পাগলী, তোমার সঙ্গে – জয় গোস্বামী
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৯৪
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সুব্রত চৌধুরী
.
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
.
সূচিপত্র
মা আর মেয়েটি
দুখানি হাতের সরোবরে
শুকনো পাতার ডালে
স্পর্শ
কলঙ্ক, আমি কাজলের
মাসিপিসি
পথ
ঘুমন্ত দেবতা
কুকুরছানাদের গল্প
কে জন্মায়, হে বৈশাখ
র্যাগিং
হাঁস
মৃত্যুটি রচনা করি
ঋণ
এসেছি, কুসুম
দোল: শান্তিনিকেতন
গীতিসূর্য: প্রেমসংখ্যা
ঋষি ও রাঙা মেঘ
ভোজসভা
তেজ
জাতিস্মর
ও আকাশপার
আকাশতীরের বন্ধু
গুপ্তচর
ঢেউ গুচ্ছ
যশোগীতি
এক লাইন, দু লাইন
দিকভ্রম
রানীকুঠি
একফোঁটা
পাঁচালি: দম্পতিকথা
প্রাক্তন
বন্ধু
জ্বলো
জলহাওয়ার লেখা
সূর্যঢেউ, দূর্বাদল
সবচেয়ে উঁচু তারাকে আমি বলি
সূর্য
রূপকথা
বয়ঃসন্ধি
মৃত্যু সব লেখাপড়া
‘চোখ পালটায়ে কয়’
লোকজন
.
মা আর মেয়েটি
এক পথ ঘুমন্তের পায়ে
এক পথ নৌকার পারানি
এক পথ পালকের গায়ে
মা আমি সমস্ত পথ জানি
দিন থামে গাছের তলায়
রাত্রি থামে পরীদের বাড়ি
সিঁড়ি দিয়ে আলো উঠে যায়
মা আমি সমস্ত আলো পারি
এ আকাশ ভাঙে মাঝে মাঝে
ও আকাশ মেঘে আত্মহারা
সে আকাশে নৌকা খোলা আছে
মা আমি আকাশভরা তারা
মা আমার এক দীঘি জল
সারা গ্রাম করে ছলোচ্ছল…
‘পোড়ামুখী, দু চক্ষের বিষ
ফের তুই প্রেমে পড়েছিস?’
দুখানি হাতের সরোবরে
দূরত্ব জানো, তোমার দুখানি হাতের তীর্থে
মৃত্যু আমার
দূরত্ব জানো, সারাদিন ধরে
খেটে আসা দুটি হাতের তীর্থে
মৃত্যু আমার
এতদিন পরে একটার পর একটা বাঁধন
ছিঁড়তে ছিঁড়তে
দূরত্ব জানো তোমার হাতের পান্থতীর্থে
মৃত্যু আমার
ধুলোয় ধুলোয় ঘাসে ঘাসে এই
মৃত্যু এখন
প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন মৃত্যু এখন দুখানি হাতের
সরোবরে, ভরা সরোবরে, ওই
সরোবরে মুখ ডুবিয়ে দিলাম
তলিয়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে,
তলিয়ে যাক সে—
একবার যদি পথে নেমে গ্যাছো,
আজ কিছুতেই পারো না ফিরতে
ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুম ঝাঁপ দিয়ে পড়ো
ধুয়ে মুছে যাও সত্যি মিথ্যে…
শুকনো পাতার ডালে
সবার সঙ্গে বসেছিলাম, পথের পাশের চায়ের দোকান
মাথার ওপর খড়ের চালা, ছই
আবার কেন ডাক পাঠালে, ও অন্ধকার বসন্ত দিন,
এখন আমার ভূমিকা অল্পই
ওরা কেমন ভেসে আসছে, দোলের ছেলে দোলের মেয়ে
সারা শরীর আবীর ওদের, পায়ের তলায় সমুদ্র থৈ থৈ
এমন সময় ঝড় নেমে আয়, আয়রে আমার শুকনো পাতার
ডালে ডালে ঝড় নেমেছে ওই
উড়িয়ে নিলো কে জানে কার পাগল করা গানের গলা
হাত থেকে কার ভাসিয়ে নিলো বই
ফিরলো যখন, চুলের উপর ঝড়ের কুটো আটকে আছে,
সরিয়ে দেবো?—কিন্তু আমার ভূমিকা অল্পই
একটা দুটো চুল রূপোলী, আমি তো তার মেয়ের বন্ধু,
তাই বলে কি বসন্তদিন মনে মনেও তার বন্ধু নই?
ঝড়কে গিয়ে জানিয়ে এসো, কী মানে হয় এমন করার?
সে বুঝবে না?—আমি যে তার শুকনো পাতা হই
আবার আমার ডাল কাঁপছে, সমস্ত ডাল কাঁপছে আমার—
কিন্তু বলো বসন্ত দিন, তার সঙ্গে তলিয়ে যাবার উপায় আমার
কই!
স্পর্শ
এতই অসাড় আমি, চুম্বনও বুঝিনি।
মনে মনে দিয়েছিলে, তাও তো সে না-বোঝার নয়—
ঘরে কত লোক ছিল, তাই ঋণ স্বীকার করিনি।
ভয়, যদি কোনো ক্ষতি হয়।
কী হয়? কী হতে পারত? এসবে কি কিচ্ছু এসে যায়?
চোখে চোখ পড়ামাত্র ছোঁয়া লাগলো চোখের পাতায়—
সেই তো যথেষ্ট স্বর্গ—সেই স্পর্শ ভাবি আজ। সেই যে অবাক করা গলা
অন্ধকারে তাও ফিরে আসে…
স্বর্গ থেকে আরো স্বর্গে উড়ে যাও আর্ত রিনিরিনি
প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু আজ বলো, দশক শতক ধ’রে ধ’রে
ঘরে পথে লোকালয়ে স্রোতে জলস্রোতে আমাকে কি
একাই খুঁজেছো তুমি? আমি বুঝি তোমাকে খুঁজিনি?
কলঙ্ক, আমি কাজলের
কলঙ্ক, আমি কাজলের ঘরে থাকি
কাজল আমাকে বলে সমস্ত কথা
কলঙ্ক, আমি চোট লেগে যাওয়া পাখি—
বুঝি না অবৈধতা।
কলঙ্ক, আমি বন্ধুর বিশ্বাসে
রাখি একমুঠো ছাই, নিরুপায় ছাই
আমি অন্যের নিঃশ্বাস চুরি ক’রে
সে-নিঃশ্বাসে কি নিজেকে বাঁচাতে চাই?
কলঙ্ক, আমি রামধনু জুড়ে জুড়ে
দিন কাটাতাম, তাই রাত কাটতো না
আজ দিন রাত একাকার মিশে গিয়ে
চিরজ্বলন্ত সোনা
কলঙ্ক, তুমি প্রদীপ দেখেছো? আর প্রদীপের বাটি?
জানো টলটল করে সে আমার বন্ধুর দুই চোখে?
আমি ও কাজল সন্তান তার, বন্ধুরা জল মাটি
ফিরেও দেখি না পথে পড়ে থাকা
বৈধ অবৈধকে—যে যার মতন রোদবৃষ্টিতে হাঁটি…
মাসিপিসি
ফুল ছুঁয়ে যায় চোখের পাতায়, জল ছুঁয়ে যায় ঠোঁটে
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি রাত থাকতে ওঠে
শুকতারাটি ছাদের ধারে, চাঁদ থামে তালগাছে
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি ছাড়া কাপড় কাচে
দু এক ফোঁটা শিশির তাকায় ঘাসের থেকে ঘাসে
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি ট্রেন ধরতে আসে
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির মস্ত পরিবার
অনেকগুলো পেট বাড়িতে, একমুঠো রোজগার
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির পোঁটলা পুঁটলি কোথায়?
রেল বাজারের হোমগার্ডরা সাত ঝামেলা জোটায়
সাল মাহিনার হিসেব তো নেই, জষ্টি কি বৈশাখ
মাসিপিসির কোলে-কাঁখে চালের বস্তা থাক
শতবর্ষ এগিয়ে আসে—শতবর্ষ যায়
চাল তোলো গো মাসিপিসি লালগোলা বনগাঁয়
পথ
বলো কী নতুন কথা বলা কওয়া করো
নরে নরে কথা হয়, নারীতে নারীতে
ভ্রম বিদ্যমান রইলো, আমার বাড়িতে
তুমি এলে একদিন, আমি জড়োসড়ো
ভয় পেতে ভয় পেলাম—হঁটের উনুন—
চালে ডালে এক ক’রে খিচুড়ি ফুটিয়ে
একটু দিলাম গালে, ইস্, কী দারুণ!
গন্ধ বশে থাকে না তো, পাড়া ছেড়ে গিয়ে
বেপাড়ায় আড্ডা দিলো, পড়োশি জুটিয়ে
চলে এলো এইখানে—অধিকারী প্রিয়
এত সব অতিথিকে বসতে দিই কোথা
মারকুটে স্বজন সব, গাণ্ডে পিণ্ডে গিলে
পুকুরে আঁচাতে গেল—যত লাঠিসোটা
আমার জিম্মায় রেখে। তারা ফিরে এলে
যার যা জিনিস তাকে দিয়ে তো ঘুমোবো
তার আগেই কাণ্ড দ্যাখো, লাঠিসোটাগণ
খটখট শব্দ তুলে—নিজেরা বার হয়ে
এদের দোকান ভাঙ্গছে, ওদের ক্ষেতের
কাকতাড়ুয়াকে মারলো, বেচারা হাঁড়িটি
মুখপোড়া হয়ে ছিলো, বাঁশ থেকে প’ড়ে
গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে পুকুরের জলে
ভেসে ভেসে ঘুরতে লাগলো মাঠের ওপারে…
এই কি নতুন কথা, সব্বনেশে কথা
বলা কওয়া করো তোমরা নরনারী সব
কী অরাজকতা বলো কী অরাজকতা…
আমি তবু যুদ্ধহারা পথের আশ্রয়ে
গিয়ে দেখি খোলা মাঠ মিশেছে জঙ্গলে
আমি সেই জঙ্গলের অন্ধকার গাছ
স্পর্শ ক’রে জনে জনে স্পর্শ ক’রে দেখি
বিশ্বাস করে না গাছ প্রতিযোগিতায়
যদিও যোজনব্যাপী জঙ্গলে ছড়ানো
মেঘ থেকে আছড়ে পড়া যাত্রীহীন রথ
ছিন্ন চূড়া, ভগ্ন চক্র, যাত্রীহীন রথ
তবু সব পথ হারানো যাত্রীরাই জানে
দিশাহীন চক্ষুষ্মান যাত্রীরাই জানে
পথের দুপাশে আছে হারানিধি পথ
পথেরও ওপারে চলে হারানিধি পথ…
ঘুমন্ত দেবতা
শত্তুরের মুখে দিয়ে ছাই
আমরা খেউড় গেয়ে খাই
…আর মেঘে ঘুমন্ত দেবতা
তোমাদের হাতে খরস্রোতা
প্রেম থেকে রক্ত লেগেছিল
মেঘে ঘটি দিলো ডুব দিলো
ওঠে ডোবে ঘটি রাত্রিদিন
আমাদের চক্ষুবল ক্ষীণ
চন্দ্রসূর্য ব’লে ভ্রম করি
বুক চাপড়ে আ মরি, হা মরি
বাংলা ভাষা উড়াই বাতাসে
যদি সুধীজন কাছে আসে
যদি দেখি ভাসছে বজরাটি
কত দূরে ডাকাতের ঘাঁটি
জোছনা পড়েছে কূলে কূলে
আমাদেরও মাতঙ্গিনী ফুলে
মধু খেতে যাবার দুর্মতি
হলো সেইদিন, জন প্রতি
একজন মাতঙ্গিনী ফুল
বেহায়ার মতো বেঁধে চুল
ঢং করল: ‘এসো মেহমান—’
পরশু শ্রাদ্ধ, কালকেই কামান
সব কিছু ভুলে মেরে দিয়ে
বসলাম একদিনের বিয়ে…
আমাদের কত কী আহ্লাদ
কাজে কর্মে গিয়েছিল বাদ
আজ সব একান্তে উশুল—
কূল ভাঙে, ঢেউ ভাঙে কূল…
কূলে ভগ্ন হয় ক্ষুদ্র বীচি
বঙ্কিমচন্দ্রকে মিছিমিছি
বাঁকা চাঁদ ডাকলাম আদরে
মাতঙ্গিনী কী সোহাগ করে
ঘন্টু মুনু, কুটু মুনু,—হায়
সে সব তো মুখে বলা দায়!
দেখতে দেখতে ফর্সা হয়ে যায়…
পরদিন ধমকালো: ‘বাড়ি যাও
কত বেলা ঘাড়ে বসে খাও
নিজ রাস্তা এবার দ্যাখো গে—’
এবংবিধ বহু মুষ্টিযোগে
রত আছি ঘুমন্ত দেবতা
তোমাদের হাতে খরস্রোতা
দেবী থেকে খুনজখম লাগে
মোহনিদ্রা ভাঙবার আগে
খুনজখম ভেসে চলে যায়
নদী নালা আধমরা গঙ্গায়
খুনজখম চলে যায় হেসে
আমরাও ক্লেশে বা অক্লেশে
হাসি অট্ট, ক্রূর কিংবা স্মিত,
যে যার পারে ভাঙচি দেয়, দিত
আমাদের প্রণয়ে, পিরীতে
শিশিরমঞ্চের নৃত্যগীতে
‘হাড় হাভাতের মতো শীতে’
যারা কেঁপে উঠেছিল, যারা
রাত্তিরে পাহারা দিত পাড়া
এ অন্যের গা থেকে কম্বল
টেনে নিত, চক্ষু থেকে জল
শুষে খেয়ে নিত পরস্পর
মিলে মিশে দুদিন অন্তর
জড়াজড়ি শুয়ে থাকত খালে
উঠে এসে আমাদের পালে
ফেলত বাঘ—আবার, আবারও
জঙ্গলে চিৎকার উঠত: ‘মারো—’
সারারাত গর্জনের তাড়া
প্রাণ হাতে করো বাস্তুহারা
গাড়িবারান্দায় গিয়ে শোও
আজ যাকে বোন পাতাও—ছোঁও,
কাল তাকে ছোঁও অন্য হাতে
তার সামনেই অর্ধরাতে
থামবে এসে গম্ভীর শকট
আর বলবে: ওঠ ছুঁড়ি, ওঠ
তোর বিয়ে…………
সব কাজ শেষ হলে পরে
সে তো ছেঁড়া বিয়ের কাপড়ে
পা থেকে গড়ানো রক্ত মোছে
পরদিন তবু অন্ন রোচে
আমাদের ঘরে ঘরে, বমি,
আমাদের চতুর্থী পঞ্চমী
পরদিন সামান্য খরচে
পথ থেকে রক্তদাগ ঘোচে
আমাদের ভেলপুরী, এগ রোল
কেনাকাটা, বোল রাধা বোল,
হবে না কি? হবে কি সঙ্গম?
কারোর সুযোগ কিছু কম—
কারো বেশি—ইচ্ছে ষোল আনা—
ভবিতব্য সবারই অজানা
কাল-ই কোনো ভালো হতে পারে
আমাদের দু’মুঠো সংসারে
এই কদিনের টানাটানি
প্রীতিময় অন্ধকারখানি
তুলে ধরি গভীর আগ্রহে
কী রকম লাগে, বাড়ি বয়ে
জানিয়ে তো গেছ, ও পাঠক
আমিও তোমারই মতো লোক
তোমারই মতন অসাবধানী
আমি ছিলাম, দৈববাণী
হাওয়া থেকে তুলে নিয়ে কানে
অর্থ পেতে লিখেছি এখানে
দেখেছি এখানে, মরা মাছ
বাজারে ঘুমোয় বারো মাস
জ্যান্ত হয়ে উঠে পত্রিকায়
এঁকেবেঁকে পরের পাতায়
চলে যায়, লাফ দিয়ে পড়ে—
গিন্নী মা আছেন কলঘরে
সে সব মানে না, বলে: ‘ভাজো
এখনি আমাকে’…আজ, আজো
তৈল শুধু ফুটছে তড়বড়
‘ওরে মৎস্য, ঝম্প দিয়ে পড়
মাটিতে, যা মাটি থেকে জলে—’
পিছু পিছু গিয়ে কৌতূহলে
দেখি আমি সেই কাটা মাছ
জলের ভিতরে নেমে আজ
তারা কাটা খণ্ডগুলি খোঁজে
নুন-কাদা-সমুদ্রে মগজে
ধরে নিয়ে সে ছুটে বেড়ায়
রসাতলে… যদি কেউ যায়
রাত্রির সমুদ্রতীরে, তবে
তাকে তো একাই বুঝতে হবে
এ সন্ধান—সন্ধানী পাঠক
তব নাম নিয়ে একঢোঁক
প্রশংসা গিলেই, পড়ি মরি
নিজের পায়ের থেকে দড়ি
খুলে ফেলে এসেছি তোমার
সকাশে, আকাশ ভরাবার
আয়োজন নিয়ে…
২
তোমাদের দ্বারে রাখো গান
আমরা তো পথের সম্মান
পথে পেয়ে গিয়েছি নগদে
বাড়ি ফিরে রাঙাভাঙা মদে
ডুবে থেকে লিখেছি দোপাটি
সসম্মানে লিখেছি দোপাটি
তাই ভাষা হেসে কুটিপাটি
‘রাস্তায় নামাতে পারবে কি
আমাকে? মুরোদখানা দেখি!’
পাশের বাড়ির ওই যে লোক
শিখে এল উৎসাহব্যঞ্জক
শেষতম সব হালচাল
শৌচাগারের গায়ে কাল
লিখে এলো নতুন যে-খেউড়
তাতে আজ বালি ঝুরঝুর…
ভাষা জিহ্বা, কামড়ে যায় জিভ
ছুঁড়ে মারো ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব
যা পায় হাতের সামনে, মারে
ত্রাহি ত্রাহি, ও বাবা রে মা রে
কাপ-ডিস-চামচ-গেলাস
কোথা, তোরা কোথা ছুটে যাস
ছুটে ওরা অন্ধকারে পড়ে
জীবিতদের মতো দেহ ধরে
কত দেশে আছে কত ঠাঁই
ডাকে রাত্রিনিশীথের ভাই
সাড়া দিয়ে জঙ্গলে জলায়
আয়ু গেছে, তলায় তলায়
কোন ভাগ্য ক’রে গেছে খেলা
ভূতসঙ্গে কেটে গেছে বেলা
আজ অন্ধ, চড়ার উপরে
শুয়ে থাকে, হাত বাড়িয়ে ধরে
প্রজাপতি কানামাছি পাখা
এ বলে: ‘আমার পায়ে চাকা
লাগানো রয়েছে কতক্ষণ—’
ও বলে: ‘আমার কথা শোন
দেখতে পাই আমি ত্রিভুবন—’
কেউ কারো মুখ তো দ্যাখে না
মুখে জল-ফেনা-বালি-ফেনা
চক্ষুগর্তে মাছের খলবল
‘কাটা খণ্ড কোথা গেল বল্—’
খণ্ডগুলি বিভিন্ন সাগরে
ভিন্ন ভিন্ন নাম নিয়ে ঘোরে
ভিন্ন ভিন্ন দেশে আর কালে
ভিন্ন মৎস্য শিকারির জালে
আবির্ভূত হয়, ছিটকে যায়
জাল থেকে জলে পুনরায়
বংশধারা ঘোরে জনপদে
নব নব বাণিজ্যে, বসতে
তার অভ্যুত্থান,
মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে প্রাণ…
আমাদের প্রাণ-ই তো সম্বল
ব্যাকরণ কৌমুদীর তল
আমরা তো পাইনি সজ্ঞানে
আমাদের সদানন্দ গানে
তামা তুলসী গঙ্গাজলে কোন
অপরাধময় প্রহসন
ঘাপটি মারে—অবধারিত সে
পাপমূর্তি বক্ষোপরে বসে
গুম্ফ ওপড়ায় সুখে, আর
আমরা তাকে দু’হাত বাড়িয়ে
ঘরে ডাকি, হাতপাখা নাড়িয়ে
হাওয়া করি, হাওয়া করি, তার
মুখে ধরি চা-জলখাবার
কী ঘেন্নায়…
তবু আমরা, প্রতিবেশীগণ,—
—‘নই শুধু জনসাধারণ
ম্রিয়মাণ জনসাধারণ—’
মেঘে ঘটি ডোবে রাত্রিদিন
আমাদের অবস্থা সঙ্গীন
পদে পদে ভয়, রিপুভয়?
আমাদের তিন থাকতে নয়—
তবু তো পেখম দেখে ভাই
এখনো মোহিত হয়ে যাই
আমাদের বিষণ্ণ খেউড়
শুনে দ্যাখো প্রাণ ভরপুর
আমাদের মৃত্যু হেলে দুলে
কত সব মাতঙ্গিনী ফুলে
কতবার বসি গিয়ে ক্যাশে
কতবার ক্যাশ ভেঙে খাই
শিশুদের লেখা উপন্যাসে
ডেকে আনি অসভ্য কিশোর
ও চরিত্র, সিটি দাও জোর—
তুমি বুঝি কলোনির ছেলে
এ বয়সে সব শিখে গেলে
তোমার মুখের রুক্ষ ভাষা
ইস্কুলের মেয়ে দেখতে আসা
ভবিষ্যৎ তুচ্ছ করা রোখ
উদ্ধত, পরোয়াহীন চোখ
আমাদের মতো নয়, ওর
আরেকরকম ভাগ্য হোক
অন্যরকম ভাগ্য হোক
শ্রীপুরুষকার…
৩
ভবিষ্যৎ সবার অজানা
মেঘে মেঘে দেবতার হানা
দেবতার খাড়া দুটো শিং
আর মাঠে ফেলে যাওয়া ডিম
খুঁজতে আসেন, দেবী যাঁরা—
ভূমি, শস্য, অগ্নির পাহারা
পথভ্রম ঘটায় তাঁদের—
মেঘে চক্র চলেছে চাঁদের
জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করে মাঠ
শুভ্র ডিমগুলি হতবাক
গড়িয়ে গড়িয়ে চলে আসে
বনযাত্রী নদীটির পাশে
কোনো ডিম জলে ভেসে যায়
কেউ শূন্যে উঠে কুয়াশায়
এক দুই তিন চার তারা
ডিম ফেটে বেরোয় বাচ্চারা
উড়ে গিয়ে বসে গাছে গাছে
সব গাছ সাদা হয়ে আছে…
পক্ষিমুখ দেবীরা তাদের
মা হন, গোলকধাঁধা ফের
ঘূর্ণী হয়ে ঘোরে সারা বন
পতঙ্গেরা দেবীর বাহন;
সরিয়ে কাশের গুচ্ছ, ধান
দেবীগণ প্রান্তরে বেড়ান
‘কাছে আয়’—দেবীরা ডাকেন
আর তারা ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে
উড়ে যেতে থাকে, যেতে থাকে
যেতে থাকে…
উড়ে, আরো উড়ে
কয়েক শতাব্দীকাল দূরে
ওই যেখানে বাঁকা হলো নদী
সেখানেই নামে শেষ অবধি—
ওইখানে ভবিষ্যৎ-তীর
নেমে আসা চাঁদনৌকাটির
ঠিক নীচে সময়ের পার
ভোর-সন্ধ্যা-ভোর একাকার
ওই পারে কে এসে ভেলায়
আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে যায়
জলে রাখি শিশুহাতখানি
আনি-মানি-জানি-আনি-মানি…
হাতে ধাক্কা দেয় খরস্রোতা
মেঘ, মেঘে জাগ্রত দেবতা
দেখা দেয়: আমার দু’হাত
হাতে নেয় আগুনের হাত
টেনে নেয় আগুনের হাত
ভেলা থেকে নেমে পড়লে জল
জল নয়, মেঘ স্বতশ্চল
আগুনের হাত ধ’রে ধ’রে
মেঘে মেঘে গোল হয়ে ঘোরে
শিশুরূপী কয়েকটি বামন
ছয় সাত আট দশ জন
অষ্টাবক্র কয়েকটি বামন
আগুনের হাত, আগুনের
শিং নিয়ে একে অপরের
কাছে আসে, দূরে যায়, কাছে—
(চাঁদচক্র জলে মগ্ন আছে)
দেবতা ও জাগ্রত দেবতা
আমাদেরই হাতে খরস্রোতা
মন্ত্র বয়,
গম্ভীর খেউড়
দূর পার হয়ে আরো দূর
চলে, বয়ে চলে,
বয়ে চলি…
আগুনের বিরাট কুণ্ডলী
ভেসে ওঠে দিগন্তের কাছে
আকাশে বামনদল নাচে
আকাশ আকাশ ঘিরে নাচে
আকাশ আকাশ ঘিরে
নাচে…
ঘিরে…
নাচে…
ঘিরে…
নাচে…
ঘিরে…
নাচে…
ঘিরে…
নাচে…
একটি দুটি বামন তলায়
খসে পড়ে, জ্বলে মুছে যায়
কুকুরছানাদের গল্প
রাস্তায় পায়ের কাছে চলে আসা কুকুর ছানার কাছে আমি
উবু হয়ে বসে পড়ি, বলি: কী রে, মা কোথায়? তোর বুঝি মা নেই,
বাপন?
তুমি পাশ থেকে বলো: বিস্কুট আমার ব্যাগে আছে, দেব ওকে?
আমি বলি: বিস্কুট, আপনার ব্যাগে? হঠাৎ?
তুমি একবার অন্যদিকে তাকাও, তারপর মুখ নিচু করে ব্যাগ খুলতে খুলতে
বলো:
বা রে, হঠাৎ কেন? ভাবলাম আপনার দরকার হয় যদি…
রাস্তার এদিক থেকে ওদিক থেকে ছুটে ছুটে চলে আসতে থাকে
কুকুরছানার আরো দু’তিনটে মা-মরা ভাইবোন
তুমি তার একজনের ঘাড়ে আলতো হাত ছুঁইয়ে বলো:
ইস্, কী নোংরা রে তুই! এক্ষুনি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে
চান করাতে ইচ্ছে করছে!—তারপরই আমার দিকে মুখ তুলে:
ছোটবেলায়, স্কুল থেকে ফেরার সময়
রাস্তা থেকে বেড়ালছানা, কুকুরছানা তুলে আনতাম…
আমি বলি: আর আপনার মা কিছু বলতেন না? রাগ করতেন না?
—করতোই তো। খুবই করতো। কিন্তু
আমি শুনতাম না, আমি জেদ করতাম।
আমি শুনতাম না, আমি জেদ করতাম…
আমি শুনতাম না, আমি জেদ করতাম…
মনে মনে বলি: জিদ্দি। জিদ্দি মেয়ে।
মুখে বলি: কোন দিকে যাবেন?
তোমার পায়ের কাছে হুটোপুটি করে আর একরত্তি ল্যাজ নেড়ে নেড়ে
গোল হয়ে বিস্কুট খায় কুকুরছানারা
আমি, সারাদিন কাজের পর তোমার কপালে এসে পড়া
ক্লান্ত চুলের গুচ্ছ মনে মনে সরিয়ে দিই,
মনে মনে, একবার, রাস্তার মধ্যেই
তোমার চোখের পাতা ছুঁই ঠোঁট দিয়ে—
আর, শেষে, মনে মনেই
দুহাতে তোমার মাথা বুকে আঁকড়ে নিয়ে
বলি: কী রে, মা কোথায়? তোরও বুঝি মা নেই রে, উঁ?
কে জন্মায়, হে বৈশাখ
রৌদ্রদিন তোমার গান বৃষ্টিদিন
অন্ধকার বনের পথ শাল পিয়াল
শালপিয়াল ধূলিধূসর ফুলগুলি
দলবেঁধে ইস্কুলের রিহার্সাল
কোথায় আজ দিন কাটে?—ভোরবেলায় মায়ের চোখ
চোখের জল—
ছোটবেলার স্কুলপোশাক, নদীর ধার, বেলতলা
শ্যামসবুজ মফস্বল।
ও রাঙা পথ, ও ভাঙা পথ দেশছাড়া
মনে রাখিস, তোরা এসব মনে রাখিস
পথে এখন নতুন বিষ। ছোট্টো থেকে বড় হওয়ার
নতুন বিষ, পুরোনো বিষ। মনে রাখিস
কেউ কি বিষ ধুইয়ে দেয়, রৌদ্রদিন?
বৃষ্টিদিন মুছিয়ে দেয়?—একটি লোক
ঘুরে বেড়ায়, মিলিয়ে যাওয়া এক বালক
এই পথেই ঘুরে বেড়ায়, ধরে বাতাস
হাওয়া মুঠোয় সে উড়ে যায়
সে উড়ে যায়:
পচাপুকুর, কলোনিমাঠ, রেললাইন,
খুনখারাপ মফস্বল—
ঘরে ঘরে ছেঁড়া চটির টিউশনি
শ্যামলীদের মাধবীদের গান শেখা
লণ্ঠন আর মোমবাতির রাত জাগা
খোকনস্যার, স্বপনস্যার, স্বপ্নদি—
সবার গায়ে ছড়িয়ে দেয় নিজের গান—
সেই গানের রঙ লাগায়
গরীব সব বাপমায়ের চোখের জল
রৌদ্র পায়, বৃষ্টি পায়…
রৌদ্র নিয়ে বৃষ্টি নিয়ে, প্রতি বছর
সবার চোখ আড়াল দিয়ে, প্রতি বছর
কে জন্মায়, হে বৈশাখ,
কে জন্মায়?
র্যাগিং
মারহাব্বা কাটা ঘা-য় শোভানাল্লা ছিটে ছিটে নুন
না বললেই মার খাবে, হাঁ বললেও দাঁড়াতে দেব না
জানো না, মানুষ মাত্রে পারঙ্গম লঘুগুরু কণা
একত্র মিশিয়ে ফেলে অনুতাপ করে রুনুঝুন।
মারহাব্বা কাটা ঘা-য় শোভানাল্লা নুন ছিটে ছিটে
পথেই গুরুত্বপূর্ণ পান্থশালা। এইখানে খেলা ও বিশ্রাম
ভাগ ভাগ করা আছে। পিতা, মাতা, নাম, ছদ্মনাম
সব লিখিয়ে ঢুকতে হয়…পেটে খেতে হলে কিন্তু পিঠে
সইয়েও নিতে হয় দু ঘা দশ ঘা, যে যতটা পারো…
ওই তো গরম বাল্ব, মুখ লাগাও, ওঠো তো ডার্লিং, ওঠো…ওঠ্।
দেখি তোরটা কত বড়, খোল্ বলছি, খুলে ফ্যাল… হ্যাঁ, এইবার ছোট
কম্পাউন্ডে ছুটে আয়…এক পাক কম্পাউন্ড, দুই পাক কম্পাউন্ড, তিন পাক,
চার
পাক, আরো
আরো বড়, আরো বড়…চারিদিকে কম্পাউন্ড…পালাবে কি? বেরোবার পথ
নেই
কারো…
ঠোঁটে ফোস্কা, গালে কাটা, খোলা প্যান্ট ন্যাংটোপুটো…
গঁদ, শ্যাম্পু, কালি কিংবা চুন
যে যা বলছে গিলে ফেলছে… কোন ইয়ার? কোন ইয়ার?
শহরে নতুন, হো হো হোস্টেলে নতুন…
মারহাব্বা কাটা ঘা-য় শোভানাল্লা ছিটে ছিটে নুন…
হাঁস
তুমি জানতে না বুঝি, আসলে স্নিগ্ধতা হলো একটি বর্ষাকাল?
কেউ বলেনি তোমাকে, সে এমনই এক বর্ষাকাল
যে নিজের ইচ্ছেমতো, সারা বছর, ভেসে বেড়াতে পারে, ভেসে বেড়
আকাশে
আজ এখানে বৃষ্টি হলো খানিক, তো কাল ওখানে বাদলা
সেই সঙ্গে থেকে থেকেই ঝোড়ো হাওয়া আর ঘূর্ণিবাতাস তো আছেই
আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, যেই বৃষ্টি শুরু হলো অমনি
বাচ্চারা সব হাত ছাড়িয়ে ছুট লাগালো মাঠে ঘাটে, আর মাটির দেয়াল
ও টিউকলের সামনে দাঁড়িয়ে, গাঁয়ের বউরা, খাল থেকে বিল থেকে
তাদের হাঁসগুলোকে ডাকতে লাগলো: চই-চই, চই-চই,
চই-চই…আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী আগের বাংলায়,
তোমার এক বাল্যসখী, তোমাকে চই-চই বলে ডাকতো আর
ক্ষ্যাপাতো, তোমার মনে পড়ছে কি?
আজ, এই জন্মে, তুমি শীতের দেশের হাঁস, কোন সরোবর থেকে
কোথায় কোন সরোবরে সাঁতার কাটতে যাও—সমুদ্রের পর সমুদ্র
পেরিয়ে, উড়ে চলো কত দূর দূর সব দেশে…
কিন্তু, এবার, এই জন্মেও,
একজন, তোমাকে তোমার সেই একশ বছর আগেকার
ডাক নাম ধরে ডাকছে, একেবারে নিঃশব্দে ডাকছে! চই-চই,
চই-চই, চই-চই,—আর তুমি বোধহয় কিচ্ছু, কিচ্ছুই
শুনতে পাচ্ছো না, তাই না?
মৃত্যুটি রচনা করি
মৃত্যুটি রচনা করি সহস্ৰ পিছল জাতিধারা
চোখ বুজে রচনা করি ধরা বাঁধা আট-দশ পয়ারে—
জানি গব্য ঘৃত আছে, শুক পক্ষী বসে আছে তারে
হাঁড়িতে আছেন যখ, খালি চোখে সহস্রটি তারা
দেখার সুযোগও আছে, খুলে দেওয়া আছে গৃহদ্বার
প্রবেশ তোমার পক্ষে সম্ভব কি অসম্ভব—তাও
বলে দেওয়া আছে বইতে—যদি সেই বই খুঁজতে চাও
চলো নাক বরাবর, দুই ধারে এসপার ওসপার
দুই ভাই রেডি আছে, মতির ভিতরে মতিভ্রম
বসে আছে চুপটি করে, তুমি যদি না দেখাও ত্রুটি
বড় অসন্তুষ্ট হবে, আর যদি একটু বেশ-কম
পায় তো দেখাবে মজা, ঘষে দেবে পশ্চাতে বিছুটি।
তুমি গড়িমসি লোক, তুমি কাছখোলা তীরন্দাজ
ঘাবড়িও না তাতে, আমি আছি। দ্যাখো, বসে বসে আজ
মৃত্যুটি রচনা করি, সহস্ৰ পিছল জাতিধারা
হাত ফসকে চলে যায়, দিন পার হয়ে চলে দিন
এই পারে রাত্রি থাকে, ঘুরে ঘুরে হাওয়া বয় ক্ষীণ,
সারাদিন যারা ব্যর্থ, গালাগাল সারাদিন যারা
খেতেই অভ্যস্ত থাকে, তারাই তো গাছ হয়ে দাঁড়ায়
এখানে, দোলায় মাথা, নিরিবিলি ডোবায় চোখের
জলে সব অহংকার, দুর্দশায় সেসব লোকের
বাঁকা গৃহকর্ম চলে, অপটু ও হাতের পাতায়
তারাই তো রোগা-পাতলা বউটির হাতখানি চায়
রাত্রে শুয়ে—ঝাপট খায় পরিবর্তে—অতরাত্রে ফের
মেনিমুখো কোনো কেউ পায়ে ধরে সাধনাও করে
রুক্ষ রাগী যে-বউটি ৭ বছর ১০ বছর আগে
একটি শ্যামলী মেয়ে মাত্র ছিল, প্রেমিক পরাগে
রেণু দিত মনে মনে, সেও শেষে কুটো আঁকড়ে ধরে
ফুলে ফুলে কাঁদে, ওই ওরা কবে মধুতে মধুতে
ঘুরে ঘুরে রাত্রি ভোর দিয়েছে কান্নাটি—কবে ওরা
গন্ধচোর, গন্ধচোর গান বলে এক পাগলঝোরা
পেয়েছে সহসা—আর সাহসও করেছে জল ছুঁতে—
সেই হিসাবের কড়ি, দল বেঁধে ঘরের মেঝেতে
চলাফেরা করে রাত্রে, খুঁড়ে খুঁড়ে তোলে তিক্ত মাটি,
ফের গর্তে চলে যায়, —ভুলে তবু আসল কথাটি
গৃহস্থকে জানায় না। পতি পত্নী ঘুমে ডুবে যেতে
জাগরণ বাইরে আসে—উঠোনে দাঁড়ায় জাগরণ
তার নামে নিন্দা হোক, তার নামে স্তবগান হোক
বনানী গর্জন করে হাওয়া লেগে—পাতাদের চোখ
সবদিক লক্ষ করে, কে ঢুকছে কে বেরোচ্ছে কখন
এই বনে, লক্ষ করে, জাগরণ ঘুম থেকে উঠে
কী বা করছে অতরাত্রে—পাতারা পিছনে যায় ছুটে…
বলো বলো মধুরাত্রি, কী ঝরনায় হাত মুখ ধুয়ে
বাড়িতে ফিরেছে লোক, চোখে ঘোর, ও যুবা বয়স।
দোলা লাগে, জানো আজো অন্ধকারে মায়াপরবশ
দোলাটি নিজের নাম বলে দেয়…নামখানি ভুঁয়ে
গড়াগড়ি যায় বলে মনস্তাপ করি না যুবক
ভবতরঙ্গের মধ্যে কত কী দেখার বস্তু জল
ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়—হাতমুখ ধোয়ার সফল
অভিব্যক্তিটুকু শুধু ধরে রাখি যত যাই হোক
অনিন্দিত গ্রুপ ফটোখানি থাকবে বাড়িতে টাঙানো—
কাঁধেও গামছাটি থাকবে, হাতে গাড়ু—‘জানো তুমি জানো’,
ব’লে কত ঊরু চাপড়ে ছেলেকে বোঝাবো: বংশ এই!
এখন অবস্থা পড়তি, যথাআজ্ঞা হাতে ছন্দ নেই—
কিংবা যথাইচ্ছা আছে তথা ছন্দ লুকোছাপা চাল
ফুটে চাল ভাজা হবে, লম্ফঝম্ফ দেখাও গো ছাওয়াল
তাই তো দিবস রাত্রি পরিশ্রম করি, যাতে আসে,
হাতে আসে যথাকালে উজ্জয়িনী, সোনা রুপো থালা
তোমাদের হাত হতে পুনায় যুঁইপুষ্প মালা
পাই আমি আচম্বিতে…নিজ নিজ কুসুম প্রকাশে
ওরা দেখি ব্যস্ত হয়, আমি কোনো আপত্তি করি না—
জানাজানি হয় যদি—কথা সব তুলে দিই মেঘে,
যে-মেঘে একভাগ আলো, একভাগ অন্ধকার লেগে
চাঁদ ঠিকরে চলে আসে, প্রয়োজনে আমি চন্দ্র বিনা
রজনী বহন করে নিয়ে চলি নদীর ওধারে…
যারা দ্যাখে, তারা দ্যাখে, দেখে হয় বিমুগ্ধ তখন—
আনন্দও করে কত…তাই ব’লে নিজেদের ঘাড়ে
সমস্যাটি ফেলবে না, ঘুরে বসে পাবলিকের মন
অন্য কাজে মন দেবে। ও আমার সাধু পরিশ্রম
খেলাটি খতম হয়নি, তাও দ্যাখো, পয়সা তো হজম!
তবু আমি বলব না আমার মৃত্যুর ইচ্ছে কী কী!
বোকা এক তীরন্দাজ, এক মহত্তম চাঁদমারী
লক্ষ্য করে হাত পাকায়—তাকে নিয়ে চালের ব্যাপারী
উৎসাহ দেখায়: ‘তুমি অত বাধা মধ্যে নিয়ে ঠিকই
মেরেছো আন্দাজমতো…’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে ধরণী উপর
কত বুঝমান ব্যক্তি হম্বিতম্বি ঘোরে আর ফেরে
পাপ করতে থমকায় না, তুড়ি বাজায়, প্রাতঃকৃত্য সেরে
ছড়িটি ঘোরাতে যায় যথাপূর্ব আপন দপ্তর…
তারা যা বলবেন তার দাম হবে, তোমার কথাকে
প্রথমে নেবে না কেউ, পরে ছুটে মাটি থেকে তুলে
কাড়াকাড়ি করে নিয়ে মুখে হাতে চুলে কর্ণমূলে
ছোঁয়াবে কী যত্ন করে। কিন্তু তুমি এই চক্রে পাকে
মজে থাকবে কত দিন? নিজ রাস্তা খুঁজে নেবে ঠিকই।
তোমার মৃত্যুর ইচ্ছে বলে দাও বলে দাও কী কী…
সংসারে অশান্তি আর যথারীতি দপ্তরে তাড়না—
ভাত ফেলে উঠে যাই, মৃত্যু ফেলে উঠে আসি আমি
আমাদের ঘরে পরে কড়া ক্রান্তি এত বেশি দামী
মধ্যবিত্ত অন্ধকার, কেন তুমি সমস্ত পারো না
যা অন্যেরা পেরে থাকে? খেয়ে পরে সামান্য বাঁচার
উপায় কত রকম? মাথা ঠুকে মরো যদি পা-য়
নিবন্ত ছাইয়ের থেকে একদিন অদ্ভুত উপায়
গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াবে উঠে—নিয়ে আসবে তোমাকে খাঁচার
বাইরে, বাহিরদেশে, মূর্তি ধরে ধ্বনি থেকে ধ্বনি
পায়ে পায়ে ছুটে যাবে বায়ু ভ’রে, তুমিও তখনি
ওরই মধ্যে নাচবে গাইবে, সুর লাগাবে, চিরস্ফূর্তিখানি
কোনো অংশে কম হবে না, তোমার পিছনে বাঁধা ঘানি
আছে কি না আছে কিছু খেয়াল থাকবে না—শোনো, শোনো
এসবই গোপন কথা—তুমি অন্যে বোলো না কখনো
বাগানে ঘুমিয়ে থাকলে তবু কানে ঢেলে দেওয়া রীতি।
যে ঢালে সরল কথা, হোরেসিও, বিষ হয়ে নামে
মগজ ঘুলিয়ে তুলে ঝোঁকে ওঠা বমি কেনা-দামে
বেচে দেবে তৃতীয়কে, চতুর্থকে—মুখে কিন্তু প্রীতি
রক্ষা করবে আজীবন—এই রীতি সমাজবিদ্যার
অন্তর্গত, বুঝতে হবে, টবে টবে তা নইলে বাগান
ফুটবে না, কখন যে অন্ধকারে কাণ্ড আর জ্ঞান
কে কোথায় পড়ে যাবে, তুমি কিছু থই পাবে না তার।
এরই নাম ভেঙে পড়া, এরই নাম মাধবী বিতানে
একবার ধাক্কা খেয়ে পুনরায় আরেক বিহ্বল
গাছে পিঠ রেখে বসা কিছুক্ষণ—অতর্কিতে ফল
কোলের উপরে পড়লে, সঙ্গে করে তাকে যথাস্থানে
পৌঁছে দিয়ে আসা ভালো, ভক্তি ভ’রে গ্রহণ করাও
খুব একটা খারাপ নয়, সুনির্মল, সুখলতা রাও
পড়ানো খারাপ নয় বড়দের সাহিত্যে না গিয়ে!
ছোটদেরই মতো তাকে আঙুলটি ধরে বৈকালিক
মাঠে নিয়ে যাওয়া ভালো, বোঝানোও ভালো চতুর্দিক।
মজা করাটাও ভালো ছোটখাটো কথায় রাগিয়ে।
এর বেশি হলে ঝুঁকি। বেশি হলে, বসন্ত পবন
উড়ে এসে তুলে নেবে, এক কথায় পাবে না নিস্তার
হাতড়ে হাতড়ে বহুকষ্টে তীরে উঠে, পার আছে গো, পার
আছে বলে গান গাইবে, বল্টু এঁটে শক্ত করবে মন।
তার চেয়ে, কী দরকার, ঘরে বসে লেখো তো মৃত্যুর
একটি রচনা, যার চতুর্দশ পদে পদে ভয়।
সহস্ৰ জাতির থেকে ফোঁটা ফোঁটা জাতি রক্ত হয়
সে রক্ত একটিই পাত্রে ধরো তুমি, ঠেলে দাও দূর
দূর ভবিষ্যৎ কালে—যতদূর স্রোতশক্তি চলে—
নিকটে তাকিয়ে দ্যাখো, মৃত্যুর তারিখ ভাসছে জলে…
ঠেলে দাও ঠেলে দাও পাত্রটিকে…ভবিষ্যৎগামী জল…ওপারে বাচ্চারা
তীরে এসে দাঁড়িয়েছে… এই পারে হিংস্র জাতিধারা…
ঋণ
অলীক, তোমার স্বপ্ন থেকে শান্ত হাতের
একটি দুটি রৌদ্রেপোড়া
সাহস
আমায় ঋণ দিয়ে যাও, দোলের দিনে
আবীর খেলতে ঋণ দিয়ে যাও অলীক তোমার
সকল তামস কলুষ হরণ
গানের অমন ঝর্নাতলায় হাসতে পারি খেলতে পারি
এমন একটি দিন দিয়ে যাও যখন তোমার সোনার বরণ
গ্রীষ্ম লেগে কাতর তখন হাতের কাছে হাতপাখা নাও, রৌদ্রেপোড়া
হাতপাখা নাও, তাকিয়ে দেখি হাতপাখাটি, তাকিয়ে দেখি
কোলের উপর গ্রীষ্ম লুটাও বর্ষা লুটাও
অলীক তোমার স্বপ্ন থেকে আর একটিবার
শান্ত হাতে আদর করার একটি দুটি
ছল খুঁজে দাও রৌদ্রেপোড়া…
এসেছি, কুসুম
ফের সেই ঘুমন্ত পাখির
ডানা থেকে ঘুম
সরিয়ে দেবার প্রয়োজনে
এসেছি, কুসুম।
আজ মৃত্যু যেখানেই থাক
গাছে গাছে তার
রাঙাপাখি বসিয়ে দিয়েছি
ডাক পাঠাবার।
খোলা সব মাঠেও রেখেছি
এক রৌদ্ররেখা
যার আজ আসার কথা আছে
সে আসুক একা
একা সে থাকবে না, মাঠে মাঠে
তার জন্য পাতা আছে নানাবিধ মন
তার মধ্যে কাকা তুলে নেবে সে বুঝুক, ও কুসুম
আমরা ঘুমোই ততক্ষণ।
দোল: শান্তিনিকেতন
১
বকুল শাখা পারুল শাখা
তাকাও কেন আমার দিকে?
মিথ্যে জীবন কাটলো আমার
ছাই লিখে আর ভস্ম লিখে—
কী ক’রে আজ আবীর দেবো
তোমাদের ওই বান্ধবীকে!
২
শান্ত ব’লে জানতে আমায়?
কলঙ্কহীন, শুদ্ধ ব’লে?
কিন্তু আমি নরক থেকে
সাঁতরে এলাম
তখন আমার শরীর থেকে
গরম কাদা গড়িয়ে পড়ছে
রক্ত-কাদা
হঠাৎ তোমায় দেখতে পেলাম
বালিকাদের গানের দলে
সত্যি কিছু লুকোচ্ছি না।
প্রাচীন তপোবনের ধারে
তোমার বাড়ি
কখন যাবো?—ঘুম পাচ্ছে—
বলো কখন মুখ রাখবো
তোমার কোলে।
বারণ করবে?
গীতিসূর্য: প্রেমসংখ্যা
কী রাগ পছন্দ করো? এ-ঘৃণা প্রেমের জন্য গান
কী আনন্দে বেঁধে দেবে? আজ বুঝি কবির সম্মান
পূর্ণ করবে ষোলোকলা?—কী উপায়ে তোমার দু পায়ে
রুপোর মলের দিকে নিৰ্ণিমেষ চেয়ে সারা গায়ে
কাঁটা দেখা দেবে আজ! কী উপায়ে, কী উপায়ে আর
তোমার শ্রীনাম নিয়ে গীতিসূর্য হবে পালাকার।
হবে সে পেখমওয়ালা, আর হবে নয়নের মণি…
তুমি শিশুকাল থেকে যা চেয়েছো, পেয়েছো তখনি।
সে ব্যাটা কিছুই পায়নি, তাই সে তোমার জুতো মুখে নিয়ে উদয়াস্ত ছোটে
এবং অপরদিকে সুগন্ধী জীবনযাত্রা তোমার শরীর হয়ে ওঠে
সুঠাম আলস্য ভেঙে তুমি বলো: এই দিচ্ছি তুড়ি—
যাও বারান্দায় গিয়ে দ্যাখো গে বাগানে সব কুঁড়ি
আমার তুড়ির শব্দে ফুটে উঠবে—আরে! উঠলো তাই!
বলিহারি যাই ওগো, দেখে আমি বলিহারি যাই
যদিও নিশ্চিত জানি, দু’চার কলি ছন্দগান নিয়ে
তোমার কী প্রয়োজন!—এ শুধু ভোজের শেষে দুটো মিঠে পান—
মুখে দাও, খচমচাও, তারপর থুক করে ফ্যালো পিক
বেচারি কোকিল ভাবে, কুড়ায়ে পেয়েছি বটে পরশমানিক
তোমার ফুলের জাতি সংখ্যাহীন, তোমার পাখির
সংখ্যা চিরঅগণন, আর আমি তোমার আঁখির
পাতা খুঁজে খুঁজে মরি ধুলোয় ধুলোয়, ধুলো চাটি—
ধুলো ও কাগজ নিয়ে বলি: ‘মাটি লেখা, লেখা মাটি।’
তোমার ভালোবাসার সংখ্যাগুলি ধরা-ছাড়া তিন চার পাঁচ ছয় সহস্ৰ অযুত
বহুমূল্য সে-বিষয়ে কী সুর লাগেতে পারি অনভিজ্ঞ আমি গেঁয়ো ভূত?
ঋষি ও রাঙা মেঘ
মেঘের দিকে তাকাও। তার রঙ
সবুজ ভাবো বুঝি?
কখনো নয়। যুদ্ধ—আমরণ
যুদ্ধখেলা খুঁজি।
জলের দিকে তাকাও। তার স্রোত
কোথায় দিলো ঢেউ?
যেখান থেকে ফিরে আসার পথ
খুঁজে পায়নি কেউ।
মাঠের দিকে তাকাও। তার ঘাস
ঘুমিয়ে আছে ভোরে।
ভোর না, জবাকুসুমসঙ্কাশ
রমণী—রাঙা মেঘের গায়ে ওঠে…
উড়ছে তার বসনও, মুনিবর
দেখা মাত্র স্খলিত হও তুমি—
যত্ন ক’রে তোমার বীজ নিয়ে
সগৌরবে পোড়ায় মরুভূমি…
ভোজসভা
আগে বাঢ়ো, নিধিরাম, সুধাকান্ত জীবনী পশ্চাতে
পড়ে থাক, নিধিরাম, একদিন গোপন নৈশভোজে
আলাপটি হল, আজ, দেখা হলে এড়িয়ে চলে যে?
ব্যাপার বুঝি না কিছু, সুধাযুক্ত জীবনী পাহাড়
তুলেছে পিছনে, তুমি আনমনে জিতেন্দ্রিয় ছাতা
খুলেছ মাথায় আর সামনে তো লড়াই শেষ
দুপাশে দুজন মৃত ষাঁড়!
অথচ তোমার জন্য এইবার অন্য এক নাচ
ব্যবস্থা করেছিলাম, নিধিরাম, বুঝে দ্যাখো, তোমার কী মাথা!
এমন জায়গায় আনলো, যে দিকেই যাবে শুধু ধুতি ঝোলা,
শাড়ি ঝোলা, দড়ি ঝোলা গাছ…
বাতাসেও অতিশয় গতিশীল ফাঁস ছুটে খাড়া দেহ
জ্যান্ত দেহ খোঁজে—
কাটিয়ে কাটিয়ে চলো, এই আমাদের জায়গা—
মনে নেই, মনে নেই? আলাপ তো নরমাংসভোজে!
তেজ
তিনবার মরি যদি দুইবার জলে আর একবার
আগুনে স্বয়ং মৃত্যু হই
হই, যদি একবার তাকে পাই বুকে তবে ওই বক্ষে
ঢুকে গিয়ে আজীবন দুগ্ধ হয়ে থাকি
দুগ্ধ দিয়ে মারো, শুভ্র, বক্ষ চেপে মারো, তোর
মাথা মুখে চুলে ব্ৰহ্মতেজ মাখামাখি
জাতিস্মর
কাঠের বাড়িটি, তার গেট থেকে পাথুরে জমির
রাস্তা শুরু হয়ে গেল ঘুম থেকে উঠে ভোরবেলা
টবে সার সার গাছ, লম্বা চিমনির মুখ থেকে
ধোঁয়া উঠে যায় সাদা এত সকালেই, আর হাওয়া
দুলিয়ে দিয়েছে যেই খাদের দুপাশে ঝোপঝাড়
কে যেন দাঁড়াল এসে ঘুমচোখে রেলিঙের ধারে
আমি কি ও বাড়িতেই কোনোদিন হ্যাভারস্যাক কাঁধে
গেটের সামনে গিয়ে বারান্দায় যে দাঁড়িয়েছিল
তার দিকে হাত নেড়ে বলেছিলাম কিছু? আজ তার
শাড়ি কি গাউন ঠিক মনে নেই, শুধু ঝাঁক ঝাঁক
ফুলের উপর দিয়ে বাগানে অঝোরধারা হাওয়া
শার্টের কলার ওড়ে, চুল এসে কপালে ঝাঁপায়
অথচ কালিয়াদহে আমি আছি সুবর্ণ কর্কট
খলমণ্ডলের ন্যায় সারাদেহ, হস্তী ধরে খাই
দাড়ার সাঁড়াশি দিয়ে। সেইমতো একটি হাতিকে
একদিন ধরেছি যেই তার সঙ্গিনীটি ছুটে এসে
কাতর প্রার্থনা করে, ছেড়ে দিই, তখনই হাতিটি
পিঠের উপরে উঠে ভেঙ্গে ফেলে আমাকে মড়মড়…
মড়মড়? প্রায় ওইরকম শব্দ বাদাম ভাঙ্গবার
আরো আস্তে, সম্ভবত যন্ত্রণাবিহীন; দুজনেই
চুপ করে বসে আছে বেঞ্চিটায়; কথা নেই; আমি
বেঞ্চির হাতলে ছোট গর্তটায় রোজকার মতো
লুকিয়ে রয়েছি ছারপোকা: বসে চুপচাপ শুনি
গভীর নিঃশ্বাস কারো, কারো শাড়ির খশখশ…
পালকে রোদের ঝাপটা, আমরা দুজনে ঘুরে ঘুরে
সারাদিন মেঘ আর বিদ্যুতের পাশ দিয়ে উড়তাম
নীচে বালুচর, নদী; হঠাৎ একদিন হাওয়া কেটে
কী যেন শনশন করে ছুটে গেল, চেয়ে দেখি পাশে
আমার পুরুষ নেই; ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ তলায়
নেমে যাচ্ছে নেমে যাচ্ছে, আছড়ে পড়ল বালুতটে
আমারই পুরুষ সারারাত ধরে বাড়িয়ে ফেরেনি
আমি জেগে বসে থাকি, মাঝে মাঝে কুপি উসকে দিই
বড়টা ঘুমিয়ে কাদা, কোলেরটা বুঝি স্বপ্ন দেখে
কেঁদে উঠল…ভোরবেলা কারখানার অন্যান্য সকলে
চাদর ঢাকা শরীর নামাল ঝোপড়ার দরজাতে
ওরা জানে, এই দৃশ্যে আমি আছড়ে পড়েছি মাটিতে
আর আমি যে দৃশ্যে ঐ মাটি ধরে উঠে দাঁড়িয়েছি
গাছের সারির ফাঁকে, মাথায় ঘাসের টোকা নিয়ে
সে দৃশ্যে আকাশপথে উড়ে আসছে দু’দুটো বিমান
সেতুটা ওদের লক্ষ্য; সঙ্গে সঙ্গে বুলেটে, ঘৃণায়
ওদের নামিয়ে আনি, তারপর গোল হয়ে সব
কফিতে, চুমুক দিই এই ছোট ভিয়েৎনামী গাঁয়ে
ফারের পোশাক ফুঁড়ে ঢুকে আসে বরফের কুচি
ছ মাস দীর্ঘ রাত্রি শুরু হয়ে গেছে কদিন আগে
আমরা কজন মাত্র বসে আছি ইগলুর ভেতর
নিঃশ্বাস জমে যাচ্ছে, সঙ্গী শুধু কয়েকটি কুকুর
কিছু বই, রেকর্ডে পাখির ডাক, আর এই সিগার
আমাদের যেতে হবে বরফে বরফে স্লেজ টেনে
কে শুয়ে রয়েছে ওটা? আমি তো? শিয়রে অবনতা
কে মহিলা অশ্রু মুছে নেন? হাত আমারই কপালে!
একটি যুবক পাশে; আর উনি? বৈদ্য সম্ভবত।
একটি মেয়েও, তার মুখ যেন সন্তানের মতো—
কিন্তু এরা কে আমার? কী একটা ঘোরের ভেতর
সব কিছু নিভে আসছে, কিন্তু ওরা? মনে আসছে না
গ্রামের কিনার ঘিরে ঘুমিয়ে রয়েছে ঐ সাঁকো
রোজ ভোরবেলা তুমি তার উপর দিয়ে নেমে যাও
ওপারে, মাথায় কলসী, আমি খোড়ো ঘর থেকে রোজ
ঘুমভাঙা চোখে দেখি; আর দূরে, মাঠের ওপাশে
প্রবল ধুলোর ঝড় তুলে যায় সুলতানের ফৌজ
কোথাও হা রে রে শব্দ, বর্গীএলো, আমি রাত্রে শুনি
গ্রামের পুরোনো চার্চ, সামনে দিকে খানিকটা বাগান
দিনে পশুপাখি থাকে, দু-একজন ভবঘুরে লোক
রাত্রি হলে দস্যুরাও নগররক্ষীর তাড়া খেয়ে
প্রাণভয়ে পালিয়ে আসে; থাকতে দিই; পরে ভোর হলে
কেউ এটা ভেঙ্গে ফেলে, কেউ ওটা নিয়ে চলে যায়
বাগানে প্রত্যেক দিন খুঁড়ে রাখি একটা কবর
হাওয়ায় ডিঙ্গির মুখ ঘুরে গেছে, আবছা তীরভূমি
ঝাপসা হয়ে গেছে আরো, দূরে দূরে প্রবালের চর,
হঠাৎ প্রবল ঢেউ উল্টে দিল পলকা ডিঙ্গিটাকে
একটা মাথা ভেসে ওঠে, ডুবে যায়, ওটা কি আমার?
দুহাতে সরাচ্ছি জল, ঝাপসা চোখে নিজের কুটির
ভেসে উঠছে পাতা ছাওয়া, আগুন আর গরম বিছানা…
আমরা কজন মিলে কলকাতা থেকে বসিরহাটে
গিয়েছি বেড়াতে, গিয়ে সামনের বাসার ছেলেটিকে
দেখলাম সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে, আর আজ
সে আমার ঘরের মানুষটি, তবু এখনো তেমনই
রয়ে গেছে; রোজ স্নান করে আমি নবীনা গৃহিণী
তরুণ স্বামীর জন্য পূজা নিয়ে যাই ঐ মঠে
কিন্তু যদি শূন্যের প্রবল মুখ ফেটে যায়? যদি
গরম ধুলোর ঝাপটা হু হু করে তুলে নেয় দেহ?
আকাশের মধ্যে দিয়ে উড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়?
তাই গেছে। কবে ঠিক মনে নেই, উঠে যেতে যেতে
তারপর একসময় সারাদেহ আগুনপাথর
খাঁ খাঁ শূন্য ভেদ করে তীব্র বেগে ছিটকে পড়েছি
জলের উপরে, এক মহাগিরিকন্দরের মুখে
জলে পড়ে নিভে গেছি। বিরাট এই গুহার ভেতর
সারাদিন ঢুকে যাচ্ছে জলস্রোত, দেহের উপরে
ধাক্কা দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, আমার তো সারাদিন ধরে
নিশ্চল আটকে থাকা; ভরে গেছে পিছল শ্যাওলায়
আমার খানিকটা অংশ, খুব ছোট জাতের উদ্ভিদ
ধীরে ধীরে বেড়ে গিয়ে তার থেকে নামছে জমিতেও
অথচ জলের মধ্যে ভেসে ভেসে চলেছি আবার
শরীর ভীষণ ক্ষুদ্র, পাখনা দিয়ে স্রোত কেটে কেটে
চলেছি, নিঃশ্বাস নিচ্ছি জলের উপরে উঠে এসে,
ফের একটু ডুবে গিয়ে ছোট ছোট শ্যাওলার গাদায়
ঢুকে যাচ্ছি, চারিদিকে আর কোনো কিছু ছিল কিনা
মনে নেই, শুধু মনে পড়ছে ঢেউ আর শ্যাওলাদের
ধীরে ধীরে একদিন জল থেকে সারা শরীর তুলে
ডাঙ্গায় উঠলাম এসে; পিছনে তাকিয়ে দেখলাম
মোটা ল্যাজ মিশে গেছে জলে আর সামনের পা দুটো
খুব ছোট, পিছনের পায়েরা আমাকে ধরে আছে
বিরাট উঁচু শরীর, থ্যাবড়া মাথা, দেহ ঘষে ঘষে
এগিয়ে চললাম ঐ উঁচু উঁচু গাছগুলোর দিকে
হঠাৎ একদিন দেখি পিঠে আটকে গেছে দুটো ডানা
মাটি থেকে ক্রমশই আমি উঠে চলেছি উঁচুতে
দেহ আর অত বড় নয়, শুধু মুখ সামনের দিকে
সরু হয়ে শক্ত ও ধারালো হয়ে গেছে দুটো পায়
লম্বা নখ, খিদে পেয়ে গেছে খুব, ঐ উঁচু থেকে
মাটি লক্ষ করে আমি নেমে আসছি ছোঁ মারব বলে
বিরাট গুহার মধ্যে এবড়োখেবড়ো জমির উপরে
অতিকায় দু বাহুতে আমার লোমশ রমণীকে
জড়িয়ে নিয়েছি আর সেও তার প্রবল দুখানি
পা দিয়ে পেঁচিয়ে আছে আমার পা, তার মুখে লালা,
তার দেহে পশুগন্ধ, গলায় অস্পষ্ট গরগর
বাইরে প্রবল ঝড়, ডাল ভেঙ্গে পড়ল গুহামুখে
হাওয়া আসছে; তখনো শরীর থেকে ওঠেনি শরীর
হঠাৎ ওর তীক্ষ্ণ দাঁত আমার বাহুতে বসে যায়
খানিকটা মাংস ছিঁড়ে চিবুতে আরম্ভ করে, আর
চিৎকার করে আমিও ছিঁড়ে নিই কাঁধের কিছুটা
গরম টাটকা মাংস, নরম ও নোনা, রক্ত মাখা,
খিদে পেয়ে গেছে খুব আমাদের, অসম্ভব খিদে
আমি ওকে তাড়া করি, প্রাণ ভয়ে বাইরে পালায়
পিছনে পিছনে আমি, ওর কালো বিরাট শরীর
গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে এই দেখা যায়, এই নেই,
অবশেষে একটা গাছ প্রাণপণে ঘুরতেই দেখি
কাঠের বাড়িটি, তার গেট থেকে পাথুরে জমির
রাস্তা শুরু হয়ে গেছে ঘুম থেকে উঠে ভোরবেলা
টবে সার সার গাছ, লম্বা চিমনির মুখ থেকে
ধোঁয়া উঠে যায় সাদা এত সকালেই, আর হাওয়া
দুলিয়ে দিয়েছে যেই খাদের দুধারে ঝোপঝাড়
কে যেন দাঁড়াল এসে ঘুমচোখে রেলিঙের ধারে
আমিই তো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি হ্যাভারস্যাক কাঁধে?
কী বলছি মনে নেই, কেবল অঝোরধারে হাওয়া
ও আকাশপার
যা কিছু মৃত্যুর নীচে যা কিছু অগ্নির
নীচে ডুবে যায় তারা ফিরে ফিরে আসে
জলভাবে, বায়ুভাবে, ঘাস থেকে ঘাসে
ফেলে দেয় লঘু পাখা—ভারী পাখাটির
বড় কষ্ট, বলে ওরা, ছোট কষ্ট বলে
লেখায় রেখায় আঁকা ও আকাশপার
তুমি জানো অস্তসূর্য যে ফেলুক জলে
আমি তা ভাসিয়ে নিই এপার ওপার…
আকাশতীরের বন্ধু
মুকুল যখন ভাসে তখন
হাতের পাতায়
দু একটি জলবিন্দু এসে
মার্জনা চায়
দুএকটি জলবিন্দু তখন
চোখের আলোয়
দুর্বল সেই দীপকে বলে!
‘আমায় জ্বালো!’
জ্বালতে গিয়ে দীপ নিজেকেই
জ্বালায় পোড়ায়
পুড়তে পুড়তে আকাশতীরের
বন্ধুকে পায়
বন্ধু তাকে ঝড়বাদলে
আগলে রাখে
কাছে পেয়েও বন্ধুকে সে
স্বপনে ডাকে
স্বপ্নটিকে সত্যি করে—
মুকুল ভাসায়
বন্ধুটি তার চোখের পাতায়
হাতের পাতায়…
গুপ্তচর
পরো পরো গুঞ্জামালা
শিশুহাড় শোভা করো গলে
রাণীর সম্পত্তি সব
আমি গুপ্তচর তলে তলে
যতই হেনস্থা করো
তোর স্বার্থ আমিই বাঁচাই
মুখেই জগৎ মারি
আমি তোর শত্রুমুখে ছাই
তাই তাই তাই তাই
দোঁহে যাই সে মাতুলালয়
সেথা লাথি ঝাঁটা খেয়ে
তোতে ও আমাতে প্রেম হয়,
এ বড় আশ্চর্য কাণ্ড
হয় রোগ বড় চমৎকার
যাকে একবার ধরে
পিণ্ডি চটকে ছেড়ে দেয় তার
আমাকেও দিত, কিন্তু
বড় বেঁচে গেছি ভাগ্যজোরে
উদো বলে: বুদো কই?
পিণ্ডি বদলাব পরস্পরে
কাকপক্ষী টের পাও না
থাকো পক্ষী জলের ভিতরে
কোত্থেকে তৃতীয় হাত
সকলের পিণ্ড গ্রাস করে।
ঢেউ গুচ্ছ
আমাদের নীল মৃত্যুকাল
আমাদের সাদা সন্তরণ
আমাদের ঢেউগুচ্ছ
আমাদের এই নিচু জীবন
জলে ফেলে দেওয়া শান্ত ঢিল
ক্ষমাশীল ঢেউগুচ্ছ
গায়ে গায়ে ঘষা কালো জীবন
হাতে মুখে হাতে মেখে নেওয়া
ঈর্ষার কাঁচা রক্ত
আমাদের এই আলোজীবন
কারো কাছে কিছু নেবে না আর
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শান্তি
আমাদের এই ভাঙা জীবন
পড়োশীর ঘর আলো করা
কচিকাঁচাদের দঙ্গল
আমাদের নীল মৃত্যুযান
আমাদের সাদা সন্তরণ
টেনে নেয় ঢেউগুচ্ছ
আমাদের এই চিরজীবন
মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনা
বন্ধুর মতো বন্ধু
যশোগীতি
একী ইচ্ছা ইচ্ছা করো ইচ্ছে ক’রে ইচ্ছামতী—
কবিযশঃপ্রার্থিজনে এ ভাই কেমন বেইজ্জতি।
এসেছিলাম রাত্রিযোগে, আমায় ঠুকরে খেল বনমোরগে
আমার জন্ম গেল কাব্যরোগে—তাই নিয়ে খুঁত ধরল যত
ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতী
হাড্ডিসার হল গাত্র, কিন্তু সুধাও পাচ্ছি পাত্র পাত্র
যার সেবায় কাটছে অহোরাত্র—অগ্রে সে কুলটা হলে
পশ্চাতে নিশ্চয় সতী
তবু চালাচ্ছি এই কামারশালা, আমি দিনে বোবা রাত্রে কালা
আসে আমার ভাগ্যে রোজ এক থালা অর্ধভুক্ত সরস্বতী
অন্নরক্ত সরস্বতী।
এক লাইন, দু লাইন
মৃত্যুবিষয়ক
অর্ধেক লিখেছ মৃত্যু। বাকি অর্ধ সেতুর ওপারে…
বজ্র
মাথার উপর বাজ ফেলেছে সোনার টাকা
কঠিন, বড় কঠিন, মাথা ঠাণ্ডা রাখা।
শ্রাবণ
ওই মেয়েটির কাছে
সন্ধ্যাতারা আছে।
অসম্মত
জানলে না গো অসম্মত, বাইরে বাইরে যেমনই হই
ভিতর থেকে আমিও ঠিক, তোমার মতো, তোমার মতো!
অভিশাপ
হে আমার দেশ, নদীমাতৃক
পাগলা কুকুরে ছিঁড়েখুঁড়ে তোকে শেষ করে দিক!
জীবিকা
ধরিত্রী, দিনের অংশ ভাগ করে দাও, দুটি খাই!
কবি
তোমার মাথায় পাড়ে সারাদিন কাগে-বগে ডিম
রাত্রে বশ হয় দানো, হাতে আনো জাদুর পিদ্দিম!
কুৎসা
এত গল্প তলে তলে আছে
তোমাদের, আমাদের কাছে?
বন্ধু
এক পা গেলে ফিসফাস হয়, তিন পা গেলে গল্প রটে
পাগলী, তোমার সঙ্গে এলাম এমন পথে!
কবি-২
জলের নীচে রেখে দিয়েছ পুরোনো সেই ব্রহ্মাস্ত্র
ছুঁলেই পুড়ে মরবে ওরা—তোমার কাছে যারা আসত!
মিলন
আগুন থেকে জানি এসব, বাতাস থেকে জানি
দুজন অসাবধানী আমরা, দুজন অসাবধানী!
নিষিদ্ধ পল্লী
আমার বাড়ির মেয়ে? আমাদেরই ঘরের উৎসব?
ফর্সা দুর্গা, কালো দুর্গা, মালতী, বকুল দুর্গা সব!
দিকভ্রম
চলে এ সমুদ্র দিকভ্রমণে ধাবিত অস্তাচল
ঢালু হয়ে নামে সুর্য রাঙা এ সমুদ্র দিগ্বিদিক
হারাল এক্ষুনি খুঁজে পেল হতজ্ঞান নিক্ষেপিত
শুণ্ড অক্লান্ত শুণ্ড নিক্ষেপে নিকটতম মেঘ
এই সে ফাটিয়ে ফেলল ওই সে জগতে মহাধূলি
নামিয়ে আনল বাষ্পসমুদ্র এ সমুদ্র আকার
হারাল এক্ষুনি অন্ধভ্রমণে ধূলির মহামেঘ
এক দিক সৃষ্টি করে, সংঘর্ষে সংঘর্ষে বদ্ধ দিক
এক ভ্রম সৃষ্টি করে, ভ্রমে বদ্ধ প্রাণ ভরে আমি
ভুল দেখি ভুল দেখি প্রত্যেক মুহূর্তে দেখি ভুল
ওপারে মস্তকপ্রভা ক্রমশ বিলুপ্ত হল যদি
এপারে সমুদ্র শেষে জেগে ওঠে পায়ের আঙুল…
রানীকুঠি
ভিখ মাঙনে আয়া ভিখু
ভিখ মাঙনে আয়া
হাতের লেখা ভিক্ষে চাইছে
বেওকুফ বেহায়া
হাতে লেখা ভিক্ষে চাইছে,
হাতের ছোঁয়া? তাও
এরপরে কী চাইবে? উঁহু,
অন্য বাড়ি যাও।
অন্য বাড়ি? ওর তো কোথাও
অন্য বাড়ি নেই।
ভিখ মাঙতে মাঙতে ভিখু
ঘুরবে এখানেই
তার চে’ ক্ষমাঘেন্না করে
একটুকু অন্তত
দাও রানীমা, তোমার দয়া
লক্ষ্মীসরার মতো
ও ফিরে যাক নিজের মুলুক,
ও ফিরে যাক ঘরে—
রামজী ভালা করে তোমার,
রামজী ভালা করে।
একফোঁটা
জলের দরে তুমি পেলে আমায়
সেই প্রথম একফোঁটা
জলের নীচে আমি ডুবে গেলাম
দেখে তোমার ভেসে ওঠা।
আকাশে শুয়েছিলে, দেখেছিলাম
বাতাসে ভেসে আছে নাভি
ভিতরে কত জল, বলে আমায়,
‘এলেই দশ নয়া পাবি’।
মূর্খ লোক, আমি মূর্খ লোক
খুঁজতে গেছি দশ নয়া
গলায় কাদাজল ঢুকে আসে
রুদ্ধশ্বাস, করো দয়া
করেছ দয়া, তাই পেলে আমায়
জলের দামে। সেই জল
এখনো ধরে আছি। আজো আমার
একফোঁটাই সম্বল!
পাঁচালি: দম্পতিকথা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম
অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙ্গব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ’৪২ কাটাব জীবন
মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান
লোকসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপঞ্চ ব্যঞ্জন
পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ বদলে একাডেমী রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাব জীবন
এক হাতে উপায় করব, দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি
রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটব সহস্র রকম
লটারী, তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন কাটাব
লটারী, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন
দেখতে দেখতে পুজো আসবে, দুনিয়া চিৎকার করবে সেল
দোকানে দোকানে খুঁজব রূপসাগরে অরূপরতন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন
কবিত্ব ফুড়ুৎ করবে, পিছ্ পিছ্ ছুটব না হাঁ করে
বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড় গল্প উপন্যাসোপম
পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন
নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে
ধরা পড়ব তোমার হাতে, বাড়ি ফিরে হেনস্থা চরম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পূজা বেদী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুবালা কাটাব জীবন
দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে
একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদ্যাপন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণ জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন
সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্য রাতে আচম্কা মিলন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রহ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম্ ইভ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন
এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব ওকে ধাক্কা দিয়ে
এটা ভাঙ্গলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘ভোর ভয়োঁ’ কাটাব জীবন।
প্রাক্তন
ঠিক সময়ে অফিসে যায়?
ঠিক মতো খায় সকালবেলা?
টিফিনবাক্স সঙ্গে নেয় কি?
না ক্যান্টিনেই টিফিন করে?
জামা কাপড় কে কেচে দেয়?
চা করে কে আগের মতো?
দুগ্গার মা কটায় আসে?
আমায় ভোরে উঠতে হতো।
সেই শার্টটা পরে এখন?
ক্যাটকেটে সেই নীল রঙটা?
নিজের তো সব ওই পছন্দ
আমি অলিভ দিয়েছিলাম
কোন রাস্তায় বাড়ি ফেরে?
দোকানঘরের বাঁ পাশ দিয়ে
শিবমন্দির, জানলা থেকে
দেখতে পেতাম রিক্সা থামল
অফিস থেকে বাড়িই আসে?
নাকি সোজা আড্ডাতে যায়?
তাসের বন্ধু, ছাইপাঁশেরও
বন্ধুরা সব আসে এখন?
টেবিলঢাকা মেঝের ওপর
সমস্ত ঘর ছাই ছড়ানো
গেলাস গড়ায় বোতল গড়ায়
টলতে টলতে শুতে যাচ্ছে
কিন্তু বোতল ভেঙে আবার
পায়ে ঢুকলে রক্তারক্তি
তখন তো আর হুঁশ থাকে না
রাতবিরেতে কে আর দেখবে!
কেন, ওই যে সেই মেয়েটা।
যার সঙ্গে ঘুরত তখন!
কোন মেয়েটা? সেই মেয়েটা?
সে তো কবেই সরে এসেছে!
বেশ হয়েছে, উচিত শাস্তি
অত কাণ্ড সামলাবে কে!
মেয়েটা যে গণ্ডগোলের
প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম
কে তাহলে সঙ্গে আছে?
দাদা বৌদি? মা ভাইবোন!
তিন কূলে তো কেউ ছিল না।
এক্কেবারে একলা এখন।
কে তাহলে ভাত বেড়ে দেয়?
কে ডেকে দেয় সকাল সকাল?
রাত্তিরে কে দরজা খোলে?
ঝক্কি পোহায় হাজার রকম?
কার বিছানায় ঘুমোয় তবে
কার গায়ে হাত তোলে এখন
কার গায়ে হাত তোলে এখন?
বন্ধু
তোমাকে নিয়ে লিখিনি কিছু তোমার সংখ্যায়
ধূলামহান বন্ধু, তাকে ফেলে এসেছি পথে
ধোঁয়ার পরে কুয়াশা পরে আয়নাভাঙা কাঁচ
কাঁটাতারের শেকল পায়ে কামড়ে বসে আছে
গোধূলি আর দুপুর আর সকাল আর সাঁঝ
কাঁচের ঘর। আলোর ঘর। নিজেকে বধ করা
নতুন লেখা দেখাতে কবে যেতাম কার কাছে?
জ্বলো
জল এই হাত। নিজ হাত, চির আজ কাল চির…
একে আমি তুলে ধরে আছি জল থেকে।
এর বর্ণ মন। এর গলন শীতলে। শীত শেষ।
এই বার গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্ম আজ। তুঙ্গ, ওর নখাগ্রে উচ্চতা
চুম্বন করছে, কারো নয় কেউ, ঢেউ, লুব্ধ ঢেউ
পায়ে ঠেলে ঠেলে যাও, সকল হাসির কথা বলো…
জ্বলো—জলে মগ্ন হয়ে—জ্বলো গ্রীষ্মদেশ!
জলহাওয়ার লেখা
স্নেহসবুজ দিন
তোমার কাছে ঋণ
বৃষ্টিভেজা ভোর
মুখ দেখেছি তোর
মুখের পাশে আলো
ও মেয়ে তুই ভালো
আলোর পাশে আকাশ
আমার দিকে তাকা—
তাকাই যদি, চোখ
একটি দীঘি হোক
যে-দীঘি জ্যোৎস্না
হরিণ হয়ে যায়
হরিণদের কথা
জানুক নীরবতা—
নীরব কোথায় থাকে
জলের বাঁকে বাঁকে
জলের দোষ?—না তো!
হাওয়ায় হাত পাতো।
হাওয়ার খেলা?—সে কি!
মাটির থেকে দেখি।
মাটিরই গুণ?—হবে।
কাছে আসুক তবে।
কাছে কোথায়?—দূর!
নদী সমুদ্দুর
সমুদ্র তো নোনা
ছুঁয়েও দেখবো না
ছুঁতে পারিস নদী—
শুকিয়ে যায় যদি?
শুকিয়ে গেলে বালি
বালিতে জল ঢালি
সেই জলের ধারা
ভাসিয়ে নেবে পাড়া
পাড়ার পরে গ্রাম
বেড়াতে গেছিলাম
গ্রামের কাছে কাছে
নদীই শুয়ে আছে
নদীর নীচে সোনা
ঝিকোয় বালুকণা
সোনা খুঁজতে এসে
ডুবে মরবি শেষে?
বেশ, ডুবিয়ে দিক
ভেসে উঠবো ঠিক
ভেসে কোথায় যাবো?
নতুন ডানা পাবো
নামটি দেবো তার
সোনার ধান, আর
বলবো: ‘শোনো, এই
কষ্ট দিতে নেই
আছে নতুন হাওয়া
তোমার কাছে যাওয়া
আরো সহজ হবে
কত সহজ হবে
ভালোবাসবে তবে? বলো
ভালোবাসবে কবে?—’
সূর্যঢেউ, দূর্বাদল
যারা আমার ধ্বংস চায় যারা আমার অন্ধকার
যারা আমার প্রতিপদের
বিরুদ্ধ
আমি যাদের কালো পাথর আমি যাদের বাধাস্বরূপ
অন্ধকারে যারা আমায় কালি ছেটায়
বায়ুদূষণ যারা আমার
তারা কোথাও কাশের বন তারা কোথাও জ্যোতিউজল
একপলক চোখের ঢেউ তারা কোথাও
তারা কোথাও বালিকাদের ঘুমের দীপ
সূর্যঢেউ
মাঠের পর মাঠের শেষে একটি গাছ তারা কোথাও জিরিয়ে নাও
হাতের পাতা, পাতায় জল
যত আমার ঢেউ জাগর যত আমার খেলাপাগল
লেখার দিন
যত আমার লেখালেখির বন্ধুদের হারানো আর
ফিরে পাওয়ার অন্ধকার
শেখার দিন—
লেখা ছাপার ছোট কাগজ
একবেলার ভাত খাওয়া, যত খুশির গরীব দিন, মুখ ঢাকার
মুখ তোলার
শঙ্খ ঘোষ—গোপন সেই উপাসনার ২২শে মাঘ
বেড়ি পরার মস্ত ভুল
বেড়ি খোলার
বেড়ি ভাঙ্গার
চির আগুন
‘ধূম লাগার হৃৎকমল…’
যত আমার যারা আমার মাঠে ঘোরার তৃণ আকাশ
ঘুম জাগার দূর্বাদল
যারা আমার ধ্বংস চায় যারা আমায় পিষে ফেলার
ব্যর্থ সব যন্ত্র হাত
এই তাদের ছুঁয়ে দিলাম, ছন্দে সব ছুঁয়ে দিলাম
হাতে আমার তাদের প্রাণ
তারা কোথাও সৃষ্টি হোক, তারা কোথাও সৃষ্টি হয়
তারা কোথাও সৃষ্টিশীল
সমুদ্র…
তারাজীবন…
সবচেয়ে উঁচু তারাকে আমি বলি
১
মড়কের পর মড়ক পেরিয়ে এসেছি আমি আমাকে
ভয় দেখিও না
আমি জানি কোমল সব হাতের পাতা আমি জানি
ঘুমন্ত সব হীরেমানিক ফুল
আমি জানি আঙ্গুলে বিঁধে যাওয়া ছুঁচ আমি জানি
তারপরের ফুটিয়ে তোলা নকশা
জানি ভীরু লোকের ভিতরকার দৈত্য
ভূমিকম্পের পর ভূমিকম্প লাফিয়ে এসেছি আমি আমাকে ভয় দেখিও না
তাছাড়া মা কোলে তুলে নেয় শিশুকে কিন্তু রাস্তায় লুটোয়
কান্না
তাছাড়া জামার দোকানে ভিড় জুতোর দোকানে ভিড় ছাতার দোকান
ফাঁকা
তাছাড়া পানীয় জল পানীয় জল সাবধান চারিদিকে
কাটা ফল
তাছাড়া সাতসকালে দোকান খুলেই দোকানের সামনে
জলের বদলে কাঁচা মদ ছিটিয়ে দেওয়া
তাছাড়া যেখানকার যা ঝড়ঝাপটা সেখানেই ফিরে যাও বরং ভাই
বেরাদর সব
ফিরে যাও গিয়ে মাঝে মধ্যে চিঠিপত্তর দিও পারলে আমার
আদর আর ভালোবাসা নিও তোমরা সবাই
নিলে তো নিলে কিন্তু ফেললেও কম না বাবা গায়ে মাখলে
মুখে মাখলে সারা মুখ রৌদ্রলোক সারা শরীর রৌদ্রালোক
সারা বিশ্ব হে আমার মেঘ বৃষ্টি রৌদ্রালোক
তোমরা আমার আজব নগরের গান আর আমি হলাম
আজব নগরের তবলা
বল আমাকে ঢোল বলতে কী বুঝ কাঁসি কাকে বলে
কাঁসি কি ভাত খাবার নিমিত্ত তৈয়ার না বাজাবার নিমিত্ত
আমি তো নিমিত্ত মাত্র আমি তো নিমিত্ত মাত্র সকলেই বলে আমিও
বললাম বিশ্বাস করা না করা তোমার ইচ্ছে ওই দ্যাখো
বিশ্বাস অবিশ্বাসের বাইরে উঠেছে খোলা রোদ্দুর সেখানে
একটি তৃণ উড়তে শুরু করলো সে এইমাত্র পেয়েছে তার পাখা
আমি পাখাদের জন্ম জানি প্রজাপতিদের জন্ম তাও জানি
আমি ছাতারপাখির হটরপটর ঝটাপটি ঝগড়া জানি
অড়হর ক্ষেতের মধ্যে
আমি হাঁটলাম কত বনবাদাড় কাঁটাজঙ্গল ছিঁড়ে আর
আমার পায়ের তলায় তলায় তৈরি হয়ে উঠলো কত নতুন নতুন
পথ আর পথের প্রান্তে প্রান্তে গড়ে উঠলো নতুন নতুন
লোকালয় ওই দ্যাখো ওই সব লোকালয়ে আমার বাস কিন্তু
আমি তো আশ্রম বানাবো বা নগর পত্তন করবো বলে বেরোইনি
এই দুর্যোগের মধ্যেও আমি ঘর ছাইতে বেরিয়েছে আমি
বেরিয়েছি নতুন করে ঘর বাঁধতে
কারণ আমি জানি কেমন ক’রে আকাশ নিজেই ঝুলিয়ে দেয় তার
দড়ির মই
কেমন ক’রে দুলতে দুলতে ভাসতে ভাসতে হাওয়ায় ডুবতে ডুবতে
আমি উঠে পড়ি, সত্যি সত্যিই একসময় উড়ে পড়ি
চাঁদের পিঠে,
যতই ওপরে উঠি ততই ঠাণ্ডা হয়ে আসে হাওয়া আমার
নিজেরই নিঃশ্বাস বরফ হয়ে জমতে থাকে আমার চুলে দাড়িতে
ভাগ্যিস এইসময় চাঁদের মাটিতে আমায় স্বাগত জানায়
একটি মেয়ে, ভাগ্যিস সে আমার নাম দেয় জাদুবুড়ো নাম দেয়
সাদাবুড়ো
আমি লম্বা চকচকে অতিকায় এক জিহ্বার উপর দিয়ে
দৌড়ে চলি
নেমে যাই তার ঢালু অন্ধকার গলার মধ্যে
আমি উঁকি মেরে দেখি তার পাকস্থলীর ভেতরটা, যেখানে
মৃত সব প্রাণীর হাড়
মৃত সব গাছের হাড়
মৃত সব শহরের হাড়
ধীরে ধীরে কয়লা হয়ে যাচ্ছে, তেল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে
আমি দৌড়ে চলি দৌড়ে চলি লম্বা চকচকে অতিকায়
জিভের উপর দিয়ে
নেমে যাই তার ঢালু গলার মধ্যে
মুখ, সেই গুহার মতো মুখ তার গহ্বর সশব্দে বন্ধ ক’রে দেয়
তক্ষুনি আমি বেধে যাই তার গলায়
সে হেঁচকি তোলা মাত্র আমি বেরিয়ে আসি তার
নাকের ফুটো দিয়ে।
আমি হেঁটে বেড়াই তার ভুরুর উপর তার গোঁফ ধ’রে
ঝুল খাই লুকিয়ে পড়ি, টুকি দিই তার দাড়ির জঙ্গল থেকে
আমায় ধরতে পারে না ছুঁতে পারে না কিছুতেই আমার কিছু করতে
পারে না
কোনো দত্যিদানব
২
তাও তো তোমাদের আমি এখনো বলিনি মেয়েরা কেমন
বলিনি কত কতবার তারা আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছে রাস্তা থেকে
কত কতবার তারা খুঁজে খুঁজে জড়ো করেছে
বিস্ফোরণের ফলে দিগ্বিদিকে ছুটে যাওয়া আমার টুকরোগুলো
আর মাঠে মাঠে তারা আমাকে ছড়িয়ে দিয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণ বীজরূপে
তবেই না আমি পারলাম, তোমাদের বিস্মিত চোখের সামনে
এমন দারুণভাবে জন্মাতে পারলাম ‘ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে’
তাও তো তোমাদের আমি বলিনি চাঁদের মাটিতে কী করলাম
গিয়ে প্রথমেই একটা তাঁবু খাটিয়ে ফেললাম
আর সেই তাঁবুর মেঝেতে খুঁড়ে ফেললাম একটা গর্ত
তারপর আমি আর আমাকে স্বাগত জানানো সেই মেয়ে
সেই গর্তে নেমে ভাবলাম যে একটু ঘুমোই কিন্তু ঠাণ্ডা এত
ঠাণ্ডা সেখানে যে আমাদের চোখের পলক অব্দি
জমে যেতে লাগলো জমে যেতে লাগল দণ্ড পল মুহূর্ত
জমে গেল স্বয়ং সময়
শেষে বাঁচবার জন্য কেবল বেঁচে থাকবার জন্য বাধ্য হয়ে
আমরা ঢুকে পড়লাম এ ওর হৃৎপিণ্ডের মধ্যে
আর, তখনই তাপের জন্ম হলো ধীরে ধীরে ধোঁয়ার মতো
তাপ বেরোতে লাগলো আমাদের যৌথ হৃৎপিণ্ড থেকে
তারপর একসময় তাঁবুর মধ্যে জ্বলতে লাগলো ছোট্ট একটা
বাতি, চাঁদের মাটিতে তো হাওয়া নেই, তাই একবারও
কাঁপলো না তার আলো
সেইদিন থেকে সমস্ত শৈত্যের শেষ আমি ঘোষণা করেছি আর
তাই তো করা উচিত
আমি স্পর্শ করেছি সমস্ত পূর্বাভাস
সমস্ত আশঙ্কার শীর্ষদেশে আমি রেখেছি আমার আঙুল
আর তাদের ঘুরিয়ে দিয়েছি আনন্দের দিকে
তোমরা কখনো দেখতে পাওনি, তাই, নইলে
আমি তো কোনোদিন লুকিয়ে রাখিনি আমার চুম্বন
আমার এই হাত, এ কত ধৈর্য জানে, তোমরা জানো?
জানো তোমরা, আমার এই চোখ জানে কত ধরনের পথ চেয়ে থাকা?
আমার এই শরীর জানে কত রূপ, কত স্নান?
তবু এই ঠোঁট একদিন কত দীর্ঘ দীর্ঘ বেলা
কেবল ধুলোয় ধুলোয় ঠোঁট ঘষে বেড়িয়েছে
আর একটি ঠোঁটের আশায়!
আমি যে কেন উত্তর দিই না তোমাদের কথার, কেন আমি
চুপ ক’রে থাকি নিজের মধ্যে, তোমরা জানো?
কারণ, তোমরা কোনোদিন দেখতে চাওনি কেমন ক’রে ঘুমের মধ্যে
পাশ ফেরে পথ, পথও কেমন ক’রে কথা বলে ঘুমের মধ্যে—
আমি পথের পাশে কত কতদিন শুয়ে থেকেছি
পথের ভাই পথ হয়ে,
গাছের ভাই গাছ হয়ে কত কত বছর আমি স্থির
দাঁড়িয়ে থেকেছি জঙ্গলে জঙ্গলে
দাবানল যখন লাগলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পুড়ে ঝুড়ে আঙরা
হয়ে গেলাম কথাটি না ব’লে
কিন্তু তাই বলে ছাই হয়ে মিশলাম না হাওয়ায়, কিংবা ধুলো হয়ে
উড়লাম না মাটিতে,
কারণ আমি জানতাম আগুনে আমার কাণ্ড ঝলসে গেছে মাত্র,
আমার শেকড় পোড়েনি
তারপরই তো আমার গায়ে একটু একটু ক’রে সবুজ আর
ঝলমলে সব পাতা জন্মালো
তারপরই তো একদিন আমার ডালে এসে বসল
দুঃখী একটি পাখি
কত না সংকোচের সঙ্গে সে তার ঠোঁট দিয়ে একবার
নাড়িয়ে দিল আমার পাতা
কত ভয়ে ভয়ে ডাকল: ‘গাছ, ও গাছ!’
আমি বললাম: ‘কি?’
পাখি বললো: ‘তোমার কি ঘুম ভাঙালাম?’
আমি বললাম: ‘না, কী বলবে বলো—’
সে বললো: আমি কে জানো?’
আমি চোখ বুজেই বললাম: ‘খুব জানি, তুমি তো সে সেই সোনার মেয়ে!’
আর সঙ্গে সঙ্গেই গাছ জন্মের অবসান হলো আমার,
ওই ভয়ঙ্কর পথ চেয়ে থাকা আর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ’রে
দাঁড়িয়ে থাকার দণ্ড এক মুহূর্তে মকুব হয়ে গেল, আমি
লাফিয়ে নামলাম মাটিতে, আর সেই মেয়ে আকড়ে আমার ধরলো হাত
আর ছুটতে লাগলো, বন পেরিয়ে নদী পেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে
ছুটতে ছুটতে আমাকে নিয়ে সে মিলিয়ে গেল দিগন্তে
৩
এক মহাসমুদ্রের মধ্যে একদিন ঘুম ভেঙে ছিল আমার
এক মহাসমুদ্রের মধ্যে একসময় আমি ভেসে থাকতাম
দূর থেকে কেউ ভাবতো উল্টে যাওয়া নৌকো
কেউ ভাবতো পিঠ ভাসানো পাহাড়
দিনে দিনে দুএকটা লতাপাতা জন্মাতে শুরু করলো যখন
তখন বড়ো জোর কেউ কেউ ভাবলো কোনো হঠাৎ-জাগা দ্বীপ
কিন্তু আমার যে প্রাণ আছে, আমার যে প্রাণ থাকতে পারে
কেউ সেকথা ভুলেও ভাবতে পারতো না
শুধু তুমি ভেবেছিলে, সোনার মেয়ে, শুধু তুমি
বুঝতে পেরেছিলে এইখানে আছে একেবারে নতুন
একটা হৃৎপিণ্ড, যে তার সমস্ত সবুজ রক্ত
একবার বললেই ফোয়ারা ক’রে দিয়ে দিতে পারে তোমাকে,
তাই, ওই মহাসমুদ্রের ওপর দিয়ে এক রাত্রিবেলা আমি
বাড়িয়ে দিলাম আমার হাত আর অন্য মহাদেশ থেকে
তোমার হাতও এগিয়ে এলো জলের ওপর দিয়ে, মিলিত হলো তারা,
আমরা কেউ কারো মুখ দেখতে পেলাম না কিন্তু আমাদের আঙুলগুলো
আবিষ্কার করলো পরস্পরকে, পাগলের মতো আদর করতে লাগলো
পরস্পরকে
অন্ধেরা যেমন ছুঁয়ে ছুঁয়ে কথা বলে তেমনি মনে মনে তারা
কথা বললো অনেক—তোমার প্রতিটি আঙুলকে আমি
আলাদা আলাদা ক’রে চিনতে পারতাম, প্রত্যেকের একটা ক’রে
নাম দিয়েছিলাম আমি
তোমার তর্জনীর নাম ছিল খবরদার, তোমার অনামিকার
নাম ছিল পাইন পাতা, তোমার মধ্যমাকে বলতাম
মঝ্লী দিদি, আর তোমার কনিষ্ঠাকে আমি
আড়ি ব’লেই ডাকতাম তোমার মনে আছে কি?
আজ যখন মাটি জমতে জমতে আমি সত্যিই
বিশাল একটা দ্বীপ
আজ যখন আমার পিঠের উপর জনবসতিও কম নয়
আজ যখন আমার জলবায়ুও বেশ স্বাস্থ্যকর বলেই
মনে করে সবাই
আজ যখন আমাকে দেখতে আসে নতুন নতুন পর্যটক
আর নতুন সব জাহাজ নোঙর করে আমার তীরে
তখন রাত্রিবেলা, ভিজে মাটির মধ্যে মুখ গুঁজে আমি
ডাকতে থাকি: সোনার মেয়ে, সোনার মেয়ে, তুমি এখন কোথায়?
তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা,
তুমি কি আমাকে ভালোবাসছো, এখনো?
কিন্তু স্থাণু কিংবা স্থবির একটা দ্বীপ হয়েই আমি থাকি না।
আমি থাকি না পর্যটকের কৌতূহল মাত্র হয়ে
আমি টুপ করে ডুব মারলাম আর ভেসে উঠলাম ভুস্ ক’রে
এই মহাসমুদ্র তোলপাড় করে আমি ভেসে বেড়ালাম
কেবল তোমার আহ্বানের ঢেউ ধ’রে ধ’রে
সবার অলক্ষ্যে আমি জল থেকে উঠে পড়লাম আর
মিশে গেলাম শহরে
সোনার মেয়ে তোমার গন্ধের অনুসরণ ক’রে চললাম আমি
হাজার লোকের মধ্যেও আমি ঠিক চিনতে পারি
কোথায় ভেসে বেড়ায় তোমার গন্ধ
আমি চিনতে পারি কোথায় তোমার জনপদ
আকাশের তারা দেখে দেখে তোমার শরীরের প্রতিটি তিল
আমি চিনতে পারি।
তুমি বললে: কোথায় আমার জমি? তুমি বললে:
কোথায় আমার থাকবার জায়গা?
নদীর মধ্যে নেমে গিয়ে আমি পিঠ দিয়ে
ঠেলে তুললাম চর, সেই হলো তোমার জমি
আমার দুই বাহুকে আমি আটকে দিলাম খুঁটির মতো দুদিকে
তার উপর ছাউনি ক’রে টাঙিয়ে দিলাম একটুখানি আকাশ
আর আকাশ দিয়ে তৈরি সেই চালা আমি ঢেকে দিলাম
আমার লেখা না-লেখা কবিতার লতাপাতা দিয়ে, যাতে
ঘুমোবার সময় অন্তত হিম না লাগে তোমার গায়ে…
তারপর আমি অনেক রাত্রি বাড়ি ফিরি আর দেখি আমার জন্য
খাবার না-রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই
তখন তুমি যেখানেই থাকো, আমি বলি, সোনার মেয়ে জানো
আজ আর আমার খাওয়া হলো না রাতে
আমি অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরি আর দেখি কাগজের বাক্সে
আমার বেড়ালছানা দুটো ঠিকমতো ঘুমিয়েছে কিনা
তখন, তুমি যেখানেই থাকো, আমি বলি, সোনার মেয়ে জানো
ওরা না বড় হয়েছে একটু
জিন্স পরা ফুটফুটে যুবরাজ আমাকে বিদ্রূপ ক’রে বলে,
তুমি কি প্রেমের কবি? প্রেমের কবি কাকে বলে?
জিন্স পরা ফুটফুটে রাজপুত্তুর আমাকে একটার পর একটা গাছ দেখায়
বলে: ‘ওই গাছের নীচে আমার পয়লা কাজ ওই গাছের নীচে আমার
দোসরা কাজ ওই গাছের নীচে আমার তেসরা…হো হো
এই পৃথিবীতে আমার কাজ কম্মের অভাব হয় না কখনো…’
হাজার টাকার জামাজুতোপরা রাজকুমার রাজকুমারীরা আমাকে বলে:
‘প্রমাণ করুন, প্রেম কী।’
সোনার মেয়ে, তখন যে আমার একবারটি তোমার কাছে
যেতে খুব ইচ্ছে করে
তোমার দুটি হাত দিয়ে এই পৃথিবী থেকে মুখ ঢাকতে বড়
ইচ্ছে করে যে আমার সে কি আমি দুর্বল ব’লে?
তুমি কি অন্যদের মতো দুর্বলকে ঘেন্না করো? তুমিও কি
কোল দিতে চাও না তাদের? বলো, কিছু একটা বলো অন্তত!
কারণ, এই পৃথিবীতে সোনার মেয়ে ব’লে কেউ কোথাও নেই এ কথা যে
আমি এখনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না!
৪
সবাই যখন ঘুমোয়, সারারাত ধ’রে আমি উঠতে থাকি, আমি
উঠতে থাকি খাড়া একটা পাহাড়ের গা বেয়ে
তলহারা এক অন্ধকার খাদের তলা থেকে, সারারাত ধ’রে
কাঁধে ক’রে আমি তুলে আনি সূর্যকে আর
চূড়ার আড়াল থেকে তাকে বসিয়ে দিই পূর্ব দিকে
তখন আকাশে অত যে রঙ লাগে, সে রঙ আর
কে লাগায়, আমি ছাড়া?
তোমার দূর থেকে দ্যাখো বিখ্যাত সূর্যোদয়
ছুটে আসো, আমাকে দেওয়ার জন্য তোমরা ছুটে আসো
হাত ভর্তি অভিশাপ নিয়ে
আমি লাফাই না পাশ কাটাই না ডুব মারি না হাওয়ায়
যেমন থাকবার দাঁড়িয়ে থাকি তেমনি
সমস্ত অভিশাপ আর অস্ত্র আমার পায়ের কাছে নেমে পড়ে
হালকা এক নদী হয়ে বয়ে যায়
মড়কের পর মড়ক পেরিয়ে এসেছি আমি আমার
রঙ তুলিকে তোমরা ভয় দেখিও না
আমি জানি ঘুমন্ত সব হাতের পাতা আমি জানি
কোমল সব হীরে মানিক ফুল
আমি জানি তিনশ’ বছর পর ‘ওয়াক’ তোলা আগ্নেয়গিরি
জানি রাক্ষসীর ভিতরকার ভ্রমর
আমি খাদের পর খাদ লাফিয়ে এসেছি আমি
বেঁধেছি গানের পর গান
আমি রাত্রিবেলা দাঁড়িয়ে উঠে চুম্বন করি চাঁদকে আর আমার
পা ধুইয়ে দেয় সমুদ্রের জল তোমরা আমাকে ভয় দেখিও না
কেননা তোমরা এখনো জানো না যখন অজন্মায় কুঁকড়ে যায় দেশ
যখন আগুনে আর তেজস্ক্রিয়ায় তোমরা নিজেরাই পুড়িয়ে ফ্যালো
সমস্ত ফসল
যখন তোমাদের খাবার বলতে ছাই ছাড়া আর কিছুই থাকে না
তখন, সবার অজান্তে, আমি আবার মুখ ডুবিয়ে দিই মাটির ভিতর
বলি: সোনার মেয়ে, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? তোমার বুক দুটির নাম
আমি দিয়েছি অনসূয়া আর প্রিয়ংবদা, তোমার সেই দুই বান্ধবী যারা
সব সময় তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে, তারা কি মনে করে আমার কথা?
আমার স্পর্শের অনুমানে, এখনো কি জাগরণ হয় তাদের?
ও সোনার মেয়ে, বলো, তুমি এখনো জাগো, আমার জন্য?
সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভের অনেক ভিতরে, পৃথিবীর একদম তলায়
বসুন্ধরার দুই বৃন্ত জেগে ওঠে
ফুলে ফুলে উঠতে থাকে বক্ষযুগ, বসুন্ধরা তার দুগ্ধমুখ মুক্ত করে দেন
আর মাটির তলায়, ফোয়ারার মতো উঠতে থাকে দুধ
সকলের চোখের আড়ালে, উপছে ওঠে দুধ…
পরদিন ভোরে, কী যেন কোন্ মন্ত্রবলে দেখা যায়
ভিজে উঠেছে সমস্ত শুকনো মাটি
ভিজে উঠেছে এমন কি মরুদেশ
তখনই উর্বরতা উঠে পড়ে তার ঘুম ভেঙে, আর
মাঠের পর মাঠে হানা দিতে থাকে লাখো লাখো অঙ্কুর
ক্ষেতের পর ক্ষেত বেসে যায় ধানে আর ধানে
কিন্তু আমি তো কখনো তোমাদের পাল্টা প্রশ্ন করি না
কখনো বলি না যে প্রমাণ করো
প্রমাণ করো হাওয়ার ঘুম, প্রমাণ করো ঘুমের তলায় সব তারা
বলি না পান করে দেখাও বজ্র অথবা ওড়াও দেখি গাছকে
কিংবা মেঘের উপর পা ঝুলিয়ে বসো দেখি
বলি না, কখনো বলি না এসব—কেবল কোনো কোনো ঘোর
ঝড়বাদলের রাতে
আমার মেরুদণ্ড খুলে নিয়ে আমি বিঁধিয়ে দিই মাটিতে শীর্ণ এক স্তম্ভ—
আর তার উপর সারারাত ধ’রে ধারণ করি
একের পর এক বজ্রপাত
যাতে আমার গ্রামের কোনো ক্ষতি না হয়
যাতে ক্ষতি না হয় আমার সোনার মেয়ের
তোমাদের আমি বলেছি একদিন এই মহাসমুদ্রের ওপর দিয়ে
আমি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম আমার হাত ওপার থেকে এগিয়ে আসা
অন্য একটি হাতের দিকে; কি, বলেছি না?
আজ যখন সেই সমুদ্রের এপার থেকে ওপারে তোমরা
মুহুর্মুহু পাঠিয়ে দাও মুখে আলো জ্বালা বিস্ফোরক
পিঠে ডানাওয়ালা বিস্ফোরক
যখন শহরে শহরে লাফিয়ে বেড়ায় আগুনের দৈত্য
যখন সেই সমুদ্রের ওপর দিয়ে আজ তোমরা গড়িয়ে দাও তেল
আর উপকূলে উপকূলে ডানা জড়িয়ে ডানা ভেঙে একটু একটু ক’রে
মরে যেতে থাকে সব পাখি
যখন মা পলকহীন তাকিয়ে থাকে তার কোলে ধরা চুরমার বাচ্চার দিকে
তখন তোমরা ভাবতেও পারো না যে আসলে
ওই মা হলো আমার সেই সোনার মেয়ে আর আমি হলাম
ওই বাচ্চা
তোমরা থাকো তোমাদের নীতি আর তত্ত্ব নিয়ে তোমাদের
অস্ত্র আর আক্রমণ নিয়ে থাকো তোমরা আমি
পরোয়া করি না ওসব
উপকূলে উপকূলে আমি পাগলের মতো চালাই আমার তুলি, আর
দেখতে থাকি কেমন ক’রে সমস্ত পাখি ফিরে পায় তাদের সুস্থ ডানা
মা আর বাচ্চার ওপর আমি ভাসিয়ে দিই আমার গান
কলসি উপুড় ক’রে আমি ঢেলে দিই আমার গান
আর দেখতে থাকি জলের তোড়ে কেমন ভাবে ধুয়ে যায় আর
আর মিলিয়ে যায় সমস্ত ক্ষতস্থান
কেমন ভাবে আবার তীরভূমি ধ’রে বাচ্চার সঙ্গে ছুটতে থাকে মা
কেমন ভাবে আবার নতুন ক’রে জন্ম শুরু করে তারা
৫
তারপর, অনেক রাত্রে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, আমি এসে দাঁড়াই এই
সমুদ্রের তীরে—আমার পায়ে ঢেউ দেয় জল—তখন মাথা তুলে
আকাশের সবচেয়ে উঁচু তারাকে আমি বলি:
সোনার মেয়ে তোমার জন্য, কেবল তোমার জন্যই জন্মেছিলাম আমি
মাথার ওপর থেকে হাজার হাজার ফুট সমুদ্র সরিয়ে
একদিন আমি ভেসে উঠেছিলাম কেবল তোমার জন্যই
আমি বলি, সবচেয়ে উঁচু তারাকে আমি বলি: আমিই প্রথম,
আমার আগে আর কোনো প্রাণ আসেনি এই পৃথিবীতে মনে রেখো
মনে রেখো, কেবল তোমার জন্য পৃথিবীতে এতগুলো অরণ্য
বানিয়েছি আমি আর সেই অরণ্যে বসিয়েছি এত রকমের গাছ
যে-কোনো গ্রামের মধ্যে আমি পেতে দিয়েছি নদী, আর
যে-কোনো পাহাড়ের গায়ে আমি নামিয়েছি ঝর্না কেবল
তোমার জন্য সোনার মেয়ে
না, শুধু আকাশেই নয়, সমস্ত নদী সাগর আর সমস্ত
সরোবরের তীরে তীরে কেবল তোমার জন্যই তো আমি বসিয়েছি
এত রঙবেরঙের পাখির মেলা
যে-কোনো মরুভূমির মধ্যে আমি তো জাগিয়ে রেখেছি ঠাণ্ডা ঝিল
আর সারি সারি খেজুর গাছ
মনে রেখো, মনে রেখো যে-কোনো গাছের মধ্যে আমি রেখেছি বাসা
আর বাসার মধ্যে ছোট্ট গুটিশুটি পরিবার
যে-কোনো তাণ্ডবের শেষে আমি রেখেছি গ্রাম আর গ্রামের মধ্যে
অজস্র কুটির
যে-কোনো, যে-কোনো পথের মধ্যে জলসত্র আর সরাইখানা রেখেছি আমি
যে-কোনো পথের শেষে রেখেছি গন্তব্য ও আশ্রয়
আমি বলি, আকাশের সবচেয়ে উঁচু তারাকে এরপর আমি বলি:
আর আমারই কি একখানা ঘর থাকবে না?
সারাদিন পর তবে কোথায় ফিরবো আমি?
সারাদিন ধ’রে মেঘে মেঘে বৃষ্টি বানাবার পর
আর আকাশে আকাশে এত রঙ লাগাবার পর
মাঠে মাঠে ফসল আর বনে বনে এত ফুল জাগানোর পর
হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেবার পর
দিনের শেষে কোথায় ফিরবো আমি? কার কাছে?
কে আমাকে জল গামছা এগিয়ে দেবে?
কে আমাকে খেতে ডাকবে বলো?
তুমি ছাড়া, সোনার মেয়ে, কে আমাকে
ঘুম পাড়াবে আর?
সূর্য
ভয় পাওয়ার কিছু নেই
মৃত্যু, জলসূর্যের।
মৃত্যু, কালো দীপাধার।
ভয় পাওয়ার কিছু নেই
অন্ধ, জলে চলমান—
যষ্টি ফেলে দেয় নিজে।
আর সে-কাঠে গ্রামবাসী
বসতি নির্মাণ করে
অস্ত্র রাখে সারসার।
অস্ত্র, ডুবে যায় জলে।
ভয় পাওয়ার কিছু নেই
নৌকো মাটিতেও চলে।
জল, দুধারে সরে যায়
সমুদ্রের নীচে নীচে
বালিতে বালি-ঢাকা প্রাণ
জল, আকাশে সরে যায়
অন্ধ, জল থেকে উঠে
পাখির থেকে আরো পাখি…
সূর্য, মাঠে যায় ছুটে
ভয় পাওয়ার কিছু নেই
রূপকথা
ফিরে এলাম সরল পথ অতিক্রম করে
যত এগোই লতার পরে লতা
পায়ের গোছ আঁকড়ে ধরে—ছাড়াতে গিয়ে দেখি
হীরেমানিক জ্বালানো জটিলতা।
ফিরে এলাম সরল জল অতিক্রম করে
যত এগোই স্রোতের পরে আরো
অন্য স্রোত নীচের দিকে, তলের দিকে টান—
হীরেমানিক, পথ বলতে পারো?
নেমে এলাম মাটির বাধা অতিক্রম করে
কঠিন ভূস্তরের নীচে ছাইয়ের পরে ছাই…
অন্ধ, ছাই অন্ধ। ছাই ঠাণ্ডা। ছাই কালো।
চমকে দেখি, ছাই সরিয়ে জ্বলছে ধকধক
হীরেমানিক—বোনের পাশে ভাই।
বয়ঃসন্ধি
রেশমী, তার বাড়িতে গেছে ঢেউ
রেশমী, তার বাড়ির কাছে গাছ
রেশমী, তোর সোনালী সহপাঠী
রেশমী, কাল নাচের ক্লাস আছে
রেশমী, আজ বইয়ের ব্যাগ কোথায়
রেশমী, আজই স্কার্ট ব্লাউজ নীল
রেশমী, আজ ফেরার পথে গাছ
রেশমী, কার আগুন ছুঁয়ে এলে?
রেশমী, এই আগুন শুরু হল
এসব কথা কাউকে বলবে না!
মৃত্যু সব লেখাপড়া
মানুষ কত কিছু পড়ে
মৃত্যুদিন নিয়ে পড়া
মেঘের কাছে আসে মেঘ
হাতের কাছে হাতকড়া
মানুষ কত কিছু ভাঙে
বন্ধুঘর ভেঙে গড়া
নিজের ঘর—সেই ঘরে
পুরো পৃথিবী জড়ো করা
মানুষ কত কিছু বাঁধে
পুরুষ মেয়ে দড়ি দড়া
মুহূর্তের ভুল থেকে
সারা জীবন বাঁধা পড়া
মানুষ কত কিছু লেখে
মৃত্যু সব লেখাপড়া
নিয়তি পার করে লেখো—
লেখাই ভাঙে হাতকড়া।
‘চোখ পালটায়ে কয়’
যারা সব রাতবিরেতে ঘুরতে বেরোয়
যারা সব দিনের বেলার ঠিক পায় না
যারা সব আগুনরঙা কয়লারঙা
যারা সব হাড়জমানো গল্পকথা
যারা সব লাগামছাড়া ঘোড়ার দখল
যারা সব এপার ওপার টহলদারী
যারা সব ডাইনে এনে বাঁয়ে ফুরোয়
যারা সব তোমার কাছে অদরকারী
তারা কেউ দিল্লী চলো-র ধার ধারে না
তারা কেউ পাঁচ পয়সার তোয়াক্কা নয়
তারা কেউ পথের দাবীর নাম শোনে নি
তারা সব বুকের কাছে আঁকড়ে নেবে
যা দেবে চরম দেবে, নিঙড়ে দেবে
সে-দেওয়া ভুলবে না কেউ, নেওয়াও কঠিন
বাইরে কি তাদের বিষয় বলতে আছে?
বলবার দরকারও নেই—স্বয়ংপ্রকাশ
তারা সব উড়ন্ত গাছ, চলন্ত গাছ
তারা সব অন্ধকারের জাগ্রত ঘাস
তারা কই? কোথায় তারা?
দেখতে হলে
চোখ পালটাও, চোখ পালটাও!
লোকজন
(শ্যামলকান্তি-কে)
প্রতিটি লোক যৌনভাবে সৎ
প্রতিটি লোক সততা ধুয়ে খায়
আমার বাড়ি ছিল বসিরহাটে
আমার বাড়ি আছিল বনগাঁয়
আমার কত মেঘের খেলা-বাড়ি
আমার দিন বেচা দিনের হাটে
কতটি লোক ভুবনগাঁয়ে ছিল,
কতটি লোক আছিল রাণাঘাটে
কতটি লোক ভাঙা বাড়ির খেলা
কতটি লোক কিছু উপায় করে
দুচারজন নারীর মন খোলা
ডুবে আবার ভেসে ওঠাও চলে
কোথায় গ্রাম, আধা-গাঁয়ের ছেলে
ঝড়ের মুখে দেখেছে নাচে ডিঙি
এলোপাথাড়ি মহিলা দেখে ফেলে
দেখার লোভে ঘুরছে প্রতিদিনই
প্রতিটি দিন যৌনভাবে ঠিক
প্রতিটি দিন সততা ধুয়ে যায়
আমার জমি ছিল মদনপুরে
আমার জমি আছিল কালনায়
আমরা আসি লরিভর্তি করে
আমরা পাই একবেলা খাবার
আমরা দেখি জাল লাগানো গাড়ি
আমরা গলা ফাটিয়ে চীৎকার
পার্কে ঘোরে চোখ ঘোরানো মেয়ে
রঙ্গনারী দেখে মাথায় বাজ
কতটি মেয়ে বনবাদাড়ে ছিল
টাউনে সব খুঁজতে আসে কাজ
কতটি মেয়ে মাটির কাজ করে
নিজের মাটি ভাঙিয়ে নিজে খায়
ওদেরও বাড়ি ছিল বসিরহাটে
ওদেরও বাড়ি আছিল বনগাঁয়
আমরা তবু অনেক খুঁজে খুঁজে
মাথা গুঁজেছি কলিকাতার গ্রামে
আমার কথা সবার মুখে ফেরে
সবার চিঠি আসে আমার নামে
আমরা তবু ধুলোখেলার মেঘ
আমরা তবু মেঘের উঁচু ঢেউ
আমরা ফুলবাড়ির কাঁটাগাছ
আমরা চোরপুলিশও কেউ কেউ
কেউ পেয়েছি ছড়া লেখার হাত
কেউ ভিড়েছি ছড়া বেচার হাটে
সন্ধে হলে সবাই ফিরে যাই
গড়িয়ামোড়ে, হাওড়া, কুঁদঘাটে
তোমরা চেনো আমার ছড়াদের?
ছড়ারা সব কাজে বেরোয় রোজ
ছড়ারা সব রাস্তা দিয়ে হাঁটে
তাদেরও কেউ মেদিনীপুরে ছিল
তাদেরও কেউ আছিল রাণাঘাটে।
Leave a Reply