নাম নেই – একটি নভেলা – মলয় রায়চৌধুরী
মুহূর্ত । প্রতিটি মানুষের মাথা তার ধড় থেকে খসে পড়ে গেল ।
কুক্ষণ আর সুক্ষণের ঠিক মাঝখানে যে ব্রাহ্মঝাক্কাস, টুক, অঘটন আর দুর্ঘটনার ঠিক ফুটিফাটা মদ্যিখানে, ঘটাঙ, উপনিবেশ আর উত্তরউপনিবেশের লোভচকচক ফাটলে, ঘ্যাচাঙ, হয়েছিল ব্যাপারটা, ঝিরিবাদলা বর্ষা ফুরিয়ে শরতের কাশফুলায়িত ডাকে ঢলে পড়তে চলেছে এরকম অপরিণামদর্শী সময়ে, ফিনফিনে রাতের চাঁদহীন চাঁদনি দুপুরে, দেশের ছেলে বুড়ো মেয়ে মহিলা ছোকরা ছুকরি কেউই আঁচ করতে পারেনি কী ঘটতে চলেছে, ভূমিকম্প হাওয়াকম্প জলকম্প কথাকম্প বিদ্যুৎকম্প না আকাশকম্প, তাদের জীবনে, দেশে, পরিবারে, সমাজে, আর ব্যাস, ঘ্যাচাঙ নিঃশব্দে, যেন সরু বাদামি চিরুনি দিয়ে কাঁচাপাকা চুলে সিঁথে কাটা হচ্ছে, কোনোরকমের কাঁপকাঁপি ছাড়াই, এক সেকেণ্ডে সব বদলে গেল । দেশের প্রতিটি মানুষের, কোলের খুকু থেকে কোলকুঁজো বুড়ি, প্রত্যেকের মাথা, সেই মুহূর্তক্ষণে, ঘাড় থেকে খসে পড়ে গেল, কারোর এক ফোঁটা ঘাম কান্না রক্ত পড়েনি, সবাক হবার আগেই তারা নির্বাক।
এককালে, যখন তারা ট্রাউজার শার্ট বুশশার্ট পরতে জানতো না, মেয়েরা জানতো না কাকে বডিস ব্লাউজ শেমিজ থঙ বলে, অশুদ্ধ হবার আতঙ্কে বাড়ির বাইরে সাতসকালের অন্ধকারে গাড়ু ঝুলিয়ে হাগতে যেতো, দেশের মানুষজনের সাধারণ ধরণ-ধারণ ছিল, জটিল-সরল মতবাদের সমন্বয় ছিল, ঝুলকোঝোলা ঐতিহ্যের জগাখিচুড়ি ছিল, হুদো-হুদো শাস্ত্রের হাঁচানো বই ছিল, যা সেই লোহার যুগ থেকে চলে আসছে, যদিও এদের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা বলে কিছু ছিল না আর নেইও, যেমন আর সবায়ের দলের হয় ।
অনেক কাল আগে, মানে সেটা যে কতোকাল তা বলা মুশকিল, এদের টোটেম ছিল বয়াংসি বা পাখি, তা কোন পাখি তা নিয়েও গোলমাল, সেই থেকে দেশের মানুষের চরিত্রে লটকান্তি উড়ুউড়ু-ভাব দেখা যায়, কোনো কিছুই নিশ্চিন্তিয়ে করতে পারে না । তবু তাদের দেশের যুবকরা, এখন, আজকের দিনে, প্রগতি যখন চনমনিয়ে দিগবিদিকে ছুটছে, মাথা না থাকা সত্ত্বেও, গলির গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারে পাড়াটা খানকিদের, ঘটকদের, দালালদের, বই বিক্রির, কালেজ ক্যান্টিনের, মেয়েদের হস্টেলের, ফাটকার না বন্দরের, তেমনি যুবতীরা, মাথা না থাকা সত্ত্বেও, গন্ধ না শুঁকেই বলে দিতে পারে কোন কালেজের বারান্দা, কোন মলের পিৎজাঠেক, কোন কফিঘরের গ্যাঞ্জাম, কোন কনডোমের আঁস্তাকুড়, কোন নাচঘরের ঘেমো মাতালদের ঠেক ।
মাঝে , মাঝে মানে এই বছর তিরিশেক আগে, হঠাৎই, যেন বিদেশি দেবদূতদের ফিনফিনে উড়ুক্কু ডানা তাদের চুলেল বগলের তলায় গজিয়েছে, এলাকার সব মানুষের গায়ের চামড়া টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিল, সবায়ের সে কি আতঙ্কিত আনন্দ, মাথাহীন চোখ না থাকা সত্ত্বেও, ওদের কমিসারের বাণী মেনে, ছোকরারা পথে-পথে ডাঁটিয়ে বেড়াতো, “এই দ্যাখ, আমার লাল্লিঙ্গ কেমন টকটকে, পুরো দুনিয়াটাকে এবার বদলে ফেলবো, বড়োলোক-ছোটোলোকে তফাত থাকবেনা, কুচো মাছ-বড়ো মাছ তফাত থাকবে না, পাঁঠা-খাসির পার্থক্য থাকবে না, পিছড়াবর্গ আর তাগড়ার্বের আলাদা গেট থাকবে না, বামুন-শুদ্দুরে পার্থক্য থাকবে না, মাঠেঘাটে ধোঁয়াক্কার কলকারখানা বসিয়ে দেবো এই লাল্লিঙ্গের জোরে” ; ছুকরিরা, মাথাহীন চোখ না থাকা সত্ত্বেও, বলে বেড়াতো, “অ্যাই, দেখ-দেখ,আমার লাল্গুদ কেমন টসটসে, পুরো দুনিয়াটাকে এবার পালটে ফেলবো, উঁচুজাত-নিচুজাত থাকবে না, বেশিপড়া-কমপড়া থাকবে না, দামি শাড়ি সস্তা শাড়ির তফাত থাকবে না, ভরাপেট-খালিপেটের তফাত ঘুচিয়ে দেবে আমার এই লাল্গুদ, দেখে নিস তোরা, পথে-পথে মিলমেশিন কাজ করবে চোপোর ঘণ্টা আমার এই লাল্গুদের জোরে”।
আসলে সবায়ের একই রকমের লাল রঙ ছিল না, যার ক্ষমতা যতো বেশি তার চামড়া ততো লাল ছিল, চুল কাঁচা হোক বা পাকা, মাথার নয়, মাথা তো নেইই, সবায়েরই খসে পড়ে গেছে, অন্য জায়গার চুল । সমস্যা হলো যে, ন্যানোনুনুকে মানুষ খারাপ মনে করতো এবং করে, অথচ ন্যানোযোনিকে মনে করতো এবং করে, উর্বশীর চাকুমচুকুম নিশিবরে পাওয়া । চামড়া দেখে লোকে টের পেয়ে যেতো কে কতো ক্ষমতা রাখে, কটা লাশ লোপাট করতে পারে, কতো বডি ফেলিয়ে দিতে পারে, কতোজন তরুণীকে পালোয়ান পাঠিয়ে ধর্ষণ করিয়ে দিতে পারে । যার চামড়া সবচেয়ে টকটকে লাল, সেই কমিসার, তার লাল্লিঙ্গ ছোয়ারার মতন শুকিয়ে গিয়ে থাকলেও, সে এসব খবর কানে এলো বলতো, “অমন তো প্রায়ই হয়, এ আবার নতুন কি”, কাউকে ক্ষমতা দিতে হলে জিগ্যেস করতো, “আমাদের কথা শুনবে-টুনবে তো?”
হায়, রঙটা কাঁচা ছিল বলে তিরিশ বছরের বেশি চামড়ায় রইলো না, কমিসার গিয়ে জমিসার এলো, একটু-একটু করে উবে গিয়ে গণ্ডারের চামড়ার রঙে ফিরে গেছে, আনন্দকে হাহুতাশে রাঙিয়ে । তার আগে, ভয়ার্তযুগে, কচি-কাঁচা ছোকরা-ছুকরিদের লিঙ্গযোনি লালের চেয়ে বেশি টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছে দেখে, রোগটা যাতে না সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, ফিকে লাল্লিঙ্গ আর ফিকে লাল্গুদদের হাতে ক্ষমতা যাবার আগের কমিসাররা , তাকে রঙের প্লেগ বলেই মনে করেছিল, তাদের কোতল করে-করে ঠেলায় ল্যাংটো চাপিয়ে চ্যাঙদোলিয়ে নদীতে গিয়ে ঝপাঝপ ফেলে দিতো, আর নদীতে তাদের পচাহাজা মাংস খেয়ে নাচিয়ে গাইয়ে রুপোলি মাছেদের পিত্তি লাল রঙের হয়ে গিয়েছিল ।
আগেকার গোষ্ঠীপতি-পত্নীরা উবে গিয়ে আর কিছুটা পালটি খাবার দরুণ, লাল চামড়ার মানুষেরা খুঁজে বেড়াতো কাদের লাল্লিঙ্গ হয়নি, কাদের লাল্গুদ হয়নি, তাদের ধরে-ধরে বেদম পিটুনি দিয়ে সমবায়ী পিপেতে তাদেরই রক্তে চুবিয়ে রাখতো, ফলে তারা হয় নেতিয়ে মরে ফুলে জলহস্তি হয়ে যেতো বা রক্তের রঙের টুকটুকে হয়ে যেতো । না হতে পারলে তাদের পেঁদিয়ে আড়ং ধোলাই দিয়ে, এলাকাছাড়া করে দেয়া হতো, এমনটাই লিখে গেছেন প্রখ্যাত ইতিহাসকার ইবন ফাতুস্তা ।
সেসময়ে লালন সাঁইয়ের একজন ভক্ত, আড়ং ধোলাই খেয়ে, ‘লাল সেলাম হায়’ নামে এই পদ্যটা লিখেছিল, সত্যিই বেচারা–
মুখের ভেতরে এক জান্তব গোঙানি-ডাক চলাফেরা করে
জেলহাজতের ভিড়ে ত্রিকালজ্ঞ যম দেখে চমকে উঠি
এরা কারা হাতকড়া পরে ঠাঠা হাসে সারাদিন
বাইরে যারা রয়ে গেল ঝুঁকিয়ে দাঁতাল মাথা
তারাই বা কারা
জল্লাদের ছেড়ে-দেয়া প্রশ্বাস বুক ভরে টানে
চাই না এসব ধন্দ
মশারি খাটিয়ে বিছানায় সাপ নারীর বদলে
নৌকোর গলুই থেকে ছুরি হাতে জ্যোৎস্নায়
বুকের ওপরে বসবে লুঙিপরা রোমশ সারেঙ
নাসারন্ধ্র থেকে বন্দুকের ধোঁয়া
‘বল শালা শকুন্তলার আঙটি কোন মাছে আছে’
জানি তবু বলতে পারি না
মুখের ভেতর আঙটি জিভের তলায় আমি লুকিয়ে রেখেছি
সেসময়র পর ইলিশমাছেরা ভয়ে সমুদ্র থেকে এই দেশের নদীতে ডিম পাড়ার বদলে পাশের দেশের নদীতে চলে যেতো, সেখানকার লোকেদের গায়ের চামড়া পিত্তি-সবুজ , সেই ইলিশ ডবল দামে কিনতো এই এলাকার লাল্লিঙ্গ-লাল্গুদ বর-বউ লোক-লোকিনি চাকুরে-চাকরানি সাইকেলবাবু-মোটরগাড়িবাবু । চামড়ার লাল রঙ ঝিংকিচিকিং ঝিংকিচিকিং ফুরিয়ে গিয়ে গণ্ডারের চামড়ার প্রাকৃতিক রঙ ধরার পর, এখন তারা, জমিসাররা, গালে তামাক পুরে আঁশটে নাইলনের থলে ঝুলিয়ে কে বেশি দামে খুকি ইলিশ কিনতে পারে তার প্রতিযোগীতা করে ; তবে ইলিশকে থলেতে ভরলে বাড়ির লোকেদের মনখারাপ হতে পারে বলে পাটের সুতলিতে বেঁধে দোলাতে-দোলাতে নিয়ে যায়, আর খুকি ইলিশের হাসিখানা নিজের ফোলা গালে গিকগিকিয়ে হাসতে হাসতে যায়।
খাটো হেটো ডাঁটো অনুসন্ধানকারীরা এদেশে বহুবার এসেছেন-গেছেন, কালো, বাদামি, হলুদ বা শাদা চামড়ার ওপরে স্যুট-টাই ঝকমকে বাদামি বা কুচকুচে জুতো , কিংবা পায়ের দুআঙুলে পরবার কোলহাপুরি চপ্পলে ধুতি-পাঞ্জাবি রিমলেস চশমায়, বা মাথায় রাষ্ট্রানুযায়ী সংস্কৃতির রঙচঙে টুপি আর ডুরে বা চাককাটা লুঙ্গিতে, দল বেঁধে বা একা, শীতকালেই বেশি, এনজিওর বিদেশি পয়সায় বা রাষ্ট্রের টাকায়, বৈজ্ঞানিক গুপ্তচরগিরি বা নিঃস্বার্থ সন্দেহে, নৌকোয়, স্টিমলঞ্চে, হুডখোলা গাড়িতে বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সাত-সিটার মেটেল মোটরে, ল্যাপটপে গবেষণা করেছেন, হ্যাণ্ডিক্যামে ভিডিও তুলেছেন, স্মার্টফোনে ছবি ধরে রেখেছেন, ছককাটা কাগজে তালিকা ছকেছেন, আলোর সামনে ধরে এক্স-রে প্লেট যাচাই করেছেন, ছুঁচে রক্ত নিয়ে টেস্টটিউব নাড়িয়ে পরীক্ষা করেছেন, শেষ পর্যন্ত নির্ণয় নিয়েছেন যে, এই মানব প্রজাতি আসলে ট্রান্সহিউম্যান বা মানবাধিক, তার কারণ এখানকার মানুষদের, দুধের শিশু থেকে কুঁজো বুড়ি, কারোরই, কাঁধের ওপর মাথা নেই, তা সত্বেও তারা সেই সব মানুষের চেয়ে কোনো প্যাঁচপেঁয়াজিতে কম যায় না, যাদের কাঁধে মাথা আছে, আর মাথা থাকলেও যারা ব্রহ্মাণ্ডজগতে নানা গোলমাল পাকিয়ে চলেছে, কতো মানুষকে যে শান্তিতে আরামে আয়েসে তন্দ্রায় আলস্যে বৈভবে দারিদ্র্যে ক্ষুধায় ল্যাদখুরিতে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না, তার গোণাগুণতি করা যন্ত্রের পক্ষেও যন্তর ঘামিয়ে সম্ভব নয় ।
ভিনদেশের কোনো জোব্বাপরা পাকাগুঁফো লম্বাদাড়ি বাবরিচুল ইতিহাসের জ্যোতিষি নতুন যুগ, যাকে অনুসন্ধানকারীরা বলেছেন অ্যানথ্রোপোসিন বা মানব্যযুগ, আনার চেষ্টায় জ্যামিতিক হামবড়াই তৈরি করেছিলেন, বই পড়ে আর বই লিখে, যাতে দেশে দেশে লোকেরা সকলেই উবেরমেনশ বা পরামানব হয়ে উঠতে পারে । তা তো হল না, কিন্তু তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষার এমনই ফল হল যে ভাদ্র মাসের শুক্রবার দুপুররাতে বারোটা বেজে এক মিনিটে সকলের ঘাড় থেকে মাথা টুপটাপ ঢুপঢাপ ঠকঠকাস দুমদাম এক লপ্তে খসে পড়ে গেল, রক্তহীন, কুমোরের চাকিতে সুতো দিয়ে কাটা কলসির ঢঙে, যেন আঠা দিয়ে জোড়া ছিল জন্মের সময় থেকে । ৯৮৫৩০১০১টা মাথা ফুলশয্যার বিছানায়, মাদুরের ওপর, আরামচেয়ারে, বাড়ির সামনে, বাজারে, পথের পাশে, মাঝ রাস্তায়, পুকুরে, নদীতে, রিকশয়, ঠেলাগাড়িতে, তাসখেলার ক্লাবে, চাষের মাঠে, নৌকোর গলুইতে, ফুটবল মাঠের ময়দানে পড়েছিল সাতরাত-ছয়দিন ।
কোনো-কোনো তে-এঁটে বেগড়বাঁই পাবলিক নিজের খসে পড়া মাথা তুলে আবার ঘাড়ের ওপর বসিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল, মাথাগুলো রাজি হয়নি, আবার মাটিতে লাফিয়ে পড়ে গিয়েছিল চোখে-ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি নিয়ে, কোনো-কোনো মাথা বিরক্তিতে খাড়া চুলে আর লম্বা বিনুনি ঝাপটিয়ে গালমন্দও করেছিল, ‘শালা আঁতেল কোথাকার, গাণ্ডু কোথাকার, গায়ক কোথাকার, চশমখোর কোথাকার, হারামজাদা কোথাকার, সাংবাদিক কোথাকার, প্রতিক্রিয়াশীল কোথাকার, খোচর কোথাকার, বানচোদ কোথাকার, খানকি কোথাকার, লুচ্চা কোথাকার, কবি কোথাকার, ফিল্মনির্দেশক কোথাকার, ঘুষখোর কোথাকার, চাষা কোথাকার’, তার কারণ মাথাগুলো তো জানতো যে যার ঘাড় থেকে খসে পড়েছে সে কেমনতর খচ্চর বা খচ্চরিনি । কতো মেয়ে যে ‘আমার বিনুনি আমার চুল আমার খোঁপা’ কাঁদতে কাঁদতে মুণ্ডুগুলোকে ঘাড়ের ওপর থাকতে অনুরোধ করেছিল তার ইয়ত্তা নেই, মাথাগুলো বাঁদিক আর ডানদিকে হেলে হেলে চুল ঝাপটিয়ে বলছিল, ‘উঁহু উঁহু উঁহু উঁহু উঁহু’ ।
দেশের মুণ্ডহীন লোকেরা যখন বুঝতে পারল যে, আরে, আমাদের মাথাগুলো সর্বত্র গড়াগড়ি যাচ্ছে, এদিকে, কই, আমাদের মাথার তো আর কোনো দরকার পড়ছে না, সব কটা ইন্দ্রিয় আগের মতনই কলকলিয়ে দমদার রয়েছে, ওই তো আকাশের তারা দেখতে পাচ্ছি, এই তো কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছি, স্বামীর জড়িয়ে ধরায় উত্তেজিত-রসাক্ত হচ্ছি, গলার ভেতরে রসোগোল্লা ফেলে মিষ্টি টের পাচ্ছি, কড়া সেন্টের গন্ধে গলা দিয়ে হাঁচছি, তখন তারা, দেশের কালো ধলা বেঁটে লম্বা রোগা মোটা মুণ্ডহীন লোকেরা, দেশের সবচেয়ে বড়ো সরকারি গম্বুজ-ভবনে মুণ্ডগুলো সংরক্ষণ করেছিল, আত্মীয়-অনাত্মীয়-প্রতিবেশী যার মুণ্ডু সামনে পেয়েছে কোলে করে নিয়ে গিয়ে রেখে এসেছে ভবনের একতলা দুতলা তিনতলায়, প্রায় এক সপ্তাহ অন্য কাজ ফেলে মুণ্ডু তোলার কাজে ব্যস্ত ছিল দেশবসতের মানুষ ।
এখন, বছরের পর বছরের পর বছরের পর বছরের পরে মুণ্ডুগুলো হাসিমুখো করোটি হয়ে গেছে, কয়েকটা শ্যাওলায় সবজেটে, কয়েকটার চোখের ভেতরে পাখির ইঁদুরের ঝিঁঝির তক্ষকের বাসা, সে আজ অনেককাল আগের কথা, তখন মাথা না হলে মানুষ কোনো কাজ করতে পারতো না, এমনকী ঝগড়া-মারামারি, মা-বোন তুলে গালাগাল, তহবিল তছরুপ, কিংবা তর্কাতর্কি-খুনোখুনি করতে পারতো না, দেশপ্রেমের গান গাইতে পারতো না, দলাদলি করতে পারতো না, ঘুষ নিতে পারতো না, বন্দুক-বোমা-গ্রেণেডের চোরাচালান করতে পারতো না, বিদেশি ব্যাঙ্কে টাকা লুকিয়ে রাখতে পারতো না, একজনের কথার মানে অন্যজনের কথার ওপর চাপানো হতো না, সকলেই সকলকে জোচ্চোর ঠকবাজ, বাটপাড়, চাপলুস, খোচর, চশমখোর, ঝালরবাজ, মিথ্যাবাদী মনে করতে পারতো । করোটিতে রূপ পেয়ে মাথাগুলো মাঝরাতে নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করে, কমিসারের লাল্লিঙ্গ ছোয়ারা হবার আগে কতো র্যালা করেছিল, কমিসারের সাঙ্গোপাঙ্গোরা কোথায় টাকা গেঁড়িয়ে লুকিয়ে রেখেছে, জমিসারদের জমিগুলো বেনামে কটা বউকে দিয়েছে, এইসব ।
প্রত্যেক দেশবাসীর ঘাড় থেকে মাথা খসে পড়ে যাবার সেই ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক, বৈপ্লবিক, গণতান্ত্রিক, আর এদেশের মানুষেরা দিনটিকে তাদের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করে, যদিও স্বাধীনতা যে ঠিক কী জিনিস,তরল না বায়বীয় না কঠিন-পদার্থ, নরম না শক্ত, গরম না ঠাণ্ডা, তা মাথা খসে পড়ে যাবার আগে, আর মাথা খসে পড়ে যাবার পরে, কেউই বুঝে উঠতে পারেনি । তবে মাথা খসে যাওয়াকে বিদেশি বৈজ্ঞানিকরা, যাঁরা নিক দিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন, বলেছেন মানব সমাজের অত্যন্ত সাহসী, কল্পনা-বাস্তবায়ন, আদর্শপূর্ণ উচ্চাকাঙ্খায় উত্তরণ ; প্রতিটি মানুষের বোধশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষমতা, দৈহিক ও মানসিক সামর্থ হয়ে গেছে সীমাহীন, স্মৃতিশক্তি প্রখর, সৃজনশীলতা অভিনব । জোব্বাপরা পাকাগুঁফো লম্বাদাড়ি ঘাড় পর্যন্ত পাকাচুলো লোকটা বলার আগে দেশবসতের কোনো লোক সাম্য আর স্বাধীনতা শব্দগুলো শোনেনি ; মাথাহীন মানুষেরা গাইবে বলে লোকটা গানও লিখে গেছে, নিজে সুর দিয়ে গেছে তাতে, স্বাধীনতা দিবসে কোটি-কোটি দেশবসতের মানুষ গম্ভীর মুখে গলা ছেড়ে সেই গান গায়, অন্যদিন ফুটবল ম্যাচে গায়, ক্রিকেট ম্যাচে গায়, সিনেমায় দাঁড়িয়ে গায়, স্কুলে লাইন দিয়ে বালক-বালিকারা গায়— তবে এই একটিমাত্র গান মধ্যবিত্ত দেশবাসীরা তাদের স্নানের ঘরে গায় না, যদিও তারা উলঙ্গ স্নান করবার সময়ে চোখ বুজে পছন্দসই নায়ক বা নায়িকার হাওয়াছবি মনের ভেতরে পুরে নিয়ে গুনগুনিয়ে নিজেরা নিজেদের গান শোনায় ।
তারপর থেকে এই দেশবসতে যারা জন্মায় তাদের ঘাড়ে মাথা থাকে না, আর মাথা থাকে না বলে বাচ্চা জন্ম দিতে বউদের কষ্ট হয় না, তারা এক লপ্তেই ফুড়ুৎ করে বাচ্চা পয়দা করতে পারে, ডাক্তাররা সিজারিয়ান করে পয়সা লোটার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবার দরুন এই দেশবসতে আর গর্ভবতীদের বাচ্চা বের করার ডাক্তার মেলে না সহজে, যারা টিকে আছে তারা কখনও-সখনও ঘাড়-আটকানো বাচ্চার জন্য ডাক পড়লে দৌড়োয় তাদের কাটাকুটির বাক্স নিয়ে ।
প্রকৃতির কি বদলামূলক লীলা, মাথা না থাকলেও, সকলেই ঘাড়ের উন্মুক্ত ছ্যাঁদা দিয়ে জিভ বের করে কথা বলতে পারে, কারোর জিভ ঢোঁড়া সাপের মাপের, কারো আবার অ্যানাকোণ্ডার মাপের ; তারা মনে করে জিভ দিয়ে তারা দেখতে পায়, যদিও জিভে চোখ নেই, তারা মনে করে জিভ দিয়ে তারা শুনতে পায়, যদিও জিভে কান নেই, তারা মনে করে জিভ দিয়ে তারা গন্ধ পায়, যদিও জিভে নাক নেই, দীর্ঘ জিভের কারণে অনেকে নেমন্তন্ন বাড়িতে খায়ও হাতের বদলে জিভ দিয়ে, তুলে পাকিয়ে ঘাড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয় । সেই থেকে এদেশে ভবিষ্যৎ আর বর্তমানে প্রভেদ নেই, বর্তমান ব্যাপারটাই ভবিষ্যৎ, সময়ের এগোনো-পেছোনো নেই । এখনও কেউই তারা বুঝে উঠতে পারেনি যে মন জিনিসটা কোথায়, বুকে, ফুসফুসে, প্লীহায়, বৃক্কে, পাকস্হলিতে, পেটের অন্ত্রে, পাছায়, পোঁদের গর্তে, পায়ে, যৌনাঙ্গে, নাকি সেটাও ঘাড়ের ভেতরের গোলাপি খরখরে জিভেতেই !
সেই মহাজৈবিক ঘটনার আগে, এদেশের মানুষ মনে করত যে তাদের নামপদবি তাদের সম্পূর্ণ দেহের, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত, আগাগোড়া, কেবলমাত্র কোনো বিশেষ অঙ্গের নয় । মাথা খসে-খসে পড়ে যাবার পর, দেশবাসীরা বুঝতে পারল যে নামকরণ হতো মাথার, পদবিও মাথার, পুরস্কার বা সম্বর্ধনাও মাথার, ধর্মও মাথার, সম্প্রদায়ও মাথার, সম্পূর্ণ শরীরের নয়, মুখ দেখেই মানুষ একজন লোককে চিনতে পারতো, ঘেন্না করতে পারতো, ঈর্ষা করতে পারতো, এড়িয়ে যেতে পারতো, কোলাকুলি করতে পারতো, গুড মরনিং বলতে পারতো, কাগজে গালমন্দ করতে পারতো, নিজেকে আনন্দ দেবার জন্য অমরদের সমালোচনা করতে পারতো নশ্বররা । চিনতে যাতে সুবিধা হয় তাই অনেকে বাবরিচুল রাখতো, অনেকে রাখতো পাকানো গোঁফ, মহিলারা খোঁপায় নানা বাহার খেলাতেন, কানে-নাকে গয়না পরতেন, গলায় সাতনরি প্লাস্টিকের সোনালি হার পরতেন, যে পুরুষদের টাক ছিল তারা মাথাহীন হবার ফলে নবসাম্যের অংশ হয়ে উঠতে পারলো, নয়তো টেকো অভিনেতাদের মতো নকল চুল বসাবার জন্য ঘটিবাটিচাটি বেচে বিদেশে গিয়ে চুল রোপণ করিয়ে আসতে হতো ।
মাথা না থাকার দরুণ, মাথা যখন নেই তখন আগেকার কালের মতন একজন মানুষ বা মানুষীর নামের প্রয়োজনহীনতা অনুভব করে, মাথাহীনতার রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটিয়ে, তারপর থেকে মানুষের নামকরণ হয় নম্বর দিয়ে, ‘নাম নেই এক’,’ নাম নেই দুই’, ‘নাম নেই তিন’, এই ভাবে ‘নাম নেই ১৮৯৭৫’, ‘নাম নেই ৯৬০২৩৮’ ; কেউ মারা গেলে তার নাম নেই নম্বর পায় সেই দিন যে শিশু জন্মেছে সে, বা মৃতের অভাবে নামহীন কোনো নাম নেই যদি থাকে, তার । এই প্রথা যখন মান্যতা পেয়েছিল তখন দেশের কুর্সিনশীন ক্ষমতাপতি কমিসার নিজের জন্যে ‘নাম নেই এক’ নামটা দখল করে নিয়ে ক্ষমতার আরামচেয়ারে দিব্বি হেলান দিয়ে বসে পড়েছিল, আর সন্ধ্যা হলেই সরকারি বাড়িতে ফিরে শহুরে শে্য়ালদের মিয়াঁকি টোড়ি শুনতে-শুনতে সিঙ্গল মল্ট স্কচ খেতো । তার জায়গায় জমিসার এসে ‘নাম নেই এক’ নম্বরটা দখল করে নিয়েছে, কারোর মুরোদ নেই যে ট্যাঁ-ফোঁ করে ।
সেসময়ে দেশের প্রখ্যাত নারীবাদী ‘মিস নাম নেই ৭০৮০’ আনন্দিত অবস্হায়, কেননা নামকরণ থেকে পিতৃতন্ত্রের বিদায় ঘটেছে অনুমান করে, যদিও তা প্রমাণসাপেক্ষ্য ছিল এবং থেকে গেছে, দেশের আনন্দদায়ী খবরতুবড়ির সংবাদপত্রে ওনার ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন মাথাহীন নবসাম্য নিয়ে । সংবাদতুবড়ির মাথাহীন মালিক খুব খুশি হয়ে তাঁকে তাঁদের সংবাদবাড়ির পুরস্কারে সোহাগ-টাকায় কিনে নিয়েছিলেন । অমন আচরণের জন্য অবশ্য সংবাদতুবড়ি পরিবারের সদস্যরা মালিককে বিবেচনাহীন বুদ্ধিহীন ছাপ মেরে একঘরে করে দিয়েছিল, আউট আউট আউট ; সে আরেক রাজনৈতিক মজার কর্পোরেট ল্যাঙ-মারামারির গোপন গল্প, অন্য কোনোদিন শোনানো যাবে ।
এখন ঘাড় থেকে জিভের উঁকি দিয়ে আরেকজনকে চিনতে হয় । জিভ শুকিয়ে যায় বলে জিভের উঁকি তো আর সব সময় বজায় রাখা যায় না, তাই এমনও ঘটেছে যে একজনের সঙ্গে পথচলতি আরেকজনের ধাক্কা লেগেছে, আর তারা দুঃখ প্রকাশ করে যে যার কাজে চলে গেছে । মাথা না থাকা সত্ত্বেও যারা পালোয়ানি করে, তারা জিভ দিয়ে বুকের গোঁফকে চুমরে নেয় ; যাদের বুকে চুলের অভাব তারা সিক্স প্যাক অ্যাব নিয়ে খালি গায়ে ঘুরে বেড়ায় আর আড়জিভ মেলে ইতিউতি তাকায়, কোন মেয়ের বুকের পাউডার-মাখা সুগন্ধী খাঁজ দেখা যাচ্ছে, কোন মেয়ের বুক আসলিমাল ডবকা নাকি নকলি ফাঁপানো । যুবতীরাও একইভাবে জিভের ডগা বের করে টের পায় কোন যুবক মালদার, কোন যুবক উস্কোখুস্কো চুলের তিনদিনের দাড়ি আর পাঁচদিন তাঁত না মেজে ফালতু ল্যাদখোর কবিত্বের ফাঁদ পাতে, কোন যুবককে বোকা বানিয়ে চুষে নেয়া যায় ।
এদেশের নামকরা চিন্দিচোর তছরুপবাজ ঘোড়েল ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর ছেলে, যাকে এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত সবাই বলত ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর একমাত্র সন্তান, যারা পরে সন্দেহের গাড্ডায় পড়ে ওই ‘একমাত্র’ কথাটা বলতে দোনামনা করত, সেই ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর ঘাড়ের ভেতরে কুড়িটা অ্যানাকোণ্ডা জুড়লে যতো বড়ো হয় সেরকমধারাই গোটানো গোলাপি জিভ আছে, যা ইচ্ছেমতন বাড়ানো-কমানো যায় তা ‘নাম নেই ৭৫০০’ কে ছোটোবেলায় যারা ‘নাম নেই ৭৫০০’ সাপুড়ে পদ্য আউড়ে খেপাতো, তারা যখন ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর বয়স বাইশ বছর তিন মাস এগারো দিন, বাদল দিনের ঝাপসা ভোরবেলায় দেশবসতের লোকে জানতে পারল এক বেটা তিরিক্ষি-মেজাজ কেলটেকালো মদ্দাদেঁতো চিকনআঁশ কুড়ি-বিঘত কালকেউটে সাপ এসে দেশবসতের লোকেদের ভয় পাওয়াবার সময়ে ‘নাম নেই ৭৫০০’ ঘাড়ের ভেতর থেকে লিকলিকে গোলাপি আধ কিলোমিটার লম্বা জিভ বের করে কেউটে সাপটাকে আলতো তুলে ঝাঁকড়ামাথা তালগাছে ঝোলানো ফেনা-ওপচানো তাড়ির কালচে-মেটেল হাঁড়িতে রেখে দিয়েছিল । অন্য মেটেল হাঁড়িগুলো কালচে ছিল না বলেই হয়তো তার কোনো একটায় রাখেনি, তবে সকলের মনে আছে, সেটা ছিল ভূত চতুর্দশী আর হাওয়ায় উড়ন্ত ছায়ারা কাচের মতন কিলবিলে পষ্ট ।
দেশবসতের এক দিকে ওপার-দেখা-যায়-না ‘নাম নেই সমুদ্র’ যার জল বর্ষাকালেও দিনের বেলায় ঘোলাটে হতে অস্বীকার করে, গ্রীষ্মকালে নদীর জলের ওপর দিয়ে কলকলে অত্যাচারী তাপ হাওয়াকে পুড়িয়ে ধর-দিকিনি ধর-দিকিনি বলতে-বলতে দৌড়োয়, যেন পুরাণের পুঁথিতে লেখা পাগলামিগুলোর রহস্য নদীই কেবল জানে,কুড়ি কিলোর রুই-কাৎলারা, যাদের পিত্তি থেকে লাল রঙ ফুরিয়ে গেছে, ঘাই মারার সময়ে নৌকোযাত্রীদের দেখে চোখ মারে, শুশুকরা লাফিয়ে চোখ মারে না বটে তবে মহিলাদের দেখলে “হাই ডিয়ার” “হাই সুইটি পাই” বলে কুপ্রস্তাব দেয়, আর সন্ধ্যে থেকে নদীর কলকলে ছম্মকছল্লো জল কমলা রঙের হয়ে যায়, যেন সূর্যটাকে বগিথালার মতন বাসন মাজছে ‘নাম নেই ৯৭৮৫’, মানে, ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর মা, যে, ‘নাম নেই ৭৫০০’ বিয়োবার সময়ে নদীর আঁতুড়ঘাটে নেমে আর উঠে আসেনি ।
দেশবসতের বউরা বিয়োবার সময় এলে আঁতুড়ঘাটে নেমে কোমরজলে অপেক্ষা করে, আর বাচ্চা হলে তাকে কোলে নিয়ে ডাঙায় উঠে আসে । যখন জলের ভেতরে বাচ্চা হয় তখন মায়েরা বাচ্চার কানে কানে, তা সে ছেলে হোক বা মেয়ে, যমজ হোক বা একা, কিছু গোপন কথা জানিয়ে দ্যায় । ‘নাম নেই ৭৫০০’র মা ‘নাম নেই ৯৭৮৫’ , বাচ্চা হবার পর তার কানে কানে ওর বাবা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর গোপন ডায়েরি বাড়িতে কোথায় রাখা আছে তা জানিয়ে দিয়েছিল, তাছাড়া ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর ইমেল লেখার পাসওয়র্ডগুলোও বলে দিয়েছিল, যা, ‘নাম নেই ৭৫০০’ যৌবনে পৌঁছে নিজের কাজে, লাগিয়েছিল, এখনও লাগায় সুযোগ পেলেই, কাজ মানে ইমোশানাল ব্ল্যাকমেইল । ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ বেশ সুবিধের মানুষ, কমিসারের সময়ে কমিসারের সঙ্গে ছিল, জমিসারের যুগে জমিসারের সঙ্গে ।
দেশবসতের অন্যদিকে শুকিয়ে-যাওয়া নোনা-খাঁড়ির ধার ঘেঁষে জঙ্গলের জঙ্গুলে সবুজ যে বনের বনানীতে গাছেদের কোনটার নাম যে ঠিক কী তা দেশের লোকেরা বড়ো একটা জানে না কেননা সূর্য উঠলে গাছগুলো বসতির দিকে এগিয়ে আসে, দেশের লোকেদের ছায়া বিলি করার জন্য, আর সন্ধ্যে হলে জঙ্গলখানা নিজের জায়গায় ফিরে গেলে শিশিরে গা ধুয়ে গাছের পাতাগুলো লাল-গোলাপি-বেগুনি হয়ে ওঠে, যাতে বসতির অলিগলিতে আলো ছড়ায় আর মাঝরাতের গাছচুন্নি-ভুতরা বসতের পল্লিপ্রিয় কুকুরদের ভয় দেখিয়ে না কাঁদায়, আর তাদের শোনাশুনি, সেদিন পূর্ণিমা না হলেও, শেয়ালেরা না ওপরমুখো কান্না জোড়ে । অন্য বসতির কেউ কুটুমের বাড়ি এসে গাছগুলোর নাম জানতে চাইলে গাঁয়ের লোকেরা বলে ‘নাম নেই গাছ ৮৭৩, কিংবা ‘নাম নেই গাছ ৫৬’, কিংবা ‘নাম নেই গাছ ৯৮০৩’ । মাথা না থাকার দরুণ স্মৃতিশক্তি সবায়েরই প্রখর হয়ে উঠেছে, নয়তো শয়ে-শয়ে হাজারে-হাজারে গাছের, ফুলের, ফলের, আনাজের নম্বর মুখস্হ রাখা চাড্ডিখানি কথা নয় ।
‘নাম নেই ৭৫০০-এর মা ‘নাম নেই ৯৭৮৫’ যখন ‘নাম নেই’ নদীতে নেমে গিয়েছিল, তখন ‘নাম নেই ৭৫০০’ পেটে, মানে পেটের তলার দিকে যেখানে গর্ভ থাকে তাইতে সবে ‘নাম নেই ৭৫০০’ ফ্রিস্টাইল সাঁতার শেষ করেছে, দুশো আশি দিন পুরো হতে এক রাত বাকি, বসতির নিয়ম অনুযায়ী ‘নাম নেই’ নদীতেই বাচ্চা বিয়োতে হয় বলে ব্যথা উঠতেই হবু ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর মা কাউকে না জানিয়ে পড়িমরি করে নেমে গিয়েছিল ‘নাম নেই’ নদীর জলে, সেদিন আষাড় মাসের অমাবস্যা সোমবার থেকে মঙ্গলবারে যেতে মিনিট কুড়ি বাকি, ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি নেমেছে, ‘নাম নেই’ নদীর জল তখন কমলা রঙের হয়ে গেছে, যখন কিনা সন্ধ্যের পর কোনো পোয়াতি ‘নাম নেই’ নদীতে নেমে ওই কমলা রঙের জন্যেই বিয়োতে চায় না, দিনের আলোয় জলে নেমে গিয়ে সকলের সামনে অথচ জলের তলায় বিয়োতে চায়, যার দরুন বাচ্চা জন্মেই সাঁতার কাটতে শিখে যায়, সাঁতার কেটে তীরে এসে উঠলে তার বাপ বা ঠাকুমা বা দিদিমা বা কাকিমা বা জেঠিমা কোলে তুলে নেয়, তারপর বাচ্চার মা তীরে এসে ওঠে আর বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ায়, তখন বাচ্চার নম্বরীকরণ হয় ।
‘নাম নেই ৭৫০০’-এর মা ‘নাম নেই ৯৭৮৫’ অমাবস্যার কালবেলায় ‘নাম নেই’ নদীর রহস্যময় স্তব্ধতায় নেমে ‘নাম নেই ৭৫০০’কে জন্ম দেবার দরুণ ‘নাম নেই ৭৫০০’ কমলা রঙের ফর্সাটে হয়েছে, শুশুকদের নাকের আদুরে ঠেলায় তীরে এসে মায়ের বুক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ওর জিভ ঘাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে অন্য বউদের বুক থেকে দুধ নিয়ে খেয়েছে । তখন থেকেই বসতের লোকজন জেনে গেছে যে ‘নাম নেই ৭৫০০’ যে-সে বাচ্চা নয়, হুঁ-হুঁ বাবা, কী যে ও পারে না তার ঠিকঠিকানা নেই, ছোটোবেলা থেকেই ওর সারা গায়ে চুল । জঙ্গলের ভেতরে একাই চলে যায় আর ওর জ্বলজলে কমলা রঙের দরুন বাঘেরাও ওর কাছ-ঘেঁষতে চায় না ; অনেক দিন দেখা গেছে গাছের ডালে শুয়ে ঘুমোচ্ছে, তা সে রাত হোক বা দিন, ওর শোবার সুবিধের জন্য গাছের ডাল নিজেকে চওড়া করে ফ্যালে যাতে ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর কষ্ট না হয় । গাঁয়ে ‘নাম নেই ৭৫০০’ই একমাত্তর বৃষ রাশির জাতক, যার দরুন ছোটোবেলা থেকেই ওর বাবা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ ওর জন্যে হাঁটুর তলা পর্যন্ত প্যান্ট মঙ্গলাহাট থেকে কিনে আনতো । ইশকুলে কোনো টিচার যদি জানতে চাইতো, এ আবার কোন ছিরি, হাঁটুর তলা পর্যন্ত প্যাণ্টুল নেমে গেছে, ছাত্ররা বলতো স্যার ও বৃষ রাশির জাতক, ওর কথাই আলাদা, ও যা খায় গত্তি লাগে ওই একটা জায়গাতেই ।
বসতের নাম ‘নাম নেই শূন্য’ ; নদীর নামও ‘নাম নেই নদী’, সেই নদীতে হালটানা বা মোটর-বসানো ধোঁয়া-ওড়ানো নৌকোয় চেপে জ্ঞাতি-কুটুমরা কপালের বিনবিনে ঘাম মুছে দেশবসতের নাম জিগ্যেস করলে লোকে বলতো এর কোনো নাম নেই, সেই থেকে দেশবসতেরও নাম হয়ে গেছে ‘নাম নেই’। বুড়োদের অনেকে তা বিশ্বাস আর প্রচার করে , বলে চিনের চোখ পিটপিটে ভ্রমণবিলাসী পরিব্রাজক হিউ এন সাঙ, যাঁর দাড়িতে সাতটা সোনালি লোম আর গোঁফে দুই দিকে ঝোলানো তেরোটা করে এক বিঘত দীর্ঘ রুপোলি চুল ছিল, নিজে এই দেশবসত দিয়ে যাবার সময়ে বলে গিয়েছিলেন যে, এই জনপদের নাম নেই, নাম থাকা উচিত নয়, তা বড্ডো গর্বের রোগব্যামো শরীরে ঢুকিয়ে দ্যায় । কেউ যদি জানতে চায় যে সবাই মিলে একটা ‘নাম নেই নম্বর’ রাখলেই তো পারেন, তখন বসতবাসীরা বলে ওই তো ওটাই নাম, ‘নাম নেই শূন্য’, ভিনদেশের কোনো বন্দরের সিটি-বাজিয়ে জাহাজের মাথায়-কিউবাটুপি কাপ্তেনকে কিংবা হাওয়াই জাহাজের দপতরে কাউন্টারবেগমকে যদি বলেন ‘নাম নেই’ দেশবসতের টিকিট দাও, তাহলে তারা আপনাদের কোনো ভিন্ন দেশবসতে নিয়ে গেলেও, সেই অন্য দেশবসতের লোকজন ঠিক আপনাদের এই দেশবসতের হদিশ দেবে, দেয়ালে টাঙানো মানচিত্র দেখিয়ে বলবে, উই যে দূরে দেখা যাচ্ছে লাল-নীল পাতার গাছের জঙ্গল, ওইটেই ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসত ।
‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতে একবার রাষ্ট্রভাষার প্রচারক এসেছিল রাষ্ট্রভাষার জন্য দান খয়রাত করতে, সে আবার ফটরফটর চটি পায়ে নোংরাটে ধুতি-পাঞ্জাবির ওপর মাথায় টুপি, বারবার নাম নেই, নাম নেই, নাম নেই শুনেশুনে বলেছিল, এটা আসলে বালিতে মুণ্ডুগোঁজা উটপাখিদের দেশবসত, নিজেদের দেশের নামই জানে না, এদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা উচিত, কিন্তু এদের তো মাথা নেই, আদালতে অভিযোগ ধোপে টিকবে না । তাছাড়া লোকটা জানতে পেরেছিল যে এদেশের মাথাহীন মানুষেরা উটপাখি দেখেনি কখনও, একজন দোজবরে কবির কবিতায় পড়েছে ।
মাথাহীন মানুষদের ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতে বাড়ি খোঁজার জন্য কেউ বাইরে থেকে এলে তাকে বলা হয় ওই তো ‘নাম নেই’ সড়ক ধরে সোজা চলে যান, বাঁ দিকে ‘নাম নেই’ মোরাম বে্ছানো পথ পাবেন, সেই পথ ধরে সোজা এগোলে ডানদিকে পাবেন ‘নাম নেই’ গলি, ‘নাম নেই’ গলির সাত নম্বর ‘নাম নেই’ বাড়িতে আপনার ‘নাম নেই ৮৪০’ কুটুম থাকেন, ওনার স্ত্রী উচ্চশিক্ষিতা ‘নাম নেই ২২২২’ আর ওনার ছেলে নোয়েট্রপিক ডাক্তার ‘নাম নেই ৩২৯’ । সে হয়তো কথার পিঠে কথা চাপিয়ে-চাপিয়ে উত্তরদানকারীকে কুঁজো করে দ্যায়, তখন এই ধরণের কথাবার্তা হয় :
—আপনাদের দেশে কোনো নেতাবংশ ছিল না ? নেতার ছেলে, তার ছেলে, তার মেয়ে, তার নাতি, এই ভাবে রাস্তার, রাজপথের, গলির, মোড়ের, পাড়ার নাম রাখতে পারতেন তো ? তাতে পথহারা আর অন্ধ নাগরিকদের অনেক সুবিধা হয় ।
—না, ওনারা সবাই চুরি-জোচ্চুরি খুন দেহলোপাটের দায়ে জেলে ।
—মাথা না থাকা সত্ত্বেও জেলে ? আর জেলে থাকলেই বা, রাস্তাঘাটের নাম তো সাধারণত জেলকয়েদিদের নামেই হয় । তারা হয় বিদেশিদের থাকার সময়ে জেল খেটেছে, নয়তো অস্ত্র ব্যবসাদারদের ঘুষ খেয়ে জেল এড়িয়েছে।
—মাথার আবার কী দরকার ! হাত আছে তো ! চ্যালাচামুণ্ডা আছে ! সবার ওপরে আছে গোখরো শঙ্খচূড়ের জিভের মাপের লিকলিকে দু-ফাঁক জিভ । লাল্লিঙ্গ, সবুজলিঙ্গ, মেরুনলিঙ্গ আর তার জন্য খাপ খায় এমন লাল্গুদ ।
—ওনারাই কি বলেছিলেন আমাদের দেশবসত চীনকে আক্রমণ করেছিল, আমরা করিনি ?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাদের মাথা থাকলে পাগলাগারদে যেতে হতো, তারা অমনধারা কথা বলেছিল । আরও নানা অভিযোগ ।
—কেমনধারা অভিযোগ ছিল ?
—অভিযোগ কি একটা ! এক একজনের বিরুদ্ধে এক-একরকম অভিযোগ ।
—যেমন ?
—গোরুকে ঘাসখড় খাওয়াবার নাম করে যেসব গোরু কোথাও নেই তাদের জন্য টাকা তুলে মেরে দিয়েছে, কোটি-কোটি টাকা ।
—আর ?
—গণধর্ষণ করে মহিলাদের খুন করে তাদের যোনিতে অ্যালুমিনিয়ামের টর্চ গুঁজে দিয়েছে ?
—উরিব্বাপ ! আর ?
—সেই টর্চ ব্যবহার করে ওনারা তিরিশ বছর নিজেদের রাস্তায় সাপখোপ এড়াতে পারতেন । বিধবা মায়ের সামনে ছেলেদের খুন করে তাদের রক্তমাখা ভাত মায়ের মুখে গুঁজে দিয়েছে, সেই থেকে মা পাগল হয়ে গেছে । সেই ভাতই তো খেলো কতো বছর ওরা সবাই ।
—আর ?
—সেতুর ওপরে গায়ে পেট্রল ঢেলে সাধু আর সন্ন্যাসিনীদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে । যে পুলিশ অফিসার গোয়েন্দাগিরি করছিল, তাকেও গুলি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে ।
—আর ? মশায়, শুনে তো বিচিতে কাঁটা দিচ্ছে ।
—টাকা ডবল করে দেবার লোভ দেখিয়ে লক্ষ-লক্ষ গরিবের টাকা হাপিশ করে দিয়েছে, সেসব মেহনতি খেটে-খাওয়া মানুষ অনেকেই আত্মহত্যা করে নিয়েছে ।
—আর ? বোধহয় দেয়ালে মেহনতি মানুষের স্লোগান বছর বছর বিষ্টির জলে ধুয়ে মুছে গিয়েছিল ।
—ধানখেত, চালাবাড়ি, খামার পুড়িয়ে, চাষিদের জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে দিয়েছে, তাদের হাড়গোড় পাওয়া গেছে পোশাকসুদ্ধ ।
—তাহলে ঠিকই করেছেন আপনারা । এই দেশবসতের নাম ‘নাম নেই শূন্য’ থাকাই উচিত ।
—আপনি এইটুকু শুনেই ঘাবড়ে গেলেন ? আরও কতো গুমখুন, টুকলি পরীক্ষা, নকল মেডিকাল কলেজ, জার্সিবদল, পুরস্কারের প্যাঁচপয়জার, সেরা উটপাখি, গণধর্ষণ, নেতাদের আফিম চাষ, জমি জবরদখল, জোতদার খুন করে জোতদারি, বিপিএল কার্ডের জন্য রাতের বেলায় বউ পাঠানো, ঠিকেদারির কার্টেল, শুনতে শুনতে আপনি পাগল হয়ে যাবেন আর বলতে বলতে আমি বোবা হয়ে যাব । এই জিভ দিয়েই তো সবকিছু করতে হয়, জিভ যদি বোবা হয়ে যায় তাহলে দেখতে পাবো না, শুনতে পাবো না, গন্ধ পাবো না, খেতে পারবো না…
—ঘাড়ের ওপর মাথা না থাকা সত্ত্বেও, সত্যি, বলিহারি এই দেশবসতের সুযোগসন্ধানী মানুষদের। সুযোগের সন্ধান সবাই করতে পারে না । সেই যে রাতের অন্ধকারে কতো একে সাতচল্লিশ ফেলা হয়েছিল হাওয়াই জাহাজ থেকে । যে ব্যাটা ফেলেছিল, সে তো দিব্বি খালাস পেয়ে নিজের বাড়ি ফিরে গেছে । নয়তো সব কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যেতো ।
—মাথা নেই বলেই তো আমরা সুস্হ সমাজ গড়ে তুলতে পেরেছি ; প্রতি বছর সেরা মাথাহীনদের শিরোপা দেয়া হয়, তা জানেন ? সেরা উটপাখি, সেরা নীল শেয়াল, সেরা দাঁড়কাক,, গণ্ডায় গণ্ডায় ।
—কারা কারা শিরোপা পেয়েছেন ?
—অতো ‘নাম নেই সংখ্যা’ কি আর মনে থাকে, ? আপনিই বলুন, তা হাজার খানেক মানুষ তো পেয়েইছেন । দিকে-দিকে এতো উটপাখি, নীল শেয়াল আর দাঁড়কাক !
—আচ্ছা, আগে তো আপনাদের দেশবসতে কতো-কতো কলকারখানা শিল্প ছিল, সেসব কী হলো বলুন তো?
—কেন ! শিল্প আছে তো । আমাদের দেশবসতের তেলেভাজা শিল্প, ভেলিগুড় শিল্প, ফুচকা শিল্প, রাধাবল্লভী শিল্প, জিলিপি শিল্প, চাউচাউ শিল্প তো রাস্তার ধারের দুই ফুটেই দুপুর বেলায় দেখতে পাবেন, পেটরোগা কেরানিবাবুদের জন্যই এই শিল্পগুলো দাঁড়িয়ে আছে । তবে বেশির ভাগ শিল্পী ভিনদেশের ভিনভাষার, এখানে বাঙালি বউ গাঁয়ে দেশোয়ালি বউ । আগেকার যে শিল্পের কথা বলছেন, তারা বন্ধের আর হরতালের ধাক্কায় অন্য রাজ্যে ভাগলবা, পুরোনো মোটর কারখানার জমিতে এখন আবাসন উঠছে, আবাসন তৈরি এখন সবচেয়ে বড়ো মাল কামানোর শিল্প । আমরা বিপদকে ভালোবাসি, বিপদ ছাড়া সুস্হ সমাজ গড়া যায় না । প্রতিটি মানুষকে আত্মপ্রেমী হতে হবে ।
—বিপ্লব হবার কথা ছিল, তার কী হলো ?
—হয়েছে তো । ওই তো দেখুন না দোকানে-দোকানে চে গেভারার মুখের ছবি আঁকা গেঞ্জি ঝুলছে, তবে আজকাল তেমন কাটতি নেই ; ছেলে-ছোকরারা চে গেভারার ছবি আঁকা পুরোনো গেঞ্জি পরেই চালাচ্ছে, রঙ উঠে যাবার ভয়ে কাচাকাচি করে না । ওই যে ওই মেয়েটির টিশার্টে দেখুন, বুকের ওপর চে গেভারার আবছা হয়ে যাওয়া ছবি, চে গেভারার গেঞ্জি পরে সেই জোব্বাপরা বুড়োর গান গায়, যার আশীর্বাদে আমাদের মাথা ঘাড় থেকে খসে গেছে । আচ্ছা, আপনি আমায় এতো কথা জিগ্যেস করছেন, আপনাদের দেশবসতে কখনও বিপ্লব হয়েছিল ?
—হ্যাঁ, হয়েছিল, তা প্রায় দেড়শো বছর আগে, চণ্ডাল বিদ্রোহ । পরে চণ্ডালদের বলা হতো নমঃশুদ্র, এখন বলা হয় দলিত । তারা উঁচু জাতের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল, এদিকে আপনাদের দেশবসতে তখন চলছে মনীষীদের রেনেসাঁ, তাঁরা কোনো খোঁজখবরই রাখেননি চণ্ডাল বিদ্রোহের । চরণ সাপাহ নামে এক চণ্ডাল বাবার শ্রাদ্ধে দশ হাজার লোককে খাবার নেমন্তন্ন করেছিল, তা নানা সম্প্রদায়ের উঁচু জাতের লোকরা ভাবলে, বড়ো টাকার গরমি দেখাচ্ছে চণ্ডালটা, তারা কেউ ভোজে যোগ দিল না । তারা বললে, তোদের বাড়ির মেয়েরা হাটে-বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করে, জেলে গিয়ে মেথরের কাজ করে, তোদের বাড়িতে খেলে তো আমরা অধঃপতিত হয়ে যাবো । বাড়ির মেয়েদের এভাবে অপমান করা সহ্য হলো না চণ্ডালদের, তারা সব সম্প্রদায়ের উঁচু জাতের জন্য প্রতিটি কাজ করা বন্ধ করে দিলে । খেতখামারের কাজ বন্ধ, নৌকোয় যাতায়াত বন্ধ, মরা জন্তুদের শব সরানো-ছাড়ানো বন্ধ, ছুতোর-কুমোর-কামারদের কাজ বন্ধ, কুলিকামিনের দেখা নেই কোথ্থাও, চারিদিকে শেয়ালের রাজত্ব, শকুনের রাজত্ব, পায়খানায় গু জমে টিলা । সাত লাখ চণ্ডাল যোগ দিয়েছিল সেই বন্ধে । শেষে বিদেশি সরকার হুকুমনোটিস জারি করে মিটমাট করলে, চণ্ডাল বলে রইলো না কেউ, তাদের বলা হলো নমঃশুদ্র, এখন বলা হয় দলিত ।
—সে বিপ্লব তো এখনও ফুরোয়নি দেশবসতগুলোয় । দলিতদের ওপর অত্যাচার চলছেই । এই তো কদিন আগে গরুর চামড়া ছাড়াচ্ছিল বলে দলিতদের পেটানো হলো । তারা আর দলিতদের কাজ করবে না । তাহলেই বুঝুন, ঘাড় থেকে মাথা খসে যাওয়া কতো জরুরি ।
—নাহ, আর বলতে হবে না । যাই, ‘নাম নেই ৮৪০’ কুটুমের বাড়ি, পেয়ে যাব আশা করি ।
—তবু, একটা কথা আপনাকে বলে রাখি, আমাদের দেশবসতে কোনোরকম ম্যাজিক কাজ করে না । ‘নাম নেই ৭৫০০’ নামে একটি ছেলে আছে আমাদের দেশে, তাকে বলবেন, সে বৃষ্টি থামিয়ে আপনাকে বাড়ি ফেরার ব্যবস্হা করে দেবে ; তার জন্যেই আমাদের দেশবসতের শ্মশানে কখনও বৃষ্টি পড়ে না ।
—আচ্ছা, তাই নাকি ।
—আমাদের দেশবসতের একজন ছোকরা হাতে হাতকড়া পরে কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্হায় সাতজন খুনি ডাকাতের সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার দরুন ওর নকশাল বন্ধুদের নিয়ে একটা পদ্য লিখেছিল, বলেন তো সেই পদ্যটা শোনাই, দেশবসতে যখন এমারজেন্সিতে চোখকান বুজে লোকেদের জেলে পচতে পাঠাচ্ছিল দেশপত্নী আর তার জুলফিদার ছেলে সেই সময়ে ছোকরাদের মাথাহীন মগজে এই লেখাটা খেলতো ।
—শোনান শোনান, এখন তো আর কোমরে দড়ি হাতে হাতকড়া পরার ভয় নেই, খোচরেরা সবাই তো শুনছি দল পালটে ফেলেছে, লাল্লিঙ্গ ধুয়ে পিত্তিলিঙ্গ হয়েছে, টেকো কুঁজো কালো ধলা কুচ্ছিত খোচরের পাল সব্বাই ।
—শুনুন তাহলে । পদ্যটার নাম ‘মুর্গির রোস্ট’ ।
—শোনান শোনান ।
পালক ফুলিয়ে ক্রোধে লড়ো মুর্গা, চাকুমালিককে খুশ করো
হুলেতে পরাগ মেখে ঝাপটাও ডানা
বলেওছি : দু’হাত মুচড়ে নতজানু করে রাখো
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে মাদুর গুটিয়ে নেমে এসো ছাদ থেকে
বুটজুতো — রাইফেল — ঘুরন্ত বুলেট — চিৎকার
বাড়ি নিয়ে চলো বলে কেঁদে ওঠে পাশের হাজতে বন্ধ বৃদ্ধ কয়েদি
ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও যেতে দাও বাড়ি যেতে দাও
ডিমের ওপরে বসে সিংহাসনে ঝিমোয় ডাহুক
অন্ধকারে গলা টিপে ধরো
লড়ো মুর্গা, মরো লড়ে, গর্জাও গুঙ্গার দলে ঢুকে
জিভেতে কাঁচের ফুলকি — নাচাচ্ছি বুকের পেশি
মাছের কানকো খুলে জলেতে কুয়াশা মিশিয়েছি
কড়ে আঙুলের টুকরো মোড়া ছিল গোলাপি কাগজে
দু’হাতে দু’চোখ ঢেকে কে কাঁদে হাউ হাউ করে জেলখানায়
নারী না পুরুষ আমি বুঝতে পারি না
এ নাও চোখের পাতা — ফুঁ দাও বাঁহাতে রেখে
শিশিরে ফণার পাঞ্জা খোলো
মেয়েলি হিসির শব্দে তলপেট কাঁপে জাত-গোখরোর
রক্ত গড়ালে নাকে তুলো গুঁজে শ্মশানে পাঠাও
রাস্তায় পড়ে থাকবে চটিজুতো ঠ্যাং টেনে ছেঁড়া পাতলুন
ঝড়ের সমুদ্র থেকে যে ঢেউ খাবলে তুলে মেখেছি দু’পায়ে
সে নববর্ণমালা থেকে আজ হরফ এনেছি
—এসব লেখার জন্য ওনার জেল-জরিমানা হয়নি ?
—হয়েছিল তো । ওনার বন্ধুরাই ওনার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন আর তারপর নিজেদের কাপড় খুলে ন্যানোলিঙ্গ বেরিয়ে পড়ার দরুন নানা গাঁজাখুরি গপ্পো ফেঁদেছিলেন । ওনাদের একজন টেকো গুরুদেব ছিলেন, তিনিই রাজসাক্ষীদের প্যাঁচপয়াজারি শিখিয়ে-পড়িয়ে বাজারে ছেড়েছিলেন ।
—বাহ, বেশ, জব্বর ষড়যন্ত্র দেখছি । আচ্ছা চলি ।
—হ্যাঁ, খুঁজে না পেলে জানাবেন ।
‘নাম নেই ৭৫০০’-এর সেই ক্যারদানির পর, মানে জিভ দিয়ে কালকেউটেকে তাড়ির কালচে-মেটেল হাঁড়িতে চুবিয়ে দেবার পর, খেটে খেতে হয় না । ওর জন্যে গাঁয়ের লোকেরা, বিশেষ করে বউরা, চাবির গোছা-বাঁধা আঁচল কাঁধে ফেলে, কন্ঠায় বেশ করে সিঁদুর ছড়িয়ে, বুকে টাকাটিপ পরে, কাঁসার থালায় করে বিরিয়ানি, মালাই-চিংড়ি, শিককাবাব, চিকেন রোল, বাড়িতে পাকানো হাকা নুডলস, পাস্তা, চিলি চিকেন, মুর্গমুসল্লম ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর ডাইনিং টেবিলের ওপরে, যাকে পাদ্রি-পুজুরিরা বলে পদপ্রান্তে, উপঢৌকন হিসেবে দিয়ে আসে ।
দেশবসতের লোকেদের শশুরবাড়ি মামারবাড়ি পিসেমসায়ের বাড়ি যেতে হলে ‘নাম নেই ৫৫৫’-এর মেছো জাহাজে চেপে যেতে হয়, তার কারণ ফিরতে ফিরতে রাত হলে জলে কুমির ডাঙায় বাঘরা যারা মরে গিয়ে কেঁদো ডুরেকাটা কুয়াশার রূপ নিয়েছে , দেখা না দিয়েও ভয় দেখায়, বিশেষ করে কৃষ্ণপক্ষে । শহরের চেয়েও দূরে যেতে হলে জাহাজ মাঝনদীতে ভেজাল গ্যাসবাষ্পে হাঁপিয়ে যায় বলে ‘নাম নেই ৫৫৫’ যেতে চায় না । রাজধানী শহরের আমলা-অফিসার ছুটকো-নেতাও কোনো কালে রোগা কালচে বেঁটে তেলচিটে মাথাহীন মানুষদের দেশবসতে আসতে চায় না, তাদের কাছে মহাকাব্যে লেখা প্রমাণ আছে যে এই দেশবসতের লোকেদের পূর্বপুরুষরা রাক্ষস ছিল, পাণ্ডবপার্টি-কৌরবপার্টির যুদ্ধে কৌরবদের পার্টিতে যোগ দিয়েছিল, তারপর যুদ্ধের মাঝপথেই ছেড়েছুড়ে চলে এসেছিল কেননা তাদের এক অক্ষৌহিনী সৈন্যের জন্য দুর্যোধনের পার্টি কুরুক্ষেত্রের ধারের বাঁশবাগানে কোনো সুলভ শৌচালয়ের ব্যবস্হা করেনি । কুরুক্ষেত্রের সময় থেকে এই দেশবসতের মানুষ দলবদলু হিসাবে বিখ্যাত হয়ে গেছে, আর মাথাহীন হবার পর তো কথাই নেই, যে দলে মধু-ঘি-দই এর ডাক পায়, বাড়ি গিয়ে জামার রঙ পালটিয়ে, হেঁচকি তুলতে-তুলতে সেই দলে পোঁপাঁ দৌড় মারে ।
তা ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর জিভের ক্যারদানিতে তাদের অজ বসত কেরমে-কেরমে হয়ে উঠলো মেট্রপলিস, আর তার নাম নানা গোলমেলে দুর্ঘটনায় ‘নাম নেই’ থেকে হয়ে গেল ‘উটপাখি’’, যদিও এক বিশালভুঁড়ি কুমড়োপোঁদা নেতা চেলাচামুণ্ডা কালোবেড়াল কমাণ্ডো যাদের মাথায় কালো ফেট্টি বাঁধা থাকে আর ট্রিগারে আঙুল সঙ্গে নিয়ে গাদাগুচ্ছের সরকারি মোটর গাড়িতে চেপে সেই মেট্রপলিসের উদ্ঘাটন করতে দুর্ঘটনাক্রমে এসে পড়েছিল, আসলে জানতেই পারেনি যে তাদের না জানিয়ে একটা বিশাল নবাধুনিক মেট্রোশহর ঠিক সেই জায়গায় গড়ে উঠেছে যেখানে রোজ বিকেল বেলায় সূর্য নিজের রঙ পালটে টিঙটিঙ করে তলিয়ে যায় বা যেদিক থেকে মেঘগুলো পিঠে জলের পুকুর চাপিয়ে বৃষ্টিকে শহরের গুমুত নালিনর্দমা ধোবার জন্যে দৌড়ুতে-দৌড়ুতে ঝিকমিকে আলোর সুতো দুলিয়ে মহানগরের দিকে তরতরিয়ে পাঠিয়ে দ্যায় ।
তালগাছের কালচে-মেটেল হাঁড়ির সেই তাড়িতে, যার ভেতরে কালকেউটে চেরাজিভ ফোঁসফোঁসিয়ে রেগেমেগে হাঁড়ির পোড়ামাটি ছুবলিয়ে চোপরদিন পড়েছিল, আর সন্ধে হতেই কোনো রকমে হামাগুড়ি দিয়ে বেরোতে পেরেছিল, জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি কভি না যায়ে খালি বলে তালগাছের মাথা থেকে ঘাসের ওপর ঝাঁপ মেরেছিল, গর্তবাড়ির সোঁদা অন্ধকারে ফিরে মাদি কালকেউটেকে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলার জন্য সরসরিয়ে পালিয়েছিল । কালকেউটেনি কিন্তু ঠিক ধরে ফেলেছে যে কালকেউটে সারাদিন কোনো একটা গোলমেলে ঝঞ্ঝাটে ফেঁসে গিয়েছিল নয়তো তার গা থেকে অমন গন্ধ বেরোবে কেন যা সেই লোকগুলোর মুখ দিয়ে বেরোয় যাদের সাপে না কামড়ালেও আধমরা হয়ে রাস্তায় পড়ে ওঝাদের ময়ূরপালক ঝ্যাঁটা-মারা সাপেকাটা রোগীর মতন মাথাহীন ঘাড় থেকে জিভ বের করে গ্যাঁজলা নিয়ে ভাট বকে, কিংবা পদ্য আওড়ায় । কালকেউটেনির সে কি জিভচেরা দুশ্চিন্তা, কেননা তখনও খোলস ছাড়ার মরশুম আসেনি, সবে মেটিঙ-নাচনের আবহাওয়া ধিকিয়ে ধিকিয়ে শুরু হয়েছে ।
তাড়িতে দ্রব্যগুণের পরিমাণ-বৃদ্ধি আঁচ করে, গাঁয়ের খোকা-খুকু ছোকরা-ছুকরি বউ-মিনসে হাবড়া-হাবড়ি গায়েহলুদের খুরিতে কিংবা সবচেয়ে সস্তা চায়ের হাফসাইজ ভাঁড়ে জিভ চুবিয়ে যারা চুকুসচুকুসিয়ে খেলো,তারা সাপান্তক তাড়ির নেশা থেকে জীবনে বেরোতে পারেনি, এমন যে পরের দিন সূর্য ওঠার পর থেকে এক-এক জনের নেশা এক এক রকম চরিত্তির গড়ে ফেলল ।
খোকাখুকু, যাদের জিভে সাপান্তক তাড়ির আঙুল আদর করে চাটিয়ে দিয়েছিল তাদের মা-বাপ, তাদের পায়ে নানা ধরণের নাচ গজিয়ে উঠল, সেসব নাচ তাদের কেউ কখনও শেখায়নি, পরে, অনেককাল পরে, যখন গাঁয়ের নাম উটপাখি মেট্রো হয়ে গেছে, আর খোকাখুকুরা হয়ে গেছে ছোকরা-ছুকরি, তখন জানা গেল যে, সেসব নাচের দাঁত কিড়মিড়ে নাম আছে, যেমন হিপহপ, কনটেমপোরারি, বলিউড, ট্যাঙ্গো, লিনডি-হপ, মালাগুনা, মোম্বো, মাতাচিন, অ্যাফ্রিবিট, বুগিউগি, ব্রেকডান্স, ডিসকো, লকিং-পপিং, স্টম্প, সুইং, ট্যাপ, বিবয়িং, মুনওয়াক, ইলেক্ট্রো, পোগো, বারোক, ভিনটেজ, রেগে, ভাঙড়া, লাওনি, ওডিশি, ভারতনাট্যম, কথাকলি, ছউ, বিহু, গরবা, কুচিপুড়ি, বোলেরো, রুমবা, চাচাচা, জাইভ, সালসা, ফ্ল্যামেংকো আরও কতো কি, যেগুলো ওরা শহরে গিয়ে আলোঝিলমিলে মঞ্চে নেচেকুদে অনেক ট্যাকা রোজগার করে এনেছে, অনেক ছোকরা থেকে গেছে শহুরে ছুঁড়িদের শ্বেতচন্দন বিকিনিবুক খাঁজে আটকে । মাথাহীন হবার দরুন ফিলিমের পত্রিকাগুলোয় তাদের নিয়ে কতো রকমের খবর যে সাংবাদিকদের ফেনাতে হয়েছে, আগেকার কালের অভিনেত্রী-অভিনেতাদের মুণ্ডু চাপিয়ে দিতে হয়েছে তাদের ছবির ঘাড়ে ।
‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতে তো আর নাচ শেখার ইশকুল ছিল না, খোকা-খুকুরা জঙ্গলের সামনে শুকনো নোনা-খাঁড়ির ধারে ফাঁকা মাঠে নাচতো, আর দেখা যেতো নানা রঙের দেশি বিদেশি ফুল ফুটতে আরম্ভ করেছে যেখানে যেখানে তারা নেচেছিল । ফুলগুলোকে দেখেই দেশবসতের লোক বুঝতে পেরেছে,যে, যেখানে ‘দেশি নাম নেই ফুল’ ফুটেছে সেখানে খোকাখুকুরা এদেশের নাচ নেচেছিল,আর যেখানে ‘নাম নেই বিদেশি ফুল’ ফুটেছিল, সেখানে বিদেশি নাচ নেচেছিল। তারা যখন ছোকরা-ছুকরি হয়ে উঠলো, তখন একদল দেশি ফুলের নাচ রপ্ত করে ফেললে, আরেকদল বিদেশি ফুলের নাচ । এতো ফুল ফুটতে লাগল যে ‘নাম নেই ৯৮০৫৫’ মালাকার, ‘নাম নেই ৫৫৫’-এর মেছো জাহাজে ওপচান্তি ফুল ভরে বেচে আসে ফুলের বাজারে, যেখান থেকে শহরের আঁৎকান্তি ভয়পান্তি বউ আর বউন্যাওটা লোকজন মেছোগন্ধ ফুল কিনে নিয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে-পড়া ভগবান আর দাড়িয়াল জাগ্রত পুরুতের গম্বুজবাড়িতে পুজোআচ্চা করে, ফুলশয্যার রাতে অনেকসময়ে বর ভাবে নতুনবউয়ের গায়ে মহাভারতের ৬৭ পৃষ্ঠার মৎস্যগন্ধা সুগন্ধ, আর বউ ভাবে নতুনবরের গায়ে যেমন তিমিমাছের পালোয়ানি, তেমনই হাঙুরে বদগন্ধের নাছোড় সুবাস ।
সাপান্তক তাড়ির গুণে ‘নাম নেই ৯৯’ দেয়ালে-দেয়ালে ল্যাঙোটের সোনালি ছবি এঁকে লিখতে লাগল, আনন্দ করুন আনন্দ করুন গণতন্ত্রের সহিত একনায়কতন্ত্রের মিশেল এলো বলে ; ‘নাম নেই ৯৯’-এর ঘোষণামতন চটকানো পিন্ডিচটকেটের লোকভোলানে ঘরভাঙানে ঢেউপেট কুমড়োপোঁদা একনায়ক এসে যেতে পারে আঁচ করে বসতের লোকে বড়ো একটা জিভ বের করে না, বসতের সবাই, বাচ্চা-বাচ্চি ছোকরা-ছুকরি হাবড়া-হাবড়ি ঘাড় বন্ধ রেখে জিভ না নড়িয়ে কথা বলা রপ্ত করে ফেলেছে । বাইরে থেকে যারা আসে তারা মুখ খুলেই কথা বলে, ঘাড়বন্ধ কথা-বলিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে। ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর বাবা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ অবশ্য ঘাড় থেকে জিভ বের করেই কথা বলে, কেননা সে নিজেকে ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতের ছত্রহীন দলপতি বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, দেশবসতের লোকেরা তাতে আপত্তি করেনি, কেননা দেশবসতের সকলের বাড়ির নোংরা নর্দমার জল আর মেয়েদের মাসিকের কানি গিয়ে নদীতে পড়ছিল দেখে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’, ছেলে ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর জিভের কেরামতি কাজে লাগিয়ে নর্দমাগুলোকে জঙ্গলের ধারের শুকনো নোনা-খাঁড়ির দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে, ফলে দেশবসতের চাষিদের দরকার পড়লে নোনা-খাঁড়ি থেকে পাঁক-সার এনে খেতের মাটিতে মিশিয়ে লাঙল টানে, অনেক সময়ে বলদরা অরগ্যানিক চাষের বদগন্ধে আপত্তি করলে চাষিরা তাদের বলে তুই তো আর ধর্মের ষাঁড় নোস যে নাক ফুলিয়ে কুয়াশার ফোয়ারা ছাড়ছিস, তুই তো নিছক চাষের পদাতিক, চাষ করার জন্য জম্মেছিস, মুখ বুজে লাঙল টান। কিন্তু বলদেরা আপত্তি করতেই পারে, তাদের তো আর ঘাড় থেকে মাথা খসে পড়েনি ।
সাপান্তক তাড়ির গুণে সোনার বেনে ‘নাম নেই ৩৫৩৫৩৫’, তার দাদামশায়ের বিয়েতে পাওয়া খ্যাংরাতারের ছেঁড়া ছাতা মাথায় দিয়ে মানকচু পাতার মাইক বানিয়ে ভাদ্র মাসের নবমী তিথিত অশ্বিনী নক্ষত্রের সাতসকাল থেকে হ্যাট-হ্যাটিয়ে জোড়বাঁধা কুকুর তাড়িয়ে এগলি-সেগলি ঘুরে-ঘুরে চেঁচিয়ে বেড়াতে লাগল, নারকেলগাছের রাষ্ট্রীকরণ করা হোক, কোনো এক নারকেল থেকে মহাপুরুষের আবির্ভাব হবে ; সোনার বেনে ‘নাম নেই ৩৫৩৫৩৫’-এর ভবিষ্যবাণী অনুযায়ী দেশবসতের সবকটা নারকেলগাছ থেকে মহাপুরুষরা পোকার আকারে জন্মাবে আর সেই পোকা পুষে রাখবে সবাই, একদিন পোকাগুলো নিশ্চিত রঙিন পোশাক পরে ভাগলেওবাবা কিংবা ঘেঁটুরামসাধু বা পয়গামবাপু হবে, কিংবা জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়ে কোমরে চাপাতি গুঁজে, কাঁধে রাইফেল টাঙিয়ে, শুয়োর-মারার আর আদিবাসি-খুনের পুলিশের হান্টারম্যান হবে । তাদের মাথা থাকলেও থাকতে পারে, আবার না থাকলেও না থাকতে পারে । তাদের ছোকরাপার্টির বিচিতে ধাতুরস উপচে পড়লে তখন দলের কোনো ছুকরিকে ধরে ঝিংকিচিকিং ঝিংকিচিকিং ধর্ষণ করে জঙ্গলের জঙ্গুলে শুকনো পাতার ওপরে গান শোনাতো, ‘ কাঁদন হাসি, ভালোবাসি ভালোবাসি’।
আশ্বিনমাসের ষষ্ঠীর সন্ধেবেলা মঙ্গলবার বটতলায় গাঁয়ে-চাষকরা জিংকো বিলোবা মেশানো গাঁজার আসরে বসে লোলচাম ঝুলমাংস বুড়োরা, জিভ উঁচিয়ে হাতে-হাতে ছিলিম ঘুরিয়ে নির্ণয় নিলে যে রাষ্ট্র তো উটপাখি দেশবসতে আসেইনি তা রাষ্ট্রীকরণ হবে কেমন করে ; আগে রাষ্ট্র নামের লোকটাকে কিংবা যদি রাষ্ট্র বলতে গিরগিটিভবনের ধোপায়-কাচা কাপড়ের মরদমাগির গ্যাঞ্জাম বোঝায়, তাহলে সেই গ্যাঞ্জামকে তো ফুসলিয়ে বা লাথি মেরে পেঁদিয়ে গাঁয়ে আনতে হবে । সোনার বেনে ‘নাম নেই ৩৫৩৫৩৫’ ছেলের ইশকুলের বই থেকে রাষ্ট্র শব্দখানা জেনেছে, অবশ্য কথাটার মানে না জানলেও তার দেঁতো-ক্ষ্যামতার দাম জেনেছে, ওর ছেলে ‘নাম নেই ২৫২৫২৫’ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে রাষ্ট্র নিয়ে পড়ে, এবার ‘নাম নেই ৫৫৫’ এর মেছো জাহাজে চেপে অন্য ইশকুলে গিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার টুকলিফাই দেবে ।
সোনার বেনে ‘নাম নেই ৩৫৩৫৩৫’ এর কথায় উৎসাহিত হয়ে জোতদার ‘নাম নেই ১১১১১’ যে আগে জোতদার-বিরোধী আন্দোলনে সাতজন জোতদারকে কচুকাটা করার বিপ্লবে যোগ দিয়েছিল, আর এখন নিজেই জোতদার, আর যে কিনা ষষ্ঠীপুজোর সকালে দু’খুরি সাপান্তক তাড়ি টাটকা সাদা বকফুলের বড়ার সঙ্গে তারিয়ে খেয়েছিল, খোঁয়ারির বেখেয়ালে কৃত্তিকা নক্ষত্রের রাতে এক বছরের নারকেল গাছকে নিজের বউ মনে করে জড়িয়ে ধরে ওপর দিকে টেনে-টেনে দশ-পনেরো বছরের করে দিতে পেরেছে, তাই দেখে ‘নাম নেই শূন্য’’ দেশবসতের লোকে জোতদার-খুনি-জোতদার ‘নাম নেই ১১১১১’কে হাতজোড় করে বলেছে ‘নাম নেই ১১১১১’ দাদা, আমার সুপুরিগাছগুলোর বয়স বাড়িয়ে দাও না গো, তাহলে তাড়াতাড়ি সুপুরি পাই, ‘নাম নেই ৫৫৫’-এর মেছো জাহাজে চেপে গঞ্জে-শহরে বেচে দুটো পয়সা রোজগার করি, মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়ে গেল । একইভাবে কলাগাছ, পেঁপেগাছ, শালগাছ, দেবদারুগাছ, আমগাছ, জামগাছ, পেয়ারাগাছ, কমলালেবুগাছ, সবেদাগাছের বয়স বাড়িয়ে দিতে পেরেছে জোতদার-খুনি-জোতদার ‘নাম নেই ১১১১১’, বউয়ের মতন জড়িয়ে আদর দিয়ে । জোতদার-খুনি-জোতদার ‘নাম নেই ১১১১১’ তো গাছগুলোর বয়স বাড়িয়ে দিলে, কিন্তু গাছগুলোতে ফুল ধরবে ফল ধরবে, সে লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না অথচ গাছগুলোর বয়স কম হল না, সোমথ্থ গাছে উড়ুক্কু ঘুমে মৌমাছি প্রজাপতি টুনটুনিপাখি পোকামাকড়দেরও ডানায় ব্যথা ধরে গেল কিন্তু ফুলের দেখা নেই ; ফুলই যখন নেই তখন পরাগের আঠার ইশারা কেই বা ওড়াবে।
দেশবসত থেকে অনেককে একঘরে করে জলচল বন্ধ করা সালিশি সভা ডেকে চাষীদের তাড়িয়ে জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’-এর মেয়ে ‘নাম নেই ৭২০’ , সিংহ-রাশি রাক্ষস-গণ অশ্লেষা নক্ষত্রের জাতিকা, যে মনের দুঃখে সাপচোবানো তাড়ি এক ভাঁড় খেয়ে হাউহাউ চোখের-জল নাকের-জল মাতাল হয়েছিল, আর যে যৈবনে পৌঁছে প্রেম পাবার তাড়নায় আঁকুপাঁকু করছিল, সে শনিবারের রাত বারোটা বেজে চৌঁত্রিশ মিনিটে বিছানায় মায়ের পাশ থেকে উঠে বাগানে গিয়ে একটা সুপুরিগাছকে জাপ্টে জড়িয়ে যেন গাছটা ওর হবু বর ওঠবোস ওঠবোস করে তৃপ্তি পেতে চাইছিল, গাছটায় পিঙপিঙিয়ে তক্ষুনি-তক্ষুনি ফুল ফুটে উঠলো, আর সেগুলো এক রাতেই হয়ে উঠলো সবুজ সুপুরির ঝুমকো-গোছা, আর পেকে মেটেলরঙা হয়ে গেলো পরের রাতে।
মেয়ে ‘নাম নেই ৭২০’কে বিছানায় না পেয়ে জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’-এর বউ ঘোমটা মাথায় মেয়ের খোঁজে সুপুরি বাগানে গিয়ে চমৎকার ঘটনা দেখে অন্য গাছগুলোতেও অমন করতে বললে, মেয়ে বলেছিল, মা এক্ষুনি পারবো না, একটা চটচটানির আঠা তো রসিয়ে গেছে, ঘণ্টাখানেক সবুর করো। জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’এর বউ ‘নাম নেই ৪৪৪৪’ টের পেল যে তার মেয়েকে আদরেশ্বরীদেবী ভর করেছে, তাই বাড়ির উঠোনে এঁটেল-মাটির আদরেশ্বরী-আদরেশ্বরের থান তৈরি করে ফেললে । ভবিষ্যতের কথা ভেবে আদরেশ্বরীর সঙ্গে আদরেশ্বরকেও থানে ঠাঁই দিয়েছে, বলা তো যায় না জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’ই কোনো ক্যারদানি দেখিয়ে ফেলল, অবশ্য বিছানায় তো কোনো ক্যারদানিই আর পারে না, হাঁপাতে থাকে কামারের হাপরের মতন, যার দোকানে গিয়ে ‘নাম নেই ৪৪৪৪’ , ছেলে ‘নাম নেই ২০২’-এর জন্য লাট্টুতে আল বসিয়ে আনতো, এখনও ঢিলে সাঁড়াশি সারিয়ে আনে, এই তো সেদিন খুন্তি-হাতা-সাঞ্চা বদলে আনলো।
জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’-এর সবকটা সুপুরিগাছে সুপুরির গোছা, নারকেলগাছে নারকেলের কাঁদি, পেঁপেগাছ লটকান্তি পেঁপে, কলাগাছে কাঁদিঝোলা কলা, আমগাছে আম, লিচুগাছে লিচু, জামরুলগাছে জামরুল পেয়ারাগাছে পেয়ারা দেখে জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’-এর কাছে ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতের লোকে জানতে চেয়েছিল যে তার গাছে অসময়েই ফল ধরে গেল, অথচ অন্য কারোর গাছে কেন ফলের সময়েও ধরছে না ! জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’-এর বউ ‘নাম নেই ৪৪৪৪’ বললে আমার মেয়ে আহ্লাদী-গাঘষানে আদরেশ্বরীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্তর বের করেছে, তোমাদের গাছেও ফলবে, তারজন্যে আমাকে ট্যাকা দিতে হবে, যা দিয়ে মেয়ের বে দিতে পারবো, বে’থার আগে আদরেশ্বরীর থানে পুজো দিতে হবে, তোমরা যে যার আগে আমার উঠোনে আদরেশ্বরীর পুজো দিয়ে যাও । কিন্তু একদিনেই অতো হাতচালানে-গাঘষানে মন্তর পড়তে পারবে না আমার কচি মেয়েটা, সময় দিতে হবে, রাতের বেলা তোমরা কেউ বাড়ির বাইরে বেরোবে না, বেরোলে রাতকানা রঙকানা বউকানা বরকানা ধাতুবাঁজা মাসিকবাঁজা হয়ে যেতে পারো, এই হুঁশিয়ারি দিয়ে রাকলুম । হুঁশিয়ারি শব্দটা এমন যে রিকশর ভোঁপু বাজলেও লোকে আজকাল ভয়ে চুপসে ছোয়ারা হয়ে যায়, আর এ তো আদরেশ্বরীর মন্তর চালাচালির ব্যাপার ।
জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’-এর ছেলে ‘নাম নেই ২০২’ যে ‘নাম নেই ৫৫৫’-এর মেছো জাহাজে চেপে মাঝেমধ্যে বর্ষায় জলে থইথই পাঁকে পকপক মল-মাল্টিপ্লেক্সের পথে-পথে দোকানিদের সাইনবোর্ড ঝোলানো বড়োশহরে ইশকুলের বই কিনতে যায়, এক ফাঁকে জিভ উঁচিয়ে সিনেমা দেখে নেয়, সিনেমার ভাঁড়ানন্দ পত্রিকার পুরোনো সংখ্যা ফুটপাথের রদ্দিঅলার কাছ থেকে যোগাড় করে আনে, এক খুরি তাড়ি এক চোঁয়ে খেয়ে নিয়ে খেয়াল করেনি যে পূর্ণিমা-চাঁদের ড্যাবড্যাবে চোখের সামনে পুকুরে নেমে জলের মধ্যে চোখ বুজে জিভ দিয়ে স্বমেহন করছে, জলের মধ্যে যৌবনের আহ্লাদ এতো ভালো লাগলো যে রোজই কাকভোরে সবার আগে উঠে যখন জোয়ান ছেলেদের যৌবন তর্জনীর সমান্তরাল থাকে, পুকুরের জলে নেমে চোখ বুজে ভাঁড়ানন্দ পত্রিকায় দেখা কোনো টইটুম্বুর অভিনেত্রীর সবকিছু দেখতে-দেখতে লপচপিয়ে যৌবনের আহ্লাদ মিটিয়ে নিতো, আবার সন্ধ্যার অন্ধকারে পুকুরে চান করার নাম করে চোখ বুজে অন্য কোনো কচি অভিনেত্রীর অদৃশ্য দৃশ্যের সবকিছুর আহ্লাদ নিতো । শরীরের তাপ ডগমগে থাকতো ।
জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’ আলুর আড়ত থেকে ফিরে পুকুরে চান করতে নেমে দ্যাখে তিন দিন আগে মাছের চারা ছাড়া হয়েছিল , সেগুলো পাঁচ-দশ কিলো হয়ে গেছে । নিশ্চই মেয়ে ‘নাম নেই ৭২০’-এর কীর্তি অনুমান করে বউ ‘নাম নেই ৪৪৪৪’কে জিগ্যেস করতে সেও অবাক হল, কিন্তু সকাল থেকে উঠে পুকুরে নজর রাখলো মেয়ে ‘নাম নেই ৭২০’ কখন নামে, হয়তো মেয়ের মাসিকের সাপান্তক রক্ত চেখে চারাগুলো ফনফনিয়ে পাঁচ-দশ কিলো হয়ে গেছে । ওমমা, তা নয়, এতো ‘নাম নেই ৪৪৪৪’এর পেটের ছেলে পুকুরে নেমে চোখ বুজে জিভ দিয়ে ফনফনিয়ে নিজের আহ্লাদ মাছেদের খাওয়াচ্ছে । ব্যাস, আর দ্যাখে কে। পুকুরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছেলে ‘নাম নেই ২০২’কে ফিসফিসিয়ে বললে সব আহ্লাদ নষ্ট করিসনে, বিক্রি করে আয় করব । দেখেছিস তো তোর দিদির আহ্লাদী-আদরের টানে গাছে-গাছে কতো ফল লাগতে লেগেছে । তোর আহ্লাদ খেয়ে মাছগুলোও দিনকেদিন পাঁইপাঁই করে বেড়ে চলেছে, আঁশের চেকনাই যেন খাঁটি পালিশদেয়া রুপো। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে আদরেশ্বরীর সঙ্গে আদরেশ্বরের থানও রেকিচি ।
তিন দিনের মাছের চারা পাঁচ-দশ কিলো হতে দেখে যাদের পুকুর আছে, আর পুকুরে চারা ছেড়েছে, তারা জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’কে ধরাধরি করতে জবরদখল জমিমালিক বললে, ওসব বউ ‘নাম নেই ৪৪৪৪’-এর ডিপার্টমেন্ট, গাছের ফলের মতন পুকুরের মাছেও ও মন্তর খাইয়েছে । ‘নাম নেই ৪৪৪৪’-এর কাছে গিয়ে ‘নাম নেই শূন্য ’ দেশবসতের লোকেরা বললে বউদি আমাদের পুকুরেও খানিক মন্তর খাইয়ে দাও না গো, মাছগুলো পাঁচ-দশ কিলো হয়ে উঠুক । ‘নাম নেই ৪৪৪৪’ সবাইকে বলে দিলে যে ও মন্তর কাকভোরে খাওয়াতে হয় কিংবা সন্ধ্যায় শিশির পড়লে খাওয়াতে হয়, তার আগে তোমরা আমার উঠোনে আদরেশ্বরের পুজো দিয়ে যাও । তোমরা কেউ সেসময়ে বাড়ির বাইরে বেরিও না, নইলে রাতকানা রঙকানা বউকানা বরকানা ধাতুবাঁজা মাসিকবাঁজা হয়ে যাবে । কিন্তুক মন্তর খাওয়াবার জন্যে আমাকে ট্যাকা দিতে হবে , আদরেশ্বরকে মাছ-মাংস-ডিম আর ভালো ভালো খাবার খেতে না দিলে তার শরীর হেদিয়ে যেতে পারে, তখন আর মন্তর খাওয়ানো যাবে না ।
যৈবনে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে পয়দা করে জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’ আর তার ভারিভরকম বউ ‘নাম নেই ৪৪৪৪’-এর মনে হয়েছিল যথেষ্ট, এখন আপশোষ হতে লাগল, হায় হায় হায় হায়, আর রোজ দুপুরে আর রাতে জবরদখল জমিমালিক আড়ত থেকে ফিরলে দুজনে মিলে ছেলে-মেয়ের যাতে আরও ভাইবোন হয়, তার জন্য আবার হাঁইহুঁই শুরু করল, বছর কেটে গেল কিছুই হল না দেখে জবরদখল জমিমালিক জীবনভরের জন্যে আপশোষ পুষে রাখার অভ্যাস করে ফেললে, ওর ভারি-ভরকম বউ দোক্তা-দেয়া পানের খিলি মুখে পুরে আর জবরদখল জমিমালিক কুচোনো ফিনফিনে সুপুরি পুরে, যে সুপুরি ‘নাম নেই ৫৫৫’ বড়োশহরে মেছো জাহাজ নিয়ে গেলে এনে দ্যায় । জবরদখল জমিমালিক চুপিচুপি ‘নাম নেই ৫৫৫’কে বলে রেখেছিল, যে, শহরে যদি আবার জোয়ান হবার কোনো ওষুধ-বিষুধ পাওয়া যায় তা এনে দিতে, যাতে আরও দু’চারটে ছেলেপুলে পয়দা করা যায়।
মেছো জাহাজের কাপ্তেন ‘নাম নেই ৫৫৫’ জবরদখল জমিমালিকের ইশারাটা বুঝতে না পেরে নিজের মেছো জাহাজে কম বয়সী একজন শহুরে ভাড়ার চিকনসুন্দরীকে ট্যাকার লোভ দেখিয়ে ফুসলিয়ে এনেছিল । জবরদখল জমিমালিক আড়তে না গিয়ে সেই চম্পাকলি চিকনসুন্দরীর সঙ্গে দুপুরটা জাহাজের মেছোগন্ধ পাটাতনে কাটিয়ে টের পেলো যে মাঝেমধ্যে ‘নাম নেই ৫৫৫’কে বলতে হবে এরকম জোয়ান হবার দাওয়াই শহর থেকে আনতে, শরীরটা বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে, যা ভারিভরকম বউয়ের সঙ্গে হাঁইহুঁই করলেও হয় না, শহুরে ভাড়ার বউরা কতো ক্যারদানি জানে, ভারিভরকম বউয়ের তো সেই একই, তাসের পিঠে তাস । ট্যাকা রোজগার হচ্ছে যখন তখন খরচ করতে দোষ নেই, যাদের ট্যাকা আছে তাদের জন্যেই তো বাজার, বাজার দর, দরের চাপান-ওতোর, বাজারের চিকনসুন্দরীরা ।
চিকনসুন্দরীদের শহুরে লিপস্টিক মাখা জিভে লম্বা জিভ বুলিয়ে চুমু খেয়ে জবরদখল জমিমালিক বলেছিল আরও ক্যারদানি শেখাস গো, যৈবনটা মিছে চলে গেল তোদের গপ্পোগাছা জানতে না পেরে, আমাকে কম হাঁপাতে হয় আর তোকে বেশি পালোয়ানি করতে হয় এমন ক্যারদানি শেখাস । চপলমতি নামে এক চিকনসুন্দরীর ক্যারদানিতে জদরদখল জমিমালিক তো একেবারে থ, হতবাক, বললে, যৌনমন্ত্রীর বডির ছাপ-দেয়া এরকুম রঙিন বেলুন পরিয়ে জিভ দিয়ে টানার-ফোলাবার খেলা জানতুম না গো, বেলুনের গন্ধে প্রাণটা রামছাগলের মতন মম-মম করে । চপলমতি মাথাহীন বুকে বুক ঘষে আদুরে গলায় বলেছিল, করুক না, নোঙরখোলা পুরুষরা যদি রামছাগল না হয় তাহলে বুঝতে হবে তাদের কোমরখানা ল্যাজখোয়ানো টিকটিকির ।
শতভিষা নক্ষত্রের এক সন্ধ্যায় ঢেউ দেদোল জাহাজে ক্যারদানি যখন বেশ জমপেশ চলছে, জবরদখল জমিমালিক পষ্ট দেখতে পেলো, মেছো জাহাজের কাপ্তেন ‘নাম নেই ৫৫৫’ও দেখলো, নদীর জল থেকে ঢাউস ঢেউ তুলে একজন বউয়ের মাথা উঠে এসে উপুড়কান্তি জবরদখল জমিমালিকের ন্যাংটা পাছায় ঠাণ্ডা ভিজে হাত দিয়ে গনগনে গরম চাপড় মেরে বললে, এসব ভালো করছোনি ‘নাম নেই ৮৯৭০-বাবু’ , তোমার ভারিভরকম বউ টেরটি পেলে তোমায় পানদোক্তার সঙ্গে চিবিয়ে গিলে খেয়ে ফেলবে ।
জবরদখল জমিমালিক আর মেছো জাহাজের কাপ্তেন পষ্ট দেখলো, দেখে স্হিরনিশ্চিত হলো, ওই বউয়ের মাথা আর কারোর নয়, অ্যানাকোণ্ডা-জিভ ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর মা ‘নাম নেই ৯৭৮৫’-এর, মাথাহীন ঘাড়ে বাচ্চা গোলাপি কাঁকড়ার ঝাঁকভরা এলোকেশ, বেশ কয়েকটা বড়ো মাপের কাঁকড়া ‘নাম নেই ৫৫৫’-এর মেছো জাহাজে ঝরে পড়েছিল, যেগুলো সেই সন্ধের রাঁড় কাঁকনমালা নিজের টুকিটাকির ঝোলায়, যাতে যৌনমন্ত্রীর মুখ দেহ আঁকা রঙিন সুগন্ধী বেলুন থাকে, আর জবরদখল জমিমালিককে অকুস্হানে পরিয়ে দিয়ে জিভে পাকিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা সামলায়, রেখে, নিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল, এতো বড়ো মাপের কাঁকড়া কতোকাল খাইনি বাবু, গরম তেলে ছাড়লেই যা রঙখানা হবে, নোলা সামলাতে পারবে নে ।
তারপর থেকে ভয়ে জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’ মেছো জাহাজের বদলে জঙ্গুলে অন্ধকারে ‘নাম নেই ৫৫৫’-এর আনা ভাড়ার চিকনসুন্দরীদের নিয়ে গিয়ে ঘাসের ওপর যৌনমন্ত্রীর বডির ছাপ-দেয়া রঙিন সুগন্ধী বেলুন পরে জাহাজের মেছোগন্ধ গদি বিছিয়ে ক্যারদানি খেলতো । মেছো জাহাজের কাপ্তেন হুশিয়ারি দিয়েছিল, অমন রাঁড়-রাঁড় বলবেন না, কে বলতে পারে হয়তো আজ বাদে কাল কাঁকনমালাকে আপনি বউ করে বাড়ি নিয়ে গেলেন । জবরদখল জমিমালিক বলেছিল, অমন ভাগ্য করে কী আর এসিচি, মাগদখলের দিনকাল কবে ফিরবে জানি নে, মাথা খসে গিয়ে নতুন যুগ এলো, অথচ যুগের সঙ্গে তাল দিয়ে সময় এগুতে পারছে না, এদিকে আমাদের বর্তমানই ভবিষ্যৎ ।
সোমবার দিন রাত একটা বেজে কুড়ি মিনিটে, চাঁদ তখন মেঘের সঙ্গে টুকি খেলছে, শুক্লপক্ষের দশমী, ‘নাম নেই নদী’ আলিস্যিতে মাঝরাতের পোয়াতি হাইতোলা আড়মোড়া ভাঙছে, একদল হাওয়া আরেকদল হাওয়ার সঙ্গে দেবদারু পাতার হলুদ ফর্ম বিলি নিয়ে মারধাড় খেলছে, জবরদখল জমিমালিক আর মেছো জাহাজের কাপ্তেন, ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর মা ‘নাম নেই ৯৭৮৫’কে দেখার ইচ্ছেতে ‘নাম নেই নদীর’ ধারে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, দাঁড়িয়ে ‘নাম নেই ৯৭৮৫’-এর কাঁকড়াকেশ এলোচুল কাঁধ দেখতে পায়নি বটে, কিন্তু নদীর ওপর দিয়ে ঘোড়াদের দৌড়ের খুরের আওয়াজ শুনেছিল, আর যেন ঝাঁসির রানির মতন তাদের হাঁকিয়ে নিয়ে চলেছে ‘নাম নেই ৯৭৮৫’-এর গলা হেই হো হেই হো । নদীর জলে ঘোড়াদের খুর পড়ার সময়ে ফিনকি দিয়ে স্ফূলিঙ্গ জ্বলে-জ্বলে উঠছিল, সেই আগুন ফিনকি বুকের ওপরে ছিটকে লেগে পুড়ে ছিটের কাপড় হয়ে গিয়েছিল জবরদখল জমিমালিক, তাতে ওর একটা সুবিধে হয়েছিল যে লোকে জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’-র বদলে আড়ালে-আবডালে ওকে পোঁদপোড়ার নাম নেই বলে উল্লেখ করতো।
মেছো জাহাজের কাপ্তেনের এসব কেলোর কিত্তি দেখাও আছে, শোনাও আছে, আগে তো সে মাছ ধরতো দূরের মাঝ-সমুদ্দুরে, সেই যবে থেকে জাহাজে তোলা তিন কিলো সোমথ্থ রুইয়ের দলের সঙ্গে একই ওজনের মাগি-কাৎলারা ঝগড়া বাধিয়ে জাহাজখানা এরেকটু হলেই কাৎ করে ডুবিয়ে দিতো, তবে থেকে মাছ ধরা ছেড়ে মানুষ আর মালপত্তর পারাপার করে । রুইদেরই দোষ, কেন মিছে কাৎলাদের বলছিল, মাথা মোটা মেড়ো কোথাকার, আর কাৎলারা কেন বলছিল রুইমেয়েগুলো বাঙালিদের মতন চরিত্রহীন, এক কিলোর হতেই যে-রুইপুরুষ পোঁদে লাগলো তা্রই ডিম বিয়োবার জন্য হেদিয়ে মরে, জলের সময়-অসময়, ভাটা না জোয়ার, উত্তরফালগুনী নক্ষত্র না পূর্বফালগুনী, কৃষ্ণপক্ষ না শুক্লপক্ষ কিচ্ছু খেয়াল করে না ।
মেছো জাহাজের কাপ্তেনের সৎভাইরা, ‘নাম নেই ১৪’ আর ‘নাম নেই ৬৩’ এখন মাছ ধরে, শহুরে নাইলনের ফিকে নীল জাল দিয়ে, সোজা শহরে নিয়ে গিয়ে মহাজনের কাছে উপুড় করে ট্যাকা নিয়ে চলে আসে, নৌকোয় তোলা মাছেরা ঝগড়া শুরু করলেই পিটিয়ে বোবা করে দ্যায়, মাছগুলো মরে গিয়ে মুখ বন্ধ করে ড্যাবডেবিয়ে বৃষ্টিফোঁটার মতন তাকিয়ে থাকে, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না । সৎভাইদের সাড্ডল্য করে তুলতে গিয়ে মেছো জাহাজের কাপ্তেনের বিয়ে করার সময় হয়ে ওঠেনি বলে শহরের লেডিলাইট পাড়ায় গিয়ে ভাড়ার চিকনসুন্দরীদের সঙ্গে পিরিত করে আশ মিটিয়ে নেয়, এক ঘণ্টা বা দশ ঘণ্টার ইচ্ছেমতন নতুন বউ পাওয়া যায়, বিয়ে-করা বউয়ের থোড়-বড়ি-খাড়ার একঘেয়েমি নেই ।
এদিকে পশ্চাদ্দেশে চাপড় খেয়ে জবরদখল জমিমালিক ‘নাম নেই ৮৯৭০’-এর পোঁদে পাঁচ আঙুলের ফোস্কা পড়ে গেছে । রাতে হাঁইহুঁইয়ের সময়ে ভারিভরকম বউ ‘নাম নেই ৪৪৪৪’ পাছায় হাত দিয়ে ফেললে জবরদখল জমিমালিকের গোঙানি-কাতরানিতে ভারিভরকম বউ ‘নাম নেই ৪৪৪৪’ লন্ঠন জ্বেলে দেখে বললে, এ কী, তোমার পেছনে তো পেত্নিতে পাঁচ আঙুলের ছ্যাঁকা দিয়ে গেছে, কোনো গোলমেলে কাজ করোনি তো ? জবরদখল জমিমালিক ককিয়ে বলেছিল, নিজেই তো দেখছিস, শুধুই হাঁইহুই, আর কি যৈবন কোমরে আছে, সবই তোকে বিলিয়ে দিয়েছি, তাই তো আর দুচারটে পয়দা করতে পারলুম না, করতে পারলে আমাদের দ্যাখে কে ! তুই রাজরানি হয়ে যেতিস । ভারিভরকম বউ ‘নাম নেই ৪৪৪৪’ কুঁচকির খোঁপা খুলে পাছা পর্যন্ত চুল দিয়ে খোলা বরের পোঁদ ঢেকে চুলের কাঁটা নিয়ে ফোস্কাগুলো গেলে দিতে জবরদখল জমিমালিকের তখনকার মতন আরাম হলো, কিন্তু পাছায় ওই পাঁচ আঙুলের ছাপ নিয়েই তাকে শ্মশানে পুড়তে যেতে হয়েছিল শুক্লপক্ষের চতুর্থীতে, যখন জবরদখল জমিমালিকের বয়স আশি বছর তিন মাস, আর ভারিভরকম বউ মারা যাবার পর ট্যাকার গরম দেখিয়ে পঁয়ষট্টি বছর বয়সে মাথাহীন ঘাড়ে টোপর, বুকে সেলো-টেপ দিয়ে সাঁটা রজনীগন্ধা-গোলাপের মালা, ছেলে ‘নাম নেই ২০২’-এর ছেলে, মানে নাতিকে, নিতবর সাজিয়ে আবার বিয়ে করেছে ; মেছো জাহাজের কাপ্তেন ছাড়া কেউই জানতো না যে বউটা আসলে কাঁকনমালা নামের এককালের ডবকাবুকো তানপুরাপাছা জবরউরু চিকনসুন্দরী, যে তার নানা কায়দার ক্যারদানির জোরে শীতের হার্নিয়ায় কেলানো আর প্রোস্টেটে ধিমেতাল ন্যাতানো প্রত্যঙ্গখানা সত্বেও, জবরদখল জমিমালিককে আশি বছর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে, দুটো ছেলে দুটো মেয়ে পয়দা করে দিয়েছে, অবশ্য ততোদিনে কালচে-মেটেল হাঁড়ির তাড়ি জল মিশিয়েও ফুরিয়ে গেছে । ছেলে-মেয়েগুলো দেখতে ভালোই হয়েছে, একটু কালচের দিকে গেছে, অনেকটা মেছো জাহাজের কাপ্তেন ‘নাম নেই ৫৫৫’-এর আদল-আদরার সঙ্গে মিল আছে, চুলও মেছো জাহাজের কাপ্তেনের মতন কোঁকড়া ।
ওদিকে জবরদখল জমিমালিকের মেয়ে ‘নাম নেই ৭২০’ আর ছেলে ‘নাম নেই ২০২’-এর কেরামতিতে ভারিভরকম বউয়ের ট্যাকা রোজগার হতে লাগলো, আর দেশবসতের জনমনিষদের গাছে ফল হতে লাগল, পুকুরের মাছ পাঁচ-দশ কিলো হতে লাগল, আর মেয়ে ‘নাম নেই ৭২০’-এর আদরের রসে মনের দুঃখ চলে গেল, দূর দেশবসতের মাথাহীন কেঁদোকাত্তিক বর জুটতে দেরি হলো না, বরকে অবশ্য কনে ‘নাম নেই ৭২০’ বলে দিয়েছিল, বিয়ের পর তোমার বাড়ি যেতে মেছো জাহাজে দু’রাত্তির লাগবে, নৌকোয় সাত রাত্তির । ফুলশয্যা করব কখন ? ‘নাম নেই ৭২০’-এর বর কেঁদোকাত্তিক নরসুন্দর নৌকোর ছইয়ের মধ্যেই বিনাফুলের ফুলশয্যার ব্যবস্হা করে ফেললে ।
ফুলশয্যার রাতের ফিনফিনে বাতাসে, চিত্রা নক্ষত্রের আকাশে খাঁড়ায় কাটা কাস্তে-চাঁদ যখন ছইয়ের ভেতরে উঁকি দিয়ে ওদের লীলেখেলায় ফোকাস মেরে দেখছে, কনে ‘নাম নেই ৭২০’ ‘নাম নেই বর’ কেঁদোকাত্তিক নরসুন্দরকে লজ্জাবতী আদুরেপনায় বললে, ও গো, তুমি যখন আমার সঙ্গে প্রেম করবে তখন আমি চোখ বুজে ঋতিক রোশনের বডিখানা কল্পনা করবো, দাদা ‘নাম নেই ২০২’-এর ভাঁড়ানন্দ ফিলিম ম্যাগাজিনে ঋতিকের অনেক খালি গায়ের ছবি দেকিচি, কি বুকের পাটা, কি হাতের গুলি, এট্টুও চুল নেইকো । ‘নাম নেই বর’ উত্তরে বলেছিল, ঠিকই তো, ঠিকই তো, আমিও চোখ বুজে প্রেম করবো আর কল্পনায় সানি লিওনকে নিয়ে আসবো, ওর পুরো ঝিকিরমিকির ছবি দেখেছি ইনটারনেটে, টাটকা থোড়ের মতন উরুর চেকনাই, বুক যেন গ্রিস দেশের মূর্তি থেকে ধার নিয়েছে, তার ওপর বসানো পাকা করমচা, তোকেও ইন্টারনেটের প্রেম দেখাবো, মেজাজ পাগলি হয়ে যাবে, সংসার করার সময় পাবি নে। আদুরে গলায় কনে বলেছিল, সংসার আবার আলাদা কোনো কাজ নাকি, এই কাজটেই তো সংসার গো ।
‘নাম নেই বর’-এর চাটানো আফিমে মশগুল ফুলশয্যার খেলা খেলতে-খেলতে জিভের উঁকি দিয়ে কনে ‘নাম নেই ৭২০’ দ্যাখে, ওম মা, এ তো সত্যিই বুকে-চুল-নেই ঋতিক রোশন, হুবহু, কেঁদোকাত্তিক ‘নাম নেই বরও’ জিভের চোখ খুলে দেখলে, ইরি বাবা, এ তো কোথ্থাও-চুল-নেই সানি লিওনে, টাটকা থোড়ের মতন উরুর চেকনাই, দুই বুকে হাত চেপে ধরে কোমর দুলিয়ে গাইছে ম্যায় বেবি ডল হুঁ সোনে দি ।
যে দুজন মাঝি দাঁড় বাইছিল, তারা একসঙ্গে বলে উঠলো, দাদাঠাকুর নৌকো বড্ডো দোল খাচ্ছে, একটু থিতিয়ে-থিতিয়ে পিরিত করলে তো ভালো হয়, আপনার গাঁয়ে ফিরতে তো আরো পাঁচ রাত লাগবে, তার জন্যে ক্ষ্যামতা ধরে রাখুন। মোটা মাঝি রোগা মাঝিকে ফিসফিসিয়ে বললে, কী সব আইজকালকার গান, কেন, উথালি পাথালি…আমায় ভাসাইলি রে…আমায় ডুবাইলি রে…গাইতে পারতিস তো, তা নয় যত্তো নোংরা হিন্দুস্তানি গান, সেই তো উথালি-পাথালি করতেছিস দুজনে, ভাসতেছিস আর ডোবাইতেছিস । শোনার গোলমেলে কারণ এই যে মাঝিদের যাতে টানা সাতরাত দাঁড় বাইতে কষ্ট না হয়, তাই ‘নাম নেই বর’ ওদেরও আফিম চাটিয়ে দিয়েছিল ।
মাঝিরা শুনতে পাচ্ছিল নদীর ঢেউখেলানো জলের ওপর দিয়ে খুরের টগবগ আওয়াজ তুলে আরবি ঘোড়ার দল ঘাড়ের লোম উড়িয়ে গুমোট হাওয়া চিরে ফালাফালা করে দৌড়ুচ্ছে, জলের ওপরে তাদের খুরের চাপে ফিনকি জ্বলে-জ্বলে উঠছিল, কনে ‘নাম নেই ৭২০’ ঠিক টের পাচ্ছিল ‘নাম নেই ৯৭৮৫’-এর গলায় হুকুমের স্বর শোনা যাচ্ছে,ঘোড়াগুলোকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোনো যুদ্ধ লড়ার জন্যে । কাঁকড়াগুলো ঢেউ চিবিয়ে হাসছে আর কাঁদছে, কেননা যদিও শুনেছে এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে পালাবদল আনতে হয়,কিন্তু ওদেরও তো মাথাহীন মানুষদের মতন এগোনো-পেছোনো বলে ব্যাপার নেই, ডাঁয়ে বাঁয়ে সামনে পেছনে না তাকিয়েই যেতে পারে ; সেই তো কবে, যারা এ আজাদি ঝুঠা হ্যায় জিগির তুলে বলেছিল পালাবদল আনবে, তাদেরই ফুসফুসে গোবরের পাহাড় জমে গেল, শিরায়-শিরায় বইতে লাগলো কুকুরের পেচ্ছাপ, মজ্জায়-মজ্জায় গজিয়ে উঠলো উইপোকার ডিম।
জবরদখল জমিমালিকের ছেলে ‘নাম নেই ২০২, বায়না ধরেছিল, মা আমি শহরের মেয়ে বে করব, একবার জঙ্গুলে পথ বেয়ে বাবার সঙ্গে শহরে গিয়ে মদ খেয়ে নাচের হোটেলে মেয়েদের দেখেছিলুম, চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল, আহা, যেমন বুকের আলো তেমনই পাছার ঢালও , জিভ এমন টুকটুকে যে মনে হয়েছিল এক কামড় দিয়ে দেখি কেমনতর মিষ্টি, ইশকুলের মেয়েদের মতন সর্ষের তেলে চোবানো আমের আচার নয় । মা ভারিভরকম ‘নাম নেই ৪৪৪৪’ দোক্তাদেয়া পানের খিলি মুখে গুঁজে বলেছিল, তা তুই যা চাস তাই হবে, তবে তার জন্যে তো শহরে যেতে হবে । এবার বাবা যদি জঙ্গুলে পথ বেয়ে শহরে যায় তাহলে তুই সঙ্গে যাস, নইলে মেছো জাহাজের কাপ্তেনের সঙ্গে যেতে পারিস, সকলেই তো আজগাল ফল-পাকুড় আর মাছ বেচতে শহরে যাচ্ছে । শহরের মেয়েরা ট্যাকা দেখলেই ঝাঁপিয়ে ছেলে ধরে । এখুন আমার অনেক ট্যাকা, জামগাছের গোড়ায় আমার বিয়ের তোরঙ্গে থোকাথোকা নোট পুঁতে রেখিচি । শুনে, ছেলে ‘নাম নেই ২০২’ বলেছিল, তাই বলো, আমি ভাবছিলুম জামগুলো দিনকেদিন এতো মিষ্টি হয়ে উঠছে কোন জৈবিক সারে !
দেশবসতের জনমনিষের চিন্তা আরম্ভ হল এতো ফসল তো কাপ্তেনের ছ্যাকড়ামার্কা মেছো জাহাজে বড়ো-বড়ো শহরের আড়তে রোজ-রোজ নিয়ে যাওয়া বেশ হ্যাঙ্গাম, আর নিজেদের দেশবসতে বিকিয়ে ফুরোবে না, এশহরে-সেশহরে নিয়ে গিয়ে বেচতে হবে অথচ শহরে যাবার রাস্তা নেই ; ভোটাভুটির সময়ে দলাদলির কুমড়োপোঁদা বিশালভুঁড়ি নেতারা জঙ্গুলে ঘাসের পথ বেয়ে কোনোরকমে এসে ঘাড় নেড়ে হাত উঁচিয়ে বলে যায় ফিবছর যে আবনারা চিন্তা করবেন না এই বাজেটেই খসড়া রাস্তা পেতে দেয়া হবে খোড়ো-যাদবের গালের চেয়েও চকচকে, তবু বছরের পর বছর কেটে যায়, নেতার ছেলে বা ছেলের বউ, কুমড়োপোঁদা বিশালভুঁড়ি হবার পর, তারাও মরা বাপের বক্তিমে আউড়ে যায়, তবু দূর-দূর বড়ো শহর পর্যন্ত রাস্তা হয় না, না কাঁচা না পাকা ।
মেছো জাহাজের কাপ্তেন ‘নাম নেই ৫৫৫’ তিন খুরি সাপান্তক তাড়ি পুঁটিমাছ ভাজার সঙ্গে খেয়েছিল, বলল আচ্ছা আমি চেষ্টা করে দেখছি, এক-কালে পালতোলা বড়ো নৌকোয় গুণ টেনেছি, দেখি তা কাজে দেয় কিনা । ‘নাম নেই ৫৫৫’ মেছো জাহাজের কাপ্তেন গ্রামের প্রধান সড়ককে টেনে লম্বা করে কাছের বড়োশহর পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্যে প্রতিদিন সকাল থেকে সড়কে গজাল পুঁতে গুণটানা নৌকোর মতন গজালে দড়ি বেঁধে টানতে থাকে, তার টানার ফলে রাস্তাটা চল্লিশ দিনে চল্লিশ কিলোমিটারের মতন বেড়ে প্রথম কাছাকাছি বড়োশহর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, সেই থেকে দেশবসতের লোকেরা তার কাছে গিয়ে পায়ে পড়ে বলে, কাপ্তেন-খুড়ো আমাদের বাড়ির সামনের গলিটাকে বাজার অব্দি টেনে দাও না গো, কেউ বলে কাপ্তেন-জেঠা আমাদের পাড়ার রাস্তাটা নদীর ঘাট অব্দি টেনে দাও না গো, আবার কেউ অনুনয়-বিনয় করে, আমাদের গলিটাকে শ্মশান পর্যন্ত টেনে দাও না গো, মড়া বইতে হাঁপ ধরে যায়, জানোই তো আমাদের পাড়া বুড়ো-বুড়িতে গিজগিজে, রোজই একটা করে টেঁসে যাচ্ছে, কতো সংখ্যা জমে যাচ্ছে অথচ সেই অনুপাতে বাচ্চা জন্মাচ্ছে না, বাজারে এতোরকমের ট্যাবলেট এসে গেছে ।
মেছো জাহাজের কাপ্তেনের দৌলতে গ্রামের ফসল আর নদীর থইথই মাছ বড়ো-বড়ো শহরে যেতে লাগল, মড়ারা শ্মশানে যেতে লাগলো, দেশবসতের লোকেরা বড়োশহর থেকে ভ্যান মোটরসাইকেল, মিনিট্রাক, সাইকেল, ভ্যান রিকশা, ঠেলাগাড়ি, কিনে এনে ফসল নিয়ে গিয়ে বেচতে লাগলো শহরের পাশের শহরে, তার পাশের শহরে, শহরের এই বাজারে সেই বাজারে, বেচে ট্যাকা রোজগার করতে লাগল । শহরে তো থাকেই দুই ধরণের মানুষ, একধরণের লোক চাষির কাছ থেকে কিনে ফড়েদের বিক্রি করে আর আরেকদল লোক মাইনে পেয়ে মজুরি পেয়ে কেনে । শহরের লোকেরা গরিবের গালাগালকে বেশ ভয় পায় কেননা তাদের গালাগালের আঘাতের জোর বড্ডো গায়ে লাগে ; সমানে-সমানে গালাগালি তবু সয়ে যায় ।
লঝঝড়ে মেছো জাহাজের কাপ্তেন দুপাশে লাল রঙের রাক্ষস আঁকা ভুটভুটি কিনে ফেললে। ভুটভুটি চেপে চৈত্রমাসের নবমী তিথির এক সকালে হাওয়া যখন লম্বালম্বি বইছে, নীল জামার ওপরে শাদা ঝোলা-কোট গলায় গলবস্ত্রের মতন রবারের পাইপ ঝোলানো একজন বেঁটেবাঁটকুল বছর চল্লিশের লোক ‘নাম নেই শূন্য’ গাঁয়ে এসে হাজির, তারও ঘাড়ের ওপর মাথা নেই, তবু দোমড়ানো শরীর দেখে টের পাওয়া যায়, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার দাগ কম বয়সের পানিবসন্তের ছোপ-ছোপ হয়ে রয়ে গেছে বেচারির সারা গায়ে, মাথা থাকলে আরো কতো দুঃখেই না ভুগতে হতো ।
ভুটভুটিতে চাপানো রোজকার ফসল জিভের উঁকি দিয়ে দেখে সে বোধহয় ভেবেছিল যে দেশবসতের লোকেরা দেদার কীটনাশক ছড়াচ্ছে, নানারকম রাসায়নিক সার দিচ্ছে মাটিতে, নিশ্চই পটল-ঢেঁড়সে সবুজ রঙ করছে, পাবদা আর লইট্টা মাছ গোলাপি রঙে চোবাচ্ছে, অতএব গাঁয়ের লোকেদের জ্বরজারি পিলেপিত্তি উদুরি আমাশা খোসপাঁচড়া আন্ত্রিক না হয়ে যায় না । লোকটা বলল সে ডাক্তার, যতই জটিল আর ঘোরতর হোক সবরকম অসুখ-বিসুখ সারায় । দেশবসতের লোকে তাকে বললে কিন্তু শাদাকোটবাবু, আমাদের ‘নাম নেই শূন্য’ দেশে কারোর তো কখনও অসুখ-বিসুখ সারে না ; সরকারি হাসপাতালের বিছানা রাস্তার কুকুর-বেড়ালদের জন্য রিজার্ভ করা, দালাল না ধরলে বেড পাওয়া যায় না, আমাদের তাই রোগ আসে রোগ যায়, যার মরার সে রোগের সঙ্গে মরে চলে যায় । বিখ্যাত লোকরা মরলে অবশ্য চার রাস্তার মোড়ের চত্বরের বেদিতে তার লাশের নাকে তুলো গুঁজে দু’দিন পচিয়ে গান শুনিয়ে গতি করা হয় ।
ডাক্তার শাদাকোটবাবু জানতে চাইলে, বুড়ো আঙুলের কর দেখিয়ে, কেননা লোকটার দুহাতেই কড়ে আঙুল ছিল না, লাল্লিঙ্গ আর লাল্গুদদের জমানায় কান ধরে হামাগুড়ি না দেয়ায় কেটে নেয়া হয়েছিল, জানতে চাইলে, এইটুকুও কি সারে না, একটু তো নিশ্চই সারে । সোনার বেনে ‘নাম নেই ৩৫৩৫৩৫’-এর বাবা, যে আগে আসল লখিবাবুর আসল চাঁদির আসল দোকানের আসল মালিক ছিল, সে বললে, কারোর কোনো ব্যারাম হলে আমরা তাড়ির খোরাক খেয়ে সারিয়ে নিই, আমাদের এক-এক তালগাছের তাড়ি এক এক ব্যারাম কিছুক্ষণেই সারিয়ে দ্যায়, ওই যে দেখছেন ওই তাল গাছটা, ওই গাছের তাড়ি খেলে শর্দিকাশি জ্বর সেরে যায়, তার পাশের গাছটার তাড়ি খেলে শীঘ্র ধাতুপতন সেরে যায়, তার পাশের গাছটার তাড়িতে ফুসফুসের সব রোগ সেরে যায়, আমাদের ‘নাম নেই শূন্য’ গাঁয়ে তালগাছের অভাব নেই । তবু, আপনি অতিথি মানুষ, দেখুন যদি কারোর উবগারে লাগেন । ‘নাম নেই ৩৫৩৫৩৫’-এর বাবা, জানতে চেয়েছিল, যে, শাদাকোটবাবু কোনো আগুনলাগা সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেনি তো কখনও, তার উত্তরে শাদাকোটবাবু বলেছিল, আজ্ঞে সেসব চাকরিতে ডাক্তারির আসল ডিগ্রি দরকার হয়, তাই কাজ করা হয়ে ওঠেনি। শুনে উপস্হিত বুড়োরা মাথাহীন ঝিমন্ত দেহ নেড়ে বলেছিল, তা বেশ, তা বেশ ।
‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতের বুড়োদের আফিমি মৌতাতে সকাল-সন্ধে গ্যাঁজাবার যে ঘরখানা ছিল, সেটাই শাদাকোটবাবুকে দেয়া হল, সে বড়োশহর থেকে মেছো জাহাজের কাপ্তেনের লাল রাক্ষস আঁকা ভুটভুটিতে চাপিয়ে নানা কৌটো শিশি বোতল ডিবে করে কীসব বড়ি আর লাল-গোলাপি জল নিয়ে টেবিল চেয়ার পেতে দোকান সাজিয়ে বসল । দেয়ালে ভয় দেখাবার রোগের রঙিন পোস্টারে ছয়লাপ, কারোর জিভের চোখে ওলাওঠা, পেটে মায়োপিয়া, কাঁধে কলেরা, পায়ের গোছে প্লেগ, পাছায় দাঁতব্যথা । শাদাকোটবাবু মেছো জাহাজের কাপ্তেন ‘নাম নেই ৫৫৫’কে জিগ্যেস করেছিলেন, আপনি ভুটভুটির দুই ধারে রাক্ষসের মুখ আঁকিয়েছেন কেন । উত্তরে ‘নাম নেই ৫৫৫’ বলেছিল, রাক্ষসরা ছাড়া তো অন্য কোনো রকমের মানুষের ঘাড়ে আর মাথা হয় না, তাই রাক্ষসর মুখের ছবিই আঁকাতে হলো ।
প্রথম দিনেই ডাক্তার শাদাকোটবাবু যখন রোগীর আশায় বসে আধঘণ্টা অন্তর ওঁয়াই ওঁয়াই করে যতোটা পারা যায় জিভ বের করে হাই তুলছে, কালকেউটেকে তাড়ির হাঁড়িতে যে ছোকরা জিভ দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল, সেই ‘নাম নেই ৭৫০০’ ছোকরা গিয়ে হাজির, বললে শাদাকোটবাবু, আমার মুখের মধ্যে জিভ নেই, সব খাবার গিলে খেতে হয়, মজা পাই না, মাংসের স্বাদের থেকে কাঁচকলার স্বাদের তফাত করতে পারি না। শাদাকোটবাবুর বিশ্বাস হয়নি বলে ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর ঘাড়ের ছ্যাঁদায় টর্চ জ্বেলে অবাক, যে, সত্যই জিভ নেই, কেমন করে বেঁচে আছে ছোকরাটা, একেই কি এখনকার যুগের বিশ্বরূপ বলে ! শাদাকোটবাবু কয়েকটা বড়ি দিয়ে বললে, এগুলো পাঁচদিন দুবেলা করে গরম জলের সঙ্গে খাও, তার পর এসো, আশা করি তুমি জিভ ফিরে পাবে, আমার ফিস বেশি নয়, চারপাঁচ কিলো চালের যা দাম হয়, তাই ।
‘নাম নেই ৭৫০০’ ডাক্তারের সামনে বসেই ঘাড়ের ছ্যাঁদা দিয়ে লম্বা লিকলিকে গোলাপি জিভ বের করে নিজের বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে বাবা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর পকেট থেকে টাকা বের করে এনে শাদাকোটবাবুকে দিতে, শাদাকোটবাবু সেই দিনকেই ঘাড়ের ছ্যাঁদা দিয়ে কালো রঙের বমি করতে-করতে, পাতলা হাগতে-হাগতে, গা চুলকোতে-চুলকোতে, হাঁটুর ব্যথায় খোঁড়াতে-খোঁড়াতে, মেছো জাহাজের কাপ্তেনের রাক্ষস আঁকা ভুটভুটি চেপে শহরে ফিরে যাবার জন্যে খেয়া ঘাটে পৌঁছোতেই, ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর বাবা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ তাকে জড়িয়ে পাকড়াও করে ফেরত আনলে, কেননা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর কথাতেই ডাক্তার শাদাকোটবাবু ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতে পশার ডালতে এয়েছিল, আর তা জানতে পেরে গিয়েছিল ওনার ছেলে ‘নাম নেই ৭৫০০’, আঁচ করেছিল যে বাপ আবার নিশ্চয়ই কোনো নোংরা ফন্দিফিকির আঁটছে ।
এখন হয়েছে কি শিশু ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’কে যে চাকরানি মানুষ করেছিল, সে দুষ্টুদুরন্ত বেয়াড়া বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্যে আফিম চাটিয়ে দিতো আর ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ চাঁদ চলে গেলেও ঘুমোতো, সূর্য এসে ফিরে গেলেও ঘুমোতো । ইশকুলে-কালেজে পড়ার সময়ে সকালে এক গ্রাম আর বিকেলে এক গ্রাম আফিম না হলে পড়ায় মন লাগতো না, আফিম চেটে-চেটে ইশকুলে ভালো ফল করলে, কালেজে ভালো ফল করলে, একবার পড়লেই বইটা লাইনের পর লাইন ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর জিভের সামনে জ্বলজল করতো, চিরকেলে ফার্স্ট হয়েছে শুধু আফিমের জোরে। শহর থেকে আফিম কিনে আনতে হতো । হঠাৎ আফিম বিক্রিতে নিষেধ লাগলো, শুধু যারা আফিম না খেলে মগজের ধনুষ্টংকারে আছাড়ি-পিছাড়ি করে, তাদের জন্যেই দোকান থেকে মাসে তিরিশগ্রাম আফিম পাবার হুকুম জারি হল, কিন্তু তার জন্যে ছবিসুদ্দু কাগজ দরকার, আর তাতে ডাক্তারের সইসাবুদ বেগনে ছাপছোপ নম্বর দরকার । আগেকার দিনে লাল্লিঙ্গদের আর লাল্গুদদের বিনে পয়সায় আফিম চাটিয়ে আয়ত্তে রাখার চল ছিল, যাতে তারা বিনা ধমকধামকেই আদৃশ্য ল্যাজ নাড়িয়ে ভেউয়ে-ভেউয়ে দাঁত বের করে তুতুতুতু বললেই কামড়াতে দৌড়োতে পারে, কিন্তু কালেজে পড়ার সময়ে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’, লাল্লিঙ্গ না থাকায়, বিনে পয়সায় কোটা পেতো না ।
বছরে প্রত্যেকবার গিরগিটিভবনের আমলাবাড়িতে হুকুমবাজদের হুকুম তামিল করতে ডাক্তারের খোঁজে হন্যে হতে হতো ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’কে, কোনো ডাক্তারই সইসাবুদ করতে রাজি হতো না, বলতো, কই আফিমখোরের মতন কাজকারবার দেখছি না তো আপনার, বোকা বানাবার আর জায়গা পাননি, প্রমাণ কি যে আপনার গু থেকে আফিমখোরের বোটকা গন্ধ বেরোয় ? ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ কাগজে মুড়ে নিজের এঁটুলি পাকানো গুয়ের বড়ি নিয়ে গিরগিটিভবনের আমলাবাড়িতে ছোটো-আমলাদের যখন দেখাতো তারা বলতো মাদি-কুকুরের গু নিয়ে এসে ইয়ার্কি করছেন ? র্যালা করার আমলা পাননি ! ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ তাই একজন স্হায়ী ডাক্তারকে ‘নাম নেই শূন্য’ গাঁয়ে এই বলে ফুসলিয়ে এনেছে, তার ক্লিনিক সপ্তাহে যে দুদিন বন্ধ থাকবে সে-দুদিন আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য একজন ভাড়ার মেয়েকে সে পাবে, তাকে ইচ্ছে করলে নিজের বউয়ের মতন বিছানায় তুলতে পারে, মায়ের মতন পায়ে পুজো দিতে পারে, নার্সের মতন অন্যের সেবায় পাঠাতে পারে, কোলে বসিয়ে শিশুর মতন লজেঞ্চুশ খাওয়াতে পারে, ল্যাংটো শুইয়ে ছবি আঁকতে পারে, চেয়ারে বসিয়ে রেখে গান শোনাতে পারে, চুপচাপ একদৃষ্টে তার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকতে পারে ।
বউ ‘নাম নেই ৯৭৮৫’’ নদীতে অদৃশ্য হবার পর ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ যদিও একজন যুবতীকে বিয়ে না করেও বিয়ে করার মতন করে সবকিছু করে, যাকে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ এসকর্ট নামে চালায়,তা সত্বেও ফি-হপ্তায় শহর থেকে ভাড়ার মেয়ে নিয়ে আসে, মেছো জাহাজের কাপ্তেন ‘নাম নেই ৫৫৫’-এর রাক্ষস আঁকা ভুটভুটি করে গিয়ে শহুরে ভুটভুটিতে ফেরে ভাড়ার আমুদে মেয়ে নিয়ে । নির্নয় নিয়ে ফেলেছে যে পাঁচ দিন নিজের কাছে রেখে, দুদিন ‘নাম নেই ডাক্তার’কে দেবে, একটু মাংসের ফাঁকফোকরের আমোদ-আহ্লাদ করার জন্যে ।
‘নাম নেই ডাক্তার’কে তার ক্লিনিকে বসিয়ে নাম নেই ৫৬৪৩২’ পষ্ট বলে দিয়েছিল, এবার থেকে দেশবসতের লোকেদের যাতে রোগবালাই হয় সে দায়িত্ব আপনার । শাদাকোটবাবু ঘাড় হিলিয়ে বলেছে, বুঝিচি বুঝিচি, প্রথম লপ্তেই দেখুন না কেমন দুঃখের আন্ত্রিক চালু করি, তারপর খারাপ অদৃষ্টের ফিতেকৃমি, তারপর যন্ত্রনার দাদ-খোস, তারপর কষ্টের টায়ফয়েড, হতাশার ম্যালেরিয়ার মশা, আমাশার শোক, যক্ষ্মার ঘেন্না, উদুরির রাগ, সিফিলিসের প্রেম, গনোরিয়ার বিষাদ, আমার বাড়িতে কাঁচের বয়ামে রাখা আছে, ও আপনি চিন্তা করবেন না, মাঝেমধ্যে শহরে গিয়ে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার বীজানুগুলো নিয়ে আসতে হবে, এই যা একটু কষ্ট । আমার একটা পা তো নকল, জানেনই, সেটা খুললেই নোট রাখার ফাঁকা জায়গা আছে, তাতে করে ছোটো শিশিতে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-ভয়-ঘৃণা ভরে নিয়ে আসবো, কেউ টেরটি পাবে না, হাগতে-হাগতে, চুলকোতে-চুলকোতে, বমি করতে করতে, জ্বরে কাঁপতে-কাঁপতে অক্কাযাত্রার প্রতিযোগীতা করবে পাবলিক , প্রত্যেক প্রজন্মের নিজেদের রাজনৈতিক অসুখ হয়, তাতে তারা ভুগবেই, শুধু দেখতে হবে যে এমন কেউ তো নেই যে ওপরওয়ালার নাম শুনলেই হাই তোলে ।
শাদাকোটবাবু ‘নাম নেই ডাক্তার’ প্রথম প্রস্তাবটাই যথার্থ জ্ঞান করে হাজির হয়েছিল ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতে, তাতে গোবরঘোটালা আরেকটু হলেই করে ফেলছিল ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর ছেলে ‘নাম নেই ৭৫০০’ । সকলেই জানে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ হল ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতের নেতা, আর অনুপান অনুযায়ী আফিম না চেটে কেউই কোনো কল্যাণকামী দেশবসতের নেতা হতে পারে না । মাধ্যমিকের সিলেবাসে একটা বইই আছে, ‘মহান নেতাদের জীবনে ও রাষ্ট্রে আফিমের অবদান’ । সকলেই জানে, গত সত্তর বছর ধরে একটা প্রশ্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় আসে, আসবেই, “নেতাদিগের দেহ হইতে পচা শবের গন্ধ কেন বাহির হয় ?” উত্তরটা সবাই জানলেও ফি-বছরের নোট বইতে দেয়া থাকে, “তাঁহারা আফিম সেবন করিয়া দেশের সেবা করেন বলিয়া ।”
‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ মারা গেলে শ্মশান থেকে ছাই তুলে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলের পাশের শুকনো খাঁড়ির ধারে কোথায় মরণোত্তর ঢিবি গড়া হবে তাও ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ খতিয়ানের নথিতে দেগে দিয়ে রেখেছে । তবে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর ইচ্ছে যে মরে গেলে তার লাশকে নাকে ইউ ডি কোলোন মাখানো তুলো গুঁজে চারমোড়ের চত্বরে কয়েক দিনের জন্য যখন রাখা হবে তখন যেন কোনো পোশাক গায়ে না থাকে, ওনার সদিচ্ছা সবাই ঘুরে-ঘুরে তাঁর লাল্লিঙ্গহীন ক্রমপচন দেখুক, সারা জীবন মনে রাখুক পচা গন্ধের নাম নেই নেতাকে।
‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর ইচ্ছে, মরণোত্তর ঢিবিটার ‘নাম নেই ৫৬৪৩২ বাপের ঢিবি’ বা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২ কাকার ঢিবি’ ধরণের একটা চিরস্মরণীয় নাম যেন দেয়া হয়, যদিও ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর আপাতত কয়েক দশক মোটেও মরার ইচ্ছে নেই, মনে-মনে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ ভাবে যে বেঁচে থাকতেই ঢিবিটার উদ্ঘাটন করে গেলে ভালো হতো, ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতের লোকেদের কোনো বিশ্বাস নেই, আর ছেলে ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর ওপর তো একেবারেই বিশ্বাস নেই । মরণোত্তর ঢিবিটা হবার পর ‘নাম নেই ৭৫০০’ হয়তো রোজ তাতে পেচ্ছাপ করতে যাবে, যেমনটা দেশবসতের লোকে সেই আগেকার কালের শাদা চামড়ার লোকেদের মরণোত্তর ঢিবিতে করে, তাদের ঢিবির দামি শ্বেতপাথর আর গ্র্যানিট বাজারে বেচে দিয়ে আসে । তাদেরই বা কি দোষ, দেশবসতটা ফাঁকা পড়েছিল, তা ওরা দল বেঁধে এসে দখল করে নিয়েছিল, দখল করে ওদের ভাষা শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, তা সেই ভাষা ইশকুলে পড়ানো বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে যদি লাল্লিঙ্গ-লাল্গুদ মুকখু করে দেয়া হয়ে থাকে তাতে তাদের দোষ দেয়া কেন ?
জিভের বাঁ কানে কম শোনে বলে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ কারোর সামনে বুকোবুকি কথা বলে বা শোনে না, ডান দিক ফিরে জিভটা এক ইঞ্চি বের করে দাঁড়ায়, এমন ভান করে যেন অন্য দিকে কোনো কিছু দেখছে, অথচ সবাই জানে যে লোকটা বাঁকান-কালা, বউ ‘নাম নেই ৯৭৮৫’ দিয়েছিল কষে একখানা থাপ্পড়, যেদিন ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ ভুলে বাড়িতেই এনে তুলেছিল, লাল স্কার্ট আর ডেনিম টপ পরা মাথাহীন এসকর্ট মেয়েটাকে, কোমরে বাঁহাতের বেড় দিয়ে । বউ ‘নাম নেই ৯৭৮৫’ বলেছিল, চটকাচ্ছি তোমার আর তোমার এসকর্টের পিণ্ডি, বলেই লোভি জিভের বাঁকানে চড়, যাতে জোরে লাগে জিভের চোখে দাঁত বসে যায়, তাই হাতখানা দূরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল রাগের পাঁচ-আঙুল, সেই থেকে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর জিভের কানে লোফার ছোঁড়াদের সিটি আর যৌনকর্মীদের খিকখিকে খনখনে হাসি বাজতো, সিটি গিয়ে এখন জিভের বাঁকানে মৌমাছিদের ডানা নাড়াবার গুনগুন গান হয়, তার কারণ একবার বড়ো শহরের বাসে ভিড়ে একজন ঢ্যাঙা ‘নাম নেই মেয়ে’র পেছনে দাঁড়িয়ে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ ফলিত ঠেকনোলজির বৈজ্ঞানিক সত্য যাচাই করার চেষ্টা করছিল, ব্যাস, মেয়েটা পেছন ফিরে জিভের বাঁকানে যে চড়টা কষালে তা বউ ‘নাম নেই ৯৭৮৫’-এর চড়ের পাঁচগুণ, চড়িয়ে ঢ্যাঙা মেয়েটা বলেছিল, আমি ‘নাম নেই দেশ’-এর চড় চাম্পিয়ন, অলিম্পকে কাঁসার তকমা জিতে এনেছি, আপনি কেমন মরদ যে আপনার ড্যাবড্যাবে জিভ দিয়ে আমার ফোটো কাগজে দ্যাখেননি ? ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ সেই দিন বুঝতে পেরেছিল যে দেশবসতের মানুষদের কেন মাথাহীন করে দেয়া হয়েছিল ।
তা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর সুখ বেশিদিন টিকলো না, কাটা ঠ্যাঙের নকল পায়ের ভেতরে করে যে শিশিগুলোয় বীজানু মিশিয়ে এনেছিল শাদাকোটবাবু ‘নাম নেই ডাক্তার’ , শ্রাবণ মাসের প্রথম সোমবার বিকেল পাঁচটা পঁয়তাল্লিশে টেবিলে রাখা শিশিগুলো অন্যমনস্ক ভেঙে ফেলেছিল ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর হাতফেরতা চিকনসুন্দরী ‘নাম নেই যুবতী’, তাড়াহুড়োতে গুঁড়ো আর তরল কয়েকটা শিশিতে ভরে রাখলে, তারপর ডাক্তার পিরিত করার জন্য পোশাক খুলে এক গেলাস জল খেতে চাইলে, হাত না ধুয়েই কাচের গেলাসে করে জল দিলে ; ঘণ্টাখানেকেই ‘নাম নেই ডাক্তার’কে ছটফট করতে দেখে, হাত থেকে সোনার আঙটি আর ঘড়ি খুলে নিয়ে, পকেট হাতড়ে তেতাল্লিশ টাকার দোমড়ানো নোটগুলো হাতিয়ে, মেছো জাহাজের কাপ্তেন ‘নাম নেই ৫৫৫’-এর রাক্ষস আঁকা ভুটভুটিতে চেপে, নদীর জলে ভালো করে হাত ধুয়ে, মেছো জাহাজের কাপ্তেনকে ভুটভুটির দুপুরের ভেতো তন্দ্রা থেকে উঠিয়ে, ওর বুকের ঘামের বিনবিনে ঘামের গান জড়িয়ে নিজের বুকে তুলে নিয়ে, বিনে পয়সায় দে পিট্টান বড়ো-শহরের বড়ো-গ্যাঞ্জামে ।
‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতের লোকজন ঘটনাটা জানতে পারলো সেই তখন, যখন ‘নাম নেই ডাক্তার’ শাদাকোটবাবুর ঘরখানা থেকে পচা মড়ার গন্ধ সারা দেশবসতের জনমনিষদের নাকে গিয়ে টোকা মেরে মাধ্যমিকের প্রশ্ন তুলতে লাগলো । যে বুড়োরা আগে ওই ঘরে গ্যাঁজাতো তারাই জানলায় লম্বা জিভের চোখ গলিয়ে দেখতে পেল, সোজা সাপটা টেবিলের পাশে পড়ে আছে উদোম উলঙ্গ ‘নাম নেই ডাক্তার’-এর শক্ত লাশ, চোখ খোলা, মুখ বেঁকে রয়েছে, যেদিন এসেছিল সেদিন যতোটা জোয়ান মনে হয়েছিল আসলে তা নয়, কাটা ঠ্যাঙের নকল পা ছিটকে দূরে, গায়ে কিলবিলে গুটিপোকাদের চোরপুলিশ খেলা শুরু হয়েছে । টেবিলের গোলাপি রবার-ক্লথের ওপরে ট্রে, তাতে সার্জেনের ছুরি-কাঁচি-নরুন, যাতে রোগিদের ভয় পাওয়ানো যায় ।
মাধ্যমিকের এক ছাত্র, ‘নাম নেই ৬৭৮’-এর ছেলে, সেই যে সেই ‘নাম নেই ৬৭৮’, যে ভারতচন্দ্রের ‘রসমঞ্জরী’ রসিয়ে গাইতে পারে এক হাত জিভ নাড়িয়ে, তার বড়ো ছেলে ‘নাম নেই ৯৫৯’ জিগ্যেস করে ফেলেছিল, “এর গা থেকে পচা মড়ার গন্ধ বেরোচ্ছে কেন গো, এও আফিম খেয়ে নেতা হয়ে গিয়েছিল নাকি ?” ঘরের দরোজায় গোটা দশেক শকুন ঠোক্কোর মেরে মেরে বোধহয় নিজেদের সাংকেতিক ভাষায় বলছিল “দরোজা খুলুন, দরোজা খুলুন, আমাদের যে খিদে পেয়ে গেছে”, তারাই ঘরটাকে নখ দিয়ে লাথিয়ে খুলে ঢুকে পড়ল আর এক ঘণ্টাতেই পড়ে রইল ডাক্তারের কঙ্কাল, শকুনরা শুধু অণ্ডকোষ দুটো তিতকুটে বলে খায়নি । সাংকেতিক ভাষায় ডেথ সার্টিফিকেট লিখে শকুন-পার্টির সদস্যরা পচা মাংস আর টাটকা পোকার ঢেঁকুর তুলতে তুলতে তিন মিটারের ডানা মেলল আকাশের বদমেজাজি গুমোট কাটিয়ে নীল রঙের ভেতরে পাক খেয়ে দুপুরের শবঘুম দেবার জন্য ।
ল্যাংপেঙে ‘নাম নেই ৯০০১’-এর ফোকলাদেঁতো দাদু , যার জিভের চোখের শিরা নীল হয়ে গেছে, বললে, মরে যাওয়ার ওপরে আর কোনো মহাজীবন নেই, যাক লোকটা স্মৃতির লাথিঝ্যাঁটা থেকে ছাড়ান পেলো, তবে বেঁকা মুখ দেখে মনে হচ্ছে ‘নাম নেই ডাক্তার’ শাদাকোটবাবুর শনির সাড়েসাতি চলছিল, লোকটা জানতো না বেঁচেথাকা শিখতে পারা কতো কঠিন, বেঁচে থাকার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারলেই ঝামেলা, বুঝতে পারছি লোকটা জানতে দিতে চায়নি যে ও কতোটা বজ্জাত, নিজের বজ্জাতি নিজের কাছে স্বীকার করা কি চাড্ডিখানি কতা, অ্যাঁ, বলো দিকিন, কিন্তু এ কেমন ধারা ব্যাপার, শাদাকোটবাবুর লাল্লিঙ্গ না থাক অন্তত ন্যানোনুনু তো থাকবে !
কঙ্কালকে শুকনো খাঁড়িতে ভালো সার হবার জন্য পুঁতে দিয়ে এসে দেশবসতের লোকেরা ‘নাম নেই ডাক্তার’ শাদাকোটবাবুর নকল ঠ্যাঙ শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুরুতের পরামর্শ অনুযায়ী ‘নাম নেই ৭৫০০’কে দিয়ে মন্ত্রপূত করলো, যে নকল ঠ্যাঙখানা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে রাখলো, মাঝে-মাঝে ঝাড়পোঁছ করতো, বলা তো যায় না, আবার কখন কার ঠ্যাঙ কাটা যায় ।
‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ অবশ্য প্রস্তাব দিয়েছিল যে দেশবসতের ময়দানের কাছে চৌমাথার মোড়ে বেদি তৈরি করে ‘নাম নেই ডাক্তার’ শাদাকোটবাবুর প্লাসটিকের ঠ্যাঙকে বিমূর্ত শিল্প হিসেবে স্হায়ী করে রাখা হোক । ল্যাঙপেঙে ‘নাম নেই ৯০০১’-এর ফোকলাদেঁতো দাদু ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’কে বললে, কেন নিজের পায়ে গুয়ের ডাবা ফেলছো হে , ওখেনে তো তুমি এগবার নিজের মূর্তি দাঁড় করিয়ে রাখার কথা ভেবেছিলে । ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর মনে পড়ল নিজের স্বপ্নের অ্যাডভেঞ্চার, চিরকাল যুবক থাকার আফিমে-পাওয়া কল্পনা। ল্যাঙপেঙে ‘নাম নেই ৯০০১’এর দাদুর কথায় ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর গায়ের চুলেল চামড়ায় ঠাণ্ডা সন্ত্রাসের লোমকূপের ফাঁকফোকর দিয়ে আরামের ঘাম বয়ে গেলো, রেগে যাওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে ভাল্লাগছিল ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর, যে কিনা শ্মশানের সুগন্ধ গায়ে নিয়ে ঘোরে, আর ওঝার প্লাস্টিকের ময়ূরপালক দিয়ে ঝাড়িয়েও তা যায়নি, ঘুমচোখ ছাড়া কথা বলতে পারে না, মিথ্যে কথা এমনভাবে বলতে পারে যেন তা ধ্রুবসত্য, বললে তা ঠিক তা ঠিক, যদিও সত্য ধ্রুব হয় কি না সে-বিষয়ে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ কেন, দেশবসতের কারোরই জানা নেই।
‘নাম নেই ৩৫৩৫৩৫’-এর ভবিষ্যবাণীকে সত্যি প্রমাণ করে একদিন, যেদিন আকাশ ওপরে চলে গেছে আর মেঘেরা তলায় নেমে এসেছে, সেই তালগাছ থেকে, সেই যে সেই যার মাথায় সাপান্তক তাড়ির বৈপ্লবিক কালচে-মেটেল হাঁড়ি ঝোলানো ছিল, তা থেকে দিনদুপুরে পাকা তালের কাঁদির বদলে একজন সাধু পুকুরে ঝরে পড়ল, ঝপপাঙ । পুকুরে যে বউ আর মেয়েরা গামছা দিয়ে বুক-পিঠ ঘষছিল তারা ও-ম্যাগো ও-ম্যাগো পুকুরে শুশুক নাকি গা, চেঁচিয়ে পাড়ে উঠে দেখলে মাথাহীন সাধুটা সবুজ রঙের আর তার বুকের চুল নারকেল ছোবড়ার মতন হলেও সবুজ, তাতে জটা পড়ে গেছে । পুকুর থেকে ডাঙায় ওঠার সময়ে সাধু প্রায় উড়ে সিঁড়িতে পা ফেলল, আর নিজেই তাতে অবাক হয়ে ঘাড়ের ছ্যাঁদা দিয়ে খোনাস্বরে বলল, মনে হচ্ছে আমি শরীরের অভিকর্ষ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি । জল থেকে ডাঙায় উঠতে গিয়ে হাওয়ায় কিছুটা উড়ে পাড়ে পৌঁছোলুম ।
বউদের মধ্যে যে জীবনকে কাছ থেকে দূর থেকে ওপর থেকে নিচে থেকে দেখেছে আর ‘নাম নেই শূন্য’’ দেশবসতের বউঝিরা যার কাছে ঋতুবন্ধের শলাপরামর্শের জন্যে ফিসফিসোতে যায়, যে শোবার সময়ে উলঙ্গ শুতে ভালোবাসে, বালিশের তলায় একটা ছোরা রাখে, মানুষের বুক দেখে তার ভবিষ্যত বলতে পারে, সে বললে, তালগাছ থেকে কখনও কোনো সবুজ নারকেলবাবাকে আবির্ভূত হতে দেখিনি, আপনিই প্রথম । খোনাস্বর সাধু জিভ বের করে বললে, আরে আমি কোনো বাবা-টাবা নই, পোশাকের রঙ সবুজ নয়, এটা পুকুরের ঝাঁঝি শ্যাওলা, দাঁড়াও ঝেড়ে নিই । শ্যাওলা ঝাড়ার পর দেখা গেল নারিয়েলবাবার পোশাকের রঙ গেরুয়া । সে বললে, জেল ভেঙে পালাবার সময়ে সঙ্গীরা এই গোরুপ্রেমি পোশাক যোগাড় করে দিয়েছিল যাতে ধরা না পড়ি, তা নদী সাঁতরে এই গাঁয়ে এসে ঠাঁই খুঁজে না পেয়ে তালগাছে উঠে গায়ের চাদরটা পাতায় বেঁধে লুকিয়ে ছিলুম, আর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, ঘুমের ঘোরেই পুকুরে পড়ে গিসলুম । রাতে খিদে পেয়েছিল বলে তোমাদের গাছ থেকে কয়েক চুমুক তাড়ি খেয়েছি , তারপর থেকেই আমার বুকের চুল আমাকে না জানিয়েই ঘুমের মধ্যে পঙপঙিয়ে বেড়ে উঠলো আর নারকেল ছোবড়া হয়ে গেল।
বউরা সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে আঁৎকে জিগ্যেস করল, কোন হাঁড়ি, কোন হাঁড়ি, ওই কালচে-মেটেল হাঁড়ির তাড়ি নাকি ? ওতে এখনও কিছুটা সাপান্তক তাড়ির দ্রব্যগুণ রয়ে গেছে । আঁৎকে ওঠার সময়ে প্রাকৃতিক নিয়মে কয়েকজন বউয়ের আঁচল বুক থেকে খসে পড়েছিল । নারকেলবাবা সবচেয়ে ফর্সা বুকের দিকে তাকিয়ে বললে, হ্যাঁ, কেন, একটুখানি তাড়ি খেয়ে নিতে পারব না, খিদে পেয়েছিল, তা কী আর করি, সামনেই হাতের কাছে যখন খাবার রয়েছে, মাঝরাতে তো কারোর বাড়ি গিয়ে খাবার চাইতে পারি না । ফর্সা বুকের বউ, যার দিকে নারকেলবাবা বিস্ফারিত জিভের চোখ মেলে তাকিয়েছিল, সে বললে, ওই তাড়ি হল সাপান্তক তাড়ি, ওই তাড়ি যারা খেয়েছে তারা তিন কি চারশো বছর সময়ের থেকে এগিয়ে গেছে ।
নারকেলবাবা এখন মহা ফ্যাসাদে, জিগ্যেস করল এখন কী হবে, আমার শরীর থেকে অভিকর্ষ চলে গেছে, প্রথমে ভাবলুম মঙ্গলগ্রহে এসে পড়েছি, পা ফেলে হাঁটার চেষ্টা করলেই খানিক উড়ে গিয়ে পা পড়বে, যেদিকে যেতে চাইব তার বদলে হয়তো ল্যাদখোর হাওয়ার ধাক্কায় অন্য দিকে চলে যাবো । সবজান্তা বউ বললে, তাতে ক্ষেতি নেই, এই গাঁয়ের সকলেই অমন তিনশো বছর কি চারশো বছর এগিয়ে গেছে, ওই যাকে ইশকুলের বইতে বলে প্রগতি, তা-ই আরকি, আপনাকে এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে, আমরা সবাই মানিয়ে নিয়েছি । তা আপনার নাম কি ?
নারকেলবাবা বললে আমি তো কারাগারত্যাগী সন্ন্যাসী, কারাগারে কারোর নাম ধরে ডাকা হয় না, নম্বর ধরে ডাকা হয়, আমার নম্বর ছিল ১৫৩২। শুনে, একজন তামাটে বউ বললে, যাক ভালোই হলো, আমাদের দেশবসতে মাথা খসে পড়ার পর থেকে কারোর নাম হয় না, সংখ্যা হয়, এই যেমন আমার হলো ‘নাম নেই ৬০’, আবনাকে আমরা ‘নাম নেই ১৫৩২’ বলেই ডাকবো নারকেলবাবা, যদ্দুর জানি এই নম্বরীকরণ এখনও হয়নি কারোর ।
‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা বললে, কতো আর মানিয়ে নেবো, মানিয়ে-মানিয়ে তো জান কয়লা হয়ে গেছে, শহরে পয়সাঅলারা মানিয়ে নেয় না আর আমাদের বলে দাম বাড়লে মানিয়ে নাও, বিষ্টির জলে রাস্তা নদী হয়ে বাড়ির পায়খানা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এলে বলে মানিয়ে নাও, খেতে দাঁড়িয়ে জলের অভাবে ধান শুকিয়ে গেলে বলে মানিয়ে নাও, ট্রেনের ধাক্কায় আরেক ট্রেনের বগিতে জ্ঞাতিগুষ্টি মারা গেলে বলে মানিয়ে নাও, ট্যাকা ডবল করার জন্য জমা নিয়ে কেটে পড়লে বলে মানিয়ে নাও, ডালচালের দাম চচ্চড় করে টঙে গিয়ে পৌঁছোলে বলে মানিয়ে নাও, পথে-ঘাটে হাগা-মোতা পেলে পথেই সেরে মানিয়ে নাও, কাঁদানে গ্যাসে কাঁদিয়ে দিলে মানিয়ে নাও, ভিড় দেখে পুলিশ বন্দুক চালিয়ে মানুষ মারলে মানিয়ে নাও, এখন তোমরা বলছ আমার শরীর থেকে অভিকর্ষ চলে যাওয়াকে মানিয়ে নিতে, জেলে থাকার সময়ে যদি তোমাদের সাপান্তক তাড়ি পেতুম তাহলে মাটির তলায় এক মাস ধরে গর্ত খুঁড়ে পালাতে হতো না, অভিকর্ষের অভাবকে কাজে লাগিয়ে উড়ে দেয়াল ডিঙোতুম ।
‘নাম নেই ৪৮১৩’ সবজান্তা বউ জিগ্যেস করল, আপনি কি বৃক্ষসন্ত ? ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা বললে, না আমি নারীবাদী, নারীদের আমার জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছি, সেকারণে যদি তোমরা আমায় সন্ত বলো তাহলে আপত্তি নেই, তবে আমি ওপরওয়ালাদের বিশ্বাস করি না । সবজান্তা বউ ফিসফিসিয়ে অন্য বউদের বললে, উনি বোধহয় বৃক্ষের অবতার । তা সত্বেও শুনতে পেয়ে নারকেলবাবা বললে, সমস্যা কি জানো, সেনাবাহিনী যদি বেশিদিন যৌনসঙ্গম থেকে বঞ্চিত থাকে তো একটা যুদ্ধ বাধাতেই হয়, যাতে সেনারা ইচ্ছেমতন চোপরদিন যুদ্ধ আর যুদ্ধের ফাঁকে ধর্ষণ করে আয়ু বাড়িয়ে নিতে পারে ; লাম্পট্য হল শিল্প, ঠিক যেমন স্পেনের বুলফাইট বা তামিলনাডুর জালাইকুট্টু, বুঝলে ? প্রতিটি আদর্শের পেছনে মুখোশ থাকবেই । যে দেশবসতের পুরুষদের গায়ের রঙ কালো তারা ফর্সা মেয়ে পাবার ধান্ধায় ফর্সামুলুকে যুদ্ধ লড়তে যায়, ফর্সা যুবতীদের দখল করবে বলে, ঘরে বন্ধ করে যা ইচ্ছে তাই করবে বলে, কই বুড়োরা তো লড়তে যায় না !
‘নাম নেই ৪৮১৩’ সবজান্তা বউ জিগ্যেস করলে, তা আপনি জেলে গিসলেন কেন । তার উত্তরে ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা বললে, আমার উল্টোপাল্টা কথার জন্য, আর তা কাগজে লেখার জন্য, কবে বিচার শুরু হবে তার কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না । কারাগারে থাকতেই বুকের আর কুঁচকির চুল পেকে গেল ।
‘নাম নেই ৪৮১৩’ সবজান্তা বউ বললে, আপনি উড়তে পারেন বলে ভালো হলো, আমাদের গাঁয়ে ভালো জাতের ষাঁড় নেই বলে গোরুগুলো দিনকে-দিন ছোটো হয়ে যাচ্ছে,আর দুধ কমে যাচ্ছে, আপনি যদি একটা তাগড়া মুলতানি ষাঁড় উড়িয়ে আনতে পারেন তাহলে তাড়ির বদলে রোজই ঘি-দুধ-দই-রাবড়ি-সন্দেশ খেতে পারবেন, গাইগোরুর ছ্যানাগুলো তাগড়া হবে আর অঢেল দুধও দেবে । আমাদের গাঁয়ের বৃষ রাশির একমাত্র জাতক দত্যিপুরুষ ‘নাম নেই ৭৫০০’ , তাকে দিয়ে আমরা নিয়োগপ্রথায় কয়েকটা দিশি গাইগোরুর সঙ্গে সম্বন্ধ করিয়েছিলুম, তার কোনো ফল হলো না, যখন কিনা ‘নাম নেই ৭৫০০’ জিভ দিয়ে ঋতুবন্ধের গর্ভ পরিষ্কার করে সম্বন্ধ করতো । উল্টে সকাল হলেই, সূর্য সবে হাই তুলতে-তুলতে আকাশে এসেছে, গাইগোরুগুলো ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর বাড়ির দোরগোড়ায় গিয়ে হাম্বা পঁচাত্তরাম্বা হেঁকে ডাক পাড়ে, বেচারা ‘নাম নেই ৭৫০০’ খিড়কিদোর দিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ।
‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা বললে, দেখি কী কত্তে পারি, আগে ঠিকমতন হাঁটাচলা রপ্ত করি, তারপর মুলতানি ষাঁড়, কোথায় পাবো তাও তো জানিনে, বোধ হয় উড়ে-উড়ে বেনজির ভুট্টোর এলাকায় যেতে হবে, উনি মুলতানের ছিলেন আর অনেক মুলতানি ষাঁড় আছে ওনাদের দলের জিম্মায় । যে বউয়ের ওপচানো ফর্সা বুক নারকেল বাবা দেখে ফেলেছিল, তার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলে, তা আপনাদের এই গাঁয়ের নাম কী । সকলে একই সঙ্গে বলে উঠল ‘নাম নেই শূন্য’। সে কি, দেখে তো বেশ পুরোনো দেশবসত মনে হচ্ছে, পুরোনো আমলের আধভাঙা তিনতলা বাড়ি, বাড়ির দেয়ালে বটগাছ অশথ্থগাছ, নোনা ইঁটের পাঁচিল-দেয়া গলি, ওপচানো নর্দমা, রাস্তার ধারে জঞ্জাল, ডাবের খোসা আর পচা সবজির পাহাড়, দেখেই বোঝা যায় ঐতিহ্যময় সংস্কৃতির দেশবসত, যাকে সাহেবরা বলা কালচারাল ক্যাপিটাল, অথচ এর কোনো নাম নেই, অবাক চোখে একই বউয়ের বুকের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল নারকেলবাবা । বউটা মুচকি হেসে বললে, ‘নাম নেই শূন্য’ হল আমাদের দেশবসতের নাম । মুচকির প্রত্যুত্তরে মুচকি বিলিয়ে ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা বললে, যাচ্চলে, আমাদের দেশেরও নাম তো ‘নাম নেই শূন্য’, তার মানে এই দেশবসত থেকেই কউ গদ্দারি করে আমাকে জেলে ঢুকিয়েছিল ।
বউরা এক সঙ্গে বলে উঠলো, হ্যাঁ, আমাদের ছেলেমেয়ের ইশকুলের কয়েকটা বইয়ের নামই তো ‘নাম নেই শূন্য দেশের ইতিহাস’ , ‘নাম নেই শূন্য দেশের ভূগোল’, ‘নাম নেই শূন্য দেশের মহাপুরুষগণ’, ‘নাম নেই শূন্য দেশের অর্থনীতি’, ‘নাম নেই শূন্য দেশের আফিমখোর নেতাবৃন্দের জীবনী ও আত্মা” । ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা সেদিকে খেয়াল না দিয়ে আঁচল-ফেলা বউটিকে বললে, তোমার হাসিটি বিশ মিষ্টি, বাঁ গালে টোল পড়ে । ‘নাম নেই ৪৮১৩’ সবজান্তা বউ ওপরপড়া হয়ে বললে, ওর কথা আর বলবেন না, হাসলে ওর তলপেটেও টোল পড়ে, ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতের অশ্লীল মাংসের যা ছিরি।
‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতের লোকেরা বহুকাল থেকে শুনে আসছে যে জেল মানেই স্বাধীনতাযোদ্ধা আর দাড়িয়াল নোংরা-নখ মুখেথুথু বিপ্লবী, যারা জেল ভেঙে পালিয়ে আবার স্বাধীনতার কিংবা বিপ্লবের জন্যে লড়তে যায়, যদিও কেউই আদপে জানে না যে স্বাধীনতা আর বিপ্লব ব্যাপারটা ঠিক কী, কার কাছ থেকেই বা স্বাধীনতা, কারা স্বাধীনতাযোদ্ধাদের আর বিপ্লবীদের জেলে পুরে রাখে, কেন মানুষ স্বাধীনতাযোদ্ধা হয়, বিপ্লবী হয়, তারা কি নিজের দুঃখ-কষ্ট থেকে স্বাধীন হতে চায়, নাকি বউয়ের কড়াকড়ি থেকে স্বাধীন হতে চায়, নাকি নিজের কাছ থেকে স্বাধীন হতে , আর কেনই বা চায়, স্বাধীন হবার পর কী হবে, বিপ্লবীরা কি গাছ-থেকে-পড়া সাধু হয়, নাকি তারা গিরগিটিভবনের আমলাবাড়িতে গ্যাঁট হয়ে বসে গণ্ডারলিঙ্গ-গণ্ডারযোনি চেলা-চেলিদের নিয়ে ‘আয় কাটি গাঁট আয় কাটি গাঁট’ গেয়ে-গেয়ে ট্যাঙ্গোনৃত্য করতে চায় !
‘নাম নেই ১৫৩২’ সাধু নিজের গা থেকে সবুজ ঝাঁঝি শ্যাওলা ঝাড়ার পরই তার গেরুয়া পোশাক বেরিয়ে এসেছিল, নয়তো বউরা মনে করত কোনো সবুজ ওপরওয়ালা বা স্বাধীনতাযোদ্ধা বা বিপ্লবী আকাশ থেকে পুকুরে ঝাঁপিয়েছে যাতে চোট না খায় আর হাড় না ভাঙে, যদিও কোনো কোনো বাংলা ক্যালেণ্ডারে, যেগুলো মেছো জাহাজের কাপ্তেন, যে এখন দুপাশে লাল রাক্ষস আঁকা ভুটভুটি চালায়, শহর থেকে পাকিয়ে-পাকিয়ে আনে, তাতে কেষ্ট ঠাকুরকে অনেক সময়ে সবুজ দেখানো হয়, আঁকিয়ের নীল রঙ ফুরিয়ে যাবার কারণে । ‘নাম নেই ৪৮১৩’ সবজান্তা বউ বলেছিল, কেষ্টঠাকুরের নীল রঙ পাক্কা অ্যাগবারে, চান করলেও যায় না, ইদিকে এনার তো সবুজ রঙ ঝরে গিয়ে গেরুয়া পোশাক বেরিয়ে পড়েছে, গায়ের রঙ কুচকুচে কালো হলেও, স্বাধীনতাযোদ্ধারা আর বিপ্লবীরা কি কালো হয়, যদি কালো হয় তাহলে গিরগিটিভবনের আমলাবাড়ির হুকুমরাজরা তো তাদের মারধোর করবে, ফর্সা লোকেদের ততো করে না, ফর্সা লোকেদের জন্য শুনেছি শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ছাড় ।
‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা-সাধুকে বউরা ধরে-ধরে শাদাকোটবাবুর ফাঁকা ঘরে রেখে এলো, বললে দরোজা বন্ধ করে চলাফেরা ওব্বেস করুন, নয়তো উড়ে কোথাও গিয়ে বিপদে পড়বেন । ঘরে ঢুকেই ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা চোখমুখ কুঁচকে বললে, এই ঘরে তো জেলের মতন দুগ্গন্ধ বেরুচ্ছে, এটা আপনাদের জেলখানা নাকি ? বউরা জানালো না গো না, এটা গাঁয়ের বুড়োদের জিভ লকলিকিয়ে গ্যাঁজা ফুঁকে গ্যাঁজাবার ঘর, আগে একজন অতিথি শাদাকোটবাবু ডাক্তার থাকতেন, ন্যানোনুনু পিরিতি করতে গিয়ে গোলমালে পড়ে হাপিশ হয়ে গেলেন, সেই থেকে ফাঁকাই পড়ে আছে ।
নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবার ঘরে রোজ ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর বেঁচে-যাওয়া বাড়তি খাবার পৌঁছে দেয়া হতো, আর ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা ষড় করতো উড়ে যখন যেতে পারবো, তখন আর মুলতানি ষাঁড় ধরতে যাবো কেন, যে বিপ্লব শুরু করিচি, গিরগিটিভবনের আমলাবাড়ি থেকে খুনে নেতাগুলোকেই উড়িয়ে মুলতানে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসবো, মুলতানে এখনও ক্রীতদাসপ্রথা বজায় আছে, যদি বেটাদের উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে, সস্তায় চাইলে সস্তায়, বেচে দিতে পারি, তাহলে বিপ্লব এক্কেবারে কেল্লাফতে, আমিই বসব গিয়ে গিরগিটিভবনের আমলাবাড়ির সেগুনকাঠের সিংহাসনখানায়, আর ধরে-ধরে শূলে তুলবো চোরবাটপাড় চশমখোর কালোবাজারি গবেটগুলোকে, যারাই আমার কথা শুনবে না, তাদের মাটির তলায় গুমোট স্যাঁতসেতে জেলনগর বানিয়ে তাতে শেকল বেঁধে রাখবো, সে তারা লাল্লিঙ্গ-লাল্গুদ হোক বা গণ্ডারলিঙ্গ-গণ্ডারযোনি ।
বুধবার রাতে, অষ্টমীর পূর্বফালগুনী চাঁদ যখন নাচতে নাচতে আকাশে খেলতে বেরিয়েছে, কেননা দিনের বেলায় ছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ, ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা নিজের সঙ্গে ষড়যন্ত্র অনুযায়ী ঘর থেকে পাখির ঢঙে লাফিয়ে বেরিয়ে উড়ে চলল নদীর ওপর দিয়ে গিরগিটিভবনের আমলাবাড়ির দিকে, হঠাৎ নদীর জল থেকে একটা বউয়ের বিশাল মাথাহীন দেহ, যার ঘাড়ের বিনুনি কাঁকড়া দিয়ে তৈরি, এক হাতে ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবাকে ধরে জলের তলায় নিয়ে চলে গেল, ‘নাম নেই শূন্য ’ দেশবসতের লোকে অপেক্ষায় অপেক্ষায় মুলতানি ষাঁড়ের কথা ভুলে গিয়ে স্বদেশি ষাঁড় দিয়েই সেবা নিতে লাগল ।
বেশ কিছুকাল পর, যখন গাঁয়ের লোকেরা ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবার কথা ভুলে গেছে, দেখতে পেল যে কচ্ছপদের ডিম পাড়ার বালিয়াড়িতে ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবার দুঃখি-দুঃখি নারকেলদাড়ি আর বিষাদমগ্ন বুকের নারকেলজটা পড়ে আছে । দেখেশুনে সবজান্তা বউ, যার ছেলের বউয়ের হাতের কচ্ছপের ডিমের পেঁয়াজকুচি লাল লঙ্কা টোমাটো ধনেপাতা দেয়া অমলেট পরোটা দিয়ে গরম-গরম খেতে দারুন লাগে, হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললে, তার মানে ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা আসলে সংসারজন্মে কচ্ছপ ছিল; কচ্ছপে আর কিই বা বিপ্লব করবে, বিপ্লব করতে হলে করবে খরগোশের দল যারা এক লপ্তে কুড়িটা করে বিয়োয় ।
‘নাম নেই ৪৮১৩’ সবজান্তা বউ কচ্ছপদের ডিম গর্ত থেকে তুলে আঁচলে রাখতে-রাখতে নদীর দিকে মুখ তুলে দেখলে সংসারজন্মে কচ্ছপ ওরফে ‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা ‘নাম নেই নদীর’ জল ডিঙিয়ে এদিকপানেই আসছে, গায়ে কাদামাটির পোশাক, গেরুয়া বা সবুজ পোশাক নেই বলে টের পেতে একটু সময় লেগে গিয়েছিল, চিনতে পারলো বুকের চুল দেখে, যার ওপর কাঁকড়ার গোলাপি বাচ্চারা হাডুডু খেলছিল । সংসারজন্মে স্বয়ং কচ্ছপ, ‘নাম নেই ১৫৩২’ গায়ে কাদামাটির প্রলেপ দেয়া পোশাক, উদোম, পা ফেলার সময়ে উড়ছে না ।
‘নাম নেই ১৫৩২’ নারকেলবাবা কাছে আসতে ‘নাম নেই ৪৮১৩’ সবজান্তা বউ বললে, আমি ভেবেছিলুম আপনি মুলতানে গেছেন একখানা ভালো ষাঁড় আনতে, তা নদীর ভেতরে ন্যাংটা হয়ে কী করছিলেন, গেরুয়া পোশাকই বা কোথায় গেলো ? সংসারজন্মে কচ্ছপ বললে, আমি যখন উড়ে ‘নাম নেই শূন্য’ বসতের ‘নাম নেই নদী’ পেরোচ্ছিলুম তখন জলের ভতর থেকে একজন দশাসই বউ, যার ঘাড়ের বিনুনি কাঁকড়া দিয়ে বানানো, আমাকে ধরে নদীর ভেতরে তার প্রাসাদে নিয়ে গেল,আর আমি তাকে আমার অভিকর্ষের সমস্যা বোঝাবার পর, সে আমায় শিকিয়ে-পড়িয়ে দিলে, কখন কী করলে আমার শরীরে অভিকর্ষ থাকবে আর কখন থাকবে না, তার কাছে ট্রেনিং নিতেই দেরি হয়ে গেল ; এ তো আর মহাকাশযানে চড়ে দুনিয়া ঘোরার মতন সহজ-সরল নয়, যাই হোক আমি যখন পোশাক পরে থাকবো তখন আমার শরীর থেকে অভিকর্ষ লোপাট হয়ে যাবে আর আমি উড়তে পারবো, কিন্তু এই যে এখন যেমন রয়েছি, উদোম শরীরে পানপাতা মাপেরও কাপড় নেই, আমার শরীরে অভিকর্ষ কুঁদেকুঁদে ঠাশা, তোমাদের মতনই চলা ফেরা করতে পারবো ।
‘নাম নেই ৪৮১৩’ সবজান্তা বউ জিগ্যেস করলে, উঁচোনো জিভের দুচোখে লজ্জাবোধের চেয়ে শ্রদ্ধাবোধ বেশি, উলঙ্গ সাধুদের দেখলে যেমনটা হয়ে থাকে, জিগ্যেস করলে, জলের ভেতরে প্রাসাদে যিনি রয়েছেন তাঁর নাম জানতে পারলেন ? সংসারজন্মে কচ্ছপ ‘নাম নেই ১৫৩২’ বললে, হ্যাঁ, ওনার নাম ‘নাম নেই ৯৭৮৫’, লম্পট মাগিবাজ স্বামীর চরিত্রহীনতায় বিরক্ত হয়ে ‘নাম নেই নদীর’ জলের ভেতরে প্রাসাদ তৈরি করে থাকেন, আর ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতে ‘নাম নেই ৭৫০০’ নামে ওনার ছেলের দিকে লক্ষ রাখেন । ‘নাম নেই ৪৮১৩’ সবজান্তা বউ উত্তরে বললে, ‘নাম নেই ৯৭৮৫’-এর আবার সবই বেশি-বেশি, পুরুষমানুষের চরিত্র বলে কিছু হয় নাকি যে চরিত্রহীন হবে ! সংসারজন্মে কচ্ছপ ‘নাম নেই ১৫৩২’ পোশাকহীনবাবা বললে, তোমার কথা মানতে পারলুম না গো, আমি হলুম গিয়ে নারীবাদী, মহিলাদের দুঃখকষ্ট যাতনা সহ্য করতে পারি না, জীবন থেকে নারীদের বাদ দিয়েছি, তাই তো বিপ্লব করতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিলুম, তা গিরগিটিভবনের আমলাবাড়ির খোচরেরা যে হন্যে হয়ে পিছু নিয়েছে জানতে পারিনি, দল বেঁধে জঙ্গলে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলুম, তারপর কারাগারের মাটিতে গর্ত করে সবাই মিলে নানা দিকে পালালুম ।
আঁচলে বাঁধা পানের খিলি থেকে মশলা ফেলে দিয়ে ‘নাম নেই ৪৮১৩’ সবজান্তা বউ বললে, পানের পাতাখানা দিয়ে বললে, আপনি এই পাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করে ওই কলাবাগানে গিয়ে একখানা বড়ো কলাপাতা কেটে নিয়ে সামনে-পেছন দুদিকের লজ্জা নিবারণ করে গাঁয়ে ঢুকুন, আপনার ঘরখানা ফাঁকাই পড়ে আছে, পোশাক-টোশাক পরে খেয়ে-দেয়ে মুলতানের দিকে উড়ুন, গাঁয়ে একটাই পুরুষ্টু ষাঁড় বেঁচে আছে, বুড়ো বয়সে সেবা দিতে-দিতে তার তো দুর্গতির শেষ নেই । ‘নাম নেই ১৫৩২’ পোশাকহীন নারকেলবাবা নিজের পেছনদিকটাকেই লজ্জাস্হান অনুমান করে পেছনে পানপাতা চেপে চলে গেল কলাবাগানে, কলাপাতা দিয়ে সামনে-পেছন ঢেকে নিজের ঘরে পৌঁছে, যে ঘরে তখনও ডাক্তার শাদাকোটবাবুর ল্যাঙড়া প্রেতের পচা গন্ধ হিঁঃ হিঁঃ করে নিঃশব্দে ভাসছে, গন্ধটা থেকে টের পাওয়া যায় যে লোকটার বউ হয় পালিয়েছিল অন্য কারোর সঙ্গে, কিংবা যৌবনে প্রেমিকা ল্যাং মেরে চলে গিয়েছিল , ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর সাতবাস্টে বাড়তি খাবারের স্তুপ থেকে খেয়ে, রুটি শুকিয়ে হয়ে গেছে পিৎজা, মাংসের ঝোল শুকিয়ে হয়ে গেছে বিফস্টিক, ঢেঁকুর তুলতে তুলতে, দেয়ালের খুঁটিতে ঝোলানে ল্যাঙড়া প্রেতের শার্ট-ট্রাউজার পরে উড়াল দিলো গিরগিটিভবনের আমলাবাড়ির দিকে ।
গাঁয়ের উন্নতি দেখে, ফসল দেখে, পুকুরের মাছ দেখে, শহর পর্যন্ত রাস্তা দেখে বড়ো-বড়ো ভুষিমগজ মোদোগাল আমলারা ‘নাম নেই শূন্য’ বসত চরতে এসে নিজেদের অবদানের তারিফ না করে পারে না । শহরের আমলাবাড়িতে রুলটানা কাগজে ঘষঘষিয়ে তিন কিস্তি রিপোর্ট পাঠায় । তিন কিলো ওজনের বেগুন, মানুষপ্রমাণ লাউ আর এক কিলো ওজনের করলার ঝুড়িতে কৃষি আধিকারিক চিঠি পাঠায় তার ঝিমন্ত বড়ো সাহেবকে । মাছ আধিকারিক চরিত্রহীন ডিমভরা রুই আর মাথামোটা কাৎলার জাদুয়ী চমৎকার সম্পর্কে কমপিউটারে টাইপ করে প্রতিবেদন পাঠায় মাছ-মন্ত্রীকে । বনের আধিকারিক তলতা বাঁশ আর মুলি বাঁশের সঙ্গে আমলাবাড়িতে চিঠিচাপাটি পাঠায় জঙ্গলমন্ত্রীকে । ঠিকেদাররা ‘নাম নেই শূন্য’ বসতের খবরাখবর পেয়ে রাস্তাগুলো পাকা করার জন্য ফুটপাত-মন্ত্রীকে ধরাধরি করে, উপরি খাওয়ায় করকরে ভেট দিয়ে । রাস্তা পাকা হয়ে গেলে বৈদ্যুতিন কোম্পানিরা, টিভির ব্যবসাদাররা, মোটর সাইকেলের দোকানদাররা, মোবাইলের টাওয়ার বসাবার আর মোবাইল বিক্রির ফড়েরা, আমলাবাড়ির ধোপদোরস্ত গণ্ডারলিঙ্গ-গণ্ডারযোনি বাবু-বিবিদের টেবিলের তলা দিয়ে পারস্পরিক ধরাধরির খেলা খেলে, উপরি খাবার করকরে ভেট দিয়ে, বাড়িতে বাড়িতে টিভি বিক্রি করে মোবাইল বিক্রি করে গোল্যান্টেনা বিক্রি করে টিভিতে দেখানো সাবান শ্যাম্পু প্যাকেটের খাবার বোতলের কালোঠাণ্ডা বিক্রি করে ।
মেছো জাহাজের কাপ্তেনের টেনে লম্বা করা রাস্তার দুধারে বড়ো-বড়ো টিনের বিজ্ঞাপন বসে, তাতে বাসিমুখের হাসিতে ডগমগ শহুরে চিকনসুন্দরীদের খাঁজুলে বুকের ইশারা-ছবি । রাস্তা লম্বা করার দরুন যা কষ্ট করতে হয়েছিল, মেছো জাহাজের কাপ্তেনের বুকে ব্যামো ধরে গেছে, উঠোনে বসে ঘড়ং-ঘড়াং কাশে আর কফ ফ্যালে, মাঝেমধ্যে জবরদখল জমিমালিকের ছেলেরা, যাদের গায়ের রঙ আর আদল-আদরা মেছো জাহাজের কাপ্তেনের মতন, তারা এসে তাড়ৌষধি আর ফলমূল দিয়ে যায় ।
‘নাম নেই ৭৫০০’-এর বাবা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’, ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতের লোকে যাকে আড়ালে বলতো এককালের রুবলহারামি, কেজিবির নথিতে নাম পাওয়া গেছে , ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ নাকি রুবলকড়ির দেশ থেকে মাল এনে দেশোদ্ধারের আর গণসাম্যের রুবল-পুঁথি আওড়াত, আর যে পঁচাশি বছর বয়সেও ‘নাম নেই শূন্য’ দেশবসতের নেতাগিরি আঁকড়ে অঢেল টাকাকড়ি কামিয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেননি, রুবলহারামি থেকে মহানগুরে নেতাদের মতন দরকচা মেরে পাকতে-পাকতে টাকাহারামিতে পাল্টে গিয়েছিল, ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’ যে নখরাউলি এসকর্ট রেখেছিল, যার মুখের থুতু-ছেটানো নোংরা গালাগালকে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ স্ল্যাং বলে চালিয়ে দিতো, আর পরিচয় করিয়ে দেবার সময়ে বলত ‘আমার এসকর্ট’, সেই ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’-এর ছেলে ‘নাম নেই ৩৩৩৩’কে নিজের নেতাগিরি দিতে চাইলে, ‘নাম নেই ৭৫০০’ বলেছিল, নেতাগিরিখানা ওকে দিচ্ছ দাও, তা এবার তোমার নোংরা গালাগালের নখরাউলিকে আমাকে লিগালি পাস অন করে দিও, জানোই তো পঁচাশি বছর বয়সে পুরুষের দেহের কীটপতঙ্গ ভেবলে জোলো হয়ে যায়, তখন নিয়োগপ্রথা অনুযায়ী অন্য কেউ প্রণয়-রসের যোগান দেয়, তোমার ‘নাম নেই টুকলি বিএ পাশ’ কে প্রণয়-রসের যোগান আমিই দিয়েছিলুম, যখন আমার তেরো বছর বয়স, সেই তখনই, যাকে বলে প্রথম প্রেম, আমি পেটে থাকতে আমার মা নিজের গবভে হাত বুলিয়ে আমাকে হুকুম করে গিয়েছিল যে স্বমেহন করার আগে যেন প্রণয়রস কোনো মাংসফাঁকে ঢালি, ফলে যে ছেলে তোমার সে ছেলে আমারও, তোমার এসকর্ট ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’ এখন আমার অস্হাবর সম্পত্তি, আমার ছেলের মা, তুমি মাঠে-ঘাটে ফোঁপরা বক্তিমে ঝাড়তে গেলে তোমার এসকর্ট ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’ আমার আলো-অন্ধকারে গদগদ সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা রাত কাটায়, জিগ্যেস করে দেখতে পারো, যখন দুটো জিভ দিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করি চাটনের আহ্লাদে টগরবগর করে, শীতবসন্ত জুড়ে উথালিপাথালি ছড়ায়, কোমর খিলখিলিয়ে নাভি কাঁপায় । কেন, ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’-এর বুকের ভাঁজের শ্বাসরোধী আহ্লাদের হল্কায় আমার গায়ের তেতোমিঠে গন্ধ পাওনি ? প্রেম হলো শাদা পোশাকের পুলিশের মতন, যতোক্ষণ না কাজ হচ্ছে ততক্ষণ অনুসরণ করবে, প্রেম হলো একজনের চেয়ে বেশি মানুষের সঙ্গে দেহসম্পর্কের অভিলাষ, প্রেমিককে মিথ্যাবাদী হতেই হবে, নয়তো মন ভোলাবে কেমন করে, আনন্দ পাবার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে, যে কোনো উপায়ে, আমিও সেই উপায়ের রাস্তায় হেঁটেছি ।
‘নাম নেই ৫৬৪৩২’কে কচি ছেলেমেয়েরা যদি রুবলহারামি বলে ক্ষেপায়, ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ আর চটে না, বরং হাসিমুখে বলে, আমি না হয় রুবল খেতুম, কোন নেতা খায় না বল দিকি ? কেউ ডলার খায়, কেউ রিয়াল খায়, কেউ ইয়েন খায়, কেউ লিরা খায়, কেউ দিনার খায়, কেউ ইউরো খায়, কেউ ইউয়ান খায়, বিদেশিমুদ্রা না খেলে নিজের দেশ কি আর চালানো যায়, সেসব দিন গেছে । আমি তো আর দেশবসতের ক্ষতি করে দেশবসতের টাকা খাইনি, লাল্লিঙ্গ বা গণ্ডারলিঙ্গও হইনি, আমার পুঙ্গাঙ্গ অরিজিনাল একেবারে, কখনও রঙ পালটাইনি।
ছেলে ‘নাম নেই ৭৫০০’ যে লুকিয়ে লুকিয়ে ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’কে খাচ্ছে, তা আর চেপে রাখতে পারছিল না বেচারা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’। ‘নাম নেই টুকলি বিএ পাশ’-এর জন্য চব্বিশ ঘণ্টা টেকে এমন পারফিউম, বাইশ ঘণ্টা টেকে এমন স্মাজফ্রি কাজল, বারো ঘণ্টা টেকে এমন জিভে মাখার টকটকে জিভস্টিক, ভালোবাসায় যাতে বাধা না পড়ে তাই বাহাত্তর ঘণ্টা টেকে এরকম ট্যাবলেট, কিনে দিয়েছে যখনই দরকার পড়েছে, আর সেই ‘নাম নেই টুকলি বিএ পাশ’ই কিনা টিকলো না ! আসলে অনেকের কাছে জীবন ব্যাপারটা নাচঘরের মতন, সেখানে সব সময়েই পার্টি চলছে ।
ব্যাপারটা যে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ জানত না তা নয় । ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর বিছানায় কুঁচকির সোনালি চুল দেখে, তুলে, শুঁকে, বুঝে গিয়েছিল যে তা এসকর্ট ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’–এর, একদিন নয়, বেশ কয়েকদিন ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ অমন চুল পেয়েছে, ভেবে পায়নি যে মাথাহীন , তার কুঁচকির চুল এতো লম্বা হয় কেমন করে ! চুলগুলো নিয়ে কৃষ্ণপক্ষের এক অমাবস্যায় ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ এসকর্ট ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’কে বকুনি দিয়ে বলেছিল, চুল ঝরে-ঝরে পড়ে যাবার যোগাড় হয়েছে, সেদিকে খেয়াল দিতে পারো না ! উত্তরে ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’’ বলেছিল, ঝরে পড়েনি, কুঁচকি থেকে ঝরিয়েছি, কখনও কখনও আবেগ-উত্তেজনা বেশি হয়ে গেলে চুল বেড়ে হাতখানেক লম্বা হয়ে যেতে থাকে, আর আবেগ-উত্তেজনা ফুরিয়ে গেলে সেই চুলগুলো ঝরে যায়, সেখানে আবার চুল গজায়, আপনাকে তো আমাদের এসকর্ট কোম্পানি এ-ব্যাপারে দশ বছরের ওয়ারেন্টি দিয়েছে, অতো চিন্তা করবেন না তো ।
‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ ছেলেকে এই বলে ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’কে আইনত হস্তান্তর করে দিয়েদিল, নিচ্ছ নাও, কিন্তু মনে রেখো, বন্ধুনি একদিন প্রেমিকা হয়, তারপরে সে স্ত্রী হয়, তারপর সে সন্তানের মা হয়, তারপর সে শাশুড়ি হয়, তারপর সে নাতির ঠাকুমা বা দিদিমা হয় । এই ধাপগুলোতে প্রেমিকার কিছুই হয় না, তার তো এগুলো প্রোমোশান, কিন্তু তুমি তো প্রেমিক, তোমার জন্য প্রতিটি ধাপ হলো জীবনের ডিমোশান । উত্তরে ‘নাম নেই ৭৫০০’ বলেছিল, সে দেখা যাবে, জীবন তো একজন প্রেমিকাতেই ফুরোয় না, আর কোনো রানিই নিজের সিংহাসনে চিরকাল বসে থাকে না, তাকে একসময়ে সিংহাসন ছাড়তে হয় ।
বাবা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ বেকায়দায় পড়েছে দেখে ‘নাম নেই ৭৫০০’ বললে, তোমার ডায়েরিখানা কোথায় লুকিয়ে রাখো তা মা আমায় আঁতুড়ঘাটেই বলে দিয়েছিল, তোমার ইমেল পাসওয়র্ডও জেনে গেছি । বুড়ো বয়সেও প্রেমিকাদের ভালোই প্রেমপত্র লিখেছ দেখছি, এই যে এইটা, জানতুম না তোমার মধ্যে একজন নাম নেই রোমান্টিক আছে । ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর বিশ্বাস হচ্ছিল না, বললে, কই দেখা, পড়ে শোনা দিকি, গুল মারাবার জায়গা পাসনি ! ‘নাম নেই ৭৫০০’ বাপের ডেস্কটপ খুলে, পাঠানো ইমেল পড়া আরম্ভ করল, কেননা বাপের এলেম কতোদূর তা ছেলে জানে, এখন জানতে চায় বাপকে এই চিঠিগুলোর খসড়া কে লিখে দিয়েছে :-
নাম নেই হে প্রিয়তমা
তোমার সৌন্দ্যর্যের জন্য আমি তোমায় আগে থেকেই ভালোবাসি কিন্তু আমি তোমায় সেই কারণগুলোর জন্য ভালোবাসা আরম্ভ করেছি যা শাশ্বত এবং যার মূল্য চিরকালীন — তোমার হৃদয়, তোমার আত্মা । যে কেউই সৌন্দ্যর্যের সঙ্গে অচিরেই পরিচিত হয় এবং এক ঘণ্টার মধ্যেই প্রেমে পড়ে যেতে পারে আর সেই দ্রুতির সঙ্গেই ভালোবাসা থেকে মুক্ত করে নিতে পারে ; কিন্তু আত্মাকে জানা শিখতেই হবে । বিশ্বাস করো, পৃথিবীতে কষ্ট না করে কিছুই পাওয়া যায় না, এমনকী প্রেমও, সবচেয়ে সুন্দর এবং স্বাভাবিক অনুভব ।
তোমার একান্ত নাম নেই ৫৬৪৩২
‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ নিজেকে জিভের মনে-মনে বলল, যাক ব্যাটা ধরতে পারেনি যে এটা আমার লেখা নয়, ভ্যালেরিয়া আরসেনেভকে লেখা লিও টলস্টয়ের চিঠি, নেট থেকে গেঁড়িয়ে লিখেছিলুম, যাকে লিখেছিলুম সে তো পড়ে আত্মহারা । ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ ছেলেকে বলল, ঠিক আছে, আরো পড়, লুকিয়ে চিঠিগুলো পড়ে ভালোই করেছিস, এখন জানতে পারছিস তো তোর বাপ কতো জ্ঞানী ? তোর মা মিছে আমাকে বদনাম দিয়ে জলের তলায় থাকতে চলে গেল ।
প্রিয়তমা নাম নেই ছোট্ট মেয়ে
বেশ কিছুকাল যাবত আমি তোমায় লিখবো ভাবছিলুম, সন্ধ্যাবেলায়, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ফেরার পর, যা আমি একটি চিঠিতে বিস্তৃত লিখবো ; ব্যাপারটা এমন যেন পৃথিবী কেবল আমাদের । আমি বিজয়ীর আনন্দ তোমার কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলুম, রেখে দিতে চেয়েছিলুম তোমার পায়ের কাছে, যেমনটা সূর্য- সম্রাটের যুগে করার চল ছিল । আর তারপর তর্কাতর্কিতে ক্লান্ত, আমি আশ্রয় নিতুম বিছানায় । আজকে আমি এই কাজ করছি আহ্লাদের জন্য, তুমি কি বুঝতে পারছো না, বন্ধুত্ব থেকে আচমকা প্রেমে চলে এসেছি, শক্তি থেকে নম্রতায় । আজকে তোমাকে এমন করে ভালোবাসছি যা তুমি আমার মধ্যে কখনও পাওনি : আমি ভ্রমণক্লান্ত নই, কিংবা তোমার উপস্হিতির আকাঙ্খার মোড়কে আবদ্ধ নই । তোমাকে ভালোবাসার জন্য এবং সেই অনুভূতিকে আমার অস্তিত্বের উপাদান হিসাবে আত্মস্হ করার জন্য আমি তার ওপর কর্তৃত্ব করার প্রয়াস করছি । আমি তোমার কাছে স্বীকার না করলেই এই আনন্দ আমার অন্তরে প্রায়ই ঘটতে থাকে । আমাকে বোঝার চেষ্টা করো : বাইরের ব্যাপারগুলো সামলিয়েও আমি তোমাকে ভালোবাসি । সেদিন আমি তোমাকে সহজ ভালোবাসা জানিয়েছিলুম । আজ তোমাকে বসন্তকালের সন্ধ্যায় ভালোবাসছি । জানালা খুলে রেখে ভালোবাসছি তোমায় । তুমি আমার, সমস্তকিছু আমার, এবং আমার প্রেম আমার চারিপাশের সমস্তকিছু পালটে দেয়, আর আমার আশেপাশের সমস্তকিছু পালটে দেয় আমার ভালোবাসাকে ।
আমি আমার হৃদয় এবং আত্মা দিয়ে তোমাকে ভালোবাসি ।
তোমার প্রিয় নাম নেই ৫৬৪৩২
বাপ ছেলেকে বলল, দেখেছিস তো, শিক্ষিত যুবতীরাও আমার প্রেমে পড়ত । ছেলে বলল, তা পড়তো কিনা জানি না, কিন্তু এই চিঠিটা আমি একটা পত্রসংকলনে পড়েছি, জাঁ পল সার্ত্রের লেখা চিঠির সংকলনে । বাপ হ্যাঃ হ্যাঃ হেসে বলে উঠল, তা ঠিক ধরেছিস, তাবে যাকে লিখেছিলুম সে তো আর জানতে পারেনি । ইমেলে চিঠি লেখার এই সুবিধা, সে চিঠি জাঁ পল সার্ত্রের চিঠির মতন সংরক্ষণ করে রাখা হবে না । শেখ, শেখ, আমার কাছ থেকে শিখে নে, এখন তো তোর সারা জীবন পড়ে আছে, কতো মেয়ে আসবে আর যাবে । ছেলে বলল, তুমি পুরো চিঠিটা কপি করে পাঠাওনি কেন, পরের প্যারায় তো আরও ভালো-ভালো কথা ছিল । বাপ জবাবে বলল, ওই এক প্যারাতেই কাছে টেনে নিতে পেরেছিলুম, আবার বাড়তি খাটুনির দরকারটা কি ? তাই তো বলছি, শেখ, শেখ । পরের চিঠিটা পড়, সেটা একজন স্নাতকোত্তর প্রেমিকাকে লিখেছিলুম, তার স্বামীকে না জানিয়ে দুজনে লফড়া করতুম, পড়, পড়, তাহলে বুঝতে পারবি তোর বাপ কতো রাজ্য আর রাজরানিকে জয় করেছিল।
হেনা
আমাকে সুস্হমস্তিষ্ক বলে মনে কোরো না । নিজেদের আর বোধবুদ্ধি সম্পন্ন বলে মনে কোরো না । তোমার স্বামীর বাড়িতে যা ঘটেছিল, তা ছিল আমাদের দুজনের বিয়ে — তুমি এর বিরোধিতা কোরো না । তোমার দেহের অংশ আমি গায়ে নিয়ে ফিরে এসেছি ; আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি, সাঁতার কাটছি, রক্তের সমুদ্রে, তোমার নোনতা রক্তে, যা চোলাই করা আর বিষাক্ত । আমি যা কিছু বলছি আর ভাবছি তা ফিরে-ফিরে ওই বিয়ের আসরেই চলে যাচ্ছে । তোমাকে তোমার বাড়ির মালকিনির রূপে দেখলুম, ভারি মুখশ্রীর একজন আদিমানবী, শাদা ত্বকের নিগ্রো নারী, যার সারা গায়ে অজস্র চোখ, নারী, নারী, নারী । জানি না কেমন করে তোমার থেকে দূরে থাকবো, এই মাঝের সময়টা যেন আমার মৃত্যু । আমার সংসর্গে তুমি হয়ে উঠেছিলে নারী । আমি সেকারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলুম । তুমি কেবলমাত্র তিরিশ বছরের নও — তুমি হাজার বছরের ।
তোমার একমাত্র পুরুষ ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’
বাপের দিকে তাকিয়ে ছেলে বলল, তোমার ধৈর্যের বড়ো অভাব । আমাকে বললেই পারতে বাকি পাঁচটা প্যারা টাইপ করে দিতুম, সেগুলো তো আরও আকর্ষক, তুমি বোধহয় ভাবলে আমাকে জানালে আমি তোমার প্রেমিকাকে ফুসলে নেবো ! ছেলের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বাপ বলল, এই চিঠিটাও জানিস ? ছেলে বললে, জানবো না কেন, এটা তো অ্যানাইস নিনকে লেখা হেনরি মিলারের চিঠি । হেনার সঙ্গে অ্যানাইস নামের মিল আছে বলে তুমি এই চিঠিটা বেছেছিলে, বুঝতে পেরেছি ।
এসকর্ট কোম্পানি থেকে ভাড়ায় আনা, যে এসকর্ট কোম্পানির লোকেরা মধুচক্র চালাবার দায়ে জেলে পচছে, সেই এসকর্ট ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’ যে ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর বিরিয়ানি মালাইচিংড়ি মুর্গমুসল্লমের টানে আটক, তা টের পেতে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর মতন গাধলেটেরও অসুবিধা হয়নি । বিষাদের রসে ন্যালবেলে বেচারা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর সেই ইচ্ছে পুরো হলো না, যা সে লাল্লিঙ্গহীন রুবলহারামি হবার সময়ে ভেবে রেখেছিল, তা এই যে ছেলে-বউকে কেজিবির টাকায় বরফের দেশে ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা গরম-গরম মধুচন্দ্রিমা করতে পাঠাবে, হায় হায় হায় হায়, লাল্লিঙ্গীদের কেজিবিটাই লালবাতি জ্বেলে লালবাতি নিভিয়ে ফেললে ।
কথাটা ‘নাম নেই ৩৩৩৩’-এর কুলোপানা জিভের কানে গিয়েছিল । সে বললে আমি নিজের কাছে বেজম্মা হয়ে থাকতে চাই না, পরিচয় চাই, কে আমার আসল বাপ ? ‘নাম নেই ৩৩৩৩’-এর ইচ্ছে পুরো করার জন্যে ‘নাম নেই ৭৫০০’ বিয়ে করে নিলে বাপের এসকর্ট ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশকে’ , যে বিয়ের পিঁড়িতে বসেও থুতু-ছেটানো নোংরা গালমন্দ বজায় রেখেছিল । সেই থেকে ‘নাম নেই ৩৩৩৩’-এর কী আনন্দ, হাততালি দিয়ে হাটেবাজারে বলতে থাকে, লোকের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শোনাতে থাকে, আমার দু’দুটো বাপ, বাপের বাপও আমার বাপ, বাপের বউ যেমন আমার মা তেমনি সেই মা আমার বাপের বাপের বউ । দেশবসতের লোকেরা শুনে প্রশংসা করে ‘নাম নেই ৩৩৩৩’-এর সৌভাগ্যের, বলে হায় হায় হায় হায় আমাদের কেন অমনধারা ডবলবাপ হলো না গো । ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’ ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’কে হুজুর বলে ডাকলেও ‘নাম নেই ৭৫০০’কে রাঙাখোকা বলে ডাকে । ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ তাতেই খুশি, অন্তত একজন তো তাকে নেতা বলে মেনে নিয়ে হুজুর বলে ডাকে ।
‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ যে সময়ে তথাকথিত লাল্লিঙ্গহীন রুবলহারামি ছিল, সেই সময়ে চুপিচুপি ‘নাম নেই ৩৩৩৩’কে দিয়ে নিজের বাড়ির দেয়ালে লিখিয়েছিল ‘’চেয়ারের মানুষ ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’এর চেয়ারম্যান’’, ‘‘মাংসের নলই ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর উৎস’’, ‘’দিকে-দিকে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর নিশানের হুমকি ছড়িয়ে দাও’’, ‘’যবতক সুরজচাঁদ রেহেগা তবতক ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ রহেগা’’, ‘’অবকিবার ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ সরদার’’ । খুনোখুনি মিটে গেলে চুনকাম করানোর পর পেশাদার দেয়াললিখিয়ে ডেকে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর কোনো শত্রু লেখালে, ‘’নাম নেই ৩৩৩৩’-এর উৎসের রহস্যখানা আমার কাছে আছে’’, ‘’যবতক সুরজ-চাঁদ রহেগা ‘নাম নেই ৩৩৩৩’ তেরা বাপ রহেগা’’। ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর সন্দেহ এই কাজ ‘নাম নেই ৭৫০০’ ছাড়া আর কারোর নয় ।
দেশবসতের ভেতর পর্যন্ত অন্য-অন্য শহর ঢুকে এসেছে দেখে ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ এতোদিন যে কালো ট্যাকা সরিয়ে রেখেছিল, তা খরচ করে গাঁয়ে ‘নাম নেই টুকলি বিএ-পাশ’ এসকর্টের মুখখানার ইংরেজি করে গোল্ডফেস নামে একটা সিনেমা হল দাঁড় করিয়ে ফেললে, কেননা জগতে এখন আমেরিকানদের ভাষা রকেটের মতন ভনভনিয়ে উড়ছে । হইহই করে দেশবসতের লোকেরা কাগজের ছোট্টো বালতিতে ভুট্টার খই খেতে-খেতে সিনেমা থেকে ঢুকতে আর বেরোতে লাগল, লোকে ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে চকরাবকরা শার্ট-টিশার্ট-ট্রাউজার ধরলে, বউরা ক্যাটকেটে লাল বা হলহলে হলুদ বা টলটলে নীল টপ আর ছেঁড়া-আধছেঁড়া জিনস ধরলে । ফর্সা যুবতীরা উরুর ছেঁড়া জায়গাটা বিজ্ঞাপন কোম্পানিদের বছর খানেকের জন্য ইজারা দিয়ে দিলে, সেখানে তেলরঙে নানা জিনিসের বিজ্ঞাপন, কেননা খোলা উরুর দিকে জিভের চোখ যাবে না এমন পুরুষ নেই । ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ সরিয়ে রাখা ট্যাকা কাজে লাগলো বলে আমলাবাড়িতে ধরাধরি করে দেশবসতে সরকারি বেসরকারি আর বিদেশি ব্যাংক নিয়ে এলো, যাতে সবাই ট্যাকা রাখতে পারে, কাউকে আর দেয়ালে গর্ত করে কিংবা গাছের গোড়ায় টিনের বাক্সতে ট্যাকা রাখতে হবে না ।
‘নাম নেই ৭৫০০’ বাবা ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর পাশাপাশি হাঁটতে চায় না, আগে লোকে বলতো ওই চলেছে ‘৭৫০০ সাপুড়ে’ আর ‘৫৬৪৩২’ রুবলহারামি, এখন বলে ওই চলেছে ‘৭৫০০ সাপুড়ের’ টাকাহারামি বাপ । এখন তারা হাড়ে-হাড়ে জানতে পেরে গেছে যে ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর জিভ পেটের ভেতরে গোটানো থাকে, সাধারণ জনগণের মতন নয়, যা দিয়ে ও কেউটে সাপকে তাড়ির হাঁড়িতে ফেলে গাঁ-গেরামে বিপ্লব এনেছে, মুখ দিয়ে ও সব খাবার কপকপ করে গিলে কুমিরের মতন খায়, সেই একবার একটা কুমির নদীতে এসে পড়েছিল তখন দেখেছিল গাঁয়ের লোকেরা , পাড় থেকে কুকুর ছাগল গাইগোরু তুলে নিয়ে গিয়ে শিঙ-খুরসুদ্দু গপাগপ গিলে ফেললে, তেমনিই ‘নাম নেই ৭৫০০’রও স্বাদের বালাই নেই, ঝাল লঙ্কা হোক বা শুয়োরের সালামি, ঘাড়ের ভেতর থেকে জিভ বের করে যথেচ্ছাচার করে বেড়ায় । দেশবসতে হয়তো পাঁজিতে বর্ষাকাল এসে গেছে অথচ বৃষ্টি পড়ছে না, ‘নাম নেই ৭৫০০’ অন্য আকাশ থেকে বাদলামেঘ জিভ দিয়ে টেনে এনে বৃষ্টি ঝরিয়ে দ্যায়, যথেষ্ট বৃষ্টি হলে জিভ দিয়ে মেঘকে বাজবিদ্যুতসুদ্দু নদীর ওপারের ঝগড়ুটে দেশবসতে পাঠিয়ে দ্যায়, কিংবা কোনো বাড়িতে ছাদে দাঁড়িয়ে কারোর দ্বিতীয় পক্ষের কচি বউ গামছায় কুঁচকির ঝাড়ছে, ‘নাম নেই ৭৫০০’ গলির মোড় থেকে জিভ বাড়িয়ে চুলের মুক্তো এক ঝটকায় শুকিয়ে দ্যায় , মেছো জাহাজের কাপ্তেনের সৎভাইদের ভুটভুটি ভিন-শহর থেকে না ফিরলে জরুরি দরকারের জন্য যাত্রীদের জিভে জড়িয়ে পারাপার করে দ্যায় ।
‘নাম নেই ৭৫০০’ কোথা যাস বাপুরে, আয় বাবা দেখে যা, দুটো সাপ রেখে যা, যে সাপের চোখ নেই, শিং নেই, নোখ নেই, ছোটে না কি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না, করে নাকো ফোঁসফাস, মারে নাকো ঢুসঢাস, নেই কোনো উৎপাত, খায় শুধু দুধভাত, সেই সাপ জ্যান্ত, গোটা দুই আনতো, তেড়েমেড়ে ডাণ্ডা, করে দিই ঠাণ্ডা, শুনে-শুনে, ছোটোবেলা থেকে,সেই যখন ‘নাম নেই ৭৫০০’ জিভ দিয়ে উড়ন্ত ঘুড়িদের নামিয়ে আনতো, আর যখন ওর প্যাণ্টের পকেটে নদী থেকে সদ্য ধরা কাঁকড়া ওকে উত্তেজিত করত, ‘নাম নেই ৭৫০০’এর ঘাড়ে শিং গজিয়ে উঠেছিল, তার কারণ দেশবসতের কুপ্রথা অনুযায়ী যাকে যা বলে খ্যাপানো হয় তার শরীরে তা ঘটতে থাকে, জিভের চোখ কুঁচকে চিনাদের মতন হয়ে গিয়েছিল, নখ বড়ো হয়ে যেত বলে রোজই কাটতে হচ্ছিল, কথা বলার সময়ে ওর ঘাড়ের জিভ থেকে ফোঁসফাস বেরোতো বেশি, দেশবসতের যুবতীরা ওর ফোঁসফোঁসের প্রতি আকৃষ্ট হতো, কেননা ও ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রেমের কথা বলে সময় নষ্ট করতো না, জিভ দিয়ে পাকিয়ে নিয়ে দুজনে একপ্রাণ একদেহ হয়ে যেতো । রেগেমেগে ‘নাম নেই ৭৫০০’ সাত বছর বয়সে প্রথম মঙ্গলবার দুপুর দুটো পঞ্চাশ মিনিটে নদীতে মা ‘নাম নেই ৯৭৮৫’-এর খোঁজে নেমে মায়ের সঙ্গে এক সপ্তাহ কাটিয়ে , ওর শিং,জিভ, ল্যাজ, ফোঁসফোঁস আর নখের সমস্যা সমাধান করে ফিরে এসেছিল, তবে যদ্দিন না ধুতি ধরেছে আর পরে ফুলপ্যাণ্ট পরেছে, হাফ-প্যাণ্টুলকে হাঁটুর নিচে পর্যন্ত পরতেই হয়েছে ।
মেছো জাহাজের কাপ্তেন ‘নাম নেই ৫৫৫’ এর দুই দিকে লাল গুঁফো-রাক্ষস আঁকা ভুটভুটিতে ‘নাম নেই নদী’ পার হবার সময়ে যাত্রীসংখ্যা বেশি থাকার দরুণ ভুটভুটি উল্টে গিয়ে কতোজন ডুবে মারা গেল তা তক্ষুণি জানা না গেলেও এটা জানা গেল যে ‘নাম নেই ৭৫০০’-এর বাপ ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ , মেয়েদের নোনতা রক্তে সাঁতার কাটতে জানলেও, জলে সাঁতার জানতো না, জল থেকে আর ওঠেনি, তার শবও ভেসে ওঠেনি, যখন কিনা অন্য সবায়ের শব দিনকতক পর, চিৎ হয়ে পেট ফাঁপিয়ে চোখ খুলে কিংবা উপুড় হয়ে ফুলে-ফেঁপে ভেসে উঠেছিল । তবে তার মতনই হাতের লেখায় একটা চিরকুট পাওয়া গেছে, তাতে কুঁচকির সোনালি চুলের গোছা, লেখা রয়েছে, “কাঁদন হাসি, ভালোবাসি ভালোবাসি’ ।
‘নাম নেই ৭৫০০’ অনুমান করতে পারল যে ওর মা ‘নাম নেই ৯৭৮৫’ বাপটাকে টেনে নিয়ে গেছে নিজের কাছে, জলের প্রাসাদে শ্যাওলার শরবত খেয়ে কাটাক বাকি জীবন এবার । যাদের শব পাওয়া গিয়েছিল তাদের অন্ত্যেষ্টি হল, তাদের জন্য রুদালি গান গাওয়া হল, ‘কেন চোখের জলে সাঁতার দিলেম না’ ।
‘নাম নেই ৫৬৪৩২’-এর শব অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না । তবে চিরকুটটা যে ওনারই লেখা তা ছেলে স্বীকার করার পর নিজের বাপকে পূন্যাত্মা ঘোষণা করে দিল একদিন দুপুর বেলায়, বাপের বউকে জড়িয়ে, কেননা তার মনে হয়েছিল যে বাপটা তো সাঁতারে কতো পুরস্কার পেয়েছিল জোয়ান বয়েসে, ডুবলো কেমন করে, নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করেছে, আর মানুষ মহৎ না হলে আত্মহত্যা করে না । যে চত্বরে তাকে নাকে তুলো গুঁজে রাখার কথা, তা ফাঁকা পড়ে রইল বহু বর্ষা বহু শীত বহু বসন্ত বহু গ্রীষ্ম বহু ঋতুহীন কুয়াশা আর ধোঁয়াশা । শেষে ‘নাম নেই ৭৫০০’ ‘নাম নেই ডাক্তার’-এর নকল ঠ্যাঙটা বাড়ির খাটের তলা থেকে এনে চত্বরের বেদিতে উল্টো করে গেঁথে বসিয়ে দিল, বেদির শ্বেতপাথরে লেখা হলো “নাম নেই” ।
দূর থেকে দেখে মনে হতো মৃত শহিদের স্মৃতিতে রাইফেল উল্টো করে পোঁতা।
দেশবসতের পোয়াতিদের আঁতুড়ঘাটে যে বাচ্চাই জন্মাক না কেন, কেউই আর কারোর নাম ‘নাম নেই ৫৬৪৩২’ রাখে না।
পঞ্চাশ বছরের বেশি হয়ে গেল নামটা ফাঁকা পড়ে আছে ।
Leave a Reply