পৃথক পালঙ্ক (কাব্যগ্রন্থ) – আবুল হাসান
উৎসর্গ : সুরাইয়া খানম
প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর ১৯৭৫
নচিকেতা
মারী ও বন্যায় যার মৃত্যু হয় হোক। আমি মরি নাই–শোনো
লেবুর কুঞ্জের শস্যে সংগৃহীত লেবুর আত্মার জিভে জিভ রেখে
শিশুর যে আস্বাদ আর নারী যে গভীর স্বাদ
সংগোপন শিহরণে পায়-আমি তাই!
নতুন ধানের ঋতু বদলে পালা শেষে
শস্যিতা রৌদ্রের পাশে কিশোরীরা যে পার্বণে আজো হয়
পবিত্র কুমারী শোনো। আমি তাতে আছি!
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
বহ্নি রচনার দ্বারা বৃক্ষে হয় ফুল;
ফুলে প্রকাশিকা মধুর মৃন্ময় অবদান শোনা,
ঝর্ণার যে পাহাড়ী বঙ্কিম ছন্দ, কবির শ্লোকের মতো স্বচ্ছ সুধাস্রোত
স্পেনের পর্বত প্রস্তর পথে টগবগে রৌদ্রের যে সুগন্ধি কেশর কাঁপা
কর্ডোভার পথে বেদুঈন!
লোকার বিষণ্ণ জন্ম, মৃত্যু দিয়ে ভরা চাঁদ,
শুধু সবিতার শান্তি-আমি তাই!
হারানো পারের ঘাটে জেলে ডিঙ্গি, জাল ভোলা কুচো মাছে
কাঁচালী সৌরভ–শোনো
সেখানে সংগুপ্ত এক নদীর নির্মল ব্রীজে
বিশুদ্ধির বিরল উত্থানের মধ্যে আমি আছি
এ বাংলায় বার বার হাঁসের নরোম পায়ে খঞ্জনার লোহার ক্ষরায়
বন্যার খুরের ধারে কেটে ফেলা মৃত্তিকার মলিন কাগজ
মাঝে মাঝে গলিত শুয়োর গন্ধ, ইঁদুরের বালখিল্য ভাড়াটে উৎপাত
অসুস্থতা, অসুস্থতা আর ক্ষত সারা দেশ জুড়ে হাহাকার
ধান বুনলে ধান হয় না, বীজ থেকে পুনরায় পল্লবিত হয় না পারুল
তবুও রয়েছি আজো আমি আছি,
শেষ অঙ্কে প্রবাহিত শোনো তবে আমার বিনাশ নেই
যুগে যুগে প্রেমিকের চোখের কস্তুরী দৃষ্টি,
প্রেমিকার নত মুখে মধুর যন্ত্রণা,
আমি করি না, মরি না কেউ কোনোদিন কোনো অস্ত্রে
আমার আত্মাকে দীর্ণ মারতে পারবে না।
মেধা দূরে ছিলে বুঝতে পারনি
আমার হয়তো একটু দেরী হয়ে গেছে
ফুল তুলতে শিশু কোলে তুলে নিতে
গর্তের ভিতরে সাপ–দেরী হয়ে গেছে!
অলস আমার সব অবোধ বোধের কাছে
হেরে গেছে বারবার পৃথিবীর গতি ও উন্নতি!
তোমার সরল হাতে একটু সরল স্পর্শ
অস্তমিত অভিসার তুলে দেবো
হয়তো সূর্যাস্তে গেছি–কী অবোধ!
হঠাৎ হারানো সূর্য বুকে এসে বিঁধেছে আমার
দেরী হয়ে গেছে!
সৃষ্টি এত সৌন্দর্যপ্রধান! সৌন্দর্য এমন ভীরু এমন কুৎসিত!
সাপ, খেলনা, নর্তকী, নদী ও নারী
বনভূমি, ফুল সমুদয় বস্তু, শিল্পকলা
এমন সুন্দর তারা, এমন কুৎসিত!
মানুষের যৌনসঙ্গম
মানুষীর যৌনসঙ্গম!
লিঙ্গ
ঘাড়
ঘৃণা
লোভ
সমস্ত মুচড়িয়ে আমি দেখেছি সুন্দর তারা আবার কুৎসিত!
ফলে দেহ ভেঙে পড়ে দেরী হয়ে গেছে
ফুল তুলতে শিশু কোলে তুলে নিতে
দেরী হয়ে গেছে!
শস্যগুচ্ছ মানুষের মিলিত উদ্যানে এত
উতরোল আকাক্ষাতন্তু,
লোভের ঘৃণার বলি, রক্তদাগ
যৌবনসঙ্গম যুদ্ধ উত্তেজনা, রাত্রি আর দিন!
সব অভিজ্ঞতা যেনো আমার বিলম্ব হেতু
মুছে গেছে মনোভূমি থেকে!
মাটির রং-এর কাছে মনীষার আজ তাই নুয়ে বলি :
আমাকে শেখাও ঋতু, শেখাও মৌসুম।
ভিত্তিভূমি : আমাকে শেখাও শিল্প, অভ্যুত্থান নীলিমা সঞ্চারী!
মিস্ত্রীর নৈপুণ্যে গড়া হে গভীর সারস শুভ্রতা :
আমাকে শেখাও শির উঁচু দালান শহর কৃতি সভ্যতা বিদ্যুৎবিভা,
আমাকে শেখাও!
দেরী হয়ে গেছে বৃক্ষ : পায়ে ধরি :–বলো
আমার ক্ষয়িষ্ণু জমি, কোন মহাদেশে গেলে
ফিরে পাবে সুরেলা সবুজ?
কেবল বিলম্বে এত অভিজ্ঞতা মুছে গেছে!
না হলে কি অহংকার আমারও ছিল না?
ছিল তবে তাকে আজো, স্পর্শ করিনি, মেধা
দূরে ছিলে, বুঝতে পারোনি।
মোরগ
ঘুরে ঘুরে নাচিতেছে পণ্ডিতের মতো প্রাণে
রৌদ্রের উঠানে ঐ নাচিতেছে যন্ত্রণার শেষ অভিজ্ঞানে!
পাখা লাল, শরীর সমস্ত ঢাকা লোহুর কার্পেটে!
মাথা কেটে পড়ে আছে, যায় যায়, তবুও নর্তক
উদয়শঙ্কর যেনো নাচিতেছে ভারতীয় মুদ্রায়!
এইমাত্র বিদ্ধ হলো বেদনায় চিকন চাকুর ক্রুরতায়!
এইমাত্র যন্ত্রণায় নাচ তার সিদ্ধ হলো, শিল্পীভূত হলো;
খুনের ঝোরায় তার নৃত্য ভেসে নর্তকের নিদ্রা ফিরে পায়!
শান্ত হয় স্মৃতি স্নায়ু প্রকৃতি ও পরম আকৃতি!
এখন শান্তি শান্তি–অনুভূতি আহত পাখায়
ভেঙ্গে পড়ে আছে পাখি, গৃহস্থের গরীব মোরগ!
একদিকে পুচ্ছ হায়–অন্যদিকে আমার ছায়ায়
মুখ গুঁজে শান্ত ঐ, শান্ত সে সমাহিত, এখন নিহত!!
অন্য অবলোকন
ফিরতে ফিরতে আবার কোথায় ফিরে তাকাবো?
শূন্যবিন্দু, স্বশূন্যতায় ফিরে তাকাবো?
ফিরতে আমার ইচ্ছে হয় না, চক্ষুচরিত গোল পৃথিবী
তাদের ভিতর এখন শুধু আবর্তিত যুদ্ধ সবার
আবর্তিত অমানবিক আকাভক্ষা চায়!
ফিরতে আমার ইচ্ছা হয় না; ফিরতে ফিরতে ফিরে তাকাবো?
কোথায় অধঃপতন স্রোতের গলাকাটা লাশ বিপ্লবীদের বুকের ক্ষতে
ফিরে তাকাবো? স্বেচ্ছাচারের তরবারীতে ফিরে তাকাবো?
ইচ্ছে হয় না! তবুও বড়ো সাধ বাসনা, ফিরে তাকাই :
প্রভু আমার ফিরে তাকাবার পৃথিবীখানি পাঁচ মিনিটের জন্যে না হয়
ফিরিয়ে দেওয়ার এলাজ করো।
দরগাতলায় মানত দেবো–এই দেহখান ধর্মে নেবো :
শূন্য থেকে পূণ্য হবো। রক্তে ঘেঁবো রামধনু রং!
প্রভু আমার তবুও যদি জগতখানি এলাজ করে!
যদি দেখাও দুঃখ দহন, ছায়াপূরণ পথের কোলে চাঁদের তলে শস্য জ্বলে!
বনমোরগের মৃদঙ্গ আর অন্ধকারে বনের বাহার
বড়েগোলামের খেয়াল গাচ্ছে : ফিরে তাকানো এলাজ করো :
চরের সিঁদুর। মায়ের শরীর : সূর্যখোলা বীজের ধনুক
দিগন্তে দূর হাওয়ার ওপার : উড়ে আসার উড়ন্ত ব্রীজ–কাঁপাস তুলো
স্বপ্নগুলো এলাজ করো, সর্বসৃষ্টি দ্যুতির মূলে : ফিরে তাকাবো!
এই সব মর্মজ্ঞান
স্পর্শ করিনি মমতায়!
তাই ফিরিয়ে দিয়েছে খালি হাতে
ভিক্ষুকের মতো।
কেউ নেয়নি। বৃক্ষ নয়। বনভূমি নয়। ঝর্ণা
শিথিল জলের নীৰিবন্ধ খুলে শুধু বলেছে নিষেধ!
স্পর্শ করিনি তাই ‘মা নিষাদ’ পক্ষী প্রেমিকার
মাংসে বিধে পড়া পীড়নের শেষ তূন
থামাতে পারিনি।
অগ্নি শুদ্ধ হতে হতে শুদ্ধির সমস্ত
স্বর্গে নরকের আগুন লেগেছে!
স্পর্শ করিনি। তাই রাবণের বংশধর এত বেশী
এত হুলস্থুল তর্ক গোলাপে গাভীতে
বুঝিনিও। তাই মেঘে ঐরাবত শুঁড় তুলে
প্লাবনের জলের ভিতর মৃত্যু, পিচকিরীর মতো
ঢেলে এখন উধাও।
বেশ্যার বেদনাবোধ বুকে ঢেলে কাঁদছে কামুক!
চাঁদের ভিতর এতো জ্যোৎস্নার চাঁদোয়া টানা,
তবু নেই খঞ্জনীর গান!
সারারাত ভূতের উৎপাত, কবন্ধ গলির কাটা
লাশের উপর যুথচারী বেকারের হু হু কান্না!
এই সব, এই সব, এই সব মর্মজ্ঞান শুধু!
কে তোমাকে বলেছিল এত বৃক্ষ ব্যয় করে
অবশেষে অনল কুসুমে হাত লোভীর মনে রাখতে?
আমাদের শ্রাদ্ধের বাগান-এ এতো সবুজ পাতার
সিংহাসন জুড়ে বসতে কে তোমাকে ডেকেছিল?
উপনিষদের সেই পাখিকেও হার মানালে হে!
কবিদেরও! তাদের রুমালে তোলা অধুনা আলোর শিল্প
তোমার দ্যুতির কাছে বারবার হেরে যায়!
তোমার শুদ্ধির কাছে দেবতার ঋণ বাড়ে
অসুর পালায়।
শুধু এই নষ্ট জমি তোমাকে তোলেনা ধর্ম,
শস্যক্ষেত, বৃক্ষভূমি, মাটি ও মৃত্তিকা আজ
মরিতেছে অবক্ষয়ে ঘুণ ধরিতেছে।
কল্যাণ মাধুরী
যদি সে সুগন্ধী শিশি, তবে তাকে নিয়ে যাক অন্য প্রেমিক!
আতরের উষ্ণ ঘ্রাণে একটি মানুষ তবু ফিরে পারে পুষ্পবোধ পুনঃ
কিছুক্ষণ শুভ্র এক স্নিগ্ধ গন্ধ স্বাস্থ্য ও প্রণয় দেবে তাঁকে।
একটি প্রেমিক খুশী হলে আমি হবো নাকি খুব আনন্দিত?
যদি সে পুকুর, এক টলটলে সদ্য খোঁড়া জলের অতল।
চাল ধুয়ে ফিরে যাক, দেহ ধুয়ে শুদ্ধি পাক স্মৃতিরা সবাই।
একটি অপার জাল, জলের ভিতর যদি ফিরে পায় মুগ্ধ মনোতল।
এবং গাছের ছায়া সেইখানে পড়ে, তবে আমি কি খুশী না?
যদি সে চৈত্রের মাঠ-মিলিত ফাটলে কিছু শুকনো পাতা তবে
পাতা কুড়োনিরা এসে নিয়ে যাক অন্য এক উর্বর আগুনে।
ফের সে আসুক ফিরে সেই মাঠে শস্যবীজে, বৃষ্টির ভিতরে।
একটি শুকনো মাঠ যদি ধরে শস্য তবে আমি লাভবান।
যদি সে সন্তানবতী, তবে তার সংসারের শুভ্র অধিকারে
তোমরা সহায় হও, তোমরা কেউ বাধা দিও না হে
শিশুর মুতের ঘ্রাণের মুগ্ধ কথা ভিজুক বিজনে,
একটি সংসার যদি সুখী হয়, আমিও তো সুখী
আর যদি সে কিছু নয়, শুধু মারী, শুধু মহামারী!
ভালোবাসা দিতে গিয়ে দেয় শুধু ভুরুর অনল।
তোমরা কেউই আঘাত করো না তাকে, আহত করো না।
যদি সে কেবলি বিষ–ক্ষতি নেই–আমি তাকে বানাবো অমৃত!
ভিতরে বাহির
হয়তো কিছুই নেই, তবু কিছু আছে।
আমার গল্পগুলি অখ্যাত হলেও তারা
দানে, ধ্যানে মোটামুটি সুখী :
আমার কবিতা আজ অভয়ে আসন গাড়ে
মেধা আর মনীষার ভেতরমহলে।
আমার বিন্যাস, ফর্ম, আমার শিল্পের সব ভাঙ্গাচোরা
আর ঐ ঐতিহ্য আড়াল :
জোড়া দাও :
কখনো সে গ্রামীণ চরকার তাঁত : গৃহস্থের গোধুলি মুকুর :
আমার ছায়াকে আমি ভালোবাসি, আর কাউকে নয়,
তাকে তুমি ভাগ করো, ওলট-পালট করে বর্তমান, ভূত, ভবিষ্যতে–
পাবে তুমি শ্যাওলা জলের গন্ধ, লাল মাটি, ফলসা রমণী :
একটি অমর শাদা গাভী, তার ভাস্বর ওলান
যেখানেই থাকো, তুমি দেখা পাবে : কাঁদো
তোমার সহিত কাঁদবে আসমুদ্র শাদা মুগ্ধধারা–
যখন শহরে ঢোকে অতিকায় আরশোলা,
যখন বাসনা সব ঢাকা পড়ে বধির লবণে :
অস্থির আজান তোলে মুয়াজ্জীন,
বিশ্বাসের ভিত :
খসে পড়ে পরচুলার মতো :
পা রাখি কেবল পাপে, পায়ে পায়ে কেবল পতন,
স্বপ্নগুলো শিকড়বিহীন :
আর তার পাতাগুলি প্রখর প্রদাহে ঝরে, মরে যায়
লাল নীল শাদা ফুলগুলি :
ভরি না, মরি না
আমার একাকী গান
গেঁথে তুলি যুঁইফুলে অদৃশ্য মালার!
রক্তগুলি
বুটিদার কাশ্মিরী শালের লাল,
বিছিয়ে বিছিয়ে ঢাকি
পাপ আর পাপিষ্ঠ পতন
অশ্রুতে লুকিয়ে ফেলি
আরশোলার আহত শহর।
আমার না পাওয়াগুলি জোড়া দাও-আছে
সেখানে বিদ্যুনা রূপোলী জলের :
ধুয়ে দাও ধীরে
আসবে বেরিয়ে এক স্বচ্ছ শহর :
কী ভালো লাগবে হাসিখুশী।
আমার না পাওয়াগুলি জোড়া দাও-আমি
তোমাদের ভালো থাকা হবো
সাবানের স্নিগ্ধ ফেনা, সেন্টের সুরভি শিশি,
জন্ম দেবো একটি গান, একটি কারখানা,
যা কেবল পবিত্রতা তৈরী করতে পারে!
তোমাদের ভালোবাসা তৈরী করতে পারে।
অপেক্ষা
বৃষ্টির ফোঁটাকে মনে হয় তোমার পায়ের পাতার শব্দ,
পাতার শব্দকে মনে হয় তোমার গাড়ীর আওয়াজ;
আমি চক্ষু সজাগ করি, কান উৎকর্ণ, ইন্দ্রিয় অটুট,
তুমি আসছো না, তুমি আসছো না–
তোমার কত হাজার বছর লাগবে আসতে?
জলের ভিতরে যেন পাথর এবং নুড়ি-তোমার ভিতরে ভেসে থাকে
হাজার হাজার প্রতীক্ষা তোমার, তুমি আসছো না, তুমি আসছো না,
তোমার কত লক্ষ বছর লাগবে আসতে?
আকাশের ভ্রূ চমকে জল নামে : জল আয়ুস্মতী :
আমি জলের উপরে সাঁকো গোছগাছ করে বাঁধি, ধনুকে লাগাই তীর,
মাঠের আলের কাদা ভেঙ্গে দেই বীজ ধানে, জ্বণের মৌসুমে;
নারীরা সন্তানবতী, লক্ষ্য দেই।
যখোন জীবন কোলে ফেলে দেয় অযত্নের আপন বিষয় :
ভুলে যাওয়া স্মৃতি, পয়সা, দুঃখ, ধ্যান, মনস্ক জগৎ :
আমি তুলে নেই যতে এ ওকে তখোন নাম দেই;
পাল্টে দেই রূপ, বর্ণ, অভিজ্ঞান, অবিচল বস্তুর ধারণা!
আমার স্পর্শে শূন্যে উদ্যানের ঘ্রাণ জন্মে : শস্যের চারায়
শহর সম্পন্ন লাগে, লক্ষ্য দেই : ক্লেদ, কুষ্ঠ ময়লা কালো জল,
রূপের রূগ্নতা ফেলে
আকাশ, অমৃত, নক্সা, ফলবতী মাটি ও মানুষ
তবু তুমি আসছো না, তবু তুমি আসছো না, কেন আসছো না?
কৃতিত্বে ধরেছে কীট, পরিস্থিতি পিঠ বাঁকা করে আজ নতমুখ,
এখন তোমাকে ওরা ছুঁয়ে দেয় শাবলের ধারালো বর্শায়;
এখন তোমাকে দেখে ঠাট মারে মূক বুদ্ধি,
অক্ষম চীৎকার, মৃত্যু, প্রতিবাদহীন জয়ধ্বনি :
উলঙ্গ শিশুর মতো শুয়ে থাকা এই অন্ধ নিষ্ফলা নির্মাণ,
এখন তোমাকে কত তুলে নেয় চলচ্চিত্র, কেবিনেট, সবুজ মহল,
রাজা আর রাজত্বের রঙ্গ টাকশাল :
তবু তুমি আসছো না, তবু তুমি আসছো না, কেন আসছো না?
অরণ্যে আপন মনে রুয়ে দেই, ঘনবর্ষা, আমফলের চাকা,
খুপরি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে তুলি মহামারী;
তাতে কতো দিন বুনি, রৌদ্রে বুনি, শিল্প বুনি, সঞ্চরণ বুনি,
প্রজ্ঞা যদি কালো মাটি : আমি তাতে ফলাই মনীষা,
তবু তুমি আসছো না, তবু তুমি আসছো না, কেন আসছো না?
লোহায় লোহিতবর্ণ মানুষের শাদা কালো বর্ণের বিভেদে
যখোন পালক খসে : অস্ত্রাঘাত যখোন যুদ্ধের কালো লেখা
ছলকে ছলকে ধরে অধঃপাত, সুন্দরের শ্রেষ্ঠ অপচয়;
জলে ও ডাঙ্কায় আমি বাঁধ দেই : শরীরে ঠেকাই বন্যা, প্রতিঘাত,
স্বপ্নের ভিতর স্বপ্নের বিদ্ধ করি আবার আমাকে;
তবু তুমি আসছো না, তবু তুমি আসছো না, কেন আসছে না?
আহত আঙ্গুল
আহত এই আঙ্গুল, তাতে ক্ষত বেরোয়
ক্ষত তো নয় পোকা
পাশ ফিরে শোয় পবিত্র পুঁজ
অমল থোকা থোকা!
পাশ ফিরে শোয় আঙ্গুলগুলি :
সুযন্ত্রণার সুখে :
দরবেশেরই মতোন ওরা আমারই সম্মুখে
আহত হয়, আহত হয় আর
গলিত এক পুঁজের ঝর্ণা তার
মন্ত্রবলে মলিন বেদনায়
আহত এই আহত আঙ্গুল যে
রক্তে ভাসে, রক্তে ভেসে যায়
–রক্তেঝরা ফুল!
জীবন এত অবাধ্য সঙ্কুল
নেয় না তুলে সন্ধিও, শান্তিকে!
আঙ্গুলে তাই আহত এক ক্ষরা
কেবল ঢলে পুঁজের ঘড়া ঘড়া
অশান্তির এই মোহ!
কিন্তু তাকে আর কে করে পান
কুযন্ত্রণার মুখে?
আমার মাঝে মোহিনী একখান
ঈশ্বরের গান
ভেঙ্গেছে সেই দুখে!
নর্তকী ও মুদ্রাসঙ্কট
তুমি যখোন নৃত্য করো মুদ্রাগুলি কাঁপে
তোমার হাতের মধ্যে তো নয় যেনবা কিংখাবে,
তলোয়ারের মতোন তুমি তোমার দু’হাত তোলো,
চোখের নীচের নগ্নতাকে ছন্দ পেয়ে ভোলো।
আমি তখোন আমার পোড়া দেশের পাপে মরি।
নিজের কাছে নিজের দহে তীব্র তুলে ধরি।
তুমি তো নও আম্রপালী, বর্তমানের নারী
তোমার লাগে লিনোলিয়াম সিফন ঘেরা শাড়ি
তোমার লাগে সাত প্রেমিকের সুলভ করতালি,
বাগান তুমি যুবারা যেন তোমার কেনা মালী।
হাজার ফুলের মধ্যে দুটি ফুলের অনুতাপে
মর্মহাত মালীরা তবু তোমার বুকে কাঁপে।
কিন্তু বুকের কাছে কি আর সেই ফুলেরা আছে
দেবদাসীরা যখোন পূজায় পুরোহিতের কাছে
রাখতো জমা যাতনা অর জ্বরার অভিমান
পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বলতো, হে সম্মান
আমাকে দাও শস্যকণা আমাকে দাও তীর
প্রাণের পাশে পরমায়ুর ঝর্ণা সুনিবিড়।
এখন শুধু হাতের কাপন, দিনযাপনের গ্লানি
মুদ্রা তুলে জাগাও তুমি অনতু একখানি
অনাশ্রয়ের অনিন্দ্রা আর অভিমানের গান :
যেখানে ভালোবাসারও নেই সুযোগ্য সম্মান।
মীরা বাঈ
ভজন গায় না, তবু কথা তার ত্রিকালের তাপিত ভজন,
যখোন জীবন কাটা রাখে তার পথে পথে
সে তখোন পায়ের তলায় বিদ্ধ ব্যথা নিয়ে নতুন নিয়ম পুষ্পিত।
ভুল বোঝে লোকে, ভাবে গরবিনী অথবা অস্থির অভিমানী :
কিন্তু আমি জানি তার হাতের উপর কেন উড়ে আসে
আহত পাখির দল মানুষ, মলিন চাষা, চীকৃত প্রসূন!
ভিতরে বিশাল এক মমতাক্ষমতা, জানে যুঁইফুল মাটির তলায়
কিসের আবেগে বাড়ে–কতটুকু সান্ত্বনার শিকড়প্রবাহে জাগে
পৃথিবীতে আজো সব ভালোবাসা, স্নেহ, প্রেম, শুভতা, শুভ্রতা।
নিজেই আহত : তবু লোকে ভাবে রয়েছে লুকোনো তার মঠোর ভিতর
কালকেউটের ঝাপি, লোহার করাত, ছুরি, ঘাতকের বিষ!
সে তার সুন্দর পোড়ে আর ওরা ভাবে দেখো জ্বালালো আগুন!
সে চায় সংসার, যাতে সুন্দরের বিন্দু বিন্দু বোধের চরকায়
সুতো কেটে দিন যাবে? কিন্তু ওরা তার পাহারায়
অদৃশ্যে এখনো আজো তুলে রাখে বজ্রপাত, লোকনিন্দা, লোলুপ ধিক্কার!
কেউই বোঝে না, তবু আছে আরো আকাঙ্ক্ষিত সুস্নিগ্ধ জগৎ :
যখোন মানুষ তাকে দুঃখ দেয়,
দলবেঁধে যখোন ঠোকরায় তাকে নষ্ট কিছু পাখি,
তখোন ঘাসের দিকে তাকাও–দেখবে ঘাস নতমুখ অপোবদনের
কিছু ভাষাম্নেহ লেগে আছে তৃষ্ণার্ত তরুর ঠোঁটে
ভোরবেলা শিশিরের মতো।
শৃন্বন্তু
ছিলাম গুটি গণিকা-রেশম রাত্রি চাষে
বিগত দিন
কিছুটা দিন
ও কলুষ, ও ক্লেদ পুণ্য,
এবার শান্তিরস্তু–এবার শান্তি হোক!
ছিলাম তিবেতিয়ান সাধু গাঁজার গন্ধে সেব্য ক’দিন
জিভ ছুঁয়েছি জিউলী বিষে, জোনাক বিষে রাত্রিবেলা
উদর ভোলা গণিকা গুহায় বাস করেছি সাপের মতোন কিছুটা দিন :
মারিজুয়ানা বুঁদ কুহেলী
বিষের ছোবল রক্তে খালি
নুন ঢুকিয়ে বলেছি ‘পৃথ্বি ধ্বংস হোক।’
হে দ্যুতিমান প্রভু সকাল। হে ঊষা নীড় নীল অদিতি
আকাশযান,
পাপ যে এবার পুণ্যপ্রার্থী, আলোর অর্থ অন্ধকার!
মাথার খুলির মালিনা দ্বার
খুলে আবার পুনর্বার
ঢোকাও দেখি পুষ্পকিরীট
বৃক্ষবিহীন পোশাক দাও। নাও ফিরে নাও বিষের কীট!
আবার বলি ঝিরি সবুজ
আবার বলি ‘শান্তিরন্তু’-শান্তি দাও।
হে ব্যাধিব্যয় মদ্যপায়ী–মুক্তি চাইছি মুক্তি দাও
জ্যোত্সা-সরাইখানার রাত্রি, অনবরত তর্ক চাষ
বন্ধুকে ব্যাধ শত্রু ভেবে শক্রগলায় রাত্রিবাস,
সে সন্দেহ কুলষ কর্ম, দাও ধুয়ে দাও, এই ধুলোট
মৃত্তিকা ঠোঁট ভেঙ্গে বলি, শান্তিরন্তু, শান্তি দাও!
আর না হলে অনুশোচনায় অনস্থির
ছেদন করো আমার আত্মা, আমার শরীর জীর্ণতার!
এতদিনের অঙ্গ ঘিরে জড়ানো সব মদের ভাঁড়
ইচ্ছে হলে কুষ্ঠ দাও
অঙ্গে অঙ্গে বসুক পোকা, যেমন নষ্ট থোকা থোকা
ফুসফুসে সব মাংসাদী ক্ষয়, ধ্রুব আয়ুর অবক্ষয়!
হা প্রভু দাও অঙ্গে আমার মুক্তি জ্বালা,
ও শৃন্বন্তু অমৃতস্য পুত্র-মানুষ
শেষকালে কি এই অমানুষ?
ক্লোরিন ফেনায় তীব্র বেহুঁশ সমুদ্রে আর মাটির ভ্রুণে
আমার প্রভু পূর্ণতা দাও।
অমৃতস্য-পুত্র তোমার
সূর্যের আবার আদিবীজের মধ্যে না হয় ঢুকতে দাও,
‘শান্তিরন্তু’ শান্তি দাও।
অপরূপ বাগান
চলে গেলে–তবু কিছু থাকবে আমার : আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।
জল নেমে গেলে ডাঙ্গা ধরে রাখে খড়কুটো, শালুকের ফুল :
নদীর প্রবাহপলি, হয়তো জন্মের বীজ, অলঙ্কার–অনড় শামুক!
তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে সমস্ত কি সত্যিই ফুরোবে?
মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পংক্তি–তা হলে এ চোখ
মাথার খুলির নীচে নরোম নির্জন এক অবিনাশী ফুল :
আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি?
জানি কিছু চিরকাল ভাস্বর উজ্জ্বল থাকে, চির অমলিন!
তুমি চলে গেলে তবু থাকবে আমার তুমি, চিরায়ত তুমি!
অনুপস্থিতি হবে আমার একলা ঘর, আমার বসতি।
ফিরে যাবো সংগোপনে, জানবে না, চিনবে না কেউ,
উঠানে জন্মাবো কিছু হাহাকার, অনিদ্রার গান–
আর লোকে দেখে ভাববে–বিরহবাগান ঐ উঠানে তত বেশ মানিয়েছে।
ধরিত্রী
পাতাকুড়োনীর মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছো? ছায়া, আমি ছায়া কুড়োই!
পাখির ডানার সিক্ত সবুজ গাছের ছায়া, গভীর ছায়া, একলা মেঘে
কুড়োই, হাঁটি মেঘের পাশে মেঘের ছায়া–ছায়া কুড়োই!
পাতাকুড়োনীর মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছো? পাতা, আমি পাতা কুড়োই!
কয়টি মেয়ে ঝরাপাতা : ঝরছে কবে শহরতলায়,
শিরায় তাঁদের সূক্ষ্ম বালু,
পদদলিত হৃদয় ক’টি, বৃক্ষবিহীন ঝরাপাতা–
কুড়োই আমি তাদের কুড়োই!
পাতাকুড়োনীর মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছো? মানুষ, আমি মানুষ কুড়োই।
আহত সব নিহত সব মানুষ কারা বাক্স খুলে ঝরায় তাদের রাস্তাঘাটে।
পঙ্গু-তবু পুণ্যেভরা পুষ্প ও তাদের কুড়োই আমি–দুঃখ কুড়োই
আর কিছু না? বটেই–আরো আছে অনেক রং বেরং-এর ঝরাপাতা,
আমার ঝাপ উল্টে পড়ে মন্বন্তরের মৃত্যুবীজে,
লক্ষ্যবিহীন লাল খনিজে!
সবাই আমার স্বার্থে ভিজে সবটুকু হয় স্বার্থবিষয়,
সবটুকু হয় শুদ্ধ ব্যথা
তাদের অন্য কুলোয়, তাদের ঝাড়বো আমি অন্য হাওয়ায়
যেমন করে শস্যভিটায় শস্য ঝাড়ার সময় এলে, শস্যে কুড়োই স্বচ্ছলতা,
এবার আমার ঝরাপাতার শস্য হবার দিন এসেছে,
শস্য কুড়োই, শস্যমাতা!
অবহেলা করার সময়
যেনো আমার এখন সব কিছুকেই অবহেলা করার সময়
উপেক্ষা করার সময়।
যেনো আমি এখন জ্যোৎস্নায় হাতলচেয়ারে অনন্তকাল শুধু
আলুথালু বসে থাকবো, এই আমার একমাত্র কাজ।
এই আমার একমাত্র অমলধবল চাকরী আর কিছু নয়
আর কিছুকেই আমি আনন্দিত উদ্ধার ভাবি না।
সুতরাং সবজির বাগান থেকে সাপের সঘন ফনা বেড়ে উঠুক, ক্ষতি নেই।
হামিদুর তার বউ নিয়ে কক্সবাজারে যাক
জল শকটের শাদা রূপচাঁদা মাছ ধরুক বিছানায়
আমি তাতে আশ্চর্য হবো না।
করতলে কুয়াশা লাগিয়ে কোন কিশোরী বালিকা কেঁদে উঠুক
রাত্রিবেলা, আমার কী?
কিশোরেরা কালো মৌমাছির মতো কুঞ্চিত কুঁইফল নিয়ে
লোফালুফি করুক শহরে, মরে যাক
আমি তাতে চোখও দেবো না। আমি জানি
এই সব কিছুর মূলেই রয়েছে রগরগে জীবনযাপন।
আর সব রগরগে জীবনযাপন মানেই পতনবিলাসী শিল্প!
সমাজ মাত্রই একটা মাথামোটা মানুষের
হুলস্থুল মিলিত প্রবাহ।
আর তোমরা যাকে চাকরী বা প্রফেশন বলো,
উন্নতি ও অভ্যুত্থান, তারা
আমার বিশ্বাসে আজ এক বিন্দু অনলের লকলকে
অজস্র বিস্তার ছাড়া আর কিছু নয়।
আর কিছুই নয়।
অনেক দিন পর ভালোবাসার কবিতা
ইঁদুরের তবু পালাবার পথ রয়েছে গর্ত
আমাদের তাও নেই হে ময়ুর মনে করে নিও
আমরা এখন কুষ্ঠরোগীর চেয়েও কাতর
নগ্ন হাতের তালুতে ঘুমিয়ে চোখের ভিতর
চোখের ভাঙ্গন সামলাই আজো
আর কিছু নয়, আর কিছু নয়–
চোখের খোড়লে সূর্য হাজার উঠলেও তাতে
আলোটি পড়ে না, ঝিলমিল হাড়
মাংসে তরল ফেনা ভাত ভরা স্নিগ্ধ ডালায়
প্রবাহিত নয় কারো সঞ্চয়
আমাদের সব পরাজয় তুমি
মনে করে নিও, মনে করে নিও
আমাদের মুখ মুখ নয় আর শূন্যতা সেঁকা
শীতের চুল্লী তপ্ত আঁধার। আমাদের বুক বুক নয় আর–
গুপ্তঘাতক পালানো বিবর। আমাদের চোখ চোখ নয় আর–
অগ্নিদগ্ধ যুগল শহর পুড়ে পুড়ে যায়…
অস্তিমে আর অন্তিমে যায়
পুড়ে পুড়ে যায়
আমাদের হাত হাত নয় আর–
অস্ত্র হঠাৎ মনে হয়, বুঝি
এই ভয়ে বুকে স্পশ করেছি
পালাবার পথে পাথুরে গুহায়
খণ্ড পাথর স্পর্শ করেছি, স্পর্শ করেছি
আর কিছু নয়, আর কিছু নয়,
এর চেয়ে বেশী আর কিছু নয়।
যুগলসন্ধি
ছেলেটি খোঁড়েনি মাটিতে মধুর জল!
মেয়েটি কখনো পরে নাই নাকছাবি।
ছেলেটি তবুও গায় জীবনের গান,
মেয়েটিকে দেখি একাকী আত্মহারা!
ছেলেটির চোখে দুর্ভিক্ষের দাহ,
মেয়েটির মুখে কত মায়া মৌনতা;
কত যুগ যায়, কত শতাব্দী যায়!
কত যুগ ধরে কত না সে বলীদান!
ছেলেটি খোড়েনি মাটিতে মধুর জল,
মেয়েটি দেখেনি কখনো বকুল ফুল।
ছেলেটি তবুও প্রকৃতি-প্রতিনিধি;
মেয়েটি আবেগে উষ্ণ বকুল তলা!
ছেলেটি যখোন যেতে চায় দক্ষিণে,
মেয়েটি তখনো ঝর্ণার গান গায়;
মেয়েটির মুখে সূর্যাস্তের মায়া!
ছেলেটি দিনের ধাবমান রোদ্দুরে।
কত কাল ধরে কত না গোধূলি তলে,
ছেলেটি মেয়েটি এর ওর দিকে চায়!
কত বিচ্ছেদ কত না সে বলীদান!
কত যে আকার শুভকাল পানে ধায়!
ছেলেটির গায়ে বেঁধে কত বল্লম;
মেয়েটির মনে কত মেয়ে মরে যায়!
ছেলেটি যদিও আঘাতে আহত তবু,
মেয়েটি আবার মেয়ে হয়ে হেসে উঠে।
কত বিদ্রোহ, কত না সে, বলীদান;
পার হয় ওরা কত না মহামারী!
ছেলেটির বুকে মেয়েটির বরাভয়;
মেয়েটির চোখে ছেলেটির ভালোবাসা!
একজন ফের উদ্যানে আনে ফুল,
একজন মাঠে ফলায় পরিশ্রম;
কতনা রাত্রি কতনা দিনের ডেরা,
কতনা অশ্রু, কতনা আলিঙ্গন!
ছেলেটি আবার খোড়ে মাটি খোঁড়ে জল!
মেয়েটি আবার নাকে নাকছাবি, ছে
লেটির চোখে মেয়েটির বরাভয়;
মেয়েটিকে দেখি একাকী আত্মহারা!!
বিচ্ছেদ
আগুনে লাফিয়ে পড়ো, বিষ খাও, মরো
হলে নিজের কাছে ভুলে যাও
এত কষ্ট সহ করো না।
সে তোমার কতদূর? কী এমন? কে?
নিজের কষ্টকে আর কষ্ট দিও না,
আগুনে লাফিয়ে পড়ো, বিষ খাও, মরো,
হলে নিজের কাছে নত হও, নষ্ট হয়ো না!
এক প্রেমিকের কথা
কাল নারীর শরীর থেকে এক নির্যাতন উঠে এসেছিল
আমার অন্ধকার অঙ্গে : আমি তাকে ধারণ করেছিলাম মৃত্যু
যেমন ধারণ করে জন্ম : জন্ম যেমন জীবন এবং মৃত্যু ঠিক
পাশাপাশি সে রকম আমার এই ধারণ ক্ষমতা, আমি
আমার সন্তোষে রেখে সুন্দর অভ্যাসে তার দিকে
তাকিয়েছিলাম ও নারী কিম্বা নিভৃতি যাই হোক, তার দিকে কেবল
তার দিকে আমার এই তাকিয়ে থাকা, আমার এই শিল্প জানি না
শোষণ ক্ষমতায় এর নামকি, মমতায় আমি একপলক পবিত্র
দৃষ্টি তার দেহে অর্পণ করে তাকালাম, ফের সেই অমল তাকানো!
মৃত্যু যতটুকু পারে, তার বাইরে কেউ কখনো যায়না, জন্ম
মৃত্যুর শুরুতে এই মা, এই মহিলাই আসলে জীবন-যাকে বলি
সুন্দর বেদনা সব : সমস্ত নিষ্পন্ন এই একটি নারীতে!
কাল নারীর শরীর থেকে এক নির্যাতন উঠে এসেছিল
আমার অন্ধকার অঙ্গে : আমি তাঁকে ধারণ করেছিলাম,
মৃত্যু যেমন ধারণ করে জন্ম :
কয়লা
দুদিকে সমান জ্বলি : প্রথমত : মাটির ভিতরে বহুকাল,
তারপর তোমরা যখোন তোলো এটা ওটা
তোমাদের কারখানায়
মেশিনে চুল্লিতে আমি টের পাই আমার আত্মায় এক অন্য আগুন!
মাটির মিথুন ভেঙ্গে এত আমি জ্বলি!
ওরা কেউ এতটা জ্বলেনা!
এত বনস্থলী, এই বনের প্রবাহ, ইতিহাস, মাটি চাপা এত উপবাস
কারো কাছে নাই আর এত দাহ, এত অভিমান।
দুদিকে সমান জ্বলি : রেণু রেণু আমার পরান পোড়ে
ওরে জনস্থলী-মুখ খুঁজে চলি, তবু দেবেনা মানুষ!
হীরা হতে দেবেনা আমাকে, দ্যাখো, করেছে কি দ্যাখো :
আমার আত্মায় ওরা অমঙ্গল দাহ দিয়ে আমাকে বৃথাই
করেছে নিশ্চল ছাই, এঞ্জিনে, লোহায়
এ আগুন তোমাতে পৌঁছায়?
বিপ্লবী
রূপসী হিংসা তার ডোরাকাটা বিদ্যুৎগতিতে খ্যাতিমান!
তাকে চেনে সকলেই, জানে পৃথিবীর সব রাজসিক সিংহেরও সমাজ
সহজেই গৃহবিবাদের মধ্যে যায়না, স্বত্ত্বার
সতেজ হুঙ্কার দিয়ে হেঁকে তোলে সাবলীল এক একটি শিকার!
একমাত্র একালের ক্ষুধার্ত নৈতিক মূর্তি,
শক্তি তার সুন্দরের শুভ্র হাতিয়ার বটে,
কিন্তু মেধা আত্মার উদ্ধার
তাই কৌশলে যুদ্ধের পটভূমিকায়-সে খোঁজে বৃক্ষের ব্যাপ্তি!
পতঙ্গের প্রণয় প্রার্থনা বামে ফেলে, সামাজিক।
সবল সচল বেগ বুকে তুলে সে এগোয় ধীরে ধীরে,
গন্তব্যে যাহার অলস অঢেল মধ্যবিত্তের পশুরা–এমনকি মানুষ
মুগ্ধতায় প্রকৃতি দেখায় মগ্ন!
অথবা নিজেরা সব সে মুহূর্তে বিচল বিমূঢ় কোনো বিচ্ছিন্ন প্রকৃতি।
কিন্তু কেবল থাকে কোজাগর সেই এক!
অন্তহীন অঙ্গারে অটুট জ্বালিয়ে লাবণ্য তার ডোরাকাটা লক্ষ্যের থাবায়
নাসারন্ধ্রে নষ্ট প্রজ্ঞা মুছে ফেলে পিঠের নক্সায় দ্রুত–
জরির জেন্নাতুলে পূর্ণিমায়ও তাকে দেখা যায় বসা–
আলাসে অতৃপ্তি তার-বসে থেকে
থির বিজুরীর ক্রোধ ঢালতে ঢালতে সে এগোয়
যেখানে শিকার রাত্রির দোলায় দুলে
তখনও মগ্ন চাঁদে, পূর্ণিমার প্রচ্ছন্ন বিষাদ!
দেখো, দেখো এখন খাঁচায় বন্দী!
যদিও সে ছিল এক অরণ্যের দলপতি
ভোরবেলা উযার সংবাদ।
সঙ্গমকালীন একটি বৃশ্চিকের মৃত্যু দেখে
এই মৃত্যু জন্ম দেয় শিল্পে কুসুম :
এই আদি সঙ্গমের অনাদি পিপাসা!
দ্যাখো দ্যাখো ঝিলের ঝাকড়া ঘাসে তীরবর্তী একলা বাতাসে ঐ
টান টান একটি বৃশ্চিক!
অফুরন্ত রক্তবমি করে গেলো, অফুরন্ত অফুরন্ত!
ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে সঙ্গমের অনাদি পিপাসায়
বৃশ্চিকের লালা যেনো স্বর্গমর্ত জুড়ে একটি
স্ত্রী বৃশ্চিকের বোবা ঘামে হিমে কুয়াশায় নিস্পন্দিত নদী হয়ে গেল!
শেষ মিথুনের শেষে তার মৃত্যু!
জানলোনা ঘাসের ভিতর একটি যৌন আলিঙ্গন
এমন গোপন শিল্পে মৃত্তিকায় মুছিল শরীর!
জানলোনা!
কেউ জানলোনা!
জরায়ু আমি জরায়ু ছিলাম
আমি জরায়ু ছিলাম, হয়ে গেলাম মানুষ, নাহয়
সেইখানে তো ফুটতে ছিলাম
মায়ের জ্বণে গর্ভাশয়ে ফুলের মতো
অমল ধবল ফুটতে ছিলাম;
ছলছলানো জলের যোনি
ঘূর্ণি মেরে ফুটতে থাকা একলা খুনী
করাতধারে চিড়তে ছিলাম মাংস মায়ের
মাখতে ছিলাম ভিতরব্যাপী বৃত্ত জুড়ে
মায়ের মধুর অন্তঃপুরে।
কোন বিদেশী ডাকাত তাকে ছিঁড়তে গেলো? ছিঁড়তে গেলো?
টাকার মতো রূপোয় ঢাকা রাত্রি তাকে ছিঁড়তে গেলো?
বাবা? নাকি অসম্ভবা জন্ম আমার?
কোন বিদেশী ধর্মাধর্ম ছিঁড়তে গেলো? ছিঁড়তে গেলো?
একলা একা শুয়ে থাকার, গন্ধ মাখার শান্তি অগাধ?
এখন আমার ক্লান্তি বড়, শরীর ভরা জড়োসড়ো,
ঘুণপোকা আর থোকাথোকা ঘামলমূত্র বহন করি,
জখম করি নিজের জন্য জখম করি, জখম করি,
ত্রিশূল বিদ্ধ শুয়ার যেমন, জখম করি নিজের দুয়ার
পিছন পাগল সকল আহার,
আত্মা থেকে অমল বাহার;
ফুলের মতো একলা থাকার গর্ব নিয়ে ফুটতে ছিলাম মায়ের ভ্রূণে,
কি কুক্ষণে ডাকাতে বেনে, ছিঁড়তে গেলো ছিঁড়তে গেলো?
আমি আছি শেষ মদ
কে বলে নিঃশেষিত?
নিঃশেষিত হতে হতে তবু সব নিঃশেষিত হয়নি এখনো!
মদের পাত্রের ঠোঁটে শেষ মদিরার চিহ্ন
কে কবে মুছেছে ঠোঁটে? কার সাধ্য, কতদুর পারে?
নিঃশেষিত হইনি ভিতরে।
থরে থরে মাটির পাত্র জুড়ে
আমি আছি শেষ মদ!
কেউ তাকে পারবেনা চুমুকে সরাতে!
অসহায় মুহূর্ত
এতটা সময় চলে গেলো, তবু কী আশ্চর্য, আজো কি জানলাম :
বনভূমি কেন এতবৃক্ষ নিয়ে তবে বনভূমি,
জল কেন এক স্বচ্ছ স্রোত পেলে তবে এত স্রোতস্বিনী।
রক্ত কেন এত রক্তপাত নিয়ে তবে যুদ্ধ, তবে স্বাধীনতা।
এতটা বয়স চলে গেলো, তবু কী আশ্চর্য আজো কি জানলাম :
বনভূমি লোকালয় থেকে কেন এত দূরে থাকে
কিশোরীরা কেন এত উৎসরণ কেন এত নিষ্ক্রমণ প্রিয়,
আর নদী কেন গভীরতা ছাড়া ঠিক ধারামতো চলতে পারেনা!
এতটা জীবন চলে গেলো, তবু কী আশ্চর্য আজো কি জানলাম :
চড় ইয়ের ঠোঁটে কেন এত তৃষ্ণা, খড়ের আত্মায় কে এত অগ্নি এতটা
দইন!
গোলাপ নিজেই কেন এত কীট, এত মলিনতা নিয়ে তবুও গোলাপ
একটি ফুলের কেন এ গাঢ় ঘুম আর
তখোন আমরা কেন তার মতো ঘুমুতে পারিনা।
সহবাস
দ্রাক্ষার বদলে আমি দুঃখ দেবো :
মৃত্যুর বদলে মধু চাও যদি তবে,
পা ডুবিয়ে বসে এই যুগল তৃষ্ণার চোখে
ভোগ করো তোমাকে তোমার মতো নারী!
সুপেয় শরীর তুমি পান করো সূর্যলতা,
পাহাড় প্রভাতরশ্মি হুলস্থুল দেশ, মহাদেশ :
স্তনে স্পর্শেী টান নীলাভ্র ছন্দের রৌদ্রে ভরে তোলো
যা আর এখন নেই সেই শুভ্র প্রাথমিক গোলা
তোমার হাতটান মানে খাদ্যের অভাবে মৃত্যু
তুমি রুষ্ট হলে সব ছন্দবাক্য লবণেও দুষ্প্রাপ্য ব্যাধির
মহাজন ঢুকে পড়ে আনে অঙ্গে আহত ঝিলিক,
দেশ ছেয়ে যায় ভূখা শিশু ও যীশুর হাড়ে চতুর্দিক
ছড়ায় মৃত্যু খুলি, মাটি, ঠুলি, বিষ, বলিদান।
কবির কল্যাণমন্ত্রে উচ্চারিত তোমার সুষমা যদি
ভালোবাসো, ভিন্ন হও, ক্ষয়ের ভিতরে যাও সুসময়,
আবার বর্বর বাধা মহিষাসুরের ক্ষুরে ছিন্ন ভিন্ন যে উদ্যান
তাকে টান টান শুভ্র উঠান করো করতলে ফোঁটাও সুদিন।
দাও অনুধ্যানমন্ত্রে শ্রেষ্ঠ নির্মাণশক্তি হাতে ধনুর্বান তুমি
ফিরে এসো অভিজ্ঞান, জলস্পর্শ, পায়রার উজান পাখা,
বসুক তোমার তীব্র শাখা পরী মৃনাল বাহুতে আজ
নিভৃতে চলুক রতি, প্রেম ও উন্থান হোক
যুগল ধর্মের শর্ত, সময়ের শুভার্থ, সৃষ্টির সম্মান।
তুমি
তুমি শিল্পিত বৃক্ষের চূড়ও দেবদারুর মতো
মুগ্ধ কিন্নরের অবিনাশী গান!
অকরিক লোহার খনিজে ভরা অন্ধকার বস্ত্র ও আগুন!
তুমি অহোরাত্রি শুধু বিশুদ্ধির!
উটপাখির যুগল ডিমের লাস্যে খিলখিল মরুভূমি তুমি
মধ্যরাতে ধাতব চাঁদের নীচে নক্ষত্রের নৃত্য সহোদরা :
সংগুপ্ত সৃষ্টির বীজ :
যুদ্ধের বিরুদ্ধে তোলা যুঁইফুল জলপাইবাহার!
হে জিনধান কেন্দ্রী পাহাড় দৃশ্য, ঝর্ণাজল
তোমাকে নাহলে এই মরাল পংক্তির মেঘে মিলতোনা জলের ভ্রমর!
বারবার অভিষিক্ত পৃথিবীর নীলাভ নিটোল জলে
সোনার ঘোড়ার মতো তোমার নিতম্ব দেখে নদীকে কুর্নিশ করি!
সিংহের কান্নার মতো তোমার শরীরে আমি
অনুমান করি অরণ্য উদ্ভাস!
এক একবার মনে হয়েছে–
আমি হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে আমার জগৎ থেকে
যে জগৎ ছিল একদিন আকীর্ণ সাপের
যে জগৎ ছিল সিংহের রোমশ উচ্ছ্বাসের
যে জগৎ ছিল অরণ্যের, অযত্নবর্ধিত সব আদি যৌবনের
উদ্বাস্তুর মতো বারবার তাই আমি ফিরে তাকিয়েছি
সেইদিকে, তোমার দিকে :
স্বদেশ ছাড়ার মতো বেদনায় আমার দু’চোখ
সূর্যসংক্রান্তির ভোরে খুঁজেছে সব হারানোকে–আর
সেই হারানোর মধ্যে আয়নার মতো বারবার দুলে উঠেছে তোমার মুখ!
‘কেন উঠেছে?’
কেন তুমি আমার সবকিছুর সঞ্চয়ে নির্মিত হয়েছে এইভাবে?
শস্যের ভিতরে অঙ্কুরে
জলের ভিতরে নীল বুদ্বুদে
পাখির ভিতর শাদা পালকের গুচ্ছ গুচ্ছ গভীর জগতে
একটু একটু
জন্ম নিয়েছে তোমার গ্রীবা, তোমার গ্রন্থিল বাহু,
কেন? কেন? কেন?
কেন তোমার বেদনা বিকাশের ছবিখানি
আমার সমস্ত গ্রাস করে আছে?
কেন আমি অস্থিরতার পাশে পল্লবিত দেখতে পাই তোমাকেই
কখনো যুদ্ধের জ্ঞানে,
কখনো মেধায় কখনোবা যেনো তুমি অলৌকিক,
কখনো বুঝিনা তুমি, কী গভীর মৌল কুটনীতি!
কেন তবু তোমাকে খুঁড়লেই ফের ফিরে পাই
যেন জলের মধ্যে লাল নীল রূপোলী সুন্দর মাছ, স্বপ্নের স্বীকৃতি?
বেদনার বংশধর
বেলা যায়? কত হাত পড়ন্ত সূর্যে তবু তুই আজ নামবি কিশোর?
সামান্য শরীর তোর! অত ছায়া লুকোবি কোথায়?
ছায়া চলে যায়, তবু চাস, তবু জেদীপনা?
–তবু ছায়া চাই? জলছায়া-ফলছায়া-শয্যাছায়া স্মৃতিছায়া?
মৃত্তিকানক্ষত্রছায়া? ছায়া চাই–ছায়া চাই মনে ও মাটিতে?
কত হাত পড়ন্ত বলয় বোধে তবে তুই নামবি কিশোর?
কত কুটিলার বানে ভেলার মতোন তার দেহকে ভাসিয়ে
জ্যোৎস্না আকাশে চাঁদ, সবুজ সোনার থালে ঢেকে দিবে জলে ভাসা লাশ?
ভিক্ষুণীর আসন্ন প্রসব যাতনায় মেলে দেওয়া গোপন জন্মের প্রহরায়
প্রথম শিওর হলো ক্ষুধা উন্মীলন! রে কিশোর, ও কি তোর শত্রু না
সমাজ?
তুই তারও ছায়া চাস? পড়ন্ত শতাব্দী বেলা শান্তি চায়
তবু বীজ ফলেনা কোথাও শুধু শতাব্দী ঘুমায়র্নার শিহরায় সব চলে
যায়,
সমস্ত প্রস্থানে তবু ছায়া চাস? শুভছায়া-শান্তিভায়া-স্বচ্ছছায়া : মনে ও
মাটিতে?
পোড় দেশ! দৈবে পুড়ে যায়! দৈবে আর মেলেনা মেধায়;
বেলা যায়; চাষী বলদের হালে চাষনা মৃত্তিকা : ঋণী হয় কেউ।।
কেউ শতাব্দীর গোপন গুহায় বসে লোহার শাবলে শান দেয়!
বেলা যায়! বিবর্ণ বিদ্যায় বুকে বেদনায় বেলা যায় :
ছায়া চলে যায় : ছায়া-শুভছায়া ও তবু ছায়া চাস তুই, তবু জেদীপনা?
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তো ফলাও!
অসুখ
অসুখ আমার অমৃতের একগুচ্ছ অহঙ্কার!
আত্মার অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ক্ষুধিত জানোয়ারের
রোমশ বলশালী শরীরের দুটি সূর্যসমান রক্তচক্ষু!
যা দেখে ঈশ্বর পর্যন্ত ভয়ে, ভয়াল হিমে শয্যাদায়গ্রস্ত হন!
হা সুখী মানুষ, তোমরাই শুধু জানলেনা
অসুখ কত ভালো কত চিরহরিৎ বৃক্ষের মতো শ্যামল
কত পরোপকারী, কত সুন্দর!
একবার রুগ্নতায় প্রবেশ করলে স্বর্গ না হোক
নরকের ভিতরের চরকীবাজি আর হল্লা আর অলঙ্কুশ
নারী নৃত্যে তো দেখে আসা যায়!
যুবতীর স্তনের ভিতরে লাবণ্যের লোহা টলটল করে–
তার চেয়ে হলুদগন্ধকের আর লোহার তপ্ত দ্রবণজাত জ্বালা
বুকের কোষে কোষে আমারও শিরা উপশিরার এক গুচ্ছ
অন্ধকারের মতো জমে আছে।
সমস্ত শরীরে আমার এখন একক প্রদাহের অমৃতনিঃসন্ধী অনল উদ্যান!
তাই ভিতরে ভিতরে… মাথার ভিতর অমৃত্যের বদলে যা প্রবাহিত…
তা অনুর্বরা জমির জ্বলনসেচ প্রদাহ, তা জ্বরের জিয়ল আঠার জ্বালা।
বেঁচে থাকতে হলে তবু মাঝে মাঝে জ্বরের, জ্বরের প্রদাহ চাই :
চাই আবার জোয়ারের মতো সাতিশয় কুলু কুলু শুশ্রূষা!
চাই আবার জোয়ারের মতো সাতিশয় কুলু কুলু শুশ্রূষা!
আমার অসুখ যেনো হঠাৎ আবার তন্দুরের রাশি রাশি রুটির
ক্ষুধার্ত উত্থান!
তখোন সমস্ত শরীর হয়ে যায় একটি বিশাল রুটি–অগ্নি ঝলোমলো,
আর তাকে ছিঁড়ে খাবলে খেতে আসে হাজার হাজার বন্যাপ্লাবিত
দুদৈর্বের দেশের মানুষ!
ভয়ে নিজের ভিতর নাগ কেশরের ডগার মতো
হৃৎপিণ্ডে সেঁধিয়ে যাই।
বিষের অতলে ঝিনুকের বিল্লী খুলে ঐ আত্মরক্ষাই
আমার অসুখ, আমার অহঙ্কার।
তবু অনাহারে মারীতে মৃত্যুতে আমি মরবোনা, না মরবোনা।
আসুর উচ্চে তুলে ধরে উষ্ণ স্রোতের ভিতর
আমার অনুপস্থিতি ডুবিয়ে বলছি :
জাপানের চেরীফুলের দোহাই :
দুদৈর্বের দেশে যেনো আমার মৃত্যু নিবারণ হয়!
সূর্যের রৌদ্রে চাবুক বানিয়ে আমি মৃত্যুকে সাবধান করে দেই!
অসুখে কে আবার কার পদানত?
এর আগে ফুলের ভিতরে মরেছি পাপড়ির মতো, পোকার মতো
সৌরভের মতো!
ঘাসের ভিতর মরে গেছি সবুজ রং এর মতে বিকেল বেলার বিলোল
আলোয়!
পাকা আতাফলের মতো মরে গেছি ঘোর ঋতু শেষের জামদানীর দিনে!
টাকার মতো মরে গেছি টাকশালের নকল ছাঁচে, কালোবাজারীর কালো
তেলোয়!
তেমন মরবোনা আর, অসুখকে চাই সুখের অমরাবতী!
হায় সুখী মানুষ বুঝলেন অসুখ কত ভালো :
আমি অসুখে যেতে যেতে এক চক্কর তোমাদের নরকে
সব সুখী মানুষদের দেখে এলাম–এটাই বা কম কি!
রোগ শয্যায় বিদেশ থেকে
বনে’র সবুজ লন্ড্রীতে আমার অরণ্য জামা উঠছে ঐ
সর্বঋতু সম্মত পোশাক আমার!
তুষারলোর বোন! বস্ত্রালয় থেকে ফিরে এসে
আবার তোমাকে যেনো পাই।
কি কি আনবো, শোনো :
পাখিরা রয়েছে তাই পরিবহণের কোনো সমস্যা হবে না।
আনবো অঢেল উষ্ণ মহাকাল, বসন্ত বৈকাল?
উড় উড় সমুদ্রের হাওয়া।
বৈদেশিক বাণিজ্য টাওয়ার বাক্সে টোকা দিয়ে
আনবো আলোর নতি, নীল মুদ্রা, মৈত্রী ও বসতি!
তৈরী থেকো হে মাধুরী মৃত্তিকা সবাই।
সজল কুয়াশা’কিছু শাদা রোদ, শুশ্রূষা, কুসুম
প্রেমিক যা ভালোবাসে প্রেমিকার উদার চুম্বন,
শিশুরা যা ভালোবাসে মায়ের মধুর মন্থন!
কবিরা যা ভালোবাসে ছন্দোদ, নৃত্য, নারী
আলো আর নৈশপথচারী সারি সারি
সমুদ্র পাহাড় ঊষা, প্রকৃতির পিলসুজ, তামা :
আনো অভিধানে তুলে বৈদেশিক ক্ষম ও সুষমা!
তৈরী থেকো, হে উত্তমা হে বোধি পরমা
ছিপখানা, তিনদাঁড় তোমাকে পাঠাই যেন তরী!
স্বাস্থ্যনিবাসের নীলে আমার উদ্ধার ঐ সুন্দরী কিশোরী
এ বয়সে এখনি সেবিকা!
জানে মমতায় কত মন্বন্তর মুছে দেওয়া যায়!
জানে মমতায় কত জন্ম নেয় মনীষা, মনীষা!
বনে’র সবুজ ঊষা আমার মঞ্জুষা হলো ঐ
পুষ্পপাত্রে পানীয় আমার!
আমি চোখে ক্লান্তি ধুয়ে ধ্যান করি
ফিরে পাবো সাবিত্রী সংসার!
শাদা পোশাকের সেবিকা
অপরাহ্ন ভরা রেলিং এ হেলান দেয়া এক সারি
শাদা কাপড়ের মতো শাদা নার্স
বুকের বাঁপাশ থেকে অস্তগামী রোদ্র টলমলিয়ে উঠলে৷ এইমাত্র
তার সেবিকা পোশাকে।
সে এখন কী যে তার অস্তগামী দেহের পোশাকে ঠিক
বোঝা যায়না দুঃখী নার্স, সেবাকাতরতা ভরা শরীর সন্ধিতে
ক্ষয়িষ্ণু মানুষের কত মৃত্যু, আর্তটীকার অসুখের গ্লানি
সে অনুভব করেছে তার সহিষ্ণু সেবায়!
সুপারী গাছের মতো ঋজু ও দৈহিক গড়নের তরুণ বরুণ
ছায়াশীতল ছায়া না রোদ্দুর তাকে বুকে তুলে নেয় সে জানেনা,
শাদাশুভ্র করিডোরে হেলানো ঔষধি ভঙ্গী তার এই প্রতিমূর্তি যেনো
প্রকৃতিতে পরম শ্রদ্ধার সাথে শুধু বলে শুশ্রূষা তোমার কাঙ্খা
কেন তুমি ক্ষীয়মান, দুর্বলতাময় এই মানুষগুলিকে তবে
রোপন করেছো এইখানে অন্ধকারে? হায় তবু বর্বর প্রকৃতি
তার নির্বোধ সন্ধেবেলা অস্তগামী সূর্যে তুলে দিয়ে
সমস্ত আকাশে কোনো প্রত্যুত্তর নয় শুধু তার অশ্রুর আভায়
আরো কটি মৃত্যু ঝরিয়ে রাত্রে নিশ্চুপতাময়
সেই একই নার্সের আত্মায় এনে দেয়
আরো কতিপয় কান্না, অসুখের আত্মগ্লানিভরা
মলিন শয্যার ছায়া দুঃখছায়া স্নানদুঃখ আর ম্লান
অন্তহীন ছায়া
মানে একেকটি মৃত্যুর পরে একেকটি জীবন।
সমুদ্র স্নান
সমুদ্র এখন মাত্র এক হাত দূরে। তোমার সমুদ্রে আমি
পুরুষের পদ্ম স্নান সেরে উঠে এলুম অন্য রোদে শুক মাছের মতো
আমার শরীর। জল ঝরে যাওয়া চোখ সময়ের আঁশটেগুলি
আর একটু কপালে সব দেখা যাবে
বাগান। কটেজ। ভিলা। ফ্লাকসের বোতলে ভরা দুধ।
পাটখোলা মেঘের কাতান কালো মহিষের মতো মেঘ জমছে :
সমুদ্র এখন মাত্র এক হাত দূরে!
আমি করতল ছাতার মতোন মেলে ধরে তোমার শরীর
ঝড় বৃষ্টি রোদ থেকে বাঁচালুম! বিয়ারের ফেনার মতো তুমি
উপচে উপচে কথা বলছ। আমার কানের কাছে…
তোমার পায়ের পাতা চাদরের মতো বালুতে বিস্তৃত।
একটু ছুঁলে সমুদ্রের শেষ থেকে শুরু হয়ে যেতে পারো তুমি!
একটু স্পর্শ করলে তোমার স্তন সূর্য সুন্দরের মতো
লাফিয়ে লাফিয়ে নীল কটিদেশে
আমার আদিম শ্যাওলা যৌনকাতর করে দিতে পারে মেঘে।
হাত মেলে দিলাম তুমি সমুদ্রকে রোখো।
বুক খুলে দিলাম তুমি বিস্তৃত বালুর কণা জলে সিক্ত করো।
মন হয় এগুলোই আমার ভাঙ্গন, শরীরে শরীরে জোড়া লেগে
আর উঠবে না–মনে হয় তুমি এলে সমস্ত সমুদ্র চুলে
সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে আমার অস্থির কান, শঙ্খমালা গলা!
মনে হয় সমুদ্রের পাশে তুমি সমুদ্রকে শরীর করেছো!
আমার জলের লোনা স্নানের তীক্ষ্ণতা আজ মাছ হলো তোমার অতলে।
অন্য রকম বার্লিন
বার্লিন এমন কোনো ব্যথিত শহর নয়।
তবুও বললুম সত্যি বার্লিন ব্যথিত!
কেন? সে রাত্রিবেলা কুলকুল কুয়াশায় শীতে
ঘুমোতে পারে না, তাই?
হাসপাতালে অপারেশন টেবিলে তার এক বিদেশী কবির
হৃদরোগ পান করে অবশ্য বাঁচতে হবে, তাই?
অথবা এত রঞ্জনরশ্মি সারাদিন অমায়িকভাবে কাজ করার পরও
সে তার পৃথিবীর কোথাও অসুখ, আগে নির্ধারণ
করতে পারলোনা-তাই?
অথবা পাবলো নেরুদাকে ওরা খড়কুটোর মতো
ছিঁড়ে ফেলেছে এই সেদিন
একটি সার্বজনীন গোলাপের ঘ্রাণের ভিতর ফুটে ওঠার আগে,
তাই তার এত আলোকিত শূন্যতার সর্বগ্রাসী বেদনা?
তার চিকন চোখের অন্তহীন শীতের ডাইনামো
সমস্ত ইউরোপ জুড়ে আজ
শুধু জেটি, ক্রেন, যুদ্ধজাহাজ কুয়াশার প্রগতি আর প্রগতি–
অথবা বার্লিন শীতে সবদিক শাদা-ইস্তাম্বুল থেকে শুরু করে
সমস্ত প্রাচ্যের অন্তহীন তাম্বুরায় আকাশবিহারী এক
সভ্যাতর উজ্জ্বিত কলরোল-তাই?
কিন্তু বার্লিন এমন কোনো ব্যথিত শহর নয়,
সত্যি বলছি ইউরোপও নয়!
মাঝে মাঝে এত পরিচ্ছন্ন আর পরিষ্কার এর পক্ষীমিথুন আর
এর মেয়েরা এমন সুন্দরী, এমন বিনীত–
যে স্তন স্পর্শ করলে মনে হয় লজ্জাহীন।
নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে, তাদের দিকে তাকানোর চোখ
সহজেই রুদ্ধ হয়–অত শাদা লাবণ্যের ঢেউ!
কালো চোখ পারেনা অতটা!
তবুও বললুম সত্যি বার্লিন ব্যথিত
এর এক কোণে প্রচণ্ড বিশাল
দারুণ দুর্দম এক শীতের কুয়াশা জমে আছে
মনে হয় সমস্ত ইউরোপে।
ভাঁড়ার ঘরের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কী সে বেদনা।
দিন দিন জমে ওঠা উজ্জ্বল ফ্রীজের মধ্যে অন্তহীন
এর এত সুস্বাদু খাবার
কতদিন যে সত্যিকার একটি ক্ষুধার্ত মানুষের দেখা পায় না
কতদিন যে এইসব ফুলের সুঘ্রাণ দুধ সমৃদ্ধ শর্তরা
তাদের জিহ্বায় স্পর্শ করেনি এক খাদ্যহীন
জিহ্বার উদগ্র আকুতি!
কতদিন যে এরা কেউ সত্যিকার একটি শূন্য পাকস্থলীতে গিয়ে
বলতে পারলো না,
আহা! কী মুক্তি! মুক্তি!
কতদিন পর না জানি আজ সত্যিকার স্বদেশে পৌঁছে
বাড়ী ফেরার গান গাইছি।
স্মৃতিচিহ্ন
ভিতর থেকে দেখা তোমার
শুকনো খালের সাঁকো :
পেরিয়ে গেলাম দেখো আমি
কতনা রোদ্দুর!
বয়স হলো বাহির টানে
সাতটা সমুদ্দুর
দেখেও এলাম শরীর তোমার
বিষের জলে ভরা :
ঘর্ষণে তার ঢেউ এর উপর
উপচে পড়ে জ্বরা!
ভিতর থেকে দেখা তোমার
মৃত জলের মেলা
পেরিয়ে গেলাম কত শহর
দেখোনা উজ্জ্বলা!
জংলাটিপি উঁইয়ের পোকা
মৃত্যু মনন্তর
শস্যবিথী নদী ও মাঠ
ভিতরে একঠায়
পেরিয়ে গেলাম কাকের মতো
শীতের কুয়াশায়!
এখন বাকী জন্ম নিতে
আবার পুনরায়
নতুন করে দেখতে হবে
তুমি কি প্রান্তর?
শস্যবিথী, নদী ও মাঠ
তরে সন্ধ্যায়
তুমি কি সেই জন্মভূমি
স্মৃতির সীমানায়
আবার কালোকাকের মতো
ফিরছে কুয়াশায়?
এই নরকের এই আগুন
ভীরু বালকেরে বাড়ীঘর দাও
মাতৃনিবাসে মেট্রন দাও
পার্কে ছড়াও যুঁইফুল
ঘাস অনিদ্র,
জোড়াখুন হোক একটু ভদ্র
কবিরা লিখুক দু’এক ছত্র প্রেমের গান!
হে মেঘ, পাবন বৃষ্টি দাও
গলাকাটা দিন সুদূরে সরাও–
নারীর মতোন পেটে তুলে নাও সুসন্তান!
ক্ষণিক আমরা, ভালোবাসা থাক
পথে পরাজিত হওয়া সরে যাক
পাতা ঝরাদের দলীয় ঝগড়া, অসন্মান!
যা কিছু অমল ধবল বাষ্পে
তৃণ কুসুমের কোমল শষ্পে
সুসময় এসো মাড়িয়ে মাড়িয়ে মৃত্যু খুন!
হে জল নেভাও
নেভাও হে জল, এই আগুন!
তুমি রুগ্ন ব্যথিত কুসুম
নয়নের মাঝখান থেকে নেমে আসা এই নিমফল
তুমি কাকে দেবে?
তার চেয়ে পান করো, গলধঃকরণ করো হৃদয়ের বিষ!
হাওয়ার হলকুম থেকে উঠে আসা এই অন্ধকার
তুমি বাইরে এনোনা, খেয়ে ফেলে।
ফুসফুসের এই রক্ত পূনরায় ঢোকাও ফুসফুসে!
বাইরে তুমি বিকশিত হয়ো না কুসুম, রুগ্ন ব্যথিত কুসুম!
তার চেয়ে গভীর গভীরতরো আড়ালে লুকিয়ে যাও!
যেখানে জন্ম নিয়েছিলে সেই সম্পূর্ণ আঁতুড়ঘর, বনদোচালায়
তুমি কি ভুলেই গেলে পূর্ণিমায় তোমার জননী তার
কুমারীত্ব পুনরায় ফিরে পেয়েছিল?
মলিন প্রদীপ, যাও মাকে বলল, এসেছিতো,
এবার কোথায় তুমি কোনদিকে কতদূর নেবে?
আমাকে কি এখনই নেভাবে?
আমার তো নেভাবার সম্পূর্ণ সময় হলো,
নাকি ফের আমাকে জ্বালাবে?
ডোয়ার্ক
(রাহাত খান)
আমাকে গ্রহণ করো, আমাকে, আমাকে!
কে কাকে গ্রহণ করে? কে বা রাখে কাকে?
দেয়ালের ফাঁকে তবু জায়গা আছে, আমাদের জায়গা নেই!
এত ছোটো, এত ছোটো হয়ে গেছি আমরা সবাই!
আমাদের জায়গা নেই : গ্রহণ করবে কাউকে–
বন্ধুকে অথবা শত্রুকে!
এত ছোটো, এত ছোটো হয়ে গেছি আমরা সবাই!
এপিটাফ
যতদূর থাকো ফের দেখা হবে। কেননা মানুষ
যদিও বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক।
মিলে যায়-পৃথিবী আকাশ আলো একদিন মেলে!
এ সেতু সম্বন্ধ মিল, রীতিনীতি সবকিছুতেই আজ
সুসংবদ্ধ, সুতরাং হে বিরহ যেখানেই যাও
মিলন সংযোগ সেতু আজ আর অসম্ভব নয়!
মূলতঃ বিচ্ছেদ চোখের বহির্বস্তু, বাহ্যিক আগুন!
কিন্তু মনে যেহেতু মঞ্জুষা আছে-মৈত্রীমমতায়
পৃথিবীর এপার ওপার তাই, তোমার সমস্তদূর এক লহমায়
মনের কোণায় এসে অলৌকিক মিলে মিশে যায়!
এখন হৃদয় আর বিরহের বিন্দুমাত্র বিকাশে অলীক
বলেনা হবেনা দেখা,-আর নয়, কোনোদিন নয়!
এখন আকাশ, আলো,-একে অপরের নিজ দায়ে
কাছাকাছি হতে জানে–সূর্য, চাঁদ,-এপিঠ ওপিঠ
একে অপরের সাথে রাত্রি ও দিনের ব্যবধানে
পরস্পর জ্যোত্সা, যৌবন, রোদ, ভালোবাসা বলাবল করে।
আমাদেরও বলা হবে, যেমন সূর্যে হয়, ঐ চাঁদে হয়!
দিন ও রাত্রির ব্যবধানে যেমন ওদের হয়, পরস্পর
দূরে ও অদূরে উষ্ণ সংরাগের সন্ধিতে তন্ময়
জন্মে ও মৃত্যুতে ফের একদিন আমাদেরও হবে!
যখোন পৃথিবী আর দেশে দেশে দুরন্তু দুঃখের
দারুণ সত্তায় জেগে মরেনা অসহ্য মাথা কুটে!
তখোন আকাশ আলো হয়তো বা মিলে যায়, মেলে :
তখোন পৃথিবী হয়তো বার বার ফিরে পায় তারে!
তখোন তোমারে পাবো, দেখা হবে, ফের দেখা হবে।
ভালোবাসা
আবার এসেছি আমি। বসে আছি তোমার উঠোনে :
প্রোথিত শিকড় নিম্নে : উর্ধে তরু, পাতার প্রতীকে
ধুকে ধুকে আমি আজো অবকাশ, বসন্তবাতাস, ঋতু, সবুজ ঝালর
জানিনা কিসের কান্না : শিকড়ে ও সঘন বাকলে
তবু চলে স্ববিরোধ,-যদি চাই ব্রণমাটি, অন্তরীণ আঘাতে লবণ
তখোন আমাকে দেয় অনাবৃষ্টি ক্ষণত, বৈশাখের বিলোল দহন।
ভিতরে দ্বিধার ক্ষেত্র ও বাইরে তাই একা একা যতদূর পারি
নিজেকে নিবিষ্ট করি, শব্দে শূন্যে স্বভাবে ও অভাবে একক
তোমাতে স্থির হই–কিন্তু নীচে ভিন্নদেশ আমাতে চঞ্চল।
চেপে যাই! তবু এদিক অস্থিরতা, অন্তরালে এ কী ঝড় বয়!
ভাঙ্গে, খণ্ড খণ্ড করে যেনো সব নিয়ন্ত্রিত গোপন বিন্যাস
আমাতে লুকিয়ে ছিল : আজ তারা অকস্মাৎ এদিকে ওদিকে
খুলে পড়ে, পাখি, বীজ, অমরতা, লৌহবোধ, শক্তির বিকাশ!
আর আমি পড়ে থাকি একা একা দ্রবীভূত আত্মার কানন,
আমাকে দেখেনা কেউ ও না পুষ্প, না ফলশ্রুতি–অদৃশ্য হওয়ার
স্বেচ্ছাচার ধীরে ধীরে গিলে খায়-নিয়তিও আমাকে অস্থির
বধির বিনাশে রেখে ধাবমান, দ্যাখো ঐ, ঐ ধাবমান!
চাকা
হত্যা হয়, হীরা ভস্ম হয়, মেধা ঝরে যায়, তবু
কুমোরের চাকা ঘোরে,
চাকা ঘোরে হাজার বছর।
যুদ্ধের যাত্রায় সাজে মহাকাল,
ওলট-পালট করে কতনা শহর
সভ্যতার বুক থেকে খসে যায়
কতনা নহর, তরু, জলপাই, অভ্র, অবসর।
দেশে দেশে নিমখুন, গুমখুন কত,
ভূতে পাওয়া জ্বঘাতক, পাতক, বদমাশ,
হাঁস ফেলে ঘরে তোলে লাশ!
সে তবু সন্ধ্যায় আজো আলো তোলে
শিশুর সবুজ জন্ম তুলে নেয় কোলে!
সে তবু সত্তায় আজো পুষে পুণ্যবান
পতিত জমির মতো থাকে অপেক্ষায়
কবে যেনো এ কলুষ যায়!
হত্যা হয়, হীরা ভস্ম হয়, মেধা ঝরে যায়, তবু
কুমোরের চাকা ঘোরে
চাকা ঘোরে হাজার বছর!
অপমানিত শহর
আমার কোমরে আমি পুষতাম শখের কলস
কেউ জানেনা, মাঠে খড় নাড়া যখোন পোড়ায়
শস্য-শেষে, আমার আত্মায় কেন জন্মেছে উদ্ভিদ!
কিন্তু আজ কোমরে করাতকল,–আমি শুধু আমাকেই কাটি!
তোমরা আমাকে দিলে কঠিন কল্লোল, তামা লোহা ও পিতল!
কিছু রেয়নের সুতো, আর এই ম্লান জুতো, আর বেঁতো ঘোড়!
সুগন্ধী মানুষ নেই, মরে গেছে উদ্যানের খোঁপা!
নষ্ট হয়ে গেছো তুমি,–তুমিও কি হে গভীর বিদ্রোহের চাকা?
আমাকে ধারণ করে ধর্মহীন আজ ঐ দুর্মুখ জনতা!
সান্ত্বনা ফুলের নামে লৌহশলাকার শীষে ওরা
আমাকে বিদ্ধ করে শিশু নই, যীশু নই তবু
আমাকে ভোলায় আজ কৃত্রিম খেলনা, পশু খড় ও গর্দভ!
আমার এ বুকে আমি পুষতাম বকুল বাউল,
চেঁকিতে হেঁটেছি রৌদ্র, সহজিয়া ভোর আর কতনা সুন্দর
পাথরে পুষ্পিত নাচ চোখে নিয়ে দৃষ্টিতে দারুণ,
দেখেছি কি করে ফলে ভালোবাসা, স্নেহ প্রেম পাখির কুজন।
কিন্তু আজ আমাকে তোমরা দিলে নিয়ন্ত্রণ, কাঠের পুতুল
জীবিত বাকলে ঢাকা মরা সব মলিন সেগুন!
যদি যেতে চাই, তবে বাঁকা করে লোহার দেয়াল
আমাকে ঢোকাও আরো খর লৌহে লাশের জগতে!
গোলাপ এখানে লাশ, মানুষের লাশ,
কুকুর এখানে আজ হতে চায় কোমল হরিণ!
তাকাও এদিকে ক্ষত ঐ দিকে খুন, তুমি তাকাও–সময়
যেখানে মমতা নেই, মনীষার ছায়া নেই–আমার গমন!
আত্মা চলে যাই
ভাই আমার বোন আমার আত্মা চলো যাই
ঘর বাঁধি
মানুষে জন্মাই
মৈত্রী,
মমতার হাওয়া!
ভাই আমার বোন আমার ব্যথা চলো যাই
জাজ্জ্বল্যে জ্বালাই আলো,
কোথায় তলালো ওরা
চক্ষু মেলে চাই,
নাড়া বুনি,
খড়চালা
সাজাই গাথুনি,
এক যোগে শুনি
মোরগের বাক,
দীপ্তি সংরাগ যত,
অস্তমিত সূর্যের–শস্যের,
ফুটে আছে ঢের অতীতে কতনা!
ভাই আমার বোন আমার ঊষা চলো যাই
ব্যথিত এষণা!
ঐ দেখো ফ্যাক্টরীর ফুল
লোহা ও মাস্তুল
জটা দড়ি, পেরেকে বর্তুল
ঘামশ্রম, মানুষের ব্যাধি
অন্তর্ঘাতময়
ফুটে আছে কতনা প্রত্যয়
কত বোধি বুকের ভেতর
বোনে চট,
বোনে সমুদয়
ছুরি, লোহা, রক্তের জবাই!
কত না সে সুবেশী কসাই
কত রুদ্র জামা,
বিদ্রোহের ঠাঁই
কামিজে ও কনুইয়ে ছোবানো
মেঘে মেঘে
হয়ে গেলো ছাই!
তবুও তো ভাই
এই রক্তে এখনো সুস্থির
কত কিছু আছে–
ঊষার লহর নদী
হাওয়া, প্রান্তর
পৌরুষের স্বাধীনতা
প্রণয়ের ঘর
যা হারালো তাই!
ভাই আমার বোন আমার আত্মা চলো যাই
জাহাজে ভাসাই নদী
উড় উড় সমুদ্রের হাই,
চলো যাই।
শেষ মনোহর
সে আমার পাশে শুয়েছিল, বাঁশির মতোন বিবসনা।
তাকে আমি দেখেছিলুম কাঁদতে গুণীর হাতের বেহালার মতো
আর মাত্র কিছুক্ষণ : এর মধ্যে নক্ষত্র ফুরোবে :
এর মধ্যে শেষ হবে আমাদের আলিঙ্গন আমাদের অদ্রি চুম্বন।
পাতলা ঝাউয়ের মতো কেঁপে উঠলো কণ্ঠ তার
কেন তুমি এইভাবে, এরকম দিলে?
সন্তের শূন্যতা নিয়ে পাশ ফিরে শুই–একা শুই!
সে আমাকে হঠাৎ উন্নত স্বরে বলে ওঠে “অহিংস ঘাতক!”
বটেই তো, না হলে কি আমি আজ তার মতো কাঁদি?
মৃত্যু, হাসপাতালে হীরক জয়ন্তী
সারারাত হীরক জয়ন্তী নয়, সারারাত শুধু সৃষ্টি হলো!
মৃত্যু আর আশার আতশজালা ভেদ করে
অরেঞ্জ স্কোয়াশের মতো ফেনাওঠা আশেপাশে বৃক্ষদল :
মনে হলো এক একটি সবুজভুক সিংহের বাহিনী!
খেতে আসে হাসপাতালের লম্বা নাকে ভরা অকসিজেন!
খেতে আসে লীভার, যকৃত, সূর্য হৃৎপিণ্ডে লুকোনো আদিম!
সারারাত বৃষ্টি হলো! চুলখোলা সবুজ বৃক্ষের ক্ষীণ কটি অশ্লীল
গহ্বর থেকে
ধুম্রজাত লোনাজল, মাটি ও মর্মের মধ্যে লোহাখনি অন্ধকারে
সমুদ্রের তীব্র লোনা খর স্রোতে বুলালো সুপক্ক মৃত্যু!
তবু ঐ, ঐদিকে নিভন্ত হেডলাইট যেনো পাখির ডানার মতো
কাঁপছে বাতাসে!
সবদিকে অরণের স্বর! একটিও শিশিরের ফণীমনসা নেই!
কেবল মানুষ সর্বাঙ্গে মৃত্যুর কাঁটা
গলগণ্ডে ধুতুরার বীজ নিয়ে শুয়ে আছে রাতে!
কারো আদি নেই। কারো অনাদিও নেই!
মর্মক্ষুব্ধ চৈতন্যের বিশুদ্ধ অগ্নির কাছে প্রত্যেকের মৃত্যুর দলিল
ধীরে ধীরে বাজেয়াফত স্বাধীনতা চুক্তির মতোন পুড়ছে!
ধানের মতোন ঝরছে অভাবের যুবতী শরীর!
একদিন ছিল! যে বৃক্ষটি হাঁটতে পারেনা, হাতে সেলাইন
লবণাক্ত জলের পৃথিবী হয়ে যাব প্রাণ এখনো জীবিত :
তারও ছিল সবল সুঠাম দেহ। গ্রামে ইক্ষুক্ষেত, ধান!
ধবল গাভীর ওলানের মতো ঘন লেবুর পাতার বনে গুচ্ছ গুচ্ছ লেবু!
একদিন ছিল পলিমাটি :
ওগো দাত্রী শস্যকন্যা, সুখী হোক সমস্ত পৃথিবী!
একদিন ছিল প্রত্যূষের প্রবহ প্রসন্ন মন্ত্র,
আকাশের গোলক আগুন ধীরে জ্বলে উঠে পৃথিবীকে প্রাপ্য
মেটাতে।
কিন্তু আজ সেই শুদ্ধি নেই–
বৃদ্ধের মৃত্যুর পাশে খালি অকসিজেন নল, খালি সেলাইন!
মৃত্যুর প্রখর প্রাণে সে জানে না,
কত কোটি বঙ্গদেশ অভাবে ও অবক্ষয়ে তারই মতো মরছে অহরহ
সারারাত বৃষ্টির মরুর জ্বালা! আত্মার আতস কাঁচ ভেদ করে বৃক্ষগুলি
সবুজ জিরাফগলা তুলে আজ খেতে আসে উচ্ছিষ্ট মৃত্যুকে!
কাছে দূরে গীর্জাঘড়ি, পাখির শব্দের স্বর তবুও বৃষ্টিতে ভাসে :
কোনদিকে হিমালয়, বরফের উঁচুচাওয়া রবীন্দ্র ঠাকুর,
তবুও বৃষ্টি আসে জোরে!
এ বৃষ্টি কি নবজন্ম?
কিছুই জানিনা শুধু অকসিজেনের নল নাকে নিয়ে বসে থাকি জাগাতুর!
আর শব্দে টের পাই? একলক্ষ জিরাফ, হলুদ সাপ, সিংহের সবুজ দল
সমস্ত জীবন ভেঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে আমার ভিতরে।
সস্ত শান্তি ভেঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে মানুষের মনীষার শেষ বৈশিকে!
বলো তারে শান্তি শান্তি
বলো তারে শান্তি শান্তি হিরন্ময় পাত্রে ঢাকা বীজধান,
জলবাশি, সুস্বাদু রাখাল,
সূর্যতপা মাটির গভীরে গাঢ় গায়কী আকড়াই গ্রাম,
আকাশে আড়ালে নীলিমা :
শাদা কপোতের মতো বিস্তারিত রৌদ্র, রৌদ্রের ভোরাই
বলো তারে শান্তি শান্তি, জলের অতলে মাছ মুগ্ধ আঁশটে সঙ্কেত-শানাই
দেশ হোক দৈবদেশ, দৈব হোক হিরণ্যগর্ভের ফোঁটা ঋতু-আসনাই!
বসন্ত যেনো না কাটে আর ঘরে খাদ্যের সারিতে এত প্রতীক্ষায় ভাই!
ফুলঅলী, শান্তির আয়না-প্রতিফলনের, বলে চন্দন সবিতা পুনরায়।
বলো তারে আতর-লোবানগন্ধী এই বীজ পুস্পোদ্যানে, স্বর্ণচক্রে হয়ে যায়
যেন জ্যোতিশ্চ সব গৃহস্থের মাটির চিবুকে আজ ঘাসের রানার!
বলো তারে শান্তি নীল সূর্য, বিকাশে রেশম!
অমরতাতন্ত্র বুনে চলে যায় রৌদ্রে রৌদ্রে যুগান্তের হাওয়া যেই হোম
বলো তারে শান্তি হোক, ভালো থোক সব।
বোরোক্ষেতে ঝরাজল, আদিজল, জিউলীজল, শস্যজল বললো শান্তি হোক
আঙ্গুলে দুঃখের ক্ষতে কুমাখা ভিখিরিনী–তবু গাড়ী টানে,
জীবিকা এমন জয়ী, রোগ শোক দুঃখ জরা কুষ্ঠকেও কান ধরে আনে
বসায় কর্মের কুবলয়ে।
তার ছায়া পড়ে পিঠে যে মানুষ সুস্থ তার ক্রমানতি ক্ষয়ে!
বেঁচে থেকে তবু বরাভয়
আমার ছায়ার চক্ষু চষাক্ষেতে চেতন চিরায়ু চাষী বলে ওঠে ‘হয়’
এতো শোভাপুর,–আমি কি বলবো তাকে হে অমোঘ
হে পরিপ্রেক্ষিতের ভঙ্গী, হে দ্যুতি হে সুন্দরের খনিজ অমিয়, তবে
হোক
অভাবের পিঠে ভাসা লোনাজলে দুঃখিনীর ভেজা চক্ষু দেখে যাক
ধর্মের অশোক।
যে পঙ্গু চরায় গাই
ও আমার সহোদর, ও আমার বনভূমি ভাই!
বলো ওরে শান্তি শান্তি, বলো ঝিরি ঝিরি
তার মরমের খেলনা মাংসে মরি মরি
স্বর্ণখালা হয়ে যায় শান্তিতে যেনো সব স্বপ্ন বুরি বুরি!
বুকের বকুলে ঝরা কারখানা, লোহার লাংসের মধ্যে রচিত মেশিনে
আত্মবলিদানে আজো রক্তে কত খৃষ্ট ঝরে পেরেকে, লোহায়!
কতনা তমসা ভাসি জন্মে কত করুণার কাকস্য বেদনা হয়ে যায়
তবু বরাভয়
হে রক্ত, হে খৃষ্ট তুমি আত্মোৎসর্গী মেশিনের দোমড়ানো লোহা!
বলো তারে শান্তি শক্তি বলো আদিভাষা বলো ‘আলো হ’, ‘আলো হ’
মানুষের মৃত্তিকায় বীজধানে শস্যেমন্ত্রে এ আলো আভায়
ওগো শান্তি তোর কন্যা যেনো তোর রূপেগুণে আয়ুষ্মতি হয়।
এই বর দেই,
দুঃখের কণ্ঠে এই বর ছাড়া আর কিছু উজ্জ্বলিত নেই
দেয় তোকে তোর ব্যবহার,
যদি চাস দেই তোকে মৃত্যু লিখে আমার উজ্জ্বল উপহার!
তবু বল আছে
সব গিয়ে সব থুয়ে এখনা চুম্বনেচিতে
স্পর্শে হর্ষে শীতে আলিঙ্গনে শিল্পের শোভায়
কেউবা সফেন শান্ত চুপিসারে মানবিক লোক
মধ্যরাতে ঝাউকান্না কেঁদে বলে, শান্তি হোক, ওরে শান্তি হোক!
সম্পর্ক
তুমি নও, তোমার ভিতরে এক অটল দ্রাক্ষার
আসন্ন মধুর মদ, মাতোয়ারা বানায় আমাকে!
গেলাসে গেলাসে দিন–ঝরে পড়ি ঝর্ণা আয়োজনে।
তোমাকে চিনিনা আমি, বহমান তোমার দেহকে
দীঘল তরুর মতো বুনে দিয়ে তবু তার তিমির ছায়ায়
তোমার খোঁপার মতো তুলে আনি কিছু কালো ফুল!
বাজারে বিকোবো? না হে, এখন বাজারে এই শোক
কেনার পুরুষ নেই–ওরা কেনে অন্য সব স্মৃতি :
এখন প্রেমিক নেই, যারা আছে তারা সব পশুর আকৃতি!
জলসত্তা
হাঁটুজল পেরিয়ে এসেছি,-মানে প্রথম যৌবন
বৃক্ষের কুসুমদল জনসেবকের মতো ডাকছে এখন, যাবো
পেশ করতে হবে কিছু জরুরী সংবাদ, ছবি, প্রদীপের আলো।
আমাকে দাখিল করতে হবে কিছু কোমল গল্পের নক্সা
মানুষের ইতিহাস, অগ্রগতি, গোলাপের শিল্পের দলিল :
আমার শরীরে জাগো, হে তরল ধবলদুহিতা!
বুকজল পেরিয়ে এসেছি,-মানে পিতামহ, তাদের শতক!
পুরনো বকুল ভিটে বৈষ্ণবীর মতো ডাকে যাবো :
তাদের দেখাতে হবে হারানো আখড়ার ছাঁদ কীর্তনের গান!
আমাকে শোনাতে হবে সেই কবেকার এক সত্যমাথুর :
প্রবাহ নদীর প্রাণ,–নাবিকের দল ফিরে এসো,
আমার দু’পাশে আজ মরা ঢেউ, অভিভূত অন্য বন্দর!
গলাজল পেরিয়ে এসেছি, মানে জীবনের সকল সন্দেহ :
এখন অন্যেরা কার করুণার ভিক্ষা চায়—যাবো
তাদের গলায় দেবো আমার আরাধ্য মালা, সকলের ভালো।
আমাকে গ্রহণ করতে হবে সব মানুষের উত্থান পতন;
জয় পরাজয় বোধ, পিছু ফেরা সামনে তাকানো–
আমার অনলে আজ জাগো তবে হে জীবন, জয়শ্রী জীবন!
Leave a Reply