পূর্ণিমানিশীথিনী-সম (গল্পগ্রন্থ)
ভূমিকা
জীবনের অনেক পথ পেরিয়ে এসে আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে আমি ফিরে গিয়েছি আমার প্রথম জীবনে। তারুণ্য আর উন্মূল যৌবনের পথে পথে হেঁটেছি। ফ্লাস ব্যাকে চলে গিয়েছি প্রথম যৌবনের চেনা পথগুলোতে। যে পথে চলতে যেয়ে অনেক মানুষকে আমি দেখেছি। তাদের সাথে বিভিন্ন সময়ে পথে প্রান্তরে, রেলওয়ে স্টেশনে, নদীর ঘাটে, নৌকায়, স্টীমারে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। এইসব চেনা মানুষদের জীবন থেকে আমার গল্পের কাহিনীগুলো তুলে এনেছি।
‘পূর্ণিমানিশীথিনী-সম’ আমার প্রথম প্রকাশিত গল্পের বই। এই বইটির বেশির ভাগ গল্পই প্রেমের। যা কখনো নিজের জীবন থেকে . কখনো আশে পাশের পরিচিত মানুষের জীবন থেকে নিয়েছি। কাহিনীর সাথে কল্পনাও মিশ্রণ করা হয়েছে। স্থান কাল পাত্রও পরিবর্তন করেছি। গল্পগুলো পড়লে মনে হবে, বেশির ভাগ গল্পের নায়ক আমি। আসলে এই ‘আমি’ আমি নই। এই ‘আমি’ অন্য কেউ। আর বেশিরভাগ গল্পের সময়কাল যেহেতু প্রথম জীবনের। তাই সেই জীবন তারুণ্য আর যৌবনের কথা বলে।
তারুণ্যের সেই সময়গুলোতে রাত জেগে জেগে একসময় অনেক প্রেমের কবিতা লিখেছি। ভালোবাসার কথাও সাজাতাম গল্পের মতো করে। জীবনের পথ চলতে চলতে সেই কবিতাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। সেই সব গল্পের কথা, সেই সব গানের কথা আজ আর মনে নেই সবকিছু। জীবনের শুক্লপক্ষের কাল শেষ হয়ে গেছে। এখন চলছে কৃষ্ণ পক্ষের কাল। আঁধারে একাকী বসে খুঁজেছি কত চেনা মুুখ, শুনতে চেয়েছি কত কথকতা। দেখতে চেয়েছি রূপ লাবণ্য খচিত সেইসব মায়াময় মুখগুলো।
আমার হৃদয় ভেঙ্গে রক্তাক্ত হয়েছিল দুই হাজার পনেরোতে। মুখর করা কর্মময় জীবনের অনেক কিছুই কর্তন করি। ফেসবুকে স্টাট্যাস লিখি। সেখান থেকেই কিছু প্রেরণা পেলাম লিখতে। আমি আমার ফেসবুকের পাঠকদের কাছে ঋণী। তাদের উৎসাহ আর চাওয়া পাওয়া আমার লেখাকে সমৃদ্ধ করেছে।
আর একজনের কাছে আমার ঋণ আছে, সে আমার প্রিয়তমা পত্নী। লেখার ব্যস্ততার কারণে অনেক মধুর মধুর মূহূর্ত তাকে বঞ্চনা পেতে হয়েছে। কত প্রেমময় আবেগের টান প্রত্যাখ্যান করেছি। তার এই ত্যাগ আমার লেখার জন্যই। তাছাড়া সংসারের কোনো ভার সে আমাকে বহন করতে দেয়নি।
আরো একজনের কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি। তিনি আমার সহপাঠী বন্ধু আফজালুল বাসার। তিনিই আমার এই ‘পূর্ণিমানিশীথিনী-সম’ গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নৈপথ্য কারিগর হিসেবে কাজ করেছে।
— কোয়েল তালুকদার
৩০ নভেম্বর, ২০১৭ ইং, দক্ষিণখান, ঢাকা।
উৎসর্গ –
আমার মা রাবেয়া খাতুন
যিনি আমাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন,
আরেক মা লুৎফুন্নেসা
যিনি তাঁর স্নেহে জড়িয়ে রেখেছিলেন,
এই দুই মাকে।
দুজনেই দূর সাদা মেঘের ছায়ায়
আড়াল হয়ে গেছেন।
১ . পূর্ণিমানিশীথিনী-সম
নির্ঘুম রাত্রি দুপুরে মিত্রার চোখে ঘুম আসে না। বাইরে যতবার সে তাকিয়েছে, দেখেছে সেখানে অন্ধকার । বেদনাহত ঝাউগাছ দাঁড়িয়ে আছে নীরব পথের পথিকের মতো। হঠাৎ হুহু ঠান্ডা বাতাস এসে লাগে ওর গায়ে। শীতে আরো বেশী কাঁপন লাগে অস্থিতে। রক্তও হিমশীতল হয়ে যেতে থাকে , হিমোগ্লোবিনের ক্ষুধা আরো বেরে যায় ওর রক্তে। অস্থিও কেমন অসার হয়ে আসে।
মেডিসিনের ক্লাশে প্রোফেসর আবেদীন স্যার মিত্রাদের বলেছিলেন — মানবদেহে রক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান৷ এই রক্তের উপাদানগুলোর মধ্যে লোহিত রক্ত কনিকা বা RBC (Red blood cell) এর ভিতরে রয়েছে হিমোগ্লোবিন নামক এই প্রোটিন যার গুরুত্ব অপরিসীম ৷ এটি ফুসফুস হতে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বয়ে নিয়ে যায়৷ স্বাভাবিকভাবে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ পুরুষের জন্য ১৩ .৫ থেকে ১৭ .৫ এবং মহিলাদের জন্য ১২ থেকে ১৫ mg/dl৷ কিন্তু মেয়েদের যখনি তা ১০ এর নীচে নামতে থাকে তখনই তা ভাবনার কারণ হয়।
মিত্রা চোখ রাখে আকাশের দিকে। এই শহরে বাজছে — ‘ দূরে কোথাও দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে। ” মিত্রা ঘুমোতে চায়। কিন্তু ওর চোখে ঘুম নেই, কুয়াশা নামে ছেঁড়া ছেঁড়া, আর ঘুম যদিও আসে, তা দেহে অসে, মনে নয়। মন তার জেগে থাকে সেই মহানন্দা নদীর তীরে। যেখানে ছোটবেলায় চেনা তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত। যে তারাগুলোর নীচে মিত্রা আর নীল জেগে রইত। যার নীচে এখন শুধুই নীল থাকে, মিত্রা নেই।
ডাঃ আবেদীন স্যারের ক্লাশে মিত্রা জেনেছিল, লিউকেমিয়া কি? লিউকেমিয়া হচ্ছে, রক্ত বা অস্থিমজ্জার ক্যান্সার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর প্রধান লক্ষণ রক্তকণিকার, সাধারণত শ্বেত রক্তকণিকার অস্বাভাবিক সংখ্যাবৃদ্ধি। রোগটির নামই হয়েছে এর থেকে লিউক অর্থাৎ সাদা, হিমো অর্থাৎ রক্ত। রক্তে ভ্রাম্যমান এই শ্বেত রক্ত কণিকাগুলি অপরিণত ও অকর্মণ্য। রক্ত উৎপাদনকারী অস্থিমজ্জার মধ্যে এদের সংখ্যাধিক্যের ফলে স্থানাভাবে স্বাভাবিক রক্তকণিকা উৎপাদন ব্যাহত হয়।
একটু পিছনে ফিরে দেখা :
দিনটি কেনো এমন হলো সেদিন। কর্কট রোগের উপর রিসার্চ করবে কে কে? ক্লাশে জানতে চেয়েছিল আবেদীন স্যার। প্রথম হাতটি উঠল তারই সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী মিত্রার। ক্লাস শেষে কলেজের লম্বা কোরিডোর দিয়ে হেঁটে ক্যান্টিনে চলে যায় মিত্রা। গরম চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে চা খেতে খেতে সহপাঠী পান্না আর জয়ন্তীকে বলছিল — একদিন আমারও করব জয়, আমরাও করব জয় এই কর্কট ক্রান্তিকাল।
শহীদ মিনারের পাশ থেকেই রিকশা উঠছিল মিত্রা। একবার ফিরে তাকালো সে মিনারের সু-উচ্চ প্রান্তের দিকে। মা তার স্তনের দুধ পান করাচ্ছে তার কোলের শিশুকে। নভেরা আহমেদ তাই-ই বলেছিল। হ্যাঁ, তাই দেখতে পেল মিত্রাও। এই দৃশ্যটি দেখে ওর মন ভালো লাগার কথা। কিন্তু ভালো লাগেনি। মাথা ঝিমঝিম করছিল। কড়ই গাছের ছায়াতল দিয়ে রিকশাটি চলে যায় নিউ মার্কেট হয়ে জিগাতলার দিকে , যেখানে ওদের বাসা।
মিত্রা বাসায় এসে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ে। মা এসে জিজ্ঞাসা করে — ‘তোমার কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?
মিত্রা : না মা। আজ আমার মন ভালো লাগছে। আজ আমাদের ক্যানসার রোগের উপর ক্লাস ছিল। মা, আমি ক্যান্সারের উপর রিসার্চ করব। তুমি আমাকে দোয়া করবেনা মা?
মা মিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল — ‘অবশ্যই করব। তুমি একদিন ক্যান্সারের অনেক বড়ো ডাক্তার হবে। ‘
মিত্রা শুয়ে শুয়ে আবেদীন স্যারের ক্লাসের লেকচারের কথা মনে করছিল — লিউকিয়ামের লক্ষণ হচ্ছে, ঘন ঘন জ্বর হওয়া, প্রচন্ড দুর্বলতা ও অবসাদ, খিদে না থাকা ও ওজন হ্রাস, মাড়ি ফোলা বা খেতে থেলে রক্তক্ষরণ, ছোট কাটাছড়া থেকে অনেক রক্তক্ষরণ, স্ফীত যকৃত ও স্প্লীন, অস্থিতে যন্ত্রণা, স্ফীত টনসিল। ‘
কর্কটময় সেই একদিনের কথা :
আবেদীন স্যারই সমস্ত রিপোর্ট দেখে কষ্ট ভারাক্রান্ত চিত্তে বলে দেয়, তারই সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রীটির লিউকেমিয়া হয়েছে। মিত্রা যেহেতু চিকিৎসা বিঞ্জানের ছাত্রী তাই ব্যাপারটি ওর কাছে আর গোপণ থাকে না। আর এও জেনে যায়, কবে তার মৃত্যু হবে সে কথাও।
এই শহর জেগে আছে। জেগে আছে মিত্রার উন্মোলিত চোখ অন্ধকার পথের দিকে। মিত্রার কান্না পায়। কিন্তু কান্না তার আসে না, গলায় কেমন ঘড়ঘড় আওয়াজ হয়, যেন মৃত্যুর গাড়িতে চেপে স্বপ্ন-চাকায় শব্দ তুলে সে কোথায় চলেছে। সবই শান্ত- জমাট বাঁধা কালো রাত্রির নীরবতা এক পায়ে দাঁড়িয়ে ধুঁকতে থাকে।
মিত্রার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। নীলের কথা মনে পড়ে। ঘাসের ঘ্রাণ আর দখিনা বাতাসের কথা মনে পড়ে। আজ আর হয়ত সেই তারাগুলোর নীচে বাতাস নেই, ঘ্রাণ নেই, আছে শুধু জমাট বাঁধা অন্ধকার। মিত্রা ঘুমোতে পারে না। সে উঠে পড়ে। ধীরগতিতে চলা একজোড়া পায়ের আওয়াজ আসে কোরিডোর থেকে এবং সে অবাক হয়ে ভাবে এই যে তারই খেলার সাথী নীলের। যার চোখে কোন তারা নেই। সেই চোখে কোনো কথা নেই, রাগ নেই, আদর নেই। সেই তারাহীন চোখের ছেলেটিকেই মিত্রা ডাকে। মিত্রা হাঁটতে থাকে করিডোর দিয়ে, নাকি ধূসর প্রান্তর দিয়ে , সে বুঝতে পারে না। কোরিডরের শেষপ্রান্তে, হাসপাতালের নীচে ক্লান্ত সিকিউরিটি গার্ড তখন সমুদ্রের স্বপ্ন দেখছিল।
ডাঃ আবেদীন স্যার একদিন ক্লাসে বলেছিল — ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকমিয়া নির্ণয় করতে রক্তের কোষ পরীক্ষা, বায়োপসি বা হাড়ের মজ্জা পরীক্ষা করাতে হয়। এর চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, ক্যান্সারের ধরণ এবং ক্যান্সার শরীরে কতটুকু ছড়িয়েছে তার উপর। চিকিৎসা পদ্ধতির ভেতর আছে কেমোথেরাপি ( কিছু ওষুধের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধংস করা হয় ), রেডিও থেরাপি (যন্ত্রের মাধ্যমে রেডিও ওয়েভ ব্যাবহারের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধংস করা হয়), হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপন। মিত্রার আজ মনে হচ্ছে, সেগুলো সব মিথ্যা লেকচার ছিল।
কে বাজায় দূরে এই গান — ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণাধারায় এসো। সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীতসুধারসে এসো।
কর্ম যখন প্রবল-আকার, গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার,
হৃদয়প্রান্তে হে জীবননাথ, শান্তচরণে এসো।’
বাবা এসেছিল হাসপাতালে। মিত্রা ওর বাবার দু ‘হাত বুকে টেনে বলেছিল — ‘ বাবা তুমি আমাকে আমার সেই ছেলেবেলার গোদাগাড়ীর মহানন্দা নদীর তীরে নিয়ে যাও। ‘
বাবা : এমন করো না মামনি আমার! তোমাকে কালই নিয়ে যাব গোদাগাড়ীর সেই মহানন্দার তীরে। ‘
আজ এই গোদাগাড়ীতে উঠবে পূর্ণিমার চাঁদ। আজ এইখানে মিত্রা এসেছে। মিত্রাকে দেখতে ওর খেলার সাথীরাও এসেছে। এসেছে ওর কাজিন
নীল, যে ওর বাল্যসাথী ছিল। নীল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স করছে। ওরা সবাই মিত্রাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় গ্রাম, প্রাইমারি স্কুল, ছোট্ট খেলার মাঠ আর ঠাকুরবাড়ির ঝিলপুকুর। এই সব জায়গাতেই মিত্রার ছেলেবেলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
সন্ধ্যা রাতের আকাশে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। মহানন্দা নদীতে তখন কুলকুল স্রোত বইছিল। মিত্রা নীল কে বলে — ‘তুমি আমার হাত ধরে ঐ মহানন্দা নদীর তীরে নিয়ে যাবে? আমি তীরে বসে শুনব জলের শব্দ, আর দেখব রাতের যত তারা। ‘
মিত্রার মন আজ স্তব্ধ। সেই স্তব্ধতার আর্তনাদ শুনতে পায় সে। অাঁধার সুড়ঙ্গ বেয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে আসা আর্তনাদ। তারাহীন চোখের তারায় ছেলেটা তাকে ডাকে। সে নদীর কুলের দিকে পা বাড়ায়।
মিত্রার সে রাতে চোখে আর ঘুম আসে নাই। রাতের শিউলি গন্ধ বিলিয়েছিল বাতাসে। তারাগুলো মমতাভরে কাছে টেনে নেয় ওকে- দেয় শীতল জল, ঘাসের ঘ্রাণ আর দখিনা বাতাস। আর নীল মিত্রাকে গেয়ে শোনায়েছিল —
‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম।
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম .. .। ‘
২ . আনন্দমঠ
তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। আমার সহপাঠিনী ছিল দীপান্বিতা। ও প্রেম করে বিয়ে করেছিল তাদেরই পাড়ার নীলেশকে। নীলেশদের সোয়ারি ঘাটে পাইকারি মাছের আড়ত ছিল। পড়াশোনা করেছিল সে অস্টম ক্লাস পর্যন্ত। কাড়ি কাড়ি টাকা ছিল নীলেশদের। কিন্তু টাকা থাকলে কি হবে, নীলেশরা ছিল একটু গোয়ার গোবিন্দ টাইপের।
একদিন দেখি, দীপান্বিতা ক্লাশে আসেনি। পরের দিনও সে এল না। তারপরের দিনও না। এবং তারপরে কোনদিন আর দীপান্বিতা ক্লাসে আসেনি।
নীলেশ শরীর চিনত দীপান্বিতার। এক রাত্রে দীপান্বিতার ভিতর জৈবিক ভালোবাসার চাহিদা নাকি আদৌ ছিল না। কিন্তু সন্তান আসছে তার নেহাতই জৈবিক নিয়মে। নীলেশ তাকে বলাৎকার করেছিল। কি নিষ্করুণ সৃষ্টির এই রুঢ় নিয়ম। যা চায় না তাই আসে জীবনে।
দীপান্বিতার জন্য মন খারাপ লাগত। ক্লাসে এত গুলো মুখের মাঝে দীপান্বিতার মুখটি আর দেখা যেত না। কিছু ভালোলাগা, কিছু অন্তর মিশ্রিত টান আমাকে বিষণ্ণ করে রাখত। দীপান্বিতা আমার কেউ ছিল না। কিন্ত ওর জন্য আমার প্রাণ কাঁদত।
আমি পুরানো ঢাকার বাকরখানি খুব পছন্দ করতাম। দীপান্বিতা প্রতিদিন আমার জন্য বাকরখানি নিয়ে আসত ওর ব্যাগে করে । এইগুলি খেয়েই প্রায়ই কাটিয়ে দিতাম বিকাল পর্যন্ত। যদি কোনো দিন বেশি খিদে লাগত, তাহলে শহীদুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেয়ে , চাঁনখারপুল পার হয়ে হাজির দোকান থেকে পাতায় মোড়ান বিরিয়ানি কিনে এনে দুজন খেতাম।
যেদিন আমার পকেটে টাকা থাকত না সেদিন আগেই আমার মুখ দেখে বুঝতে পারত দীপান্বিতা। ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় ও যখন বাড়ি চলে যেত, তখন ভ্যানেইটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে আমার বুক পকেটে দিয়ে বলত, চাকুরি পেলে — পরে এ টাকা আমায় শোধ করে দেবে। এখন শুধু হিসাবটা ডাইরিতে লিখে রাখবে।
প্রায়ই দীপান্বিতা মন খারাপ করে ক্লাসে আসত। সবাইকে হাসি খুশি মুখ দেখাবার চেষ্টা করত। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম, ওর অন্তরের গভীর বেদনার কথা। আমি জানতে চাইতাম, কিন্তু কোনো কথা বলত না দীপান্বিতা। কান্না এবং দীর্ঘশ্বাস দুটোই বুকের গভীরে আড়াল করে রাখত সে। মাঝে মাঝে উদাস কোনো রাত্রি বেলা একাকী শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, জগতে এত মেয়ে থাকতে কেন এই অন্তর দুঃখী মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় হলো।
একদিন এক মেঘলা দিনের অসতর্ক মুহূর্তের কথা। কার্জন হলের সামনে সবুজ ঘাসের উপর দুজন বসেছিলাম। চুপচাপ আছি দুইজনই, কারও মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ দীপান্বিতা আমার হাত টেনে নিয়ে আঙুল ছুঁয়ে বলেছিল — ‘তুমি তোমার এই অঙুলি দিয়ে আমার সিঁথির সিঁদুর সব মুছিয়ে দাও।’ সেদিন কোনো সিঁদুর মোছা হয়নি। ঝমঝম করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল।
যেদিন ওর সাথে আমার শেষ দেখা হলো, সেদিন বুঝতে পারিনি এইটি হবে ওর সাথে আমার শেষ দেখা। আমরা বসেছিলাম, লাইব্রেরী বারান্দায়। আমাকে দীপান্বিতা বলেছিল — ‘কে যেন আমার চলাফেরা গতিবিধি অনুসরণ করে। এক অজানা আশংকা আমার মধ্যে। যদি আর তোমার সাথে কোনো দিন দেখা না হয়। ‘
আমার শিক্ষা বর্ষের বাকি সময়গুলোতে আর কোনো বন্ধু করিনি কাউকে। প্রতিদিন ক্লাশে আসতাম। পিছনের ব্রেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকতাম। দুপুরে প্রায় দিনই খাওয়া হতো না আমার । খেতে ইচ্ছাও করত না। ক্লাস শেষে একাকী শহীদ মিনারের সোপান তলে বসে থাকতাম। বসন্তদিনে ইউক্যালিপটাসের পাতা ঝরে পড়ত। পথের ধূলো উড়ত বাতাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চেনা পথ দিয়ে তারপরেও প্রায় দুই বছর চলেছি। কোথাও কোনো দিন আর দীপান্বিতার দেখা পাইনি। কার্জন হলের সামনে সবুজ লনের ঘাস, বাংলা একাডেমির বৃক্ষছায়া তল, কিংবা খাজা নাজিমউদ্দিনের মাজার প্রাঙ্গণের সোপান, বৃক্ষরাজি কেউই বলতে পারেনি, দীপান্বিতা এখানে আর এসেছিল কি না?
প্রার্থনার দিনগুলোতে প্রায় সন্ধ্যায় চলে যেতাম ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। শঙ্খ ধ্বনি বাজত সেখানে । আরতি হতো পূজার। কোনো দিন কোনো পূজার স্থলে দীপান্বিতার দেখা পাইনি। ধূপের গন্ধ বিষাদের ধূয়া হয়ে মন্দিরে মিলিয়ে গেছে। সকল পূজা শেষ হয়ে গেছে। আরতি থেমে গেছে। কিন্তু দেবীর দেখা আর মেলেনি।
শিক্ষা জীবন শেষ হয় একসময়। বৃটিশ সরকারের স্কলার্শিপের চিঠি আমি পেয়েছি। হঠাৎই বঙ্কিমের ‘আনন্দ মঠ’ বইটি নতুন করে আবার পড়বার ইচ্ছা হলো । কিন্তু ‘আনন্দ মঠ ‘ কোথাও খুঁজে না পেয়ে নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানে বইটি খুঁজতে যাই । বইটি পেলামও সেখানে।
বইটি কার ছিল জানি না। বইটি কিনে বাসায় এসে আনন্দ মঠের পাতা উল্টায়ে দেখছিলাম। প্রথম সাদা পাতাটি ছিল আংশিক ছেঁড়া। কোনো কিছু লেখা ছিল না তাতে। বইয়ের শেষ সাদা পাতার প্রথম পৃষ্ঠায় আবছা নীল কালিতে লেখা ছিল —
‘ বুড়িগঙ্গার ধারে নির্জন শ্মশান ঘাট থেকে
লাশ পোড়ানোর গন্ধ আসছে,
কার হৃদয় পুড়ছে ওখানে দাউ দাউ করে
বাতাস ভারী হয় কার ক্রন্দনে —
কে চলে গেল কাকে শূন্য করে দূরের পরপারে। ‘
আনন্দ মঠের শেষ সাদা পাতার অপর পৃষ্ঠায় লেখা ছিল —
‘সময়ের ব্যবধানে হার মেনেছি সময়ের সাথে
আজো বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে নিঝুম রাতে
মন খারাপের তো কয়েক হাজার কারণ থাকে
সত্যিই কেন যে দেখা হয়েছিল তোমার সাথে। ‘
———- দীপান্বিতা সেন।
প্রথম চরণগুলো উৎসর্গ করা ছিল স্বর্গীয় শ্রী নীলেশ সেনকে, আর দ্বিতীয় চরণগুলো উৎসর্গ করা ছিল আমাকে।
৩ . জীবন এত বড় কেনে
তখন কলেজে পড়ি। কলেজ বার্ষিকীতে আমার একটা লেখা দিয়েছিলাম। ছাপাও হয়েছিল তা। না ছিল সেটি কোনো গল্প, না ছিল অনুগল্প। না ছিল এর কোনো গঠনশৈলী। কোনো কিছুই আজ সংরক্ষণে নেই, না বার্ষিকীটি না লেখাটি। ছাপার হরফে ঐটি ছিল আমার জীবনের প্রথম লেখা। তাই প্রথম ভালোবাসার মতোই লেখাটির কিছু কিছু অংশ আজো মনে আছে। স্মৃতি উপড়িয়ে যতোটুকু মনে পড়ছে, তাই এখানে লিখলাম।
জীবন এতো বড়ো কেনে
মনে পড়ে মালতী, তুমি ছিলে নিতান্তই একজন বালিকা। তোমার দাদাজান আর আমার দাদাজান ছিল প্রাণের সখা। তাদের ইচ্ছায় এক পৌষ সংক্রান্তিতে বাড়ি ভর্তি মানুষ এল। বিসমিল্লা খাঁর সানাই বেজে উঠল। তোমাকে পরানো হলো বেনারসি লাল শাড়ি। আমাকে পরিয়েছিলো পায়জামা আর পাঞ্জাবি। সেদিন বালকও কিছু বোঝে নাই। আর বালিকা ভেবেছিল আজ তার পুতুলের বিয়ে।
তারপর পুতুলের খেলায় কাটতে থাকে বেলা। কেটে যায় মাস ও বছর। আমরা বুঝতে পারি, তুমি আর আমি কি? বুঝতে পারি, প্রেম কি, ভালবাসা কেন হয়? শরীর কি, তাও। মনে পড়ে মালতী, একবার চড়ুইখোল স্টেশনে বসে থাকতে থাকতে, পার হয়ে যায় গ্রীষ্মের এক দুপুর। সকালের লোকাল ট্রেন সেদিন আর এল না। রেললাইনের স্লিপার ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি কুমারখালীতে। বৃষ্টির মতো কপাল থেকে ঘাম ঝরে পড়েছিল। তুমি তোমার আঁচল দিয়ে সেই ঘাম মুছতে যেয়েও মুছে দিলে না। সেটি ছিল আমার প্রথম অভিমান।
দুজনেরই একবার ইচ্ছা হলো, এক সারা বিকেল কাটাব, শিলাইদহে রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়ির বকুলতলার ঘাটে। তুমি পরেছিলে সেদিন কুমারখালির সুন্দর একটি তাঁতের সবুজ শাড়ি। লালপেঁড়ে কাপড়ে তোমাকে লাগছিল কাদম্বরী দেবীর মতো। তুমি বললে, আমি কাদম্বরী না। বললাম, মৃণালিনী তবে। তুমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে। আমি বললাম – চলো মৃণাল, কুঠিবাড়ির চিলেকোঠার উপরে যেয়ে দুজন নিরিবিলি বসে থাকি। দেখি — দুরের পদ্মা। তুমি বললে — না। এটি ছিল আমার দ্বিতীয় অভিমান।
বাড়ি থেকে বলে এসেছিলাম, জগতি স্টেশনের কাছে মেহেরজান ফুফুদের বাড়ি যাব। তুমি স্টেশনে নেমে মত পাল্টালে। বললে — পদ্মা পাড়ে যাবে। বললে, দেখবে পদ্মার ঢেউ। আমি বললাম – এখন গ্রীষ্মকাল, ঢেউ নেই পদ্মায়। বললে — ছোট ছোট ঢেউই দেখব।
লোকাল ট্রেনে চলে যাই প্রথমে পাকশি। ওখানে একটি হোটেলে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে নেই দুইজন। তারপর রেললাইনের স্লিপার ধরে হাঁটতে হাঁটতে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের কাছে চলে যাই ।
দুজনই চেয়ে থাকি পদ্মার জলের দিকে। বড় কোনো ঢেউ নেই। নেই ছোট ছোট ঢেউও । মালতীর মুখখানি মলিন হলো। বললাম — দেখো, মাঝখানে চর জেগে আছে। ঢেউ নেই, কাশবন তো আছে। এই গ্রীষ্মে বনে ফুল নেই। যেন সব কাশ জঙ্গল হয়ে আছে। মালতিকে বলি — চলো, ডিঙি নেই। মুখে কোনো মলিনতা রেখ না। কাশবনের ঝাড়ে বসে সূর্যের উত্তাপ নেব আমরা । মাথার উপর উড়ৰে গাংচিল। এই পদ্মায় আজ কুবেরের নৌকা ভাসিয়ে দেবো। তুমি বললে — না। এখানেও আমার অভিমান হলো।
এক বরষামুখর দিনে আমাদের দক্ষিণ দুয়ারি ঘরের বারান্দায় বসে মালতীকে বলেছিলাম, আমাকে সংসার মুখো করো। ছোট ছোট পায়ে কেউ সারা ঘরময় ঘুরে বেড়াক। পোড়ামুখি সংসারভূক করেছিল আমাকে ঠিকই। কিন্তু কি এক অভিমানে সে অনেকদূরে চলে গেল একদিন। সেই থেকে আমিও তাই সংসার ছেড়ে দিলাম।
এই পৃথিবীর বনে বাঁদারে, পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াই। জীবনকে বড় বেশি দীর্ঘ মনে হয়। ভরা বর্ষায় পদ্মা পাড়ে গেলে বড় বড় ঢেউ দেখা যায়। জগতি স্টেশন থেকে আজো হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে চলে যায় দূরের কোনো স্টেশনে। কেমন যেন চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কেমন যেন ঘুম চলে আসে চোখে। ভালো লাগে না। প্রিয় তারাশঙ্কর, তুমি বলেছিলে — ‘জীবন এত ছোট কেনে? ‘ আমি বলি — হায়! জীবন, তুমি এত বড় কেনে?
৪ . মাধবী এসেছিল
দক্ষিণ দুয়ারে বসেছিলাম এক শরৎ সন্ধ্যায়। চোখের সামনে রাত নামতে থাকে। আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, আকাশ ভরা তারা। এমন করে একসাথে এত তারা দেখিনি কখনও। এ যেন ‘হীরা মুক্তা মানিক্যের ঘটা, যেন ইন্দজাল ইন্দ্রধনুর ছ্বটা।’
যেখানে বসেছিলাম পাশেই ছিল হাস্নাহেনার ঝাড়। কে যেন পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল সুবাস নিয়ে। এ কোন্ দিগবালিকা। যাকে আমি দেখেছিলাম আমার প্রথম স্বপ্ন প্রহরে। হাস্নাহেনার সকল মাধুরী সে ছড়িয়ে রেখে গেল চারদিকে। দূর থেকে নয়, কাছে যেয়ে তাকে চিনলাম, এ যে আমার সেই মাধবী।
সন্ধ্যাও উতলা হয় তার নীল শাড়ির হাওয়ার টানে
বাতাসে বাজে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ
পাখিদের গান সব থেমে গেছে রাতের আঁধারে
ভালোবাসার সুর খুঁজি মাধবীর বুকের খাঁজে
আমি তার চোখের দিকে চেয়ে থাকি
আমি তার মুখচ্ছবিতে দেখি জীবনের ছবি।
চারুকলা কলেজের আর্ট গ্যালারিতে সেবার শিল্পী শাহাবুদ্দীনের একক চিত্র প্রদর্শনী চলছিল। একদিন বিকেলে ইউনিভার্সিটির হল থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম এই প্রদর্শনী দেখতে। গ্যালারিতে শাহাবুদ্দিনের শিল্প কর্মগুলো দেখতে দেখতে একটি ছবির দিকে আমার চোখ আটকে যায়। এটি ছিল একটি পেইন্টিং। একজন রমণীর বিমূর্ত ছবি। মেয়েটির মুখ দেখা যায় না। শুধু পিছনের প্রোফাইল। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক সৈন্য কর্তৃক ধর্ষিতা এক রমণীর ছবি।
চারুকলার গ্যালারিতে ছবি দেখতে দেখতে একটি মেয়ে আমার মতোই থমকে দাঁড়ায় এসে এই ছবিটির পাশে। সেও চেয়ে দেখছিল শাহাবুদ্দীনের শিল্প কর্মটি। মেয়েটিকে একটু দেখলাম। কি অদ্ভুত সুন্দরে ছেয়ে আছে ওর শরীরে। ঈশ্বর কখন কাকে তৈরি করে তার উদাস মুহূর্তে, শিল্পীর মুগ্ধ করা কালির অাঁচরে। কেউ বলতে পারে না। গ্যালারির শেষ ছবিটি দেখে আমি যখন বাইরে মন্তব়্য খাতার পাশে এসে দাঁড়াই। দেখি, সেই মেয়েটিও সন্তর্পণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি কমেন্ট বুকে লিখেছিলাম — ”আমাদের নেই পাবলো পিকাসো, আমাদের নেই ভিনসেন্ট ভ্যানগগ, কিংবা যামিনী রায়। আমাদের আছে জয়নুল, আমাদের আছে শাহাবুদ্দিন, আছে সুলতান। এনসাইক্লোপিডিয়া ঘাঁটতে যেয়ে একদিন বিস্ময় চোখে দেখেছিলাম এ্যামেদিও মদিজিয়ালিনীর ‘Nude sitting on a Divan’ তার চেয়ে বড়ো বিস্ময়ে আজ দেখলাম, শাহাবুদ্দিনের নান্দনিক শিল্পকর্ম গুলি।” তারপর নীচে আমার নাম ও ঠিকানা লিখি।
আমি কমেন্ট টেবিল ছেড়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকি চারুকলার বারান্দা ধরে সামনের দিকে। মেয়েটি কমেন্ট টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, কি হয়ত লিখতে চেয়েছিল, কিন্তু লিখেনি। সে দ্রুত আমার পাশে চলে আসে। এবং বলে — ‘ আপনাকে আমি খুঁজছি অনেকদিন ধরে। ‘
আমি : আমাকে আপনি জানেন কিভাবে?
মেয়েটি : আপনি জানেন না, কিভাবে আপনাকে আমি জানতে পারি? সেই কবে থেকে আপনাকে চিনি আপনার কবিতায়। কত ছন্দ মিলিয়েছি আপনার গানের কথার সাথে। সেই থেকে বড়ো ইচ্ছা ছিল আপনাকে একবার দেখার। আজ আপনাকে দেখলাম।
আমি : আপনার নাম কি?
মেয়েটি : মাধবী।
এখান থেকে শুরু মাধবী পর্ব আমার জীবনে। নারিন্দা ওদের বাড়ি। সে ছিল হোম ইকোনোমিক্স কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। মাধবীকে ভালো লাগত আমার! মাথা ভর্তি কালো চুল! যার হাসিতে ভূবন জুড়ে আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়ত। চোখ ছিল পদ্মরাগের সৌন্দর্যের মতো মায়া ভরা। হঠাৎ অপলকে চোখ বিঁধে যেত সুরভিত বুকের খাঁজে। পদাবলীর ছন্দের মতো ছোট ছোট পা উঠিয়ে সে হাঁটত। ভ্রু যুগলের মধ্যিখানে অপরাজিতা রঙের টিপ্ পরত। হেনা স্যারের কবিতায় পড়েছিলাম — কমলা কোয়ার মতো তার ঠোঁট। কেমন যেন মাধুকরী রূপ ছিল মাধবীর।
আমার প্রথম স্বপ্ন গাঁথা মাধবী। একদিন রাত্রে পূরবীর দ্বারে বসেছিলাম বিহঙ্গের মতো আকাশের পানে —
সেখানে ধ্রুবতারা ছিল না, নিথর আঁধারে বসে ভাবনাগুলো ছিল আমার। ভাবছিলাম একি হচ্ছে জীবনের। প্রেম আমার। বিষণ্নতাও আমার। বিপণ্নতা যা আসে তাও আমার। যদি পরাজয় হয় ভালোবাসা — সেই গ্লানিও আমার। আমি মনে মনে মাধবীকে বলি –‘তুমি রাখো নাই কোনো সীমানা, নীল আকাশ আর নীলিমা তুমি এক করে দিলে।’
সলিমুল্লাহ হলের সামনের রাস্তার ফুটপাত ধরে রেইন ট্রির ছায়াতল দিয়ে হাঁটছিলাম আমি আর মাধবী। সেদিন দুপুরে বসন্তের রুক্ষ বাতাস ছিল। ভ্রান্ত নাকি উদ্ভ্রান্ত লাগছিল নিজকে, জানিনা। মাধবী বলছিল — ‘চলো যেয়ে বসে থাকি, অন্য কোনো ছায়াতলে।’ আমি বললাম, আমার খুব খিদে লেগেছে। আগে খাব।
মাধবী : তুমি যে খাবে, তোমার পকেট তো রেসকোর্স ময়দান।
আমি : তোমার অঞ্চলে বাঁধা আছে দৌলত।
মাধবী : তো কোথায় যাবে ?
আমি : মেডিক্যাল ক্যান্টিনে।
সেদিনের সেই বিকেল কেটেছিল রমনার নাগলিঙ্গমের ছায়াতলে। এক দুই তিন চার করে মুহূর্তগুলো পার হচ্ছিল লেকের ছোট ছোট ঢেউ তুলে। মাধবীর হাত নিয়ে নোখের গোলাপি রং তুলে ফেলেছিলাম আমার নোখের খোঁচায়। ওকে বলি, একদিন আফসানা লাগিয়ে আসো শাড়ির আঁচলে, একদিন হাতে পরবে রেশমি চূড়ি। একদিন দেবে চোখে কাজল। আর একদিন পরবে কাঁঠালি চাঁপার মালা তোমার খোঁপায়। মাধবী সেদিন মাথা নেড়ে আর মুখে হ্যাঁ বলে সম্মতি দিচ্ছিল আমার সব কথার। সন্ধ্যা নেমে আসছিল তখন। মাধবীর কানের কাছে মুখ রেখে কানে কানে বলছিলাম —
আমার দিনলিপিতে তোমার ছায়া পড়ে থাকে। মগ্ন চৈতণ্যে তোমার রহস্য জড়িয়ে থাকে। বেলাশেষের ভালোবাসা মিলিয়ে যায় সূবর্ণরেখায়। তোমাকে নিয়ে উৎসব করব, তাই যোগাড় করি কড়ি। নীলকন্ঠ পাখি উড়ে ধূসর আকাশে। তুমি অন্তবিহীন ভালোবাসা আমার। কখনোই তুমি অসম্পূর্ণ নও। তুমি অচেনা কোনো দেবীও নও! তুমি সত্যিই আমার মাধবী।
জায়গাটা যদি হয় রবীন্দ্র সরোবর! এর চেয়ে সুন্দর জায়গা ঢাকা শহরে সে সময়ে ছিল না। নীলক্ষেত থেকে রিক্সা নিয়ে আমরা চলে যাই মিরপুর রোড ধরে কলাবাগান। কাঁলাচাঁদ রেস্টুরেন্টে গরম সিঙ্গারা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে। কিছু কথা থাকে জলকে স্বাক্ষী রেখে বলতে হয়। বৃক্ষও শোনে এ কথা। সেদিন ছিল চৈত্রের দুপুর। মাথার উপর কড়ই গাছের ছায়া। বিপন্ন বসন্ত বাতাসে ঝিরিঝিরি মরা পাতা ঝরে পড়ছে। আজ কথা ছিল মাধবী মন ভালো করে দেবে । কথা ছিল আজ প্রাণ ভরে গান শুনব পাখিদের।
কোনো পাখি সেদিন গান করেনি উদাসী দুপুরে। পাড়ের দূর্বা ঘাস তপ্ত রোদে পুড়ে খাক হয়ে আছে। একটি পানকৌড়িও সেদিন জলে ভাসেনি। এইসব বিযণ্নতা নিয়েই মুখোমুখি বসে আছি আমরা দুইজন। আমিই মন ভালো করে দিতে চাই মাধবীর। জলকে সামনে রেখে মাধবীকে বলি —
‘বাড়িতে মা’র কাছে চিঠি লিখেছি। মা আসছেন। বড়ো বোন, দুলাভাই যাবে তোমাদের বাড়ি। তোমাকে দেখবে। তোমাকে আমার বউ করে ঘরে আনার সব কথা পাকাপাকি করে আসবে। ‘
সন্ধ্যা পর্যন্ত সেদিন রবীন্দ্র সরোবরে ছিলাম। আজও মাধবীর হাত কাছে টেনে ওর নোখের গোলাপী নেইল পালিশ মুছে দিচ্ছিলাম। মাথার একগুচ্ছ চুল নাকের কাছে টেনে এনে গন্ধ নেই। ওর কানের কাছে মুখ রেখে কানে কানে বলি —
” সবচেয়ে সুন্দর লাল কাতান শাড়িটি তোমার জন্য কেনা হবে। টিকলি, কানের দুল, গলার হার, আর হাতের চুড়িও বানানো হবে। কপাল জুড়ে আঁকবে আলপনা। হাতে পরবে মেহেদী, পায়ে মাখবে আলতা। জরোয়া জরানো থাকবে সারা গায়ে। খোঁপায় পরবে কাঁঠালি চাঁপার মালা। কি, বউ হয়ে তুমি আসবে না ঘরে? ‘
তখন ছিল সন্ধ্যার আলো আঁধার। মাধবী কোনো কথা বলল না। হয়ত তার কন্ঠ রোধ হয়ে এসেছিল। সে শুধু আমার বুকে মাথা রেখে অঝোর ধারায় কেঁদেছিল।
নাহ্, মাধবী আর আমার ঘরে বউ হয়ে আসেনি। পরে জেনেছি, সে ছিল বিবাহিতা।
এই পৃথিবীতে একজনই কি মাধবী থাকে ? দক্ষিণ দুয়ারে বসেছিলাম এক শরৎ সন্ধ্যায়। চোখের সামনে রাত নামতে থাকে । আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, আকাশ ভরা তারা। যেখানে বসেছিলাম পাশেই ছিল হাস্নাহেনার ঝাড়। কে যেন পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল। এ কোন্ দিগবালিকা। দূর থেকে নয়, কাছে যেয়ে তাকে চিনতে পারি — ‘এও একজন মাধবী, আমার মায়াবতী, আমার অনঙ্গ বউ।’
৫ . শিউলী কথা
পর্ব এক :
বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পরীক্ষার পরপরেই তূলানামুলক ভাষাতত্বের উপর উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য ক্যালেফোর্নিয়ার লস এ্যাঞ্জেলেসের একটি ইউনিভার্সিটি থেকে দুই বৎসরের স্কলারশীপ পাই । সব ফর্মালিটিস্ কমপ্লিট করতে সপ্তাহ খানেক সময় লেগে যায়। হাতে বেশি সময় ছিল না। তিন দিন পরেই ফ্লাইট। আমার এই সুখবরটি শুনে যিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন তিনি আমার এক স্কুলের শিক্ষক জনাব মোঃ ইদ্রিস আলী। যার বাড়িতে নন্ পেয়িং গেস্ট হিসাবে আমি পাঁচ বছর ছিলাম।
আমার এই শিক্ষক মহোদয়কে এই সুসংবাদ ও তার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য সকালের ট্রেনেই চলে আসি জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে। সেখান থেকে যমুনার কূল ধরে হেঁটে হেঁটে আড়াই মাইল দূরে উল্লা নামে একটি গ্রামে চলে যাই। নদীর পাড় ঘেসেই মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি। পথে আসছিলাম আর ভাবছিলাম, এই মাষ্টার মশাই ছাড়া এ জগতে আমার আর কেউ নেই। আমি যখন এখানে পৌঁছি, তখন বিকাল হয়ে যায়। বাড়ি পৌঁছে মাষ্টার মশাইকে সব কথা বললাম। এও বললাম কাল প্রত্যুষেই আমি চলে যাব।
এখানে এই নদীর কূলে একাকী কত মময় কাটিয়েছি। ভাটির স্রোতের টানে মাঝি মাল্লারদের কত গান শুনেছি। যমুনার জলে কত যে গা ভিজিয়েছি। এই বাড়ির পূর্ব পাশে দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে যমুনা নদী। খুব ইচ্ছা হলো, আরেকবার সব ঘুরে ঘুরে দেখতে। সারা বিকেল একাকী নদীর কুল ধরে হাঁটলাম। নির্জন নদীর পাড়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম অনেক কথা, মাস্টার মশাইয়ের কথা, ওনার স্ত্রীর কথা, তাদের কিশোরী মেয়ে শিউলীর কথা। আমি যখন প্রথম এই বাড়িতে আসি। তখন শিউলীর বয়স ছিল নয় দশ বছর। এখন চৌদ্দ পনরো হবে। অস্টম ক্লাশ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। আমাকে এই বালিকা আনেক সেবা করেছে। অনেক যত্ন সহকারে খাবার খেতে দিয়েছে। জ্বর আসলে মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছে।
নদীর কূল থেকে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে মাস্টার মশাইয়ের কাছে বসে কথা বলছিলাম- উনি বলছিল– ”আমার শরীরটা ভালো যাইতেছে না। কোনো ঔষুধ পত্র কাজে আসিতেছে না। যে কোনো সময় ইহলোক ত্যাগ করিতে পারি। আমার খুব ইচ্ছা ছিল শিউলীর সহিত তোমাকে বিবাহ দিতে। তুমি কাল প্রত্যুষে চলিয়া যাইবে। তুমি যদি রাজি হও, তাহা হইলে আজ রাতেই তোমাদের বিবাহের ব্যবস্থা করিতাম।’
এই পরিবারের কাছে, এই মাস্টার মশাইয়ের কাছে আমার অনেক ঋন আছে। এরা আমার মতো একজন অনাথকে অনেক স্নেহ করেছে। আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। নিজেরা কষ্ট করে আমার লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছে। আমি বেশি কিছু ভাবলাম না। বললাম- বিবাহের ব্যবস্থা করেন।
মেয়েটির গায়ে কোনো হলুদ দেওয়া হলো না। দূর্বা চন্দন ভিজিয়ে গোসল করানো হলো না। নতুন কোনো শাড়ি পরানো হলো না। হাতে মেহেদী দিল না। মুখে কেউ আলপনা আঁকল না, পায়ে আলতা মেখে দিল না। বুকে লাগানো হলো না কোনো সুগন্ধী। আমারও তাই। কোনো শেরোয়ানী পরলাম না। পাঞ্জাবীও পরলাম না। সানাই বাজল না। মসজিদের মৌলভী সাহেবকে ডেকে এনে ইসলামী নিয়মে আমাদের বিবাহ পড়ানো হলো।
সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল না। তারাগুলি জ্বলছিল নিষ্প্রভ হয়ে। রাতের যমুনায় কুলুকুলু শব্দ হচ্ছিল। বাইরে ছিল ঝিঁঝি পোকাদের গান। নীরব নিস্তব্ধ রাত্রি যেন চাপা কান্নায় গুমরিয়ে কাঁদছিল। দেখলাম শিউলী ওর মায়ের পুরানো একটি শাড়ী পরে চৌকির এক কোনে ঘোমটা টেনে বসে আছে। ভাবলাম, কাল প্রত্যুষেই চলে যাব। এই সরলা বালিকাকে আজ রাতের বঞ্চনায় রেখে কি লাভ ? কাছে যেয়ে বললাম-
আমি: তুমি কি খুশি ?
শিউলী: হে।
আমি : কাল সকালে চলে যাব। কষ্ট পাবে না ?
শিউলী : হে।
আমি: আমাকে মনে রাখবে না ?
দেখি শিউলী অঝোর ধারায় কাঁদছে। ঘোমটা খুলে ওর মুখখানি দেখলাম। কেরোসিনের শিখার আলো এসে মুখে পড়েছে। এর আগেও এই বালিকাকে অনেক দেখেছি। চন্দ্রালোকের সকল মাধূর্য আজ যেন মুখে লেগে আছে। ওর চোখে জল, তারপরেও আলপনাহীন মুখখানি হিরন্ময় লাগছিল। ওকে বুকে টেনে নেই।
সকালবেলা যখন বিদায় নিচ্ছিলাম তখন শিউলী বলেছিল – ‘আপনি আমাকে ভুলে যাবেন না।’
পর্ব দুই :
থাই এয়ারওয়েজের বিমানটি লস এ্যাঞ্জেলেসের লাক্স এয়ারপোর্টে অবতরণ করে। আমার থাকার ব্যবস্থা ছিল গ্রামের্সি প্লেসের একটি হোস্টেলে। এয়ারপোর্ট থেকে একটি ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই সেখানে। অচেনা শহর, কোনো সজ্জন নেই। পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে রিপোর্ট করি। ঠিক তৃতীয় দিনে ওয়েস্টার্ন বেলভিউতে রোড ক্রসিংএর সময় একটি লরি আমাকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দেয়। যখন আমার জ্ঞান ফেরে দেখি একটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। শুনেছি আমি নাকি একমাস অজ্ঞান ছিলাম। বেশ স্মৃতিভ্রম হয়ে গিয়েছিল। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়। বাম পায়ের হাড় ভেঙ্গে যায়।
হাসপাতালে আমাকে একটানা এক বৎসর চিকিৎসা নিতে হয়েছে। আমার স্কলারশীপ প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে যায়। হাসপাতালে মেক্সিক্যান বংশোদ্ভূত এক নার্স আমাকে নিবিড়ভাবে সেবা করে। সে ছিল পঞ্চাশোর্ধ এক বিধবা মহিলা, নাম রেবেকা উইন্টার। যেদিন আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়, এই রেবেকা উইন্টারই তার বাসায় নিয়ে যায়। সে আমাকে তার বাসায় রেখে সেবা করে। আমাকে ক্রাচে ভর করে হাঁটতে হতো। রেবেকা তার সারা জীবনের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ আমার চিকিৎসার পিছনে খরচ করে।
আমার পুরোপুরি স্মূতি ফিরে পেতে তিন বছর লেগে যায়। আসার পর থেকে বাংলাদেশের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারি নাই। আমি স্মরণে আনতে পারি নাই — মাস্টারমশাইয়ের কথা, শিউলীর কথা।
একদিন গীর্জায় গিয়ে খ্রীষ্ট ধর্ম মোতাবেক রেবেকাকে বিয়ে করি। আরো তিন বছর চলে যায় পঙ্গুত্ব অবস্থায়। ইতোমধ্যে রেবেকা ইহলোক ত্যাগ করেন। নিজেকে নিঃস্ব ও একাকী লাগছিল। ভাবলাম, আর কার জন্য এদেশে থাকব ? রেবেকাই নেই। আমি দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
পর্ব তিন :
ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমে কেমন যেন উদাস লাগছিল। এই শহরে একজন আপন মানুষ নেই যে সেখানে গিয়ে উঠব। পল্টনে একটি হোটেলে যেয়ে উঠি। ভাবলাম কাল সকালবেলাতেই মাস্টার মশাইয়ের ওখানে চলে যাব। ট্রেন চলছে জগন্নাথগঞ্জের ঘাটের দিকে। কামড়ার মধ্যে বসে ভাবছিলাম– শিউলী কি আমার কথা মনে রেখেছে? শিউলী কি আমার জন্য অপেক্ষা করছে? শিউলী কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?’ ট্রেন জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যেয়ে থামে। যমুনার কূল ধরে হেঁটে হেঁটে উল্লা গ্রামের দিকে চলতে থাকি।
তখন বিকাল হয়ে গিয়েছে। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির আঙ্গিনায় পৌঁছতেই দেখি কাঁঠাল গাছের তলায় একটি বালিকা দু’টি ছাগল ছানাকে কাঠালপাতা খাওয়াচ্ছে। পরনে তার সালোয়ার কামিজ। দেখতে একদম শিউলীর মতো। আমাকে দেখে বালিকা থমকে দাঁড়িয়ে যায়। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম– সেই শিউলীর চোখ, শিউলীর চুল, শিউলীর নাক, সেই চাহনি, সেই রকমই মুখের মায়া! আমি ওর কাছে যেয়ে বলি–‘ তোমার নাম কি ? মেয়েটি বলে- ‘রূপালী’। বলি -‘তোমার মায়ের নাম কি ?’ ও বলে- ‘শিউলী বেগম।’ আমার চোখ ছল ছল হয়ে ওঠে। ওকে বলি- ‘তোমার বাবার নাম কি ?’ রূপালী তখন আমার নাম বলে। রূপালীকে বলি–‘তোমার মা কোথায় ?’ বাড়ির ভিটার পিয়ারা গাছের তলা দেখিয়ে বলে- ‘ঐখানে মাটির নীচে শুয়ে আছে।’
আমাদের কথাগুলো শুনছিল বারান্দায় বসে থাকা এক অন্ধ বৃদ্ধা। উনি মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী। সে আমার কন্ঠ শুনে চিনতে পারে। রূপালীকে ডেকে বলে – ‘রূপা, তুই চিনতে পারছিস না ? উনি তোর বাবা।’ আমি রূপালীকে বলি– ‘মামনি আমার হাত ধরো, চলো ঐ পিয়ারা গাছের তলায়। তোমার মায়ের আত্মার শান্তির জন্য এসো আমরা প্রার্থনা করি।’
৬ . প্রথমা
তখন গভীর অন্ধকার রাত। বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝরছিল। রাস্তায় ফুটপাতে কোনো পথচারী নেই। নেই কোনো মাতাল ড্রাঙ্কারও । গলির মুখে কয়েকটি কুকুর নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে। রাস্তার শেয মাথায় একটি বাড়িতে টিমটিম করে তখনো আলো জ্বলছিল। হঠাৎ সেই বাড়ির ভিতর থেকে একটি মেয়ে বের হয়ে আসে। সে সন্তর্পনে হেঁটে হেঁটে এবং বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পরের গলির মুখে ঢুকে কোথায় যেন ছায়ার মতো মিলিয়ে যায়।
কি হয়েছিল সে রাতে, সেই বাড়িতে? সাদা এ্যাপ্রেণ পরা ছিল মেয়েটির গায়ে । ঐ বাড়িতে বসবাসরত একাকী লোকটি বলছিল মেয়েটিকে : সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য, কিন্তু তুমি এলে না।’ তারপর তৃতীয়ার চাঁদ ওঠে আকাশে। কিছুক্ষণ ছিল সে চাঁদ। তারপর ডুবে যায়। তারপর অন্ধকার হয়ে আসে। তারপর তুমি এলে। লোকটি মেয়েটিকে বলে –‘ তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন? কাছে এসো, কন্ঠলগ্ন হও।’
ষাটোর্দ্ধ বয়সী লোকটির দিকে মেয়েটি এগিয়ে যায়। এবং আবেগ মাখা কন্ঠে বলে — ‘তুমি আমাকে এত ভালোবাসো? এত আদর দাও, এত আদর চাও! আমি আজ অনেক ক্লান্ত! তারপরও আসো। কবে কখন শেষ চুম্বনটি হয়, কেউ কি জানে তা? এসো তুমি, কণ্ঠে তুলে নাও আমাকে। ‘
লোকটি : এসো আমার বাহুতলে। দুটো জীবনে বাজুক আজ আনন্দ সঙ্গীত।’
মেয়েটি চুম্বন উদ্যত ভঙ্গিতে লোকটির কাছে এগিয়ে যায় এবং হাত দুটি দিয়ে তার গ্রীবায় রংধনু বাঁকা রুপালি আচড় বসিয়ে দেয়। লোকটি চিৎকার করতে থাকে এবং ক্রমে সে চিৎকার গোঙানিতে রুপ নেয়। ব্রেড কাটার ছুরি মেজেতে ফেলে দিয়ে চলে যেতে যেতে মেয়েটি বলে — ‘ভালোবাসার সাথে প্রতারণা করলে পরিণতি এমনি হয়, যদি প্রণয় না থাকে। ‘
ফ্লাশ ব্যাক : পিছনে ফিরে দেখা
সেই দিনের বৃষ্টিমুখর রাতে স্টেশন থেকে ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ফিরছিলেন প্রফেসর সাহেব। জনমানবহীন গলির পথ। প্রফেসরের মনে হয়েছিল, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু পিছনের পথে কেউ ছিলো না। সে দ্রুত চলে আসে । বাড়ির গেটের তালা খুলে সে প্রবেশ করে ভিতরে। ঘরে ঢুকেই সুইস অন্ করতে বিছানায় বসে থাকতে দেখতে পায়, মিশনারী হাসপাতালের সিনিয়র নার্স অনিতা রোজারিও কে। অনেকটা বিস্ময়ে প্রোফেসর সাহেব বলে : কিভাবে ভিতরে প্রবেশ করলে তুমি?
অনিতা : পিছনের গোপণ দরজা তো তুমিই আমাকে চিনিয়েছিলে। আর একদিন আমার হাতে ডুপ্লিকেট চাবির গোছা দিয়ে বলেছিলে — ‘ এই চাবি তোমার, এ ঘর তোমার, এ নিঃসঙ্গ সংসারের সংগী তুমি। ‘
পড়ন্ত বিকেলের লাল আভার মতো ভালোবাসার আমন্ত্রণ নিয়ে প্রোফেসরই প্রথম এগিয়ে গিয়েছিল অনিতার কাছে । তার আগে জীবনের দুই যুগ ছিলো একাকীত্বের। একতারার টুংটাং সুরে কেটে গেছে অনেক প্রহর। নিঃসঙ্গ প্রহরের মুহূর্ত থামিয়ে দোতারার সুর তুলল এসে অনিতা রোজারিও। আজও বাহুলগ্ন করতে চেয়েছিল তাকেই কিন্তু রক্তাক্ত হতে হলো রাতের সকল নিস্তব্ধতা।
অবসরে প্রোফেসর সাহেব তার বাড়ির আঙ্গিনায় ফুলের বাগান পরিচর্যা করতো। তার প্রিয় ফুল ছিলো লাল গোলাপ। যৌবনের প্রথম লগ্নে এক শীতের সন্ধ্যায় একটি লাল গোলাপ খোপায় গুঁজে দিয়েছিল তার প্রথমাকে। সারারাত সতেজ করে রাখতে পারেননি সে ফুল। সকল পাঁপড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল রাতভোর। সকালে যখন ঘুম ভেঙ্গেছিল তার, শরীর থেকে কেবল গোলাপের গন্ধই আসছিল। তাইতো সন্ধ্যা হলে বাগান পরিচর্যা করতে গেলে হাত পা তার অবশ হয়ে থেমে যায়। প্রিয়তমা স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সে তার বাগানে একটি গোলাপও লাগায়নি।
প্রতিদিন চন্দ্র ওঠে, আকাশ ভরে তারা ওঠে। মেঘ হয়, বৃষ্টি নামে। বাতাস বয় খোলা প্রান্তর থেকে। পৃথিবীর কক্ষপথে চলতে থাকে গ্রহ নক্ষত্র তারা। কোনো কিছুই থেমে নেই। জীবনও থেমে ছিল না প্রোফেসর সাহেবের। কিন্তু এক অসতর্ক মুহূর্তে তার জীবন থেমে যায়। তিনি গিয়েছিলেন এক পাহাড়ী এলাকায় একটি কাজে। হঠাৎ সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভর্তি হন মিশনারী হাসপাতালে, আর সেখানেই তার জীবনকে থামিয়ে দেয় ঐ হাসপাতালের সিনিয়র নার্স অনিতা রোজারিও।
অনিতা ছিলো অনিন্দ্য সুন্দরী এক স্বামী বিচ্ছিন্ন রমণী। প্রোফেসর সাহেবের নিঃসঙ্গ আঁধারে থাকা জীবনকে আলো ছড়িয়েছিল সে। কিন্তু হতভাগ্য প্রোফেসর কখনোই সে আলো পছন্দ করেনি। জীবনের চব্বিশ বছর সে সন্ধ্যা বাতি জ্বালায়নি তার ঘরে। আঁধারে বসে থেকে, নিঃস্বিম অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকেছে। সারা মন প্রাণ জুড়ে জড়িয়ে থাকতো শুধুই তার প্রথমা। তার প্রথম প্রেম, প্রথম জীবন সঙ্গিনী।
এই প্রথমাই হলো কি তার জীবনের কাল? সেই রাতে সেই বাড়ির মেঝেতে প্রোফেসর সাহেবের শরীরের রক্ত গড়ে পড়ছিল অঝোর ধারায়। পুলিশ তদন্তে আসার আগেই তিরুপতি রেলস্টেশনের অদূরে ট্রেনে কাটা পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল অনিতা রোজারিওর দেহখানি। সেখানেও রক্তের ধারা বইছিল। তখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি ঝরে পড়ছিল।
৭ . সাগরিকা
সেই কবে একদিন বন্দরে জাহাজ এসে ভিড়েছিল। দেখেছিলাম, কিভাবে বন্দর জেগে উঠে কূলে। অসংখ্য মানুষ নামছে প্লাট ফরম ধরে । সবাই ডিনদেশি নারী পুরুষ যুবক যুবতি। সব অচেনা মুখ। যাত্রী নামতে নামতে জাহাজটি একসময় খালি হয়ে যায়। জাহাজটিতে এবার যাত্রী ওঠার পালা। কিন্তু হায়! আমি ছাড়া অন্য কোনো যাত্রী নেই । আমি যেয়ে বসি উপরে উন্মুক্ত কেবিনে। চারদিকে স্বচ্ছ কাঁচের বেষ্টনী। দূরে সফেদ জলরাশি, সারা আকাশ জুড়ে সীগাল চ্রিঁহি চ্রিঁহি করে ডাকছে।
নাবিক যখন জাহাজ ছাড়ার শেষ হূইসেলটি বাজিয়ে ফেলে, ঠিক তখনই দেখি — সাদা শাড়ি পরে একজন রমণী আমার মুখোমুখি এসে বসলেন। যেন —
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে। ” অনেকটা এই চিত্রকল্গের মতো তাকে আমিও দেখি।
জাহাজ কোন দিকে চলছে, কোথায় যাচ্ছে জানি না। শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম — দৃষ্টি সীমানা জুড়ে অসীম সমুদ্র। অতল শুভ্র জল ফেনায়িত হচ্ছে, সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে রূপালী সী গালের সাদা পালকের মতো জল। ঠিক তখনই সেই রমণী ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে’ আমাকে বলেছিলো, ‘ আপনি কোথায় যাবেন? ‘ আমি বলেছিলাম —
‘ সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে’ কিংবা যেতে পারি —
‘বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে’
কিংবা ‘ আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে। ‘
আমি তাকে বললাম,’ আপনি কোথায় যাবেন?’ সে তখন বলল– ‘তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানেই যাব। ‘ জানো, বাতাস আজ কানে কানে এসে বলেছিল , তুমি নাকি আজ একাকী সাগরে ভাসবে। তুমি একা থাকবে, তাই কি হয়? তাই চলে এলাম তোমার কাছে। ‘
আমি : কে তুমি? আমি তোমাকে চিনতে পারছি না ! কিন্তু চেনা চেনা লাগছে। তুমি কি বনলতা সেন?
মেয়েটি : না, আমি বনলতা সেন হবো কেন? আমি তোমার সেই সাগরিকা। যাকে তুমি ভালোবেসেছিলে তোমার পূর্ব জনমে।’
আমি ৰিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম সাগরিকার চোখের দিকে। এই চোখ আমি কবে দেখেছিলাম মনে করতে পারছি না। সমুদ্রের হিম শীতল বাতাসে ওর যে চুলের গন্ধ পাচ্ছি, তা বহু যুগ আগের পরিচিত কোনো পুরনো গন্ধ। আমি তাকে প্রথম দেখেছিলাম, গোমতী নদীর পারে। এলোমেলো চুল ছিল তার পিঠের উপরে। তখনো সেখানে দখিনের বাতাস ছিল। আমি মাতাল হয়েছিলাম তার চুলের গন্ধ নিয়ে। ‘
সাগরিকা হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। বলে – তুমি এসো, চলো ঐ রেলিং এর ধারে। দেখি ভূবন জুড়ে জলরাশি। ‘ রেলিং ধরে দেখছিলাম দুজন জলের উপর নীল আকাশ, আর আকাশের নীচে থৈথৈ করা পানি । রূপালী ডলফিন সব নৃত্য করছে। সাগরিকা একবার সমুদ্রের দিকে মুখ রেখে, আর একবার আমার দিকে চেয়ে গুনগুন করে গাইছিলো —
‘তুমি সাত সাগরের ওপার হতে আমায় দেখেছো
আর মন ভ্রমরের কাজল পাখায় ছবি এঁকেছো
আমি বলি :
আমি ময়ুর পংখি নাও ভিড়িয়ে তোমায় দেখেছি
আর প্রবাল দ্বীপের পান্না ভেবে চেয়ে থেকেছি
সাগরিকা :
আগুন ঝরা ফাগুন যখন ছিল পলাশ বনে
তোমার কথাই ভেবেছিলেম আমি মনে মনে।
আমি :
তোমার চোখে তাই তো খুশির পরাগ মেখেছি।’
আমি সাগরিকাকে বলি এখন তো গানের সময় নয়। এখন তো কোনো কথা বলবারও সময় নয়। এখন সাগরের ভাষা শুনব দুজন ! সাগরিকা তুমি কান পাতো ঐ জলের কাছে। ঐখানে জীবনের যতো সুর বাঁধা পড়ে আছে। ঐ অতল জলধিতে কি হারাবে তোমার প্রাণ? এবং আমারও।
সাগরিকা বলছিল, তোমার কি মনে আছে? অনেক আগের এক বসন্ত দিনের কথা? ময়নামতি থেকে আমরা দুইজন হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত পূর্ব দিকে চলে গিয়েছিলাম। দুইপাশে ধানক্ষেত ছিল, পথের উপর দূর্বা ঘাস ছিল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা গোমতীর তীরে পৌঁছে যাই। গোমতীর স্বচ্ছ নির্মল জল আজলা ভরে তুলে এনে তুমি আমার তৃষ্ণা মিটিয়েছিলে। ক্লান্ত দুপুরে আমি আমার মুখ রেখেছিলাম তোমার বুকে। তারপর নদী থেকে শীতল বাতাস এল। ছাতিম গাছে ঘুঘু গান গেয়ে উঠল। মেঘ ঢেকে দিল সেদিনের সব রোদ্র। তুমি আমায় তোমার বুকের ছায়ায় আগলে রাখলে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, তারপরও তুমি তোমার সকল ক্ষণ শেষ করতে চাওনি।
আমি সাগরিকার মুখের পানে চেয়ে আছি। মনে করি কতো বছর আগের সেই সব কথা? সেই মধু ক্ষণ আমার মনে পড়ে না। আমার ভাবনায় কেবল শুধু এই আজকের বিকেল। সাগরের জলে ভাসে রক্তিম আভা ঐ সূর্যের। যে হাওয়া আসছে সমুদ্র থেকে, তার দোলায় উড়ছে সাগরিকার অবিনস্ত চুল, উড়ছে তার শাড়ির আঁচল। আজ এই স্বর্নাভ বিকেল শুধু আমার আর সাগরিকার করে পেতে চাই —
‘হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় —
চিতা শুধু পড়ে থাকে তার,
আমরা জানি না তাহা; — মনে হয় জীবনে যা আছে। ‘
তারপর সেই সাগরের মাঝে সন্ধ্যা নেমে এল। সূর্য ভেসে ডুবে গেল লোনা জলে । সীগাল চ্রিঁহি চ্রিঁহি করে গান গেয়ে উড়ে চলে যায়। কত অরণ্যের আঁধার আমরা দেখেছিলাম, কতো অন্ধকার নেমে এসেছিল গোমতীর তীরে, ময়নামতির শালবনে ডুবেছিল শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। আজ যেন সে সবই নস্টালজিক। সাগরে নেমে আসা এই মনোরম সন্ধ্যায় সাগরিকার মুখখানি স্নিগ্ধ রূপ পেল। মনে হলো — ফিরে গিয়েছিলাম অনেক বছর আগের সেই গোমতীর তীরে। সাগরে নেমে আসা সেই সন্ধ্যায় আমার কাঁধে মাথা রেখে সাগরিকা গেয়েছিল এই গান —
‘বাতাসের কথা সে তো কথা নয়
রূপ কথা ঝরে তার বাঁশিতে
আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই
যেন দুটি আঁখি ভরে
রাখে হাসিতে।
কিছু পরে দূরে তারা জ্বলবে
হয়তো তখন তুমি বলবে।’
তারপর একে একে আকাশের সব তারা জ্বলে উঠল। আশ্বিনের পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে পূর্ব আকাশে। সাগরের জলে ভাসে যত ধ্রুবতারা। এই রাত কি আজ আমাদের হবে? ঐ চাঁদ কি দুজনের হবে? ঐ ধ্রুবতারা কি সাগরিকার কপালে জ্বলবে? জাহাজের রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজন। সাগরিকা খুব নিবিড় ভাবে আমার কাছে চলে আসে। দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে — ‘ ওগো, তুমি সেই আগের জনমের মতো আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। সেবার গিয়েছিলে, সে জন্য আমি আত্মাহূতি দিয়েছিলাম গোমতীর জলে। এবার তোমাকে অনেক সাধনা করে পেয়েছি। এবার আর তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে না। ‘
পূর্ণিমার চাঁদ হঠাৎ করেই যেন মেঘে ঢেকে গেল। কেমন অদ্ভুত এক আঁধার নেমে এল সারা সাগর জুড়ে। অনেকটা অন্ধকারে আমি সাগরিকার আনত মুখখানির দিকে তাকিয়ে বলি — ‘কিভাবে আমি তোমার হবো? আমার ঘরে লক্ষ্মী একজন মায়াবতী স্ত্রী আছে। ‘
সেই রাতে পূর্ণিমার আলো এসে সাগরিকার মুখে পড়েনি। তাই দেখা হলো না ওর মায়াবী মুখখানি। যে বাহুডোরে সাগরিকা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল, তা শিথিল হলো। কোনো কথা না বলে সাগরিকা আমায় ছেড়ে সরে দাঁড়াল। হঠাৎ যেন জগৎ জুড়ে নিকষ অন্ধকার নেমে আসে। রেলিংয়ের ওপাশে সাগরের জলে ঝাঁপ দেওয়ার একটি শব্দ শোনা গেল।
মানুষের জীবনে কখনো ভ্রান্তি চলে আসে । অতীতের অনেক কিছুই বর্তমানের জন্য সত্যি হয়। আবার কখনো সে সব স্বপ্ন হয়ে আসে। সাগরিকা কি শুধু স্বপ্নই ছিল আমার? বিশ্বাস করতে হয় তাই। যখন স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, জেগে দেখি — আমার স্ত্রীর একটি হাত জড়িয়ে আছে আমারই বুকের উপর।
৮ . আত্মার স্পন্দনধ্বনি
মানুষ মরে গেলে তার আত্মার কি হয়? কোথায় চলে যায় সে আত্মা? সেকি এই ইথারেই থাকে? কেউ তার অভিজ্ঞতা থেকে আজো বলতে পারেনি মৃত্যুর পরে আত্মা আসলে কোথায় যায়। কিংবা মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্ব থাকে কতোটুকু ? সেই আত্মার কি কোনো রকম অনুভূতি আছে? যেহেতু এটি মৃত্যুর পরের অৰস্থা, তাই এর কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা কেউ লিখে যায় নাই।
ক্লাশে কিংবা টিউটোরিয়াল ক্লাশে আহমদ শরীফ স্যার কিংবা সেই সময়ের তরুণ শিক্ষক হূমায়ূন আজাদ স্যার সিলেবাসের বাইরে অনেক কথাই বলতেন। তাঁদের অনেক বক্তব্যেই চিত্তকে আলোড়িত করত, মনের সিংহ দুয়ার খুলে যেত বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী বক্তৃতা শুনে। তাঁদের অনেক কথাই কোনো গ্রন্থে হয়ত লিপিবদ্ধ হয়নি। কিন্তু তাদের সেইসব মত ও পথ অনুসরণ করতে ব্যাকুল হয়ে উঠত আমার তরুণ মন।
আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল দর্শন শাস্ত্র। এই সাবসিডিয়ারি ক্লাশেই একদিন পরিচয় হয় সংস্কৃত ও পালি বিভাগের ছাত্রী কীর্তিকা পোখরেলের সাথে। কীর্তিকা এসেছিল নেপাল থেকে স্কলারশিপ নিয়ে। হালকা বাদামি বর্ণের চেহারার এই মেয়েটির লাবণ্য ছিল গৌরীয়, চোখ ছিল কালো, আর চুল ছিল কৃষ্ণ বর্ণের। অসম্ভব মার্জিত মনের মেয়ে ছিল কীর্তিকা। তার মননে ছিল কার্ল মার্ক্স, লেলিন, আর মাও সেতুং এর দর্শন। ওর সাথে যখন কথা বলতাম, তখন কোথায় যেন একটা অদ্ভূত মনের মিল খুঁজে পেতাম। ‘আমরা করব জয় একদিন ‘ এর মতো সত্যিই আমরা দু’জন একদিন ভালো বন্ধু হয়ে যাই।
ভিসি স্যারের বাড়ির পাশ দিয়ে, রেইনট্রির ছায়াতল দিয়ে, নির্জনতায় হাঁটতে হাঁটতে দু’জন প্রায়ই চলে যেতাম ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরীতে। ওখানে যেয়ে পড়তাম ঐ সময়ের সারা জাগানো যত বিখ্যাত বই। কীর্তিকাকে পড়তে দেখতাম বোভোয়ার, জন এ্যান্ডারসনের মতো দার্শনিকদের বই। আবার বায়রন, শেলী, সেক্সপীয়ার এবং বোদলেয়ারের বইও পড়ত সে। আমরা দুইজনই নেশার মতো সেইসব বই পড়তাম আর আলোচনা করতাম। পড়তে পড়তে ক্লান্তি চলে আসলে কখনো উঠে এসে বসতাম বারান্দায়। আমাদের সামনে থাকতো সবুজ ঘাস। আমি কীর্তিকাকে মাঝে মাঝে ফান করে আবৃত্তি করে শোনাতাম —
” দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস –
আকাশের ওপারে আকাশ।”
একদিন টিএসসি র ক্যাফেটেরিয়ায় বসে দুইজন লাঞ্চ করছিলাম। খেতে খেতে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিল আমাদের। তারপর দুজন চলে যাই পুলপারে। অনেকেই বসা ছিল সেখানে। আমরাও বসে থাকি বিকেল পর্যন্ত। কীর্তিকা বলছিল, মানুষের আত্মার কথা। বলছিল স্বর্গ আর নরকের কথা। কি এক মায়াবী চোখে বলছিল — ‘ এই যে তুমি আমি বসে আছি, কথা বলছি, এইসবই আমাদের আত্মার কথা। আমি যদি তোমার বুকে কান পেতে রাখি, আমি তার শুনব মর্মরধ্বনি। সে ধ্বনি কান্নারও হতে পারে, আনন্দেরও হতে পারে। আবার তুমি আমার বুকে কান পেতে ধরো, তুমিও শুনতে পাবে এইরূপই কোনো শব্দ । ‘
কীর্তিকা আরো বলছিল — ‘জানো স্বর্গ নরক বলতে কিছু নেই। মানুষকে ভালোবাসো, আত্ম পরিজনদের প্রতি খেয়াল রাখো, অন্নহীনকে অন্ন দাও, চিকিৎসাহীনতায় যে মানুষগুলো ব্যথা বেদনায় আর্তনাদ করছে, তাদেরকে একটু চিকিৎসা দাও। দেখবে এখানেই স্বর্গ সুখ পাবে। আর যদি তুমি এসব না করো, দেখবে তোমার চারপাশটা নরকের মতো মনে হবে। ‘
কীর্তিকা বলছিল -‘তোমার একটি হাত আমার হাতের উপর রাখো। আমাকে ধরে উঠাও। চলো দুইজন হাত ধরে এই পুলপারে হাঁটি। এখন পরিক্রমণের সময়। ক্লান্ত হবে না কখনো। আমাদের অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হবে।’
কীর্তিকা একবার গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে কাঠমান্ডু থেকে ঘুরে ঢাকা চলে আসে। আমি ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হোস্টেলে ওর রুমে যেয়ে দেখা করি। ছোট্ট কেটলীতে ও নিজেই চা তৈরী করে। সাথে টোস্ট বিস্কুট। চা খেতে খেতে শুনছিলাম স্টেরিওতে বাজানো টেরি জ্যাকের গান। ‘স্কিন্ভ আওয়ার হার্টস এ্যান্ড স্কিন্ড আওয়ার নিস’ এবং ‘সিজন ইন দ্য সান’ এ্যালবামের গানগুলো শোনার ভিতরে ডিলান আর বিটলসের মাঝে গুনগুন করছিল কীর্তিকা। আমি বলছিলাম, ‘তুমি ভারতীয় গণ সংগীত পছন্দ করো না?’
কীর্তিকা : করি। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকার গান আমার ভালো লাগে। হেমাঙ্গের আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগীত ‘ইন্টারন্যাশনাল’ ও রাশিয়ান সুরে তার গাওয়া ‘ভেদী অনশন মৃত্যু তুষার তুফান (গান) টি ‘In the call of comrade Lenin’ এর ভাবানুবাদ। এটি কমিউনিস্ট কর্মীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।’
কথায় কথায় কীর্তিকা বলছিল চারু মজুমদারের কথা।এই বিপ্লবী কম্যিউনিস্টের আদর্শ সে ধারণ করত। ওর বড়ো ভাই নেপালের পূর্বাঞ্চলে চারু মজুমদারের সশস্ত্র আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি এলাকায় সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্ব নেপালে ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করে । কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, নাগি রেড্ডি প্রমুখের সহযোগিতায় অত্র অঞ্চলে একটি কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন গঠিত হয়। কীর্তিকার ভাই এই কনসোলিডেশনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন কিসের যেনো ছুটি ছিল। কীর্তিকা আমাকে আগের দিনই বলে রেখেছিল, আমি যেন ওর সাথে দেখা করি। আমি কলাভবনের সামনের সিঁড়িতে বসে ছিলাম। কীর্তিকা আসে অনেকটা ক্যাজুয়াল ড্রেস পরেই। ও আমাকে বলছিল, আমি একটু গুরুদ্বুয়ারা নানক সাই এর মন্দিরের ভিতরে যাব। তুমিও চলো আমার সাথে। আমি বললাম – ‘আমাকে তো ঢুকতে দেবে না। ‘ ও বলল – ‘আমার সাথে চলো, ঢুকতে দেবে।’
কীর্তিকা কোনো ধর্মই অনুসরণ করত না। কিন্তু ও আজ এই শিখ মন্দিরে প্রার্থনা করল। আমিও ওর সাথে প্রার্থনায় মগ্ন ছিলাম।
মন্দির থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরী বারান্দায় যেয়ে বসি দু’জন। কড়ই গাছ থেকে অহেতুক মরা পাতা ঝরে পড়ছিল। আমি কীর্তিকাকে বলছিলাম – ‘তোমার কি আজ মন খারাপ? ‘
কীর্তিকা : না। তুমি কি এরিক সিগালের ‘লাভ স্টোরি’ বইটি পড়েছ? ‘
আমি : না, পড়িনি।
কীর্তিকা ওর ব্যাগ থেকে লাভ স্টোরি বইটি আমাকে দিয়ে বলে, ‘তোমার জন্য এনেছি। পড়ে নিও।’
আমি : আমি গতরাতে পড়ছিলাম কার্ল সাগান। আজ তুমি দিলে ‘লাভ স্টোরি’।
কীর্তিকা : আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম কাল রাতে। স্বপ্ন কেন আসে? যে স্বপ্ন কোনোদিন সত্য হবে না, সেই স্বপ্ন আমাকে দেখতে হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখব বলে হিমালয়ের পাদদেশে টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছি তুমি আর আমি। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা আর দেখা হয় নাই। দূরে অন্ধকারে দেখতে পেয়েছিলাম একাকী দুটি নক্ষত্র। ‘
আমি : স্বপ্ন তো স্বপ্নই। এর জন্য মন খারাপ করতে হয় না।
কীর্তিকা : আমাকে সিগারেট খেতে হবে।
আমি : খাও। তেমন কেউ আজ এখানে নেই।
বেশ কিছু দিন আমি কীর্তিকার সাথে দেখা করতে পারি নাই। আমারও ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল, ওরও চলছিল। পরীক্ষা শেষ হলে আমি হোস্টেলে ওর সাথে দেখা করতে যাই। দেখলাম, কীর্তিকা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। খুব মায়া হলো ওকে দেখে। ওর মনটা ভালো করার জন্য বললাম — ‘চলো সিনেমা দেখে আসি। মধুমিতায় চলছে ডি সিকার ‘টু ওমেন’। ছবিটি দেখলে তোমার ভালো লাগবে। ওয়ার ফিল্ম। যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইতালিতে ঘটে যাওয়া এক মর্মস্পর্শী ঘটনা যা মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাই নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্বসেরা এ চলচ্চিত্র।’
ছবিতে গীর্জার ভিতরে মা এবং তার এগারো বছরের মেয়ে দুইজনই নাৎসী সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। কীর্তিকা ছবিটি দেখছিল আর আমার কাধেঁ মাথা হেলান দিয়ে কাঁদছিল। ওর মন ভালো করে দেওয়ার পরিবর্তে মনটি আরো বেশি খারাপ করে দিয়েছিলাম। হল থেকে বেরিয়ে রিকশায় আসতে আসতে কীর্তিকা বলছিল,পরশু কাঠমান্ডু চলে যাব। আবার কবে আসব, জানিনা। নাও আর আসতে পারি। সার্টিফিকেট এ্যামবাসি থ্রো নিয়ে নিতে পারি। তুমি কাল একবার আমার হোস্টেলে চলে এসো।
রাতে আর ঘুম আসছিল না। শুয়ে শুয়ে কীর্তিকার শুকিয়ে যাওয়া মুখটির কথা মনে হচ্ছিল। বারবার শুধু এপাশ ওপাশ করছিলাম। রাতের শেষ প্রহরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি দুপুরের একটু আগেই কীর্তিকার রুমে চলে যাই। ওর রুমে বসতেই গুনি – স্টেরিওতে বাজছে, লুডভিগ ফান বেটোফেনের পিয়ানোর সুর।
কীর্তিকা বলছিল, এবার যেয়ে আমি কমুনিস্ট পার্টিতে পুরো দমে কাজ শুরু করে দেব। আমি সিন্দুলি, দুলাখা আর গুর্খা এরিয়াতে মেয়েদের সশস্ত্রভাবে সংগঠিত করবো। পার্টির পরবর্তী স্টেপ একটি জনযুদ্ধ। যা নেপালের রাজ শাসনকে কবর দেবে।
কীর্তিকা বলছিল — ‘আমার শরীরটা হঠাৎই কেমন যেন রোগাগ্রস্ত হয়ে গেল। দুর্গম পাহাড়ে পাহাড়ে কিভাবে কাজ করব? ‘
আমি : তুমি ওখানে যেয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবে। আর একটি কথা।
কীর্তিকা : কি কথা।
আমি : তোমার সাথে আমার আর কি দেখা হবে না?
কীর্তিকা : থাকব নিষিদ্ধ জীবনে। কি হয় বলতে পারি না। যদি জয়ী হই, যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে। আর যদি মরে যাই, তবে আর দেখা হবে না।
আমি কীর্তিকার হাতটি ধরি, বলি — ‘এই হাতে কি একটি চুম্বন দিতে পারি? ‘
কীর্তিকা : দাও। তুমি এত মন খারাপ করছ কেন, পাগল ছেলে! আরে, আমি তো আমার আত্মা তোমার বুকের মাঝেই রেখে যাচ্ছি। বেঁচে থাকলেও তোমার কাছে থাকবে, মরে গেলেও তোমার কাছে থাকবে। ‘
শুনেছি জনযুদ্ধে কীর্তিকা মারা গেছে। মানুষের আত্মা আসলে কি হয়? কীর্তিকা বলেছিল, ও মরে গেলেও নাকি ওর আত্মা আমার বুকের মাঝে থাকবে। হ্যাঁ, আমি আজো নিঃস্তব্ধ রাত্রি দুপুরে আমার বুকের মাঝে বেটো়ফোনের সুরের মতো কীর্তিকার আত্মার স্পন্দন ধ্বনি শুনতে পাই।
৯ . যা হারিয়ে যায়
কোনো একসময় প্রতিদিনই চিঠি আসত কণিকার। কোনো কোনো দিন তিন চারটি করে। এত ভালোবাসা আর এত ভালোলাগা থাকত সেইসব চিঠিতে। জীবন ভরে উঠত, হৃদয় দুলে উঠত। কতো ঝিম দুপুর পার করেছি এইসব চিঠি পড়ে। চিঠি হয়ে উঠত এক একটি কবিতার প্রহর । কণিকা কাকে ভালোবেসেছিল? আমাকে না আমার কবিতাকে? সে যখন লেখে —
প্রিয় সখা, তোমার ‘চোখ’ কবিতাটি পড়েছি। তুমি যে চোখ নিয়ে কবিতাটি লিখেছ সেটি কার চোখ ছিল? তুমি তো আমার চোখ দেখনি, কিভাবে মেলালে আমার ভ্রু। আমার চোখের তারা। লিখেছ, চোখের জলপতনের কথা। লিখেছ করোতোয়ার স্বচ্ছ জলের কথা। আমার চোখে নাকি স্বপ্ন আঁকা আছে। তুমি কোথায় পেলে সে স্বপ্নের রং। আবার লিখেছ, আমার চোখে নাকি কান্না মানায় না। ভূবন জোড়া হাসি দেখতে চাও। আমি স্বপ্ন দেখি দুই চোখ ভরে। স্বপ্ন দেখি তোমাকে নিয়ে। তুমি যে চোখে স্বপ্ন খোঁজো, আমি সেখানে খুঁজি মুক্তির স্বাদ। দিন আসে দিন যায়। রাত্রি আর ফুরায় না। আমি কি কোনো অনন্ত দূঃখের ছায়া দেখতে পাই। নাহ্ এসবই আমার দুর্ভাবনা। আমি তোমার স্বপ্ন হতে চাই। আমি তোমার দূরের মাধবী হয়ে থাকতে চাই না।
আমি লিখেছিলাম —
কণিকা, পড়তে পড়তে আমার ঘুম এসে যায়। লিখতে লিখতে ঘুম এসে যায়। তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে যায়। কালকে হেনা স্যারের পদাবলীর ক্লাসে রাধার বিরহবিধুর কথা শুনতে শুনতে ঘুম এসে গিয়েছিল। ঘুম আসুক, কিন্তু সে ঘুমে কোনো স্বপ্ন না আসুক। বন্ধন আমার ভালো লাগে না। জীবন যেভাবে চলছে, সেই ভাবেই চলুক। আমার সবকিছুই এলমেল, কোনোকিছুই সাজাতে চাই না। আমি যে পথে চলছি, সেই পথ চলা অন্তহীন। তুমি আমার যাত্রী হইও না।
কনিকা কি মনে করে লিখেছিল — ‘ আমি তোমার জন্য পথে নেমেছি। এই পথ মিলবে একদিন তোমারই পথে। পথের মাঝের এই ক্লান্তিকে তুমি থামিয়ে দিও না। আমার পথের মাঝে ফুল বিছিয়ে নাইবা রাখলে, কাঁটা বিছিয়ে রেখ না। আর যদি রাখো, সেই কাঁটা বিঁধেই আমি হাঁটব। রক্ত ঝরবে পথে, ঝরুক না। আমি একদিন ঠিকই পৌঁছে যাব তোমার বাড়ি। যদি তুমি তুলে নাও তোমার ঘরে।’
একটি চিঠিতে লিখেছিলাম —
তুমি করোতোয়া পাড়ের মেয়ে। যে স্বচ্ছ জল তুমি হাত দিয়ে ধরো, সে সৌন্দর্য তোমার। শিমুল পিয়াল থেকে যে ফুল ঝরে পড়ে, সে রক্তিম পাঁপড়ি তোমার। ফাগুনে যে জীর্ণ পাতা ঝরছে, সে মর্মরধ্বনি তোমার। বসন্ত রাতে জ্যোৎস্নার যে মাধুর্য, সে সিম্ফোণীও তোমার। এই শহরের রুক্ষ ইট পাথরের কথা তুমি শুনতে চাইবে না। অট্টালিকার ফাঁকে যে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, তা দেখে তুমি কখনোই তোমার দয়িতের জন্য আকুল হবে না। এখানে কখন শুক্লপক্ষ আর কখন কৃষ্ণপক্ষ হয়, তুমি জানতে পারবে না।
কি এক আবেগ ছিল তার, কি এক ভালোবাসার টান ছিল কণিকার। একটি চিঠিতে সে লিখেছিল — ‘আমার আর সালোয়ার কামিজ পড়তে ইচ্ছা করে না। আমার মাথায় ঘোমটা দিয়ে শ্বশুরবাড়ির উঠোনে হাঁটতে ইচ্ছা করে। কুয়া পার থেকে কলসীতে জল তুলতে ইচ্ছা করে। তুমি সোহাগপুরের হাট থেকে একটি সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি কিনে এনে দেবে। আমি সাধারণের মতো করে পরবো সে শাড়ি। করোতোয়ার স্বচ্ছ জল কলসী ভরে আমি নিয়ে যাব তোমাদের বাড়ি। যমুনায় মিশাব সে জল। তুমি কি আমাকে পাগলি ভাবছ। আসলেই হয়ত তাই। এসবই আমার ভাবনার কথা। তুমি হাসবে না। এ যে আমার ভালোলাগার কথাও।’
কণিকা, এইভাবে স্বপ্ন দেখ না। যদি সব স্বপ্ন একদিন ভেঙে যায়, সেদিন কার কাছে এসব স্বপ্নের কথা বলবে। তুমি কবিতাকে ভালোবাসো, কবিতাকেই বাসো। আমাকে না। আমি বিহঙ্গের মতো ঘুরে ফিরি নীল আকাশের মেঘের নীচে। কখনো হয়ে যাই ডানামেলা গাংচিল সমুদ্রের। রাতের নিবিড়ে সাগরের শব্দ শুনি। তোমার ওখানে আছে হেমন্তের চাঁদের রাত্রি। আমার আছে ঝলমলে নিয়ন বাতি। তুমি করোতোয়ার পাড়ে ভাটিয়ালী গান শোনো মাঝিদের। আমি বুড়িগঙ্গার পাড়ে যেয়ে শুনি অসংখ্য লঞ্চের কর্কশ ভেঁপুর শব্দ। আমার সাথে তোমার জীবন মিলবে না।
প্রিয় কবি, তোমাকে কেবল চিঠিই লিখে গেলাম। তোমার কন্ঠ কখনো শোনা হয় নাই। তুমি কেমন করে বলো – ‘ভালোবাসি’, বড়ই শুনতে ইচ্ছা করে এ জীবনে। তুমি যে গান লিখ সে গান আর কে শোনাবে। তুমি দেখতে কেমন, তোমার সে রূপ আমার অন্তরে গেঁথে আছে। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাকে যে দীপ জ্বালাতে হবে, তা তোমার সেই মূর্তিকে সামনে রেখেই জ্বালাতে হবে। এ এক অসীম বেদনার দীর্ঘশ্বাস। তোমার গায়ে সে তপ্ত বাতাস কোনদিনই লাগবে না।
কণিকা, রাত জেগে জেগে তোমাকে নিয়ে অনেক কবিতা আমি লিখেছি। তোমার শরীরবৃত্ত সাজিয়েছি আমি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। তোমাকে আমি কোনো দিন দেখিনি কিন্তুু তোমাকে দেখেছি আমার কবিতায়। তোমার কাজল কালো চোখ এঁকেছি প্রিয়তম শব্দগুলি দিয়ে। তোমার চুলের সুবাস নিয়েছিলাম কত দখিনা বাতাস থেকে। তোমার মায়াময় ঐ মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি কতো রাত। সবই যেন এক রূপকথা। মাঝে মাঝে মনে হয়, তোমাকে পেলে ভালোই হতো।সোহাগপুরের হাট থেকে শাড়ি কিনে এনে দিতাম তোমাকে । তুমি ঘোমটা দিয়ে হাঁটতে আমাদের বাড়ির উঠোনে। কিন্তু তা আর এ জীবনে হবে না।
প্রিয়তম, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করতে না করতে সে স্বপ্ন দেখা তুমি ভেঙে দিও না। আমি প্রায়ই করোতোয়ার নদীর পাড়ে বসে নিস্তব্ধ জল দেখি। কি নির্জনতা চারদিকে। আমি কান পেতে থাকি তোমার পদধ্বনি শোনার জন্য। জীবনের আর কোনো মধুর রাগিণী শোনা হলো না। প্রায়ই ভ্রান্তি হয়, তোমার গভীর আলিঙ্গনে উদ্বেলিত হই। তোমার বুকের গন্ধ লাগে আমার গায়ে। আচ্ছা বলো তো, জীবন এমন কেন? আমি কি বেশি কিছু চেয়েছিলাম? যাক, নাই বা হলে তুমি আমার। তোমার লেখা কবিতা আর গানগুলোই আমার জীবনের করে নেব।
তারপর কোনো এক সময়ে কণিকাকে আর খুব বেশি চিঠি লিখি নাই। কণিকা মাঝে মাঝে লিখেছে, কিন্তু তার আর উত্তর দেওয়া হয় নাই। শেষ যে চিঠিটি লিখেছিল সেখানে সে বলেছিল — ‘তুমি কি সত্যিই আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলে? তুমি আর আমায় লিখবে না? ‘ আমি সেই চিঠিরও উত্তর দিয়েছিলাম না। জীবনে এরকম কত মায়া এসেছে, এরকম কত কনিকা’ই তো চিঠি লিখেছে। একটা হেয়ালি অহংকার ছিল আমার। যে অহংকার করতে ভালোই লাগেত। এর জন্য কতজন যে চোখের জল ফেলেছে। আবার এজন্যে আমাকে অনুতপ্তও হতে হয়েছে। সব কিছুরই একটি প্রায়শ্চিত্ত আছে।
এমনি এক প্রায়শ্চিত্তের কথা বলছি। কণিকাকে আমি একদম ভুলেই গেছি। আমার কোনো কবিতায়, কোনো গানে সে আর ছিলো না। একদিন দুপুরে পোষ্টম্যান একটি চিঠি দিয়ে যায়। অনেক দিন পর কণিকার চিঠি। হঠাৎ পুরনো আবেগ প্রাণে দোলা দিয়ে উঠলো। আমি খুলে চিঠিটি পড়ছিলাম–
‘প্রিয়তম, জীবনকে হার মানাতে পারলাম না। আমার এই জীবন আমার একার নয়। এ জীবন আমার বাবা মা ভাই বোনদেরও। তাদের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে। তাদেরকে আমার সুখী করার দায় আছে। আগামী অগ্রহায়ণের সাত তারিখে আমার বিয়ে। তুমি তো আর বিয়েতে আসবে না। তুমি আমার সুখের জন্য শুধু প্রার্থনা করিও।’
সেদিন রুমেই সারা বিকেল শুয়ে রইলাম। চোখে আর ঘুম এল না। সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই লাইব্রেরী এলাকায় হাকিম চত্বরে। পর পর তিন কাপ চা খেলাম। তিনটি সিগারেটও খেলাম। আজ কোনো পরিচিত বন্ধুর দেখা পেলাম না। সন্ধ্যার পর রাতে হলে চলে আসি। মন ভালো লাগছিল না। হলের বন্ধু মমিনের রুমে যাই। দেখি ওরা তিন বন্ধু নীলক্ষেত থেকে মৃত সঞ্জিবনী সুরা কিনে এনে খাচ্ছে। ওদের সাথে আমিও বসে কয়েক পেগ খেলাম। তারপর রুমে এসে ঘুম দেই।
ছুটিতে বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে এসে শুনি, আমার এক কাজিনের বিয়ে। বগুড়ার মহাস্থানগড়ের এক গ্রামে। কনের নাম পারভীন আকতার কণিকা। আমাকে সে বিয়েতে বরযাত্রী হিসাবে যেতে হবে। গেলামও আমি।
করোতোয়া নদীর পারে ছায়া সুনিবিড় একটি গ্রাম। সেই গ্রামেরই মেয়ে কণিকা। ওকে দেখে চমকে উঠি, এ যে সত্যিই আমার সেই কণিকা। যাকে আমি কল্পনায় অনেক ছবি এঁকেছিলাম। কণিকা লাল বেনারসি শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। সে আমাকে চিনতে পারেনি। কি অপরূপ কবিতার মতো সুন্দরী মেয়ে। কি মায়াময় তার চোখ! আমি বিমুগ্ধ নয়নে ওকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, কণিকা তো আমারও বউ হতে পারত। জীবনে কত না পাওয়ার বেদনা আসে। সে যে আজ অন্য একজনের বউ।
কি এক দহনে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়িটির সামনে করোতোয়া নদীর তীরে চলে যাই। দেখি শান্ত আর স্নিগ্ধ নদীর জল। আমি একটি ঢিল ছুঁড়ি, জল আলোড়িত হলো। কিছুক্ষণ পরে আবার স্তব্ধও হলো। জীবনটা কি এই রকমই? এই আলোড়িত হয়, এই স্তব্ধ হয়।
১০ . মায়াদ্বীপ
বালক বয়সে এই কাহিনিটি আমার পিতামহের জেঠাতো ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তিনিও আমার দাদাজান হন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতবর্ষ জুড়ে তখন স্বদেশি আন্দোলন চলছিল। বাংলায়ও তখন এ আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠে। অরবিন্দ ঘোষ, গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে আন্দোলন উচ্চ মাত্রা পায়। উল্লেখ্য এই স্বদেশি আন্দোলনে একটি গ্রুপ ছিল সশস্ত্র। তাদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কারণে এই আন্দোলন একসময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আমার এই দাদাজান সশস্ত্র গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ওনার নাম ছিল শ্রীমান মফিজ উদদীন মন্ডল।
স্বদেশি আন্দোলন করতে যেয়ে সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের কারণে প্রায় তেরো জনের একটি গ্রুপকে তৎকালীন বৃটিশ সরকার শাস্তি স্বরূপ কালাপানি অর্থাৎ আন্দামান দ্বীপে দীপান্তরিত করে। তার ভিতর আমার দাদাজান শ্রীমান মফিজ উদ্দিনও ছিল। আমার দাদাজান ছিলেন তৎকালীন এন্ট্রান্স পাশ শিক্ষিত সুদর্শন এক যুবক। আসুন তৎসময়ের সেই যুবক মফিজ উদদীনের মুখেই তার সেই দীপান্তর জীবনের কাহিনিটি শোনা যাক —
৭ই ডিসেম্বর, ১৯১১ সাল। এম .ভি মহারাজ যখন কোলকাতা বন্দর থেকে ভোরে ভেঁপু বাজিয়ে ছাড়ে তখনও ভোরের সূর্য ওঠে নাই। জাহাজটি বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে দক্ষিণ পূর্ব অক্ষরেখার দিকে চলতে থাকে। আমার হাতে হাতকড়া, জাহাজের দোতলায় ক্যাবিনের মতো একটি কামড়ায় আরো পাঁচজন আসামির সাথে আমিও বসে আছি। আমাদের রুমের দরজার সামনে দুইজন নিরাপত্তা রক্ষী দাঁড়ানো। বাইরে তখন সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছিল। আমার খুব ইচ্ছা করেছিল বাইরের সূর্যোদয় দেখার । গভীর সমুদ্র থেকে সূর্যোদয় দেখা কয়জনেরই ভাগ্যে জোটে। আমি রক্ষী দুইজনকে বললাম — ‘আমাকে একটু রেলিংয়ের পাশে যেতে দাও। আমি জলে ঝাঁপ দিয়ে মরব না। এই সাগর, এই সূর্যোদয়, চারদিকে এত আলো, সাগরের এই নিনাদ, ডানা মেলা গাংচিল পৃথিবীর এত সুন্দরকে রেখে কেউ কোনো দিন মরতে চাইবে না। আত্মহত্যা তো নয় -ই। ‘
মহারাজ চলতে চলতে দুপুরের মধ্যেই ভারত
মহাসাগর টেরিটোরীতে ঢুকে যায়। আমি এর আগে দেখেছিলাম বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে সাগর কিন্তু কখনও দেখিনি গভীর সমুদ্রের মাঝে সমুদ্র। আমার হাতে শিকল পরানো, কিন্তু আমার ইচ্ছে হচ্ছিল দুই হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে। এ আমার শাস্তি নহে গো, এ আমার পরম পাওয়া। আমি দেখতে পাচ্ছি সৃষ্টির অসীমত্ব। হে প্রভু তুমি আমাকে অমরত্ব দাও এই জলধিতে। আমাকে তুমি মহান করো। ‘
এই মহারাজ জাহাজে রাজপুত্তুরের মতো বেশ আছি। দুপুরে কোরাল মাছের তরকারি, ভুবনেশ্বরের মিহি আতব চালের ভাত। চারিদিকে জলরাশি! এত সুখ এখানে, মনে মনে লুই মাউন্টব্যাটেনকে স্মরণ করছিলাম, বলছিলাম– তোদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। শাস্তি স্বরূপ পাঠিয়ে দিচ্ছিস কালাপানিতে। কিন্তু আমি তো উপভোগ করছি জীবন। পৃথিবীর এই অপরূপ রূপ না দেখলে জীবন অপূর্ণ থেকে যেত।
তারপর সমুদ্রে নেমে এল সেই সন্ধ্যা। রক্ষীদের বলি –‘তোরা আমায় এই রুমের ভিতর শিকল পরিয়ে রাখিসনে। আমাকে একবার শুধু যেতে দে ঐ রেলিংয়ের পাশে। যেতেও দেয় ওখানে। পানিতে চেয়ে দেখি হাজার হাজার রূপালী মাছ লাফাচ্ছে। আহা! আমি যদি একটিবার এই জল ছুঁইতে পারতাম। যদি ধরতে পারতাম একটি রূপালী মাছের পালক। চিলগুলোর দিকে চেয়ে ভাবছিলাম – এখানে এই অতলান্তিকে এত চিল আসল কই থেকে? রাত হলে উড়ে ওরা কোথায়-ই বা চলে যাবে? কোথায় নেবে ঠাঁই? ওরা কি ক্লান্ত হয়না?
আস্তে আস্তে সমুদ্রে রাত নেমে আসে। সাগরের শোঁ শোঁ গর্জনে মন কেমন যেন উচাটন হয়ে ওঠে। কেবিনের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। গভীর সমুদ্রে এমন চন্দ্র দর্শনে আত্মা আমার হিম হয়ে আসে। এমন মায়া মুগ্ধ রাতে আমার দুই চোখে সেদিন আর ঘুম আসেনি।
তিন দিন ধরে সাগরে ভাসতে ভাসতে চতুর্থ দিনের সকাল বেলায় মহারাজ জাহাজটি যেয়ে পৌঁছে কালাপানিতে তথা আন্দামান দ্বীপে। মহারাজ যখন কূলে নোঙ্গর করে, তখন দ্বীপে তাকিয়ে দেখি আন্দামানের পারিপার্শ্বিক দৃশ্য। কি সুন্দর সমুদ্রসৈকত ও ম্যানগ্রোভ অরণ্য। মুহূর্তেই এক উত্তেজক আনন্দের উপলব্ধির ঢেউ খেলে গেল অন্তরে। বিস্ময়কর ও চিত্তাকর্ষক অরণ্য, শ্বেত বালুকাময় সমুদ্র সৈকত ও সমুদ্রের কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ জলধারা এই দ্বীপকে মহিমান্বিত করেছে।
আমাদের প্রথম দিন নিয়ে যাওয়া হয় সেলুলার জেলে। গরাদের পিছনে কয়েকমাস বন্দী করে রাখা হয়। এই সেলুলার জেল একটি মহান অতীতকে জড়িয়ে ধরে আছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা যে কি অসহ্য দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে তাঁদের জীবন কাটিয়েছিল তার সাক্ষী আমিও হতে পেরেছিলাম।
আমার মাত্র পাঁচ বছরের দীপান্তরের শাস্তি হয়।
আমি কোনো চোর বদমাশ ছিলাম না। আমি ছিলাম নিছক ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন তরুণ যোদ্ধা। আসামিদের আচরণ ভেদে সাগর দ্বীপেই শর্ত সাপেক্ষে মুক্ত জীবনে ছেড়ে দেওয়া হতো। সৌভাগ্যক্রমে আমি ছিলাম তাদেরই একজন।
মুক্ত জীবন পেয়ে সেলুলার জেল থেকে প্রায় পনেরো মাইল উত্তরে মায়াদ্বীপ নামে একটি ছোট্ট দ্বীপে চলে যাই। দ্বীপটি ভারত মহাসাগরের কোলে অবস্থিত। এই উর্বর সমভূমীয় দ্বীপটি নারিকেল গাছ দ্বারা আবৃত। সমুদ্রের অনবরত হুঙ্কারের নিনাদ মনকে পুলকিত করে তুলে। দ্বীপের প্রকৃতির হেঁয়ালিপূ্র্ণ সৌন্দর্য আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। ছোট্ট এই দ্বীপে দশ বারোটি নিকোবরী কুঁড়ে ঘর ছিল। যেখানে কয়েকঘর শোমপেন আদিবাসি পরিবার বাস করে। এরা দেখতে অনেকটা মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্ঠীর মতো। নাক চ্যাপ্টা। গায়ের রং বাদামি। প্রায় নগ্ন হয়ে এরা বসবাস করে। মেয়েরা শরীরে স্বল্প লতাপাতা জড়িয়ে রাখত আর পুরুষগুলো জালের নেংটি পরে থাকত।
দামোদর নামে এক জেলের সাথে আমি ভাব করি। এবং তার পরিবারের সাথে মিশে যাই। দামোদরের বউ ছিল, একটি যুবক ছেলে ছিল, ছেলে বউ এবং একটি চোদ্দ পনেরো বছরের মেয়ে ছিল। এরা কোনো ধর্মব্রত পালন করত না। শুধু সন্ধ্যার সময় অগ্নি উপাসনা করত এবং কি সব জপ করত। আমি এদের ভাষা বুঝতাম না। প্রথম প্রথম ইশারায় কথা বলতাম। পরে ভাষা রপ্ত করতে পেরেছিলাম। ঠিক ধর্ম গ্রহণ নয়, অনেকটা খেয়ালি বশে আমি ওদের সাথে বসে অগ্নি উপাসনাও করতাম এবং জপ করতাম।
আমার সেই একাকী দীপান্তর জীবনে দামোদরের পরিবারটির সাথে আমি মিশে যাই। আমি দামোদরদের সাথে সাগরে মাছ ধরতে যেতাম। মনে হতো আমি দামোদরেরই একটি ছেলে। দামোদর, দামোদরের বউ, সবাই আমাকে আপন করে নেয়। আপন করে নিয়েছিল দামোদরের মেয়ে চিনুপুদিও।
আমার যখন মন খারাপ লাগত, তখন দূরে বহুদূরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম। ভারত মহাসাগরের তীরে বসে বঙ্গোপসাগরের জলের নিনাদ শুনতাম। মন আর ভালো হতো না। চলে আসতাম পর্ণকুটিরে। এই কুঁড়ে ঘরে কখনোই সন্ধ্যা বাতি জ্বলত না। সন্ধ্যা হলেই সবাই শুয়ে পড়ত। কিন্তু আমি শুতাম না। বাইরে তালপাতা বিছিয়ে শুয়ে থাকতাম, না হয় বসে থাকতাম। একাকী আকাশ ভরা তারা দেখতাম। জ্যোৎস্না ঝরে পড়ত। তারপর একসময় ঘুমিয়ে যেতাম।
সেদিন ছিল পূর্ণিমা সন্ধ্যা। পুঞ্জে ছিল অগ্নি উপাসনার উৎসব। নাচ হবে। গান হবে। তাড়ি খাবে। নেশা করবে। স্ফূর্তি করবে। উৎসবের এই দিনে আমি উপস্থিত থাকি না। মনটা খুব খারাপ লাগছিল। একাকী চলে যাই সমুদ্র তীরে। বালুকাবেলায় বসে থাকি। শুনি সাগরের শব্দ। জলের কুলকুল ধ্বনি কান্নার শব্দের মতো মনে হচ্ছিল। চাঁদের আলো এসে ভেসে গিয়েছিল নীল জলে। হঠাৎ পিছনে ফিরে দেখি চিনুপুদি দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছোট ডিঙ্গিটার কাছে চলে যাই। যেয়ে ডিঙ্গিতে বসি। চিনুপুদিও আমার পিছে পিছে এসে নৌকায় বসে।
আমি : তুমি চলে আসলে যে। ওখানে উৎসব হচ্ছে।
চিনুপুদি : আমার ভালো লাগছিল না, তাই চলে এলাম।
আমি : তোমাকে খুঁজবে না?
চিনুপুদি : না। সবাই নেশায় চূর হয়ে আছে।
আমি : তুমি ওসব খাওনা?
চিনুপুদি : না।
হঠাৎ সাগরে পূর্ণিমার জোয়ার শুরু হয়ে যায়। আমরা তখনও বিহবল হয়ে নৌকায় বসে আছি । ডিঙ্গিটি ভাসতে ভাসতে আরো কূলের দিকে চলে আসে। সাগরের ঢেউ আমাদের শরীরের উপরে আছড়ে পড়ছিল। চিনুপুদি ভয় পেয়েছিল কিনা জানিনা। সে আমাকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে। সমুদ্রের ঢেউ আর জ্যোৎস্নার প্লাবনে আমরা সেই সন্ধ্যা রাতে আরো বেশি ভিজে স্নাত হয়েছিলাম।
এই মায়া দ্বীপে আরো চার পাঁচ মাস চলে যায়। এর মাঝে আমি চিনুপুদির আরো কাছে চলে আসি। ওকে একটু ভালোও বেসে ফেলি। এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় পুঞ্জের পুরোহিত কি এক মন্ত্র পড়িয়ে চিনুপুদিকে আমার হাতে সপে দেয়। এটি ওদের বিয়ের নিয়ম ছিল কিনা জানিনা।
বন্দীদের শর্ত অনুযায়ী প্রতি মাসে মুক্ত বন্দীদের সেলুলার জেলে যেয়ে রিপোর্ট করতে হতো। এবার রিপোর্ট করতে যেয়ে জানতে পারি, গভর্নর লুই মাউন্টবাটেন যীশু খ্রিস্টের বড়োদিন উপলক্ষে আন্দামানের কিছু বন্দীকে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দেবে। সেই তালিকায় আমার নামও আছে। আমি খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। আগামীকাল সন্ধ্যায়ই মহারাজ ছেড়ে যাবে বন্দর থেকে। ঐ জাহাজে করেই চলে যেতে হবে কোলকাতা।
আমি ঐদিনই চলে আসি মায়া দ্বীপে। আজ রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ নেই। ভারত মহাসাগরের তীরে এই দ্বীপে আজ নেমেছে আঁধার। চিনুপুদি আমাকে জড়িয়ে ধরে সারারাতই কেঁদেছে। খুব ভোরে মায়াদ্বীপ থেকে ছোট নৌকায় করে পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেলে চলে আসি। বিদায় বেলায় চিনুপুদি ওর পেটের কাছে কান পেতে আমাকে ওর বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে বলেছিল। আমি শুনেওছিলাম। আর ওর হাত থেকে পিতলের একটি রুলিবালা খুলে দিয়ে বলেছিল — ‘এটি আমার স্মৃতিচিহ্ন, ভুলে যাবে না। এস আবার এই মায়াদ্বীপে।’
বিকেলে যখন সেলুলার জেলের অফিসে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সেরে বিদায় নিচ্ছিলাম, জেলার সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল — ‘এই দ্বীপের আমার সবচেয়ে বেশি কি ভালো লেগেছিল? ‘আমি উত্তরে বলেছিলাম, তিনটি জিনিস আমার ভালো লেগেছিল — এক . মায়াদ্বীপ, দ্বিতীয়: সাগরের শব্দ, আর তৃতীয় হচ্ছে — চিনুপুদি।
১১ . যামিনী না যেতে
একদিন রাতে অনলাইনে বসে ‘সে যে আমার নানা রঙ্গের দিনগুলি’ নামে আমার ব্লগে এক বর্ষা দিনের কথা লিখছিলাম। আর্ট কলেজের বকুল তলায় বসে, পাপিয়া সেদিন আমাকে বলেছিল – ‘ভালোবাসি।’ ঠিক সেই সময়ে কোথা থেকে উদ্ভ্রান্ত বাতাস এল। বকুলের পাতা সব দুলে উঠল। পাপিয়া’র মাথার চুল উড়ছিল। ঝরা ফুল এসে ঝরে পড়েছিল ওর চুলে। আমি চুল থেকে কুঁড়াই ফুল। সেই ফুল পাপিয়া ‘র হাতে দিয়ে বলেছিলাম- ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি। ‘
ভালো বাসতে বাসতেই আমাদের দু’জনের জীবনে বসন্ত আসে। এমনি এক বসন্ত দুপুরে আমরা বসেছিলাম সেই বকুল তলাতেই। তপ্ত দুুপরে সেদিন কোনো উদ্ভ্রান্ত বাতাস আসেনি। বকুলের পাতার ফাঁক দিয়ে কেবল রোদ্দুর ঝরে পড়ছিল। এত মায়ময় আলোর ঔজ্জ্বল্যে পাপিয়ার মুখ সেদিন বিষন্ন লাগছিল। আমার ব্লগে লিখছিলাম তাই —
‘ সেদিন আমার অপেক্ষা ছিল আনন্দের
সেদিন তোমার আগমন ধ্বনি ছিল
পাতা ঝরার মতো বসন্ত গানের —
আম্র মুকুলের আড়ালে কোকিল ডেকে উঠেছিল
সমস্ত সৌরভ হঠাৎ কোথায় মিলিয়ে গেল
কি দ্বিধায় গোপণ রেখেছিল সে সত্য
ভালোবাসার কাছে সত্যও গোপন হয়
তার আকণ্ঠে কখনো চুম্বনের দাগ দেখিনি
বুঝতে পারিনি অন্য কারোর ঘর থেকে
সে প্রতিদিন বেরিয়ে আসতো রাধিকার মতো। ‘
আমার ব্লগে যখন পাপিয়া’র কথা, তার অভিসারিকা হওয়ার কথা লিখতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই ল্যাপটপে খুলে থাকা ফেসবুকের উইন্ডোতে একটি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট নোটিফিকেশন আসে। রিকুয়েস্টটি ছিল একটি মেয়ের। নাম যামিনী। আমি যামিনীর ওয়ালে চলে যাই। একটি মাত্র ছবি সেখানে দেওয়া আছে। পিছন দিক হওয়া, মুখ দেখা যায় না। লাল পেঁড়ে সাদা শাড়ি পরে কাশবনের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
এ্যাবাউটে লেখা আছে –”আমি যামিনী, একসময় কাশবনের সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে হাঁটতে খুব পছন্দ করতাম। এখন যেখানে আছি, সেখানে কাশবন নেই। আছে রডোডেনডন গুচ্ছ। অবশ্যই তা শিলংয়ের পাহাড়ের ঢালে নয়। সুদূর অষ্ট্রিয়ায় দানিয়্যুব নদীর তীরের এক উপত্যকায়।”
আমি রিকুয়েস্টটি এ্যাকসেপ্টটেন্স দেই। কোনো মিউচুয়াল ফ্রেন্ড নেই। এমনকি তার বন্ধু লিস্টে অন্য কোনো বন্ধুও নেই। আমিই তার প্রথম বন্ধু হলাম। ইনবক্সে প্রথম সে লিখল – ‘আমাকে তুমি বন্ধু করলে! কী যে ভালো লাগছে আমার।’
আমি বিব্রত হই প্রথমেই ‘তুমি’ সম্বোধনে। তারপরও সহজ করে নেই ব্যাপারটা। বলি : আমিও খুশি, আপনার বন্ধু হতে পেরে। ‘
যামিনী : বন্ধুকে ‘আপনি’ বলছ কেন? বন্ধুকে কেউ . ‘আপনি ‘ বলে?
আমি : আমি খুশি তোমাকে বন্ধু পেয়ে।
যামিনী : কি করছিলে?
আমি : ব্লগে লিখছিলাম। বায়োগ্রাফিমুলক লেখা।
যামিনী : কার কথা লিখছিলে?
আমি : সে তুমি চিনবে না! একটি মেয়ের কথা।
যামিনী : কি নাম তার?
আমি : পাপিয়া।
যামিনী : ভালোবাসতে তাকে ?
আমি : জ্বী।
যামিনী : তোমার সাথে কাল আবার কথা বলব। ঠিক এই সময়ে। তুমি অনলাইনে থেক। নীচে আমার হাজব্যান্ড এসে গাড়ির হর্ণ বাজাচ্ছে। যাই।
যামিনী অফ্ লাইনে চলে যাবার পর ভাবছিলাম, একজন মেয়ে অনেক কিছুই পারে, তার অত্যাশ্চর্য সম্মোহন শক্তি দিয়ে মুহূর্তেই একজন ছেলের মন জয় করতে পারে । সেই সুদূর অস্ট্রিয়ার দানিয়্যুব নদীর তীর থেকে এক অজানা অচেনা রমণী এ কোন্ হৃদয় দোলায় দোল দিয়ে রেখে গেল।
পরের দিন রাতে ব্লগে পাপিয়া’র অসমাপ্ত কথা লিখতে যেয়ে আর লেখা হলো না। ইউটিউবে রবি ঠাকুরের এই গানটি শুনছিলাম —
“কেন যামিনী না যেতে জাগালে না,
বেলা হল মরি লাজে।
শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথেরি মাঝে।
আলোকপরশে মরমে মরিয়া
হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া,
কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া
কামিনী শিথিল সাজে। “
গান শেষ হতে না হতেই ইনবক্সে যামিনীর নোটিফিকেশন চলে আসে। যামিনী লিখে : কি করছ এই রাতে? সবুজ আলো জ্বেলে একাকী।
আমি : শুনছিলাম ‘কেন যামিনী না যেতে’ গানটি।
যামিনী : তাই? ভালো লাগল। গতকাল থেকে তোমার কথা মনে পড়ছে খালি। তারপর বলো — ‘তোমার সেই পাপিয়া ‘র কথা।
আমি : পাপিয়া আমার জীবনে নেই। আসেও নাই। তাকে ভালোবাসবার আগেই সে আরেকজনের বউ ছিল। আমি তা জানতাম না। দুইজনের কত ভালবাসা ছিল, কত স্বপ্ন ছিল, কত চাওয়া পাওয়া ছিল। এই জীবনে কোনো কিছুই আর পাওয়া হয়নি। পাপিয়া যার স্বপ্ন ছিল তারই স্বপ্ন হয়ে আছে।
যামিনী : তুমি কখন জানলে, পাপিয়া আরেকজনের বউ।
আমি : সেদিন আর্ট কলেজের বকুলের তলায় আমরা বসেছিলাম, শুধু ভালোবাসার সময়গুলো একসময় শেষ হয়ে আসে, পাপিয়াকে বলি — ‘চলো আমরা বিয়ে করি, ঘর বাঁধি। ‘ পাপিয়া সেদিন কাঁদতে কাঁদতে তার সেই না বলা কথাটি বলে দিয়েছিল।
যামিনী : তারপর কি হলো?
আমি : পাপিয়ার সাথে সেইটাই ছিল আমার শেষ দেখা। এরপর ওর সাথে আমি কখনো দেখা করি নাই। চিঠিও লিখি নাই। পাপিয়াও বুঝতে পেরেছিল আমার অভিমানের কথা। আমি চিরতরে নিজেকে তার কাছ থেকে দূরে সরে রেখেছিলাম।
যামিনী : তোমার কি এখনো পাপিয়ার কথা মনে হয়? তুমি কি তাকে এখনো ভুলে যেতে পেরেছ?
আমি : মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। ও আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা ছিল। এক বর্ষায় আমার দু’হাত নিয়ে করোতলের উপর সে চুম্বন একেঁ বলেছিল, ‘এমনি করেই সারা জীবন তোমাকে ভালোবাসব।’ বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। এখনো কোনো বর্ষার দিনে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হলে পাপিয়া ‘র কথা মনে পড়ে। মনে হয়, সে যেন আছে আমারই পাশে। তার নিঃশ্বাস এসে আমার বুকে পড়ে। আমার দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে তার কপোলে।
যামিনী : পাপিয়া এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? জানো কি?
আমি : আজ বহু বছর হয়ে গেছে। কিছু জানিনা তার কথা । বেঁচে আছে কিনা তাও জানিনা।
যামিনী : তুমি আমাকে মনটা খারাপ করে দিলে। আজ এই পর্যন্তই। কাল আবার কথা হবে। ভালো থেকো।শুভরাত্রি।
সন্ধ্যা থেকেই মনটা কেমন উতলা হয়ে উঠছিল। কখন রাত্রি গভীর হবে। কখন আসবে যামিনী অনলাইনে। এই দুই দিনেই যামিনীর প্রতি কেমন যেন টান চলে আসে। ইনবক্সে যামিনীর ইমোজি দেখতে পাই —
যামিনী : কেমন আছ?
আমি : ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
যামিনী : ভালো নেই। কাল রাত থেকেই তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। জানো, আমিও খুব দুঃখী। সেই কতকাল ধরে, কত রাত্রিতে গোপনে কত যে আমাকে কাঁদতে হয়েছে। সে কথা শুধু ঈশ্বরই জানে। তোমার প্রোফাইলে তোমার বউয়ের ছবি দেখলাম। খুবই সহজ সরল মায়াময়ী এক দেবী যেন। ওকে খুব ভালো লাগল।
আমি : জ্বী, ও খুব ভালো মেয়ে। ওকে নিয়ে সুখেই আছি। ও সত্যিই একজন মায়াবতী।
যামিনী : আমি ভালো নেই। আসো না তুমি একবার এখানে বেড়াতে। এক সন্ধ্যায় দানিয়্যুবে বজরা ভাসিয়ে দূরে অনেক দূরে চলে যাব। এখানেও ওঠে আমাদের দেশের মতো পূর্ণিমার চাঁদ। সারা রাত চন্দ্রালোকে ভাসব দুইজন। তুমি যদি আসো দানিয়্যুবের তীরে ওপারে রয়েছে আকাশ জুড়ে পাহাড় আর উপত্যকা। সারা বিকেলে হাঁটব গিরি পথে পথে। দেখতে পাবে রডোডেনডন গুচ্ছ। এখানেও আছে মাধবীলতা। আসবে তুমি?
আমি : দেখি, তোমাকে আমি দেখতে যাব একদিন ভিয়েনায়। তোমার প্রোফাইলে তোমার একটি মাত্র ছবি। তাও পিছন দিক হয়ে। যামিনী, তোমার মুখ আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। তোমার মুখের একটি ছবি পোস্ট দাও না? তোমায় একটু দেখি।
যামিনী : আমি দেখতে খুবই কুৎসিত। তুমি আমাকে দেখে পছন্দ করবে না। অামাকে ঘৃণা করবে।
আমি : কে বলেছে, তোমায় ঘৃণা করব? সত্যি বলছি, ঘৃণা করব না। তুমি একটি ছবি পোষ্ট দিও।
যামিনী : ঠিক আছে। পোষ্ট দেব। কাল সকালে তুমি দেখতে পাবে। এখন যাই। ভালো থেক। কোনো দিন তুমি আমাকে ভুলে যেও না।
সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে, তখন ফেসবুকে যেয়ে যামিনীর প্রোফাইলে ছবি খূঁজি। পেলামও। অনেক আগের একটি সাদা কালো ছবি। এ যে দেখছি সেই পাপিয়া! নামটাও চেঞ্জ করা। যামিনী নয় — পাপিয়া আলী, ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।
১২ . কাঁদালে তুমি মোরে
তখন বেলা দ্বিপ্রহর। ঈশ্বরদী জংশনের একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর বিশ্রামাগারে প্রফেসর সাহেব একাকী বসে আছেন। মুখে তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি এবং বিষণ্ণতার ছাপ। যেন কতোকালের দুঃখ সেখানে লেগে আছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে, এই চোখ একাকী অনেক রাত কেঁদেছে। বিশ্রামাগারের এককোণে বসে নিরিবিলি পত্রিকা পড়ছিল সে। তিনি এসেছেন নওগাঁ থেকে, যাবেন খুলনায়। সুন্দরবন এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করছে।
বিশ্রামাগারে আরো দুই তিনজন যাত্রী বসে আছে। তারাও চুপচাপ। কেউ কাউকে চেনে না। কেউ কারোর সাথে কথা বলে না। এমনি এক নীরব সুনসান মুহূর্তে রুমে প্রবেশ করে একটি ছোট্ট পরিবার। স্বামী স্ত্রী এবং তাদের পনেরো ষোলো বয়সের একটি মেয়ে। তারা এসে বসে প্রফেসরের ঠিক পাশেই। প্রফেসর সাহেবের বয়স চল্লিশের কাছে। মেয়েটি উৎসুক হয়েই প্রফেসর সাহেবকে দেখছিল। সে খুব আকুবাকু করছিল, তার সাথে একটু কথা বলবার। মেয়েটি নিজ থেকেই কথা বলে – ‘ আঙ্কেল, আপনি কোথায় যাবেন?
প্রফেসর : খুলনা। সেখান থেকে আরো ভিতরে, এক পাড়াগাঁয়ে।
মেয়েটি : ওখানে কি আপনার বাড়ি?
প্রফেসর : না। ওখানে আমি এক কলেজের প্রফেসর।
মেয়েটি : কোন্ সাবজেক্ট আপনি পড়ান?
প্রোফেসর : বাংলা।
মেয়েটি : খুব ভালো সাবজেক্ট। আমারও বাংলা পড়ার খুব ইচ্ছা।
মেয়েটির বাবা মেয়েটিকে বলে : ‘ সেঁজুতি মা, তুমি ওনাকে বিরক্ত করছ কেন? ‘
সেঁজুতি মেয়েটি এই রকমই। ৰাড়িতে, স্কুলে, পথে ঘাটে মানুষকে আপন করে নেওয়া তার স্বভাব। মুহূর্তে মানুযকে সে ভালোও বাসে। এমন সহজ সরল মেয়ে সাধারনতঃ খুঁজে পাওয়া ষায়না। সেঁজুতি প্রোফেসর সাহেবের সাথে কথা বলছেন, এজন্য ওর বাবা কিছু মনে করছে না। তিনি বুঝতে পারছে যে, প্রোফেসর সাহেবের বিষণ্ণ মুখই সেঁজুতির মনের মধ্যে এক ধরণের মমত্ব তৈরি করেছে। যার কারণে তার সাথে কথা বলতে তার এত আকুতি।
প্রোফেসর সাহেব সিটের উপর পত্রিকাটি রেখে ওয়েটিং রুমের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সে দেখছিল অনেকগুলি রেললাইন চলে গেছে সামনের দিকে। অনেক পথই খালি পড়ে আছে, ট্রেন নেই। আবার কোনো কোনো প্লাটফর্মে ট্রেন আসছে, কোনো কোনো প্লাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ট্রেনদের এই আসা যাওয়ার মাঝেই তিনি ভাবছিলেন অতীতের একটি স্মৃতির কখা।
আজ থেকে তেরো বছর আগে কার্তিকের এক শেষ রোদের বিকেলে চাটমোহরের বড়াল নদীর পাড়ের একটি গ্রাম থেকে সাহানাকে সে বিয়ে করে এনেছিল। নওগাঁয় ফিরে যাবার সময় এমনি করেই সেদিন অপেক্ষা করছিল এই ঈশ্বরদী জংশনে। প্লাটফরমের উপর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে এসে বসেছিল এই ওয়েটিং রুমেই। আজ এখানে দাঁড়িয়েই দেখছিল সেই তেরো বছর আগের দৃশ্যটি। লাল রঙের জর্জেট শাড়ির ঘোমটা ছিল সাহানার মাথায়। সাদা পাঞ্জাবী পরেছিল সে নিজে। তার হাতটি ধরা ছিল তার হাতে।
প্রোফেসর সাহেব বাইরে দাঁড়িয়েই আছে। সেঁজুতি ওর বাবাকে বলছিল – ‘বাবা, আমি কি প্রোফেসর আঙ্কেলের কাছে যেয়ে একটু কথা বলতে পারব?’
বাবা : ‘যাও, বলো গে। ‘
সেঁজুতি চলে আসে বারান্দায়। প্রোফেসর তখনো তাকিয়েই ছিল জনারণ্যময় প্লাটফর্মের দিকে। সেঁজুতি যেয়ে বলে — ‘আঙ্কেল, আপনি মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? আপনার কি হয়েছে?’
প্রোফেসর : শুনবে তুমি? তুমি তো অনেক ছোট মানুষ।
সেঁজুতি : আপনি বলেন, আমি শুনব।
প্রোফেসর : আমার কলেজের কাছেই টিনের একটি ছোট্ট বাড়িতে আমি থাকি। ঘরে শুধু আমার স্ত্রী ছিল। আমাদের কোনো সন্তান নেই। সেদিন ক্লাশ নিচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর এল, সে খুব অসুস্থ। আমি বাসায় চলে যাই। যেয়ে দেখি, সে মৃত। ব্রেন স্টোক করেছিল। মুখ তার পরনের শাড়ির আঁচলে ঢাকা। হাসপাতালে নেওয়ার সময়ও পাই নাই। আট দিন আগের ঘটনা। পরে লাশ নওগাঁয় নিয়ে আসি। আত্রাই নদীর তীরে আমদের গ্রাম। সেখানেই তাকে কবর দিয়ে এলাম। এখন চলে যাচ্ছি খুলনায়।
সেঁজুতি : আপনার একা একা ওখানে খারাপ লাগবে না? বাড়ি থেকে কাউকে সাথে করে আনতেন?
প্রোফেসর : “আমার তেমন কেউ নেই। বাবা, মা, ভাইবোন কেউ নেই। ছিল শুধু আমার স্ত্রীই। তেরো বছর ধরে আমরা একদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন ছিলাম না । দুই তিনবার সে শুধু তাদের বাড়ি গিয়েছিল, তাও আমি সাথে ছিলাম। ”
বিয়ের পর তিন বছর গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। কয়েকটি টিউশনি করতাম। ভালোই চলছিল জীবন। ছোট্ট একটি কুটিরে থাকতাম। কত হেমন্ত জ্যোৎস্নায় আমাদের কেটেছে সময় আত্রাইয়ের কূলে কূলে। তারপর সেই জীবন ফেলে চলে আসি খুলনায়। কলেজে চাকুরী হলো। ভালোই চলছিল জীবন।
সেঁজুতি : তারপর?
প্রোফেসর : তুমি ছোট মানুষ। তোমায় আর কি বলব? আমি ওখানে যাচ্ছি, সপ্তাহখানেক থাকব। কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে আমার পদত্যাগপত্র জমা দেব। ওখানে আমার একাকী থাকা সম্ভব নয়। ঐ কলেজ, ঐ কলেজের প্রাঙ্গন, কলেজের কাছে আমার ঐ বাড়ি, সবখানে ওকে নিয়ে আমার হাজার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ওখানে আমার একাকী দম বন্ধ হয়ে আসবে।
সেঁজুতি : আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
প্রোফেসর : ওর বেশ কিছু ব্যাবহার করা কাপড় চোপর আছে। ভাবছি সেগুলো গরীবদের দিয়ে দেব। তাছাড়া বিয়ের দিনের লাল শাড়ি, নাকফুল, চারটে চুরি আর একটি মালাও আছে। এ ক’টি জিনিস কাকে যে দেব, ভেবে পাচ্ছিনা। আমার তো ঐরকম আপন কেউ নেই।
সেঁজুতি : কেন, আপনার কাছেই রেখে দিবেন। আপনি আর বিয়ে করবেন না?
প্রোফেসর : না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনেক দূরে চলে যাব। বাকি জীবন মাজারে মাজারে, আশ্রমে আশ্রমে ঘুরে বেড়াব। মঠ,গীর্জা, মন্দিরে মন্দিরে থাকব। যেথায় শান্তি পাব, সেখানেই ঘুমিয়ে যাব। কেউ দেখবেও না, কেউ জানবেও না।
সেঁজুতির চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে।
প্রোফেসর : সেঁজুতি, তুমি খুব ভালো মেয়ে। খুব ছোট্ট বেলায় আমি মাকে হারিয়েছিলাম। তার কথা আমার মনে নেই। তারপর এই পৃথিবীতে আমার স্ত্রীকে পেলাম। সেও ছেড়ে চলে গেল। আর আজ তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগল। তুমি কি সেই লাল শাড়ি, নাকফুল, হাতের চুড়ি আর গলার মালাটি নেবে? যদি না নাও, তাহলে এক হেমন্তের পূর্ণিমার রাতে সেগুলো আত্রাইয়ের জলে ফেলে দিয়ে আসব। তারপর চিরতরে অনেক দূরে নিরুদ্দেশ হয়ে যাব।
সেঁজুতির কন্ঠ রোধ হয়ে আসে। কোনো কথা বলতে পারছিল না।
সেঁজুতির কোনো কথার উত্তর প্রোফেসর আর শুনতে পেল না। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্লাটফর্মে এসে ততোক্ষণে ভিঁরে গেছে। সে ওয়েটিং রুম থেকে তার ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে প্লাটফর্মের হাজারো মানুষের মধ্যে মিশে যায় এবং ট্রেনে যেয়ে উঠে
পড়ে।
হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটি পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রীজের দিকে ছেড়ে চলে যেতে থাকে। সেঁজুতি ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ রেখে অঝোর ধারায় কাঁদছিল তখন।
১৩ . যত আনন্দ সঙ্গীত
উত্তরার একটি বহুতল বানিজ্যিক ভবনের পনেরো তলায় ছিল আমার অফিস। অফিস বলতে আমিই একাই সব। ছিল শুধু অল্প বয়সের একজন এ্যাটেন্ডেন্ট। বসে বসে সেখানে ইন্ডেন্টিং এর কাজ করতাম। তবে বেশির ভাগ সময় কোনো কাজ থাকত না। তখন ফেসবুক এত জনপ্রিয় ছিল না। ইয়াহু ম্যাসেঞ্জারে মাঝে মাঝে চ্যাটিং করে সময় কাটাতাম। ফিলিপিনো মেয়েরা তখন চ্যাটরুমে লাইন দিয়ে বসে থাকত।
একদিন সকালবেলা পার্কে ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটার সময় অনিক নামে এক তরুণের সাথে আমার পরিচয় হয়। সে উত্তরার একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটির ফ্যাশন ডিজাইনের শেষ সেমিস্টারের ছাত্র ছিল। ছেলেটি দেখতে খুব সুদর্শন ও ভদ্র ছিল। সৌখিন ভাবে সে নাটকে অভিনয়ও করত। ভদ্র ও সাংস্কৃতিমনা ছেলে দেখে ওকে আমার খুব ভালো লাগে। আমার একটি ভিজিটিং কার্ড ওকে দিয়ে বলেছিলাম — তুমি আমার অফিসে এসো।
এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই পরিপূর্ণ সুখের মানুষ নয়। ক্রান্তিকাল সবার জীবনেই আসে। কিছু ভুলের জন্য কিছু দুঃখ কষ্ট আমিও বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। রিভোলডিং চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রায়ই বসে থাকতাম। জানালা খুলে দেখতাম উত্তরার নীল আকাশ। দূর দিয়াবাড়ির খোলা বালুর প্রান্তরও দেখতাম। কাশবনের সাদা ফুলগুলো গালিচার মতো লাগত। দেখা যেত বিমানবন্দরের রানওয়ে, সেখানে বিকট শব্দ করা প্লেনগুলোর ওঠা নামা দেখতাম। এমনি বসে থাকা এক ক্লান্ত দুপুরে অনিক প্রথম আমার অফিসে এসেছিল।
আমি অনিককে অন্য কথা না বলে সরাসরি বলি – ‘তুমি কি লাঞ্চ করে এসেছ ? ‘ অনিক প্রথম দিনের আমার এমন স্ট্রেইট কথা শুনে ও তার সত্য কথাটিই বলে ফেলে — ‘ না, সকালের নাস্তাও করিনি। ঘুম থেকে উঠেছি একটু আগে। হোস্টেলের ক্যান্টিনে তখন খাবার শেষ। আমার পকেট দিয়াবাড়ির ধূঁ-ধূ বালুর মাঠ। ঘুম ভেঙ্গেই আপনার কথা মনে হলো। তাই চলে এলাম।’
আমরা চলে আসি উত্তরার আকাশ ছোঁয়া রেস্টুরেন্ট ‘শিকারা’তে। জানালার কাছে বসে এখানেও দেখা যায় নীল আকাশ, দিয়াবাড়ির কাশবন, আশুলিয়ার গ্রাম আর তুরাগ নদীর জল। আমরা দুইজন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম এমনি জানালার পাশে বসে। খেতে খেতে অনেক কথাই বলা হলো দু ‘জনের। দূরের নিসর্গগুলি দেখতে দেখতে একে অপরের অনেক কিছুই জানা হলো।
অনিক নিতান্তই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। ওর গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চল দিরাই তে। ঢাকায় উল্লেখ করার মতো কোনো আত্মজন নেই। থাকে প্রাইভেট হোস্টেলে। গ্রাজুয়েশন শেষ হবার পথে। শেষ সেমিস্টার শেষ হয়ে যাবে। অনিক আমার অফিসে প্রায় প্রতিদিনই আসতে থাকে। আমার একাকীত্বের সময়গুলোর ও সাথী হয়। জীবনের অনেক হতাশা,বঞ্চনা আর গ্লানির কথাগুলো ওর কাছেই ভাগাভাগি করে নেই। আমিও ওকে অনেক কিছুইতে সাহায্য সহযোগিতা করি। ওর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান পনেরো ষোল বছর। তারপরেও সম্পর্কটা হয়ে ওঠে বন্ধুর মতো, আমি হয়ে যাই ওর আপন আত্মজন।
একদিন অফিসে মৌরি নামে একটি মেয়েকে অনিক নিয়ে আসে। মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দরী। অনিক আমাকে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওরা একে অপরে ভালোবাসে। মৌরি বিত্তবান ঘরের মেয়ে হলেও ছিল নিরাহংকারী ও সহজ সরল। এক ধরণের নিষ্পাপ সারল্য ওর চোখে মুখে দেখতে পাই। আমি প্রথম দিন অফিসেই ওদেরকে আপ্যায়ন করাই। এরপর থেকে মেয়েটাকে প্রায়ই অনিক আমার অফিসে নিয়ে আসত। ওদের দুজনেরই সাথে আমারও একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ৰাড়ি থেকে অনিক যে টাকা পয়সা পেত তা দিয়ে অনিকের সারামাস যেত না। মৌরিকে ভালোবাসার কারণে ওর অতিরিক্ত খরচ হয়ে যেত। মাসের শেষের দিনগুলো আমিই ওকে চালাতাম। বলতাম, ‘তোমাকে করুণা করছি না। হিসাব রেখ। যখন সামর্থ্য হয়, দিয়ে দিও। আর না দিলেও তুমি ঋৃণী হবেনা কখনো। মনে করবে একজন ভাইয়ের স্নেহের এ দান।’
অনেক সময় আমি অফিসে থাকতাম না, সে সময়ে অনিক আর মৌরি গল্প করত প্রহরের পর প্রহর। ওদের প্রেমময় মধুর ক্ষণগুলো আমার অফিস চেম্বারে কাটিয়েছে। হাজার স্বপ্ন দেখেছে ওরা এখানে বসেই। বিয়ে, ঘর বাঁধা, সন্তান, সংসার সব। অনেক সময় ওদের ভিতর ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে, সেগুলো আমিই মিটিয়ে দিয়েছি।
একদিন আমরা তিনজনই বসে আছি। ওদের দুইজনকেই দেখতে খুব ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল কোন্ স্বপ্নের দেশ থেকে ময়ুরপঙ্খী নাও ভাসিয়ে আমার এখানে ওরা চলে এসেছে। মনে হচ্ছিল ওরা দু’জন শত জনমের এক রাজপুত্র আর রাজকুমারী। ওদের মায়াময় চোখে মুখে তাকিয়ে আমার মন স্নিগ্ধতায় ভরে উঠেছিল। এত আপন লাগছিল যে, সেদিন তা ওদেরকেও বুঝতে দেইনি। শুধু বলেছিলাম — ‘তোমাদের বিয়ের দিনে আমি পিয়ানো বাজাব। গাইব আমি জগতের যত আনন্দ সঙ্গীত। ‘
ইতোমধ্যে অনিকের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যায়। দুই তিন মাস বেকার ছিল। এই বেকার সময়গুলোতে আমি ওকে আর্থিক সহায়তা করি। প্রতি দিনই আমার এখানে এসে লাঞ্চ করত। মৌরিও আসত প্রায় প্রতিদিনই। এরই মাঝে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে অনিকের ভালো চাকুরি হয়ে যায়। এরপর অনিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে চাকুরিতে। আগের মতো আর আমার এখানে আসে না। অনিক আসে না দেখে মৌরিও আসত না। একসময় ওরা আসা টোটালেই বন্ধ করে দেয়। প্রথম দিকে ফোন করলে পাওয়া যেত। পরে আর পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সিম কার্ড চেঞ্জ করে ফেলেছিল।
অফিসে সময়গুলো এখন আর কাটতে চায় না কিছুতেই। মানুষের জীবনটা মনে হয় এই রকমই। জীবনের বাঁকে বাঁকে কত মানুষ আসে। কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়, কত মানুষ আবার চলে যায়। একাকীত্ব কিছুতেই ঘুঁচে না। এই অফিসে বসে ক্লান্তিতে কেমন যেন অবশ হয়ে যায় দেহ। রিভোলভিং চেয়ারে বসে জানালার পাশে প্রায়ই বসে থাকি। নীল আকাশ আর হৃদয়ে দোলা দেয় না। মনে হয় ধূসর মেঘে ছেয়ে আছে সমস্ত আকাশ।
এরপর কখন তিনটি বছর চলে গেছে বুঝতে পারি নাই। এরই মধ্যে আমার ব্যাবসার অনেক উত্থান পতন হয়েছে। শরীরটাও হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। ব্যবসাও ভালো করতে পারছিলাম না। অফিসটা তাই ছেড়ে দেই। শেষ দিনে অফিস ঘরের সমস্ত বকেয়া ভাড়াদি পরিশোধ করে মালিককে চাবি বুঝে দেই। শুধু একটি অফিস ব্যাগ হাতে করে হেঁটে হেঁটে বাসার দিকে চলে আসছিলাম। ফুটপাতের উপর দিয়ে হাঁটছিলাম, কিন্তু পা কিছুতেই সামনের দিকে চলতে চাইছিল না।
তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি। উত্তরা ৭ নং সেক্টরের পার্কের কাছে চলে আসি। মনটা ভালো লাগছিল না। ভাবলাম পার্কের ভিতরে যেয়ে পাকা বেঞ্চের উপর একাকী বসে থাকি কতক্ষণ। পার্কের মূল গেট দিয়ে ঢুকে ওয়াকওয়ে দিয়ে হেঁটে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম। দেখি একটা ছেলে আর একটি মেয়ে তাদের দুই বছরের বাচ্চা মেয়ের দুইহাত দু’জন দুই দিক থেকে ধরে আস্তে আস্তে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটি ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে হাঁটছিলো। আমি এ দৃশ্য ওদের পিছন দিক থেকে দেখছিলাম। ওদের দেখে চিনতে পারলাম, ওরা অনিক আর মৌরি।
ওদের এই আনন্দমুখর মুহূর্তটি নিরবে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি অবলোকন করছিলাম, আমার আজকের সকল মনখারাপ মুহূর্তে যেন ভালো হয়ে গেল। এমন হাসিখুশির দৃশ্য কিছুক্ষণ দেখে – পিছন ঘুরে হেঁটে হেঁটে পার্কের বাইরে চলে আসি।
সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছিল তখন। ধূসর সেই সন্ধ্যার ক্ষণে ফুটপাতের উপর দিয়ে হাঁটছিলাম, আর ভাবছিলাম একটি দুঃখবোধের কথা — ‘আমি তো ওদের বিয়ের দিনে বাজাতে চেয়েছিলাম পিয়ানো, আর গাইতে চেয়েছিলাম জগতের যত আনন্দ সঙ্গীত।’
১৪ . চন্দ্রাহত মেয়েটির কথা
মালা নামের মেয়েটি নিতান্তই গ্রামের একটি বালিকা ছিল । ছোটবেলা় থেকেই ও ছিল কিছুটা পাগলি স্বভাবের। সে পছন্দ করত চাঁদ। দশমী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত সে বেশি অস্বাভাবিক থাকত। নির্জন সন্ধ্যা রাতে পুকুরের পাড়ে বসে দেখত জলে ভাসা চাঁদ। ঝিরিঝিরি ঢেউয়ের দোলায় চাঁদ ভাসত, সাথে এই বালিকা মেয়েটির অন্তরও দুলে উঠত যেন । রাতে কুয়ার জলেও দেখত চাঁদ। কলসি নামিয়ে দিত জলে। জলে শুয়ে থাকা সেই চাঁদ কলসির ঢেউয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলে মেয়েটির মন খারাপ হয়ে যেত।
আমি তখন কৃষি বিভাগে চাকুরী করতাম। একটি এ্যাসাইনমেন্টে তিন মাসের জন্য আমাকে সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে যেতে হয়েছিল। এই থানাটি চারদিকে নদী বেস্টিত। একদিকে ধলেশ্বরী অন্য দিকে প্রমত্তা যমুনা। এক আষাঢ়ে মেঘের দিনে টাংগাইলের নাগরপুর থেকে নৌকায় করে চৌহালীতে চলে যাই। আমি ওখানে যেয়ে অবাক! নদী ভাঙ্গনের জন্য থানা সদর স্থানান্তর হয়েছে চরের মধ্যে। তখনও কোনো ভবন তৈরি হয়নি ঠিকমতো। অস্থায়ী টিনের ঘরে চলত যাবতীয় অফিসিয়াল কার্যাদি।
আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল অফিস থেকে অদুরে ধূঁ-ধূ চরের মধ্য এক গৃহস্থ বাড়ির কাচারি ঘরে। এর জন্য ঐ বাড়ির মালিককে কিছু পে করতে হয়েছিল। বাড়িটি থেকে পশ্চিম পার্শ্বে যমুনা নদী বেশি দূরে নয়। ভালো লাগছিল নদী মুখোমুখি এই রকম একটি বাড়ি। আমার অফিসের পিয়ন ছমির আলী ঐ গাঁয়েরই চাঁদ পাগলী মালা নামের এতিম এক বালিকাকে আমার টুকটাক ফয় ফরমাস পালনের জন্য ঠিক করে দেয়।
মেয়েটির বয়স কতই হবে। এগারো বারো বছর হবে। গরীবের ঘরে মেয়ে হলেও সে ছিল খুব পরিচ্ছন্ন। চেহারায় ছিল এক ধরনের সরলতা। খুব মায়া করে কথা বলত। ওর সাথে আমার কথা বলতে এত ভালো লাগত যে, ওকে আমি কখনোই তুই সম্বোধন করিনি। যখন আমি জানলাম মেয়েটি চাঁদ পাগল, তখন আরো বেশি ওর প্রতি আমার আলাদা কেয়ার চলে আসে।
আমার একাকী অবসর সময়গুলোতে এই মালার সাথে কথা বলে কাটাতাম। ছোট ছোট করে ও অনেক কথাই বলত, অনেক কিছুই জানতে চাইত। ঢাকায় আমার চার বছরের মেয়েকে রেখে এসেছি, তার কথা মালা শুনতে চাইত। জিজ্ঞাসা করত, ও কেমন দেখতে! প্রায়ই বলত বাবুকে তার কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করে। এমনি করেই ওর সাথে কথা বলতে বলতে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে মালা আমার ভালো ক্ষুদে বন্ধু হয়ে উঠল।
একদিন বিকাল থেকেই মালা আসছিল না। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরে বসে আছি। তারপরও ও আসেনি। আমি ঘর থেকে বের হই। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে। পূর্ব আকাশে দেখলাম দশমীর চাঁদ উঠেছে। চরের চরাচর জুড়ে জ্যোৎস্না নেমে পড়েছে। আমি হেঁটে হেঁটে মালাদের বাড়ির দিকে যাই। ওখানে যেয়ে শুনি, সন্ধ্যা থেকেই সে ছোট্ট পুকুর পাড়ে বসে ছিল। ঐসময়ে সে নাকি কারো সাথে কথা বলে না। দেখলাম বাড়ির বারান্দায় মাদুর পেতে মালা শুয়ে আছে। আমি ওকে ডাকলাম, কিন্তু শুনল না। কথা বলতে চাইলাম, কথাও বলল না।
পরের তিন দিনও মালা আসেনি। আমার খুব ইচ্ছা হলো- একদিন সন্ধ্যা রাতে ওর সাথেই আমি পুকুর পাড়ে বসে থাকব। দেখব চাঁদের সাথে ও কিভাবে সময় কাটায়। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। বাড়ির কাচারি ঘর হতে বের হয়ে কাশবনের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে মালাদের বাড়ি যাই। যেয়ে দেখি মালা নেই। সন্ধ্যাই সে নদীর তীরে চলে গেছে। মালার মা মেয়ের সাথেই রয়েছে। আমি আর নদীর তীরে যাইনি।
চার পাঁচটি দিন মালার অভাব আমি খুব অনুভব করছিলাম। আমার ঘরে ঠিকমতো রান্না হয় নাই। প্রতিদিনের একাকী বিকেলগুলো ঘরের মধ্যেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দেই। যে মেয়েটি আমার সাথে ছোট ছোট করে কথা বলে আমার সময় পার করে দিত, সে আজ চারদিন ধরে নেই। কি এক অবাক করা চন্দ্র তাকে এই জগৎ থেকে আলাদা করে রেখেছে, সে এক বিস্ময়ই শুধু।
এক মাস পার হতেই হেড অফিস থেকে হঠাৎ টেলিগ্রাম পেলাম, আমাকে আবার ঢাকাতে থাকতে হবে এক মাস। আমি পরের দিন সকালে ঢাকায় চলে আসার প্রস্তুতি নেই। মালাই আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছিল। মালা বলছিল — ‘দাদাভাই, আপনি আর আসবেন না?
আমি : এক মাস পরে আসব।
মালা : আপনি আমাকে সাথে করে নিয়ে যান। আমি বাবুকে দেখে রাখব। ঘরের কাজ সব করে দেব।’
আমি : ঠিক আছে, তোমাকে আমি নিয়ে যাব। তবে এবার না। আমি তোমার আপার সাথে আলাপ করে আসব। এর পরেরবার আমি যখন একেবারে এখান থেকে চলে যাব, তখন তোমাকে নিয়ে যাব। ‘
মালা : আচ্ছা।
একমাস ঢাকায় থেকে আমি আবার চৌহালী চলে আসি। পিয়ন ছমির আলীকে বললাম, মালাকে খবর দিতে যে, আমি এসেছি। ও যেন আমাকে একটু দেখভাল করে। ছমির বলল – ‘স্যার, মালা খুব অসুস্থ। ও এখন চলাফেরা করতে পারে না। ‘
আমি : কি হয়েছে ওর?
ছমির আলী : আপনি চলে যাবার পরপরই ওকে ময়মনসিংহে এক সাহেবের বাসায় কাজ করতে পাঠিয়েছিল। পাঁচ দিন ওখানে ছিল। তারপর অসুস্থ হয়ে সে ফিরে আসে। ‘
আমি : ওহ! তাই।
হেড অফিসের সিদ্ধান্তে চৌহালীর এই এ্যাসাইন্টমেন্ট তাড়াতাড়ি ক্লোজ করতে হ্চ্ছে। এবং তা আগামী আট দশ দিনের ভিতরেই। আমি ছমির আলীকে বললাম, মালার এ্যাবসেন্টে সেই যেন আমার একটু দেখভাল করে। কাজের ব্যস্ততার কারণে আমি আর তিন চার দিন মালার কোনো খোঁজখবর নিতে পারি নাই। মালা’ই একদিন বিকেলে ওর মার সাথে আমার এখানে চলে আসে। ওকে দেখার পর আমার মনটা হাহাকার করে ওঠে। একি অবস্থা মালার! একদম শুকিয়ে গেছে। মায়াবী সেই চোখ দু’টো কোঠরে চলে গেছে। চোখের নীচের পাতা কালচে হয়ে গেছে।
মালা’র মা বলছিল, আপনি এসেছেন একথা শোনার পর মালা আপনাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। ও বলছিল — ‘আমাকে দাদা ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও। ‘ মালা ছলছল চোখে আমাকে দেখছিল । ও বসে থাকতে পারছিল না, ওর মা মালা’কে বুকের পাজরে ধরে বাড়ি নিয়ে যায়। মালা যখন চলে যায় তখন সন্ধ্যা। আমি ওর চলে যাবার সময়ে অতটুকু খেয়াল করিনি। চলে যাবার পরপরেই দেখি – যে পথ দিয়ে মালা হেঁটে হেঁটে চলে গেছে, সেই পথে টপ টপ করে তাজা রক্ত মাটিতে পড়ে আছে। ছমির আলীর মুখে পরে জানতে পারি– মালা ময়মনসিংহে যে বাড়িতে ছিল সেখানে সে একাধিক বার ধর্ষিত হয়েছিল।
ছমির আলী আরো বলল, মালা আগের মতো চাঁদ দেখে আর ঘরের বাইরে যায় না। বিনম্র হয়ে শুয়ে থাকে বিছানায়। মেয়েটির জন্য কেন জানি খুব মায়া হলো। অন্তরটা হুহু করে কাঁদতে লাগল। আমারও তো ছোট্ট একটি মেয়ে আছে। মালার মুখচ্ছবিতে আমার মেয়ের মুখ দেখতে পেলাম। বেতনের টাকা উঠিয়েছিলাম, সেখান থেকে ঢাকা যাবার সামান্য টাকা রেখে বাকিটা ছমির আলীর মারফতে মালা’র মা’র কাছে পাঠিয়ে দিলাম।
অফিসের ব্যস্ততার জন্য আমি আর মালাদের বাড়ি যাই নাই। সেদিন বিকাল থেকেই একটু অবসরে ছিলাম। অফিসের কাজও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। একাকী বসে আছি। ভালো লাগছিল না কিছুই। যে মেয়েটি থাকলে ওর সাথে ছোট্ট ছোট্ট করে কথা বলে সময় কাটাতাম, সেই মেয়েটি আজ নেই। ঘরের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতে পারি নাই। হারিকেনটাও জ্বালানো হয় নাই। মালা থাকতে সন্ধ্যা আলোটা ঐ জ্বালিয়ে রাখত। মালা নেই তাই ঠিকমতো সন্ধ্যা বাতিটাও জ্বলে ওঠে না। হারিকেনের কাঁচের চিমনি ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে।
সন্ধ্যার পর ঘর হতে নেমে আসি। সারা চর জুড়ে সন্ধ্যা রাতের নির্জন পূর্ণিমার চাঁদের অন্ধকার। সমস্ত কাশবন জ্যোৎস্নায় ছেয়ে গেছে। একবার মনে হলো হাঁটতে হাঁটতে যমুনা তীরে চলে যাই। যেয়ে যমুনার জলে চাঁদের মুখ দেখি, কিন্তু ওদিকে আর গেলাম না। মালার করুণ মুখখানি মনে পড়তে লাগল। আমি চলে যাই মালাদের বাড়ি। মালা মাদুর পেতে বারান্দায় শুয়ে আছে। আমি কাঠের একটি টুলে ওর পাশে বসি। ওকে বলি – ‘মালা, আজতো আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। পুকুরের জলে চাঁদ দেখবে না? ‘
মালা : ‘দাদা ভাই, আপনি আমাকে একটু ধরে পুকুরের পাড়ে নিয়ে যান। আমি চাঁদ দেখব আজ। ‘
আমি সেই সন্ধ্যা রাতে মালাকে ধরে পুকুর পাড়ে নিয়ে যাই । পাড়ের দূর্বা ঘাসের উপর বসে ও কিছুক্ষণ জলের উপর চাঁদ দেখেছিল।
পরেরদিন সকালবেলা ছমির আলী এসে আমাকে খবর দেয় – ‘মালা রাতেই মারা গেছে।’
এরপর আরো দুইদিন আমি চৌহালীতে ছিলাম। তৃতীয় দিন ঢাকায় চলে আসার প্রস্তুতি নেই। আজ আর আমার ব্যাগটি কেউ গুছিয়ে দিল না। আমিই গোছালাম। ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে যখন ঘর হতে বের হচ্ছিলাম, তখন পাশ থেকে মালার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম — ‘দাদাভাই, আপনি আমাকে সাথে করে নিয়ে যান। বাবুকে দেখে রাখব। ঘরের কাজ সব করে দেব। ‘
খেয়াঘাটে এসে নৌকায় উঠে বসি। ধলেশ্বরীর প্রবল ভাটির স্রোতে নৌকাটি ভেসে যাচ্ছিল নাগরপুরের দিকে। পাড়ের গ্রাম, আর বৃক্ষশৈলীর দিকে তাকিয়ে চন্দ্রাহত সেই মেয়েটির কথা খুই মনে হচ্ছিল। দূরে কোন্ নৌকার মাঝি গাইছিল তখন —
” তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার।
তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে মন, মন রে আমার।
যে পথ দিয়ে চলে এলি, সে পথ এখন ভুলে গেলি–
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে, মন, মন রে আমার।”
১৫ . রোড টু গৌরীপুর
অনেক ছোট বেলায় বাবার কাছ থেকেই শুনেছিলাম আমার এক ফুফুর কথা। সে ছিল বাবার সবচেয়ে ছোট বোন। তখন অবিভক্ত ভারতবর্ষ। বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম জেলাগুলোর সাথে আসামের সঙ্গে ছিল একটি নিবিড় সম্পর্ক। ব্যবসা বানিজ্য, বিয়ে সাদি এবং অন্যান্য যোগাযোগ ছিল প্রাত্যাহিক মেলবন্ধনের মতো। আমাদের বাড়ি উত্তরের জেলা বৃহত্তর পাবনাতে। আমার বাবা ব্যাবসায়িক কাজে আসামের ধুবড়ি এবং গোয়ালপাড়াতে যেতেন। ঐখানে কিছু আত্মীয় ছাড়াও বাবার পরিচিত জনেরাও ছিল।
আমার সেই ফুপুটির নাম ছিলো নুরজাহান। সে নাকি বেশ সুন্দরী ছিল। বাবার ইচ্ছাতেই আমার এই ফুফুর ৰিয়ে হয় আসামের ধুবড়িতে। নিতান্ত বালিকা বয়স ছিল তার। অসম্ভব সুন্দরী হওয়ার কারণে মাত্র তেরো চৌদ্দ বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। ছেলে ছিল নাকি ওখানকার খান্দানী পরিবারের। প্রচুর জমি জিরাতের মালিক ছিল তারা।
এক শ্রাবণ বর্ষায় তিনটি বড়ো পানসী নৌকা করে ফুপুকে বিয়ে করার জন্য ধুবড়ি থেকে বরযাত্রীরা আসে। ঢাকঢোল, বাদ্য যন্ত্র আর কলের গান বাজিয়ে এসেছিল তারা। ব্রহ্মপুত্র আর যমুনা নদীর ভাটি বেয়ে ভরা বর্ষায় পানসীগুলো এসেছিল। আর বিয়ে করে উজান বেয়ে সে নৌকাগুলো চলে গিয়েছিল আবার ধুবড়িতে। এই বিয়ে ছিল নাকি বিশাল আয়োজনের আর মহা ধুমধামের। এত সমারোহ, এত উৎসব আর এত আনন্দের মাঝে আমার সেই নুরজাহান ফুফু লাল শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেদিন শ্বশুর বাড়ি চলে গিয়েছিল।
নূরজাহান ফুফুর সেই যে লাল শাড়ি পরে চলে গিয়েছিল তারপর আর ফিরে আসে নাই। ফুফুর শ্বশুর, শাশুড়ী, স্বামী ও বাড়ির লোকজন সবাই নাকি ফুফুকে খুব ভালোবাসত ও আদর করত। বিয়ের পরপরই ফুফু সন্তানসম্ভবা হয়ে যায়। এবং সন্তান প্রসবকালীন সময়ে তিনি ওখানে মারা যান। একটি মেয়ে নাকি হয়েছিল। সে মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা বাবা আর তা বলতে পারে নাই। ঠিক সেই বছরেই অর্থাৎ সাতচল্লিশে ভারত বিভক্ত হয়ে যায়। তারপর আসামের ধুবড়ি আর ঐ পরিবারের সাথে বাবাদের সকল যোগাযোগ ও সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে।
বাবার মুখে এই ফুপুর কথা শুনে সেই কিশোর বয়সে আমার মনে রেখাপাত করেছিল। তাকে আমি কোনোদিন দেখি নাই, তার কোনো ছবি নাই, সে ছিল আমার জন্মেরও আগে। অথচ তার জন্য আমার প্রাণ কাঁদত। কেন কাঁদতো, তাও জানি নাই। আমি মনে মনে তার একটি মুখচ্ছবি অন্তরে গেঁথে রেখেছিলাম। বাবার মুখে ফুপুর কথা শোনার পর, আরো অনেক বছর চলে গেছে। ইতোমধ্যে বাবাও মারা যান।
বাবার মুখ থেকে শোনা ফুপু বাড়ির দুই তিনটি তথ্য আমার মনে ছিল। আমার ফুপার নাম : আব্দুল রশিদ মন্ভল। গ্রামের নাম গৌরীপুর, ধুবড়ি, আসাম। প্রাণের এক অসম্ভব তাড়নায় আমার এই ফুপুর সমাধি খূঁজতে আমি এক ফাল্গুন মাসে চলে গিয়েছিলাম ধুবড়ির সেই গৌরীপুরে।
ট্রেন নং ১৫৭৬৬, ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস, শিলিগুড়ি টু ধুবড়ি। প্রত্যুষ ৬ .৩০ মিনিটে শিলিগুড়ির নিউ জলপাইগুড়ি জংশন থেকে ট্রেনটি ধুবড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে । আমি সামনে মুখি জানালার পাশে বসে আছি। আমি তাকিয়ে দেখছিলাম জলপাইগুড়ির নয়নাভিরাম চা বাগান। ট্রেনটি যখন হাশিমারা স্টেশনে দাঁড়ায় তখন মনে পড়ছিল সমরেশ মজুমদারের কালবেলা কালপুরুষ উপন্যাস দুইটির কথা। পথে পথে আসছিলাম আর মিলাচ্ছিলাম উপন্যাসের সব চিত্রকল্পগুলি।
আলিপুর দুয়ার জংশনে ট্রেনটি অনেকক্ষণ দাড়িয়েছিল। আমি নেমে একটি রেস্টুরেন্টে ঘীএ ভাজা লুচি আর মহিষের দুধের ছানা দিয়ে নাস্তা করে নেই। ট্রেনটি কয়েকটি ছোট বড়ো নদী অতিক্রম করে, রাইডাক, কালিজানি তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে রাইডাক নদীটি আমাকে ভীষণরকম মুগ্ধ করেছিল।
কোচবিহার স্টেশন থেকে একজন ছাত্র উঠেছিল, ওর নাম শ্যামল রায়। ও পুন্ডিবারী আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। ওর কাছ থেকে আমি ধুবড়ি ও গৌরীপুর সম্পর্কে জেনে নেই। গৌরীপুরও একটি স্টেশন, ধুবড়ির ঠিক আগের স্টেশনটাই হচ্ছে গৌরীপুর। ও আমাকে ধুবড়িতেই নামবার ও থাকবার পরামর্শ দেয়। শ্যামলের সাথে আরো অনেক কথা হয়েছিল। ও তুফানগঞ্জ স্টেশনে নেমে যায়। অল্প কিছুক্ষণ সময়েই খুব ভালো লেগেছিল ছেলেটিকে।
ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ট্রেন টি ধুবড়ির খুব কাছাকাছি এসে যায়। শ্যামল বলেছিল, ঠিক ধুবড়ির আগের স্টেশনটি গৌরীপুর। আমি স্টেশনটি দেখার জন্য জানালার কাছে বসে আছি। একসময় দেখলামও। আমার আত্মা কেমন যেন হিম হয়ে গেল। মুহূর্তেই চোখ মুখ বিষাদে ছেয়ে যায়। দ্রুতগামী ট্রেনটি এখানে থামল না। ঝিকঝিক শব্দ করে ট্রেন ধুবড়ির দিকে চলে গেল।
ধুবড়ি স্টেশনে নেমে ছোট এই শহরটির দিকে একবার তাকালাম। শহরটিকে কেমন যেন চেনা শহর মনে হলো। আজ থেকে অর্ধ শত বছর আগে এখানে আমার বাবার হাজারো পদচিহ্ন পড়েছিল। আমার নুরজাহান ফুপুরও অনেক পদচিহ্ন আছে এই শহরেই। ব্রহ্মপুত্র তীরে যোগমায়া ঘাটেই হয়ত বরযাত্রীর সেই পানসী নৌকাগুলো এসে ভীঁড়েছিল। এই ঘাট থেকেই হয়ত লাল শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে হেঁটে হেঁটো স্টেশনে এসেছিল ফুপু ।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিক্সা ডাকলাম। বললাম – আমাকে এনএস রোডে মহামায়া হোটেলে নিয়ে যাও। তখন বিকাল হয়ে গেছে। আমি হোটেলে একটু রেস্ট নিয়ে আবারও শহরের ভিতর বের হই। একটি রিক্সা রিজার্ভ করে ঘুরতে থাকি শহরময়। চলে যাই ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে। এই শহরের তিন দিকেই নদী। আমি একটি তীর থেকে ফিরে তাকালাম পশ্চিম পাড়ে। কে একজন বলল ঐপাড়েই বাংলদেশের রৌমারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যমুনা – ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে নৌকায় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আর স্মরণার্থীরা এসেছিল এই ধুবড়িতে।
পরের দিন সকাল বেলায় হোটেল থেকে চেক আউট নেই। ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে চলে আসি স্টেশনে। একটি লোকাল ডেমো ট্রেনে উঠে বসি। নামব সামনের স্টেশন গৌরীপুর।
ট্রেনটি আস্তে আস্তে চলে আসে গৌরীপুরে। আমি কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে নেমে পড়ি প্লাটফর্মে। মৃদু পায়ে হাঁটতে থাকি প্লাটফর্মের উপর দিয়ে। আমি কোথায় যাব, কাকে বলব আমার ফুফুর কথা। কেউ চেনা নেই, কোনো আপন মানুষ নেই। স্টেশনেই একটি ছোট চা’র দোকানে যেয়ে বসি। দেখি একজন পৌঢ় লোক ওখানে বসে আছে। বয়স সত্তরোর্ধ্ব হবে। অমি ওনাকে নমস্কার দিয়ে বলি – ‘কাকা আপনি কি এই গাঁওয়ের আব্দুল রশিদ মন্ডল নামে কাউকে চেনেন?’ পৌঢ় লোকটি কিছুক্ষণ ঝিম ধরে রইলেন। একটু পর জিজ্ঞাসা করলেন – ‘ওনার বাবার নাম কি?
আমি : বাবার নাম জানিনা।
পৌঢ় : ওনার কোনো ছেলে মেয়ের নাম জানো কি?
আমি : একটি মেয়ে থাকতে পারে, তার নামও জানিনা।
পৌঢ় : তুমি কোথায় থেকে এসেছ?
আমি : বাংলাদেশ থেকে।
পৌঢ় : উনি তোমার কি হয়?
আমি : আমার ফুপা হয়। উনি বিয়ে করেছিলেন অনেক আগে, অবিভক্ত ভারত বর্ষের পূর্ব বাংলায়।
পৌঢ় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন — ‘ চিনতে পারছি। উনি তো মারা গেছেন সে অনেক বছর আগে। ‘
আমি খুশিতে স্তব্ধ হয়ে যাই। পৌঢ়ের দুই হাত ধরে বলি — ‘কাকা, আপনি কি ওনার বাড়িটি কি আমাকে চিনিয়ে দিবেন? ‘
কাকা : আসো তুমি আমার সাথে।
গ্রামের মেঠো পথ ধরে আমি কাকার পিছনে পিছনে চলতে থাকি। প্রায় হা়ফ কিলো যাওয়ার পর দূরে নদী দেখা গেল। কাকাবাবু বলছিলেন, ঐটা ব্রহ্মপুত্র নদী। এক সময় অনেক দূরে ছিল, এখন কাছে চলে এসেছে।তবে এখন আর আগের মতো ভাঙ্গে না। আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা নদীর কাছেই চলে আসি। একটি টিনের বাড়ির কাছে এসে কাকাবাবু থামে। ফলের গাছ বেষ্টিত ছায়া ঢাকা খুবই ছিমছাম একটি বাড়ি। আমাকে বাড়ির বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে উনি ভিতরে চলে যান।
কিছুক্ষণ পর চল্লিশোর্ধ্ব একজন মহিলা কাকাবাবুর সাথে বাইরে চলে আসে। ওনাকে দেখার পরেই আমার ধমনির সকল রক্ত প্রবাহ থেমে গেল। জগতের সকল হাহাকার যেন সুখের আতিশয্যে ভরে উঠল। বহু বছরের পূর্ব পুরুষদের রক্তের ঋণ পরিশোধ হওয়ার জন্য সমস্ত শরীর অসীম এক আবেগে চঞ্চল হয়ে উঠল। কাকাবাবু বললেন – ‘ইনি তোমার বোন, তোমার ফুপির মেয়ে।’ আমি তাকে ‘বুবু’ বলে ডাক দেই। বুবু আমাকে তার বাহুডোরে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন।
সেদিন আমার বোনটির বাড়িতেই ছিলাম। তার কাছেই জানতে পারি, ফুপুর মৃত্যুর পর ফুপা আর বিয়ে করে নাই। কিন্তু সেও বেশী দিন বাঁচে নাই। অকালেই সে মারা যায়। আমার এই বোনটির নাম, আলোজান। আমি আলো বুবু কে জিজ্ঞাসা করি, ‘ফুপুর কবরটি কোথায়?’
আলো বুবু আমাকে বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বে ভিটায় নিয়ে যায়। ওখানে বেশ কয়েকটি কবর দেখতে পাই। তার ভিতর দুইটি কবর আলাদা করে বাঁধানো। একটি ফুপু’র, আরেকটি ফুপার। ফুফু ‘র কবরে শ্বেতপাথরের উপর লেখা আছে : মোছাম্মাৎ নুরজাহান খাতুন। মৃত্যু তারিখঃ ৮ই আগস্ট, ১৯৪৭ ইং। আমরা দুই ভাই বোন দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করি। মোনাজাতে অঝোর ধারায় দুইজনই কেঁদেছিলাম।
পরের দিন অপরাহ্নে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ট্রেন ধুবড়ি থেকে ছেড়ে চলে আসে। ট্রেনটি আজকেও গৌরীপুর অতিক্রম করল। আমি ফিরে তাকালাম আলো বুবুদের গ্রামের দিকে। পাশেই ব্রহ্মপুত্র চিরন্তন ধারায় বয়ে চলেছে। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ হঠাৎই যেন বেগ পেল এখানে। কিন্তু মনে হলো চাকা থেমে যাচ্ছে। এই মাটি এই দেশ অনেক দূরের দীর্ঘশ্বাস হয়ে পড়ে রইল। এই মাটির নীচে মিশে রয়েছে আমারই রক্ত ধারার অযুত বিন্দু,অশ্রু বিন্দু হয়ে।
সমান্তরাল পথে ট্রেনটি তখন দ্রুত গতিতে চলে আসছিল আরো দূরের দিকে। পিছনে ফিরে তাকিয়ে থাকলাম, মনে হলো আলো বুবু এখনও কাঁদছে।
১৬ . কঙ্কনা দাসী
হাজার বছর আগের কথা। কেমন ছিল তখন নবদ্বীপ? ভাগিরথী ও জলাঙ্গী নদীর সঙ্গমস্থল তখনো কি প্লাবনে ভরে থাকত? এখনকার এই নীল আকাশ, এখনকার বাতাসের এই ঝিরি ঝিরি দোলা তখনও কি বইত সেখানে ? খুব মন চায়, ভাগিরথী তীরে যেতে। দেখতে ইচ্ছা হয়, কোথায় আমার সেই পূর্ব পুরুষদের রাজধানী নবদ্বীপ।
কৃষ্ণনগর। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কৃষ্ণনগর। গোপাল ভাঁড়ের কৃষ্ণনগর। মাটির পুতুলের কৃষ্ণনগর।সরপুরিয়া-সরভাজার কৃষ্ণনগর । বাংলার ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা কৃষ্ণনগর । হ্যাঁ, আমি নদিয়ার কথা বলছি। নবদ্বীপের কথা বলছি। হাজার বছর আগে আমার পূর্ব পুরুষদের রাজধানীর কথা বলছি।
এক রবিবারের সকালে ‘কৃষ্ণনগর সিটি জংশন’ লোকাল ট্রেন ধরে গিয়েছিলাম কৃষ্ণনগরে। সারাদিনে শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার অনেকগুলো ট্রেন চলে । সপ্তাহের অন্যদিনে এই ট্রেনগুলো গ্যালপিং হলেও রবিবার সব স্টেশনে থামে। প্রায় তিন ঘন্টা লেগে যায় কৃষ্ণনগর পৌঁছতে। ওখানে পৌঁছে শহরের জগজিৎ হোটেলে আমি উঠি।
বিকেলে রিক্সা করে প্রথমে যাই রাজবাড়ি। নদীয়া অধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বিখ্যাত রাজপ্রাসাদ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিরাট বড় রাজবাড়ি, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দেয় না । বাইরে থেকে ভেতরটা যতদূর দেখা যায় দেখলাম। কিন্তু আমার কৃষ্ণনগরে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য বাংলার সেন বংশের রাজাদের লুপ্ত প্রায় রাজ প্রাসাদের ধংসাবশেষ দেখা।
নদিয়া জেলায় বর্তমান নবদ্বীপের প্রায় তিনক্রোশ উত্তর পূৰ্বদিকে বল্লালদীঘি নামক গ্রাম আছে । সেখানে অতি উচ্চ এক ভূমিখণ্ড আছে । তাঙ্গকে লোকে “বল্লাল টিবি” বলে থাকে । শোনা যায় সেখানে বল্লাল সেনের রাজ প্রাসাদ ছিল । আমি একটি টাঙার মতো ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করি। ইতিহাসের এক পোড়া মাটির ধূলো পথ ধরে আমার টাঙা গাড়িটি চলতে থাকে ভাগিরথীর তীর ধরে বল্লাল সেনের সেই ধ্বংস প্রায় রাজ প্রাসাদের দিকে।
আমার টাঙা গাড়ির কোচোয়ান ছিল পৌঢ় বয়সের একটি লোক, নাম বিষ্ণুপদ ঘোষ। সে বহু বছর ধরে এই পরগনায় টাঙা গাড়ি চালায়। তার যাত্রী বেশির ভাগ বাইরে থেকে আসা পর্যটক। সে অনেকটা গাইডের মতোও কাজ করে । পথ চলতে চলতে আমি ওনার কাছ থেকে অনেক কিছুই জেনে নেই। সবকিছু শুনে একটু ভয়ও পাচ্ছিলাম। একা একা যাচ্ছি অপরিচিত নির্জন এক ভগ্ন প্রাসাদের দিকে।
সেই নির্জন দুপুরে আমি এখন আমাদের পূর্ব পুরুষদের রাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদের সামনে। এক সময়ের সেই জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদটি ভাঙ্গা পোড়া ইট আর মাটির স্তুপ হয়ে আছে। ইটের ভিতর থেকে গাছ গাছালী বেড়ে উঠেছে, কতো গাছে পরগাছা হয়ে আছে। আমার চোখের সামনে দেখলাম একটি বিষধর গোক্ষুর সাপ গর্তে যেয়ে লুকালো। প্রাসাদের কাছেই দেখি একটি শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটের পাশেই আর একটি জরাজীর্ণ প্রাসাদ। বিষ্ণুপদ বলছিল ওটা ছিল একটি প্রমোদশালা। আমি ঘাট আর ঐ জীর্ণ প্রমোদ ঘরের দিকে এগুতে থাকি। তখন ছিল তপ্ত দুপুর সময়। অদূরে ভাগিরথী নদী। ওখানকার শীতল হাওয়া এসে তপ্ত দুপুরের উষ্ণতাকে শীতল করে তুলেছিল।
কি এক অদ্ভুত টানে আমি এগুতে থাকি সেই ঘাটের দিকে, সেই ভগ্ন প্রমোদশালার দিকে। বিষ্ণুপদ ঘোষ আমাকে বাঁধা দিচ্ছিল, কিন্তু আমার চোখে তখন একাদশ শতকের এক স্বপ্নের ঘোর। মনে হলো যেন হাজার বছর আগে আমার পূর্ব পুরুষদেরই কেউ আমি। ঠিক আবার তাও নয় – আমি যেন এই রাজ্যের এক রাজকুমার।
ফ্লাসব্যাক —
আমি নাকি আমার পিতামহ বিজয় সেনের মতো দেখতে। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো কালো চুল। বাউলের মতো লম্বা হয়ে তা পিছনে ঘাড় পর্যন্ত নেমে গেছে। চোখ নীল পাথরের মতো জ্বলজ্বল করে। প্রশস্ত বুকের খাঁজে নাগ কেশরের গন্ধ ছড়ায়। ধবল সাদা বাহুদ্বয় বাজ পাখির পালকে উড়ে। লম্বা লম্বা পা ফেলে আমি যখন পাসাদ প্রাঙ্গণে হাঁটতে থাকি, তখন সব রমণীকুল, দাসী, নর্তকীরা আমাকে কুর্নিশ করে। তাদের হৃদয় আত্মা কেঁপে উঠত আমাকে পাওয়ার আকুলতায়। শুধু একজনের হৃদয় আত্মা কেঁপে উঠত না, নাম তার কঙ্কনা দাসী।
রাজ প্রাসাদের খাস দাসী রত্নাবতীকে নিয়ে এসেছিল আমার মাতা রামদেবী। আমার মা পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের রাজকুমারী ছিলেন। এই রত্নাবতী ছিল আমার মাতার পরিচারিকা । বিবাহের পরেও আমার মা রত্নাবতীকে নবদ্বীপের এই প্রাসাদে নিয়ে আসে। কারণ সে ছিল আমার মায়ের বিশ্বস্ত দাসী। আর এই রত্নাবতীর গর্ভের মেয়েই হচ্ছে কঙ্কনা দাসী।
কঙ্কনা ছিল আমার খেলার সাথী। দিনের পর দিন সে বেড়ে ওঠে আমার চোখের সামনে। কঙ্কনা যেন বাগানের অপ্রয়োজনীয় ফুল নয়। সে প্রস্ফুটিত হতে থাকে গোলাপের সৌরভ নিয়ে। তার উন্মেলিত চোখে আমার স্বপ্ন দেখতাম। চুল থেকে গুঞ্জ ফুলের সুবাস পেতাম। কাঁচা হলুদের গায়ের রঙে আবীরের দরকার হতো না। বুকে তার কালান্তরের কুন্দন, বক্র শরীরে হাঁটত প্রাসাদময় সর্পিনী্র মতো। নিকষিত হেমের ছোবলটি এসে পড়ত যেন আমার বুকে। কণ্ঠতল থেকে বুক হয়ে নাভিমূলে তার উত্তাল ভাগিরথীর বাঁক। তার সেই প্রমত্ত শরীরের বাঁকে বাঁকে আমি আমার দৃষ্টি হারাতাম।
সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। বিকাল থেকেই মনটা উদাসী হয়ে উঠেছিল। প্রগাঢ় এক আকাঙ্ক্ষা মন প্রাণ জুড়ে, আজকের এই চাঁদের সন্ধ্যায় কঙ্কনাকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ভাগিরথীর তীর ধরে বেড়াতে নিয়ে যেতে মন চায়। বনারণ্যের সবুজে সবুজে, পাতায় পাতায় ঢলে পড়ছিল জ্যোৎস্নার প্লাবন। কঙ্কনা একজন দাসী হলেও তার অহংকার ছিল রাজকুমারীর মতো। তন্বী এই তরুণী আমার সকল শৌর্যবীর্য কেড়ে নিয়েছিল। গোপনে গোপনে ইচ্ছা পোষণ করে রেখেছিলাম, ওকেই আমি বিয়ে করব, হোক না সে দাসী।
পাইককে বললাম আস্তাবল থেকে ঘোড়া বের করতে। দাসী মহলে খবর পাঠিয়েছি কঙ্কনাকে অপরূপ সাজে সাজাতে। এই যে এত আয়োজন, এত সাজ সাজ রব, সবকিছুই আমার মা রামদেবী আর পিতা বল্লাল সেনের অগোচরে। সেদিনের সেই মনোরম সন্ধ্যা রাতে দেবদারু গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা দিল। প্রাসাদের দাসীদের দরজা দিয়ে চন্দ্রালোকে হাঁটতে হাঁটতে কঙ্কনা দাসী বের হয়ে আসে। পরনে ছিল কারুকার্যখচিত চোলি ও ঘাঘরা। চাঁদের আলো পড়ে ওর পোশাকে লাগানো পাথর আর চুমকিগুলি ঝিকমিক করছিল।
অশ্বের খুরের খটখট শব্দ তুলে ভাগিরথীর তীর ধরে ঘোড়া ছুটতে থাকে বনের দিকে। আমার হাতে সোয়ার। পিছনে কঙ্কনা দাসী। চাঁদের আলো বাঁধ ভেঙে পড়েছে আরো আগেই। উতলা কুন্তলা হয়ে কেঁপে ওঠে ভরা পুর্ণিমার চাঁদ। একি পাগলকাড়া এই ক্ষণ! দুটো মানব মানবী আদিম উৎসবে মেতে উঠল বন নিভৃতে। বুঁনো জ্যোৎস্নায় বনের মরা পাতার সব মর্মরধবনি একসময় থেমে যেতে থাকে । যেন সব গান আর সব সুর বনের গভীরে হারিয়ে যায়। এত আলো আর এত জ্যোৎস্না সব আঁধারে ভেসে যায়।
আমরা যখন রাজ প্রাসাদে ফিরে আসি তখন চাঁদ মধ্য গগনে মেঘের নীচে নিস্তব্ধ হয়ে ডুবে গেছে। কঙ্কনা দাসী চলে যায় দাসী মহলে তার মায়ের কাছে। পরের দিন সকাল বেলা পুকুরের জলে কঙ্কনা দাসীর মা রত্নাবতীর মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায়।
তারপর —
বিষ্ণুপদ ঘোষের টাঙা গাড়িতে আমি বসে আছি। লাল পোড়া মাটির ধুলো উড়তে উড়তে ঘোড়ার গাড়িটি ছুটে চলতে থাকে কৃষ্ণনগরের দিকে। তখন বিকাল হয়ে গেছে। আমি বিষ্ণুপদ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – কঙ্কনা দাসীর পরে কি হয়েছিল? পথে আসতে আসতে বিষ্ণুপদ বলছিল, ঠিক পরের রাত্রিতেই কঙ্কনা দাসীও একই পুকুরের জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিল। সত্য মিথ্যা জানিনা — জনশ্রুতি আছে যে, রাজকুমারের পিতার ঔরসে রত্নাবতীর গর্ভে কঙ্কনার জন্ম হয়। এই কথাটি রত্নাবতী যে রাতে আত্মহত্যা করেছিল, সেই রাতেই কঙ্কনাকে সে বলে গিয়েছিল।
ঐ ভাঙ্গা রাজ প্রাসাদের পাশ দিয়ে পথিকেরা সন্ধ্যার পর চলতে ভয় পায়। হেমন্তের পুর্ণিমা রাতে ভাগিরথী তীরের জীর্ণ এই প্রাসাদ থেকে মা মেয়ের দু ‘জনেরই কান্নার ধ্বনি নাকি ভেসে আসে।
——————————————————-
ডিসক্লেইমার : এই কাহিনীর তথ্যগুলো বিষ্ণুপদ ঘোষের দেওয়া। আমার কাছে মনে হয়েছে এইসবই ছিল তার কল্প কাহিনী। সেন রাজাদের কারও সাথে এর কোনো মিল নেই।
১৭ . এখনো টিউলিপ
পাহাড়ের কোল ঘেসে বিসর্পিলের মতো আঁকাবাঁকা করে চলতে চলতে টয় ট্রেনটি যখন দার্জিলিং স্টেশনে পৌঁছে, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। নেমেই দেখি হাতের কাছে মেঘ ভাসছে। একেবারে হাত দিয়ে মেঘ ধরা যায়। হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে মেঘ উড়ে যায়। হ্যাপি বিস্ময়ে দেখছিল ধূপের কুণ্ডলীর মতো সাদা মেঘ। ওর মাথার চুল দুলছিল মেঘে মেঘে। এসব দেখতে না দেখতেই দেখি বেশ কয়েকজন নেপালি, ভূটানি,গূর্খা তরুণ প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আগত যাত্রীদের কাছে এসে ওফার করছে হোটেল ঠিক করে দেবার কথা।
আমাদের কাছে এগিয়ে আসে তেরো চৌদ্দ বছরের এক কিশোর। দেখে ঐরকমই মনে হলো ভূটানি কিংবা নেপালি হবে। ওর হাতে দুইটি টিউলিপ ফুল, ভাঙ্গা হিন্দি আর ভাঙ্গা বাংলায় বলছিল — ‘মে সনেম ভালদারো হু, কেয়া আপকো কিসি গাইড কি জরুরাত হ্যায়? ‘ আমি দ্বিধা দ্বন্দ্ব করছিলাম। ছেলেটি খুব মায়াভরে আবার বলছিল, ‘ স্যার, আপ মুঝে কাম রুপি দিজিয়েগা। লেকিন মে আপকেহি সাথ সারেদিন রেহেনা চাহাতা হূ।’
হ্যাপি বলছিল, ‘ছেলেটি মনে হয় ভালোই হবে। তুমি রাজি হয়ে যাও। ‘ আমি সনেমকে বললাম — ‘ঠিক হ্যায়, আবসে হামারে সাথ রয়হেনা।’ সোনেম ওর হাতে থাকা দুটি টিউলিপ আমাদের দুইজনকে দিয়ে দেয়। এবং আমাদের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নেয়। আমরা দুই দিন থাকব দার্জিলিংএ। এই দুই দিন সনেমই আমাদের গাইড করবে।
সনেমের পরামর্শেই আমরা হিল ক্রাউন হোটেলে উঠি। এই হোটেলটির বৈশিষ্ট্য হলো এর এক দিকে তাকালে পাহাড়, নদী, ছরা, গিরিখাদ, সবুজ বনরাজি, পাহাড়ের ঢালে বাড়ি ঘর, নীল আকাশ, শৈল শহর দার্জিলিংকে উপভোগ করা যায়। আরেকপাশ থেকে তাকালে দেখা যায় অনেক দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা।
সনেমের সাথে আমাদের কথাগুলো বোঝার সুবিধার্থে আমি এখানে বাংলাতেই লিখছি। সনেম বলছিল — সন্ধ্যার পরে রাতে শহরের চৌরাস্তার মলের সামনে ওপেন কনসার্ট হয়। আমরা ইচ্ছে করলে সেটি উপভোগ করতে পারি। ও আরো বলছিল — আমরা রাতে কোথায় খাব ? আমরা ইচছা করলে হোটেল ক্যাফেতে খেতে পারি, আবার বাইরের কোনো হোটেলেও খেতে পারি। আপাতত সনেমকে কোনো প্রয়োজন নেই বিধায়, আমরা একশত রুপি ওর হাতে দিয়ে বললাম কাল সকাল নয়টায় তুমি চলে এসো। ও আমাদের দু’জনকে নমস্কারের ভঙ্গিতে সালাম করে চলে যায়।
সন্ধ্যার পর রাতের খাবার খেয়ে আমরা শহরের ভিতরে বের হই। শহরের রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট ওয়াইনের দোকান। লাল নীল আলো জ্বলছে দোকান গুলোতে। ঠিক খাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, কৌতুহলবশতঃ একটি দোকানে ঢুকে পড়ি। সেলসম্যান আমাদের দেখাচ্ছিল বিভিন্ন ব্রান্ডের ওয়াইন। বেশিরভাগ সব ইন্ডিয়ান। ছোট্ট একটি সোনালি প্যাকেটে অনেকটা আতরের শিশির মতো দেখতে একটি ওয়াইন আমাদের দেখায়। ওটি নাকি ভেষজ ওয়াইন। তিব্বতের তৈরি। আমার খুব লোভ হলো কেনার। এবং কিনেও ফেলি। হ্যাপি অবশ্য এতে কোনো আপত্তি করেনি।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই চৌরাস্তার দিকে। মলের সামনে খোলা জায়গায় উন্মুক্ত মঞ্চে গান হচ্ছিল তখন। কেউ একজন আমাদের বলল, কোলকাতা থেকে ব্যান্ড গোষ্ঠী ‘ভূমি’ এসেছে। সুরজিৎও নাকি এসেছে। আমরা এদের কাউকেই চিনিনা। তবে গানগুলো খুব সুন্দর ছিল। কোনো একজন গাইল এই গান দুটি – ‘তোমার দেখা নাইরে’ এবং ‘মধু মধু চাহনি রে তোর।’ অনেক রাত পর্যন্ত গান শুনে আমরা হোটেলে ফিরে আসি।
রাতে শোবার আগে আমরা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই। দেখছিলাম রাতের দার্জিলিং। পাহাড়ের গায়ে বাড়িগুলোতে জ্বলছে মিটিমিটি করে অসংখ্য বাতি। আঁধার ভেধ করে দাঁড়িয়ে আছে দূরে সুউচ্চ শৃঙ্গ। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। মনে হচ্ছিল আমরা কোনো স্বপ্ন রাজ্যের রাজা রানী। চারদিকে ছোট ছোট আলো দেখে মনে হয়েছিল — আমরা আছি তারাদের মাঝে। এমন তারাভরা রাতে আমরা কেবল পাশাপশি, এমন স্বপ্নের জগতে শুধুই দুজন। ভালো লাগছিল তারাদের, বিস্ময়ে কাতর হচ্ছিলাম স্বপ্নের মাঝে। আজকের এই রাত, আজকের এই স্বপ্ন, মিটিমিটি জ্বলে থাকা সব তারা যেন আমাদের জন্যই আকাশ প্রদীপ হয়ে জ্বলছে।
আমাদের ঘুম ভাঙ্গে সকাল দশটারও পরে। সনেম ভালদারো ঠিক নয়টায় এসে অপেক্ষা করছিল নীচে ওয়েটিং রুমে। রুমেই প্রাতঃরাশ করে নেই। তারপর ডাকি ভালদারোকে। ও ঢুকেই আমাদের দুই হাত উঁচু করে নমস্কারের ভঙ্গিতে সালাম দেয়। ও একটি পলিথিন ব্যাগ থেকে নীল রঙের লিলিয়ান ফুলের মালা বের করে। মালাটির মাঝে মাঝে হলুদ রঙের টিউলিপ গাঁথা। লকেটটা লাল টিউলিপ দিয়ে করা। সনেম এগিয়ে যায় হ্যাপির কাছে এবং বলে — ম্যাম এই মালাটি আপনার জন্য এনেছি।
হ্যাপি খুশিতে মালাটি পরে নেয় গলায়। হ্যাপির এইভাবে মালাটি পরা দেখে ভালদারোও খুব খুশি হয়। ভালদারোকে কালকের চেয়ে আজ বেশি স্মার্ট লাগছে। ও পরেছে একটি গ্রাবাডিনের এ্যাশ ট্রাউজার এবং ইয়েলো টি সার্ট। রুমে বসে বসে আমরা কথা বলছিলাম ভালদারোর সাথে। ওর সাথে আলাপ করে জানা গেল, ভালদারোর বাবা হচ্ছে তিব্বতী আর মা হচ্ছে নেপালি।ওর বাবা মা দার্জিলিংয়ের বৃহৎ হ্যাপি ভ্যালী চা বাগানের শ্রমিক ছিল। প্রেম করে তারা বিয়ে করেছিল। ভালদারোরা থাকে দার্জিলিং থেকে পাঁচ মাইলা দূরে ‘ঘুম’ নামে একটি জায়গায়। ‘ঘুম’ একটি টয় ট্রেন স্টেশনও। যা আমরা দার্জিলিং আসতে দেখে এসেছিলাম। ‘ঘুম’ও একটি ছোট্ট মায়াময় পার্বত্য বাজার। এখানে অনেক ভালো ভালো স্কুল আছে। নয়নাভিরাম চা বাগান আছে। নদী আছে। ঝর্ণা আছে। আছে জলপ্রপাত।
আজ হ্যাপির পরার কথা ছিল সালোয়ার কামিজ।
কিন্তু তা না পরে ও পরে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা লাল পেঁড়ে সাদা রঙের জামদানি। লিলিয়ান ও টিউলিপ ফুলের মালাটি গলায় না পরে বাঁধল খোঁপায়। অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল ওকে। আর ভালদারোও ওকে বার বার দেখছিল পরম বিস্ময়ে। ক্রাউন হিল হোটেল থেকে আমরা যখন নিচে নেমে আসছিলাম তখন রিসেপসোনিস্ট ও আন্যান্যরা দেখছিল হ্যাপি কে। তারা হ্যাপিকে দেখছিল, নাকি ঢাকাই জামদানি শাড়ি দেখছিল, নাকি খোঁপায় বাঁধা টিউলিপ ফুল দেখছিল, বোঝা গেল না।
ভালদারো আজ আমাদের রক গার্ডেন এর ঝর্ণা দেখাতে নিয়ে যায়। রক গার্ডেন দার্জিলিং শহর থেকে অনেক নিচে। যাওয়ার পথে অনেক গুলো চা বাগান চোখে পড়ল। আর নীচ থেকে দেখা যায় দার্জিলিং শহর। আবহাওয়াটা বেশি ভালো থাকায় সব কিছু অনেক দারুণ লাগছিল।
রক গার্ডেন একটা ঝর্ণা। আমি মনে করেছিলাম বাগান হবে। যদিও বাগানও আছে। কারণ জায়গাটা খুব সুন্দর করে সাজানো ফুল গাছ দিয়ে। ঝর্ণাটা অত বেশি বড়ো না। কিন্তু সুন্দর। ঝর্ণা থেকে ঝর্ণার চারপাশ বেশি সুন্দর। ঝর্ণার উপরের দিকে উঠার জন্য সিঁড়ি করে দেওয়া আছে। পাহাড়, মেঘ আর আকাশের নীল মিলে দারুণ লাগছিল রক গার্ডেন।
ভালদারো গার্ডেন থেকে কখন এক গুচ্ছ হিমালয়ান ব্লু পপি তুলে হ্যাপি র হাতে দিয়েছে আমি খেয়াল করিনি। হ্যাপিও খুশিতে সনেমের সাথে গল্প করছিল। সনেম ওর সাথে কখনো ম্যাম, কখনো দিদি সম্বোধন করে কথা বলছে। আমরা রক গার্ডেন থেকে ফেরার পথে বাতাসিয়া লুপে যাই। হরেক রকমের ফুল গাছ সুন্দর করে সাজানো আছে সেখানে। এটা ছোট রেইল লাইনের একটা রাস্তা বা লুপ। যেটা সুন্দর, তা হচ্ছে বাতাসিয়া লুপ থেকে দার্জিলিং শহরের অসাধারণ ভিউ দেখা যায়। বাতাসিয়া লুপ দেখার পর আমরা হোটেলে ফিরে আসি।
বিকেলে কেবল কারে উঠতে যাই। ভালদারোকেও আমাদের সঙ্গে নেই। কেবল কারে এক কারে ছয়জন বসা যায়। আমরা তিনজন এবং আমাদের সাথে ওঠে ওড়িশা থেকে আসা একটি বাঙ্গালি পরিবার। ভালোই লাগছিল ওদের সাথে সখ্যতা। ভালদারো বলছিল, সে বসবে তার হ্যাপি দিদির পাশে। ভাবলাম, বসতে চাচ্ছে বসুক।
আমরা জানলাম ক্যাবলকারে মোট চার কিঃমিঃ আসা যাওয়া করতে হয়। নামতে দুই কিলো, উপরে উঠতে দুই কিলো। এক ঘন্টা থেকে দেড় ঘন্টার মতো লাগে। ক্যাবল কার থেকে চারপাশ দেখতে এত বেশি ভালো লেগেছে বলার মতো না। পাহাড়ের উপর থেকে পাহাড় দেখা যায়। হ্যাপি খুব ভয় পাচ্ছিল। দেখলাম, ভালদারো ওকে খুব সাহস দিচ্ছে। হ্যাপির একটি হাত ও শক্ত করে ধরে রেখেছে।
সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে আসি। ভালদারোকে আজকের জন্য ছুটি দিয়ে দেই। ওকে বলি কাল আটটায় আবার অাসতে। এও বলি কাল দুপুরে আমরা শিলিগুরি চলে যাব। পকেট থেকে একশত রুপি বের করে সোনেমকে দিতে চাই। কিন্তু ও নেয় না। বলে বাবুজি — পরে একসাথে নিয়ে নেব। আমাকে নমস্কার দেয় আর হ্যাপির দুই হাতের করতল ওর কপালে নিয়ে স্পর্শ করে এবং কিছুটা খুশি আর কিছুটা বিষাদ নিয়ে ভালদারো চলে যায়।
সন্ধ্যার পর হাঁটতে হাঁটতে আমরা ‘ক্যাফে ডি কফি’- তে যেয়ে কফি খেয়ে নেই। ক্যাফে থেকে বেরিয়ে দার্জিলিং শহরের ফুটপাতে আলো আধাঁরির ভিতর দিয়ে হাঁটছিলাম দুইজন। আশেপাশের রংবেরঙের আলো জ্বলা ওয়াইনের দোকান থেকে মৃদু স্বরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল, ওদের ওখানে বসতে। আমি হ্যাপিকে বলছিলাম – ‘ওখানে বসবে নাকি? সফট কিংবা হট্ কিছু চলবে ?’ ও বলল – না।
রাতে হোটেল ক্যাফেতে খেয়ে নেই। রিসিপশনে যেয়ে কালকের চেক আউট করে রাখি। আজও হোটেল ব্যালকনিতে যেয়ে দুজন অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকি। দেখি রাতের দার্জিলিংকে। পাহাড়ের গায়ে আজকেও মিটিমিটি করে বাতি জ্বলছে। দূরে অনেক দূরে পাহাড়ও ঘুমিয়ে পড়েছে। চারিদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ। বাতাসের কানে কথা নেই। হ্যাপি নীরব হয়ে আমার কাঁধের উপর মাথা রেখে দুরে অন্ধকারে গিরিশৃঙ্গ দেখছে। কেন জানি আজ এই পাহাড়ি নিঝুমরাতে মনে পড়ছে শৈলেন্দু রায়ের লেখা গানের এই কথাগুলি —
‘তখনো গহন রাত্রি,
শান্ত কুজন পথ নির্জন, ঘরে ফিরে গেছে যাত্রি
আমি তাহারই স্বপনরথে
চলিনু পুলকে মধু অভিসারে ধূলায় ধূসর পথে —
এলোনা তো হার, স্মৃতিতে শুকায়
যে ফুল ফুটিল প্রাতে। ‘
সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি হ্যাপি ওপাশের ব্যালকনিতে একাকী দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছে। যা গত দুইদিন দেখা হয়নাই। শৃঙ্গে সাদা মেঘ তুলার মতো উড়ছে। পূর্ব দিক থেকে আসা সূর্যরশ্মি পড়ে সাদা মেঘগুলি চিকচিক করছে। আমি এবং হ্যাপি আমরা যেন একই নয়নে এই স্বর্গীয় রূপসুধা অবলোকন করছিলাম।
সনেম ভালদারো সকাল আটটায়ই চলে আসে। আজও ও হ্যাপির জন্য মালা নিয়ে এসেছে। তিন রকমের ফুল দেখলাম সেই মালাতে। অপরাজিতা রঙের অর্কিড, লিলি আর লাল রঙের টিউলিপ। এই মালাটি পেয়ে হ্যাপির মুখে এক চিরায়ত হাসি ফুটে ওঠে। কিশোর ভালদারোর মুখেও দেখলাম একই রকম সেই মোহনীয় হাসি।
ভালদারোকে সাথে করেই আমরা নাস্তা করে নেই। ওকে বলি — আমরা একটার সময় টয় ট্রেনে করে শিলিগুড়ি চলে যাব। এই সময়টুকু আমরা কোথায় যেতে পারি? ভালদারো বলছিল — ‘আমার মা বাবা দুইজনই দিদিকে দেখতে চায়। আপনারা ‘ঘুমে’ আমাদের বাড়িতে চলেন। ‘ঘুম’ স্টেশন থেকে পরে শিলিগুড়িতে যেতে পারবেন। আমারা রাজি হই।
একটি জীপ নিয়ে ‘ঘুম’ চলে যাই। বাজারের অদুরেই উপত্যকার ঢালে ভালদারোদের ছোট্ট কাঠের বাড়ি। ঘরে একটি বড়ো কাঠের চোকি আছে। পরিপাটি বিছানা পাতা তাতে। আমাদের ঐ চোকিতেই বসতে দেয়। ভালদারোর বাবা মা দুজনকেই দেখলাম। পঞ্চাশোর্ধ বয়স তাদের। ভালদারোর মা হ্যাপিকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। কান্নার সাথে পাহাড়ি আঞ্চলিক ভাষায় বলছিল অনেক কথা। যার কোনো অর্থ আমরা বুঝি নাই।
ভালদারোর বাবা কাঁচের ফ্রেমে বাঁধা চোদ্দ পনেরো বছরের একটি বালিকার ছবি নিয়ে এসে আমাদের সামনে মেলে ধরে। ছবিটি দেখে আমরা দুইজনই চমকে উঠি। চেহারা অবিকল হ্যাপির মতো দেখতে। ছবিতে মেয়েটির গলায় লিলি আর টিউলিপ ফুলের মালা। হাস্যজ্জ্বল মুখ তার। মেয়েটি ভালদারোর বড়ো বোন। সে পর্যটকদের কাছে ফুল বিক্রি করত। চার বছর আগে পাহাড় ধসে গিরি খাদে পড়ে মেয়েটি মারা যায়। ঘটনাটি শুনে খুব কান্না পেল।
আমরা বেলা একটা পর্যন্ত ভালদারোদের বাড়িতে ছিলাম। খেয়েছিলামও সেখানে। শিলিগুড়িতে হ্যাপি কিছু কেনাকাটা করতে চেয়েছিল। কেনাকাটার সেই টাকা থেকে দুই হাজার রুপি ভালদারোর মার হাতে হ্যাপি তুলে দেয়।
বেলা দেড়টায় ট্রেন ছাড়বে। আমরা চলে আসি ‘ঘুম’ স্টেশনে। ভালদারোও আমাদের সাথে স্টেশন পর্যন্ত চলে আসে। টয় ট্রেনটি যথাসময়ই ছেড়ে চলে আসে। ডালদারো স্টেশনের প্লাটফর্মেই দাঁড়ান ছিল। সে তার দিদি’র জন্য কাঁদছিল কী না, দেখা যায় নাই। আমি হ্যাপির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম — দুর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে সে অঝোর ধারায় কাঁদছে। ট্রেনের মিউজিক সাউন্ড বক্স থেকে এই গানটি ভেসে আসছিল তখন —
“দূরে কোথায় দূরে দূরে
আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে
যে পথ সকল দেশ পারায়ে, উদাস হয়ে যায় হারায়ে
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে।
১৮ . বনলতা সেন
তখন সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে জগন্নাথগন্জ ঘাট পর্যন্ত ট্রেনের যাত্রীরা স্টীমারে পারাপার হতো। আমি ঢাকায় আসছিলাম রাতের ট্রেনে। যমুনা পার হচ্ছিলাম শের আফগান নামে বড়ো একটি স্টীমারে। তখন ছিল ভরা বর্ষা কাল। সারা যমুনার বুক জুড়ে অথৈ পানি। সেদিন আকাশ ভরা তারা ছিল, পূর্ণিমার চাঁদ ছিল। এমনি শ্রাবন বর্ষারাতে সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে শের আফগান স্টীমারটি ছেড়ে চলে আসে।
আমি ডেকের যাত্রী ছিলাম। তৃতীয় ক্লাশের টিকেট আমার। সিটের উপর ব্যাগটি রেখে পাশের যাত্রীকে বলে আমি বাইরে রেলিং এর কাছে চলে আসি। তারুণ্যের বাঁধ ভাঙা বয়স তখন। রাতের যমুনা দেখবার জন্য অনেকটা দৌড়ে চলে যাই রেলিংয়ের পাশে। ভরা যমুনায় পানি ছলাৎছলাৎ করছে। পশ্চিম কুল ঘেষে স্টীমারটি চলছিল। রাতের নিস্তব্ধতা আর জলের শব্দের মাঝে পাড় ভাঙ্গনের শব্দ শুনছিলাম। আমি আবার চলে আসি পূর্ব রেলিংয়ে পাশে। পূর্ব আকাশে তখন উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। জলের অনেক উপর দিয়ে চাঁদটি যেন ভাসছে। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম চাঁদ, দেখছিলাম থৈথৈ জল, দেখছিলাম শ্রাবনের তারা ভরা আকাশ।
রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছিলাম অনেকটা সময়। তারপর আবার চলে আসি ডেকে, বসে পড়ি আমার সিটের উপরে। দেখি ঠিক আমার সামনে একজন বৃদ্ধ লোক এবং তার পাশে একটি মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি হয়তো বৃদ্ধের কন্যা হবে। তাকে একজন ছাত্রীর মতো মনে হলো। বৃদ্ধ লোকটি ক্লান্তিতে ঘুমাচ্ছে আর মেয়েটি জেগে আছে। মেয়েটি এত কাছে মুখোমুখি বসে আছে অথচ কোনো কথা নেই। ‘যেনো সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুরায় জীবনের সব লেনদেন। থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখী বসিবার বনলতা সেন। ‘
আমার ব্যাগের মধ্যে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’। আছে শামসুর রাহমানের ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। আছে সুনীলের ‘দাঁড়াও সুন্দর’ আর আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’। সুনীল থেকে ঐ মেয়েকে বলতে ইচ্ছা করছিল —
‘স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ
ছেঁড়া পৃষ্ঠা উড়ে যায়, না-লেখা পৃষ্ঠাও কিছু ওড়ে
হিমাদ্রি-শিখর থেকে ঝুঁকে-জড়া জলাপ্রপাতের সবই আছে
শুধু যেন শব্দরাশি নেই
স্পর্শটুকু নাও আর বাকি সব চুপ। ‘
আমি ঐ মেয়েকে মনে মনে বলছিলাম চুপ করে থেক না মেয়ে। তোমার চোখ বনলতা সেনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সুনীলের নীরার চোখে জল থাকলেও তোমার চোখে নেই। চলো বাইরে যেয়ে দেখি শ্রাবণের আকাশ। দেখ যেয়ে যমুনার জলে কি সুন্দর ভাসছে পূর্ণিমার চাঁদ। চলো রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে দুইজন চাঁদ দেখি। আকাশ ভরা তারাদের গুনগুন গান শুনি।
উপরে গুডস্ রাকে রাখা ব্যাগ থেকে ‘বনলতা সেন’ বইটি বের করার সময় হঠাৎ নিচে ঐ মেয়ের পায়ের কাছে বইটি পড়ে যায়। এবং বইটি উঠিয়ে সে আমার হাতে তুলে দেয়। এই প্রথম মেয়েটি আমার দিকে সরাসরি তাকালো। হঠাৎ আমার চোখের তারা যেন থেমে গেল তার চোখের তারায়। আমি বনলতা সেনের পাতা উল্টাতে থাকি —
‘তোমার মুখের্ রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না, খুঁজি না।
ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পান্ডুলিপি। ‘
স্টীমারের ইম্পেইলার যমুনার জলে গর্জন করছিল। ইঞ্জিন রুম থেকে ভেসে আসছিল যন্ত্রের বিকট শব্দ। ডেকে বসে থাকা মধ্যরাতের যাত্রীদের চোখে ঘুম তখন। সব শব্দ ভেঙ্গে ঐ মেয়েটি মৃদুস্বরে বলছিল — ‘ বনলতা সেন’কে আপনার খুব পছন্দ বুঝি? ‘
আমি : জ্বী।
মেয়ে : কোথায় যাচ্ছেন?
আমি : ঢাকা। আপনারা কোথায় যাবেন?
মেয়ে : সামনে সরিষাবাড়ী নেমে যাব।
ইঞ্জিন ঘর থেকে ভেসে আসা শব্দে কথা শুনতে অসুবিধা হচ্ছিল। আমাদের কথা বলা তাই থেমে গেল। বনলতা সেন আর পড়তে ইচ্ছা হলো না। রেখে দিলাম পাশের সিটের উপরে। স্টীমার গর্জন করে সামনের দিকে চলছে। মনটা কেমন উড়ো উড়ো লাগছিল। আবার দেখতে ইচ্ছে করছিল রাতের আকাশ, শুনতে ইচ্ছে করছিল যমুনার কুলকুল জলের ধ্বনি ।
দেখলাম ঐ মেয়েটি ঘুমে চোখ মুদে ফেলেছে। জানিনা সে হয়ত জাগারণে আছে, না হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সে কি ভাবছে আমার কথা? হয়ত না। আমি চলে আসি রেলিংয়ের ধারে। চাঁদ তখন পূর্ব আকাশ থেকে মধ্য গগনে চলে এসেছে। যে চাঁদ আমি হাসি খুশি রেখে গিয়েছিলাম, তাকে এখন বিষন্ন মনে হচ্ছে। জলের শব্দগুলিকে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা অস্ফুট কান্নার ধ্বনির মতো মনে হচ্ছিল।
হঠাৎ আবার সেই মায়াবী কন্ঠস্বর! বলছে সে আমাকেই — ‘ঘাট আর কতোদূর?’ মেয়েটি আমার পাশে এসে রেলিং ধরে দাঁড়ায়। আমরা দুই জনই দূরে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের বাতি খুঁজছিলাম। অন্ধকার ভেধ করে দেখা যাচ্ছিল অনেক দূরের বাতি। আমি বলছিলাম, হয়ত আর আধা ঘন্টার মধ্যে আমরা ঘাটে পৌঁছে যাব।
আলো আঁধারের মাঝেই আমরা দুই জন জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। একটু আগে যে চাঁদকে দেখে মন খারাপ লাগছিল, সেই চাঁদকে এখন দেখতে ভালো লাগছে। যমুনার জলের শব্দকে আনন্দ ধ্বনির মতো মনে হচ্ছে। জগতের সকল সুখ যেন জ্যোৎস্না ধারা হয়ে ঝরে পড়ছে যমুনার জলে। ভাবছিলাম – এই মেয়েটি এই চাঁদের রাতে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তাই নিজকে এতো ভালো লাগছে। আর যদি এই মেয়ে আমার সারা জীবনের জন্য হয়, না জানি কতো সুখের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে ভাসব আমি!
আবারও মায়া জড়ানো কণ্ঠ তারই — ‘কোথায় পড়েন।?’
আমি : ঢ়াকা সিটি কলেজে। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। বললাম — আপনি?
মেয়েটি : কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। এখন বন্ধ রেখেছি। কলেজে আর যাই না।
আমি : বন্ধ রেখেছেন কেন?
মেয়ে: সে অনেক কথা। বলা যাবে না।
আমি : আচ্ছা থাক্, না বললেন। আপনার নামটি কি?
মেয়েটি: কাকতালীয় ভাবে বলতে হয় ‘বনলতা সেন।’
শের আফগান স্টীমারটির ঘাটে পৌঁছবার প্রথম দূর সাইরেন বেজে ওঠে।
আমি : এত সুন্দর নাম আপনার! একদম জীবনানন্দের নাটোরের বনলতা সেন যেন!
বনলতা : কাকতালীয় ভাবে আবারও বলতে হয় — আমার বাড়িও নাটোরে।
আমি : বিশ্বাস করবেন, আপনাকে দেখার পর ঠিক কল্পনার সেই ‘বনলতা সেন’ এর মতো আপনাকে মনে হয়েছে । আমি বিস্ময়ে আপনাকে দেখছিলাম কেবল।
বনলতা : সত্যি তাই?
আমি : জ্বী।
স্টীমারটির ঘাটে পৌঁছবার দ্বিতীয় সাইরেন বেজে ওঠে।
আমি বনলতা সেনকে বলছিলাম — ‘আপনার সাথে আর কি কখনো দেখা হবে না? ‘
বনলতা সেন : অবশ্যই দেখা হবে। তুমি তোমার ঠিকানাটি আমায় লিখে দাও। আমি তোমাকে চিঠি লিখব।
আমি : তুমি সিটে চলো। এখানে কাগজ নেই। ‘বনলতা সেন’ বইটির পাতায় আমার ঠিকানা লিখে তোমাকে দিয়ে দেব।
শের আফগান স্টীমারের ঘাটে পৌঁছার শেষ সাইরেনটি বেজে ওঠে।
এতক্ষণে সেই বৃদ্ধ লোকটি বনলতা সেনের কাছে চলে আসে, এবং ধমকের সুরে বলে — ‘বৌমা, তুমি এখানে কি করছো? চলে এসো’।
স্টীমারটি তখন নোঙ্গর ফেলেছে। যাত্রীরা নামবার জন্য সবাই ছুটাছুটি করছে। একে একে সবাই নেমে যায়। আমার আর নামতে ইচ্ছা করছিল না। ঠাঁয় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি — পূর্ণিমার চাঁদ আর সেখানে নেই। ডুবে গেছে, না হয় মেঘে ঢেকে গেছে। রাতের গায়ে কেমন যেন আঁধার নেমে আসছিল। শেষ যাত্রীটি হয়ে আমি স্টীমারের সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নামতে থাকি।
‘হঠাৎ ভোরের আলোর মুর্খ উচ্ছাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে বুঝতে পেরেছি আবার,
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুনির্বার বেদনা
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে।’
১৯ . টিনটিন ন্যু
অনেক দিন আগের কথা। তখন বিয়ে করিনি। রাজধানীর পাশে অজো এক পাড়া গাঁও, নাম গাওয়াইর। এই গ্রামে ছিমছাম নিরিবিলি এক বাড়িতে আমি একা থাকি। সেদিন ছিল হিমেল শীতের রাত্রি। শৈত্য প্রবাহও ছিল। ইউনিভার্সিটির হলে বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়ে রাত নয়টার দিকে বাসায় চলে আসি। আমি যখন আসি, দেখি আশেপাশের দুই একটি বাড়িতে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে। দূরে বড়ো রাস্তায় গাড়ি হর্ণ বাজিয়ে চলে যাচ্ছে টংগীর দিকে। পুরো জনপদ নীরব তখন। আমি ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকি। সারা রুমময় অন্ধকার। বালিশের নীচে দিয়াশিলাই খুঁজতে থাকি। হঠাৎ রুমের ভিতরে আলো জ্বলে ওঠে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি একটি তিব্বতি ঘরানার মেয়ে। হাতে তার মাটির প্রদীপ। সলতেতে আলো জ্বলছে। ও বলে – ‘তুমি ভয় পেও না। আমার নাম টিনটিন ন্যু। আমি দূর পাহাড়ের একটি মেয়ে। আমি এ্যাঞ্জেল হয়ে রাতবিরাতে এমনিতেই ঘুরে বেড়াই। তুমি একা থাকো। আমি দূর হতে তা দেখতাম। তোমার জন্য আমার মায়া হয়। এই নাও, এই প্রদীপ খানি হাতে ধরো।’ আমি টিনটিন ন্যুর হাত থেকে প্রদীপটি হাতে নেই। এবার সে বলে, ‘তুমি চোখ বন্ধ করো। ‘ আমি দুই চোখ বন্ধ করি। তারপর আর কোনো কথা নেই। নিঝুম নীরবতা। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে দেখি – টিনটিন ন্যু নেই। হাতে আমার প্রদীপ জ্বলছে।
আর একদিন এইরকমই রাত নয়টার দিকে বাড়িতে ফিরি। ফেরার পথে আজিজের হোটেলে খেতে যাই । ইতালিয়ান টাইপের হোটেল। ভাত শেষ হয়ে গেছে। আজিজ মিয়া বলে – ‘ শীতের রাইত। কাস্টমার আসেনা স্যার। তাই অল্প স্বল্প রানদি। সব শ্যাষ অইয়া গ্যাছে।’ আমি অভূক্ত থেকেই ঘরে এসে লেপ মুড়ে দিয়ে সেদিনের মতো শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাই। কার যেন হাতের ছোঁয়ায় আমার তন্দ্রা ভেঙ্গে যায়। পাশ ফিরে দেখি, টিনটিন ন্যু আমার শিয়রে বসে আছে। পাখির পালকের মতো নরম আঙ্গুলের ছোঁয়ায় আমার মাথার চুল বিলিয়ে দিচ্ছে। কাঠের টেবিলে ল্যাম্প জ্বলছে। এই বাতিটি আমি নিভে দিয়েছিলাম শোবার সময়ে। টিনটিন ন্যু বলছিল – আমি দেখেছি তুমি না খেয়ে শুয়ে পড়েছ। আমি জানি, কিছু না খেলে তোমার ঘুম আসে না। তোমার জন্য তাই আমি হাজীর বিরিয়ানি কিনে নিয়ে এসেছি। ওঠো তুমি। খেয়ে নাও। ‘ আমি ওকেও খেতে বললাম কিন্তু খেল না সে। আমাকে যত্ন করে খাওয়ায়ে দিয়ে বলল — ‘এবার তুমি শুয়ে পড়ো। আমি মাথার চুল বুলিয়ে দেই। ‘ সকালে ষখন ঘুম ভাঙ্গে, দেখি, টিনটিন ন্যু নেই।
তখন কলাবাগানে আমার অফিস। একদিন ছুটির পরে অফিস থেকে হেঁটে হেঁটে গ্রীনরোড আসতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আমি ভিজে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে একটি মেয়ে এসে আমার মাথায় তার ছাতাটি মেলে ধরে। মেয়েটিকে আমি চিনতে পারছিলাম না। একই ছাতার নিচে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ফার্মগেট পর্যন্ত চলে আসি। ততোক্ষণে বৃষ্টি থেমে যায়। এবং মেয়েটি অন্য দিকে চলে যায়। বাসায় আসতে আসতে সেদিনও নয়টা বেজে গিয়েছিল। বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখি, আমার ঘরে বাতি জ্বলছে। রুমে ঢুকেই দেখি টিনটিন ন্যু আমার বিছানায় বসে আছে। পরনে তার পরীর মতো সাদা কারুকাজময় ঘাগরা। চুল সাদা ফিতা দিয়ে বাঁধা। খোঁপায় আর গলায় বেলী ফুলের মালা। ও খুব অভিমান করে বলছিল — ‘ তোমাকে ছাতা মাথায় ধরে নিয়ে এলাম, আর তুমি কিনা আমাকে চিনতে পারলে না।’
টিনটিন ন্যু বলছিল – ‘তুমি আমার হাত ধরো। চোখ বন্ধ করো।’ আমি তাই করলাম। তারপর ও বলল — এবার চোখ খোলো। আমি চোখ খুলে দেখি, সে এক শুভ্র আকাশ বাড়ি। ধবল মেঘরাশি তুলোর মতো চতুর্দিকে উড়ছে। পরম আবেশে দু’হাত দিয়ে টিনটিন ন্যু আমাকে জড়িয়ে ধরে। ও বলছিল তখন – ‘গানের মতো এ রাত, প্রাণের মতো এ ক্ষণ।’ এক অদ্ভূত মেঘে মেঘে আমরা ঢেকে যাচ্ছিলাম দু ‘জন। আমার দুই চোখ মুদে ঘুম পাচ্ছিল খুব এবং মেঘের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাই। যখন ঘুম ভাঙ্গে, দেখি টিনটিন ন্যু নেই।
কখনো সন্ধ্যারাতে, কখনো মাঝরাতে, কখনো বৃষ্টিমূখর বর্ষার রাতে টিনটিন ন্যু আমার ঘরে চলে আসত। কি এক মোহ আমাকে পেয়ে বসল আমি নিজেই মোহাবিষ্ঠ হয়ে অপেক্ষা করতাম ওর জন্য। আমি কোনো দিন কোথাও আর রাত কাটাতাম না। সন্ধ্যার মধ্যেই ঘরে ফিরে আসতাম, অপেক্ষা করতাম টিনটিন ন্যু ‘র জন্য। যেদিন ও আসত না, সেদিন সারারাত আমার চোখে ঘুম আসত না। এক জাদুর মায়ায় টিনটিন ন্যু ‘র সাথে আমি আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে যাই।
বাড়ি থেকে খবর আসত বাড়ি যাবার জন্য। কিন্তু আমি যেতাম না। যেতে মন চাইত না। জীবনের প্রতি, জগৎ সংসারের প্রতি কেমন উদাসীনতা চলে আসে। কাছের মানুষগুলোর সাথেও ভালো মতো কথা বলতে ইচ্ছা করত না। সব সময় একটি ঘোরের মাঝে থাকতাম। কিন্তু বাড়ি থেকে আমার এই উদাসিনতা বুঝতে পেরে আমাকে বিবাহ করানোর জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠে এবং বিয়ে ঠিক করে ফেলে।
যেদিন আমার গায়ে হলুদ হবে তার আগের রাতের কথা। সম্ভবত পঞ্চমীর চাঁদের রাত হবে সেদিন। সন্ধ্যার চাঁদ সন্ধ্যা রাতেই ডুবে গেছে। ঘরের চারদিকে আঁধার। সেদিন আমি নিজেই সন্ধ্যা প্রদীপখানি ঘরে জ্বালালাম। অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে পথের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হলো আজকের আকাশে কোনো তারা নেই। উত্তরের বাতাস থেকে কোনো সুর আসছে না। মৃদুমন্দ বাতাসেই বাঁশ ঝাঁড় থেকে মর্মর ধ্বনীতে মরা পাতাগুলি ঘরের চালের উপর ঝরে পড়ছিল।
রাত তখন অনেক হয়েছে । আধো ঘুম চোখে দেখতে পাই টিনটিন ন্যু চলে এসেছে। ওর পরনে পাহাড়ি পিরান। গালে তার চন্দন মাখা। গলায় বৈচী ফুলের মালা। এই মেয়েটিকে দেখেছিলাম কবে বান্দরবনের পাহাড়ি পথে পথে। উপত্যকার ঢালে অচ্ছূত ফুল হয়ে ফুটে আছে। সেকি কোনো স্বপ্ন দেখার কেউ ছিল? টিনটিন ন্যু আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ফুপরে ফুপরে কাঁদতে থাকে । কোনো কথাই আর সে রাতে বলল না। নীরবে ঘর হতে সে বেরিয়ে যায়। অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে পথের মাঝেই সে মিলিয়ে গেল।
তারপর টিনটিন ন্যু কোনো রাতেই আর আমার কাছে আসে নাই। আমি আমার মায়াবতী বউটিকে নিয়ে বেশ সুখেই আছি।
২০ . জ্যোৎস্না পড়ুক গায়ে
তার সাথে আমার কোনো রাগ নেই, কোনো অভিমানও নেই। তারপরও আমরা দুইজন দুইজনের সাথে ঠিকমতো কথা বলি না। আজ রিক্সায় আসছিলাম ওর মামার বাড়ি থেকে । সারা রাস্তা সে আমার সাথে কথা বলল না অথচ গোপনে গোপনে আমি তার চুলের গন্ধ নিচ্ছিলাম। উত্তরের এলমেল হাওয়ায় ওর মাথার এক গুচ্ছ চুল এসে পড়েছিল আমার গালে। মাঝে মাঝে ঢেকে যাচ্ছিল আমার চোখ। সে কি নির্বিকার ছিল, নাকি সেও দেখছিল এ সব।
একবার রমনা পার্ক থেকে বেরিয়ে মিন্টো রোড ধরে শেরাটনের দিকে আসছিলাম। বৃষ্টি নেই, রাস্তায় জল নেই, কোনো খানা খন্দক নেই। হঠাৎ শাড়ীর পাড়ে জুতা প্যাঁচ লেগে পা ফসকে পড়ে যাচ্ছিল সে। আমি আমার শক্ত হাতে তার বাহু ধরে ফেলি। দেখলাম তিরিশ সেকেন্ড আমার বুকে সে আলিঙ্গন বদ্ধ হয়ে থাকল। পথচারীরা সে দৃশ্য দেখে হতচকিত হয়ে উঠেছিল।
প্রায়ই খাট ছেড়ে সে সোফার উপর যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর সে দেখতে পেত, তার মাথার নিচে বালিশ রাখা আছে, আর শরীর তার চাদর দিয়ে ঢাকা। আমি খাটের উপর ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকি তখন। আমি জানি সে বিস্ময়ে দেখছিল তার রাতের বেলার এই পরিবর্তনগুলো।
আবার কোনো কোনো দিন উল্টোটাও হয়। একদিন খুব ক্লান্ত্ হয়ে অফিস থেকে ফিরেছি। বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই। যখন ঘুম ভাঙ্গে দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত দেড়টা বাজে। আমার চোখের চশমাটি সে খুলে ওয়্যারড্রবের উপর রেখে দিয়েছে। বুকের উপর পরে থাকা পত্রিকাটি ভাঁজ করে সাইড টেবিলে রাখা। খাবার টেবিলে খাবার সাজানো রয়েছে। সে সোফায় বসে মাথা হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম এসব। সে কি ঘুমের ভিতরে আমার এই বিস্ময় ভরা চোখ দেখতে পেয়েছিল?
খাটের দুই পাশে দুইজন শুয়ে আছি। কথা বলি না কেউই। মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। সারাদিন অফিসে কাজ করেছি। ক্লান্ত ছিল শরীর। তাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। সে ওপাশ ফিরে হয়ত জেগেই ছিল। রাতের শেষ প্রহরে যখন জেগে যাই, দেখি সে আমার বাহুর উপর মাথা রেখে বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার একহাত আমার পাজর জড়িয়ে রয়েছে। আমি নিঃশব্দে চোখ মেলে সবই দেখলাম। আমি জানি তার এই অবস্থাটি ঘুমের ঘোরে হয়েছে।
দেখা গেল,ডাইনিং টেবিলে বসে একসাথে দুইজন
খেতে বসেছি। আমার পাতের ভাত খাওয়া শেষ হয়েছে। সে আর দ্বিতীয় বার দিচ্ছে না। আমি চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ি। দেখলাম সেও পূর্ণ খাবার না খেয়ে উঠে চলে গেল।
সকাল বেলা অফিসে যাওয়ার সময় টাইয়ের নট বেঁধে দেয় না। আমিও বলতাম না — তুমি বেঁধে দাও। অফিস থেকে বিকাল বেলা বাসায় এসে দেখি, সে আর সেদিন তার চুল বাঁধেনি। চোখে কাজল নেই। হাতের চুড়ি রিনিঝিনি করে বাজে না।
কেন এই অস্বাভাবিক আচরণ তার? তখন আশ্বিনের মধ্য সময়। তাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। পরনে তার লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। বানের পানি নেমে গেলেও পুকুর ভরা ছিল জল। সন্ধ্যায় আম আর কদম গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা গেল। প্রগাঢ় আকুলতা দেখলাম তার ভিতরে। পুকুর পাড়ে বসে থাকবে সে, দেখবে রাতভর পূর্ণিমার চাঁদ।
পূরানো কাঠের চেয়ার পেতে বসে আছি দুইজন। সে বলছিল প্রথম কথা — সারারাত বসে থাকতে ইচ্ছে করছে এইখানে!
আমি : আমার সারা জীবনই বসে থাকতে ইচ্ছা হয়।
আমি : একটা গান গেয়ে শোনাও না।
সে : আমি তো গান গাইতে পারি না।
আমি : গুণ গুণ করে শুধু কথাগুলো শোনাও।
সে : ‘ একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে
ওগো বন্ধু কাছে থেকো, কাছে থেকো
রিক্ত আমার ক্ষুদ্র প্রাণে
তোমার আঁখিটি রেখো। ‘
আমি : এই গানটি আমার খুব প্রিয়। আমার এক বন্ধু এই গানটি খুব পছন্দ করত।
সে : কোন বন্ধু? নাম কি?
আমি : মানসী
সে : কেমন বন্ধু?
আমি : ভালো বন্ধু!
সে : সে এখন কোথায় থাকে ?
আমি : জানিনা কোথায় থাকে, হয়ত দূর পাহাড়ে সে ঘুরে বেড়ায়! অথবা চেঙ্গী ভ্যালীর বাঁকে বাঁকে, বনে বাদারে।
সে : তুমি তাকে মিস করো?
আমি : করি।
সে : আমি আর এই গান কোনো দিন গাইব না।
আমি : কেন?
সে : আমার আর চাঁদ দেখতে ইচ্ছা করছে না।
এইটি তার রাগ না অভিমান আমি এই ব্যাপারে খুব কনফিউজড্। সে আমাকে যে পাগলের মতো ভালোবাসে এটা আমি বুঝতে পারি। আমি অনুভব করতে পারি সে আমাকে এক দণ্ড না দেখে থাকতে পারেনা।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। দুপুরে খাবারের পর শুয়ে আছি। তাকে বললাম — এস, পাশে শোও। সে সোফায় যেয়ে শুয়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখলাম, দুই চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তারও কিছু পরে সে ঘুমিয়ে যায়। আমি তার মুখখানি দেখছিলাম। কিছু দুঃখ সেখানে ছেয়ে আছে। সে এখনো নিতান্তই একজন বালিকা। ওকে তৈরি করতে হবে যে আমাকেই।
আমার আর ঘুম এল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। টেবিলের কাছে বসে লিখছিলাম —‘ তুমি আগের মতো চুল বাঁধো না কেনো মেয়ে? দুই বেনী বেঁধে খুকু হয়ে যাও। পায়ের আলতা তুলে আবার আলতা লাগাও। যখন তুমি আলতা উঠাও তখন তোমার পা আরো গোলাপি হয়ে যায়। আমি সুন্দর আলপনা আঁকতে পারি। এস তোমার পায়ে আলপনা এঁকে দেই। আমি দেখছি তোমার আনত মুখ! ঐ মুখে দুঃখ রাখতে নেই। তুমি জেগে থাকলে তোমাকে নিয়ে তুরাগ নদীর পারে নিয়ে যেতাম। এই মায়াবী সন্ধ্যায় দু’জনে বসে থাকতাম নদীর তীরে। আজও তো পূর্ণিমা সেখানে। আমরা দেখতাম অসম্পূর্ণ সেই পূর্ণিমা তিথি। যা তুমি একদিন না দেখে চলে এসেছিলে। ‘
অনেকটা মন খারাপ করেই ঘর হতে বেরিয়ে যাই। পাশেই রেলস্টেশন। একাকী হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে চলে যাই। চা ‘র দোকানে বসে চা খাই। একটা লোকাল ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ানো ছিল। ট্রেনটি হুইসেল বাজিয়ে ছেড়ে চলে গেল। আমি শুন্য পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কতোক্ষণ। মনটা ভালো করতে পারলাম না। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাত নয়টার দিকে বাসায় চলে আসি।
ঘরে এসে দেখি সে একটা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে বিছানায় পা মেলে বসে আছে। সন্ধ্যা মালতী ফুল দিয়ে খোঁপা বাঁধা তার। কপালে কালো টিপ পরেছে অপর্ণা সেনের মতো। আজ ওকে দেখে আর বালিকা মনে হলো না। যেন সে একজন সম্পূর্ণ রমণী। পাশে তার আলতার বাটি। সে বলছিল — ‘পায়ে আলপনা এঁকে দাও। ‘
আমি তার পায়ে আলপনা এঁকে দেই।
রাতে দুইজন পাশাপাশি শুয়ে আছি। জানালা
দিয়ে পূর্ণিমার আলো এসে আছড়ে পড়ছিল ঘরে।
আমি বলি — ‘জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি।’ সে বলছিল — ‘খোলাই থাক্। জ্যোৎস্না এসে পড়ুক আমাদের গায়ে! ‘
২১ . একাকী সী-গাল
ক্যাপ্টেন সাহেব যখন বাসায় আসলেন তখন রাত্রি বারোটা। তার স্ত্রী কুমকম মির্জা তখন সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ক্যাপ্টেন জুতার খটখট শব্দ তুলে সোজা বেডরুমে চলে যায়। তার পায়ের শব্দে কুমকুমের ঘুম ভেঙে যায়। কুমকুম যেয়ে দেখে তার স্বামী সু পায়ে দিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়েছে এবং চোখ বন্ধ করে রয়েছে। কুমকুম তাকে ডাকল কিন্তু সে আর উঠল না। এতক্ষণ কুমকুম না খেয়েই তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। সেই রাতে কুমকুমের আর খাওয়া হলো না।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই ঝরঝর বৃষ্টি হচ্ছিল। কখনো হালকা দমকা বাতাস। দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে থাকে কুমকুম, একে একে রাত বারোটা, এক টা, দুই টা বেজে গেল। তারপর এক সময় ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে কুমকুম ঘুমিয়ে পড়ে। রাতের আলোছায়ার ভিতরে ক্যাপ্টেন রেইনকোট গায়ে দিয়ে বৃষ্টিমুখর রাতে একাকী বড়ো রাস্তা থেকে হেঁটে হেঁটে বাসার গলিতে প্রবেশ করে। বাসার দরজায় যখন নক্ করে তখন রাত্রি আড়াইটা। কুমকুম দরজা খুলে দেয়। ক্যাপ্টেন সোজা বেডরুমে চলে যায়।
কুমকুম: খাবে না তুমি?
ক্যাপ্টেন : না, খেয়ে এসেছি।
কুমকুম নিজেই আজ স্বামীর পায়ের জুতা খুলে দেয়। ক্যাপ্টেন বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে এবং ঘুমিয়ে পড়ে। আজ রাতেও আর কুমকুমের খাওয়া হলো না।
সকালে যখন ক্যাপ্টেন বেরিয়ে যায়, তখন সে কুমকুমকে বলে – দুই দিন বাসায় ফিরব না।
কুমকুম : কেন, কোথায় যাবে?
ক্যাপ্টেন : মংলা পোর্ট, খুলনা।
কুমকুম : আমার একাকী ভালো লাগে না।
ক্যাপ্টেন শুনল কিনা সে কথা বোঝা গেল না। সে কোনো কথা না বলে গলির পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে বড়ো রাস্তার দিকে চলে গেল। কুমকুম শুধু তার স্বামীর চলে যাওয়াটাই দেখল। কিন্তু ক্যাপ্টেন পিছনের দিকে আর ফিরে তাকাল না।
ক্যাপ্টেন মংলা থেকে এসে তিন দিন ঢাকায় ছিল। এই তিন দিনও সে অধিক রাতে বাড়ি ফিরেছে। এই তিন দিনও কুমকুম স্বামীর জন্য অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। কখনও ঘুমে কখনও নির্ঘুমে বসে থেকেছে। ক্যাপ্টেন এবার পাঁচ দিনের জন্য চট্টগ্রাম পোর্টে চলে যায়। চট্টগ্রাম থেকে যথারীতি আবার ঢাকায় চলে আসে।
একদিন ক্যাপ্টেন সকালে নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার জন্য বের হবে, তখন কুমকুম স্বামীর কাছে এসে বলে – কখন ফিরবে বাসায়?
ক্যাপ্টেন : কেন? আজও রাত হবে।
কুমকুম : তুমি বাসার চাবিটি তোমার কাছে রাখো।
ক্যাপ্টেন : কেন?
কুমকুম : আমি একটু বড়ো আপার ওখানে যাব। আজ নাও আসতে পারি।
ক্যাপ্টেন : ঠিক আছে, চাবি দাও।
ক্যাপ্টেন আজ রাতে যখন বড়ো রাস্তা দিয়ে একাকী হেঁটে হেঁটে গলিতে ঢুকেছিল, তখন মহল্লায় বিদ্যুৎ ছিল না, আজকের আকাশে কোনো চাঁদও নেই । রাত তখন বারোটার উপরে বাজে। নির্জন অন্ধকারে শুধু তার জুতার খটখট শব্দ শোনা যাচ্ছিল। জনশূন্য রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে বাসায় চলে আসে। প্রতি দিনের মতো আজও সে দরজায় নক করে। কিন্তু ভিতরে থেকে কেউ দরজা খুলে দিল না। হঠাৎ তার মনে হলো, ঘরের চাবি তো তারই কাছে!
তালা খুলে ক্যাপ্টেন যখন ঘরে প্রবেশ করে, দেখে ভিতরে নিঃসিম এক আঁধার। দিয়াসলাই দিয়ে সে আলো জ্বালায় একবার। কিন্তু সে আলো নিভে যায়। অন্ধকারেই সোফার উপরে যেয়ে বসে পড়ে। প্রায় তিরিশ মিনিট পর বিদ্যুৎ চলে আসে। সে রুমের সুইসগুলো জ্বালিয়ে দেয়। বুকের ভিতরে শুন্যতায় হূহু করে ওঠে। আজ আর কেউ অপেক্ষায় নেই। টেবিলে কোনো খাবারও রেডী নেই। সে খেয়েও আসে নাই। রাতে তার আর খাওয়া হলো না। পায়ের জুতোও কেউ খুলে দিল না। জুতা পায়ে রেখেই সে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়ে এবং ঘুমিয়ে যায়।
সকালে ক্যাপ্টেনের যখন ঘুম ভাঙে তখন আর সকাল ছিল না। অনেক বেলা হয়ে গেছে তখন। বিছানা থেকে উঠে বসে সে। বালিশ সরাতে যেয়ে দুই বালিশের মাঝে সে একটি চিঠি দেখতে পায়। চিঠিটি কুমকুমের লেখা।
” প্রিয়তম, মনকে তৈরি করছিলাম অনেক দিন ধরে। তুমি আমাকে একটা মুহূর্ত বুঝতে পারোনি। অসীম একাকীত্ব আর তোমার অবহেলা প্রতিদিনই তোমার থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাই আজ আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। তুমি আমাকে কোনোদিন খুঁজবে না। সন্ধ্যায় বাসার সামনে গলি আর বড়ো রাস্তা পর্যন্ত আমি আজও তাকিয়েছিলাম। এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন তোমার চলে যাবার দিকে আমি তাকিয়ে থাকতাম। একটু পর চাঁদহীন এই রাতে এই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমি অনেক দূর চলে যাবো। অথচ তুমি আমাকে দেখতে পাবেনা। “
অনেক বেলা করেই ক্যাপ্টেন আজ ঘর হতে বের হলেন। বাসার সামনে গলিতে নামতেই দেখে ঠিক সামনের বাসার কাছে কতোগুলো মানুষের ভীড়। জানতে পারে সাবলেটে থাকা এক যুবক গতরাতে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। ক্যাপ্টেন মুহূর্তে বুঝতে পারে পুরো ঘটনাটি। এরপর দিন কয়েক ঐ বাড়িতে ক্যাপ্টেন ছিল। তারপর সে ঐ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।
যে থাকে, যখন থাকে, অন্তরে অন্তরেই থাকে। বোঝা যায়না তা। সে ভালবাসা অনেক সময় দূরেরও হয়ে যায়। সে তখন প্রকৃতই একা হয়। বড়োই মায়া হয় ক্যাপ্টেনের জন্য। কিন্তু কুমকুমের জন্য নয়। কী আশ্চর্য! কেন? অথচ তারই তো সহানুভুতি প্রাপ্য ছিল। তবু কেন জানিনা বৃষ্টি নামলে আজও ক্যাপ্টেনকেই মনে পড়ে। হতভাগ্য একজন মূর্খ দুঃখী। আজও সে না জানি কোন বন্দরের সোঁ সোঁ লোনা হাওয়ায় সী-গালের ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে। বুড়ো চামড়ার গালে অনেকদিনের দাড়ি। কেউ একবারও তাকে বলেনা, এত কষ্টভোগের পরও তুমি তাকেই চাও? যাকে কারণে অকারণে এত অবহেলা করেছিলে?
ক্যাপটেন কি কাউকে জবাব দেয়? নাকি বালির ওপর অস্তসূর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে হেঁটে হেঁটে সে কোনো অচিনপুরের দিকে চলে যায়?
২২ . আজি ঝড়ের রাতে
বিয়ের কয়েক মাস পরের কথা। স্ত্রী বাপের বাড়ি নাইওর চলে গিয়েছে। সকালবেলা খবরে কাগজ পড়ে জানতে পারলাম, আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। জানালা খুলে দেখি, বাইরে সত্যি সত্যি বৃষ্টি হচ্ছে। মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল। এমন বাদল দিনে আমি একা। ঘরে সে নেই। বিটিভি অন করতেই জানা গেল আবহাওয়ার খবর। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ শুরু হয়েছে। এ রকম মেঘলা বৃষ্টি থাকবে নাকি আরো তিন দিন।
ঘর থেকে বৃষ্টির মধ্যেই বড় কালো ছাতাটি নিয়ে বের হই। প্রথমে আজিজের হোটেলে গরম পরোটা খেয়ে নেই। তারপর চলে যাই অফিসে। অফিস থেকে ফিরে আসি সন্ধ্যায়। রাতেও ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাই আজিজের হোটেলে। শুনলাম ওরা নাকি আজ কচু দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না করেছে। আমি ইলিশ মাছের অর্ডার দিলাম। মাছ দিয়ে ভাত খেতে বসেছি . তখন বেয়ারা এসে বলল- ‘স্যার রুই মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডালের ঘন্টো রান্না করা আছে, দিবো নাকি?’ আমি বললাম- দাও । হোটেলে ভাত খেয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মোরে দিয়ে ঘরে চলে এলাম।
বাড়িতে আর কেউ নেই। রাতে একা একা বিছানায় শুয়ে আছি। গ্রামীন পরিবেশ। বাংলো টাইপের ঘর। টিনের চালের উপর ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে ঝরো বাতাসও বইছে। হঠাৎ করেই জানালার কাঠের পাল্লা বাতাসে শব্দ করে দুলে ওঠে। ঘরের পশ্চিম পাশে বাঁশ ঝাড়। দমকা বাতাসে হেলানো বাঁশগুলো টিনের চালে ঘর্ষণ লেগে বিকট শব্দ হচ্ছিল। একা একা একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম। ঘুমও আসছিল না। বিছানা থেকে উঠে এক পাশে এসে বসি। বৃষ্টি তখনও অঝোর ধারায় ঝরছে। খুব ইচ্ছা হলো রাতের এই বৃষ্টি দেখতে। দরজা খুলে বাইরে চলে আসি। ঘরের চাল থেকে বৃষ্টির জল তখন গড়িয়ে পড়ছে। আমি হাত দিয়ে সে জল ধরি। বাইরে নিস্তব্ধ নির্জন অন্ধকার। দূরে কেবল এয়ারপোর্ট টার্মিনালের আলোটাই দেখা যাচ্ছিল।
আমি ঘরের ভিতর এসে আবারও শুয়ে পড়ি। ঘুমাবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঘুম আসছিল না। বাইরে বাঁশ ঝাড়ে কোঁত কোঁত করে পেঁচা ডেকে উঠল। তার কিছু পরে বিমান বন্দর স্টেশনে ট্রেনের হুইসেলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি শুয়ে আছি, জানালাটা আরো একবার ঝরো বাতাসে দুলে ওঠে। হঠাৎ বাইরে বারান্দার গেটে কড়া নারার শব্দ শুনতে পাই। একটু ভয়ই পাচ্ছিলাম, তারপরও উঠে দরজা খুলে বারান্দায় চলে আসি। দেখলাম, আমার স্ত্রী বাইরে দাঁড়ানো। পরনের সালোয়ার কামিজ বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে। আমি এত রাতে তাকে দেখে বিস্মিত হই। গেট খুলে দেই। সে ভিতরে প্রবেশ করে।
ঘরের ভিতর আমার বিছানায় এসে সে বসলো। হাতে ওর একগুচ্ছ ভেজা কদমফুল। ফুলগুলো আমার হাতে দিয়ে বলল- ‘আজ এই প্রথম বর্ষার রাতে তোমাকে আমার ভালোবাসায় সিক্ত করলাম।’ আমি ফুলগুলো হাতে নিয়ে তার সুবাস নেই, তারপর বলি – ‘হঠাৎ এত রাতে কি ভাবে তুমি এলে ?’
স্ত্রী: ট্রেনে চলে এলাম। পথে কোনো অসুবিধাই হয় নাই।
আমি : তোমার তো আরো পরে আসার কথা ছিল, এত তাড়াতাড়ি চলে আসলে যে ?
স্ত্রী : সকালে বৃষ্টি দেখে তোমার কথা খুব মনে পড়ল। তুমি বৃষ্টি পছন্দ করো এবং সেই বৃষ্টির সময়ে আমি তোমার কাছে থাকব না তা কি করে হয় ? এটা মনে করেই তোমার কাছে চলে এলাম।
আমি : এই ফুল কোথায় পেলে ?
স্ত্রী: রাজেন্দ্রপুর স্টেশন থেকে কিনেছি।
সে তার গায়ের ভেজা জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিল। হঠাৎ এই বৃষ্টির রাতে ওকে পেয়ে চিত্ত আমার আনন্দে ভরে উঠল। আষাঢ়ের প্রথম দিনে সকালবেলায় যে শূন্যতা অনুভব করছিলাম, আজ এই রাতে তাকে কাছে পেয়ে মন প্রাণ পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। দেখলাম, সে একটি সাদা রঙ্গের সালোয়ার কামিজ পড়েছে। মূখে কোনো সাজ সজ্জা করা নেই। নির্মল প্রকৃতির মতো মুখ। কবেকার সেই লোধ্ররেণুও সে মাখেনি। পায়ে তার রূপার নুপুরটাও আজ পরে নাই। বৃষ্টির রিনঝিন ধ্বনি যেন তার পায়ে বাজছে। এই বৃষ্টি ঝর ঝর বাদল দিনে স্টেরিওতে কোমল মৃদমন্দ সুরে গান শুনতে ইচ্ছা করল–
‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার॥
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম, নাই যে ঘুম নয়নে মম–
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার॥
বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন্ নদীর পারে, গহন কোন্ বনের ধারে
গভীর কোন্ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার।’
গান বাজতে বাজতে একসময় গান থেমে যায়। বাইরে বৃষ্টির ধারা প্রবল হতে থাকে। দমকা বাতাস ঝড়ের রূপ নেয়। ঝুম ঝুম শব্দে ভরে উঠল বাইরের পৃথিবী। কে কবি কখন লিখেছিল– ‘এমন দিনে কি তারে বলা যায় !’ অথবা ‘দুঁহ করে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।’ তারপর বৃষ্টির রিমঝিম স্বপন দোলায় কখন ঘুমিয়ে গেছি, জানি নাই।
সকালে দেরি করেই আমার ঘুম ভাঙ্গে। বাইরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছিল। পাশে ফিরে দেখি বিছানায় সে নেই। ভাবলাম, আগেই ওর ঘুম ভেঙ্গেছে । হয়তো সে স্নান ঘরে গেছে। অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষণ, কিন্তু সে আসে না। খুঁজলাম এ রুম ও রুমে, কোথাও সে নেই। ঘরের দরজা এবং বারান্দার গেটও বন্ধ। বিস্ময়ে ভাবছিলাম- তাহলে কোথায় গেল সে ! আলনায় রাতের ভেজা সালোয়ার কামিজ মেলে দেওয়া দেখলাম। খাটের কাছে যেয়ে দেখি– রাতের কদম ফুলগুলো এলমেল হয়ে বিছানার উপরে পড়ে আছে।
২৩ . এ নহে কাহিনী
অনেকদিন আগের কথা। রাজশাহী থেকে ট্রেনে ফিরছিলাম সিরাজগঞ্জ। রাত আটটার দিকে ট্রেন সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশনে এসে পৌঁছে। শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে আমাদের গ্রামের বাড়ি। বাড়িতে যাবার তখন কোনো পাকা রাস্তা ছিল না। কোনো রিক্সাও চলত না। হেঁটে যেতে হতো অথবা টমটমে কিংবা গরুর গাড়ীতে। টমটমও সব সময় পাওয়া যেত না। আমি স্টেশনে নেমে খুঁজছিলাম টমটম কিন্তু কোথাও দেখছিলাম না। হেঁটে হেঁটে চলে আসি স্টেশন রোডের মোড়ে। দেখি কড়োই তলায় একটি টমটম দাঁড়িয়ে আছে। সাধারনতঃ সন্ধ্যার পরে কোনো টমটমই রাজি হয়না গ্রামে যেতে। তারপরেও কাছে যেয়ে কোচোয়ানকে বললাম — তুমি যাবে ?
কোচোয়ান: কোথায় যাবেন ?
আমি : ছোনগাছা হাট।
কোচোয়ান : শালুয়াভিটা খেয়াঘাট পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তারপর আর যাব না।
আমি : আমি যদি তোমাকে দেড়গুণ বেশি টাকা দেই।
কোচোয়ান : যদি খেয়া নৌকা টমটম পার করে, তবেই যাব।
আমি : ঠিক আছে, তাই হবে। চলো।
আমি উঠে বসলাম টমটমে। কোচোয়ানকে দেখে ভালোই মনে হলো। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। টমটম শহর থেকে বের হয়ে কাটাখালি নদীর তীর ধরে চলতে থাকে। নদীর তীরে এসে দেখি — পূর্ব আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে । কাটাখালি নদীর ওপাড়েই ভাঙ্গাবাড়ি গ্রাম। সেই গ্রামের মাথার উপর দিয়েই চাঁদটি দেখা যাচ্ছে। সারা লোকালয় আর প্রান্তর যেন জ্যোৎস্নার প্লাবনে ভেসে গেছে। আমার মনটা খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ভাবলাম,এই পূর্ণিমার আলোর নীচ দিয়ে পথ চলতে ভালোই লাগবে।
নদীর ওপারে ভাঙ্গাবাড়ী গামটি দেখে মনে পড়ল স্কুলে পড়ার সময় সহপাঠিনী ঝর্ণার কথা। ঝর্ণা বাগবাটী স্কুলে আমার সাথে পড়ত। মেট্রিক পরীক্ষার পর ওর বিয়ে হয়ে যায় । শুনেছি এই ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামেই ঝর্নার বিয়ে হয়েছে। আজকের এই পূর্ণিমার চন্দ্রভূক রাতে হঠাৎ মনটা উদাস হয়ে উঠল ঝর্ণার জন্য। মনে হলো কোচোয়ানকে বলি, টমটমটি ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামের দিকে ঘুরিয়ে দিতে। একটু দেখে যাই আমার সেই প্রিয় সহপাঠিনী ঝর্ণাকে।
ঝর্ণা ছিল নিতান্তই গ্রামের সহজ সরল একটি মেয়ে। আমাদের ক্লাশে আটজন মেয়ে পড়ত। ওদের সাথে বেশি কথা বলার সুযোগ হতো না। স্যাররা ক্লাশে আসার সময় কমনরুম থেকে ওদের নিয়ে আসত, আবার ক্লাস শেষ হলে ওদেরকে আবার নিয়ে যেত।একবার আমার কাছ থেকে ঝর্ণা ‘এ নহে কাহিনী’ নামে একটি বই নিয়েছিল। বইটি তখন গল্পের বই হিসাবে ক্লাস সেভেনে আমাদের পাঠ্য ছিল। বইটি যখন ঝর্ণা আমাকে ফেরৎ দেয়, তখন খুলে দেখি, ভিতরে একটি ঝাঁও গাছের ঝিরিঝিরি পাতা।
আরেকবার তখন ক্লাস নাইনে উঠেছি। ঝর্ণা আমার কাছ থেকে এ্যালজাবরা নোট খাতাটি চেয়ে নিয়েছিল। খাতাটি যখন ঝর্ণা ফেরৎ দেয়, দেখি খাতার ভিতরে একটি কাগজ ভাঁজ করা। খুলে দেখি কাগজটিতে কোনো কিছু লেখা নেই। শুধু একটু জল ছাপ বোঝা গেল। আমি বাড়িতে যেয়ে কাগজটি জলে ভিজাই। দেখলাম, সেখানে জলছাপে লেখা আছে – ‘ ঝর্ণা + আমার নাম।’
সেদিন মেট্রিক পরীক্ষার ফরম ফিল আপ করার শেষ দিন ছিল। ঝর্ণাকে দেখলাম, খুব বিষণ্ণ। আমার সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ খুঁজছিল। আমি বুুঝতে পারছিলাম, হয়তো ঝর্ণার সাথে আর কোনো দিন দেখা হবেনা। আমারও মন খারাপ লাগছিল- ভাবছিলাম, মেয়েটিকে না হয় ভালোবাসি নাই, কিন্তু মায়া তো করেছি। ওকে দেখে আজকেও খুব মায়া হলো। আমি ওর কাছে এগিয়ে যাই, বলি- পরীক্ষার রেজাল্টের পর কোন্ কলেজে তুমি ভর্তি হবে ?
ঝর্ণা : জানিনা, বাবা আর পড়াবে কিনা, তাও জানিনা।
আমি : পড়া বন্ধ করো না।
ঝর্ণা : হুম। তুমি কোথায় ভর্তি হবে ?
আমি : ঢাকায় চলে যাবো।
ঝর্ণা: তোমার সাথে আর দেখা হবেনা ?
আমি : হয়ত হবে, হয়ত না।
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। ঝর্ণার সাথে আমার আর দেখা হয় নাই। শুনেছি মেট্রিক পরীক্ষার পর এই ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে ঝর্ণার বিয়ে হয়েছে। অনেকদিন পর্যন্ত ‘এ নহে কাহিনী’ র ভিতরে ঝর্ণার দেওয়া সেই ঝাঁউ গাছের পাতাটি রেখে দিয়েছিলাম। এক সময় পাতাটি শুকিয়ে অস্তিত্ব চিহ্নহীন হয়ে যায়। তারপর ঝর্ণাকে ধরতে গেলে এক প্রকার ভুলেই যাই।
আজ এই হেমন্ত পূর্ণিমা রাতে, এই বাঁধভাঙ্গা জ্যোৎস্নায় ,দুরের ঐ ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামটি দেখে ঝর্ণার কথা খুব মনে পড়ছে। একসময় কাটাখালী নদীর কাঠের পুল আমরা অতিক্রম করি। ঘোড়ার পায়ের খটখট শব্দে রাতের নির্জনতা ভেঙ্গে চলতে থাকে টমটম। রহমতগঞ্জের কবরস্থানটি অতিক্রম করে আরো কিছুদূর চলে যাই। গা’টা একটু ছমছমই করছিল। নির্জন দুই রাস্তার মোড়ে ,যেখানে ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামের শেষ প্রান্ত। সেখানে দেখতে পাই- অদূরে বটগাছের নীচে বসে একটি মেয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে। কোচোয়ান লোকটিকে বললাম- ‘ঐ বটগাছের নীচে আমাকে নিয়ে যাও’ কিন্তু কোচোয়ান আমার কথা শুনল না। বলল- ‘ভাই, ওদিকে আমাদের যাওয়া ঠিক হবেনা।’
আমার কাছে মনে হয়েছিল- ঝর্ণাই এ রকম করে বসে বসে ওখানে কাঁদছে। ও হয়তো আমাকেই বলতে চাইছে, ‘তুমি তোমার টমটমে তুলে আমাকে নিয়ে যাও। ওরা খুব অত্যাচার করে।’ ভাবলাম কোচোয়ানকে আবার বলি- ‘টমটমটি ঐ বটগাছের দিকে ঘুরিয়ে দিতে’।
দেখলাম- কোচোয়ান ততোক্ষণে ঘোড়ার পিঠে জোরে চাবুক মারছে। ঘোড়াটি তখন আরো জোরে পায়ের খটখট শব্দ তুলে শালুয়াভিটা খেয়াঘাটের দিকে দৌড়ে চলে যাচ্ছে।
২৪ . নদীর কূলে খুঁজি তারে
অনেক বছর আগের এই কাহিনি । ইছামতি নদীতে তখন হেমন্তেও জল থাকত। শান্ত সৌম্য স্রোত কার্তিক মাসেও তা প্রবাহমান হতো। এই নদীর তীরেই গারোদহ গ্রাম। গ্রামের উত্তর প্রান্তে খোলা মাঠে ছিল অনেক জীর্ণ পুরানো একটি মঠ। এর পলেস্তারার ফাঁকে অনেক লতা গুল্ম জন্মেছে। মঠের বয়স কত শত বৎসর হবে তা কেউ বলতে পারে না। এই মঠে কার দেহ ভস্ম রাখা হয়েছিল, তার কোনো কিংবদন্তীও নেই।
মঠের অদূরে একটি পাকুড় গাছতলায় প্রতিবছর ছোট্ট আকারে কার্তিক মাসের কৃষ্ণতিথির শেষ তিন দিনে মেলা বসত। দূর দুরান্ত থেকে কিছু সাধু সন্ন্যাসী আসত এখানে। সারারাত গান হতো। কীর্তন, ভজন সহ নানান গান গাওয়া হতো। এখানে বিভিন্ন রোগীরাও আসত। ধর্মীয় অর্চণার মাঝে তারা রোগ মুক্তির প্রার্থনা করত। দূরের মানুষদের জন্য অস্হায়ী ধর্মশালারও ব্যবস্হা করা থাকত ।
মঠের পাশে সেবার মেলা শুরু হয়েছে। এই গারোদহ গ্রামেই কানাইদেব বর্মণের বাড়ি। বর্মণরা ছিল খুব রক্ষণশীল। পরিবারের মেয়েরা খুব বেশি বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পেত না। এই বর্মণবাড়ির কিশোরী মেয়ে পিয়ালী। বয়স কতোই হবে, এগারো বারো । পিয়ালী মেলা দেখবার অনুমতি পায় বাবার কাছ থেকে। কিন্তু সাথে যাবে ওর দিদিমা।
মেলার শেষ দিনে পিয়ালী ওর দিদিমার সাথে মেলায় যায়। তখন পরন্ত বিকেল। ধানক্ষেতের আলপথ দিয়ে, নদীর তীর ধরে হেঁটে হেঁটে মেলার দিকে যাচ্ছিল। মঠের কাছাকাছি নদীর কুলে বকুলতলায় একাকী এক বালক করুণ সুরে বাঁশি বাজাচ্ছিল। সুরটি ছিল রজনীকান্তের একটি গানের। দিদিমা আগে, পিছে পিছে পিয়ালী। ওরা ঐ বালকটির কাছাকাছি যেতেই বালক তার বাঁশি বাজানো বন্ধ করে দেয় এবং মুখ ফিরিয়ে পিয়ালীকে পলকহীন ভাবে দেখতে থাকে। পিয়ালীও বালককে অতিক্রম করার পরও পিছেনে ফিরে বার বার দেখছিল।
তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পিয়লী আর ওর দিদিমা মেলা থেকে ফিরছিল ঐ পথ দিয়েই। ছেলেটি তখনো বসেছিল বকুলতলায়। তখনো সে বাঁশি বাজাচ্ছিল। পিয়ালীকে দেখে বালক বাঁশি বাজানো বন্ধ করে। এবারও বালক নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে পিয়ালীর দিকে। পিয়ালী ওর হাঁটা ধীর করে ফেলে। দিদিমা পিছনে না খেয়াল করেই সামনে অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায়। তখন সন্ধ্যার আঁধার বেশ কালো হয়ে উঠেছে। পিয়ালী এগিয়ে বালকটির কাছে যায়। পিয়ালী বলে: ‘তুমি কই থেকে এসেছ ?’ বালক যে গ্রামের নাম বলে, পিয়ালী তা চিনতে পারেনা।
পিয়ালী: তুমি অনেক সুন্দর বাঁশি বাজাও।
বালক: হু।
পিয়ালী: তুমি আমাকে অমন করে তাকিয়ে দেখছিলে কেন ?
বালক: আমার চোখে খুব অসুখ। বাবা আমাকে এখানে আজ সকালেই নিয়ে এসেছে। কাল সূর্য ওঠার আগেই আমরা চলে যাব। আমি যদি অন্ধ হয়ে যাই, তাই তোমাকে দেখছিলাম বেশি করে। অন্ধ হয়ে গেলেও তোমাকে যেন মনে রাখতে পারি। কিন্তু এই সন্ধ্যা রাতের আবছায়ায় তোমাকে যতোটুকু দেখলাম তা আমার মনে থাকবে না।
ওর কথা শুনে পিয়ালীর মনটা একটু খারাপ হলো। মেলা থেকে কেনা বাঁশিটি সে ছেলেটিকে দিয়ে দেয়। আর ছেলের হাতের বাঁশিটি কেড়ে নিয়ে দ্রুত হেঁটে দিদিমার কাছে চলে আসে।
তারপর সাত বছর চলে গেছে। পিয়ালী এখন তন্বী তরুণী। বাবা কানাইদেব বর্মণ অনেক দেখে শুনে পিয়ালীর বিবাহ ঠিক করলেন। ছেলে এগারো মাইল দূরে কালোকুশি গ্রামের। ছেলে রায় পরিবারের। খুবই ভালো, অমায়িক, ভদ্র, রুচিবান, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সে।
এক শ্রাবণ বর্ষার দিনে ইছামতি নদী দিয়ে পানসি নৌকায় করে বরযাত্রীরা চলে আসে। চারিদিকে রাশি রাশি আনন্দ বইছে। রাত তখন গভীর, সবাই বলছে- এখন লগ্ন হয়েছে। ব্রাহ্মণ বিবাহের মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। সানাই বেজে উঠল। পিয়ালী শ্যামল কৃষ্ণ রায়ের সাথে সাত পাকে বাঁধা পড়ল।
স্বামীর ঘরে যেয়ে পিয়ালী সংসারের প্রতি অমনোযোগী ছিল। স্বামী শ্যামল কৃষ্ণ রায়কে খুব একটা দেখ্ ভাল্ করত না। কালোকুশী গ্রামের পাশ দিয়েও ইছামতি নদী বহমান। ঘরের জানালা খুললেই ইছামতি নদী দেখা যায়। পিয়ালী প্রায়ই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকত। নদীর দিকে উদাস দূষ্টিতে তাকিয়ে জল দেখত। কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকত সে। কেমন যেন পাগলিনীর মতো। পিয়ালী কারো সাথে ভালোভাবে কথা বলত না। ঠিকমতো নাওয়া খাওয়া করত না। স্বামী শ্যামল কৃষ্ণ উজার করে তাকে ভালোবাসা দিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো প্রেম, কোনো মায়া মমতা পিয়ালীকে আচ্ছন্ন করতে পারে নাই।
এমনিভাবেই দশ বছর কেটে গেছে। পিয়ালী একসময় কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। শরীর শুকিয়ে আসে। প্রাণ শক্তি ফুড়াতে থাকে। চোখের পাতা কালো হয়ে যায়। পিয়ালী শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। ঘরের মধ্য তখন কেউ ছিল না। পিয়ালী স্বামীকে কাছে ডাকে। বলে– ‘আমার হাতটি একটু ধরো, আমাকে বুকে জড়িয়ে ঐ জানালার কাছে নিয়ে যাও।’
শ্যামল পিয়ালীকে জানালার কাছে নিয়ে যায়। পিয়ালী মায়াময় চোখের দৃষ্টি মেলে দেখে ইছামতি নদীর শান্ত সৌম্য জল। পিয়ালী শ্যামলকে বলে–
‘তুমি কি আমাকে একটু ধরে সিন্ধুকের কাছে নিয়ে যাবে ?’
শ্যামল পিয়ালীকে ধরে সিন্ধুকের কাছে নিয়ে যায়। শ্যামলই সিন্ধুকটা খুলে দেয়। পিয়ালী সিন্ধুকের ভিতর থেকে কাপড়ে মোড়ানো কি যেন একটি জিনিস বের করে।
পিয়ালী খুব হাঁপাচ্ছিল। শ্যামলকে বলে — ‘আমাকে বিছানায় শোয়ায়ে দাও’।
শ্যামল পিয়ালীকে বিছানায় শোয়ায়ে দেয়। আবারও শ্যামলের হাত ধরে পিয়ালী অনুনয় করে বলে– ‘আমি তোমাকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারি নাই। তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি আর একটি বিয়ে করবে। সংসার করবে। আমি তোমাকে সন্তান সংসার দিতে পারি নাই।’
কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটা দেখিয়ে বলে- ‘ এর মধ্যে অমঙ্গলের অভিজ্ঞান আছে। তুমি ইছামতি নদীতে এটি ফেলে দেবে। ঘরে রাখলে তোমার সংসারে অমঙ্গল হবে।’
তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শ্যামল নিজেই কেরোসিনের বাতি জালিয়ে আনে। পিয়ালী বলছিল– ‘আমার খুব ঘুম পা্চ্ছে, একটা গান গেয়ে শোনাও না লক্ষ্মীটি !’ শ্যামল তখন গায়ছিল–
‘তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে। তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে’ ।
পিয়ালী গান শুনতে শুনতে চির ঘুমে ঘুমিয়ে যায়। ওর আত্মা বুঝতে পারছিল, আজ থেকে সতেরো বছর আগে এই গানের সুর তুলেছিল বাঁশিতে এক বালক, ইছামতির তীরে বকুলতলায়।
শ্যামল কৃষ্ণ রায় পরেরদিন শ্মশাণে স্ত্রীর সৎকার করে বাড়ি ফিরলেন। ইছামতি নদীতে স্নান করবার যাবার সময় কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটা নিয়ে ঘাটে যায়। মোড়ানো কাপড় খুলে সে দেখতে পায় — একটি পুরানো বাঁশি। যে বাঁশিটি এক কিশোরী বালিকা তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল সতেরো বছর আগে এক সন্ধ্যায়, ইছামতির নদীর তীরে।
২৫ . জিপসি ছেলে
তখন ইউনিভার্টিতে পড়ি। থাকতাম কবি জসিম উদ্দীন হলে। আমার বড়ো বোনের চিকিৎসা চলছিল পিজি হাসপাতালে। যে কয়দিন আপা হাসপাতালে ছিল প্রতিদিন সন্ধ্যায় চলে যেতাম তাকে দেখতে। আমার মাথায় তখন নজরুলের ইসলামের মতো ঝাঁকরা চুল। হাতে পরতাম পিতলের ব্রেসলেট। গায়ে থাকত বুক খোলা টি-সার্ট, আর পরনে থাকত কাউবয় মার্কা জিন্স প্যান্ট। আপার পাশের কেবিনে এক ভদ্রমহিলার চিকিৎসা চলছিল। ওনার একটি টিনেজ মেয়ে ছিল, সেও প্রায়ই আসত হাসপাতালে। ঐ মেয়েকে আমি চেয়ে দেখতাম, কিন্তু কথা বলতাম না। আবার ওর সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা করত। একদিন হাসপাতালের কোরিডরে একাকী দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটি হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করে — আপনারা কি খ্রীষ্টান ?
আমি : না
মেয়ে : তাহলে কি ?
আমি: সুন্নী মুসলমান। আমার বাবার নাম মৌলভী .. .. .. .. .. .. ..।
মেয়ে: আপনাকে দেখে খ্রীষ্টান মনে হয়।
আমি: তাই নাকি ?
মেয়ে : হু।
সন্ধ্যার পর হলে চলে আসি। সখ করে তখন একটু আধটু কবিতা লিখতাম। আর আমার যে বয়স সে বয়সে মানুষ প্রেমের কবিতা লিখে থাকে। সে প্রেমে পড়লেও লেখে, প্রেমে না পড়লেও লেখে। জুনিয়র রুমমেট সাহিদ বলছিল — আপনাকে আজ বেশ খুশি খুশি লাগছে । কবিতার খাতায় লিখলাম —
আমি তো তোমাকে আজ দেখলাম মেয়ে,
পরীবাগের খোলা আকাশের দিক থেকে এসেছিল মলয় বাতাস,
হাওয়ায় দুলছিল তোমার মাঘার চুল,
কাজল ছিল না চোখে, বাঁকা হয়ে যাওয়া ভ্রু ছিল তোমার চোখ সুচিত্রা সেনের মতো,
ইশারা কি ছিল সেই ভ্রু-তে? আমি বুঝি নাই তা-
কামিজের ভাজে ঢাকা ছিল সব নদীর বাঁক,
মেয়ে তোমার চোখে মুগ্ধতা ছিল, পরানের নীচে ছিল কেবলই ঘাস ।
পরের দিনও দেখা হয় ঐ মেয়ের সাথে। পাখির পাখার মতো উড়ছে তার ওড়না। মাথার চুল পিছনে ব্যানড দিয়ে বাঁধা। পায়ে সেমি হিল জুতো। খট্ খট্ করে হাঁটছে হাসপাতালের করিডোরে। আমি তার চরণ ধ্বনি শুনি। সে শোনে এলিফ্যান্ট রোডের গাড়ীর হর্ণ। আমি অপেক্ষা করছি তার জন্য, দাঁড়িয়ে আছি কোরিডোরে একাকী। চোখ একবার তাকালো দূরে বেতার ভবনের দিকে। তরঙ্গে ভেসে এলো রুনা লায়লার সেই গান —
‘অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে, যেন এক মুঠো রোদ্দুর,আমার দু’চোখ ভরে তুমি এলে।’ হঠাৎ পাশে থেকে সে মেয়ের কন্ঠস্বর শোনা গেল —
মেয়ে : কেমন আছেন ?
আমি : ভালো আছি।
মেয়ে: আপনি কোথায় পড়েন ? কি পড়েন ?
আমি: ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, বাংলা সাহিত্যে।
মেয়ে: আপনাকে দেখে মনে হয় ইংরেজিতে পড়েন।
আমি: কেন মনে হলো ?
মেয়ে: হিপ্পি হিপ্পি চুল, ছেঁড়া জিন্স, ম্যাগি হাতা গেঞ্জি পরেন, তাই মনে হলো।
আমি: আপনি কোথায় পড়েন , কি পড়েন ?
মেয়ে: ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার, ইডেন কলেজে।
আমি: নাম কি আপনার ?
মেয়ে: জিনিয়া
জিনিয়া আমার নামটিও জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়।
রূমে এসে রাত জেগে খাতার পাতায় লিখলাম হিবিজিবি কথা—
তোমার চোখে দেখলাম অসীম দৃস্টি এক, চেয়ে দেখো অন্তর গভীরে
উড়ে চিল ডানা মেলে, নিঃসীম নীল মেঘের উপর দিয়ে
তোমার চঞ্চল ডানা মেলতে চায় তারও উপর দিয়ে
আফ্রোদিতির মতো প্রেম বুকে নিয়ে ডাক দাও আমাকে—
আমি সানাইওয়ালাদের খবর দিব,
পাল্কি নিয়ে চলে যাব তোমার রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাড়ি।
আজ আগে ভাগেই দেখা পাই জিনিয়ার। একাকী দাঁড়িয়ে আছে কোরিডোরে। মনে হলো আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। দু’জন দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। আমি যখন কথা বলি, তখন দেখি— আমাকে দেখতে দেখতে জিনিয়ার চোখ উদাসীন হয়। ও কি ভাবছিল আমি তা জানি না। আবার জিনিয়া যখন কথা বলে আমি তখন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, দেখতে পাই— নীল সমুদ্রপাড়ে, সাগরের ঢেউ আছড়িয়ে পড়ছে বালুকাবেলায়। সাদা শাড়ি পরে ধবল আঁচল উড়িয়ে জিনিয়া আসছে আমারই দিকে। দূর থেকে আস্তে আস্তে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরছে বুকে।
আমরা দু’জন ‘মৌলি’র দোতালায় গিয়ে বসি। ওখানে কিছু স্নাকস্ জাতীয় খাবার খাই। কথা বলতে বলতে ভালোবাসার কোনো কথাই বলা হলো না। বলা হলো না– ‘তোমাকে আমার ভালোলাগে’, বলতে পারলাম না– ‘জিনিয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ জিনিয়াও কিছু বললো না। মৌলি থেকে যখন উঠব– তখন ও বলছিল — ‘তুমি কবি জসীম উদ্দীন হলের কত নাম্বার রুমে থাকো ?’ আমি বললাম- ‘৪২৬ নং রুমে।’ জিনিয়া যেন ভুলে না যায়– ,তাই ওর হাতের তালুতে নম্বরটি লিখে দেই।
রাতে বিছানায় শুয়ে আছি। কেমন যেন এক মুগ্ধতায় দু’চোখে ঘূম আসছিল না। মানুষের যেমন দুঃখের কারণে চোখে ঘুম আসে না। আবার অনেক সময় অনাবিল সুখের ভাবনাতেও ঘুম আসে না। মনে হচ্ছিল অচেনা অজানা এক মেয়ের দেখা পেলাম, তাকে ভালও লাগল, হয়ত এই মেয়ে আমার বউ হয়ে ঘরে আসবে একদিন। বিছানা থেকে উঠে কবিতার খাতায় লিখছিলাম–
তোমার ঐ মায়াবী চোখ আমাকে টানে
তোমার লাবণ্য মুখ আমাকে বের করে নিয়ে যায়
মখমলের চাদর বিছানো মসৃন পথে–
তুমি কোনও স্বপ্ন নও, আমি জানালা খুলে দেখি শাহবাগের আকাশ,
এত তারা কখনও এক সাথে দেখিনি
এত গানের সুর কখনও একসাথে বাতাসে ভাসেনি।
পরের দিন হলুদ রঙের একটি টি-সার্ট গায়ে দিলাম। গাঢ় নীল রঙের একটি জিন্স প্যান্ট পরলাম। খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো রয়েই গেল। আয়নায় ঘুরে ফিরে দেখলাম নিজের মুখ খানি। আজ জিনিয়াকে মৌলিতে ডেকে নিয়ে যে করেই হোক বলব — ‘তোমাকে ভালোবাসি।’
সন্ধ্যায় হাসপাতালে যাই। আজ কোরিডোরে কাউকে দাঁড়ানো দেখলাম না। আপার কেবিনে যেয়ে শুনি— পাশের কেবিনের ঐ মহিলা রোগীটি আজ সকালে রিলিজ নিয়ে চলে গেছে। বুকের ভিতর কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। আমি আজ আর বেশিক্ষণ দেরি করলাম না। হাসপাতালের শূন্য কোরিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হলে ফিরে আসি।
তারপর কত দুপুর কত বিকেল অপেক্ষা করেছি জিনিয়ার একটি চিঠির জন্য। কিন্তু আসেনি কোনো চিঠি। তারও অনেক পরে একদিন একটি বিদেশি নীল খামের চিঠি পাই। প্রেরক — জিনিয়া নাওসীন, নিউ ইয়র্ক, ইউ এস এ । চিঠিটির কিছু অংশ এই রকম লেখা ছিল —
”তোমাকে অনেক দিন ধরে লিখব লিখব করে লেখা হয় না। তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছিল, কিন্তু আমি একজনের বাগদত্তা ছিলাম। তাই তোমাকে বলতে পারিনি — ‘ভালোবাসি’। .. ..
এখানে প্রায়ই আমার স্বামীর হাত ধরে হাডসন নদীর তীরে বেড়াতে যাই। সেখানে দেখতে পাই বড় বড় চুলের জিপসি ছেলে হলুদ রঙের টি-সার্ট গায়ে দিয়ে, ছেঁঁড়া জিন্স পরে ঘুরে বেড়াতে। আর তখনই মনে হয় এমনই একজন জিপসি ছেলেকে আমি দেখে এসেছিলাম পিজি হাসপাতালের বারান্দায় .. ..।”
২৬ . অথৈ জলে ভাসি
তখন ছিল ভরা বর্ষাকাল । খাল, বিল, নদী, মাঠ, ঘাট সব জলে ভেসে গেছে। মা’র হাতের কড়া করে লেখা একটি পত্র পেলাম। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। কি জন্য বাড়ি যেতে হবে পত্রে তার কোনো উল্লেখ নাই। শুধু বলেছে ‘পত্র পাওয়া মাত্র চলিয়া আসিবে। কোনো রূপ দেরি করিবে না।’
আমি নতুন চাকুরি নিয়েছি। তারপরেও মায়ের ডাক , যেতেই হবে। চাকুরি চলে গেলেও যেতে হবে, চাকুরি থাকলেও যেতে হবে। তবে এরূপ কোনো কিছু হয় নাই। কর্তৃপক্ষ আমাকে পাঁচ দিনের ছুটি দিয়েছে।
আমি ভূয়াপুর থেকেই দেখতে পাই রাস্তার দু’পাশে বানের জলে থৈথৈ করছে। ভরা যমুনার উপর দিয়ে লঞ্চে যেতে যেতে যখন সিরাজগঞ্জ শহরে পৌঁছি তখন বিকাল হয়ে যায়। শহরের বাহিরগোলা থেকে কাটাখালী নদীর উপর দিয়ে নৌকায় আমাদের বাড়ি যাওয়া যেত। আমি ছইওয়ালা একটি ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করি। অথৈ জলের উপর দিয়ে ডিঙ্গিটি ভাসতে ভাসতে যখন বাড়িতে পৌঁছে তখন সন্ধ্যা গত হয়ে যায়।
রাতে মা যখন আমাকে খাবার খাওয়াচ্ছিল — তখন তিনি বললেন- ‘ ইউনুস ঘটক একটি পাত্রীর সন্ধান দিয়াছে। বংশ মর্যাদা নাকি ভালো। শুনিয়াছি মেয়ে খুবই রূপবতী। কালকে তোমাকে নিয়া সেই মেয়ে দেখিতে যাইব। আমি মনস্থির করিয়া রাখিয়াছি, মেয়ে যদি পছন্দ হয়, তবে এই মেয়ের সাথেই তোমার বিবাহের কথা পাকাপাকি করিয়া আসিব।’
আমি বিদ্যাসাগরের মতো মাথা নেড়ে মাকে আমার সম্মতি জানিয়ে দিলাম।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম — মা’কে তো সম্মতি জানিয়েই দিলাম। মেয়ে দেখতে না জানি কেমন হয়, সেই কথাই ভাবছিলাম। যদি পছন্দ না হয়, যদি দেখতে অসুন্দর হয়, তখন তো মার উপর দিয়ে কথা বলতে পারব না। মা যাই পছন্দ করবে তাই আমাকে বিবাহ করতে হবে। জীবনে বড়ো আশা করেছিলাম — আমার বউয়ের চোখ হবে বনলতা সেনের মতো স্নিগ্ধময়, কুচবরণ কন্যার মেঘবরণ কেশের মতো কালো লম্বা চুল হবে, অনঙ্গ বউয়ের মতো লাবণ্যময় মুখ হবে, চাঁপাডাঙ্গা বউয়ের মতো লক্ষ্মী হবে, আর আনোয়ারা উপন্যাসের নায়িকার মতো সতি সাধবী হবে। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে যাই।
পরের দিন একটি পানসি নৌকা এসে ঘাটে ভীরে। নিকট পরিজনদের মধ্যে একটি সাজ সাজ রব উঠল। আমার বিয়ের কন্যা দেখতে যাবে। সবাই সুন্দর সুন্দর কাপড় পরিধান করল। মা, বড়ো বোন, ভাবীসহ আট দশ জন হবে। যেহেতু এটা শুধুই কন্যা দেখা তাই আমাকে কেবল পায়জামা আর পাঞ্জাবী পরতে হলো। আমরা সবাই যেয়ে নৌকায় উঠি, তারপর নৌকা ছেড়ে দেয়।
নৌকাটি কখনো মাঠের জলের উপর দিয়ে, কখনো খাল দিয়ে, কখনো নদীপথ দিয়ে পৌঁছে যায় ব্রহ্মগাছা গ্রামে। এই গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনার একটি শাখা নদী বয়ে গেছে। যার নাম ইছামতী নদী। ভরা বর্ষার মৌসুমে নদীটি খরস্রোতা থাকে। দুপুরের ঠিক পরপরেই আমাদের নৌকাটি শেখ বাড়ির ঘাটে পৌঁছে যায়। বাড়ির অন্দরমহলে তখন উৎসবের আমেজ। আমাদের বসার ব্যবস্থা বাড়ির খাস মহলেই করা হয়েছে।
একসময় খাওয়া পর্ব শেষ হয়। এবার কন্যা দেখানোর পালা।
আমরা ঘরের মধ্যে বসে আছি। জরী করা লাল রংয়ের জর্জেট শাড়ি পরে ঘোমটা টেনে একটি মেয়েকে আমাদের সামনে আনা হলো। কেউ একজন তার ঘোমটা খুলে দিল। উন্মোচন হলো মেয়ের মুখখানি। কেউ দেখছে চুল, কেউ দেখছে নাক, কেউ দেখছে ভ্রূ। কেউ দেখছে চোখ, কেউ দেখছে ওর উচ্চতা- কেউ দেখছে মেয়ে কেমন করে হাঁটে। দেখছে গায়ের রং কেমন, দেখছে হাসিতে গালে টোল পড়ে কী না, দেখছে মুক্তার মতো দাঁত কী না। আমিও দেখলাম মেয়েটিকে।
ওর নাম শোভা।
শোভা দেখতে বেশ সুন্দরী, হাসিতে মুক্তা ঝরে, ডাগর ডাগর চোখ, নির্মল ওর মুখশ্রী। কিন্তু আমার চেতনার রংএর সাথে ওর রং মিলল না। আমি যাকে এতদিন খুঁজেছি, এই পৃথিবীর পথে পথে– এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। আমার চোখ বিনম্র হলো। কোনো কথা বলছিলাম না। আমি মাঝে মাঝে দেখছিলাম- শোভার পাশে বসে থাকা ওর ছোট বোন প্রভাকে। আমার চেতনার রংএর সাথে এই মেয়ের রং মিলে গেছে। এ যে দেখছি সেই মেয়ে— যাকে আমি এতদিন এই পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে, গ্রামে, গঞ্জে, শহরে ও জনারণ্যে খুঁজে বেড়েয়েছি।
আজ আর কোনো মতামত মেয়ে পক্ষকে জানানো হলো না। সন্ধ্যা রাতের মধ্যেই আমাদের নৌকা বাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছল। আমি ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়ি। ভাবী এসে টিপ্পনী মারল– ‘হায় আল্লাহ, দেখতে না দেখতে ধ্যান শুরু হয়েছে।’ আমি কিছুই বললাম না। রাতে যখন খেতে বসেছি মা তখন বলল- ‘কন্যা আমার ভারি পছন্দ হইয়াছে। আমি এই মেয়েকে আমার বউমা করিয়া ঘরে তুলিয়া আনিব।’
আমার মন খারাপ দেখে মা প্রশ্ন করে — ‘তোমার কি কন্যাকে দেখিয়া পছন্দ হয় নাই ?’
তখন আমার খাবার খাওয়া শেষ হয়েছে। হাত ধুতে ধুতে বললাম — ‘তোমরা যে মেয়েকে পছন্দ করেছ, তাকে আমার পছন্দ হয় নাই। পছন্দ হয়েছে প্রভাকে।’
এই বলে আমি আমার ঘরের ভিতর চলে আসি।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম সেই ত্বন্নী তরুণী প্রভার কথা–
কি চঞ্চলা তোমার চোখ, বাঁকা চোখে চেয়ে তুমি কাকে দেখেছিলে মেয়ে ?
তোমার চোখেই বনলতা সেনকে আমি দেখলাম
আমার সারা জনমের চেয়ে থাকা তোমার চোখেই স্থির হয়ে গেল, এত অথৈ জল ভেঙ্গে আমি যেয়ে তোমাকেই দেখলাম —
এই মেয়ে তো আমার জন্ম জন্মান্তরের,
ছায়া শীতল ইছামতী নদীর তীরে জলবতী মায়াবতী এই মেয়ে আমার জন্যই জন্মেছে।
আবার মনটা এই ভেবে বিষণ্ণ হল শোভা’র জন্য । ওতো কোনো অন্যায় করে নাই। আমি রাজি হলেই শোভা’ও আমার বউ হতে পারে। ওতো স্বপ্ন দেখতে পারে এই রকম করে —
‘এ কোন্ ধ্রুবতারার ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আমার আকাশে তুমি আবির্ভূত হলে
তুমি কি দেখতে পাচ্ছ অনেক তারার পাশে একটি নিষ্প্রভ স্বাতি জ্বলে আছে
তুমি অরুন্ধতিকে কেন খুঁজে বেড়াও–
এত অথৈ জলে নৌকা ভাসিয়ে তুমি আমাকেই দেখতে এলে,
তুমি আছ আমার চোখে, আমার চোখের তারায়-
তুমি দেখেছ ইছামতী নদীতে এখন কত জল,
এই জলে ভেসে ভেসে এক রাজপুত্রের বাড়ি আমার যেতে ইচ্ছা করে।’
একবার মনে হলো, মাকে বলে দেই– শোভাকেই আমার পছন্দ হয়েছে। ওর সাথেই আমার বিবাহের ব্যবস্থা করো। কিন্তু তা আর হলো না। পরের দিন সারাদিন বাল্য বন্ধুদের সাথে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। আমাদের বাড়ির সাথে ঐ একই নদী বহমান, সেই নদীর তীরে আনন্দেই সারাদিন ঘুরলাম ফিরলাম। তাই মাকে আর কোনো কথা বলা হলো না। মনে করলাম– মা যা করে, আমি তাই করব।
রাতে খেতে বসেছি। মা তখন বললেন- ‘আমি আজকে ইউনুস ঘটককে শেখ বাড়ি পাঠিয়াছিলাম। প্রভার সাথেই তোমার বিবাহের তারিখ পাকাপাকি করিয়া আসিয়াছে। আমি বেশি দেরী করিব না। আগামী পরশু দিনই বিবাহের তারিখ ধার্য্য করা হইয়াছে।’
বিয়ের দিন সকালবেলা লাহিড়ী মোহনপুর এলাকা থেকে বড় বড় দু’টি দক্ষিণা পানসি নৌকা বাড়ির ঘাটে এসে ভীরে। নৌকা দুটিকে রঙ্গিন কাগজ দিয়ে সাজানো হলো। সানাই আর ব্যান্ড পার্টি আনা হলো। শহর থেকে কলের গানও নিয়ে এসেছে। ফেরদৌসি রহমানের একটি গান বাজছে। ‘ওকি বন্ধু কাজল ভ্রমারারে,
কোন্ দিন আসিবেন বন্ধু কইয়া যাও, কইয়া যাওরে।’
বিয়ের দিন আকাশে ঝিকিমিকি রোদ উঠল। আমাকে শেরওয়ানী ও টুপি পরানো হলো। নৌকায় যেয়ে উঠলাম। দখিণ দিক থেকে বাতাস বয়ে আসছে শান্ত বেগে। নৌকায় বাদাম টানানো হলো। মাঝি মাল্লারা গান ধরল। সানাই বাজছে। কলের গান বাজাচ্ছে। ব্যান্ড পার্টির ঢোলের শব্দে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল।
শেখ বাড়িতে বিকালের আগেই বর যাত্রীরা যেয়ে পৌঁছে। এখানেও সানাই বাজছে। চারিদিকে হাসি রাশি রাশি, চারিদিকে উৎসবের আনন্দ। কাজী এসে বিবাহ পড়ালেন। সন্ধ্যার সময় আমাকে নিয়ে প্রভার পাশে বসানো হলো। বাড়ির বৌঝিরা আনন্দ করছে। আয়নাতে প্রভার মুখ দেখানো হলো।
এই সেই মুখ যাকে আমি হাজার বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, তাকেই আজ পেয়ে গেলাম এই ইছামতী নদীর তীরে।
রাতেই নতুন বউকে নিয়ে বাড়িতে ফিরি। ধান দূর্বা সোনা পানি ছিটিয়ে নববধুকে বরণ করে ঘরে তোলা হলো। রাত ততোক্ষণে অনেক হয়ে গেছে। সানাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কলের গান আর বাজছে না। ঢাকের বারিও থেমে গেছে। ভাবী কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন- ‘নাও, এখন থেকে আমার কোমড়ের বাঁকের উপর তোমার আর তাকাতে হবে না। আমার তুলতুলে গালও তোমার আর টিপতে হবে না। এবার দরজাটা বন্ধ করে দাও।’
সকালবেলা পাখির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তার আগে আযানের সুরও ধ্বনিত হয়েছে। প্রভারও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বাড়ির ঘাটে লোকজনের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। সবাই বলাবলি করছে কোথা থেকে এক মেয়ের লাশ এসে ঘাটে ঠেকে আছে। আমি এবং প্রভা ঘাটের দিকে এগিয়ে যাই। লাশটি তখন ঘাটের উপর মাটিতে শুয়ে রাখা হয়েছে। আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে প্রভা চিৎকার করে “বুবু” বলে লাশটিকে জড়িয়ে ধরে।
এরপরে পঁচিশ বছর চলে গিয়েছে। আমার জীবনটাকে পুরাপুরি সুখী করতে পারি নাই। একটা অপরাধবোধ প্রতিনিয়ত দহন করে। যদি কখনো বাড়িতে যাই, যদি তখন ভরা বর্ষার দিন থাকে, যদি সারা নদীর বুকে জুড়ে অথৈ জল থাকে, যদি তখন পূর্ণিমার তিথি হয়– ইছামতীর নদীর কুলুকুলু জলের শব্দে তখন শোভার কান্নার ধবনি শুনতে পাই।
২৭ . সান্তা মনিকা’র তীরে
মেয়েটির নাম কোভা ভেলহস্ট্রম। মা একজন তাইওয়ানিজ, বাবা সুইডিস। ছেলেবেলা কাটিয়েছে সুইডেনের স্টকহোম শহরে। বাবা স্ক্যান্ডিনেভীয় হওয়াতে ওর চোখ ছিল নীল রংএর আর চুল ছিল সম্পূর্ণ সফেদ সোনালি। আর মা তাইওয়ানিজ হওয়াতে ওর চেহারা দেখতে লাগত মঙ্গোলীয় এশিয়ান। দ্বৈত জাতিসত্ত্বার মিশ্রণ হওয়াতে কোভা একধরণের লাবন্যময়ী মেয়ে হয়ে উঠেছিল।
হাই স্কুলের পড়া শেষ করে কোভা আমেরিকায় পারি জমায়। ওখানে নভোদা’র লাসভেগাস শহরে সে থাকত। কোভা তখনো বিয়ে করেনি। তবে ওর একজন মেক্সিক্যান বয় ফ্রেন্ড আছে। কোভাও এসেছিল লস এ্যাঞ্জেলসে হলিউড সিনেমা সিটিতে। ওখানে একটি ‘হলিউড সিনে মেকআপ আর্টিস্ট্রী’র উপর এক মাসব্যাপি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় যোগ দিতে। আমিও যোগ দিয়েছিলাম সেই প্রশিক্ষণ কর্মশালায়। আর কোভার সাথে আমার পরিচয় সেখানেই।
ওয়ার্কশপে আমার পাশের আসনটি কোভার। প্রথম কথা বলাও সেখানে কোভার সাথে। ইনাস্ট্রাক্টর ছিল হলিউডের বিখ্যাত মেকআপ আর্টিস্ট নেলী রেচিয়া। হয়তো সৌভাগ্যই বলতে হবে, ভারতীয় উপমহাদেশের বাদামি রঙ্গের কোনো একটি মুখকে খুঁজছিল নেলীর চোখ। ডেকে নেয় আমাকে। ত্রিশ মিনিটের একটি ওরিয়েন্টেশন মডেল হতে হলো আমাকে। চারদিকে অনেক স্লাইড স্ক্রীনে আমার মুখ রঙ্গিন আলোতে ঝলমল করছে। নেলীর অনুপম হাতের তুলি আর ব্রাশের ছোঁয়া তখন আমার চোখে মুখে। প্রথমদিনই এই রকম একটি বর্ণিল অভিজ্ঞতা আমাকে ভীষণভাবে আপ্লুত করে।
কফি ব্রেকেও আমি আর কোভা পাশাপাশি থাকি। যদিও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল কোরিয়ার সিউল থেকে আসা ইয়াংজু কিম আর ওয়াসিংটন ডিসি থেকে আসা মিলিশা উইনটার। সিগারেটের ওফারটা করে কোভাই প্রথম। প্রিয় ব্রান্ড মার্লবোরো লাইট। যদিও আমি খেতাম মার্লবোরো হার্ড। শুধু কোভার কারণে আমি পরে মার্লবোরো লাইট কেনা শুরু করি। বিকালে ওয়ার্কশপ শেষে আমরা দুজন এক সাথে উইলটার্ণ থিয়েটার বিল্ডিং-এর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসি। উইলশেয়ার বেল্যুভার্ডের ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে দু’জন মেট্রো স্টেশনের দিকে চলে যাই। রিফ্রেশ কর্ণারে দাঁড়িয়ে দুজন আবার সিগারেট খাই। এবার আমি ওকে সিগারেট ওফার করি। সিগারেট টানতে টানতে বলছিলাম- ‘তুমি এখন কোন এরিয়ায় যাবে ?
কোভা : কালভার্ট সিটি , সান্তা মনিকা।
আমি : ওখানে কার কাছে থাকো ?
কোভা : একটি ডরমেটরীতে, জাস্ট লাইক এ্য হোস্টেল।
আমি: ওহ, তাই।
কোভা : তুমি কোথায় উঠেছ ?
আমি : গ্রামের্সী প্লেস, ওটাও একটি হোস্টেল।
কোভা : খুব সুন্দর, কাল তোমার সাথে আবার দেখা হবে।
আমি : ইয়েস, গুড ইভেনিং, বাই।
কোভা চলে যায় কালভার্ট সিটি, সান্তা মনিকার দিকে। আমি চলে আসি গ্রামের্সী প্লেসে।
সন্ধ্যায় গ্রামের্সীর খোলা গার্ডেনে রাখা একটি চেয়ারে বসে আছি। ভাবছিলাম আজকের প্রথম ব্যস্ত দিনটির কথা। ভাবছিলাম কোভার কথাও। কতো বন্ধুবৎসল মেয়েটা। কতো ভদ্র এবং বিনয়ী। এত সুন্দর মেয়ে হয় ! ভাবছিলাম- আমার যদি সেই প্রথম যৌবনের দিনগুলি থাকত, যদি আামার থাকত সেই কুমারত্বের তারুণ্যের সময়, তবে সত্যিই এই মেয়ের প্রেমে পড়তাম। কিন্তু তা আর হলো না, আমার ঘরে যে একজন মায়াবতী স্ত্রী আছে। যদি এই মায়াবতী না থাকত তাহলে এই মেয়েকে নিয়ে লেখা যেত এমনই একটি কবিতা–
তোমার ঐ নীলাভ চোখ ডুবে থাকে স্টকহোমের মায়াবী
সান্ডোম হৃদের নীল জলে
মেলোর্নের ঝিরঝির বাতাসে উড়ে তোমার সোনালি চুল
দেখতে তুমিও যদি তিব্বতি,
তোমার নাক আমাদেরই কূষ্ণের বাঁশির মতো
তুমি কথা বলো ভ্রু তুলে শুভ্র মেঘের মতো বাঁকা ঠোঁটে
ছোটো ছোটো হাসি ঝরে পড়ে মুক্তার ন্যায়
হঠাৎই মনে হয় তুমি আমাদেরই যমুনাপারের মেয়ে একজন —
যাকে আজ দেখে এলাম উইলটার্ন থিয়েটারের
আলো ঝলমল হল রুমে।
আমার সাথে কোভার কথা হয় প্রতিদিনই। প্রতিদিনই আমাদের আসন থাকে পাশাপাশি আলোচনা, ওরিয়েন্টেশন, প্রজেক্টরে হলিউডের বিখ্যাত ছবিগুলোর বিশেষ অংশগুলো দেখা, বিখ্যাত ফ্যাশান ফটোগ্রাফারদের কাজের অভিজ্ঞতার কথা, মডেলস, রাম্প মডেলস, আপকামিং মডেলদের ক্যাটওয়াক প্রদর্শনী দেখার ফাঁকে ফাঁকে আমি আর কোভা ছোট ছোট করে অনেক কথাই বলতে থাকি। আমাদের এক অপরের অনেক ব্যক্তিগত কথাও বলি।
একদিন দুপুরে ম্যাকডোনাল্ডে বসে লাঞ্চ করছিলাম। আগেই শর্ত দিয়ে রেখেছিল কোভা, পেমেন্ট সে করবে। আমরা বসেছিলাম স্বচ্ছ কাঁচের জানালার পাশে। মুখোমুখি নয় পাশাপাশি দুজন বসে আছি। সুপরিসর রাস্তার পাশে দেখছিলাম রোদ্রকরোজ্জ্বল বাইরের আকাশ। অনেক গাড়ী ছুটে চলছে, কোনো হর্ণ বাজছে না, সব গাড়ী চলছে নৈঃশব্দে। কোভা বলছিল — ‘তোমার বউয়ের ছবি থাকলে আমাকে একটু দেখাও না ?’ আমি আমার স্মার্ট ফোন থেকে আমার স্ত্রীর কয়েকটি ছবি বের করে দেখাই। ও খুব বিস্ময় চোখে দেখছিল ছবিগুলি–
কোভা : তোমার বউ তো বেশ সুন্দরী।
আমি : হু
কোভা : তোমার বউ কি করে ?
আমি : সেও একজন বিউটি এক্সপার্ট। শি হ্যাজ বীন রানিং এ বিউটি সেলুন।
কোভা : তোমার দেশে আমাকে নিয়ে যাবে ?
আমি : যাবে তুমি ? তুমি যাবে, আর তোমাকে আমি নেব না ?
কোভা : তোমার বউকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
আমি : তোমার বয়ফ্রেন্ডকে দেখাও।
কোভা : দেখবে এই মেক্সিক্যান কাউবয়কে ?
আমি : দেখাও।
কোভা ওর ফোন মিমোরি থেকে ওর ফ্রেন্ডের কয়েকটি ছবি বের করে দেখায় আমাকে । আমি ওকে বললাম — ‘তুমি কি তোমার এই বন্ধুটিকে নিয়ে সুখী ? ‘ কোভা বিষণ্ণ মুখোয়বে বলেছিল- ‘না’।
রাতে হোস্টেলের বিছানায় শুয়েছিলাম। ঘুম আসছিল না চোখে। এর আগে ঢাকায় কথা বলেছিলাম প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে। ওর সাথে কথা বললে পরের সময়গুলো ভালোলাগার চেয়ে খারাপই বেশি লাগে। পরের সময়গুলো দারুণভাবে ওকে মিস করতে থাকি। হোস্টেলের পিছনে রিক্রিয়েশন এরিয়াতে যেয়ে সিগারেট খাই। পরপর তিনচারটা স্টীক খেয়ে ফেলি। কোভার জন্য কেন জানি একটু মায়া হচ্ছিল। মনে পড়ছিল আজকের পড়ন্ত দুপুরে সেই বিষণ্ণ মুখখানির কথা–
‘এত সুন্দর লাবণ্যময় মুখে কোনো বিষণ্ণতা কি মানায় ?
জীবন তো পলে পলে উপভোগ করার কথা–
সব স্বপ্নের পাখিরা ডানা মেলে তোমার ভূবনে আসবে এইটাই সত্য,
কে সেই কাওবয়? চিনতে পারেনি এই সারল্যে ঢাকা লাস্যময়ীকে–
লাসভেগাসের রাতের পথে পথে জ্বলে ওঠে নীল নীল আলো
তুমিও তো সে আলোয় নীল হয়ে যেতে পার নিমিষেই
দুঃখও ভুলে থাকতে পারো সেখানে।’
সেদিন ছিল আমাদের হোস্টেলের থ্যাংস্ গিভিং ডে ডিনারপার্টি। হোস্টেলের মালিকান মিসেস সেলিয়া এই ডিনারপার্টির আয়োজন করেছিল। কোভাও এসেছিল সেদিন। ডিনারের মেনু ছিল, Staffed Turkey, Gravy, Mashed Potatoes Cranberry Sauce, Mince Meat Pie, Soft and Hard drinks . আর ছিল মিউজিকের সুরের মূর্ছণা। অনেক রাত পর্যন্ত কোভা সেখানে ড্যান্স করেছিল, ঘুমিয়ে পড়েছিল গ্রামের্সী হোস্টেলেই। হতাশার ছায়ার নীচে কোভার যে কোনো সুখ নেই, তা বুঝতে পেরেছিলাম আমি সেই রাতে।
যতদিন ছিলাম কোভার সাথে আমার বন্ধুত্বের মেলবন্ধন ছিল স্বচ্ছতোয়া নদীর জলের মতো বন্ধনহীন। আমরা ভেসেছি রাজহংসের মতো জলে কিন্তু আমরা ডুবে যাইনি কখনো সেই জলের
অতলে।
একসময় আমাদের ট্রেনিং ওয়ার্কশপ প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যায়। দেশে ফিরবার দিনও কাছে চলে আসে। যেদিন ঢাকায় ফিরব, তার আগের দিন বিকেল বেলা আমি আর কোভা সান্তা মনিকা বিচে চলে যাই। বিচ টার্মিনালের দোতালায় একটি মেক্সিক্যান রেস্টুরেন্টে বসে কিছু খেয়ে নেই। তারপর দু’জন সিগারেট ধরাই। পেমেন্ট আমিই করি। এরপর আমরা বালুকাবেলায় হাঁটতে থাকি। কখন কোভা আমার হাত জড়িয়ে হাঁটছিল জানি নাই। তখন সুর্যাস্তের সময়। আমরা দাঁড়িয়ে আছি প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলের পাশে। সূর্য তখন ডুবে যাচ্ছিল অসীম জলধি তলে।
আমি কোভাকে বলছিলাম- ‘ তুমি কি আমাকে ভুলে যাবে ?’ কোভা আনত মুখ তুলে বলল- না, চির জনম ধরে ‘না’। আমি দেখছিলাম ওর স্ক্যান্ডিনেভীয়ান নীল চোখে প্যাসিফিকের লোনা জল। কোভা আমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
Standing here, Starring at the blue .
Thought and memories surfing one after one like waves,
Deeper than the deepest Pacific Ocean, at Santa Monica
In the calm presence of waves around me,
Finally, my heart is at peace .
২৮ . একজন হেমা মালিনী
হঠাৎ করেই তার প্রেমে পড়ে যাই। হঠাৎ করেই আমার জীবনের রোজকার রোজনামচা পরিবর্তন হয়ে গেল। এক বিকেলে একে অপরে দেখা না হলে সে বিকেল হয়ে যায় মৌনতার সঙ্গীত। যেন দুঁহু করে দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।’
মেয়েটির নাম- হোমায়রা আকতার। পাবলিক লাইব্রেরীতে ওর সাথে আমার পরিচয় । মাঝে মাঝে নোট করতে আসত এখানে। পড়ত বদরুন্নেসায়। ও পড়ত ওখানে বাংলায়। আমি পড়তাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায়। তাই মনে হয় একে অপরে স্টাডি সহায়কের কারণে সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরটা আমাদের যেন প্রেমের বৃন্দাবন হয়ে উঠল।
এক ফাল্গুনের উদাস দুপুরে লাইব্রেরীর সিঁড়ি সোপানে বসে আছি। এবং ওকে ডাকি : হোমায়রা ?
হোমায়রা : জ্বী।
আমি : ভালো লাগে না।
হোমায়রা: কি ভালো লাগে না ?
আমি : তোমার এই নাম !
হোমায়রা: হুম।
আমি : তোমাকে হেমা নামে ডাকব।
হোমায়রা: ডাকো ।
আমি : হেমা ?
হেমা : জ্ব্বী।
আমি: না এ নামেও ডাকব না।
হেমা: পাগল তুমি ! কি নামে ডাকবে ?
আমি: মালিনী।
আমি মালিনীর কানের কাছে যেয়ে আস্তে আস্তে এই কবিতাটি আবৃতি করতে থাকি–
দেখ তুমি চেয়ে কড়োই গাছের ছায়ায় রোদ্র থেমে গেছে
ঝরা পাতার শব্দে তোমার আগমনের গান শুনি
বেণী খোপায় পরো তুমি সাদা সন্ধ্যা মালতী
তোমার বাগানের তুমি যেন মালিনী একজন —
প্রতিদিন জল ঢালো সেখানে, তুমি নিজেই হয়ে যাও সন্ধ্যা মালতী
আজ শাহবাগের মোড়ে কোনো ফুল নেই, সব ফুল আজ তোমার বাগানে।
একদিন লাইব্রেরীর ভিতরে বসে দু’জন নোট করছিলাম। আমি নোট করছিলাম বৈষ্ণব পদাবলীর জীবাত্মা আর পরমাত্মার প্রেমের উপরে। মালিনী করছিল রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের প্রকৃতির ভূমিকা। বাইরে তখন মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। মালিনী বলে- ‘ভালো লাগছে না’। আমি বলি- ‘কেন ?’ মালিনী বলে – চলো বৃষ্টি দেখি।’
বাইরে এসে দু’জনেই দেখছিলাম বৃষ্টি। আমগাছের ডালে জুবুথুবু হয়ে দুইটি কাক ভিজছে। আমি মালিনীকে বলি– চলো কাকের মতো অমন করে দু’জনে জলে ভিজি। মালিনী বলে- ‘চলো, ভিজতে ভিজতে আমরা রিক্সায় গিয়ে উঠি। তুমি নীল ক্ষেতের মোড়ে নেমে যাবে, আমি একাকী ওখান থেকে হোস্টেলে চলে যাব।’
রিক্সা চলছে আজিমপুরের দিকে, হুড উঠানো নেই। কাকের মতোই ভিজে দু’জন জুবুথুবু হচ্ছি। আমি মালিনীর কানে কানে বলি- ‘তোমাকে রাধিকার মতো লাগছে। শুধু যমুনার তীর এখানে নেই। নেই এখানে সেই শ্রাবণ দুপুর।’ মনে মনে ভাবি, আজ এই বাদলমূখর দিনে মালিনী আমারই পাশে। ভিসির বাড়ির সামনে বড়ো বড়ো কড়োই গাছের ছায়াতল দিয়ে রিক্সা চলছে। পাতা ছুঁয়ে বৃষ্টির জল এসে পড়ছিল আমাদের
গায়ে।
আরেকদিন দু’জনের মন উঁড়ু উঁড়ু। লাইব্রেরীর টেবিলে মন বসছে না। পেটে দুপুরবেলার খিদা। মালিনী বলছে খিদে লেগেছে। লাইব্রেরীর ক্যান্টিনে যেয়ে দু’জন খেয়ে নেই। আমি মালিনীকে বলি– সিনেমা দেখবে ? বলাকায় ‘দেবদাস ‘। মালিনী বলে- ‘চলো’।
হলের রুম অন্ধকার হলো। সামনের কালো পর্দা সরে গেল। আমার ডান হাত মালিনীর বাম হাত ছুঁয়ে আছে। পারু দেবদাসের কৈশোর প্রেম তখন চলছে। আমি মালিনীকে বললাম- একটু ডার্ক ড্রামা করব ?’ মালিনী আস্তে করে বলে- ‘মাইর চিনো, মাইর’?। সিনেমার শেষ দৃশ্যে পারু আর্ত চিৎকার করে যখন বাড়ির বাইরে আসতে চায়, ততোক্ষণে লোহার সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।’ প্রেক্ষাগৃহের বাতিগুলো তখন জ্বলে উঠেছে। দেখলাম আমার মালিনীর মন খারাপ। ডার্ক ড্রামা আর হলো না।
আমাদের ভালোবাসা চলছে, ভানু চক্রবর্তীর এই কবিতার মতো–
”পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, .
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল
পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,
ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে দিগঙ্গনার নৃত্য,
হঠাৎ-আলোর ঝল্কানি লেগে
ঝলমল করে চিত্ত।”
একদিন ঘরে বসে আছি। মনে হলো পূবের জানালাটা খুলে বাইরের আকাশটা দেখি। জানালা খুলতেই এক ঝলক পূর্ণিমার আলো এসে চোখে মুখে লাগল।
ভানু চক্রবর্তীর মতো আমারও কবিতা লিখতে ইচ্ছে হলো। হলো না কিছুই —
তুমি এখন হোস্টলে ব্যালকনীতে একাকী আছো কি বসে ?
উদাস ভাবনায় কাটছে কি প্রহর ?
আজিমপুরের আকাশে উঠেছে কি চাঁদ ? তুমি কি দীপ্তময় হয়ে উঠেছ উদাস প্রেমে ?
তুমি কি অনুভব করতে পারো কোনো উচ্ছ্বসিত তরুণের ভালোবাসার প্রাণ স্পর্শ ?
আজকের এই জ্যোৎস্না রাতে তুমি বের হয়ে আসো রাধার মতো-
চলো দূর প্রান্তরের দিকে হেঁটে যাই, ভেসে বেড়াই মেঘের নীচে নীচে।
দেখতে দখভে প্রায় তিন মাস চলে যায়। সামনে গ্রীস্মে কলেজ ইউনিভার্সিটি দুটোই বন্ধ হয়ে যাবে। মালিনীও চলে যাবে দেশের বাড়ি। যেদিন যাবে তার আগের দিন পাবলিক লাইব্রেরী চত্বরে দুজন বসে আছি। কাল মালিনী চলে যাবে।
আজ কেমন যেন মনমরা হয়ে আছে লাইব্রেরী চত্বরের ঘাস। কোনো পাখি গাইছে না গান । রোগীবাহি এ্যাম্বলেন্সগুলো করুণ হর্ণ বাজিয়ে হাসপাতালে ঢুকছে। মালিনী চুপ হয়ে বসে আছে, কোনো কথা বলছে না। আমি ওকে ডাকলাম- মালিনী।
মালিনী : জ্বী।
আমি : ভুমি আসবে ফিরে কবে ?
মালিনী: এইতো দেড় মাস পর।
আমি : এসে আমার সাথে দেখা করবে না ?
মালিনী: করব।
আমি: কেমনে জানতে পারব তুমি ঢাকা এসেছ ?
মালিনী : তুমি আগামী জুন মাসের ১৭ তারিখে এখানে থাকবে।
আমি : আচ্ছা।
মালিনী ওর ব্যাগ থেকে একটি ক্যাসেট আমার হাতে দিয়ে বলে- ‘এখানে আমার গাওয়া একটি গান আছে। যদি কখনো আমার কথা মনে পড়ে তবে বাজিয়ে শুনো এই গান।’ আমি ওকে বললাম- তুমি যে গান জানো এ কথা তো কখনো বলো নাই। মালিনী বলল– তুমিতো জানতে চাও নাই, আর মানুষের কতো কথাই তো অপ্রকাশিত থাকে।’ আমি মালিনীকে বলি— ‘তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো ?
মালিনী : না।
আমি : মালিনী ।
মালিনী : জ্বী।
আমি : তোমার হাতটা একটু ধরি ?
মালিনী : ধরো।
আমি : একটু চুমু দেই হাতে।
মালিনী : দাও।
একদুই করতে করতে দেড়মাস চলে গেল। আসে ১৭ই জুন। আমি পাবলিক লাইব্রেরীতে চলে যাই। সারাদিন অপেক্ষায় থাকি। মালিনী আর এলো না। এরপর পরপর আরো দশ দিন যাই। কোনো দিনই মালিনী এলো না। তারপর প্রতি সপ্তাহেই একদুই দিন করে লাইব্রেরীতে যেয়ে মালিনীকে খুঁজেছি। কিন্তূু মালিনী কে আর পাইনি। মালিনীর দেশের বাড়ি বগুড়ার মহাস্থান গড় এলাকায়। এই টুকু ঠিকানাই জানতাম। এর চেয়ে বেশি ঠিকানা আমার জানা ছিল না। ওখানে যেয়ে কোথায় খুঁজব মালিনীকে ? হোস্টেলেও খোঁজ নিয়েছি, সেখানেও আসে নাই।
আমি মালিনীর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। তারো দুই বৎসর পরে আমি বিয়ে করি। যেদিন আমার গায়ে হলুদ হবে সেদিন কি মনে করে মালিনীর ক্যাসেটটির কথা মনে পড়ে। যা এতোদিন শোনা হয় নাই। তাছাড়া ওর কথা আজকের এই দিনে মনে পড়ছিল খুব। আমাদের বাড়ির মধ্যে তখন উৎসব আনন্দ হচ্ছে। চারিদিকে হাসি আর গান। আমি আমার ঘরে মালিনীর নিজের কণ্ঠে গাওয়া সেই গানটি শুনতে থাকি–
তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি–
তবু মনে রেখো।
যদি জল আসে আঁখিপাতে,
এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু মনে রেখো।
এক দিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে– মনে রেখো।
যদি পড়িয়া মনে
ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে–
তবু মনে রেখো।
২৯ . কোন্ অচিনপুরে
তিন মাস হাসপাতালে থাকার পর আজই বাসায় ফিরেছে নাজমা। বাসায় এসে দেখে সবকিছু এলোমেলো। তার সাজানো সংসার যেভাবে সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল, তা আর আগের মতো নেই। আলনায় কোনো কাপড় ভাজ করা নেই। ময়লা করে একটার উপর আরেকটি কাপড় অগোছালো করে রেখে দিয়েছে । বিছানা পরিপাটি নেই। ঘরের মেঝের কোণে কোণে ময়লা জমে আছে। রান্না ঘরের মেঝেতে মাছি উড়ছে। ময়লার ঝুড়ির ভিতর বাসি খাবার পড়ে আছে। হাঁড়ি পাতিলগুলো ঝকঝকে নেই। এলোমেলো এসব জিনিস দেখতে দেখতে নাজমা কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছিল।
শরীরে ক্যামো দেওয়ার কারণে এমনিতেই দূর্বল ছিল। কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। হাত পা কাঁপছিল। ওর এই অবস্থা দেখে ওর স্বামী ওকে হাত ধরে ভিতরে বিছানায় নিয়ে শোয়ায়ে দেয়।
নাজমা’র চার মাসের বাচ্চাটি পাশের রুমে দোলনায় ঘুমাচ্ছে। নাজমা ওর স্বামীকে বলে — ‘মর্জিনাকে বলো, বাবুকে একটু আমার কাছে নিয়ে আসতে।’ মর্জিনা যখন বাবুকে নিয়ে আসে তখনো ওর ঘুম ভাঙ্গে নাই। বাবু’র জামাটি ফিডারের দুধে ভিজে আছে। ফিডারের নিপলটা পুরোনো দুধের গন্ধে ভরে গেছে। বাবুর চোখে কোনো কাজল নেই। কপালে কোনো কালো টিপ নেই। নাজমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগুলো দেখছিল , আর বিষাদে ছলছল হয়ে উঠেছিল ওর চোখ ।
পিছনে ফিরে দেখা —
আজ থেকে দেড় বছর আগে এক বসন্ত দিনে নাজমার বিয়ে হয়। মধুরতম এক ভালোবাসায় সাজিয়ে তোলে নিজের ঘর। আহ্লাদের জীবন ছিল তার প্রতিদিন। বিয়ের পর প্রিয়তম স্বামীর সাথে কতো জায়গায় সে ঘুরেছে। কতো প্রান্তর , কতো পথ যে দু’জন হাতে ধরে হেঁটেছে। কতো বনছায়া তলে তারা একান্তে বসে থেকেছে, কতো নদীর কূলে তারা জলের গান শুনেছে। তারা ঘুরে বেড়িয়েছে পাহাডে পাহাড়ে , আবার গিয়েছে কখনো সাগর বালুকাবেলায়। কতো ক্ষণ গানে গানে কেটে গেছে দুজনের। যেন — ‘ আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনই লীলা তব, ভরিয়ে তুলে শূন্য করেছ এমনই নব নব।’
তারপর একসময় বাবু পেটে এলো। কতো স্বপ্ন ভরা চোখ নিয়ে বাবুর আগমনের দিন গুণতে থাকে।
একদিন সন্ধ্যারাতে উত্তরার একটি ক্লিনিকে সিজার করে একটি রাজপুত্রকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসা হয় । ঠিক তারপরেই জানা গেল মরণ ব্যাধি ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। তারপরেই তার সাজানো ঘর এলোমেলো হতে থাকে। হাসপাতালে থেকে আজই নাজমা ঘরে এলো। এসে দেখতে পায় বারান্দায় ঝুল জমে আছে। উঠোনের ঘাসগুলো বড়ো হয়ে গেছে। ভেন্টিলেটরের ফাঁকে চঁড়ুই পাখি এসে বাসা বেঁধেছে।
আসলে ডাক্তার তাকে তিন দিনের জন্য হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়েছে বাড়ি আর বাবুকে দেখার জন্য। তিনদিন পর তাকে আবার হাসপাতালে ফিরে যেতে হবে। নাজমা একটা ব্যাপার পুরোপুরি জানেনা, সে বাঁচবে মাত্র আর জোর একমাস।
ঠিক তিনদিন পর একদিন বিকালে হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স এসে বাড়ির গেটে থামে। নাজমাকে যখন এ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হয়, তখনও বাবু তার কোলেই ছিল। সে দেখছিল বাবুর মুখ আর ফিরে ফিরে দেখছিল স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির আঙ্গিনা।
একদিন হাসপাতালের বেডে নাজমা শুয়ে আছে। তার স্বামী সিয়রে দাঁড়ানো ছিল । নাজমার প্রাণ নিঃশেষিত প্রায়। শরীরের সব মাধূর্য নষ্ট হয়ে গেছে। মাথার চুল সব পড়ে গেছে। দাঁত ও হাতপায়ের নোখগুলো কালো হয়ে গেছে। স্বামীর দিকে নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে নাজমা বলছিল– ‘ওগো আমি চলে গেলে তোমাকে দেখবে কে ? বাবুকে দেখে রাখবে কে?’ স্বামী ওর কপালে হাত বুলিয়ে বলেছিল – ‘তুমি ভালো হয়ে যাবে, তুমিই দেখবে।’
কিন্তু নাজমা আর ভালো হয় নাই। প্রায় একমাস পর একটি লাশবাহি গাড়ি বাড়ির গেটে এসে থামে। এবার আর ওকে ঘরের ভিতর নেওয়া হলো না। বাইরেই ওকে ধোয়ায়ে কাফনের কাপড় মুড়িয়ে কবরস্থানে মাটির ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
তারপর অনেক দিন চলে গেছে। নাজমার সাজানো সেই ঘর এখনো এলোমেলোই থাকে। এখনো বারান্দায় জমে থাকে ঝুল। এখনো ঘরের আসবাব পত্রের উপর ধুলোবালি পড়ে আছে। আলনায় কাপড় চোপর এলোমেলো। ঘরের চালের ফাঁকে চঁড়ুই পাখিরা এসে আরো বেশি করে বাসা বেঁধেছে।
নাজমার আদরের খোকনসোনা প্রায় সময় অনাদরে দোলনায় শুয়ে থাকে। প্রায়ই ও কান্না করে। ওর কান্নাভেজা চোখ হয়তো মাকে খুঁজে বেড়ায়। গৃহকর্মী মর্জিনার আদর নিতে চায় না। নাজমার স্বামী প্রায়ই বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় পায়চারি করে। স্বজনেরা কত করে বলেছে তাকে — আর একটি বিয়ে করতে। কিন্তু তিনি তা করেনি।
অন্ধকার রাতে বারান্দায় ইজি চেয়ারে একাকী সে বসে থাকে। মনখারাপের চোখে দূরে নক্ষত্রবীথির মাঝে খুঁজে বেড়ায় তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখখানি। অন্তরের ভিতর তখন বিষাদের সুর বেজে ওঠে। কত স্মৃতি কত কথা মনে পড়ে। দুচোখ তার জলে ভরে ওঠে।
আঁধারের গা ছুঁয়ে কোথা থেকে এই গানটি যেন ভেসে আসে ক্লান্ত সুরে —
‘দূরে কোথায় দূরে দূরে . আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে/ যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে / যে পথ সকল দেশ পারায়ে উদাস হয়ে যায় হারায়ে / সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে।’
৩০ . মনের মতো বউ
জীবনে কতো সাধ আহলাদ আর স্বপ্ন ছিল — শহরের মেয়েকে বিয়ে করব। মেয়ে ফ্যাসান করে চলবে। মাধুরী কাট চুল কাটবে। ডায়নার মতো ভ্রু স্টাইল করবে। পোষাক পরবে বোম্বের নায়িকা রেখার মতো করে। কথা বলবে ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে। কিন্তু তা আর কপালে জুটল না। মা আমাকে বিয়ে করালেন তারই পছন্দ মতো এক মেয়েকে।
মা’র সখ ছিল ছেলেকে পাল্কিতে চড়িয়ে বিয়ে করাবে। আমি তাই করলাম। এক হেমন্তের সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরের এক গ্রাম থেকে অচেনা এক মেয়েকে বিয়ে করে পালকিতে চড়িয়ে বউ করে বাড়িতে নিয়ে আসলাম।
মা তার রূপবান সুন্দরী পুত্রবধুকে লাল শাড়ি পরিয়ে রাখলেন। গ্রামের বালক বালিকা, বৌঝিরা সব দল বেঁধে বউ দেখতে আসতে লাগল। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন। সবাই উৎসব আর আনন্দ করছে।
এরই ফাঁকে বিয়ের তিন দিন চলে গেছে। মাকে বললাম– আমার ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছে। ঢাকা যেতে হবে।’
মা বললেন– ‘নতুন বৌমাকে রাখিয়া তুমি এত তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবে তাহা কি করিয়া হয় ? তুমি আর কয়েকটা দিন থাকিয়া যাও ”।
আমি বললাম- ”তোমরা আমাকে হঠাৎ করে ধরে এনে বিবাহ করিয়েছ। আমি অফিস থেকে ছুটি আনি নাই। আমাকে চলে যেতে হবে।’
মা তখন বললেন,- ‘তাহলে বৌমাকেও সাথে করে তুমি ঢাকা নিয়ে যাও।’
বউকে একদিনের জন্য বাপের বাড়ি ঘুরিয়ে এনে পরের দিনই তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি।
ভালোই লাগছে হঠাৎ শুরু হওয়া আমার সংসার জীবন। ভালোই লাগছে নতুন জীবনের শুরু। হঠাৎ করেই যেন অনেক বড়ো পাওয়া পেলাম। হঠাৎ করেই প্রতিদিনের জীবনের সব নিয়ম কানুন বদলে যেতে লাগল। একজনের জীবন থেকে দু’জনের জীবনের রুপান্তর হলো। রাতে ঘুমিয়ে থাকি পাশাপাশি। স্বপ্নগুলোও দেখি একসাথে। জীবন হঠাৎ করেই সাজানো গোছানো হয়ে উঠল। এখন আর আধাঁরে একাকী বসে থাকিনা। এখন ঠিক সময়েই ঘরে সন্ধ্যা বাতি জ্বলে ওঠে।
চারদিক থেকে সকল আলোর বিচ্ছুরণ যেন ঘরে এসে পড়তে লাগল — ঘরে বাইরে কোনো শুন্যতা নেই। জীবনের সকল সুখ ভরে উঠতে থাকে সকল পূর্ণতা দিয়ে। আমি বিস্ময়ে চেয়ে থাকি এই মেয়ের দিকে। অসীম ও নিঃশেষিত ভালোবাসা নিয়ে এই মেয়ে আমার কাছে এসেছে। এক জীবনেই যে এত প্রেম কেউ দিতে পারে– আগে জানি নাই।
আমার এই বউয়ের নাম আনারকলি। আমি তাকে ‘কলি’ বলে ডাকি, আবার কখনো আনারকলিও বলি। মোঘল হেরেমের আনারকলি সে নয়। অতো জৌলুশ তার নেই। সে নেহাতই একটি সহজ সরল গ্রামের মেয়ে।
একদিন অফিস থেকে এসে শুনি — পাশের বাসার এক ভাবীর সাথে রাস্তায় বেড়াতে বের হয়েছিল সে। ভাবী নাকি বেশ সাজগোজ হয়ে বের হয়েছিল। পাড়ার ছেলেরা নাকি ভাবীর দিকেই তাকিয়ে থেকেছে। তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। এজন্য তার মন খারাপ। আমার কাছে আবদার করেছে- মেকআপের সামগ্রী কিনে এনে দিতে হবে ।
পরের দিন আনারকলিকে ফাউন্ডেশন,কনসিলার, ব্লাসন, আই ভ্রু পেন্সিল, আইল্যাস, কাজল, নেইলপালিশ, লিপস্টিক, ফেসপাউডার, আইস্যাডো, ব্রাশ, প্যানকেক, টিপ, চুড়ি ইত্যাদি কিনে এনে দেই।
তারপরের দিন অফিস থেকে এসে দেখি– আনারকলি সুন্দর করে সেজে বসে আছে। যদিও এলোমেলো ভুল সাজগোছ। বললাম –‘ দারুণ লাগছে তোমাকে! বেড়াতে যাওনি?’
কলি তখন বলে– ‘ কোথায় বেড়াতে যাব? তোমার জন্যই সেজে গুজে বসে আছি।’
আরেকদিন আনারকলিকে নিয়ে সিনেমা দেখতে
যাই। আনন্দ সিনেমা হলে তখন চলছিল- ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’। চাঁপাডাঙ্গা বউয়ের দুঃখ দুর্দশা দেখে — আনারকলি কাঁদছে। আমি বললাম, ‘তুমি কাঁদছ কেন ? আমার কথা শুনে সে আরো জোড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। পাশের মানুষরা উৎসুক হয়ে কলির কাণ্ড দেখতে থাকে। আমি সিনেমার বাকি অংশ আর না দেখে কলিকে নিয়ে সোজা বাসায় চলে আসি।
আরেকদিন ওকে নিয়ে চায়নিজ খাবার খেতে যাই উত্তরার একটি রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের ভিতরে আলো আঁধার তার মোটেই পছন্দ হয়নি। সে বলছিল — তার নাকি দম বন্ধ হয়ে আসছে। এক চামচ স্যুপও খেলো না। ভেজিটেবলও মুখে নেয় নাই। ওর জন্য আলাদা করে বীফ কারী নেই। তাই দিয়ে একটু রাইচ খেয়ে নেয়। আমি আমার বউকে চায়নিজ খাওয়ায়ে সেই বার খুশি করাতে পারিনি।
আনারকলিকে নিয়ে কেটে যায় প্রতিদিন ভালোলাগার দিন। ভালোলাগে ওর সারল্য ভরা খুনসুটি। ছোট ছোট মানঅভিমান। ভালোলাগে যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমি চেয়ে দেখি ওর মায়াময় চোখ। দেখি ওর হেঁটে চলা মেঝেতে ও উঠোনে। ভালো লাগে ভেজা চুল যখন সে সিঁথি করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি দেখি কেমন করে সে সাজাচ্ছে ঘর, আলনায় গুছিয়ে রাখছে কাপড়, আর ফুলদানীতে ফুল।
দেখতে দেখতে কখন হয়ে উঠল সে ঘরের লক্ষ্মী। আমি বিস্ময়ে দেখি ওর এই ঘরণী হয়ে ওঠা। আমার প্রতিটি কর্মে সে হয়ে ওঠে প্রেরণাময়ী। সে যেন আমারই– মনের মতো বউ।
এত প্রেম আর এত ভালোবাসার জীবন থেকে কলিকে দূরে রাখতে মন চায়নি কখনও। তাই তো নতুন বউ নিয়ে আসার পর থেকে ওকে আর বাড়ি পাঠানো হয় নাই। আমার এই ভালোলাগার আনন্দময় জীবনের সাথে সে রয়ে গেছে।
একদিন সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখি কলি শুয়ে আছে। আমি ওকে বলি– এই অসময়ে কেন শুয়ে আছ ?
কলি বলে — ‘মাথা ঘুরছে। বমি করেছি।’ আমি বুঝতে পারলাম — হয়তো এ কোনো নতুন অতিথির আগমনী বার্তা হবে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার পরীক্ষা করালেন। রিপোর্ট পজেটিভ। আমাদের ঘরে একজন নতুন অতিথি আসছে।
কলির কথা মতো সুন্দর একটি ছেলে বাচ্চার পোস্টার কিনে এনে ঘরে লাগিয়ে দেই। প্রায়ই এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে সে স্বপ্ন দেখে। কল্পনার জাল বুনে, তারও এই রকম একটি ছেলে সন্তান হবে । সে আদর করবে। বুকের দুধ খাওয়াবে।
একদিন বিকেলবেলা খুব মন খারাপ করে কলি বলছিল– ‘আমার যদি মেয়ে হয়, তুমি রাগ করবে না তো ?’ আমি বলেছিলাম – ‘না গো।’
আস্তে আস্তে আনারকলির ডেলিভারীর ডেট চলে আসে। দেশের বাড়ি থেকে শাশুরী মাকে ঢাকায় আনা হয়।
তখন শ্রাবণ মাস। সেদিন ছিল আমার ছুটির দিন। সকাল থেকেই আকাশে কালো মেঘ হয়ে আছে। একটু পর মুশুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আনারকলি বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আমিও যেয়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াই। বৃষ্টি দেখছিলাম দু’জনই।আনারকলি বলছিল — শরীরটা ভালো লাগছে না।
আমি : বেশি খারাপ লাগছে ?
কলি : অত বেশি না।
আমি: বিছানায় শুয়ে থাকো।
কলি : ওগো, আমার খুব ভয় হয় !
আমি : চলো তোমাকে বিছানায় শোয়ায়ে দেই।
আমি আনারকলিকে পাশ জড়িয়ে বিছানায় এনে শোয়ায়ে দেই। ও বলছিল তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়ার কথা। ভাবলাম আর দেরি করা ঠিক হবে না। শাশুরী মার সাথে আলাপ করে বৃষ্টির মধ্যেই একটি ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসি। ঢাকায় অবস্থানরত আমার বড়ো বোন ও দুলাভাইকেও খবর দেওয়া হয়। তারাও চলে আসে। মুশুলধারে বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের ট্যাক্সিা হলি ফ্যামেলি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে গিয়ে পৌঁছে।
অপারেশন রুমের সামনে অপেক্ষা করছিলাম সুসংবাদের জন্য। একটু পর ডাক্তার এসে যে সংবাদটি দেয় তাহলো — ‘অধিক রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। নবজাতক শিশুটিও বেঁচে নেই।’
আকাশ তখনও মেঘে ঢাকা ছিল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল কর্কশ শব্দ করে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছিল অনবরত। জীবনের সব আশা আর স্বপ্নগুলোকে পিছনে ফেলে আমি রাস্তায় নেমে আসি। তারপর শুধু অসীম শূন্যতার কথা।
ঘর আর ভালো লাগে নাই কখনো। ঘর ছেড়ে বেশির ভাগ সময় মাজার, মসজিদ, পথে, ঘাটে,পার্কে শ্টেশনে পড়ে থাকি। মন চাইলে ঘরে ফিরে যাই। না চাইলে পথে পথেই ঘুরে বেড়াই।
ওগো, একি শূন্যতা তুমি দিয়ে গেলে আমায়, দম বন্ধ হয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস– জীবন আর ভরাতে পারিনা কোনো আনন্দে। জীবন আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি না সামনে। কী যে মর্মর বেদনা হয় প্রাণ জুড়ে। দিনগুলি আর চায় না যে ফুরোতে .. .।
৩১ . অমৃতা
কোনো এক বসন্ত বিকেলে চন্দ্রিমা উদ্যানের সবুজ ঘাসে বসে আমি আর অমৃতা দু’জন হাতে হাত রেখে প্রতিশ্রুতি করেছিলাম, আমরা এ জীবনে অন্য কাউকে বিয়ে করব না। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে অমৃতা মৃত্যুর ওপারে চলে যেয়ে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। সে আর বিয়ে করেনি। অমৃতার মৃত্যুর পর তার কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে মায়ের অনেক পিড়াপিড়ীতে শেষ পর্যন্ত আমি বিয়ে করলাম।
আমি তখন বনবিভাগে চাকুরি করি। পোস্টিং ছিলো গাজীপুর রেঞ্জে। শ্রীপুর থানা সদরের অদূরে বাংলো টাইপের এক বাড়িতে আমি থাকি এবং সেখানেই নতুন বউ জেসমিনকে নিয়ে ঘরে তুলি। জেসমিন জানতো না অমৃতা নামে কাউকে আমি ভালোবাসতাম। বিয়ের আগে একটা জেদ করেছিলাম, বউকে বেশি ভালোবাসব না; তাকে খেয়াল করব না, তাকে সময় দেবো না কিন্তু সে জেদ আর করতে পারিনি। আস্তে আস্তে আমি জেসমিনকে ভালোবাসতে থাকি।
জেসমিন যখন স্নান সেরে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে থাকে , তখন আমি ওকে দেখি। ও যখন কালো এলো চুল সামনে এনে আচড়াতে থাকে, তখন ওকে আমি দেখি। রান্না করতে যেয়ে টুকটুকে গালে কালি লাগিয়ে যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন আমি ওকে দেখি। ও যখন ঘুমিয়ে থাকে আমার পাশে, ওর স্বপ্ন মুখ আমি তখন দেখি। জেসমিনকে দেখতে দেখতে ওর প্রতি আমার অসম্ভব মায়া জন্মাতে থাকে।
একদিন ছুটির দিনে জেসমিনকে নিয়ে পাশেই বালু নদীর তীরে বেড়াতে যাই। একটি রিক্সা নিয়ে আধা পাকা পথ পেড়িয়ে, কিছু মেঠো পথ পায়ে হেঁটে আমরা নদীর কূলে চলে যাই। ওখানে তীরে বসে দেখি বালুর নদীর শান্ত জল। দেখি পানকৌঁড়ি আর বকদের জলের উপর ঘোরাঘুরি। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পশ্চিম আকাশের লাল আভা জেসমিনের মুখের উপর এসে পড়ে। ঠিক এমনি এক মোহনীয় ক্ষণে অমৃতাকে একবার দেখেছিলাম বুড়িগঙ্গার পারে। সেই রক্তিম মুখ, সেই স্বর্ণাভ ললাট, সেই সৌম্য মুখখানি দেখতে পেলাম আজ জেসমিনের মুখ অবয়বে।
সেদিন ছিল বৃষ্টির দিন। বাংলোর বারান্দায় দুজন বসে আছি। শালবনের ঝোপে ঝাড়ে অনবরত বৃষ্টি ঝরছে। টিনের চালে ঝুমঝুম করে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। বারান্দার চাল থেকে গড়িয়ে পড়া জল ধরছিল জেসমিন। এ যেনো শ্রাবণ মেঘ মল্লার দিন। মন আঁধার করে নামছে সন্ধ্যা। নির্জন সেই মায়াবী ক্ষণে আমাদের ছিল অনেক চাওয়ার আকুলতা। গুণগুণ করে জেসমিন গাচ্ছিল- ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে, জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগেনা।’ এমনি এক বৃষ্টিমুখর দিনে অমৃতার কন্ঠে শুুনেছিলাম এই গান।
রাতে বিছানায় শুয়ে আছি। আমার দুহাত জেসমিনের বাহুতে বাঁধা। দেখলাম ওর খুব মন খাারাপ। কথা বলতে চাইছে না। ডাকি আদর করে, চুপ হয়ে থাকে সে। টানতে চাই বুকের খাঁজে, আসতে চায় না। কানের কাছে যেয়ে কানে কানে ওকে বলি–‘ কি হয়েছে তোমার ?’ অভিমান ভেঙ্গে জেসমিন বলে– সন্ধ্যায় বারান্দায় বৃষ্টির সময়ে তুমি আমাকে ‘মিত্রা’ বলে ডেকেছিলে কেন ?’ আমি বললাম- ‘তুমি একটা পাগলি মেয়ে। আমি তো আদর করে তোমাকে ‘মিত্রা’ ডেকেছিলাম।’ অবাক হই, আমি যে কখন জেসমিনকে ‘মিত্রা’ বলে ডেকেছিলাম, এ কথা আমার মনেই পড়ছে না।
দিনগুলি চলছে ভালো করেই, সময়গুলি কাটছে ভালোবেসে। সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। বাংলোর সামনে পুকুরপাড়ে ঘাসে দু’জন বসে আছি। জেসমিন পরেছিল সাদা শাড়ি। শুভ্র জ্যোৎস্নার বিমুগ্ধ স্রোতে জেসমিন মিশে গিয়েছিলো। ওর গোলাপি গাল হয়ে উঠেছিল সাদা,খয়েরি ঠোঁট হয়ে উঠেছিল নীল, কালো চুল হয়ে গেল সোনালি। পুকুরপাড়ের হাস্নাহেনার সুবাস এসে ভরে উঠছিল জেসমিনের বুকে। আমি তখন কাছে টানি অমৃতাকে। ওকে বলি- চলো মিত্রা, কেউ যাক বা না যাক, আজ এই জ্যোৎস্না রাতে তুমি আর আমি যাব শালবনে।’ এত ভালোবাসা ওকে ঢেলে দিলাম সেইখানে, তারপরেও জেসমিন সে রাতে ঘরে এসে বিছানায় মুখ গুজে কেঁদেছিল।
আমি জেসমিনের কাছে ক্রমেই আমার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলাম। ওকে যত বেশি ভালোবেসে কাছে টানছিলাম, ঠিক তত বেশি ওর ভিতর অমৃতা সিনড্রোমে আমাকে পেয়ে বসতে থাকে। যা কিছু পুরোনো প্রেম তা প্রকাশিত হচ্ছে অজ্ঞাতসারে, কখনো ঘুমের ঘোরে, কখনো স্বপ্নে, কখনো জাগরণে, কখনো বিহব্বলতায় জেসমিনকে ‘অমৃতা’ ‘মিত্রা’ বলতে থাকি। এতে করে জেসমিন কতো যে কষ্ট পেয়েছে, কত যে গোপনে গোপনে কেঁদেছে . এ খবর আমি কখনো রাখি নাই।
অফিসে সেদিন ঢাকা থেকে অডিট টীম এসেছিলো। তাই বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। জেসমিনকে দেখলাম, তাঁতের সবুজ রঙ্গের শাড়ি পরে আছে। এই শাড়িটি পরেছিল বিয়ের দ্বিতীয় দিনের সকালবেলায়। মুখে ওর বিষাদের হাসি। শরীরটা খুব ক্লান্ত ছিল আমার। আমি দু’মূঠো খেয়ে শুয়ে পড়ি। চোখে দুনিয়ার ঘুম জড়িয়ে আসছে।
মিত্রা বলছিল — আমি তোমাকে মনে হয় ভালোবাসা দিতে পারি নাই।’
আমি বলি– কি যে বলো তুমি মিত্রা ! সেই কতোকাল ধরে তুমি আমাকে ভালোবেসে আসছো ! বুড়িগঙ্গার পাড়ে কত সন্ধ্যা কেটেছে, কত বিমুগ্ধ তারার রাত কেটেছে আমাদের। মিত্রা, তুমি কি ভুলে গেছ সেই সব গভীর চুম্বনের কথা ? ভুলে কি গেছ সেই সব প্রগাঢ় আলিঙ্গনের কথা ? ‘
তারপর ঘুমের ঘোরে বলেছিলাম হয়তো আরো অনেক কথা। কোনো কথা মনে করতে পারছি না। জেসমিন বলেছিল- ‘তোমার পুরানো ট্রাংক খুলে অমৃতার লেখা সব চিঠি আমি আজ পড়েছি।’ তারপর আরো কি বলেছিল অমৃতা মনে নেই। আমি গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে যাই।
সকালবেলা বাইরে অনেক মানুষের কথার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায়। জেগে দেখি পাশে জেসমিন নেই। পুকুরপাড়ে অনেক মানুষের ভীড়। সবাই দেখছে- একটি মেয়ে উবু হয়ে পুকুরের জলে ভাসছে।
তারপর ঐ বাংলোতে একাকী বেশি দিন আমি থাকতে পারিনি। হেড অফিসে অনুরোধ করে বদলির আদেশ নেই। যেদিন চলে আসব, সেদিন সকালবেলা পুকুরপাড়ে জলের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। জলে দেখতে পাই জেসমিনের মুখ। ওকে বলি– অমৃতা মৃত ছিল, সে তুমি জানতে না। তার জন্য এত বড়ো অভিমান ! তোমরা দু’জনেই একই রকম। আমাকে একা করে রেখে দু’জনেই চলে গেলে।
Leave a Reply