নীল নকশা
০১. পর্বতমালা পেরিয়ে
পর্বতমালা পেরিয়ে, দিনে গা ঢাকা দিয়ে রাতে পথ চলে ইণ্ডিয়ান এলাকার ভিতর দিয়ে এসেছে ও–লম্বা, সুঠামদেহী এক-তরুণ, রোদে পোড়া তামাটে চেহারা, অবসাদের ছাপ চোখেমুখে। শক্তিশালী একটা মাসট্যাং ওর সঙ্গী। স্টোনি রিভার বেসিনের উত্তরের ঢালে ডাই ক্রীকে থামলো ও, নাশতা করার জন্যে। বারবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ব্যাকট্রেইলের দিকে তাকাচ্ছে। গতকাল সকাল থেকে তিনজন মেসকেলারো অ্যাপাচী ক্রমাগত অনুসরণ করে আসছে ওকে। অবশ্য পর্বতমালা পেরিয়ে আসার পর এখন আর ওদের দেখা পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তবু অ্যাাপাচীদের বোঝা কঠিন।
এক ঘণ্টা কাটলো, ইনডিয়ানদের দেখা নেই। উত্তপ্ত আর একটা দিনের প্রতিশ্রুতিসহ সূর্য উঠলো পুব দিগন্তে। প্রচুর সময় নিয়ে দাড়িগোঁফ কামালো ও। এখন ইনডিয়ানদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। স্টোনি রিভার বেসিনে নতুন প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় নামতে হবে ওকে, এখানে সতর্ক থাকতে হবে রবার্ট ওয়ারেন আর তার দলের বিরুদ্ধে।
পাইপে তামাক ভরে আগুন জ্বাললো ও, আরাম করে বসলো। তারপর একটা চিঠি বের করলো পকেট থেকে, দিন দশেক আগে হাতে এসেছে। চিঠিটা পেয়েই তড়িঘড়ি স্টোনি রিভার বেসিনে ফিরে এসেছে ও। বেশ কয়েকবার পড়া হয়ে গেছে, তবু আবার পড়তে শুরু করলো ওটা।
প্রিয় ফোর্বস,
এ-চিঠি তুমি পাবে কিনা জানি না, তবু পাবে আশা করেই লিখছি। খবরটা তোমাকে না জানিয়ে পারছি না। তোমার বাবার সঙ্গে উপত্যকায় নবাগত র্যাঞ্চার রবার্ট ওয়ারেনের বিবাদ শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘাতের রূপ নিয়েছে। কাল রাতে তোমা দের ব্ল্যাঙ্কে এক প্রচণ্ড সংঘর্ষে আহত হয়েছে তোমার বাবা, ওর অবস্থা সংকটজনক। মারা গেছে এডি।
মাত্র কদিন আগে তোমার বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে, উদ্বিগ্ন মনে হয়েছে ওকে আমার, যেন খারাপ কিছু আশঙ্কা করছে। সেদিনই তোমার বাবা আমাকে বলেছে যদি কোনো কারণে ওর বা এডির মৃত্যু ঘটে, আমি যেন র্যাঞ্চ আর গরু বিক্রি করে টাকাগুলো তোমার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা নিই, যাতে তোমাকে আর ওয়াইওমিং থেকে এখানে আসতে না হয়। লড়াইটাকে ফিউডে পরিণত করা মারাত্মক বোকামি হবে বলে ভেবেছে সে, আমি ওর সংগে সম্পূর্ণ একমত।
চিঠি লিখতে কলম সরছে না, তোমার বাবা আমার কতখানি ঘনিষ্ঠ ছিলো তোমার তো অজানা নয়! ও খানিকটা সেরে উঠলে আমিতোমাকে খবর দেবে। আর যদি খোদার ইচ্ছে ভিন্ন হয়, যত দ্রুত সম্ভব তোমাদের র্যাঞ্চ আর গরু বিক্রির ব্যবস্থা নেবো আমি, তোমার স্বার্থ রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। সম্পত্তি বিক্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব টাকা তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো, তোমাকে আর কষ্ট করে ওয়াগোনারে আসতে হবে না।
এখানে বাজারের হালচাল বিশেষ সুবিধের নয়, রাঞ্চের ন্যায্য দাম পাওয়ার আশা কম, তবু যাতে তোমার লোকসান না হয় সেজন্যে আমি চেষ্টার ত্রুটি করবো না। এ ব্যাপারে তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে চিঠি লিখে জানিয়ে।
শুভ কামনায়
অ্যারন হেলার।
পর পর দুবার চিঠিটা পড়লো ও, তারপর ভাঁজ করে আবার পকেটে রাখলো। চুপচাপ বসে ভাবতে শুরু করলো এর অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে। নিরাবেগ ভাষা, যেন কোনো ব্যবসায়ীর হাতে লেখা। ওর কৌতূহল মেটানোর মতো কিছু নেই চিঠিটায়, বাবার র্যাঞ্চে গোলমাল বাধার কারণ, লড়াই কেন হলো–তার ব্যাখ্যা নেই। লড়াই শেষে ওয়ারেনের কি হয়েছে তাও বলেনি হেলার। বাবার মৃত্যুর পর র্যাঞ্চের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব থেকে ওকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আবার একই সঙ্গে বেসিন থেকে দূরে থাকতে বলে আবার ফিরে আসার জন্যে চ্যালেঞ্জও করা হয়েছে ওকে।
হঠাৎ অস্থির বোধ করলো ও, উঠে দাড়ালো, নজর বোলালে। নিচের বিস্তীর্ণ উপত্যকায়। পর্বতমালার কাছাকাছি হওয়ায় আশ পাশের এলাকা এবড়োখেবড়ো, ছোট বড় অসংখ্য টিল; ঢিবিতে ভরা, কিন্তু নদীর কাছে আস্তে আস্তে সমতলে রূপ নিয়েছে তুমি।
বেসিনের উঁচু এলাকায় ছ’ থেকে আটটি র্যাঞ্চ আছে, নিচু অঞ্চলের র্যাঞ্চের সংখ্যাও প্রায় তাই। ফোর্বস র্যাঞ্চের অবস্থান উঁচু এলাকায়, সামনে, রেড ফিলডের রেনজ পেরিয়ে। পুবে একটা হগব্যাকের চূড়ায় ম্যাকমিলান র্যাঞ্চ; গ্রেবার, ডেনিস স্মিথসহ আরো কয়েকজনের র্যাঞ্চ ওদিকে পড়েছে, ওগুলোর কোনো একটাতেই এখন রবার্ট ওয়ারেনের বাস।
পাইপ নিভিয়ে ফেললো ও, সাফ করে পকেটে রাখলো, কি করবে ভাবছে। ওয়াগোনার আর চার ঘণ্টার পথ। ভাগ্য ভালো হলে কারো চোখে ধরা না পড়ে নদীর কাছে পৌঁছে যেতে পারবে। তার পর শহরসীমান্তে গাছপালার আড়ালে রাত পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়ে অন্ধকারে অ্যারন হেলারের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারে ও। পরি স্থিতির আসল চেহারা বোঝার আগে উপত্যকায় ওর প্রত্যাবর্তনের খবর জানাজানি হওয়াই ভালো।
স্যাডলে উঠে বসলো ও, ড্রাই ক্ৰীক ধরে এগোলো বেশ কয়েকমাইল, তারপর হঠাৎ ঘোড়া ঘুরিয়ে পাহাড়ের মাঝে একটা সংকীর্ণ ফাঁক দিয়ে কোণাকুণিভাবে এগোলো দক্ষিণে। কোন দিকে যাবে আগেই ঠিক করে নিয়েছে। এই বেসিনের অন্ধিসন্ধি ওর নখ দর্পণে, এখানে জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে, আট বছর আগেও এখানেই ছিলো ও। রাতের নিকষ অন্ধকারেও এখানে পথ চলতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হবে না। এবং শিগগিরই হয়তো সেটা জরুরি হয়ে দাঁড়াবে, ভাবলো সে, ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো। ঠোঁটের কোণে। রবার্ট ওয়ারেন হয়তে। ভেবেছে ফোর্বসদের খতম করে দিয়েছে সে, কিন্তু কদিনের মধ্যেই নতুন কথা ভাবতে হবে তাকে।
নদীর দিকে অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এলো ও, এক চিলতে খোলা মাঠের ওপর দিয়ে এগোচ্ছে, হঠাৎ বাম দিকে একটা অনুচ্চ টিলার চূড়ায় দুজন ঘোড়সওয়ারের দেখা পেলো। রাশ টেনে ধরলে ওরা, ইতস্তত করলো মুহূর্তের জন্যে, তারপর এগিয়ে এলো ওর দিকে। স্যাডলে নড়েচড়ে বসলো ফোর্বস। চলার পথে লোকজনের সঙ্গে দেখা হওয়া স্বাভাবিক, তবু এবার অন্তত এড়ানো যাবে ভেবে ছিলো সে। পালিয়ে গেলে অবশ্য এখনো এড়ানো সম্ভব, কিন্তু পালানোর ইচ্ছে বোধ করছে না।
হোলসটারের ফিতে খুলে পিস্তল আলগা করে নিলো ও, গতি না কমিয়ে এগিয়ে চললো। মুখোমুখি হওয়ার পর ওই লোকদুটো কে কি বলতে হবে জানা নেই। অপরিচিত কেউ হলে যা হয় এক টা বলে দিলেই চলবে, আর পরিচিত হলে–তাহলে অন্তত ওদের কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে।
আরো কাছে এলো দুই অশ্বারোহী, লাগাম টেনে ঘোড়া থামালো। একজন মাঝবয়সী, লম্বা ছিপছিপে, একটু যেন কুঁজো হয়ে আছে। চার্লস রেডফিলড, চিনতে পারলে ফোর্বস। চার্লসের সঙ্গী অল্প বয়সী তরুণ, গাঢ় বাদামী তার গায়ের রঙ, চেহারায় কুৎসিত একটা ভাব–যেন সারাক্ষণ ভেঙচি কাটছে। লোকটা ওকে চেনে না বলেই মনে হলো ফোর্বসের, কিন্তু চার্লসের এক মুহূর্তও বিলম্ব হলো না।
ফোর্বস। কলিন ফোর্বস!
ঠিক চিনেছ, বললে কলিন। কেমন আছে, চার্লস
পিঠ সোজা করে বসলো রেডফিলভ, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালে। অস্থিরভাবে একপলক তরুণ সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে ফের চোখ ফেরালো কলিনের দিকে। তুমি ফিরে আসছো, জানতাম না তো! আমি: কলিন, ওর নাম টেরেন্স মিচেল। এখানকার এক রাঞ্চে কাজ করে।
হ্যালো, মিচেল, বললো কলিন।
মুখভাব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো ও, পারলো না। ওর নাম কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিচেলের দুচোখে কুঞ্চন সৃষ্টি লক্ষ্য করেছে সে, অজান্তে বিপদাশঙ্কায় সতর্ক হয়ে উঠলো ফোর্বস, কিঞ্চিৎ উত্তেজিত।
হাউডি, ফোর্বস, বললো মিচেল।
দ্রুত কথা বললো রেডফিলড। কলিন, এখানে যা ঘটে গেছে, বলার নয়, কি বলে যে তোমাকে সমবেদনা জানাবো, জানি না। তোমার বাবা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলো, এডি ছেলেটাকেও আমি পছন্দ করতাম। তোমার যদি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়, আমাকে বলল, আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।
কাঁধে সকালের সূর্যের উত্তাপ অনুভব করছে কলিন ফোর্বস। মুহূর্তের জন্যে রেডফিলডদের অস্তিত্ব ভুলে সোজা সামনে তাকালো। রেডফিলডের কথায় বোঝা যাচ্ছে বাবা আর বেঁচে নেই। অথচ বাবার সঙ্গে শেষ দেখা করার আশাতেই তাড়াহুড়ো করে এখানে এসেছে সে। মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিলো বাবার সঙ্গে দেখা হবে, যদিও হেলারের চিঠি পড়েই আঁচ করা গেছে বাবা বাঁচবে না।
কখন ঘটলো ব্যাপারটা? ফাঁকা শোনালো ওর কণ্ঠস্বর।
সপ্তাহ তিনেক আগে।
বাবার মৃত্যুর কথা জিজ্ঞেস করছি।
র্যাঞ্চে লড়াইয়ের দুদিন পর, ডাক্তার মারভিন ওকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি।
সোজা হয়ে এলো কলিন, লম্বা একটা দম নিলো। এখানকার শেরিফ একবার অনুযোগের সুরে বলেছিলো, ড্যানিয়েল ফোর্বস প্রয়োজনে যেচে লড়াই বাধাবে; শেরিফের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলো ও, তবে এটা ঠিক লড়াইয়ের ভয়ে পিছিয়ে যাবার মানুষ ছিলো না বাবা। ড্যানিয়েল ফোর্বস রগচটা, ভয়ঙ্কর এবং একগুয়ে ছিলো, কিন্তু নিজের ভুল বা অন্যায় স্বীকার করতে কখনো দ্বিধা করেনি। স্টোনি রিভারের সবাই জানতো বাবাকে। মুখে এক কথা বলে কাজের বেলায় অন্য রকম করেছে-ড্যানিয়েল ফোর্বসের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলবে না কেউ।
রবার্ট ওয়ারেন লোকটা কে? জানতে চাইলে কলিন। কি ব্যাপারে ঝামেলা হয়েছিলো বলতে পারবে?
আমি যা শুনেছি সেটুকুই কেবল বলতে পারি, কলিন, অস্বস্তির সঙ্গে বললো চার্লস রেডফিলড।
তাই শোনাও।
বছর দুয়েক আগে এখানে এসেছে ওয়ারেন। ম্যাকমিলানের র্যাঞ্চটা কিনে নিয়েছে সে। এখানে সে পা দেয়ার পর পরই ড্যানিয়েলের সঙ্গে ওর বিরোধের কথা ছড়িয়ে পড়ে। তারপর, এই ধরো মাসখানেক আগে, হঠাৎ একদিন কারা যেন ওয়ারেনের একপাল গরু ক্লেব্যাংকসের ওপর থেকে ছত্রভঙ্গ করে নিচের ক্যানিয়নে ফেলে হত্যা করে। স্ট্যামপিডের জন্যে তোমার বাবাকে দায়ী করে রবার্ট ওয়ারেন। ড্যানিয়েলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় সে, তারপর শেরিফের সঙ্গে লোকজন নিয়ে তোমাদের র্যাঞ্চে হাজির হয়। তোমার বাবা ওদের র্যাঞ্চ থেকে বেরিয়ে যেতে হুকুম করে–বোধ হয় প্যসি বাহিনীকে চিনতে পারেনি। তারপর আচমকা কে যেন গুলি ছুড়তে শুরু করে। গোলাগুলি শেষ হওয়ার আগেই এডিসহ মোট তিনজন প্রাণ হারায়, মারাত্মকভাবে আহত হয়। ড্যানিয়েল।
হোলসটার স্পর্শ করলো মিচেল, পরমুহূর্তে একপাশে ছেড়ে দিলো হাতটা। আড়চোখে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো কলিন। হয়তো গুরুত্ব হীন, তবু নিজের প্রকৃত অবস্থা না জেনে কোনো রকম ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। ওকে কৌতূহলী করে তুলেছে মিচেল। ওর নাম শুনে চমকে উঠেছিলো সে, কেন? চোখের আড়াল হলে সে কি করতে পারে আন্দাজ করার চেষ্টা করলে কলিন।
আমার বোধ হয় শেরিফের সঙ্গে একবার দেখা করা উচিত, চিন্তিত চেহারায় বললো ও।
হ্যাঁ, সে-ই ভালো, সায় দিলো রেডফিলড।
ঘোড়ার লাগামে টান দিলে কলিন, এগোনোর আগে বললো, তোমার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ায় ভালো লাগলো, চার্লস। মিচেল, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
মাথা দোলালো ওরা, কলিনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল, সামনে চার্লস পেছনে মিচেল। ঘোড়া নিয়ে সরে এলো কলিন, মনে মনে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনলো, তারপর ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো পেছনে। রাশ টেনে ধরেছে মিচেল, চোখের পলকে পিস্তল বের করে আনলো সে। নিমেষে স্যাডল থেকে লাফিয়ে পড়লো কলিন, মাটি স্পর্শ করার আগেই পিস্তল উঠে এলো হাতে। গুলি করলো মিচেল। ওর স্যাডলের ওপর দিয়ে বাতাসে শব্দ তুলে চলে গেল বুলেট। মাটিতে উবু হয়ে বসে ঘোড়ার পেটের নিচ দিয়ে গুলি করলো কলিন, একবার, দুবার।
গুলির আঘাতে কেঁপে উঠলো মিচেল, পিছিয়ে গেল তার ঘোড়া, বাতাসে আঁচড় কাটলো সামনের দুই পায়ে। পিছলে স্যাডল থেকে মাটিতে পড়লো মিচেল, উপুড় হয়ে, আর নড়লো না।
আস্তে, সাবধানে উঠে দাড়ালো কলিন, চার্লস রেডফিলডকে কাভার করে রেখেছে ওর পিস্তল। ঘোড়াকে বাগে আনার প্রাণপণ চেষ্টা করছে লোকটা। মিচেলকে পিস্তল বের করতে দেখেছে সে, অথচ ওকে সতর্ক করে দেয়নি। হয়তো তার করার কিছুই ছিলো না। তবে মিচেলের মতলব ঠিকই টের পেয়েছিলো।
শান্ত হলো চার্লস রেডফিলডের ঘোড়া, শক্ত হাতে লাগাম ধরে রেখেছে সে, কাকড়ার মতো পাশে হেঁটে কলিনের দিকে এগিয়ে এলো ওটা। এক হাতে মুখের ঘাম মুছলো রেডফিলড। টেরেন্স মিচেলের নিথর শরীরে দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকালো।
হায় খোদা, কি ভয়ঙ্কর। বললো সে। ও এমন কিছু করবে ভাবতেও পারিনি। আমি–
ওকে পিস্তল বের করতে দেখছো তুমি, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো কলিন ফোর্বস। তুমি কি আমার মৃত্যু কামনা করেছিলে, রেডফিলড?
মাথা নাড়লে রেডফিলড়। আ-আমি…না!
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তার। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে, কপালে। কলিনের পিস্তল থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছে না কিছুতেই।
গানবেলট খুলে ফেলো, আদেশ করলো কলিন, ফেলে দাও মাটিতে।
কিন্তু আমি—
কোনো কথা নয়! চড়া গলায় বললো কলিন ফোর্বস। যা বলছি, করো, এখুনি!
বাকলস খুলে গানবেলটটা মাটিতে ফেললো চার্লস রেডফিলড।
এবার রাইফেল, বললে কলিন। বুট থেকে রাইফেল বের করে মাটিতে ফেলে দিলো রেডফিলড।
এবার ঘোড়া নিয়ে ওই টিলাটার দিকে এগেও, অর্ধেক পথ গিয়ে থামবে, আমি না যাওয়া পর্যন্ত থাকবে ওখানে, তারপর এসে মিচে লের লাশ নিয়ে শহর কিংবা র্যাঞ্চে–যেখানে ইচ্ছে যেয়ো। যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাও, এখানকার ঘটনাবলীতে তোমার কি ভূমিকা? কোন্ পক্ষে তুমি?
আমি দলাদলিতে নেই, ভারি গলায় বললো রেডফিলড।
আমার বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যুর দিন প্যসিতে ছিলে তুমি?
না।
জাহান্নামে যাক, ভাবলো কলিন, এ-ব্যাপারে পরে খোঁজ করা যাবে। আরো অনেক কিছু জানতে হবে ওকে–যদি প্রাণে বেঁচে থাকে।
নাও, এবার এগোও, বললো ও।
ঘোড়া ঘুরিয়ে সরে গেল রেডফিলড, তারপর লাগাম টেনে পেছনে তাকালো, চিৎকার করে বলে উঠলো, রবার্ট ওয়ারেনের সঙ্গে তুমি পারবে না, কলিন। অনেক শক্তিশালী সে। লোকবলের অভাব নেই তার, আইন ওর পক্ষে। যদি বুদ্ধিমান হও, বেসিন ছেড়ে চলে যাও, আর কোনো দিন ফিরে এসো না।
আমি বুদ্ধিমান নই, বললে কলিন। আবার এগোতে শুরু করলো রেডফিলড।
ঘাড় ফিরিয়ে পাহাড়চূড়াগুলো জরিপ করলো কলিন। গুলির শব্দ আরো কাউকে আকৃষ্ট করে থাকতে পারে, এই মুহূর্তে আর কারো মুখোমুখি হতে চায় না ও। মিচেলের পাশে মুহূর্তের জন্যে হাঁটু গেড়ে বসলো সে, তারপর উঠে দাড়ালো পেটের ভেতর কেমন অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি, লালায় ভরে উঠছে মুখ। মিচেল মারা গেছে, সন্দেহ নেই।
নিজের ঘোড়ার কাছে ফিরে এলো কলিন, উঠে বসলো স্যাডলে, লাফিয়ে সামনে ছুটলে। মাসট্যাং। অসুস্থ বোধ করছে ও, কাউকে হত্যা করা মোটেই সুখের ব্যাপার নয়।
০২. পুর্ব থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিলো সূর্য
আস্তে আস্তে পুর্ব থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিলো সূর্য, তারপর এক সময় পাহাড় সারির আড়ালে হারিয়ে গেল। গোধূলির রঙ লাগলো তাকাশে, সারাদিনের দুঃসহ গরম থেকে নিস্তার পাওয়া গেল। অন্ধকার আরো গাঢ় হওয়ার অপেক্ষায় রইলো কলিন ফোর্বস। ওয়াগোনারের উপকণ্ঠে স্টোনি রিভারের তীরে গাছপালার মাঝে ঘুরে ফিরে বিকেলটা পার করে দিয়েছে ও। আর কিছুক্ষণ পর শহরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়বে, অ্যারন হোরের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
পাইপে আবার তামাক ভরলো কলিন, আগুন জ্বেলে ফের বিচার করতে বসলো রেডফিলডের বক্তব্য। রেডফিলডের কথা থেকে যত দুর বোঝা যায় : বছর দুয়েক আগে ওয়ারেন নামে এক লোক স্টোনি বিভার বেসিনে হাজির হয়, ম্যাকমিলান র্যাঞ্চটা কিনে নেয় সে, এখানে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ড্যানিয়েল ফোর্বসের সাথে তার বিরোধ জন্ম নেয়। ক্লেব্যাংকসের ওপর থেকে ওয়ারেনের গরুর পাল স্ট্যামপিড করার অভিযোগ থেকে বোঝা যায় ইদানীং ওদের রেষারেষি তুঙ্গে পৌছে গিয়েছিলো। আনুষ্ঠানিকভাবে আইনের শরণাপন্ন হয়েছে ওয়ারেন, শেরিফকে সঙ্গে নিয়ে ফোর্বস র্যাঞ্চে গেছে। র্যাঞ্চে সংঘটিত সংঘর্ষে এডি আর ড্যানিয়েল ফোর্বস প্রাণ হারিয়েছে।
রেডফিলডের কাহিনীতে দুটো বড় ধরনের ফাঁক ধরা পড়েছে কলিন ফোর্বসের চোখে। বাবার সাথে কারো বিরোধ দেখা দিলে সামনাসামনি তার ফয়সালা করার কথা, প্রতিশোধ স্পৃহায় প্রতি পক্ষের পোষা জানোয়ার হত্যা করার মতো নৃশংস কাপুরুষ নয় বাবা। আইনের কতৃত্ব ত স্বীকার করাও বাবার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। বরং ড্যানিয়েল ফোর্বসের সক্রিয় সহযোগিতায়ই স্টোনি রিভার বেসিনে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পাইপ নিভে গেছে কলিনের। আবার ধরিয়ে কিছুক্ষণ পাইপ টানলো ও, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলল, জমাট অন্ধ কারে চোখ কুঁচকে তাকালো ওয়াগোনারের দিকে। এবার এগোনো যায়, ভাবলো, যথেষ্ট অন্ধকার হয়েছে। ঘোড়ার পিঠে জিন চাপিয়ে উঠে বসলো, তারপর গাছপালার আড়ালে আড়ালে নদীর উজানে সামনে এগোলো।
ওয়াগোনারের কাছাকাছি পৌছে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলো কলিন ফোর্বস। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশে, সামনের ঘরবাড়ির সারি আলাদা করে চেনা দায়। হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এলো একটা কুকুর, খেকিয়ে উঠলো ওর উদ্দেশে, আরো একটা স্বজাতি এসে যোগ দিলে ওটার সঙ্গে। কিন্তু ওদের তীক্ষ্ণ চিৎকার সন্ধ্যার জমাট অন্ধ কারে কাউকে কৌতূহলী করে তুললো না দেখে স্বস্তি বোধ করলো কলিন।
যদ্দূর মনে আছে, শহরের নদী তীরের অংশে প্রধান সড়ক থেকে সামান্য ভেতরে অ্যারন হেলারের বিশাল অথচ বিবর্ণ দালান। বাড়িটা খুঁজে বের করতে কষ্ট হলো না কলিনের। পর্দা টানানো জানালায় আলোর আভাস দেখতে পেয়ে স্যাডল থেকে নেমে পড়লো ও, হিচিং পোস্টে বাঁধলো ঘোড়াটা। এক মুহূর্ত পর হেলারের দরজায় টোকা দিতে দেখা গেল ওকে।
কলিনের স্মৃতিতে অ্যারন হেলার লম্বা মানুষ, হালকা পাতলা গড়ন, সামান্য কুঁজো; পুর থেকে এখানে এসেছে সে। কথা বলার সময় অদ্ভুত এক রকম খসখসে শব্দ বেরোয় গলা থেকে; অমায়িক, তাই তার বন্ধু আর শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা প্রচুর। দরজা খুলে দাড়ালো অ্যারন হেলার, আগের মতোই লম্বা এবং কুজো, কিন্তু তারুণ্য বিদায় নিয়েছে অবয়ব থেকে, গালের চামড়া যেন লেপ্টে গেছে চোয়ালের হাড়ে, চোখজোড়া কোটরাগত, বিলোপের পথে মাথার চুল।
কি চাই? জানতে চাইলে হেলার, কণ্ঠে বিরক্তি।
আমি কলিন ফোর্বস।
ঝট করে সোজা হয়ে দাড়ালো অরিন হেলার, এক পা পিছিয়ে গেল সে, ঢোক গিলে বললো, ফোর্বস! পরমূহুর্তে আবার জানতে চাইলো, তুমি এসেছো কেউ জানে? এখানে আসতে দেখেছে কেউ?
বোধ হয় না, বললো কলিন।
এসো, ভেতরে এসো। দরজাটা আটকে দাও।
ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলে কলিন ফোর্বস, বুঝতে পারছে ওর আগমন ভালো চোখে দেখছে না হেলার। কেন কে জানে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
আমার চিঠি পাওনি? জানতে চাইলে অ্যাটর্নি।
পেয়েছি, জবাব দিলো কলিন।
তাহলে ফিরে এলে কেন? কোনো দরকার ছিলো?
না এসে উপায় ছিলো না।
এখনো আগের মতোই আছো? বাপের মতোই বদরাগী।
অনেক সময় বদরাগী না হলে চলে না, বললো কলিন, এবার বোধ হয় তার সময় এসেছে। আচ্ছা, কার ভয়ে কুকড়ে রয়েছো তুমি, ভূতের?
হাড়সর্বস্ব হাত দুটো কচলালে অ্যাটর্নি। না, রবার্ট ওয়ারেন আর ওর সাঙ্গপাঙ্গরা ভূত-পেত্নী নয়, দানব। বেসিনে কয়েক দিন থাকলেই ওদের পরিচয় জানতে পারবে। কিন্তু এখানে থাকা তোমার জন্যে ঠিক হবে না। বরং দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি পারো সরে পড়ো, বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তোমার র্যাঞ্চ বিক্রির দায়িত্ব আমার হাতে ছেড়ে দাও, মোটামুটি ভালো দাম আদায়ের চেষ্টা করবো। আমি, টাকাটা হাতে পেলে মনে করবে মহা বাঁচা বেঁচে গেছে। চিঠিতেই তো এখানে আসতে নিষেধ করেছিলাম তোমাকে, বুঝতে পারেনি?
তোমার লেখার ঢঙ এমন ছিলো যে না এসে থাকতে পারিনি।
কি বোকার মতো কথা বলছো!
নিজেই আবার পড়ে দেখে চিঠিটা।
পকেট থেকে বের করে বাড়িয়ে ধরলো কলিন চিঠিটা। মাথা নাড়লো হেলার।
থাক, আর পড়তে হবে না, বললো সে, এসে তো গেছো, এখন কি করার কথা ভাবছো তুমি?
র্যাঞ্চ চালাবো!
অসম্ভব!
কেন?
এক কথায় তোমার প্রশ্নের জবাব দেয়া যায় : ওয়ারেনের জন্যে।
ওয়ারেন আমাকে ঠেকাবে কিভাবে?
বুলেট, ফোর্বস, সে নিজের হাতে গুলি করবে কিংবা আর কাউকে দিয়ে সারবে কাজটা। ছেলের জন্যে তোমাদের র্যাঞ্চটা দরকার তার, সেদিন আমার কাছে কেনার কথা তুলেছে। তাই বলে তুমি আবার ভেবে বসে না যেন রাঞ্চের জন্যেই তোমার বাবার সাথে লড়াইতে নেমেছে সে। ওদের বিবাদের কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমায় মনে হয় না ড্যানিয়েলের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় তোমাদের র্যাঞ্চ নেবার কথা ভেবেছে সে। কিন্তু এখন প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে হয়তো কাজে লাগাতে চাইছে ওটা। ওর ছেলেটা বুনো, খামখেয়ালী স্বভাবের, বলগাহীন ঘোড়া একটা; র্যাঞ্চিং ওর কাজ নয়, তবু হয়তো চেষ্টা করে দেখতে চায় ওয়ারেন, ছেলেটাকে যদি পোষ মানানো যায়।
ঘাড় ফিরিয়ে কামরার চারপাশে নজর বোলালো কলিন ফোর্বস। ছোট এবং অগোছালো, একপাশে একটা টেবিলে কাগজ আর বইয়ের ছড়াছড়ি।
বসো, ফোর্বস, বললো হেলার, অস্থির হবার কিছু নেই। সন্ধ্যায় সাধারণত আমার কাছে কেউ আসে না।
মাথা নাড়লো কলিন। ওয়ারেন সম্পর্কে বলো আমায়।
এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো অ্যাটর্নি, পায়ের ওপর পা তুলে দিলো। লণ্ঠনের ম্লান হলদে আলো ওর চেহারায় একটা রোগা ভাব এনে দিয়েছে।
ওয়ারেন সম্পর্কে জানতে চাও? কোত্থেকে শুরু করি? একজন মানুষের পক্ষে আরেকজন মানুষকে মূল্যায়ন করা কি সহজ? কাউকে যখন আমাদের ভালো লাগে আমরা তার ভালো দিকগুলোই সব সময় লক্ষ্য করি, অপছন্দ করলে তার সব আচরণই বাঁকা চোখে দেখি; আর যখন কারো ব্যাপারে নিরাসক্ত থাকি, সেক্ষেত্রে তার সম্পর্কে দায়সারা গোছের এমন কিছু বলি যেটা ভালো বা খারাপ কিছুই বোঝায় না। ওয়ারেন সম্পর্কে আমি তোমাকে অনেক কথাই বলতে পারি, কিন্তু তা কতখানি বিশ্বাস্য তোমাকেই বুঝে নিতে হবে। তবে এটা ঠিক, যথা সম্ভব সত্যির কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবো আমি।
শুরু করো, বললো কলিন।
মাথা দোলালো হেলার। ওয়ারেনের বয়স আন্দাজ চল্লিশ বছর, বিশাল শরীর ওর, চওড়া কাধ, স্বাস্থ্যবান; প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং নিজের শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অহঙ্কারী লোক। ভারি গলায় কথা বলে, যখন কাউকে নির্দেশ দেয়, মনে হয় ঝগড়া করছে। ওর হাবভাবে একটা রাজকীয় ভাব আছে, উদ্ধত; দুর্বল লোককে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। টেকসাস থেকে কলোরাডো হয়ে এখানে এসেছে ওয়ারেন, বংশপরম্পরায় র্যাঞ্চিং ব্যবসা করে আসছে ওরা, র্যাঞ্চিং কিভাবে করতে হয় জানে। প্রচুর টাকা নিয়ে এখানে এসেছে সে, আসামাত্র ম্যাকমিলানের র্যাঞ্চটা কিনে নিয়েছে, তারপর খবর পাঠিয়ে লোকজন এনেছে; এখন যারা ওর র্যাঞ্চে কাজ করছে বেশির ভাগই পুরোনো লোক। কঠিন একটা দল, সবাই মদ্যপ, কাউকে পরেরয়া করে না। কোমরে ঝোলানো পিস্তল চালানো কিংবা গরু চরানো-দুটোতেই ওস্তাদ। এবং চমৎকার কাজ দেখাচ্ছে ওরা। বুড়ো ম্যাকমিলান-এর র্যাঞ্চ থেকে এখন প্রচুর টাকা মুনাফা করছে ওয়ারেন, অথচ ম্যাকমিলান কখনো লাভের মুখ দেখেনি।
কিন্তু চিঠিতে তুমি লিখেছে বাজার খুব মন্দা।
ঠিক, কিন্তু ওয়ারেন ঝানু ব্যবসায়ী। বাস্তববাদী লোক এবং দক্ষ। কোনো বাধাই তার কাছে বাধা নয়।
আর ওর ছেলে?
বিল ওয়ারেন, দীর্ঘদেহী, সুদর্শন এবং দারুণ মেয়ে ঘেষা, মেয়ে দেখলেই বেসামাল হয়ে যায়।
র্যাঞ্চ চালাতে পারবে?
আগেই বলেছি সেটা ওকে দিয়ে হবার নয়, তবে বাপ ওকে সাহায্য করতে পারতেও পারে।
ওয়ারেনের স্ত্রী?
নীল নকশা
এখানে বিপত্নীক অবস্থায় এসেছিলো ওয়ারেন। কিন্তু বছর খানেক আগে একবার ক্যানসাস সিটিতে গিয়েছিলো সে, ওখানে বিয়ে করে সস্ত্রীক ফিরে আসে। ওয়ারেনের তুলনায় মেয়েটার বয়স অনেক কম, বড়জোর তিরিশ। দীর্ঘ একহারা গড়ন, সুন্দরী এবং আমার বুঝতে ভুল না হয়ে থাকলে ভীষণ অসুখী।
কেন?
কে জানে! তবে আন্দাজ করতে পারি। যে কোনো বিচারেই ক্যানসাস সিটির তুলনায় ওয়াগোনার তুচ্ছ, এখানে এই মেয়েকে সন্তুষ্ট করার উপকরণ কই? তাছাড়া ওয়ারেন সবসময় এত ব্যস্ত থাকে, স্ত্রীকে সময়ই দিতে পারে না। মেয়েটাকে অবশ্য কালেভদ্রে শহরে নিয়ে আসে, ওই পর্যন্তই।
কি নাম তার?
লিনডা।
লিনডা? পুরো নাম? ক্যানসাস সিটিতে লিনডা ওয়াইলড নামে একটা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো।
পুরো নাম জানি না, তবে ওর বাবা শুনেছি ক্যানসাস সিটির হোমড়া-চোমরাদের একজন।
সিনডিকেটের কাজ নিয়ে বছর দুই আগে ক্যানসাস সিটিতে গিয়েছিলো কলিন। ওখানে লিনডা ওয়াইলড নামে একটা মেয়েকে বিপদ থেকে বাঁচায়। ওর বাবাও ক্যানসাস সিটির একজন ব্যবসায়ী, বিরাট ধনী। সেই লিনডাইকি ওয়ারেনের স্ত্রী এখন? কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? লিনডার বাবা রবার্ট ওয়ারেনের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে যাবে কেন?
চিন্তিত চেহারায় মাথা দোলালো কলিন।
বাবার সঙ্গে রবার্ট ওয়ারেনের রেষারেষির আসল কারণটা কি?
উপত্যকায় একটা সমিতি গঠনের প্রস্তাব তুলেছিলো ওয়ারেন, সে থেকেই বিরোধের সূত্রপাত। সমিতি করার প্রস্তাব গৃহীত হলে রবার্ট ওয়ারেনের হাতেই সব ক্ষমতা চলে যেতো, সে-ই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। তোমার বাবা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দেয় প্রস্তাবটা। ড্যানিয়েল ফোর্বস ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদে বিশ্বাস করতো। নিজের গরু সবসময় নিজেই বাজারে চালানের ব্যবস্থা করেছে ও। ওয়ারেনের ইশারায় চলবে এমন কোনো সমিতির হাতে সেই কাজ তুলে দেবে তোমার বাবা, চিন্তার বাইরে। কিন্তু ওটা ছিলো মতা নৈক্যের কেবল শুরু। এরপর প্রায় সব ব্যাপারেই ওদের দ্বিমত পোষণ করতে দেখা গেছে, রাজনীতি, র্যাঞ্চের সীমানা ঘেষে বয়ে যাওয়া ইনডিয়ান ক্রীকের পানি ভাগাভাগি, রেনজে বেড়া দেয়া কোনো কিছুই বাদ যায়নি। ওয়ারেন যখনই কিছু বলেছে তার বিরোধিতা করেছে তোমার বাবা। ড্যানিয়েল ফোর্বস তো নগণ্য কেউ নয় যে তাকে উপেক্ষা করা যায়। কিন্তু ওয়ারেন আর শেষ পর্যন্ত পদে পদে এই বিপর্যয় মেনে নিতে পারেনি। ড্যানিয়েল ফোর্বসকে ধ্বংস করা ছাড়া তার কোনো উপায় ছিলো না এবং সেটাই ঘটেছে।
স্ট্যামপিড এম্পর্কে বলল এবার।
মাস খানেক আগের কথা, হঠাৎ একদিন ওয়ারেনের প্রায় পনেরো শে গরুর একটা বিশাল পাল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পাহাড় থেকে নেমে আসার পথে স্টোনি ক্রীক যেখানটায় বাঁক নিয়েছে সেখানে বেসিনের পুব প্রান্তের দিকে উঁচু একটা মাঠে চরছিলো গরুগুলো তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, নদীটা ওখানে কতখানি ভীব, সেজন্যে ক্লেব্যাংসের ওপর নদীর কিনারে বেড়া দিয়ে ঘেরারও ব্যবস্থা করেছিলো ওয়ারেন। কিন্তু একরাতে কে বা কারা সেই বেড়া কেটে ছত্রভঙ্গ করে দিলো গরুর পাল, অত উঁচু থেকে নিচে পড়ায় একটা গরুও বাঁচেনি। তোমার বাবা আর ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে ওয়ারেন, ওদের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায়। তারপর শেরিফ আর স্থানীয় লোকদের সহায়তায় সদলে তোমাদের র্যাঞ্চে গিয়ে হাজির হয় সে। গ্রেপ্তারে তোমার বাবা বাধা দেয়ায় সংঘর্ষ বেধে যায়। লড়াইয়ে সে রাতেই মারা যায় তোমার ভাই, মারাত্মকভাবে আহত হয় ড্যানিয়েল, শেষ পর্যন্ত ওকে বাঁচানো যায়নি।
চার্লস রেডফিলডের কাছে শুনলাম বাবা নাকি প্যসিকে র্যাঞ্চ ত্যাগ করার হুকুম করেছিলো?
হ্যাঁ, আমিও তাই শুনেছি।
কিন্তু, হেলার, বাবা তো এরকম কিছু বলতে পারে না! অতীতে কোনো সময় বাবা আইনের বিরুদ্ধে যায়নি। গরুর পাল ছত্রভঙ্গ করার অভিযোগও আমি বিশ্বাস করি না। বাবার চরিত্রের সঙ্গে কোনোটাই মেলে না।
তোমার বাবা তো অস্বীকারও করেনি।
সেটা তুমি কি করে জানলে?
লোকজনের কথায় সেরকমই মনে হয়।
লড়াইয়ের সময় আমাদের লোকেরা কোথায় ছিলো?
র্যাঞ্চেই ছিলো প্রায় সবাই। ওদের দুজন লড়াইতে মারা যায়। লড়াইয়ের পর আত্মসমর্পণকারীদের শহরে নিয়ে আসা হয়, কয়েক দিন জেলে আটক ছিলো ওরা। তারপর বেসিন ছেড়ে চলে যাবে কথা দেয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়। ওয়ারেনের মাথা থেকেই বেরিয়েছে বুদ্ধিটা। চমৎকার চাল, এর ফলে সবার চোখে ওর একটা ভালো ইমেজ গড়ে উঠেছে। সে ঝামেলা করতে চায় না–এটাই সবাইকে বোঝাতে চেয়েছে ওয়ারেন। শত্রু হিসেবে ওয়ারেন সাধারণ কেউ নয়, ফোর্বস, জীবনের বিনিময়ে তা জেনে গেছে তোমার বাবা।
ঘরময় পায়চারি করতে লাগলো কলিন ফোর্বস। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে উপত্যকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ঠিক বিবরণই ওকে দিয়েছে, অ্যাটিনি, এখানে থেকে র্যাঞ্চিংয়ের চেষ্টা করলে কি পরিণতি হতে পরে তারও আভাস মেলে ওর কথায়। কিন্তু হেলারের বক্তব্যে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এডি আর বাবা ওয়ারেনের গরু স্ট্যামপিড করতে পারে ভাবাই যায় না। বাবা তেমন মানুষই নয়। ড্যানিয়েল ফোর্বসের লড়াইয়ের কৌশল অমন হতে পারে না। অবশ্য অভিযোগ যদি ভিত্তিহীন হয়, সেক্ষেত্রে গ্রেপ্তারে বাধা দেয়াই ওর পক্ষে স্বাভাবিক। বাবার যদি মনে হয়ে থাকে যে প্যসি আইনের প্রতিনিধিত্ব করছে না বা আইন রবার্ট ওয়ারেনের ইচ্ছেয় চলছে, সন্দেহ নেই পরিণাম চিন্তা না করেই অস্ত্র তুলে নেবে।
ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে ওকে, ভাবলে কলিন। বাবার ঘনিষ্ঠ কারো সাথে কথা বলতে হবে। ডাক্তার মারভিনের কাছ থেকে হয়তো সাহায্য মিলতে পারে। মৃত্যুর আগে জ্ঞান ফিরে পেয়ে হয়তো ওর উদ্দেশে কোনো বার্তা রেখে গেছে বাবা।
আঙুল তুলে কলিনের দিকে ইঙ্গিত করলে অ্যারন হেলার। এখন, ফোর্বস, আস্তে আস্তে বললল সে, ছেলের জন্যে তোমাদের র্যাঞ্চটা কিনতে চাইছে রবার্ট ওয়ারেন। তুমি যদি নিজেই র্যাঞ্চ চালাতে যাও, কিছুতেই মানতে চাইবে না সে। এবং তোমাকে সরিয়ে দেয়া ওর জন্যে কঠিন কিছু নয়
একথা বলার মানে?
মানে খুব সহজ। আজ থেকে আট বছর আগে এখানে একটা গানফাইটে জড়িয়ে পড়েছিলে তুমি, সেবার একজন প্রাণ হারিয়ে ছিলো তোমার হাতে, এরপর বেসিন থেকে পালিয়ে গেছে তুমি–অন্তত সবাই তাই জানে।
ওই লোকের অনেক বন্ধুবান্ধব ছিলো। বাবা ভাবলো—
নিশ্চয়ই। ড্যানিয়েলই তোমাকে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়ে ছিলো, নইলে লোকটার কোনো বন্ধুর সঙ্গে গানফাইটে নৈপুণ্যের পরিচয় দিতে হতো সেজন্যেই পালাতে হয়েছে তোমাকে। সম্ভবত এরপর আর কাউকে প্রাণ দিতে হয়নি তোমার হাতে, হতে পারে ঝামেলাহীন ভাবে কাটিয়ে দিয়েছে আটটি বছর, কিন্তু মানুষ হত্যা করেই এখান থেকে পালিয়েছিলে তুমি–এটা ভোলেনি কেউ। সুতরাং উপত্যকাবাসীদের সহজেই বোঝানো যাবে যে বাবার মৃত্যুর বদলা নিতেই তুমি বেসিনে ফিরে এসেছে। ফলে ওয়ারেনের সহজ শিকারে পরিণত হবে। ক্রমাগত উত্যক্ত করে লড়াইতে নামতে বাধ্য করে অনায়াসে তোমাকে হত্যা করতে পারবে ওরা। এবং শেষে তোমাকেই দায়ী করবে লোকে, তাই নয় কি? তোমার পক্ষে কথা বলার কেউ থাকবে না।
ব্যাপারটা আসলেই এরকম?
হ্যাঁ। তোমার কোনো সুযোগই নেই।
তোমার কথা আমাকে আগ্রহী করে তুলছে।
মরণ যদি আগ্রহ জন্মানোর মতো কিছু হয়…
এলোচুলে হাত চালালে কলিন ফোর্বস, বললো, স্ট্যামপিড সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিত জানতে হবে, হেলার। এখন ডাক্তার মারভিনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আমি। মৃত্যুর আগে ডাক্তার কে হয়তো কিছু বলে গেছে বাবা। এদিকে আমার হয়ে কয়েকটা কাজ করতে হবে তোমাকে।
কি রকম?
এক, ওয়ারেনকে বলবে, ফোর্বস র্যাঞ্চ আমি বিক্রি করবে। না। ওকে জানিয়ে দেবে, আমি ফিরে এসেছি এবং নিজেই র্যাঞ্চটা চালাবে।
ও তা মানবে না।
তাতে আমার বয়ে গেল। আর হ্যাঁ, টাকা পয়সার ব্যাপারে কিছু জানো? বাবার ব্যাংকে জমা কত? তোলা যাবে?
সম্পত্তির একটা নিষ্পত্তি না হলে তোমার বাবার অ্যাকাউনটে হাত দেয়া যাবে না, তবে খুব যদি দরকার থাকে, আমার কাছ থেকে ধার হিসেবে নিতে পারো।
তোমার কাছ থেকে? কেন?
প্রশ্ন করো না, কলিন। টাকাটা জানি গচ্চা যাবে, খরচ করার জন্যে বেঁচে থাকবে না তুমি।
থাকতেও পারি।
অসম্ভব, ভুরু কুচকে বললো হেলার, যদি না সমস্যার মুলে আঘাত হানতে পারো।
ওয়ারেনের কথা বলছো?
নয়তো কার? ওয়ারেনের অনুপস্থিতিতে ওর দল ছিন্নভিন্ন হয়ে। যাবে।
অ্যাটর্নির দিকে চিন্তিত চেহারায় তাকালো কলিন। লোকটার উদ্দেশ্য যেন ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। কারণটা যাই হোক, ওয়ারেনের বিনাশ চায় হেলার। ওর চিঠি আর এখন টাকা ধার দেয়ার প্রস্তাব, এসব তারই ইঙ্গিত দেয়।
আমি আমার মতো কাজ করতে চাই, গম্ভীর কণ্ঠে বললো কলিন।
তবে বোকার মতো কিছু করো না। এবার বলো কত টাকা দর কার?
এখনই লাগবে, তা বলিনি। তবে লাগতে পারে।
যখনই লাগবে, বলো। এখন তো ডাক্তার মারভিনের কাছে যাবে বললে, তারপর?
জানি না। র্যাঞ্চে কেউ আছে?
আদালত থেকে একজন কেয়ার টেকার নিয়োগ করা হয়েছে। ডার্ক পিট, লোকটা—
হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দ হলো, থেমে গেল হেলার, দ্রুত এক পলক তাকালো দরজার দিকে উঠে দাড়ালে চট করে। রান্না ঘরে চলে যাও, তুমি, ফিসফিস করে বললো কলিনকে।
না, আমি চলে যাচ্ছি, জবাব দিলো ফোর্বস। পরে দেখা হবে, হেলার।
আবার টোকা পড়লো দরজায়, অস্থির।
আসছি। বিরক্তির সঙ্গে বললো হেলার। এক মিনিট।
দরজার দিকে পা বাড়ালো সে।
রান্নাঘর হয়ে বাইরে চলে এলো কলিন। বাইরে পা রাখার আগমুহূর্তে ফ্রণ্টরুম থেকে ভেসে আসা সমবেত কণ্ঠস্বরকানে লাগলো, কিন্তু একটা শব্দও বুঝতে পারলো না ও। উঠোনে এসে দালানের পেছন দেয়ালের অন্ধকার ছায়ায় দাড়িয়ে পড়লো। ইতিমধ্যে হয়তো ওর প্রত্যাবর্তনের খবর ওয়ারেনের কানে পৌঁছে গেছে, ভাবলে ও। বেডফিলড যদি খবরটা দিয়ে থাকে, তাহলে এটাও নিশ্চয়ই বলেছে যে ওকে ওয়গোনারের দিকেই আসতে দেখা গেছে। ওকে ধরার জন্যে লোক পাঠিয়ে দিতে পারে ওয়ারেন।
চারপাশের অন্ধকারে নজর বোলালো কলিন, কোনো নড়াচড়া ধরা পড়লো না। চোখে। উঠোন পেরিয়ে পাশের বাড়ির আড়ালে আড়ালে ঘুরপথে প্রধান সড়কের দিকে এগোলো ও। শহরের অপর প্রান্তে ডাক্তার মারভিনের বাড়ি। হেলারের বাড়ির সামনে রয়ে গৈছে ওর ঘোড়াটা, অপ্রত্যাশিত কোনো বিপদ না ঘটলে পরে এসে নেয়া যাবে। আপাতত পায়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো, অযথা উৎকণ্ঠায় ভুগতে হবে না।
পাঁচ মিনিট পর ফীড স্টোর আর স্যাডল শপের মাঝখানের গলি পথ থেকে বেরিয়ে রাস্তা অতিক্রম করলে কলিন ফোর্বস। হোটেলের বারান্দায় কয়েকজন লোক জটলা করছে, রিভার বেনড স্যালুনের সামনে আরেক দল। ওদের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করলো কলিন। কিন্তু অন্ধকারে ওকে আলাদা করে চেনা যাবার কথা নয়। আরো দুমিনিট পর ডাক্তার মারভিনের বাড়ির বারান্দায় পৌঁছুলে কলিন, টোকা দিলে দরজায়।
০৩. ছোটখাট মানুষ ডাক্তার মারভিন
মাঝ বয়সী, ছোটখাট মানুষ ডাক্তার মারভিন, গোলগাল চেহারায় গোলাপী ভাব। চশমার পুরু কাঁচের ওপাশ থেকে চোখ দুটে। কুচকে আগন্তুকের দিকে তাকালে সে, পরমুহূর্তে চিনতে পেরে চেঁচিয়ে উঠলো, আরে, কলিন ফোর্বস। এসো, ভেতরে এসো। কয়েকদিন হলো তোমার অপেক্ষাই করছি।
হাত বাড়িয়ে দিলো ডাক্তার, করমর্দন করলো কলিন, ডাক্তারের আন্তরিকতা ওকে মুগ্ধ করল। বসার ঘরে ঢুকতেই চোখ পড়লো এক মহিলা আর বছর পাঁচেক বয়সের একটা বাচ্চা মেয়ের ওপর। একটা টেবিলের ওপর বসে রয়েছে বাচ্চাটি, এক গামলা পানিতে ওর হাত ডোবানো। লম্বা ছিপছিপে গড়নের মহিলাটিকে দেখলে বিশ্বাস হবে না সে-ই বাচ্চাটির মা, একেবারে অল্প বয়স। মাথাভর্তি কালো চুলের মাঝখানে সিথি কেটে চমৎকার একটা খোঁপা বেঁধেছে মাথার পেছনে; ওর গায়ে ব্লাউজ আর জ্যাকেট, পরনে বিশেষ ধরনের রাইডিং স্কার্ট, পায়ে জুতো; গভীর কালো দুটো চোখ, কমনীয় চেহারা। কেন যেন মেয়েটিকে খুব পরিচিত ঠেকছে কলিনের। হঠাৎ মনে পড়ে গেল ওর নাম, বেলিনডা কালাইল।
মাথা থেকে টুপি নামালে কলিন, হ্যালো, বেলিনডা!
হ্যালো, কলিন, ভারি গলায় বললো বেলিনডা, একটুও অবাক হয়নি, বরং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছে কলিনকে। টেবিলের ওপর বসা বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকালে বেলিন।
এখন কেমন লাগছে মা-মনি?
ভালো, আম্মু, ব্যথা লাগছে না।
টুপিটা তুলে রাখো, কলিন, বললো ডাক্তার মারভিন। মেরিকে দেখেই তোমার সঙ্গে বসছি। হাত কেটে গেছে বেচারির, ঘা হয়ে গেছে তাতে।
গামলার পানি থেকে মেয়েটির হাত তুলে ক্ষত পরীক্ষা করলো ডাক্তার, ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে সামনে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করলো বেলিন।
হাতটা বিশ্রী রকম ফুলে উঠেছে দেখার পর আর দেরি করিনি, এখানে নিয়ে এসেছি, বললো সে। আরো খারাপের দিকে যাবে না তো।
সে ভয় আর নেই, ওকে আশ্বস্ত করলো ডাক্তার মারভিন। আমি তোমাকে দুটো ট্যাবলেট দিচ্ছি, ওগুলো পানিতে গুলে নিয়ে কাল সকালে আর সন্ধ্যায় একবার করে দুবার আর পর সকালে একবার, মোট তিনবার ওষুধ-পানিতে ওর হাত ধুইয়ে আগের মলম টাই লাগিয়ে ব্যানডেজ বেঁধে দেবে। পরশু সকালেও যদি ফোলা না কমে কিংবা যদি কনুই বা কাঁধে ব্যথার কথা বলে, ডেভিড স্পেক্টকে পাঠিয়ে দিয়ে, আমি আবার দেখে আসবো ওকে, ঠিক আছে?
ডাক্তারকে কি যেন জিজ্ঞেস করলো বেলিনডা, জবাবে ডাক্তার কি বললো তাও বোঝা গেল না। দীর্ঘ সময় আলাপ করলো ওরা। চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো কলিন, ওদের দেখছে আর ভাবছে বেলিনডার স্বামী কে হতে পারে। মেরি বেলিনডারই সন্তান তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। আশপাশের কোনো র্যাঞ্চেই হয়তো এখন থাকছে ও। আট বছর আগে ওর পরিচিত বেলিনডা ছিলো এক অষ্টাদশী তরুণী, বাবা মায়ের সঙ্গে ওয়াগোনারে এসেছিলো, শহরের স্টেজ লাইনে চাকরী করতে। ওর বাবা। শহরে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই সব ক’টি যুবকের প্রেমনিবেদন পর্বটি শেষ হয়ে–ছিলো, সবাই মিলে বেলিনডার চোখে পড়ার কত কসরতই না করেছে ওরা। কিন্তু তারপর এমন একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হলো কলিনকে, ওয়াগোনার থেকে পালানো ছাড়া উপায় রইলো না।
মেরির হাতে ব্যানডেজ করে দিতে লাগলো ডাক্তার মারভিন। ব্যানডেজ বাধা শেষ হলে বললো, বাহ মেরি, লক্ষ্মী মেয়ে আমার, একটুও ভয় পাওনি তুমি। কিন্তু মনে রেখো এখন থেকে আরো লক্ষ্মী, হয়ে থাকতে হবে তোমাকে, আর কখনো রান্নাঘরে ছুরি নিয়ে দুষ্টমি করো না যেন, কি মনে থাকবে? আর কটা দিন যেতে দাও, তারপর দেখবে আম্মুই তোমাকে ছুরি চালানো শিখিয়ে দিচ্ছে। ঠিক আছে?
মেরিকে কোট পরিয়ে দিলো মারভিন, তারপর কোলে তুলে নিলো ওকে, বেলিনডার সঙ্গে দরজার দিকে এগোলো, কলিন দাড়িয়ে রয়েছে ওখানে। ওর দিকে তাকালে বেলিনডা, কপালের চামড়া কুঞ্চিত হলো তার।
তোমার মেয়েটি কিন্তু বেশ মিষ্টি, বেলিনডা, বললে কলিন।
অথচ ওকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি, সারাক্ষণ দুষ্টমিতে মেতে থাকে, একটুও কথা শোনে না।
মায়ের মতোই, না?
হেসে ফেললো বেলিনডা, একটু যেন লাল হলো চেহারা। ঠিক কবে ফিরেছ তুমি, কলিন?
এই তো আজই।
তাহলে তো জান না—
বাবা আর এডির কথা? হ্যাঁ, জানি, বললো কলিন। সেজন্যেই তো ফিরে এলাম। মাত্র তো ফিরে এসেছি, কি করবো ঠিক করতে পারছি না।
কি যেন বলতে চাইলে বেলিনডা, হেলারের মতো ওকে সতর্ক করতে চাইলো হয়তো, আন্দাজ করলে কলিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নীরব থাকারই সিদ্ধান্ত নিলো। ঘুরে দাড়ালো সে, মেরিকে কোলে তুলে নিয়ে নিচু গলায় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললো, তারপর বেরিয়ে গেল বাইরে।
দরজা আটকে দিলো ডাক্তার মারভিন, চোখজোড়া কুচকে আছে, তার।
বলে গেল আমি যেন তোমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করি, হঠাৎ বললো ডাক্তার মারভিন। বেলিনডা আগেই জানতো বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তুমি ঠিক ফিরে আসবে, সত্যি বলতে কি আমিও তাই ভেবেছিলাম। প্রতিশোধ নেয়াই তোমার উদ্দেশ্য?
হতে পারে, স্বীকার গেল কলিন।
সেক্ষেত্রে তোমাকে বোকাই বলতে হবে।
সবাই দেখছি বোকা ভাবছে আমাকে।
তবেই বোঝে।
অস্বস্তির সঙ্গে হাত নাড়লো কলিন ফোর্বস। ডাক্তার, তোমার বাবাকে যদি ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হতো, তুমি কি করতে?
শেরিফের আদেশ অগ্রাহ্য করেছিলো ওরা। কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিলো।
ভিত্তিহীন কিনা জানছো কিভাবে? আমি যদ্দূর শুনেছি, ওরা ইচ্ছাকৃতভাবেই ক্লেব্যাংকসের ওপর চরানো ওয়ারেনের গরুর পাল স্ট্যামপিড করেছিলো।
ঠিক জানো?
না, কিন্তু তোমার বাবা অস্বীকার করেনি।
বাবা নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলে?
পারবে কি?
জানি না। মৃত্যুর আগে তোমাকে কিছু বলে যায়নি বাবা?
কিছু না, কলিন। মুহূর্তের জন্যেও জ্ঞান ফেরেনি ওর, তিনটা গুলি বিধেছিলো বুকে, বেঁচে ছিলো কিভাবে সেটাই আশ্চর্য।
আমাদের রাইডাররা সব কোথায়?
অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে সবাই। তোমাদের কাউকেই বেসিনে পাবে না এখন, একজনকেও না।
আচমকা দড়াম করে খুলে গেল সামনের দরজা। পাই করে ঘুরলো কলিন, চোখের পলকে হোলসটারের দিকে হাত বাড়ালো, নিমেষে বেরিয়ে এলো পিস্তলটা, পরমুহূর্তে নিচু করে নিলো, চোখ মুখ গরম হয়ে উঠলো।
মেরির পুতুলটা ফেলে যাইনি তো? জানতে চাইলে বেলিনডা।
অস্বাভাবিক চড়া শোনালে ওর কণ্ঠস্বর, ফ্যাকাসে লাগছে ওকে; মেরির পুতুল খুঁজতে ফিরে আসেনি বেলিনডা বুঝে ফেললল কলিন।
কই, নাহ! জবাব দিলো ডাক্তার মারভিন।
একটু খুঁজে দেখো না। বললে বেলিনডা, তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে জানালো, বাইরে তিনজন লোককে দেখলাম আমি, কলিন, এদিকে নজরে রাখছে। সামনে যখন লোক রয়েছে পেছনেও থাকতে পারে।
পিস্তল হোলসটারে ঢোকালো কলিন। ধন্যবাদ, বেলিনডা।
এখন কি করবে?
জানি না।
তুমি চাইলে শেরিফকে খবর দিতে পারি।
মনে হয় না তাতে লাভ হবে।
তাহলে আমার সঙ্গে চলো, ওরা কিছু বুঝতে পারবে না।
না, ওরা সত্যি সত্যি আমার খোঁজে এসে থাকলে এভাবে ঠেকানো যাবে না। অন্য কোনো উপায় খুজতে হবে।
তুমি বরং এখানে থেকে যাও, বললো ডাক্তার মারভিন। ওরা জোর করে আমার বাড়িতে ঢোকার সাহস হবে না কারো!
ঠিক আছে, বললো কলিন, আজকের রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেবে। আবার ধন্যবাদ, বেলিনডা।
কিন্তু এখানে থাকছে না ও। বাইরের লোকগুলো বেলিন্ডার ফিরে আসা নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠার আগেই ওকে বিদায় করা জরুরি হয়ে দাড়িয়েছে–তাই বলতে হলো কথাটা ওর কথায় বেলিনডা আশ্বস্ত হয়েছে বলে মনে হলো। আবার চড়া গলায় কথা বললো সে, অযথা কষ্ট দিলাম, ডাক্তার, ধন্যবাদ। পুতুলটা বোধ হয় ওয়্যাগনেই আছে।
এতক্ষণ চুপ করে ছিলো মেরি, আর সইতে পারলো না সে। ও আম্মু, ওটা তো ওয়াগনেই আছে, বললাম না তোমাকে?
ঠোঁট কামড়ালে বেলিনড। আহ, চুপ করো, মেরি, বললো ও তারপর বেরিয়ে গিয়ে টেনে দিলো দরজা।
দরজায় তালা মেরে কলিনের মুখোমুখি দাড়ালো ডাক্তার মারভিন, আমি মিথ্যে বলিনি, কলিন, জোর দেখিয়ে এ-বাড়িতে ঢুকে পড়বে ওয়ারেন, এখনো সেদিন আসেনি দাড়াও না, কালই ওকে একগাদ কথা শোনাচ্ছি আমি। ইচ্ছে হলে তুমি নিশ্চিন্তে থেকে যেতে পারো, কোনো ভয় নেই।
থেকে যাবে কিনা বুঝতে পারছে না কলিন। কিন্তু এভাবে কোণঠাসা ওয়া পছন্দ নয় ওর। এখান থেকে ওকে তো বেরুতে হবেই। দেরি করলে বরং আরো কঠিন হবে শত্রু বেষ্টনী, জাল গুটিয়ে আনবে ওরা।
এ বাড়ির কোনো জানালা খোলা আছে? হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে কলিন
পশ্চিমের একটা জানাল! খুলে রেখেছি, বাতাস ঢোকার জন্যে। বিকেলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ওই কামরার রোগীকে। বন্ধ করতে হবে ওটা?
ঠিক আছে, আমিই বন্ধ করে আসছি, বললো, কলিন। তুমি বরং পেছন দরজা আটকানো কিনা দেখো।
মাথা দুলিয়ে অন্দরের দিকে গেল ডাক্তার মারভিন। কলিন পা বাড়ালো হসপিটাল উইংয়ের দিকে।
কামরাটা মাঝামাঝি, চেঁচিয়ে জানালো ডাক্তার
আচ্ছা, জবাব দিলো কলিন, ধন্যবাদ। নিদিষ্ট কামরার সামনে পৌঁছে দরজা ঠেলে ভেতরের জমাট অন্ধ কারে পা রাখলো কলিন। খোলা জানালার আবছা চৌকো কাঠামো দেখা যাচ্ছে। পিস্তল বের করে জানালার দিকে এগোলো ও। তিন জন লোকের কথা বলেছে বেলিনডা, বাড়ির সামনে রয়েছে ওরা, পেছনেও পাহারা থাকা সম্ভব, তবে বাড়ির পাশে হয়তো থাকবে না কেউ।
জানালার পাশে ঘাপটি মেরে বসে তীক্ষ্ণ চোখে অন্ধকারে ছয় গুলোর দিকে তাকালো কলিন, কোনো ছায়ামূতি নজরে এলো না। জানালার চৌকাঠ ডিঙিয়ে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়লো ও। এখুনি খেকিয়ে উঠবে একটা পিস্তল, আশঙ্কা করলো, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না। মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে অনড় পড়ে রইলো কলিন।
একটা মিনিট পেরিয়ে গেল। আরেক মিনিট। আরো এক মিনিট। জানালার কাছে এসে আবার ফিরে যাচ্ছে ডাক্তার মারভিন টের পেলো কলিন। ঘাড় ফিরিয়ে উঠোনের দিকে তাকালো ও, অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে ইতিমধ্যে, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। সত্যিই কি ছিলো তিনজন? কার কাছে খবর পেলো ওরা। ওর এখানে আসার কথা কে জানতো?
হেলার। হেলারের বাড়ির সামনে ঘোড়া রেখে এসেছে ও, অপরিচিত ব্র্যানডের ঘোড়া। এক বা একাধিক লোক অ্যাটিনির সঙ্গে ওর আলাপে বাধা দিয়েছিলো, ওরাই হয়ত এখন হাজির হয়েছে। হেলারই বোধ হয় বলে দিয়েছে যে এখানে আসবে ও।
রাস্তার দিক থেকে রাগী গমগমে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো হঠাৎ। প্যাটেন! কনারস। মেইন! কোথায় সব? এখানে এসো, জলদি!
বুকে হেঁটে বাড়ির সামনের দিকে এগোলে কলিন, দেয়ালের অন্ধকার ছায়া থেকে সরলো না। কণ্ঠস্বরের মালিক কে হতে পারে আঁচ করতে পারছে ও। রবার্ট ওয়ারেন। হেলার বলছিলো চেঁচিয়ে নির্দেশ দেয়া ওয়ারেনের স্বভাব। ঠিক তাই করেছে রাস্তার লোকটি।
বাড়ির সামনে দেয়ালের কোণে পেীছে মাটির সঙ্গে মিশে গেল কলিন, ওয়ারেনকে দেখা যাচ্ছে এখন-লম্বা, চওড়া কাধঅলা সুঠামদেহী একলোক। অন্য দুজন লোক অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে এসে যোগ দিয়েছে ওর সঙ্গে, এবার আরো একজন হাজির হলো।
আর কে আছে তোমাদের সঙ্গে? কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ওয়ারেন।
আর কেউ না, রবার্ট।
এখানে কি করছো তোমরা?
টেরেন্স মিচেল আমাদের বন্ধু ছিলো, ওকে আমাদের ভালো লাগতো।
আমারও, একই রকম চড়া গলায় বললো ওয়ারেন। কিন্তু সে বোকার মতো গায়ে পড়ে ফোর্বসের সঙ্গে লাগতে গিয়ে মরেছে, ওর জন্যে বুনো বর্বরের মতো অন্ধকারে গাঢাকা দিয়ে ফোর্বসকে হত্যা করতে হবে, এমন কোনো কথা আছে? ওকে যদি মারতেই হয়, পুরুষমানুষের মতো সামনাসামনি মোকাবিলা করে, এক এক করে। বেসিনে আইন কানুন বলে একটা কথা আছে, ভুলে যেয়োনা সেটা।
বিড়বিড় করে কি যেন বললো ওদের একজন, বুঝতে পারলো না কলিন।
বিশাল কাধ ঝাঁকালো ওয়ারেন। ডাক্তার মারভিনের দরজার দিকে এগোলে সে, টোকা দিলো। দরজা খুলে যেতেই বললো, শুভসন্ধ্যা, ডাক্তার। কলিন ফোর্বস আছে নাকি এখানে?
না।
সত্যি?
মিথ্যে বলা আমার স্বভাব নয়।
এক মুহূর্ত চুপ রইলো ওয়ারেন, তারপর বললে, ঠিক আছে, ডাক্তার, খেপে যেয়ো না। তবে ও এখানে থাকলে বা আবার এলে বলল আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই। অতীতের একটা ব্যাপার নিয়ে অযথা বিরোধ জিইয়ে রাখার কোনো মানে নেই, আমার হয়ে কথাটা বলো ওকে, ঠিক আছে?
যদি ও আসে, বলবো, শান্ত কণ্ঠে বললো ডাক্তার মারভিন।
ধন্যবাদ, ডাক্তার।
ঘুরে দাড়ালো ওয়ারেন, নিজের রাইডারদের কাছে এসে বললো, ধেত্তেরি, এসব আমার একেবারে ভালো লাগছে না, তোমাদের ভাবসাবে মনে হচ্ছে ফোর্বসকে হত্যা করার মতলবেই এখানে আসা আমাদের। কিন্তু মানুষ এমন কিছু ভাবুক আমি তা চাই না। অতীত অতীতই, আমি সেসব ভুলে গিয়ে ফোর্বসের সঙ্গে মিটমাট করে ফেলতে চাই। অবশ্য ফোর্বস যদি গায়ে পড়ে ঝামেলা বাধাতে চায়, সেটা পরের কথা, তবে সেটা তাকেই আগে শুরু করতে দাও।
কিন্তু ফোর্বস টেরেন্স মিচেলকে মেরেছে। প্রতিবাদ করলে একজন।
ওর কথা আপাতত ভুলে যাও। শহরে এ-কথা ছড়িয়ে দাও, ইচ্ছে করলে ফোর্বস ওর রাঞ্চে ফিরতে পারে, আমাদের দিক থেকে কোনো গোলমাল হবে না।
এটা তোমার মনের কথা নয়, রবার্ট।
কে বলেছে? হাসলো রবার্ট ওয়ারেন, সশব্দে। অপেক্ষা করো, দেখো কি হয়।
রাস্তা ধরে শহরের দিকে এগোলে। ওরা।
উঠে দাড়ালো কলিন, অনুসরণ করলে ওদের। উঁচু রাস্তা পেরো নোর পর কোণাকুণিভাবে হেলারের বাড়ির দিকে এগোলো ও। যেখানে রেখে গিয়েছিলো। সেখানেই আছে ঘোড়াটা। কাছেপিঠে কাউকে দেখা গেল না। ওয়ারেনের লোকজন যদি নেতার কথা মেনে চলে তাহলে এখন ঘোড়ায় চেপে প্রধান রাস্তা ধরেই যেতে পারবে ও, বিপদ হবে না; এমনকি যেকোনো একটা স্যালুনে ঢুকে গলাটাও ভিজিয়ে নেয়া যায়। স্যালুনে ঢুকবে কিনা একবার ভাবলে কলিন, পরমুহূর্তে মত পাল্টালো।
জনমতের মূল্য বোঝে রবার্ট ওয়ারেন, বেসিনবাসীদের চিন্তা ভাবনা বোঝার চেষ্টা করে। আজ সে ডাক্তার মারভিনের বাড়িতে এসেছে এমন একটা হত্যাকাণ্ডে বাধা দিতে যেটা লোকচোখে জঘন্য হয়ে ধরা দিতে। কর্মচারীদের সে অতীতের কথা ভুলে যাবার পরামর্শ দিয়েছে, তার নাকি যেচে ঝামেলা করার ইচ্ছে নেই। কিন্তু গোলমালের ব্যবস্থা করা কঠিন কিছু নয়। যে কোনো লোককে ক্রমাগত উত্যক্ত করে তাকে লড়াইয়ে নামতে বাধ্য করা সহজ কাজ এবং এভাবে লড়াই বাধানোর দায়-দায়িত্বও তার ঘাড়ে চাপানো যায়।
তারা উঠেছে আকাশে। ম্লান আলো বিলোচ্ছে আধখানা চাঁদ। ঘোড়ার কাছে এসে হিচিংপোসট থেকে লাগাম খুলে নিয়ে স্যাডলে চেপে বসলো কলিন। তারপর শহরের বাইরের দিকে এগোলো, শেষ দালানটা অতিক্রম করে ঢাল বেয়ে নদীর দিকে এগোলো। নদী পেরিয়ে উত্তর পুবে চললো ও। ম্যাকমিলানের র্যাঞ্চ কিনেছে রবটি ওয়ারেন, ওখানেই যাচ্ছে কলিন। ওয়ারেন দেখা করতে চেয়েছে ওর সঙ্গে।
০৪. পর্বতমালার প্রান্তছোঁয়া
পর্বতমালার প্রান্তছোঁয়া একটা প্রকাণ্ড মাঠের-দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে ওয়ারেন র্যাঞ্চ; জড়াজড়ি করে দাড়ানো কয়েকটা দালানকোঠা। উইলো ঝোঁপের মাঝে একেবেঁকে বয়ে যাওয়া একটা ক্ৰীকের ধারে ঘোড়া বাধলো কলিন ফোর্বস, তারপর পায়ে হেঁটে র্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোলো। আসার পথে কোথাও অযথা সময় নষ্ট করেনি ও, তাই আশা করছে ওয়ারেনদের আগেই পৌঁছুতে পেরেছে।
এখন মাঝরাত হলেও র্যাঞ্চ হাউসের জানালায় আর বাংক হাউসে আলোর আভাস। ওয়ারেন রাইডারদের কেউ হয়তো এখনো জেগে, র্যাঞ্চ হাউসে যেই থাকুক এখনো বিছানায় যায়নি।
বারান্দায় উঠে এলো কলিন, চুপচাপ দাড়িয়ে কান পাতলো দরজায়, কিন্তু কিছুই শুনতে পেলো না। দরজায় টোকা দিলে ও, একই সঙ্গে পিস্তলের দিকে এগিয়ে গেল হাত। ওয়ারেনের ছেলে বিল যদি দরজা খুলে দাড়ায় কি করতে হবে জানে না ও। মিসেস ওয়ারেন দরজা খুললেই বা কি করবে? কি যেন নাম মেয়েটার? ও হ্যাঁ, হেলার বলেছিলো, লিনডা। ওর চেনা লিনডা?
কিন্তু সাড়া দিলো না কেউ।
আবার টোকা দিলে। কলিন, অপেক্ষা করলো, হঠাৎ ক্লান্ত বোধ করলো ও। শিরদাড়ার কাছে টনটন করছে, খিল ধরেছে যেন পায়ের পেশীতে। বিশ্রাম না নিলে আর হচ্ছে না, শরীর মন দুটোই একটু আরামের জন্যে আঁইঢাই করছে।
কে? দরজার ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। বিড়বিড় করে অস্পষ্ট একটা জবাব দিলো কলিন, আশা করলে। এতে কাজ হবে। হলোও। খুলে গেল দরজা। এবং অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো ও-পাশের মেয়েটি, বোঝা যাচ্ছে বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেয়েছে, একটা হাত তুলে আনলো সে মুখের কাছে। তুমি তুমি এখানে?
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি? তোমাকে এখানে দেখবে কল্পনাও করিনি হেলারের কাছে নাম শুনে সন্দেহ জেগেছিলো, কিন্তু বিশ্বাস করি নিঃ অনেকদিন পর দেখা, তাই না? কেমন আছো তুমি?
ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো কলিন ফোর্বস, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কামরার ওধারে একটা পিঠ উঁচু চেয়ার, উল্টোদিকে ফেরানো, ওটার পেছনে কেউ লুকিয়ে থাকতে। পারে। দুটো লণ্ঠন জ্বলছে কামরায়, পিয়ানো আর টেবিলের ওপর।
কলিন ফোর্বস? ফিসফিস করে বললো লিনডা ওয়ারেন, তুমি–
হ্যাঁ, ড্যানিয়েল ফোর্বস আমার বাবা, আমি আবার ফিরে এসেছি।
ভালো করে লিনডার দিকে তাকালো কলিন। তেমন বদলায়নি মেয়েটা, চেহারায় সামান্য মলিনতা এসেছে কেবল। তেমনি আছে মধুরঙা রেশমী চুল, নীল দুটো চোখ, মাখনের মতো মসৃণ ত্বক। কোমরের কাছে চাপা সার্টিনের পোশাক ওর পরনে, মেঝে ছুঁই ছুঁই করছে ওটার ঝুল। ওকে দেখে মনে হয় না ও শোবার আয়োজন করছিলো। কোনো পুরুষকে আকৃষ্ট করতে কিংবা অন্য মেয়ের মনে ঈর্ষা জাগাতেই এ-ধরনের পোশাক পরা হয়। এ বোধ হয় নিজেকে খুশি করতেই পরেছে, ভাবলো কলিন। হেলারের কথা সত্যি হলে দামী পোশাক-আশাক দেখানোর সুযোগ মেলে না, ওর।
লিনডার সঙ্গে পরিচয়ের কথা ভাবলো কলিন।
সে বছর সিনডিকেটের কাজে ওয়াইমিং থেকে ক্যানসাস সিটিতে গিয়েছিলো ও। একদিন সন্ধ্যায় রেস্তরাঁয় সাপার সারছে, হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এলো, চমকে উঠলো ও, চট করে বাইরে বেরিয়ে এলো। তিনজন ষণ্ডা ধরনের লোক এক তরুণীকে টেনে হিচড়ে কাছেই দাড় করানো একটা ব্যাক বোর্ডে তুলতে চাইছে। ব্যাপার কি চট করে বুঝে নিলো কলিন। সময় নষ্ট না করে দ্রুত ছুটে গেল ও। সবচেয়ে কাছের লোকটার কলার জাপটে ধরলো ওর হাত, হ্যাঁচকা টান মারলো, এলোপাতাড়ি পা ফেলে বাকবোর্ডের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো লোকটা। সঙ্গীকে আক্রান্ত হতে দেখে মেয়েটিকে ছেড়ে ওকে মোকাবিলা করতে একসঙ্গে, তেড়ে এলো অন্য দু’জন। দেরি করলো না কলিন, ওর দু’হাত বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গেল দুই গুণ্ডার চোয়াল বরাবর। প্রচণ্ড আঘাতে চমকে উঠলে ওরা। সুযোগটা লুফে নিলে কলিন। চট করে সামনে বেড়ে দু’হাতে দু’জনের চুল মুঠি করে ধরে মাথা দুটো ঠুকে দিলো পরস্পর। নির্দ্বিধায় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো ওরা। এবার মেয়েটার দিকে দৃষ্টি দিলো কলিন। এক পাশে দাড়িয়ে আতঙ্কে থরথর কাপছে বেচারা চেহারা দেখে বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে, পরনে দামী পোশাক। ওর দিকে এগিয়ে গেল কলিন। ভয় নেই, বললো ও, কোথায় যাচ্ছিলে, চলো পৌঁছে দিই।
বা-বাসায়। অনেক কষ্টে মুখ খুললো মেয়েটি, এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম, গলা কাঁপছে, স্যালুনের সামনে আসতেই আচমকা ঝাপিয়ে পড়লো ওরা…এমন কিছু ঘটবে ভাবিনি…আমি.. আমি..মানে…।
ভুলে যাও, বললো কলিন, চলো,তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছি।
চলো। তিন গুণ্ডাকে শেরিফের হাতে সোপর্দ করার ব্যবস্থা করে তারপর এগোলে। ওরা।
আমার নাম লিনডা ওয়াইলড, পরিচয় দিলো মেয়েটা, জন ওয়াইলড আমার বাবা, শহরের সবাই এক ডাকে চেনে ওকে।
নিজের নাম বললে কলিন। তাহলে তো তোমার ওপর হামলা হবাব কথা নয়, বোধ হয় চিনতে পারেনি।
এই ঘটনার পর আর মাত্র একবার দেখা হয়েছে ওদের। তারপর আবার ওয়াইওমিংয়ে ফিরে গেছে কলিন। এতদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় ওর কথা এক রকম ভুলেই গিয়েছিলো।
বর্তমানে ফিরে এলো কলিন ফোর্বস। লিনডার দিকে তাকালো। কিন্তু ও এখানে এলো কিভাবে?
এখানে এসেছো কেন? জানতে চাইলে লিনডা।
মুখে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করলে কলিন, বললো, উত্তেজিত হয়ো না, রবার্ট ওয়ারেনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম আমি। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি, তুমি ওর সঙ্গে জড়ালে কি করে?
জানালো লিনডা। বাবার কারণেই আজ ওর এ-অবস্থা। বছর খানেক আগে ক্যানসাস সিটিতে গেলে বাবার সঙ্গে পরিচয় হয় রবার্ট ওয়ারেনের। ওয়ারেনের কেতাদুরস্ত চালে মুগ্ধ হয়ে মেয়েকে ওর হাতে তুলে দিয়েছে জন ওয়াইলড। বিয়ের পর ক্যানসাস সিটি ছেড়ে এখানে চলে আসতে হয়েছে ওকে।
ক্যানসাস সিটির তুলনায় আমাদের বেসিন তোমার কাছে মৃত্যু পুরীর মতো লাগার কথা?
মৃদু হাসলো লিনডা। স্বাভাবিক কি আছে এখানে আমাকে মুগ্ধ করার মতো?
ঠিক কোন জিনিসটার অভাব বোধ করছো তুমি? জানতে চাইলে কলিন।
আনন্দ। কত মজাই না ছিলো ওখানে। আর এখানে-কথা বলবে, একটা বন্ধু পর্যন্ত নেই–ছেলে বা মেয়ে–কেউ না।
তুমি এখানে আছো জানলে আরো অগেই ফিরে আসতাম আমি।
লিনডা খুশি হয়েছে বলে মনে হলো, হাসলো ও, বিস্ময়ের ছাপ বিদায় নিয়েছে চেহারা থেকে।
কফি আছে? জিজ্ঞেস করলো কলিন।
আছে, কিন্তু ঠাণ্ডা।
তাই দাও।
একটু দাড়াও, বললো লিনডা। এখুনি আনছি।
রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল লিনডা। একটু পরেই দু’কাপ কফি নিয়ে ফিরে এলো। এক কাপ কলিনকে দিলো।
কফিতে চুমুক দিলো ওরা। ক্যানসাস সিটিতে যদি ফিরতে পারতাম, লিনডার কণ্ঠে হতাশা, আর কিছু চাইতাম না। এখানে আমার দম আটকে আসছে!
গেলেই পারো?
টাকা? রবার্ট একসঙ্গে বেশি টাকা দেয় না আমাকে।
কত টাকা লাগবে?
দেবে তুমি? কমপক্ষে পাঁচশো ডলার!
গম্ভীরভাবে মাথা দোলালো কলিন ফোর্বস। হেলারের কাছ থেকে পাঁচশো ডলার আদায় করা কঠিন হবে না। টাকাটা নিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। লিনডাকে এই নিরানন্দ একঘেয়ে জীবন থেকে উদ্ধার করে ক্যানসাস সিটিতে ওর আপন পৃথিবীতে ফিরে যেতে সাহায্য করে একই সঙ্গে রবার্ট ওয়ারেনকে আঘাত করতে পারে। লিনডাকে পালাতে সাহায্য করে খবরটা ওয়ারেনের কানে পৌঁছে দিলেই হবে। ওয়ারেনের ঘরে সুখী নয় লিনডা, বরং বলা যায়বিপদেই আছে। মেয়েটিকে বিপদ থেকে বাঁচানোয় দোষের কিছু নেই। অতীতে একবার ওর বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছিলো সে। ওকে এখানে দেখে এবারও নিশ্চয়ই সাহায্য আশা করবে মেয়েটা। ক্যানসাস সিটিতে ফিরতে চায় লিনডা, অথচ এক অর্থে ওকে আটকে রেখেছে ওয়ারেন কিন্তু লিনডা তার বিবাহিত স্ত্রী…উঁহু, বিয়ে করলেও ওকে স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা দেয়নি সে, লিনডার কথাতেই তা বোঝা যায়…তবে… চট করে চিন্তাটা দূর করে দিতে চাইলো কলিন। বাঁকা পথে লড়াই করার সময় এখনো আসেনি।
আমাকে যেভাবে পারে, পাঁচশো ডলার যোগাড় করে দাও, কলিন, আবেদন ঝরলো লিনডার কণ্ঠে, উদ্ধার করে এ-নরক থেকে।
ঠিক আছে, বললো কলিন। ভেবো না, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
হঠাৎ বাইরে ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল, ক্রমশ বাড়ছে। তিনসঙ্গীসহ ফিরে আসছে রবার্ট ওয়ারেন।
ঘোড়ার খুরের শব্দ লিনডাও শুনেছে। ঝট করে দরজার দিকে তাকালো সে।
পালাও, কলিন! রুদ্ধশ্বাসে বললো। পিস্তলের দিকে হাত বাড়ালো কলিন। না, লিনডা।
কিন্তু ওরা এসে
একসঙ্গে ঢুকে পড়বে সব কটা?
রবার্ট, আর বিল। কিন্তু—
ওদের সঙ্গে দেখা করতেই তো আমার এখানে আসা। কলিনের হোলসটারে রাখা পিস্তলের দিকে তাকালো লিনড, একটু যেন শিউরে উঠলো।
আলাপ করতে, লিনডা, হত্যা নয়।
কিন্তু ওরা—
ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছে কলিন, তবু হাসতে চেষ্টা করলো।
এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, বললো ও, তুমি ঘরে চলে যাও। আমি রইলাম এখানে।
না!
উঠোনে পৌঁছে গেল ওয়ারেনরা। এক এক করে স্যাডল থেকে। নামছে। চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে কলিন, দেরি নেই, এখুনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলে রবার্ট ওয়ারেন আর তার ছেলে।
লিনডা, বললে কলিন, ঘরে যাও।
না। আমাকে দেখলে গোলাগুলি করবে না ওরা।
কিন্তু তুমি ওদের সতর্ক করোনি বলে প্রশ্ন উঠবে। আমার কাজ আমি বুঝি, লিনডা, তুমি ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো। আমি রবার্টের সঙ্গে একটু আলাপ করে ফিরে যাবো, ব্যস।
কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই—
না। কই, গেলে? তাড়াতাড়ি করো!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুরে দাড়ালো লিনডা। বারান্দায় পায়ের আওয়াজ পেলো কলিন। উল্টোদিকে ফেরানো পিঠ উঁচু চেয়ারটার দিকে এগিয়ে গেল ও, বসে পড়লো। লিনডার ঘরের দরজা বন্ধ হলো, একই সঙ্গে খুলে গেল বারান্দার দরজা। কামরার ভেতর পায়ের আওয়াজ। দরজা বন্ধ হবার শব্দ।
বাতি জ্বলছে, গজগজ করে উঠলো রবার্ট। কিন্তু লিনডা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতি নেভায়নি কেন বুঝলাম না যে কোনো মুহূর্তে বিপদ হতে পারে?
ওর মাথায় ঘিলু বলে কোনো পদার্থ আছে নাকি! জবাব দিলো আরেকটা কণ্ঠস্বর।
চুপ, বিল। ধমকের সুরে বললো ওয়ারেন।
কিভাবে যে তোমায় বোকা বানিয়ে রেখেছে সে, আবার বললো বিল, পরে টের পাবে।
ধেত্তের, বললাম না, চুপ করো! গর্জে উঠলো রবার্ট ওয়ারেন।
কামরার আরো ভেতরে এলো ওর। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো কলিন, মুখোমুখি হলো ওদের, আগেই পিস্তল তুলে নিয়েছে হাতে। ওয়ারেনকে কাভার করলো ও, সামান্য নোয়ালো ব্যারেলটা।
তুমি নাকি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও? বললো ও, আমি এসেছি।
যেন নিজের বাড়ি, কাকে বলে ঢুকেছো তুমি? চিৎকার করে বললো ওয়ারেন।
তুমি রেগে যাবে ভাবিনি, বললো কলিন, দুঃখিত।
লাল টকটকে চেহারা ওয়ারেনের, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ মোটা, ঘন ভুরুর নিচে প্রায় ঢাকা পড়েছে চোখ দুটো, চৌকো চোয়াল, এক গুয়ে একটা ভাব চেহারায়। হাপাচ্ছে রবার্ট ওয়ারেন। নিজের ঘরে হঠাৎ অন্য লোকের উপস্থিতিতে কিছুটা হতবাক।
ওর ঠিক পাশে বিল, একটু সামনে ঝুঁকে আছে, আড়ষ্ট। বাপের ক্ষুদ্র সংস্করণ যেন, রবার্ট ওয়ারেনের চেয়ে একটু লম্বা, কিন্তু অতটা ভারি নয় শরীর, শুকনো চেহারা, কিন্তু বাপের মতোই একগুয়ে ভাব। হেলার বলেছিলো ছেলেটি নাকি সুদর্শন, হাসলে হয়তো ভালোই লাগবে। হেলার অবশ্য বিলকে বিপজ্জনক মনে করেনি, কিন্তু কলিনের বিশ্বাস, বিল রবার্ট ওয়ারেনের মতোই বেপরোয়া লোক।
তোমার নাম জানতে চাওয়ার দরকার আছে আর? জিজ্ঞেস করলো রবার্ট ওয়ারেন।
আমার ধারণা ওটা জানতে বাকি নেই তোমার।
তোমার বাবার প্রতি আমার কোনো ঘৃণা ছিলো না, ফোর্বস। ওর সাথে নানা ব্যাপারে আমার অমিল ছিলো বটে, অনেক ব্যাপারে ওর বিরোধিতা করেছি, লড়াই করেছি, কিন্তু কখনো ঘৃণা করিনি।
কিন্তু বাবাকে তুমি হত্যা করেছে।
না, আমি হত্যা করিনি। তোমার বাবা যেদিন আহত হয়, আমিও ছিলাম প্যসিতে, ওর গায়ে কার গুলি লেগেছে জানতে পারিনি আমরা আজও।
হামলাটার কথা একটু শোনাও।
ওটা হামলা ছিলো না, চট করে বললো ওয়ারেন। ফোর্বস রাঞ্চে শেরিফের প্যসি গিয়েছিলো, তোমার বাবা শেরিফের কতৃত্ব অস্বীকার করেছে, প্যসিকে র্যাঞ্চ ছেড়ে চলে যেতে হুকুম দিয়েছে। শেরিফ ওর নির্দেশ অমান্য করায় গুলি ছুড়তে দ্বিধা করেনি।
তাহলে বাবার র্যাঞ্চে প্যসি যাবার কারণটাই বলো, বললো কলিন।
মাথা দোলালো ওয়ারেন, বললো, ফোর্বস, আর সবার বেলায় যেমন ঘটে, তোমার বাবার সঙ্গেও আমার নানা বিষয়ে মতের অমিল ছিলো। আমি আমার কথায় অনড় থেকেছি, তোমার বাবা তারটায়। অসংখ্যবার আমাদের দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়েছে, কিন্তু স্ট্যামপিড না ঘটলে ব্যাপারটা কিছুতেই এতদুর গড়াতে না। গভীর ক্যানিয়নে একসঙ্গে পনেরো শ’ গরুর একটা পাল পিছলে পড়ার পর কি অবস্থা হয়েছিলো যদি দেখতে। ক্লেব্যাংকসের ওপর থেকে এ নিদারুণ দৃশ্যটাই দেখতে হয়েছে আমাকে!
কিন্তু সেজন্যে আমার বাবাকে দায়ী করছো কেন?
গরুর পাল পাহারা দেয়ার জন্যে আমার দুজন লোক ছিলো। দুজনই তোমার বাবা আর ভাইকে দেখেছে। আরো তিনজন লোক ছিলো ওদের সঙ্গে।
ওরা সত্যি বলেছে তার কোনো প্রমাণ আছে?
ওরা মিথ্যে বলেনি। কিন্তু ব্যাপারটা আরো জটিল। তোমার বাবা আর ভাই ফিরে আসার সময় ডেনিস স্মিথ দেখেছে ওদের, স্ট্যামপিডের ঘটনাস্থলের কয়েক মাইলের মধ্যে ডেভিড স্পেক্টরও দেখেছে তোমার বাবাকে।
তবু আমি বিশ্বাস করি না, বললে কলিন।
কিন্তু এটাই সত্যি। সময় পেলে স্মিথের সঙ্গে আলাপ করো, জিজ্ঞেস করে দেখো ডেভিড স্পেক্টরকে। বেলিনতা গ্রেবারের র্যাঞ্চে পাওয়া যাবে ওকে। শেরিফের কাছে দেয়। ওদের জবানবন্দী জেনে নাও।
ঠিক আছে, তাই নেবো।
বেশ। তা, এবার পিস্তলটা হেলসটারে রাখলে হয় না? কয়েক টা ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাই আমি। পিস্তলের মুখে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে।
ওর কোনো দরকার আছে এখানে? বিলের দিকে ইশারা করলো কলিন ফোর্বস।
বিল, বললো ওয়ারেন, তুমি আমাদের আলাপে বাগড়া দিতে এসো না। বেসিনে আর রক্তপাত চাই না আমি।
বাগড়া দেয়ার ইচ্ছে আমারও নেই, তিক্ত কণ্ঠে বললে বিল। তবে একটা কথা মনে রাখতে বলি, লাশ ছাড়া ফোর্বসদের বিশ্বাস করা ঠিক হবে না!
ফায়ারপ্লেসের দিকে এগিয়ে গেল সে, ঠেস দিয়ে দাড়ালো। বাপ বেটার মাঝখানে পড়ে গেল কলিন।
এখানে ঝামেলা করার ঝুঁকি নিতে চাইবে না রবার্ট ওয়ারেন, নিজেকে আশ্বস্ত করতে চাইলো ও। লোকজন ভালো চোখে দেখবে না সেটা। আমাকে মারতে হলে অন্য কোথাও কাজটা সারবে সে, যাতে সবাই জানে লড়াই শুরু করার জন্যে আমিই দায়ী। হত্যার সময় বাইরের লোকের সাক্ষীরও দরকার হবে তার। কাধ ঝাঁকিয়ে পিস্তলটা খাপে ঢোকালে কলিন।
শুরু করো, ওয়ারেন, বললো ও, বলো, কি বলবে।
তুমি বেসিনে ফিরে এলে কেন?
বাবা আর ভাই মারা গেছে খবর পেলে তুমি কি করতে?
পকেট থেকে সিগার বের করলো রবার্ট ওয়ারেন, দাঁত দিয়ে গোড়া কেটে ফেটে ঝোলালে, অগুন জ্বেলে টান দিয়ে মাথা দোলালো। হ্যাঁ, আমিও হয়তো তোমার মতোই করতাম। আচ্ছা, শুনলাম ওয়াইওমিংয়ে নাকি বেশ ভালো একটা চাকরি করছো তুমি।
হ্যাঁ, করতাম।
এখন কি ফিরে যাবে আবার ওই কাজে?
না, এখানে থেকে ফোর্বস র্যাঞ্চ চালাবো।
ভুরু কোচকালো ওয়ারেন। কিন্তু আমি কিনতে চাই যে র্যাঞ্চটা। কথাটা হয় তো তোমার পছন্দ হচ্ছে না, পরোক্ষে হলেও ড্যানিয়েলের মৃত্যুর জন্যে আমি কিছুটা দায়ী, এখন আবার র্যাঞ্চ কেনার কথা বলছি-সন্দেহজনক, না? আসলে অনেক দিন থেকেই জায়গা খুজছি আমি, তোমাদের র্যাঞ্চটা আমার পছন্দ, যত দাম চাও দেবো।
র্যাঞ্চ আমি বিক্রি করবে না।
কি বলছো? ওয়াইওমিংয়ের চাকরিটা সত্যিই ছেড়ে দেবে?
ছেড়ে দিয়েই এসেছি।
ভালো করে ভেবে দেখলে হতো না?
ভেবেই বলছি।
কাজটা ঠিক হচ্ছে না।
আমার ধারণা অন্য রকম।
সেটা ভুল, বললে ওয়ারেন, তীক্ষ্ণ শোনালো তার কণ্ঠস্বর। এতক্ষণ বেশ অমায়িক ছিলো লেকটার আচরণ, কিন্তু এখন বদলে যাচ্ছে তার হাবভাব, দৃষ্টি কঠিন।
আমার বিশ্বাস, আবার বললো ওয়ারেন, তুমি ভুল করছে, ফোর্বস, এবং তোমাকে তা শোধরাতে হবে। আমার র্যাঞ্চ ছেড়ে যাবার আগেই তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমার কাছে তোমাদের র্যাঞ্চ বিক্রি করে ওয়াইওমিংয়ের পুরোনো চাকরিতে ফিরে যাবে তুমি।
সোজা হয়ে দাড়ালো বিল ওয়ারেন, হাসছে, দুহাত ঘষতে ঘষতে মাথা দোলালো সে।
কলিনের শিড়দাড়ার কাছটায় শিরশির করে উঠলো। এখনো সশস্ত্র ও। শক্তির পাল্লা সমান। পিস্তলে ওর হাত চালু, কিন্তু ওয়ারেন আর বিলের মাঝখানে বিস্তর ফারাক, দুজনকে এক সাথে কাভার করা যাবে না। ব্যাপারটা ড্রয়ের দিকে গড়ালে ঠিক মরতে হবে।
কি করতে হবে শোনো, ফোর্বস, খেই ধরলে। রবার্ট ওয়ারেন, আজ, এখুনি একটা কাগজে সই দেবে তুমি, তোমার র্যাঞ্চ আমার কাছে বিক্রি করছে লেখা থাকবে তাতে; তারপর কাল সকালে গরে গিয়ে লেনদেন চুকিয়ে ফেলবে। আমরা, এবং পরশু তল্পিতল্পা গুটিয়ে ওয়াইওমিংয়ের পথ ধরবে তুমি। পরিষ্কার?
ভেবে দেখতে দাও, বললে কলিন, সময় পেতে চাইছে।
ভাবনার কিছু নেই, প্রায় খেকিয়ে উঠলো ওয়ারেন, আমি তো বিকল্প কিছু দেখছি না। যা বলছি তাই করতে হবে তোমাকে।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালে কলিন ফোর্বস। ওয়ারেন চমৎকার বুদ্ধি বের করেছে। ওয়ারেনের কথায় রাজি হয়ে কাগজে সই দিলে ওকে সে আটকে রাখবে সারারাত, সকাল হলে ওয়াগোনারে নিয়ে যাবে, সবার সামনে ওর হাতে দলিলে সই করিয়ে বিক্রিটাকে বৈধ রূপ দেবে, তারপর বেসিন থেকে চির বিদায় জানানো হবে ওকে। লোকে জানবে স্বেচ্ছায় সম্পত্তি বিক্রি করে চলে গেছে কলিন ফোর্বস। এরপর উপত্যকায় আরো বেড়ে যাবে ওয়ারেনের প্রতি পত্তি। ধেত্তের, নিকুচি করি! ভাবলো ফোর্বস, সই না দিলে কি করতে পারবে ওরা? নিরুপায় না হলে কিছুতেই লড়াই বাধাতে চাইবে না ওয়ারেন, এবং তার আগে সম্ভাব্য সব কৌশলই কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে সে।
আমি কোনো কাগজে সই করছি না, দৃঢ় কণ্ঠে বললে কলিন।
নইলে পস্তাবে!
কিভাবে? বিলের উদ্দেশে চিবুক নাচালো রবার্ট ওয়ারেন। বিল, লুইস প্যাটেন আর চাক কনারসকে ডেকে আনো…না, দরজা থেকেই ডাকে। ওদের। পিস্তলের বাঁটে হাত রেখে একটা চোখ ফোর্বসের ওপর রেখো।
এতক্ষণে আসল কথায় এসেছ। বললো বিল।
দরজার দিকে এগোলো সে, কবাট খুলে চেঁচিয়ে প্যাটেন আর কনারসকে ডাকলো, কিন্তু কলিনের ওপর থেকে নজর সরালো না।
পিস্তল বের করার চেষ্টা করলো না কলিন। এখান থেকে অস্ত শরীরে বেরোতে পারবে ভেবে ভুল করেছে, বুঝতে পারছে। রবার্ট ওয়ারেন সম্পর্কে ওর অনুমান ঠিক হয়নি। বেসিনে নিজ থেকে বড় ধরনের গোলমাল করতে চাইবে না ওয়ারেন, ঠিক, কিন্তু নিজের ঘরে ছোট খাট হাঙ্গামায় ক্ষতি কি? এখানে সে সম্রাট। এখানে যাই ঘটুক কেউ জানবে না।
এবার গানবেলটের বাকল খুলে ফেলো, বললো ওয়ারেন, ওটা আর কোনো কাজে আসছে না তোমার।
হাসলো কলিন।
বাপের মতোই গোয়ার এবং নির্বোধ তুমি! অপেক্ষা করলো কলিন। বারান্দায় পায়ের শব্দ। কামরায় ফিরে এলো বিল ওয়ারেন, সঙ্গে আরো দুজন। একজন লম্বা, ঢ্যাঙা মত, চোখ মুখ কোঁচকানো, যেন ভেঙচি কাটছে সারাক্ষণ। অন্যজন খর্বাকৃতি, স্থূলকায়, লালচে একজোড়া গোফ ঠোঁটের ওপর।
দেখো, কে এসেছে, বললো বিল, এর নাম ফোর্বস, ওই মেরেছে আমাদের টেরেন্স মিচেলকে।
নিমেষে পিস্তল বের করে আনলো গুফো।
দাড়াও, বললো রবার্ট ওয়ারেন। এই শেষ সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে, ফোর্বস, আমার কথা শোনো, তোমার ভালো হবে।
লম্বা করে দম নিলে কলিন। না।
এরা দুজনই মিচেলের বন্ধু, মিচেলকে ওরা পছন্দ করতে।
সে-ই আগে পিস্তল বের করেছিলো, বললে কলিন।
জানি, জবাব দিলো ওয়ারেন, রেডফিলড শেরিফের কাছে তোমার পক্ষে সাক্ষী দিয়েছে, তাতে কিছু যায় আসে না। যত যাই হোক, তুমিই মিচেলের হত্যাকারী। কাল সূর্য ওঠার আগেই আপসোস হবে তোমার কেন তার সঙ্গে দেখা হতে গেল ভেবে। প্যাটেন, কনারস, আস্তাবলে নিয়ে যাও ওকে, তবে আমি না আসা পর্যন্ত গায়ে হাত তুলল না, আমি লিনডাকে দেখেই আসছি। কই, ফোর্বস, গানবেলট খুলতে বললাম না?
বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করলো কলিন, উপায় নেই। প্যাটেন আর কনারস এগিয়ে এসে ওর দু’পাশে দাড়ালো, জাপটে বরলে কজি, তারপর টেনে হিচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে চললো আস্তাবলের দিকে। দাঁত মুখ খিচে ব্যথা সহ্য করলো কলিন।
০৫. আস্তাবলের ছাদের বীম থেকে
আস্তাবলের ছাদের বীম থেকে ঝুলছে তিনটে জ্বলন্ত লণ্ঠন।
মেঝেয় চিত হয়ে শোয়া কলিন ফোর্বস, মাথায় প্রচণ্ড এক অঘাতে ছিটকে পড়েছে, ওকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে বিল ওয়ারেন, লুইস প্যাটেন আর চাক কনারস, রবার্ট ওয়ারেনের জন্যে অপেক্ষা করছে। ঢ্যাঙা লোকটার নাম প্যাটেন, গুফোর নাম কনারস।
ব্যাটা উদয় হলো কোন্ জাহান্নাম থেকে? জানতে চাইলে কনারস।
ঘরে ঢুকে দেখি ঘর আলো করে বসে আছে, জবাব দিলো বিল।
চুরির মতলব নাকি?
হতেও পারে।
তাহলে শালাকে খতম করে দিলেই হয়?
ওকে দিয়ে র্যাঞ্চ বিক্রির-দলিলে সই করাবে বাবা।
ওসব দলিল-ফনিল রাখো। বুড়োর কাছ থেকে পরে কিনে নিলেই হবে।
কিন্তু এভাবেই বাবার ইচ্ছে, বললো বিল, কেউ সন্দেহ করবে না।
রবার্ট ওয়ারেন ঢুকলে তার দিকে তাকালো বিল। লিনডা ঠিক আছে?
অঘোরে ঘুমাচ্ছে, বললো ওয়ারেন। সামনে এসে কলিনের দিকে তাকালে সে। সই দেবে?
কখনো না!
পিছিয়ে গেল ওয়ারেন, বললো, প্যাটেন, কনারস, শোনো, টেরেন্স মিচেলকে হত্যা করেছে ও, তোমরা মনের ঝাল মিটিয়ে ধোলাই দিতে পারো এবার ওকে, তবে দেখো, হাতদুটো যেন আস্ত থাকে, সকালে একটা দলিলে সই দিতে হবে ওকে।
সবুট লাথি হাঁকালো কনারস, পাজরে আঘাত অনুভব করলো কলিন। আবার লাথি মারতে গেল সে, চট করে জুতো সুদ্ধো কনারসের পা জাপটে ধরলো কলিন, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়ালো, ধরে থাকা পা একটু উঁচু করে সজোরে ঠেলে দিলো সামনে। ছিটকে পেছনে চলে গেল কনারস, বেসামাল, আর্তনাদ বেরিয়ে এলো তার গলা চিরে। প্যাটেনের মোকাবিলা করতে পাই করে ঘুরলো এবার কলিন, পরমূহুর্তে একটা রাম ঘুসি খেলে চোয়ালে, তারপর পেটে, ভজি হয়ে গেল ও। সামনে ঝাপিয়ে পড়লো কলিন, প্যাটেনকে নিয়ে মেঝে স্পর্শ করলো।
পরক্ষণে গড়ান দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো ও, বাউলি কেটে কনারসের ছুড়ে দেয়া ঘুসি এড়ালো, পাল্টা ঘুসি কালো তার মুখ, লক্ষ্য করে, আবার। ওদিকে আবার উঠে পড়লো প্যাটেন, এগিয়ে এলো কলিনের দিকে এবং মারপিটে অংশ নেবে ঠিক করলো বিল ওয়ারেন।
একসঙ্গে কলিনের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো ওরা তিনজন। ঘাড়ের পেছনে কোপ মারলো যেন কেউ, দুই হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল ওর, আছড়ে পড়লে মাটিতে, কিন্তু অজান্তেই আবার উঠে দাঁড়ালো। তাল হারিয়ে যাচ্ছে বারবার, অসম্ভব ভারি লাগছে হাতদুটো তোলা যাচ্ছে না। তারপর এক সময় লুটিয়ে পড়লো আবার কলিন, ওঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। এবার ওকে লাথি মারতে শুরু করলো ওরা, লাগাতার; সেই সঙ্গে চললো অকথ্য গালিগালাজ। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল কলিনের। নিঃশ্বাস আটকে আসতে চাইছে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে চোখের সামনে, কিন্তু তারপরও চেতনা হারালো না ও।
আবার ওয়ারেনের চিৎকার শোনা গেল। ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে! এবার থামো! কলিনের উদ্দেশে আবার কথা বললো ওয়ারেন। ফোর্বস? শুনতে পাচ্ছে, ফোর্বস?
জবাব দিতে চাইলো কলিন, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোলো না ওর মুখ দিয়ে।
সই করবে, ফোর্বস? মাথা নাড়ার চেষ্টা করলো কলিন। মুখ খিস্তি শুরু করলো ওয়ারেন, একটু থেমে আবার বললো, অ্যাই, ওকে বেঁধে ফেলো। সকাল পর্যন্ত থাকুক ওভাবে। প্যাটেন, তুমি ওকে পাহারা দেবে, সকালে জ্যান্ত তুলে দেবে আমার হাতে, বুঝেছো?
ওকে ওরা বেঁধে ফেললো, তারপর প্যাটেন ছাড়া অন্যরা বেরিয়ে গেল আস্তাবল থেকে। এতক্ষণ বাতাসে ওড়া ধুলো থিতিয়ে এলো। আচমকা দপ করে নিভে গেল একটা লণ্ঠন। মাথা ঘুরছে কলিনের, বমি আসছে, চোখ বন্ধ করে অস্বস্তিভাব দূর করতে চাইলো ও। প্রচণ্ড মারে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে এখন, জ্বর আসবে বলে মনে হচ্ছে। সকালে আরো ভয়ঙ্কর নির্যাতনের মোকাবিলা করতে হবে, সহ্য করতে পারবে কি? হয়তো না।
প্যাটেন? কর্কশ কণ্ঠে ফিসফিস করে ডাকলো ও। প্যাটেন?
চোপ রাও। বললো প্যাটেন, আমি যদি উঠি, লাথি মেরে তোমার থেতা মুখ ভোঁতা করে দেবে! কেন জানতে চাও? তোমার নাম ফোর্বস, সেজন্যে নয়, মিচেলকে খুন করেছ বলে। মিচেলের মতো মানুষ হয় না!
নীরব রইলো কলিন।
হাসিখুশি মানুষ ছিলো ও, বলে চললো প্যাটেন, মিচেল থাকতে এক মুহূর্তের জন্যেও কেউ গোমড়া মুখে থাকেনি র্যাঞ্চ হাউসে, হাসির লহর বয়ে গেছে। খুব সুন্দর গীটার বাজাতে পারতো ও, গানও জানতে, আবার কাজের কোনো খুত ছিলো না ওর। নিজের কাজ কখনো ফেলে রাখতো না। আর কাউকে যদি মারতে তুমি, আমরা এতটা দুঃখ পেতাম না, মিচেলের কথা কি বলবো–
একনাগাড়ে বকবক করে চললো প্যাটেন, ছ’ফুট দূরে একটা কাঠের বাক্সের উপর উবু হয়ে বসে রয়েছে। গালভতি তামাক, মুখের একপাশ ফুলে আছে তাই। পিক ফেলতে মাঝে মাঝে কথা থামতে বাধ্য হচ্ছে সে। কিন্তু প্যাটেনের কথায় কান নেই কলিনের, চিন্তার ঝড় চলছে মাথায়। সকালে যদি ওয়ারেন ওর হাতে সই করিয়ে নিতে পারে, সাজিয়ে গুজিয়ে শহরে নিয়ে যাবে ওকে, আনুষ্ঠানিকভাবে বিক্রির ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবে প্রথমে, তারপর কোনো এক মিচেল অনুরাগী পিস্তল প্র্যাকটিস করবে ওর ওপর। মোট কথা জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই।
অনেক ভেবেও সমাধানের কোনো পথ দেখল না কলিন। হঠাৎ একটা চাপা শব্দে চমকে উঠলো ও। খেয়াল হলো এখন আর বকবক করছে না প্যাটেন। ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালো কলিন।
প্যাটেনের আসনের কাছ থেকে সরে এলো লিনডা ওয়ারেন, ওর ডান হাতে এক টুকরো লাকড়ি, বাম হাতটা গলার কাছে তুলে রেখেছে। আস্তাবলের মেঝেয় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে প্যাটেনে, নিথর।
বেশি জোরে মেরে দিইনি তো। ফিসফিসিয়ে বললো লিনডা। নাইট গাউনের ওপর একটা লম্বা গাঢ় রঙের রোব চাপিয়েছে সে, ঘাড়ের ওপর লুটিয়ে আছে দুটোবেণী। হাত থেকে লাকড়ির টুকরো ফেলে দিলো লিনডা।
জলদি পালাও! বললো সে, ভোর হতে দেরি নেই! ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি আমি।
আমার ঘোড়াটা ক্ৰীকের ধারে রেখে এসেছি, বললে। কলিন, হাত পায়ের বাঁধনটা খুলে দিতে পারো?
মাথা দোলালো লিনডা, পা টিপে টিপে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল, একটা হারনেস নাইফ হাতে ফিরে এলো আবার, কলিনের বাধন কেটে দিলে। দ্রুত। হাত কাঁপছে ওর, লক্ষ্য করলো কলিন, ছুরিটা পড়ে গেছে মেঝেয়, প্যাটেনের দিকে তাকিয়ে আছে এখন।
উঠে বসলো কলিন, তারপর হাঁটু ভেঙে দাড়ালো; এক সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো শরীরের প্রতিটি পেশী। সঁতে দাঁত চেপে সোজা হয়ে দাড়ালো ও, ঘুরে উঠলো মাথাটা, লিনডা না ধরলে পড়েই যেতো, ওকে সোজা হয়ে দঁাড়াতে সাহায্য করলো লিন, তারপর বললো, জলদি, কলিন, সকাল হয়ে এলে বলে, ওকে সঙ্গে নিয়ে দরজার দিকে এগোল।
প্রচণ্ড অবসাদে ভেঙে পড়তে চাইছে কলিনের শরীর। চোখ জোড়া একবার বন্ধ করে আবার খুললো ও, উঠোনের ওপাশে ক্রীকের দিকে তাকালো। অন্ধকারে গাছপালার গাঢ় ছায়া ছাড়া কিছু বোঝা যায় না। দুরত্বটুকু পার হতে পারবে কিনা বুঝতে পারলো না কলিন। হাঁটু কাঁপছে, ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে না। মাথা নাড়লো ও, বিড়বিড় করে উঠলো, লিনডা বুঝছি না, আমি—
কিন্তু কিছুতেই এখানে থাকা হবে না তোমার, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো লিনা, আমি তোমাকে ঘোড়ার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসছি।
না, তুমি এখানে থাকো। আস্তাবলের মেঝে থেকে তোমার পায়ের ছাপ মুছে ফেলো।
চট করে আস্তাবলে ঢুকে পড়লো লিনডা। দরজার চৌকাঠে ভর দিয়ে দাঁড়ালো কলিন, কিঞ্চিৎ স্বস্তি বোধ করলো। একটু পরিষ্কার হয়ে এসেছে মাথাটা। ও পালিয়েছে টের পাওয়ামাত্র ধাওয়া করতে শুরু করবে ওয়ারেন রাইডাররা। ট্রেইল করে ক্রীকের তীরে ঘোড়া বেঁধে রাখার জায়গা পর্যন্ত যেতে পারবে অনায়াসে, ওখান থেকে ওকে অনুসরণ করা আরো সহজ হবে। তবে ও শহরেই যাচ্ছে, এমন একটা ধারণা ওদের মনে জন্মাতে পারলে হয়তো ওরা ওকে অনু সরণ বাদ দিয়ে দ্রুত ওয়াগোনারে পৌঁছুনোর জন্যে সোজা রাস্তা ধরবে, অন্তত সে সম্ভাবনা আছে। অস্থির স্বভাবের লোক রবার্ট ওয়াবেন, ঝোঁকের মাথায় কাজ করে, সেখানেই ভরসা।
আবার বাইরে এলো লিনডা। আমাকে কেউ সন্দেহ করবে না, বললে ফিসফিস করে।
কিন্তু কেউ একজন এসেছিল ঠিকই বুঝবে, বললে কলিন, প্যাটেনের কপালে ইয়া বড় একটা আলু বানিয়ে দিয়েছ!
ববের নতুন লোকগুলোর সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভালো নয়, মনে করবে কাজটা ওদের কারো, আমার কথা মাথায় আসবে না।
তাহলে জলদি ঘরে ফিরে যাও।
আর তুমি?
ঠিক নেই।
বেসিনে থেকো না যেন, কলিন।
হাসলে কলিন। আমার জন্যে অনেক করেছে তুমি, লিনডা। ধন্যবাদ। ক্যানসাস সিটিতে যদি সত্যিই যেতে চাও, জানিয়ো, তোমাকে সাহায্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো আমি।
নিশ্চয়ই চাই। এই নরকবাস আর সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু টাকা পাবে কোথায়?
ভেবো না, একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। বাংকহাউসের দিকে তাকালো কলিন। অন্ধকারে ডুবে আছে, নীরব। কোরালে কয়েকটা ঘোড়া দেখা যাচ্ছে, এদিকে তাকিয়ে আছে, যেন বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হচ্ছে এখানে। আবার লিনডার দিকেফিরলো ও। আবারো ধন্যবাদ, লিনডা বলে হাঁটতে শুরু করলো।
মাতালের মতো চলছে ও, এপাশ ওপাশ দুলছে, বেসামাল অবস্থা। আস্তাবলের কোণে এসে দড়াম করে পড়লো ও, উঠে দাড়ালো, এলোপাতাড়ি পা ফেলে এগোলে আবার। ঘোড়র কাছে পেীছার আগে আরো দুবার পড়লে তারপর কখন কিভাবে স্যাডলে উঠে বসেছে জানে না, ব্যথার তীব্র হামলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে চাইছে সারা শরীর, এখুনি ফুলে উঠবে যেন, ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। রাস্তার দিকে মোড় নিলো ও, ওয়াগোনারের দিকে মাইলখানেক এগিয়ে বাক নিয়ে উঁচু ঘাসের ভেতর দিয়ে ক্রীকের দিকে এগোলে। ফের, ফিরতি পথ ধরলো, পানির ভেতর হাঁটিয়ে নিয়ে চললো ঘোড়াটা।
কলিন যখন ওয়ারেন র্যাঞ্চের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, ভোরের আলোর আভাস পুব আকাশে। এতক্ষণে বাবুর্চির উঠে পড়ার কথা, কিন্তু তাকে দেখতে পেলো না ও, আর বড় জোর আধ ঘণ্টা, তারপরই জেগে উঠবে সবাই, সাথে সাথে জানবে কলিন উধাও। শুরু হবে মানুষ শিকার অভিযান।
ওর ভাগ্য যদি ভালো হয়, ওয়ারেন রাইডাররা ট্রেইল করে প্রথমে রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে তারপর সোজা শহরের পথ ধরবে। ও ফাঁকি দিয়েছে বুঝতে বুঝতে বিকেল হয়ে যাবে ওদের। পালানোর জন্যে যথেষ্ট সময় মিলবে। কিন্তু পালানোর কথা ভাবছে না ও–আপাতত।
ক্রীক বরাবর এগিয়ে চললল কলিন। এখনো বনবন ঘুরছে মাথা টা। যতবার সামনে পা ফেলছে ঘোড়া, সাথে সাথে ছলকে উঠছে মাথার রক্ত। কোন্ দিকে যাচ্ছে জানে না ও। একটা পরিকল্পনাখাড়া করা প্রয়োজন, জানে, কিন্তু পারছে না। সূর্য উঠছে আস্তে আস্তে। বেশ কিছু সময় এগোনোর পর কনি বুঝতে পারলো ওয়ারেন র্যাঞ্চ থেকে অনেক উঁচুতে এসে পড়েছে ও, পাহাড়ের দিকে উঠে যাচ্ছে ঘোড়াটা। দুরে দেখা যাচ্ছে গাছে ছাওয়া পাহাড়চূড়া।
দুপুর নাগাদ ঘোড়া থামালো কলিন। ডান পাশে একটু দুরে পাহাড়ের মাঝখানে একটা র্যাঞ্চ। গ্রেবার র্যাঞ্চ, যদি এখনো আগের মালিকানা বহাল থাকে। হঠাৎ রবার্ট ওয়ারেনের কথা মনে পড়ে গেল ওর। স্ট্যামপিড প্রসঙ্গে কথা বলার সময় সে বলেছিলো : …সময় পেলে ডেনিস স্মিথের সঙ্গে আলাপ করো, জিজ্ঞেস করে দেখো ডেভিড স্পেক্টরকে; বেলিনড গ্রেবারের র্যাঞ্চে পাওয়া যাবে ওকে। শেরিফের কাছে দেয়। ওদের জবানবন্দী জেনে নাও। ডাক্তার মারভিনের মুখেও ডেভিড স্পেক্টরের নাম উচ্চারিত হয়েছে, মেরির হাত ভালো না হলে ডেভিড স্পেক্টরকে দিয়ে খবর পাঠাতে বলেছিলো সে বেলিনডাকে।
অনেক কষ্টে তথ্যগুলো সমন্বিত করার চেষ্টা করলে কলিন ফোর্বস। বেলিনডা, যাকে বেলিনডা কারলাইল নামে চিনতো ও, সম্ভবত হেনরী গ্রেবারকে বিয়ে করেছে এবং এখন গ্রেবার র্যাঞ্চেই আছে। কিন্তু হেনরী গ্রেবারের বদলে র্যাঞ্চটা বেলিনডা গ্রেবারের বললো কেন ওয়ারেন? হেনরীর কি হয়েছে?
প্রশ্নটা পরের জন্যে তুলে রাখলে কলিন। ডেভিড স্পেক্টর আছে গ্রেবার র্যাঞ্চে, হয়তো স্ট্যামপিড সম্পর্কে অনেক কিছু তার জানা আছে। কোণাকুণিভাবে রাস্তার দিকে এগোলো ও। গ্রেবার রাঞ্চের পথ ধরলো।
উঠোনে পৌঁছুতে পৌঁছুতে স্যাডলের ওপর নুয়ে পড়লো কলিন, রাশ টেনে ঘোড়া থামালো, এপাশ ওপাশ দুলছে। কেউ একজন গিয়ে এলো বারান্দায়। আস্তাবলের দরজায় এসে দাড়ালো, তিনজন, দুজন লোক আর বার-তেরো বছর বয়সী এক কিশোর।
সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলো কলিন, হাত বাড়িয়ে মাথার টুপি স্পর্শ করলে। হ্যালো, বেলিনডা, বললো ও, নামলো স্যাডল থেকে। পা দুটো মাটি স্পর্শ করামাত্র হাঁটু ভাজ হয়ে গেল, টান চিত হয়ে পড়ে গেল ও। চিৎকার করে কি যেন বলে উঠলো বেলিনডা, ছুটে এসে ওর পাশে হাটু গেড়ে বসলো। বিব্রত বোধ করলে কলিন, বিড়বিড় করে বললো, বেলিনডা, আসলে আমি–
পরে বলো এসব, বললো বেলিনডা। ডেভিড, ওকে ঘরে নিয়ে এসো।
টাটকা খাবার আর কয়েক কাপ কড়া কফি পেটে পড়তেই অনেকটা চাঙা বোধ করলো কলিন ফোর্বস। রান্নাঘরের টেবিলে বসে আছে ও, সারাদিনে এই প্রথম স্থির বোধ করছে। যদিও পেশীগুলো এখনো অসাড়, দপদপ করছে মাথার ভেতর, মুখের একপাশ ফুলে আছে, কাঁধ নাড়লেই খোঁচা লাগছে পাজরে, চিনচিন করছে, একটা হাড় বোধ হয় ভেঙে গেছে। তারপরও আরাম লাগছে ওর।
উঠোন থেকে ফিরে এলো ডেভিড স্পেক্টর, বয়সের ভারে কুজো হয়ে গেছে এখন, চাপদাড়ি পেকে শাদা, চোখ দুটো কোটরে বসে গেছে, কোঁচকানো চেহারা, মাথায় টাক।
বিকেলের আগেই এসে যাবে ওরা, বললো সে, ওয়ারেনের কথা বোঝাতে চাইলো। তোমার ঘোড়ার সামনের ডানপায়ের নাল খসে গেছে, ট্রেইল করা সহজ হবে। আমি হোসেকে বলেছি ওটাকে নিয়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে দক্ষিণে যেতে, ওখান থেকে স্টোনি রিভারের কাছে যাবে ও, ঘোড়াটা ছেড়ে দিয়ে ওয়াগোনারে চলে যাবে; কাল পরশু ওখানে যাচ্ছি আমি, আমার সঙ্গে ফিরে আসবে।
ধন্যবাদ, ডেভিড, বললো কলিন।
এসব তোমার জন্যে করিনি আমি, বললো ডেভিড, কুচকে উঠলে ওর চোখমুখ। বেলিনডা বললো, তাই। তাছাড়া ওয়ারেনের সঙ্গে গোলমাল করার সাধ্য আমাদের নেই।
ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকালো বেলিনডা, চুলের আগুনের আঁচে লাল হয়ে উঠেছে চেহারা। ওর পরনে লেভিস প্যান্ট, গায়ে শার্ট, হাতা গোটানো, বাদামী হাতদুটো দেখা যাচ্ছে; গভীর ওর চোখজোড়া, খাড়া নাক, কপট কাঠিন্য দুঠোঁটে।
হেনরী হলে একথাই বলতে, ডেভ, বললো বেলিনড়া।
হয়তো, সায় দিলো ডেভিড স্পেক্টর।
ডেভিড, বললো কলিন, আমি কয়েকটা কথা জানতে চাই।
কি ব্যাপারে?
স্ট্যামপিড।
এই সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।
কিন্তু ওয়ারেন তো বললো জানে।
মিথ্যে বলেছে।
শেরিফের কাছে নাকি তুমি জবানবন্দী দিয়েছো?
এক পা থেকে অপর পায়ে শরীরের ভর বদল করলো জেভিড স্পেক্টর। দিয়েছি। কিন্তু স্ট্যামপিড সম্পর্কে কিছুই বলিনি।
তাহলে কি বলেছে?
বলেছি স্ট্যামপিডের রাতে ক্লেব্যাংকসের দিক থেকে তোমার বাবা, এডি এবং আরো তিনজনকে আসতে দেখেছিলাম আমি, তখন মাঝরাত হবে–ব্যস।
সত্যিই দেখেছিলে?
আমি মিথ্যে বলিনি, ফোর্বস।
ওরা অন্য কোথাও থেকে আসেনি কিভাবে জানো?
মাথা নাড়লো স্পেক্টর। সম্ভব নয়। এখান থেকে ক্লেব্যাংকসের দূরত্ব কয়েক মাইলের বেশি না। তোমার বাবা, এডি আর তাদের তিন সঙ্গীকে যেখানে দেখি, জায়গাটা ক্লেব্যাংকসে যাবার পথেই পড়ে। শহর থেকে আসছিলাম আমি।
ওরাই ওয়ারেনের গরু স্ট্যামপিড করেছে বলতে চাও?
অন্য কিছু হতে পারে না।
এগিয়ে এলে বেলিনডা তোমার কি মনে হয়, কলিন?
আমি বিশ্বাস করি না।
কেন?
স্ট্যামপিভ করে লড়াই করার মানুষ বাবা নয়। বাবা অস্ত্র হাতে ওয়ারেনকে হত্যা করতে ছুটে গেছে বলে অবিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এই কথা মরে গেলেও বিশ্বাস করতে পারবে না। ব্যাপারটা বাবার চরিত্রের সঙ্গে একদম খাপ খায় না।
তোমার বাবা অস্বীকার করেনি শুনেছে তো?
শুনেছি। তবু ইচ্ছাকৃতভাবে ক্লেব্যাংকসের ওপর থেকে পনেরো শ’ গরু স্ট্যামপিড করে মেরেছে বাবা, বিশ্বাস হয় না।
মানুষ বদলায়, কলিন।
তাই বলে এত?
আট বছর দুরে ছিলে তুমি, আট বছর অনেক লম্বা সময়।
দরজার দিকে ঘুরলো ডেভিড স্পেক্টর। আমার আর দরকার আছে, বেলিনডা?
না। ওয়ারেনরা আসে কিনা খেয়াল রেখো, বললে বেলিনডা। ওরা এলে কি করতে হবে জানো তো? কলিন এসেছিলো, কিন্তু চলে গেছে।
ওয়ারেনকে শত্রু বানাতে চাই না আমি, অস্বস্তির সঙ্গে বললো স্পেক্টর। র্যাঞ্চটা মাটিতে মিশিয়ে দেবে সে, দেশছাড়া করবে আমাদের।
এটা আমাদের জায়গা, বললো,বেলিন, আমাদের উৎখাত করার সাধ্য কারো নেই। মিস্টার ওয়ারেন অাসছে দেখলে আমাকে জানিয়ে, যা বলার আমি বলবো।
বেলিনডার কণ্ঠে ভর্ৎসনার সুর থাকলেও ডেভিড স্পেক্টর লক্ষ্য করেছে বলে মনে হলো না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল সে।
আরেকটু কফি দেবো? জিজ্ঞেস করলে বেলিনডা।
মাথা দোলালে কলিন। মেরি কোথায়, দেখছি না যে?
আস্তাবলে ওর একটা খেলাঘর আছে, এলেনার সঙ্গে ওখানে খেলছে। এলেনা, হলে হোসের মা, ওর বাবা হুয়ান মেরিনো। এখানে চাকরি করতো। তুমি হেনরীর কথা ভাবছে, না?
কাপে কফি ঢাললো বেলিনডা।
হ্যাঁ বললো কলিন। হেনরীর কথা বলো।
আজ থেকে তিনবছর আগে স্যাডল থেকে ছিটকে পড়ে মারা গেছে, ও মারা যাবার পর আমি হয়তো র্যাঞ্চ বিক্রি করে দিতে পারতাম–এখনো পারি-কয়েক মাস আগে ওয়ারেন কেনার প্রস্তাবও দিয়েছে–কিন্তু শহরের চেয়ে এ জায়গাটাই আমার বেশি পছন্দ।
হেনরীর কথা শুনে দুঃখ পেলাম, বললে কলিন।
হেনরীকে স্পষ্ট মনে আছে ওর। দীর্ঘদেহী সুদর্শন হেনরী ছিলো ধীর স্থির, মৃদু ভাষী, বয়সে বেলিনডার চেয়ে দশ বছরের বড়।
ওর মৃত্যুর পর খুব কষ্ট গেছে আমাদের, বললো বেলিনডা, পুরুষের মতো ঘোড়া হাঁকানো আর ল্যাসে ছোঁড়া শিখতে হয়েছে আমাকে। এখনো খুব ভালো রকম আয়ত্ত করতে পারিনি, তবে ট্রেনার হিসেবে ডেভের জুড়ি নেই, ধৈর্যের সঙ্গে শেখানোর চেষ্টা করছে ও। কিন্তু আসল সমস্যা মেরিকে নিয়ে, ওকে একেবারেই সময় দিতে পারি না। আমার চেয়ে এলেনার সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে ওর সম্পর্ক।
আবার বিয়ে করলে না কেন?
বিষণ্ণ হাসি হাসলো বেলিনডা। এ-নিয়ে আমিও ভেবেছি, তবে খুব একটা গুরুত্ব দিইনি।
বেলিনডার দিকে তাকালো কলিন। র্যাঞ্চ বিক্রি করে শহরে চলে গেলে সহজেই ভালো একটা চাকরি যোগাড় করতে পারতো মেয়েটা, ভাবলো ও, করেনি, কেন? র্যাঞ্চিং মেয়েদের কাজ নয়। একাজে প্রয়োজনীয় শারীরিক ক্ষমতা খুব কম মেয়েরই থাকে।
হঠাৎ চুলোর কাছ থেকে সরে কলিনের দিকে এগিয়ে এলো বেলিনডা।
আবার বেসিনে কেন ফিরলে, কলিন? তোমার বাবা সবাইকে বলে বেড়াতে ওয়াইওমিংয়ে নাকি দারুণ একটা চাকরি করছে। তুমি, কোন এক সিনডিকেটের র্যাঞ্চ চালাও, তুমিই নাকি ওদের এক নম্বর লোক।
ভালো লোকের অভাব নেই ওদের।
কিন্তু তুমি ফিরলে কেন?
শহরের কেউ একজন চিঠি লিখেছিলো আমাকে, বাবা আর ভাইয়ের খবর দিয়ে বেসিন থেকে দূরে থাকতে বলেছে আমাকে। এ অবস্থায় আমার কি করণীয় ছিলো বলে মনে করো?
তার মানে প্রতিশোধ নিতে এসেছে। গোলমালটা জিইয়ে রাখতে চাও।
বেলিনডার কণ্ঠে রাগের আভাস, ঠোঁটের হাসি মুছে গেছে।
ওয়ারেনের গরু স্ট্যামপিডের জন্যে বাবা আর এডি দায়ী–একথা আমি মানি না, গোয়ারের মতো বললে কলিন।
কোন্ ভরসায় ওয়ারেনের সঙ্গে লাগতে চাইছো, বলবে?
আমি কি তাই বলেছি? আমি কেবল এখানে কি ঘটেছে জানার চেষ্টা করছি।
আচ্ছা, ধরো, জানা গেল তোমার বাবা আর এডিই স্ট্যামপিডের জন্যে দায়ী, তাহলে?
বলেছি তো, ওরা নির্দোষ!
যদি দোষী হয়?
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো কলিন। এভাবে চিন্তা করেনি ও। এখনো ভাবতে পারছে না। বেলিনডার কথায় অস্বস্তিতে ছেয়ে গেল মন। একটু আগে মানুষ বদলে যাবার কথা বলছিলো বেলিনডা, বাবা আর এডি হয়তো সত্যি বদলে গিয়েছিলো। আচ্ছা, যদি জানা যায় যে ওয়ারেনের গরু বাবাই স্ট্যামপিড করেছে, তখন কি করবে ও? ভুরুজোড়া কুচকে উঠলো কলিনের।
দরজায় উঁকি দিলো ডেভিড স্পেক্টর। ওরা আসছে! জানালো সে।
মিসটার ওয়ারেন আছে ওদের সাথে? জানতে চাইলে। বেলিনডা।
বোঝা যাচ্ছে না।
এলেনাকে বলে দাও, মেরিকে নিয়ে আস্তাবলেই থাকতে, বললে বেলিনডা, তুমিও যাও।
উঠে দাড়ালো কলিন, পা বাড়ালো দরজার দিকে।
না, তুমি ভেতরেই থাকো, বললো বেলিনডা, আমি বিদায় করার ব্যবস্থা করছি ওদের।
আমার জন্যে এত না করলেও পারতে, অস্বস্তির সঙ্গে বললো কলিন।
এখানে র্যাঞ্চিংয়ের চেষ্টা না করলেও পারতাম, প্যানট-এ হাত মুছলো বেলিন। কিন্তু অনেক সময় না করে উপায় থাকে না।
দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে, বারান্দায় এসে অপেক্ষা করতে লাগলো।
০৬. জন সাতেক ঘোড়সওয়ার
সব মিলিয়ে জন সাতেক ঘোড়সওয়ার হাজির হয়েছে উঠোনে, ওয়ারেন, লুইস প্যাটেন বা চাক কনারস নেই দলে, তবে বিল ওয়ারেন আছে, সে-ই নেতৃত্ব দিচ্ছে সম্ভবত। বারান্দার কাছে এসে রাশ টেনে ঘোড়া থামালো সে, মাথা থেকে টুপি নামালো।
সুপ্রভাত, বেলিনডা চমৎকার লাগছে কিন্তু তোমাকে! মেরি কোথায়?
এলেনার সঙ্গে, বললো বেলিনডা।
মেরিনো আর ডেভিড স্পেক্টর?
আছে কোথাও!
আর কলিন ফোর্বস?
দেখতেই পাচ্ছে পাহাড়ের দিকে গেছে ওর ট্র্যাক, বললো বেলিনডা।
ঘোড়সওয়ারদের একজনের উদ্দেশে ইঙ্গিত করলো বিল। জো, তুমি যাও, ট্র্যাক পরীক্ষা করে এসো। একটু থামলো সে, তারপর বেলিডার কাছে জানতে চাইলে, এখানে এসেছিলো কখন?
দুপুরের পর।
কোনো হাঙ্গামা বাধায়নি তো?
নিজেকে কিভাবে রক্ষা করতে হয় আমি জানি, বিল।
কোথায় যাবে বলেছে?
না
কিছু জানতে চায়নি?
চেয়েছে। স্ট্যামপিড সম্পর্কে কিছু জানি কিনা জিজ্ঞেস করেছে। বলেছি আমি জানি না। আসলেও জানি না।
উত্তরে গিয়েছিলো জো, ফিরে এলো সে। বড় জোর দু’ঘন্টা আগে রওনা হয়েছে।
ঠিক আছে, ধাওয়া করো, নির্দেশ দিলো বিল। আমি একটু পরে আসছি, তোমাদের ঠিক ধরে ফেলবো।
ঘোড়া হাঁকিয়ে উত্তরে চললো ঘোড়সওয়াররা, মুচকি মুচকি হাসছে কয়েকজন, বিল ওয়ারেন কেন রয়ে যাচ্ছে জানে।
হাসছে বিলও। কফি খেতে ডাকবে ভেবেছিলাম, বেলিনডার উদ্দেশে বললো সে।
কোরালের বেড়ায় ঘোড়া বেঁধে এসো, বললো বেলিনডা, আমি কফি গরম করে নিই।
ভেতরে এসে ভুরু কেঁচকালো বেলিনা। তুমি ওঘরে চলে যাও, কলিন, শোবারঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বললো ও। যত যাই হোক বেরোবে না।
লুকিয়ে থাকা আমার দারুণ অপছন্দ, গম্ভীর কণ্ঠে বললে কলিন।
রাগে আড়ষ্ট হয়ে গেল বেলিনডা। আমি কি তোমাকে এখানে ডেকে এনেছি? শোবারঘরে বাইরের লোককে ঢোকানো, বিল ওয়ারেনের কাছে মিথ্যে বলা–এসবও আমার অপছন্দ, ইচ্ছে না থাকলেও করতে হচ্ছে, উপায় নেই। এবার যাও, ওঘরে ঢুকে চুপ করে বসে থাকো।
শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ালো কলিন। দরজা খুলে ঢোকার আগে আবার ঘাড় ফিরিয়ে বেলিনডার দিকে তাকালো। আমি দুঃখিত, বেলিনডা।
চুলোয় আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে বেলিনডা, জবাব দিলো না। বারান্দায় পায়ের আওয়াজ পেলো কলিন, বিল আসছে। শোবার ঘরে ঢুকে পড়লো ও, কিন্তু পুরোপুরি আটকালো না দরজা, সামান্য ফাঁক করে রাখলো।
দরজার ওপাশে বিলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কফির লোভে থামতেই হতো, বেলিনডা, পুরো বেসিনে তোমার কফির কোনে জুড়ি নেই, ইচ্ছে করে প্রত্যেকদিন একবার এসে খেয়ে যাই।
ওদের নাগাল পেতে চাইলে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে তোমাকে, বললে বেলিনডা।
বাদ দাও। ফোর্বসকে আমরা ধরতে না পারলে সে নিজেই এসে ধরা দেবে।
ওকে ধরা জরুরি নয় তাহলে?
বাবার ধারণা সেরকমই। বাবা দ্রুত সবকিছু মিটমাট করতে চায়। অবশ্য আমিও চাই। ফোর্বস র্যাঞ্চ তোমার পছন্দ হবে, বেলিনডা।
এখানেই আমার ভালো লাগে, বললে বেলিনডা।
নীরবে কাটলো একমুহূর্ত, পাশে কামরায় কি ঘটছে দেখতে পাচ্ছে না কলিন। ও এতক্ষণ যেখানে বসেছিলো বোধ হয় সেখানেই বসেছে বিল, অনুমান করলো। ওকে কফি দিয়ে আবার চুলোর কাছে গেছে বেলিনডা।
ঘাড় ফিরিয়ে শোবার ঘরে নজর বোলালো কলিন। একটা বিশাল খাট; ঘরে তৈরি ছোট্ট বিছানা, সম্ভবত মেরির; একটা বিরাট চেস্ট-অভ-ড্রয়ারস, বিছানার পাশে একটা টেবিল আর চেয়ার, টেবিলের ওপর একটা ল্যামপ–কামরায় আসবাবপত্র বলতে এই; অবশ্য চেস্ট-অভ-ড্রয়ারসের পাশে একটা প্রমাণ সাইজের আয়নাও রয়েছে। জানালার পর্দাগুলো মেঝে স্পর্শ করেছে। পরিষ্কার পরিছন্ন ঘর। বিছানাটা যেন ডাকছে ওকে, শুয়ে একটু বিশ্রাম নেবে কিনা ভাবলে কলিন। বিছানায় ঘুমোয়নি কতদিন? দশ? পনেরো?
পাশের কামরা থেকে বেলিনডার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। বিল থামো! কি হচ্ছে এসব। আমি–
আহা! অমন করো না! বললে বিল, কেন বোঝে না আমি তোমায় কতটা–
চড় কষানোর প্রচণ্ড শব্দ পেলো কলিন, হুটোপুটির আওয়াজ, তারপর রাগী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো বিলের। ধুশ শালা! তোমাকে উচিত শিক্ষা দেবো আমি, বেলিনডা! আমি–
না দেখলেও পাশের কামরায় কি ঘটছে আঁচ করতে পারলো কলিন। আর দেরি করা ঠিক হবে না, এক ঝটকায় দরজা খুলে বিল আর বেলিনডার দিকে দৌড়ে গেল ও। টেবিলের কাছে ওরা, বিলের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে বেলিনডা। ওকে দেখেই বেলিনডাকে ঠেলে সরিয়ে দিলো বিল, চট করে হাত বাড়ালো পিস্তলের দিকে।
বেসামাল ছিলো বিল, ট্রিগারে টিপ দিতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে ফেললো। মেঝেয় বিধলো গুলিটা মাথা নিচু করে ছুটে গেল কলিন। দ্বিতীয়বার গুলি করার ফুরসত পেলো না বিল। সজোরে ঘুসি হুঁকালো কলিন ওর মুখ লক্ষ্য করে, পরের ঘুসিটা লাগলে তার মুখের একপাশে।
টলমল পায়ে পিছিয়ে গেল বিল, চিত হয়ে প্রথমে টেবিলের ওপর পড়লো, তারপর গড়িয়ে মেঝেতে। উঠে দাঁড়ানোর কোন চেষ্টা করলো না, পড়ে রইলো স্থির, উদভ্রান্তের দৃষ্টি দুই চোখে।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে নিজেকে সামলে নিলো বেলিনডা, হাতের পিঠে মুখ মুছলো, তারপর এগিয়ে এলো সামনে, মোটেও ভীত মনে হচ্ছে না ওকে। বিলের পাশে মুহূর্তের জন্যে হাঁটু গেড়ে বসে আবার উঠে দাঁড়ালো।
ওঘর থেকে বের হতে কে বলেছে তোমাকে? কৈফিয়ত দাবি করলো ও। বিলের মতো লোকদের কিভাবে সামলাতে হয় জানি না ভেবেছো? এখন আমি কি করবো বলো, দেখি।
চ্যাংদোলা করে বাইরে ছুড়ে দাও হারামীটাকে, বলল কলিন।
এবং তারপর ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ওয়ারেনকে জানিয়ে আসি আমি তোমাকে আমার শোবারঘরে লুকিয়ে রেখেছিলাম, না? ব্যাপারটা জটিল করে ফেলেছো তুমি।
ঊর্ধ্বশ্বাসে আস্তাবল থেকে ছুটে এলো ডেভিড স্পেক্টর, হাতে উদ্যত পিস্তল। বিল আর কলিন হয়ে বেলিন্ডার দিকে গেল তার দৃষ্টি।
ওর ঘোড়া নিয়ে এসো, বলল কলিন।
মাটিতে পা ঠুকলো বেলিনডা। এটা আমার ঘর, নির্দেশটা আমার মুখ থেকে বেরোলে মানানসই হতো না? মিসটার ফোর্বসকেও একটা ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দাও।
বিল ওয়ারেনের পিস্তলটা তুলে নিয়ে গুলি বের করে টেবিলের ওপর রাখলো কলিন। দ্বিধাগ্রস্ত ও বেলিন বিল ওয়ারেনের প্রতি দুর্বল নয় তো? একটু আগে বিলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছিলো অথচ পরমুহূর্তে ভোল পাল্টে ফেললো, উল্টে খেপে উঠলো ওর ওপর।
উঠোনে ফিরে গেছে ডেভিড স্পেক্টর। পিটপিট করে তাকালো বিল, গুঙিয়ে উঠলো, উঠে বসলো সাবধানে, হাত তুলে ফুলে ওঠা মুখ স্পর্শ করলো।
আজকের কথা আমার মনে থাকবে, ফোর্বস, ভারি গলায় সলো সে।
তাই রেখো, বললো কলিন।
তোমার কথাও আমি ভুলবো না। কটমট করে বেলিনভার দিকে তাকালো বিল। উত্তরে গেছে ফোর্বস, না? উত্তরে মনে সোজা শোবারঘরে।
রাগে লাল হয়ে উঠলো বেলিনডার চেহারা, জবার দিতে গিয়েও বিরত রইলো, চট করে এগিয়ে গেল জানালার কাছে, তাকিয়ে রইলো উঠোনের দিকে।
টেবিলের সঙ্গে ভর দিয়ে উঠে দাড়ালো বিল, সঙ্গে সঙ্গে চোখ গেল পিস্তলের দিকে, হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো ওটা।
ওটার বিষদাত আমি তুলে নিয়েছি, বললে কলিন। এখান থেকে বিদেয় হওয়ার আগে লোড করার চেষ্টা করো না।
পিস্তলটা হোলসটারে ঢোকালো বিল। আবার যখন আমাদের দেখা হবে, এটা লোডেড থাকবে, মনে রেখো।
লম্বায় কলিনের সমানই হবে বিল, তবে ওজন অন্তত পঞ্চাশ পাউণ্ড বেশি; চওড়া কাঁধ ওর, শক্তিশালী লম্বা দুটো হাত। মুখের বামপাশটা ফুলে আছে ওর, কালসিটে দাগ পড়ে গেছে বাম চোখে, এই মুহূর্তে দুর্বল বোধ করছে ছেলেটা, সন্দেহ নেই, কিন্তু চেহারায় ছাপ পড়তে দেয়নি।
মন্থর পদক্ষেপে দরজার দিকে এগোলে বিল, বেরিয়ে যাবার আগে একবার থেমে বললো, কাল সকালে আবার আমি আসতে পারি, বেলিনডা।
অহেতুক কষ্ট করতে যেয়ো না, জবাব দিল বেলিনডা।
সামনে পা বাড়ালে কলিন। দাড়াও। আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।
চরকির মতো ঘুরে ওর মুখোমুখি হলো বেলিনডা, কিন্তু ওর দিকে তাকালো না কলিন, বিলের দিকে তাকিয়ে রইলো।
আমার পিঠে গুলি করার জন্যে? ঝাঁঝের সঙ্গে বললে বিল।
দেখতেই পাচ্ছো আমি নিরস্ত্র, বললো কলিন, তোমার পিস্তলেও গুলি নেই।
বিলের চোখ কুঞ্চিত হলো, ভাবছে। ঠিক আছে, ফোর্বস। তোমার সঙ্গে যাবো আমি কয়েক মাইল।
একপা এগিয়ে এলো বেলিনা। তুমি যাবে না
আমাদের জন্যে ভেবো না, বললে কলিন, ও, হ্যাঁ, খাবার আর বিশ্রামের সুযোগ দিয়েছে বলে অসংখ্য ধন্যবাদ।
বিল ওয়ারেনের পেছন পেছন বেরিয়ে এলো কলিন। ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাচ্ছে ডেভিড স্পেক্টর, একসঙ্গে সেদিকে এগোলো ওরা। আড়চোখে বারবার কলিনের দিকে তাকাচ্ছে বিল।
তোমার মতলবটা কি, ফোর্বস? কোথায় যাচ্ছি আমরা?
স্মিথ র্যাঞ্চে।
কেন?
স্ট্যামপিড সম্পর্কে কিছু জানে কিনা দেখতে।
ও কি বলবে আমার কাছে শুনে নাও।
কি?
তোমার বাবাই ওই ঘটনার হোতা।
বিশ্বাস করি না।
কাধ ঝাঁকালো বিল ওয়ারেন। বিশ্বাস অবিশ্বাস তোমার মর্জি, ফোর্বস। কিন্তু যাকে জিজ্ঞেস করবে একই কথা বলবে সবাই–এটাই সত্যি।
দক্ষিণ পুবে এগিয়ে চললে ওরা। ঘোড়া চালাতে কষ্ট হচ্ছে কলিনের। এখনো দপদপ করছে মাথা, খোঁচা লাগছে পাঁজরে।
বেলিনডার র্যাঞ্চের কয়েক মাইল দূরে আসার পর ঘোড়া থামালো কলিন, পাইপে তামাক ভরে জ্বাললো। কাগজ তামাক বের করে সিগারেট বানালো বিল।
তোমার সাথে এভাবে যাওয়া পাগলামী ঠেকছে আমার কাছে, অস্বস্তির সঙ্গে বললে বিল। ইচ্ছে করলে পিস্তলের এক বাড়িতে তোমাকে বেহুশ করে ফেলে রেখে যেতে পারতাম, কিন্তু করিনি, কেন জানো?
কারণ তার আগে আমার সঙ্গে লড়াই করতে হতো তোমায়, জবাব দিলো কলিন, পিস্তল দিয়েও সুবিধে করতে পারতে না।
চেষ্টা করতে তো ক্ষতি ছিলো না।
বাদ দাও, তারচেয়ে কয়েকটা কাজের কথা বলা যাক।
কি কথা?
ফোর্বস র্যাঞ্চ, ওটা আমি কোনোদিনই বিক্রি করবো না, বিল।
মরা মানুষের ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম নেই কোনো
কিন্তু আমি এখনো বেঁচে!
তবে মরবে।
তার আগে র্যাঞ্চটা যাতে তোমরা না পেতে পার তার ব্যবস্থা করবো।
কিভাবে?
বুলেট দিয়ে। আমরা বেলিনডার র্যাঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমার সাথে পিস্তল ছিলো না, পাবদা ভাবিওনি, কিন্তু ঘোড়াটা ধার করা হলেও এটা আমার নিজের স্যাডল, স্যাডলব্যাগে অতিরিক্ত একটা পিস্তল আছে। অবশ্য তুমি পিস্তলে গুলি ভরার আগে ওটা বের করা সম্ভব নাও হতে পারে। ঝুঁকি নিতে চাও, বিল, এখুনি ফয়সালা করবে?
মুহূর্তের জন্যে অনড় রইলো বিল ওয়ারেন, গোলাপী হলো তার চেহারা, ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। সহসা পিস্তল বের করে আনলো সে, ত্রুত ভাঁজ করলে ওটা, বেলট থেকে বুলেট তুলে লোড করতে শুরু করলো।
চট করে একপাশে বেঁকে সামনে ঝুঁকে স্যাডলব্যাগে হাত চালালো কলিন। অতিরিক্ত পিস্তলটা জায়গামতো না থাকলে ওর আয়ু আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু না, আছে। তুলে নিলো ও পিস্তলটা, তাক করলো বিল ওয়ারেনের দিকে।
গুলি ভরার জন্যে পিস্তল ভাঁজ করেছিলো বিল, কয়েকটা গুলি ভরেওছে, এখন ওটা সোজা করলেই হয়, কিন্তু পারছে না সে, হাত কাঁপতে শুরু করেছে, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে কপালে।
গলা চিরে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এলো তার। আমাকে কোনো সুযোগ দাওনি তুমি। তুমি–
পিস্তল সোজা করে নাও, বললো কলিন। আমি অপেক্ষা করছি।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালে। বিল ওয়ারেন, কাঁপা কাঁপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো। সঠিক সময় বেছে নেয়ার চেষ্টা করছে সে, পরিস্কার বুঝতে পারলো কলিন।
আমি অপেক্ষা করছি, হাসল কলিন, আর বেশি সময় দিতে পারবো না।
কি যেন বলতে চাইলে। বিল ওয়ারেন, পারলো না, কেঁপে উঠলো তার পুরো শরীর, হাত থেকে খসে পড়লো পিস্তল, হাঁটুতে একবার বাড়ি খেয়ে মাটি স্পর্শ করলো। মাথা নামিয়ে ওটার দিকে তাকালো সে, পরমুহূর্তে হ্যাঁচকা টান লাগাল লাগামে, সাঁই করে ঘুরলো ঘোড়াটা, ঝড়ের বেগে ছুটলো সামনে, স্যাডলের ওপর ঝুঁকে পড়লো বিল।
বিল দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কলিন। এই ঘটনার কথা কোনোদিন মুছবে না বিলের স্মৃতি থেকে, এই অপমান ছোকরার পাওনা ছিলো। বড় বড় বুলি কপচাচ্ছিলো, বেলিনডার ওখানে পিস্তল ছুড়তে গিয়েছিলো সে, অথচ তখন নিরস্ত্র ছিলো কলিন। এ ধরনের লোকগুলোকে তাদের আসল চেহারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া দরকার।
স্যাডল থেকে নামলো কলিন, মাটি থেকে বিলের ফেলে যাওয়া কোল্টটা তুলে নিলো, তারপর আবার ঘোড়া ছোটালো। শেষ বিকেলে স্মিথ র্যাঞ্চে পৌঁছুলো ও। কিন্তু কাউকে পাওয়া গেল না ওখানে। স্মিথের অপেক্ষায় বসে থাকা ঠিক হবে না, ভাবলো কলিন। কারণ বিল ওয়ারেন জানে, এখানে আসছে ও, র্যাঞ্চ থেকে দলবল নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে।
স্টোনি রিভার যেখানে পশ্চিমে বাঁক নিয়েছে, স্মিথ র্যাঞ্চ থেকে জায়গাটা এক ঘণ্টার পথ, সেদিকে এগোলো কলিন। স্মিথের সঙ্গে দেখা করা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। শেরিফের সঙ্গে আলাপ করতে হবে ওকে, হেলারের সঙ্গেও আবার দেখা করা দরকার। কিন্তু তারপর? বেসিনে ওর আসল অবস্থান কি? এই মুহূর্তে রবার্ট ওয়ারেন খুঁজে বেড়াচ্ছে ওকে। এই নির্জন প্রান্তরে বাগে পেলে দফারফা করে ছাড়বে। কিন্তু শহরে কেমন হতে পারে তার আচরণ? অন্যরকম অবশ্যই? দেখাই যাক না।
০৭. ওয়াগোনারে পৌঁছুলো কলিন ফোর্বস
মাঝরাতের দিকে ওয়াগোনারে পৌঁছুলো কলিন ফোর্বস। অন্ধকারে ডুব মেরে আছে হেলারের বাড়ি, সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে অ্যাটর্নি। বড় রাস্তায় হিচ রেইলে আট-দশটা ঘোড়া দেখতে পেলো কলিন। তিনটে স্যালুনের দুটো এখন সরগরম, বাতি জ্বলছে হোটেলে, শেরিফের অফিসে।
হঠাৎ কারো নজরে পড়বে না এমন একটা জায়গা বেছে ঘোড়। বেঁধে রাখলো ও, তারপর স্যালুনগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে শেরিফের অফিসের সামনে এসে দাড়ালো। ঠিক সময়েই এসেছে, অফিস বন্ধ করে ঘরে ফেরার তোড়জোড় করছে শেরিফ। আরচার, ফাইল ইত্যাদি সাজিয়ে রাখছে যথাস্থানে।
এক মিনিট সময় পাওয়া যাবে? চৌকাঠে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো কলিন।
চোখ কুচকে মাথা তুলে তাকালে। আরচার, সাদামাঠা চেহারা, তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, মাঝবয়সী, জুলফির কাছে পাক ধরেছে চুলে; রোদে পোড়া তামাটে একটা ছাপ চোখে মুখে, হালকা নীলের ছোয়া চোখের তারায়; দাড়ানোর ভঙ্গিটাকে ঠিক ঋজু বলা যাবে না। কলিনকে প্রথমে চিনতে পারলো না সে, আরো কুচকে উঠলো তার চোখজোড়া।
আমার নাম ফোর্বস, ভেতরে ঢুকে দরজা আটকাতে আটকাতে বললো কলিন।
ফোর্বস! বার কয় চোখ পিটপিট করলে। শেরিফ। কলিন। ওখানে তোমার চেহারা ভালো করে দেখতে পাইনি। আমি–
থেমে গেল শেরিফ। কিভাবে ওকে গ্রহণ করা উচিত স্থির করতে পারছে না সে, বুঝতে পারলো কলিন। হঠাৎ যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে লোকটা।
গতকাল বেসিনে আসার পথে ছোট্ট একটা ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলাম আমি, বললে কলিন, তাই ভাবলাম তোমার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে।
মাথা দোলালো আরচার। রেডফিলড সব বলেছে আমাকে, তবু তুমি আসায় খুশি হলাম। সত্যি বিশ্রি একটা ব্যাপার হয়ে গেল।
ও-ই আগে পিস্তল বের করে বললো কলিন।
চার্লস বলেছে। ব্যাপারটা একটু দুর্বোধ্যই বটে। লোক হিসেবে খারাপ ছিলো না মিচেল, ওয়ারেন রাইডারদের মধ্যে ওর বেশ কদর ছিলো।
সেটা আমি টের পেয়েছি, শুকনো কণ্ঠে বললো ফোর্বস।
এর ফলে ঝামেলা আরো বাড়তে পারে, সতর্ক করলো শেরিফ, সেখানেই ভয়। বিকেলে ওয়ারেনের সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা হয়েছে আমার। ও বলেছে মিচেলের বন্ধুদের বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে, যদিও কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনি।
ওয়ারেন তার কথা রাখবে?
রাখবে না কেন?
আমার মনে হয় না।
কেন?
মিচেলের বদলা নেবার জন্যে ওরা আমাকে মারতে পারলেই বরং তার সুবিধে, ফোর্বস র্যাঞ্চ দখল করতে কষ্ট হবে না।
ভুরু কুচকে মাথা নাড়লো শেরিফ আরচার। কলিন, ঝামেলা করার মতলবে যদি বেসিনে এসে থাকো তোমার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া কিছু করার নেই আমার। আমার পরামর্শ শোনো, দয়া করে অযথা গোলমাল করতে যেয়ো না। যদি ভেবে থাকো ওয়ারেন বা ওর কোনো লোক তোমার বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যুর জন্যে দায়ী, ভুল করছে। সেদিন শেরিফের প্যসি গিয়েছিলো ফোর্বস র্যাঞ্চে, আমি নিজে নেতৃত্বে ছিলাম। রবার্ট ওয়ারেনের লোক ছাড়াও আরো অনেকে ছিলো সেদিন প্যসিতে।
এ-ধরনের তথ্যই খুজছে কলিন। শেরিফের ডেসকের দিকে এগিয়ে গেল ও।
সেদিন ঠিক কি ঘটেছিলো খুলে বলো তো আমাকে?
বলার মতো তেমন কিছু নেই। তোমার বাবার র্যাঞ্চে যেদিন গেলাম, বিষুদবার ছিলো, রাত, স্ট্যামপিডের দুরাত পর। সন্ধ্যার দিকে এখান থেকে রওনা হই, জনতা আমাদের আগেই পৌঁছে গিয়েছিলো, র্যাঞ্চে পৌঁছুনোর পর তোমার বাবাকে বেরিয়ে আসতে বললাম আমি, এলো না, বরং ঘরের ভেতর থেকে আমাকে হুকুম করলো দূর হয়ে যেতে। আমরা ওর নির্দেশ অগ্রাহ্য করলাম, ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ওরা গুলি ছুড়তে শুরু করলো আমাদের দিকে। পাল্টা নীল গুলি চালাতে বাধ্য হলো প্যসি। সম্ভবত মিনিট বিশেক স্থায়ী হয় সংঘর্ষ। তারপর তোমাদের রাইডাররা যখন আত্মসমর্পণ করলো, এডিসহ তিনজন মারা গেছে, মারাত্মকভাবে আহত তোমার বাবা, প্যসিরও চারজন সদস্য আহত হয় লড়াইতে।
ওয়ারেন রাইডার বাদে আর কারা ছিলো প্যসিতে?
ডেনিস স্মিথ, লেম মুসেলমান, ডার্ক পিট, রবার্ট কার্য-এর গিয়েছিলো শহর থেকে, জ্যাক ফ্লেনারিও ছিলো, ছিলো আরো কয়েকজন। ওরা সবাই তোমার বাবাকে নির্দেশ দিতে শুনেছে। এসব আমি বানিয়ে বলছি না, কলিন, প্রত্যেকটা শব্দ নির্মম সত্য। আসল কথায় আসি এবার, তোমার বাবার সঙ্গে রবার্ট ওয়ারেনের বৈরিতা ছিলো সন্দেহ নেই, কিন্তু তাই বলে তার মৃত্যুর জন্যে কিছু তেই ওয়ারেনকে দায়ী করা যাবে না। ফিউড চালানোর জন্যে যদি ফিরে এসে থাকো, ভুলে যাও।
এক পা থেকে অন্য পায়ে শরীরের ভর বদল করলো কলিন ফোর্বস।
ওয়ারেন এখন ফোর্বস র্যাঞ্চ কিনতে চাইছে, এটার কি ব্যাখ্যা দেবে তুমি?
বাস্তববাদী লোক সে, কলিন, তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছেলের জন্যে একটা জায়গা কিনতে চাইছে। তুমি যখন ওয়াই মিংয়ে চমৎকার একটা চাকরি করছে স্বভাবতই র্যাঞ্চটা বিক্রি করে দেবে, ওয়ারেন যদি কিনতে চায় দোষ কি? বেসিনে কেনার মতো আর কোনো র্যাঞ্চ তো নেই।
কিন্তু র্যাঞ্চটা যদি নিজে চালাতে চাই আমি?
তাহলে ওয়ারেন নিশ্চয়ই বাধা দেবে না।
নির্বোধ, ভাবলো কলিন, কাল রাতে ওয়ারেনের আস্তাবলে হাজির থাকলে টের পেতে।
একটা কথা বলি, খেই ধরলো আরচার, তোমার বাবার সঙ্গে বিরোধ ছিলো তাই ওয়ারেন তোমারও শক্ত, এ-ধারণা মুছে ফেলে। মন থেকে। প্রত্যেকটা মানুষের একটা আলাদা পরিচয় থাকা দরকার, কলিন, অন্যের ছায়ায় বড় হওয়া যায় না।
স্ট্যামপিড প্রসঙ্গে ফিরে আসি, বললো কলিন, বাবাই ওই ঘটনার জন্যে দায়ী জানলে কিভাবে?
অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি মাত্র সেদিন–হ্যারলড লেভিটের জবান বন্দী–তবে আগেই এগোনোর মতো যথেষ্ট তথ্য পেয়ে যাই আমি। সেরাতে যারা ওয়ারেনের গরু পাহারায় ছিলো তোমার বাবা জোর করে ওদের তাড়িয়ে দেয়, ওদের একজন ড্যানিয়েলদের স্ট্যামপিড শুরু করতে দেখেছে, তারপর ভোররাতের দিকে ফোর্বস ক্রুদের ওদের যেতে দেখেছে বলে জানিয়েছে ডেনিস স্মিথ এবং শেষরাতে ওদের ফিরতে দেখেছে ডেভিড স্পেক্টর। অমির ফোর্বস র্যাঞ্চে গিয়ে জিজ্ঞেসও করেছিলাম তোমার বাবাকে, একটা কথাও অস্বীক ব করেনি, উল্টো আমাদের হুকুম দিয়েছে র্যাঞ্চ ত্যাগ করতে।
হ্যারলড লেভিটের কথা বললে না? ওর কথা আমার মনে আছে। আমাদের র্যাঞ্চে কাজ করতো।
স্ট্যামপিডের রাতে সেও ছিলো তোমার বাবার সঙ্গে। কথা বলবে তার সাথে? হাজতেই আছে। গোলমাল থামার পর ওয়া রেন ফোর্বস রাইডারদের মধ্যে যারা স্ট্যামপিডে অংশ নিয়েছিলো তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেয়, তোমার বাবার নির্দেশে ওরা কাজটা করতে বাধ্য হয়েছে, এই যুক্তিতে বোধ হয়। বেসিন ছেড়ে চলে যাবে, এই শর্তে ছেড়ে দেয়া হয় ওদের, চলেও গিয়েছিলো, কিন্তু হ্যারলড আবার ফিরে এসেছে। কেন, আমি তা বুঝি। ওর একটা মেয়ে আছে এখানে, স্বামীর সঙ্গে বেচারির বনিবনা নেই, মেয়েটার জন্যে সে চিন্তিত, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আমার উপায় ছিলো না। ওয়ারেনের কয়েকজন রাইডারের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে বসেছিলো, আমি বাধা না দিলে ব্যাপারটা গোলা গুলি পর্যন্ত গড়াতে পারতো। কথা বলবে ওর সাথে?
মাথা দুলিয়ে সায় দিলে কলিন।
শেরিফের অফিসের পেছনেই জেলখানা। পকেট থেকে চাবি বের করে বাইরে কাঠের দরজাটা খুললো। আরচার, কিন্তু আট কানো রইলো ভেতরের লোহার গরাদের দরজা। চড়া গলায় ডাকলো সে, হ্যারলড, জেগে আছো?
এই নরকে মানুষ ঘুমাতে পারে? নিশ্চয়ই জেগে আছি।
এদিকে এসো, বললো আরচার।
দরজার কাছে এগিয়ে এলো হ্যারলড, ছিপছিপে গড়ন ওর, সামান্য কুজো। মুখ তুলে প্রথমে আরচার তারপর কলিনের দিকে তাকালো সে, চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো তার।
হাঁউডি, কলিন! দারণ শরীর বানিয়েছে দেখছি এই ক’বছরে!
ও কিছু না, বললে কলিন।
তোমার কি অবস্থা, হ্যারলড?
খারাপ, জলদি আমাকে এই গর্ত থেকে বের করার ব্যবস্থা করে, বললো হ্যারলড।
চেষ্টা করবো, আশ্বাস দিলো কলিন, এখন একটা কাজ করে, স্ট্যামপিড সম্পর্কে বলো আমাকে।
কাঁধ ঝাঁকালো হ্যারলড। ওটা একটা স্ট্যামপিডই ছিলো, আর কি বলবো?
শুরু করেছিলো কে?
আমরা। আমি, তোমার বাবা, এডি, টেরি জেলারম্যান, টমাস টম্পসন আর শেরিডান।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো কলিন। ঠিক করে বলো, হ্যারলড, তোমরা দলবেঁধে ওয়ারেনের র্যাঞ্চে গিয়ে ওর গরু ছত্রভঙ্গ করে হত্যা করেছে?
ঠিক তাই, কলিন।
স্ট্যামপিডের উদ্দেশ্য নিয়েই গিয়েছিলে?
সত্য গোপন করে লাভ নেই, হ্যাঁ।
কত বড় ছিলো পালটা?
অনেক বড়, পরে শুনেছি পনেরো শ’য়ের মতো গরু ছিলো, আমারও তাই ধারণা।
ভুরু কোচকালো হ্যারলড লেভিট, হাতের পিঠে মুখ মুছলো। জ্যোৎস্না রাত ছিলো। ওয়ারেনের দুই রাইডার পাহারায় ছিলো ওখানে, প্রথমে ওদের তাড়িয়ে দিলাম আমরা, তারপর এলো পাতাড়ি গুলি ছুড়ে আর চিৎকার করে তেড়ে গেলাম গরুর পালের দিকে, মশাল ছিলো আমাদের কাছে, আগুনের নাচ দেখে রীতি মতো ভড়কে যায় জানোয়ারগুলো, অনেক সময় এমনিতেই অস্থির হয়ে থাকে গরুবাছুর, সামান্য কারণেই ছুটোছুটি শুরু করে, এবারও তাই হলো, যেদিকে চাইছিলাম সেদিকেই ছুটতে লাগলো ওরা, বেড়া ভেঙে ক্লেব্যাংকসের ওপর থেকে ঝুপঝাপ নিচে পড়তে শুরু করলো, জানো তো, ক্যানিয়নের দেয়াল ওখানে কি রকম খাড়া পতনের আওয়াজ পাইনি আমরা, পরে শুনেছি একটানা দশদিন নাকি পাওয়া গেছে পচা গন্ধ।
চুপ করে গেল সে, কঁধ ঝাঁকালো, পকেট থেকে পাইপ বের করে জ্বাললো।
ঘুরে দাড়ালো কলিন, দুহাত মুঠি পাকালো। রীতিমতো অসুস্থ বোধ করছে। বিশ্বাস করতে মন চায় না, কিন্তু অবিশ্বাসই বা করে কিভাবে? হ্যারলড কেন মিথ্যে বলতে যাবে? তাছাড়া ওর বক্তব্য সাক্ষীদের জবানবন্দীর সাথে মিলে যায়। হ্যারলড নিজেই ছিলো স্ট্যামপিডে! শালা!
ড্যানিয়েল ফোর্বস ওয়ারেনের গরু স্ট্যামপিড করেছে–এটাই সত্যি!
এখন কি করবে ও? বাবা অপরাধী ছিলো মেনে নেবে? তাছাড়া…
যথেষ্ট হয়েছে, হ্যারলড, বললো আরচার, জেলের দরজা আটকানোর উপক্রম করলো।
আমাকে ছেড়ে দাও, বললো হ্যারলড!
সকালে দেখা যাবে। দরজা বন্ধ করে তালা আটকালো আরচার, তারপর ডেসকের কাছে এসে ঠেস দিয়ে দাড়ালো। তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি, কলিন, নিচু গলায় বললে সে। প্রথম শোনার পর আমিও তো বিশ্বাস করতে পারিনি। তোমার বাবা সৎ স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলো, কখনো বেআইনী কিছু করতে দেখিনি। ওয়ারেনকে ও পছন্দ করতো না, সেটা সবাই জানতো, কিন্তু সেজন্যে সে ওয়া রেনের কোনো অনিষ্ট করেনি–মানে স্ট্যামপিডের আগ পর্যন্ত। হঠাৎ সে এভাবে বদলে গেল কেন খোদা জানেন।
সব শুনে মনে হচ্ছে স্ট্যামপিডের ব্যাপারটা, বললে কলিন, বাবা গোপন করার চেষ্টা করেনি এবং অপরাধ, যদি অপরাধ হয়ে থাকে, অস্বীকার করেনি।
ঠিক।
কিন্তু আর কিছুই মেলাতে পারছি না।
না মিললেও এসব সত্যি।
অস্পষ্টভাবে মাথা দোলালো কলিন। দরজার দিকে পা বাড়ালে। ও, কিন্তু শেরিফের ডাকে থামতে হলো।
কোথায় যাচ্ছ? জানতে চাইলে অরচার, ইচ্ছে করলে আজ রাতে আমাদের সঙ্গে থেকে যেতে পারে।
আজ নয়। ধন্যবাদ, জেফরি।
ওয়ারেনের ব্যাপারে কি করবে ভাবছো?
ওর সঙ্গে আলাপ করবো,বললো কলিন, যদি সম্ভব হয় কাল।
আমাকে তার ব্যবস্থা করতে দাও। তুমি তাহলে আবার ওয়াইওমিংয়েই ফিরে যাবে?
জানি না।
গেলে, ধরে নিচ্ছি যাকে র্যাঞ্চ বিক্রি করার জন্যে একজন লোকই পাবে বেসিনে যার নগদ টাকা দেয়ার ক্ষমতা আছে–বার্ট ওয়ারেন। এসব ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থা স্বীকার করে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, কলিন।
ঠিক বলেছো, বিড়বিড় করে বললে কলিন, কাল আবার কথা বলবো তোমার সঙ্গে।
বেরিয়ে এসে মুহূর্তের জন্যে বারান্দায় দাড়ালো ও, সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। অনেক আশায় বুক বেঁধে এখানে এসেছিলো, কিন্তু এখন কেমন যেন ফাঁকা লাগছে সব। ইচ্ছে করলে ফোর্বস র্যাঞ্চে গিয়ে উঠতে পারে ও, রবার্ট ওয়ারেনকে উপেক্ষা করে ওখানে বসবাস করা যায়; জিইয়ে রাখা যায় লড়াইটা। কিন্তু কি লাভ? ওয়ারেন যদি হার স্বীকার করে বেসিন ছেড়ে চলেও যায়, কি লাভ হবে ওর?
ঘোড়ার কাছে এসে স্যাডলে চেপে বসলে। কলিন, রাস্তার শেষ মাথায় দাঁড়ানো লিভারি আস্তাবলের দিকে এগোলো। জিন লাগাম খসিয়ে কোরালে ঢোকালো ঘোড়াটা, আস্তাবলের দরজার কাছে র্যাকে তুলে রাখলে স্যাডল। তারপর ফিরতি পথে হোটেলে এসে ঢুকলো ও। ডেসকের ওপাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে বুড়ো ডেস্ক ক্লার্ক। ওকে জাগালো না কলিন, হুক থেকে একটা চাবি নিয়ে হল ধরে হাঁটতে হাঁটতে নির্দিষ্ট কামরার সামনে এসে দাড়ালো, তালা খুলে ভেতরে পা রাখলো। বিছানাটা দেখে পছন্দ হয়ে গেল। পোশাক খুলে ঝাপিয়ে পড়লো ও, কিন্তু ক্লান্তিতে অনেকক্ষণ ঘুম এলো না।
নীরবে জেগে উঠলো ওয়াগোনার, কোলাহলহীন। অ্যালটশেলার অ্যানড কায মারকেনটাইল কোমপানী মনে জেনারেল স্টোরের রবার্ট কায দোকান খুললো সবার আগে। ঘর ঋটি দেয়া শেষ করে বারান্দায় এসে দাড়ালো ও, সকালের মিঠে রোদের উষ্ণ পরশ উপভোগ করলো। রাস্তার উল্টোদিক থেকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালো রিভার বেনড স্যালুনের মালিক ভিক্টর কানিং। ব্যাংক ভবন পেছনে ফেলে রালফ বেলামী, শহরের নাপিত, এগিয়ে গেল তার দোকানের দিকে। দোকান খোলার তোড়জোড় করছে জিন কেলনার, অর্থাৎ কফি তৈরি। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রেস্তরাঁর নিয়মিত দশবারোজন খদ্দের এসে পড়বে, দৈনন্দিন কাজ শুরুর আগে কিছুক্ষণ খোশগল্প করবে আর চুমুক দেবে কফির কাপে।
আজ বেশ সকালে একজন খদ্দের এসেছে রালফ কেলামীর দোকানে, অপরিচিত; তাতে সে অবাক হয়নি। নানা জায়গা থেকে আগত ড্রামার, গরু ব্যবসায়ী ভবঘুরে কাউহ্যানডরা প্রায়ই এখানে পা ফেলে, ওদের কাউকেই সে চেনে না। এবং ওরা জানতে চাক বা চাক চলতি ঘটনা সম্পর্কে তাদের সে ওয়াকিবহাল করবেই। আজকের খরিদ্দারকেও ভবঘুরে কাউহ্যানড ধরে নিয়েছে বেলামী, বেকার এবং চাকরির ধান্ধায় আছে।
রবার্ট ওয়ারেনের সঙ্গে দেখা করেছ? জিজ্ঞেস করলো সে।
কেন? জানতে চাইলো কলিন।
নতুন লোক নিতে পারে সে। একজন লোক কমে গেছে তার। মিচেল গুলি খেয়ে মরেছে।
তাই?
হ্যাঁ। ফোর্বস নামে এক লোকের পাল্লায় পড়েছিলো। ফোর্বসকে মারার জন্যে পিস্তল বের করেছিলো সে, কিন্তু ক্ষিপ্রতায় ফোর্বসের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। এর আগের আরো ঘটনা আছে। এই ফোর্বস আবার বুড়ো ড্যানিয়েল ফোর্বসের ছেলে, মাসখানেক আগে এক প্যসির সঙ্গে লড়াইতে মারা গেছে ভদ্রলোক। ওর আর এক ছেলে এডিও মারা গেছে সেদিন। ওয়ারেনের গরুর পাল স্ট্যামপিড করার অপরাধে ড্যানিয়েল ফোর্বসকে প্রেপ্তার করতে গিয়েছিলো প্যসি। আচ্ছা, মানুষ কেন হঠাৎ কালো পথে পা বাড়ায় বলতে পারো?
জানি না, বললো কলিন।
ড্যানিয়েল ফোর্বসের কথাই ধরো। চমৎকার মানুষ ছিলো, এত ভালো, চিন্তা করতে পারবে না, কোনোরকম জটিলতা ছিলো না ওর মধ্যে। ওয়ারেনকে সে পছন্দ করতো না, কিন্তু শত্রুতাবশত সে এমন কিছু করবে কল্পনাও করেনি কেউ। পনেরো শ গরুর পাল স্ট্যামপিড করে ক্লেব্যাংকসের ওপর থেকে নিচে ফেলেছে ড্যানিয়েল ফোর্বস। তুমি জানো না, ক্যানিয়নের দেয়াল ওই জায়গায় খাড়া দুশো ফুট নেমে গেছে, এত ওপর থেকে পড়ে গরুগুলোর কি অবস্থা হয়েছিলো ভাবতে পারো। আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলবো এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর হতে পারে না।
আমি জিজ্ঞেস করিনি, বললো কলিন।
হতভম্ব দৃষ্টিতে কলিনের দিকে তাকালো রালফ বেলামী, থমকে গেল তার হাতের ক্ষুর, কিন্তু কথা থামালো না সে। কলিন ফোর্বস কি করতে যাচ্ছে তা নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় আলোচনা করছিলাম আমরা, আবার বললো বেলামী, ওয়াইওমিংয়ে এতদিন চাকরি করতো সে, ভালো চাকরি, ওখানে ফিরে গেলেই তারজন্যে ভালো, কিন্তু সে যদি এখানে থেকে র্যাঞ্চিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই সঙ্গে রবার্ট ওয়ারেনের সঙ্গে তার বাবার এতদিনের বিরোধ জিইয়ে রাখতে চায়, সন্দেহ নেই শেষমেষ ঠিক একটা রেনজ-ওঅর বেধে যাবে বেসিনে। একটা গানফাইটে জড়িয়ে পড়ে একজনকে হত্যা করার পর এখান থেকে চলে গিয়েছিলো ছেলেটা, আট বছর পর ফিরে আসামাত্র আবার একজনকে হত্যা করেছে। অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না ব্যাপারটা।
নড়েচড়ে বসলো কলিন। শেভের দিকে মন দাও তো।
নিশ্চয়ই, বললো রালফ বেলামী।
বকবক করেই চললল সে, অবশেষে মনে মনে কলিন যা ভাব ছিলো সেই প্রসঙ্গেই ফিরে এলো : কেন ভুল পথে পা বাড়ায় মানুষ? কেন হঠাৎ এমন কিছু করে যা তার চরিত্রের সাথে একেবারেই মেলে না?
জবাব নেই।
কিন্তু জবাব ওকে পেতেই হবে।
নাপিতের দোকান থেকে বেরিয়ে রেস্তরাঁয় এলো কলিন ফোর্বস। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, চুল দাড়ি কাটার পর সতেজ বোধ করার কথা, কিন্তু বেলামীর বকবকানি মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। বেলামীর কথায় আসলে জনমতেরই প্রতিফলন ঘটেছে, হঠাৎ উপলব্ধি করলে কলিন। বেসিনে রেঞ্জ-ওঅর বাধলে বা রবার্ট ওয়ারেনের সঙ্গে ওর, বিরোধ প্রলম্বিত হলে বেসিনবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার মানে সবাই এখন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, ও কি সিদ্ধান্ত নেবে সেকথা ভেবে উদ্বিগ্ন তারা।
রেস্তরাঁয় যারা ছিলো দেখামাত্র চিনে ফেললো কলিনকে। করমর্দন করার জন্যে এগিয়ে এলো রবার্ট কাষ, ড্যানিয়েল ফোর্বস সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বললো, কিন্তু তার মৃত্যু প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল সুকৌশলে। লিভারি আস্তাবলের মালিক টনি হাইড ওয়াইও মিংয়ের চাকরি সম্পর্কে এটা ওটা জিজ্ঞেস করলো ওকে। এছাড়া আরো দুজন নাগরিক কুশল বিনিময় করলো ওর সঙ্গে। সপ্রতিভ দেখালো তাদের, কিন্তু তারপরও কলিন বুঝতে পারলে তলে তলে এরা প্রত্যেকে উৎকণ্ঠিত, মুখে কিছু না বললেও সবাই যেন জানতে চাইছে : রেস্তরাঁ থেকে বের হয়ে কি করতে যাচ্ছে ও?
জেফরি আরচার এসে যোগ দিলো ওর সাথে। শহরেই থাকছে সারাদিন? জানতে চাইলো।
থাকতে পারি, বললে কলিন। বাবার কাজ-কর্ম সম্পর্কে কার কাছে ধারণা পাওয়া যেতে পারে?
অ্যারন হেলারকে আদালত তোমাদের সম্পত্তির ব্যবস্থা করার জন্যে ট্রাস্টি নিয়োগ করেছে।
তাহলে তো ওর সঙ্গে আলাপ করতে হয়।
কেয়ারটেকার হিসেবে র্যাঞ্চে আছে ডার্ক পিট।
পরে দেখা করবে ওর সাথে।
ওয়ারেন আজ শহরে এলে—
ওর সাথে কথা বলবো।
ওকে খবর দিচ্ছি তাহলে আমি, বললো আরচার।
নাশতা শেষ করলো কলিন। আবার হোটেলে ফিরে এলো, বারান্দায় একটা চেয়ার বেছে বসলো, তারপর অলস ভঙ্গিতে পাইপ টানতে লাগলো। ওয়ারেনের আস্তাবলে প্রহৃত হওয়ার আড়ষ্টতা কাটেনি এখনো, তবে ব্যথা অনেক কমেছে, দপদপ করছে না আর মাথার ভেতর।
পাইপ নিভিয়ে বারান্দার রেলিংয়ে পা তুলে দিলো কলিন, সকালের সূর্যের তীব্র রশ্মির হামলা থেকে চোখ বাঁচাতে চোখ বুজলো। চারদিক অবিশ্বাস্য রকম শান্ত, নীরব; এ নীরবতা যেন ঝড়ের পূর্ব ভাস। হোটেলের বারান্দায় এভাবে প্রকাশ্যে বসে থাকলেও আপাতত বিপদের আশঙ্কা করছে না কলিন। অ্যারন হেলারকে ওয়ারেনের কাছে র্যাঞ্চ বিক্রির ব্যবস্থা করতে বলে দিলে আর কোনোদিনই কোনো বিপদ হবে না, নিশ্চিন্তে ওয়াইওমিংয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তে পারবে ও। কিন্তু যদি এখানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে?
ওয়াইওমিংয়ে ফিরে যাওয়াই অনেক সহজ। যোগ্যতার বলে সিনডিকেটের একটা দামী পদ দখল করতে পেরেছে ও, এমন একটা চাকরি চাইলেই মেলে না, কিন্তু…
বেলা গড়িয়ে চললো। রাস্তায় বেরিয়ে এলো অ্যারন হেলার, অফিসের দিকে এগিয়ে গেল, তালা খুলে ঢুকে পড়লো ভেতরে, হোটেলের বারান্দায় বসা কলিনকে লক্ষ্য করলো না। ডেভিড স্পেক্টরের সঙ্গে শহরে এলে বেলিনডা গ্রেবার, ওকে দেখতে পেয়ে ঘোড়া থামালো। উঠে মাথা থেকে টুপি নামালো কলিন।
সুপ্রভাত বেলিনডা। চমৎকার লাগছে কিন্তু তোমাকে।
অধৈর্যের সঙ্গে মাথা নাড়লো বেলিনা। তুমি আর বিল র্যাঞ্চ থেকে বেরোনোর পর কি হয়েছে?
কই, কিছু না। খানিকক্ষণ একসঙ্গে এগোই আমরা, তারপর আলাদা হয়ে বিল চলে যায় ওদের র্যাঞ্চের উদ্দেশে, আর আমি সোজা এদিকে।
কিসের আশায় বসে আছ এখানে? রবার্ট ওয়ারেনের সঙ্গে দেখা করতে।
গোলমাল মিটিয়ে ওয়াইওমিংয়ে ফিরে যাচ্ছো? বেশ, শুনে খুশি হলাম, কলিন। এটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
হাসলে কলিন, তারপর হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল কথাটা, বেলিনডা, তুমি যাবে আমার সাথে ওয়াইওমিংয়ে?
আরক্ত হলো বেলিনডা। এখানেই ভালো আছি আমি, কলিন, এবং ব্যস্ত। তোমার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ায় অবশ্য খুশিই হয়েছি।
ঘোড়া ঘুরিয়ে সরে গেল বেলিনডা, স্পেক্টরের সঙ্গে যোগ দিলো, রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল ওরা।
আবার বসলো কলিন, ভাবছে, হঠাৎ বেলিনডাকে ওয়াইওমিংয়ে যাবার কথা বলতে গেল কেন? ভাবতে ভাবতে কথাটা পছন্দ হয়ে গেল। আজ না হলেও শিগগিরই বিয়ে করতে হবে ওকে, সবাই করে, বেলিনডার মতো মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া সত্যি সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আরেকটা দল শহরে পৌঁছুলো। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো কলিন। রবার্ট ওয়ারেন, বিল, লুইস প্যাটেন এবং চাক কনারসসহ মোট আটজন ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেলো। হোটেলের কাছাকাছি এলো ওরা, কলিনের দিকে একবারও না তাকিয়ে চলে গেল সামনে। নিশ্চয়ই ওকে দেখেছে ওরা। অজান্তে শিউরে উঠলো কলিন। প্রকাশ্যে ওয়ারেনের চেহারা যত মসৃণই হোক না কেন ওর আসল রূপ দেখেছে ও, ভোলার নয়।
খানিকটা সামনে গিয়ে একে একে স্যাডল থেকে নামলো ওয়া রেন রাইডাররা, হিচ রেইলে ঘোড়া বাঁধলো। বোর্ডওঅকে ওদের সঙ্গে যোগ দিলো। শেরিফ জেফরি আরচার, ওকে ঘিরে সঁাড়ালো তারা। কয়েক মিনিট পর আরচার আর ওয়ারেন একসঙ্গে পা বাড়ালো হোটেলের উদ্দেশে।
বারান্দার চেয়ারে হেলান দিয়ে অপেক্ষায় রইলো কলিন ফোর্বস।
০৮. সহজ পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে
সহজ পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে দু’জন, ওয়ারেনের সঙ্গে তাল মেলাতে জোরে পা চালাতে বাধ্য হচ্ছে আরচার। ওদিকে সিলভার বুলেট স্যালুনে অদৃশ্য হলো ওয়ারেনের তিন রাইডার, কনারস আর বিল এগোলো অ্যালটশেলার অ্যানড কার্য-এর দিকে, বারান্দায় থামলো ওরা, চেয়ে রইলো হোটেলের দিকে। ফীড স্টোরে গেল প্যাটেন, একটা জায়গা বেছে দাড়ালো, রেস্তরাঁর এক কোণে অবস্থান নিলো ওয়ারেনের অপর এক রাইডার।
হয়তো ওদের কোনো উদ্দেশ্য নেই, তবু সতর্ক থাকা ভালো ভেবে বাম হাতে টুপি ঠেলে পেছনে সরানোর ভান করে ডান হাতে হোলসটারের পিস্তল আলগা করে নিলে কলিন। অফিস থেকে বেরিয়ে এলো হেলার, রেস্তরাঁর দিকে এগিয়ে গেল। এবারও দেখা করা হলো না, ভাবলো কলিন, অবশ্য পরে করলেও চলবে, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ওয়ারেন আর অরচার হোটেলের বারা লায় উঠে এলো, চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো কলিন। চেহারা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে মাথা দোলালো ওদের উদ্দেশে।
কলিন, বললে শেরিফ, এসো, পরিচয় করিয়ে দিই, রবার্ট ওয়ারেন–মিসটার ওয়ারেন, কলিন ফোর্বস।
সুপ্রভাত, ফোর্বস, বললে ওয়ারেন। সপ্রতিভ দেখাচ্ছে ওয়ারেনকে, কেন কে জানে মুচকি হাসছে সে।
হ্যালো, ওয়ারেন, বললো কলিন।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো আরচার। মিসটার ওয়ারেন, আমি আগেই ওর সঙ্গে ওর বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে আলোচনা, করেছি। ওকে বলেছি এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। প্রতিশোধ নিতে এখানে এসেছে কলিন, আমি তা বিশ্বাস করি না, তেমন ছেলেই ও নয়। টেরেন্স মিচেলের সঙ্গে ওর লড়াইটা অনভিপ্রেত, কিন্তু দুর্ঘটনাকে স্রেফ দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখা উচিত। ওসব ভুলে গেলেই সবার মঙ্গল। আজ, এখানে কলিন ফোর্বস আর তোমার রাইডারদের মধ্যে যে কোনো ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা দূর করতে চাই আমি, এই লোকালয়ে কিছুতেই একটা ফিউড শুরু হওয়ার ঝুঁকি নিতে পারবো না আমরা।
আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, বললো ওয়ারেন, আমার ছেলেরা মিচেলকে খুব পছন্দ করতো, তবু ওদের সঙ্গে আমি কথা বলবে, যথাসাধ্য চেষ্টা করবো ওদের লাইনে রাখার।
ওয়ারেনের আস্তাবলের ঘটনা এখানে বলার সুযোগ নেই, বুঝতে পারলো কলিন। শহরে মহৎ, বিবেকসম্পন্ন সুনাগরিকের ভূমিকায় নিখুঁত অভিনয় চালিয়ে যাবে ওয়ারেন, বোঝানোর চেষ্টা করবে বেসিনে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিই তার কাম্য। আপাতত ওর এই মুখোশ খুলে দেয়ার উপায় নেই। চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? লোকটাকে একটু উস্কে দিলে কেমন হয়!
ফোর্বস র্যাঞ্চের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি আমি, শান্ত কণ্ঠে বললে কলিন, নিজেই ওটা চালানোর চেষ্টা করবো।
ভেবেছিলাম বিক্রির কথা বলবে, বললো ওয়ারেন, আমার কেনার ইচ্ছে ছিলো। তুমি ওয়াইওমিংয়ে একটা ভালো চাকরি করো বলে শুনেছিলাম…।
কিন্তু সবারই নিজের একটুকরো জমির স্বপ্ন থাকে।
জমির মালিক হওয়া ঝামেলার ব্যাপার।
তোমার জমি বেচবে নাকি, ওয়ারেন?
চোখ দুটো পিটপিট করে উঠলো ওয়ারেনের। নিশ্চয়ই না। আমার বয়স হয়েছে, তাছাড়া গোটা একটা সং সারের দায়িত্ব আমার কাঁধে!
আমারও একদিন সংসার হবে, বলে হাসলে কলিন, এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি যদিও, তবু যত ভাবছি ততই মন বলছে এখানে স্থায়ী হয়ে যাওয়াই ভালো।
পরস্পর চেপে বসলো ওয়ারেনের ঠোঁটজোড়া, এক মুহূর্ত, তারপরই সহজ হয়ে গেল আবার।
তাহলে শূন্য থেকে সব কিছু শুরু করতে হবে তোমার, বললো ওয়ারেন, আমার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে আগে, আদালত অবশ্যই আমার দাবীর পক্ষে রায় দেবে। যদ্দর জানি দেনা শোধ করতে গেলে একটা ফুটো পয়সাও আর থাকবে না তোমার হাতে।
সেক্ষেত্রে আমাদের সিনডিকেট থেকে প্রয়োজনীয় আনডার রাইটিংয়ের ব্যবস্থা করবো, টেনে বললো কলিন, ওরা র্যাঞ্চ কিনতেও রাজি হতে পারে, সম্ভাবনাটা খতিয়ে দেখতে হবে, অবশ্য তাড়াহুড়োর কিছু নেই, কি বল?
ভুরু কোচকালো ওয়ারেন, কিন্তু চেহারা স্বাভাবিক করে নিতে ভুলে গেল এবার।
এ-প্রসঙ্গে পরে কথা হবে, ফোর্বস।
আট-দশদিন পর, ঠিক আছে? অলস ভঙ্গিতে মাথা দোলালো কলিন। এখানেই পাবে আমাকে।
ছিটকে যেন দূরে সরে গেল রবার্ট ওয়ারেন, দাড়িয়ে পড়লো। সে, ঘাড় ফিরিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে বললো, এসো, শেরিফ, একসঙ্গে বসে ড্রিংক করা যাক। চলে!
আমন্ত্রণ নয়, নির্দেশ।
কলিনের দিকে তাকালে আরচার, যেন সতর্ক করে দিতে চাইলো, তারপর ঘুরে অনুসরণ করলে ওয়ারেনকে।
আবার চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো কলিন, লক্ষ্য করলো স্থান বদল করেছে বিল ওয়ারেন, প্যাটেন, কনারস আর অপর লোকটা, নতুন জায়গা থেকেও ওর ওপর নজর রাখা সম্ভব। অ্যারন হেলার অফিসের দিকে যাচ্ছে দেখে উঠে দাঁড়ালে কলিন, এগোলো সে দিকে। কনারসকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় ওকে দেখে গোঁফে তা দিয়ে চাপা গলায় বললো ওয়ারেন রাইডার, ছয় কি আট ঘণ্টা, ফোর্বস, এর বেশি সময় পাচ্ছে না তুমি, মৌজ করে নাও।
না শোনার ভান করে এগিয়ে চললল কলিন, ভাবছে; ছয় থেকে আট ঘণ্টা, আট ঘণ্টা পর সন্ধ্যা নামবে, তখন কেউ ওকে গুলি করলে ব্যাপারটাকে মিচেলের অজ্ঞাত কোনো বন্ধুর ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফল বলে চালিয়ে দেয়া যাবে অনায়াসে। আজ রাতে কোথায় লুকাবে ও?
হেলারের অফিসে পেীছে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো কলিন। চেয়ারে আরাম করে বই পড়ছিলো হেলার, পুরু চশমার ওপর দিয়ে তাকালো, কলিনকে দেখে খুলে রাখলো চশমাটা।
এসো, কলিন, তোমাকে দেখে খুশি হলাম, বললো সে। ওয়ারেন কিন্তু এখন শহরে, জানো?
হ্যাঁ, এইমাত্র আলাপ হলো।
কেমন লাগলো, ভালো?
ওপরে ওপরে তো ভালো মানুষ, আমাকে র্যাঞ্চ কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলো। আমি প্রত্যাখ্যান করেছি।
ভালো।
মানে?
বিক্রি করতে চাইলে, বললো হেলার, এতে দরকষাকষির সুবিধে হয়।
আর বিক্রি করতে না চাইলে?
আসলে সময় পেতে চাইছে তুমি।
আমাকে কি করতে বলো?
সূক্ষ্ম হাসি হাসলো হেলার। আমার বলায় কিছু আসে যায় না, তুমি ভালোই জানে সেটা। বোকার মতো যদি রবার্ট ওয়ারেনের সঙ্গে লড়াই ৰাধানোর সিদ্ধান্ত নিতে চাও, নেবে, আমার কি করার আছে।
সেদিন এখান থেকে ডাক্তার মারভিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ছিলাম আমি, বলল কলিন, সতর্ক ছিলাম যাতে কেউ না দেখে, অথচ ঠিকই ওখানে আমার জন্যে ওত পেতে ছিলো ওরা, মানে ওয়ারেন রাইডাররা। ওয়ারেন অবশ্য পরে এসে ওদের নিরস্ত করে ছিলো, আমাকে হত্যা করলে জনমত বিরুদ্ধে চলে যাবে, বুঝতে পেরেছিলো সে। ওয়ারেন ইতিমধ্যে সবার মনে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, ওর সব রাইডার মিচেলকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, ওদের সামলে রাখা কঠিন হবে, সোজা কথায়, আমাকে ওরা মার বেই, শুধু সুযোগের অপেক্ষা। কিন্তু কথা সেটা নয়, আমার প্রশ্ন : আমি মারভিনের কাছে যাচ্ছি ওর জানলো কিভাবে?
আমি বলেছি কিনা?
বলোনি?
নাহ। ওরা তো আগে থেকেই জানতো তুমি শহরে অআসছে, মনে হয় আন্দাজ করে নিয়েছে ডাক্তারের ওখানে একসময় যাবেই, মারভিনের বাড়ির দিকে নজর রাখছিলো নিশ্চয়ই। •
তা হতে পারে, কিংবা হয়তো ডাক্তার মারভিনের বাড়িতে যেতে দেখেছে ওরা!
ব্যাংকে বাবার কত টাকা আছে?
হাজার পাঁচেকের বেশি না।
ওর দেনার পরিমাণ কত?
অনাদায়ী ঋণ নেই, তবে ওর সম্পত্তির বিরুদ্ধে পঁচিশ হাজার ডলারের একটা দাবী আছে–ওয়ারেন ওর গরুর আনুমানিক মূল্য হিসেবে এই টাকাটা দাবী করেছে।
ফোর্বস র্যাঞ্চে এখন কতগুলো গরু আছে?
ইদানীং গোণা হয়নি, তবে ডার্ক পিট আছে ওখানে, ওর ধারণা বারো থেকে পনেরো শ’য়ের মতো হতে পারে।
মাত্র!
মাস দুয়েক আগে প্রায় একহাজার গরুর একটা পাল স্প্রীংগার ভিলে চালান দিয়েছিলো ড্যানিয়েল ফোর্বস।
সেই টাকা গেল কোথায়?
জানি না। র্যাঞ্চেই আছে হয়তো, কিংবা আমাদের অজানা কোনো ঋণ শোধে ব্যয় করেছে। আমি এখন ওর কাগজপত্র পরীক্ষা করছি, দেখি কোনো সূত্র পাওয়া যায় কিনা।
আমি ফোর্বস র্যাঞ্চ চালাতে চাইছি বলেছিলে ওয়ারেনকে?
হ্যাঁ।
কি বললো?
তোমার সঙ্গে নাকি কথা বলবে। র্যাঞ্চ চালাতে চাইলে আগে ওর পাওনা কড়ায়গায় মিটিয়ে দিতে হবে।
এবং পঁচিশ হাজার ডলার শোধ করতে গেলে ফতুর হয়ে যাবো আমি।
ওয়ারেনের ধারণাও তাই।
ঘাড় ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো কলিন। আবার জায়গা বদল করেছে বিল ওয়ারেন আর লুইস প্যাটেন।
হেলার, বললো ও, কি এমন ঘটেছিলো এখানে যার কারণে পুরো এক পাল গরু স্ট্যামপিড করে মারতে বাধ্য হলো আমার বাবা? শত্রুতা থাকলে কেন সামনাসামনি মোকাবিলা করলো না?
ওয়ারেনকে কখনো একা পাওয়া সম্ভব নয়, সেজন্যে হয়তো। ওর প্রায় সব লোকই গানগিংগার।
না, এটা কোনো কারণ হলো না। ম্যাকমিলানের সঙ্গে বাবার একবার গোলমাল বেঁধেছিলে,মনে আছে? তোমার মনে নাও থাকতে পারে। অনেক আগের ঘটনা। আমার বয়স তখন ষোলো। এক দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ক্রীক শুকিয়ে ফাটা-ফাটা হয়ে গেছে। ক্রীক ধরে পাহাড়ে গেলাম আমরা, দেখা গেল, ডিনামাইট ফাটিয়ে কীকের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে ম্যাকমিলান। ওখান থেকে সোজা ম্যাকমিলান র্যাঞ্চে গেলাম আমরা, পথে শীতের জন্যে জমানো ম্যাকমিলানের বেশ কয়েকটা খড়ের গাদা চোখে পড়লো, ওগুলোয় আগুন ধরিয়ে দিতে চাইলাম আমি, কিন্তু বাবা কিছুতেই মত দিলো না। র্যাঞ্চে পৌঁছে পিস্তল হাতে ম্যাকমিলানের মুখোমুখি হলো বাবা, সেদিনচোখের সামনে আজরাইলকে প্রত্যক্ষ করেছিলো ম্যাকমিলান, ওকে ক্ৰীকের মুখ খোলার জন্যে এক সপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছিলো, দেরি করেনি সে।
কিন্তু ম্যাকমিলান আর ওয়ারেন এক নয়। হার মানার লোক নয় ওয়ারেন।
কিন্তু তবু বাবা কেন ওর গরু হত্যা করলে তা দুর্বোধ্য হয়ে যায়। বাবার সঙ্গে ওয়ারেনের ঝগড়ার আসল কারণটা কি?
জানি না, কলিন, তবে এটা বলতে পারি, প্রায় সব ব্যাপারেই ওরা দ্বিমত পোষণ করতো, কিন্তু এতে তোমার প্রশ্নের জবাব মিলবে না; অবশ্য স্পষ্ট করে এটুকু বলা যায়, শহরের বাইরে উঁচু এলাকায় ড্রাই ফ্রীকে তিনটি নবাগত পরিবার বসতি করেছিলো, ওদের উৎখাত করতে চাইছিলো ওয়ারেন, হোমস্টিডারদের জন্যে বেসিন কে একরকম নিষিদ্ধ করার ইচ্ছে ছিলো তার, কিন্তু তোমার বাবা ওদের জ্বালাতন করতে নিষেধ করে দিলো, সংঘর্ষের ঠিক আগের ঘটনা এটা, অবশ্য আগেই বলেছি সব তাতেই ওদের এমন পরস্পরের বিরোধিতা করতে দেখা গেছে; সব মিলিয়ে গোটা ব্যাপারটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ওয়ারেন চাইছিলো এখানে সবকিছু তার ইচ্ছেয় চলবে, বেসিনের সবচেয়ে শক্তিশালী লোক হতে চেয়েছে সে, কিন্তু যখনই কোনো ব্যাপারে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে তোমার বাবা…আমার ব্যক্তিগত ধারণা কি শুনবে?
বলো।
আমার বিশ্বাস ওদের দুজনের ছোট ছোট বিরোধগুলোই শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে পাহাড়ের রূপ নিয়েছে, সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে ওয়ারেনের, তোমার বাবার মনের অবস্থাও একই পর্যায়ে পোঁছে গিয়েছিলো।
তুচ্ছ ব্যাপারগুলোই ওয়ারেনের গরু হত্যায় প্ররোচিত করেছে বাবাকে?
শেষ পর্যন্ত একজন তো ভেঙ্গে পড়তোই, তোমার বাবা…
কিন্তু ড্যানিয়েল ফোর্বস ভেঙ্গে পড়ার মানুষ নয়!
নিজের বাবা তাই বলছো এ-কথা। পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিষ্কার। এভাবে দেখো ব্যাপারটা : বেসিনে ওয়ারেনের বিরুদ্ধে একজনকে দাড়াতেই হতো, তোমার বাবা সেই ভূমিকা গ্রহণ করেছে, চরম আঘাত হেনেছে এক সময়; এখন যদি ওয়ারেন তোমার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাবার ভরসায় না থাকতো রীতিমতো টাকা পয়সার ব্যাপারে টানাটানি পড়ে যেতো তার।
অথচ আগে বললে আমাদের র্যাঞ্চ কেনার ক্ষমতা আছে তার?
তোমাদের বিরুদ্ধে বিরাট একটা দাবী থাকায় র্যাঞ্চটা পানির দরে কিনে নিতে পারতো সে; তাছাড়া, ঋণের ব্যবস্থা করা ওর জন্যে সমস্যা হতো না। তোমার কাছে পাওনা টাকা যে কোনো লোকসানের বিরুদ্ধে বীমার কাজ করতো।
এখন আমার কি করা উচিত?
বলেছি তো। একটা লোকই সব ঝামেলার মূল। রবার্ট ওয়ারেন।
ওকে ঘৃণা করো তুমি, তাই না? কেন?
নিজেদের যারা শ্রেষ্ঠ মনে করে আমি তাদের অপছন্দ করি।
নিজের ক্রোধের তীব্রতায় নিজেই হতবাক হয়ে গেল অ্যাটর্নি। কলিনের দৃষ্টির সামনে বিব্রত মনে হলো তাকে। হাতের বইটা একপাশে নামিয়ে রেখে উঠে দাড়ালো সে, তারপর, পায়চারি শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ পায়চারির পর থেমে আবার কলিনের মুখোমুখি হলো।
ওয়ারেনের এখন সুসময়, তিক্ত কণ্ঠে বললো হেলার, ওর সামনে বাধা হয়ে দাড়ানোর মতো কেউ নেই এ-তল্লাটে। মসেল মান, স্মিথ, ডেভিস, চার্লস-কারুরই সাহস নেই ওর বিরোধিতা করার। তুমিও ওর সঙ্গে পেরে উঠবে না-সুযোগই পাবে না।
যদি না ওকে খুন করি, শান্ত কণ্ঠে বললো কলিন, তাই না, হেলার?
চমকে তাকালো অ্যারন হেলার। কেন নয়? তোমার বাবার মৃত্যুর জন্যে কে দায়ী?
পকেটে হাত ঢোকালো কলিন ফোর্বস। আরেকবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, তারপর বললো, সেটাই করতে হবে হয়তো, হেলার, তবে এখন নয়। আরো ভালো করে ব্যাপারটা বুঝতে চাই আমি। এখন আমার হয়ে একটা কাজ করতে হবে তোমাকে।
কি?
জেমস জি. হ্যাগারটি, প্রেসিডেন্ট, ওয়াইওমিং অ্যাণ্ড ওয়েস্টার্ন ল্যান্ড অ্যাণ্ড ক্যাটল কোমপানী, এমপায়ার বিলডিং, শিকাগো এই ঠিকানায় একটা চিঠি লিখতে হবে, ‘প্রিয় জিম’ দিয়ে শুরু করবে, শেষে আমার নাম থাকবে, লিখবে আমাদের র্যাঞ্চটা যে অবস্থায় আছে ঠিক এই অবস্থায় নগদ পঁচিশ হাজার ডলারে কিনে নিতে পারে ওরা এবং আমি আগের বেতনেই এখানে থেকে এটার দেখাশোনা করতে রাজি আছি; এ-প্রসঙ্গে ওদের একথা মনে করিয়ে দেবে যে, নিউ মেকসিকোতে ওদের ব্যবসা সম্প্রসারণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা যেতে পারে। জায়গাটা অনেক সস্তায় পাবে ওরা। লিখো, র্যাঞ্চে এখন তিন হাজারের মতো গরু আছে। আমরা বলবে, ওরা র্যাঞ্চ কিনবে ধরে নিয়ে এখানে কোমপানীর পক্ষে আমি কাজ শুরু করে দিয়েছি। তবে চিঠিটা আবার ডাকে দিয়ো না, রবার্ট ওয়ারেনকে শুধু ওটার একটা কপি দেখাবে, ব্যস।
ওয়ারেন ওটা পড়ার পর কতক্ষণ তোমার আয়ু থাকবে?
আয়ুর কথা কে বলতে পারে? হাসতে হাসতে বললো কলিন। চিঠিটা দেখানোর উদ্দেশ্য ওয়ারেনকে বোঝানো ওর দাবী মেটানোর সামর্থ আমার আছে, ফোর্বস র্যাঞ্চ চালানো সম্ভব এবং বিক্রি যদি করতেই হয়, সে ছাড়াও খদ্দের আছে। প্রতিক্রিয়া কি হয় দেখা যাক না।
প্রতিক্রিয়া কি হবে বলেছি।
তবু নিজের চোখে দেখতে চাই, বললে কলিন, চিঠিটা লিখে ওয়ারেনকে দেখাও।
দরজার দিকে এগিয়ে গেল কলিন, বাইরে পা রাখলো। অ্যারন হেলারের বক্তব্যে সন্তুষ্ট নয় ও। অজ্ঞাত কোনো কারণে ওয়ারেনকে ঘৃণা করে অ্যাটর্নি। ওকে এখানে এনে ওয়ারেনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার মতলবেই ওয়াইওমিংয়ে ওর ঠিকানায় চিঠি লিখেছে সে।
আক্রোশে জ্বলছে হেলার, তার পক্ষে পরিস্থিতির নিরপেক্ষ মূল্যা যন কি সম্ভব?
আবার হোটেলে ফিরে এলো কলিন। ওয়ারেন রাইডাররা এখনো আছে রাস্তায়। চেয়ার টেনে বসে পড়লো ও, হেলান দিলো, কনারসের হুমকির কথা মনে পড়ে গেল ওর।
রাত পর্যন্ত সময় আছে, ভাবলো, সময়টা কাজে লাগানো যাক।
ওয়ারেনের সঙ্গে স্যালুনে গিয়েছিলো জেফরি আরচার, ওখান থেকে বেরিয়ে অফিসের দিকে যাচ্ছে এখন। অ্যালটশেলার অ্যাণ্ড কার্য থেকে বেরিয়ে এলো ববলিনডা, অন্য একটা দোকানে গেল, নিজের অবস্থান ছেড়ে সিলভার বুলেট স্যালুনে ঢুকলো প্যাটেন, কিন্তু কনারস বা বিল নড়লো না।
টুপি টেনে মুখের ওপর আনলে কলিন, চোখ বন্ধ করলো। পুরো ব্যাপারটা পর্যালোচনা করতে চায়, হঠাৎ হ্যারলড লেভিটের কথা মনে পড়ে গেল, টুপি সরিয়ে উঠে বসলো ও। বহু বছর ওদের র্যাঞ্চে কাজ করেছে হ্যারলড। বাবা ওকে বিশ্বাস করতো, নির্ভর করতো ওর ওপর। হ্যারলড স্ট্যামপিডে অংশ নিয়ে থাকলে এর পেছনের কারণটা নিশ্চয়ই তার জানা থাকবে। গতকালই জিজ্ঞেস করলো না কেন?
উঠে দাড়ালো কলিন, সোজা শেরিফের অফিসে গিয়ে ঢুকলো। ডেস্ক থেকে পা নামিয়ে বসলো আরচার, বিষণ্ণ চেহারা।
হ্যারলড লেভিটের সঙ্গে কথা বলবো, বললো কলিন।
কেন?
স্ট্যামপিড প্রসঙ্গে আলাপ করবো।
কাল রাতে একবার করলে না?
আবার করবো, বললো কলিন, আপত্তির কোনো কারণ আছে নাকি?
খুব ভালো একটা কারণ আছে, বললো অরচার। হ্যারলড লেভিট চলে গেছে। সকালের আগেই বেসিন ছেড়ে চলে যাবে কথা দেয়ায় ওকে শেষ রাতে ছেড়ে দিয়েছি আমি। ওয়ারেনের লোকেরা যেভাবে তোমার ওপর নজর রাখছে–এটাই যথেষ্ট, লেভিটকে আটকে রেখে আর ঝামেলা বাড়াতে চাই না।
কোন দিকে গেল ও?
আমি কি করে জানবো? পশ্চিমে বোধ হয়। তুমি র্যাঞ্চে উঠতে যাচ্ছো–নিশ্চয়ই মন থেকে বলেনি কথাটা?
অবশ্যই বলেছি।
র্যাঞ্চ চালাবে, পয়সা কোথায়?
একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কেউ টেরেন্স মিচেলের বদলা নিতে চাইলে কি করবে?
সেটা তখনই ঠিক করা যাবে।
এসব আমার ভালো ঠেকছে না, কলিন, তালিকাটা অনেক লম্বা, ওয়ারেনের অর্ধেকের বেশি লোক–
হাত নেড়ে বিরক্তি প্রকাশ করলো কলিন। বাদ দাও তো, শেরিফ। আসল ঘটনা তুমি জানো। রেঞ্জে টেরেন্স মিচেলের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো, রেডফিলড ছিলো ওর সঙ্গে, রেড ফিলডের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, কিন্তু মিচেলের সঙ্গে ধরতে গেলে কথাই হয়নি, তারপর ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খানিকটা দূরে এসে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি পিস্তল বের করছে মিচেল, একটু হলেই পেছন থেকে গুলি করতে সে আমাকে, আমি যা করেছি, পরিষ্কার, আত্মরক্ষার খাতিরেই মিচেলকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছি।
হয়তো তাই। আর কেউ হলে অবশ্য—
কিন্তু টেরেন্স মিচেলই মারা গেছে, তো সেজন্যে কি করতে হবে, লেজ তুলে পালাবো?
আগেও একবার তাই করেছিলে, সেই লোকটারও প্রচুর বন্ধু বান্ধব ছিলো।
তখন আমার বয়স অনেক কম ছিলো, পালানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেছিলাম। কিন্তু সারাজীবন কারো পক্ষে পালিয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়, শেরিফ। মোট কথা এবার আমি থাকছি। রবার্ট ওয়ারেনকে বলে দিয়ে ওর লোকদের যেন সামলে রাখে।
বলেছি। ও চেষ্টা করবে বলেছে। ওয়ারেন সব রকম সহযোগিতা করতেই রাজি আছে, কিন্তু ওর রাইডাররা যদি বেঁকে বসে? আমি তোমাকে সতর্ক করছি, কলিন–।
বাদ দাও, বিড়বিড় করলো কলিন, দ্রুত বেরিয়ে এলো।
দুই কদম সামনে এগিয়ে গতি কমালো।
স্টেজ স্টেশন থেকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে বিল। রিভার বেনড় স্যালুনের কোণে কনারস, নাপিতের দোকানের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়েছে আরেকজন পাহারা দিচ্ছে।
০৯. বিদায় নিলো রবার্ট ওয়ারেন
বিকেলের দিকে দুজন সঙ্গী নিয়ে বিদায় নিলো রবার্ট ওয়ারেন, শহরেই রইলো বাকি সবাই-বিল ওয়ারেন, লুইস প্যাটেন, চাক কনারস আর কুৎসিত চেহারার খর্বাকৃতি এক লোক, কলি নের অপরিচিত। একটু পর পর সিলভার বুলেট স্যালুন, রিভার বেনড কিংবা কার্লটন অ্যাণ্ড ওয়েবারে যাচ্ছে ওরা, গলা ভেজানোর জন্যে, তবে অধিকাংশ সময় রাস্তাতেই থাকছে, হোটেলের বারান্দায় অপেক্ষারত কলিনের ওপর কড়া নজর রাখছে।
কয়েকবার অফিস থেকে বেরিয়ে এসে লুইস প্যাটেন আর বিল ওয়ারেনের সঙ্গে বাক্য বিনিময় করলে শেরিফ জেফরি আরচার, বাকি দু’জনকে সে খুব একটা গ্রাহ্য করে বলে মনে হলো না। যখনই বাইরে আসছে অস্বস্তির সঙ্গে হোটেলের পোর্চের দিকে তাকাচ্ছে অরচার, লক্ষ্য করলে কলিন।
শহরবাসীরাও যেন অস্বাভাবিক কিছু আলামত টের পেয়ে গেছে। দোকানের দরজা থেকে বারবার উঁকি দিচ্ছে নাপিত রালফ বেলমী, রবার্ট কাষ, ভিক্টর কানিং, জ্যাক ফ্লেনারি আর স্যাম উইল সন একাধিকবার রাস্তায় এলো, ওকে জরিপ করলো, শেষমেষ দ্বিধা ঝেড়ে রাস্তা পেরিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলার জন্যে এগিয়ে এলো রবার্ট কার্য।
কোনো সাহায্য লাগবে, কলিন?
নাহ, জবাব দিলো কলিন।
যেসব কথা শুনছি সুবিধের মনে হচ্ছে না, বললো কাষ। মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো কলিন। ভেবো না, বব। দেখতেই পাচ্ছো, এখনো কিছুই হয়নি।
আরো পরে, শেষ বিকেলের দিকে আবার বেলিনডা এলো। কলিন, বললো সে, রাতে মায়ের কাছে থাকছি আমি। তুমি আমাদের সঙ্গে সাপার করবে? খুব খুশি হবো। এক্ষুণি এসো না?
ধন্যবাদ, বেলিন, এখন নয়, পরে কোনো একসময় হবে।
ওই লোকগুলো যদি—
কথা বলতে কারো আটকায় না, বেলিনডা, খামোকা গুজবে কান দিতে যেয়ো না। লোকে যেমন ভাবে পরিস্থিতি আসলে কখনোই তত খারাপ হয় না।
এটা কথার কথা!
বাজি? ঠিক আছে, শোনো, কালই সন্ধ্যায় পার করতে তোমার র্যাঞ্চে আসছি আমি, দুপুরে কম করে খাবো, তো বুঝতেই পারছে, রাক্ষুসে ক্ষুধা থাকবে পেটে •••
ঠোঁট কামড়ালে বেলিনডা। আমার কোনো কথাই তুমি শুনবে না, তাই না? নড়বে না এখান থেকে! শেষ পর্যন্ত ওরা কি করে দেখতে গাট হয়ে বসে থাকবে?
আমি আসলে বিশ্রাম নিচ্ছি, আর কিছু না, এখানে এভাবে বসে থাকতে বেশ ভালো লাগছে।
একটা কথা কি জান, কলিন? মাঝে মাঝে পুরুষদের ওপর আমার ঘেন্না ধরে যায়, স্বস্তি পাই একা আছি ভেবে।
কথা শেষ করে চরকির মতো ঘুরলো বেলিনডা, সোজা শের ফের অফিসের দিকে চলে গেল। এক মুহূর্ত পর বেরিয়ে এলো জেফরি আরচার, দ্রুত পদক্ষেপে হোটেলের দিকে এগিয়ে এলো, বসে পড়লো কলিনের পাশে।
বেলিনডা পাঠিয়েছে, না? জানতে চাইলো কলিন।
এমনিতেই আসতে হতো, জবাব দিলো আরচার, শবযাত্রা ব্যাপারটি আমার নিদারুণ অপছন্দ। রাত নামার পর কি করবে, ভেবেছো?
ঘোড়ায় চেপে ঘুরতে বের হতে পারি।
জেলের পাশে অফিসের পেছনে একটা ঘোড়া বাঁধা আছে, আমার ঘোড়া ওটা, দ্রুত ছুটতে পারে। অন্ধকার পর্যন্ত অপেক্ষা করে একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ওদিকে যেতে পারি না আমরা?
ধন্যবাদ, শেরিফ। অস্পষ্ট কণ্ঠে কি যেন বললৈ শেরিফ। হেলান দিয়ে বসে পায়ের ওপর পা তুলে দিলো। সত্যি বলতে কি মিচেলকে নিয়ে ওরা এত বাড়াবাড়ি করছে কেন আমার মাথায় ঢুকছে না, লোকটাকে কখনোই আমার কাছে বিরাট কিছু মনে হয়নি।
মনে না হওয়াটাই হয়তো যুক্তিসঙ্গত, বললে কলিন, মিচেল কে ওরা উসিলা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে হয়তো, এইদিক থেকে চিন্তা করেছ ব্যাপারটা?
রাগী চেহারায় রাস্তার দিকে তাকালে শেরিফ, কিছু বললো না।
সূর্য ডুবে গেছে, কিন্তু অন্ধকার নামেনি এখনো, অবশ্য ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে দিনের অবশিষ্ট আলো। পর্বতমালার দিক থেকে বইছে মৃদু হাওয়া। জেনকিনস থেকে ইঙ্গিত পেয়ে রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়ানো চার ওয়ারেন রাইডার আস্তে আস্তে সিলভার বুলেট স্যালু নের সামনে এসে সমবেত হলো, খানিক পর পর হোটেলের দিকে তাকাচ্ছে ওরা।
প্যাটেন, কনারস আর বিল ওয়ারেন-এই তিনটাকে চিনি, বললো কলিন, কিন্তু চার নম্বরটা কে?
এরিক মেইন, বললো জেফরি আরচার, লোকে বলে চালু পিস্তলবীজ, অবশ্য খুব ভালো করে চিনি না ওকে।
বিল সম্পর্কে তোমার মতামত কি?
ওর সব বাহাদুরী মুখে! কিন্তু প্যাটেন সত্যিই বিপজ্জনক লোক, কনারসও।
দল ভেঙে আলাদা হয়ে গেল চারজন। রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলো কনারস, তার উল্টোদিকে চললে মেইন। স্যালুনে ঢুকে পড়লো প্যাটেন এবং দরজা ঘেষে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়ালো বিল ওয়ারেন।
অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে এলো, আকাশের রঙ এখন গাঢ় নীল, আর কিছুক্ষণ পরই তারা উঠবে। হাত দিয়ে পিস্তল স্পর্শ করলে কলিন, হোলসটারে আলগা করে নিলো ওটা। রাস্তার এ-মাথা ও মাথায় নজর বোলালো, মেইন বা কনারসের চিহ্ন নেই, কোথায় গেছেকে জানে! প্যাটেনই বা কোথায়? স্যালুনে ঢুকেছিলো, পেছন দরজা গলে বেরিয়ে যায়নি তো! স্যালুনের সামনের দরজা আগলে রেখেছে বিল ওয়ারেন, আবছা অবয়ব দেখা যাচ্ছে এখন।
হঠাৎ নড়ে উঠলো আরচার। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, কলিন। চলো, এবার অফিসের দিকে এগোই। ওখানে—
আচমকা প্রচণ্ড গুলির শব্দে কেঁপে উঠলো চারদিক, পর পর তিনটে গুলি হলো, তারপর তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার। এক ঝটকায় উঠে দাড়ালো জেফরি অরচার।
এর মানে কি? প্রকাশ্যে কৌতূহল প্রকাশ করলো সে। এসো, কলিন। আমার পেছনে থেকো, অফিসের পাশ দিয়ে যাবার সময় কেটে পড়বে।
রাস্তা ধরে এগোলে শেরিফ, কলিন অনুসরণ করলো ওকে, হোটেলের কোণে পৌঁছেই থমকে দঁাড়ালো, পরমুহূর্তে হোটেল আর স্যাডল-শপের মাঝের সংকীর্ণ গলিতে ঢুকে পড়লো ও। হোটেল ভবনের মাঝামাঝি এসে ওর কামরার জানালা খুঁজে পেলো, খোলাই আছে, ঝটপট ভেতরে ঢুকে পড়লো ও, লবির উদ্দেশে এগোলো দ্রুত, ওখান থেকে সামনের দরজার দিকে।
দরজার মুখে ঝাড়া তিরিশ সেকেণ্ড অনড় দাড়িয়ে রইলো কলিন, হাপাচ্ছে, ধুকপুক করছে বুক, একটু জিরিয়ে নিলোও। একটু আগের গুলির শব্দ কি অর্থ বহন করে আঁচ করতে পেরেছে। একই পিস্তল থেকে ছোঁড়া হয়েছে গুলি তিনটে, খুব সম্ভব কনারসের, হোটেলের বারান্দা থেকে শেরিফকে সরিয়ে নেয়ার কৌশল।
রাস্তার দিকে তাকালো কলিন। স্যালুনের সামনে থেকে উধাও হয়েছে বিল ওয়ারেন। বোধ হয় ওকে ধরার আশায় ঘুরপথে হোটেলের পেছন দিকে গেছে। স্যালুনের খোলা দরজায় দুজন লোককে দেখা যাচ্ছে, গুলির শব্দ অনুসরণ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ব্যাপার কি বোঝার চেষ্টা করছে। আর কাউকে দেখা গেল না আশপাশে।
বারান্দায় বেরিয়ে এলো কলিন, সহজ পদক্ষেপে রাস্তা পেরুলো, স্যালুনের পেছন হয়ে শহরের অপর প্রান্তে যাবে। পাঁচ কি ছয় কদম এগিয়েছে, হঠাৎ দেখলো স্যালুনের দুরবর্তী কোণ থেকে বেঁটে অথচ বলিষ্ঠদেহী এক লোক বেরিয়ে আসছে। পলকে তাকে চিনে ফেললল কলিন। গুলি ছুড়েই ফিরে এসেছে চাক কনারস।
থমকে দাড়ালো কলিন। নিমেষে উঠে এলো কনারসের হাত, গর্জে উঠলো তার অস্ত্র, কলিনের মাথার ওপর দিয়ে ছুটে গেল বুলেটটা। কলিনের হাতও ঝলসে উঠলো পরক্ষণে, পর পর দুবার গুলি করলো ও। পেছনে একটা ঝাঁকি খেলে কনারস, আধ পাক ঘুরলো, তারপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ধুলায়।
পেছন থেকে গুলির শব্দ ভেসে এলে, বেশ দূরে। আন্দাজে সেদিকে একবার গুলি ছুড়লে কলিন, এক দৌড়ে স্যালুনের সব চেয়ে কাছের কোণের দিকে এগিয়ে গেল। পরমুহূর্তে বিল ওয়ারে নের চিৎকার শুনতে পেলো।
ওদিকে গেছে! স্যালুনের পেছনে!
হোটেলের সামনে আছে বিল, ভাবলো কলিন। স্যালুন আর রেস্তরাঁর মাঝখান দিয়ে ছুটলো কলিন, হাঁপ ধরে গেছে, স্যালুনের পেছনে এসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে দম নিলো, পিস্তল উচিয়ে রেখেছে। রেস্তরাঁর পেছনের অন্ধকার ছায়ার দিকে তাকালো ও। ওখানে আছে কেউ একজন, একটা বাক্সে স্কুপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। কে হতে পারে? প্যাটেন? সে-ই কি লুকিয়েছে ওখানে?
হঠাৎ একটা ফিসফিস কণ্ঠস্বর কানে এলো কলিনের।
কলিন? কলিন ফোর্বস?
জবাব দিলো না কলিন, অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু বেশি। ক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। বিল ওয়ারেন চিৎকার করে তার লোকদের এদিকে আসতে নির্দেশ দিয়েছে, এখুনি এসে পড়বে সে, আসবে এরিক মেইনও, একটু আগে সে-ই বোধ হয় গুলি ছুড়েছে।
আবার সেই ফিসফিস কণ্ঠস্বর।
কলিন ফোর্বস। গুলি করে না যেন। আমি হ্যারলড।
হ্যারলড, পুনরাবৃত্তি করলো কলিন, হ্যারলড লেভিট?
বাক্সের ভূপের ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসা ঢ্যাঙা, কুজো লোক টাকে চেনা মুশকিল।
হ্যারলড, বললো কলিন, শহরে কি করছো তুমি? আরচার বললো তুমি নাকি চলে গেছ?
গিয়েছিলাম, স্বীকার গেল হ্যারলড, কিন্তু আবার চিরে এসেছি। তোমার সাথে দেখা করা জরুরি। তোমার অপেক্ষাই করছিলাম আমি। চলো, এবার কেটে পড়া যাক। আমাদের কারো জন্যেই ওয়াগোনার নিরাপদ নয়। নদীর কিনারে দুটো ঘোড়া রেখে এসেছি।
স্যালুনের দেয়াল থেকে সরে এলো কলিন, পাশে এসে দাড়ালো হ্যারল। তারপর একসাথে ছুটতে শুরু করলো ওরা। প্রধান রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে এসে গতি কমালো। পেছনে তাকালে কলিন।
মি কোথায় গায়েব হয়েছ প্রথমে বুঝতে পারবে না ওরা, বললো হ্যারলড। কিন্তু আমি আর দৌড়তে পারছি না, বুড়িয়ে গেছি তো?
যদ্দর মনে পড়ে, বললে কলিন, এটা তোমার মুদ্রাদোষ। আগে সারাক্ষণ বলতে, বুড়িয়ে গেছি তো, আর দুজনের সমান খাটুনি খাটতে। বাজি রাখতে পারি, দরকার হলে সারারাত দৌড়াবে তুমি।
তার অবশ্য দরকার হবে না, বললো হ্যারলড। এবার কিছু ক্ণ কোথাও বসে কথা বলবো আমরা। ওদিকে রাস্তায় দারুণ দেখিয়েছে কিন্তু তুমি, শুটিংয়ের কথা বলছি।
দেখেছো?
হ্যাঁ, রেস্তরাঁর কোণেই তো ছিলাম। সন্ধ্যা নামামাত্র শহরে ঢুকে পড়ি আমি, তোমাকে কোথায় পাওয়া যাবে জানা ছিলো না, কিন্তু দেখলাম হোটেলের বারান্দাতেই বসে আছে। হঠাৎ দেখলাম রাস্তার দুদিকে হাঁটা ধরেছে কনারস আর মেইন। তার পরই গুলির আওয়াজ হলো। হোটেলের কোণ ঘুরে তুমি উধাও হলে, বিল ওয়ারেন তোমাকে অনুসরণ করলো, কিন্তু দেরি করে ফেললো সে। বিল ছেলেটা কথাবার্তায় এত বেপরোয়া, কাজে লবডঙ্কা, নিজের প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত থাকে।
চারজন ছিলো ওরা, বললো কলিন, প্যাটেনকে স্যালুনে ঢুকতে দেখেছি, পেছনের দরজা গলে বেরিয়ে এসেছিলো কিনা কে বলবে!
আমার কপাল ভালো বলতে হয়, বললো হ্যারলড, ওর চোখে ধরা পড়িনি।
শহর সীমান্তে নদীর কাছে এসে পড়লো ওরা। থামলো। আবার পেছনে তাকালো কলিন।
এবার সত্যিকার অর্থে পিছু ধাওয়া শুরু হবে, আস্তে করে বললো ও, এতক্ষণ মিচেলের উসিলা দেখাচ্ছিলো, এবার কনারস যোগ হলো।
যে করেই হোক তোমাকে খতম করার চেষ্টা করবে ওরা, বললো হ্যারলড।
কেন?
তুমি ড্যানিয়েল ফোর্বসের ছেলে তাই।
কি বোঝাতে চাইছ, হ্যারলড?
আগে এসো, কোথাও বসা যাক, তারপর বলা যাবে, বললো হ্যারলড। বললাম না, বয়স হয়েছে, বেশি ছোটাছুটি শরীরে সয় না।
চাপা হাসি হাসলে কলিন।
নদীর দিকে এগোলো ওরা। হ্যারলডের রেখে যাওয়া দোড়া দুটো যথাস্থানেই পাওয়া গেল, ওগুলোর কাছাকাছি উপড়ে পড়া একটা গাছের গুড়িতে বসে পড়লো দুজন। পিস্তল লোড করে নিলো কলিন, হোলসটারে ঢুকিয়ে রাখলো, তারপর পাইপে তামাক ভরে জ্বাললো, অপেক্ষায় রইলো। গালের ভেতর তামাকের পিণ্ড টাকে বাগে আনার চেষ্টা করছে হ্যারলড।
এদিকে কেউ আসছে দেখলেই পগার পার হয়ে যাবো আমরা, বললো হ্যারলড, ওই ঘোড়াটা মেয়ে-জামাইকে না বলে তোমার জন্যে নিয়ে এসেছি, স্যাডলব্যাগে কিছু খাবার দিয়ে দিয়েছে মেয়েটা।
ওগুলো সম্ভবত কাজেই লাগবে, শুকনো কণ্ঠে বললে কলিন।
হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা, সায় দিলো হ্যারলড, কয়েকটা দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে তোমাকে–ওদের সঙ্গে যে ক’দিন যোগাযোগ করা না যাচ্ছে।
ওরা? ওরা কারা?
টেরি জেলারম্যান, টমাস টম্পসন, আরথার শেরিডান আর হনডো স্টার্ন।
কাল তিনজনের নাম বলেছিলে।
হ্যাঁ, স্ট্যামপিডের দিন টেরি, টমাস ও আরথার আমাদের সঙ্গে ছিলো, হনডা মিস করেছে ব্যাপারটা, কিন্তু র্যাঞ্চ হাউসের লড়াই তে ও ছিলো। টমাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব নাও হতে পারে, তোমাকে খবর দিতে ওয়াইওমিংয়ের পথে রয়েছে ও। কয়েকদিন পালিয়ে থাকার পর ওয়াগোনারে এসেছিলাম আমি, লুকিয়ে থাকারই কথা ছিলো, কিন্তু কি ভেবে একদিন শহরে ঢু মারলাম এবং জড়িয়ে পড়লাম ঝামেলায়। টমাস যদি তোমার নাগাল না পায় সেই কথা ভেবে ওয়াগোনারে এসে অপেক্ষা করছিলাম।
মাথা চুলকালো কলিন। বুঝলাম না।
প্রথম থেকে শুনতে চাও?
অবশ্যই।
অনেক পেছনে যেতে হবে তাহলে, ওয়ারেন ম্যাকমিলান র্যাঞ্চ কিনে বেসিনে হাজির হওয়ার পরই ব্যাপারটা শুরু, অনেক কিছু ঘটেছে এরপর, সব বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে, অত কথার দরকারও নেই, সব কিছুর সারাংশ হচ্ছে : ওয়ারেনের খায়েস ছিলো বেসিনের সবাই তার কথায় নাচবে; সমবায়ের ভিত্তিতে গরু বাজারে চালান দেয়ার কথাবার্তা হচ্ছিলো, সেখানেও মাতব্বরি ফলানোর চেষ্টা করেছে সে, হোমস্টিডারদের উৎখাত করার চেষ্টা করেছে, বেসিনের ক্রীকগুলোকে শুকিয়ে যেতে দেয়া যাবে না–এরকম একটা পুরোনো চুক্তির উসিলায় তিনটে ক্ৰীকে বাঁধ দিতে চেয়েছে এমনি আরো অনেক আছে–প্রত্যেকবার ওর বাধা হয়ে দাড়িয়েছে তোমার বাবা, রুখে দিয়েছে ওকে। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও ব্যাপারটা লড়াইয়ের দিকে মোড় নেয়নি, তবে লড়াই যখন শুরু হলো, বেসিন থেকে বহুদুরে তার সূচনা, মোক্ষম আঘাত হানলো ওয়ারেন। কিন্তু সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো আমরা ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণই যোগাড় করতে পারিনি। এমনকি স্প্রীংগারভিল ড্রাইভের ঘটনা টাও ওয়াগোনারের কেউ জানে না। কেউ না।
সামনে ঝুকলো কলিন ফোর্বস। স্প্রীংগারভিল ড্রাইভ? কি ঘটেছিল স্প্রীংগারভিল ড্রাইভে?
মাস আড়াই আগের কথা, প্রায় এক হাজারের মতো একটা গরুর পাল স্প্রীংগারভিলে চালান দিয়েছিলাম আমরা। সাতজন কাউহ্যাণ্ড, একজন-কুক মোট আটজনের ট্রেইল। ড্রাইভের নেতৃত্বে ছিলো আরনেস্ট হল। স্প্রীংগারভিলের পথটা এমন কিছু দুর্গম নয়, গরু সামলানোর জন্যে সাতজন কাউহ্যাণ্ডই যথেষ্ট, চলার পথে পানির অভাব নেই, দুটো শহর পার হতে হয়, আগেও কয়েকবার নির্বিঘ্নে গরুনিয়ে গেছি আমরা। সাতদিন,বড়জোড় আটদিন লাগে সব মিলিয়ে। দু’সপ্তাহর মধ্যে ফিরে আসা উচিত ছিলো ওদের, কিন্তু ফিরলো না। আরো কয়েকটা দিন অপেক্ষা করার পর ব্যাপার কি জানার জন্যে আমি আর তোমার বাবা স্প্রীংগারভিলে রওনা দিলাম।
স্প্রীংগারভিলে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম গরু বিক্রি করে যথারীতি টাকা নিয়ে ফিরে গেছে আমাদের লোকেরা। লম্বা, ছিপ ছিপে একলোক নিজেকে আরনেস্ট হল পরিচয় দিয়ে টাকা গ্রহণ করেছে, লোকটার চোখজোড়া নীল। কিন্তু তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের আরনেস্ট হল মোটাসোটা খাটো মানুষ এবং ওর চোখ সবুজ। গরুর পাল ব্যাকট্র্যাক করা শুরু করলাম আমরা। জানা গেল আমাদের আরনেস্ট রসদপত্রের জন্যে লুডলোতে যাত্রাবিরতি করেছিলো, স্প্রীংগারভিলের নিকটতম শহর ওটা, মাত্র দু’দিনের পথ। লুডলো থেকে স্প্রীংগারভিল পর্যন্ত পুরো এলাকা চষে বেড়ালাম আমরা এবং লুডলোর মাইল বারো দূরে একটা রুক্ষ জায়গায় পেলাম কবরগুলো।
পাথরের মতো বসে রইলো কলিন।
মোট পাঁচটা, বললো হ্যারলড, বাকি তিনটেও হয়তো ছিলো কোথাও, আমরা পাইনি। গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ওই পাঁচ জনকে, আমাদের লোক সরাই, আরনেস্টও ছিলো; রূপ উইলিস, ফ্রেড সিবার্ট আর ম্যাট ওলডফিলডের কোনো খোঁজ পাইনি, ওরা মারা গেছে ধরে নিয়েছি আমরা। আবার এমনও হতে পারে ভয় দেখিয়ে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে ওরা, কিংবা নিজেরাই বিকিয়ে গেছে; পালাতে পারলে ভবিষ্যতে ওদের মুখ খোলার সম্ভাবনা আছে, এ-দিক থেকে চিন্তা করলে ওদের হত্যা করাই স্বাভাবিক।
তারমানে লুডলো আর স্প্রীংগারভিলের মাঝামাঝি কেউ আমাদের গরু ছিনিয়ে নিয়েছে এবং ওগুলো বিক্রির টাকা হজম করেছে, এই তো?
হ্যাঁ। কাজটা কার প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি। তোমার বাবা এটাকে কোনো আউট-ল দলের অপকর্ম বলে ধরে নিলো, আমিও তাই ভেবেছিলাম। কবরগুলো পাওয়ার পর শেরিফের সঙ্গে কথা বলতে আবার স্প্রীংগারভিলে ফিরে গেলাম আমরা, সোজা স্যালুনে গিয়ে ঢুকলাম প্রথমে, গলা না ভিজিয়ে আর পারছিলাম না। অনেকক্ষণ মদ খেলাম আমরা দুজনেই। স্যালুনের বারটেনডার তোমার বাবাকে চিনে ফেললো–স্টোনি রিভার বেসিনের পুরোনো বাসিন্দা আমরা জানতে–সে জানতে চাইলে ওয়ারেনের রাইডার ক্লাইভ কাসলারকে আমরা চিনি কি না। ড্যানিয়েল বললো, না। বারটেনডার তখন জানালো কাসলার লোকটা লম্বা, ছিপছিপে, এবং তার চোখজোড়া নীল। সপ্তাহ দুই আগে স্প্রীংগারভিলে এসেছিলো সে। এসব তথ্য এক করলে কি অর্থ বেরিয়ে আসে আন্দাজ করতে পারো, কলিন? ক্লাইভ কাসলার ওয়ারেনের লোক, লম্বা, ছিপছিপে, নীল চোখ তার। আরনেস্ট হলের নাম ভাড়িয়ে আমাদের গরুর টাকা ছিনতাইকারীও লম্বা, ছিপছিপে এবং তার চোখও নীল। এতে হয়তো কিছুই স্পষ্ট হয় না–আবার অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়, না?
কিভাবে প্রমাণ পেলে তোমরা?
শেরিফের কাছে আর যাইনি। পরদিন ক্যাটলপেনে গেলাম, লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম। ওদের অনেকেই আমাদের গরুর পাল আর ট্রেইল ক্রুর চেহারা মনে করতে পারলো। ওদের কাছে কয়েকজনের চেহারার বর্ণনা পাওয়া গেল, কনারস, প্যাটেন আর পিটার রাইটকে চিনতে কষ্ট হলো না–সব কয়টা ওয়ারেন রাই ডার। দু’রাত পর আবার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম আমরা। সেই পাঁচটা কবরের কাছে ক্যামপ করলাম রাতে, অন্ধকার রাত, নীল নকশা ক্যামপফায়ারের পাশে বসে অনেক আলোচনা করলাম।
ক্ষীণ হয়ে আসছে হ্যালডের কণ্ঠস্বর। ঢোক গিললো সে, তারপর আবারখেই ধরলো, সব তথ্য যোগ করলাম অমিরা, দেখলাম আদালতকে বিশ্বাস করানোর মতো কোনো প্রমাণই নেই আমাদের হাতে। গরুর পাল ক্রেতার হাতে তুলে দেয়ার সময় কয়েকজন ওয়ারেন রাই ডার স্প্রীংগারভিলে ছিলো, এটা প্রমাণ করা গেলেও ওই ট্রেইলে হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী কেউ বিশ্বাস করতো না, বরং লোকে বলতে পেনস কর্মীদের অস্ত্রের মুখে মিথ্যে সাক্ষী দিতে বাধ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ মামলা করার কোনো উপায়ই ছিলো না আমাদের। মনে আছে উইলিস, সিবার্ট আর ওলডফিলডের খোঁজ করার কথা বলেছিলাম আমি, কিন্তু তোমার বাবার তখন ধৈর্য নেই, ও বললো, প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছি আমি, হ্যারলড়, কতটা কল্পনাও করতে পারবে না তুমি। টাকাটা আমার খুব দরকার ছিলো, ওটা না হলে দারুণ মুশকিলে পড়ে যাবো। গরু কেনার তালে আছে। ওয়ারেন, জায়গাও কিনবে, চার্লসসহ কয়েকজন র্যাঞ্চার তাদের স্টক বিক্রি করতে এক পায়ে খাড়া, ওয়ারেন সফল হলে বেসিনে ওর অবস্থান আরো দৃঢ় হয়ে যাবে। নগদ টাকা ছাড়া ওকে ঠেকানো যাবে না।
তাহলে চলো টাকাটা কেড়ে নিই, বললাম আমি।
কি ভাবে? জানতে চাইলো তোমার বাবা।
আমি জবাব দিতে পারিনি। তোমার বাবাও তখন কোনো উপায় খুঁজে পায়নি। কিন্তু স্যাঞ্চে পৌঁছা’র আগেই কর্তব্য স্থির করে ফেল লাম আমরা। তোমার বাবা বললো, ওয়ারেনের অস্ত্রেই ওকে ঘায়েল করবো আমরা, হ্যারলড চালান দেয়ার জন্যে ক্লেব্যাংকসে একপাল গরু জড়ো করেছে ওয়ারেন, আমার চেয়ে এই মুহূর্তে ওর টাকার প্রয়োজন অনেক বেশি, কয়েকদিনের মধ্যেই একটা মোটা অঙ্কের দেনা শোধ করতে হবে ওকে। আমাকে যেমন কপর্দকহীন করেছে সে, ঠিক তেমনি তার জীবনও দুর্বিষহ করে তুলবো, কিন্তু কি করবে সেই মুহূর্তে বলেনি ড্যানিয়েল। আরনেস্ট হলদের স্মৃতি রোমন্থন শুরু করেছে, আগে বলিনি, আসলে সারাক্ষণই ওদের কথা বল ছিলো সে, গরু খোয়া যাওয়ায় যতটা না তারচেয়ে ওদের অকাল মৃত্যুই বড় হয়ে বেজেছে ওর বুকে। ওকে প্রায়–কি বলবো–পাগল করে তুলেছিলো ব্যাপারটা-ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে পারছিলো না কিছু, অনেকগুলো বছর ছেলেগুলো ওর হয়ে কাজ করেছে তো!
কলিনের পাইপ নিভে গেছে। আবার জ্বালিয়ে নিলো। রাতের হাওয়া আলোড়ন তুলছে গাছের পাতায়, ঝিরঝির।
নড়েচড়ে বসলো হ্যারলড। ঠোঁটের কোণ দিয়ে পিক ফেললো, বিড়বিড় করে কি যেন বলে আবার শুরু করলো, র্যাঞ্চে ফেরার তিনদিন পর ক্লেব্যাংকসের ওপর ওয়ারেনের গরু স্ট্যামপিড করলাম আমরা, তারপর আবার ফিরে এলাম এখানে। জানতাম এ ঘটনার দায় আমাদেরই বহন করতে হবে, তোমার বাবাও তা বুঝে নিয়েছিলো। ওয়ারেন রাইডাররা পিছু ধাওয়া করবে–জানা ছিলো–মোটামুটি তৈরি ছিলাম আমরা লড়াইয়ের জন্যে, কিন্তু শেরিফ আর শহরের লোকজন ওদের সঙ্গে যোগ দেবে চিন্তাও করতে পারিনি, আমার মাথাও ঠিক মতো কাজ করছিলো না বোধ হয়।
র্যাঞ্চের লড়াইয়ের কথা শোনাও, বললে কলিন।
লড়াই বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু হয়নি। গোলাগুলি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারায় এডি, একটু পর আহত হয় তোমার বাবা, এর পরপরই আমরা বাকি সবাই আত্মসমর্পণ করি। কারণ ততক্ষণে আমার মাথা কাজ করতে শুরু করেছে, আমি ভেবে দেখলাম, শেরিফ থাকায় ঝটপট আমাদের ফাঁসিতে ঝোলাতে পারবে ওরা, একটু সময় পেলে আসল ঘটনা সবাইকে জানানোর সুযোগ হবে। তারপর যেই বেসিন ছেড়ে যাবার শর্তে আমাদের ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলো, দেরি না করে লুফে নিলাম সুযোগটা।
ওয়াগোনার থেকে বিদায় নিলাম অমিরা, মোট পাঁচজন, আমি, টেরি জেলারম্যান, টমাস, আরথার আর হনডো। শহরের ছ’মাইল দুরে গিয়ে ওয়াইওমিংয়ের পথ ধরলো টমাস, তোমার কাছে গিয়ে আসল ঘটনা খুলে বলবে; অন্যদের প্রীংগারভিলে নিয়ে গেলাম আমি, কাজে লাগিয়ে দিলাম, এখনো ব্যস্ত আছে ওরা; তারপর ফিরে এসে তোমার অপেক্ষায় রইলাম, কিছু না জেনে তুমি হঠাৎ হাজির হও যদি, তাই; টমসতোমার দেখা পাবেই তার, ভরসা কি? কাল রাতে তুমি জেলে এলেও ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শেরিফের সামনে মুখ খুলতে পারিনি, সে আমাকে না ছাড়লে আবার তোমাকে খবর দিয়ে আনাতাম অবশ্য, ওকে না শুনিয়ে বলার চেষ্টা করতাম।
স্প্রিংগারভিলে কি করছে ওরা?
নিখোঁজ সেই তিনজনের খোঁজ করছে; ওদের হত্যা করা হয়ে থাকলে, লাশ। ওদের অবশ্য খুঁজে পাওয়ার আশা কম, ভবঘুরে ছিলো, ঘুরতে ঘুরতে এসে চাকরিতে ঢুকেছিলো, আবার এমনও হতে পারে-ওহ্, ধেৎ! এখন আমরা কি করবো, কলিন?
উঠে দাড়ালো কলিন। জানি না, হ্যারলড। কিছু জানি না।
ম্প্রীংগারভিল থেকে ওদের নিয়ে ফিরতে কয়েকদিন লেগে যাবে আমার।
ওরা আবার বেসিনে আসবে?
কেউ ঠেকাতে পারবে না। তোমার বাবাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো ওরা, বছরের পর বছর একসঙ্গে কাজ করেছে। আবার লড়াইয়ের সুযোগ পাবার আশাতেই সেদিন আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছিলো ওরা।
ক্ষুব্ধ শোনালো হ্যারলডের কণ্ঠস্বর। সোজা হয়ে দাড়ালো কলিন, বুঝতে পারছে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ওহ,এখন আর ওএকা নয়! পাশে দাড়ানোর মতো চারজন কঠিন দুর্ধর্ষ লোক পাওয়া গেছে,
ওয়াইওমিং থেকে টমাস ফিরে এলে পাঁচজন হবে ওর সঙ্গী।
হ্যারলড, বললো ও, ঘোড়ায় চাপো। যত তাড়াতাড়ি পারে। ওদের নিয়ে এসো।
এ-কথাই শুনতে চাইছিলাম, বললে হ্যারলড। আগামী চার-পাঁচদিন কোথায় লুকাবে? ফিরে এসে কোথায় যোগাযোগ করবো?
লুকাবো কোথায় জানি না। তবে যোগাযোগ করার মতো একটা জায়গার নাম বলতে পারি।
বলো।
ফোর্বস র্যাঞ্চ। আজ থেকে পাঁচদিন পর।
যদি ফিরে আসতে পারি।
তাহলে ছ দিন।
পাঁচ দিনেই ফিরে আসার চেষ্টা করবো। কিন্তু, কলিন, একা ওয়ারেনের সঙ্গে লাগতে যেয়ো না, কেমন? গা ঢাকা দিয়ে থেকো।
মাথা দোলালো কলিন। হাত মেলালে হ্যালডের সঙ্গে, ঘোড়া পর্যন্ত এগিয়ে দিলো ওকে, ঘোড়ার খুরের শব্দ মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো ও। তারপর গাছপালার আড়ালে অপেক্ষা করলো কিছু সময়। পুরো ব্যাপারটা আবার উল্টেপাল্টে দেখলে মনে মনে। হ্যারলডের কাছে সব শোনার পর বারবার বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে মনটা, কই, বাবা তো আসলে অন্যায় কিছু করেনি।
রবার্ট ওয়ারেন অপরাজেয় এক অশুভ শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে এখানে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে জিতবে ও? ওই লোকটার মুখোশ খুলে দিতে পারবে?
পাঁচ দিন সময় পাচ্ছে ও, উপায় খুঁজে বের করতে হবে। পাঁচ দিন–যদি ওয়ারেনের নাগালের বাইরে থাকা যায়!
১০. স্টোনি রিভার-এর কাছে
ঘণ্টাখানেক স্টোনি রিভার-এর কাছে নিবিড় গাছপালার ভেতর ঘুরে বেড়ালে কলিন ফোর্বস, মনে মনে বেসিনের মানচিত্র উল্টে পাল্টে দেখছে আর ভাবছে আগামী চার-পাঁচ দিনে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াতে পারে। নিশ্চিত করে কিছুই বলার উপায় নেই। ওকে ধরার ব্যাপারটাকে ওয়ারেন কতখানি গুরুত্ব দেবে কে জানে। সব ক’জন লোক নিয়ে মাঠে নামতে পারে সে, হয়তো আঠার মতো লেগে থাকবে ওর পেছনে; কিংবা হতে পারে বেশির ভাগ লোককে দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত রেখে শহরে আর রাঞ্চে দু-একজনকে পাহারায় বসিয়ে রাখবে, দেখলেই খপ করে ধরে ফেলবে ওকে। কোনটা ঘটে অচিরেই জানা যাবে, এঁবে কোনো ক্ষেত্রেই তেমন লাভ হবে না ওর।
এটা অবশ্য ওর সমস্যার একটা দিক। আসল সমস্যা প্রীংগার ভিল হত্যাকাণ্ডের দায় ওয়ারেনের গড়ে চাপানো। ও এখন শেরিফের কাছে খুলে বললেও তাকে সে স্পর্শ করতে পারবে না, এমন কি কবরগুলো দেখিয়ে আনলেও না। ট্রেইলে খুন খারাবী আর গরু ছিনতাই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, ওসবের জন্যে অনায়াসে অজ্ঞাত আউট-ল দলকে দায়ী করা যায়। ওয়ারেন রাই ডারদের জড়িত থাকার অভিযোগ টিকবে না ধোপে।
ওয়ারেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার আগে অকাট্য প্রমাণ জোগাড় করা দরকার। উইলিস, সিবাট আর ওলডফিলড এখনো বেঁচে থাকলেও ওদের খুঁজে বের করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
তাহলে?
ওয়ারেনের যে কোনো একজন রাইডারকে নিংড়ে তথ্য বের করবে নাকি?
সাত সদস্যের একটা ট্রেইল ত্রুকে পরাস্ত করতে কমপক্ষে দশ-বারোজন গানহ্যাণ্ড প্রয়োজন, এদের ভেতর চাপের মুখে নতিস্বীকার করার মতো কেউ একজন না থেকেই যায় না। হামলায় ছিলো এমন তিনজনের নাম জানা গেছে : কনারস, প্যাটেন এবং ক্লাইভ কাসলার। চাক কনারস সম্ভবত মারা গেছে, কিংবা মৃত্যুপ্রহর গুণছে। প্যাটেন কঠিন মানুষ, সে হয়তো মুখ খুলবে না। আর ক্লাইভ কাসলার সম্পর্কে কিছু জানা নেই ওর, সন্দেহ নেই গুরুত্বপূর্ণ লোক সে, নইলে আরনেস্ট হলের নাম ভাঁড়িয়ে গরু বিক্রির টাকা নেয়ার দায়িত্ব তার ওপর বর্তাতো না, হামলার নেতৃত্বেও বোধ হয় সে-ই ছিলো।
গাছপালার কিনারায় চলে এলো কলিন ফোর্বস, ওয়াগনারের দিকে তাকালো। ওরা পালিয়ে এসেছে দু’ঘন্টা হলো, এতক্ষণে শহরে ওদের খোজাখুজিতে ভাটা পড়ার কথা। অবশ্য এখনো সতর্ক অবস্থায় থাকবে ওরা, কিন্তু ওকে শহরে আশা করবে না। হেলারের সঙ্গে আবার দেখা করা দরকার, এটাই সবচেয়ে নিরাপদ সময়-ভাবলে কলিন।
পাইপ নিভিয়ে পকেটে ঢোকালো ও, হাটতে শুরু করলো। শহরের দিকে। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি, এভাবে চললে নদী আর শহরের মধ্যে শিগগিরই একটা নতুন ট্রেইল জন্ম নেবে, ভাবলে ও। প্রথম বাড়িটা পাশ কাটাচ্ছে, হঠাৎ একটা কুকুর হাজির হলো, গন্ধ শুকলো, তারপর লেজ নাড়তে শুরু করলো মহা আনন্দে। মৃদু হাসলো কলিন। কুকুরগুলো পর্যন্ত চিনে ফেলেছে!
হেলারের বাড়ির পর্দা টানানো জানালায় আলোর আভাস, বারান্দায় উঠে এলো কলিন, কান পাতলে দরজায়, কোনো শব্দ নেই, টোকা দিয়ে অপেক্ষায় রইলো।
দরজা খুলে ওকে দেখেই চমকে উঠে ঢোক গিললো হেলার। তুমি এখানে কি করছো? আমি তো ভেবেছি এতক্ষণে-হায়, খোদা!
এক পা পিছিয়ে গেল সে। ভেতরে ঢুকে দরজা আটকালো কলিন, হাসলো। এখনো আমাকে খুজছে ওরা? এখানেই?
আমি কি করে জানবো? বিরক্তির সাথে বললো হেলার। কি জন্যে এসেছে?
পাঁচ শো ডলার আর একটা ছোট্ট তথ্য।
পাঁচ শো ডলার, কেন?
একটা জিনিস কিনতে হবে। ব্যাংকে বাবার হিসেবে পাঁচ শো ডলার হবে না?
মাথা দোলালো হেলার। কিন্তু সম্পত্তির বন্দোবস্ত না হওয়া পর্যন্ত তো টাকা তোলা যাবে না।
তাহলে ধার দাও, রসীদ লিখে দেবো।
হঠাৎ পাঁচ শো ডলারের দরকার পড়লো কেন?
বললাম তো একটা জিনিস কিনতে হবে, ব্যস। পাবো?
আমার কাছে তো অত টাকা নেই, দেখি জ্যাক ফ্লেনারির কাছ থেকে আনা যায় কিনা।
সেটাই করো।
ঠিক আছে।
আজই দরকার।
তুমি বললে এখুনি যাই।
না, তার আগে একটা কথা বলো, চাক কনারস এখন কি অবস্থায়?
পটল তুলেছে।
এমন কিছুই শুনবে জানা ছিলো, তবু চমকে উঠলো কলিন। আরেকটা লাশ যোগ হলো ওর নামের সাথে, আরেকটা! মাথা থেকে টুপি খুলে চুলে আঙুল চালানোর ফাঁকে মুহূর্তের জন্যে ঢালের মতো ওটা ধরে রাখলো মুখের সামনে, অভিব্যক্তি গোপন করলো।
ঘণ্টা খানেক আগে শেরিফের সঙ্গে আলাপ হলো, বললো হেলার। ওর কাছেই শুনলাম রাস্তায় কয়েকবার ফঁকা গুলি করে সে নাকি শেরিফকে তোমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো, যাতে বিনা বাধায় খতম করা যায় তোমাকে; আর চারের মতে আত্মরক্ষার জন্যেই তুমি কনারসকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছ। স্যালুনের দরজায় দুজন লোক দাড়ানো ছিলো, ওরা সাক্ষী দিয়েছে, কনারসই আগে গুলি ছুড়েছে; যাই হোক তারপরও তোমাকে খুজছে আরচার গ্রেপ্তার করে আটকে রাখবে, তোমার নিরাপত্তার খাতিরেই নাকি এটা করা দরকার।
নিরাপত্তার নিকুচি করি আমি।
বেসিনে আরো সন্ত্রাস চায় না আরচার।
তাহলে ওকে বলো ওয়ারেন রাইডারদের বেঁধে রাখতে।
ওদের লাইনে রাখার ব্যাপারে ওয়ারেনের ওপর ভরসা করছে ও।
সে বরং আমার বিরুদ্ধেই লেলিয়ে দেবে তাদের। আচ্ছা, ক্লাইভ কাসলারকে কতখানি জানো তুমি?
ওয়ারেনের লোক, ওর টপহ্যানড বলতে পারো, যদিও নিজের হাতেই কাজ চালাতে পছন্দ করে ওয়ারেন।
কি ধরনের মানুষ ও, মানে কাসলার?
ধূর্ত, স্বল্পভাষী, ঠাণ্ডামাথার খুনী তিরিশের মতো হবে। বয়স, লম্বা, ছিপছিপে। চালু পিস্তলবাজ। লোক টা অবশ্য দেখতে শুনতে ভালো। বেলিনডার প্রতি কিছুটা দুর্বল, অবশ্য গ্রেবারের মৃত্যুর পর অন্য কোনো পুরুষের দিকে তাকায়নি বেলিনডা, বিল ওকে রাজি করানোর কম চেষ্টা করেনি, সুবিধে করতে পারেনি।
পুরো কামরায় একটা চক্কর দিলো কলিন, তারপর হেলারের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ওয়ারেন বিকেলে যাবার আগে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো?
হ্যাঁ, অল্পক্ষণের জন্যে।
আমি যে একটা চিঠি লিখতে বলেছিলাম, দেখিয়েছিলে ওটা?
হ্যাঁ।
কি বললো?
মুখখিস্তি করলো রীতিমতো। ও বেঁচে থাকতে নাকি কোনো হতচ্ছাড়া সিনডিকেটকে বেসিনের ধারেকাছে আসতে দেবে না।
হাসলে কলিন। আবার কবে তার সঙ্গে দেখা হতে পারে?
কাল, রোজই তো শহরে আসে।
দেখা হলে আমার হয়ে একটা খবর দেবে ওকে, ঠিক আছে? আর একটা কথা জানতে চাইবে।
কি?
খবরটা হলো আমরা পাঁচটা কবরের খোঁজ পেয়েছি, আর জানতে চাই অন্য তিনজনের কবর কোথায়?
পাঁচটা কবর? ভুরু কেঁচিকালো হেলার, পাচটা কবর মানে?
কলিন জবাব দিলো না। আবার প্রশ্ন করলো হেলার, তোমার বাবার গরু নিয়ে যারা শ্রীংগারভিলে গেছে তাদের কথা বলছ নাকি?
হ্যাঁ, হেলার। তুমি বলেছিলে বাবার কাগজপত্র ঘেটে গরু বিক্রির টাকার হদিস পাওনি, পাবে কি করে! ওই টাকা বাবার হাতে এলে তো! টাকাটা কোথায় গেছে জানি না, আমাদের কাউ হ্যানডরা কিভাবে মারা গেল তাও এখনো জানতে পারিনি, তবে আসল খবর বের করতে বেশি সময় লাগবে না। যাই হোক, আপাতত ওয়ারেনকে কিঞ্চিৎ উতলা করে তোলার ইচ্ছে আমার।
যাতে তোমাকে হত্যা করার একটা অজুহাত পায় সে।
অজুহাত তো তার আছেই!
হেলারের কোঁটরাগত চোখে চিন্তার ছায়া। এক মুহূর্ত পর নীরব থাকার পর সে আবার বললো, একটা কথা তুমি কেন বুঝতে পারছে না, কলিন? ওয়ারেনকে হামলা করার, ওকে নিশ্চিহ্ন করার অধিকার তোমার আছে না! তাহলে কেন অযথা বোকামি করছো? অনর্থক সময় ক্ষেপণ করলে যে কোনো মুহূর্তে ওদের কেউ তোমাকে হত্যা করে বসতে পারে। প্রমাণের, আশায় বসে থাকলে প্রতিশোধ নেয়া তোমার হবে না কোনোদিন।
ওয়ারেনকে তুমি ঘৃণা করো কেন বলবে? হঠাৎ জানতে চাইলে কলিন।
আগেই বলেছি, যারা অন্যকে পদানত করতে চায়, তাদের আমি ঘৃণা করি।
আর কোনো কারণ নেই?
না। নিঃশব্দে শিস্ দেয়ার ভঙ্গি করলে কলিন। সন্দেহ নেই, কিছু একটা গোপন করছে হেলার। যখনই দেখা হচ্ছে ওয়ারেনের বিরুদ্ধে ওকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে সে, হত্যাকাণ্ডে প্ররোচনা দিচ্ছে, কেন? কি উদ্দেশ্য অ্যাটর্নির?
পঁচিশো ডলার চাইলে, আমাকে তো তাহলে এখুনি বেরোতে হয়, বললে হেলার, অপেক্ষা করবে এখানে?
না, আমিও আসছি তোমার সঙ্গে, বললে কলিন।
একসঙ্গে বেরিয়ে এলো ওরা, হাঁটতে হাঁটতে সিলভার বুলেট স্যালুনের পেছনে এলো।
আমি এখানে দাঁড়াই, বললে কলিন, তোমার দেরি হবে?
না, এই যাবো আর আসবো।
একা এগিয়ে গেল হেলার। উপর দিকে তাকালো কলিন। তারা জ্বলা আকাশ। জোর বাতাস বইছে যদিও, শীত করছে না। স্যালুনের পেছনে এক কোণে অন্ধকার ছায়ায় অপেক্ষায় রইলো ও, পিস্তলটা পরীক্ষা করে নিলো, তারপর হোলসটারে ঢুকিয়ে রাখলো আলগোছে। সেরাতে হেলারের ওখান থেকে মারভিনের কাছে যায় ও, খবরটা ওয়ারেন রাইডাররা যদি তার কাছেই পেয়ে থাকে, আজও সেরকম কিছু ঘটতে পারে। সাবধানীর মার নেই।
কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু ঘটলো না। পাঁচ মিনিটের মাথায় ফিরে এলো অ্যারন হেলার, এক তোড়া ব্যাংক নোট দিলো
কলিনের হাতে, টাকাগুলো পকেটে রাখলে কলিন।
টাকা দিয়ে কি করবে জানলে ভালো হতো, বিড়বিড় করে বললে অ্যাটর্নি।
একটা জিনিস কিনবো।
এবার কোথায় যাবে?
উত্তরে।
তোমার সঙ্গে আবার কবে দেখা হচ্ছে?
জানি না। সপ্তাহ খানেক পর, কিংবা আগামীকাল, ঠিক নেই। আগাম বলার উপায় নেই।
ওয়ারেনকে ঘায়েল করতে পারলে–
ওকে ঠিকই ঘায়েল করবো, বললো কলিন, তবে আমার নিজের কায়দায়, হেলার। যা হোক, টাকাটার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
অন্ধকারে পা চালালে কলিন, হেলারের দৃষ্টিসীমার বাইরে এসে কোণাকুণিভাবে নদীর দিকে এগোলো। ইতিমধ্যে চাঁদ উঠেছে আকাশে, চারদিকে ম্লান জ্যোৎস্না। নদীর কিনারে গাছ পালার কাছাকাছি পৌঁছুতেই হঠাৎ একটা নড়াচড়া ধরা পড়লো ওর চোখে। থমকে দাড়ালে কলিন। ফাঁকায় বেরিয়ে এলো। একটা ছায়ামুতি। চাঁদের আলো ঝিলিক মারছে তার উদ্যত পিস্তলের ব্যারেলে।
মাথার ওপর হাত তুললো কলিন। লোকটাকে এখানে দেখে দারুণ অবাক ও, মনে হচ্ছে কেউ একটা ঘুসি বসিয়ে দিয়েছে পেটে।
সাবধান, কলিন, বললো ছায়ামূর্তি, গলা শুনে শেরিফ জেফরি আরচারকে চিনতে পারলো কলিন। বাধ্য না হলে তোমাকে গুলি করতে চাই না।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কলিন।
জেফরি, প্রায় অনুনয়ের মতো শোনালো ওর কণ্ঠ, ‘তুমি—
তোমাকে গ্রেপ্তার করছি আমি, বললো আরচার, ওয়ারেনের সঙ্গে একটা অপসরফায় না আসা পর্যন্ত তোমাকে জেলে ভরে রাখব, বেসিনে আরো হত্যাকাণ্ড ঘটুক; আমি চাই না। আজ রাতে যা ঘটলো, এরপর ওয়ারেনের লোকদের সামলে রাখা কঠিন হবে, কথাটা ভালো করে জানো তুমি।
তাহলে ওদের ধরছো না কেন? বললো কলিন, আজকের লড়াইটা কি আমি শুরু করেছি?
তোমাকে গ্রেপ্তার করাটাই সোজা। দশবারোজনকে একসঙ্গে আটকে রাখা আমার সাধ্যের বাইরে। দুঃখিত, কলিন, আমি নাচার।
আমি এ-কথা মানতে পারলাম না, শান্ত কণ্ঠে বললো কলিন, গাছপালার মাঝে আমার ঘোড়া বেঁধে রেখেছি, ছেড়ে দাও, ভাগি।
হ্যারলড ওর মেয়ে-জামাইয়ের ঘোড়াটা এনে দিয়েছে, ঠিক না? আবার ফিরে এসেছে সে? এখন কোথায়?
আবার চলেও গেছে। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো। বাবার একটা খবর জানিয়ে গেল।
আরচার আর কিছু বললো না। মাথা দোলালো। আমার ঘোড়াটা তখন নাওনি, তাই ভাবছিলাম ঘোড়া আবার পেলে কোথায়, তাই এখানে ঢু মারতে এসেছিলাম। নদীর কিনারার গাছপালা আগেও আরো অনেকে পালানোর সময় আড়াল হিসেবে ব্যবহার করেছে; বোঝে তো, শেরিফকে এসব দিকে খেয়াল রাখতে হয়। তোমার পিস্তলটা যে দিতে হয়, কলিন।
ওয়ারেনের সঙ্গে কি রকম সমঝোতার কথা ভাবছো তুমি?
ঠিক বলতে পারছি না। ওয়ারেন লোকটার বিচারবুদ্ধি আছে, একটা উপায় নিশ্চয়ই বের করবে সে। তুমি বেসিনে থেকে যাবার কথা ভাবছে না তো?
থাকতেও পারি।
তাহলে যে কোনো মুহূর্তে তোমার প্রাণের ওপর হামলা হতে পারে, কিন্তু অন্যভাবে ব্যাপারটার সুরাহা করতে চাই আমি।
কলিনকে কাভার করে সামনে এলো আরচার, হাত বাড়িয়ে ওর হোলসটার থেকে একটানে পিস্তলটা বের করে নিলো, ঢোকালে নিজের পকেটে, তারপর পিছিয়ে গেল আবার। তুমি গোলমাল না করায় খুশি হলাম, অস্পষ্ট স্বরে বললো সে। তোমার বাবাকে আমি পছন্দ করতাম, এডিকেও ভালো লাগতো। এখন তোমাদের দু’পক্ষের মাঝখানে পড়ে গিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না, উভয়সঙ্কট অবস্থা। অফিসে যাবার আগে আমার ঘরে কিছুক্ষণ বসবো আমরা, কথা বার্তা বলবো, ম্যড কফি বানিয়ে রেখেছে নিশ্চয়ই, ওর কথা মনে পড়ে?
মাথা দোলালো কলিন, যদিও শেরিফের স্ত্রীর কথা স্পষ্ট মনে নেই। একসঙ্গে শহরের উদ্দেশে পা বাড়ালো ওরা।
বিকেলে সেধে ঘোড়া দিতে চাইছিলে, ধীর কণ্ঠে বললো কলিন, অথচ এখন পাকড়াও করে নিয়ে যাচ্ছ, কেন?
তখন ভেবেছিলাম ঘোড়াটা পেলে চলে যাবে, বোকামি করে ছিলাম, আসলে তুমি যেতে না, ঠিক?
ঠিক, বললে কলিন, মজার কথা কি জানো—
কথা শেষ না করেই শেরিফের দিকে ঘুরলে ও, চোখের পলকে সজোরে ঘূসি কালো তার চোয়ালে, একই সঙ্গে এগিয়ে গেল ওর বাম হাত।
টলে উঠলো আরচার, বাতাসের জন্যে হাঁসফাঁস শুরু করলো। হোলসটার হাতড়ালো, কিন্তু পিস্তল বের করতে পারলো না সে। তার আগেই পরপর আরো দুবার আঘাত হানলো কলিন, চোয়ালে। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল শেরিফ।
আরচারের পিস্তল নিয়ে বেলটে গুজলে কলিন, তার কোটের পকেট থেকে নিজের-টা বের করে পিছিয়ে এলো। গোঙাচ্ছে আরচার, উঠে বসার চেষ্টা করলো সে, পারলো না, আবার চেষ্টা করলো, এবার বসতে পারলে, ফোলা গালে হাত বোলাচ্ছে।
তুমি আমাকে মারলে, কলিন। আজ থেকে যদ্দিন বাচি কাউকে, যদি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি!… কাউকে বিশ্বাস নেই…
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো আরচার।
শান্ত হও, জেফরি, বললে কলিন, অস্থির হয়ো না।
দু’হাতে মুখ ঢেকে নীরবে বসে রইলো শেরিফ।
যাও, মরে গে, অবশেষে ভারি গলায় বললো সে।
দুঃখিত, জেফরি, বললো কলিন, আমার ইচ্ছে অবশ্য অন্য রকম।
দ্রুত ঘোড়ার দিকে পা বাড়ালো ও।
১১. পুব বরাবর এগোলে কলিন ফোর্বস
পুব বরাবর এগোলে কলিন ফোর্বস, শহর থেকে খানিকটা দূরে এসে ঘোড়া ঘুরিয়ে নদীর সমান্তরালে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে চললো, একটানা কয়েক মাইল এভাবে গেছে পথটা। নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে ঠিক তার আগে একটা শাখা পথ বেরিয়ে একেবেঁকে চলে গেছে উত্তরের পাহাড়সারির দিকে, ওটা ধরে ওয়ারেন স্মিথ আর গ্রেবার র্যাঞ্চে যাওয়া যায়।
রাত, তবু সামনে প্রায় আধ মাইল পর্যন্ত পরিষ্কার দৃষ্টি চলে, বিপদ এলে আগেই টের পাওয়া যাবে। এত রাতে শহরমুখী কারু সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তারপরও সতর্ক থাকা ভালো। জেফরি আরচারের কাছে ভালো শিক্ষা পাওয়া গেছে : অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বড় খারাপ জিনিস।
শেরিফকে মারধোর করে অস্বস্তি বোধ করছে কলিন। কিন্তু কি করা, উপায় ছিলো না। আরচার লোকটা নিপাট ভদ্রলোক, সাহসী। অন্য কারো বেলায় যা স্বাভাবিক ছিলো; ওয়ারেনের পক্ষাবলম্বন, করেনি সে, নিজের স্বাধীনতা বজায় রেখেছে, আইনকে তার স্বাভাবিক ধারায় চলতে দিয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করতে যায়নি। অবশ্য আজকের অঘটনের পর ওর সম্পর্কে অবিশ্বাস্য কোনো অভিযোগও যদি সে বিশ্বাস করে বসে অবাক হবে না কলিন। নিজেই শেরিফকে ওয়ারেনের দিকে ঠেলে দেয়ার ব্যবস্থা করে এসেছে।
পাইপে তামাক ভরার জন্যে ঘোড়া থামালো কলিন, পর মুহূর্তে আড়ষ্ট হয়ে গেল হঠাৎ, ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকালো। একাধিক ঘোড়ার ছুটন্ত খুরের শব্দ, এগিয়ে আসছে। ঝটপট রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমে এলো কলিন, এখানে ওখানে শুয়ে রস একপাল গরুর মাঝে ঢুকে পড়লো। আবার লাগাম টেনে দ্রুত স্যাডল থেকে নেমে হাটু গেড়ে বসে পড়লো, লাগামটা ধরা রইলো হাতে। রাস্তা থেকে একপাল গরুর মাঝে দাঁড়ানো জিন চাপানো ঘোড়াটা ওদের চোখে নাও পড়তে পারে, অশান্বিত মনে ভাবলে কলিন।
আরো কাছাকাছি এলো ঘোড়াগুলো। ধীরে সুস্থে এগোচ্ছে সওয়ারীরা, বুঝতে পারলো কলিন। দৃষ্টিসীমায় এলো অশ্বারোহীরা, দুজন, সহজ ওদের এগোনোর ভঙ্গি, f° তে কষ্ট হলো না ওর। বেলিনডা গ্রেবার এবং ডেভিড স্পেক্টর। ওর দিকে তাকালো না, চলে গেল আপন পথে।
উঠে দাড়ালো কলিন, আবার স্যাডল চাপলো, হঠাৎ কি ভেবে দ্রুত এগোলো ওই দু’জনের উদ্দেশে। রাতে শহরে মায়ের কাছে থাকবে বলেছিলো বেলিনড, সাপারের নিমন্ত্রণ করেছিলো ওকে, স্পষ্টতই ওকে হোটেলের বারান্দা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। কলিন ওর আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেয়ায় মত পাল্টে এখন র্যাঞ্চে ফিরে যাচ্ছে বোধ হয়।
ওর ঘোড়ার খুরের শব্দে একসঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকালো বেলিনডা আর স্পেক্টর, ঘোড়া থামালে সাথে সাথে। চোখের পলকে হোলসটারের দিকে হাত বাড়ালো স্পেক্টর। তাকে কি যেন বললো বেলিনডা, হাত সরিয়ে আনলো সে। রাশ টেনে ঘোড়া থামিয়ে মাথা থেকে টুপি নামিয়ে অভিবাদন করলো কলিন। চোখ। কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে বেলিনডা, মনে হলো ওর, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলো না। টুপির কিনারার নিচে এক রকম অদৃশ্য ওর চোখজোড়া।
তুমি কোত্থেকে এলে? সোজাসাপ্টা জানতে চাইলে বেলিনা।
রাস্তার ওপাশে ছিলাম।
ওত পেতে? বেলিনডার কণ্ঠে অভিযোগ, বুঝেও না বোঝার ভান করলে। কলিন।
না, তোমাদের ঘোড়ার আওয়াজ পেয়ে সরে গিয়েছিলাম, প্রথমে চিনে উঠতে পারিনি কিনা।
এতক্ষণে, বললে বেলিনডা, ইচ্ছে করলে বেসিন ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে পারতে, অথচ যাওনি, কেন?
কারণ বেসিনেই থাকছি আমি,বললে কলিন, আর কোনো প্রশ্ন?
হঠাৎ সামনে ঝুঁকে এলো বেলিনডা। আচ্ছা, বলতে পারো, আজ আরেকটা খুন করে কি লাভ হলো? তুমি না থাকলে কি ঘটতো এটা? এভাবে একের পর এক খুন করে কোন ফায়দা লুঠতে চাও? এ কেমন মানুষ হয়েছে। তুমি?
বেলিনডার কথায় ক্ষুব্ধ হলো কলিন, কিন্তু রাগ প্রকাশ করলো না।
আমার অপরাধটা কোথায়, বেলিনডা? ইচ্ছে করে কাউকে হত্যা করেছি আমি? আমি এখানকার লোক নই? আর সবার মতো বেসিনে বসবাস করার অধিকার নেই আমার? আমি কেন ডেভিড স্পেক্টরের মতো নিশ্চিন্তে ওয়াগোনারের রাস্তায় হাঁটতে পারবে। না?
এটা কোনো যুক্তি হলো না।
হলো না? ওয়াগোনারের আজকের ব্যাপারটার কথাই ধরো, দোষটা কি আমার ছিলো?
লোকে বলাবলি করছে পুরোনো বিরোধ জিইয়ে রাখাই তোমার বেসিনে আসার উদ্দেশ্য।
তার প্রয়োজনও হতে পারে—
কেন?
অনেক কারণেই—
ঠিক আছে, ঝাঁঝের সঙ্গে বললো বেলিনডা, ধরে নিলাম প্রয়োজন হলো, তারপরও, মানুষ হত্যাকে কি তোমার খুব ভালো কাজ বলে মনে হয়?
চাক কনারসকে শখে মেরেছি ভাবছো নাকি?
জানি না। হ্যাঁ অথবা না, দুটোই হতে পারে, কিন্তু আসল কথা লোকটা মারা গেছে। তুমি যতক্ষণ এখানে আছে। খুনোখুনি চল বেই, ঠেকানো যাবে না।
সেজন্যে লেজ তুলে পালাতে হবে আমায়।
হ্যাঁ।
ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে দেখছে না তুমি, বেলিনডা। আসলে মনে মনে চাইলেই সব অন্যায় অসুন্দর ভেসে যায় না, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে লড়াই করতে হয়, তোমাকে তোমার বিশ্বা সের পক্ষে দাঁড়াতে হবে: আচ্ছা, তুমি আরনেস্ট হলকে চিনতে? আমাদের র্যাঞ্চে ছিলো?
হ্যাঁ। সে তো কাজ ছেড়ে চলে গেছে।
না মারা গেছে ও। প্রীংগারভিলে যাবার পথে হত্যা করা হয়েছে ওকে। ওর সঙ্গে আমাদের আরো সাতজন লোক প্রাণ দিয়েছে। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে ওদের।
আমি-আমি-এ-কথা তো জানতাম না। কিন্তু তার সাথে ওয়ারেনের কি
ক্লাইভ কাসলারকে জিজ্ঞেস করে দেখো।
ক্লাইভ?
চেনো না?
চিনি! আমি-কলিন, ঠিক কি বলতে চাইছো?
মাথা নাড়লো কলিন। ক্লাইভকেই জিজ্ঞেস করে।
যদি দেখা হয়—
থেমে গেল বেলিনডা, হঠাৎ ভয়ের ছায়া পড়লে চেহারায়, যেন বুঝে গেছে ভয়ঙ্কর কোনো কথা শুনতে হবে।
বেলিনডা, বললো কলিন, আগামীকাল রাতে তোমাদের ওখানে সাপার খেতে যাবো বলেছিলাম, তা বোধ হয় পয়ারবো না। অন্য একদিন আসলে হয় না?
মাথা দোলালো বেলিনডা, কিন্তু ও কি বলতে চায় বুঝতে পারছে কিনা ধরতে পারলো না কলিন।
বলো তো, কলিন, জানতে চাইলে বেলিনডা, তোমার আসল ইচ্ছেটা কি?
এই একটা কথাই জানতে চাইছে সবাই, বললো কলিন, আমার জবাবও একটাই। জানি না। ও হ্যাঁ, তোমার ঘোড়াটা লিভারি আস্তাবলে আছে।
হুয়ান এরপর ওয়াগোনারে গেলে ছাড়িয়ে নেবে, বললে ডেভিড স্পেক্টর। অসলারকে বলে রেখেছি হুয়ান গেলে যেন ঘোড়াটা ওকে দিয়ে দেয়। কালই ওয়াগোনারে যেতে পারে সে। তোমার ঘোড়াটা কোথায় ছেড়ে দিয়ে এসেছে জিজ্ঞেস করে জেনে রাখবে।
কথা বলার আগে এতক্ষণ কান খাড়া করে ওদের কথা শুনছিলো ডেভিড স্পেক্টর, কাসলারের প্রসঙ্গ উঠতেই বিড়বিড় করে কি যেন বলেছে সে, লক্ষ্য করেছে কলিন, কাসলারকে বোধ হয় পছন্দ করে স্পেক্টর, ভাবলো ও।
তোমাকে সাহায্য করতে পারলে খুশি হতাম, বললে বেলিনডা, কোনো সমস্যাই সমাধানের অতীত নয়, এই ব্যাপারটার সুরাহা করার কাজে কোনোভাবে যদি তোমাকে সাহায্য করতে পারতাম।
সুযোগ আসতেও পারে, বললো কলিন। যাক গে, একদিন তোমার বাড়ি আসবো আমি, বেলিনদাঁ, তখন কথা হবে।
সামনে ঝুঁকে বেলিন্ডার হাতে মৃদু চাপ দিলে কলিন, তারপর ডেভিড স্পেক্টরের উদ্দেশে হাত নেড়ে ঘোড়া ঘুরিয়ে ছুটলো।
কিছুক্ষণ পশ্চিমে এগিয়ে রাস্তা ছেড়ে একটা অনুচ্চ টিলার আড়ালে এসে ঘোড়া থামালো ও, আবার পাইপ বের করে তামাক ভরা শুরু করলো। বেলিনডার প্রতি প্রসন্ন কলিন, সন্তুষ্ট বুড়ো ডেভিড স্পেক্টরের প্রতি। ডেভিড স্পেক্টরের মনটা আসলে, ভাবলো ও, কোমল, সেটা আড়াল করতেই চেহারা অমন রুক্ষ করে রাখে। বেলিনডাও নরম মনের মেয়ে, হানাহানি রক্তপাত চায় না। তবে সম্ভবত এবার নতুন করে ভাবতে শিখবে ও।
কিন্তু হঠাৎ মনে পড়লো কথাটা। হেলার বেলিনডার প্রতি কাসলারের দুর্বলতার কথা বলেছিলো। কতখানি দুর্বল সে? ভাবলে কলিন, বেলিনডাই বা কোন চোখে দেখে তাকে? ধেৎ, বেলিনডার মতো মেয়ে খুনেডাকাত কাসলারকে কিছুতেই ভালো বাসতে পারে না!
পাইপটা পরিষ্কার করতে হবে, তেতো লাগছে তামাকের ধোঁয়া, কেমন একটা দুর্গন্ধ!
পাইপ থেকে ছাই ঝাড়লো কলিন। বার কয়েক থুতু ফেললো। তারপর আবার রাস্তার দিকে এগোলো। বেলিনডার প্রশ্নের উত্তরে সত্যি কথা বলেনি ও। হ্যারলড ওর সঙ্গীদের নিয়ে ফিরে আসার আগে একটা কাজ করতে যাচ্ছে কলিন। ঝুঁকিবহুল কাজ, কিন্তু পুরো সপ্তাহটা টিকে থাকাও তো অনিশ্চিত!
রাস্তায় এসে উত্তরে বাঁক নিলো, কলিন। বেলিনডা আর ডেভিড স্পেক্টর যেদিকে গেছে সেদিকে এগোলো। বেলিনডারা বড়জোর মিনিট বিশেকের পথ এগিয়ে আছে, তাই তাড়াহুড়ো করলো না কলিন, ওদের অতিক্রম করতে চায় না। রাস্তাটা যেখানে বীর ক্রীক অতিক্রম করেছে সেখানে পৌঁছে পানিতে নেমে গেল কলিন, অগভীর ক্রীকের বালুময় তলদেশ ধরে এগোলো। লিনডা ওয়া রেনের কথা ভাবছে মনে মনে, ক্যানসাস সিটির জাঁকজমক আর কোলাহল থেকে বঞ্চিত মেয়েটা, পাঁচশো ডলার পেলে আবার ফিরে যাবার কথা বলেছিলো, ওয়ারেনের কবল থেকে বাঁচতে চায় সে।
হেলারকে ধন্যবাদ। পাঁচশো ডলার পাওয়া গেছে তার কল্যাণে।
বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো কলিনের ঠোঁটে। লিনডাকে ক্যানসাস। সিটিতে যেতে সাহায্য করে ওয়ারেনের আঁতে ঘা দেবে ও।
জিম হ্যাগারটি, সিনডিকেটের প্রেসিডেন্ট, একবার প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলো : লড়াইয়ের কৌশল মাত্র একটা, যতক্ষণ সম্ভব লড়াই থেকে দূরে থাকবে, কিন্তু লড়াই যদি করতেই হয়, হাতের কাছে যা পাবে, যত তুচ্ছ হোক, অশোভন হোক, তাই দিয়ে আঘাত করবে প্রতিপক্ষকে, প্রথম সুযোগেই তাকে দিশেহারা করে দিতে হবে, সামলে ওঠার সুযোগ যেন না পায়, পরাস্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগত আঘাত হেনে যাও; লড়াই মানেই লড়াই, এখানে ভদ্রতার স্থান নেই, প্রয়োজনে হীন কৌশল গ্রহণেও পিছপা হবে না, লড়াই শেষ হওয়ার পর ভদ্রতা দেখানোর প্রচুর সুযোগ মিলবে।
জিম হ্যাগারটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। লড়াই মানেই নোংরামি। তুমি যদি প্রতিপক্ষকে টলাতে না পারো, সে তোমাকে ছাড়বে না, পরাজয় মেনে নিতে হবে তোমাকে। এই মুহূর্তে নিরস্ত্র অবস্থা ওর, তারপরও ওয়ারেনকে বেসামাল করে দেয়ার একটা চেষ্টা চালানো যায়!
স্প্রীংগারভিল ট্রেইলে ফোর্বস র্যাঞ্চ রাইডারদের পরিণতি ওর জানা, হেলারের কাছে খবরটা পেয়ে চমকে উঠবে ওয়ারেন। বেলিনডা আরনেস্ট হল সম্পর্কে ক্লাইভ কাসলারকে প্রশ্ন করলে আরেকটা ধাক্কা খাবে ওরা; তারপর ও যদি ক্যানসাস সিটিতে যেতে লিনড ওয়ারেনকে সাহায্য করে, প্রচণ্ড আঘাত লাগবে ওয়ারেনের মর্যাদায়। সন্দেহ নেই তাল হারিয়ে ফেলবে সে।
আবার যখন ঘোড়া থামালে কলিন, মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। বেসিনে আসার পর প্রথম রাত কাটানোর জায়গাটিতে, ওয়ারেন র্যাঞ্চের কাছে, ক্ৰীকের ধারে গাছপালার আড়ালে এসে পড়েছে ও। স্যাডল থেকে নেমে ঘোড়া বাধলো কলিন। তারপর রাঞ্চের দালানগুলোর দিকে তাকালো। আলো নেই কোথাও। সবাই ঘুমাচ্ছে বোধ হয়। ঘুমাক যত ইচ্ছে। একাকী এই মুহূর্তে হামলে পড়ার পরিকল্পনা নেই ওর, অতটা নির্বোধ ও নয়।
স্যাডলের পেছন থেকে প্রথমে বিছানা নামালে কলিন, তার–পর খসালো স্যাডলটা। মাটিতে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লো। পাতার ফাঁকে তারা দেখা যাচ্ছে, জ্বলজ্বল করছে। পাহাড়ের ওপাশে আর্তনাদ করে উঠলো একটা কয়োটে, জবাব দিলো আরেকটা। ঝিরঝির বাতাস বইছে। চোখ বুজলে কলিন, কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেয়া যাক। রাতে কেউ বিরক্ত করবে না আশা করা যায়। সকালেও কারো এখানে আসার সম্ভাবনা নেই। কেন আসবে? ওয়ারেন রাঞ্চের নাকের ডগায় ক্যামপ করেছে ফোর্বস, ভাবতেও পারবে না ওরা।
পাশ ফিরে শুলো কলিন, সকালের কথা ভাবছে। সূর্য ওঠার পর ওয়ারেনের রাইডাররা বেরিয়ে পড়বে, শহরের দিকে যাবে একদল, দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে কেউ। এবং ওর খোঁজে যাবে একটা দল। এই সুযোগে হয়তো লিনডার সঙ্গে দেখা করতে পারবে ও। নইলে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সুযোগের সন্ধানে। তার আগেই ওদের চোখে ধরা পড়ে গেলে কেটে পড়বে।
আবার চিত হয়ে শুলে কলিন, একটু পরেই তলিয়ে গেল ঘুমে। ভোর হওয়ার আগেই ঘুম ভাঙলো, উঠে পড়লো ও। হ্যারলডের মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া সেই বাকস থেকে ঠাণ্ডা খাবার দিয়ে নাশতা সারলো। তারপর দ্রুত পালানোর সুবিধের কথা ভেবে ঘোড়ার পিঠে স্যাডল চাপিয়ে রাখলো।
এবার অপেক্ষার পালা।
ওয়ারেন র্যাঞ্চ জেগে উঠলো ধীরে ধীরে। উঠোন থেকে সমবেত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। বাংক হাউস, র্যাঞ্চ হাউস আর কোরালে যাওয়া আসা করছে রাইডাররা। খাবারের ঘণ্টা বাজার বেশ আগেই ঘোড়ার পিঠে জিন চাপালো কয়েকজন। বাকিরা নাশতা শেষ হওয়ামাত্র ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলো। কয়েক মুহূর্ত পর ওয়ারেনের নেতৃত্বে এগারোজনের একটা দল শহরের পথ ধরলো। বিলও আছে ওই দলে, ঢ্যাঙা কাঠামো দেখে লুইস প্যাটেনকে চিনতে পারলো কলিন। কিন্তু ওদের প্রতি তেমন আমল দিলে না ও।
এখনো দুটো জিন চাপানো ঘোড়া দেখা যাচ্ছে কোরালে। তার মানে কমপক্ষে দু’জন রাইডার রয়ে গেছে, বেশিও হতে পার। এরাও হয়তো একটু পর বেরিয়ে যাবে। দেখা যাক।
আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। একটা লোককে বাংক হাউসের দিকে যেতে দেখলো কলিন। কয়েক মিনিট পর কোরালের দিকে গেল আরেকজন, দুহাতে দুটো বাকেট, ঘোড়ার খাবার নিয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। কোরালে ঢুকে ফীডিং-ট্রাফে বাকেট খালি করলো সে, তারপর বেরিয়ে এসে বাংক হাউসের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ডাকলো, ডেকস, অ্যাই ডেকস। জবাব পেলো কিনা বুঝতে পারলো না কলিন। কোণাকুণিভাবে আস্তাবলের দিকে পা বাড়ালো লোকটা।
আরো আধ ঘণ্টা কাটলো। এর মধ্যে খড় নিয়ে আগের লোক টাই আরো একবার কোরালে গেছে। একটা লোক, ঝোলানো কঁধি তার, পরনে অ্যাপ্রন, তার মানে বাবুর্চি, বাড়ির একপাশের একটা দরজা গলে বাইরে এলো, কাপড় শুকাতে দিয়ে আবার ঢুকে পড়লো ভেতরে।
নিভে যাওয়া পাইপে টান দিলো কলিন ফোর্বস, দাতের ফাঁকে চেপে ধরে রেখেছে ওটা।
বিরক্তির সঙ্গে জিন চাপানো ঘোড়া দুটোর দিকে তাকালে কলিন। ঘোড়ায় চেপে ওই দু’জনের বেরিয়ে যাবার কথা, অথচ কোনো আলামতই নেই, দেখে শুনে ওদের বাইরে যাবার ইচ্ছে আছে বলেও মনে হচ্ছে না। এখনো তিনজন লোক আছে র্যাঞ্চে, আরো বেশিও হতে পারে; বাবুচি, বাংক হাউসে একজন–ব্যাটা এখনো বেরোয়নি, করছেটা কি?–আরেকজন সকাল থেকে নানা কাজে ব্যস্ত, বার্নের পুব পাশে মুরগীকে খাবার দিচ্ছে এখন! মুরগীগুলোকে খাইয়ে তারপর বেরোবে? খোদাই জানেন!
হামাগুড়ি দিয়ে কয়েক গজ পিছিয়ে এলো কলিন, উঠে দাড়ালো, আড়মোড়া ভেঙে হাত পায়ের খিল ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। পিস্তল বের করে পরখ করলো ও। এভাবে চলতে থাকলে সারা সপ্তাহতেও লিনডার সঙ্গে দেখা করা যাবে না। র্যাঞ্চে মোট তিনজন আছে, আবার ভাবলো কলিন। বাংক হাউসে একজন–বিশ্রাম নিচ্ছে নয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত, উঠোনে এটা ওটা করছে একজন; আর বাবুচি নিশ্চয়ই কিচেনে। তিনজন। বেশি হতে পারে। সম্ভাবনা কম।
উঠোনটা পরিষ্কার নজরে আসে এমন জায়গায় এসে দাড়ালো কলিন। মুরগীকে খাইয়ে এবার বানে যাচ্ছে লোকটা। আস্তাবলে ঢুকলো সে। সময় গুণে চললো কালন। পাঁচ মিনিট। দশ। আর বেরিয়ে এলো না লোকটা।
এখান থেকে র্যাঞ্চ হাউসের দুরত্ব বড়জোর পঞ্চাশ গজ। পঞ্চাশ কদম। অধি মিনিটেরও কম সময়ে এই দূরত্বটুকু পেরোনা যায়, তারপর আর ছ’সাত পা এগোলেই ওই দরজাটা, ওটা গলে মেস হল আর কিচেনে ঢুকে পড়া যাবে অনায়াসে। বাবুর্চি অসতর্ক অবস্থায় থাকবে, তাকে সামলানো সমস্যা হবে না।
সমস্যা একটাই, র্যাঞ্চ হাউসে পৌঁছুনোর আগেই বাংক হাউস বা বার্ন থেকে যদি ওদের কেউ বাইরে তাকায়! মাত্র আধ মিনিট সময় দরকার। নাও তাকাতে পারে। পরিস্থিতি মোটামুটি অনুকূল। লম্বা একটা দম নিলে কলিন, ফাঁকায় বেরিয়ে এলো, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে র্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোলো।
কারো চিৎকার বা পিস্তলের আওয়াজ পাওয়া গেল না। র্যাঞ্চ হাউসে পৌঁছে দেয়ালঘেষে এগোলে কলিন, দরজাটার কাছে এসে পড়লো। আধ খোলা দরজা, কবাটে ধাক্কা দিয়ে আরেকটু ফাঁক করলো ও, তারপর পা রাখলে খালি মেসহলে। রান্নাঘরে গুনগুন করে জনপ্রিয় গানের সুর ভাজছে কেউ একজন। লিনডা? রান্না ঘরের দরজায় এসে উঁকি দিলো কলিন, বাবুর্চি আলু কাটছে আর গান গাইছে। ওর কোমরে পিস্তল দেখলো না কলিন, আপনমনে কাজ করছে।
বাবুর্চিকে বিরক্ত না করে ভবনের মূল অংশের দিকে পা বাড়ালো কলিন। একটা নাতিপ্ৰশস্ত ডাইনিং রুম হয়ে পারলারে এলো ও, কেউ নেই, জানালায় পর্দা টানানো। লিনডা কোথায়? এখনো ঘুমে? লিনডার শোবার ঘর চেনা, সেদিকে এগোলে। কলিন। দরজা খুলে ভেতরে তাকালো।
বিছানাতেই পাওয়া গেল লিনডাকে, জেগেই আছে, উবু হয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ছে।
হ্যালো, লিনডা, আস্তে করে বললো কলিন। চমকে সোজা হয়ে বসলো লিনডা।
তুমি। ঢোক গিলে বললো সে।
হ্যাঁ। আবার এলাম।
ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে চৌকাঠের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাড়ালে কলিন। দাড়ি কামিয়েছে সেই গতকাল সকালে, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে ধুলো মলিন পোশাক, কেমন দেখাচ্ছে খোদা মালুম। অবশ্য পুরুষের এ-চেহারা লিনডার অপরিচিত নয়। কাউবয়রা প্রতিদিন শেভ করে, এমন ঘটনা বিরল।
তোমাকে এখানে পেলে ঠিক খুন করে ফেলবে। ফাঁসফেসে গলায় বললো লিনডা। নিজেকে সামলে নিয়েছে সে ইতিমধ্যে, আঙুল দিয়ে একগোছা চুল প্যাচাচ্ছে। কি বললাম শুনেছো? জানতে চাইলো এবার।
নিশ্চয়ই, বললে কলিন, কিন্তু তার আগেই আমরা পালাচ্ছি।
আমরা? বিস্ফারিত চোখে তাকালো লিনডা।
কেন নয়? বললো কলিন, পাঁচশো ডলার জোগাড় করার কথা বলেছিলে না? টাকা নিয়েই তো এসেছি।
পকেট থেকে টাকার বানডিলটা বের করলো কলিন, ছুড়ে ফেললো বিছানায়।
হাত বাড়াতে গিয়েও থমকে গেল লিনডা, এক ঝটকায় সরিয়ে নিলো হাতটা। আমি–কোথায় পেলে এত টাকা?
ভয়ের কিছু নেই, বললো কলিন, চুরি করিনি। তোমার ইচ্ছে পূরণ হতে যাচ্ছে এবার, কি বলো? ক্যানসাস সিটিতে ফিরে যাওয়া এখন আর সমস্যা নয়।
ঝিম মেরে বসে রইলো লিনডা, আঙুলের বিয়ের আঙটিটা ঘোরাতে লাগলো আনমনে।
সেদিন আসলে কথার কথা বলেছিলাম, কিন্তু এখন হাত দুটো এক করে কোলের ওপর রাখলে লিন, এখন পালানো ছাড়া গতি নেই আমার। নইলে ওরা–
কি করবে, লিনডা?
থাক, এই প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই না। কিভাবে যাবো, বলো?
র্যাঞ্চে এখন মোট কজন আছে?
বাবুর্চিকে ধরলে তিনজন।
তোমাকে আটকানোর চেষ্টা করবে ওরা?
হ্যাঁ, করবে। কারণ আমার ঘর ছেড়ে বের হওয়া নিষেধ।
লিনডা হঠাৎ পালানোর জন্যে খেপে উঠেছে কেন বোঝার চেষ্টা করলো কলিন। কিন্তু এখন জিজ্ঞেস করার সময় নেই। দরজা খোলার অস্পষ্ট শব্দ পেয়েছে ও। চরকির মতো ঘুরলো কলিন। লম্বা, চওড়া কাঁধঅলা এক তরুণ, বাংক হাউসে ঢুকেছিলো যে, পারলারে পা রাখছে।
শোবার ঘরে ঢোকার আগে টুপি খুলে ফেললে লোকটা। মিসেস ওয়ারেন, তার কণ্ঠে উদ্বেগ, একটা কথা ছিলো।
চোখের আড়ালে যাবার ফুরসতই পেলো না কলিন। দাড়িয়ে রইলো লোকটা কখন ওকে দেখবে তার অপেক্ষায়। সতর্ক।
শোবার ঘরের দরজার দিকে ঘুরলে লোকটা, বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলে তার চোখ, টুপি ফেলে পাগলের মতো পিস্তলের দিকে হাত বাড়ালো।
সে পিস্তল তুলে আনতেই ড্র করলো কলিন, টিপে দিলো ট্রিগার। ওর কাঁধের পাশ দিয়ে সই করে গিয়ে দেয়ালে বিধলে প্রতিপক্ষের বুলেট। ঝট করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো কলিন, ফের গুলি করার জন্যে প্রস্তুত। কিন্তু দীর্ঘদেহী গানম্যান যেন বাতাসে ঝুলছে এখন, অনড়, ছাদের সঙ্গে অদৃশ্য সুতোয় যেন বেঁধে দিয়েছে কেউ। এক মুহূর্ত। পায়ের পাতার ওপরই আধপাক ঘুরলো সে, তারপর আচমকা যেন ছিড়ে গেল অদৃশ্য সুতো, দড়াম করে মেঝেতে আছড়ে পড়লো।
আর্তনাদ করে ছুটে এলো লিনডা। টমি। টমি! মৃত গান ম্যানের পাশে বসে পড়লো, কান্নার মতো শব্দ বেরিয়ে আসছে তার গলা চিরে।
রান্নাঘর থেকে রাইফেল বাগিয়ে ঝড়ের বেগে তেড়ে এলো বাবুচি ছোড়া। সাথে সাথে তাকে কাভার করলো কলি।
ফেলে দাও ওটা, রাইফেলের দিকে ইঙ্গিত করে বললো কলিন। এক চুল নড়বে না! মাথার ওপর তোল দুই হাত।
বারান্দায় পায়ের আওয়াজ। একটা ছায়া সরে গেল দরজা থেকে। ঝট করে তাকালে কলিন। কেউ নেই। অন্য লোকটা বোধ হয়, আন্দাজ করলো ও। দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু দোরগোড়ায় পৌঁছুনোর আগেই ওয়াগোনারের দিক থেকে তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এলো। মানে পরিষ্কার। তৃতীয় লোকটা সাহায্যের আশায় দ্রুত কেটে পড়েছে। বাইরে তাকালো কলিন। অপস্রুয়মান একটা ঘোড়ার স্যাডলে ঝুঁকে থাকা সওয়ারীর কাঠামো দেখতে পেলো।
আবার বাবুর্চির দিকে চোখ ফেরালে কলিন ফোর্বস। মাথার ওপর হাত তুলেই দাড়িয়ে আছে, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে, ভীত। লিনডার দিকে তাকালো কলিন। নিহত কাউহ্যানডের পাশেই বসা সে।
পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠলো কলিনের, মনে হলো বমি করে দেবে। দ্রুত কয়েক বার নিঃশ্বাস নিলো ও। একটু ভালো লাগলো তাতে। আবার একটা খুন করলো ও, হত্যা করতে বাধ্য হলো।
এখন আর ওর পক্ষে সরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।
১২. স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবুর্চি
স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবুর্চি, তার কাছে এসে মাটি থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখলো কলিন।
কি নাম? জানতে চাইলো ও।
জর্জ উইলসন।
বেশ। জর্জ, যাও, ওই ওদিকে ক্ৰীকের ধারে গাছপালার মাঝে আমার ঘোড়া রেখে এসেছি, চট করে নিয়ে এসো। সাবধান, কোনো কুমতলব যেন মাথায় না খেলে, আমার নিশানা সাধারণত ভুল হয় না।
এখুনি আনছি, মিসটার ফোর্বস, বললো বাবুর্চি।
দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।
নিহত গানম্যানের নিথর দেহের পাশে এখনো বসে লিনডা, এবার ওর কাছে এলে কলিন। কাধ ধরে লিনডাকে টেনে তুললো। কঁপছে মেয়েটা থরথর করে, নিজেকে সামলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
আমি দুঃখিত, লিনডা, আন্তরিক কণ্ঠে বললো কলিন, ইচ্ছে থাকলেও, অনেক সময় এইসব এড়ানো সম্ভব হয় না। কে ও? বিশেষ কেউ?
না, তবে এখানকার অনেকের চেয়ে ভালো ছিলো। একমাত্র ওর কাছেই নিরাপদ বোধ করতাম।
অন্যদের ভয় পেতে, কেন?
আসলে এতদিন কাউকেই ভয় লাগতো না–কিন্তু সেদিন থেকে–
সেদিন থেকে মানে?
মাথা নেড়ে পিছিয়ে গেল লিনডা। এ-প্রসঙ্গে আমি কিছু বলতে চাই না। এখান থেকে কিভাবে পালাবে সেটা বলো তুমি।
সোজা ওয়াগোনারের পশ্চিমে স্টেজ লাইনে চলে যাবো আমরা।
পারবে না।
পানির মতো সহজ, বললো কলিন। প্রথমে ইউনিটাহ পাসের দিকে যাবে, তারপর অন্ধকার হলেই দক্ষিণে বাঁক নিয়ে স্প্রীংগারভিলের রাস্তা ধরবো, কেউ পিছু ধাওয়া করলেও ভাববে পাসের দিকেই যাচ্ছি আমরা, সারারাত সেদিকেই চলতে থাকবে তারা।
যদি ধরা পড়ে যাই?
পড়বো না। রবার্ট ওয়ারেনকে তুমি চেনো না, কলিন। কেন সে এত সতর্ক জানো না। কোনোমতেই আমাদের পিছু ছাড়বে না সে।
ওয়ারেন এত সতর্ক কেন?
আতঙ্কে।
কিসের?
জবাব দিলো না লিনডা, সঙ্গে নিতে টুকটাক জিনিস গোছাতে ঘরে চলে গেল। বারান্দায় এসে দাঁড়ালে কলিন ফোর্বস, অস্থির বোধ করছে। কি বলতে চাইলে লিনডা? রবার্ট ওয়ারেন আতঙ্কিত? কেন? স্প্রীংগারভিল হত্যাকাণ্ড জানাজানি হবার ভয়?
প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলো লিনডা।
তৈরি? জানতে চাইলে কলিন।
এ-জন্যে তোমাকে না। আবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়, মৃদু গলায় বললো লিনডা। রবার্ট তোমাকে সহজে ছাড়বে না।
এমনিতেও আমাকে ছাড়বে না সে, বললো কলিন।
কলিনের-টাসহ দুটো ঘোড়ার লাগাম ধরে অপেক্ষা করছে বাবুর্চি। লিনডার কাছ থেকে ব্যাগটা নিলে কলিন, বেশ ভার, ব্যাগটা লিনডার ঘোড়ার স্যাডলের পেছনে বাঁধিলো, রেকাবের ঝুল ঠিক করে দিলো। এক পাশে সরে দাড়িয়েছে বাবুর্চি, ভীত দৃষ্টিতে দেখছে ওকে। লিনডা ঘোড়ায় উঠে বসলে কলিনও স্যাডলে পলল, ফিরে তাকালো বাবুর্চির দিকে। জর্জ, বললেও, ওয়ারেন আসার পর কিছুই গোপন করো না ওর কাছে। সব বলবে। তবে তার আগেই কেটে পড়া তোমার জন্যে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ওপর-নিচ মাথা দোলালো বাবুর্চি, কথা ফুটলো না মুখে।
উত্তর-পশ্চিমে রওনা হলো। ওরা। বেসিনের পশ্চিম সীমান্তে, প্রায় একদিনের দুরত্বে প্রীংগারভিল রোডের একটা শাখা ইউনিটাহ পাসে এসে যোগ হয়েছে। ট্রেইল অনুসরণ করলেও ওদের গন্তব্য আঁচ করতে পারবে না ওয়ারেন। তবে ওদের ট্র্যাক সোজা ইউনি টাহ পাস রোডের দিকে গেছে দেখার পর নিশ্চিন্তে ধরে নেবে ওখানেই যাচ্ছে ওরা। ফলে অন্ধকার হওয়ার পর, আশা করা যায়, ট্রেইল না দেখে আন্দাজেই সেদিকে এগিয়ে যাবে সে।
মাঝে মাঝে ঘোড়া দুটোকে বিশ্রাম দিতে যাত্রাবিরতি করতে হচ্ছে। কাল সকালে প্রথম কাজ হলো লিনডাকে বিদায় করা।
একটা ঘোড়া অচল হলেই দারুণ বিপদে পড়ে যাবো আমরা, লিনডাকে বললো কলিন। আমাদের ধরতে ঊধ্বশ্বাসে ধেয়ে আসবে ওয়ারেন রাইডাররা। ওদের এক আধটা ঘোড়া অচল হয়ে পড়লেও ক্ষতি নেই, কিন্তু আমাদের দুটো ঘোড়ার একটা অচল হলে দুজনকে একটা ঘোড়ায় চাপতে হবে। তারপর কি হবে বুঝতেই পারো।
কিন্তু আমাদের দ্রুত এগোতে হয় যদি?
ওরা খুব কাছাকাছি এসে পড়লে তা করতে হবে বৈকি। ধরা পড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই, লিনডা।
কাল সকালে তুমিও চলো না আমার সঙ্গে?
না, ধন্যবাদ। এখানে আমার অনেক কাজ।
কি রকম?
কবর খোড়া।
কবর! তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকালে লিনডা।
হ্যাঁ, কবর। স্প্রীংগারভিল ট্রেইলে কয়েকটা কবরের খোঁজ পাওয়া গেছে, ওগুলো খুড়তে হবে। আচ্ছা, তুমি জানো, মাস দুয়েক আগে ওয়ারেনের কিছু রাইডার বাইরে কোথাও গিয়েছিলো কি না?
মুখ ফিরিয়ে নিলো লিনডা। বলতে পারবো না!
ক্লাইভ কাসলারকে চেনো তুমি?
চিনি।
ওয়ারেন র্যাঞ্চেই আছে এখনো?
সকালে সবার সাথে সে-ও তো শহরে গেছে।
কি রকম লোকটা?
কিছু লোক আছে যাদের দেখলেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়, সেরকম। লোকটার চোখজোড়া নীল, বরফ শীতল দৃষ্টি। শুদের হাতে ধরা পড়ার সময় ক্লাইভ থাকলে–
আমাদের টিকিটিরও নাগাল পাচ্ছে না ওরা, বললে কলিন। চলো এগোনো যাক।
দুপুরের দিকে পেছনে, অনেক দূরে একটা ধুলোর মেঘ দেখতে পেলো কলিন। ঘণ্টাখানেক বাদে দুরত্ব কমে এলে ওটার, মেঘের আড়ালে প্রায় ডজন খানেক ঘোড়সওয়ারের উপস্থিতি বুঝতে পারলো কলিন।
সন্ধ্যার আগেই এখানে পৌঁছে যাবে ওরা, মনে মনে হিসেব যে বললে কলিন। অবশ্য আর আধঘটা পর আর আমাদের fi্যাক দেখা যাবে না, অন্ধকার হয়ে যাবে ততক্ষণে। রাতে ওরা তো যাত্রাবিরতি করবে কিংবা না থেমে পাসের দিকেও চলে যেতে পারে। আমার বিশ্বাস দ্বিতীয়টাই করবে।
কলিন যেমন ভেবেছিলো সেভাবেই এগোচ্ছে ঘটনাপ্রবাহ। প্রতিপক্ষের চেয়ে পুরো একদিনের পথ এগিয়ে আছে ও। তবে এ-অবস্থা অপরিবর্তনীয় থাকবে না। কাল বা পরশুই হয়তো প্রাণ বাঁচাতে গুলিবৃষ্টির মধ্যে প্রাণপণে ঘোড়া ছোটাতে হবে ওকে। গোধূলি বেলায় দক্ষিণে বঁকি নিলে কলিন, একটা শুকনো ঝর্নার পাথুরে তলদেশে নেমে এলো। কাল দিনের আলোয় ওয়ারেন রাইডাররা ব্যাক ট্র্যাক করে এই পর্যন্ত এসে বুঝতে পারবে কোন দিকে গেছে ওরা। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলে ততক্ষণে ক্যানসাস সিটির পথে বেরিয়ে পড়তে পারবে লিনডা। প্রতিপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাবে কলিন।
মাঝরাত নাগাদ বেসিনের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তে পাহাড়ী এলাকায় যাত্রা বিরতি করলো কলিন। জিন খসিয়ে ঘোড়াগুলোকে বিশ্রা মের সুযোগ দিলো। ঝুঁকি আছে, তবু আগুন জ্বাললো কলিন, কফি বানাবে আর হ্যারলডের দেয়া খাবার গরম করবে। এদিকে আগেই বিছিয়ে দেয়। চাদরে শুয়ে পড়লে লিনডা, ওর কাজ দেখতে লাগলো। খানিক পর তৃপ্তির সঙ্গে কফির কাপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে কলিনের কাছ থেকে খাবার নিয়ে খেলো।
খাবার খাওয়া শেষ হলে আগুন নিভিয়ে দিলো কলিন। লিন ডার পাশেই চাদর বিছালো, তারপর শুয়ে হাই তুললো সশব্দে।
অসুবিধে হচ্ছে না তো? লিনডাকে জিজ্ঞেস করলো ও, তাহলে বলল, ঘাস বিছিয়ে গদি বানিয়ে দিই।
এক রাতের জন্যে আর কষ্ট কি? বললো লিনডা। কলিন, আমার সঙ্গে তুমি ক্যানসাস সিটিতে যাবে না?
বলেছি তো এখানে কাজ আছে।
কিন্তু সে সুযোগ তো আর পাবে না। আমি তো কোনো উপায় দেখি না।
উপায় একটা সব সময়ই থাকে।
না, কলিন, তুমি জানো না কার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। স্প্রীংগারভিল ট্রেইলে যারা মারা গেছে তাদেরও কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি।
ব্যাপারটা তুমি জানো?
জানি।
কবে থেকে?
দুদিন আগে শুনেছি। পারলারে কাউচে ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ বিল আর কাসলারকে নিয়ে ঘরে এলো রবার্ট। আমি যে ঘরে আছি টের পায়নি। ওদের সব কথা শুনে ফেললাম আমি। রবার্টকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিলো, তার ভয় সেরাতে কেউ পালিয়ে যেতে পেরেছে কিনা; কিন্তু ক্লাইভ কাসলার জোর গলায় বলেছে একটা লোকও রক্ষা পায়নি–পুরো ঘটনা রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেছে সে।
তারপর তোমাকে দেখে ফেললো?
হ্যাঁ। আমি এত ভয় পেয়েছিলাম তখন কি বলবো, ওরা তা বুঝে ফেলে। তারপর একটা ভুল করে বসলাম, ঝগড়া করলাম রবার্ট ওয়ারেনের সাথে। মুহূর্তে পিস্তল বের করলো ক্লাইভ কাসলার, মেরেই ফেলতে বোধ হয়, বলছিলো মেরে ফেললেই চির দিনের জন্যে আমার মুখ বন্ধ হবে। রবার্ট বললো আরেকটা উপায় আছে, সেটাই গ্রহণ করলো সে, কলিন, আমরা একা হবার পর সেদিন খুব মারধোর করলো আমাকে; আগেও মেরেছে, কিন্তু এর কাছে সেসব নস্যি, পরদিন সকালে শাসিয়ে দিলো ঘর থেকে যদি বের হই আমার কপালে নাকি দুর্ভোগ আছে। ওর বলার ভঙ্গিটা যদি দেখতে! ভয়ঙ্কর!
লিনডার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে কলিন। আন্তরিক কণ্ঠে ওকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলো। ওসব ভুলে যাও, লিনডা। কাল দুপুরের আগেইএসব পেছনে ফেলে বহুদুরে চলে যাচ্ছে, আর ভাবনা কি?
কি জানি, অনিশ্চিন্ত কণ্ঠে বললো লিনডা, কিন্তু স্বস্তি বোধ হয় কোনোদিন পাবো না আমি? এই আমি আর সেই আমি হতে পারবো না। একজন হত্যুকারীর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিলো, কথাটা ভুলে থাকবে। কি করে! লোকটা বদরাগী আর নিষ্ঠুর জান তাম, কিন্তু তার আসল চেহারা এত ভয়াবহ ভাবতেও পারিনি।
স্প্রীংগারভিল ট্রেইলে আসলে কি ঘটেছিলো বলতে পারবে যেভাবে শুনেছো?
ক্যামপফায়্যারের কাছেই তোমাদের পাঁচজন রাইডারকে হত্যা করা হয়। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ওদের কাছে এগিয়ে যায় ওয়ারেনের লোকেরা, অতর্কিতে হামলা চালায়, আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই পায়নি ওরা। সেরাতে যারা গরু পাহারায় ছিলো ওদেরও হত্যা করা হয় খরগোশের মতো তাড়া করে। রবার্ট ভয় করছিলো। কেউ হয়তো পালিয়েছে, কিন্তু ক্লাইভ কাসলার এক রকম নিশ্চিত, কেউ রেহাই পায়নি।
কাসলারের সঙ্গে কে কে ছিলো?
মোট ছ’জন। বিল, ওয়ারেন, চাক কনারস, লুইস প্যাটেন, এরিক মেইন, পিটার রাইট আর হেনরী রয়েস।
গরু বিক্রির টাকাগুলো এখন কার কাছে?
তা জানি না। রবার্টের অফিস কামরায় একটা সেফ দেখেছি, কিন্তু ওটার ভেতরে কি আছে দেখার সুযোগ হয়নি কোনোদিন।
এতক্ষণ যা বললে ঠিক এ-কথাগুলোই যদি শেরিফকে বলতে পারতে?
পারতাম, বললে লিনডা, কিন্তু কি লাভ হতো? আমার কথা বিশ্বাসই করতে না শেরিফ। আমিই-বা প্রমাণ দিতাম কোত্থেকে? দু’মাস আগে যে সাতজন ওয়ারেন রাইডার দশ দিনের জন্যে বাইরে গিয়েছিলো, সেটাই তো প্রমাণ করতে পারতাম না আমি।
উঠে বসলো কলিন, ভুরু কুচকে অন্ধকারের দিকে তাকালো। বাবার সমস্যাটাও ঠিক এ-রকম ছিলো, ধীরে ধীরে বললো ও, বাবাও কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। আমারও একই সমস্যা।
তারচেয়ে চলো আমার সঙ্গে ক্যানসাস সিটিতে?
না, এখানে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে আমাকে।
কিভাবে? কেন বুঝতে পারছে না, তোমার টিকে থাকার কোনো আশা নেই?
এখনো তো বহাল তবিয়তেই আছি।
এক মুহূর্ত ভাবলে কলিন। ওর এই কাজটা কি ঠিক হয়েছে? কোনো লাভ হবে ওর? লিনডাকে অপহরণ করেছে ও-এবার এ রকম অভিযোগ তোলার সুযোগ পেয়ে যাবে ওয়ারেন, এই অজু হাতে ওকে গুলি করে মারতে পারবে, কেউ প্রশ্ন তুলবে না। লিনডা স্টেজে চেপে বসার পর ওরা যদি বলে কলিন ওকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেছে, সেটা মিথ্যে প্রমাণ করার জন্যে লিনডাকে কোথায় পাবে ও? লিনডাকে সাহায্য করতে গিয়ে ওয়ারেনকে পরাজিত করার সুযোগ কমিয়ে আনলো না তো? হোক যা হবার। ওয়ারেনের দুষ্কর্মে লিনডা অংশ নেয়নি। নরপশুটার হাত থেকে উদ্ধার পাবার অধিকার মেয়েটার আছে।
এমন নাছোড়বান্দা কেন তুমি? জানতে চাইলে লিনডা।
অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও, বললো কলিন, মানুষকে তার দায়িত্ব পালন করতে হয়।
সেজন্যে খুন করতে হলেও?
অনেক সময়।
তাহলে আমি বোধ হয় কোনোদিন তোমার মতো মানুষ হতে পারবো না। আমি আসলে বাঁচতে চাই, কলিন। জানি, আমার জীবনের তেমন মূল্য নেই, তবু।
অস্থিরভাবে নড়েচড়ে বসলো কলিন। ক্যানসাস সিটিতে তোমার বন্ধু-বান্ধব নেই?
ওখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি। রবার্টের সঙ্গে কিভাবে বিয়ে হলো সেটা তো তোমাকে বলেছি। বাবার সামনে একেবারে নিখাদ ভদ্রলোকের মুখোশ পরে ছিলো সে, অবশ্য এখানেও ভালোমানুষি চেহারা করে রাখে, কিন্তু ওর আসল রূপ তো আমার দেখা, তাই জীবনে যা করতে হবে ভাবিনি, স্বামীর কাছ থেকে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছি। কিন্তু উপায় কি?
ক্যানসাস সিটিতে কি করবে ভাবছে?
বাড়িতেই থাকবে। পার্টিতে যাবো, নাচবো-আর তোমার মতো কারো অপেক্ষায় থাকবো।
পছন্দের কেউ নেই?
কয়েকটা ছেলেকে আমার বেশ ভালো লাগতো, ডিভোর্স পাওয়ার পর হয়তো ওদের একজনকে বিয়ে করতে পারি; ইচ্ছে করলে তুমি আসতে পারো আমার সঙ্গে।
আকাশের দিকে তাকালে কলিন। জবাব দিলো না।
ভোরের প্রথম আলোয় আবার রওনা হলো ওরা, দুপুরের ঘণ্টা খানেক আগে স্প্রীংগারভিল রোডে পৌঁছুলো। সারা সকাল পিছু ধাওয়াকারীদের চিহ্ন চোখে পড়েনি। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর স্টেজ এলো, কলিনের ইশারায় থামলো ওটা। বিদায়ের আগে শেষ কথোপকথন হলো ওদের।
কিছুদিনের মধ্যে একবার ক্যানসাস সিটিতে যেতে পারি, বললে কলিন।
আমাদের ওখানে যাবে কিন্তু। হাসলে লিনডা, কষ্টার্জিত হাসি, ওর চোখে ক্লান্তি। দুহাতে চুলে খোঁপা বেঁধে নিলো। তারপর দ্রুত এগোলে স্টেজ কোচর দিকে।
একটু পরেই এগোতে শুরু করলো স্টেজ। জানালা দিয়ে হাঁত নেড়ে বিদায় জানালো লিনডা।
আবার স্যাডলে চেপে বসলো কলিন। কিছুক্ষণ আগে একটা গাছের ডাল কেটে নিয়েছিলো, ওটা দিয়ে রাস্তার খুরের চিহ্ন মুছে ফেললো; যদিও জানে ঝানু ট্র্যাকারকে এভাবে ফাঁকি দেয়। যায় না, তবে ওয়ারেন রাইডাররা ট্র্যাকিংয়ে দক্ষ নাও হতে পারে। স্টোনি রিভারের উদ্দেশে এবার উত্তরে এগোলে কলিন, লিনডার ঘোড়াটার লাগাম ধরে রেখেছে। লিন্ডার ঘোড়ার খুরের হালকা চাপ দেখে অভিজ্ঞ ট্র্যাকার বুঝে যাবে ওটার স্যাডল খালি, তবুও খানিকক্ষণের জন্যে চোখে ধুলো দেয়া যাবে হয়তো।
ভর দুপুরে আরো একবার পেছনে ওয়ারেন রাইডারদের উপ স্থিতি দেখলে কলিন, কিন্তু নদী তীরের নিবিড় গাছপালা একটু পরেই ওকে আড়াল করলো। ওয়াগোনারের উদ্দেশ্যে পুবে মোড় নিলো ও, অন্ধকার নেমে আসার পরেও থামলো না, এগিয়ে চললো। সন্ধ্যায় চাঁদ উঠলো। দুরে পর্বতমালার উদ্দেশে উত্তরে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিলো ও।
রাতে ক্যামপ করতে থামলো না কলিন। এতক্ষণ ভাগ্যের সহা য়তা পেয়ে এসেছে, আরো দরকার, কিন্তু ভাগ্যের ওপর পুরোপুরি ভরসা করে বসে থাকা ঠিক হবে না, সূর্যোদয়ের আগেই ওয়ারেনের ষাগুলোর কাছ থেকে যতটা সম্ভব দুরে সরে যেতে হবে। হ্যারলড ফিরে আসতে আরো তিনদিন। অর্থাৎ তিন তিনটে দিন সামনে পিছনে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এখান থেকে ওখানে ছুটে বেড়াতে হবে, যদি না ফেউ খসিয়ে কোথাও লুকানো যায়। ওদের খসানো কঠিন, তবু চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
ভোরের দিকে মেসকেলারসের পাদদেশে থামলো কলিন। লিনডা বোধ হয় এতক্ষণে স্প্রীংগারভিলে পৌঁছে গেছে, ক্যানসাস সিটির উদ্দেশে রওনা হয়ে যেতে পারে। লিনডার কথা মনে পড়তেই মৃদু হাসি ফুটে উঠলে ওর ঠোঁটে, একদিন হয়তো ক্যানসাস সিটিতে যাবে ও…
না।
অন্তস্তল থেকে জানে কলিন, যাবে না। আসন্ন সংঘাতের পরও যদি বেঁচে থাকে এখানেই রয়ে যাবে ও, কিংবা ফিরে যাবে ওয়াইও মিংয়ে। আসলে ওয়ারেনের চেয়ে বেশি কিছু লিনডাকে দেবার নেই ওর। সীমান্তের জীবনে নাগরিক কোলাহলের অস্তিত্ব কোথায়?
ওরা দুজন দুই পটভূমির মানুষ। সম্পূর্ণ আলাদা।
১৩. ঘন ঝোপে ভরা ক্যানিয়ন
ঘন ঝোপে ভরা ক্যানিয়ন, খাড়া আকাশছোঁয়া দেয়াল, খালি পায়ে হয়তো এই দেয়াল বেয়ে ওঠা যাবে, কিন্তু ঘোড়ার পিঠে প্রশ্নই ওঠে না। ক্যানিয়ন মুখের মাইলখানেক ভেতরে দুপাশের দেয়াল পরস্প রের সঙ্গে মিশে গেছে, কানা গলিতে পরিণত হয়েছে জায়গাটা। ফাঁদে পড়ে গেছে আবার কলিন, কঠিন ফাঁদ। গত কয়েক দিনে অন্তত তিনবার ওকে কোণঠাসা করেছে ওয়ারেন রাইডাররা, কিন্তু প্রতিবারই ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়েছে। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে নিস্তার মিলবে না!
এদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। বেড়া তুলে বন্ধ করে দিয়েছে ওর। ক্যানিয়ন-মুখ। এখন আগুন জ্বালানোর জন্যে কাঠ জোগাড় করে আনছে, সারারাত পাহারা দেবে। সকালে কলিন যদি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ না করে, ক্যানিয়নের খরায় শুকিয়ে খড় হয়ে যাওয়া ঘাসে আগুন লাগিয়ে দেবে ব্যাটারা, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে বিনা দ্বিধায়!
ক্যানিয়ন-মুখ থেকে খানিকটা দূরে শত্রুর দৃষ্টি আড়ালে অপেক্ষ। করছে কলিন। ঘোড়র সামনের বাম পা পরীক্ষা করলে ও, খুরের ওপর থেকে হাঁটু পর্যন্ত ফুলে ঢোল হয়ে কুৎসিত দেখাচ্ছে, পেশীতে টান পড়েছে, বোধ হয়। ঘোড়াটা খুড়িয়ে চলছিলো বলে এখানে ঢুকেছিলো ও, প্যসির চোখকে ফাঁকি দেবার আশায়, কিন্তু আশা পুরণ হয়নি।
বাইরে থাকলেও এ অবস্থায় খুব একটা লাভ হতো না, ভাবলে। কলিন, ধাওয়া খেয়ে বেড়াতে হতো, ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকতো ষোলো আনা।
হ্যারলডের দেয়া এই ঘোড়াটা চমৎকার, সহিষ্ণু; পরপর পাঁচ দিন-নাকি ছয়?–শত্রুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে ওকে। এক টানা পরিশ্রমে কাহিল হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক, তবে ভাগ্য ভালো বলতে হবে পা-টা ভেঙে যায়নি!
ধোঁয়া দিয়ে বের করবে, সে সুযোগ দেব না শয়তানগুলোকে, আপনমনে বললো কলিন, তার আগেই একটা উপায় বের করে ফেলবে।
হাঁটতে হাঁটতে ক্যানিয়ন-মুখের দিকে এগোলো কলিন ফোর্বস, সতর্ক, যেন শত্রুর চোখে পড়তে না হয়। শেষ বিশ গজ দূরত্ব গির গিটির মতো বুকে হেঁটে এগোলো ও। মাটির সঙ্গে শরীর মিশিয়ে বাইরে তাকালো। চার জায়গায় কাঠ জড়ো করেছে ওয়ারেন রাইডাররা। লাকড়ির স্কুপের সামান্য দুরে ক্যামপ। ছ’ থেকে আটজন লোককে দেখা যাচ্ছে। রাতের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত দুজন। দিনের আলো নেই বললেই চলে, তবু কয়েকজনকে চিনতে পারলো কলিন। ওয়ারেনের সঙ্গে আলাপে মগ্ন ডেনিস স্মিথ আর জেফরি আরচার। দাতে দাঁত চাপলো কলিন। গত কদিন ধরে ধাওয়া করছে ওকে প্যসিটা। ওর ধারণা ছিলো সবাই ওয়ারেনের লোক অথচ এখন দেখা যাচ্ছে আরচারসহ আরো কয়েকজন শহরবাসী যোগ দিয়েছে। এক অর্থে অবশ্য ভালোই হয়েছে, কারণ শেষ পর্যন্ত ওয়ারেনের রাইডাররা খটখটে শুকনো ঘাসে ভরা ক্যানিয়নে কায়দা মতো পাওয়ার পর সকালের জন্যে বসে থাকতো না। শেরিফ উপস্থিত থাকায় ওকে বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য হবে ওরা।
ভালোই হলো, ভাবলো কলিন, কিছু সময় পাওয়া গেল হাতে। পালানোর জন্যে সময়টা কিভাবে কাজে লাগানো যায়?
ঊধ্ব শ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবে, সেটা সম্ভব নয়–দৌড়াতে পারবে না ঘোড়াটা। অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পর আগুনের পাশে যারা সতর্ক পাহারায় থাকবে তাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানোর সুযোগও কম। দেয়াল টপকে ক্যানিয়নের ওপাশে যাওয়ার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু ঘোড়া ছাড়া পাহাড়ী রুক্ষ এলাকায় খুব বেশি সময় টিকে থাকতে পারবে না ও। খাবারের ভাঁড়ার শূন্য, তামাক নেই, গুলিও প্রায় শেষের পথে।
খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি গাল চুলকালে কলিন। মরণ অথবা আত্মসমর্পণ–এছাড়া পথ নেই মনে হচ্ছে। চিৎকার করে শেরিফের কাছে আত্মসমর্পণের কথা বলে বেরিয়ে পড়বে নাকি? দৃশ্যটা কল্পনা করলো ও : সোজা হয়ে মাথার ওপর হাত তুলে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে, পরাস্ত। কিছুই হয়তো ঘটবে না। গ্রেপ্তার করে ওকে জেলে ভরে রাখা হবে সম্ভবত কিংবা…অদৃশ্য কোনো অবস্থান থেকে ছুটে আসা একটা বুলেট ওর প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। হত্যাকারী পরে বলে দেবে ফোর্বসের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব সে শুনতে পায়নি, ব্যস। ব্যাপারটা স্বভাবতই কেউ কেউ মেনে নিতে চাইবে না, সমালোচনার ঝড় উঠবে হয়তো, কিন্তু তাতে কলিন আবার প্রাণ ফিরে পাবে না!
জাহান্নামে যাক আত্মসমর্পণ!
আবার পেছনে চলে এলো কলিন, একটু ডানে সরলো, তারপর ফের ক্রল করে এগোলো সামনে। গোধূলি-ধূসর প্রকৃতি। ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ় হচ্ছে ছায়ার, আর দশ পনেয়ে মিনিট পরেই নিকষ অন্ধকার নেমে আসবে। ঠিক সামনেই এক স্তূপ লাকড়ি দেখা যাচ্ছে। লাকড়ির বানডিল হাতে এগিয়ে এলে এক লোক, স্থূপটার ওপর ওগুলো ফেলে আবার ফিরে গেল। চট করে অন্যান্য স্থূপ আর ক্যামপের দিকে তাকালে কলিন। এদিকে কারো দৃষ্টি নেই। ক্রল করে আরো সামনে এগোলো ও, বেড় গলে পৌঁছে গেল লাকড়িস্তুপের কাছে, প্রথমে হাঁটু গেড়ে বসলো, সোজা হয়ে দাড়ালো তারপর, সামনে ঝুঁকে লাকড়ি সাজানোর ভান করলো, কেউ ওকে লক্ষ্য করেছে বলে মনে হলো না।
লাকড়ি হাতে আরেকজন এগিয়ে এলো এবার। চট করে পেছন ফিয়ে দাড়ালো কলিন। লোকটা কাছাকাছি আসামাত্র পিস্তল বের করে ঘুরে দাড়ালো। প্রতিপক্ষের চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ পরিষ্কার দেখতে পেলো ও।
খুব আস্তে, বললো কলিন, লাকড়িগুলো ফেলো, তারপর এক সঙ্গে আবার কাঠ আনতে যাবো আমরা।
লোকটার হাত থেকে খসে পড়লো লাকড়ি। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো সে। চোয়াল ওঠানামা করলে তার, কিন্তু কোনো কথা বের হলো না।
কই, চলো, লোকটার দিকে এগোলে কলিন, নাকি আমার কথা কানে যায়নি? আরো লাকড়ি আনতে যাচ্ছি আমরা।
পিস্তলটা একটু নিচু করে শরীরের সঙ্গে চেপে রাখলো ও, যাতে হঠাৎ করে কেউ বুঝতে না পারে। লাকড়ির অন্য তিনটা স্কুপের আশপাশে লোকজনের চলাচল টের পাওয়া যাচ্ছে, ক্যামপেও ব্যস্ত তার আভাস। ক্যামপের এপাশে বেঁধে রাখা হয়েছে ঘোড়াগুলো।
আমার সঙ্গে এগোও, বললো কলিন, স্বাভাবিক থাকবে, যদি বাঁচার ইচ্ছে থাকে!
লোকটা কলিনের অপরিচিত, ওয়ারেনের রাইডার হতে পারে, কিংবা শহরবাসী কেউ। মাঝবয়সী লোক, ছোটখাট, দুর্বল স্বাস্থ্য, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
কোণাকুণিভাবে ঘোড়াগুলোর দিকে এগোবে আমরা, আবার বললো কলিন।
এভাবে পার পাবে না, মিস্টার!
চেষ্টা করা যাক না!
ঘোড়াগুলোর উদ্দেশে এগোলে ওরা। গন্তব্যে পৌঁছে থামলো। সবচেয়ে কাছের ঘোড়াটাকে পরখ করলো কলিন, জেব্রা ডান মাসট্যাং, পিঠে জিন বা লাগাম নেই। একটা দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বাঁধা। কলিনের কাছে ছুরি আছে। সঙ্গের লোকটার দিকে তাকালো ও।
তুমি, বললো, বরং আবার লাকড়ি আনতে চলে যাও, কিন্তু সাবধান, কোনো রকম চালাকী করতে যেয়ো না। তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ জানতে পারলে ওয়ারেন তোমাকে আস্ত রাখবে না।
দেখো, কিছু করবো না আমি, বললো লোকটা, কিন্তু তুমি কিছুতেই পালাতে পারবে না, কোনো আশা নেই, ফোর্বস, আপাতত এখান থেকে যদি যেতে পারোও আগামী কাল রাতের মধ্যেই ঠিক আবার পাকড়াও করা হবে তোমাকে।
যাও তো, লাকড়ি আনো গে! ওর কথায় আমল না দিয়ে বললো কলিন।
ঘনায়মান অন্ধকারে হারিয়ে গেল লোকটা। পিস্তলটা হোলস টারে রেখে বেলট থেকে ছুরি বের করলো কলিন।
অ্যাই। হলো কি! আগুন জ্বালছো না কেন? ওয়ায়েনের চিৎকার শোনা গেল। সবাই চোখ কান খোলা রাখবে! আমার ভুল না হলে ফোর্বস ব্যাটা পালানোর চেষ্টা চালাবেই!
শেরিফও কথা বললো এবার। ফোর্বস। চিৎকার করে উঠলো সে, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে! শুনতে পাচ্ছে, ফোর্বস?
পরিষ্কার, বিড়বিড় করে বললো কলিন। মাসট্যাংয়ের আরো কাছে এগিয়ে এলো ও, ছুরির এক পোচে কেটে ফেললো দড়ির বাধন। পরমুহূর্তে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলো, দু’হাটুতে ওটার পেট চেপে সামনে ঝুঁকে পড়লো, তারপর তুফান তুলে ছুটলো সামনে। চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে, তারপর বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি। চিৎকার করে নির্দেশ করলো ওয়ারেন, শেরিফের ভারি গলার আওয়াজ ভেসে এলো। বিদ্রুপের হাসি সিলো কলিন, বাড়িয়ে দিলো ছোটার গতি।
আকাশজোড়া মেঘ, একে একে অদৃশ্য হয়েছে সব তারা, চাদের আলো এখন ফ্যাকাসে। জোর বাতাস বইছে। বৃষ্টির পূর্বাভাস। ঘণ্টাখানেক যেতে না যেতে বিজলি চমকান শুরু হলো, মেঘের গুরুগুরু গর্জন, তারপর হঠাৎ শুরু হলো ঝমঝম বৃষ্টি। এক মিনিটেই ভিজে চুপসে গেল কুলিন। তবু মনে মনে খুশি হয়ে উঠলো ও। এই বৃষ্টিটা কাজে আসবে, ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে ঘোড়ার খুরের ছাপ। এক সপ্তাহ আগে যেখানে ছিলো ঠিক সেই অবস্থায় ফিরে যাবে প্যসি। আরচাররা বুঝতেই পারবে না বেসিনের ঠিক কোন্ জায়গায় খুজতে হবে ওকে। অবশ্য ইতিমধ্যে ওদের জেনে যাবার কথা, ওর সঙ্গে খাবার নেই, সুতরাং এলাকার সব কয়টা র্যাঞ্চের ওপর কড়া নজর রাখা হবে, যাতে রসদের খোঁজে গেলেই ওকে ধরে ফেলা যায়। কিন্তু ফোর্বস র্যাঞ্চে ওকে খোঁজার কথা ভাববে কি ওরা?
এই মুহূর্তে ওখানেই যাচ্ছে কলিন। অনেক আগেই র্যাঞ্চে যাবার কথা ছিলো ওর। দুদিন আগে ওখানে হারলডের সঙ্গে দেখা করবে বলেছিলো। কোনো অঘটন না ঘটলে হ্যারলডের সঙ্গে ফোর্বস র্যাঞ্চের অন্যান্য কাউহ্যানডও থাকবে ওখানে।
ভোরের দিকে র্যাঞ্চে পৌঁছুলো কলিন ফোর্বস, এখনো বৃষ্টি থামেনি। আস্তাবলের একপাশে ঘোড়া থামিয়ে র্যাঞ্চ হাউসের দিকে তাকালো ও। শীতে জমে যাবার দশা। র্যাঞ্চে পৌছেও স্বস্তি পাচ্ছে না। বৃষ্টির বরফ শীতল পানি যেন মাংস ভেদ করে হাড় স্পর্শ করছে। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়লো কলিন, একটা চাপড় দিলে ওটার পাছায়, ভোরের আবছা অন্ধকারে হারিয়ে গেল ঘোড়াটা। পছন্দসই আশ্রয় না মেলা পর্যন্ত বৃষ্টির মধ্যে একটানা ছুটতে থাকবে, পরে, বৃষ্টি থামলে ফিরে যাবে আপন ডেরায়। প্যসি ওটার খোঁজ পেলেও ব্যাকট্র্যাকিংয়ের উপায় থাকবে না ওদের।
দু’হাত ডলতে ডলতে বার্নের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়ালে। কলিন, শরীরের আড়ষ্টতা কাটানোর চেষ্টা করলো। হ্যারলড ফিরেছে কিনা কে জানে! আদালতের পক্ষ থেকে ডাক পিটকে কেয়ারটেকার নিয়োগ করা হয়েছে এখানে, ওর আগমন সে সুনজরে নাও দেখতে পারে।
দু’হাতে আবার অনুভূতি ফিরে পেলো কলিন, হোলসটার থেকে পিস্তল বের করে পরখ করলো, আলগোছে ঢুকিয়ে রাখলো। আবার। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো নীরব র্যাঞ্চ হাউসের দিকে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। উঠোন ধরে হাঁটা ধরলো ও, ঠিক এই সময় বার্নের দরজা থেকে হুকুমজারি করলো একটা কণ্ঠস্বর।
মাথার ওপর হাত তোলো, মিসটার।
আদেশ পালন করে বার্নের দরজার দিকে ঘুরে দাড়ালো কলিন। রাইফেল বাগিয়ে এগিয়ে এলো একটা লোক, হঠাৎ থমকে দাড়ালো সে।
কলিন! মনে হচ্ছিলো তুমিই, কিন্তু ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছিলো না।
দ্রুত এসে কলিনের সঙ্গে হাত মেলালো লোকটা, ছিপছিপে গড়ন তার, থ্যাবড়া নাকটা চোখে পড়ে সবার আগে। আমি জেলারম্যান, বললো সে। টেরি জেলারম্যান। আমার কথা হয় তো এতদিন পর তোমার মনে নেই।
কি বলো, মনে নেই মানে! বললো কলিন। কি খবর, টেরি। ইয়ে, ঘরের ভেতর আগুন আছে? ঠাণ্ডায় যে জমে গেলাম।
জ্বালিয়ে নিতে কতক্ষণ! বললো জেলারম্যান। এসে। দুজন একসঙ্গে র্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোলে ওরা। দরজায় টোকা দিলো জেলারম্যান, হ্যারলডকে ডাকলো জোর গলায়।
দরজা খুলে গেল, ভেতরে বাতি জ্বাললো কে যেন, ওকে এক রকম ঠেলে ভেতরে ঢোকালে জেলারম্যান। হ্যারলড, আরথার শেরিডান আর হনডো স্টার্নকে দেখতে পেলো কলিন। চুলোয় আগুন জ্বেলে কফি বানানোর জন্যে পানি চাপানো হলো। শুকনো কাপড় বের করে দেয়া হলো ওকে, আর গা মোছার জন্যে তোয়ালে। বার্নে নিজের অবস্থানে ফিরে গেল টেরি জেলারম্যান। জানালাগুলোর পর্দা ঠিক মতো টানানো আছে কিনা দেখে নিলো হ্যারলড। গা মুছে পোশক পাল্টে নিলো কলিন, ওকে ঘিরে দাঁড়ালো এবার সবাই।
আজই এসেছি আমরা, বললো হ্যারলড। পথে: ওয়াগোনারে থেমেছিলাম, একটা খবর শুনলাম, বিশ্বাস করবে কিনা বুঝছি না। এখানে তোমার জন্যে চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করবো ঠিক করে রেখেছিলাম, তারপর কি করতাম জানি না।
কফিটা শেষ হোক, তারপর আলাপ করা যাবে, বললে কলিন। কতদিন যে কফি খাই না। পাঁচ দিনের কম না।
তাহলে বেঁচে আছো কিভাবে? কায়দা করে বললে হনডো।
ঠেকা হলো আসল কথা, বললে কলিন। পারলারে পেটমোটা চুলোর কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লে কলিন, পরিচিত কামরার চারপাশে নজর বোলালো। বাবার শোবার ঘরের দিকে চোখ গেল আপনাআপনি, মনে হলো এই বুঝি দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসবে বাবা, ভারি গলায় জিজ্ঞেস করবে সাত সকালে এত হৈচৈ কিসের?
ডার্ক পিটকে ওখানে বেঁধে রেখেছি, বললো হ্যারলড, আমাদের এখানে দেখে বেজায় অসন্তুষ্ট সে। আমাদের নাকি এখানে আসার কোনো অধিকার নেই! ও হ্যাঁ, ওয়াগোনারে একটা কথা সবাই বলাবলি করছে, আমার অবশ্য বিশ্বাস হয়নি।
কি?
তুমি নাকি মিসেস ওয়ারেনকে অপহরণ করার পর মেরে লাশ গুম করে ফেলেছে! হাহ! মাত্র দুদিন আগে স্প্রীংগারভিলে, নিজের চোখে দেখেছি ওকে, জ্যান্তই তো মনে হয়েছে।
দুদিন আগে? পুনরাবৃত্তি করলো কলিন, ঠিক তো, হ্যারলড?
বিলকুল।
চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো কলিন, কুঁচকে উঠলো ওর ভুরু জোড়া। স্প্রীংগারভিলে কি করছে লিনডা? সপ্তাহখানেক আগে ওকে স্টেজে তুলে দিলো, এতদিনে ক্যানসাস সিটিতে পৌঁছে যাবার কথা! মাথা নাড়লো ও, হতবুদ্ধি।
যা ইচ্ছে করুক গে সে, ওর কি? লিনডা যদি ক্যানসাস সিটির বদলে স্প্রীংগারভিলে থাকবে স্থির করে থাকে, ওর কি করার আছে?
যাদের কবর পাওয়া যায়নি, ওই তিনজনের কোনো খবর মিললো? সোজা হয়ে বসে জানতে চাইলে কলিন।
কাপে আবার কফি ঢেলে ওকে দিলল হ্যারলড লেভিট।
নাহ। কোনো চিহ্ন নেই। তবে একটা দারুণ খবর জোগাড় করেছি আমরা।
কি?
ওয়ারেন রাইডাররা যখন আমাদের গরু বিক্রি করছে, অ্যারন হেলার তখন প্রীংগারভিলে ছিলো।
উত্তপ্ত কফিতে জিভ পুড়ে যাবার দশা হলো কলিনের।
বলো কি?
হ্যাঁ। ওখানকার জাজ, ফসেট, আমার পুরোনো বন্ধু। অনেক দিন হলো প্রীংগারভিলে বসবাস করছে, এখানকার অনেককেই চেনে, ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম এখান থেকে মাস দুয়েকের মধ্যে প্রীংগারভিলে কে কে গিয়েছিলো, কয়েকজনের মধ্যে যারন হেলারের নামও বলেছে সে। হোটেলেও খোঁজ নিয়েছি, ক্লাইভ কাসলার যেদিন আমাদের গরু বিক্রির টাকা নেয়, সেদিনই হোটেলে ওঠে হেলার, বলা যায় না, দুটোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নাও থাকতে পারে তবে
পিরিচে কফি ঢেলে ফু দিয়ে জুরিয়ে নিয়ে চুমুক দিলো কলিন। হেলার, ভাবলো ও, মহা ধুরন্ধর লোক।
চুল্লীর আগুনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কামরা। হেলারকে ঘিরে চিন্তার ধারা একীভূত করার চেষ্টা করলে কলিন। কিন্তু বারবার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত, অবসন্ন ও। চোখ বুজে ক্লান্তি দূর করতে চাইলো। জানতেও পারলো না হ্যারলড কখন ওর গায়ে চাদর টেনে দিয়েছে।
১৪. বেশ দেরিতে নাশতা সারলো ওরা
বেশ দেরিতে নাশতা সারলো ওরা, এত বেলায় নাশতা ফোর্বস র্যাঞ্চের ইতিহাসে নেই। ওরা যখন রান্নাঘরে নাশতার টেবিলে এসে বসলো তার দু’ঘণ্টা আগেই সূর্য উঠে গেছে। এতক্ষণ একটানা ঘুমিয়েছে কলিন, ঘুম থেকে ওঠার পরও ক্লান্তি কাটেনি ওর, কিন্তু হ্যারল্ড। লেভিটের কাছ থেকে সবকিছু বিস্তারিত জানার জন্যে উদগ্রীব।
কাজে লাগতে পারে তেমন তথ্য এখন পর্যন্ত মেলেনি। নিখোঁজ তিন রাইডারের সন্ধানে স্প্রীংগারভিল আর তার আশপাশ চষে বেড়িয়েছে ওরা।
খুব বেশি দূর এগোতে পারিনি আমরা, গম্ভীর কণ্ঠে বললো ইনডো। তবু তোমার আসার অপেক্ষা করছিলাম।
হনডো, মাঝ বয়সী, কঠিন চেহারা তার, অন্যদের মতোই ফোর্বস র্যাঞ্চের পুরোনো লোক। বেসিনের আদি বাসিন্দা এরা, এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা জগৎ আছে, সংসার আছে, একটা লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করে, কিন্তু ওদেরকে এই রাঞ্চের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই দেখে কলিন
লিনডা ওয়ারেনের কাছে শুনেছি আমাদের আটজন রাইডারের একজনও রেহাই পায়নি, ওদের জানালো ও, তারপর লিনডাকে স্টেজ পর্যন্ত পৌঁছুনোর কারণ ব্যাখ্যা করলো।
তোমার কাজটা ড্যানিয়েলের সেই স্ট্যামপিডের মতো, বললো হ্যারলড। তোমার বাবা জানতো ওয়ারেন আমাদের লোকদের হত্যা করেছে, কিন্তু তা প্রমাণ করার উপায় ছিলো না, তাই একমাত্র বিকল্প পথটাই বেছে নিয়েছে ও, পাল্টা আঘাত হেনেছে এবং আঘাতটা ওয়ারেনের আঁতেই লেগেছে।
কিন্তু এভাবে তো কোনো ফয়সালা হচ্ছে না, বললো কলিন, স্প্রীংগারভিল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওয়ারেনকে জড়ানো যায় কিভাবে?
কেউ জবাব দিলো না। স্প্রীংগারভিলের হত্যাকাণ্ড আর গরু ছিনতাইয়ের ঘটনা অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। স্প্রীংগারভিলের কাছে খুঁজে পাওয়া কবরগুলোর দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে প্রমাণ করা যায় স্ত্রীংগারভিলে যারা গরু বিক্রি করেছে তারা ফোর্বস ব্ল্যাঞ্চ রাইডার ছিলো না। কিন্তু তার। যে ওয়ারেনের লোক সেটা কিভাবে বোঝাবে? ড্যানিয়েল ফোর্বস যেভাবে রহস্যের মীমাংসা করেছে আদালত তা মানবে না।
প্রশ্নের ধরন বদলালো কলিন। অ্যারন হেলারকে, বললো ও, তো তোমরা সবাই চেনো, না? ওয়ারেনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক আছে?
হেলার ওয়ারেনের অ্যাটর্নি, বললো হ্যারলড লেভিট, অবশ্য উপত্যকার সবাই আইনের ব্যাপারে ওর কাছেই সাহায্যের জন্যে যায়।
ওর সঙ্গে বাবার সম্পর্ক কেমন ছিলো?
ভালোই–তবে আমার বিশ্বাস তোমার বাবা ওকে ঠিক ভালো চোখে দেখতে না-বিশ্বাসও করতো না।
কিন্তু হেলারের স্প্রীংগারভিলে যাওয়ার একশো একটা কারণ থাকতে পারে।
ঠিক। কিন্তু ওখানে তার যাতায়াত খুবই কম।
আচ্ছা, লোকটা বিয়ে সাদী করেনি?
না। বছর কয়েক আগে একবার গুজব রটলো পুবের কোন এক মেয়েকে নাকি বিয়ে করতে যাচ্ছে, ম্যাকমিলান র্যাঞ্চটাও কেনার তোড়জোড় শুরু করেছিলো সে তখন, ওকালতি ছেড়ে দিয়ে রাঞ্চিং করবে। পরে অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি। তারপর ওয়ারেন এলো, সে-ই কিনলো ম্যাকমিলান র্যাঞ্চ–এবং শুরু হলো আমাদের ঝামেলা!
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজলো কলিন। ভাবছে। হেলা য়ের চিঠি সতর্ক করার উসিলায় ওকে এখানে আসতে চ্যালেঞ্জ করেছে। এখানে আসার পর ডাক্তার মারভিনের বাড়িতে ওকে হামলা করতে গেল ওয়ারেন রাইডাররা। কলিন মারভিনের ওখানে যাচ্ছে হেলার ছাড়া কেউ জানতো না। কলিন ওখানে যেতে পারে অনুমান করে আগে থেকেই ওরা ওত পেতেছিলো–হেলারের এই ব্যাখ্যা খুবই দুর্বল।
হেলারের আরেকটা আচরণ বেশ রহস্যজনক। শুরু থেকেই ওকে ওয়ারেনের বিরুদ্ধে খেপিয়ে দিতে চাইছে সে, কেন? ওয়ারেনকে কেন ঘৃণা করে সে? সত্যিই কি ঘৃণা করে? ছিনতাই করা গরু বিক্রি করার সময় কেন স্প্রিংগারভিলে গিয়েছিলো সে? ঘটনাটা কাকতালীয়? হতে পারে। কিন্তু–
সোজা হয়ে বসলো কলিন। আমার ইচ্ছেটা কি শুনবে? বললো ও, হেলারকে এখানে ধরে এনে দুটো কথা বলা। হয়তো নতুন কিছু জানা যেতে পারে।
হেসে ফেললো হ্যারলড লেভিট। নিশ্চয়ই। আমরা যে-কেউ দুজনই পিছলে ওয়াগোনারে ঢুকে ওকে দাওয়াত করে নিয়ে আসতে পারি। দাওয়াত নিতে সে আপত্তি তুলতে পারে, তখন জোরাজুরি করবো, অসুবিধে কি!
দরকার হলে পিঠে হাত বুলিয়ে দেবো, বললো ইনডো।
আরেকটা কাজ করা যায়, বললো কলিন, আমাদের গরু ছিন তাইকারী যে কোনো একজনকে তুলে আনতে পারি। সেদিন ক্লাইভ কাসলারের ছয় সঙ্গীর নাম লিনডা আমাকে বলেছে, এদের মধ্যে চাক কনারস মারা গেছে, বাকি আছে বিল ওয়ারেন, লুইস প্যাটেন, পিটার রাইট, এরিক মেইন, আর হেনরী রয়েস। কে সবার আগে মুখ খুলতে পারে বলে তোমাদের ধারণা?
বিল ওয়ারেন, বললে টেরি জেলারম্যান। সায় দিলো হ্যারলড। কোনো সন্দেহ নেই। ওকে কাবু করা কোনো ব্যাপারই নয়।
কিন্তু ধরবে কিভাবে?
যে কোনো দিন বেলিনডা গ্রেবারের র্যাঞ্চ থেকে তুলে আনা যায়, আবার শহরে এলেন হডসন বা বেথ মেয়রসের বাড়ি থেকেও পাকড়াও করা যেতে পারে। শহরে গেলেই স্যালুনে বসে কয়েক গ্লাস গলায় ঢেলে সোজা ওদের কোনো একজনের বাড়ি হাজির হয় সে। তা, কলিন, আজই যাবে নাকি ওয়াগোনারে? নীল নকশা
মাথা দোলালো কলিন। এছাড়া আর কোনো উপায় দেখা যাচ্ছে না।
কিভাবে কি করতে হবে শোনো, বললো ও, আমরা–
উঠোনে পাহারায় ছিলো আরথার শেরিডান, দ্রুত এসে ঢুকলো সে, থামতে বাধ্য হলো কলিন।
সাত আটজনের একটা দল, বললে শেরিডান, এদিকে আসছে!
ওয়ারেন?
হতে পারে।
উঠে দাঁড়ালো কলিন। পিট আছে না ওঘরে?
আছে।
ওর সঙ্গে দুটো কথা বলা যাক, বললে কলিন। ওয়ারেনরাই যদি আসে ওদের বিদেয় করতে হবে, পিঠে পিস্তলের নল ঠেকানো থাকলে সম্ভবত সহায়তা করতে আপত্তি তুলবে না। পিট। এসো।
সব মিলিয়ে আটজন ঘোড়সওয়ার ঢুকলো উঠোনে। চারজনকে চিনতে পারলো কলিন–ওয়ারেন, লুইস প্যাটেন, এরিক মেইন এবং ক্লাইভ কাসলার–ওয়ারেনের পাশে লম্বা ছিপছিপে পাথরের মতো কঠিন চেহারার লোকটা কাসলার না হয়ে যায় না।
আধখোলা দরজার একটু বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডার্ক পিট, অবসন্ন দৃষ্টিতে ঘোড়সওয়ারদের দিকে তাকাচ্ছে, মেদ স্বর্বস্ব বিশাল শরীর তার, সারারাত নিঘুম কেটেছে, তারপর এখন আবার পিঠে ঠেকে রয়েছে কলিনের পিস্তল, আত্মারাম খাঁচাছাড়া অবস্থা!
সব ঠিক আছে? স্বভাবসুলভ চড়া গলায় জানতে চাইলে ওয়ারেন।
ওপর-নিচ ওঠানামা করলো ডার্ক পিটের মাথা।
রাতে কেউ এসেছিলো?
নাহ।
বার্ন-এ গিয়েছিলে সকালে?
খামোকা কেন যাবো?
ক্লাইভ, জো, হেনরী–যাও, বার্ন-এ ঢু মেরে এসো। নির্দেশ দিল ওয়ারেন। সম্ভাবনা কম, তবু এখানে এসে লুকিয়ে থাকতে পারে হারামীটা!
কলিনের অনুমান ঠিক, লম্বা লোকটাই ক্লাইভ কাসলার, অন্য দু’জনকে নিয়ে বার্ন-এর দিকে গেল সে। স্যাডল থেকে নেমে হোলসটারের পিস্তল বের করলো, ঢুকে পড়লো ভেতরে। স্যাড়লে নড়েচড়ে বসলো ওয়ারেন। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে, চোখজোড়া ফোলা ফোলা, আরো গাঢ় হয়েছে কপালের দাগগুলো।
এখনো প্রচুর টাকা পাওয়ার সুযোগ আছে তোমার, পিট, ভারি গলায় বললো সে। কাল রাতে প্যসিকে ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়েছে কলিন ফোর্বস। কোন দিকে যে গেল। বৃষ্টিতে ট্রেইল মুছে সাফ। এদিকে এসে থাকতে পারে।
এখানে আসতে যাবে কেন?
যেখান থেকেই হোক খাবার জোগাড় করতে হবে তাকে, বললে। ওয়ারেন। নজর খোলা রেখো, পিট। যদি এখানে আসে, ঘায়েল করতে পারলে পাঁচশো পাবে। টাকার দরকার আছে না তোমার?
তা আছে, নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললো ডার্ক পিট।
দুই সঙ্গীসহ বার্ন থেকে বেরিয়ে এলো ক্লাইভ কাসলার, পিস্তল হোলসটারে ঢোকালো। কেউ নেই, জানালো সে। আমার মতে শহরে নয়তো আরেকটা র্যাঞ্চ আছে ওখানে পাওয়া যাবে শালাকে।
আরেকটা র্যাঞ্চ? কোন্ র্যাঞ্চ? জিজ্ঞেস করলো ওয়ারেন।
ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো কাসলারের ঠোঁটে। আমার সন্দেহ সত্যি নাও হতে পারে, নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে চাই আমি, তার আগে এখান থেকে কফির পালাটা চুকিয়ে নিলে কেমন হয়?
পিটের পেছনে ঘাপটি মেরে আছে কলিন, ওর পিস্তলের নল পিটের পিঠ স্পর্শ করেছে, রুদ্ধশ্বাসে ওয়ারেনের জবাবের অপেক্ষায় বইলো ও।
সময় নেই হাতে, বললো ওয়ারেন, আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে! চলে। কথাটা মনে রেখো, পিট। পাঁচশ। অনেক টাকা।
মনে থাকবে, দুর্বল গলায় বললো পিট।
একটু পর বিদেয় হলো ওয়ারেন, রেডফিলডের র্যাঞ্চ ওদের গন্তব্য, আন্দাজ করলো কলিন।
পিস্তলটা খাপে ঢোকালো ও, সোজা হয়ে দাড়িয়ে বানোনা বের করে মুখ মুছলো, তারপর বললো, চমৎকার দেখিয়েছে, পিট, কয়েকটা দিন আয়ু বাড়লো তোমার।
কামরায় ফিরে এলো পিট, থরথর করে কাঁপছে। আমার ওপর অযথা অত্যাচার করছে। তোমরা, বললো সে। আমি নিরপেক্ষ মানুষ, অাদালতই আমাকে এখানে পাঠিয়েছে।
আবার বেঁধে ফেলো ওকে, বললো কলিন।
জানালার কাছে এসে বাইরে তাকালো কলিন। কি বোঝাতে চাইলো তখন কাসলার? নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে চায় মানে কি? বেলিনডার দিকে ইঙ্গিত করেনি তো? সম্ভব। সেরাতে ওয়ারেনের আস্তাবল থেকে পালানোর পর বেলিনডার র্যাঞ্চে গিয়ে ছিলো ও, কথাটা নিশ্চয়ই আগে শুনেছে সে, বিলই বলেছে। এক বার সাহায্যের জন্যে বেলিনডার কাছে গেছে, আবারও নিশ্চয়ই যাবে। মহা ধূর্ত লোক কাসলার।
বিকেলের দিকে ওয়াগোনারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লো ওরা কলিন, হ্যারলড, টেরি জেলারম্যান এবং ইনডো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিটকে পাহারা দিতে র্যাঞ্চে থাকতে বাধ্য হলে আরথার শেরিডান।
দিনের আলোয় খোলা প্রান্তর দিয়ে এগোনো বিপজ্জনক, জানে কলিন, কিন্তু বিপদের মধ্যেই তো আছে ওরা, তাছাড়া সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই পৌঁছুতে চায় ও। শহরের দক্ষিণে স্টোনি রিভারের দিকে কোণাকুণিভাবে এগোলে। ওরা, গোধূলির দিকে পৌঁছুলো ওখানে।
শহরের পুব দিকে একটা আস্তাবল অাছে, ঘোড়াগুলো ওখানে লুকিয়ে রাখা যায়, বললো হ্যারলড, অনেকদিন ধরে পরিত্যক্ত ওটা, খোদ মালিক ফ্রেড হাইলস, সে-ই কখনো ধারেকাছে যায় কিনা সন্দেহ।
মাথা দোলালো কলিন। নদীর তীরে গাছপালার মাঝে ঘোড়া লুকোনোর চেয়ে ভালো হবে সেটা। এই জায়গায় আবার শেরিফের মুখোমুখি হতে চায় না ও।
শহরে ঢুকে আগে আমি একবার রেকি করে আসবে, বললো হ্যারলড। তোমার জন্যে অপেক্ষা করার সময় এখানকার অন্ধি সন্ধি চেনা হয়ে গেছে। এবার আর আগের মতো ভুল করে ধরা পড়বে না।
অন্ধকার আরো গাঢ় হলো। পুব দিক থেকে শহরে ঢুকবে বলে ঘুরপথে এগোলে ওরা। হ্যারলড পথ দেখিয়ে ফ্রেড হাইলসের পরিত্যক্ত আস্তাবলে নিয়ে এলো ওদের, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।
আধ ঘণ্টা কাটলো।
অবশেষে গম্ভীর চেহারায় ফিরে এলো হ্যারলড।
ভালো দিনই বেছে নিয়েছি, বললো সে, ওয়ারেন এখন শহরে। বিল, এরিক মেইন আর লুইস প্যাটেনকেও পলকের জন্যে দেখলাম, ওরা ছাড়াও ওয়ারেনের বেশ কয়েকজন রাইডার এখন এখানে। রাস্তায় টহল দিচ্ছে জেফরি আরচার। চার্লস মুসেলমান আর ডেনিস স্মিথকেও দেখেছি। মনে হচ্ছে বেসিনের অর্ধেকের বেশি লোক এখন ভিড় জমিয়েছে এখানে। এর মানে হেলারের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছুনো সহজ হবে না। ওখানেই আগে যেতে চাও?
ভাবলো কলিন। হেলার আর বিলকে অপহরণ করা সম্ভব হলেও লাভ হবে শেষ পর্যন্ত। প্রীংগারভিল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে হেলারের হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই, যদি থাকেও, চতুর লোক সে, ওর কাছ থেকে আত্মঘাতী কোনো বিবৃতি আদায় করা সহজ হবে না।
বিল ওয়ারেন হয়তো শেষ পর্যন্ত মুখ খুলবে, কিন্তু ওর স্বীকারোক্তি আদালতে প্রতিষ্ঠা করবে কিভাবে? ওর পক্ষের উকিলের সামান্য বুদ্ধি থাকলেই সে দাবি করে বসবে যে মৃত্যু ভয়ে মিথ্যে জবানবন্দী দিতে বাধ্য হয়েছিলো বিল। কিন্তু আর কোনো পথ কি আছে? অনন্তকাল ধরে ওদের পক্ষে আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব নয়। কিছুদিন প্যসিকে ফাঁকি দেয়া যাবে, কিন্তু শোডাউনের পালা আসবে যখন? আউট-লদের মতো গ্রেপ্তারে বাধা দেয়ার অভিযোগ উঠবে ওদের বিরুদ্ধে, নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার কোনো উপায় থাকবে না–সোজা কথায় কোনো সুযোগই দেয়া হবে না।
সুতরাং এখন প্রাণ ছাড়া হারাবার মতো আর কিছুই নেই।
আগে হেলারের ওখানেই যাবার চেষ্টা করবো, মৃদু কণ্ঠে বললো কলিন।
তোমরা তিনজন ওকে সামলাতে পারবে? জিজ্ঞেস করলে। হ্যারলড, তাহলে আমি বিলের দিকে নজর রাখতে যেতে পারতাম।
ঠিক আছে, হ্যারলড, সেটাই করো, কিন্তু দেখো ধরা পড়ে যেয়ো না যেন! তাহলে আর রেহাই পেতে হবে না!
আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এলো ওরা, শহরের প্রধান সড়কের দিকে এগোলো। স্টেজ স্টেশনের কাছে আসার পর প্রথমে রাস্তা পার হলো কলিন, তারপর টেরি জেলারম্যান, সবশেষে হনডো হ্যারলড রয়ে গেল পেছনে। স্টেজ স্টেশনের পেছন থেকে কোণা কুণিভাবে হেলারের বাড়ির দিকে এগোলেতিনজন। অ্যাটনির বাড়ির জানালায় আলোর আভাস।
এবার? সোজা গিয়ে ধরে আনবো ব্যাটাকে? জিজ্ঞেস করলো এনডো।
না, বলল কলিন, আগে কিছু কথা আছে ওর সঙ্গে।
বাইরে কারো পাহারায় থাকার দরকার নেই?
না। সবাই একসঙ্গে থাকবো আমরা। সাক্ষী যত বেশি হবে আমার জন্যে তত ভালো। এসো।
হেলারের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল ওরা, দরজায় টোকা দিলে কলিন।
প্রায় সাথে সাথে দরজা খুলে ধরলো হেলার, ওদের দেখে এক সঙ্গে বিচিত্র ভাবের খেলা চললো তার চেহারায়, একেবারে পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলো, যেন মৃত্যুদণ্ড শোনার অপেক্ষা করছে কোনো আসামী।
টেরি জেলারম্যান আর হনডো স্টার্ন, বললে কলিন। ফোর্বস র্যাঞ্চ রাইডার, চেনো বোধ হয়?
হ্যাঁ, বললে হেলার। কিন্তু আমি তো জানতাম–মানে শুনেছি ওরা বেসিন ছেড়ে চলে গেছে।
ঠিকই শুনেছিলে, কিন্তু আবার ফিরে এসেছে, বললে কলিন। কিছুক্ষণের জন্যে ভেতরে আসতে পারি?
জবাবের অপেক্ষা করলো না কলিন, সামনে পা বাড়ালো, ফলে পিছু হটতে বাধ্য হলো অ্যাটর্নি।
দরজা বন্ধ করে কাটে ঠেস দিয়ে দাড়ালো ইনডো। কলিন আর অ্যাটর্নির পিছু পিছু কামরার ভেতর দিকে এগোলে জেলার ম্যান। ওরা থামলে একপাশে সরে গেল সে, ফাইল কেবিনেটের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে থাকলো। নিজের টেবিলের কাছে গিয়ে দাড়ালো হেলার, পেশাদারি একটা ভাব চেহারায়।
লোকজন তোমার নামে কি সব বলাবলি করছে জানো নিশ্চয়ই? শুরু করলো সে।
মাথা দোলালো কলিন।
কোথায় ও?
লিনডা?
হ্যাঁ, লিনডা ওয়ারেন। ওকে পালাতে সাহায্য করার মতো নিরেট বোকামি করতে গেলে কেন?
ওর জন্যে আমার খারাপ লাগছিলো, হয়তো সেজন্যে।
কোথায় ও?
শেষ খবর, প্রীংগারভিলে দেখা গেছে ওকে। তবে এতদিনে বোধ হয় ক্যানসাস সিটির দিকে রওনা হয়ে গেছে।
প্রমাণ করা গেলেই হয়, কলিন। কিংবা সময় থাকতেই যদি ওকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়–
সময় থাকতে মানে? কি বলছো?
নইলে ফাঁসির দড়ি থেকে গলা বাঁচাতে পারবে না। লোকে বলছে ওকে অপহরণ করে তারপর হত্যা করেছে তুমি।
গাল চুলকালো কলিন। মনে হয় এখনো স্প্রীংগারভিলেই আছে লিনডা। ওখানে পরিচিত কেউ নেই তোমার, যাকে চিঠি লিখে খোঁজ নিতে পারো?
পরিচিত কয়েকজনই আছে, বললো হেলার, তবে কারো সঙ্গেই তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। বছরখানেক ওদিকে যাওয়া হয় না।
পাইপ বের করার জন্যে পকেটে হাত ঢোকালে কলিন। শেরিডানের কাছে ধার করা তামাক ভরলে ওটায়। এই একটা মিথ্যে কথা কিছুই প্রমাণ করে না, ভাবলো, কিন্তু মিথ্যে বললো কেন? দু মাস আগেও স্প্রীংগারভিলে গিয়েছিলো সে, অথচ এখন বলছে বছর খানেক যাওয়া হয় না, কেন?
পাইপ ধরালো কলিন। হেলার, বললো ও, সেদিন বলেছিলে ওয়ারেনের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, আমাদের গরু বিক্রির পঁচিশ হাজার ডলার দিয়ে তাহলে সে কি করেছে? হ্যারলডের কাছে শোনা ঘটনা বলে জানতে চাইলো ও।
কোথাও লুকিয়ে রেখেছে হয়তো, এসব আমার জানার কথা নয়।
তাহলে তো ওয়ারেনের অবস্থা খারাপ বলা যায় না?
তা যায় না।
দু’মাস আগে, বাবা যখন স্প্রীংগারভিলে গরু চালান দিলো, ওয়ারেন গিয়েছিলো নাকি ওখানে?
না, আমি যদ্দূর জানি, না। গেলে বোকামি করতো।
তার মানে কাসলারকে বিশ্বাস করে সে?
কেন করবে না?
পঁচিশ হাজার ডলার সামান্য ব্যাপার নয়। কাসলার টাকা নিয়ে সটকে পড়লে কি করার থাকতে ওয়ারেনের? আমাদের লোকদের হত্যার দায় স্বীকার করা না করে কি আইনের সাহায্য নিতে পারতো? এতটাকা নিয়ে পালিয়ে যাবার সুযোগ জীবনে হাজার বার মেলে না।
বুদ্ধিটা বোধ হয় কাসলারের মাথায় খেলেনি।
বটে। আসলে কি ঘটেছিলো আমার কাছে শোনো। কাসলার কে ভারমুক্ত করার জন্যে ঠিক সেই সময় আরো একজন ছিলো প্রীংগারভিলে। ওয়ারেনের, বিশ্বাসভাজন একজন? কে হতে পারে?
ওর ছেলে?
বিল? আমার মনে হয় না। কাসলারকে সামলানোর সাধ্য ওর নেই। অন্য কেউ। কে হতে পারে? ভাবো, মাথা খাটাও।
পাতলা চুলে হাত চালালো হেলার, হনডো অর জেলারম্যানের দিকে তাকালো সে, পেশাদারি ভাব খসে পড়েছে চেহারা থেকে। ধেত্তের, কলিন, বললো সে। সব কথা জানা কি আমার পক্ষে সম্ভব, চিন্তা করলে হয়তো বুঝতে পারবো, কিন্তু —
তাহলে এক কাজ করে। আজ আমরা কিছু তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালাবো। কপাল ভালো হলে হয়তো এমন কাউকে পেয়ে যাব যে সব কিছু জানে, জেরা করতে র্যাঞ্চে নিয়ে যাব তাকে, আসবে আমাদের সঙ্গে? ওর জবানবন্দীর একজন নিরপেক্ষ সাক্ষী দরকার হবে।
তার মানে আরো একজনকে অপহরণ করবে?
কথাটা অবশ্য এভাবেও বলা যায়।
তারপর ওকে র্যাঞ্চে নিয়ে যাবে-ফোর্বস র্যাঞ্চে?
ঠিক।
মাথা নাড়লে অ্যাটনি। কাল সকালে প্রথমেই ওখানে হামলা চালাবে প্যসি। সেরকমই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তার আগেই সত্যি কথাটা জানতে পারবো আশা করি।
কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হবে না। কোনো কিছু শোনার মুডে নেই এখন ওয়ারেন।
শেরিফ, শুনবে।
তা শুনতে পারে। কিন্তু ওকে শোনানোর সুযোগ পাবে না। তারচেয়ে লোকটাকে এখানে নিয়ে এসো, আজই।
শহর আমাদের জন্যে নিরাপদ নয়, বললো কলিন, ভাবছি র্যাঞ্চেই সুযোগটা নেবো। যাবে আমাদের সঙ্গে?
ভুরু কোঁচকালো হেলার। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই, সকালে ব্যাঙ্কে জরুরী একটা মিটিং আছে।
মিটিং পরে করলেও চলবে।
তা কি করে সম্ভব?
কিন্তু উপায় নেই, হেলার।
সন্ত্রস্ত চেহারায় এদিক ওদিক তাকালো হেলার, এক পা পিছিয়ে গেল।
এসব কি বলছো? নিশ্চয়ই—
এভাবে বলা যায় কথাটা, বললে কলিন, আমাদের সঙ্গে আজ ফোর্বস র্যাঞ্চে যাচ্ছো তুমি, ইচ্ছেয় অথবা অনিচ্ছায়। যে কোনো একটা বেছে নাও।
আরেক পা পিছিয়ে গেল হেলার। হাঁপাচ্ছে। ঘনঘন নজর বোলাচ্ছে কামরার চারপাশে, অদৃশ্য কোনো শক্তি বুঝি সাহায্য করতে আসবে ওকে! আচমকা পেছন দরজার দিকে দৌড় দিলো সে।
দরজার কাছে পৌঁছানোর আগেই তাকে ধরে ফেললো টেরি জেলারম্যান, একটা ঝলকের মতো ওঠানামা করলো ওর পিস্তলটা। হাড়ের সঙ্গে ইস্পাতের সংঘর্ষের বিশ্রী শব্দ শোনা গেল, মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো হেলার, বেহুশ।
ব্যাটা আস্ত ইবলিস, বললো জেলারম্যান, যেভাবেই হোক ও-ও আমাদের শত্রু।
মাথা দোলালো কলিন। কাঁধে তুলে নাও ওকে, পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে আমরা।
১৫. দালানের পেছনে এসে
দালানের পেছনে এসে অন্ধকার ছায়ায় কাঁধের ওপর থেকে হেলারের অচেতনদেহ নামিয়ে ওর ওপর ঝুঁকে পড়লো কলিন।
বেশি জোরে মেরে ফেললাম না তো। বিব্রত কণ্ঠে বললো জেলারম্যান।
না না, দেখো, এখুনি চোখ মেলে তাকাবে,সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললো কলিন। হনডো, ওপাশে চলে যাও তুমি, রাস্তার দিকে কড়া নজর রাখে, ও হাঁটার মতো সামলে উঠুক, ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, বয়ে নিতে গেলে আবার সবার চোখে পড়ে যাবো।
ভূতের মতো নিঃশব্দে চলে গেল হনডো স্টার্ন।
আসলে এত জোরে মারতে চাইনি, আবার বললো জেলার ম্যান।
হাসলে কলিন। ভুলে যাও, টেরি। শিগগিরই আপসোস করবে আরো জোরে মারনি বলে।
অপেক্ষা করতে লাগলো কলিন। অবশেষে ককিয়ে উঠলো হেলার, উঠে বসতে গিয়ে ব্যর্থ হলো প্রথমে, পরের চেষ্টায় উঠে বসতে পারলো, বিড়বিড় করে বকতে লাগলো আপনমনে।
কি অবস্থা? জানতে চাইলে কলিন।
কি অবস্থা মানে? ঢোক গিললো হেলার, বাড়ি খেলাম কিসের সঙ্গে?
গান ব্যারেল। তোমার কপাল ভালো, বুলেটের বাড়ি খাওনি।
অবশেষে সংবিৎ ফিরে পেলো হেলার, ক্রোধে পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠলোতার চেহারা। কলিন, এ-অন্যায়, বর্বরতা! আমি তো কিছুই বুঝছি না!
বুঝবে, বললো কলিন। তা হাঁটতে পারবে এবার?
হাঁটতে-টাটতে পারবো না!
তাই নাকি? ফের মার খাবার সাধ?
সাহস আছে?
দেখতে চাও? ভয় করবো কেন?
লম্বা করে দম নিলো অ্যাটনি, জেলারম্যানের দিকে তাকালো, হাতে পিস্তল নাচাচ্ছে সে।
আমাকে নিয়ে কি করবে, কলিন?
একটু আগে যা বললাম, র্যাঞ্চে নিয়ে যাচ্ছি তোমায়, ওখানে একজনকে জেরা করা হবে, ওর জবানবন্দীর সাক্ষী হবে তুমি।
ব্যস?
অন্য কিছু কি বলেছি? বললো কলিন, তা, হেলার, স্বেচ্ছায় ঘোড়ায় চেপে যাবে না বয়ে নিয়ে যেতে হবে?
নিজেই যাচ্ছি, বাবা! বললো হেলার, হাঁটতে পারলে হয়!
ওকে দাড়াতে সাহায্য করলো কলিন, কোণ ঘুরে দেয়াল ঘেষে এগোলো ওরা, হনডো ইশারায় থামালো।
রাস্তার উল্টোদিকের ওই গাছটার আড়ালে কে যেন লুকিয়ে আছে, ফিসফিস করে বললো সে। হ্যারলড নাকি অন্য কেউ বুঝছি না।
গাছটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো কলিন, নিকষ অন্ধকার, কাউকে দেখা গেল না। অস্থির বোধ করলো ও। ঘোড়ার পিঠে চেপে বসার আগেই ধরা পড়ে গেলে মুশকিল, বেশ দুরে রেখে এসেছে ওগুলো।
তোমরা এখানে দাড়াও, বললো হনডে, আমি দেখি ওর পরিচয় বের করা যায় কিনা।
কলিন ভেবেছিলো অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ঘুরপথে গাছটার দিকে যাবে হনডো, তেমন কিছু করলো না সে, নাক বরাবর হাঁটা ধরলো; বাড়ির সামনে গিয়ে কোণাকুণিভাবে রাস্তার উল্টোদিকে রওনা হলো। চারপাশে অন্ধকার, কিন্তু ওখানে যেই থাকুক হনডোকে ঠিক দেখতে পাবে। পিস্তল বের করে প্রস্তুত হলো কলিন।
টেরি, বললো ও। হেলারের দিকে চোখ রাখো।
দ্রুত সামনে এগোলো ও, হনডো এভাবে ঝুঁকি নেয়ায় কিছুটা ক্ষুব্ধ, ওকে বাধা দেয়া উচিত ছিলো, ভাবছে।
হঠাৎ কে যেন নড়ে উঠলো সেই গাছটার নিচে, অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে এলো একটা ছায়ামূতি, হনডোর দিকে এগিয়ে এলো, এবার হ্যারলড লেভিটকে চিনতে পারলো কলিন, হাঁপ ছাড়লো ও।
হনডো আর হ্যারলড ফিরে আসার অপেক্ষা করলে কলিন। ওরা আসার পর বললো, এটা কি করলে, হনডো, হ্যারলডের জায়গায় শত্রুপক্ষের কেউ হতো যদি?
জানি না, বললো হনডো, কিন্তু হ্যারলডের বেলায় লুকোচুরি খেলার চেয়ে এরকম ঝুঁকি নেয়া ঢের ভালো অন্ধকারে হ্যারলডের সঙ্গে লুকোচুরির মানে সেধে ঝামেলায় জড়ানো।
খামোকা তেল দিয়ো না, বললো হ্যারলড, সপ্রতিভ কণ্ঠ।
হাতের পিঠে মুখ মুছলে কলিন, ঘামে ভিজে গেল হাত।
লেন হডসনের বাসায় এখন বিল ওয়ারেন, জানালো হ্যারলড।
বাড়িটা কোথায়?
বেশি দূরে না, চলো নিয়ে যাচ্ছি।
আর কেউ নেই ওখানে?
মায়ের কাছে থাকে মেয়েটা। মহিলা দর্জির কাজ করে, তুমি এখানে থাকতে মিসেস ফিশার একটা দোকান চালাতো, মনে আছে? সেটাই এখন চালায় ওরা।
হনডোর বাহুতে চাপড় দিলো কলিন, ‘তুমি’ আর টেরি হেলারকে ঘোড়ার কাছে নিয়ে যাও, দুজনের মাঝখানে রাখবে ওকে, লিভারি আস্তাবল পেরিয়ে গিয়ে তারপর রাস্তা পার হবে। আমি আর হ্যারলড যাচ্ছি বিল ওয়ারেনকে ধরে আনতে। হেলার যদি ঝামেলা করে ব্যবস্থা নেবে, মায়া দেখতে যেয়ো না।
হেলার যাতে শুনতে পায় সেজন্যে শেষের কথাগুলো একটু জোরেই বললো কলিন। দম দেয়া পুতুলের মতো হলো আর জেলারম্যানের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলে হেলার।
এখনো কোনো ঝামেলা বাধেনি, বললো হ্যারলড।
মাথা দোলালো কলিন। কিন্তু এখানে আসল কাজ বাকি।
শহরের প্রায় শেষ সীমায় একটা ছোট্ট বাড়ি, এখানেই মায়ের সঙ্গে থাকে এলেন হডসন। উঠোনের বেড়ার সঙ্গে একটা ঘোড়া বাধা আছে দেখতে পেলো কলিন, বিল ওয়ারেনের ঘোড়া। জানালায় পর্দা টানানো, ভেতরে আলো জ্বলছে বোঝা যায়।
সোজা গিয়ে দরজায় টোকা দেবো আমি, বললে কলিন। এলেন কিংবা ওর মা যদি দরজা খোলে, আমাকে চিনতে পারবে, আমি বলবো, বিলের কাছে একটা খবর পৌঁছে দিতে এসেছি। ওরা অবিশ্বাস করবে না; বিল দরজা খুলে বেরোলে সাথে সাথে ওর বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে বের করে নিয়ে আসবে।
শুনে তো মনে হচ্ছে পানির মত সহজ, বললো হ্যারলড।
দরজা পর্যন্ত একসঙ্গে এগোলো ওরা। কবাটে টোকা দিয়ে অপেক্ষায় রইলো কলিন, ডানহাত পিস্তলের বাটে। দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেছে হ্যারলড।
ভেতর থেকে চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, বিল। আমি দেখছি, মিসেস হডসন।
ঠিক এই সময় রাস্তায় ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনলে কলিন, এদিকেই আসছে। ঝট করে কাধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকালো, ঠিকই, কে যেন আসছে। অন্ধকারে একজন ঘোড়সওয়ারের অবয়ব দেখা গেল, ধীরে সুস্থে এগোচ্ছে এ-বাড়ির দিকে।
ধরা পড়া গেল কি? বিল আর নবাগত ঘোড়সওয়ারের মাঝখানে পড়ে যাচ্ছে। বিল দরজা খোলার আগেই সটকে পড়া যায়, কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে যাবার আগেই ওই ঘোড়সওয়ার দেখে ফেলবে। কলিনের মাথায় চিন্তার ঝড়। ও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ঘোড়সওয়ার নিজের পথে চলে গেলে চিন্তা নেই, কিন্তু এখানে হাজির হলেই মুসিবত। কিন্তু নাহ, এখন অার পালানো সম্ভব নয়। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে খেলায় নেমেছে ওর, বিল ওয়ারেনকে যেভাবেই হোক ধরে নিয়ে যেতে হবে।
হ্যারলড, ফিসফিসিয়ে বললো কলিন, ওই কোণে চলে যাও তুমি। ঘোড়াঅলাকে কাভার করবে, পারলে দুর করো ব্যাটাকে।
কথা মতো কোণের দিকে গেল হ্যারলড, এখন দরজা খুললে ঘরের আলো ওই পর্যন্ত যাবে না। গেটের কাছে পৌঁছুলো ঘোড় সওয়ার, ঠিক এই সময় ঘোরা শুরু করলো দরজার হাতল। ঘাড় ফেরানোর সাহস হলো না কলিনের, পেছন থেকে ওকে না-ও চিনতে পারে আগন্তুক। কিন্তু বিল ওয়ারেন ঠিকই চিনবে, তার মানে ওকেই সামলাতে হবে।
পিস্তলটা শরীরের সঙ্গে চেপে ধরলো কলিন। দরজা খুলে দাড়া লো বিল ওয়ারেন, বিস্ময়ে বিকৃত হয়ে গেল তার চেহারা, রক্ত সরে গেছে। হোলসটারের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও হাল ছেড়ে দিলো। ফোর্বস! প্রায় ককিয়ে উঠলো সে, আর কোনো কথা বের হলো না তার মুখ থেকে।
অ্যাই, বিল! গেট থেকে ডাকলো নবাগত ঘোড়সওয়ার। তোমার বাবা যেতে বলেছে, এখুনি। তোমার সঙ্গে ওটা আবার কে?
ওকে বিদেয় করো, অস্পষ্ট কণ্ঠে নির্দেশ দিলো কলিন, বলে দাও একটু পড়ে যাচ্ছে।
ঠোঁটজোড়া নড়ে উঠলো বিলের, কোনো শব্দ বেরোলো না। ঘর থেকে বেরিয়ে আসা লণ্ঠনের ম্লান আলোয় অসুস্থ দেখাচ্ছে, যেন পান্ডু রোগি। কপাল আর ঠোঁটে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
আরে, হলো কি, কি হচ্ছে? গেট থেকে সন্দিহান কণ্ঠে জানতে চাইলে আগন্তুক, ব্যাপারটা কি, বিল?
এখুনি পিস্তল বের করবে লোকটা, ভালো কলিন। পেটের ভেতর গুড়গুড় করে উঠলো, গলার কাছে মনে হচ্ছে কিযেন আটকে রয়েছে। ঘাম জমে উঠেছে কপালে। হ্যারলড, বললো ও, ওই ব্যাটাকে দূর করে।
কোণের আবছা অন্ধকার ছেড়ে এলে হ্যারলড লেভিট, হাতে উদ্যত পিস্তল। ফিরে যাও, রয়েস! বিলকে নিয়ে একটু পরেই আসছি আমরা।
নিমেষে উঠে এলো হ্যারলডের পিস্তল, আগুন ওগরালো। গেটের ওখান থেকে ছোড়া গুলির শব্দ শুনতে পেলো কলিন। তীব্র কর্কশ কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো রয়েস। আগেই ঘোড় ঘুরিয়ে নিয়েছিলো বোধ হয়, কারণ পরক্ষণে ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠলো, মিলিয়ে গেল ক্রমশ।
ঘুরে তাকানোর ইচ্ছে বহু কষ্টে দমন করে রেখেছে কলিন। বিল কে কাভার করতে হচ্ছে, চোখ সরানোর উপায় নেই। বিলের পেছনে এলেন হডসন আর তার মায়ের উপস্থিতি টের পেয়েছিলো কলিন, গোলাগুলি শুরু হবার আগ মুহূর্তে সরে গেছে। এখন হয়তো কোনো এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে কিংবা পেছন দরজা গলে বেরিয়ে গেছে।
এবার এখান থেকে পালানো উচিত, ভাবলো কলিন, সম্ভব হলে ওয়াগোনার ছেড়েই চলে যেতে হবে। দরজার কাছ থেকে সরে এলো ও, ইশারা করলো বিলকে, চলো, বললো, আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছো তুমি।
আমি–কোথায়? এভাবে বাঁচতে পারবে না, ফোর্বস।
চেষ্টা করতে দোষ কি, বললো কলিন। এখন বলে ফেলো, এখানে মরতে চাও, নাকি বেঁচে থাকার একটা সুযোগ নেবে? জলদি।
পিস্তল উঁচু করলো ও, ট্রিগারে চেপে বসলো তর্জনী। কলিনের চেহারা দেখে বিলের স্থির বিশ্বাস জন্মালে ঠিক ট্রিগার টেনে দেবে ও। বিনা বাক্যব্যয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো সে। ওর হোলসটার থেকে পিস্তল বের করে পকেটে ঢোকালে কলিন, পাশে এসে দাঁড়ালো হ্যারলড।
হেনরী রয়েস এসেছিলো, বললো সে, আমার গুলিটা লেগেছে যদিও, কিন্তু তেমন চোট পায়নি বোধ হয়, তাহলে স্যাডল থেকে পড়ে যেতো। বেশি সময় নেই হাতে, একটু পরেই ফিরে আসবে ব্যাটা।
তার আগেই আমরা ভাগছি, বললে কলিন। বিলের ঘোড়া থেকে দড়িটা নিয়ে এসো, ওর হাত দুটো পেছনে নিয়ে বাঁধে, তারপর ঠেলে তুলে দাও স্যাডলে। ওকে নিয়ে শহর থেকে প্রথমে পুবে যাবো আমি, তারপর ঘুরে নদীর পশ্চিম কিনারে আসবো। তুমি অন্যদের সঙ্গে করে ওখানে চলে এসো। আসার পথে যেখান টায় নদী পার হয়েছি ওখানেই একসঙ্গে জড়ো হব আমরা।
বিলের ঘোড়ার দিকে এগিয়ে গেল হ্যারলড।
বাবা, তোমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে, গজগজ করে বললো বিল। বাবাকে চেনো না। তোমার সঙ্গে ওর—
চলো, মিয়া, বললে কলিন, পিস্তল দিয়ে খোঁচা দিলো বিলের কিডনিতে।
মাঝরাতের অনেক পরে দুই বন্দীসহ ফোর্বস র্যাঞ্চে পৌঁছুলো ওরা। একটা দল ওদের ধাওয়া করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ওরা শেষ পর্যন্ত কোথায় খসে পড়েছে জানে না কলিন। বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে ওর। সকাল হলেই ওদের ট্রেইল পেয়ে যাবে ওয়ারেনরা, এখানে পৌঁছে যেতে দেরি হবে না। সম্ভবত দুপুরের আগেই এসে পড়বে অতিথিরা, অবশ্য ততক্ষণে এখান থেকে ওরা উধাও হয়ে যাবে।
আকাশে মেঘ জমছে। বাতাসে, ঠাণ্ডা একটা ভাব। আবার ঝড় আসতে পারে, তবে তার দেরি আছে, বৃষ্টিতে আবার ট্রেইল মুছে যাবার আশা না করাই ভালো।
উঠোনে ওদের সঙ্গে মিলিত হলো শেরিডান। কলিনকে এক পাশে নিয়ে এলো সে। একটা কাজ করে ফেলেছি, ঠিক হয়নি বোধ হয়, উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললো, কিন্তু কি করবো ওকে আটকে রাখা ছাড়া উপায় ছিলো না, ভদ্রমহিলা ব্যাপারটা সুনজরে দেখছে না।
ভদ্রমহিলা? কাকে আবার?
বেলিনডা গ্রেবার।
বেলিনডা, এখানে?
হ্যাঁ, র্যাঞ্চ হাউসে। এখন ঘুমাচ্ছে অবশ্য, কিন্তু যতক্ষণ জেগে ছিলো এক মুহূর্তের জন্যেও থামেনি, গালাগালি করে ভূত ছাড়িয়েছে আমার। যতটা মনে হয় তত সোজা মানুষ না ও।
এখানে এলো কিভাবে? চার্লস-এর র্যাঞ্চ থেকে শহরে যাচ্ছিলো, যাবার পথে ডার্ক পিটের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো-ডাক পিট এক সময় গ্রেবারের ওখানে কাজ করতো বুঝতেই পারছে ডার্ক পিটের চেহারা দেখে সন্দিহান হয়ে ওঠে সে, আমি টের পেয়ে ভাবলাম আটকে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নইলে হয়তো ওয়াগোনারে গিয়ে যার তার কাছে বলে বসতো।
গলা খুলে হাসতে ইচ্ছে করছে কলিনের, তবু গম্ভীরভাবে মাথা দোলালো, বেচারা শেরিডান। কাজটা অবশ্য খারাপ করেনি।
বারান্দার দরজা খোলার শব্দ পেলো কলিন, ম্লান আলোয় বেলিনডার ছিপছিপে কাঠামো চোখে পড়লো। বারান্দার কিনারে এসে কোরালের দিকে তাকালো সে। ওখানে ঘোড়ার পিঠ থেকে স্যাডল খসাচ্ছে সবাই।
ফোর্বস। চিৎকার করে ডাকলো বেলিনডা, ফোর্বস, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি।
আসছি! বললো কলিন।
আবার কোরালে ফিরে গেল ও, হ্যারলডকে খুঁজে বের করলো। হেলার আর বিলকে ঘরে নিয়ে জেরা করার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু বেলিন্ডা থাকায় এখন আর তা সম্ভব নয়।
বেলিনডা আবার কোত্থেকে উদয় হলো! গজগজ করে উঠলো হ্যারলড।
চার্লস রেডফিলডের র্যাঞ্চ থেকে, শহরে যাবার পথে এখানে ঢু মারতে এসেছিলো। ওয়ারেন আর হেলারকে বরং বার্ন-এ নিয়ে যাও তোমরা, বাধন খুলে দিয়ো না যেন। বেলিনডার সঙ্গে কথা বলেই আসছি আমি।
বিল ওয়ারেনকে ধোলাই শুরু করবো?
কেন নয়?
ঠিক জানো হামলার সময় সে ছিলো।
লিনডা বলেছে।
সেরাতে টম ক্রসেন নামে একটা ছেলেও মারা গিয়েছিলো–মাত্র সতেরো বছরের টগবগে তরুণ, এতো ভালো ছেলে আর হয় না, খুব মন দিয়ে কাজ করতো। কোনো সময় ‘না’ করতো না। বুদ্ধিমান, ধীর-স্থির স্বভাবের ছিলো ও; ছেলেটাকে আমার খুব ভালো লাগতো, সবাই পছন্দ করতো ওকে–বেচারা–জীবন শুরু করার আগেই ওকে হত্যা করা হলো।
হাত বাড়িয়ে হ্যারলডের কাধ স্পর্শ করলে কলিন।
সামলে। আমি নিরেট তথ্য চাই, যেটা প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগানো যাবে। বদলা নেবার সময় এখনো আসেনি।
জানি।
কথাটা একটু খেয়াল রেখো।
ওয়ারেন রাইডাররা আসার আগে কতটা সময় পাবো আমরা?
কাঁধ ঝাঁকালো কলিন।
ঠিক আছে। যাও, তাড়াতাড়ি বেলিনডার সঙ্গে কথা সেরে আসো।
আচ্ছা, বললো কলিন।
ঘুরে ধীর পায়ে র্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগিয়ে গেল কলিন, বেলিনডার ছায়ামূতির দিকে তাকিয়ে মৃদু উত্তেজনা বোধ করলো।
১৬. র্যাঞ্চ হাউসের পারলার
র্যাঞ্চ হাউসের পারলার। রাগে আগুন হয়ে আছে বেলিনডা, অবিরাম বকছে।
ঘরে আসার দেড় মিনিট পার হবার আগেই কয়েক দফা দাবি পেশ করে বসেছে বেলিনডা: ওকে ছেড়ে দিতে হবে এবং তার আগে ব্যাখ্যা করতে হবে আটকে রাখা হলো কেন; হাত পা বেঁধে দুজন কে বার্ন-এ নিয়ে যেতে দেখেছে সে, তাদের পরিচয় জানাতে হবে।
পুরোন কার্পেটের ওপর পায়চারি করছে কলিন ফোর্বস, শিগগিরই শান্ত হবে বেলিনডা, আশা করছে।
কখন যাচ্ছি এখান থেকে। এই নিয়ে তৃতীয় বারের মতো জানতে চাইলে বেলিনডা।
তোমার যখন ইচ্ছে, একই জবাব দিলো কলিন, কিন্তু এই রাত বিরেতে একা বেরোনো কি ঠিক হবে? সঙ্গে দেব, তেমন লোকও নেই আমার কাছে।
তোমার ধারণা এখানে নিরাপদে আছি আমি। ঝাঁঝিয়ে উঠলো। বেলিনডা, বেসিনের কেউ একমত হবে না তোমার সঙ্গে।
ধ ঝাঁকিয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করলে কলিন। তোমার যা মর্জি, বেলিনডা, আমি কিছুই বলবো না; ইচ্ছে হলে সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো নয়তে এখুনি রওনা হয়ে যেতে পারো, কেউ আটকাবে না।
বার্ন-এ কাদের আটকে রেখেছো?
দুজন লোককে জেরা করার জন্যে।
কেন?
তা জেনে কি লাভ? বলেছি তো চাইলে এখুনি চলে যেতে পারো তুমি।
মেঝেতে পা ঠুকলো বেলিনডা। কারা ওরা বলো? ওরা তোমার প্রশ্নের জবাব না দিলে কি করা হবে?
দেবে, গম্ভীর কণ্ঠে বললো কলিন, পায়চারি থামলো। আচ্ছা, আমি তো তোমাকেও সাক্ষী হিসেবে সঙ্গে রাখতে পারি।
কথাটা পছন্দ হলো কলিনের, আবার কিছু সময় পায়চারি করলো, ভাবলো।
বেলিনডা তোমাকে এখন এমন একটা কথা বলবো আমি যা এখনো বেসিনের কারো জানা নেই। মন দিয়ে শোনো। এটা তো জানো যে, মাস দুই আগে আমার বাবা প্রায় হাজার গরুর একটা পাল বিক্রির জন্য স্প্রীংগারভিলে চালান দিয়েছিলো, সেই ক্যাটল ড্রাইভে আটজন কাউহ্যানড ছিলো, ট্রেইলস ছিলো আর্নেস্ট হল। ওকে তুমি চিনতে।
হ্যাঁ, সেটা আগেও বলেছি, ভুরু কুচকে বললো বেলিনডা, বেশ পছন্দ করতাম লোকটাকে। কেন যে টাকা নিয়ে পালালো সেটা আজও এক রহস্য।
আমি বলেছিলাম, পালায়নি, বললো কলিন। আমাদের গরু স্প্রীংগারভিলে ঠিকই পৌঁছেছিলো, কিন্তু তখন আমাদের কোনো লোক ছিলো না ওগুলোর সঙ্গে। পরে ওদের খোঁজে গিয়েছিলো বাবা, স্প্রীংগারভিলের উত্তরে একদিনের দুরত্বে ট্রেইলের কাছে পাঁচটা কবর খুঁজে পায়, তিনটে কবরের খোঁজে পাওয়া যায়নি, বুঝতেই পারছো, ট্রেইল ক্রুর প্রত্যেককে হত্যা করা হয়েছিলো।
কিন্তু আমি শুনেছি—
ভুল শুনেছো। আসল ঘটনা হলো স্প্রীংগারভিলের উত্তরে একদিনের দুরত্বে ওয়ারেন রাইডাররা হামলা চালায় ওদের ওপর, গরু ছিনতাই করে ওরা এবং ট্রেইল ক্রুর সবাইকে হত্যা করে গরু নিয়ে স্প্রীংগারভিলে যায় এবং আর্নেস্ট হলের নাম ভাঁড়িয়ে গরু বিক্রির টাকা গ্রহণ করে কাসলার।
টলে উঠলো বেলিনডা, চেতনা হারাবে বলে মনে হলো।
বিশ্বাস করি না! ক্লাইভ কখনো—
ক্লাইভের সঙ্গে তোমার প্রেম আছে নাকি?
নাহ। কিন্তু—
কাসলারের সঙ্গে বিলও ছিলো।
না!
আরো দুজনের নাম বলতে পারি আমি, বললো কলিন। এখন না, সকালে প্যসির সামনে বলবো–যদি বার্নের দুই মেহমান আশানুরূপ সহযোগিতা করে।
এলোমেলো পা ফেলে চামড়া মোড়া চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেল বেলিনডা, বসে পড়লো, রুমাল বের করে কিনারে লাগানো লেসে হাত বোলালো কয়েক মুহূর্ত, তারপর আবার রেখে দিলো ওটা।
কথা থামালো না কলিন। ড্যানিয়েল ফোর্বস কেন ওয়ায়েনের গরু স্ট্যামপিড করলো, কেন ও লিনডাকে পালাতে সাহায্য করতে গেল, হ্যারলড আর অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ হলো সব ব্যাখ্যা করলো একে একে। বেলিনডা ওর কথা শুনেছে কিনা বুঝতে পারলো না। একদৃষ্টে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা।
বার্নের দুজন–ওরা কারা? অবশেষে জানতে চাইলে সে।
বিল ওয়ারেন এবং অ্যারন হেলার।
হেলার? ওর সাথে এসবের সম্পর্ক কি?
আমার সন্দেহ স্প্রীংগারভিলে কাসলারের কাছ থেকে সেই আমাদের গরু বিক্রির টাকা নিয়েছিলে–এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।
টোকা পড়ল দরজায়।
হনডো। বেলিনডার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করতে লাগলো সে।
বলে ফেলো, বললো কলিন, ওর সামনে বলতে অসুবিধে নেই।
বিলের মুখে খই ফুটছে, জানালো হনডে।
হেলার?
ওর পালা এখনো শুরু হয়নি।
আমি আগে আসি, তারপর শুরু করো।
মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে গেল হন।
থাকতে চাও সকাল অবধি? বেলিনডাকে জিজ্ঞেস করলো কলিন।
আমিও বার্নে যাবো তোমার সঙ্গে।
এসব হয়তো তোমার ভালো লাগবে না। নোংরা ব্যাপার, বেলিনডা, কিন্তু কি করবো, আর কোনো উপায় নেই আমার। তুমি বরং এখানেই অপেক্ষা
না, আমি যাবো।
দরজার দিকে এগোলো কলিন। ওর সঙ্গে বেরিয়ে এলো বেলিনডা।
দমকা হাওয়া বইছে। পতপত করছে বেলিনডার স্কার্ট, উড়িয়ে নিতে চাইছে কলিনের হ্যাট। হ্যাটটা ধরে রেখে ঘাড় কাত করে আকা শের দিকে তাকালো কলিন। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, কিন্তু ঝড় আসতে এখনো ঢের দেরি। কোনো সুবিধে হবে না আমাদের-ভাবলো কলিন। অসময়ে শুরু হবে ঝড়ের তাণ্ডব।
বেলিনডাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো কলিন। বার্নের দরজা খুলে প্রথমে বেলিনডাকে ঢুকতে দিয়ে তারপর নিজে ঢুকলো। আস্তাবলের ভেতরের অবস্থা দেখামাত্র সেইদিন রাতের ওয়ারেনের আস্তাবলের কথা মনে পড়ে গেল। এখানেও সেই একই রকম ছাদের কড়িকাঠে তিনটে লণ্ঠন ঝুলছে। একটা থামের সঙ্গে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে হেলারকে। মেঝেতে শোয়া বিল ওয়ারেন, ওকে ঘিরে দাড়িয়ে রয়েছে হনডো, শেরিডান এবং হ্যারলড লেভিট, ফুলে ঢোল বিলের চোখ মুখ, রক্ত আর ধুলোয় কাদাকাদা।
নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল বেলিনডা, ঠেলে আসা চিৎকার টা প্রাণপণ চেষ্টায় চেপে রাখলো সে। হনডো আর শেরিডান ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিলের দিকে তাকিয়ে আছে আরন হেলার। বিলের ওপর ঝুঁকে রয়েছে হ্যারলড লেভিট, অনড়।
আবার শোনাও! গর্জন করে উঠলো সে।
হেলার নিয়েছে টাকাটা, দুর্বল কণ্ঠে বললে বিল, আমার সামনে ক্লাইভের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে ও।
আর কে দেখেছে?
কেউ না।
টাকাটা হাত বদল হয়েছে কোন্ জায়গায়?
স্প্রীংগারভিল কোর্ট হাউসের পেছনের গলিতে।
পিছিয়ে এলে হ্যারলড লেভিট, সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
শুনলে তো কলিন?
মাথা দোলালো কলিন। টেরি জেলারম্যান কোথায়?
বাইরে, রাস্তায় নজর রাখছে। পালা করে পাহারা দিচ্ছি আমরা, একটু পরেই ওর পালা শেষ হবে।
আমাদের প্রিয় উইলিয়াম আর কি জানালো?
সব। হত্যাকাণ্ডে অংশ গ্রহণকারী কাসলারের সব কটা সঙ্গীর নাম বলেছে। অন্ধকারে লুকিয়ে কিভাবে ক্যামপফায়ারের দিকে গেছে ওরা, প্রত্যেককেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল একজন করে হত্যা করার। পিস্তল স্থির করে অপেক্ষা করছিলো, সঙ্কেত পাওয়ামাত্র একসঙ্গে গুলি ছুড়েছে, আগুনের কাছে ফাঁকায় ছিলো আমাদের ছেলের, সহজ নিশানা, বাচার সুযোগই পায়নি, নৈশ প্রহরীরা একটা সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে পারেনি; মাত্র দু-তিনজন ছিলো ওরা, তাড়া করে ওদেরও খতম করে শয়তানের বাচ্চারা।
পরিকল্পনাটা কার?
এই প্রসঙ্গে এখনো আসিনি।
সামনে এগোলো কলিন। বিলের পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো, তার পর জানতে চাইলে, পরিকল্পনাটা কার ছিলো, বিল? কার মাথা থেকে বেরিয়েছিলো বুদ্ধিটা?
জানি না, সত্যি। থেতলানো ঠোঁটের ফাঁকে বিড়বিড় করে উঠলো বিল। কোথায় যাচ্ছি না জেনেই সেদিন বেড়িয়ে পড়েছিলাম আমি।
হেলারকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, বললে ইনডো।
উঠে দাড়ালো কলিন, ঘুরে হেলারের মুখোমুখি হলো। জানো তুমি?
নিশ্চয়ই না! বললে হেলার। তুমি বড় বাড়াবাড়ি করছে, কলিন। ওয়ারেন সম্পর্কে আমার মনোভাব তুমি জানো!
সে তো তোমার মুখে শোনা।
আমি কি মিথ্যে বলেছি? আমি—
রাখো!
কোন জিনিসটা গোপন করেছি, বলো?
বছর খানেকের মধ্যে নাকি স্প্রীংগারভিলে যাওনি তুমি? অথচ কাসলার আমাদের গরু বিক্রি করার সময় ওখানেই ছিলে তুমি।
কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। যাই হোক, আমি কি করে। জানবো যে, সেদিনই তোমাদের গরু স্প্রীংগারভিলে গেছে? অন্য কাজে ওখানে গিয়েছিলাম আমি, অ্যামিটি ক্রীক পানি বিরোধ সংক্রান্ত একটা মামলার নিষ্পত্তির ব্যাপার ছিলো।
কোর্ট হাউসের পেছনের গলিতে কাসলারের সঙ্গে দেখা হয়নি বলতে চাও?
নিশ্চয়ই! বিল মিথ্যে কথা বলেছে। ওরা বাপ-বেটা দুজনেই আমাকে ঘৃণা করে।
মেরামত শুরু করার আগে বিলও আবোলতাবোল বকছিলো, বললো হ্যারলড লেভিট।
ঘাড় ফিরিয়ে সঙ্গীদের দিকে তাকালো কলিন। দৃশ্যটা দেখা মতো, ভাবলো, একপাশে দাড়িয়ে অসহায়ের মতো হাত কচলাচ্ছে বেলিনডা, স্বেচ্ছায় এখানে এসেছে সে, ওর কিছু করার নেই
হেলারকে নিংড়ে কথা বের করার ইচ্ছা কার? জিজ্ঞেস করলো কলিন।
আমার, বললে হনডো।
আমারও, বললো শেরিডান। টস, করা যাক তাহলে, পকেট থেকে একটা রূপোর মুদ্রা বের করলো সে। বলে, ইনডো, কোন দিক?
আমিও আছি, বলে উঠলো হ্যারলড, শুরু করার আগেই তো বিল ছোঁকরা টেসে গেছে, হাতের সুখ মেটেনি আমার।
ওদের কথাবার্তার বহর দেখে ফ্যাকাসে হয়ে গেল হেলারের। চেহারা, কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো, দাড়াও, কলিন, এক মিনিট।
আবার কি?
বিলের মতো আমার সহ্য ক্ষমতা নেই, কি জানতে চাও, বলো, সব বলছি।
সত্যি জানতে চাই আমি, হেলার।
তারপর কি করবে?
শেরিফ এবং আদালতের সামনে তোমাকে দাড় করানো হবে।
ঝুলে পড়লো হেলারের মাথা, চেহারা আড়াল হলো।
আমি–আমি তোমার সঙ্গে একটা আপোসরফায় আসতে চাই।
কি রকম?
তুমি যদি আমাকে ছেড়ে দাও তাহলে ওয়ারেনের বিরুদ্ধে আদালতে তোমার পক্ষে সাক্ষী দেবো আমি।
জুতোর ডগার দিকে তাকালো কলিন ফোর্বস। নাটকীয় পরিবর্তন! ভেবে দেখার জন্যে সময় দরকার। গা বাঁচাতে হেলার ওয়ারেনকে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছে, সন্দেহ নেই ওতপ্রোতভাবে এসব জড়িত সে। যদি তাই হয়, তাহলে ওয়ারেনের স্রেফ প্রতি নিধি হিসেবে স্প্রিংগারভিলে যায়নিহেলার, কাসলারের কাছ থেকে টাকা নেয়াটাই তার একমাত্র কাজ ছিলো না। হামলার পরিকল্পনাটাও সম্ভবত তার মাথা থেকে বেরিয়েছিলো এবং খুব সম্ভব তার নির্দেশানুযায়ীই সব কিছু করেছে রবার্ট ওয়ারেন। নাটের গুরু?
বলে যাও, সহজ কণ্ঠে বললে কলিন, ওয়ারেনের বিপক্ষে কি সাক্ষী দেবে? কি বলার আছে তোমার?
আমি বলবো কাসলারের কাছ থেকে টাকা নেয়ার জন্যে ওয়ারেনই আমাকে স্প্রীংগারভিলে পাঠিয়েছিলো, ওই টাকা যে তোমাদের গরু বিক্রি করে পাওয়া, সেটা পরে জানতে পারি আমি!
টাকাটা নিয়ে তারপর কি করেছ?
কেন ওয়ারেনকে দিয়েছি।
আস্তাবলের বালিতে গোড়ালি দাবালে কলিন, আবার জুতোর ডগার দিকে তাকালো, তারপর বললো, উঁহু হেলার, এত অল্পে হবে না। তুমি আদালতে দাড়িয়ে উল্টো সুরে কথা বলবে না তার কি নিশ্চয়তা। আমি প্রমাণ চাই, নিরেট কিছু।
সেটা কোথায় পাবো?
আমি কি জানি। ভেবে দেখো। চিন্তা ভাবনা করে একট। কি বের করো, নইলে তোমারও বিলের দশা হবে। আধ ঘন্টা সময় দিলাম তোমাকে।
মাত্র আধ ঘণ্টা!
হ্যাঁ, মাত্র আধ ঘণ্টা। আধ ঘণ্টা পর আবার আসবো আমি, ভালো কিছু শুনতে চাই তখন, নইলে…’ কথাটা ইচ্ছে করেই অসমাপ্ত রাখলো কলিন।
হ্যারলড লেভিটের উদ্দেশে মাথা দোলালো ও। বেলিনডাকে নিয়ে যাচ্ছি আমি। কফি তৈরি হচ্ছে। তোমরা এখানে ঠিক করো আধ ঘন্টা পর আমাকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে ওর দায়িত্ব কে নেবে। তবে যা ওয়াদা করেছি, ওকে ঠিক আধ ঘণ্টা সময়ই দেবো আমরা, তারপর—কাঁধ ঝাঁকালো ও, বেলিনডার হাত ধরে বেরিয়ে এলো আস্তাবল থেকে।
পুব আকাশে ভোরের ধূসর আলো, হালকা হয়ে আসছে অন্ধকা। র্যাঞ্চ হাউসে ফেরার পথে লক্ষ্য করলো কলিন, অবাক হলো, এত তাড়াতাড়ি সকাল হবে ভাবেনি।
কাপছে বেলিনডা, বারান্দার সিঁড়িতে পৌঁছে দাড়িয়ে পড়লো সে। বিলকে নিয়ে কি করেছে ওরা?
মেরেছে।
ওকে কোনো সুযোগ না দিয়েই?
স্প্রীংগারভিলে আমাদের লোকদের হত্যা করার সময় ওরাও তাদের কোনো সুযোগ দেয়নি। তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম, এসবে ভব্যতার অস্তিত্ব খোজা অবান্তর।
তুমি যা জানতে চাইছে, যদি না বলে, হেলারকে কি করবে? ওকে—
মাথা দোলালো কলিন। আমি যতটা ভেবেছিলাম তারচেয়ে অনেক গভীরভাবে জড়িত হেলার এটাই, আমার মাথায় ঢুকছে না, ওয়ারেনের সাথে ওর সম্পর্কটা কোথায়?
হেলার রবার্ট ওয়ারেনের অ্যাটর্নি।
বেসিনের প্রায় সবারই তো অ্যাটর্নি সে। নিশ্চয়ই ম্যাকমিলানেরও অ্যাটর্নি ছিলো হেলার। ম্যাকমিলান র্যাঞ্চটা বিক্রি করে দিলো কেন?
বয়স হয়েছিলো তো, মনে হয়, ব্যাঞ্চিংয়ের খাটুনি আর সহ্য হচ্ছিলো না তার।
ওয়ারেন হঠাৎ হাজির হলো কিভাবে?
এই মানে হাজির হলো আরকি-ম্যাকমিলান র্যাঞ্চ বিক্রি হবে–খবরটা কারো কাছে শুনেছিলো হয়তো।
মাথা নাড়লো কলিন। এভাবে সমাধানে পৌঁছুনো সম্ভব নয়।
ভেতরে ঢুকলো ওরা। রান্নাঘরে চুলের আগুন উস্কে দিলো কলিন, আরো লাকড়ি দিলো। চুলোয় চাপানো পটে অবির কফি আর পানি দিলে বেলিনডা।
র্যাঞ্চে তোমার জন্যে ভাববে না তো ওরা? জিজ্ঞেস করলো কলিন।
ভাবতে পারে। অবশ্য প্রায়ই রাতের বেলা ওয়াগোনারে থাকি আমি, ওরা তা জানে।
আচ্ছা, মেরি কেমন আছে?
ভালোই, সারাক্ষণ অস্থির। বুঝলে কলিন, ওকে আসলে আরো বেশি সময় দেয়া উচিত আমার, কিন্তু র্যাঞ্চের হাজারো কাজে এত ব্যস্ত থাকতে হয়–
আবার বিয়ে করলেই পারো?
পছন্দসই ছেলে কই?
এদিকটা ভালো করে ভেবে দেখা উচিত তোমার। র্যাঞ্চের কাজ দেখাশোনার জন্যে একজন পুরুষ থাকলে মেরিকে অনেক বেশি সময় দিতে পারতে তুমি।
মৃদু হেসে মাথা নাড়লো বেলিনডা। আমার জন্যে তোমাকে অত ভাবতে হবে না। পছন্দসই ছেলে যদি পাই কখনো এবং সে রাজি হলে তখন দেখা যাবে।
কথা বলে চললো ওরা। টগবগিয়ে ফুটছে পটের কফি। এই পরিবেশ বেশ ভালো লাগছে কলিনের। আস্তাবলে কিছুক্ষণ পরে কি ঘটতে যাচ্ছে ভুলে গেল ও, প্যাসি আসার পর কি করবে সেই চিন্তাও মুছে গেল মন থেকে। রান্নাঘরে একটা চেয়ারে বসে ও, মাথার পেছনে হাত। একটা কাপে কফি ঢাললো বেলিনড, চুমুক দিলো, মাথা দোলালো, সন্তুষ্ট, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো কলিন। আরেকটা কাপে কফি ঢাললো বেলিনডা, কলিনকে দিলো।
আমি বাইরে গিয়ে দুজন দুজন করে কফি খেতে পাঠিয়ে দেবো, বেলিনডাকে বললো কলিন। ইশ, রোজ এরকম তোমার বানানো কফি যদি খেতে পারতাম! তোমাকে আটকে রাখতে ইচ্ছে করছে!
আরক্ত হলে বেলিনডা। বোকার মতো কথা বলল না, কলিন।
বেরিয়ে গেল কলিন। আরো ফর্সা হয়ে এসেছে আকাশ, উত্তরে মেসকালেরে মাউনটেনসের কালো কাঠামো দেখা যাচ্ছে, তবে আরো কাছের করাতের মতো খাজ কাটা পাহাড়সারি অনেক বেশি স্পষ্ট। অনেক নিচ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘের দল, বৃষ্টি আসবে, কিন্তু কখন?
আস্তাবলের দিকে এগিয়ে গেল কলিন ফোর্বস। কফি খাওয়ার জন্যে হ্যারলড আর হনটেকে র্যাঞ্চ হাউসে পাঠালো। শেরিডান কে বললো পাহারায় থাকতে। তারপর টেরি জেলারম্যানকে নিয়ে হেলারের কাছে এলো।
কিছু বের হলো? জিজ্ঞেস করলো। মাথা দোলালো অ্যাটর্নি। মনে হয় তোমাকে সন্তুষ্ট করতে পারবো।
কিভাবে?
তুমি নিরেট প্রমাণ চাইছে, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবে না–প্রতিশ্রুতি দিলে আমি তা দেবো।
কি প্রমাণ?
তোমাদের গরু বিক্রির টাকা, রবার্ট ওয়ারেন আমার কাছেই জমা রেখেছে ওগুলো; ঊনত্রিশ হাজার দুশো একাশি ডলার, প্রত্যেকটা তোড়ায় ক্যাটল-বায়ার অফিসের ছাপ মারা। টাকাটার উৎস বের করা কঠিন হবে না।
টাকাটা তোমার সেফে গেল কিভাবে?
ওয়ারেন ব্যাঙ্কে রাখতে চায়নি ওগুলো–নানা প্রশ্ন উঠত–রাঞ্চে ওর নিজস্ব একটা সেফ আছে অবশ্য, কিন্তু আমারটার তুলনায় ওটা টিনের বাক্স ছাড়া কিছু না।
তাহলে তো দেখা যাচ্ছে খুব ঘনিষ্ঠ মানুষ তোমরা? তোমাকে বিশ্বাস করে এতগুলো টাকা জমা রেখেছে।
আমি ওর অ্যাটর্নি, তাই রাখতে দিয়েছে ঘনিষ্ঠতার প্রশ্ন আসছে কেন?
বার্নের বাইরে ছুটন্ত পায়ের শব্দ পেলো কলিন। দরজা খুলে মাথা গলিয়ে দিলো শেরিডান।
ওরা আসছে! বললো সে।
প্যসি?
প্যসি বললে প্যসি। বাইরে এলো কলিন ফোর্বস। শহরমুখী রাস্তার দিকে তাকালো। একদল অশ্বারোহী আসছে,এদিকে। এগারোজন, গুণলো ও। অবশ্য সংখ্যাটা কোনো ব্যাপার নয়, ওদের সঙ্গে লড়াইতে টিকতে পারবে না কলিনরা।
কি করবো আমরা? জানতে চাইলে শেরিডান।
হেলার আর বিলকে নিয়ে র্যাঞ্চ হাউসে চলে যাও তোমরা জলদি! একদম সময় নেই।
দীর্ঘ এক মিনিট ঠায় দাড়িয়ে রইলো কলিন, মনে মনে উপায় খুজছে। সটকে পড়ার মতো সময় নেই, ওয়ারেনের নেতৃত্বাধীন প্যসির কাছে আত্মসমর্পণের ঝুঁকিও নেয়া যাবে না; ব্যাপারটা লড়াইয়ের দিকে গড়ালে টিকে থাকার আশা নেই বললেই চলে।
আর একটা ঘণ্টা সময় যদি পেতো! হেলারের পেট থেকে সব কথা বের করে ফেলতে পারতো ও। তারপর আবার শহরে যেত ওরা। কিন্তু এখন আর এসব ভেবে ফায়দা কি?
অ্যারন হেলার আর বিল ওয়ারেনকে নিয়ে র্যাঞ্চ হাউসের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে শেরিডান আর জেলারম্যান।
ওদের অনুসরণ করলো কলিন।
১৭. শোবার ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে
শোবার ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কলিন, প্যসির দিকে চোখ; রাইফেলের আওতায় এসে ঘোড়া থামিয়েছে ওরা। নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে এখন। প্যসির সদস্যদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছে না কলিন, তবে পাশে দাড়িয়ে আছে হ্যারলড লেভিট, সে নাকি রবার্ট ওয়ারেনকে চিনতে পেরেছে।
তুমি এখানে দাড়াও, হ্যারলড, ওদের দিকে নজর রাখো, বললো কলিন। এদিকে আসতে দেখলেই জানাবে।
ওদের কাছে আসার সুযোগ দিয়ে, বললো হ্যারলড, তারপর আমরা যদি এক সঙ্গে আচমকা গুলি চালানো শুরু করি, ব্যাপার কি টের পাবার আগেই কিন্তু ওদের অর্ধেক স্যাডল খালি করে দেয়া যায়।
এবং বাকি অর্ধেক শহর থেকে লোকজন আসা পর্যন্ত আমাদের ঘেরাও করে রাখুক।
পাশের ঘরে চলে এলো কলিন ফোর্বস। হাত পা বাঁধা অবস্থায় মেঝেয় পড়ে আছে বিল ওয়ারেন, ডার্ক পিট আর হেলার।
ছেড়ে দেবার জন্যে একঘেয়ে কণ্ঠে কাকুতি মিনতি করছে ডার্ক পিট, ইনিয়ে বিনিয়ে বলছে নিরপেক্ষ লোক সে, আদালতের নির্দেশেই এসেছে এখানে। এখনো মারের ধকল সামলে উঠতে পারেনি বিল ওয়ারেন, ঝিমোচ্ছে সে, কোথায় রয়েছে তা নিয়ে যেন তিলমাত্র মাথা ব্যথা নেই তার। হেলারের ঠোঁটে সূক্ষ্ম বিদ্রুপাত্মক হাসি।
এবার কি করবে, কলিন? জানতে চাইলো সে।
জানি না, স্বীকার গেল কলিন।
প্যসির সঙ্গে আমাকে আলাপ করতে দাও।
কি নিয়ে আলাপ করবে?
তোমাকে গ্রেপ্তার করে ওয়াগোনারে যাতে নেয়ার ব্যবস্থা করা যায়
মাথা নাড়লো কলিন, হেলারকে কথা বলার সুযোগ দেয়ার মানে খাল কেটে কুমীর আনা, ভালো করে জানে।
কফি হাতে রান্নাঘর থেকে এলো বেলিনডা। তুমি, বললো সে, যাই করবে আমার সমর্থন পাবে।
সমাধানের একটা উপায় খুজছি আমি, বেলিনডা, বললো কলিন, কি ভাবে যে কি করি!
আমি অস্ত্র চালাতে পারি, কলিন।
বেলিনডাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো, কলিনের, তা না করে হাসলো, বললো, ধন্যবাদ, দোয়া কর গোলাগুলি করতে না হয় যেন।
কফি শেষ করে কাপ ফিরিয়ে দিলো কলিন, কামরায় এসেছে হ্যারলড তার দিকে তাকালো।
এগোচ্ছে ওরা, বললো হ্যারলড, সব ওয়ারেনের পাণ্ডা।
দুজন বাদে, শেরিফ আরচার আর চার্লস রেডফিলড।
ওয়ারেনের সঙ্গে রেডফিলডের সম্পর্ক কেমন?
চার্লস তার চাকরি করে না। যদিও, তবে সব সময় তার হয়ে ওকালতি করে।
উঠোনে ঢুকে পড়েছে প্যসি। মাটিতে পা ঠুকছে ঘোড়াগুলো, অস্থির, শুনতে পেলো কলিন। বেলিনডার দিকে তাকালো ও। মেঝেতে শুয়ে পড়ে, তুমি, বললো, হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলে তোমাকে নিয়ে শঙ্কায় থাকতে চাই না আমি।
সাথে সাথে বসে পড়লো বেলিনডা, তারপর চিত হয়ে শুয়ে কলিনের দিকে তাকিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে হাসলো। কেমন জানি বোকা বোকা লাগছে নিজেকে।
সাবধান, উঠবে না!
সামনে জানালার উদ্দেশে এগিয়ে গেল কলিন, হ্যারলড আর হনডো ওর পিছু নিলো। এক পাশে সরে জায়গা করে দিলো শেরিডান আর জেলারম্যান।
ওয়ারেনের প্যসি, তিক্ত কণ্ঠে বললো জেলারম্যান। চার্লস আর জেফরি আরচার ছাড়া সব ওয়ারেন রাইডার।
বাইরে তাকালো কলিন। অশ্বারোহীরা ঘোড় ঘুরিয়ে র্যাঞ্চ হাউসের মুখোমুখি হয়েছে, এখন সবাইকে চেনা যাচ্ছে, অবশ্য সবার নাম জানে না ও। অর্ধেকের বেশি ঘোড়সওয়ার স্যাডলের ওপর আড়াআড়িভাবে রাইফেল ফেলে রেখেছে, বাকিরা পিস্তল বের করে নিয়েছে হোলসটার থেকে।
ওয়ারেনের উদ্দেশে কিছু বললো জেফরি আরচার, তারপর গলা চড়ালো।
ফোর্বস। কলিন ফোর্বস! বেরিয়ে এসো! আমরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই!
তোমাকে বেকুব মনে করেছে নাকি? বাইরে যেতে বলছে! গজগজ করে উঠলো হ্যারলড।
কেন যাবো না? বললো কলিন।
দরজা পেরোনোর আগেই ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।
উঁহু, ইচ্ছে থাকলেও ওয়ারেন পারবে না, ওর সঙ্গে আরচার রয়েছে
খামোকা ঝুঁকি নিতে যেয়ো না, কলিন। ভেতর থেকেই সেরে নাও আলাপ-সালাপ।
কলিন! আবার ডাকলো শেরিফ। কলিন ফোর্বস!
আসছি। চেঁচিয়ে জবাব দিলো কলিন।
পরমুহূর্তে দ্বিধায় পড়ে গেল ও, হ্যারলঙের কাছে শেনি। বাবা ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের সেই রাত্রির কথা মনে পড়ে গেছে। সেরাতে র্যাঞ্চ হাউস ঘেরাও করে ফেলেছিলো প্যসি, কাভার নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসেছে কাছে, তারপর আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়েছে জেফরি অরচার। আজও সেই একই ব্যক্তির নেতৃত্বে সদর্পে। উঠোনে পা রেখেছে আরেকটা প্যসি। এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? জেফরি আরচার হয়তো ভেবেছে র্যাঞ্চ হাউসে ও ছাড়া আর কেউ নেই।
আরচারের সঙ্গে তাল মেলাতে ঠিকই বের হবে ও, কিন্তু খালি হাতে, বিনা প্রস্তুতিতে নয়।
ঘাড় ফিরিয়ে সঙ্গীদের দিকে তাকালো কলিন। ওদের একটা ধাপ্পা দিলে কেমন হয়?
ভুরু নাচালো হ্যারলড। যেমন?
এতে অবশ্য কাজ নাও হতে পারে।
কি করতে চাও?
আমি বারান্দায় যাবার পর আমার প্রত্যেকটা কথার দিকে খেয়াল রাখবে তোমরা দুজন এই জানালায় থাকবে আর দুজন ওই জানালাটার কাছে। সময় বুঝে জানালার কাঁচ ভেঙে রাইফেল বের করবে, দেরি যেন না হয়, কিন্তু ওদের আগে গোলাগুলি শুরু করবে না। প্যসির প্রত্যেককে কাভার করার চেষ্টা করবো আমরা-সফল হওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে।
এছাড়া উপায় দেখছে না কলিন। এতক্ষণ বেলিনডার মতোই নিরাশায় ভুগছিলো ও। প্যসির সদস্যের মধ্যে নিরপেক্ষ লোক কেবল জেফরি অরচার আর রেডফিলড। হেলার ও বিলের কথায় ওই দুজন কান দিলেও বাকি সবাই ঠিকই বিরোধিতা করতো, সামান্য ছুতোয় হত্যা করার চেষ্টা করতো ওকে। কিন্তু একটা ব্যাপারে কলিন স্থির নিশ্চিত, প্যসির প্রত্যেকটা লোকের প্রাণের মায়া আছে, ওকে পাকড়াও করতে চায় ওরা, কিন্তু সেজন্যে প্রাণ হারাতে চাইবে না নিশ্চয়ই।
হোলসটারের পিস্তল আলগা করে দরজার দিকে পা বাড়ালো কলিন, কবাট খুলে পা রাখলো বারান্দায়।
কলিনের ছায়া দেখামাত্র সবগুলো অস্ত্র ওর দিকে ফিরলো। রবার্ট ওয়ারেনের হাতেও অস্ত্র দেখা যাচ্ছে, কুৎসিত বিকৃত চেহারা তার, বোঝা যায়, ট্রিগার টানার জন্যে উতলা হয়ে আছে সে।
কলিনের জীবনের সবচেয়ে সঙ্কটময় মুহূর্ত। শিউরে উঠলো ও অজান্তে, নিঃশ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে, মাথার ওপর হাত তুলে রেখেছে, কাউকে গুলি ছোড়ার সুযোগ দিতে চায় না। চেহারা বহু কষ্টে স্বাভাবিক রেখেছে, কিন্তু এক বিন্দু স্বস্তি বোধ করতে পারছে না।
ঠিক আছে, ওকে কাভার করে রাখো, গম্ভীর কণ্ঠে দেশ দিলো আরচার, যেমন কথা ছিলো বিচারের জন্যে শহরে নিয়ে যাবো ওকে।
বিচার তো এখানেই করা যায়, চিবিয়ে চিবিয়ে বললো না ওয়ারেন।
এই প্যসির লীডার যখন আমি, বললে আরচার, নির্দেশটা আমিই দেবো।
লম্বা করে দম নিলো ওয়ারেন। ক্লাইভ, ডাকলো সে।
বলো, রবার্ট।
কি করতে হবে জানো তুমি।
শেরিফের একটু পেছনে ক্লাইভ কাসলার, ডান হাতে সিকস গান, কলিন দেখল শেরিফের দিকে পিস্তল ঘুরিয়েই ট্রিগার টেনে দিল সে।
আধ পাক ঘুরে কাসলরের দিকে ফিরেছিলো শেরিফ, কাসলারের পয়লা গুলি ওর দেহ ভেদ করে আরেকটা ঘোড়ার গায়ে বিধলো, তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো আরচার। রাইফেল ঘোরানোর চেষ্টা করলো সে, কিন্তু তার আগেই ফের গুলি করলো কাসলার এবং আবার।
লাফিয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে এলো শেরিফের ঘোড়াটা লাগমে টান পড়লো না দেখে লাফাতে শুরু করলো। বাকা গেল আরচার, পিছলে দড়াম করে পড়লো মাটিতে। গুলির শব্দে আরো কয়েকটা ঘোড়া ভীত হয়ে উঠলো, সওয়ারীরা সামলে নিলো ওদের।
আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রয়েছে কলিন, রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত, চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না ব্যাপারটা। অবশ্য ঠাণ্ডামাথার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড অপ্রত্যাশিত নয়, এখুনি একই অবস্থা হতে পরে ওরও। ক্লাইভ কাসলার পিস্তলে গুলি ভরছে এখন, আর্নেস্ট হলদের হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিলো লোকটা, মানুষ হত্যা তার কাছে আর দশটা দৈনন্দিন কাজের মতোই মামুলী।
কোনোমতে চেহারা স্বাভাবিক রেখে কালারের দিকে তাকালো কলিন। ইস্পাত কঠিন চেহারা লোকটার, চোখে খুনের নেশা। রেড ফিলডের দিকে চোখ ফেরালো এবার, সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে তাকে, চোখ জোড়া যেন বেরিয়ে আসবে তার কোটর ছেড়ে, এই হিমেল সকালেও ঘামছে রীতিমতো।
তোমার সাহস আছে, স্বীকার করছি, ফোর্বস, বললো ওয়া রেন। কিন্তু এখন যদি জলদি মুখ না খোলো তোমারও আরচারের দশা হবে। দুটো প্রশ্নের জবাব চাই আমি।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালে কলিন। যথা?
আমার স্ত্রী, কোথায় সে?
সম্ভবত ক্যানসাস সিটিতে, স্প্রীংগারভিল রোডে ওকে স্টেজ কোচে তুলে দিয়ে এসেছি আমি।
ঠিক?
হ্যাঁ।
ওর দিকে তাকিয়ে রইলো ওয়ারেন, জবাবটা বিচার করছে যেন, অবশেষে মাথা দোলালো সে। আমি অবশ্য আগেই আঁচ করেছিলাম, স্বীকার করলো, কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। এবার দু’নম্বর প্রশ্ন। বিল ওয়ারেন কোথায়?
মনে মনে কুঁকড়ে গেল কলিন, এই প্রশ্নটার জবাব দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হবে ওকে, ওয়ারেনের চেহারা দেখেই বোঝা যায় সেটা।
তার আগে একটা কথা বলি?
না।
কিন্তু আমাকে যে বলতেই হচ্ছে। খুব জরুরি।
ধাপ্পা দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়, হয়তো কাজ হবে না, তাতে কি, মরতে তো হবেই, চেষ্টা করেই দেখা যাক!
আমার ছেলে কোথায়? বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠলো ওয়ারেন।
আমি যে কথাটা বলতে চাই, কায়দা করে বললো কলিন, সেটা হলো, ঠিক এই মুহূর্তে একটা রাইফেল তোমার মাথার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, রাইফেলধারী এমন জায়গায় রয়েছে গুলি ফসকানোর কোন সম্ভাবনাই নেই।
র্যাঞ্চ হাউসের সামনের দিকটা চষে ফেললে ওয়ারেনের দু চোখ। কোথায়? দেখছি না তো?
ভুল হচ্ছে আরকি, বললো কলিন, আসলে ঠিক কোন রাইফেলটা যে তোমাকে নিশানা করেছে আমি নিজেও জানি না, চারটে রাইফেল কি না!
প্রথমে ডানে তারপর বামদিকের জানালার কাঁচ ভাঙার মৃদু শব্দ পেলো কলিন। আবার র্যাঞ্চ হাউসের সামনের অংশে নজর বোলালো ওয়ারেন, হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে গেল সে। এতক্ষণ পর্দা টানানো ছিলো জানালায়, কিন্তু কাঁচ ভাঙ্গার পর পর্দা সরিয়ে ফেলা হয়েছে, চারটে রাইফেলের নল বেরিয়ে আছে জানালার ফোকর দিয়ে, উঠোনের দিকে তাক করা। চারটে রাইফেলে দশ জনকে হত্যা করা সম্ভব না, কিন্তু এদের প্রত্যেকের মনে হবে রাই ফেলটা বুঝি তার দিকেই চেয়ে রয়েছে!
গোড়ালিতে ভর দিলো কলিন, সতর্ক, জানে এখুনি মৃত্যু ঘটতে পারে ওর, কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষশ আশ।
ইচ্ছে করলে আমাকে তুমি মেরে ফেলতে পারো, ওয়ারেন, স্পষ্ট কণ্ঠে বললে কলিন। আমি জানি সেটা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তোমারও মরণ ঘটবে। এর আগে রাইফেলের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছে। কোনোদিন?
এতক্ষণে ওয়ারেনের চোখে ভয়ের ছাপ পড়লো, চেহারা শাদা হয়ে গেছে, বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে, ঘাড় ফিরিয়ে প্রতিক্ষণে সঙ্গীদের দিকে তাকাচ্ছে। ইচ্ছে করলে জানালা বরাবর গুলি বর্ষণের নির্দেশ দিতে পারে, কিন্তু তার মানে হবে জানালার ওপাশে রাইফেলধারীদের উস্কে দেয়া, এটুকু বোঝার ক্ষমতা সে রাখে। গ্যাড়াকলেই পড়া গেছে। ভাবলো ওয়ারেন।
কে কে আছে ওখানে? কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইলো সে।
মোট চারজন, সবাই আমাদের পুরোনো কাউহ্যানড, স্প্রীংগারভিল রোডের কবরগুলোর কথা এরা সবাই জানে। ওই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্যে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে তোমাকে, ওয়ারেন, যারা ওই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে কাউকে মাফ করা হবে না।
পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে, বুঝতে পারছে কলিন। উঠোনের ওই লোকগুলো সশস্ত্র এবং যেকোনো মুহূর্তে ওরা আবার মরিয়া হয়ে উঠতে পারে, গোলাগুলি শুরু হলেই প্রথমে প্রাণ দিতে হবে ওকে, কিন্তু তারপরও এক চাল এগিয়ে আছে ও। প্রতিপক্ষের ওই লোকগুলোর প্রাণের মায়া, বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছাই ওর তুরুপের তাস। ওয়ারেন জানে একটা রাইফেল তার দিকে তাক করা, বিশ গজ দূরত্বে ওটার গুলি ফসকানোর প্রশ্নই ওঠেনা। লড়াই শুরু হওয়ামাত্র অবশিষ্ট তিনটে রাইফেলও গর্জে উঠবে, কার গায়ে লাগবে গুলি কেউ জানে না! রক্তলোলুপ না হলে লড়াইয়ের ঝুঁকি নেবে না কেউ।
রক্তলোলুপ?
ঝট করে শেরিফের হত্যাকারীর দিকে তাকালো কলিন। স্যাডলে ঝুঁকে বসে রয়েছে কাসলার, একবার এই জানালায় আরেকবার ওই জানালায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তার দৃষ্টি, আড়ষ্ট চেহারা দেখে বোঝা যায় মানসিক চাপের মধ্যে আছে সে। আর কতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখতে পারবে লোকটা? ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠলো কলিন।
হাত নামালো ও, আস্তে আস্তে।
কাসলার! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো তারপর, কাসলার, তুমি সবার আগে পিস্তল ফেলো! এখুনি!
কথা শেষ করার আগেই হোলসটার থেকে পিস্তল বের করে কাসলারকে কাভার করলো ও।
হ্যারলড!
আছি, কলিন! ডান দিকের জানালা থেকে জবাব এলো।
ওয়ারেনকে কে কাভার করছে?
আমি, অপর জানালা থেকে বললো শেরিডান। কড়ে আঙল নাড়লেও খুন হয়ে যাবে।
ওরা দুজন পিস্তল ফেলে স্যাডল থেকে নামার সময় আমি কাভার করছি, বললো কলিন। তোমরা বাকিদের ওপর নজর রাখো। কাসলার, পিস্তল ফেলতে বললাম না তোমাকে! জলদি ফেলল। তারপর স্যাডল থেকে নেমে ছেড়ে দাও ঘোড়াটা।
মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত করলো কাসলার, অবশেষে ঢিল পড়লো তার কাধে, হাত থেকে খসে পড়লো পিস্তল। মাটিতে নেমে কলিনের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে রইলো, খুনের নেশা উধাও দৃষ্টি থেকে।
ওয়ারেন, এবার তুমি।
এভাবে পার পাবে না, ফোর্বস! এই বলে দিচ্ছি।
হতচ্ছাড়া রাইফেলটা ফেলে! ধমকে উঠলো কলিন। গান বেলট খুলে নেমে পড়ে স্যাডল থেকে।
চোয়াল নড়লো ওয়ারেনের, কিন্তু কোনো কথা বেরোলো না। রাইফেল ফেলে গানবেলটের বালস-এ হাত রাখলো সে, মাটিতে পড়লে ওটা।
স্যাডল থেকে নেমে র্যাঞ্চ হাউসের দিকে ফিরে পা ফাঁক করে দাড়িয়ে রইলো ওয়ারেন, হাপাচ্ছে, রাগে?
অনেকটা স্বস্তি বোধ করছে এখন কলিন। অবশেষে সফল হতে যাচ্ছে ও, প্রতিপক্ষের সবচেয়ে বিপজ্জনক দুটো সাপের বিষদাত উপড়ে ফেলতে পেরেছে। অন্যদের নিয়ে তেমন উৎকণ্ঠার কিছু নেই।
প্যাটেন! চেঁচিয়ে বললো ও, এবার তুমি! লুইস প্যাটেনের দিকে ঘুরলো কলিনের পিস্তল।
ঠিক এই সময় গোলমাল বাধালো রেডফিলড। ওই লোক এমন কিছু করতে পারে কল্পনাতেও আসেনি কলিনের। হয়তো অনিচ্ছেকৃত, সন্ত্রস্ত হয়ে পালানোর চেষ্টা সম্ভবত, আচমকা খোড়ার পেটে স্পার দাবিয়ে বসলো সে, লাফিয়ে উঠলো তার ঘোড়া। ভারসাম্য বজায় রাখতে অজান্তে উঁচু করলো পিস্তল ধরা হাতটা।
জানালার পেছনে যারা অপেক্ষমান, রাইফেলধারীরা ব্যাপার কি বুঝে ওঠার অবকাশ পেলো না। তারা স্রেফ দেখলো রেডফিলডের ঘোড়া লাফিয়ে আরেকটা ঘোড়ার ওপর পড়তে যাচ্ছে, ধরে নিলো পিস্তল উচিয়ে গুলি করতে যাচ্ছে সে, ফলে আচমকা আগুন ঝরালো ওদের রাইফেল।
এভাবেই শুরু। ভিড়ের এক কিনার থেকে সহসা বেপরোয়া ভাবে জানালা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে বসলো এরিক মেইন, তারপর দৌড়ে ঘোড়ার আড়ালে চলে যাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে, জামালার দিক থেকে ছুটে এলো একটা গুলি, কাধে বিধলো তার।
বারান্দায় দাড়িয়ে সংঘর্ষের সূচনা প্রত্যক্ষ করলো কলিন ফো। চেঁচিয়ে রেডফিলডকে সাবধান করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই প্রতিপক্ষের শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের পর্বটি ভেস্তে গেছে। ঘোড় ঘুরিয়ে উল্টোদিকে ছুট লাগালে তিনজন। এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করলে অন্যরা। ঘরে ঢুকে পড়ার ফুরসত পেলো না কলিন, হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগলো কাঁধে, তীব্র ধাক্কায় এক পাশে কাত হয়ে গেল ও, আছড়ে পড়ল দেয়ালের ওপর, চেয়ে রয়েছে উঠোনের দিকে, চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল অবস্থা। তিনজন অশ্বারোহী পালাচ্ছে, স্যাডলের সঙ্গে মিশে গেছে ওরা। একেবেঁকে আস্তাবলের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে একজন। ফেলে দেয়া পিস্তল তুলে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওয়ারেন আর কাসলার। পিস্তলটা জাবড়ে ধরেই হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলো ওয়ারেন, কলিনের দিকে তাক করলো ওটা, খিস্তি করছে অবিরাম। নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। কলিন, মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে ওয়ারেনের উদ্দেশে গুলি ছুড়লো ও, পরপর দুবার, তারপর গুলি করলো কাসলারকে, চোখ থেকে খুনের নেশা আবার উধাও হলো তার।
দোলনার মতো দুলছে ওয়ারেন, বাতাসে আঁকিবুকি কাটছে যেন তার পিস্তল, অপর হাত দিয়ে ধরে ওটাকে স্থির করতে চাইলে সে। আবার গুলি করলে কলিন, তারপর পিস্তল ঘোরালো ক্লাইভ কাসলারের দিকে। ট্রিগার টানলে, ‘ক্লিক’ শব্দ হলো শুধু, গুলি বের হলো না!
গুলি করার আর প্রয়োজন ছিলো না অবশ্য। র্যাঞ্চ হাউসের ভেতর থেকে কাসলারের উদ্দেশে ছুটে গেল একটা বুলেট, পাঁই করে আধপাক ঘুরলো কাসলার। আবার রাঞ্চের জানালায় রাইফেলের বজ্রনিনাদ। ভাঁজ হয়ে গেল ক্লাইভ, মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ঘোড়া থেকে বেশ তফাতে।
যেমন হঠাৎ শুরু, তেমনি শেষ হলো সংঘর্ষ।
কলিন অস্পষ্টভাবে অনুভব করলো হ্যারলড, ইনডো আর অন্য কে একজন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসেছে ওর পাশে। হ্যালডের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে সে, বলছে, ভেতরে নিয়ে চলো ওকে, তারপর দেখো ক্ষতটা মারাত্মক কি না! বেলিনডা।
তাড়াহুড়োর কিছু নেই, বেলিনডা, দুর্বল কণ্ঠে বললো কলিন।
ক্লান্ত বোধ করছে ও, বড্ড ক্লান্ত। কাধের তীব্র যন্ত্রণা যেন মাথা খারাপ করে দেবে! ঝিমুনি আসছে, জোর করে ঝিমুনি ভাব দূর করে দিলো ও, পিটপিট করে তাকালো আবার ওয়ারেনের দিকে। কাত হয়ে পড়ে আছে লোকটা, নড়ছে না একটুও। কঠিন পথে জীবন কাটিয়েছে, মৃত্যুটাও এসেছে তার কঠিন রূপেই।
কেমন বোধ করছো, কলিন, জানতে চাইলে হনডো।
খুব খারাপ না, বললো কলিন, কাধে সামান্য লেগেছে মাত্র।
আমার কাছে মোটেও সামান্য মনে হচ্ছে না, বললো হ্যারলড। অবশ্য আরো মারাত্মক হতে পারতো।
ভেতরে নিয়ে যাও ওকে।’ বললো বেলিনডা, এখানে বসে বকবক করে না!
‘না’ বললো কলিন। একটু দাড়াও।
উঠোনের দিকে তাকালো ও। বার্নের দরজার কাছে পড়ে মোচড় খাচ্ছে একজন, ওয়ারেনের পাশে আরো তিনটে নিথর দেহ গুনলো কলিন। এরিক মেইন, রেডফিলড এবং অপরিচিত একজন।
চারজন চম্পট দিয়েছে, জানালো হ্যারলড।
চারজন? প্রশ্ন কলিনের, আমি তো তিনজনকে দেখলাম।
না, চারজন। পালানোর সময় বোধ হয় ওদের দুজন চোট পেয়েছে।
চার্লস দেখছি নড়ছে, বললো কলিন, পাশের ওই লোকটাও।
কাসলার। তোমাকে আগে ভেতরে নিয়ে যাই, তারপর ওদের দেখবো ডাক্তার আনতে শহরে পাঠাবো কাউকে।
এবার আর আপত্তি করলো না কলিন। ওকে ঘরে নিয়ে আসা হলো।
ড্যানিয়েল ফোর্বসের খাস কামরায় এনে বিছানায় শোয়ানো হলো, ওর কাঁধের ক্ষতে ব্যাণ্ডেজ করে দিলো বেলিনডা অরি শেরিডান। একটু পরেই চেতনা হারালো ও।
হ্যারলডের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরে ঘোর, কাটলো কলিনের।
কলিন, বললো হ্যারলড, এই যে, কলিন, ইচ্ছে ছিলো না তবু জাগাতে হলো, আরেকদল ঘোড়সওয়ার আসছে এদিকে। চোদ্দ পনেরোজনের কম না!
আরেকটা প্যসি? আবার লড়াই করা সম্ভব হবে না ওদের পক্ষে।
ধরে বসাও আমাকে জড়ানো গলায় বললে কলিন।
নাহ, বললো হ্যারলড, আমি দেখছি ব্যাপারটা। বেলিনডা?
কি? দরজায় দাড়িয়ে বললো বেলিনডা।
এদিকে এসো। তোমার কাজ হলো একে পাহারা দেয়, যেন বিছানা ছাড়তে না পারে।
পারবে না, বললো বেলিনডা। বিছানার কিনারে বুকে হাত বেঁধে বসলো বেলিনডা, ভয়ঙ্কর চেহারা। দোরগোড়ায় পৌঁছে থামলো হ্যারলড, ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। এরিক মেইন মরেনি, জানালো সে, এখনো মুখ খোলেনি, তবে খুলবে।
অন্যরা?
চার্লসও বেঁচে আছে–আর যারা পালাতে পেরেছিলো–বাকি সবাই অক্কা পেয়েছে।
বিল আর অ্যারিন হেলার?
বেঁধে রাখা হয়েছে, পিটকেও।
দেখো, কারা এলো, বললো কলিন, যেভাবেই হোক ওদের আগে আমাদের বক্তব্য শোনানোর চেষ্টা করো।
বেরিয়ে গেল হ্যারলড।
ব্যাপারটা, বললো বেলিনডা, সহজভাবে নিতে চেষ্টা করো, কলিন। যথেষ্ট করেছে তুমি। যতক্ষণ বারান্দায় ছিলে, প্রতিটি মুহূর্ত কি যে আতঙ্কে কাটিয়েছি আমি। ইশ, গোলাগুলি শুরু হলো যখন–
থেমে গেল বেলিনডা, ঘাড় ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকালো।
একটুর জন্যে গড়বড় হয়ে গেল, ধীর গলায় বললো কলিন। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লোকদুটো পরাস্ত হলো আর হঠাৎ ঝামেলা শুরু করলো কিনা নিরীহ রেডফিলড! কেন অমন করলো সে? মানুষকে বোঝা কঠিন। অনেক সময় খুব সাহসী লোকও চাপের মুখে ভেঙে পড়ে আর মহাভীতু প্রচণ্ড সাহসের পরিচয় দিয়ে বসে।
কথা বলো না তো, বললে বেলিনডা।
ডাক্তার আনতে গেছে কে?
হনডো। এবার চুপ। খামোকা হয়রান হচ্ছ। ডাক্তার এসে কাধের গুলি বের করার জন্যে খোঁচাখুচি শুরু করবে, তখন সহ্য করার জন্যে শক্তি লাগবে, জমিয়ে রাখ।
উঠোনে ঘোড়ার খুরের শব্দ, সমবেত চাপা কণ্ঠস্বর। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো বেলিনডা, বাইরে তাকালো।
শহরের কিছু লোক, বললো ও, মানে প্রায় সবাই। হ্যারলডের সঙ্গে কথা বলছে কে যেন, আগে কোনোদিন দেখিনি তাকে, বিশালদেহী লোক, বছর চল্লিশেক হবে বয়স, ভেসটে একটা ব্যাজ আঁটা দেখতে পাচ্ছি।
বর্ণনার সাথে মেলে এমন কারো কথা মনে করতে পারলো না কলিন। উঠে বসতে গেল ও, সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথায় চোখে অন্ধ কার দেখলো, দুলে উঠলো পৃথিবী। ছুটে এসে ওকে ধরলো বেলিনডা, আলগোছে শুইয়ে দিলো আবার, আপত্তি করলো না। কলিন।
ভেতরে ঢুকছে ওরা, ওকে জানালে বেলিনডা, ভদ্র আচরণ করো।
সরাসরি এ-ঘরে এলো না অতিথিরা। মিনিট দশেক পর সপ্রতিভ চেহারায় দরজায় এসে দাড়ালো হ্যারলড, বেলিনডার বর্ণিত সেই আগন্তুকও রয়েছে সঙ্গে।
কলিন, এর নাম আর্ল সিমুর, বললো হ্যারলড, স্যানতা ফে’র ইউএস মার্শাল, বিশেষ কাজে স্প্রীংগারভিলে এসেছিলো, ওখানে লিনডা ওয়ারেনের সঙ্গে ওর আলাপ হয়।
বিছানার কাছে এগিয়ে এলো সিমুর। হ্যালো, ফোর্বস, বললো সে, খুব ঝামেলায় গেল সকালটা, না?
হ্যাঁ, বললো কলিন।
ভোরের স্টেজে ওয়াগোনারে পৌঁছেছি আমি, বললো সিমুর। গতকাল শেষরাতে একটা প্যসি এদিকে এসেছে শুনে লোকজন জোগাড় করে পিছু নিয়েছি, দেরি হয়ে যাবে আশঙ্কা ছিলো, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আসলে আমার কোনো প্রয়োজনই ছিলো না।
তাহলে–কি ঘটেছে বুঝতে পেরেছ?
হ্যাঁ। কেন, তাও, বললো সিমুর। এখানে আসার আগেই সব জানতে পারি আমি। লিনডা-মিসেস ওয়ারেনের কাছে। চমৎকার মহিলা, তাই না?
হ্যাঁ, বললে কলিন, তাই।
অবশ্য একটু একগুয়ে,বলে চললো সিমুর, প্রথম যখন আমাকে স্প্রীংগারভিলের কাছের কবরগুলোর কথা বললো, বিশ্বাস করা দূরে থাক, আমলই দিইনি, কিন্তু মহিলা নাছোড়বান্দা। এ কে শেষে বাধ্য হয়ে অকুস্থলে গেলাম, খুঁজে পেলাম কবরগুলো। খানিক আগে আরেকটা চমক খেয়েছি আমি, তোমরা যাকে রবার্ট ওয়ারেন বলছ, তার চেহারা দেখলাম, ওকলাহোমায় অন্য নামে পরিচিত ছিলো লোকটা, রাস ম্যাকডোনালড, দুই আড়া বছরই আগে জেল ভেঙে পালায়, ব্যাঙ্ক ডাকাতির একটা চেষ্টা চালায় এরপর, ব্যর্থ হয়, তারপর আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলো? বললেকলিন, তাহলে এখানে র্যাঞ্চ কেনার জন্যে টাকা পেলো কোথায়?
পরমুহূর্তে পেয়ে গেল ও জবাবটা।
হেলার।
সে-ই টাকার ব্যবস্থা করেছে। হেলারই নাটের গুর। শেষের দিকে বোধ হয় ওয়ারেনকে বশে রাখতে পারছিলো না। ওকে ওয়ায়েনের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল এবার। ওরা যে কেউ একজন মারা গেলে শেষ পর্যন্ত হেলারই লাভবান হতো। ওয়ারেন র্যাঞ্চের মালিকানা দাবি করতে পারতো একদিকে, কিনে নিতে পারত ফোর্বস র্যাঞ্চটাও…দুটো র্যাঞ্চের মালিকানাই হেলারের লক্ষ্য ছিলো?
হেলারের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি, গম্ভীর কন্ঠে বললো কলিন।
না, আমি, বললো হ্যারলড, কি বলতে হবে আমি জানি।
সেদিন বিকেলে আবার শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়ালো সিমুর। একটু পরেই আমরা চলে যাচ্ছি, ফোর্বস, বললো সে। হেলারকে শহরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ঢোকাতে চাই। ম্যাকডোনালডের ছেলে, মানে তোমরা যাকে বিল ওয়ারেন হিসেবে জানো, তাকেও নিয়ে যাচ্ছি। আগামী কয়েকটা দিন এই মামলার ছেড়া সুতোগুলো একত্র করার চেষ্টা করব আমরা, তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে ফয়সালার ব্যবস্থা নেবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা তোমার উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ নেই। হেলারের স্বীকারোক্তিতেই স্পষ্ট বোঝা যায় এতসবের পেছনে সে-ই আসল লোক। আচ্ছা, ক্যানসাস সিটিতে যাবার সম্ভাবনা আছে নাকি তোমার কিছুদিনের মধ্যে?
ক্যানসাস সিটি? বললো কলিন। এক মুহূর্ত ভাবলো। লিনডা অসাধারণ মেয়ে সন্দেহ নেই, যে কোনো পুরুষের জীবন পূর্ণ করে তুলতে পারবে। কিন্তু ক্যানসাস সিটির মতো একটা জায়গায় গিয়ে কি করবে কলিন? বিস্তর্ণ খোলা প্রান্তরের মানুষ ও, যেখানে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ানো যায়, ফুলবাবু সেজে থাকতে হয় না।
নাহ, অবশেষে বললে ও, নেই।
কদিন পর আবার দেখা হবে তাহলে, বললে সিমুর, আশা করি শিগগির সুস্থ হয়ে ওঠো। ডাক্তার বলেছে কাঁধের ক্ষতটা তেমন মারাত্মক নয়।
সম্ভব হলে কালই উঠে বসার চেষ্টা করবো আমি, বললো কলিন, এমন একটা র্যাঞ্চের কাজকর্ম তো আর ফেলে রাখা যায় না!
চমৎকার কিছু সঙ্গীও পেয়েছো তুমি!
সেরা।
শুধু একটা মেয়ের অভাব।
সেটাও পূরণ করা হয়তো সম্ভব, বললো কলিন।
জানালার দিকে তাকালো ও, বেলিনডার চেহারা রক্তিম হয়ে উঠলো, লক্ষ্য করলো।
হেসে ফেললো সিমুর, ওদের দুজনের উদ্দেশে হাত নেড়ে বেরিয়ে গেল। ওকে বিদায় সম্ভাষণ জানানো আর হলো না কলিনের।
জানালার কাছে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো বেলিনডা, এখন ওর চেহারা দেখতে পাচ্ছে না কলিন।
বেলিনডার দিকে চেয়ে রইলো ও। ভবঘুরে মানুষের পক্ষে একাকী জীবন কাটানো সম্ভব, কিন্তু জীবনে স্থির হওয়ার জন্যে বিয়ে অপরিহার্য। নিজস্ব একটা র্যাঞ্চ আছে বেলিনডার, ঠিক; ওরও আছে; কিন্তু দুটো র্যাঞ্চ তো একসঙ্গে চালানো যায়।
আমি এবার বাড়ি ফিরবো, বললো বেলিনা।
তাহলে আমিও উঠে পড়বে, বললে কলিন।
চট করে ঘুরলো বেলিনডা। না! কিছুতেই উঠবে না তুমি। ডাক্তার বলেছে।
–আমার এখন শুশ্রূবার দরকার।
কিন্তু আমাকে মেরির কথা ভাবতে হবে না?
র্যাঞ্চে ওর দেখাশোনার জন্যে এলেনা আছে।
কিন্তু আমি ওর মা।
তাহলে কাউকে পাঠিয়ে দাও, নিয়ে আসুক ওকে, এখানে ওর কোনো কষ্ট হবে না।
কাজটা কি ভালো দেখাবে?
আমার কাছে তো চমৎকার মনে হচ্ছে, বললো কলিন। আমার মনে হয় এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
আবার আরক্ত হলো বেলিনডার চেহারা। বুঝে বলছো তো?
মাথা দোলালো কলিন। এবার এদিকে এসো।
এক পা সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো বেলিনডা। ভেবে দেখার জন্যে একটু সময় দেবে না?
পাঁচ সেকেণ্ড সময় দিলাম, বললো কলিন। তারপর উঠে বসবো।
পাঁচ সেকেণ্ড পর উঠে বসার উপক্রম করলো কলিন, কিন্তু তার আর প্রয়োজন হলো না।
Leave a Reply