নারীবাদের নানা পাঠ – ঋতু সেন চৌধুরী (সম্পাদিত)
প্রথম সংস্করণ: এপ্রিল ২০২১
.
উপক্রমণিকা
বাংলায় নারীবাদচর্চার নানা দিক নিয়ে ভাবনা আমাদের। বাক্যটি পড়ার সময় ‘বাংলা’র ওপর জোর দিন কারণ কী চর্চা করছেন তা ভাষাভেদে বদলে বা লঘু হয়ে যাওয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধে তুলে ধরা হচ্ছে এই বই। সমকালীন বাংলায় নারীবাদ সংক্রান্ত কাজের ক্ষেত্রে একটা অলিখিত নিয়ম লক্ষ করা যায়। যেকোনও বিষয়কে সোজা করে বলার বাড়তি একটা চাপ নিয়ে নিই আমরা। সহায়িকা ধরনের লেখালিখিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি আর অনাবশ্যক সরলীকরণে খাটো হয়ে যায় বিষয়বস্তু ও যুক্তিক্রমের পরিধি, অভিঘাত। অনেকসময় লেখাগুলি হয়ে ওঠে অমৌলিক, বর্ণনাধর্মী— হয় তারা বিশ্ব অ্যাকাডেমিয়ার বিদ্যমান প্রবণতাগুলি নিয়ে চর্চা করে, কিংবা প্রাক্-প্রদত্ত শর্তে লিখে রাখে মেয়েদের বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা। নারীবাদের একপ্রকার ব্যর্থতাই বাংলার পাঠক-লেখকের এমন অবমূল্যায়নের কারণ। আজও নারীবাদের কেতাবি অনুশীলন মূলত শহুরে মধ্য-উচ্চ বর্গীয়, অভিজাত, হিন্দু মহিলাদের১ কুক্ষিগত। অনেকসময় নিজেদের অজান্তেই তাঁরা নারীবাদী কল্পনা বা তত্ত্বায়নকে ইংরিজি/ইউরোপীয়/বিদেশি/বিশ্বজনীন আদলে বেঁধে রাখেন। তার ফলে নারীবাদের সমস্ত কৃতিত্বই এসে জড়ো হয় আত্মপ্রত্যয়ী ইংরিজিভাষীদের মধ্যে।২ আঞ্চলিক ভাষার অবদানকে বহাল করা হয় নিম্ন পদে। কোনও বিরল উপলক্ষে যদি তা স্বীকৃতিও পায় তবে অবধারিতভাবে অভিজ্ঞতালব্ধ স্থানীয় ইতিহাসের স্তরে; তত্ত্ব-উদ্ভাবনের স্তরে নয়।৩
ফলে পুরো ব্যাপারটা এসে দাঁড়ায় ইংরিজি-তত্ত্ব আর বাংলা-অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা বঞ্চনামূলক বিভাজনে। বাংলা-অভিজ্ঞতাকে অবিচারে ভরে ফেলা হয় বিশ্বজনীন তত্ত্বের সর্বগ্রাসী ঠোঙায়। তৈরি হয় না আঞ্চলিক তত্ত্ব। বদ্ধমূল এই বিভাজনকে ভাঙতে চাই— দেখতে চাই নারীবাদী প্রতর্কের জটিল উদ্ভাস। মনে রাখি, ইংরিজি তত্ত্ব থেকে বিযুক্ত হয়ে ‘শুদ্ধ’ দেশি তত্ত্ব উদ্ভাবনার ‘সরল’ সিদ্ধান্ত খুব-একটা সম্ভাবনাময় অ্যাকাডেমিক প্রচেষ্টা নয়। অন্ধ অনুকরণ বা অকারণ প্রয়োগ না করে বিশ্বজনীন তত্ত্বের সঙ্গে নানাভাবে মোকাবিলা করা দরকার। তর্ক করতে হলেও এসব তত্ত্ব কাঠামোগুলির সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া প্রয়োজন। চর্চার বহুমাত্রিক প্রক্রিয়াগুলি থেকেই সমৃদ্ধ হবে আঞ্চলিক বয়ান, তৈরি হবে আঞ্চলিক তত্ত্ব। কিন্তু তার পরিধি আঞ্চলিক হবে না। বিশ্বজনীন তত্ত্বের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে। তা ছাড়া শুধুমাত্র ইউরোপ/আমেরিকার তত্ত্বই প্রাধান্য বিস্তার করে না। দলিত নারীবাদীরা বারংবার ধরিয়ে দিয়েছেন ‘সম্পূর্ণ’ দেশি ব্রাহ্মণ্যবাদ/ব্রাহ্মণ্যবাদী নারীবাদ কীভাবে গ্রাস করেছে তাদের জবান। ইংরিজি-তত্ত্ব আর বাংলা-অভিজ্ঞতার যে অন্যায় বিভেদ তা ঠিক কোনও ষড়যন্ত্র নয়। সাধারণত ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থেকেই তৈরি হয় জ্ঞান। তার ভিতরেও কাজ করে উচ্চাবচ বিন্যাস। প্রাধান্যকারী জ্ঞানের উজ্জ্বলতায় ম্লান হয়ে যায় প্রান্তিক কথন— নারীবাদও যে এর বাইরে নয় এটা প্রায় একটা পরিহাস। মূলস্রোতের জ্ঞানচর্চার এই প্রবণতার কঠোর সমালোচনা করেও৪ নারীবাদীরা এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন না— ভুলে যান ভাষার আগ্রাসন গঠনগতভাবে পুরুষালি৫— বুঝতে চান না ধারণা-ভাষা-রাজনীতির মূলে বৈপ্লবিক সচেতনতা না আনলে মুক্তি অসম্ভব। ফলে ইংরিজি-তত্ত্ব আর বাংলা-অভিজ্ঞতার বৈষম্যকে শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থে বা ইংরিজি বনাম বাংলা অর্থে ধরে রাখলে চলবে না। সমস্যাটিকে কেন্দ্র-প্রান্ত অথবা বিশ্বজনীন-আঞ্চলিক প্রভেদ রাজনীতির দিক থেকে বুঝতে হবে। প্রান্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে পড়তে হবে কেন্দ্রকে আর সেই পাঠকে প্রয়োজনমতো তুলে ধরতে হবে বিশ্ব অ্যাকাডেমিয়ায়। ফলে বাংলায় নারীবাদচর্চায় বিশ্বজনীন তত্ত্বকে অস্বীকার না করে বরং তার সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়েই পথ চলেছি আমরা। স্থানীয় বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করে অন্ধ প্রয়োগ নয়, পাশ্চাত্য তত্ত্বের সঙ্গে কথা চলেছে সামনাসামনি। আরও একটা কথা, স্থানীয় নারীবাদচর্চার সামগ্রিক চিত্র পরিবেশনের দাবি নেই এ বইয়ের— আন্তঃবিষয়ক অ্যাকাডেমিয়ার ছোট একটা পরিসরে কিছু মৌলিক কাজকে একত্র করার প্রচেষ্টা কেবল। রচনাগুলিতে নানা বর্ণের আঞ্চলিক-বিশ্বজনীন ঘটনাপঞ্জিকে অকারণে নারীবাদী আন্দোলন-তরঙ্গ বা সম্পর্কিত তত্ত্বে (উদার, উগ্র, মার্কসবাদী, উত্তর-কাঠামোবাদী/আধুনিক) খোপবদ্ধ করার প্রচেষ্টা নেই। বাংলায় লেখা মানেই তা সুদূরপ্রসারী এমনও নয়। অ্যাকাডেমিয়ার বাইরে অদেখা অচেনা জগতের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নেই আমাদের।
বাহুল্য জেনেও বলি, সমকালীন প্রযুক্তি-সংস্কৃতি (ডিভাইস, সাহিত্য, কলা, সিনেমা, বিজ্ঞাপন), সচলতা (ভৌগোলিক, শ্রেণি বা জাত), বৈষম্য (শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, জাত)-এর এক অদ্ভুত, চলমান প্রতিচ্ছবি আমাদের ভাষা। আমাদের চলন-বলন, শব্দচয়নের ফারাক ভাববিনিময়ের আড়ষ্টতা তৈরি করে। একই শব্দ, বাক্যবন্ধ বহন করে ভিন্ন বার্তা। অনেকসময় অর্থ এক হলেও অমেয় অনুষঙ্গে তাৎপর্য বদলে যায়। প্রাত্যহিক কথাবার্তার একটা বড় অংশ এমনই নিষ্ফল। কখনও-সখনও এসব নিয়ে ঝগড়া অভিমান হলেও বেশিরভাগ কথোপকথনেই একটা নিরুত্তাপ, বেপরোয়া ভাব। এমন অনিবার্য দূরত্ব রোজকার জীবনে গা-সওয়া হলেও লেখাপড়া, তত্ত্বায়ন বা সক্রিয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বেদনার। তবু তা অবশ্যম্ভাবী। নারীবাদের জটিলতাকে কোনও বিশেষ কর্তৃত্বকারী ভাষা বা তত্ত্ব বা দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করতে পারে না— নারীবাদের নানা পাঠ ছড়িয়ে পড়ে নানা অনুষঙ্গে। নারীবাদ কোনও বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ নয়। লিঙ্গভেদ নিয়ে যেমন সোজাসুজি কথা বলা যায় তেমনই আপাত অপ্রাসঙ্গিক সাধারণ কোনও ঘটনার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে পৌঁছে যাওয়া যায় বৈষম্যের আকরে। সক্রিয়ভাবে বা একইসঙ্গে নাছোড়বান্দা তার্কিকের মতো আমরা অনেকেই নারীবাদী।
‘নারীবাদের নানা পাঠ’ শীর্ষক বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে দুটো মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে। এক, ভাষার (এক্ষেত্রে বাংলা) সঙ্গে নারীবাদের সম্পর্ক কী। দুই, নানা পাঠের প্রয়োজন হচ্ছে কেন। একটা রাজনৈতিক যুক্তি আর কিছু সম্ভাবনা প্রশ্ন দুটোকে একে অপরের সঙ্গে জুড়ে রাখে। একরোখা আধিপত্যের কবল থেকে মুক্ত করে নানা ভাষা, নানা পাঠ নারীবাদকে সম্ভাবনাময় বিবিধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। পাঠক খেয়াল করবেন বইয়ের অনেক প্রবন্ধই প্রত্যক্ষভাবে এ প্রশ্ন উত্থাপন করবে না। তবু লেখাগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগে ভাষা ও নারীবাদের ধারণাগত কয়েকটি দিক নিয়ে একটু বলা প্রয়োজন। নারীবাদী রাজনীতির কোন অবস্থান৬ থেকে বইটির সম্পাদনা তাও এ প্রসঙ্গে একবার বলে নিতে চাইব। লিঙ্গ-পরিচিতির ভিতরে ও বাইরে যেভাবে শ্রেণি, যৌন অভিমুখ, জাত, বর্ণ, ধর্ম ও অন্যসকল প্রান্তিক অভিজ্ঞতা এবং বীক্ষণের ভাঙা-গড়া কাজ করে যায় নারীবাদকে সেইসব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ভাবা হয়েছে এখানে।
প্রথম প্রশ্ন (ভাষার সঙ্গে নারীবাদের সম্পর্ক) ধরে কিছুটা এগোনো যাক, প্রসঙ্গত বারংবার উঠে আসবে দ্বিতীয় প্রশ্নটি (নানা পাঠের প্রয়োজন)। তবে তারও আগে মনে করে নিই প্রাধান্য বিস্তারের একটি মূল আকর হল ভাষা। লিঙ্গ (অথবা শ্রেণি, ধর্ম, জাত, বর্ণ)-ভিত্তিক কর্তৃত্ব যেমন একভাবে তৈরি হয়, তেমন টিকেও থাকে ভাষা ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। সমাজে যা ঘটছে, ঠিক যেভাবে ঘটছে তা-ই নিয়েই ভাষার নির্মাণ। দৈনন্দিন কথাবার্তা অনায়াসে সমাজের প্রভাবশালী মতাদর্শ— নীতি-নিয়ম, ঠিক-ভুলের মাপকাঠিতে বেঁধে রাখে আমাদের। ভাষাকে ‘স্বাভাবিক’ ভেবে আমরা তাকে প্রশ্নাতীত ধরে নিই। অজান্তেই বলে চলি সেইসব কথা যা বললে সমাজ ঠিক যে অবস্থানে আছে তার মধ্যেই রয়ে যাবে— বদলাবে না। রাজনীতির প্রাথমিক শর্তই তো পরিবর্তন। অথচ কথা বলা বা লেখার সময় খেয়াল করি না ভাষার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চলনে (প্রবাদপ্রবচন, ইঙ্গিত-অভিব্যক্তি, লিঙ্গভেদ, গালিগালাজ) ক্ষমতার আশ্চর্য বিন্যাস। একটা উদাহরণে ভাবনাটা আর একটু ভেঙে নিই। ভাষার খেলায় বার বার শুধু দুইয়ের বিভাজন— ভাল/মন্দ, পাশ্চাত্য/প্রাচ্য, যুক্তি/আবেগ, বিবেচক/অর্বাচীন, মানব/অবমানব, সূর্য/চন্দ্র। কালোর নিরিখে আমরা সাদাকে দেখতে চাই, বোকার বিপরীতে চালাককে চিনি, যা পুরুষালি নয় তা-ই মেয়েলি। দ্বি-বিভাজনের বাইরে অসংখ্য সম্ভাবনার কোনও আঁচ পাওয়া যায় না প্রাধান্যকারী ভাষায়।
অর্থ তৈরির অমোঘ এই প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় বৈষম্য। দ্ব্যণুক কাঠামোয় একটা দিক সবসময় দুর্বল— অনেকটা মেয়েদের৭ মতো— অকিঞ্চিৎকর। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ভাষার টান শিশ্নকেন্দ্রিক— ক্রমাগত দৃঢ় করে তোলে পুরুষের ক্ষমতার ভিত। ভাষার সমস্ত উপাদান নারীকে পুরুষের অপর রূপে সংজ্ঞায়িত করে। ভাষার উপকরণ সততই নারীবিদ্বেষী— বার বার লঙ্ঘন করে নারীর অস্তিত্ব। তবু, সে কোনও গভীর চক্রান্তকারী নয়— হয়তো কিছুটা তরল— যেদিকে বওয়াবে বয়ে যাবে সেইদিকে। ভাষাকে অন্য দিকে বইয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন নারীবাদীরা। পাশ কাটিয়ে নয়, মূলস্রোতের সঙ্গে ক্রমাগত মোকাবিলা করতে করতে এগিয়ে যাওয়া। ধাবমান, ভয়ানক জলরাশির সামনে অনেকগুলো ছোট ছোট স্রোত— মিশে যায়, ছড়িয়ে যায়, হয়তো কখনও পেরিয়েও যায়— সবসময় ঠিক ঠাহর হয় না— নিরন্তর তাদের যুদ্ধ— স্বপ্নের সন্ধান। সংগ্রাম সর্বতই স্বপ্নাশ্রয়ী। কিন্তু ভাষার বিরুদ্ধে লড়াই যেন মানচিত্রহীন এক অনন্ত ভ্রমণ— বৈষম্যবর্জিত ভাষার কোনও আদল এখনও নেই আমাদের কাছে। স্পষ্ট রূপরেখা দিতে গেলেই তা আবার এসে পড়বে চলতি ভাষার কবলে। এ এক আশ্চর্য কূটাভাস। যখনই বাস্তব ভাষায় বলতে চাইব কল্পনার কথা তখনই তা খর্ব হবে। তাহলে কীভাবে নির্দিষ্ট হবে রাজনীতির পথ? কোনও নারীবাদীরা হয়তো বলবেন রাজনীতির পথ সবসময় পূর্বনির্ধারিত হবে না, বার বার ঠেকে ঠেকে চিন্তা-কাজের মধ্যে দিয়ে পথ চলতে হবে। প্রত্যেকটি দিন গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যেকটি পদক্ষেপ রাজনৈতিক। হয়তো-বা শুধু কতগুলো মুহূর্ত, বাঁধাগতে পুরুষালি আগ্রাসনের বাইরে অন্য কোনও সম্ভাবনার ইঙ্গিত— হয়তো কবিতার, অবচেতন ইচ্ছের— কিছু আভাস যা উলটে দেয় আধিপত্যের বয়ান! হয়তো কোনও সংজ্ঞাহীন প্রলাপ, চরম সুখানুভূতি যা বার বার পরাভূত করতে চায় দুর্বহ দৈনন্দিনকে। তাহলে কি অস্পষ্ট অবচেতনেই মুক্তির আভাস? উত্তর খুঁজতে একবার ফিরে দেখা প্রয়োজন।
ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতকের প্রথমার্ধ ব্যাপী, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়, প্রথম তরঙ্গের নারীবাদী আন্দোলনের উদারনৈতিক অভিমুখ জন-পরিসরে নির্দিষ্ট কিছু সমানাধিকার স্থাপন করেছিল। তাতে বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে তারা স্থান করে নিতে পারলেও সার্বিকভাবে নারীর মর্যাদা কিছুমাত্র বৃদ্ধি পায়নি। এক দিকে চলেছে গায়ের জোরে বা প্রেমে-ভালবাসায় তার অস্তিত্বকে মা, স্ত্রী, বোন, কন্যার ছাঁচে বেঁধে ফেলার সর্বব্যাপী প্রচেষ্টা। পারিবারিক ভূমিকাকেই মুখ্য মেনে জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীকে পরিবার বিধিতেই বিচার করার প্রবণতা। অন্য দিকে অবাধ নির্যাতন, অবমাননা, যৌন ও গার্হস্থ্য হিংসার আকারে গভীর নারীবিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে সমাজের সর্বস্তরে। নারীবাদীরা বেশ বুঝতে পারছিলেন আইনানুগ সমানাধিকারের দাবি আসলে একটা প্রাথমিক ধাপ, তাতে পিতৃতন্ত্র পরাস্ত হবে না। সমানাধিকারের দাবি প্রভুত্বকারী কাঠামোকে প্রশ্ন করে না বরং তার ভিতরেই প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। ফলে, আমূল পরিবর্তন দরকার। অন্তত দুটো দিক থেকে ভাবছিলেন দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদীরা। প্রথমত, ব্যক্তি-পরিসরকে বাদ দিয়ে নারীমুক্তির কথা ভাবা সম্ভব নয়। যৌনতা, যৌন-আগ্রাসন, বিসমকাম*, মাতৃত্ব বা আকাঙ্ক্ষার মতো বিষয়গুলিকে নিয়ে আসতে হবে সতর্ক বিবেচনার আওতায়। তাঁরা বলেছিলেন যা ব্যক্তিগত তাও রাজনৈতিক। বৃহত্তর সামাজিক প্রক্রিয়ার এক-একটি ক্ষুদ্র প্রতিবিম্ব হল ব্যক্তিজীবন। ব্যক্তির নিপীড়ন প্রকৃতপক্ষে সামাজিক বৈষম্যের প্রতিফলন, আর তাই তা রাজনীতি সাপেক্ষ। দ্বিতীয়ত, র্যাডিকাল নারীবাদীরা বুঝতে পারছিলেন, অধিকারের ধারণা যদি পিতৃতান্ত্রিক বয়ানে আটকা পড়ে বা খাটো হয়ে যায় তবে সমানাধিকার নিশ্চিতভাবে পুরুষের আদলেই তৈরি করবে নারীকে। সরাসরি বর্জিত না হয়ে এবার সে অন্তর্ভুক্ত হবে, কথা বলবে পুরুষের ভাষায়। অধরা থেকে যাবে তার নিজের ভুবন, তার অন্তরঙ্গ আলাপ। এ লেখায় প্রথম তরঙ্গ নিয়ে প্রত্যক্ষ আলোচনার সুযোগ কম। দ্বিতীয় তরঙ্গ ধরেই ভাষার প্রশ্নে ফিরব।
প্রধান প্রবাহের বাইরে যদি নারীর কোনও স্বতন্ত্র জগৎ থাকে তবে তা নারী-পুরুষ অভিন্নতার আদলে বোঝা যাবে না। স্ত্রী আর পুরুষের পার্থক্যগুলো চিহ্নিত করতে হবে (পার্থক্য মানেই বিভেদ নয়)। শনাক্ত করতে হবে নারীর নিজস্ব স্বর। কিন্তু কীভাবে শুনব সেসব উচ্চারণ? কীভাবে পৌঁছোব নারীর বিশিষ্টতায়?
সরাসরি? খুঁড়ে বার করব অশ্রুত আখ্যান? কীভাবে পড়ব? পড়া মানেই তো এক ধরনের রূপান্তর যা অশ্রুতপূর্বকে নিয়ে আসে শোনার আওতায়— পরিচিত ভাষ্যের আচ্ছাদনে। মূলস্রোত কি তাহলে ভিন্ন ভিন্ন স্বরকে বোধগম্য করে তোলার একটা ভিত্তি নয়? নিশ্চয়ই, মূলস্রোত সর্বকর্তৃত্বময়, তার প্রভাবেই ভিন্ন স্বরের মানে তৈরি হয় আর তারা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যে কথা কক্ষনো শোনা যায়নি তাকে শোনা-কথার শর্তে বুঝে নিতে হয়। যেসব ধারণাকে চলতি ছকে ফেলা যায় না, তা অধরাই থেকে যায়। এই প্রক্রিয়া অনিবার্যভাবে অসম। ফলে, পড়তে গেলেই সংকুচিত হয়ে যায় নারীর (একই যুক্তিতে সব নিম্নবর্গীয় মানুষের) আখ্যান। তাহলে কি প্রান্তিক স্বর চাপাই পড়ে থাকবে চিরকাল? কেন? এ আশঙ্কার উলটো পিঠে আরও এক উদ্বেগ! সংক্রমণহীন মেয়েলি স্বর কি আদৌ থাকা সম্ভব? অবিমিশ্রিত নারীজগৎ বলে কিছু আছে ধরে নিলে কি নিজেদেরই ঠকানো হবে না? অপাপবিদ্ধ নারীসত্তার রোম্যান্টিকতায় আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, চিন্তাভাবনার গভীর গোপনে লুকিয়ে-থাকা পিতৃতন্ত্রের চিহ্নগুলি মুছে যেতে পারে। মেয়েদের কথা মানে স্বভাবতই তা কর্তৃত্বকারী বয়ানের বাইরে এমনটা নয়। সামাজিক ক্ষমতা অর্জন করতে নারীরাও প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছে মূলস্রোতের অংশীদার হবার। তাহলে বিফল অনুলাপে সময় নষ্ট করছি কেন? একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে কথাগুলো নিছক পুনরাবৃত্তি নয়। আসলে অনেকগুলো পরস্পরবিরোধী ঘটনা একসঙ্গে কাজ করছে বলে একটু জটিল দেখাচ্ছে ব্যাপারটা। ধাপে ধাপে আবার ভাবতে শুরু করি—
এক, পিতৃতন্ত্র/পুংবাদ/নারীবিদ্বেষ সমাজের সব ক’টি স্তরে (চিহ্ন-সংস্কৃতি, ক্ষমতা-রাজনীতি, আকাঙ্ক্ষা-মনন, মালিকানা-অর্থনীতি, প্রতিনিধিত্ব-প্রতিষ্ঠান) নানা অছিলায় অনন্তকাল পরাধীন করে রাখতে চাইছে নারীকে। তাকে ভাবা হচ্ছে পুরুষের অস্বীকারমূলক আদলে অর্থাৎ যা পুরুষ নয় তাই হল নারী। অন্যথায় বলা হচ্ছে নারী পুরুষের অনুরূপ বা অনুপূরক। কিংবা ‘প্রহেলিকাময়’ নারীজগৎকে অবোধ্য আখ্যা দিয়ে পুরুষের রাজ্যপাট থেকে একেবারে বাদ দেওয়া হচ্ছে। ধারণাগতভাবে আলাদা করা হলেও অবস্থানগুলি নানান সামাজিক ক্ষেত্রে একইসঙ্গে কাজ করে। এই তিনটি যুগপৎ অবস্থানের মধ্যে একটা সাদৃশ্য আছে। তিনটি পরিস্থিতিতেই— নিকৃষ্টতা (মেয়েদের না-সূচক সংজ্ঞার ভিত্তিতে), অন্তর্ভুক্তি (নারী-পুরুষ অভিন্নতার ভিত্তিতে), বহিষ্কার (নারী-পুরুষের অতুল্য পরিমাণ ভিন্নতার ভিত্তিতে)— নারীকে পুরুষেরই সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে— তাকে স্থাপন করা হচ্ছে পুরুষের অপর রূপে।
দুই, এখানে পিতৃতন্ত্র কাজ করছে একটি সার্বজনীন মতাদর্শ-প্রতিষ্ঠান হিসেবে। লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই, জেনে বা না-জেনে, এর আওতাভুক্ত। সমাজে বৈধ প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সর্ববিদিত বিধিনিয়ম মেনে চলতে হবে। শ্রবণযোগ্য হতে হলে কথা বলতে হবে সবার মতো করে।
তিন, সার্বজনীন মানে আসলে মানবিক (মনুষ্যত্বপূর্ণ নয় মনুষ্যসুলভ)। ‘মানুষ’ আপাতভাবে একটা নিরপেক্ষ নামপদ হলেও প্রকৃতপক্ষে পুরুষধর্মী। মানবিক গুণাবলি পুরুষের গুণেরই সমাহার, নারী যেন তার মূর্তিময়ী স্খলন, যা বারংবার প্রতিফলিত হয় দ্বিমূল চিহ্ন-কাঠামোয়। ফলে সর্ব ক্ষেত্রেই সঠিক এবং প্রধান ভূমিকা পালন করে পুরুষ।
চার, স্খলিত নারীর (বা পুরুষেরও) জায়গা নেই সমাজে। জন-পরিসরে স্থানমর্যাদা পেতে হলে তাকে মানবিক গুণসম্পন্ন হতে হয়। খোয়াতে হয় নিজস্বতা, দমন করতে হয় বাঁধনবিহীন ইচ্ছে।
পাঁচ, স্বতন্ত্র আকাঙ্ক্ষার কোনও মূর্ত প্রতিচ্ছবি হয়তো হয় না কারণ প্রকাশ সর্বতই ভাষানির্ভর। নারীর (বা অন্য প্রান্তিক অস্তিত্বের) নিজস্বতা প্রকাশের জন্য পৃথক কোনও ভাষা নেই। যে ভাব/ভাষাকে নিজের ভেবে আঁকড়ে ধরছি তারই গোপন, অলক্ষ উপশিরায় পুরুষালি টান— আবার নিয়ন্ত্রণ, আবার ঢুকে পড়ছি চক্র/বক্র ব্যূহে— বুঝতে পারিনি হয়তো কখনওই এর বাইরে ছিলাম না।
ছয়, দমন বা নিপীড়ন সবসময় সোজাসুজি বা বাহ্যিক হয় না। অনেক সূক্ষ্ম, পরোক্ষ তার চালচলন— অনেকসময় কাজ করে চলে ভিতরে ভিতরে। নিজের মতাদর্শে ঘাপটি মেরে থাকা পুরুষতান্ত্রিকতা— আটকে রাখি নিজেকে। মেয়েদের কথা মানেই ‘অন্য’ কথা নয়। সজাগ না থাকলে ধরে নেওয়া বা লুকিয়ে থাকা পুরুষ স্বরের অনড় অস্তিত্ব টের পাওয়া অসম্ভব।
সাত, সচেতনতা নারীর অন্য স্বর বা বৈশিষ্ট্যকে চিনতেও সাহায্য করে। নিজের এবং সমাজের কঠোর অবদমনের আনাচেকানাচে বা চেনা জগতের বাইরে অনভিপ্রেত কোনও কোনও মুহূর্ত হয়ে ওঠে নারীর— সে আঘাত করে পুরুষের ভাষ্যে, হয়ে উঠতে চায় লঙ্ঘনের প্রতীক। নারীর মতো অন্যান্য প্রান্তিক মানুষও দমনের বাইরে অন্য ভুবনের খোঁজ করেন। তখন তাঁরাও হয়ে উঠতে পারেন নারীসুলভ। এক্ষেত্রে নারীসুলভ মানে দ্বৈত কাঠামোয় পুরুষের ক্ষমতাহীন অপরের মতো হয়ে ওঠা নয়। উত্তর-কাঠামোবাদী/উত্তর-আধুনিক নারীবাদীরা (র্যাডিক্যাল নারীবাদের একটি অভিমুখ) ‘নারীর’ নিজস্ব স্বর খুঁজতে খুঁজতে তাকে চিনতে চেয়েছেন পিতৃতান্ত্রিক বয়ানের উচ্ছেদকারী রূপে। ভাষা ব্যবস্থার দমনমূলক নিয়মকে অগ্রাহ্য করে মেয়েলি ভাষা আমূল বদলে দিতে পারে চিহ্ন-তত্ত্বের প্রতিটি শর্ত।
আট, নারীর বিশিষ্টতা বা প্রাধান্যবিস্তারী ভাষাকে উলটে দেওয়ার ইচ্ছে৮ কোনওটাই একরৈখিক স্তর পরম্পরায় প্রগতিশীল নয়। অবদমিত অজানার হাত ধরে এ যেন এক অবিশ্রান্ত, দ্বিধাগ্রস্ত, এদিক-ওদিক আগু-পিছু ভ্রমণ।
নানা ধরনের নারীবাদের মধ্যে একটু একটু করে উঠে এসেছে নানা ধরনের কথা। উদারপন্থী সাম্যের দাবি থেকে র্যাডিক্যাল নারীবাদের ভিন্নতার দিকে যাওয়ায়, অগোচরে কাজ করে গেছে এক ধরনের সারসত্তাবাদ। বিশিষ্টতাকেই যেন স্থাপিত করা হয়েছে মর্মমূলে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করে উত্তর-কাঠামোবাদীরা অনেকটা দূর অবধি নারীর ভিন্নতা বা বিশিষ্টতার জটিলতাকে ধরে রাখতে চাইছেন। নারীর বিশিষ্টতার কথা ভাবতে গিয়ে উত্তর-কাঠামোবাদীরা ভাষা ও মনঃসমীক্ষণের প্রতিচ্ছায়ায় এক ধরনের সম্ভাবনা লক্ষ করেছিলেন। সচেতন চিন্তার নিরিখে অবচেতনকে সম্পূর্ণ বোঝা যায় না অথচ সচেতনে আমরা যা-কিছু করি তার ওপর অবরুদ্ধ অবচেতনের একটা লঙ্ঘনকারী প্রভাব থাকে। ভাষার মধ্যে এসবের ছাপ লক্ষ করা যায়। ফরাসি নারীবাদী জুলিয়া ক্রিস্তেভা৯ মেয়েদের লেখায় এক ধরনের অতিক্রমণের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন। মেয়েদের লেখা মানে শুধু রক্ত-মাংসের মেয়ের লেখা নয়। যেকোনও লেখা, পুরুষের বা নারী-পুরুষের বাইরে কারুর, যা ব্যাহত করবে প্রভাবশালী বয়ান তা-ই মেয়েদের। নারী এখানে লঙ্ঘনের এক সচল প্রতিমূর্তি। ক্রিস্তেভা অর্থনির্মাণ প্রক্রিয়ার দুটো সম্পর্কযুক্ত উপাদানের কথা উল্লেখ করেছিলেন— সিম্বলিক ও সিমিওটিক। সরল করে বলতে গেলে সিম্বলিক হল পিতার নিষেধাজ্ঞার মতো প্রাধান্যকারী— চিহ্নকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাকরণের আদলে। অন্য দিকে সিমিওটিক ভাষার মধ্যে নিয়ে আসে অবাধ্য উদ্দীপনা, অবরুদ্ধ করে মানে তৈরির পথ। চলতি ভাষার বিপরীতধর্মী দু’টি কাজ (সচেতন গঠন-নিয়ন্ত্রণ ও অবচেতন আঘাত-উৎপাটন) সিম্বলিক ও সিমিওটিকের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে একইসঙ্গে। ক্রিস্তেভা সিম্বলিককে ব্যাহত করার কিছু ঝলক দেখেছিলেন আভাঁ-গার্দ পুরুষ কবিদের লেখায়। কবিতার ছন্দময় ধারা যেন জঠরসমুদ্রের গভীর দোলাচল— মাতৃস্তন্যের স্বছন্দগতি। নির্ধারিত কাঠামোর বাইরে কবিতা যেন সিমিওটিকের আহ্বান। অবচেতন উদ্যমে সিমিওটিক এক পূর্ববর্তী অবস্থা যা সামাজিক নিয়মের বাইরে— কর্তৃত্বকারী ভাষা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে না, তাই তা নারীসুলভ। তা যেন মায়ের শরীর থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত নয়— যে-বিযুক্তি জাক লাকাঁ-র তত্ত্বকাঠামোয় অর্থনির্মাণের প্রধান শর্ত। লাকাঁ সিম্বলিককে স্থাপন করছেন ভাষার মূল সত্য রূপে যা নির্দেশ করছে পিতার শাসনই বিধি। মায়ের শরীরের আদিম টান ছিন্ন করে বিধি-নিষেধ মানুষকে বয়ে আনে সামাজিকতার আলোয়। একার্থক পিতৃপ্রধান লাকানীয় তত্ত্বকে অস্বীকার করে ক্রিস্তেভা ভাষাকে উন্মুক্ত করে দিলেন— শুনতে চাইলেন অবচেতনের বহুস্বর। এক দিকে তিনি মাতৃ-দেহের সঙ্গে মৌলিক যোগকে কর্তৃত্বকারী সংস্কৃতি ব্যাহত করার কবিতাময় মুহূর্ত রূপে চিহ্নিত করলেন। আবার একইসঙ্গে মনে রাখলেন তার অসংলগ্ন ক্ষণকালীন প্রভাব— চেতনা কাঠামোয় অবচেতনকে সম্পূর্ণ/সংগতিপূর্ণ রূপে ধারণ করার যৌক্তিক অসম্ভাব্যতা— মায়ের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকার উন্মত্ত পরিণাম। যে মায়ের টান ছিঁড়ে বেরোতে পারে না সে বিকারগ্রস্ত— তার প্রলাপ অর্থগঠনের পথ অবরোধ করে দেয়।
ফলে সিম্বলিক ও সিমিওটিক খাপে খাপে বসে যায় আমাদের চেনা যুগ্ম ছাঁচে: চেতনা-অবচেতন, সংস্কৃতি-প্রকৃতি, প্রকৃতিস্থ-অপ্রকৃতিস্থ, পিতা-মাতা। জুডিথ বাটলার তাঁর ১৯৯৩ সালে লেখা ‘দ্য বডিপলিটিক্স্ অফ জুলিয়া ক্রিস্তেভা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লক্ষ করলেন, তিনি ঠিক যে পিতৃ-বিধিকে লঙ্ঘন করতে চাইছেন আদপে ক্রিস্তেভার তত্ত্ব তারই স্থায়িত্ব ও পুনরুৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। ‘Her theory appears to depend upon the stability and reproduction of precisely the paternal law that she sought to displace.’১০ যেভাবে ক্রিস্তেভা সংস্কৃতির সব ছাপ অস্বীকার করে মায়ের শরীরকে প্রকৃতির সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন, স্থাপন করছেন অতিবাস্তবতায় তা খুবই সমস্যার। যখনই বলছেন মাতৃত্বের আদি অকৃত্রিম আকর্ষণে সংস্কৃতির মধ্যস্থতা নেই, জড়িয়ে পড়ছেন পিতৃতন্ত্রের ফাঁদে। অখণ্ড নারী-প্রকৃতিকে বার বার জুড়ে দেওয়া হয়েছে প্রজননের সঙ্গে। নারীর প্রধান কাজ মা হওয়া— সে সংস্কৃতির অংশ নয়। সংস্কৃতি পুরুষের কর্মক্ষেত্র, চিহ্ন ও প্রযুক্তির সাহায্যে, প্রকৃতিকে পরাভূত করে তার নির্মাণ আর নিয়ন্ত্রণ।
কথা শুরু হয়েছিল নারীবাদ আর ভাষার সম্পর্ক নিয়ে। নারীর বিশিষ্টতা, ভিন্ন ভাষার প্রশ্ন উঠে এসেছিল প্রসঙ্গক্রমে। অনেকগুলো কথার পর আমরা কি ফিরে এলাম পুরনো প্রতিপাদ্যে— ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কি আবার বললাম— ভাষা শিশ্নকেন্দ্রিক, মুক্তির পথ নেই? না তা নয়। ক্রিস্তেভার তাত্ত্বিক আলোচনা থেকে উঠে আসবে কিছু সম্ভাবনা। তিনি যা বলছেন যদি তা আক্ষরিক অর্থে না ধরে এক ধরনের কৌশল হিসেবে বুঝতে চেষ্টা করি তাহলে নারীবাদী রাজনীতিতে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যদি ভাবি গল্প বা রূপকের সাহায্যে ক্রিস্তেভা একটি কল্পস্বর্গের প্রস্তাবনা করছেন, বলতে চাইছেন দুর্জ্ঞেয় অগোচরের কথা, তাহলে সমসাময়িক নারীবাদী আলোচনায় কল্পনার যে কী মর্মান্তিক প্রয়োজন তা কিছুটা বোঝা যেতে পারে। সংগত কারণেই হয়তো আমরা নারীবাদীরা অনেকসময় খুব তাড়ায় থাকি। অবিলম্বে কিছু জ্বলন্ত সমস্যা মিটিয়ে নেওয়ার তাগিদে বিশদ চিন্তাভাবনা না করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই। পরিণামে সাময়িকভাবে সমস্যা কিছুটা মিটলেও মূল জটিলতার সুরাহা হয় না। পিতৃতন্ত্রকে কি সবসময় দৃশ্যমান প্রতিবন্ধকতা রূপে চেনা সম্ভব? কর্মসূচি দিয়ে কি মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়? নারীবাদ, শুধুই একের পর এক কাজের পরিকল্পনা নয়, একটা চিন্তার অবকাশও বটে। এমন চিন্তা যা অনাবিষ্কৃতকে, যা নেই তাকে, আহ্বান করতে পারে। শ্রেণি, রাষ্ট্র, জাত, ধর্ম, পরিবারের অসহ প্রকল্প পেরিয়ে যে পরিত্রাণ— কল্পনাই তার পথপ্রদর্শক। কল্পনার আশ্রয় ছাড়া যা নেই তার দিকে এগোব কেমন করে? যেভাবে ভাষায় সংস্কৃতিতে নিহিত রয়েছে পিতৃতন্ত্র, ভাবনার অবকাশ ছাড়া তার থেকে মুক্তি নেই। ধারণাগত বা মতাদর্শগত পরিবর্তনের জন্য কল্পস্বর্গ হয়তো একটা প্রাথমিক, যৌক্তিক প্রয়োজনীয়তা। মেয়েদের কথা/লেখা যাকে ক্রিস্তেভা মনে করছেন পুরুষালি ভাষার আগ্রাসনের বাইরে যেন তেমনই এক কল্পস্বর্গের আভাস— কান পেতে শুনতে চাইছেন তাকে— খুঁজছেন কবিতায়, রূপকে, অবচেতনে।
একটা প্রশ্ন ফিরে আসছে বার বার— এ কবিতা/কথা কার? কার কথা শুনব? কার কথা শুনতে পাওয়া যায়? একটা সহজ নিদর্শন দিই। ‘ওদের’ নিয়ে কাজ করার অব্যর্থ টানে আমরা উচ্চবর্গীয় গবেষকরা ঝাড়খণ্ডের একটি প্রত্যন্ত জেলায় উপস্থিত হই। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ছাড়াও আমাদের হাতে থাকে একটা স্ট্রাকচার্ড ইন্টারভিউ-স্কেডিউল বা বাছাই-করা উত্তর-সহ একটি প্রশ্নমালা যা সামনে রেখে মহিলাদের কাছে জানতে চাই তাঁদের জীবনযাত্রার মান। গ্রামের এক প্রত্যন্ত কোনায় যে দলিত মেয়েটি ছবি এঁকেছে তার মাটির দেওয়ালে, পুরনো খাতায় লিখে রেখেছে যেসব কথা তা কি দেখতে পাই? পড়তে পারি? এতক্ষণ যেসব আলোচনা চলছিল তা হয়তো এই ধরনের গবেষণা (প্রচলিত, প্রভাবশালী) বা তার জ্ঞানের লক্ষ্যবস্তু (এক্ষেত্রে দলিত মহিলা) কারও কাছেই পৌঁছোবে না। গবেষক হিসেবে এসব কথার সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হলেও হয়তো এলিটিস্ট বলে উড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। হয়তো বলা হবে ফরাসি নারীবাদী তত্ত্বের কচকচানিতে তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তস্থ মানুষের অভিজ্ঞতা ধরা পড়ে না! ঠিকই। কিন্তু এই চাওয়াটাই কি ভুল নয়? কেন হঠাৎ একটা নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক বয়ানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে প্রান্তস্থ অভিজ্ঞতা? তত্ত্ব নিয়ে আরও দু’-একটা কথা বলে নিতে চাই। ক্ষমতা-প্রতিষ্ঠানের ঘেরাটোপের মধ্যেই ঘনীভূত হয় তত্ত্ব— নিজের থেকে বা স্বাভাবিকভাবে নয়— তাই তার গতিপথও বদলানো সম্ভব। জ্ঞানের ইতিহাসে বার বার প্রমাণিত হয়েছে তত্ত্বের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সম্ভাবনা। প্রাধান্যকারী তত্ত্বের ভিতর থেকেই তাকে প্রতিহত করা হয়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়া হয় নানা মাত্রায় নানা স্থানে। অন্য পরিস্থিতিতে পরিবর্তিত তত্ত্ব তৈরি করে কর্তৃত্বের অন্য কোনও স্তর— আবার ভাঙা পড়ে তা, তৈরি হয় আবার। নিরন্তর ভাঙা-গড়ার খেলায় জ্ঞান আসলে একটি সচল প্রক্রিয়া। তত্ত্ব বাধ্যতামূলক নয়, তার নিয়ন্ত্রণও বাহ্যিক নয়— আমাদের কাজের মধ্যে দিয়ে তা সম্পাদিত, উপস্থাপিত হয়। একভাবে তা আমাদের তৈরি করে, দেখতে শেখায়, শেখায় শেখানো পাঠ লঙ্ঘন করতেও। তত্ত্বচর্চার মধ্যেই থাকে তাকে পেরিয়ে যাওয়ার শর্ত। পাশ্চাত্য তত্ত্বকে সোজাসুজি প্রয়োগের নিরিখে না ভেবে একটা বৃহত্তর জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরের মধ্যে থেকে দেখতে চাইছি। সেখানে নিজেদের কথা বলে ওঠার মুহূর্ত খুঁজছি আমরা। উত্তর-কাঠামোবাদী নারীবাদী তত্ত্ব— তার সমস্ত ভুলত্রুটি, ইউরোকেন্দ্রিকতা নিয়েও— স্পষ্ট করে দিয়েছে যে নারীবাদ এক নয়, অনেক। উদার, উগ্র, মার্কসবাদী মহান-আখ্যান পেরিয়ে অসংখ্য নারীবাদ শুনতে চাইছে নারীর অগণিত স্বর। কারণ নারীও যে এক নয়। শুধুমাত্র নারী হওয়ার জন্য নানা শ্রেণি, ধর্ম, জাত, বর্ণ নির্বিশেষে মেয়েদের অভিজ্ঞতার মিল যেমন আছে তেমনই তার মধ্যেও আছে বৈষম্য আর ক্ষমতার লড়াই। গরিব নারী, দলিত নারী, অশিক্ষিত নারী, ক্যুইয়ার নারী, তৃতীয় বিশ্বের নারী, অ-শ্বেতাঙ্গ নারী বা মুসলমান নারীর স্বার্থ এক নয়। উচ্চবর্গীয় নারীরাই অনেক ক্ষেত্রে নারীবাদের হাল ধরেছেন, তাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠ অবরুদ্ধ করেছে পিছিয়ে-পড়া মেয়েদের কথা। সবার হয়ে বলতে চেয়েও প্রবল হয়ে উঠেছে উচ্চশ্রেণির বয়ান। বার বার নানা প্রান্তিক পরিস্থিতি থেকে উঠে এসেছে বিরোধী মতধারা— নানা মাত্রায় সমৃদ্ধ হয়েছে নারীবাদ। তাই, নারীবাদের নানা পাঠ।
নারীবাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখাগুলির মধ্যে লক্ষ করা গেল মূল চারটি অভিমুখ। তারই আদলে চারটি অংশে বিভক্ত হল বইটি— ১) তত্ত্ব ও ধারণার রাজনীতি; ২) পরিচিতির রাজনীতি; ৩) উপস্থাপনের রাজনীতি; ৪) অনুভূতির রাজনীতি। রাজনীতি এখানে একটা বিস্তৃত ক্ষেত্র— বৈষম্য ও উচ্চাবচ বিন্যাসের বিভিন্ন ধরনকে চিহ্নিত করার প্রয়াস এবং তাকে পেরিয়ে যাবার পরিকল্পনা। প্রথম পর্যায়ের আলোচ্য বিষয় নারীবাদী ধারণা ও তত্ত্ব। পরিচিতি, অনুভূতি, ও উপস্থাপনের নানান দিক থেকে অভিজ্ঞতা ও তত্ত্বের সঞ্চার লেখাগুলিতে। ভূমিকার একটা বড় অংশ জুড়ে নারীবাদী তত্ত্ব নিয়ে বিশদ আলোচনায় উপনীত হয়েছি নানা পাঠের ব্যঞ্জনায়। তার খেই ধরেই পরিচয় করিয়ে দেব চারটি লেখার সঙ্গে। অনির্বাণ দাশের লেখা ‘নারীবাদের নানা কথা: ডিসিপ্লিনের ঘেরাটোপ আর লঙ্ঘনের রাজনীতি’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে লেখক দেখতে চেয়েছেন কীভাবে ঘেরাটোপ এবং লঙ্ঘন এই দু’টি ধারণার পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে কাজ করে নারীবাদী তত্ত্ব ও চর্চার পরিসর। পুনরাবৃত্তির যে ভিত্তিতে তৈরি হতে থাকে ঘেরাটোপ তারই ভিতরে লঙ্ঘনের সম্ভাবনা। প্রত্যেকটি পুনরুক্তি আগে-পরের সব উচ্চারণ থেকে আলাদা— লঙ্ঘন তাই প্রতিনিয়ত। জাক দেরিদার তত্ত্বসূত্রে লেখক পাঠ করেছেন রাসসুন্দরী দেবীর আত্মজীবনী— প্রত্যেক দিন বেঁচে থাকার ভিতর নিঃশব্দ অথচ অপার লঙ্ঘনের মুহূর্তগুলো। পরবর্তী প্রবন্ধে শেফালী মৈত্র ‘নারীবাদী গবেষণা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিশ্বজনীন গবেষণা পদ্ধতিতে তৈরি হয় জ্ঞান, এবং পদ্ধতির বস্তুনিষ্ঠতার জোরেই তা মান্যতা পায়। পদ্ধতিবিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্বের জটিল রাজনীতির মধ্যে দিয়ে বার বার প্রতিষ্ঠিত হয় পিতৃতন্ত্র। নারীবাদীচর্চার চারটি ধাপের সূত্র ধরে লেখাটিতে উঠে আসে গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন। মেরুকরণের বিরুদ্ধে, দ্বিকোটিক বা সমরূপী চর্চার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে একাধিক আঞ্চলিক স্বর। ‘লিঙ্গ-পরিচিতির রাজনীতির দিকে: (অ)পরতার একটি পাঠ’ পেশ করেছেন দেবরাজ দাশগুপ্ত। এক দিকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও কমলকুমার মজুমদার, অন্য দিকে এভলিন ফক্স কেলার এবং জুডিথ বাটলারের ঘনিষ্ঠ পাঠ— আর তার ভিতর থেকে দেহ, প্রকৃতি, লিঙ্গ, বিজ্ঞানের মতো সন্দর্ভগুলির পূর্বাপর সংগতি ভেঙেচুরে এগিয়েছে লেখাটি। মেলে ধরেছে অনেকগুলি প্রশ্ন, লিঙ্গ রাজনীতির অ-সম্ভাব্যতা। সন্মিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘পাশ্চাত্য চিন্তন, নারীবাদী দর্শন ও (বস্তু)শরীর ভাবনার ক্রমবিবর্তন: একটি স-তর্ক পর্যালোচনা’ প্রবন্ধটি দিয়ে শেষ হয়েছে এই অংশটি। মূলত জুডিথ বাটলারের তত্ত্বের অনুসরণ-সমালোচনায় লেখাটি পড়তে চেয়েছে বস্তুশরীরের তৈরি হওয়ার আখ্যান। চেতনা বয়ানের মধ্যস্থতায় তৈরি হওয়া বস্তুশরীর সততই অসম্পূর্ণ তবু তার ভিতরেও রয়ে যায় বস্তু আর আদর্শরূপের দ্বৈতভেদ। আবার আরও একটি অ-সম্ভাব্যতার মুখোমুখি হই আমরা।
পরিচিতির রাজনীতি নিয়ে কথা হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে। দ্বিবিভাজিত সমাজ-ভাষা কাঠামোয় পুরুষের অক্ষম অপর রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নারীর পরিচিতি। ইতিমধ্যে, সাধারণ ধারণার আঙ্গিকে, এ বিষয়ে কিছুটা আলোচনাও করেছি আমরা। এবার ভারতের দিকে নজর ফেরানো। সমগ্র পৃথিবীর মতো ভারতে বাসরত মহিলারা দেখতে পেলেন যে রাজনৈতিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানে পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে আছেন তাঁরা। বারংবার হিংসা অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। অন্যায্য, অসহনীয় এই অবস্থার বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে সংগঠিত হল আন্দোলন— ধরে নেওয়া হল জাত, ধর্ম, শ্রেণি, বর্ণের ঊর্ধ্বে মহিলাদের কেবল মহিলা হিসেবেই একটি ‘সম্মিলিত পরিচিতি’ আছে। দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিবাদ-আপস অনুপ্রেরণা–প্রতিবন্ধকতা, অর্জন–ব্যর্থতার বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এক আশ্চর্য পরিস্থিতি তৈরি হল। নারীবাদীরা বুঝতে পারলেন ভিন্নতা নির্বিশেষে অবমাননা আর বিদ্বেষের সম-অভিজ্ঞতার বুনিয়াদ প্রায় আটের দশক অবধি ভারতীয় মহিলাদের যতটা ঐক্যবদ্ধ রেখেছিল বলে তাঁরা ভেবেছিলেন, তা শিথিল হয়ে আসছে। লক্ষ করা গেল আদপে উচ্চবর্গীয়, সুস্থ, হিন্দু, বিসমকামী, শহুরে মহিলারাই আন্দোলনের পথিকৃৎ। ভারতের সমস্ত মহিলার প্রতিনিধিত্ব করার অসম্ভব পরিকল্পনা নারীবাদী আন্দোলনকে প্রাধান্যকারী করে তুলেছে— বাদ পড়ে যাচ্ছে প্রান্তিক পরিচিতি ও অভিজ্ঞতা। নয়ের দশক জুড়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসতে থাকল দলিত, মুসলমান, জনজাতি, সমকামী বা ভিন্ন যৌন অভিমুখী নারীবাদের নানা স্বর। তার মাত্র দু’টি দিক নিয়েই বিশদে কথা বলার সুযোগ রইল এখানে।
এ অংশে তিনটি লেখা। ‘নারীবিদ্যাচর্চা ও নারীবাদী আন্দোলন’ শীর্ষক প্রথম লেখায় মল্লারিকা সিংহ রায় মানবীবিদ্যার সঙ্গে নারীমুক্তি আন্দোলনের সম্পর্ক ও তার ইতিহাস-বাস্তবতা-ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন। কেতাবি বিদ্যা ও সক্রিয় রাজনীতি দুইয়ের মধ্যে একইসঙ্গে বিরোধ ও ধারাবাহিকতা। মানবীবিদ্যাচর্চার মধ্যে থেকেই নারী আন্দোলনের পর্যালোচনা হয়েছে; লেখা হয়েছে তার ইতিহাস; যৌনতা, যৌন অভিমুখ, ক্যুইয়ার ধারণাগুলির স্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। নারীবাদ ও নারী আন্দোলন উভয়ের মধ্যেই ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ভিন্ন স্বর বা নানা মতের সহাবস্থান। ভারতের নারী-পরিচিতিভিত্তিক আন্দোলন নিয়ে বলতে গিয়ে প্রবন্ধটি একটা বৃহত্তর প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। সেই প্রেক্ষাপটেই অন্যান্য পরিচিতিনির্ভর আন্দোলনগুলিও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। একভাবে প্রবন্ধটি পরের লেখা দু’টির— ঈপ্সিতা হালদারের ‘ছাইচাপা আগুন: লিঙ্গ-যৌনতার প্রশ্নে কলকাতার ক্যুইয়ার আন্দোলন (দু’-চার কথা)’ আর তনুশ্রী কুন্ডুর ‘বহুমাত্রিক হিজড়া পরিচিতি: একটি নারীবাদী পাঠ’— পথ সুগম করে দেয়। ঈপ্সিতার লেখায় মূল দু’টি দিক। এক দিকে ভারতের নারী আন্দোলন ও নারীবাদের সঙ্গে ফায়ার চলচ্চিত্রের সূত্র ধরে উঠে আসা নারীর সমকামনার টানা-পোড়েন। আর অন্য দিকে ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ নামক মঞ্চটির, নানা জটিলতার ভিতর দিয়ে, ক্যুইয়ার আন্দোলনের পথে এগিয়ে যাওয়ার একটি বিশদ বিবরণ। প্রবন্ধের এই দু’টি অংশকে জুড়ে রেখেছে একটা মূল প্রশ্ন— নারীর সম-প্রেম তথা ক্যুইয়ার রাজনীতি কি পেরিয়ে যেতে পারবে বিসমকামী প্রজনন প্রথা? তনুশ্রীর রচনাটিতে উঠে এসেছে হিজড়াদের ‘নিজস্ব’ আখ্যান— তাদের সামাজিক পরিচিতি গড়ে ওঠার জট পাকানো প্রক্রিয়াগুলি। হিজড়া কারা? তাদের কি তৃতীয়-লিঙ্গ নামক বৃহত্তর ছাতার মধ্যে ধরে ফেলা যাবে? আগ্রাসী পিতৃতন্ত্র আর নারী-পুরুষ বিভাজনের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করবে তারা?
নারীবাদের নানা পাঠের ভিতর দিয়ে, তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনা উপস্থাপনের রাজনীতি নিয়ে। পরিচিতির রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি যুক্ত হয়ে আছে উপস্থাপনা। পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ কিছু বিশেষ গুণের আধারে নারীর পরিচিতিকে বেঁধে ফেলতে চায় আর তারই নিরিখে নির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করে তাকে। একই আদর্শে উপস্থাপিত হতে হতে তৈরি হয় বাঁধাগৎ— বার বার নারী উপস্থাপিত হয় পুরুষের সাপেক্ষে। স্বভাবসুলভ পৌরুষের বিপরীতে সে কখনও পরাশ্রয়ী, সহজবশ্য, অপরিণত আবার কখনও মনন-বিমুখ, শরীরী, ক্ষুদ্র। উপস্থাপনার প্রক্রিয়ায় সরাসরি একটা সৌধ বা বেদির মতো করে কোনও কিছুকে স্থাপন করা যায় না। এই প্রসঙ্গে ‘উপ’ উপসর্গটির দু’টি অভিধানগত অর্থ উল্লেখযোগ্য— সামীপ্য ও সাদৃশ্যহীনতা। আপাতভাবে শব্দ দু’টি বিপরীতার্থক হলেও উপস্থাপনের কাঠামোয় এই বৈপরীত্য সম্পর্কযুক্ত— নিকটবর্তী বলেই তা সাদৃশ্যহীন। উপস্থাপন মানে সামীপ্যে স্থাপন— যা ঠিক যেভাবে আছে সেভাবে নয়, তার মতো করে কাছাকাছি স্থাপন। এই সাদৃশ্যহীনতার কারণ সরাসরি স্থাপনের যৌক্তিক অসম্ভাব্যতা। ভাষা-মতাদর্শের মধ্যস্থতা ছাড়া কীভাবে কোনও কিছুকে বর্ণনা বা চিত্রিত করা যাবে? উপস্থিত করা যাবে সমাজচেতনায়? আর মধ্যস্থতা থাকলেই তো তা আর খাঁটি নয়। একইসঙ্গে, মধ্যস্থতাহীন ‘খাঁটি’ বলে আদৌ কিছু কি থাকা সম্ভব— এমন কিছু যা উপস্থাপনার পূর্ববর্তী? ‘কী আছে’ তা যেমন উপস্থাপনা ছাড়া জানা যাবে না তেমন ‘ঠিক কী আছে’ তা-ও বলা যাবে না কখনও। কারণ উপস্থাপনা সর্বতই অসম্পূর্ণ। অসংখ্য বয়ানের অস্পষ্ট মধ্যস্থতা ও টানা-পোড়েন উপস্থাপনার যেকোনও প্রক্রিয়াকেই অনির্দিষ্টভাবে স্থগিত করে চলে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠা থেকে। ফলে পিতৃতান্ত্রিক (বা যেকোনও) ভাষা কাঠামোও কার্যত আংশিক। উপস্থাপনা কখনওই পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারবে না নারীকে। এই অসম্পূর্ণতাই নারীবাদের হাতিয়ার। উপস্থিতির প্রাধান্যকারী বয়ান আর তার পরম ‘সত্য’ (যা মূলত নারীবিদ্বেষী)-কে আঘাত করার অস্ত্র।
এই অংশে তিনটে লেখা। প্রথমটি, সায়ন চট্টোপাধ্যায়ের ‘আবেগতান্ত্রিক নির্মাণ: পঞ্চাশ-ষাটের দশকের জনপ্রিয় বাংলা মেলোড্রামায় পুরুষত্বের উপস্থাপনা’— এ প্রবন্ধে কীভাবে বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষের নির্মাণ আবেগকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পথে হল দেরী (১৯৫৭) চলচ্চিত্রটি পাঠের মাধ্যমে তর্ক তোলা হয়েছে যে, স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি পুরুষের ক্ষেত্রে তার আত্মপরিচয় বৌদ্ধিক ধারণার বদলে কার্যকরীভাবে আবেগ দ্বারা প্রভাবিত। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের বাঙালি পারিবারিক মেলোড্রামার দ্ব্যর্থব্যঞ্জকতা বাঙালি পুরুষের এক ধরনের পারফর্মেটিভিটিকে মঞ্জুরি দেয়। পরবর্তী রচনা ‘সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্রে ‘নতুন ম্যাসকিউলিনিটি’: একটি নারীবাদী পাঠ’-এ সুস্মিতা ঘোষ দেখাতে চেয়েছেন যে সমসাময়িক হিন্দি সিনেমায় চিরায়ত আগ্রাসী পৌরুষের সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের অনুভূতিশীল, নারীসুলভ পৌরুষও উপস্থাপিত হয়। লক্ষণীয় এই যে, তার সঙ্গে বিশ্বায়নের সর্বব্যাপী সংস্কৃতির একটি নিবিড় সংযোগ আছে। স্নেহা কর চৌধুরীর ‘ইংরেজি সাহিত্য ও নারীবাদ: বিতর্ক ও বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এ পর্যায়ের শেষ লেখাটি সচেতনভাবেই রাখা হয়েছে এখানে। মনে হয়েছে ইংরিজি সাহিত্যকে এড়িয়ে গিয়ে নয়, পরিষ্কার বাংলায় তা নিয়ে আলোচনা করতে পারলেই হয়তো ইংরিজির প্রভুত্বকে কিছুটা পরাস্ত করা সম্ভব।১১ ভারতীয় সমাজ ও আঞ্চলিক ভাষা বা সাহিত্য নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা ইংরিজি ভাষায় হয়েছে তার উলটোটা কী হয়েছে একটুও? এখানে লেখক ইংরিজি সাহিত্যে নারীর উপস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। অন্য দিকে সাহিত্যের মূল বয়ানে নারীবাদের লঙ্ঘনকারী অভিঘাত নিয়ে তুলে ধরেছেন অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ব্রিটিশ সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে মহিলা সাহিত্যিকরা কীভাবে মূলস্রোতে ঢুকে পড়ে নারীবাদী দর্শনের নানা সম্ভাবনার উন্মেষ ঘটিয়েছেন সে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন তিনি।
চতুর্থ অংশের বিষয় অনুভূতির রাজনীতি যা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে উপস্থাপনের সঙ্গে। সাধারণত অনুভূতিকে প্রাক্-সাংস্কৃতিক বা সহজাত ধরে নেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে ভাষা-মতাদর্শের মধ্যস্থতা ছাড়া তা হয়ে ওঠে না। অনুভূতি কোনও পরম সত্য নয়; উপস্থাপন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তা তৈরি হতে থাকে। আশ্চর্যভাবে ‘অনু’ উপসর্গটির অভিধানগত অর্থও সামীপ্য। আর এক্ষেত্রেও কাজ করবে একই যুক্তি, উপ-স্থাপিত বলেই অনু-ভূতি যুক্তিগতভাবে অসম্পূর্ণ। কাছাকাছি গেলেও তা পুরোটা পৌঁছোতে পারে না ‘অনুভূতির মূলে’। আবার, মধ্যস্থতাহীন উপস্থাপন-পূর্ববর্তী ‘অনুভূতির মূল’ বলে কিছু-একটা আছে, অকপটে এমন কিছু ধরে নিলে প্রাধান্যকারী বয়ানের অভিঘাতটাই ঢাকা পড়ে যাবে। অনুভূতিকে অপাপবিদ্ধ, একান্ত আপন ধরে নিলে আমাদের প্রশ্নাতীত বদ্ধমূলে পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শের কার্যকলাপ অধরা রয়ে যাবে। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের প্রত্যক্ষ লড়াই অজান্তে তাকেই পুষে রাখব ভিতরে ভিতরে। অনুভূতিস্থলের এই অসম্পূর্ণতাও তাই নারীবাদের সহায়ক।
শেষ অংশটি তিনটি লেখার সমাহার। শুরুতেই রইল অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিষয় প্রেম: নারীবাদী ইতিহাসচর্চার একটি প্রয়াস’। নারীবাদের তাত্ত্বিক পর্যালোচনার সঙ্গে সঙ্গে ঔপনিবেশিক উচ্চবর্ণ বাঙালি হিন্দু সমাজ সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে লেখাটি— বুঝতে চেয়েছে উনিশ শতক এবং বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে নারী-পুরুষের প্রেম কীভাবে পিতৃতন্ত্রের বজ্র-আঁটুনির সঙ্গে মোকাবিলা করে চলেছে নিরন্তর। অর্পিতা ব্যানার্জির লেখা পরবর্তী প্রবন্ধটির বিষয় ‘ব্যবহার ও বিতাড়নের ইতিহাস: জাতীয়তাবাদ ও রাবীন্দ্রিক উপন্যাসে নারী’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসগুলিতে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে সমালোচনা উঠে এসেছে তারই একটা নারীবাদী পাঠ পেশ করেছেন লেখক। নারীকে মাতা, দেবী এবং সঞ্জীবনী শক্তির আধার রূপে খাড়া করার পুরুষকেন্দ্রিক রাজনীতিকে নিন্দা করেছেন রবীন্দ্রনাথ— নিখিল মানবতার আলোয় দেখতে চেয়েছেন অন্য এক মুক্ত পরিসর। সবশেষে উপস্থাপিত হয়েছে দেবরাজ দাশগুপ্তর করা কবিতা পাঞ্জাবীর অনুলিখন ‘মেয়েদের প্রেক্ষিত ও মৌখিক ইতিহাস গঠনের পদ্ধতি’। মৌখিক ইতিহাসকে এখানে ভাবা হয়েছে বৃহত্তর আখ্যানের মতো করে। তুলে ধরা হয়েছে সাক্ষাৎকার বা কর্মসমীক্ষায় বক্তা-শ্রোতা সম্পর্কের নানা জটিলতা (হয়তো এই জটিলতার আভাস অনুলিখনটির নিজস্ব বিন্যাসেও খানিকটা ধরা পড়বে)। অপর দিকে রিগোবের্তা মেঞ্চু-র Testimonio বা সাক্ষ্য-সাহিত্যের ঘনিষ্ঠ পাঠের ভিতর থেকে প্রভাবিত হয়েছে আঞ্চলিক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অবস্থানে মৌখিক আখ্যানের প্রাসঙ্গিকতা। সংস্কৃতি-অনুবাদের অসম্ভাব্যতাকে ঘিরেও নানা প্রশ্ন উঠে এসেছে বার বার।
তবু, নারীবাদের নানা পাঠে বাদ পড়ে থাকে অনেকগুলি প্রসঙ্গ। কথায় কথায় ছুঁয়ে গেলেও আলাদা করে আলোচিত হয় না শ্রম, আকাঙ্ক্ষা, যৌনতা বা হিংসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। সরাসরি উঠে আসে না প্রান্তিক কোনও অভিজ্ঞতা-আখ্যানের অংশ। হয়তো একটা বইয়ের মধ্যে এতগুলো কথা বলা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, একভাবে ‘সব বলে দেওয়ার’ বা ‘সবার হয়ে বলে দেওয়ার’ প্রবণতার বিরোধিতাও কি করছি না আমরা? নারীবাদের একটা সামগ্রিক ছবি পেশ করা তো আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বরং এর উলটোটাই বলতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি বহুমাত্রিক নারীবাদী পাঠের অবশ্যম্ভাবী অসম্পূর্ণতার কথা। লেখাগুলি সাজানোর সময় পাঠ শব্দটিকে দু’ভাবে ভাবা হয়েছে— নারীবাদী পাঠ ও নারীবাদ সংক্রান্ত পাঠ। দু’টি ধারণা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও এক নয়। সব ক’টি প্রবন্ধকে যেমন কোনও নির্দিষ্ট নারীবাদী আঙ্গিকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা হয়নি তেমন লিখনশৈলীর ওপরেও কোনও কৃত্রিম সাযুজ্য আরোপ করা হয়নি এখানে।
নানান অবস্থান থেকে উঠে এসেছে নানারকম লেখা। সব ক’টি যে একইরকমভাবে অ্যাকাডেমিক তা-ও হয়তো নয়। পাঁচমিশেলি এই ধরন আমাদের দুর্বলতা নয়, শক্তি। সম্পাদনার কাজে এটা আমার রাজনৈতিক অবস্থানও বটে। নারীবাদের নানা স্বর শুনতে চেয়েছি বলেই বইটি বহুমাত্রিক। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা ভাষায় নারীবাদ সংক্রান্ত কী ধরনের কাজ হচ্ছে তার একটা আন্দাজ তৈরি হতে পারে পাঠকের। মনে পড়ছে ‘Subjectivity, Experience and Knowledge: An Epistemology from/for Rainbow Coalition Politics’ শীর্ষক প্রবন্ধে Sandra Harding-এর বিখ্যাত উক্তি: ‘In so far as women… live in oppositional race, class and sexuality relations to each other, the subject of feminist knowledge will be not just multiple, but also contradictory or “incoherent”.’১১ বহুস্বরের স্বীকৃতি যে জ্ঞানতাত্ত্বিক সংকট ডেকে আনবে তা Harding জানতেন। তাই বলেছেন, মহিলারা একে অপরের সঙ্গে যত জাতি-, শ্রেণি- এবং যৌনতাধর্মী-বিরোধী সম্পর্কের মধ্যে থাকবেন নারীবাদী জ্ঞানের বিষয়টি ততই নানারকম, পরস্পরবিরোধী বা ‘অসংলগ্ন’ হয়ে উঠবে। হয়তো সুসংগত বলেই পিতৃতান্ত্রিক জ্ঞানতত্ত্ব প্রাধান্যকারী হতে সক্ষম। নারীবাদের ‘অসংলগ্নতা’ই হয়তো পিতৃতান্ত্রিক জ্ঞানতত্ত্বকে প্রতিহত করবে। এই আশায় প্রকাশিত হোক ‘নারীবাদের নানা পাঠ’— রামধনুর নানা রঙে রঙিন হোক আমাদের নারীবাদী জোট।
পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে সাধারণত উত্তর কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগনার অলিগলি, গ্রামগঞ্জ থেকে পড়তে আসে ছেলেমেয়েরা। তাদের বেশিরভাগের চিন্তাভাবনা ও লেখাপড়ার মাধ্যম বাংলা। গত নয়-দশ বছরের বিভাগীয় চর্চায় উঠে এল কয়েকটি মূল সমস্যা। বাংলায় নারীবাদ নিয়ে অ্যাকাডেমিক লেখালিখির অভাব, বিষয়টা আমাদের অনেকের কাছেই ঠিক করে পৌঁছোতে দিচ্ছিল না। ইংরিজিতে পড়তে হয় বলে এক ধরনের জড়তা কাজ করছিল। শেফালী মৈত্রের লেখা ‘নৈতিকতা ও নারীবাদ’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩-এ। তারপর কেটে গেল প্রায় দুটো দশক। সুতপা ভট্টাচার্য ও রুশতী সেনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় বাংলায় নারীবাদচর্চা অবিচ্ছিন্ন থাকল। টুকরো টুকরো উদ্যোগে আরও কিছু বই ছাপা হলেও সব ক’টিই যে খুব নির্ভরযোগ্য ছিল তা বোধহয় বলা যায় না। আরও একটা জটিলতা তৈরি হল বাংলা ভাষা নিয়েই। আমাদের মুখে নানা রকমের বাংলা, আমরা পড়াই আরেকরকম বাংলায়, বাংলা পাঠ্যবইয়ের অন্যরকম টান আর গুগল ট্র্যান্সলেটরের কথা নাহয় বাদই দিলাম। বছরের পর বছর বিভিন্ন ধারার বাংলায় চলতে থাকল নারীবাদের মন্থন— আমরাও একটু একটু বদলাতে থাকলাম।
কীভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলায় নারীবাদের কাজ হয় তা জানার জন্য আর, কিছুটা আমাদের কথা বলার জন্যও, দু’হাজার চোদ্দো-পনেরো শিক্ষাবর্ষ থেকে একটি ধারাবাহিক বক্তৃতামালার আয়োজন করা হল বিভাগে। তারই ফলশ্রুতি ‘নারীবাদের নানা পাঠ’ (স্বাভাবিকভাবেই যেমন সব ক’টি বক্তৃতা সংযোজিত হয়নি, তেমন বক্তৃতামালার বাইরেরও কিছু লেখা রাখা হয়েছে এ সংগ্রহে)। বইয়ের পরিকল্পনায় উৎসাহিত হলেন অনেকেই। লেখা আসতে থাকল। বুঝতে পারলাম বিভাগীয় গণ্ডি পেরিয়ে আমরা ক্রমশ অ্যাকাডেমিয়ার বৃহত্তর পরিসরে ঢুকে পড়ছি। তার মূল কারণ দু’টি। এক, যে সমস্যার সঙ্গে আলাদা আলাদা করে বোঝাপড়া করছিলাম, এবার হয়তো অনেকে একসঙ্গে কথা বলার একটা সুযোগ তৈরি হল কারণ সমস্যাগুলি প্রকৃতপক্ষে সর্বাত্মক। দুই, আগেই বলেছি বাংলায় চর্চা মানে বিষয়বস্তুর সরলীকরণ নয় বরং তার সম্প্রসারণ। নারীবাদকে আঞ্চলিকতা, ভাষা এবং প্রান্তিকতার সঙ্গে জুড়ে নিলে তৈরি হয় নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা।
এসব ভাবনাচিন্তার মধ্যেই কথা হয়েছিল মলয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তখন থেকে সম্পাদনার প্রতিটি স্তরে, আনন্দ পাবলিশার্সের তরফে, তিনি যে অক্লান্তভাবে সাহায্য (এবং তাড়না) করেছেন তার জন্য তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই প্রত্যেক প্রাবন্ধিককে যারা ‘নানা পাঠে’ গড়ে তুলেছেন সংগ্রহটি। দেবরাজ দাশগুপ্ত আর সায়ন চট্টোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক সহায়তার জন্য তাঁদের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ। তিতির চক্রবর্তীর সার্বিক সমর্থন আর সাহায্য ছাড়া সম্ভব হত না এই বই। তাঁকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই আমার। তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদের একটি বিশেষ ধারা তৈরির ক্ষেত্রে অনির্বাণ দাশের সঙ্গে কাজের মাধ্যমেই এ বইয়ের সূত্রপাত। এই সংগ্রহের ভাবনা আর বিন্যাসে গাঁথা আছে তাঁর অবদান। পরিশেষে এ কথাই বলার যে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে ভাবনার আদান-প্রদান, তর্কবিতর্ক আর কল্পবিনিময়ের মুহূর্তগুলি ছাড়া এ বইয়ের প্রকাশ সম্ভব হত না।
ঋতু সেন চৌধুরী
সেপ্টেম্বর ২০২০, কলকাতা
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. যদিও অনেক পুরুষই নারীবাদ চর্চা করে থাকেন, যার নজির পাওয়া যাবে এ বইয়েও, এক্ষেত্রে মহিলারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্যদিকে ভিন্ন-লিঙ্গের মননও বিশেষভাবে জুড়ে আছে নারীবাদের সঙ্গে। তবু মূলস্রোতের নারীবাদের সঙ্গে ভিন্ন-লিঙ্গের আন্দোলনকারীদের একধরনের টানাপড়েন লক্ষ করা যায়। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা মুলতুবি রেখে শুধু এইটুকু বলি যে এখানে প্রাধান্যকারী নারীবাদ নিয়ে কথা বলব বলেই ‘মহিলা’ শব্দটির উল্লেখ।
২. বলা বাহুল্য এখানে ইংরিজি (বা বাংলা) শুধুমাত্র ভাষা নয় বরং সংস্কৃতি, জীবনযাপন, দেখার ধরন সব কিছু নিয়ে এক-একটি আদল।
৩. এর মানে এই নয় যে, তত্ত্ব আঞ্চলিক অভিজ্ঞতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অভিজ্ঞতাই তো তত্ত্বের প্রেক্ষিত। ফলে তুল্যমূল্য বিচার নয়। বলতে চাইছি, স্থানীয় অভিজ্ঞতা তত্ত্বে তেমন ঠাঁই পায় না। পেলেও তাকে গ্লোবাল ধারণা ও তত্ত্বের খাপে ভরে ফেলা হয়।
৪. একটু পরেই এই নিয়ে বিশদ আলোচনা করব।
৫. Julia Kristeva তাঁর অনেক লেখায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যেমন, Desire in Language (trans. Leon S Roudiez, Oxford: Basil Blackwell’s, 1980) এবং Revolution in Poetic Language (trans. Margaret Waller, New York: Columbia University Press, 1984)।
৬. Towards a Politics of the (Im)Possible: The Body in Third World Feminisms (UK, USA: Anthem Press, 2010) নামক গ্রন্থে নারীবাদী রাজনীতির যে দার্শনিক প্রেক্ষাপট অনির্বাণ দাশ উদ্ভাবন করেছেন তা ভাষা ও নারীবাদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা না করলেও, আমাদের এ বইয়ের সার্বিক অবস্থানের অনুরূপ। বিশ্বজনীন তত্ত্বে ‘সম্ভাবনা’র সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে এক অসম্ভাব্যতার রাজনীতির কথা বলেন তিনি। এমন এক রাজনীতি যা অনির্ধার্য, অজ্ঞেয়ের প্রতি দায়িত্বশীল থাকার কথা বলে।
৭. এখানে ‘মেয়ে’ শব্দটি কোনও ব্যক্তিচরিত্র নয় বরং একটা গতানুগতিক পরিচিতি-মোড়ক। বাস্তবে অনেক ব্যক্তিনারী ক্ষমতাশীল হলেও ধারণা হিসেবে ‘মেয়ে’ একটা ক্ষমতাহীন অবস্থান।
৮. সচেতনভাবেই ‘ইচ্ছে’ শব্দটির ব্যবহার, কারণ প্রাধান্যকারী ভাষার বাইরে যাওয়াকে নির্দিষ্ট কর্মসূচির আদলে ভাবা যাচ্ছে না। নির্দিষ্ট কাঠামো ‘বাইরে’ যেতে সাহায্য করবে না। হয়তো ‘খোঁজ’ বা ‘ইতস্তত যাত্রা’য় কিছুটা অকপট হতে পারে ভাবনা।
৯. Desire in Language এবং Revolution in Poetic Language শীর্ষক লেখাগুলিতে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন Kristeva.
১০. Butler 1993, pp. 164-165; Judith Butler, ‘The Body Politics of Julia Kristeva’ in Ethics, Politics and Difference in Julia Kristeva’s Writing (ed. Kelly Oliver. pp. 164-178. New York: Routledge, 1993).
১১. তা ছাড়া আধুনিক সময়ে canonical ঘেরাটোপ ভেদ করে (উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনা ও ভারতীয় লেখালিখির সৌজন্যে) ইংরিজি সাহিত্যের যে অসাধারণ বিস্তৃতি ঘটেছে তাতে কলকাতার অলিগলি থেকে মুম্বাইয়ের বস্তির মতো আঞ্চলিক দৃশ্যপটগুলি উপস্থাপিত হয়েছে বার বার। আর তা একভাবে সমস্যাকীর্ণ করেছে কেন্দ্র-প্রান্ত অথবা বিশ্বজনীন-আঞ্চলিক প্রভেদ রাজনীতিকে। অবশ্য প্রবন্ধটিতে এইভাবে তোলা হয়নি কথাটা।
১২. Sandra Harding, 1992, pp. 175-176; ‘Subjectivity, Experience and Knowledge: An Epistemology from/for Rainbow Coalition Politics’ in Development and Change, 23 (3), pp. 175-193.
* Heterosex, Heterosexual, Heterosexuality–র বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে এই বইয়ের বিভিন্ন লেখায় যথাক্রমে ‘বিসমকাম’ ‘বিসমকামী’ ও ‘বিসমকামিতা’ ব্যবহৃত হয়েছে।
.
লেখক পরিচিতি
অনির্বাণ দাশ (জন্ম ১৯৬৭): সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটা-য় কালচারাল স্টাডিজের শিক্ষক। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস. করার পর দর্শনে পি.এইচ.ডি.। সরে আসেন বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও মানবীবিদ্যার প্রশস্ততর আন্তঃবিষয়িতায়। আগ্রহের বিষয়: তত্ত্বচর্চা, বিশেষত নারীবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা ও সাহিত্যতত্ত্ব, অবিনির্মাণ, শরীরের দর্শন, বিজ্ঞানের দর্শন ও চিকিৎসার জ্ঞানতত্ত্ব। বাংলা ও ইংরেজি পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও সম্পাদনা করেছেন; সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য বই: বাংলায় বিনির্মাণ/অবিনির্মাণ (২০০৭) এবং ইংরেজিতে: Toward a Politics of the (im)possible: The Body in Third World Feminisms (2010)।
অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৬৯): ডায়মন্ডহারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ উইমেনস স্টাডিজ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। গবেষণার বিষয়: ঔপনিবেশিক বাংলার মেয়েদের প্রেম। সন্দর্ভটি ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। নাম: Desire and Defiance: A Study of Bengali Women in Love, 1850-1930 (2016)। প্রেম ছাড়া মেয়েদের লেখালেখি, অবসরযাপন এবং সামগ্রিকভাবে ঔপনিবেশিক বাংলার মানবী ইতিহাস বিষয়ে উৎসাহী। তাঁর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে দু’টি সংকলন: The ‘Other’ Universe: An Anthology of Women’s Studies (2014) এবং নহি সামান্যা নারী: ইতিহাসে, সমাজে, চিন্তায় (২০১৭)।
অর্পিতা ব্যানার্জি (জন্ম ১৯৮১): যাদবপুর বিদ্যাপীঠ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর বিগত ছয় বছর ধরে মহারাজাধিরাজ উদয়চাঁদ মহিলা মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। গবেষণার ক্ষেত্র: মূলত উত্তর-উপনিবেশবাদী বিবিধ তাত্ত্বিক, যেমন— এডওয়ার্ড সাইদ, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, ফ্রান্জ্ ফাঁনো, আমে সেজেয়ার প্রমুখের উপর একাধিক কাজ করে চলেছেন তিনি। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ‘Unsettling the Archaic: Edward Said and His Theory of Orientalism’ (2015), ‘অশ্রুত ইতিহাস আর অব্যক্ত নেপথ্যের সন্ধানে: গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক’, ‘কিছু অ-উপনিবেশিত কণ্ঠস্বর: উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বচর্চায় সেজেয়ার এবং ফাঁনো’ (২০১১), ‘উত্তর-উপনিবেশবাদী তত্ত্বে নারীবাদ: অস্মিতার উদ্যাপন নাকি উপস্থাপনার রাজনীতি’ (২০১১)।
ঈপ্সিতা হালদার (জন্ম ১৯৭৫): যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য পড়ান। স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এর সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট-এ ভিজিটিং ফেলো হিসেবে ছিলেন (চার্লস ওয়ালেস ইন্ডিয়া ট্রাস্ট ফেলোশিপ, ২০১৮)। তাঁর কাজের ক্ষেত্র: বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় আধুনিকতার নানাবিধ রূপ। এই বিষয়ে তাঁর গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশিতব্য। মহরম ও শিয়া সম্প্রদায়ের আত্মপরিচয় নির্মাণের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে রয়েছে তাঁর চর্চা। মহরম নিয়ে কাজ করার জন্য পেয়েছেন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ফর দি আর্টস, ব্যাঙ্গালোর থেকে ফেলোশিপ (২০১১-২০১৩) ও সেইসঙ্গে সরাই সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ-এর ফেলোশিপ (২০১৬)। এ ছাড়াও চার্লস ওয়ালেস ইন্ডিয়া ট্রাস্ট শর্টটার্ম ফেলোশিপ পেয়েছেন ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে কাজ করার জন্য (২০১১)। আনন্দবাজার পত্রিকা-য় উত্তর-সম্পাদকীয় কলামে নিয়মিত লেখেন। ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র সদস্য হিসেবে কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে লিঙ্গ-যৌনতা সংবেদনশীলতা বিষয়ক ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেন।
কবিতা পাঞ্জাবী (জন্ম ১৯৬১): যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপিকা এবং সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন ল্যাটিন আমেরিকান লিটারেচার ও কালচার, কলকাতার কো-অর্ডিনেটর। তিনি যাদবপুর জার্নাল অফ কম্প্যারেটিভ লিটারেচার পত্রিকার সম্পাদক। উল্লেখযোগ্য গ্ৰন্থ: Unclaimed Harvest: An Oral History of the Tebhaga Women’s Movement এবং Old Maps and New: Legacies of the Partition। তাঁর সম্পাদিত গ্ৰন্থ: Poetics and Politics of Sufism and Bhakti in South Asia: Love, Loss and Liberation এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত: Women Contesting Culture Changing Frames of Gender Politics in India।
তনুশ্রী কুন্ডু (জন্ম ১৯৮২): ছাত্রীজীবন কাটিয়েছেন টাকি গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্ব কাটিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে এম.ফিল. সম্পন্ন করেন। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে হিজড়া পরিচিতির বিষয় নিয়ে গবেষণারত। ২০১৮ সালে তার পি.এইচ.ডি. গবেষণাপত্র, নাম ‘ন্যারেটিভস অফ বিকামিং: রি-কনসেপচুয়ালাইজিং হিজড়া আইডেন্টিটিজ’ পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য দাখিল করা হয়ে গেছে। অন্যান্য গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ক্যুইল, সোশ্যাল ভিশন, উইমেন স্টাডিজ় নিউজলেটার প্রভৃতি জার্নালে।
দেবরাজ দাশগুপ্ত (জন্ম ১৯৯১): বীরভূম জেলার সিউড়ি শহরে স্কুলজীবন শেষ করে তাঁর কলকাতা আসা। এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর (২০১৩) ডিগ্রি অর্জন করার পর সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটা থেকে কমলকুমার মজুমদারের সাহিত্য বিষয়ে এম.ফিল. (২০১৫) করেন। সাধারণভাবে সাহিত্য সংস্কৃতি ও দর্শন বিষয়ক পড়াশুনোর সূত্রেই তার নারীবাদী দর্শনের প্রতি গভীর আগ্রহ ও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। ২০১৬ সালে ওই সেন্টারেই তিনি পি.এইচ.ডি.–র কাজে যুক্ত হন। আপাতত সেখানেই গবেষণারত।
মল্লারিকা সিংহ রায় (জন্ম ১৯৭৭): শান্তিনিকেতনের পাঠভবন, প্রেসিডেন্সি কলেজ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীজীবন কাটিয়ে বর্তমানে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর উইমেনস স্টাডিজ-এ শিক্ষকতা করেন। ২০১০-এ পি.এইচ.ডি. গবেষণাপত্র গ্রন্থ রূপে প্রকাশ পায় রাটলেজ ইউকে প্রকাশনা থেকে, নাম Gender and Radical Politics in India: Magic Moments of Naxalbari (1967-1975)। অন্যান্য গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ফেমিনিস্ট রিভিউ, ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি, সাউথ এশিয়া হিস্টরি অ্যান্ড কালচার, কনটেম্পোরারি সাউথ এশিয়া প্রভৃতি জার্নালে। Displacement and Citizenship: Histories and Memories of Exclusion (Tulika Books, 2020) বইটি সহ-সম্পাদনা করেছেন বিজয়া রাও, শম্ভবি প্রকাশ এবং পাপোরি বোরার সঙ্গে।
শেফালী মৈত্র (জন্ম ১৯৪৫): বার্নপুর গার্লস হাইস্কুল, ব্রেবোর্ন কলেজ ও বিশ্বভারতী থেকে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে প্রথমে ছয় বছর লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় ও তারপর ১৯৭৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপনায় রত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষায় নারীবাদী তত্ত্বচর্চার অন্তর্ভুক্তিতে অধ্যাপক হিসেবে তাঁর অবদান অগ্রগণ্য। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের তিনি প্রাক্তন ডিরেক্টর। উল্লেখযোগ্য কয়েকখানি বই: Feminist Thought: Androcentrism, Communication and Objectivity (2002), নৈতিকতা ও নারীবাদ: দার্শনিক প্রেক্ষিতের নানা মাত্রা (২০০৩), উজানি মেয়ে: সিমন দ্য বোভোয়ার জীবন ও দর্শন (২০১৩), রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য: একটি নারীবাদী পাঠ (২০১৯)।
সন্মিত চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৮৯): যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের একজন ডক্টরাল গবেষক। তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরের পর তিনি এম.ফিল. করেন মানবীবিদ্যায়, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক ড. অনির্বাণ দাশের তত্ত্বাবধানে। থিসিসের শিরোনাম: ‘বস্তুশরীরের খোঁজ: কন্টিনেন্টাল দর্শনের প্রেক্ষিতে’। ২০১৬-য় ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের থেকে জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড পান এবং সেই বছরই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে নথিভুক্ত হন ডক্টরাল গবেষক হিসেবে। গবেষণার বিষয়: জুডিথ বাটলারের দর্শনে Materiality বা বস্তুসত্তার প্রসঙ্গ ও New Materialism। ২০১৪ থেকে তিনি কন্টিনেন্টাল ধারার নারীবাদী দর্শন নিয়ে কাজ করে চলেছেন। বাংলাভাষায় নারীবাদী দর্শনচর্চার অনুপস্থিতি অনুভব করে বাংলায় এ জাতীয় চর্চার পরিসর গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে যে স্বল্প কিছু প্রয়াস দেখা গিয়েছে বিগত কয় বছরে, তাতে তিনি অংশ নিয়েছেন সাগ্রহে। নারীবাদী দর্শন নিয়ে তাঁর বেশ কিছু লেখা ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে অ্যাকাডেমিক পত্রিকা ও বাংলা নিবন্ধ সংকলনে। যেমন, ‘সত্তাবোধের আত্মঅন্যীভবন’ (২০১৯), ‘সম্মতি ও ক্ষমতা: প্রসঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌনসংস্কৃতি’ (২০১৭), ‘বস্তুরূপের পুনঃপাঠ’ (২০১৭), ‘From Being to Becoming: Reading Ontogenesis, Reading Ethics’ (২০১৮), ইত্যাদি। নারীবাদী দর্শন ছাড়াও তাঁর আগ্রহের বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সাহিত্যতত্ত্ব এবং বিজ্ঞানের ইতিহাস ও বিজ্ঞানের দর্শনের মতো বিষয়।
সায়ন চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৮১): বর্তমানে বারুইপুর কলেজের সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ উইমেনস স্টাডিজ থেকে এম.ফিল. সম্পূর্ণ করার পর বর্তমানে পি.এইচ.ডি. গবেষণায় যুক্ত। অন্যান্য গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে সাউথ এশিয়া রিসার্চ, স্টাডিজ ইন সাউথ এশিয়ান ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া, জার্নালিজ্ম প্র্যাক্টিস, মিডিয়া এশিয়া প্রভৃতি জার্নালে।
সুস্মিতা ঘোষ (জন্ম ১৯৭৯): পড়াশোনা পাঠভবন স্কুল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্স–এ। বর্তমানে একটি এন.জি.ও.-র সঙ্গে যুক্ত। আগ্রহের বিষয় চলচ্চিত্র, ইতিহাস ও জেন্ডার স্টাডিজ।
স্নেহা কর চৌধুরী (জন্ম ১৯৭৯): পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা। গবেষণার বিষয়: ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের সম্পর্ক, নারীবাদী সাহিত্য ইত্যাদি। এই বিষয়গুলির উপর তিনি দেশে-বিদেশে বহু আলোচনা সভায় বক্তব্য পেশ ও প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। তাঁর অন্যতম বই: Tagore’s Ideas of the New Woman (2017)।
ঋতু সেন চৌধুরী (জন্ম ১৯৭২): সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্বে স্নাতকোত্তর, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটা থেকে পি.এইচ. ডি.। গবেষণার ক্ষেত্র: সমাজতাত্ত্বিক ও নারীবাদী তত্ত্ব, জাত-ব্যবস্থায় লিঙ্গভেদ, মেয়েদের লেখা, রবীন্দ্র সাহিত্য ও সিনেমা। সম্প্রতি প্রকাশিত: ‘Ambedkar beyond the Critique of Indology: Sexuality and Feminism in the Field of Caste’ (2018), ‘Kiki and the ‘‘girl’’: A Moment of Reading between Deleuze and Feminism’ (2018), ‘Women’s Movement’ (2020), ইত্যাদি।
Leave a Reply