নোরা – হেনরিক ইবসেন
হেনরিক ইবসেন-এর ‘এ ডলস হাউস’-এর বাংলা অনুবাদ শ্রেষ্ঠ স্ক্যান্ডিনেভীয় নাটক
অনুবাদ – খায়রুল আলম সবুজ
প্রচ্ছদ – ধ্রুব এষ
উৎসর্গ
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
যিনি আলোকিত মানুষ খুঁজে বেড়ান
.
হেনরিক ইবসেন ও তাঁর ‘নোরা’
১৮৭০ সালের মধ্যেই ইউরোপীয় নাটকে বাস্তববাদী ধারার ক্ষেত্রে বেশকিছুটা অগ্রগতি হয়ে গেছে। বেশকিছু পরীক্ষানিরীক্ষা এবং নাটক লেখা হয়ে গেছে। একটা মোটামুটি শক্ত ভিত্তিও পেয়ে গিয়েছিল বাস্তববাদী নাটকের ধারা। অনেকে মিলে এই কাজটা করেছেন—কিন্তু বিশেষ এমন একজন তখনো আসেননি যিনি এই নতুন ধারার প্রতিভূ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন। নাটকের ক্ষেত্রে যখন সেই মানুষটির অপেক্ষা চলছে ঠিক তখনই হেনরিক ইবসেনের আবির্ভাব। হেনরিক ইবসেনই বহু প্রতীক্ষিত সেই মানুষ
ইবসেনের জন্ম ১৮২৮ সালে নরওয়ের শিয়েন শহরে। ‘পিয়ার জিন্ট’ লেখার আগ পর্যন্ত জীবনের চল্লিশটি বছর প্রায় পুরোটাই তাঁর দুর্দিন। জীবন-সংগ্রাম, সাহিত্যজীবনে একের পর এক ব্যর্থতা, আর্থিক অনটন—এসবের মধ্যেই কেটেছে তাঁর সময়। জন্ম নিয়েছিলেন অর্থবিত্তশালী পরিবারেই। ইবসেন যখন চার বছরের তখন তাঁদের পুরো পরিবারটা বাড়ি বদল করে একটা বড় বাড়িতে চলে আসে। এখানে চলতে থাকে অত্যন্ত বেহিসেবি জীবনযাপন। এভাবে বেশিদিন চালানো সম্ভব হয়নি। ইবসেন তখন এতই ছোট যে পারিবারিক জৌলুসের সেই দিনগুলো পরবর্তী সময়ে তিনি আর মনেও করতে পারতেন না। তাঁর ছয় বছর বয়সের সময়ই পিতা নুড ইবসেন দেউলিয়া হয়ে পড়েন। সুতরাং শিয়েন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে খামারবাড়িতে তাঁদের চলে যেতে হয়।
ইবসেন একেবারে ছোটবেলা থেকেই চুপচাপ। নিজের মধ্যে একটি জগৎ তৈরি করে তার ভেতরে বাস করতেন। তাঁদের পরিবার ছিল বড় এবং এই বড় পরিবারের সবচেয়ে বড় সন্তান তিনি। ছোট্ট পরিত্যক্ত একটি ভাঁড়ার ঘর ছিল তাঁর নিজস্ব জগৎ। সেখানে নিরিবিলি ছোটভাইদের ব্যঙ্গ করে ছবি আঁকতেন, থিয়েটার বানিয়ে খেলতেন। এই জগতে কেউ প্রবেশ করার চেষ্টা করলেও ভীষণ খেপে যেতেন ইবসেন। অত্যন্ত জেদি প্রকৃতির ছিলেন বলে কেউ তাঁকে খুব একটা ঘাঁটাত না। হেডউইগ নামে তাঁর একটি বোন ছিল। এই বোনটির প্রতি তিনি খুবই দুর্বল ছিলেন। ‘দ্য ওয়াইল্ড ডাক’–এর নায়িকার নাম তিনি রেখেছিলেন হেডউইগ। পরবর্তী জীবনে ইবসেন শুধু এই বোনের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।
ইবসেন ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাবার অর্থে কুলোয়নি বলে তা হওয়া সম্ভব হয়নি। ডাক্তার না হলেও, বাড়ি থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে গ্রিমস্টাডে একটি ওষুধের কারখানায় ছয় বছরের মতো কাজ করেছিলেন। এখানে তাঁর সময় মোটেই ভালো কাটেনি। প্রথমদিকে মাঝেমধ্যে শিয়েন শহরে অনিয়মিত হলেও যেতেন, কিন্তু এক পর্যায়ে যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপারটা এতদূর গড়ায় যে প্রায় ত্রিশ বছর পরে নিজের বাবার মৃত্যুসংবাদ তাঁকে খবরের কাগজ দেখে জানতে হয়েছিল।
গ্রিমস্টাডে সময় ভালো না কাটলেও তা যে একেবারেই নিষ্ফলা ছিল তা–ও নয়। এখানে তিনি মাঝেমধ্যে লেখার চেষ্টা করতেন—লিখেছেন কিছু কবিতা, কিছু ব্যঙ্গ কবিতা। ১৮৪৯ সালে ইবসেন প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখলেন; নাম ‘ক্যাটালিন’। রোমান ইতিহাসের ওপর কাব্যঢঙে লেখা। নাটকটি ক্রিস্টিয়ানিয়া (বর্তমান অসলো) থিয়েটার প্রশংসা করলেও মঞ্চস্থ করেনি। প্রকাশকরাও প্রকাশ করেনি। তাঁর বন্ধু শুলেরাড নাটকটি প্রকাশের জন্য টাকাপয়সার ব্যবস্থা করলে ১৮৫০ সালে প্রকাশিত হয়। এই নাটক প্রকাশকে ঘিরে ধনাঢ্য হবার যে–স্বপ্ন দুই বন্ধু দেখেছিলেন সেটা কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। নাটকের কিছু বই পরে ঠোঙা বানাবার কাজে লেগেছিল।
গ্রিমস্টাড থেকে শূলেরাড ও ইবসেন ক্রিস্টিয়ানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। এ বছর শীতে তাঁর নাটক ‘দ্য ওয়ারিয়রস টুল’ মঞ্চস্থ হয় এবং নাটকটির তিনটি প্রদর্শনী হয়। ওই তিনটি প্রদর্শনী, সেদিনের কথা ভাবলে সফলই বলা চলে। গ্রীষ্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তিনি গ্রিক ভাষা ও অঙ্কে ফেল করেন। তবে এই সময় তিনি বার্গেন থিয়েটার থেকে বাৎসরিক ষাট পাউন্ডের একটি চাকরির প্রস্তাব পান। বার্গেন থিয়েটারের চাকরি নিয়ে ইবসেন সাত বছর কাটান। এখানে তিনি কাব্যনাটক লিখতেন লোকগাথার ওপর ভিত্তি করে। তাঁর এই সময়ের কাজে বাস্তববাদী ধারার কোনও চিহ্নও নেই—তিনি ভাবতেন শিল্প মানেই একটা কাল্পনিক চকমকে জগৎ সৃষ্টি করা। ইবসেনের এই সময়ের নাটকগুলোর নামই শুধু উল্লেখ করা যায়। এরপর’ফিস্ট অ্যাট সোলাগ’ নামে তাঁর একটি নাটকের ছয়টি প্রদর্শনী হয়। এতে তিনি কিছুটা সাফল্যের স্বাদ পান এবং এই সাফল্যের সুবাদে ধর্মযাজক থোরেসেনের কাছ থেকে তিনি আমন্ত্রণ পান। থোরেসেনের উনিশ বছরের মেয়ে সুসানার সঙ্গে তাঁর এখানে দেখা হয় এবং ১৮৫৮ সালে তাঁদের বিয়ে হয়।
১৮৫৭ সালে বার্গেন থিয়েটারের সঙ্গে ইবসেন আরও এক বছরের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, কিন্তু ঠিক এই সময়ে ক্রিস্টিয়ানিয়া ন্যাশনাল থিয়েটার তাঁকে দ্বিগুণ বেতনের প্রস্তাব দিলে তিনি সেপ্টেম্বরে রাজধানীতে চলে আসেন। তখন তাঁর বয়স ত্রিশ। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত ইবসেন এই থিয়েটারে কাজ করেন। নরওয়েজিয়ান নাটক মঞ্চস্থ করার জন্যই ন্যাশনাল থিয়েটার স্থাপিত হয়েছিল। এর আগে এ-অঞ্চলে ড্যানিশ নাটকই চলত। এ দুটো ভাষা অনেকটাই কাছাকাছি। ন্যাশনাল থিয়েটার শুরুতে বেশ সাফল্য পায়। ইবসেনের ‘ওয়ারিয়র্স অ্যাট হেল্জল্যান্ডাসহ বেশকিছু নরওয়েজিয়ান নাটক মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু প্রাথমিক উত্তেজনা কমলে দেখা গেল মঞ্চে আনার মতো তেমন নাটক আর পাওয়া যাচ্ছে না। জাতীয়তাবোধ-সমৃদ্ধ নাটক না-পাওয়াতে তাদের প্রহসন ধরনের হাসির নাটক মঞ্চায়ন করতে হচ্ছে। ইবসেন সবসময়ই তাঁর সময়ের আগে চিন্তা করতেন—তিনি বার্গেন থিয়েটারে থাকতেই জাতীয়তাবোধ সম্বলিত কিছু নাটক লিখেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে সে-নাটকের কিছুটা চাহিদা হয়েছিল কিন্তু এতদিনে তাঁর মানসিকতারও পরিবর্তন হয়ে গেছে। ‘দ্য প্রিটেন্ডার অবশ্য তাঁর এই সময়েরই নাটক।
যাই হোক, ইবসেন এ ধরনের নাটক লিখে সুখ পাচ্ছেন না বলে ছবি আঁকা আর কবিতা লেখার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। নাটক লেখা আপাতত বন্ধ থাকল। ন্যাশন্যাল থিয়েটার আরও কয়েক বছর কোনওমতে চলতে চলতে ১৮৬২ সালে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল এবং ইবসেন তাঁর চাকরি খোয়ালেন। এই সময়ের দিনগুলো ছিল বড় কঠিন। সংসারে একটি চার বছরের ছেলে, নিজেরা দু-জন—সবকিছু সামলানোই মুশকিল। সাংবাদিকতা করে ও কবিতা লিখে কিছু টাকা এ-সময় তাঁর উপার্জন হত। ইবসেন ধার-দেনায় জড়িয়ে পড়লেন। উদ্ধার পেলেন যখন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে গ্রামে গ্রামে লোকগাথা সংগ্রহ করার জন্য যাতায়াত খরচ বাবদ কিছু টাকা বরাদ্দ করল। এই সময় গদ্যরীতিতে তিনি ‘লাভস কমেডি’ নামে একটি নাটক লিখতে শুরু করলেন। কিন্তু গদ্য অত্যন্ত কঠিন মনে হওয়াতে তিনি আবার কাব্যে চলে গেলেন। নাটকটি ১৮৬২ সালের শেষ দিনটিতে প্রকাশিত হয়। প্রচলিত বিবাহপ্রথাকে আক্রমণ করার কারণে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল দর্শকদের মধ্যে। ফলে নাটকটি আর মঞ্চের মুখ দেখেনি। কবি হিসেবে কিছু ভাতার জন্য তিনি সরকারের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু আবেদন নাকচ হয়ে যায়।
গদ্যরীতিতে নাটক লেখা কঠিন মনে হলেও চেষ্টা তিনি ছাড়েননি। অবশেষে ‘দ্য প্রিটেন্ডার নাটকে তাঁর সাফল্য এল। ১৮৬৩ সালের শরৎকালে নাটকটি প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তী বছরের জানুয়ারি মাসে মঞ্চস্থ হয়। দুই মাসে নাটকটির প্রদর্শনী হয় আটটি।
এর মধ্যে ইবসেন তাঁর বন্ধুর সহায়তায় বিদেশ ভ্রমণের একটা সুযোগ পেয়ে যান। ১৮৬৪ সালের এপ্রিলে তিনি কোপেনহেগেনের দিকে পাড়ি দেন। ডেনিশরা এই সময় প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত—ইবসেন চেয়েছিলেন সমগ্র স্ক্যান্ডিনেভিয়া এই যুদ্ধে একত্রিত হোক। কিন্তু নরওয়ে ও সুইডেন নিরাপদ দূরত্বে নির্লিপ্ত থাকল। এই যুদ্ধে ডেনিশরা পরাজিত হলে তাঁর খুব কষ্ট হয়। নরওয়ে যুদ্ধে ডেনিশদের সহযোগিতা না-করায় জাতির এই অমার্জনীয় অপরাধে তিনি লজ্জিত হন এবং দেশে না-ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। ইবসেন চলে যান রোমে। ইতালিতে বসে লেখেন ‘ব্রান্ড’ (১৮৬৬)। এই নাটকের জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় ভাতা পেতে শুরু করেন। ‘পিয়ার জিন্ট’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালে। এই দুটো নাটকই ইবসেনকে নাট্যকার হিসেবে সুপরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করে। তবে এই পর্যন্ত আসতে তাঁকে দীর্ঘ চল্লিশটা বছর পার করতে হয়েছে। এই সময় থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত মাত্র দু-বার ইবসেন নরওয়েতে গিয়েছেন, তা-ও অল্প সময়ের জন্য। বাকি দীর্ঘ সময় তিনি ইতালি ও জার্মানিতেই কাটান।
‘লিগ অব ইউথ’ (১৮৬৯)–এর পর থেকেই কাব্যনাটক লেখা ছেড়ে দেন তিনি। ইবসেন— সমাজ, দেশ ও মানুষের স্বার্থে সবসময় পদক্ষেপ নিয়েছেন নির্দ্বিধায় এবং দৃঢ়তার সঙ্গে। নারী-স্বাধীনতা অর্থাৎ নারীও যে মানুষ, তারও যে নিজস্ব আশা— আকাঙ্ক্ষা থাকবে, তারও যে নিজস্ব ভুবন আছে, জীবনে তার অধিকার যে সমান সমান—এই প্রসঙ্গে ইবসেনের ‘এ ডলস হাউস’ (১৮৭৯) আজও চূড়ান্ত নাটক বলে বিবেচিত। ‘গোস্ট’ (১৮৮১) নাটকটি মানুষকে আলোড়িত করেছে। এই দুটি নাটকই সে-সময় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এই নাটকে ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থাকে সরাসরি আঘাত করা হয়েছে। ফলে পক্ষে-বিপক্ষে মানুষ বিভক্ত হয়ে গেছে।
‘দ্য পিলার্স অব সোসাইটি’ (১৮৭৭), ‘অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল’ (১৮৮২), ‘দ্য ওয়াইল্ড ডাক’ (১৮৮৪), ‘দ্য লেডি ফ্রম দ্য সী’ (১৮৮৮), ‘হেডা গ্যাবলার (১৮৯০), ‘দ্য মাস্টার বিল্ডার’ (১৮৯২), ‘জন গ্যাব্রিয়েল বোকম্যান’ (১৮৯৬) এবং ‘হোয়েন উই ডেড অ্যাওকেন’ (১৮৯৯) তাঁকে বাস্তববাদী নাট্যধারার প্রবর্তক হিসেবে বিশ্বনাট্যসাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
জীবনের শেষের দিকে স্ট্রোকের কারণে তাঁর স্মরণশক্তি লোপ পায়। এমনকি তিনি আর অক্ষরও চিনতে পারতেন না। ১৯০৬ সালে ক্রিস্টিয়ানিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়।
নোরা
‘নোরা’ (এ ডলস হাউস) সম্বন্ধে ইবসেন বলেছেন—’লেখা শুরু করবার আগে চরিত্রগুলো আমার মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়েছিল, তারা এসেছিল ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে—যেন কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটু একটু করে হেঁটে এসে আমার চোখের সামনে রক্ত-মাংস নিয়ে হাজির হয়েছিল। ভেতর ও বাহির দু-দিক থেকেই। ইবসেন একদিন তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘নোরাকে আজ রাতে দেখেছি—আমি লিখছিলাম, নোরা এসে আমার কাঁধে আলতো করে হাত রাখল।’
‘কী কাপড় পরা ছিল বল তো’—তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
ইবসেন বললেন, ‘একেবারে সাধারণ নীল একটি ফ্রক পরা।’
ইবসেন ধীরে ধীরে সময় নিয়ে জীবন্ত করেছেন চরিত্রদের।
‘এ ডলস হাউসে’র কথা প্রথম শোনা যায় ১৮৭৮ সালের মে মাসে। হেজেলের কাছে লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ আছে যে তিনি আধুনিক জীবন নিয়ে একটি নাটকের কাজ করছেন। এরপর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনও সাড়াশব্দ নেই। হতে পারে চরিত্রের রেখাগুলো তখনও নাট্যকারের মনে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। হেজেলকে আবার লিখলেন যে তিনি রোমে যাচ্ছেন এবং সেখানেই নাটকটি শেষ করবেন। এর মাঝে লরা কেলার নামে এক ভদ্রমহিলা এবং তার স্বামী এলেন মিউনিখে ইবসেনের ওখানে বেড়াতে। দশ বছর আগে লরাকে ইবসেন অন্য নামে চিনতেন। এখন কেলার নামে একজন স্কুল–মাস্টারকে সে বিয়ে করেছে—কিন্তু লরা স্বামীর হাতের পুতুল হবার মতো মেয়ে নয়—তাদের সম্পর্কও ভালো যাচ্ছিল না। লরা লেখক হিসেবে একটু একটু নাম করতে শুরু করেছে মাত্র। লরা এবং কেলার; ইবসেনের নোরা এবং টোরভাল্ড-এর মডেল। এই দুটি মানুষকে ইবসেন ধীরে ধীরে নোরা এবং টোরভাল্ডে রূপান্তরিত করেছিলেন।
১৮৭৯ সালের মে মাসের দিকে শোনা গেল নাটক শেষের দিকে। আরও জানা গেল রোমে গরম পড়ার কারণে ইবসেন সপরিবারে আমালফি নামে সমুদ্রের পাড়ে একটি জায়গায় যাচ্ছেন এবং সেখানেই নাটকটি শেষ করবেন। আসলে ওখানেই ‘নোরা’ (এ ডলস হাউস)-এর বেশিরভাগ লেখা হয়েছিল। জুনের দিকে হেজেল আবার একটা চিঠি পেলেন। তাতে লেখা : ‘এই নাটক সম্পর্কে আগস্টের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।’ আসলে সংলাপগুলোকেই ইবসেন তিনবার ঘষামাজা করেছেন এর মধ্যে। সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে কিস্তিতে নাটক পাঠাতে শুরু করেন তিনি। সঙ্গে একটি চিঠি—চিঠিতে লিখলেন : ‘আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আমার কোনও লেখাই নোরার (এ ডলস হাউস) মতো এত আনন্দ আমাকে দেয়নি।
‘নোরা’ (এ ডলস হাউস) প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে। প্রথম সংস্করণে ছাপা হয়েছিল আট হাজার কপি। প্রকাশিত হবার তিন সপ্তাহের মাথায় ‘নোরা’ (এ ডলস হাউস) মঞ্চস্থ হয় ‘থিয়েটার রয়াল কোপেনহেগেন-এ মঞ্চস্থ হবার পরে যে—অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা এতদিন পর চিন্তা করাও কঠিন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে মেয়েদের জন্য বিবাহের চুক্তি ভঙ্গ তো দূরের কথা— নিজের মনের মতো করে চলা অথবা স্বামীর কথা অমান্য করা কোনও কিছুই সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। নতুন কণ্ঠস্বর শোনার জন্য থিয়েটারে মানুষ ভেঙে পড়ল। ১৮৮০ সালের জানুয়ারিতে আর একটা সংস্করণ বের করতে হয় নাটকটির—তিন মাস যেতে-না-যেতে মার্চে আবার আর একটা।
জার্মানিতে ‘নোরা (এ ডলস হাউস) মঞ্চস্থ হয় ১৮৮০ সালে। নাটকের শেষটা ইবসেনকে ভিন্নভাবে লিখতে হয়েছিল সমকালের চাপে। কোনওক্রমেই নোরাকে ঘরের বাইরে যেতে দেয়া যাবে না। জার্মান মঞ্চায়নে শেষদৃশ্যে হেলমার নোরাকে তার ঘুমন্ত ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখতে বাধ্য করে। নোরা তাকায়, তার সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষিত, আর পারে না—কাপড়চোপড়ের ব্যাগটি টুপ করে পড়ে যায় হাত থেকে, আর নোরা ধীরে ধীরে নুয়ে পড়তে থাকে মাটির কাছে। জার্মান পুরুষরা এতেই গৌরববোধ করেছিল। অনেকে মনে করেন এই ভিন্নভাবে লেখার দায়িত্বটা মঞ্চায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাই সেরেছিলেন; কিন্তু তা নয়, এ কাজটা ইবসেন নিজেই করেছিলেন। তবে তা ওই একবারই শুধু জার্মান মঞ্চায়নের জন্য—অন্যত্র নাটকটি আজকে যেমন আছে তেমনই ছিল। পরবর্তী সময়ে মেয়েরা ইবসেনের নোরার মতো সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে যে-যার মতো বেড়ে উঠতে শুরু করল— স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখে স্বামী-সংসার ছেলে-মেয়েসহ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। এই সামাজিক পরিবর্তনে নোরা অবশ্যই পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে—এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
খায়রুল আলম সবুজ
৩৯৯/এ নিউ ইস্কাটন
ঢাকা।
চরিত্রলিপি
টোরভাল্ড হেলমার : একজন আইনজীবী
নোরা : হেলমারের স্ত্রী
ডাক্তার র্যাংক : হেলমারের বন্ধু
নিলস ক্রোগস্ট্যাড : একজন আইনজীবী
মিসেস লিন্ডে : নোরার সহপাঠিনী
: হেলমারের তিনটি বাচ্চা
আনা ম্যারিয়া : আয়া
হেলেনা : পরিচারিকা
: কুলি
Md Enamul Haque
Very nice book