পিরানদেল্লোর গল্প / সম্পাদনা করেছেন – বুদ্ধদেব বসু
অনুবাদ করেছেন – কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ক্ষিতীশ রায়, কমলা রায়, বুদ্ধদেব বসু
.
লুইজি পিরানদেল্লো (১৮৬৭-১৯৩৬)
গাব্রিয়েলে দাননুনৎসিও আর লুইজি পিরানদেল্লো— এঁরা দু’জন আধুনিক ইতালিয়ান সাহিত্যের দুই চূড়ামণি। কিন্তু দু’জনের প্রতিভার স্বভাব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। দাননুনৎসিও দীপ্ত,দৃপ্ত, উচ্ছ্বসিত, আনন্দময়; পিরানদেল্লো শান্ত, সূক্ষ্ম, নিপীড়িত, রহস্যময়। তরুণ বয়সে পিরানদেল্লো যখন প্রথম সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন, তখন দাননুনৎসিওর খ্যাতি মধ্যগগনে, কিন্তু পূর্বসূরীর শিষ্যত্ব তিনি কখনও গ্রহণ করেননি,দাননুনৎসিওর কলোল্লাস তাঁর ভালই লাগত না। অন্য অনেক প্রসিদ্ধ গদ্যলেখকের মতোই, পিরানদেল্লো তাঁর সাহিত্যজীবন আরম্ভ করেন কাব্যকলার প্রাঙ্গণে, কিন্তু ঠিক সুরটি লাগল না, বোধহয় সেটা বুঝতে পেরেই একটি কাব্যগ্রন্থের তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘বেসুরো’। কাব্যলক্ষ্মীর কাছে বিমুখ হয়ে তিনি গদ্য লেখা ধরলেন, এবং গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভা, স্বল্পকালের মধ্যেই বিকশিত হয়ে উঠল। তারপর পরিণত বয়সে ইতালিয়ান ‘গ্রোটেস্ক’ নাট্যের শ্রেষ্ঠ উদ্গাতারূপে তিনি জগদ্বিখ্যাত হলেন। ইওরোপ-আমেরিকার বড় বড় শহরে তাঁর নিজস্ব সম্প্রদায় ইতালিয়ান ভাষাতেই তাঁর নাটকের অভিনয় করে বেড়াল, হলিউডে গ্রেটা গার্বো তাঁর একটি নাটকের সুলভ চলচ্চিত্র-সংস্করণ প্রকাশ করলেন, নোবেল প্রাইজের বরণ-মাল্য তাঁর গলায় পড়ল। ইওরোপে— সুতরাং আমাদের দেশে তাঁর খ্যাতি প্রধানত নাট্যকাররূপেই পৌঁচেছে; কিন্তু স্বদেশে কথাসাহিত্যেও তাঁর বিপুল প্রতিষ্ঠা, ছোটগল্পে তিনি বর্তমান ইতালির প্রধান পুরুষ বলে স্বীকৃত। জীবন ভরে অজস্র ছোটগল্প তিনি লিখেছেন, ইতালিয়ান-এ তাঁর সমগ্র গল্পসংগ্রহ Novelle per unanno (‘বছরের প্রতি দিনের জন্য একটি গল্প’) নামে অনেকগুলি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ছোটগল্পের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের প্রাথমিক পরিচয় ঘটানো এই বইয়ের উদ্দেশ্য।
এ বইয়ের গল্প ক’টি থেকেই পিরানদেল্লোর মূল সুরটি ধরা যায়। গভীর বেদনারসে গল্পগুলি পরিপ্লুত। এ বেদনা কখনও মধুরের আভাস এনে দেয়, যেমন ‘কয়েকটা কমলালেবু’তে, কখনও-বা অতল হতাশায় মগ্ন করে, যেমন ‘তা বেশ’ গল্পে। কখনও তিক্ততা, কখনও বিদ্রুপের বাঁকা হাসি, কখনও-বা একটু দুর্লভ অশ্রুজল। কিন্তু বেদনা ছাড়া আর কিছু নয়। পিরানদেল্লোর ব্যক্তিগত জীবনের দিকে তাকালে এই বিচিত্র বিশাল দুঃখের একটা পটভূমি পাওয়া যায়। তিনি বিবাহ করেছিলেন যুবাবয়সে, পাত্রী তাঁর পিতার নির্বাচিত— বিবাহের পূর্বে কন্যাকে তিনি চোখেও দেখেননি। দাম্পত্য জীবন কিছু দিন সুখেই কেটেছিল, কিন্তু তারপর পিতার ব্যাবসা ফেল পড়ায় তিনি আর্থিক টানাটানিতে পড়লেন, বাধ্য হলেন রোমের একটা মেয়ে ইস্কুলে মাস্টারি নিতে এবং দুঃখের পাত্র তাঁর পূর্ণ হল যখন তাঁর স্ত্রী মনঃপীড়ার আক্রমণে অমানুষিক মূর্তি ধরলেন। রোগের প্রধান লক্ষণ হল স্বামীর প্রতি সুতীব্র সন্দেহ— এই সন্দেহের তাড়নায় পিরানদেল্লোকে বছরের পর বছর দুঃসহ নির্যাতন ভোগ করতে হয়। তাঁর স্নেহশীল মন স্ত্রীকে উন্মাদ-আশ্রমের নির্বাসনে পাঠাতে পারল না, নিঃশব্দে তিনি সহ্য করলেন ভাগ্যের এই আঘাত, এই দীর্ঘ নিষ্ঠুর যন্ত্রণা। বছরের পর বছর কোনও বন্ধুর বাড়ি তিনি যেতেন না, নিজের উপার্জনের শেষ কপর্দকটি স্ত্রীর হাতে তুলে দিতেন। এই সময়েই তিনি ভাবতে আরম্ভ করেন— তাঁর মধ্যে আসল মানুষটি কে, তাঁর স্ত্রী যাকে সন্দেহ করে আর তিনি নিজে যাকে চেনেন, এ দুয়ের মধ্যে কোনজন? এই চিন্তা ক্রমে গভীরভাবে তাঁর সমস্ত রচনায় ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে— প্রতি মানুষের মধ্যে এই ব্যক্তিবহুলতার সমস্যার উল্লেখ পাওয়া যাবে তাঁর নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে। ১৯১৮ সালে উন্মাদিনী মরে তাঁকে মুক্তি দিল, কিন্তু তাই বলে জীবনে তাঁর সুখ ফিরে এল না। শেষ বয়সে তাঁর মুখের গভীর গম্ভীর বিষণ্ণতা লক্ষ করে অনেকে তাঁকে বলতেন ‘চিনে বুদ্ধ’ —এই সময়ে তাঁর নাটুকে দলের সঙ্গে পাশ্চাত্য ভূখণ্ডের নগরগুলিতে গৃহহারা ভ্রাম্যমাণের জীবন তিনি কাটাতেন, টাকাকড়ি সব ছেলেদের লিখে দিয়েছিলেন— সংসারের বাঁধন কিছুই তাঁর ছিল না। মুখে বলতেন, ‘হোটেলের ঘরই আমার বাড়ি, আর সম্পত্তির মধ্যে আমার টাইপ রাইটার।’
এ কথা মনে রাখতে হবে যে পিরানদেল্লো খাস ইতালিয়ান নন, জাত সিসিলিয়ান। ছাত্রজীবনে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য তিনি প্রবন্ধ লিখেছিলেন সিসিলির মৌখিক ভাষার বিষয়ে এবং ওই ভাষায় লেখা কয়েকটি নাটকও তাঁর আছে। এই ছোট বইটি পড়েও বোঝা যাবে যে তাঁর সাহিত্য সিসিলির গন্ধে ভরপুর। জীবনে যখনই যেখানে থেকেছেন, সিসিলির নীল আকাশ, উজ্জ্বল রৌদ্র, সিসিলির অজ্ঞ সরল আবেগপ্রবণ মানবপ্রকৃতি কখনও তিনি ভুলতে পারেননি। ইওরোপের হিসেবে সিসিলি আমাদের দেশের মতোই ‘পেছিয়ে পড়া’ দেশ, তাই এই গল্পগুলিতে বর্ণিত কোনও কোনও চরিত্র মনে হয় যেন আমাদেরই আপন জন। সেই দারিদ্র্য, সেই কুসংস্কার, সেই আত্মঘাতী অচেতনতা। ‘ধাইমা’র নায়িকা অনায়াসে বাংলার পাড়া-গাঁর মেয়ে হতে পারে, ‘মাছি’র দু’ভাই যেন আমাদের দেশেরই চাষি। সমস্ত দুঃখের পরপারে মাতৃভূমি সিসিলির প্রতি একটি গভীর প্রেম পিরানদেল্লোর ধ্যানী চিত্তে নিঃস্পন্দ।
অনুবাদ সম্বন্ধে দু’-একটি কথা। অনুবাদ ইংরেজি থেকে করা হয়েছে, মূল ইতালিয়ান থেকে নয়। অনুবাদের অনুবাদে কিছুটা ক্ষতি হয়তো অপরিহার্য, সে ক্ষতি আমরা পূরণ করবার চেষ্টা করেছি ভাষাবিন্যাসের সৌষ্ঠবে। অনুবাদের বাংলা যাতে সহজেই বাংলার মতো পড়া যায়, যাতে বিজাতীয় গন্ধ কোথাও তাকে শ্রীভ্রষ্ট না করে, সেইদিকেই আমরা বিশেষ লক্ষ রেখেছি। নামগুলির ইতালিয়ান উচ্চারণই রাখা হয়েছে— যদি স্বরলিপিতে কোথাও ভুল হয়ে থাকে, পণ্ডিতরা মার্জনা করবেন— শুধু জায়গার নামগুলি লেখা হয়েছে ইংরেজি উচ্চারণের অনুসরণে, রোমকে রোমা লিখলে বাঙালির অভ্যাসের উপর বড় বেশি জুলুম করা হত।
Leave a Reply