পাঁচকড়ি রচনাবলী ২ (দ্বিতীয় খণ্ড) – পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়
.
ভূমিকা
পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলী বহু দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রে বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে। আমরা দুই খণ্ডে আমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত নির্বাচন ও সঙ্কলন করিলাম। বহু প্ৰবন্ধ, নিবন্ধ ও রসরচনা এখনও অবশিষ্ট রহিল, কয়েকটি সাময়িক-পত্ৰ এখনও সংগ্ৰহ করিতে পারা যায় নাই। ভবিষ্যতে সেগুলি হইতে সঙ্কলন করিয়া তৃতীয় খণ্ড রচনাবলী প্ৰকাশ করিবার পথ খোলা রহিল।
আমরা বৰ্ত্তমান খণ্ডে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী যোজনা করিয়া দিলাম; বিস্তৃততর পরিচয় ‘সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’র ৮২ সংখ্যক গ্রন্থে মিলিবে।
জীবনকথা
১৮৬৬ সনের ২০ এ ডিসেম্বর (৬ পৌষ ১৭৮৮ শক, বৃহস্পতিবার) ভাগলপুরে পাঁচকড়ির জন্ম হয়। তাঁহার পিতা হালিশহর-নিবাসী বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ভাগলপুরে কালেক্টরী আপিসে ওয়ার্ডস ক্লার্ক ও বাটোয়ারী ক্লার্কের পদে নিযুক্ত ছিলেন।
পাঁচকড়ি ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র আদরের সন্তান; তাঁহার শিক্ষা-দীক্ষা পিতার সান্নিধ্যে ভাগলপুরেই সমাধা হয়। তিনি ১৮৮২ সনে ভাগলপুর জিলা-স্কুল হইতে প্ৰবেশিকা পরীক্ষা (১ম বিভাগ), এবং ১৮৮৫ ও ১৮৮৭ সনে পাটনা কলেজ হইতে এফ. এ. (২য় বিভাগ) ও বি. এ. (২য় বিভাগ, সংস্কৃত অনার্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তরুণ বয়সে পাঁচকড়ি ধৰ্ম্মপ্রচারক শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰসন্ন সেনের দ্বারা বিলক্ষণ প্রভাবিত হইয়াছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰসন্নের ‘ভারতবর্ষীয় আৰ্য্যধৰ্ম্মপ্রচারিণী সভা’ ও ‘সুনীতিসঞ্চারিণী সভা’র জন্য এক সময়ে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়াছিলেন। কিছু দিন পরে মনের অকুশল ঘটায় তিনি শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰসন্নকে ছাড়িয়া পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণির সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট হন। পাঁচকড়ি লিখিয়াছেন :–’বি.এ. পাস করিয়া কলিকাতায় আসিয়াছিলাম; পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি মহাশয়ের হিন্দুধৰ্ম্ম প্রচারকার্য্যে লেখক ও বক্তারূপে সহায়তা করিতাম।…১৮৮৭ খ্ৰীঃ অব্দ হইতে ১৮৯১ খ্ৰীঃ অব্দ পৰ্য্যন্ত আমি কলিকাতায় আসিতাম যাইতাম, সাহিত্য-চৰ্চা করিতাম, মাসিক ও সাপ্তাহিকে লিখিতাম, তখন আমাদের একটা বড় দল ছিল, সে দলের আনুকূল্য লাভ করিবার জন্য অনেকে আমার আনুগত্য করিতে বাধ্য হইতেন।‘
সম্ভবতঃ ১৮৯২ সনে পাঁচকড়ি ভাগলপুরে টী. এন. জুবিলী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক-পদ গ্ৰহণ করেন। এইখানে ঔপন্যাসিক শরৎ চন্দ্ৰ তাহার ছাত্র ছিলেন। কয়েক বৎসর শিক্ষকতা করিবার পর তিনি সাংবাদিকের ব্ৰত বরণ করেন।
সংবাদপত্র-সেবায় পাঁচকড়ির হাতে খড়ি—‘বঙ্গবাসী’তে। তিনি ১৮৯৫ সনের শেষাশেষি* ‘বঙ্গবাসী’র সম্পাদক হন। স্বনামধন্য ইন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ই ‘বঙ্গবাসী’র সহিত তাহার সংযোগ ঘটান। ‘বঙ্গবাসী’র সংস্রবে। আসিয়া পাঁচকড়ি আত্মোন্নতির প্রভূত সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। ‘বঙ্গবাসী’র প্রতিষ্ঠাতা যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুকে স্মরণ করিয়া তিনি বলিয়াছেন–’আপনার ‘বঙ্গবাসী’র সেবায় নিযুক্ত থাকিয়া আমি বাঙ্গালা। লিখিতে শিখিয়াছি, আপনার ‘বঙ্গবাসী’র সম্পাদক-পদে উন্নীত হইয়া আমি বাঙ্গালীর সাহিত্য-সমাজে সুপরিচিতৃ হইয়াছি।’ কিন্তু এ সকলের মূলে ছিলেন ইন্দ্রনাথ,–’বঙ্গবাসী’র হিতৈষী, পরামর্শদাতা ও লেখক। পাঁচকড়ি সাহিত্য-গুরু হিসাবে তাঁহাকে স্বীকার করিতে কোন দিনই কুষ্ঠিত হন নাই। তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে লিখিয়া গিয়াছেন :–
‘তিনি আমার খাঁটি গুরু মহাশয় ছিলেন, হাতে ধরিয়া লিখিতে শিখাইয়াছিলেন, কত ভঙ্গী করিয়া পড়িতে, বুঝিতে এবং বুঝাইতে শিখাইয়াছিলেন।… এখনও তাঁহারই কথা বেচিয়া খাইতেছি, তাঁহারই সিদ্ধান্তসকল ব্যাখ্যা করিয়া সমাজে স্থান পাইয়া আছি। গুরু, বন্ধু, সখা, ভ্রাতা, পরিচালক-তিনি আমার সব।’।
বিশেষ যোগ্যতার সহিত চারি বৎসর কংগ্রেস-বিরোধী ‘বঙ্গবাসী’ সম্পাদন করিয়া পাঁচকড়ি ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ হইতে কংগ্রেস-সমর্থনকারী ‘বসুমতী’র সম্পাদক নিযুক্ত হন। ইহার দুই বৎসর পরে স্বত্বাধিকারীর সহিত মতবিরোধের ফলে তিনি অমরেন্দ্রনাথ দত্ত-প্ৰবৰ্ত্তিত ‘রঙ্গালয়’ পত্রে যোগদান করেন। পাঁচকড়ি স্বদেশী-আন্দোলনের যুগে ব্ৰহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ‘সন্ধ্যা’তেও নিয়মিতভাবে লিখিতেন। ১৯০৮ সনে তিনি ‘হিতবাদী’র সম্পাদক হন। তিনি আরও কয়েকখানি পত্র-পত্রিকা সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন; ইহার মধ্যে সাপ্তাহিক ‘প্রবাহিণী’ (১৩২০-২২) ও দৈনিক ‘নায়কে’র নাম উল্লেখযোগ্য; শেষোক্ত পত্ৰখানির সহিত তিনি দীর্ঘ কাল যুক্ত ছিলেন। সুরেশচন্দ্র সমাজপতির মৃত্যু হইলে পাঁচকড়ি সুহৃদের সাধের ‘সাহিত্য’কে কিছু দিন বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন; ১৩২৭ সালের পৌষ-মাঘ সংখ্যা হইতে তিনি ‘সাহিত্যে’র সম্পাদন-ভার নিজ স্বন্ধে গ্ৰহণ করেন।
পাঁচকড়ি দীর্ঘায়ু ছিলেন না। ১৯২৩, ১৫ই নবেম্বর (২৯ কাৰ্ত্তিক ১৩৩০), ৫৭ বৎসর বয়সে, বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও পত্নীকে শোক-সাগরে ভাসাইয়া ইহলোক হইতে বিদায় গ্ৰহণ করেন।
পাঁচকড়ির রচিত ও সম্পাদিত গ্ৰন্থ :–১। আইন-ই-আকবরী ও আকবরের জীবনী (বসুমতী, ইং ১৯০০); ২। শ্ৰীশ্ৰীচৈতন্যচরিতামৃত (বসুমতী, ইং ১৯০০); ৩। উমা (গৃহচিত্র), ইং ১৯০১; ৪। রূপ-লহরী বা রূপের কথা, ইং ১৯০২; ৫। সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস (হিতবাদী, ইং ১৯০৯); ৬। বিংশ শতাব্দীর মহাপ্ৰলয় (বসুমতী, ইং ১৯১৫); ৭। সাধের বউ (উপন্যাস), ইং ১৯১৯; ৮। দরিয়া (উপন্যাস), ইং ১৯২০৷
——————–
* ১৮৯৬, ৭ই আগষ্ট ‘টি. এন. জুবিলী কলেজিয়েট ছাত্রবৃন্দ’ ভাগলপুরে তাঁহাকে বিদায় অভিনন্দন দিয়াছিলেন। এই উপলক্ষে যে ‘শোকোচ্ছ্বাস’ মুদ্রিত হইয়াছিল, তাহাতে প্ৰকাশ–
‘গিয়াছিলে দেব, নয় মাস তরে
আশা ছিল প্ৰাণে ইহা,
হেরিব চরণ, কিন্তু আজি হায়
ভাসিয়া ডুবিল তাহা।।
Leave a Reply