প্রতিনায়ক : সিরাজুল আলম খান – মহিউদ্দিন আহমদ
উৎসর্গ : কাজী আরেফ আহমদ, শাজাহান সিরাজ, স্বপন কুমার চৌধুরী, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাসুদ আহমেদ রুমি, আবদুল বাতেন চৌধুরী, মমতাজ বেগম, চিশতি শাহ্ হেলালুর রহমান, নিখিল চন্দ্র সাহা, আফতাব আহমাদ, সুমন মাহমুদ, একরামুল হক
.
সূচি
ইতিহাসের সত্যি কথা
পর্ব ১ নিউক্লিয়াস
নিউক্লিয়াসের খোঁজে
অপূর্ব সংসদ
পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট ইস্ট
বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ
পর্ব ২ মুজিববাহিনী
বিএলএফ
ঢাকা থেকে কলকাতা
মুক্তিযুদ্ধ
পর্ব ৩ জাসদ
বিদ্রোহ
বিপ্লব
বিভক্তি
হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা
পরিশিষ্ট
১. জয় বাংলা
২. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি
৩. বিশেষ বিজ্ঞপ্তি
৪. যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন
৫. গ্রন্থপঞ্জি
.
ইতিহাসের সত্যি কথা
জীবনের একটা সুন্দর সময় পেরিয়ে এসেছি, যার নাম শৈশব। যা শুনতাম বা পড়তাম, তা মনের মধ্যে গেঁথে যেত। রূপকথা, পুরাণ আর ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য বুঝতাম না। পৌরাণিক চরিত্রগুলো খুব আকর্ষণ করত। কাউকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতাম, কাউকে করতাম ঘৃণা। ওই সময় রামায়ণ, মহাভারত আর ইলিয়াড-এর শিশুতোষ পাঠের সুযোগ হয়েছিল। এগুলো আমার পড়া প্রথম মহাকাব্য। সেখানে কেউ নায়ক, কেউ প্রতিনায়ক, কেউবা খলনায়ক। আছে দ্বন্দ্ব, আছে যুদ্ধ, আছে মৃত্যু। সে এক বিশাল ক্যানভাস।
এখন চারপাশে জান্তব পৃথিবী, ঘোর বাস্তবতা, সবকিছু গদ্যময়। কাব্যের ছিটেফোঁটাও নেই। ভালোবাসার মানুষগুলোকেও অনেক সময় অচেনা মনে হয়, মনে হয় প্রতারক। তারপরও কেউ কেউ আছেন, যাদের খুব বেশি রকম মনে পড়ে। আমরা তাদের জন্য নৈবেদ্য সাজাই, গুণকীর্তন করি। এসব করতে করতে অজান্তেই তৈরি করি মিথ। এর আড়ালে ইতিহাসের সত্য চাপা পড়ে যায়।
আমাদের জীবনের দুটি দিক আছে। একটি আলোয় ভরা, অন্যটি অন্ধকারে ঘেরা। আমরা যখন জীবনের গল্প বলি, অন্ধকার দিকটি এড়িয়ে যাই। আলোময় দিকটা নানান মসলা মেখে পরিবেশন করি। ফলে গল্প হয়ে যায় একপেশে। একপেশে গল্প শুনতে শুনতে একসময় এটি হয়ে যায় ইতিহাস, যদি না তার বিপরীতে অন্য কেউ অন্য গল্প দাঁড় করান।
সমাজে চিন্তার পাশাপাশি প্রতিচিন্তা বা বিকল্প ভাবনার জায়গাটি এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। সমাজ তো বদ্ধ পুকুর নয়। সেখানে ঢিল ছুড়লে এখনো তরঙ্গ তৈরি হয়।
ইংরেজ লেখক হার্বার্ট জর্জ ওয়েলস (১৮৬৬-১৯৪৬) দ্য টাইম মেশিন নামে একটি কল্পকাহিনি লিখেছিলেন। এটি প্রথম ছাপা হয় ১৮৯৫ সালে। তিনি তাঁর জীবনকালে দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। বড় লেখকদের লেখায় অনাগত সময়ের ছাপ থাকে। টাইম মেশিন তার ব্যতিক্রম নয়। সেখানে ভবিষ্যতের এক ভয়ংকর সময়ের ছবি ফুটে উঠেছে, যেখানে মানুষ বই পড়ে না, চিন্তা করে না। মানুষগুলো সব যন্ত্রের মতো।
আমাদের মধ্যে এমন সমাজপতি আছেন, যাঁরা সব সময় চোখ রাঙিয়ে কথা বলেন–এটা বলা যাবে না, ওটা করা যাবে না। তারা ঠিক করে দেন মানুষ কী লিখবে, কী পড়বে, কী শিখবে, কী জানবে, কী ভাববে, কী বলবে। পান থেকে চুন খসলেই তারা সর্বনাশের গন্ধ পান। তাদের শিখিয়ে দেওয়া কথা কিংবা দেখিয়ে দেওয়া পথের বাইরে গেলেই রব ওঠে, সব বুঝি উচ্ছন্নে গেল।
সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ বা বহুত্ববাদের বিপরীতে এককেন্দ্রিকতার লড়াই অনেক দিনের। একদিকে বৈচিত্র্যের আবাহন, অন্যদিকে সামাজিক শৃঙ্খলা ও কর্তৃত্বের দর্শন। এই দুই পথের লড়াই থেকে তৈরি হয় নানান ডিসকোর্স বা তত্ত্ব। সবাই সব ব্যাপারে একমত হবেন না। এর প্রয়োজনও নেই।
‘ঐকমত্য’ শব্দটি আমরা বুঝে কিংবা না বুঝে ব্যবহার করি। মনে করি এটা বুঝি খুবই দরকারি। তখন দরকারি জিনিসটা সমাজে চাপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা তৈরি হয়। ফলে তৈরি হয় সংকট। ১২৯৮ বঙ্গাব্দে ‘আহার সম্বন্ধে চন্দ্রনাথ বাবুর মত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন :
“রুচিভেদে অভিজ্ঞতাভেদে আমাদের কোনো জিনিস ভালো লাগে কোনো জিনিস মন্দ লাগে, সকল সময়ে তাহার কারণ নির্দেশ করিতে পারি না। তাহার যেটুকু কারণ তাহা আমাদের সমস্ত জীবনের সহিত জড়িত, সেটাকে টানিয়া বাহির করা ভারি দুরূহ। মনের বিশেষ গতি অনুসারে অসম্পূর্ণ প্রমাণের উপরেও আমরা অনেক মত গ্রহণ করিয়া থাকি; এইরূপ ভূরি ভূরি অপ্রমাণিত বিশ্বাস লইয়া আমরা সংসারযাত্রা নির্বাহ করিয়া যাই। সেইরূপ মত ও বিশ্বাস যদি ব্যক্ত করিবার ইচ্ছা হয় তবে তাহা বলিবার একটা বিশেষ ধরন আছে। একেবারে অভ্রান্ত অভ্রভেদী গুরুগৌরব ধারণা করিয়া বিশ্বসাধারণের উপর নিজের মতকে বেদবাক্য স্বরূপে বর্ষণ করিতে আরম্ভ করা কখনো হাস্যকর, কখনো উৎপাতজনক। আমরা পছন্দ করি বা না করি, আমরা একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি। রাষ্ট্রের নিজস্ব একটি ধর্ম আছে। এর চরিত্র আপাত-নৈর্ব্যক্তিক হলেও এটি যারা চালান, তাদের ইচ্ছা ও দর্শন রাষ্ট্রের নৈর্ব্যক্তিক চরিত্র ঢেকে দেয়। ফলে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে শ্রেণি, গোষ্ঠী বা পরিবারের সম্পত্তি। এ অতি পুরোনো কথা। এ অবস্থায় রাষ্ট্র তার সর্বজনীন মালিকানা হারায়। অথবা বলা যায়, রাষ্ট্রের সর্বজনীন মালিকানা কখনোই ছিল না। এটাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলার চেষ্টা ছিল এবং আছে।”
আমরা যখন পুরাণের যুগ থেকে ইতিহাসের যুগে প্রবেশ করলাম, তখন থেকেই রাষ্ট্র আমাদের সামনে নানারূপে দেখা দিয়েছে। রূপান্তর ঘটেছে রাজনীতিশাস্ত্রে। রাষ্ট্রীয় দর্শন জটিলতর হচ্ছে, রাষ্ট্র হচ্ছে ক্রমাগত শক্তিশালী। রাষ্ট্র একপর্যায়ে ইতিহাসের ওপরও দখলদারি চাপিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র ঠিক করে দিচ্ছে কোনটি ইতিহাস আর কোনটি কেচ্ছা। ফলে যখন রাষ্ট্রের দখল এক গোষ্ঠীর হাত থেকে অন্য গোষ্ঠীর হাতে চলে যায়, তখন ইতিহাসও যায় পাল্টে। এ এক মজার খেলা। কাল শুনেছি অমুক হলো নায়ক আর তমুক হলো খলনায়ক, আজ শুনছি খলনায়ক হয়ে গেছে নায়ক আর নায়ক হয়ে গেছে খলনায়ক। ইতিহাস এখানে হয়ে গেছে ইচ্ছাপূরণের গল্প।
অতীতকে কীভাবে দেখা হবে, কোন ঘটনার কার্যকারণ কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, পরবর্তী ঘটনার ওপর তার অভিঘাত কেমন হবে বা হয়েছে, এর ব্যবচ্ছেদের তরিকা নিয়ে শাস্ত্র আছে। কিন্তু শাস্ত্রচর্চায়ও সমস্যা আছে। ঘটনা। একটি। কিন্তু তার ব্যাখ্যা তো নানা রকম হতে পারে। কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, তা অনেকটাই নির্ভর করে তাঁর ইচ্ছার ওপর। আমাদের সমাজে ইতিহাসচর্চা সব সময় একাডেমিক পদ্ধতি ব্যবহার করে হয় না। নানান। উদ্দেশ্য থেকেও ইতিহাস তৈরির চেষ্টা হয়। ফলে তৈরি হয় মিথ বা অপ ইতিহাস। ইতিহাসের নানান বিবরণের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। কোনোটি রাষ্ট্রের আনুকূল্য পায়, কোনোটি পায় না। রাষ্ট্রীয় তরিকার বাইরে গিয়ে ইতিহাসচর্চার চ্যালেঞ্জ অনেক, ঝুঁকিও প্রবল।
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল। এটি নিয়ে জোসেফ স্তালিন একটি বই লিখেছেন। আরেকটি লিখেছেন লিও ট্রটস্কি। দুজনের রাজনীতি ও চিন্তায় বিস্তর ফারাক। ভিন্ন স্বাদের একটি বই লিখেছেন জর্জ অরওয়েল অ্যানিমেল ফার্ম ট্রটস্কি পরে আরেকটি বই লিখেছিলেন– রেভলুশন বিট্রেইড। ওই সময়কে কলমের আঁচড়ে তুলে এনেছেন উপন্যাসের মাধ্যমে মিখাইল শলোকভ অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোওজ দ্য ডন। একই ধারার ভিন্ন একটি উপন্যাস লিখেছেন বরিস পাস্তারনাক– ডক্টর জিভাগো। কোন বইয়ে সত্য চাপা পড়েছে, কোনটাতে বিকৃতি ঘটেছে, তার বিচার কে করবে? পার্টি, সরকার না পাঠক? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার সময় আমার শিক্ষক মো. আনিসুর রহমান একটি বই পড়তে দিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে, মোশে লেউইনের লেখা। ইংরেজি অনুবাদ করেছেন আইরিন নোভ। বইটির নাম রাশান পিজেন্টস অ্যান্ড সোভিয়েট পাওয়ার : আ স্টাডি অব কালেকটিভাইজেশন। স্তালিনের সময়টিকে বোঝার জন্য এটি একটি ভালো বই। বইটি পড়ার মুগ্ধতা আমার মধ্যে এখনো রয়ে গেছে।
একটি সময়কে নানান আঙ্গিকে দেখা যায়। যিনি লিখবেন তাঁর ইচ্ছা, রুচি ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে তিনি কী লিখবেন, কতটুকু গভীরে যাবেন। লেখা অনেক সময় পারিপার্শ্বিকতার ওপরও নির্ভর করে। অর্থাৎ কতটুকু লিখলে লেখক ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন কিংবা পড়বেন না, তিনি আপস করবেন কি করবেন না, এটা বিবেচনায় আসবে। লেখক যদি কাউকে খুশি করার জন্য লেখেন বা কাউকে অখুশি করতে না চান, তাহলে নানাজনের পিঠ চুলকে একধরনের বই দাঁড় করানো যায়। সেটা কি ইতিহাস হবে?
একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়–ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ইতিহাস কি সম্পূর্ণ লেখা হয়ে গেছে? এটা কি এক রাতে, এক বছরে কিংবা একটি সরকারের মেয়াদে সম্পন্ন করার বিষয়? ইতিহাসচর্চা কি প্রজেক্ট ওয়ার্ক?
আমি অনেক দিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর আদি-অন্ত ঘাঁটাঘাঁটি করছি। একটি বিষয় বুঝতে পেরেছি, ইতিহাসের কোনো সরল পাঠ নেই। তাহলে ইতিহাস জানব কেমন করে? মস্কোয় তৈরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে বানানো সিনেমা লিবারেশন দেখেছিলাম ঢাকায় ১৯৭৩ সালে। এর প্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে আছেন স্তালিন ও হিটলার। ছবি দেখে মনে হয় স্তালিন নিতান্তই একজন মার্শাল এবং হিটলার একজন উন্মাদ। ছবি দেখার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দৈনিক গণকণ্ঠ-এ ইতিহাসের সত্যি কথা কেমন করে জানব’ শিরোনামে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম দুই কিস্তিতে। আমি এই সিনেমায় নির্মাতার মধ্যে সূক্ষ্ম রাজনীতির ছোঁয়া দেখেছিলাম। সিনেমার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে নির্মাতা অনেক সময় তাঁর ভালো লাগা বা মন্দ লাগা মিশিয়ে ফেলেন।
একটা কথা প্রায়ই শুনি–বিচারের ভার ইতিহাসের ওপর ছেড়ে দিলাম। মুশকিল হলো, ইতিহাস জিনিসটা কী? কে বা কারা কবে এটা লিখে গেছেন? ইতিহাস তো আসমানি কিতাব নয় যে এটা বদলানো যাবে না? যত দিন। যাবে, আমরা ততই নতুন নতুন তথ্যের খোঁজ পাব, নানান মাত্রার বিশ্লেষণ চোখে পড়বে। ফলে আমাদের জানার পরিধি বাড়বে, জ্ঞানের ভান্ডার আরও বিস্তৃত হবে।
ইতিহাসচর্চা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া, এর অধিকার পাওয়ার জন্য ইতিহাসশাস্ত্রের ডিগ্রি থাকা খুব জরুরি নয়, পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। যে কেউ তাঁর অনুসন্ধানী মন এবং বিচার-বুদ্ধি দিয়ে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। গণ-আদালত বলে একটা বস্তু যেমন আছে, গণ-ইতিহাস তাহলে কেন নয়। আবারও রবীন্দ্রনাথে শরণ নিতে হয়। ১৩০৫ বঙ্গাব্দে ‘প্রসঙ্গকথা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন :
“অতীত সময়ের অবস্থা কেবল ঘটনার দ্বারা নির্ণয় হয় না, লোকের দ্বারা তাহা কিরূপ ঠেকিয়াছিল সে-ও একটা প্রধান দ্রষ্টব্য বিষয়। অতএব ঐতিহাসিক ঘটনার জনশ্রুতিতে বাস্তব ঘটনার সহিত মানব মন মিশ্রিত হইয়া যে পদার্থ উদ্ভূত হয় তাহাই ঐতিহাসিক সত্য। সেই সত্যের বিবরণই মানবের নিকট চিরন্তন কৌতুকাবহ এবং শিক্ষার বিষয়।”
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এ অঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাসে একটি বড় ঘটনা। ওই সময় যে প্রচণ্ড ওলটপালট হয়েছে, তা এ দেশের মানুষকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। এত রক্ত, এত মৃত্যু এর আগে আমরা দেখিনি। একাত্তর নিয়ে তাই আমরা গভীর কষ্ট ও আবেগ অনুভব করি। আবেগের চাদরটা গায়ে জড়ানো থাকলে অনেক সময় সহজ-সরল সত্য চোখে ধরা পড়ে না। সময় যত বয়ে যায়, আবেগ যত থিতিয়ে আসে, ততই আমরা নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক চোখে ফেলে আসা সময়কে বিচার করতে, সত্য উদঘাটন করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের পর এতগুলো দশক পেরিয়ে এসে আমরা কি সেই সামর্থ্য অর্জন করতে পেরেছি?
কিছুদিন আগে লেখক-সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মস্মৃতি পড়ছিলাম। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে একাত্তর সালে সরকার গঠন ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। ঘটনাটি তিনি আত্মস্মৃতিতে উল্লেখ করেছেন। জবাবে তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ‘আমি, আপনি এবং কামরুদ্দীন সাহেব একত্রে বসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে পারি।’ পরে বললেন, এখন সত্য ইতিহাস লেখা যাবে না। লিখবেন না, লিখলে মেরে ফেলবে।’ বোঝা যায়, একাত্তরের পূর্বাপর নিয়ে অনেক রহস্য, প্রশ্ন, দ্বন্দ ও টানাপোড়েন আছে। অনেক সত্য চাপা পড়েছে বা চাপা দেওয়া হয়েছে।
যারা ইতিহাসের সাক্ষী কিংবা নির্মাতা, তাদের একেকজনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসেরও মৃত্যু হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, অনেক কিছু লেখার মতো অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। কাজ করতে গিয়ে আমি অনেকের শরণাপন্ন হয়েছি। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছি। আলাপের একপর্যায়ে এসে কেউ কেউ বলেছেন, রেকর্ডিং বন্ধ করুন। অথবা বলেছেন, ‘এটা ক্ল্যাসিফায়েড, আমাকে কোট করবেন না। তাঁদের শুধু বিব্রত বোধ করতে দেখিনি, তাঁদের মধ্যে ভীতিও লক্ষ করেছি।
আরও সমস্যা আছে। সবাই ইতিহাসের নায়ক হতে চান। তারা যখন কোনো ঘটনা বা সময়ের বিবরণ দেন, তাতে অনেক সময় কিছুটা খাদ মেশানো থাকে। মনের মাধুরী মিশিয়ে তারা অনেক কিছু বলেন। নিজের ভূমিকা একটু বাড়িয়ে বলা, অন্যের ভূমিকা খাটো করে দেখা, তথ্য লুকানো–এসব আছে। কেউ কেউ অবলীলায় মিথ্যা বলেন। একই ঘটনার পাল্টাপাল্টি বিবরণ পাওয়া যায় দুজনের কাছ থেকে। দুটোই তো সত্য হতে পারে না। হয় দুটোই অর্ধসত্য কিংবা একটি অসত্য। আবার একই ব্যক্তিকে দেখা যায় সময়ের ব্যবধানে তথ্য আমূল বদলে দিতে। ৪০ বছর আগে তিনি যা বলেছিলেন, এখন বলছেন ঠিক তার উল্টো। এসবের মধ্য দিয়ে সত্যের নির্যাসটুকু হেঁকে তোলা খুবই কঠিন। যে যা-ই বলুন না কেন, তা হুবহু উদ্ধৃত করে দিলে তা সত্যিকারের ইতিহাস না-ও হতে পারে। একজনের দেওয়া তথ্য আরেকজনের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা দরকার। তা সত্ত্বেও কোনো মীমাংসায় আসতে না পারলে উভয়ের মত তুলে ধরাটাই যুক্তিযুক্ত। তাতে পাঠক চিন্তার খোরাক পাবেন, নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। এ ক্ষেত্রে লেখকের নিজের মতামত পাঠককে গেলানো ঠিক হবে না।
ইতিহাসের বই সরকারের প্রেসনোট নয়। ইতিহাসের নামে অনেকেই প্রেসনোটের কাঠামো ও ভাষা ব্যবহার করেন। এ ধরনের সরকারি লেখক আছেন ভূরি ভূরি। প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজকবি, সভাকবি এই সব ছিল। তাঁরা রাজার মনোরঞ্জনের জন্য প্রশস্তিগাথা লিখতেন। এই প্রবণতা এখনো আছে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকে গোলাম হোসেন নামের একটি চরিত্র আছে। গোলাম হোসেনরা সব সময় ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তারপরও কাউকে না কাউকে রাজশক্তির মুখের ওপর ‘না’ বলার সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করতে হয়।
পাঠককে নিয়েও সমস্যা আছে। অতীত নিয়ে অনেকের মধ্যে একটা ছবি তৈরি হয়ে আছে। তিনি হয়তো একধরনের তথ্য পেয়ে এবং জেনে অভ্যস্ত, যার ভিত্তিতে একধরনের মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়। তিনি যদি নতুন কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ পান, যেটি তার পূর্বধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তিনি সেটি সহজে গ্রহণ করতে চান না। অনেক পাঠক আবেগাশ্রয়ী এবং পূর্বধারণার ঘেরাটোপে বন্দী। ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। লেখককে যেমন নির্মোহ হতে হয়, পাঠককেরও নির্মোহ হওয়া দরকার। পাঠকের মনে বিশেষ রাজনৈতিক মত বা ধারার প্রতি পক্ষপাত এবং তার বিপরীত মত বা ধারার ব্যাপারে প্রচণ্ড আপত্তি থাকতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ধরনের পক্ষপাত বা আপত্তি মাথায় রেখে কোনো বই পাঠ করলে তিনি ওই লেখকের ওপর পুরোপুরি সুবিচার করতে পারবেন না।
ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ সব সময়ই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। সবটা জানা সম্ভব হয় না। এ দেশে প্রকাশ্য রাজনীতির পাশাপাশি একাধিক গোপন প্রক্রিয়া সব সময়ই ছিল। তার সবটা লিখিত আকারে পাওয়া যায় না। সম্ভবও নয়। এ জন্য ইতিহাসের চরিত্রগুলোর শরণাপন্ন হতে হয়। দরকার হয় সাক্ষাৎকারের। আমি চেষ্টা করেছি প্রাসঙ্গিক অনেকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে। অনেকেই মন খুলে কথা বলেছেন। তাদের অনুমতি নিয়েই রেকর্ড করেছি আমাদের কথোপকথন। তারা যদি কথা না বলতেন, এ বই লেখা সম্ভব হতো না। কিন্তু কাজটি করতে আমাকে অনেক সময় দিতে হয়েছে। তারাও তাদের মূল্যবান সময় এ কাজে খরচ করেছেন। এটি ছিল একটি কষ্টকর, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
এ বইয়ে যা লিখেছি, তার কিছু কিছু আমার আগের প্রকাশিত বইয়ে। উল্লেখ করা হয়েছে। আগের তথ্যের সঙ্গে এ বইয়ে দেওয়া তথ্যের কিছু গরমিল থাকতে পারে। দেখা গেছে, একই ব্যক্তি একেক সময় একেক ধরনের তথ্য দিয়েছেন। বলতে দ্বিধা নেই, লেখাজোকার ব্যাপারে আমি আগের চেয়ে বেশি সতর্ক। চেষ্টা করেছি যত দূর সম্ভব তথ্য যাচাই-বাছাই করে ব্যবহার করতে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সাংঘর্ষিক তথ্য নিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। কোনো মীমাংসায় আসতে পারিনি।
বইটি লিখতে গিয়ে অনেকের কাছ থেকে উৎসাহ ও সাহায্য পেয়েছি। আমার অনেক বন্ধু ও পাঠকের একটা চাহিদা ও দাবি ছিল, ষাট ও সত্তরের দশকের রাজনীতির অজানা ছবিগুলো তুলে ধরি। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি। পাণ্ডুলিপি গোছাতে সাহায্য করেছেন অরুণ বসু। যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাঁদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি বইয়ের শেষে দেওয়া আছে। এখানে ব্যবহৃত ছবিগুলো বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং ইন্টারনেট থেকে নেওয়া। আমি তাঁদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
মহিউদ্দিন আহমদ
Leave a Reply