নেক্রোপুরুষ – উপন্যাস – মলয় রায়চৌধুরী
আমি এতোকাল যা করেছি, তা আমার নিজস্ব আর্ট ফর্ম, আমার সৃষ্টিচেতনার বহিঃপ্রকাশ ।
আমি মেয়েদের শবের সঙ্গে শুতে ভালোবাসি ; এটাই আমার জীবনের উদ্দেশ্য । [১]
তলপেটে বারবার ছোরা ঢুকিয়ে আপনি আমার গু-মুতকে রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন, উচিত কাজই করেছেন, জানি ডাক্তাররা আমাকে বাঁচাতে পারবে না, তারা চেষ্টা চালালেও, পুলিশ চাইবে না যে আমি বেঁচে থাকি, আপনি এখন রেকর্ড করতে চাইছেন আমার জীবনের ঘটনাগুলো, কেমন করে আমি এই শিল্পবোধে আক্রান্ত হলুম । করুন, করুন । তবে আপনি যদি আমার কথাগুলো ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে পড়েন, তাহলে ভালো হয় ।
আমার ইংরেজি, শুনে টের পাচ্ছেন নিশ্চয়ই, ইনডিয়ান ইংলিশ নয়, ইস্ট আফ্রিকান ইংলিশ । মাঝে-মাঝে আমি শ্বাস নেবার জন্য জিরিয়ে নেবো ; আপনি ট্র্যান্সক্রিপ্ট নেবার সময়ে ঘটনাগুলোর ঠিকমতন সংযোগ তৈরি করে নেবেন ।
আপনি জানতে চেয়েছিলেন আমি কোথাকার লোক । বলেছিলুম, অখণ্ড বাংলার । তবু আপনি জোর দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন আমি ‘অ্যাকচুয়ালি’ কোথাকার । কেউ কি বলতে পারে সে ‘অ্যাকচুয়ালি’ কোথাকার? বাবার কাছে শুনেছিলুম, আমাদের আদি বাড়ি ছিল চিটাগঙে । ইনডিয়ার পার্টিশানের পর কেউ কি চতুর্থ প্রজন্মে পৌঁছে বলতে পারেন যে তিনি ‘অ্যাকচুয়ালি’ চিটাগঙের বা বরিশালের বা ঢাকার বা কলকাতার বা দিল্লির ?
হ্যাঁ, আমি মেয়েদের শবের সঙ্গে প্রেম করে পরমসন্তোষ পাই, নাঃ, পেতুম বলা ভালো । মেয়েদের শব মাত্রেই, হোয়াট ইউ কল, সচ্চিদানন্দময়ী, মানে যাদের বুকের বাইরে আর ভেতরে লেজার আলো কিং কোবরার মতন কুণ্ডলি পাকিয়ে ওৎ পেতে থাকে, আচমকা বেরিয়ে জাপটে ধরে, আলোয় আলো করে দ্যায় অস্তিত্বকে ।
এই প্রেমকে বেআইনি ঘোষণা করার মানে হয় না ; যে মারা গেছে তার নির্বাক অনুমতি নিয়েই তো তার সঙ্গে প্রেম করি, করেছি, কেননা মৃত্যু মানেই তো কাম, প্রতিটি নারীর শবই চিরঘুমন্ত সুন্দরী, স্বপ্নের মৌতাতে ভেসে আসে, ডানা মেলে, তাকে দেখতে সাধারণের চোখে ভালো হোক বা না হোক, ওনারা তো নিজের উইলে লিখে যান না যে মৃত্যুর পর কারোর সঙ্গে প্রেম করবেন না । আর নেহাৎই যদি কারোর মনে হয়, যার সঙ্গে প্রেম করতে চলেছেন তার মুখ কুৎসিত, তাহলে তাকে সুন্দরীর স্বপ্ন পরিয়ে দিতে পারেন, বহু সুন্দরীর মুখ আপনারা পেয়ে যাবেন পোস্টারে, বিজ্ঞাপনে, চকচকে পত্রিকার পাতায়, চোখ বুজে ইচ্ছামতন তা থেকে নিজের কল্পনা বেছে নিতে পারেন ।
কুয়াশায় মোড়া সন্ধ্যা কি বেআইনি, ধানখেতের ওপর দিয়ে বেগে পেছু নেয়া বৃষ্টি কি বেআইনি, শিমুলের কৌটো ফেটে উড়তে থাকা রোঁয়া কি বেআইনি, আঙুরঝুমকোয় লুকিয়ে থাকা মদ কি বেআইনি, সূর্যকে ঢেকে ফেলা গ্রহণের কালো কি বেআইনি, সমুদ্রের নীলে ধনুকের মতন তিমির নাচ কি বেআইনি, হরিণকে লক্ষ্য করে উড়ন্ত গতিতে ছুটতে থাকা চিতাবাঘ কি বেআইনি, মরুভূমিতে অতিদূরে ভেসে ওঠা মরিচিকার টলটলে জল আর খেজুরগাছের সবুজ সারি কি বেআইনি ! নয়তো ? তবে ? [২]
বুঝলেন তো ? আমি মৃত্যুর কালো নোংরা বোটকা বাসি মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চেঁচাই, মানে চেঁচাতুম, ‘ফেরত নিচ্ছি, ফেরত নিচ্ছি, ফেরত নিচ্ছি’; আমার চিৎকার শুনে মৃত্যু কালোকে ফর্সা করে তোলে, বোটকাকে সুগন্ধী করে তোলে, বাসিকে তরতাজা চনমনে করে তোলে । তার জন্য সাহস দরকার, ক্ষমতার সাহস, যে ক্ষমতা থাকে শরীরে, এই যে এইখানে, চেয়ে দেখুন, এইখানে ; কাপুরুষদের অমন সাহস থাকে না, কেননা তারা মতান্ধ, তারা নীতিবাদী, তারা আদর্শবাদী, তারা মৌলবাদী, তারা ফাঁকিবাজ, তারা কেবল অন্যের মগজে সুড়সুড়ি দেবার তালে থাকে । ক্ষমতা হল জ্ঞান, জৈব রসায়ন, ধৈর্য ধরে থাকতে হবে।
রাজনৈতিক দলরা দেশে দেশে ক্ষমতা চায় কেন ? ক্ষমতাকে সেই দলের কয়েকজন, বা কেবল একজন, কুক্ষিগত করতে চায় কেন ? অন্যের, মানে জনসাধারণের, ভালোর জন্য নিশ্চয়ই নয় । একবার কেউ ক্ষমতা দখল করলে জোঁকের মতন লেগে থাকে, রক্ত চুষে-চুষে খায় ; তারা ক্ষমতা প্রয়োগ করে কোথাও পৌঁছোতে চায় না, কেননা ক্ষমতাই তাদের লক্ষ্য । বুঝলেন তো ? মৃত্যুর সঙ্গে যদি ক্ষমতাকে একাকার করে দেয়া যায়, তার চেয়ে কাম্য আর কিছু হতে পারে না । ইতিহাস ঘাঁটলেই টের পাবেন একনায়করা মৃত্যুকে কতো অনায়াসে ক্ষমতার সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে শাসন করে গেছে বছরের পর বছর, আর জনসাধারণ তখন পিণ্ড পিণ্ড শব, অবাধে প্রতিরোধহীন প্রেম করে গেছে ক্ষমতাধরের সাথে, তার নামে স্লোগান দিয়েছে, পতাকা উড়িয়েছে । [৩]
হ্যাঁ, আমি মেয়েদের শবের সঙ্গে প্রেম করতে ভালোবাসি ; বারবার ভুল করে ফেলছি, মরে যাবো কিছু দিনের মধ্যেই জেনেও অভ্যাস ছাড়তে পারছি না । ভালোবাসতুম, ভালোবাসতুম । মেয়েমানুষের শব মাত্রেই মহানন্দময়ী, মানে রিডিমিং, অস্তিত্বের উত্তরণ ঘটায় ।
একনায়কদের দেখবেন, তারা নিজেদের ক্ষমতার প্রতি সৎ, জীবনকে সমুদ্রের মতন সাগরে সাগরে বয়ে যেতে দেয় । একনায়কের জন্য, দলের জন্য, সম্প্রদায়ের জন্য, বিশেষ দর্শনের উদ্দেশে, যারা মরে যাবার জন্য সব সময় এক পা এগিয়ে, তারা ঘৃণ্য, তারাই ঘৃণ্য, ঘৃণ্য, ঘৃণ্য । দেখছেন তো সাদ্দাম হোসেনকে সরাবার পর সে দেশে কী ঘটছে, গাদ্দাফিকে সরাবার পর লিবিয়ায় কী ঘটছে, আফগানিস্তানে, সিরিয়ায় কী ঘটে চলেছে ! ভালোবাসা সে দেশগুলোয় বালির ঝড়ের সঙ্গে উড়ে চলে গেছে । এতো খুনোখুনি, যদি তারা নারীর শবকেও ভালোবাসা দিত, তাদের দেশে শান্তি নেমে আসতো । তারা তো নারীকে সম্ভ্রম জানাতেও কুন্ঠিত, আফগানিস্তানে ঢিল মেরে-মেরে যুবতীদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে আজও, নারীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হচ্ছে । দেখে, আমার ইচ্ছে করেছে আমি ওই বোরখা-ঢাকা নারীদের শবদেহকে জড়িয়ে কাঁদি।
আমি কোনো তর্কেই ঘৃণার যোগ্য নই । আমি ভালোবাসাকে মাংসের গেঁতো নোংরামি থেকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছি ।
দেহের ক্ষমতা অবাধ, নিজেকে জানতে হলে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতেই হবে, ক্ষমতা কেউ দেয় না, নিজের ভেতর ডুবে তুলে আনতে হয় । ক্ষমতা থাকলে ভয়ও ভয়কে ভয় পায় । কোনো একজন মহাত্মা বলে গেছেন যে, যেদিন প্রেমের ক্ষমতা কাবু করতে পারবে ক্ষমতার প্রেমকে, সেদিন পৃথিবীতে নেমে আসবে শান্তি । আমি প্রেমের ক্ষমতা আর ক্ষমতার প্রেমকে মৃত্যুর বিন্দুতে মেলাতে পেরে শান্তির শীতল স্বর্গ গড়ে তুলতুম । প্রতিটি শবের সঙ্গে প্রেম করার সময় আমি নিজের কথা একেবারে ভুলে যেতুম, নির্বাকের সঙ্গে নির্বাক আলাপ দিয়ে শুরু করতুম, তার দুঃখযন্ত্রণায় তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতুম, প্রেম তো নির্বাক চিৎকার, যার সঙ্গে প্রেম করতুম, সে হাসিমুখে শুনে যেতো । সত্যকার ভালোবাসা কেবল মেয়েমানুষের শবের সঙ্গে সম্ভব । কোনো নারী যদি সত্যকার ভালোবাসা পেতে চায় তাহলে তাকেও পুরুষের শবের সঙ্গে প্রেম করতে হবে, অন্যথায় তাদের মাঝে যা ঘটবে তা ধর্ষণের নামান্তর ।
শবের দুঃখে আমি কষ্ট পাই, পেতুম , শবের যন্ত্রণায় আমি যন্ত্রণা ভোগ করি, করতুম ।
শরীর হলো সাম্রাজ্য , তার যাবতীয় গোপনতা অতিপবিত্র, সে চায় সত্যকে চূড়ান্তভাবে জয় করতে, শরীরের আনন্দ-আহ্লাদকে সিরিয়াসলি নিতে হবে, সিরিয়াসলি মানে জানেন তো, সে তো জানবেনই, আপনি ইংরেজি সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েট, বলেছে পুলিশের অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার, যে আপনি বিদূষী, অনেক কিছুই জানবেন, তবে আপনি নাকি কোকেন জাতীয় রাসায়নিক মাদকও নেন, উত্তরাধুনিক জীবনযাপন করেন, আর সেই সূত্রেই এই ছেলেগুলোর সঙ্গে আপনার আলাপ ।
আমি ছোঁড়া চারটেকে বারবার বলেছি, বলতুম, নেশাটা একটু কম কর তোরা, নয়তো নিজেরাও ডুববি, আমাকেও ডোবাবি । শেষ পর্যন্ত তাই হল । ওদের কাছ থেকে আপনি আমার হদিশ পেলেন ।
আপনার দিদি আপনার মাদক নেবার অভ্যাস ছাড়াতে না পেরেই আত্মহত্যা করেছিলেন, তাও বলেছে পুলিশের ইনভেসটিগেটিং অফিসার । দিদিই আপনার অভিভাবক ছিলেন । আপনার উত্তরাধুনিক জীবনযাত্রা, রেভ পার্টিতে গিয়ে সারারাত ধুন্ধুমার নাচ, অচেনা-অজানাদের সঙ্গে ডিসকোয় মাতাল হওয়া, সপ্তাহান্তের উল্লাসে মাদকে আচ্ছন্ন হয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফেরা, অনুমোদন করেননি আপনার দিদি । আপনি ওনার নিষেধ শোনা প্রয়োজন মনে করেননি, উঁচু পদের চাকরিতে প্রচুর রোজগার করেন আর ব্যয় করেন, শুনেছি আপনার গল্প।
জানি, ওদের, ছেলে চারটেকে, আপনি নিজের সঙ্গে এনেছেন পুলিশকে অনুরোধ করে, আমার জীবনের ঘটনা যাতে ওরাও শোনে, ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ে ছেড়ে দিয়েছিল, আমার এই ইংরেজি আত্মজীবনী ওরাও বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই । ওই তো মাথা নাড়ছে, বুঝতে পারছে দেখছি ।
আপনি অভিযোগ দায়ের করেছেন যে আমি নেকরোফাইল, ডাক্তাররাও বলেছে আমি নেকরোফিলিয়া রোগে ভুগি, পুলিশও দণ্ড সংহিতার সেই ধারায় আমাকে গ্রেপ্তার করে, হাসপাতালে চারজন সশস্ত্র পুলিশেকে এই ঘরে বসিয়েছে । কিন্তু বিস্বাস করুন, আমি নেকরোফাইল নই, নেকরোফিলিয়া নামে কোনো মানসিক রোগে ভুগি না, ইনসমনিয়া বা ডিমেনশিয়াতেও ভুগি না ।
আমি প্রেমের শিল্পবোধে ভুগি, নারীদেহের সঙ্গে প্রেমের শিল্পবোধে । প্রেম করা তো বেআইনি নয় । তাহলে কেন আপনি আমাকে ঘৃণার পাত্র বলে মনে করলেন ! ভুল, ভুল, ভুল, আপনাদের সবায়ের ভুল । যুদ্ধক্ষেত্রের মৃত্যু-মহামারীর মাঝে, গৃহযুদ্ধের খুনোখুনির মাঝেও, আমি খুঁজে পেয়েছি প্রেমের শান্তি, নারীদেহের শবকে জড়িয়ে, সারারাত জেগে থেকে । [৪]
মৃত্যু আমাকে ভালোবাসে, বলুন ঠিক কি না, নয়তো হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকব কেন ! আমি মৃত্যুকে ভালোবাসি, মৃতার শরীরকে ভালোবাসি, মৃত্যুর ঐন্দ্রজালিক গন্ধকে ভালোবাসি,আর তো কখনও ভালোবাসতে পারব না তাদের, তারাও, কৃষ্ণাঙ্গী শবদেহরাও, আমাকে ভালোবাসতো, তাই চোখ বন্ধ করে থাকতো, আমি চোখের পাতায় চুমু খেতুম, এই ভালোবাসা ছিল শর্তহীন, প্রেম করার সময়ে আমি সেই নারীদেহের বয়ফ্রেণ্ড, প্রেমিক, স্বামী, বন্ধু, অভিভাবক, তারা তা জানে, আই মিন জানতো, জানতো কিনা বলুন, শবদেহ তো জানে যে ও মাত্র কয়েকদিনের অতিথি, দিনকতক পরেই কুৎসিত হয়ে যাবে, পচতে থাকবে, গায়ে পোকা ধরবে, হাড় চুণ হয়ে যাবে, বা ছাই হয়ে হাওয়ায় মিশে যাবে।
চোখের পাতায় বারবার চুমু খেয়ে আমি অনেকে শবদেহের চোখের পাতা মেলে ধরতে শিখিয়েছি, তারা অতিপরিচিতের মতন আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতো, ধন্যবাদ জানাতো অপলক ।[৫]
মৃত্যুর পরের দিনও কেবল ঠোঁটেই থাকে বিশুদ্ধতার জীবাণু ; শরীরের সবচেয়ে অনাবৃত এরোগেনাস এলাকা হল মানুষের ঠোঁট, যেখানে গিয়ে কেন্দ্রিত অজস্র স্নায়ুর শেষবিন্দু, সেখানে সামান্য স্পর্শ আমাদের মস্তিষ্কে তথ্যের প্রপাত গড়ে তোলে, ক্যানভাসে হাজার রঙের তুলির ছোঁয়ার মতন । চুমুর ম্যাজিকের মাধ্যমে শরীরে হরমোন আর নিউরোট্র্যান্সমিটারের ঝড় ওঠে । চুমু থেকে যে স্নায়বিক অনুপ্রাণন গড়ে ওঠে তা ত্বক, মগজ, মুখের মাংসপেশী আর ঠোঁটে অবিরাম আনাগোনা করে, যতক্ষণ চুমু খাওয়া বজায় থাকে ততক্ষণ । প্রগাঢ় চুমুর ফলে স্নায়ুবার্তা সৃষ্টি করে ডোপামাইন রসায়ন, যে রসায়ন থেকে আসক্তি আর আকাঙ্খার উৎসার ঘটে, অক্সিটোসিন অর্থাৎ প্রেমের, হরমোন বয়ে যায় দেহের ভেতরে ভেতরে । মৃতার দেহেও তা ঘটে ।
মৃতার ঠোঁটেও একই প্রক্রিয়া ঘটে বলে আমি মনে করি; আপনার হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে না । শিল্পবোধ না থাকলে এরকমই হয়, আপনার শিল্পবোধ নেই, কেবল কলেজে-পড়া জ্ঞান আছে, তাই আমার আর্ট ফর্মকে বুঝে উঠতে পারলেন না । প্রেমকে জাগতিক নোংরামির অন্তর্ভুক্ত করে ফেললেন । হয়তো যে সময়ে আপনি আমাকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করছিলেন, তখন আপনি মাদকে আচ্ছন্ন ছিলেন, আচ্ছন্নতায় আক্রান্ত আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে চালনা করছিল, আপনি শবের অভিনয় করার জন্য ভ্যানগাড়িতে শুয়ে নিজেকে নোংরা তেরপলে ঢেকে চলে এলেন আমাকে খুন করতে, এমনকি মর্গের ডোমকে বলে পায়ের বুড়ো আঙুলে ভুয়ো নামের ট্যাগও ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন । [৬] আপনার দেহের তাপ থেকে আমার অনুমান করা উচিত ছিল যে আপনি ভার্জিন নন ।
হ্যাঁ, আমি নারীর শবের সঙ্গে প্রেম করতুম । নারীর শব মাত্রেই সচ্চিদানন্দময়ী শিল্পমাধ্যম।
আমি কী করতুম ? আমি তার শরীরে প্রেম জাগিয়ে তুলতুম, আমার কাঁপুনিটুকু তাকে দিতুম, অন্ধকারে, বা গোধূলির আলোয়, ঘন জঙ্গলে, গৃহযুদ্ধে ফাঁকা গ্রামের রাস্তায়, পোড়া চালাবাড়ির পেছনে । দিনের আলোয় যা করতে সে-নারীর অস্বস্তি হয়েছে, বা মুখ খুলে বলতে পারেনি, আমি তাই দিয়েছি । আমি কোনো নারীর চরিত্রের কথা ভাবি না, ভাবিনি, সে যদি যৌনকর্মীর কাজও করে থাকে, তাতেও কিছু এসে যায় না, কেননা আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে তাকে ওই ব্যবসা থেকে মুক্তি দিই, দিতুম । ওরাও আমার শরীরের দুর্গন্ধ, আমার গায়ের রঙ, আমার নাক-নকশা নিয়ে প্রশ্ন তোলে নি কখনও । ওদের কন্ঠস্বরহীনতাই ছিল ওদের ভাষা, বেঁচে থাকতে হয়তো আমার ভাষা আর ওদের ভাষা আলাদা ছিল, একজন আরেকজনকে কিছুই বুঝিয়ে বলতে পারতুম না, প্রেম করার সময়ে দিব্বি নিজেদের সঙ্গে ভালোবাসার দুটো কথা শোনাতুম, সদ্য পরিচিত দুই পেলিকান পাখির মতো, সমুদ্র থেকে উঠে আসা নিম্নচাপের বাতাসের মতো ।
আগে আমি এই ছেলেগুলোকে থ্যাঙ্কস দিয়ে নিই, প্রায় প্রতি রাতের উপহারের জন্য । ওরা চারজন তো প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ির তলায় বসে পাতা ফুঁকতো আর ছিঁচকে চুরি করত । আমিই ওদের বিপথ থেকে বাঁচালুম । এই পোড়ো বাড়িটায় ওরা রাত কাটাতো, এখানে আলো নেই, জলের কল আছে, বাগান জংলি ঝোপে প্রায় অন্ধকার ছিল, সাফ করিয়েছি, চাপাকল কাজ করতো না, সারিয়েছি, তার আগে ওরা ভ্যানগাড়িতে চাপিয়ে আমায় মিনারাল ওয়াটারের ড্রাম এনে দিত ; মিনারাল ওয়াটারের প্রয়োজন হয় না আমার, আমি ইমিউন। বাজার থেকে আমার জন্য খাবার এনে দিতো, নিজেরাও খেতো, ম্যাকডোনাল্ড, পিৎসা হাট, কেএফসি, ওদের কি খাবার ইচ্ছে হতো না । ওরা একটাই পোশাক পরে মাসের পর মাস চালাতো, আমি ওদের পছন্দের পোশাক কিনে দিয়েছি ।
আমি ওদের আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো ভেবেছিলুম, আপনি সব ভেস্তে দিলেন ; ওদের পাসপোর্টও আমি করিয়ে নিয়েছিলুম, লেক ভিকটোরিয়াকে ঘিরে যে দেশগুলো, সেখানে গিয়ে হারিয়ে যাবার প্রচুর সুযোগ, প্রায়ই এথনিক গোষ্ঠীগুলো ক্ষমতা দখলের জন্য লড়ে মরে । সেখানে গিয়ে মিশে যেতে পারতো ভিড়ের ভেতরে ।
ছেলেগুলোর তো কোনো পরিচয়ই ছিল না, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, বিপিএল কার্ড, র্যাশান কার্ডের বাইরে যে জগত, ওরা ছিল সেই জগতের বাতিল নাগরিক । আমিই ওদের পরিচয়ের প্রতিষ্ঠা দিয়েছি। আমি চেয়েছিলুম, ওদের নিয়ে গিয়ে লেক ভিকটোরিয়ার ধারে কোনো একটা দেশে ছেড়ে দিই, তারপর ওরা নিজেদের জীবন আফ্রিকার মানুষদের মতন কাটাক, চাষে, জঙ্গলে, মাছ ধরায়, এথনিক গোষ্ঠীতে ঢুকে তাদের দল ভারি করতে, যা চায় ছেলেগুলো ।
আশেপাশের দেশগুলো হ্রদটাকে লেক ভিকটোরিয়া বলে না । লুয়ো ভাষায় বলে নামলোলওয়ে, লুগাণ্ডা ভাষায় বলে নালুবালে, বানটু ভাষায় বলে নেয়ানজা । বয়স ওদের কম, শিখে নিতো কোনো ভাষা । আবহাওয়াও ভারতের মতন, মানিয়ে নিতে পারত । ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারতো পাশের দেশ রোয়াণ্ডা কিংবা রোয়াণ্ডা হয়ে কঙ্গোয় । প্রত্যেকে স্হানীয় মেয়েকে বিয়ে করে থেকে যেতে পারতো, গোষ্ঠী-যুদ্ধে অংশ নিতে পারত ।
লেক ভিকটোরিয়াকে নষ্ট করে দিয়েছে ব্রিটেন আর ফ্রান্সের উপনিবেশবাদীরা, তাতে বিদেশি মাছ ছেড়ে । পঞ্চাশ বছরে হ্রদটার জৈবিক চরিত্র পালটে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে । জাহাজের নোংরায় জলের নীল পবিত্রতা ঘুচে গেছে ।
ওদের আমি বিপথগামী করিনি । কেবল বলতুম যে, বুঝলি, যার সঙ্গে শুচ্ছিস, তার বডি যতো ঠাণ্ডা হবে ততো আনন্দ, রিয়্যালি, আনন্দ, কেন জানিস, স্বর্গ কোথায় বল : ওপরে, ওই আকাশে তো ! ওখানটা কি গরম ? একেবারেই নয় ; ভীষণ ঠাণ্ডা, যতো স্বর্গের কাছাকাছি যাবি ততো ঠাণ্ডা । আমি যে বডির সঙ্গে শুতে চাই তাদের অমন ঠাণ্ডা চাই, বুঝলি, উর্বশী-মেনকাদের নাম শুনেছিস তো, স্বর্গে থাকে, তা ওদের বডি কতো ঠাণ্ডা ভেবে দ্যাখ তোরা, তাই তো প্রাচীন ভারতীয় মুনি-ঋষিরা হকচকিয়ে যেতো, তোরা বোধহয় মুনি-ঋষিদের পেছলাবার গল্পগুলো জানিস না, ফিল্মও তো আজকাল হিন্দু মুনিঋষিদের চরিত্র নিয়ে হয় না । [৭] ওরা অবশ্য টিভির কথা বলেছিল, কিন্তু তার পর্দায় তো অপ্সরাদের দেহের তাপ দেখানো সম্ভব নয় ।
ওদের সঙ্গে শেষবার কথা বলে নিই, আর তো বলা হবে না । এদেশ ছেড়ে চলে যাবো ভেবেছিলুম, কিন্তু ওদের সাহচর্যের কারণে কিছুদিন এই দেশে থাকার ইচ্ছা হল, আমার পূর্বপুরুষদের দেশ, সে দেশের নারীদের শবদেহের সঙ্গে শোবার ইচ্ছা হল, জড়িয়ে ধরে সারারাত কাঁদবার ইচ্ছা হল ।
এনার আগে যে বডিটা তোরা দিয়েছিলি, ওঃ, কচি আঠারো হবে, আর কতো ফর্সা, মরার পর বডি শক্ত হয়ে যায় বলে আরও আনন্দ, কোনো বডিপার্টস ঢলঢলে থাকে না, স্মল লিটল পুসি, বুঝলি । নারীর শব মাত্রেই ভার্জিন, এনট্রি শক্ত হয়ে গিয়ে ভার্জিনিটি ফেরত আনে, তা সে যতো বয়সই হোক, বুকও ফর্ম ফিরে পায়, শীতল, চুমুতে কোল্ড ড্রিংকস আর হাজার গোলাপি সারসের উড়াল। শবের সমস্ত শরীরে কৌমার্য ছেয়ে থাকে ।
জীবন্ত দেহ আমার একেবারে পছন্দ নয়, নিজের ইচ্ছেমতন হ্যাণ্ডল করা যায় না, জীবন্ত দেহের নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে থাকে, তা মানতে হয়, অমন মানামানি করতে গেলে আনন্দটাই মাটি । তার ওপর জীবন্ত দেহের নিজের তাপ হয়, আমার তাতে ছ্যাঁকা লাগে, আনন্দ পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যেন সদ্য বেরিয়ে আসা নীলাভ ধোঁয়া-ওড়ানো লাভার হল্কার ওপর শুয়ে আছি ।
পনেরো-ষোলো বছর বয়সে জীবন্ত দেহের সঙ্গে অনেক শুয়েছি, ভাল্লাগে না, কাদার চোরাবালিতে সেঁদিয়ে যাচ্ছি মনে হয়, সঙ্গে তার রস, কী কেলেঙ্কারি । দেহের যা নাম সেই নামেই সে আটকে থাকবে, আমি তার নাম প্রতি চুমোর সঙ্গে পালটাতে পারব না, ভাববে দেহের বদলে নামে অরগ্যাজম আনতে চাইছে । জীবন্ত দেহের অরগ্যাজম দরকার হয়, অনেক সময়ে বারবার ।
রোয়াণ্ডা থেকে জার্মানিতে যখন গিয়েছিলুম, ওখানে তো যৌনালয়গুলো লিগ্যাল, তাই যৌনরোগের ভয় কম, রেগুলার চেকআপ হয়, কাজের জন্য লাইসেন্স দরকার হয় । সেখানে যৌনকর্মীদের কতোবার বলেছি যে শব সেজে চুপচাপ পড়ে থাকো, তা তারা পারে না, তারা তো আফটার অল জীবন্ত দেহ । হেসে ফ্যালে কিংবা অভ্যাসমতো প্রেমিকার ভান করে, নকল অরগ্যাজমের অভিনয় করে । মেজাজ খারাপ করে দেয় ; আর জার্মান মেয়েদের গা বড্ডো গরম, ওরা, মনে হয়, হিটলারের রাজনৈতিক তাপ থেকে মনে মনে বেরোতে পারেনি এখনও। একজন তো প্রায় হুমকি দেবার মতন করে বলেছিল, অতোই যদি শখ তো চলো না ফুলের কোল্ড স্টোরেজে গিয়ে শুই আর প্রেম করি ।
নারীর শবদেহ ফোর প্লে চায় না, অরগ্যাজম চায় না, সে চায় স্বর্গীয় ভালোবাসা, দেবদূতের ভালোবাসা, চায় তার কৌমার্যের বন্দনা, অর্চনা।
শবদেহের সঙ্গে যে ভাবে ইচ্ছে শুতে পারি, সে খুঁতখুঁত করবে না, অভিনয় করবে না, নারীর শবদেহ হল অবিনশ্বর, শাশ্বত, ভালোবাসা দিয়ে উত্তরণে নিয়ে যায় । মৃত্যুর নিজের হাতে তৈরি করা আর্ট।[৮]
মৃত নারীদের প্রয়াত বলা ভুল. তারা চিরকাল অমর, নারীর শবে অজস্র স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে, আমি সেই স্বপ্নগুলোর ভেতরে গিয়ে খেলা করি, জড়িয়ে ধরে নিয়ে যাই সমুদ্রের তলদেশে, শবের দেহ থেকে নানা রঙের রঙিন মাছ বেরিয়ে আসে ঝাঁক বেঁধে, আমাকে ঘিরে খেলা করে তারা, কিংবা উড়িয়ে নিয়ে যাই মেঘের রূপালি কিনারায়, সে আমাকে তুলতুলে মেঘের চাদরে মুড়ে ঘুমোয় ।
স্যাঁতসেতে মাটি বলে সে, নারীর শবদেহ, কখনও অভিযোগ করবে না, বলবে না যে আমার ডানলোপিলোর বিছানা চাই, মখমলের চাদর চাই, সাটিনে মোড়া বালিশ চাই, স্কচ হুইস্কি চাই, পুরু চকোলেট চাই, সুগন্ধী রঙিন কনডোম চাই । দাঙ্গায় পোড়ানো বাড়ির মেঝেতেও সে সুখী, গৃহযুদ্ধে খুনোখুনির শেষে মাঠের অন্ধকারে মশার ঝাঁকের ভেতরে শুয়েও সে সুখী । [৯]
হ্যাঁ, আমি নারী শবের সঙ্গে প্রেম করে পরমানন্দ পাই । নারীর শব মাত্রেই সচ্চিদানন্দময়ী আর্ট ফর্ম।
নারীর শবদেহ ভালোবালা বিলিয়েই সন্তুষ্ট । তার সঙ্গে ফিসফিস করে অশ্লীল কথা বলা যায় । নারীর শবদেহ থেকে যে জ্ঞান পাওয়া যায়, তা জীবন্ত দেহ থেকে পাওয়া যায় না, জীবন্ত দেহ সব ব্যাপারে নাক গলায়, নিজেকে সবজান্তা মনে করে।
নারীর শবদেহ শোবার সময়ে বিশেষ ক্ষমতা দিতে থাকে, জীবন্ত দেহ উলটে ক্ষমতা শুষে নিতে থাকে। জীবন্ত দেহের জন্য নিত্যনতুন উপহার দিতে হবে । নারীর শবদেহ সেসব কিছুই দাবি করে না, সে বরং দেবার জন্য অপেক্ষা করে থাকে ।
নারীর শবদেহ কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না যা জীবন্ত দেহ করে, হ্যান চাই, তেন চাই, এই দাও, সেই দাও, এই কোরো না, তাই কোরো না ।
নারীর শবদেহ ফিস ফিস করে কানে কানে বলে আমাকে নাও, আমাকে ভালোবাসো, আমাকে জড়িয়ে ধরো, আমাকে তোমার বুকে মিশিয়ে নাও ।
নারীর শবদেহ সমস্ত কাজকে অনুমোদন করে, মুখ বন্ধ করে বলে হ্যাঁ, যা করছ ভালো করে করো, ভালোবাসো, আমায় আগাপাশতলা ভালোবাসো, ভালোবাসো, ভালোবাসো , তুমিই আমার শেষতম প্রেমিক, আমাকে নাও, আমাকে পৃথিবীর যোগ্য করে তোলো, আকাশের যোগ্য করে তোলো, নীহারিকার যোগ্য করে তোলো, নক্ষত্রপূঞ্জের যোগ্য করে তোলো ।[১০]
নারীর শবদেহ হলো শক্তির পূজারি, আত্মত্যাগের পূজারি । নারীর শবদেহের কোনো ধর্ম হয় না । সে শবে রুপান্তরিত হবার সঙ্গে-সঙ্গে ধর্মের নোংরামো তাকে ছেড়ে চলে যায় । কোনো ধর্মযুদ্ধে যোগ দিতে সে ওসকাবে না ।
নারীর শবদেহের সঙ্গে প্রেম তাকে আবার জৈব করে তোলে, তার শরীরে শিল্পের প্রাণ এনে দেয় ভালোবাসার মাধ্যমে ।
নারীর শবদেহ বলে ওঠে, উলটো রাস্তায় কেবল প্রতিভাবানরাই হাঁটে, হে প্রতিভাবান, তুমি আমাকে আগুনের সন্ত্রাসে বা মাটির কালো কারাগারে যাবার আগে চুটিয়ে ভালোবাসো, ভালোবাসো, ভালোবাসো ।
জীবন্ত দেহের প্রেম হল দু’পক্ষের পারস্পরিক সন্ত্রাস । আধুনিক সভ্যতা মানেই সন্ত্রাস । আমি আমার শবপ্রিয়াকে আধুনিকতার সন্ত্রাস থেকে বের করে আনি ।
জীবন্ত দেহরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না । তারা ভালো সন্ত্রাসবাদী আর খারাপ সন্ত্রাসবাদীর কথা বলে, অথচ অসততার সন্ত্রাসবাদ ছাড়া রাজনীতি হয় না, রাজনেতা মানেই অসততা, কোনো রাজনেতা যুদ্ধাস্ত্র কমাবে না, যুদ্ধশিক্ষা বন্ধ করবে না ।
হ্যাঁ, আমি নারী শবের সঙ্গে প্রেম করি । তাদের সঙ্গে প্রেম করে পরমানন্দ পাই । আমার কাছে তা আমার নিজস্ব আর্ট ফর্ম ।
নারীর শবের সঙ্গে কথা বলার সময়ে শব্দগুলো মানেহীন আর ফাঁপা হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই ; মানেহীন কথাবার্তাই তো ভালোবাসা, নয়কি ! তা হলেই বা ! মৃত্যু হল জীবনের ওপার থেকে আনা প্রেমের বীজ ।
নারীর শবদেহের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, যা জীবন্ত দেহের থাকে, জীবন্ত দেহ বর্তমান আর ভবিষ্যতের চিন্তায় নিজেকে বিষাক্ত করে তোলে । যুবতী হলে সে যৌবন হারানোর আতঙ্কে আক্রান্ত হয়, প্রৌঢ়া হলে সে বৃদ্ধা অকর্মণ্য হবার দুশ্চিন্তায় সময় কাটায় ।
জীবন্ত দেহের সঙ্গে শুলে, কিছুক্ষণ পর যে একাকীত্ববোধ কামড়ে ধরে, তা শবদেহের সঙ্গে শুলে হয় না, শবদেহের বগলের খাঁজে জোনাকির ঝাঁক এসে বসলেও সে বিরক্তির অভিনয় করে না, খাঁজ থেকে জোনাকিগুলোর তরল পারা তুলে তার ভেতরে লুকিয়ে যেতে দেয় সে, লুকিয়ে যেতে দেয় তার গন্ধের ঢেউয়ে । বহুক্ষণ চোখ মেলে তার দেহের প্রতিটি ইঞ্চের, খাঁজের, ভাঁজের রহস্য খুঁটিয়ে দেখা যায়, অথচ জি-স্পট হাতড়ে খুশি করার সমস্যায় ভুগতে হয় না, তার সঙ্গে প্রতিটি অভিজ্ঞতা ভিন্ন, জীবন্ত দেহের মতন রিপিটিটিভ নয় ।[১১]
জীবন্ত দেহের সঙ্গে প্রেম হলো অর্থহীন অভিজ্ঞতা, কেননা আরেকজন সেই অভিজ্ঞতাকে থিতোতে দেয় না, বাগড়া দিতে থাকে, মাথা গলায়, অনেক সময়ে তো দু’পায়ের মাঝেও বকবক থামাতে পারে না, বোকার মতন হাসাহাসি করে । দুটি জীবন্ত দেহের মাঝে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তাদের মস্তিষ্ক ।
নারীর শবদেহ জানে যে সতীত্ব হল সবচেয়ে গোঁড়া বিকৃতি । শবের তুলনায় বিছানায় কেউ সুশ্রী নয়, তাদের গর্ভবতী হবার আতঙ্ক নেই, গর্ভনিরোধক বড়ি খেতে হয় না ।
নারীর শবদেহরা আমাকে ভয় থেকে টেনে বের করে এনেছে ; আমাকে পাপ-পূণ্যের বিভাজন থেকে মুক্ত করে জানোয়ারের মতন স্বাধীনতা দিয়েছে, সিংহের মতন, বাঘের মতন, চিতাবাঘের মতন, জাগুয়ারের মতন, হায়েনার মতন, যাদের কোনো কাজে পাপ নেই ।
কোনো কোনো শবের মুখ কি দুঃখি হয় না ? হয় । তাদের কষ্ট আমি নিজের ভেতর তুলে আনি, আর শবদেহের মুখে আমি হাসি ফোটাবার চেষ্টা করি । এমনকি সে শবের বুকে-পেটে পোস্টমর্টেমের কাটা-সেলাই থাকলেও । অবহেলার প্রশ্ন নেই, অবিচারের প্রশ্ন নেই। আমি তাকে বর্তমানে টেনে নিয়ে এলেও তারা নিজের নিজের অতীতের গল্পহীন কাহিনিকে লুকিয়ে রাখে, আমি সেই দুঃখের আলাদা গল্প তৈরি করে নিই, তার দুঃখে কাঁদি । কাগজে তার সম্পর্কে সাংবাদিকরা যে গল্প লেখে, আমি তা বিশ্বাস করি না, সে তো শবদেহ, তার কোনো দোষ থাকতে পারে না, সে অপরাধের, পাপের, গ্লানির ঊর্ধে ।[১২]
নারীর শবদেহ হলো পুরোনো গান যা হারিয়ে গেছে, যে মেলোডি আর ফিরবে না । জীবন্ত দেহ হল এই সময়ের ঝালাপালা গান, যা ক’দিনেই লোকে ভুলে যাবে । আমি নারীর শবের শরীরে আমার পছন্দের সঙ্গীতের ঝিলমিলে নক্ষত্রের পোশাক পরিয়ে দিই, প্রেম নিখুঁত হয়ে ওঠে, ভালোবাসা হয়ে ওঠে পূর্ণাঙ্গ ।
নারীর শবদেহ কখনও প্রেমের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে না, ডাক দিলেই আলিঙ্গনে সাড়া দেয় । জীবন্ত দেহ প্রত্যাখ্যান করে, অপমান করে ।
জানি, পছন্দের শবদেহের সঙ্গে আবার দেখা হবে না কোনোদিন । অথচ সারারাত চুমো খেয়েছি ঠোঁটে, বুকে মুখ গুঁজে থেকেছি বহুক্ষণ, অক্লান্ত মুখমেহন করেছি, তা অলৌকিক, তা এক অসেতুসম্ভব সেতু।
হ্যাঁ, আমি নারীর শবের সঙ্গে প্রেম করি । আমি একজন শিল্পী ।
মর্গের ডোমটাকে ড্রাগ অ্যাডিক্ট করাতে এই ছেলেগুলোর পনেরো-কুড়ি দিন সময় না লাগলে আগেই আনন্দ নিতে পারতুম, বুঝলেন, ওদের ড্রাগের টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে রেখেছি, যদি আরও দরকার হোতো, দিতুম, ওদের বলেছিলুম আমার কথা কাউকে কক্ষনো বলিসনি যেন, তাহলে আমাকে তো বিপদে ফেলবিই, নিজেরাও বিপদে পড়বি, ডবল ফৌজদারি জুটবে, ড্রাগ নেবার আর মেয়েদের ডেড বডি তোলার ।
যে ভ্যানগাড়ি ওরা কিনেছে, শবকে চাপা দিয়ে আনার তেরপল কিনেছে, এটা প্রশংসার, পাবলিক দেখলে ভাবতো পুলিশের কাজেই যাচ্ছে, যদিও সন্ধ্যার অন্ধকারে কেউ অতো খেয়াল করতো না, তবুও। নারীর শব জানতে পারলে মানুষ তার দেহ দেখতে চায় না, অপয়া মনে করে, অথচ তার গল্পটুকু জানবার জন্য সতত উৎসুক থাকে ।
ওরা একদিন এক নারীর শবদেহের ওপর পারফিউম ছিটিয়ে এনেছিল । বুঝিয়েছিলুম, শবের উঁচু জাত নিচু জাত হয় না, নোংরা-পরিষ্কার হয় না । শব হল শব, শিল্পমাধ্যম । সুগন্ধিত করার কোনও দরকার ছিল না । গরিব বাড়ির হলেই বা, হয়তো জীবনে কখনও সাবান মাখেনি, তাই বলে শরীরের গন্ধ চাপা দিতে পারফিউম ? ছিঃ । নারীর শবদেহের গন্ধই মাতনলাগানো, একটা আমেজ থাকে, যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহাবাসিনী, জংলি জানোয়ারের কাঁচা মাংস খেয়ে গায়ে হাত পুঁছে নিয়েছে, সৌন্দর্যের ডিভাইন রূপ, পুঁজিবাদের শেকল থেকে মুক্ত ; তার তো ফ্যাশানিস্টা হবার দরকার নেই কোনো, সে তো ঈর্ষার কামড়ে দুমড়ে যায়নি, জীবন্ত দেহদের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় নামে না । সে প্রতি মাসের মেন্সের কষ্ট থেকে মুক্ত । আইডিয়াল, কতো রোমান্টিক ভেবে দেখুন ।
এই শিল্পে, অর্থাৎ শবদেহের সঙ্গে প্রেমে, দরকার হয় শিভালরি, ড্রামা, ইশারা, সম্পর্কের গভীরতা, আসক্তি, কামোচ্ছ্বাস, অন্তরঙ্গতা, সমবেদনা, উপলব্ধি, সম্বন্ধ । তাতে “আমি তোমার তুমি আমার” ধরণের ভালগার ফিলমি ক্লিশের জায়গা নেই, আমি তাকে ঘর বাঁধতে বাধ্য করি না, সেও আমাকে সংসার পাততে অনুরোধ করে না । আমি জানি যে আমি প্রতি রাতে একটা তরোয়ালের ধারের ওপরে দাঁড়াই, কিন্তু আমি জানি যে আমার প্রেমিকা একজন শবদেহ, তাই আমার কিছুই হবে না । যে কোনো নতুন আর্ট শুরু করতে গেলে ঝুঁকি নিতে হয় বটে, তবে শেষ পর্যন্ত শিল্পীর কোনো ক্ষতি হয় না । [১৩]
জীবন্ত দেহের সঙ্গে বিয়ে করলে দেখবেন যে প্রেম তাদের জীবনের কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে চলে গেছে । নারীর শবদেহ হল ব্লিস, ইউ ক্যান গো অন কাউন্টিং ইওর ব্লিসেস, যতো দিন তাদের সঙ্গে প্রেম বজায় রাখবেন, ততোদিন আপনি ব্লেসেড । প্রেম হল ক্ষুধার মতন, ক্ষুধাও তো ব্লিস, নয়কি ?
নারীর শব কোনোরকম অন্তর্দ্বন্দ্বতে ভোগে না, তার কোনো উচ্চাকাঙ্খাও থাকে না । আমি তাকে গতকালের সঙ্গে আগামীকাল মেলাবার মুহূর্তে নিয়ে আসি । শবের ওপরে শব হয়ে শুয়ে পড়ি আর ক্রমশ দুজনেই মৃত্যুর ওপারের মানুষ হয়ে যাই । আমি তো তার আত্মপরিচয় হ্যাক করছি না । সে তো অনাত্মা । সে কচি হলেও ভিডিও গেম, কেবল টিভি, ফিল্মে সময় অপচয় করে না, কমপিউটার ভাইরাস নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে না । তার প্রণয়ের জগতে আমি মিষ্টি করে গ্লাইড করে যাই, যার দরুণ সম্পর্ক হয়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্ত ; সে জীবন্তকালের প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আত্মহত্যা করে থাকলেও, আমি তার জীবনে বিকল্প ন্যারেটিভ যোগ করে প্রতিদানহীনতার গ্লানিকে মুছে দিই ।
জীবন্ত দেহদের প্রেমের কাছে বড় বেশি চাহিদা থাকে, তার ফলে সৃষ্টি হয় মোহভঙ্গ । একজন চায় আরেকজনকে ভোগদখল করার অধিকারী হতে, ফলে অন্যজন সেই বাঁধন কেটে বেরিয়ে যেতে চায় । দুজনের মধ্যে শুরু হয় গোপন লড়াই, যার দরুণ এক পক্ষ পরিত্যক্ত বোধ করে । একজন চালায় গোপন লড়াই, আরেকজন গোপনে বোধ করে পরিত্যক্ত থাকার একাকীত্ব। জীবন্ত প্রেমিক-প্রেমিকা গোপনে পরস্পরকে ঘেন্না করা আরম্ভ করে, আর ভাবে সেটাই বুঝি প্রকৃত প্রেম । জীবন্ত দেহরা সম্পর্ককে চাপাচুপি দিয়ে এমনি করেই যৌবন পার করে, প্রৌঢ় হয়, তারপর বুড়িয়ে যায় ।[১৪]
এই ফাঁকা বাড়িটা যে ওরা আইডেনটিফাই করেছিল, এটা দারুণ কাজ । শহরের ঝুটঝামেলার বাইরে, শাল আর শিমূল গাছে ঘেরা, চারিদিকে বৈঁচির ঝোপ, অসাধারণ, এই পোড়োবাড়ির সন্ধ্যা প্রতিদিন তার গন্ধ বদলে-বদলে অন্ধকারকে মোহিনী করে তোলে ।
এনার সঙ্গে দুর্ঘটনার আগের বডিটা ঠিকমতন ডোমটাকে হ্যাণ্ড ওভার করে দিয়েছিলিস তো তোরা? যেমন ড্রেস পরানো ছিল তেমন করে ? বুড়ো আঙুলে নামের যে ট্যাগ লাগানো ছিল তা আমি দেখিনি, দেখলেই সর্বনাশ, তার পরিচয় তার বডির সঙ্গে লেপ্টে যাবে, তার ধর্ম, তার ভাষা আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে । আপনার বুড়ো আঙুলের ট্যাগও আমি চেয়ে দেখিনি ।
আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে আমি বাঙালি, রিয়্যাল ব্ল্যাক বেঙ্গলি ব্লাড । আমার পদবি কাঙালি হয়েছিল দাদুর বাবার কারণে, আমার নাম দীনেশ কাঙালি, ওরা, চার্চের পাদরিরা, উচ্চারণ করতে পারত না, করে দিলে ডেনিস কাংগালি । আমার দাদার নাম বাবা রেখেছিলেন রমেশ কাঙালি, পাদরিরা দাদাকে করে দিলে র্যামজে কাঙালি । পুরো গল্পটা শুনলে বুঝতে পারবেন ।
জানি একে, আমার শিল্পকর্মকে, আপনারা নেকরোফিলিয়া বলেন ; চেষ্টা করেও এই আকর্ষণ থেকে মুক্ত হতে পারিনি । এই দোষ আমার দাদুর বাবার ছিল । একজন মাসাই যুবতীকে খুন করে তার শবকে ধর্ষণ করেছিল কয়েকজন কুলি, দাদুর বাবা এক মাসাই যুবতীর শবকে জড়িয়ে রাতভর কেঁদেছিলেন । মাসাইরা দুই যুবতীকে ধর্ষণের জন্য তীর-ধনুক বর্শা নিয়ে কুলিদের ঘিরে ধরেছিল কিন্তু দাদুর বাবার আচরণে তারা অবাক হয়ে গিয়েছিল, তারা মেয়ে দুটির শব নিয়ে যখন চলে যাচ্ছিল, তখন তাদের ওপর গুলি চালিয়েছিল রেল কোম্পানির সশস্ত্রবাহিনী, ভবিষ্যতের বিদ্রোহ শুরুতেই দাবিয়ে দেবার উদ্দেশে ।
আমি সেই রোগে আক্রান্ত হলুম রোয়াণ্ডায়, যেসময়ে হুটু আর টুটসিদের খুনোখুনি আরম্ভ হল, আমার মা তো টুটসিদের হাতে খুন হয়েছিল, বাবাও টুটসিদের হাতে খুন হয়েছিল, পরে দাদা আর দাদার বউ খুন হয়েছিল টুটসিদের হাতে । গৃহযুদ্ধের খুনোখুনির সময়ে আমি হুটু খুনিদের একটা ছোটো দলের নেতা ছিলুম ।
আপনি হয়তো ভাবছেন বাঙালি হয়েও আমি কেন এরকম কালো, পুরু ঠোঁট, থ্যাবড়া নাক, আমার পদবি কেন কাঙালি, বাঙালির তো এরকম পদবি হবার কথা নয়, এরকম চেহারা হবারও কথা নয় । ঠিকই অনুমান করেছেন । আমার দাদু, মানে ঠাকুর্দার নাম ছিল কাঙালি, পদবি কি ছিল তা জানি না, সবাই ওনাকে কাংগালি বলেই ডাকত, ওনার ছেলে হল, তার পদবি হয়ে গেল কাংগালি । [১৫]
দাদুর বাবা আর বউকে যখন ফুসলিয়ে আরও বত্রিশ হাজার কুলির সঙ্গে কেনিয়া-উগাণ্ডা রেললাইন পাতার জন্য ১৮৯৬ সালে আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন দাদুর বাবার বয়স আঠারো আর ওনার বউয়ের বয়স তেরো ।
আড়কাঠিরা ভেবেছিল ওনাদেরও দক্ষিণ আমেরিকায় আখচাষের খেতে মজুর হিসেবে পাঠাবে, কিন্তু আফ্রিকার রেল লাইনের জন্য মাথাপিছু কমিশন বেশি পাচ্ছিল বলে পাঠিয়ে দিলে রেল লাইন পাততে । ব্যাপারটা ভেবে দেখুন । আফ্রিকা থেকে, জালের ফাঁদ পেতে, পালোয়ান মানুষ ধরে-ধরে দক্ষিণ আমেরিকা আর আমেরিকায় জাহাজে চাপিয়ে ইউরোপীয়রা চালান করে দিলে সেখানে কেনা গোলামের কাজ করতে, ওই যাকে বলে স্লেভ, অথচ সেই পালোয়ানগুলোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না মনে করে এশিয়ানদের নিয়ে গেল রেল লাইন পাততে ।
স্লেভদের বাঙালিরা কেন ক্রীতদাস বলে জানি না ; স্লেভরা তো কেনা নয়, জোর করে কিডন্যাপ করে তুলে নেয়া, তারপর নিলাম ডেকে দল বেঁধে বিক্রি ।
রেল লাইন পাতার শ্রমিকদের কেন কুলি বলা আরম্ভ হল তাও জানি না ।
তখন তো পুরো আফ্রিকাকে ইউরোপীয়রা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির জন্য খেয়োখেয়ি করছে । ইনডিয়ায় যেমন ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানি প্রথমে খুঁটি গেড়ে তারপর সরকারকে ডেকে আনলে, তেমনি কেনিয়া আর উগাণ্ডায় ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকা কোম্পানি মোমবাসার কিলিনডিলি বন্দর থেকে কেনিয়া-উগাণ্ডা রেললাইন বসিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে আনার পোক্ত ব্যবস্হা করে ফেললে । ১৯০০ সালে লাইনটা পৌঁছেছিল নাইরোবি, ১৯০১ সালে কিসুমুর ফ্লোরেন্স বন্দরে । রেল লাইনকে এলডোরেট থেকে কামপালা পর্যন্ত বেছানো হয়েছিল, যাতে ভিক্টোরিয়া হ্রদে জাহাজে করে মাল চালান এড়ানো যায় । রেল লাইনের জন্যই ইথিওপিয়া থেকে মুসোলিনির ইটালিকে তাড়াতে পেরেছিল ব্রিটিশ সৈন্যরা, নামে ব্রিটিশ সৈন্য, কিন্তু জওয়ানরা বেশির ভাগ ছিল ভারতীয় । প্রথম দিকে রেলের ইনজিন আর কামরা যেতো ভারত থেকে, যেগুলো প্রায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল সেগুলো ।
দু লাখ লোক লেগে ছিল ওই রেল লাইন বসাতে, এমন রেল লাইন যে, বাবার মুখে শুনেছি, লোকে বলত লুনাটিক এক্সপ্রেস , মাসাইরা বলত ইস্পাতের অজগর । [১৬]
সাভো নদীর ধারে লাইন বসাবার সময়ে আঠাশ জন কুলিকে খেয়ে ফেলেছিল দুটো মদ্দা সিংহ । প্রথম যাকে খেয়েছিল, সে একজন শিখ সরদার, তার নাম উগন সিং । পরে যাদের খেয়েছিল সিংহ দুটো, তাদের নাম-সাকিন কেউ জানে না, অতো কুলির মধ্যে প্রায়ই তো কেউ না কেউ মারা যেতো । সিংহদের পালের ব্যাপারটা জানেন তো । সিংহীদের হারেম নিয়ে একজন সিংহই থাকতে পারে । সিংহীদের হারেমের দখল নিতে পালের গোদা বিগ ড্যাডি মদ্দা সিংহকে লড়াইতে হারিয়ে দখল করতে হয় । বাচ্চা হলে মাদিগুলো পালে থেকে যায় আর মদ্দাগুলোর ঘাড়ে কেশর উঁকি দিলেই তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয় । তাড়ানো সিংহগুলো তালে থাকে কখন পালের গোদা বিগ ড্যাডি মদ্দাটা বুড়িয়ে যাবে, বা শিকার ধরতে গিয়ে আহত হবে । নতুন যে মদ্দাটা পালের দখল নেয়, সে যদি দ্যাখে যে পালেতে আগের বিগ ড্যাডির শিশু-সিংহ রয়েছে, তাহলে সেগুলোর টুঁটি টিপে মেরে ফ্যালে, যাতে মা-সিংহী আবার গর্ভবতী হবার জন্য তৈরি হয়ে ওঠে । কতো সুন্দর ব্যবস্হা, বলুন । কারোর কোনো পাপবোধ নেই । মরা শিশু-সিংহীর মায়েরাও নতুন মদ্দাকে আকৃষ্ট করার জন্য যা-যা করা দরকার তা করে। অনেকটা বাড়ি থেকে তাড়ানো বজ্জাত ছেলের মতন । মদ্দা সিংহ দুটো অমনই বজ্জাতি করে বেড়াতো । চিফ ইনজিনিয়ার মিস্টার প্যাটারসন গুলি করে খতম করে দুটোকে ।
এখনকার যে নাইরোবি শহর তার জন্য খেটে মরেছিল ভারতীয় কুলিরা । তার আগে জায়গাটা ছিল বিশাল একটা ডোবা, বাবার ঠাকুর্দারাই নাইরোবিতে আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোর বনেদ তৈরি করেছিল । ১৯২০ সালে কেনিয়াকে ব্রিটিশ কলোনি বানানো হয়েছিল । ভারতীয়রা সেখানে এখন পাত্তা পায় না ।
রেল লাইনের গল্প কেন শোনাচ্ছি জানেন ? তাহলে আমার ব্যাকড্রপ বুঝতে সুবিধা হবে । আমি ‘অ্যাকচুয়ালি’ কোন জগতের তা আপনার কাছে স্পষ্ট হবে ।
গুজরাটিরা তার আগে জাহাজে মাল চাপিয়ে আফ্রিকায় পাঠাত । রেল লাইন বসার পর আফ্রিকার ভেতরে মাল পাঠাতে সুবিধা হয়ে গেল, আর মুটের মাথায় চাপিয়ে, সিংহের পালের মুখে পড়ার বিপদ রইল না । একে একে গুজরাটিরা উগাণ্ডা আর কেনিয়ায় ব্যবসা আরম্ভ করে দিলে, ওদের আফ্রিকানরা আজও দুকানওয়ালা বলে ডাকে । ১৯৬০ সালের পর কেনিয়া, উগাণ্ডা, তানজানিয়ার স্বাধীনতার পর ওরা, গুজরাতিরা, কেনিয়া-উগাণ্ডা থেকে আফ্রিকার অন্য দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়ল।
কাজ শেষ হয়ে গেলে পঁচিশ হাজার কুলি ভারতে ফিরে গিয়েছিল । আমার দাদুর বাবা আর মা উগাণ্ডায় থেকে গেল, উগাণ্ডা জানেন তো, সেই যে দেশে ইদি আমিন নামে একজন শাসক ছিল, পাঁচ লাখ লোককে মেরে ফেলেছিল, যেমন টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানে বুদ্ধিজীবীদের বেছে-বেছে খুন করেছিল, আল বদর রাজাকর দল গড়েছিল, ঠিক তেমনিই ইদি আমিন নিজের দেশের বুদ্ধিজীবীদের, এমনকি নিজের বন্ধুদেরও, খুন করে লোপাট করে দিয়েছিল । লোকটা সুন্দরী আফ্রিকান দেখলেই জোর করে বিয়ে করত, একটা বউকে নাকি কেটে রেঁধে খেয়ে ফেলেছিল । তারপর ব্যাটা ভারতীয়দের ব্যবসা দখল করে আফ্রিকানদের মধ্যে বিলিয়ে দিলে, আর ভারতীয়দের উগাণ্ডা থেকে কেটে পড়ার হুমকি দিলে, যাদের ব্রিটেনের পাসপোর্ট ছিল তারা ব্রিটেনে পালালো । গুজরাটিরা চালাক-চতুর, ওদের ব্রিটিশ পাসপোর্ট ছিল । আশি হাজার ভারতীয় পালালো নানা দেশে ।
১৯৭৯ সালে আর ১৯৮৬ সালে উগাণ্ডায় গৃহযুদ্ধের সময়ে জঙ্গলের ভেতরের রেল লাইন উপড়ে বেচে দেয়া আরম্ভ করেছিল স্হানীয় আফ্রিকানরা । ভারত থেকে পাঠানো সেকেণ্ড হ্যাণ্ড ইনজিন আর কামরাগুলোও ততোদিনে ঝরঝরে হয়ে পড়েছে ।
আমার বাবা বোকার মতন ব্রিটেনের পাসপোর্ট নেয়নি, ভেবেছিল, জমিজমা খেতখামার রয়েছে, এদেশেই থেকে যাই, আমরা নাকি জাতে চাষি ছিলুম । বাবার মতনই আরও আটঘর বাঙালি পরিবার, যারা জমিজমা খেতখামার নিয়ে আনন্দে ছিল, তারাও থেকে গিয়েছিল । লোকে তাই আমাদের ইনডিয়ান ইস্ট আফ্রিকান বলে চেনে । আমাদের নিজেদের মধ্যেই বিয়ে-শাদি হতো, কেউ-কেউ অবশ্য আফ্রিকান মেয়ের প্রেমে পড়ে বিয়ে করে তাদের গোষ্ঠীতেও ঢুকে গিয়েছিল , যেমন আমার দাদা র্যামজে কাঙালি।
শেষে ইদি আমিনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমরা আর ওই নয়টা পরিবার পাশের রাজ্য রোয়াণ্ডায় গিয়ে বসবাস শুরু করলুম । আমি তখন ছোটো ছিলুম, আমার বডি দেখছেন তো, আফ্রিকানদের চেয়ে কম নয়, হাতের মাসল দেখুন, বুকের মাসল দেখুন । ফাইটিঙে কেউ পারত না আমার সঙ্গে, রোয়াণ্ডার হুটুরাও নয়, টুটসিরাও নয় ।
আপনার বোর হচ্ছে না তো ? অনুবাদ করিয়ে ট্র্যান্সক্রিপ্ট নেবেন, অপ্রয়োজনীয় মনে হলে সেই অংশ বাদ দিয়ে পরের অংশ পড়া আরম্ভ করবেন ।
আপনি জামিন নিয়ে আপাতত ছাড়া পেয়েছেন । আমি জামিন নিইনি, ছাড়া পেতে চাই না, কেননা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছি । আপনি জামিন নিয়ে থাকলেও মামলা আরম্ভ হলে আপনার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করতে পুলিশের অসুবিধা হবে না ; হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তাও মর্গের ডোম বলেছে পুলিশকে, এই ছেলেগুলোও তেমনই স্টেটমেন্ট দিয়েছে ; হত্যার জন্য ব্যবহৃত ছোরা, তাতে আপনার আঙুলের ছাপ, আর আমার রক্ত পাওয়া গেছে । জানেন তো তার সাজা কী, হয় যাবজ্জীবন কিংবা ফাঁসি । আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই, এই ছেলেগুলোকে থার্ড ডিগ্রি মার দিয়ে পুলিশ ওদের মুখ থেকে যে তথ্য আদায় করেছে, সে সমস্ত তথ্যের কোনো প্রমাণ নেই, কোনো শবের কিছুই পাওয়া যায়নি, তাদের কবেই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বা গোর দেয়া হয়েছে, পুলিশ ওদের কুকুর এনে শুঁকিয়েও পায়নি কিছু ।
আমি নিজে থেকে যাবতীয় তথ্য রেকর্ড করছি, এইটুকুই হয়তো আমার বিরুদ্ধে প্রমাণের জন্য যথেষ্ট । কিন্তু মামলা যখন আরম্ভ হবে তখন আমি এই শহরের কোনো গোরস্তানে মাটির তলায় ঘুমোচ্ছি, হয়তো এমন কোনো নারীর গোরের পাশে, যার শবের সঙ্গে শুয়েছিলুম ।
আপনি প্রকৃত সুন্দরী, ফর্সা, তা আমাকে ক্ষণিকের জন্য দুর্বল করে দিয়েছিল, নয়তো আপনার দেহের তাপ থেকে আমি কি সন্দেহ করতুম না, যে এর শব তো ঠাণ্ডা নয়, এর দেহে নিশ্চয়ই রক্ত চলাচল করছে, এখনও এর প্রকৃত মৃত্যু হয়নি । আপনাকে আপনার পোশাক পরিয়েই এনেছিল ছেলেগুলো, মর্গের ডোম সেভাবেই চাপিয়ে দিয়েছিল ওদের ভ্যানগাড়িতে, তেরপলের চাদর চাপা দিয়ে । আপনি যে শাড়ির ভেতরে ছোরা গুঁজে রেখেছেন তা খেয়াল করতে পারিনি, আপনার চোখ বোজা অপরূপ কচি মুখের দিকে তাকিয়ে ।
শবকে আমার বিছানায় শুইয়ে দেবার পর আমি পোশাক খুলি, জেনে গিয়েছিলেন হয়তো, এও শিখে এসেছিলেন যে তলপেটে ছোরা মেরে তার বাঁটকে ঘুরিয়ে দিতে হয়, তেমন করলেই নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যায়, বাঁচার সম্ভাবনা থাকে না । [১৭]
প্রতিশোধের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়েই এসেছিলেন । আমি কিন্তু মনে করতে পারছি না কোনটা আপনার দিদির শব ছিল, যার সঙ্গে শুয়েছিলুম বলে আপনি প্রতিশোধ নেবার ষড়যন্ত্র করলেন । আপনার মতন সুন্দরী তো কোনো শবই ছিল না । তাছাড়া আপনার দিদি আত্মহত্যা করে থাকলে শবের পোস্টমর্টেমের কাটা-সেলাই থাকতো বুকে পেটে, যদি না আপনারা কর্তৃপক্ষকে টাকা খাইয়ে আত্মহত্যার মামলা হাশাপ করিয়ে দিয়ে থাকেন । হয়তো তাই করেছেন, কেননা যে দুটি শবের পোস্টমর্টেম করা দেহ ওরা এনেছিল, তারা দুজনেই ছিল কালো ।
আমি আহত হবার পরও আপনার হাত থেকে ছোরাটা কেড়ে নিয়ে আপনাকে খুন করে, শুতে পারতুম আপনার সদ্যমৃত শবের সঙ্গে, আমার দেহে যথেষ্ট শক্তি ছিল । আমার অভিজ্ঞতাও আছে । তা করিনি, কেন জানেন ?
অতীতের এক ঘটনার ঝলক মাথায় আসার সঙ্গে-সঙ্গেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে টুটসিদের হাতে আমার দাদার হত্যা, আর দাদার হুটু বউকে খুন করার আগে সেখানেই কয়েকজন টুটসি যুবক কী ভাবে বৌদিকে হাতপা বেঁধে ধর্ষণ করেছিল । বাবা-মা দাদাকে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন প্রচুর ভারতীয় মেয়ে আছে, তারা গেঁয়ো হলেই বা, চাষিবাড়ির হলেই বা । কিন্তু দাদা হুটু যুবতীর গভীর প্রেমে পড়েছিলেন ।
আমি হুটু বা টুটসি কোনো পক্ষেই ছিলুম না, আমি তো এথনিকালি ভারতীয়, কেনই বা থাকব কোনো একটা গোষ্ঠীতে, দাদা হুটু মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পাতলেও । দাদার বাচ্চা ছেলেটার গলা চাপাতি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল টুটসিরা । আমি পালিয়ে হুটুদের খুনী গোষ্ঠীতে যোগ দিই, বলতে পারেন প্রাণে বাঁচার জন্য ; তখন দুই পক্ষে আরম্ভ হয়ে গেছে তুমুল খুনোখুনি ।
বাবা-মা রোয়াণ্ডায় না গেলেই পারতেন । হুটু আর টুটসি প্রজাতির আফ্রিকানদের উৎস নিয়ে রোয়াণ্ডা আর বুরুণ্ডি আর হ্রদ এলাকায় বহুকালের বিতর্ক । ভারতীয়দের তো আফ্রিকা সম্পর্কে আগ্রহ নেই, তাই কোনো খবর রাখে না, কেবল আমেরিকা-ইউরোপে কি ঘটছে তা নিয়েই ব্যস্ত । রোয়াণ্ডায় হুটুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা স্হানীয়, চাষবাস করে কাটাতো, টুটসিরা বাইরে থেকে এসেছিল, সাধারণত গরুর পাল চরাতো । বিরক্ত হচ্ছেন না তো ? আমার বিষয়ে জানার জন্য, আমার সৃষ্টিচেতনাকে বোঝার জন্য হুটু আর টুটসিদের খুনোখুনির ইতিহাসটা জানা জরুরি ।
আপনাদের ভারতে যেমন সাম্প্রতিককালে কে খাঁটি ভারতীয় তা নিয়ে দাঙ্গা হয়েছে, তেমনিই কারা খাঁটি ভূমিপুত্র তা নিয়ে গণহত্যা ঘটেছে ১৯৭২ সালে বুরুণ্ডিতে, ১৯৯৪ সালে রোয়াণ্ডায় আর ১৯৯৬ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত কঙ্গোতে । প্রথমে ছোটোখাটো দাঙ্গা দিয়েই শুরু হয়েছিল, পরে যে ধরণের পারস্পরিক গণহত্যা হয়েছে তা বোধহয় হিটলারের জার্মানিতেও হয়নি । হিটলারের লোকেরা চাপাতি দিয়ে মানুষের হাত-পা কেটে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু করেনি, যা হুটু আর টুটসিরা করেছিল । জেনোসাইড জানেন তো, জেনোসাইড, একজ্যাকটলি তাই, অনেক গ্রামে এখনও হাজার-হাজার মাথার খুলির পাহাড় পাবেন দেশগুলোয় গেলে। এর কারণ জানেন ? কারণ হল ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীদের আফ্রিকা নিয়ে ভাগ বাঁটোয়ারা । দেশগুলোকে কেটে তৈরি করার সময়ে ওরা খেয়াল করেনি যে আফ্রিকার উপজাতিদের প্রতিটি গোষ্ঠী নিজেদের ভৌগলিক এলাকায় থাকে, শান্তিতেই ছিল তারা, কিন্তু দেশগুলোকে গড়ে ওরা উপজাতিদের মধ্যে ক্ষমতার আর জমিজমার রেশারেশির সূত্রপাত ঘটিয়ে ফিরে গিয়েছিল, আড়াল থেকে শোষণ আর শাসনের জন্য । ম্যাপ খুললে দেখবেন বেশ কয়েকটা দেশের সীমা যেন স্কেল দিয়ে সোজা লাইন টেনে আঁকা ।[১৮]
প্রথমে বুরুণ্ডিতে হুটু বধ শুরু করে টুটসি সংখ্যাগরিষ্ঠ সৈন্যবাহিনী । প্রথম সাধারণ নির্বাচনে হুটুরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও রাজা মুয়ামবুটসা হুটু প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করার বদলে নিজের টুটসি সাকরেদদের নিয়োগ করেছিল, পূর্ব পাকিস্তানে যেমন শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী করার বদলে ভুট্টোকে গদিতে বসানো হয়েছিল । পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান যদি পাশাপাশি হতো তাহলে পূর্ব পাকিস্তানকে বাঙালিমুক্ত করে দিত পশ্চিম পাকিস্তান, এখন যে চাপাতি কয়েকজনের ওপর চালানো হচ্ছে তখন তা হুটু আর টুটসিদের মতন বাঙালিদের ঘরে-ঘরে চালানো হতো ।
হুটু সৈন্যরা বিদ্রোহের চেষ্টা করেছিল, রাজা তখন ভয়ে পালায় । ১৯৭২ সালে হুটুরা সামনে যে টুটসিকে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে বা চাপাতি দিয়ে মুণ্ডু উড়িয়ে দিয়েছে, বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের দুই হাত কেটে ছেড়ে দিয়েছে । টুটসি রাষ্ট্রপতির সৈন্যরা তখন পাইকারি হারে খুন করা আরম্ভ করলে হুটুদের । প্রাণ বাঁচাতে হুটুরা জাইরে, রোয়াণ্ডা আর তানজানিয়ায় পালালো । খুনোখুনির বিষ হুটুদের সঙ্গে পৌঁছোলো রোয়াণ্ডায় আর সেখানে প্রথমে দেখা দিল দাঙ্গা, তারপর পারস্পরিক খুনোখুনি, গৃহযুদ্ধ ।
১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের একশো দিনের মধ্যে রোয়াণ্ডার সংখ্যাগরিষ্ঠ হুটুরা প্রায় দশ লক্ষ টুটসিকে খুন করেছিল । আরম্ভ হয়েছিল রাজধানি কিগালিতে, আর সেই গণহত্যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের সর্বত্র, হুটুদের স্হানীয় সরকারি আধিকারিকরা তাদের উসকিয়েছিল যাতে টুটসি প্রতিবেশিদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, বাড়ির সবাইকে খুন করে, মেয়েদের গণধর্ষণ করার পর গলা কেটে উড়িয়ে দেয়, বাচ্চাদের হাত বা পা কেটে দেয় ।
টুটসিদের সেনাদল রোয়াণ্ডা প্যাট্রিয়টিক ফ্রণ্ট জুলাই মাসে প্রতিআক্রমণ করে কয়েক লক্ষ হুটুকে খুন করে, তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, মেয়েদের গণধর্ষণ করে খুন করে, বাচ্চাদের হাত বা পা কেটে দেয় । কুড়ি লাখ মানুষ এই পারস্পরিক খুনোখুনিতে রূপান্তরিত হয় উদ্বাস্তুতে । ইউরোপ-আমেরিকা যখন নড়েচড়ে বসল তখন দেশটা ধ্বংসের পথে চলে গেছে । আসলে ইউরোপ-আমেরিকা যুগোস্লাভিয়ার ভাঙন নিয়ে যতো ব্যস্ততা দেখিয়েছিল, আফ্রিকার ক্ষেত্রে তারা চিরকাল চোখ বুজে থেকেছে কিংবা দেশগুলোকে ষড়যন্ত্র করে ধ্বংসের পথে পাঠিয়েছে, যাতে সেই দেশগুলোর খনিজের দখল নিতে পারে । রোয়াণ্ডায় সমস্যার বীজ পুঁতেছিল বেলজিয়াম, সংখ্যাগরিষ্ঠ হুটুদের বদলে টুটসিদের মসনদে বসিয়ে । [১৯]
আপনি হয়তো ভাবছেন কি আবোল-তাবোল আফ্রিকার খুনোখুনির ইতিহাস শুনিয়ে চলেছি । আমি, একজন ভারতীয়, যার সঙ্গে হুটু আর টুটসির খুনোখুনির কিছু করার ছিল না, আমাকে মানসিক শান্তি খোঁজার পথ আবিষ্কার করতে হয়েছে, নিজেকে বাঁচিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষহীন গভীর জঙ্গলে । খুনোখুনির দরুণ দেশের কৃষিব্যবস্হা এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছিল যে জঙ্গলও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল, সব রকমের জন্তু-জানোয়ার ধরে খেয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছিল মানুষেরা । ঝোপের খাটো হাতি, বাদুড়, লেমুর, ব্লু বাঁদর, গ্বেরেজা বাঁদর, জংলি লাল কাঠবিড়ালি, খরগোশ, জংলি ইঁদুর, হরিণ, জংলি বেড়াল, বেঁজি, অ্যান্টিলোপ, সাপ এমনকি গোরিলার মাংস, পুড়িয়ে, কাঁচা কাঠে পুড়িয়ে। আমাকেও খেতে হয়েছে সেই সব মাংস । জঙ্গলে বেশিদিন লুকিয়ে থাকা সম্ভব হয়নি । তাই ভিড়ে গেলুম হুটুদের সাথে, দাদার আর বৌদির হত্যার প্রতিশোধ নিতে ।
প্রতিশোধ নেবার জন্য আমি হত্যা, বাড়ি জ্বালানো, ধর্ষণের পথ বেছে নিইনি । আমি টুটসি নারীদের শবের সঙ্গে শোয়া আরম্ভ করেছিলুম, আমি তাদের সঙ্গে কেবল শুয়ে থাকতুম, আর জড়িয়ে ধরে কাঁদতুম, সারাদিন, সারারাত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা । শব হলেও, একজন নারীকে জড়িয়ে বেশিক্ষণ ধরে থাকলে পুরুষের দেহ আপনা থেকেই জেগে উঠতে থাকে । ক্রমে আমার নেশা বা অভ্যাস হয়ে গেল শবের সঙ্গে শোয়া, তা হুটু নারীর হোক বা টুটসি নারীর । আমি বুঝতে পারছিলুম যে এই দাঙ্গা আর খুনোখুনি আরম্ভ হয়েছে আমার জন্যই, আমাকে এক নতুন শিল্পবোধে উন্নীত করার জন্য ।[২০] আমি গৃহযুদ্ধের আগুন থেকে বেরিয়ে এলুম সম্পূর্ণ এক নতুন মানুষ । কালো নারীর শবে আমি খুঁজে পেয়েছি ভাগ্যের দেবী তাইচেকে, ঔজ্জ্বল্যের দেবী পান্দিয়াকে, শান্তির দেবী আইরিনকে, শিকারের দেবী আর্টেমিসকে, প্রেম আর সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতিকে, জ্ঞানের দেবী আথেনাকে, জীবনমৃত্যুর দেবী ব্রিতোমার্তিসকে, প্রতিশোধের দেবী তিসিফোনেকে । অজস্র শব আমায় দিয়েছে নিরাময়, উপশম, সান্ত্বনা ।
আরে…কী করছেন…কী করছেন…শোবেন না…শোবেন না…আমার পাশে শোবেন না…নামুন…নামুন…
—————————————————————————————————————-
সহায়িকা
১. McNiece, Morris . Sleeping with the Dead : The Beautiful Art of Necrophilia. University of Bellmont, Bellmont, 1991.
২. Edward, Jorgensen. Existence and Love for The Mirage, Simple Shackled Press, Blue Mountain, 1981
৩. Kelly, Florence. Human Love and Love for The Dictator, Champion Books, Berlin, 2001.
৪. Patrice, Kenneth. Redemption of The Necrophile through Death, University of Lexing, Lexing, 1923.
৫. Kingston, Amy. Last Stare of Death and Human Memory, Six Farthing Press, Williamshire, 2003.
৬. Hollery, James. Aftermath of Drug Delirium, Ohio Psychotropical Research Centre Magazine, Volume III, September 1974.
৭. Beatrice, Norton. Warmth of The Corpse and Baudelaire’s Love Life, Thumping & Sickle, New Jersey, 1922.
৮. Bourgenstakis, Helen. The Greek Goddesses and The Death Muse, University of Lesbos Island, Lesbos, 1976.
৯. Constantin, Herbert. The Disposal of Love in Civil War and Battlegrounds, Schuster & Blumfeld, Kampala, 2005.
১০. Salzburg, Catherine. Love and Death as Octopus, Standard Journal of Science as Art, Nottinghamshire, 1965.
১১. Novak, Jess. Let The Breeze Waft and Other Essays, Brimstone and Gardiner Associates Inc, NY, 2011
১২. Jonas, Brigit. Sinlessness and The Body, Home Street Journal for The Jesuits of Kelvinshire, Kelvinshire, 1939.
১৩. Chimpinsky, Susan. Vampire and Love, Gutten Research Journal, Volume 23, Munich, 1958.
১৪. Finch, Norman. The Secret War Between His and Her, Columbia School of Continuing Education, NY. 2002.
১৫. Gregory, Jane. Slave Trade and Indian Indentured Labour, University of Birmingham, Birmingham, 1952.
১৬. Beth, Copeland. The Lunatic Express : Entertainment of Imperialism, University of Toronto, Toronto, 1928.
১৭. Corn, Alfred. Hand Weapons and their Use, Thema literary Review, Alabama University, Alabama, 1980.
১৮. Dugas, Andrew. Imperialist Ambition in Africa, Rollins College Review, Florida, 1979.
১৯. Rich, Thelma. Aftermath of Africa’s Ethnic Wars Before Colonialism, College of East African Studies Review, Kampala, 1909.
২০. Blim, Emily. The Dead in Jungle War and their Treatment, Assorted Press of Madagascar, Madagascar, 2000.
Leave a Reply