নিলীমা – কাসেম বিন আবুবাকার
প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০০৮
উৎসর্গ
উদীয়মান লেখক
সাঈফ আবেদীন
আমার খুব প্রিয় একজন…
(১) “যাহারা ইমান আনিয়াছে এবং সৎ কাজ করিতে থাকে, তাদের জন্য ক্ষমা ও সম্মান জনক জীবিকা রহিয়াছে।” –আল-কুরআন, সূরা-হজ্ব, আয়াত-৫০, পারা-১৭
(২) “পূর্ণময়ী স্ত্রী মানুষের সৌভাগ্যের সূচক”–সাগীর।
(৩) মিথ্যাবাদী মিথ্যা দ্বারা কেবল নিজেকে কষ্ট দেয়।”–সাগীর
১
আজ মাঘের শেষ। দুপুরের পর হঠাৎ ভীষণ মেঘ করে অনেক্ষণ ধরে শীলাবৃষ্টি হয়েছে। তার পর থেকে হিমেল বাতাস বইছে। তাই সামিনা বেগম ছেলেমেয়েদের নিয়ে সোনার গাঁও রাজবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার কথা থাকলেও গেলেন না। তাদের নিয়ে ড্রইংরুমে বসে টিভিতে একটা ভারতীয় হিন্দি ছবি দেখছেন।
নিলীমার বেড়াতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে থাকলেও টিভি দেখতে মোটেই ভাল লাগে না। অবশ্য বেড়ানো বা টিভি দেখার ইচ্ছা তার কোনোদিন পূরণ হয় নি। কারণ তার মামি ড্রইংরুমে টিভি দেখার পারমিশন দেননি এবং কখনও তাকে কোথাও বেড়াতেও নিয়ে যাননি। সে জন্য নিলীমার কোনো দুঃখ নেই। সে বই পড়ার পাগল। অবসর পেলেই বই পড়ে। তার মামা সেকেন্দারের ভীষণ বই। পড়ার নেশা ছিল। তাই বাড়িতে একটা লাইব্রেরী করে প্রচুর বই স্টক করেছিলেন। সেই বই-এর মধ্যে ধর্মীয় বই, মানে কুরআনের বাংলা ব্যাখ্যা, বিভিন্ন হাদিসের বাংলা অনুবাদ, মুসলিম মনীষীদের জীবনি ও ইসলামিক বিভিন্ন বইই বেশি। তা ছাড়া শিশু-কিশোরদের উপযুক্ত মনীষীদের জীবনি, বিভিন্ন দেশের রূপকথা, বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস ও গল্পের বইও আছে।
নিলীমার বয়স এখন বার। দু’বছর আগে যে বছর প্রাইমারী পাস করে সেই বছর সেকেন্দার মারা যান। তারপর তার মামি সামিনা বেগম তাকে আর স্কুলে না পাঠিয়ে সংসারের কাজে লাগিয়েছেন। এই দু’বছরের মধ্যে সে শিশু-কিশোরদের অনেক বই পড়ে ফেলেছে। আজ লাইব্রেরী রুমের জানালার ধারে পর্দার আড়ালে বসে নাসির উদ্দিন হুজ্জার গল্প সমগ্র পড়ছিল। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হতেই চমকে উঠল। পরক্ষণে মামাত ভাই জামানের গলা শুনতে পেল, দূর! এখানে তো নেই।
নিলীমা জামানকে খুব ভয় পায়। তাকে একদম দেখতে পারে না। মামা মারা যাওয়ার পর থেকে যখন তখন সামান্য কারণে অথবা বিনা কারণে তাকে মারে। তার চেয়ে চার বছরের বড় জামান। কিন্তু স্বাস্থ্য খুব ভালো দেখতে লম্বা চওড়া যুবকের মতো। নিলীমাকে নিষ্ঠুরের মতো মারে। সামিনা বেগম দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন। নিলীমার গড়ন পাতলা। চোখ দুটো ভীষণ সুন্দর। চোখের মনি নীল। তাই হয়তো তার মা বাবা মেয়ের নাম রেখেছেন নিলীমা।
সামিনা বেগম নিলীমাকে এতটুকু পছন্দ করেন না। তাই তাকে দিয়ে বাসার যাবতীয় কাজ করান। নিজের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে খেলাধূলা, মেলামেশা ও খাওয়া দাওয়া করতে দেন না। দু’বেলা পেট ভরে খেতেও দেন না। অসুখ বিসুখ করলেও নিস্তার নেই। সেই অবস্থায়ও সংসারের সব কাজ করান। ভালো জামা কাপড়ও পরতে দেন না। ঝি চাকরানীর মতো তাকে সব সময় বকাঝকা করেন। একটু আদর যত্ন বা পেট ভরে খেতে পেলে নিলীমার স্বাস্থ্য যেমন ভালো হত, তেমনি দেখতে আরও বেশি সুন্দরী হত। সামিনা বেগমের দু’ মেয়ে কেকা ও চম্পা দেখতে ভালো নয়। নিজের মেয়েদের তুলনায় নিলীমা অনেক বেশি সুন্দরী। তাই হয়তো তিনি নিলীমাকে দেখতে পারেন না এবং তার সঙ্গে চাকরানীর মতো ব্যবহার করেন। কোনো মেহমান কুটুম এলে তাদের সামনেও তাকে যেতে দেন না।
যাই হোক, নিলীমা পর্দার আড়ালে থাকার কারণে জামান তাকে দেখতে পেল না। তাকে খুঁজে না পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কেকা, মাকে বল নিলীমা এ ঘরে নেই। বৃষ্টির মধ্যে বাইরে চলে গেছে।
প্রতি উত্তরে কেকা বলল, আমার মনে হয় ও জানালার পর্দার আড়ালে বসে বই পড়ছে।
কেকার কথা শুনে নিলীমা চিন্তা করল, জামান যদি তাকে এখানে পায়, তা হলে সাড়া না দেয়ার কারণে মারের মাত্রা অনেক বেড়ে যাবে। তাই তাড়াতাড়ি পর্দা সরিয়ে তার সামনে এসে সাহস করে বলল, আমাকে খুঁজছিলে কেন?
জামান গম্ভীর স্বরে বলল, আমাকে আপনি করে বলবি। এদিকে আয় বলে একটা চেয়ারে বসে বলল, সামনে আয়। নিলীমা সামনে এসে দাঁড়াতে এক চোখ খোলা রেখে অন্য চোখ বন্ধ করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
নিলীমা বুঝতে পারল, তাকে মারার পূর্ব প্রস্তুতি।
আচমকা বেশ জোরে লাথি মারল নিলীমার তলপেটে।
মাগো বলে টলমল করতে করতে কয়েক পা পিছিয়ে এসে টাল সামলাল নিলীমা। পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। ঠোঁট কামড়ে ব্যথাটা সহ্য করল।
জামান হাসিমুখে বলল, এটা লুকিয়ে থাকার শাস্তি।
পরবর্তী আঘাতের জন্য চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল নিলীমা।
পর্দার আড়ালে কি করছিলি?
ভয়ার্তস্বরে নিলীমা বলল, পড়ছিলাম।
কি পড়ছিলি দেখি।
নিলীমা জানালার কাছ থেকে বইটা এনে তার হাতে দিল।
বই দেখে জামান বলল, আমাদের বই পড়ার কোনো অধিকার তোর নেই। আর কখনও কোনো বই ধরবি না। তোর বাপ এক কানাকড়িও দিয়ে যাই নি। আর দেবেই কি করে? সে তো পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়াত। আমাদের মতো ভদ্রলোকের বাড়িতে তোর থাকার অধিকার নেই। এখানে থাকতে তোর লজ্জা করে না? বাঁদী দাসির মতো থাকবি। তারপর বলল, যা, দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়া।
দরজার কাছে এসে দাঁড়াতে জামান হাতের ভারি বইটা ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হলে নিলীমা ভয়ে চিৎকার দিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার আগেই আঘাত পেয়ে পড়ে গেল। মাথাটা সজোরে ঠুকে গেলে দরজার সঙ্গে। কেটে গিয়ে দরদর করে বেরিয়ে এল রক্ত। তীব্র ব্যথায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নিলীমা খুব রাগের সঙ্গে বলল, বদমাস, খুনী কোথাকার।
জামান চিৎকার করে বলল, কি বললি? দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি বলে তেড়ে এসে চুলের মুঠি ও কাধ ধরে মেঝের সঙ্গে চেপে ধরল।
নিলীমা মরিয়া হয়ে তাকে কিল চড় মেরে ও মুখে খামচি কেটে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগল।
জামান উচ্চস্বরে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তাড়াতাড়ি এসে দেখ কালনাগিনী খামচে আমার মুখ চিরে দিচ্ছে।
সামিনা বেগম ছেলের গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি এলেন। ওনার সঙ্গে কাজের বুয়া মরিয়মও এল। প্রথমে সে-নিলীমাকে ছাড়িয়ে নিল। আর সামিনা বেগম দাঁত কিড়মিড় করে নিলীমার চুলের ঝুঁটি ধরে মারতে মারতে বললেন, তোর এত বড় সাহস, আমার ছেলের গায়ে হাত তুলিস? তারপর মরিয়মকে বললেন, ওকে উপরের ঘরে তালা দিয়ে রেখে আয়।
মরিয়ম সামিনা বেগমের বাপের বাড়ির গ্রামের মেয়ে। আধা বয়সী মেয়ে হলেও অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারীনি। সে নিলীমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল। নিলীমা হাত পা ছুঁড়ে তীব্র প্রতিবাদ করে যেতে চাইল না। কিন্তু মরিয়মের সঙ্গে পেরে উঠল না। সে তাকে দু’হাতে তুলে উপরের ঘরে নিয়ে এসে বলল, তোমাকে কতবার বলেছি, জামানের সঙ্গে লাগবে না। কথা না শোনার ফল ভোগ কর বলে বেরিয়ে যেতে উদ্দত হল।
নিলীমা তাকে খালাআম্মা ডাকে। তাকে চলে যেতে দেখে বলল, খালাআম্মা, আমাকে এখানে রেখে যাবেন না। তারপর নিয়ে যাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করে বলল, এখানে থাকলে ভয়ে মরে যাব। কিন্তু কোনো ফল হল না। দরজা বন্ধ করে শিকল লাগিয়ে মরিয়ম চলে গেল।
নিলীমার মামা সেকেন্দার এই রুমে মারা গেছেন। ছোট মেয়ে চম্পা জন্মাবার দু’বছর পর থেকে স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে এই রুমে থাকতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে এ ঘরে কেউ ঘুমায় না। ঘরটা সম্বন্ধে কেমন যেন একটা ভীতিকর অসস্তি অনুভব করে সকলে।
সব ঘরেরই এক সাইডে খাট থাকে; কিন্তু এই ঘরের মাঝখানে খাট। খাটে পরিপাটি করে বিছানা সাজানো। খাটের পাশে একটা টেবিল ও চেয়ার। বড় বড় তিনটে জানালার পাল্লা বন্ধ। ঘরের ভিতরে ভীষণ ঠাণ্ডা, আর নিঝুম। বেশ ভয় ভয় করতে লাগল নিলীমার। ভাবতে লাগল নিজের দুর্দশার কথা। সব সময় মামিকে খুশি রাখার চেষ্টা করে। তবুও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গালাগালি শুনতে হয়?
মাথায় যন্ত্রণা অনুভব করে কেটে যাওয়া জায়গাটায় হাত দিয়ে বুঝতে পারল, এখনও রক্তপড়া বন্ধ হয়নি। চুপচাপ বসে কাঁদতে লাগল।
এখন বিকেল চারটে। শীতকালে বিকেল চারটে থেকে দিনের আলো কমতে থাকে। মেঘলা আকাশের জন্য সন্ধ্যার অন্ধকারের মতো লাগছে। হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল। সেই সাথে ঝড় উঠল। বৃষ্টির ছাঁট জানালার পাল্লায় লাগছে। বন্ধ দরজা জানালায় বাতাস লেগে শো শো শব্দ হচ্ছে। ঠাণ্ডায় নিলীমা ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। তখন তার মায়ের কথা মনে পড়ল। পাঁচ বছর বয়স হলেও স্পষ্ট মনে আছে, মা মারা যাওয়ার সময় সেকেন্দার মামার হাতে একটা পুটলী দিয়ে বলেছিল, “এই দুনিয়াতে নিলীমার নানা নানি থেকেও নেই। তুমি একে নিজের মেয়ের মতো লেখাপড়া করাবে। সেই সাথে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে এবং সেই মতো অনুশীলন করিয়ে মানুষ করো।” সেকেন্দার মামাও মাকে কথা দিয়েছিল, নিলীমাকে মায়ের কথা মতো লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করবে।
সেকেন্দার যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন নিলীমার মাকে দেয়া কথা রেখেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে নিলীমার উপর শুরু হল মামি ও মামাত ভাই-এর অত্যাচার। মামাত বোন দুটো তার চেয়ে ছোট, তাই হয়তো কিছু করার সাহস তাদের হয়নি।
সেকেন্দার নিলীমাকে খুব ছোটবেলায় মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে নামায ও কুরআন পড়া শিখিয়েছিলেন। সেকেন্দার যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন নিলীমা একদিনও নামায বা কুরআন পড়া বাদ দেয়নি। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর মামিমা তাকে আর ওসব করতে দেয় নি।
ঝড় বৃষ্টির তোড়ে হঠাৎ ছাদের দিকের একটা জানালার ছিটকিনি ভেঙ্গে যেতে দুটো পাল্লা শব্দ করে খুলে গেল। সেই সাথে হু হু করে বৃষ্টির ছাঁট ঘরের মধ্যে আসতে লাগল। এমনিই আগে থেকে ঠাণ্ডায় ও ভয়ে নিলীমা ঠক ঠক করে কাঁপছিল, তার উপর এই ঘটনায় আরও বেশি ভয় পেয়ে সেই কাঁপনি বেড়ে গেল। এমন সময় বিদ্যুৎ চমকে উঠে কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়তে চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় পড়ে গেল।
নিলীমার উপর যে অন্যায়ভাবে অত্যাচার করা হয়, তা কাজের বুয়া মরিয়ম জানে। সে জন্যে দুঃখ অনুভব করলেও তার কিছু করার নেই। গৃহকর্তী মানে সামিনা বেগম যদি জানতে পারেন নিলীমার জন্য সে দরদ দেখাচ্ছে, তা হলে তাকে দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। দেশের বাড়িতে তার কেউ নেই যে তাকে খাওয়াবে। তাই নিলীমা তাকে কেঁদে কেঁদে ঐ ঘর থেকে নিয়ে যেতে বললেও তা করতে পারে নি। এখন কাছাকাছি বাজ পড়তে ভাবল, মেয়েটা হয়তো ভয়ে জ্ঞান হারাল, না মরেই গেল আল্লাহ জানে। এদিক ওদিক তাকিয়ে সামিনা বেগমকে দেখতে না পেয়ে চুপি চুপি ছাদের ঘরে এসে দরজা খুলে অন্ধকারের জন্য কিছুই দেখতে পেল না। বিদ্যুৎ চমকাতে তাকে মেঝেয় পড়ে থাকতে দেখল। তাড়াতাড়ি কাছে এসে নাকে হাত দিয়ে বুঝতে পারল নিশ্বাস বইছে। মাথা ধরে নাড়া দিতে দিতে কয়েকবার নাম ধরে ডাকতেই নিলীমার জ্ঞান ফিরে এল।
মরিয়ম জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোমার? মেঝেয় শুয়ে রয়েছ কেন?
নিলীমা উঠে বসে বলল, এখান থেকে আমাকে আমার ঘরে নিয়ে চল খালা আম্মা।
কি হয়েছে বলবে তো? কিছু দেখে ভয় পেয়েছ?
নিলীমা তার দুটো হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলল, বাজ পড়ার আগে বিদ্যুৎ চমকে উঠতে একটা ভূতকে ঐ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম বলে খোলা জানালার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল।
এমন সময় সামিনা বেগম এসে রাগের সঙ্গে বললেন এখানে হচ্ছেটা কি? বলেছি না, আমার হুকুম ছাড়া কেউ এই ঘর খুলবে না?
মরিয়ম ভয়ার্ত স্বরে বলল, বাজ পড়ার সময় মেয়েটার চিৎকার শুনে এসে দেখি অজ্ঞান হয়ে মেঝেয় পড়ে আছে।
অজ্ঞান কেন, মরে পড়ে থাকলেই ভালো হত। তারপর সামিনা বেগম নিলীমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোর দুষ্টুমীর শাস্তি স্বরূপ আজ সারারাত এখানে থাকবি, কাল সকালে ছাড়া পাবি।
নিলীমা আঁৎকে উঠে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে অন্য যে কোনো শাস্তি দিন, সারারাত এখানে থাকলে মরে যাব মামিমা।
সামিনা বেগম কর্কশস্বরে ধমকে উঠলেন, চুপ, একদম চুপ। মরে গেলে আমি নিস্তার পাই। তারপর মরিয়মকে নিয়ে বাইরে এসে দরজায় তালা মেরে নিচে চলে গেলেন।
তখন রাত হয়ে গেছে। দরজা লাগিয়ে দিতেই ঘরটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে গেল। নিলীমা আরও বেশি ভয় পেয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে কাকুতি মিনতি করে তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে বলতে একসময় আবার জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় পড়ে গেল।
২
পরের দিন সকাল আটটায় নিলীমার জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে তাকিয়ে বুঝতে পারল, তার ঘরেই শুয়ে আছে। গতকালের ঘটনা মনে পড়তে একবার শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে নিল। তারপর আবার চোখ খুলে ঘরের চারপাশে তাকাল। পায়ের দিকে মরিয়ম খালাআম্মা দাঁড়িয়ে আছে। মাথার কাছে ডাঃ হারুণকে বসে থাকতে দেখে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
নিলীমাকে চোখ খুলতে দেখে মরিয়ম সেখান থেকে চলে গেল।
ডাক্তার হারুন মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, বলতো আমি কে?
আপনি ডাক্তার চাচু বলে নিলীমা সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে ডাক্তার হারুন বললেন, আমি ভালো, তুমি কেমন আছ বল।
আমি তো ভালো আছি। কেন? আমার কি কোনো অসুখ করেছে? আপনি কি আমাকে দেখতে এসেছেন?
হ্যাঁ, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। গতরাতে তোমার কি হয়েছিল? অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে কেন?
ওরা আমাকে দোতলার ছাদের ঘরে আটকে রেখেছিল, ঐ ঘরে মামা মারা গিয়েছিল, সেই থেকে ঐ ঘর বন্ধ ছিল। আমাকে রেখে দরজায় তালা দিয়ে দিয়েছিল, হ্যারিকেন বা মোমবাতি দেয়নি। অন্ধকার ঘরে খুব ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করি, তবু ওরা আমাকে জোর করে ঐ ঘরে আটকে রেখেছিল, তখন। খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। কাছাকাছি বাজ পড়তে ভয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
তোমাকে ওরা ঐ ঘরে রেখেছিল কেন? নিশ্চয় কোনো কারণ ছিল?
নিলীমা কারণটা বলে বলল, আমাকে যেন ঐ ঘরে বন্দি করে আর না রাখে সে কথা মামিমাকে বলবেন।
তা না হয় বলব; কিন্তু তোমার মন অত খারাপ কেন? মুখও শুকিয়ে কড়িকাঠ হয়ে গেছে।
আমার অনেক দুঃখ। সেসব আপনি শুনবেন?
হ্যাঁ, শুনব, তুমি বল।
আমার মা বাবা কেউ বেঁচে নেই। আমার বয়স যখন পাঁচ তখন তারা মারা যান। সেকেন্দার মামা আমাকে নিয়ে আসে। মামি আমাকে একদম পছন্দ না করলেও মামা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন তার অগোচরে শুধু বকাঝকা করত। মামা মারা যাওয়ার পর সারাদিন রাত গালাগালি আর মারধর করে। মামাত ভাই জামানও কারণে অকারণে খুব মারে। এখানে থাকতে আমার ইচ্ছা করে না, সুযোগ থাকলে অন্য কোথাও চলে যেতাম। কথা বলার সময় চোখ থেকে নিলীমার পানি পড়ছিল। এবার চোখ মুছে বলল, এসব কথা আপনাকে বলেছি। জানলে মামিমা আমাকে হয়তো মেরে মেরে মেরেই ফেলবে। কথা শেষ করে আবার চোখ মুছল।
ডাক্তার বললেন, ভয় নেই, এসব কথা আমি কাউকেই বলব না। আচ্ছা তোমার কি আরও লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে না?
করে না আবার; কিন্তু তাতো সম্ভব নয়।
এমন সময় কাজের বুয়া মরিয়ম এসে ডাক্তারকে বলল, আপনাকে বেগম সাহেব ড্রইংরুমে ডাকছেন।
ডাক্তার বললেন, তুমি যাও, আমি আসছি। মরিয়ম চলে যাওয়ার পর নিলীমাকে বললেন, ওরা যাতে তোমাকে ছাদের ঘরে না রাখে সে কথা বলে যাব। তুমি ধৈর্য ধরে থাক। দেখি, আমি তোমার জন্য কি করতে পারি। তারপর ড্রইং রুমে এলেন।
ডাক্তার হারুনকে সামিনা বেগম স্বামীর বন্ধু হিসাবে জানেন। তা ছাড়া এ বাড়ির কারো অসুখ বিসুখ হলে উনি চিকিৎসা করেন। ওনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করলেন, নিলীমাকে কেমন দেখলেন?
হারুন ডাক্তার বললেন, এখন তো ভালো, তবে ওকে যদি আবার ছাদের ঘরে রাখা হয়, তা হলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। এমন কি পাগলও হয়ে যেতে পারে। যাই হোক, অনুরোধ করব ওকে ঐ ঘরে দিনে হোক অথবা রাতে তোক রাখবেন না। আর ঐ ঘরে রাখার কথা আমাকে বলেছে বলে ওকে কিছু বলবেন না। আচ্ছা, ওর কি অন্য কোনো পরিচয় আছে? সেকান্দার তো একদিন আমাকে বলেছিল, নিলীমা আমার ভাগ্নি।
সামিনা বেগম বললেন, কথাটা সত্য নয়। নিজের সম্মান বাঁচাবার জন্য সবাইকে উনি তাই বলতেন। আসল কথা হল, নিলীমার মা সালমা ধনী ও উচ্চ বংশের মেয়ে। নিলীমার বাবা মিরাজ সাধারণ ঘরের ছেলে। ভার্সিটিতে পড়ার সময় প্রেম করে বিয়ে করে। সালমার বাবা এ বিয়ে মেনে না নিয়ে তালাকের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সালমা রাজি না হয়ে স্বামীর সঙ্গে ঢাকা চলে আসে। তারপর আর কোনোদিন মা বাবার কাছে ফিরে যাইনি। আপনার বন্ধু ও মিরাজ একই গ্রামের ছেলে এবং এক সঙ্গে ভার্সিটিতে পড়ত। ওদের দুজনকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আপনার বন্ধু জানতেন। মিরাজ সালমাকে নিয়ে মিরপুর থাকতেন। চাকরি না পেয়ে দু’জনেই ব্যাচে ছাত্র পড়াতেন। এভাবেই কয়েক বছর বেশ সুখেই ছিলেন। ওনাদের বিয়ে ও ছাত্র পড়ানোর ব্যাপারে আপনার বন্ধু অনেক সাহায্য করেছেন। সে সময় সালমা তাকে ভাই ডেকে ছিলেন। তাই ঢাকা গেলে মাঝে মধ্যে তাদের বাসায় গিয়ে উঠতেন। একবার ঢাকা থেকে ফিরে এসে বলল, মিরাজের টাইফয়েড হয়েছে, বাঁচবে কি না সন্দেহ। তার কয়েকদিন পর গিয়ে দেখল, মিরাজ মারা গেছে। সালমাও টাইফয়েডে আক্রান্ত। সপ্তাহ খানেক পর পাঁচ বছরের নিলীমাকে সঙ্গে করে ফিরে এসে বললেন, সালমাও মারা গেছে।
এই পর্যন্ত বলে সামিনা বেগম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনি তো আমাদের সবকিছু জানেন। নিলীমার মামার ভালো রোজগার ছিল আর এখন তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কিভাবে সংসার চালাচ্ছি, তা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন। তাই নিলীমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।
হারুন ডাক্তার বললেন, আমি যদি নিলীমাকে অন্য কোথাও রেখে স্কুলে ভর্তি করে দিই। তাতে কি আপনার কোনো আপত্তি আছে?
ডাক্তারের কথা শুনে সামিনা বেগম ভীষণ খুশি হলেন। ভাবলেন, আপদটা দূর হলেই ভালো। মনের ভাব প্রকাশ না করে বলেন, আপত্তি থাকবে কেন? হাজার হোক ওর মামার বন্ধু আপনি। তবে মন্দলোকের তো অভাব নেই, তারা। হয়তো আমাদেরকে দোষ দেবে।
ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। সবাই জানবে আপনি ওকে অন্যত্র রেখে লেখাপড়া করাচ্ছেন।
সামিনা বেগম আরও বেশি খুশি হয়ে বললেন, তা হলে তো আর কোনো চিন্তা নেই।
ডাক্তার হারুন বললেন, এখন তা হলে আসি, পরে আবার আসব।
এরপর থেকে এ বাড়ির কেউ নিলীমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না।
শুধু জামান ওকে দেখলেই জিভ বার করে ভেংচি কাটে। তবে কাছেও আসে না আর মারধরও করে না। সামিনা বেগমও তাকে গালাগালি বা মারধর করেন না। এমন কি লাইব্রেরীতে গিয়ে বই পড়লেও কেউ কিছু বলে না।
দশ বছরের কিশোরী নিলীমার ধারণা হল, নিশ্চয় ডাক্তার চাচুর কারণে সবাই তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে। আরও ধারণা হল, ডাক্তার চাচু নিশ্চয় তাকে স্কুলে ভর্তি করার চেষ্টা করছেন।
একমাস পরে রমযান মাস এসে গেল। রমযানের প্রথম তারিখে ডাক্তার হারুন এসে নিলীমা সামিনা বেগম আর ওনার ছেলেমেয়েদের সামনে জানালেন, ঈদের এক সপ্তাহ পরে নিলীমাকে মাগুরা নিয়ে যাবেন। সেখানে সে থাকবে, পড়াশুনা করবে।
কথাটা শুনে আনন্দে নিলীমার চোখে পানি এসে গেল। মামিমা যাতে দেখতে না পায়, সেজন্যে মুখ নিচু করে চোখ মুছে ফেলল।
সামিনা বেগম ভেবেছিলেন, আপদ যত তাড়াতাড়ি দূর হয় ততই ভালো। আরও একমাস থাকবে জেনে অসন্তুষ্ট হলেন। মুখে বললেন, ঠিক আছে, তাই নিয়ে যাবেন। একটা এতিম মেয়ের জন্য যা করেছেন, তার ফল আল্লাহ আপনাকে দেবেন।
হারুন ডাক্তার বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর জামান ভেংচি কেটে নিলীমাকে বলল, মাগুরায় গিয়ে ঝিগিরি করবি, না লেখাপড়া করে জজ ব্যারিস্টার হবি?
নিলীমা কিছু না বলে মুখ নিচু করে রইল।
সামিনা বেগম বললেন, জজ ব্যারিস্টার হবে না আর কিছু, সারা জীবন ঝিগিরী করেই কাটাতে হবে।
জামান বলল, এখানে তবু তিনবেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছিলি, ওখানে ঝিগিরী করে তাও পাবি না।
তাদের কথা শুনে দুঃখে নিলীমার চোখে পানি এসে গেল, চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে গেল।
সেকেন্দার মামা যে বছর মারা যান, সে বছর থেকে নিলীমা রোযা রাখতে শুরু করে। এ বছরও রেখেছে। সামিনা বেগম অন্য সময় তাকে নামায ও কুরআন পড়তে দেখলে রাগারাগি করলেও রোযার মাসে কিছু বলেন না। অন্য মাসে খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো না দিলেও এই মাসে ঠিকমতো খেতে দেন। তবে ঈদের জন্য নিজের ও ছেলেমেয়েদের এমনকি কাজের বুয়ার জন্য নতুন জামা কাপড় কিনলেও নিলীমার জন্য কিনতেন না। মেয়ে কেকার পুরানো জামা দিতেন পরার জন্য, কিন্তু এ বছর সবার সঙ্গে নিলীমারও ঈদের নতুন জামা কাপড় কিনেছেন।
ঈদের দিন নতুন জামা কাপড় পড়ার সময় নিলীমা ভাবল, সে চলে যাবে বলে হয়তো মামিমা তাকে এ বছর নতুন জামা কাপড় দিলেন।
ঐ দিন নিলীমা মাগরীবের নামায শেষ করেছে, এমন সময় মরিয়ম এসে বলল, তোমাকে বেগম সাহেব ড্রইং রুমে যেতে বলেছেন। কথা শেষ করে সে চলে গেল।
ড্রইংরুমে ঢুকে ডাক্তার চাচুকে দেখে নিলীমার মনে আনন্দে বান ডাকল। সালাম দিয়ে কাছে এসে কদমবুসি করে বলল, চাচু, কেমন আছেন?
হারুণ ডাক্তার বললেন, আমি ভালো আছি। তারপর পাশে বসা একজনকে দেখিয়ে বললেন, তুমি যার বাড়িতে থেকে লেখা পড়া করবে, ইনি তার আত্মীয়।
নিলীমা ড্রইংরুমে ঢুকে হারুন ডাক্তারকে দেখে খুব আনন্দিত হয়েছিল বলে অন্য কোনো দিকে খেয়াল করেনি। এখন ওনার কথা শুনে পাশে বসা লোকটার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। কালো কুচকুচে ও রোগা লিকলিকে লোকটাকে তার কাছে তালগাছের মতো লম্বা বলে মনে হল। চোখ দুটো কোঠরে ঢুকে গেছে। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি লম্বা মোচ ও তার চকচকে দৃষ্টি দেখে নিলীমা কেন জানি খুশি হতে পারল না।
তাকে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হারুণ ডাক্তার বললেন, ওকে চাচা বলে ডাকবে। সালাম দিয়ে কদমবুসি কর।
লোকটাকে সালাম দিতে ইচ্ছা করলেও কদমবুসি করতে মন চাইল না নিলীমার। তবু ডাক্তার চাচুর কথা রাখার জন্য সালাম দিয়ে কদমবুসি করতে হল।
লোকটার নাম বসির মোল্লা। নিলীমা কদমবুসি করতে থাক, থাক বলে মাথায় হাত ছুঁয়ে চুমো খেলেন।
হারুণ ডাক্তার সামিনা বেগমকে বললেন, সাত আটদিন পরে আসল লোক এসে নিলীমাকে নিয়ে যাবে। একটা বিশেষ কাজে আমি আগামী কাল ঢাকা যাচ্ছি। ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে।
৩
আজ বুধবার। নিলীমা প্রতিদিনের মতো ফজরের আজানের সময় ঘুম থেকে উঠেছে। তারপর বাথরুমের কাজ সেরে নামায পড়ে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে উঠেছে এমন সময় মরিয়ম এসে বলল, বেগম সাহেব তোমাকে তোমার সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রেডি হয়ে থাকতে বললেন। একটু পরে নাকি তোমাকে নিতে লোক আসবে।
সেকেন্দার একটা মাঝারী ধরনের টিনের সুটকেশ নিলীমাকে কিনে দিয়েছিলেন। তাতেই নিলীমা নিজের সব কিছু রাখত। মরিয়ম চলে যাওয়ার পর সব কিছু তাতে গুছিয়ে রেখে মাথার চুল আঁচড়াচ্ছিল আর ভাবছিল, এতদিনে আল্লাহ তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। তাই এই নরকপুরী থেকে তিনি অন্যখানে নিয়ে যাচ্ছেন। তারপর ঈদের দিনে মামির দেয়া শালওয়ার কামিজ ও ওড়না গায়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে জামান এসে তাকে দেখে বলল, আরে বাপরে, এ যে দেখছি। ফুরপরী সেজে বসে আছিস। মনে হচ্ছে তোকে দেখার জন্য পাত্র পক্ষের লোকজন আসবে। যাক গে, তুই চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছিস, তাই আজ আর কিছু করলাম না। চল, নাস্তা খেতে মা ডাকছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে নিলীমার ভয় করতে লাগল, পেছন থেকে না জামান তার পাছায় লাথি মারে। ডাইনিং রুমে এসে দেখল, সে দিনের সেই লোকটা নয়, অন্য একজন। ভদ্রলোক নাস্তা খাচ্ছেন, খাওয়ার সময় সালাম দিতে নেই জানে, তাই সালাম না দিয়ে একটা চেয়ারে ভয়ে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসল। সেকেন্দার মামা মারা যাওয়ার পর মামিমা তাকে ডাইনিং রুমে খেতে দেন না। কিচেন রুম থেকে খাবার নিয়ে গিয়ে নিজের রুমে খায়।
একটু পর মরিয়ম দুটো গমের আটার রুটি ও একটা বাটিতে অল্প একটু ডাল এনে নিলীমার সামনে রেখে বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।
ডাক্তার হারুণ যে লোককে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন তার নাম ইউসুফ গাজী। ব্যস্ততার কারণে প্রথম বারে একটা চিঠি লিখে বসির মোল্লাকে পাঠিয়ে ছিলেন। আজ তিনি গাড়ি নিয়ে নিজে এসেছেন। উনাকে উদ্দেশ্য করে সামিনা বেগম বললেন, নিলীমা ভীষণ দুষ্টু, খুব শাসনের সঙ্গে রাখবেন। তা না হলে ওখানকার ছেলেমেয়েদেরকে দুষ্টুমী করে অতিষ্ট করে তুলবে। আমার ছেলেমেয়েরা তো ওর দুষ্টুমীর জ্বালায় অস্থির হয়েছিল এতদিন। এবার ওরা একটু স্বস্তি পাবে।
মামিমাকে নিলর্জ মিথ্যা বলতে শুনে নিলীমা এতটুকু হয়ে গেল। প্রতিবাদ করা ঠিক হবে না ভেবে মুখ নিচু করে বসে রইল।
ততক্ষণে ইউসুফ গাজীর খাওয়া শেষ হয়েছে। চায়ে চুমুক দিয়ে নিলীমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখতে শুনতে তো বেশ ভালো, কিন্তু তোমার পেটে এত
দুষ্টুমী কেন? তারপর সামিনা বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর বয়স কত?
দশ এগার হবে।
অবিশ্বাস্য কন্ঠে ইউসুফ গাজী বললেন, এগার বছর বয়স তবু দুষ্টুমী করে?
তবে আর বললাম কি?
এই মেয়ে নামায পড়?
জি পড়ি।
কুরআন পড়তে জান?
জি, জানি।
নাচ গান জান?
জি, না।
কেন জান না?
নাচ-গান তো মুসলমানদের জন্য হারাম। তাই শিখিনি।
মোল্লা মৌলবীরা ঐ রকম বলে থাকে। আসলে তো নাচ-গান একটা কালচার। আমার ওখানে সব মেয়েরা নাচ-গান শিখছে। তোমাকেও শিখতে হবে।
নিলীমা দৃঢ় গলায় বলল, মেরে ফেললেও আমি নাচ-গান শিখব না। আপনি মুসলমান হয়েও মেয়েদেরকে নাচ-গান শিখাচ্ছেন কেন? আপনি কি আল্লাহকে ভয় করেন না?
ইউসুফ গাজী ধমকে উঠলেন, “এই মেয়ে চুপ,” তোমার সাহস তো কম না, আমাকে জ্ঞান দান করছ? এ ব্যাপারে আর একটা কথা বলবে না। দেখছি, সত্যিই তুমি খুব ডেঞ্জারাস মেয়ে। তারপর সামিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। এরকম মেয়েদের কি করে দুষ্ট্রমী ছাড়াতে হয় আমার জানা আছে। এবার আসি হলে?
সামিনা বেগম বললেন, আসুন। তারপর মরিয়মকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর সুটকেশ গাড়িতে তোলা হয়েছে?
মরিয়ম বলল, সুটকেশ গাড়ির কাছে এনে রেখেছি।
সুটকেস গাড়ির ব্যানেটে রেখে ইউসুফ গাজী মরিয়মকে গাড়ির পিছনে তুলে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ছেড়ে দিলেন।
অনেক পুরানো লক্কড় ঝক্কর মার্কা গাড়ি। তাই উইসুফ গাজী খুব সতর্কতার সাথে ঘন্টায় বিশ মাইল বেগে চালাচ্ছেন।
নিলীমা এরকম গাড়ি চড়াতো দূরের কথা কখনও ভাবেওনি। তাই তার মন আনন্দে ভরে গেল। কিন্তু যখন কিছুক্ষণ পরপর গাড়ি বিশ্রী শব্দ করে বন্ধ হতে লাগল এবং ইউসুফ গাজী গাড়ি থেকে নেমে ইঞ্জিন পরীক্ষা করতে লাগলেন তখন আনন্দটা নিরানন্দ লাগতে লাগল।
তবে এই লাঞ্ছিত জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন জীবনে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
কারও ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। ইউসুফ গাজী তাকে দুটো কলা ও একটা পাউরুটি তার পাশে রেখে বললেন, এগুলো খেয়ে নাও।
নিলীমা বলল, আমি বাথরুমে যাব।
ইউসুফ গাজী তাকে বাথরুম দেখিয়ে দিলেন।
বাথরুমে যাওয়ার সময় নিলীমা দেখল, বিশ পঁচিশটা বাস ও ছয় সাতটা ছোট গাড়িসহ কিসে চেপে যেন নদীর উপর দিয়ে ভেসে ভেসে যাচ্ছে। খুব অবাক হলেও চুপচাপ বাথরুমের কাজ সেরে ফেরার সময় ইউসুফ গাজীকে জিজ্ঞেস করল, যাতে করে এত গাড়ি ও এত মানুষ পানির উপর দিয়ে যাচ্ছে, সেটাকে কি বলে?
ইউসুফ গাজী বললেন, ফেরী বলে।
নিলীমা কলা খেতে খেতে খুব অবাক হয়ে চিন্তা করল, যদি নদীর মাঝখানে ফেরী ডুবে যায়, তা হলে কি হবে? ইচ্ছা হল কথাটা ইউসুফ গাজীকে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছাটা দূর হয়ে গেল।
আরিচা ঘাট পার হতে চারটে বেজে গেল। তখন শীতকাল চারটেতেই সন্ধ্যা মনে হচ্ছে। গাড়ি চলতে শুরু করলে নিলীমার বেশ শীত করতে লাগল। গায়ের চাদরটা সুটকেসে আছে, সেটা বের করে দেয়ার কথা ইউসুফ গাজীকে বলতে সাহস হল না। গুটি গুটি হয়ে বসে থাকতে থাকতে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙতেই দেখল, একটা বাড়ির গেটে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। গেটটা খোলা। একজন লোক দাঁড়ান। তাকে দারোয়ান বলে মনে হল নিলীমার। গেটের উপর। একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। তার আলোতে নিলীমা দেখতে পেল, একটা আধা বয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে।
ইউসুফ গাজী ঐ মহিলাকে বলল, জ্যোত্যা, নিলীমাকে নিয়ে এসেছি। একে নিয়ে যাও। আর নাসরিনকে ওর সুটকেসটা নিয়ে যেতে বল।
একটা এতিমখানা। এখানে শুধু গরিব এতিম মেয়েদের লালন পালন ও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ান হয়। সেই সঙ্গে হস্তশিল্প, সূচিশিল্প, শিক্ষা দেয়া হয়, যাতে করে মাধ্যমিক পাশ করার পর তারা স্বাবলম্বী হয়ে নিজেরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। এখানে মোট দশজন শিক্ষিকা আছেন। ছয়জন শিক্ষিকা বাইরে থেকে আসেন আর চারজন শিক্ষিকা এতিমখানার ভিতরে থাকেন। ওনারা এখানকার পঞ্চাশজন এতিম মেয়েদের থাকা খাওয়া ও পড়াশোনার তত্ত্বাবধান করেন।
এতিমখানার বর্তমান মালিক ইউসুফ গাজী। উনি বিপত্নিক ও নিঃসন্তান। ওনার স্ত্রী রুকসানার খালা আবেদা বেগম এটার প্রতিষ্ঠাতা। তিনিও নিঃসন্তান ছিলেন। ওনার বোন চার বছরের রুকসানাকে রেখে মারা গেলে আবেদা বেগম ভাগ্নীকে মানুষ করেন। তিনি এতিমখানার দায়-দায়িত্ব পালন করতেন। ওনার স্বামী খুব ভালো চাকরি করতেন। রুকসানা যে বছর ঢাকা ভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স নিয়ে মাস্টার্স কমপ্লিট করে সে বছর তার খালু মারা যান। রুকসানা অনার্স করার সময় ইউসুফ গাজীকে ভালবেসে গোপনে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে। খালু মারা যাওয়ার পর খালাকে সেকথা জানায় এবং খালুর অফিসে স্বামী ইউসুফ গাজীকে ঢোকবার ব্যবস্থা করতে বলে।
আবিদা বেগম ভাগ্নীর কথা শুনে মনে খুব কষ্ট পেলেও তাকে মানুষ করেছিলেন এবং ভীষণ স্নেহ করতেন বলে কোনো উচ্চবাচ্চ্য করলেন না। বরং জামাই যাতে স্বামীর চাকরিটা পায় সেই ব্যবস্থা করেন।
স্বামী মারা যাওয়ার পর আবিদা বেগমের শরীর দিন দিন ভেঙ্গে পড়তে লাগল। তিনি বুঝতে পারলেন বেশি দিন বাঁচবেন না। তাই স্বামীর স্থাবর অস্থাবর সবকিছু ভাগ্নী রুকসানার নামে উইল করে দেন আর এই এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করে সব দায়-দায়িত্বও লিখিতভাবে তার উপর দেন। এর কিছুদিন পর তিনি মারা যান।
খালা মারা যাওয়ার পর রুকসানা এতিমখানার সব দায়দায়িত্ব পালন করে চললেন। কয়েক বছর পর উনিও নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। মৃত্যু শয্যায় স্বামীকে আবার বিয়ে করার অনুরোধ করেন আর এতিমখানার সমস্ত দায়-দায়িত্ব পালন করারও অনুরোধ করেন।
জ্যোত্সা কাজের মেয়ে নাসরিনকে ডেকে বললেন, গাড়ির পিছনে নিলীমার সুটকেস আছে নিয়ে এস। নাসরিন সুটকেস নিয়ে আসার পর ইউসুফ গাজী গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। জ্যোত্সা নিলীমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেট লাগিয়ে দিলেন। তারপর লম্বা বারান্দা পার হয়ে শেষ মাথার একটা ঘরে এসে বললেন, এখানে তুমি থাকবে। নাসরিন আগেই সুটকেস রেখে গেছে। সেটা দেখিয়ে আবার বললেন, ঐ তোমার সুটকেস। কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নাও। কথা শেষ করে তিনি চলে গেলেন।
বারান্দা দিয়ে আসার সময় নিলীমা লক্ষ্য করেছে, পাকা বাড়িটা একতলা হলেও বেশ বড়। বারান্দা বেশ চওড়া। বারান্দার দু’পাশে অনেকগুলো রুম। জানালা খোলা থাকায় দেখতে পেল, প্রতিটা রুমে ষাট পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। শুধু গেটের কাছে দুটো রুমে টিউব লাইট জ্বলছে। অত বড় বারান্দার দু’মাথায় দুটো চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে মাত্র।
জ্যোৎস্না চলে যাওয়ার পর নিলীমা ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখল, পাকা মেঝেয় তিনটে বিছানা পাতা। প্রতি বিছানার মাথার দিকে একটা করে সুটকেস। আর একটা বিছানা পাতার মতো জায়গায় পাঁচহাত লম্বা ও দেড় হাত চওড়া ফোমের গদী পাতা রয়েছে।
নিলীমা প্রথমে সুটকেস খুলে জামা কাপড় পাল্টাল, তারপর ফোমের উপর কাঁথা ও তার উপর চাদর বিছিয়ে বালিশটা সিথানে রেখে শোয়েটার গায়ে দিয়েছে এমন সময় দু’জন মহিলাকে ঢুকতে দেখে সালাম দিল।
মহিলা দু’জন এখানকার শিক্ষিকা। নাম ঝরনা ও নন্দিতা। নিলীমা সালাম দিতে ঝরণা সামান্য মাথা নেড়ে বিছানার দিকে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মোটা কাঁথা বা কম্বল নেই?
নিলীমা বলল, না। একটা পাতলা কাঁথা ছিল, সেটা বিছিয়েছি।
তুমি যাদের কাছে ছিলে তারা কেমন মানুষ? কনকনে শীতের সময় গায়ে দেয়ার জন্য কিছুই দেয় নি? এখানে তো বাড়তি কিছু নেই যে তোমাকে দেব। আজ রাতটা ঐ কথাটা গায়ে দিয়ে কোনো রকমে কাটাও। দেখি, কাল কিছু ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
ঝরণা যেতে উদ্যত হলে নন্দিতা বললেন, হাতমুখ ধুয়ে অফিস রুমে এস। অফিস রুম চেনো তো?
নিলীমা মাথা নেড়ে জানাল চেনে না।
গেট দিয়ে ঢুকে বাম দিকের যে রুমটায় সাদা লাইট জ্বলছে আর দরজায় পর্দা ঝুলছে, ঐটা অফিস রুম। কথা শেষ করে নন্দিতা ঝরণাকে বললেন, চলুন আমরা যাই।
আসার সময় নিলীমা তার রুমের পাশে চাপকল দেখেছিল। ওনারা চলে যাওয়ার পর কলতলায় এসে দেখল, অল্প দূরে পাঁচটা বাথরুম। বাথরুমের কাজ সেরে অযু করার সময় ঠাণ্ডায় কাঁপতে লাগল। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে নামায পড়তে দাঁড়িয়ে ভাবল, পশ্চিম কোন দিকে হবে? হঠাৎ মাথায় বুদ্ধিটা এল, বাথরুমের পাদানির কথা চিন্তা করে পশ্চিম কোন দিকে বুঝতে পারল। জোহর, আসর, মাগরিবের কাযা নামায ও এশার নামায পড়তে প্রায় পৌনে একঘন্টা লাগল। তারপর অফিস রুমে গেল।
ঝরণা ম্যাডাম তাকে দেখে রাগের সঙ্গে বললেন, এত দেরি হল কেন? এতক্ষণ কি করছিলে?
নিলীমা ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, সারাদিনের কাযা নামায ও এশার নামায আদায় করতে দেরি হয়ে গেল।
ঝরণা ম্যাডাম কিছু বলার আগে নন্দিতা ম্যাডাম খুব অবাক হয়ে বললেন, এতটুকু মেয়ে তুমি নামায পড়?
তাকে থামিয়ে দিয়ে ঝরণা ম্যাডাম গম্ভীর কন্ঠে নিলীমাকে বললেন, এখানে কেউ নামায পড়ে না। তুমিও পড়বে না। তারপর তার বায়োডাটা লিখে নিয়ে বললেন, এবার যাও, ঠিক দশটার সময় চার নাম্বার রুমের সামনে আসবে। ওখানে খাবার দেয়া হবে।
সাড়ে নটার সময় তিনটে মেয়েকে বই খাতা হাতে করে ঢুকতে দেখে নিলীমা তাদের দিকে তাকাল। একজন তার সমবয়সী, আর বাকি দু’জন তার চেয়ে দু’এক বছরের ছোট হবে।
সুটকেসের উপর বই খাতা রেখে সমবয়সী মেয়েটি নিলীমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি শেফালি, তুমি?
আমার ডাকনাম নিলীমা, ভালো নাম নুসরাত জাহান। তোমার ভালো নাম কি?
আমার ভালো নাম নেই।
কম বয়সী মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে নিলীমা জিজ্ঞেস করল, তোমাদের নাম কি?
একজন বলল, আমার নাম ফরিদা। অন্যজন বলল, আমি জাহানারা। শেফালি বলল, আমার মা বাবা বা অন্য কোনো আত্মীয় নেই।
ফরিদা বলল, আমার বাবা নেই। মা অন্য লোককে বিয়ে করে চলে গেছে।
জাহানারা বলল, আমার মা নেই। বাবা পঙ্গু। এবার তোমার কে কে আছে। বল।
নিলীমা বলল, আমার মা বাবা নেই। অন্যান্য আত্মীয় স্বজন আছে কিনা জানি না। দূর সম্পর্কের মামার কাছে মানুষ হচ্ছিলাম, তিনিও মারা গেছেন। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
একটা হলরুম আছে। সন্ধ্যে থেকে রাত সাড়ে নটা পর্যন্ত সবাইকে সেখানে পড়তে হয়।
শেফালি বলল, আর গল্প নয়, এবার সবাই চার নাম্বার রুমের কাছে যাই চল। খাবার দেয়ার সময় হয়ে গেছে। তারপর নিলীমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার বাসন আছে?
নিলীমা বলল, না।
শেফালি বলল, নেই যখন তখন আর কি করা। ম্যাডাম হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন। চার নাম্বার রুমের কাছে এসে বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিলীমা গুণে দেখল, তাকে নিয়ে একান্ন জন।
নিলীমার কানের কাছে মুখ নিয়ে শেফালি ফিস ফিস করে বলল, জ্যোৎস্না ম্যাডাম যার নাম ধরে ডাকবেন, সে ভিতরে গিয়ে প্লেটে খাবার নিয়ে যে যার রুমে খাবে। দিনে রাতে তিনবার এভাবেই খেতে দেয়া হয়।
নিলীমার নাম ডাকা হল সবার শেষে। প্লেটে দু’টো গমের আটার রুটি আর অল্প একটু বুটের ডাল দেখে তার চোখে পানি এসে গেল।
রুমে এসে খাওয়ার সময় শেফালিকে জিজ্ঞেস করল, ভাত কখন দেয়া হয়?
দুপুরে। তাও আধ প্লেট।
সকালে নাস্তা কি দেয়?
এখন যা দিয়েছে তাই।
খাওয়ার পর যে যার কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাল। আজ বেশি শীত পড়েছে। নিলীমা পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়ে কাঁপতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যে শেফালী, ফরিদা ও জাহানারা মুখ ও মাথা কম্বল দিয়ে ঢেকে ঘুমিয়ে পড়ল। তাদের নাক ডাকার শব্দ নিলীমা শুনতে পাচ্ছে। মাথা মুখ কাঁথা দিয়ে ঢেকেও নিলীমার কাঁপনী থামল না।
তার পাশে শেফালির বিছানা। সে নিলীমার অবস্থা বুঝতে পেরে কম্বল থেকে মুখ বের করে নিলীমাকে বলল, শীতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি যদি চাও, তা হলে তোমার কথার উপর আমার কম্বল চাপিয়ে দু’জনে এক সঙ্গে ঘুমাই এস।
নিলীমা কাঁপতে কাঁপতে তার বালিশের সঙ্গে নিজের বালিশ ঠেকিয়ে বলল, তোমার কম্বলটা কাঁথার উপর চাপিয়ে আমার কাঁথার মধ্যে ঢুকে পড়। শেফালী তাই করার পর আবার বলল, শীতের হাত থেকে রক্ষা করে আমাকে ঋণী করে রাখলে। তোমার আপত্তি না থাকলে আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু।
শেফালি বলল, আপত্তি থাকবে কেন? তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। কথাটা তুমি না বললে, আমিই দু’এক দিনের মধ্যে বলতাম। তারপর আবার বলল, এবার ঘুমিয়ে পড়ি এস। নচেৎ সকালে উঠতে দেরি হলে সালমা ম্যাডামের বেতের বাড়ি খেতে হবে।
৪
নিলীমার ভোরে উঠা অভ্যাস। আজও উঠে প্রথমে বাথরুমের কাজ সেরে এসে ফজরের নামায পড়ল। তারপর আবার কাঁথা ও কম্বলের তলায় ঢুকে পড়ল।
নিলীমার নড়াচড়ায় শেফালির ঘুম আগেই ভেঙে গিয়েছিল। তাকে নামায পড়তেও দেখেছে। তাই বলল, কাল ঝরনা ম্যাডাম তোমাকে নামায পড়তে নিষেধ করলেন, তবু পড়লে যে?
নিলীমা জিজ্ঞেস করল, ঝরনা ম্যাডাম মুসলমান কিনা জান?
না জানি না।
উনি জানতে পারলে কি করবেন বলতে পার?
ঝরনা ম্যাডাম খুব কড়া। কেউ উনার কথা না শুনলে হাতে দশ ঘা বেতের বাড়ি মারেন। তা ছাড়া সেদিন তাকে সারাদিন কিছু খেতে দেয়া হয় না। তবে নামায পড়ার ব্যাপারে তোমাকে কিছু করবেন কিনা বলতে পারছি না।
নিলীমা ভয় পেয়ে বলল, কি করব বলতে পার?
আমার মতে নামায না পড়াই উচিত। এখন যে নামায পড়েছ, সে কথা। আমি কাউকে বলব না।
নিলীমা খুব বুদ্ধিমতি। তাই শেফালী মুসলমান কিনা সরাসরি জিজ্ঞেস না করে বলল, তোমার মা-বাবার নাম জান?
হ্যাঁ, জানি। বাবার নাম আনিসুর রহমান আর মায়ের নাম জোবেদা খাতুন।
শেফালী মুসলমান ঘরের মেয়ে বুঝতে পেরে নিলীমা বলল, আল্লাহ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীকে দৈনিক পাঁচবার নামায পড়তে বলেছেন। এ কথা জান?
না, জানি না।
মুসলমান ঘরে জন্মেও জান না কেন? একথা তো আমি ছোট বেলায় মা বাবার মুখে শুনেছি।
শেফালী বলল, চার বছর বয়স থেকে এখানে আছি। এখানে কেউ নামায পড়ে না, জানব কি করে?
ও তাই বল বলে নিলীমা বলল, আমাকে যত কঠিন শাস্তি দিক না কেন, নামায ছাড়তে পারব না।
এমন সময় ঝরনা ম্যাডাম এসে দরজায় নক করে বললেন, সবাই আধ ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে মাঠে ড্রিল করতে আস।
শেফালি নিলীমাকে বলল, তুমি তো বাথরুমের কাজ সেরেই এসেছ, আমি যাই বলে বিছানা থেকে উঠে ফরিদা ও জাহানারাকে জাগিয়ে বেরিয়ে গেল।
ঠিক সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ঝরনা ম্যাডাম খালি হাতে ব্যায়াম করালেন। তারপর নাস্তা খেয়ে আটটায় সবাই হল রুমে পড়তে গেল।
নিলীমাকে পরীক্ষা করে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করলেন জ্যোত্স ম্যাডাম। উনি এখানকার হেড মিস্ট্রেস।
প্রথম দিকে নিলীমার সঙ্গে শেফালী ছাড়া অন্য মেয়েরা তেমন মেলামেশা করত না। কিন্তু যতদিন যেতে লাগল তার আচার ব্যবহার ও লেখাপড়ার অগ্রগতি দেখে শুধু সহপাঠীরা নয়, স্কুলের সব ম্যাডামরাও ভালোবাসতে শুরু করলেন। তারপর বার্ষিক পরীক্ষায় যখন ফার্স্ট হয়ে সেভেনে উঠল তখন থেকে সবাই আরও বেশি ভালোবাসতে শুরু করলেন।
প্রথম বছর নিলীমার নামায পড়ার কথা গোপন থাকলেও সেভেনে উঠার পর প্রকাশ হয়ে পড়ল। কারণ সে রুমমেট শেফালি, ফরিদা ও জাহানারাকে নামায শিখিয়ে নামায ধরিয়েছে।
ঝরনা ম্যাডাম স্কুলের সহকারী হেড মিস্ট্রেস। তিনি তাদের নামায পড়ার কথা জেনে একদিন নিলীমাকে অফিস রুমে ডেকে বললেন, যেদিন তুমি এখানে প্রথম আস, সেদিনই তোমাকে নামায পড়তে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার নিষেধ শুধু অমান্য করনি, বরং তোমার রুমমেট তিনজনকেও নামাযী করেছ। সেজন্য তোমাকে কঠিন শাস্তি দিতাম; কিন্তু ভালো ছাত্রী হিসেবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছ। তাই শাস্তি না দিয়ে শেষবারের মতো নির্দেশ দিচ্ছি, তুমি নিজেও নামায পড়বে না, আর অন্যকেও নামায পড়ার জন্য প্রভাবিত করবে না। তারপর কড়া মেজাজে জিজ্ঞেস করলেন, কী, কথাটা মনে থাকবে তো?
এখানে আসার পর প্রথম দিকে নিলীমার বেশ কিছুদিন ভয়ে ভয়ে কেটেছে। তারপর যখন সবার সুদৃষ্টি তার দিকে পড়ল তখন ভয় কেটে যায়। আর এখন সে যথেষ্ট সাহসী হয়েছে। তাই ঝরনা ম্যাডামের কড়া মেজাজ শুনে ভয় পেল না। বলল, মাফ করবেন, আপনার এই নির্দেশ আমি মানতে পারব না।
অনেক বছর হয়ে গেল ঝরনা ম্যাডাম এখানে সহকারী হেড মিস্ট্রেস পদে কাজ করছেন। কোনো ছাত্রী তো দূরের কথা, কোনো সহকর্মীরা পর্যন্ত ওনার কথার প্রতিবাদ করেন নি। নিলীমার কথা শুনে ভীষণ রেগে গেলেন। রাগের চোটে ফরসা মুখটা লাল হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে টেবিলের উপর রাখা বেতটা নিয়ে শপাং শপাং করে কয়েক ঘা লাগিয়ে বললেন, তোমার গার্জেয়ানরা তোমাকে আদব-কায়দা শেখান নি? বড়দের মুখের উপর তাদের নির্দেশের অবাধ্যতা করা যে কত বড় বেয়াদবি, তা শিক্ষা দেন নি? আবার যদি কোনোদিন আমার নির্দেশের অবাধ্যতা কর, সেদিন মেরে তোমার হাড় গুড়ো করে ফেলব।
নিলীমার সহ্যশক্তি প্রচুর। অতগুলো বেতের বাড়ি খেয়েও কাঁদল না বা বিচলিত হল না। ঝরনা ম্যাডাম থেমে যেতে দৃঢ়কণ্ঠে বলল, খুব ছোটবেলায় মা বাবাকে হারিয়েছি। ওনারা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় আদব-কায়দা শেখাতেন। যারা আমাকে মানুষ করেছেন, তাঁরা বাদীর মতো সংসারের কাজ করিয়েছেন, আদব কায়দা শেখান নি। আর নামায পড়ার জন্য যদি আপনি আমাকে মারতে মারতে মেরেও ফেলেন অথবা এখান থেকে তাড়িয়েও দেন, তবু আপনার এই নির্দেশ মানতে পারব না। কারণ হাদিসে আছে, আমাদের নবী (দ:) বলিয়াছেন, ‘আল্লাহর নির্দেশ প্রত্যেক মুসলমানকে মেনে চলতে হবে। নচেৎ সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে না। আর আল্লাহ কুরআন পাকে বলিয়াছেন। কেউ যদি আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে বাধা দেয়, এমনিক মা-বাবাও বাধা দেন, তবু তাদের বাধা না মেনে আল্লাহর নির্দেশ মানতে হবে।” একথা মুসলমান মাত্রই জানে। আমার মনে হয়, আপনি মুসলমান না। তাই একথা জানেন না বলে আমাকে নামায পড়তে নিষেধ করছেন।
নিলীমার কথা শুনে ঝরনা বেগম এত রেগে গেলেন যে, কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তারপর গর্জে উঠলেন, এতবড় সাহস তোমার, আমাকে জ্ঞান দান করা হচ্ছে বলে বেত দিয়ে তার সারা শরীরে মেরেই চললেন।
সেখানে নন্দিতা ও সালমা ম্যাডাম ছিলেন। ওনারা ঝরনা ম্যাডামকে ভয় পান। তাই কিছু বলতে বা করতে না পেরে চুপ করে রইলেন।
জ্যোত্সা ম্যাডাম হলরুমে ছাত্রীদের পড়াচ্ছিলেন। কাজের মেয়ে মরিয়মের মুখে ঘটনা শুনে তাড়াতাড়ি এসে প্রথমে নিলীমার একটা হাত ধরে সরিয়ে দিলেন। তারপর ঝরনা ম্যাডামকে রাগের সঙ্গে বললেন, থামুন, যথেষ্ট হয়েছে। জানেন না, ছাত্র-ছাত্রীদের বেত দিয়ে মারা আইনত দণ্ডনীয়?
জ্যোৎস্না বেগম ইউসুফ গাজীর খালাত বোন। তিনি এম. এ. পাশ। প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের সাত-আট বছর পরও যখন ওনার পেটে সন্তান এল না তখন ডাক্তারী পরীক্ষা করালেন। উনি কখনও মা হতে পারবেন না জেনে স্বামী ওনাকে তালাক দেন। তারপর থেকে আজ দশ বছর হল এখানে কাজ করছেন।
ইউসুফ গাজী বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন; কিন্তু জ্যোত্সা ম্যাডাম রাজি হন নাই। বলেছিলেন, যে কারণে প্রেমিক স্বামী আমাকে ত্যাগ করল, সেই কারণে কিছুদিন পর তুমিও আমাকে ত্যাগ করবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর বিয়ে করব না, শিক্ষকতা করে জীবনটা কাটিয়ে দেব। ওনাদের এসব কথা অন্য তিন ম্যাডামও জানেন। ওনারা আরও জানেন, ইউসুফ গাজী আজও জ্যোৎস্না ম্যাডামের আশা ত্যাগ করেন নি। তাই জ্যোৎস্না ম্যাডামকে অন্য ম্যাডামরা সমীহ করে চলেন।
এখন ঝরনা ম্যাডাম রাগের চোটে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে নিলীমাকে মেরেই চলেছিলেন। জ্যোৎস্না ম্যাডামের কথা শুনে বাস্তবে ফিরে এলেন।
ছাত্রীরা রুমের দরজার কাছে ভীড় করেছে দেখে জ্যোৎস্না ম্যডাম তাদেরকে চলে যেতে বললেন। তারা চলে যাওয়ার পর নন্দিতা ও সালমা ম্যাডামকে বললেন, আপনারাই বা কি? আর কয়েক ঘা মার খেলে মেয়েটা তো জ্ঞান হারাত? তারপর ঝরনা ম্যাডামকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ধর্ম হল নিজের বিশ্বাস। কাউকে যেমন ধর্মের কোনো কিছু জোর করে বা শাস্তি দিয়ে করানো উচিত নয়, তেমন কেউ ধর্মের কোনো কিছু মেনে চললে জোর করে বা শাস্তি দিয়ে নিষেধ করাও উচিত নয়। এখানে আমরা কেউ নামায পড়িনি, তাই বলে কেউ পড়লে তাকে নিষেধ করব অথবা শাস্তি দেব, এটা একেবারেই উচিত নয়। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। কথা শেষ করে নিলীমার একটা হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে আঘাত পাওয়ার জায়গাগুলো ডেটল লাগিয়ে দিয়ে বললেন, দারোয়ানকে দিয়ে ঔষধ আনিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি খেও। তা হলে অসুস্থতা বোধ করবে না। আর শোন, নামায পড়ার জন্য তোমাকে আর কেউ কিছু বলবে না। যদি বলেন, আমাকে জানিও। যাও, এবার তোমার রুমে যাও। এখন আর হলরুমে পড়তে আসতে হবে না। শরীর ভালো থাকলে সন্ধ্যার পর এস।
এরপর থেকে ছোট বড় সব ছাত্রীরা নিলীমাকে আগের থেকে ভক্তি শ্রদ্ধা করতে লাগল। তাই নয়, অনেকে তার কাছ থেকে নামায শিখে পড়তে শুরু করল। সব থেকে আশ্চর্য ঘটনা একে একে সব ম্যাডামরাও নামায পড়তে শুরু করলেন। তাই দেখে জ্যোৎস্না ম্যাডাম লাইব্রেরী রুমের পাশে যে রুমটা খালি ছিল, সেটাকে নামাযের রুম বলে নির্দিষ্ট করে দিলেন এবং অনেক ইসলামিক বই কিনে ঐ রুমে রাখা হল। শুধু তাই নয়, প্রত্যেকদিন এশার নামাযের পর দশ মিনিট তালিম দেয়ার ব্যবস্থা করা হল।
এতিমখানাটা পাঁচ একর জমির উপর। পঞ্চাশ-ষাটজন ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের থাকার ব্যবস্থা আছে। চারপাশে পাকা প্রাচির দিয়ে ঘেরা। গেট দিয়ে ঢুকে অল্প দূরে ডান পাশে স্কুল ঘর। তার পাশে খেলার মাঠ। গেট থেকে সোজা উত্তর দিকের প্রাচিরে গা ঘেঁষে এতিমখানা। আর বাকি প্রায় অর্ধেক জায়গায় নানা রকম সজির চাষ হয়। এতিমখানার ছাত্রী ও ম্যাডামরা এইসব সজির চাষ করেন। নিজেদের চাহিদা মিটেও বিক্রি করা হয়।
সকাল সাতটায় ফ্রি হ্যান্ড এক্সাসাইজ করা হলেও বিকেলে সন্ধ্যের আগে আগে একজন মেয়ে ট্রেনার আসেন ছাত্রীদেরকে মার্শাল আর্ট শেখানোর জন্য। সব বিষয়ের মতো এই বিষয়েও নিলীমা দক্ষতা অর্জন করল। তাই ছয় মাস পর মেয়ে ট্রেনারকে ছাড়িয়ে নিলীমাকে সেই কাজ দেয়া হল।
ইউসুফ গাজী পনের দিন অন্তর একবার এসে এতিমখানার মেয়েদের খোঁজ খবর নেন। জ্যোত্সা ম্যাডামের কাছে জমা খরচের হিসাব নেন। নিলীমাকে নিয়ে এখানে যা কিছু হচ্ছে সব খবর রাখেন। যখনই আসেন নিলীমাকে ডেকে সুবিধে অসুবিধের কথা জিজ্ঞেস করেন।
দেখতে দেখতে ছয় বছর কেটে গেল। নিলীমা মাধ্যমিক পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে এতিমখানা স্কুলের সুনাম বাড়িয়ে দিল।
ইউসুফ গাজী খুশি হয়ে একদিন এতিমখানার সবাইকে বিরানী রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ঐদিন গোপনে জ্যোৎস্না ম্যাডামকে বললেন, তোমার জন্য অনেক বছর অপেক্ষা করলাম, তবু ধরা দিলে না। এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিলীমাকে বিয়ে করব। তবে এক্ষুনি নয়। দুটো বছর আমাদের স্কুলেই টিচারী করুক। এর মধ্যে নাইট কলেজ করে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিক। তারপর ওকে বিয়ে করব। সে ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহায্য করবে।
কথাটা শুনে জ্যোৎস্না ম্যাডাম যেমন অবাক হলেন, তেমনি রেগেও গেলেন। নিজেকে সংযত করার জন্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
ইউসুফ গাজী তা বুঝতে পেরে বললেন, এতে অবাক হওয়ার বা রেগে যাওয়ার কি আছে? অনেক ভেবে চিন্তে আমি সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। ও খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে। ভবিষ্যতে ওকে দিয়ে এই এতিমখানা চালাতে চাই। ওর যে এই দুনিয়াতে কেউ নেই তা তো তুমিও জান। কীভাবে জীবন কাটাবে আমরা কেউ বলতে পারব না। আমার কথাটা চিন্তা করে উত্তর দিও। আর শোন, আমি যে বিয়ে করতে চাই সে কথা ওকে না বলে বলবে, ‘ভালো ছেলে পাওয়া গেছে তার সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। ঐ ছেলে তুমি যতদূর পড়তে চাইবে পড়াবে।
জ্যোত্সা ম্যাডাম ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, গাজী ভাই, এতদিন তোমাকে মনের যে উচ্চ আসনে রেখেছিলাম, তা ধূলায় মিশিয়ে দিলে। বয়সের দিক থেকে যে মেয়ে তোমার নাতনির বয়সী তাকে বিয়ে করার কথা চিন্তা করতে তোমার বিবেকে এতটুকু বাধল না? আমার তো মনে হয় তোমার বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে। এই বয়সে একটা কচি মেয়েকে বিয়ে করার মানে তার জীবনটা নষ্ট করে দেয়া। ছিঃ ছিঃ গাজী ভাই, তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। এই বয়সে কোথায় মরণের কথা চিন্তা করে আল্লাহ বিল্লাহ করবে, বিগত জীবনের ন্যায়-অন্যায়ের জন্য তওবা করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করবে, তা না করে একটা কচি মেয়ের জীবন নষ্ট করতে চাচ্ছ। নিলীমা হীরের টুকরো মেয়ে, স্ত্রী হিসেবে ওকে যে পাবে সে ধন্য হয়ে যাবে। ওর ভবিষ্যতের কথা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। একটা কথা জেনে রেখ, আমি যতটা ওকে চিনি, তাতে আমার বিশ্বাস, তুমি যদি ছল চাতুরীর মাধ্যমে ওকে বিয়ে কর, তা হলে বাসর রাতেই গলা টিপে তোমাকে মেরে ফেলবে। তাই সাবধান করে দিচ্ছি, ওকে বিয়ে করার যে ভূত তোমার ঘাড়ে চেপেছে, তা নামিয়ে ফেল। নচেৎ কি হবে তা তো বললাম। আর একটা কথা শুনে রাখ, আমি বেঁচে থাকতে তুমি নিলীমাকে পাবে না। জীবন দিয়ে হলেও ওকে আমি রক্ষা করব।
ইউসুফ গাজীও ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেলেন। বড় গলায় স্টপ ইট, স্টপ ইট বলে বললেন, আমিও দেখব কীভাবে তুমি নিলীমাকে আমার কাছ থেকে রক্ষা করো। কথা শেষ করে গটগট করে চলে গেলেন।
জ্যোৎস্না ম্যাডাম মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে টেবিলের উপর দু’হাত রেখে কপাল চেপে বসে রইলেন। তখন ওনার মন ইউসুফ গাজীর উপর ঘৃণায় ভরে উঠল।
নিলীমা জানে জ্যোৎস্না ম্যাডামের রুমে ইউসুফ গাজী কথা বলছেন, সবাইয়ের খাওয়া শেষ হওয়ার পরও যখন ওনারা খেতে এলেন না তখন ডাকতে যাচ্ছিল। ইউসুফ গাজীকে চলে যেতে দেখে ভিতরে ঢুকল। জ্যোৎস্না ম্যাডাম ঐভাবে বসে আছেন দেখে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে ম্যাডাম? শরীর খারাপ লাগছে?
তাকে দেখে ও তার কথা শুনে জ্যোৎস্না ম্যাডামের চোখে পানি এসে গেল। ভাবলেন, তার যদি মেয়ে থাকত, তা হলে এতদিনে ওর মতোই হত। চোখ মুছে বললেন, হ্যাঁ, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সবার খাওয়া শেষ হয়েছে?
নিলীমা বলল, জি। তারপর আবার বলল, গাজী সাহেব না খেয়ে চলে গেলেন যে?
জ্যোৎস্না ম্যাডাম একটা দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রেখে বললেন, ওনার পেটে এসব খাবার সহ্য হয় না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি খেয়েছ?
না, আপনার সঙ্গে খাব বলে খাইনি।
জ্যোৎস্না ম্যাডাম নিলীমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই সব সময় তার ভালোমন্দের দিকে লক্ষ্য রাখতেন। খাওয়ার পর ঘুমাবার সময় চিন্তা করতে লাগলেন, ইউসুফ গাজী তাকে অনেক বার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন; কিন্তু সে মেনে নিতে পারেন নি। আজ নাতনির বয়সী নিলীমাকে বিয়ে করার কথা শুনে মনে হয়েছে, সে রাজি হয় নি বলে নিলীমাকে বিয়ে করে তার উপর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে। ভাবলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত ইউসুফ গাজীকে মিথ্যে কথা বলে আশ্বাস দিয়ে রাখতে হবে। আর নিলীমাকে আগলে রাখতে হবে যাতে করে ইউসুফ গাজী তার কোনো ক্ষতি করতে না পারে। পরীক্ষার পর নিলীমাকে এখান থেকে এমন জায়গায় সরাতে হবে, যেখানে তার সন্ধান ইউসুফ গাজী যেন কখনও না পায়।
মিথ্যা ও ছল চাতুরীর মাধ্যমে ইউসুফ গাজীকে খুশি রাখলেন দু’বছর জ্যোত্সা ম্যাডাম। তারপর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর নিলীমাকে কোথায় কীভাবে সরাবেন কয়েকদিন ধরে চিন্তা করতে লাগলেন। হঠাৎ একদিন পেপারে একটা আট বছরের মেয়ের গর্ভনেস দরকার বিজ্ঞাপন পড়ে আশার আলো দেখতে পেলেন। এক সময় নিভৃতে নিলীমাকে ডেকে ইউসুফ গাজীর উদ্দেশ্য জানিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য।
কথাটা শুনে নিলীমার চেহারায় ঘৃণা ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ওনার উদ্দেশ্য কোনোদিন পূরণ হবে না। যদি জোর করে কিছু করতে চান, তা হলে এখান থেকে পালিয়ে যাব। তাতে ব্যর্থ হলে বাসর রাতে ওনাকে খুন করব। তাতে যদি আমার ফাঁসি হয় হবে। তারপর ভিজে গলায় বলল, মা বাবার আদর স্নেহ কি জিনিস জানি না। যতটুকু পেয়েছি পালক মামার কাছে। এখানে আসার পর কিছুটা হলেও আপনার কাছে মায়ের স্নেহ পেয়েছি। আপনি কি পারেন না, এই হতভাগীকে ওনার হাত থেকে রক্ষা করতে? আরও লেখাপড়া করার আশা রাখি। সেই আশা পূরণ করার জন্য আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারেন না? তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে জ্যোৎস্না ম্যাডাম বললেন, কান্না বন্ধ করে চোখ মুখ মুছে আমার কথা মন দিয়ে শোন, তুমি যদি আমি যা বলব তা মেনে নাও, তা হলে ইনশাআল্লাহ তোমার আশা পূরণ করার চেষ্টা করব।
নিলীমার মনে হল, গভীর পানির মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছিল। জ্যোৎস্না ম্যাডাম তাকে উদ্ধার করলেন। ওনার দু’হাত ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, ওয়াদা করছি, আপনার প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।
আবার কাঁদছ? তোমার মতো মেয়ের ভেঙে পড়া উচিত নয়। শোন, আমি তোমাকে ইউসুফ গাজীর হাত থেকে রক্ষা করতে চাই। তাই তোমার মনের খবর জানার জন্য তার উদ্দেশ্য জানালাম। তারপর তার হাতে পেপারের বিজ্ঞাপনের কাটপীসটা দিয়ে বললেন, একটা দরখাস্ত লিখে আমাকে দিও। আমি পোেস্ট করে দেব। আর শোন, এ ব্যাপারে কারও সঙ্গে এতটুকু আলাপ করবে না।
প্রায় পনের দিন পরে জ্যোৎস্না ম্যাডামের নামে চিঠি এল, নিলীমা যদি তার চরিত্র ও যোগ্যতা সম্বন্ধে স্কুল ও এতিমখানা থেকে সন্তোষজনক প্রশংসাপত্র প্রদান করতে পারে, তা হলে তাকে আসতে বলা হয়েছে। আর থাকা খাওয়া বাদে পাঁচ হাজার টাকা বেতন দেয়া হবে। তিনি পড়ে খুশি হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। তারপর নিলীমাকে পড়তে দিলেন।
পড়ে নিলীমাও খুশি হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তারপর ওনাকে কদমবুসি করে বলল, আপনার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না।
জ্যোৎস্না ম্যাডাম বললেন, ভুলেও কখন আমাকে চিঠি দেবে না। ইউসুফ গাজী তোমার খোঁজে লোক লাগাবেন। তাই বলছি, প্রয়োজনে আমি তোমাকে চিঠি দেব। তুমি কি করবে না করবে চিঠিতে লেখা থাকবে।
নিলীমা ভয়ার্ত স্বরে বলল, আমি চলে যাওয়ার পর উনি তো আপনাকে সন্দেহ করে আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন।
আমাকে নিয়ে তুমি কিছু ভাববে না। তোমাকে যা যা বললাম সেই মতো করবে।
কয়েকদিনের মধ্যে জ্যোৎস্না ম্যাডাম ওনার একজন বিশ্বস্ত লোকের সঙ্গে নিলীমাকে এক গভীর রাতে এতিমখানা থেকে বিদায় দিলেন। এতিমখানার দারোয়ানকে আগেই টাকা দিয়ে হাত করে রেখেছিলেন।
বিকেল চারটের সময় লোকটা গাজীপুর জেলার কাঁপাসিয়া গ্রামের নির্দিষ্ট বাড়ির কাছে পৌঁছে দিয়ে জ্যোত্স ম্যাডামের কথামতো ফিরে গেল।
পরের দিন সকালে নিলীমাকে না পেয়ে এতিমখানায় হৈচৈ পড়ে গেল। চারজন ম্যাডাম প্রথমে তার রুমমেট শেফালি, ফরিদা ও জাহানারাকে ডেকে তার কথা জিজ্ঞেস করলেন।
তারা প্রত্যেকে বলল, রাত সাড়ে দশটার সময় আমরা একসঙ্গে ঘুমিয়েছি। ফজরের আজান শুনে ঘুম ভাঙার পর থেকে তাকে দেখতে পাচ্ছি না।
জ্যোৎস্না ম্যাডাম শেফালিকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর সুটকেস ও জামা-কাপড় সব আছে?
শেফালি বলল, জি, আছে।
ঝরনা ম্যাডাম বললেন, নিলীমা আপনাকে সবার থেকে বেশি ভক্তি শ্রদ্ধা করত। আপনাকে না বলে চলে যাবে একথা ভাবতেই পারছি না।
নন্দিতা ও সালমা ম্যাডাম বললেন, আমাদের তো বিশ্বাসই হচ্ছে না, নিলীমার মতো মেয়ে কাউকে কিছু না বলে চলে যাবে। তা ছাড়া চলেই বা যাবে কেন বুঝতে পারছি না।
জ্যোত্সা ম্যাডাম বললেন, আপনাদের মতো আমিও কাউকে কিছু না বলে চলে যাবার কারণ বুঝতে পারছি না। গাজী ভাই শুনলে কি করবেন কি জানি।
জ্যোৎস্না ম্যাডাম দুপুরে ইউসুফ গাজীকে ফোন করে আসতে বললেন।
ইউসুফ গাজী এসে ঘটনা শুনে সব ম্যাডামদের ও ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করে কোনো সদউত্তর পেলেন না। শেষে জ্যোৎস্না ম্যাডামকে একাকী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার বিয়ের প্রস্তাব ওকে দিয়েছিলে?
জ্যোৎস্না ম্যাডাম বললেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু’দিন পর বলেছিলাম।
শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি নিলীমা?
মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পেরেছিলাম খুব অসন্তুষ্ট হয়েছে।
ওকে আরও লেখাপড়া করার কথা বলতে বলেছিলাম, বললি?
বলেছি। শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ভেবেচিন্তে পরে জানাবে।
আর আমি যদি বলি, এতক্ষণ যা কিছু বললে সব মিথ্যে? ওকে তুমিই কোথাও পালাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছ?
তা বলতে পার, তবে যা সত্য তাই বলেছি।
যদি সত্য বলে থাক, তা হলে ভালো। আর যদি মিথ্যে বলে থাক, তা হলে তোমাকে অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। কথা শেষ করে ইউসুফ গাজী সেখান থেকে চলে গেলেন।
৫
জ্যোত্সা ম্যাডামের লোকটা নিলীমাকে গেটের কাছে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাবার পর নিলীমা গেটের দিকে তাকিয়ে দেখল, বেশ বড় গেট। তবে তার পাশে একটা এক পাল্লার ছোট গেটও আছে। দু’টো গেইট বন্ধ দেখে এগিয়ে গিয়ে ছোট গেটের পাশের দেয়ালে সুইচ দেখে চাপ দিল। কেউ খুলছে না দেখে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর আরও দু’বার চাপ দিল। তাতেও কাজ না হতে কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে বাড়িটার দিকে তাকাল। গেট থেকে দোতলা বাড়িটা বেশ দূরে। উঁচু পাঁচিল থাকায় ভিতরের আর কিছু দেখতে পেল না। আশপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল, কাছাকাছি কোনো বাড়ি ঘর নেই। বেশ দূরে কয়েকটা বাড়ি দেখতে পেল। দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার কলিংবেলের সুইচে চাপ দেবার জন্য হাত বাড়াতে যাবে এমন সময় ছোট গেটের পাল্লা খুলে একজন আধ্যবয়সী লম্বা চওড়া ইয়া মোচওয়ালা লোক বোরখাপরা নিলীমাকে দেখে বলল, আপকা পরিচয়?
নিলীম তার কথা শুনে বুঝতে পারল, লোকটা বিহারী দারোয়ান। বলল, আমি মাগুরা থেকে আসছি। আমাকে ডেকে পাঠান হয়েছে বলে চিঠিটা তার হাতে দিল।
লোকটা চিঠিটা নিয়ে আধা বাংলা আধা হিন্দি মিশিয়ে বলল। হামি এখানকার দারোয়ান আছি। আপনি থোড়া অপেক্ষা করুন। কথা শেষ করে চিঠিটা নিয়ে চলে গেল।
প্রায় দশ মিনিট পর ফিরে এসে বলল, আসুন আমার সাথে।
নিলীমা ভিতরে ঢুকে দেখল, বাড়িটা দোতলা হলেও খুব সুন্দর প্যাটার্নের। গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার একপাশে বিরাট ফুলের বাগান, অন্যপাশে খেলার মাঠ।
চওড়া বারান্দায় একজন কাজের মেয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাকে দেখিয়ে দারোয়ান বলল, আপনি উসকি সাথ যান। তারপর সে গেটে ফিরে যেতে লাগল।
দারোয়ানের বাংলা হিন্দি মিশ্রিত কথা শুনে প্রথম থেকেই নিলীমার হাসি পেলেও চেপে রেখেছে।
কাজের মেয়েটা নিলীমাকে নিয়ে চওড়া বারান্দা পার হয়ে কিছু দূর গিয়ে, একটা দরজায় টোকা দিল। তারপর পর্দা ফাঁক করে বলল, ঐ যে একজন মহিলা সোজা বসে আছেন, উনি এ বাড়ির মালেকিন। আপনি ওনার কাছে যান।
নিলীমা তাকে জিজ্ঞেস করল, মালেকিন কি?
কাজের মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, উনি এই বাড়ির মালিক। কথা শেষ করে চলে গেল।
নিলীমা মুখের নেকাব সরিয়ে দেখল, রুমটা খুব বড়, দরজা জানালায় মোটা পর্দা ঝুলছে। পর্যাপ্ত আলো না থাকায় বেশ অন্ধকার অন্ধকার ভাব। নিলীমা খুব সাহসী মেয়ে হয়েও তার গা ছমছম করে উঠল।
এমন সময় মালেকিনের গমগম শব্দ ভেসে এল, ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার কাছে এস।
কাছে এসে নিলীমা ওনার রূপ দেখে ভীষণ অবাক হল। ভাবল, এত বয়সে যদি এ রকম, তা হলে যৌবনে কতই না রূপসী ছিলেন? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে সালাম দিল।
এই অপুর্ব সুন্দরী মালেকিনের নাম আসমা হুমায়রা। ডাক নাম চাঁদনী বেগম। নিলীমা সালাম দিতে প্রতি উত্তর না দিয়ে শুধু ডান হাতটা অল্প একটু তুলে চোখে কালো চশমা পরলেন। তারপর সোফার পাশের দেয়ালে একটা সুইচ টিপতে আলোর বন্যা বয়ে গেল।
এখন ওনাকে দেখে নিলীমার কিছুতেই মানবী বলে মনে হল না। তাই আরও এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করতে সন্দেহটা দূর হল। বলল, আপনাকে দেখে আমার নানির কথা মনে পড়ছে। যদিও নানিকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। যে মামা আমাকে মানুষ করেছেন, তাঁর কাছে শুনেছি, আমার নানির মতো রূপবতী মেয়ে দুনিয়াতে দেখা যায় না।
চাঁদনী বেগম গম্ভীর স্বরে বললেন, তোমার মায়ের কথা বললে না যে?
শিশুকালে–বাবা দু’জনকেই হারিয়েছি। তাই মা কেমন ছিলেন মনে নেই। ঐ মামার কাছেই শুনেছি, মাও খুব রূপবতী ছিলেন, তবে নানির মতো নয়।
তুমিও তো কম রূপবতী নও বলে চাঁদনী বেগম তাকে বসতে বলে বললেন, কই, কাগজপত্র দেখাও?
নিলীমা কাগজপত্র দেখাল।
সবকিছু দেখে চাঁদনী বেগম বললেন, এরকম কাগজপত্র আজকাল টাকার বদলে পাওয়া যায়। যাই হোক, এগুলো সত্য কিনা অল্প কিছুদিনের মধ্যে জানতে পারব। এখন খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নাও। সন্ধ্যের পর আলাপ করব। তারপর কলিংবেল বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা কাজের মেয়ে পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকল।
চাঁদনী বেগম কাজের মেয়েকে দেখে বলেন, একে এর রুমে নিয়ে গিয়ে খাবার ব্যবস্থা কর।
রুম দেখে নিলীমা খুব খুশি হল। পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বেশ বড় বড় দুটো জানালা। বারান্দার দিকেও একটা আছে। পূর্ব দিকের জানালা খুলে দিতে খেলার মাঠ দেখতে পেল। আর দক্ষিণ দিকের জানালা খুলতেই গেট ও তার পশ্চিম পাশের ফলের বাগান দেখতে পেল।
কাজের মেয়েটার নাম ফারজানা। সে এটাচ বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে বলল, আধ ঘণ্টার মধ্যে খাবার নিয়ে আসছি। তারপর চলে গেল।
আসার সময় নিলীমা মাত্র এক জোড়া পরার কাপড় এনেছিল। কাপড় পাল্টে বাথ রুমের কাজ সেরে মেঝেয় তোয়ালে বিছিয়ে ফযর ও জোহরের কাযা নামায পড়ে আসরের নামায পড়ে উঠেছে এমন সময় ফারজানা খাবার নিয়ে এল।
খাবারের মেন্যু দেখেও নিলীমা খুশি হল। ভাবল, আল্লাহ হয়তো এতদিনে তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন।
খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, এত বড় বাড়িতে আর কোনো লোকজন নেই?
ফারজানা বলল, আমাদের কোনো কিছু বলা নিষেধ। যা জানাবার মালেকিন জানাবেন। খাওয়া শেষ হতে বাসন পেয়ালা নিয়ে চলে যাওয়ার সময় কলিংবেলের সুইচ দেখিয়ে বলল, দরকার হলে সুইচ টিপবেন।
মাগরিবের নামায পড়ে নিলীমা দক্ষিণ দিকের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গেটের দিকে তাকিয়েছিল। কেউ ঘরে ঢুকেছে বুঝতে পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে ফারজানাকে দেখে বলল, কিছু বলবে?
মালেকিন আপনাকে ডাকছেন, আসুন আমার সঙ্গে। তারপর তাকে নিয়ে দোতলায় উঠে একটা রুমের দরজার কাছে এসে বলল, ভিতরে যান।
নিলীমা ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারল, এটা দোতলার ড্রইংরুম। নিচতলার চেয়ে এখানকার আসবাবপত্র আরও দামি। আলোতে রুমটা দিন হয়ে আছে। চাঁদনী বেগম কালো চশমা পরে রুমে আছেন। আর তাঁর পাশে সাত-আট বছরের একটা অসম্ভব সুন্দরী ফুটফুটে মেয়ে বসে আছে। তার মুখ থেকে হাসি যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। মেয়েটার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে না পেরে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। তারপর এগিয়ে এসে চাঁদনী বেগমের দিকে তাকিয়ে সালাম দিল।
চাঁদনী বেগম বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, এসেই তো একবার সালাম দিয়েছ, আবার কেন? তারপর বসতে বললেন।
নিলীমা বসে বলল, বেয়াদবি মাফ করবেন। আমাদের নবী করিম (দ:) বলিয়াছেন, “মুসলমানদের পরস্পর সাক্ষাৎ হইলে একজন অন্যজনকে বলিবে : “আসোলামু আলাইকুম” (তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হউক)। ইহা বলা সুন্নত। কেহ ইহা বলিলে তদুত্তরে বলিবে : ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ (তোমাদের উপরও শান্তি বর্ষিত হউক)। ইহা বলা ওয়াজিব।’ সালাম মুসলমানের প্রাথমিক বন্ধন। ইহা সাম্য শিক্ষার অন্যতম নিদর্শন। সালাম আদান প্রদানের নিয়ম হল, ছোটরা সালাম দিবে বড়দের, আরোহী সালাম দিবে উপবিষ্ঠকে, মটর বা যানবাহনের আরোহী সালাম দিবে পথি-পার্শ্বস্থ ফকিরকে ইত্যাদি। আর কোনো অমুসলিম কোনো মুসলিমকে প্রথমে সালাম দ্বারা সম্ভাষণ করিলে তাহার উত্তরে বলিবে। হাদাকাল্লাহ’ (আল্লাহ তোকে সৎ পথ প্রদর্শন করুন।)
চাঁদনী বেগম রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, জ্ঞান দান করার জন্য তোমাকে ডেকে পাঠান হয়নি। ভবিষ্যতে এরকম ভুল আর করবে না। তারপর পাশে বসা মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, সব সময় এর সঙ্গে থাকবে। এমন কি খাওয়া, শোয়া, লেখাপড়া ও খেলাধুলা পর্যন্ত। এক মাস সময় দেয়া হল; এর মধ্যে যদি সবকিছু ঠিকঠাক মতো করতে পার অর্থাৎ সব কিছু করে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পার, তা হলে তোমাকে পারমানেন্ট করা হবে। নচেৎ এক মাসের বেতন দিয়ে বিদায় করে দেয়া হবে। আর একটা কথা, এই এক মাসের মধ্যে অহনার মনও তোমাকে জয় করতে হবে। নচেৎ ঐ একই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারপর কলিংবেল বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে একজন কাজের মেয়ে ঢুকলে নাতনিকে বললেন, ওর সঙ্গে রিডিং রুমে যাও।
নিলীমার মনে হল, প্রত্যেকটা কাজের মেয়ে ওনার হুকুমের অপেক্ষায় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে এবং তাদের ডাকার আলাদা আলাদা কলিংবেল আছে।
চাঁদনী বেগম নিলীমাকে বললেন, এ বাড়ির কারও সম্পর্কে অথবা অন্য যে কোনো ব্যাপারে অহনাকে জিজ্ঞেস করবে না। এক মাসের মধ্যে যদি কৃতকার্য হতে পার, তা হলে এখানে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে সবকিছু জানতে পারবে। আর যা জানতে পারবে না, আমার কাছ থেকে জেনে নেবে। কোনো কাজের মেয়ের কাছে জিজ্ঞেস করবে না। এখন শুধু এতটুকু জেনে রাখ, আমার ছেলেমেয়ে কেউ বেঁচে নেই। অহনা হল আমার ছেলের ঘরের একমাত্র নাতি বখতিয়ার হাবিবের একমাত্র সন্তান। দু’বছর আগে ওর মা রেহানা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। রেহানা যে শুধু অপূর্ব রূপবতী ছিল তাই নয়, স্বামীকে এত বেশি ভালোবাসাত, সম্মান করত, যা পৃথিবীতে বিরল।
নিলীমা জিজ্ঞেস করল, আপনার নাতি এখন কোথায়?
চাঁদনী বেগম বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, আহ! কথার মাঝে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবে না। নাত বৌ মারা যাবার পর নাতি অনেক দিন এ্যাব-নরমাল ছিল। এখন কিছুটা সুস্থ। মাসে একবার এখানে আসে। প্রচুর মদ খায়। সব সময় মাতাল হয়ে থাকে। খুব সাবধানে থাকবে, ভুলেও তার সামনে যাবে না। কোনো মেয়েকেই সহ্য করতে পারে না। তারপর কলিংবেলের সুইচ টিপতে সেই কাজের মেয়েটা এলে তাকে বললেন, একে অহনার রিডিংরুমে নিয়ে যাও।
রিডিং রুমটা নিচতলার সিঁড়ির পাশে। নিলীমাকে পৌঁছে দিয়ে কাজের মেয়েটা চলে গেল। রুমটা খুব সুন্দর। এক সাইডে একটা আলমারিতে কিশোরদের নানারকমের গল্পের বই। রুমের মাঝখানে একটা টেবিল আর তার দু’পাশে দুটো চেয়ার।
নিলীমাকে দেখে অহনা দাঁড়িয়ে পড়ল।
তাকে বসতে বলে নিলীমাও বসল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কোন ক্লাসে পড়?
অহনা কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি কি জানেন আমার মা কোথায় গেছে?
নিলীমা বুঝতে পারল, তাকে তার মায়ের মৃত্যুর কথা জানানো হয়নি। চিন্তা করল, এ কথাটা চাঁদনী বেগম তাকে জানালেন না কেন?
কই, বলুন না, মা কোথায় গেছে জানেন?
আমি তো আজই এলাম এ বাড়িতে, জানব কি করে?
যে দিন জেনে আমাকে বলবেন, সেদিন থেকে আপনার কাছে পড়ব। এই কথা বলে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল অহনা।
সেদিন থেকে না হয় পড়বে। যে কয়েকদিন না বলতে পারছি, সেই কয়েকদিন গল্প শুনতে তো আপত্তি নেই।
অহনা বই-এর আলমারীর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে বলল, ওখানে যত গল্পের বই আছে সব পড়েছি। আর কি গল্প আপনি শোনাবেন?
নিলীমা উঠে গিয়ে আলমারির বইগুলোর নামের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, এই সমস্ত বই-এর গল্প ছাড়া আমি তোমাকে নতুন গল্প শোনাব।
অহনা মৃদু হেসে বলল, তাই নাকি? তা হলে আপত্তি নেই বলে বসে পড়ল।
নিলীমা আলমারির বইগুলো দেখে জানতে পেরেছে, সাইন্সফিকসান, বিভিন্ন দেশের রূপকথা, ভূত-পেত্নী ও ছোটদের উপযোগী দেশি-বিদেশি কিছু মনীষিদের জীবনি। ইসলামিক বা মুসলিম মনীষিদের কোনো জীবনি নেই। অহনা বসার পর বলল, তুমি তো ক্লাস টুয়ে পড় তাই না?
জি, বলে অহনা জিজ্ঞেস করল, আপনি জানলেন কি করে?
নিলীমা বলল, টেবিলের উপর যে ইংরেজি বইটা রয়েছে, এটা ক্লাস টুয়ের। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার স্কুলের নাম বলতে পার?
কেন পারব না বলে অহনা স্কুলের নাম বলল।
নাম শুনেই নিলীমা বুঝতে পারল, ওটা বিদেশি এনজিওদের স্কুল। বলল, তুমি তো অনেক ধরনের বই পড়েছ, সেই সাথে দেশি-বিদেশি মনীষিদের জীবনিও পড়েছ; কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, সারা পৃথিবীর সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ মনীষীর জীবনি পড়নি।
অহনা অবাক হয়ে বলল, ওনার নাম বলুন তো?
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায় হিসসালাম।
উনি পৃথিবীর সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ মনীষী অথচ বাবা আমাকে ওনার জীবনি কিনে দিলেন না কেন বুঝতে পারছি না।
হয়তো ভেবেছেন পরে কিনে দেবেন।
কিন্তু বাবা তো এখন আমাকে একটুও ভালোবাসেন না; কে আমাকে কিনে দেবে?
তোমার ধারণা ভুল। এখন হয়তো কোনো কারণে ভালোবাসেন না, পরে নিশ্চয় বাসবেন।
আপনি তো জানেন না, বাবা আগে আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। যখন থেকে মা চলে গেলেন তখন থেকে আমাকে একদম ভালোবাসেন না। এমন কি আমাকে দেখতেও পারেন না। কাছে গেলে মারতে আসেন বলে অহনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
নিলীমা তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলল, কাঁদছ কেন? আমি বলছি, কিছুদিনের মধ্যে তোমার বাবা তোমাকে আগের মতো ভালোবাসবেন। তোমার বড় মা নিশ্চয় তোমাকে ভীষণ ভালোবাসেন, তাই না?
জি, উনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন।
আচ্ছা, বড় মা তোমার বাবাকে কিছু বলেন না?
আগে বড় মাকে বাবা ভীষণ ভালোবাসতেন। বড় মার সব কথা মেনে চলতেন। এখন বড় মার কোনো কথা শোনেন না।
আমার মনে হয় তোমার বাবা মানষিক রোগে ভুগছেন। এসব কথা থাক। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায় হিস সালামের কথা বলি। তা হলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।
ঠিক আছে বলুন। তার আগে হযরত মুহাম্মদ নামের পরে সাল্লাল্লাহু আলায় হিসসালাম বললেন কেন বলুন।
সাল্লাহু আলায়হিস সালাম আরবি কথা। ওটার অর্থ হল, তার উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক। উনি পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী। তাই ওনার নাম পড়লে বা শুনলে সাল্লাল্লাহু আলায় হিসসালাম বলা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য, নচেৎ গুনাহ্ হবে।
গুনাহ্ কি?
গুনাহ্ অর্থ পাপ। আর যা অন্যায় তাকে পাপ বলে। এবার ওনার কথা বলছি। শোন, আমাদের দেশের পশ্চিম দিকে আরব নামে একটা দেশ আছে। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে সেই দেশের মক্কা নগরে বিখ্যাত কুরাইশ বংশে হযরত মুহাম্মদ (সা:) জন্ম গ্রহণ করেন। ওনার মায়ের নাম আমেনা, বাবার নাম আব্দুল্লাহ আর দাদার নাম আব্দুল মুত্তালেব। হযরত মুহাম্মদ (সা:) যখন মায়ের পেটে ছয় মাসের তখন ওনার বাবা আব্দুল্লাহ মারা যান। সেই দেশের তখনকার সামাজিক প্রথা অনুসারে শিশু মুহাম্মদ (সা:)-কে হযরত হালিমা (রা:) নিজের বুকের দুধ পান করিয়ে লালন-পালন করেন।
অহনা বলল, দাঁড়ান দাঁড়ান। হযরত হালিমা নামের পরে রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন কেন? এটার আবার অর্থ কি?
নিলীমা বলল, হযরত মুহাম্মদ (সা:) যখন ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন তখন যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ইসলাম প্রচার করার কাজে জান ও মাল দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন এবং ওনার আদেশ নিষেধ মেনে চলেছেন; তাদেরকে সাহাবী বলে। সাহাবীদের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়ই ছিলেন। ওনারা আল্লাহর ও তাঁর রসূলের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। তাই পৃথিবী সমস্ত মুসলমানদের কাছে ওনারা সম্মানীয় ও সম্মানীয়া। সেই সম্মানীয় পুরুষ সাহাবীদের নাম পড়লে বা শুনলে রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলতে হয়। আর নারী সাহাবীদের নাম পড়লে বা শুনলে রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলতে হয়। আর এটার অর্থ হল, আল্লাহ ওনাদের উপর রাজি হউন।
এবার তা হলে শোন, হযরত মুহাম্মদ (সা:) হযরত হালিমা (রা:) ঘরে লালন-পালন হওয়ার পাঁচ কি ছয় বছর বয়সের সময় একটা দারুণ ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনা বলে আজকের মতো গল্প শেষ করব। একদিন হযরত হালিমা (রা:)-র ছেলেদের ও পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (সা:) মাঠে খেলা করছিলেন। তখন আল্লাহ জীবরাঈল (আঃ) নামে এক ফেরেশতাকে মানুষের বেশে পাঠিয়ে ওনার সীনাকে অর্থাৎ বুককে ছুরি দিয়ে অপারেশন করান। তাই দেখে অন্য ছেলেরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। আর হযরত হালিমা (রা:)-এর ছেলেরা গিয়ে মাকে ঘটনাটা বলল।
শুনে হযরত হালিমা (রা:) ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে মাঠের দিকে ছুটলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন হযরত মুহাম্মদ (সা:) একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। হযরত হালিমা (রা:) তাঁকে জীবিত দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, একটা লোক নাকি ছুরি দিয়ে তোমার বুক ফেড়েছে? হযরত মুহাম্মদ (সা:) বললেন, লোকটাকে আমার কাছে আসতে দেখেছি; কিন্তু তারপর উনি কি করলেন না করলেন আমি কিছুই জানি না। হযরত হালিমা (রা:) ওনাকে সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে এলেন।
এ পর্যন্ত বলে নিলীমা বলল, আজ তা হলে এ পর্যন্ত থাক। আবার অন্য একদিন ওনার গল্প বলা যাবে।
অহনা বলল, তা না হয় বলবেন, কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না। কেউ ছুরি দিয়ে কারও বুক ফাড়লে সে তো মারা যাবে। হযরত মুহাম্মদ (সা:) বেঁচে থাকলেন কি করে?
কি করে উনি বেঁচে থাকলেন, সে কথা বললেও তুমি এখন বুঝবে না। আরও বড় হয়ে যখন হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর জীবনি পড়বে তখন বুঝতে পারবে। এবার একটা কথা বলি, আজ তো পড়লে না, কাল স্কুলের টিচাররা কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে পারবে?
অহনা অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, স্কুল এক সপ্তাহ বন্ধ।
এমন সময় ফারজানা এসে বলল, মালেকিন ডাইনিং টেবিলে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
চাঁদনী বেগম সবার আগে খাওয়া শেষ করে চলে গেলেন।
উনি চলে যাওয়ার পর নিলীমা ফারজানাকে বলল, মালেকিন বললেন অহনার সঙ্গে সব সময় আমাকে থাকতে হবে। এমন কি ঘুমাতেও হবে। তা হলে নিচের রুমটা আমাকে দেয়া হল কেন?
ফারজানা মৃদু হেসে বলল, ওটা আপনার ব্যক্তিগত রুম। এতদিন আমি অহনা আপার সঙ্গে সব সময় থাকতাম, ঘুমাতাম। আজ থেকে আপনি ঐসব করবেন। আর আমি আপনাদের দুজনের দেখাশোনা করব।
অহনার রুমটা বেশ বড়। দু’পাশে দু’টো খাট। মেঝেয় পুরু কার্পেট বিছানো। দু’টো খাটের উপর দু’টো ফ্যান, একটা দুই সীটের সোফা ও কাঁচের টি টেবিল। নিলীমা রুমে ঢুকে দেখল, অহনা স্লিপিং গাউন পরে একটা খাটের উপর বসে আছে।
তাকে দেখে অহনা বলল, আপনি কি এক্ষুনি ঘুমাবেন?
কেন বলতো? তোমার কি ঘুম পাইনি?
না, ফারজানা গান শুনিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াত। যদিও তার গানের গলা ভালো না; তবু শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। আপনি গান গাইতে পারেন?
না।
কেন?
আমাদের ধর্ম ইসলাম। আর ইসলামে গান বাজনা নিষিদ্ধ। তাই আমি গান শিখিও না আর গাইও না। তবে ভালো কবিতা আবৃত্তি করা ও গজল গাওয়া নিষিদ্ধ নয়।
আপনি কখনও কবিতা আবৃত্তি করেছেন?
না।
গজল গেয়েছেন?
কোনো সভায় না গাইলেও দু’চারটে গজল জানি।
তা হলে একটা গজল শোনান।
সাহারাতে ফুটলরে ফুল রঙিন গুলে লা-লা
সেই ফুলেরই খোশবুতে আজ দুনিয়া মাতোয়ালা।
সেই ফুল নিয়ে কাড়াকাড়ি চাঁদ সুরুজ গ্রহ তারা
ঝুঁকে পড়ে চুমে সে ফুল নীল গগণ নিরালা।
সেই ফুলেরই রৌশনীতে আরশ কুরশী রৌশন
সেই ফুলেরই রঙ লেগে আজ ত্রিভূবন উজালা।
চাহে যে ফুল জীন ইনসান, হুর পরী ফেরেশতারা
ফকির দরবেশ বাদশাহ চাহে করতে গলার মালা।
চিনে রসিক ভোমরা বুলবুল সে ফুলের ঠিকানা
কেউ বলে হযরত মুহাম্মদ (সা:) কেউ বলে কামলিওয়ালা।
অহনা হাত তালি দিয়ে আনন্দিত স্বরে বলল, আপনার গলা দারুন। প্রতিদিন ঘুমাবার সময় আমাকে গজল শোনাবেন।
ঠিক আছে শোনাব বলে নিলীমা বলল, এবার ঘুমিয়ে পড়।
আপনি গজল গাইতে থাকুন, শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়ব।
ভোরে উঠে ফজরের নামায পড়ে কুংফু প্র্যাকটিস করাটা নিলীমার প্রতিদিনের অভ্যাস। আজও তাই করে রেস্ট নেয়ার সময় জানালার কাছে গিয়ে খেলার মাঠ দেখে ভাবল, অহনাকে মাঠে প্রাত:ভ্রমণ করান দরকার।
কয়েকদিন পর একদিন ভোরে অহনার ঘুম ভেঙে যেতে নিলীমাকে কুংফু প্র্যাকটিস করতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর যখন ফ্যানের নিচে বসে রেস্ট নিতে দেখল তখন জিজ্ঞেস করল, ম্যাডাম, আপনি এতক্ষণ হাত পা ফিকা ফিকি করছিলেন কেন?
নিলীমা বলল, আমি কুংফু প্র্যাকটিস করছিলাম।
কুংফু আবার কি?
কুংফু হল একটা আর্ট। এটা শেখা থাকলে শত্রুর হাত থেকে যেমন নিজেকে রক্ষা করা যায়, তেমনি শত্রুকে আঘাত করে ঘায়েল করাও যায়।
তা হলে তো আমারও শেখা উচিত।
হ্যাঁ, শেখা উচিত। তবে তুমি তো এখন ছোট, আর একটু বড় হও তখন শেখাব। এখন প্রতিদিন তোমার প্রাত:ভ্রমণ করা উচিত। তারপর জানালার কাছে গিয়ে বলল, ঐ খেলার মাঠ দেখা যাচ্ছে, ওখানে কারা খেলাধুলা করে?
আগে বাবা তার বন্ধুদের নিয়ে ফুটবল, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলতেন। মা চলে যাওয়ার পর আর খেলেন না।
আমি তোমাকে নিয়ে ওখানে হাঁটতে চাই যাবে নাকি?
কাল থেকে হাঁটতে যাব, আজ বড়মার অনুমতি নেব।
ঠিক আছে তাই নিও।
আজ রিডিং রুমে এসে নিলীমা বলল, একটা কথা বলব মনে রাখবে তো?
কি কথা?
আগে বল রাখবে?
সহজ কথা হলে রাখব, কঠিন বললে রাখব না।
নিলীমা মৃদু হেসে বলল, সহজ কথাই বলব।
তা হলে বলুন, রাখব।
আমি তোমার কে?
ম্যাডাম।
ম্যাডাম কাকে বলে?
যিনি ছাত্র-ছাত্রী পড়ান তাকে ম্যাডাম বলে।
গুড, ভেরি গুড। ম্যাডামের কথা ছাত্র-ছাত্রীদের মেনে চলা একান্ত উচিত। এটাও নিশ্চয় জানো?
জি, জানি।
তা হলে স্কুলের বই বের করে পড়। আমি তো আপনাকে বলেছি, আমার মা কোথায় গেছে যেদিন বলতে পারবেন, সেদিন থেকে পড়ব।
তা বলেছিলে, কিন্তু তুমি তো এক্ষুনি বললে, ম্যাডামের কথা ছাত্র-ছাত্রীদের মেনে চলা একান্ত উচিত?
নিলীমার কথা শুনে অহনা থতমত খেয়ে কিছু বলতে না পেরে এক দৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার ডাগর ডাগর চোখ দুটো থেকে টপটপ করে পানি জামায় পড়তে লাগল।
অহনা যে মায়ের জন্য কাঁদছে তা বুঝতে পেরে নিলীমা তার চোখ মুছে দিয়ে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, আল্লাহ যদি আমাকে এখানে থাকার জন্য কবুল করেন, তা হলে কথা দিচ্ছি ইনশাআল্লাহ তোমার মা কোথায় গেছেন জেনে তোমাকে বলব।
আর কোনো কিছু না বলে অহনা পড়াশোনা শুরু করল। শুধু তাই নয়, সেদিন থেকে নিলীমার খুব ভক্ত হয়ে উঠল।
নিলীমা প্রতিদিন তাকে নিয়ে প্রাত:ভ্রমণ করে। বিকেলে মাঠে ড্রিল করায়। আবার মাঝে মধ্যে ব্যাডমিন্টন খেলে।
চাঁদনী বেগম দোতলার বারান্দা থেকে তাদের খেলা দেখেন। ওনার সঙ্গে খাওয়ার সময় ছাড়া অন্য কোনো সময় নিলীমার দেখা সাক্ষাৎ হয় না। সেই সময় প্রয়োজনীয় দু’একটা কথা হয়।
অহনা আগে বড়মাকে মায়ের কথা বার বার জিজ্ঞেস করত। চাঁদনী বেগম। বিরক্ত বোধ করে অন্য কথা বলে এড়িয়ে যেতেন। অহনা আসার পর আর জিজ্ঞেস করেনি। তাই একদিন নিলীমাকে জিজ্ঞেস করলেন, অহনা তার মায়ের কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করে?
নিলীমা বলল, জি, করে।
তুমি উত্তরে কি বল?
নিলীমা অহনাকে দ্বিতীয় দিন পড়তে বসে যা বলেছিল, তাই বলল।
চাঁদনী বেগম আর কিছু না বলে চুপ করে গেলেন।
৬
ঠিক পঁচিশ দিনের মাথায় রাত তিনটের সময় অহনার বাবা হাবিব মাতাল অবস্থায় বাড়িতে এল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাম দিকের প্রথম রুমটা ড্রইংরুম। তারপরের রুমটা হাবিবের। সিঁড়ির ডান দিকের প্রথম রুমে চাঁদনী বেগম থাকেন। তারপরের রুমে অহনা থাকে। আগে তার সঙ্গে কাজের মেয়ে ফারজানা থাকত, এখন নিলীমা থাকে।
হাবিব মাতাল অবস্থায় বাম দিকে না গিয়ে ডানদিকে গিয়ে চাঁদনী বেগমের রুম পার হয়ে অহনার রুমের দরজায় নক করতে লাগল।
অহনা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
নিলীমা প্রতিদিন এই সময়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়তে উঠে। দরজায় নক হতে টেবিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত তিনটে। দরজার নক হচ্ছে শুনে ভাবল, কে হতে পারে? দরজা খুলবে কিনা চিন্তা করতে লাগল। এমন সময় পুরুষ কণ্ঠে দরজা খোলার কথা শুনতে পেল। সেই সাথে দরজায় লাথি মারারও শব্দ পেল। তবু দরজা না খুলে চিন্তা করল, বাড়ির চাকর–চাকরাণী ও চাঁদনী বেগমের তো জেগে যাবার কথা। তাদের কারও সাড়া না পেয়ে ভাবল, দরজা খোলা উচিত হবে না। মনে হয় ডাকাত পড়েছে। হঠাৎ বারান্দার দিকের জানালার কথা মনে পড়তে পর্দা সরিয়ে আস্তে আস্তে ছিটকিনি খুলে একটা পাল্লা একটু ফাঁকা করতেই তিনজন কাজের বুয়াকে দেখতে পেল। সেই সাথে চাঁদনী বেগমের গলা শুনতে পেল; হাবিব, ওটা তোর মেয়ে অহনার রুম, তোর রুম এদিকে।
হাবিব দাদির কথা গ্রাহ্য না করে দরজায় লাথি মেরেই চলছে। কেউ সাহস করে তার দিকে এগোচ্ছে না।
তা হলে ডাকাত পড়েনি, অহনার বাবা মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে এরকম করছে বুঝতে পেরে নিলীমা দরজা খুলে বজ্র কণ্ঠে বলল, একজন উচ্চ বংশের শিক্ষিত মানুষ হয়ে মদ খেয়ে নিজের বাড়িতে মাতলামী করতে আপনার বিবেকে বাধছে না? চাকর চাকরানীদের সামনে এরকম করতে লজ্জা করছে না? যান, নিজের রুমে যান।
দরজা খুলতেই মাতাল অবস্থায় নিলীমাকে স্ত্রী রেহানা মনে হল হাবিবের। তাই প্রচন্ড রেগে উঠে বিশ্বাসঘাতিনী তুই এ বাড়িতে এসেছিস কেন বলে মারার জন্য তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
নিলীমা এজন্য প্রস্তুত ছিল। তড়িৎ গতিতে সরে গিয়ে খপ করে তার দু’টো হাত ধরে একই কণ্ঠে বলল, আমি আপনার স্ত্রী নই, অহনার গভর্নেস।
হাবিব শক্তিশালী যুবক। কোনো রকমে হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে গর্জে উঠে বলল, তুই মিথ্যেবাদী, ছলনাময়ী। কে তোকে অহনার গভর্নেস রেখেছে? দুনিয়ার সব নারীরাই তোর মতো মিথ্যাবাদী, ছলনাময়ী। তোকে আজ খুন করে ফেলব বলে আবার তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
নিলীমা সরে গিয়ে এবার তার একটা হাত ধরে পিঠের দিকে এনে জোরে চাপ দিয়ে বলল, বললাম না, আমি আপনার স্ত্রী নই, অহনার গভর্নেস?
হাবিব ঝাঁকিয়ে উঠে বলল, ব্যথা পাচ্ছি, হাতটা ছেড়ে দে নিশাচিনী। নচেৎ আজ আর তুই এখান থেকে পালাতে পারবি না। তারপর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল।
নিলীমা হাতটা ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে তাকে ধরে শুইয়ে দিল।
সবাই এতক্ষণ দূর থেকে ঘটনা দেখছিল। এবার চাঁদনী বেগম এগিয়ে আসার সময় একজন বুয়াকে বললেন, মুখতারকে ডেকে নিয়ে এস।
মুখতার এ বাড়িতে প্রায় ত্রিশ বছর আছে। হাবিবকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। তার অনেক অন্যায় আবদার পূরণ করতে হয়েছে। সে জন্য হাবিবের মা-বাবার কাছে অনেক বকুনি খেতে হয়েছে। এখন তার বয়স পঁয়ষট্টি বছর। কিন্তু স্বাস্থ্য ও শক্তিতে এখনও ভাটা পড়েনি। ছোট সাহেবের বড় গলা পেয়েই তার ঘুম ভেঙে গেছে। মালেকিনের ডাকের অপেক্ষায় নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। বুয়া গিয়ে বলতেই উপরে উঠে এল।
চাঁদনী বেগম তাকে বললেন, হাবিবকে তার ঘরে নিয়ে চল। তিনি নিলীমার শক্তি ও সাহস দেখে অবাক হয়েছিলেন। এবার তাকে বললেন, তুমি দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
নিলীমা বলল, ওনার মাথায় পানি ঢাললে জ্ঞান ফিরে আসবে।
সে কথা আমি জানি। যা বললাম তাই কর বলে চাঁদনী বেগম নাতির রুমের দিকে চলে গেলেন।
দরজায় হাবিবের লাথির শব্দে অহনারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। শুয়ে শুয়ে সবকিছু দেখে ঘুমের ভান করে পড়েছিল। নিলীমা রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়ার পর বলল, আপনি বাবাকে মদ খেয়ে মাতলামী করার কথা বললেন, তা হলে সব মানুষই কি মদ খেলে ঐ রকম মাতলামী করে?
নিলীমা বুঝতে পারল, দরজায় লাথি মারার শব্দে ওরও ঘুম ভেঙে গেছে। বলল, হ্যাঁ, করে।
মদ কি জিনিস ম্যাডাম?
এখন তোমার জানার দরকার নেই।
আমার যে জানতে খুব ইচ্ছা করে।
মদ হল নেশার জিনিস। আর নেশা হলে মানুষ অমানুষ হয়ে যায়। তার প্রমাণ-একটু আগে তোমার বাবার কাণ্ডতো দেখলে? তাই আল্লাহ মদকে হারাম করেছেন।
হারাম কাকে বলে?
হারাম অর্থ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের যে সব জিনিস নিষিদ্ধ করেছেন, সেগুলোকে হারাম বলে। আর যে সমস্ত জিনিস খেলে বান্দাদের ক্ষতি হবে, সেগুলোকেই আল্লাহ হারাম করেছেন। যারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করে তারা বড় পাপী।
বাবা তো মদ খেয়েছে, তা হলে বাবা বড় পাপী?
হ্যাঁ।
বড় পাপী হলে কি হয়?
আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়াতে অল্প কিছু শান্তি দিলেও পরকালে কঠিন শাস্তি দেন আর যদি মদ ছেড়ে দিয়ে তওবা করে, তা হলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন। এসব কথা এখন তুমি বুঝবে না, আরও বড় হও, লেখাপড়া কর তখন বুঝবে। এবার কোনো কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়।
আর একটা কথা বলতে যে ইচ্ছা করছে?
তা হলে বল।
কাল বড়মাকে বলব, বাবাকে যেন মদ খেতে নিষেধ করেন।
ঠিক আছে, তাই বলো। এবার ঘুমিয়ে পড়।
পরের দিন বেলা ন’টার সময় ঘুম ভাঙল হাবিবের। গোসল করার সময় ডান হাতটা ব্যথা অনুভব করল। ব্যথা হওয়ার কারণটা ভাবতে গিয়ে গত রাতের ঘটনা আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল, দাদিমা তা হলে অহনার জন্য গভর্নেস রেখেছেন? ঘটনাটার জন্য একটু অনুতপ্ত হল।
এই দিনটার জন্য চাঁদনী বেগম একমাস অপেক্ষা করেন। নাতির সঙ্গে নাস্তা খাওয়ার জন্য না খেয়ে থাকেন।
ঠিক দশটার সময় নাস্তার টেবিলে এসে দাদিমাকে দেখে হাবিব বলল, কেমন আছেন?
চাঁদনী বেগম অভিমানভরা কণ্ঠে বললেন, তুই আর ভালো থাকতে দিলি কই? আগে নাস্তা খাওয়া শেষ কর তারপর আলাপ করব।
নাস্তা খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে হাবিব বলল, কি একটা আলাপ করবেন বললেন।
চাঁদনী বেগম বললেন, এভাবে আর কতদিন কাটাবি? তুই শিক্ষিত ছেলে হয়ে অশিক্ষিত ছেলের মতো কাজ করছিস কেন বলতে পারিস? তোর মনের ব্যথা আমি বুঝি। সেই ব্যথা দূর করার চেষ্টা না করে আর কত দিন বয়ে বেড়াবি। অহনার কথাও ভাবছি না? আজ দু’বছর মেয়েটা মা-বাবার স্নেহ সালমা থেকে বঞ্চিত। বাবা হয়ে কি করে তুই নিজের জন্ম দেয়া মেয়েকে দূরে সরিয়ে রেখেছিস? মেয়েটা একটু স্নেহ সালমার কাঙ্গাল হয়ে রয়েছে।
হাবিব ধরা গলায় বলল, কিন্তু দাদিমা আপনি তো সবকিছু জানেন, অহনার দিকে তাকালেই সেই বিশ্বাসঘাতিনীর কথা মনে পড়ে। তাই ওকে কাছে আসতে দিই না।
দোষ করেছে ও মা, মায়ের জন্য মেয়ের কষ্ট দিবি এটা কি উচিত? যা বলছি। শোন, মেয়েকে কাছে টানার চেষ্টা কর, তা না হলে যত দিন যাবে তত দূরত্ব বেড়ে যাব আর সেই সাথে বাবার প্রতি ছেলেমেয়েদের যে ভক্তি শ্রদ্ধা থাকে তা থাকবে না। বরং বিরূপ মনোভাব তৈরি হবে। সে জন্য বলছি প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে এসে মেয়েকে সময় দিবি। আর একটা কথা জেনে রাখ, হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন সমান হয় না তেমনি সব নারী পুরুষও সমান হয় না। তাদের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করলে অন্য সবাইও করবে একথা মোটেই ঠিক নয়। ভালোমন্দ দুনিয়াতে থাকবেই। শুধু ভালো অথবা শুধু মন্দ থাকলে পৃথিবী অচল হয়ে যেত। যাই হোক, আমি আর দেরি না করে তোর আবার বিয়ে দেব।
হাবিব বলল, আমি তো বলেছি, আর বিয়ে করব না।
তোকে ছোট রেখে তোর মা বাবা-মারা গেছে। এক দিকে বিষয় সম্পত্তি ও ব্যবসা আর অন্য দিকে তুই। কত কঠোর পরিশ্রম করে দু’দিক বজায় রেখেছিলাম। তোকে মানুষ করতে আমাকে যে কত কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে, তা তোকে বোঝাতে পারব না। শেষ বয়সে আমি তোর সুখ দেখতে চাই। তুই যদি আমার কথা না মানিস, তা হলে আমি না খেয়ে মরব।
দাদিমার শেষের দিকে কথাগুলো হাবিবের কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, ঠিক আছে, আমকে কি করতে হবে বল।
আমার তিনটে কথা তোকে মানতে হবে। প্রথম কথা, আজ থেকে অহনাকে কাছে টানার চেষ্টা করবি। দ্বিতীয় কথা হল, তুই তো নিজে পছন্দ করে একবার বিয়ে করেছিলি, এবারে আমি যে মেয়েকে পছন্দ করব তাকে বিয়ে বিয়ে করবি। তৃতীয় কথা হল, মদ খাওয়া ছেড়ে দিবি। কাল মদ খেয়ে ঘরে এসে যে কাণ্ড করেছিস, অন্য কোনো মেয়ে হলে কি কেলেঙ্কারিই না করে বসতিস।
কালকের ঘটনার জন্য খুব দুঃখিত। তুমি যে অহনার গভর্নেস রেখেছ তা জানতাম না। আর মাতাল অবস্থায় ওনাকে দেখে রেহানা মনে করেছিলাম। তাই ঐ ঘটনা ঘটে গেছে।
তাইতো তোকে মদ ছেড়ে দিতে বললাম। মদ খেলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কথা দে, মদ ছেড়ে দিবি।
একেবারে ছেড়ে দেব এখনই এমন কথা দিতে পারছি না, তবে এতটুকু বলতে পারি, গতরাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হবে না। ভবিষ্যতে আস্তে ধীরে মদ ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করব।
আর অহনা ও বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলবি না?
আপনার একটা কথা যখন মানার চেষ্টা করব বলেছি তখন অন্য দুটোও মানার চেষ্টা করব।
চাঁদনী বেগম খুশি হলেও তা প্রকাশ না করে একটু গম্ভীর স্বরে বললেন, আজ দুপুরে, খাওয়ার টেবিলে অহনাও আমাদের সঙ্গে খাবে।
হাবিব হ্যাঁ না কিছু না বলে সেখান থেকে নিচে ফুলের বাগানে চলে এল।
দু’জন মালিকে নিয়ে মুখতার ফুলবাগানের পরিচর্যা করে। আজও করছিল। প্রায় দু’বছর পর ছোট সাহেবকে আসতে দেখে এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, কিছু বলবেন ছোট সাহেব?
না, অনেকদিন এদিকে আসি নি, তাই আজ দেখতে এলাম। তারপর তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এক সময় জিজ্ঞেস করল, গতরাতে বাসায় কি করেছিলাম তুমি জান নাকি?
আমি তো নিচে ছিলাম। মালেকিন ডেকে পাঠাতে গিয়ে দেখি আপনি অজ্ঞান হয়ে বারান্দায় পড়ে আছেন। মালেকিনের কথামতো আপনাকে আপনার রুমে নিয়ে গিয়ে মাথায় পানি দিই। পরে ফারজানা আমাকে ঘটনাটা বলেছে।
ঘটনাটা বলতো?
মুখতার ঘটনাটা বলে বলল, অহনার ম্যাডাম খুব ধার্মিক মেয়ে। প্রায় একমাস হতে চলল এসেছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা তার মুখ দেখিনি। সব সময় একটা বড় উড়না দিয়ে সারা শরীর ও মুখ ঢেকে রাখেন। শুধু চোখ দুটো খোলা থাকে। ঐ অবস্থায় প্রতিদিন ভোরে অহনাকে নিয়ে খেলার মাঠে দৌড়ান। তাকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় বোরখা পরে যান।
তাই নাকি বলে হাবিব অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
মুখতার বলল, একটা কথা বলব ছোট সাহেব?
বল কি বলবে।
অহনা দাদুর জন্য খুব দুঃখ লাগে। ওর দিকে আপনি একটু লক্ষ্য রাখবেন। আগে তো ওর দিকে তাকানই যেত না। সব সময় মনমরা হয়ে থাকত। ম্যাডাম আসার পর থেকে মাঝে মধ্যে হাসি-খুশি দেখা যায়। ছোট মুখে হয়তো বড় কথা বলে ফেললাম, দয়া করে মাফ করে দেবেন।
হাবিব কিছু না বলে আরও বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বলল। অনেক ভালো ভালো ফুলগাছ মরে গেছে দেখছি। তোমরা লক্ষ্য রাখনি?
লক্ষ্য রাখব না কেন? ওগুলোর বয়স হয়েছিল, তাই মরে গেছে। আগে আপনি প্রতিদিন আসতেন। তখন যে গাছ মরে যেত সেই গাছ কিনে এনেছেন। এখন আর আসেন না, তাই…
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে হাবিব বলল, যে যে ফুলগাছ মারা গেছে। সেগুলোর নাম একটা কাগজে লিখে দিও; কিনে নিয়ে আসব। তারপর হাঁটতে হাঁটতে যখন বাগান থেকে বেরিয়ে বারান্দার কাছে এল ঠিক তখনই নিলীমা অহনাকে নিয়ে গাড়ি করে স্কুল থেকে ফিরল। গাড়ি হাবিবের কাছ থেকে সামান্য দূরে দাঁড়াল।
ড্রাইভার প্রথমে অহনার দিকের ও পরে নিলীমার দিকের গেট খুলে দিল।
নিলীমা গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে এসে অহনার একটা হাত ধরে নামাল। তারপর ড্রাইভার গাড়ি গ্যারেজে নেয়ার জন্য ছেড়ে দেয়ার পর হাবিবকে সালাম দিয়ে অহনার কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চস্বরে বলল, বাবাকে সালাম দাও।
অহনা ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়েই মুখ নিচু করে নিল।
হাবিব সালামের উত্তর দিয়ে এগিয়ে এসে অহনার চিবুক ধরে তুলল।
বাবা চিবুক ধরতেই ভয়ে কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে নিল অহনা।
মেয়ের ভীত হওয়ার কারণ হাবিব জানে। তাই তার ভয় কাটানোর জন্য চিবুক নাড়া দিয়ে খুব নরম স্বরে বলল, বাবাকে দেখতে ইচ্ছা করে না?
মা চলে যাওয়ার পর থেকে বাবা তার সঙ্গে নরম স্বরে কথা বলা তো দূরের কথা, তার কাছেই আসতে দেয় নি। তাই এতদিন পর নরম স্বরে কথা বলছে। শুনে একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা বলে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল।
হাবিবও তাকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে ধরে রইল। তারপর কপালে কয়েকটা চুমো খেয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে নিজের রুমালে চোখ মুছে দিয়ে বলল, যাও, ভিতরে যাও। তারপর নিলীমার দিকে তাকিয়ে বলল, গতরাতের ঘটনার জন্য খুব দুঃখিত। আশা করি, ভবিষ্যতে আর কোনোদিন ওরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।
প্রথম থেকেই নিলীমা নিচের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। হাবিব থেমে যেতে ঐ অবস্থায় ধন্যবাদ বলে অহনা তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে তার একটা হাত ধরে ভিতরে চলে গেল।
নিলীমা গাড়ি থেকে নামার আগেই হাবিবকে দেখেছে। গতরাতে মাতাল অবস্থায় যা দেখেছিল, তার সঙ্গে এখনকার হাবিবের কোনো তুলনাই হয় না। এখন তাকে খুব সুন্দর একজন সুপুরুষ মনে হয়েছে।
নিলীমা যে এতক্ষণ নিচের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল, তা হাবিব লক্ষ্য করেছে। শেষে তাকে উদ্দেশ্য করে যখন কথা বলল তখন ভেবেছিল সে নিশ্চয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুনবে এবং যাওয়ার আগে কিছু বলবে। তাই সে রকম কিছু না করে চলে যেতে ভাবল, মেয়েটা খুব অহঙ্কারী। এখন আবার দাদিমার কথা মনে পড়ল, “অন্য কোনো মেয়ে হলে কি কেলেঙ্কারিই না করে বসতিস”। সঙ্গে সঙ্গে মুখতারের কথাও মনে পড়ল, “ম্যাডাম খুব ধার্মিক। প্রায় একমাস হল এসেছেন, আমরা তার মুখ দেখিনি। সব সময় একটা বড় ওড়না দিয়ে দুটো চোখ ছাড়া সারা শরীর ও মাথা মুখ ঢেকে রাখেন।”
দুপুরে খাবার টেবিলে হাবিবকে আসতে দেখে নিলীমা মাথার ওড়না সামনের দিকে টেনে চলে যাওয়ার জন্য মুখ নিচু করে উঠে দাঁড়াল।
চাঁদনী বেগম বললেন, কি হল, দাঁড়ালে কেন বস। তারপর হাবিবকে মেয়ের চেয়ারের পাশে বসতে দেখে বললেন, তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই।
হাবিব দাদিমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, অহনাকে নিয়ে উনি যখন স্কুল থেকে ফেরেন তখন পরিচয় হয়েছে।
নিলীমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চাঁদনী বেগম বললেন, এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছ যে?
ফারজানার কাছে নিলীমা জেনেছে, চাঁদনী বেগম ভীষণ রাগী। যে কোনো হুকুম একবার করেন। দ্বিতীয়বার করার আগে হয় তাকে শাস্তি পেতে হয়, নয়তো চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এখন তিনি দু’বার নিলীমাকে বসতে বলেছেন, তাই ফারজানার কথা মনে পড়তেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসল। তারপর ঘোমটা দেয়া অবস্থায় অহনার খাওয়ার তদারকি করল ও নিজে খেল। খাওয়া শেষ হতে অহনাকে নিয়ে চলে গেল।
নিলীমা যখন গাড়ি থেকে নেমে অহনাকে নামাবার জন্য আসছিল তখন চার পাঁচ সেকেন্ডের জন্য তার চোখের সঙ্গে হাবিবের চোখাচোখি হয়েছিল। সে সময় তার নীল চোখ দেখে হাবিব মুগ্ধ হয়েছিল। খেতে বসে নেকাব থাকায় মুখ দেখতে না পেলেও আড়চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়েছে; কিন্তু ঘোমটা থাকায় তার চোখ দেখতে পাইনি। এখন তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
চাঁদনী বেগম নাতির দৃষ্টি অনুস্বরণ করে বললেন, অহনাকে মেয়েটা কন্ট্রোল করতে পেরেছে। ভাবছি, ওকে পারমানেন্ট রেখে দেব।
হাবিব বলল, ওনার বায়োডাটা পরীক্ষা করেছ?
না, তবে এতিমখানা, স্কুল ও কলেজের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দেখেই ওকে রেখেছি।
আজকাল টাকার বদলে ওসব পাওয়া যায়। যাচাই না করে কাউকে বাড়িতে রাখা ঠিক নয়। বলা যায় না, কোনো ডাকাত দলের সদস্যা কি না। ওনার সব কাগজপত্র আমাকে দিও, আমি লোক দিয়ে সত্য মিথ্যা যাচাই করে জানবার পর যা করার করো।
হাবিবকে দেখার পর থেকে নিলীমার কেবলই মনে হয়, তার মন যেন এ রকম একজন পুরুষের খোঁজ করছে। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর কথা চিন্তা করে তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল।
কিন্তু অনেক রাত পর্যন্ত তার স্মৃতি ঘুমাতে দিল না। তাহাজ্জুদের নামায পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
প্রতিদিনের মতো আজও ফজরের নামাযের পর অহনাকে নিয়ে মাঠে দৌড়াতে লাগল।
হাবিবও অনেক রাত পর্যন্ত নিলীমার কথা ভেবেছে। তার নীল চোখ তাকে ঘুমাতে দেয়নি। মখতারের কাছে তাদের দৌড়ানোর কথা শুনেছে। তাই তাদের দৌড়ানোর দৃশ্যও নিলীমার মুখ দেখবার জন্য রাতে মদ খেলেও নেশা হওয়ার মতো খায়নি এবং ভোরে ঘুম থেকে উঠে দোতলার বারান্দা থেকে তাঁদের দৌড়ান দেখতে লাগল। কিন্তু তার মনের আশা পূরণ হল না। কারণ তখনও নিলীমার চোখ দুটো ছাড়া মাথাসহ সারা মুখ ওড়না দিয়ে ঢাকা। তবে তার দেহসৌষ্ঠব তাকে খুব আকৃষ্ট করল।
বেলা ন’টার সময় হাবিব নাস্তা খেয়ে যখন ঢাকা চলে গেল তখনও নিলীমা অহনাকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরেনি।
৭
ঢাকায় আসার পরও নিলীমাকে হাবিব ভুলতে পারল না। দু’তিন দিন পর নিজে গাড়ি নিয়ে মাগুরার এতিমখানায় গেল।
দারোয়ানের মুখে গাজীপুর থেকে একজন লোক এসেছে শুনে জ্যোত্সা ম্যাডাম আতঙ্কিত হলেন। কিন্তু তা প্রকাশ না করে তাকে বললেন, ওনাকে আমার অফিস রুমে নিয়ে আসুন। তখন উনি নিজের রুমে ছিলেন।
দারোয়ানের সঙ্গে আসার সময় চারদিকে তাকিয়ে এখানকার পরিবেশ হাবিবের কাছে ভালই লাগল। পরদাফেলা একটা দরজার কাছে এসে দারোয়ান বলল, আপনি ভিতরে যান। কথা শেষ করে সে গেটে ফিরে গেল।
হাবিব অফিস রুমে ঢুকে নিলীমার মতো ওড়না পরা একজন ভদ্রমহিলাকে দেখে সালাম দিল।
জ্যোৎস্না ম্যাডাম সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বললেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কেন এসেছেন বলুন।
হাবিব বলল, আমি এখানকার তত্ত্বাবধায়ক ও স্কুলের হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
আপনার পরিচয় বলুন।
হাবিব পরিচয় দিয়ে বলল, এখানকার নিলীমা নামে একটি মেয়ে আমার মেয়ের গভর্নেসের কাজ করছে। ওনাকে আমার দাদিমা রেখেছেন আমাকে না জানিয়ে। তাই জানার পর ওনার বায়োডাটা সত্য কিনা জানার জন্য এসেছি।
জ্যোৎস্না ম্যাডাম বললেন, আপনার ভিজিটিং কার্ড আছে?
হাবিব পার্শ খুলে একটা কার্ড বের করে দিল।
কার্ডটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জ্যোৎস্না ম্যাডাম বললেন, আমি এখানকার তত্ত্বাবধায়ক ও স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। এখানে অনেক বছর কাজ করছি। নিলীমার মতো সব বিষয়ে এত ভালো মেয়ে আর দেখিনি। এতিমখানার ও স্কুলের ওর ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট আমিই দিয়েছি। তবে কলেজের সার্টিফিকেট ওখানকার প্রিন্সিপাল দিয়েছেন। তারপর আপ্যায়ন করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু জানতে চান?
ওনার মা-বাবার পরিচয় জানেন?
না। তবে যিনি ওকে মানুষ করেছেন, তার ঠিকানা জানি। তিনি অবশ্য মারা গেছেন। তবে তাঁর স্ত্রী বেঁচে আছেন।
ঠিক আছে, তাই ওনার ঠিকানা দিন।
ঠিকানা লিখে দিয়ে জ্যোৎস্না ম্যাডাম বললেন, নিলীমা যে আপনাদের বাড়িতে আছে, এ কথা কারও কাছে প্রকাশ করবেন না।
কেন বলুন তো?
এখানকার একজন গণ্যমান্য লোক নিলীমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, লোকটার স্বভাব চরিত্র ভালো না। তাই ওর ভালোর জন্য গোপনে আপনার মেয়ের গভর্নের্স হয়ে থাকার ব্যাপারে আমিই ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
হাবিবের মনে হল, জ্যোৎস্না ম্যাডাম সব সত্য বলছেন। খুশি হয়ে বলল, সবকিছু জানানোর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তারপর ঠিকানার উপর চোখ বুলিয়ে বিদায় নিয়ে ঢাকা ফিরে এল।
কয়েকদিন পর সময়মতো একদিন সেকেন্দারের বাড়ি নরসিংদীতে গিয়ে ওনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিলীমার মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করল।
সেকেন্দারের স্ত্রী সামিনা বেগম যতটুকু স্বামীর কাছে শুনেছিলেন, সেসব জানিয়ে বললেন, পাঁচ বছর বয়স থেকে দশ এগার বছর বয়স পর্যন্ত পেটের মেয়ের মতো মানুষ করেছি। আর সে কিনা আজ এক যুগের বেশি হয়ে গেল আমাদের একটু খোঁজও নিল না। এমন নিমকহারাম মেয়ে জীবনে দেখিনি। তা আপনি ঐ রকম একটা মেয়ের মা বাবার পরিচয় জানতে এসেছেন কেন? সে কি তেমন কোনো অঘটন ঘটিয়েছে?
হাবিব বলল, না-না, ওসব কিছু নয়। তারপর বিদায় নিয়ে ফিরে আসার সময় চিন্তা করল, নিলীমার মা বাবার পরিচয় পাওয়া না গেলেও সামিনা বেগমের কথায় বোঝা গেল উচ্চ বংশের মেয়ে।
এক মাস অন্তর হাবিব গভীর রাতে মাতাল অবস্থায় বাড়ি আসত। কিন্তু এবারে পনের দিন পর মাতাল না হয়ে সুস্থ অবস্থায় সন্ধ্যের এক ঘন্টা আগেই। এল।
অনেক দিন পর সন্ধ্যের আগে ছোট সাহেবকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি আসতে দেখে দারোয়ান থেকে অন্যান্য কাজের লোকজন ও বুয়ারা যেমন অবাক হল, তেমনি খুশিও হল।
গাড়ি থেকে নেমে হাবিব দেখল, নিলীমা সেই একই পোশাকে ট্রাকসুট পরা অহনাকে ড্রিল করাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে পা-পা করে এগিয়ে অল্প দূর থেকে দেখতে লাগল।
হঠাৎ নিলীমা তাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে অহনাকে বলল, ঐ দেখ, তোমার বাবা এসেছেন। যাও, বাবাকে প্রথমে সালাম দিবে, তারপর যেভাবে কদমবুসি করতে শিখিয়েছি, সেইভাবে পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করে বলবে, বাবা, কেমন আছ?
অহনা বাবাকে দেখে প্রথমে ভয় পেয়েছিল। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, আগের মতো মুখে রাগের চিহ্ন নেই। পা পা করে এগিয়ে এসে ম্যাডামের কথামতো প্রথমে সালাম দিল, তারপর কদমবুসি করে বলল, বাবা, কেমন আছ?
হাবিব মেয়েকে আদর করে বলল, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
আমি খুব ভালো আছি বাবা, দেখলে না ম্যাডাম আমাকে ড্রিল করাচ্ছিলেন?
ঠিক আছে, তুমি গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াও, আমরা আসছি। অহনা চলে যাওয়ার পর হাবিব নিলীমার দিকে তাকাতে নিলীমা সালাম দিয়ে দৃষ্টি নিচু করে দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে হাবিব জিজ্ঞেস করল, অহনা কেমন পড়াশোনা করছে?
নিলীমা বলল, ভালো, তবে আপনি যদি আরও স্নেহ সালমা দিয়ে কাছে টেনে নেন, তা হলে ভবিষ্যতে আরও ভালো ছাত্রী হতে পারবে। একটা অনুরোধ করব রাখবেন?
বলুন।
অহনা যেন আর কোনোদিন আপনাকে মাতাল অবস্থায় না দেখে। আজ আপনাকে যেমন দেখেছে, সব সময় যেন সে রকম দেখে।
জানি না আপনার অনুরোধ রাখতে পারব কিনা, তবে রাখার চেষ্টা করব।
ধন্যবাদ বলে নিলীমা বলল, আজ আর ড্রিল করাব না। আপনি ওকে নিয়ে ভিতরে যান।
হাবিব বলল, আর আপনি?
আমি এখন ফুলবাগানে একটু হাঁটব। তারপর মাগরিবের নামাযের সময় হলে ভিতরে যাব।
আজ আর হাঁটার দরকার নেই। অহনার জন্য অনেক খেলনা এনেছি সেগুলো দেখবেন চলুন। তারপর বারান্দায় এসে ফারজানাকে ডেকে গাড়িতে যা কিছু আছে সব নিয়ে আসার কথা বলে অহনার একটা হাত ধরে উপরে এল।
চাঁদনী বেগম দোতলার বারান্দা থেকে নাতিকে আসতে দেখেছেন এবং এতক্ষণ নিলীমা ও অহনার সঙ্গে কথা বলছিল তাও দেখেছেন। তাদেরকে একসঙ্গে আসতে দেখে বারান্দায় এসে একটা চেয়ারে বসলেন। বারান্দাতে একটা টেবিল ও চার-পাঁচটা চেয়ার সব সময় থাকে।
ফারজানা অনেক ধরনের খেলনা এনে টেবিলের উপর রাখল। হাবিব একটা চেয়ারে বসে নিলীমাকে বলল, খেলনাগুলো বাক্স থেকে বের করুন। তারপর অহনাকে বলল, তোমার পছন্দ হয় কিনা বলবে।
খেলনা দেখে অহনা খুশিতে টগবগিয়ে উঠে বলল, এত খেলনা তুমি আমার জন্য এনেছ বাবা?
সবকিছু দেখে চাঁদনী বেগমও খুব খুশি হয়েছেন। অহনার কথা শুনে নাতির আগে বলে উঠলেন, এ বাড়িতে আর কোনো ছেলে মেয়ে আছে না কি যে, তার জন্যও আনবে? সব তোর জন্যই এনেছে।
অহনা বাবার একটা হাত ধরে বলল, এবারে আমার জন্য একটা সাইকেল নিয়ে আসবে, আমি চালাব।
হাবিব হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে আনব।
এবারেও হাবিব দু’দিন থেকে ঢাকা ফিরে গেল। এই দুদিন রাতে মদ খেলেও মাতাল হওয়ার মতো খায়নি এবং দু’দিনই ভোরে উঠে অহনাকে নিয়ে নিলীমার প্রাত:ভ্রমণ দেখেছে দো’তলার বারান্দা থেকে চোখে বাইনোকুলার দিয়ে।
এরপর থেকে হাবিব প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে আসতে লাগল। এভাবে ছ’মাস কেটে যাওয়ার পর চাঁদনী বেগম নাতির পরিবর্তন দেখে খুশি হলেন। সেই সঙ্গে নিলীমার কারণে যে নাতির পরিবর্তন এসেছে, তা বুঝতে পেরে তার উপরও খুশি হয়েছেন। কিন্তু বাড়িতে এসে হাবিব নিলীমার সঙ্গে কিছু সময় কাটায় এটা বরদাস্ত করতে পারছেন না। কারণ মেয়েটা যতই ভালো হোক এতিম, মা বাবার কোনো ঠিকানা নেই।
নাতির বিয়ে দেয়ার চিন্তা করে একদিন তাকে বললেন, আমি তোর বিয়ে দেয়ার জন্য মেয়ের খোঁজ করছি।
এই ছ’মাস হাবিব চেষ্টা করেও নিলীমার নাগাল পাচ্ছে না। সে যত নিলীমার কাছে পৌঁছাতে চায়, নিলীমা তত এড়িয়ে যায়। তাকে প্রথম দেখার পর থেকে পছন্দ হয়েছে। তাই তার সম্পর্কে যা জানার জেনেছে এবং তারপর থেকে তাকে পাওয়ার জন্য দিন দিন ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। এখন দাদিমার কথা শুনে বলল, এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? এ ব্যাপারে আরও পরে আমার মতামত জানাব।
আজ দু’বছরের বেশি হয়ে গেল, আর কত সময় চাস? আমি তোর কোনো কথা শুনব না। সামনের বিশ তারিখে অহনার জন্মদিন। ঐ দিন সমস্ত আত্মীয়স্বজন ও তোর বাবার বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছি। তাদের অনেকের বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে আছে। মেয়েদেরকেও সঙ্গে আনার জন্য ফোনে তাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। ঐ সব মেয়েদের মধ্য থেকে যাকে তোর পছন্দ হবে তাকেই নাতবৌ করব।
হাবিব হেসে উঠে বলল, দাদিমা, আপনি পাগলের মতো কথা বলছেন? যাকে পছন্দ করব, সে যদি আমাকে পছন্দ না করে অথবা সেই মেয়ের যদি পছন্দ করা কোনো ছেলে থাকে, তা হলে?
আমি পাগলের মতো কথা বলছি না। তারপর একটা ফটো তার হাতে দিয়ে বললেন, এই মেয়েটাকে চিনতে পারছিস?
হাবিব কিছুক্ষণ ফটোটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল; বাহ! মেয়েটা তো দারুন। এত সুন্দর মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না।
চাঁদনী বেগম মৃদু হেসে বললেন, আমি ওকে নাতবৌ করতে চাই। চিনতে পারিস নি তা হলে?
ঠিক চিনতে না পারলেও চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে অনেক আগে দেখেছি।
হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। তোর বাবার বন্ধু আলাউদ্দিনের কথা তোর মনে আছে?
কেন থাকবে না। উনি তো প্রায় বিশ বছর আগে স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে কানাডা চলে গেছেন। সেখানেই সেটেল্ড।
এ হল রাইসা, তোর আলাউদ্দিন চাচার মেয়ে। যখন মা বাবার সঙ্গে কানাডা যায় তখন ওর বয়স পাঁচ বছর। গতকাল আলাউদ্দিন ফোন করেছিল। বলল, কয়েকদিনের মধ্যে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে আসছে। এখানে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আবার চলে যাবে। তোর বিপর্যয়ের কথা ওকে বলেছি। শুনে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, কি আর করবেন খালাআম্মা, সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছা। সবাইকে নিয়ে আমাদের এখানে কয়েকদিন বেড়িয়ে যেতে বলেছি। সে সময় রাইসার সঙ্গে আলাপ করে পছন্দ হলে জানাবি। আমি ওর মা বাবার কাছে প্রস্তাব দেব। আশা করি, লুফে নেবে। একটা কথা তোকে বলব বলব করেও বলা হয়নি, নিলীমাকে এতটুকু প্রশ্রয় দিবি না। এতিমখানার মেয়ে, মা-বাবার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তবে মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালো, ভদ্র সমাজে মেলামেশা করার মতো শিক্ষাও আছে। তুই যে ওর খোঁজ-খবর নিবি বলেছিলি নিয়েছিস?
রাইসাকে দাদিমা নাতবৌ করতে চান শুনে হাবিব বিপদের গন্ধ পেল। তখন নিলীমার কথা মনে পড়তে চুপ করে তার কথা চিন্তা করতে লাগল।
চাঁদনী বেগম বললেন, কিরে, কি ভাবছিস? আমার কথার উত্তর দিলি না যে?
হাবিব বলল, হ্যাঁ, খোঁজ নিয়েছি, খারাপ কিছু পাইনি।
তবু প্রশ্রয় দিবি না। ভাবছি তোর বিয়ের পর ওকে ছাড়িয়ে দেব।
কিন্তু আপনার নাতবৌ যদি অহনাকে মেনে নিতে না পারে? অথবা ঠিকমতো দেখাশোনা না করে? তখন কি হবে?
তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।
হাবিব নিলীমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এতিমখানার মেয়ে বলে দাদিমা তাকে ছোট নজরে দেখেন বুঝতে পেরে চিন্তা করল, এখন যদি নিলীমার হয়ে কিছু বলে, তা হলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। তাই মনের ভাব গোপন করে বলল, নাতবৌ হওয়ার পর আগে দেখবেন নাতবৌ কতটা অহনাকে আপন করে নেয়। তারপর চিন্তা করবেন নিলীমাকে ছাড়িয়ে দেবেন কিনা। আমার মনে হয়, রাইসা কেন কোনো মেয়েই অহনাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করবে না।
চাঁদনী বেগম বললেন, বললাম তো, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। রাইসা ছাড়া আরও অনেক মেয়ে আছে। তারা সবাই কি অহনাকে মেনে নিতে পারবে না? একটা কথা ভুলে যাচ্ছিস কেন, হাতের পাঁচটা আঙ্গুল সমান হয় না। আগে রাইসাকে দেখ, তার সঙ্গে মেলামেশা কর, তারপর পছন্দ-অপছন্দের কথা।
হাবিব দাদিমাকে খুশি করার জন্য বলল, বেশ, তাই হবে। এমন সময় অহনা এসে বাবাকে বলল, তুমি এখানে, আর আমি তোমাকে কত খুঁজছি। তুমি আজ আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে বলেছিলে না?
হ্যাঁ, চল বলে হাবিব মাকে বলল, অনেক দিন ওকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাইনি, আজ ন্যাশনাল পার্ক দেখিয়ে আনি। তারপর তাকে নিয়ে নিচে নেমে এল।
হাবিবের খুব ইচ্ছা নিলীমাকেও সঙ্গে নেবে; তাই দাদিমা অসন্তুষ্ট হবেন। জেনেও অহনাকে বলল, তোমার ম্যাডামকে গিয়ে বল, বাবার সঙ্গে ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে যাচ্ছ, আপনাকেও বাবা যেতে বলেছেন।”
সময় পেলেই নিলীমা ফুলবাগানে ঘুরে-বেড়াই, কখন মালিদের সঙ্গে আবার কখনও মুখতারের সঙ্গে ফুল ও ফুলগাছের সম্পর্কে আলাপ করে। আজ বিকেলে অহনা তার বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাবে সে কথা জানে। তাই ফুল বাগানে হাঁটতে হাঁটতে মুখতারের সঙ্গে কথা বলছিল।
অহনা তাদের কাছে গিয়ে নিলীমাকে বাবার কথা জানাল।
শুনে নিলীমা খুশি হয়ে যেতে মন চাইলেও যাওয়াটা উচিত হবে কিনা কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, তোমার বাবাকে গিয়ে বল “ম্যাডাম ধন্যবাদ দিয়ে জানিয়েছেন, উনি যাবেন না।”
অহনা ফিরে এসে বাবাকে ম্যাডামের কথা জানাল।
পার্কে বেড়াবার সময় বাবাকে চুপচাপ দেখে অহনা বলল, তুমি কিছু বলছ কেন?
হাবিব বলল, ম্যাডাম তোকে ভালবাসে?
ও ওনার কথা ভেবে বুঝি তোমার মন খারাপ?
আমার মন খারাপ তুই বুঝলি কি করে?
তোমার মুখ দেখে আমি বুঝতে পেরেছি।
তা হলে যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দে।
ম্যাডাম আমাকে ভীষণ ভালবাসেন।
তোর মায়ের চেয়ে বেশি ভালবাসে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও হাবিব সামলে নিল। বলল, তোকে দেখাশোনা করার জন্য আমরা ওনাকে অনেক টাকা বেতন দিই। তাই ভালবাসেন। আচ্ছা ধর, কোনো কারণে তোর বড় মা ম্যাডামকে বিদায় করে দিল, তখন তুই কি কষ্ট পাবি?
হ্যাঁ পাব। তারপর মুখভার করে বলল, বড় মা ম্যাডামকে বিদায় করে দেয়ার কথা তোমাকে বলেছেন?
মেয়ের মন খারাপ করতে দেখে হাবিব বলল, এখন বিদায় করে দেয়ার কথা বলেন নি, তুই যখন বড় হবি তখন। তা ছাড়া ম্যাডাম তো চিরকাল আমাদের কাছে থাকবেন না।
অহনা এই কথার উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইল।
.
কিছুদিন থেকে হাবিব মেয়েকে নিয়ে ঘুমায়। তাই হাবিব বাড়িতে এলে নিলীমা নিচতলায় নিজের রুমে ঘুমায়।
নিলীমা ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে না যাওয়ায় হাবিবের মন খারাপ। তার ইচ্ছা ছিল, পার্কে বেড়াবার সময় এক ফাঁকে নিলীমাকে মনের কথা জানাবে। সেই ইচ্ছাটা রাতে চেপে রাখতে পারল না। রাত বারটার সময় যখন অহনা ঘুমে অচেতন তখন সে মদ খায়। আজ মদ না খেয়ে নিচ তলায় এসে নিলীমার রুমের দরজায় নক করল।
পার্কে বেড়াতে যাওয়ার অফার ফিরিয়ে দিয়ে নিলীমাও তখন থেকে অশান্তি ভোগ করছে। তাই রাত বারটা বেজে গেলেও ঘুমাতে পারেনি। দরজায় নক হতেই বুকটা ধক করে উঠল। ভাবল, হাবিব সাহেব নয়তো? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, কে?
আমি হাবিব, দরজা খুলুন।
এত রাতে কেন এসেছেন? কিছু বলার থাকলে কাল দিনের বেলা বলবেন।
না, এখনই বলতে চাই। আপনি দরজা খুলুন।
কিন্তু দরজা খোলা কি উচিত হবে? কেউ দেখে ফেললে কি হবে ভেবেছেন?
এ কথা ভেবেই দরজা খুলতে বলেছি। প্লীজ, খুলুন। কথা দিচ্ছি কোনো অশোভন আচরণ করব না। বিশেষ কিছু কথা বলতে চাই।
নিলীমা চিন্তা করল, দরজা খুলতে যত দেরি করবে তত হাবিব সাহেব জোরে জোরে কথা বললেন। তাতে বরং বাড়ির চাকর-চাকরানীরা জেগে যাবে। আরও চিন্তা করল, সেদিনের মতো যদি মদ খেয়ে এসে থাকেন, তা হলে তো দরজায় লাথি মারতে মারতে চেঁচামেচি করবেন। তাই নিজেকে তৈরি রেখে দরজা খুলে দরজার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, বলুন, কি বলতে এসেছেন।
হাবিব তার একটা হাত ধরে বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে বলল, এখানে নয়, ফুলবাগানের বেঞ্চে বসে বলব।
প্রথমে নিলীমা মনে করেছিল, হাবিব সাহেব মদ খেয়েছেন। তারপর যখন বুঝতে পারল, মদ খাননি তখন বলল, প্লীজ হাতটা ছাড়ন।
হাবিব চুপচাপ ফুলবাগানে এসে হাত ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে বলে নিজেও বসল। তারপর জিজ্ঞেস করল, পার্কে বেড়াতে গেলেন না কেন?
আজ পূর্ণিমা। তাই জ্যোৎস্নায় সারা বাগান দিন হয়ে আছে। সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে নিলীমা বলল, যাওয়া উচিত হবে না ভেবে যাইনি।
আর এখন এই গভীর রাতে যে আমার সঙ্গে এলেন, এটা উচিত হয়েছে?
না উচিত হয়নি।
তবু এলেন কেন?
বারে, আপনি তো জোর করে নিয়ে এলেন।
তেমন জোর তো খাটাইনি? তা ছাড়া নিজেকে রক্ষা করার অনেক কলাকৌশল জানেন, সে সব প্রয়োগ করে বাধাও দেননি।
বাড়ির সবাই জেনে যাবে বলে বাধা দিই নি।
এখন যদি আপনার উপর হামলা করি, তা হলে নিশ্চয় বাধা দেবেন?
তা তো দেবই।
তখন তো সবাই জেনে যাবে?
মদ খেয়ে যে মাতলামি করা যায়, মদ না খেয়ে তা করা যায় না। তাই বাধা না দিয়ে এসেছি। এবার কি বলার জন্য এত রাতে এখানে নিয়ে এলেন বলুন।
আপনি বুঝতে পারেননি?
মানুষের মনের কথা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানতে পারে না।
তা আমিও জানি।
তা হলে বুঝতে পারার কথা বললেন কেন?
প্রেমিক প্রেমিকারা একে অন্যের মনের কথা বুঝতে পারে।
তা হয়তো পারে, কিন্তু আমাদের মধ্যে সে কথা কি প্রযোজ্য?
যদি বলি আমরা একে অপরের প্রেমে পড়েছি?
কথাটা শুনে নিলীমার বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল। তা সামলাবার জন্য কিছু না বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
হাবিব অধৈর্য গলায় বলল, কি হল, কিছু বলছেন না কেন?
যা অবাস্তব তা নিয়ে আলাপ না করাই উচিত।
অবাস্তব বলছেন কেন? সত্যি করে বলুন তো আপনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন কিনা?
অনেক সময় সত্য প্রকাশ করা যায় না। যেমন আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়, এটা চিরন্তন সত্য। তাই বলে কেউ ইচ্ছা করে কি আগুনে হাত দেয়?
কিন্তু এখানে সে কথা আসছে কেন?
ছেলেরা সাধারণত রূপের কাঙ্গাল। তাই তারা রূপসী মেয়ে দেখলে ভালোমন্দ বিচার না করে রূপের আগুনে ঝাঁপ দেয়।
আর মেয়েরা?
মেয়েরা অর্থ ও রূপ দুটোই চাই। যারা ঐ দুটো দেখে ভালোমন্দ বিচার না করে ঝাঁপ দেয়, তাদের দলে আমি নই।
আপনি কোন দলে?
কোনো দলেরই নই। আমি যে কোনো কাজ করি তা ইসলামের কষ্টিপাথরে যাচাই করে করি।
ইসলামে কি ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা নিষেধ?
বিয়ের আগে নিষেধ। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যত বেশি প্রেম ভালোবাসা হবে, তত সংসার সুখের ও শান্তির হবে।
কি গ্রামে কি শহরে শিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমান ঘরের ছেলেমেয়েরা প্রেম ভালোবাসা করে বিয়ে করছে, সেগুলোকে তা হলে কি বলবেন?
সমাজের দিকে লক্ষ্য করলেই তাদের পরিণতি জানতে পারবেন। আপনি নিজেও তো একবার এই পথে পা বাড়িয়েছিলেন, তার পরিণতির কথা চিন্তা করলেই আমার কথা উপলব্ধি করতে পরবেন। কথাটা বলে হয়তো আপনাকে দুঃখ দিয়ে ফেললাম, সে জন্য ক্ষমা চাইছি।
ক্ষমা পেতে হলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
নিলীমা বুঝতে পেরেও বলল, বলুন কি জানতে চান।
আমাদের প্রেমকে আপনি অবাস্তব বললেন কেন?
কারণ যা কখনও বাস্তবে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়, তাকে অবাস্তব ছাড়া আর কি বলব?
আর আমি যদি বলি, অবাস্তবকে বাস্তব করতে চাই?
আপনি চাইলেও আপনার দাদিমা রাজি হবেন না। কারণ একবার আপনি তার অমতে যে কাজ করেছেন, সেই কাজ দ্বিতীয়বার আর করতে দেবেন না। তা ছাড়া আমার কোনো পরিচয় নেই। এতিমখানায় মানুষ হয়েছি। মা-বাবার পরিচয় জানি না। এমন মেয়েকে শুধু উনি কেন, কোনো গার্জেনই মেনে নিতে পারেন না।
দাদিমার কথা বাদ দিন। আমি কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি। দাদিমার কাছে আপনার বায়োডাটা শুনেও সেই ভালোবাসায় চিড় ধরেনি। তাই আপনার আসল পরিচয় জানার চেষ্টা করি। আপনার মা বাবার পরিচয় না পেলেও আপনার পরিচয় যতটুকু পেয়েছি তাতেই আপনাকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছি। রেহানার কারণে নারী জাতির উপর আমার মনে যে আক্রোশের আগুন জ্বলেছিল, আপনাকে ভালোবেসে সেই আগুন নিভতে শুরু করেছে। আপনি কি অবশিষ্ট আগুন একেবারে নিভিয়ে দিতে পারেন না? তারপর তার দুটো হাত ধরে বলল, প্লীজ, চুপ করে থাকবেন না, আমার কথার উত্তর দিন।
হাবিবের কথা শুনে নিলীমার হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে থাকলেও চিন্তা করল, চাঁদনী বেগম তাকে কিছুতেই নাতবৌ করবেন না। তাই অন্য প্রসঙ্গ তুলল। বলল, দেখুন, ধর্ম সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন জানি না। আর ধর্মের কিছু বিধি-নিষেধ মেনে চলতেও আপনাকে দেখিনি। যেমন প্রত্যেক মুসলমান নরনারীর দৈনিক পাঁচওয়াক্ত নামায অবশ্যই পড়তে হবে, রমযান মাসে রোযা রাখতেই হবে। বেশি ধনদৌলতের মালিক হলে যাকাত দিতেই হবে, হজ্বও করতেই হবে। আর আল্লাহ ও তাঁর রসূল (দঃ) যে সমস্ত কাজ করতে ও যে সব জিনিস খেতে নিষেধ করেছেন, সেসব কাজ করা ও সেসব জিনিস খাওয়া চলবে না। মোট কথা ইসলামের বিধি-নিষেধ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে। আমি সে সব যথাসাধ্য মেনে চলি; কিন্তু আপনি বলে থেমে গেল। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, নর-নারী বিয়ে করে সুখ শান্তির জন্য। আমার ও আপনার মধ্যে যে পার্থক্য, বিয়ে করলে সুখ শান্তি তো কেউ পাব না বরং অশান্তিতে আমাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠবে।
হাবিব কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনাকে পাওয়ার জন্য আমি ইসলামের বিধি-নিষেধ জানার ও মানার চেষ্টা করব। তা হলে তো আমাকে ফেরাবেন না?
শুধু মুখে বললে তো হবে না, কাজ করে দেখাতে হবে।
নিশ্চয় কাজ করেই দেখাব।
মুসলমান হিসাবে কথাটা এভাবে বলুন, “ইনশাআল্লাহ কাজ করেই দেখাব।”
নিলীমার কথাটা রিপীট করে হাবিব জিজ্ঞেস করল, ইনশাআল্লাহ শব্দের অর্থ কি?
ইনশাআল্লাহ শব্দের অর্থ হল “আল্লাহ রাজি থাকলে। কারণ আল্লাহ রাজি না থাকলে মানুষ কোনো কাজই করতে পারে না।
চাঁদ পশ্চিম আকাশে অনেকটা হেলে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে নিলীমা আবার বলল, রাত প্রায় তিনটে বাজে, চলুন এবার ওঠা যাক।
হাবিব কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমার কি মনে হচ্ছে জানেন? চাঁদের চেয়ে আপনি বেশি সুন্দরী।
নিলীমা লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আরও দেরি করা উচিত হবে না।
হাবিব একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, জানি না কবে আপনাকে একান্ত করে পাব। তারপর হাঁটতে শুরু করে বলল, আপনার হৃদয়ে কি প্রেম ভালোবাসা, দয়া-মায়া বলে কিছু নেই?
আল্লাহ হৃদয় যখন দিয়েছেন তখন নিশ্চয় ওগুলোও দিয়েছেন।
কিন্তু প্রমাণ তো পেলাম না।
আল্লাহ রাজি থাকলে সময়মতো প্রমাণ পাবেন।
ততক্ষণে তারা বারান্দায় চলে এসেছে। হাবিব দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, আবার এরকম সাক্ষাৎ হতে পারে না?
না, কারণ বিয়ের আগে এরকম সাক্ষাৎ ইসলামে নিষেধ।
আমি তো আপনাকে বিয়ে করতেই চাই; কিন্তু আপনিই তো বলে হাবিব থেমে গেল।
নিলীমা বলল, একটু আগে বিয়ের সুবিধে অসুবিধের কথা আপনাকে বলেছি। তা ছাড়া আল্লাহর ইশারা ছাড়া যখন দুনিয়াতে কোনো কিছুই হয় না তখন ওনার ইশারার জন্য আমাদের অপেক্ষা করাই তো উচিত। তারপর আল্লাহ হাফেজ বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেল।
নিলীমা রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়া পর্যন্ত হাবিব তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দোতলায় উঠতে লাগল।
ন্যাশনাল পার্কে মেয়েকে নিয়ে হাবিব বেড়াতে যাওয়ার সময় চাঁদনী বেগম বারান্দা থেকে সবকিছু দেখে বুঝতে পেরেছিলেন, হাবিব নিলীমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অহনাকে ডাকতে পাঠিয়েছিল। নিলীমা গেল না দেখে খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু বাড়িতে ফেরার পর থেকে নাতির মন খারাপ দেখে অনুমান করেছিলেন, নিশ্চয় রাতে নিলীমার সঙ্গে দেখা করবে। তাই তিনিও জেগেছিলেন। হাবিবকে রাত বারটার পর বোরোতে দেখে তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের অভিসার দেখেন। তারা ফিরে আসার পর তিনিও নিজের রুমে এসে চিন্তা করলেন, বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিলীমাকে বিদায় করতে হবে। নচেৎ ঐ ছোট জাতের মেয়েটা রূপ যৌবন দেখিয়ে হাবিবকে বিয়ে করে ফেলবে। তবে কাজটা এমনভাবে করতে হবে, হাবিব যেন বুঝতে না পারে তার কারণেই নিলীমাকে বিদায় করা হয়েছে। তারপর কিভাবে কি করবেন ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
৮
প্রথম ছয় বছর অহনার বার্থডে খুব ধূমধামের সঙ্গে পালন করলেও তার মা রেহেনা চলে যাওয়ার পর গত দু’বছর পালন করা হয়নি। এ বছর আগের মতো খুব ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হচ্ছে। সকাল থেকে সারাবাড়ি উৎসব মুখর। গেট থেকে বারান্দা পর্যন্ত রংবেরঙের রঙিন কাগজ ও কাগজের ফুল দিয়ে সাজান হয়েছে। আর বারান্দা ও রুমগুলো বাগানের ফুল দিয়ে সাজান হয়েছে। আত্মীয় ও অনাত্মীয় নিমন্ত্রিতরা, বন্ধু-বান্ধব ও তাদের স্ত্রী ছেলেমেয়েরা আসায় যেন বিয়ে বাড়ির উৎসব বলে মনে হচ্ছে।
নিলীমা চাঁদনী বেগমের পাশে পাশে রয়েছে। তিনি সবার কাছে নিলীমাকে অহনার গভর্নের্স বলে পরিচয় দিচ্ছেন।
হাবিব নানান ছুতোয় দাদিমার কাছে বারবার আসছে নিলীমাকে দেখার জন্য।
নিলীমা তা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে মুখে নেকাব দিয়ে রেখেছে। তবে মাঝে মাঝে চোখের ইশারায় তাকে সান্তনা দিচ্ছে।
চাঁদনী বেগম এসব খেয়াল করছেন না। তিনি মেহমানদের অভ্যর্থনা নিয়ে ব্যস্ত।
সন্ধ্যের কিছুক্ষণ আগে হাবিবের বাবার বন্ধু আলাউদ্দিন সাহেব স্ত্রী হেলেনা বেগম ও মেয়ে রাইসাকে নিয়ে এলেন।
চাঁদনী বেগম ওনাদের জন্য এতক্ষণ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সালাম ও কুশল বিনিময় করে হাবিবকে ডেকে বললেন, দেখতো চিনতে পারিস কিনা।
হাবিব সেদিন রাইসার ফটো দেখে চিনতে না পারলেও আজ তার মা বাবাকে চিনতে পারল। হাসিমুখে বলল, বাবার বন্ধু ও বন্ধুপত্নীকে চিনতে পারব না কেন? তারপর সালাম দিয়ে বলল, আপনারা কেমন আছেন?
আলাউদ্দিন সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ভালো আছি বাবা। তা তোমার ব্যবসাপত্রের খবর কি?
হাবিব বলল, জি ভালো।
চাঁদনী বেগম রাইসার একটা হাত ধরে নাতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সেদিন ফটো দেখে চিনতে পারিসনি, আজ নিশ্চয় পারছিস?
হাবিব কিছু বলার আগে রাইসা বলল, আমি কিন্তু হাবিব ভাইকে দেখেই চিনতে পেরেছি।
হাবিব লজ্জা পেয়ে বলল, সেদিন তোমার ফটো দেখে চিনতে না পারলেও চেনাচেনা লেগেছিল। আজ বাস্তবে দেখেই কিন্তু চিনতে পেরেছি।
এই কথায় সবাই হেসে উঠল। নিলীমা পর্দা করে মেহমানদের আদর আপ্যায়ন করছিল তাকে দেখিয়ে হেলেনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, পর্দানশীন মেয়েটা কে খালাআম্মা?
চাঁদনী বেগম বললেন, অহনার গভর্নেস।
হেলেনা বেগম নাক সিটকে বললেন, এ রকম মোল্লা মার্কা মেয়েকে অহনার গভর্নের্স রাখা ঠিক হয়নি।
কথাটা শুনে হাবিব বিব্রত বোধ করে চুপি চুপি অন্য দিকে চলে গেল।
চাঁদনী বেগম কথাটা না শোনার ভান করে তাদেরকে বসিয়ে বললেন, এক্ষুনি আসছি তারপর নিলীমার কাছে গিয়ে অনুচ্চস্বরে তাকে বললেন, এখানে তোমার আর থাকার দরকার নেই। মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গেছে। যাও, নামায পড়ে রুমেই থাকবে। না ডাকা পর্যন্ত আসবে না।
হেলেনা বেগমের কথা নিলীমা শুনতে পেয়েছে। তাই চাঁদনী বেগমের কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে মনে ব্যথা পেয়ে কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেল।
কেক কাটার সময় নিলীমাকে দেখতে না পেয়ে অহনা বাবাকে বলল, ম্যাডাম কোথায়? ওনাকে ডাক।
দাদিমা যে নিলীমাকে এ সময় তার রুমে থাকতে বলেছেন, তা হাবিব জানে না। তাই মেয়ের কথা শুনে চারপাশে তাকিয়ে নিলীমাকে দেখতে না পেয়ে দাদিমাকে জিজ্ঞেস করল, অহনার গভর্নের্সকে দেখছি না কেন?
চাঁদনী বেগম বললেন, সে তার রুমে আছে। তুই অহনার হাত ধরে কেক কাট।
হাবিব ছুরিটা অহনার হাতে দিতে গেলে সে না ধরে বলল, ম্যাডাম না এলে আমি কেক কাটব না।
চাঁদনী বেগম বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, অহনা, কি হচ্ছে?
কিছুই হচ্ছে না বলে ছুটে নিলীমার ঘরে গিয়ে বলল, আপনি এখানে কেন? চলুন কেক কাটা হবে।
নিলীমা চাঁদনী বেগমের নিষেধের কথা না বলে তাকে আদর করে বলল, আমার এখনও অজিফা পড়া শেষ হয়নি। তুমি যাও, আমি অজিফা শেষ করে আসছি।
অহনা তার একটা হাত ধরে বলল, কেক কাটা হয়ে গেলে আপনি এসে অজিফা পড়বেন। আপনি না গেলে আমিও যাব না বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
নিলীমা কি করবে না করবে ভেবে না পেয়ে অনেক করে বুঝিয়ে পাঠাবার চেষ্টা করল; কিন্তু অহনাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারল না।
মেয়ের পিছু পিছু হাবিব এসে এতক্ষণ দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। এবার অহনার নাম ধরে ডেকে ভিতরে এসে নিলীমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনার মন এত শক্ত কেন? মেয়েটা কাঁদছে আর আপনি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন? চলুন, কেক কাটা হয়ে গেলে না হয় ফিরে এসে অজিফা পড়বেন।
নিলীমা তাড়াতাড়ি মাথার কাপড় সামনে টেনে দিল। তারপর তার কথা শুনে একরকম বাধ্য হয়ে অহনার চোখ মুখ মুছে দিয়ে বলল, এই দিনে কেউ কাঁদে না। চল বলে তার একটা হাত ধরে বেরিয়ে এল।
হাবিব তাদের পিছন পিছন এল।
কেক কাটার পর্ব শেষ হতে নিলীমা ফিরে যেতে উদ্যত হলে অহনা তার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখে বলল, একটা গজল গেয়ে তারপর যাবেন।
মেয়ের পাশে হাবিব ছিল। নিলীমাকে তার দিকে চাইতে দেখে চোখের ঈশারায় নিলীমাকে থাকতে বলল।
অগত্যা নিলীমা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল। এখানে আসার সময় মুখে নেকাব না থাকলেও ঘোমটা ছিল। তাই তার মুখ কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
প্রথমে কয়েকজন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে জন্মদিনের একটা গান গাইল।
হেলেনা বেগম মেয়ের গলার জন্য খুব গর্বিতা। তাই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গান শেষ হতে মেয়েকে বললেন, তুই একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শোনা।
রাইসাও নিজের গলার জন্য গর্বিতা। তাই বাধ্য সন্তানের মতো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইল।
রাইসার গলা সত্যিই খুব ভালো। তার গাওয়া রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে সবাই ভীষণ আনন্দিত হয়ে হাত তালি দিতে লাগল।
চাঁদনী বেগম রাইসার সঙ্গে অহনার প্রথমেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। রাইসা আন্টির গলা ভালো লাগলেও রবীন্দ্র সঙ্গীত অহনার কাছে ভালো লাগেনি। সবাইকে হাততালি বন্ধ করতে বলে বলল, এবার আমার ম্যাডাম একটা গজল গেয়ে শোনাবেন। কথা শেষ করে নিলীমার ধরা হাতটা উপরে তুলল।
নিলীমা সালোয়ার কামিজের উপর বড় চাদর জড়িয়ে নামায পড়ছিল। এখানে সেই পোশাকেই এসেছে। কেক কাটার পর অহনার কথা শুনে সেই থেকে নার্ভাস ফিল করে ঘামছিল। রাইসার গানের গলা তার কাছেও খুব ভালো লেগেছে। তাই অহনা আবার যখন তার গজল গাওয়ার ঘোষণা দিল তখন আরও নার্ভাস ফিল করে ভাবল, তার গলা শুনে সবাই না উপহাস করে। ভয়ে ভয়ে সবার দিকে একপলক তাকাবার সময় হাবিবের চোখে চোখ পড়তে বুঝতে পারল, চোখের ঈশারায় তাকে যেন সাহস দিচ্ছেন। তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, আমি কোনেদিন গলা সাধিনি, গলা সাধবার সুযোগও পাইনি, কোনো মাহফিলেও কিছু গাইনি। অহনার কথা রাখার জন্য গাইছি। জানি না আমার গজল আপনাদের কতটা আনন্দ দেবে। তারপর অনুচ্চস্বরে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম বলে গাইতে শুরু করল–
বক্ষে আমার কাবার ছবি–চক্ষে মুহাম্মদ রসূল (দঃ)
শীর পরি মোর খোদার আরশ–গাহি তারই গান পথ বেভুল।
লাইলির প্রেমে মজনু পাগল–আমি পাগল লা-ইলাহার,
প্রেমিক দরবেশ আমায় চিনে আরসিকে কয় বাতুল।
বক্ষে আমার কাবার ছবি– চক্ষে মুহাম্মদ রাসূল (দঃ)।
আমার মনের মসজিদে দেয়–আযান হাজার মুয়াজ্জিন,
প্রাণের লহমে কুরআন লেখা–রুহ পড়ে তা রাত্রি দিন।
খাতুনে জান্নাত মা আমার–হাসান হোসেন (রাঃ) চোখের জল,
ভয় করি না রোজ কিয়ামত–পুলসিরাতের কঠিন পুল।
বক্ষে আমার কাবার ছবি চক্ষে মুহাম্মদ রাসূল (দঃ)।
এখানে যারা এসেছেন তারা ইসলামকে যেমন জানেন না, তেমিন মেনেও চলেন না। তাই তারা ইসলামের বিধি-নিষেধকে এড়িয়ে চলেন। কোনো ইসলামিক সভা-সমিতিতেও যান না। গজলটা ইসলামিক হলেও নিলীমার মধুর কণ্ঠ সবাইকে এত মুগ্ধ করল যে, অনেকক্ষণ পিনপতন স্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল। তাদের কাছে মনে হল রাইসার গলার থেকে নিলীমার গলা আরও অনেক বেশি মধুর। প্রথমে অহনা হাত তালি দিয়ে উঠতেই সবাই মুহূর্মুহূ হাততালি দিতে লাগল।
অনেকে আরও একটা গজল গাওয়ার অনুরোধ জানাল।
নিলীমা অপারগতা জানিয়ে ও ক্ষমা চেয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
.
গজল গাওয়ার আগে নিলীমার মুখে নেকাব থাকায় কেউ তার মুখ দেখতে পাইনি। গজল গাওয়ার সময় নিলীমা মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়েছিল। তাই তার মুখের সৌন্দর্য দেখে সবাই খুব মুগ্ধ হয়েছে। সে চলে যাওয়ার পর সবার মুখে তার গলার ও রূপের আলোচনা হতে থাকল। সব থেকে বেশি মুগ্ধ হয়েছে। হাবিব। তার গলার স্বর তাকে মোহিত করে দিয়েছে। তাই সবকিছু ভুলে কংগ্রাচুলেশন জানাবার জন্য তার রুমের দিকে যেতে লাগল।
চাঁদনী বেগমও নিলীমার গজল শুনে মুগ্ধ হয়ে চিন্তা করছিলেন, মেয়েটা যদি এতিমখানার না হয়ে কোনো উচ্চ বংশের হত, তা হলে তাকেই নাতবৌ করতেন। পরক্ষণে রাইসার কথা মনে পড়তে এদিক ওদিক তাকিয়ে নাতিকে নিলীমার রুমের দিকে যেতে দেখে তার নাম ধরে ডাকলেন।
দাদিমার ডাক শুনে হাবিব ওনার কাছে এসে বলল, ডাকলেন কেন?
চাঁদনী বেগম বললেন, ওদিকে কোথায় যাচ্ছিলি? রাইসাকে নিয়ে নিরিবিলিতে আলাপ কর। আর শোন, ওকে একা রেখে কোথাও যাবি না।
দাদিমার কথা শুনে হাবিব অসন্তুষ্ট হলেও তা প্রকাশ না করে রাইসার দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে গেল।
তাকে যে বাবা মা কানাডা থেকে নিয়ে এসেছে বিয়ে দেয়ার জন্য তা রাইসা জানে। হেলেনা বেগম একদিন হাবিবের সব কিছু জানিয়ে মেয়েকে বলেছেন, হাবিবের সঙ্গে মেলামেশা করে তার মন জয় করবি। বাকিটা আমরা দেখব। আর হাবিবের একটা সাত আট বছরের মেয়ে থাকলেও তোর যাতে কোনো প্রবলেম না হয় সে ব্যবস্থা তোর বাবা করবে। শুধু একটা কথা মনে রাখবি, কানাডায় তোর বাবা ব্যবসায় ফেল করে বহু টাকা ঋণ করে ফেলেছে। হাবিবের দাদার শুধু যে দুতিনটে ব্যবসা আছে তাই নয়, বিভিন্ন ব্যাংকে কত টাকা যে রেখে গেছেন তার হিসাব হাবিব নিজেই জানে না। তা ছাড়া ঢাকায় কয়েকটা বাড়িও আছে। তুই, আমাদের একমাত্র সন্তান। আমরা তোর কাছে শুধু এটাই আশা করব, বিয়ের পর তুই শুধু তোর বাবার ঋণটা শোধ করে দিবি।
রাইসাও খুব উচ্চাভিলাসী। তাই হাবিবের স্ত্রী বিয়োগের কথা শুনে এবং তার একটা সাত আট বছরের মেয়ে আছে জেনেও ঐশ্বর্যের কথা জেনে খুব খুশি হল। বলল, তোমাদের একমাত্র সন্তান হিসাবে যতটুকু করার নিশ্চয় করব। আজ খুব খুশি মনে মা-বাবার সঙ্গে হাবিবদের বাসায় এসেছিল। কিন্তু নিলীমাকে দেখে ও তার গজল শুনে খুশিটা একটু কমে গেল।
রাইসা এমনই খুব সুন্দরী। তার উপর উগ্র ও অত্যাধুনিক পোশাক পরায় আজ আরও বেশি সুন্দরী দেখাচ্ছে। সব বয়সের মেয়ে পুরুষের দৃষ্টি তার দিকে এবং সবাই তার রুপের প্রশংসা করছিল। রাইসা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেকে খুব গর্বিত মনে করছিল। শেষে যখন নিলীমা মুখের নেকাব সরিয়ে গজল গাইল তখন থেকে সবাইকে নিলীমার রূপ ও তার গলা নিয়ে প্রশংসা করতে শুনে ও হাবিবকে তার পিছন পিছন যেতে দেখে ঈর্ষায় জ্বলছিল আর ভাবছিল, এই মেয়েকে যত শীঘ্র সম্ভব এখান থেকে তাড়াতে হবে।
চাঁদনী বেগমের কথা রাইসা শুনতে পাইনি। তাই হাবিব যেতে যেতে যখন দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল তখন তার মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠল। হাবিব কাছে আসার পর বলল, চলুন একটু নিরিবিলিতে আলাপ করা যাক।
হাবিব আধুনিকতা পছন্দ করলেও উগ্র ও অত্যাধুনিক পোশাকে রাইসাকে প্রথম থেকে পছন্দ করতে পারেনি। শুধু দাদিমাকে খুশি করার জন্য তার সঙ্গে থেকেছে ও কথাবার্তা বলেছে। কিন্তু নিলীমার গজল শুনে এত মুগ্ধ হয়েছে যে, রাইসার কথা ভুলে আলাপ করার জন্য তার পিছু নিয়েছিল। এখন রাইসার কথা শুনে বলল, বেশ তো চল।
নিলীমাকে যে রুমে যেতে দেখেছে, সেই রুমের জানালা বরাবর বারান্দায় এসে রাইসা একটা চেয়ারে বসে হাবিবকেও বসতে বলল। বসার পর নিলীমা যাতে তাদের কথাবার্তা শুনতে পায় সেরকম গলায় জিজ্ঞেস করল, অহনার গভর্নের্স মানে নিলীমা ম্যাডাম কতদিন অহনাকে পড়াচ্ছেন?
হাবিব বলল, তা প্রায় এক বছর হতে চলল।
ওনাকে পর্দানশীন মনে হল, তবু এই কাজ করছেন কেন বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, উনি ম্যারেড না আনম্যারেড?
হাবিব বুঝতে পারল, নিলীমাকে অপমান করার জন্য রাইসা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে এরকম প্রশ্ন করছে। বলল, ওনার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য কিছু বল।
রাইসা মৃদু হেসে বলল, ওনার সম্পর্কে সবকিছু আমার যে জানতে খুব ইচ্ছা করছে?
হাবিব তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেও ভনিতা করে বলল, হঠাৎ এরকম ইচ্ছা হওয়ার পিছনে নিশ্চয় কারণ আছে?
তা তো আছেই।
তা হলে কারণটা বল।
কেন? আপনার দাদিমা আপনাকে কিছু বলেননি?
তেমন কিছু বলেননি; তবে এতটুকু বলেছেন, তুমি এলে তোমাকে যেন সঙ্গ দিই।
ওনার উদ্দেশ্য নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন?
তা পারব না কেন? উনি তোমাকে পছন্দ করেন এবং নাতবৌও করতে চান।
আপনি চাননি?
এ প্রশ্নের উত্তর এখন দিতে পারব না।
কেন?
রেহানা মানে অহনার মা আমার সঙ্গে যে বেঈমানী করেছে, তারপর আর কোনো মেয়েকেই আমি বিশ্বাস করতে পারব না।
শুনেছি রেহানা ভাবিকে আপনি পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। আরও শুনেছি, আপনারা একে অন্যকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। তবু কেন উনি আপনার সঙ্গে বেঈমানী করলেন?
হাবিব দাঁড়িয়ে উঠে একটু উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ঐ পিশাচিনীর কথা আর বলবে না। তার কথা মনে হলে আমার সারা শরীর ঘেন্নায় রিরি করে উঠে। না-না, ওর কথা বলতে পারব না।
রাইসা তার দুটো হাত ধরে বসিয়ে মিনতি স্বরে বলল, প্লীজ, হাবিব ভাই, উত্তেজিত হবেন না। সেই পিশাচিনীর কথা আমাকে শুনতেই হবে। কারণ তার মতো আমিও একজন নারী। তা ছাড়া আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন এক হাতে তালি বাজে না?
হাবিব চিন্তা করল, কথাটা রাইসা ও নিলীমার জানা উচিত। তা হলে ওরা ভবিষ্যৎ চিন্তা করে অগ্রসর হবে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রাইসা বলল, কই, বলুন।
হাবিব বলতে শুরু করল–
অফিসের কয়েকজন স্টাফের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। যারা ইন্টারভিউ কার্ড পেয়েছিল তাদের মধ্যে রেহানা ছিল। ইন্টারভিউ-এর দিন রেহানাকে দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার মন বলে উঠল, এ রকম মেয়েকে বিয়ে করলে জীবনে সুখী হতে পারব। ওকে আমার পিএ পদে নিয়োগ দিলাম। তারপর আস্তে ধীরে ওকে আমার মনের কথা জানালাম। ও একবছর সময় চাইল। কারণ জিজ্ঞেস করতে বলল, বাবা একসিডেন্ট করে মারা যাওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব তাকে বহন করতে হচ্ছে। ছোট ভাইটা এ বছর ডিগ্রি পরীক্ষা দেবে। ওর রোজগারের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত, এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে ্না। বললাম, আমি তোমাদের সংসারের সব দায়িত্ব নেব। আর তোমার ভাই এর পরীক্ষার পর তাকে নিয়ে এস, আমার অফিসেই তাকে চাকরি দেব। বলল, ঠিক আছে, মায়ের সঙ্গে আলাপ করে জানাবে।
এদিকে আমি একদিন দাদিমাকে রেহানার ফটো দেখিয়ে বললাম, মেয়েটা কেমন দেখুনতো ওকে আমি বিয়ে করতে চাই।
দাদিমা আমার বিয়ের জন্য অনেক দিন থেকে চেষ্টা করছিলেন। ঘটকরা অনেক মেয়ের ফটোসহ সম্বন্ধ এনেছেন; কিন্তু তাদের কাউকেই আমার পছন্দ হয়নি। আজ আমার মুখে বিয়ে করার কথা শুনে ও রেহানার ফটো দেখে খুব খুশি হয়ে বললেন, বাহ! খুব সুন্দর মেয়ে তো? ঠিকানা দে, আজই আমি ওর মা বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলব।
বললাম, ঠিকানা দেয়া লাগবে না, রেহানা আমাদের অফিসে চাকরি করে। তারপর তার বায়োডাটা বললাম।
দাদিমা খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন, নিজের অফিসের মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলতে বিবেকে বাধল না। আমাদের ফ্যামিলির একটা স্ট্যাটাস আছে। এই মেয়েকে বিয়ে করলে আত্মীয়স্বজনের কাছে মান সম্মান থাকবে? না, না, এ কখনই সম্ভব নয়। উচ্চ ফ্যামিলীর এর থেকে অনেক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আমি তোর বিয়ে দেব।
বললাম, দু’তিন বছর ধরে তো সুন্দরী মেয়ের খোঁজ করছেন, কই পেয়েছেন? আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করব। তাতে যদি আত্মীয়-স্বজনরা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখে তাতে আমাদের কি? আর আপনি যদি রেহেনাকে নাতবৌ বলে মেনে নিতে না পারেন, তা হলে আমি ঢাকার বাড়িতে ওকে নিয়ে থাকব।
শেষ পর্যন্ত দাদিমা আমার জীদের কাছে হার মানলেন। এর মাস দুয়েকের মধ্যে রেহানাকে বিয়ে করি। বিয়ের পর রেহানা অফিস করতে চাইলে আমি ও দাদিমা করতে দিইনি। বিয়ের দু’বছর পর অহনা হল। আমরা দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালবাসতাম। এভাবে সাত বছর স্বপ্নের মতো কেটে গেল। যতক্ষণ বাসায় থাকতাম আঠাকাটির মতো রেহানা আমার সঙ্গে থাকত। অহনা ঘুমাত আমাদের পাশের রুমে। রেহানা তাকে ঘুম পাড়িয়ে আসার পর ফারজানা তার কাছে ঘুমাত।
রেহানা ভোরে উঠে অহনাকে নাস্তা খাইয়ে ফারজানার সঙ্গে স্কুলে পাঠিয়ে দিত। তারপর আমাকে আটটার সময় ঘুম থেকে জাগাত। নাস্তা খেয়ে আমি ন’টার সময় অফিসে যেতাম। একদিন দাদিমা আমাকে বললেন, তুই অফিসে চলে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে সুমন নামে একটা ছেলে রেহানার সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমি রেহানাকে জিজ্ঞেস করতে বলল, ওর খালাত ভাই। অনেকদিন আমেরিকায় ছিল। তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। এ ব্যাপারে রেহানা তোকে কিছু বলেছে?
কই, না তো। তা কতদিন থেকে আসছে?
হ্যাঁ, প্রায় মাস দুয়েক হবে।
জিজ্ঞেস করলাম, এতদিন আমাকে বলেননি কেন?
দাদিমা বললেন, প্রথম দিকে মনে করেছিলাম, ভাই বোনকে দেখতে আসে, এটা দোষের কি আছে? কিন্তু ইদানিং প্রায় প্রতিদিন আসে এবং সারাদিন থেকে সন্ধ্যের দু’ঘন্টা আগে চলে যায়। তা ছাড়া মনে করেছিলাম রেহানা তোকে কথাটা বলেছে।
রেহানা এতদিন কথাটা জানাল না কেন ভেবে বেশ চিন্তিত হলাম। ভাবলাম, ও যখন ব্যাপারটা গোপন করেছে তখন নিশ্চয় এর মধ্যে রহস্য আছে। কি রহস্য থাকতে পারে জানার জন্য সেদিন রেহানাকে কিছু বললাম না। পরের দিন নিয়ম মতো অফিসে গেলাম। কিন্তু ঘন্টা দুই কাজ করে বাসায় ফিরতে দাদিমা বললেন, তুই চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পর সুমন এসেছিল। এই আধঘন্টা আগে রেহেনা তার সঙ্গে যাওয়ার সময় আমাকে বলল, খালাআম্মা মৃত্যুশয্যায় আমাকে দেখতে চেয়েছেন, সন্ধ্যের আগেই ফিরবে।
দাদিমাকে জিজ্ঞেস করলাম, অহনা কোথায়?
সে ঘুমাচ্ছে।
রুমে এসে কি করা উচিত চিন্তা করছিলাম, হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের উপর নজর পড়তে একটা ভাঁজ করা কগজ দেখতে পেলাম। তাড়াতাড়ি সেটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম বলে হাবিব রুমে গিয়ে চিঠিটা নিয়ে এসে পড়তে শুরু করল—
হাবিব,
তোমাকে ও অহনাকে ছেড়ে চলে যেতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে; কিন্তু তবু চলে যেতে বাধ্য হলাম। কারণ এটাই আমার ভাগ্যের লিখন। তা না হলে আজ সাত বছর তোমার সঙ্গে সুখে সংসার করার পরেও স্বামী-সন্তান ফেলে কেউ চলে যায় না। জানি না এরপর ভাগ্য আমাকে নিয়ে কি খেলা খেলবে।
ভার্সিটিতে পড়ার সময় সুমন ও আমি একে অপরের প্রেমে পড়ি। ও খুব বড়লোকের ছেলে। আমাকে না জানিয়ে একদিন কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে জোর করে আমাকে বিয়ে করে। ছাত্র অবস্থায় আমি বিয়েতে অমত থাকলেও দৃঢ়ভাবে বাধা দিতে পারিনি। কারণ ওকে এত ভালবেসেছিলাম যে ওর মতের বাইরে কিছু করার বা প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আমার ছিল না।
পড়াশোনা শেষ করে পিএইচডি করার জন্য ও আমেরিকায় চলে গেল। যাওয়ার সময় আমাকে বলল, দু’ বছরের কোর্ষ শেষ করে ফিরে এসে তোমাকে ঘরে তুলব।
প্রথম দিকে ঘন ঘন চিঠি দিত এবং মাঝে মাঝে ফোনও করত। কিন্তু দু’বছর পর আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। একজন লোকের দ্বারা ওদের বাড়িতে খোঁজ করতে জানা গেল, তার বাবাও নাকি তার কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। এভাবে সাড়ে তিন বছর কেটে গেল। এদিকে বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের দায়িত্ব আমার উপর পড়ল। তাই চাকরির চেষ্টা করতে করতে তোমার অফিসে চাকরি পাই। প্রথম থেকে তোমার হাবভাবে বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি আমার প্রতি খুব দুর্বল। অবশ্য আমারও অবস্থা তখন তোমার মতো, কারণ এতদিন সুমনের খোঁজ-খবর না পেয়ে ক্রমশঃ তার প্রতি মন বিষিয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া মহল্লার কিছু ছেলে ও বিপত্নিক লোক আমাকে বিয়ে করার জন্য মায়ের কাছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় তুমি প্রস্তাব দিতে না করতে পারিনি। তবু এক বছর সময় চেয়েছিলাম। কারণ একজন মাওলানার কাছ থেকে জেনেছিলাম, “স্বামী চার বছর নিরুদ্দেশ থাকলে স্ত্রী আবার অন্য লোককে বিয়ে করতে পারে।”
যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি, সুমন পিএইচডি করে ফেরার কয়েকদিন আগে রোড এ্যাকসিডেন্টে স্মৃতিশক্তি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। হাসপাতালের একজন বড় ডাক্তার তাকে আশ্রয় দিয়ে চিকিৎসা করতে থাকেন। দীর্ঘ সাত আট বছর চিকিৎসায় স্মৃতিশক্তি ও বাকশক্তি ফিরে পায় এবং ঐ ডাক্তারকে সবকিছু খুলে বলে। ডাক্তার দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। ওনারা সুমনকে ছেলের মতো গ্রহণ করেছিলেন। সে সব জেনে সুমনও ওনাদের মা বাবার মতো মনে করে বলল, “আমি শুধু কয়েকদিনের জন্য দেশে গিয়ে মা বাবা ও ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা করে আমার স্ত্রী রেহানাকে নিয়ে চলে আসব।”
ওনারা খুশি মনে সুমনকে খরচাপাতি দিয়ে পাঠান। সুমন দেশে ফিরে আমাকে যখন তার সবকিছু জানিয়ে বলল, আমরা একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, ভাগ্য বিপর্যয়ে পড়ে কয়েক বছর আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছে। তাই বলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তো শেষ হয়ে যাইনি। তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও বলে রিভলবার বের করে নিজের কানের কাছে ঠেকিয়ে বলল, এখানে তোমার সামনেই সুইসাইড করব। তারপর কি ঘটবে শিক্ষিত মেয়ে হয়ে নিশ্চয় বুঝতে পারছ।
তাই একরকম বাধ্য হয়ে ওর সঙ্গে চলে গেলাম। পারলে আমাকে ক্ষমা করো।
ইতি–
অভাগিনী রেহেনা
পুনশ্চঃ
যাওয়ার সময় শুধু একটা অনুরোধ করে গেলাম, “তুমি আবার বিয়ে করে আমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো আর অহনাকে আমার সম্পর্কে কিছু জানাবে না, জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি মরে গেছি।
চিঠি পড়া শেষ করে হাবিব ভাঁজ করে পকেটে রেখে বলল, এখন তুমিই বল, এ রকম ঘটনার পর মেয়েদের উপর কি আর বিশ্বাস রাখতে পারি?
রাইসা তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আপনি কি তার কোনো খোঁজ করেননি। আমার তো মনে হয়, তখনি পিছু নিলে ওদেরকে ধরতে পারতেন।
রেহেনা আমাকে এত ভালবাসত যে, চিঠিটা পড়ে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম। দাদিমা যখন এসে বললেন, কিরে ওরকম চুপচাপ বসে রয়েছিস কেন? তখন চিঠিটা তার হাতে দিলাম।
দাদিমা পড়ে রাগে আগুন হয়ে বললেন, তোকে প্রথমেই ওকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলাম। গরিবরা যেমন ছোটলোক তেমনি লোভী। দেখ, সোনাদানা ও টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়েছে কিনা।
আমার তখন ওসব কথা খেয়াল হল না। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার মনে হল ওদেরকে এয়ারপোর্টে পাব। তাই ফুলস্পীডে এয়ারপোর্টের দিকে যেতে লাগলাম। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি গোলচক্করের কাছে লোকের ভীড় ও অনেক গাড়ি জ্যামে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমি গাড়ি সাইড করে পার্ক করলাম। তারপর কাছে গিয়ে দেখলাম একটা প্রাইভেট কার একটা ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি এ্যাক্সিডেন্ট করেছে। প্রাইভেট কারটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। লোকজন কোনো রকমে তার ভেতর থেকে প্রথমে একটা মেয়ের লাশ বের করে রেখে আর একটা লাশ বের করে প্রথম লাশটার পাশে রাখল। এ্যাক্সিডেন্টে তাদের চেহারা বিকৃত হয়ে গেলেও রেহানাকে চিনতে পারলাম। আর ছেলেটা যে তারই প্রাক্তন স্বামী সুমন তা বুঝতে পারলাম। ততক্ষণে পুলিশ এসে লাশ দুটো পোস্টমর্টেম করার জন্য হাসপাতালে নিয়ে চলে গেল।
ভাবলাম, আমার ও অহনার মনে কষ্ট দিয়ে রেহানা যে অন্যায় করেছিল, আল্লাহ তার প্রতিফল দিলেন। বাসায় এসে দাদিমাকে কথাটা জানাতে তিনি বললেন, “আল্লাহর কাজ আল্লাহই করেন। এখন আর তার প্রতি এতটুকু বিদ্বেষ রাখবি না। কারণ বিয়ের আগে এক মৌলবীর কাছে শুনেছিলাম, মানুষ মারা যাওয়ার পর তার কৃতকর্মের ফল সে পাবে। তাকে জীবিত মানুষেরা যেন বদদোয়া না করে, এটা হাদিসের কথা।”
রাইসা বলল, আপনার দাদিমা ঠিক কথা বলেছেন। তবু কেন আপনি রেহানা ভাবিকে যা-তা করে বকেন?
কেন বকি সে কথা তুমি বুঝবে না বলে হাবিব চোখ মুছে চলে যেতে উদ্যত হল।
রাইসা তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে তাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলল, রেহেনা ভাবি আপনার হৃদয়ে যে আঘাত দিয়েছেন, আমি সেই আহত স্থানে ভালোবাসার প্রলেপ দিয়ে আপনাকে সুখী করতে চাই। আমাকে সেই সুযোগ দিন বলে চুমো খেতে লাগল।
প্রায় তিন বছরের বেশি হাবিবের বুভূক্ষ মন ও দেহ রাইসার আলিঙ্গনে আগুনে ঘী ঢালার মতো হল। পারিপার্শ্বিকতা ভুলে সেও রাইসাকে বুকে চেপে ধরে পাগলের মতো চুমো খেতে লাগল।
এ রকম সুযোগের অপেক্ষায় রাইসা ছিল। তার আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে দিয়ে বলল, খুব তাড়াতাড়ি আমাদের বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত। তা হলে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসা দিয়ে রেহানা ভাবির কথা ভুলিয়ে দিতে পারব।
রাইসার কথা শুনে হঠাৎ হাবিবের নিলীমার কথা মনে পড়তেই চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে ভাবল, ছি ছি, নিলীমা যদি এই ঘটনা দেখে থাকে, তা হলে কি মনে করল?
তার পরিবর্তন বুঝতে পেরে রাইসা বলল, কি হল হাবিব ভাই, চমকে উঠলেন কেন?
না, তেমন কিছু হয়নি। শরীরটা যেন কেমন কেমন লাগছে বলে হাবিব নিজের রুমের দিকে চলে যেতে লাগল।
রাইসা মনে করল, উত্তপ্ত দেহের চাহিদা মেটাবার কথা বলতে না পেরে শরীর কেমন কেমন লাগছে বলে ইশারা করল। তাই সেও পিছন পিছন যেতে যেতে নিলীমা যেন শুনতে পায় সেরকম উঁচু গলায় বলল, আমি কি আপনার রুমে আসব?
রাইসার কথার ইঙ্গিত হাবিব বুঝতে পেরে ভাবল, যে মেয়ে বিয়ের আগে দেহ দিতে চায়, সে নিশ্চয় এর আগেও অন্যকে দেহ দিয়েছে। ততক্ষণে রুমের দরজার কাছে পৌঁছে গেছে। ঢোকার আগে দৃঢ়কণ্ঠে বলল, না, তুমি আমার রুমে আসবে না। তারপর ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।
রেহেনার কাহিনী শুনে নিলীমার হৃদয় হাবিবের জন্য দুঃখ ও সহানুভূতিতে ভরে উঠেছিল। বিড় বিড় করে আল্লাহকে জানিয়েছিল, তুমি যদি আমাকে হাবিবের সঙ্গে জোড়া করে থাক, তা হলে রেহানা যে কষ্ট তাকে দিয়েছে, আমি যেন তা দূর করতে পারি। তারপর রাইসা ও হাবিবের কাণ্ড দেখে যেমন লজ্জা পেল, তেমনি তাদের উপর আক্রোশের আগুন জ্বলে উঠল। জানালার কাছ থেকে সরে এসে চিন্তা করল, সেদিন হাবিব যা বলেছিল, তা কি মিথ্যে? তা না হলে আমার রুমের জানালার সামনে এ রকম সীন ক্রীয়েট করল কিভাবে?
খাওয়া দাওয়ার পর চাঁদনী বেগম আলাউদ্দিন সাহেবকে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে কয়েকদিন থাকতে বললেন।
আলাউদ্দিন সাহেবের ভাই গাজীপুরে বাড়ি করেছেন। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে তিনি ভাই-এর বাড়িতে উঠেছেন। চাঁদনী বেগমের কথা শুনে কাজের অজুহাত দেখিয়ে বললেন, এখান থেকে গাজীপুর আর কতটুকু। আমরা ঘন ঘন আসতে না পারলেও রাইসা ওর চাচার গাড়ি নিয়ে যখন খুশি আসতে পারবে।
হাবিবদের বাড়ি থেকে ফিরে রাইসা মাকে বলল, অহনার গভর্নেস নিলীমাকে যত শিঘ্র তাড়াবার ব্যবস্থা করবে ততশিঘ্র আমি হাবিবের মন জয় করতে পারব।
নিলীমাকে দেখে হেলেনা বেগমেরও তাই মনে হয়েছিল। তাই মেয়ের কথা শুনে বললেন, চাঁদনী বেগমের সঙ্গে আলাপ করে সেই ব্যবস্থা করছি।
পরের দিন ফোন করে তিনি চাঁদনী বেগমকে বললেন, হাবিবকে রাইসার পছন্দ হয়েছে। আপনি কি হাবিবের মতামত নিয়েছেন?
চাঁদনী বেগম বললেন, গতকাল সময় আর পেলাম কোথায়? সময় পেলে ওর মতামত নিয়ে জানাব। রাইসাকে প্রতি শুক্রবার সকালে আসতে বলো। সারাদিন থেকে বিকেলে ফিরে যাবে।
তা বলব। একটা কথা বলতে চাই খালাআম্মা, কিছু মনে নেবেন না। অহনার গভর্নের্সকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিন।
সে কথা আমিও ভেবেছি, কিন্তু কি জান মা, অহনাও গভর্নের্সকে ভীষণ ভালবাসে। দেখলে না, কাল কেক কাটার সময় কি করল? এখনই ওকে বিদায় করে দিলে অহনা ভীষণ কান্নাকাটি করবে।
এক কাজ করুন, প্রথমে অহনাকে কোনো ভালো হোমে রেখে পড়াবার ব্যবস্থা করুন, তারপর আর গভর্নেস রাখার দরকার নেই বলে নিলীমাকে বিদায় করে দিন।
কথাটা মন্দ বলনি। হাবিবের সঙ্গে আলাপ করে দেখি সে কি বলে।
তাই করুন। সে যদি অমত না করে, তা হলে তো ভালই। আর যদি অমত করে, তা হলে আপনি তাকে বুঝিয়ে মত করাবেন।
ঠিক আছে, তাই হবে বলে চাঁদনী বেগম বললেন, এবার রাখি তা হলে?
রাখুন বলে হেলেনা বেগম লাইন কেটে দিলেন।
একদিন চাঁদনী বেগম নাতিকে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, রাইসাকে তোর পছন্দ হয়?
হাবিব বলল, রাইসা তো অপছন্দ করার মতো মেয়ে নয়।
তা হলে ওর মা-বাবাকে জানাই, তুই ওকে বিয়ে করতে রাজি আছিস?
তার আগে রাইসা আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছে কি না জেনেছেন?
হ্যাঁ জেনেছি, রাজি আছে। তুই রাজি আছিস কিনা বল।
এক্ষুনি বলতে পারব না।
কেন পারবি না।
রাইসা খুব চালাক মেয়ে। আমাকে না আমার ঐশ্বর্যকে পছন্দ করে, তা জানার পর মতামত জানাব।
এ রকম কথা বলছিস কেন? সব মেয়েরাই তো স্বামীর ঐশ্বর্য পছন্দ করে।
আপনার কথা অস্বীকার করব না। তবে কি জানেন দাদিমা, যে মেয়ে শুধু ঐশ্বর্য পছন্দ করে, সে স্বামীকে সুখ শান্তি দিতে পারে না, স্বামীকে ভালবাসতে জানে না, স্বামীর ভালোমন্দের দিকে খেয়াল না করে নিজের সুখের জন্য যে কোনো অন্যায় কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
রাইসাকে কি তোর সে রকম মেয়ে মনে হয়?
অতটা সিওর না, তবে তার আচার ব্যবহারে মনে কিছু সন্দেহ জেগেছে। তাই আরও সিওর হওয়ার জন্য সময় লাগবে।
হাবিব যে দিন দিন নিলীমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে, তা চাঁদনী বেগম অনেক আগেই অনুমান করেছিলেন। তারপর তাদেরকে গভীর রাতে অভিসার করতে দেখে অনুমানটা দৃঢ় হয়েছে। তাই রাইসার সঙ্গে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এখন তার কথা শুনে বললেন, তুই শুধু শুধু রাইসাকে সন্দেহ করছিস। আমার তো তাকে ওরকম কিছু মনে হয়নি। সন্দেহ জিনিসটা খুব খারাপ। মন থেকে ওসব মুছে ফেল।
হাবিব একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, সন্দেহ জিনিসটা খুব খারাপ জানি বলেই সেটা দূর করার জন্য রাইসাকে আরও ভালো করে জানতে চাই। আপনি তাড়াহুড়ো করবেন না। কিছুদিন যাক, আমি নিজেই আপনাকে জানাব।
তুই কতদিন পর জানাবি? মেয়ের বিয়ে দিয়ে আলাউদ্দিন স্ত্রীকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে। ওরা তো বেশিদিন থাকতে পারবে না বলছে।
মেয়ের বিয়ে দিতে যখন এসেছেন তখন অন্ততঃ দু’তিন মাস সময় নিয়ে এসেছেন। মাস খানেকের মধ্যে আমার মতামত জানাব। আর যদি ওনারা এতটুকু সময় দিতে না চান, তা হলে অন্যত্র মেয়ের বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করুক।
চাঁদনী বেগম চিন্তা করলেন, বেশি চাপাচাপি করলে হাবিব রাইসাকে বিয়ে করতে রাজি নাও হতে পারে। তাই বললেন, ঠিক আছে, রাইসার সঙ্গে আরও কিছুদিন মেলামেশা করে মতামত জানাস। হ্যাঁ, আর একটা কথা, অহনাকে কোনো ভালো হোমে রেখে লেখাপড়া করালে কেমন হয়? ওর গভর্নেসের পিছনে যে টাকা খরচ হয়, হোমে রাখলে যদি তার চেয়ে বেশিও হয়, তবু হোমে রাখাই ভালো বলে আমি মনে করি।
হাবিবের মনে হল, কথাটা রাইসা দাদিমাকে নিশ্চয়ই বলেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হঠাৎ অহনাকে হোমে রাখার কথা বলছেন কেন?
হঠাৎ বলব কেন? কিছুদিন থেকে কথাটা তোকে বলব বলব ভাবছিলাম। তা ছাড়া যে নাতবৌ হয়ে আসবে, সে অহনাকে কতটা গ্রহণ করবে তা তো বলা যায় না। তাই তোর বিয়ের আগেই ওকে হোমে রাখতে চাই।
হাবিব অসন্তুষ্ট গলায় বলল; শুনুন দাদিমা, দু’তিন বছর অহনা আদর ও স্নেহ-সালমা থেকে বঞ্চিত ছিল। ভুল করেছি বুঝতে পেরে তাকে আমি মা বাবার সব কিছু দিতে শুরু করেছি। এখন সেসব থেকে আবার বঞ্চিত করে হোমে দিতে পারব না। তা ছাড়া এ সময় যদি তাকে ঐ সব থেকে বঞ্চিত করি, তা হলে বড় হয়ে অহনা তার বাবাকে ঘৃণা করবে। আর একটা কথা, আপনার হবু নাতবৌ ও তার গার্জেনদের জানিয়ে দেবেন, যে মেয়ে অহনাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে না পারবে, তাকে কিছুতেই আমি বিয়ে করব না। তাতে যদি কোনো মেয়ে রাজি না হয়, তা হলে আমিও আর জীবনে বিয়ে করব না। কথা শেষ করে দাদিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
৯
রাইসা প্রতি শুক্রবার সকালের দিকে চাচার গাড়ি নিয়ে দুতিন ঘন্টা হাবিবের সঙ্গে কাটিয়ে যায়। কোনো কোনো দিন চাঁদনী বেগমের কথায় দুপুরে খেয়ে বিকেলে ফিরে যায়। কিন্তু অহনাকে সময় দেয় না। আর অহনাও তার কাছে বড় একটা আসে না।
প্রত্যেক বৃহস্পতিবার বিকেলে হাবিব বাড়ি এলেও পরপর দু’সপ্তাহ এল না।
চাঁদনী বেগম ফোন করতে হাবিব জানাল, অফিসের কাজের চাপে আসতে পারেনি।
পরের সপ্তাহে বৃহস্পতিবার না এসে শুক্রবার সন্ধ্যের কিছুক্ষণ আগে বাড়ি এল।
নিলীমা অহনাকে ব্যায়াম করাচ্ছিল। হাবিবের গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে তাকে বলল, তোমার বাবা এসেছেন, চল, আজ আর ব্যায়াম করাব না।
বারান্দার কাছে গাড়ি থেকে নেমে হাবিব তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল।
অহনা ছুটে এসে সালাম দিয়ে বাবাকে কদমবুসি করল, তারপর জড়িয়ে ধরে অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, অনেক দিন বাড়ি আসনি কেন?
সালামের উত্তর দিয়ে হাবিব মেয়েকে আদর করতে করতে বলল, কাজের খুব চাপ, তাই আসতে পারিনি।
ততক্ষণে নিলীমা এসে সালাম বিনিময় করে বলল, কেমন আছেন?
হাবিব বলল, ভালো, আপনি?
আমিও ভালো।
এমন সময় গ্রামের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান শুনে অহনা বলল, জান বাবা, ম্যাডাম আমাকে নামায পড়তে শিখিয়েছেন। এখন আমি দিনে পাঁচবার নামায পড়ি।
হাবিব বলল, তাই নাকি? তোমার ম্যাডাম খুব ভালো কাজ করেছেন। উনি আমাকেও নামায ধরিয়েছেন। এখন আমিও দৈনিক পাঁচবার নামায পড়ি। এবার চল তা হলে মাগরিবের নামায পড়তে হবে। নিলীমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, পরে দেখা করব বলে মেয়ের এক হাত ধরে চলে গেল।
সেদিনের ঘটনার জন্য হাবিব খুব লজ্জা পেয়েছে। তাই দাদিমাকে কাজের অজুহাত দেখিয়ে দু সপ্তাহ বাড়ি আসেনি। আজ আসার পর লজ্জায় নিলীমার দিকে ভালো করে তাকাতে পারেনি।
ব্যাপারটা নিলীমা অনুমান করতে পেরে খুশি হয়েছে। এখন নামায পড়ার কথা শুনে আরও খুশি হয়ে মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে করতে নিজের রুমের দিকে এগোল।
চাঁদনী বেগম দোতলার বারান্দায় ছিলেন। হাবিব, মেয়ের হাত ধরে উঠে এসে সালাম দিয়ে বলল, দাদিমা কেমন আছেন?
এর আগে হাবিব কখনও সালাম দেয়নি। তাই চাঁদনী বেগম বেশ অবাক হলেও সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, গত দুই শুক্রবার রাইসা এসে ফিরে গেছে। আজও এসেছিল, তুই আসিসনি শুনে চলে গেল।
হাবিব বলল, আজান হয়ে গেছে, আগে নামাযটা পড়ে নিই, তারপর আলাপ করব বলে রুমে গিয়ে নামায পড়ল। তার পাশে দাঁড়িয়ে অহনাও নামায পড়ল।
হাবিব সালাম দিতে চাঁদনী বেগম যতটা না অবাক হয়েছিলেন, নামায পড়ার কথা শুনে আরও বেশি অবাক হয়ে চিন্তা করলেন, নিশ্চয় নিলীমা তাকে নামায পড়তে বলেছে। আরও চিন্তা করলেন, আজ রাতে নিশ্চয় নিলীমার সঙ্গে অভিসার করবে।
নামায শেষ করে হাবিব মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় দাদিমার সঙ্গে নাস্তা খাওয়ার সময় বলল, এতদিন নামায না পড়ে খুব অন্যায় করেছি। আপনিও তাই করছেন। অনেক আগের থেকে আপনার নামায পড়া উচিত ছিল। আসলে কি জানেন দাদিমা, আমরা ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা না করে ইসলামের বিধি নিষেধ যেমন জানি না, তেমনি মেনেও চলি না। অথচ প্রত্যেক মুসলমান নর নারীর ওইগুলো করা একান্ত কর্তব্য।
চাঁদনী বেগম বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, এসব কথা তোকে নিশ্চয় নিলীমা বলেছে?
নিলীমা ইসলামের বিধি-নিষেধ সম্পর্কে অল্পকিছু একদিন বলেছিল। আজকাল বাংলায় ইসলামিক অনেক বই-পুস্তক বেরিয়েছে। সে সব পড়ে ভালোভাবে ইসলামকে জেনে মেনে চলার চেষ্টা করছি। বইগুলো এনেছি পড়বেন। পড়লে আপনিও ইসলামের বিধি-নিষেধ মেনে চলার প্রেরণা পাবেন।
চাঁদনী বেগম বললেন, তা না হয় পড়ব। আমি জানতে চাই, রাইসার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?
এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। কারণ ইসলামিক বই পুস্তক পড়ে মনে হয়েছে, ধার্মিক মেয়েকে বিয়ে না করলে সংসার জীবনে সুখ শান্তি পাওয়া যায় না। রাইসার সঙ্গে ধর্ম সম্পর্কে আলাপ করব। সে যদি ধর্মের বিধি-নিষেধ মেনে চলে ধার্মিক মেয়ে হতে চেষ্টা করে, তা হলে ওকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই। নচেৎ বলে থেমে গেল।
চাঁদনী বেগম গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কবে রাইসার সঙ্গে আলাপ করবি?
অফিসের কাজের চাপ কমেনি। কমলেই একদিন আলাপ করব। চাঁদনী বেগম যা বোঝার বুঝে গেলেন। বললেন, যা করার তাড়াতাড়ি করিস। দেখতে দেখতে একমাস পার করে দিলি।
রাত বারটার সময় হাবিব নিচে এসে নিলীমার রুমের দরজায় নক করল।
নিলীমা সিওর ছিল হাবিব এই সময়ে আসবে। তাই জেগেছিল। দরজা খুলে দিয়ে বলল, সেদিন আপনাকে বলেছিলাম না, স্বামী-স্ত্রী ছাড়া এভাবে মেলামেশা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ?
হাবিব বলল, কাল সকালেই ঢাকা চলে যাব। তাই কোনো উপায় না দেখে এ সময়ে আসতে হল। কথা দিচ্ছি, আর কখনও এ সময় আসব না। চলুন, বাগানে বসে কিছু জরুরি আলাপ করব।
বাগানে কেন? যা আলাপ করার এখানেই করুন।
আপনি আসুন তো বলে হাবিব তার একটা হাত ধরতে গেলে নিলীমা হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, চলুন।
আজও চাঁদের পনের তারিখ। চাঁদের আলোয় চারদিক মনোরম দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। বাগানে এসে বসার পর হাবিব বলল, যা বলব বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, তবু বলব। প্রথম যে দিন মাতাল অবস্থায় আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। সেটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। পরের দিন সে জন্য ক্ষমা চেয়ে বলেছিলাম, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হবে না। তার প্রমাণ নিশ্চয় পেয়েছেন। অহনার জন্মদিনে রাইসার সঙ্গে যা কিছু করেছি তাও একটা দুর্ঘটনা। তাই লজ্জায় গত দু’সপ্তাহ বাড়িতে আসিনি। কিন্তু মনে এতটুকু শান্তি পাইনি। আজ এসেছি সেই দুর্ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে। যদিও জানি মেয়েরা এ ব্যাপারে ক্ষমা করতে পারে না, তবু চাইছি আপনাকে অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা জেনে। কথা শেষ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, চাঁদের আলো মুখে পড়ে তার সৌন্দর্য হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
নিলীমা এতক্ষণ মুখ নিচু করেছিল। হাবিব থেমে যেতে মুখ তুলে তাকিয়ে তাকে ঐ ভাবে চেয়ে থাকতে দেখে মুখ আবার নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, প্রথম দিন আপনি মাতাল অবস্থায় আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, তা ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু অহনার জন্মদিনে রাইসার সঙ্গে যা কিছু করেছেন, তা আল্লাহর আইনের পরিপন্থী। সে জন্যে আল্লাহর কাছে তওবা করে ক্ষমা চাইবেন তিনি অসীম করুণাময়। কোনো বান্দা অন্যায় করে কায়মনোবাক্যে তওবা করে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করে দেন।
এই কয়েকদিন তাই করেছি। এখন আপনি করেছেন কিনা বলুন।
হাবিবের পরিবর্তন দেখে আনন্দে নিলীমা আগেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছে। এখন তার কথা শুনে সেই আনন্দ আরও বেড়ে গেল। কিছু বলতে গেলে কান্নার মতো শোনাবে। তাই চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হাবিব মিনতিস্বরে বলল, জানেন, আপনাকে পাওয়ার জন্য মদ ছেড়েছি, নামায ধরেছি, ইসলামিক বই কিনে পড়াশুনা করছি। আর কি করিছি জানেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর আপনাকে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি।
নিলীমা খুব শক্ত দিলের মেয়ে। কিন্তু হাবিবকে দেখার পর থেকে সেই দিল নরম হতে শুরু করে। তাকে পাওয়া অসম্ভব জেনে এতদিন ধৈর্য ধরে থাকলেও এখন আর পারল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
তাই দেখে হাবিব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, কি হল, আপনি কাঁদছেন কেন? আমি কি খুব খারাপ আচরণ করে ফেলেছি?
নিলীমা সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, না, আপনি কিছু করেননি, নিজের তকদিরের কথা চিন্তা করে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমরা একে অপরকে ভালবেসে ফেলেছি, এ কথা সত্য, কিন্তু আমাদের মনের আশা কি পূরণ হবে?
হাবিব দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় হবে।
কিন্তু আপনার দাদিমা যে কিছুতেই রাজি হবেন না, সে কথা আগেও একদিন বলেছি। তিনি রাইসাকে নাতবৌ করতে চান। আর দাদিমার অমতে আমাকে যদি বিয়ে করেন, তা হলে তিনি ভীষণ ব্যথা পাবেন। মুরুব্বীদের মনে ব্যথা দিয়ে আপনি কি সুখী হতে পারবেন?
আমার তকৃদিরে সুখ লেখা থাকলে আমি পাব, নচেৎ যাকেই বিয়ে করি না কেন পাব না। শুনুন, দাদিমা ব্যথা পেয়ে যদি সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি থেকে আমাকে বঞ্চিতও করেন, তবু রাইসাকে আমি বিয়ে করব না। কারণ সে দাদিমার ঐশ্বর্য চায়, আমাকে নয়। দাদিমাকে খুশি করার জন্য আমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করছে। আমার ফাইন্যাল সিদ্ধান্ত তোমাকে বিয়ে করবই। তুমি আমার পাশে থাকলে কুলিগিরি করতেও পিছপা হব না। এক্ষুনি এই মুহূর্তে তোমাকে বলতে হবে সারাজীবন তুমি আমার পাশে থাকবে কিনা।
নিলীমা ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, চুপ করুন, প্লীজ চুপ করুন। আমি এতিম মেয়ে। এতিমখানাতে মানুষ হয়েছি। আমি কি আপনার এত ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারব না। আপনার ভালোবাসা গ্রহণ করার যোগ্যতা কি আমার আছে? তাই খুব ভয় হয়, বিয়ের পর আপনি না অনুশোচনার আগুনে পুড়ে সারাজীবন অশান্তি ভোগ করেন।
তাকে থামিয়ে দিয়ে হাবিব বলল, এক্ষুনি বললাম না, যাকেই বিয়ে করি না কেন, আল্লাহ আমার তকদিরে সুখ শান্তি রাখতে পাব, না রাখলে পাব না? আমি তোমার কোনো যুক্তিই শুনতে চাই না, শুধু রাজি আছ কিনা বল।
নিলীমা চোখ মুছতে মুছতে বলল, জীবনের প্রথমে আপনি আমার হৃদয়ের আসনে বসেছেন। এ জীবনে যদি আপনাকে নাও পাই, তবু সেই আসনে অন্যকে বসাতে পারব না। আমরণ আপনার অপেক্ষায় থাকব।
এই কথা শোনার জন্য তোমাকে গভীর রাতে এখানে এনেছি। তারপর খুশির আমেজে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল।
নিলীমা তড়িৎ গতিতে তার দুটো হাত ধরে মিনতি স্বরে বলল, প্লীজ, রাগ করবেন না। বিয়ের আগে এটাও ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ। চলুন, এবার ফেরা যাক বলে দাঁড়িয়ে পড়ল নিলীমা।
হাবিব বলল, আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আমি কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করব। তারপর আবার বলল, আমি তোমাকে তুমি করে বলছি। আর তুমি কি আপনি করে বলছ।
নিলীমা কিছু না বলে চুপ করে হাঁটতে লাগল।
নাতি যে আজ অভিসারে বেরোবে তা চাঁদনী বেগম আগেই অনুমান করেছিলেন। তাই তিনিও জেগেছিলেন। তাকে রুম থেকে বেরোতে দেখে তার পিছু নিয়ে ফুলবাগানে এসে তাদের অনতিদূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনে বুঝতে পারলেন, ওরা শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। রুমে ফিরে এসে কি করবেন না করবেন চিন্তা করে ঠিক করে রাখলেন।
পরের দিন হাবিব ঢাকা চলে যাওয়ার পর চাঁদনী বেগম ফারজানাকে বললেন, অহনার ম্যাডামকে ডেকে নিয়ে এস।
নিলীমা সবেমাত্র অহনাকে স্কুলে দিয়ে ফিরেছে। এমন সময় ফারজাহানা এসে বলল, আপনাকে মালেকিন ডাকছেন।
নিলীমা কিছুক্ষণ পরে নিচ তলার ড্রইং রুমে এসে চাঁদনী বেগমকে সালাম দিল।
চাঁদনী বেগম গম্ভীর কণ্ঠে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে আর আমাদের দরকার নেই। তারপর একটা পাঁচশ টাকার বান্ডিল টেবিলের উপর রেখে বললেন, তুমি দেড় বছর কাজ করেছ। প্রতিমাসে দু’হাজার টাকা নিয়েছ আর তিন হাজার টাকা করে মোট চুয়ান্ন হাজার টাকা তোমার পাওনা ছিল। এখানে পুরো চুয়ান্ন হাজারই আছে, গুনে নাও। তোমার যা কিছু আছে সে সব গুছিয়ে নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাও।
নিলীমা জানত হাবিব যখন দাদিমাকে বিয়ে করার কথা বলবেন তখন হয়তো চাঁদনী বেগম তার সাথে খুব রাগারাগি করবেন অথবা চাকরি ছাড়িয়ে দিয়ে চলে যেতে বলবেন। কিন্তু তার আগেই এরকম করবেন ভাবতেই পারেনি। তাই খুব অবাক হয়ে বলল, দু’দিন আগে হোক পরে হোক আমাকে আপনাদের দরকার থাকবে না একথা ঠিক। কিন্তু এখন চলে গেলে অহনার পড়ালেখার ক্ষতি হবে। আগে ওর টিচারের ব্যবস্থা করুন, তারপর না হয় আমি চলে যাব।
চাঁদনী বেগম গম্ভীর কণ্ঠেই বললেন, অহনার ভালোমন্দ চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। সেটা আমরা দেখব। তোমাকে যা বললাম তাই কর।
কিন্তু হঠাৎ এরকম সিদ্ধান্ত কেন নিলেন, না জেনে আমি যাব না।
চাঁদনী বেগম গর্জে উঠলেন, তোমার সাহস তো কম না? তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছ। জান, ইচ্ছে করলে তোমাকে চাকর-চাকরানীদের দ্বারা অপমান করে তাড়িয়ে দিতে পারি?
কই, ওদেরকে ডেকে অপমান করতে বলুন তো দেখি। এমন পাঁচজন চাকর-চাকরানীকে আমি তোড়াই কেয়ার করি। আমাকে যদি ওদের মতো মনে করেন, তা হলে ভুল করবেন। আমাকে কেন এক্ষুনি চলে যেতে বলছেন তা না জানালে আমি যাব না।
চাঁদনী বেগম খুব রেগে গিয়ে বললেন, তবে শোন, তুমি একটা জঘন্য চরিত্রের মেয়ে। ধর্মের মুখোশ পরে ঐশ্বর্যের লোভে আমার নাতিকে রূপ যৌবনের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করতে চাও। তাই গভীর রাতে ফুল বাগানে তার সঙ্গে অভিসার কর। আমি কিছু জানি না মনে করেছ? তোমার আচার-আচরণ ভালো দেখে অহনার গর্ভনেস করে রেখেছিলাম। আসল চরিত্র জানতে পেরে তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি। যাও এক্ষুনি চলে যাও, নচেৎ ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে রাজরানী হওয়ার স্বপ্ন চিরকালের জন্য ঘুছিয়ে দেব। আর একটা কথা জেনে রাখ, হাবিব আমার আপন ছেলের ঘরের নাতি নয়। পালক ছেলের ঘরে নাতি। তুমি যদি ঢাকায় গিয়ে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করে তাকে বিয়ে কর, তা হলে আমার সমস্ত সম্পত্তি থেকে সে এক কানাকড়িও পাবে না। বিয়ের আগে কথাটা তাকেও জানিয়ে দিও। আমি যে কাউকে কখনও দু’বার আদেশ করিনি, তা এতদিনে নিশ্চয় জেনেছ? যাও, নিজের যা কিছু আছে নিয়ে এক্ষুনি আমার নজর থেকে দূর হয়ে যাও।
নিলীমা বলল, বার বার চলে যেতে বলছেন কেন? চিরকাল এখানে থাকার জন্য তো আসিনি। একদিন না একদিন যেতেই হত। যাওয়ার আগে দু’একটা কথা না বলে পারছি না। জানতাম উঁচু ও বড় ফ্যামিলির মানুষের মনও খুব বড় হয়; কিন্তু আপনার মতো নিচু মনের মানুষও যে আছে জানতাম না। আর মনে রাখুন, আমি কোনোদিন ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে রাজরাণী হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি। তারপর সালাম দিয়ে নিজের রুমে এসে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে গেটের কাছে এসে দারোয়ানকে গেট খুলে দিতে বলল।
তার একহাতে সুটকেশ ও অন্যহাতে সাইড ব্যাগ দেখে দারোয়ান গেট খুলে দিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এসব নিয়ে কোথায় যাবেন?
নিলীমা বলল, চাকরি করতে এসেছিলাম, এখন চাকরি নেই, তাই চলে যাচ্ছি।
এ বাড়ির দারোয়ান, বাগানের মালি ও কাজের মেয়ে পুরুষ সবাইকে নিলীমা কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে নামায রোযা ধরিয়েছে। তা ছাড়া ইসলামের অনেক বিধি-নিষেধের কথা শুনিয়ে সে সব মেনে চলার চেষ্টা করিয়েছে। তাই তার কথা শুনে দারোয়ান বলল, তাই বলে আমাদেরকে না জানিয়ে চলে যাবেন?
ততক্ষণে মুখতার দেখতে পেয়ে সেখানে এসেছে। দারোয়ানের কথা শুনে ও নিলীমার দু’হাতে সুটকেস ও সাইড ব্যাগ দেখে বুঝতে পারল, অহনার ম্যাডাম একেবারে চলে যাচ্ছেন। দারোয়ান থেমে যেতে ছল ছল চোখে ভিজে গলায় বলল, দারোয়ান ঠিক কথা বলেছে। যখনই আপনি চলে যেতেন তখনই আমরা দুঃখ পেতাম; কিন্তু এভাবে চলে যাচ্ছেন জেনে সেই দুঃখ আরও বেশি পেলাম।
আল্লাহর ইচ্ছাতেই আমাকে এভাবে চলে যেতে হচ্ছে। তবু আপনাদের সবার কাছে ক্ষমা চাইছি বলে নিলীমা গেট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর আসার পর একটা খালি রিকশা পেয়ে বাস স্ট্যান্ডে যেতে বলল।
রিকশায় বসে চিন্তা করতে লাগল, কোথায় যাবে? কিশোর বয়স থেকে এতিমখানায় মানুষ হয়েছে। তারপর এখানে একজন দিয়ে গেছে। কখনও কোথাও যায় নি। তার মন বলে উঠল, ঢাকা গিয়ে হাবিবের সঙ্গে দেখা করে তাকে সবকিছু জানাও। জানার পর সে নিশ্চয় তোমাকে বিয়ে করে ঢাকার বাড়িতে রাখবে।
নিলীমা মনকে বলল, আমাকে বিয়ে করলে তো সে চাঁদনী বেগমের সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। তা ছাড়া বড়লোকের ছেলেদের বিশ্বাস নেই, তারা মেয়েদেরকে খেলার সামগ্রী মনে করে। পুরানো হয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। হাবিব যদি সেরকম কিছু করেন, তা হলে আমার প্রেম কলুষিত হবে। তার চেয়ে দূর থেকে তাকে ভালবেসে যাব। আর আল্লাহ যদি তার সঙ্গে আমার জোড়া করে থাকেন, তা হলে তিনি সবকিছুর ব্যবস্থা করবেন।
তার মন বলল, তা হলে এতিমখানায় ফিরে গিয়ে জ্যোৎস্না ম্যাডামকে সবকিছু খুলে বল।
নিলীমা বলল, তা একেবারেই অসম্ভব। কারণ তিনি ইউসুফ গাজীর মতো নরপশুর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করার জন্য যা কিছু করেছেন, তারপর সেখানে গিয়ে সবার কাছে ওনাকে ছোট করা কিছুতেই উচিত হবে না। এইসব চিন্তা করতে করতে রিকশা কখন বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছে জানে না। রিকশাওয়ালা যখন বলল, নামুন, বাস স্ট্যান্ডে এসে গেছি তখন সম্বিত ফিরে পেয়ে নেমে ভাড়া দিল।
অনেক ভেবে চিন্তে নিলীমা ঢাকার টিকেট কেটে যখন গাড়িতে উঠল তখন বেলা দুটো। এতক্ষণ চিন্তায় ক্ষিধের কথা মনে ছিল না। বাসে উঠার পর প্রচণ্ড ক্ষিধে অনুভব করল। কন্ট্রাক্টারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল দু’ঘন্টার মধ্যে ঢাকা পৌঁছে যাবে। বাস চলতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লান্তিতে নিলীমা ঘুমিয়ে পড়ল। কন্ট্রাক্টরের ডাকে ঘুম ভাঙতে দেখল, বাসে একটাও প্যাসেঞ্জার নেই।
তাকে তাকাতে দেখে কন্ট্রাক্টর বলল, নামুন, ঢাকা এসে গেছেন।
নিলীমার প্রথমে ভ্যানিটি ব্যাগের কথা মনে পড়ল। ব্যাগটা কোলের উপর রেখেছিল। সেটা নেই বুঝতে পেরে ব্যাগ ও সুটকেসের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানে সাইড ব্যাগ এবং সুটকেসও নেই। হতাশ ও আতঙ্কিত হয়ে বলল, আমার ভ্যানিটি ব্যাগ, সাইড ব্যাগ ও সুটকেশ কি হল?
কাকডার যা বোঝার বুঝে গেল, বলল, সেগুলোর দিকে আপনি লক্ষ্য রাখেন নি? নেই যখন তখন সেগুলো অন্য প্যাসেঞ্জার নিয়ে চলে গেছে।
নিলীমা আঁতকে উঠে বলল, সে কি? সাইড ব্যাগ ও সুটকেসে আমার জামা কাপড় থাকলেও ভ্যানিটি ব্যাগে বেশ কিছু টাকা ছিল।
ড্রাইভার শুনতে পেয়ে কন্ট্রাক্টরকে বলল, ঝামেলা না করে ওনাকে নামিয়ে দে। ড্রাইভারের কথা শুনে কন্ট্রাকটার নিলীমাকে বাস থেকে নামিয়ে দিল।
নিলীমা বোরখা পরে ছিল বলে রক্ষে, নচেৎ এতক্ষণ বাসস্ট্যান্ডের টাউটরা তার রূপ দেখে সাহায্য করার নামে চেপে ধরত।
দুপুর থেকে মেঘে আকাশ অন্ধকার হয়ে ছিলো। কোথায় যাবে, কি খাবে ভাবতে ভাবতে বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুদূর এসেছে। এমন সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামল। নিলীমা ভিজতে ভিজতে ছুটে রাস্তার ধারে একটা বিল্ডিং এর গেট খোলা দেখে ভিতরে ঢুকে কড়িডোরে দাঁড়াল। তবু বৃষ্টির ঝাঁপটা এসে তার গায়ে লাগতে লাগল। বরান্দা লোহার গ্রীল দিয়ে ঘেরা। গ্রীলের দরজা থাকলেও সেটা ভিতর থেকে তালা দেয়া। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তালাটা নাড়া দিয়ে শব্দ করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে ভিতরের দরজা খুলে একজন চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছরের মহিলা বললেন, এখানে কেন এসেছ?
নিলিমা বলল, আজকের মতো আশ্রয় চাই আর সামান্য খাবার, কাল ভোরেই চলে যাব।
মহিলা তার আপাদ মস্তক কয়েকবার চোখ বুলিয়ে বললেন, কোনো সাহায্য। করতে পারব না। তোমার মতো মেয়েকে এই রকম পরিস্থিতিতে একবার আশ্রয় দিয়েছিলাম। সে ছিল ডাকাত দলের গুপ্তচর। গভীর রাতে ডাকাতদের ঘরে ঢোকার ব্যবস্থা করে ডাকাতি করে। তাই দ্বিতীয়বার সেই ভুল আর করব না বলে দ্রুত পায়ে ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
নিলিমা ঠাণ্ডায় জমে যেতে লাগল। বসে দু’হাত মোনাজাতের মতো করে আল্লাহকে বলল, তুমি রহমানুর রহিম, তোমার দয়া অসীম। আমি তোমার প্রিয় রসূল (দঃ) এর একজন উম্মত। তাঁর ওসিলা দিয়ে তোমার কাছে সাহায্য চাইছি। তুমি উত্তম সাহায্যকারী আমাকে সাহায্য কর।
কিছুক্ষণ পরে হেড লাইট জ্বালিয়ে একটা গাড়ি এসে তার সামনে থামল। গাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক নেমে নিলিমাকে ঐ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি?
নিলিমার তখন কথা বলার শক্তি নেই। কিছু বলতে গিয়েও পারল না। জ্ঞান হারিয়ে নেতিয়ে পড়ে গেল।
ভদ্রলোক এই বাড়ির মালিক আমিনুল ইসলাম। তিনি একজন উকিল। নিলিমার অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে কলিং বেলের সুইচে চাপ দিলেন। দরজা খুলে একজন কাজের বুয়া এসে বারান্দার গ্রীলের দরজার তালা খুলে দিল। উকিল সাহেব তাকে বললেন, আরও একজনকে ডেকে এই মেয়েটাকে ভিতরে নিয়ে যাও। ভিজে কাপড় পাল্টে গরম তেল সারা গায়ে মালিস করে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করো।
নিলিমার জ্ঞান ফেরার পর একজন বুয়া এসে উকিল সাহেবকে সে কথা জানাল। সেখানে ওনার স্ত্রী আরিফা বেগমও ছিলেন। স্বামীর সঙ্গে এসে নিলীমাকে দেখে বলে উঠলেন আরে, এতো সেই মেয়ে, যে বেশ কিছুক্ষণ আগে করিডোরে আমার কাছে আশ্রয় চেয়েছিল।
উকিল সাহেব বুয়াদের বললেন, ওকে গরম গরম খাবার দাও। খাওয়ার শেষে একগ্লাস গরম দুধও দিও। তারপর স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে আসার সময় বললেন, একজন বিপদগ্রস্থকে সাহায্য না করে কাজটা তুমি ঠিক করনি। আমি সময়মতো না এলে মেয়েটা মারা যেতে পারত।
আরিফা বেগম বললেন, মনে নেই, কয়েক বছর আগে এরকম দুর্যোগের রাত্রে একটা মেয়েকে আশ্রয় দিয়ে কি ঘটনা ঘটেছিল?
মনে থাকবে না কেন? সবাই কি সমান হয়? এই মেয়েকে দেখে ভালোমন্দ বিবেচনা করা উচিত ছিল। যাক গে, যা হওয়ার হয়েছে। মেয়েটার দিকে একটু লক্ষ্য রেখ।
ঠাণ্ডা লেগে নিলীমার সর্দিজ্বর হলেও তিন চারদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠল।
উকিল সাহেব একদিন পরিচয় জানতে চাইলেন।
নিলীমা নাম গোপন করে রাবেয়া বলল। তারপর সংক্ষেপে এতিমখানার জীবন ও অহনার গভর্নের্স হয়ে চাকরি করা ও চাকরি চলে যাওয়ার পর ঢাকায় আসার পথে টাকা ও ব্যাগ-সুটকেস ছিনতাই হয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে বলল, আপনি যদি আমায় একটা কাজ জোগাড় করে দিতেন, তা হলে খুব উপকৃত হতাম। এর আগে কোনোদিন ঢাকায় আসিনি। কোথায় কাজের চেষ্টা করব, কোথায় থাকব কিছুই ভাবতে পারছি না।
নিলীমার রূপ, আচার ব্যবহার ও কথাবার্তায় উকিল সাহেব চিন্তা করলেন, মেয়েটা এতিমখানায় মানুষ হলেও ভদ্র বংশের। জিজ্ঞেস করলেন, কতদূর লেখাপড়া করেছ?
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় নাম ছিল।
ঠিক আছে, আপাতত তুমি এখানে থেকে আমার তিনজন নাতি নাতনিকে পড়াও। পরে চেষ্টা করে দেখি কোথাও যদি লাগাতে পারি।
উকিল সাহেবের ছেলে নেই, একটা মেয়ে ছিল। সাত ও দশ বছরের দুটো মেয়ে ও চার বছরের একটা ছেলে রেখে সে মারা যায়। জামাই আবার বিয়ে করেছে। নাতি নাতনিদের কষ্ট হবে ভেবে উকিল সাহেব ও ওনার স্ত্রী নাতি নাতনিদের নিজেদের কাছে রেখে মানুষ করছেন। নাতিন বড় দু’জনের একজন নাইনে ও অন্যজন সিক্সে পড়ে আর ছোট নাতি ক্লাস টুয়ে পড়ে। উকিল সাহেবের বাড়ির কেউ নামায রোযা করে না। কেউ কুরআনও পড়তে জানে না। কিছুদিনের মধ্যে নিলীমা ওরফে রাবেয়া বাড়ির সবাইকে কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে নামায ধরিয়েছে, কুরআন পড়া শিখিয়েছে।
কোনো গৃহিনীই একজন রূপসী যুবতী মেয়েকে বাসায় রাখতে চাইবেন না। কারণ যে কোনো সময়ে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। নিলীমাকে বাসায় রাখাতে আরিফা বেগম স্বামীর উপর প্রথম দিকে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল নিলীমার সবকিছু দেখে শুনে তার উপর আর অসন্তুষ্ট থাকতে পারেন নি। বরং নিজেও নাতনিদের মতো ভালোবেসে ফেলেছেন।
১০
হাবিব পরের সপ্তাহে বাড়িতে এসে গাড়ি নিয়ে গেটের ভিতর ঢুকতেই দেখতে পেল, ফারজানা অহনাকে নিয়ে হাঁটছে। বারান্দার কাছে গাড়ি পার্ক করে তাদের দিকে এগোল।
অহনা দেখতে পেয়ে ছুটে এসে সালাম বিনিময় করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, জান বাবা, মায়ের মতো ম্যাডামও কাউকে কিছু না বলে চলে গেছেন।
কথাটা শুনে হাবিব চমকে উঠলেও বিশ্বাস করতে পারল না। মেয়েকে আদর করে চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, ম্যাডাম হয়তো কোনো কারণে কোথাও গেছেন। দু’একদিনের মধ্যে এসে পড়বেন।
না বাবা, বড় মা বললেন, ম্যাডাম ওনার সবকিছু নিয়ে চলে গেছেন আর আসবেন না। তুমি বড়মাকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে।
ততক্ষণে ফারজানা কাছে এসেছে দেখে হাবিব মেয়েকে বলল, তুমি ফারজানার সঙ্গে বেড়াও, আমি তোমার বড়মার কাছে যাচ্ছি। দোতালায় উঠে দাদিমাকে বারান্দায় চেয়ারে বসে থাকতে দেখে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, কাউকে কিছু না বলে অহনার গভর্নেস নাকি চলে গেছেন?
চাঁদনী বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কার কাছে শুনলি?
নিচে অহনার কাছে।
হ্যাঁ, চলে গেছে।
শুধু শুধু চলে গেলেন কেন? নিশ্চয় যাওয়ার পিছনে কোনো কারণ ঘটেছিল।
কারণ আবার কি ঘটবে? শনিবার অহনাকে স্কুলে দিয়ে এসে কখন চলে গেছে জানি না। অহনাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার সময় হলে দারোয়ান এসে বলল, অহনার গভর্নেস সুটকেস ও ব্যাগ নিয়ে চলে গেছেন। অহনাকে নিয়ে আসার জন্য গাড়ি পাঠান। ঐ ছোটলোকের মেয়ের ব্যাপারে আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবি না।
হাবিব বলল, আপনি ওকে গালাগালি করছেন কেন?
চাঁদনী বেগম রেগে উঠে বললেন, গালাগালি করব না তো দোয়া করব? যাকে ভালো জেনে আজ দেড় বছর বাড়ির লোকের মতো রেখেছিলাম, সে কিনা যাওয়ার সময় একটা মুখের কথা বলেও গেল না?
নিলীমা চলে গেছে শোনার পর থেকে হাবিবের মনে ঝড় বইছে। নিলীমার মতো মেয়ে কাউকে কিছু না বলে শুধু শুধু চলে যাবে, কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারল না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অহনা ওনাকে খুব ফিল করছে। তা ছাড়া ওর দু’তিন মাস পরে পরীক্ষা। কি যে করি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তোর বোঝার দরকার নেই, যা করার আমি করব। এতিমখানার মা বাবার পরিচয়হীন মেয়ের জন্য অত ভাবছিস কেন? শোন, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে রাইসার সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। রাইসা অহনার সবকিছু দেখাশোনা করবে।
এই কথা শুনে হাবিবের দৃঢ় ধারণা হল, এই জন্যই নিশ্চয় দাদিমা বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিলীমাকে তাড়িয়েছেন।
কি রে, কিছু বলছিস না যে?
বলার এখনও সময় হয়নি। আগে আমাকে জানতে হবে নিলীমা কেন চলে গেল।
আমার কথা তা হলে তুই বিশ্বাস করিস নি?
এতদিন আপনার সব কথা বিশ্বাস করেছি; কিন্তু এখন এই কথা বিশ্বাস করতে পারছি না।
কেন বলতো?
কারণ এই ঘটনার সঙ্গে রাইসা জড়িত।
রাইসাকে আবার এখানে টানছিস কেন? নিলীমা চলে গেছে রাইসাও জানত না। আমি তাকে টেলিফোন করে জানিয়েছি।
শুনুন দাদিমা, এখন আমার পক্ষে বিয়ে করা কিছুতেই সম্ভব নয়।
চাঁদনী বেগম রেগে উঠে বললেন, কেন সম্ভব নয়?
সে কথা এখন বলাও সম্ভব নয়।
কেন সম্ভব নয় আমি জানি। নিলীমাকে তুই বিয়ে করতে চাস তাই না?
হ্যাঁ, চাই। কারণ তাকে আমি ভালোবাসি।
কথাটা উচ্চারণ করতে তোর মুখে বাধল না। ছি, ছি, তোর রুচি যে এত নিচে নেমে যাবে ভাবতেই পারছি না।
হ্যাঁ দাদিমা, যে মেয়ে তার আদর্শ ও চরিত্রের গুনে আমার মতো একজন মাতালকে মদ ছাড়িয়ে ধর্মের পথে এনেছে, বাসার দারোয়ান থেকে কাজের বুয়াদের পর্যন্ত নামায শিখিয়েছে, অহনাকে মায়ের স্নেহ মমতা দিয়ে তার মায়ের কথা ভুলিয়েছে, সেই মেয়েকে ভালোবাসলে যদি রুচি নিচে নেমে যায়, তা হলে রাইসার মতো অত্যাধুনিক, উচ্ছখল ও অর্থলোভী মেয়েকে বিয়ে করলে উঁচু রুচির পরিচয় দেয়া হবে তাই না?
অত যে তার গুণ গাইছিস, সে যে ধর্মের আড়ালে তার রূপ যৌবন দেখিয়ে আমার বিশাল ঐশ্চর্যের লোভে তোকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে বিয়ে করতে চায়, তা কি আমি বুঝতে পারিনি মনে করেছিস? সে একটা অর্থলোভী পিশাচিনী।
আর সেই অর্থলোভী পিশাচিনীর কবল থেকে আমাকে রক্ষা করার জন্য আপনিই তাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তাই না?
যদি তাই তোর মনে হয়, তা হলে তাই।
কিন্তু আমি যে তাকে ছাড়া বিয়েই করব না। সেজন্য পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে তাকে খুঁজে বের করব।
তা হলে তুইও শুনে রাখ, নিলীমাকে বিয়ে করলে আমার সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবি। শুধু যে ব্যবসাটা তোর দাদু তোর বাবাকে দিয়ে গেছে, সেটা ছাড়া অন্যান্য ব্যবসা ব্যাংকের সমস্ত টাকা ও জমি-জায়গা, ঘর-বাড়ি থেকেও বঞ্চিত হবি। আর…
হাবিব দাদিমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, শুধু আপনার সমস্ত ঐশ্বর্য নয়, সারা পৃথিবীর ঐশ্বর্যের বদলে আমি নিলীমাকে পেতে চাই। কথা শেষ করে নিচে নেমে এসে গাড়ি নিয়ে ঢাকা চলে গেল।
পরের দিন সকালে রাইসা চাঁদনী বেগমকে ফোন করে জানতে চাইল হাবিব এসেছে কি না।
চাঁদনী বেগম বললেন, এসেছিল। নিলীমা চলে গেছে জেনে আমাকে সন্দেহ করেছে, আমি নাকি তাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি। শেষে যখন তোমাদের বিয়ের কথা বললাম তখন সাফ জানিয়ে দিল, এখন সে বিয়ে করবে না। আরও জানাল, আমি যেন তোমার মা বাবাকে কথাটা জানিয়ে বলে দিই, “তারা যেন তাদের মেয়ের বিয়ে অন্য ছেলের সঙ্গে দেয়ার ব্যবস্থা করে।”
রাইসা বলল, আপনি নিলীমাকে তাড়িয়ে খুব ভুল করেছেন। বিয়ের পর আমিই বুদ্ধি করে তাড়িয়ে দিতাম। যাই হোক, আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি ঢাকায় হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া করব। আপনি ঢাকার ঠিকানা দিন।
কিন্তু ও তো ঢাকায় নেই। অফিসে ও বাসায় ফোন করেছিলাম, কোথায় গেছে কেউ জানে না।
তাই নাকি? তা হলে তো খুব চিন্তার কথা।
চিন্তা করার কিছু নেই, ও আগেও এরকম কয়েকবার করেছে। রাগ পড়ে যেতে ফিরে এসেছে।
ও ফিরলে অবশ্যই জানাবেন।
তাতো জানাব। তারপর এখন রাখছি বলে লাইন কেটে দিলেন চাঁদনী বেগম।
হাবিব জানে অফিসে ও বাসায় দাদিমা বারবার ফোন করে ডেকে পাঠাবেন। তাই একটা হোটেলে উঠে ঢাকার রাস্তায়, অলিতে-গলিতে ও সমস্ত হাসপাতাল ও ক্লিনীকে খোঁজ করল; কিন্তু নিলীমাকে পেল না। একদিন ম্যানেজারকে ফোন করে ডেকে পাঠাল। ম্যানেজার আসার পর বলল, বিশেষ কারণে আমি আরও কিছুদিন অফিসে ও বাসায় আসব না। আপনি সবকিছু সামলাবেন। যে কেউ আমার খোঁজ করলে বলবেন, আমি ঢাকার বাইরে গেছি, কবে ফিরব বলে যায় নি।
ম্যানেজার বললেন, ঠিক আছে স্যার, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
প্রায় মাস খানেক হাবিব হোটেলে থেকে নিলীমাকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ও ঢাকার বাইরে অনেক খোঁজা খুঁজি করল। এমন কি নরসিংদিতে তার মামা সেকেন্দারের বাড়িতেও খোঁজ করল। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পেল না। শুধু মাগুরার এতিমখানায় খোঁজ নিতে বাকি রইল। তার বিশ্বাস ছিল, ওখানে নিলীমা গেলে জ্যোৎস্না ম্যাডাম নিশ্চয় তাকে ফোন করে জানাবে। তাই যাই যাই করেও যায় নি।
প্রায় মাস দুই পর হাবিব নিয়মিত অফিস করছে। প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে গিয়ে অহনাকে সঙ্গ দিচ্ছে। প্রথম যেদিন বাড়িতে গেল, সেদিন অহনা বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদল। তারপর বলল, ম্যাডামকে খুঁজে পাওনি?
হাবিব বলল, না। তবে ইনশাআল্লাহ একদিন না একদিন খুঁজে পাব।
অহনা বলল, খুঁজে পেলে এখানে নিয়ে আসবে তো?
তা তো আনবই।
তুমি কিন্তু প্রতি সপ্তাহে আসবে।
ঠিক আছে আসব।
প্রমিস?
প্রমিস। তারপর হাবিব বলল, তোর ম্যাডামকে যদি পারমানেন্ট রাখার ব্যবস্থা করি, তা হলে কেমন হয়?
অহনা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, তা হলে তো খুব ভালো হয়। কিন্তু তুমি তো বলেছিলে আমি বড় হয়ে গেলে উনি চলে যাবেন? তা হলে কি করে পারমানেন্ট রাখবে?
ওনাকে আমি বিয়ে করব বলে হাবিব মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তার মনোভাব বোঝার জন্য।
অহনা কিছুক্ষণ চুপ করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে উৎফুল্ল কণ্ঠেই বলল, সত্যি বলছ বাবা?
হ্যাঁরে, সত্যি। তুই তাকে মা বলে ডাকবি তো?
কেন ডাকব না? নিশ্চয় ডাকব।
হাবিব মনে করেছিল, কথাটা শুনে অহনা খুব অসন্তুষ্ট হবে। তাই তার কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, নামায পড়ে আল্লাহকে জানাবি তাকে যেন খুঁজে পাই।
অহনা বলল, নিশ্চয় করব বাবা। আমার মন বলছে, ম্যাডামকে তুমি একদিন খুঁজে পাবেই।
হাবিব বলল, আল্লাহ তোর মনের ইচ্ছা পূরণ করুক।
একদিন চাঁদনী বেগম হাবিবকে বললেন, তোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে আলাউদ্দিন মেয়েকে নিয়ে কানাডা ফিরে গেল। তুই কি বিয়ে করবি না?
হাবিব বলল, নিলীমাকে যদি খুঁজে পাই, তবে তাকেই বিয়ে করব, নচেৎ করব না। চাঁদনী বেগম চিন্তা করেছেন, নিলীমা যখন ঢাকায় হাবিবের সঙ্গে দেখা করে নি তখন নিশ্চয় এমন কোথাও আত্মগোপন করে আছে, যেখানে হাবিব তাকে কখনও খুঁজে পাবে না। আরও কিছুদিন যাক, নিলীমার কথা ভুলে গেলে তখন বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন। তাই এখন নাতির কথা শুনে আর কিছু বললেন না।
আরও প্রায় মাস খানেক পর একদিন বাড়ি থেকে হাবিব অফিসে আসার পর ম্যানেজার তাকে বললেন, কিছুক্ষণ আগে মাগুরার এক এতিমখানা থেকে এক ভদ্র মহিলা ফোন করে আপনাকে চাচ্ছিলেন। আপনার সঙ্গে নাকি খুব জরুরি আলাপ আছে।
কথাটা শুনে হাবিবের বুক ধক করে উঠল। ভাবল, এতদিন পর নিশ্চয় নিলীমা ওখানে গিয়ে উঠেছে। জিজ্ঞেস করল, ওনার ফোন নাম্বার রেখেছেন?
জি বলে ম্যানেজার একটা কাগজ দিয়ে বললেন, এতে লেখা আছে।
ঠিক আছে, আপনি এখন আসুন। ম্যানেজার চলে যাওয়ার পর হাবিব ফোন করল।
জ্যোৎস্না ম্যাডাম ফোন ধরে বললেন, কাকে চান? হাবিব বলল, আমি এতিমখানার তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওনাকে একটু দিন তো?
বলছি।
হাবিব সালাম বিনিময় করে পরিচয় দিয়ে বলল, কিছুক্ষণ আগে আমার অফিসে ফোন করে আমাকে চেয়েছিলেন কেন?
বিশেষ জরুরী আলাপ আছে, যা ফোনে বলা যাবে না। সময় করে একদিন আসুন।
হাবিবের ধারণাটা দৃঢ় হল। বলল, ঠিক আছে, আগামী কাল আসছি।
পরের দিন হাবিব এতিমখানায় গিয়ে জ্যোৎস্না ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করল।
আপ্যায়ন করানোর সময় জ্যোৎস্না ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, নিলীমা কেমন আছে?
হাবিব বুঝতে পারল, নিলীমা এখানে আসে নি। হতাশ গলায় বলল, উনি আমার দাদিমার উপর রাগ করে প্রায় মাস তিনেক আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছেন। অনেক খোঁজ করেও পাইনি। ম্যানেজারের কাছে আপনার ফোন করার কথা শুনে ভেবেছিলাম, এখানে এসেছেন। অন্য কোথাও যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা বলতে পারেন?
কথাটা শুনে জ্যোৎস্না ম্যাডামের মন খারাপ হয়ে গেল। বললেন, এখানে ছাড়া ওর যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। তবে যে মামা মামি ওকে ছেলেবেলায় লালন পালন করেছিলেন, সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
সেখানে প্রথমেই খোঁজ নিয়েছিলাম, যায়নি।
জ্যোৎস্না ম্যাডাম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তা হলে তো খুব চিন্তার কথা। এতিমখানা ছাড়া কখনও কোথাও যায় নি। আজকাল দেশের যে অবস্থা কোনো খারাপ লোকের পাল্লায় পড়লে মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।
হাবিব বলল, ওনাকে যতটুকু জানি, নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা ওনার আছে।
জ্যোৎস্না ম্যাডাম বললেন, সে কথা আমিও জানি। দোয়া করি, আল্লাহ ওকে হেফাজত করুন। তারপর আবার বললেন, আপনাকে কেন ডেকেছি শুনুন, কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে একজন উকিল নিলীমার খোঁজে এসেছিলেন। কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করতে একটা চিঠির ফটোস্টেট কপি দিয়ে বললেন, এটা পড়লেই জানতে পারবেন। তারপর জ্যোৎস্না বেগম ড্রয়ার টেনে চিঠিটা বের করে হাবিবের হাতে দিলেন।
হাবিব চিঠি পড়তে শুরু করল,
“সামসুদ্দিন চৌধুরী গাজীপুর জেলার কাঁপাসিয়া গ্রামের ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। ওনার স্ত্রী আসমা হুমায়রা ওরফে চাঁদনী বেগমও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে ওনাদের একমাত্র সন্তান সালমা তাহেরা ওরফে সালমা ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সময় এক সাধারণ পরিবারের মোল্লা টাইপ ছেলে মিরাজের প্রেমে পড়ে। পড়াশোনা শেষ করে সালমা বাড়ির সবার অমতে মিরাজকে বিয়ে করে। সামসুদ্দিন চৌধুরী এই বিয়ে মেনে নিতে পারলেন না। বললেন, হয় তুমি ডিভোর্স নাও, নচেৎ এ বাড়িতে তোমার জায়গা হবে না। শুধু তাই নয় আমার সমস্ত সম্পত্তি থেকে তুমি বঞ্চিত হবে।
সালমা ডিভোর্স নিতে রাজি না হয়ে মিরাজের সঙ্গে ঢাকা চলে আসে। অনেক চেষ্টা করেও যখন তারা চাকরি পেল না তখন মিরাজের বন্ধু সেকেন্দারের সাহায্যে কোচিং সেন্টার খুলে। তাতে তাদের বেশ ভালোভাবেই দিন কাটছিল। তিন বছরের মাথায় তাদের একটা মেয়ে হয়। তারা মেয়ের নাম রাখে নিলীমা। নিলীমার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন কিছুদিন অন্তর টায়ফায়েডে সালমা ও মিরাজ মারা যায়। সেকেন্দার নিলীমাকে লালন পালন করেন। উনি মারা যাওয়ার পর ওনার স্ত্রী নিলীমাকে মাগুরার এক এতিমখানায় পাঠিয়ে দেন।
সামসুদ্দিন চৌধুরী মেয়ে, জামাই ও নাতনির কোনো খবর জানতে পারেন নি। একমাত্র সন্তান থেকেও নেই সে কথা চিন্তা করে ওনার শরীর দিন দিন ভেঙ্গে পড়তে লাগল। স্ত্রীর পরামর্শে ব্যবসা ও সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য শালার এক ছেলে ফয়সালকে রেখে সবকিছুর দায়িত্ব তার উপর দেন। এর দু’বছর পর চৌধুরী সাহেব মারা যান। মারা যাওয়ার আগে স্ত্রীর অগোচরে এক উকিলের দ্বারা মেয়ে সালমার নামে অর্ধেক আর বাকি অর্ধেক স্ত্রী ও ফয়সালের নামে উইল করে দেন। এবং উনি মারা যাওয়ার পর সালমাকে খুঁজে বের করে উইলটা দিতে নির্দেশ দেন উকিলকে। আরও নির্দেশ দেন, সালমা যেন তার বাবাকে ক্ষমা করে দেয়।
চিঠি পড়ে হাবিব অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার চিঠির দিকে আর একবার জ্যোৎস্না ম্যাডামের দিকে তাকাতে লাগল। তখন তার মনে আনন্দের বান ডাকতে শুরু করেছে।
তার অবস্থা দেখে জোৎস্না ম্যাডাম অবাক না হয়ে পারলেন না। বললেন, কি ব্যাপার চিঠি পড়ে একবার আমার দিকে আর একবার চিঠির দিকে তাকাচ্ছেন কেন?
হাবিব এতক্ষণ বাস্তবে ছিল না। ওনার কথায় স্বম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, খুব অবিশ্বাস্য কথা চিঠিতে লেখা রয়েছে।
বুঝলাম না।
বুঝবেন কি করে? আপনি তো নিলীমার আসল পরিচয় জানেন না?
আপনি জানেন?
আগে জানতাম না, চিঠি পড়ে জানতে পারলাম, তাই তো বিশ্বাস করতে পারছি না।
ওর আসল পরিচয় বলুন তো শুনি।
নিলীমা আমার ফুপাতো বোন।
এবার জ্যোত্সা ম্যাডামও খুব অবাক হয়ে বললেন, কি বলছেন আপনি? সত্যিই কি তাই?
জি, সত্যি। নিলীমা তার নানির কাছে চাকরি করে মামাত ভাই-এর মেয়েকে পড়িয়েছে।
খুব আশ্চর্যজনক ঘটনা, নানি হয়ে নাতনিকে চিনতে পারলেন না?
চিনবেন কি করে? উনি তো নাতনিকে কখনও দেখেন নি।
দুঃখিত, কথাটা আমার স্মরণ ছিল না। যাই হোক, ছোটবেলা থেকে মেয়েটা খুব কষ্টে মানুষ হয়েছে। এবার আল্লাহ ওকে সুখী করুক এই দোয়া করি।
হাবিব বলল, কিন্তু ওকে পাব কোথায় বলতে পারেন?
জ্যোৎস্না ম্যাডাম বললেন, আমি বলব কেমন করে? আপনি ওকে খুঁজে বের করে উকিল সাহেবের কাছে নিয়ে যাবেন। তারপর একটা কাগজ দিয়ে বললেন, এতে ওনার ঠিকানা আছে।
ঠিকানার উপর একবার চোখ বুলিয়ে হাবিব বলল, উকিল সাহেব চিঠিতে যা, কিছু লিখেছেন, সেসব উনি জানলেন কি করে?
জ্যোৎস্না ম্যাডাম বললেন, তা আমি জানবো কেমন করে? আপনি ওনাকেই জিজ্ঞেস করবেন। শুনুন, নিলীমার খোঁজ পেলে অবশ্যই ফোন করে জানাবেন।
তাতো জানাবই। আর একটা কথা আপনাকে না জানিয়ে পারছি না। নিলীমা ও আমি একে অপরকে শুধু যে ভীষণ ভালবাসি তাই নয়, বিয়ে করার জন্যও প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। তাই ওকে হন্যি হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
শুনে খুব খুশি হলাম। মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। দোয়া করি, আল্লাহ তাড়াতাড়ি আপনাদের ইচ্ছা পূরণ করুক।
হাবিব অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে ঢাকা ফিরে এল।
পরেরদিন সকাল আটটায় হাবিব ঠিকানামতো উকিল সাহেবের বাসায় গিয়ে গেট বন্ধ দেখে কলিং বেল বাজাল।
উকিল সাহেব কাজের ছেলেকে নিয়ে বাজারে গেছেন। রিডিংরুমে নিলীমা ওনার তিন নাতি নাতনিকে পড়াচ্ছিল। সে উকিল সাহেবকে দাদু ও ওনার স্ত্রীকে দাদি বলে ডাকে। কলিংবেল বেজে উঠতে বলল, মনে হয় দাদু বাজার থেকে ফিরেছেন। তোমরা পড়, আমি গেট খুলে দিচ্ছি। তারপর সেখান থেকে এসে গেট খুলে হাবিবকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে মাথার কাপড় টেনে ঘোমটা দিয়ে মুখ নিচু করে বলল, কে আপনি? কাকে চান?
নিলীমাকে দেখে হাবিবও ভীষণ অবাক হয়েছে। তার কথা শুনে থতমত খেয়ে বলল, নিলীমা, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি অহনার বাবা। জান নিলীমা, আজ তিন মাস তোমাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি। দাদিমা তোমাকে তাড়িয়ে দেয়ার যে অজুহাত দেখিয়েছেন, তা একবিন্দু বিশ্বাস করি নি। তুমি তো আমার ঢাকার ঠিকানা জানতে, তবু কেন আমার কাছে এলে না? এতদিন আমাকে কষ্ট দিতে পারলে?
হাবিবকে দেখে ও তার কথা শুনে নিলীমা খুব দুর্বল হয়ে পড়লেও চাঁদনী বেগম যেসব কথা বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেসব কথা ভেবে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ভদ্রভাবে কথা বলুন। আপনি ভুল করছেন। আমি নিলীমা নই, রাবেয়া। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি কি উকিল দাদুর কাছে এসেছেন?
হাবিব নিলীমাকে মাত্র এক নজর দেখেছে। তারপরেই সে ঘোমটা টেনে মুখ নিচু করে রয়েছে। তাকে দ্বিতীয়বার আর দেখার সুযোগ পায় নি। তাই তার কথা শুনে ভেবাচেখা খেয়ে চিন্তা করল, সত্যিই কি আমি ভুল করছি? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? এত কাছ থেকে তাকে চিনতে পারব না কেন? তা ছাড়া গলার স্বরও নিলীমার মতো।
তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে নিলীমা একটু রাগতস্বরে বলল, কিছু বলছেন না কেন?
হাবিব বলল, হ্যাঁ, উকিল সাহেবের কাছে এসেছি। কিন্তু তুমি আমাকে না চেনার ভান করছ কেন? প্লীজ, একবার মুখ তুলে আমার দিকে তাকাও।
রাগতস্বরেই নিলীমা বলল, জানেন না, ইসলামে বয়স্ক ছেলে মেয়েদের একে অপরকে একবার দেখা জায়েজ থাকলেও দ্বিতীয়বার দেখা জায়েজ নেই।; এমন সময় উকিল দাদুকে বাজার করে ফিরে আসতে দেখে আবার বলল, ঐতো দাদু এসে গেছেন। আপনি ওনার সঙ্গে কথা বলুন বলে নিলীমা ভিতরে চলে গেল। উকিল সাহেব কাছে এসে একজন সুদর্শন ছেলেকে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি?
আমি হাবিব। তারপর সালাম বিনিময় করে বলল, আপনার কাছে এসেছি।
আসুন ভিতরে আসুন বলে হাবিবকে ড্রইংরুমে নিয়ে এসে উকিল সাহেব বললেন, একটু বসুন। এগুলো রেখে আসছি।
পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এসে একটা চেয়ারে বসে বললেন, কেন এসেছেন বলুন।
হাবিব নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি নিলীমার খোঁজে মাগুরার এতিমখানায় গতকাল গিয়েছিলাম। ওখানকার প্রিন্সিপ্যাল আমাকে একটা চিঠি ও আপনার ঠিকানা দিয়েছেন। এখানে এসে…
উকিল সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি নিলীমার খোঁজ করছেন কেন? আর আমার কাছেই বা এসেছেন কেন?
হাবিব বুক পকেট থেকে চিঠিটা বের করে ওনার হাতে দিয়ে বলল, এর লেখা সত্য হলে নিলীমা আমার ফুপাতো বোন।
উকিল সাহেব ভ্রু কুঁচকে হাবিবের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তা হলে আপনি কাঁপাসিয়ার মরহুম সামসুদ্দিন চৌধুরীর পালক ছেলের ঘরের নাতি, তাই না?
জি, আপনি ঠিক বলেছেন।
তাই আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। চৌধুরী বাড়িতে আপনাকে দেখেছি। তারপর কাজের ছেলেটাকে ডেকে হাবিবের জন্য চা-নাস্তা নিয়ে আসতে বললেন।
হাবিব বলল, ওসব পরে হবে, আগে কাজের কথা হোক। এখন বলুন চিঠির লেখাগুলো সত্য কি না।
এক বর্নও মিথ্যে নয়, সব সত্য।
নিলীমাকে খুঁজে পেয়েছেন?
না।
হাবিব অবাক হয়ে বলল, এ কথাটা কিন্তু মিথ্যে বললেন।
উকিল সাহেব রেগে গেলেও সংযত কণ্ঠে বললেন, আমি কয়েক বছর গাজীপুর কোর্টে ওকালতি করেছি। তখন আমি ব্যাচেলার। বয়সের অনেক তফাৎ থাকলেও সে সময় চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আমার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক ছিল। সেই হিসাবে আপনি আমারও নাতি। নাতি হয়ে দাদুকে মিথ্যাবাদী বলা নিশ্চয় বেয়াদবী।
জি, বেয়াদবী। তবু বলব, আমি সিওর, নিলীমাকে পাওয়ার ব্যাপারে যা বলেছেন, তা সত্য নয়। আর আমাকে যদি নাতি মনে করে থাকেন, তা হলে আপনি করে না বলে তুমি করে বলুন।
তা না হয় বলব; কিন্তু নিলীমার ব্যাপারে যা বললে, প্রমাণ করতে পারবে?
নিশ্চয়। কিছুক্ষণ আগে যে মেয়েটা গেট খুলে দিল, সে নিলীমা।
এবার উকিল সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কি বলছ তুমি?
যা সত্য তাই বলছি।
কিন্তু ওতো আমার নাতনি রাবেয়া।
নিশ্চয় আপনার আপন নাতনি নয়?
এ কথা বলছ কেন?
কেন বলছি পরে জানতে পারবেন। এখন আমার কথার উত্তর দিন।
না, আপন নাতনি নয়।
তা হলে কেমন নাতনি?
উকিল সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, সে কথা শোনার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
বলুন, কি জানতে চান।
নিলীমার সঙ্গে নিশ্চয় পরিচয় আছে?
আছে।
কতদিন থেকে?
প্রায় দু’বছর হবে।
কি ভাবে?
নিলীমা আমার মেয়ে অহনার দেড় বছর গভর্নেস ছিল। মাস তিনেক আগে আমার অগোচরে দাদিমা ওকে বরখাস্ত করেন। অবশ্য তখন আমরা কেউ-ই ওর আসল পরিচয় জানতাম না। গতকাল এই চিঠি পড়ে আমি জানলেও দাদিমা এখনও জানেন না। এই তিন মাস ওকে অনেক খুঁজেছি।
কেন বল তো?
আমি বিপত্নীক। দাদিমা আমার আবার বিয়ে দেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করছেন; কিন্তু আমি রাজি হইনি। তারপর নিলীমা যখন অহনার গভর্নের্স হয়ে আমাদের বাড়িতে এল তখন তাকে দেখে ও তার আচার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ভালোবেসে ফেলি। নিলীমাও আমাকে ভালোবেসে ফেলে। তাই তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। গতকাল মাগুরার এতিমখানার প্রিন্সিপালের ফোন পেয়ে ওনার কাছে গেলাম। উনি আমাকে এই চিঠি পড়তে দিলেন। চিঠি পড়ে নিলীমার আসল পরিচয় জানতে পেরে উইলের ব্যাপারটা সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্য আপনার কাছে এসেছি। এখানে এসেই নিলীমাকে দেখব কল্পনাও করিনি।
তোমাকে দেখে নিলীমা কি বলল বা কি করল?
নিলীমা যা বলেছিল বা করেছিল, হাবিব বলল।
তুমি তো আমাকে বিভ্রান্তে ফেলে দিচ্ছ। তোমরা যদি একে অপরকে ভালোবেসে থাক, তা হলে নিলীমা এরকম করল কেন?
তার আগে আপনি বলুন ওকে পেলেন কি করে?
উকিল সাহেব সেই দুর্যোগপূর্ণ রাতের কথা বললেন।
তা হলে আপনার রাবেয়া নাতনি যে নিলীমা তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন?
হ্যাঁ, পেরেছি। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
দাদিমা আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে রাইসাকে নাতবৌ করতে চান। আমি রাজি না হয়ে নিলীমার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা বলে তাকেই বিয়ে করার কথা বলি। ও এতিমখানার পিতৃ-মাতৃ পরিচয়হীন মেয়ে বলে দাদিমা রেগে গিয়ে আমাকে অনেক গ্রেটিং দেন। এমন কি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করারও ভয় দেখান। তবু আমি ওনার কথা মেনে নিইনি। আমার বিশ্বাস, আমি যখন ঢাকায় ছিলাম তখন দাদিমা নিলীমাকে তাড়িয়ে দেন। সেই সময় তিনি আমাকে যে সব কথা বলে গ্রেটিং দিয়েছিলেন, ওকে ও সেইসব বলে ভয় দেখিয়েছিলেন। তাই আমাকে না চেনার ভান করছে।
উকিল সাহেবের মনে হল, হাবিব সত্য কথা বলছে। তবু সিওর হওয়ার জন্য কাজের ছেলেকে ডেকে বললেন, রাবেয়াকে এখানে আসতে বল।
এতক্ষণ নিলীমা দরজার আড়াল থেকে হাবিব ও উকিল দাদুর কথা শুনছিল। কাজের ছেলে বেরিয়ে এলে তাকে ইশারা করে চলে যেতে বলল। তারপর একটু সময় নিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, আমাকে ডেকেছেন দাদু?
উকিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, একে তুমি চেনো?
নিলীমা সত্য মিথ্যা কোনোটাই বলতে না পেরে মুখ নিচু করে রইল।
অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে উকিল সাহেব আবার বললেন, বল দাদু। একে তুমি চেনো?
নিলীমা একইভাবে চুপ করে রইল।
তুমি ইসলামের অনেক কিছু জান। আর এটা জান না, মেয়েদের চুপ থাকাটাই সম্মতির লক্ষণ?
তবু যখন নিলীমা কিছু বলল না তখন চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বললেন, এটা পড়।
চিঠি পড়ে নিলীমা যেন আকাশ থেকে পড়ল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এসব আপনি জানলেন কেমন করে?
কেমন করে জানলাম, সে কথা তোমার জানার দরকার নেই। হাবিবও জিজ্ঞেস করেছিল। তাকেও ঐ একই কথা বলেছি। এখন তা হলে স্বীকার করছ তুমিই নিলীমা?
নিলীমা মুখ নিচু করে মাথা নেড়ে সায় দিল।
আমার কাছে নাম গোপন করেছিলে কেন?
নিলীমা কিছু বলার আগে হাবিব বলল, আমার কারণে গোপন করেছেন।
তোমার কারণে কেন?
সে কথা পরে বলব। তার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
কি কাজ?
দাদুর বন্ধু হিসাবে আমরা আপনার নাতি ও নাতনি। তাই গার্জেন হিসাবে আজই আমাদের বিয়ের কাজটা মিটিয়ে দেবেন। তারপর উইলসহ আমাদেরকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দাদিমার হাতে তুলে দেবেন। অবশ্য এজন্য আপনি দ্বীগুন পারিশ্রমিক পাবেন।
পারিশ্রমিকের কথা বলা তোমার উচিত হয় নি। দাদু হিসাবে ও চৌধুরী সাহেব যে দায়িত্ব আমার উপর দিয়েছিলেন, তা সমাধান করে সেই দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়াটাই আমার বড় পাওয়া। তারপর নিলীমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হাবিবের কথা তো শুনলে, এবার তোমার মতামত বল। কারণ বিয়ের ব্যাপারে ছেলেমেয়ে উভয়ের মতামত নেয়া একান্ত কর্তব্য।
নিলীমা এতক্ষণ নিজের সৌভাগ্যের কথা মনে করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিল। উকিল দাদুর কথা শুনে চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, বর্তমানে আপনি আমার গার্জেন। গার্জেনদের কথা ছোটদের মেনে নেয়া উচিত। তাই আপনি যা বলবেন বা করবেন তা মেনে নেব। তবে। উইল আমি নেব না। ওটা নানিমাকে দেবেন। আল্লাহর কাছে আমি যা কামনা করেছি, তা তিনি দিচ্ছেন। এর বেশি আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। আপনার আশ্রয় না পেলে আমি আজ কোথায় থাকতাম, কি করতাম জানি না। আপনাদের ঋণ কোনো কিছুর বিনিময়ে শোধ করতে পারব না। শুধু দোয়া করব, “আল্লাহ যেন আপনাদেরকে দোজাহানে সুখী করেন।” আর আপনারাও দোয়া করবেন, “আল্লাহ যেন আমাদেরকে দোজাহানে সুখী করেন।”
কিছুক্ষণ আগে উকিল সাহেবের স্ত্রী আরিফা বেগম এসে সবকিছু শুনে খুব অবাক হয়েছেন। নিলীমা থেমে যেতে বললেন, আমিন। সেই সাথে অন্যরাও বলে উঠলেন, আমিন।
Leave a Reply