয় টোপরের কথা জেনেছে। তার মনের অবস্থাটা একবার চিন্তা করে দেখ।
হাঁ সেই চিন্তাই তো করছি। ও জেনে কি করছে কি জানি।
আমার মতে রাজশাহী গিয়ে ওকে শান্তনা দিয়ে আসা তোমার উচিত।
তুমি ঠিক কথা বলেছ। বাবাকে বলা যাবে না, মাকে বলে যাব।
অনেকক্ষণ এসেছি, এবার আসি বলে জিনিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আলি বলল, বারটা বাজতে যায়, দুপুরে খেয়ে গেলে হত না?
প্লীজ আজ নয়, বাবা তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল। এমনি অনেক দেরি হয়ে গেছে।
তা হলে বল, আমাকে ক্ষমা করেছ। সেদিন তোমাকে ভুল বুঝে অন্যায় করেছি।
জিনিয়া মৃদু হেসে বলল, সেদিনের ব্যাপারে ভুল বোঝাই স্বাভাবিক। তোমার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। তবে একটা কথা আমাদের মনে রাখা উচিত, যে কোনো সন্দেহজনক ব্যাপার সত্য মিথ্যা যাচাই করা দরকার, তাই না?
আলিও মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ তাই। আর সে জন্যেই অপেক্ষায় ছিলাম। তবে। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে অন্যায় করেছি। তাই ক্ষমা চাইছি।
ক্ষমা তুমি আগেই পেয়েছ। এর থেকে বড় কিছু অন্যায় করলেও পাবে। তবে আমার খুব কষ্ট হবে।
কথা দিচ্ছি, আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেব না। তবে অজান্তে যদি দিয়ে ফেলি, তা হলে তুমিও কথা দাও, কষ্ট না পেয়ে আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দেবে।
দিলাম, এবার আসি হলে?
মায়ের সঙ্গে দেখা করবে না?
তোমার মতো উনিও খেয়ে যেতে বলবেন। তাই আমার হয়ে তুমি মায়ের কাছে। ক্ষমা চেয়ে নিও।
ঠিক আছে, চলো তোমাকে গাড়িতে তুলে দিই।
.
প্রায় পনের দিন অপেক্ষা করেও জিনিয়ার কোন চিঠি না পেয়ে টিকলী ঢাকা এল। একদিন মা-বাবার অগোচরে টোপরের সঙ্গে দেখা করতে গেল। টোপর তার সঙ্গেও দেখা করল না। টিকলী কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে জিনিয়াদের বাসায় গেল।
সালাম ও কুশল বিনিময় করে জিনিয়া বলল, টোপর ভাইয়ের কথা তুই পেপারে জেনেছিস ভেবে চিঠি দিইনি। শুনেছি, থানা তার বাবার কাছে এক লক্ষ টাকা চেয়েছিল। কারো বাবা যে এত কৃপণ হয় তা জানতাম না। টিকলী চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, এখন আমি কি করব বলতে পারিস? ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, করেনি।
তুই আবার কি করবি? তোর করারই বা কি আছে। তুই তো জানতিস, টোপর ভাই কলেজ লাইফ থেকে পার্টি করে, নিষেধ করিসনি কেন?
অনেক করেছি। করলে বলত, আমি পার্টির কাজ করলেও মিটিং, মিছিল কখনো করি না। কি জানিস, আমার মনে হয় বিয়েতে রাজি হইনি বলে আমার উপর রাগ করে এবারে মিছিলে গিয়েছিল। চিঠিটা ওকে দিয়েছিলি?
কি করে দেব। চিঠি পাওয়ার পরের দিনই তো ভার্সিটিতে গোলমাল হল।
চিঠিটা দে।
জিনিয়া সেদিন আলিকে চিঠিটা পড়তে দিয়েছিল, ফেরৎ নিতে ভুলে গেছে। তাই চুপ করে রইল।
কই দে।
কাল তোদের বাসায় গিয়ে দিয়ে আসব।
কেন? এখনই দে না, কাল সকালের ট্রেনে আমি রাজশাহী চলে যাব।
সত্য মিথ্যা কিছু বলতে না পেরে জিনিয়া চুপ করে রইল।
কি ব্যাপার বলতো, চিঠিটা দিচ্ছিস না কেন?
আমি তোর কাছে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি।
কি যা তা বলছিস, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
চিঠিটা এখন আমার কাছে নেই।
টিকলী খুব অবাক হয়ে বলল, কার কাছে আছে?
তোর ভাইয়ার কাছে।
কি বলছিস তুই? নিষেধ করা সত্ত্বেও দিলি? তোর সঙ্গে এত দিনের বন্ধুত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলি? ছিঃ ছিঃ ভাইয়াকে আমি মুখ দেখাব কি করে?
বিশ্বাস কর দিতে চাইনি, তোর ভাইয়া বাধ্য করিয়েছে।
থাক, আর সাফাই গাইতে হবে না। তোকে চিনতে আমারই ভুল হয়েছে বলে টিকলী চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।
জিনিয়া তার হাত ধরে বসিয়ে ভিজে গলায় বলল, কেন তোর ভাইয়াকে চিঠিটা দিতে বাধ্য হয়েছি, শোনার পর আমাকে যা কিছু বলতে পারিস। প্রথম চিঠিটা ভার্সিটিতে টোপর ভাইয়াকে দিতে তোর ভাইয়া দেখে ফেলে। তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমি বললাম, একটা মেয়ে আমার হাতে টোপর ভাইকে দিতে দিয়েছিল। তোর ভাইয়া তোদের দুজনের সম্পর্কের কথা জানে। তাই মেয়েটার পরিচয় জানতে চায়। আমি বলিনি। ফলে টোপর ভাইয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে ভেবে আমাকে সন্দেহ করে খুব রেগে গিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে তোর দ্বিতীয় চিঠি পাই। পেপারে ভার্সিটির গোলমালের ঘটনার পড়ে চিঠিটা টোপর ভাইকে দেওয়া হল না। এদিকে আমার উপর তোর ভাইয়ার সন্দেহ আমাকে অস্থির করে তুলল। শেষে থাকতে না পেরে তিন দিন আগে তোদের বাসায় যাই। তারপর কিভাবে আলিকে চিঠিটা দিল এবং টোপরের সম্বন্ধে যা কিছু কথাবার্তা হয়েছিল সব বলে বলল, তোর ভাইয়া তোকে ভীষণ ভালবাসে। টোপর ভাইয়ের কার্যকলাপে খুব দুঃখ পেয়েছে। বলল, টোপর স্বাবলম্বি হওয়ার পর আমি মা-বাবাকে বুঝিয়ে ওদের বিয়ে দেওয়ার কথা বলব ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন আর তার সঙ্গে টিকলীর সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। আরো বলল, রাজশাহী গিয়ে তোকে সে কথা জানিয়ে সান্তনা দিয়ে আসবে। কথায় কথায় চিঠিটা নিতে ভুলে গিয়েছি। তা তুই এসেছিস কবে?
কাল।
তোর ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হয়নি?
তোর সঙ্গে আলাপ করার পর করব বলে করিনি। তা ছাড়া ভাইয়া কাল কোথায় যেন গিয়েছিল। অনেক রাতে ফিরেছে। আজ সকালে তোর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। বলে শুধু মাকে বলে বেরিয়েছি।
আমার মনে হয়, আজ তোর ভাইয়া নিজেই তোর সঙ্গে আলাপ করবে। এরপরও যদি আমাকে দোষী মনে করিস, তা হলে মাফ চাইছি।
এক্ষেত্রে তোর অন্যায় হয়নি। তোর জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। এবার
আসি রে।
থাক না, দুপুরে খেয়ে বিকেলে যাবি।
নারে, বাসায় সবাই চিন্তা করবে।
তা হলে সামান্য কিছু খেয়া যা।
চা-নাস্তা খেয়ে বিদায় নেওয়ার সময় টিকলী বলল, চিঠি দেব, উত্তর দিস।
.
০৭.
মাগরিবের নামায পড়ে আলি পড়তে বসেছে, এমন সময় বুয়া চা নিয়ে এল। যখনই সে পড়তে বসে তখনই তার এক কাপ চা চাই। এটা তার ছোটবেলা থেকে অভ্যাস। চা না খেলে পড়ায় মন বসে না। বুয়া চা দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আলি তাকে বলল, টিকলীকে ডেকে দাও।
টিকলী মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল। বুয়া এসে বলল, আপনাকে ভাইয়া ডাকছেন।
টিকলীর তখন জিনিয়ার কথা মনে পড়ল। আজ তোর ভাইয়া তোকে কিছু বলতে পারে। ভয়ে ভয়ে ভাইয়ার রুমে এল।
আলি পড়া শুরু না করে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখে বলল, আয়। বস। কয়েকটা কথা বলব বলে ডাকলাম।
আলি পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসেছিল, টিকলী খাটে বসল।
আলি বলল, তোর আর টোপরের ব্যাপারটা জানি বলে তার পরিণতি দেখে খুব দুঃখ পেয়েছি। এবারে যে চিঠি তুই টোপরকে দেওয়ার জন্য জিনিয়াকে দিয়েছিলি, সেটা আমি পড়েছি। পড়ে তোদের গভীর সম্পর্কের কথা জানতে পেরে সেই দুঃখ আরও বেড়ে গেছে। শোন্, মানুষ তকদিরের হাতে বন্দী। তাকে কেউ রদবদল করতে পারে না। তাই বলছি, টোপর যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে শুধরে যায়, তা হলে আমি তোকে বাধা দেব না। কিন্তু তা না হয়ে যদি আরো খারাপ হয়ে যায়, তা হলে খুব শক্ত ভাবে বাধা দেব। আর তোকেও তকদিরের উপর সবর করে তাকে ভুলে যেতে হবে। তুই আমার একমাত্র বোন। তোকে কতটা ভালবাসি, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তুইি ভবিষ্যৎ জীবনে দুঃখ কষ্ট বা অশান্তি পাবি, এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। তারপর চিঠিটা তাকে দিয়ে ভিজে গলায় বলল, জিনিয়াকে দিতে বাধ্য করিয়েছিলাম। তাকে তুই ভুল বুঝিস না। এবার যা, আমার আর কিছু বলার নেই।
ভাইয়ার কথা শুনতে শুনতে টিকলীর চোখে পানি এসে গেছে। চোখ মুছে বলল, ভাইয়া, তুমি দোওয়া করো, আমি যেন তোমার দুঃখের কারণ না হই। তারপর গুটি গুটি পায়ে সেখান থেকে চলে গেল।
তিনমাস পরে যেদিন টোপর ছাড়া পেল, সেদিন কাহহার সাহেব ও শাফিয়া বেগম। তাকে সাথে করে বাসায় নিয়ে এলেন। টোপর কারো সঙ্গে কথা বলল না। বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে মায়ের কাছ থেকে যে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছিল, তা থেকে রাজশাহী যাতায়াত বাবদ পাঁচ-ছশো টাকা খরচ হয়েছিল। বাকি টাকা তার রুমে ছিল। সেই টাকা থেকে প্রতিদিন হিরোইনের নেশা করতে লাগল। ভার্সিটিতে যাওয়ার। নাম করে সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে অনেক রাতে বাসায় ফেরে। এভাবে কিছু দিন চলার পর টাকা ফুরিয়ে যেতে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতে লাগল।
টোপর আগে টাকা নিলেও এত ঘন ঘন নিত না। জিজ্ঞেস করলে যদি সৎ মায়ের। তুলনা দেয়, তাই শাফিয়া বেগম একরকম বাধ্য হয়ে দেন।
জেলে থাকার সময় টোপর আসলামকে বলেছিল, সে যখন ছাড়া পাবে তখন হিরোইনের সব টাকা দিয়ে দেবে। তাকে বাসার ঠিকানাও দিয়েছিল।
ছয়মাস পর আসলাম ছাড়া পেয়ে একদিন তাদের বাসায় এসে টাকা চাইল।
টোপর আপ্যায়ন করিয়ে বলল, আপনার ঠিকানা দিন, গিয়ে দিয়ে আসব।
আসলাম ঠিকানা দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, দুদিন অপেক্ষা করব; না পেলে এখানে নিতে আসব।
শাফিয়া বেগম জেল থেকে আসার পর টোপরের পরিবর্তন দেখে সন্দেহ করেছিলেন, সে জেলে খারাপ লোকের সংস্পর্শে খারাপ হয়ে গেছে। আজ আয়া যখন তার এক বন্ধু এসেছে বলে নাস্তার কথা বলল, তখন তার হাতে নাস্তা পাঠিয়ে দিয়ে কেমন বন্ধু দেখার জন্য ড্রইংরুমের দরজার পর্দা ফাঁক করে তাদের কথাবার্তা শুনে সন্দেহটা আরো দৃঢ় হল। বন্ধুটা চলে যাওয়ার পর ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটা কে?
আমার বন্ধু।
কেন এসেছিল?
ওর কাছে একবার কিছু টাকা নিয়েছিলাম, চাইতে এসেছিল।
কত টাকা?
আসলাম হিসাব দিয়েছিল দুহাজার। টোপর বেশি করে বলল, পাঁচ হাজার।
শাফিয়া বেগম অবাক হয়ে বললেন, এত টাকা কেন নিয়েছিলি? তুই তো ইচ্ছা মতো আমার কাছ থেকে টাকা নিস।
টোপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, অনেক আগে কিসের জন্য যেন নিয়েছিলাম। তুমি আজ টাকাটা দাও, ওকে দিয়ে আসতে হবে।
শাফিয়া বেগম রেগে উঠে বললেন, তুই যে পানির মতো টাকা খরচ করছিস, একটু চিন্তা করে দেখছিস, টাকাটা আসে কোথা থেকে? তোর বাবা দিন রাত পরিশ্রম করছে। আর তুই দরকারে অদরকারে ইচ্ছামতো খরচ করছিস। আমার কাছে যা ছিল, এতদিন তোকে দিয়েছি। আর নেই, দিতে পারব না। তোর বাবার কাছ থেকে চেয়ে নিস। তোর ঐ বন্ধুকে দেখে ভালো বলে মনে হল না। তুইও যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছিস।
টোপর মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, টাকাটা ওকে দুএক দিনের মধ্যে দিতে হবে। তুমি বাবার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে দিও।
শাফিয়া বেগম আরো রেগে গিয়ে বললেন, আমি পারব না। তোর দরকার, তুই চেয়ে নিস। তারপর সেখান থেকে চলে গেলেন।
টোপর চিন্তা করল, দুহাজার টাকা যেমন করে হোক জোগাড় করতেই হবে। তা না হলে আসলামের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। ছয় মাস হয়ে গেল জেল থেকে বেরিয়েছে, রাগে ও অভিমানে সাগরের সঙ্গে দেখা করেনি। ভাবল, ওর কাছ থেকে দু হাজার টাকা নিয়ে আসলামকে দিবে। সাগরকে দুএকমাস পরে ফেরৎ দেওয়ার কথা বলা যাবে। এই ভেবে সাগরের বাসায় যখন গিয়ে পৌঁছাল, তখন সে পার্টির ছেলেদের সঙ্গে বাসাতেই মিটিং করছিল। টোপরকে দেখতে পেয়ে ঈশারা করে বসতে বলল।
মিটিং শেষে সবাইকে বিদায় দিয়ে সাগর টোপরকে বলল, কি খবর? এতদিন পর। এলি যে? ভার্সিটিতে খোঁজ করেও তোকে পাওয়া যায় না। পড়াশোনা ছেড়ে দিলি নাকি?
টোপর বলল, হ্যাঁ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি। তা তুইও তো কোন খোঁজ খবর নিসনি?
খোঁজ খবর যে নিই নি তা নয়। বললাম না, ভার্সিটিতে খোঁজ নিয়েছি। না পেয়ে তোদের বাসায় একজনকে পাঠিয়েছিলাম। তোর বাবা বললেন, তুই ভার্সিটি গেছিস। তা পড়াশোনা ছেড়ে দিলি কেন?
সে কথা পরে বলব। একটা দরকারে তোর কাছে এসেছি।
বল কি দরকার?
হাজার দুই টাকার খুব দরকার। কিছু দিনের মধ্যে দিয়ে দেব।
তোর বাবা বিরাট ব্যবসায়ী। আমার কাছে টাকা চাইছিস, কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
বাবার টাকা তো আমার টাকা না যে, ইচ্ছা মতো খরচ করব।
তা হলে আমার টাকা দিবি কোথা থেকে?
সে ম্যানেজ করে দেব। আজ কালের মধ্যে দরকার। তাই তোর কাছে এলাম। দিবি কিনা বল।
সাগর পার্টির একটা ছেলেকে টোপরের খোঁজ নিতে বলেছিল। সে কয়েক দিন ফলো করে টোপর হিরোইন ধরেছে জানতে পেরে সাগরকে জানায়। তাই টাকা চাওয়ার কারণ বুঝতে পেরে বলল, দেব, তবে কি দরকার না বললে দেব না।
একজন পাবে, সে খুব তাগিদ দিচ্ছে। তাকে দিতে হবে।
নিশ্চয় তাকেও কিছুদিন পর দিবি বলে নিয়েছিল? তাকে যখন দিতে পারিসনি, তখন আমাকে দিবি কি করে?
সাগর, মাত্র দুহাজার টাকার জন্য তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস?
হা করছি। কারণ তুই টাকাটা কখনো দিতে পারবি না। তবে টাকাটা কার কাছ থেকে কেন নিয়েছিলি বললে দিতে পারি।
তোকে আর দিতে হবে না বলে টোপর চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল।
আরে বস বস, যারা হিরোইনের নেশা করে তাদেরকে কেউ টাকা দেয় না।
টোপর চমকে উঠে বলল, তোকে একথা কে বলল?
যেই বলুক, কথাটা অস্বীকার করতে পারবি? পারবি না। তোর চেহারা, চোখ, মুখ তার প্রমাণ করছে। শোন, অন্য কোন কারণে যদি টাকা চাইতিস, তা হলে দুহাজার কেন, পাঁচ দশ হাজারও দিতে দ্বিধা করতাম না। কিন্তু হিরোইনের জন্য এক টাকাও দেব না। ছিঃ ছিঃ, তুই এই জঘন্য পথে পা বাড়ালি? জানিস না এর পরিণতি মৃত্যু? তোকে থানা থেকে ছাড়াইনি বলে তুই যে আমার উপর মনে কষ্ট পেয়েছিস এবং সেই কারণে জেলে দেখা করতে গেলেও দেখা করিসনি এবং জেল থেকে বেরিয়ে এতদিন আমার কাছে আসিসনি, তা আমি জানি। বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, সে সময় তোর বাবাকে বলেছিলাম, আমার পক্ষে এক লাখ টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। আমি পঁচিশ হাজার দিচ্ছি, বাকিটা আপনি ম্যানেজ করুন। তোর বাবা বললেন, তোমার জন্যই আমার ছেলের এই পরিণতি। তারপর আরো অনেক কিছু বলে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। যাক সেসব কথা, এখন যা বলছি শোন, টাকাটা আমি তোর হাতে দেব না। আমাকে নিয়ে চল, আমি পাওনাদারকে দেব। অন্যান্য বন্ধুদের মধ্যে তোর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক। তাই বলছি তুই হিরোইনের নেশা ছেড়ে দে। এ ব্যাপারে আমি তোকে সাহায্য করব। তা তোর টিকলীর খবর কি?
টোপর টিকলীর নাম শুনে জ্বলে উঠল। বলল, ওর কথা বলবি না, ও আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছে। ওর জন্যেই আমার আজ এই পরিণতি।
সাগর বলল, তোর মত বুন্ধু দুনিয়াতে আর দ্বিতীয় নেই। আরে তোকে তো কতবার বলেছি, আরো হাজার টিকলী রয়েছে। তাদের মধ্যে যাকে পছন্দ তাকে বেছে নে। তুই তো আমার কথা শুনলি না। আরে বাবা, যৌবন আর কয় দিনের? যতটা পার মজা লুটে নাও। যাক বাদ দে ওসব কথা। এখন হিরোইন ছাড়বি কিনা বল।
টোপর বলল, আমি ছাড়তে চাইলেও হিরোইন আমাকে ছাড়বে না। আমার এখন এমন অবস্থা একদিন হিরোইন না নিলে পাগল হয়ে যাব। তুই টাকাটা দিবি কিনা বল, নচেৎ আমাকে অন্য চেষ্টা করতে হবে।
সাগর দৃঢ় কণ্ঠে বলল, যা বললাম, তা যদি মেনে নিস, তা হলে দেব।
টোপর কোন কথা না বলে হন হন করে চলে গেল। ফেরার পথে চিন্তা করল, মা টাকা না দিলে রাহাজানী, ছিনতাই করে জোগাড় করবে, মায়ের অথবা বাবার টাকা চুরি করবে। বাস থেকে শান্তিনগরের মোড়ে নেমে রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে উঠেছে এমন সময় টিকলীর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা।
টোপর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এই ছয় মাসের মধ্যে টিকলী প্রতিমাসে ঢাকায় এসে তার সঙ্গে দেখা করার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। সাগর নামে টোপরের যে একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু আছে তা টিকলী জানত। টোপরই তার কথা প্রায় বলত। কিন্তু তার বাসার ঠিকানা বলেনি। তাই জিনিয়াকে বলেছিল, সাগরের বাসার ঠিকানা জানতে। জিনিয়া অনেক বুদ্ধি খরচ করে সাগরের পার্টির এক মেয়ের দ্বারা ঠিকানা জোগাড় করেছে। টিকলী পরশু এসে কাল তার কাছ থেকে ঠিকানা এনেছে। আজ সাগরের কাছে টোপরের খোঁজ নেওয়ার জন্য যাচ্ছিল। নিউ বেইলী রোডের মাথায় দেখা হয়ে গেল।
কয়েক সেকেণ্ড কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। এক দৃষ্ট্রে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় টিকলীর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তাই দেখে টোপর পাশ কেটে দ্রুত চলে যেতে লাগল। টিকলী চোখ মুছে তাকে অনুসরণ করে বলল, টোপর দাঁড়াও কথা আছে, যেওনা বলছি। তবু টোপরকে চলে যেতে দেখে আরো দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বলল, প্লীজ টোপর দাঁড়াও, একটা কথা অন্তত শুনে যাও।
টোপর দাঁড়াল না, বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে দৌড়ে পালাতে লাগল।
টিকলী গলির মুখে এসে তাকে দৌড়াতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখন তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
রাণু নামে তাদেরই মহল্লার একটা জানালোনা মেয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। সে ক্লাস এইটে। পড়ে। টিকলীকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে দেখে বলল, কি হয়েছে আপা?
টিকলী তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল, না কিছু হয়নি, তুমি যাও। তারপর রাস্তা পার হয়ে বাস স্ট্যাণ্ডে এল।
রানু বেশ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, টিকলী আপার মতো মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিল কেন? কারণটা বুঝতে না পেরে স্কুলের পথে পা বাড়াল।
সাগরের বাসা যাত্রাবাড়ি। টিকলী বাস থেকে নেমে কিছুটা এসে একটা ভদ্র ও সুন্দর যুবককে ঠিকানা দেখিয়ে বলল, বাসাটা কোনখানে বলতে পারেন?
সাগর একজন পর্দানশীল মেয়ের হাতে নিজের নাম ঠিকানা দেখে খুব অবাক হল। বলল, এটা আমাদের বাসার ঠিকানা, আমিই সাগর। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
টিকলী সালাম দিয়ে বলল, আমি টিকলী। টোপরের কাছে নিশ্চয় আমার কথা শুনেছেন?
সাগর টোপরের কাছে টিকলীর রূপের কথা শুনেছে, কখনো দেখেনি। মনে মনে তারিফ করে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ শুনেছি। আসুন কাছেই আমাদের বাসা।
যেতে যেতে টিকলী বলল, টোপরের কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি।
সাগর তাকে বাসায় নিয়ে এসে ড্রইংরুমে বসতে বলে ভিতরে গেল। একটু পরে ফিরে এস বলল, আপনি কেন এসছেন বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। টোপর আপনাকে আমার সম্বন্ধে তালো মন্দ যাই বলুক না কেন, একটা কথা বিশ্বাস করুন, আমি টোপরের কখনো খারাপ কিছু চিন্তা করিনি। বরং তার ভালোর চিন্তাই সব সময় করেছি। আমার পার্টির সঙ্গে সে জড়িত ছিল ঠিক কথা; কিন্তু কোনো দিন তাকে কোনো বিপদের মধ্যে জড়াইনি। ঐদিন পিস্তলটা ওকে আমিই দিয়েছিলাম আত্মরক্ষা করার জন্য। এভাবে যে দুর্ঘটনা ঘটে যাবে তা কল্পনা করিনি। অবশ্য এজন্য আমি খুবই দুঃখিত।
টিকলী জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমাদের সব কথা জানেন?
এমন সময় বুয়া চা-নাস্তা নিয়ে এলে সাগর বলল, বলছি। আগে নাস্তা খেয়ে নিন।
টিকলী বলল, মাফ করুন সাগর ভাই, এখন আমার পেটে কিছু যাবে না। অন্য। দিন এসে খাব। প্লীজ, কিছু মনে করবেন না।
সাগর বুয়াকে বলল, এগুলো নিয়ে যাও। বুয়া চলে যাওয়ার পর বলল, আপনাদের সব কথা আমি জানি। ও রাজশাহীতে গিয়েছিল আপনাকে বিয়ে করার জন্য। আপনি ফিরিয়ে দিয়ে খুব ভুল করেছেন। ভার্সিটির ঘটনাটা তেমন কিছু না। ওর এই পরিণতির জন্য আপনিই দায়ী। আপনাকে ও ভীষণ ভালবাসে। তাই আপনি ফিরিয়ে দিতে মনে ভীষণ আঘাত পেয়েছে। সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে হিরোইনে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
টিকলী চমকে উঠে ভয়ার্ত স্বরে বলল, কি বলছেন আপনি?
হ্যাঁ, যা বলছি সত্য। ব্যাপারটা জেনে আমিও খুব মর্মাহত। কিছুক্ষন আগে আমার কাছে দুহাজার টাকা চাইতে এসেছিল, হিরোইন খাওয়ার বিল শোধ করার জন্য। আমি দিইনি। বলেছি হিরোইন ছেড়ে দিলে দুহাজার কেন পাঁচ দশ হাজার টাকা তোকে দেব। তাই রাগ করে চলে গেল। তাকে ভালো হওয়ার জন্য অনেক বুঝিছি; কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
টিকলী ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, আপনি ওর অন্তরঙ্গ বন্ধু, আপনি ওকে ঐ জঘন্য নেশা থেকে বাঁচান। আর আমাকে বলে দিন আমি কি করব। ওর কিছু হলে আমি বাঁচবো না। ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি সত্য। তারপর কেন ফিরিয়ে দিয়েছে সে কথা বলে বলল, এবার আপনিই বিচার করুন, আমার অন্যায় কতটা। ও বড় জেদী। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেমন কোনো কাজ করে না; তেমনি কারো ভাল কথাও শুনতে চায় না।
সাগর বলল, ওর এই স্বাভাবের কথা আমি জানি। আমি ওর এই জঘন্য নেশা ছাড়াতে পারব কিনা জানি না, তবে আমার বিশ্বাস, আপনিই একমাত্র ওকে ঐ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
উপায়টা বলে দিন।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনারা বিয়ে করে ফেলুন।
টিকলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেশ, তাই করব। আমি কয়েক দিনের মধ্যে রাজশাহী চলে যাচ্ছি। সেখানে ওকে নিয়ে আপনিও আসুন।
সাগর বল, ঠিক আছে, তাই হবে। তবে এর মধ্যে টোপরকে আপনি কথাটা জানান। কি করে জানাব? ওকে পাওয়াই যায় না। এখানে আসার সময় বেলী রোডের মুখে হঠাৎ দেখা। কিছু বলার আগে ছুটে পালিয়ে গেল। অনেক কিছু বলেও ফেরাতে পারলাম না।
তবু যেমন করে হোক দেখা করে কথাটা ওকে বলুন। জেল থেকে বেরিয়েছে। ছমাস হল। একবারও আমার কাছে আসেনি। আজ এসেছিল টাকার জন্য।
আপনি একটু কষ্ট করে ওকে কথাটা জানিয়ে রাজশাহী নিয়ে আসুন। আমিও যাওয়ার আগে দেখা করে কথাটা জানাবার চেষ্টা করব। তারপর বিদায় নিয়ে ফিরে এল।
ঐদিন টোপর সাগরের কাছে টাকা না পেয়ে আসলামের সঙ্গে দেখা করে বলল, আপনি আর আমাদের বাসায় যাবেন না। দুচার দিনের মধ্যে টাকাটা পেয়ে যাবেন।
আসলাম বলল, ঠিক আছে, কিন্তু এর মধ্যে না পেলে বাসায় যেতে বাধ্য হব।
তার আগেই পেয়ে যাবেন বলে টোপর সেখান থেকৈ ফেরার পথে মৌচাক মার্কেট থেকে একটা বড় চাকু ও একটা খেলনা পিস্তল কিনল। বাসায় এসে চিন্তা করল, মা যদি টাকা না দেয় তা হলে কাল থেকে রাহাজানী করবে।
আজ সকালে নাস্তার টেবিলে শাফিয়া বেগম স্বামীকে বললেন, তুমি তো শুধু ব্যবসা নিয়ে থাক। এদিকে টোপর ঘুম থেকে সকাল নয়টার সময় উঠে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাত বারটার দিকে। পড়াশোনাও করে না। কারও সঙ্গে কথাও। বলে না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকে। ওর দিকে তোমার লক্ষ্য করা উচিত।
কাহহার সাহেব তখন কিছু না বলে অফিসে চলে গেলেন।
রাতে খাওয়ার পর টোপরকে ডেকে পাঠালেন।
টোপর এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
সেখানে শাফিয়া বেগমও ছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? বস।
টোপর বসার পর কাহহার সাহেব বললেন, তুই কি আর ভার্সিটি যাসনি?
টোপর চুপ করে রইল।
কি হল, উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
না।
কেন?
আমি আর পড়াশোনা করব না।
কারণটা জানতে পারি?
ভালো লাগে না।
কি করবি তা হলে?
টোপর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
কাহহার সাহেব এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললন, শত্রুর মেয়ের জন্য নিজের উজ্জল ভবিষ্যৎ নষ্ট করিস না। বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা না করে মন দিয়ে পড়াশোনা করে মাস্টার্স শেষ কর। আরো উচ্চ ডিগ্রী নেওয়ার জন্য তোকে তো ফরেনে পাঠাব বলেছি। আর হাত খরচের জন্য মাসে যা পাস তাই দিয়ে চল। অযথা বন্ধুদের সঙ্গে মিশে টাকা নষ্ট করিস না। সন্ধ্যের পর পর বাসায় ফিরবি। আর তোর মাকে যে দুহাজার টাকার কথা বলেছিস, তা এখন পাবি না। আমার কথা মতো চললে মাসখানেক পরে পাবি। যদি না চলিস, তা হলে ঐ টাকাতো পাবিই না, উপরন্তু হাত খরচের টাকাও পাবি না। এবার তুই যেতে পারিস।
কিন্তু বাবা, দুহাজার টাকাটা যে আমার ইমিডিয়েট দরকার।
তোর মায়ের কাছে সে কথা শুনেছি। বন্ধুর কাছে এক মাস সময় চেয়ে নে।
টাকাটা অনেক আগে নিয়েছি। সে আর এক মাস দেরি করবে না। দুএকদিনের মধ্যে দিতেই হবে।
তোর কোন কথাই শুনতে চাই না। যা যা বললাম তাই কর।
টাকাটা এখন না দিলে পরিণামের জন্য তোমরাই দায়ী হবে।
কাহহার সাহেব রেগে উঠে বললেন, কি? তোর এতবড় সাহস, আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? চলে যা এখান থেকে, এক পয়সায়ও দেব না। দেখি তুই কি করিস।
কাজটা তুমি ভালো করলে না বাবা। বলে টোপর নিজের রুমে চলে এল। সারারাত ঘুমাতে পারল না। সাগরের কথা, টিকলীর কথা চিন্তা করে কাটাল। মায়ের উপরও খুব অভিমান হল। নিজের মা হলে এরকম করতে পারত না।
পরের দিন টোপর আসলামের কাছে গয়ে বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে থাকব। আপনারা যা করেন আমিও তাই করব।
আসলামের বাড়ি পটুয়াখালি। হলে থেকে ভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স করার সময় একটা মেয়ে সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া হয়। মাস্টার্স করার সময় মেয়েটার আমেরিকা প্রবাসী এক আত্মিয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। সেই থেকে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে হিরোইনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তার বন্ধুরাও শিক্ষিত বেকার। অনেক দিন চাকরির চেষ্টা করেও পায়নি। তাই হাইজ্যাক, রাহাজানী ও চাদাবাজী করে দিন কাটায়। ওরা চারবন্ধু কমলাপুরে একটা মেসে থাকে। খুন খারাপী না করলেও একবার চাঁদাবাজী করতে গিয়ে মারামারি করে। তাতে আসলামের পিস্তলের গুলিতে ফ্যাক্টরীর ম্যানেজার আহত হন। আর আসলাম ধরা পড়ে যায়। এ্যাটেম টু মার্ডারের কেসে আসলামের দুবছরের জেল হয়। ছাড়া পাওয়ার নয় মাস আগে জেলে টোপরের সঙ্গে পরিচয় হয়। জেল থেকে বেরিয়ে আসলাম পুরোনো বন্ধুদের দলে ভিড়েছে।
টোপরের কথা শুনে আসলাম বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় দিয়ে বলল, আজ থেকে আমাদের দলে আরো একজন বাড়ল। তারপর বলল, আমাদের দলে থাকতে হলে ওসব আপনি টাপনি বলা যাবে না। তুই তোকারী না হলে বন্ধু কিসের? তা আমার টাকার ব্যবস্থা কি করলি?
টোপর বলল, টাকা তুই সময় মতো পেয়ে যাবি। শোন, আমি সারাদিন তোদের সঙ্গে থাকলেও কয়েকটা দিন সন্ধ্যের পর বাসায় চলে যাব। তারপর এখানেই থাকব।
আসলাম বলল, তোর যা মর্জি। তবে টাকাটা যেন সময় মত পাই।
টোপর বলল, বললাম তো পাবি।
সেদিন থেকে টোপর মাকে ভার্সিটি যাওয়ার কথা বলে তাদের সঙ্গে সারাদিন সন্ত্রাসী করে বেড়ায়। আর সন্ধ্যের পর বাসায় এসে পড়াশোনা করার অভিনয় করতে লাগল। মাঝে মধ্যে বিকেলেও ফিরে এসে বই নিয়ে বসত।
শাফিয়া বেগম ছেলের মতিগতি ভালোর দিকে দেখে খুশি হলেন। তবু একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ভার্সিটিতে সারাদিন কি করিস?
টোপর বলল, পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করি।
শাফিয়া বেগম ছেলের মতি গতির কথা স্বামীকে একদিন জানালেন।
কাহহার সাহেব মনে মনে খুশি হয়ে বললেন, হাজার হোক আমারই রক্ত তো। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আরকি?
টোপর বাসায় যতক্ষণ থাকে ততক্ষন ছোট ভাই বোনের পড়াশোনার খবর নিতে লাগল। মায়ের কাছে দশ বিশ টাকার আবদার করে। শাফিয়া বেগম খুশি হয়ে বলেন, দশ বিশ টাকা আবার টাকা? তারপর দুএকশো টাকা দিয়ে বলেন, বুঝে সুঝে খরচ করবি।
টোপরের প্ল্যান মা-বাবার মন জয় করে আলমারীর চাবির খোঁজ করা। সে জানে মায়ের রুমে স্টীলের আলমারীর সিন্দুকের মধ্যে বাবা টাকা রাখে। আর তার চাবি মায়ের কাছে থাকে। চার-পাঁচ দিনের মাথায় সুযোগ পেয়ে গেল। সেদিন রাতে পাশের বাড়ির ছেলের বৌভাত। টোপরদের সবাইয়ের দাওয়াত। কাজের মেয়ে ছাড়া সবাই পাশের বাড়িতে গেছে। টোপরও গিয়েছিল। সে না খেয়ে ফিরে এসে মায়ের ঘরে ঢুকে চাবি খুঁজতে লাগল।
শাফিয়া বেগম চাবির গোছা সব সময় আঁচলে বেঁধে রাখেন। আজ বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য আলমারী খুলে পছন্দ মতো শাড়ী ব্লাউজ ও গহনা বার করে পরে গেছেন। যাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করে চাবির গোছা নিতে ভুলে গেছেন। আলমারীতেই লাগান রয়ে গেছে।
টোপর চাবি খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ আলমারীর দিকে নজর পড়তে মুখে হাসি ফুটে উঠল। তারপর আলমারীর সিন্দুক খুলে যা টাকা ছিল সব বার করে বাবার একটা লুংগীতে বাঁধল। তারপর আলমারী বন্ধ করে চাবিটা নিয়ে নিজের রুমে এসে লুংগী সহ টাকাগুলো একটা কাগজে মুড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কাজের মেয়ে দুলারীর সামনে পড়ে গেল।
দুলারী বলল, আপনি বিয়ে বাড়ীতে যান নি?
টোপর বলল, গিয়েছিলাম, তারপর কাগজের প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল, প্রেজেন্টেশানটা নিয়ে যাওয়া হয়নি, নিতে এসেছিলাম। কথা শেষ করে বেরিয়ে এল। রাস্তায় এসে একটা স্কুটার নিয়ে ফকিরা পুলে আল হেলাল হোটেলে সিট নিল। তারপর দুহাজার টাকা নিয়ে আসলামের মেসে এসে টাকাটা দিয়ে বলল, আমার কথা আমি রেখেছি।
আসলাম বলল, আজ হঠাৎ টাকাটা পেলি কোথায়?
টোপর বলল, কাল সকালে এসে বলব, এখন আমাকে বাসায় যেতে হবে। কথা শেষ করে সেখান থেকে হোটেলে ফিরে এসে খাওয়া দাওয়া করল। তারপর দরজা জানালা লাগিয়ে পর্দা টেনে দিয়ে টাকাগুলো গুনে দেখল। এক লাখ আঠাশ হাজার। টাকাগুলো সব পাঁচ শো টাকার নোট। ভাবল, ঢাকায় থাকা ঠিক হবে না। সকালেই চিটাগাং চলে যাবে। ভয়ে সারা রাত ভালো ঘুম হল না। ভোরে উঠে কমলাপুরে এসে এস আলম লাক্সারী কোচের ফাস্ট ট্রিপে চট্টগ্রাম রওয়ানা দিল।
শাফিয়া বেগম ছেলে মেয়ে নিয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় বারটার সময় ফিরলেন। জামা কাপড় ও গহনা খুলে আলমারীতে তোলার সময় চাবি খুঁজে পেলেন না। হঠাৎ মনে পড়ল, চাবির গোছা ভুলে আলমারীতেই লাগান রয়ে গিয়েছিল। সেখানে নেই দেখে বালিশের তলায়, গদীর নিচে, শোকেসের মাথায় ও অন্যান্য সবখানে খোঁজ করে না পেয়ে দুলারীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ঘরে এসেছিলি?
দুলারী বলল, না বেগম সাহেব আসিনি। আপনি না ডাকলে তো এঘরে কখনো আসিনি। ঘন্টাখানেক আগে বড় ভাইজান এসেছিলেন। তিনি হয়তো এঘরে এসে থাকবেন। কেন বেগম সাহেব কি হয়েছে?
শাফিয়া বেগম বললেন, আলমারীর চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। ঠিক আছে তুই যা। ছেলে মেয়েদের ঘুমাতে যেতে বলে চিন্তা করতে লাগলেন, চাবির গোছা গেল কোথায়? টোপরই বা বিয়ে বাড়ী থেকে বাসায় এসেছিল কেন?
কাহহার সাহেব পরিচিতি একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাই কিছুক্ষণ পরে আসছি বলে স্ত্রীকে ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে যেতে বলেছিলেন। প্রায় সাড়ে বারটার সময় বাসায় ফিরে স্ত্রীকে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখে বললেন, কি ব্যাপার, কি ভাবছ?
শাফিয়া বেগম বললেন, ভুলে চাবির গোছা আলমারীতে লাগিয়ে রেখে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে পাচ্ছি না। আলমারীতেও চাবি দেওয়া।
কাহহার সাহেব বললেন, অন্য কোথাও রেখেছ হয় তো, ভালো করে খুঁজে দেখ।
সব জায়গায় খুঁজেছি, পাইনি।
কাহহার সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন, দুলারী এঘরে আসেনি তো?
ওদের সে সাহস হবে না, তবু ডেকে জিজ্ঞেস করেছি। বলল, টোপর নাকি বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিল, কখন এসেছিল দেখেনি। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখেছে।
কাহহার সাহেব চিন্তিত মুখে বললেন, সে আলমারী খুলে টাকা নেয়নি তো? ও ফিরেছে কিনা দেখেছ?
না বলে শাফিয়া বেগম নিজেই টোপরের রুমে গিয়ে ফিরে এসে বললেন, মা এখনো ফেরেনি।
কাহহার সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, সে আর ফিরবে না।
কি বলছ তুমি?
হ্যাঁ, যা বলছি এখন না বুঝতে পারলেও পরে পারবে।
তুমি কি বলতে চাচ্ছ, টোপর টাকা নিয়ে আলমারী বন্ধ করে চাবি নিয়ে পালিয়ে গেছে?
হ্যাঁ তাই। তারপর চিৎকার করে বললেন, শুনে রাখ টোপরের মা, আমার অনুমান যদি সত্য হয়, তা হলে ওকে আমি আস্ত রাখব না।
অত জোরে কথা বলছ কেন? আশে পাশের লোকজন শুনলে কি ভাববে। উত্তেজিত না হয়ে আগে আলমারী খোলার ব্যবস্থা কর।
চাবি ছাড়া আলমারী খোলা গেলেও সিন্দুক তো আর ভোলা যাবে না। আচ্ছা সব চাবির তো দুসেট করে ছিল। আর এক সেট কোথায়?
আলমারীর ভিতরের ড্রয়ারে।
তুমি তো আচ্ছা বোকা। ডবল চাবি থাকে, একটা হারিয়ে গেলে অন্যটা কাজে লাগাবার জন্য। অন্য কোথাও রাখলে এই অবস্থায় পড়তে হত না।
তোমার কথা ঠিক, তবে অন্যে সে কথা জেনে গেলে কি হত ভেবে দেখ।
তাও ঠিক বলে কাহহার সাহেব পায়চারী করতে লাগলেন।
শাফিয়া বেগম বললেন, এখন কাপড় চোপড় পাল্টে ঘুমাও। কাল সকালে বাজার থেকে চাবি সারানওয়ালাকে ডেকে এনো।
পরের দিন বেলা নয়টার দিকে চাবি সারানওয়ালা এনে আলমারী খুলিয়ে বিদায়। দিলেন।
শাফিয়া বেগম ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে দেখলেন, একটা টাকাও নেই।
কাহহার সাহেব দেখে মাথায় হ্রাত দিয়ে বসে পড়লেন। তারপর টোপর তোকে আমি কোনো দিন ক্ষমা করব না বলে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন।
শাফিয়া বেগম আগেই চিন্তা করেছিলেন, টোপর যদি টাকা নিয়ে যায়, তা হলে তার বাবা কি করতে না কি করে বসে। এখন অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে দুলারীকে ডেকে মাথায় পানি ঢাকার ব্যবস্থা করলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর কাহহার সাহেবের জ্ঞান ফিরল।
শাফিয়া বেগম দুলারীকে বালতি বদনা নিয়ে চলে যেতে বলে মাথা মুছিয়ে দেওয়ার সময় বললেন, বেশি দুশ্চিন্তা করো না। নিজের ছেলে নিয়েছে। ওকে ফরেনে পাঠালে তো এর চেয়ে বেশি টাকা লাগত।
কাহহার সাহেব কিছু বললেন না। চুপচাপ নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে গেলেন।
কাহহার সাহেবের ছোট ছেলে শাহিনের সবকিছু বোঝার মতো বয়স হয়েছে। ভাইয়া যে, আলমারী থেকে বাবার অনেক টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে তা বুঝতে পারল। তাই মা-বাবার মন খারাপ দেখেও কোন কিছু জিজ্ঞেস করল না।
আর নিশাত ছেলে মানুষ বলে এসব কথা বুঝতে পারল না।
কয়েক দিন পর শাহিন মাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা ভাইয়ার খোঁজ করেনি?
শাফিয়া বেগম বললেন, তোর বাবা পুলিশ লাগিয়ে খুঁজে বার করতে চেয়েছিল। আমি করতে দিইনি। থানা পুলিশ করলে অনেক টাকা লাগবে, তা ছাড়া আমাদের মান সম্মানের হানি হবে। এইসব বলে বুঝিয়েছি।
শাহীন বলল, জান মা, ভাইয়া আগে কত ভালো ছিল। আমাদেরকে কত আদর করত। জেল থেকে ফিরে ভাইয়া যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল।
শাফিয়া বেগম বললেন, তোর ভাইয়া খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মিশে খারাপ হয়ে গেছে। তুই কিন্তু কোন খারাপ ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবি না। আর তোর ভাইয়ার কথা কারো সঙ্গে আলাপ করবি না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি, সে আমেরিকায় পড়তে গেছে।
শাহিন বলল, তাই হবে মা।
এদিকে টিকলীর দুমাস পরে ফাষ্ট ইয়ারের পরীক্ষা। তাই রাজশাহী ফিরে যাওয়ার জন্য মনে তাগিদ অনুভব করলেও টোপরের সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারছে না। কয়েক দিন রাস্তার মোড়ে সকাল থেকে বেলা দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও তার দেখা পেল না। তিন দিনের দিন টোপরের ছোট ভাই শাহিনকে স্কুলে যেতে দেখে ডেকে জিজ্ঞেস করল, তোমার ভাইয়া বাসায় আছে? শাহিন জানে ওদের সঙ্গে তাদের মনোমালিন্য। আরো জানে প্রায় বছর খানেক আগে ভাইয়া টিকলীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল বলে বাবা রাগারাগি করেছিল। তাই মায়ের শেখান কথা বলল, ভাইয়া দুদিন হল আমেরিকায় পড়তে চলে গেছে। তারপর সে হাঁটতে শুরু করল।
কথাটা শুনে টিকলী অবাক হলেও বিশ্বাস করতে পারল না। তাকে চলে যেতে। দেখে দ্রুত হেঁটে এসে তার পথ আগলে বলল, কথাটা কি সত্য বললে?
শুধু শুধু মিথ্যা বলব কেন? তারপর পাশ কাটিয়ে শাহিন চলে গেল।
টিকলী তবু বিশ্বাস করতে পারল না। চিন্তা করল, যদি সত্যি হয়, তা হলে সাগর ভাই নিশ্চয় জানবে। তার সঙ্গে দেখা করার মনস্থ করে একটা স্কুটার নিয়ে রওয়ানা দিল। ফকিরাপুলে এসে ট্রাফিক জ্যামে পড়ল।
স্কুটার ড্রাইভার বলল, এই জ্যাম ছাড়তে এক ঘন্টা লাগবে। রাজারবাগ দিয়ে ঘুরে যাই আপা?
টিকলী বলল তাই চল।
রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ি পার হয়ে এসেছে, এমন সময় সাগর ভাইকে একটা ছেলের সঙ্গে রিকশায় করে সামনের দিক থেকে আসতে দেখে ড্রাইভারকে বলল, স্কুটার ঘুরিয়ে নাও, কমলাপুর যাব না।
ড্রাইভার স্কুটার ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই যাবেন?
টিকলী হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ রিকশাটার পাশে চল। স্কুটার রিকশার পাশে এলে টিকলী বলল, সাগর ভাই, আপনার কাছে যাচ্ছিলাম।
সাগর টিকলীকে চিনতে পেরে রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল।
টিকলীও স্কুটার ড্রাইভারকে সাইড নিয়ে দাঁড়াতে বলল।
সাগর সঙ্গের ছেলেটাকে বলল, একটু বস, আসছি। তারপর টিকলীর কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কি ব্যাপার?
টিকলীও স্কুটার থেকে নেমে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি টোপরের কোনো। খোঁজ পেয়েছেন?
না, তবে কয়েক দিনের মধ্যে পেয়ে যাব। আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি?
না, আজ আসার সময় তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। টোপর বাসায় আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে বলল, দুদিন আগে সে আমেরিকা চলে গেছে।
তাই নাকি? তা হলে তো ভালই হল। এবার মানুষ হয়ে যাবে।
কিন্তু কথাটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
কেন?
তা বলতে পারব না, এমনিই বিশ্বাস করতে পারছি না।
সাগর মৃদু হেসে বলল, অবিশ্বাস করার কি আছে, ওর তো যাওয়ারই কথা ছিল। আর সত্যি সত্যি যদি না গিয়ে থাকে, তবে আমি নিশ্চয় জানতে পারব। জানার পর আপনাকে চিঠি দিয়ে জানাব।
টিকলী ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, অনুগ্রহ করে ভালো মতো খোঁজ নেবেন। আমি আপনার চিঠির অপেক্ষায় থাকব।
সাগর বলল, আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব। আমার মনে হয়, আমেরিকায় গিয়ে থাকলে আপনাকে চিঠি দেবে।
আল্লাহ যেন তাই করেন বলে টিকলী বলল, আপনাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি, মনে, কিছু নেবেন না।
সাগর বলল, কষ্ট আবার কি? বন্ধু হিসাবে আমারও কিছু কর্তব্য আছে। আর কিছু বলবেন?
না, এবার আসুন। বলে টিকলী সালাম বিনিময় করে স্কুটারে উঠে সিদ্ধেশ্বরী রোডে যেতে বলল।
বাসায় ফিরে এলে আলি বলল, সারাদিন কোথায় কোথায় যাস? তোকে তো বাসায় পাওয়াই যায় না। তার ধারনা টিকলী টোপরের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘুরে বেড়ায়, তাই কথাটা একটু রাগের সঙ্গে বলল।
টিকলী কিছু না বলে ছলছল চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
তাই দেখে আলি নরম সুরে বলল, তুই এখনো টোপরকে ভুলতে পারিস নি? টোপর হিরোইনের নেশা করে। টিকলী চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, তা আমিও জানি। কিন্তু কেন করে তুমি না জানলেও আমি জানি। আমার জন্যই আজ ওর এই পরিণতি। তারপর কান্না চাপতে চাপতে সেখান থেকে ছুটে চলে গেল।
বোনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আলির চোখেও পানি এস গেল। বিড় বিড় করে দোওয়া করল, আল্লাহ তোকে টোপরকে ভুলার তওফিক দিক। তোকে হেফাজত করুক।
পরের দিন রাজশাহী যাওয়ার জন্য আলি টিকলীকে কমলাপুর ট্রেনে তুলে দিতে এল। ট্রেন ছাড়ার আগে টিকলী বলল, শাহিনের কাছে শুনলাম, সে আমেরিকা চলে গেছে। কথাটা যদি ঠিক হয়, তা হলে শাহিনের কাছ থেকে তার ঠিকানাটা নিয়ে আমাকে জানাবে।
আলি বলল, ঠিক আছে জানাব।
প্রায় তিন ঘন্টা ডাঃ মাহাবুবা চেয়ারে হেলান দিয়ে নিজের আগের জীবনের স্মৃতিচারন করে চলেছেন। এমন সময় কারো ম্যাডাম ডাকে বাস্তবে ফিরে এলেন। তাকিয়ে ইয়াসমিনকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ঐ রুগী কেমন আছেন?
এখনো ঘুমাচ্ছেন।
আমি কোয়ার্টারে যাচ্ছি। ঘুম ভাঙ্গার পর চার্ট দেখে ঔষুধ খাওয়াবেন। কোন রকম অসুবিধা করলে আমাকে খবর দেবেন।
ইয়াসমিন জ্বি আচ্ছা বলে চলে গেল।
ডাঃ মাহবুবা বাসায় এসে ড্রেস চেঞ্জ করে আসরের নামায পড়লেন। তারপর বারান্দায় চেয়ারে বসে মাসিক মদিনা পত্রিকা পড়ার জন্য হাত বাড়ালেন। এমন সময় কাজের মেয়ে জোহরা চা-বিস্কুট নিয়ে এলে পত্রিকা রেখে দিলেন। তারপর দুটো বিস্কুট ও একগ্লাস পানি খাওয়ার পর চা খেয়ে পত্রিকাটা হাতে নিলেন। আরো দুতিনটে পত্রিকা ও দৈনিক পেপার রাখেন। মাসিক মদিনা তার খুব প্রিয়। এতে যেমন অতীত যুগের মুসলমানদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, তাঁদের উন্নত চরিত্রের কথা, মুসলিম মনীষীদের অমীয় বানী ও তাঁদের জীবন চরিতের সমালোচনা থাকে, তেমনি এমন কিছু প্রশ্ন উত্তর থাকে যা প্রত্যেক মুসলমানের জানা একান্ত জরুরী। পত্রিকা পড়ার জন্য খুললেন বটে, কিন্তু পড়তে পারলেন না। তখন তার মনের পাতায় আবার পূর্ব জীবনের কথা ভেসে উঠল।
টোপর আমেরিকা চলে গেছে শুনে টিকলী রাজশাহী চলে এসেছিল। তারপর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর টোপরের চিঠির অপেক্ষা করছে। আর মাসে মাসে দুতিন খানা করে জিনিয়াকে ও সাগরকে চিঠি দিয়ে টোপরের আমেরিকায় ঠিকানা জানাতে বলেছে। চার-পাঁচ মাস পরপর ঢাকায় এসে তাদের সঙ্গে দেখা করেছে। তারা কেউ টোপরের আমেরিকার ঠিকানা দিতে পারেনি। নিজেও কয়েকবার টোপরের ছোট ভাই শাহিনের সঙ্গে দেখা করে জানতে চেয়েছে। শাহিন জানে না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। টিকলীর দৃঢ় ধারনা টোপর আমেরিকা যায়নি। সে দেশেই অন্য কোথাও আছে।
বোনের অবস্থা দেখে আলি তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য অনেক বুঝিয়েছে, টিকলী তাকে বলেছে, এ জীবনে তাকে ভুলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি আমাকে ওর ব্যাপার নিয়ে কিছু বলল না। আমি ওর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব। তুমি শুধু আমাকে টোপরের ঠিকানা জোগাড় করে দাও। আমি আর কোনো দিন কোনো কিছু তোমার কাছে চাইব না।
প্রায় বছর তিনেক পর টিকলী একদিন ঢাকা নিউমার্কেটে বই কিনতে গিয়েছিল। ফেরার সময় গেটের বাইরে শাহিনের সঙ্গে দেখা, শাহিন তখন কলেজে পড়ে। সেও বই কিনতে গিয়েছিল।
শাহিন তাকে দেখে চিনতে পারল, বলল, কিছু বলবেন?
হ্যাঁ এদিকে এস। শাহিন এগিয়ে এলে বলল, আমাকে নিশ্চয় চিনতে পারছ?
শাহিন ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব সঠিক উত্তর দেবে?
শাহিন এখন বড় হয়েছে। ভালোমন্দ জ্ঞান হয়েছে। বলল, আপনি ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করবেন তো?
হ্যাঁ ঠিক বলেছ, তুমি ওর আমেরিকার ঠিকানাটা দাও তো।
শাহিন কিশোর বয়সে মায়ের কথা মত মিথ্যা বলেছিল। এখন তা পারল না, বলল, আপা, আমি আপনাদের সব কথা জানি। আপনি এখনো ভাইয়াকে ভুলতে পারেননি শুনে খুব দুঃখ হচ্ছে। আপনি ভাইয়াকে ভুলে যান আপা।
টিকলী খুব অবাক হয়ে বলল, আমি তোমার বড় বোনের মত। তুমি আমাকে একথা কেন বলছ বল তো?
শাহিন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, প্রায় তিন বছর আগে আপনাকে যে কথা : বলেছিলাম, তা ঠিক নয়। ভাইয়াকে বাবা আমেরিকায় পাঠায়নি।
কি বললে আমেরিকা পাঠায়নি?
না আপা, সে সময় মা নিষেধ করেছিল বলে মিথ্যা বলেছিলাম। এখন আর কোনো কথা আপনার কাছে গোপন করব না। ভাইয়ার যে ছয় মাসের জেল হয়েছিল, তা নিশ্চয় শুনেছেন। জেলে কোনো কয়েদির পাল্লায় পড়ে হিরোইনের নেশায় ধরেছিল। ছাড়া পেয়ে মা বাবার কাছে দুহাজার টাকা চায়। না দিতে একরাতে আমরা সবাই পাশের বাসায় বিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। সেই ফাঁকে ভাইয়া ষ্টীলের আলমারী থেকে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
টিকলী কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ঠোঁট কামড়ে সামলাবার চেষ্টা করতে লাল।
তার অবস্থা দেখে শাহিনের চোখে আবার পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, যারা একবার হিরোইনের নেশা শুরু করে তারা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ছাড়তে পারে না। বেশি দিন বাঁচেও না। ভাইয়া কি আর এত দিন বেঁচে আছে? আপনি তাকে ভুলে যান। আপা ভুলে যান। তারপর দ্রুত হেঁটে এসে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে যেতে বলল।
টিকলী স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল।
টিকলীও গাড়ি নিয়ে এসেছে ড্রাইভার বেশ বয়স্ক লোক। এতক্ষন মালিক কন্যাকে লক্ষ্য করছিল, তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে বলল, বাসায় যাবেন না মা?
টিকলী তাড়াতাড়ি চোখ মুখ মুছে বলল, হ্যাঁ চাচা চলুন।
টিকলী বাসায় ফিরে এলে আলি বলল, কিরে এত দেরি করলি যে, তাড়াতাড়ী ফিরতে বলছিলাম না।
টিকলী জানে ভাইয়া জিনিয়াদের বাসায় যাবে। অন্য সময় হলে দুষ্টুমী করে বলত, বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি যেতে তোমার লজ্জা করে না? আজ মন খারাপ থাকায় দুষ্টুমী করে বলল, সরি ভাইয়া, তারপর কান্না চেপে রাখতে না পেরে ছুটে ভিতরে চলে গেল।
আলি তার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে, একটু আগে কেঁদেছে। আবার বেসামাল অবস্থায় চলে যেতে দেখে চিন্তা করল, তা হলে কি টোপরের কোনো খারাপ খবর পেয়েছে? এমনি দেরি হয়ে গেছে তাই ফিরে এসে জিজ্ঞেস করবে ভেবে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
টিভিতে রাত দশটার খবর সবাই এক সঙ্গে শোনে। আজ টিকলী নেই দেখে আলি তার রুমে গিয়ে দেখল, বালিশে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদছে।
ছোট বোনের জন্য আলির খুব মায়া হল। পাশে বসে মাথায় একটা হাত রেখে বলল, বিকেলে কান্না ভেজা মুখে বাসায় ফিরলি। এখন আবার কাঁদছিস, কি হয়েছে বল সাধ্যমত সাহায্য করব। টোপরের কি কোনো খবর পেয়েছিস?
টিকলী কান্না থামিয়ে উঠে বসে ভিজে গলায় বলল, টোপর আমেরিকায় যায়নি। তারপর শাহিনের কাছে যা শুনেছে সে সব বলে বলল, ও দেশের কোথাও না কোথাও আছে।
আলি বলল, এত ভেঙ্গে পড়িসনি বোন, সবর কর। জানিস না, আল্লাহ কোরআন পাকে সবর করতে বলেছেন। আমি তার অনেক বন্ধুবান্ধবদের কাছে খোঁজ করেছি। তারা কেউ তার খবর বলতে পারেনি। এমন কি আমেরিকা গেছে কিনা তাও বলতে পারেনি। তুই তো ডাক্তারী পড়িস, এটা নিশ্চয় জানিস, যারা হিরোইনের নেশা করে তারা বেশি দিন বাঁচে না। আমার মনে হয়, সে বেঁচে নেই। থাকলে এতদিনে নিশ্চয় খোঁজ পাওয়া যেত। তাকে তোর ভুলে যাওয়া উচিত।
ভাইয়া তুমি অমন কথা বলো না। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, আমার মন বলছে, সে বেঁচে আছে এবং দেশেই আছে। তুমি যাও ভাইয়া আমাকে একা থাকতে দাও।
আলি আর কিছু না বলে চলে এল।
এরপর আরো তিন বছর পার হয়ে গেল। টোপরের খোঁজ খবর নেই। ডাক্তারী পাশ করার পর এক বছর ইন্টার্নশিপ করে টিকলী রাজশাহী মেডিকেলে থেকে গেল।
হালিম সাহেব রিটায়ার্ড করেছেন, আলি মাষ্টার্স করে বাবার অফিসেই চাকরি পেয়েছে। জিনিয়ার সঙ্গে এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। টিকলীর জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। ভাইবোনের বিয়ে এক সঙ্গে হবে।
ইদানিং উচ্চ ধনী ঘরের এক ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সন্ধান পেয়ে হালিম সাহেব ফোন করে মেয়েকে বললেন, আমরা তোর জন্য ভালো পাত্র দেখেছি। তুই দুএক দিনের মধ্যে চলে আয়।
টিকলী বলল, আমি বিয়ে করব না তোমরা ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে দাও। তারপর সালাম বিনিময় করে ফোন ছেড়ে দিল।
হালিম সাহেব মেয়ের মতামত স্ত্রীকে ও ছেলেকে জানালেন।
আলি বলল, তুমি আম্মাকে নিয়ে যাও। খালা খালুর সঙ্গে পরামর্শ করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেখ, যদি রাজি করাতে পারো।
মাজেদা বেগম বললেন, তুইও চল।
আলি নিশ্চিত, টিকলী টোপরকে ছাড়া বিয়ে করবে না। তাই বলল, অফিসে ছুটি দিবে কিনা ঠিক নেই, তোমরাই যাও।
হালিম সাহেব ও সাজেদা বেগম রাজশাহী গিয়ে মেয়েকে অনেক বোঝালেন। সাজেদা বেগমের বড় বোন ও দুলাভাই রাজি করাতে অনেক চেষ্টা করলেন; কিন্তু পারলেন না।
টিকলী তাদেরকে জানাল, আপনারা তো জানেন, টোপরকে আমি ছোটবেলা থেকে ভালবাসি। আমরা কবেই বিয়ে করে ফেলতাম। শুধু আম্মার কাছে ওয়াদা করেছিলাম বলে করিনি। তারপর মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি আমার ওয়াদা রক্ষা করেছি। এবার তুমি তোমার ওয়াদা রক্ষা কর।
সাজেদা বেগম বললেন, সে তো আজ চার পাঁচ বছর নিখোঁজ শুনেছি, হিরোইনের নেশা করত। সে কি আর বেঁচে আছে? বেঁচে থাকলে নিশ্চয় তার খোঁজ পাওয়া যেত।
সে বেঁচে আছে কিনা তা আল্লাহ পাককে মালুম। বেঁচে থাক আর না থাক, আজীবন তার জন্য আমি অপেক্ষা করব। তোমরা যদি জোর করে কিছু করতে চাও, তা হলে তার পরিনতি ভালো হবে না। কথা শেষ করে তাদের কাছ থেকে টিকলী নিজের রুমে চলে গেল।
মাজেদা বেগম বললেন, জোর করে কিছু করা ঠিক হবে না তোমরা চেষ্টা চরিত্র করে টোপরের খোঁজ কর।
সাজেদা বেগম বললেন, কি বলছ বুবু তুমি? টোপর কি বেচে আছে যে, তার খোঁজ করব।
মাজেদা বেগম বললেন, বুঝতে পারছিস না কেন? ওদের সম্পর্ক ছোটবেলা থেকে। সারাজীবনে ও তাকে ভুলতে পারবে না। তাই বলছি, সে যে বেঁচে নেই, তার প্রমাণ ওকে জানাতে হবে। তা যদি পারিস, তা হলে হয়তো বিয়েতে রাজি হতে পারে।
মাজেদা বেগমের স্বামী রহমান সাহেব বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছ। বাল্যপ্রেম কেউ ভুলতে পারে না, তারপর ভাইরাকে বললেন, মাজেদা যা বলল, তা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
দুতিন দিন থেকে হালিম সাহেব ও সাজেদা বেগম ঢাকা ফিরে এলেন।
টিকলী একদিন পেপারে কক্সবাজারে একটা প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তী দেখে খালা খালুকে না বলে গোপনে কক্সবাজার চলে এল।
হাসপাতালের মালিক হামিদ সাহেব টিকলীর আচার-আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে সুপারিন্টেনডেন্ট পদে নিয়োগ করেন এবং দুতিন মাসের মধ্যে হাসপাতালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেন। একবছর হতে চলল টিকলী এখানে তার আসল নামে (ডাঃ মাহবুবা)। কাজ করছে। আজ পর্যন্ত মা-বাবা বা খালা খালুকে জানায়নি। তবে এখানে আসার মাস দুয়েক পর জিনিয়াকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, সে দেশেরই কোনো এক হাসপাতালে চাকরী করছে। মা-বাবা ও ভাইয়াকে আমার জন্য দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করবি। বলবি আমি ভাল আছি। তারা যেন আমার খোঁজ না করে। আমি মাঝে মাঝে চিঠি দেব। খামের উপর ঠিকানা না দিয়ে, চিঠিটা হাসপাতালের একজন অফিস স্টাফের হাতে দিয়ে ঢাকাতে পোষ্ট করে দিতে বলেছিল। অফিসের ডাকে তিনি ঢাকা গিয়েছিলেন।
যে দিন টিকলী কক্সবাজার রওয়ানা দেয়, সে দিন সন্ধ্যে পর্যন্ত বাসায় না আসায় মাজেদা বেগম স্বামীকে বললেন, তুমি মেডিক্যালে ফোন করে দেখ, টিকলী কেন এখনো আসছে না।
রহমান সাহেব ফোন করে জানতে পারলেন টিকলী আজ ডিউটিতে আসেনি।
সে কথা মাজেদা বেগম শুনে খুব চিন্তিত হলেন। বললেন, এখন কি হবে তা হলে।
রহমান সাহেবও খুব চিন্তিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কখন বাসা থেকে বেরিয়েছে?
তা জানি না। বেলা আটটা বেজে যাওয়ার পর নাস্তা খেতে আসছে না দেখে বুয়াকে বললাম, দেখতো টিকলী ঘরে কি করছে?
বুয়া বলল, আপাকে তো ফজরের নামাজ পড়ে সুটকেস হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। তারপর বলল, ঢাকা গেল কিনা ফোন করলে হত না?
আজ করার দরকার নেই। রাতটা দেখা যাক, না ফিরলে কাল করা যাবে।
পরের দিন বেলা নটার সময় মাজেদা বেগম ঢাকায় ফোন করে বললেন, টিকলী কি ওখানে গেছে।
সাজেদা বেগম বললেন, না তো। কেন তোমরা কি ওকে তেমন কিছু বলেছ?
সাজেদা বেগম বললেন না। কাল সকালে সুটকেস হাতে করে বেরিয়ে যেতে আমাদের কাজের বুয়া দেখেছে। আমরা মনে করেছি, ঢাকা গেছে।
সাজেদা বেগম বললেন, ওকি আসার কথা দুএকদিন আগে বলেছিল?
মাজেদা বেগম বললেন, না।
সাজেদা বেগম আতঙ্কিত স্বরে বললেন, তা হলে কোনো বিপদে পড়ে নি তো?
কি করে বলব? তোর দুলাভাই এখানকার সব ক্লিনিকে খোঁজ নিয়েছে তারা ওর বান্ধবীদের বাসায় খোঁজ নে। আমরাও এখানে ভালো করে খোঁজ নিচ্ছি।
ঠিক আছে, রাতে ফোন করে জানাব; এখন রাখি তাহলে?
রাখ বলে মাজেদা বেগম ফোন ছেড়ে দিলেন।
সাজেদা বেগম কথাটা ছেলে ও স্বামীকে জানিয়ে খোঁজ নিতে বললেন।
আলি বলল, তা নিচ্ছি; কিন্তু আমার মনে হয়, তোমরা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছ বলে কোনো হাসপাতালে চাকরি নিয়ে চলে গেছে।
সাজেদা বেগম বললেন, তোর যেমন কথা, কোথাও চাকরি নিয়ে গেলে আমাদেরকে নিশ্চয় জানাত। তুই ওর বান্ধবীদের বাসায় খোজঁ কর। না পেলে তোর মামাদের বাসায় যাবি। সেখানে অনেক দিন থেকে যাবে যাবে করছিল।
হালিম সাহেব ছেলেকে বললেন, তোমার মা যা বলল, তাই কর।
সব জায়গায় খোঁজ নিয়েও টিকলীকে পাওয়া গেল না। হালিম সাহেব বিজ্ঞপ্তী দিলেন,
মা টিকলী, তুমি যেখানেই থাক ফিরে এস। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা কিছু করব না। যদি কোথাও চাকরি নিয়ে নিয়ে থাক, অতি সত্বর পত্র দিয়ে জানাবে। আমরা তোমার জন্য খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
–তোমার মা ও বাবা
বিজ্ঞপ্তী দেওয়ার প্রায় দেড় মাস পর জিনিয়া টিকলীর চিঠি পেল মা-বাবাকে সে কথা জানিয়ে আলিকে অফিসে ফোন করে বলল, টিকলী আমাকে চিঠি দিয়েছে, তুমি তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় এস।
আলি বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে জিনিয়াদের বাসায় এল।
সালাম ও কুশল বিনিময় করে জিনিয়া চিঠিটা আলির হাতে দিল।
আলি পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তারপর ঠিকানা দেয়নি দেখে বলল, খামের উপর জি.পি.ওর সীল। মনে হয়, ঢাকায় অথবা কাছাকাছি কোন ক্লিনিকে আছে।
জিনিয়া বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
কিন্তু এমনও তো হতে পারে, দুরে কোনো মফস্বলের হাসপাতালে বা ক্লিনিকে আছে। ঠিকানা জেনে যাব বলে কারো হাতে ঢাকায় পোষ্ট করতে দিয়েছে।
তাও হতে পারে, তবু তুমি ঢাকার আশপাশের ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নাও।
খোঁজ নিয়েছি, আবার না হয় নেব। এখন যাই, আম্মা-আব্বাকে জানাতে হবে। তরপর বিদায় নিয়ে আলি বাসায় এসে তাদেরকে জানাল। হালিম সাহেব ও সাজেদা বেগম আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
ঠিকানা দেয়নি শুনে সাজেদা বেগম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ছেলেকে বললেন, তুই আবার সব ক্লিনিকে খোঁজ কর।
আলি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারপর কয়েক দিন ধরে খোঁজ করেও পেল না। প্রায় একবছর খোঁজ করেও যখন পাওয়া গেল না তখন জিনিয়ার সঙ্গে আলির বিয়ে হয়ে গেল। এর মধ্যে টিকলী মা-বাবাকে দুটো চিঠি দিয়েছে। কিন্তু ঠিকানা দেয়নি।
বিয়ের মাসখানেক পর আলি জিনিয়াকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে এল। এখানকার হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারল, সমুদ্র। সৈকতের কাছে রহিম-আফরোজা নামে নতুন একটা হাসপাতাল হয়েছে।
একদিন সকালে নাস্তা খেয়ে সেখানে গিয়ে টিকলীর দেখা পেল।
সালাম ও কুশল বিনিময় করে টিকলী তাদেরকে বসতে বলল। তারপর বলল, তোমরা নিশ্চয় বিয়ে করেছ?
আলি বলল, আমি চেয়েছিলাম তোকে খুঁজে বের তারপর বিয়ে করব। জিনিয়ার। মা-বাবা বললেন, তোমার মা-বাবা জিনিয়াকে কাছে পেলে টিকলীর শোক কিছুটা অন্ততঃ ভুলতে পারবেন। একরকম বাধ্য হয়ে মাসখানেক আগে করতে হল। তা তুই আত্মগোপন করলি কেন? পেপারে আব্বা যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, পড়িসনি?
পড়ার পর জিনিয়াকে তো দুটো চিঠি দিয়েছি। তারপরও আব্বা-আম্মাকে দুটো দিয়েছি।
কিন্তু ঠিকানা দিসনি কেন? আম্মা তোর জন্য কত কাঁদে জানিস? টিকলীর চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে বলল, ওসব কথা থাক, এটা অফিস, এখানে ব্যক্তিগত ব্যাপারে বেশী সময় দিতে পারব না। তোমরা আমার কোয়ার্টার গিয়ে অপেক্ষা কর। আমি ঘন্টা খানেক পরে আসছি। তারপর একজন পিয়নকে ডেকে বলল, ইনাদেরকে আমার কোয়ার্টারে দিয়ে এস।
একঘন্টা পরে টিকলী কোয়াটারে এসে ভাইয়ার কাছ থেকে সে চলে আসার পর যা কিছু ঘটেছে সব শুনল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমরা ফিরবে কবে?
আলি বলল, এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছিলাম, কাল চলে যাব।
আজ দুপুরে ও রাতে তোমরা এখানে খাবে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বিদায় নেওয়ার সময় আলি টিকলীর ফোন নাম্বার নিয়ে বলল, কয়েক দিনের জন্য তুইও আমাদের সঙ্গে চল।
টিকলী বলল, পুরো হাসপাতালের দায়-দায়দায়িত্ব আমার উপর। এখন থেকে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। আব্বা-আম্মাকে আমার ছালাম দিয়ে বললো, তারা যেন। আমাকে মাফ করে দেয়।
তুই কি সারাজীবন বিয়ে করবি না?
সেকথা আল্লাহপাক জানেন। তোমাকে তো অনেক আগেই বলেছি, টোপরের জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব।
কিন্তু সে যদি মারা গিয়ে থাকে?
টিকলী চমকে উঠে ভাইয়া বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বলল, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, রাগ করবে না বল?
না, বল কি জিজ্ঞেস করবি।
কোনো কারণে জিনিয়া যদি হারিয়ে যেত, তা হলে তুমি কি অপেক্ষা করতে না?
আলিও চমকে উঠে একবার জিনিয়ার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে কিছুক্ষন চুপ করে রইল। তারপর ভিজে গলায় বলল, হ্যাঁ করতাম। তোকে আর এ ব্যাপারে কোনো দিন কিছু জিজ্ঞেস করব না।
জিনিয়া টিকলীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
টিকলী চেখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, কাঁদছ কেন ভাবী? জীবন আর কয় দিনের। এ দেশের মানুষের গড় আয়ু চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। তার অর্ধেক তো পার হয়ে গেছে। বাকিটা রুগীদের সেবা করে কাটিয়ে দেব। তারপর তাদেরকে গাড়িতে তুলে দিল।
এর কয়েক দিন পর কে বা কারা আজ টোপরকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
এইসব চিন্তা করতে করতে কখন যে মাগরিবের আযান হয়ে গেছে ডাঃ মাহবুবা জানতে পারলেন না। বুয়া যখন এসে বলল, আপামনি আযান হয়ে গেছে, নামায পড়বেন না তখন হুশ হল। বললো, হ্যাঁ পড়ব।
নামাজ পড়া শেষ হয়েছে, এমন সময় নার্স ইয়াসমীন এসে বলল, ম্যাডাম, রুগীর ঘুম ভেঙ্গেছে। আমাকে হিরোইন দাও, নচেৎ এখান থেকে চলে যাব, বলে বেড থেকে নেমে পড়েছিলেন। আমরা দুতিন জন মিলে বেডের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে রেখে আপনাকে জানাতে এলাম।
ডাঃ মাহবুবা বললো, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করে বোরখা পরে আসার সময় জিজ্ঞেস করলেন, ওঁকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?
ইয়াসমীন বলল, জ্বী
ডাঃ মাহবুবা এখানে মাদকে আসক্ত রুগীর সংখ্যাধিক্য দেখে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ সারওয়ার কে ঢাকা থেকে আনিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি কয়েক জন রুগীকে চিকিৎসা করে ভালোও করেছেন।
কেবিনের দরজার কাছে এসে ডাঃ মাহবুবা বললেন, আপনি ডাঃ সারওয়ারকে ডেকে নিয়ে আসুন। তারপর কেবিনে ঢুকে বেডের কাছে এগিয়ে এলেন।
টোপর তাকে চিনতে পারল না। কারণ ডাঃ মাহবুবার চোখ দুটো ছাড়া সারা শরীর ও মুখ বোরখা দিয়ে ঢাকা। জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
ডাঃ মাহবুবা বললেন, তা জানার আপনার দরকার নেই। আপনি ওষুধ খাচ্ছেন না কেন?
টোপর চিৎকার করে বলল, আমি ওষুধ খাব না, আমাকে হিরোইন দিন। তারপর বলল, আমি এখানে কেন? শালা কায়সার নিশ্চয় এখানে নিয়ে এসেছে। শালাকে পেয়ে নিই একবার, মজা দেখাব।
ডাঃ মাহবুবা বললেন, তা পরে দেখাবেন, এখন ওষুধ খেয়ে নেন।
টোপর নরমস্বরে বলল, আগে আমার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিন।
উঁহু, আগে ওষুধ খেয়ে নিন, তারপর খুলে দেব।
ওষুধ খাইয়ে আমাকে ভালো করতে চান? কিন্তু আমি তো বাঁচতে চাই না। প্লীজ, হয় আমাকে ছেড়ে দিন, নচেৎ হিরোইন দিন।
আমার কথা না শুনলে, আমিও আপনার কথা শুনব না। তারপর দুটো ট্যাবলেট ও এক গ্লাস পানি এনে বলল, নিন হাঁ করুন।
না, আমি খাব না। আমাকে হিরোইন দিন।
এটা হাসপাতাল, এখানে চিকিৎসা করে রুগীদের ভালো করা হয়। ইনশাআল্লাহ আপনিও ভালো হয়ে যাবেন।
আমার চিকিৎসা করার দরকার নেই। আমি ভালো হতে চাই না।
কেন চান না বলুন তো?
সে কথা শুনে আপনার কি লাভ?
লাভ আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি।
বলার পর হিরোইন দেবেন বলুন।
হাসপাতালে তো হিরোইন থাকে না, দেব কি করে?
তাহলে আমাকে ছেড়ে দিন প্লীজ, আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।
ডাঃ মাহবুবা একটু চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, বাইরে থেকে আনিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। এবার বলুন, কেন আপনি এই মরণনেশায় আসক্ত হলেন?
সে কথা বলতে আমার খুব কষ্ট হবে। সে সময় হিরোইন না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব। আগে ব্যবস্থা করে আসুন।
ডাঃ মাহবুবা চালাকি করে বাইরে থেকে ঘুরে আসার জন্য কেবিন থেকে বেরিয়ে ইয়াসমীনকে একা আসতে দেখলেন। কাছে এলে জিজ্ঞেস করলেন, ডাঃ সারওয়ার এলেন না?
উনি একটা রুগী নিয়ে খুব ব্যস্ত আছেন। বললেন, কিছুক্ষণ পরে আসবেন।
আপনি সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করুন। রুগী দেখা হয়ে গেলে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।
ইয়াসমীন জ্বী ম্যাডাম বলে চলে গেল।
ডাঃ মাহবুবা বেরিয়ে যাওয়ার পর টোপরের হঠাৎ মনে হল, এই মহিলা ডাক্তারের গলার স্বর ঠিক টিকলীর মতো। ভাবল, সে নয় তো? সে নিশ্চয় এতদিনে ডাক্তার হয়ে। গেছে। আবার ভাবল, ডাক্তার হলে ও এখানে আসবে কেন? ঠিক করল, ফিরে এলে পরিচয় জানতে চাইবে।
ডাঃ মাহবুবা মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এসে বললেন, ব্যবস্থা করে এলাম, এবার বলুন।
তার আগে আপনার পরিচয় বলুন।
আমি এখানকার ডাক্তার।
তাতো বুঝেছি, আপনার বায়োডাটা বলুন।
আগে আপনার কথা শেষ করুন, তারপর বলব।
তাহলে আপনার মুখের নেকাবটা খুলুন।
ডাঃ মাহবুবা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আপনি কিন্তু ভদ্রতা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
প্লীজ, রাগ করবেন না। একটা মৃত্যু পথযাত্রির অনুরোধ রক্ষা করুন।
ডাঃ মাহবুবা এতক্ষণ সামলে থাকতে পারলেও আর পারলেন না। মুখের নেকাব সরিয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল।
টোপর চমকে উঠে রাগ ও ঘৃনাপূর্ণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হাত পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে হাপরের মতো ফুসতে ফুসতে বলল, আমি আর একদন্ড এখানে থাকব না। কে কোথায় আছ, আমার বাঁধন খুলে দাও।
ডাঃ মাহবুবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, প্লীজ টোপর, একটু শান্ত হও। তোমার টিকলীর কথা আগে শোন, তারপর যা ইচ্ছা তাই করো।
কে টোপর? কে টিকলী? কাউকেই আমি চিনি না। আমি হাসান। আমি কিছুই শুনতে চাই না। তারপর নিজেকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করতে লাগল।
ডাঃ মাহবুবার মনে হল, হার্টফেল করতে পারে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমের ইনজেকশন রেডি করে পুশ করতে এলেন।
টোপর চিৎকার করে উঠল, কে কোথায় আছেন, আমাকে বাঁচান। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে আমাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন?
এমন সময় ডাঃ সারওয়ার ও ইয়াসমীন কেবিনে ঢুকলেন।
তাদের দেখে টোপর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আপনারা ঐ পিশাচীনির হাত থাকে আমাকে বাঁচান। আমাকে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছেন। ওঁকে এখান থেকে চলে যেতে বলুন। ওঁর মুখ আমি দেখতে চাই না।
ডাঃ মাহবুবা ডাঃ সারওয়ারকে বললেন, উনি হিরোইনের জন্য খুব অস্থির হয়ে উঠে ছিলেন। তাই এই ইনজেশন দিতে চাচ্ছি বলে চিৎকার করছেন।
ডাঃ সারওয়ার মাস চারেক হল, এখানে এসেছেন। ডাঃ মাহবুবাই যে এখানকার সর্বেসর্বা তা জানেন। ওঁর মুখ কোনো দিন দেখেন নি। আজ দেখে কিছু একটা অনুমান করলেন। বললেন, আপনি চলে যান, আমি দেখছি।
ডাঃ মাহবুবা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ নার্সের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাইরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ডাঃ সারওয়ার টোপরকে বললেন, ভয় নেই উনি আপনার কাছে আসবেন না। তারপর তার একটা হাত শক্ত করে ধরে নার্সকে ইনজেকশন পুশ করতে বললেন।
টোপর বলল, প্লীজ ইনজেকশন দেবেন না, আমাকে ছেড়ে দিন।
নার্স ইনজেকশন পুশ করার পর ডাঃ সারওয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, আগে ঠিক মতো ওষুধ পত্র খান, আমাদের কথা মতো চলুন। ভালো হয়ে গেলে আমরাই আপনাকে রাখব না। তারপর নার্সকে বললেন, এখানে সব সময় একজন থাকবেন। প্রয়োজনে আমাকে খবর দেবেন। কথা শেষ করে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে ডাঃ মাহবুবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।
বেশ তো চলুন বলে ডাঃ মাহবুবা এগোলেন। কোয়ার্টারের বারান্দায় এসে দুজন দুটো চেয়ারে বসে ডাঃ মাহবুবা বললেন, কি আলাপ করতে চান বলুন।
ডাঃ সারওয়ার বললেন, যদি অনুমতি দেন, কয়েকটা প্রশ্ন করব।
করুন।
এই রুগী কী আপনার পরিচিত?
হ্যাঁ।
কিছু হয় কী আপনার?
ডাঃ মাহবুবা কি বলবে ঠিক করতে না পেরে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
প্লীজ ম্যাডাম, চুপ করে থাকবেন না। আমি মনে করি, ওঁকে বাঁচাতে হলে আপনার সাহায্য খুব দরকার। ডাক্তার হিসাবে কথাটার গুরুত্ব নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?
বুয়াকে চা নিয়ে আসতে দেখে ডাঃ মাহবুবা বললেন, চা খেয়ে নিন, বলছি। চা খাওয়ার পর ডাঃ মাহবুবা প্রথমে নিজের ও টোপরের বায়োডাটা বললেন। তারপর ছোটবেলার সম্পর্ক থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সব বলে বললেন, এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আমার কারণেই ওঁর আজ এই অবস্থা। ওঁকে বাঁচাবার জন্য আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব।
ডাঃ সারওয়ার বললেন, যারা হিরোইনের নেশা করে, তারা চার পাঁচ বছরের বেশি বাঁচে না। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, উনি প্রায় ছয় বছর ধরে নেশা করছেন। এখনো যে বেঁচে আছেন, ভাবতেই খুব অবাক লাগছে। এই জন্যেই বোধ হয় কথায় আছে, রাখে আল্লাহ মারে কে? অবশ্য কোরআনপাকেও আছে, আল্লাহ হায়াৎ মউতের মালিক।
ডাঃ মাহবুবা ভিজে গলায় বললেন, এ কথা মুসলমান মাত্রেই জানে। আপনি আপনার সাধ্যমতো চিকিৎসা করুন। আমি আমার সাধ্যমত সব কিছু করব।
ডাঃ সারওয়ার বললেন, কি সাহায্য দরকার, তা ডাক্তার হিসাবে আপনি নিশ্চয় জানেন। তবু বলছি, আপনার প্রতি ওর ঘৃণা বা বিদ্বেষ দূর করার চেষ্টা করবেন। আপনার ও ওঁর মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই যে তাদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত এবং সেই জন্যে ওঁকে যে তারা এখনো খুঁজছেন, সে কথা বিশ্বাস করাতে হবে।
ডাঃ মাহবুবা বললেন, আমি ওঁর জন্য সবকিছু করব। আপনি শুধু একটু ভালো করে কেয়ার নেবেন।
এটা আমার কর্তব্য, আপনি না বললেও নিতাম। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে ডাঃ সাওয়ার বললেন, রাত একটার দিকে ওঁর ঘুম ভাঙ্গবে। আমি নার্সকে থাকতে বলেছি। কোনো রকম অসুবিধা হলে আমাকে খবর দিতেও বলেছি। আমি না বলা পর্যন্ত আপনি ওঁর কাছে যাবেন না। তবে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আসতে পারেন। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
ডাঃ মাহবুবা এশারে নামায পড়ে খাওয়া দাওয়া করলেন। তারপর টোপরের কেবিনে এলেন।
ইয়াসমীন টুলে বসে ছিল। দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
ডাঃ মাহবুবা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আপনি যান। নামায পড়ে খেয়ে দেয়ে আসুন। আমি ওঁর ঘুম ভাঙ্গার আগে পর্যন্ত আছি।
ইয়াসমিন চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ টোপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর টুলটা বেডের কাছে এনে বসে তার মাথায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে দুহাত তুলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ফরিয়াদ করলেন, হে রাবুল আলামিন, তুমি বিশ্বব্রহ্মান্ডের একমাত্র মহান প্রভু। তোমার সমকক্ষ কেউ নেই। তুমি অসীম দয়ালু। তাই যারা তোমাকে অস্বীকার করে এবং যারা তোমার আদেশ নিষেধ অমান্য করে। তাদেরকে ও তুমি জীবন-যাপন করার অবসর দিয়েছ। আমি তোমার একজন নাদান। বান্দী হলেও তোমার পেয়ারা হাবিব হযরত মুহম্মদ (দঃ)-এর উম্মত। সেই হাবিবে পাকের উপর শত কোটি দরূদ ও সালাম পেশ করে ফরিয়াদ করছি, তুমি টোপরকে ভালো করে আমাকে তার স্ত্রী হিসাবে কবুল কর। তুমি অন্তর্যামী। আমাদের দুজনের অন্তরের সব কিছু জান। তোমার মনোনীত প্রিয় বান্দারা ছাড়া প্রত্যেক মানুষই কিছু না কিছু গোনাহ করে থাকে। আমিও করেছি। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাস, আমি ক্ষমা চাইছি। আমাকে ও টোপরকে ক্ষমা করে আমাদের মনের নেক মকসুদ পূরণ কর। তুমি ক্ষমা না করলে মানুষের পরিত্রানের কোনো উপায় নেই। তুমি কোরআন পাকে বলেছ, হে আমার বান্দাগণ যাহারা নিজের উপর অত্যাচার করিয়াছ, তোমরা আল্লাহতায়ালার রহম হইতে নিরাশ হইও না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ (অতীতের) সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করিবেন; নিশ্চিয় তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, দয়ালু। [সূরা-যুমার, ২৪-প্যারা, ৫৩ নং আয়াত।] তোমার পবিত্র বানী মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাসের জোরে তোমার কাছে ফরিয়াদ করছি, তোমার হাবিবে পাকের অসিলায় আমাকে ক্ষমা করে আমার দোওয়া কবুল কর। আমিন, সুম্মা আমিন।
মোনাজাত শেষ করে চোখ মুখ মুছে টোপরের মুখের দিকে চেয়ে বসে রইলেন। এগারটার সময় ইয়াসমীন ফিরে এলে বললেন, আমি স্যুপ পাঠিয়ে দিচ্ছি, ওঁর ঘুম ভাঙ্গলে খাওয়াবেন। যদি খেতে না চান অথবা তেমন কিছু উৎপাত করেন, তা হলে ডাঃ সারওয়ারকে খবর দেবেন।
ইয়াসমীন প্রথমেই বুঝতে পেরেছে, ইনি নিশ্চয় ম্যাডামের আপনজন। বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ডাঃ সারওয়ার আমাকে সবকিছু নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
ডাঃ মাহবুবা ভারাক্রান্ত মনে কোয়ার্টারে ফিরে এসে ফ্রীজ থেকে মুরগীর মাংস নিয়ে স্যুপ তৈরী করে বুয়ার হাতে পাঠিয়ে দিলেন।
পরের দিন সকালে ডাঃ মাহবুবা ঢাকায় ফোন করলেন।
আলি ড্রইংরুমে বসে পেপার পড়ছিল। ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, কাকে চান?
ডাঃ মাহবুবা ভাইয়ার গলা বুঝতে পেরে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভাইয়া, আমি টিকলী, কক্সবাজার থেকে বলছি। তোমরা সব কেমন আছ?
আল্লাহরপাকের দোওয়ায় ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
আমিও আল্লাহপাকের রহমতে ভালো আছি। ভাইয়া শোন, টোপরের দেখা আল্লাহ মিলিয়েছে। ওর অবস্থা খুব খারাপ।
তাই নাকি? ওর সঙ্গে দেখা হল কি করে।
গতকাল একটা লোক ওকে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। এখানে আছে। আমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। হিরোইনের নেশা করে করে কঙ্কাল হয়ে গেছে। তোমরা সবাই ওর জন্য দোওয়া করো।
তা তো করবই। ধর, আম্মা-আব্বাকে ডেকে নিয়ে আসি।
না ভাইয়া, আমার মনের অবস্থা এখন কি রকম তা নিশ্চিয় বুঝতে পারছ। তুমি সবাইকে নিয়ে দুএকদিনের মধ্যে চলে এস। আর টোপরের মা-বাবাকে খবরটা দিয়ে তাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। সায়কিয়াট্রিস্ট ডাঃ সারওয়ার ওর চিকিৎসা করছেন। উনি বলেছেন, ওকে বাঁচাতে হলে আমাদের ও ওর গার্জেনদের উপস্থিতি খবর দরকার।
আলি বলল, আমি পরশু আমাদের সবাইকে নিয়ে আসছি; কিন্তু আমার কথায় টোপরের মা-বাবা যেতে মনে হয় রাজি হবেন না। তুই নিজে তাকে ফোন করে বল।
টিকলী বলল, ঠিক আছে, তুমি ফোন রেখে দাও। আমি এক্ষুণী করছি।
আলি ফোন রেখে দেওয়ার পর টিকলী টোপরদের বাসায় ফোন করল।
কাহহার সাহেব বাসায় ছিলেন, ফোন ধরে বললেন, হ্যালো, কাহহার সাহেব বলছি।
টিকলী সালাম দিয়ে বলল, আমি কক্সবাজার রহিম আফরোজা হাসপাতালের ডাক্তার বলছি। এখানে আপনার ছেলে টোপর মুমূর্ষ অবস্থায় রয়েছেন। আপনাদের সবাইকে একবার দেখতে চাচ্ছেন।
প্রথম সন্তানের উপর সব মা-বাবার স্নেহ ভালবাসা একটু বেশি থাকে। তাই টোপরের অধঃপতনে রেগে গেলেও পাঁচ-ছ বছর পর খোঁজ পেয়ে পিতৃস্নেহ উথলে উঠল। তার মুমূর্ষ অবস্থার কথা শুনে চোখে পানি ধরে রাখতে পারলেন না। কথা বলতে গেলে কেঁদে ফেলবেন ভেবে চুপ করে সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
টিকলী মনে করল, এখনো উনি ছেলেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। বলল, বান্দা অন্যায় করে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আর আপনি বাবা হয়ে মুমূর্ষ ছেলেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। তা ছাড়া ভুল যে আপনারাও করেছেন, তা ভালো করে চিন্তা করলে বুঝতে পারতেন।
কাহহার সাহেব চিন্তা করলেন, টোপর নিশ্চয় ডাক্তারকে সব কথা বলেছে। নচেৎ উনি এরকম কথা বলছেন কেন। ভিজে গলায় বরলেন, হ্যাঁ মা, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমরাও ওর প্রতি অবিচার করেছি। আমি সবাইকে নিয়ে দুএকদিনের মধ্যে আসছি। টোপর কেমন আছে মা?
টিকলী বলল, অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমরা চিকিৎসার ত্রুটি করছি না। আপনারা দোওয়া করুন, আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ করে দেন। এবার রাখি বলে সালাম বিনিময় করে ফোন রেখে দিল।
ডাঃ সারওয়ারের তত্ত্বাবধানে ও চিকিৎসায় দুতিন দিনের মধ্যে টোপর কিছুটা নরম্যালে এল। মাঝে মাঝে হিরোইনের দেওয়ার কথা বললেও তেমন উত্তেজিত হয় না। তিন দিনের দিন ডাঃ সারওয়ার ডাঃ মাহবুবাকে বললেন, আজ রাত থেকে আপনার তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দিলাম। হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়ার ব্যাপারটা আপনার উপর নির্ভর করছে। কিন্তু খুব সাবধান, আপনাকে দেখে যদি আগের মতো উত্তেজিত হয়ে পড়েন, আর আপনি যদি সামলাতে না পারেন, তাহলে আমাকে কাউকে দিয়ে খবর দেবেন।
ডাঃ মাহবুবা শুধু ধন্যবাদ বলে চুপ করে রইলেন।
এশার নামায পড়ে খাওয়া দাওয়ার পর ডাঃ মাহবুবা যখন টোপরের কেবিনে এল তখন সে ঘুমাচ্ছে। বোরখা খুলে টুলে বসে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন। সাড়ে তিনটার সময় টোপরের ঘুম ভেঙ্গে যেতে বুঝতে পারল, হাত পায়ের বাঁধন খোলা। পাশ ফিরে শুয়ে টিকলীকে দেখে রেগে উঠে চিৎকার করে বলল, আপনি আবার এসেছেন? বেরিয়ে যান, নচেৎ আমিই চলে যাব। তারপর বেড থেকে নামতে গেল।
টিকলী তাকে ধরে ফেলে বলল, তুমি খুব দুর্বল টোপর, যেতে পারবে না। আমি তোমার টিকলী। আমাকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করছ কেন? আজ ছয় বছর পর তোমাকে পেয়েছি, কিছুতেই যেতে দেব না।
টোপর চিৎকার করেই বলল, কে টোপর? তাকে আমি চিনি না। টিকলী নামেও কাউকে চিনি না। আমি হাসান। আপনি আমাকে ছেড়ে দিন; আমি এখান থেকে চলে যাব।
টিকলী তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমাকে যেতে দিলে তো যাবে। আমার একটু ভুলের জন্য তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে আজ ছয় বছর কি যে অশান্তির আগুনে জ্বলছি, তা উপরের মালিক জানেন। তারপর টোপর রাজশাহী থেকে চলে আসার পর যা কিছু ঘটেছে, কি ভাবে তাকে খুঁজেছে বলল। তারপর মা-বাবা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করার কথা, গোপনে এখানে চলে আসার কথা এবং টোপরকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে জিনিয়ার মারফত যে সব চিঠি টোপরকে দিয়েছিল সেগুলো তার হাতে দিয়ে বলল, আমার কথা সত্য না মিথ্যা এগুলো পড়লেই জানতে পারবে। তোমার বন্ধু সাগরও সবকিছু জানে। তাকেও জিজ্ঞেস করে যাচাই করতে পারবে। আমার মা-বাবা ভাইয়া সবাই তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল। আর তোমার মা-বাবা ও ভাইবোন ভুল বুঝতে পেরে তোমাকে অনেক খুঁজেছে। একটা কথা শুনে রাখ, তুমি যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর, তা হলে আমিও তোমার মতো হিরোইনের নেশা করতে বাধ্য হব।
চিঠিগুলো পড়ে ও টিকলীর কথা শুনে টোপর নিথর হয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, ঐ জঘন্য নেশার নাম মুখে এনো না। ঐ নেশা করে আমি মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি। তুমি ওর ধারে কাছেও যেও না। আমাকে এবার যেতে দাও টিকলী; মৃত্যু আমাকে ডাকছে। পারলে ক্ষমা করো।
টোপরের মুখে টিকলী ডাক শুনে তার অন্তরে শীতল বাতাসের পরশ বয়ে গেল। ভিজে গলায় বলল, হায়াত মউত আল্লাহ পাকের হাতে। আমি তোমাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ইনশাআল্লাহ ফিরিয়ে আনবোই। সে জন্য যদি জীবন দিতে হয়, তাও দেব।
অনেক দেরী হয়ে গেছে টিকলী; আমি আর বেশি দিন বাঁচব না। আমার জন্য জীবনটা নষ্ট করো না।
এ জীবন শুধু তোমার জন্য আগে যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে। ডাঃ সারওয়ার ফরেন থেকে সাইকিয়াট্রিস্টে ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন। তিনি তোমার চিকিৎসা করছেন। তার হাতে তোমার মতো অনেক মাদকে আসক্ত রুগী ভালো হয়েছে। তুমি কোনো দুঃশ্চিন্তা করো না। ইনশাআল্লাহ তিনি তোমাকে খুব শিঘ্রী ভালো করে তুলবেন। এবার বল, তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ?
টিকলীর কথা শুনতে শুনতে টোপরের বেঁচে থাকার ইচ্ছা প্রবল হল। বলল, তোমার প্রতি অবিচার আমিও কম করিনি। তুমি আগে বল আমাকে ক্ষমা করেছ?
টিকলী কেঁদে ফেলে বলল, আল্লাহ আমাদের দুজনকে মাফ করুক।
টোপর বলল, সত্যি করে বল তো টিকলী, আমি কি বাঁচব?
টিকলী বলল, ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় বাঁচবে। যদি তোমার হায়াত না থাকে, তবে আমি আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে আমার অর্ধেক হায়াত দিয়ে তোমাকে বাঁচাবার ফরিয়াদ করব।
টোপর তাকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, তোমার মতো আল্লাহর নেক বান্দীর কথা না শুনে যে অন্যায় করেছি, আল্লাহ কি ক্ষমা করবেন? কথা বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
টিকলী তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, আল্লাহ বহুৎ দয়াবান ও ক্ষমাশীল। কোনো বান্দা অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা না করে থাকতে পারেন না। তারপর বলল, আমি ঢাকায় ফোন করে তোমার কথা আমাদের ও তোমাদের বাসায় জানিয়ে সবাইকে আসতে বলেছি। আজ কালের মধ্যে হয়তো এসে পড়বে। আসার পরপরই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলব ঠিক করেছি। আশা করি, ইনশাল্লাহ এবার আমাদের ও তোমাদের বহুদিনের পারিবারিক মনোমালিন্যে অবসান হবে।
টোপর চমকে উঠে বলল, সত্যি বলছ?
আমি কখনো মিথ্যা বলি না। তা ছাড়া এতবড় সুসংবাদ কেউ কি মিথ্যা করে বলতে পারে?
কিন্তু আমি তো বেশি দিন বাঁচব না। আবার বলছি, এতবড় ভুল করো না টিকলী।
টিকলী তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, ওরকম কথা আর কখনো বলবে না। জান না, তুমি না বাঁচলে আমিও বাঁচব না? এত বছর সবর করে তোমাকে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করেছি। তিনি যখন ফরিয়াদ কবুল করে তোমাকে পাইয়েছেন তখন তিনিই তোমাকে সুস্থ করে আমাদের জোড়া কবুল করবেন।
টোপর ভিজে গলায় বলল, এই পাপী বান্দার দোওয়া আল্লাহ কবুল করবেন কিনা জানি না; তবু করছি, তিনি যেন তোমার বাসনা পূরণ করেন।
টিকলী কান্না মুখে মৃদু হেসে বলল, উঁহু, হল না, আল্লাহ যেন আমাদের দুজনেরই মনের বাসনা পূরণ করেন। তারপর দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, আমিন।
এমন সময় হাসপাতালের মসজিদ থেকে ফজরের সুমধুর আযান ভেসে এল, আল্লাহু আকবার– আল্লাহু আকবার।
ইবনুল আরাবী
আমার কথা মনে হয় আপনার দৃষ্টিগোচর হয় না