পাঁচকড়ি দে রচনাবলী ১ (প্ৰথম খণ্ড)
সম্পাদনা বারিদবরণ ঘোষ
করুণা প্রকাশনী, কলকাতা
প্রথম প্রকাশ : ১লা বৈশাখ, ১৪১৭
প্রচ্ছদ : ইন্দ্রনীল ঘোষ
॥ রোমাঞ্চন ॥
বাংলা রহস্যকাহিনির একটা পর্বের ইতিবৃত্ত লিখতে গিয়ে বড়ো ধন্দে পড়া গেছে। কাকে রহস্য কাহিনি বলা যাবে? সংস্কৃত মতে, এমনকি বাংলা মতেও ‘রহস্য’ অনেকটা ঠাট্টা বিদ্রুপের দলে পড়ে, যেমন গোপাল ভাঁড়ের রহস্য। ইংরেজি মতে আবার রহস্যের নানা ব্যাখ্যান–এডভেঞ্চার, থ্রিলার, শিকার, ক্রাইম, ডিটেকটিভ, মিস্ট্রি, স্পাই—নানান শব্দের ফাঁকে-ফোঁকরে রহস্য ছড়িয়ে আছে। আমরা এই শেষের দিকের সবধরনের রচনাকে একত্র করে ভেবে নিচ্ছি। এছাড়া উপায় নেই। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকে শর্বিলক-এর চুরি করতে যাওয়ার মধ্যে রোমাঞ্চের গন্ধ আছে—কিন্তু তাকে কোনোক্রমেই গোয়েন্দা-কাহিনি বলা যাবে না। বাংলা গোয়েন্দা কাহিনি ইংরেজি গোয়েন্দা রচনার অনুবাদের হাত ধরে এসেছে। অতএব ইংরেজি মতগুলোকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ইংরেজি মতের কথা মনে হলেই এডগার অ্যালেন পো-এর কথা আগে মনে পড়ে যাবে। তাঁর The Murders in the Rue Morgue- পৃথিবীর প্রথম ডিটেকটিভ গল্প (১৮৪১ খ্রি.)। এর পরে নাম করতে হয় উইলকি কলিন্স-এর। তাঁর মুন স্টোন অথবা দি উওম্যান ইন্ হোয়াইট-এর ইন্সপেক্টর বাকেট ছিলেন ডিটেকটিভদের প্রথম সেরা মানুষ। তারপরে এসেছেন শার্লক হোমস্ আর ওয়াটসন নিয়ে আর্থার কোনান ডয়েল। আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়রোর কথা রসিকমাত্রেই জানেন। জেমস্ বন্ড, হ্যাডলি চেজ তো হাল আমলের ব্যাপার। নইলে Mystries of the Court of London (বাংলায় ‘লণ্ডন রহস্য’ নামে কয়েকখণ্ডে অনূদিত) পুরনো আমলে কম সাড়া জাগায়নি। এসব নামের উল্লেখ এজন্যে যে বাংলা রহস্য কাহিনি এগুলির কাছে সবচেয়ে ঋণী। পাঁচকড়ি দে মশাই কি গোবিন্দরাম বা দেবেন্দ্রবিজয় নির্মাণ করতে পারতেন, যদি না পুলিস ইন্সপেক্টর বাকেট তাঁর চোখের সামনে ঘোরাফেরা না করতেন?
॥২॥
কাজেই বাংলা সাহিত্যে ডিটেকটিভ রচনার আবির্ভাব হতে দেরি হয়েছিলো। ভালো ডিটেকটিভ গল্প লেখা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। হত্যা, খুন, রাহাজানি, জোচ্চুরি এসব কাজের মধ্যে একটা অপরাধজনক মৌজ আছে। এর গল্পকে হতে হয় ঘামছোটানো ঘুম-তাড়ানো চরিত্র। আমাদের মধ্যে গোপন অপরাধ-বোধকে জাগ্রত করে তাতে সুড়সড়ি দিতে হবে—গল্পটা হবে পো-এর ভাষায় ‘Somewhat Peculiar Narrative.’ লেখককে হতে হবে একইসঙ্গে নাট্যকার, সাংবাদিক, ঐতিহাসিক, মনস্তাত্ত্বিক, বিজ্ঞানী এবং শিল্পীও। চাই কৌতূহল শেষ অবধি জিইয়ে রাখার দুঃসাধ্য সংযম এবং আর্ট। রহস্যময়তাকে বজায় রাখতে হবে আদ্যোপান্ত। ভারতের আপাত নিস্তরঙ্গ জীবনে এতোগুলো বিপ্লব একসঙ্গে ঘটেনি। ঘটলো ইংরেজ আগমনের পর অপরাধ প্রবণতার বিচিত্র পরিবেশ সৃষ্টির ফলে। ইংরেজি সাহিত্য এবং ব্রিটিশ সরকার দুই হাত ধরে অতএব রহস্যকাহিনি বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় এসে পড়ল। এর মধ্যে ছোট গল্পের যথার্থ একটা কাঠামোর সঙ্গে বাঙালি রসিক পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছেন। কারণ তখনি আবির্ভূত হচ্ছেন বাংলা ছোটগল্পের জন্মদাতা, পালয়িতা এবং অভিভাবক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অভিযোগ, তাঁর রহস্যময় গল্পের পিছনে ছিলো অ্যালেন পো-র রহস্যময়তার ছায়া। রবীন্দ্রনাথকে অভিযুক্ত করবো কি, স্বয়ং কোনান ডয়েল শার্লক হোমসের চরিত্র কি আঁকতে পারতেন যদি না সামনে পোর ডিটেকটিভ Dupin প্রত্যক্ষ না থাকতেন! তাঁর প্রভাবেই ডয়েল Professor Challenger-কে নিয়ে Science fiction লেখেননি?
অতএব সত্যেন্দ্রনাথের লাইব্রেরি থেকে পো নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মগ্ন হলেন এবং Golden Bag এবং গুপ্তধন, The Cask of Amontillado আর The Tell – Tale-Heart ও সম্পত্তি সমৰ্পণ, Premature Burial এবং জীবিত ও মৃত ইত্যাদি মিতালি পাতিয়ে বসলো। কঙ্কাল, নিশীথে, ক্ষুধিত পাষাণ, ডিটেকটিভ গল্পগুলি অচিরে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
॥৩॥
একটু আগে যে ব্রিটিশ রাজত্বের কথা বলছিলাম। তার একটা কারণ চোর-ডাকাতের প্রাধান্য যেমন বেড়েছিল, তেমনি ধনীদের অত্যাচারও বেড়েছিলো। বেন্টিকের আমলে শ্লিম্যানের চেষ্টায় ঠগিদমন হলেও অপরাধীর সংখ্যা কমেনি। “থানাদার” স্থলে ‘দারোগা’রা এলেন। এমনি এক দারোগা ছিলেন গিরিশচন্দ্র বসু (এ পদে যোগ দেন ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে)। ডাকাতি দমনে তাঁর পটুত্ব ছিল। তাঁর চোখে দেখা অপরাধীদের অপরাধ ও তার দমনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে ছিল। তাই দিয়ে তিনি লিখে বসলেন ‘সেকালের দারোগার কাহিনী’–বিশ্বস্ত এবং রোমাঞ্চকর আত্মজীবনীর ভঙ্গিতে। প্রকাশিত হলো ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। সত্যি কথা বলতে বাংলার মাটিতে অপরাধ ও তার দমনের একটা বিশ্বাসযোগ্য চিত্র প্রথম পেলাম এই বইটিতে। একে গোয়েন্দাকাহিনি কেউ বলবো না—কিন্তু তার সূত্রপাত তো বলতেই পারি।
সঠিক গোয়েন্দা কাহিনি পাবার জন্যে আমাদের আরও সাত-আট বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।১৮৯৬। তার আগেই অবশ্য আমরা ক্রাইম-এর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম বঙ্কিমচন্দ্রের বিভিন্ন রচনায়—ইংরেজি রাজমোহনস্ ওয়াইফ, কৃষ্ণকান্তের উইল প্রভৃতিতে। কিন্তু রীতিমতো রহস্য-রোমাঞ্চ নিয়ে প্রথম আবির্ভূত হলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এবং বাঁকাউল্লার দপ্তরের লেখক বরকতুল্লা (?)। দুজনকেই ব্রাকেটে প্রথম বলা যেতে পারে বই প্রকাশের দিক থেকে।
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৫৫-১৯১৭) আদরিণী (১৮৮৭), ডিটেকটিভ পুলিস-১ম কাণ্ড (১৮৮৭) পাহাড়ে মেয়ে (১৮৮৯), বনমালীদাসের হত্যা (১৮৯১) প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা হলেও তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন ‘দারোগার দপ্তর’ লিখে। এটি ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে (১ম সংখ্যা) ধারাবাহিকভাবে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে। ৪০-৪৮ পৃষ্ঠার এই পুস্তিকাগুলি বিভিন্ন নামে অবশ্য প্রকাশিতহত। যেমন ১৭৯ সংখ্যার নাম ছিল ‘প্রতিশোধ’। ১৫৯ সংখ্যার নাম ছিল ‘দীর্ঘকেশী’। ১৫৭ সংখ্যার নাম (১৪ বর্ষ ১৩১৩ব.) “ভীষণ হত্যা অর্থাৎ একটি স্ত্রীলোক হত্যার ভীষণ রহস্য”। ‘দারোগার দপ্তর’ এর প্রচার সংখ্যা ছিল প্রচুর। খুব লক্ষ্য করার ব্যাপার ইংল্যান্ডে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে শার্লক হোমস্-এর আবির্ভাবের মাত্র এক বছর পরে প্রিয়নাথের ‘ডিটেকটিভ পুলিস’ বাজার মাত করে দেয়। Indian Mirror পত্রিকা (২৫ জানুয়ারি ১৮৮৮) এর প্রশংসা করে লিখেছিল :
We have also read with attention another book composed by the same author, and styled. ‘Detective Police’. The book has also been written by following the story of a man who was actually tried by the High Court of Calcutta on the most serious charges and is up to date undergoing the term of punishment in the criminal jail of Alipore.
১৪নং হুজুরি মলস্ লেন বৈঠকখানা ‘দারোগার দপ্তর’ কার্যালয় থেকে (সুকুমার সেন জানিয়েছেন ১৬২ নং বহুবাজার স্ট্রিট এর কার্যালয় ছিল। তবে কি ঠিকানার পরিবর্তন হয়েছিল?) উপেন্দ্রভূষণ চৌধুরি কর্তৃক প্রকাশিত হয়ে ‘দারোগার দপ্তর’ খণ্ডে খণ্ডে আত্মপ্রকাশ করত।
এই সময়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর’। এর দারোগা মশায়ের নাম ছিল বরকাতুল্লা—‘শ্রীযুক্ত কোতোয়া, বরকতুল্লা নাম’। একদা সুকুমার সেন অনুমান করেছিলেন বইটির ‘সম্ভাব্য লেখক’ প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। এই অনুমান অবশ্য তথ্যসমর্থিত নয়। তবে বরকতুল্লা নামটি লোকমুখে বকাউল্লা থেকে বাঁকাউল্লায় পরিণত হয়েছিল সম্ভবত। এর কাহিনির মূল ছিলো ইংরেজি পরে বাংলায় রূপান্তরিত হয়ে ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর’, নাম পায়। বারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত এর প্রতিটি অধ্যায়ের নামকরণ ছিল লোমহর্ষক। এইভাবে গিরিশচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্র-প্রিয়নাথদের দিয়ে বাংলা সাহিত্যের পাঠক ফাঁড়ি-দারোগা-থানা-পুলিশের একটা রোমাঞ্চিত স্বাদ পেতে শুরু করেছিল। বাঁকাউল্লার দপ্তরের মধ্যেই নারীরা ডিটেকটিভ কাহিনীর অনিবার্য চরিত্রে পরিণত হতে শুরু করেছিল।
এই নারী-হত্যা-নারীহরণ-ডাকিনীবিদ্যা প্রত্যক্ষভাবে এসে গিয়েছিল ‘বিলাইতি’ রহস্যরস আর দেশি কাহিনির জারজসন্তান হিসেবে ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের (১৮৪২-১৯১৯) কলম মারফৎ। রেনল্ডসের Joseph Wilmot-এর ছায়া অবলম্বনে এই এক নূতন! আমার গুপ্তকথা (১৮৭০-৭৩) নামে ৮৭০ পৃষ্ঠার এই বিশাল খিচুড়িরসের বইটির অনুক্রম হিসেবে ১৮৭৩-৭৯ সালে ছয় বছর ধরে ‘আমার গুপ্তকথা।—আশ্চর্য!!!’ নামে ধারাবাহিক প্রকাশের পর তিনখণ্ডে মোট ৪৯৬ পৃষ্ঠার ‘তুমি কি আমার’ গ্রন্থনামে পরবর্তী বইটি প্রকাশিত হল। আর ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ৬৪৪ পৃষ্ঠার আর একটি ঢাউস ‘নবন্যাস’ প্রকাশিত হল ‘আর এক নতুন! হরিদাসের গুপ্তকথা’। আসলে এই ‘গুপ্তকথা’ প্রকাশ্য করেই ভুবনচন্দ্র খ্যাতিমান হয়ে পড়লেন। অবশ্য রেনল্ডস-এর বইটির বঙ্গানুবাদ দুখণ্ডে মোট (৭৪৫+৭৮৪) ১৫২৯ পৃষ্ঠায় প্রকাশকালে নাম ছিল ‘বিলাতি গুপ্তকথা’। কিন্তু প্রত্যক্ষ ডিটেকটিভ বইগুলির মধ্যে ছিল চার খণ্ড ‘মার্কিন পুলিস কমিশনার’ (১ম খণ্ড হারাধনের অনুসন্ধান : ১৮৯৬, পৃ. ৬৪, ২য় খণ্ড মেয়ে চুরি : ১৮৯৬, পৃ. ৬০;৩-৫ খণ্ড—অপূর্ব নারী ডিটেকটিভ : ১৮৯৬, পৃ. ২৬৮ এবং ৬ষ্ঠ খণ্ড জলবিবি : ১৮৯৬, পৃ. ৬০) গুপ্তচর (১৮৯৮), ইউজিন সু রচিত ওয়াণ্ডারিং জু অবলম্বনে রচিত চারখণ্ডে ঠাকুরবাড়ীর দপ্তর। অভিশপ্ত য়িহুদী (১৯০০), নন্দনকানন সিরিজের তৃতীয় বল্লরী চন্দ্রমুখী (১৯০২), ঐ সিরিজের মারী কোরেলির Sorrows of Satan এর বঙ্গানুবাদ ‘সন্তপ্ত সয়তান’ (১৯০৩-৪), সয়তানী (১৯০৬), ডিউক তারাচাঁদ (১৯২০), গোয়েন্দার গল্প (মাইকেল মোহনচাঁদ) প্রভৃতি। তাঁর খ্যাতির অন্য আর একটি কারণ ছিলো রেনল্ডস-এর বিখ্যাত Mysteries of Court of London-এর খণ্ডশ অনুবাদ ‘লণ্ডন রহস্য’ (১৯১২-১৪)।
এই ফাঁকে একজন কৃতী লেখকের কথা বলে নিই। ভদ্রলোক যে কেন আর রহস্য কাহিনি লিখলেন না জানিনা, লিখলে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হতো। কারণ তাঁর আগে ‘ভদ্রস্থ’ কোনো লেখক এপথে পা বাড়াননি। তিনি নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ‘তপস্বিনী’ উপন্যাস লিখে যিনি খ্যাতি-অখ্যাতি দুই-ই কুড়িয়েছিলেন। ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পটি ছিল ‘চুরি না বাহাদুরি’। রহস্যজনক গোয়েন্দা গল্পের যথার্থ স্রষ্টা তাকে বলা চলতো যদি তিনি এপথে থাকতেন। রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি, ভৌতিক আবেশ রচনা ও শেষাবধি কৌতূক নির্মাণে সিদ্ধহস্ত লেখক ট্রেনের মধ্যে দুই ভদ্রলোকের চুরি ও গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার একটা ঠাসবুনুনিতে পাঠকদের অভিভূত করে রাখেন। শেষ অবধি চোর টাকা পয়সা দিয়ে যায় এক অদ্ভুত কৌশলে। গল্পে হয়তো চমৎকারিত্ব নেই, কিন্তু আছে পরিবেশ রচনার কৃতিত্ব। প্রিয়নাথের ‘Detective Story গুলি বঙ্গভাষায় মৌলিক Sensational novel-রূপে পরিগণিত হইবার উপযোগী’ বলে সাহিত্য সমালোচক মন্তব্য করলেও এগুলিকে সাহিত্য পর্যায়ভুক্ত করা যাবে কিনা বলা মুস্কিল। সেদিক থেকে নগেন্দ্রনাথের রচনাটি সাহিত্যরসে টইটম্বুর।
সাহিত্যরস থাকুক না থাকুক গোয়েন্দারহস্য একালের পাঠকদের রুচি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল। আসলে নতুন স্বাদের এই রচনা পাঠককে অভিভূত করতে সমর্থ হচ্ছিল। শরচ্চন্দ্ৰ দেব (সরকার)-এর ক্রাইম কাহিনিগুলির বিক্রির হিসেব থেকে এটা সহজে বোঝা যায়। শরচ্চন্দ্র সরকার ‘সংকলিত গোয়েন্দা কাহিনি নামে ডিটেকটিভ গল্প মাঝে মাঝে প্রকাশিত হত। প্রত্যেক খণ্ড সপ্তাহে দুদিন করে সাময়িকপত্রের মতো ফর্মা ধরে বিক্রি হত। এ-সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞাপনের বয়ান থেকে জানতে পারি, “গোয়েন্দা কাহিনী” এপর্যন্ত প্রায় পাঁচ লক্ষ ফর্মা বিক্রীত হইয়াছে।’ শরচ্চন্দ্র তীর্থে বিভ্ৰাট অথবা গুমখুন নামে বইপত্রও লিখেছিলেন। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ‘ভাল ভাল লোকে ও যে গোয়েন্দা কাহিনি পড়তে শুরু করেছিলেন তার প্রমাণ লেখকেরা অনেক সময় এই সব ভালো ভালো লোককে বই উৎসর্গ করতেন। সুকুমার সেন এঁদের কয়েকজনের নাম জানিয়েছেন—মহেন্দ্ৰনাথ বিদ্যানিধি, নগেন্দ্রনাথ ঘোষ, কালীপ্রসাদ ঘোষ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাজনারায়ণ বসু, দামোদর মুখোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ বসু, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় কৃষ্ণ দেব, সারদাচরণ মিত্র প্রভৃতি। গল্পগুলির সঙ্গে বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে এ সময়ে আসতে শুরু করেছিল ভালো ভালো ছবির আকর্ষণও। গোয়েন্দা কাহিনি চরিত্র হয়ে প্রকাশিত হতে আরম্ভ করেছিল প্রথমযুগের ঠিক অব্যাবহিত পরেই। ‘রঘু ডাকাত’ ছিল এদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
এসময়ে অনেক অকিঞ্চিৎকর লেখকের আবির্ভাব ঘটেছিল, তাদের কথা আমরা তেমন করে বলতে চাইছি না।
।। 8।।
বাংলা ডিটেকটিভ উপন্যাসের দ্বিতীয় ভূবন নির্মাণে এগিয়ে এসেছিলেন তিন বিখ্যাত রহস্যরসিক পাঁচকড়ি দে, দীনেন্দ্রকুমার রায় এবং সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য। আর একজনেরও নাম করতে পারি হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।
পাঁচকড়ি দে (১৮৭৩-১৯৪৫) এই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। বঙ্গ-বিহার- উড়িষ্যা-আসাম পর্যন্ত তিনি খ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। ছোটোগল্প লেখার তেমন চেষ্টা তিনি করেন নি—কিন্তু ছোটো আকারের রহস্য কাহিনী লিখেছিলেন। পাঁচকড়ির খ্যাতি শুধু গল্পের প্লটের জন্য নয়, তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রথম দুটি গোয়েন্দাকে আমদানি করলেন ইংরেজি অনুকরণে। এঁরা হলেন দেবেন্দ্রবিজয় ও তাঁর সহায়ক-কাম-গুরু অরিন্দম। আগেই বলেছি পুলিশ ইন্সপেক্টর বাকেট সাহেব ছিলেন তাঁর আদর্শ।
শরচ্চন্দ্র দেবের জনপ্রিয়তার কথা আগেই বলে এসেছি। কিন্তু যার বই নিয়ে প্রথম কাড়াকাড়ি প’ড়ে গেল লাইব্রেরিতে লাইন পড়লো, সংস্করণের পর সংস্করণ ছাপা হতে শুরু করলো—তিনি পাঁচকড়ি দে। তাঁর হাতের কাছে আছে শার্লক হোমস আর আছে ‘যমুনা পত্রিকা’। যমুনা পত্রিকা মানে ফণীন্দ্রনাথ পাল আর তাঁর দাদা যতীন্দ্র পাল। দুই পাল-ভাই আর পাঁচকড়ি মিলে যেন বই লেখার প্রতিযোগিতায় নামলেন। যতীনবাবু লিখলেন কুলবধূ, গৃহিণী, ঘরের লক্ষ্মী, ধর্মপত্নী নাম দিয়ে অজস্র বই। তাঁর ভাই লিখলেন ইন্দুমতী, ছোট বৌ, বন্ধুর বৌ, মধুমিলন প্রভৃতি। আর বন্ধু পাঁচকড়ি বাজার সরগরম করে ফেললেন মায়াবী, মায়াবিনী, হত্যাকারী কে? নীলবসনা সুন্দরী দিয়ে। ‘যমুনা’ আর ‘জাহ্নবী’তে জোয়ার বইতে লাগল তাই নিয়ে। পাঁচকড়ি কলকাতার তিন জায়গায় তিনটে প্রাসাদ নির্মাণ করলেন। হবেই না বা কেন? ১০০,০০০ লক্ষাধিক বিক্রি হয় তাঁর বই—মায়াবী, মনোরমা, মায়াবিনী, পরিমল, জীবনস্মৃত রহস্য, হত্যাকারী কে? লক্ষ টাকা, হত্যারহস্য, ভীষণ প্রতিশোধ, ভীষণ প্রতিহিংসা, কালসর্পী, নীলবসনা সুন্দরী, গোবিন্দ রাম, রহস্য বিপ্লব, মৃত্যু বিভীষিকা, পরিতজ্ঞা পালন, বিষম বৈসূবন, জয় পরাজয়, নরবলি, মৃত্যুরঙ্গিনী, শক দুহিতা, হরতনের নওলা, সুহাসিনী, মরিয়ম প্রভৃতি। ‘বিশেষ সুবিধা—একত্রে ৫ কিংবা তদূর্ধ্ব মূল্যের এই উপন্যাস লইলে মাশুল লাগে না।’ উপরন্তু ‘সতী শোভনা’ সঙ্গে ফ্রি। সমস্ত বই অনুবাদিত হয়ে চলেছে হিন্দি, উর্দু, তামিল, তেলেগু, ‘কেনেদী’, মারাঠি, গুজরাটি, সিংহলি, ইংরেজি—দেশি-বিদেশি ভাষায়। ছাপা ভালো, ছবিও সব মনোরম। বই পড়ে কখনও হিতবাদী লেখে “রচনাচাতুর্য চরিত্র অঙ্কনে তিনি বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করিয়াছেন, কখনও Statesman লেখে- This is a sensational Hypnotic Novel in Bengali’ তাঁর জনপ্রিয়তা রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত ধাওয়া করেছে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজের বছরে (১৯১৩) পাঁচকড়ি তাঁকে উৎসর্গ করেছেন ‘জীবমৃত-রহস্য’–’শ্রদ্ধাস্পদ কবিবর/শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/মহাশয় করকমলেষু’। সুকুমার সেন অনুমান করেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ পড়ে তিনি ‘শ্রীমতী শোভনা’ লিখেছিলেন।
খুব মজার একটা কাকতলীয় ব্যাপার ঘটে গেলো পাঁচকড়ির শেষ জীবনে। হঠাৎ বন্ধু যতীন্দ্রনাথ পাল মারা গেলেন। যতীন্দ্রনাথ পাল সাহিত্যিক ধীরেন্দ্রনাথ পালের পুত্র। মাত্র ৩৬/৩৭ বছর বয়সের মধ্যেই ছোটোবড়ো মিলিয়ে প্রায় ২০০ খানা বইয়ের লেখক। তাঁর মৃত্যুতে পাঁচকড়ি ‘জীবনৃত’ হয়ে গেলেন। তাঁর রহস্যকাহিনির ‘উৎস’টি গেল শুকিয়ে। বন্ধুর মৃত্যুর পর আড়াই দশকের বেশি বেঁচে রইলেন তিনি—কিন্তু আর কোনো বই লিখতে পারলেন না। কু-লোকে নানা কথা বলে। বলেন—তাঁর রচনায় নাকি শরৎচন্দ্র সরকার, ধীরেন্দ্রনাথ পাল এবং রাজানারায়ণ বসুর পুত্র মনীন্দ্রনাথ বসুর হাতের গন্ধ পান তাঁরা।
।। ৫।।
পাঁচকড়ি দে-র জন্ম ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। বাবার নাম কেদারনাথ দে। বাল্য শিক্ষার সূচনা ভবানীপুরের একটি স্কুলে। খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনো করেছিলেন বলে বলা যায় না। দেখতে বেশ সুরুপুষ। শুধু রহস্য উপন্যাস লিখেই যা উপার্জন করে গেছেন তা তিন পুরুষে ভোগ করার উপযুক্ত। জোড়া সাঁকোর ৭নং শিবকৃষ্ণ দাঁ লেনে তাঁর একটি বইয়ের দোকান ছিল—”পাল ব্রাদার্স”। তিনি দে দোকান কেন পাল ব্রাদার্স হল ভাবতে গেলে মনে হয়- তিনি সম্ভবত ধীরেন্দ্রনাথ পাল যতীন্দ্রনাথ পালেদের বকলমা নিয়েছিলেন। একটি, ছাপাখানারও তিনি মালিক হন বাণী প্রেস।
পাঁচকড়ির জনপ্রিয়তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। হিতবাদী পত্রিকা সে সময়ে মন্তব্য করেছিলেন—”রচনা চাতুর্যে চরিত্র অঙ্কনে তিনি বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করিয়াছিলেন। আমরা দেওয়ান গোবিন্দরাম পাঠে প্রকৃতই পরম প্রীতি লাভ করিয়াছি। এই জনপ্রিয়তার মূলে ছিল তাঁর বিদেশি রোমাঞ্চ সাহিত্যের আত্মকরণ। তার প্রমাণ তিনি অনেক বইতে রেখে গেছেন। একটি বইয়ের পাদটীকায় তিনি লিখে গেছেন—”সঞ্জীবচন্দ্রই এরূপ একটা ক্ষমতাপ্রাপ্ত দেখিয়া কেহ কেহ বিস্মিত হইবেন সন্দেহ নাই। এই বিদ্যা অতিশয় ধৈর্য্য এবং বিপুল অধ্যবসায় সাপেক্ষ। ইহা আমাদিগের দেশীয় বিদ্যা নহে, ইউরোপীয়। এখন আমাদের দেশে অল্পসংখ্যক ব্যক্তি এই বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছেন। ইহার নাম (Ventroquilism) ভেন্ট্রোকুইলিজম। কেবল অপরের স্বর অনুকরণে সক্ষম হইলে ভেন্ট্রোকুইলিস্ট হইতে পারা যায় না—শব্দকে ইচ্ছামত স্থানে উত্তেজিত করা প্রয়োজন। আমরা বৃহৎ অট্টালিকা মধ্যে, প্রান্তরে, নদীতটে, অথবা কোন নির্জন স্থানে দাঁড়াইয়া কোন শব্দ করিবামাত্র চারিদিক হইতে প্রতিধ্বনি শুনতে পাই;যিনি নিজের স্বর অব্যক্ত রাখিয়া কেবলমাত্র সেই প্রতিধ্বনিতে ইচ্ছামত দূরে সুস্পষ্টরূপে উত্তেজিত করিতে পারেন, তিনি প্রকৃত ভেস্ট্রোকুইলিস্ট।’
তাঁর সময়ে উপন্যাস রাজত্বে সম্রাটের স্থানে আসীন বঙ্কিমচন্দ্র। সেকারণে ভাষার ভঙ্গিমায় তিনি বঙ্কিমচন্দ্রকে অনুসরণ করেছেন—’প্রভাত হইলে কাহার? বিষাদ, আনন্দ কাহার উত্তমর্ণের, তাহার একদিনের সুদ বাড়িল। আর কাহার, কয়েদী তস্করের; তাহার একদিনের মেয়াদ কমিল।’
আমরা এই খণ্ডে পাঁচকড়ি দে-রচিত পাঁচটি রহস্য উপন্যাসের সংকলন ঘটিয়েছি। পরবর্তী খণ্ডগুলিও একে একে প্রকাশিত হবে। সেখানে পাঁচকড়ির রচনা-বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা আরও কথা বলবো—যেমন তাঁর রচিত গোয়েন্দা চরিত্র, সহকারী গোয়েন্দা-চরিত্র, পুলিশের ভূমিকা ইত্যাদি প্রকাশ বিস্তারিতভাবে আলোচিত হবে। এখন সংকলিত উপন্যাস-পঞ্চকের মধ্যে তিনটি উপন্যাস সম্পর্কে সমসাময়িক কালের বক্তব্য তুলে দিয়ে তৎকালীন প্রতিক্রিয়ার কথা একালের পাঠকের সমীপে নিবেদন করি—
মায়াবিনী উপন্যাসের আগে তিনি ‘মনোরমা’ উপন্যাস লেখেন। এই মায়াবী যখন ‘গোয়েন্দার গ্রেপ্তার’ সাময়িকপত্রে ধারাবাহিকভাবে বের হচ্ছিল—তখন এর নাম ছিল ‘জুমেলিয়া’। তিনফর্মা ছাপা হয়েছিল, পরে বাকি অংশটি লিখে তিনি একেবারে বই আকারে যখন প্রকাশ করলেন—তখনই নাম বদলে হয় ‘মায়াবিনী’। তিনি চেষ্টা করতেন প্রতি পুনর্মুদ্রণে বইকে পরিমার্জিত করার। যেমন দ্বিতীয়বার ছাপার সময় মায়াবিনী উপন্যাসের ভূমিকায় লেখেন—’এখানে ইহার অনেকাংশ পরিবর্ধিত হইয়াছে, অনেকাংশ পরিত্যাগ করা গিয়াছে, এবং কোন কোন স্থান পুনর্বার লিখিত হইয়াছে। মুদ্রাঙ্কণকার্যও পূর্বাপেক্ষা সুসম্পাদিত করা গেল এবং তিনখানি ছবি দেওয়া হইল।’
মায়াবিনীর আগে যে ‘মায়াবী’ রহস্যন্যাস লেখা হয়েছিল—সেটি সম্পর্কে ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা ২ জ্যৈষ্ঠ ১৩১২ তারিখে মন্তব্য করেছিলেন—
“আমরা অন্যান্য অনেক লেখকের ও অনেক ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়িয়াছি কিন্তু তন্মধ্যে কোনখানি শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বাবু লিখিত উপন্যাসের ন্যায় হৃদয়গ্রাহী নয় নাই। হয়ত সেগুলিতে নানা রকমের বীভৎস ঘটনার দ্বারা কেবল একটা গল্প তৈয়ারী করা হইয়াছে মাত্র, কিন্তু বাঁধন নাই, গল্প সাজাইবার যে একটা কৌশল থাকা দরকার তাহাও নাই। নতুবা হয়ত কোন একখানি ইংরাজি বা ফরাসী উপন্যাসের ধারাবাহিক অক্ষম অনুবাদ। ‘মায়াবী’র ঘটনা সর্ব্বাঙ্গসুন্দর। ভাষাও গ্রন্থকারের নিজস্ব; যেমন প্রাঞ্জল তেমনি মধুর। গ্রন্থকারের গল্প সাজাইবার বেশ হাত আছে—রহস্য বিন্যাসের ক্ষমতাও অতুলনীয়। একবার পড়িতে আরম্ভ করিলে শেষ পৃষ্ঠার শেষ পংক্তি পর্যন্ত পাঠককে বিপুল আগ্রহে অগ্রসর হইতে হয়।”
এবার ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘নীলবসনা সুন্দরী’ বইটি সম্পর্কে কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন ‘জাহ্নবী’ পত্রিকায় প্রথম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যায় যে সমালোচনাটি করেছিলেন—তা উদ্ধার করে দিই—
“নীল বসনা সুন্দরী, হত্যাকারী কে? শ্রী পাঁচকড়ি দে প্রণীত। এই দুইখানি ডিটেকটিভ উপন্যাস আমরা স্বীকার করতে বাধ্য, আমরা সচরাচর ইংরাজি ও ফরাসীস্ লেখকদিগের রচিত যেসব ডিটেকটিভ উপন্যাস পাঠ করি, তদপেক্ষা সমালোচ্য উপন্যাস দুখানি কোন অংশে হীন নহে। ভাষা বেশ সরল, সুন্দর যেন জলধারার মত বহিয়া যাইতেছে। লেখক সুনিপুণ কৌশলে, মুন্সিয়ানার সহিত, ওস্তাদির সহিত পাঠককে গ্রন্থের প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত পাঠ করিতে বাধ্য করেন। কৌতূহল চরিতার্থ করিবার জন্য এক দুর্দমনীয় ব্যাকুলতা জন্মে। লেখকের পক্ষে ইহা কম বাহাদুরীর বিষয় নহে।”
‘বঙ্গভূমি’ পত্রিকা (১৯ মাঘ ১৩১১) পাঁচকড়ির সবচেয়ে সাড়াজাগানো রচনা ‘নীলবসনা সুন্দরী’ সম্পকে লিখেছিলেন :
“নীলবসনা সুন্দরী বঙ্গ সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ ঔপন্যাসিক শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি দে প্রণীত। ইনি সাহিত্য সমাজে সুপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা এই পুস্তক অত্যন্ত আগ্রহের সহিত পাঠ করিয়াছি। পূর্বে বাংলায় ভালো ডিটেকটিভ উপন্যাস ছিল না, শ্রীযুক্ত পাঁচকড়িবাবু বঙ্গীয় পাঠকগণের সে অভাব পূরণ করিয়াছেন। আমরা তাঁহার ডিটেকটিভ উপন্যাসের সমাদর করি। তাঁহার ন্যায় প্রতি পরিচ্ছেদে এমন নব নব কৌতূহল সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা কাহারও দেখি না। যদি এমন উপন্যাস পড়িতে চাহেন, যাহা একবার পড়িয়া তৃপ্তি হয় না, দশবার পড়িয়া দশ জনকে শুনাইতে ইচ্ছা করে তবে এই ‘নীলবসনা সুন্দরী’ পাঠ করুন। পড়িতে পড়িতে যেন এই উপন্যাস চুম্বকের আকর্ষণে পাঠককে টানিয়া লইয়া যায়। ঘটনা কৌতূহলজনক, ভাষাও তেমন সরল ও তরল, যেন নির্ঝরিণীর ন্যায় তরতর বেগে বহিয়া যাইতেছে। শব্দচ্ছটাও অতি সুন্দর। বঙ্গ সাহিত্যে গ্রন্থকারের ডিটেকটিভ উপন্যাস যথেষ্ট সমাদর লাভ করিবে।”
“হত্যাকারী কে?” (দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯০৭) সম্পর্কে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় (৩ বর্ষ ১ সংখ্যা) বিখ্যাত সমালোচক চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন :
“হত্যাকারী কে? পাঁচকড়ি দে প্রণীত একখানি ডিটেকটিভ গল্প এবং সে হিসাবে ইহাতে বিবৃত ঘটনার সমাবেশ এবং অনুসন্ধানের প্রণালীতে কারিকুরীর পরিচয় পাওয়া যায়। অক্ষয়বাবু যে একজন সুদক্ষ ডিটেকটিভ ইহা গ্রন্থকার দেখাইতে সমর্থ হইয়াছেন। ভাষাও প্ৰশংসার্হ।”
আর ১৯ ভাদ্র ১৯১০ তারিখের ‘বসুমতী’ মন্তব্য করেছিলেন—
“গল্পটি বেশ হইয়াছে, গল্পটি আদ্যোপান্ত পাঠ করিবার পর সত্য সত্যই জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করে হত্যাকারী কে? ইহাতে লেখকের বাহাদুরী প্রকাশ পাইয়াছে। যে পাঠকগণ ডিটেকটিভ গল্প পাঠ করিতে বিশেষ উৎসুক, এই পুস্তকখানি তাঁহাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগিবে।”
পাঁচকড়ির বই ইংরেজির মতও বহু ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে তাঁর জনপ্রিয়তার পরিসরকে বহুধাবিস্তৃত করেছিল। সেই প্রবাহকে একালেও বহমান রাখার জন্যে আমাদের খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশের এই আয়োজন।
দোলযাত্রা ১৪১৬
বারিদবরণ ঘোষ
সূচি
- নীলবসনা সুন্দরী
- মায়াবিনী
- মায়াবী
- হত্যা রহস্য
- হত্যাকারী কে
Partha Mukherjee
Pans
Debasish Masat
I like to download পাঁচকড়ি দে রচনাবলী