পৃথিবীর ইতিহাস – মহাপ্লাবন থেকে রোম সাম্রাজ্যের পতন – প্ৰথম খণ্ড – সুসান ওয়াইজ বাউয়ার
অনুবাদ – ইশতিয়াক খান
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি ২০২২
প্রচ্ছদ – ধ্রুব এষ
.
উৎসর্গ
আমার দাদা শহীদ বুদ্ধিজীবী
ড. সিরাজুল হক খান
আপনার সঙ্গে সশরীরে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি,
কিন্তু তারপরেও মনে হয় আমার প্রতিটি লেখার
পেছনে আপনার দোয়া ও অনুপ্রেরণা রয়েছে
.
মুখবন্ধ
খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৭০ সালের আশেপাশে কোনো এক সময়, ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীর ঘেরা মারি শহরের রাজা জিমরি লিম তার কনিষ্ঠ কন্যার কার্যকলাপে যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
এই ঘটনার আরও এক দশক আগে, জিমরি লিম তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শিমাতুমকে আরেকটি প্রাচীর ঘেরা স্বায়ত্তশাসিত শহর লানসুরার রাজার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। এটি একটি ভালো সম্বন্ধ ছিল এবং বিয়েটি উদ্যাপিত হয়েছিল রাজসিক আপ্যায়ন এবং কনেপক্ষ থেকে আসা বিপুল পরিমাণ উপহারের মাধ্যমে। জিমরি লিম আশা করেছিলেন যে তার নাতিনাতনিরা পরবর্তীতে সেখানকার সিংহাসনের দাবিদার হবে আর লানসুরা একটি প্রতাপশালী মিত্রে পরিণত হবে। সেই সময় স্বাধীন শহরগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছিল ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত সামান্য কিছু উর্বর জমির দখল নেওয়ার উদ্দেশ্যে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত নাতিনাতনিদের আবির্ভাব তিন বছরেও হলো না। অগত্যা জিমরি লিম লানসুরার সাথে মিত্রতার সম্পর্ককে সুসংহত করার বেপরোয়া প্রচেষ্টায় শিমাতুমের মেজো বোন কিরুমকেও একই রাজার সাথে বিবাহ দেন। স্পষ্টবাদিতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার গুণসম্পন্ন কিরুমকে নিয়ে প্রত্যাশা ছিল যে সে রাজার দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তার বোনের সহায়তাকারী হিসেবে একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছে যাবে। কিন্তু কিরুম সেই পথে পা না বাড়িয়ে বরং নিজেকে রাজার প্রথম স্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় রত হয়। সে রাজনীতির আশ্রয় নিয়ে চাকরদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল এবং তার বোনের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করতে লাগল। শিমাতুম যমজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগ পর্যন্ত সে কর্তৃত্ববান মহারানির মতো করে ঘোরাফেরা করছিল। কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত বংশধরদের আগমনের সাথে সাথে নিঃসন্তান কিরুম রাজপ্রাসাদের ক্ষমতার দৌড়ে পিছিয়ে গেলেন।
‘কেউ এখন আর আমার অভিমত শুনতে চায় না, কিরুম অভিযোগ করতে লাগল তার বাবার কাছে লেখা চিঠিগুলোতে, ‘আমার স্বামী আমার চাকরদের চাকরি নট করে নিয়েছে। আমার বোন বলেছে যে তার যা খুশি সে তাই করবে আমাকে নিয়ে।’ বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর কিরুম তার বোনের প্রতি যে আচরণ করেছিল তাতে ‘যা খুশি তাই’-এর কোনো ভালো অর্থ থাকার কথা না এবং এই কারণেই কিরুমের চিঠির ভাষা অনুযোগ অভিযোগ থেকে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করার জন্য কাকুতিমিনতিতে রূপান্তরিত হয় শীঘ্রই। চিঠির ভাষায় নাটকীয়ভাবে ‘আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাও অথবা নিশ্চিতভাবেই আমার মৃত্যু হবে’ থেকে ‘যদি তুমি আমাকে মারিতে ফিরিয়ে না নাও তা হলে আমি লানসুরার সর্বোচ্চ চূড়া থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করব’-এর মতো হুমকিতে রূপান্তরিত হয়।
জিমরি লিম আশা করেছিলেন লানসুরার রাজাকে তার বন্ধু বানাবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লানসুরার রাজবাড়িতে কিরামের উপস্থিতি দুই পক্ষের মাঝের সম্পর্কের অবনতি ঘটার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিল। বিয়ের প্রায় সাত বছর পর, অবশেষে জিমরি লিমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় এবং তিনি লানসুরায় রাজকীয় ভ্রমণে গমন করেন। রাজসভার নথিপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ‘লানসুরার প্রাসাদকে স্বাধীন করে’ কিরুমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন।
হাজার হাজার বছর আগে, শিকারি ও আহরণকারী দলগুলো এশিয়া আর ইউরোপে ঘুরে বেড়াত আর অনুসরণ করত জংলি ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকা ম্যামথ হাতির পালগুলোকে। আস্তে আস্তে বরফের উপস্থিতি কমতে থাকল এবং ঘাসের প্রকৃতি ও বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসতে লাগল। এর ফলে ম্যামথের পালগুলো খাদ্যের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে উত্তরে চলে গেল এবং ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেল। কিছু শিকারি তাদের অনুসরণ করতে থাকল। কিন্তু বাকিরা তাদের খাদ্যতালিকার মূল উপাদান মাংস থেকে বঞ্চিত হয়ে বিকল্প হিসেবে নতুনভাবে বেড়ে ওঠা সেই জংলি ঘাসগুলো কেটে নিল এবং পরবর্তীতে তারা তাদের নিজেদের জন্য সেই ঘাসের বীজগুলো বপন করল মাটিতে।
উপরের গল্পগুলো অনেকটাই অনুমাননির্ভর। যদিও পৃথিবী ইতিহাসের আলোচনা সাধারণত প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে শুরু হয়, ইতিহাসবিদদের জন্য এটি যথোপযুক্ত প্রক্রিয়া নয়। ইতিহাসবিদ ব্যতিরেকে অন্যান্য বিশেষজ্ঞ দূরবর্তী অতীতের বেড়াজালে প্রবেশ করার জন্য বেশি উপযুক্ত। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ ম্যামথের হাড়গোড় দিয়ে তৈরি গ্রামের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করেন মাটি খুঁড়ে এবং নৃতত্ত্ববিদরা চেষ্টা করেন এসকল নমুনা ব্যবহার করে হারিয়ে যাওয়া সেই গ্রামবাসী ও তাদের জীবনকে পুনর্গঠন করতে।
দুই দলই একটি অনুমাননির্ভর তত্ত্বের অনুসন্ধান করছেন যা যাবতীয় তথ্য- প্রমাণের সাথে মিলে যাবে। তারা খুঁজছেন এমন একটি লেন্স যার মাধ্যমে বের হয়ে আসবে যে দলে দলে মানুষ পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গিয়েছিল, ম্যামথের মাংসকে পরিত্যাগ করে বার্লিকে বেছে নিয়েছিল আর গর্ত খুঁড়ে বীজ বপন করেছিল অধিক ফসলের আশায়। কিন্তু একজন ইতিহাসবিদের উদ্দেশ্য শুধু ‘মানুষ কী করে’ সেটা ব্যাখ্যা করা নয় বরং ‘কেন’ এবং ‘কীভাবে করে’ সেটাও বোঝানো। প্রাক-ইতিহাস খুবই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন-মানুষ কীভাবে লিখতে শুরু করল, প্রাচীন যুগের রাজাবাদশা, বীরপুরুষ এবং সাধারণ মানুষের গল্পগুলো লিখতে শুরু করল এবং তা বলতে গেলে অনেকটাই কল্পকথার মতো শোনায়।
এই ‘নিওলিথিক’ মানুষদের ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ যে সমাপ্তিই টানুক না কেন, একজন ইতিহাসবিদ নিওলিথিক যুগের কুমারদের দিন ও রাত্রির ব্যাপারে কিছুই জানেন না; তিনি জানেন না কীভাবে তারা দক্ষিণ ফ্রান্সের একটি গ্রামে বসে রিং বসানো পাত্র তৈরি করতেন। শিকারি ও আহরণকারীদের ফেলে যাওয়া পাত্র, পাথরের টুকরো, মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর হাড়গোড়, পাহাড় ও গুহার গায়ে আঁকা ছবি প্রভৃতি জীবনের একটি ধারাকে উন্মোচন করে কিন্তু এসকল তথ্যের ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়।
প্রাক-ইতিহাসে কোনো রাজা কিংবা তাদের স্ত্রীদের স্থান নেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যহীন মানুষগুলোকে মানচিত্রের উপর বসানো কাঠের খেলনা-পুতুলের মতো দেখায়। খেলনাগুলো মানচিত্রের উত্তর থেকে পশ্চিমে যেতে যেতে রং বদলায়; কখনও তারা থেমে যায় জমি থেকে ফসল আহরণ করার জন্য, আবার কখনও বা গোধূলিবেলায় গৃহপালিত পশুর পালকে তাড়িয়ে বাসার দিকে নিয়ে যায়। এসকল নামহীন চরিত্রের গল্পগুলো বলতে হবে কোনো ব্যক্তিগত পক্ষপাত ছাড়া; আবেগহীন অনুত্তাপ কণ্ঠে ‘ইউফ্রেটিস নদীর তীরবর্তী উর্বর, অর্ধচন্দ্রাকার ভূমি থেকেই সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটে; সেখানেই প্রথমবারের মতো গমের বীজ বপন করা হয়েছিল। সেখানে অল্পদিন পরেই উদ্ভাবিত হয় লেখনী এবং শহরগুলো একে একে প্রতিষ্ঠিত হয়।
একজন ইতিহাসবিদকে কোনো একটি নির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠীর আচরণ নিয়ে কথা বলতে বলা মানেই তাকে বিপদে ফেলা। এই ধরনের বর্ণনায় সে হারিয়ে ফেলে তার লেখার সহজাত সাবলীলতা। এই লেখাগুলো সর্বদাই হয়ে ওঠে প্রাণহীন ও বিরক্তিকর। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের লেখাগুলোতে থাকে ভুলের ছড়াছড়ি। প্রকৃতপক্ষে ইউফ্রেটিসের অর্ধচন্দ্রাকার ভূমিই নয়, এশিয়া ও ইউরোপের অনেক জায়গাতেই প্রায় একই সময়ে ফসল ফলানো আরম্ভ হয়েছিল উষ্ণ আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে।
নৃতত্ত্ববিদগণ মানবগোষ্ঠীর আচরণ নিয়ে জল্পনাকল্পনা করতে পারেন, প্রত্নতত্ত্ববিদগণ জনবসতির শাখা উপশাখা নিয়ে চিন্তা করতে পারেন, দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদগণ মানুষকে যেসকল বস্তু অনুপ্রাণিত করে তার সবকিছুকে একটি নিরবচ্ছিন্ন আকৃতি দিয়ে তার বিশ্লেষণ করতে পারেন-তাদের সে স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু একজন ইতিহাসবিদের কাজটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাকে কিছু মানুষের জীবন পর্যালোচনা করে একটি মানবগোষ্ঠীর আচার আচরণ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করতে হয়, যা খুবই দুরূহ।
পুরাকালে প্রাচ্যের একটি ছোটো শহরের গুরুত্বহীন শাসকের ভূমিকা পালন করা কোনো সহজ কাজ ছিল না। জিমরি লিমের অর্ধেকের বেশি সময় চলে যেত পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর রাজাদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আর বাকি সময় যেত তার ব্যক্তিগত জীবনের জটিল সমস্যার জট ছাড়াতে ছাড়াতে। তার যোগ্য স্ত্রী রানি শিপটু দেশ সামলাতেন আর তিনি এক যুদ্ধ থেকে আরেক যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বেড়াতেন। ভূমধ্যসাগরীয় গ্রীষ্মের দাবদাহের মাঝে রানি তাকে চিঠি লিখেছিলেন, ‘সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে ভুলবেন না। আমি আপনার জন্য যে রোদ-নিরোধক আলখাল্লাটি বানিয়েছি, সেটা অবশ্যই পরে থাকবেন। আমার হৃদয়ে অশনি সংকেত বেজেছে; দয়া করে দ্রুত চিঠির উত্তর দিয়ে জানাবেন যে আপনি সুস্থ আছেন।’ জিমরি লিম প্রত্যুত্তরে লিখেনে, ‘আমি এখনও সশস্ত্র হুমকির মুখে পড়িনি। সবকিছু ঠিক আছে। আপনার হৃদয়ের বেদনাকে দূরীভূত করুন।
ইউফ্রেটিসের তীর থেকে উদ্ধার করা হাজার হাজার কুনেইফর্ম ট্যাবলেট (প্রাচীন লিপি) থেকে উন্মোচিত জিমরি লিমের উপাখ্যানে আমরা তাকে দেখি একজন প্রথাগত মেসোপটেমীয় রাজা হিসেবে; আর ব্যক্তি জিমরি লিমকে আমরা চিনতে পারি একজন নিবেদিতপ্রাণ স্বামী ও ব্যর্থ পিতা হিসেবে।
সুতরাং গুহায় আঁকা ছবি অথবা সমতলভূমিতে ঘুরে বেড়ানো বেনামি যাযাবরদের কাহিনির পরিবর্তে এই বইতে ইতিহাসের সূচনালগ্ন হিসেবে ধরা হয়েছে সেই সময়টাই, যখন থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু মানুষের জীবন এবং তাদের গলার শ্রবণযোগ্য আওয়াজকে ইতিহাসের পাতায় স্থান দেওয়া যায়। তারপরও কিছু প্রাক-ইতিহাসের উপাখ্যান এখানে স্থান পেয়েছে যা মূলত পুরাতত্ত্ববিদ এবং নৃতত্ত্ববিদগণের কাছ থেকে ধার করে নেওয়া। তবে এই প্রাক-ইতিহাসের অবতারণা করা হয়েছে অপেক্ষমাণ, জাঁকজমকপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্রদের পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই।
প্রাক-ইতিহাসের কাহিনিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কিছু পৌরাণিক গল্পগাথাকে ব্যবহার করা হয়েছে সতর্কভাবে। প্রাচীন ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকা প্রাথমিক চরিত্রগুলো মানুষ ও দেবতার সংমিশ্রণে তৈরি। সেই সময়ের রাজারা হাজার হাজার বছর ধরে রাজত্ব করতেন এবং বীরগণ ঈগলের ডানায় চড়ে স্বর্গে আরোহণ করতেন অহরহ। পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদগণ ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই এসকল উপাখ্যানকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় দীক্ষিত ইতিহাসবিদগণ তাদের সাথে অধ্যয়ন করা বিজ্ঞানের ছাত্রদের মতোই উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণহীন যে-কোনো ‘ইতিহাস’-কেই বর্জন করতে শুরু করেন।
সব মিলিয়ে সুমেরীয় রাজাদের তালিকা হিসেবে বিবেচিত দলিলটি ‘ইতিহাস’ হিসেবে খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয়। রাজারা হাজার হাজার বছর ধরে রাজত্ব করেছেন কিংবা তারা সরাসরি স্বর্গ থেকে নেমে এসে পৃথিবী শাসন করেছেন—এই ধরনের অলৌকিক গল্প বিশ্বাস করার চেয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের সিন্ধু নদের তীর ও সুমেরের ধ্বংসাবশেষ থেকে খুঁজে পাওয়া বিভিন্ন প্রাচীন মানুষের ব্যবহার্য উপকরণ থেকে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের কাজটি অনেক বেশি যৌক্তিক।
কিন্তু ভিন্নভাবে দেখতে গেলে, ভগ্ন বাড়ির কাঠামো কিংবা তৈজসপত্র থেকে একটি সমগ্র মানবগোষ্ঠীর ব্যাপারে লিখতে যাওয়া সহজ নয়। এসকল বস্তুর যেমন নিজস্ব কোনো প্রাণ নেই তেমনই এদেরকে নিয়ে লেখা কাহিনিতে নেই কোনো আত্মার টান। অপরদিকে, প্রাচীন মহাকাব্যগুলোতে রয়েছে মানুষের ভয়ভীতি ও আশাভরসার গল্প, যা থেকে সহজেই গল্পকথকদের চরিত্র সম্পর্কে আমরা ধারণা পেতে পারি। ‘পুরাণ হচ্ছে ইতিহাসের ধোঁয়াশাচ্ছন্ন অংশ”, বলেছিলেন ইতিহাসবিদ জন কেই। এই ধোঁয়ার উপর দীর্ঘক্ষণ বায়ু সঞ্চালন করলেই হয়তো নিচে ধামাচাপা পড়ে থাকা আগুনের ফুলকির দেখা পাওয়া যাবে। সুতরাং ধোঁয়া দেখলে সেটিকে অবজ্ঞা না করাই মঙ্গলজনক।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রাচীন ইতিহাসের একটি বড় অংশ অনুমাননির্ভর। এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শননির্ভর অনুমান মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত গল্পগাঁথার ভিত্তিতে তৈরি অনুমানের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য এমনটাও বলা যায় না। প্রতিটি ইতিহাসবিদই বিভিন্ন ধরনের তথ্য-প্রমাণের মধ্য থেকে অপ্রয়োজনীয় উপকরণকে বর্জন করে একটি সঠিক ইতিহাসের ধারা তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে বলা যায় যে পুরাকালের বণিকদের রেখে যাওয়া তথ্য- প্রমাণের পাশাপাশি এসব গল্প-উপাখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলোকেও যাচাইবাছাই করার মাধ্যমে সংগ্রহ করে কাজে লাগাতে হবে। পৌরাণিক কাহিনিগুলোকে ইতিহাসের ভিত্তি হিসেবে একেবারেই স্বীকার না করার মানে হচ্ছে মানবিক আবেগকে বিসর্জন দিয়ে শুধু ইটপাথরে খোদাই করা সত্যকে আলিঙ্গন করা, যা কাম্য নয় কোনোদিক দিয়েই। এই বইকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে দ্বিতীয় অংশ থেকে জল্পনাকল্পনা বা পুরাণের বদলে প্রকৃত সত্যকে বেশি জোর দেওয়া হয়।
বইয়ের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা কিংবা আফ্রিকার ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি কিছু বলা হবে না, কারণ এসকল অঞ্চলের মানুষের কথ্য ইতিহাস খুব বেশি পেছনদিক পর্যন্ত যায় না। তাদের নেই কোনো মেসোপটেমীয় রাজার তালিকা কিংবা মিশরীয় রাজাদের স্মৃতিবাহক ট্যাবলেট।
সময় একটি সরলরৈখিক প্রবাহ—এই ধারণার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে প্রাক-ইতিহাস, প্রাচীন ইতিহাস, মধ্যযুগীয় ইতিহাস এবং ভবিষ্যৎ—এভাবেই ইতিহাসের ক্রমকে বর্ণনা করা যায়, যে ধারণাটি সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্য থেকে এসেছে। এখানে জাতি বা গোষ্ঠী অনুযায়ী ইতিহাসের বর্ণনা পরিবর্তন করার সুযোগ কিংবা প্রয়োজন কোনোটিই নেই।
প্রাক-ইতিহাস নিয়ে ক্রিস গসডেন উল্লেখ করেন, অস্ট্রেলিয়ার এবোরিজিনদের মতো আদিবাসীদের কাছে ‘প্রাক-ইতিহাস’ বলে কোনো বস্তু নেই; তারা অতীত ও বর্তমানকে একভাবেই বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করে আসছিলেন, যতদিন না পশ্চিমারা তাদের দেশ থেকে ‘ইতিহাস’ নিয়ে আসে।
রাজা হাম্মুরাবির রাজত্বের (খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০) আগের যে-কোনো ঘটনাকে বর্ণনা করা দুঃসাধ্য, কেননা সেই সময় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা ব্যক্তির বর্ণনা দেওয়ার জন্য দিন-তারিখের ধারণাটিকে সঠিকভাবে অনুসরণ করা হতো না। এই ব্যাপারটি একেবারে খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ থেকে ৪০০০ পর্যন্ত তিন হাজার বছরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ব্যাপারটাকে আরও জটিল করার জন্য তিন প্রাক-ইতিহাসের তিন ধরনের সংজ্ঞা প্রচলিত রয়েছে, যার একটির সাথে অন্যটির কোনো মিল নেই এবং অন্তত একটি সময়পর্বকে পুরোপুরি ভুল হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। বইটিতে সময়ক্রম বোঝানোর জন্য ‘খ্রিষ্টাব্দ’ আর ‘খ্রিষ্টপূর্ব’ বোঝানো হয়েছে, যা সর্বজনবিদিত। অনেকে যিশু খ্রিষ্টের জন্মের সাথে ইতিহাসকে না মেলাতে গিয়ে ভিন্ন সূচক ব্যবহার করে থাকেন কিন্তু এই বইয়ের জন্য সেটা অপ্রয়োজনীয়।
Leave a Reply