নিষ্পত্তি – রওশন জামিল / প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৮
০১.
সূর্য ওঠার ঘন্টাখানেক আগে মরুভূমিতে এসে পড়ল ওরা। চারদিকে ফণীমনসার ঝাড় আঁর অসংখ্য বেলেপাথরের টিবি ছড়ানো ছিটানো। থোকা থোকা অন্ধকার জমে রয়েছে ফাঁকে-ফোকরে। তারই ছায়ায় এগিয়ে চলেছে দুই ঘোড়াসওয়ার। সতর্ক, কারণ এই গোলকধাঁধায় পথ হারাবার ভয় প্রতি পদে।
ঝড়ের বেগে চিন্তা করছে জেমস গ্রীন। যেখানে যাচ্ছে সেখানে পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে ওদের? সকাল হবার আগেই ও গন্তব্যে উপস্থিত হতে চায়, পলাতক আসামীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সেরা সময় ওটা, তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে, শরীর আড়ষ্ট হয়ে থাকে।
নিঝুম ভোরে কোথাও কোনও শব্দ নেই। কেবল অবিশ্রাম ঘোড়ার খুরের ভোতা আওয়াজ আর স্যাডল লেদারের খসখস। অকস্মাৎ খাড়া একটা ঢালের গোড়ায় পৌঁছে রাশ টেনে মাটিতে নামল লাইল ক্যানাডা। যোৎ করে নাক ঝাড়ল ওর বুটিদার সোরেল, হেষাব করল। গলা খাকারি দিল কানাডা, গুতু ফেলল। তারপর জামার আস্তিনে শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ মুছে হাসল গ্রীনের দিকে তাকিয়ে।
বাপস! এসেছি শেষপর্যন্ত, খনখনে গলায় বলল সে। বলেছিলাম পারব, এখন হয়েছে বিশ্বাস? হাতের ইশারায় পাথরাইভরা, খাড়াইটা দেখাল ক্যানাডা। এই খাজের ওপাশে কেবিন, ছোকরাগুলো ওখানেই লুকিয়ে থাকে। ঝরনাও আছে একটা, ঠিক যেমনটা বলেছি তোমাকে। গার্সিয়া পরিবার আগে এখানে ভেড়া চরাত, বুড়ো পটল তোলার পর ছেলেপুলেরা শহরে উঠে গেছে। মাথা দুলিয়ে খিকখিক করে হাসল ও, স্যাডলবুটে রাখা রাইফেলের উদ্দেশে হাত বাড়াল। যাই, দেখে আসি গিয়ে ওরা আছে কিনা।
ফিকে আলোয় ঢালটা জরিপ করছিল গ্রীন। বলল, তুমি এখানেই থাকবে।
অসম্ভব! আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে এনেছি, আনিনি? টাওসেই বলেছি একসময় এই সীমান্তে কাজ করেছি আমি, কাজেই এখানকার সবকিছু আমার–
চেঁচাবেনা, বাধা দিল গ্রীন, চোখ পাকিয়ে তাকাল সঙ্গীর পানে। গলা নামাও। বুট থেকে নিজের কারবাইনটা তুলে নিল সে, পরখ করে স্যাড ছাড়ল।
তা হলে আমরা দুজনেই যাব, বেজার মুখে বলল ক্যানাডা। ওদেরকে ওখানে না পেলে অকটিওতে গিয়ে মার্শাল মককে জানান ব্যাপারটা।
আমাকে পথ দেখিয়েছ তুমি, ব্যস, এন বিরক্ত। তোমার দায়িত্ব শেষ।
বললেই হলো! ওই তিন ছোকরাই হয়তো আছে ওখানে, ওদের–
লম্বা একটা শ্বাস টানল গ্রীন, ওর ভরাট বুকের ছাতি ফুলে উঠল। থাকতে পারে। কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না ডাকাতিটা ওরাই করেছে, আমার কাজ সেটা তদন্ত করা।
ক্যানাডা ইতিমধ্যে রাইফেল বের করেছে বুট থেকে। রাগের পাশাপাশি প্রচ্ছন্ন ধূর্ততা প্রকাশ গেল ওর কণ্ঠে। একাই পুরস্কারের টাকাগুলো তুমি হাতিয়ে নেয়ার তাল করছ না নিশ্চয়?
আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াল গ্রীন, মুখ থমথমে, চোখ দুটো সংকুচিত, নিষ্ঠুর। এখনও তুমি বেঁচে আছ কীভাবে সেটাই আশ্চর্য, নরম গলায় বলল ও। যাকগে, চুপচাপ এখানে থেকে ঘোড়াগুলো পাহারা দাও।
ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত পাখরাইয়ের মাঝ দিয়ে, কোনাকুনিভাবে ছোট ছোট পা ফেলে দ্রুত ওপরে উঠতে শুরু করল গ্রীন। মেজাজ তেতো হয়ে গেছে, ঝগড়া করছে নিজের সঙ্গে। হামবাগ। লোকটাকে দেখেই তোমার বোঝা উচিত ছিল কেমন চিজ। মস্ত বোকামি করেছে ওকে সাথে এনে। একটু চেষ্টা করলে ওর সাহায্য ছাড়াই এ জায়গা খুঁজে বের করতে পারতে তুমি।
এই দায়িত্বটা নেয়া তার উচিত হয়নি, কথাটা আবারও ভাবল ও। পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন খাপছাড়া। শুরু থেকেই খুঁতখুঁত করছে ওর মন। ক্যানাডার সঙ্গে দুই দিন দুই রাত কাটাবার পরেও তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কোনও কারণ সে খুঁজে পায়নি। যাক, আজকের পর আর ওই লোককে প্রয়োজন হবে না তার। অন্তত কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাবে এর ফলে।
দীর্ঘ দুরারোহ খাড়াই, খাজের মাথায় উঠে হাঁপাতে লাগল গ্রীন। ঘামছে দরদর করে, ব্যথা করছে ভর পেশীগুলো। একটা বোল্ডারে ঠেস দিয়ে বুকভরে শ্বাস টানল ও আকাশ ধূসর হয়ে এসেছে লক্ষ্য করে বুকে হেঁটে এগোল, কিনার থেকে আলগোছে উঁকি দিয়ে দেখল নীচের অবতল জমিটা।
প্রথমে ছোট্ট জরাজীর্ণ একটা বাড়ি চোখে পড়ল ওর। রোদে পোড়া ইটের তৈরি বড়সড় জানালা রয়েছে একটা গরাদবিহীন; দরজাটা ওর মুখোমুখি বন্ধ। একপাশে খড়ের চালাঘর, দুটো ঘোড়া বাধা আছে। বাসা থেকে শ-খানেক গজ দূরে, পাহাড়ের গোড়ায়, ঝরনা-প্রচুর ঘাস আর উইলো ঝাড়ে ঘেরা।
আবার ঘোড়া দুটোর দিকে তাকাল গ্রীন, ভাবছে তিনটে থাকা উচিত ছিল। তারপর আপনমনে কাঁধ ঝাঁকাল। ঘোড়াগুলো দুজন ভবঘুরের হওয়া বিচিত্র না, কাছেপিঠে পানি আছে দেখে পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ব্যাপারটা আসলে কী, সেটা জানাই ওর কাজ।
সবে নামতে শুরু করেছে ও এই সময় আচমকা ভোরের আলো ফুটে উঠল, দূরের পাহাড়-পর্বতে ছড়িয়ে পড়ল নবারুণের উষ্ণ গোলাপি আভা! চট করে একটা পাথরচাঁইয়ের আড়ালে আত্মগোপন করল গ্রীন। ধেত্তোরি, বলল বিড়বিড় করে। মরুভূমিতে কত দ্রুত সকাল হয় ভুলে গিয়েছিল সে।
বেকায়দায় পড়ে গেছে ও, এখন সরাসরি বাড়িতে ঢুকে পড়তে হবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, ওখানে যারা আছে ঘুমন্ত অবস্থায়ই পাকড়াও করতে পাবে তাদের। তারপর বাসার পেছন দিকে দৃষ্টি গেল ওর, চুলোর চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখল। গ্রীন অনুভব করছে তার এখন খাঁজের ওপাশে, আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া উচিত। একটু বাদে ক্যাচ শব্দে খুলে গেল নীচের দরজাটা, বুট আর জিন্স পরনে একহারা গড়নের এক যুবক পা রাখল বাইরে, হাই তুলল! লম্বা কালো চুল নেমে এসেছে ঘাড় অবধি, মুখমণ্ডল বাদামি, গাল তোবড়ানো। মেক্সিক্যান, প্রথম দর্শনেই বুঝতে পারল গ্রীন। অনুমান করুল ও-ই বোধহয় গার্সিয়াদের ছেলে, কার্লোস।
আরেকটু এগিয়ে এসে ছোকরা এবার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিল; গ্রীন যেখানে লুকিয়ে আছে, ওর চোখ পাহাড়ের সেই অংশে ঘোরাফেরা করছে। হালকা হয়ে ঘোড়াগুলো দেখতে গেল ও। তারপর মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য হলো বাসার পেছনে, ফিরে এল একটা গামলা হাতে, ঝরনায় যাচ্ছে।
ছোকরাকে পানি আনতে বার কয়েক আসা-যাওয়া করতে হবে, ভাবল গ্রীন। পিছিয়ে খাজের নীচে চলে গেল ও, ঘোরাপথে ঢাল ধরে এগোল। যা ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি সময় লাগল এতে, ও যখন ঝরনার ধারে পৌঁছাল তখন ছেলেটা এসে আবার চলে গেছে। উইলো ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে সন্তর্পণে উঁকি দিল সে, লক্ষ করল বাসায় ফিরে যাচ্ছে ও, পানিভর্তি গামলাটা টলমল করছে ওর দুই হাতে।
গোড়ালিতে ভর রেখে বসল গ্রীন। ঝরনাস্রোতটা ইঞ্চি দুয়েকের বেশি গভীর নয় দেখে বুঝতে পারল কেন ছেলেটা ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়াতে এখানে আনেনি। ও যেখানে বসে আছে, আর দশ-বারো কদম ওপাশে ভেজা বালুর বুকে ছোঁকরীর বুটের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। প্রথমে ওকে কাবু করে তারপর বাসার ভেতরে যে আছে তার ওপর চড়াও হওয়াই সুবিধেজনক হবে, ভাবল ও। এতে করে অনেক সোজা হয়ে যাবে কাজ, জানতে পারবে তার তদন্ত কোন্ পর্যায়ে রয়েছে।
গ্রীনের এই চিন্তা তার অভিজ্ঞতার ফসল, যুক্তিসঙ্গত; জীবনে বহুবার এরকম চিন্তাভাবনা করেছে সে। কিছুক্ষণ আগে যেমন অনিশ্চয়তার মাঝে ছিল, পরিস্থিতি এখন তার চেয়ে ভাল, অনেকটাই তার আয়রে মাঝে এসে গেছে। এবার সে নিজের পছন্দমত পরিকল্পনা করতে পারবে, অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হবে না। নিঃশব্দে, অপেক্ষা করছে ও! এ সময় ওকে দেখলে মনে হবে যেন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। চওড়া শরীর, তবে কোথাও বাড়তি মেদ নেই। লম্বা, কিন্তু ঢ্যাঙা একে বলা যাবে না। বয়সের ছাপ বলতে, কপালের কাছে সামান্য পাক ধরেছে চলে।
উবু হয়ে আঁজলাভরে টলটলে ঠাণ্ডা পানি তুলে নিয়ে ঘষে মুখ পরিষ্কার করল সে, দুদিনের দাড়ির জঙ্গলে খসখসে শব্দ হলো। ভাল করে কুলি করল, ঘাড় ফেরাল থুতু ফেলতে। আবার যখন তাকাল গ্রীন তখন দেখতে পেল ছেলেটা ঝরনার কাছাকাছি চলে এসেছে, আস্তে হাঁটছে, মিনিট কুড়ি আগে গ্রীনকে প্রথম যেখানে দেখা গিয়েছিল সেই খাঁজটা জরিপ করছে ওর চোখ।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল ছেলেটা, ঘুরে পালাবার জন্য টানটান হয়ে গেল পায়ের পাতার ওপর, যেন সন্দেহজনক কোন শব্দ ধরা পড়েছে ওর কানে। খাজের দিকে তাকাল গ্রীন, কিন্তু উজ্জ্বল সূর্যালোকে ক্ষণিকের তরে ধাধিয়ে গেল ওর চোখ। তারপর। দেখল একটা মনুষ্যমূর্তি বেরিয়ে এসেছে বোল্ডারের আড়াল থেকে, পরক্ষণে রাইফেলধারী ক্যানাডাকে চিনতে পেরে ওর বিস্ময় ক্রোধে রূপান্তরিত হলো।
ছেলেটাও দেখতে পেয়েছিল ক্যানাডাকে, ওর যে প্রতিক্রিয়া হলো তা কোন নিরীহ ভবঘুরের কাছে প্রত্যাশা করা যায় না। ঝট করে গামলাটা হাত থেকে ফেলে দিল সে, ঝেড়ে দৌড় দিল বাসার উদ্দেশে, চেঁচাচ্ছে, ডিউক! সাবধান! কে যেন আসছে!
লাফিয়ে ঝরনাটা পার হলো গ্রীন, চোখের কোণে লক্ষ্য করল ক্যানাডা কাঁধের নিষ্পত্তি কাছে রাইফেল তুলছে। গুলি কর না! চিৎকার করে বলল ও।
কিন্তু ক্যানাডা ট্রিগার টিপে দিল। ওর চিৎকার ছাপিয়ে শোনা গেল রাইফেলের গর্জন, প্রতিধ্বনিত হলো পাহাড়ে-পর্বতে। বুলেটের আঘাতে কোমরের কাছে বাকা হয়ে গেল ছোঁকর কৃশকায় শরীর, ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল। হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে বসল ও, টলতে টলতে সোজা হচ্ছে এমন সময় আরেকটা গুলি হলো। এবার লাটিমের মত একপাক ঘুরে গেল ছেলেটা, সটান আছাড় খেল চিত হয়ে। অসাড় দেহটাকে দৌড়ে পাশ কাটাল গ্রীন, রাগে জ্বলছে ওর ব্রহ্মতালু, ভাবছে এর চেয়ে জঘন্য কাজ আর কিছুই হতে পারে না। বাসার দিকে ছুটে গেল ও, কারবাইনটা ফেলে দিয়ে পিস্তল বের করল হেলস্টার থেকে। প্রথমে জানালা, তারপর দরজা লক্ষ্য করে গুলি করল দুবার। গরাদবিহীন জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর ঝাপিয়ে পড়ল গ্রীন, দেখল পায়জামা পরিহিত হাড্ডিসার এক যুবক একটা বাংকের পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে, হাতে রাইফেল। গুলি করল ছেলেটা, তাড়াহুড়োয় নিশানা নড়ে গেল, বদ্ধ ঘরে বিকট শোনাল রাইফেলের আওয়াজ। চকিতে পালটা জবাব দিল গ্রীন, প্রতিপক্ষের মাথার আধইঞ্চি ওপর দিয়ে উড়ে গেল বুলেট। তপ্ত সীসার ছ্যাকায় ভয়ে কুঁকড়ে গেল। ছেলেটা, চোখের পাতা ফেলল। ওকে হত্যা করা গ্রীনের ইচ্ছে নয়, জ্যান্ত ধরতে পারলে তদন্তের সুবিধা হবে, অপ্রত্যাশিত সুযোগটাকে তক্ষুণি কাজে লাগল সে। লাফিয়ে আগে বাড়ল ও, রাইফেলটা ছিনিয়ে নিল হাত থেকে, ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের এককোণে।
শুরুতে হকচকিয়ে গেল অপরজন, তারপর আক্রমণ করল গ্রীনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল দেয়ালের ওপর। এমনিতেই যথেষ্ট শক্তি ধরে যুবক, তার ওপর ভয় ওকে মরিয়া করে তুলেছে। এলোপাতাড়ি ঘুসি হাঁকাল সে, গ্রীনের পিস্তল ধরা হাত লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল।
বাংকের তলায় অস্ত্রটা ছুঁড়ে দিল গ্রীন, জানে আপাতত ওটার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। মাথা নিচু করল ও, এক কদম আগে বেড়ে সেঁটে গেল ছোরার গায়ের সাথে, ঝটকা মেরে ওর হাত দুটো সরিয়ে দিল দূরে, হাঁটু দিয়ে সজোরে আঘাত করল তলপেটে ব্যথায় ককিয়ে উঠল ছোকরা, পিছিয়ে গিয়ে দুহাতে চেপে ধরল পেট, হুমড়ি খেয়ে পড়ল দুরমুজ করা মেঝেতে ছটফট করছে যন্ত্রণায়, গোঙাচ্ছে।
এবার দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত খানাতল্লাশি করল গ্রীন, দুটো রাইফেল, দুটো .৪৫ কোল্ট আর কার্তুজের বেল্ট উদ্ধার করল। বাংকের নীচ থেকে নিজের পিস্তলটা তুলে নিয়ে হোলস্টারে রাখল সে, বাকি অস্ত্রশস্ত্র বাইরে নিয়ে গিয়ে একে একে ছুঁড়ে ফেলল ছাতের ওপর। এরপর ওর কারবাইনটা কুড়িয়ে নিল সে, ক্যানাডা যেখানে ঝুঁকে পড়ে প্রথমজনের লাশ পরীক্ষা করছে সেখানে গেল।
মাত্র কৈশোর পেরিয়েছিল ছেলেটা, বছর আঠারো বয়েস হবে, হালকা-পাতলা শরীর। বুকের বাঁ পাশে দুটো গুলি লেগেছে, এখনও ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে ক্ষতস্থান থেকে। শক্ত হয়ে গেল গ্রীনের চোয়াল, কঠিন চোখে তাকাল ক্যানাডার দিকে। ওই দৃষ্টির সামনে চুপসে গেল অপরজন, কেশে গলা সাফ করে লাশটা দেখিয়ে বলল, কার্লোস গার্সিয়া। এও ছিল, মনে হয়। ডিউক নামের একজনকে ডাকছিল ও, শুনেছ নিশ্চয়? ওটা ডিউক রিপ, এদের আরেক সঙ্গী, সবসময় একসাথেই থাকে ওরা। ওকে মেরেছ তুমি?
আমি তোমাকে নিষেধ করেছিলাম আসতে, বলল গ্রীন, গলা অস্বাভাবিক রকমের শান্ত, হিমশীতল। ঘোড়া পাহারা দিতে বলেছিলাম।
উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম, অপেক্ষা করতে করতে।
গুলি করার দরকার ছিল না। আমার চিৎকার শুনতে পেয়েছিলে তুমি। তখনও যথেষ্ট সময় ছিল তোমার হাতে।
ও দৌড় দিয়েছিল; পালিয়ে যাচ্ছিল।
পারত না, আমি ওর পেছনেই ছিলাম। শুধু শুধু একটা লোককে খুন করলে, আরেকটু হলেই আমাকেও মেরে ফেলেছিলে।
এতটা আমি ভেবে দেখিনি।
স্বাভাবিক, বিরক্তির সুরে বলল গ্রীন। তুমি ভাবছিলে পুরস্কারের কথা।
গার্সিয়ার লাশের দিকে তাকাল ক্যানাডা। খনখনে গলায় বলল, যাই হোক, মড়া নিয়ে গেলেও টাকাটা পাওয়া যাবে, কি বল?
মুচকি হাসছিল ক্যানাডা, আচমকা ওর নাকের বাঁশিতে আঘাত করল গ্রীন। আরও দুবার চোয়ালে মারল সে, ভাঁজ হয়ে গেল ক্যানাডার হাঁটু, লুটিয়ে পড়ল। ঘুর ঘরে ফিরে গেল গ্রীন। ইতিমধ্যে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছে ডিউক রিস, বাংকের কিনারে, বসে আছে নতমুখে। ঠিক আছে, রিপ, কঠিন সুরে সরাসরি প্রশ্ন করল গ্রীন, এবার বল অন্য লোকটার নাম কী? এখন কোথায় আছে?
পলক তুলল রিপ, চোখ দুটো জ্বলছে। কিন্তু গ্রীনের স্থিরদৃষ্টির সামনে টিকতে পারল না বেশিক্ষণ, আবার নিচু করল মাথা। কে তুমি? গোমড়া মুখে জিজ্ঞেস করল সে। হুট করে এসেই গুলি করলে, তারপর এখন উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করছ?
আমার জবাব আমি এখনও পাইনি, রিপ! জবাব দাও–এক্ষুণি।
তাই? আমার নাম জানলে কীভাবে?
তা জেনে তোমার লাভ নেই কোন। তুমি বলতে শুরু কর।
লম্বা একটা শ্বাস টানল রিপ। তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, কাজেই আমারও কিছু বলার নেই তোমাকে।
গেল হপ্তায় তোমার বন্ধুরা টাওসে একটা স্টেজ ডাকাতির চেষ্টা করে। তুমিও ছিলে সেই দলে কোল্টার নামে এক লোককে খুন করেছ তোমরা। মোট চারজন ছিল। তোমাদের দলে। কোল্টার একজনকে গুলি করে। তার নাম স্কালি ব্রাওয়ারপরদিন। টাওসে ওর লাশ শনাক্ত করে একজন। তোমরা পালিয়ে চলে আস এখানে। একটু আগে গুলির আওয়াজ পেয়েছ, তাতে মারা গেছে কার্লোস গার্সিয়া। এর অর্থ, তোমাদের আরেকজন বাকি আছে এখনও। আমি তার নাম, এবং কোথায় গেলে পাব তা জানতে চাই।
মাথা নত করে শুনছিল রিপ, কিন্তু গার্সিয়ার নামটা কানে যেতেই চোখ তুলল, মুখ হাঁ হয়ে গেছে, চেহারায় অবিশ্বাসের ছাপ। কথা বলার সময় কেঁপে গেল ওর গলা, কার্লোসকে খুন করেছ তুমি?
বাইরে পড়ে আছে ওর লাশ।
চাপ সুরে ডুকরে উঠল রিপ, ঘুসি বাগিয়ে তেড়ে এল গ্রীনের দিকে। গ্রীনও দেখতে পেয়েছিল সেটা, একপাশে সরে গেল ও, পেশীবহুল, হাতের সমস্ত জোর খাটিয়ে চড় মারল রিপের মাথায়।
মুহূর্তের জন্য লোপ পেল রিপের বুদ্ধিশুদ্ধি, চোখে সর্ষের ফুল দেখল, কাত হয়ে পড়ে গেল বাংকের কিনারে। একটুক্ষণ অপেক্ষা করল গ্রীন। দম আটকে আসছে ঘরের ভেতর, রান্নাঘরের ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। কফি ফুটে ফুটে শুকিয়ে যাচ্ছিল, চট করে এগিয়ে গিয়ে কেতলিটা নামাল গ্রীন, চুলো বন্ধ করল। তারপর আবার আগের জায়গায় ফিরে এল সে। দেখল রিপ উঠে বসেছে, দুহাতে চেপে ধরে আছে মাথা।
গ্রীন এখন নিশ্চিত কার্লোসের সঙ্গে এই লোকও ডাকাতিতে জড়িত। সুতরাং কথা বলাতে হবে ওকে। কঠোর অথচ শান্ত সুরে ও বলল, আমাকে লোকটার নাম বল, রিপ।
জাহান্নামে যাও, রূঢ় স্বরে জবাব দিল রিপ, তাকাতে সাহস পাচ্ছে না।
নিকুচি করি, ভাবল গ্রীন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও, শক্ত হয়ে গেল চোয়াল। রিপের চুলের গোছা চেপে ধরল সে, একঝটকায় পেছনে কতি করল মাথা, আবার চড় মারল, তারপর আরেকবার। প্রতিটা আঘাতে সাময়িকভাবে বিকৃত হয়ে গেল রিপের মুখাবয়ব।
থামল গ্রীন, তবে চুলের মুঠি ছাড়েনি, ভাবলেশহীন গলায় বলল, আমি সারাদিন এভাবে চালিয়ে যেতে পারব, বাছা।
আবার আঘাত করল ও ব্যথায় কেঁদে ফেলল রিপ, দুর্বলভাবে ককিয়ে উঠল। গ্রীনের কজি আঁকড়ে ধরতে হাত বাড়াল ও, কিন্তু তেমন জোর পেল না। কপালে আরও দুটো খুসি খেয়ে অবশেষে একেবারে ভেঙে পড়ল রিপ, গ্রীন ছেড়ে দিল ওকে। ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট বানাল ও শুনতে পাচ্ছে লজ্জায় ফুপিয়ে কাঁদছে ছেলেটা, রক্তবর্ণ চোখজোড়ায় ফুটে উঠেছে অসীম হতাশা।
কষে একবার সিগারেট টানল গ্রীন, খানিক ইতস্তত করে, রুক্ষ ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দিল রিপের উদ্দেশে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে ওটা নিল সে, তাড়াহুড়ো করে টানতে গিয়ে বেশি ধোঁয়া গিলে ফেলায় কাশি এসে গেল। নিজের জন্য আরেকটা সিগারেট বানাল গ্রীন। নাও, শুরু কর এবার, গম্ভীর সুরে বলল।
রিপের নাকের পাটা ফুলে উঠেছে, ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। আমার মত লাল হয়ে গেছে একদিকের গাল। ঠোঁট ফেটে ক্ষীণ রক্তের ধারা গড়াচ্ছে কশ বেয়ে। দুহাতে মুখ ঢাকল ও, কম্পিত গলায় বলল, কার্ল হালাম। ওর বাবা অ্যাংকর র্যাঞ্চের মালিক, পশ্চিমের পাহাড়ে ওদের বাথান। ওখানে থাকতে পারে, আমি ঠিক জানি না।
সব মিথ্যে, দোরগোড়া থেকে একটা চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। গ্রীন ঘাড় ফিরিয়ে দেখল কখন যেন নিঃসাড়ে ক্যানাডা এসে দাঁড়িয়েছে, ব্যান্ডানা দিয়ে নাক চেপে ধরে আছে! রুমালটা নামাল ও, নাক ঝাড়ল, তারপর বলল খিটখিটে গলায়, আমি একসময় কাজ করেছি অ্যাংকরে। কার্ল এরকম ছেলেই না। বইয়ের পোকা বলা যায়। বাপকে অন্ধের মত ভক্তি করে। কেন জানি না, তবে হালা একটা আস্ত শয়তান।
চোখ কুঁচকে ক্যানাডাকে জরিপ করছিল রিপ হ্যাঁ, এবার চিনতে পেরেছি তোমাকে, বলল ও। র্যাংলার ছিলে। বেশি কথা বলার দায়ে হালাম তোমাকে বরখাস্ত করে। অন্তত আমরা তাই শুনেছি।
আবার নাক সিটকাল ক্যানাডা। ঠিক। হালাম সবাইকে কুকুর বেড়াল মনে করে, তার সামনে কারও মুখ খোলা চলবে না। একবার যদি
থাম! বলল রিপ, যেন আচমকা মনে পড়েছে কিছু। গ্রীনের দিকে ঘুরল ও। তুমি বলছিলে স্কালি ব্ৰাওয়ারের লাশ টাওসে শনাক্ত করা হয়েছে। নিশ্চয় ক্যানাডা করেছে?
আলবত, ধূর্ত হাসি হেসে বলল ক্যানাডা। লাশটা দেখেছিলাম আমি। কিন্তু কার্ল এসবের মধ্যে জড়াল কী করে?
তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না, বাধা দিল গ্রীন। অন্য একটা বাক থেকে কম্বল তুলে নিয়ে ক্যানাডার দিকে সেটা ছুঁড়ে দিল ও। লাশ জড়িয়ে নাও, তারপর আমাদের ঘোড়াগুলো নিয়ে এস এখানে।
আমি বরং মার্শাল মককে ডেকে আনি গিয়ে, ক্যানাডার গালে ভাঁজ পড়ল।
না। আমি যা বলছি তাই কর। কাল তুমি বলেছিলে শহর এখান থেকে বেশ দূরে, কাজেই সূর্য তেতে ওঠার আগেই রওনা হতে চাই আমি।
মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল ক্যানাডা। গ্রীনের ধমক খেয়ে ও যদি অসন্তষ্ট হয়েও থাকে, বাইরে তা প্রকাশ করল না। কিন্তু ওর ধূর্ত হাবভাব বিচলিত করল গ্রীনকে; ধূর্ত লোককে বিশ্বাস করা যায় না কোনমতে।
রিপকে ঝটপট কাপড় পরে তৈরি হতে বলল ও। তারপর সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দিল। ভাল কথা, আমার নাম জেমস গ্রীন, প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ডাকাতির ব্যাপারটা তদন্ত করতে আমার সংস্থাকে হুইলার স্টেজ কোম্পানি নিয়োগ করেছে।
পায়ে বুট গলাচ্ছিল রিপ। চোখ তুলে তিক্ত সুরে বলল, মোটা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে বোধহয়
হয়েছে।
তার মানে, একজন বাউন্টি হান্টারের সাথে তোমার কোনও তফাত নেই। উঠে দাঁড়িয়ে বিছানা থেকে রিপ ওর শার্টটা তুলে নিল। আমার বয়স মাত্র বাইশ, অথচ ফাঁসিতে ঝুলতে যাচ্ছি।
খুনের সাজা ফাঁসি-কথাটা আগে ভাবা উচিত ছিল। তোমরা হঠাৎ স্টেজ ডাকাতি করতে গেলে কেন?
শার্টের বোতাম লাগাচ্ছিল রিপ। মাঝপথে থেমে গেল হাত। মনে করার চেষ্টা করছে কিছু! মাতাল ছিলাম আমরা। শোন, তোমার মন গলাতে চেষ্টা করছি না আমি, যেটা সত্যি তাই বলছি। কার্লের কাছে কিছু টাকা ছিল। সেটা দিয়ে হপ্তাখানেক শহরে বসে ফুর্তি করি আমরা। তারপর একদিন মার্শাল পিপার মক এসে বলল, আমরা যদি না যাই, আমাদের সে হাজতে পুরবে। কাজেই শহর ছাড়লাম আমরা, উত্তরে যাচ্ছি, তখনও কিন্তু মদ লছে। এখনও স্বপ্ন মনে হয় সবকিছু। কার্ল বলল, চল স্টেজ ডাকাতি কিংবা ব্যাংক লুট করি
অর্থাৎ পুরোটাই কাল হালামের দোষ?
না, তা না। তবে ও শুধু একটা কথাই বলছিল, ওর বাবার কাছে নাকি ও নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করতে চায়। মাতাল ছিলাম, সবকথা ঠিক বুঝতে পারিনি। জানোই তো, মাতাল মানুষ বোকার মত কতকিছুই না বলে
অনেকের মাতাল হরারও দরকার পড়ে না, চাঁছাছোল জবাব গ্রীনের।
তা অবশ্যি। যাই হোক, আমরা দেখলাম স্টেজ আসছে, এরপর কীভাবে যেন ঘটে গেল ব্যাপারগুলো। ঝোঁপের ভেতর ঘোড়া বেধে স্টেজ থামালাম, তারপর স্কালি যখন মাথায় গুলি খেয়ে পড়ে গেল, আমরা পালালাম। প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হলো সবকিছু, পরে যখন বুঝতে পারলাম কঠিন বিপদে পড়েছি, দিনরাত ঘোড়া ছুটিয়ে সোজা চলে এলাম এখানে। তারপর কার্ল বলল সে বাথানে যাচ্ছি, ঝামেলা না মেটা পর্যন্ত ওখানেই থাকবে গা ঢাকা দিয়ে।
থামল রিপ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাপল গ্রীনকে, ধীরে ধীরে বলল, তোমার কথাই ঠিক-মাতাল না হয়েই অনেকে বোকার মত কথা বলে।
মৃদু হাসল গ্রীন। রিপ তৈরি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে, তারপর বাইরে যেতে আদেশ করল ওকে। যাও, তোমাদের ঘোড়া দুটোয় জিন চাপাও গিয়ে। চালাকির চেষ্টা করবে না, আমি নজর রাখব।
রিপের পেছন পেছন ও বাইরের কড়া রোদে বেরিয়ে এল। ওর বাড়ির কোনা ঘুরে পেছনে যেতেই থমকে দাড়াল রিপ, দালানের ছায়ায় রাখা কম্বল জড়ানো মৃতদেহটার দিকে তাকাল শোকার্ত দৃষ্টিতে। ভাল ছেলে ছিল কার্লোস, খুউব ভাল, অনুচ্চ স্বরে বলল, গলা কাঁপছে। খোদা! মারিয়া জানলে তখন কী হয় দেখ।
মারিয়া কে?
ওর বোন। মেক্সিক্যান পাড়ায় একটা ক্যাফে চালায়। কার্লোসের ব্যাপারে খুব চিন্তা করে ও। রিপের ক্রুদ্ধ চোখ দুটো যেন ভস্ম করতে চাইল গ্রীনকে। তুমি ওকে খুন করেছ। এখন মারিয়া হয়তো প্রতিশোধ নিতে চাইবে তোমাকে মেরে।
গার্সিয়াদের ছেলেকে ক্যানাডা খুন করেছে, তথ্যটা গ্রীন জানাবার প্রয়োজন বোধ করল না। এর মধ্যে ওর বোন আসবে কেন-এটা আইনের ব্যাপার, বলল ও। তুমি তোমার কাজে যাও।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওই বোন ওকে ভাবিয়ে তুলল! কানাডার দোষে কাজটা শুরুই হয়েছে খারাপভাবে, এটা মনে হতে ওর মেজাজ খিচড়ে গেল। এখন কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারবো হলফ করে।
০২.
ওই যে অকটিও; ওখানে! একগাল হেসে বলল ক্যানাডা, মরুভূমির মাঝখানে কতকগুলো ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘর দেখাল। অল্প কিছুক্ষণ আগে দুপুর পেরিয়ে গেছে, ধূসর আকাশে আগুন ছড়াচ্ছে হলুদ সূর্য শহরের ওপাশে, দিগন্তে, আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে পাহাড় পর্বতের চূড়া। ঘাম ঝরানে প্রচণ্ড গরমে ধীরকদমে এগিয়েছে ওরা, ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দিতে বার থেমেছে পথে। গ্রীন বিরক্ত হয়ে উঠেছিল।
এখান থেকে ভুতুড়ে শহর মনে হচ্ছে, বলে ব্যান্ডানা দিয়ে মুখ আর ঘাড়ের ঘা মুহল ও। কেন মানুষ দেখা যাচ্ছে না।
ঘুমাচ্ছে সবাই।
মার্শাল মকের অফিসটা কোথায়?
রাস্তার শেষ মাথায়। ওই যে, দূরে একটা কটনউড গাছ দেখতে পাচ্ছি না? শহরের একমাত্র গাছ-জেলখানার ঠিক পেছনেই। রিপের দিকে ধূর্ত দৃষ্টিতে তাকাল ক্যানাডা। এক সময় বহুলোকের ফাঁসি হয়েছে ওখানে।
আমাকে ফাঁসি দেবে না কেউ, বিড়বিড় করে বলল রিপ।
বল, এখানে না, কানাডা হাসল।
চুপ কর, দুজনেই, ধমক দিল গ্রীন। ঠিক আছে, আমরা ঘুরে জেলখানার পেছন দিয়ে আসব। শহরবাসীদের নজরে যত কম পড়া যায় এখন ততই ভাল।
লোকচক্ষুর অগোচরে জেলখানায় পৌঁছাতে পারবে ওরা এ আশা করেনি গ্রীন, বিশেষত ওদের সঙ্গে যখন স্যাডলে বাধা একটা লাশ রয়েছে। তবে মেক্সিক্যানদের সুউচ্চ প্রাচীন গির্জা, দোকানপট আর ক্যান্টিনাগুলো যেখানে অবস্থিত, শহরের সেই এলাকা পেরিয়ে আসার সময় কারও চেহারায় উদ্বেগ লক্ষ করল না ওরা। একজন আলোর দৃষ্টিতে এই অঞ্চলের পরিচয় মেক্সটাউন হিসেবে এখানেই কার্লোসের বেনি, মারিয়ার ক্যাফে রয়েছে, গ্রীনের মনে পড়ল। বাড়িঘর আর ব্যবসায়িক ভবনগুলোর পেছন দিয়ে এগোল ওরা, দু-এক জোড়া কৌতূহলী চোখ ছাড়া আর কেউ কোনরকম উৎসাহ দেখাল না ওদের ব্যাপারে। অবশেষে কটনউডের ছায়ায় থামল তিন অশ্বারোহী। সামনেই একটা চুনসুরকির চৌকো লাল দালান-অকটিওর কাগার। ঘোড়া থেকে নেমে হিচ রেইলে লাগাম বাঁধল গ্রীন, ইশারায় রিপকেও নামতে বলল। চল, ভেতরে গিয়ে মার্শালের সাথে দেখা করি। তারপর শহরবাসীরা জেগে ওঠার আগেই চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলব লাশটা।
.
নিজের চেয়ারে হেলান দিল মার্শাল পিপার মক। মাঝবয়সী, দড়ির মত পাকানো শরীর। ঘন ভারি পাপড়ির নীচে সুন্দর দুটো চোখ। হলদেটে জমির মাঝখানে পিঙ্গল তারা। শান্তভাবে বেসরকারি গোয়েন্দার বক্তব্য শুনল সে। তার ডেস্কের সামনে, একটা চেয়ারে বসে আছে গ্রীন, ক্লান্ত চরণযুগল মেলে দিয়েছে টানটান করে। হ্যাট আর স্যাডলব্যাগগুলো চেয়ারের একপাশে মেঝের ওপর পড়ে আছে। ঘর ভাড়া করাতে হোটেলে গেছে ক্যানাডা, তবে ও বিদায় নেয়ার আগে পিপার মক সাবধান.. করে দিয়েছে, যা ঘটেছে সে ব্যাপারে যেন কিছুই ফাঁস না করে ও।
লোকে যাই জিজ্ঞেস করুক, তুমি কিছু জানো না, বোঝা গেছে? এটা এখন শান্ত শহর, আমি চাই শান্তই থাক।
ভয় নেই, আমার মুখ আলগা হবে না, ক্যানাডা হেসেছে। এখানে আমার অন্য কাজ আছে।
কার্লোস গার্সিয়ার লাশ আপাতত পেছনের দুটো সেলের একটায় রাখা হয়েছে; অন্যটায় কয়েদ করা হয়েছে ডিউক রিপকে। গ্রীনের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করেছে মক।
ডাকাতির ব্যাপারটা খুলে বলতে যাচ্ছিল গ্রীন, কিন্তু মার্শাল বাধা দিয়ে জানাল সে ইতিমধ্যেই পত্রিকায় ওই ঘটনার খবর পড়েছে। ডেস্কের ওপর রাখা একটা খবরকাগজ গ্রীনের দিকে ঠেলে দিল সে।
টাওস উইকলিতে ছাপা হয়েছে। ওরা আমাকে পাঠায় এক কপি। এটা এসেছে আজ দুপুরের স্টেজে। সম্ভবত তুমি আর ক্যানাডা যেদিন টাওস ছেড়েছ, সেদিনকার কাগজ।
পত্রিকাটা নিল গ্রীন। প্রথম পাতায় সুদীর্ঘ রিপোর্ট, বড় হরফের শিরোনাম।
ডাকাতের হাতে স্টুয়ার্ট কোস্টার নিহত
টাওস স্টেজে স্টুয়ার্ট কোল্টারের নিধুর হত্যাকাণ্ড স্থানীয় জনমনে ক্রোধের সঞ্চার, করিয়াছে। মিস্টার কোল্টার এই অঞ্চলে একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। গবাদি পশু, খনি এবং কাঠের ব্যবসা ছিল তার। পশ্চিমগামী স্টেজে চড়িয়া ঈগল পাস হইতে টাওসে আগমনকালে চারজন মুখোশধারী ডাকাতের আক্রমণে তিনি নিহত হন। স্টেজচালক টম ওয়েবস্টার ঘটনা সম্পর্কে আমাদের কাছে নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রদান করেন।
এটা ছিল নিয়মিত কোচ, মিস্টার ওয়েবস্টার বলেন। গাড়িতে কোন মেইল ব্যাগ বা স্ট্রংবক্স ছিল না বলে আমি বন্দুকধারী পাহারাদার নিইনি সঙ্গে। মিস্টার কোল্টার ছিলেন একমাত্র যাত্রী।
স্টোন লজে, ঘোড়া বদলাই আমরা। দুপুরের খাওয়াও ওখানেই সারি। যাত্রার সময় মিস্টার কোল্টার জিজ্ঞেস করেন তিনি ওপরে এসে বসলে আমার কোন আপত্তি আছে কিনা, আমি বলি না। চমৎকার আবহাওয়া ছিল সেদিন। স্টোন লজের আট মাইল পশ্চিমে রক জর্জে মোড় নিচ্ছি আমরা এই সময় চারজন মুখোশধারী লোক একটা ঝোঁপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের পথরোধ করে দাঁড়ায়। ওদের দুজনের হাতে ছিল রাইফেল, অন্য দুজনের পিস্তল! এর আগেও স্টেজকোচ চালাতে গিয়ে বার কয়েক ডাকাতের কবলে পড়েছি আমি। জানি এরা কথা বলে কম, কাজ দ্রুত সারেবাধ্য না হলে গুলি করে না।
কিন্তু এদের ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। আমি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম এই চারজন পেশাদার লুটেরা না-আনাড়ি। অস্থির দেখাচ্ছিল ওদের, বোকার মত হাসাহাসি করছিল নিজেদের মধ্যে প্রথমে আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা নিছক কৌতুক, তারপর দেখলাম ওরা মাতাল হয়ে আছে, দুজন তাদের প্যান্টের পকেট থেকে বোতল বের করছে।
তা সত্ত্বেও, আমি ভয়ের কারণ দেখিনি। আমি ওদের বললাম গাড়িতে কোন মূল্যবান জিনিসপত্র নেই, তবে ইচ্ছে করলে ওরা খুঁজে দেখতে পারে। দুজন তল্লাশি করে দেখল সবকিছু। এরপর নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করল ওরা, খুব নিচু স্বরে কথা বলছিল, ফলে আমি কিছুই শুনতে পাইনি। ইতিমধ্যে শেষ করেছিল একটা বোতল, এবার ওরা সেটা ছুড়ে ফেলে দিল ঝোঁপের ভেতর। তারপর রাইফেলের নল দিয়ে একজন খোঁচা মারল মিস্টার কোল্টারের বুকে। মিস্টার কোল্টারের ওয়েস্টকোটের পকেটে বাঁধা সোনার ঘড়ির চেইনটা চোখে পড়েছিল এর। মিস্টার কোল্টারের পার্সসহ ঘড়িটা চাইল সে।
এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি মিস্টার কোল্টার। এবার তার মুখের দিকে অকিয়ে আমি বুঝলাম তিনি দারুণ রেগে গেছেন। তারপর উনি কঠোর ভাষায় নিন্দা করলেন ওদের। বললেন, সৎভাবে জীবনযাপনের বদলে যারা অন্যের ধন লুটে খায় তাদের উনি কোন চোখে দেখেন। ওরা শুনল তাঁর কথা, কিন্তু বেশিক্ষণ না। যে লোকটা রাইফেলের গুতো মেরে মিস্টার কোল্টারের পার্স আর ঘড়ি দাবি করেছিল, এবার সে তক্ষুণি ওটা দিয়ে দিতে বলল।
তো, মিস্টার কোল্টার তার কোটের তলায় হাত ঢোকালেন যেন পৃর্স বের করবেন, কিন্তু তিনি বের করলেন পিস্তল। মুখোশপরা লোকগুলো চমকে উঠে ছড়িয়ে পড়ল, তারপর শুরু হলো তুমুল গোলাগুলি। আমার কাঁধে গুলি লাগল। তারপর মিস্টার কোস্টার আঘাত পেয়ে সিট থেকে ছিটকে পড়ে গেলেন মাটিতে। তার অদুরেই একজন ডাকাত আহত হয়ে পড়েছিল, মিস্টার কোস্টারের গুলিতে মাথায় চোট লাগে তার! বাকি লোকগুলো এরপর তাদের ঘোড়ায় চেপে পালিয়ে যায়।
আমি যখন নেমে আসি, মিস্টার কোল্টার এবং ডাকাত দুজনেই মারা গেছে। ওদের লাশ কোচে তুলে টাওসে হাজির হই আমি।
মিস্টার ওয়েবস্টারের বিবরণ হইতে পরিষ্কার বোঝা যায় মুখোশধারী ডাকাতরা নিতান্তই আনাড়ি ছিল। নিহত দস্যুকেও তৎক্ষণাৎ শনাক্ত করা সম্ভব হয় নাই। শেরিফ শেভলিন লাশের ছবি তোলেন এবং সকল দায়িত্বশীল নাগরিককে অনুরোধ করেন মৃতদেহ শনাক্ত করিতে। অতঃপর মাত্র গতকাল স্থানীয় সানরাইজ কোরাল ও লিভারি বার্নের অসল্যার, লাইল ক্যানাডা, লাশ দেখিয়া শেরিফ শেভলিন ও হুইলার স্টেজ অ্যান্ড ফ্রেইট লাইন্সের সভাপতি ফ্র্যাংক হুপারের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চান। তাহাদের আলাপের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছু জানা যায় নাই, তবে মিস্টার হুপার ঘোষণা করেন বিষয়টি তদন্ত করিয়া দেখার জন্য তিনি একটি বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থাকে নিযুক্ত করিয়াছেন।
জেমস গ্রীন, সংস্থার সেরা অপারেটর, আজ সকালে শহরে উপস্থিত হন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পরপরই তিনি ও মিস্টার ক্যানাডা এক অজ্ঞাত গন্তব্যের উদ্দেশে টাওস ত্যাগ করেন। মিস্টার গ্রীন একজন সাবেক ইউ, এস, মার্শাল। গত বৎসর ডেনভারের কুখ্যাত ব্ল্যাক হ্যাক চক্রকে একক প্রচেষ্টায় নির্মূল করিয়া তিনি সুনাম অর্জন করেন।
তার বর্তমান দায়িত্ব প্রসঙ্গে মিস্টার গ্রীন সংক্ষেপে বলেন, এমন কিছু বিশেষত্ব নেই এতে। সম্ভবত অবসর নেয়ার আগে এটাই আমার শেষ অ্যাসাইনমেন্ট।
.
ডেস্কের ওপর পত্রিকাটা নামিয়ে রাখল গ্রীন। ঠিকই লিখেছে। স্কালি ব্রাওয়ারের লাশ শনাক্ত করে ক্যানাডা। জানত ওর বাড়ি এখানে। হুপারকে বলে, পথ দেখিয়ে আমাকে সে নিয়ে আসতে পারবে গার্সিয়াদের পুরানো বাসায়। ও জানায়, দরকার হলে ব্ৰীওয়ার তার বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে থাকত ওখানে। হুপার রাজি হয়ে যায়। সমস্ত খরচপাতি সেই দিচ্ছে।
তরুণ গার্সিয়া কীভাবে নিহত হয়েছে এবং ডাকাতিতে কার্ল হালামের ভূমিকা সম্বন্ধে ডিউক রিপ যে জবানবন্দী দিয়েছে তা জানাল গ্রীন। খবরটা শুনে মার্শালের চেহারায় কোনরকম ভাবান্তর হলো না।
বলতে কী, মোটেই অবাক হচ্ছি না আমি। তবে লোকজন যখন জানবে, অনেকেই বিস্মিত হবে খুব। একটু থামল মার্শাল। ভাল ছেলে ছিল ওরা, সবাই। তরতাজা তরুণ একেকটা, নিষ্পাপ। আমি ডিউক রিপ আর বাকি দুজনের কথা বলছি, কার্লের না। ওর ব্যাপারটা একটু আলাদা।
ক্যানাডা বলছে ছেলেটা নাকি বইয়ের পোকা, বাপকে দেবতা মনে করে। অথচ রিপের কথা যদি সত্যি হয়, ডাকাতির পরিকল্পনাটা কার্লের, এর মাধ্যমে ওর বাবার কাছে ও কিছু একটা প্রমাণ করতে চাইছিল। ক্যানাডা বলেছে হালাম লোকটা ভীষণ নীচ।
কঠিন লোক। প্রথম যখন এখানে বসতি করে ও, আইন বলতে কিছু ছিল না এদিকে, কিন্তু হালাম মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। সত্তর সালে, তখনও শেরিফ হইনি আমি, হালাম তার বাথানের কর্মচারীদের নিয়ে একদল গরুচোরকে ধাওয়া করে মেক্সিকোতে গিয়ে পাকড়াও করে। ওখানেই ওদের সে ফাঁসি দেয়। কঠিন, গোয়ার টাইপের লোক, নিজের খেয়ালখুশিমত চলতে চায় সবসময়। তুমি আগেও দেখেছ এধরনের মানুষ। থুতনিতে হাত ঘষল মক, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবে ছেলেটা যে ওকে দেবতা মনে করে বলছ, আমি কিছু জানি না এ ব্যাপারে। বোধহয় ভয় আর শ্রদ্ধা মিশে তৈরি হয়েছে এরকম কিছু একটা।
রিপ বলছে সম্ভবত ওদের বাথানে আছে ও
থাকতে পারে। হপ্তা দুয়েক হলো আমি আর দেখছি না ওকে। শহরে এসে পাগলামি করছিল। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে তুমুল হট্টগোল শুরু করে। বিষণ্ণ সুরে হাসল মক। আঠারো বছরের ছেলে, এর আগে হয়তো এক ফোঁটা মদও খায়নি কোনদিন। আমরা সবাই খুব অবাক হয়েছিলাম। মেক্সটাউনে আড্ডা জমায়। ওখানেই কার্লোস এবং অন্যদের সঙ্গে দেখা হয় ওর। তবে ওখানে বেশিক্ষণ মদ খেতে পারেনি; কারণ গার্সিয়ার বোন, মারিয়া, চায়নি ওই ছেলে মদ খাক। ফলে স্যালুনে চলে আসে ওরা, ভাঙচুর করে জিনিসপত্র, কিন্তু ওদের মধ্যে একজন ফ্রেন্ড হালামের ছেলে বলে, কেউ কিছু করতে সাহস পায়নি। আমি ওদের বলি, ভদ্রভাবে না চললে হাজতে পুরে রাখব। তখন ওরা শহর ছেড়ে চলে যায়।
হালাম নিশ্চয় শুনেছে কী ঘটছে। আমায় মনে হয় যেকোন কড়া লোকই এমন অবস্থায় তার ছেলেকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
ওপর নীচ মাথা ঝাঁকাল মক। আমিও সেজন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু আসেনি সে।
মাথায় হ্যাট চাপাল গ্রীন, স্যাভলব্যাগগুলো তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এখানে যাওয়ার সেরা সময় কখন? আজ বিকেলে?
দেরি হয়ে গেছে অনেক। বেশ দূরের পথ, কাল সকালে যাব আমরা। চেয়ার ছাড়ল মক, হাত বাড়িয়ে ব্ল্যাক থেকে তার টুপিটা নিন। দুই জায়গায় যেতে হবে, আমাকে। প্রথমে পাদ্রি। তারপর দেখা করব মারিয়া গার্সিয়ার সঙ্গে।
বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল ঘুম থেকে আবার জেগে উঠেছে শহর। ইশারায় ওপাশের হোটেলটা দেখাল মক। তোমার যা কিছু দরকার সব পাবে ওখানে-গোসলের ব্যবস্থাও আছে।
হ্যাঁ, গোসল করতে হবে, যা ধকল গেছে এই দুদিন। আরেকটা কথা, কাল ভোরেই বেরোব আমরা। দেরি করলে নাও পেতে পারি ওকে।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল মার্শাল। ভোরেই।
তারপর হাত মিলিয়ে দুদিকে চলে গেল দুজন।
০৩.
ঘোড়ার খুরের গুরুগম্ভীর আওয়াজে সচকিত হয়ে উঠল কার্ল হালাম। র্যাঞ্চ হাউসের দোতলার বারান্দায় অন্ধকারে বসে আছে ও। সামনে ঝুঁকল কার্ল, হাতুড়ির ঘা পড়ছে যেন বুকে, চোখ কুঁচকে তাকাল নীচে। রুপালি জ্যোত্যায় ভেসে যাচ্ছে আশপাশ। শুধু ঝোঁপঝাড় আর দালানের আনাচেকানাচে মৃদু ছায়া পড়েছে। উঠনের কিনারে একজন ঘোড়াসওয়ার দাঁড়িয়ে রয়েছে লক্ষ করে ভয়ের স্রোত বয়ে গেল ওর শরীরে, সতর্ক হয়ে উঠল।
র্যাঞ্চের দালানকোঠা একে একে জরিপ করছে ঘোড়াসওয়ার। পার্লারের পর্দার ফাঁক গলে, আলো আসছে। কার্ল বুবলি ওর বাবা জেগে আছে, তার শখের ঘোড়ার চামড়া, বিছানো আরাম কেদারায় বসে ফেনিমোর কুপারের কোন বই পড়ছে। বিরাট উঠনের আরেক পাশে ক্যারেজ হাউস, বার্ন, স্ট্যাবল আর কোরাল। সবশেষে, চত্বরের অপর প্রান্তে বাংকহাউস। এখন সেদিকে প্রসারিত হয়েছে ঘোড়াসওয়ারের দৃষ্টি। ভেজা খড় আর গরুবাছুর আর ঘোড়ার মলমূত্রের দুর্গন্ধে রাতের বাতাস ভারি হয়ে আছে। কাছের কোন পাহাড় থেকে কতির সুরে চাঁদের কাছে ফরিয়াদ জানাল একটা কয়ৌট এবং থামল।
ঘোড়াসওয়ার সামনে এগোতে, মোজা পায়ে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল কার্ল, নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের সন্ধানে তাকাল ডাইনে বাঁয়ে। ভবঘুরে না, ভাবল কার্ল, জানে ক্ষুধার্ত কাউহ্যান্ড সরাসরি বাবুর্চির, ঘরেই যাবে। বুড়ো টিম ওখানে বাসনকোসন ধুচ্ছে এখনও। পরক্ষণে ভীষণভাবে দমে গেল ও যখন দেখল নীচের পোর্ট থেকে দশ-বারো গজ দূরে, হিচ রেইলের সামনে থেমে স্যাডল থেকে নামছে অশ্বারোহী। আচমকা ভারমুক্ত হয়ে যাওয়ায় ঘোৎ শব্দে নাক ঝাড়ল ঘোড়াটা।
ওই আওয়াজে সতর্ক হয়ে উঠল একন। কার্ল জানে ওটা হার্ভে স্টেজ। সম্ভবত, এতক্ষণ ক্যারেজ হাউসের বাংকে বসে আগন্তুকের সমস্ত গতিবিধিই লক্ষ করেছে সে। নবাগত নিজেই তার উপস্থিতি জানান দেবে এই আশায় অপেক্ষা করছে। হার্ভের নাগালের মধ্যে নিশ্চয়ই একটা পিস্তল আছে এখন। শহরের অধিকাংশ লোক যেখানে আজকাল আর সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র রাখে না, সেখানে হার্লে কোমরের বেল্টে সর্বদা একটা পিস্তল আর ছুরি গোজা থাকে। এর কারণ জানতে জীবনের অনেকগুলো বছর ব্যয় করতে হয়েছে কার্লকে।
ও লক্ষ করল হার্ভের ছোট শরীরটা ধীরে ধীরে উঠনের কিনার ঘুরে আসছে। আগন্তুক আর নিজের মাঝখানে রেখেছে ঘোড়াটাকে। নবাগত এখন হিচ রেইলের নীচে বসে পর্যবেক্ষণ করছে চারদিক। কার্লের ক্ষীণ আশা ওর সাথে বা যা ঘটেছে তার সঙ্গে লোকটার আগমনের কোন সম্পর্ক নেই। দুঃস্বপ্নের মত ওই ঘটনা অহরহ তাড়িয়ে ফিরছে ওকে, তবু সে এই আশায় বুক বাঁধতে চাইল। কার্ল দেখল আগন্তুকের পেছনে চলে এসেছে হার্ভে, তারপর স্বস্তির সুরে ওকে বলতে শুনল, অ, তুমি। এখানে কী করছ?
সশব্দে হাসল লোকটা। তোমার খেলনাটা সরাও, হার্ভে, বলল সে, ফ্রেডের সাথে দেখা করতে এসেছি আমি।
মিস্টার হালাম বলরে। তার সাথে তোমার কী দরকার?
তুমি শুধু গিয়ে বল লাইল ক্যানাডা এসেছে, দেখা না করলে পরে আফসোস করতে হবে তাকে।
লাইল ক্যানাডা! হাঁপ ছাড়ল কার্ল, জাট অথচ কর্কশ কণ্ঠস্বরের মালিককে চিনতে পেরেছে, অ্যাংকরে একসময় কাজ করত ক্যানাডা। লোকটা ঘোড়া ভালবাসত খুব, আর ওরাও সহজে পোষ মানত ওর কাছে। কিন্তু ফালতু বকবক করার অভ্যাস আছে বলে কার্লের বাবা ওকে বরখাস্ত করে।
সামনের দরজাটা খোলার আওয়াজ পেল কার্ল। একচিলতে আলো ছড়িয়ে পড়ল বাইরে, তারপর ফ্রেড হালামের ছায়া এর অধিকাংশই দখল করে নিল। নীচের পোর্চে তার পা ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কে? রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করল সে। কথা বলছ না কেন?
আলোর কিনারে এগিয়ে এল হার্ভে, কার্ল দেখল ওর রুক্ষ, সন্দিহান চোখজোড়া কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। লাইল ক্যানাডা, তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
ক্যানাডা? আমি তার সাথে দেখা করার কোন কারণ দেখছি না।
এখন আমাকে দেখছ তুমি, আলোয় এসে বলল ক্যানাডা। দাড়িগোঁফে ঢাকা মুখখানা এবার দেখতে পেল কার্ল, ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা অস্থির ধূর্ত হাসিটা চিনতে পারল। আমার কথা শুনলে তোমারই লাভ-এর সাথে আইনের প্রশ্ন জড়িত।
তুমি আইনের লোক নও।
আমিও তা বলিনি। টাওসের এক আস্তাবলে কাজ করি আমি, সেখানে
এ কথা বলতে তুমি ছুটে আসনি এতদূর।
পাগল! এত ভাল একটা চাকরি ছেড়ে এসেছি যখন ব্যাপার নিশ্চয় গুরুতর। লোক আছে আমার সঙ্গে-ডিটেকটিভ গ্রীন। টাওসের হুইলার স্টেজ কোম্পানি ডাকাত ধরার জন্য, ঠিক করেছে ওকে। ডাকাতরা ওদের একটা স্টেজ লুট করার সময় একজন যাত্রীকে খুন করে।
কথাগুলো আলোড়ন তুলল কার্লের মগজে; ওর বাবার বক্তব্য ও শুনতে পেল। ধড়ফড় করছে বুক, দ্রুত শ্বাস পড়ছে, আচমকা মাথা ঘুরে, উঠতে দেয়ালে হেলান দিয়ে টাল সামলাল ও। একসময় ক্যানাডার অট্টহাসি শুনতে পেল সে। লোকটা বলছে, জানতে চাইলে টাকা খরচ হবে তোমার। ইচ্ছে করলে আজ রাতেই কিনে নিতে পার তথ্যটা, নয়তো কাল সকালে মার্শালের কাছেই শুনবে। তবে তখন হয়তো কিছুই করার থাকবে না তোমার।
মুহূর্তের নীরবতা। তারপর ওর বাবা যখন মুখ খুলল কার্লের বাকি আশাভরসাও উবে গেল। কত? কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন করল ফ্রেড ছালাম।
এক হাজার। নগদ। এখনকার বাজারে তোমার বিশটা গরুর দাম। টাকা না দেখা অবধি মুখ খুলছি না আমি। আর হ্যাঁ, কথাটা যেন আমাদের এই তিনজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
উদ্বিগ্ন স্বরে হারে প্রশ্ন করল, ছেলেটা কোথায়, ফ্রেড?
আজ সকালে বলল শহরে যাচ্ছে, রাতে বাইরেই থাকবে। তুমি ছিলে তখন, তুমিও শুনেছ।
আমরা যখন বাইরে ছিলাম তখন ফিরেও এসে থাকতে পারে। তুমি ঠিক জানো, ও ঘরে নেই?
হালাম বলল, দাঁড়াও, তারপর পারলার হয়ে সিঁড়িতে ওর পদশব্দ পাওয়া গেল। কার্ল! ল্যান্ডিং থেকে ভেসে এল ডাক। কার্ল!
বাবার ওপর টেক্কা দিয়েছে ভেবে চাপা উল্লাস বোধ করল কার্ল। সকালে শহরে যায়নি সে, গিয়েছিল কার্লোস আর ডিউকের সঙ্গে দেখা করতে গার্সিয়াদের পুরানো শীপ র্যাঞ্চে। ওরা ছিল না সেখানে অগত্যা বাসায় ফিরে আসে ও। টের পেয়েছে লোকজনসহ ফিরে এসেছে ওর বাবা, কিন্তু রাতের খাওয়া খেতে ও বেরোয়নি নিজের ঘর থেকে, বিষণ্ণ মনে কেবলই ভেবেছে কার্লোস আর ডিউক হয়তো শেষপর্যন্ত চলেই গেছে দেশ ছেড়ে।
ওর ঘরের দরজা খুলে গেছে শুনতে পেল ও, তারপর রুক্ষ কর্তৃত্বসুলভ গলায় আবার ডাকল ওর বাবাঃ কার্ল! থাকলে, জবাব দাও।
বাবাকে যেন দেখতে পাচ্ছে সে, মনে হলো ওর, বিশাল চওড়া শরীর, চৌকো মুখখানা,থমথম করছে, চোখ দুটো কঠিন। সহসা ভয়ে শুকিয়ে গেল ওর বুক, তারপর এক মুহূর্ত বাদে শুনতে পেল তাচ্ছিল্যের সুরে অব্যক্ত একটা শব্দ করল ওর বাবা, ঘুরে চলে গেল সিঁড়ির পানে।
সামনে ঝুঁকল কার্ল, দেখল হার্ভে জরিপ করছে উঠটা। আধো-অন্ধকারে অ্যাংকর ফোরম্যানের ক্ষুদ্রকায় অবয়বটা দেখে ওর মনে পড়ল গোলাঘরে মাটির নীচে কী পোঁতা রয়েছে। সেদিন প্রায় ঘণ্টাখানেক উন্মত্তের মত ওখানে মাটি খুঁড়েছিল হার্ভে, কোমর-সমান গভীর একটা গর্ত খুঁড়তে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে, গাল বকছিল অনবরত। পরে গর্তটা আবার বুজিয়ে ভালমত মাটি দুরমুজ করে হার্ভে, তারপর প্রচুর কেরোসিন ছিটিয়ে দেয় সেখানে যাতে কোন অস্বাভাবিক গন্ধ না বেরোয় ছালায় পুরে যে জিনিস, ওখানে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে খোলা হাওয়ায় বেশিক্ষণ ফেলে রাখলে একশো গজ দূর থেকেও তার দুর্গন্ধে পরিবেশ বিষিয়ে উঠবে।
পোর্টে ফিরে এল ফ্রেড হালাম, রূঢ় গলায় বলল, পাশের দরজায় যাও। বাড়ির কোনা ঘুরে অদৃশ্য হলো হার্ভে আর ক্যানাডা। অ্যাংকরের অফিস-ঘর ওইদিকে অবস্থিত।
কার্ল দিশেহারা হয়ে ভাবতে থাকে কী করবে সে-বাবার অনুকম্পা চাইবে, না পালিয়ে যাবে। বাবার সামনে দাঁড়াবার কথা মনে হতেই সাহস হারিয়ে ফেলল ও, জানে কোনদিনই তা সম্ভবপর হবে না ওর পক্ষে। কাজেই এখানে আর কোন আশা নেই, পালাতে হবে ওকে। ঘোড়ার পিঠে জিন চাপানো সম্ভব নয়, হার্ভে টের পেয়ে ওকে পাকড়াও করবে এও সত্যি, বাকি রাতটুকু আজ জেগেই কাটাকে হার্ভে, শহর থেকে ওর ফেরার অপেক্ষায় থাকবে। এর বাইরে যেতে চাইল না ওর চিন্তাশক্তি, ওর ভবিষ্যৎ বিচার করতে অস্বীকার করল তার কি আইনের হাতে ধরা দেয়া উচিত কার্লোস আর ডিউক কোথায় গেছে একবার জানতে পারলে হত।
পা টিপে টিপে নিজের ঘরে ঢুকল কার্ল, বুট পরল, পালাবার আকুতিতে হাত কাঁপছে। সরু কোমরে পিস্তলসমেত গানবেল্ট জড়াল সে, অন্ধকারে হাতড়ে টুপি খুঁজে নিয়ে মাথায় চাপাল। ড্রয়ার থেকে ওর টাকার বাকফিনের থলেটা বের করল, এখন আর মাত্র শ-দুয়েক ডলার রয়েছে ওতে। এবার ব্যারান্দায় বেরিয়ে এসে রেইল টপকাল কার্ল, নিচু হয়ে লাফ দিল। মাটিতে পড়ে ভারসাম্য হারাল সে, হুমড়ি খেল, হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল হিচ রেইলে বাঁধা, ক্যানাডার ঘোড়ার দিকে লাগাম খুলে ও যখন অপরিচিত স্যাডলে লাফিয়ে চড়ে বসল, ভয় পেয়ে হেষারব করল জানোয়ারটা। পরমুহূর্তে হার্ভের সচকিত চিৎকার পৌঁছাল ওর কানে।
ফিরে,এস, বাছা! ফিরে এস, শুনতে পাচ্ছ না?
গোড়ালির ছোঁয়ায় মাঝারিকদমে ঘোড়া ছোটাল কার্ল, পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল অফিস-ঘরের খোলা দরজা দিয়ে আলো এসে পড়েছে বাইরে, তিনজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে ওখানে। ও বুঝতে পারল না, ওরা ধাওয়া করবে কিনা। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভয়ানক শঙ্কিত হয়ে উঠল সে, অন্য সব অনুভূতি লোপ পেল। বাবার ওপর ওর শ্রদ্ধাবোধ বিশ্বাস যেদিন চুরমার হয়ে গেল সেদিন ও প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিল, এবং সেজন্যই ডাকাতির পরিকল্পনা আঁটে কারণ ওর কোমল মন এভাবে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল জন্মদাতার ওপর, কিন্তু ওর আজকের অবস্থার কাছে তাও যেন তুচ্ছ হয়ে গেছে। এখন শুধু একটা কথাই ভাবতে পারছে সে কোথায় যাবে। দশ মিনিট পর কাল যখন সদর রাস্তায় উঠল তখন মনস্থির করে ফেলেছে সে। ডানে মোড় নিল ও, মেঠোপথ ধরে পাহাড়ি এলাকার ভেতর দিয়ে ছুটে চলল মরুভূমির উদ্দেশে।
.
ক্যানাডা তার কাহিনি বলা শেষ করতে সবে হার্ভে স্টেজের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে ফ্লেভ হালাম, এই সময় বাড়ির সামনের অংশে গোলযোগের আভাস পায় ওরা।
ঝটপট বাইরে বেরিয়ে এল লোক তিনজন, কী ঘটছে বুঝতে পেরে তক্ষুণি চেঁচিয়ে উঠল হার্ভে। ক্যানাডাও একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল। ও-ই, উদ্বিগ্ন সুরে বলল ও। আমার কথা শুনতে পেয়ে পালিয়ে গেল।
নিশ্চয় দোতলার বারান্দায় বসেছিল ঘাপটি মেরে, বিরক্তির সঙ্গে বলল হার্ভে। ঠিক আগের বারের মত
মানে? জিজ্ঞেস করল ক্যানাডা।
কিছু না, রুক্ষ সুরে জবাব দিল হার্ভে।
ঘোড়া চুরি নেহাত সমান্য ব্যাপার না। একসময় তোমার আইনে এর সাজা হত
ফাঁসি-তাই না, ফ্রেড? যাকগে, ঘোড়াটা আমার না টম টেরিলের আস্তাবল থেকে ভাড়া
টেরিল জানে তুমি এখানে আসছ? প্রশ্ন করল হালাম
না, জানে না। বলেছি সেজে এক লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। এখানে আমরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি কেন? ধরার চেষ্টা করবে না ওকে?
লাভ নেই, সংক্ষেপে বলে অফিস-ঘরে ঢুকে গেল হালাম। ভেতরে এস, আমি বাকিটাও শুনব।
ক্যানাডা এবার দ্রুত জেমস গ্রীন, কার্লোস গার্সিয়ার মৃত্যু এবং ডিউক রিপের জবানবন্দীর কথা বলে গেল। জানাল রিপ গোয়েন্দার কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছে, কার্লই ডাকাতির পরিকল্পনাটা করে।
কাল সকালেই গ্রীন আর মককে এখানে দেখতে পাবে তুমি। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকবে ওদের সাথে। ছেলেটা পালিয়েই মুশকিল করল, নইলে সীমান্তের ওপাশে পাঠিয়ে দিতে পারতে।
আচ্ছা, এই গ্রীন লোকটা দেখতে কেমন? স্বভাব-চরিত্র?
ক্যানাডা তার পক্ষে যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে বর্ণনা দিল গ্রীনের। ইউ,এস, মার্শাল ছিল, কঠিন লোক। বোকা বানাতে পারবে না-এটুকু বলতে পারি।
অবজ্ঞার সুরে হাসল, হালাম। অ, ইউ,এস, মার্শাল? হুঃ! ঘুরে বিরাট সিন্দুকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল সে, কম্বিনেশন লক ঘুরিয়ে ভারি ভালাটা খুলল। লোহার ক্যাশবাক্স থেকে গুনে এক হাজার ভলার বের করল হালাম, সিন্দুকটা বন্ধ করে কানাড়ার হাতে টাকাগুলো দিল। আত্মতুষ্টির জন্য আরেকবার সেটা গুনল ক্যানাডা, লোভে চকচক করছে চোখ।
আবারও হার্ভের উদ্দেশে তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টি হানল হালাম। আলতোভাবে একবার চোখের পাতা ফেলল হার্ভে, মুখ শক্ত হয়ে গেল।
দুটো ঘোড়া নিয়ে আসছি আমি, তারপর আমরা শহরে যাব, বলে বেরিয়ে গেল
ক্যানাডা তার প্যান্টের পকেটে রাখল টাকাগুলো। এখন ঘোড়ার ব্যাপারে টেরিলকে আমি কী কৈফিয়ত দেব? জিজ্ঞেস করল আবর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে ওকে। আমার ঘোড়া ক্লান্ত, তাই ভাড়া করেছিলাম ওটা। কিন্তু স্যাভলটা আমার; তা ছাড়া
আহ! অধৈর্য সুরে বাধা দিল হালাম। একটা কিছু বানিয়ে বলে দিও। দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল অ্যাংকর মালিক। তারপর হার্ভে যখন একটা লম্বা পায়ের সোরেলে চেপে আরেকটা বিশাল রোয়ানসহ হাজির হলো, একপাশে সরে দাঁড়াল সে।
দোল খেয়ে স্যাডলে উঠে বসল ক্যানাডা। শহরেই থাকছি আমি, দেখি তোমার জন্য নতুন কোন খবর জোগাড় করতে পারি কিনা, হালামকে বলল।
আচ্ছা, জবাব দিল হালাম। ঘোড়াসওয়ার দুজনকে উঠ ছেড়ে চলে যেতে দেখল সে, অফিসে ফিরে গিয়ে গ্লাসে ব্র্যান্ডি ঢালল। তারপর সিগার ধরিয়ে নিজের ডেস্কের চামড়ার গদি আঁটা চেয়ারে বসে ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। অত্যন্ত কঠোর এবং বস্তিরবাদী মানুষ ফ্রেন্ড হালাম। যে কোন ভয়ঙ্কর সত্যকে সহজেই উপলব্ধি করতে পারে, ভাবাবেগের বালাই নেই ওর মাঝে এমকী যে ছেলেটি তার পরিচয় সে। বহন করছে তার ব্যাপারেও সে সম্পূর্ণ উদাসীন। স্বার্থপর বলতে যা বোঝায়, ফ্রেড হালাম এককথায় তাই। ছেলেটা স্বেচ্ছায় বিপদে জড়িয়েছে নিজেকে এতে মোটেও অবাক হয়নি সে; ও আঁচ করেছিল এরকম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভাগ্যকে তার আপন পথে চলতে দেবে। তবু যা আশা করেছিল সে ঘটনা তার চেয়ে খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। পরিণতি যা-ই হোক, এমনকী তা ফাঁসিতে গড়ালেও, ছেলেটি যদি একাই তার সমস্যা সামলাত খুশি হত সে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম, দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে বাধ্য হলো হালাম। তার নিজের ভালমন্দ তাকে বিবেচনা করতে হবে আগে।
লিভারি স্ট্যাবলের মালিক টম টেরিলকে কী বলেছে ক্যানাডা ওর মনে পড়ল; সেজে এক লোকের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। জেমস গ্রীনের কথা ভাবল সে, কার্ল আর ডিউক রিপকে গ্রেফতার করে টাওসের আদালতে হাজির করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে ওকে। বলা যায় না, সেজে গিয়ে তদন্ত করতে পারে ও, আপনমনে বিড়বিড় করল হালাম।
উঠল সে, অসমাপ্ত সিগারটা ছুঁড়ে ফেলে দিল দরজার বাইরে। তারপর বাইরে যাবার পোশাক পরে ফু দিয়ে অফিসের বাতি নিভিয়ে কোরালে গেল। ঘোড়ায় চড়ে শেষবারের মত নজর বোলাল বাথানের অন্ধকার দালানকোঠার দিকে রওনা হলো!
.
হার্ভে প্রত্যাবর্তনের আগেই ফ্রেড হালাম আবার ফিরে এল তার অফিসে। কয়েক মিনিট পর গলা পাওয়া গেল ফোরম্যানের, ঘোড়া দুটো কোরালে রেখে এসে ক্লান্ত শরীরে অফিস ঘরে ঢুকল সে। ধপ করে চেয়ারে বসে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, খতম।
কৌতুকের দৃষ্টিতে ফোরম্যানকে জরিপ করল হালাম। অসুস্থ দেখাচ্ছে তোমাকে বলল সে। কী ব্যাপার? আজকাল মনে হয় খুন করে আর মজা পাও না তুমি।
মজা নিকুচি করি। আমি ভাবছি আমার গর্দানের কথা মুখ তুলল হার্ভে, চোখ। সংকুচিত, ঝটপট বলল, ছেলেটাকে খুঁজে বের করা দরকার-আইনের হাতে পড়লেই.. সর্বনাশ।
তুমি যা ভাবছ সেরকম কিছু জানে না ও।
এটা কী বলছ তুমি? ও জানে লিউ এসেছিল এখানে, কী ঘটেছে তার কপালে। খামোকা আমাকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা কর না। তুমি, আমি আর ডার্লিং গলা অবধি ডুবে আছি এতে, জানাজানি হলেই এখনও ফাঁসি হয়ে যেতে পারে আমাদের। সুতরাং যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে ছেলেটাকে!
তারপর?
দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেব। আবার কী?
শীতল অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে হালাম তার ফোরম্যানকে জরিপ করল, যেন অনেকদিন ওকে দেখেনি সে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, সখেদে ভাবল। এতদিনেও ভুলতে পারেনি ব্যাপারটা, এখন ছেলেটাকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিতেই ওটাও ডালপালা মেলেছে।
তুমি একটু বেশি চিন্তা কর, বলল অ্যাংকর মালিক। ডার্লিং ভয় পায় না, ভুলেও মনে-টা পর্যন্ত করে না। ওর শুধু চিন্তা মরার আগে কত টাকা কামাতে পারবে। লিউ শহরে এসে হাজির হওয়ার আগে পর্যন্ত কোনওদিন আলাপও করেনি।
ছেলেটার কথা ভুলে যেও না। যেরকম মাতাল হয়েছিল, বন্ধুদের কী বলেছে। তার নেই ঠিক।
সবাই মারা গেছে, রিপ ছাড়া-এবং সেও হাজতে।
হার্ভে ঢোক গিলল। কদ্দিন্তের জন্য?
যদ্দিন ওকে ওরা টাওসের স্টেজে তুলে না দিচ্ছে, বলল হালাম। তারপর রসকষহীন গলায় যোগ করল, কার্লের ব্যাপারে একমাত্র ওর কথার ওপরই নির্ভর করতে হবে ওদের। আর গ্রীনকে ও যা বলেছে সেগুলোই যদি আবার না বলে কোর্টে গিয়ে মামলা টিকবে না।
একটা হাঁদাও বোঝে এটা, তিক্ত সুরে বলল হার্ভে। এরপরেও ছেলেটা থাকছে, সবকিছুই ও জানে। জেমস গ্রীনের কথা ভাব। ক্যানাড়া কী বলেছে মনে নেই-ওকে বোকা বানানো যাবে না।
গ্রীনকে নিয়ে চিন্তা কর না। ওর ব্যবস্থা আমি করছি।
কী ব্যবস্থা?
আপাতত তুমি ভুলে থাক ওটা।
মুখ বিকৃত করল হার্ভে। উঠে দাঁড়াল, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে দুপ দুপ করে পা ফেলে এগোল দরজার দিকে।
তুমি ভুলে গেছ কিছু একটা, পেছন থেকে বলল হালাম।
আবার ভেংচি কাটল হার্ভে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর রঙজ্বলা জিন্সের পকেট থেকে টাকার তোড়া বের করল একটা, ছুঁড়ে দিল ডেস্কের ওপর। হালামের উদ্দেশে একরার তাকাল সে, পরস্পর মিলিত হলো ওদের চোখ, তারপর হার্ভে ভাবলেশহীন চেহারায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে দরজা বন্ধ না করেই বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে স্থাণুর মত চুপ করে বসে রইল হালাম, ভাবছে এর একটা বিশেষ অর্থ রয়েছে। বিদ্রোহের পূর্বাভাস। হার্ভে কি তলে তলে নিজস্ব কোন মতলব আঁটছে? এতগুলো বছর একসাথে কাটাবার পর কেমন যেন অসম্ভব মনে হয় ব্যাপারটা, বিশেষত্ব চিরকাল যেখানে সাহায্যের জন্য ওর ওপর নির্ভর করে এসেছে। হার্ভে। অসম্ভব। হার্ভে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে এটা অবা বোধহয় অন্যায় হচ্ছে, মনে মনে বলল হালাম। তবু, ওর সন্দেহ ঘুচল না। মানুষ চিনতে কখনও ভুল হয় না তার বিশেষ করে ওইসব লোক যারা শত্রুতে পরিণত হতে পারে।
০৪.
পোশাক পালটে হোটেল কামরা থেকে বেরোবে গ্রীন এমন সময় টোকা পড়ল দরজায়। ঘর আধো-অন্ধকার, বাইরে সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে। কপাট খুলল গ্রীন, দেখল মার্শাল মক দাঁড়িয়ে, মুখ থমথমে।
বেরোবার জন্য তৈরি? বলল মার্শাল। ভাল। নাস্তা চুলোয়, রান্নাঘরে বসেই খেয়ে নেব আমরা। তারপর একটা জিনিস দেখাব তোমাকে।
টেবিলের ওপর থেকে গ্রীন ওর টুপি তুলে নিল। দাড়ি কামিয়ে গোসল করেছে ও, ফলে ঝরঝরে বোধ করছে। কী জিনিস? করিডরে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করল ও।
দেখতেই পাবে, সংক্ষেপে জবাব দিল মক। নীচে নামল ওরা, লবি হয়ে গ্রীনকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল মার্শাল। কেরোসিনের চুলের সামনে দাঁড়িয়ে হৃষ্টপুষ্ট গড়নের এক মেক্সিকান মহিলা তাওয়ায় ডিম ভাঁজছিল।ঝট করেগ্রীনের আপাদমস্তক মাপল সে, কালো চোখের তারায় ফুটে উঠল ঘৃণা আর আক্রোশ। ব্যাপার কী? ভাবল গ্রীন, তারপর ধারণা করল নিশ্চয় তরুণ গার্সিয়ার মৃত্যুর খবর জেনেছে মহিলা; এবং সে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে তাকেই দায়ী করছে এর জন্য।
পেছন দিকের একটা জানালার পাশে পাইন কাঠের একটা টেবিল দখল করল ওরা। গ্রীন বিড়বিড় করে বলল, কার্লোসের মৃত্যুর খবর তা হলে জেনে গেছে সবাই।
ওর বোন পাদ্রির কাছে লাশ দাবি করে ওর, তারপর আমি ওর সাথে কথা বলেছি, জানাল মক। প্লেটে করে মহিলা ওদের জন্য বেকন আর ডিমভাজা নিয়ে আসতে আর কথা বাড়াল না সে। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ধাক্কা মেরে গ্রীনের প্লেটটা ঠেলে এগিয়ে দিল মহিলা, বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে বিদায় নিল। হাত বাড়িয়ে কাঁটাচামচ তুলে নিল গ্রীন।
মেক্সটাউনে বোধহয় এখন আর কেউ পছন্দ করবে না আমাকে, বলল ও। কিন্তু এরা কি জানে না ক্যানাডা খুন করেছে ছেলেটাকে?
তুমি বা ক্যানাডা, কথা সেই একই। মেয়েটাকে আমি বলেছি তার ভাই একটা স্টেজ ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল, তবে যেহেতু সে মারা গেছে আমাদের আর কোন বিরোধ নেই ওদের সাথে। মেয়েটা বুঝেছে আমার কথা।
হুঁ।
নীরবে নাস্তা সেরে বেরোবার উদৃযোগ করছে ওরা এই সময় মাঝবয়সী এক লোক ঢুকল রান্নাঘরে। বুকের নীচে দশাসই একটা উঁড়ি। পরনে গাঢ় রঙে ঢলঢলে প্যান্ট আর সস্তা কোট, মাথায় চ্যাপ্টা শক্ত শোলার টুপি মর্নিং, মার্শাল, বলল লোকটা। শুনলাম ঝামেলায় আছ তুমি। গার্সিয়াদের ছেলেটা মারা গেছে গুলিতে, ডিউক রিপ জেলে রয়েছে। ব্যাপার কী? আমি এ পর্যন্ত উড়ো-উড়ো কিছু খবর শুনেছি।
আপাতত ওতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে তোমাকে, বলল মক। গ্রীনের দিকে তাকাল সে। ইনি ড্রাম ডার্লিং। আর, ড্রাম, এ হচ্ছে জেমস গ্রীন।
দ্রুত হাত বাড়াল ডার্লিং, জোরে চাপ দিল করমর্দনের সময়ে তীক্ষ্ণ, চতুর দৃষ্টিতে মাপল গ্রীনকে। আরেকজন আইনের লোক? স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করল সে। ব্যাপার–
গলা খাঁকারি দিল মক। দুঃখিত, ড্রাম, ক্ষমা করতে হবে। আমাদের কাজ আছে বাইরে।
দূরে কোথাও?
বলতে পার, জবাব দিয়ে পা বাড়াল মক। ঈষৎ মাথা হেলিয়ে ডার্লিয়ের কাছ থেকে বিদায় নিল গ্রীন, মার্শালকে অনুসরণ করল। শহরবাসীরা জেগে ওঠেনি এখনও, জনশূন্য রাস্তা ধরে টম টেরিলের আস্তাবলের দিকে এগোল ওরা। আগের দিন গ্রীন আর ক্যানভা ওখানেই রেখে এসেছে ওদের ঘোড়া।
কোণের জেনারেল স্টোরটা চোখে পড়ল গ্রীনের। বিরাট সাইনবোর্ড লেখা ডার্লিং-স্ মার্কেন্টাইল। একই ডার্লিং?
একই। হোটেল আর একটা স্যালুনের মালিক। এখানকার ফ্রেটিং ব্যবসাটাও ওর, বেলুরাইডে অফিস। এসময় ফ্রেড, হালামের পর্টিনার ছিল। একপাল গাছুরসহ এখানে আসে ওরা, তখনও শহর গড়ে ওঠেনি। বাড়ি বলতে কেবলমাত্র টেরিলের আস্তাবলটাই ছিল, স্টেজ ডিপো হিসেবে ব্যবহৃত হত ওটা। তবে ডার্লিং বেশিদিন থাকেনি গরু ব্যবসায় প্রথমে স্যালুন আর দোকানটা খোলে। তারপর যত লোক এসেছে ওরও উন্নতি হয়েছে। সে আমলের কথা টম টেরিল ভাল বলতে পারবে তোমাকে। ও এখানকার সবচেয়ে পুরানো বাসিন্দা স্টেজ ডিগোটা চালাত।
অনেকটা জায়গা জুড়ে লিভারি বার্ন। চুনসুরকির দেয়ালে ঘেরী। কাঠের ফটক পেরিয়ে বিরাট ওয়াগন ইয়ার্ডে প্রবেশ করল ওরা। আস্তাবল আর একার ওয়াগনের পাশ দিয়ে এগোবার সময় ঘোড়ার মলমূত্র, আর জিনের, চামড়ার কটু গন্ধের ঝাঁপটা লাগল নাকে। ওভরজল গায়ে লম্বা-পাতলা স্বাস্থ্যের এক বুড়ো আস্তাবল থেকে বেরিয়ে উঁকি দিল, তোমাদের ঘোড়া লাগবে? লোকটা টম টেরিল।
লাগবে, জানাল মক।
হাতছানি দিয়ে দুজনকে ডাকল টেরিল। ব্যবস্থা করছি, বলে ফের ভেতরে ঢুকে গেল সে।
একটা চুনসুরকির চালাঘরে দ্বীনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল মক। দরজা খুলে সরে দাঁড়াল একপাশে। দেখে এস একবার, গম্ভীর সুরে বলল ও। গ্রীন পা রাখল ভেতরে।
ওটা একটা ছুতোরশালা। ওঅর্কবেঞ্চ আর যন্ত্রপাতি রয়েছে একদিকে। আরেক দেয়ালের পাশে শোভা পাচ্ছে নড়বড়ে একটা টেবিল, তার ওপর একটা লাশ শোয়ানো; উধ্বংশ রঙ আর কালিঝুলি মাখা একফালি ক্যানভাস দিয়ে ঢাকা। ক্যানভাসটা তুলে গ্রীন যখন লাইল ক্যানাডাকে আবিষ্কার করল, তখন কেন যেন মোটেও অবাক হলো না ও।
আমার শহরে খুন হতেই বোধহয় অ্যদ্র ছুটে এসেছিল টাওস থেকে, ঝাঁঝের সুরে বলল মার্শাল। আমার এসব ভাল লাগছে না, গ্রীন। আগে বলিনি, কিন্তু কাল তোমরা যখন গার্সিয়ার লাশ নিয়ে এলে তখনই ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি আমার। তবে এরকম কিছু ঘটতে পারে আশা করিনি।
ঝট করে ওর পানে তাকাল গ্রীন। পুলিসের লোক হিসেবে এটা তোমার সমস্যা, বলল। গুলি?
ছুরি। আজ খুব ভোরে বাইরের দেয়ালের পাশে ওকে আবিষ্কার করেছে টম। কিন্তু কাল সন্ধ্যায় যে ঘোড়াটা ভাড়া করেছিল ও, সেটা দেখতে পায়নি।
কী করেছিল?
এখানে এসে টমকে বলে ওর সোরেলটা ক্লান্ত তাই একটা ঘোড়া দরকার। বলেছিল সেজে এক লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। অথচ, নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছ তুমি, মাঝরাত থেকে মরে পড়ে আছে, ঘোড়াটা উধাও হয়েছে।
চালাঘরের ভেতরটা গুমোট, পচা আলকাতরার গন্ধ আসছে। হাড্ডিসার দাড়িভর্তি মুখখানার দিকে চোখ নামাল গ্রীন। বলল, সম্ভবত এই ডাকাতির ব্যাপারে আলাপ করতেই কালরাতে গিয়েছিল কারও কাছে। লোকটা যে-ই হোক, ওর ঘড়ি। বন্ধ করে দিয়েছে। মুখটা ঢেকে দিয়ে ক্ষুব্ধ মার্শালের উদ্দেশে ঘুরল ও। সেজের কথা বলছিলে তুমি, কোথায় জায়গাটা?
এখান থেকে প্রায় আঠারো মাইল দক্ষিণে, মরুভূমিতে। মাইনিং ক্যাম্প ছিল, একসময়। আট-নয় বছর আগে সোনা পাওয়া যায়। যা হয় এসব ক্ষেত্রে, রাতারাতি একটা শহর গজিয়ে ওঠে ওখানে। এক বছর বাদেই সব শেষ। এখন একটা স্যালুন, মুদিখানা আর একটা আস্তাবল আছে। ভাঙাচোরা ঝুপড়ি আছে কয়েকটা। সবগুলোরই মালিক ভার্জিল রীড নামে এক লোক। এদিকে এখন আর স্টেজ যায় না। গুজব, অর্থের বিনিময়ে ইচ্ছে করলে যে কেউ গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে ওখানে। নিশ্চয় বুঝতে পারছ কেমন হবে জায়গাটা, পশ্চিমে এরকম প্রচুর আছে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মক, ঘুরে দাঁড়াল। ক্যানাডার কী দরকার ওখানে আমার মগজে ঢুকছে না।
সম্ভবত আদপেই ওখানে যায়নি। পাছে ওর অনুপস্থিতি ধরা পড়ে যায় আমাদের কাছে, তাই ধুলে দেয়ার জন্য মিথ্যে কথা বলেছিল টেরিলকে।
জানি না, তবে তোমার আন্দাজই মনে হয় ঠিক, রুক্ষ সুরে বলল মার্শাল। গ্রীনের দিকে তাকাল সে। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, চারজন ছেলে মাতাল হয়ে একটা অন্যায় করেছিল। দুজন তাদের জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছে। এবং আরও দুজন লোক অকারণে মারা গেছে এতে। আমি হলে অন্য ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে এখানেই ইতি করতাম মামলার।
সেটা সম্ভব না, শান্তু কণ্ঠে জবাব দিল গ্রীন।
জানি, ক্লান্ত সুরে বলল মক। তোমার কথাই ঠিক ধরে নিলাম, কাল রাতে কারও সাথে দেখা করেছিল ব্যানাডা, এবং বেশি কথা বলতে গিয়ে খুন হয়েছে। কে হতে পারে লোকটা আমরা বোধহয় জানি, তাই না?
তার মানে তুমি বলছ ও অ্যাংকরে গিয়েছিল খবর বেচতে।
কিন্তু ওরা ওকে খুন করবে কেন?
কাষ্ঠ হাসি হাসল গ্রীন। ক্যানাডাকে চেন তুমি, বেঈমানি করবে না তোমার সাথে এ বিশ্বাস রাখতে পারতে ওর ওপর?
না।
পেয়ে গেলে তোমার উত্তর,বলল গ্রীন। চল, দেরি হয়ে গেল অনেক।
.
সকালের কড়া রোদে শহর ছাড়িয়ে পাহাড়ের রাস্তা ধরল ওরা; গ্রীন অনুভব করছে সূর্যের তাপ শার্ট ভেদ করে ওর পিঠ পুড়িয়ে দিচ্ছে, ঘাম গড়াচ্ছে বগল থেকে। জোরকদমে সমতল প্রান্তর পেরিয়ে এল ওরা, তারপর ঘাসঝোঁপ, পাইন আর জুনিপার বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা ওপরে উঠে যেতে ঘোড়া হাঁটিয়ে এগোল।
দুরারোহ একটা খাড়াইয়ের মাথায় উঠে ঘোড়া দুটোকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য একটুক্ষণ থামল ওরা। পেছনে উত্তপ্ত ধু-ধু মরুভূমির দিকে তাকাতে গ্রীনের চোখ ঝলসে গেল। দূরে ডাকিনীর মত, উদ্বাহু নৃত্য করছে কমলা-হলুদ তাপতরঙ্গ। গ্রীনের মনে হলো ভিন্ন এক জগতে এসে পড়েছে সে।
আঙুল তুলে বিপরীত দিকে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল মক, উত্তর থেকে দক্ষিণে সরে গেল ওর হাত। ওদিকে যতদূর দেখতে পাচ্ছ, পুরোটাই অ্যাংকর রেঞ্জ। এখানে কোন গরুবাছুর দেখতে পাবে না। ওরা এখন পাহাড়ি তৃণভূমিতে রয়েছে, জঙ্গলের কাছাকাছি। অ্যাংকরের লোকজনও ওখানেই থাকবে। কার্ল ওদের সাথে থাকলে কী করব বুঝতে পারছি না আমি। প্রায় তিন দিনের পথ। এত লম্বা সময় বাইরে থাকা সম্ভব না আমার পক্ষে।
বাথানে কেউ না থাকতে পারে এখন। গেলেই বোঝা যাবে। আর কদ্দূর?
মাইলখানেক। এরপর যে পাহাড়টা পড়বে, তার ওপাশে।
অ্যাংকরের বাড়িঘর সবে দৃষ্টিসীমায় এসেছে এই সময় ওরা দেখতে পেল গোলাঘর থেকে ক্ষুদ্রকায় একটা মানুষ বেরিয়ে এসে হনহন করে র্যাঞ্চ হাউসে ঢুকে গেল। ওটা হার্ভে স্টেজ, হালামের লাঠি: হালাম আর ডার্লিং যখন প্রথম আসে। এখানে স্টেজও ছিল ওদের সাথে। আশ্চর্য, কাউহ্যান্ডদের সঙ্গে আজ ও কাজে যায়নি। কেন? গ্রীনের দিকে অস্বস্তিভরে তাকাল মার্শাল। জঙ্গলে সশস্ত্র ডাকাত খুঁজতে হলেও এর চেয়ে বেশি খুশি হতাম আমি।
কাজটা সারতেই হবে
ওরা যখন বাথানে পৌঁছে হিচ রেইলের সামনে নামল, দরজা খুলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ফ্রেড হালাম, পেছনে তার ফোরম্যান। ধাপের মাথায় থামল হালাম, চকিতে গ্রীনকে একনজর দেখে নিয়ে মকের উদ্দেশে বলল, আমাকে তুমি অবাক, করলে মার্শাল। তোমার এলাক: ছেড়ে চলে এসেছ দেখছি?
তাই, বলল মক। টুপি খুলে জামার আস্তিনে কপালের ঘাম মুছে আবার টুটি বসিয়ে দিল যথাস্থানে। কেমন আছ, ফ্রেড, হার্ভে? গ্রীনের পরিচয় দিতে ঘুরল সে। একটা দরকারে এসেছি আমরা; অপ্রীতিকর, কিন্তু গ্রীন যা বলেছে, কমজটা সারতেই হবে।
তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না আমি, রূঢ় গলায় বলল হালাম, গ্রীনের দিকে তাকাল এবার। স্বল্প দূরত্বে কঠিন একজোড়া চোখের মুখোমুখি হলো গ্রীন, জীবনে এরকম নিষ্ঠুর, নির্দয় চেহারা কখনও দেখেনি সে। ইস্পাতের মত কঠিন আর, হিমশীতল দুটো চোখ, দৃঢ়বদ্ধ ভাবলেশহীন মুখ। এককথায় দুর্বোধ্য চেহারা, ঝানু জুয়াড়ি কিংবা ভয়ঙ্কর স্বার্থপর মানুষের যেমন থাকে। কৃপণ মানুষ, যে সারাক্ষণ যকের, মত আগলে রাখে তার ধন, পাছে একটু বেখেয়াল হলেই কেউ কেড়ে নিয়ে যায়। কিছুই না, আবারও কথাটা বল হালাম। যাই হোক গ্রীন যখন বলছে সারতে হবে, তখন সেরেই ফেল।
মানে- বলল মক, তারপর সরাসরি মূল প্রসঙ্গে চলে এল। অচঞ্চল দৃষ্টিতে হালামের দিকে তাকিয়ে রইল গ্রীন, প্রতিক্রিয়া দেখার আশায় নজর রাখছে। হার্ভে স্টেজ তার মনিবের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ওর রুক্ষ দৃষ্টি গ্রীনের ওপর স্থির। ভাবান্তর, বলতে এটুকুই, মার্শালের কথা শুনতে শুনতে ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠল, হালামের মুখ, এবং সে শেষ করার আগেই, তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল অ্যাংকর মালিক।
কী সব আবোলতাবোল বলছ তুমি! কার্ল ওই ভিখারিগুলোর সঙ্গে মদ খেয়েছে। মানলাম খেয়েছে। ওদেরকে নিয়েই শহর ছাড়ে ও, কিন্তু সেটা ভেড়ার পালে একটু খোঁচা দেয়ার জন্য। ওই ডাকাতি যখন হয় ও তখন এখানে-বাসায়। এখন ওই, ডিউক, রিপ হতভাগাটা উল্টোপাল্টা কিছু বললেই তো আর সত্যি হয়ে যাচ্ছে না সেটা।
গম্ভীর গলায় মক বলল, কার্লকেই আমরা সেটা জিজ্ঞেস করব। ও কোথায়?
আমি আমার উকিলের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত ওর দেখা পাবে না তোমরা, এটুকু বলতে পারি! আরেকটা কথা, এখানে আসার কোন অধিকার নেই তোমার। গ্রীনের উদ্দেশে তীব্র দৃষ্টি হানল হালাম, ওরও না।
শেরিফ কার্টারের সই করা ওয়ারেন্ট আছে গ্রীনের কাছে। এখানে আসার পথে পরশু বেলুরাইড কোর্টহাউসে থেমে নয়ে এসেছে। কাজেই তোমার বাসায় এসে বেআইনি কিছুই করিনি আমরা।
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সিঁড়ির পাশে থুতু ফেলল হালাম। হাহ, ওয়ারেন্ট, বলল। ওসব কাগজকে এক কানাকড়িও দাম দিই না আমি। এখন তোমরা ভাগ, আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।
অ্যাংকর মালিক ঘুরে বাসায় ঢুকতে যাবে এমন সময় শান্ত গলায় গ্রীন জিজ্ঞেস করল, কাল রাতে ক্যানাডা কী বলতে এসেছিল এখানে?
ধীরে-সুস্থে পেছন ফিরল হালাম, চেহারা নির্লিপ্ত, কিন্তু হার্ভে স্টেজের চোখের পাতা বিস্ময়ে নড়ে গেল সামান্য। হালাম বলল, ওই নামে একজন লোককেই চিনি আমি, অনেক কাল আগে কাজ করত আমার এখানে। খুব বেশি কথা বলত, আমার সহ্য হয়নি, পাওনা গুণ্ডা মিটিয়ে বিদায় করে দিয়েছি।
গ্রীনের উদ্দেশে আরেকবার চ্যালেঞ্জের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাসার ভেতর ঢুকে গেল সে। হার্ভে স্টেজ অনুসরণ করল অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল মক, তারপর দুজনেই স্যাড়লে চেপে মন্থর গতিতে বেরিয়ে গেল উঠন থেকে। মক বলল, অযথা সময় নষ্ট। তবে তোমার অবস্থানটা অন্তত জানতে পেলে তুমি।
ইচ্ছা করলে কেয়ামত অবধি ছেলেটাকে লুকিয়ে রাখতে পারে ও, আপনমনে বলল-গ্রীন। অথচ কাজটা আমি তাড়াতাড়ি সারতে চাই। পরের চালটা মনে হয় আমাকেই দিতে হবে
মানে?
শোরগোল তোলা, সংক্ষেপে জবাব দিল গ্রীন।
কীভাবে?
প্রথমত, রটিয়ে দেব কার্ল হালামকে আইন খুঁজছে। এ ব্যাপারে তুমি সাহায্য করতে পারবে আমাকে, শহরে। আমি সেজে যাচ্ছি, তোমার সেই প্রাক্তন মাইনিং ক্যাম্পট ঘুরে-ফিরে দেখব একটু। ঘোট পাকাবার জন্য এটাও একটা ভাল জায়গা।
শঙ্কার ছায়া ফুটল মকের চেহারায়, মাথা নাড়াল এপাশ-ওপাশ। সাবধান, চোখ কান খোলা রাখবে ওখানে গিয়ে! তোমাকে দেখলেই মনে হয় পুলিসের লোক, ওখানে এমন অনেক লোক আছে যারা পুলিস দেখামাত্র গুলি করতে দ্বিধা করবে না গ্রীনের দিকে তাকাল ও, বিরস সুরে যোগ করল, অবসর নেয়ার জন্য অন্তত আরও কিছুদিন বাঁচতে চাও তুমি কি চাও না? টাওসের ওই কাগজের কথা সত্যি হলে, এটাই তোমার শেষ অ্যাসাইনমেন্ট।
আমি বলেছি এই কাজটা সেরে অবসর নেয়ার ইচ্ছে আছে।
জাহান্নামে যাও, তিক্তকণ্ঠে বলল মক। তোমার চেয়ে বেশিদিন হলো ব্যাজ ঝোলাচ্ছি আমি, পশ্চিমে বহু জায়গায় মার্শালের দায়িত্ব পালন করেছি। ছবছর আগে একবার সিদ্ধান্ত নিলাম অনেক হয়েছে, আর না। বেলুরাইডে লিভারি স্ট্যাবল খুললাম একটা। মাস দুই যেতে না যেতেই বুঝলাম ব্যবসা হরে না আমার দ্বারা। তাই অকটিওতে এই কাজের প্রস্তাবটা যখন এল, লুফে নিলাম। ঠাণ্ডা মরুশহর, দাঙ্গা ফ্যাসাদ নেই বললেই হয়, কিন্তু তারাটা ঝোলাতে পেরে আমি খুশি। বিয়ে-থা করিনি, তুমি?
না।
স্বাভাবিক। আমাদের মত লোকেরা বাঁধা পড়ে না কোথাও। আমরা হয় গুলি খেয়ে মরি, নয়তো এত বুড়ো হয়ে যাই যে কিছু করার শক্তি থাকে না তখন, দম নিয়ে খেই ধরল, মক, এই কাজ শেষ হবার পর অবসর নিচ্ছ না তুমি। এখন যা-ই ভাব না কেন; অবসর তুমি নিচ্ছ না। পাগল হয়ে যাবে তা হলে।
অবসর নেব, সংক্ষেপে জবাব দিল গ্রীন, বিরক্ত বোধ করছে কারণ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে, কীভাবে ওই দিনগুলো কাটাবে সে ব্যাপারে ওর নিজের মনেই যথেষ্ট সংশয় আছে। অবসর নেব আমি, জেদের সুরে পুনরাবৃত্তি করল ও। এবার বল, সেজে যাবার পথ কোনটা?
০৫.
দিগন্তে সাবেক মাইনিং ক্যাম্পের বিরাট দালানটার আশপাশে ছোট ছোট ঝুপড়িগুলো যখন প্রথম দেখতে পেল গ্রীন, চোখ ধাঁধানো রোদে ওর মনে হলো মরুভূমির হলুদ তাপ-সমুদ্রে প্রাচীন সেজ শহরটা বুঝি ঝকমক করছে। ভাঙাচোরা মলিন ঝুপড়িগুলোর দিকে এগিয়ে গেল ও, লক্ষ করল মূল দালানের সামনে হিট রেইলে কোন ঘোড়া বাঁধা নেই। আশপাশে কোথাও বিন্দুমাত্র প্রাণচাঞ্চল্যের আভাস পেল না সে।
কোণের গোলাঘরটার পেছনের দেয়াল ভাঙা, রোদ বৃষ্টিতে দুপাশের কাঠের দেয়ালে পচন ধরেছে। আস্তাবলের অবস্থাও শোচনীয়। একধারে পানির গামলা রাখা একটা, শুকিয়ে খটখট করছে হাড়ের মত। গ্রীন যখন ভেতরে ঢুকে মাটিতে নামল বোটকা গন্ধে বমির ভাব হলো ওর।
ঝাপসা চোখের কৃশকায় এক লোক পেছন থেকে এগিয়ে আসতে গ্রীন তার ঘোড়ার লাগামটা ধরিয়ে দিল ওর হাতে, পানি আর কিছু শস্যদানা দিতে বলল ওকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, ভার্জিল রীডকে কোথায় পাব?
স্যালুনে, জানাল অসল্যার, অনাবশ্যক ব্যগ্রতা প্রকাশ পেল কণ্ঠে।
গ্রীন ঘুরে ওপাশের কাঠের দোতলা বাড়িটার দিকে তাকাল। আড়ষ্ট হয়েছিল পা দুটো, বার কয়েক ঝাড়া দিয়ে স্বাভাবিক করল রক্ত চলাচল জিরিয়ে নিচ্ছে কারণ ও জানে না ওখানে কেমন অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছে ওর জন্য। অবশেষে একসময় রাস্তা পেলোতে শুরু করল গ্রীন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওপর-নীচ জরিপ করছে বাড়িটার। দোতলার একটা জানালার ধারে একজনকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো সে, ভেবে পেল না কোন্ দুঃখে কিছু কিছু মানুষ এরকম শ্রীহীন জায়গায় তাদের জীবন কাটাতে আসে। ভাবলেশহীন মুখে লোকটা ঝুঁকে ওর দিকে তাকাতে গ্রীন লক্ষ্য করল ওর চোয়ালের হাড় দুটো একটু বেশিমাত্রায় চওড়া, চামড়া ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এক কানের লতি চুলকাল লোকটা, বিদ্বেষের হাসি হাসল, সরে গেল আড়ালে।
সন্দেহজনক ব্যাপার। ভুরু কুঁচকে, স্যালুনে ঢুকল গ্রীন। দোরগোড়ায় থেমে চারপাশে নজর বোলাল। একপাশে বিধ্বস্তপ্রায় পুরানো একটা বার। ঘুরে ওটার পেছনে চলে গেল এক লোক, হাঁটার সময় ঈষৎ খোড়াচ্ছে। প্রতি পদে মেঝেতে শব্দ তুলছে ওর ছড়িটা। শেষপ্রান্তের দেয়ালে কয়েকটা তাক। কিছু টিনজাত খাবার, আলু, পেঁয়াজ, শালগম আর মটরশুটি রাখা। বারটেন্ডার ইতিমধ্যে তার দেহের ত্র রেখেছে একটা উঁচু টুলে; নধর দেহ, পরনে নোংরা কাপড়চোপড়, মাথাভর্তি পাকা বাবরি চুলের জট। মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লাল লাল শিরাগুলো। ভারি লাঠি-সদৃশ ছড়িটা বারের ওপর রাখল সে, পোড় খাওয়া দৃষ্টিতে জরিপ করল গ্রীনকে।
হুইস্কি?
মার্থা ঝাঁকাল গ্রীন, লক্ষ করল কাউন্টারের নীচ থেকে বোতল আর গ্লাস বের করছে অপরজন। হাত বাড়িয়ে ওগুলো কাছে টেনে নিল সে, গ্লাসে ঢেলে পান করল নির্জলা হুইস্কি, কটু ঝাঁঝে জিভ পুড়ে যেতে মুখ বিকৃত করল। তুমি ভার্জিল, রীড? জিজ্ঞেস করল গ্রীন।
ওই নামটাই ব্যবহার করছি আমি।
কাল রাতে লাইল ক্যানাডা এসেছিল?
ঝুলকালি মাখা জানালাটার দিকে রীড তার তিক্ত দৃষ্টি ফেরাল কবরের মত নীরব ছিল ক্যাম্পটা। তারপর তুমি এলে, একজন অচেনা লোক, আমার কাছে মনে হলো আবার যেন সেইসব দিনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। অহরহ লোক আসছে যাচ্ছে, চোখের নিমেষে ভেঙে ফেলছে দালানকোঠা। জনাকীর্ণ রাস্তায় বন্ধুদের গাল দিচ্ছে মানুষ। যখন তখন গুলি হচ্ছে, কিন্তু কেউ আমল দিচ্ছে না তাতে। চিৎকার, হৈ-হুল্লোড়, তারপর মাতাল মানুষগুলো ঢলে পড়ছে বেশ্যার কোলে।
বারের ওপর সজোরে ছড়িটা কয়েকবার আছড়াল রীড। তখনকার দিনে কেউ কাউকে চিনত না, কিন্তু সেজন্য প্রশ্ন করত না কোন। সবকিছুই ছিল জ্যান্ত, আমিও। তারপর একটি শ্যাফটে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেললাম আমি, খোড়া হয়ে গেলাম জীবনের মত।
ছড়িটা তুলল ও, আবার আছড়াল বারে। দেহের ভর বদল করল গ্রীন, অস্বস্তি বোধ করছে। উদ্ভট আচরণ লোকটার, লুকোচুরি খেলছে। বাধ্য হয়ে এবার সরাসরি বলল ও, আমি কার্ল হালামকে খুঁজছি। ওকে দেখেছ?
হালামের কাজ কর তুমি?
না। তবে আইন ছেলেটাকে খুঁজছে। ধরিয়ে দিতে পারলে ইনাম আছে। তুমি বরং ছড়িয়ে দাও খবরটা কারও কিছু জানা থাকলে, তাকে বলবে অকটিওতে মার্শাল মকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
মুখ দিয়ে অবজ্ঞার ঢঙে বিজাতীয় একটা শব্দ করল রীড, তারপর বিরাট ঘরটার পেছনের অংশে অবস্থিত সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তে ফিক করে হেসে ফেলল আচমকা, দুই সারি কালো কালো ভাঙা দাঁত বেরিয়ে পড়ল। কয়েক জোড়া বুটের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল সিঁড়িতে; একটু বাদে একজন তোক আবির্ভূত হলো, ঠিক পেছনেই আরেকজন।
গ্রীন লক্ষ্য করল প্রথমজন সেই থ্যাবড়া চোয়ালের লোকটা, কিছুক্ষণ আগে। দোতলার একটা জানালা থেকে একগাল হাসি উপহার দিয়েছিল ওকে। দ্বিতীয়জনের মুখটা লালচে, তাগড়া শরীর, চলাফেরায় হামবড়াই ভাব রয়েছে। দুজনেই নিরস্ত্র, খেয়াল করল সে।
ওদের উদ্দেশে ঘুরল রড, চেহারায় উত্তেজনার ছাপ। তোমরা মদ খাচ্ছিলে? জিজ্ঞেস করল।
হাচের কথা জানি না, তবে আমি দুঢোক খেয়েছি, জবাব দিল থ্যাবড়া-চোয়াল, হাসি দুকান ছুঁয়েছে। আমার এই বন্ধুকে দাও এক পেগ, গ্রীনের দিকে থুতনি ঝাঁকিয়ে যোগ করল।
সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল গ্রীনের মন, বলল, থাক, লাগবে না, ধন্যবাদ। আরও ঘনীভূত হলো ওর সন্দেহ যখন লাল-মুখ হাচ বলল যাত্রার ঢঙে, আমাদের চেহারা ওর পছন্দ হচ্ছে, ফ্লিন্ট। জাহান্নামে যাক শালা।
আমারও পছন্দ হয়নি ওকে, সে কথাই যদি বল, আচমকা বিদ্বেষে হিসহিস করে উঠল ফ্লিটের গলা। দেখলেই মনে হয় কোন বেয়াড়া শেরিফ।
গ্রীন অনুভূব করল সে ফাঁদে পড়েছে, এবং ব্যাপারটা পুরোপুরি সাজানো। ফ্লিন্টের চোখে কুমতলবের আভাস পেল ও, নিরুপায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক আছে, খাচ্ছি।
না, খাবে না–আপত্তি জানাল ফ্লিন্ট। কিন্তু গ্রীন ততক্ষণে ভরে ফেলেছে ওর গ্লাস। ওটা উঁচু করল সে, আবার কাঁধ ঝাঁকাল, তারপর ভেতরের তরল পদার্থটুকু ছুঁড়ে দিল ফ্রিন্টের চোখে-মুখে।
চমকে উঠল ফ্লিন্ট, পিছিয়ে গেল। হাচ খিস্তি করল, ক্ষিপ্তভাবে লাফ দিল গ্রীনের দিকে। চকিতে একপাশে সরে গেল শ্ৰীন, মদের বোতল দিয়ে বাড়ি মারল হাচের মাথায়। বেমক্কা আঘাতে টলে উঠল দুবৃত্ত, ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটু।
ব্যান্ডানা দিয়ে চোখ মুছে পিটপিট করে গ্রীনের দিকে তাকাল দীর্ঘদেহী, ফ্লিন্ট, রাগে হাত আর কাঁধের পেশীগুলো ফুলে উঠেছে। বারে পিঠ ঠেকিয়ে ওদের পরবর্তী হামলার অপেক্ষায় রইল গ্রীন। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল হাচ, এক হাতে চেপে ধরে আছে মাথা। খুকখুক করে কাশল ও, থুতু ফেলল, কুদ্ধ ভঙ্গিতে বুকে চাপড় মেরে বলল, ধোলাই খাওয়ার শখ হয়েছে মনে হয়।
দাঁত কেলিয়ে হাসল ফ্লিন্ট, তেড়ে এল। আচমকা পেছন থেকে হাত বাড়াল ভার্জিল রীড; গ্রীন কিছু বুঝে ওঠার আগেই শক্ত বেষ্টনীতে পেঁচিয়ে ধরল ওর গলা। এইবার! চিৎকার করল রীড, দুহাত আঁকড়ে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বাঁকা করে ফেলেছে গ্রীনের ঘাড়, কজির হাড় ক্রমশ চেপে বসছে থুতনির নীচে।
বারের ওপর ধনুকের মত বাঁকা হয়ে আছে গ্রীনের পিঠ, অনুভব করছে ওর উক্ত পেটে দমাদম ঘুসি মারছে ফ্লিন্ট। এরপর হাচ যোগ দিল ফ্লিন্টের সঙ্গে, দুজনে মিলে অনবরত আঘাত করতে লাগল ওর শরীর আর মুখে। চোয়াল চেপে নরকযন্ত্রণা সহ্য করল গ্রীন, চোখে সর্ষের ফুল দেখছে। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে কোমর সামান্য উঁচু করল ও, হাত উঠিয়ে চেপে ধরল রীডের দুই কব্জি। শুনতে পেল খিস্তি করছে রীড, বলছে, তাড়াতাড়ি কর! বেশিক্ষণ এভাবে ধরে রাখতে পারব না আমি। শালার শরীরে ষাড়ের শক্তি।
এখনই শেষ করছি, গরগর করে উঠল ফ্লিন্ট, বুট দিয়ে সজোরে আঘাত করল গ্রীনের দুই উরু সংযোগস্থলে। নিমেষে তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল ওর শরীরে, অসুস্থ বোধ করল। এবার মরিয়া হয়ে উঠল গ্রীন, রীডের কব্জি চেপে ধরে আচমকা লাফিয়ে আগে বাড়ল, ডিগবাজি দিল। বারের পেছন থেকে শূন্যে উঠে গেল রড, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। ব্যথায় চিৎকার করল সে, কোকাতে লাগল।
হাচ আর ফ্লিন্ট এগিয়ে আসছিল আবার, দুপাশ থেকে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথার খিচুনি সহ্য করল গ্রীন, এক হাঁটুতে ভর রেখে লাফিয়ে পড়ল হাচের পায়ের ওপর, হ্যাচকা টান মারল। সশব্দে আছাড় খেল হাচ, কাঠের মেঝে থেকে ধুলো উড়ল। তড়াক করে ওর বুকের ওপর চেপে বসল গ্রীন, দুবার ঘুসি মারল, মুখে, চুলের গোছা ধরে সর্বশক্তিতে মাথা ঠুকে দিল মেঝেতে। ওর দেহের ভারে ছটফট করছিল হাচ, এবার অসাড় হয়ে গেল।
তক্ষুণি গড়িয়ে সরে গেল গ্রীন, কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়াল, দেখল বার থেকে রীডের ছড়িটা ছো মেরে তুলে নিয়েছে ফ্লিন্ট
ছড়ির চেয়ে মুগুরের সঙ্গেই এটার আত্মীয়তা বেশি। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের কজির মত মোটা, একপ্রান্তে গোলাকার একটা মুকুট রয়েছে। সংঘর্ষ হলে ওই মুকুট অনায়াসে যে কোন লোকের মাথার খুলি বা হাত গুড়িয়ে দিতে পারবে। হাপাতে হাঁপাতে এগিয়ে এল ফ্লিন্ট, নিশ্বাসের তালে তালে ভরাট বুক ওঠানামা করছে, মুকুট ধরে লাঠি খেলার ভঙ্গিতে ছড়িটা ধীরগতিতে ঘোরাচ্ছে। পিছিয়ে গেল গ্রীন, এ অবস্থায় প্রতিপক্ষের সঙ্গে সরাসরি মোকাবেলা করা নির্বুদ্ধিতার শামিল, তাই পিস্তলের শরণ নিল। হোলস্টার থেকে প্রায় বের করে এনেছে ওটা, এমন সময় খেঁকিয়ে উঠল রীড, বের কর-আমি তোমার হাঁটু উড়িয়ে দেব।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে বারের পেছনে চলে গেছে শয়তান বুড়ো, একটা দোনলা কাটাবন্দুক হাতে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গ্রীনের পানে।
ওকে ধর, ফ্লিন্ট, বলল রীড! কিন্তু খুন করবে না।
ফ্লিন্ট ব্যবধান কমিয়ে আনতে কামরার আরেক প্রান্তে সরে গেল গ্রীন। খিড়কিপথে বেরোনোর সুযোগ রয়েছে একটা, দেখতে পেল ও। একবার এখান থেকে বেরোতে পারলে পিস্তল ব্যবহারে আর কোন বাধা থাকবে না ও, পালিয়ে যেতে পারবে প্রাণ নিয়ে। কিন্তু ওর জেদ আর অকুতোভয় সাহস পালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত করল ওকে।
আর এক কদম পিছু হটল সে, একটা চেয়ারের পিঠ স্পর্শ করল ওর কোমর। চট করে চেয়ারটা টেনে সামনে আনল গ্রীন। ফ্লিষ্ট ওর মাথা লক্ষ্য করে সবেগে ছড়ি যোগাতেই চেয়ার তুলে আঘাতটা মাঝপথে ঠেকিয়ে দিল। আচমকা বাধা পাওয়ায় দুড়িটা খসে পড়ল ফ্লিন্টের হাত থেকে, সুযোগ বুঝে চেয়ারটা ওর দিকে ছুড়ে দিল গ্রীন, তেড়ে গেল।
ফ্রিন্টের মুখে প্রচণ্ড একটা ঘুসি হকাল ও, চোয়ালের হাড়ে পিছলে বেরিয়ে গেল মুঠি। ফ্লিন্ট পাল্টা ঘুসি হানল কয়েকটা, কিন্তু গ্রীনের চেয়ে হাতে-পায়ে লম্বা বলে ওর অধিকাংশই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো, গ্রীন একরকম সেঁটে গেল ওর গায়ের সাথে, ঝটপট আরও দুটো ঘুসি ঝাড়ল পেটে ওই আঘাতে দীর্ঘদেহীর দম বন্ধ হয়ে এল, পিছিয়ে গেল এলোমেলো পায়ে, গ্রীন ধাওয়া করল ওকে। লাফিয়ে উঠে ফ্লিন্টের নাকের বাঁশিতে আঘাত করল ও, তারপর সংক্ষিপ্ত অথচ শক্তিশালী কয়েকটা ঘুসি মারল চোয়াল লক্ষ্য করে, বুঝতে পারছে প্রতিপক্ষ কাহিল হয়ে পড়েছে। ফ্লিন্টের রক্তাক্ত মুখে আরও দুবার আঘাত হানল সে, তারপর ওকে ধরাশায়ী করতে হাত উঠিয়েছে এই সময় অকস্মাৎ কিছু একট: আছড়ে পড়ল ওর খুলিতে। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় মাথা ঘুরে উঠল গ্রীনের, চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু।
জ্ঞান ফিরে পেয়ে হাচ বুঝতে পেরেছিল কী ঘটতে যাচ্ছে, ভারি ছড়িটা তুলে নেয়। সে, গ্রীনের মাথার পেছনে আঘাত করে ওটা দিয়ে।
আবার যখন চেতনা ফিরে পেল গ্রীন তখন অনুভব করল ওর সারা শরীরে অজস্রধারায় ঘুসিবৃষ্টি হচ্ছে। অনবরত ওকে ঘুসি মারছে ফ্লিন্ট, আর পেছন থেকে ওর দুই হাত মাটিতে চেপে ধরেছে হাচ। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে গেল গ্রীনের দেহ, ভীষণ দুর্বল বোধ করল-সে। রক্ত বেরোচ্ছে নাক-মুখ থেকে, চিবুক গড়িয়ে নীচে নামছে। মুক্ত হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করল ও, কিন্তু মনে হলো সমস্ত শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। ক্ষীণ, দুরাগতভাবে রীডকে বলতে শুনল ও, ঠিক আছে, ওতেই হবে। হাচ, জনকে ডেকে বল ওর ঘোড়া আনতে। আমার মনে হয় ঢের শিক্ষা হয়েছে ওর।
হ্যাঁ, আচ্ছা ধোলাই দিয়েছি, সদম্ভে বলল ফ্লিন্ট। আমার গায়ে হাত তোলার উচিত সাজা।
মাথা ঝিমঝিম করছিল গ্রীনের, ঝাঁকিয়ে অসাড় ভাবটা দূর করল সে, চোখ মেলে দেখল ফ্রিন্টের রক্তাক্ত মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে। ভার্জিল রীডের দিকে তাকাল ও, তারপর মুহূর্তের জন্য আবার নিস্তেজ হয়ে পড়ল। শুনতে পেল রীড বলছে, এক্ষুণি ভাগ, গ্রীন। ওই ঘোড়ায় উঠে আর থামবে না। তোমার চেহারা দেখতে চাই না আমরা।
বাইরে থেকে হাক দিল হাচ, মাতালের মত টলতে টলতে গ্রীন এগোল দরজা অভিমুখে। রোদে চোখ ধাধিয়ে গেল ওর। তারপর হাচ ওর ঘোড়াটা ধরে রয়েছে দেখে সেদিকে এগোল। এক হাতে স্যাডহঁন এবং অন্যটা দিয়ে কেশর ধরে পা রাখল রেকাবে দুবার ছিলে গেল ওটা, দ্বিতীয়বার স্রেফ মাথা ঘুরে উঠতে শূন্যে ঝুলে রইল ও। তারপর অতিকষ্টে চড়ে বসল স্যান্ডলে, লাগাম গুছিয়ে নিয়ে রওনা হলো ধীরে ধীরে।
ক্যাম্পটা যখন দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেল রাশ টেনে নামল গ্রীন। খোলা হাওয়ায় মাথা অনেক পরিষ্কার হয়ে এসেছে এখন। স্যাডলব্যাগ থেকে ক্যান্টিনটা বের করল সে। ঠাণ্ডা হয়েছিল মোটা ক্যানভাসের পাত্রটা, ওর হাত জুড়িয়ে গেল। ছিপি খুলে এক ঢোক পানি খেল ও, কুলি করল ভাল করে। তারপর ব্যান্ডানা ভিজিয়ে ঘষে মুখ আর ঘাড় মুছল। ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে মুখ, আরাম পেল ভেজা কাপড়ের ছোয়ায়। আরেক ঢোক পানি খেল গ্রীন, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পরিষ্কার মাথায় নিবিষ্ট মনে ভাবল ওর পরবর্তী কর্মপন্থা। ঘাড় ফিরিয়ে যখন দেখল কেউ নেই পেছনে, আবার স্যাডলে চেপে একসার ভাঙাচোরা বেলেপাথরের টিবির দিকে এগোল। ওই ঢিবিগুলোর পাশ দিয়ে সরু একটা মেঠোপথ চলে গেছে ক্যাম্পের দিকে।
বালুময় ঢাল ধরে একটা গভীর গিরিখাতে নেমে গেল গ্রীন; খাতটা এত গভীর যে খুব সহজেই একজন অশ্বারোহী লুকিয়ে, চলাফেরা করতে পারবে। যখন সে বুঝতে পারল প্রয়োজনীয় দূরত্ব অতিক্রম করেছে, নেমে মাটিতে লাগামের খুটাটা পুঁতে দিল। গিরিখাতের খাড়াই বেয়ে কিনার অবধি উঠে গেল গ্রীন, সন্তর্পণে মাথা জাগিয়ে নীচের ধসে পড়া ঝুপড়ি আর দালানগুলো জরিপ করল। গরম বাতাসের ভাপ লাগল, ওর চোখে-মুখে, অনুভব করল সূর্যকিরণে পিঠ পুড়ে যাচ্ছে। একজনের কাশির আওয়াজ শুনতে পেল ও একটু বাদেই দেখা গেল অসল্যারকে, ধীর পদক্ষেপে আস্তাবলে। যাই।
এরপর আর কোনওরকম কর্মব্যস্ততা বা লোকজনের সাড়াশব্দ মিলল না নীচে। গ্রীন অনুমান করল ফ্লিন্ট আর হা এখনও স্যালুনেই আছে। নিজের পিস্তলটা পরখ কল সে, সাবধানে ঢাল গড়িয়ে নেমে গেল ক্যাম্পে, দৌড়ে গা ঢাকা দিল একটা ঝুপড়ির আড়ালে, তারপর সেখান থেকে একই কায়দায় আরও কয়েকটা কুটির পেরিয়ে স্যালনের ঠিক পেছনেই শৌচাগারের কাছে এসে থামল। গরম আর দুর্গন্ধ মিলেমিশে দম আটকে এল গ্রীনের, কিন্তু একটা অট্টহাসির আওয়াজ পেয়ে ঝট করে বসে পড়ল ঝোঁপঝাড়ের ভেতরে। স্যালুনের খিড়কি দোর খুলে বেরিয়ে এল হাচ, মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি ঘুরে জোর গলায় হেঁকে উঠল সে, ফ্লিন্ট ওপরে হাত-মুখ ধুতে ধুতে আমি আরেকটা কাজ সেরে ফেলছি। তুমি বরং আরও কিছুটা পনির আর শুকনো মাংস বের কর, ভার্জ। যে একখানা ধকল গেল, খিদেয় পেট চো-চোঁ করছে আমার।
দরজা খোলা রেখেই শৌচাগার অভিমুখে হাঁটা দিল ও। পিস্তল বের করল গ্রীন, উত্তেজনায় টানটান হয়ে আছে সমস্ত স্নায়ু। বেলে মাটিতে হাতের বুটের থপথপ শব্দ শুনতে পাচ্ছে। চট করে শৌচাগারের কোনা ঘুরে সামনে চলে এল গ্রীন হাচ তখন গোড়ালি অবধি প্যান্ট নামিয়ে বসতে যাচ্ছিল, গ্রীনকে দেখে কপালে উঠল, চোখ, চেঁচাবার জন্য মুখ হাঁ করল। পিস্তলের নল দিয়ে ওর চাঁদিতে বাড়ি মারল গ্রীন, জ্ঞান হারাল গাট্টাগোট্টা লোকটা, উলঙ্গ অবস্থায় নেতিয়ে পড়ল শৌচাগারের আসনে
গ্রীন আন্দাজ করল কিছুক্ষণ এভাবেই থাকবে ও, অন্তত কাজটা সারা পর্যন্ত। দৌড়ে মাঝের দূরত্বটুকু অতিক্রম করল গ্রীন, খোল! দরজার পাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখল বারের পেছনে বসে আছে ভার্জিল রীড, দৃষ্টি সামনের নোংরা জানালার দিকে নিবদ্ধ। ভেতরে পা রাখল গ্রীন, বারের কাছাকাছি চলে এসেছে এমন সময় পাই করে রীড তার ধূসর মাথাটা ঘোরাল, মুখ চালু হলো কথা বলার জন্য।
তারপর গ্রীনকে যখন চিনতে পারল ও কেবল ঘোৎ করে একটা শব্দ বেরোল, হাত চলে গেল বারের নীচে।
গ্রীন ওর পিস্তলটা নাচাল। বিড়বিড় করে বলল, চোখের সামনে রাখ, রীড, দুটোই। বারের ওপর। ছড়ি আছড়ে সংকেত দেয়ার চেষ্টাও করবে না।
এতে কী লাভ হবে তোমার বুঝতে পারছি না, ক্রুদ্ধ স্বরে বলল রীড।
প্রথমত, তৃপ্তি। বারের পেছনে চলে এল গ্রীন, কাটাবন্দুকটা তুলে নিল তাক থেকে। অস্ত্রটা বাঁকিয়ে ভেতরের কার্তুজ দুটো বের করে নিল ও, তারপর ওগুলো পকেটে ফেলে বন্দুকটা রেখে দিল আগের জায়গায়। এবার কাউন্টার ঘুরে রীডের সামনে এসে দাঁড়াল, ফোলা চোখ দুটো জ্বলছে অদ্ভুতভাবে।
ফ্লিন্ট নীচে না আসা পর্যন্ত একদম চুপ থাকবে, বোঝা গেছে?
চোখ কোঁচকাল রীড। খুন করতে চাও ওকে?
খুন করতে ফিরে আসিনি আমি, শুধু চোখের সামনে দেখতে চাই সবাইকে।
প্রতিশোধের ব্যাপার না হলে কেউই খুন করতে চায় না। অবশ্যি তাই বলে, সবসময় না। বেশির ভাগ খুনখারাপিই হয় মুহূর্তের রাগে। ভাল, হাসিখুশি একটা মানুষ, কারও সাতে-পাঁচে নেই। তারপর হঠাৎই একটা কিছু গোলমাল হয়ে যায়। কোন ফালতু কথা, কিংবা হয়তো কোন মেয়েছেলের ব্যাপার থাকে। এই ক্যাম্পটা যখন জমে উঠছে, অধিকাংশ সময় এমনটাই হত। তারপর লড়াই, হাতাহাতি না; খুব কম লোকই জানে এটা পিস্তল অথবা ছুরি, মার নয়তো মর। যোগ্য লোকই জিতবে এরকম কোন কথা নেই।
সময় চুরি করছে রীড, ভাবল গ্রীন।
এত কথা কীসের? জানতে চাইল একটা গলা। সিঁড়িতে দুপদাপ শব্দ তুলল এক জোড়া বুট। বুঝলে, এখন বেশ আরাম বোধ করছি আমি! পিস্তলটা আবার…ঝোলাতে পেরে ভাল লাগছে। ভেবেছিলে আমরা ওকে গুলি করব, না, ভার্জ? সে জন্যেই ওপরে রেখে আসতে বলেছিলে অস্ত্র? হা, হা!
সিঁড়িতে দেখা গেল ফ্লিন্টকে। বলছে, এখন পেটে খানিকটা মাল আর কিছু দানা পড়লেই তাজা হয়ে যাব আবার। তখন সুবিধে করতে পারব মেয়েছেলের সঙ্গে। ভার্জ, এখানে তোমার গোটা দুয়েক মেয়েছেলে রাখা উচিত, তবে না শরীরটা ঠিকঠাক-
গ্রীনকে চিনতে পেরে থমকে দাঁড়াল ও। মৃদু গলায় বলল, বাহ! লম্বা একটা শ্বাস টানল ফ্লিন্ট! সাহস আছে মানতে হবে। ও কী চায়, ভার্জ?
বলেনি।
একটু আগে আস্ত অবস্থায় বেরিয়ে গেছিল এখান থেকে। এখনকার কথা বলতে পারি না। কী ব্যাপার, গ্রীন? কী চাই তোমার?
রীডকে বলেইছি-তৃপ্তি। কিংবা বলতে পার আমার চিহ্ন রেখে যেতে চাই, অনেক বাচ্চাছেলে যেমন গাছের গায়ে নিজের নাম খোদাই করে। এবার তোমার গানবেল্টটা ফেলে দিয়ে ওই দেয়ালের কাছে যাও।
নিশ্চয়ই, বলেই পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল ফ্লিন্ট।
ফ্লিন্টের পিস্তল গর্জে ওঠার এক সেকেন্ড আগে গ্রীন ওর অস্ত্রের ট্রিগার টিপল। বুকে ভারি বুলেটের ধান্ধা লেগে লাটুর মত একপাক ঘুরে গেলু ফ্লিস্ট, হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে গেল কাঠের মেঝেতে। ওর গুলি নিশানার অনেক দূর দিয়ে চলে গেছে। তিক্ত সুরে খিস্তি করল রীড।
না, তুমি কেন এখানে খুন করতে ফিরে আসবে।
দেখেইছ তুমি, কে আগে ড্র করেছে।
অবশ্যই। কিন্তু তুমি ফিরে না এলে কিছুই ঘটত না।
ও আর হাচ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়লেও ঘটত না, গ্রীন বলল কর্কশ সুরে। নাও, এবার তুমি এদিকে এসে কোণের ওই টেবিলটায় চুপ করে বস।
তোমার মতলবটা কী?
দেখতেই পাবে, বুড়ো খোকা। কই, এস!
হাচের ব্যবস্থাও মনে হয় করে ফেলেছ আগেই, বিড়বিড় করে বলল রীড, ছড়িতে ভর দিয়ে মুখ বিকৃত করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এল বারের পেছন থেকে। তবে পার পাবে না তুমি, মনে রেখ। চেয়ারে বসে হিংস্র দৃষ্টিতে গ্রীনের দিকে তাকাল ও আইনের লোক হলৈই যা খুশি তাই করা যায় না।
হালাম বুঝি তাই বলেছে তোমাকে? মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল রীড, বলল না কিছু। আমি পুলিসের লোক না, খেই ধরল গ্রীন। একজন মুখচেনা আসামীর সঙ্গে বসে ড্রিংক করতে বাধরে না আমার। তোমার ব্যাপারটা কী, বুড়ো খোকা? দাঁগী চোর-বাটপারকে আশ্রয় দিয়ে পয়সা কামাও না তুমি? যদিও এখানে ওই টাকা-পয়সা তোমার কোন কাজেই আসবে না। উপহাসের ভঙ্গিতে মুখ বঁকিয়ে এগিয়ে গিয়ে ফ্লিন্টের পিস্তলটা তুলে নিল গ্রীন, আড়চোখে দেখল ভূলুষ্ঠিত লাশটাকে। অন্যখানেও না, বিদ্রুপের সুরে বলল।
প্রত্যেক মানুষেরই বাঁচার অধিকার আছে, মিনমিন করে বলল রীড। আইনের কবল থেকে লুকিয়ে থাকারও–যদি সেটাই চায় সে।
আরও অনেক কিছুরই অধিকার আছে। বিশেষ করে তার সাথে যদি অন্যায় করা হয়ে থাকে।
ঘুরে পিস্তলটা ছুঁড়ে মারল গ্রীন, সামনের জানালার কাঁচ ভেঙে বাইরে গিয়ে পড়ল সেটা। বারের পেছনে গিয়ে হাতের কাছে যতগুলো মদের বোতল পেল শটগানের ব্যারেল দিয়ে সব গুড়িয়ে দিল ও। তরল হুইস্কি সহস্র ধারায় ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে, ওর কাপড়চোপড়ে ছিটা লাগল।
এবার বারের ওপর ওর ভারি শরীরটা চাপাল গ্রীন, দেবে যাচ্ছে অনুভব করে দোল খেতে শুরু করল। মেহনত করতে হলো একটু, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোটা জিনিসটাই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সামান্য ধুলোর মেঘ উড়িয়ে। নির্বিকার দৃষ্টিতে ওর কার্যকলাপ লক্ষ করতে লাগল রীড। আরও কিছু ক্ষতিসাধন করা যায় কিনা দেখতে চারপাশে নজর বোলাল গ্রীন। কিন্তু ইতিমধ্যে রাগ পড়ে এসেছে, ওর, ফলে অন্য এক অনুভূতি জাগল মনে, পুরো ব্যাপারটাই ছেলেমি হয়ে যাচ্ছে, অথচ তার বোঝা উচিত এখন সে আর ছোটটি নেই। বিরক্তির সঙ্গে কাঁধ ঝাঁকাল ও, রূঢ় স্বরে বলল, হালামের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে নিয়ো। ওর ইশারাতেই তো হয়েছে সব, তাই না?
রীডের মুখের মানচিত্র বদলে গেছে, ভেজা-ভেজা চোখ দুটো সংকুচিত; প্রখর, স্থির
আবার যখন হালাম আসবে তোমার কাছে, তাকে বলবে আমার সঙ্গে যেন লাগতে না আসে, বলে বেরিয়ে গেল গ্রীন। মাইনিং ক্যাম্পে তার যেজন্য আসা তা সফল হয়েছে।
০৬.
উৎফুল্ল মনে অকটিওতে ফিরে যাচ্ছে গ্রীন ভাবছে সেজের ঘটনাবলী যখন জানতে পাবে তখন কেমন হবে হালামের চেহারা। মাইলখানেক চলে এসেছে, চকিতে আরেকটা কথা খেয়াল হলো কার্ল গার্সিয়াদের শীপ র্যাঞ্চে লুকিয়ে থাকা বিচিত্র না। কার্লোস মৃত, ডিউক রিপ হাজতে-ফলে বাসাটা এখন ওর কাছে নিরাপদ মনে হওয়াই সঙ্গত।
হ্যাট ব্রিমের নীচ থেকে চোখ কুঁচকে সূর্যের দিকে তাকাল গ্রীন, অনুমান করল এখন বেলা দুটো হবে। ওর পেছনে, পশ্চিমে, অসংখ্য পাহাড়; হালামের অ্যাংকর র্যাঞ্চ এই পর্বতমালার গোড়ায় অবস্থিত। সামনে দিগন্তবিসারী উত্তপ্ত মরুভূমি, রোদে পুড়ছে। কমলা-হলুদ আলোয় উদাসী রূপ ধরে আছে বন্ধুর প্রান্তর। এখানে-সেখানে সেজ, কিওসোট আর ক্যাকটাসের ঝোঁপ। সূর্যের অবস্থান বিচার করে পথ নির্ণয় করল গ্রীন দক্ষিণপুবে বাঁক নিল, ভাবছে, এ পথে গন্তব্যের কতটা কাছে পৌঁছাতে পারবে ও, নাকি হারিয়ে যাবে মরুভূমিতে।
আরেকটু হলেই ভুল রাস্তায় চলে গিয়েছিল সে। দুই ঘণ্টা বাদে, ক্লান্ত দেহে দীর্ঘ একটা খাড়াই বেয়ে খা বরাবর ঘোড়া হটিয়ে উঠছে ও, হঠাৎ চোখের কোণে বা দিকে সবুজে ঘেরা ঝরনাটা দেখতে পেল। ঘোড়া ঘুরিয়ে ওদিকে এগোল গ্রীন; এক মিনিট পর বাসা আর নড়বড়ে কোরালটা চোখে পড়ল, কিন্তু এতদূর থেকে বোঝা সম্ভব হলো না কাছেপিঠে আর কেউ আছে কিনা।
তাড়াহুড়ো করল না ও, কোন প্রয়োজন নেই তার। জানোয়ারটা যখন পানির গন্ধ পেল তখন অপন:আপনি মাথা সামনে ঝুঁকিয়ে জোরকদমে ছুটতে শুরু করল। মিনিট কয়েক পর ঝোঁপঝাড় ভেঙে ঝরনায় পৌঁছে গেল সে, মুখ ডোবাল অগভীর পানিতে। গ্রীনেরও তেষ্টা পেয়েছিল, ছিলে নামল স্যাঙল থেকে।
উইলো ঝেপের ছায়ায় ঠাণ্ডা পানি খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে গেল ওর। যখন খাওয়া শেষ হলো ধীরে ধীরে উঠে দাড়িয়ে মাথায় হ্যাট চাপাল, তারপর আগের দিন, যে খাড়াইয়ের কিনার থেকে বাথানটা প্রথমে চোখে পড়েছিল সেটার পানে তাকাল। বেশ ঝরঝরে বোধ করছে ও।
ঘোড়ার দিকে ঘাড় ফেরাল গ্রীন। দেখল ঝরনার পাড়ে ঘেসো জমিতে মহানন্দে চরছে জানোয়ারটা। এবার পানি, ভেঙে অপর পাড়ে চলে গেল সে, উইলো ঝোঁপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে জরিপ করল দালানটা। কেউ নেই ধারেকাছে, কোরালটাও শূন্য। ছাতের ওপর আগের দিন কয়েকটা আগ্নেয়াস্ত্র ছুঁড়ে ফেলেছিল মনে পড়তে সিদ্ধান্ত নিল আজ সেগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে শহরে, মার্শালের দফতরে জমা দেবে। বাসার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে ও, হঠাৎ বিকট শব্দে গর্জে উঠল একটা রাইফেল।
ভোমরার গুঞ্জন তুলে ওর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল বুলেট, চোয়ালের হাড়ে তপ্ত সীসার ঘঁাকা লাগল। পেছন দিকে, ঝোঁপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল গ্রীন, প্রাণপণ প্রয়াস পেল রাইফেলের আওতা থেকে সরে যাবার। পরমুহূর্তে আরও দুটো গুলি, ছুটে এল। এবার কাছ থেকে। খুউব কাছে। একদিনে দুই-দুবার ফাঁদে পা দেয়ায় নিজেকে গাল দিল ও। দীর্ঘ পদক্ষেপে মাত্র চার কদমে ঝরনা অতিক্রম করল সে, ঝোঁপঝাড় : তুড়ানো-ছিটানো রোল্ডারের মাঝ দিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে গেল পাহাড়ের ওপাশে, এই বেরঠে এল খাজের মাথায়।
চালের গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল গ্রীন, হাঁপাচ্ছে, কিনার থেকে সাবধানে মাথা জাগিয়ে দেখা দালানের একপাশে একটা বোর্ড রাখা। অনুমান করল, যে লোকই গুলি ছুড়ে থাকুক ওর উদ্দেশে সে এর পেছনে লুকিয়ে আছে।
গ্রীন এর পিস্তলটা বের করে দৌড়ে নেমে গেল ঢাল বেয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটল বাড়ির দিকে। পাটাতনের ওপর ভাঁজ করা কম্বল আর কিছু কাপড়চোপড় পড়ে আছে লক্ষ্য করে, নোনা ধরা দেয়াল আর বাকবোর্ডের মাঝামাঝি জায়গায় গুড়ি মেরে বসে পড়ল। ছাতের ওর যেসব অস্ত্রশস্ত্র ছুঁড়ে ফেলেছিল দেখেই সেগুলো চিনতে পেরেছে ও।
বাঁকবোর্ডের ছটফটে ঘোড়াগুলোকে পাশ কাটিয়ে দালানের কোণে চলে গেল সে। পরক্ষণে শ্যামলা একটা অবয়ব আচমক এসে পড়ল ওর সামনে, ঠোলকি হলো ওদের। তারপর গ্রীন অনুভব করল একজন ক্রুদ্ধ মহিলার গায়ে হাত পড়ে গেছে। তার।
ঘন কালো দীর্ঘ এক গোছা চুল দেখতে পেল সে, লম্বাটে শ্যামবর্ণ মুখের দুপাশ দিয়ে নেমে গেছে। চোখ দুটো ডাগর কালো; টানা টানা ভ্রূ, লম্বা পাপড়ি! গ্রীনকে চিনতে পেরে তীব্র আক্রোশে শ্যামাঙ্গিনীর পুরু ঠোঁটজোড়া উল্টে গেল। আমি খুন: করব তোমাকে সত্যিই খুন করব একদিন, আমার ভাইকে মেরেছ তুমি। ছুরির মত ধার ওর ঘৃণায়। খুনী! তুমি মেরেছ ওকে, তুমি!
মেয়েটাকে একপাশে সরিয়ে ওর হাত থেকে রাইফেলটা কেড়ে নেয়ার সময় এই সুডৌল পেলব শরীরের নীচে কাঠিন্যের আভাস পেল গ্রীন। ওর নিজের মুখ শক্ত হয়ে আছে। মার্শাল মকের সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার। পাদ্রির সাথে আলাপ করেছ। নিশ্চয় শুনেছ লাইল ক্যানাডা খুন করেছে তোমার ভাইকে।
তুমি বা অন্য কেউ-একই কথা। হিসহিস করে উঠল শ্যামাঙ্গিনী। এখানে কেন এসেছ। কী চাই তোমার?
কার্ল হালামের খোঁজে, জবাব দিল গ্রীন, এখন ছেড়ে দিয়েছে মেয়েটাকে উদ্ধত বনবেড়ালির মত মাথা ঝাঁকিয়ে এক কদম পিছিয়ে গেল সে, দৃষ্টিতে আগুন
যাতে ওকেও খুন করতে পার! ঘৃণায় ভরে আছে শ্যামাঙ্গিনীর চোখ, তবু সকৌতূহলে গ্রীনের মুখখানা জরিপ করছে। মারামারি করেছ তুমি। কোথায়?
ইতস্তত করল গ্রীন, চোয়ালে বুলেটের হাত বোলাল। তোমার টিপ ভাল না, মিস গার্সিয়া। আর ইঞ্চি দুয়েক হলেই খুন হয়ে যেতাম আমি। কিন্তু আমি ভাবছি আমাকে তুমি চিনলে কীভাবে? কোন নিরীহ লোক মারা পড়তে পারত।
মার্শালের সাথে দেখেছি তোমাকে, ঘৃণার সুরে বলল, মারিয়া। তোমার ঘোড়া দেখেছি, ওই বিরাট স্টীলডাস্টটা। যাই হোক তোমাকে অবশ্যি খুন করতে চাইনি আমি। ভাইকে কবর দিয়ে ওর জিনিসপত্র নিতে এসেছিলাম এখানে। তোমাকে দেখে সামলাতে পারিনি রাগ।
চলে যাবার জন্য আধপাক ঘুরল মেয়েটা, হঠাৎ করেই যেন ওর শ্যামল সৌন্দর্যে বেদনা আর হতাশার ছায়া ঘনিয়েছে। পাশ থেকে ওর শরীরের বাঁধুনি লক্ষ্য করল গ্রীন, বিচিত্র অনুভূতি হলো হৃদয়ে। ঘটনাবহুল চল্লিশটা বসন্ত পাড়ি দিয়েছে সে। এই দীর্ঘ সময়ে কোন মেয়েই রেখাপাত করতে পারেনি ওর মনে, কিন্তু আজ প্রথম দর্শনেই শামাঙ্গিণীর আদর সেই উষর অন্তরকে ছুঁয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে ভীষণ আশ্চর্য হলো গ্রীন।
লম্বা একটা শ্বাস টানতে আন্দোলিত হলো মারিয়ার ভরাট বুক। গ্রীনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হলো বলছে না, কোথায় মারামারি করেছ?
ভার্জিল রীডের স্যালুণে, সেজে।
ওই শয়তান বুড়োটা। কিন্তু ওর সাথে লড়োনি তুমি। অন্য কেউ ছিল। মারিয়ার চোখ জ্বলে উঠল কার্ল হালামের খোঁজে গেছিলে, না? ভেবেছিলে ওখানে যাবে সে?
এখন আর ভাবছি না। তবে তুমি বোধহয় বলতে পারবে কোথায় পাওয়া যাবে ওকে।
নিদারুণ ঘৃণায় শ্যামাঙ্গিণীর ঠোঁট বেঁকে গেল। বলব না।
তা হলে আমি ধরে নিচিছ তুমি হালামদের বন্ধু, ওদের পক্ষে আছ।
হালামদের! ক্ষিপ্ত সুরে মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল। ভাবছ ফ্রেড হালামের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আছে, যেখানে সে কখনও শান্তিতে থাকতে দেয়নি আমাদের? আমার প্রেমিককে খুন করেছে লবণ হ্রদে? যে লবণ ঈশ্বর সবার ব্যবহারের জন্যই দিয়েছেন। ফ্রেড হালমকে আমি খুন করতে পারি!
ওর উত্তেজিত মুখের দিকে তাকাল গ্রীন। শান্ত সুরে বলল, আমি জানতাম না।
উদ্ধত ভঙ্গিতে ঘাড় বাকল মারিয়া। গ্রিংগোরা যেমন হয়, তুমি একটা বোকা।
হাঁসি চাপতে পারল না গ্রীন ঠিক আছে, তবে সব গ্রিংগোকেই এক রকম ভেব না। আমরা সবাই বোকা না, তুমি জানো। যাই হোক, অতীতে এখানে কী হয়েছে আমি জানি না, কাজেই আমাকে দোষারোপ করার মানে হয় না কোনও। তুমি বলছ ফ্রেড হালামকে তুমি ঘৃণা কর, আমার ধারণা ওর ছেলে কোথায় লুকিয়ে আছে তুমি জানো, কিন্তু বলতে চাইছ না, কেন?
ওখানেই তো তফাত, থমথমে মুখে জবাব দিল মারিয়া।
ওর পানে ঝুঁকল গ্রীন, তখনও চোখ হাসছিল, নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী তফাত?
আড়ষ্ট হয়ে গেল মারিয়ার মুখ, আচমকা সজোরে চড় মারল ওর গালে, তারপর গ্রীবা বাঁকিয়ে পিছিয়ে গেল বনবেড়ালির মত।
আমাকে শিশু মনে কর না। কচিখুকী নই আমি। শিগগিরই বুড়ি হয়ে যাব, সবসময় এই কাপড় থাকবে গায়ে-উরু ঢাকা কাল স্কার্টের ওপর চাপড় মারল মারিয়া-শোকে।
নিজেকে গুটিয়ে নিল গ্রীন। ঠিক আছে, ভুলে যাও। বাঁকবোর্ডের পাটাতনটা দেখাল ও। অস্ত্রগুলো তুমি নামিয়েছ?
সহজ হয়ে এল শ্যামাঙ্গিনী। কেন নয়? পুরুষরা খুব অগোছাল হয় বাচ্চাছেলের মত। সব জায়গায় খুঁজেছি আমি, তারপর মই বেয়ে-ছতে উঠে পেয়েছি ওগুলো। কম্বল আর কাপড়চোপড় আমি নিচ্ছি, নয়তো অন্য কেউ এসে নিয়ে যাবে।
গ্রীনকে পাশ কাটিয়ে গর্বিত ভঙ্গিমায় বাকবোর্ডের আসনে উঠে বসল মেয়েটা, লাগাম তুলে নিল। তারপর এক মুহূর্ত বসে রইল নীরব হয়ে, চিন্তিত চেহারা, খাওয়া-দাওয়া করছ কোথায়?
আচমকা কথাগুলো বলল ও। সহানুভূতি বা বিদ্বেষ, কোন প্রতিক্রিয়াই প্রকাশ পেল না।
কেন; যেখানে উঠেছি সেখানেই খাচ্ছি, হোটেলে, গ্রীন জবাব দিল। বিস্মিত হয়েছে।
নাক সিটকাল মারিয়া, এখন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আজ রাতে আমার সঙ্গে খাবে–আমার ক্যান্টিনায়।
মেক্সটাউনে আমার যাওয়া বোধহয় পছন্দ করবে না ওখানকার কেউ, গ্রীন জানাল।
মেক্সটাউন! ঝাঁঝ ফুটে উঠল শ্যামাঙ্গিনীর গলায় দুশো বছর ধরে এদেশে বাস করছি আমরা, অথচ তোমাদের গ্রিংগোদের চোখে এখনও মেক্সিক্যন রয়ে গেছি। হয়তো ভাল ইংরেজি বলতে পারি না, কিন্তু-
থাম। মুচকি হেসে বাধা দিল গ্রীন। আমি যদ্দূর জানি ওই গ্রিংগো শব্দটা খুউব প্রশংসার না। তুমি আমাদের মানুষ মনে কর না, কর কি?
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল মারিয়া। তফাত সবখানেই আছে।
আবার ওর দিকে জ্বলন্ত চাহনি হানল মেয়েটা, ওর কালো চোখের তারায় গ্রীন তপ্ত সূর্যালোকের ঝিলিক দেখতে পেল। ক্ষিপ্ত বুনো দৃষ্টি, তবে এখন সহানুভূতিও ফুটে উঠেছে। ওর উদ্দেশে অনাবিল হাসি হাসল গ্রীন, মুহূর্তের জন্য মিলিত হলো চার চোখ। মারিয়া বলল, সন্ধ্যে সাতটায় আমার ক্যান্টিনাতে। তারপর, ঘোড়া ছুটিয়ে বাকবোর্ডসহ হারিয়ে গেল দৃষ্টিসীমার আড়ালে।
ওর গমনপথের দিকে চেয়ে রইল গ্রীন। তারপর একসময় ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, ঝরনার দিকে ফিরে রওনা হলো ওর ঘোড়ার কাছে। গ্রীনের মনে হচেছ এখনও যেন মেয়েটার নরম শরীরের ছোয়া লেগে আছে তার বাহুতে।
.
বহু পদ্ধতির পয়লা চাল এটা, গ্রীন বলল! অবসন্ন দেহে মার্শাল মকের দফতরে বসে আছে ও। পাইন টেবিল ডেস্কের ওপাশ থেকে ওর কথা শুনছে মার্শাল। আচ্ছামত ধোলাই দাও কোন লোককে, পালিয়ে যাবে সে। তারপর ঘুষ দিয়ে কেনার চেষ্টা কর। এতেও যদি কাজ না হয় মেরে ফেল ওকে।
তুমি ঠিক জানো এটা হালামের চক্রান্ত?
নয়তো আর আবার কে? হালাম আঁচ করেছিল আমি হয়তো সেজে যাব-গিয়েছিলাম। রীডের চ্যালা আমাকে আমার নাম ধরে ডেকেছে। অথচ ওদের আমি নাম বলিনি। তার মানে নিশ্চয় ফ্রেড হালার্মের কাছে শুনেছে।
ওপর নীচ মাধাঝাঁকাল মার্শাল। হুম,বলল সে। আমি বলছি না হালাম চক্রান্ত করেনি, কিন্তু আমার ধারণা সাদা চোখে যা দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা বোধহয় তার চেয়ে ঘোলা। তবে, মৃদু হেসে যোগ করল মক, রীডের স্যালুনে তুমি সত্যিই ঝড় তুলেছ। ওদিককার আরেকটা ক্লেইম থেকে দুই ছোকরা আসছিল সেজের ভেতর দিয়ে। ড্রিংক করতে ওখানে থেমেছিল ওরা–পায়নি। একটা হুইস্কির বোতলও আস্ত নেই। বুটহিলে ফ্লিন্টকে কবর দিচ্ছিল হাচ! ভার্জিল বসেছিল তখনও ধ্বংস্তুপের মাঝে! ওই ছেলে দুটোকে শেষ পর্যন্ত গলা ভেজাবার জন্য অ্যাদূর আসতে হয়েছে। তোমার নিশানা তুমি ভালমতই গেড়ে রেখে এসেছ ওখানে।
তবে সেজন্য আমি কিন্তু মোটেও গর্বিত বোধ করছি না। জানালার দিকে তাকল গ্রীন, শেষ বিকেলের আলোয় লাল দেখাচ্ছে শার্সি। উঠে দাঁড়াল ও। এখানে নাপিত কোথায় পাব? দাড়িটা কামানো দরকার, তারপর গোসল করব।
রাস্তার ওপাশে চারটে বাড়ি পরে। আমার ধারণা ছিল কাল রাতে হোটেলে গোসল করেছ তুমি?
করেছিলাম, তবে আজ আবার করব। রহস্যময় হাসি ফুটল গ্রীনের ক্ষতবিক্ষত মুখে। রাতে খাওয়ার দাওয়াত আছে। মিস গার্সিয়া। ওদের পুরানো শীপ ক্যাম্পে দেখ হয়েছে আমাদের! কার্ল হালামের খোঁজে গিয়েছিলাম আমি, আর ও কার্লোসের কম্বল আর কাপড়চোপড় আনতে। আর অল্পক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে নিশ্চয়।
তা আর বলতে, মৃদু গলায় ফোড়ন কাটল মক, অবাক হয়েছে। তোমাকে যে গুলি করেনি এটাই অবাক কাণ্ড।
মহিলা বেশ বিবেচক। একগাল হাসল গ্রীন। কার্লোসকে মনে হয় পছন্দ করে মেয়েটা। আমার বিশ্বাস ও জানে কোথায় লুকিয়ে আছে সে। আজ রাতে হয়তো আমি জানতে পারব কিছু। ওর ক্যান্টিনটা কোন দিকে?
মক জালাল। কার্লকে পছন্দ করলেও, ওর বাপকে কিন্তু করে না। ওরা যখন ভেড়া পালত তখন ফ্রেড খুব জ্বালিয়েছে ওদের। মারিয়ার বিয়ের হপ্তাখানেক আগে ওর হবু স্বামীকে খুন করে সে, কিংবা তার লোকেরা।
বলেছে আমাকে। দরজা খুলে রাস্তার এপাশ-ওপাশ দেখল গ্রীন। কাল সকালে এ ব্যাপারে আলাপ করতে হবে আমাদের, বলা যায় না, নতুন কোন তথ্য জানা যেতে পারে এতে। তোমার কয়েদির খবর কী?
ঘুমাচ্ছে পড়ে পড়ে। খায় দুজন লোকের সমান। শোন, উইলি আবার দোকান বন্ধ করে দেবে, তুমি দাড়িটা কামিয়ে ফেল গিয়ে।
যাচ্ছি, বলে বাইরে পা রাখল গ্রীন।
ভাল মানুষ, আপনা থেকেই কথাটা মনে হলে পিপার মকের; খুব ভাল। উঠে দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল মার্শাল, ভাবছে অল্পক্ষণের মধ্যেই ডিউক রিপের খাবার নিয়ে এসে পড়বে ওর সহকারী। তারপর হোটেলে গিয়ে নিজের খাওয়া সেরে রাস্তায় কিছু সময় পায়চারি করবে ও। কোথাও কোন ঝামেলা নেই, কারও প্রয়োজন হবে না তাকে। কাজেই পুরানো দিনের লোকজনের সঙ্গে আড্ডা মারতে এরপর সে হোটেলের বারান্দায় যাবে এবং একসময় শুয়ে পড়বে গিয়ে ওর দোতলা ঘরে।
পুরানো আমলের সঙ্গে তুলনা কলে এখনকার জীবন ওর নিরানন্দ মনে হয়। তখন বিপদের আশঙ্কায় সর্বদা সজাগ থাকতে হত একজন মার্শালকে, রাখতে হত নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা।
আপনমনে হাসল মক, তারপর দেখতে পেল রাস্তা ধরে বাকবোর্ডটা সোজা এগিয়ে আসছে ওর পানে। ঘর্মাক্ত ঘোড়াগুলোর পিঠ চকচক করছে গোধূলি আলোয়।
জেলখানার সামনে বাকবোর্ড থামাল মারিয়া গার্সিয়া। মার্শালকে দেখে জোর করে হাসল, চেহারায় ক্লান্ত গাম্ভীর্যের ছাপ। মক এগিয়ে এল ওর পাশে, বলল, মারিয়া, কেমন আছ? এইমাত্র ফিরে এসেছে জেমস গ্রীন, বলল তোমার সঙ্গে শীপ রাঞ্চে দেখা হয়েছে ওর।
সন্দেহের ছায়া ঘনাল মারিয়ার চোখে। রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করল আর কী বলেছে?
কিচ্ছু না। মক ভাবল লাওবণ্য আছে মেয়েটার, আর সেই চপলা কিশোরীটি নেই ও, কিন্তু বখে যায়নি তাই বলে, বিশের কোঠায় পা দিলে বেশির ভাগই যেমন যায়।
পেছনে ঝুঁকে অস্ত্রগুলো দেখাল মারিয়া। ডিউক রিপের জিনিস।
রাইফেল, গানবেল্ট আর পিস্তলটা তুলে নিল মার্শাল। ধন্যবাদ, মারিয়া আমার মনে হয় না, আপাতত কিছুদিন এগুলো কোনও কাজে আসবে ওর
আড়ষ্ট হয়ে গেল মারিয়ার চোয়াল। সি, বুঝতে পেরেছি।
লাগাম গুছিয়ে রওনা হবে, ঠিক সেই মুহূর্তে পড়ন্ত রোদে দুজন অশ্বারোহীকে দেখতে পেল মারিয়া। ফ্রেড হালাম আর হার্ভে স্টেজ। ওর পানে তাকাল ওরা, কোনওরকম ভাবান্তর ঘটল না চেহারায়; সেও সমান তালে ওদের চোখে চোখ রাখল, দৃষ্টিতে সীমাহীন আক্রোশ। পিপার মকের উদ্দেশে থুতনি ঝাকাল হালাম, পরিচিতদের প্রতি অ্যাংকর মালিকের অভিবাদন জানানোর রীতি। পাশ কাটিয়ে চলে গেল দুই ঘোড়াসওয়ার। তিক্ত সুরে মারিয়া বলল, ওই স্টেজ! ও একটা খুনী। ভর করে আছে হালামের ওপর। আর হালায় ওর ওপর, বোধহয়–ঠিক জানি না।
চমৎকার কৌশল।
এসব মানুষকে বুঝতে পারি আমি, বলল মারিয়া। তার মৃদু হেসে বিদায় নিল বাকবোর্ড ছুটিয়ে।
রাস্তার কোণে যেখানে ডার্লিং মার্কেন্টাইলের হিচ রেইলে নিজেদের ঘোড়া বাঁধছিল হালাম আর হার্ভে, ঘাড় ফিরিয়ে সেদিকে তাকাল মক। দেখল হনহন করে ভেতরে ঢুকে গেল ওরা। ওদের আগমন অবাক করেছে মার্শালকে। শহরে ওরা কেউ বিশেষ আসে না। বছরে চার-পাঁচবার ক্যানসাস সিটিতে ফুর্তি করতে যায় হালাম। রটনা, ওখানে তার এক রক্ষিতা আছে। স্টেজ অবশ্য এই অর্থে নীরস-মদ, মেয়েছেলে কোনটাতেই ওর তেমন আকর্ষণ নেই। এখন ওরা ওদের সাবেক পার্টনার, ড্রাম ডার্লিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সত্যি, তামাক বা ওই জাতীয়, কোনকিছু কেনার জন্য আসতেই পারে ওরা, কিন্তু কেন যেন মক বিশ্বাস করতে পারছে না ব্যাপারটা তাই। অ্যাংকর থেকে ওদের এত দূরে আসার কারণ একটাই: ডার্লিংয়ের সাথে দেখা করা। মার্শাল সন্দিগ্ধমনা লোক, আন্দাজ করতে চেষ্টা করল ওদের আলাপের বিষয়বস্তু কী হতে পারে।
০৭.
হালাম আর হার্ভে স্টেজ মালপত্রে ঠালা বিভিন্ন কাউন্টারের মাঝ দিয়ে পথ করে, পেছনে ডার্লিংয়ের অফিস-ঘরের দিকে এগোল। কেরানি অপেক্ষা করতে বলেছিল ওদের, কিন্তু হালাম মাথা নেড়ে আপত্তি করায় চুপ করে গেল সে। ডার্লিংকে তার রোলটপ ডেস্ক বসে থাকতে দেখল ওরা, ছোট্ট একটা হ্যারিকেনের স্বল্প আলোয় হিসেবখাতা পরীক্ষা করছিল। অতিথি দুজন প্রবেশ করতে মুখ তুলে তাকাল সে, চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে ব্রাস-রিমের চশমাটা নামাল চোখ থেকে, তারপর মুখে জোর করে হাসি টেনে বলল, কী সৌভাগ্য তোমরা হঠাৎ?
ওদের আকস্মিক আগমনে অস্বস্তি বোধ করছে ডার্লিং, এটা বুঝতে পেরে-হালাম মজা পেল। তোমার দোকান বন্ধর সময় হয়েছে না? জিজ্ঞেস করল সে।
আর মিনিট পনেরো। শেষবেলার খদ্দেরদের আমি হারাতে চাই না। পালা করে হালাম আর স্টেজের মুখ জরিপ করল ডালিং। তোমাদের খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে।
তার কারণ ঘটেছে, তিক্ত সুরে জবাব দিল হার্ভে স্টেজ। আমি হলে কেরানীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে সামনের দরজাটা বন্ধ করে দিতাম।
ঘোঁৎ করে সম্মতিসূচক শব্দ করল ডার্লিং, উঠে পা টেনে টেনে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। একে ভয় পাইয়ে দিয়েছি আমরা, বলল হালাম, হাসছে দাঁত বের করে। ঝাঁঝের সঙ্গে স্টেজ জানাল এতে আমোদ পাবার কিছুই নেই।
দায়সারাভাবে কাঁধ ঝাঁকাল হালাম। সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেছে ওর যেদিন ড্রাম তার বেতো ঘোড়ায় চেপে পাহাড়ে গিয়ে ওকে খবর দেয়, লিউ ড্রেক শহরে এসেছে। ভবঘুরেরা যেমন হয়, নিঃস্ব অবস্থায় শহরে এসেছিল লিউ, তারপর ডার্লিংয়ের সাইনবোর্ড দেখে দোকানে ঢোকে।
প্রায় বিশ বছর আগে একটা আর্মি পে রোল লুট করেছিল ওরা, তবু ওকে দেখামাত্র চিনতে পারে ডার্লিং। একগাল হেসে লিউ জানায় ওর বখরার টাকা টেকেনি বেশিদিন, এখন নিশ্চয় একজন পুরানো বন্ধুর কাছে কিছু ধার আশা করতে পারে সে। এরকম ইঙ্গিতও দেয় ও, নিজের অবস্থা যখন; মনে হয়, ফিরিয়ে ফেলেছে ডার্লিং, সবাই সম্মান করে তাকে কেউ জানে না তার অতীতের ইতিহাস, তখন শ-খানেক ডলার দিতে এমন কিছু অপত্তি হবার কথা নয় ওর।
পাব না জেনেও, একশোটা ডলার ওকে দিতে হয়েছে আমার, ক্ষিপ্ত সুরে বলেছিল ডার্লিং পাশেই আমার স্যালুনে গিয়ে ঢেকে ব্যাটা। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি, কেবলই মনে হয়েছে নেশার ঝোঁকে সব ফাস করে দিল। তারপর কাল রাতে এসে আরও একশো দাবি করেছে রীতিমত দাবি করেছে। স্রেফ ব্ল্যাকমেইল। আমাকে বলল, স্যালুনে কার কাছে নাকি ও শুনেছে তোমরা দুজনও এদিকে আছ। তাই ঠিক করেছে আগামী দু-এক দিনের ভেতরেই অ্যাংকরে আসবে সে, একটু খোশগল্প করবে তার পুরানো বন্ধুদের সাথে। তাই ভাবলাম, তোমাকে আগেভাগে সাবধান করে দিই। অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে পালা করে হালাম আর হার্ভে স্টেজের দিকে তাকিয়েছিল ড্রাম। তোমরা হয়তো একটা ব্যবস্থা করতে পারবে ওর।
এখন নিচু স্বরে মুচকি হাসল হালাম। ব্যবস্থা বলতে ড্রাম কী বুঝিয়েছিল সেইদিনই বুঝতে পেরেছিল সে। খুনোখুনির ব্যাপারটা আবার ড্রামের ধাতে সয় না, যদিও টাকাটা ভোগ করতে পারে নির্দ্বিধায়।
দোকান বন্ধ করে ডার্লিং ফিরে আসতে ওর দিকে তাকাল হালাম। অভিযোগে সুরে দোকানি বলল, আশা করি লিউয়ের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। আমার বিশ্বাস তোমরা ওর একটা কিছু ব্যবস্থা করেছ?
কোদাল দিয়ে ব্যবস্থা করেছি, হার্ভে স্টেজ নির্বিকার।
বর্ণনা দেয়ার দরকার নেই, মুখ বিকৃত করল ডালিং! শুনতে চাইনি আমি।
বটে, বলল স্টেজ, তারপর আচমকা হাসল-নেকড়ের হাসি। ড্রামকে কখনোই দুচোখে দেখতে পারে না সে, এমনকী যখন সে ওদের সমস্ত অপকর্মের দোসর ছিল তখনও পারত না। তাই ইচ্ছা করে ওকে চটিয়ে মজা করতে চাই হার্ভে। ছফুট মাটির নীচে কবর দেয়ার সময়ও ওই কোদালটাই ব্যবহার করেছি।
অস্থিরভাবে ডার্লিং তার ঠোঁট ভেজল। ব্যাপারটা যদি লিউয়ের না হয়, তা হলে কেন খামোকা এখানে এসে একজন বুড়োমানুষকে চিন্তার মধ্যে ফেলছ তোমরা? জানতে চাইল সে। লিউ আসার আগে পর্যন্ত ব্যাপারটা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম আমি, কিন্তু এখন নিজের ছায়া দেখলে চমকে উঠি। সবসময় মনে হয় কেউ অনুসরণ করছে আমাকে। ওই জেমস গ্রীনকে দেখে আমার সেরকম অনুভূতি হয়েছে। এখন শুনতে পাচ্ছি, কার্লকে খুঁজছে সে।
ব্যাপারটা তা হলে জানো তুমি? হালাম অবাক
শহরের সবাই জানে-মক তার ব্যবস্থা পাকা করেছে। ভাল কথা; তোমরা শুনেছ কিছু, জেমস গ্রীনের কী দশা হয়েছে সেজে?
সাগ্রহে সামনে ঝুঁকল হালাম; প্রত্যাশিত খবরটা জানতে চায়। কী?
আজ সকালে তোমার ওখান থেকে ফেরার পথে মাইনিং ক্যাম্পে যায় ও। সম্ভবত কার্লের খোঁজে গেছিল, ঠিক জানি না।
যাই হোক, রীডের স্যালুনে যে লোক দুটো থকে, তারা মারধর করে ওকে, তারপর ঘোড়ার পিঠে তুলে দিয়ে বলে এই তল্লাট ছেড়ে চলে যেতে-আর কখনও যেন ফিরে না আসে।
মন খুলে একচোট হাসল হালাম, তাই?
তাই, গোমড়া মুখে জবাব দিল ডার্লিং। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে যায় ও, খুন করে ওদের একজনকে-নাম ফ্লিন্ট ডুয়েলে, তারপর রীডের স্যালুন লণ্ডভণ্ড করে চলে আসে।
হালাম তার চেয়ারে নড়েচতে বসল, ভেতরে ভেতরে ফুসছে। ও নিশ্চিত ছিল গ্রীনকে এমন ধোলাই দেয়া হবে যে এখানে থাকার ব্যাপারে আগুপিছু চিন্তা করবে সে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে যা ভেবেছিল ও, লোকটা তার চেয়ে কঠিন। চিন্তিত হলো হালাম, তবে বাইরে তা প্রকাশ করল না।
কার্লের খোঁজ জানো? কর্কশ সুরে জানতে চাইল ফ্রেড।
সেই যে মাতলামি করছিল শহরে এসে, তার পর আর দেখিনি। আশ্চর্য, আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। মানে, ছেলেটা মদ খাওয়ার ব্যাপারটা আরকী। কথা বলার জন্য ডাকলাম রাস্তায়, অথচ ও মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। ভাল ছেলে ছিল কার্ল, ভদ্র। হঠাৎ এমন বদলে গেল কেন?
লিউয়ের সাথে আলাপ হয়েছে ওর, সব জানে, থমথমে গলায় জবাব দিল হার্ভে স্টেজ।
ফ্যালফ্যাল করে একটুক্ষণ স্টেজের দিকে তাকিয়ে রইল ডার্লিং, তারপর কথাটা ওর মগজে ঢুকতে রক্তশূন্য হয়ে গেল মুখ। মানে লিউ ওকে বলে দিয়েছে আমাদের কীর্তিকলাপ।
তাই।
আচ্ছা, এটাই তা হলে পাগল করে তুলেছে ওকে, মৃদু সুরে বলল ডার্লিং, অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হালামের দিকে। তোমাকে ভীষণ বিশ্বাস করত ও, ফেরেশতার মত জানত। তারপর এখন জানতে পেরেছে তোমার আসল চেহারা
তুমিও ছিলে এতে, রুক্ষ স্বরে মনে করিয়ে দিল হালাম। এভাবেই তুমি বড়লোক হয়েছ, ব্যবসার টাকা পেয়েছ।
ঠিক। কিন্তু ওই পাট চুকে গেছে অনেক আগেই। কার্ল হয় পালিয়ে বেড়াচ্ছে, নয়তো লুকিয়ে আছে কোথাও। তাই না? এখন যদি গ্রীন ধরতে পারে ওকে, তখন কী হবে?
সব বলে দেবে ও, সেটজ বলল রূঢ় স্বরে। আর তা হলেই ফেঁসে যাব আমরা।
নড়েচড়ে বসল ডার্লিং, অস্বস্তি বোধ করছে। আমার ভাল ঠেকছে না এটা। আমরা আর্মির লোককে খুন করেছিলাম-এখনও ব্যাপারটা ফাঁসিতে ঝোলাতে পারে আমাদের, কিংবা বিশ বছরের জেল উঠে দাঁড়াল ড্রাম, প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে উত্তেজিতভাবে পায়চারি করল কামরার এমাথা-ওমাথা। অনেক সাধনা করে আমি ব্যবসা গড়ে তুলেছি, এখন ওই, ছোকরার জন্য সব রসাতলে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে আমিও-ভাবতেই আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
জাহান্নামে যাক তোমার ব্যবসা, খেঁকিয়ে উঠল হালাম, স্টেজ অর ডার্লিংয়ের কথাবার্তা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে ওর, রক্ত চড়ে গেছে মাথায়। আমরা তোমাকে সাবধান করতে এসেছিলাম, ব্যস। কারণ লিউয়ের ব্যাপারে তুমি আমাদের সাবধান করেছিলে তোমরা বলছ বটে, কিন্তু আমার মনে হয় না কার্ল ফাঁস করে দেবে সবকিছু। ডাকাতি মামলায় ওর নাম জড়িয়েছে ডিউক রিপ–বাকি সবাই মারা গেছে। এখন আমি রিপের একটা হিল্লে করতে পারলেই কার্ল রেহাই পেয়ে যাবে, ফিরে আসতে পারবে বাসায়।
অসম্ভব, ওই ছেলেকে শ্বিাস নেই। ও ঠিকই বলে দেবে, অসন্তোষের সুরে বলল হার্ভে।
আমার ইচ্ছে হচ্ছে সময় থাকতে সব বেচে দিয়ে ভাগি এই দেশ ছেড়ে, বিড়বিড় করল ডার্লিং।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল, স্টেজ। সাবধান এক পালাবার চেষ্টা করলে ফল ভাল হবে না কিন্তু, হিসহিস করে উঠল ওর গলা। মনে রেখ, আমাদের সঙ্গে তুমিও ছিলে ডাকাতিতে, লিউকে খুন করার ব্যাপারেও।
আমার কোন ভূমিকা ছিল না ওতে, মিনমিনে গলায় প্রতিবাদ করল ডার্লিং। মাথা নিচু করে এক মুহূর্ত ভাবল সে, তারপর হালামের দিকে তাকিয়ে বলল, শোনেন, তুমি যদি ছেলেটাকে ধরে ওর সাথে কথা বল, হয়তো এদিককার সবকিছু শান্ত না হওয়া পর্যন্তমেক্সিকো কিংবা অন্য কোথাও চলে যেতে রাজি হবে ও।
কোথায় পাব তাই জানি না, বিরক্তির সুরে বলে উঠে দাঁড়াল হালাম। দোরগোড়ায় গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে যোগ করল, ভুলে যাও আমরা এখানে এসেছিলাম, ড্রাম। আমার সমস্যা আমি একাই সামলাতে পারব।
ভুলে যাব! বিস্ফোরিত হলো ড্রাম ডার্লিং। কীভাবে ভুলব? ঝামেলা না মেটা পর্যন্ত ঘামতে ঘামতে রক্ত পানি হয়ে যাবে আমার, খুব ভাল করেই তুমি তা জানো। ভাবছি আগামী হস্তী দুই বেলুরাইডে গিয়ে থাকব, আমার ফ্রেইটিং ব্যবসাটা দেখাশোনা করব। তা হলে হয়তো ভুলে থাকতে পারব এদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে।
নিদারুণ বিরক্ত হলো স্টেজ, খিস্তি করল। ভীতুর ডিম কোথাকার। সবসময় তোমাকে দেখে আসছি এরকম। ঝামেলা দেখলেই কেটে পড়তে চাও। এখন টাকা হওয়ায় সেই ভয় বেড়েছে আরও, খরগোশের ভয়ে পালাচ্ছে লেজ তুলে। কিন্তু মনে ক্লেখ, তোমার পেছনেই নেকড়ে আছে একটা। ডার্লিংয়ের দিকে আরেকবার জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে বাইরে বেরিয়ে গেল সে।
বেহায়ার মত হসিল হালাম। দোকানি বলল, খেপে উঠেছে। তুমি একটু নজর রেখ।
ভয় নেই। হার্ভে আগেও আমার বুড়ো আঙুলের নীচে ছিল, এখনও আছে, মুচকি হাসল হালাম, অনুসরণ করল তার ফোরম্যানকে।
পেছনে গোলাপি আভা রেখে ডুবে গেছে সূর্য। সাঁঝ নেমে এসেছে শহরে, বাড়িঘরের জানালাগুলো হলুদ করে তুলেছে লণ্ঠনের আলো। ডার্লিংয়ের সালুনের দিকে হাঁটা দিল হালাম। এস, গলা ভেজাবে, বলল স্টেজকে।
মদ, সিগারেটের ধোঁয়া আর পোড়া কেরোসিনের গন্ধ ভাসছে স্যালুনের বাতাসে। বিরাট ঘরটা মোটামুটি জনাকীর্ণ। সখেদে হালাম অনুভব করল ওরা ঢুকতেই থেমে গেছে সমস্ত গুঞ্জন। তার ছেলের ব্যাপারেই আলোচনা করছিল ওরা, অনুমান করল সে। মাইনিং ক্যাম্পে গিয়ে রীডের কী হাল করে এসেছে গ্রীন তাও নিশ্চয় জেনে গেছে শহরবাসীরা।
বারে দাঁড়ানো খদ্দেরদের পাশ কাটিয়ে যাবার সময় কোন ভাবান্তর ঘটল না হালামের চেহারায়। গম্ভীর মুখে পেছন দিকের একটা ফাঁকা টেবিলে গিয়ে বসল ওরা। বোতল আর দুটো গ্লাস হাতে তক্ষুণি ওদের সেবায় এগিয়ে এল বারটেন্ডার। নিজের জন্য খানিকটা পানীয় ঢালল হালাম, একঢেকে শেষ করল সবটুকু, আচমকা কড়া নির্জলা হুইস্কি পেটে পড়ায় কেঁপে উঠল সামান্য, আবার ভরে নিল গ্লাস। এরপর বোতলটা সে ঠেলে দিল হার্ভে স্টেজের দিকে। অনেকটা সময় নিয়ে নিজের গ্লাস ভরল অ্যাংকর ফোরম্যান, ওর রুক্ষ মুখে খেলা করছে কুটিল ভ্রূকুটি।
ফিসফিস করে হালাম বলল, আজ সন্ধ্যায় সেজে যাবে তুমি। ভার্জিল রীডকে বলবে স্যাম ট্যানারকে খবর দিতে। যদ্দুর জানি সীমান্তের ওপাশে একটা র্যাঞ্চে আছে ও। রীডকে বলবে আজ রাতেই যেন লোক পাঠায় সে। আর যদি সেরকম কোন লোক না থাকে, তুমি নিজেই যাবে। কাল দুপুরের মধ্যে রীডের আস্তানায় স্যামকে হাজির করা চাই আমি থাকব ওখানে।
নিচু গলায় শিস বাজাল স্টেজ, চোখ ছোট ছোট হয়ে এসেছে। একসময় বেলুরাইডে আস্তানা ছিল স্যাম ট্যানারের। তার মানে, এখানে ওকে দেখলেই চিনে ফেলবে পিপার মক। মক ঝানু লোক, অনেকদিন হলো মার্শালের কাজ করছে, বোকা না। স্যামকে দেখামাত্র বুঝে ফেলবে তুমি আছ এর পেছনেও জানে কাজ না থাকলে অহেতুক কোথাও ঘুরঘুর করে না স্যাম।
তাই পেতে যাচ্ছে স্যাম, সম্ভবত দুটো কাজ, কঠিন সুরে বলল হালাম। তোমার ওপর কখন নির্ভর করা যায় আমি বুঝি, কিন্তু
একটা লোকের কাছে কত আশা কর তুমি শুনি? তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল হার্ভে স্টেজ। কাল রাতেই একটা কাজ সেরেছি আমি, মনে নেই। তবে ওটাই শেষ।
আমরা একসুতোয় বাঁধা, যুক্তি দেখাল হালাম। কাজেই আমরা যে যা-ই করি কেন, দুজনের জন্যেই করি। তাই না?
সেজন্যেই বুঝি তুমি থাক প্রাসাদে, আর আমি আস্তাবলের বাংকে, তিক্ত সুরে বলল স্টেজ। তুমি ক্যানসাস সিটিতে গিয়ে ফুর্তি কর, আর আমি পচে মরি এই পচা শহরে।
আগে কখনও অভিযোগ করনি তুমি,জবাব দিল-হালাম, অবাক হয়েছে।
বলিনি কারণ সবকিছুই সুন্দরভাবে চলছিল। এখন অন্যরকম মনে হচ্ছে। ডার্লিংয়ের মত অবস্থা হচ্ছে আমার, খালি পেছনে তাকাতে ইচ্ছে করে, মনে হয় কেউ বুঝি তাড়া করছে আমাকে। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, ডার্লিংয়েরও বোধহয় সেরকমই তলব, মনে হচ্ছে অতীত কোণঠাসা করে ফেলেছে আমাকে। আর এর জন্য দায়ী-তোমার ছেলে।
তুমি আর ড্রাম শুধু শুধু ভয় পাও, হালাম বিরক্ত।
মনে হয় না। অন্তত গ্রীনকে না। তুমি ওর ব্যাপারে চিন্তিত, আর আমার বিশ্বাস ওকে কেনা যাবে। এই পেশায় যারা আছে তাদের টাকা পয়সা নেই বিশেষ। হাজারখানেক ডলার ধরিয়ে দিলেই আর থাকবে না এখানে আমরাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচব।
বোকার মত কথা বল না, হালামের কণ্ঠে ঝাঁঝ। গ্রীনের মত লোককে কেনা যায় না-মেরে ফেলতে হয় :
স্যামকে বল!
তাই বলব। তুমি বরং এবার তোমার কাজে যাও।
ওঠার কোন চেষ্টাই করল না হার্ভে স্টেজ। সরাসরি তাকাল হালামের দিকে। আবার সেই বিদ্রোহের পূর্বাভাস পেল র্যাপার। আমাকে হুকুম করবে না, স্টেজ বলল। আরেক দফা মদ খাব, সাপার সারব হোটেলে গিয়ে-তারপর যাব।
বেশ,জবাব দিল হালমি। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল সে। তোমার যেমন মর্জি, বলে গটগট করে বেরিয়ে গেল বার-কামরা ছেড়ে।
০৮.
ক্যান্টিনটা বিশেষ বড় নয়। নানারকমের শাকসবজি আর মশলার গন্ধ ভুরভুর করছে। একদিকের দেয়ালে সারবাধা টেবিল, মিটমিট করে জ্বলছে অনেকগুলো মোম। মেক্সিক্যান, আমেরিকান দুই ধরনের খাবারই পাওয়া যায়। পরিবেশনের দায়িতে, আছে একটি মেয়ে। গায়ে লাল জিপসি ব্লাউজ, মিষ্টি একটুকরো হাসি সারাক্ষণ লেগে থাকে মুখে। উল্টো দিকে বার। কৃষ্ণকায় সুদর্শন এক লোক আপনমনে, নিচু গলায় করুণ সুরে গান গাইছিল গিটার বাজিয়ে, মেক্সিক্যানদের অতি প্রিয় একটা প্রেমসংগীত। গ্রীন ঢুকতে বাজনা থামিয়ে গিটারটা বারের নীচে রেখে দিল সে। গ্রীনের আপাদমস্তক ভাল করে একবার জরিপ করে, পেছনের একটা পর্দার ওপাশে অদৃশ্য হলো।
ধীর পদক্ষেপে এগোল গ্রীন! নিচু সিলিং থেকে কয়েকটা তামার লণ্ঠন ঝুলছে। লালচে আলোয় ওর সদ্য দাড়ি কামানো মুখে গুটিকতক জখমের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে মাত্র। যখন টুপি সরাল ঘন কালো চুলে নাপিতের কাচির দাগ বেরিয়ে পড়ল।
অল্পক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে এল মারিয়া। প্রশান্ত কমনীয় মুখশ্রী; ডাগর কালো চোখজোড়া উজ্জ্বল, গম্ভীর। পোশাক বদলে এখন ধূসর রঙের স্কার্ট পরেছে, গলা আর আস্তিনের মুড়ি সাদা। চুল টেনে আঁচড়ে বেনী করেছে পিঠের কাছে।
খুব সংক্ষেপে অভ্যর্থনা জানাল ও। এস।
পুঁথির পর্দা সরিয়ে ভেতরে যাবার সময় মাথা নিচু করল গ্রীন, বড়সড় রান্নাঘরে ঢুকল মারিয়াকে অনুসরণ করে। গরম গরম খাবারের গন্ধে পানি এসে গেল ওর জিভে। দেখল, হৃষ্টপুষ্ট বয়স্কা এক মহিলা ডিম দিয়ে ময়দা ছেনে কেক তৈরি করছে।
মারিয়া ভেতর বাড়ির দরজাটা খুলে দিতে, চুনসুরকির পাঁচিলে ঘেরা শান বাঁধানো ছোট্ট একটা উঠনে পা রাখল গ্রীন। দেয়াল জুড়ে বাগান। রকমারি মরু লতাপাতা আর ফুলের ঝাড় রয়েছে। ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির লাউ আর লাল, হলুদ গোলমরিচের ছড়া ঝুলছে জাফরি কাটা মাচান থেকে। একধারে ভারি ওক কাঠের টেবিল আর খানকতক চেয়ার পাতা। টেবিলের ওপর, মাচান থেকে চৌকোমত একটা লণ্ঠন জ্বলছে। তার আলোয় রঙিন মায়াবী হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
সপ্রশংস দৃষ্টিতে বাগানটা দেখল গ্রীন। স্মিত হেসে মারিয়াকে বলল, চমৎকার। আমাকে তুমি দাওয়াত করেছ, সেজন্য আমি আনন্দিত।
আমি অতিথি পছন্দ করি। ঝট করে টেবিলের দিকে ঘুরল মারিয়া। টেকুইলার বোল আর দুটো বড় গ্লাস রাখা আছে ওখানে। পাশেই ছোট ছোট দুটো পিরিচে খানিকটা লবণ আর লেবুর কোয়া।
টেকুইলা ভালবাস তুমি?
খাইনি কখনও। আমাদের ওদিকে পাওয়া যায় না। শুধু হুইস্কি আর বিয়ার।
এভাবে খাবে।
বাঁ হাতের পিঠে একচিমটি লবণ রাখল মারিয়া, লেবুর একটা কোয়া তুলে নিল। লবণ চাখল ও, লেবু চুষল, তারপর টেকুইলার গ্লাস তুলে নিয়ে পান করল একঢোকে নির্জলা, চোখের পাতা না ফেলে। গ্রীনের দিকে তাকাল মারিয়া, এই প্রথম সামান্য হাসির রেখা ফুটেছে মুখে।
এবার তুমি খাও, বলল ও।
মারিয়ার অনুকরণে ছোট্ট আচার অনুষ্ঠানটি পালন করল গ্রীন; লবণ আর লেবুর স্বাদ বিদঘুঁটে ঠেকল জিভে জ্বালাময় পানীয়টা গলায় ঢেলে দিল ও, মুখ হাঁ করে গিলে ফেলার সময় ভয় হলো, আদৌ সে ওটা নীচে নামতে পারবে কিনা। মাথা পেছনে হেলিয়ে কিশোরীসুলভ হাসিতে ফেটে পড়ল মারিয়া। তোমার মুখ! খুব কড়া?
হয় মারা যাবে, নয়তো বুড়িয়ে যাবে অকালে, জবাবদিল গ্রীন, হাসি দুকান ছুঁয়েছে।
অন্যদিকে সরে গেল মেয়েটার চোখ, হাসি থেমে গেছে আচমকা।
তুমি বস এখান। অমি খাবার নিয়ে আসছি।
ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল, গ্রীন, ভরাট যৌবনের হিল্লোল উপভোগ করল। আরেকবার টেকুইলা পান করল সে, এবার খাওয়া সহজ হলো অনেক। তারপর পা ছড়িয়ে আরাম করে বসল ও, সারা দিনে যে ধকল গেছে, পানীয়ের প্রভাবে তার ক্লান্তি দূর হয়ে যাচ্ছে।
নাপিতের চেয়ারে চোখ বুজে বসে থাকার সময় যে চিন্তাটা বিব্রত করেছিল ওকে এখন সেটা আবার ফিরে এল। গ্রীন কিছুতেই ভেবে পায় না যে মহিলা খুন করতে উদ্যত হয়েছিল ওকে; সে কেন হঠাৎ করে তাকে রাতে খাওয়ার দাওয়াত দিল।
এর একটাই জবাব পেল গ্রীন, একমাত্র সমাধান: মারিয়া গার্সিয়া কিছু চায় তার কাছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ভাপ ওঠা মাটির ডিশ হাতে ফিরে এল মারিয়া, রাখল টেবিলে।
ভেড়া। আর এক মিনিট অপেক্ষা কর।
ঘন সুবাসিত ঝোলের ওপর চাক চাক ভেড়ার মাংস ভাসছে। এরপর বড় প্লেটভর্তি ফ্রিওলস নিয়ে ফিরে এল মারিয়া, মাংস আর লাল গোলমরিচ দিয়ে ভুনা করা। এ ছাড়াও রয়েছে কয়েক থালা ট্যাকোস বা স্মোকড টর্টিলা। গ্রীনের পাতে ভেড়ার মাংস তুলে দিয়ে উল্টো দিকে বসল মারিয়া; সকালে নাস্তার পর থেকে আর কিছুই খায়নি গ্রীন, গোগ্রাসে খেতে শুরু করল। ফ্রিওলসটা খুব ঝাল, স্মোকড টর্টিলা আর মাংস গুরুপাক, সুস্বাদু। খাওয়ার মাঝপথে ক্ষমা প্রার্থনা করে উঠে গেল মারিয়া, ফিরে এল কয়েক বোতল ঠাণ্ডা বিয়ার হাতে। গ্রীন ভরে নিল একটা গ্লাস, পান করে ঝাল দূর করুল কিছুটা।
ধীরে ধীরে খাচ্ছে ও, সবশেষে টর্টিলা খেয়ে খালি করল প্লেট। মারিয়া খায়নি বিশেষ, এটা ওটা মুখে দিয়েছে শুধু গ্রীন যখন তৃপ্তির একটা সেঁকুর তুলে চেয়ারে হেলান দিল, আঁসি ফুটল ওর মুখে।
পেট ভরেছে?
মৃদু হেসে ঘাড় কাত করল গ্রীন। খাবার সুস্বাদু হলে জীবনটা খুব সুন্দর মনে হয়। তবে আমার বোধহয় এসব বলা ঠিক হচ্ছে না। তোমার জন্য খুব ভাল ছিল না, আজকে দিনটা
না।
রমণীয় ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়াল মারিয়া, এটো থালাবাসন গোছাতে শুরু করল। গ্রীন উপলব্ধি করল ওর সহ্যক্ষমতা অসীম, ব্যথা-বেদনা কাবু করতে পারবে না সহজে, কাজের মধ্যে ভুলে থাকবে সমস্ত জ্বালা।
খাওয়া-দাওয়ার পর এখন আর বিদায় নিতে মন চাইছিল না গ্রীনের। ও যখন উঠতে নিল, তীক্ষ্ণ সুরে মারিয়া জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?
এই তোমার উঠনে পায়চারি করে একটু হাওয়া খাব।
টেকুইলা রেখে যাচ্ছি। খাও। হজমের জন্য উপকারী।
উঠে দাঁড়িয়ে টানটান পেটে আদরের চাপড় মারল গ্রীন, হেসে বলল, এই একটা জায়গা যেটা নিয়ে কখনও ঝামেলা হয়নি আমার।
দেয়ালের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফুলের গন্ধ শুকল ও। কড়া তবে মদির। প্রাচীরের গায়ে ফটকটা ভারি মজবুত কাঠের, বাদামি রঙ করা, গ্রীনের কাঁধ সমান উঁচু। ওপর দিয়ে অন্ধকারে তাকাল সে, রাস্তার ওপাশে কয়েকটা আলোকিত জানালা চোখে পড়ল।
অন্ধকারে প্রাচীন গির্জার গম্বুজটা সম্ভ্রম জাগায় মনে। ওপরে তারাজ্বলা আকাশ, লণ্ঠনের মত মিটমিট করে জ্বলছে। পুবের চাঁদ এখন মাথার ওপরে; পাহাড়ি বাতাস শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে মরুভূমির বুকে। বারটেন্ডারের গিটার বাজনা শুরু হয়েছে আবার, মৃদু সুরে।
চলে আসছিল গ্রীন, এই সময় হঠাৎ সে ছুটন্ত পদশব্দ শুনতে পেল।
পাই করে ঘুরে দাঁড়াল ও, ফটকের ভারি হুড়কোটা নামিয়ে বেরিয়ে এল গলিতে। এক দৌড়ে পৌঁছে গেল মোড়ে, চন্দ্রালোকিত রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে এক লোক, পা ফেলার অলে তালে, ভেসে আসছে ওর বুটের আওয়াজ। কোন তরুণ হবে, নইলে এত জোরে ছুটতে পারত না।
পরক্ষণে অদৃশ্য হলো ছায়ামূর্তি, আবার নিঝুম হয়ে গেল রাত… তবে গ্রীনের বুঝতে ভুল হয়নি। লোকটা ঘাপটি মেরে বসেছিল ফুটকের বাইরে, নজর রাখছিল, অপেক্ষা করছিল। হাচ? তাকে শেষ করতে কোন ভাড়াটে বন্দুকবাজ পাঠিয়েছিল ভার্জিল? বিশ্বাস হতে চাইল না গ্রীনের। লণ্ঠনের আলোয় বসে সে যখন আহার করছিল তখন তাকে গুলি করার মত যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিল লোকটা।
তবে যে-ই হোক, সন্দেহ নেই, কারও নজরে পড়তে চায়নি সে।
ফিরে এল গ্রীন। হুড়কোটা জায়গামত বসিয়ে বন্ধ করল ফটক। ওর পেছন থেকে মারিয়া কড়া গলায় জানতে চাইল, কী করছ?
এই ঘুরে-ফিরে দেখছি একটু।
টেকুইলার বোতল বাদে আর সবকিছুই টেবিল থেকে সরিয়ে ফেলেছিল মারিয়া, লন্ঠনের আলোয় দাঁড়িয়ে জরিপ করে ওকে চোখে তিরস্কার।
মিথ্যে কথা বললে কেন? কারও পায়ের আওয়াজ পেয়েছ তুমি-আমি নিজেও শুনেছি। মিথ্যেকথা বললে কেন?
ইচ্ছে করে বলিনি, জবাব দিল গ্রীন, বিরক্তি বোধ করছে। আসলে তোমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইনি আমি।
আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাওনি! পুরুষ্টু ঠোঁট দুটো ওলটাল মারিয়া। তোমার ধারণা আমি দুশ্চিন্তা করি? ঘৃণা করি, কিন্তু দুশ্চিন্তা–কক্ষনো না!
এগিয়ে এসে চেয়ারে বসল গ্রীন, তাকিয়ে আছে শ্যামাঙ্গিনীর দিকে।
জানি। ফ্রেড হালামকে ঘৃণা কর তুমি। কিন্তু ওর ছেলেকে না। বুরং, ওর পক্ষেই আছ, এমনকী স্টেজ ডাকাতির পরিকল্পনাটী ওর, তা জানার পরেও? ওর ওপর তোমার এত দরদ কেন?
আবহাওয়ার মত চকিতে বদলে গেল মারিয়ার মেজাজ। এক মুহূর্ত আগেও গ্রীনের ওপর ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত হয়েছিল সে, কিন্তু এখন নারীসুলভ কোমলতায় নরম হয়ে গেল দৃষ্টি।
আমার চোখের সামনে ও বড় হয়েছে ওর নিঃসঙ্গতাকে বুঝতে পারি, বিশাল র্যাঞ্চ হাউসে ওই লোকটার সাথে একা থাকে, কোন মেয়ে নেই ওকে একটু স্নেহ মমতা দেবার জন্য। একটা পনি ছিল ওর, ছেলেবেলায় আমাদের শীপ ক্যাম্পে আসত কার্লোসের সঙ্গে খেলতে। একদিন আমার হাত চেপে ধরল ও তখন ওর বয়েস বছর দশেক হবে, বলল, তোমাকে ভালবাসি। এখন বুঝতে পারছ? ওই বাড়িতে ওকে ভালবাসার মত কেউ ছিল না।
আমাদের বাসায় আসতে নিষেধ করা হয়েছিল ওকে, তবু আসত। তারপর একদিন ওর বাবা এসে পনিটা কেড়ে নিয়ে গেল। কার্লকে বলল হেঁটে র্যাঞ্চে ফিরতে,.. মরুভূমি থেকে দীর্ঘ পথ। এই নোংরা মেক্সিকানদের কাছে যেন আর না আসিস। তাই শিক্ষা দিচ্ছি তোকে, আমাদের সবার সামনে ছেলেকে বলল সে। দক্ষিণে ওর ক্রীতদাস, তুলাবাগানে কাজ করে। আর এখানে ভেড়া চরায়-সব জংলী ভূত।
ঠিক এ কথাগুলোই বলেছিল সে। হেঁটে বাসায় ফিরল ছেলেটা। ওকে খবর আর পানির ক্যান্টিন দিয়েছিলাম আমি, আর কার্লোস এক জোড়া মোকাসিন কারণ কাউবয় বুট পরে বেশিদূর হাঁটতে পারবে না ও। আর কোনদিন ও আর্সেনি, বাবার ভয়ে কুঁকড়ে থেকেছে। তবে কার্লোসের সঙ্গে দেখা করত, মাঝে-মধ্যে আমিও কথাবার্তা বলেছি শহরে।
এবার বুঝেছ কেন-
রান্নাঘর থেকে আচমকা একটা চিৎকার ভেসে আসতে মাঝপথে চুপ করল মারিয়া। পরমুহূর্তে দড়াম করে দরজা খুলে উঠনে পা রাখল, ফ্রেড হালাম, শানের ওপর স্পার লাগানো বুটের শব্দ তুলে এগিয়ে এল হনহন করে, মুখ ঝোড়ো আকাশের মত অন্ধকার।
গ্রীনকে যখন চিনতে পারল মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ের ছাপ ফুটল ওর চেহারায়
এখানে কী করছ তুমি? রূঢ় স্বরে জানতে চাইল হালাম।
ভার্জিল রীডের সাথে আজ কথা হয়েছে তোমার? পাল্টা প্রশ্ন করল গ্রীন।
হালামের চোখ দুটো সংকুচিত, সতর্ক হয়ে উঠল।
এই মেক্সের বাড়িতে তোমার আসার সঙ্গে রীডের কী সম্পর্ক।
কিছু না। আমি শুধু ওকে বলেছিলাম তোমার সাথে দেখা হলে জানাতে, আমি বলেছি তুমি যেন আমাকে না ঘাঁটাও। যাক, এখন আমি নিজেই সাবধান করতে পারব। সাহস থাকলে, এরপর নিজে লড়তে এস-অন্যকে লেলিয়ে দিও না। তবে আগেই সাবধান করে দিচ্ছি, আমার পেছনে লাগলে তোমার খুলি উড়িয়ে দেব আমি।
চেয়ারের পিঠে হাত রেখে ধনুকের ছিলার মত সটান দাঁড়িয়ে আছে মারিয়া গার্সিয়া, কর্তৃত্বপূর্ণ চেহারা, চোখজোড় আত্মাভিমানী, হিংস্র। ঠোঁটের কোণে একটা সিগারের গোড়া কামড়ে ধরেছিল হালাম। ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিল দিল সে, থুতু ফেলল, মেঘ গর্জনের সুরে বিদ্রুপের হাসি হাসল।
আমাকে হুমকি দিচ্ছ? হাহ, ইচ্ছা করলেই তোমাকে আমি একতুড়িতে উড়িয়ে দিতে পারি-তুমি একা। কেউ তোমাকে সাহায্য করতে আসবে না! মকও না-আমার বিরুদ্ধে যাবার সাহসই হবে না ওর। আবার সশব্দে হাসল হালাম। আর তুমি কিনা হুমকি দিচ্ছে আমাকে।
রীডের স্যালুনে কেউ সাহায্য করেনি আমাকে।
ছিলাম না ওখানে, কাজেই বলতে পারব না।
গ্রীন একা না। এই প্রথম মুখ খুলল মারিয়া। অহঙ্কার উঁচু করে রেখেছে ওর মাথা, অহঙ্কার আর নিদারুণ ঘৃণা। তুমি এখানে এসেছ কেন?
ওর পানে তাকাল হালাম, ব্যঙ্গের হাসি খেলে গেল মুখে। বলছি, মেক্স। তোমার, নাগরের সামনে বলতে আমি ভয় পাই না। কার্লকে খুঁজতে। দেখেছ ওকে?
না। ও এখানে আসবে কেন?
কারণ: ও সবসময় তোমার স্কার্টের ছায়ায় ঘুরঘুর করে, মারিয়ার আপাদবক্ষ নজর বুলিয়ে হালাম বলল। পুরুষমানুষের বুঝতে অসুবিধে হয় না এটা। তুমি সুন্দরী, পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত রূপ তোমার আছে। কাজেই ওর দোষ আমি দিই না, তোমার স্কার্ট চেপে ধরার
মুখ সামলে, হিসহিস করে উঠল গ্রীনের গলা।
জাহান্নামে যাও, হালাম জবাব দিল, তাকাচ্ছে না গ্রীনের দিকে। শুধু শুধু ভয়ে পালাচ্ছে কার্ল। তোমার সঙ্গে দেখা হলে বলবে, আমি তাকে বাসায় ফিরে আসতে বলেছি।
ও যাবে না। তোমাকে ও ঘৃণা করে কেন যাবে?
শ্রদ্ধা করে, এখন থেকে আরও বেশি করে করবে, খেঁকিয়ে উঠল হালাম।
ওর জন্য তোমার দরদ নেই, তোমার একমাত্র ছেলে। তুমি কেবল নিজের কথা ভাব। তোমার এত ভয় কীসের শুনি? কী লুকাতে চাও? যে ছেলের প্রতি দরদ নেই, তাকে খুঁজছ কেন?
খবরদার! এভাবে কথা বলবে না আমার সাথে। কালো হয়ে গেল হালামের মুখ, রাগে কাঁপছে গল। আমাকে প্রশ্ন করবে না, বোঝা গেছে, মেক্স? হুকুম বক্সব আমি, আর তোমরা চুপ করে তামিল করবে। একদম চুপচাপ, বুঝেছ?
মাথা নাড়ল গ্রীন। সংক্ষেপে বলল, হালাম, তুমি একটা গর্দভ, কথাবার্তাও তেমনি।
স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইল মারিয়া, অদ্ভুতরকমের ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে শ্যামল চেহারা। বেরিয়ে যাও! এক্ষুণি! আর কক্ষনো আসবে না।
চকচক করছিল হালামের চোখ, ক্রুর হাসিতে ভরে উঠল মুখ। যাচ্ছি। ক্যান্টিন চালালে কী হবে, তোমার গায়ে এখনও ভেড়ার গন্ধ লেগে আছে। ওই একটা গন্ধ আবার আমার সহ্য হয় না।
ঝট করে টেবিলের ওপাশ থেকে পা বাড়াল মারিয়া, গ্রীন এগিয়ে যেতে ওর বাহু আঁকড়ে ধরে টাল সামলাল। হালামের হাসি চওড়া হলো!
তো, মেক্স, এখন আরেকজন নাগর ধরেছ তুমি। ভাল।
যাও! ক্ষিপ্ত সুরে বলল মারিয়া। খুন হয়ে যাওয়ার আগেই চলে যাও তুমি।
সশব্দে হেসে উঠল হালাম, ঘুরে রান্নাঘর হয়ে বেরিয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে ফুপিয়ে উঠল মারিয়া, প্রগাঢ় আবেগে গ্রীন ওকে কাছে টেনে নিল।
অনুভব করল সে ঢিল পড়েছে মেয়েটার পেশীতে, উত্তেজনা কমে আসতে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা, কিন্তু সাড়া পেলনা কোন।
তোমার সাহায্য আমার লাগবে না। আমি তোমাকে বলেছি, কচিখুকি নই আমি।
ওর শরীরের চড়াই-উতরাই নিজের বাহুতে অনুভব করতে পারছে গ্রীন। পেলবতার নীচে প্রচ্ছন্ন কাঠিন্যকে উপলব্ধি করছে। বহুকাল পর কোন মেয়েকে এভাবে বুকে টেনে নিয়েছে সে, মারিয়ার চিবুক উঁচু করে ওর বুনো সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে গ্রীন অনুভব করল তর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। কিন্তু শ্যামাঙ্গিনীর চোখে সামান্য কৌতূহল ছাড়া অন্যকিছুই নেই। তারপর ওর নিষ্ঠুর ঠোঁটজোড়া নেমে গেল ধীরে ধীরে-তবু সমর্পণের আভাস পেল না। গ্রীন যখন রেহাই দিল ওকে, আস্তে করে পিছিয়ে গেল মারিয়া, দুর্বলভাবে কাঁধ ঝাঁকাল।
আমি তোমাকে বন্ধুর মত মনে করেছিলাম।
বোধহয় না, জবাব দিল গ্রীন। ভাবছে মেয়েটার সাথে প্রেমের অভিনয় করার কোন অধিকার তার নেই। ও বারোয়ারি না। তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলে, হালামকে বলেছিলে আমি একা নই। আমার ভাল লেগেছে ওটা।
ওর বিরুদ্ধে যে লোকই দাঁড়াবে, তার হয়ে ওই কথা বলব আমি, অধৈর্য সুরে বল মরিয়া। তারপর, সহসা চড়া গলায় বলল, এখন আরও স্পষ্ট করে বলছি। খুন কর ওকে। সমস্ত খারাপের মূল ওই লোক, কাজেই ওকে মেরে ফেল।
–আচ্ছা, তা হলে এটাই চায় ও, গ্রীন ভাবল। মেয়েটা তবে ওর কাছে এটাই চইছে।
নির্লিপ্ত কণ্ঠে ও জবাব দিল, আমি এখানে এসেছি ছেলেটাকে ধরতে, ওর বাবাকে খুন করতে নয়।
ওর চোখ ভেদ করল মারিয়ার শীতল, অনুসন্ধিসু দৃষ্টি।
ভয় পাচ্ছ? আজ সেজে এক লোককে গুলি করেছ তুমি, তখন ভয় পাওনি। হালামকে খুন করা আলাদা কিছু না।
শক্ত হয়ে গেল গ্রীনের মন, রুক্ষতা ফিরে এল।
আমাকে ব্যবহার করার চেষ্টা কর না, সুন্দরী। বন্দুক ভাড়া করতে চাও, অন্য কোথাও খোঁজ কর। আমার-টা বিক্রির জন্য নয়।
তুমি একটা বোকা।
ঘুরে মাথায় হ্যাট চাপাল গ্রীন, মেয়েটার দিকে তাকাতে উপহাসের ভঙ্গিতে বেঁকে গেল ঠোঁট
হ্যা, বোধহয় তাই। তুমি কিছু চাও জেনেও এখানে আসার মত বোকা। তবে একজন মানুষের জীবননাশ করতে চাইবে তা আশা করিনি : ভালই গুলি চালাতে জানো তুমি-নিজেই চেষ্টা করছ বা কেন?
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে এক ঝলক তাকাল মারিয়া, তারপর চোখ সরিয়ে নিল।
আসলে আমরা বোধহয় একা নই। আমার শরীরে স্প্যানিশ রক্ত, আমরা অহঙ্কারী জাত। অপমানের প্রতিশোধ নিতে খুন করি আমরা, কিংবা যখন আমাদের পুরুষদের মেয়ে ফেলা হয়। গ্রিংগোরা বুঝবে না। ওরা অন্য মেয়েমানুষের কাছে চলে যায়।
মন্দ না, কখনও কখনও। তবে আমারও একধরনের অহঙ্কার আছে। নিছক তোমাকে প্রতিশোধের স্বাদ দেয়ার জন্য কারোকে খুন করতে পারব না আমি। স্থিরদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল গ্রীন, ভাবল আরও কিছু বলবে, তারপর মত পাল্টাল।
খাবারের জন্য ধন্যবাদ। শুভ রাত্রি।
ঘুরে রান্নাঘর আর ক্যান্টিনা হয়ে বাইরে বেরিয়ে এল গ্রীন, রাস্তায় নেমে শ্বাস টান বুকভরে। ভীষণ একলা বোধ করছে সে, জানে মাতাল হওয়া ছাড়া এ মুহূর্তে আর কিছুই এর করবার নেই। পরক্ষণে দুঃখের সঙ্গে উপলব্ধি করল ওর আত্মমর্যাদাবোধ টনটনে, স্রেফ আঁতে ঘা লেগেছে বলেই কোন স্যালুনে গিয়ে মাতলামি করা সম্ভবপর নয় তার পক্ষে।
০৯.
রাগে হতাশায় জর্জরিত হয়ে আছে মারিয়া। রাগ নিজের ওপর, অন্ধ ভাবাবেগে তার মনোভাব প্রকাশ করে ফেলায়; হতাশা জন্মসূত্রে পাওয়া উদ্ধত স্বভাবকে অবদমিত করতে না পারার কারণে।
টেকুইলার বোতল, গ্লাস আর অবশিষ্ট বাসনপত্র জড়ো করে সেগুলো ও রান্নাঘরে নিয়ে গেল, মন গ্রিংগো জেমস গ্রীনের কাছে পড়ে আছে। ওর বাহুস্পর্শের কথা মনে পড়তে মারিয়ার রক্ত নেচে উঠল। হুয়ানের পর আর কোন পুরুষ এভারে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়নি। তবে হুয়ান এখন মৃত; শরীরের রক্ত ঝরিয়ে নিজের জীবন দিয়েছে সে লবণের শয্যায়, উত্তপ্ত মরু সূর্যের নীচে।
কার্লোস ওই অর্থহীন খুনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। বাকবোর্ড চালিয়ে লবণ হ্রদে গিয়েছিল ওরা; মানুষের যেমন লাগে, ভেড়ার তেমনি প্রয়োজন হয় লবণ। অ্যাংকরের লোকজন তখন ছিল সেখানে, গরুবাছুরের জন্য কোদাল চালিয়ে বড় একটা ওয়াগনে লবণ বোঝাই করছিল। ওদের নেতৃত্বে ছিল হার্ভে স্টেজ।
মেক্সিকান আর মেষপালকদের সম্বন্ধে মৃদু টীকা-টিপ্পনি কাটে ওরা, এবং হুয়ান ছিল সশস্ত্র। তারপর আর হালকা থাকেনি অপমান, ছুঁচাল হয়ে উঠেছে। হুয়ানের তরুণ রক্তে সহ্য হয়নি তা।
কার্লোস ঠিক বলতে পারেনি কে শুরু করেছিল গোলাগুলি তবে হঠাৎ করেই গর্জে ওঠে কয়েকটা পিস্তল, হুয়ান লুটিয়ে পড়ে, এর রক্তে রঞ্জিত হয় লবণ হ্রদ। পরে, শহরে, হার্ভে স্টেজ আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রচার করে, মেক্সই প্রথম গুলি করেছিল, তাই আত্মরক্ষা করতে হয়েছে আমাদের।
ওখানেই ধামাচাপা পড়ে যায় ব্যাপারটা; কোনরকম তদন্ত হয়নি। কেউ আশাও করেনি তা। বন্দুকের লড়াই হয়েছে এবং তাতে মারা গেছে একজন। সীমান্তের অতি পুরাতন চল এটা।
অধিকাংশ মানুষই হয় বোকা এবং খুনী।
কিন্তু গ্রিংগ গ্রীন নয়। সত্যিকারের মানুষ ও। সে প্রায় খুন করতে বলেছিল ওকে, কিন্তু গ্রীন শুধু ওর হাত থেকে রাইফেলটা ছিনিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে! অন্য কেউ হলে মারধোর করত তাকে, মাতাল হয়ে বেশ্যাপড়ায় গ্রিংগোরা হরহামেশা যেমন করে।
গ্রীন স্পর্শ করেনি তাকে। প্রাথমিক রাগ পড়ে যাবার পর বন্ধু ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে, এমনকী সে যখন মন্তব্য করেছে সব গ্রিংগোই বোকা তখন কৌতুক বোধ করেছে। সেজে একজন লোককে হত্যা করেছে ও, কিন্তু বিচলিত হয়নি সেজন্য। তবু খুনী ওকে বলা যাবে না।
বোকাও না, কারণ মুহূর্তে তার অন্তর দেখে নিয়েছে ও। সত্যি ওকে সে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, এক গ্রিংগো আরেক গ্রিংগোকে খুন করলে কী আসে যায়? কিন্তু এখন লজ্জা পাচ্ছে সে, নিজের কাছেই। এই উপলব্ধি মোটেই স্বস্তিকর নয়; কোন লোককে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে তার কাছে ধরা পড়লে মাথা হেঁট হয়ে যায় আপনা থেকেই।
বন্ধের সময় হয়ে আসছিল, ক্যান্টিনায় একবার উঁকি মেরে ভেজা তোয়ালে হাতে উঠনে ফিরে এল মারিয়া। টেবিল মুছে, লণ্ঠনটা নেভাতে একটা চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়াল।
সবে, নেমেছে ও এই সময়ে একটা শব্দ সচকিত করে তুলল ওকে। তারপর ফিসফিসে গলায় একটা ব্যগ্র কণ্ঠ ভেসে এল, মারিয়া ধক করে উঠল ওর বুক, কার্ল হালামের গলা চিনতে পেরেছে।
তাড়াতাড়ি ফটক খুলে দিল সে ভেতরে পা রাখল কার্ল, মৃদু হেসে বলল, আরেকবার এসেছিলাম, কিন্তু তোমার কাছে লোক ছিল। আরেকটু হলেই ধরে ফেলেছিল আমাকে।
ভয় পেয়েছে কার্ল, কিন্তু ওর সামনে নিজের দুরবস্থা হালকা করার প্রয়াস পাচ্ছে। এর কারণ উপলব্ধি করতে পারে মারিয়া। পশ্চিম বেপরোয়া, সহসী লোকদের দেশ কিন্তু কার্ল বেপরোয়া বা সাহসী কোনটাই নয়। তবে মারিয়া জানে কেবলমাত্র এই কারণেই ওকে আগলে রাখতে চায় সে-অনেকটা মা যেমন ছেলেকে করে হতাশাগ্রস্ত বেপরোয়া মানুষের প্রতি ওর এক ধরনের টান আছে; ইন্দ্রিয়সুখে ও একদা আসক্ত ছিল। জ্যোৎস্নালোকে মারিয়া কার্লের চেহারায় ভাবান্তরক্ষ করল, গম্ভীর মুখে মাথা নিচু করে নখ খুঁটছে,
কার্লোস মারা গেছে আমি জানি। কিন্তু কী বলব বুঝতে পারছি না। দুঃখিত বললে সবটা বলা হবে না। পলক তুলল কার্ল, আত্মধিক্কারে কণ্ঠ তেতো হয়ে আছে, আমিই এজন্য দায়ী। সব দোষ আমার। কেউ মরলে, আমারই মরা উচিত ছিল।
শ। কার্লোসের কথা শুনলে কীভাবে?
যে রাতে লাইল ক্যানাডা ওদের বাথানে উপস্থিত হয়েছিল এবং আড়ি পেতে সে কী শুনেছিল তার কথা মারিয়াকে জানাল ও কার্লোস হত বা ডিউক রিপ হাজতে আছে তা নয়, শুনেছিল গ্রীন নামে এক গোয়েন্দা তাকে খুজছে।
সেই থেকে, পালিয়ে শীপ ক্যাম্পে গিয়ে সেখানে কারোকে না পেয়ে, কোথাও দুদণ্ড স্থির হয়ে বসেনি ও, কেবলই ভেবেছে এখন আর কী করণীয়।
মেক্সিকো পালিয়ে যাব না আশপাশেই লুকিয়ে থাকব কোথাও। ক্যানাডা যে ঘোড়াটা ভাড়া করেছিল, পালাবার সময়-ওটাই চুরি করেছিলাম আমি। তারপর আজ বিকেলে যখন বাথানের কাছেই একটা ঝোঁপের মধ্যে বসেছিলাম, তখন দেখলাম বাবা আর স্টেজ শহরে যাচ্ছে। সুযোগ বুঝে বাথানে ঢুকে পড়ে মাঠ থেকে আমার নিজের ঘোড়াটা ধরে এনেছি। আমাদের বাবুর্চি, বুড়ো টিম ছাড়া সে সময় কেউ ছিল না কাছেপিঠে। দিনের বেলায় বাজার করতে ও শহরে এসেছিল ওই বলল কার্লোস মারা গেছে, ডিউক রিপ হাজতে আছে।
লিভারি স্ট্যাবলের ঘোড়াটা কী করেছ?
শহরে এনে, সন্ধ্যের পর টেরিলের আস্তাবলের কাছে ছেড়ে দিয়েছি। তারপর এসেছি এখানে।
এস আমার সাথে। কোন শব্দ করবে না।
হাত ধরে মারিয়া ওকে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ওর বাসায় নিয়ে গেল।
চুপ করে বস এখানে। ক্যান্টিনা বন্ধ করে তোমার জন্য খাবার আনছি। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়?
খেতে পারব।
কার্লকে ওখানে রেখে বেরিয়ে এল মারিয়া। কোন খদ্দের ছিল না ক্যন্টিনায়, টেবিলগুলো সাফ করছিল ওয়েট্রেস, বারটেন্ডার তখনও আপনমতে বাজিয়ে চলেছে, তার গিটার এদেরকে সে জানাল এবার চলে যেতে পারে ওরা। তারপর বারটেন্ডার যখন সমস্ত বাতি নিভিয়ে বিদায় নিল, দরজায় তালা ঝুলিয়ে রান্নাঘরে ফিরে এল মারিয়া।
ওর রাধুনি অনেক আগেই চলে গেছে। মোটামুটি গরম ছিল খাবার, একটা প্লেটে সাজিয়ে সেগুলে ওর বসার ঘরে নিয়ে গেল ও। লন্ঠন ধরতে দেখল গদি ভাঁটা সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে কার্ল, চোখে ঘুম।
খাও। পরে তোমার সঙ্গে আরও কিছু খাবার দিয়ে দেব। কিছুদিনের জন্য তোমার বোধহয় শীপ র্যাঞ্চে লুকিয়ে থাকাই ভাল। ঝরনায় পানি আছে, আমি একটা কম্বল দিচ্ছি।
বাসা থেকে আমি এক জোড়া কম্বল নিয়ে এসেছি।
বেশ। এখন খাও তারপর বল আমাকে, সেদিন ওরকম মাতলামি করেছিলে কেন তুমি। কীসের এত তিক্ততা, হতাশা তোমার মধ্যে? তুমি তো এরকম ছিলে না। হঠাৎ করে কী এমন ঘটল?
একটা টর্টিলা মুখে পুরল কার্ল, নিষ্প্রাণ সুরে হাসল।
বেশিকিছু না বলাই ভাল। কেবল এটুকু বলছি, আমি যা জেনেছি তাতে বাবার সম্বন্ধে আমার ধারণা চুরমার হয়ে গেছে। শ্রাগ করল কার্ল প্রথম যখন জানলাম, মাথা ঠিক রাখতে পারিনি তাই মদ খেতে শুরু করি। তারপর মনে হয় ওকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলাম। জানি, পাগলামি করেছি। নিছক পাগলামি।
এখন কীরকম মনে হচ্ছে?
বুঝতে পারছি না ঠিক। একবার মনে হয় পালিয়ে যাই। পরক্ষণে যখন ভাবছি ব্যাপারটা, বুঝতে পারছি এভবে আমি বাঁচতে পারব না। বাবা কী করেছে এখন আর সেটা বড় না, আমি কী করেছি, এর পরিণতি মেনে নেয়ার সৎসাহস আমার আছে কিনা, কী করব শেষ পর্যন্ত, জানি না এখনও।
মারিয়ার দৃষ্টি না হয়ে এল। কার্লের খাওয়া দেখছে। কার্লোস, তার ভাই, মারা গেছে, কিন্তু সেজন্য ওকে দায়ী করতে পারছে না সে। এখন সে কার্লকে সাহায্য করতে চাইল।
তোমার বাবা এসেছিল। বাসায় ফিরে যেতে বলেছে তোমাকে। একটু ইতস্তুত করল মারিয়া। ধারণা করেছিল তুমি আসবে এখানে।
তুমি কী বললে?
তুমি ফিরে যাবে না। বলেছি, তুমি তাকে ঘৃণা করো, কাজেই কেন যাবে?
ঢেঁকুর তুলে প্লেটটা ঠেলে একপাশে সরিয়ে রাখল কার্ল।
আসলেও বোধহয় ঘৃণা করি, বিশেষ করে সত্যটা জানার পর। আগে ভয় পেতাম, শ্রদ্ধাও ছিল হয়ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভয় করতাম: পাছে কোন কারণে রেগে যায় আমার ওপর। ধারেকাছে থাকলে পা টিপে টিপে চলেছি, মুখ খুলিনি সহজে। জানি এরকমটা হওয়া উচিত ছিল না, কিন্তু বাবার চোখে ধিক্কার দেখেছি, আমি তাকে খুশি করতে চেয়েছি, অথচ বুঝতে পারিনি কীভাবে করব। এখন আর পরোয়া করি না–অন্তত বাবাকে না।
ওর দিকে তাকাল মারিয়া। ধরতে পারল তফাতটা। যা ঘটে গেছে তা বদলে দিচ্ছে কার্লকে। এখনও তার ভয় কাটেনি, তবু চেহারায় ফুটে উঠেছে একটা স্থিরসংকল্প-ইতিপূর্বে ওর মাঝে যা সে দেখেনি। সমস্যা মোকাবেলা করছে ও, এড়িয়ে, যাচ্ছে না।
তবে ওর হৃদয়হীন বাবা যে ক্ষতি করেছে ছেলের পরিণামে তা ওকে উচ্ছৃঙ্খল করেছে, অন্যদের নিয়ে গেছে পাপের পথে। গ্রীন যে লোকটাকে সাবেক মাইনিং ক্যাম্পে হত্যা করেছে তাঁর কথা ভাবল মারিয়া, ভাবল গ্রীনকে অন্ধ আক্রোশে সে নিজে যে গুলিটা করেছিল তার কথাও। মারিয়া উপলব্ধি করল ঘৃণাবশত নির্দ্বিধায় সে মানুষ খুন করতে পারবে এবং ন্যায়সঙ্গত মনে করবে ব্যাপারটাকে।
রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে ন্যাকড়া জড়িয়ে খাবারের পোঁটলা বাধল ও, খানিকটা কফি আর ছোট্ট একটা কেতলির সঙ্গে ওটা একটা ময়দার থলেতে রাখল। তারপর চারটে ম্যাচবাক্স ভরে থলেটা নিয়ে ফিরে গেল বসার ঘরে।
এই তোমার খাবার। এবার তুমি যাও। আমি যতক্ষণ না ডাকছি বাসাতেই থেকো। সাবধান থাকবে, বাছা। খোদার নাম জপে রওনা হয়ে যাও।
কার্ল বিদায় নেবার পর মুহূর্তের জন্য দুঃখ, হতাশায় ম্রিয়মাণ হলো মারিয়া। তারপর উদ্ধত অহঙ্কার ভর করল ওর উপর, সহসা একটা কিছু সংকল্প করে কার্লোসের রাইফেলটা আনতে উঠে গেল।
১০.
জেমস গ্রীন যখন হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিপার মকের দফতরে গেল তখন অনেক বেলা, সূর্য তেতে উঠেছে।
মক তার ডেস্কে বসে একগাদা ওয়ান্টেড পোস্টার ঘাটছিল, কিন্তু গ্রীন ঢুকতে সেগুলো একধারে সরিয়ে রেখে বলল, টেরিল তার ঘোড়া ফিরে পেয়েছে, ক্যানাডা যেটা ভাড়া করেছিল। আজ সকালে ওর ওয়াগন ইয়ার্ডের গেটের সামনে পেয়েছে।
সেক্ষেত্রে কার্ল হালাম এখন কোথায়? চিন্তিত গলায় বলল গ্রীন। শহরেই কোথাও লুকিয়ে থাকা সম্ভব?
সম্ভব। তবে আমার তা মনে হয় না। আমার বিশ্বাস এখন আরেকটা ঘোড়া জোগাড় করেছে সে। স্মিত হাসল মক। রাতে দাওয়াত কেমন খেলে?
ভাল। কেবল শেষ দিকে হালাম এসে পড়েছিল, অল্পের জন্য আমাদের মধ্যে মারামারিটা হয়নি।
গ্রীন খুলে বলল কী ঘটেছে, তবে মারিয়া ওকে দিয়ে হালামকে খুন করাতে চেয়েছিল সেটা এড়িয়ে গেল সযত্নে।
ওপর-নীচ মাথা ঝাঁকাল মার্শাল।
হালাম রাতে ছিল শহরে। আধঘণ্টাটেক আগে বাথানের দিকে রওনা দিয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে মক তার টুপি তুলে নিল। চল, আস্তাবলে যাই। ঘোড়াটা একবার দেখব আমি।
ওরা ওয়াগন ইয়ার্ডটা অতিক্রম করতেই টেরিল বেরিয়ে এল আস্তাবল থেকে। মককে বলল, আন্দাজ করেছিলাম ঘোড়াটা তুমি দেখতে চাইবে। যদিও জানি না কী লাভ হবে এতে।
কিছুই বলা যায় না।
তা অবশি। ও হ্যাঁ, ওই যে মেক্সিকান ছোকরা মারা গেছে, ওর ঘোড়াটা আজ সকালে নিয়ে গেছে ওর বোন। বাইরে যাচ্ছিল ও, আমি ভাবলাম ওটাই দিই, এমনিতেও ও-ই পাবে।
মক বলতে নিয়েছিল কিছু একটা, কিন্তু গ্রীন বাধা দিল।
কোথায় যাচ্ছে কিছু বলেছে?
না।
কতক্ষণ আগে?
টেরিল কাঁধ ঝাঁকাল।
মিনিট কুড়ি হবে।
আমার ঘোড়ায় জিন চাপাতে পারবে? এক্ষুণি?
নিশ্চয়, বলে ভেতরে ঢুকে গেল আস্তাবল মালিক।
চিন্তাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে মক তাকাল গ্রীনের দিকে। কোন ঝামেলা? জিজ্ঞেস করল।
তেমন কিছু না অধৈর্য সুরে জবাব দিল গ্রীন। কামনা করছে তা-ই যেন হয়। কিন্তু ও জানে হালামকে কোন চোখে দেখে মারিয়া। হালাম বাসার দিকে রওনা হবার পরপরই শহর ত্যাগ করেছে ও, ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না গ্রীনের!
কার্লের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে? মক জিজ্ঞেস করল।
কাঁধ ঝাঁকাল গ্রীন, টেরিলেতে দেরিতে বিরক্ত বোধ করছে। অসম্ভব না।
ও নিজেই ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাতে পা বাড়িয়েছে এই সময় বিশাল লাগাম ধরে স্টীলডাস্টটা টেনে নিয়ে এল আস্তাবল মালিক। একলাফে ওর পিঠে চড়ে বসল গ্রীন, মার্শালকে, পরে দেখা করব, বলে ছুটে বেরিয়ে গেল ওয়াগন ইয়ার্ড থেকে।
ঝড়ের বেগে পশ্চিমের রাস্তা ধরল ও। ভাবছে এখনও হয়তো সময় আছে। পাথুরে রাস্তায় ঢাক পেটবার মত আওয়াজ তুলল ওর ঘোড়ার খুর। শঙ্কিত বোধ করছে গ্রীন, বুঝতে পারছে মারিয়া যদি খুন করতে চায় হালামকে নির্ঘাত অ্যামবুশ করবে। কোথায় হতে পারে জায়গাটা অনুমান করতে চেষ্টা করল।
আধঘণ্টা পর, যখন অনুভব করল হালাম আর বেশি দূরে নেই গতিবেগ মন্থর করল গ্রীন। পরমুহূর্তে সামনে ঘোড়ার পদশব্দ শুনতে পেল। রাস্তাটা যেখানে বাক নিয়েছে সেখানে পৌঁছে আধমাইল দূরে একজন অশ্বারোহীকে দেখতে পেল সে, বুঝল ওটাই হালাম।
রাস্তার ডান পাশে উঁচু খাড়াই ডগলাস ফার আর গ্রীষ্মঋতুর হলুদ অ্যাসপেনে ছাওয়া। মেয়েটা যদি অ্যামবুশ করতে চায় এই খাড়াইয়ের কোন জায়গা থেকে করবে, গ্রীন অনুমান করল। কারণ উঁচু বলে নিশানা করতে সুবিধে হবে।
এগোল সে, ট্রেইলের সন্ধানে, তাকাচ্ছে আশপাশে। যখন দেখতে পেল না ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে রওনা হলো খাড়াই বরাবর। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটল দ্রুতগতিতে। একটু বাদে ঘেসো জমিতে বেরিয়ে এল সে, তারপর ট্রেইলটা চোখে পড়ল, রাস্তার সমান্তরলে সামনে এগিয়েছে। জোরকদমে ওটা অনুসরণ করল গ্রীন, ভাবছে আলেয়ার পেছনে ছুটছে কিনা। ঘন্টাখানেক এগোবার পর, যখন সে বুঝতে পারল হালামকে পেছনে ফেলে এসেছে সেই সময় হঠাৎ করেই ঘোড়াটা চোখে পড়ল ওর। একতা ঝোঁপের সঙ্গে বাধা অবস্থায় ঘাস খাচ্ছে।
মাটিতে নেমে নিজের ঘোড়াকে ঘেসো জমিতে ছেড়ে দিল গ্রীন, হলুদ অ্যাসপেন বনের ভেতর দিয়ে কোনাকুনি নামতে শুরু করল।
অচিরেই শ-খানেক গজ নীচের রাস্তাটা দেখতে গেল ও, তার অদূরে হাঁটু সমান ঘাসের মধ্যে বুক ডুবিয়ে কেউ একজন শুয়ে আছে লক্ষ্য করে বুক ভরে শ্বাস টানল। মারিয়া গার্সিয়াকে চিনতে পারল গ্রীন। ওর কাঁধে রাইফেলের কুঁদো ঠেকানো তাড়াতাড়ি পা চালাল ও, কাছেই একটা ঘোড়া ছুটে আসার শব্দ হতে দেখল গুলি ছোড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে মারিয়া।
দৌড়াতে শুরু করল গ্রীন। চমকে উঠে ঘাড় ফেরাল মারিয়া, পরক্ষণে ওর ওপর ঝাপিয়ে পড়ল গ্রীন, রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল একপাশে, শ্যামাঙ্গিনী চেঁচাবার প্রয়াস পেতে ওর মুখে চেপে ধরল।
মারিয়া ছাড়া পাবার আপ্রাণ চেষ্টা করল, কিন্তু গ্রীন আরও শক্ত করে ধরে রইল ওকে। অনুভব কছে ঢিলেঢালা ব্লাউজ আর বাকষ্কিন রাইডিং স্কার্টের নীচ থেকে ওর উষ্ণ শরীর আর উদ্দাম যৌবনের স্পর্শে আগুন ছড়াচ্ছে তার দেহে। ক্রোধের তাপে তড়পাচেছ মারিয়ার হৃৎপিণ্ড। গ্রীনকে লাথি মারার চেষ্টা করল ও, কিন্তু গ্রীন তার ডান পায়ের ভর ওর দু-পায়ের ওপর চাপিয়ে দিল। তারপর হালাম যখন নীচের রাস্তা ধরে মাঝারি কদমে বেরিয়ে গেল তখন আড়ষ্ট হয়ে গেল মারিয়া, জ্বলন্ত দৃষ্টিতে পেছন থেকে চেয়ে রইল অশ্বারোহীর দিকে।
অবশেষে হালাম দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল গ্রীন। একটুক্ষণ কাত হয়ে নিঃসাড়ে ঘাসের মধ্যে পড়ে রইল মারিয়া, মুখ আরক্ত, চোখ বোজা। টের পেল শিউরে উঠছে, মেয়েটা, বুঝল নিজের ভুল উপলব্ধি করেছে ও।
সব এখন ঠিক হয়ে গেছে, তবে আরেকটু হলেই হত না, গ্রীন বলল।
চিত হলো মারিয়া, ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল ওর দিকে, খামচি দেয়ার চেষ্টা করল মুখে।
মনে করেছে ওকে খুন করলে আমার কী হবে ভেবে আমি ডরাই? তুমি এটা বোকা।
আবার ওকে চড় মারার প্রয়াস পেল মেয়েটা, ঝট করে ওর কজি দুটো চেপে ধরল গ্রীন।
বাঘিনী! বলল সে। এরকম করলে তুমি আউট-ল হয়ে যাবে।
ঝুঁকে ওর ঠোঁটে চুমু খেল সে, ফের ছাড়া পাবার ব্যর্থ চেষ্টা করল মারিয়া। তারপর, সহসাই, ফুপিয়ে উঠল, গ্রীনের ঘন চুল জাপটে ধরে বুনো আবেগে সাড়া দিল ভয়ঙ্করভাবে। ওর গায়ের সাথে সেঁটে গেল মারিয়া, গ্রীন সোহাগ করল। তারপর আবার বনবেড়ালির মত আচড়ে খামচে লড়তে শুরু করল মেয়েটা।
ওকে ছেড়ে দিল গ্রীন, কামনাবেগে ঝিমঝিম করছে শরীর।
উঠে বসল মারিয়া, হাঁপাচ্ছে, তপ্ত নিশ্বাসের তালে তালে দ্রুত ওঠানামা করছে ভরাট বুক, আগুন ঝরছে চোখ থেকে।
কী মনে কর তুমি? একজন গ্রিংগোর সাথে প্রেম করব আমি? বাহ! আমি কারোকে ভালবাসি না।
কোন একদিন করতেও পারো, পাল্টা জবাব দিল গ্রীন। রাইফেলটা তুলে নিল। আপাতত আমার কাছেই থাক, শহরে গিয়ে ফেরত পাবে। যেরকম বাঘিনী তুমি, আবার হয়তো তারা করবে ওকে।
ভেবেছ আমি তোমার সঙ্গে শহরে যাব? অবজ্ঞার সুরে বলল মেয়েটা। না! আমি একাই যাব, গ্রিংগোদের আমি বিশ্বাস করি না, কেবল প্রেম করতে চায়। তুমি একটা পশু। ফের যদি আমাকে চুমু দেয়ার চেষ্টা কর-খুন করব!
তোমার মধ্যেও একটা জানোয়ার বাস করে, থাবা আছে তার, গ্রীন বলল। কামনাও।
বোকা।
ওকে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘোড়ার কাছে চলে গেল মারিয়া, মাথা উঁচু, অবাধ্য কালো চুল ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপর। ওকে স্যাডলে চড়তে দেখল গ্রীন, তারপর যখন রওনা হল ধীরে ধীরে তখন কর্কশ সুরে চেঁচিয়ে বলল, তোমার রাইফেল নিয়ে আসছি আমি-আজ সন্ধ্যায়!
একটিবারও পেছনে না তাকিয়ে চলে গেল মারিয়া। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল গ্রীন, ভাবছে মেয়েটার ভেতর নারীসুলভ সবকিছুই আছে, কেবল প্রয়োজন একটু বশ মানার। মুচকি হেসে ওর রাইফেলটা ক্যান্টেলের পেছনে বাঁধল সে, স্যাডলে চেপে রওনা হলো মারিয়ার ট্রেইল ধরে।
১১.
মার্শাল মক তার দফতরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পশ্চিমের পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখছিল। হঠাৎ চোখের কোণে লক্ষ করল সে গোধূলি আলোর ভেতর দিয়ে এক অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে তার দিকে। ধক করে উঠল মার্শালের বুক, একটা হার্টবিট মিস করল
স্যাম ট্যানার কী করছে এখানে? অকটিওতে ওর কী কাজ?
মার্শলকে দেখতে পেয়েছিল স্যাম ট্যানার, এগিয়ে এল। লম্বা পায়ের তাগড়া একটা সোরেলে চড়েছে ও, চমৎকার জানোয়ার। কিন্তু স্যাম, যতটা মনে পড়ছে মকের, আগের মতই বদখত রয়েছে। খর্বকায় একটা মানুষ, পরনে ধুলোমলিন কাউবয় পোশক, সাদামাটা চেহারা। ব্যতিক্রম শুধু ওর ছাইরঙা চোখ দুটো–ভাবলেশহীন, মরা মানুষের চোখের মত নিষ্প্রাণ ।
চোখ আর পিস্তল, মক ভাবল। মোটামুটি একসাথে কাজ করে ওরা। মার্শাল লক্ষ্য করল ট্যানারের হাড্ডিসার উরুর সাথে তার অস্ত্রটা নিচু করে বাঁধা।
রাশ টানল বন্দুকবাজ, একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মকের দিকে, নীরবে। এটাই ওর রীতি, মকের মনে পড়ল। এমনকী কোন লোক যদি একটা সাধারণ প্রশ্নও করে, জবাব দেবার আগে ওই ধূসর চোখজোড়া মেলে দীর্ঘক্ষণ তার পানে অপলকে তাকিয়ে থাকবে স্যাম। যে কেউ এই দৃষ্টির সামনে কেঁপে উঠবে, যেমন এখন উঠল মার্শাল।
কেমন আছ, স্যাম? জিজ্ঞেস করল মক। আসলে সে বলতে চেয়েছিল, এখানে তুমি কী করছ? কিন্তু স্যাম ট্যানারকে ওই ধরনের প্রশ্ন করতে নেই।
ভাল, একটু বাদে জবাব দিল স্যাম ট্যানার। সেই বেলুরাইডের পর আর দেখিনি তোমাকে, তখন একটা লিভারি স্ট্যাবল চালাতে। তবে শুনলাম, এখানে তুমি মার্শাল।
এই শহরটা খুব শান্ত, স্যাম।
এমনভাবে মককে জরিপ করল বন্দুকবাজ যেন বহুদূর থেকে দেখছে।
তাই, একসময় জবাব দিল সে। ঠিক সীমান্তের দক্ষিণের মত, যেখানে আমি থাকি, ভদ্র, শান্ত-যেমনটা হওয়া উচিত। সিধে হলো স্যাম, আলতোভাবে নড করে চলে গেল। মক খেয়াল করল ও হোটেলের উদ্দেশে যাচ্ছে। অকটিওতে, তার শহরে, আস্তানা গাড়ছে স্যাম ট্যানার ভাবতেই মার্শালের গায়ে কাঁটা দিল!
পরক্ষণে আরেকটা চিন্তা আঘাত করল তার মগজে, কেবলমাত্র একজন মানুষই স্যাম ট্যানারকে ডেকে পাঠাবার ক্ষমতা রাখে-ফ্রেড হালাম।
এবং এর পেছনে কারণও একটাই: জেমস গ্রীনকে খুন করা। এই তল্লাটে আসার পর থেকেই হালামকে সে অনবরত নাকানি-চোবানি খাওয়াচ্ছে।
মক আন্দাজ করতে চেষ্টা করল এখন কোথায় গেলে পাওয়া যাবে গ্রীনকে, সাবধান করতে চায়। তার অনুমান যদি ঠিক হয়, গ্রীনকে গানফাইটে প্ররোচিত করবে স্যাম ট্যান্যার, এবং সামান্যতম সুযোগও পাবে না গ্রীন। ওর এখন শহর ত্যাগ করাই উত্তম, যদিও মকের দৃঢ়বিশ্বাস তা সে করবে না। পালাবার লোক না ও, এমনকী মৃত্যু নিশ্চিত একথা জেনেও।
ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর সত্যটা অনুধাবন করতে পারল কি; একান্তই যদি কোন গোলাগুলি হয়, শেষ পর্যন্ত তাকেই মোকাবেলা করতে হবে সেটা-এবং স্যাম ট্যানারের বিরুদ্ধে সেও টিকবে না একমুহূর্ত।
.
মারিয়া ক্যান্টিনায় রাতের খাওয়া সেরে হোটেলে ফিরছে গ্রীন এমন সময় গুলি আওয়াজ শুনতে পেল সে।
মৌন রাতে আপনমনে হাঁটছিল গ্রীন, সকৌতুকে মারিয়ার কথা ভাবছিল। সারাটা সন্ধ্যে খুব নিরুত্তাপ ছিল ও, দূরে-দূরে থেকেছে, কথাবার্তা বিশেষ বলেনি, আর যাও বা বলেছে তার সবই ছিল ওর প্রতি ধিক্কারে ভরা।
তবু গ্রীনের বিশ্বাস মেয়েটাকে বোঝে সে, যদিও ওর তখনকার সেই মদিরাবেগের পাশাপাশি আচমকা খেপে ওঠার ব্যাপারটা একটু খাপছাড়া।
গুলির আওয়াজ নিমেষে সতর্ক করে তুলল গ্রীনকে। পিপার মকের অফিসের দিক থেকে এসেছে ওই আওয়াজ। দ্রুত পা চালাল ও, তারপর ঘটনাস্থলের দিকে আরও লোকজনকে ছুটে যেতে দেখে দৌড়াতে শুরু করল।
অফিসের সামনে ভিড় করেছে একদল মানুষ, উঁকি মারছে জানালা দিয়ে, ভেতরে একটা লণ্ঠন জ্বলছে। ভিড় ঠেলে এগোল গ্রীন, দরজা খুলে পা রাখল ঘরে। কারোকে দেখতে পেল না ও। পিস্তল বের করে দ্বিতীয় দরজা খুলে সেল ব্লকে গেল। দুটো কারাকক্ষ, মুখোমুখি, ডানেরটায় বিস্ফারিত চোখে এক লোক গরাদ আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়েছিল, গ্রীনকে দেখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল। ফাঁসাসে গলায় কোনমতে বলল সে, কেউ ওকে গুলি করেছে।
মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল গ্রীনের চেহারা। ঝট করে ঘাড় ফেরাল দ্বিতীয় সেলটার দিকে, দেখল পাথুরে মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে ডিউক রিপ, করিডরের বাতিতে নিপ্ৰভ দেখাচ্ছে চোখ, বুকের গর্ত থেকে রক্ত চোয়াচ্ছে।
অপর কয়েদির দিকে ঘুরল গ্রীন। লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে গরাদ আঁকড়ে, লাশটা দেখছে।
কীভাবে ঘটেছে?
সচল হলো লোকটার মুখ, ঘাড়ের সংযোগস্থল থেকে নড়ছে মাথাটা।
অজ সকাল থেকে মদ খাচ্ছিলাম আমি, তাই ঘণ্টা দুয়েক আগে মার্শাল আমাকে কয়েদ করেছে। ঘোরের মধ্যে ছিলাম, ফলে বলতে পারব না ঠিক কী ঘটেছে। তবে একটা লোকের গলা শুনতে পেয়েছি। ডিউক, অ্যাই, ডিউক, বলে ডাকছিল। তারপর দুটো গুলি, পেছনের দেয়ালের ওই ছোট্ট জানালাটা দিয়ে।
খিড়কি দরজা খুলে বাইরে গেল গ্রীন। রুপালি জ্যোৎস্নায় দেখল জানালার ঠিক নীচে একটা কাঠের বেঞ্চ পাতা। বেঞ্চে উঠে দাঁড়াতেই ও বুঝে গেল এখান থেকে সেলের ভেতরটা দেখা যায়। এর অর্থ এখানে দাঁড়িয়ে খুনী ডাক দিয়েছিল ডিউক রিপকে, তারপর ও এগিয়ে এলে গুলি করেছে।
জেলহাজতে ফিরে এল গ্রীন। গরাদের ফাঁক দিয়ে বেশকিছু লোক অপলকে দেখছিল লাশটা! পিপার মক এসে ওদেরকে যখন রুক্ষ স্বরে বেরিয়ে যেতে আদেশ করল, অনিচ্ছাসত্ত্বেও সরে গেল লোকগুলো।
তালা খুতে খুলতে গ্রীনকে জিজ্ঞেস করল মার্শাল, তুমি খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছেছ। জানো, কীভাবে কী ঘটেছে?
মাতালের কাছে যা শুনেছে গ্রীন জানাল ওকে। একটা বাংকের ওপর লাশটা তুলল ওরা, মক কম্বল দিয়ে ঢেকে দিল।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল মার্শাল, দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কার্লের বিরুদ্ধে তোমার একমাত্র সাক্ষী ছিল ও। এখন ছেলেটা একরকম বেঁচে গেল। প্রমাণ ছাড়া মামলা টিকবে না।
হিসেবি চাল, তাই না? গ্রীনের মুখ থমথমে। কার কাজ বলে মনে হয়? হালামের ফোরম্যান?
গম্ভীরভাবে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়াল মার্শাল।
কে গুলি করেছে আমি জানি, হার্ভে স্টেজ না, ধীরে ধীরে বলল ও। তবে প্রমাণ করতে পারব না। চল, অফিসে যাওয়া যাক তোমার একটা কথা জানা দরকার।
করিডর ধরে ওরা রওনা হয়েছে, এই সময় চেঁচিয়ে উঠল মাতাল। অ্যাই, মক; তুমি আমাকে একটা লাশের সাথে রেখে যাচ্ছ নাকি?
তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না ও, মক বিরক্ত।
এখন সুস্থ হয়ে গেছি আমি। কসম, সুস্থ হয়ে গেছি। গুলির আওয়াজে কেটে গেছে নেশা।
ধেত্তেরি, বলে সেলের তালা খুলল মক। এবারের মত ছেড়ে দিলাম, টোবি। বাড়ি যাও। আবার স্যালুনে থেমে সবাইকে বল না যেন কী জানো তুমি, বোঝা গেছে? তা হলে কিন্তু এরপর এক মাসের ঘানি।
ধন্যবাদ জানিয়ে একরকম ছুটে পালাল মাতাল। গ্রীন আর মক অফিস ঘরে গেল। সেখানে ওকে স্যাম ট্যানার সম্পর্কে অবহিত করল মক।
হালাম তলব করছে ওকে, আমার বিশ্বাস। এবং এরপর তোমার পালা-যদি আগেই চলে না যাও। আর যাবে না-ই বা কেন তাও বুঝতে পারছি না আমি। কার্ল মোটামুটি বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে এখন, কেবল সময়ের ব্যাপার।
মৃদু হাসল গ্রীন। মোটামুটি। না, মক, ওকে আমার ধরতে হবে। এটাই আমার কাজ।
অস্বস্তিভরে মক বলল, আর আমার স্যাম ট্যানারের সঙ্গে দেখা করা।
তুমি না বললে প্রমাণ করতে পারবে না। যাই হোক, ওটা তোমার ব্যাপার, তবে আমি ওর পরবর্তী চালের অপেক্ষায় থাকব।
ঘোৎ করে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করল মার্শাল। দেখা যাক কী হয়। স্যাম ট্যানারের চেহারার বিবরণ দিল ও। জানি না কীভাবে সারবে, তবে কোন অন্ধকার গলিতে ঢুকবে না, খোলা দরজার দিকে পেছন ফিরবে না। এর বেশি কিছু বলতে পারব না আমি। হালামের ছেলের ব্যাপারে কী করবে ভেবেছ কিছু? কোথায় খুঁজবে ওকে? এজরে অন্ধকারে হাতড়ে লাভ হবে না কোন। ও যদি ধরা দিতে না চায়, ওকে খুঁজে পাবে না তুমি।
দুটো বুদ্ধি এসেছে মাথায়, বলে উঠে দাঁড়াল গ্রীন। প্রথমটায় যদি কাজ না হয়, আঙুল বাকাতে হবে।
পিস্তলে তোমার হাত কেমন?
সেরা নই।
স্যাম ট্যানার তাই। অন্তত সেরাদের একজন।
এ ব্যাপারে মাথা ঘামাব না, এখন, এটুকু বলতে পারি। এসব কাজের সবচেয়ে খারাপ দিক এটাই-অযথা চিন্তা করা। দুর্বল করে ফেলে মানুষকে, নিজের ছায়া দেখলেও ভয় পায়। চলি, মক। শুভ রাত্রি। তুমিও খামোকা দুশ্চিন্তা কর না।
চেষ্টা করব, শুকনো গলায় বলল মার্শাল। ওকে স্বর্গীয় হাসি উপহার দিয়ে বেরিয়ে গেল গ্রীন।
১২.
অন্ধকার রাস্তায় বেরিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাল গ্রীন। খোলা দরজা-জানালা গলে ছেড়াখোঁড়া আলো এসে পড়েছে ফুটপাতে। এখন আর হাসছে না ও। জানে এখন থেকে সময় হুশিয়ার থাকতে হবে ওকে। খানিক ইতস্তত করল সে, তারপর ঘুরে মেক্সিক্যান পাড়ায় মারিয়ার ক্যান্টিনার উদ্দেশে রওনা হলো, আলোর বাইরে দিয়ে ফুটপাতের কিনার ঘেঁষে হাঁটছে।
মেক্সটাউনের প্রান্তে শেষ হয়ে গেল ফুটপাত। এখানকার চুন-সুরকির ঝুপড়িগুলোতে আলো কম, ম্লান। গির্জাটা পেরিয়ে গেল গ্রীন, দেখল ভেতরে মিটমিট করে মোম জ্বলছে, উপাসনা করছে জনাকয়েক লোক। জানালার কাছে লালচে আভা ছড়িয়েছে ক্যান্টিনার বাতি। ঢোকার আগে মুহূর্তের জন্য থামল গ্রীন, গতরাতে মারিয়ার বাসার ফটকের বাইরে এক লোক লুকিয়েছিল মনে পড়তে কানখাড়া করে বোঝার চেষ্টা করল আজও সেরকম কেউ আছে কিনা আশপাশে।
সন্দেহজনক কোনকিছু টের পেল না ও। ক্যান্টিনায় ঢুকল গ্রীল, বারে দাঁড়ানো। লোকটাকে দেখে ধক করে উঠল বুক।
লোকটাও তাকিয়েছিল ওর দিকে, বিদ্যুণ্ডমকের মত একটা পরিচয়ের আভাস বিনিময় হলো ওদের মাঝে। গ্রীন তার দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিল। বারের দিকে এগোল সে, ক্ষুদ্রকায় লোকটা থেকে তিন ফুট দূরে থামল।
টেকুইলা,কৃষ্ণকায় বারটেন্ডারকে বলল গ্রীন।
গ্লাসে মদ ঢেলে এগিয়ে দিল বারটেন্ডার, বারের ওপর একটা রৌপ্যমুদ্রা রাখল গ্রীন। একচুমুকে পানীয়টুকু শেষ করল ও, তারপর পাশে দাঁড়ানো লোকটার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, তুমি স্যাম ট্যানার। এইমাত্র তোমার ভাষায় একটা কাজ সেরে এসেছ।
নির্লিপ্ত, চোখ দুটো স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর পানে, কিন্তু স্যাম ট্যানার মুখ খুলল না।
নিশ্চয় হালাম তোমাকে বলেছে আমাকে পাওয়া যাবে এখানে, গ্রীন বলল।
আর তুমিও বোধহয় ভেবেছিলে তোমাকে খুঁজে পাব না আমি, মৃদু গলায় বলল, ট্যানার, এক মুহূর্ত পর।
আমি চলে গেলে পেতে না।
হয়তো এখনও খুব দেরি হয়ে যায়নি।
আমাদের একজনের জন্য তাই যাবে, জবাব দিল গ্রীন, লক্ষ করল ঈষৎ কেঁপে উঠল স্যাম ট্যানারের চোখের পাতা। জীবনে বহু বন্দুকবাজক, দেখেছে গ্রীন, অনেকের সঙ্গে লড়াইও করেছে। তার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায়, অন্যকিছু না হোক, একটি সত্য সে জেনেছে; অধিকাংশ বন্দুকবাজই হয় কাপুরুষ, প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবেলা করার চাইতে আড়াল থেকে গুলি করতেই পছন্দ করে বেশি।
কিন্তু স্যাম ট্যানারের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না ও। অতিসাধারণ চেহারা; কেরল অদ্ভুত ওর চোখ দুটো, নিরাসক্ত, ভাবলেশহীন-কোনরকম ভাবান্তর নেই।
গ্রীনের মনে পড়ল মক তাকে অন্ধকার গলি আর খোলা দরজা থেকে সরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
বন্দুকবাজের উদ্দেশে আরেকবার শীতল চাহনি হানল সে, তারপর বারের কোনা ঘুরে রান্নাঘরের দিকে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা দিল পুঁতির পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় শিরদাড়ার কাছে শিরশিরে অনুভূতি হলো ওর।
রান্নাঘরেই মারিয়াকে পেয়ে গেল গ্রীন, কাজে ব্যস্তু ছিল। এত তাড়াতাড়ি ওকে ফিরে আসতে দেখে অবাক হলো মেয়েটা, কালো ভ্রূজোড়ায় ভাঁজ পড়ল।
আবার কী? শিগগিরই বন্ধ করে দেব, তখন এমনিতেও চলে যেতে হবে তোমাকে,
বিরাট দুই হাতের মুঠোয় গ্রীন তার টুপিটা নাচাল, অস্বস্তি বোধ করছে। শান্ত গলায় মেয়েটাকৈ জানাল ডিউক রিপ মারা গেছে।
আধঘন্টা আগে কেউ ওকে গুলি করেছে সেলের মধ্যে। তুমি হয়তো আওয়াজ শুনে থাকবে।
দুর্বোধ্য ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল মেয়েটা, গভীর কালো চোখ দুটো চিকচিক করে উঠল।
ডিউক ভাল ছেলে ছিল, মোটামুটি। কে খুন করল? কেন?
কান্নায় ভেঙে পড়ল মারিয়া, বিস্ফারিত হয়ে গেছে চোখ, গাল ভেজা, মুখ ফ্যাকাসে।
কী ব্যাপার? গ্রীন জিজ্ঞেস করল। কী ভাবছ এত?
খুব দুঃখজনক এই মৃত্যু। তবে আমাকে জানাতে এসেছ তুমি, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
জানাচ্ছি তার কারণ কার্লের সঙ্গে যদি তোমার দেখা হয় তাকে বলতে পারবে ঘটনাটা।
ভোতা হয়ে গেল মারিয়ার দৃষ্টি, গলার স্বর রুক্ষ হয়ে উঠল। কার্লের সঙ্গে আমার দেখা হবে এরকম ভাবছ কেন?
আমি বলেছি যদি দেখা হয়, বলল গ্রীন, মেয়েটার এই আকস্মিক মেজাজ পরিবর্তনে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে ওর মন।
দেখা হবে না আমার সাথে, ঝাঁঝের সাথে বলল মারিয়া। এবার তুমি যাও! আমি খুব ব্যস্ত। সারারাত ধরে গ্রিংগোর সাথে প্যাচাল পাড়ার মত সময় নেই।
বিদায় জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াল গ্রীন। পর্দাটা সামান্য ফাঁক করে বারের দিকে অকিয়ে দেখল স্যাম ট্যানার নেই।
দ্বিধায় পড়ল ও, বুঝতে পারছে মারিয়া লক্ষ করছে ওকে। বাইরে কোথাও হয়তো ওত পেতে অপেক্ষা করছে স্যাম ট্যানার, ও বেরোলেই গুলি করবে, পেছনে ক্যান্টিনার আলো থাকায় নিশানা করা সহজ হবে গুপ্তঘাতকের পক্ষে। মারিয়ার দিকে ফিরল গ্রীন।
পেছনের রাস্তা দিয়ে বেরোতে চাই আমি। তোমার ঘরের ভেতর দিয়ে যে দরজাটা উঠনে খোলে।
কী ব্যাপার? কার ভয় করছ?
ভয় পাচ্ছি না, গ্রীন বিরক্ত। সামনে দিয়ে বেরোলে একটা যুদ্ধ বাধতে পারে, তোমার খদ্দেররা তা হলে বিপদে পড়বে।
উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল মারিয়ার দৃষ্টি, গলা নেমে গেল খাদে।
কে আছে বাইরে?
ডিউক রিপকে যে লোকটা খুন করেছে। নাও, এবার আমাকে দেখাও
ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল মারিয়া, বাসায় ঢুকে শোবার ঘর হয়ে ওকে নিয়ে গেল দরজার কাছে। অন্ধকার ঘরে গ্রীনের হাত চেপে ধরল। অন্ধকারে ওর মুখাবয়ব, চকচকে চোখ দেখতে পেল গ্রীন।
সাবধান, নয়তো তুমিও খুন হয়ে যেতে পার, মৃদু গলায় বলল মারিয়া।
স্মিত হাসল গ্রীন। তাতে কি সত্যি তুমি খুব দুঃখ পাবে, মারিয়া?
সি। পাব।
ওর ক্ষীণ কটি জড়িয়ে ধরল গ্রীন, অনুভব করল শক্ত হয়ে গেল শরীর-সেই চাপা ইস্পাত। তারপর ঢিল দিল মারিয়া, চোখের পলকে ওর মাথাটা টেনে নামিয়ে চুমু খেল ক্ষুধার্ত কামনায়। সকালে সোনালি অ্যাসপেনের নীচে ঘাসের মধ্যে যেরকম অনুভূতি হয়েছিল গ্রীনের এখন আবার তেমনি আগুন ছড়াল ওর শিরায় শিরায়।
বাইরে যাবার বদলে রাতটা এখানে কাটাতে পারলেই বেশি খুশি হবে সে, চকিতে একবার ভাবল ও।
মারিয়াকে রেহাই দিল গ্রীন, তপ্ত একটা নিশ্বাস ছেড়ে সোজা হলো।.. তোমার মধ্যে বারুদ আছে, বলল ও।
তারপর ঘুরে দরজা খুলল সে, দ্রুত পা রাখল বাইরের: জাফরি কাটা মাচানের নীচে। চন্দ্রালোকিত উঠানটা জরিপ করার সময় মারিয়ার কথা পুরোপুরি ভুলে গেল ও, দেয়াল ঘেঁষে ফটকের দিকে এগোল উবু হয়ে। একটু ইতস্তত করে তুলল হুড়কোটা, নিঃশব্দে নামিয়ে রাখল একপাশে। তারপর পিস্তল বের করে ঠেলে ফাঁক করল গেট, অনুভব করল চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে।
অদূরে কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল এবং চুপ করল। পেলব রাতে আর কোন শব্দ নেই। গলিতে বেরিয়ে ফটকটা টেনে বন্ধ করে দিল গ্রীন, চোখ সতর্ক, আশপাশের রুপালি আঁধার,আর সামনের নিচ্ছিদ্র অন্ধকার রাস্তাটা জরিপ করছে।
আগে বাড়ল গ্রীন, গেল রাতে যে লোকটা দৌড়ে পাশের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল তার কথা ভাবছে।
দেয়ালের কোণে পৌঁছল সে। উবু হয়ে চলাফেরা করছে খেয়াল হতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পিস্তলটা রাখতে যাচ্ছে হোলস্টারে এই সময় আচমকা গুলির আওয়াজে। খানখান হয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতা। অন্ধকারের ভেতর উল্টো দিকে আগুনের ঝলক দেখতে পেল গ্রীন। নিক্ষিপ্ত পাথরখণ্ডের মত শক্ত একটা কিছু আঘাত করল ওর কোমরে, এক হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল ও। পরক্ষণে আরেকটা বুলেট উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে, পেছনের দেয়ালে বিঁধল। আগুনের ঝলক নিশানা করে গুলি ছুঁড়ল গ্রীন, তারপর আরও দুটো গুলি করে উঠে দাঁড়িয়ে এগোল সামনে। হিমশীতল ভয়ঙ্কর ক্রোধে জেগে উঠেছে এর মাঝে।
এরপর আরেকটা গুলি বিস্ফোরিত হলো ওর মগজে। গ্রীন খেয়াল করছে না। ও সামনে এগোচ্ছে। শুধু বুঝতে পারছে প্রতিবার ট্রিগার টেপার সাথে সাধে পিস্তলটা লাফিয়ে উঠছে ওর হাতের মুঠোয়। এখন আর কোন পাল্টা গুলি ছুটে আসছে না। সামনে অন্ধকার রাস্তায় হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা মানুষটাকে ঝাপসা চোখে দেখতে পেল ও, পিস্তলের শেষ গুলিটা দুলিয়ে দিল ওর শরীরে। গ্রীনের মনে হলে ও একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেয়েছে, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারার আগেই ওর মাথা ঘুরে উঠল, ভীষণভাবে, ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটু, কিন্তু টের পেল না কখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে সে।
.
আবার যখন চেতনা ফিরে পেল গ্রীন তখন দেখল হোটেলে নিজের কামরায় শুয়ে আছে সে। নিঃসাড়ে পড়ে রইল ও, বুক ধড়ফড় করছে, শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে দ্রুতলয়ে। গ্রীন বুঝে উঠতে পারল না এখানে সে কী করছে। তারপর, প্রথমে ধীরে ধীরে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চকিতে মনে পড়ে গেল সব। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। চোখ পিটপিট করল, আচমকা টের পেয়েছে ঘরে সে একা নেই। আড়ষ্টভাবে বালিশের ওপর ঘাড় ফেরাল ও, দেখল, বিছানার পাশে মারিয়া বসে আছে। মেয়েটার চেহারায় স্বস্তির ছাপ ফুটে উঠতে লক্ষ করল সে।
তারপর মারিয়া যখন খেয়াল করল গ্রীন লক্ষ করছে ওকে তখন ঠাট্টার সুরে বলল, এবার তা হলে বুঝতে পারছ তুমি বেঁচে আছ? অনেক সময় লাগল কিন্তু।
কত? ক্ষীণ শোনাল গ্রীনের কণ্ঠ, যেন গভীর কোন কুয়ো থেকে উঠে আসছে।
দুদিন। প্রায় তিন। আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো মারাই যাবে ডাক্তার বলেছে তোমার কনফিউশন হয়েছে।
আকর্ণ বিস্তৃত হাসি হাসল গ্রীন। মানে কনকাশন।
একই কথা। মাথা ঘুরবে তোমার। এখন কেমন লাগছে?
গ্রীন অনুভব করল ওর মাথার একপাশে এখন ব্যথা করছে, হাত ওঠাতে আঙুলে ব্যান্ডেজের স্পর্শ পেল। ঝিমঝিম করছে ভেতরটা, ভুরু কোঁচকাল ও।
খিদে পেয়েছে, বলল।
ভাল, উঠে দাঁড়াল মারিয়া। চুপ করে শুয়ে থাক, আমি খাবার আনছি।
মারিয়া যখন দরজায় পৌঁছাল, গ্রীন ওর নাম ধরে ডাকল, মেয়েটা ঘুরে দাঁড়াতে বলল, এই দু-তিনদিন তুমি এখানেই বসেছিলে?
যে কারও জন্য এটা করব আমি।
বেরিয়ে গেল মারিয়া। জানালার দিকে পাশ ফিরতে গ্রীন দেখল বাইরে রোদ। তা হলে সে প্রায় তিন দিন অজ্ঞান হয়েছিল ও ভাবল। আস্তে আতে হাত-পা নাড়াল গ্রীন, তার, মাজার ব্যান্ডেজটা টিপে দেখল। তারপর চোখ মুদল সে এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল।
.
পরে, মারিয়া যখন ঢাকনা দেয়া খাবারের ট্রে নিয়ে এল জেগে উঠে গোগ্রাসে সেগুলো খেল গ্রীন। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সন্ধ্যে নাগাদ ওকে দেখতে এল ডাক্তার, সংক্ষিপ্ত পরীক্ষার পর রায় দিল শিগগিরই ও সেরে উঠবে।
তবে তোমার চোটটা খারাপ, কাজেই আরও কটা দিন শুয়ে থাকতে হবে তোমাকে। এরপরও, দ্রুত চলাফেরা করতে গেলে মাথা ঘুরবে।
মারিয়া চলে গেছে কান্টিনায়। রাতের খাওয়া নিয়ে পিপার মককে আসতে দেখে অবাক হলো গ্রীন। ওর কোলের ওপর ট্রেটা রেখে গম্ভীর গলায় মার্শাল বলল, বুটহিলে তোমার জায়গায় স্যাম ট্যানারের স্থান হয়েছে সেজন্য আমি খুশি।
ধন্যবাদ, বলে খেতে শুরু করল গ্রীন।
দুবার ওর মাথায় গুলি লাগিয়েছ তুমি, জানো?
ওই পর্ব শেষ। আলাপ করে খামোকা সময় নষ্ট। কার্লের ব্যাপারে কিছু শুনলে?
না, একটু থামল মার্শাল। নতুন কোন খবর নেই-শুধু ড্রাম ডার্লিং সব ব্যবসা বেচে দিয়ে চলে যাচ্ছে।
এতে অবাক হবার কী আছে?
অপ্রত্যাশিত, এই পর্যন্ত। ভাল ব্যবসা করছিল, টাকা কামাচ্ছিল। আর টাকাটাই ওর কাছে সব। তা ছাড়া আগেই বলেছি, ফ্রেড হালাম আর হার্ভে স্টেজের সঙ্গে সেই প্রথম দিকে এখানে বসতি করে ও। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোন কারণ না ঘটলে মানুষ সাধারণত তার পুরানো জায়গা ছেড়ে নড়তে চায় না। তবে আমার কেন যেন মনে হয় ওই তিনজনের ভেতরে একটা গোপন কোন ব্যাপার আছে। আগেও এরকম মনে হয়েছে আমার।
তোমারটা ঠিক বলতে পারব না, তবে আমি একটা ব্যাপারে অনেক ভেবেও কূলকিনারা করতে পারিনি। এত ভাল ছেলে ছিল কার্ল হালাম, সে কেন হঠাৎ করে এমন মাতাল হয়ে স্টেজ ডাকাতি করতে গেল? তোমার মনে আছে আমরা একবার আলাপ করেছিলাম, ডিউক রিপ আমাকে বলেছিল কার্ল তার বাবার কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চাইছি? আমার কাছে ব্যাপারটা এখনও রহস্যময়। এই ঘর থেকে বেরোতে পারলেই ওকে খুঁজে বের করব আমি।
মামলাটা বন্ধ করে দেয়াই বোধহয় ভাল। একটা সাক্ষীও তো আর বেঁচে নেই।
না, তা সম্ভব না, সংক্ষেপে বলল গ্রীন। নীরবে খাওয়া সারল ও। মক উঠে খালি ট্রেটা তুলে নিল।
এবার নিশ্চয়ই ঘুম?
গ্রীন হাসল। খাওয়া আর ঘুম, সামনের কয়েকটা দিন কেবল এ দুটোই করব, বলল ও। শুভ রাত্রি, মার্শাল। এবং ধন্যবাদ।
মক অকপটে বলল, আমারই উচিত তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া। তুমি স্যাম ট্যানারকে না মারলে ওকে মোকাবেলা করতে হত আমার। এবং এ মুহূর্তে আমিই থাকতাম বুটহিলে।
১৩.
পরদিন উঠে বসল গ্রীন। মাজার ক্ষতটা শুকিয়ে আসছে, খুব একটা সমস্যায় ফেলছে না ওকে। কিন্তু মাথার-টাই ভাবিয়ে তুলেছে। ঘরের ভেতর মাত্র তিনটে চক্কর দিতেই এমন ঝিমঝিম করে উঠল যে সময়মত বিছানায় বসে না পড়লে মেঝেতে পড়ে যেত ও।
পরের দিনটা একটু ভাল কাটল। প্রচুর পুষ্টিকর খাবার আর ঘুম ওর শক্তি আর দম ফিরিয়ে এনেছে কিছুটা। অবসন্ন বোধ করার আগে প্রায় মিনিট পনের ঘরের মধ্যে পায়চারি করল, সে
একটু বেলা করে পিপার মক এল, মুখ থমথমে।
ঝামেলা। ডার্লিংকে আজ সকালে তার দোকানে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পিঠে ছুরি মেরেছিল কেউ।
তাই নাকি! কারোকে সন্দেহ হয়?
মক ওপর-নীচ মাথা ঝাঁকাল, শ্বাস ফেল ক্লান্তভাবে।
আন্দাজ করছি, কিন্তু প্রমাণ নেই। লাইল ক্যানাডা মরেছিল ছুরিতে। এখন ড্রাম ডার্লিং। দুজনেরই একসময় যোগাযোগ ছিল হালামের সাথে। আর হার্ভে স্টেজ তার কোমরের বেল্টে সবসময় একটা ছুরি রাখে। দম নিতে চুপ করল মক। কাল রাতে শহরে ছিল হার্ভে, ডালিংয়ের স্যালুনে মদ খাচ্ছিল।
তার মানে ওকে বাদ দেয়া যায় সন্দেহের তালিকা থেকে। খুনী কখনও ঘটনাস্থলের আশপাশে দেখা দিতে চায় না।
জানি। তবে আমার বিশ্বাস, হার্ভে কাল সন্ধ্যায়ই স্যালুনে বসে ডার্লিংয়ের চলে যাওয়ার খবরটা জেনেছে।
কিন্তু একজন লোক তার ব্যবসা বেচে দিচ্ছে বলেই তাকে খুন করতে হবে কেন? বলল গ্রীন। এটা ঠিক ঢুকছে না আমার মাথায়।
কালই তোমাকে বলেছি ডার্লিংয়ের বিক্রি করার ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। এবং হার্ভে, হালাম আর ওর মাঝে একটা গোপন কিছু আছে। এমন কিছু যেটা ঘটেছে এখানে আসার আগে। এখন ডার্সিং চলে যেতে চাইছিল এখান থেকে। ধরা যাক, হার্ভে ধারণা করে ও পালাবার মতলব করছে। ওর পছন্দ হয়নি সেটা-তাই খুন করেছে।
তোমার অনুমান হয়তো ঠিক, তবে ওদের সম্বন্ধে আমি বেশিকিছু জানি না। ফলে হুট করে একটা মন্তব্য করে বসা উচিত হবে না।
পাগল হয়ে যাব আমি, মক বলল। যাক, এখন আমি যাচ্ছি। কার আসব আবার।
মার্শাল চলে যাবার পর গ্রীন উঠে দাড়ি কামাল। ছোট্ট আয়নায় রক্তশূন্য দেখাল মুখ, তবে খোঁচা খোঁচা জঙ্গল সাফ করে বেশ আরাম বোধ করল ও। তারপর বিছানায় ফিরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ওর দুপুরের খাবার নিয়ে এল মারিয়া। বসে থেকে গ্রীনের খাওয়া দেখল সে, মুখ অন্ধকার।
তুমি তা হলে চলে যাচ্ছ? মানে যখন ঘোড়ায় চড়তে পারবে কোথায় যাবে?
নির্দিষ্ট করে কোন যাওয়ার জায়গা নেই, তবে কথাটা ইদানীং ভাবছি আমি। একটা সময় আসে যখন মানুষের কোথাও সুস্থির হতে হয়, নইলে পানিও পায় না মরার সময়। একবার ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা কাজ করেছিলাম। সমুদ্রের কাছাকাছি, স্যানডিয়েগো নামে ছোট্ট এক শহরে। শহরের পুরে প্রচুর ঘাস মেলে। চমৎকার উপত্যকা, ঝরনা এসব আছে। সীমান্ত থেকে খুব বেশি দূরে না। ভাবছি ওখানে যাব। ঘোড়া পালব, ভাল জাতের। স্যাডল হর্সের দাম বাজারে সবসময়ই চড়া। আপাতত এরকমই ইচ্ছে আমার।
তেমনি মুখ কালো করে গ্রীনের দিকে তাকাল মারিয়া, বলছে না কিছু।
তবে সব পুরুষেরই বউ লাগে। একা থাকা ভাল না, কোন পুরুষই একা একা বাঁচতে পারে না বেশিদিন। তা ছাড়া ঘরদোর সাফ করা, রান্না, ছেলেপুলে মানুষ-এগুলোর জন্যেও মেয়েমানুষ দরকার একজন।
হাহ! বিদ্রুপের স্বরে বলল মারিয়া। তুমি বউ, চাওনা, বাদি চাও।
ওকে অনাবিল হাসি উপহার দিল গ্রীন।
প্রেম, যত্নআত্তি সব পাবে ওই মেয়ে, ঘরের টুকিটাকি কাজে সুন্দর কেটে যাবে সময়।
খুব বেশি কথা বল তুমি।
আমাকে তুমি বিয়ে করবে, মারিয়া? যাবে আমার সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া?
উঠে পড়ল মেয়েটা, আগের মতই নির্বিকার, গ্রীনের কোল থেকে সরিয়ে নিল ট্রে।
তোমাকে বিয়ে করব? একজন গ্রিংগোকে? তুমি একটা বোকা। কোন সাদা চামড়ার মেয়েকে বিয়ে কর, আমাকে এসব বলে লাভ হবে না।
তবে ভুলে যেও না আমি তোমাকে প্রস্তাব দিয়েছি এবং মন থেকে।
ভোলা সোজা। যেমন তুমি ভুলে যাবে আমাকে।
হয়তো পারব না শেষ পর্যন্ত। যাই হোক, কাল আবার আসছ তো?
দোনোমনো করল মারিয়া, মাথা নিচু করে আছে।
কাল না, বলে বেরিয়ে গেল।
পুরানোগুলো বদলে নতুন ব্যান্ডেজ বাঁধতে সন্ধ্যায় ডাক্তার এল। মাথার জখমটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করল সে।
ভাল, খুব ভাল, বিড়বিড় করে বলল ডাক্তার। আজ ছোট পট্টি বাঁধলেও চলবে। একটা দাগ থেকে যাবে, তবে তোমার চুল ঘন, ঢেকে রাখতে পারবে।
টাকমাথা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল গ্রীন।
তোমাকে আমার মাথার কিছু চুল দিতে ইচ্ছে করছে, ডাক্তার। তোমার ফি হিসেবে।
নগদ পেলেই বেশি খুশি হব আমি, ধন্যবাদ। ডিম, মুরগি, গরুর রান এগুলো নিয়েছি। তাই বলে চুল-না। ব্যাগ বন্ধ করে মাথায় হ্যাট চাল ডাক্তার। দিন দুয়েক পরে আবার আসব, যদিও আমার মনে হয় না আমাকে আর লাগবে তোমার। বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে, আশা করা যায়, আর দু-এক হপ্তার মধ্যেই চলাফেরা করতে পারবে তুমি।
ডাক্তার বিদায় নেয়ার পর আরেক দফা ঘুমাল গ্রীন। তারপর হরেকরকমের তরকারি দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে আবার শুয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে পায়জামা পরে ঘরের ভেতর পায়চারি করছে ও এই সময় দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকল পিপার মক। গ্রীনকে দেখে হাসল মার্শাল।
উঠে পড়েছ? সকালের দিকে টেরিলের কাছে গিয়েছিলাম। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল।
বুড়ো খুব ভাল।
স্মিত হাসিল মক, মাথা ঝাঁকাল।
আমি থাকতেই মারিয়া আসে ওখানে। ওর বাকবোর্ড নিতে। ঠাট্টা করার চেষ্টা করেছিলাম। তোমার ব্যাপারে। সাড়া পেলাম না, মেজাজ বিগড়ে ছিল। বাকবোর্ডে মালপত্র চাপিয়ে কোথায় যেন গেল।
চিন্তার ভাঁজ পড়ল গ্রীনের কপালে।
কোথায় যাচ্ছে আন্দাজ পাচ্ছ কিছু?
কারও সাথে দেখা করতে, মনে হয়। শহরের বাইরে অনেক মেক্সিকান পরিবার আছে। সকলেই ওর বন্ধু।
তোমার কথাই হয়তো ঠিক, তবু আমি একটু নিশ্চিত হতে চাই। একটা উপকার কর, আমার ঘোড়াটা নিয়ে এস এখানে।
কী বলছ তুমি, গ্রীন। তোমার কোন কাজে আসবে না ঘোড়া। অন্তত এখনও না। নাকি তুমি আন্দাজ করেছ কোথায় যেতে পারে মারিয়া।
তাই। প্রথম যেদিন ওর ক্যান্টিনায় খেলাম–সেদিন থেকেই মেয়েটার ওপর আমার সন্দেহ। আমি কাপড় পরতে পরতে তুমি নিয়ে এস ঘোড়াটা। এখন আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না।
পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল মক। দেয়াল আলমারি থেকে কাপড় বের করে তৈরি হতে শুরু করল গ্রীন। গানবেল্ট বাঁধছে কোমরে এই সময় আবার ঘুরে উঠল ওর মাথা। খাটের বাজু ধরে পতন ঠেকাল ও, সহজ হতে বলল নিজেকে, টুপি চাপাল। ব্যান্ডেজ থাকায় একটু আঁটসাট হল ওটা। সিঁড়ি বেয়ে গ্রীন যখন একতলায় নেমে গেল, ওকে দেখে চোখ কপালে তুলল হোটেলের কেরানি। লোকটাকে পাত্তা দিল না ও, বারান্দায় গিয়ে ফুসফুস ভরে নিল মুক্ত বাতাসে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘোড়া নিয়ে হাজির হলো মার্শাল মক। স্যাডল থেকে নেমে বলল, আমি আসব?
না, দরকার হবে না। স্ক্যাবার্ড থেকে রাইফেলটা টেনে বের করল গ্রীন, পরখ করে রেখে দিল যথাস্থানে। দোল খেয়ে স্যাভলে চাপল সে, মাথা ঘুরে উঠল আবার। একবার মনে হলো সে হয়তো আলেয়ার পেছনে ছুটছে। তবু নিশ্চিত হতে চাই আমি,আপনমনে ভাবল গ্রীন, তারপর মক্কে ঘাড় কাত করে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল।
.
মারিয়া তার পুরানো বাড়ি, পরিত্যক্ত শীপ র্যাঞ্চে যাচ্ছে, জেমস গ্রীনের কথা ভাবছে ও। কখনও দারুণ আত্মাভিমান জেগে উঠছে ওর মাঝে নিজেকে পরিতৃপ্ত বলে মনে হচ্ছে; আবার পরক্ষণে ভয়ঙ্কর হতাশা ওর মনোবল ভেঙে দিচ্ছে, একলা বোধ করছে ভীষণ।
ওই লোক একটা পুরুষ বটে। বিয়ে করতে চেয়েছে তাকে, বলেছে প্রেম ভালবাসা পাবে সে। উফ! কিন্তু তা কী করে সম্ভব? একজন গ্রিংগোকে বিয়ে করে এই সীমান্ত শহর, তার জন্মস্থান ছেড়ে সে চলে যাবে কীভাবে? ক্যালিফোর্নিয়া হ্রদ, মেসো উপত্যকার কথা বলেছে লোকটা। সে কখনও হ্রদ দেখেনি। অকটিও থেকে বিশ মাইল দূরে, বেলুরাইড ছাড়া অন্য কোথাও জীবনে যায়নি ও। ক্যালিফোর্নিয়াকে মনে হচ্ছে বহুদূরে; যেন পৃথিবীর অপর প্রান্তে। আর কখনও তার দেশ, বন্ধুদের দেখতে পাবে না সে। তারপর ক্যান্টিনাটা আছে। ওটা গড়ে তোলার জন্য দারুণ পরিশ্রম করেছে ও। শুরুতে কোন বার ছিল না, শুধু ঘরে তৈরি স্মোকড টর্টিলা বিক্রি করত। ধীরে ধীরে তার টর্টিলার সুখ্যাতি বাড়ে, তারপর গ্রিংগোরাও খেতে আসতে শুরু করে।
এরপর থেকে ভালভাবেই চলছে সব। তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে, শহরের মেক্সিক্যান প্রান্তের বাসিন্দারা সম্মান করে তাকে। চারপাশের ভয়াল অথচ সুন্দর মরুভূমির দিকে তাকাল মারিয়া। এই বুনো দেশ তার জন্মস্থান। একজন গ্রিংগো, যে তাকে সম্পূর্ণ অজানা অচেনা এক দেশে নিয়ে যেতে চায়, তাকে বিয়ে করার জন্য এর মায়া সে ত্যাগ করবে কীভাবে?
নিজের শরীরে গ্রীনের ছোঁয়া, তার শক্তিশালী দুই বাহুর কথা, ভাবল ও, দুর্বল বোধ করল।
অদূরে জরাজীর্ণ শীপ র্যাঞ্চটা চোখে পড়তে হাঁপ ছাড়ল মারিয়া, সতর্ক হয়ে উঠল ওদিকে এগোবার সময় ঝরনার পানে তাকাল ও, দেখল উইলো বন থেকে বেরিয়ে এসে ওর উদ্দেশে হাত নাড়ছে কার্ল। সেও জবাব দিল হাত নেড়ে, ঘোড়া ঘুরিয়ে বাড়ির একপাশে বাকবোর্ড থামাল।
বাকবোর্ডের পাটাতন থেকে মালপত্র তুলে নিল মারিয়া, বাসায় ঢুকল। স্টোভ জ্বেলে কফির পানি ছড়াচ্ছে এই সময় কার্ল হাজির হলো দোরগোড়ায়, হাসছে ম্লান মুখে।
গত কদিনে বদলে গেছে ছেলেটা, মারিয়া ভাবল। ডিউক রিপ খুন হবার পর এ পর্যন্ত মাত্র একবারই ওর সাথে দেখা করেছে সে। ডিউকের মৃত্যুতে দারুণ আঘাত পেয়েছে কার্ল; তবে গ্রীন আততায়ীকে মারতে সমর্থ হয়েছে শুনে শোক প্রশমিত, হয়েছে কিছুটা।
কার্লের উদ্দেশে হাসল মারি! বলল, আজ তুমি গরম খাবার খাবে! ফ্রিওলস আর টর্টিলা। এবং কফি।
স্মিত হাসল কার্ল, পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে গেল আবার। বলল, অনেক ভাবনাচিন্তা করলাম। মনস্থির করে ফেলেছি এখন। খাওয়া-দাওয়া সেরেই বাসায় ফিরে গিয়ে বাবাকে বলব, আমি ধরা দিচ্ছি পুলিসের কাছে।
সঙ্গে আনা তাওয়াটা বের করছিল মারিয়া, ঝট করে ঘুরল কার্লের দিকে দৃষ্টিতে ক্রোধ।
বোকার মত কথা বল না। ডাকাতির সঙ্গে তুমি জড়িত ছিলে তার কোন প্রমাণ নেই। এখন তুমি নিরাপদ-মুক্ত। কেন শুধু শুধু ধরা দিয়ে বিপদ বাড়াবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কার্ল। প্রথমত, অন্যায় করেছি। দুই, আমার দোষেই হয়েছে সব। বন্ধুরা মারা গেছে, তারপর আছে স্টেজের সেই নিরীহ যাত্রী। সবাই তাদের জীবন দিয়ে সাজা ভোগ করেছে। আমি কেন বাদ যাব? বুঝতে পারছ না, ভীষণ অন্যায় হবে এটা করা?
ছেলেটার অকপট আগ্রহে মারিয়ার দৃষ্টি নরম হয়ে এল।
প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছ। তাই না?
অনেকটা তাই, মুখ নিচু করল কার্ল। এভাবে বাঁচতে পারব না আমি। কিছু একটা সুরাহা না করলে সারাটা জীবন জ্বলে-পুড়ে মরব
সি। বুঝতে পারছি। কিন্তু সেজন্য তোমার বাবার সাথে দেখা করবে কেন? তাকে বলার কী দরকার?
জানি না, তবে হয়তো এটা আমার অহঙ্কার। জানোই তো, বাবাকে সবসময় ভয় করতাম আমি, কিন্তু আর না। সেটাই প্রমাণ করতে চাই তার কাছে।
হ্যাঁ, তোমার সিদ্ধান্তই ঠিক। সি, যাবে তুমি।
তুমি খাওয়া গরম কর, এই ফাঁকে আমি আমার ঘোড়া নিয়ে আসছি, বলে বাইরে বেরিয়ে গেল কার্ল। দরজায় গিয়ে দাঁড়াল মারিয়া, দেখল দৃঢ় পদক্ষেপে ছেলেটা এগিয়ে যাচ্ছে ঝরনার দিকে, সংকল্পের ছাপ ওর চলাফেরায়।
উল্টো দিকের ঢালে দাঁড়ানো ঘোড়াসওয়ারকে লক্ষ করল না মারিয়া। কার্লকে দেখছিল লোকটা।
১৪.
কার্লও দেখেনি ওই অশ্বারোহীকে।
ঝরনার পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা গুহামুখের কাছে গেল সে, ওর ঘোড়াটা বাধা আছে ওখানে। বাহনের পিঠে জিন চাপাচ্ছে কাল এমন সময় পেছন থেকে একটা রুক্ষ, ক্রুদ্ধ গলা বলে উঠল, ঠিকই ভেবেছিলাম, তোমাকে পাব এখানে। এর আগেও একবার খুঁজেছি, তারপর আর আসিনি। আজ ওই মেক্স ছুঁড়িটাকে দেখেই বুঝেছি বাগে পাব তোমাকে।
ধীরে ধীরে সোজা হলো কার্ল, বিতৃষ্ণায় বেঁকে গেছে ঠোঁট।
তা হলে তুমি আমাকে খুঁজছ, হার্ভে?
আলবত! ওই মেক্স মেয়েটাকে কী বলেছ তুমি?
চাপা গলায় বিদ্রুপের হাসি হাসল কার্ল।
আচ্ছা, তবে এজন্যই ভয় পাচ্ছ তুমি মাতাল অবস্থায় পোর্ক বসে লিউ য়া বলেছে আমাকে। তারপর কী ঘটেছে ওর কপালে? কোথায় ওকে পুঁতে ফেলেছ তুমি? ভয় পাচ্ছ, আমি ফাঁস করে দেব সব?
কঠিন চোখে তাকাল হার্ভে স্টেজ, সমস্ত রক্ত জমা হয়েছে মুখে। আমার সঙ্গে তামাশা কর না, বাছা কর্কশ গলায় বলল। তোমার বাবার হুকুম শুনছি, কিন্তু তাই বলে একটা দুধের বাচ্চার ঠাট্টা সহ্য করব না। এমনিতেও তোমাকে আমি পছন্দ করি না-ভেজা বেড়ালের মত ছোঁক-ছোঁক করে বেড়াও সবসময়।
তুমি কখনোই কারোকে পছন্দ কর না, হার্ভে। সেজন্যই কেউ তোমাকে দেখতে পারে না। আর পারবেই-বা কেন-।
চোপ। কার সাথে কথা বলছিলে তুমি? কজনকে বলেছ এ পর্যন্ত?
নিঃশব্দে হাসল কার্ল, নিজেকে এখন অসীম ক্ষমতাবান মনে হচ্ছে ওর।
কেন, হার্ভে, বলিনি কারোকে… এখনও। ইচ্ছে করেই তুলে রেখেছি ভবিষ্যতের জন্য, তুমি ঘামতে থাকবে, মনে হবে এই বুঝি লোকজন ফাঁসি দেয়ার জন্য তোমাকে ধরতে আসছে।
কার্ল আবার হাসল, হার্ভের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। না, বলবে না তুমি! খেঁকিয়ে উঠল সে, পিস্তল বের করল।
মুহূর্তে বোবা হয়ে গেল কার্ল। আজন্ম এই লোককে চেনে সে; বন্ধুত্ব না থাকলেও, কল্পনা করতে পারেনি হার্ভে কখনও বন্দুক ধরবে তার দিকে। তবু ওর মনে হলো, হার্ভে হয়তো নিছক চোখ রাঙাচ্ছে, তাই নিজের পিস্তল বের করার কোন চেষ্টাই সে করল না।
খেলনাটা রেখে দাও, হার্ভে, বলল ও। আমাকে তুমি গুলি করতে পারবে না।
ছোটখাট কামান-সদৃশ পিস্তলটা কেঁপে উঠল হার্ভের হাতে, ভোতা ফ্যাকাসে হয়ে গেল ওর দৃষ্টি। ট্রিগার টিপল সে।
পিস্তলের গর্জন প্রতিধ্বনি তুলল রোদেলা মরুভূমিতে।
বিস্ফারিত হয়ে গেল কার্লের চোখ, টলতে টলতে দুকদম আগে বাড়ল সে, রক্তে ভিজে যাচ্ছে শার্ট। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, আমি মারা যাচ্ছি।
তারপর ভাঁজ হয়ে গেল ওর হাঁটু, মুখ থুবড়ে পড়ল ধুলোয়।
.
লম্বা একটা কাঠের হাতা দিয়ে টর্টিলা নাড়ছিল মারিয়া গুলির শব্দে আপনাআপনি স্থির হয়ে গেল হাত, তারপর তাওয়া নামিয়ে রেখে দৌড়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
উদ্বিগ্ন চোখে ঝরনার দিকে তাকাল ও, তারপর ছুটল ওই পথে মাঝামাঝি দূরত্বে পৌঁছে গেছে এমন সময় দেখতে পেল অশ্বারোহীকে।
একনজরেই হার্ভে স্টেজকে চিনতে পারল সে, ঘৃণিত লোকটাকে দেখতে পেয়ে ছোটার গতি কমাল।
পরমুহূর্তে একটা ভয়ের স্রোত বয়ে গেল মারিয়ার শরীরে, ঘোড়াসওয়ার তার উদ্দেশে ছুটে আসছে, চাপা দিতে চাইছে।
ঝট করে একপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ল মারিয়া, ঘোড়ার তপ্ত নিশ্বাস লাগল গায়ে। ধুলোর মেঘের ভেতর দিয়ে হার্ভে স্টেজের হিংস্র মুখখানা দেখতে পেল সে, ওর হাতের পিস্তলটা সরাসরি তার পানেই চেয়ে আছে।
গর্জে উঠল পিস্তল, বুলেট লাগার আশঙ্কায় বুকফাটা চিৎকার করে গড়ান দিয়ে সরে গেল, মারিয়া। তবু, ঠিক ওই মুহূর্তে উপলব্ধি করল সে স্টেজ গুলি করেছে কার্লকে, এবং এখন তাকে, একমাত্র সাক্ষীকে খুন করতে চাইছে।
একশো ফুট দুরে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরল হার্ভে, ক্রুদ্ধ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, এবার তোকে আমি শেষ করবু, মেক্সিক্যান কুত্তী।
আবার উঠে পড়েছে মারিয়া, কাপড়চোপড়, মুখ, আর চুল ধুলোয় মাখামাখি, দাঁড়িয়ে আছে ঈষৎ উবু হয়ে, আগুন ঝরছে দুচোখ থেকে। ওর উদ্দেশে ঘোড়া দাবড়াল হার্ভে।
মেয়েটার ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে সে এমন সময় দুবার গর্জে উঠল একটা রাইফেল। মাথার ওপর বুলেটের হিংস্র গুঞ্জন শুনতে পেল মারিয়া। হার্ভে স্টেজের গায়ে লাগেনি ওগুলো, তবে দৌড় থামিয়ে বাউলি কেটে একপাশে সরে যেতে বাধ্য করেছে তাকে। যেদিক থেকে এসেছিল গুলি এখন সেদিকে তাকিয়ে আছে স্টেজ।
মারিয়াও তাকিয়েছিল ওইদিকে, তারপর গ্রীনের ধাবমান বিশালকায় স্টীলডাস্টকে যখন চিনতে পারল মনে মনে বলল, খোদা মেহেরবান।
জেমস গ্রীন যখন পয়লা গুলির আওয়াজ শুনতে পায় তখনও সে শীপ র্যাঞ্চ থেকে বেশ দূরে ছিল। ঝড়ের বেগে খাড়াইয়ের মাথায় ছুটে আসে ও, দেখে হার্ভে স্টেজ মারিয়াকে ঘোড়ার পায়ের তলায় পিষে মারার চেষ্টা করছে। ক্রোধ জেগে উঠল ওর মাঝে, বুট থেকে বের করল রাইফেল। তখনও দুশো গজ দূরে রয়েছে গ্রীন, হঠাৎ হার্ভেকে আবার ধেয়ে যেতে দেখে বুঝল, আর অপেক্ষা করা চলবে না। কড়া রোদে ছোটাছুটি করায় এমনিতেই মাথা ঝিমঝিম করছিল ওর, তার ওপর ধীরে-সুস্থে নিশানা করার সময় ছিল না। বাঁ হাতে লাগাম আর ডান হাতে পিস্তলের ঢঙে রাইফে ধরে গুলি করল সে-তারপর আরেকটা কার্তুজ চেম্বারে পাঠিয়ে আবার ট্রিগার টিপল।
তাড়া করে স্টেজকে ধরতে চেষ্টা করল ও, কিন্তু আচমকা ডানে মোড় নিল অ্যাংকর ফোরম্যান, দ্রুতগতিতে ছুটল দূরের ঢাল বরাবর, নুয়ে পড়েছে স্যাভলে।
গ্রীন ধাওয়া করল ওকে, ঘোড়ার পেটে অনবরত স্পার বসাচ্ছে, তারপর মারিয়ার কথা স্মরণ হতে রাশ টানল। যত্নের সঙ্গে লক্ষ্যস্থির করে তৃতীয়বার গুলি ছুড়ল সে। কিন্তু চোখ ধাঁধানো কমলা-হলুদ আলোয় নিশানা নড়ে গেল, ট্রিগার টানার সময়েই গ্রীন বুঝতে পেরেছিল এবারও ফসকে যাবে তার গুলি তারপর খাজের ওপাশে, অদৃশ্য হলো হার্ভে স্টেজ।
পরে ধরলেও চলবে একে, সখেদে ভাবল গ্রীন।
ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল সে, লক্ষ করল ঝরনা-সংলগ্ন উইলো ঝোপের পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে মারিয়া। ওকে অনুসরণ করল গ্রীন, মিনিট কয়েক পর দেখল একহারা গড়নের এক যুবকের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে ও মুখ তুলল মারিয়া, তামাটে ত্বকের নীচে আশ্চর্যরকমের ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে ওকে। চোখ দুটো বিস্ফারিত, ছলছলে।
দোল খেয়ে মাটিতে নেমে ওর কাছে হেঁটে গেল গ্রীন।
কার্ল? জিজ্ঞেস করল সে।
অসাড় ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা।
মারা গেছে?
বোধহয়
এক হাঁটুতে বসে নাড়ি দেখল গ্রীন। পেল না। এবার কার্লের পাতলা চিবুকের নীচে বুড়ো আঙুল, ঠেসে ধরুল সে। অনুভব করল খুব দ্রুতলয়ে অথচ দুর্বল সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। উঠে দাঁড়াল গ্রীন।
বেঁচে আছে এখনও। বাসায় নিয়ে যেতে হবে! আমি পারব বইতে, কিন্তু মারাত্মক ঝাঁকুনি লাগতে পারে। আমাদের আসলে এখন দরকার একটা স্ট্রেচার। বাশ-টাশ কিছু আছে বাড়িতে?
আছে, কোরালের।
চলবে, তুমি এখানেই থাক।
ফের স্যাডলে চেপে জোরকদমে বাড়ির দিকে ছুটল গ্রীন। একটু বাদে দুটো সরু খুঁটি আর একটা কম্বল নিয়ে ফিরে এল সে। দেখল মারিয়া তার পেটিকোটের একটা প্রান্ত ছিড়ে সেটা ভিজিয়ে কার্লের মুখ মুছে দিচেছ।
দৃক্ষহাতে কম্বলটা দুভাঁজ করল গ্রীন, প্রত্যেক কোণে ছুরি দিয়ে চিরে ফেলল খানিকটা অংশ, ফুটোগুলোর ভেতর সাবধানে ঢুকিয়ে দিল খুঁটি দুটো। ও আর মারিয়া ধরাধরি করে কার্লকে আলতোভাবে শোয়াল কম্বলের ওপর। তারপর চলনসই স্ট্রেচারটা দুজনে মিলে তুলে নিয়ে বাসার পথ ধরল। কার্লের ওজন বেশি না, ফলে কষ্ট হচ্ছে না তেমন।
বাসায় পৌঁছে কার্লকে একটা বাংকে শুইয়ে দিল ওরা। গ্রীন আড়মোড়া ভাঙল।
ওকে বাকবোর্ডে করে নেয়া যায় শহরে, তবে মনে হয় না ধকল সইতে পারবে। তার চেয়ে আমি বরং ডাক্তার ডাকতে যাই। একটু ইতস্তত করল সে, তারপর বলল, দাঁড়াও।
ঝরনার পাড় থেকে নিজের ঘোড়াটা আনতে ছুটে বেরিয়ে গেল গ্রীন। ও ফিরে আসতে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল মারিয়া। গ্রীন বুট থেকে রাইফেলটা বের করে দিল ওর হাতে। এটা, ও যদি ফিরে আসে তার জন্য। এলে, আশা করি সোজা গুলি ছুঁড়তে পারবে তুমি।
গ্রীনের দিকে তাকাল মারিয়া, রাইফেল ধরে আছে, চকচক করছে চোখ।
তোমার বিছানায় থাকার কথা। তবু এসেছ তুমি? কেন?
শুনলাম বাকবোর্ড নিয়ে বেরিয়েছ, আমার সন্দেহ হলো কার্লের সঙ্গে দেখা করতে আসতে পার তুমি।
হাত বাড়াল মারিয়া, দুম করে একটা কিল বসাল গ্রীনের উরুতে।
বোকা গ্রিংগো। এখন কেমন আছ?
খুব খারাপ, গ্রীন হাসল, রওনা হয়ে গেল মারিয়ার চুলে একবার বিলি কেটে, ভাবছে মিথ্যে কথা বলেনি সে। আসলেও খারাপ লাগছে ওর, দুর্বল অবসন্ন বোধ। করছে। তবে, ও জানে, আস্তে আস্তে কেটে যাবে এটা। শহরে ঢোকার সময় গ্রীন কামনা করল ডাক্তারকে যেন তার চেম্বারেই পাওয়া যায়। জরুরি তলবে বাইরে কোথাও গিয়ে থাকলেই বিপত্তি।
.
চেম্বারে ঢুকে হাঁপ ছাড়ল গ্রীন। ডেস্কে বসে প্রেসক্রিপশন লিখছিল ডাক্তার, ফ্যালফ্যাল করে তাকাল ওর দিকে, অবাক হয়েছে।
বিছানা ছেড়ে উঠেছ কেন? কমপক্ষে আরও তিন দিন তোমার শুয়ে থাকা উচিত।
ও কিছু না ডক।
সংক্ষেপে এবং দ্রুত ডাক্তারকে বলল গ্রীন কী ঘটেছে। ওর বক্তব্য শেষ হবার আগেই তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিল ডাক্তার। গ্রীন তাকাল তার দিকে।
বাড়িটা চেন?
অবশ্যই। মিস্টার গার্সিয়া মারা যাবার আগে কতবার দেখতে গেছি। মরতে অনেক সময় লেগেছিল বেচাররি। যাই হোক, এবার তুমি বিছানায় ফিরে যাও, নইলে এরপর আবার তোমাকে নিয়ে টানাটানি হবে।
যাব, ডাক্তার। তোমাকে ঘোড়া, বা বাকলোর্ড কিছু একটা এনে দেব?
লাগবে না, বাসার পেছনে আমার নিজেরই ছোট একটা আস্তাবল আছে। লোক রেখেছি, ওকে বললে ও-ই দেবে এনে। তুমি এখন বিছানায় যাও।
গুড লা ডক।
রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরে গেল গ্রীন। সরাসরি খাবার ঘরে ঢুকল ও। এখনও সন্ধ্যে হয়নি, জনা দু-তিনেক খদ্দের আছে মোটে। ওয়েট্রেস আসতে দিনের স্পেশাল মেনু, বিফ স্টয়ের ফরমার্স দিল সে। সবিস্ময়ে লক্ষ করল গ্রীন, যা ভেবেছিল তার বেশি খিদে পেয়েছিল ওর, অনায়াসে দুই বাটি স্টু আর দুকাপ কফি সাবাড় করল। খাওয়া সেরে সোজা রাস্তায় পিপার মকের দফতরে গেল ও, দেখল জানালা দিয়ে-আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে মার্শাল।
স্বীকার করছি বিছানা থেকে ওঠা উচিত হয়নি আমার, মার্শাল মুখ খুলতে পারার আগেই বলল গ্রীন। আমি
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে মাপছিল মক।
তোমার মাথা ঠিক আছে তো? সকালে আমি ঘোড়া এনে দিয়েছিলাম তোমাকে, মনে নেই?
সিলিংয়ের পানে তাকাল গ্রীন, ধীরে ধীরে মাথা নাড়াল।
ঠিক আছে, পয়লা জিত তোমার, মার্শাল। তবে এবার মন দিয়ে শোনো।
শীপ র্যাঞ্চের ঘটনা ওকে জানাল গ্রীন, বলল ডাক্তার রওনা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
মক উঠে দাঁড়াল, পাতলা ঠোঁটজোড়া পরস্পর চেপে বসেছে।
এবার তা হলে আমাকে খেলা শুরু করতে হয়, টুপি পরতে পরতে বলল ও। খোদা জানে, তুমি এমনিতেই অনেক করেছ।
ওটাই আমার দায়িত্ব, বলল গ্রীন, বিরক্ত হয়েছে। তুমি বাথানে যাচ্ছ?
হার্ভে ওখানেই যাবে, আমার ধারণা।
মারিয়া, আমি দুজনেই দেখে ফেলেছি ওকে, পালাবার চেষ্টা করাই স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক। বাথানে গেলেই বুঝতে পারব।
নিশ্চয়ই। আমি গার্সিয়াদের র্যাঞ্চে ফিরে যাচ্ছি। জানা দরকার কেমন আছে ছেলেটা।
হলদেটে চোখ দুটো পিটপিট করে গ্রীনকে জরিপ করল মার্শাল। অসন্তুষ্ট গলায় বলল, বেঁচে গেলে নিশ্চয় ওকে টাওসে ধরে নিয়ে যাবে তুমি-আর ওরাও হয়তো ফাঁসি দেবে ওকে।
পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বের করল মক, ডেস্কের পেছনের দেয়াল ঘেঁষে রাখা ক্যাবিনেট খুলে রাইফেল বের করে নিল একটা। ওটা পরখ করল সে, একটা বাক্স থেকে একমুঠো কার্তুজ নিয়ে কোটের সাইড পকেটে রাখল। তারপর বন্ধ করল ক্যাবিনেট, ক্লান্ত দেখাচ্ছে, মাত্র এই ক’মিনিটেই যেন বয়স বেড়ে গেছে কয়েক বছর।
সহজ হবার চেষ্টা কর, পরামর্শ দিল গ্রীন, রূঢ় স্বরে।
এই দায়িত্বটা নেয়ার পর থেকে আমি সহজভাবেই নিচ্ছি সবকিছু, কিন্তু এবার টাকাটা হালাল করা দরকার। তারপর বেরোবার মুখে গ্রীনের উদ্দেশে ঝাঝের সঙ্গে বলল, তুমি চেষ্টা কর সহজ হতে।
পেছন থেকে ওর পানে তাকিয়ে রইল গ্রীন; ধীরপায়ে টেরিলের আস্তাবলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে মার্শাল, হাতে রাইফেল, গায়ে একটা কালো কোট,তারপর ও চোখের আড়াল হতে স্টীলডাস্টে চেপে শীপ র্যাঞ্চে পথ ধরল সে।
১৫.
হিংস্র মেজাজে অ্যাংকর ইয়ার্ডে প্রবেশ করল হার্ভে স্টেজ। স্যাডল থেকে নেমে হিচ রেইলে লাগাম বাঁধল ও, দুমদুম করে পা ফেলে অফিস-ঘরের দিকে এগোল। খোলাই ছিল দরজা, ভেতরে ঢুকে হার্ভে দেখল হালাম তার পুরু গদি আঁটা চেয়ারে ডুবে আছে, পাশেই মেঝের ওপর পড়ে আছে একটা আধখালি বোতল। দুদিন হলো দাড়ি কামায়নি হালাম, মুখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে, ফোলা-ফোলা। ড্রাম ডার্লিংয়ের সঙ্গে ওদের সাক্ষাতের পর ফিরে এসে আর বেরোয়নি সে, র্যাঞ্চে বসে মদ খেয়েছে সারাক্ষণ। নিশ্চিত না হলেও, হার্ভে অনুমান করতে পারে এর কারণ-তবে এখন সে পরোয়া করে না কোনকিছুর।
বার দুই-তিনেক পিটপিট করে চোখের পাতা মেলল হালাম, ভুরু কোঁচকাল, সোজা হয়ে বসল চেয়ারে। মেঝে থেকে বোতলটা তুলে নিল সে, ছিপি খুলে ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিল খানিকটা তরল পদার্থ। তারপর একটা চেঁকুর তুলে বলল, ড্রামকে খুন করেছ তুমি। কেন?
ড্রাম মারা গেছে জানলে কীভাবে? হার্ভে সন্দিগ্ধ।
শহর থেকে সকালে একজন কাউহ্যান্ড ফিরেছে। শুনেই বুঝেছি কার কাজ। কেন খুন কুরতে গেলে ওকে?
মুখ বিকৃত করল হার্ভে, কোমরে গোঁজা ছুরির বাঁটটা চেপে ধরল।
ড্রাম সব বেচে দিয়ে পালাচ্ছিল দেশ ছেড়ে, গরগর করে উঠল হার্ভে। স্যালুনে খবরটা পাই আমি। দোকানের পেছন দিকে গিয়ে দরজা খোলাই ওকে ডেকে। তারপর কথা বলি। জ্বলজ্বল করছে ফোরম্যানের চোখ, ক্রুর ভঙ্গিতে বেঁকে আছে ঠোঁট। বলল ভাল দাম পাচ্ছে, বিক্রি করবে না কেন। এমনিতেও লোকটাকে দেখতে পারতাম না, দিয়েছি শেষ করে।
বিরক্তি প্রকাশ করল হালাম। মদ খেল আরেক ডোক। ওর কার্যকলাপ লক্ষ করছে হার্ভে, ভাবছে দিনের এই সময় কখনও এত মদ খেত না অ্যাংকর মালিক।
গ্রীনের খবর কিছু জানো? রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করল হালাম।
ওর দৃষ্টি এড়িয়ে গেল হার্ভে।
তুমি জানো সবই, ক্ষিপ্ত সুরে জবাব দিল সে। স্যাম ট্যানারকে খুন করেছে, ওর মাথায় আর কোমরে চোট লেগেছে। আমি যদ্দুর জানি, হোটেলের বিছানায় এখনও শুয়ে আছে ও।
আমি আশা করেছিলাম তুমি ওর মরার খবর দেবে, ম্লান গলায় বলল হালাম। এখানে এসেছিল সে, ফ্লিন্টকে খুন করে, ভার্জিল রীডের স্যালুন ভাঙচুর করেছে।
তারপর আমি যখন ওই মেক্স ছুকরির ক্যান্টিনায় গেলাম ও শাসাল আমাকে। হ্যাঁ, ওখানেও ছিল গ্রীন, মেয়েটার পাশেই দাড়িয়েছিল। আর সবশেষে স্যাম ট্যানারকে মারল–দেশের সেরা পিস্তলবাজদের একজন ছিল স্যাম। হারামির ভাগ্যটাই দারুণ। অ্যামবুশ না করে, স্যামের উচিত ছিল খোলা জায়গায় ওকে আক্রমণ করা।
নাক চুলকাল হার্ভে। ফ্রেডের বিচলিত হবার কারণ এখন বুঝতে পারছে সে। জেমস গ্রীন, এখানে আসার পর থেকেই লোকটা বারবার টেক্কা মারছে ওর ওপর। চুলোয় যাক ফ্রেড, ভাবল স্টেজ। এক পা এগিয়ে এল সে, বলল, ড্রামকে খুন করার দায়ে, মক, আমার পিছু নিয়েছে। সিন্দুকে যা আছে আপাতত তাই দাও আমাকে, কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকব কোথাও।
চোখ পিটপিট করল হালাম। বলল, কী?
আমার কথা শুনতে পেয়েছ তুমি। খেঁকিয়ে উঠল হার্ভে। এই র্যাঞ্চের অর্ধেক শেয়ার আমার। কিন্তু এখন সিন্দুকে যা আছে তাই দাও।
পাগল, এখানে তোমাকে আমার দরকার। হপ্তাখানেকের মধ্যে গরুবাছুরের খোঁজ নিতে যায়নি কেউই। কার্টার মন্দ না, কিন্তু কোনওরকম ঝামেলা হলে কতটা কি সামলাতে পারবে আমি জানি না।
কার্টার সামলাতে পারবে না এমন ঝামেলা হবে না, জবাব দিল হার্ভে, মনে মনে পুলকিত হয়েছে কারণ জীবনে এই প্রথম ফ্রেড তার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করল। দেখল আবার মদ খাচ্ছে হালাম। একটা সুস্থ-সবল আত্মবিশ্বাসী মানুষ কত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেতে পারে ভেবে অবাক হলো হার্ভে। হয়তো গ্রীন সম্পূর্ণ দায়ী নয় এর জন্য হয়তো বাপের ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ছেলেটা যা করেছে, স্টেজ ডাকাতি, সেটাই শেষপর্যন্ত কুরে কুরে খাচ্ছে ওকে। ভেতরে ভেতরে হালামের প্রতি করুণা বোধ করল হার্ভে।
টাকাটা আমার দরকার, এবং এক্ষুণি! কর্কশ গলায় বলল সে। সঙ্গে নেয়ার মত কিছু মালপত্র গোছাতে যাচ্ছি এই ফাঁকে টাকাটা তুমি বের করে রাখ।
হাজারখানেকের বেশি হবে না, বড়জোর।
চলবে, বলে বেরিয়ে গেল হার্ভে, ক্যারেজ হাউসে এর ঘরের দিকে যাচ্ছে।
পেছন থেকে ওকে একটুক্ষণ লক্ষ করল হালাম। তারপর আবার ভুরু কেঁচকাল সে, দাড়িতে হাত ঘষল জোরে জোরে, ভাবল আজই কেটে ফেলতে হবে। অতীতে মাঝে-মধ্যে মাতাল হয়েছে ও, তবে একেবারে ভিন্ন কারণে, একঘেয়েমি দূর করতে কিংবা হয়তো দুর্বিষহ ঠেকেছিল জীবন। উঠে সিন্দুক খুলতে গেল সে; টিনের ক্যাশবাক্সের ওপর থেকে ৪৫ কোল্টটা তুলে নিল হালাম, তারপর সিন্দুকের ভারি ডালা বন্ধ করে বাক্সসমেত ফিরে এল নিজের ডেস্কে।
টাকার তোড়াগুলোর দিকে তাকাল ও, কিন্তু গুনতে ইচ্ছে হলো না। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে এক ঢোক মদ খেল হালাম, উপলব্ধি করছে হার্ভে চলে গেলে তার অপূরণীয় ক্ষতি হবে। জাহান্নামে যাক। ও ফিরে আসবে আবার, আসতে হবে, হালাম ভাবল। চিরকাল হার্ভে নীরবে আর সমস্ত হুকুম, এমনকী মানুষ খুন পর্যন্ত করে আসছে বলে ওর প্রতি একধরনের করুণা বোধ করে সে। বেশির ভাগ মানুষের মত, ওর জন্ম হয়েছে ব্যবহৃত হতে; খুব কমসংখ্যক লোকই আছে, যেমন সে নিজে হালাম ভাবল, যারা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবার যোগ্যতা রাখে।
নিদারুণ তাচ্ছিল্যের সাথে হালাম তার ছেলের কথা ভাবল। ছেলেটা সবসময় তার বিরক্তির কারণ ঘটিয়েছে, ওর উপস্থিতি অসহিষ্ণু করে তুলত তাকে। ও কোথায় আছে হালাম জানে না, জানার আগ্রহও নেই, যদিও ওর ঘোড়াটা পাওয়া যাচ্ছে না শুনে বুঝেছে কার্ল এসেছিল বাসায়।
বোতলটা শেষ করল হালাম, তারপর ঘরের কোণে অন্যান্য খালি বোতলের সঙ্গে ওটা রেখে দিয়ে নতুন আরেকটা বের করল লিকার কেবিনেট থেকে।
ওটা থেকে এক ঢোক খাবে সে এমন সময় ডেস্কের পাশের খোলা জানালা দিয়ে দুজন মানুষের কথাবার্তা শুনতে পেল।
পর্দাটা একপাশে সরল হালাম, ফোরম্যানের সঙ্গে আলাপরত অশ্বারোহীকে দেখল ভাল করে, বুঝল এটা মার্শাল পিপার মক।
মাথা সাফ করার জন্য এপাশ-ওপাশ নাড়াল সে, কান খাড়া করল।
হার্ভে বলছিল, …মিথ্যেকথা।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মক। তুমি ওকে গুলি করেছ, হার্ভে। মারিয়া গার্সিয়াকেও মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলে। গ্রীন উপস্থিত না হলে, ঠিকই খুন করতে। এখন তোমাকে গ্রেফতার করতে এসেছি আমি।
বললাম তো, মিথ্যে বলছে ওরা!
এসব বলে তুমি বাঁচতে পারবে না, হার্ভে। আমার কাছে প্রমাণ নেই, কিন্তু জানি ডার্লিংকেও তুমিই খুন করেছ। লাইল ক্যানাডাকেও। তবে কার্লকে গুলি করার ব্যাপারটা প্রমাণ করটে পারব আমরা। ও যদি মারা যায় ফাঁসি হবে তোমার। আমি যতটুকু জানি বাচার আশা কম। এবার তোমার গানবেল্টটা খুলে
বজ্রাহতের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল হালাম। তার ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে, হার্ভে বেঈমানি করেছে এই খবর দুটো ওর ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে দারুণভাবে।
নিশিতে পাওয়া মানুষের মত সিন্দুকের কাছে এগিয়ে গেল সে, ঝট করে ডালা তুলে পিস্তলটা বের করে নিল।
পিঠের কাছে রেখে বাইরে বেরোল সে, বাসার কোনা ঘুরে এসে থামল।
…চেষ্টা কর না, বলছে হার্ভে ঈষৎ বাঁকা হয়ে আছে সে, ডান হাতটা ঝুলছে পিস্তলের বাঁটের ওপর। তুমি ড্র করার আগেই তোমাকে খুন করতে পারব আমি। বিশ্বাস না হয়, নিতে পার ঝুঁকি
হার্ভের ঘাড়ের পাশ দিয়ে সামনে তাকাল মক, দেখতে পেল হালামকে, কিছু বলল না।
হার্ভে, ডাকল হালাম।
ওর কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে আড়ষ্ট হয়ে গেল হার্ভে।
কী? বলল সে।
এদিকে ফের, হার্ভে।
হার্ভে ফিরল না-পাঁই করে ঘুরে গেল লাটিমের মত, এবং সেইসঙ্গে ঝাঁপ দিল একপাশে, হাত চলে গেছে পিস্তলে।
কোন লাভ হলো না। হালামের পয়লা গুলি ওর কাঁধে বিঁধল, হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল সে। দ্বিতীয়টা ঢুকল পেটে, তিন নম্বর ওর বুকের খাঁচা খুঁড়িয়ে দিল।
হাঁটুতে ভর দিয়ে ওঠার প্রয়াস পেল হার্ভে, মুখ থুবড়ে পড়ল।
হালাম তার পিস্তল ফেলে দিল, হাঁটু গেড়ে বসল হার্ভের পাশে, চিত করে ওর মরা মুখে চড় মারল। মকের দিকে চোখ তুলে তাকাল অ্যাংকর মালিক, ওর চেহারায় যন্ত্রণার আভাস দেখে বিস্মিত হলো মার্শাল।
নিপাত যাক, হারামজাদা, নিপাত যাক, কর্কশ কন্ঠে বলল হালাম।
কী লাভ বলে। মারা গেছে ও, বলল মার্শাল।
আমি হার্ভের কথা বলছি না, বোকা গাধা কোথাকার! বলছি গ্রীনের কথা। ওই সব নষ্টের গোড়া, না হলে সব ঠিক করে ফেলতাম আমরা। কিন্তু বেজন্মটা এসেই ভণ্ডুল করে দিল।
একটা বিশেষ কাজেই এখানে এসেছে ও, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল মক।
কাজ! ও এমনকী পুলিসের লোকও না। ওর মত লোক দরকার নেই আমাদের।
মুখ খুলতে গিয়েও আবার বন্ধ করল মক। বলল না কিছু।
বেজন্মা, হালাম খিস্তি-করল।
আমার বিশ্বাস, এবার তুমি ছেলের কথা জানতে চাইবে, বলল, মক। জানালা থেকে আমার কথা শুনতে পেয়েই হার্ভেকে খুন করেছ তুমি, তাই না?
না।
অ, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল মক টুপি নাচিয়ে মাথা চুলকাল সে, তারপর আবার যথাস্থানে বসাল ওটা। স্রেফ রেকর্ডের খাতিরে, হার্ভেই ছুরি মেরেছে ডার্লিংকে?
এখন সে কথা জেনে লাভ নেই কোন। আছে?
বললাম তো রেকর্ডের খাতিরে।
ঠিক আছে। হ্যাঁ, ডার্লিংকে ও-ই খুন করেছে, মরা মুখের দিকে চোখ নামিয়ে জবাব দিল হালাম। ক্যানাডাকেও, যদি সেটাও জানতে চাও। মুখ তুলল সে, চোখের তারায় আগুন। ছুরিটা ও গ্রীনকে মারলেই আমি খুশি হতাম।
হালাম মাতাল হয়ে আছে, ভাবল মক। এরকম অবস্থায় এটাই স্বাভাবিক। তবু কোন মানুষের মাঝে এত পরিবর্তন সে দেখেনি কখনও। উন্মাদ মনে হচ্ছে ওকে।
আচ্ছা, ও তা হলে ক্যানাডাকেও মেরেছে, মক বলল। আমিও তাই, ভেবেছিলাম। তা এক্ষেত্রে তোমার অবস্থানটা কী দাঁড়াচ্ছে?
হালাম তখনও জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মকের দিকে। যাই দাঁড়াক, আমাকে জেলে পুরতে পারছ না তুমি-এটুকু বলতে পারি!
ঠিক আছে, ফ্রেড। আমি কোন সাহায্যে আসতে পারি?
সরাসরি উত্তর দিল না হালাম। দুহাতে হার্ভের লাশটা তুলে নিয়ে সোজা হলো।
এই জঞ্জালটা সরাতে পার আমার বাড়ি থেকে। তুমি না এলে, এতক্ষণে চলে যেত ও। অনেক দেরিতে জানতে পেতাম আমি, ওকে খুন করতে হত না। যাও, বেরিয়ে যাও এবার।
ঘুরে হার্ভের লাশ অফিসে বয়ে নিয়ে গেল হালাম। অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল মক, শ্রাগ করল, ধীর পদক্ষেপে রওনা হলো শহরের উদ্দেশে।
১৬.
কার্লকে বাঁচাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ডাক্তার। সুচিকিৎসার জন্য রোগীকে সন্ধ্যার আগেই শহরে নেয়া দরকার এই সিদ্ধান্ত দেয়ায় ওকে বাকবোর্ডের পাটাতনে শুইয়ে ধীরগতিতে রওনা হয়েছে ওরা। চালকের আসনে বসেছে গ্রীন।
পরীক্ষায় বোঝা গেছে কার্লের বুক ভেদ করে বেরিয়ে গেছে গুলি, গুরুত্বপূর্ণ কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে চোট লাগেনি।
ওর কপাল ভাল, ক্ষতে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে বলেছে ডাক্তার। রক্তও বেশি হারায়নি। তবে এভাবে আঘাত লাগাটাই একটা মারাত্মক ধাক্কা, বিশেষ করে এরকম হালকা-পাতলা শরীরে।
ওরা যখন শহরে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যে। ডাক্তারের বাসার দোতলায় ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো কার্লকে। মুমূর্ষ রোগীদের জন্য কয়েকটা বাড়তি ঘর আছে ওখানে।
হ্যাঁ, এবার ওর ওপর নজর রাখতে পারব আমি, বলে গ্রীনের উদ্দেশে ফিরল ডাক্তার। আর তোমার প্রেসক্রিপশন-টানা বারো ঘণ্টা ঘুম। মনে হচ্ছে এটা তোমার দরকারও।
তাই, অক্তার।
গ্রীন আর মারিয়া ফিরে গেল বাকরোর্ডে। স্টীলডাস্ট, কার্লের সোরেল দুটোই বাধা আছে পেছনে। মেয়েটাকে সীটে উঠতে সাহায্য করল গ্রীন, তারপর নিজে বসল চালকের আসনে। মার্শালের অফিসের পাশ দিয়ে যাবার সময় মক ভেতরে আছে দেখে রাশ টানল ও, নেমে লাগামটা মারিয়ার হাতে দিল।
তুমি যাও টেরিলের কাছে। মারিয়ার উরুতে চাপড় মারল গ্রীন। চট করে পা টেনে নিল,মেয়েটা, চোখ জ্বলে উঠল। গ্রীন হাসল একগাল। বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নাও। মকের সাথে কথা আছে আমার।
পরে আসছ? খাবে না?
আজ রাতে মনে হয় পারব না। খুব ক্লান্ত, মাথাটাও ব্যথা করছে। হোটেলেই কিছু একটা খেয়ে শুয়ে পড়ব।
নরম হয়ে এল মারিয়ার দৃষ্টি। মৃদু গলায় বলল, তুমি আসায় বেঁচে গেছি। খুব ভয় পেয়েছিলাম।
তুমি একটা বনবেড়ালি-সহজে মরবে না। তা হলে যাও এবার। অনেক ধকল গেছে তোমার ওপর দিয়ে। তা ছাড়া, খদ্দেররাও হয়তো অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।
কর্মচারীরাই খুলবে ক্যান্টিনা। রাধা-বাড়া ওরাই করে, আমার না থাকলেও চলে।
যাই হোক, তোমাকে থাকতে হবে ওখানে, না হলে আমি আসব না।
সরে দাড়াল গ্রীন। অবাধ্য ঘোড়ার মত ওকে ভেংচি কাটল মারিয়া, হাসতে হাসতে চলে গেল। সাঁঝের অন্ধকারে ওকে মিলিয়ে যেতে দেখল গ্রীন, তারপর ফুটপাত মাড়িয়ে মার্শালের অফিসে গিয়ে ঢুকল।
ভ্রূকুটি করে গ্রীনের দিকে তাকাল মক। কার্ল বেঁচে আছে?
এখনও। এইমাত্র নিয়ে এলাম ওকে।
মাথা ঝাঁকাল মার্শাল। দেখেছি তোমাদের। চুপ করল সে। হার্ভে মার গেছে। হালাম গুলি করেছিল।
অ্যাংকর র্যাঞ্চে কী ঘটেছে গম্ভীর মুখে গ্রীনকে জানাল মক। হালাম মদ খাচ্ছিল। ওর আচরণ একটু উদ্ভট মনে হয়েছে আমার কাছে। অবশ্য নেশা ছুটে গেলে হয়তো কেটে যাবে। ঠিক জানি না। এরকম অবস্থায় ওকে কখনও দেখিনি আমি। ও খুব শক্তিশালী-কী যেন শব্দটা?–দাম্ভিক মানুষ, নিজের নিয়মে চলে। এখন বদলে গেছে। তোমার কারণে, আমার বিশ্বাস।
আমি আবার কী–
এখানে আসার পর থেকেই অনবরত ওকে নাজেহাল করছ তুমি। হালামের মত মানুষের পক্ষে এটা হজম করা কঠিন। ওর ধারণা এখানে থাকার কোন অধিকার নেই তোমার। সবই তো জানো তুমি, প্রথম লোক লাগিয়ে মার দিয়েছে তোমাকে, তারপর খুন করার জন্য স্যাম ট্যানারকে পাঠিয়েছিল। একটাতেও সফল হয়নি
এখন ভয়ঙ্কর খেপে উঠেছে তোমার ওপর। কী করবে বলতে পারছি না, তবে সাংঘাতিক কিছু একটা করে বসতে পারে, যেটা হয়তো কল্পনাও করতে পারছ না তুমি। আমি হলে এখনই শহর ছাড়তাম। এখানে তোমার কাজ শেষ হয়েছে। কার্লকে এ অবস্থায় নিয়ে যেতে পারবে না টাওসে, আর তা ছাড়া ও পালাবে না আর।
জানি, শান্ত কণ্ঠে বলল গ্রীন। মারিয়া আমাকে বলেছে ও আত্মসমর্পণ করতেই আসছিল। বিবেকের দংশনে ভুগছে ছেলেটা। মনে করছে তার অপরাধের শাস্তি পাওয়া উচিত। এটা এখন একটা নৈতিক দায়িত্ব হয়ে উঠেছে ওর কাছে। আমার নিজেরই শ্রদ্ধা আসছে ছেলেটার ওপর।
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মক। নাক চুলকে ঝট করে একবার তাকাল গ্রীনের দিকে তারপর অন্ধকার জানালার পানে চোখ ফেরাল।
আমার কী মনে হচ্ছে জানো? ইস্তফা দিই। দেয়াই উচিত।
প্রতিবাদ করতে গিয়েও মত পাল্টাল গ্রীন। আবার এর উদ্দেশে চোরা চাহনি হানল মক, তারপর অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
পুলিসের ব্যাজ কেউ ঝোলালে তার কর্তব্য একে সম্মান করা, ধীরে ধীরে শুরু করল মক, নিজের মনের কথা খুলে বলতে চাইছে। এটা পরার যোগ্যতা থাকা উচিত। আমার তা ছিল, আজকের আগে পর্যন্ত।
গ্রীন কাল ওর দিকে, জানে কী বলছে ও, কিন্তু কোন মন্তব্য করল না।
হার্ভেকে গ্রেফতার করতে চাইলাম আমি। ও আমাকে চ্যালেঞ্জ করল, শ্লেষভরা কণ্ঠে বলে চলে মক। বলল ও আমাকে গুলি করে ফেলে দেবে স্যাডল থেকে। পারতও তা। হালাম ওই সময় এসে না পড়লে কী করতাম, আমি নিজেই জানি না। হয়তো চলে আসতাম পালিয়ে। খোদা জানে, আমি মরতে চাই না; কিন্তু হালাম যদি তখন না আসত আর আমি আমার কর্তব্য পালন করতে চাইতাম, নির্ঘাত মারা পড়তাম। গ্রীনের দিকে তাকাল মার্শাল, স্পষ্ট ভাষায় বলল, আমি বোধহয় এ কাজের যোগ্য না, অথচ সেটা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
অল্পদিনের পরিচয় ওদের, কিন্তু একই পেশার লোক হওয়ায় পরস্পরকে বোঝে। গ্রীন চাঁছাছোলা কণ্ঠে জবাব দিল, খামোকা উতলা হচ্ছ। এদ্দিন যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছ তুমি; আজ হার্ভেকে ধরার আগেই হালাম ওকে মেরে ফেলার মানে এই নয় তোমার যোগ্যতা শেষ হয়ে গেছে। কাজেই
জেনেশুনে মরতে যেতাম? বাধা দিয়ে ম্লান গলায় বলল মক।
তাতে কী? এ কাজে ওরকম ঝুঁকি আছেই, তাই না? তুমি কি মনে কর তুমিই হতে প্রথম মাশল যে গুলি খেত? ঝেড়ে ফেল এসব ফালতু ভাবনা। আমার মনে হয়, যা ঘটেনি তা নিয়ে অযথা চিন্তা করছ তুমি।
মক শিরদাঁড়া সোজা করল। হয়তো তাই। মোকাবেলা না করা পর্যন্ত এসব ব্যাপারে কিছু বলা শক্ত। তা ছাড়া মানুষের বয়স যত বাড়ে, ততই সে হিসেব কষে চলাফেরা করে। যদিও কোন অর্থ হয় না এর। একজন তরুণ, যার সারাটা জীবনই ধরা আছে সামনে, সে পরোয়া করে না কোনকিছুর। অথচ আমরা বুড়োরা খুব হুঁশিয়ার কোন মানে হয় না এর।
দুবার বললে কথাটা। ঢের হয়েছে। গ্রীন উঠে দাড়াল। আজেবাজে চিন্তা করে নিজেকে আর কষ্ট দিও না। কিছু হয়নি তোমার! আমি যাই, আমার এখন একটু ঘুম দরকার। শুভ রাত্রি, মার্শাল।
মক কোন জবাব দিতে পারার আগেই বেরিয়ে গেল গ্রীন। হোটেল কামরায় ফিরে এসে কাপড়চোপড় পাল্টে বিছানায় গিয়ে ঢলে পড়ল ঘুমের কোলে।
.
গ্রীন যখন জেগে উঠল তখন সকল, রোদে ঝলমল করছে চারদিক। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে বিছানা ছাড়ল সে, বেসিনে পানি ভর্তি করে তোয়ালে ডুবিয়ে দিল তাতে, তারপর দিগম্বর হয়ে ভেজা তোয়ালে দিয়ে ভালমত ঘষল সারা গা। গোসল সেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও, হাই তুলল কয়েকবার। তেমন জরুরি কোন কাজ ছিল না হাতে, কাজেই বিছানায় ফিরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল আবার।
ওর কাঁধে কিল মারল কেউ একজন, চোখ মেলে জানালার শার্সিতে গোধূলির রঙ খেল গ্রীন। পাশ ফিরল ও, হাই তুলে তাকাল, মারিয়ার দিকে। এর ওপর ঝুঁকে পড়েছিল মেয়েটা, ঢোলা জিপসি ব্লাউজের গলার ফাঁক দিয়ে ওর শরীরের অনেকটাই দেখতে পেল গ্রীন। ঢোক গিলল। ঢেউ খেলানো কালো চুলগুলো পিঠের ওপর বিছিয়ে দিয়েছে মারিয়া। গ্রীন এর কমনীয় মুখে উৎকণ্ঠা দেখল।
শরীর ঠিক আছে তোমার? সারা রাত ঘুমিয়েছ, দিনেও। অসুখ-বিসুখ করেনি তো?..
আলসেমি লাগছে, গ্রীন হাসল। অবশ্য এরকম কখনও হয় না আমার। কার কাছে শুনলে এত ঘুমাচ্ছি?
নীচতলায় : ঝাড়ুদার ঘর পরিষ্কার করতে এসে ফিরে গেছে।
মারিয়ার অহেতুক উকণ্ঠায় না হেসে পারল না গ্রীন, জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিল ওকে। চেঁচিয়ে উঠে বাহুপাশ ছাড়বার প্রয়াস পেল মেয়েটা, আদরের চড় মারল ওর গালে।
মুখ বিকৃত করল গ্রীন, মারিয়াকে ছেড়ে দিল।
পরে আমার মাথায় মারতে পারবে তুমি। তবে এখন ব্যথা সহ্য করতে পারব না আমি।
সহসা ভয়ের ছায়া ঘনাল মারিয়ার চেহারায়, চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
ব্যথা দিয়েছি? গ্রীনের গালে নিজের গাল ঘষল মারিয়া। ওহ, জেমস, আমি সত্যিই খুব দুঃখিত।
এই প্রথম আমার নাম ধরে ডাকলে তুমি। এর আগে ছিল শুধু গ্রিংগো।
তোমাকে আমি জেমস বলেই ডাকব-জেমস, জেমস, জেমস, অস্ফুট স্বরে জপল মারিয়া। চুমু দিল ওর গালে।
শোবে না?
ঝট করে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা, দুচোখে আগুন ঝরিয়ে পিছিয়ে গেল, ক্ষিপ্ত বনবেড়ালির মত এমনভাবে মাখা ঝাঁকাল যে একগুচ্ছ চুল এসে পড়ল কপালে।
কেন শোব? প্রেম করতে? গ্রিংগোর সাথে? হাহ্! চেঁচিয়ে উঠল ও, মাথা ঝাঁকাল আবার। এর চেয়ে বরং ষাড়ের সঙ্গে প্রেম করা ভাল। না!
বিছানা থেকে ওকে স্বর্গীয় হাসি উপহার দিল গ্রীন, হাত বোলাল নিজের লোমশ বুকে।
অন্য সময়? শিগগিরই?
ও হো হো, শখ কত, ঠোঁট ওল্টাল মারিয়া। আমি তোমাকে ঘৃণা করি গ্রিংগো! আজ রাতে না, কাল না, কক্ষনো না। কী ভাব তুমি? গ্রিংগোরা বললেই আমি পটে যাই?
না। আমার কাছে আসবে-আসতে চাও বলে।
চাই না। এবার তুমি কাপড় পাল্টে নাও, তারপর আমরা কার্লকে দেখতে যাব।
আচ্ছা! তবে কিনা আমি জন্মদিনের পোশাকে আছি, তুমি হয় পেছন ফিরে থাক, নয়তো অপেক্ষা কর নীচে গিয়ে।
বিছানা ছাড়ার প্রয়াস পেল গ্রীন, মাগো বলে একটা চিৎকার দিয়ে দৌড়ে দরজার কাছে চলে গেল মারিয়া, ঝট করে ওর পানে একবার তাকিয়েই কপাট খুলল।
নীচে আছি আমি।
বেরিয়ে গেল ও। হো-হো করে একচোট হাসল গ্রীন, পোশাক পরতে শয্যা ত্যাগ করল। পরে, ডাক্তারের বাসায়, বলা হলো ওদের কার্ল এখন খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাচ্ছে। ওর ফাড়া কেটে গেছে সেরে উঠবে, শুধু একটু সময়ের ব্যাপার। বাইরে এসে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগল ওরা, সাঁঝের আলোয় গ্রীনের দিকে তাকাল মারিয়া।
খেতে আসবে না?
আসব। তবে আগে দাড়ি কামাতে হবে, আজ রাতে এক মেয়ের কাছে যাচ্ছি আমি।
থমকে দাঁড়াল মারিয়া, চকিতে সজাগ হয়ে উঠেছে।
কোন মেয়ে!
তুমি।
ওহ্। গ্রীনের কোমর জড়িয়ে ধরল শ্যামাঙ্গিনী। হোটেলের দিকে এগোচ্ছে ওরা, রাস্তায় পরিচিত কারোকে দেখতে পেলে আলতো করে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মান জানাচ্ছে। আমি ভাবলাম কোন সাদা চামড়ার মেয়ে হয়তো।
আমার জন্য এক শ্যামলা মেয়ে অপেক্ষা করছে।
কক্ষনো না কোন গ্রিংগোর জন্য আমি অপেক্ষা করি না।
ঠিক। কিন্তু একবার যদি তোমার ওই সুন্দর মাথায় ঢুকত
ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়ল মারিয়া, তাকাল ফ্যালফ্যাল করে।
আমি? সুন্দর?
হ্যাঁ, তুমি, মৃদু গলায় জবাব দিল গ্রীন। খুব সুন্দর।
ওহ না, আমি না, বলল মারিয়া, হাসছে-গর্বের হাসি। আমি একটা বনবেড়ালি।
তোমার যখন খুশি আঁচড় কেট! মুচকি হাসল গ্রীন। মারিয়াও হেসে উঠল, গ্রীনে বাহু চেপে ধরল আরও শক্ত করে।
হোটেলের সামনে এসে পড়ল ওরা। বারান্দায় বসে আড্ডা মারছে, অনেক লোক। টুপি খুলে গ্রীন বিড়বিড় করে বলল, আধঘণ্টার মধ্যেই আসছি।
এস, গম্ভীর কণ্ঠে বলে বিদায় নিল মারিয়া। দোতলায়, নিজের কামরায় ফিরে গেল গ্রীন, জামা খুলে দাড়ি কমাবার সরঞ্জাম নিয়ে বসল। শ্যামাঙ্গিনীর কথা মনে পড়তে আপনমনে হাসল ও। মারিয়া। মিষ্টি মেয়ে! ছন্নছাড়া পুরুষকে বাধতে জানে।
দাড়ি কামানোর পর, ধোঁয়া জামাকাপড় পরে নীচে নেমে এল গ্রীন, সন্ধ্যার রাস্তায় নেমে ক্যান্টিনার উদ্দেশে হাঁটা ধরল।
ও ঢুকতেই বারটেন্ডার জিজ্ঞেস করল, সিনর গ্রীন?
হ্যাঁ, আমি। মিস গার্সিয়া আছে ভেতরে?
ম্লান মুখে ওর হাতে একটা চিরকুট দিল বারটেন্ডার। সিনোরিটা ফেরেনি। এক লোক দিয়ে গেছে এটা, আগে কখনও দেখিনি। বলেছে, তোমাকে এটা দিতে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বারটেন্ডারের দিকে তাকাল গ্রীন, তারপর ভুরু কুঁচকে চিরকুটটা পড়লঃ
মেক্স ছুকরিকে ফেরত চাইলে আজ রাতেই সেজে আসবে।
গুম মেরে দাঁড়িয়ে রইল গ্রীন, অনুভব করছে ভয়ঙ্কর ক্রোধ জেগে উঠছে ওর মাঝে। মকের সাবধানবাণী মনে পড়ল ওর: কী করবে, বলতে পারছি না, তবে এমন একটা কিছু যা তুমি হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না।
তা হলে ওকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে, গ্রীন ভাবল, বারটেন্ডারের উদ্বিগ্ন চোখের দিকে তাকাল ও।
সিনোরিটা ঠিক আছে? শঙ্কা ঝরে পড়ল কৃষ্ণকায় লোকটার গলায়।
ঠিক হয়ে যাবে। ধন্যবাদ, অ্যামিগো। এই চিঠি যে নিয়ে এসেছিল তুমি তবে চেন না তাকে?
না। খুব মোটা। বেঁটে, আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু অচেনা।
হাচ, গ্রীন ভাবল; অবশ্যই হাচ। দশাসই দাম্ভিক লোকটার চেহারা স্মরণ করল ও। দুবার ওকে ধরাশায়ী করেছিল সে-দ্বিতীয়বার শৌচাগারে। মারিয়াকে তা হলে ধরে নিয়ে গেছে ওরা; ওকে ফাঁদে ফেলার জন্য টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে মেয়েটাকে।
এখন ওরা আমার অপেক্ষায় থাকবে; জানে, আমি নির্দ্বিধায় গিয়ে পা দেব ওই ফাঁদে।
কতজন লোকের মোকাবেলা করতে হবে ওকে? ভার্জিল রীভ থাকবে, সন্দেহ নেই; রীড তার স্যালুন ভাঙচুর করার জন্য মনেপ্রাণে ঘৃণা করে ওকে।
হাচ থাকবে, চেষ্টা করবে ফ্লিন্টের মৃত্যুর বদলা নিতে। আর থাকবে হালাম নিজে, এবং হয়তো আরও দু-তিনজন।
উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে গ্রীনকে জরিপ করছিল বারটেন্ডার। বলল, আমরা চাই না সিনোরিটার কোন ক্ষতি হোক। আমাদের যদি কিছু করার থাকে–
চিন্তা কর না, অ্যামিগো। এটা আমার দায়িত্ব।
বাইরে এসে লিভারি স্ট্যাবলের দিকে দ্রুত পা চালাল গ্রীন। মারিয়া ফাঁদে পড়েছে মনে হতেই খুন চড়ে যাচ্ছে ওর মাথায়, কিন্তু বুদ্ধি হারাচ্ছে না।
ওখানে গিয়ে ওকে উদ্ধার করে আনবে সে। হ্যাঁ, তাই, মনে মনে নিজেকে বলল গ্রীন। ওকে ফিরিয়ে দাও আমার কাছে–ও আমার।
১৭.
দীর্ঘ ঘটনাবহুল জীবন ভার্জিল রীডের। সহজে ভয় পাবার কে সে নয়। বারে সামনে অস্থিরভাবে হালামকে পায়চারি করতে দেখে এখনও ভয় পাচ্ছে না সে, কিন্তু গরু ব্যবসায়ীর অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল চোখ, ছেড়াখোড়া খ্যাপাটে হাসি আর স্বগত সংলাপে অস্বস্তি বোধ করছে।
হারিকেনের হলুদ আলোয় হালামের কপালে ঘামের ধারা দেখতে পাচ্ছে সে। সাহায্যের আশায় আজ বিকেলেই হালাম এসেছে এখানে। রীড জানত না মেক্সিকান মেয়েটিকে অপহরণ করতে চায় অ্যাংকর মালিক; জানলে সে অনুমোদন করত না ব্যাপারটা, এমনকী ওকে উদ্ধার করতে এসে জেমস গ্রীন মরার ঝুঁকি নেবে এটা বোঝার পরেও না।
গ্রীনের মৃত্যুতে তৃপ্তি পাবে রীড; স্যালুনের ভাঙা জানালার দিকে তাকালে ওর চোখের সামনে ভাসে কীভাবে ওই লোক তার সমস্ত বোতল চুরমার করে দিয়েছে। তখন উন্মত্ত ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে রীডের মাঝে! হ্যাঁ, তার সামনে মেঝের ওপর গ্রীনের লাশ পড়ে থাকতে দেখলে আনন্দিত হবে সে।
যাই হোক, গ্রীনের বিরুদ্ধে তারা মোট চারজন, তাকে ধরে। আস্তাবলে অসল্যারের সঙ্গে রয়েছে হাচ। আছে নতুন আমদানি তুর্ক। একতাড়া ডলার খরচ করে লোকটাকে কিনে নিয়েছে হালাম। তুর্ক পালিয়ে বেড়াচ্ছে; ফেরারি লোকের চেহারা দেখলেই চিনতে পারে ভার্জিল রীড।
বারে এসে নিজের গ্লাসে মদ ঢালল হালাম। রীডের দিকে তাকাল সে, একপাশে রাখা কাটাবন্দুকটা দেখল। বন্দুকটা তুলে নিল হালাম, নিশানা তাক করে জোড়া ট্রিগার টেপার ভান করল, দুটো ব্যারেলই ওর পেটে খালি করতে চাই আমি, ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল অ্যাংকর মালিক। তারপর দেখব ওর চিৎকার।
দেখি, গানটা দাও আমাকে, বলল, রীড। প্রয়োজন হলে তোমার নিজের বন্দুক ব্যবহার কর। তবে দুটো বাকশট লাগলে বাছাধনকে আর চিৎকার করতে হবে না-এমনিতেই ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।
বিড়বিড় করে হালাম বলল কিছু। হার্ভে নামটা কানে গেল রীডের। গতকাল তার ফোরম্যানকে খুন করার পর থেকে ওই নামটা ঘুরছে গরু ব্যবসায়ীর মাথায়। হালামের স্বগতোক্তি থেকে একটু-একটু করে ব্যাপারটা জেনেছে রীড; বুঝেছে র্যাঞ্চার প্রকৃতিস্থ নেই।
আচমকা হনহন করে দরজার কাছে হেঁটে গেল হালাম, চৌকাঠে ঠেস দিয়ে রাখা, রাইফেলটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রীড। ছাতের দিকে অস্বস্তিভরে তাকাল সে, ছড়িতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দোতলায় উঠে গেল পেছনের সিঁড়ি বেয়ে, কষ্টেসৃষ্টে একেকটা ধাপ টপকাচ্ছে।
শেষ ধাপে পৌঁছে হাঁপাতে লাগল রীড, ছড়িতে ভর রেখে জিরাল কিছুক্ষণ দেয়ালে বসানো ছোট্ট কুপির আলো ওর পাকা বাবরি চুলের জট আর তোবড়ানো গালে প্রতিফলিত হয়ে চকচক করছে। তারপর একসময় ডানের প্রথম দরজাটার দিকে এগোল সে। তালা খুলে ফিরে এল সিঁড়ির মাথায়, কুপি নিয়ে ঘরে ঢুকল। শতরঞ্চি বিছানো একটা লোহার খাটের ওপর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে মারিয়া, মুখে কাপড় গোঁজা যাতে চিৎকার করতে না পারে।
স্বভাবসিদ্ধ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর পানে তাকাল মেয়েটা, ঘৃণা আর আক্রোশে মুখ বিকৃত করল।
রুক্ষ সুরে রীড বলল, কেমন আছ মেয়ে?
হিসহিস একটা শব্দ করল মারিয়া, মুহূর্তের জন্য চোখ সরাচ্ছে না রীডের ওপর থেকে। ওই দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি বোধ করল বুড়ো। ও জানে অকটিও এবং তার আশপাশে প্রচুর বন্ধুবান্ধব আছে মেয়েটার, এখানে যদি ওর কোন ক্ষতি হয় চড়া মশুল গুনতে হবে তাকে বিশেষ করে মেক্সিকানরা মরণকামড় দেবে।
তবে ভরসা একটাই: হালাম রয়েছে। মেক্সিকানদের সে দুচোখে দেখতে পারে না, মেষপালক বা তার চেয়েও খারাপ কিছু বলে গালি দেয়। মেয়েটাকে ধরে এনেছে, সম্ভবত গ্রীনের সাথে মাখামাখি আছে বলে। হালামের বোধহয় চোখ পড়েছে ওর ওপর, মনে মনে ভাবল ভার্জিল রীড। বিছানার সাথে মেয়েটাকে বাঁধার সময় ওর আচরণে লালসা দেখতে পেয়েছে সে।
সেরকম কিছু ঘটলে দেশ ছাড়তে হবে হালামকে, নইলে মেক্সিকান পুরুষরা ছাড়বে না ওকে, খুঁজে বের করে ওদের ধারাল ছুরি দিয়ে ফেড়ে ফেলবে ওর পেট। মেক্সিকান পুরুষরা ভীষণ আত্মাভিমানী, ওদের মা-বোনদের বেইজ্জতি সইতে পারে না।
ঠিক হয়ে যাবে সব, রুক্ষ সুরে মারিয়াকে সান্ত্বনা দিল রীড। গ্রীন এলেই তোমাকে ছেড়ে দেবে।
অপলকে ওর পানে চেয়ে রইল মারিয়া। দায়সারাভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে এল রীড, দরজা টেনে বন্ধ করে দিল পেছনে।
আচমকা অন্ধকার হয়ে গেল ঘর। বাঁধন ছেঁড়ার চেষ্টা করল মারিয়া। জানে কোন ফল হবে না, তবে এতে করে অন্তত ব্যস্ত থাকতে পারবে একটা কিছুতে, দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়বেনা। তবু, যখনই ভাবছে ফাঁদে পা দিতে আসছে প্রীন, তখনই পাষাণভার চেপে বসছে ওর বুকে।
রীড বলেছে বটে ঠিক হয়ে যাবে সব কিন্তু, মারিয়া নিশ্চিত, গ্রীন বাঁচবে না-সেও। একবার অপহরণ করে, ওকে ছেড়ে দেয়ার মত ঝুঁকি নিতে পারবে না হালাম। স্রেফ গুম হয়ে যাবে সে, এবং হপ্তাখানেকের মধ্যেই তার কথা ভুলে যাবে লোকে। ওর ব্যাপারে ভাববে এমন কোন নিকটাত্মীয় নেই ওর, শুধু দু-চারজন, বন্ধুবান্ধব, কিছুদিন খোঁজ করেই হাল ছেড়ে দেবে তারা।
ভুল, অধৈর্য সুরে হঠাৎ নিজেকে বলল মারিয়া। গ্রিংগো গ্রীনের ওপর ভরসা রাখা উচিত তোমার। একে বিশ্বাস করতে পার, সত্যি। অন্ধের মৃত দে পা দেবার লোক ও না। বিশ্বাস রাখ।
সহসা একধরনের সাহস বোধ করল মারিয়া, হৃতশক্তি ফিরে পেল! ক্যান্টিনা থেকে মাত্র কয়েকটা বাড়ি দূরে ওকে পাকড়াও করে হালাম আর হাচ নামের এক লোক। বাধা দিতে চেষ্টা করেছিল সে, পারেনি। একটা ছালা দিয়ে ওর মুখ বেঁধে ফেলে ওরা যাতে চিৎকারে আওয়াজ ঢাকা পড়ে যায়। তবু আপ্রাণ লড়েছিল ও, কিন্তু হালাম ওর মাথায় আঘাত করতে প্রায়, অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তারপর ওকে আড়াআড়িভাবে নিজের স্যাডলে তুলে নেয় হালাম। এর পরের ঘটনা দুঃস্বপ্নের মত। নোংরা, ছালার ভেতর দম আটকে আসছিল ওর। শক্ত করে ওকে এক হাতে স্যাডলে ধরে রেখে দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছোটাল হালাম। তারপর ও যখন ক্রুদ্ধভাবে হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করে তখন বসার সুযোগ দেয় ওকে। এক হাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে ছুটতে থাকে হালাম। হাচ ওদের পাশাপাশি ছুটছিল। কয়েক ঘণ্টা পর সেজে পৌঁছায় ওর এবং হালাম তাকে বেঁধে রাখে এখানে। তখন তার মনে হচ্ছিল সমস্ত শক্তি বুঝি হারিয়ে ফেলেছে সে।
অচিরেই আসবে গ্রীন, আস্থা রাখা উচিত তার। নিঃসাড়ে পড়ে রইল, মারিয়া, বুক ধড়ফড় করছে, মুখ বাঁধা থাকায় কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে, পট্টিটা ভিজে গেছে লালায়। চোখ বুজল মারিয়া, বাজুর সঙ্গে বাধা হাত দুটো ঢিলে করে দিল; ওর পা দুটোও বাধা, অসাড় হয়ে গেছে।
এমনভাবে বাঁধব যেন ছুটতে না পারিস, খোদার কসম! নির্দয় ব্যবহার করেছে হালাম, অকারণে ওকে ব্যথা দিচেছ। ভার্জিল রীড তখন উপস্থিত না থাকলে আর কী ঘটাত কার্লের বাবা ভাবতে গেলেই ওর গা শিউরে উঠছে।
কার্ল এখনও বেঁচে আছে কিনা জানে না মারিয়া কায়মনোবাক্যে কামনা করল যেন থাকে। তারপর শান্ত হয়ে পড়ে রইল ও, কান খাড়া, ঘোড়ার খুরের শব্দ, গুলির শব্দ শুনতে চেষ্টা করছে-এমন কোন আওয়াজ যা থেকে বুঝতে পারে গ্রীন এসেছে তাকে উদ্ধার করতে।
.
সন্দেহ নেই এটা একটা ফাঁদ, সেজের রাস্তায় জোরকদমে ছুটতে ছুটতে কথাটা আবারও ভাবল গ্রীন। দূরে স্যালুনের বাতি দেখতে পাচ্ছে সে, সাবেক মাইনিং ক্যাম্পের একমাত্র বাতি ওগুলো।
স্যালুনেই মারিয়াকে আটকে রাখবে ওরা, দোতলার একটা ঘরে। রাস্তার এ মাথায়, আস্তাবলের কাছে, পাহারায় থাকবে এক লোক, আরেকজন থাকবে অপর প্রান্তে-যদি আদৌ সেরকম কারোকে জোগাড় করে থাকে হালাম।
ঘোড়ার গতি হাঁটার পর্যায়ে নামিয়ে আনল গ্রীন, গতযাত্রায় যে গিরিখাত ধরে সে দ্বিতীয় বার মাইনিং ক্যাম্পে ঢুকেছিল সেদিকে এগোল।
একটু বাদে স্যাডল থেকে নামল সে, ঘোড়াসমেত পায়ে হেঁটে স্যালুন ছাড়িয়ে বেশ কিছুদূর চলে এল। লাগামের খুঁটাটা মাটিতে পুঁতে রেখে, খাড়াই বেয়ে গিরিখাতের কিনারে উঠল গ্রীন, চোখ কুঁচকে তাকাল, বাড়িঘরের অন্ধকার কাঠামোগুলোর দিকে। ছায়ার ভেতর যা খুঁজছিল, খানিক বাদে দেখতে পেল সে। রাস্তার শেষ মাথায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছে এক রাইফেলধারী!
একটা ঝুপড়ির আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দীর্ঘ ঢাল বেয়ে কারবাইন হতে গলিতে নামল গ্রীন। গোটা দুতিনেক ঝুপড়ি পেরিয়ে চলে এল গলির মুখে, উঁকি মেরে দেখল লোকটাকে। হাচ নয়, এ বেশ লম্বা। নতুন কেউ? ওর দিকে এগিয়ে গেল গ্রীন। পেছনে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল রাইফেলধারী, ঘাড় ফেরাল।
দেখতে পেলে কারোকে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল গ্রীন।
কিছু না, একটা শব্দ পর্যন্ত নেই। তুমি কোত্থেকে এলে? হালাম বলছিল আমরা মাত্র চারজন।
র্যাঞ্চ থেকে এসেছি। গ্রীনকে খুন করতে চায় ফ্রেন্ড, আজ রাতে বোধহয় সম্ভব হবে সেটা। মেয়েটাকে কোথায় রেখেছে ওরা?
কেন, তোমাকে বলেনি? রাইফেলধারীর কণ্ঠে সন্দেহ, এক কদম আগে বাড়ল সে, ভাল করে দেখার চেষ্টা করল অন্ধকারের ভেতর। চমকে উঠল পাহারাদার, অব্যক্ত একটা শব্দ বেরিয়ে এল ওর গলা চিরে। ইতিমধ্যে গ্রীন পৌঁছে গিয়েছিল ওর কাছে, কারবাইনের কুঁদো দিয়ে লোকটার মাখায় আঘাত করল সে।
হাঁটু দুমড়ে ধসে পড়ন্স রাইফেলধারী, গ্রীন আবার আঘাত করতে জ্ঞান হারাল।
ওকে নিরস্ত্র করল গ্রীন, কোমরের বেল্ট ধরে টানতে টানতে অদুরের একটা ঝুপড়ির ভেতর নিয়ে গিয়ে রাখল, বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে শেকল তুলে দিল দরজায়। এরপর সে রাস্তার ওপাশে চলে গেল, বুকে হেঁটে স্যালুনের উল্টো দিকে এসে থামল ভাঙা জানালা দিয়ে আলোকিত ঘরটা জরিপ করল গ্রীন।
ভার্জিন রীডকে দেখতে পেল সে, বারের পেছনে ওর নিজের জায়গায় বসে আছে; ডান হাতের কাছে রাখা শটগানটাও চোখে পড়ল। কিন্তু মারিয়াকে দেখতে পেল না কোথাও, হালামকেও না।
শিরদাঁড়া সোজা করল গ্রীন, কাছেই এক জোড়া পদশব্দ শুনতে..পেয়ে দ্রুত পিছিয়ে গেল গাঢ়তর অন্ধকারে স্যালুনের দরজা-জানালা গলে আসা আলোয় এসে দাঁড়াল এক লোক, হাতে রাইফেল। ওকে চিনতে পারল গ্রীন-হালাম। র্যাঞ্চার স্যালুনের ভেতরে ঢুকে যাবার সময় ওর চওড়া পিঠ বরাবর কারবাইন তাক করল সে।
ওকে মারতে পারতাম আমি, যা করেছে ও তাতে অন্যায় হত না এটা, ভাবল গ্রীন। বুড়ো রীডকেও মারতে পারি। শেষ করে দাও ওদের, নিজেকে বলল গ্রীন, তারপর মারিয়াকে নিয়ে চলে যাও এখান থেকে।
কিন্তু গুলি করল না সে-ট্রিগার টেপার প্রবৃত্তি হলো না। হাচের কথা ভাবল গ্রীন, ব্যাপারটা কীভাবে সামলাবে মনস্থির করে ফেলেছে। কিন্তু হাচকে পেছনে রেখে কাজে নামতে চাইল না ও, ঠিক করল প্রথম ওর একটা ব্যবস্থা করবে।
নিঃশব্দে রাস্তার পাড় ধরে এগোল গ্রীন, চোখ অদূরবর্তী আস্তাবলটা জরিপ করছে। কোন বাতি দেখা যাচ্ছে না ওখানে। অসল্যারের মুখটা মনে করল, ও, জরাগ্রস্ত, নেহাত গোবেচারা মানুষ।
তখনও একশো ফুট দূরে আছে গ্রীন এমন সময় আস্তাবলের কোণে ফস করে একটা ম্যাচ জ্বলে উঠল, সিগারেট ধরানোর সময় লোকটার মুখ দেখতে পেল ও। হাচ। ম্যাচ নিভে যেতে আবার অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু।
একটু দোনোমনো করল গ্রীন। তারপর একদৌড়ে রাস্তা অতিক্রম করে আস্তাবলের পেছনে চলে এল। আবার ইতস্তত করল সে। একটা দরজা খোলা রয়েছে এপাশে, গোবর আর পচা খড়ের দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে। কপাটের পাশ দিয়ে সাবধানে সামনের বড় দরজাটার দিকে তাকাল গ্রীন; দেখল ওটাও খোলা, দোরগোড়ায় গোড়ালির ওপর বসে আছে এক লোক। নড়ে উঠল লোকটা, গলায় উপুড় করল একটা বোতল, কয়েক ঢোক খেয়ে নামিয়ে রাখল আবার, স্থির হয়ে, গেল।
পিস্তল বের করে আস্তাবলে ঢুকল গ্রীন, মেঝেতে খড় থাকায় ঢাকা পড়ে গেছে বুটের মচমচ আওয়াজ। অকস্মাৎ একজন মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে অস্থিরভাবে পা ঠুকল স্টলে বাধা ঘোড়াগুলো, খাওয়া থামিয়ে নাক ঝাড়ল ঘোৎ করে। ওদের পাশ কাটিয়ে এল সে, উৎকট গন্ধে বমি চলে আসছিল, এক হাতে নাক-মুখ চাপা দিল।
দরজার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে গ্রীন এই সময় হাই তুলে উঠে দাঁড়াল অসল্যার, বাইরে গেল। একলাফে দরজার পাশে চলে এল গ্রীন, শুনতে পেল জড়ানো গলায় অসল্যার বলছে, ওরা কেন ভাবছে ও আসবে বুঝতে পারছি না। গাধা না হলে যে কেউ বুঝবে এটা একটা ফাঁদ। আমি হলে তো আসতাম না, এমনকী দোতলার ঘরে যে মেয়েটাকে আটকে রেখেছে তার খাতিরেও না।
তুমি গ্রীন না, চাঁছাছোলা জবাব দিল হাচ। ও ঠিকই আসবে। লড়াই দেখে ভয় পাবার লোক না গ্রীন।
তাই বলে মরতে আসবে?
আসবে।
ওই মেক্স মেয়েটাকে নিয়ে কী করবে ওরা?
সেটা আমার মাথাব্যথা না। যাকগে, এবার তুমি চুপ কর। এরকম বকবক করলে শুনতে পাব কীভাবে ও আসছে কিনা?
মৃদু সুরে বিরক্তি প্রকাশ করল অসল্যার, দোরগোড়ায় ফিরে এসে আবার বোতল খুলে বসল। কপাটের পেছনে জমে গেল গ্রীন, মাকড়সার আঠাল জালে পড়ায় গা ঘিনঘিন করে উঠল। আরও এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল সে, তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে পিস্তলের নল দিয়ে বাড়ি মারল অসল্যারের কানের পাশে। কলার ধরে ভেতরে টেনে এনে দেয়ালের পাশে শুইয়ে দিচ্ছে ওকে এই সময় হাচ এগিয়ে এসে বলল, অ্যাই, কোথায় তুমি? বোতলটা কই? আমি খাব এক ঢোক।
আরও এক কদম এগোল হাচ, ও পায়ে বেধে উল্টে পড়ল বোতল। গ্রীন কোথাও লুকাতে পারার আগেই নিচু স্বরে গাল বকে, ওটা কুড়িয়ে নিল সে।
শার্টের আস্তিনে বোতলের গলা মুছে নিল হাচ, উঁচু করে গলায় ঢালল। খেতে খেতে ওর দৃষ্টি সরে গেল আস্তাবলের ভেতর দিকে, দেয়ালের গায়ে গ্রীন আর অচেতন অসল্যারের ছায়া দেখতে পেল।
শালা–আঁতকে উঠেই গ্রীনের উদ্দেশে বোতলটা ছুঁড়ে মারল হাচ, কনুইয়ের ফাঁকে ধরা রাইফেলের ট্রিগার টিপল।
আচমকা এবং দ্রুত ঘটে গেল ব্যাপারটা। বুলেটের ঘষায় পুড়ে গেল গ্রীনের বাহু, ঝট করে বাঁ-হাতে দুবার গুলি ছুঁড়ল সে, পিছিয়ে গেল হাচ, তারপর টলতে টলতে দুকদম এগিয়ে এসে লুটিয়ে পড়ল ধুলোয়।
দৌড়ে আস্তাবলের বাইরে চলে এল গ্রীন, জানে গুলির আওয়াজে এক্ষুণি ছুটে আসবে হালাম। রাস্তা ধরে এগোল না সে, আস্তাবলের পাশ দিয়ে গলিতে ঢুকল, একটু থেমে খাড়া করল কান। ভারি বুটের আওয়াজ পেল গ্রীন, ঘুরে স্যালুনের পেছনে চলে গেল, লাথি মেরে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
চমকে উঠে টুলের ওপর সোজা হলো, ভার্জিল রীড, শটগানের দিকে হাত বাড়াল।
যত্নের সঙ্গে নিশানা করে শয়তান বুড়োর কাঁধে গুলি করল গ্রীন। কর্কশ সুরে বলল, বাইরে যাও, রীড। তারপর শটগানটা তুলে নিয়ে দৌড়ে টপকাতে শুরু করল সিঁড়ির ধাপ।
দেয়ালে বসানো কুপির আলোয় করিডরের দুপাশে সারি সারি ঘর চোখে পড়ল। ওর। প্রথমে বায়ের দরজাটা খুলল গ্রীন। কারোকে দেখতে পেল না। তারপর উল্টো দিকের দরজা খুলেই বুঝতে পারল মারিয়া আছে এখানে। করিডর থেকে আসা ক্ষীণ আলোয় দেখল খাটের ওপর মুখ-হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে ও। ছুরি বের করে ঝটপট বাধন কাটতে শুরু করল গ্রীন।
১৮.
ছাড়া পেয়েই একটা খুশির চিৎকার দিয়ে গ্রীনের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মারিয়া। আস্তে করে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিল গ্রীন।
দেখ, জানালা বেয়ে নীচে নামার মত দড়ি হবে কিনা। এটাই বোধহয় সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তা।
কথা শেষ করে গ্রীন বেরিয়ে গেল, খাটের বাজু থেকে দড়ি খুলতে শুরু করল মারিয়া। সিঁড়ির মাথায় চলে এল গ্রীন। ওর পা দৃষ্টিপথে আসা মাত্র নীচ থেকে ছুটে এল তিনটে গুলি। লাফিয়ে পেছনে সরে গেল গ্রীন, একটু থেমে দেয়ালের কুপিটা নামাল। কেরোসিন ছিটাল সিঁড়ির ধাপে, জ্বলন্ত কুপিটা ছুঁড়ে মারল ওই তেলের ওপর।
নীল শিখা জ্বলে উঠল ধাপগুলোয়, তারপর শুকনো কাঠে ছড়িয়ে পড়ল আগুন। ক্ষিপ্রপায়ে ঘরে ফিরে এল গ্রীন। জানালা হাট করে খুলে দিয়েছে মারিয়া, খাট ঠেলে নিয়ে গেছে ওখানে। দড়ির এক মাথা বেঁধেছে খাটের বাজুর সাথে, অন্যপ্রান্ত ঝুলিয়ে দিয়েছে জানালার বাইরে। ওর হাতে শটগানটা দিল গ্রীন।
আমি নামছি আগে। বেশিক্ষণ লাগবে না। হালাম যদি আগুনের এপাশে চলে আসে, গুলি করতে দেরি কর না।
হাহ! খুন করব!
কুঁদো নীচমুখী করে রাইফেলটা জানালা গলিয়ে ফেলে দিল গ্রীন। তারপর চৌকাঠে বসে টেনে দেখল দড়িটা ওর ভার সইতে পারবে কিনা। সন্তুষ্ট হয়ে নামতে শুরু করল ও, মাঝামাঝি চলে এসেছে এই সময় শটগানের গর্জন শুনতে পেল সে, প্রথম একটা গুলি, তারপর আরেকটা।
এর এক সেকেন্ড পর দড়ির শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল ও, ছেড়ে দিয়ে ধপ করে নামল মাটিতে। গোড়ালির ওপর পড়ে সামান্য ঝুঁকি খেল সে, তবে ভারসাম্য হারাল না।
ওপরে তাকিয়ে দেখল জানালার বাইরে শরীর গলিয়ে দিয়েছে মারিয়া, নামতে শুরু করেছে।
যখন দড়ির শেষমাথায় পৌঁছাল, পাঁজাকোলা করে ওকে মাটিতে নামিয়ে রাইফেলটা কুড়িয়ে নিল গ্রীন! চল, বলল ও। তুমি গুলি করেছ ওকে?
না। ছায়া দেখে মেরেছি। চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম না ভাল করে।
মারিয়ার হাত ধরে ছুটতে ছুটতে গলির মুখে এসে পড়ল গ্রীন, ডাইনে-বাঁয়ে একবার নজর বুলিয়ে রাস্তা পার হলো। ঘাড় ফিরিয়ে শেষবারের মত স্যালুনের, খিড়কি দোরের দিকে তাকাল ও, দেখল ভেতরে লকলক করছে আগুনের শিখা। পরক্ষণে দোরগোড়ায় বেরিয়ে এল হালাম, রাইফেল ছুঁড়ল ওদের উদ্দেশে। অনেকদূর দিয়ে চলে গেল গুলি, হালাম আসলে দেখতে পায়নি ওদের, আন্দাজে নিশানা করেছিল। গ্রীন পাল্টা জবাব দিল না, নিজেদের অবস্থান জানাতে চায় না বলে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই খাড়াইয়ের মাথায় পৌঁছে গেল ওরা, পিছলে গিরিখাতে নেমে গিয়ে স্টীলডাস্টের উদ্দেশে ছুটল। স্যাডলে চাপল গ্রীন, মারিয়া পেছনে বসল, দুই হাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরেছে।
ঘোড়া ঘুরিয়ে গিরিখাতের বাইরে বেরিয়ে এল গ্রীন। আবার পেছনে তাকাল। ভার্জিল রীডের স্যালুনটা এখন দাউদাউ করে জ্বলছে। ওই আগুনে বহুদূর অবধি আলোকিত হয়ে উঠেছে রাতের আকাশ।
.
শহরে পৌঁছে মারিয়াকে ক্যান্টিনায় নামিয়ে দিল গ্রীন ওকে যেতে নিষেধ করল মারিয়া, লুকিয়ে থাকতে বলল।
এবার হালাম কী করবে কিছুই বলা যায় না, মার্শালকে সাবধান করা দরকার, মারিয়ার কথার পিঠে গ্রীন জবাব দিল।
পাগলা কুকুর হয়ে গেছে ও। তুমি সাবধান থেক, জেমস, না হলে ও তোমাকে খুন করবে।
চেষ্টা করবে বোধহয়। আমার বিশ্বাস, শেষ একটা মোকাবেলা হবে আমাদের-তবে আমি ওর পিছু নেব না।
সেটা করলেই মনে হয় ভাল করতে, যুক্তি দেখাল মারিয়া। ভয় পেত তোমাকে।
ও ভয় পাবার লোক না, বলে মারিয়ার চোখের পানে তাকাল গ্রীন। এবার তুমি ভেতরে যাও-আর বেরোবে না।
তুমি আসছ পরে?
অবশ্যই। তবে তোমার উঠনে খাব না, অন্তত আজ রাতে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘেরা জায়গায় বসতে হবে, যেন দরজার ওপর চোখ রাখতে পারি।
সি- বলে ওর একটা হাত বুকে টেনে নিল মারিয়া, চাপ দিল আলতোভাবে। তুমি আসবে, গাঢ় স্বরে আমন্ত্রণ জানাল ও। মেয়েদের সম্মান বাঁচাতে জানো তুমি।
এভাবে ভেবে দেখিনি কখনও। যেটা উচিত মনে হয় করি-ব্যস।
অনাবিল হাসি হাসল গ্রীন। দেখল মারিয়ার দৃষ্টি নরম হয়ে এসেছে, চোখ ছলছল করছে। মেয়েটা ওর হাত ছেড়ে দিতে রওনা হলো গ্রীন, শহরের মূল অংশে ফিরে যাচ্ছে। মার্শালের দফতরের সামনে থামল ও। মক ছিল না, মাঝবয়সী এক লোক-সম্ভবত ডেপুটি-স্মিত হাসল ওকে দেখে। বেশ রাত হয়েছে, মককে খবর দিতে বলে বিদায় নিল গ্রীন।
চারটে বাড়ি পরেই টেরিলের আস্তাবল। সেখানে ঘোড়া রেখে রাইফেলটা নিয়ে হোটেলে ফিরে এল সে, জামাকাপড় না খুলেই টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। ঘুম চলে আসছিল, ঝট করে উঠে পড়ল গ্রীন, হাই তুলে বেসিনের ধারে গিয়ে হাত-মুখ রগড়ে সাফ করল পানি দিয়ে। তারপর ওর সর্বশেষ পরিষ্কার শার্টটা গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে এল করিডরে, ভাবছে হালাম এতক্ষণে বোধহয় পৌঁছে গেছে শহরে। করিডর ধরে পেছনের সিঁড়িতে চলে গেল গ্রীন, অন্ধকার গলিতে নামল। নানান গলিঘুচি হয়ে মেক্সটাউনের কিনারে পৌঁছে কিছুটা নিরাপদ বোধ করল ও। তবু, স্যাম ট্যানার ওকে অ্যামবুশ করেছিল মনে পড়তে, ক্যান্টিনার আশপাশের এলাকা জরিপ করল ভাল করে।
হালামের এখন যে মানসিক অবস্থা, বিশেষ করে সেজের ঘটনাবলীর পর, তাতে এর পক্ষে অ্যামবুশ করা বিচিত্র কিছুই নয়। ক্যান্টিনায় ঢুকল গ্রীন। বারটেন্ডার ছাড়া আর কেউ নেই, সাপারের সময় বহু আগেই পেরিয়ে গেছে। ওকে চওড়া একটা হাসি উপহার দিল বারটেন্ডার, বেশ অনেকটা মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাল।
সিনর গ্রীন। সিনোরিটা গার্সিয়াকে নিরাপদে ফিরিয়ে এনেছ তুমি, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। রান্নাঘরেই ওকে পাবে।
ধন্যবাদ। আর কতক্ষণ খোলা আছে ক্যান্টিনা?
বড়জোর ঘণ্টাখানেক, সিনর।
হালামকে চেন?
সি, দেখলেই চিনব।
বন্ধের আগেই যদি আসে, চিৎকার করবে।
তার চেয়েও ভাল কিছু করব, কঠিন গলায় জবাব দিল বারটেন্ডার। বারের নীচ থেকে বড় একটা পিস্তল বের করল সে। এর সাহায্যে চিৎকার করব, সিনর। সিনোরিটার গায়ে হাত তুলেছে ওই লোক, ওকে পেলে আমি ছাড়ব না।
ওপর-নীচ মাখা ঝাঁকাল গ্রীন। যথেষ্ট বলে রান্নাঘরে পা রাখল।
বাসায় ফিরে জামাকাপড় পাল্টেছে মারিয়া, চুল আঁচড়েছে নতুন করে। স্টোভে একটা কিছু ভাঁজছিল ও, গ্রীনকে দেখে স্মিত হাসল।
বুয়েন্স নচেস, শুভ সন্ধ্যা, সিনর জেমস গ্রীন। তুমি বস ওখানে, দেয়ালে পিঠ দিয়ে। অল্পক্ষণ আগে সাজানো দুটো চেয়ার আর টেবিল দেখিয়ে বলল মারিয়া। রান্না হয়ে এল, শিগগিরই আমরা খাব।
সত্যি, খুব খিদে পেয়েছে আমার, স্বীকার করল গ্রীন। তবে, আজ আর টেকুইলা না। মাথা পুরোপুরি সেরে না ওঠা পর্যন্ত ঠিক হবে না খাওয়া।
মিনিট কয়েক বাদে টেবিলে খাওয়া দিল মারিয়া, গ্রীনের মুখোমুখি বসল। দুজনেই খাচ্ছে গোগ্রাসে, কথা হচ্ছে সামান্য। বলার বিশেষ কিছু নেই ওদের। যা ঘটে গেছে তা এতই সাম্প্রতিক যে নতুন করে আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। তা ছাড়া গ্রীনের বিশ্বাস, ভবিষ্যতেও এ প্রসঙ্গ কখনও তুলবে না তারা।
পিপার মক যখন ঢুকল রান্নাঘরে তখন ওরা কফি খাচ্ছে। থমথমে হয়ে আছে মার্শালের মুখ, ওকে এত গম্ভীর এ যাবৎ কখনও দেখেনি গ্রীন।
গ্রীন বলল, তোমার অফিসে গিয়েছিলাম, কেবল ডেপুটি ছিল।
ওপর নীচ মাথা ঝাঁকিয়ে মক বলল, সেজের অসল্যার ভার্জিল রীডকে ডাক্তারের কাছে আনার পরপরই ও খবর দিয়েছে আমাকে। তোমার তলবও পেয়েছি তখন: অসল্যারের সাথে আলাপ হয়েছে আমার। ও বলল, হালাম তোমাকে খুঁজছে।
আন্দাজ করেছিলাম। কোথায় আছে এখন, জানো কিছু?
না। তবে অসল্যার বলল রীডকে নিয়ে ও আসার আগেই হালাম রওনা হয়েছে। কাজেই স্বচ্ছন্দে ধরে নিতে পার কাছেপিঠেই কোথাও ওত পেতে আছে তোমার জন্য।
মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল গ্রীন।
অন্ধকারে অনেক গোলাগুলি হয়েছে–আর না। এবার আমি হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ব। প্রয়োজন হলে কাল সকালে আমাকে খুঁজে নিতে পারবে-যদি সেটাই চায় ও।
গ্রীনের দিকে তাকাল মার্শাল। এখনও কিন্তু শহর ছাড়ার সময় আছে, বলল রুক্ষ গলায়।
এই নিয়ে তিনবার কথাটা আমাকে বললে তুমি, কাঠখোট্টা গলায় জবাব দিল গ্রীন। ভাল করেই জানো, আমি তা করব না। কেন করব না-তাও জানো।
টুপি পরল গ্রীন। মক একদৃষ্টে তাকিয়েছিল, বলল, চল, হোটেল অবধি এগিয়ে দিই তোমাকে, তারপর অফিসে যাব।
বেশ, গ্রীন বলল।
খাবারের জন্য মারিয়াকে ধন্যবাদ দিল ও। এ পর্যন্ত মনে হয় একবারও দাম দেইনি, শাস্যে বলল। মুফতে খাচ্ছি। চলি, শুভ রাত্রি। ঘুমাও ভাল করে।
তোমার এরকম বিপদে আমার ঘুম হবে কীভাবে? জানতে চাইল, মারিয়া। রাতটা এখানেই থেকে যাও। বল থাকবে, থাকবে না।
আজ রাতে না, মারিয়ার গাল টিপে দিল গ্রীন। পরে, আমাদের বিয়ের পর।
ধাক্কা মেরে ওর হাত সরিয়ে দিল মেয়েটা, চোখ জ্বলছে।
কে বিয়ে করছে তোমাকে? আমি না! বোকা গ্রিংগোকে কে করবে বিয়ে, মরা মানুষের সাথে ঘর করতে পারব না আমি।
বড় বড় হয়ে গেছে মারিয়ার চোখ, মুহূর্তের জন্য গ্রীনের মনে হলো মেয়েটা বুঝি কেঁদে ফেলবে।
ঝুঁকিটা নিয়েই দ্যাখ, বলে ক্যান্টিনার মূল ঘরে পা রাখল ও। একটু থেমে এক পেগ টেকুইলা পান করল মক, দাম চুকিয়ে বেরিয়ে এল দুজন।
বাইরে রাতের রাজপথ নীরব, কোমল। ধীর পদক্ষেপে হাঁটছে ওরা। গ্রীন বিড়বিড় করে বলল, সেজে আরও দুজন লোক ছিল। একজনকে মেরে বেহুশ করেছিলাম আমি। দ্বিতীয়জন বোধহয় মারা গেছে-নাম হাচ।
অসল্যারের কথা অনুযায়ী, হাচ মারা গেছে। অপরজনের নাম তুর্ক। অসল্যারকে ও বলেছে সকালে হাচকে সে কবর দেবে। কিন্তু অসল্যারের ধারণা তার আগেই ভাগবে ব্যাটা, তাই ও নিজেই কবর দিয়ে আসবে গিয়ে।
তা হলে মিটে গেল এদিককার পাট। লাশ বেশিক্ষণ বাইরে ফেলে রাখতে নেই, অযথা কষ্ট দেয়া।
হাঁটার সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশপাশের গলিঘুচি, ছায়াচ্ছন্ন এলাকা জরিপ করছে ওরা। এত রাতে একমাত্র স্যালুনগুলোই খোলা আছে। গোটা কয়েক পনি বাধা আছে ওগুলোর হিচরেইলে। হোটেলের খোলা দরজা দিয়েও আলো এসে পড়েছে বাইরে, হলুদ করে তুলেছে বারান্দা। এতক্ষণ স্নায়ুর চাপে ভুগছিল গ্রীন, বারান্দার ধাপে পৌঁছে হাঁপ ছাড়ল।
এগিয়ে দেয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, মার্শাল। শুভ রাত্রি। দেখা হবে কাল, সম্ভবত।
হুঁশিয়ার থেক, গম্ভীর সুরে বলল মক। গ্রীন ওপর-নীচ মাথা ঝাঁকিয়ে উঠতে শুরু করল সিঁড়ি ভেঙে। প্রায় মাথায় পৌঁছে গেছে ও, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওকে হোটেলের বাড়িতে, এই সময় রাস্তা থেকে ভেসে এল একটা বাজখাই গলা।
আজ পর্যন্ত কারও পিঠে গুলি করিনি আমি-ঘুরে দাঁড়াও, গ্রীন!
সামনে, বারান্দার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল গ্রীন, প্রায় একই সময় নীচের রাস্তায় হালামের পিস্তল গর্জে উঠল। ক্রুদ্ধ গুঞ্জন তুলে মাথার ওপর দিয়ে লবির দিকে উড়ে গেল বুলেট। একটা আর্তচিৎকার ভেসে এল ভেতর থেকে। ইতিমধ্যে পিস্তল বের করে গড়িয়ে একপাশে সরে গিয়েছিল গ্রীন, অ্যাংকর মালিক আবার গুলি ছুঁড়তে তার পিস্তলের আগুন লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপল ও!
তারপর মার্শাল মকের কর্কশ অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনতে পেল গ্রীন। পিস্তল ফেলে দাও, হালাম। খুনের চেষ্টা করার দায়ে গ্রেফতার করা হলো তোমাকে।
অশ্রাব্য খিস্তি করল হালাম, বিরক্ত হয়েছে।
কেন, ব্যাটা বুড়ো গর্দভ, তুমি কেন এর মধ্যে অবজ্ঞার সুরে শুরু করল হালাম, আধপাক ঘুরে গুলি করল মার্শালকে।
কিন্তু মক ততক্ষণে সরে গেছে অন্যপাশে, পাল্টা গুলি করল সে, বারান্দা থেকে গ্রীন তার দ্বিতীয় গুলিটা ছুঁড়ল।
হালামের তরফ থেকে আর কোন সাড়াশব্দ এল না, আচমকা গোলাগুলির পর থমথমে নীরবতা নেমে এসেছে, রাস্তার মাঝখানে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ। তারপর দূর থেকে কোলাহল ভেসে এল, লোকজন ছুটে আসছে। রাস্তায় নেমে গেল গ্রীন, হালামের লাশের কাছে মকের সঙ্গে মিলিত হলো।
চল, বাতিতে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করি, বলল মক। সিঁড়ির গোড়ায় যেখানে সামান্য আলো এসে পড়েছে, ধরাধরি করে হালামের দেহ সেখানে নিয়ে গেল ওরা। লাশের ওপর ঝুঁকে পড়ল মার্শাল, জামার বোতাম খুলল। একসময় পরীক্ষা শেষ করে উঠে দাঁড়াল সে।
একটাই গুলি লেগেছে। সোজা হৃৎপিণ্ডে, মনে হয়। তুমি অথবা আমি-কে তা জানার উপায় নেই। অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না।
ভিড় জমে উঠেছে চারপাশে, বিস্ফারিত চোখে দেখছে, অশি। ক্লান্ত সুরে মককে বলল গ্রীন, আমার কিছু করার থাকলে বৎ। না হলে আমি ঘুমাতে চললাম।
যাও। সকালে দেখা হবে।
দোতলায় নিজের কামরায় উঠে গেল গ্রীন, মাথা খালিখালি লাগছে। পরে এক সময়ে কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা সম্পর্কে ভাববে ও কাপড়চোপড় খুলে বিছানার চাদরের তলায় ঢুকল সে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল।
.
মারিয়া বলছিল, কাল রাতে গুলির শব্দ পেয়ে পাগলের মত ছুটে আসছিলাম আমি। ভয় হচ্ছিল তুমি মারা গেছ। তারপর দেখলাম লোকজন ভিড় করে একটা লাশ দেখছে-হালামের। খুশিতে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। তারপর মার্শাল মক এসে বলল, তুমি ঘরে আছ, ঘুমাচ্ছ। তাই আর বিরক্ত করিনি, ফিরে গিয়ে আমিও ঘুমিয়ে পড়েছি।
বেলা করে, হোটেলের খাবারঘরে বসে নাস্তা খাচ্ছে ওরা, এরপর কার্লকে দেখতে যাবে। মারিয়া ঠিক করেছে ছেলেটাকে তার বাবার মৃত্যুসংবাদ জানাবে ও। হাজার হলেও বাপ; সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করবে কার্লকে।
আমরা খুব আপন, কার্ল আর আমি। সেই ওর ছোটবেলা থেকে। আর এখন ও বড় হয়ে গেছে।
ওরা এখন হাঁটতে হাঁটতে ডাক্তারের বাসায় যাচ্ছিল, আড়চোখে গ্রীনকে একবার মাপল মারিয়া।
ছেলেটার ব্যাপারে ভাবলে কিছু?
তোমার কথাই ঠিক-বড় হয়ে গেছে।
কথা বলার জন্য মুখ খুলছিল মারিয়া, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কি ভেবে চুপ করেই রইল।
দরজায় ওদের সঙ্গে মিলিত হলো ডাক্তার, ভেতরে নিয়ে গেল।
তোমরা বোধহয় কার্লের সাথে দেখা করতে এসেছ। জেগে আছে, তবে দু চার মিনিটের বেশি থেক না। খানিক আগে মার্শাল মক এসেছিল, ওর বাবার মৃত্যুর খবর জানিয়ে গেছে। শান্তভাবেই ব্যাপারটা নিয়েছে কাল, তবে দেরিতে প্রতিক্রিয়া হওয়া অসম্ভব না। ঠিক আছে, যাও তোমরা। করিডরের শেষ দরজা।
মারিয়া এগোল, কিন্তু গ্রীন আরেকটু থেমে জিজ্ঞেস করল, ভার্জিল রীড কেমন আছে, ডাক্তার? খারাপ চোট?
ওই বুড়ো মরবে না সহজে, এটুকু বলতে পারি, হাসল ডাক্তার। একটু মাংস উড়ে গেছে। তবে ওর দুঃখ স্যালুনটার জন্য। মনে হয় না আর কিছু অবশিষ্ট আছে।
সাধ করে নিজের সর্বনাশ করেছে রীড আচ্ছা, ধন্যবাদ, ডাক্তার।
ডাক্তার বেরিয়ে যেতে কার্লের ঘরে গেল গ্রীন। বিছানার পাশে বসে ওর একটা হাত ধরে আছে মারিয়া। ও ঢুকতে ম্লান হেসে ছেলেটা বলল, আপাতত বোধহয় তোমার সঙ্গে আমি টাওসে যেতে পারছি না, মিস্টার গ্রীন।
টুপি খুলে আগে বাড়ল গ্রীন। তুমি টাওসে যাচ্ছ না, কার্ল। এই মামলার কারণে না। আজই আমার রিপোর্ট পাঠাচ্ছি আমি, তোমার নাম থাকছে না।
আন্তরিক সুরে কথা বলছে ও। তোমার যা অপরাধ, আমার দৃষ্টিতে যথেষ্ট সাজা হয়েছে। তোমার সুস্থ হয়ে ব্যবসা দেখবে। এটাই গুরুত্বপূর্ণ। কাজই একজন মানুষের জীবনে সব।
অপলকে গ্রীনকে লক্ষ করছিল মারিয়া, দৃষ্টিতে আনন্দ। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কার্ল, হাত টেন নিল মারিয়ার মুঠি থেকে, সিলিংয়ের পানে তাকাল।
হ্যাঁ, ব্যবসা দেখব আমি, একসময় বলল ও। মার্শালের সঙ্গে র্যাঞ্চের ব্যাপারে আলাপ হয়েছে আমার। লী কার্টারকে খবর দিতে পাহাড়ে লোক পাঠাবে সে। লী অস্থায়ী ফোরম্যান, ভাল মানুষ। আমি ওর নিয়োগ পাকা করব। এখন ও-ই দেখাশোনা করবে সবকিছু। স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত হলো কার্লের চেহারা। রাউন্ডআপের আগেই পুরোপুরি সুস্থ হতে চাই আমি।
খানিক বাদে বিদায় নিল গ্রীন আর মারিয়া! চলে আসার আগে মারিয়া প্রতিশ্রুতি দিল, ডাক্তার রাজি হলে, রোজ ওর প্রিয় মেক্সিক্যান খাবারগুলো নিজের হাতে রেঁধে নিয়ে আসবে সে।
রাস্তায় বেরোতে রোদের তীব্র ঝাঁঝ টের পেল ওরা। চারপাশে কর্মব্যস্ত মানুষের ভীড়। গ্রীন বলল, তুমি যাও। আমি মার্শালের সঙ্গে দেখা করব। হয়তো ওর অফিসে বসেই লিখে ফেলব আমার রিপোর্ট।
তারপর আসছ? দুপুরে খেতে?
সি, সিনোরিটা, বলে টুপির কারনিসে হাত ছোঁয়াল গ্রীন, রাস্তা পেরিয়ে মার্শালের অফিসে গিয়ে ঢুকল।
ডেস্কে বসে কাজ করছিল মক, অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ বেশ তরতাজা দেখাচ্ছে ওকে।
ভালই করেছ এসে, বলল মার্শাল। কার্লকে দেখতে গিয়েছিলে? আমি সকালে ঘুরে এসেছি, ভাবলাম আমারই দায়িত্ব ওর বাবার মৃত্যুসংবাদটা ওকে দেয়া। চেয়ারে হেলান দিল মক। কার্লও আমাকে একটা মজার খবর জানাল। তোমার মনে আছে আমি বলেছিলাম, হালাম, হার্ভে স্টেজ আর ড্রাম ডার্লিংয়ের মধ্যে একটা, কিন্তু আছে? আসলেও তাই। লিউ নামে এক লোকের কাছে ব্যাপারটা জানে কার্ল-এর পরপরই মাতাল হয়ে ওইসব কাণ্ড করে ও। হালাম আর তার ওই তিন বন্ধু যুদ্ধের অল্প কদিন পর একটা আমি পে-রোল লুট করে। কয়েকজন অফিসারকে খুন করে টাকা নিয়ে সরে পড়ে এরা। লিউ তার বখরা নিয়ে চলে যায় নিজের পথে। কিন্তু হালাম, হার্ভে আর ড্রাম ঠিক করে তারা একসঙ্গে থাকবে, টাকাগুলো গরু ব্যবসায়ে খাটাবে। একপাল গরু কিনে এখানে চলে এল ওরা। একসময় আলাদা হয়ে গেল ডার্লিং।
তারপর, কিছুদিন আগে হঠাৎ একদিন বাথানে এসে হাজির হয় লিউ। কার্ল তখন ওখানে। মাতাল ছিল লিউ, নেশার ঘোরে সব ফাঁস করে দেয়। বাপকে ফেরেশতা মনে করত কাল, এবার তার আসল চেহারা জেনে মনে দারুণ আঘাত পেল। যাই হোক একটু বাদে ওর বাবা আর হার্ভে স্টেজ ফিরে এলে খড়ের গাদায় আত্মগোপন করে কার্ল। লিউর সাথে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয় ওদের, তারপর হার্ভে ওর মাথায় কোদালের বাড়ি মেরে খুন করে ওকে আমার বিশ্বাস, গুলি করার ঝুঁকি নিতে চায়নি ওরা। এরপর হালামকে পাহারায় রেখে লিভারি বার্নের যেখানে কেরোসিনের ব্যারেল রাখে ওরা সেখানে গর্ত খুঁড়ে লিউকে মাটিচাপা দেয় হার্ভে।
দম নিতে থামল মক, তারপর নিচু সুরে বলল, আমাদের মুর্দাফরাশকে সঙ্গে করে আমি ওখানে যাচ্ছি। লাশটা উঠিয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করব। বিচ্ছিরি কাজ।
জিভ নেড়ে চুকচুক শব্দ করল গ্রীন, এপাশ-ওপাশ মাধা নাড়াল।
এ দেখছি, একেবারে বটতলার উপন্যাস, মার্শাল। অবশ্য যুদ্ধের পর হঠাৎ করে বেকার হয়ে গিয়ে প্রথম প্রথম অনেকেই চুরি-ডাকাতি করেছিল।
এখনও আছে অনেক চোর-ডাকাত, গম্ভীর সুরে বলল মক। নাহ্, আমি এবার যাই; দেরি করলে বেলাবেলি ফিরতে পারব না।
আমাকে আমার রিপোর্ট পাঠাতে হবে, মার্শাল। কার্লের নাম থাকবে না। তোমার অফিসটা ব্যবহার করলে আপত্তি আছে?
স্বচ্ছন্দে করতে পার। ডান দিকের ড্রয়ারে দোয়াত, কলম, কাগজ সবই পাবে। একটা ব্যাজ এঁটে দেব বুকে?
মার্শালের রসিকতায় মৃদু হাসল গ্রীন, মাথা নাড়াল।
মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল মক, গ্রীন কাজে বসল। রিপোর্ট লেখা শেষ করে তলায় নিজের নাম সই করছে ও, এমন সময় ঘরে ঢুকল মারিয়া, ক্ষুব্ধ চেহারা।
আর কতক্ষণ লাগবে তোমার? দেরি সহ্য হচ্ছিল না, তাই চলে এলাম।
এইমাত্র শেষ করলাম, চেয়ার ছাড়তে ছাড়তে একগাল হেসে বলল গ্রীন। লাথি মেরে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে, কাছে টেনে নিল মারিয়াকে। আচ্ছা, অস্থির হয়ে পড়েছ তা হলে? বিয়ে অবধি তর সইছে না?
চোখ কুঁচকে ওর দিকে তাকাল মারিয়া। কবে? জিজ্ঞেস করল।
রোববার?
হাহ্। তারপর ক্যালিফোর্নিয়া?
হ্যাঁ, তবে এক্ষুণি না। ক্যান্টিনাটা বিক্রি করতে হবে তোমাকে, তারপর আমরা ডেনভার হয়ে ক্যালিফোর্নিয়া যাব। ডেনভারে আমার একটা সম্পর্ক আছে, চুকিয়ে ফেলব সেটা।
দুম করে গ্রীনের বুকে কিল মারল মারিয়া। চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল, কে? কোন মেয়ে বুঝি?
জবাব দিল না গ্রীন, ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অন্য কাজে।
Leave a Reply