পাঁচকড়ি দে রচনাবলী ২ (দ্বিতীয় খণ্ড)
সম্পাদনা – বারিদবরণ ঘোষ
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ২০১১
প্রচ্ছদ : ইন্দ্রনীল ঘোষ
করুণা প্রকাশনী
পাঁচকড়ির পাঁচ-সাত
ইংরেজিতে লেখা এডগার অ্যালেন পো-এর The Murders of the Rue Morgue যদি পৃথিবীর আদিতম লিখিত ডিটেকটিভ গল্প হয়, তবে বাংলা ডিটেকটিভ গল্পের জন্য আমাদের আরও পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। পো লিখেছিলেন ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে, আর প্রিয়নাথ মুখুজ্যের হাত থেকে প্রথম বাংলা সার্থক ডিটেকটিভ গল্প ‘বনমালি দাসের হত্যা’ আমরা পেলাম ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে। তিনি অবশ্য হাত মক্শো করতে শুরু করেছিলেন ১৮৮১ সালে ‘আদরিণী’লিখে—কিন্তু গপ্পো জমতে আরও দশটা বছর লেগেছিল। পাঁচকড়ি দে-র জন্যে আমাদের আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হল—১৯০৯ সাল অবধি।
এর মধ্যে বাংলা সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে ‘যমুনা’ প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ১৩১০ সালে। কিন্তু পত্রিকাটি ১৩১৩ সালে বন্ধ হয়ে গেল। আবার নবকলেবরে প্রকাশিত হল বাংলা ১৩১৬ সালের বৈশাখ মাসে (ইংরেজি ১৯০৯)। সম্পাদক ধীরেন্দ্রনাথ পাল। এই পর্বের দ্বিতীয় বর্ষে (১৩১৭) ধীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পাদনা সূত্রে আরও কয়েকজন ব্যাক্তি যোগ দিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম যতীন্দ্রনাথ পাল। ইনি ধীরেন্দ্রনাথের পুত্র। ইনি নবপর্যায়ের ‘যমুনা’র প্রথম সংখ্যায় (বৈশাখ ১৩১৬) একটি কবিতা লিখেছিলেন—‘ভিক্ষা’ নামে। ঘটনাচক্রে ১৩১৭ সালের মাঘ মাসে ধীরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। ‘যমুনার’ মাঘ ১৩১৭ সংখ্যায় (পৃ.৩৪৩) ‘শোকসংবাদে’ প্রসঙ্গক্রমে লেখা হয়—স্বৰ্গীয় ধীরেন্দ্রবাবুর বিশেষ বন্ধু বঙ্গীয় সাহিত্যের প্রতিভাবান সুলেখক শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি দে মহাশয় ‘যমুনার’ বিশেষ পৰ্য্যবেক্ষণে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন। তাঁহারই উপদেশে ‘যমুনার’ সম্পাদনাভার এই মাস হইতে শ্রী সতীশচন্দ্র মিত্র, শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার, শ্রী গুরুদাস আদক ও শ্রী যতীন্দ্রনাথ পাল—এই চারিজন নবীন সাহিত্যসেবীর হস্তে অর্পণ করা হইল। ফনীন্দ্রনাথ পাল (জন্ম ১২৮৮, মৃত্যু ১৩৪৬) পাঁচকড়ি দে-র চেয়ে বয়সে আট বছরের ছোট ছিলেন।
যমুনা যখন প্রথম পর্যায়ে ১৩১০ সালে প্রকাশিত হয়, তখন এর প্রথমবর্ষের প্রথম সংখ্যার লেখক সূচিতে পাঁচকড়ি দে-কে পাইনি। তাঁকে পেলাম নবপর্যায় ‘যমুনার’ প্রথম বর্ষে—-১৩১৬ সালে—লেখক হিসেবে। ১৩১৭ সালে তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে ‘যমুনা’ মন্তব্য করেছে, আমরা একটু আগে লক্ষ করেছি—’বঙ্গীয় সাহিত্যের প্রতিবাবান সুলেখক।’ অর্থাৎ তিনি অনেকদিন ধরেই লিখে এই ‘প্রতিষ্ঠা’ পেয়েছেন। সেটা কবে থেকে? সুকুমার সেন মহাশয় আমাদের একটি সংবাদ জানিয়েছেন—‘দারোগার দপ্তর’ও ‘গোয়েন্দাকাহিনী’ নাম দুইটির খিচুড়ি করে ‘গোয়েন্দার গ্রেপ্তার নামে একটি সিরিজ বেরোতে থাকে। বেরোত পুস্তকাকারে নয়, ফর্মা হিসাবে। এই পত্রিকায় পাঁচকড়িবাবুর ‘জুমেলিয়া’উপন্যাসটির তিনচার ফর্মা বেরিয়েছিল। তারপর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এ হল ১৩০৪ সালের কথা।” আমরা পত্রিকাপঞ্জির তালিকাগুলি হাতড়েও ‘গোয়েন্দার দপ্তর-এর হদিশ পেলাম না। তবে কি এটি ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজর এড়িয়ে গেছিল? যেতেও পারে। সুকুমার সেনের মন্তব্যে সংশয় প্রকাশের কারণ দেখি না। এ-বিষয়ে কেউ আলোকপাত করলে উপকৃত হবো। এই পত্রিকাতেই তিন-চার ফর্মা বের হয়েছিল তাঁর ‘জুমেলিয়া’ রহস্য উপন্যাস। হঠাৎ করে এই ফর্মা-পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রচনাটি অসমাপ্ত থেকে যায়। পরে গল্পের নাম বদল করে পুরোপুরি বই তৈরি করে লেখক তার নাম দেন ‘মায়াবিনী’। সেটা ছিল ১৮৯৯ সালের এপ্রিল-মে মাসের কথা। খুব টেনেছিল এর কাহিনি পাঠকদের। পরের বছরেই এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়ে এর জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে দিয়েছিল। অর্থাৎ ‘যমুনা’র সঙ্গে সংযোগের (১৯০৯) অন্তত বছর দশেক আগে থেকেই তিনি পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিতে পেরেছিলেন। এই ‘মায়াবিনী’তেই তাঁর বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র দেবেন্দ্রবিজয় এসে পাঠকদের চিত্ত বিজয় করে নিলেন। ১৯০৪ সালের ১৪ জুন মঙ্গলবারের সংখ্যায় ইংরেজি পত্রিকা ‘The Indian Echo ‘ লিখল—
‘We have been presented with a copy of an interesting detective story Mayabini writen by the well known author of detective stories Babu Panch Kouri De. We have gone through it and have no hesitation in saying that the author has well sustained the reputation he holds as a writer of this particular class of literary production. The book is very nicely got up and we hope the author will endeavour to satisfy the reading public with other production of similar nature. Babu Gurudas Chatterjee of Bengal Medical Library is the publisher.’
বোঝা গেল, যখন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স হয়নি, যখন মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের সিঁড়ির নিচে গুরুদাসবাবু, বেঙ্গল মেডিকেল লাইব্রেরী খুলে বসেছিলেন—তখনই পাঁচকড়ি দে-র এই বইটির প্রকাশ। পাঁচকড়িবাবু ‘গুরু’ পেয়েছিলেন অনেক আগে থেকেই।
আমরা প্রথম খণ্ডে ‘মায়াবিনী’ অন্তভুক্ত করার সময় এ-সব কথাগুলি বলে উঠতে পারিনি, এই সুযোগে তা বলে নিলাম। হয়তো পরের খণ্ডেও আবার বলবো। আসলে সব ‘খণ্ডগুলি সম্পূর্ণ হলে তবেই তো আমরা ‘অখণ্ড পাঁচকড়িকে পাবো। এই একই কারণে আমরা ঐ Indian Echo পত্রিকা তার ২ আগষ্ট ১৯০৪ সংখ্যায় পাঁচকড়ির ‘মায়াবী’ উপন্যাস সম্পর্কে যা মন্তব্য করেছিল, তা কৌতূহলী পাঠকদের জন্য উদ্ধার করে দিই :
“Mayabee” by Babu Panchcari Dey. It is full of interest and excitement. The Punishment of the murderer and his accomplice the beautiful widow is swift and sure, and is related in thrilling manner. The reader who once launches into it is not likely to lay it down before he comes to the end. For the skill with` which worked out the thorougly dramatic nature of the crime which it records, mystery which shrouds the perpretator, the means by which that mystery is ultimately solved, all serve to answer to ‘Mayabee” a high place in the class of fiction to which it belongs.”
প্রথম খণ্ডে সংযুক্ত ‘নীলবসনা সুন্দরী’ সম্পর্কে এই পত্রিকা যে মন্তব্য করেছিল তাও উদ্ধারযোগ্য মনে করি :
We have great pleasure in acknowledging receipt of an interesting detective story “Nil Basana Sundari” written by the well-known detective author Babu P.C. Dey. One will be awe-struck while going through its pages with the thrilling descriptions and adventures of Debendra Bejoy. We can without any scruple say that Babu P.C. Dey’s detective books may justly take a very conspicuous place in this particular class of literature in the Bengalee Lan- guage. The chief reason why he has been successful in his laudable attempt as a writer of detective stories is to be attributed to the peculiarly novel and attractive way in which he delineates the character of the principal hero. From beginning to end there is full of mysteries and wonderful events. The book under review contains more than 300 pages, and has been very neatly got up and the printing is highly satisfactory.’
প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি এসময়ে মায়াবী, মায়াবিনী, নীলবসনা সুন্দরী আর হত্যাকীর কে?—এই বই চারটির প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় বিক্রির জন্যে মূল্য নির্ধারণ করেছিলেন যথাক্রমে এক টাকা ছ’ আনা, দেড়টাকা এবং পাঁচ আনা। এবং ‘গোবিন্দরাম’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ হবার মধ্যেই পাঁচকড়ির বইপত্র ইংরেজি ছাড়া হিন্দি, উর্দু, তামিল সমস্ত ভাষাতেই অনূদিত হতে আরম্ভ করায় তিনি একই সঙ্গে ভারতীয় ও বিশ্বসাহিত্যে ঠাঁই পেতে শুরু করেছিলেন। আজকের দিনে আমরা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সির সহযোগী হিসেবে অজিতকে যেমন পাই, অথবা সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা আর তপসে যেমন ইংরেজি শব্দে Q-এর পরেই U-এর মতো অনিবার্য—এর সূত্রপাত ঘটিয়ে অনেক আগেই ‘মায়াবী’ (১৯০১)-তে ‘মায়াবিনী’র দেবেন্দ্রবিজয়ের একজন সহকারী নয়—একজন ডিটেকটিভ গুরু এনে দিয়েছিলেন পাঁচকড়িবাবু, তাঁর নাম অরিন্দম। ফুল সাহেবের দৌরাত্ম্যে ‘মায়াবী’র মনোহর কহিনিয়া কেমন জমজমাট হয়ে উঠেছিল–তা প্রথম খণ্ডের পাঠকমাত্রই অনুভব করে এসেছেন
এই খণ্ডে যে বইগুলি সংকলিত হল—তার কাহিনির আকর্ষণে পাঠককে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। এরমধ্যে পাঠক ‘গোবিন্দরাম’ নামে যে বইটি পড়বেন, তার গোয়েন্দা চরিত্রের নাম বদল করেছেন লেখক। দেবেন্দ্রবিজয় নন, এখানের গোয়েন্দার প্রবরের নাম স্বয়ং ‘গোবিন্দরাম’। আসলে এগুলি ছাড়া আরও তিনটি বইয়ের গোয়েন্দা হয়ে অমর হয়েছিলেন গোবিন্দরাম। সেগুলি হল মৃত্যু বিভীষিকা, প্রতিজ্ঞাপালন ও সতী সীমন্তিনী। এদের মধ্যে আকারে এবং প্রকারে গোবিন্দরামই সেরা। কাহিনীগুলির মূল ইংরেজি কাহিনি হওয়াই সম্ভব। সুকুমার সেন অনুমান করেছেন এসব কাহিনি লিখে দিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ পাল—আগেই ‘যমুনা’ প্রসঙ্গে যাঁর কথা বলে এসেছি। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে। তারপরেও কি পাঁচকড়ি আর লিখেননি। নাকি বন্ধুর মৃত্যুতে ‘শোকগ্রস্ত’ হয়ে লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন? তা যদি হয়ে থাকে তবে তো লেখক হিসেবে পাঁচকড়ির কোনও অস্তিত্বই থাকবে না। পাঁচকড়ি একজন বকলমা-লেখক—হাওয়ায়-ওড়া এই অভিযোগের বিচার কোথায় হবে—ডিভিসন বেঞ্চে, না পাঠকের সুপ্রিম কোর্টে। পাঠক, আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।
বারিদবরণ ঘোষ
মহালয়া ১৪১৭
সূচি
সৰ্ব্বনাশিনী
Leave a Reply