পঁচিশটি গল্প – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
গ্রন্থন – সমীর চট্টোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ : এপ্রিল ২০১৬
প্রচ্ছদ : গৌতম মাঝি
বর্ণ সংস্থাপন : অরিন্দম দাশগুপ্ত
স্বত্ব : ইতি গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশক : গৌতম দাশ
পরম্পরা প্রকাশন
.
যাঁরা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পড়তে ভালোবাসেন
.
হে প্রিয় পাঠক
সাহিত্যের ইতিহাস খুব দুর্জ্ঞেয়। কী বিশ্বসাহিত্যে কী বাংলা সাহিত্যে। একজন মান্য লেখক সফল ঔপন্যাসিক এবং অসামান্য গল্পকারও—গদ্যসাহিত্যের দুই ধারাতেই উচ্চতম শৃঙ্গ-আরােহী—বিরল নয়, কিন্তু সবাই নন। আমরা মনে করি, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সেই বিরল গদ্যকার যিনি উপন্যাস এবং গল্প—দুটিতে সমান অনায়াস এবং বিশিষ্ট। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় উপন্যাসের ড্রিম মার্চেন্ট, ছােটোগল্পের ম্যাজিসিয়ান। সংকলিত পঁচিশটি গল্পেই তার ব্যতিক্রমি অনবদ্য লিখনশৈলীর ভারী পাঞ্জার ছাপ রয়ে গেছে।
প্রতিটি গল্পই লেখকের বহুমুখী জীবনপ্রণালী থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতা, ভণিতাবিহীন চিন্তাভাবনার ফসল। অসহায় নিরুপায় মানুষ যেমন তার গল্পের চরিত্র, তেমনি মধ্যবিত্ত কূপমণ্ডুক ভীত নিরাপত্তা-আশ্রয়ী মানুষও লেখকের গল্পের বিষয়। একটি ভিনটেজ অস্টিন গাড়ি, কলকাতার রাত, নিজের দুই মেয়ে, রাতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা লেখার মুন্সিয়ানায় গল্প হয়ে ওঠে (আত্মজা ও একটি…)। হারিয়ে যাওয়া গান, তার অনুসন্ধান, সেসব গান শুনতে শুনতে সেইসময়ে ফিরে যাওয়া, সেই ঘ্রাণ সেই ঘটনা-পরম্পরা, বেদনাবােধ—এই সংকলনে এরকম গল্প ‘ঝিঝােটি দাদরা’, ‘গানের বাগান’—পাঠক স্মৃতিমেদুর হতে বাধ্য। ঘােড়ার মনমেজাজ যেমন গাড়ির জগত এবং একটি বিচিত্র মানুষের গল্প, তেমনি নিজেদের রেললাইন’ এক বঙ্গবাসী প্রবীণ মারােয়ারি দম্পতির আবেগাপ্লুত কাহিনি। স্মৃতি-বিস্মৃতির দোলাচলে আবর্তিত একজন সফল বিজ্ঞানীর গল্প যেমন ‘বিলাসখানি’, আবার ‘বােম্বে রােডের রাধা’ এক ফুটপাথবাসিনীর মর্মান্তিক জীবনযুদ্ধের কাহিনি। সিধু পালের হিমসাগর’ এমন মানুষের গল্প যিনি তিনপুরুষের আমবাগান নিশ্চিহ্ন হতে দেখেও কথার জাদুতে তিনটি প্রাণাধিক আবৃক্ষ নিধন বিলম্বিত করতে চান। প্রতিনিয়ত অপমানিত মানুষ হঠাৎ বড়ো সাফল্যের স্বাদ পায় ‘মৎস্যপুরাণ’ গল্পে। সময় পিছিয়ে যায়, মানুষ তার আইডেনটিটি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে ‘পাগলাঘন্টি’ গল্পে। ‘অপমানের স্বাদ পেতে চান লেখক যাতে পরিপার্শ্বের আসল রূপ খুঁজে পান। ‘বেঁচে থাকার বিশেষ উপায়’ লেখকের আবিষ্কৃত এক বিশেষ উপায়। আবার ‘বাসি পুরুষমানুষ’ এক অসম প্রেমের অন্তিম পরিণতি। মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে’ মধ্যবিত্ত নিরাপত্তা বিলাসীর প্রশ্ন যেমন, আবার ‘নদী’ গল্পে লেখক এক আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে আশ্চর্য নদীভ্রমণের সঙ্গী। রাজরাজেশ্বর’ বারবার ভেঙ্গে পড়েও হার না মানা স্বপ্নসন্ধানী আরেক আশ্চর্য মানুষের গল্প। ইতিহাসােমিটার’ সফলতম ইতিহাসের অধ্যাপকের এতকালের স্বীকৃতি সত্ত্বেও আত্ম-উন্মােচন, নতুনতম উপলব্ধির গল্প।
এসব লিখতে লিখতে লেখক কখনও অহেতুক সিরিয়াস হয়ে যান না, জ্ঞান বিলােন না, ন্যায়-অন্যায় নিয়ে ভাষণ দেন না, কি করিতে হইবে’ বা ‘কি করা উচিত ছিল’–এবং বিধ ফতােয়া দেন না। জীবন এরকমই, এমনই বয়ে চলে জীবন বা হলেও হতে পারে—জীবনের এমন সব গল্প। ইনভড হতে চান না লেখক, কথকের উদাসীনতা তঁার স্টাইল। অথচ কী প্রগাঢ় মমত্ববােধ, চুইয়ে পড়া বেদনা, ছােটো ছােটো ইচ্ছা, আরও বড়ো কিছু গড়ে তােলার জেদ—লেখকের প্রতিটি গল্পের খাঁজে খাঁজে। ইতিহাসচেতনা, সময়কে টপকে টপকে যাওয়া—সত্য উচ্চারণে কোনও দ্বিধা নেই লেখকের। এবং ঈর্ষণীয় ‘হিউমার। গভীর কথা হাল্কা ঢংয়ে হিউমারের মােড়কে পাঠচলাকালীন মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং বিস্ফোরণ ঘটায়। আনচান প্রতিক্রিয়া টের পায় পাঠক। এই সমস্ত কিছু লেখক পেশ করেন। এমন এক শব্দ-তন্তুজালে যার কোনও পূর্বসূরি নেই, উত্তরসূরি পাওয়াও অনিশ্চিত। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই লিখছেন—“লেখার উদ্দেশ্য একটিই। তা হল উন্মােচন। অনুসন্ধানের পথে পথে এই উন্মােচন। বিনা মন্তব্যে সরল বাক্য সাজিয়ে এগিয়ে যাওয়াই আমার পদ্ধতি। আমি বলতে চাই সবচেয়ে কম। আর চাই—আমার না বলাটুকু পাঠকের মনে ক্রমিক পুনঃসৃষ্টি হতে থাকুক। সে-ই পথ খুঁজে পাক। তাই সাধারণত আমার কোনও রচনাতেই জটিল বাক্য থাকে না। কেউ বলেন—বড়াে কাটা-কাটা লাগে। আমি এটা ইচ্ছা করেই করি। কেননা, এটাই আমার পদ্ধতি। সেই পদ্ধতিতে আমি ‘টেবিল’ ‘চেয়ারের মতােই অনায়াসে উপযুক্ত ইংরাজি কথা ব্যবহার করি। কারণ জানি এই কথাগুলি আমরা অন্যসময়ে বাংলার মতােই আমাদের বাক্যে ব্যবহার করে থাকি। নজর রাখি, একটা হেভি শব্দের বদলে যেন আটপৌরে শব্দ খুঁজে পাই।”
ভিন্ন ভিন্ন মুডের, ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, আঙ্গিক এবং প্রেক্ষাপটের পঁচিশটি গল্প এই সংকলনে গ্রন্থবদ্ধ হল। যাঁরা আগে পড়েছেন তারা আবার পড়বেন, যাঁরা পড়ার সুযােগ পাননি তারা নতুন করে পড়বেন—এই আশায় পাঠকের দরবারে রাখা হল এই সংকলন-গ্রন্থ। পাঠক সাদরে গ্রহণ করলে আমাদের পরিশ্রম সার্থক।
পরিশেষে ধন্যবাদ জানাই আমার অনুজপ্রতিম গৌতম দাশকে। তার উৎসাহ এবং আগ্রহই এই পুস্তক প্রকাশনার মূল প্রেরণা। গৌতম যেহেতু শ্যামল-অনুরাগী, তাই ওর তাড়নাও ছিল আন্তরিক। পাঠক, আপনাদের শুধুমাত্র আপনাদেরই জন্য নিবেদিত হল এই গ্রন্থ।
বিনত
সমীর চট্টোপাধ্যায়
৩৫, কাশীপুর রোড
কলকাতা-৭০০০০২
পয়লা বৈশাখ, ১৪২৩
চোদ্দ এপ্রিল, ২০১৬
Leave a Reply