পালামৌ – সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রথম সংস্করণ—বৈশাখ ১৩৫১
প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্ৰ সংস্করণ
ফাল্গুন ১৩৯৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯
ভূমিকা
বাংলাসাহিত্যের প্রথম সফল ভ্ৰমণকাহিনীর বিস্ময়কর লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৩৪ সালে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্রের রচনার মৌলিকতা, চিত্রাবহুলতা, কবিত্ত্ব, দীপ্তি সত্যিকার অর্থে ব্যতিক্রমী। বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক না হয়ে কিছুকাল আগের লেখক হলে তার নাম হয়তো বাংলাসাহিত্যে আরো শ্ৰদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হতো। একাধারে ঔপন্যাসিক, প্ৰবন্ধকার ও সম্পাদক ছিলেন তিনি। তবে উপন্যাস-লেখক কিংবা সম্পাদক হিশেবে তার যে খ্যাতি তার চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতিমান তিনি তাঁর পালামৌ (১৮৮০-৮২) নামের ছোট্ট ভ্রমণকাহিনীর লেখক হিশেবে। এক শতাব্দীকাল ধরে এই বইটির অপূর্ব সৌন্দর্য, সজীবতা, বর্ণনাপ্রতিভা সুধী পাঠকসম্প্রদায়ের কাছে প্রীতিস্নিগ্ধ অভিনন্দন পেয়ে আসছে। বাংলাসাহিত্যের সেই বিস্মৃতি দীপ্তিময় রচনাটিকে নতুন করে তুলে ধরার জন্যে আমাদের এই প্রকাশ-প্ৰয়াস।
সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’ ভ্রমণের ওপর ভিত্তি করে রচিত এই বিখ্যাত ভ্রমণ-বৃত্তান্ত পালামৌ। নানা দিক থেকে বইটি বাংলা ভাষার অন্যতম উজ্জ্বল রচনা। সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতিভার প্রতি উৎসাহী রবীন্দ্রনাথ বইটির ভারসাম্যমধুর মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে বইটির অনন্যসাধারণত্বের দিকে আঙুলি নির্দেশ করেছেন। বইটির মধ্যে দুর্বলতা, অসংলগ্নতা বা ঊষর অংশ নেই এমন নয়, কিন্তু যে-সব জায়গায় বইটি ভালো, সে-সব বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আলোকিত অংশগুলোর সমকক্ষ। বাংলা ভাষার অনেক স্মরণীয় বর্ণনা বা উক্তি যেমন, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্ৰোড়ে’—জাতীয় লোকশ্রুত বাক্যের সাক্ষাৎ আমরা পাই এই বইয়ের পৃষ্ঠাতেই।
পালামৌ সম্বন্ধে রবীন্দ্ৰনাথের উচ্ছসিত আগ্রহের উল্লেখ আগেই আমরা করেছি। রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্জীবচন্দ্ৰ’ [পালামৌ] প্ৰবন্ধটি আজ আদি সম্ভবত এই গ্রন্থের শ্রেষ্ঠতম মূল্যায়ন। এই বইয়ের উজ্জ্বল ও ব্যৰ্থ দুটি দিকই রবীন্দ্রনাথের এই রচনায় সমান সহানুভূতিতে বর্ণিত হয়েছে। সঞ্জীবচন্দ্রের মধ্যে প্রতিভার ঐশ্বর্য থাকলেও গৃহিণীপনার যে অভাব ছিল সে বিষয়টি উল্লেখ প্রসঙ্গে রবীন্দ্ৰনাথ তার রচনার প্রথমেই জানিয়েছেন:
[কোনো কোনো ক্ষমতাশালী লেখকের প্রতিভায় কী-একটি গ্ৰহদোষে অসম্পূর্ণতার অভিশাপ থাকিয়া যায়; তাহারা অনেক লিখিলেও মনে হয় তাহাদের সব লেখা শেষ হয় নাই। তাঁহাদের প্রতিভাকে আমরা সুসংলগ্ন আকারবদ্ধভাবে পাই না, বুঝিতে পারি তাহার মধ্যে বৃহত্ত্বের মহত্ত্বের অনেক উপাদান ছিল, কেবল সেই সংযোজনা ছিল না যাহার প্রভাবে সে আপনাকে সর্বসাধারণের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে প্রকাশ ও প্রমাণ করিতে পারে।
সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতিভা পূর্বোক্ত শ্রেণীর। তাহার রচনা হইতে অনুভব করা যায় তাহার প্রতিভার অভাব ছিল না, কিন্তু সেই প্রতিভাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাহার হাতের কাজ দেখিলে মনে হয়, তিনি যতটা কাজে দেখাইয়াছেন তাঁহার সাধ্য তদপেক্ষা অধিক ছিল।
তাঁহার মধ্যে যে পরিমাণে ক্ষমতা ছিল সে পরিমাণে উদ্যম ছিল না। তাহার প্রতিভার ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু গৃহিণীপনা ছিল না। ভালো গৃহিণীপনায় স্বল্পকেও যথেষ্ঠ করিয়া তুলিতে পারে; যতটুকু আছে তাহার যথাযোগ্য বিধান করিতে পারিলে তাহার দ্বারা প্রচুর ফল পাওয়া গিয়া থাকে। কিন্তু অনেক থাকিলেও উপযুক্ত গৃহিণীপনার অভাবে সে ঐশ্বর্য ব্যর্থ হইয়া যায়; সে স্থলে অনেক জিনিস ফেলাছাড়া যায়, অথচ অল্প জিনিসই কাজে আসে। তাহার অপেক্ষা অল্প ক্ষমতা লইয়া অনেকে যে পরিমাণে সাহিত্যের অভাব মোচন করিয়াছেন তিনি প্রচুর ক্ষমতা সত্ত্বেও তাহা পারেন নাই; তাহার কারণ, সঞ্জীবের প্রতিভা ধনী, কিন্তু গৃহিণী নহে।]
কিন্তু ‘গৃহিণী’ না হলেও তাঁর প্রতিভা যে ‘ধনী ছিল তার বিস্তারিত আলোচনা পাই রবীন্দ্রনাথের ঐ প্রবন্ধেই, একটু পরে :
[পালামৌ-ভ্রমণ বৃত্তান্তের মধ্যে সৌন্দর্যের প্রতি সঞ্জীবচন্দ্রের যে একটি অকৃত্রিম সজীব অনুরাগ প্রকাশ পাইয়াছে এমন সচরাচর বাংলা লেখকদের মধ্যে দেখা যায় না।. ‘পালামৌ’ তে সঞ্জীবচন্দ্ৰ যে বিশেষ কোনো কৌতুহলজনক নূতন কিছু দেখিয়াছেন অথবা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কিছু বর্ণনা করিয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু সর্বত্রই ভালোবাসিবার ও ভালো লাগিবার একটা ক্ষমতা দেখাইয়াছেন। পালামৌ দেশটা সুসংলগ্ন সুস্পষ্ট জাজ্জ্বল্যমান চিত্রের মতো প্রকাশ পায় নাই, কিন্তু যে সহৃদয়তা ও রসবোধ থাকিলে জগতে সর্বত্রই অক্ষয় সৌন্দর্যের সুধাভাণ্ডার উদঘাটিত হইয়া যায়। সেই দুর্লভ জিনিসটি তিনি রাখিয়া গিয়াছেন, এবং তাঁহার হৃদয়ের সেই অনুরাগপূর্ণ মমত্ববৃত্তির কল্যাণকিরণ যাহাকেই স্পর্শ করিয়াছো-কৃষ্ণবর্ণ কোল রমণীই হউক, ছোট হউক, বড়ো হউক— সকলকেই একটি সুকোমল সৌন্দর্য এবং গৌরব অর্পণ করিয়াছে। ]
সঞ্জীবচন্দ্রের বর্ণনা ক্ষমতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য সঞ্জীবচন্দ্রের প্রতিভার মূলশক্তিকে বোঝার ব্যাপারে অন্তৰ্ভেদী। রবীন্দ্ৰনাথ লিখেছেন :
[গ্রন্থকার কোল-যুবতীদের নৃত্যের যে বর্ণনা করিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করি—
যুবাদিগের প্রতি উপহাস আরম্ভ করিল, সঙ্গে সঙ্গে বড়ো হাসির ঘটা পড়িয়া গেল। উপহাস আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; কেবল অনুভবে স্থির করিলাম যে, যুবারা ঠকিয়া গেল। ঠকিবার কথা—যুবা দশ-বারোটি, কিন্তু যুবতীরা প্রায় চল্লিশজন; সেই চল্লিশ জনে হাসিলে হাইলন্ডের পল্টন ঠকে। হাস্য উপহাস্য শেষ হইলে নৃত্যের উদ্যোগ আরম্ভ হইল। যুবতী সকলে হাত ধরাধরি করিয়া অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি রেখা বিন্যাস করিয়া দাঁড়াইল। দেখিতে বড়ো চমৎকার হইল। সকলগুলিই সম-উচ্চ, সকলগুলিই পাথুরে কালো; সকলেরই অনাবৃত দেহ; সকলেরই সেই অনাবৃত বক্ষে আশির ধুকধুকি চন্দ্ৰকিরণে এক-একবার জ্বলিয়া উঠিতেছে। আবার সকলের মাথায় বনপুষ্প, কৰ্ণে বনপুষ্প, ওষ্ঠে হাসি। সকলেই আহ্লাদে পরিপূর্ণ, আহ্লাদে চঞ্চল—যেন তেজঃপুঞ্জ অশ্বের ন্যায় সকলেই দেহবেগ সংযম করিতেছে।
সম্মুখে যুবারা দাঁড়াইয়া, যুবাদের পশ্চাতে মৃন্ময়মঞ্চোপরি বৃদ্ধেরা এবং তৎসঙ্গে এই নরাধম। বৃদ্ধের ইঙ্গিত করিলে যুবাদের দলে মাদল বাজিল, অমনি যুবতীদের দেহ যেন শিহরিয়া উঠিল। যদি দেহের কোলাহল থাকে তবে যুবতীদের দেহে কোলাহল পড়িয়া গেল, পরেই তাহারা নৃত্য আরম্ভ বরিল।’
এই বর্ণনাটি সুন্দর, ইহা ছাড়া আর কী বলিবার আছে? এবং ইহা অপেক্ষা প্রশংসার বিষয়ই-বা কী হইতে পারে? যুবতীদের দেহে কোলাহল পড়িয়া গেল,… এ কথা বলিলে ত্বরিত আমাদের মনে একটা ভাবের উদয় হয়; যে কথাটা সহজে বর্ণনা করা দুরূহ তাহা ঐ উপমা-দ্বারা এক পলকে আমাদের হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়া যায়। নৃত্যের বাদ্য বাজিবামাত্র চিরাভ্যাসক্রমে কোল-রমণীদের সর্বাঙ্গে একটা উদাম উৎসাহিচাঞ্চল্য তরঙ্গিত হইয়া উঠিল, তৎক্ষণাৎ তাহাদের প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে যেন একটা জানাজানি কানাকানি, একটা সচকিত উদ্যম, একটা উৎসবের আয়োজন পড়িয়া গেল—যদি আমাদের দিব্যকর্ণ থাকিত তবে যেন আমরা তাহাদের নৃত্যবেগে উল্লসিত দেহের কল-কোলাহল শুনিতে পাইতাম।]
বইটির পাতায় পাতায় সহজ লালিত্য, অরণ্যের আদিম গাঢ় অনুভব, চিত্ররূপময় বর্ণনা, ভাষার সৌন্দর্য, প্রকৃতি-মধুরতা এই বইকে বাঙালি পাঠকের কাছে বহুদিন পর্যন্ত স্মরণীয় করে রাখবে।
পালামৌ-এর মধ্যে একই সঙ্গে যে-প্রতিভার ঐশ্বর্য এবং গৃহিণীপনার অভাবের কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন সঞ্জীবচন্দ্রের জীবনও ছিল তারই উদাহরণ। তাঁর জীবনকে ঘিরে ছিল এক অদ্ভুত দায়িত্বহীনতা, আলস্য, খামখেয়ালিপনা এবং উদাসীনতা। আচমকা বিদ্যুচ্চমকের মতো তার মধ্যে সক্রিয়তা দেখা যেত—তিনি ‘জ্বলে’ উঠতেন, কিন্তু তা স্বল্প সময়ের জন্যেই। আবার সেই বিরতিহীন দীর্ঘ অলসতা এবং দায়িত্বহীনতা তাকে অধিকার করত। অসাধারণ মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও সুস্থিরভাবে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া কিংবা চাকরি কোনোটাই তিনি করতে পারেননি।
আমরা যদি পালামৌ সম্পর্কিত মূল্যায়নকে অতি সংক্ষেপে সূত্রবদ্ধ করি তাহলে বলব যে, পালামৌ বাংলাসাহিত্যের সর্বপ্রথম সার্থক ভ্ৰমণকাহিনী। আবার এই রচনাটিকে যদি কেবল ভ্ৰমণসাহিত্য বলা হয় তাহলেও এর পরিচয় যথার্থ হয় না। কারণ ব্যক্তিগত জীবন উপলব্ধির আলোকে তিনি যে ভাষ্য রচনা করেছেন তাতে তাঁর বক্তব্য হয়ে উঠেছে। একদিকে দার্শনিকতাময় অন্যদিকে কবিতামণ্ডিত। সবকিছুর সমন্বয়ে রচনাটি যে সংরূপে সম্পন্ন হয়েছে তাকে বাংলাসাহিত্যের একটি শ্ৰেষ্ঠ নিদর্শন বলা যাবে। কারণ রচনাসাহিত্যের দর্শনেই লেখকের ব্যক্তিসত্তার প্রতিফলন ঘটে। উপন্যাসেরও গুণ রয়েছে এতে। রবীন্দ্রনাথ পালামৌ-এর মধ্যে অসম্পূর্ণতার অভিশাপ দেখতে পেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও যে এর রচনারীতি তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল তার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল সঞ্জীবচন্দ্রের গদ্যের ‘প্রসাদ গুণ’। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অপরূপ বর্ণনা-কুশলতা। যে-সময়ে সঞ্জীবচন্দ্র এই রচনাটি লিখছিলেন তখন আজকের মতো ভাষাচেতনা গড়ে ওঠেনি বাঙালি সমাজে। ভাষাচেতনার একটি ছোট দৃষ্টান্ত তাঁর রচনা থেকে উদ্ধৃত করি।
[তিনি বলেছেন: সাধুভাষা অতি অসম্পন্ন; এই ভাষায় গালি চলে না, ঝগড়া চলে না, মনের অনেক অনেক কথা বলা যায় না।’]
আমরা সাম্প্রতিককালে ভাষা নিয়ে যে ধরনের চিন্তা করছি তার সঙ্গে তার এত আগের চিন্তার কী চমৎকার নৈকট্যই-না রয়েছে।
পালামৌ বইটির বর্ণনায় কেবল সৌন্দর্যই নেই, রয়েছে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, আধুনিক নৃবিজ্ঞান-চেতনারও পরিচয় তিনি দিয়েছেন এতে। বিশেষত কোল-নারীদের বর্ণনায় এই পরিচয় পাওয়া যায়।
সঞ্জীবচন্দ্রও একজন রেনেসাঁস-মানুষ। তাঁর এই রচনায় আমরা দেখতে পাই অনুসন্ধিৎসা ও বিজ্ঞানচেতনা। সবার ওপরে রয়েছে মানবিকতার প্রতি পক্ষপাত যা রেনেসাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রেনেসাঁসের আরও একটি দিক স্বদেশপ্ৰেম । রচনাটি স্বদেশপ্ৰেমেও উজ্জ্বল। বিশেষত এই পরিচয় আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে বিদেশি মদের সঙ্গে দেশি মদের তুলনার ক্ষেত্রে।
প্রসঙ্গান্তরে যাবার যে দৃষ্টান্ত ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে তাতে বাঙালি মনের বৈশিষ্ট্য দেখানো হয়েছে। বাঙালিদের সংকীর্ণতা-প্রসারিতার কথাও এই ভ্ৰমণ-স্মৃতিমূলক রচনাসাহিত্যের অন্যতম পার্শ্ববিষয় হয়ে এসেছে।
মাঝে মাঝেই সঞ্জীব প্রসঙ্গান্তরে গিয়েছেন। যেমন তিনি লিখেছেন,
[যাঁহার বাটীতে যাইতেছি, তাহার সহিত আমার কখনো চক্ষুষ হয় নাই। তাহার নাম শুনিয়াছি, সুখ্যাতিও যথেষ্ট শুনিয়াছি, সজ্জন বলিয়া তাহার প্রশংসা সকলেই করে। কিন্তু সে প্রশংসায় কৰ্ণপাত বড় করি নাই, কেননা বঙ্গবাসীমাত্রই সজ্জন; বঙ্গে কেবল প্রতিবাসীরাই দুরাত্মা, যাহা নিন্দা শুনা যায় তাহা কেবল প্রতিবাসীর। প্রতিবাসীরা পরশ্ৰীকাতর, দাম্ভিক, কলহপ্রিয়, লোভী, কৃপণ, বঞ্চক। তাহারা আপনাদের সন্তানকে ভালো কাপড়, ভালো জুতা পর্যায়; কেবল আমাদের সন্তানকে কাঁদাইবার জন্য। তাহারা আপন পুত্রবধূকে উত্তম বস্ত্ৰালঙ্কার দেয়, কেবল আমাদের পুত্রবধূর মুখ ভার করাইবার নিমিত্ত। পাপিষ্ঠ প্ৰতিবাসীরা। যাহাদের প্রতিবাসী নাই, তাহাদের ক্ৰোধ নাই। তাহাদেরই নাম ঋষি। ঋষি কেবল প্রতিবাসী-পরিত্যাগী গৃহী। ঋষির আশ্ৰম-পার্শ্বে প্রতিবাসী বসাও, তিনদিনের মধ্যে ঋষির ঋষিত্ব যাইবে। প্রথম দিন প্রতিবাসীর ছাগলে পুষ্পবৃক্ষ নিষ্পত্ৰ করিবে। দ্বিতীয় দিনে প্রতিবাসীর গরু আসিয়া কমণ্ডলু ভাঙিবে, তৃতীয় দিনে প্রতিবাসীর গৃহিণী আসিয়া ঋষিপত্নীকে অলঙ্কার দেখাইবে। তাহার পরই ঋষিকে ওকালতির পরীক্ষা দিতে হইবে নতুবা ডেপুটি মেজিষ্ট্রেটির দরখাস্ত করিতে হইবে। (প্রথম প্ৰবন্ধ)]
এইটুকু বলে তিনি বলেছেন ‘এক্ষণে সে সকল কথা থাক।’ রবীন্দ্রনাথ এই ধরনের প্রসঙ্গান্তরে যাওয়াকে এই রচনার সৌষ্ঠবহানি বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যকে নির্বিচারে গ্রহণ করা যায় না। কারণ রচনাসাহিত্য’ এমন এক মুক্ত সংরূপ যা একের মধ্যে অনেককে ধারণ করে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। লেখক যদি প্রসঙ্গান্তরে না-ই যেতেন তাহলে বাঙালি স্বভাব সম্পর্কে এই অসাধারণ পর্যবেক্ষণ কীভাবে প্ৰকাশ করতেন?
ছাত্র হিশেবে তিনি মেধাবী ছিলেন, কিন্তু ছাত্রজীবন তার সুস্থির ছিল না। পিতার চাকরিস্থল পরিবর্তনের কারণে তাকে নানা জায়গায় লেখাপড়া করতে হয়েছে। এই ঘনঘন স্থানচ্যুতি তার ছাত্রজীবনে বারে বারে ছেদ এনে এই জীবনকে একরকম ব্যর্থ করে দেয়। চাকরিজীবনেও এই অসংলগ্নতা, ছেদ এবং পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে। প্রথমে পিতার চেষ্টায় সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। যে পদে তিনি কর্মরত ছিলেন। সে পদের বিলুপ্তি ঘটলে তিনি চাকরি হারান এবং হঠাৎ করেই পুষ্পেপাদ্যান নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। এর কিছুকাল পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিশেবে পুনরায় চাকরিতেও যোগদান করেন। কিন্তু এ চাকরিও বছর দুয়ের বেশি স্থায়ী হয়নি। এই চাকরি-সূত্রেই সরকার তাকে পালামীে নামে এক প্রায়-অরণ্যে বিশেষ দায়িত্বে নিয়োগ করলে তিনি পালামৌ যান, কিন্তু পালামৌ-এর মতো বিজন বনে বসবাস করা তার কাছে দুঃসহ মনে হওয়ায় তিনি অল্পদিনের মধ্যেই ফিরে আসেন। তার চাকরিজীবনের এ-ছাড়াও রয়েছে কিছু বিক্ষিপ্ত অধ্যায়। কিন্তু পালামৌ-এর স্বল্পকালীন অবস্থিতির ঘটনা তার চেতনায় যে অনুভূতি-গভীর ছায়া ফেলে তা নিয়েই রচিত তাঁর এই অসামান্য ভ্ৰমণকাহিনী। ‘প্রমথনাথ বসু ছদ্মনামে এই ভ্ৰমণকাহিনী ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রতিভা এবং অপব্যয়ের লোকশ্রুত উদাহরণ এই অদ্ভুত মানুষটি বেশকিছু কাজের মধ্যেও জড়িত হয়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে। বঙ্কিমচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন কিছুকাল। বহু তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে প্ৰজাকল্যাণের উদ্দেশে Bengal Ryot নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেন—যা পড়ে মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন লেফটেনেন্ট গভর্নর তাঁকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ করেছিলেন। উপন্যাসও লিখেছিলেন কয়েকটি। কণ্ঠমালা, মাধবীলতা তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। উপন্যাসতুল্য ইতিহাস-কাহিনী ‘জাল প্রতাপচাঁদ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। ক্ষণিক সক্রিয়তা এবং ব্যাপ্ত দায়িত্বহীনতার দ্বৈরথে চিহ্নিত এই সৌন্দর্যপ্রিয় প্রতিভাবান মানুষটি জীবনের শেষপর্বে কৃষ্ণনগরের নিজের বাড়িতে সম্পূর্ণ নিক্রিয় অবস্থায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান। তাঁর মৃত্যু ঘটে ১৮৮৯ সালে।
আহমাদ মাযহার
Leave a Reply