পরমপদকমলে (অখণ্ড) – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
পরমপদকমলে (অখণ্ড) – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
উদ্বোধন কার্যালয়
কলকাতা
প্রকাশক – স্বামী নিত্যমুক্তানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ, বাগবাজার উদ্বোধন কার্যালয়
রামকৃষ্ণ মঠ, বেলুড় মঠের সঙ্ঘাধ্যক্ষ
প্রথম সংস্করণ – উদ্বোধন বাটীতে শ্রীশ্রীমায়ের শুভ পদার্পণ তিথি
৫ জুন ২০০০
.
প্রকাশকের নিবেদন : দ্বিতীয় সংস্করণ
‘পরমপদকমলে’-র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলো। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ৫ জুন ২০০০ উদ্বোধন-বাটীতে শ্রীশ্রীমায়ের শুভ পদার্পণ তিথিতে। অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার ফলে গত ১১ মাসের মধ্যেই গ্রন্থটির নয়টি পুনর্মুদ্রণ হয়ে গেছে। প্রথম প্রকাশ সহ গত ১১ মাসে ১০টি মুদ্রণে গ্রন্থটির ২৮,৬০০ কপি মুদ্রিত হয়েছে।
গ্রন্থটি প্রকাশের পর ‘উদ্বোধন’-এ জ্যৈষ্ঠ ১৪০৮ সংখ্যা পর্যন্ত ‘পরমপদকমলে’ বিভাগে লেখকের আরো ১৩টি রচনা প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলি বর্তমান সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রথম সংস্করণে গ্রন্থটি ছিল ৪৯৬ পৃষ্ঠার। দ্বিতীয় সংস্করণে গ্রন্থটির কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫৬০ পৃষ্ঠা
আশাকরি, ‘পরমপদকমলে’-র দ্বিতীয় সংস্করণটি পাঠক-পাঠিকাদের কাছে আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
স্বামী সত্যব্রতানন্দ
উদ্বোধন-বাটীতে শ্রীশ্রীমায়ের শুভ পদার্পণ তিথি
২৬ মে ২০০১
.
প্রকাশকের নিবেদন : প্রথম সংস্করণ
একালের বাঙলা সাহিত্যের এক দিকপাল ব্যক্তিত্ব সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। প্রায় ষোল বছরের অধিককাল তিনি ‘উদ্বোধন’-এ লিখছেন। গত বার বছর ধরে প্রায় প্রতি সংখ্যায় উদ্বোধন’-এর ‘পরমপদকমলে’ বিভাগে তিনি নিয়মিত লেখক। তাঁর অননুকরণীয় শৈলী, উপস্থাপন এবং অনুভূতির গুণে বিভাগটি ‘উদ্বোধন’-এর পাঠকসাধারণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কয়েক বছর আগে অনিবার্য ব্যক্তিগত কারণে ‘উদ্বোধন’-এর পরপর দুটি সংখ্যায় তিনি লিখতে পারেননি। সেসময় দেশ-বিদেশ থেকে ‘উদ্বোধন’-এর বহু পাঠক (যাঁদের মধ্যে অবাঙালী পাঠকও ছিলেন) উদ্বিগ্ন হয়ে ‘উদ্বোধন’-সম্পাদকের কাছে অনুযোগ জানাতে শুরু করলেন—“কেন এমনটি হলো? কেন সঞ্জীববাবুর লেখা পরপর দুটি সংখ্যায় পাচ্ছি না?” ‘উদ্বোধন’-এর পাঠকবর্গের কাছে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এমনই জনপ্ৰিয়!
‘উদ্বোধন’-এর সঙ্গে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের যোগাযোগ প্রায় অর্ধ-শতাব্দীর। পাঁচের দশকে যখন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ ‘উদ্বোধন’-এর সম্পাদক ছিলেন, সেসময় ‘উদ্বোধন’-এর সঙ্গে তাঁর একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেসময় তিনি ‘উদ্বোধন’-এর এক নিষ্ঠাবান স্বেচ্ছাসেবক-রূপেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের পর ‘উদ্বোধন’-এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নানা কারণে শিথিল হয়ে যায়। স্বামী অজজানন্দের সময় থেকে ‘উদ্বোধন’-এর সঙ্গে তাঁর পুনরায় যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সে-যোগাযোগ নিবিড় হওয়ার আগেই তাতে ছেদ পড়ে। তারপর বিগত বার বছর ধরে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে ‘উদ্বোধন’-এর ‘পরমপদকমলে’ বিভাগের নিয়মিত ও জনপ্রিয় লেখক হিসাবে ‘উদ্বোধন’-এর সঙ্গে তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ১৩১-টি রচনার অধিকাংশই ‘উদ্বোধন’-এর বিভিন্ন সংখ্যায় ‘পরমপদকমলে’ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছিল। দু-তিনটি প্রকাশক তাঁর এবং ‘উদ্বোধন’-এর অনুমতি নিয়ে কিছু কিছু লেখা সঙ্কলন করে ইতিপূর্বে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই গ্রন্থস্বত্ব ছিল লেখকের নিজের। এবার তিনি সব লেখাগুলিকে একত্রে সঙ্কলিত আকারে উদ্বোধন কার্যালয় থেকে ‘পরমপদকমলে’র একটি অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশের জন্য আমাদের কাছে প্রস্তাব করেন। আমরা সানন্দে সেই প্রস্তাবে সম্মত হই। তারই ফসল বর্তমান গ্রন্থটি। আমরা জানি, ‘উদ্বোধন’-এর লক্ষ লক্ষ পাঠক বর্তমান গ্রন্থটি পেয়ে অত্যন্ত খুশি হবেন। আমরা আনন্দিত যে, উদ্বোধন-বাটীতে শ্রীশ্রীমায়ের একানব্বইতম পদার্পণ তিথি উৎসবে গ্রন্থটি আমরা প্রকাশ করতে পারলাম।
শ্রীদুর্গাপদ ঘোষের অর্থানুকুল্যে বর্তমান গ্রন্থটি অপেক্ষাকৃত সুলভ মূল্যে আমরা পাঠকসাধারণের কাছে তুলে দিতে সমর্থ হয়েছি। সেজন্য শ্রীদুর্গাপদ ঘোষকে আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী এবং স্বামী বিবেকানন্দের পরম অনুরাগী ভক্ত। ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁকে ছোট করতে চাই না। শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী এবং স্বামী বিবেকানন্দের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি দীর্ঘকাল সুস্থ দেহে ভক্তসাধারণের কাছে তাঁদের রসময় অমৃতকথা পরিবেশন করে চলুন। আশা করি, উদ্বোধন কার্যালয় প্রকাশিত ‘পরমপদকমলে’ গ্রন্থটির অখণ্ড সংস্করণ সকলের কাছে সমাদৃত হবে।
স্বামী সত্যব্রতানন্দ
১ জুন ২০০০
.
লেখকের নিবেদন
এ এক ধরনের সংলাপ। বেশ কিছুকাল বেঁচে থাকার পর ভোগজর্জর বস্তুজগতের অন্তঃসারশূন্যতায় মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন বাঁচাটা হয়ে দাঁড়ায় একধরনের কসরত। আর ঠিক সেই বয়সেই মানুষ কথা বলে ঈশ্বরের সঙ্গে, ঈশ্বর-মানবের সঙ্গে। সুখ-দুঃখের, মান-অভিমানের যত কথা। যে-মহামানব তার প্রাণের মানুষ, তিনি সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁর জীবন ও সাধনার বাণীদীপ হাতে। বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিতে চান—কেন এসেছিলে? কে তুমি? কি হেতু এলে? আপনারে ভুলে গেলে! এই মহাপ্রশ্ন নাড়াচাড়া করতে করতে অতৃপ্তি আর গ্লানি নিয়ে একদিন আমাদের চলে যাওয়া। এই নাকি জীবনের আনন্দ! নেশা, পেশা, অসুখ, আরোগ্য, আবার অসুখ, ভাবনা, দুর্ভাবনা, অভাব, অভিযোগ, জয়-পরাজয় নিয়ে খানিক মেতে থাকার নাম জীবন। কিছু বাঁচা হলো শুধুই ক্ষয়। শুধুই দিয়ে যাওয়া, জীবন, যৌবন, ধন-মান। আর কিছু বাঁচা হলো অক্ষয়। অভিজ্ঞতার পর অভিজ্ঞতায় আত্মবোধের বিকাশ। প্রতিদিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠা। শুধুই প্রাপ্তি। অর্থ নয়, বিত্ত নয়, চেতনায় সমৃদ্ধি। সেই জীবনই বলতে পারে—যা নিয়েছ তারো চেয়ে বেশি দিয়েছ আমায়। এমন কিছু অক্ষয় সম্পদ তুমি দিয়েছ যা সমস্ত বৈষয়িক আনন্দকে ম্লান করে দেয়। সে-আনন্দ হলো পরমানন্দ। নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত পথের পথিক করেছ আমায়। “ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং, মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ।।”
বিশ্বস্ত এক সারমেয়ের মতো তাঁকে অনুসরণ
তিনি প্রভু, আমি দাস, তিনি বন্ধু, আমি সখা
তিনি পিতা, মাতা, প্ৰেমাস্পদ।
কিছুই হয়তো পাব না, এমন কিছু যা মানুষকে ডেকে দেখানো যায়! তবু অগ্নি-সংস্পর্শ লোভী পতঙ্গের মতো উড়ে যাওয়া। ওরে! তুই মরবি। তা হোক, লক্ষ জন্মের চেয়েও সে-মৃত্যু মহান
“শোতে শোতে ক্যা করো ভাই, ওঠ, ভজো মুরার।
অ্যায়সে দিন আতে হেঁয়, লম্বা পা পসার।।”
‘উদ্বোধন’-এর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঠাকুরের কৃপায়। তিনি যেমন বলতেন—কেউ এক পা এগোলে তিনি একশ পা এগিয়ে আসেন। ১৯৫৪ সালে একটি প্রবন্ধ হাতে আমার ‘উদ্বোধন’-এ প্রবেশ। তারপর জীবনের ঘুরপথে ঠিকরে যাওয়া। তখন বুঝিনি, লাটাই কার হাতে, কে ওড়ায় ঘুড়ি!
‘পরমপদকমলে’ শিরোনামে এই রচনাগুলি দীর্ঘদিন ধরে ‘উদ্বোধন’-এ প্রকাশিত হচ্ছে, ঠাকুরের অসীম কৃপায়। এই লেখা আমার পূজা। ‘উদ্বোধন’ আমার কাছে শুধুমাত্র একটি পত্রিকা নয়, ‘উদ্বোধন’ আমার ‘মন্দির’। এই মন্দিরে সদা সর্বদা আত্মবিকাশের যজ্ঞ হচ্ছে।
‘পরমপদকমলে’র অনেক লেখা ইতিমধ্যেই ছোট ছোট বইয়ের আকারে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন প্রকাশনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেইসব গ্রন্থের স্বত্ব আমারই, প্রকাশকদের নয়।
শ্রদ্ধেয় স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজী এক অসাধারণ যাজ্ঞিক। অসীম দিগন্তে তাঁর উদার বিচরণ। প্রেমিক সাধক আবার কঠোর প্রশাসক। তাঁর মাধ্যমে উদ্বোধন কার্যালয়ের অধ্যক্ষ মহারাজকে অনুরোধ করেছিলাম—বিভিন্ন গ্রন্থে প্রকাশিত বিক্ষিপ্ত এই রচনাগুলি, যাদের অধিকাংশই ‘উদ্বোধন’-এ প্রকাশিত, একত্রিত করে উদ্বোধন কার্যালয় থেকে গ্রন্থাকারে একটি অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশিত হলে বেশ হয়। জীবনপ্রদীপের তেল ফুরিয়ে এল। শিখা নিবু নিবু। স্মৃতিতে পঞ্চাশের কলকাতা। চুয়ান্ন-পঞ্চান্নর ‘মায়ের বাড়ী’। ‘উদ্বোধন’-এর সম্পাদকের আসনে স্বামী শ্রদ্ধানন্দজী। এক যুবকের ভীরু প্রবেশ ঠাকুর, মা, স্বামীজীর অর্গলমুক্ত আলোর জগতে।
ভাবতেও পারিনি তাঁরা আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করবেন! বর্তমান গ্রন্থটি সেইসমস্ত লেখার সম্পূর্ণ একটি অখণ্ড সঙ্কলন— ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের পরমপদকমলে নিবেদিত সুচারু ‘উদ্বোধন সংস্করণ’।
বেলুড় মঠের পরমশ্রদ্ধাভাজন কর্তৃপক্ষ, উদ্বোধন কার্যালয়ের অধ্যক্ষ শ্রদ্ধেয় স্বামী সত্যব্রতানন্দজী, ‘উদ্বোধন’-এর সম্পাদক শ্রদ্ধেয় স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজী আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। উদ্বোধন কার্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মিগণকে জানাই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
পরিশেষে শ্রীরামকৃষ্ণলোকে প্রয়াত স্বামী শ্রদ্ধানন্দজীকে নিবেদন—মহারাজ! সেই ‘মানুষ’ প্রবন্ধটি নিয়ে যে-যুবক একদা প্রবেশ করেছিল ‘উদ্বোধন’-এ আপনার দপ্তরে, আপনি তাকে বলেছিলেন অনুচ্চারে-এস, ঠাকুর, মা, স্বামীজীর শ্রীচরণে তোমাকে নিবেদন করি—তুমি মানুষ হও। জানি না কি হয়েছি! তার খাতায় আপনি লিখে দিয়েছিলেন—
“বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ।
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীত্বা বিদ্যয়াহমৃতমতে।।” (ঈশোপনিষদ্, ১১) আমার তীর্থের দুটি ঘাট—স্বামী শ্রদ্ধানন্দজী, স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজী। এই দুই ঘাটের মধ্যে আমার সন্তরণ। প্রণাম।।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১ মে ২০০০
.
Leave a Reply