নির্বাচিত ভূতের গল্প – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত
প্রসঙ্গ: নির্বাচিত ভূতের গল্প
ভূত মানেই অতীত। আমরা যার মধ্যে আছি, তা বর্তমান। যে গেছে তার জন্যে মানুষের মধ্যে একটা টান জেগে থাকে। সেই অতীতের ধূসরতার সঙ্গে বর্তমানের যোগ ঘটিয়ে দেয় ভূতের গল্প। এই গল্পের কাজ-কারবার অতীত আর বর্তমান নিয়ে। এই গল্পের কিছুটা ঝাপসা, গোটাটাই রহস্য আর তার আমেজ সম্পূর্ণ ভয়ের। এই আবছায়া রহস্যে ঢাকা ভয়ের টান বড় টান, যা শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলকেই প্রবলভাবে টানে। শিশুরা রূপকথার পরেই যা শুনতে চায়, তা হল ভূতের গল্প আর বহু পণ্ডিত ব্যক্তির শিয়রের পাশে রাখা বইটি হয় ভূতের গল্পের, নয় কোন রহস্যের। দুনিয়ায় হেন লেখক বোধ হয় নেই যিনি জীবনে চূড়ান্ত অবিশ্বাসী হলেও অন্তত একটি ভূতের গল্পও লেখেননি। বিদেশী লেখকদের নাহয় বাদই দিলাম, ভারতীয় পরম্পরাগত শিল্পের সর্বেক্ষণ যিনি করেছিলেন, সেই সরকারী অফিসার ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন ভূতের গল্প। বঙ্কিমচন্দ্রও তাঁর মননশীল প্রবন্ধ ও গুরুগম্ভীর উপন্যাসের ফাঁকে ভূতের গল্পে হাত দিয়েছিলেন। যে রবীন্দ্রনাথের দর্শন নিয়ে রাধাকৃষ্ণণ বই লিখেছিলেন, তিনিও এই ক্ষেত্রে তাঁর দান রেখে গেছেন। এই পণ্ডিতদের দিয়ে আমাদের একালের ভূতের গল্পের যাত্রা শুরু। আর, চলচ্চিত্রে নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য অস্কার অর্জনকারী সদ্যপ্রয়াত সত্যজিৎ রায় তো এ সময়ে ভূতের গল্পের অন্যতম বিশিষ্ট লেখক ছিলেন। সুতরাং ভূতের গল্পকে আমরা কিছুতেই খাটো করে দেখতে পারি না। বাংলা সাহিত্যে বহু পথিকৃৎ লেখকের কলমের দাবীতে ভূতের গল্প তার অনন্য আসনটি বিছিয়েছে। আর তাই ভূতের গল্পের একটি সার্বাঙ্গীন সংকলন যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা কে অস্বীকার কবেন? আমাদের এই উদ্যম বাংলা সাহিত্যের এই বিশেষ ক্ষেত্রে একটি মূল্যবান সংযোজন হিসেবে গৃহীত হবার দাবী আপনা থেকেই রাখে। আমরা এই সংকলনে নিছক ছোটদের জন্যে লেখা কেবল শিরশিরানি-জাগানো গল্পের বদলে বয়স্ক পাঠকদের জন্যে লেখা গল্পগুলিই গ্রন্থিত করেছি। এই গল্পগুলির মধ্যে প্রতিটি লেখকের শৈলী ও ভাষার বিশিষ্টতা পাঠক অবশ্যই লক্ষ্য করবেন। ভূতের গল্প বাংলা সাহিত্যে যে আদৌ অনাদরের যোগ্য নয়, এই সংকলনে আমরা এ-কথাটি নতুন করে মনে করিয়ে দিতে চাই।
ভূতের গল্পের মধ্যেও পাঠক তিনটি স্পষ্ট শ্রেণীবিভাগ লক্ষ্য করবেন। সংকলিত গল্পের কয়েকটি বিশুদ্ধ ভূতের গল্প, কয়েকটি অতিলৌকিক যা ইংরেজীতে সুপার ন্যাচারাল আর কয়েকটি গল্প ইংরেজী হরর স্টোরির পর্যায়ে পড়ে। অর্থাৎ যে বৈচিত্র্য নিয়ে বাংলা ভূতের গল্পের পরম্পরা। যুগ বদলায়, মানুষ বদলায়, কিন্তু ভূতের গল্প পুরোন হয় না। এই গল্পের টানেই মানুষ তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে। একেবারে হাল সময়ের লেখকরাও যে ভূতের গল্প লিখতে কতখানি তৎপর, তা বলে দিতে হয় না। এই সংকলন ভূতের গল্পের ভিতর দিয়ে প্রায় একশো বছরের লেখকদের মধ্যে সেতু তৈরি করেছে বলা যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় একশো বছরের বিশিষ্ট ভূতের গল্পগুলি একসঙ্গে তুলে ধরার এই প্রয়োজন ছিল বলে আমরা মনে করি।
গ্রন্থভুক্ত প্রতিটি গল্পই লেখকের কিংবা তাঁর স্বত্বাধিকারীর অনুমতি নিয়ে ছাপা হয়েছে। যাঁদের সাহায্য ব্যতিরেকে এই সংকলন-কর্ম আরও দুরূহ হয়ে উঠত, বিবেকানন্দ রোডের ‘মদনমোহন লাইব্রেরী’ ও গোয়াবাগানের ‘দি বয়েজ ওন লাইব্রেরী’র কর্তৃপক্ষ তাঁদের অন্যতম। এই ব্যাপারে আরও যে দুজনের নাম অনুচ্চারিত থাকা উচিত নয়, তাঁরা হলেন শ্রীশুভ্রদীপ চট্টোপাধ্যায় ও শ্ৰীমতী বীথি চট্টোপাধ্যায়। গল্প সংগ্রহে ও প্রুফ সংশোধনে তাঁদের ঋণ অপরিশোধ্য।
রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়
Leave a Reply