প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস : বিকল্প মহাবিশ্বের বিজ্ঞান ও আমাদের ভবিষ্যৎ – মিচিও কাকু
ভাষান্তর – আবুল বাসার
প্রথম প্রকাশ : চৈত্র ১৪২৭, মার্চ ২০২১
প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন
প্রচ্ছদ : মাহবুব রহমান
Parallel Worlds by Michio Kaku
Translated in Bangla by Abul Bashar
Published in Bangladesh by Prothoma Prokashan
অনুবাদকের উৎসর্গ
দাদা মজির উদ্দিন বিশ্বাস
ও
দাদি তহিজান নেছা
অনুবাদকের কথা
১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল। যুক্তরাষ্ট্রের একটা হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীর বয়স তখন ৭৭ বছর। পরদিন প্রধান প্রধান মার্কিন দৈনিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হলো তাঁর মৃত্যুসংবাদ। কোনো কোনো পত্রিকায় আইনস্টাইনের ব্যবহৃত এলোমেলো ডেস্কের একটা ছবিও ছাপা হয়েছিল।
ডেস্কটার ঠিক পেছনেই হিজিবিজি সমীকরণে ভর্তি একটা ব্ল্যাকবোর্ড। ক্যাপশনে বলা হয়েছিল : এই ডেস্কেই রয়েছে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের খসড়া। কিন্তু সেটি অসমাপ্ত। আসলে জীবনের শেষ তিন দশক ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি সূত্রবদ্ধ করতে দিন-রাত কাজ করছিলেন আইনস্টাইন। অর্থাৎ তখন পর্যন্ত জানা সব কটি বলকে একীভূত করে একটিমাত্র তত্ত্বে প্রকাশের ইচ্ছা ছিল তাঁর। সেই তত্ত্বের পোশাকি নাম এখন থিওরি অব এভরিথিং বা সার্বিক তত্ত্ব। অবশ্য তেমন কোনো তত্ত্ব খাড়া করতে ব্যর্থ হন আপেক্ষিকতার জনক আইনস্টাইন।
স্কুলে নিজের ক্লাসে বসে পরদিন আইনস্টাইনের মৃত্যুর খবর শুনল ছোট্ট এক বালক। বয়স তার সবে আট। কিন্তু কে এই বিখ্যাত বিজ্ঞানী—তা বুঝতে পারল না ছেলেটি। শ্রেণিশিক্ষক সবার উদ্দেশে বুঝিয়ে বললেন সেকালের সেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথা। বললেন, তাঁর আবিষ্কার আর তাঁর শেষ না হওয়া কাজের কথা। কিন্তু ওটুকুতে মন ভরল না বালকের। এই বিজ্ঞানী সম্পর্কে আরও জানতে লাইব্রেরিতে ছুটল কৌতূহলী ছেলেটি। বেছে বেছে আইনস্টাইন আর তাঁর আবিষ্কার সম্পর্কে লেখা বেশ কিছু বই পড়ল। সবটুকু যে মাথায় ঢুকল, তা-ও নয়। অধিকাংশই রহস্যে মোড়া। তবে সেগুলো পড়তে গিয়ে দারুণ এক রোমাঞ্চ জাগল মনে। সেদিন লাইব্রেরি থেকে অন্য এক মানুষ হয়ে বেরিয়ে এল ছেলেটি। বড় হয়ে বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল সেদিন থেকে। সেই সঙ্গে একটা থিওরি অব এভরিথিং খুঁজে বের করারও পণ করল মনে মনে। আইনস্টাইনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করাই যার মূল উদ্দেশ্য। সেই ছেলেটিই আজকের অন্যতম জনপ্রিয় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও লেখক মিচিও কাকু।
আবিষ্কারের নেশা সেই যে শুরু হলো, এরপর তার রেশ আর কাটেনি। বেড়েই চলল বলা চলে। হাইস্কুলে পড়ার সময় নিজের জন্য একটা অ্যাটম স্ম্যাশার বানানোর কথা ভাবলেন মিচিও কাকু। বড়দিনের ছুটিতে অন্য ছেলেরা যখন আনন্দ উৎসবে ব্যস্ত, তখন অ্যাটম স্ম্যাশার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন তিনি। সেই ঘাম পায়েও ফেললেন। মাকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলের মাঠে ২২ মাইল দীর্ঘ তামার তার প্যাচালেন। এরপর বাবা-মায়ের গ্যারেজে তৈরি করলেন ২.৩ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট বিটাট্রন পার্টিকেল একসিলারেটর। সেটি চালাতে ৬ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ লাগত। যন্ত্রটি থেকে তৈরি হলো শক্তিশালী বিদ্যুৎ-চুম্বক। পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে সেটা ছিল প্রায় ২০ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। আসলে এই অ্যাটম স্ম্যাশার দিয়ে অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত স্ম্যাশারটা চালু করে কাজের কাজ যেটা হয়েছিল, সেটা বেশ হতাশাজনক। কাকুর মায়ের বাড়ির বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এতে একদম ভেঙে পড়েছিল। ব্ল্যাকআউটে থাকতে হয়েছিল তাদের বেশ কিছুটা সময়।
অবশ্য দাগ নেই তো শেখাও নেই—এই বিজ্ঞাপনী ভাষার মতোও এই পারিবারিক ক্ষতি থেকেও কিছু শিখতে পেরেছিলেন কাকু। এমনকি ভবিষ্যতে তাঁর বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পেছনেও এটিই সবচেয়ে বড় নিয়ামক হয়ে দেখা দেয়। অ্যাটম স্ম্যাশারটা বগলদাবা করে জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় অংশ নেন তিনি। তাঁর যন্ত্রটা ছিল গতানুগতিক আর দশটা বিজ্ঞান প্রজেক্টের মধ্যে একেবারে আলাদা। ছোট্ট একটা কিশোরের বানানো এ রকম যন্ত্র দেখে সেবার তাক লেগে গেল পদার্থবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেলারের। মার্কিন হাইড্রোজেন বোমার জনক তিনি। বিজ্ঞান মেলায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন টেলার। অসাধারণ এই বিজ্ঞান প্রজেক্টের কারণে সেবার বিজ্ঞান মেলায় হার্জ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কলারশিপ জিতে নিল কিশোর এই প্রডিজি। এরপর পেলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বৃত্তি। এটিই তাঁর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হওয়ার লক্ষ্য পূরণে প্রায় সব বাধা ডিঙাতে সহায়তা করল।
এরপর ক্রমেই এগোতে থাকেন ছোট্টবেলার দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ধরে। সত্তরের দশকে থিওরি অব এভরিথিং খুঁজে বের করতে কাজ শুরু করেন। সে জন্য যোগ দেন বহুল আলোচিত-সমালোচিত স্ট্রিং থিওরিস্টদের দলে। তাঁর গবেষণা থেকে জন্ম হলো স্ট্রিং থিওরির শাখা স্ট্রিং ফিল্ড থিওরির। এটিই বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি এনে দিল তাঁকে। গবেষণা ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত আছেন। নিউইয়র্কের সিটি কলেজে।
তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যুর পর মিচিও কাকুকে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞানী হিসেবে গণ্য করেন অনেকে। আবার তাঁকে ‘পরবর্তী কার্ল সাগান’ হিসেবে অভিহিত করেন কেউ কেউ। কারণ, বিজ্ঞানী হিসেবে শুধু গবেষণাতেই মুখ গুঁজে বসে থাকেননি তিনি, সর্বস্তরে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে একাধিক বই লিখেছেন, উপস্থাপনা করেছেন বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন রেডিও ও টিভি অনুষ্ঠানে। বিবিসি, ডিসকভারি চ্যানেল, হিস্ট্রি চ্যানেল ও সায়েন্স চ্যানেলে তিনি পরিচিত মুখ। নিয়মিত বিজ্ঞানবিষয়ক কলাম লেখেন জনপ্রিয় বিজ্ঞান ম্যাগাজিনগুলোতে। বিজ্ঞানের জটিল-কঠিন বিষয়গুলো সবার জন্য সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন করাই এসবের উদ্দেশ্য। তাই লেখক হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছেন বিশ্বজুড়ে। তাঁর বেশ কিছু বই অনূদিত হয়েছে বাংলাসহ অন্যান্য ভাষাতেও।
মিচিও কাকুর লেখা জনপ্রিয় বইগুলোর মধ্যে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস অন্যতম। বইটির বিষয়বস্তু বিকল্প মহাবিশ্ব তথা সমান্তরাল মহাবিশ্ব। পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সমান্তরাল মহাবিশ্বের আদৌ অস্তিত্ব আছে কি না, কিংবা তার হদিস কীভাবে পাওয়া যাবে অথবা আমাদের মহাবিশ্ব কখনো ধ্বংসের মুখে পড়লে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র ব্যবহার করে বিকল্প ওই সব মহাবিশ্বে যাওয়া সম্ভব কি না বা সেখানে যাওয়ার সম্ভাব্য উপায়-সেসব প্রশ্নের তাত্ত্বিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন মিচিও কাকু।
এ বইয়ের মূল বিষয়বস্তু সমান্তরাল মহাবিশ্ব হলেও এতে পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা ও কসমোলজির তত্ত্ব ও ধারাবাহিক ইতিহাস সাবলীল গদ্যে তুলে ধরেছেন এই পদার্থবিদ। স্বাভাবিকভাবে এতে বিস্তারিতভাবে মহাবিশ্বের জন্ম তথা মহাবিস্ফোরণ, তার বিবর্তন, গ্রহ, নক্ষত্র বা ছায়াপথের সৃষ্টি রহস্য, কৃষ্ণগহ্বর, ওয়ার্মহোল, হাইপারস্পেস ও মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আধুনিক তত্ত্বের আলোকে বিশদ আলোচনা করেছেন। সেই সঙ্গে মহাবিশ্বকে সঠিকভাবে উদ্ঘাটন করতে যুগে যুগে যেসব মানুষ প্রাণপাত করেছেন, তাঁদের কথা এবং তাঁদের আবিষ্কৃত বিজ্ঞানের চুলচেরা বিশ্লেষণ উঠে এসেছে গল্পের আদলে। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব, ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আপেক্ষিকতা তত্ত্ব কিংবা স্ট্রিং থিওরি ও এম-থিওরি নিয়েও এ বইয়ে লেখা হয়েছে সহজবোধ্য ভাষায়। বইটি লেখার সময় বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের বাইরের সব পাঠকের কথা মাথায় রেখেছিলেন মিচিও কাকু। তাই শুধু বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীই নয়, বরং বিজ্ঞানে আগ্রহী যেকোনো পাঠকের কাছেই ভালো লাগবে এ বই।
তবে একটা কথা না বলে পারছি না। জনপ্রিয় ধারা বা পপুলার ঘরানার বিজ্ঞান বই পড়ার কিছু বিপদও আছে। অনেক সময় কিছু পাঠক তাত্ত্বিক
অনুমানকেও জলজ্যান্ত সত্য বলে ধরে নেন। এ ব্যাপারে এই বইয়ের পাঠককে একটু সাবধান হওয়ার অনুরোধ জানাই। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস নামের এই ঢাউস সাইজের বইতে প্রচলিত আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে বিকল্প মহাবিশ্ব সম্পর্কে মিচিও কাকু যা বলেছেন, তা এখনো অনুমানমাত্র। এর কোনোটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়। আবার প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস-এর সপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণও আপাতত বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। তাই আক্ষরিক অর্থে প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বা সমান্তরাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে—তেমনটি ভাবার অবকাশ নেই। আপাতত এটুকু মাথায় রাখলেই চলবে।
শেষ করার আগে সহকর্মী আবদুল গাফফার, উচ্ছ্বাস তৌসিফ, আব্দুল্ল্যাহ আদিল মাহমুদকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। বইটি লেখার সময় তাঁদের সহযোগিতার জন্য। প্রথমা প্রকাশনের সবার সহযোগিতাও অতুলনীয়। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আর বিনা শর্তে সবকিছুর জন্য শারমীন আফরোজ আর নীলের জন্য ভালোবাসা, আদর। সবশেষে যেসব পাঠকের জন্য এই বই অনুবাদ, তাঁদের ভালো লাগলে আমার শ্রম সার্থক বলে মনে করব। সবার জন্য শুভকামনা।
হ্যাপি রিডিং।
আবুল বাসার
.
লেখকের ভূমিকা
পুরো মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা করাকে বলা হয় কসমোলজি বা বিশ্বসৃষ্টি তত্ত্ব। এর মধ্যে রয়েছে মহাবিশ্বের জন্ম ও হয়তো তার চূড়ান্ত পরিণতিও। অবাক হওয়ার কিছু নেই, মহাবিশ্বকে ধীরগতির আর বেদনাদায়ক বেশ কিছু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এই বিবর্তন যুগে যুগে প্রায়ই ঢাকা পড়েছে ধর্ম ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মতবাদের ছায়ায়।
কসমোলজিতে প্রথম বিপ্লবের দেখা পাওয়া গিয়েছিল ১৬০০ শতকে টেলিস্কোপ বা দুরবিন ব্যবহারের মাধ্যমে। টেলিস্কোপের সহায়তায় প্রথমবার স্বর্গীয় উজ্জ্বল দীপ্তিগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে কাজে লাগাতে সক্ষম হন গ্যালিলিও গ্যালিলি। তাঁর এসব কাজের ভিত্তি ছিল জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস এবং জোহানেস কেপলারের গবেষণা। কসমোলজির এই প্রথম পর্যায় সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করে আইজ্যাক নিউটনের কাজের মাধ্যমে। তিনিই শেষ পর্যন্ত মহাকাশের বস্তুগুলোর গতি নিয়ন্ত্রণকারী মৌলিক সূত্রগুলো লিপিবদ্ধ করেন। এভাবে একসময় দেখা গেল, জাদুবিদ্যা ও আধ্যাত্মিকতা নয়, মহাকাশের বস্তুগুলোর বিধি আসলে কিছু বলের অধীনে। শুধু তা-ই নয়, এসব বল গণনাযোগ্য ও পুনরুৎপাদনযোগ্য।
কসমোলজির দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা হয় বিশ শতকে বড় আকৃতির কয়েকটি টেলিস্কোপের কারণে। এসবের মধ্যে অন্যতম মাউন্ট উইলসনের ১০০ ইঞ্চি ব্যাসের বিশাল আকৃতির রিফ্লেক্টিং মিরর টেলিস্কোপ বা প্রতিফলক দুরবিন। ১৯২০-এর দিকে জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবল এই প্রকাণ্ড টেলিস্কোপটা ব্যবহার করে কয়েক শতাব্দী ধরে প্রচলিত মতবাদ হটিয়ে দেন। আগের প্রচলিত মতবাদ অনুযায়ী, মহাবিশ্ব ছিল স্থির ও চিরন্তন। কিন্তু টেলিস্কোপে চোখ রেখে হাবল দেখতে পান, স্বর্গীয় গ্যালাক্সি বা ছায়াপথগুলো বিপুল বেগে পৃথিবীর কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। এর একটাই অর্থ, প্রসারিত হচ্ছে আমাদের মহাবিশ্ব। অবশ্য আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের ফলাফল থেকে অনেক আগেই এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। এই তত্ত্বে স্থান-কালের কাঠামো আর সমতল ও রৈখিক রইল না, হয়ে গেল গতিশীল ও বক্র। প্রথমবারের মতো মহাবিশ্বের জন্ম বা উৎপত্তি বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য একটা ব্যাখ্যা জোগাল এই তত্ত্ব। এর ব্যাখ্যামতে, বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ নামের এক আকস্মিক বিস্ফোরণে সূচনা হয়েছিল আমাদের এই মহাবিশ্বের। মহাবিস্ফোরণের কারণে নক্ষত্র আর ছায়াপথগুলো স্থানের বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। বিগ ব্যাং তত্ত্ব নিয়ে গবেষণার পথ দেখান জর্জ গ্যামো আর তাঁর সহকর্মীরা। একই সময়ে মৌলিক কণার উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করেন ফ্রেড হয়েল। তাঁদের এসব গবেষণার কারণে আমাদের চোখের সামনে খুলে গেল পুরোপুরি নতুন এক মঞ্চের দুয়ার। তাতে মহাবিশ্বের বিবর্তন সম্পর্কে পাওয়া গেল বিস্তৃত এক রূপরেখা।
এখন চলছে তৃতীয় বিপ্লব, যার বয়স প্রায় ৫ বছর। এ বিপ্লবের সূচনার পেছনে রয়েছে স্পেস স্যাটেলাইট, লেজার, মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্র, এক্স-রে টেলিস্কোপ আর অতি উচ্চগতির সুপারকম্পিউটারের মতো নিত্যনতুন ও আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি। আমাদের কাছে এখন মহাবিশ্বের প্রকৃতি- সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত আছে। এসবের মধ্যে রয়েছে মহাবিশ্বের গঠন, এমনকি এর ভবিষ্যৎ ও চূড়ান্ত মৃত্যুসম্পর্কিত আরও নানা তথ্যও।
জ্যোতির্বিদেরা এখন বুঝতে পেরেছেন, মহাবিশ্ব দ্রুতগতিতে প্রসারিত হচ্ছে। এর প্রসারিত হওয়ার ত্বরণের কোনো সীমা নেই। আবার মহাবিশ্ব কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে শীতল থেকে শীতলতরও হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে, আমরা একসময় মহাশীতলতা বা বিগ ফ্রিজের মুখোমুখি হব। তখন গোটা মহাবিশ্বটা ডুবে যাবে গাঢ় কালো অন্ধকার আর হিমশীতলতায়। তেমন পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমান সব জীব মারা যাবে।
এই বইটার বিষয়বস্তু কসমোলজির তৃতীয় বিপ্লব সম্পর্কে। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে আমার আগের লেখা বিয়ন্ড আইনস্টাইন এবং হাইপারস্পেস শিরোনামের বইগুলো থেকে এটি বেশ আলাদা। ওই বইগুলো সাধারণ মানুষকে হায়ার ডাইমেনশন বা উচ্চ মাত্রা আর সুপারস্ট্রিং থিওরি সম্পর্কে জানতে সহায়তা করেছিল। কিন্তু প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস-এ স্থান-কালকে কেন্দ্র করে আলোচনা করিনি। তার বদলে বেশ কয়েক বছর ধরে উদ্ঘাটিত কসমোলজির বৈপ্লবিক অগ্রগতির দিকে মনোযোগ দিয়েছি এ বইতে।- এসব অগ্রগতির ভিত্তি হলো বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগার এবং বহুদূরের মহাকাশ থেকে পাওয়া নিত্যনতুন তথ্যপ্রমাণ। এ ছাড়া রয়েছে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বড় ধরনের সাফল্য। আমার ইচ্ছা ছিল, পদার্থবিদ্যা ও কসমোলজিতে আগে থেকে কিছু জানা না থাকলেও যাতে এই বইটি নিমেষে পড়া ও বোঝা যায়। বইটির প্রথম পর্বে আলোচিত হয়েছে মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা, কসমোলজির শুরুর পর্যায়ে যেসব অগ্রগতি হয়েছে তার সংক্ষিপ্তসার। আলোচিত হয়েছে এর শীর্ষবিন্দু ইনফ্লেশন বা স্ফীতি নামের এক তত্ত্ব নিয়ে। বর্তমানে মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বকে আমরা সর্বোচ্চ উন্নতভাবে সূত্রবদ্ধ করতে পেরেছি এ তত্ত্বের কারণে। দ্বিতীয় পর্বে আমি মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্বের উদীয়মান তত্ত্ব নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি। মাল্টিভার্স এমন এক বিশ্ব, যা অসংখ্য মহাবিশ্ব নিয়ে গঠিত। তার ভেতরে আমাদের মহাবিশ্বটা হলো অনেকগুলোর মধ্যে মাত্র একটা। এ ছাড়া এই পর্বে ওয়ার্মহোল, স্থান ও কালের র্যাপের সম্ভাবনা এবং উচ্চতর মাত্রা দিয়ে তাদের সংযুক্ত করার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আইনস্টাইনের মৌলিক তত্ত্বটাকে ছাড়িয়ে আরও সামনে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ সুপারস্ট্রিং থিওরি এবং এম-থিওরি। এই তত্ত্বগুলো মূলত প্রমাণ দেয়, আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো অনেক মহাবিশ্বের মধ্যে একটিমাত্র। সবশেষে তৃতীয় পর্বে আমি মহাশীতলতা বা বিগ ফ্রিজ এবং মহাবিশ্বের পরিণতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের বর্তমান ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছি। এ ছাড়া ভবিষ্যতের কোনো উন্নত সভ্যতা এখন থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন বছর পর আমাদের মহাবিশ্ব ছেড়ে অন্য মহাবিশ্বে যেতে চাইলে, কীভাবে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো ব্যবহার করতে পারে—তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অনুমানভিত্তিক আলোচনা করেছি। একদিন হয়তো এ রকম কোনো সভ্যতা আরও আরামদায়ক কোনো মহাবিশ্বে নতুন করে নবজাগরণ শুরু করবে। কিংবা সময়ের পেছন দিকে গিয়ে মহাবিশ্বের উষ্ণতর সময়ে চলে যেতে পারবে উন্নত সেই সভ্যতা।
বর্তমানে পাওয়া নতুন তথ্য-উপাত্তের প্রবল তোড়ে, মহাকাশ স্ক্যান করতে সক্ষম স্পেস স্যাটেলাইটের মতো নতুন যন্ত্র, নতুন মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকারী যন্ত্র আর গোটা এক শহরের সমান আকৃতির পরমাণু ত্বরক যন্ত্র বা অ্যাটম স্ম্যাশার আমাদের পরিপূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে এনে দিয়েছে। তাই পদার্থবিদেরা মনে করেন, আমরা হয়তো কসমোলজির স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছি। সংক্ষেপে বললে, যেসব পদার্থবিদ আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম আর চূড়ান্ত পরিণতিটা বোঝার চেষ্টা করছেন এবং যেমন অভিযাত্রী এই অন্বেষার পেছনে দিনরাত্রি ছুটে চলেছেন, তাঁদের জন্য এটা দুর্দান্ত একটা সময়ই বটে।
মিচিও কাকু
দিগন্ত
ধন্যবাদ আপনাদের। এমন একটি বই আপনাদের লাইব্রেরীতে যোগ করে, বিজ্ঞানপিয়াসু পাঠকদের বইটি পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।