নির্বাচিত প্রবন্ধ – আবুল ফজল
নির্বাচিত প্রবন্ধ – আবুল ফজল
সম্পাদনা – মাহবুবুল হক / সময় প্রকাশন / প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ২০০১
ফ্লাপের লেখা
আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) অধ্যাপনা ও সাহিত্যসাধনার পাশাপাশি সমাজবিকাশের কাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। সৃজনশীল সাহিত্যিক আবুল ফজল ক্রমশ প্রধানত মননশীল চিন্তাবিদের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। তার সৎ ও সাহসী বক্তব্য এই দ্বিধাগ্রস্ত সমাজমানসকে বারংবার আঘাত দিয়ে আলোড়িত করেছে। সকল অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনা, দুর্নীতি-চাতুরির বিরুদ্ধে তার সময়োচিত তীক্ষ্ণ লেখনি আবুল ফজলকে সমাজের যথার্থ অভিভাবক ও বিবেকের মর্যাদা দিয়েছে। প্রবন্ধ তার সাহিত্যকর্মের শীর্ষপ্রকাশ; চিন্তার সাহস ও প্রকাশের স্বচ্ছতার সাথে যুক্তি ও বিশ্লেষণের সমন্বয়ে তাঁর প্রবন্ধ পাঠকের আত্মোপলব্ধির ও উত্তরণের পথ সুগম করে তোলে। প্রথম জীবনে প্রধানত সমাজের বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে সংস্কারকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রবন্ধ লিখেছেন। মধ্যবয়সে সাহিত্যের নানা বিষয়ে মননশীল সব প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন আবুল ফজল। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংকট গভীরতর আর নিপীড়ন অত্যাচারের মুখেও বাঙালির জাগরণ অনিবার্য হয়ে ওঠার সাথে সাথে তিনি লিখতে শুরু করলেন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ও জাতির জন্য প্রয়োজনীয় সব বিষয় ‘মানবতন্ত্রের’ মতো বিখ্যাত সব নিবন্ধ। নির্বাচিত প্রবন্ধে মূলত সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র সম্পর্কে তার অজস্র লেখা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রবন্ধ বাছাই করে একটি গ্রন্থে সাজানো হয়েছে। আবুল ফজল এখনও কেবল সমকালীন নন অনেক ক্ষেত্রেই সময়ের চেয়েও এগিয়ে আছেন। তাই তার নির্বাচিত প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশ সময়েরই দাবি পূরণ মাত্র।
.
আবুল ফজল জন্মেছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের গোড়া মুসলিম পরিবারে, গত শতাব্দীর গোড়ায় ১৯০৩ সনে। তার পিতা আলেম হিসেবে খ্যতিমান ছিলেন, ১৮৯৯ থেকে ১৯২৯-এ মৃত্যু পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদের পেশ ইমামের দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বভাবতই মক্তব-মাদ্রাসা দিয়েই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। স্কুল-জীবনে প্রবল তারুণ্যের প্রতিভাবান কবি দিদারুল আলমের সান্নিধ্য আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেনের সান্নিধ্যে এবং শিখা-গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্তি তাকে বরাবর সংস্কারমুক্ত উদার যুক্তি নির্ভর মানবতাবাদের দিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছে। বুদ্ধির মুক্তি-আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত মানস ও যুক্তিবাদী মননশীলতার প্রতি তার অহঙ্কারকে পাকা করেছে। আবুল ফজল বরাবর সংস্কারকের মনোভাব নিয়ে লিখে গেছেন–প্রথম জীবনে প্রধানত ছোট গল্প ও উপন্যাস আর শেষবয়সে সৃজনশীল সাহিত্যের চেয়ে মননশীল প্রবন্ধের দিকে ঝুঁকেছেন।
স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে তার চাকুরি জীবন শুরু হয়, আর কলেজে অধ্যাপনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাষ্ট্রপতির শিক্ষা-উপদেষ্টার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। শিক্ষকতায় সফল তিনি, কিন্তু উপাচার্যের প্রশাসনিক দায়িত্বে তার সাফল্য বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।
আবুল ফজল তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক, রাষ্টীয় ও বেসরকারি পুরস্কার, পদক ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। তবে দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে সাধারণ মানুষের পক্ষে বলিষ্ঠ-সৎ-স্পষ্ট ভূমিকার জন্যে তিনি যে জাতির বিবেক অভিধা পেয়েছেন তা-ই হয়ত তাঁর অবদানের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি।
এই নিরহঙ্কার কিন্তু দৃঢ়চেতা, সবল এবং সৎ স্পষ্টভাষী তথাপি স্নিগ্ধ চরিত্রের অধিকারী এই লেখক বরাবর সমাজের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৮৩ সালে পরিণত বয়সে তাঁর মৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে।
.
সূচিপত্র
ভূমিকা : সম্পাদনা প্রসঙ্গে
প্রথম পর্ব : সাহিত্য
১. সাহিত্য ও শিল্পের উপেক্ষিত উপকরণ
২. সাহিত্যের সংকট
৩. সাহিত্যের ঐতিহ্য
৪. সমাজ ও সাহিত্যিক
৫. সাহিত্যে আধুনিকতা
৬. সাহিত্যের একটি সমস্যা
৭. আধুনিক মন : আধুনিক সাহিত্য
৮. সাহিত্যের ভূমিকা
৯. সাহিত্য ও সাহিত্যিক
১০. সাহিত্যে বিদ্রোহ
১১. সাহিত্য ও সাহিত্য-পুরস্কার
১২. সাহিত্যের উপকরণ
১৩. সমালোচনা
১৪. সাহিত্য ও সংস্কৃতি
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি
১৫. সংস্কৃতি
১৬. সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তা
১৭. সংস্কৃতি প্রসঙ্গে
১৮. বুদ্ধির মুক্তি
১৯. শিল্পীর স্বাধীনতা
২০. বনের বাঘ বনাম মনের বাঘ
২১. লেখকের স্বাধীনতা
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র
২২. মানবতন্ত্র
২৩. মানবকল্যাণ
২৪. ধর্ম ও রাষ্ট্র
২৫. সভ্যতার সংকট
২৬. ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রসঙ্গে
২৭. ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিণতি
২৮. রাষ্ট্র : সমাজ আর ছাত্র
২৯. ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপদ
৩০. শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা প্রায় নৈরাজ্যের সম্মুখীন
.
ভূমিকা
আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) বাংলাদেশের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী, চিন্তাশীল লেখক ও সাহসী প্রাবন্ধিক।
সাহিত্যের জগৎ এবং সমাজ-মানস থেকে ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, পশ্চাৎপদতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, ভেদবুদ্ধি ও অন্ধ গোঁড়ামির অনভিপ্রেত অপচ্ছায়া দূর করার জন্যে যারা বিগত শতাব্দীর সিংহভাগ জুড়ে আমাদের দেশে মানব-মুক্তি ও মানস-মুক্তির মুক্ত হাওয়া ছড়িয়ে দিয়েছেন সাহিত্য-শিল্পী আবুল ফজল ছিলেন তাঁদের অন্যতম পুরোধা।
১৯০৩ সালের ১ জুলাই (তার পিতার একটি ডায়েরি থেকে জানা যায়, তার সঠিক জন্ম তারিখ ১৭ জুলাই] দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার কেঁউচিয়া গ্রামে এক নিম্ন-মধ্য পরিবারে প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের জন্ম। তার বাবা মৌলভি ফজলুর রহমান ছিলেন আলেম এবং প্রায় তিন দশক ধরে চট্টগ্রাম জামে মসজিদের পেশা-ইমামের দায়িত্ব পালন কালেই ১৯২৯ সালে তার মৃত্যু হয়। মা গুলশান বেগম ছিলেন গৃহবধূ।
গ্রাম্য মক্তবে আবুল ফজলের পড়ালেখায় হাতেখড়ি। ১৯১৩-য় চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন। উচ্চ বিদ্যালয়-সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েক মাস পড়ার পর ধারাবাহিকভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি নিউ স্কিম মাদ্রাসায় (১৯১৪-১৯২২)। সেখান থেকে প্রবেশিকা (১৯২৩) এবং চট্টগ্রামের ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজ) থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার (১৯২৫) পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এ. ক্লাসে ভর্তি হন।
আলেম পরিবারে জন্ম এবং লেখাপড়ার ভিত্তি মাদ্রাসায় হলেও ছেলেবেলা থেকেই নানা বিষয়ে কৌতূহল ও সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ পারিবারিক পরিবেশের সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে মুক্ত-মানস গঠনে আবুল ফজলকে সহায়তা করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি বিখ্যাত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে (১৯২৬-১৯৩১) আকৃষ্ট হন এবং এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সে আন্দোলনের মূল কথা ছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ’কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই আন্দোলন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল সেদিনকার বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বিভ্রান্তির চোরাবালি থেকে উদ্ধার করে তাদের চৈতন্যে নবজাগরণের জোয়ার সৃষ্টি। চৈতন্যের পশ্চাৎপদতা, সংস্কারবদ্ধতা, ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডুকতার মত অবক্ষয়ী মূল্যবোধের স্বরূপ উন্মোচন করে এই আন্দোলন বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সঙ্কীর্ণতামুক্ত উদার মানবিকতা, মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িকতা, প্রগতিশীল চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উদ্বোধন ও বিকাশে প্রয়াসী হয়েছিল। এই আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হিসেবে আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮), কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩ ১৯৬৫) প্রমুখের সঙ্গে আবুল ফজলও উপলব্ধি করেছিলেন, কেবল ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল নয়, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সংস্কারাচ্ছন্নতা, সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবাদ ও সামাজিক অশিক্ষা কুশিক্ষার এক বিশাল অচলায়তনে বাঙালি মুসলমানের মানবিকতাবোধ ও সুস্থবুদ্ধি বন্দি হয়ে আছে। বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে না পারলে বিভ্রান্তির চোরাবালি থেকে তাদের উদ্ধার করা যাবে না। এভাবেই কিছু সংখ্যক তরুণ মুসলমান প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীর সাথে একত্রে আবুল ফজল আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মানস-আকাশে এক প্রগতিশীল ধারা রচনা করেছিলেন। এই আন্দোলনের মুখপত্র শিখা (১৯২৭-১৯৩১) গণমুখী সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সংগঠক ও অন্যতম রূপকার হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং শিখা পত্রিকারসম্পাদনা (১৯৩১) আবুল ফজলের মনোজাগতিক পালাবদলে পালন করেছিল অনুঘটকের ভূমিকা। এই আন্দোলনের চেতনার শিখাঁটিকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন।
আবুল ফজল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ ১৯৪১) এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে তিনি ‘The Philosophy of Art’ এবং ‘What is Art’ শিরোনামে দুটি বক্তৃতা দেন (৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৬)। আবুল ফজল কবির বক্তৃতা শুনে এবং ঘরোয়া আলাপে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়ে উদ্বুদ্ধ ও যারপরনাই প্রভাবিত হয়েছিলেন।
যতদূর জানা যায়, ছাপার অক্ষরে আবুল ফজলের প্রথম রচনা ‘একটি আরবী গল্প’। আরবি সাহিত্যের খ্যাতনামা লেখক আবু মোহাম্মদ আল কাসেম ইবনে আলী আল হাবিবী-র লেখা একটি গল্পের এই অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল কল্লোল পত্রিকার কার্তিক ১৩৩০ সংখ্যায়। তার প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ-–’হজরত মোহাম্মদের উদারতা’। এটি প্রকাশিত হয় প্রাচী পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩৩০ সংখ্যায়। তবে ভারতবর্ষ পত্রিকার মাঘ ১৩৩০ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বাহাই ধর্ম’ প্রবন্ধটি আবুল ফজলের লেখক জীবনের প্রথম দিকে লেখা উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। এসব প্রবন্ধ তিনি লেখেন ছাত্রাবস্থায়।
১৯২৭-২৮-এ লেখা হয় আবুল ফজলের প্রথম উপন্যাস চৌচির। ১৯২৮ সালে ঢাকা। থেকে প্রকাশিত শান্তি পত্রিকায় এই উপন্যাসের কিছু অংশ ছাপা হলেও পুরোটা ছাপা হয়। ১৯২৯-এ সওগাত পত্রিকায়। এ উপন্যাস পড়ে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ পত্রালাপে। ‘মুসলমান সমাজের সমস্যা’ ও ‘সমাজের অন্তরের দিক’ জানার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন (৬. ৯. ১৯৪০ সালে লেখা পত্রটি ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে)।
১৯২৮ সালে বি. এ. পাশ করার পর আবুল ফজল কলকাতায় যান আইন পড়তে। তবে আইন ব্যবসায়ে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় বলে বাবা বাদ সেধেছিলেন। আবুল ফজল এ যুক্তি মানতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত আইন পড়াও হয় নি। বাবার ইচ্ছাকেই মান্য করেছিলেন। অবশ্য আইন পড়তে যাওয়াটা তার একেবারে বিফলে যায় নি। কলকাতায় থাকা কালে তিনি মাসিক সওগাত পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। এই সূত্রে কলকাতার সাহিত্য-জগতের সঙ্গে আবুল ফজলের যে পরিচয় ঘটেছিল তাঁর সাহিত্যিক মানসগঠনে তার ভূমিকাও কম নয়। এখানেই তিনি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী (১৮৯৬-১৯৫৪), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৭-১৯৭৯), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮) প্রমুখ সমকালীন খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের সাহচর্যে আসেন। এই সময়ে সওগাত পত্রিকায় তার কয়েকটি লেখাও প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাবা ছিলেন বাংলা লেখার ঘোর বিরোধী। কীভাবে আবুল ফজল নাম ভাঁড়িয়ে বাবার রোষের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন তার বর্ণনা আছে তার আত্মচরিতমূলক গ্রন্থ রেখাচিত্রে (১৯৬৬)।
১৯২৯-এর জুলাইয়ে আবুল ফজল ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বি.টি পড়ার জন্যে ভর্তি হন। ১৯৩০-এ ছয় মাসের জন্য চাকরির সুযোগ পান ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের একটা অস্থায়ী পদে। পাশাপাশি তিনি আবার মুসলিম সাহিত্য সমাজের কর্মতৎপরতায় ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হন। ১৯৩০-এ পালন করেন ঐ সংগঠনের সম্পাদকের দায়িত্ব।
১৯৩১-এ আবুল ফজল বি.টি, পাশ করেন। ১৯৩২-এ চট্টগ্রামের কাজেম আলী স্কুলে অস্থায়ীভাবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ঐ বছরই সীতাকুণ্ড নিউ স্কিম মাদ্রাসায় হেডমাস্টার পদে যোগ দেন। এর পর থেকে দীর্ঘ জীবন তিনি নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৩-এ সরকারি চাকরিতে যোগ দেন খুলনা জেলা স্কুলে। ১৯৩৭-এ বদলি হয়ে এসে যোগ দেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে।
অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৯০-১৯৭৭) সঙ্গে যোগাযোগ করে আবুল ফজল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনিয়মিত প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৪০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ. পাশ করেন। এরপর ১৯৪১-এ কৃষ্ণনগর কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসেবে তার অধ্যাপনা জীবনের শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রাম কলেজে (১৯৪৩)। এখান থেকেই ১৯৫৯-এ তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।
তার অবসর গ্রহণ উপলক্ষে চট্টগ্রামের নাগরিকদের পক্ষ থেকে ড. মুহম্মদ এনামুল হকের (১৯০৬-১৯৮২) সভাপতিত্বে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয় (১৯৫৯)। ১৯৬২ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। ঐ বছরই ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে চট্টগ্রামে সাড়ম্বরে তার হীরক জয়ন্তী উদ্যাপিত হয়। ১৯৬৫-তে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি তাকে মুক্তবুদ্ধির চির সজাগ প্রহরী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৯৬৬-তে তিনি লাভ করেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার।
শিক্ষাবিদ হিসেবেও আবুল ফজল প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) অনুরোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বছর খানেক রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি থাকাকালে (১৯৭৬-১৯৭৭)। তবে রাষ্ট্রীয় আদর্শ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়ার কারণে মতান্তর হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করে ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। এখানেই সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োজিত থাকাকালে ৪ঠা মে ১৯৮৩ স্বগৃহ ‘সাহিত্য নিকেতনে’ প্রায় ৮০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
দুই
আবুল ফজল উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, অনুবাদ ও আত্মজীবনীমূলক রচনা মিলিয়ে প্রায় ৬০টি গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর পরিচয় তিন গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার। কিন্তু সৃজনশীল সাহিত্য-শিল্পী হিসেবে তাঁর যে পরিচিতি সে পরিচয় তার সব পরিচয় নয়। পেশাগত দিক থেকে এবং জাতীয় সমাজ-জীবনে ভূমিকা মিলিয়ে তিনি একজন শিক্ষাবিদও। কিন্তু এর চেয়ে বড়ো পরিচয়ও তার আছে। তিনি সমাজ-সচেতন সাহসী বুদ্ধিজীবী, জাতির বিবেক।
আর সেই কারণেই দেখা যায়, দীর্ঘ আট বছরের নিরলস সাহিত্য-সাধনায় যে বৈচিত্র্যময় প্রচুর ফসল তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন সে-সবের সর্বত্রই আমরা একজন সমাজ সচেতন, দায়িত্ববান, সজাগ লেখকের নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি লক্ষ করি। বুদ্ধির মুক্তি ও সমাজ প্রগতির যে শিখায় তাঁর অন্তরজগৎ উদ্ভাসিত হয়েছিল তারই প্রোজ্জ্বল প্রতিফলন ঘটেছে তার সাহিত্যে। শুধু সৃষ্টিশীল সাহিত্যে নয়, তার মহৎ ভাবনায়, তার বাস্তব কর্মকাণ্ডে তিনি পালন করেছেন সজাগ বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব।
লেখক জীবনের শুরু থেকেই আবুল ফজলের মধ্যে সামাজিক সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য-সাধনার পথে যে-সব বাস্তব অন্তরায় সেদিন বিরাজ করছিল ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি সেসব চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। সেই সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন সেসব অপসারণের চেষ্টায়। তার সজাগ দৃষ্টি ও মহান ব্রত তাকে এক্ষেত্রে সহায়তা করেছিল। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সাহিত্য-সাধনার পথে বিরাজমান যে সব বাধাকে আবুল ফজল চিহ্নিত করেছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে :
১. বাংলা ভাষার প্রতি এক ধরনের বিরূপ মনোভাব;
২. শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত ইত্যাদির চর্চায় অংশগ্রহণকে মুসলমানদের পক্ষে না-জায়েজ গণ্য করা;
৩. নারীসমাজকে পর্দার অন্তরালে আবদ্ধ রাখা;
৪. যুক্তিবাদী মনোভাবের পরিবর্তে অন্ধ বিশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও প্রথানুসরণের মনোভাব নিয়ে জীবন ও জগৎকে দেখা; এবং
৫. উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ইত্যাদি।
শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের একটা অংশের মধ্যে সাধারণভাবে এই বিশ্বাস ও ধারণা তখন প্রচলিত ছিল যে, মুসলমানদের বাংলা ভাষা শেখার দরকার নেই। ইংরেজির মতো বিদেশী ভাষা কিছুতেই শেখা উচিত নয়। কিন্তু আরবি ভাষা অবশ্যই শেখা চাই। এমন কি আবুল ফজলের আলেম পিতা যখন শুনেছিলেন, আবুল ফজল লিখতে চান, তিনি আরবি, ফারসি কিংবা উর্দুতে লেখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে উর্দু ভাষাকে নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার যে উৎকট প্রবণতা সে-সময় আবুল ফজল লক্ষ করেছিলেন ১৯২৬ সালের দিকে লেখা ‘মাতৃভাষা ও বাঙালি মুসলমান’ প্রবন্ধে তার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন। ঐ প্রবন্ধে তিনি যে শুধু শ্লেষাত্মক ভাষায় সকল বিভ্রান্তির মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন তা নয়, বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা কী সে বিষয়েও নির্দ্বিধায় সঠিক মত ব্যক্ত করেছিলেন :
‘বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী? উর্দু না বাংলা? আমার মতে ইহাই সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত কথা। আম গাছে আম ফলিবে না কাঁঠাল–এমন অদ্ভুত প্রশ্ন অন্য কোনো দেশে কেহ করিয়াছেন কি না জানি না।’
(তরুণপত্র, শ্রাবণ, ১৩৩২)
ধর্মের নামে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত চর্চা ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ থেকে সেদিন যে বাঙালি মুসলমান নিজেদেরকে স্বেচ্ছায় দূরে রাখতে প্রয়াসী হয়েছিল তার জন্য আবুল ফজলের দুঃখের সীমা ছিল না। তার চৌচির (রচনা ১৯২৭, প্রথম প্রকাশ ১৯৩৪) জীবনপথের যাত্রী (১৯৪৮) ইত্যাদি উপন্যাস এ বেদনারই ফসল। চৌচির উপন্যাসের নায়ক তসলিম বিদেশে জাদুঘরে চিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে যে আত্মবিশ্লেষণ করে তাতে আমরা আবুল ফজলের চিন্তারই প্রতিফলন দেখতে পাই :
মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ও ভাবধারা প্রকাশের একমাত্র বাহন যে চিত্র-শিল্প, তা কি মানুষের ধর্ম ইসলাম হারাম করিতে পারে?… এ আমাদের ইসলামকে বুঝিবার ও বুঝাইবার ভুল….। এটা হারাম, ওটা না-জায়েজ, এই করিয়া বিশ্বের এই জ্ঞানের অভিযানে আধুনিক মুসলমান তাহার হক আদায় করিতেছে না। এই জন্য একদিন তাহাকে পস্তাইতে হইবে।
পর্দার অন্তরালে নারীসমাজের বন্দিদশা সে সময়ে সাহিত্যচর্চার পথে কীভাবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আবুল ফজল সে কথা শুধু লেখেন নি, তিনি সকলকে এ বিষয়েও সজাগ করে তুলেছিলেন যে, এই অবরোধ প্রথা সমাজপ্রগতির পথেও বাধার বিন্ধ্যাচল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবরোধবাস থেকে নারীসমাজকে মুক্ত করার জন্যে সক্রিয় আন্দোলনেও শরিক হয়েছিলেন। তিনি। পর্দাবিরোধী সংঘের (Anti Purdah League) সদস্য হয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের এক সভায় (১৯২৫) পঠিত ‘পর্দা প্রথার সাহিত্যিক অসুবিধা’ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, পর্দাপ্রথা। তথা নানা বিধি-নিষেধের বেড়াজালে বাঙালি মুসলমান নারীসমাজ বন্দি বলে নারীর জীবন সম্পর্কে লেখকরা ছিলেন অজ্ঞ। অথচ নরনারীর চির রহস্যময় সম্পর্কই সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপকরণ। ফলে তিনি সহজেই এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, পর্দাপ্রথা মুসলমান সাহিত্যিকদের সাহিত্য সাধনার পথে বিশেষ অন্তরায়। কথাসাহিত্যের চর্চার মুসলমানরা কেন এগিয়ে আসতে পারছেন না–সে প্রসঙ্গে নিজের অভিমত ব্যক্ত করে তিনি লিখেছিলেন :
মুসলমান সাহিত্যিকের জন্য মুসলমান সমাজের কল্পলোকের রঙমহল আজ তালাবন্দি, তাই আমাদের দ্বারা যথার্থ সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে না–যা হচ্ছে তা হয় অসম্ভব কল্পনা না হয়। পরানুকরণ।
(পর্দাপ্রথায় সাহিত্যিক অসুবিধা)
ধর্মান্ধ মোল্লা-মৌলবিরা তাদের সংকীর্ণ চিন্তা ও সীমাবদ্ধ শিক্ষা দিয়ে ধর্মীয় বিধি-নিষেধের যে বিশাল পাঁচিল তুলে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাজগৎকে তার মধ্যে আবদ্ধ করতে চেয়েছিল–তা লক্ষ করেও আবুল ফজল মর্মাহত হয়েছিলেন। তাই তিনি চেয়েছিলেন, বাঙালি মুসলমানের চেতনার জাগরণ ঘটিয়ে বিশ্বের মানবধর্মের সাথে তার মিতালি রচনা করতে। তাঁর প্রথম উপন্যাস চৌচির রচনার পেছনে কাজ করেছিল এই বোধ। কিন্তু তারও আগে ‘ইসলাম কী জয়’ রচনায় তিনি ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও অন্ধ বিশ্বাসের অন্তঃসারশূন্যতার স্বরূপ উদঘাটনের জন্য কলম ধরেছিলেন। ঐ প্রবন্ধ তিনি লেখেন :
বিশ্বাস করিয়া সুখ আছে জানি, কিন্তু সত্যের সন্ধানে বা সত্যকে আবিষ্কার করিয়া মানুষের যে সুখ, যে আত্মপ্রসাদ তাহার তুলনা নাই। অনুসন্ধানের ভিতর দিয়া সত্যে পৌঁছার পথে বাধার সৃষ্টি করা হইলে তাহাতে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ হয় না।
এভাবে লেখক জীবনের শুরু থেকেই আবুল ফজল এক মহৎ সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্রত নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। এবং যতই অগ্রসর হয়েছেন ততই তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র ক্রম-প্রসারিত হয়েছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই তিনি দৃষ্টিপাত করেছেন দায়িত্ববান সজাগ লেখকের মতো। তবে আবুল ফজলের ভূমিকা মূল্যায়নে। এ কথা কটিই শুধু যথেষ্ট নয়। কারণ তিনি নিজে যে শুধু সমাজ-সচেতন লেখকের দায়িত্ব। পালন করেছেন তা নয়, অন্যান্য লেখককেও দায়িত্ব-সচেতন করে তোলার প্রচেষ্টা ছিল তার। বরাবর। এখানেই অন্যান্য লেখকের সাথে তার সুস্পষ্ট পার্থক্য।
তিন
আবুল ফজলের লেখক প্রতিভার সম্যক স্ফুরণ ঘটেছে তার প্রবন্ধে। সেখানে একজন ঋজু, মননশীল, সৎ, সাহসী, মানবতাবাদী প্রাবন্ধিকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে সাহিত্য ও সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ধর্ম ও রাজনীতি, মানবকল্যাণ ও মানবমুক্তি–এ সব বিষয়ে তিনি ভাবুক মন নিয়ে লিখেছেন এবং সব ক্ষেত্রেই তার ভূমিকা একজন সমাজসচেতন লেখকের।
আবুল ফজলের প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থ বিচিত্র কথা (১৯৪০)। আর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ প্রবন্ধ গ্রন্থ হচ্ছে, নিবাচিত প্রবন্ধ সংকলন (১৯৮১)। এ দুইয়ের মাঝখানে প্রকাশিত তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থ হচ্ছে : সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা (১৯৬১), সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন (১৯৬৫), সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র (১৯৬৮), সমকালীন চিন্তা(১৯৭০), মানবতন্ত্র (১৯৭২), শুভবুদ্ধি (১৯৭৪), সাহিত্য ও অনান্য প্রসঙ্গ (১৯৭৪), একুশ মানে মাথা নত না করা (১৯৭৮), রবীন্দ্র প্রসঙ্গ (১৯৭৯), সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধাবলী (১৯৮০)। এসব প্রবন্ধে তার ভাবনা-চিন্তা, মানসিকতা, ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে।
আবুল ফজলের প্রবন্ধের একটা উল্লেখযোগ্য পরিসর দখল করে আছে তার সাহিত্য ভাবনা। সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধে তিনি অবশ্য সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনায় ততটা আগ্রহী নন; বরং তার অন্যান্য রচনার মতোই এগুলি দিক-নির্দেশনামূলক ফলাকাঙ্ক্ষী রচনা। সাহিত্যক্ষেত্রে সমকালীন সমস্যা ও তার অভিপ্রেত ও প্রত্যাশিত সমাধান-নির্দেশ করে বুদ্ধিজীবীর কর্তব্য সম্পাদনই সেগুলির লক্ষ্য।
অগ্রসর বুদ্ধিজীবী হিসেবে আবুল ফজলের এই ভূমিকা স্পষ্টতই লক্ষ করা গিয়েছিল পাকিস্তানের জন্মলগ্ন (১৯৪৭) থেকে। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ধর্ম ও সম্প্রদায়ভিত্তিক তথাকথিত সাহিত্যিক ঐতিহ্য গড়ে তোলার এবং বাংলা ভাষার হাজার বছরের ঐতিহ্য অস্বীকার করার যে প্রবণতা সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী মদদ যোগাচ্ছিল আবুল ফজল তার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি দ্বিধাহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন : দেশের ঐতিহ্য। ও বিশ্বসাহিত্যের ঐতিহ্য–এ দুয়ের মিলনভূমির উপর হবে নতুন ঐতিহ্যের গোড়াপত্তন। আবুল ফজল শুধু যে নিজে সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন তা নয় তিনি সেদিন দেশের সাহিত্যিকদের সামনে একজন সত্যিকার পথনির্দেশকের এবং অকুতোভয় বুদ্ধিজীবীর ভূমিকার অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ‘সাহিত্যের ঐতিহ্য’ প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে তার সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ :
কালের ক্ষয় ও বিচার পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে যে সব সাহিত্য-শিল্প মানুষের চিরন্তন ঐতিহ্যে পরিণত, তা যে দেশের, যে জাতের, যে ভাষারই হোক না কেন সাহিত্যিকের কাছে তা কিছুতেই উপেক্ষণীয় হতে পারে না। ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নামে অথবা জাতি কি ভাষাগত কারণে সাহিত্য-শিল্পের স্মরণীয় ঐতিহ্য বিশেষকে উপেক্ষা করা মানে নিজের শিল্প সাধনাকে খর্ব করা, ছোটর জন্য বড়কে ত্যাগ করা।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, সাহিত্যের নীতি বা চরিত্র কোনো ক্রমেই সাম্প্রদায়িক বা দলীয় প্রকৃতির হতে পারে না। তাই সাহিত্যিকদের কাছে তিনি দাবি করেছেন সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি :
জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে এখন সব দেশের মানুষের মনের পটভূমি অন্তত এক হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও আয়ত্ত করতে হবে সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি, করতে হবে বিশ্বসাহিত্যের খবরদারি।
(সাহিত্যের ঐতিহ্য)
পাকিস্তানি আমলে ধর্মের নামে, তথাকথিত জাতীয় আর্দশের ধুয়া তুলে সাহিত্যিকদের উপর স্বরাষ্ট্র বিভাগের জবরদস্তি চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হলে আবুল ফজল তীব্র ভাষার এর প্রতিবাদ করেন। আপোসহীন মনোভাব নিয়ে লেখেন :
সাহিত্যিকের কাছে সত্যই বড়ো কথা। সত্যের সঙ্গে যদি জাতীয় আদর্শ, ধর্ম ও শাস্ত্রের বিরোধ ঘটে, নিঃসন্দেহে বিনা দ্বিধায় সাহিত্যিক সত্যের পক্ষাবলম্বন করবে।
স্বৈরাচারী কায়েমি স্বার্থবাদী শাসক-চক্রের নির্দেশে সে সময়ে এক শ্রেণীর জি-হুজুর সাহিত্যিক যখন নিজের দেশ, মাটি, ঐতিহ্য ও পরিবেশকে অস্বীকার করে আরব-বাগদাদ মিশর প্রভৃতি অঞ্চলের পরিবেশকে এ দেশের সাহিত্যের উপকরণ করার মানসিকতা পোষণ করেছিল, তখন আবুল ফজল সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন :
আমাদেরও সাহিত্যের প্রাণরস স্বদেশের মাটি থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। সব বড় সৃষ্টিরই বুনিয়াদ দেশের মাটি ও প্রকৃতি। এমন কি ধর্মগ্রন্থগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়। …পূর্ববঙ্গের পাঠকদের কাছে ফোরাত, দুজলা, বসফোরাস অপেক্ষা পদ্মা, কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা অনেক বেশি সত্য; আরাফাতের মাঠে থেকে রমনার মাঠ অনেক বেশি প্রত্যক্ষ।
(কথা সাহিত্যের কথা)
তাই বলে এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে, ইসলাম ধর্ম বা ঐতিহ্যের উপাদানকে আবুল ফজল সাহিত্যের উপাদান হিসেবে উপেক্ষা করতে চেয়েছেন। বরং তিনি মনে করেন, অন্যান্য ধর্মের ওপর সাহিত্যের আধিপত্য বিস্তৃত হলেও ‘ইসলামের ধর্মীয় ও আধা-ধর্মীয় ঘটনা ও কাহিনীগুলি এখনো যথাযথভাবে সাহিত্য-শিল্পের উপকরণ হতে পারে নি সামাজিক গোঁড়ামি ও অসহিষ্ণুতাই এর কারণ’ (সাহিত্য ও শিল্পের উপেক্ষিত উপকরণ)। তিনি দুঃখ করে বলেছেন, ‘মুসলমানদের শিল্পবোধ ও সৃষ্টিপ্রতিভা অন্য কোনো রকমে মুক্তি না পেয়ে তা শুধু মসজিদ আর স্মৃতিসৌধেই চুড়ান্ত রূপ নিয়েছে’ (সাহিত্য ও শিল্পের উপেক্ষিত উপকরণ)। তিনি এসব উপকরণকে যুগোপযোগী আঙ্গিকে রূপ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
৫০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলায় সাহিত্য-সংস্কৃতির স্বাভাবিক ও অবাধ বিকাশের পথে নানা অন্তরায় সৃষ্টি করে। জীবন-সত্য রূপায়ণ করতে গিয়ে শাসকগোষ্ঠীর বিষনজরে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। এই প্রেক্ষাপটে আবুল ফজল লেখেন সাহিত্যের সংকট প্রবন্ধটি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজমান অস্থিতিশীলতা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বৈষম্য, ভৌগোলিক ব্যবধান, শাসক শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক চরিত্র ইত্যাদি সংকট স্পষ্টভাবে অনুধাবন করে তিনি মন্তব্য করেন :
…আজ সাহিত্যিক, সাহিত্য প্রতিষ্ঠান, ও সাহিত্য সম্পর্কিত অনুষ্ঠানাদি এক অবাঞ্ছিত শিকারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়েছে। ফলে জাত লেখক ও সাহিত্যসেবীরা আজ অনেকটা দিশেহারা। সব দেশের মত আমাদের দেশেরও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয়তার সুষ্ঠু রূপ গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। এ যদ্দিন না হচ্ছে তদ্দিন। সাহিত্য ও সাহিত্যিকের দুর্গতির অবসান ঘটবে না।
(সাহিত্যের সংকট)
আবুল ফজল আধুনিকতাকে দেখেছেন আধুনিক মন ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টিশীল সংশ্লেষ হিসেবে। এর জন্য আধুনিক মনের সঙ্গে আধুনিক জীবন ও সমাজ-বাস্তবতার সংঘর্ষের ফলে। তার মতে, আধুনিকতায় সমসাময়িক যুগজিজ্ঞাসার প্রতিফলন যেমন প্রত্যাশিত তেমনি জোর করে আধুনিক হওয়ার চেষ্টায় নিছক চমক লাগিয়ে চোখ ভোলানোর চেষ্টাও নিন্দনীয়। তিনি বিশ্বাস করেন, আধুনিক শিল্পী যুগের সন্তান; তাঁর রচনার উপকরণ তিনি সংগ্রহ করেন যুগ থেকে, কাল থেকে; কিন্তু শিল্পীসত্তায় তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে হয় যুগকে, কালকে। এ প্রসঙ্গে আবুল ফজল লিখেছেন :
আধুনিক হওয়ার সংকল্প নিয়ে কলম হাতে লিখতে বসলেই আধুনিক হওয়া যায় না–মনের ভিতর আধুনিকতার বোধ থাকা চাই অর্থাৎ কালের ধারাবাহিকতার বোধ। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের যে অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্র আছে তা কালের দিক থেকে যেমন সত্য তেমনি মানুষের শ্রেয়, সৌন্দর্য ও রসবোধের দিক থেকেও সত্য।
(সাহিত্যে আধুনিকতা)
সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে যারা সাহিত্যকে দেখেন আবুল ফজল কখনো তাদের দলে ছিলেন না। সমাজ ও সময়-লালিত ব্যক্তিমানুষের মতো সাহিত্যিকও যে সামাজিক মানুষ, সমাজজীবনের অনুষঙ্গে সাহিত্যিকেরও যে সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে আবুল ফজল কেবল মনে-প্রাণে তা বিশ্বাস করতেন না, বার বার সেকথা সাহিত্যিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শিল্পী-সাহিত্যিককে সমাজের বিবেক’ আখ্যায়িত করে তিনি লিখেছেন :
সাহিত্যিকের কাজ শুধু সমাজ জীবনের রূপায়ণ নয়–মহৎ জীবনের, মহৎ চিন্তা-ভাবনার রূপায়ণও। সমাজকে অর্থাৎ সমাজের মানুষকে সত্য, ন্যায়, কল্যাণ ও সৌন্দর্যের কথা সর্বাঙ্গীণ সামঞ্জস্যের দিকে নিয়ে যাওয়া। এক কথায়, সুদৃঢ় সামাজিক ভিত্তির উপর মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে ভোলাই সাহিত্যিকের ধর্ম।’
(সমাজ ও সাহিত্যিক)
সমাজ জীবনে সাহিত্যের ভূমিকা সম্পর্কে আবুল ফজলের ধারণা গভীর দেশপ্রেম প্রসূত। সে ধারণার মর্মবস্তু হচ্ছে :
ব্যক্তি, সমাজ, সম্প্রদায়, দেশ, জাতি, শাস্ত্র ও দেশাচারের হাজারো রকমের ভূত তথা সংস্কারের বন্ধনে মানুষের মন বাধা। ভয়, মোহ ও অহমিকা এ সব বাধনকে প্রায় অচ্ছেদ্য করে তোলে। সাহিত্য হচ্ছে এ বাঁধন কাটার মন্ত্র।
(সাহিত্যের পথ ও পাথেয়)
বিভিন্ন লেখায় ও ভাষণে আবুল ফজল বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন লেখক-শিল্পীর মহান দায়িত্বের কথা। বলেছেন, সাহিত্যিককে পলাতক আর দায়িত্বহীন হলে চলে না। তাকে হতে হয় সচেতন শিল্পী। রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক সংকট, শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে শিল্পীমন সংকুচিত হতে পারে–এই আশঙ্কা দ্বারা ভাবিত হয়ে তিনি লেখক-শিল্পীদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, ‘শিল্পীর পক্ষে অজ্ঞতা ও ভয় দুই-ই শুধু মহা অপরাধ নয়–মহাপাপ।’
চার
আমরা আগেই বলেছি, আবুল ফজল কেবল কথা-সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমাজসচেতন, উদার মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ববান, সৎ ও সাহসী বুদ্ধিজীবী। এ দেশের যে কোন সামাজিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংকটে তিনি অকুতোভয়ে সত্যের পক্ষে, যুক্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, দেশ জাতি-জনতার স্বার্থে কলম ধরেছেন। ১৯৫০-এর দাঙ্গার সময় সরকারি চাকুরে আবুল ফজল প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নেমেছেন দাঙ্গার বিরুদ্ধে। ১৯৫১ সালে চরম সাম্প্রদায়িক উসকানির মুখে দৃঢ় ও বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছেন চট্টগ্রামে সংস্কৃতি সম্মেলন সফল করার জন্য। ১৯৬১সালে চট্টগ্রামে আয়ুব খানের সামরিক আইন উপেক্ষা করে যে অভূতপূর্ব উদ্দীপনার মধ্যে সপ্তাহব্যাপী রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয় তাতে পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা।
একাধারে কর্মী, সংগঠক ও লেখকের ভূমিকা পালন করেছেন আবুল ফজল। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর পর আবুল ফজল লেখেন তার বিখ্যাত প্রবন্ধ মানবতন্ত্র। এটি সমকাল পত্রিকায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩৭১) প্রকাশের সাথে সাথে পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। ষাট-এর দশকের মধ্যভাগে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের (১৯৬৫) পর আয়ুব-মোনেমের উসকানিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও রবীন্দ্রবিরোধী যে চক্রান্ত এ দেশে দানা বেঁধে উঠছিল আবুল ফজল তার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক স্বাধিকার ও জাতীয়তার প্রশ্নে তিনি শুধু লিখে নয়, সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করে বাঙালি চেতনা ও ঐতিহ্যের সপক্ষে নিরন্তর লড়ে গেছেন। তাকে বিকশিত ও প্রসারিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন।
১৯৭১-এ বৃদ্ধ বয়সে চট্টগ্রামের নগর ও গ্রামে আত্মগোপন অবস্থায় লিখেছেন দুর্দিনের দিনলিপি (১৯৭২)–শান্তি, মুক্তি ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার এক উজ্জ্বল দলিল।
শিক্ষাঙ্গনের এক নৈরাশ্যজনক ও চরম অবক্ষয়ী অবস্থার মধ্যে আবুল ফজল উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। গণ-টোকাটুকির জোয়ারে সেদিন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। আবুল ফজল অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সেই প্রবণতা মোকাবেলা করে সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। রাষ্ট্রপতির শিক্ষা উপদেষ্টা থাকাকালেও তিনি শেখ মুজিবের হত্যার পটভূমিতে একাধিক গল্প লিখে (মৃতের আত্মহত্যা [১৯৭৮] গ্রন্থে সন্নিবেশিত) শুধু সাহসিকতার পরিচয় দেন নি, হত্যার রাজনীতির প্রতি ধিক্কার বাণী উচ্চারণ করে পরিচয় দিয়েছেন সুষ্ঠু বিবেকের, পালন করেছেন দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা। এমন কি রাষ্ট্রীয় জীবনের শঙ্কাগ্রস্ত শৃঙ্খলিত মুহূর্তেও তিনি আমাদের সাহসের সমাচার শুনিয়েছেন। শাসকগোষ্ঠীর ত্রাসের রাজত্বের মুখে ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণীকে তার মত কে এমন সাহসী ভাষায় স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পেরেছেন–একুশ মানে মাথা নত না করা–এই নির্ভীক উচ্চারণের মাধ্যমে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল লেখকদের মুখপত্র সমকাল স্বাভাবিক কারণেই তাকে ১৯৭৮ সালে ‘জাতির বিবেক’ অভিধায় ভূষিত করেছিল।
বস্তুত আবুল ফজল সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের একজন তীক্ষ্ণদৃষ্টি পর্যবেক্ষক ছিলেন। তাঁর প্রবন্ধ কিংবা দিনপঞ্জি এর স্বাক্ষর বহন করছে। জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি সংকটে তিনি বিচলিত হয়েছেন, উদ্বিগ্ন হয়েছেন। এবং সাথে সাথেই তার মানস-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। শুধু এতেই তিনি ক্ষান্ত হন নি। সজাগ বুদ্ধিজীবীর স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে প্রত্যক্ষ ও ঋজু ভাষায় আপন সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন, সংকট উত্তরণের সম্ভাব্য পথ-নির্দেশ করেছেন। এবং এসব ক্ষেত্রে চাপ ও টোপ–দুটোকেই পরিহার করেছেন সাহস ও দৃঢ়তার সাথে।
যে কোন পরিস্থিতিতে বক্তব্যের স্পষ্টতা, মনোভাবের দৃঢ়তা, সুস্পষ্ট যুক্তিবাদী মনোভাব ও শঙ্কাহীন নিরঙ্কুশ সত্যভাষণ সমকালীন অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর চেয়ে তাকে পৃথক ও বরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। আর এভাবে তিনি জাতীয় বুদ্ধিজীবীর মর্যাদায় আসীন হতে পেরেছিলেন। আবুল ফজল সাহিত্যিক হিসাবে তার আপন ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন :
সাহিত্যকে আমি কোনদিন বিলাসের বস্তু মনে করি নি। মানুষের জীবনের, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সাহিত্যের এক বিশেষ ভূমিকা আছে। সে ভূমিকা সম্বন্ধে আমি সচেতন ছিলাম। তাই দেশের মানুষ ও সমাজের সমস্যা বার বার আমার লেখায় ছায়াপাত করেছে। ভয়ে বা প্রলোভনে আমি কখনো আমার কথাকে সাহিত্যের সত্যের পথ থেকে বিপথগামী হতে দিই নি। দেশ ও সমাজের কথা ভেবে যখনই আমার মন আলোড়িত হয়েছে তখন আমি তা নির্ভয়ে প্রকাশ করেছি–আমার কণ্ঠস্বর কখনো চাপা থাকে নি।
(সাহিত্যের পথ ও পাথেয়)
আবুল ফজল এ ক্ষেত্রে এক বর্ণও বাড়িয়ে বলেন নি। বুদ্ধির মুক্তি ও সমাজ প্রগতির আলোক শিখায় তাঁর জীবন ও সাহিত্য ভাস্বর। নিঃশঙ্কচিত্তে আমৃত্যু আবুল ফজল দায়িত্বশীল লেখকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। প্রলোভন বা সন্ত্রাস–কোনো কিছুই তাকে বশীভূত করতে পারে নি। সত্যব্রতী দেশপ্রেমিক আবুল ফজল সব সময় বিবেকের কাছে মুক্ত থেকে। আপোসহীন মনোভাব নিয়ে জাতীয় সংকটের পথ-নির্দেশ করে যেভাবে সজাগ বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন সে জন্যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ সব সময় তাঁর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবেন।
পাঁচ
আবুল ফজলের সমস্ত সৃষ্টিকর্মের পেছনে এক সুস্পষ্ট আদর্শ ক্রিয়াশীল ছিল। লেখকের নিজের ভাষায় যদি সে আদর্শকে চিহ্নিত করতে হয় তবে বলতে হয় সেটি মানবতন্ত্র, যার মূল কথা হলো, মানুষের মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক-দার্শনিক পরিভাষায় এর নাম উদার মানবতাবাদ। ওপর তলে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা, মানব কল্যাণ, মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও সমাজজীবনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি মানবতন্ত্রের অভীষ্ট। গভীরতলে শোষণ, অন্ধ বিশ্বাস ও প্রথানুগত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রগতির পক্ষে দাঁড়ানোর ইতিবাচক সক্রিয়তা মানবতন্ত্রের প্রতিপাদ্য।
‘মানবতন্ত্র’ তথা মানুষের মর্যাদার জয়গান আবুল ফজলই যে প্রথম উচ্চারণ করেছেন তা নয়, কালে কালে যুগে যুগে মানুষের মহিমার সত্যভাষ্য ঘোষিত হয়েছে। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’–এই ধরনের মর্মবাণী অনেকেই উচ্চারণ করেছেন। এবং ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যায়, দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে উদার মানবিকতার ধারণাটি স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে চতুর্দশ থেকে ষষ্ঠদশ শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁসের কালে। আর ঐ সময়-কালের মানবতাবাদীদের মধ্যে যারা বিশিষ্ট তাদের মধ্যে রয়েছেন ইতালির কবি দান্তে (১২৬৫-১৩২১), পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪), ও বোকাচ্চিত্ত (১৩১৩-১৩৭৫), ইতালীয় চিত্রশিল্পী লেওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯), ইতালীয় বিজ্ঞানী-দার্শনিকব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০), ফরাসি লেখক সঁতেন (১৫৩৩-১৫৯২), পোলিশ জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩), ইংরেজ নাট্যকার শেকসপিয়র (১৫৬৪-১৬১৬), ইংরেজ দার্শনিক বেকন (১৫৬১-১৬২৬) প্রমুখ।
নানা দেশের নানা কালের মানবতাবাদীরা যে মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গেছেন সেই সড়কেরই একজন অভিযাত্রী আবুল ফজল। এদের সবার লক্ষ্য অভিন্ন। কিন্তু এদের সবারই রয়েছে। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, চলার নিজস্ব ধরন। অন্যান্যদের মতো আবুল ফজলের মানবতন্ত্র ও তেমনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। উদার মানবিকতা সম্পর্কে পশ্চিমি ভাব-ধারণার বিকাশ এ দেশে অনেক আগেই ঘটেছিল।
উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁসের অন্যতম অগ্রপথিক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ ১৮৯১) উদার মানবিকতা চর্চার যে ধারা সূচনা করেছিলেন সেই ধারার নব উত্তরণ ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে। বিশ শতকের শুরুতে রুশ বিপ্লব (১৯১৭)ও রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বিজয় অভিযানের প্রভাবে এ দেশে সূচিত মুক্তি আন্দোলনের জোয়ারে উদার মানবিকতার চিন্তায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল। বুর্জোয়া মানবতাবাদী চিন্তা থেকে সরে এসে এ ধারার সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদী চিন্তার পথে ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটছিল। কিন্তু সমসাময়িককালে বাঙালি মুসলমান সমাজ ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধ প্রথানুসরণ ও আধুনিক শিক্ষা বিমুখতার যে পথ বেছে নিয়েছিল তাতে উদার-মানবিক চিন্তাধারা থেকে একটা উল্লেখ্যযোগ্য দূরত্ব রচিত হয়ে গিয়েছিল। শিখা গোষ্ঠীর মাধ্যমে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ থেকে শুরু করে আমৃত্যু আবুল ফজল মানবতন্ত্রের পক্ষে যে আদর্শিক লড়াই করে গেছেন তা বাঙালি মুসলমানদের উদার মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে।
আবুল ফজল মানবতন্ত্রী। কিন্তু মানুষের সত্যিকারের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম-সংগঠনের বিশেষ পথে তিনি অগ্রসর হন নি। তিনি প্রধানত লেখন ও মননচর্চাকেই এই পথের প্রধান অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং মূলত তাকেই অবলম্বন করেছিলেন। তবে রাজনীতির প্রতি তিনি যে চোখ ফিরিয়ে ছিলেন তা মোটেও নয়। বরং বলা যায়, রাজনীতিকেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তা করেছেন ‘মানবতন্ত্রী’ চোখ দিয়ে। সেই কারণেই তিনি যখনই দেখেছেন যে রাজনীতি মানব-মর্যাদার অবমাননা ঘটাচ্ছে তখনই তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
বিষয়টি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নিরিখে আবুল ফজলকে বিচার করলে। পাকিস্তানের জন্মের মধ্যে আবুল ফজলের হয়ত-বা ক্ষীণ প্রত্যাশা জেগেছিল–নতুন দেশটিতে মানব-মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই কারণেই হয়ত তিনি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর (১৮৭৬ ১৯৪৮) মধ্যে একজন মানবতন্ত্রীকে আবিষ্কার করতে গিয়েছিলেন (কায়দে আজম [১৯৪৬] নাটক দ্রষ্টব্য) কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই আবুল ফজল দেশে মানবতার লাঞ্ছনা ও অবমাননা দেখে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উন্মাদনা ও অন্ধ গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং মানব মর্যাদার পক্ষে কলম ধরেছেন। রাঙা প্রভাত (১৯৫৭) উপন্যাসে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর ও নবতর বিন্যাসের মাধ্যমেই সত্যিকার মানবতন্ত্রে পৌঁছানো সম্ভব।
মানবতন্ত্রী আবুল ফজলের উদার মানবতাবাদী চিন্তাধারার অন্যতম দলিল ‘মানবতন্ত্র’ রচনাটি। তার রাঙাপ্রভাত উপন্যাসের বিরুদ্ধে আনীত তথাকথিত ‘ইসলাম বিরোধী’, ‘পাকিস্তানি ভাবধারার পরিপন্থী’ ইত্যাদি অভিযোগ খণ্ডন করতে গিয়ে আবুল ফজল এই প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন। ১৯৬০-এর দশকে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী। উদারনৈতিক চেতনা বিকাশে এই রচনাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। যে ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডুকতাকে বাঙালি মুসলমানদের মানস বিকাশের পথ রুদ্ধ করার কাজে সে সময় ব্যবহারের হীন প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল তার স্বরূপ উদঘাটন করে এবং তার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ উচ্চারণ করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, ধর্মান্ধতা নয়–মানবতন্ত্রের মধ্যেই মানুষের সত্যিকারের বিকাশ ঘটে। মানবতন্ত্র রচনায় আবুল ফজল মানবতন্ত্র সম্পর্কে তার প্রধান প্রধান উপলদ্ধি নিয়ে সমুপস্থিত; মানুষের মর্যাদার প্রতি সর্বাধিক সম্মান প্রদর্শনের কথা এখানেই উচ্চারিত। মানবতার মর্মবস্তু তথা মানব কল্যাণের বিষয়, মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ও সমাজ জীবনে মানবিক মূল্যবোধের অনুকূল পরিবেশ রচনার বিষয়ে মহৎ উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ এখানেই ঘটেছে; শোষণের বিরুদ্ধে, অন্ধ বিশ্বাস ও প্রথানুগত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সমাজ প্রগতির পক্ষে দাঁড়ানোর মতো সত্যকারের মানবতাবাদী চিন্তাধারা এখানেই উদ্ভাসিত, এখানেই তিনি টেনে এনেছেন ব্যক্তির মুক্তির প্রসঙ্গ; এনেছেন ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা, এনেছেন মানুষের মুক্তি ও আনন্দ রচনার জন্য জাগতিক আকাক্ষা ও চাহিদা পরিপূরণের বিষয়।
‘মানবতন্ত্র’ প্রবন্ধে আবুল ফজল সবার উপরে মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত করে তুলে ধরেছেন। মানুষের মর্যাদাকে যদি মানুষ যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম না হয় তবে অমানুষিকতা ও বর্বরতারই বিজয় অনিবার্য হয়ে উঠবে। তাই প্রাণিজগৎ থেকে উদাহরণ দিয়ে আবুল ফজল মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে জাগরিত করার প্রয়াস পান :
মানুষকে অমানুষিকতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে মানবতাকেই করতে হবে এক মাত্র অবলম্বন। কথা আছে : বাঘ বাঘের মাংস খায় না। কথাটা সত্য। বাঘও বাঘের বেলায় নিজেদের সাধারণ ব্যাঘত্ব সম্বন্ধে সচেতন। ব্যাঘ্ৰত্বে পরস্পর অভিন্ন। অতএব অবধ্য। মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে সাধারণ মানবতা সম্বন্ধে।
(মানবতন্ত্র)
মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা করতে হলে চলনে-বলনে-আচরণে, চিন্তায়-কর্মে-প্রতিজ্ঞায় চাই মনুষ্যত্ববোধের উদ্বোধন। এই বোধ থেকেই আবুল ফজল লিখেছেন :
ব্যক্তি বা মানুষ হল সমাজ ও রাষ্ট্রের এক একটি অঙ্গ। সেই মানুষ যদি সৎ না হয়, সেই মানুষের মন থেকে যদি অবিদ্যা দূরীভূত না হয়, সেই মানুষ যদি ‘মধ্যমা প্রতিপ্য’ গ্রহণ না করে, মোট কথা ব্যক্তি মানুষের মন থেকে যদি হিংসা বিদ্বেষ নির্মূল না হয়, তা হলে শান্তি চিরকাল মানুষের নাগালের বাইরে বন্য হংস হয়েই থেকে যাবে।
(মানবতন্ত্র)
আবুল ফজলের প্রায় রচনারই মূলগত আদর্শ মানবতন্ত্র। এমন কি রবীন্দ্র প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি অন্যান্য মানবতাবাদীর মতোই মানবতাকেই ধর্মভেদ-জাতিভেদের ঊর্ধ্বে স্থান দেন :
হিন্দুর ধর্ম, মুসলমানের ধর্ম, খ্রিস্টানের ধর্ম আলাদা হতে পারে কিন্তু মানুষের ধর্ম এক। ওখানেই মানুষের এক জাতিত্ব ও স্বরূপের প্রকাশ।
(রবীন্দ্র প্রসঙ্গ)
মানুষের শক্তির মহিমাকেও আবুল ফজল মানবতাবাদীর চোখে বিচার করেন। শক্তির পেছনে তিনি সব সময় শুভবুদ্ধিকে সক্রিয় দেখতে চান। কারণ তিনি জানেন, বিবেকশক্তিহীন বৃহৎশক্তি মানবের অকল্যাণই ডেকে আনে। তাঁর ভাষায়;
বৃহৎ শক্তির পেছনে যদি বৃহৎ বিবেকশক্তি সক্রিয় না হয় তা হলে মানব-সভ্যতার কিছুমাত্র উপকার সাধিত হবে না। ইতিহাসে বিবেকহীন শক্তির পরিচয় তৈমুর থেকে হিটলার পর্যন্ত অনেকেই দিয়েছেন, তাতে মানুষের কোন কল্যাণ হয় নি, তাদের নিজেদেরও না। সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করাই মানবতা, তা ধ্বংস করা মানবতা নয়।
(শুভ বুদ্ধি)
আবুল ফজল এই উদার মানবিকতার নীতি অনুসরণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে ছিলেন। প্রেগতিবাদী। তাই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল মানবজাতির কল্যাণ-কামনাই তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে, কর্মে ও বক্তব্যে সুস্পষ্ট।
ছয়
এই ছিলেন আবুল ফজল। নিরলসভাবে লিখেছেন, চোখের সামনে কোনো অন্যায় দেখলে তার প্রতিকারে সচেষ্ট হয়েছেন; মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন। রাজনৈতিক সংকটে ভয় পান নি, সে সংকটে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে ভোলেন নি।
এগিয়ে চলাই ছিল আবুল ফজলের ধর্ম। এই এগিয়ে চলার পথে পথের বাধাকে তিনি শুধু অতিক্রম করেন নি, তাকে অপসারণ করে অন্যের চলার পথকে সুগম করতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল তার মাদ্রাসা শিক্ষক হিসেবে আর শেষ জীবনে বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল, কারণ তিনি সময়ের পিছু পিছু চলেন নি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যুগের আধুনিকতাকে সব সময় তিনি গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। বরং বলা চলে, তিনি সময়ের চলমানতার তুলনায় বরাবর একটু এগিয়েই চলেছে। অন্তরে তার তারুণ্য ছিল সব সময় জাগর।
বহু উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকলেও আবুল ফজলের জীবনযাত্রা ছিল সাদা-মাটা, নিরাভরণ। সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবি ছিল তার একমাত্র বেশ, শীতে কেবল তাতে যোগ হত শাল বা চাদর। শ্বেত শশ্রুমণ্ডিত শুভ্র বৃদ্ধ যখন কোনো সভামঞ্চে উঠে দাঁড়াতেন তখন শ্রোতামাত্রই উদগ্রীব হয়ে থাকত তার দরাজ ভারী গলায় যুক্তিসিদ্ধ সুস্পষ্ট কথন-নির্দেশনা শোনার জন্য। আজ তিনি নেই। কিন্তু জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় আসনটি তার পাকা হয়েই থাকবে।
মাহবুবুল হক
বাংলা বিভাগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সেপ্টেম্বর ২০০০
.
সম্পাদনা প্রসঙ্গে
এই গ্রন্থে সংকলিত প্রবন্ধগুলি ইতিমধ্যে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলেও অধিকাংশ গ্রন্থই বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। আবুল ফজলের এ সব লেখার যেমন ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে তেমনি সমকালীন প্রেক্ষাপটেও এগুলির মূল্যবত্তা কম নয়। এ বিবেচনা থেকেই আবুল ফজলের এই মননঋদ্ধ প্রবন্ধগুলি বর্তমান গ্রন্থে সংকলিত করা হল।
প্রবন্ধগুলিকে তিনটি পর্বে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। লেখাগুলি কালানুক্রমে বিন্যস্ত।
প্রথম পর্বে সন্নিবেশিত হয়েছে আবুল ফজলের সাহিত্য-বিষয়ক নির্বাচিত প্রবন্ধ। এগুলির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে লেখকের সাহিত্য-বিষয়ক মৌল ধারণা। অবশ্য সেই সঙ্গে এসেছে সাহিত্যের উপকরণ, ঐতিহ্য ইত্যাদি প্রসঙ্গ; এসেছে সাহিত্য সমালোচনাসহ সাহিত্যের সঙ্গে সমাজ ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের নানা দিক।
দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে আবুল ফজলের সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ। সেই সঙ্গে রয়েছে লেখক শিল্পীর স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গ। প্রায় অর্ধশতক ধরে বাঙালি মুসলমানকে তার স্বরূপ অন্বেষার জন্য যে নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করতে হয়েছে তার প্রেক্ষাপট, লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমকালীন সচেতন পাঠক ও সনিষ্ঠ গবেষকদের কাছে তা উদ্ভাসিত হবে এ সব প্রবন্ধের মাধ্যমে।
তৃতীয় পর্বে সংকলিত হয়েছে শিক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে লেখা প্রবন্ধ। এসব প্রবন্ধে আবুল ফজল সমকালীন অনেক জ্বলন্ত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, বিবেকী সাহসী দৃঢ়তায় উচ্চারণ করেছেন প্রকৃত সত্যকে, পথ-নির্দেশ করেছেন সমস্যা মোকাবেলার। ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে আমরা এখনও যে সব সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি সেগুলো মোকাবেলায় আবুল ফজলের চিন্তা কেবল আমাদের ভাবনাকে উসকে দেয় না, উত্তরণের পথকেও আলোকিত করে।
গ্রন্থভুক্ত লেখাগুলির মুদ্রণ-কপি প্রস্তুত করা হয়েছে ইতোমধ্যে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত আবুল ফজলের প্রবন্ধ গ্রন্থ থেকে। সেগুলি হচ্ছে: সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা (১৯৬১), সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন (১৯৬৫), সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র (১৯৬৮), সমকালীন চিন্তা (১৯৭০), মানবতন্ত্র (১৯৭২), শুভবুদ্ধি (১৯৭৪), সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৭৪), সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধাবলী (১৯৮০) ও নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন (১৯৮১)। সম্পাদনার ক্ষেত্রে মূল রচনাকে অপরিবর্তিত রেখে কেবল বানানের সমতাবিধানকেই আমরা সংগত বিবেচনা করেছি। বানান পরিমার্জনার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানের নিয়মকেই যথাসম্ভব অনুসরণ করা হয়েছে।
এ গ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন আমার জন্যে গৌরবের ও আনন্দের। এ কাজে আমাকে আবুল ফজলের পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করেছেন বিশিষ্ট কবি, সাংবাদিক ও জনপ্রিয় কলাম লেখক বন্ধুপ্রতিম আবুল মোমেন। সম্পাদনার কাজেও প্রয়োজনীয় অকুণ্ঠ সহয়োগিতা করেছেন তিনি। এ গ্রন্থের গ্রুফ সংশোধন ও সম্পাদনায় সহায়তা করেছেন সাপ্তাহিক অনুবীক্ষণের ফিচার সম্পাদক মাসহুদা ইয়াসমিন। সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী জনাব ফরিদ আহমদের আন্তরিক আগ্রহে এ বই প্রকাশিত হল। এদের সকলকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাই।
মাহবুবুল হক
বাংলা বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৭ সেপ্টেম্বর ২০০০
Leave a Reply