পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড) – বদরুদ্দীন উমর
(প্রথম প্রকাশ ১৯৭০)
(তথ্যসূত্র সংশোধন করা হয়নি)
উৎসর্গ
পূর্ব বাঙলার
ভাষা আন্দোলনসহ
অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সত্যিকার নায়ক
পূর্ব বাঙলার
সংগ্রামী জনগণের উদ্দেশে
প্রথম প্রকাশের মুখবন্ধ
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের কতকগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন ঘটনা এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক মূল্য এবং তাৎপর্যকে কখনোই সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে না। এই তাৎপর্য বিচার পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস ও তার শ্রেণী চরিত্র; পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী পর্যায়ে শ্রেণীসমূহের বিকাশ, বিন্যাস ও দ্বন্দ্ব; সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসূচীর মধ্যে তার অভিব্যক্তি – এ সমস্তকে বাদ দিয়ে কোনক্রমেই সম্ভব নয়। অন্য কথায়, আমাদের দেশের সামগ্রিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনকে বাদ দিয়ে যেমন অসম্পূর্ণ থাকে, ঠিক তেমনি ভাষা আন্দোলনের পর্যালোচনাও সেই পরিস্থিতি বাদ দিয়ে দাঁড়ায় তাৎপর্যহীন এবং অন্তঃসারশূন্য। বস্তুতঃপক্ষে পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন তৎকালীন রাজনীতির সাথে একই গ্রন্থিতে অবিচ্ছিন্নভাবে গ্রথিত এবং সেই অনুসারে পরস্পরের সাথে নিবিড় ও গভীরভাবে একাত্ম।
প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে ভাষা আন্দোলনের মুখ্যত দুটি পর্যায় – ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারী-মার্চ এবং ১৯৫২-এর জানুয়ারী-মার্চ। এই দুই পর্যায়ের আন্দোলনের মধ্যে সচেতনতা, ব্যাপকতা, সাংগঠনিক তৎপরতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে তারতম্য এত বেশী যে প্রথম দৃষ্টিতে এই তারতম্যকে মনে হয় গুণগত। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২-র মধ্যেকার এই তফাৎকে বুঝতে হলে মধ্যবর্তী চার বছরের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির খতিয়ান ব্যতীত তা কিছুতেই সম্ভব নয়।
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত, সাংস্কৃতিক আন্দোলনরূপে তার প্রাথমিক বিকাশ এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের উন্নততর পর্যায়ে তার উত্তরণের বর্ণনা এ বইয়ের প্রথম খণ্ডে সংক্ষিপ্তভাবে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম লীগ এবং কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা অনুসৃত নীতি ও তাদের আভ্যন্তরীণ সংকট সম্পর্কে কিছু আলোচনার প্রয়োজন অপরিহার্য। কারণ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই দুই রাজনৈতিক পার্টি ব্যতীত পূর্ব বাঙলায় প্রকৃতপক্ষে অন্য রাজনৈতিক সংগঠনই ছিল না। এবং এই দুই পার্টির শ্রেণী চরিত্র, তাদের অনুসৃত তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক লাইন, তাদের কর্মসূচী ও ভুলভ্রান্তি এবং সেই উদ্ভূত পরিস্থিতিই পূর্ব বাঙলার রাজনীতিকে নোতুন এক গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর স্থাপন করে। এগুলিকে কেন্দ্র করেই এক প্রান্তে মুসলিম লীগ এবং অন্যপ্রান্তে কমিউনিস্ট পার্টিকে রেখে পূর্ব বাঙলায় গড়ে ওঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণী সংগঠন। এই সমস্ত দল ও সংগঠন সম্পর্কে, তাদের উত্থানের পটভূমি এবং অনুসৃত নীতি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে মোটামুটি একটা আলোচনা ব্যতীত ভাষা আন্দোলনের চরিত্রের উপলব্ধি ও বর্ণনা সম্ভব নয়। এই বর্ণনাকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্যে দ্বিতীয় খণ্ডের শেষে একটা সামগ্রিক পর্যালোচনা সংযোজিত হবে।* (এই পর্যালোচনা তৃতীয় খণ্ডে সংযোজিত হবে।)
বইটিতে আমি কাগুজে তথ্য এবং মৌখিক আলাপ ও সাক্ষাৎকার এ দুইয়ের ভিত্তিতেই বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়েছি। কাগুজে তথ্য অর্থাৎ খবরের কাগজ, অন্যান্য সাময়িকী, পার্টিসমূহের দলিলপত্র, ইস্তাহার, পুস্তিকা ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য আমি বস্তুতঃপক্ষে ১৯৬৩ সাল থেকেই চেষ্টা করে আসছি। এ ব্যাপারে যখন যে সূত্রে কোন তথ্য সম্বলিত কাগজ পাওয়া সম্ভব সেখানেই আমি ব্যক্তিগতভাবে অথবা অন্যের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছি। অনেক ক্ষেত্রে নিরাশ হতে হয়েছে। কারণ যাঁদের কাগজপত্র থাকার কথা তাঁরা সেগুলির গুরুত্ব উপলব্ধির অভাব থেকেই হোক বা অন্য কোন ব্যবস্থা করতে সক্ষম না হওয়ার ফলেই হোক এমনভাবে সেগুলি রেখেছিলেন যাতে করে ১৯৫২ সালে এবং পরবর্তী ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের সময় সেগুলির সমস্তই নষ্ট হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশ বাড়ী তল্লাশী করে সেগুলি নিয়ে যায়। কোন ক্ষেত্রে কাগজের মালিক নিজেই পুলিশের ভয়ে সেগুলি পুড়িয়ে ফেলেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আবার তাঁরা যাঁদের কাছে সেগুলি গোপনে সংরক্ষণের জন্যে জমা রেখেছিলেন তাঁরাই পুলিশী আক্রমণ ও তল্লাশীর সম্ভাবনা কল্পনা করে সেগুলি অনাবশ্যকভাবে পুড়িয়ে দিয়ে নিজেদের কাপুরুষতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন। আমি যত জনকে তথ্যমূলক কাগজপত্র ইস্তাহার ইত্যাদির কথা জিজ্ঞেস করেছি তাঁদের অধিকাংশই এই শেষোক্ত কাহিনীই আমার কাছে বিবৃত করেছেন।
যাই হোক, এ সত্ত্বেও আমি কয়েক বৎসরের একটানা খোঁজাখুঁজির ফলে কিছু কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি। এ ব্যাপারে যাঁরা আমার সাথে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের প্রত্যেকের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ। দলমত নির্বিশেষে তাঁরা প্রত্যেকেই পূর্ব বাঙলার একটা অধ্যয়ের যথা সম্ভব তথ্যপূর্ণ ইতিহাস রচনার খাতিরে আমার সাথে সহযোগিতা করেছেন। এই সহযোগিতা আমি অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বন্ধু-বান্ধব এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের থেকে পেয়েছি, যার পূর্ণ তালিকা দেওয়া এখানে সম্ভব নয়। তবে এঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ না করলে এই বইয়ের ভূমিকা নিতান্তই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদের নাম এ ব্যাপারে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য। তিনি বহু ইস্তাহার ও রাজনৈতিক প্রচার পুস্তিকা এবং নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরী দেখার সুযোগ আমাকে দিয়েছেন। তাঁর ডায়েরীতে প্রতিটি দিনের একটি হিসাব আছে এবং সেটা থেকে বহু সভা-সমিতি ও ঘটনার সময় এবং তারিখ নির্ধারণ আমার পক্ষে সহজ হয়েছে। ছোট ছোট অনেক ঘরোয়া সভার বিবরণ এবং অংশগ্রহণকারীদের নামধামও তাঁর ডায়েরী থেকেই আমি পেয়েছি। এদিক দিয়ে ডায়েরীটির গুরুত্ব অপরিসীম। জনাব মাহমুদ আলী তাঁর সাপ্তাহিক পত্রিকা নওবেলাল-এর ফাইল আমাকে বিনা দ্বিধায় দেখতে দিয়েছেন। এই পত্রিকাটি ১৯৪৮-এর জানুয়ারীতে প্রকাশিত হয় এবং পূর্ব বাঙলার তৎকালীন পত্রপত্রিকার মধ্যে রাজনীতিগতভাবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নওবেলাল দেখার সুযোগ না পেলে তৎকালীন রাজনীতিতে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিবরণ সংগ্রহ করা আরও কঠিন ব্যাপার হতো। নানারকম দুর্বলতা সত্ত্বেও এ পত্রিকাটি সেদিক দিয়ে খুবই উল্লেখযোগ্য।
নওবেলাল প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পর তমদ্দুন মজলিশের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক সৈনিক আত্মপ্রকাশ করে। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ পত্রিকাটির ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। তবে তমদ্দুন মজলিশের সংকীর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে এর গুরুত্ব অনেকাংশে খর্ব হয়েছে। ভাষা আন্দোলনকে তমদ্দুন মজলিশের আন্দোলন হিসেবে চিত্রিত করতে গিয়েই পত্রিকাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। পত্রিকাটি দেখার ব্যাপারে অধ্যাপক শাহেদ আলী এবং বাংলা একাডেমীর গ্রন্থাগারিক জনাব শামসুল হক আমাকে সাহায্য করেছেন। কলকাতার পত্রপত্রিকাগুলি থেকে আমাদের নির্দেশিত প্রাসঙ্গিক অংশগুলি কপি করে পাঠিয়েছেন জনাব সৈয়দ হোসেন রেজা। তার এই অমূল্য সহযোগিতা না পেলে যে কি অসুবিধা হতো এ বইয়ের পাঠকমাত্রই তা উপলব্ধি করবেন। দৈনিক আজাদ থেকে বিশেষ বিশেষ অংশ কপি করার ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আব্দুল কাদের ভূঁইয়া এবং স্নেহভাজন সাইফুল ইসলাম। ১৯৫২ সালের ইত্তেফাক থেকে নির্দেশিত অংশসমূহ কপি করার ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করেছেন সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদের গ্রন্থাগারিক জনাব নুরুল হক চৌধুরী এবং অধ্যাপক শামসুল আলম। দৈনিক মর্নিং নিউজ-এর সম্পাদক জনাব সৈয়দ বদরুদ্দীন মর্নিং নিউজ-এর ফাইল ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেন। এদের প্রত্যেকের কাছেই এই সব সহযোগিতার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
পত্রপত্রিকা ছাড়া অন্যান্য তথ্যমূলক কাগজপত্র যাঁদের থেকে পেয়েছি তাঁদের মধ্যে জনাব আবদুল রশিদ খান, জনাব কমরুদ্দীন আহমদ, জনাব আতাউর রহমান (রাজশাহী), জনাব অলি আহাদ, জনাব শহীদুল্লাহ কায়সার, জনাব শফিউদ্দিন আহমদ, জনাব শামসুদ্দীন আহমদ, জনাব মাহমুদ জামাল জাহেদী, ডক্টর রশিদুজ্জামান প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে তোলা একটি ছবি প্রকাশের অনুমতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দিয়েছেন জনাব আমানুল হক (এ ছবি তৃতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হবে)। এঁদের সকলের কাছেই এই অমূল্য সহযোগিতার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। যাঁদের সাথে এই বই লেখার ব্যাপারে আমার সাক্ষাৎ আলাপ হয়েছে তাঁদের নামের একটা তালিকা শেষের দিকে দেওয়া হলো। অনেকে ব্যক্তিগত কারণে নাম উল্লেখ না করার অনুরোধ জানানোর ফলে তাঁদের নাম এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হলো না। কাজেই সেদিক দিয়ে তালিকাটি অসম্পূর্ণ।
মৌখিক আলাপ ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক সতর্কতা আমাকে অবলম্বন করতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অতিশয়োক্তি, নিজের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা, অন্যের ভূমিকাকে ছোট করার চেষ্টা এবং সর্বোপরি অনিচ্ছাকৃত
ভাবে অথবা দুর্বল স্মৃতির জন্যে অনেক ভুল ঘটনা বিবৃতিকে নানাভাবে যাচাই করে গ্রহণ ও প্রয়োজনে বাতিল করতে হয়েছে। কিন্তু আমার এই চেষ্টা সত্ত্বেও এর মধ্যে ভুল ত্রুটি অনেক ক্ষেত্রে থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। যাঁরা এ ব্যাপারে উপযুক্তভাবে ওয়াকেফহাল তাঁরা এ ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলে আমি বাধিত হবো।
ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন তাঁদের প্রত্যেকের ভূমিকা ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। কারও গুরুত্ব প্রথম দিকে এবং কারও শেষের দিকে বেশী ছিলো। কারও গুরুত্ব সব পর্যায়েই মোটামুটি উল্লেখযোগ্য হলেও বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে সেখানেও তারতম্য ছিলো। কাজেই ভাষা আন্দোলনে ব্যক্তি-বিশেষের সামগ্রিক ভূমিকা বুঝতে গেলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত পুরো সময়ের ইতিহাস আলোচনা ব্যতীত সেটা সম্ভব নয়।
ভাষা আন্দোলনের মৌলিক স্বতঃস্ফূর্ততা সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে তাতে যাঁরা কিছুটা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা অবশ্য পুরাতন আমলের নেতৃবৃন্দ নন। এই নেতৃত্ব যাঁরা দেন তাঁরা অল্পবয়স্ক এবং মোটামুটিভাবে এক নোতুন রাজনৈতিক চেতনারই তাঁরা প্রতিনিধি। কিন্তু এঁদের মধ্যেও কোন একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে আন্দোলনের নায়ক হিসেবে নির্দেশ অথবা চিহ্নিত করা চলে না। এ আন্দোলনের প্রকৃত নায়ক পূর্ব বাঙলার সংগ্রামী জনগণ। বইটির শেষে যে নির্ঘণ্ট সংযোজিত হলো সেটি তৈরি করার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছেন স্নেহভাজন সিরাজুল হক কুতুব, পিনাকী দাস, সালাহুদ্দীন আবুল আসাদ এবং জনাব আবদুর রশিদ খান।
তথ্যনির্দেশের উদ্দেশ্যে অনেক ক্ষেত্রে প্যারার শেষে ক্রমিক নম্বর দেওয়া আছে। এসব ক্ষেত্রে পুরো প্যারার তথ্যই একই সূত্র থেকে প্রাপ্ত বলে ধরে নিতে হবে।
বইটি লেখার কাজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে শুরু করলেও সেই বিখ্যাত বিদ্যাপীঠে বিভিন্ন অসুবিধার জন্য কাজ প্রকৃতপক্ষে কিছুই অগ্রসর হয়নি। এ লেখার কাজ আমি নোতুনভাবে শুরু করি ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে। অন্যান্য নানা কাজে ব্যাপৃত থাকলেও বইটির কাজও সেইভাবে চলে। এজন্যে সব সময়ে প্রথম খসড়াই পর্যায়ক্রমে লেখার সাথে সাথে প্রেসে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মধ্যে ছাপাখানার গণ্ডগোল ও হরেকরকম অসুবিধার জন্যে ছাপার কাজ বন্ধ থাকে এবং লেখাও সেই অনুসারে প্রায়ই স্থগিত থাকে। এইভাবে এক অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যে প্রথম খণ্ডের ছাপার কাজ শেষ করতে হয়। স্নেহভাজন আবু নাহিদ এবং আহমেদ আতিকুল মাওলা বইটি প্রকাশের দায়িত্ব নেওয়ায় এবং শেষ পর্যন্ত এটিকে ছেপে বের করার জন্যে তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
৫.১০.১৯৭০
দ্বিতীয় প্রকাশের মুখবন্ধ
এই দ্বিতীয় সংস্করণে আমি বিশেষ কোন পরিবর্তন করিনি। যে কয়টি ছোটখাটো তথ্যগত ভুল কেউ কেউ আমার কাছে উল্লেখ করেছেন অথবা আমার নিজের কাছেই ধরা পড়েছে সেগুলি হয় একেবারে বাদ দিয়েছি, নয়তো সংশোধন করে নোতুনভাবে লিখেছি।
দশম পরিচ্ছেদে পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকার কৃষক সংগ্রামের বর্ণনা এই খণ্ডে আমি একেবারে সংক্ষিপ্ত করেছি। নাচোল কৃষক বিদ্রোহের উপর যে অংশটি ছিলো তা একেবারে বাদ দিয়েছি। কারণ সানেশ্বর, নাচোল ইত্যাদি এলাকার কৃষক বিদ্রোহসহ পূর্ব বাঙলার তৎকালীন কৃষক আন্দোলনের অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত বর্ণনা দ্বিতীয় খণ্ডে দেওয়া হয়েছে।
এই খণ্ডের শেষে ‘পরিশিষ্ট’ অংশে আমার কাছে লেখা কবি জসীমউদ্দীনের একটি পত্র এবং অন্য কয়েকজনের একটি বিবৃতি সংযোজিত হলো।
১৯৭২ সালের শেষ দিকে এ বইয়ের প্রথম প্রকাশ নিঃশেষিত হলেও এতোদিন পর্যন্ত নানা অসুবিধা ও বাধাবিঘ্নের জন্য দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হতে পারেনি। বইটির এই দ্বিতীয় সংস্করণের উদ্যোগ ও দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আহমেদ মাহফুজুল হকের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
১২.১১.৭৬
চতুর্থ সংস্করণের মুখবন্ধ
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির প্রথম খণ্ড প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে। প্রকাশক ছিলেন মাওলা ব্রাদার্স এর আহমেদ আতিকুল মাওলা। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে আকস্মিকভাবে অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। আতিকুল মাওলার মৃত্যু বাংলাদেশের প্রকাশনা ক্ষেত্রে ছিলো এক বড়ো ধরনের ক্ষতি। তাঁর মতো রুচিশীল, সুবিবেচক ও সদ্ব্যবহারপরায়ণ ব্যক্তির অভাব আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি অনুভব করি। আতিকুল মাওলার পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আহমেদ মাহফুজুল হক এ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড ‘মাওলা ব্রাদার্স’ থেকেই প্রকাশ করেন। পরে তিনি ‘সুবর্ণ’ নামে একটি পৃথক প্রকাশনা সংস্থা করেন এবং সুবর্ণ’ থেকে প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণ, তৃতীয় সংস্করণ মাওলা ব্রাদার্স থেকে আবার প্রকাশিত হয় আতিকুল মাওলার অপর ভ্রাতুষ্পুত্র আহমেদ মাহমুদুল হক কর্তৃক। ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’র তৃতীয় খণ্ড চট্টগ্রামের ‘বইঘর’ থেকে প্রকাশ করেন সৈয়দ মহম্মদ শফি।
বহুদিন থেকেই আমার ইচ্ছে ছিলো, এ বইটির তিনখণ্ড একই প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশের। কারণ একটি বইয়ের একাধিক খণ্ড একাধিক সংস্থা থেকে বের হলে অনেক অসুবিধা হয়। শেষ পর্যন্ত তিন খণ্ড একত্রে একসঙ্গে প্রকাশ করছেন জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন। ভাষা আন্দোলন এ দেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা যার গভীর প্রভাব পরবর্তী প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের মধ্যেই দেখা গেছে এবং যার গুরুত্ব এখন পর্যন্ত কমেনি। সে দিক থেকে শুধু ইতিহাসের পাঠকদের কাছেই নয়, সাধারণ পাঠকদের কাছেও এখনো পর্যন্ত পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা নিঃশেষিত হয়নি। এর অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, এই বইটিতে শুধু ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলীর ইতিহাস ও তার পর্যালোচনাই নেই, আমি সমকালীন সব উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস ও পর্যালোচনাও সংক্ষিপ্তভাবে এর অন্তর্ভুক্ত করেছি। কাজেই পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতিকে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাঙলার সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসও বলা যেতে পারে। আমি যখন এ কাজ শুরু ও শেষ করি তখন পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে আবেগ ও উচ্ছ্বাসের কোন অভাব না থাকলেও এ বিষয়ে ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারী নামে হাসান হাফিজুর রহমান কর্তৃক প্রকাশিত সংকলনটি ছাড়া উল্লেখযোগ্য আর কিছু প্রকাশিত হয়নি, যদিও সে সময় একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে অনেক বাৎসরিক সংকলন প্রকাশিত হতো। এখন বাৎসরিক সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে আগের মতো আর বের হয় না, তবে ভাষা আন্দোলনের ওপর অসংখ্য স্মৃতিচারণমূলক রচনা এবং অন্য বই এখন প্রকাশিত হয়েছে। এগুলির অধিকাংশের বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকলেও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা যে এখনো রয়েছে, এর থেকে তা সন্দেহতীভাবে প্রমাণিত হয়।
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির তিন খণ্ডেরই নোতুন সংস্করণ এক সাথে বের করার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন এর কমলকান্তি দাস ও মোরশেদ আলমকে ধন্যবাদ।
বদরুদ্দীন উমর
ঢাকা
২২.০১.১৯৯৫
huda
এইটা একটা অসাধারণ কাজ হইছে।