পাঞ্চজন্য – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
পাঞ্চজন্য – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
‘পাজ্ঞজন্য’ প্রথম অখন্ড সংস্করণ – বৈশাখ ১৩৯৪
ষড়বিংশ মুদ্রণ, পৌষ ১৪১৬
উৎসর্গ
রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের পরমপূজনীয় স্বামী শিবস্বরূপানন্দ ও এই গন্থের ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশকালে যেসব অগণিত পাঠক ও পাঠিকা আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে উৎসাহিত করেছেন—সকৃতজ্ঞ নমস্কারের সঙ্গে তাঁদের সকলকে
পাঞ্চজন্য – প্ৰথম খণ্ড
মুখবন্ধ
মহাভারতের তথা শ্রীকৃষ্ণের কাল একালের থেকে অন্যরকম ছিল তা মনে করার কোন কারণ নেই। শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাককালে বলেছেন—’যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত/অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্’ সেই তিনি যখন ঐ কালে জন্মেছিলেন এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের তিনিই একরকম প্রধান নায়ক—তখন বুঝতে হবে যে ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান ভালরকমই ঘটেছিল, পৃথিবীর মানুষ অত্যাচারে অবিচারে দুঃখে কষ্টে ‘ত্রাহি’ ‘ত্রাহি’ করছিল। নইলে যাকে ‘ভগবান স্বয়ম’ বলা হয় তিনি অবতীর্ণ হবেন কেন?
বস্তুত ভারতেতিহাসের কাল চিরকালই ঐ কাল। লোভ, অসূয়া, পরশ্রীকাতরতা, দ্বেষ, হিংসা, কলহ, চণ্ডাল-ক্রোধ, শূন্যগর্ভ অহঙ্কার এবং আত্মনাশা বুদ্ধি—এই কি ভারত-ইতিহাসের সামগ্রিক ফলশ্রুতি নয়?
এ অবস্থা থেকে ভারতকে রক্ষা করতে অনেকেই চেষ্টা করেছেন। সে অসাধ্য সাধনের প্রয়াস পেয়েছেন কেউ ধর্মের পথে, কেউ বা শৌর্যের পথে—অর্থাৎ গায়ের জোরে।
বাহুবলে সাম্রাজ্য স্থাপন করে বাইরে-থেকে-চাপিয়ে-দেওয়া কৃত্রিম একতায় আত্মতৃপ্তি লাভ করেছেন।
শ্রীকৃষ্ণও কি ভারতকে তার পঙ্কশয্যা থেকে, নিত্য আত্মাবমাননা থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সম্ভোগমত্ত মদগর্বিত কলহপরায়ণ মাৎস্যন্যায়ধর্মী নির্বোধ বিকৃত ক্ষাত্রশক্তির দূষিত অধীনতা দূর করে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সৎ মানুষের হাতে দেশের ভার তুলে দিতে, চেয়েছিলেন জনসাধারণের মনে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে?
সেই জন্যেই কি নিকটাত্মীয়ের কারাগারে তাঁর জন্মগ্রহণ করা, সামান্য গোপালকদের গৃহে লালিত-পালিত হওয়া, একক শক্তিতে কংস বধ করে নিপীড়িত জনসাধারণের মনে আশ্বাস ও আশার সঞ্চার করা?
সেই প্রশ্নেরই উত্তর সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন লেখক এই গ্রন্থে।
শ্রীকৃষ্ণ যখন জন্মগ্রহণ করেছেন তখন ভারতের কি চেহারা আমরা দেখি!
মগধাধিপতি সম্রাট জরাসন্ধ ছিয়াশিটি রাজাকে এনে বন্দী করে রেখেছেন—আর চৌদ্দটি পেলে রাজমেধযজ্ঞ বা হত্যামহোৎসব সম্পন্ন করবেন।
কংসের মৃত্যুতে ক্রদ্ধ জরাসন্ধ নাকি ঊনবিংশতিবার মথুরা আক্রমণ করেন। তাতে যাদবদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যই হয়েছে, কিন্তু ঐ অঞ্চলের অধিবাসী জনসাধারণকে যে অবর্ণনীয় দুঃখদুর্দশা ভোগ করতে হয়েছে তার বিবরণ মহাভারতে লেখা না থাকলেও আমরা অনুমান করতে পারি।
সম্ভবত সেইজন্যই, তাদের কথা ভেবেই আরও শ্রীকৃষ্ণ এই বিগ্রহ এড়াবার জন্য বহুদূরে দ্বারাবতী-রৈবতকে গিয়ে বসবাস করেছিলেন—জরাসন্ধের বিনাশের অপেক্ষায় বা তার আয়োজনে।
কালযবন, চেদীরাজ শিশুপাল, ভগদত্ত, পৌণ্ড্রক বাসুদেব, মদ্ররাজ, সিন্ধুরাজ প্রভৃতি সমসাময়িক নৃপতিদের যে রূপ দেখি, সে-সময়কার যেসব যুদ্ধবিগ্রহ দিগ্বিজয়- যাত্রা প্রভৃতির বিবরণ পাই—তার কিঞ্চিন্মাত্রও যদি সত্য হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে সে-সময় সাধারণ দেশবাসীর অবস্থা একালের চেয়ে সুখকর ও শান্তিময় ছিল না, যতই কেন না জীবনযাত্রার উপকরণ সুলভ ও সহজপ্রাপ্য হোক।
সুতরাং—’পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম—ধর্মসংস্থাপনার্থায়’ শ্রীকৃষ্ণের যে প্রচেষ্টা—তার কারণ, তার পিছনে পুরুষোত্তমের যে বেদনা ও ক্ষোভ—তা উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না। সেই বিরাট প্রচেষ্টার বিপুল আয়োজন, এক অমানুষিক মানুষের অবিশ্বাস্য প্রজ্ঞা, বুদ্ধিকৌশল, পরিকল্পনার কল্পনাতীত বিশালতা, লোকোত্তর মনোবল—তার সাফল্য ও তার ব্যর্থতাই বর্তমান গ্রন্থের উপজীব্য।
পরিশেষে নিবেদন, এটি উপন্যাস মাত্র, জীবনী নয়।
এই মহামানব যে রূপে লেখকের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়েছেন—সেই রূপই দেবার চেষ্টা হয়েছে এই গ্রন্থে। এ শ্ৰীকৃষ্ণ লেখকের কল্পনার, ধারণার মানুষ—বুঝি তার ইচ্ছাতুর স্বপ্নেরও। এর মধ্যে ঐতিহাসিক পারম্পর্য, পৌরাণিক অতিশয়োক্তি বা মুগ্ধ স্তুতিগান খুঁজতে গেলে হয়ত হতাশ হতে হবে।
‘মনুষ্যধর্মশীলস্য লীলা সা জগতঃ পতেঃ। অস্ত্রাণ্যনেকরূপাণি যদরাতিষু মুঞ্চতি ।। মনসৈব জগৎসৃষ্টিং সংহারঞ্চ করোতি যঃ। তস্যারিপক্ষক্ষপণে কো’য়মুদ্যমবিস্তরঃ ।। তথাপি যো মনুষ্যাণাং ধর্মস্তনুবর্ততে। কুর্বন বলবতা সন্ধি হীনৈর্বুদ্ধং করত্যসৌ ।। সাম চোপপ্ৰদানঞ্চ তথা ভেদং প্রদর্শয়ন। করোতি দণ্ডপাতঞ্চ কচ্চিদেব পলায়নম ।। মনুষ্যদেহিনাং চেষ্টামিত্যেবমনুবর্ততঃ। লীলা জগৎপতেস্তস্য ছন্দতঃ সংপ্ৰবৰ্ততে ।। –বিষ্ণুপুরাণ, (৫ম অংশ : ২২ অধ্যায়)
জগৎপতি হইয়াও যে তিনি শত্রুদের প্রতি অনেক অস্ত্রনিক্ষেপ করিলেন, ইহা তিনি মনুষ্যধর্মশীল বলিয়া তাঁহার লীলা। নহিলে যিনি মনের দ্বারাই জগতের সৃষ্টি ও সংহার করেন, অরিক্ষয় জন্য তাঁহার বিস্তর উদ্যম কেন? তিনি মনুষ্যগণের ধর্মের অনুবর্তী, এজন্য তিনি বলবানের সঙ্গে সন্ধি ও হীনবলের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কাম, দান, ভেদ প্ৰদৰ্শনপূর্বক দণ্ডপাত করেন, কখনও পলায়নও করেন। মনুষ্যদেহীদিগের ক্রিয়ার অনুবর্তী সেই জগৎপতির এইরূপ লীলা তাঁহার ইচ্ছানুসারেই ঘটিয়াছিল।
[ অনুবাদ বঙ্কিমচন্দ্র ]
‘মহাভারতের সবচেয়ে রহস্যময় পুরুষ কৃষ্ণ। বহু হস্তক্ষেপের ফলে তাঁর চরিত্রেই বেশী অসংগতি ঘটেছে। মূল মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বললেও সম্ভবত তাঁর আচরণে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বেশী দেখান নি। সাধারণত তাঁর আচরণ গীতাধর্মব্যাখ্যাতারই যোগ্য, তিনি বীতরাগভয়ক্রোধ স্থিতপ্রজ্ঞ লোকহিতে ব্রত। কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁর যে বিকার দেখা যায় তা ধর্মসংস্থাপক পুরুষোত্তমের পক্ষে নিতান্ত অশোভন, যেমন ঘটোৎকচ বধের পর তাঁর উদ্দাম নৃত্য এবং দ্রোণবধের উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যাভাষণের উপদেশ।…সর্বত্র ঈশ্বররূপে স্বীকৃত না হলেও কৃষ্ণ বহু সমাজে অশেষ শ্রদ্ধা ও প্রীতির আধার ছিলেন এবং রূপ শৌর্য বিদ্যা ও প্রজ্ঞার জন্য পুরুষশ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হতেন।’
রাজশেখর বসু
[মহাভারতের ভূমিকা]
Leave a Reply