পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ – রজতকান্ত রায়
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৯৪
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: প্রবীর সেন
.
সুচরিতা-র জন্য
.
ভূমিকা
এই গ্রন্থ রচনায় আমি যাঁর কাছে অশেষ ভাবে ঋণী তিনি আমার প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্রাবস্থার শিক্ষক অশীন দাশগুপ্ত। অধ্যাপক সুশীল চৌধুরী তাঁর অপ্রকাশিত গবেষণা পত্র দিয়ে উপকৃত করেছেন। প্রেসিডেন্সী কলেজের লাইব্রেরীর সহকর্মীরা সর্বতোভাবে এই গ্রন্থ রচনায় সাহায্য করেছেন। সে সহায়তা ব্যতীত এই গ্রন্থ রচনা সম্ভব হত না।
.
সূচনা
সুজা খাঁ নবাবপুত সরফরাজ খাঁ।
দেয়ান আলমচন্দ্র রায় রায় রায়াঁ॥
ছিল আলিবর্দ্দি খাঁ নবাব পাটনায়।
আসিয়া করিয়া যুদ্ধ বধিলেক তায়॥
তদবধি আলিবর্দ্দি হইল নবাব।
মহাবদজঙ্গ দিল পাতসা খেতাব॥
—কবি ভারতচন্দ্র রায়, অন্নদামঙ্গল,
গ্রন্থ সূচনা।
.
ছোট ছোট তেলেঙ্গাগুলি লাল কূর্তি গায়।
হাঁটু গেড়ে মারে তীর মীর মদনের গায়॥
নবাব কান্দে সিপাই কান্দে আর কান্দে হাতী।
কলকাতায় বসে কান্দে মোহনলালে পুতি॥১
দুধে ধোয়া কোম্পানির উড়িল নিশান।
মীরজাফরের দাগাবাজিতে গেল নবাবের প্রাণ॥
—মোক্ষদারঞ্জন ভট্টাচার্য, ‘নিরক্ষর কবি ও গ্রাম্য কবিতা,’ সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৩ : ১৯৩-২৩৬ পৃঃ।
.
পলাশীর গ্রাম্য কবিতার সঙ্গে রায় গুণাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যের সূচনা মিলিয়ে পড়লে পাঠকের চোখে একটি কথা ফুটে উঠবে। তা হল এই যে পলাশীর ষড়যন্ত্র কোন অভূতপূর্ব ঘটনা নয়। ঐতিহাসিকেরা যে আমলকে নবাবী আমল বলে চিহ্নিত করেন, সে আমলে এ রকম ষড়যন্ত্র দু’তিন বার ঘটেছিল। যে বছর নাদির শাহ দিল্লীতে চড়াও হন সে বছর কেন্দ্রীয় মোগল শাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সিরাজউদ্দৌলাহ্র মাতামহ আলিবর্দি খান ষড়যন্ত্র করে মুর্শিদাবাদে নবাব হয়ে বসেন। তখন ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দ। সুবাহ্ বাংলা বিহার ওড়িষার মোগল সুবাহ্দার বা নাজিম সরফরাজ খান মুর্শিদাবাদের তখ্ৎ মোবারকে আসীন। আলিবর্দি খান তাঁর অধীনে বিহার সুবাহ্র নায়েব নাজিম। আলিবর্দির সঙ্গে মুর্শিদাবাদের ত্রয়ী—হাজ আহমদ (তাঁর নিজের দাদা), জগৎ শেঠ, এবং রায় রায়ান আলম চন্দ—তলে তলে যোগসাজস করলেন। বছর যেতে না যেতে দেখা গেল দেশের সার্বভৌম মোগল বাহশাহ মহম্মদ শাহের অপেক্ষা না রেখেই আলিবর্দি খান এই তিন রাজপুরুষের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে গদি দখল করে বসেছেন।
আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পরেও তাঁর নাতি সিরাজউদ্দৌলাহ্র বিরুদ্ধে ঐ রকম একটি ষড়যন্ত্র পাকিয়ে ওঠে কিন্তু সে চক্রান্তটি তখনকার মত ব্যর্থ হয়। এ বারের নায়ক ছিলেন পূর্ণিয়ার ফৌজদার শওকৎ জঙ্গ। বাদশাহের ফারমান বলে তিনিই আইনতঃ সুবাহ্ বাংলার নাজিম। তাঁকে তলে তলে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলেন জগৎশেঠ, মীর জাফর ইত্যাদি মুর্শিদাবাদের রাজপুরুষবৃন্দ। এই চক্রটি ব্যর্থ হবার পর তবেই তাঁরা ইংরাজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতে অগ্রসর হন। যে অভিসন্ধি ও মনোবৃত্তি নিয়ে মুর্শিদাবাদের রাজপুরুষরা পূর্বে দু দুবার ষড়যন্ত্র করেছিলেন এ বারেও সে মনোবৃত্তির সঙ্গে কোনো তফাৎ ছিল না। ইংরেজদের হাতে রাজ্যভার তুলে দেবার জন্য তাঁরা ষড়যন্ত্র করেন নি। ইংরেজরাও রাজ্য দখল করবার পরিকল্পনায় ষড়যন্ত্রে হাত দেয় নি। তবু গণনার বহির্ভূত ভাবে সুবাহ্ বাংলা বিহারে যে ‘ইন্কিলাব’২ বা উথালপাথাল সূচিত হল, ইংরেজ সাম্রাজ্য স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত তার অগ্রগতি রোধ হল না।
পলাশীর যুদ্ধের পিছনে ছিল মুর্শিদাবাদের রাজপুরুষের ষড়যন্ত্র। সে চক্রান্তের সঙ্গে সুবাহ্ বাংলার জনজীবনের কোনো যোগ ছিল না। এর পিছনে কোনো গভীর নিহিত সামাজিক শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠেনি—এই ষড়যন্ত্রের পিছনেও নয়, তার পূর্ববর্তী দুটি ষড়যন্ত্রের পিছনেও নয়। অন্য দুটির মতো এটিও রাজকীয় ষড়যন্ত্র। এরও পেছনে মোগল ওমরাও৩ বা অভিজাত মহলের কলকাঠি আন্দোলন। তফাতের মধ্যে—এবার ওমরাও মহল কলকাঠি রূপে ব্যবহার করলেন বিহারের নায়েব নাজিম বা পূর্ণিয়ার ফৌজদারকে নয়, পরন্তু কলকাতার ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে। ওমরাও-দের দুর্যোগের সূত্রপাত হল এইখানে। পনের বছর যেতে না যেতে—১৭৭২ খ্রীস্টাব্দের মধ্যেই —তাঁরা ক্ষমতা থেকে ধাপে ধাপে চ্যুত হলেন। কিন্তু তাঁরা ষড়যন্ত্র করেছিলেন ক্ষমতার জন্য, ক্ষমতা থেকে চ্যুত হবার জন্য নয়।
এখন প্রশ্ন হল, এই ক্ষমতাবান্, ক্ষমতালিপ্সু রাজপুরুষরা চক্রান্ত করলেন কেন? অল্প কিছু লোক নবাব বাড়ির মধ্যে ষড়যন্ত্র করতেই পারে—সেটা সে বাড়ির লোকেদের স্বভাব। কিন্তু তৎকালীন সমাজের কাঠামো থেকে এই সব রাজকীয় কলকাঠি নাড়ানোর ব্যাপার স্যাপার সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেখলে চলবে না। সমাজের যে সারিগুলি সুবাহ্ বাংলাতে ক্ষমতায় আসীন ছিল, গত চল্লিশ বছর ধরে সেই সব সারিতে কতকগুলি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের আমলে মোগল সাম্রাজ্যে কেন্দ্রীভূত শাসন বজায় ছিল। তখনকার মোগল শাসক শ্রেণী ও তাঁর মৃত্যুর পরবর্তীকালীন মোগল শাসক শ্রেণী মূলতঃ এক হলেও নানা প্রকারে ভিন্ন বটে। মুর্শিদাবাদের মোগল ওমরাওরা দিল্লী থেকে যত বিচ্ছিন্ন হতে লাগলেন, বাংলার দেশীয় ও বাণিজ্যিক শক্তিগুলির উপর তাঁদের নির্ভরতা তত বাড়তে লাগল। মোগল যুগের ঢাকা দরবারে সর্বক্ষমতার অধিকারীবৃন্দ ছিলেন মনসবদারান্। জমিদার ও সওদাগররা তখন তাঁদের মুখাপেক্ষী ছিলেন। মুর্শিদাবাদ দরবারে এ সম্পর্ক পাল্টে গেল। সেখানে জমিদার ও সওদাগরদের বিশিষ্ট স্থান নির্দিষ্ট হওয়ায় দরবারের চেহারা আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছিল। পলাশীর যুদ্ধের চল্লিশ বছর আগে থাকতে মনসবদার, জমিদার, সওদাগর ইত্যাদি যে সকল কায়েমী স্বার্থ গজিয়ে উঠছিল, তাদের সঙ্গে ওলন্দাজ, ইংরাজ, ফরাসী ইত্যাদি বিদেশী কোম্পানিগুলিকেও ধরতে হবে।৪ বিশেষ করে কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুর্শিদাবাদ দরবারে উত্তরোত্তর প্রভাবশালী হয়ে উঠছিল। নবাব আলিবর্দি খান এই সব কায়েমী স্বার্থগুলিকে স্বীয় প্রতিভাবলে বশে রাখতে পেরেছিলেন এবং বর্গিদের হটাতে এই সব প্রভাবশালী শক্তির সহযোগিতা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর নাতি সিরাজউদ্দৌলাহ্ অধৈর্য তরুণ। নবাব হয়ে তিনি ঐ সব কায়েমী স্বার্থগুলির উপর নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে তৈরি হলেন। বিদেশী কোম্পানিগুলিকেও ছাড়লেন না—তারা যাতে বাধ্য আরমানী সওদাগরদের মতো মোগল শাসনের আওতায় থাকে সে জন্য তাদের কেল্লাগুলি ভুঁয়ে ফেলে দিতে অগ্রসর হলেন। ইংরেজদের কলকাতা থেকে খেদিয়ে দিয়ে তিনি শহরের নতুন নামকরণ করলেন আলিনগর।
নতুন নবাবের গণনায় ভুল হল। সুবাহ্ময় রটে গেল তিনি জগৎশেঠকে থাপ্পড় মেরেছেন, আর মীরজাফর, রায় দুর্ল্লভ ইত্যাদি বড়ো বড়ো মোগল মনসবদারকে নিজের ইয়ার মোহনলালের বাড়ি সেলাম বাজাতে যেতে বলেছেন। আরো শোনা গেল নবাব হবার আগেই তিনি নাকি রানী ভবানীর মেয়ে তারাসুন্দরীকে হরণ করতে গিয়ে বিফল হন, আর নবাব হয়ে তিনি নাকি বিষ্ণুপুরের রাজার বিরুদ্ধে ফৌজ পাঠাবার তোড়জোড় করছেন। মনসবদার, জমিদার, সওদাগর, মায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলি পর্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠায় তখ্ৎ মোবারক টলে উঠল।
সিরাজউদ্দৌলাহ্র বুঝতে এইখানে ভুল হয়েছিল যে সুবাহ্ বাংলায় নিরঙ্কুশ রাজক্ষমতার দিন চলে গেছে। শওকৎ জঙ্গকে দমন করবার অভিযানে বেরোতে গিয়ে তিনি জগৎ শেঠের কাছে তিন কোটি টাকা দাবি করেছিলেন। সে টাকা চেয়েও তিনি পাননি এটা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় ব্যাপার। বড়ো বড়ো লোকদের কাছ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা চাইলেই যে পাওয়া যায় না এ থেকে তাঁর হুঁশ হওয়া উচিত ছিল যে নিরঙ্কুশ রাজক্ষমতার দিন চলে গেছে। জগৎশেঠকে থাপ্পড় মারলেও সে দিন আর ফিরবে না, এই কথাটা তিনি আস্তে আস্তে বুঝতে পারলেন। কিন্তু যখন তাঁর হুঁশ হল তখন বড়ো দেরি হয়ে গেছে।
ততদিনে ইংরেজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের মোগল রাজপুরুষরা চক্র গঠন করে ফেলেছেন। তলে তলে ঐ রাজপুরুষদের সাহায্য করছেন দেশের বড়ো বড়ো জমিদার। ইংরেজ ফৌজ এসে কলকাতা পুনর্দখল করেছে। তারপর চন্দননগর থেকে ফরাসীদের তাড়িয়ে দিয়ে হুগলী বন্দরের বাইরে বিস্তৃত ময়দানে তাঁবু বিছিয়ে বসেছে।
এই ফৌজ এসেছিল মাদ্রাজ থেকে। এমনিতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে এত টাকা বা ক্ষমতা ছিল না যে নবাবের সঙ্গে লড়াই করে। প্রথম বার নবাব তাদের অনায়াসে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার ইতিহাসের অদৃষ্টপূর্ব চক্র আবর্তনে ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সপ্ত বর্ষের যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় ইংল্যাণ্ডের রাজার নৌবহর ও ফৌজ মাদ্রাজে এসে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মদৎ করতে হাজির ছিল। মাদ্রাজে হাজির ওই ফৌজ ফরাসী বন্দর পণ্ডিচেরী দখল করা স্থগিত রেখে একেবারে হুগলী নদী বেয়ে উঠে এল। বিপদে দিশাহারা হয়ে নবাব শেষ মুহূর্তে মীর জাফর, জগৎশেঠ ও অন্যান্য রাজপুরুষদের তোয়াজ করতে লাগলেন। কিন্তু তখন বড়ো দেরি হয়ে গেছে। নবাবের উপর আর আস্থা স্থাপন করা যায় না। মীর জাফর, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র—এঁরা মনসবদার, সওদাগর ও জমিদার শক্তির প্রতিভূরূপে আস্থা স্থাপন করলেন কর্নেল ক্লাইভের উপর। এই ইংরেজ সেনাপতি তাঁদের কাছে সাবিৎ জঙ্গ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল মনসব ও খেতাব দিয়ে সাবিৎজঙ্গকে মোগল শাসনের আওতায় টেনে আনা যাবে। তখৎ মোবারকে বসবেন নতুন নবাব, পূর্ববৎ মোগল শাসন চলতে থাকবে, সাবিৎজঙ্গ যথাকালে বিদায় নেবেন। কিন্তু তাঁদের গণনাতেও ভুল হল।
টীকা
১। মোহনলালের পুতি বা বেটি কে তা ইতিহাসে নির্দিষ্ট নেই। গোলাম হোসেন খান প্রণীত Seir Mutaqherin গ্রন্থের হাজি মুস্তফা কৃত ইংরেজী অনুবাদের মুস্তফা কৃত পাদটীকা থেকে জানা যায় সিরাজউদ্দৌলাহ্কে নিজের পরমাসুন্দরী স্বচ্ছ্গ্রীবা ক্ষীণতটী ভগিনীকে উপহার দিয়ে কাশ্মীরী মোহনলাল স্বীয় পদবৃদ্ধি করেছিলেন। এই কাশ্মীর সুন্দরীর ওজন ছিল বাইশ্ সের মাত্র। পলাশীর যুদ্ধের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ্ ও রাজা মোহনলাল নিহত হলে এই তন্বীর কি পরিণতি হয় জানা যায় না। উপরোক্ত কবিতার তাঁকে নির্দেশ করা হয়ে থাকতে পারে। নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।
২। আজকাল ‘ইনকিলাব’ বলতে বুঝায় বিপ্লব বা revolution। সে যুগে ফার্সি ইতিহাস ও কবিতাতেও তাই—তবে অর্থ ভিন্ন। অশুভ উটল পালট।
৩। আমীর—বহুবচনে ওমরাও। Mughal nobility.
৪। P. J. Marshall, Bengal: The British Bridgehcad Eastern India, 1740-1828 (Cambridge, 1987) (pp. 74-77.)
Leave a Reply