নিকি – মোশতাক আহমেদ – সায়েন্স ফিকশন
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৪
[আধো অন্ধকারে রনি দেখতে পেল তার থেকে তিন চার হাত দূরে মোটা একটা জাম গাছের গোড়ায়। অদ্ভুত একটা প্রাণী বসে আছে। প্রাণীটা দেখতে অনেকটা মানুষের মতোই। তবে আকারে অনেকটা। ছোট, ফুট তিনেক লম্বা হবে। মানুষের মতোই হাত পা আছে প্রাণীটার। হাত পাগুলোও ছোট ছোট। চেহারায় কেমন যেন বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব। গলা থেকে পা পর্যন্ত বিশেষ একটা পোষাক পরা থাকায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে চোখ দেখে মনে হচ্ছে প্রাণীটা তাকে দেখেও ভয় পাচ্ছে। কেমন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। প্রাণীটার ডান হাতে মোবাইল ফোনের মতো ছোট্ট একটা ইলেকট্রনিক। যন্ত্র। প্রাণীটা খুব সতর্কতার সাথে যন্ত্রটিকে তার দিকে তাক করে রেখেছে। আর বাম হাতটা শূন্যে। ঝুলছে। হাতের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে হাতে। মারাত্মক আঘাত পেয়েছে প্রাণীটা। মুখেও রক্তের ছোপ। কিছুক্ষণ আগে যে মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে মুখের জমাট বাধা রক্ত যেন তারই প্রমাণ। রনি কিছু বলার আগেই প্রাণীটা বলল, আমার নাম। নিকি। দুর্ঘটনাবশত আমি হিমিচুন গ্রহ থেকে। পৃথিবীতে এসে পড়েছি। গিগোরা আমাকে হত্যা করতে চেষ্টা করছে। একমাত্র তুমিই পারবে আমাকে বাঁচাতে। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? রনি কিছু বলতে পারল না। শুধু উপরে নিচে সম্মতিসূচক মাথা দোলাল। শেষ পর্যন্ত কি রনি আর। তার বন্ধুরা পেরেছিল ভয়ংকর প্রাণী গিগোদের হাত থেকে নিকিকে রক্ষা করতে?]
উৎসর্গ
পরম শ্রদ্ধেয় দাদী-কে
১
রাহাত সাহেব উল্কণ্ঠিত চোখে ডাক্তার হকের দিকে তাকিয়ে আছেন। ডাক্তার হককে বেশ অনেকক্ষণ ধরে রিপোর্টগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাহাত সাহেব যা বুঝার বুঝে নিলেন। তার আশঙ্কাই যে সত্য বলে প্রতীয়মান হতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে তিনি অনেকটাই নিশ্চিত। তাই ডাক্তার হক কিছু বলার আগেই তার বুক চিরে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
ডাক্তার হক আরো কিছুটা সময় নিলেন। তারপর সামনে ঝুঁকে এসে বললেন, রাহাত সাহেব, এখন আপনি কেমন অনুভব করছেন?
রাহাত সাহেব সরাসরি ডাক্তার হকের চোখে তাকালেন। তারপর বললেন, ডাক্তার হক, আপনি কি সত্যি করে বলবেন আমি আর কতদিন বাঁচব?
আপনি কি ওষুধগুলো নিয়মিত খাচ্ছেন? রাহাত সাহেবের উত্তর এড়িয়ে যেয়ে উল্টো প্রশ্ন করলেন ডাক্তার হক।
ওষুধে নিশ্চয় কোনো কাজ হচ্ছে না? নিজেই বললেন রাহাত সাহেব।
এবার ডাক্তার হক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন, আমি দুঃখিত রাহাত সাহেব। আপনার শরীরে কেমোথেরাপিও কাজ করছে না।
আমি আগেই বুঝতে পেরেছি। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি আমাকে সত্য কথাটাই জানাচ্ছেন। সত্য জানাটা আমার খুবই জরুরী।
আপনার তো একটি ছেলে আছে, তাই না?
হ্যাঁ, ওর নাম রনি। বয়স বার বছর। আমার একমাত্র সন্তান। ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই। ওর জন্যই আমার সত্যটা জানা খুব প্রয়োজন আমি আর কতদিন বাঁচব। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন আমি আমার ছেলের সাথে হেসে খেলে আনন্দে কাটাতে চাই। আমি ওকে নিয়ে গ্রামে চলে যাব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি সেখানেই থাকতে চাই।
না রাহাত সাহেব, সেটা ঠিক হবে না। আমি আপনাকে এখন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেব। আপনি আজই হাসপাতালে ভর্তি হবেন।
ডাক্তার হক, না। আমি বুঝতে পারছি আমার আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই। টিউমারের কাছে আমি পরাজিত। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আমি আমার অর্থের আর অপচয় করতে চাই না। এমনিতেই অনেক টাকা খরচ করেছি। এখন যা কিছু আছে আমি আমার ছেলের জন্য রেখে যেতে চাই। এমনিতেই ও খুব অসহায়, বঞ্চিত। জন্মের সময় ও ওর মাকে হারিয়েছে। মাঝে মাঝে আমাকেও অফিসের কাজে এতটা ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে ওকে একটু সময় পর্যন্ত দিতে পারিনি। কিছুদিন পর আমিও যখন থাকব না তখন ও একেবারে একা হয়ে যাবে। তাই জীবনের শেষদিনগুলো আমি আমার ছেলের সাথে কাটাতে চাই। তাও গ্রামে, একেবারেই গ্রামে।
রাহাত সাহেব, আপনি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন। বললেন ডাক্তার হক।
হ্যাঁ হ্যাঁ, সত্যি আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি। আগেপ্রবণ হওয়াটাই কী স্বাভাবিক নয়? আমি যে মারা যাচ্ছি। কি, কিন্তু আমি মৃত্যুকে মোটেও ভয় পাচ্ছি না। ভয় পাচ্ছি শুধু ছেলেটার ভবিষ্যৎ ভেবে। ছেলেটাকে একেবারে একা ফেলে যেতে হচ্ছে ভাবতেই আমার বুকটা হু হু করে উঠছে। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না, কিছুতেই না।
আপনি ধৈর্যহারা হবেন না। চিকিৎসা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আমরা আপনাকে আবারো কেমোথেরাপি দেব।
না না, আমি আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আপনি কী দয়া করে বলবেন আমি আর কতদিন বাঁচব?।
ডাক্তার হক আবারো খানিকটা সময় নিলেন। তারপর বললেন, রাহাত সাহেব, সত্যি কথা বলতে কি আপনার অসুখটা একিউট পর্যায়ে আছে। আপনার উচিত ছিল আরো অনেক আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া। অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আপনার মস্তিষ্কের টিউমারটা দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে। টিউমারটা হয়েছে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে। টিউমারটা এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে, কোনে ডাক্তার অপারেশনের ঝুঁকি নেবে কিনা আমার সন্দেহ। তবে সম্ভাবনা যে একেবারে নেই তা নয়। কেমোথেরাপিতে যদি টিউমারের বিস্তৃতিটা রোধ করা সম্ভব হয় তাহলে পরবর্তীতে অপারেশন করাও সম্ভব হতে পারে।
অপারেশনে আমার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
ডাক্তার হক চোখ বন্ধ করলেন। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে সামনে ঝুঁকে এসে বললেন, রাহাত সাহেব, আমি আপনাকে সত্য কথাই বলব। আপনার মস্তিষ্কের টিউমারটা অনেক বড়। আপারেশনের মাধ্যমে আপনার এই টিউমার ফেলে দেয়া মানে মস্তিষ্কের কিছু অংশ কেটে বাদ দেয়া। সেক্ষেত্রে অপারেশনের সাফল্য সম্পর্কে আমি আপনাকে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারব না। সত্যি কথা বলতে কি আমাদের দেশে কখনো এত বড় অপারেশন হয়নি। উন্নত বিশ্বে হয়েছে, কিন্তু সেখানেও সাফল্যের হার খুব কম।
রাহাত সাহেব ম্লান হেসে আবারো বললেন, ডাক্তার হক, আপনি কি বলবেন আমি আর কতদিন বাঁচব?
এ-প্রশ্নের উত্তর আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও বলছি, আপনি যদি ওষুধগুলো নিয়মিত খান এবং ওষুধগুলো ঠিকমতো কাজ করে অন্তত একমাস স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারবেন। তবে কেমোথেরাপি…
থাক থাক, আমি আর শুনতে চাচ্ছি না। আমি বুঝতে পারছি আমার আয়ু সর্বোচ্চ এক মাস। অর্থাৎ আমি আর একটা মাস আমার ছেলের পাশে থাকতে পারব। এ কটা দিন আমাকে আমার ছেলের পাশে থাকতে দিন। আমাকে আর হাসপাতাল, কেমোথেরাপির কথা বলবেন না।
কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন রাহাত সাহেব। রাহাত সাহেব, আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন। আপনার ছেলের কথা চিন্তা করেও আপনার..। বোঝাতে চেষ্টা করলেন ডাক্তার হক। কিন্তু তিনি কথা শেষ। করতে পারলেন না। তার আগেই চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন রাহাত সাহেব।
ডাক্তার হক রিপোর্টগুলোর দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। সত্যি তিনি যদি রাহাত সাহেবের জন্য কিছু করতে পারতেন তাহলে তার ভালো লাগত। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষমতা নেই রাহাত সাহেবকে বাঁচিয়ে রাখার। তার মস্তিষ্কের টিউমারের প্রত্যেকটি কোষই কারসিনেজোনিক বা ক্যান্সার সেলে পরিণত হয়েছে। ফলে কোষগুলো দ্রুত বিভাজিত হয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল আর অপরিপক্ক কোষের সৃষ্টি করছে। কেমোথেরাপিও বন্ধ করতে পারছে না এই বিভাজন। একারণেই ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে রাহাত সাহেবের মস্তিষ্ক এবং খুব অল্পসময়ের মধ্যেই মারাত্মক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবেন তিনি।
২
রাহাত সাহেব চাকরিটা ছেড়ে দিতেই গিয়েছিলেন। রেজিগনেশন লেটারও জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু অফিস সেটা গ্রহণ করেনি। দীর্ঘদিন সততা, দক্ষতা এবং একনিষ্ঠতার সাথে দায়িত্ব পালন করার জন্য কর্তৃপক্ষ তাকে তিন মাসের ছুটি প্রদান করেছে। অবশ্য ছুটি প্রাপ্তি রাহাত সাহেবের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি। কারণ তিনি জানেন তার আয়ু আর মাত্র একমাস। এরই মধ্যে আবার দুটো দিন পার হয়েছে। এই দুটো দিন তিনি অপেক্ষা করেছেন রনির ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার জন্য। আজ রনির পরীক্ষা শেষ হবে। পরীক্ষা শেষে সবকিছু গোছগাছ করে আগামীকাল সকালে রওনা দেবেন গ্রামের উদ্দেশে।
ক্লাস সিক্সের ছাত্র রনি অবশ্য এসবের কিছুই জানে না। সে শুধু জানে তার বাবা ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত এবং দ্রুত সেরে উঠবে। ডাক্তার তার বাবাকে অধিক পরিশ্রম করতে নিষেধ করেছে। তাই কয়েকদিন ধরে স্কুল ছুটি হলে তার বাবা আর তাকে স্কুল থেকে নিতে আসছে না। তাই পরীক্ষা শেষে রনি যখন স্কুলের গেটে তার বাবাকে দেখল তখন অবাক হয়ে বলল, বাবা তুমি!
রাহাত সাহেব মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ আমি, তোমাকে নিতে এলাম।
অফিস থেকে চলে এসেছ বুঝি?
না ছুটি নিয়েছি।
ছুটি নিয়েছ!
হ্যাঁ।
কতদিনের?
একমাসের।
একমাসের! কি করবে এত লম্বা ছুটি দিয়ে?
গ্রামের বাড়িতে যাব। সেখানেই থাকব।
সত্যি! চোখ বড় বড় করে বলল রনি।
হ্যাঁ। ভাবছি এবার দীর্ঘদিন গ্রামে থাকব। অনেকদিন গ্রামে থাকা হয় না।
বাবা, আমিও তোমার সাথে থাকব। সামনের একমাস আমার স্কুলও বন্ধ। এবার কিন্তু আমরা খুব মজা করব। কাদের যাবে না?
হুঁ যাবে। ও অবশ্য দু’দিন পরে যাবে।
কাদের হলো রনিদের বাসার কাজের ছেলে। বয়স আঠার উনিশ হবে। বাড়ি তাদের গ্রামেই। সে খানিকটা বোকা গোছের হলেও খুবই বিশ্বস্ত। বাসার বাজার ঘাট, রান্না-বান্না, ধোয়া-মোছা থেকে শুরু করে সব কাজ সে-ই করে। গত কয়েকদিন ধরে কাদেরই তাকে স্কুলে দিয়ে যাচ্ছে আবার নিয়ে যাচ্ছে। এজন্য রনি স্কুল শেষে প্রতিদিন কাদেরকেই আশা করে। আজও তাই করেছিল। কিন্তু পরীক্ষার শেষ দিনে সে তার বাবাকে দেখে সত্যি দারুন খুশি। তাই রিকশায় উঠেই আব্দার করে বসল, বাবা, আজ কিন্তু তুমি আমাকে আইসক্রীম খাওয়াবে।
না না, আজ আইসক্রীম খাওয়া হবে না।
কেন বাবা? আজ তো আমার পরীক্ষা শেষ।
ভাবছি…
কি ভাবছ?
আজ অন্য কিছু খাওয়া যায় কি না।
কি বাবা? রাহাত সাহেবের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল রনি।
আজ তুমি খাবে তোমার পছন্দের খাবার। পাকুড়া, থাই স্যুপ, চিকেন ফ্রাই, চাইনিজ রাইস, প্রন কারি আর তারপর তারপর.. আইসক্রীম। মৃদু হেসে বললেন রাহাত সাহেব।
রিকসার মধ্যেই লাফ দিয়ে উঠে রাহাত সাহেবের গলা জড়িয়ে ধরল রনি। তারপর বেশ জোরেই বলে উঠল, ইউ আর রিয়েলি গ্রেট! মাই গ্রেট গ্রেট ফাদার!
রাহাত সাহেব কিছু বললেন না। ছেলেকে তিনি জোরে নিজের মধ্যে চেপে ধরলেন। এ মুহূর্তে তার সত্যি খুব ভালো লাগছে। সন্তানের ভালোবাসা যে কীভাবে পিতৃত্বকে আবেগাপ্লুত করে তা তিনি যেন নতুন করে উপলব্দি করলেন।
রনি কি কি খেতে পছন্দ করে রাহাত সাহেবের সবই জানা ছিল। তাই রেস্টুরেন্টে এসে সবগুলো আইটেমেরই অর্ডার দিলেন তিনি। রনিও বেশ তৃপ্তির সাথে খাবারগুলো খেল। রাহাত সাহেবও খেলেন। রনির মনে যেন কোনো অতৃপ্তি না থাকে তাই খাওয়া শেষে তিনি বললেন, তুমি আর কিছু নেবে?
না বাবা না, যথেষ্ট হয়েছে।
আর একটা আইসক্রীম?
অসম্ভব বাবা।
তুমি কিছু কিনবে রনি? হঠাই প্রশ্নটা করলেন রাহাত সাহেব।
রনি ভ্রূ কুঁচকে তার বাবার দিকে তাকাল।
রাহাত সাহেব বললেন, বলছিলাম আমরা গ্রামে যাব। তুমি যদি কিছু কিনতে চাও তাহলে বলতে পার।
রনি একটু ভেবে বলল,তুমি কি সত্যি কিনে দেবে?
অবশ্যই কিনে দেব। কি কিনবে?
একটা ফুটবল।
ফুটবল?
হ্যাঁ বাবা। আমি গ্রামে যেয়ে সবার সাথে বল খেলব। গতবার যখন গিয়েছিলাম তখন ওদের বল ছিল না। আমাকে খুব করে বলেছিল একটা বল। কিনে দিতে। আমি তোমাকেও বলেছিলাম। কিন্তু পায়ে ব্যথা পাব এই ভয়ে তুমি কিনে দাওনি।
হ্যাঁ আমার মনে আছে।
এবার কি কিনে দেবে?
রাহাত সাহেব মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, তোমার আবেদন মঞ্জুর করা হলো।
থ্যাংক ইউ বাবা। থ্যাংক ইউ। লাফিয়ে উঠে বলল রনি।
আর কিছু?
হুম…। আর একটা জিনিস কিনে দিতে পার।
কি?
টর্চ লাইট। গ্রামে মাঝে মাঝেই রাতে ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। তখন খুব সমস্যায় পড়তে হয়। আমাকে কয়েকটা টর্চলাইট কিনে দাও বাবা।
কয়েকটা দিয়ে কি করবে?
আমার গ্রামের বন্ধুদের দেব। ওরা তো খুব গরীব। রাতে পথ চলতে ওদের খুব কষ্ট হয়। টর্চ থাকলে খুব সুবিধা হবে।
ঠিক আছে আমি তোমাকে অনেকগুলো টর্চ কিনে দেব।
সত্যি বাবা!
হ্যাঁ সত্যি।
আমার বন্ধুরা যে কী খুশি হবে তোমাকে বোঝাতে পারব না! উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল রনি।
রাহাত সাহেব এবার সামনে ঝুঁকে এসে বললেন, আর কিছু?
আরো কিছু! বিস্মিত কণ্ঠ রনির।
হ্যাঁ।
তু..তুমি আমাকে আজ এত কিছু দিতে চাচ্ছ কেন বাবা!
মানুষের জীবনে কিছু কিছু দিন আসে যেগুলো থাকে শুধুই আনন্দের, শুধুই উপভোগের, শুধুই প্রাপ্তির। মনে করো তোমার জীবনে আজ সেরকমই একটা দিন।
রনি একটু সময় নিল। তারপর বলল, তাহলে আমাকে এক হাজার টাকা দেবে।
টাকার কী প্রয়োজন এ ব্যাপারে রাহাত সাহেব কোনো প্রশ্নই করলেন না। তিনি হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন, এক হাজার টাকায় হবে, নাকি আরো বেশি?
এক হাজার টাকা হলেই চলবে।
ঠিক আছে দেব।
সবগুলো দশ টাকার নোট এবং নতুন। চোখ বড় বড় করে বলল রনি। একটু থেমে নিজে থেকে আবার বলল, আমি কতগুলো বঁড়শি কিনব, ঘুড়ি উড়ানোর লাটাই কিনব আর..
রাহাত সাহেব রনিকে শেষ করতে না দিয়ে বললেন, তুমি নতুন নোটই পাবে এবং সবগুলো দশ টাকার নোট। তুমি যেভাবে ইচ্ছে টাকাগুলো খরচ করতে পার। আমাকে বলতে হবে না।
তুমি অসাধারণ বাবা! অসাধারণ! আমি নিশ্চিত, গ্রামে যেয়ে এবার আমি খুব আনন্দ করব। আমার বন্ধুরাও দারুন খুশি হবে।
আমি খুব খুশি হচ্ছি যে তুমি তোমার বন্ধুদের কথা ভাবছ? বললেন রাহাত সাহেব।
ওরা খুব গরীব বাবা, খুব গরীব। অল্পতেই ওরা খুব খুশি হয়। রাহাত সাহেব আবারো হাসলেন। তারপর বললেন, আমার এখন কি হতে ইচ্ছে করছে জানো?
কি বাবা? আগ্রহ নিয়ে বলল রনি।
তোমার বন্ধুদের মতোই গ্রামের খুব সাধারণ একটা ছেলে হতে। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন তোমার বন্ধুদের মতোই আনন্দ করতাম, ছুটে বেড়াতাম ফসলের মাঠে, খোলা আকাশে উড়িয়ে দিতাম লাল রঙের ঘুড়ি, ডুবে ডুবে চোখ রাঙাতাম খালের নতুন পানিতে, নতুন কেনা ছুরিতে কেটে খেতাম বৈশাখের কচি কচি আম, শীতের রাতে বিলের মাঝে ছোলা পোড়ানোর উৎসব বসাতাম, পুরো বর্ষায় ছুটে যেতাম ঝম্ঝম বৃষ্টির নিচে, শরতের মেলায় চুরি করতাম ঘোষের জিলাপি- আর তাতে ঘোষের কী রাগ! তুমি যদি দেখতে! এই বলে হো হো করে হেসে উঠলেন রাহাত সাহেব।
রনি খুব অবাক হলো দেখে যে হাসির মধ্যেও তার বাবার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল তার বাবার চোখে পানি। হঠাৎই সে তার বাবাকে দারুণভাবে অনুভব করল। তাই তো সে উঠে তার বাবার সামনে এসে দাঁড়াল।
রাহাত সাহেব ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন, এবার আমি তোমার মতো ছোট হয়ে যাব বাবা। তোমার সাথে মাছ ধরতে যাব, তোমার সাথে ঘুড়ি উড়াব, তোমার সাথে বল খেলব, অন্ধকার রাতে টর্চলাইট নিয়ে অভিযানে যাব.. আরো আরো অনেককিছু, তুমি যা বলবে-চাইবে তার সবকিছুই।
রনি এবার নিজেই তার বাবাকে জোরে আঁকড়ে ধরল। তার বাবা যে অন্যদিনের তুলনায় আজ কিছুটা ভিন্ন সেটা বুঝতে তার অসুবিধা হলো না। আর এ-কারণেই এতকিছু প্রাপ্তির আনন্দটা সে সম্পূর্ণ উপভোগ করতে পারল না। কেন তার বাবার মনটা এত বিষণ্ণ সেটা জানতে অস্থির হয়ে উঠল তার ছোট মনটা।
৩
রাত এগারোটা। রাহাত সাহেব টেবিলের উপর কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে রেখে রনির ঘরে এলেন। রনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নতুন কেনা বলটাকে সে কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। দুহাতে বলটাকে ঘুমের মধ্যেই আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সে। বোঝা যাচ্ছে বলটা পেয়ে সে খুব খুশি। রাহাত সাহেব অনুমান করলেন, গ্রামে যাওয়ার পর বলটাকে নিয়ে রনি কি কি করবে এই চিন্তা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। ঘরের লাইটটাও বন্ধ করেনি। অথচ রনি লাইট জ্বালিয়ে কখনোই ঘুমাতে পারে না।
রাহাত সাহেব রনির শরীরে চাদর টেনে দিলেন। তারপর লাইটটা বন্ধ করে বেরিয়ে এলেন রনির ঘর থেকে। বাসার মূল দরজাটা বন্ধ করা হয়েছে কিনা
সেটা পরীক্ষা করে এলেন কাদেরের ঘরে। কাদের বিছানার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার হাতের মুঠোয় নতুন একটা দশ টাকার নোট। রনি তাকে দিয়েছে। নোটটা পেয়ে সে মহাখুশি। রাহাত সাহেব প্রতিমাসেই কাদেরকে ভালো বেতন দেন। বেতনের সম্পূর্ণ টাকাটাই কাদেরের থেকে যায়। কারণ তার থাকা খাওয়ার কোনো খরচ নেই। অথচ কেন যে এই দশ টাকাকে কাদের এতটা মূল্যায়ন করছে সেটা তিনি বুঝতে পারলেন না। টাকাটা পাওয়ার পর কাদের তাকে দু’বার নোটটা দেখিয়েছে এবং একই সাথে আনন্দের অভিব্যক্তিও প্রকাশ করেছে। কাদেরের আচরণে রাহাত সাহেব নিজে নিজেই হেসেছেন।
রাহাত সাহেব এবার তার নিজের ঘরে ফিরে এলেন। আগামীকাল খুব সকালে তারা রওনা দেবেন। কাদের অবশ্য কয়েকদিন পরে আসবে। তিনি যে স্থায়ীভাবে বাড়ি চলে যাচ্ছেন সেটা এখনো কাদেরকে বলেননি। এখন বললে রনি সবকিছু জেনে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে রনির দিনগুলো দুঃসহ হয়ে উঠবে এই আশঙ্কায় কাউকেই কিছু বলেননি তিনি। কিছুদিন পর কাদেরকে ফোন করে মালামাল নিয়ে বাড়ি চলে আসতে বলবেন। এই কটা দিন রনিকে নিয়ে হাসি আনন্দে কাটিয়ে দেবেন। এটাই তার পরিকল্পনা। অবশ্য তিনি বুঝতে পারছেন হাসি-আনন্দটা খুব বেশিদিন স্থায়ী হবে না। কারণ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে তার শরীর। মাঝে মাঝে অসহনীয় একটা ব্যথা হয় মাথার মধ্যে। মনে হয় কেউ বুঝি সুই দিয়ে তার মাথার মধ্যে খোঁচাচ্ছে। খুব কষ্ট হয় তখন। আগে ওষুধ খেলে ব্যথাটা কমত। এখন ব্যথানাশক ইনজেকশনের প্রয়োজন হয়। রাহাত সাহেব বুঝতে পারেন এই ব্যথাটাই একসময় তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ব্যাগটা চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করলেন রাহাত সাহেব। যা যা নেয়া দরকার সবই নেয়া হয়েছে। অবশ্য খুব বেশি কিছু নিচ্ছেন না তিনি। কারণ অধিকাংশ জিনিসই আর তার কোনো কাজে আসবে না। এগুলো কাদের যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নেয়া হয়েছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর এসে দাঁড়ালেন দেয়ালে টাঙান রনির মায়ের ছবিটার সামনে। কিছুক্ষণ স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে বলতে থাকলেন,
সালমা, ইদানিং তোমার কথা খুব বেশি মনে পড়ে। হয়তো তোমার কাছে যাচ্ছি এজন্য। তোমার কাছে যাচ্ছি এটা সত্যি আনন্দের কথা। কিন্তু কেন যেন এই আনন্দটা আমি উপভোেগ। করতে পারছি না। হয়তো রনিকে একা ফেলে যেতে হচ্ছে এজন্য। বিশ্বাস করো, কষ্টে যন্ত্রণায় মুষড়ে থাকে বুকটা। কষ্ট হবেই বা না কেন? বিয়ের কতদিন পর আমরা রনিকে পেয়েছিলাম! মনে আছে? সাত বছর। যেদিন প্রথম উপলব্দি করেছিলাম আমাদের সন্তান হবে সেদিন কতটাই না সুখী হয়েছিলাম। অথচ সুখের হাওয়ার স্পর্শ পাওয়ার আগেই চলে গেলে তুমি। যাওয়ার সময় রনিকে রেখে গেলে আমার কোলে। বিশ্বাস করো সালমা, আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিটা ক্ষণ, প্রতিটা মুহূর্ত তোমার সন্তানের কথা চিন্তা করেছি আমি। আমি সবসময়ই জানতাম তুমি আমার আশেপাশেই আছ। তোমার সন্তানের হাসি তোমাকে প্রশান্তি দেবে- এই ভাবনা থেকে আমি সবসময় চেষ্টা করেছি রনিকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। কিন্তু আর পারলাম না সালমা। আজ আমি একেবারে অসহায়। শূন্য হাতে আমি ফিরে আসছি তোমার কাছে। প্রকৃতি মাঝে মাঝে বড় নির্মম, বড় নিষ্ঠুর আচরণ করে। প্রকৃতির এই নিষ্ঠুরতার রহস্য বোঝা বড় কঠিন। আমার এখন খুব ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে ফিরে পাই। তুমি যদি থাকতে রনিকে অন্তত তোমার কাছে রেখে আমি শান্তিতে মরতে পারতাম। কিন্তু আ..আমি এখন কী করব? তুমি বলে দাও সালমা, বলে দাও। আর মাত্র একটা মাস! তারপর, তারপর একেবারে এতিম হয়ে পড়বে আমাদের সন্তান। কোথায় থাকবে, কার কাছে যাবে, কী খাবে, ভাবতেই অস্থির হয়ে উঠছি আমি। বড় কষ্ট সালমা! বড় কষ্ট! তুমি আমাকে বলে দাও আমি এখন কী করব?
এই বলে দেয়ালের উপর মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে উঠলেন রাহাত সাহেব। কিছুক্ষণ পর শরীরে হালকা স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকালেন তিনি। রনিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললেন, তুমি ঘুমাওনি?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রনি উল্টো প্রশ্ন করল, তোমার মন খারাপ বাবা?
না না। দ্রুত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করলেন রাহাত সাহেব।
তাহলে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়েছিলে যে?
হঠাৎ তোমার মায়ের কথা মনে পড়েছিল তাই। চলো ঘুমাবে, তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আসি।
আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাব।
রাহাত সাহেব মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, আমার সাথে ঘুমাবে।
তুমি ওষুধ খেয়েছ বাবা?
না খাইনি।
তোমার তো আগেই খাওয়া উচিত ছিল।
আগে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেই। তারপর খাব।
না আগে ওষুধ খাবে। তারপর আমি ঘুমাব।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তাই হবে। আমার বাবাটা চাইলে কী আমি আর না খেয়ে পারি।
এই বলে রাহাত সাহেব রনির চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লেন রনির পাশে। লাইট বন্ধ করে দিতে রনি বলল, বাবা?
হ্যাঁ বলো।
তোমার কি খুব মাথা ব্যথা করছে?
না বাবা, আমি ঠিক আছি।
আমি কি তোমার মাথা টিপে দেব? চুল টেনে দেব?
না তুমি ঘুমাও।
না, তোমার মাথা টিপে দিচ্ছি। তোমার ভালো লাগবে।
তুমি ঘুমাবে না?
আজ আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।
রাহাত সাহেব হেসে উঠে বললেন, ঠিক আছে দাও।
রনি তার বাবার মাথা টিপে দিতে লাগল। মাঝে মাঝে চুলও টেনে দিচ্ছে সে। খুব ভালো লাগছে তার। মাঝে মাঝে সে ভাবে রাতে সে বাবার পাশে ঘুমাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়ে উঠে না। সে নাকি অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন নাকি তাকে আলাদা ঘরে শুতে হবে। অথচ প্রায় রাতেই ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বাবাই তার পাশে শুয়ে আছে। তখন খুব ভালো লাগে তার। আজও তার খুব ভালো লাগছে। যখন বুঝতে পারল তার বাবা তারই হাতের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে তখন তার ভালো লাগাটা আরো বাড়ল।
৪
রনিদের গ্রামের বাড়িটা ছোট্ট হলেও সুন্দর। বাড়ির সামনে বড় উঠোন, একপাশে মাঝারি আকৃতির একটা পুকুর, অন্যপাশে বিশাল ফলের বাগান। এমন কোনো ফলের গাছ নেই যা ঐ বাগানে নেই। কয়েকটা গাছ আছে যেগুলো অনেক বড় এবং উঁচু। একটা তেঁতুল গাছ তো বিশাল উঁচু। বয়স তিনশ, চারশ কিংবা পাঁচশ বছর গাছের বয়স নিয়ে সন্দেহ থাকলেও গাছটি যে গ্রামের সবচেয়ে উঁচু গাছ এ ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ নেই। সাধারণত তেঁতুল গাছ এত উঁচু হয় না। অথচ এই তেঁতুল গাছটা একেবারে সোজা উপরের দিকে উঠে যেন আকাশ ছুঁয়েছে। গাছটাতে ডালপালাও অনেক। নিচ থেকে উপরের দিকে তাকালে উপরটা আর দেখা যায় না। তেঁতুলও ধরে প্রচুর। আর ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাপারটা হলো সারা বছরই এই গাছে তেঁতুল থাকে এবং তেঁতুলগুলো অতটা টক না, কাঁচা থাকতেই মিষ্টি মিষ্টি লাগে। এজন্য গ্রামের সবার কাছে এই গাছের তেঁতুল খুব প্রিয়।
রনিদের বাড়ির পিছনে শুরু হয়েছে জমিদার বাড়ির সীমানা। অনেক আগে এ এলাকায় একজন জমিদার ছিল। তার ছিল অনেক জমি। জমিদারের জমির এদিকটা ছিল বাগান, গাছপালায় পূর্ণ। দীর্ঘদিনের অযত্ন আর অবহেলায় বাগানটা এখন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে ভগ্নপ্রায় বাড়িটা। সামনে বিশাল পুকুর। আর পুকরের ওপাশে শুরু হয়েছে ফাঁকা বিল। এজন্য জমিদার বাড়ি থেকে সামনে অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। জমিদার বাড়ির সামনে যেয়ে দাঁড়ালে যে কেউ এখনো মুগ্ধ হবে।
বছর পাঁচেক আগে প্রচন্ড এক ঝড়ে জমিদার বাড়িটা ধ্বসে পড়ে। আগে লোজন ওদিকটা দেখতে গেলেও বাড়িটা ধ্বসে যাওয়ার পর এখন আর কেউ যায় না। সম্পূর্ণ বাড়িটা এখন জঙ্গলে ঘিরে আছে। গতবার রনি যখন বাড়ি এসেছিল তখন বন্ধুদের সাথে একবার ওদিকে গিয়েছিল। কিন্তু বাড়িটার ভিতরে ঢুকতে সাহস পায়নি। বাড়িটাকে কেমন যেন ভৌতিক ভৌতিক লাগে। তাই সে শুধু চারপাশ থেকে দেখে ফিরে এসেছিল।
রনি তার গ্রামের বন্ধু মিলন, জাফর, রহিম, আব্দুল, রউফ, বাশার, হাসান, জব্বার, হোসেন, হাবিব এরকম প্রায় পনেরজনকে নিয়ে বাড়ির বাগানের তেঁতুল গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। বন্ধুদের সবার গায়ে তার বাবার কিনে দেয়া জার্সি। বল কিনে দেয়ার সময় সবার জন্য একসেট জার্সি কিনে দিয়েছে তার বাবা। জার্সির পিছনে আবার নম্বর আছে। জার্সি আর বল পেয়ে সবাই যতটা না খুশি তার থেকে বেশি খুশি জার্সিতে নম্বর পেয়ে। জার্সি পরার পর সবাই অনেকক্ষণ একে অন্যকে জার্সি নম্বর দিয়ে ডাকাডাকি করেছে। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বল খেলায়। খেলা শেষে তেঁতুল খেতে ছুটে এসেছে তেঁতুল গাছের নিচে। সেখানে এসেই পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করতে বসল সবাই।
জাফর বলল, আমরা এহন কি করব?
খালে গোসল করবার যাব। আমি বল নিয়া সাঁতরাব। জব্বার উত্তর দিয়ে বলটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। বলটা জব্বারের কাছে সবসময়ই প্রিয়। প্রথম থেকেই বলটা সে তার কাছে রাখছে। খেলার সময় ছাড়া অন্য কোনো সময় সে বলটাকে নিজের হাতছাড়া করছে না। গতবার যখন রনি বাড়ি এসেছিল এই জব্বারই তাকে বারবার বলের কথা বলেছিল। এমন কী ঢাকা যাওয়ার পর মোবাইল ফোনে ফোন করেও বলেছে দুবার।
এদিকে জব্বারের প্রস্তাবের বিপক্ষে মত দিয়ে বাশার বলল, না না। এহন গোসল না। সন্ধ্যা হবার এহনো অনেক দেরি, আমরা..
রনি বাশারকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন তোমাদের আমি নতুন একটা জিনিস দেব।
সবাই একসাথে বলল, কি?
তোমাদের জন্য বাবা টর্চ লাইট কিনে দিয়েছে। আমি টর্চ লাইটগুলো এখন। এখানে নিয়ে আসব।
মুহূর্তেই একসাথে হো হো করে চিৎকার করে উঠল সবাই।
রনি বলল, টর্চগুলো খুবই ভালো এবং শক্তিশালী। তোমরা অনেকদূর পর্যন্ত দেখতে পাবে। গতকাল আমি আর বাবা ঘুরে ঘুরে টর্চলাইটগুলো কিনেছি।
তুমি কী ব্যাটারী আনছ? উপরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল হাসান। হাসান অবশ্য রনির দিকেই তাকিয়েছিল। কিন্তু সে ট্যারা বলে যখন কারো দিকে তাকায় মনে হয় উপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
রনি বলল, হ্যাঁ এনেছি। তবে তোমরা ইচ্ছে করলে ইলেকট্রিসিটিতেও চার্জ করতে পারবে।
আমরা ইলেকট্রিসিটি পাব কোথায়? আমাগো ঘরে তো ইলেকট্রিসিটি নাই। বলল হাবিব।
আমরা যে কয়েকদিন আছি আমাদের এখানেই চার্জ করবে। কোনো অসুবিধা হবে না।
তাইলে তাড়াতাড়ি নিয়া আস। বলল জাফর।
হ্যাঁ হ্যাঁ তাড়াতাড়ি। এবার একসাথে চিৎকার করে উঠে বলল সবাই।
রনি কিছুক্ষণের মধ্যেই টর্চগুলো নিয়ে ফিরে এলো। সবাইকে একটা করে টর্চ দিতে সবাই যে কী খুশি! সবাই এদিক ওদিক আলো ফেলে বোঝার চেষ্টা করল টর্চগুলো কতটা শক্তিশালী। তারা যখন বুঝতে পারল আলো অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে তখন তাদের আনন্দ দেখে কে! তারা তেঁতুল খাওয়া বাদ দিয়ে একজন আরেকজনের চোখে টর্চের আলো ফেলতে লাগল। আলোগুলো এতটাই শক্তিশালী যে এই দিনের বেলাতেও তাদের অনেকের টর্চের আলোর দিকে। তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড একটা শব্দে চমকে উঠল সবাই। হাসান চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, কি…কি…হইল?
রনি বলল, মনে হচ্ছে বিস্ফোরণের শব্দ।
কোন জায়গায়? চোখ কুঁচকে বলল জাফর।
মনে হচ্ছে বিলের মধ্যে। চলো, এক্ষুনি যেতে হবে।
আর দাঁড়াল না কেউ। সবাই ছুট দিল বিলের দিকে। বাগান পার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে আরো কয়েকটা বাড়ি পার হয়ে তারা এসে পৌঁছাল বিলের প্রান্তে। আর বিলের প্রান্তে পৌঁছেই তাদের সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তাদের থেকে শ’পাঁচেক গজ দূরে খালের পাশে বড়সড় একটা ধাতব অবয়বে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আব্দুল বিস্ময় নিয়ে বলল, ঐডা কি?
রনি বিড়বিড় করে বলল, সম্ভবত কোনো প্লেন। বিধ্বস্ত হয়েছে।
কিন্তু প্লেন তো ঐরকম না। এইডা মনে হয় অন্য কোনোকিছু। বলল হাবিব। আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে। এটা অন্য কিছুই হবে। চলো যাই।
এই বলে সবাই আবার দৌড়াতে শুরু করল অদ্ভুত ধাতব অবয়বের দিকে। বিলের মধ্যে জমি-জমাতে যারা কাজ করছিল ততক্ষণে তারাও ছুটতে শুরু করেছে ধাতব অবয়বটার দিকে। গ্রাম থেকেও লোকজন আসতে শুরু করেছে এদিকে।
রনি ধাতব অবয়বের বেশ খানিকটা দূরে এসে থামল। জিনিসটাকে সে যতটা ছোট মনে করেছিল আসলে ততটা ছোট নয়। আকারে ছোটখাট তিনতলা একটা বাড়ির সমান হবে। তীর্যকভাবে নরম মাটিতে এসে পড়ায় সামনের অনেকখানি ভিতরে ঢুকে গেছে। উপরের অংশে এখনো আগুন জ্বললেও আগুনের তীব্রতা কমে এসেছে। কারণ গ্রামের মানুষজন যে যা পারছে বালতি, ঘটি, বাটি, বদনা সেটা দিয়েই পানি দিচ্ছে আগুনের উপর। তারা সবাই নিশ্চিত, এটা একটা প্লেন এবং ভিতরে মানুষ আছে। কিন্তু রনি ঠিকই বুঝতে পারল এটা কোনো প্লেন নয়, ইউএফও বা আনআইডেন্টিফাইড় ফ্লাইং অবজেক্ট। যে কোনো কারণেই হোক এটা এখানে বিধ্বস্ত হয়েছে এবং এটাতে করে ভিন গ্রহের কোনো প্রাণী এখানে এসে পৌঁছেছে।
একঘন্টার মধ্যে আগুন নিভে গেল। এরই মধ্যে পুলিশ এসে ঘিরে ফেলল সম্পূর্ণ জায়গাটা, সাংবাদিকরাও এসে উপস্থিত হয়েছে। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় পুলিশ মাইকে সবাইকে ঘরে ফিরে যেতে বলতে থাকল। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের তারা কিছুতেই আশেপাশে থাকতে দিচ্ছে না। একারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রনি থাকতে পারল না সেখানে। বিষণ্ণ মনে বড়ির দিকে পা বাড়াতে বাধ্য হলো সে। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে চারদিকে।
৫
রাতে টিভির সংবাদ শুনে বিস্মিত হলো রনি। আটটার সংবাদের প্রায় পুরোটাতেই বিধ্বস্ত মহাকাশযান সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রচার করা হলো যার সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপ,
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে বিধ্বস্ত আকাশযানটি ছিল একটি মহাকাশযান। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশ মহাকাশযানটির মালিকানা দাবি করেনি। ধারণা করা হচ্ছে মহাকাশযানটি মহাবিশ্বের অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছে। কারণ মহাকাশযানের মধ্যে এমন দুটো ধাতু পাওয়া গেছে যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। সম্ভবত মহাকাশযানটি পৃথিবীর পাশ দিয়ে কোথাও যাওয়ার সময় মারাত্মক যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পৃথিবীতে বিধ্বস্ত হয়। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো মহাকাশযানে ভিন গ্রহের প্রাণী জীবিত ছিল। কারণ মহাকাশযানের পাশেই বিশেষ এক ধরনের পদচিহ্নের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ ধরনের পদচিহ্ন পৃথিবীর কোনো প্রাণীর নেই। বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ করছে এই পদচিহ্নগুলো মহাকাশযানে অবস্থানরত প্রাণীরই হবে। আর এই ভিনগ্রহের প্রাণী মানুষের প্রতি বন্ধুসুলভ কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এজন্য নিরাপত্তার স্বার্থে আশেপাশের গ্রামের সকলকে রাতে বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। পাশাপাশি সবাইকে চারদিকে সজাগ দৃষ্টিও রাখতে বলা হয়েছে। কেউ যদি অপরিচিত কিছু দেখে তাহলে যেন সাথে সাথে নিকটতম থানায় খবর দেয়। এরই মধ্যে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে আগামীকাল সকাল থেকে তারা কাজ শুরু করতে পারবে।
রনি তার বাবার পাশেই বসেছিল। সংবাদটা সে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছে। এমন কী প্রতিবেদনে যে-সকল চিত্রও দেখাচ্ছিল সেগুলোতেও তার মনোযোগ ছিল। তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে যে পদচিহ্নগুলো দেখান হয়েছে সেগুলো সত্য নয়। কারণ মহাকাশযানের চারপাশে এত মানুষ ছুটাছুটি করেছে যে সেখানে আলাদাভাবে কোনো পদচিহ্নই থাকার কথা নয়। নিজের সন্দেহ দূর করতে সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা, তুমি কি মনে করো ভিনগ্রহের প্রাণীরা সত্যি আমাদের পৃথিবীতে এসেছে?
রাহাত সাহেব একটু সময় নিয়ে বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। মহাকাশযানটা যে পৃথিবীর নয় এটা তো সত্য?
তা সত্য।
তাই যদি সত্য হয় তাহলে ভিনগ্রহের প্রাণীর ব্যাপারটাও সত্য হতে পারে। কারণ মহাকাশযানটা তো আর একা একা এখানে আসবে না। নিশ্চয় কেউ চালিয়ে নিয়ে আসবে।
তা আসবে। তাহলে ভিনগ্রহবাসী সেই প্রাণী কোথায়?
এ প্রশ্ন তো সবারই। দেখা যাক কী হয়। আগামীকাল বিশেষজ্ঞরা আসবে। তদের অভিমত জানলে অনেক তথ্যই বের হয়ে আসবে।
সত্যি যদি ভিনগ্রহবাসী কোনো প্রাণী থাকে এবং পৃথিবীর মানুষ তাদেরকে খুঁজে পায় তাহলে তাকে কী করবে?
বোঝা মুশকিল। যদি প্রাণীটি বন্ধুসুলভ হয় তাহলে তো মানুষের বন্ধুই হয়ে যাবে। কিন্তু স্বভাবে যদি হিংস্র হয় তাহলে হয়তো মানুষই তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইবে না।
তোমার কি মনে হয়? প্রাণীটা বন্ধুসুলভ হবে নাকি আমাদের শত্রু হবে?
রাহাত সাহেব মৃদু হেসে বললেন, তোমার দেখি ভিনগ্রহবাসীকে নিয়ে খুব আগ্রহ।
বলো না বাবা?
রাহাত সাহেব আবারো খানিকটা সময় নিলেন। তারপর বললেন, আমার মনে হয় বন্ধুসুলভই হবে।
কেন?
কারণ যে প্রাণী এত বড় মহাকাশযান তৈরি করে মহাকাশে কোটি কোটি মাইল পাড়ি দিয়ে এখানে আসতে পারে সেই প্রাণী বুদ্ধিমানই হবে। আর বুদ্ধিমান প্রাণী বন্ধুসুলভ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া এই গ্রহে এসে প্রাণীটি বুঝতে পারবে এখানে বেঁচে থাকতে হলে তাকে মানুষের সাহায্য নিতে হবে। কারণ পৃথিবীতে মানুষই সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। সে আর যাই করুক মানুষের শত্রু হতে চাইবে না।
প্রাণীটি কি মানুষের থেকেও বুদ্ধিমান হবে বাবা?
হতে পারে। কারণ ওরা আমাদের গ্রহে চলে এসেছে কিন্তু আমরা ওদের গ্রহে। যেতে পারিনি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে স্বীকার করতে হবে ওরা আমাদের থেকে বেশি বুদ্ধিমান।
তুমি ‘ওরা’ বলছ কেন বাবা? তাহলে কি ভিনগ্রহের প্রাণীরা একের অধিক?
সেই সম্ভাবনাই বেশি। মহাশূন্যে নিশ্চয় কোনো প্রাণী একা ভ্রমণ করবে না। আমার বিশ্বাস, সত্যি যদি ভিনগ্রহের প্রাণী এসে থাকে তাহলে তারা একের অধিকই হবে।
রনি আর কোনো প্রশ্ন করল না। টিভিতে ইউএফও এবং এলিয়েন সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন শুরু হতে সেদিকে মনোযোগ দিল সে। এই ফাঁকে রাহাত সাহেব উঠে গেলেন। তার হালকা মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন এখনই না ঘুমালে এই ব্যথার তীব্রতা ধীরে ধীরে বেড়ে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছাবে।
রনি গভীর মনোযোগের সাথে টিভি দেখছিল। আধঘন্টা পর হঠাৎ একটা গোঙানীর শব্দে চমকে উঠল। কান খাড়া করতে বুঝতে পারল গোঙানীর শব্দটা তার বাবার ঘর থেকে আসছে। সাথে সাথে সে ছুটে গেল সেই ঘরে। যেয়ে দেখে তার বাবা বিছানায় উপুর হয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি কাছে যেয়ে বলল, কি ব্যাপার বাবা?
ব্যথাটা আবার উঠেছে। এই বলে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে রাহাত সাহেব শক্তভাবে বিছানায় পড়ে থাকলেন।
ওষুধ খেয়েছিলে না?
হু। কাজ হচ্ছে না।
রনি একটু ভাবল। তারপর বলল, বাবা, তুমি একটু ধৈর্য ধর। আমি ডাক্তার চাচাকে ডেকে নিয়ে আসছি। সে তোমার ইনজেকশন দিয়ে দেবে।
না না, এত রাতে তুমি পারবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই কমে যাবে।
আমি পারব বাবা, আমি পারব। তুমি ভেবো না।
তোমার ডাক্তার চাচার বাড়ি অনেক দূর।
আমি আড়াআড়ি বাগানের মধ্যে দিয়ে চলে যাব।
তাহলে আশেপাশের বাড়ি থেকে কাউকে নিয়ে যেও।
হ্যাঁ বাবা, নিয়ে যাব। তুমি একটু ধৈর্য ধর। আমি যাব আর আসব।
সাবধানে যেও। সাথে টর্চ নিও।
হ্যাঁ বাবা।
রনি আর কথা বলল না। সে বাইরে পা বাড়াল। সে বুঝতে পারছে তার বাবার ব্যথাটা এখন খুব বেশি। তা না হলে রাতের বেলায় কখনো তাকে ডাক্তার ডেকে আনার অনুমতি দিত না।
গ্রামে একজনই ডাক্তার আছে। সবাই তাকে রহমত ডাক্তার বলে চিনে। অবশ্য সে সম্পূর্ণ ডাক্তার না। ডিপ্লোমা ডাক্তার। ছোটখাট অসুখের ওষুধ-পত্র দেয়। তবে গ্রামে তার ভালোই সুনাম আছে। রনির বাবার সাথেও তার ভালো সম্পর্ক। আজ দুপুরের পর এসে দেখে গেছে। বলে গেছে প্রয়োজন হলে যেন তাকে খবর দেয়া হয়। এজন্যই ছুটে চলছে রনি।
রহমত ডাক্তারের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে সর্বোচ্চ পনের মিনিট লাগে। আর বাগানের মধ্যে দিয়ে আড়াআড়ি গেলে অর্ধেক সময়ে পৌঁছান সম্ভব। তাই আড়াআড়ি পথটাই ধরেছে রনি। বাগানের পথটা তার পরিচিত। ভিতর দিয়ে ছুটে যেতে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাছাড়া হাতে টর্চ তো আছেই।
রনি যখন তেঁতুল গাছের নিচে এলো তখন ‘উ উ’ অদ্ভুত একটা শব্দ শুনে থমকে দাঁড়াল সে। তেঁতুল গাছের নিচে এত রাতে উ উ’ কে শব্দ করতে পারে ভাবতেই শরীরের সমস্ত লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল তার।
আবারো ‘উ উ’ শব্দটা কানে এলো রনির।
শব্দের উৎস লক্ষ্য করে রনি তেঁতুল গাছের ওপাশে টর্চের আলো ফেলল। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। অথচ সে নিশ্চিত পিছনে কেউ আছে। কে আছে সেটাই অনুমান করতে পারছে না সে। হঠাৎ ভূত-প্রেতের কথা মনে পড়তেই ভয়ে সম্পূর্ণ শরীরটা ঝাড়া দিয়ে উঠল তার। আর দাঁড়াল না সে। দৌড় দিল বাগানের মধ্যে দিয়ে।
৬
রহমত ডাক্তার রাহাত সাহেবকে ইনজেকশন দিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যথাটা কমে এলো। আরো কিছুক্ষণ পর রাহাত সাহেব ঘুমিয়ে পড়লে সে বলল, রনি, আমার মনে হয় তোমার বাবার বাড়িতে থাকা ঠিক হচ্ছে না। তোমরা কালই শহরে চলে যাবে এবং সেখানে হাসপাতালে তোমার বাবাকে ভর্তি হতে বলবে।
বাবার অবস্থা কি খুবই খারাপ? শঙ্কিত কণ্ঠে বলল রনি।
অনেকটা সেরকমই। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ ব্রেইন টিউমার সারানোর মতো ক্ষমতা আমার নেই।
কিন্তু বাবা তো গ্রামে থাকতে চাচ্ছে।
এটা ঠিক হচ্ছে না। আমি বরং আগামীকাল এসে তোমার বাবাকে বুঝিয়ে যাব।
ঠিক আছে ডাক্তার চাচা।
আর হ্যাঁ। তোমার একা বাড়িতে থাকা ঠিক হচ্ছে না। তোমাদের না একটা কাজের ছেলে আছে? কি যেন নাম?
কাদের।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ও কোথায়?
ঢাকার বাসায় আছে।
আগামীকালই ওকে আসতে বলো যেন প্রয়োজনে রাতে আমাকে ডাকতে পারে। আর হ্যাঁ, তুমি রাতে এভাবে একা বের হবে না। আশেপাশের বাড়ি থেকে কাউকে ডেকে নিতে পারতে।
দেরি হয়ে যাবে ভেবে ডাকিনি।
ঠিক আছে যাও, শুয়ে পড়। রাতে তোমার বাবার পাশেই থেকো।
জ্বি থাকব।
আশা করছি রাতে আর তেমন কোনো সমস্যা হবে না। তোমার বাবা এখন গভীর ঘুমে আছে। সকালের আগে এ ঘুম ভাঙবে না। আমি সকালেই চলে আসব।
জ্বি চাচা।
এখন যাও শুয়ে পড়। তোমার এতটা আসাও উচিত হয়নি।
ঠিক আছে।
রহমত ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে রনি উঠোনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এসেছিল। ফিরে যাওয়ার সময় সে আবার শুনতে পেল ‘উ উ’ শব্দটা। সাথে সাথে তার অন্তঃরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। এতক্ষণ সে একবারও শব্দটা শুনেনি। যেই না রহমত ডাক্তার দূরে সরে গেছে তখনই হলো শব্দটা। ভয়ে একেবারে জমে গেল সে।
‘উ উ’ শব্দটা আবারো কানে এলো রনির। উঠোনের যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে তার বামপাশ থেকেই শুরু হয়েছে বাগানটা। সে নিশ্চিত বাগানের মধ্যে কয়েকটা গাছের পিছন থেকে আসছে এই শব্দ। ওদিকে এগোবে কী এগোবে না রনি যখন এরকম ভাবছে তখন শব্দটা আবারো শুনতে পেল সে।
রনি স্পষ্ট বুঝতে পারল কেউ তাকে বাগানের মধ্যে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। সে ঘড়ি দেখল, সাড়ে দশটা বাজে। গ্রামে এটা যথেষ্ট রাত। এত রাতে তাকে কারো প্রয়োজন হলে সে তাকে নাম ধরে ডাকবে, এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু কেউ নিজের পরিচয় গোপন করে তাকে বাগানের মধ্যে নিয়ে যেতে চাইছে সেহেতু সেই আত্মগোপনকারী ব্যক্তির উদ্দেশ্য যে ভালো নয় সে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরে ফিরে যাবে। অনেক চেষ্টায় ভয়টাকে দমিয়ে রেখে ঘরের দিকে দ্রুত পা বাড়াল সে।
রনি কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। বাগানের একটু ভিতরে হঠাৎ একটা টকটকে লাল রঙের আলো জ্বলে উঠল। আলোটা খুব অল্প জায়গা নিয়ে জ্বললেও তীব্রতা খুব বেশি। এরকম উজ্জ্বল আলো রনি আগে কখনো দেখেনি। আলোটা বারবার জ্বলছে এবং নিভছে। রনি নিশ্চিত হলো, যে আলো জ্বালাচ্ছে সে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে।
একদিকে কৌতূহল আর অন্যদিকে ভয় এই দুইয়ের মাঝামাঝি থেকে দ্বিধায় ভুগছে রনি। অবশেষে কৌতূহলই জয়ী হলো। টর্চ লাইটটা বন্ধ করে ধীর পায়ে সে এগিয়ে গেল বাগানের দিকে। বাগানের মধ্যে পা রাখতেই বন্ধ হয়ে গেল লাল আলোটা। রনির মনে হলো হঠাৎ সে যেন নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে গেল। সাথে সাথে টর্চ জ্বালাল সে। তারপর এগিয়ে গেল আরো ভিতরে। কিন্তু না, কিছুই নেই। একটু আগে যেখানে সে আলোটা দেখেছিল সেই জায়গাটা এখন একেবারেই ফাঁকা।
রনির ভয়টা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। সে যখন ফিরে আসার কথা ভাবছে ঠিক তখনই হাতের ডান পাশে ‘উ উ’ শব্দটা শুনে চমকে উঠল সে। সাথে সাথে টর্চের আলো ফেলল ডানদিকে। আর তাতেই তার চোখ দুটো বড় হয়ে গেল।
আধো অন্ধকারে রনি দেখতে পেল তার থেকে তিন চার হাত দূরে মোটা একটা জাম গাছের গোড়ায় অদ্ভুত একটা প্রাণী বসে আছে। প্রাণীটা দেখতে অনেকটা মানুষের মতোই। তবে আকারে অনেকটা ছোট, ফুট তিনেক লম্বা হবে। মানুষের মতোই হাত পা আছে প্রাণীটার। হাত-পাগুলোও ছোট ছোট। মাথায় কোনো চুল নেই, মাথার উপরটা বেশ চকচকে। চেহারায় কেমন যেন বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব। গলা থেকে পা পর্যন্ত বিশেষ একটা পোষাক পরা থাকায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে চোখ দেখে মনে হচ্ছে প্রাণীটা তাকে দেখেও ভয় পাচ্ছে। কেমন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। প্রাণীটার ডান হাতে মোবাইল ফোনের মতো ছোট্ট একটা ইলেকট্রনিক যন্ত্র। প্রাণীটা খুব সতর্কতার সাথে যন্ত্রটিকে তার দিকে তাক করে রেখেছে। আর বাম হাতটা শূন্যে ঝুলছে। হাতের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে হাতে মারাত্মক আঘাত পেয়েছে প্রাণীটা। মুখেও রক্তের ছোপ। কিছুক্ষণ আগে যে মুখ দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে মুখের জমাট বাঁধা রক্ত যেন তারই প্রমাণ।
রনিই আগে কথা বলল, তু..তুমি কে?
প্রাণীটা একেবারে মানুষের মতো টেনে টেনে উত্তর দিয়ে বলল, নি..কি।
তো..তোমার পরিচয়?
আমি ‘হিমিন’।
‘হিমিন’ কি? হিমিন হলো মানুষের মতোই এক প্রকার বুদ্ধিমান প্রাণী। আমি এসেছি অনেক দূরের গ্রহ থেকে।
তুমিই কি তাহলে ঐ মহাকাশযানে…
রনিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে নিকি বলল, হ্যাঁ, আমি ঐ মহাকাশযানে ছিলাম এবং এ মুহূর্তে তোমার সাহায্য আমার খুব প্রয়োজন। এজন্যই আলোর সংকেতের মাধ্যমে তোমাকে আমি এখানে ডেকে আনতে চেষ্টা করেছি।
আ..আমাকে কেন? ইতস্তত করে বলল রনি।
কারণ তুমি ছোট। তুমি নিষ্পাপ। তোমার চিন্তায় সরলতা আছে। আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে সাহায্য করবে।
আ..আমি…। চেষ্টা করেও কথা বলতে পারল না রনি।
হ্যাঁ তুমি, অবশ্য যদি তুমি চাও। আমার পক্ষ থেকে আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে তুমি আমার কোনো ক্ষতি না করলে আমিও তোমার কোনো ক্ষতি করব না। কাজেই আমাকে ভয় পাবে না। এখন বলো, আমার প্রতি তোমার
আচরণ কি বন্ধুসুলভ হবে নাকি শত্রুভাবাপন্ন? প্রশ্ন করল নিকি।
রনি তোতলাতে তোতলাতে বলল, অ..অবশ্যই ব..বন্ধুসুলভ।
কথা দিচ্ছ?
হ্যাঁ হ্যাঁ কথা দিচ্ছি। কাঁপা কণ্ঠে বলল রনি।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি?
হ্যাঁ পারো। এবারে খানিকটা জোর দিয়ে বলল রনি।
এই প্রথম নিকি তার মোবাইলের মতো যন্ত্রটাকে নিচে নামাল। রনি লক্ষ্য করল সেই সাথে লাল একটা আলো তার শরীরের উপর থেকে সরে গেল। রনি অনুমান করল নিকি এতক্ষণ তার দিকে লেসার রশ্মি তাক করে রেখেছিল। সে যদি সন্দেহজনক কিছু করত তাহলে যে এতক্ষণে তাকে পরজগতে চলে যেতে হতো সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। এখন পর্যন্ত সেরকম কিছু ঘটেনি দেখে সে কিছুটা সাহসী হয়ে উঠল। একই সাথে আতঙ্কিত হয়ে উঠল এই ভেবে যে মোবাইলের মতো দেখতে ঐ ইলেকট্রনিক অস্ত্র যেটাকে সে যন্ত্র ভেবেছিল এখনো নিকির হাতে আছে। আতঙ্কটা তাকে এতটাই জেঁকে ধরল যে তার হাত কাঁপতে লাগল।
নিকি এবার বলল, তোমার নাম কি?
র..রনি। ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল রনি।
নিকি এবার বলতে থাকল, আমি আবারো বলছি তুমি ভয় পাবে না। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। দুর্ঘটনাবশত আমি তোমাদের এই গ্রহে এসে পড়েছি। বর্তমানে আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি। তোমার সাহায্য আমার খুব প্রয়োজন। যদি তুমি আমাকে সাহায্য করতে না চাও তাহলে বলতে পারো। আমি তোমাকে আর বিরক্ত করব না। তবে কথা দিতে হবে আমার সাথে তোমার সাক্ষাতের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ গোপন রাখবে। তুমি ছাড়া অন্য কেউ জানবে না।
রনি স্থির চোখে তাকিয়ে আছে দেখে নিকি আবার বলল, আমি সত্যি খুব বিপদে আছি। আমার হাতে একদম সময় নেই। তোমার সাহায্য আমার খুব দরকার রনি। তা না হলে ওরা আমাকে হত্যা করবে। আমি আবারো বলছি, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার।
রনি উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে বলল, আ..আমি তোমাকে সাহায্য করব নিকি।
ধন্যবাদ রনি। আমি বিশ্বাস করছি আমাদের বন্ধুত্ব হবে বিশ্বাস এবং সৌহার্দের।
রনি শুধু উপরে নিচে মাথা দোলাল।
রনির হাত তখনো কাঁপছে দেখে নিকি বলল, তুমি তোমার হাতটাকে শক্ত করো।
রনি হাত শক্ত করতে পারছে না দেখে নিকি এবার নিজেই তার ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে রনির হাত স্পর্শ করল। তারপর মৃদু ঝাঁকি দিল হাতে। আর তাতে রনি কেঁপে উঠলেও তার ভয় অনেকটা কমে এলো। ব্যাপারটা বুঝতে পারল নিকি সে বলল, তুমি এখনই আমাকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে।
নিরাপদ জায়গা?
হ্যাঁ, যেখানে দিনের মতো আলো আছে এবং তুমি ছাড়া অন্য কেউ থাকবে না।
এত রাতে তো কোথাও আলো পাওয়া যাবে না। কিন্তু নিজেকে রক্ষার জন্য আমার আলোর খুব প্রয়োজন। তা না হলে গিগোরা আমাকে হত্যা করবে।
গিগো কারা?
সেটা পরে তোমাকে ব্যাখ্যা করব। এ মুহূর্তে আমার আলোর খুব প্রয়োজন।
তাহলে আমার ঘরে চলো। সেখানে ইলেকট্রিসিটির আলো আছে।
সেখানে আমি কি নিরাপদ থাকব?
আশা করছি। বাড়িতে বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। সে এখন ঘুমাচ্ছে। কাজেই অন্য কেউ তোমার কথা জানতে পারবে না।
নিকি কিছু একটা ভাবল। তারপর চারপাশে তাকিয়ে উদ্বিগ্নভাবে কাউকে যেন খুঁজল। সন্দেহজনক কাউকে না দেখে শেষে বলল, চলো। তবে অনুরোধ, টর্চ বন্ধ করবে না। তোমার টর্চটা খুব শক্তিশালী, যে কোনো সময় কাজে লাগবে হয়তো।
রনি হাঁটা শুরু করতেই নিকি তার পাশে চলে এলো। রনি লক্ষ্য করল নিকি বারবার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে এবং কেন যেন দ্রুত হাঁটতে চেষ্টা করছে। নিকি যে খুব বিপদে আছে সে তা বুঝতে পারল। তাই সে নিজেও দ্রুত পা চালাল।
৭
ঘরের মধ্যে এসে নিকি একটা টুলের উপর বসল। তারপর চারপাশটা দেখে বলল, রনি, তোমাদের এখানে কি সবসময় ইলেকট্রিসিটি থাকে?
রনি নিকির সামনেই খাটের উপর বসেছে। সে বলল, না, যে কোনো সময় চলে যেতে পারে।
তাহলে তো চারদিকটা অন্ধকার হয়ে যাবে। আমরা আলো পাব কোথায়? রনি একটু ভেবে বলল, আমাদের চার্জার লাইট আছে। সেটা বাবার ঘরে। তুমি বললে এ ঘরে নিয়ে আসি। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে চার্জার লাইট সাথে সাথে জ্বলে উঠবে।
তোমার বাবার অসুবিধা হবে না তো?
অসুবিধা হবে কেন? বাবা তো ঘুমিয়ে আছে।
ঠিক আছে তাহলে নিয়ে এসো। সম্মতি দিল নিকি।
রনি আর তার বাবার ঘরটা পাশাপাশিই বলা চলে। মাঝে শুধু ছোট্ট একটা ঘর। এটা ডাইনিং এর মতো, এখানে তারা খাওয়া দাওয়া করে। এক কোণায় একটা টিভিও আছে। এই ঘরটা থাকার কারণে খুব জোরে কথা না বললে এক ঘর থেকে তা অন্য ঘরে কথা পৌঁছাবে না। এ কারণে রনি নিশ্চিত, সে আর নিকি যে কথা বলছে তার বাবা জেগে থাকলেও সেগুলো শুনতে পাবে না।
রনি তার বাবার ঘর থেকে চার্জার লাইটটা নিয়ে এলো। তারপর লাইটের প্লাগটা ইলেকট্রিক সকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, এখন ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে লাইট জ্বলে উঠবে।
নিকি আরেকবার চারপাশটা পরীক্ষা করে দেখল। তারপর লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শান্ত হয়ে বসল টলের উপর। এতক্ষণ তাকে খুব অস্থির দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ বুঝি তাকে তাড়া করে ফিরছে। নিকি শান্ত হতে রনি বলল, তোমার মুখে রক্ত কেন?
নিকি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, তুমি কি আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারবে?
হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। এই বলে রনি উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে পৌঁছে বলল, আর কিছু খাবে?
নিকি ডানে বামে মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দিল।
রনি মাঝের ঘর থেকে পানি নিয়ে এলে নিকি তার অস্ত্রটা কোলের উপর রেখে ডান হাতে পানির গ্লাস নিল। রনি লক্ষ্য করল একান্ত প্রয়োজন না হলে বাম হাতটা নাড়াচ্ছে না নিকি। পানির গ্লাসে চুমুক দেয়ার আগে নিকি বলল, তোমাদের এই পানির গ্রেড কত?
রনি কিছুই বুঝল না। শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।
নিকি বলল, আমি পানির বিশুদ্ধতার মাত্রা জানতে চাচ্ছিলাম।
রনি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, আমি তো বলতে পারব না। তবে এটা আমাদের চাপ-কলের পানি। রাতে খাওয়ার আগে আমি নিজে কল থেকে নিয়ে এসেছি।
তুমি বিশ্বাস না করলে আমি তোমার সামনে খেতে পারি।
নিকি এবার হেসে উঠে বলল, না না রনি, তোমাকে খেতে হবে না। আমি তোমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করছি।
এই বলে নিকি একবারেই গ্লাসের সম্পূর্ণ পানিটুকু খেয়ে ফেলল। তারপর বলল, তোমাদের পানি আমাদের পানির মতোই। অবশ্য সকল পানির গঠনই এক।
দুই পরমাণু হাইড্রোজেন এবং এক পরমাণু অক্সিজেন। বিডুবিড় করে বলল রনি।
নিকি চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি তো দেখি জানো!
হ্যাঁ স্কুলে শিখেছি।
চমৎকার। তোমরা মানুষেরা যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে খুব উন্নতি লাভ করেছ তা আমরা হিমিনরা জানি। তোমাদের সভ্যতার উন্নতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ সত্যি বিস্ময়কর। মহাবিশ্বের ইতিহাসে কোনো প্রাণীরই এত দ্রুত উন্নতি করার নজির নেই। আর..উহ..উহ..।
কথা শেষ করার আগেই ব্যথায় মুষড়ে উঠল নিকি।
তাই দেখে রনি উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কী ব্যাপার? কি হলো?
বাম হাতে হঠাৎ হঠাৎই ব্যথাটা উঠছে।
কি হয়েছে তোমার বাম হাতে?
হাড় ভেঙ্গে না গেলেও হাড়ে যে ফ্রাকচার হয়েছে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
কিভাবে হলো?
গানশিপটা বিধ্বস্ত হওয়ার সময়। তবে কপাল ভালো যে বেঁচে আছি। মারা গেলেও কিছু করার থাকত না। গিগোরা মহাকাশ বিজ্ঞানে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। গানশিপটা বিধ্বস্ত হলো ঠিকই, কিন্তু শরীরে অতটা ঝাঁকি লাগল না, শুধু হাতে মারাত্মক চোটটা পেয়েছি। এটাই ওদের প্রযুক্তির সাফল্য।
গিগো কে?
ও তোমাকে তো বলাই হয়নি। গিগো হলো অন্য এক বুদ্ধিমান প্রজাতি, তবে আমাদের মতো অতটা উন্নত নয়। বিশেষ করে বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, নিউক্লিয়ার সায়েন্স এবং মেডিকেল সায়েন্সে ওরা আমাদের ধারে কাছেও নেই। কম্পিউটার এবং ইলেকট্রনিক্সে গিগোরা উন্নতি সাধন করলেও আমাদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। এজন্য ওরা সুযোগ পেলেই আমাদের প্রযুক্তি চুরি করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যাপারটা খুবই কষ্টসাধ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ওরা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন শুরু করেছে। সুযোগ পেলেই আমাদের অর্থাৎ হিমিনদের ধরে নিয়ে যায়। তারপর তার উপর অত্যাচার করে প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জেনে নেয়ার চেষ্টা করে। এভাবে বেশ কিছু তথ্য ওরা জেনে গেছে। এজন্য ওদের সাথে আমাদের ছোট-খাট যুদ্ধ সবসময়ই লেগে থাকে। আর এরকমই এক যুদ্ধের সময় আমি ওদের হাতে ধরা পড়ে যাই। আমাকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে আমাদের একটা স্পেসশিপ তাড়া করে গিগোদের। একসময় আক্রমণও করে। আক্রমণের তীব্রতায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে গিগোরা। শেষে ছুটতে ছুটতে এসে বিধ্বস্ত হয় তোমাদের এই পৃথিবীতে। ঘটনাক্রমে আমি বেঁচে যাই। দুটো গিগোও বেচে আছে। সন্ধ্যার পর ওদেরকে আমি দেখেছি। ওরা আমাকে খুঁজছে। ধরতে পারলে নিশ্চিত ওদের গ্রহে নিয়ে আমার উপর অত্যাচার করবে। তারপর জেনে নেবে মেডিকেল সায়েন্সের সকল আধুনিক প্রযুক্তি।
তার মানে তুমি ছাড়াও এ গ্রহে আরো দুটো ভিনগ্রহের প্রাণী আছে! চোখ বড় বড় করে বলল রনি।
হ্যাঁ এবং ওরা মোটেও ভালো নয়। সুযোগ পেলেই আমাকে আটক করতে চেষ্টা করবে। আর না পারলে হত্যা করবে।
কিন্তু ওরা মহাশূন্যে ফিরে যাবে কিভাবে? ওদের মহাকাশযানটা তো বিধ্বস্ত হয়েছে।
তোমরা যেটাকে মহাকাশযান বলছ ওটা মূলত গানশিপ। এরকমই আর একটা গানশিপ অনুসরণ করে আসছিল আমাদের। আমার ধারণা ওটা পৃথিবীর কাছাকাছি কোথাও আছে। হয়তো চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীতে পৌঁছাবে।
কী বলছ! এতো সাংঘাতিক কথা! তাহলে তো ওরা তোমাকে আবার ধরে নিয়ে যাবে।
এজন্যই আমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে।
কিন্তু এভাবে তুমি কতদিন লুকিয়ে থাকবে?
আমাকে উদ্ধারের জন্য ছোটখাট একটি সামরিক স্পেসশিপ আসছে। আমার বিশ্বাস ওটাও পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এসেছে। কারণ আমি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে পৌঁছানোর পর ঐ স্পেসশিপের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম। আশা করছি ওটাও চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে পারবে। আর একবার আমাদের স্পেসশিপ পৌঁছে গেলে গিগোদের গানশিপ নিশ্চিত পড়িমড়ি করে ছুটে পালাবে।
তার মানে তোমাকে অন্তত একদিন লুকিয়ে থাকতে হবে।
হ্যাঁ একদিন। তবে বেশিও হতে পারে। এজন্যই তোমার সাহায্যের প্রয়োজন।
আমি তোমাকে সবরকম সাহায্য করব।
ধন্যবাদ রনি। তুমি সত্যি খুব ভালো ছেলে।
কিন্তু তুমি আহত। তোমার মুখে আমি রক্ত দেখেছি। নিশ্চয় মুখের ভিতরে কোথাও কেটে গেছে। আর বামহাতের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার কথা তো তুমিই বললে।
হু, খুব ব্যথা করছে। হাতের আঘাতটা মারাত্মকই বটে! আমি কি রহমত চাচাকে ডেকে আনব? সে এই গ্রামের ডাক্তার।
না না! আঁতকে উঠে বলল নিকি। তারপর একটু থেমে বলল, আমি নিজেই একজন ডাক্তার।
তুমি ডাক্তার! বড় বড় চোখে বলল রনি।
হ্যাঁ। বলতে পার হিমিনদের মধ্যে সবচেয়ে বিজ্ঞ ডাক্তারদের মধ্যে আমি একজন।
তাহলে তো তুমি নিজেই নিজের চিকিৎসা করতে পার।
পারতাম যদি কিনা আমার ট্রিটিসকোপটা সাথে থাকত।
ট্রিটিসকোপ কি?
ট্রিটিসকোপ হলো আমাদের ডাক্তারদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। ছোট্ট একটা বাক্সের মতো এই যন্ত্রটা সম্পূর্ণই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। এই ট্রিটিসকোপই রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে ওষুধ নির্ধারণ পর্যন্ত করে থাকে।
ওষুধ পর্যন্ত নির্ধারণ করে। বড় বড় চোখে বলল রনি।
এমন কি অপারেশনও করে। আমাদের শুধু ট্রিটিসকোপটা পরিচালনা শিখতে হয়। এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। কিন্তু দুঃখের বিষয় ট্রিটিসকোপটা গানশিপের মধ্যে রয়ে গেছে। গানশিপটা বিধ্বস্ত হওয়ার সময় এত দ্রুত বেরোতে হয়েছিল যে সেটাকে নিয়ে আসতে পারিনি।
ইস! তোমার ট্রিটিসকোপটা থাকলে খুব ভালো হতো। আপসোস করে বলল রনি। তারপর আবার বলল, আমাদের এখানে কিছু ওষুধ আছে। তুমি চাইলে আমি এনে দিতে পারি। আমি নিশ্চিত এই ওষুধগুলো তোমার ব্যথা কমিয়ে দেবে।
না না রনি, তোমাদের ওষুধ খাওয়া যাবে না। সাইড ইফেক্ট খুব বেশি!
তোমাদের ওষুধে বুঝি সাইড ইফেক্ট নেই?
আমাদের অসুখ-বিসুখ একেবারেই হয় না। আমরা অধিকাংশ রোগের প্রতিষেধক বা টীকা তৈরি করে ফেলেছি। আর যে সকল জটিল রোগ এখনো আছে সেগুলোর চিকিৎসায় আমরা সাধারণত আলোক রশ্মি এবং শব্দ শক্তি ব্যবহার করি। ওষুধের ব্যবহার খুবই কম।
আলোক রশ্মি এবং শব্দ শক্তি! কিভাবে! আবারো বড় বড় হয়ে গেল রনির চোখ।
তুমি ছোট মানুষ। তুমি সবকিছু বুঝবে না।
ও আচ্ছা। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রনি এবার বলল, তাহলে তোমার চিকিৎসার কি হবে?
কষ্ট করে সময়টা পার করতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তবে হাতটাকে নিয়ে সত্যি চিন্তায় আছি।
তুমি কি এখন ঘুমাবে? ঘুমালে আমার বিছানায় শুয়ে পড়।
আমি এখানে ঘুমালে তুমি ঘুমাবে কোথায়?
বাবার পাশে।
তুমি আমার পাশে শুয়ে পড়তে পার।
বাবার পাশে থাকতে হবে।
তুমি তো অনেক বড়। তোমার বাবার পাশে থাকবে কেন?
বাবা যে খুব অসুস্থ। মুখটা ম্লান করে বলল রনি।
কি হয়েছে তোমার বাবার?
ব্রেইন টিউমার। ডাক্তার বলেছে খুব নাকি মারাত্মক। আমি খুব ভয়ে আছি। আজ রাতে তীব্র ব্যথা উঠেছিল। শেষে দৌড়ে গেলাম রহমত চাচার কাছে। উনি এসে ওষুধ দিলে তারপর কমেছে। কিন্তু বাবার খুব কষ্ট হয়েছে।
ও, এজন্যই বুঝি তুমি বাগানের মধ্যে দিয়ে দৌড়াচ্ছিলে?
হু। তখন তুমি ‘উ উ’ করলে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।
আমি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছিলাম। কারণ তোমার সাহায্য আমার খুব প্রয়োজন ছিল।
আমি দুঃখিত। আমি তোমাকে অন্যকিছু ভেবেছিলাম। তোমাকে ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। বলল রনি।
এতে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। তোমার জায়গায় আমি হলে হয়তো ঐ একই কাজ করতাম। একটু থেমে নিকি আবার বলল, যদি তুমি কিছু মনে না করো আমি কি তোমার বাবাকে একটু পরীক্ষা করতে পারি?
অবশ্যই অবশ্যই! উদ্ভাসিত মুখে বলল রনি। তারপর আবার বলল, তুমি কি সকালেই পরীক্ষা করবে?
না এখন করতে চাচ্ছি। কারণ উনি এখন ঘুমিয়ে আছেন। আমার উপস্থিতি বুঝতে পারবেন না।
তাহলে এক্ষুণি চলো।
হ্যাঁ যাব। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তোমার বাবার ঘরের লাইটটা বন্ধ। তুমি লাইটটা জ্বালিয়ে দাও। আমি আসছি।
রনি সাথে সাথে ছুটে গেল তার বাবার ঘরে। এ মুহূর্তে সে খুব উত্তেজিত। তার কেন যেন মনে হচ্ছে নিকি তার বাবাকে সুস্থ করে তুলতে পারবে।
৮
নিকি রাহাত সাহেবের মাথার কাছে এক মিনিটও দাঁড়াল না। সে ফিরে এলো রনির ঘরে। রনি কিছুটা আহত হলো, তার মুখটাও কালো হয়ে গেল। নিকি যে তার বাবাকে মনোযোগ দিয়ে দেখেনি এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। তাই ঘরে ফিরে আসতে নিকি যখন রনিকে তার বাবার রিপোর্টগুলো আনতে বলল সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখটা। সে দ্রুত রিপোর্টগুলো এনে নিকির হাতে দিল। এক্সরে, এমআরআই, স্ক্যানিং, পাথলজি কোনোকিছুর রিপোর্ট বাদ গেল না।
নিকি প্রায় দশ মিনিট ধরে রিপোর্টগুলো খুব মনোযোগের সাথে দেখল। তারপর বলল, রনি, সত্যি কথা বলতে কী, তোমার বাবার টিউমারটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
বাবা ওষুধ খাচ্ছে। কিন্তু তারপরও কোনো উন্নতি হচ্ছে না। নিকিকে সমর্থন করে বলল রনি।,
ওষুধে কাজ না হওয়ারই কথা। মস্তিষ্কের কোষগুলো এত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে সে সাধারণ কোনো ওষুধ কাজ করবে না।
বাবা কেমোথেরাপিও নিয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
হু বুঝতে পেরেছি। এই বলে খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল নিকি।
রনি বলল, আমি বাবাকে খুব ভালোবাসি নিকি। বাবা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমার জন্মের সময় আমার মা মারা যায়। বাবাই আমাকে বড় করেছে। বাবাকে আমি খুব ভালোবাসি নিকি, খুব ভালোবাসি। তাই বাবার যখন খুব ব্যথা হয় তখন আমার খুব কষ্ট হয়। আমি বাবার জন্য কিছুই করতে পারি না।
নিকি ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, রনি, আমি তোমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছি। তোমার জন্য কিছু করতে পারলে আমি নিজেও খুব আনন্দিত হতাম। কিন্তু তোমার বাবার এমন অবস্থা যে উপযুক্ত চিকিৎসা ছাড়া তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বাবার উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। কোথায়! বিস্ফোরিত চোখে বলল রনি।
তোমাদের প্রযুক্তিতে নেই, আমাদের প্রযুক্তিতে আছে। কারণ আমরা মৃত্যুকে প্রায় জয় করতে চলেছি।
কী বলছ তুমি! বিস্মিত কণ্ঠ রনির।
হ্যাঁ রনি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমার পক্ষে তোমার বাবার জন্য কিছু করা সম্ভব হবে না। কারণ আমার কাছে ট্রিটিসকোপ নেই। যদি ট্রিটিসকোপটা আমার কাছে থাকত তাহলে আমি তোমার বাবাকে বাঁচাতে চেষ্টা করতাম।
রনি একেবারে হাঁ হয়ে গেলে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, তুমি যদি ট্রিটিসকোপটা ফিরে পাও তাহলে কি বাবাকে বাঁচাতে পারবে?
আমি বলেছি চেষ্টা করব। কিন্তু তুমি ট্রিটিসকোপটা পাবে কিভাবে?
আ..আমি জানি না। উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে বলল রনি।
কোনোভাবে যদি ট্রিটিসকোপটা আমি হাতে পাই তাহলে আমি তোমাকে কিছুটা হলেও আশার কথা শোনাতে পারতাম। কারণ তোমার বাবার থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ রুগীকে ট্রিটিসকোপের সাহায্যে আমি সুস্থ করেছি।
কি..কিন্তু ট্রিটিসকোপটা পাওয়াই সমস্যা। তুমি বলেছ সেটা বিধ্বস্ত গানশিপের মধ্যে আছে। সেখানে যাওয়াই তো মুশকিল। পুলিশ চারপাশটা ঘিরে রেখেছে। অনুমতি ছড়া গানশিপের আশেপাশে কাউকে ভিড়তে দিচ্ছে না পুলিশ।
তুমি কী সকালে চেষ্টা করলে পারবে না? যদি পুলিশকে বুঝিয়ে বল? তবে শর্ত একটাই, অবশ্যই আমার উপস্থিতির কথা পুলিশকে জানাতে পারবে না।
তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সকালে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ দল আসবে। তাদের সাথে অনেক পুলিশ, সাংবাদিকও আসবে। তারা কোনোভাবেই আমাকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেবে না। তাছাড়া আমি ছোট মানুষ, আমার কথা তারা পাত্তাও দেবে না। উপরন্তু তোমার কথাও আমি তাদের বলতে পারব না। কাজেই কোনোভাবেই আমাকে তারা বিশ্বাস করবে না। সেক্ষেত্রে আমি ট্রিটিসকোপটাও হাতে পাব না।
নিকি খানিকটা ভেবে বলল, হু, তাহলে আমরা একটা কাজ করতে পারি।
কি কাজ? আগ্রহ নিয়ে বলল রনি।
আমরা আজ রাতেই অভিযান চালাতে পারি। আমার বিশ্বাস আজ রাতে পুলিশের সংখ্যা আগামীকালের তুলনায় কম থাকবে। আর তাছাড়া সেই বিকেল থেকে ডিউটি করায় পুলিশ খুব ক্লান্ত থাকবে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাব আমরা।
তুমি ঠিকই বলেছ নিকি। আজ রাতেই ট্রিটিসকোপটা উদ্ধার করতে হবে। একটু থেমে রনি বলল, তুমি একা থাকতে পারবে না?
তুমি একা যেতে চাচ্ছ? পাল্টা প্রশ্ন করল নিকি।
আমি চেষ্টা করতে চাচ্ছি। যদি না পারি আমার কয়েকজন বন্ধু আছে, ওদের নিয়ে যাব।
না না। সেটা হবে মারাত্মক ভুল। আমাদের সম্পূর্ণ বিষয়টা গোপন রাখতে হবে। নিকি-৩
আমি বুঝতে পারছি। তাহলে আমি একাই যাব।
নিকি কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল, না রনি, তুমি একা যাবে না। আমি তোমার সাথে যাব।
কী বলছ তুমি! গিগোরা তোমাকে ধরে ফেলবে। ওরা আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছে।
ধরলে ধরবে। আমি ভয় পাচ্ছি না।
তু..তুমি এত বড় ঝুঁকি নেবে! বড় বড় চোখে বলল রনি।
ঝুঁকি যে শুধু তোমার বাবার জন্য নিচ্ছি তা নয়। আমার এই হাতের জন্যও নিচ্ছি। আর তাছাড়া আমি যদি তোমার সাথে না যাই, তাহলে ট্রিটিসকোপটা যে কোথায় আছে ত জেও পাবে না। কারণ গানশিপের ভিতরে কোথায় কি আছে তা তোমার জানা নেই।
কি..কিন্তু..
আর কিন্তু নয়। চলো বেরিয়ে পড়ি, আমাদের হাতে সময় খুব কম। তবে হ্যাঁ, তুমি সাথে একটা টর্চ লাইট অবশ্যই নেবে।
হ্যাঁ নেব। কিন্তু একটা কথা কি আমাকে বলবে?
কি কথা?
তুমি অন্ধকারকে এত ভয় পাও কেন?
আমি অন্ধকারকে ভয় পাই না। গিগোদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই অন্ধকারকে এড়িয়ে চলি। তীব্র আলোতে গিগোরা কিছু দেখতে পায় না। দিনের আলোতেও ওরা কিছু দেখে না। এজন্য গিগোরা কখনো দিনের বেলা চলাচল করে না। তারা চলাচল করে রাতে।
তাহলে তো তোমার জন্য ঝুঁকিটা থেকেই গেল।
তা তো কিছুটা থাকবেই। তবে মানুষ দেখলে গিগোরা কাছে ঘেঁষবে না।
কেন?
কারণ গিগোরা ভাববে, আমি আর যাই করি মানুষের কাছে নিজেকে ধরা দেব না। অবশ্য এমন ভাবাটাই স্বাভাবিক। যে কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী নতুন কোনো গ্রহে গেলে স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত একা একাই থাকবে। ঠিক গিগোরা এখন যেমন আছে।
হু সেটা বুঝলাম। কিন্তু তুমি তো খুব ক্লান্ত।
কাজ ক্লান্তি দূর করে দেয়। এখন যদি আমি বিশ্রামের চেষ্টা করি তাহলে অপরাধবোধে আমি শান্তি পাব না। সবসময় মনে হবে কেন আমি তোমার বাবার জন্য কিছু করতে চেষ্টা করলাম না। তাছাড়া তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করছ, আর আমি যদি তোমার জন্য এতটুকু না করি তা হলে কীভাবে হবে? আমার তো মনে হচ্ছে তোমাকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য।
কৃতজ্ঞতাভরা চোখে রনি এবার নিকির দিকে তাকাল। তারপর বলল, তুমি সত্যি খুব ভালো নিকি, সত্যি ভালো।
নিকি মৃদু হেসে বলল, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো যাই। গানশিপের কাছে যেয়ে আবার কী না কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
ঠিক আছে চলো।
এই বলে রনি আর নিকি গানশিপের উদ্দেশে পা বাড়াল।
৯
পূর্ণিমা হতে আর একদিন বাকি। এজন্য বাইরে চাঁদের আলোও পর্যাপ্ত। আর সেই আলোতে বাগানের মধ্যে দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলছে রনি আর নিকি। হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছে তারা। রনি বলল, গিগোরা যদি আমাদের আক্রমণ করে তাহলে চিনব কিভাবে? গিগোরা দেখতে কেমন?
উচ্চতায় গিগোরা মানুষের প্রায় সমান। তবে দেখতে মানুষের মতো নয়। এদের মুখের অবয়বটা লম্বা। নাকটা এত ছোট যে মনে হবে নাককাটা প্রাণী। অন্ধকারে গিগোদের মুখ ছাড়া অন্যকিছু তুমি দেখতে পাবে না। কারণ মাথা থেকে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত সমস্ত শরীর কালো আলখেল্লার মতো একরকম পোষাকে ঘেরা থাকে। দেখলে মনে হবে বুঝি কালো চাদরে সমস্ত শরীর ঢেকে রেখেছে। এজন্য অন্ধকারে গিগোদের লাল চোখ দুটো শুধু স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এমন কী মুখটাও ভালোমতো দেখতে পাবে না। কারণ এদের মুখটাও কালো।
তাহলে তো গিগোরা আক্রমণ করলে আমরা বুঝতে পারব না।
পারব, কারণ উজ্জ্বল চাঁদের আলো আছে। এই আলোতে গিগোদের দেখা যাবে। অবশ্য এই আলোর সমস্যাও আছে। এরকম আলোতে গিগোরা সবচেয়ে ভালো দেখতে পায়।
গিগোরা কেন এমন আলোতে সবচেয়ে ভালো দেখতে পায়?
এর মূল কারণ বিবর্তন এবং অভিযোজন। তুমি নিশ্চয় জানো বিবর্তন এবং অভিযোজন হলো এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে যে কোনো প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। গিগোদের গ্রহে সর্বোচ্চ আলো আজকের এই রাতের চাঁদের জোস্ন্যার মতো এবং তা খুব অল্প সময়ের জন্য থাকে। অধিকাংশ সময়ই গিগোদের গ্রহ অন্ধকারে ডুবে থাকে। এজন্য তাদের চোখের গঠনটাও এমন হয়েছে যেন অন্ধকারে তারা দেখতে পায়। প্রকৃতি যে নিজেই চমৎকার ভারসাম্য রক্ষা করে চলে তার অন্যতম উদাহরণ এই গিগোরা। প্রকৃতি ঠিকই গিগোদের অন্ধকারে দেখার ক্ষমতা দিয়েছে কিন্তু আলোতে দেয়নি। গিগোরা আলোতে কিছুই দেখতে পায় না। সামনের সবকিছু কালো দেখে। যদি আলো এবং অন্ধকার দুটোতেই গিগোরা দেখতে পেত তা হলে হয়তো ওরা আরো অনেক উন্নত হতো। কিন্তু প্রকৃতি সেটা হতে দেয়নি। আলোতে ওদের অন্ধ করে রেখেছে।
তাহলে আমি টর্চ জ্বালাই। গিগোরা টর্চের উজ্জ্বল আলোতে আমাদের দেখতে পাবে না।
তা পাবে না। কিন্তু এতে সমস্যা আছে। অনেক দূর থেকে টর্চের আলো দেখে পুলিশ আমাদের সন্দেহ করবে। তখন আমরা ইচ্ছে করলেই আমাদের লুকিয়ে রাখতে পারব না। তাছাড়া আলো জ্বালালে গিগোরা আলোর জায়গাটা কালো দেখবে। ফলে ওরাও সন্দেহ করতে পারে।
অর্থাৎ ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
সকল কাজেই কম বেশি ঝুঁকি থাকে। যেহেতু আমরা বড় একটা কাজ করছি। সেহেতু ঝুঁকিটা কিছুটা বেশিই হবে। এটাই নিয়ম।
ধন্যবাদ নিকি। তুমি আমার বাবার অসুস্থতাকে খুব গুরুত্বের সাথে দেখছ। সত্যি আমার ভালো লাগছে।
আমি ডাক্তার। প্রাণীর প্রাণ রক্ষা করাই আমার কাজ। আর সেটা যদি মানুষের হয় তাহলে তো কথাই নেই। সেটা আমার জন্য বিশাল সৌভাগ্যের।
তুমি তো অনেক হিমিনের জীবন রক্ষা করেছ। তাহলে মানুষের জীবন রক্ষা করা এতটা সৌভাগ্যের মনে করছ কেন?
কারণ এখন পর্যন্ত মানুষ মহাবিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে স্বীকৃত।
কী বলছ তুমি! আমার তো মনে হচ্ছে তোমরা হিমিনরা মানুষের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমান, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অধিক উন্নত।
আমরা উন্নত ঠিকই কিন্তু সম্ভবত তোমাদের মতো অতটা বুদ্ধিমান নই।
এটা কী বললে! তোমাদের ট্রিটিসকোপ আছে, আমাদের নেই, তোমরা গ্রহ থেকে গ্রহে বিচরণ করছ কিন্তু আমরা পারছি না, তোমরা মৃত্যুকে প্রায় জয় করতে চলেছ অথচ আমরা বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছি, তোমরা সকল রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলেছ, অথচ আমরা নানা অসুখে মৃত্যুবরণ করছি- এরকম আরো অনেক অনেককিছু। এত কিছু অর্জনের পরও তোমরা বলছ তোমরা আমাদের মতো বুদ্ধিমান নও?
আসলে এই অর্জনগুলো আমাদের দীর্ঘদিনের গবেষণা করার সুযোগ প্রাপ্তির ফল।
ঠিক বুঝলাম না। কপাল কুঁচকে বলল রনি।
নিকি একটু সময় নিল। তারপর বলতে শুরু করল, আমি এসেছি তোমাদের পাশের গ্যালাক্সি থেকে। সেখানে আমাদের গ্রহের নাম ‘হিমিচুন’। হিমিচুন গ্রহে বসবাস করি বলেই আমাদের হিমিন বলা হয়। হিমিনদের সভ্যতার ইতিহাস মানব। সভ্যতার থেকে দশ হাজার বছরেরও বেশি। অর্থাৎ পৃথিবীতে যখন মানুষের সৃষ্টি হয় তখন হিমিনদের বয়স দশ হাজার বছর। আরো সহজ করে বললে বলতে হয়, হিমনরা মানুষের থেকে দশ হাজার বছরের বেশি বড়। এই দশ হাজার বছর এগিয়ে থাকার কারণেই আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান তোমাদের থেকে উন্নত। কারণ জ্ঞানের চর্চা করার জন্য আমরা দশ হাজার বছর বেশি সময় পেয়েছি।
কিন্তু তোমরা বুঝলে কিভাবে যে আমরা মহাবিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী? প্রশ্ন করল রনি।
আসলে এটা আমাদের ধারণা। যেহেতু প্রাণীর বুদ্ধি পরিমাপের নিশ্চিত কোনো পদ্ধতি বা যন্ত্র মহাবিশ্বের কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি সেহেতু তোমাদের সভ্যতার উন্নতি দেখেই এই ধারণা করেছি। কোনো প্রজাতি কতটা উন্নত তা সেই প্রজাতির দীর্ঘদিনের কাজ বা সভ্যতার বিকাশ দেখে বোঝা যায়। আমরা মহাবিশ্বে বিচরণ শুরু করি এখন থেকে আট হাজার বছর আগে। আর তোমরা শুরু করেছ পঞ্চাশ বছর আগে। এভাবে হিসেব করলে দেখা যায় যে আমাদের থেকে দশ হাজার বছরের ছোট হয়েও আমাদের থেকে প্রায় এক হাজার নয়শ পঞ্চাশ বছর আগে তোমরা মহাকাশে বিচরণ শুরু করেছ। এটা তোমাদের বুদ্ধিমত্তা এবং সভ্যতার চরম উৎকর্ষতারই বহিঃপ্রকাশ। যাইহোক যা বলছিলাম, আমরা তোমাদের গ্রহের অস্তিত্ব আবিস্কার করি এখন থেকে প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে। তোমাদের আচরণ এবং বুদ্ধিমত্তার বহিঃপ্রকাশ দেখে তখন থেকেই তোমাদের উপর আমরা নজর রাখছি। প্রথমে তোমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা খুবই আশঙ্কিত ছিলাম। কারণ তখন তোমরা শুধু মারামারি আর হানাহানিতে ব্যস্ত থাকতে। প্রায় চারশ বছর ধরে ইউরোপ, এশিয়াতে এই হানাহানি এতটাই ব্যাপক ছিল যে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম মানুষ নামের প্রজাতিটা পৃথিবী থেকে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু গত একশ’ বছরে তোমাদের উন্নতি আমাদের বিস্মিত করেছে। তোমারা জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে অকল্পনীয় উন্নতি করেছ। একশ বছর আগে যেখানে তোমরা সর্বোচ্চ রেলগাড়ির কথা চিন্তা করতে পারতে এখন তোমরা চিন্তা করছ গ্রহ থেকে গ্রহে ঘুরে বেড়ানোর। সত্যি কথা বলতে কী আমাদের অর্থাৎ হিমিনদের রেলগাড়ি থেকে মহাকাশযান তৈরি করতে প্রায় দেড় হাজার বছর সময় লেগেছিল। আর তা তোমরা করেছ মাত্র একশ বছরে। অর্থাৎ তোমরা আমাদের থেকে প্রায় পনের গুণ দ্রুত গতিতে উন্নতি সাধন করছ। মহাবিশ্বের কোনো প্রাণীর সভ্যতার ইতিহাসে এত দ্রুত উন্নতি করার কোনো রেকর্ড নেই। এই গতিতে উন্নতি করতে থাকলে আগামী চার হাজার বছরে তোমরা আমাদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে। এজন্যই বলছি প্রযুক্তিতে আমরা তোমাদের থেকে উন্নত হলেও বুদ্ধির বিবেচনায় হয়তো তোমরা আমাদের থেকে উপরে। তবে বিষয়টা এখনো পরীক্ষিত নয়।
নিকির কথাগুলো শুনে কেন যেন নিজের মধ্যে একধরনের গর্ব অনুভব করল রনি। পাশাপাশি আশঙ্কিতও হলো সে। আর এই আশঙ্কা থেকেই প্রশ্ন করল, তাহলে কি তোমরা আমাদের পথিবী দখল করে নেবে?
কেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল নিকি।
এই যে আমরা তোমাদের থেকে বেশি বুদ্ধিমান।
নিকি এবার হেসে উঠে বলল, আমি তো বলেছি বিষয়টা পরীক্ষিত নয়। আর তোমাদের পৃথিবী দখল করার কিংবা মানুষকে শাসন করার কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। কারণ আমরা খুবই শান্তিপ্রিয়। সাধারণত আমাদের কেউ বিরক্ত না করলে আমরা কাউকে বিরক্ত করি না। যাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ চলছে তার জন্য তারাই দায়ি, আমরা নই।
তাহলে আমাদের নিয়ে নিশ্চয় তোমাদের কোনো পরিকল্পনা আছে? কারণ পাঁচশ বছর ধরে তোমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ করছ।
নিকি একটু সময় নিয়ে বলল, তুমি তো দেখছি খুব বুদ্ধিমান। আমি তোমার ধারণার সত্যতা স্বীকার করছি। সত্যি তোমাদের নিয়ে আমাদের একটা পরিকল্পনা আছে। আর তা হলো তোমাদের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব স্থাপন করা। কারণ এই মহাবিশ্বে অন্য যে কোনো প্রাণীর তুলনায় তোমাদের সাথেই আমাদের শারীরিক, মানসিক এবং বুদ্ধিমাত্রার মিল সবচেয়ে বেশি। এজন্য তোমাদের সাথে আমরা চমৎকার একটা সম্পর্ক তৈরি করার চিন্তা-ভাবনা করছি।
কখন এই সম্পর্ক তৈরি করবে?
এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আরো সময়ের প্রয়োজন আছে?
কেন এত সময়ের প্রয়োজন?
আমি তোমাকে পরে জানাব। আমরা বিলের মধ্যে চলে এসেছি। দ্যাখো, ঐ যে গানশিপটা।
হঠাৎ মনে পড়েছে এমনভাবে প্রশ্ন করল রনি, এমন কী হতে পারে যে গিগোরা তোমার ট্রিটিসকোপটা নিয়ে গেছে?
তোমার প্রশ্নটা যুক্তিসংগত এবং ট্রিটিসকোপটার প্রতিই ওদের লোভ বেশি। কিন্তু সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই। কারণ গিগোরা আমাকে একটা খাঁচার মধ্যে আটকে রেখেছিল। আমাকে আটকে রাখার আগে আমার কাছ থেকে ট্রিটিসকোপ এবং লাইফারটা নিয়ে নিয়ে নিয়েছিল।
লাইফার কি?
আমার হাতে যে ছোট ইলেকট্রনিক যন্ত্রটা দেখতে পাচ্ছ এটা হলো লাইফার। এটা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। এটা সম্পর্কে তোমাকে পরে ব্যাখ্যা করব। যা বলছিলাম, গিগোরা আমার উপর নানাভাবে চাপ দিয়ে ট্রিটিসকোপ ব্যবহার শিখতে চাচ্ছিল। এ উদ্দেশে ওরা অনেকবার আমাকে ট্রিটিসকোপের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আমি অবশ্য ওদের কিছুই শিখায়নি, উল্টো জেনে যাই ট্রিটিসকোপটা কোথায় আছে। পাশাপাশি লাইফারটার অবস্থানও জেনে যাই। গানশিপটা বিধ্বস্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ওরা আমাকে খাঁচা থেকে বের করে। ওদের ইচ্ছে ছিল আমাকে নিয়ে ওরা পৃথিবীর কোথাও লুকিয়ে থাকবে এবং পরে ওদের অন্য একটা গানশিপে করে আমাকে নিয়ে ওদের গ্রহে ফিরে যাবে। কিন্তু গানশিপটা মাটিতে পড়ার পরপরই সেটাতে আগুন ধরে যায়। তখন মুহূর্তের জন্য ওরা আমাকে ছেড়ে দিলে সেই সুযোগে আমি ওদের দুজনের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে যাই। আগুনের কারণে চারপাশটা তখন এতটাই আলোকিত হয়ে পড়েছিল যে গিগোরা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না, আর আমাকে খুঁজে পাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। বেঁচে থাকার জন্য ওরা তখন দ্রুত গানশিপ থেকে বেরিয়ে পড়ে, ট্রিটিসকোপটা নেয়ারও সুযোগ পায়নি। আর এই ফাঁকে লাইফারটা আমি আমার হাতে নিয়ে নেই। ট্রিটিসকোপের কাছে যেতে পারিনি। ততক্ষণে ভিতরে আগুন ঢুকে গিয়েছিল। তাই কোনোমতে বেরিয়ে আসি।
কিন্তু তখন বাইরে অনেক আলো ছিল। গিগোদের কিছুই দেখার কথা নয়। ওরা পালাল কীভাবে?
নিকি এবার অবাক চোখে রনির দিকে তাকাল। তারপর বলল, তুমি তো দেখি খুবই বুদ্ধিমান? খুব খুটিনাটি কিন্তু যুক্তিসংগত ব্যাপারগুলো নিয়ে প্রশ্ন কর। আমি তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করছি। আর তোমার প্রশ্নের উত্তরে জানাচ্ছি যে গিগোদের কাছে বিশেষ যন্ত্র আছে যেটার সাহায্যে তারা আলোতে চলতে পারে এবং সহজেই অন্ধকার খুঁজে নিতে পারে। গানশিপের বাইরে অনেক ফসলের ক্ষেত। সেই ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ক্রলিং করে হয়তো ওরা নিরাপদ স্থানে চলে গিয়েছিল। এজন্য তোমরা মানুষেরা ওদেরকে দেখতে পাওনি।
ও আচ্ছা। কিন্তু ওরা তো আবার ফিরে আসতে পারে?
আসবে না।
কেন?
দুটো কারণে। প্রথমত, এখানে অনেক মানুষ আছে। আগেই বলেছি মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে গিগোরা। আর দ্বিতীয় কারণ হলো সন্ধ্যার পর থেকেই গানশিপটার আশেপাশে লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে পুলিশ। যদিও আলোর পরিমাণ অপর্যাপ্ত কিন্তু গিগোদের কিছু না দেখার জন্য যথেষ্ট। গিগোরা আর যাই হোক অন্ধ থেকে ট্রিটিসকোপ উদ্ধার করতে আসবে না। ট্রিটিসকোপের থেকে জীবন যে অনেক বড় এটা ওরা ভালোমতোই বোঝে।
হু, বুঝতে পেরেছি।
এখন বলো আমরা কিভাবে গানশিপের কাছে পৌঁছাব? প্রশ্ন করল নিকি।
নিচু হয়ে ফসলের জমির মধ্যে দিয়ে।
তুমি পারবে?
হ্যাঁ পারব।
তাহলে চলল। আর দেরি নয়।
কিন্তু তোমার খুব কষ্ট হবে। তোমার একটা হাতে তো সমস্যা।
আমার উচ্চতা কম, আর তোমাদের ফসল লম্বা। কাজেই অসুবিধা হবে না। আমি নিচু হয়ে এগোতে পারব। আর দেরি করো না। দেখা যাক কী হয়?
রনি, নিকি দুজনেই নেমে পড়ল বিলের মধ্যে। তাদের লক্ষ্য গিগোদের বিধ্বস্ত গানশিপ, যেভাবেই হোক উদ্ধার করতে হবে ট্রিটিসকোপটাকে।
১০
গানশিপ থেকে একশ’ গজ দূরে একটা গম ক্ষেতের পাশে এসে থামল রনি আর নিকি। ক্ষেতের আড়ালে থাকার কারণে তাদেরকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তারা ঠিকই দেখতে পাচ্ছে সবাইকে। রনি বলল, নিকি আমরা তো কোনোভাবেই গানশিপের কাছে যেতে পারব না। পুলিশ গানশিপটা ঘিরে রেখেছে। আমরা কাছে গেলেই দেখে ফেলবে।
হু, সমস্যাই বটে। অন্য কোনোভাবে কি আমরা গানশিপের কাছে যেতে পারব?
কি বলতে চাচ্ছ তুমি?
অন্য কোনো পথ আছে নাকি?
অন্য কোনো পথ থাকবে কিভাবে?
আমি যখন গানশিপ থেকে বের হয়েছিলাম তখন একেবারে পানির পাশে এসে পড়েছিলাম। সেটা কিভাবে সম্ভব ছিল?
ও বুঝতে পেরেছি। গানশিপটা আসলে একটা খালের কিনারে এসে পড়েছে। খালটা ওপাশে।
ওপাশে যাওয়ার উপায় আছে?
আমাদের ঘুরে যেতে হবে।
তাহলে চলল। আর দেরি করো না।
রনি আর নিকি আরো খানিকটা ফসলের ক্ষেতে ঘুরে পিছনের দিকে এলো। এখান থেকে গানশিপটা একেবারেই কাছে। খালের পাশে ঝোঁপের মধ্যে কিছু গাছ দেখে নিকি বলল, এগুলো কিসের গাছ?
কলমী গাছ। উত্তরে বলল রনি।
আমি গানশিপ থেকে বেরিয়ে এই কলমীর নিচে লুকিয়েছিলাম। তারপর কলমীর নিচ দিয়েই তোমাদের ওদিকে চলে যাই। এজন্য কেউ আমাকে দেখতে পায়নি। এবারো আমরা সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করব।
কিন্তু ভিতরে ঢুকব কিভাবে?
সমস্যা হবে না। তুমি নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছ এপাশে মাত্র দুজন পুলিশ আছে।
হ্যাঁ। সম্ভবত ওরা ভেবেছে খালের এপাশে পানি থাকায় এদিকটায় কেউ আসবে না। বলল রনি।
তাছাড়া এ পাশে আলোও কম। কেউ আমাদের দেখতে পাবে না।
আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে নিকি।
হ্যাঁ এখনই চলো। দ্যাখো, দুজন পুলিশই দুই প্রান্তে চলে গেছে। মাঝের জায়গাটা অন্ধকারচ্ছন্ন। এখনই আমাদের উপযুক্ত সময়।
কিন্তু আমরা গানশিপের ভিতরে ঢুকব কিভাবে?
আমি যে পথে বেরিয়েছিলাম সেই পথ দিয়ে। এখান থেকে বোঝা যাবে না। কাছে গেলেই বুঝতে পারবে গানশিপে একটা ফাটল আছে, সেখান দিয়েই ঢুকব। চলো, তাড়াতাড়ি চলো।
অন্ধকারের মধ্যে দ্রুত তারা দুজন গানশিপের একেবারে কাছে পৌঁছে গেল। কিন্তু ততক্ষণে ফিরে আসতে শুরু করেছে দুই পুলিশ। ভয়ে রনির শরীরের সমস্ত লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। এখনো ভিতরে ঢুকতে পারেনি তারা। নিকি ফিসফিস করে বলল, একেবারে চুপ করে পড়ে থাকো। কোনো শব্দ করবে না।
রনি দম নিতেও যেন ভুলে গেল। তাদের ঠিক চার ফুট সামনে দিয়ে দুজন পুলিশই হেঁটে গেল। প্রথমত অন্ধকার আর দ্বিতীয়ত পুলিশ দুজনের দৃষ্টি বাইরের দিকে থাকায় এ যাত্রায় বেঁচে গেল তারা। দুজন পুলিশ আবার দুপ্রান্তের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে নিকি বলল, হ্যাঁ এবার এই দিকে, এই ফাটল দিয়ে ঢুকে পড়।
ভিতরে ঢুকে রনি তো অবাক। সে যেন ভিন্ন এক জগতে এসে পড়েছে। চারদিকে এত যন্ত্রপাতি যে সে কল্পনাও করতে পারেনি। গানশিপটা বিধ্বস্ত হলেও ভিতরে এখনো লাল নীল সবুজ অনেক বাতি জ্বলছে। তবে আলোর উজ্জ্বলতা একেবারেই কম। হয়তো গিগোরা আলো পছন্দ করে না এজন্য আলোগুলো উজ্জ্বল নয়। রনি সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছে গানশিপটার আকার দেখে। গানশিপটার যতটুকু মাটির উপর আছে ঠিক ততটুকু মাটির নিচে ঢুকে গেছে।
রনি বুঝতে পারল তারা খুব ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আরো খানিকটা এগোতে নিকি বলল, খুব সাবধান রনি।
হ্যাঁ আমি সাবধানই আছি।
লক্ষ্য রেখো ভুলেও যেন কোনো শব্দ না হয়। রাতের শব্দ অনেকদূর পর্যন্ত পৌঁছায়। পুলিশ আমাদের উপস্থিতি টের পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
না কোনো শব্দ হবে না। ফিসফিস করে বলল রনি।
আশেপাশের তারগুলো থেকে সাবধানে থেকো। এগুলোর কোনো কোনোটিতে হাই-ভোল্টেজের ইলেকট্রিসিটি থাকতে পারে।
ঠিক আছে।
রনি বুঝতে পারল তারা একটা সরু করিডোরের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে। এই করিডোরের দুপাশে ছোট ছোট অনেকগুলো কম্পার্টমেন্ট আছে। অধিকাংশ কম্পার্টমেন্টই বন্ধ। সে একটা কম্পার্টমেন্টের দরজার হাতল ঘোরাতে চেষ্টা
করতেই নিকি জোরে বলে উঠল, খবরদার! ওটা ঘোরাবে না।
আমি দেখতে চেষ্টা করছিলাম ওটাতে কী আছে।
তার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা গানশিপ। এগুলোর কম্পার্টমেন্টে শক্তিশালী এক্সপ্লোসিভ থাকার সম্ভাবনা আছে। একটু এদিক ওদিক হলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তাহলে গানশিপটা বিস্ফোরণের সময় এক্সপ্লোসিভগুলো বিস্ফোরিত হয়নি কেন?
কম্পার্টমেন্টের মধ্যে ওগুলো সুরক্ষিত। হয়তো এজন্য। হ্যাঁ, এখন এদিকে এসো, এই যে ডান দিকে।
নিকির পিছন পিছন রনিও ডানে মোড় নিয়ে মাঝারি আকৃতির একটা কক্ষে এসে পৌঁছাল। রনি বলল, এই কক্ষটাতে একেবারেই আলো নেই।
নিকি ফিসফিস করে বলল, রনি, আমরা মাটির নিচে আছি। এখন টর্চটা জ্বালাও। আশা করছি আলো বাইরে যাবে না।
রনি টর্চ জালাতে দেখতে পেল কক্ষটার মধ্যে অনেক জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এখানে যেন কোনো টর্নেডোর তান্ডবলীলা বয়ে গেছে। নিকি বলল, ভালোমতো লক্ষ্য করো, আশেপাশে ছোট চারকোণা ধাতব বাক্সের মতো কিছু দেখা যায় কিনা।
ট্রিটিসকোপটা কি বাইরে ছিল? নাকি কোনোকিছুর ভিতরে আটকান ছিল? বাইরে ছিল। গিগোরা নিজেরাই ট্রিটিসকোপটা চালাতে চেষ্টা করত। হ্যাঁ ঐ টেবিলটার উপর। এই বলে নিকি তাড়াতাড়ি সেদিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু টেবিলের আশেপাশে কোথাও ট্রিটিসকোপটাকে না দেখে সে বেশ হতাশ হলো। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ঐ পাশের ধাতব ডেক্সে যে ড্রয়ারগুলো আছে তুমি সেগুলো পরীক্ষা কর। আমি এপাশটা করছি।
এই বলে নিকি ব্যস্ত হয়ে পড়ল ড্রয়ারগুলো পরীক্ষা করতে। রনিও ঝুঁকে পড়ল নিকির নির্দেশিত অন্যপাশের ডেক্সের উপর। তৃতীয় ড্রয়ারটা পরীক্ষা করার সময় একটা ব্যাগের মধ্যে চারকোনা বাক্সের মতো একটা জিনিস দেখে রনি বলল, নিকি, এটা কি?
নিকি কাছে এসে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই। গিগোরা ড্রয়ারে রেখে ভালোই করেছে। অক্ষত আছে যন্ত্রটা। আগুনের উত্তাপ পৌঁছাতে পারেনি এ পর্যন্ত।
দেখতে অনেকটা ল্যাপটপের মতো।
হ্যাঁ অবিকল সেরকমই। ভিতরে ডিজিটাল স্ক্রিণও আছে। পরে তোমাকে দেখাব। এখন চলো, দ্রুত ফিরতে হবে।
রনি যদিও ফিরে যাচ্ছিল কিন্তু বারবার পিছনে তাকাচ্ছিল সে। গানশিপটাকে তার ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে জানে এখানে থাকা কতটা বিপদজনক।
বারবার পিছনে ফিরে তাকানোর জন্যই বিপত্তিটা ঘটল। হঠাৎ রনির পা নিচে ধাক্কা খেল কিছুর সাথে। আর তাতে সে মুখ থুবড়ে পড়ল সামনের দিকে। পড়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সে পাশে একটা লোহার পাইপ আকড়ে ধরল। পাইপটা খোলা থাকায় সেটাসহ নিচে পড়ল রনি। পরের মুহূর্তেই হাত থেকে ছুটে গেল পাইপটা। তারপর গড়িয়ে যেতে থাকল নিচের দিকে। আর এতে যে শব্দ হলো তাতে আঁতকে উঠল দুজন। তারা নিশ্চিত এই শব্দ বাইরে পুলিশের কানে পৌঁছেছে।
নিকি ব্যস্ত হয়ে বলল, তাড়াতাড়ি এসো।
যেখান দিয়ে তারা গানশিপের ভিতরে প্রবেশ করেছিল কোনোরকম বিপদ ছাড়াই সেখানে এসে পৌঁছাল। কিন্তু বেরোতে পারল না। কারণ তাদের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ দুজন। এদিকে তারা বুঝতে পারছে পিছন থেকে ভিতরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে পুলিশ। ভয়ে মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেল রনির।
নিকিও খুব আতঙ্কিত। সে বড় বড় চোখে বলল, এখন কী হবে রনি? পুলিশ নিশ্চয় আমাদের ধরে ফেলবে?
রনি তার হাতের ট্রিটিসকোপের দিকে তাকাল। নিকির বাম হাত ভাঙ্গা থাকায় সে-ই বহন করছিল ট্রিটিসকোপটা। সে ট্রিটিসকোপটা নিকির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিকি, আমি পুলিশকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি সুযোগ বুঝে এদিক দিয়ে বের হয়ে যাবে।
কী বলছ তুমি! আঁতকে উঠে বলল নিকি।
হ্যাঁ নিকি। তা না হলে বাবাকে বাঁচানো যাবে না, তোমাকেও রক্ষা করা যাবে না। ওরা সবাই তোমার কথা জেনে যাবে।
রনি, তুমি এই ঝুঁকি নিও না।
বিদায় নিকি!
নিকিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রনি উল্টো ছুটতে শুরু করল। গানশিপের ভিতরে সরু করিডোরে এসে থামল সে। পুলিশকে প্রথমে এখানে আসতে হবে। তার কাজ হবে পুলিশকে একেবারে মাটির নিচের দিকের অংশে নিয়ে যাওয়া। পুলিশ তাকে দেখলে আর অন্য কাউকে খুঁজবে না। আর এতে নিকি গানশিপ থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাবে।
রনির অনুমানই সত্য প্রমাণিত হলো। চারজন পুলিশ করিডোরে প্রবেশ করল এবং তাকে দেখে ফেলল। সামনের একজন বলল, হেই.. কে ওখানে?
রনি আর দাঁড়াল না। গানশিপের নিচের দিকে ছুটতে শুরু করল।
পুলিশও দাঁড়াও, দাঁড়াও বলে পিছন থেকে এগিয়ে আসতে থাকল। তবে তাদের গতি অতটা দ্রুত নয়। বোঝা যাচ্ছে তারা বেশ ভয়ে আছে। ভিনগ্রহের এই মহাকানের মধ্যে কি না কি আছে তা নিয়ে তাদের আতঙ্কে থাকাটাই স্বাভাবিক। আর এটাই শাপেবর হলো রনির জন্য। কারণ এই আতঙ্কের কারণেই তাকে খুঁজে পেতে পুলিশের অধিক সময় ব্যয় করতে হবে। আর তাতে গানশিপ থেকে বের হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পাবে নিকি।
রনি একেবারে শেষ মাথায় এসে থামল। এখান থেকে আর এগোনোর উপায় নেই। উল্টানো একটা টেবিল দেখে তার পিছনে লুকিয়ে পড়ল সে। অবশ্য খুব বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারল না। পাঁচ মিনিটের মাথায় চারজন পুলিশ তার দিকে অস্ত্র তাক করে বলল, তুমি কে? বেরিয়ে এসো।
রনি বুঝতে পারল সে ধরা পড়ে গেছে। অবশ্য সেটা নিয়ে সে বিচলিত নয়। কারণ সে নিশ্চিত এরই মধ্যে নিকি গানশিপ থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছে।
১১
গানশিপের বাইরে রনিকে যার সামনে আনা হলো সে একজন পুলিশ অফিসার। রনি লক্ষ্য করল অফিসার তাকে বেশ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। মনে হলো সে ভাবছে আদৌ সে পৃথিবীর মানুষ নাকি মানুষরূপী ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী। এরই মধ্যে সে একজন কনস্টেবলকে তার শরীর পরীক্ষা করতে বলেছে। বেচারা কনস্টেবল ভয়ে ভয়ে তার হাত-মুখ টিপে টিপে দেখে বলল, স্যার মনে হয় মানুষই।
পুলিশ অফিসার খানিকটা গম্ভীর গলায় বলল, তুমি কে?
রনির কেন যেন ভয় করল না। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমি প্রাণী।
প্রাণী তো বুঝলাম। কিন্তু কি প্রাণী?
তুমি দেখতে পাচ্ছ না? ইচ্ছে করেই রনি অফিসারকে তুমি করে বলল।
অফিসার খানিকটা থমকে গেল। তারপর প্রশ্ন ঘুরিয়ে বলল, তুমি কোথা থেকে এসেছ?
রনি এবার চালাকি করল। সে মুখে কিছু না বলে আঙ্গুল দিয়ে দূরে এমনভাবে নির্দেশ করল যে সেটা না জঙ্গল না আকাশকে বুঝাল। অফিসার কিছু বুঝতে না পেরে বলল, তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছ?
রনি কোনো কথা বলল না। সে চুপ থাকল।
তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না কেন?
রনি এবারো চুপ থাকল।
তুমি এখানে কি করছিলে? উত্তর না পেয়ে রেগে উঠে অন্য প্রশ্ন করল অফিসার।
আমি দরকারে এসেছি।
কি দরকার?
এরই মধ্যে রনি ঠিক করে ফেলেছে সে কিছুতেই সত্য কথা বলবে না। বললে এখনই তারা নিকিকে ধরার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। পাশপাশি ট্রিটিসকোপটা হাতে পাওয়ার জন্যও ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তাই সে বলল, আমি আমার বন্ধুকে খুঁজতে এসেছি।
তোমার বন্ধু কে?
নিকি।
নিকি?
হু।
কোথায় থাকে?
আগের মতোই হাত উঁচু করে সে জঙ্গল আর আকাশের মাঝামাঝি জায়গা দেখাল। অফিসার ভ্রু কুঁচকে বলল, জঙ্গলে?
ডানে বামে মাথা নেড়ে ‘না’ বোধক উত্তর দিল রনি।
তাহলে কি আকাশে?
এবার উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক উত্তর দিল রনি।
সাথে সাথে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কনস্টেবল খানিকটা দূরে সরে গেল। অফিসারও কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, তু..তু..তুমি এসব কি বলছ?
হ্যাঁ সত্য বলছি। আমার আরো বন্ধু আছে। ওরা আমাকে উদ্ধার করতে আসবে। তোমরা আমাকে ধরে ঠিক করোনি।
পুলিশ অফিসার এবার অন্যদের দিকে তাকাল। সে দ্বিধায় ভুগছে। বলল, তুমি কি বলতে চাচ্ছ?
আমাকে ছেড়ে দাও। তা না হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারবে।
কি বুঝতে পারব?
তোমরা ভুল করছ…
রনির কথা শেষ হওয়ার আগেই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটল। হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আর সাথে সাথে অন্ধকারে ডুবে গেল চারপাশটা। অথচ ইলেকট্রিসিটির জন্য যে জেনারেটরটা পুলিশ বসিয়েছিল সেটা ঠিকই চলছে। পুলিশ যেন একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। অনেকে ভয়ে তাড়াতাড়ি রনির কাছ থেকে দূরে সরে গেল।
দু’একজন পুলিশ হাতের টর্চ জ্বালালেও এর পরে যা ঘটল তার জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তাদের থেকে একশ’ গজ দূরে হঠাৎ আকাশের উপর থেকে নেমে এলো নীল একটা আগুন। আগুনটা আকাশ থেকে নিচে ফসলের ক্ষেতে পড়ে দাউ দাউ করে জ্বলে মুহূর্তেই চারদিকটা আলোকিত করে ফেলল। তারপর আবার নিভে গেল। সাথে সাথে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল চারদিকটা।
বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠার আগেই আকাশে আবার নীল আলো দেখা গেল। ভয় আর আতঙ্কে ততক্ষণে একজায়গায় জড়ো হয়েছে সকল পুলিশ। রনি লক্ষ্য করল সে এখন একেবারেই একা। তাকে কেউ লক্ষ্য করছে না। আলো দেখে যদিও সে নিজে খুব ভয় পেয়েছে, তারপরও মাথাটা ঠান্ডা রেখেছে। তাই আর সময় নষ্ট করল না। দৌড়ে গানশিপের পিছনে চলে এলো। কিন্তু আশেপাশে কোথাও নিকিকে না দেখে মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সে। তারপরই ছুটতে শুরু করল খালের পাড় দিয়ে।
হঠাৎ কেউ একজন পিছন থেকে টেনে ধরল তাকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই কানের কাছে ফিসফিস করে নিকিকে বলতে শুনল, তাড়াতাড়ি এই কলমী গাছের নিচে এসো। তারপরই তাকে ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। আর তাতে একেবারে কলমী ঝোঁপের মধ্যে যেয়ে পড়ল রনি।
নিকিকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল রনি। সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, নিকি, তুমি ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ ঠিক আছি। কিন্তু জোরে কথা বলো না। ঐ যে ঐ দ্যাখো, ঐ দূরে।
নিকির নির্দেশিত স্থানে তাকাতে রনি দেখল চাঁদের আলোয় আবছা দুটো কালো অবয়ব দেখা যাচ্ছে। অবয়ব দুটো যে গিগোদের তা বুঝতে অসুবিধা হলো না তার। তাই বলল, ঐ নীল আলোগুলো কি গিগোরাই জ্বালিয়েছিল?
না আমি। উত্তরে বলল নিকি।
তুমি! বিস্মিত কণ্ঠে বলল রনি।
হ্যাঁ আমি। তা না হলে তুমি পালাতে পারতে না। গানশিপ থেকে বের হতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। বাইরে এসে যখন অপেক্ষা করছিলাম তখন দেখি পুলিশ তোমাকে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। জেনারেটরের মূল তারটি সামনে দিয়ে গেছে দেখতে পেয়ে তখনই বুদ্ধিটা এলো মাথায়। প্রথমেই তারটিকে মাঝখান থেকে কেটে ফেললাম। আর তাতে অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশটা। তারপরই নীল আলোতে ভয় দিলাম সবাইকে। আমি নিশ্চিত ছিলাম তুমি পালানোর জন্য যথেষ্ট সময় পাবে এবং তুমি তাই করেছ।
রনি অবাক হয়ে বলল, তু..তুমি জেনারেটরের তার কাটলে কীভাবে? ওটা তো বিপদজনক ছিল।
তা ছিল। তবে আমার জন্য কঠিন কিছু নয়। লাইফার দিয়ে কেটেছি। লাইফারের শক্তিশালী লেসার রশ্মির কাছে ঐ তার কিছুই না।
আর নীল আলো?
সেটাও লাইফারের খেলা। লাইফার থেকে প্রথমে আমি ইনভিজিবল রেঞ্জের আলোকরশি ছুড়ি। ফলে আলোকরশ্মিটা কোথা থেকে ছোঁড়া হয়েছে সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। এই আলোকরশ্মিই নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করার পর ভিজিবল বা দৃশ্যমান রেঞ্জে পৌঁছায়। তখন মনে হয় হঠাৎ বুঝি শূন্যে আগুন জ্বলে উঠেছে। পুলিশদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে এবং তারা খুব ভয় পেয়েছে। অবশ্য এই প্রযুক্তিটা এখনো পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেনি। শূন্য মাধ্যমে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিবর্তনের প্রযুক্তি শিখলেই তোমরা এমন করতে পারবে। এজন্য তোমার কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে।
রনি বড় বড় চোখে শুধু বলল, অ! সে সত্যি বিস্মিত।
রনি যখন দেখল কিছুক্ষণ পরও নিকির মধ্যে উঠার কোনো লক্ষণ নেই তখন সে বলল, আমরা ফিরে যাচ্ছি না কেন?
এখন বের হওয়া কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ গিগোরা বুঝতে পেরেছে আমি আশেপাশেই আছি। ঐ নীল আলো আমার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। কারণ ঐ রকম নীল আলো আমরা হিমিনরাই তৈরি করতে পারি, তোমরা পার না। তাই আমাদের চুপচাপ কিছুক্ষণ পড়ে থাকতে হবে। আমার বিশ্বাস ওরা খুব বেশিক্ষণ থাকবে না। চলে যাবে।
কিন্তু এখানে থাকলে তো মশা কামড়ে আমাদের অস্থির করে ফেলবে। বিশেষ করে মশা তোমার জন্য ভয়ানক।
ভয়ের কিছু নেই। তুমি হয়তো ম্যালেরিয়ার কথা ভাবছ। আমরা ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছি। কাজেই আমাদের ম্যালেরিয়া হবে
না। তবে হ্যাঁ, মশার কামড়ের যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে। সেটাই করছি।
কি ব্যবস্থা?
রনি অনুভব করল একমিনিটের মাথায় আশেপাশে আর কোনো মশা নেই। একটা মশার ভনভনও সে শুনতে পাচ্ছে না। সে অবাক হয়ে বলল, মশাগুলো কোথায় গেল?
তাড়িয়ে দিয়েছি।
কিভাবে?
লাইফারের মাধ্যমে আমি এমন একটা শব্দ তৈরি করেছি যেটা মশা সহ্য করতে পারে না। তাই মশাগুলো সব ভেগেছে। বলল নিকি।
কিন্তু শব্দটা তো আমি শুনলাম না!
এটা মানুষের শব্দ শোনার স্বাভাবিক তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বাইরের রেঞ্জের। এজন্য তুমি শুনতে পাওনি।
রনি হাঁ করে আছে দেখে নিকি আবার বলল, মানুষ অনেক শব্দ শুনতে পায় না কিন্তু কুকুর সেগুলো শুনতে পায়। মশার শোনার ব্যাপারটা ঠিক সেরকম।
ও! আমি তোমার লাইফার দেখে সত্যি মুগ্ধ হচ্ছি। অবাক কণ্ঠে বলল রনি। ধন্যবাদ।
প্রায় আধঘণ্টা পর পুলিশ আবার ইলেকট্রিক বাতিগুলো জ্বালাতে পারল। তাতে চারদিক আলোকিত হলে গিগোরাও চলে গেল। তারও প্রায় পনের মিনিট পর বাড়ির পথ ধরল রনি আর নিকি।
১২
বাড়িতে ফিরে রনি ট্রিটিসকোপটা ভালোমতো লক্ষ্য করল। দেখতে হুবহু একটা ল্যাপটপের মতো। মনিটর, কি বোর্ড, সবই আছে। তবে সে যখন দেখল ট্রিটিসকোপটা নিজে নিজেই বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, কি হলো? কোনো সমস্যা?
হু, গিগোরা নানাভাবে এটাকে চালু করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। উল্টাপাল্টা কমান্ড দেয়ার জন্য এমন হচ্ছে।
কেন চালু করতে পারেনি? এটা তো কঠিন কিছু না।
তা কঠিন না, যদি না আমার ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট কোড ওদের জানা থাকত। যে কয়বার চালু করেছে তা আমার সাহায্যেই। এটা একমাত্র আমিই চালু করতে পারি।
আমি ঠিক বুঝলাম না।
স্বচ্ছ একটা বাটন নির্দেশ করে নিকি বলল, এই যে বাটনটা দেখতে পাচ্ছ এটা মূলত ডিএনএ সেন্সর। এখানে একমাত্র আমার তর্জনী আঙ্গুল রাখলেই এটা চলবে। এটা ডিএনএ কোডিং এর মাধ্যমে লক করা।
ও তাই বলো। তাহলে তুমি এত ভয় পাচ্ছিলে কেন?
ভয় পাচ্ছিলাম এ কারণে যে ওরা আবার আমার তর্জনী আঙ্গুলটা কেটে না ফেলে। অবশ্য তাতে কোনো লাভ হতো না। কারণ তাহলে আমার তর্জনী আঙ্গুলের কোষগুলো মরে যেত। আর মরা কোষের প্রতি ডিএনএ সেন্সরের কোনো সেনসিটিভিটি না থাকায় ট্রিটিসকোপ কখনোই চালু হতো না।
তোমার কথাগুলো খুব কঠিন মনে হচ্ছে। অনেককিছু বুঝতে পারছি না।
তুমি খুব ছোট। এজন্যই কঠিন মনে হচ্ছে। যাইহোক, এখন চলো তোমার বাবার ওখানে যাই।
না তার আগে তুমি তোমার হাতের চিকিৎসা কর। এটা বেশি জরুরী।
আগে তোমার বাবার চিকিৎসা করব। কারণ সেখানে সময় বেশি লাগবে। আর এমনো হতে পারে তোমার বাবার একাধিকবার ট্রিটিসকোপের থেরাপি লাগতে পারে। যদি এর মধ্যে আমাদের স্পেসশিপটা চলে আসে তাহলে আমাকে চলে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে যাবে। তাই আগে তোমার বাবার চিকিৎসা করতে চাচ্ছি। চলো যাই।
ঠিক আছে। সম্মতি দিয়ে বলল রনি। সে বুঝতে পারছে নিকি মোটেও স্বার্থবাদী নয়, বরং খুবই পরোপকারী।
রনি তার বাবার ঘরে প্রবেশ করার আগে বলল, নিকি, ট্রিটিসকোপ ব্যবহারের সময় বাবা কি ব্যথা পাবে?
না না, ব্যথা পাবে না। বলল নিকি।
কিন্তু বাবা তো জেগে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সে তোমাকে দেখে ফেলবে।
না জাগবে না। তিনি গভীর ঘুমে থাকবেন।
কিভাবে সম্ভব?
ট্রিটিসকোপের মাধ্যমে। ব্রিটিসকোপ তোমার বাবার মস্তিষ্কে এমন একটি শব্দতরঙ্গ প্রবেশ করিয়ে দেবে যেটা তোমার বাবার মস্তিষ্ক খুব পছন্দ করবে। এজন্যই তিনি গভীর ঘুমে থাকবেন।
তোমরা কি সব রুগীর ক্ষেত্রেই এরকম করো?
হ্যাঁ। কারণ আ্যানেসথেটিক বা অজ্ঞান করার ওষুধের অনেক জটিল সাইড ইফেক্ট আছে। অথচ আমাদের এই পদ্ধতির কোনো সাইড ইফেক্ট নেই। আমাদের অর্থাৎ প্রত্যেক হিমিন কী ধরনের শব্দতরঙ্গে কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবে তার একটা তালিকা অনেক আগে থেকেই আমাদের ডেটাবেজে সংরক্ষিত আছে। ফলে আমাদের কোনো অসুবিধা হয় না।
রনি খুব স্বাভাবিকভাবে ‘ও আচ্ছা’ বলল। বিস্মিত হতে হতে সে এখন আর কোনোকিছুতেই বিস্মিত হচ্ছে না। সে বুঝতে পারছে নিকির সবকিছুই তার জন্য বিস্ময়কর।
নিকি রাহাত সাহেবের মাথার পিছনে এসে তাকে গভীরভাবে ঘুম পাড়িয়ে ফেলল। তারপর ট্রিটিসকোপের সাথে সংযুক্ত কতগুলো সেন্সর তার মাথায় লাগিয়ে দিয়ে ট্রিটিসকোপের উপর প্রায় পনের মিনিট কাজ করল। এতে অনেক শব্দ হলেও রাহাত সাহেব ঘুম থেকে উঠলেন না। রনি জানত এরকম শব্দে তার বাবার জেগে উঠার কথা। অথচ তারপরও যখন তিনি জেগে উঠলেন না তখন রনি অধিকতর আশান্বিত হয়ে উঠল। সে বিশ্বাস করতে শুরু করল ট্রটিসকোপের মাধ্যমে তার বাবাকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হবে।
রনি নিকির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মনিটরে তার বাবার মস্তিষ্কের ছবি দেখতে পেল। আর সেই ছবি দেখিয়ে নিকি স্বাভাবিক এবং ক্যান্সার কোষগুলোর পার্থক্য বুঝিয়ে দিল রনিকে। রনি খুব সহজেই এখন বুঝতে পারছে কোনগুলো স্বাভাবিক এবং কোনগুলো ক্যান্সার কোষ। সে এবার প্রশ্ন করল, তুমি এখন কি করবে নিকি?
আমি এখন স্বাভাবিক কোষগুলো ট্রিটিসকোপকে চিনিয়ে দেব। ট্রিটিসকোপের কাজ হবে অন্য কোষগুলোকে স্বাভাবিক কোষে রূপান্তরিত করা। আর এটা করা হবে অতিসূক্ষ এবং নিয়ন্ত্রিত সিসার রশির মাধ্যমে।
সিসার রশি কি?
সিসার রশ্মি হলো লেসার রশ্মিরই এক পরিবর্তিত রূপ। লেসার রশ্মিকে বিশ্লেষিত এবং বিচ্ছুরিত করে এই সিসার রশ্মি তৈরি করা হয়। তোম মানুষেরা এখনো সিসার তৈরি করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারনি।
সিসার রশ্মি কি সকল ক্যান্সার কোষকেই স্বাভাবিক কোষে রূপান্তরিত করবে?
সবগুলোকে পারবে না। অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোষগুলোকে সিসার রশ্মি মেরে ফেলবে। কোষের কোস্থানে প্রবেশ করালে সিসার রশ্মি কোষের মৃত্যু ঘটাবে, কোন্স্থানে প্রবেশ করালে সিসার রশি কোষের বৃদ্ধি ঘটাবে তা ট্রিটিসকোপ খুব সহজেই নির্ধারণ করতে পারে। অবশ্য সম্পূর্ণ ব্যাপারটা যত সহজ মনে হচ্ছে আসলে তত সহজ নয়। মাত্র দু’হাজার বছর আগে আমরা সিসার রশি আবিষ্কার করেছি। আর তারপর থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে আমরা অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করছি। তোমাদের পৃথিবীতে বাস্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার যেমন পৃথিবীর সভ্যতার উন্নতিতে যুগান্তরী ভূমিকা রেখেছে, ঠিক সেরকমভাবেই সিসার রশি আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। তোমার জানার জন্য বলছি যে গিগোরা এখনো সিসার রশ্মি আবিষ্কার করতে পারেনি। এজন্য তারা চিকিৎসাবিজ্ঞানে আমাদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।
রনি আর কথা বলল না। সে অবাক বিস্ময়ে নিকির কাজ দেখতে লাগল। তার মনে হলো মনিটরে যেভাবে কোষের বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে তা যেন সে নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে।
একঘন্টা পর নিকি ঘুম জড়ানো চোখে বলল, ট্রিটিসকোপের তথ্য অনুসারে তোমার বাবা সুস্থ হতে চলেছেন।
তুমি কি সত্য বলছ নিকি! চোখ বড় বড় করে বলল রনি।
ট্রিটিসকোপের রিপোর্ট সেরকমই বলছে। তবে তোমার বাবাকে আগামী চারসপ্তাহে চারটি ওষুধ খেতে হবে। আমি ওষুধগুলো তোমাকে দিয়ে যাব।
ঠিক আছে, ঠিক আছে বাবাকে কি আবার ট্রিটিসকোপের চিকিৎসা নিতে হবে?
আপাতত মনে হচ্ছে না।
বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ হবে কবে?
এ মুহূর্তে তাকে সুস্থই বলা চলে। আগামীকাল থেকেই তুমি বুঝতে পারবে। তবে ওষুধগুলো খেলে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ নিকি, অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আগে তোমার বাবা সুস্থতা নিজে অনুধাবন করুক। তারপর আমাকে ধন্যবাদ দিও। এখন চলো তোমার ঘরে যাই। তোমার বাবা আরো তিনঘণ্টা ঘুমাবেন।
এই ঘুমটা তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।
রনির ঘরে এসে নিকি ট্রিটিসকোপের সাহায্যে তার নিজের হাত পরীক্ষা করল। নিকির হাতের হাড়ের চিড়টা ট্রিটিসকোপের মনিটরে স্পষ্ট দেখতে পেল রনি। চিড়টা যে মারাত্মক সে নিজেই বুঝতে পারল। তবে কপাল ভালো হাড়াটা ভেঙ্গে যায়নি। তাই নিকি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মনে হচ্ছে ক্ষতিটা খুব বেশি নয়।
কিন্তু তোমার হাঁড়ে তো চিড় ধরেছে।
আশা করছি কয়েকদিনেই সেরে উঠবে। আপাতত হাতটাকে নড়াচড়া কম করতে হবে। এই বলে হাই তুলল নিকি।
তোমার খুব ঘুম পেয়েছে নিকি?
হ্যাঁ আমি অনেকদিন ঠিকমতো ঘুমাই না। এখন কটা বাজে?
রনি ঘড়ি দেখে বলল, রাত সাড়ে চারটা।
সূর্য উঠবে ক’টায়?
সকাল ছ’টায়।
তাহলে কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারব।
তুমি আরো বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারো। কেউ টের পাবে না।
আমি তাহলে তোমার এখানে ঘুমিয়ে পড়ি।
হ্যাঁ।
এই বলে নিকি একটা কাপড়ে বাম হাতটা গলার সাথে ঝুলিয়ে নিল। তারপর ট্রিটিসকোপ দিয়ে হাতে কী যেন করল। এতে নাকি ব্যথা কমবে। পাশপাশি একটা ওষুধও খেল সে। ওষুধটা ট্রিটিসকোপের ব্যাগের মধ্যে ছিল। এরপর নিকি তার লাইফারে কতক্ষণ কী যেন টিপাটিপি করল। তারপর শুয়ে পড়ল বিছানায়। অবশ্য ঘুমানোর আগে সে পানি খেতে চাইল। রনি পানি এনে দেখে নিকি ঘুমিয়ে পড়েছে। নিকি যে খুবই ক্লান্ত ছিল বুঝতে পারল সে।
শোয়ার আগে রনি একবার তার বাবার ঘর থেকে ঘুরে এলো। তার বাবাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘরে এসে দরজাটা ভালোমতো আটকে দিয়ে দিল সে। তারপর শুয়ে পড়ল নিকির পাশে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেও হারিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
১৩
রনি বুঝতে পারল না কীভাবে গিগোরা জানতে পারল নিকি তার ঘরে আছে। আর কেইবা তার ঘরের লাইটটা বন্ধ করল। তার স্পষ্ট মনে আছে ঘুমানোর আগে সে লাইটটা জ্বালিয়ে রেখেছিল। ঘরের মধ্যে এখন হালকা একটা আলো, ঠিক যেমন পছন্দ করে গিগোরা। রনি আরো চমকে উঠল যখন দেখল নিকি তার পাশে নেই, গিগোদের হাতে বন্দি।
রনি উঠে বসতেই একটা গিগো লাল চোখে তার দিকে তাকাল। তারপর স্পষ্টভাবে বলল, খবরদার, টু শব্দ করবে না।
তো.. তো..তোমরা নিকিকে ধরেছ কেন? তারপরও প্রশ্ন করল রনি।
সেটা আমাদের ব্যাপার।
না, তোমরা এরকম করতে পার না। এই বলে নিকি নিচে নামতে গেল। কিন্তু সাথে সাথেই তার চোখটা ছানাবড়া হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে পুলিশ ঢুকেছে। রাতের সেই অফিসার সবার সামনে। সে আরো চমকে উঠল যখন দেখতে পেল তার হাতে ট্রিটিসকোপটা। অফিসার চোখ কটমট করে বলল, তুমি গানশিপের মধ্যে থেকে ট্রিটিসকোপটা চুরি করেছ?
না আমি চুরি করিনি। ওটা নিকির। তুমি নিকিকে জিজ্ঞেস করতে পার।
তুমি মিথ্যা বলছ। গানশিপের সবকিছুই পৃথিবীর সম্পত্তি। মূল গানশিপ, ট্রিটিসকোপ, লাইফার এমন কী নিকিও।
কী বলছ তুমি!
হ্যাঁ এটাই সত্য এবং তুমি ট্রিটিসকোপটা চুরি করেছ।
আমি চুরি করিনি। আমার বাবাকে বাঁচাতে ওটা নিকির সাথে আনতে গিয়েছিলাম। নিকি আমার বাবার চিকিৎসা করেছে।
কিন্তু চিকিৎসা করে তো কোনো লাভ নেই?
কেন?
কারণ আমরা নিকির সাথে সাথে তোমার বাবাকেও গিগোদের কাছে হস্তান্তর করছি।
কী বলছ তুমি? বিস্ফোরিত চোখে বলল রনি।
হ্যাঁ এরকমই সিদ্ধান্ত হয়েছে। গিগোরা বলেছে আমরা যদি নিকিকে এবং একজন মানুষকে গিগোদের কাছে হস্তান্তর না করি তাহলে তারা আমাদের এই গ্রামকে উড়িয়ে দেবে। তাই উপর থেকে এরকমই নির্দেশ এসেছে।
না না, এটা মিথ্যা কথা। আমার বাবাকে দিয়ে ওরা কি করবে?
গিগোরা মানুষকে নিয়ে গবেষণা করবে। এজন্য গিগোদের একজন মানুষ দরকার যার দেহ কেটে-ছিড়ে ওরা পরীক্ষা করতে পারবে। আর এ উদ্দেশে তোমার বাবাকেই ওদের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ তোমার বাবা ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত। আর মাত্র কয়েকদিন পরই মারা যাবে। এই গ্রামে তার আগে কেউ মারা যাবে বলে আমাদের জানা নেই। তাই তার জীবন পৃথিবীর কাছে মূল্যহীন। এজন্য তাকেই আমরা দিয়ে দিচ্ছি। আমরা সৌভাগ্যবান যে গিগোরা তাতে রাজি হয়েছে। তা না হলে আমাদের হয়তো কোনো সুস্থ মানুষকে দিতে হতো।
বিশ্বাস করো আমার বাবা সুস্থ। আর তোমরা এত বড় বোকামি করছ কীভাবে? নিকি বলেছে গিগোরা এত সহজে মানুষকে আক্রমণ করবে না। তাই নিকি? দুই গিগোর মাঝে বন্দি ম্লান মুখের নিকির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রনি।
নিকি উত্তর দেয়ার আগেই অফিসার বলল, গিগোরা অবশ্য আমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে। তারা নিকির ট্রিটিসকোপ এবং লাইফার দুটোই আমাদের দিয়ে যাচ্ছে।
এ দুটো দিয়ে মানুষ কি করবে! বড় বড় চোখে বলল নিকি।
গবেষণা করবে। গবেষণা করে জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরো উন্নতি করবে।
অসম্ভব। প্রযুক্তিতে মানুষ এখনো এতটা উন্নত হয়নি যে তারা লাইফার এবং ট্রিটিসকোপ ব্যবহার করবে। আর এভাবে নিকি আর মানুষের পরিবর্তে ট্রিটিসকোপ আর লাইফার পৃথিবীতে রাখা অন্যায়। ভয়াবহ অন্যায়।
তুমি ন্যায় অন্যায় নির্ধারণ করার কেউ নও। যাইহোক, আর কথা বলো না। আমরা নিকি আর তোমার বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি।
না না। এটা অসম্ভব। রনি এবার ছুটে এসে নিকির সামনে দাঁড়াল। তারপর বলল, নিকি কিছু একটা কর?
নিকি ম্লান স্বরে বলল, আমি খুব অসহায় হয়ে পড়েছে রনি। এ মুহূর্তে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। যদি করতেই হয় তোমরা মানুষেরাই করতে পারবে। কারণ মহাবিশ্বে তোমরাই সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী।
রনি অসহায়ভাবে বলল, আমার বাবা কোথায়?
অফিসার এবার গম্ভীর মুখে বলল, আছে বাইরে। তাকে গিগোদের নতুন গানশিপে তোলা হচ্ছে।
‘না’ বলে জোরে চিৎকার করে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো রনি। কিন্তু বারান্দা অতিক্রম করতে পারল না। তার আগেই একজন পুলিশ তার হাত ধরে ফেলল। সে স্পষ্ট দেখতে পেল আকাশের অনেক উপর থেকে একটা সিঁড়ি নিচে নেমে এসেছে। সিঁড়িটা যে গিগোদের নতুন গানশিপের এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না তার। রনি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল যখন দেখতে পেল তার বাবাকে সেই সিঁড়িতে তুলে গানশিপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আশেপাশে গ্রামের অনেক মানুষ। এমন কী তার বন্ধু হাসান, রহিম, আব্দুল, মিলন, রউফ, বাশার, হোসেনও আছে। কিন্তু কেউই কিছু করছে না। ভয়ে সবাই যেন একেবারে স্থবির হয়ে গেছে।
রনি আর সহ্য করতে পারল না। সে বাবা বাবা’ বলে চিৎকার করে উঠল।
তারপরও থামল না গিগোরা। তারা উপরে উঠতে লাগল।
রনি আবারো চিৎকার করে উঠে বলল, বাবা, বাবা, তুমি যাবে না।
এই বলে ছুটতে চেষ্টা করল রনি। কিন্তু পারল না। তাকে আটকে ধরে রেখেছে এক পুলিশ। সে ছুটতে না পেরে, শরীরের সমস্ত শক্তিতে এবার চিৎকার করে উঠল, বা..বা.. বা..বা। বা..বা.. বা..বা..বা..
রনি, রনি। হঠাৎ রনি তার বাবা রাহাত সাহেবের কণ্ঠ শুনতে পেল।
কিন্তু সে আগের মতোই বা..বা. বা..বা বলে চিৎকার করতে থাকল।
রনি, রনি, কী হয়েছে তোমার?
হঠাৎ চোখের সামনের তীব্র আলোতে চোখ কুঁচকে ফেলল রনি। পরের মুহূর্তেই দেখতে পেল গিগোরা সব পালিয়েছে, কেউ নেই। চারদিকটা একেবারেই ফাঁকা। কী ঘটেছে বুঝতে একটু সময় লাগল তার। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা যে স্বপ্ন ছিল- বিষয়টা উপলব্দি করতে পেরে বুকভরে জোরে শ্বাস নিল সে।
দরজায় রাহাত সাহেবের কড়া নাড়ার শব্দ আর রনি রনি’ ডাক শুনে লাফ দিয়ে উঠল রনি। কিন্তু পরক্ষণেই চমকে উঠল সে। বিছানার উপর নিকি নেই। অথচ নিকিই তার আগে ঘুমিয়েছিল এবং তারই বিছানায়। সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে তার। শুধু নিকিই না, ট্রিটিসকোপ লাইফার কিছুই নেই। ভয়ে মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেল রনির। সে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পায়নি।
এদিকে আবার রনি রনি’ ডাক শুনে রনি কম্পিত পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতে দেখে তার বাবা রাহাত সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। সে কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, কী ব্যাপার রনি? কি হয়েছে তোমার? আমাকে এভাবে ডাকছিলে কেন?
আমি খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি বাবা। ফিসৃফিস্ করে বলল রনি।
রনির চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে রাহাত সাহেব বললেন, আমি সেরকমই অনুমান করেছিলাম। তারপর হঠাৎ রনির পোষাকের উপর নজর পড়ায় তিনি বড় বড় চোখে বললেন, এ! তোমার জামা-কাপড়ে এভাবে কাদা লাগল কিভাবে?
রনি নিজেও চমকে উঠল। গতরাতে তাকে বাগানের মধ্যে দিয়ে যাওয়া আসা করতে হয়েছিল। তাছাড়া গানশিপে ঢোকার আগে ভেজা মাটির উপর দিয়ে ক্রলিংও করতে হয়েছিল। এজন্যই কাদা লেগেছে।
রনিকে অবশ্য রাহাত সাহেবই বাঁচিয়ে দিলেন। বললেন, তুমি কি খুব সকালে বাগানে গিয়েছিলে নাকি? নাকি খালে মাছ ধরতে গিয়েছিলে?
রনি অস্পষ্টভাবে বলল, বা..গা..নে।
তাই বলো। এজন্যই ভাবছিলাম রাতে নিশ্চয় ঘুম হয়নি তোমার। কিন্তু এটা তো ঠিক না। এত সকালে কাউকে কিছু না বলে বাইরে যাওয়া মোটেও তোমার উচিত হয়নি। বুঝতে পেরেছি তুমি তোমার বন্ধুদের ফাঁদে পা দিয়েছ। ওদেরকে আমার শাসন করতেই হবে।
বাবার মুখে কড়া কথা শুনে রনি চুপ থাকল। কিছুই বলল না।
রাহাত সাহেব যাওয়ার সময় বললেন, টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়েছে। খেয়ে নাও। আর আমি কাদেরকে আসতে বলে দিয়েছি। ও বোধহয় দুপুরের পরেই চলে আসবে। কোথাও গেলে ওকে সাথে নিয়ে যাবে।
এই বলে রাহাত সাহেব চলে গেলেন। রাহাত সাহেবের কথাতে কিছুটা রুক্ষতা থাকলেও রনি মন খারাপ করল না। রবং সে খুশিই হলো। এই রুক্ষতা যে তার বাবার শাসন সে সেটা বুঝতে পারল। অসুস্থ হওয়ার আগে তার বাবা মাঝে মাঝেই তাকে এভাবে শাসন করত। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর বাবা সবসময় তাকে বেশি বেশি আদর করত। এই বেশি আদরটা রনির মাঝে মাঝে ভালো লাগত না। কারণ এর মধ্যে ভয় ছিল, বাবাকে হারানোর ভয়। আজ অনেক অনেক দিন পর বাবার শাসনে সে সত্যি আনন্দিত হলো। সে বুঝতে পারল তার বাবা সুস্থ হয়ে উঠছে।
নিকির কথা মনে হতেই আনন্দটা আতঙ্কে পরিণত হলো রনির। সে ধীর পায়ে ঘরের মাঝে আসতেই খাটের নিচ থেকে উঁকি দিল নিকি। বলল, তোমার বাবা কি চলে গেছেন?
নিকি! বলেই রনি ঝুঁকে এলো খাটের নিছে। তারপর নিকিকে বের হওয়ার সুযোগ না দিয়েই তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি এখানে! আমি তোমার ভয়ে অস্থির হয়ে আছি।
নিকি মৃদু হেসে বলল, যখন বুঝলাম তোমার বাবা দরজা ধাক্কাচ্ছেন তখন তাড়াতাড়ি খাটের নিচে এসে পালিয়েছি।
তুমি খুব বুদ্ধিমান নিকি। আর.আর..
আর কি?
আর খুব ভালো।
তুমি যে আমার থেকেও বুদ্ধিমান এবং অনেক অনেক ভালো।
নিকি!
রনি।
দুজনেই হাসতে হাসতে দুজনকে জড়িয়ে ধরল।
১৪
রনি তাড়াতাড়ি পোষাক পাল্টে ফেলল। এরই মধ্যে নিকি তার ট্রিটিসকোপ আর লাইফার নিয়ে বসেছে। রনি পাশে এসে বলল, নিকি, তুমি কিছু খাবে না?
না আমি খেয়েছি। লাইফার থেকে মাথা না তুলেই বলল নিকি।
কি খেয়েছ! অবাক হয়ে প্রশ্ন করল রনি।
আমাদের খাবার।
কই দেখলাম না তো?
তুমি দেখবে না। কারণ ট্রিটিসকোপের ব্যাগের মধ্যে খাবার ছিল। খাবার মানে ছোট একটা ট্যাবলেট। চুষে চুষে খেতে হয়।
ট্যাবলেট?
হ্যাঁ। আমরা হিমিনরা দুই হাজার বছর আগে খাদ্য গ্রহণ ছেড়ে দিয়েছি। প্রয়োজনীয় খাদ্যউপাদান দিয়ে আমরা ট্যাবলেট তৈরি করে নেই। এর একটা খেলে সারাদিন আর কিছু খাওয়া লাগে না। একটু বড় ট্যাবলেট খেলে সাতদিন পর্যন্ত কিছু খেতে হয় না। আমি যে ট্যাবলেটটি খেয়েছি তাতে সাতদিন আমার আর ক্ষুধা লাগবে না। এটা একটা সাসটেইন রিলিইজড ব্যালান্সড় ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেট দীর্ঘদিন ধরে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে।
তাহলে তোতোমাদের পাকস্থলী, পরিপাকতন্ত্র এগুলোর কোনোকিছুরই প্রয়োজন নেই।
তুমি অনেকটা ঠিকই বলেছ। আমাদের পরিপাকতন্ত্র এখন শুধু পানির উপস্থিতি টের পায়। আর তেমন কিছু না। এজন্য আমাদের পরিপাকতন্ত্র অনেক সরু হয়ে গেছে। হয়তো কিছুদিন পর আমাদের পানিও পান করতে হবে না। তখন পরিপাকতন্ত্রেরও প্রয়োজন হবে না।
সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
অবিশ্বাস করার কিছু নেই। এগুলো বিবর্তনের ফল। তুমি তো জানো তোমার পরিপাকতন্ত্রের শেষ অংশের দিকে একটা অ্যাপেনডিক্স আছে যেখানে ইনফ্লামেশন হলে অ্যাপেনডিসাইটিস নামের একরকম রোগ হয়।
হ্যাঁ জানি।
এই অ্যাপেনডিক্সটা এখন তোমাদের মানুষের কোনো কাজে লাগে না। তবে আগে লাগত যখন মানুষ শুধুই তৃণভোজী ছিল। পরে মানুষ যখন মাংসাশী হয় তখন থেকে অ্যাপেনডিক্সের ব্যবহার কমতে থাকে। এখন প্রায় অপ্রয়োজনীয় অংশ হিসেবে শরীরে আছে। কাজেই অবিশ্বাস করার কিছু নেই। দেখা যাবে একসময় আমাদের পরিপাকতন্ত্র আছে ঠিকই কিন্তু কাজে লাগছে না।
রনি খানিকটা মাথা চুলকে বলল, তোমরা আমাদের সম্পর্কে এত কিছু জানলে কিভাবে?
আগেই বলেছি প্রায় পাঁচশ’ বছর ধরে আমরা তোমাদের পর্যবেক্ষণ করছি। আর এখন আমাদের সকলের মানুষ সম্পর্কে জানা বাধ্যতামূলক। এমন কী মানুষের সকল ভাষা জানাও আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। তোমাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের জন্য আমাদের একটি মহাকাশযান গত একশ বছর ধরে সবসময়ই ব্যস্ত আছে।
কিন্তু এ তো অবিশ্বাস্য। পৃথিবীতে এত ভাষা, তোমরা শিখবে কিভাবে?
আমরা ভাষা শিখি না। আমাদের মস্তিষ্কে ভাষাটা সন্নিবেশিত করা হয়। মানুষের মস্তিষ্কের যেখানে ভাষা সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষিত থাকে সেখানেই আমরা পৃথিবীর বহুল ব্যবহৃত ত্রিশটি ভাষাকে বিশেষ বায়োটেকনোলজির সাহায্যে সন্নিবেশিত করি। ফলে আমরা এই ত্রিশটি ভাষা সহজে যেমন বুঝতে পারি তেমনি বলতেও পারি। তোমার জানার জন্য বলছি যে এই ত্রিশটি ভাষার মধ্যে তোমাদের ভাষাও আছে।
গিগোরাও কি তোমাদের মতো আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারে?
না পারে না। কারণ আমি আগেই বলেছি ওরা আমাদের মতো উন্নত নয়।
এমন সময় রনি তার বাবার ডাক শুনতে পেল, রনি নাস্তা করতে এলে না?
রনি তাড়াতাড়ি পোষাক ঠিক করতে করতে বলল, আমি আসছি বাবা। তারপর নিকির দিকে ফিরে বলল, নিকি আমি কি তোমার জন্য পানি নিয়ে আসব?
হ্যাঁ আনতে পার।
তুমি তাহলে একটু অপেক্ষা করো।
এখানে কেউ আসবে না তো?
আসলে আমি দেখতে পাব। সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে আগেই সতর্ক করে দেব।
ঠিক আছে।
তুমি ভয় পেও না। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব। এই বলে রনি নাস্তা করার জন্য টেবিলে এলো।
নাস্তার টেবিলে রনি তার বাবা রাহাত সাহেবকে তার চাচা ডাক্তার রহমতের সাথে মন খুলে আলাপ করতে দেখল। রাহাত সাহেবকে দেখে এখন কারো বোঝার উপায় নেই যে গতকালও তিনি একজন মৃত্যুপথযাত্রী রুগী ছিলেন। একসময় তো তাকে বলতে শোনা গেল, আমার মনে হচ্ছে আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। মাথাটাকে এত হালকা লাগছে যে গত চারমাসে কখনোই এতটা হালকা লাগেনি। এই বলে এমনভাবে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন যে রনি নিজেই বিস্মিত হলো। বহুদিন পর সে তার বাবাকে এভাবে হাসতে দেখল- সত্যি তার খুব ভালো লাগছে। আর এটাও বুঝতে পারছে এসব কিছুর কৃত্বিত্ব হলো তার বন্ধু নিকির।
রনি তার ঘরে ফিরে আসতে দেখতে পেল নিকি গভীর মনোযোগ দিয়ে লাইফারের উপর কাজ করছে। রনি পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে সামনে ঝুঁকে এসে বলল, কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে?
হু। মুখ না তুলেই উত্তর দিল নিকি।
কি হয়েছে?
আমাকে উদ্ধারের জন্য যে স্পেসশিপটা আসার কথা সেটা পৃথিবীর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। স্পেসশিপ থেকে আমার লাইফারে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে। কিন্তু সিগন্যালটা খুব দুর্বল। লাইফার একবার মাত্র রিসিভ করতে পেরেছে। আমি যদি কয়েকঘন্টার মধ্যে আমার অবস্থান জানাতে না পারি তা হলে স্পেসশিপটা পৃথিবীর মহাকাশ সীমানায় এসে চারদিকে শুধু ঘুরতে থাকবে।
তোমাদের স্পেসশিপ কখন পৃথিবীর মহাকাশ সীমানায় পৌঁছাবে?
আরো প্রায় বার-তের ঘন্টা সময় লাগবে। আশা করছি সন্ধ্যার পরপরই স্পেসশিপটা পৃথিবীর মহাকাশ সীমানায় প্রবেশ করবে।
আমার বিশ্বাস লাইফার তখন সিগন্যালটা ধরতে পারবে।
আমি বারবার লাইফার থেকে সিগন্যাল পাঠাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। আশেপাশে কোথাও বাধা পাচ্ছে।
আমার মনে হয় তোমাদের স্পেসশিপ অনেক দূরে বলে সিগন্যালটা পৌঁছাচ্ছে না।
না ব্যাপারটা সেরকম নয়। লাইফারের সিগন্যাল পৃথিবীর মাহাকাশ সীমানায় পৌঁছাতে পারছে না। তার আগেই বাধাগ্রস্ত হয়ে কিংবা শোষিত হয়ে সিগন্যালের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে সিগন্যাল।
তাহলে উপায়?
আমাদের উঁচু কোনো স্থানে যেতে হবে। সেখান থেকে সিগন্যাল পাঠালে আমাদের স্পেসশিপ সিগন্যালটা রিসিভ করতে পারবে।
কিন্তু আশেপাশে তো উঁচু জায়গা নেই। আমাদের বাড়ির ছাদে গেলে কি হবে?
মনে হয় না। আরো উঁচু জায়গা লাগবে। তবে ছাদে যেয়ে চেষ্টা করা যায়।
তাহলে এখনই চলে। অবশ্য তার আগে পানিটা খেয়ে নাও। তুমি পানি খেতে চেয়েছিলে। এই বলে রনি নিকির দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল।
নিকি এবার প্রথমে পানিটা খেল না। সে ট্রিটিসকোপ থেকে বেরিয়ে আসা একটা সেন্সর পানিতে ডুবিয়ে দিল। আর সাথে সাথে ট্রিটিসকোপের মনিটরে অনেকগুলো রিডিং ভেসে এলো। কিন্তু রনি তার কিছুই বুঝল না। সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল নিকির দিকে।
নিকি বলল, তোমাদের পানি অতটা বিশুদ্ধ নয়। কেন?
সংকুচিত চোখে বলল রনি।
পানির পিএইচ ঠিক থাকলেও পানিতে আয়রনের পরিমান বেশি। তাছাড়া এখানে অনেক জীবানুও আছে।
কী বলছ তুমি! জীবানু?
হ্যাঁ, এই দ্যাখো। মনিটরের রিডিং বলছে এই পানিতে ছাব্বিশটি কলেরার জীবানু, তেরটি টাইফয়েডের জীবানু এবং অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস মিলে একশ তেষট্টিটি জীবানু রয়েছে।
সর্বনাশ! তাহলে তো এই পানি খেলে আমরা অসুস্থ হয়ে যাব।
না না! ভয়ের কোনো কারণ নেই। এই সামান্য জীবানু শরীরে কোনো অসুখ সৃষ্টি করতে পারবে না। অসুখ হওয়ার জন্য প্রতি মিলিলিটার পানিতে আরো অনেক জীবানু থাকতে হবে। তবে তোমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। আমাদের গ্রহের পানি একেবারেই বিশুদ্ধ। সেখানে হাইড্রোজেন-অক্সিজেন এবং প্রয়োজনীয় মিনারেল ছাড়া আর কিছু নেই।
তাহলে তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি তোমার জন্য মিনারেল ওয়াটার নিয়ে আসি। বাবার ঘরে আছে। বোতল এখনো ভোলা হয়নি।
না, তার প্রয়োজন হবে না। এই পানিই আমি খেতে পারব। রনি অবশ্য শুনল না। সে এক দৌড়ে তার বাবার ঘর থেকে মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতল নিয়ে এলো। বোতলটা আগে খোলা হয়নি। নিকিই প্রথম খুলল। কিন্তু পানিটা পরীক্ষা করে সে খুব হতাশ হলো। রনির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের টিউবওয়েলের পানি বোতলের এই মিনারেল ওয়াটারের পানি থেকে অনেক বিশুদ্ধ এবং ভালো।
কী বলছ তুমি!
হ্যাঁ। বোতলের পানির পিএইচটা পর্যন্ত ঠিক নেই। তাছাড়া এখানে অনেক দ্রবীভূত ময়লা আছে যা তোমাদের পানিতে ছিল না। এই পানিতে যতটুকু মিনারেল থাকার কথা তার একটাও ঠিকমতো নেই। পাশাপাশি ব্যকটেরিয়া ভাইরাসের সংখ্যাও তোমাদের পানির তুলনায় বেশি।
কিন্তু এই পানিই তো আমরা টাকা দিয়ে কিনি।
আমার বিশ্বাস পানিটার উৎস ভালো ছিল না এবং পানিটাকে যেভাবে বিশুদ্ধ করা উচিত ছিল সেভাবে করা হয়নি। এই বলে নিকি রনির আগে আনা গ্লাসের পানিটুকু এক চুমুকে খেয়ে ফেলল।
আরে করছ কী! করছ কী! তুমি তো জীবানুসহ খেয়ে ফেললে! অনেকটা জোরেই বলে উঠল রনি।
ভয় পেও না। আমার শরীরে কলেরা টাইফয়েডের টীকা দেয়া আছে।
তাই বলে..
রনি শেষ করতে পারল না। তার আগেই নিকি বলল, হ্যাঁ আমি সত্য বলছি। আমাদের গ্রহে শেষ টাইফয়েড হয়েছিল এখন থেকে নয় হাজার বছর আগে এবং শেষ কলেরা হয়েছিল প্রায় দশ হাজার বছর আগে।
রনি হাঁ করে আছে দেখে নিকি বলল, তুমি অবাক হচ্ছ ঠিকই। কিন্তু আমি নিশ্চিত তোমরা মানুষেরা আমাদের চেয়েও দ্রুত সবকিছু জয় করবে। যাইহোক, এখন চলো ছাদে যাই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা আমাকে এখন করতে হবে।
ঠিক আছে চলল।
ছাদে আমাকে কেউ দেখে ফেলবে না তো?
না না। সিঁড়িটা আমার ঘরের সাথেই। বাবা সামনের দিকে আছে। আমরা পিছন দিয়ে ছাদে উঠে যাব।
ঠিক আছে চলল।
ট্রিটিসকোপটা ঘরে রেখে দুজনে গোপনে ছাদের উপর উঠে এলো। তারপর লাইফারের সাহায্যে নিকি তাদের স্পেসশিপে সিগন্যাল পাঠানোর চেষ্টা করতে শুরু করল।
১৫
লাইফারটা দেখতে অনেকটা মোবাইল ফোনের মতো। রনি এখন পর্যন্ত একবারও নিকিকে লাইফারটা হাতছাড়া করতে দেখেনি। সবসময়ই নিকি সেটাকে হাতের মধ্যে রাখে। শেষ পর্যন্ত কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করল, নিকি, তোমরা কি সবসময়ই লাইফার সাথে রাখো?
হ্যাঁ।
কেন?
লাইফার আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা তোমাকে আগেও বলেছি। কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটাই ব্যাখ্যা করছি তোমাকে। কাকতলীয়ভাবে তোমাদের আর আমাদের ভাষার দু’একটা শব্দ এবং তার অর্থ হুবহু মিলে গেছে। তার মধ্যে একটা হলো ‘লাইফ’ বা ‘জীবন’। এই লাইফ থেকেই লাইফার শব্দটা এসেছে। জীবন পরিচালনা এবং জীবন রক্ষার জন্য লাইফারের গুরুত্ব অপরিসীম। লাইফারের সাধারণ ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে- এটাকে মোবাইল ফোন, রেডিও, টেলিভিশন, অডিও-ভিডিও রেকর্ডার, ক্যামেরা, কম্পিউটার হিসাবে ব্যবহার করা যায়। পাশাপাশি এটা হলো আমাদের সবার আইডি কার্ড। তোমাদের যেমন সিটিজেন নম্বর আছে আমাদের আছে লাইফার নম্বর। এই নম্বর দিয়েই আমাদের সনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি লাইফারকে আমরা আমাদের লাইব্রেরি বলে থাকি। এর মধ্যে গত একশ’ বছরের হিমিনদের সকল তথ্য সন্নিবেশিত করা আছে। ফলে যে কোনো প্রয়োজনে আমরা যে কোনো তথ্য এখান থেকে পেতে পারি। লাইফার আমাদের সহজেই সনাক্ত করতে পারে এবং আমাদের অবস্থান নিশ্চিত করে।
লাইফার তোমাদের অবস্থান নিশ্চিত করে?
হ্যাঁ। আমাদের সবার শরীরে একটা মাইক্রোচিপস্ বসান আছে। মাইক্রোচিপসটি এত ক্ষুদ্র যে খালি চোখে দেখা যায় না। এটা আমাদের শরীরে রক্তের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন কারণে এটা আমাদের প্রয়োজন হয়। এই মাইক্রোচিপস আর লাইফারের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। লাইফার সবসময়ই এই মাইক্রোচিপসকে নির্দেশ করে। আর মাইক্রোচিপসটি আমাদের শরীরে থাকায় লাইফারের মনিটরে আমাদের অবস্থান নির্দেশিত হয়। এই যে তুমি মনিটরে একটা তীর চিহ্ন দেখতে পাচ্ছ, এই তীর চিহ্ন এখন আমাকে চিহ্নিত করছে। যদি আমি ঘুরে বসি তীর চিহ্নটিও ঘুরে যাবে। এই লাইফারটা এতটাই শক্তিশালী যে আমি যদি একহাজার কিলোমিটারের মধ্যে থাকি তাহলে সেটা আমার অবস্থান নির্দেশ করবে।
কিন্তু কেন এটা প্রয়োজন? লাইফারটা তো সবসময় তোমার কাছেই থাকছে? লাইফারটা দিয়ে তুমি তোমার অবস্থান জেনে কি করবে?
সুন্দর প্রশ্ন করেছ। আসলে এই ব্যবস্থাটা আমাদের আগে ছিল না। গিগোদের সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে শুরু করা হয়েছে। সবার প্রতি নির্দেশ আছে যদি কেউ কোনো কারণে গিগোদের হাতে বন্দি হয় এবং লাইফার ব্যবহার করতে না পারে তাহলে সুবিধাজনক জায়গায় এই লাইফারটায় প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে বা রেকর্ড করে ফেলে দিতে হবে। উদ্ধারকারী দল সহজেই এই লাইফার খুঁজে বের করে তার সাহায্যে বন্দি হিমিনকে খুঁজে পাবে। আপাতদৃষ্টিতে এই ব্যবহারটাকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও একজন বন্দির কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু আমার তো মনে হয় বন্দি হওয়ার সময় তোমরা নিজেরাই লাইফার থেকে লেসার রশি ছুঁড়তে পার।
হ্যাঁ পারি। শুধু লেসারই নয়, সিসার রশিও ছুঁড়তে পারি। কিন্তু সকল লাইফারে সেই ক্ষমতা প্রদান করা থাকে না। শুধু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের লাইফারে এই ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে।
তুমি তো খুব গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তার। নিশ্চয় তোমার লাইফারে আছে।
হ্যাঁ আছে।
তাহলে তুমি লেসার ছুঁড়ে গিগোদের হত্যা করো না কেন?
সেরকম কোনো সুযোগ আমি পাইনি। কারণ বন্দি হওয়ার সাথে সাথে গিগোরা লাইফারটা আমার কাছ থেকে নিয়ে নেয়। পরে গানশিপ বিধ্বস্ত হলে বলতে পার অনেকটা ভাগ্যগুণে লাইফারটা আমি হাতে পাই। তবে লেসার ছুড়লেই যে আমি গিগোদের হত্যা করতে পারব তা ঠিক নয়। গিগোদের কাছে। লেসার অ্যাবজরবার আছে যেটা যে কোনো লেসার রশ্মি, এমন কী সিসার রশ্মিকেও শোষণ করে নিতে পারে। গিগোরা সিসার রশ্মি আবিষ্কার না করলেও সিসার অ্যাবজরবার ঠিকই আবিষ্কার করে ফেলেছে।
তাহলে তো গিগোরা তোমাকে লেসার ছুঁড়ে হত্যা করতে পারে।
সে সম্ভাবনা খুব কম। কারণ আমাকে হত্যা করে গিগোদের কোনো লাভ হবে না। তারা আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইবে। আর যদি দূর থেকে ছুঁড়ে আমাকে হত্যা করতেও চায়, পারবে না। কারণ আমার লাইফারেরও লেসার শোষণ করার ক্ষমতা আছে।তাহলে তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন?
কারণ গিগোরা যে কোনো সময় আমাকে বন্দি করতে পারে। শারীরিকভাবে আমি কখনো গিগোদের সাথে পেরে উঠব না। গিগোরা উচ্চতায় আমার প্রায় দ্বিগুন, শরীরে শক্তিও বেশি। অবশ্য বন্দি কিংবা মৃত্যু হওয়ার ভয়ে আমি যতটা না শংকিত থাকি তার থেকে বেশি শংকিত থাকি আমাদের প্রযুক্তি ওদের কাছে হস্তান্তর হওয়া নিয়ে।
ও আচ্ছা। এই বলে রনি আবার লাইফারের দিকে দৃষ্টি ফেরাল।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পরও যখন নিকি তাদের স্পেসশিপের সাথে যোগযোগ করতে পারল না তখন সে হতাশ হয়ে বলল, আমাদের আরো উপরে উঠতে হবে।
এখানে তো আর উপরে উঠার কোনো জায়গা নেই। আমাদের গ্রামে যতগুলো বিল্ডিং আছে সবগুলোই একতলা।
তাহলে অপেক্ষা করতে হবে। স্পেসশিপ পৃথিবীর মহাকাশসীমানায় পৌঁছানোর পর আবার আমি সিগন্যাল পাঠাতে চেষ্টা করব।
আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। তুমি তোমার স্পেসশিপের সিগন্যাল পাচ্ছ কিন্তু তারা কেন তোমার সিগন্যাল পাচ্ছে না।
ব্যাপারটা খুবই সহজ। আমাদের স্পেসশিপের ট্রান্সমিশন সিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী। কিন্তু এই ছোট্ট লাইফারের ট্রান্সমিশন সিস্টেম অতটা শক্তিশালী নয়। তবে যদি উঁচু কোনো টাওয়ার থাকত তাহলে আমি লাইফারের ট্রান্সমিশনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারতাম।
আমরা একটা কাজ করতে পারি। হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে বলল রনি।
কি কাজ?
বাগানে যে তেঁতুল গাছটা আছে সেটা অনেক উঁচু। ঐ গাছের উপরের ডালে উঠলে তোমার লাইফার কাজ করতে পারে।
গতকাল রাতে আমি যে গাছটার নিচে ছিলাম সেটার কথা বলছ?
হ্যাঁ হ্যাঁ।
গাছটা উঁচু বটে। কিন্তু আমি তো উঠতে পারব না। আমার বাম হাতের অবস্থা দেখতেই পাচ্ছ।
আমিও পারব না। আগে আমি কখনো তেঁতুল গাছের অতটা উপরে উঠিনি।
তাহলে তো সমস্যাই।
সমস্যার কিছু নেই। আমার বন্ধু হাসান আছে। ও গাছে উঠায় খুবই পারদর্শী। ওই আমাদের তেঁতুল পেড়ে দেয়। তুমি অনুমতি দিলে আমরা ওর সাহায্য নিতে পারি।
না না। আমি অন্য কারো কাছে নিজের অবস্থানকে প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। কিন্তু এটা ছাড়া তো উপায়ও নেই। তুমি তাকে আমার মতোই বিশ্বাস করতে পার।
বিশ্বস্ত হলেই তো হবে না, তাকে তো লাইফার চালাতে জানতে হবে।
তুমি শিখিয়ে দেবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তুমি যদি সিগন্যালটা পাঠাতে না পার তাহলে তো স্পেসশিপের কেউ তোমাকে খুঁজে পাবে না।
নিকি কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, তুমি কি নিশ্চিত সম্পূর্ণ ব্যাপারটা হাসান গোপন রাখবে?
হ্যাঁ নিশ্চিত। ও গ্রামের ছেলে, খুব সহজ সরল। তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে।
বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমার তো বাইরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
ঐ যে বললাম, তুমি হাসানকে শিখিয়ে দেবে। আমি আর হাসান যাব। তারপর সিগন্যাল পাঠিয়ে আবার ফিরে আসব।
আমার জন্য ব্যাপারটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কিছুতেই আমি লাইফার হাতছাড়া করতে চাচ্ছি না।
আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু দিনের বেলায় তো গিগোরা আর আক্রমণ করবে না। তুমিই তো বলেছ দিনে ওরা কিছু দেখতে পায় না।
গিগো ছাড়াও আরো ঝুঁকি আছে। মানুষকেও আমি ভয় পাচ্ছি।
তুমি আমার ঘরে থাকবে। সেখানে কেউ হ্রাসবে না।
নিকি আরো খানিকটা সময় নিল। তারপর বলল, ঠিক আছে, তুমি তোমার বন্ধু হাসানকে খবর দাও। কিন্তু মনে রাখবে কোনোকিছুই যেন প্রকাশ না পায়।
না পাবে না। আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
নিকি আর কোনো কথা বলল না। তবে তাকে খুব চিন্তিত দেখাল। আর নিকিকে চিন্তিত দেখে মন খারাপ হয়ে গেল রনির। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল যেভাবেই হোক সাহায্য করবে নিকিকে?
১৬
নিকিকে দেখে হাসানের চোখ তো ছানাবড়া! চোখ ট্যারা বলে কারো দিকে তাকালে তার চোখের মনি দুটো উপরের দিকে উঠে যায়। আর যখন সে বড় বড় চোখে তাকায় তখন মনে হয় মনি দুটো বুঝি উল্টে পিছনে চলে যাচ্ছে। এখন তার ঠিক সেরকম অবস্থা। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না নিকির। সে বলল, তোমার চোখে কি হয়েছে?
আমি ট্যারা। উত্তর দেয়ার সময় কিছুটা লজ্জা পেল হাসান।
তুমি চিকিৎসা করাওনি?
আমাদের দেশে চোখের এই অসুখ সারানোর কোনো ভালো চিকিৎসা নেই। রনিই উত্তর দিল এবার।
কী বলছ? এটা তো কোনো সমস্যাই নয়।
তোমাদের কাছে কী চিকিৎসা আছে?
অবশ্যই। আমরা তো বহু আগেই এ ধরনের চোখের চিকিৎসায় সাফল্য অর্জন করেছি। তুমি চিন্তা করো না, আমি হাসানের চোখ ঠিক করে দিচ্ছি।
কথাটা শোনামাত্র হাসানের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে একবুক আশা নিয়ে তাকাল নিকির দিকে।
নিকি বলল, তোমার চোখটা আমাকে একটু পরীক্ষা করে দেখতে হবে। চোখের লেন্সের অসম ফোকাসের কারণে এমন হতে পারে। অবশ্য আরো অনেক কারণ আছে। তবে আমি বিশ্বাস করছি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি তোমার চোখ ঠিক করে দিতে পারব। এই বলে সে হাসানকে বিছানায় শুতে বলল।
হাসান শুয়ে পড়লে নিকি ট্রিটিসকোপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ট্রিটিসকোপের কয়েকটা সেন্সর সে দশ মিনিটের মতো হাসানের চোখে লাগিয়ে পরীক্ষা করল। তারপর চোখের মধ্যে কয়েকরকম আলোকরশি প্রবেশ করিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল সে।
রনি উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, তোমার পরীক্ষা কি শেষ নিকি?
আমি বিশ্বাস করছি হাসানের চোখ ঠিক হয়ে গেছে।
কী বলছ তুমি! অবিশ্বাস ভরা চোখে বলল রনি।
হ্যাঁ তুমি পরীক্ষা করতে পার।
রনি তাড়াতাড়ি হাসানের উপর ঝুঁকে বলল, হাসান, আমার দিকে তাকাও তো।
হাসান রনির দিকে তাকাতে রনি সাথে সাথে বলল, হ্যাঁ নিকি, তুমি ঠিকই বলেছ। আমার মনে হচ্ছে হাসান আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনিদুটো একদম আমার সোজা। তুমি তো মনে হলো ম্যাজিক দেখালে!
না ম্যাজিকের না। আমাদের প্রযুক্তির কাছে এগুলো কোনো সমস্যাই না।
তোমাদের কাছে তাহলে সমস্যা কোনগুলো?
আমাদের সমস্যা ব্যাখ্যা করলে তোমরা বুঝবে না।
কেন বুঝব না?
কারণ আমরা যা কিছু করতে পারি তোমরা তার অনেককিছু কল্পনাই করতে পার না। যেমন ধর তোমরা কম্পিউটার আবিষ্কার করেছ। কম্পিউটার নিয়ে তোমাদের বড় একটা সমস্যা হচ্ছে কম্পিউটার ভাইরাস যা মূলত একটা প্রোগ্রাম। এখন এই কম্পিউটার ভাইরাস নিয়ে তোমরা তোমাদের দশ হাজার বছরের পূর্ব-পুরুষদের যদি কিছু বোঝাতে চেষ্টা কর তাহলে তারা কিছু বুঝবে না। কারণ কম্পিউটার সম্পর্কেই তাদের কোনো ধারণা নেই। ব্যাপারটা ঠিক সেরকম। তোমরা আমাদের সমস্যা বুঝবে না।
কিন্তু উপলব্দি তো করতে পারব।
তা হয়তো পারবে। যেমন ধর, আমাদের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে যে নিজেদের অবস্থানকে গোপন করে চলাচল করা। আরো সহজভাবে বললে বলতে হয় নিজেদের অদৃশ্য করা। আমরা লক্ষ্য করছি যখনই আমরা কোনো প্রাণীকে অদৃশ্য করে পরে আবার দৃশ্যমান করছি তখনই সেটার কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটছে। চাইলেও আমরা সেটাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারছি না। এই সমস্যার সমাধান এখানো আমরা করতে পারিনি।
তোমরা প্রাণীকে অদৃশ্য করতে পারছ! বিস্মিত কণ্ঠে বলল রনি।
এখনো করিনি। তবে সাফল্যের প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আলোর গতির সাথে সম্পর্কিত। আলোর গতিকে জয় করতে পারলে অনেক কিছুই জয় করা সম্ভব।
তোমরা কি আলোর গতিতে চলতে পার? প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল?
আমাদের প্রযুক্তি কিছুটা ভিন্ন। তবে এটা সত্য, আমরা অবিশ্বাস্য গতিতে চলতে পারি। তোমরা। মানুষেরা তা কল্পনাও করতে পারবে না। আর এজন্যই আমরা এতদূর থেকে এখানে আসতে পেরেছি।
তোমরা এত দ্রুত চলো কিভাবে?
আগেই বলেছি আমাদের প্রযুক্তি তোমাকে বোঝান যাবে না। যাইহোক, শুধু এটুকু রাখো, আমরা যখন সর্বোচ্চ গতিতে চলাচল করি তখন নিজেরাই শক্তিতে রূপান্তরিত হই। ব্যাপারটা খুব জটিল, তোমাকে ব্যাখ্যা করতে পারব না। এমন কী আমি নিজেও সবকিছু ভালোমতো বুঝি না। কারণ আমি আলোকবিদ্যা বিশারদ নই, আমি একজন ডাক্তার। নিকি- ৫
নিকি আর রনির আলোচনায় কোনো আগ্রহই ছিল না হাসানের। সে এতক্ষণ ব্যস্ত ছিল আয়নায় নিজের চোখ পরীক্ষা করতে। যখন বুঝতে পারল সত্যি তার চোখ ভালো হয়ে গেছে সে নিজে থেকেই বলল, আমার চোখ ভালো হইয়া গ্যাছে।
ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছ তো তুমি? প্রশ্ন করল নিকি।
হাসান কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে নিকির দিকে তাকিয়ে থাকল।
নিকি আবার বলল, কোনোকিছু দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না তো তোমার?
না না। সব ঠিকই আছে।
ব্যথা করছে কি? অথবা অন্য কোনো অসুবিধা?
স্বল্পভাষী হাসান ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল তার কোনো সমস্যা নেই। এই মুহূর্তে সত্যি তাকে খুব আনন্দিত দেখাচ্ছে। এতদিন বন্ধুদের কাছে, স্কুলে, খেলার মাঠে সব জায়গায় তাকে ট্যারা কথাটা শুনতে হতো। তখন তার খুব কষ্ট হতো, মাঝে মাঝে গোপনে চোখের পানিও ফেলত সে। নিজের উপরই নিজের রাগ হতো। এখন থেকে কেউ আর তাকে ট্যারা’ বলবে না ভাবতেই অন্যরকম আনন্দ লাগছে তার। চোখে মুখেও তার কৃতজ্ঞতার আভাস স্পষ্ট। আর যখন রনি তাকে বুঝিয়ে দিল নিকির জন্য তাকে কিছু একটা করতে হবে তখন সে সেটা করার জন্য সত্যি ব্যস্ত হয়ে উঠল।
সম্পূর্ণ ব্যাপারটা নিকি বেশ সময় নিয়ে হাসানকে বুঝিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর পর লাইফারের লাল বাটনটা একবার করে চাপ দিতে হবে- এটাই যে মূল কাজ সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না হাসানের। পাশাপাশি লাইফারে সবুজ বাতি জ্বলে উঠলে সাথে সাথে যে নিকিকে ব্যাপারটা জানাতে হবে সেটাও বুঝল সে।
রনি আর হাসান লাইফারটা নিয়ে বাইরে আসার সময় নিকি বলল, আমি কি তোমাদের সাথে আসতে পারি?
এখন অবশ্য বাগানে কেউ থাকবে না। তেঁতুল গাছের পাশে একটা ঘন ঝোঁপ আছে সেখানে তুমি লুকিয়ে থাকতে পারবে। তবে ঝুঁকি কিছুটা থেকেই যাচ্ছে।
সত্যি কথা বলতে কী আমি সবসময় লাইফারের পাশে থাকতে চাচ্ছি। যে কোনো সময় এটা আমার প্রয়োজন হতে পারে।
তাহলে চলো। আশা করছি কেউ তোমাকে দেখবে না।
রনির ঘরের পিছনে একটা দরজা আছে। এই দরজাটা বহুদিন ধরে ব্যবহার করা হয় না। সেটা দিয়েই তারা বাইরে এলো। ফলে বাড়ির সামনের কেউ তাদের দেখতে পেল না।
তেঁতুল গাছের নিচে এসে নিকি বলল, তোমরা পারবে তো?
হ্যাঁ পারব। আর তুমি ঐ ঝোঁপটার মধ্যে যেয়ে বসতে পার। ঝোঁপটা খুব ঘন, কেউ দেখতে পাবে না তোমাকে।
ঠিক আছে। কিন্তু খুব সতর্ক থাকবে।
অবশ্যই থাকব।
নিকি ঝোঁপের মধ্যে প্রবেশ করলে রনি দূর থেকে পরীক্ষা করে দেখল আদৌ নিকিকে বাইরে থেকে দেখা যায় কিনা। যখন নিশ্চিত হলো নিকিকে বাইরে থেকে দেখা যায় না তখন সে হাসানকে বলল, তুমি এখন উঠতে পার।
হাসান যেন এতক্ষণ গাছে উঠার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে তর তর করে একেবারে উপরের ডালে উঠে গেল। তারপর নিকি যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে সেভাবে লাইফারটা চালাতে চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পর রনি জোরে জিজ্ঞেস করল, কি খবর হাসান? সবুজ বাতিটা কি জ্বলেছে?
না। উপর থেকে উত্তর দিল হাসান।
এভাবে প্রায় পনের মিনিট অপেক্ষা করার পরও যখন কোনো সবুজ আলো জ্বলল না তখন রনি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। হাসান এত উপরে উঠেছে যে তাকে নিচ থেকে দেখা পর্যন্ত যাচ্ছে না। এর থেকে উপরে উঠা এই গ্রামের কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অথচ এখনো যদি সিগন্যালটা পাঠাতে না পারে। তাহলে নিকিকে সত্যি সমস্যায় পড়তে হবে। এই চিন্তায় দারুণভাবে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল সে। তার উৎকণ্ঠাটা আরো বাড়ল যখন দেখল চারজন মানুষ এদিকেই হেঁটে আসছে। সামনে বয়স্কমতো এক ভদ্রলোক, চুলগুলো সব সাদা। তার পিছনে অন্যদের বয়স কম। এদের কাউকেই রনি আগে কখনো দেখেনি। হাতে স্টিল ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, মাঝারি আকৃতির একটা খচা এবং আরো কিছু যন্ত্রপাতি দেখে রনি বুঝতে পারল ঢাকা থেকেই এসেছে সবাই।
বয়স্ক ভদ্রলোক সামনে আসতে রনি আড়চোখে ঝোঁপের দিকে তাকাল। তার বুকটা ধক ধক করছে। কী জানি কী হয়!
বয়স্ক ভদ্রলোকই প্রথম কথা বললেন, এই ছেলে তোমার নাম কি?
রনি।
আমি প্রফেসর হায়দার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার শিক্ষক।
জ্বি।
তুমি এখানে কি করছ?
ইয়ে..মানে তেঁতুল পাড়ছি। ইতস্তত করে বলল রনি।
প্রফেসর হায়দার উপরের দিকে তাকিয়ে বললেন, কই, কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না?
আছে উপরে আছে। আমার বন্ধু হাসান আছে। এই বলে সে জোরে ডেকে উঠল, হাসান?
না কোনো সিগন্যাল নাই। জোরে চেঁচিয়ে উত্তর দিল হাসান। নিচে যে কেউ এসেছে সে সেটা উপর থেকে বুঝতে পারেনি।
এদিকে হাসানের কথা শুনে অন্তঃরাত্মা কেঁপে উঠল রনির। তার গলা প্রায় শুকিয়ে এলো। ঠিক যে প্রশ্নটা সে আশা করছিল প্রফেসর সাহেব সেই প্রশ্নটাই করলেন, কিসের সিগন্যালের কথা বলছে তোমার বন্ধু?
ইয়ে…ইয়ে.. মানে। শুনেছি এখানে একটা ভিনগ্রহের জীব আছে। সেটা থাকলে নিশ্চয় সিগন্যাল দেয়ার কথা। সেটাই খুঁজছে হাসান।
তুমি না বললে তেঁতুলের জন্য এসেছ?
দু..দুটোই। চোখ বড় বড় করে বলল রনি।
তুমি তো দেখি বেশ সাহসী ছেলে। এত কম বয়সেই ভিনগ্রহের প্রাণীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইছ। আমরাও সেই সকাল থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি প্রাণীটাকে। যদি তুমি সন্ধান পাও আমাদের জানিও।
জ্বি..জ্বি.. জানাব। তাড়াতাড়ি বলল রনি।
আমাদের কাছ থেকে অবশ্য পালাতে পারবে না। আমরা সবসময় ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছি। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা প্রথম থেকেই ভিডিও করব। আমাদের কাছে অজ্ঞান করার ডার্টও আছে। দূর থেকে ছুঁড়ে মারলেই ওষুধ শরীরে ঢুকে যাবে। সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যাবে প্রাণীটা।
এমন সময় পাশে দাঁড়ান তরুণ বয়সের একজন বলল, স্যার, ওই ঝোঁপটা দেখে আসি। ওখানে থাকতে পারে। ঝোঁপের মধ্যে কী আছে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না।
হ্যাঁ দেখে এসো। সাথে ডার্ট নিয়ে যেও। ভিনগ্রহের প্রাণী আক্রমণাত্মকও হতে পারে।
কথাটা শোনার সাথে সাথে রনির মুখটা সাদা হয়ে গেল। তার মনে হলো তার পায়ের নিচ থেকে বুঝি সমস্ত মাটি সরে গেল। সে বুঝি শূন্যে ভাসছে। তারপরও সে নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। বলল, না..না.. ওখানে কেউ নেই। আমি একটু আগে দেখেছি।
তুমি ঠিক দেখেছ তো? প্রশ্ন করলেন প্রফেসর।
হ্যাঁ। আমি নিজে দেখেছি। আমি আবার যাচ্ছি। আপনাদের কারো যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
এই বলে রনি ছুটে এলো ঝোঁপের কাছে। ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে নিকি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সে ভিতর থেকেই বলল, এখানে কেউ নেই।
এই বলে সে আবার বের হয়ে এলো।
প্রফেসর এবার বললেন, ঠিক আছে, তুমি তাহলে চলে এসো। আর কিছু দেখলে সাথে সাথে আমাদের জানাবে।
জ্বি জানাব।
আমাকে খুঁজে পাবে কিভাবে?
রনি কিছু বলছে না দেখে প্রফেসর হায়দার একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিয়ে বললেন, এখানে আমার মোবাইল নম্বর লেখা আছে। তুমি আমাকে ফোন করবে। খবরদার অন্য কাউকে আগে জানাবে না। আমিই প্রথম ওদেরকে ধরতে চাই।
জ্বি স্যার, আমি আপনাকে খবর দেব। সায় দিয়ে বলল রনি।
প্রফেসর হায়দার আর কোনো কথা বললেন না। তিনি তার দলের লোকজন নিয়ে ডান দিকে ঘুরে গেলেন।
প্রফেসর হায়দার চলে যেতে রনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। সে আবার ছুটে গেল ঝোঁপের মধ্যে। তারপর নিকিকে জড়িয়ে ধরে বলল, নিকি, আমি কিছুতেই তোমাকে ওদের হাতে পড়তে দেব না।
নিকি ফিসফিস্ করে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রনি। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ।
তুমি খুব ভালো নিকি, খুবই ভালো। আর এখানে নয়। চলো আমার ঘরে চলো, সেখানেই তুমি সবচেয়ে নিরাপদ।
রনি, নিকি এবং হাসান যখন ঘরে ফিরে এলো তখন দুপুর প্রায় পেরিয়ে গেছে।
১৭
সারাদিনের ব্যস্ততায় রনি আশেপাশের কোনো খবরই রাখতে পারেনি। হঠাৎ টিভিতে দুপুরের সংবাদ শুনে সে সেদিকে এগিয়ে গেল। সংবাদে সে যা শুনল তার সংক্ষিপ্তসার এরকম,
আজ সকালে বিশেষজ্ঞদল ঢাকা থেকে বিধ্বস্ত মহাকাশযানের নিকট পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে প্রমাণ পেয়েছে যে ভিনগ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীতে অবতরণ করেছে। তাদের সংখ্যা একের অধিক হবে বলেই বিশ্বাস করছে বিশেষজ্ঞরা। তবে এখন পর্যন্ত ভিনগ্রহের কোনো প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। অবশ্য গতরাতে পুলিশের সূত্র থেকে জানা গেছে যে বিধ্বস্ত মহাকাশযানের পাশে হঠাৎই কয়েকবার নীল আলো দেখা যায়। এই আলোর উৎস সম্পর্কে তারা কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তবে তাদের সন্দেহ ভিনগ্রহের প্রাণীরাই এরকম আলো জ্বালিয়েছে এবং তারা তাদের বিধ্বস্ত মহাকাশযানের উপর নজর রাখছে। ভিনগ্রহের প্রাণীর খোঁজে পুলিশ আশেপাশের এলাকায় জোরাল অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে এলাকার সকলের সহযোগিতা কামনা করেছে পুলিশ।
সম্পূর্ণ বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণের জন্য ইতিমধ্যে নাসা থেকে তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে তারা আগামীকাল সকালে বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবে। এদিকে নাসার বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর মহাকাশ সীমানায় দুটো ইউএফও বা আন-আইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্টের অস্তিত্ব চিহ্নিত করছে। দুটো ইউএফও-ই ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আরো প্রায় ছয় ঘন্টা পর ইউএফও দুটো পৃথিবীর মহাকাশসীমানা অতিক্রম করে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করবে। বিষয়টি নাসা অত্যন্ত গুরুত্ব এবং সতর্কতার সাথে বিবেচনা করছে।
সংবাদে আরো অনেককিছু বললেও রনির কাছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। সে তাড়াতাড়ি নিকির কাছে এসে বলল, নিকি, এইমাত্র সংবাদে শুনলাম পৃথিবীর মহাকাশসীমানায় দুটো মহাকাশযান এসে পৌঁছেছে।
হ্যাঁ আমিও বুঝতে পারছি। আমাদের মহাকাশযান থেকে আমাকে বারবার অবস্থান জানানোর জন্য সিগন্যাল পাঠাচ্ছে। আমি সিগন্যালটা ঠিকই পাচ্ছি কিন্তু আমার সিগন্যাল পৌঁছাচ্ছে না।
পৃথিবীর আরো কছে এলে বোধহয় তোমার সিগন্যাল পৌঁছাবে।
হয়তো সেরকমই। সেক্ষেত্রে হাসানকে আবার তেঁতুলগাছে উঠতে হবে।
হাসান তোমার জন্য সারাদিন এমন কী সারাজীবন তেঁতুল গাছে থাকতে রাজি। সে যে কতটা খুশি তোমাকে বোঝাতে পারব না। কোথা থেকে যেন একটা আয়না জোগাড় করেছে, তারপর সেই আয়নায় সে শুধু নিজের চোখ দেখছে। আমি আগে কাউকে কখনো এতটা মনোযোগ দিয়ে নিজের চোখ দেখতে দেখিনি। আমার খুব ভালো লাগছে নিকি।
ভালো লাগারই কথা। কারো উপকার করতে পারলে সবারই ভালো লাগে। তোমার ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটছে। একটু থেমে নিকি বলল, তুমি কি খেয়েছ?
না খায়নি।
যাও খেয়ে এসো। তোমার অনেক আগেই খাওয়া উচিত ছিল।
আমার ক্ষুধা নেই।
না আছে, আমি জানি। তোমাদের মতো সময় আমরাও একসময় পার করেছি। অবশ্য তা হাজার বছর আগের কথা। সেই ইতিহাসগুলো যখন পড়ি মনে হয় তখনকার জীবনটা ছিল সত্যিই উপভোগের। জীবন তখন ছিল আনন্দের, জীবনে প্রতিযোগিতা ছিল, ছিল আশা, ছিল ভালোবাসা। আর এখনকার জীবনটা কেমন যেন শূন্যতার। জীবনে কিছুই নেই, না আছে সংসার, না আছে সন্তান, না আছে আবেগ ভালোবাসা।
কী বলছ তুমি! মার বাবা-বা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই? অবাক হয়ে বলল রনি।
না নেই। এ ধরনের সম্পর্ক অনেক আগেই আমাদের অর্থাৎ হিমিনদের সমাজ থেকে উঠে গেছে।
তাহলে তোমাদের জন্ম হলো কিভাবে?
আমাদের কেন্দ্রিয় গবেষণাগারে আমাদের কোষ সংরক্ষিত থাকে। যখন যেরকম হিমিনের প্রয়োজন হয় সেই কোষ থেকে ঠিক সেরকম হিমিন তৈরি করা হয়। আমাদের সমাজে যখন একজন ডাক্তারের প্রয়োজন হয়েছিল তখন সৃষ্টি করা হয়েছিল আমাকে।
কী বলছ তুমি! চোখ কপালে তুলে বলল রনি।
হ্যাঁ রনি। এটাই সত্য। এজন্যই আমাদের বাবা মা নেই। নেই সংসার, নেই সন্তান।
তাহলে তোমাকে লালন পালন করল কে? তুমি বড় হলে কিভাবে? শৈশব কৈশর তুমি কার সাথে কাটিয়েছ? তোমার স্কুল, কলেজ এগুলোতে পড়তে কিভাবে?
নিকি মৃদু হেসে বলল, আমার কোনো শৈশব ছিল না, ছিল না কৈশর, ছিল না স্কুল কলেজ। আমার জন্মের প্রথম দিনই আমার বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর।
বিস্ময়ে একেবারে হাঁ হয়ে গেল রনি। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, তো..তো.. তোমার বয়স কত?
দুইশ আশি বছর।
দুইশ আশি বছর!
হ্যাঁ। মূলত আমি সক্রিয় হয়ে বেঁচে আছি দুইশ ত্রিশ বছর। আর আমার জন্ম হয়েছিল পঞ্চাশ বছর বয়সে। এই মোট দুইশ আশি বছর। আর হ্যাঁ, জনের সময় আমার বয়স পঞ্চাশ ছিল কীভাবে এটাই তো তোমার প্রশ্ন? আমাদের গ্রহের নিয়মটাই এরকম। সাধারণত পঞ্চাশ বছরে কারো জন্ম হয়। ব্যাপারটা তোমাকে বোঝান বেশ মুশকিল হবে। তারপরও বলছি, যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কোনো হিমিন সৃষ্টি করা হবে, তখন তার মস্তিষ্কে স্কুল, কলেজসহ সকল সাধারণ এবং প্রয়োজনী জ্ঞান কিংবা বিদ্যা বিশেষ টেকনোলোজির সাহায্যে সন্নিবেশিত করা হয়। তারপর তাকে যে জন্য সৃষ্টি করা হয় সে সম্পর্কিত জ্ঞান তার মস্তিষ্কে সন্নিবেশিত করা হয় যেমন আমার ক্ষেত্রে করা হয়েছে চিকিৎসা বিদ্যা। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করতে খুব বেশি হলে তোমাদের পৃথিবীর সময়ের এক বছর সময় লাগে। অথচ এই এক বছরে আমরা পঞ্চাশ বছরের জ্ঞান অর্জন করি। এ সময়ে আমাদের শরীরেরও প্রয়োজনীয় বৃদ্ধি ঘটে। তারপর থেকে শুরু হয় আমাদের জীবন।
তোমরা কতদিন বেঁচে থাক?
আগেই বলেছি আমরা মৃত্যুকে প্রায় জয় করতে চলেছি। এখন পর্যন্ত আমরা গড়ে পাঁচশ বছর বেঁচে থাকি।
পাঁচশ বছর।
হ্যাঁ পাঁচশ বছর। তবে আমার ধারণা আমাদের বিজ্ঞানীরা আরো অধিক সময় বেঁচে থাকার প্রযুক্তি বের করেছে। কিন্তু আরো অধিক সময় বেঁচে থাকা আমাদের জন্য মঙ্গলময় হবে কিনা সেটা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। এ কারণে
অধিক সময় বেঁচে থাকার প্রযুক্তি এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে না।
অধিক সময় বেঁচে থাকলে সমস্যা কি?
অনেক অনেক সমস্যা। আমাদের জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। তখন অনাকাঙ্খিত মৃত্যুই হয় আমাদের পরিণতি।
মৃত্যুর পর তোমাদের কি হয়?
মৃত্যুর পর আমাদের জ্ঞানকে পরবর্তী হিমিনের মধ্যে সন্নিবেশিত করা হয়। ফলে আমি যেখানে শেষ করব পরবর্তী হিমিন সেখান থেকে শুরু করবে। তাকে দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে আর পড়াশুনা করতে হবে না। এভাবে আমরা দ্রুত জ্ঞান চর্চার সুযোগ করে নেই এবং নতুন নতুন অভাবনীয় প্রযুক্তি আবিষ্কার করি। অবশ্য মৃত্যুর পর জ্ঞানকে এভাবে সন্নিবেশিত করার প্রক্রিয়াটা সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে।
তাহলে তো তোমরা খুবই সুখী। কষ্ট করে স্কুলে যেতে হয় না, কলেজে যেতে হয় না, রাত জেগে পড়তে হয় না, পরীক্ষা দিতে হয় না, কারো বকুনি খেতে হয় না।
নিকি আবার মদু হাসল। তারপর বলল, একদিনের জন্য যদি তুমি আমাদের জীবনকে অনুভব করতে পারতে তাহলে বুঝতে আমাদের জীবনটা কেমন। যে জীবনে আনন্দ নেই, ভালোবাসা নেই, পরিবারের বন্ধন নেই সে জীবন কখনো সুখের হয় না। আমাদের সামনে লক্ষ্য শুধু জ্ঞানের চর্চা। শুধু উন্নতি আর উন্নতি। কিন্তু এই জ্ঞান আর উন্নতির মধ্যেই কী সত্যিকারের আনন্দ নিহিত? না কখনোই না।
তাহলে কোথায় পাবে সত্যিকারের আনন্দ?
সত্যিকারের আনন্দ হলো সাধারণ হওয়ার মধ্যে। প্রযুক্তি আর জ্ঞানচর্চার বিবেচনায় আমরা এই মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উন্নত, সবচেয়ে অসাধারণ এটা হয়তো সত্য। কিন্তু এটা কী সত্য আমরা সবচেয়ে সুখী? আমাদের এই অসাধারণত্ব যদি আমাদের সুখকে কেড়ে নেয়, আমাদের পরিবারকে কেড়ে নেয়, আমাদের সন্তান, আশা-ভালোবাসাকে কেড়ে নেয় তাহলে সেই অসাধারণত্বের মূল্য কোথায়? তুমি একটু চিন্তা করে দ্যাখো তো, আমাদের সবকিছু কীজন্য? নিশ্চয় জীবনে আনন্দ আর সুখ পাওয়ার জন্য। অথচ অসাধারণত আমাদের কোনো সুখ কিংবা আনন্দ দিতে পারছে না। আজ আমরা সবাইকে চিনতে পারি ডিজিটাল কোডের মাধ্যমে; চেহারা দেখে কিংবা আবেগ ভালোবাসা অনুভব করে নয়। তুমি কী ব্যাপারটা চিন্তা করতে পার? আজ যদি তোমার বাবার সত্যিকার পরিচয় তার আদর, ভালোবাসা, আবেগ, চেহারা না হয়ে শুধুই একটা ডিজিটাল কোড হয় তাহলে কেমন লাগবে তোমার?
ভালো লাগবে না। মিমি করে বলল রনি।
আমাদেরও ভালো লাগে না। অসাধারণ কিংবা পরম উৎকর্ষতা আমাদের আর পছন্দ নয়। আমরা হাঁপিয়ে উঠেছি। কিছুক্ষণ আগে তুমি প্রশ্ন করেছিলে সত্যিকারের আনন্দ কোথায়? সত্যিকার আনন্দ হলো সবার মধ্যে সাধারণ হয়ে বেঁচে থাকার মাঝে। সবাই অসাধারণত্ব চায়, কিন্তু তারা জানে না অসাধারণত্বের প্রাপ্তিতে বঞ্চনা অনেক। আর এই বঞ্চনাগুলো খুবই কষ্টের, খুবই যন্ত্রণার। তাই সত্যিকারের আনন্দ সাধারণত্বে, অসাধারণত্বে নয়।
কি..কিন্তু সাধারণ থাকার উপায় কি?
একমাত্র উপায় হলো চাওয়া পাওয়া কমানো, লোভী না হওয়া, বর্তমানেই সন্তুষ্ট থাকা। আমরা হিমিনরা আজ এতটাই চাচ্ছি, এতটাই লোভী হয়েছি যে আমরা আমাদের সমাজ-পরিবার, আবেগ-ভালোবাসা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সবকিছু বিসর্জন দিয়ে শুধু প্রযুক্তির নেশায় ছুটে চলছি। তাই তো,
তাই তো কি? নিকি এবার ম্লান একটা হাসি দিল। তারপর বলল, না থাক্। তুমি ক্ষুধার্ত। যাও খেয়ে এসো। তোমার বাবা হয়তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
রনি বেশ অবাক হলো। নিকি কী যেন বলতে যেয়েও বলল না। আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু কেন যেন মনে শান্তি পেল না। তার বারবার মনে হতে লাগল নিকির মনে কী যেন এক বিশাল দুঃখ আছে। আর এই দুঃখটার ভার এত বেশি যে নিকি কিছুতেই সইতে পারছে না।
১৮
রনি আর তার বাবা রাহাত সাহেব খেতে বসেছে। রনির অবশ্য খাওয়ায় মন নেই। তার মনে অনেক প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। নিকির মনে কিসের দুঃখ? কিসের যন্ত্রণা? অনেকবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও হিমিনদের স্পেসশিপের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? হিমিনদের স্পেসশিপ না আসা পর্যন্ত নিকির সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কিনা? শেষ পর্যন্ত নিকিকে সে তার স্পেসশিপে তুলে দিতে পারবে কিনা? কেউ নিকির কথা জেনে যাবে কিনা? ভুল করে হাসান অন্য কাউকে নিকির কথা বলে দেবে কিনা? তার বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে কিনা? এরকম আরো কিছু প্রশ্ন তাকে অস্থির করে রেখেছে। তাই খাওয়ার মধ্যে প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে সে। ব্যাপারটা রাহাত সাহেবেরও চোখ এড়াল না। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন, কী ব্যাপার রনি? তুমি মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছ না কেন?
না বাবা খাচ্ছি তো। উত্তরে বলল রনি।
আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি ঠিকমতো খাচ্ছ না। আমি অবশ্য বুঝতে পেরেছি, খাবার খুব সাধারণ, এজন্য হয়তো খেতে পারছ না। চিন্তা করো না, কাদের কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। রাতে আমরা ভালো খাবার খাব।
রনি তাড়াতাড়ি বলল, না বাবা আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তারপর একটু থেমে আবার বলল, বাবা, একটা প্রশ্ন করি তোমাকে?
হ্যাঁ করো। ভ্রূ কুঁচকে বললেন রাহাত সাহেব। তিনি তার ছেলের কথা বলার ধরনটা ঠিক বুঝতে পারছেন না।
বাবা, তুমি কি হতে চাও? সাধারণ কিছু নাকি অসাধারণ কিছু?
কুঞ্চিত চোখ দুটো আরো কুঞ্চিত হলো রাহাত সাহেবের। তিনি বললেন, তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না।
প্লেট থেকে চোখ তুলে রনি এবার বলল, ধরো তোমাকে দুটো অপশন দেয়া হলো। প্রথম অপশন হলো তুমি এখন যেমন আছে তেমনই থাকবে। আর দ্বিতীয় অপশন হলো, তুমি অনেক ক্ষমতাশালী কিংবা বিখ্যাত কেউ হয়ে যাবে, তোমার অনেক অনেক টাকা, অনেক অনেক সম্পদ থাকবে। এককথায় তুমি হবে অসাধারণ কেউ। তাহলে তুমি কি হবে?
রাহাত সাহেব উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলেন।
রনি আবার করল প্রশ্নটা, বলো না বাবা, তুমি কোটা পছন্দ করবে?
রাহাত সাহেব এবার একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, আমি সাধারণকেই পছন্দ করব।
কেন?
কারণ সাধারণের মধ্যে তুমি আছ, আমার বাড়ি আছে, আছে এই গ্রাম, আছে সুখ-দুঃখ-আনন্দ। কিন্তু যখন আমি অসাধারণ হব তখন হয়তো দেখা যাবে আমার শুধু অর্থ আর ক্ষমতাই আছে। কিন্তু কোনো আনন্দ নেই। সব দূরে অনেক দূরে চলে গেছে।
কেন এগুলো দূরে চলে যাবে? তুমি চাইলেই তো পাবে।
এটাই প্রকৃতির নিয়ম বাবা। কেউ যখন অসাধারণ হয়ে যায় তখন তার পাশে সাধারণ কিছু থাকে না। আর জীবন থেকে যখন সাধারণ সবকিছু হারিয়ে যায় তখন মানুষ সত্যকে হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলে প্রিয় সবকিছুকে। তখন আর সে সুখী হতে পারে না। খুব কম মানুষই আছে যারা অনেক প্রাপ্তির পরও নিজের পাশে সাধারণকে স্থান দিতে পারে। এই মানুষগুলোই হলো সত্যিকারের অসাধারণ মানুষ। এদের জন্যই টিকে আছে পৃথিবী।
রনি হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে রাহাত সাহেব আবার বললেন, তোমার কাছে ব্যাপারটা জটিল মনে হচ্ছে। আমি খুব সহজ করে দিচ্ছি। তুমি আমাকে ভালোবাসো?
রনি এ ধরনের প্রশ্ন আশা করেনি। তার বাবাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আর সেই বাবাই কিনা তাকে এরকম একটা প্রশ্ন করল। সে খাবার ছেড়ে একেবারে তার বাবার পাশে চলে এলো। তারপর বলল, আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি বাবা।
আমি যদি তোমাকে পৃথিবীর সবকিছু দিয়ে দেই তুমি কি আমাকে ভালো না বেসে পারবে?
না বাবা না, পারব না। এই বলে রনি তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরল।
এটাই হলো সাধারণের আনন্দ। সত্যিকারের আনন্দ। পৃথিবীর সকল অসাধারণ দিয়েও সাধারণের সত্য, সাধারণের আনন্দকে পাওয়া যাবে না।
বাবা আমি বুঝতে পেরেছি।
তুমি যতদিন সাধারণ থাকবে ততদিন তুমি তোমার আশেপাশের মানুষ, তোমার বাবা-মা, তোমার ছেলে-সন্তান, তোমার পরিবার, তোমার সমাজ, তোমার দেশ, সবার জন্য কিছু না কিছু করতে পারবে। কিন্তু যেদিনই তুমি নিজেকে অসাধারণ ভাবে সেদিনই সবার থেকে আলাদা হয়ে যাবে। তখন জীবনটা হয়ে যাবে শুধুই স্বার্থকেন্দ্রিক। একে একে সবাই তোমার কাছ থেকে দূরে, অনেক দূরে চলে যাবে। এটাই মানুষের মূল সমস্যা। মানুষ যখন সামান্য একটু ক্ষমতা পায় তখনই নিজেকে অসাধারণ মনে করে, নিজেকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে মনে করে, নিজে নিজে আকাশ ছুঁতে চেষ্টা করে। তারপর যখন একসময় বুঝতে পারে সেসব হারিয়ে ফেলেছে তখন তার আর ফিরে আসার সময় থাকে না। মৃত্যু বা ধ্বংসই হয় তার একমাত্র পরিণতি। এজন্যই বাবা আমি অসাধারণ হতে চাই না, হারাতে চাই না তোমাকে, তোমার এই ভালোবাসাকে।
বাবা, আমি বুঝতে পেরেছি। আমি তোমাকে ছেড়ে কখনোই যাব না। আমি সবসময়ই তোমাকে ভালোবাসব। আবেগভরা কণ্ঠে বলল রনি।
আমি জানি রনি, আমি জানি।
বাবা?
বলো।
তোমাকে একটা সত্য কথা বলি।
হ্যাঁ বলো।
তুমি সুস্থ হয়ে গেছ বাবা। তোমার অসুখটা আর নেই।
রাহাত সাহেব কোনো কথা বললেন না। ছেলেকে তিনি বুকের মধ্যে আরো জোরে আঁকড়ে ধরলেন। যদিও তার আজ খুব ভালো লাগছে কিন্তু তিনি জানেন তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। এ মুহূর্তে তার খুব বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তিনি জানেন তা অসম্ভব।
রনি আবার ডেকে উঠে বলল, বাবা।
হ্যাঁ বলো। কোনো কারণে আমি যদি তোমার কাছে কারো জীবন রক্ষার জন্য সাহায্য চাই তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?
রাহাত সাহেব এবার পিছনে সরে এসে সরাসরি রনির চোখে তাকালেন। তারপর বললেন, অবশ্যই করব। কে সে?
সে আমাদের অনেক বড় উপকার করেছে।
তাহলে করব না কেন? বলল কখন করতে হবে? কি করতে হবে?
আমি সময় হলে তোমাকে বলব। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে তুমি আমাকে সাহায্য করবে এবং সম্পূর্ণ ব্যাপারটা গোপন রাখবে।
রাহাত সাহেব এবার মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললেন, মনে হচ্ছে তোমার কথার মধ্যে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।
হ্যাঁ বাবা আছে। তবে এটুকু বলছি আমরা একটা ভালো কাজ করছি।
তোমার সাথে অন্য কেউ আছে নাকি?
হ্যাঁ আমার বন্ধু আছে। কিন্তু কাজটায় ঝুঁকি আছে। আমরা খুব চিন্তায় আছি। তোমার সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। কথা দাও আমাকে সাহায্য করবে।
রাহাত সাহেবের হাসিটা আরো বিস্তৃত হলো। তিনি রনির কপালে আলতোভাবে চুমু খেয়ে বললেন, কথা দিলাম, আমার বাবাটার ভালো কাজে অবশ্যই আমি তাকে সাহায্য করব।
ধন্যবাদ বাবা, ধন্যবাদ। এখন আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম। তোমার সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে জানাব।
ঠিক আছে জানিও। আর হ্যাঁ, তুমি কি উত্তর পাড়ায় গিয়েছিলে?
না যাইনি। কেন?
গাছ থেকে পড়ে তোমার বন্ধু মন্টুর হাত ভেঙ্গে গেছে। কিছুক্ষণ আগে আমি সংবাদ পেয়েছি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। পারলে তুমি একবার দেখে এসো।
আমি এক্ষুণি যাচ্ছি বাবা।
না না, খাওয়া শেষ করে যাও।
না বাবা। আর খাব না।এই বলে রনি বেরিয়ে গেল।
রাহাত সাহেব ডানে বামে মাথা নেড়ে মৃদু হাসলেন। তিনি বুঝতে পারছেন রনি খুব দ্রুত বড় হয়ে উঠছে। এসময় ওর একজন ভালো অভিভাবকের খুবই প্রয়োজন। তার মৃত্যুর পর কে রনিকে দেখাশুনা করবে ভাবতেই তার বুক চিরে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তিনি বুঝতে পারছেন তার ক্ষুধাটা মরে গেছে। এখন চেষ্টা করলেও তিনি আর খেতে পারবেন না। তাই টেবিল ছেড়ে তিনিও উঠে দাঁড়ালেন।
এদিকে রনি তার ঘরে এসে দেখে নিকি ট্রিটিসকোপ নিয়ে কী যেন করছে। সে কাছে এসে বলল, নিকি, আমি একটু উত্তর পাড়ায় যাচ্ছি। আমার বন্ধু মন্টুর হাত ভেঙ্গে গেছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আমি দেখেই চলে আসব।
ঠিক আছে তুমি যাও।
তুমি ভয় পেও না। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব।
আচ্ছা ভয় পাব না। তুমি যাও।
রনি দরজাটা টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। তারপর ছুটে চলল উত্তর পাড়ার দিকে। যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসবে। নিকিকে এভাবে ফেলে রেখে যাওয়া যে তার উচিত হচ্ছে না সে সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু মন্টুকেও দেখা দরকার। মন্টু তার মাছ ধরার সঙ্গী। মন্টু মাছ ধরায় এতটাই ওস্তাদ যে সবাই বলে মন্টু ডাকলেই যেন মাছ এসে তার হাতে ধরা দেয়। মন্টু ছাড়া মাছ ধরা কখনোই জমে উঠে না। সেই মন্টুর হাত ভেঙ্গে গেছে ভাবতেই আরো জোরে ছুটতে শুরু করল রনি।
২০
মন্টুকে দেখে রনি যখন গ্রামের বড় রাস্তায় উঠে এলো ততক্ষণে একঘণ্টা পার হয়ে গেছে। সূর্য অনেকটাই হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। রড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিধ্বস্ত গানশিপটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রনি। সারাদিনের নানা ব্যস্ততায় সে এদিকে আসতে পারেনি। গানশিপের পাশে এখন অনেক লোক। বোঝা যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে তারা। সাংবাদিকরা এখনো ক্যামেরা নিয়ে ছুটাছুটি করছে। অনেকে এখনো আসছে এদিকে। এত মানুষের ভিড় দেখে গ্রামের কয়েকজন এরই মধ্যে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেউ ডাব বিক্রি করছে, কেউ বাদাম আবার কেউ ঘরে তৈরি খাবার। চারদিকে কেমন যেন উৎসব উৎসব ভাব।
হঠাৎ কাদেরকে ছুটে আসতে দেখে অবাক হলো রনি। কাদের যে এরই মধ্যে চলে আসবে ভাবতে পারেনি সে। কাদেরও তাকে দেখেছে। তার দিকেই ছুটে আসছে সে। একেবারে সামনে এসে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ভা..ভাইজান, দা..দাদারে দ্যাখছেন?
রনি খুবই অবাক হলো। কাদের তাকে ভালো মন্দ কিছু জিজ্ঞেস না করে সরাসরি তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করছে। কাদের তার বাবাকে সবসময় দাদা বলে ডাকে। কিন্তু কথা বলার সমস্যা থাকায় সে ঠিকমতো শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারে না।
রনি কিছুটা সন্দেহ নিয়ে বলল, কেন?
স..স..সর্বনাশ হ হইছে ভাইজান!
কি সর্বনাশ হয়েছে?
আ..আমি আইসা দাদারে ঘ..ঘ..ঘরেই পাইছিলাম। তারপর হে..হে.. যে কোথায় গেল!
হয়েছেটা কি?
আ..আ..আমি আপনের ঘর প.প..পরিষ্কার করবার যাইয়া দেহি..
সাথে সাথে আত্মাটা ধক করে উঠল রনির। সে বলল, তু..তুমি আমার ঘরে ঢুকেছিলে?
হ..হ.. ভাইজান। যাইয়া দেহি আজব একটা কী যেন আ…আপনের ঘরে বইসা আছে। দ্যা..দ্যা..দ্যাখতে মানুষের মতো না, কিন্তু প্রাণ আছে। পড়ে মনে হইল অ..অ, অন্য গ্রহের প্রাণীই হবে। তাই আর দেরি করি নাই। সাথে সাথে..
কি করেছ?
দা..দা..দারে খুঁজছি। তারে না পাইয়া আ..আপনেরেও খুঁজছি। আপনেরেও না পাইয়া পু..পু..পুলিশরে যাইয়া কইছি। আমার মনে হয় এ..এ..এতক্ষণে পুলিশ পৌঁছায় গেছে…
এ তুমি কী করেছ! এটুকু বলেই রনি ছুটতে শুরু করল বাড়ির উদ্দেশে। এবার আর সে বড় রাস্তা দিয়ে গেল না। আড়াআড়ি ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ছুটতে শুরু করল। উঁচু-নিচু পথ-ঘাট, ঝোঁপ-ঝাড়, খানা গর্ত কোনোকিছুর দিকেই তাকাচ্ছে না সে। শুধু ছুটে চলছে, আর ছুটে চলছে। তার মনে হচ্ছে সে বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম পথটা পাড়ি দিচ্ছে।
এদিকে রনিকে কিছু বলতে না দেখে খুব অবাক হলো কাদের। সে ভেবেছিল রনি বুঝি খুব খুশি হবে। কিন্তু রনির অভিব্যক্তি দেখে সে বুঝতে পেরেছে কোথাও সাংঘাতিক ভুল হয়েছে। তাই সেও আর দাঁড়াল না। ছুটতে শুরু করল রনির পিছন পিছন।
বাড়ির সামনে এসে রনি একেবারেই চুপসে গেল। সে দেখতে পেল পুলিশ সম্পূর্ণ বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে। শুধু পুলিশই নয়, সাথে সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ, গ্রামের মানুষ সবাই আছে। সবাই উৎকণ্ঠিত, উত্তেজিত। এক কোণায় রনি তার বাবাকে পুলিশের সাথে কথা বলতে দেখে সে ছুটে গেল সেদিকে। কাছে যেয়ে পুলিশের একজন অফিসারকে তার বাবাকে বলতে শুনল, আপনার বাড়িটা আমরা সার্চ করব। আমরা জানতে পেরেছি এখানেই আছে ভিন গ্রহের প্রাণীটা।
আপনারা নিশ্চিত হলেন কিভাবে? প্রশ্ন করলেন রাহাত সাহেব।
গ্রামের একজনই বলেছে আমাদের।
কে?
আমি অবশ্য চেহারাটা চিনে রাখতে পারিনি। শুধু আপনার নাম বলে বলল, আপনাদের বাড়ি। বাড়ি খুঁজে পেতে অবশ্য কষ্ট হয়নি। আপনি অনুমতি দিলে আমরা এখনই বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করা।
আপনারা যদি মনে করেন এই বাড়িতে ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী লুকিয়ে আছে এবং তাকে খুঁজে বের করতে আমার সহায়তা দরকার তাহলে আপনাদের সাহায্য করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
ধন্যবাদ রাহাত সাহেব।
এই বলে পুলিশের অফিসার অন্য পুলিশদের দিকে চলে গেল। বোঝা যাচ্ছে সে এখনই বাড়ি সার্চ করা শুরু করবে।
এমন সময় রনি তারা বাবার হাত টান দিয়ে বলল, বাবা, তোমার সাথে আমার কথা আছে। এদিকে এসো।
রাহাত সাহেব বললেন, কি কথা?
খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে এসো।
পরে বললে হয় না?
রনি জোর করে তার বাবাকে টেনে একপাশে নিয়ে এলো। তারপর বলল, বাবা তুমি পুলিশকে বাড়ি সার্চ করতে নিষেধ করো।
কেন?
প্লিজ বাবা। তুমি ওদের নিষেধ করো। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল রনি।
কি হয়েছে? আর পুলিশকে বললেও পুলিশ শুনবে না।
তুমি বললে শুনবে বাবা, তুমি বললে শুনবে। নিকি তোমাকে বাঁচিয়েছে। ও তোমার অসুখ সারিয়ে তুলেছে।
তুমি এসব কি বলছ? নিকি কে?
নিকি হলো হিমিচুন গ্রহ থেকে আসা অতিবুদ্ধিমান প্রাণী। ও আমার বন্ধু। ওই আছে আমার ঘরে। কাদের ভুল করে পুলিশকে সব বলে দিয়েছে। নিকি খুবই ভালো বাবা, খুবই ভালো। ও তোমাকে বাঁচিয়েছে, হাসানের চোখ ঠিক করে দিয়েছে। তুমি ওকে বাঁচাও বাবা। পুলিশের হাতে পড়লে নিকিকে মানুষেরা মেরে ফেলবে। ওর খুব বিপদ! কথা বলতে বলতে রনির চোখে পানি চলে এলো।
সর্বনাশ! এ তুমি কী বলছ! আ..আমি এখন কি করব?
তুমি বলেছিলে আমাকে তুমি সাহায্য করবে। এখন তুমি আমাকে সাহায্য করো। নিকিকে বাঁচাও। নিকি মানুষদের খুব ভালোবাসে। নিকি আমার ঘরে আছে। যেভাবেই হোক ওকে বের করে আনেনা।
কি..কিন্তু..
আ..আমি কিছু শুনতে চাই না বাবা, কিছুই শুনতে চাই না। তুমি পুলিশের কাছে যাও। তাদেরকে বলো বাড়ি সার্চ না করার জন্য। কিন্তু খবরদার তুমি নিকির কথা ওদের বলবে না। পাগলের মতো হাত নেড়ে নেড়ে বলল রনি।
রাহাত সাহেব রনির কথা সম্পূর্ণ বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝলেন ভিতরে কোনো রহস্য আছে। আর রনি যে সবকিছু কারো মঙ্গলের জন্যই করছে সেটাও বুঝতে পারলেন তিনি। তাই তো তিনি এগিয়ে গেলেন পুলিশ অফিসারের কাছে। তারপর বললেন, আমার মনে হয় আপনারা শুধু শুধু কষ্ট করছেন। আসলে ভিতরে কেউ নেই। গতকাল থেকে তো আমিই এখানে আছি।
এমনও হতে পারে ভিনগ্রহের প্রাণী আপনাকে ফাঁকি দিয়ে আপনারই বাড়িতে বসবাস করছে। বলল পুলিশ অফিসার।
সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আমাদের বাড়িটা এত ছোট যে কোথাও ভিনগ্রহের কেউ লুকিয়ে থাকতে পারবে না।
হয়তো আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু তারপরও আমরা একবার সার্চ করে দেখতে চাই।
রাহাত সাহেব আরো কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। পুলিশ ভিতরে সার্চ করবেই। তবে সার্চের সময় পুলিশ রাহাত সাহেবকে সাথে থাকার অনুরোধ করল। এই সুযোগটা রনিও নিল। সে তার বাবার সাথে সাথে এগিয়ে গেল ঘরের ভিতর।
পুলিশ প্রথমে রাহাত সাহেবের ঘরটা খুঁজে দেখল। কিছু না পেয়ে তারা ঢুকল মাঝের ঘরটাতে। সেখানেও তারা কাউকে পেল না। এদিকে উত্তেজনায় রনির ঘাম ছুটে গেছে। এরই মধ্যে সে কয়েকবার তার ঘরে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। দুজন পুলিশের সাথে চোখাচোখি হওয়ায় সে একেবারে চুপসে গেছে। পুলিশ যে তাকে সন্দেহ করতে পারে এটা ভালোমতোই জানে সে! তবে কপাল ভালো যে পুলিশ বুঝতে পারেনি কোন ঘরে নিকি আছে। যদি বুঝতে পারত তাহলে যে তারা তার ঘরটাই আগে সার্চ করত এ ব্যাপারে রনির কোনো সন্দেহ নেই।
পুলিশ যখন রনির ঘুরে ঢুকতে যাবে তখন রনির মনে হলো তার পায়ের নিচ। থেকে বুঝি মাটি সরে গেছে। সে যেন শূন্যে ভাসছে। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে। পারছে না নিজেকে। কোনোভাবে যদি নিকিকে একবার সতর্ক করে দিতে পারত তাও একরকম সান্ত্বনা পেত সে। কিন্তু সেটাও সে করতে পারছে না। নিকি বন্দি হলে কী হবে সেটা ভাবতেই তার বুকটা হু হু করে উঠল।
পুলিশের আগেই রনি তার ঘরে ঢুকতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। পিছন থেকে অফিসার তাকে টেনে ধরে বলল, তুমি এতটা ছটফট করছ কেন? বুঝতে পারছ না প্রাণীটা আমাদের জন্য বিপদজনক হতে পারে?
রনি একেবারে চুপসে গেল। সে বুঝতে পারল তার আর কিছু করার নেই।
তারপরও দুজন পুলিশের পরই ঘরে ঢুকল রনি। সে যা আশা করেছিল তাই, নিকি কোথাও নেই। তবে নিকি যে খাটের নিচে আছে এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। এই ঘরে নিকির পালানোর মতো ঐ একটা জায়গায়ই আছে। রনি ইচ্ছে করেই খাটের নিচে তাকাল না, ভাবখানা এমন যেন সে না তাকালে কেউ তাকাবে না। কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে একজন পুলিশ ঠিকই খাটের নিচে তাকাল।
তারপর আরো একজন।
রনি বুঝতে পারল তার পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। সে যেন কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এই বুঝি পুলিশ নিকিকে ধরে ফেলে। কিন্তু সে অবাক হলো যখন পুলিশ দুজন একই সাথে জানাল খাটের নিচে কেউ নেই।
রনির নিজেরও বিশ্বাস হলো না কথাটা। তাই সে নিজে ঝুঁকে খাটের নিচে তাকাল। তারপর সত্যি যখন দেখল কেউ নেই তখন তার বুকের মধ্যে থেকে যেন বিশাল একটা পাথর নেমে গেল। কিন্তু একই সাথে অন্য একটা আতঙ্ক দানা বাঁধল তার মনে। নিকি তাহলে গেল কোথায়? নিকি কী তার উপর রাগ করে চলে গেল?
পুলিশ সম্পূর্ণ ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কিন্তু কোথাও ভিনগ্রহের প্রাণী দেখতে পেল না। শেষে অফিসার খানিকটা হতাশ হয়ে বলল, আমি দুঃখিত রাহাত সাহেব। আপনাকে অহেতুক ঝামেলার মধ্যে ফেললাম।
না না, ঠিক আছে। বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠেই বললেন রাহাত রাহেব।
তাহলে আসি। কিন্তু কে আমাদের এভাবে ভুল সংবাদ দিল?
এই বলে পুলিশ অফিসার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় ভীড়ের মধ্যে কাদেরকে দেখে বলল, ঐ তো, ও-ই-তো আমাদের সংবাদ দিয়েছে।
এই বলে অফিসার এগিয়ে গেল কাদেরের দিকে। তারপর হালকা ধমকের স্বরে বলল, এ্যাই, তুমিই না আমাদের জানিয়েছিলে এখানে এই বাড়িতে একটা অদ্ভুত প্রাণী আছে। কোথায় সেটা?
হ…আ..ছে। আ..আমি নিজে দেখেছি।
কোথায়?
ঐ..ঐ ঘরের মইধ্যে। আঙ্গুল দিয়ে আবারো রনির ঘরটা দেখাল কাদের। কিন্তু আমরা তো পেলাম না।
রাহাত সাহেব এবার খুব কৌশলে অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি কাদেরের কথা শুনে এসেছেন! ওর তো মাথাই ঠিক নেই। আয়নায় হয়তো নিজের চেহারা দেখে ভেবেছে অন্য গ্রহের কাউকে দেখছে।
দা..দা.দাদা, আ..আমি নিজের চোখে..
চোপ। ফাজলামি করার আর জায়গা পাস না।
রাহাত সাহেবের প্রচণ্ড ধমকে মুখটা একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল কাদেরের। সে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি এরকম একটা ধমক খাবে সে।
পুলিশ অফিসার আর কিছু বলল না। তবে তাকে খুব গম্ভীর দেখাল। রাহাত সাহেবকে পূনরায় ধন্যবাদ দিয়ে সে সবাইকে নিয়ে চলে গেল। অবশ্য যাওয়ার সময় বলে গেল, সত্যি যদি তারা এমন কিছু দেখে যেটা সন্দেহজনক তাহলে যেন তাদের খবর দেয়।
রাহাত সাহেব অবশ্য আর কিছু বললেন না। পুলিশ চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর গ্রামবাসীরাও চলে যেতে শুরু করল। তারা সবাই খুব হতাশ। তারা আশা করেছিল হয়তো বিস্ময়কর কিছু দেখবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশা ভঙ্গ হওয়ায় তারা বেশ মর্মাহত। গ্রামবাসী সবাই যখন চলে গেল তখন দলবল নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন প্রফেসর হায়দার। তিনি এসেই উদ্ভ্রান্তের মতো বললেন, কই, প্রাণীটা কই? তারপর রনির দিকে চোখ পড়তে খানিকটা ধমকের সাথে বললেন, তোমাকে না বলেছিলাম আমাকে সবার আগে খবর দিতে, কই দিলে না তো? এখন প্রাণীটা কোথায়?
রাহাত সাহেব খুব ঠান্ডা মাথায় এবং স্পষ্টভাবে বললেন, পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। পুলিশের কাছে যান।
কী বলছেন আপনি? ওরা প্রাণীটাকে মেরে না ফেলে! ওরা কী জানে কীভাবে এই প্রাণীর সাথে সম্পর্ক করতে হয়! চোখ দুটো কপালে তুলে বললেন প্রফেসর হায়দার। তারপর পিছনের তিন চারজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দৌড়ে চলো, দৌড়ে। আমাদের হাতে একদম সময় নেই। এতক্ষণে ওরা প্রাণীটাকে মেরে ফেলল কিনা!
এই বলে প্রফেসর হায়দার তার দলবল নিয়ে যেভাবে ছুটে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
রনি অবাক চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে দেখল তার বাবা মিটিমিটি হাসছে। সে মনে মনে স্বীকার করল, তার বাবার এই হাসিটা সত্যি খুব সুন্দর।
২১
রনির সাথে রাহাত সাহেবও রনির ঘরে ঢুকলেন। রনির মুখটা একেবারে অন্ধকার হয়ে আছে। রনির অবস্থা দেখে রাহাত সাহেবের নিজেরই খারাপ লাগছে। তিনি নিজে থেকেই বললেন, রনি, তোমার কথা যে সত্য সেটা আমি বিশ্বাস করছি।
কিন্তু বাবা, নিকি কোথায়? ও বোধহয় আমার উপর রাগ করেছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল রনি।
না নিকি রাগ করেনি। আমার বিশ্বাস নিকি অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী এবং সে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। আর যে প্রাণী বিশাল মহাশূন্য পাড়ি দিতে পারে সেই প্রাণী নিশ্চয় জানে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। কাজেই তুমি নিশ্চিত থাকতে পার নিকি নিজেকে রক্ষা করার জন্য কোথাও লুকিয়ে আছে।
কিন্তু কোথায়?
সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
এই বলে রাহাত সাহেব চারদিকে খুঁজতে লাগলেন। রনিও উঁকি দিল খাটের নিচে। কিন্তু আগের মতোই সে নিকিকে দেখতে পেল না। এমন কী ট্রিটিসকোপ কিংবা লাইফারটা পর্যন্ত না।
রাহাত সাহেব হঠাৎ পিছনের দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই দরজাটা খুলল কে? এটা তো অনেকদিন ধরে বন্ধ ছিল।
রনি সাথে সাথে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকাল। এই দরজা দিয়ে সে নিকিকে নিয়ে বাগানে গিয়েছিল। তার স্পষ্ট মনে আছে ফিরে আসার পর দরজাটা সে নিজে আটকে দিয়েছিল। তাহলে কে খুলল দরজাটা? পুলিশ খুলেনি সে নিশ্চিত। কারণ পুলিশের সাথে সম্পূর্ণ সময়টা সে এ ঘরেই ছিল। এরকম ভাবতেই বুঝতে পারল নিকিই খুলেছে দরজাটা। কারণ নিকি জানে এখান দিয়ে বেরিয়ে সবার অলক্ষ্যে বাগানে যাওয়া যায়।
রনি তার বাবার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল, বাবা আমার মনে হয় নিকিই খুলেছে।
সেটা হওয়াই সম্ভব।
কিন্তু নিকি কোথায় লুকিয়ে থাকবে?
নিকি এমন জায়গায় লুকিয়ে থাকবে যেখানে সে সম্পূর্ণ নিরাপদ। বললেন রাহাত সাহেব।
কিন্তু নিরাপদ জায়গাটা কোথায়?
রাহাত সাহেব খানিকটা চিন্তা করে বললেন, যেখানে নিকি আগে নিরাপদ ছিল।
রনির মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে গেলে। কোথায় নিকি আগে নিরাপদ ছিল? এরকম ভাবতেই তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে সাথে সাথে পিছনের দরজা দিয়ে বাগানে চলে এলো। তারপর ছুটে চলল তেঁতুল গাছের উদ্দেশে। তেঁতুল গাছ থেকে একটু দূরে যে ঝোঁপটা আছে সেটার সামনে এসে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল সে। তারপর ঢুকে গেল ভিতরে।
রনি দেখল নিকি জড়োসড়ো হয়ে ঝোঁপের একেবারে কোণায় বসে আছে। সে নিকিকে কোনো কথা বলারও সুযোগ দিল না। ছুটে যেয়ে জড়িয়ে ধরল নিকিকে। নিকিও কোনো কথা বলতে পারল না। সেও জোরে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল রনিকে। দুজনের কেউ কথা না বললেও তাদের দুজনের চোখের পানিই প্রকাশ করল এ মুহূর্তে দুজনে কতটাই না আবেগাপ্লুত!
কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর রনি মৃদু হেসে নিকির চোখে তাকাল। তারপর বলল, খুব ভয় পেয়েছিলে নিকি?
আমার মনে হয় আমার থেকে তুমি বেশি ভয় পেয়েছ। তোমার চোখমুখে এখনো আতঙ্কের ছাপ।
আমি সত্যি ভয় পেয়েছিলাম। তোমার কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলল রনি।
আমি বুঝতে পারছি। কাদের আমাদের বাসা দেখাশুনা করে, ও না বুঝে পুলিশকে তোমার কথা বলে দিয়েছে। তুমি এখানে এসে কী যে বুদ্ধিমানের কাজ করেছ!
আমি অনুমান করেছিলাম এমন কিছু ঘটতে পারে। তাই আগেভাগেই সতর্ক হয়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্য ভালো আমাকে পিছনের দরজা দিয়ে বাগানে আসার পথটা চিনিয়ে দিয়েছিলে।
এবং তুমি এখানে এসে পালিয়েছ। পুলিশ তোমাকে খুঁজে পায়নি। এই বলে হিহি করে হেসে উঠল রনি।
নিকিও হেসে উঠে বলল, তোমার আনন্দ দেখে সত্যি আমার ভালো লাগছে।
তোমাকে খুঁজে পেয়েছি এর থেকে বড় আনন্দের আর কী হতে পারে। চলো বাড়ি চলো। এখন আর ভয় নেই। পুলিশ চলে গেছে।
পুলিশ কি আবার ফিরে আসতে পারে না?
সম্ভাবনা কম। আর বাবাকে আমি তোমার কথা বলেছি। বাবা বলেছে তোমাকে সাহায্য করবে।
আমার মনে হয় আমি এখানেই ভালো আছি। বলল নিকি?
কিন্তু এখানে তো বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। এখন বিকেল হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তখন গিগোরা তোমাকে আবার খুঁজতে বের হবে। এখানে আলো নেই। তোমার জন্য জায়গাটা বিপদজনক।
নিকি কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ঠিক আছে চলো। নিকির সাথে প্রথমে রাহাত সাহেবের পরিচয় হলো। পরে পরিচয় হলো কাদেরের। কাদের তো নিকেকে দেখে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু রাহাত সাহেবই তাকে বুঝিয়েছেন- ভয়ের কোনো কারণ নেই। কাদের যখন বুঝতে পারল নিকিকে সত্যি ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই তখন সে নিকির প্রতি দারুন আগ্রহী হয়ে উঠল। কিন্তু কথা বলার সমস্যার কারণে সে খুব একটা এগোতে পারল না। একসময় নিকিই বলল, কাদের, কতদিন থেকে তোমার এমন সমস্যা?
ছো..ছোট বেলায় আমার পক্স হইছিল। তা..তারপরতে আমি তো..তো.. তলা হইয়া গেছি।
বুঝতে পেরেছি, পক্স থেকে তোমার জিহ্বায় কোনো সমস্যা হয়েছিল। আর এ কারণেই তুমি ঠিক মতো কথা বলতে পারছ না। আমার মনে হয় সামান্য চিকিৎসা করলেই তোমার জিহ্বা আবার ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চাইলে আমি তোমার জিহ্বাটা পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
ভা, ভা, ইজান এহনই দেহেন। এই বলে সাথে সাথে জিহ্বা বের করল কাদের। সে নিকিকে ভাইজান বলে ডাকে।
নিকি একটু হাসল। তারপর বলল, এভাবে তো হবে না। তোমাকে আরো ভালোভাবে সময় নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। আমার মনে হয় তোমার জিহ্বায় ছোট্ট একটা অপারেশন করতে হবে। তাহলেই তুমি ঠিক হয়ে যাবে। প্রয়োজনে কণ্ঠনালীটাও পরীক্ষা করতে হবে।
অ…অপারেশন! চোখ বড় বড় করে বলল কাদের।
আগে দেখি। তারপর নিশ্চিত করে বলতে পারব।
নিকি কাদেরের জিহ্বাটা পরীক্ষা করে বলল, পক্সের সময় তোমার জিহ্বার অগ্রভাগে কিছুটা মাংসের বৃদ্ধি ঘটেছে। এই মাংসটুকু তোমার জিহ্বাকে ঠিক মতো মুখের তালু কিংবা দাঁতকে স্পর্শ করতে দিচ্ছে না। এজন্য তুমি ভালোমতো কথা বলতে পারছ না। এটুকু কেটে ফেললেই ঠিক হয়ে যাবে।
না না, আ..আমি ব্যথা পাব ভাইজান। বলল কাদের।
না পাবে না। তোমার এই মাংসটুকু অপ্রয়োজনীয়। অনেকের ক্ষেত্রে এ সমস্যা হয়। এর চিকিৎসা যে কোনো হাসপাতালেই সম্ভব। খুব বেশি হলে পনের মিনিট সময় লাগবে। তুমি চাইলে আমি ট্রিটিসকোপ দিয়ে তোমার চিকিৎসা করে দিতে পারি। এতে কোনো ব্যথা তো তুমি পাবেই না, বরং আধঘন্টার মধ্যে তুমি একেবারে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারবে। এই আধঘন্টা শুধু তোমার জিহ্বাকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য।
কাদের জিজ্ঞাসু চোখে রনির দিকে তাকালে রনি সম্মতি দিতে বলল। কাদের ভয়ে ভয়ে বলল, ভা..ভা..ইজান, পুরা জি..জি..বাটা কাইটা ফেলাবেন না তো?
নিকি মৃদু হাসল। তারপর বলল, দেখা যাক কী হয়।
নিকি আর কোনো কথা বলল না, ব্যস্ত হয়ে পড়ল কাদেরের জিহ্বায় অপারেশন করতে! রনি আর তার বাবা পাশেই দাঁড়িয়ে থাকল। তারা সবাই নিশ্চিত কাদেরের জিহ্বা ঠিক হয়ে যাবে এবং কাদের ভালোভাবে কথা বলতে পারবে।
২২
রনি নিকি দুজনে ঘরের মধ্যে বসে আছে। এ মুহূর্তে ভিতরে কেউ নেই, শুধু তারা দুজনই। কাদেরের অপারেশন হয়ে গেছে। নিকি কাদেরকে আধঘন্টা কথা না বলে থাকতে বলেছে। এজন্য কাদের যেয়ে শুয়ে আছে। রাহাত সাহেব একটু বাইরে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। এদিকে বিকেল হওয়ায় রনির বন্ধুরাও এসেছিল। রনি অবশ্য ওদের বলে দিয়েছে আজ সে খেলতে যাবে না। সবাইকে সে সন্ধ্যার পর আসতে বলেছে। সবার কিছুটা মন খারাপ হলেও তারা মাঠে চলে গেছে। সন্ধ্যার পর আবার আসবে।
নিকিকে খানিকটা চিন্তিত দেখে রনি বলল, নিকি, তুমি কি নিয়ে চিন্তা করছ?
ভাবছি আমি যদি আমাদের স্পেসশিপে সিগন্যাল পাঠাতে না পারি তাহলে ওরা আমাকে খুঁজে পাবে না। আমার অবস্থান জানার জন্য বারবার আমাকে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে।
আমি হাসানকে আসতে বলেছি। ও কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। তখন ও আবার তেঁতুল গাছে উঠবে। আশা করছি ততক্ষণে তোমাদের স্পেসশিপ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করবে এবং আমাদের সিগন্যাল তোমাদের স্পেসশিপে পৌঁছাবে।
আরো একটা সমস্যা আছে।
কি সমস্যা?
গিগোরা আমাদের সিগন্যাল বুঝে না ফেলে।
মানে!
মানে আমরা আমাদের অবস্থান জানিয়ে যে সিগন্যাল মহাশূন্যে পাঠানোর চেষ্টা করছি তা গিগোদের লাইফারে ধরা পড়ে যাবে ঠিক যেমন আমার লাইফারে গিগোদের সিগন্যাল ধরা পড়ছে। আমার লাইফার যে সংকেত দিচ্ছে তার অর্থ হলো গিগোরা তাদের স্পেসশিপে তাদের অবস্থান জানাতে পেরেছে।
তারমানে গিগোদের স্পেসশিপ তোমাদের স্পেসশিপের আগে আসছে।
অনেকটা তাই।
কিন্তু তাতে সমস্যা কী? ওরা ওদের মতো চলে যাবে। তুমি তোমার মতো যাবে।
তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি ভাবছি আমার জন্য তোমাদের আবার কোনো ক্ষতি না হয়। গিগোরা ক্ষেপে উঠলে তোমাদের গ্রাম আক্রমণ করতে পারে।
সেক্ষেত্রে যা হবার তাই হবে। তুমি ভেব না।
সত্যি কথা বলতে কী আমি খুব চিন্তায় আছি রনি। আজ রাতে বোধহয় খুব ঝামেলা হবে।
আমি বিশ্বাস করছি কিছুই হবে না। জোর দিয়ে বলল রনি। তারপর একটু সময় নিয়ে বলল, নিকি, সত্যি যদি আজ তোমাদের স্পেসশিপ আসে তুমি কি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?
নিকি মৃদু হাসল। তারপর বলল, তোমাদের এখানে থাকতে পারলে আমার খুব ভালো লাগত। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। আমার যে অনেক দায়িত্ব।
কি এত দায়িত্ব তোমার?
সবকিছু তো তোমাকে বোঝান যাবে না। তবে আমরা হিমিনরা এখন মারাত্মক একটা সমস্যার মধ্যে আছি।
কি সমস্যা?
আমরা হিমিনদের বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না। হিমিনদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা খুব বেড়ে গেছে।
কী বলছ তুমি!
হ্যাঁ রনি। একশ’ বছর হওয়ার আগেই শতকরা পঞ্চাশ ভাগ হিমিন আত্মহত্যা করে। খুব কম সংখ্যক হিমিনই আছে যারা পাঁচশ বছর বেঁচে থাকে।
কেন হিমিনরা আত্মহত্যা করে?
কারণ জীবনটা একঘেয়েমি হয়ে গেছে হিমিনদের কাছে। তাদের জীবনে কোনো আনন্দ নেই, নেই কোনো বন্ধন, নেই কোনো পিছুটান। একজন হিমিনকে যখন সৃষ্টি করা হয় তখন তার মূল কাজ থাকে তার উপর অর্পিত নির্দিষ্ট জ্ঞান সংক্রান্ত চূড়ান্ত উৎকর্ষতা লাভ করা। একই বিষয়ে দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে সে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার জীবনটা হয়ে উঠে বিতৃষ্ণাময়। তখন সে জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পায় না। এভাবে পাঁচ বছরেই সে হাঁপিয়ে উঠে। সেখানে পাঁচশ বছর বেঁচে থাকা তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। একসময় ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে বিতৃষ্ণাময় জীবন থেকে সে মুক্তি চায়। আর তখনই আত্মহত্যা করে।
তুমি তো সাংঘাতিক কথা বলছ! বিস্ফোরিত চোখে বলল রনি।
হ্যাঁ রনি। ব্যাপারটা সাংঘাতিকই বটে! আমরা নিজেরাও কখনো চিন্তা করতে পারিনি এমন কিছু ঘটবে। আমরা ভেবেছিলাম প্রযুক্তি আমাদের অস্তিতুকে আরো নিশ্চিত করবে, কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি প্রযুক্তি আমাদের অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
কিন্তু কেন এমন হচ্ছে?
কারণ আমরা প্রকৃতিকে জয় করে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করতে চেষ্টা করেছি। প্রকৃতির অনেক কিছু জয় করা যায় ঠিকই, কিন্তু কিছু কিছু জিনিস যায় না। এ সকল জিনিস এতটাই স্পর্শকাতর যে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করারও চেষ্টা করা উচিত নয়। প্রকৃতির কিছু নিজস্বতা আছে, এই নিজস্বতায় হস্তক্ষেপ করলে প্রকৃতি সেটা সহ্য করে না। প্রকৃতি নিজেই মধুর প্রতিশোধ নিয়ে আবার আগের অবস্থানে ফিরে যায়। ঠিক যেমনটি ঘটছে আমাদের ক্ষেত্রে। যেমন ধরো জন্ম আর মৃত্যু–এ দুটো ব্যাপার শুধুই প্রাকৃতিক। আমরা এ দুটোকে প্রায় জয় করতে চলেছি। ইচ্ছে হলে হিমিনদের জন্ম দিতে পারি এবং তাদেরকে সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করে আশি নব্বই বছরের পরিবর্তে পাঁচশ বছর বাঁচিয়ে রাখতে পারি। অর্থাৎ জন্ম এবং মৃত্যু দুটোই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। অথচ দ্যাখো, প্রকৃতির কী নিয়ম! হিমিনা নিজে নিজেই আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। অর্থাৎ একশ’ বছর হওয়ার আগেই তারা আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করছে। তুমি জানলে অবাক হবে যে, হিমিচুনে একশ’ বছরের বেশি বয়সের হিমিনের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও কম।
কী বলছ তুমি! তোমরা মাত্র পাঁচ হাজার হিমিন মহাবিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান। ব্যাপারটা সত্যি অবাক করার মতো। তার থেকে অবাক করার মতো ব্যাপার হলো আমরা আমাদের আয়ু কমানোর চিন্তাভাবনা করছি। মহাবিশ্বের সকল প্রাণী যেখানে আয়ু বাড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত, তখন আমরা চিন্তিত আয়ু কমানোর চেষ্টায়। অবশ্য চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। বিষয়টা নিয়ে বিতর্ক চলছে।
তাহলে তোমরা কি সেই আগের প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরে আসবে?
হতে পারে। কারণ পূর্বের অবস্থাটাই ছিল সাধারণ। আর সাধারণের বাইরে টিকে থাকার মধ্যে কোনো আনন্দ বা শান্তি নেই। হিমিনরা এখন সবাই শান্তি চাই। আর এই মহাবিশ্বে সবচেয়ে শান্তিতে আছ তোমরা, তাই তো আমরা তোমাদের পর্যবেক্ষণ করে তোমাদের মতো হতে চাচ্ছি।
আ, আমি সত্যি বিস্মিত হচ্ছি নিকি?
আমরা যেখানে নিজেরাই বিস্মিত হচ্ছি তোমরা তো বিস্মিত হবেই। প্রথম প্রথম আমরা ভাবতাম প্রযুক্তি নিয়ে আমরা তোমাদের অর্থাৎ মানুষদের সাহায্য করব। কিন্তু এখন আমাদের অভিজ্ঞতা এবং উপলব্দি দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা তোমাদের নতুন নতুন প্রযুক্তি দিয়ে তোমাদের ধ্বংস করব না, তোমাদের স্বকীয়তাকে নষ্ট করব না, তোমাদের নিজস্বতাকে জলাঞ্জলি দেব না।
কি..কিন্তু কিছু কিছু প্রযুক্তি তো তুমি আমাদের দিতে পার। এই যেমন ধরো, এইডস, ক্যান্সারের চিকিৎসার প্রযুক্তি। এগুলো অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের দিতে পারি ঠিকই কিন্তু মূল সিদ্ধান্তটা। আমাদের কেন্দ্রিয় সভায় অনুমোদিত হবে না। আমি তোমার বাবাকে সুস্থ করেছি, হাসানের দৃষ্টি ভালো করেছি কিংবা কাদেরের কথা বলাকে ঠিক করে দিয়েছি- এগুলো তোমাদের সমগ্র পৃথিবীর স্বকীয়তার উপর গুরুত্ত্বপূর্ণ কোনো প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু আমরা যদি তোমাদের কাছে এইডস কিংবা ক্যান্সার চিকিৎসার প্রযুক্তি হস্তান্তর করি তাহলে সেটা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কোনো ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে পড়বে। মনে রেখো, এই অসুখগুলো প্রকৃতিরই সৃষ্ট এবং প্রকৃতি কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই এগুলো সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতির সেই উদ্দেশ্যকে আমরা নষ্ট করতে চাই না। দেখবে তোমরা নিজেরাই এই আসুখগুলোর চিকিৎসা পদ্ধতি বের করে ফেলেছ।
তুমি বলতে চাচ্ছ এইডস্ প্রকৃতি তার প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছে?
হ্যাঁ অনেকটা তাই। তুমি ছোট মানুষ, তোমাকে হয়তো বোঝান যাবে না। প্রকৃতি সমস্ত পৃথিবীতে এটা এমনভাবে বিন্যস্ত করেছে যে মানুষের মধ্যেকার শারীরিক সম্পর্কটা যেন নিয়ন্ত্রিত থাকে। তা না হলে হয়তো পারিবারিক ভারসাম্য, জাতিগত ভারসাম্য, ধর্মীয় ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেত।
কিন্তু একদিন তো মানুষ এইডস-এর ওষুধ আবিষ্কার করবে। তখন এইসকল ভারসাম্য রক্ষা হবে কিভাবে?
নিকি মৃদু হাসল। তারপর বলল, প্রতি নিজে থেকেই ভারসাম্য রক্ষা করার ব্যবস্থা করবে। মানব ইতিহাস ঠিক সেরকমই বলে। যখন প্লেগ গেল, তখন ম্যালেরিয়া এলো। যখন ম্যালেরিয়া গেল, তখন পক্স এলো। যখন পক্স গেল, তখন এইডস্ এলো। যখন এইডস্ও যাবে তখন নতুন কিছু আসবে। আর তোমরা তোমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেচনা, আবিষ্কার দিয়ে সেটাকে প্রতিহত করবে। এভাবেই প্রকৃতির মাঝে লক্ষ লক্ষ বছর বেঁচে থাকবে তোমরা। আমরা তোমাদের এই বেঁচে থাকার উপর হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছি না।
আমি তোমাকে বুঝতে পারছি নিকি।
আমি জানি তুমি বুঝতে পারবে। কারণ তোমরা মানুষেরা সত্যি বুদ্ধিমান। একটু থেমে নিকি আবার বলল, তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ভুলে গেছি। তোমার বাবার আগামী চার সপ্তাহে চারটি ওষুধ খেতে হবে। প্রতি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে ঘুমানোর আগে তিনি একটি করে ওষুধ খাবেন।
এই বলে নিকি ছোট ছোট চারটি ট্যবলেট রনির দিকে এগিয়ে দিল। রনি ট্যবলেটগুলো নিতে নিকি আবার বলল, পানিতে গুলিয়ে খেতে বলবে। খবরদার ভুল যেন না হয়।
না হবে না। বলল রনি।
এমন সময় দরজা দিয়ে হাসানকে ঢুকতে দেখে রনি বলল, হাসান চলে এসেছে। আমরা বাগানে যাচ্ছি। আশা করছি এবার আমরা সিগন্যালটা পাঠাতে পারব।
ঠিক আছে যাও। সবধানে থেকো। বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে যেও।
হ্যাঁ জ্বালিয়ে দিচ্ছি। তুমি ভয় পেও না। বাবাকে তোমার এখানে থাকতে
বলছি। বাবা চলে এসেছে। ওপাশে তার কথা শুনতে পাচ্ছি।
ঠিক আছে।
রনি লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে তার বাবাকে নিকির পাশে থাকতে বলল। তারপর হাসানকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। কাদেরও যোগ দিল তাদের সাথে।
২৩
হাসানের সাথে সাথে কাদেরও তেঁতুল গাছে উঠতে শুরু করেছে। হাসানের মতো কাদেরেরও এখন সবকিছুতে উৎসাহ বেশি। সেও যেন নিকির জন্য কিছু করতে পারলে মহাখুশী। নিকি যে তার কথা বলার সমস্যাটা ঠিক করে দিয়েছে। এজন্য সে যেভাবেই হোক তার প্রতিদান দিতে চায়। তাই অপারেশনের পর থেকেই সে নিকির জন্য কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
হাসান প্রথম ডালের উপরে উঠলে রনি বলল, হাসান, তোমার মনে আছে তো কিভাবে সংকেত পাঠাতে হয়?
হু আছে।
ভুল যেন না হয়।
না হবে না। স্বল্প কথায় উত্তর দিল হাসান।
আর সতর্ক থেকো লাইফারটা যেন হাত থেকে পড়ে না যায়।
না পড়বে না।
সবুজ আলোটা জ্বলে উঠার সাথে সাথে আমাকে জানাবে।
হু, জানাব।
যত উপরে পার তত উপরে উঠবে।
হু উঠব।
কথা বলতে বলতেই স্বল্পভাষী হাসান তরতর করে তেঁতুল গাছে উঠে গেল। তার পিছন পিছন উঠল কাদের। আর নিচে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকল রনি।
বেশ আগেই সন্ধ্যা হয়েছে। তবে আকাশে চাঁদের আলো থাকায় বাগানের ভিতরের সবকিছু অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রনির হাতে টর্চ লাইট আছে। সে ইচ্ছে করেই লাইটটা জ্বেলে রেখেছে। তারপরও কেন যেন তার ভয় ভয় করছে। তার বারবার মনে হচ্ছে নিকির কথাই হয়তো সত্য, আজ রাতে সত্যি অশুভ কিছু ঘটবে।
একটু পরপরই রনি বাড়ির দিকে তাকাচ্ছে। গাছপালার অধিক ঘনত্বের জন্য এখান থেকে তাদের বাড়িটা দেখা যায় না। তবে বাড়ির বাইরের ইলেকট্রিক বাতিটা দেখা যায়।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রনি নিচ থেকে বলল, হাসান, কি খবর?
চেষ্টা করতেছি। উপর থেকে উত্তর দিল হাসান।
সিগন্যাল পাঠাতে পেরেছ?
হ পারছি।
সবুজ আলোটা জ্বলেছে?
না জ্বলে নাই।
আবার চেষ্টা করো। বারবার চেষ্টা করো। হাসান আর কোনো কথা বলল না। রনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এ মুহূর্তে সত্যি তার দারুন ভয় করছে। হঠাৎ একটা খসখস্ শব্দে চমকে উঠল সে। তার মনে হলো অনেকে যেন শুকনো পাতা মাড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে এদিকে। সে তাড়াতাড়ি ডান দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দেখল তার বন্ধুরা সব এসে হাজির। সবার শরীরে গতকালকের জার্সি।
রনি অবাক হয়ে বলল, তোমরা এখানে?
তোমারে খুঁজতেছিলাম, সারাদিন তো তোমার সাথে দেখাই হইল না। বলল জাফর।
হু ব্যস্ত ছিলাম।
সন্ধ্যার পর এইখানে এই তেঁতুল গাছের নিচে কি করতেছ?
রনি একটু সময় নিল ভাবতে। নিকির কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না সে।
এমন সময় আব্দুল বলল, তাই তো বলি তোমাগো বাড়িতে কেউ নাই কেন?
তোমরা কি আমাদের বাড়ি গিয়েছিলে? প্রশ্ন করল রনি।
হ! তোমারে না পাইয়া যহন বাগানে তোমারে চিৎকার করবার শুনলাম তহন এইহানে আইলাম। তয়..
তবে কি?
তমাগো বাড়িতে কেউ নাই? সন্ধ্যার বাতিডা পর্যন্ত জালায় নাই কেউ।
কী বলছ তুমি? বাবাকে দ্যাখোনি?
আমরা তো তোমার নাম ধরে ডাকাডাকি করলাম। কাউরে দেখলাম না। আর..
আর কি?
সব বাড়িতে কারেন্ট আছে। কিন্তু তোমাগো বাড়িতে নাই। খুব অবাক হইছি।
কী বলছ তুমি! আঁতকে উঠে বলল রনি। তারপরই তাকাল তাদের বাড়ির দিকে। দূর থেকে এতক্ষণ যে ইলেকট্রিক বাতির আলো সে দেখতে পাচ্ছিল এখন সেটা আর দেখা যাচ্ছে না। তারমানে বাতিটা বন্ধ হয়ে গেছে। সাথে সাথে হৃদপিন্ডটা ধক্ করে উঠল তার। আর একমুহূর্তও দাঁড়াল না সে। শুধু বলল, তোমরা সবাই আমার সাথে এসো। এটুকু বলেই ছুটতে শুরু করল বাড়ির উদ্দেশে।
বাড়ির উঠোনে এসে থমকে গেল রনি। সে বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটেছে। তাই খুব সতর্ক হয়ে গেল সে। কয়েকমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার পর খুব সতর্কতার সাথে পা বাড়াল ঘরের উদ্দেশে। ঘরে পা রেখেই ডেকে উঠল, বাবা, বাবা।
কোনো সাড়াশব্দ হলো না।
আবারো ডেকে উঠল রনি। বাবা, বাবা?
পিছন থেকে কেউ কথা বলার চেষ্টা করলে রনি তাকে ইশারায় চুপ থকতে বলল। ভয়ে সে টর্চ লাইটটা পর্যন্ত জ্বালাচ্ছে না। এবার সে ডেকে উঠল, নিকি, নিকি।
এবারো কোনো উত্তর এলো না দেখে ভয়ে একেবারে জমে গেল রনি। সে। আর সময় নষ্ট করল না। যা হবার হবে ভেবে টর্চ জ্বালিয়ে ঢুকে গেল তার নিজের ঘরে যেখানে নিকি ছিল। আর ভিতরে ঢুকেই সে বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। তার বাবা উপুর হয়ে মেঝেতে পরে আছে। আর নিকি নেই, কোথাও নেই। এমন কী ট্রিটিসকোপটাও নেই।
রনি ছুটে এসে তার বাবা রাহাত সাহেবের মাথার কাছে বসল। তারপর জোরে ডেকে উঠল, বাবা বাবা। রাহাত সাহেব খুব ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, রনি, আমি ঠেকাতে পারিনি, গিগোরা নিকিকে ধরে নিয়ে গেছে।
কী বলছ বাবা!
হ্যাঁ। হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে আমি দেখি ঘরের মধ্যে অদ্ভুত কালো দুটো প্রাণী। কিছু বুঝে উঠার আগেই ওরা আমাকে একটা যন্ত্র দিয়ে এত জোরে ইলেকট্রিক শক্ দিল যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। শেষ মুহূর্তে শুধু দেখতে পাই ওরা নিকিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
সর্বনাশ! কিন্তু চার্জার লাইট তো জুলার কথা।
ওটা আগে থেকেই নষ্ট ছিল–এজন্য জ্বলেনি।
রনির এখন নিজেরই নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। সে গতকাল চার্জার লাইটটাকে এ ঘরে এনেছে ঠিকই কিন্তু একবারও পরীক্ষা করে দেখেনি।
এরই মধ্যে রাহাত সাহেব উঠে বসতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। তার হাত পা কেঁপে উঠছে। অবশেষে সবার সাহায্য নিয়ে তিনি বিছানায় শুতে পারলেন। রনি বলল, বাবা তুমি চিন্তা করো না, আমি আব্দুল আর বাশারকে পাঠিয়েছি। ওরা ডাক্তার চাচাকে ডেকে আনতে গেছে।
না না, আমার কিছু হয়নি। সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি মাত্র। আশা করছি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাব। তুমি নিকিকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করো। প্রয়োজনে পুলিশকে খবর দাও।
তুমি চিন্তা করো না বাবা। আমি দেখছি কী করা যায়।
আমি সত্যি দুঃখিত রনি। আমি নিকিকে রক্ষা করতে পারলাম না। সম্ভবত ওরা পরিকল্পনা করেই আক্রমণ করেছিল। আক্রমণের আগে আমাদের বাড়ির ইলেকট্রিক লাইনের সংযোগটা ওরাই বিচ্ছিন্ন করে। অন্ধকারে আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। একেবারে অসহায়ভাবে বললেন রাহাত সাহেব।
প্লিজ বাবা। তুমি একটু বিশ্রাম নাও। নিকিকে কোনো না কোনোভাবে উদ্ধার করা যাবেই।
রনি বলল ঠিকই কিন্তু সে নিজেও বুঝতে পারছে না কি করবে। নিকি যে কোথায় আছে সেটাও জানে না সে। আর জানলেও উদ্ধার করবে কীভাবে? গিগোদের সাথে যুদ্ধ করে নিকিকে উদ্ধার করে আনা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তাদের না আছে অস্ত্র না আছে প্রযুক্তি। খালি হাতে তো আর গিগোদের সাথে পারা যাবে না! লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রনি তাকাল তার বন্ধুদের দিকে। তার বন্ধুরা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তারা অনুমান করতে পারছে সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে কিন্তু কী ঘটেছে সেটাই বুঝতে পারছে না।
হঠাৎ হাসানকে ছুটে আসতে দেখল রনি। সে এসে থামল একেবারে রনির সামনে। তারপর লাইফারটা রনির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সিগন্যাল, সবুজ সিগন্যাল।
রনি দেখতে পেল লাইফারের সবুজ বাতিটা জ্বলছে নিভছে। সে বুঝতে পারল লাইফারের সিগন্যাল ধরতে পেরেছে হিমিনদের স্পেসশিপ। আর তাতে কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখটা। পরের মুহূর্তে তার চোখ পড়ল লাইফারে ছোট্ট একটা তীর চিহের উপর। সেটা জ্বলে নিভে একবার দৃশ্যমান হচ্ছে আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। রনির মনে পড়ল, নিকি বলেছিল এই তীর চিহ্নটা সবসময় সংশ্লিষ্ট হিমিনের অবস্থান নির্দেশ করে। কাজেই এটার সাহায্যে যে নিকির অবস্থান জানা যাবে এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। আর এরকম ভাবতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখটা।
রনি বুঝতে পারল নষ্ট করার মতো সময় এখন আর তার হাতে নেই। তাই সে তার বন্ধুদের নিয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে তাড়াতাড়ি আলোচনায় বসল।
২৪
সম্পূর্ণ ব্যাপারটা রনি তার বন্ধুদের খুলে বলল। আজ রাতে যে নিকিকে উদ্ধারের জন্য একটা স্পেসশিপ আসবে সেটা জানাতেও ভুলল না। একইসাথে গিগোদেরও যে একটা স্পেসশিপ আসবে তাও বলল সে। পাশাপাশি কীভাবে নিকিকে খুঁজে পাবে এবং কীভাবে তাকে উদ্ধার করবে তার পরিকল্পনাও জানিয়ে দিল সবাইকে। সবাইকে এটাও বুঝল, যা কিছু ঘটুক না কেন, নিকিকে নিয়ে যেন গিগোরা পালাতে না পারে তার জন্য সবরকম প্রতিরোধের ব্যবস্থা করবে তারা। আর গিগোরা যে তাদের আক্রমণ করতে পারে সেটাও বলতে ভুলল না। এজন্য প্রত্যেককে তার নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে- এটাও বারবার মনে করিয়ে দিল সে। আর নিরাপত্তার জন্যই যে সকলের সাথে টর্চ লাইট নিতে হবে সেটা জানাতেও ভুলল না।
রনি যখন তার বন্ধুদের নিয়ে রওনা দিল তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। তারা জমিদার বাড়ির জঙ্গল অর্থাৎ আগে যেটা জমিদার বাড়ির বাগান ছিল সেখান দিয়ে এগোচ্ছে। কারণ লাইফার সেদিকেই নিকির অবস্থান নির্দেশ করছে। জঙ্গলে অধিক ঘনত্বের গাছপালা থাকার কারণে পর্যাপ্ত চাঁদের আলো ভিতরে আসতে পারছে না। অবশ্য তাতে তাদের খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। অন্তত এগোতে পারছে তারা। তবে তারা টর্চ জালাচ্ছে না। টর্চ জ্বালালে গিগোদের কাছে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ হয়ে যাবে- এই আশঙ্কায় সবাই টর্চ বন্ধ রেখেছে।
এ মুহূর্তে লাইফার সোজা পথ নির্দেশ করছে। সে পথেই এগোচ্ছে তারা। এগোতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। কারণ রনির বন্ধুদের বন-জঙ্গলের এই পথ প্রায় মুখস্থ। তাই অনেকটা নির্বিঘ্নেই অগ্রসর হচ্ছে তারা। ভয় যে একেবারে নেই তা নয়। তবে ভয়কে জয় করতে পেরেছে তারা। তাই তো একইসাথে সবাই এগিয়ে চলছে সামনের দিকে।
কিছুদূর আসার পর রহিম ফিসফিস্ করে বলল, আমার তো মনে হয় আমরা জমিদার বাড়ির দিকে যাইতেছি।
তাই নাকি? প্রশ্ন করল রনি।
হু। নিকিরে মনে হয় ঐ দিকে নিয়া গেছে।
হতে পারে। কারণ জমিদার বাড়িটা অনেক পুরনো। ভিতরটা অন্ধকার। গিগোরা অন্ধকার পছন্দ করে। এজন্য ওখানেই নিয়ে যেতে পারে। তোমার অনুমান হয়তো সত্য রহিম।
গিগোরা খুঁইজা খুঁইজা ঠিক জায়গাড়াই বাইর করছে।
গিগোরা বুদ্ধিমান প্রাণী।
কিন্তু আমাগো সাথে পারব না। আমরা বেশি বুদ্ধিমান। বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল রহিম।
রনি রহিমের আত্মবিশ্বাস দেখে অবাকই হলো। সে বিড়বিড় করে বলল, তাই যেন হয়। আশা..
মোবাইল ফোনে রিং হওয়ায় কথা শেষ করতে পারলনা রনি। সে দেখল তার বাবা ফোন করেছে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে রাহাত সাহেব বললেন, রনি তুমি কোথায়?
আমি নিকিকে উদ্ধার করতে যাচ্ছি বাবা।
কী বলছ! তুমি একা!
না। আমার সাথে আমার বন্ধুরা আছে।
তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
সম্ভবত জমিদার বাড়িতে। তবে এখনো নিশ্চিত নই।
তোমরা এভাবে যেও না। গিগোরা ভয়ংকর।
না বাবা। অপেক্ষা করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। গিগোরা নিকিকে নিয়ে পালিয়ে যাবে।
তুমি আমার কথা শোনো। তুমি ফিরে এসো। আমরা পুলিশ নিয়ে যাব।
না বাবা। আমরা..
কথা শেষ করতে পারল না রনি। তার আগেই লাইন কেটে গেল। রনি দেখতে পেল তার মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। মনে পড়ল বাড়িতে আসার পর ব্যস্ততার কারণে মোবাইলে চার্জ দিতে ভুলে গিয়েছিল সে। অবশ্য মোবাইল নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়। তার সকল চিন্তা-চেতনা আর ভাবনা নিকিকে নিয়ে। যেভাবেই হোক নিকিকে তার উদ্ধার করতেই হবে।
আরো খানিকটা আসার পর লাইফারের লাল বাতিটা বারবার জুলতে নিভতে লাগল। তাই দেখে পাশ থেকে হাবিব বলল, কী ব্যাপার? লাইফার এমন করে কেন?
মনে হচ্ছে নিকির সাথে কেউ যোগাযোগ করতে চেষ্টা করছে। বলল রনি।
কে?
হতে পারে নিকিদের স্পেসশীপে যে হিমিনরা আছে তাদের কেউ।
তুমি উত্তর দিবার পারবা না?
কীভাবে পারব? আমি তো নিকিদের ভাষা জানি না। মাঝে মাঝে লাইফারে কিছু লেখা উঠছে। সম্ভবত হিমিনরা কোনো জরুরী তথ্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু আমরা
তো হিমিনদের ভাষা বুঝতে পারি না।
ওরা যদি বুঝবার পরত নিকি বিপদে আছে তাইলে আরো তাড়াতাড়ি আসত।
হিমিনরা খুবই বুদ্ধিমান। আমি নিশ্চিত স্পেসশিপের হিমনরা বুঝতে পেরেছে নিকি বিপদে আছে। কারণ লাইফারটা নিকির হাতে থাকলে নিকি অবশ্যই উত্তর দিত। যেহেতু আমরা উত্তর দিচ্ছি না সেহেতু ওরা বুঝবে নিকি বিপদে আছে।
অন্য হিমিনদের সাহায্য পাইলে ভালো হইত।
তা হতো। কিন্তু সে সম্ভাবনা নেই। চলো, দ্রুত চলো। এখানে গাছপালার ঘনত্ব কিছুটা কমে এসেছে। আমরা বেশদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি।
আরো কিছুদূর আসার পর জমিদার বাড়িটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। আশেপাশে উঁচু গাছ থাকায় বাড়িটার চারপাশে অন্ধকারটা ঘন। তবে এই বাড়ির ভিতরই যে নিকি আছে সে ব্যাপারে রনি মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ সে লক্ষ্য করেছে তারা যতই জমিদার বাড়িটার দিকে এগোচ্ছে লাইফারের তীর চিহ্নটা ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। এ ব্যাপারে আরো নিশ্চিত হতে সে বলল, তোমাদের মধ্যে জমিদার বাড়ি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা আছে কার?
রউফ বলল, আমার। আমি এই বাড়ির সবকিছু চিনি।
তাহলে তুমি আমার সাথে এসো। আমাকে আগে নিশ্চিত হতে হবে নিকি এই। বাড়ির মধ্যেই আছে।
রনির বন্ধুদের মধ্যে রউফ কিছুটা ব্যতিক্রম। সে খুব ঠান্ডা এবং মিশুক। এজন্য গ্রামের সবার সাথে তার সম্পর্ক ভালো। তাছাড়া সে গ্রামের ছেলে হলেও শুদ্ধভাষায় কথা বলে। ছোটবেলায় বাবার সাথে শহরে থাকার কারণেই এই অভ্যাসটা গড়ে উঠেছে তার। হঠাৎ তার বাবা মারা গেলে পরিবারের সবাই গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এখন গ্রামেই পড়াশুনা করে। মাঝে অর্থাভাবে পড়াশুনা বন্ধ হতে চলেছিল। পরে তার বাবাই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
রনি সবাইকে ঝোঁপের আড়ালে বসতে বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর রউফকে বলল, আমরা এই বাড়ির চারপাশটা ঘুরে আসব। যদি দেখি লাইফার সবসময়ই বাড়ির দিকে নিকির অবস্থান নির্দেশ করছে তাহলে বুঝব। নিকি ঠিকই এই বাড়িতে আছে।
ঠিক আছে চলো। বলল রউফ।
তুমি কী জানো কোন পথে এই বাড়ির চারপাশে সহজে ঘুরে আসা যাবে?
এই বাড়ির সবাই আমার চেনা জানা। শহর থেকে আসার পর আমার মাঝেমাঝে খুব খারাপ লাগত। তখন একা একা এখানে এসে ঘুরে বেড়াতাম। তখন থেকেই বাড়ির সবকিছু আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।
এখানে আসতে কেন?
রউফ একটু সময় নিল। তারপর বলল, জায়গাটা আমার বাবার খুব প্রিয় ছিল। বাবা যখনই বাড়িতে আসত তখনই আমাকে নিয়ে এখানে আসত। মাঝে মাঝে জমিদার বাড়ির পুকুরে বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরত। আমি পাশে বসে থাকতাম। সবাই এখানে আসতে ভয় পেলেও বাবা পেত না। কেন যেন জায়গাটা তার ভালো লাগত। তাই এখানে আসলে মনে হতো বাবা বুঝি পাশে কোথাও আছে। এজন্য এখানে বারবার আসতাম।
রনি এ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা বলল না। সে বুঝতে পারল রউফ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, আমরা কি এই পথে যাব?
না, সামনে থেকে ডানে মোড় নেব। তাহলে আমাদের কেউ দেখতে পাবে না।
ঠিক আছে। এই বলে সমনে পা বাড়াল রনি।
রনি বাড়িটাকে যত বড় মনে করেছিল বাড়িটা আসলে তত বড় নয়। খুব দ্রুতই তারা ঘুরে আসতে পারল বাড়ির চারদিকে এবং ঘুরে এসে নিশ্চিত হলো। যে নিকি এই বাড়ির মধ্যেই আছে। কারণ বাড়ির প্রত্যেক পাশ থেকেই লাইফার বাড়ির দিকেই নিকির অবস্থান নির্দেশ করেছে।
রনি ঝোঁপের মধ্যে ফিরে আসতে জাফর বলল, এখন আমাদের কাজ কি হবে?
রনি বলল, আমাদের কাজ হবে নিকিকে উদ্ধার করা। আর এজন্য প্রথমে যে কাজটা করতে হবে তা হলো গিগোদের বাড়ির বাইরে আসা বন্ধ করা। সেটা একমাত্র সম্ভব যদি আমরা বাড়ির চারপাশটা আলোকিত করতে পারি। কিন্তু আগেই যদি আমরা আলো জ্বালাতে থাকি তাহলে গিগোরা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে। এজন্য আমরা প্রথমে দুজন দুজন করে বাড়ির চারপাশটা ঘিরে ফেলব। আমাদের অবস্থান হবে বাড়ির কোণায় কোণায় যেন আমরা অন্তত দুটো পাশ দেখতে পারি।
গিগোরা যদি আমাদের আক্রমণ করে?
করতে পারে। এজন্য সবাইকে গাছের উপর থাকতে হবে। গিগোরা গাছের উপর দ্রুত উঠতে পারবে না। ওরা মানুষের মতোই পায়ে চলাচল করে। গাছে উঠতে গেলে তোমরা উপর থেকে ওদের চোখে টর্চের আলো ফেলবে। তখন ওরা কিছু দেখতে পাবে না।
আর তুমি?
আমি আর রউফ নিকিকে খুঁজতে বাড়ির ভিতরে যাব। আমাদের সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত তোমরা আলো জ্বালাবে না। যখনই শুনতে পাবে আমরা আলো জ্বালাতে বলছি তখন তোমরা আলো জ্বালাবে। যেহেতু তোমরা বাড়ির চারপাশে থাকবে এবং গাছের উপর থেকে আলো ফেলবে তোমরা সম্পূর্ণ বাড়িটাকে আলোকিত করতে পারবে। গিগোরা কিছুই দেখতে পাবে না। আশা করছি তোমরা আমাকে বুঝতে পেরেছ।
সবাই একসাথে সম্মতি জানাল।
মনে রেখো, নিকি আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে। আমার বাবাকে সুস্থ করে তুলেছে, হাসানের চোখ ঠিক করে দিয়েছে, কাদেরের কথা বলা ঠিক করে দিয়েছে। এজন্য আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। আর এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যই আমরা নিকিকে সাহায্য করব। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হিমিনের মতো অতি বুদ্ধিমান প্রাণী যারা মানুষ অর্থাৎ আমাদের ভালোবাসে, তাদেরই একজন আমাদের সাহায্য চেয়েছে। কাজেই নৈতিকতা থেকে হলেও আমাদের উচিত হবে নিকিকে সাহায্য করা। এজন্য আমরা সবাই নিকিকে সাহায্য করব।
আমরা তোমার সাথে একমত রনি। ফিসফিস করে বলল সবাই।
ঠিক আছে। তাহলে চলো, আমরা একসাথে এগোই।
নির্বিঘ্নে এবং নিঃশব্দে রনি প্রত্যেককে যার যার অবস্থান দেখিয়ে দিল। কোথাও একা কেউ নেই। কমপক্ষে দুজন এবং তারা গাছের উপরে। সবাই পজিশন নিলে রনি এবং রউফ ফিরে এলো বাড়ির সামনে। দুজন দুজনের দিকে তাকাল। তারপর ধীর পায়ে প্রবেশ করতে শুরু করল জমিদার বাড়িতে।
২৫
জমিদার বাড়ির বারান্দায় উঠে আসতেই চারদিক থেকে ভয় জেঁকে ধরল রনিকে। এখানে অন্ধকার বেশ ঘন। তাছাড়া পরিবেশটাও কেমন যেন থমথমে। সে বুঝতে পারছে রউফও ভয় পাচ্ছে। কারণ রউফ তার বেশ কাছে ঘেঁষে এসেছে।
রউফই আগে কথা বলল, রনি, লাইফার কোন দিকটা নির্দেশ করছে?
বোঝা যাচ্ছে না। তীর চিহ্নটা কাঁপাকাপি করছে। একবার ডানে আর একবার বামে যাচ্ছে।
তাহলে কি গিগোরা নিকিকে বারবার একস্থান থেকে অন্যস্থানে সরিয়ে নিচ্ছে?
অহেতুক এ কাজ ওরা করতে যাবে না।
তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, লাইফার থেকে আমরা কোনো সাহায্য পাব না।
রনি ফিসফিস করে বলল, আপাতত সেরকমই মনে হচ্ছে। এখন বলো, আমরা কিভাবে খোঁজা শুরু করব?
নিচ থেকে শুরু করব। দোতলাটা বিপদজনক। তাছাড়া দোতলায় উঠার সিঁড়িটাও ভাঙ্গা।
দোতলায় কি কোনোভাবেই উঠা যায় না?
উঠলে ঐ সিঁড়ি দিয়েই উঠতে হবে। কিন্তু সেটা ঝুঁকিপূর্ণ।
যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাহলে গিগোরা উপরে উঠবে না। কারণ তাদের মূল চিন্তা এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া, লুকিয়ে থাকা নয়। আর গিগোরা হয়তো আশা করবে না যে আমরা তাদের খোঁজার জন্য এখানে আসব। কাজেই তারা লুকানোর জন্য খুব ভালো জায়গা খুঁজবে না। তারা ভাববে এই পরিত্যক্ত বাড়িটাই তাদের জন্য যথেষ্ট।
তারপরও আমরা সতর্ক থাকব।
তা থাকব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভিতরটা খুব অন্ধকার।
তুমি যতটা ভাবছ অতটা হবে না। এখানে এই বারান্দায় গাছের ছায়া এসে পড়ছে দেখে একটু বেশি অন্ধকার লাগছে। কিন্তু ভিতরে অতটা হবে না। অধিকাংশ ঘরের দরজা জানালা ভেঙ্গে গেছে। সেখান দিয়ে চাঁদের আলো আসবে।
তাহলে চলো কাজ শুরু করি। কোন জায়গা থেকে পরীক্ষা করবে?
একেবারে উত্তরপাশের ঘরটা থেকে। প্রথমে বাইরের ঘরগুলো দেখব। পরে ভিতরের গুলো।
ঠিক আছে চলল।
উত্তরপাশের ঘরটার সামনে এসে রনি বুঝতে পারল এভাবে তাদের পক্ষে নিকিকে খোঁজা সম্ভব নয়। প্রথমত ঘরের ভিতরটা অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। আর দ্বিতীয়ত দরজা জানালাগুলো এমনভাবে আছে যে ছোটখাট ধাক্কা লাগলেই শব্দ হচ্ছে। এই শব্দ যে বাড়ির যে কোনো জায়গা থেকে শোনা যাবে এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। তাই সে বলল, রউফ, এভাবে আমরা নিকিকে খুঁজতে পারব না। এতে ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
আমারও তাই মনে হচ্ছে।
আমাদের অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে।
কি উপায়?
তুমি দেখতে পাচ্ছ বারান্দায় ধূলোর উঁচু আস্তরণ আছে।
হ্যাঁ। এদিকে কেউ আসে না বলে বছরের পর বছর ধরে এই ধূলো জমেছে।
এটাকেই কাজে লাগাতে হবে আমাদের।
কিভাবে?
যেহেতু এখান দিয়ে গিগোরা হাঁটাচলা করেছে এখানে ওদের পায়ের ছাপ থাকবে।
তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু পরীক্ষা করব কিভাবে? আমরা তো আলো জ্বালাতে পারব না।
আপাতত বারান্দা থেকে শুরু করি। ওখানে চাঁদের আলো আছে, সেই আলোতে দেখা যাবে।
ঠিক আছে চলল।
বারান্দায় এসে খুব একটা খুঁজতে হলো না। তারা পায়ের ছাপ পেল। ছাপগুলো মানুষের থেকে বড় আর কিছুটা ভিন্ন মনে হওয়ায় তারা নিশ্চিত হলো এগুলো গিগোদেরই পায়ের ছাপ। একটু ভালোমতো লক্ষ্য করতেই বুঝল পায়ের ছাপগুলো মাঝের বারান্দা দিয়ে ভিতরে চলে গেছে। রনি ফিসফিস করে বলল, এই বারান্দাটা কোথায় যেয়ে শেষ হয়েছে?
ভিতরে যেখানে কয়েকটা শোবার ঘর আছে সেখানে। সম্ভবত ওটা মেহমানখানা ছিল।
তাহলে ওখানেই আমাদের যেতে হবে।
চলো।
মাঝের বারান্দায় ঢুকতেই তারা সমস্যায় পড়ল। এই বারান্দায় কোনো জানালা না থাকায় ভিতরটা খুবই অন্ধকার। রউফ ফিসফিস্ করে বলল, এখন
তো আমরা আর পায়ের ছাপ খুঁজে পাব না। যে অন্ধকার।
লাইফারের আলো আছে। আলোটা সামান্য হলেও চারদিকের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। এই দ্যাখো, এই আলোতে মেঝের উপর পায়ের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
রউফ দেখল রনি সত্য কথা বলেছে। আলোটা হালকা হলেও পায়ের ছাপ ঠিকই দেখা যাচ্ছে। সেই ছাপ দেখে দেখেই এগোতে শুরু করল তারা।
রনি বলল, রউফ তুমি আমার পিছন পিছন এসো আর চারদিকে লক্ষ্য রাখো। আমি লক্ষ্য রাখছি পায়ের ছাপের দিকে।
ঠিক আছে। তুমি এগোতে থাক। কিন্তু আমি বেশিদূর দেখতে পাচ্ছি না।
এটাই সমস্যা। অন্ধকারে গিগোরা আমাদের ঠিকই দেখতে পাবে কিন্তু আমরা গিগোদের দেখতে পাব না। অথচ আলোও জ্বালাতে পারছি না। আলো জ্বালালে সাথে সাথে আমাদের অবস্থান জেনে যাবে ওরা। সেক্ষেত্রে ওরা সতর্ক হওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে। এমন কী আমাদের আক্রমণও করতে পারে।
আমরা কি জোরে ‘নিকি’ বলে ডেকে উঠতে পারি না?
পারি। কিন্তু তাতে গিগোরা নিকিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে, আমরা হয়তো টেরও পাব না। আমরা গিগোদের সেই সুযোগ দিতে চাচ্ছি না।
আরো একটু এগোতে লাইফারের তীর চিহ্নটা স্থির হয়ে গেল এবং ডানদিকে নির্দেশ করতে লাগল। রনি সাথে সাথে বলল, রউফ, আমরা বোধহয় নিকির খুব কাছাকাছি চলে এসেছি।
খুব সতর্ক থেকো। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। কাঁপা কণ্ঠে বলল রউফ।
ভয় পেও না। মনে সাহস রাখো। আর গিগোদের দেখামাত্র টর্চ লাইট জ্বালাবে। বুঝতে পেরেছ?
হু।
আমি ডানে মোড় নিচ্ছি। লাইফারটা এদিকটাই নির্দেশ করছে।
ডানে সরু একটা বারান্দা। রনি সেদিকেই মোড় নিল। এখানেও গিগগাদের পায়ের ছাপ আছে। লাইফারও এদিকটাই নির্দেশ করছে। সে নিশ্চিত, নিকি খুব কাছাকাছি কোথাও আছে। তাই আগের মতোই ফিসফিস্ করে বলল, রউফ আমরা বোধহয় চলে এসেছি।
পিছনে রউফ কোনো কথা বলল না।
রনি আবার বলল, রউফ, আমরা বোধহয় চলে এসেছি।
এবারো কোনো উত্তর না পেয়ে রনি পিছনে ফিরে তাকাল। আর তখন রউফকে না দেখে চমকে উঠল সে। একটু আগেও রউফ তার পিছনে ছিল, অথচ এখন নেই। গিগোরা কী তাহলে রউফকে আটক করেছে? একরম ভাবতেই রনির হৃদপিন্ডের স্পন্দন দ্বিগুন হয়ে গেল।
পরের মুহূর্তেই ভয়ানক একটা ঘটনা ঘটল। সরু বারান্দার শেষ মাথার দরজা থেকে নীল একটা আলো ছুটে আসতে থাকল রনির দিকে। রনি শুধু এক নজর দেখতে পেল নীল আলোটাকে, সে সরে যাওয়ারও সময় পেল না। কিন্তু যা ঘটল তা তার কাছে অবিশ্বাস্য। নীল আলোটা হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে নিচের দিকে বেঁকে গেল। তারপর আঘাত করল তার লাইফারে।
দ্বিতীয়বার নীল আলো ছুটে আসার পর আগের মতো একই ঘটনা ঘটল। তবে এবার লাইফারটা এত জোরে কেঁপে উঠল যে সেটা রনির হাত থেকে নিচে পড়ে গেল।
ব্যাপারটা বুঝতে পারল রনি। গিগোরা তাকে লক্ষ্য করে যে লেসার ছুড়ছে লাইফার সেটাকে অ্যাবজর বা শোষণ করে নিচ্ছে। নিকি তাকে বলেছিল শত্রুর লেসার থেকে হিমিনদের রক্ষা করার জন্য লাইফারে এ ধরনের লেসার শোষণের ক্ষমতা দেয়া হয়ে থাকে। আর সেটাই এখন সে প্রত্যক্ষ করছে।
রনি বুঝতে পারল এই লাইফারই তাকে রক্ষা করবে। তাই সে তাড়াতাড়ি ঝুঁকে যখন লাইফারটা হাতে তুলতে যাবে ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ তার ঘাড় চেপে ধরল। তারপর টেনে তুলল উপরে। অনেক কষ্টে পিছনে ফিরে তাকাল রনি। আর তখনই দেখতে পেল জ্বলজ্বলে লাল দুটো চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে।
২৬
সরু বারান্দার শেষ মাথার কক্ষে এসে গিগোটা রনিকে উপর থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলল। মেঝেতে আছড়ে পড়ে হাঁটুতে দারুণ আঘাত পেল রনি। তারপরও মাথা তুলে তাকাল সে। দেখল, তার সামনেই বসে আছে নিকি। তার হাত দুটো সামনে ইলেকট্রনিক হ্যান্ডকাফে বাধা। আর তার পাশে রউফ। ভয়ে রউফ একেবারে চুপসে আছে। কারণ তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে দুই গিগো।
এই কক্ষের সবগুলো জানালা বন্ধ থাকলেও লাইফারের আলোতে হালকা আলোকিত হয়ে আছে কক্ষটা। সেই আলোতে মোটামুটি দেখা যাচ্ছে সবকিছু। গিগোগুলো যে এখন ভয়ানক কিছু ঘটাবে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে রনি। কিন্তু তার এখন কিছুই করার নেই। গিগোরা তাদের দুজনের টর্চ লাইট দুটো পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছে, এমন কী মোবাইল ফোনটা পর্যন্ত। সবগুলো ঘরের এককোণায় ছুঁড়ে ফেলে রেখেছে তারা। আর নিকির লাইফারটা এখন এক গিগোর হাতে।
রনি ভেবে দেখল এ মুহূর্তে সে শুধু চিৎকারই করতে পারবে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। তার বন্ধুরা বাইরে আলো জ্বালাবে ঠিকই কিন্তু সেটা ভিতরে আসবে না। কপাল খুব ভালো হলে হয়তো তারা ভিতরেও আসতে পারে কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে। গিগোদের লাইফারের লেসার রশ্মি তাদের মস্তিষ্ক ফুটো করে দেবে।
রনি অসহায় দৃষ্টিতে নিকির দিকে তাকাতে নিকি বলল, তোমরা ভয় পেও না। যা হবার তা হবে। তবে আমার জন্য তোমরা অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়েছ।
নিকি আমরা বোধহয় তোমাকে রক্ষা করতে পারলাম না। অসহায়ভাবে বলল বনি।
তোমরা চেষ্টা করেছ। এজন্যই আমি খুশি। তবে এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি।
কিরকম?
আমাদের আরো কিছুক্ষণ বেঁচে থাকতে হবে। সুযোগ নিশ্চয় আসবে। মনে রেখো, আমাদের একটা স্পেসশিপ পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে।
কিন্তু তার আগে তো গিগোদের একটা আসছে।
আমরা যেহেতু সত্যের পথে আছি আমাদের জয় হবেই।
কিন্তু..
কোনো কিন্তু নয়। অপেক্ষায় থাকো, সুযোগ আসবে। আর মনে রেখো, সেটাই হবে আমাদের শেষ সুযোগ। তখন..
নিকি কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই একটা গিগো ধমকে উঠে কি যেন বলল। এরপর অন্য একটা গিগো আরো কিছু বলে ট্রিটিসকোপটা নিকির সামনে এগিয়ে ধরল। আর তখন প্রথম গিগোটা এসে লেসার গান ধরল রউফের কপাল বরাবর। এই গিগোর হাতেই নিকির লাইফারটা। রনি মনে মনে ভাবল, গিগোরা গানশিপ থেকে শেষ পর্যন্ত লেসার গান নিয়েই বের হয়েছিল।
গিগো আর নিকির কথা কিছুই বুঝতে পারল না রনি। ভাষাটা সম্পূর্ণই ভিন্ন। তবে সে এটুকু বুঝল, গিগোরা কিছুক্ষণের মধ্যে ভয়ংকর কিছু ঘটাবে। সে নিকির দিকে তাকাতে দেখল নিকি অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর হঠাৎ মৃদু হেসে বলল, ওরা বলছে, এখনই যদি আমি আমাদের ট্রিটিসকোপের মূল প্রোগ্রামকে ওদের কাছে হস্তান্তর না করি তাহলে ওরা তোমাদের মেরে ফেলবে।
কী বলছ তুমি! ঢোক গিলে বলল রনি।
হ্যাঁ। এই দ্যাখো একটা মাইক্রোচিপস, এটাতে আমাকে আমার ট্রিটিসকোপ থেকে মূল প্রোগ্রামটা ওদের চিপস্ েকপি করে দিতে বলছে।
না না নিকি, তুমি করবে না। ওরা আমাদের মেরে ফেললে ফেলবে। কিন্তু ওদেরকে তুমি এই প্রযুক্তি দেবে না।
নিকি আবারো হাসল। তারপর বলল, আমি কোনোভাবেই চাই না তোমাদের মৃত্যু হোক।
না নিকি না। তুমি এ কাজ করো না। তুমি..
সামনের গিগোটা বোধহয় বুঝতে পেরেছে রনি নিকিকে নিষেধ করছে। তাই আচমকাই সে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল রনির মুখে। ঘুষির তীব্রতাটা খুব বেশি না হলেও রনির ঠোঁট কেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো। তারপর গিগোটা ফিরে তাকাল নিকির দিকে। বড় বড় চোখে কী যেন বলল।
রনি বুঝতে পারল গিগোরা আর সময় দিতে চাচ্ছে না। নিকিকে এক্ষুণি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মূল প্রোগ্রামটা চিপসে কপি করে দিতে বলছে।
নিকি ট্রিটিসকোপটা হাতে নিল। বাম হাতটা আঘাতপ্রাপ্ত থাকায় খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তার উপর হাতে ইলেকট্রনিক হ্যান্ডকাফ। তারপরও ট্রিটিসকোপের সেন্সরে নিজের আঙ্গুল বসিয়ে ট্রিটিসকোপটা চালু করতে শুরু করল নিকি। রনি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। কেন যেন তার নিজেকেই সবকিছুর জন্য দায়ী মনে হচ্ছে। কিছু একটা করার জন্য ছটফট করছে তার মন। কিন্তু বুঝতে পারছে মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া এখন আর তার কিছু করার নেই।
রনি লক্ষ্য করল নিকি খুব ধীরে কাজ করছে। সাধারণত ট্রিটিসকোপে সে যত দ্রুত কাজ করে তার থেকে অনেক ধীরে ধীরে বাটনগুলো চাপছে সে। রনি বুঝতে পারল নিকির কোনো উদ্দেশ্য আছে। হয়তো নিকি কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করছে।
গিগো আবার ধমক দিতে নিকি মাইক্রোচিপসটিকে ট্রিটিসকোপের সাথে সংযুক্ত করল। তারপর মূল প্রোগ্রামকে ট্রান্সফার করতে শুরু করল চিপসের মধ্যে। ট্রিটিসকোপ থেকে যখনই প্রোগ্রাম চিপসে কপি হতে শুরু করল ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা।
হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কক্ষটা। সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল নিকি, তোমরা দুজন তাড়াতাড়ি টর্চটা হাতে নাও। সময় খুব কম। লাইফার শক্তি বিকিরণ করতে শুরু করেছে।
দ্বিতীয়বার আলোর ঝলকানি হতেই রনি আর রউফ ছুটে গেল টর্চের কাছে। তারা যখন টর্চ দুটো হাতে পেল ততক্ষণে তৃতীয়বার আলোর ঝলকানি শেষ হয়েছে। এতটুকু সময়ের জন্য একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছিল গিগোরা। কারণ তীব্র আলোতে কী ঘটছিল কিছুই বুঝতে পারছিল না তারা। উল্টো হাতের মধ্যে আলোর ঝলকানি দেখে লাইফারটা হাত থেকে ফেলে দেয় গিগো। তারপর শক্তভাবে ধরে তাদের লেসার গান।
কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রনি আর রউফ দুজনেই হাতে পেয়েছে তাদের টর্চ লাইট।
এদিকে নিকি চিৎকার করে বলে উঠল, তোমরা তাড়াতাড়ি আলো জ্বালাও। আলো জ্বালাতে যেয়ে থমকে গেল রনি আর রউফ। রউফের টর্চ থেকে আলোই জ্বলল না। গিগোরা টর্চটা ছুঁড়ে ফেলার সময় সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। আর রনিরটা জ্বললেও হালকা আলো হলো। কারণ বাল্বের সামনের কাঁচটা ভেঙ্গে গেছে। আলো এতটাই অপর্যাপ্ত যে তা গিগোদের দৃষ্টির উপর কোনো প্রভাব ফেলল না।
এদিকে রনির চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেছে। সে দেখতে পেল একটা গিগো তার আর রউফের দিকে এবং অন্য গিগোটা নিকির দিকে লেসার গান তাক করে রেখেছে। নিকি লাইফারের দিকে হাত বাড়িয়েছিল মাত্র, কিন্তু আর পেরে ওঠেনি। তার আগেই গিগো লেসার গান তাক করে তার দিকে। বিপদ বুঝে থেমে গেছে নিকি।
হঠাৎ দরজার কাছে কিছু একটা অন্ধকারে নড়তে দেখল রনি। তারপরই বলতে শুনল, ভাইজান আমি আইস্যা গেছি, আর ভয় নাই।
কাদের টর্চের আলো জ্বালাতেই উল্টো ঘুরে লেসার ছুড়ল নিকির সামনের গিগোটা। কাদের দ্রুত এগোতে থাকার কারণেই হয়তো লেসারটা জায়গামতো লাগল না। তবে তার পায়ে যেয়ে আঘাত করল। আর তাতে কাদের উঃ শব্দ করে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। হাতের টর্চটাও ছিটকে পড়ল দূরে।
এবার আর সুযোগ পেল না গিগোরা। নিকি লাফ দিয়ে উঠে লাইফারটা হাতে তুলে নিল। পরের মুহূর্তেই লেসার ছুড়ল সামনের গিগোকে লক্ষ্য করে। গিগোটা বোধহয় আগেই বুঝতে পেরেছিল এমন কিছু ঘটবে। তাই শেষ মুহূর্তে সে সরে গিয়েছিল। লেসার গিগগাদের শরীর স্পর্শ না করে পিছনের দেয়ালে যেয়ে লাগল।
এরই মধ্যে লাইফার থেকে বিচ্ছুরিত আলোতে চারদিকটা আলোকিত করে ফেলল নিকি। আর তাতে গিগোরা প্রায় অন্ধ হয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে তারা কক্ষটা থেকে বের হতে পারলেও নিকির লাইফারের লেসার আহত করল একটা গিগোকে। ঐ অবস্থায় দুটো গিগোই ছুটে বেরিয়ে গেল ভিতর থেকে। আর তাদের পিছনে ছুটল নিকি।
রনি কাদেরের কাছে ছুটে আসতে কাদের হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ভাইজান, দাদায় যহন কইল আপনে এই রাইতে জমিদার বাড়িতে আইছেন তহন আর থাকবার পারলাম না। ছুঁইটা আইলাম। ভিতরে আইসা দেহি খালি এই ঘরডার মইধ্যে আলোর ঝিলিক। বুঝলাম যা হবার তা এইহানেই হইতেছে। তারপরে তো আপনে দ্যাখছেনই।
তুমি চুপচাপ শুয়ে থাক। আমি আসছি। রউফ থাকছে তোমার পাশে।
না না, ভাইজান। বাইরে যাবেন না। বাইরে আকাশতে যেন কী একটা নামতেছে!
রনি আর থামল না। সে ছুটল নিকির পিছন পিছন।
বারান্দার শেষ মাথায় এসে রনি যখন বাইরে বের হবে ঠিক তখনই কেউ একজন পিছন থেকে টেনে ধরল তাকে। চমকে উঠে পিছনে তাকাতে দেখে নিকি। নিকি ফিসফিস করে বলল, এখন বের হবে না। সম্ভবত ওদের গানশিপটা চলে এসেছে। গানশিপ খুব ভয়ংকর। কথা বলার ফাঁকেই নিকি লাইফারের লেসার দিয়ে হাতের হ্যান্ডকাফটি কেটে ফেলল। তারপর উঁকি দিয়ে বাইরে তাকাল। রনিও নিকির পিছন পিছন তাকাল। দেখতে পেল সামনে পুকুরের পাড়ে মাটি থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট উপরে একটা গানশিপ এসে থেমেছে, ঠিক গতকালকেরটার মতো। আর তার নিচে লম্বা একটা মই দিয়ে নেমে এসেছে আরো চার গিগো। তারপর সবাই মিলে আসতে শুরু করেছে জমিদার বাড়ির দিকে।
নিকি সাথে সাথে বলল, সর্বনাশ! ওরা এখন সংখ্যায় ছয়। ওদের সাথে পারা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
রনি নিকির দিকে তাকাতে নিকি আবার বলল, ওরা এই বাড়িতে ঢুকলে নিশ্চিত আমাদের ধরে ফেলবে।
ওদের প্রতিহত করার উপায় কি? প্রশ্ন করল রনি।
প্রথম উপায় ওদের হত্যা করা। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আর দ্বিতীয় উপায় সম্পূর্ণ বাড়িকে আলোকিত করা। সেটাও সম্ভব নয়। আমার লাইফারের আলো লম্বা সময়ের জন্য সম্পূর্ণ বাড়িকে আলোকিত করতে পারবে না।
কিন্তু কিছুক্ষণ আগে যে তোমার লাইফার থেকে উজ্জ্বল আলো বের হচ্ছিল।
সেটা লাইফারের নিজস্ব আলো নয়। লাইফার যদি কোনো লেসার বা সিসার রশিকে অ্যাবজরব করে তাহলে পাঁচ মিনিট পর সেটাকে সে আলোক শক্তিরূপে বিকিরিত করে। কিছুক্ষণ আগে এরকমই ঘটেছিল। কিন্তু ঐ বিকিরণের আলো কয়েক সেকেন্ড মাত্র স্থায়ী হয়। দীর্ঘ সময় ধরে কোনো স্থানকে আলোকিত করার জন্য কখনোই যথেষ্ট নয়।
তুমি চিন্তা করো না। আমি দেখছি। এই বলে রনি জোরে সংকেত দিল।
সাথে সাথে চরদিকে অপেক্ষমান তার বন্ধুদের শক্তিশালী টর্চগুলো জ্বলে উঠল। মুহূর্তেই বাড়ির চারপাশটা আলোকিত হয়ে উঠল। নিকি অবাক হয়ে বলল, এটা কিভাবে সম্ভব হলো?
বাড়ির চারপাশে গাছের আড়ালে আমার বন্ধুরা আছে। ওরাই টর্চ থেকে আলো ফেলছে।
তাই বলো। তাহলে তো গিগোরা আর ভিতরে ঢুকতে পারবে না।
এদিকে গিগোরা তীব্র আলোর ঝলকানিতে খানিকটা পিছিয়ে গেলেও আবার এগিয়ে আসতে লাগল। কিছুটা এসেই এলোপাতাড়ি লেসার রশি ছুঁড়তে শুরু করল তারা। তাদের মূল লক্ষ্য আলোর উৎস। আর তাতে রনি আঁতকে উঠে বলল, সর্বনাশ নিকি! ওরা তো আমার বন্ধুদের মেরে ফেলবে।
নিকির মুখটাও শুকিয়ে গেছে। সে বলল, গাছের প্রতিবন্ধকতা বোধহয় খুব বেশিক্ষণ ওদের রক্ষা করতে পারবে না।
এখন কি করব!
নিকিও একেবাইে স্তম্ভিত। কী করতে হবে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
এদিকে গিগোদের লেসার বৃষ্টির ভয়ে অনেকেই তাদের টর্চ বন্ধ করে দিয়েছে। আর তাতে উল্টো ফল হতে শুরু করল। এতক্ষণ আলোর কারণে গিগোরা গাছের উপর রনির বন্ধুদের দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু এখন অন্ধকার হওয়ায় তারা দেখতে পাচ্ছে এবং সেভাবেই লক্ষ্য স্থির করে লেসার ছুড়ছে। সবাই গাছের মোটা মোটা কান্ডের আড়ালে অবস্থান নেয়ায় এখন পর্যন্ত কেউ আহত হয়নি। তবে এভাবে যে বেশিক্ষণ তারা টিকতে পারবে না সেটাও বুঝতে পারছে তারা।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে গিগোরা হঠাৎ যেভাবে এলোপাতাড়ি লেসার ছুঁড়তে শুরু করেছিল তেমনি হঠাৎ তারা লেসার ছুড়া বন্ধ করল। তারপর পড়িমড়ি করে ছুটে গেল তাদের গানশিপের কাছে। কোনোরকম সময় ক্ষেপণ ছাড়াই মই বেয়ে দ্রুত উঠতে শুরু করল উপরে। আর তাই দেখে রনি বলল, কী ব্যাপার? কি হয়েছে?
ঠিক বুঝতে পারছি না। বলল নিকি।
ওরা এভাবে পালিয়ে যাচ্ছে কেন?
সম্ভবত ভয় পেয়েছে।
কেন?
জানি না।
এরই মধ্যে গানশিপটা বেশ উপরে উঠে গেছে। তারপর এগোতে শুরু করেছে বিলের দিকে। হঠাৎ গানশিপ থেকে মিসাইলের মতো কিছু একটা ছুটে গেল বিধ্বস্ত গানশিপের দিকে গতকাল যেটা মাটিতে এসে পড়েছিল। আর তাতে সাথে সাথে আগুন জ্বলে উঠল বিধ্বস্ত গানশিপে। আজকের আগুনের তীব্রতা গতকালের চেয়ে প্রায় দশগুণ হবে। রনি নিজের বিস্ময় ধরে রাখতে না পেরে বলল, ওরা নিজেদের গানশিপকে নিজেরাই ধ্বংস করল কেন?
কারণ ওরা চায় না ওদের প্রযুক্তি মানুষের হস্তগত হোক। বিড়বিড় করে বলল নিকি।
তাহলে ওরা কেন তোমাদের প্রযুক্তি পেতে চায়?
কারণ ওরা অসাধারণ হতে চায়। কিন্তু ওরা জানে না ওদের এভাবে অসাধারণ হওয়ার প্রচেষ্টা ওদেরকে ধ্বংস করে দেবে।
এরই মধ্যে গানশিপটা অনেক উপরে উঠে গেছে। তারপর হঠাৎ তীব্র একটা আলোর ঝলকানি ছেড়ে ছুটে গেল দূর আকাশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে গেল গানশিপটা। কেউই আর দেখতে পেল না সেটাকে। তবে তারা বিস্মিত হলো আকাশে হাজার হাজার আলো দেখে। আকাশের বিশাল এলাকা নিয়ে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ আলোগুলো এমনভাবে জ্বলছে যেন মনে হচ্ছে আকাশে নানা রঙের তারার মেলা বসেছে।
এরইমধ্যে রনির বন্ধুরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রউফ আর কাদেরও বাড়ির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে। সবাই দেখতে পেল আকাশের আলোগুলো দ্রুত নিচের দিকে নেমে আসছে। আলোগুলোর যেন কোনো সীমা পরিসীমা নেই। কোথায় যে শুরু হয়েছে আর কোথায় শেষ হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। রউফ শেষ পর্যন্ত কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলল, এই আলোগুলো কিসের?
নিকি একটু সময় নিল।
রউফ আবার বলল, এগুলো কিসের আলো?
নিকি ফিসফিস করে বলল, এটা আমাদের ছোট একটা স্পেসশিপ, সম্ভবত আমাকে উদ্ধার করতে এসেছে। আর এটার উপস্থিতি টের পেয়েই পালিয়েছে গিগোদের গানশিপ।
সবাই বিস্মিয় নিয়ে তাকিয়ে আছে নিকিদের স্পেসশিপের দিকে। স্পেসশিপটা এখন অনেক নিচে নেমে এসেছে। স্পেসশিপের হাজার হাজার আলো আলোকিত করে ফেলেছে চারদিকটা। মাঝে মাঝে বড় বড় সার্চ লাইটের মতো
২৭
আলোও জ্বলছে। আলোর উজ্জ্বলতা এতটাই বেশি যে দিনের আলোকেও হার মানাবে। যতদূর চোখ যাচ্ছে ততদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে শুধু আলো আর আলো। তার থেকে বিস্ময়ের ব্যাপার স্পেসশিপটার আকার। সামনের বিলের প্রায় পুরোটাই দখল করে রেখেছে স্পেসশিপ। পিছনে জঙ্গলও সম্পূর্ণ ঢাকা স্পেসশিপে। রনি মনে মনে ভাবল, এটা যদি নিকিদের ছোট স্পেসশিপ হয় তাহলে বড় স্পেসশিপের আকার কেমন হবে!
স্পেসশিপটা ভূমি থেকে একশ ফুট উপরে এসে থামল। আরো হয়তো নামতে পারত, কিন্তু গাছের জন্য নামল না। রনি অবাক হয়ে দেখল যে স্পেসশিপটা শূন্যে স্থির হয়ে আছে। এতটুকু নড়াচড়া পর্যন্ত করছে না। সে ভেবে পেল না এত বড় একটা স্পেসশিপ কীভাবে এভাবে শূন্যে স্থির হয়ে আছে। এটার ওপর কী অভিকর্ষজ ত্বরণ এতটুকু প্রভাব ফেলতে পারছে না?
এরইমধ্যে নিকি লাইফারে দু’বার কথা বলে নিজের অবস্থান জানিয়েছে। কিছুক্ষণ পরই তাদের থেকে মাত্র দশ গজ দূরে বিশাল একটা ক্রিস্টালের পাইপ নেমে এলো। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাইপটার নিচে একটা দরজা খুলে গেল। রনি বুঝতে পারল এটা আসলে পাইপ না। বিশেষ কোনো স্বাচ্ছ লিফট। নিকিকে উপরে তোলার জন্য নিচে নামানো হয়েছে।
নিকি এবার ঘুরে দাঁড়াতে রনি বলল, নিকি, তুমি এখনই চলে যাবে?
হ্যাঁ রনি। আমার যে সময় হয়ে এসেছে।
তু..তুমি..কথা বলতে পারল না রনি।
আমাকে যেতেই হবে রনি।
এ..এত তাড়াতাড়ি। তোমার সাথে তো মন খুলে কথাই বলতে পারলাম না।
নিকি মৃদু হাসল। তারপর বলল, রনি, তুমি সত্যি খুব ভালো। তোমার বন্ধুরা আরো ভালো।
এই বলে নিকি একে একে রনির সব বন্ধুদের সাথে হ্যান্ডসেক করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে শুরু করল। কাদেরের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময়। কাদের কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ভাইজান, আপনে আমার জন্য যা করছেন তা দুনিয়ার কেও করত না।
ছিঃ কাদের। এভাবে বলল না। আমার সাধ্যের মধ্যে ছিল বলেই করেছি। বলল নিকি।
না ভাইজান। আপনের মন মেলা বড়, মেলা বড়। আমার জন্যই আপনে বিপদে পড়বার গেছিলেন। আমি বুঝি নাই ভাইজান, আমারে মাফ কইরা দিবেন।
তুমি এভাবে ভেব না। তোমার কোনো দোষ নেই। তুমিই তো আমাদের জীবন রক্ষা করেছ। এই বাড়ির মধ্যে সময়মতো তুমি না পৌঁছালে আমাদের কেউই হয়তো বাঁচতে পারতাম না।
ভাইজান, আপনে মহান, সত্যই মহান।
কথা বলার মধ্যেই নিকি কাদেরের পায়ের জখমটা পরীক্ষা করল। তারপর বলল, তোমার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। গিগোদের লেসার রশি তোমার চামড়া পুড়িয়ে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু কোনো টিস্যুর মারাত্মক কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। আশা করছি সাতদিনেই সেরে উঠবে।
ভাইজান আমি আপনেরে ভুলবার পারব না। আপনি সত্যই মহান ভাইজান, সত্যই মহান। আবারো বলল কাদের।
নিকি এবার কাদেরের সাথে হ্যান্ডসেক করতে করতে বলল, সত্যিকারের মহান হচ্ছ তোমরা যারা জীবনকে ভালোবাসো, প্রাণকে ভালোবাসো, প্রাণীকে ভালোবাসো। তোমাদের ব্যবহারে আমি সত্যি মুগ্ধ, অভিভূত।
কাদের আর কোনো কথা বলতে পারল না। তার চোখে পানি চলে এলো।
নিকি এবার এগিয়ে গেল রউফের কাছে। রউফ হেসে দিয়ে বলল, নিকি, তোমার কথা আমার অনেক অনেকদিন মনে থাকবে।
আমারও থাকবে। তুমি খুব সাহসী ছেলে রউফ।
তোমার জন্য সাহসী হয়েছি।
আশা করছি মানুষের জন্যও তোমরা এরকম সাহসী হবে। যতদিন তোমরা সাহসী থাকবে এবং তোমাদের উদ্দেশ্য ভালো থাকবে ততদিন তোমরা জয়ী হবে।
ধন্যবাদ নিকি। মিষ্টি হেসে বলল রউফ।
এরইমধ্যে জব্বার নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছে। এতকিছুর মধ্যেও জব্বার তার বলটা সাথে রেখেছে। সে নিকির একেবারে কাছে এসে দুহাতে বলটা নিকির দিকে এগিয়ে ধরল।
নিকি অবাক হয়ে বলল, তুমি এ কি করছ!
আমরা তোমারে কিছুই দিবার পারলাম না। এই বল দিলাম। বলা আমার মেলা আপন। তোমারে দিয়া দিলাম।
তুমি আমাকে বলটা দিয়ে দিচ্ছ! বিস্মিত কণ্ঠে বলল নিকি।
হ। তুমি যহন তোমাগো দ্যাশে যাবা তহন এই বল দেইখা আমাগো কথা মনে রাখবা। আমাগো তুমি ভুইলা যাবা না।
জব্বারের আচরণ দেখে নিকি যতটা না অবাক হলো তার থেকে বেশি অবাক হলো অন্য সবাই। যত যাই হোক না কেন জব্বারের কাছ থেকে কোনোভাবেই বলটা কেউ নিতে পারত না। অথচ সেই জব্বারই কিনা ভালোবেসে বলটা দিয়ে দিচ্ছে নিকিকে। ব্যাপারটা সত্যি বিস্মিত করল সবাইকে।
নিকি বলল, আমি তোমাদের কোনোদিনও ভুলব না। তোমরা থাকবে আমার বুকের মধ্যে, একেবারে বুকের গভীরে। তোমাদের ভালোবাসা আমাকে আজীবন গর্বিত করবে।
এই বলে নিকি হাত বাড়িয়ে বলটা নিল। তারপর এগিয়ে এলো হাসানের সামনে। হাসান কিছুই বলল না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল নিকির দিকে। তার দৃষ্টি এখন আর আকাশের দিকে নয়। সরাসরি নিকির চোখে।
নিকি হেসে দিয়ে বলল, হাসান, তুমি সত্যি অসাধারণ!
স্বল্পভাষী হাসান কিছুই বলতে পারল না। সে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল নিকির দিকে।
নিকি এবার বলল, আমার কী ইচ্ছে করে জানো? আমার ইচ্ছে করে তোমার মতো তরতর করে তেঁতুল গাছে উঠতে। তারপর মগডাল থেকে তেঁতুল পেড়ে তোমাদের মতো মজা করে খেতে। কিন্তু কী জানো, আমাদের গ্রহে কোনো তেঁতুল গাছ নেই।
এবারো হাসান কিছু বলল না। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কাঁদতে কাঁদতেই সে তার প্যান্টের পকেট থেকে কয়েকটা তেঁতুল বের করে এগিয়ে দিল নিকির দিকে।
হাসানের হাত থেকে তেঁতুলগুলো নেয়ার সময় নিকির হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সংবরণ করে কাঁপা কণ্ঠে বলল, আমার খুব ইচ্ছে করে তোমার মতো এরকম অঝোর ধারায় কাঁদতে, প্রিয়জনের জন্য কাঁদতে। কিন্তু আমাদের গ্রহ হিমিচুনে কোনো প্রিয়জন নেই। আমরা সবাই সমান। তাই অনেক আগেই হিমিচুন থেকে কান্নাটা উঠে গেছে। যদি আমাদের হিমিচুন গ্রহে তোমাদের গ্রহের মতো কান্না থাকত তাহলে হয়তো আমরা তোমাদের মতোই সুখী হতাম।
এটুকু বলে নিকি হাসানের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আসি হাসান।
হাসান এবার হঠাৎ নিকিকে জড়িয়ে ধরল। তারপর হু হু করে কেঁদে উঠে বলল, তুমি আর আসবা না নিকি?
নিকি ভেঁজা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, তোমাদের আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করবে হাসান। খুব দেখতে ইচ্ছে করবে। আমার দীর্ঘ দুইশ আশি বছরের জীবনে তোমাদের সাথে কাটানো গত একটি দিনই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন। এত আনন্দের দিন আমার জীবনে কোনো দিন আসেনি এবং আমি বিশ্বাস করছি আর কখনো আসবে না।
নিকি এবার রনির দিকে ফিরে তাকাল। কিন্তু আবেগে সে কিছুই বলতে পারল না। শুধু রনিকে জোরে দুহাতে বুকের মধ্যে টেনে নিল। তারপর কিছুক্ষণ আগের হাসানের মতোই হু হু করে কেঁদে উঠল।
রনি একেবারে হতবিহ্বল হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে তার চোখ দিয়েও অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, তার ঠোঁট দুটো থর থর করে কাঁপছে। কিন্তু সে কথা বলতে পারছে না। সে যেন হারিয়ে গেছে ভিন্ন এক জগতে।
কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর নিকি মুখ তুলে সরাসরি রনির চোখে তাকাল। তখনো তার চোখে অশ্রু। অনেক কষ্টে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সে বলল, রনি, আমি আমার দীর্ঘ জীবনে কখনো কাঁদিনি। কান্নার মধ্যে যে এত আনন্দ আমি জানতাম না। এই কান্নার মধ্যেই আমি আমার সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছি। হিমিনদের আয় নিয়ে যে বিতর্ক চলছিল আমি তার উত্তর পেয়ে গেছি। আমি বিশ্বাস করছি হিমিনদের আয়ু কমিয়ে আবার আগের মতো করে ফেলা উচিত। আমাদের জন্ম পঞ্চাশ বছর থেকে শুরু না করে শূন্য থেকে শুরু করা উচিত। আমাদের ক্লোনিং এর মাধ্যমে জন্ম না হয়ে নারী পুরুষের শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে জন্ম হওয়া উচিত। আমাদের বিশেষ ল্যাবে বড় না হয়ে পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে বড় হওয়া উচিত। আমাদের টেস্টটিউবে শিক্ষিত না হয়ে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে শিক্ষিত হওয়া উচিত, শুধু জ্ঞানের পিছনে না ছুটে জীবনকে উপভোগের দিকেও নজর দেয়া উচিত, নিজেদের শুধু অসাধারণ করার চেষ্টা না করে মাঝে মাঝে সাধারণ হওয়ারও চেষ্টা করা উচিত। তাহলেই হয়তো আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকার স্পৃহার সৃষ্টি হবে, সৃষ্টি হবে হাসি আনন্দ আর কান্নার। তাহলেই হয়তো আবার আমরা সুখী হব, তোমাদের মতো হাসতে পারব, খেলতে পারব, ভালোবাসতে পারব, কাঁদতে পারব, অন্যকে সাহায্য করার জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ পর্যন্ত করতে পারব। রনি, আমি তোমার এবং তোমার বন্ধুদের কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞ। তোমাদের কাছ থেকে আমি অনেক অনেক কিছু শিখেছি। তোমরা আমাদের অনেক বড় উপকার করেছ।
না না নিকি। তুমি এভাবে বলো না। তুমি আমাদের এমন সব উপকার করেছ যা আমরা কল্পনা পর্যন্ত করতে পারিনি। তুমি আমার বাবাকে সুস্থ করে তুলেছ, কাদেরের কথা বলা ঠিক করে দিয়েছ, হাসানের দৃষ্টি ঠিক করে দিয়েছ। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল রনি।
আর তোমরা যে তোমাদের জীবন বাজি রেখে আমার জীবনকে বাঁচিয়েছ। যেখানে গিগোদের মোকাবেলা করতে আমরা হিমিনরাই অনেক চিন্তা ভাবনা করি সেখানে তোমরা বলতে গেলে একেবারে খালি হাতে গিগোদের সাথে যুদ্ধ করেছ এবং তাদের পরাজিত করেছ। এটা তো অনেক বড় ব্যাপার রনি, অনেক বড় ব্যাপার।
নিকি এবার চোখ মুছে মিষ্টি হেসে বলল, আমার চলে যাওয়ার সময় হলো। চলে যাওয়ার আগে আমি তোমাদের সাথে একটা ছবি তুলতে চাই।
কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই যেয়ে নিকির পাশে দাঁড়াল।
নিকি তার লাইফারটা সামনে একটা গাছের গুঁড়ির উপর রেখে আবার এসে দাঁড়াল সবার মাঝে। দুই সেকেন্ডের মাথায়ই ক্লিক করে উঠল লাইফার।
নিকি লাইফার নিয়ে ফিরে আসতে কাদের তার হাতের ট্রিটিসকোপটা এগিয়ে দিল নিকির দিকে। নিকি সেটা হাতে নিয়ে আবার ফিরে তাকাল সবার দিকে। তারপর বলল, এই ছবিটা শুধুই ছবি, এটা কখনো আমার জন্য নয়। কারণ তোমরা থাকবে আমার মনের মাঝে, হৃদয়ের গভীরে, অন্তরের অন্তঃস্থলে। এই ছবিটা শুধুই হিমিনদের জন্য। আমি তাদের তোমাদের ছবি দেখিয়ে বলব, এই সেই অসাধারণ বুদ্ধির মানুষ যারা আমার জীবনকে রক্ষা করেছিল, যারা আমাকে অনেক বড় শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিল, যারা ভালোবাসা দিয়ে আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল, যারা আবেগ দিয়ে আমাকে হু হু করে কাঁদিয়েছিল, যারা আমাকে নতুন জীবনের নতুন দিগন্তের স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
কথাগুলো বলার সময় নিকি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। তার চোখ দিয়ে আবারো গলগল করে পানি বেরিয়ে আসছিল। নিকির এই আবেগকে সম্মান জানাতে সবাই একসাথে জড়িয়ে ধরল নিকিকে। একসময় তারাও বুঝল নিকির ভালোবাসায় তারাও সিক্ত হয়েছে। তা না হলে তাদের সবার চোখে কখনোই এভাবে একসাথে পানি আসত না।
নিকি যখন স্পেসশিপের লিফটে যেয়ে উঠল তখন সবার চোখে অশ্রু কিন্তু মুখে হাসি। তারা সবাই তাদের প্রিয় বন্ধু হিমিচনের অধিবাসী নিকিকে হাসিমুখে বিদায় দিতে চায়। তাই তো সবাই হাসি মুখে হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে নিকিকে। নিকিও সবার কাছে থেকে একইভাবে হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় নিচ্ছে। তার মুখেও হাসি, তবে চোখে রনিদের মতোই অশ্রু।
লিফটা যখন স্পেসশিপের মধ্যে প্রবেশ করল তখনো হাত নেড়ে চলছে রনি আর তার বন্ধুরা। তাদের মুখে সেই আগের মতোই হাসি। এই হাসিটা সত্যি। আনন্দের, তাদের বন্ধু নিকিকে রক্ষা করতে পারার আনন্দের। তাই তো আজ তারা সবাই তপ্ত, গর্বিত। অন্তত ভিনগ্রহের কেউ একজন সবসময় বিশ্বাস করবে পৃথিবীতে মানুষ নামের অতিবুদ্ধিমান এক প্রাণী রয়েছে যাদের হৃদয় অন্যের জন্য উদ্বেলিত হয়, আবেগাপ্লুত হয়। পৃথিবীর মানুষের জন্য এর থেকে বড় প্রাপ্তির আর কী থাকতে পারে!
স্পেসশিপটা ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে সরে যেতে থাকল। একই সাথে গতি বাড়তে শুরু করল স্পেসশিপের। প্রায় চারমিনিট চলার পর মাথার উপরের চাঁদ দেখতে পেল তারা। রনি আবারও অনুধাবন করল কত বড় ছিল হিমিনদের ছোট স্পেসশিপটা!
দক্ষিণের আকাশে ধীরে ধীরে অনেক উপরে উঠে গেল স্পেসশিপটা। নিচে তখনো হাজার হাজার লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সাদা বাতি জ্বলছে। তারপর হঠাৎ নিভে গেল সবগুলো আলো। তারপর আবার জ্বলে উঠল। পরের মুহূর্তেই স্পেসশিপটা ছুটে হারিয়ে গেল দূর মহাশূন্যে।
রনি আর তার বন্ধুরা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ফিরে আসার জন্য যখন ঘুরে দাঁড়াল, তখন দেখল পিছনে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছেন প্রফেসর হায়দার। তার পিছনে তার দলের সদস্যরা টিভি ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, স্টিল ক্যামেরা, ছোট্ট একটা খাঁচা আর অনেকগুলো ডার্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রফেসর হায়দার রনিকে দেখে বলল, তোমাকে না বলেছিলাম ভিন গ্রহের প্রাণী এলে সবার আগে আমাকে খবর দেবে? একমাত্র আমিই জানি ওদের সাথে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়।
রনি কিছু বলল না দেখে তিনি ধমকের স্বরে আবার বললেন, ওরা কি চলে গেছে? নাকি আছে?
রনি এবারো কিছু বলল না।
প্রফেসর আগের মতোই বললেন, কোথায় ওরা?
রনি এবার হাতের আঙ্গুল দিয়ে দক্ষিণ দিকটা দেখিয়ে দিল।
প্রফেসর হায়দার সাথে সাথে তার দলবল নিয়ে দক্ষিণ দিকে ছুটতে শুরু করলেন। রনির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রনি তাকে বিড়বিড় করে বলতে শুনল, ভিনগ্রহের প্রাণী, তোমার সাক্ষ্যাৎ আমার পাওয়া চাই-ই-চাই।
প্রফেসর হায়দার যখন জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেলেন তখন রনি আর তার বন্ধুরা সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠল। তারপর তারা দ্রুত পায়ে রওনা দিল বাড়ির উদ্দেশে।
২৮
এক মাস পর।
রনির বাবা রাহাত সাহেব এরইমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ঢাকায় যেয়ে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন তিনি। অবশ্য তার মাথার টিউমারটা সেরে গেলেও চোখে হালকা সমস্যা হয়েছে। এখন তাকে চশমা ব্যবহার করতে হয়। তাতে রনির মনে কোনো দুঃখ নেই। তার বাবা যে সুস্থ হয়ে উঠেছে এটাই তার জন্য অনেক। পাশাপাশি আগমীকাল তিনি তার চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। এটাও তাদের জন্য অনেক বড় একট সুসংবাদ।
রনি গত একমাস ধরে গ্রামেই ছিল। আজ সে শহরে ফিরে যাচ্ছে। তাই তো তার সকল বন্ধুরা তাকে বিদায় জানাতে এসেছে। রনি ট্রেনে উঠার আগে জাফর, হাবিব, রউফ, বাশার, হোসেন, আব্দুল, মিলন, জব্বার, হাসান সবাই তাকে ঘিরে ধরল। রনি সবার কাছ থেকে যখন বিদায় নেয়া শেষ করল তখনই তার মোবাইলে একটা মেসেজ এলো। মোবাইল ফোন পরীক্ষা করতেই তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সবাই আগ্রহ নিয়ে বলল, কি?
রনি বলল, একটা মেসেজ এসেছে।
কে পাঠিয়েছে?
নিকি।
নিকি!
হুঁ।
কি মেসেজ?
সে ঠিকমতো হিমিচুনে পৌঁছেছে। আর একটা ছবি পাঠিয়েছে। এই দ্যাখো।
ছবিটা দেখে সবাই খুব খুশি হলো। এই ছবিটা সেই ছবি যেটা নিকি চলে যাওয়ার আগে সবার সাথে তুলেছিল। ছবিটা দেখেই সবাই হইহই করে উঠল। তারা যে সত্যি নিকির সাথে দেখা করেছিল এটা অনেকে বিশ্বাস করতে চায়নি। এবার বিশ্বাস করবে। তাই সবাই ছবি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল।
রাহাত সাহেব তখনো ট্রেনে উঠেননি। রনি তার পাশে যেয়ে বলল, বাবা।
হ্যাঁ বলো।
তুমি কি আমার একটা কথা শুনবে?
আবার কি কথা? তোমার অনেক কথাই তো শুনেছি। তোমার বন্ধুদের বল কিনে দিয়েছি, জার্সি কিনে দিয়েছি, তোমাদের আনন্দের জন্য টাকা দিয়েছি।
এত কিছুর পর আবার কি?
একটা ছবি অনেকগুলো কপি করতে হবে।
কেন? ভ্রূ কুঁচকে বললেন রাহাত সাহেব।
আমার বন্ধুদের দেয়ার জন্য।
আবার বন্ধু!
প্লিজ বাবা।
দেখি কি ছবি?
ছবি দেখে রাহাত সাহেবের কুঞ্চিত টা আরো কুঞ্চিত হলো। তারপর তিনি মুচকি হেসে বললেন, বুঝতে পেরেছি, তোমরা আমার থেকেও বেশি চালাক হয়েছ। আমাকে বাদ দিয়েই সবকিছু করেছ। ঠিক আছে, এবারই শেষ। তোমাদের সবাইকে এক কপি করে ছবি দেয়া হবে।
সাথে সাথে সবাই হইহই করে চিৎকার করে উঠল।
রাহাত সাহেবের মুচকি হাসিটা এবার আরো বিস্তৃত হলো। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমার ছেলেটা সত্যিই অসাধারণ! রনি পাশেই ছিল। সে সাথে সাথে বলল, না বাবা না, আমি অসাধারণ না এবং কখনো হতেও চাই না। আমি সবসময় সাধারণ থাকতে চাই।
রাহাত সাহেব চোখ কুঁচকে তাকাতে রনি আবার বলল, ‘পৃথিবীর সকল সুখ শান্তি যে সাধারণেই বাবা। তাই আমি আজীবন সাধারণ থাকতে চাই।
রাহাত সাহেব মৃদু হেসে রনির মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললেন, আর এজন্যই তুমি অসাধারণ কারণ তুমি অসাধারণ হয়েও সাধারণকে ভুলে যাওনি।
বাবা!! এই বলে রনি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরল।
ট্রেন চলতে শুরু করলে রনি যখন ট্রেনের জানালা দিয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় নিচ্ছিল তখন তার বন্ধুরাও একইভাবে তাকেও হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় দিচ্ছিল ঠিক যেভাবে একমাস আগে তারা নিকিকে বিদায় দিয়েছিল। তবে নিকি আর রনির বিদায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। নিকি হয়তো আর কখনো তাদের মাঝে ফিরে আসবে না। কিন্তু রনি আসবে, প্রত্যেক ছুটিতেই আসবে। কারণ রনি যে সাধারণ, একেবারেই সাধারণ। তাই তো সে বারবার ফিরে আসবে গ্রামের পরিবেশে বেড়ে উঠা তাদের মতো সহজ সরল সাধারণদের কাছে।
[প্লেবো, লাইবেরিয়া, ২২.০৫.২০০৭ – ০৯.০৬.২০০৮]
Leave a Reply