পাঁচকড়ি দে রচনাবলী ৫ (৫ম খণ্ড)
সম্পাদনা – বারিদবরণ ঘোষ
করুণা প্রকাশনী।। কলকাতা-৯
প্রথম প্রকাশ : ১লা বৈশাখ, ১৪২২
প্রচ্ছদ : ইন্দ্ৰনীল ঘোষ
.
সম্পাদকীয় রসাস্বাদন
ডিটেকটিভ্!
শব্দটি উচ্চারণ মাত্রই একটা রহস্য, একটা মায়াজাল, একটা সন্দেহের ভ্রূভঙ্গি—অনিবার্য হয়ে ওঠে। এবং এরই সঙ্গে গড়ে ওঠে একটা ছবি—রক্তাক্ত দেহ, একাধিক ধারালো অস্ত্র— বন্দুক, রিভলবার বা কোনও শাণিত ছুরি-ভোজালি, কিছু রাসায়নিক বস্তু—ক্লোরোফর্ম বা ওই জাতীয়। এবং অনেক ক্ষেত্রেই একরাশ অর্থ—বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যার রঙ কালো। আর…আর প্রেম—সুন্দরী নারী, নারীদেহলোলুপ কিছু যুবক অথবা কোনও প্রৌঢ় এমনকি বৃদ্ধ প্রণয়প্রার্থী। প্রেম কখনও ত্রিভুজাকৃতি কখনও বা বহুলাকৃতির।
এসে যান অনিবার্যভাবে পুলিশ এবং পুলিশকে অপদস্থ করার জন্যে পুলিশের বাবা ডিটেকটিভ। ব্যাপারটা পুরনো ভারতীয় সাহিত্যে এমন ধারায় ছিল না। চুরি-ডাকাতি-খুন মানব সভ্যতার সভ্য অঙ্গবিশেষ! কাজেই পুরনো কালে অপরাধ ছিল না—এমন মনে করার কারণ নেই। সেজন্যে অপরাধীদের ধরার জন্যে পাহারাদারেরা ছিলেন। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটকে দেখেছি সেই ধীবরের কাহিনি যিনি নদীতে জাল ফেলে একটা বড়ো আকারের রুই মাছ ধরেছিলেন। মাছটা কেটে দেখলেন তার পেটে একটা মহারত্নভাস্বর আংটি। বেচারার কোনও দোষ ছিল না। সেটা জানাজানি হতেই ‘পুলিশে’ খবর যায়। তাঁরা তাঁকে পাকড়াও করে রাজা দুষ্যন্তর কাছে নিয়ে যান। ‘পুলিশে’র দলে একজন ছিলেন যাঁর নাম সূবর্ণক। তাঁর আচার-আচরণ দেখে মনে হয় তিনি সম্ভবত ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ—ডি.জি. পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু কোনও গোয়েন্দার সন্ধান পাইনি। শূদ্রকের লেখা ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে দেখি নগরের প্রধানা নটী বসন্তসেনা দূরদেশে যাবার আগে সজ্জন চারুদত্তের কাছে তাঁর গয়নাগাঁটি জমা রেখে যান। কিন্তু সেগুলি সব চুরি হয়ে যায়। চুরি করে চারুদত্তের পরিচারক শার্বিলক—তাঁর প্রেমিকাকে বিয়ে করবে বলে গয়না উপহার দেবার লোভ সামলাতে না পেরে। তাকে ধরবার জন্যে নাট্যকার কোনও টিকটিকিকে (এই জীবটি গোয়েন্দাগিরি করে নিশ্চয়ই—নইলে গুটি গুটি পায়ে ছোঁ মেরে কীটপতঙ্গ ধরে কী করে) এই গয়না-উদ্ধারে ডাকেন নি!
আসলে তখন অপরাধগুলো এতোই সাদামাটা রকমের হতো যে হদিশ পাবার জন্যে দু-চারটে ধমকই কার্যকরী হতো। ডিটেকটিভ্রা এসেছেন আমাদের দেশে কালাপানি পার হয়ে। বিদেশী রহস্য উপন্যাসের রহস্য উদ্ঘাটনকারীরা কেমন করে সমাজে আবির্ভূত হলেন—তার ইতিহাস আমি লিখতে বসিনি। কারণ আমি জানি—কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি কি জেমস বন্ডের নাম জানে না; এরদুল পোয়ারো, ওয়াটসন, শার্লক হোমস বা রবার্ট ব্লেকের নাম জানেন না— ইংরেজি-না-জানা এমন বাঙালি পাঠক আছেন—তা কেউ বিশ্বাস করবেন না। সেজন্যে যাঁরা বিদেশি রোমাঞ্চকর উপন্যাস বাংলায় এমন করে এনে দিয়েছেন—যেন তাঁদের গোবিন্দরাম, দেবেন্দ্রবিজয়, কৃষ্ণা, দীপক, কিরীটি রায়’রা একেবারে আগমার্কা বাঙালি। এটা একটা বাহাদুরি বটে সন্দেহ নেই। কোনও কোনও লেখক বিদেশি ঋণের কথা বেমালুম চেপে গিয়ে তাঁদের ‘মৌলিকতা’ প্রচার করেছেন। কিন্তু ‘সৎ লেখকরা ধরা পড়ার চেয়ে কবুল-করা নিরাপদ—এই প্রবচনে বিশ্বাস রেখে ঋণের কথা স্বীকার করেছেন। তবে মূল লেখকের নাম উচ্চারণ করেননি, পাছে কাপড় খুলে বে-ইজ্জত হয়ে যান!
এত কথার কারণ, পাঁচকড়ি দে আর দীনেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলি খণ্ডে খণ্ডে যে আমরা প্রকাশ করে চলেছি—তাঁদের কাছে এই রহস্যটা উদ্ঘাটিত হয়েই গেছে ইতোমধ্যে। পাঁচকড়িবাবুর বর্তমান খণ্ডটিতে তাঁর লেখা ‘রহস্য-বিপ্লব’ নামে যে রহস্য-কাহিনীটি আমরা ছাপিয়ে দিয়েছি তার সূচনাতেই সজ্জন লেখক স্বীকার করেই নিয়েছেন তিনি কোনও ইংরেজি থ্রিলার থেকে এই মনোহর কহানিয়ার রসদ সংগ্রহ করেননি—ইংরেজি সাহিত্যের পরম প্রতিপক্ষ ফরাসি সাহিত্য থেকে এর মূল কাহিনী ও মূল রস আহরণ করেছেন। কিন্তু সেই লেখক বা বইয়ের নামটি পাঠকের কাছে ব্যক্ত করেননি। কারণ তিনি এমন করে খোল-নলচে বদলে দিয়েছেন যে হুঁকোটার অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ জাগতে পারে। জেগেছেও। কাহিনি ফরাসি দেশে থেকে বঙ্গদেশে না এসে সুরাটে হাজির হয়েছেন, চরিত্ররা গুজরাটি বা পারসি, রাস্তাঘাট গলি-ঘুঁজি সবই সেখানের। তবে কথাবার্তা বলেন বাংলায় এবং প্রায়ই বিদেশি খোলসটা না ছাড়িয়েই। বিদেশি ভাষার যে কতকগুলো রীতি বা লব্জো আছে—তা পাঠকের কাছে ধরা পড়ে যায়।
এই রহস্যোপন্যাসটি তিনি দীর্ঘদিন লিখে ফেলে রেখেছিলেন, তারপর যখন শুরু করেন—তখন তিনিই সেটি ‘লেখেন’ বলেছেন। আমরা তাঁর সততায় অবিশ্বাস করিনা। কারণ গল্পটি শুরু থেকেই এমন জমিয়ে দিয়েছেন যে গল্পটা অবাঙালির—এই প্রশ্নটাই মাথায় আসে না—এমনি এর দেশি সাজ-সজ্জা আর রস-প্রবাহ। গল্পটি শুরু হয়েছে এক দম্পতির একটি ষোড়শী কন্যাকে দিয়ে। পুরুষটি স্বভাবতই প্রৌঢ় এবং বিপুল ধনী। ধনী ব্যবসায়ী যখন, তখন একজন হিসাবরক্ষক—ইংরেজিতে ‘যার নাম ‘কেসিয়ার’-থাকা প্রয়োজন। তো তিনি আছেন এবং আছেন তাঁর শৈশব থেকেই। তাঁকে কর্তামশায় নিজের ছেলের মতোই মানুষ করেছেন। তাঁর কন্যাটি বড়ো হয়ে ওঠায় (বয়স ষোল হলে তাঁকে সুন্দরী হতেই হয়, উপন্যাসে অন্তত) কর্তা পিতা সঙ্গতভাবেই ভাই-বোনের মত বেড়ে ওঠা দুজনকে আলাদা করে দিলেন—আগুন এবং ঘি পাশাপাশি না রাখার পরামর্শ সেই কতোকাল আগে থেকে মুনি-ঋষিরা দিয়ে চলেছেন। কারণ ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে’ এবং কখন কে তাতে ধরা পড়ে যায়। অতএব হরমসজি মেয়ে কমলাকে বললেন তুমি রস্তমজির সঙ্গে কথা বলবে না আর। আর ‘কেসিয়ার’ রস্তমজিকে বললেন-তোমার মাইনে বাড়িয়ে দিলাম, তুমি অন্য একটা বাসায় উঠে যাও—পাড়ার লোকের ঢি টি-ক্কার শুনতে রাজি নই। তাই চলে গেলেন মন ভারি করে রস্তমজি।
শূন্যস্থান ফাঁকা পড়ে থাকে না—একটা ইংরেজি প্রবাদ আছে। তাই হরমসজির শ্যালি-পুত্র এবং আরও দুজন সাঙ্গোপাঙ্গ এলেন। একজন তো তাঁর ১০ লাখ টাকা বিশ্বাস করে হরমসজির বাক্সে রেখেছিলেন। কিন্তু টাকা তুলতে গিয়েই বিভ্রাট। দেখা গেল সিন্দুকে একটা টাকাও নেই। অথচ সিন্দুক খোলার সিম সিম খুলে যাওয়ার মন্ত্রটা জানেন দুজন—হরমসজি আর রস্তমজি। কিন্তু দুজনেই বলেন—টাকা তাঁরা নেননি। বিশেষ করে ‘কেসিয়ার’ বাবুকেই জেরা করে জেরবার করে তুললেন কর্তা। এর মধ্যে সুদর্শন ফ্রামজি এসে পড়েছেন গল্পের ফ্রেমে। তিনি আপাতত কমলার পাণিপ্রার্থী।
টাকা চুরির কিনারা করতে এসেছেন পুলিশের ইন্সপেক্টর এবং গোয়েন্দা দাদাভাস্কর। আদালতে রুজু হল মামলা। সেই টাকা চুরির মামলার রায় এবং মন চুরি মামলার রায় জানবার জন্যে টানটান উত্তেজনার মধ্যে পাঠকের দুটি বিস্ফারিত নয়নের আকুলি বিকুলির অবসানের জন্যে তাঁকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আসলে এই টেনে রাখার একটা আশ্চর্য কালি দিয়ে পাঁচকড়ি দে মশায়ের লেখনির মুন্সিয়ানা একেবারে প্রবাদের জায়গা করে নিয়েছে। এই যে টেনে রাখা, পাঠককে তরতরিয়ে এগিয়ে দেওয়া—এটাই তো পাঠকপ্রিয়তার সেরা লক্ষণ। সংকলিত অন্য লেখাটিতেও পাঠক এই গুণটাই দেখতে পাবেন। তার মন বিদেশী-স্বদেশী বিচারবুদ্ধির কথা ভুলে গিয়ে শেষ লাইনের শেষ শব্দটি পর্যন্ত পড়ে নেবার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে। এখানেই পাঁচকড়ির জিৎ।
বারিদবরণ ঘোষ
মার্চ, ২০১৫
Leave a Reply