নারী, সৃষ্টি ও বিজ্ঞান – পূরবী বসু
প্রথম প্রকাশ : ফাল্গুন ১৪১৫, ফেব্রুয়ারি ২০০৯
প্রচ্ছদ : সুখেন দাস
উৎসর্গ
স্বদেশ বসু, নূরজাহান বসু
আলী আনোয়ার, বেগম হোসেন আরা
গোলাম মুরশিদ, এলিজা মুরশিদ
দেশে ও বিদেশে নারীর অবস্থা ও অবস্থান যাঁরা দেখেছেন
.
ভূমিকা
১
বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ পাঠ করা কিংবা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ব্যবহার জানার অর্থ বিজ্ঞানী হওয়া নয়। এসবের অর্থ তথ্য জানা এবং প্রয়োজনে হাতেকলমে প্রয়োগ করা। গৃহস্থের বাড়িতে যে-মানুষটিকে প্রায়শই আসতে হয় বৈদ্যুতিক পাখা, বাতি কি ফ্রিজ, টিভি বা এসি ইত্যাদির গোলযোগ সারাতে তাকে কেউ বৈজ্ঞানিক বলে না; সে টেকনিশয়ান মাত্র। তার আয়ত্তে আছে প্রযুক্তির কিছু খুঁটিনাটি ব্যাপার, তার বেশি কিছু নয়। যে কম্পিউটার নামক যন্ত্রটির মেরামতি নিয়ে অর্থোপার্জনে সংসার চালায় সে কিন্তু কম্পিউটার বিজ্ঞানে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত নয়, সে মিস্ত্রী বা মেকানিক মাত্র। বিজ্ঞানের কোনো শাখা সম্পর্কে অধীত জ্ঞান একজনকে শাস্ত্রজ্ঞ করে তোলে ঠিকই, কিন্তু সেজন্য তাঁকে কেউ বিজ্ঞানী বলবে না; বলবে তখনই যখন তিনি ঐ শাস্ত্রের জ্ঞান প্রয়োগ করে কোনো কিছু উদ্ভাবন করবেন। তবু এঁরা কেউই চিন্তা-ভাবনায় বিজ্ঞানমনস্ক নাও হতে পারেন। আমাদের দেশে বিজ্ঞান-পড়ুয়া মানুষজন তো কম নেই—ডাক্তার, প্রকৌশলী, স্থপতি, নির্মাণকুশলী ইত্যাদি যথেষ্ট, কিন্তু তাঁদের ভিতরে স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার মানুষ নিতান্তই কম। তা যদি না হত, দেশের মেডিকেল কলেজ-ইউনিভার্সিটি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এত ধর্মান্ধ জামাতী-তবলিগী শিক্ষার্থী ও শিক্ষক দেখা যেত না। বিজ্ঞানের বিষয়াদি সম্পর্কে তথ্যাদি জানা আর বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হওয়া- এ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।
বিজ্ঞানমনস্কতার শিকড় প্রোথিত থাকে ন্যায় ও যুক্তির সাধনার ভিতরে। এর প্রস্ফুটন লক্ষ্য করা যায় ব্যক্তির সার্বিক চিন্তাধারায় যুক্তির পারম্পর্য এবং ন্যায় ও বিবেকবোধের সর্বব্যাপী দীপ্তিতে। জগৎ, জীবন ও সভ্যতার ধারণার সংমিশ্রণে যে- ব্যক্তিমানুষ জীবদ্দশায় নিজের পথচলা নির্মাণ করেন তাঁকে বিজ্ঞান না পাঠ করেও বিজ্ঞানমনষ্ক হতেই হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, এদেশে বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা নেই। বিজ্ঞানসম্পর্কিত নানাবিধ পাঠ্যপুস্তক নয়, অন্যধরণের বিজ্ঞানবিষয়ক বই যে পনেরো কোটি লোকের এই দেশে সংখ্যায় কত কম, জরিপ করলে তা বোঝা যায়। এর মূল কারণ, আমার বিবেচনায়, বিজ্ঞানে অধীত বিদ্যা সম্পন্ন করলেও বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব তাঁদের অন্তরে কোনো বিজ্ঞানবুদ্ধির আলো জ্বালাবার প্রণোদনা যোগায় না।
২
পূরবী বসু সৃজনশীল কথাশিল্পী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। সৃজনকল্পনার বাইরে তাঁর কারবার প্রত্যক্ষভাবে বিজ্ঞান নিয়ে, বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি তাঁর শাস্ত্রে সিদ্ধকাম ও দেশ-বিদেশে স্বীকৃত। তাঁর প্রবাসজীবন সুদীর্ঘ; বর্তমানে তিনি দেশের বাইরেই রয়েছেন গবেষণাগারে কাজ নিয়ে। দূরে বসেই দেশহিতৈষণার ব্রত পালন করে যাচ্ছেন তথ্য ও বিশ্লেষণাশ্রয়ী নানা ধরনের গ্রন্থ বাংলায় লিখে ও প্রকাশ করে। তাঁর সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য—তাঁর দৃষ্টি নির্মোহ ও সংস্কারমুক্ত, প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে তিনি প্রশ্রয় দেন না, যাচাই-বাছাই করে দেখেন, প্রয়োজনবোধে তাকে মান্য কিংবা পরিত্যাগ করেন। শ্রীমতী বসুর এই বইটিতে আমি তাঁর দৃষ্টি ও মনস্বিতার প্রকাশ দেখতে পেলাম।
নারী, সৃষ্টি ও বিজ্ঞান গ্রন্থের বাইশটি রচনায় যে-সব প্রসঙ্গ এসেছে সে-সব নিয়ে আমরা আলোচনা করি না; হয়তো অস্বস্তি বোধ করি কিংবা চিন্তাভাবনার অযোগ্য মনে করি অথবা লজ্জাজনিত জড়তা এসে বাধা দেয়। সংস্কারগত বাধা পূরবী বসু উপেক্ষা করতে পেরেছেন তাঁর বিজ্ঞানবুদ্ধি ও ঔচিত্তজ্ঞানের কারণে। তিনি নিজে নারী হওয়ায় সমস্যাগুলোকে ভিতর থেকে দেখতে পেয়েছেন; অন্য নারীও হয়তো দেখেন কিন্তু উপেক্ষা করেন। পূরবী উপেক্ষা করেননি। নারী তো পুরুষের মতোই মনুষ্যপ্রাণ, তার জীবন পুরুষের আধিপত্য কিংবা সমাজের প্রচলিত সংস্কারের চাপে ব্যর্থ হতে পারে না। বিজ্ঞান, সমাজ, মানব-মানবীর সম্পর্ক, মনুষ্যশরীরের জৈবিক গঠন, হৃদয়ের আবেগের পশ্চাতে দেহাভ্যন্তরে জৈব রাসায়নিক ফল্গুস্রোত ইত্যাদি অজস্র বিষয় আলোচনায় এসেছে। পাঠ করে আমরা ভিন্ন চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে উঠি। কোনো পূর্ব-ধারণায় স্থিত বিশ্বাস নিয়ে এ বইয়ের লেখাগুলো পড়ে ওঠা সম্ভব নয়। তথ্য, যুক্তি, বিজ্ঞান ও সত্যানুসন্ধানে যে-বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টি জন্মায়, তা ব্যাতিরেকে এ গ্রন্থের মহিমা কাউকে উপলব্ধি করানো যাবে না।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও সীমিত পঠনপাঠন অন্তত বলে যে বাংলাদেশে নারী, সৃষ্টি ও বিজ্ঞান গ্রন্থের মতো কোনো বই এর আগে লেখা হয় নি। আমার বিবেচনায়, অবশ্যপাঠ্য বলে মনে করি।
হায়াৎ মামুদ
১লা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯
Leave a Reply