নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একদল ফুলওয়ালি চলেছে ফুল বিক্রি করতে
ফুলওয়ালির দল। নব বসন্তের দানের ডালি এনেছি তোদেরি দ্বারে,
আয় আয় আয়,
পরিবি গলার হারে।
লতার বাঁধন হারায়ে মাধবী মরিছে কেঁদে–
বেণীর বাঁধনে রাখিবি বেঁধে,
অলকদোলায় দুলাবি তারে,
আয় আয় আয়।
বনমাধুরী করিবি চুরি
আপন নবীন মাধুরীতে–
সোহিনী রাগিণী জাগাবে সে তোদের
দেহের বীণার তারে তারে,
আয় আয় আয়॥
আমার মালার ফুলের দলে আছে লেখা
বসন্তের মন্ত্রলিপি।
এর মাধুর্যে আছে যৌবনের আমন্ত্রণ।
সাহানা রাগিণী এর
রাঙা রঙে রঞ্জিত,
মধুকরের ক্ষুধা অশ্রুত ছন্দে
গন্ধে তার গুঞ্জরে।
আন্ গো ডালা, গাঁথ্ গো মালা,
আন্ মাধবী মালতী অশোকমঞ্জরী,
আয় তোরা আয়।
আন্ করবী রঙ্গন কাঞ্চন রজনীগন্ধা
প্রফুল্ল মল্লিকা,
আয় তোরা আয়।
মালা পর্ গো মালা পর্ সুন্দরী,
ত্বরা কর্ গো ত্বরা কর্।
আজি পূর্ণিমা রাতে জাগিছে চন্দ্রমা,
বকুলকুঞ্জ
দক্ষিণবাতাসে দুলিছে কাঁপিছে
থরথর মৃদু মর্মরি।
নৃত্যপরা বনাঙ্গনা বনাঙ্গনে সঞ্চরে,
চঞ্চলিত চরণ ঘেরি মঞ্জীর তার গুঞ্জরে।
দিস নে মধুরাতি বৃথা বহিয়ে
উদাসিনী, হায় রে।
শুভলগন গেলে চলে ফিরে দেবে না ধরা,
সুধাপসরা
ধুলায় দেবে শূন্য করি,
শুকাবে বঞ্জুলমঞ্জরী।
চন্দ্রকরে অভিষিক্ত নিশীথে ঝিল্লিমুখর বনছায়ে
তন্দ্রাহারা পিক-বিরহকাকলি-কূজিত দক্ষিণবায়ে
মালঞ্চ মোর ভরল ফুলে ফুলে ফুলে গো,
কিংশুকশাখা চঞ্চল হল দুলে দুলে গো॥
দইওয়ালার প্রবেশ
দইওয়ালা। দই চাই গো, দই চাই, দই চাই গো?
শ্যামলী আমার গাই,
তুলনা তাহার নাই।
কঙ্কনানদীর ধারে
ভোরবেলা নিয়ে যাই তারে–
দূর্বাদলঘন মাঠে তারে
সারা বেলা চরাই, চরাই গো।
দেহখানি তার চিক্কণ কালো,
যত দেখি তত লাগে ভালো।
কাছে বসে যাই ব’কে,
উত্তর দেয় সে চোখে,
পিঠে মোর রাখে মাথা–
গায়ে তার হাত বুলাই, হাত বুলাই গো॥
মেয়ে। ওকে ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি,
ও যে চণ্ডালিনীর ঝি–
নষ্ট হবে যে দই
সে কথা জানো না কি।
[ দইওয়ালার প্রস্থান
চুড়িওয়ালার প্রবেশ
চুড়িওয়ালা। ওগো তোমরা যত পাড়ার মেয়ে,
এসো এসো দেখো চেয়ে,
এনেছি কাঁকনজোড়া
সোনালি তারে মোড়া।
আমার কথা শোনো,
হাতে লহ প’রে,
যারে রাখিতে চাহ ধ’রে
কাঁকন দুটি বেড়ি হয়ে
বাঁধিবে মন তাহার–
আমি দিলাম কয়ে॥
প্রকৃতি চুড়ি নিতে হাত বাড়াতেই
মেয়েরা। ওকে ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি,
ও যে চণ্ডালিনীর ঝি।
[ চুড়িওয়ালা প্রভৃতির প্রস্থান
প্রকৃতি। যে আমারে পাঠাল এই
অপমানের অন্ধকারে
পূজিব না, পূজিব না সেই দেবতারে পূজিব না।
কেন দিব ফুল, কেন দিব ফুল,
কেন দিব ফুল আমি তারে–
যে আমারে চিরজীবন
রেখে দিল এই ধিক্কারে।
জানি না হায় রে কী দুরাশায় রে
পূজাদীপ জ্বালি মন্দিরদ্বারে।
আলো তার নিল হরিয়া
দেবতা ছলনা করিয়া,
আঁধারে রাখিল আমারে॥
পথ বেয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ
ভিক্ষুগণ। যো সন্নিসিন্নো
বরবোধিমূলে,
মারং সসেনং মহতিং বিজেত্বা
সম্বোধি মাগঞ্চি অনন্তঞ্ঞানে
লোকুত্তমা তং পণমামি বুদ্ধ।
[ প্রস্থান
প্রকৃতির মা মায়ার প্রবেশ
মা। কী যে ভাবিস তুই অন্যমনে
নিষ্কারণে–
বেলা বহে যায়, বেলা বহে যায় যে।
রাজবাড়িতে ওই বাজে ঘণ্টা ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং,
বেলা বহে যায়।
রৌদ্র হয়েছে অতি তিখনো
আঙিনা হয় নি যে নিকোনো,
তোলা হল না জল,
পাড়া হল না ফল,
কখন্ বা চুলো তুই ধরাবি।
কখন্ ছাগল তুই চরাবি।
ত্বরা কর্, ত্বরা কর্, ত্বরা কর্–
জল তুলে নিয়ে তুই চল্ ঘর।
রাজবাড়িতে ওই বাজে ঘণ্টা
ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং
ওই যে বেলা বহে যায়।
প্রকৃতি। কাজ নেই, কাজ নেই মা,
কাজ নেই মোর ঘরকন্নায়।
যাক ভেসে যাক
যাক ভেসে সব বন্যায়।
জন্ম কেন দিলি মোরে,
লাঞ্ছনা জীবন ভ’রে–
মা হয়ে আনিলি এই অভিশাপ!
কার কাছে বল্ করেছি কোন্ পাপ,
বিনা অপরাধে একি ঘোর অন্যায়॥
মা। থাক্ তবে থাক্ তুই পড়ে,
মিথ্যা কান্না কাঁদ্ তুই
মিথ্যা দুঃখ গ’ড়ে॥
[ প্রস্থান
প্রকৃতির জল তোলা
বুদ্ধশিষ্য আনন্দের প্রবেশ
আনন্দ। জল দাও আমায় জল দাও,
রৌদ্র প্রখরতর, পথ সুদীর্ঘ,
আমায় জল দাও।
আমি তাপিত পিপাসিত,
আমায় জল দাও।
আমি শ্রান্ত,
আমায় জল দাও।
প্রকৃতি। ক্ষমা করো প্রভু, ক্ষমা করো মোরে–
আমি চণ্ডালের কন্যা,
মোর কূপের বারি অশুচি।
তোমারে দেব জল হেন পুণ্যের আমি
নহি অধিকারিণী,
আমি চণ্ডালের কন্যা।
আনন্দ। যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা।
সেই বারি তীর্থবারি
যাহা তৃপ্ত করে তৃষিতেরে,
যাহা তাপিত শ্রান্তেরে স্নিগ্ধ ক’রে
সেই তো পবিত্র বারি।
জল দাও আমায় জল দাও।
জল দান
[ প্রস্থান
প্রকৃতি। শুধু একটি গণ্ডূষ জল,
আহা নিলেন তাঁহার করপুটের কমলকলিকায়।
আমার কূপ যে হল অকূল সমুদ্র–
এই যে নাচে এই যে নাচে তরঙ্গ তাহার,
আমার জীবন জুড়ে নাচে–
টলোমলো করে আমার প্রাণ,
আমার জীবন জুড়ে নাচে।
ওগো কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী পরম মুক্তি!
একটি গণ্ডূষ জল–
আমার জন্মজন্মান্তরের কালি ধুয়ে দিল গো
শুধু একটি গণ্ডূষ জল॥
মেয়ে পুরুষের প্রবেশ
ফসল কাটার আহ্বান
মাটি তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে,
আয় আয় আয়।
ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে–
মরি হায় হায় হায়।
হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে,
দিগ্ বধূরা ফসলখেতে,
রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে ধরার আঁচলে–
মরি হায় হায় হায়।
মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।
ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো দুয়ার খোলো।
আলোর হাসি উঠল জেগে,
পাতায় পাতায় চমক লেগে
বনের খুশি ধরে না গো, ওই যে উথলে–
মরি হায় হায় হায়॥
প্রকৃতি। ওগো ডেকো না মোরে ডেকো না।
আমার কাজভোলা মন, আছে দূরে কোন্–
করে স্বপনের সাধনা।
ধরা দেবে না অধরা ছায়া,
রচি গেছে মনে মোহিনী মায়া–
জানি না এ কী দেবতারি দয়া,
জানি না এ কী ছলনা।
আঁধার অঙ্গনে প্রদীপ জ্বালি নি,
দগ্ধ কাননের আমি যে মালিনী,
শূন্য হাতে আমি কাঙালিনী
করি নিশিদিন যাপনা।
যদি সে আসে তার চরণছায়ে
বেদনা আমার দিব বিছায়ে,
জানাব তাহারে অশ্রুসিক্ত
রিক্ত জীবনের কামনা॥
দ্বিতীয় দৃশ্য
অর্ঘ্য নিয়ে বৌদ্ধনারীদের মন্দিরে গমন
স্বর্ণবর্ণে সমুজ্জ্বল নব চম্পাদলে
বন্দিব শ্রীমুনীন্দ্রের পাদপদ্মতলে।
পুণ্যগন্ধে পূর্ণ বায়ু হল সুগন্ধিত,
পুষ্পমাল্যে করি তাঁর চরণ বন্দিত॥
[ প্রস্থান
প্রকৃতি। ফুল বলে, ধন্য আমি
ধন্য আমি মাটির ‘পরে।
দেবতা ওগো, তোমার সেবা
আমার ঘরে।
জন্ম নিয়েছি ধূলিতে,
দয়া করে দাও ভুলিতে,
নাই ধূলি মোর অন্তরে।
নয়ন তোমার নত করো,
দলগুলি কাঁপে থরোথরো।
চরণপরশ দিয়ো দিয়ো,
ধূলির ধনকে করো স্বর্গীয়,
ধরার প্রণাম আমি তোমার তরে॥
মা। তুই অবাক ক’রে দিলি আমায় মেয়ে।
পুরাণে শুনি না কি তপ করেছেন উমা
রোদের জ্বলনে,
তোর কি হল তাই।
প্রকৃতি। হাঁ মা, আমি বসেছি তপের আসনে।
মা। তোর সাধনা কাহার জন্যে।
প্রকৃতি। যে আমারে দিয়েছে ডাক,
বচনহারা আমাকে দিয়েছে বাক্।
যে আমারি জেনেছে নাম,
ওগো তারি নামখানি মোর হৃদয়ে থাক্।
আমি তারি বিচ্ছেদদহনে
তপ করি চিত্তের গহনে।
দুঃখের পাবকে হয়ে যায় শুদ্ধ
অন্তরে মলিন যাহা আছে রুদ্ধ,
অপমান-নাগিনীর খুলে যায় পাক॥
মা। কিসের ডাক তোর কিসের ডাক।
কোন্ পাতালবাসী অপদেবতার ইশারা
তোকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে,
আমি মন্ত্র প’ড়ে কাটাব তার মায়া।
প্রকৃতি। আমার মনের মধ্যে বাজিয়ে দিয়ে গেছে–
জল দাও, জল দাও।
মা। পোড়া কপাল আমার!
কে বলেছে তোকে “জল দাও’!
সে কি তোর আপন জাতের কেউ।
প্রকৃতি। হাঁ গো মা, সেই কথাই তো ব’লে গেলেন তিনি,
তিনি আমার আপন জাতের লোক।
আমি চণ্ডালী, সে যে মিথ্যা, সে যে মিথ্যা,
সে যে দারুণ মিথ্যা।
শ্রাবণের কালো যে মেঘ
তারে যদি নাম দাও “চণ্ডাল’,
তা ব’লে কি জাত ঘুচিবে তার,
অশুচি হবে কি তার জল।
তিনি ব’লে গেলেন আমায়–
নিজেরে নিন্দা কোরো না,
মানবের বংশ তোমার,
মানবের রক্ত তোমার নাড়ীতে।
ছি ছি মা, মিথ্যা নিন্দা রটাস নে নিজের,
সে-যে পাপ।
রাজার বংশে দাসী জন্মায় অসংখ্য,
আমি সে দাসী নই।
দ্বিজের বংশে চণ্ডাল কত আছে,
আমি নই চণ্ডালী।
মা। কী কথা বলিস তুই,
আমি যে তোর ভাষা বুঝি নে।
তোর মুখে কে দিল এমন বাণী।
স্বপ্নে কি কেউ ভর করেছে তোকে
তোর গতজন্মের সাথি।
আমি যে তোর ভাষা বুঝি নে।
প্রকৃতি। এ নতুন জন্ম, নতুন জন্ম,
নতুন জন্ম আমার।
সেদিন বাজল দুপুরের ঘণ্টা,
ঝাঁ ঝাঁ করে রোদ্দুর,
স্নান করাতেছিলেম কুয়োতলায়
মা-মরা বাছুরটিকে।
সামনে এসে দাঁড়ালেন
বৌদ্ধ ভিক্ষু আমার–
বললেন, জল দাও।
শিউরে উঠল দেহ আমার,
চমকে উঠল প্রাণ।
বল্ দেখি মা,
সারা নগরে কি কোথাও নেই জল!
কেন এলেন আমার কুয়োর ধারে,
আমাকে দিলেন সহসা
মানুষের তৃষ্ণা-মেটানো সম্মান।
—
বলে, দাও জল, দাও জল।
দেব আমি কে দিয়েছে হেন সম্বল।
কালো মেঘ-পানে চেয়ে
এল ধেয়ে
চাতক বিহ্বল–
বলে, দাও জল।
ভূমিতলে হারা
উৎসের ধারা
অন্ধকারে
কারাগারে।
কার সুগভীর বাণী
দিল হানি
কালো শিলাতল–
বলে দাও জল॥
মা। বাছা, মন্ত্র করেছে কে তোকে,
তোর পথ-চাওয়া মন টান দিয়েছে কে।
প্রকৃতি। সে যে পথিক আমার,
হৃদয়পথের পথিক আমার।
হায় রে আর সে তো এল না এল না,
এ পথে এল না,
আর সে যে চাইল না জল।
আমার হৃদয় তাই হল মরুভূমি,
শুকিয়ে গেল তার রস–
সে যে চাইল না জল।
চক্ষে আমার তৃষ্ণা,
তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন,
সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে।
ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায়,
মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়–
অবগুণ্ঠন যায় যে উড়ে।
যে ফুল কানন করত আলো,
কালো হয়ে সে শুকালো।
ঝরনারে কে দিল বাধা–
নিষ্ঠুর পাষাণে বাঁধা
দুঃখের শিখরচূড়ে॥
মা। বাছা, সহজ ক’রে বল আমাকে
মন কাকে তোর চায়।
বেছে নিস মনের মতন বর–
রয়েছে তো অনেক আপন জন।
আকাশের চাঁদের পানে
হাত বাড়াস নে।
প্রকৃতি। আমি চাই তাঁরে
আমারে দিলেন যিনি সেবিকার সম্মান,
ঝড়ে-পড়া ধুতরো ফুল
ধুলো হতে তুলে নিলেন যিনি দক্ষিণ করে।
ওগো প্রভু, ওগো প্রভু
সেই ফুলে মালা গাঁথো,
পরো পরো আপন গলায়,
ব্যর্থ হতে তারে দিয়ো না দিয়ো না।
রাজবাড়ির অনুচরের প্রবেশ
অনুচর। সাত দেশেতে খুঁজে খুঁজে গো
শেষকালে এই ঠাঁই
ভাগ্যে দেখা পেলেম রক্ষা তাই।
মা। কেন গো কী চাই।
অনুচর। রানীমার পোষা পাখি কোথায় উড়ে গেছে–
সেই নিদারুণ শোকে
ঘুম নেই তাঁর চোখে,
ও চারণের বউ।
ফিরিয়ে এনে দিতেই হবে তোকে,
ও চারণের বউ।
মা। উড়োপাখি আসবে ফিরে
এমন কী গুণ জানি।
অনুচর। মিথ্যে ওজর শুনব না, শুনব না,
শুনবে না তোর রানী।
জাদু ক’রে মন্ত্র প’ড়ে ফিরে আনতেই হবে
খালাস পাবি তবে,
ও চারণের বউ।
[ প্রস্থান
প্রকৃতি। ওগো মা, ওই কথাই তো ভালো।
মন্ত্র জানিস তুই,
মন্ত্র প’ড়ে
দে তাঁকে তুই এনে।
মা। ওরে সর্বনাশী, কী কথা তুই বলিস–
আগুন নিয়ে খেলা!
শুনে বুক কেঁপে ওঠে,
ভয়ে মরি।
প্রকৃতি। আমি ভয় করি নে মা,
ভয় করি নে।
ভয় করি মা, পাছে
সাহস যায় নেমে,
পাছে নিজের আমি মূল্যে ভুলি।
এত বড়ো স্পর্ধা আমার,
এ কী আশ্চর্য!
এই আশ্চর্য সে’ই ঘটিয়েছে–
তারো বেশি ঘটবে না কি,
আসবে না আমার পাশে,
বসবে না আধো-আঁচলে?
মা। তাঁকে আনতে যদি পারি
মূল্য দিতে পারবি কি তুই তার।
জীবনে কিছুই যে তোর
থাকবে না বাকি।
প্রকৃতি। না, কিছুই থাকবে না, কিছুই থাকবে না,
কিছুই না, কিছুই না।
যদি আমার সব মিটে যায়
সব মিটে যায়,
তবেই আমি বেঁচে যাব যে
চিরদিনের তরে
যখন কিছুই থাকবে না।
দেবার আমার আছে কিছু
এই কথাটাই যে
ভুলিয়ে রেখেছিল সবাই মিলে–
আজ জেনেছি, আমি নই-যে অভাগিনী;
দেবই আমি, দেবই আমি, দেব,
উজাড় করে দেব আমারে।
কোনো ভয় আর নেই আমার।
পড়্ তোর মন্তর, পড়্ তোর মন্তর,
ভিক্ষুরে নিয়ে আয় অমানিতার পাশে,
সে’ই তারে দিবে সম্মান–
এত মান আর কেউ দিতে কি পারে।
মা। বাছা, তুই যে আমার বুকচেরা ধন।
তোর কথাতেই চলেছি
পাপের পথে, পাপীয়সী।
হে পবিত্র মহাপুরুষ,
আমার অপরাধের শক্তি যত
ক্ষমার শক্তি তোমার
আরো অনেক গুণে বড়ো।
তোমারে করিব অসম্মান–
তবু প্রণাম, তবু প্রণাম, তবু প্রণাম।
প্রকৃতি। আমায় দোষী করো।
ধুলায়-পড়া ম্লান কুসুম
পায়ের তলায় ধরো।
অপরাধে ভরা ডালি
নিজ হাতে করো খালি,
তার পরে সেই শূন্য ডালায়
তোমার করুণা ভরো–
আমায় দোষী করো।
তুমি উচ্চ, আমি তুচ্ছ
ধরব তোমায় ফাঁদে
আমার অপরাধে।
আমার দোষকে তোমার পুণ্য
করবে তো কলঙ্কশূন্য–
ক্ষমায় গেঁথে সকল ত্রুটি
গলায় তোমার পরো॥
মা। কী অসীম সাহস তোর, মেয়ে।
প্রকৃতি। আমার সাহস!
তাঁর সাহসের নাই তুলনা।
কেউ যে কথা বলতে পারে নি
তিনি ব’লে দিলেন কত সহজে–
জল দাও।
ওই একটু বাণী–
তার দীপ্তি কত;
আলো ক’রে দিল আমার সারা জন্ম।
বুকের উপর কালো পাথর চাপা ছিল যে,
সেটাকে ঠেলে দিল–
উথলি উঠল রসের ধারা।
মা। ওরা কে যায়
পীতবসন-পরা সন্ন্যাসী।
বৌদ্ধ ভিক্ষুর দল
ভিক্ষুগণ। নমো নমো বুদ্ধদিবাকরায়,
নমো নমো গোতমচন্দিমায়,
নমো নমো নন্তগুণণ্ণরায়,
নমো নমো সাকিয়নন্দনায়।
প্রকৃতি। মা, ওই যে তিনি চলেছেন
সবার আগে আগে!
ফিরে তাকালেন না, ফিরে তাকালেন না–
তাঁর নিজের হাতের এই নূতন সৃষ্টিরে
আর দেখিলেন না চেয়ে!
এই মাটি, এই মাটি, এই মাটিই তোর
আপন রে!
হতভাগিনী, কে তোরে আনিল আলোতে
শুধু এক নিমেষের জন্যে!
থাকতে হবে তোকে মাটিতেই
সবার পায়ের তলায়।
মা। ওরে বাছা, দেখতে পারি নে তোর দুঃখ–
আনবই আনবই, আনবই তারে
মন্ত্র প’ড়ে।
প্রকৃতি। পড়্ তুই সব চেয়ে নিষ্ঠুর মন্ত্র,
পাকে পাকে দাগ দিয়ে
জড়ায়ে ধরুক ওর মনকে।
যেখানেই যাক,
কখনো এড়াতে আমাকে
পারবে না, পারবে না।
আকর্ষণীমন্ত্রে যোগ দেবার জন্যে মা
তার শিষ্যাদলকে ডাক দিল
মা। আয় তোরা আয়,
আয় তোরা আয়।
তাদের প্রবেশ ও নৃত্য
যায় যদি যাক সাগরতীরে–
আবার আসুক, আসুক ফিরে।
রেখে দেব আসন পেতে
হৃদয়েতে।
পথের ধুলো ভিজিয়ে দেব
অশ্রুনীরে।
যায় যদি যাক শৈলশিরে–
আসুক ফিরে, আসুক ফিরে।
লুকিয়ে রব গিরিগুহায়,
ডাকব উহায়–
আমার স্বপন ওর জাগরণ
রইবে ঘিরে॥
মায়ের মায়ানৃত্য
মা। ভাবনা করিস নে তুই–
এই দেখ্ মায়াদর্পণ আমার,
হাতে নিয়ে নাচবি যখন
দেখতে পাবি তাঁর কী হল দশা।
এইবার এসো এসো রুদ্রভৈরবের সন্তান,
জাগাও তাণ্ডবনৃত্য।
[ প্রস্থান
তৃতীয় দৃশ্য
মায়ের মায়ানৃত্য
প্রকৃতি। ওই দেখ্ পশ্চিমে মেঘ ঘনালো,
মন্ত্র খাটবে মা, খাটবে–
উড়ে যাবে শুষ্ক সাধনা সন্ন্যাসীর
শুকনো পাতার মতন।
নিববে বাতি, পথ হবে অন্ধকার,
ঝড়ে-বাসা-ভাঙা পাখি
ঘুরে ঘুরে পড়বে এসে মোর দ্বারে।
দুরু দুরু করে মোর বক্ষ,
মনের মাঝে ঝিলিক দিতেছে বিজুলি।
দূরে যেন ফেনিয়ে উঠেছে সমুদ্র–
তল নেই, কূল নেই তার।
মন্ত্র খাটবে মা, খাটবে।
মা। এইবার আয়নার সামনে নাচ্ দেখি তুই,
দেখ্ দেখি কী ছায়া পড়ল।
প্রকৃতির নৃত্য
প্রকৃতি। লজ্জা ছি ছি লজ্জা!
আকাশে তুলে দুই বাহু
অভিশাপ দিচ্ছেন কাকে।
নিজেরে মারছেন বহ্নির বেত্র,
শেল বিঁধছেন যেন আপনার মর্মে।
মা। ওরে বাছা, এখনি অধীর হলি যদি,
শেষে তোর কী হবে দশা।
প্রকৃতি। আমি দেখব না, আমি দেখব না,
আমি দেখব না তোর দর্পণ।
বুক ফেটে যায়, যায় গো,
বুক ফেটে যায়।
কী ভয়ংকর দুঃখের ঘূর্ণিঝঞ্ঝা–
মহান বনস্পতি ধুলায় কি লুটাবে,
ভাঙবে কি অভ্রভেদী তার গৌরব।
দেখব না, আমি দেখব না তোর দর্পণ।
না না না।
মা। থাক্ তবে থাক্ এই মায়া।
প্রাণপণে ফিরিয়ে আনব মোর মন্ত্র–
নাড়ী যদি ছিঁড়ে যায় যাক,
ফুরায়ে যায় যদি যাক নিশ্বাস।
প্রকৃতি। সেই ভালো মা, সেই ভালো।
থাক্ তোর মন্ত্র, থাক্ তোর–
আর কাজ নাই, কাজ নাই ,কাজ নাই।
না না না, পড়্ মন্ত্র তুই, পড়্ তোর মন্ত্র–
পথ তো আর নেই বাকি!
আসবে সে, আসবে সে, আসবে,
আমার জীবনমৃত্যু-সীমানায় আসবে।
নিবিড় রাত্রে এসে পৌঁছবে পান্থ,
বুকের জ্বালা দিয়ে আমি
জ্বালিয়ে দিব দীপখানি–
সে আসবে।
—
দুঃখ দিয়ে মেটাব দুঃখ তোমার।
স্নান করাব অতল জলে
বিপুল বেদনার।
মোর সংসার দিব যে জ্বালি,
শোধন হবে এ মোহের কালি–
মরণব্যথা দিব তোমার
চরণে উপহার॥
মা। বাছা, মোর মন্ত্র আর তো বাকি নেই,
প্রাণ মোর এল কণ্ঠে।
প্রকৃতি। মা গো, এতদিনে মনে হচ্ছে যেন
টলেছে আসন তাঁহার।
ওই আসছে, আসছে, আসছে।
যা বহু দূরে, যা লক্ষ যোজন দূরে,
যা চন্দ্রসূর্য পেরিয়ে,
ওই আসছে, আসছে, আসছে–
কাঁপছে আমার বক্ষ ভূমিকম্পে।
মা। বল্ দেখি বাছা, কী তুই দেখছিস আয়নায়।
প্রকৃতি। ঘন কালো মেঘ তাঁর পিছনে,
চারি দিকে বিদ্যুৎ চমকে।
অঙ্গ ঘিরে ঘিরে তাঁর
অগ্নির আবেষ্টন,
যেন শিবের ক্রোধানলদীপ্তি।
তোর মন্ত্রবাণী ধরি কালীনাগিনীমূর্তি
গর্জিছে বিষনিশ্বাসে,
কলুষিত করে তাঁর পুণ্যশিখা।
আনন্দের ছায়া-অভিনয়
মা। ওরে পাষাণী,
কী নিষ্ঠুর মন তোর,
কী কঠিন প্রাণ,
এখনো তো আছিস বেঁচে।
প্রকৃতি। ক্ষুধার্ত প্রেম তার নাই দয়া,
তার নাই ভয়, নাই লজ্জা।
নিষ্ঠুর পণ আমার,
আমি মানব না হার, মানব না হার–
বাঁধব তাঁরে মায়াবাঁধনে,
জড়াব আমারি হাসি-কাঁদনে।
ওই দেখ্, ওই নদী হয়েছেন পার–
একা চলেছেন ঘন বনের পথে।
যেন কিছু নাই তাঁর চোখের সম্মুখে–
নাই সত্য, নাই মিথ্যা;
নাই ভালো, নাই মন্দ।
মাকে নাড়া দিয়ে
দুর্বল হোস নে হোস নে,
এইবার পড়্ তোর শেষনাগমন্ত্র–
নাগপাশ-বন্ধনমন্ত্র।
মা। জাগে নি এখনো জাগে নি
রসাতলবাসিনী নাগিনী।
বাজ্ বাজ্ বাজ্ বাঁশি, বাজ্ রে
মহাভীমপাতালী রাগিণী,
জেগে ওঠ্ মায়াকালী নাগিনী–
ওরে মোর মন্ত্রে কান দে–
টান দে, টান দে, টান দে, টান দে।
বিষগর্জনে ওকে ডাক দে–
পাক দে, পাক দে, পাক দে,পাক দে।
গহ্বর হতে তুই বার হ,
সপ্তসমুদ্র পার হ।
বেঁধে তারে আন্ রে–
টান্ রে, টান্ রে, টান্ রে, টান্ রে।
নাগিনী জাগল, জাগল, জাগল–
পাক দিতে ওই লাগল, লাগল, লাগল–
মায়াটান ওই টানল, টানল, টানল।
বেঁধে আনল, বেঁধে আনল, বেঁধে আনল॥
এইবার নৃত্যে করো আহ্বান–
ধর্ তোরা গান।
আয় তোরা যোগ দিবি আয়
যোগিনীর দল।
আয় তোরা আয়,
আয় তোরা আয়,
আয় তোরা আয়।
সকলে। ঘুমের ঘন গহন হতে যেমন আসে স্বপ্ন,
তেমনি উঠে এসো এসো।
শমীশাখার বক্ষ হতে যেমন জ্বলে অগ্নি,
তেমনি তুমি, এসো এসো।
ঈশানকোণে কালো মেঘের নিষেধ বিদারি
যেমন আসে সহসা বিদ্যুৎ,
তেমনি তুমি চমক হানি এসো হৃদয়তলে,
এসো তুমি, এসো তুমি এসো এসো।
আঁধার যবে পাঠায় ডাক মৌন ইশারায়,
যেমন আসে কালপুরুষ সন্ধ্যাকাশে
তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো।
সুদূর হিমগিরির শিখরে
মন্ত্র যবে প্রেরণ করে তাপস বৈশাখ,
প্রখর তাপে কঠিন ঘন তুষার গলায়ে
বন্যাধারা যেমন নেমে আসে–
তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো॥
মা। আর দেরি করিস নে, দেখ্ দর্পণ–
আমার শক্তি হল যে ক্ষয়।
প্রকৃতি। না, দেখব না আমি দেখব না,
আমি শুনব–
মনের মধ্যে আমি শুনব,
ধ্যানের মধ্যে আমি শুনব,
তাঁর চরণধ্বনি।
ওই দেখ্ এল ঝড়, এল ঝড়,
তাঁর আগমনীর ওই ঝড়–
পৃথিবী কাঁপছে থরো থরো থরো থরো,
গুরু গুরু করে মোর বক্ষ।
মা। তোর অভিশাপ নিয়ে আসে
হতভাগিনী।
প্রকৃতি। অভিশাপ নয় নয়,
অভিশাপ নয় নয়–
আনছে আমার জন্মান্তর,
মরণের সিংহদ্বার ওই খুলছে।
ভাঙল দ্বার,
ভাঙল প্রাচীর,
ভাঙল এ জন্মের মিথ্যা।
ওগো আমার সর্বনাশ,
ওগো আমার সর্বস্ব,
তুমি এসেছ
আমার অপমানের চূড়ায়।
মোর অন্ধকারের ঊর্ধ্বে রাখো
তব চরণ জ্যোতির্ময়।
মা। ও নিষ্ঠুর মেয়ে,
আর যে সহে না, সহে না, সহে না।
প্রকৃতি। ওমা, ওমা, ওমা,
ফিরিয়ে নে তোর মন্ত্র
এখনি এখনি এখনি।
ও রাক্ষুসী, কী করলি তুই,
কী করলি তুই–
মরলি নে কেন পাপীয়সী।
কোথা আমার সেই দীপ্ত সমুজ্জ্বল
শুভ্র সুনির্মল
সুদূর স্বর্গের আলো।
আহা কী ম্লান, কী ক্লান্ত–
আত্মপরাভব কী গভীর।
যাক যাক যাক,
সব যাক, সব যাক–
অপমান করিস নে বীরের,
জয় হোক তাঁর,
জয় হোক।
আনন্দের প্রবেশ
প্রভু, এসেছ উদ্ধারিতে আমায়,
দিলে তার এত মূল্য,
নিলে তার এত দুঃখ।
ক্ষমা করো, ক্ষমা করো–
মাটিতে টেনেছি তোমারে,
এনেছি নীচে,
ধূলি হতে তুলি নাও আমায়
তব পুণ্যলোকে।
ক্ষমা করো।
জয় হোক তোমার জয় হোক।
আনন্দ। কল্যাণ হোক তব, কল্যাণী।
সকলে বুদ্ধকে প্রণাম
সকলে। বুদ্ধো সুসুদ্ধো করুণামহাণ্ণবো,
যোচ্চন্ত সুদ্ধব্বর ঞানলোচনো
লোকস্স পাপুপকিলেসঘাতকো
বন্দামি বুদ্ধং অহমাদরেণ তং॥
Leave a Reply