নানা রসের ৬টি উপন্যাস – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
ভূমিকা
গত পঞ্চাশ বছরের বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এক স্মরণীয় নাম। বিশ শতকের পাঁচের দশকে যারা লেখালেখি করতে আসেন, তাদের মধ্যে নানা কারণেই তিনি বিশিষ্ট। তাঁর ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ ইতিমধ্যেই ক্লাসিক হিসাবে স্বীকৃত। এ বইটি এখনও পর্যন্ত বারোটি আঞ্চলিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগান’, ‘মানুষের ঘরবাড়ি’র মতো ধ্রুপদী রচনার স্রষ্টা। অতীন সাধারণত বড় ক্যানভাসে লিখতে ভালোবাসেন। তিনি প্রকৃতিমুগ্ধ লেখক। প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনায় মজে যান। তাঁর রচনা মানবিক রসে সিক্ত। মানুষের জীবনের, বিশেষ করে নারী—পুরুষের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কাহিনী লিখতেও তিনি ভালোবাসেন। তাঁর রচনায় উঠে আসে আটপৌরে জনজীবনের বাস্তব চিত্র। যদিও এই বাস্তবতায় নিজেকে সীমিত রাখতে তিনি রাজি নন। তাই এই বাস্তবতাকে প্রায়ই তিনি রূপকের মোড়কে উপস্থাপিত করেন। লোকজীবনের সঙ্গে কিংবদন্তীর সীমান্তরেখাটি মুছে দেন। তাঁর চরিত্রেরা লোকজীবন থেকে উঠে এসে কিংবদন্তীর পরিসরে জায়গা করে নেয়। কখনও বা তিনি ডুব দেন মনস্তত্ত্বের নানা গূঢ় জটিলতায়।
আর তাঁর আখ্যানে নারীর ভূমিকা সবসময়ই খুব অভিঘাতময় হয়ে ওঠে। অতীন লিখেছেন, ‘আসলে মানুষ এবং তার চারপাশের মধ্যে যে আত্মীয়তা গড়ে ওঠে সে শুধু এক নারীর জন্য। জীবনের সবকিছুর মধ্যে যেন তাকেই বারবার আবিষ্কার…। নারী যদি তার সেই রূপবান মাছরাঙা পাখিটাকে উড়িয়ে দেয়, যে—কোনো পুরুষই অবহেলায় সব দুর্যোগ অতিক্রম করে যেতে পারে।’ এরকমই কাব্যময় হয়ে ওঠে তাঁর ভাষা। যেন স্বপ্নকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। অতীন জীবন—রসিক লেখক। জীবনের অভিজ্ঞতাকে নিংড়ে তিনি তার আখ্যানের রসদ বার করে আনেন। কিন্তু সেই রসদকে স্বপ্নের কাব্যময়তায় সিক্ত করে তিনি পাঠকের কাছে পরিবেশন করেন। এইজন্য তাঁর রচনায় শ্লেষ ও অম্লতা প্রায় নেই, বরং তা এত মরমী ও মধুর। তাঁর রচনা পাঠ করলে এইজন্যই মন নিবিড় ও প্রশান্ত এক অনুভূতিতে ভরে যায়। জীবনের হিংস্রতা ও নৃশংসতাকেও তিনি বেদনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন। পাঠক আহত হওয়ার চেয়েও বেশি তাই বেদনা বোধ করে। তিনি তাই লেখেন, ‘সব কলরবের মধ্যেও আছে জীবনের এক গোপন আকাঙ্ক্ষা।’ অতীন এই গোপন আকাঙ্ক্ষার কাছেই পৌঁছতে চান। কোনও কলরব তখন তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।
অতীনের একটি স্মরণীয় উপন্যাস, ‘শেষ দৃশ্য’ (১৯৬৭)। শ্মশানে শবদাহের পেশায় নিযুক্ত সম্প্রদায়কে নিয়ে লেখা এই রচনা, রাজা হরিশচন্দ্রের নাম যারা জানে, আর জানে ওরা গঙ্গাপুত্র। শ্মশানের চারধারে অনেকগুলি কুঁড়েঘর। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের চোখে ঘৃণ্য, অবহেলিত হলেও এই মানুষগুলির জীবন আঁকা হয়েছে গভীর দরদ দিয়ে, রয়েছে তাদের ‘চটানে’র নিপুণ চিত্র, তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার অন্তরঙ্গ পরিচয়। গোমানি—হরিতকি—নেলি—গেরু—লখি—টুনুয়ার মতো অন্ত্যজ মানুষ এবং সেই সঙ্গে ঘাটোয়ারিবাবুকে আমরা ভালোবেসে ফেলি তাদের যন্ত্রণায়, তাদের অসহায়ত্বে। এই মানুষগুলো কেউ হাড় বিক্রি করে, কেউ চুরি করে, দারিদ্র্য আর অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। আবার গেরুর বউ শনিয়া অনাহারের মধ্যেও স্বামীকে কোনও খারাপ কাজ করতে বাধা দেয়।
অস্কার ওয়াইল্ডের প্রতীকধর্মী আখ্যানগুলির মতোই বেশ কিছু প্রতীকী আখ্যান লিখেছেন লেখক, যার মধ্যে ‘টুকুনের অসুখ’ (১৯৭৪) অন্যতম। খরায় গ্রাম জ্বলছে, এক ফোঁটা জলের জন্য মানুষের হাহাকার, সরকারি লঙ্গরখানায় যদিও কিছু খাবার মেলে কিন্তু জলের অভাব সেখানেও, তার ওপর আছে দুর্নীতি। সুবল নামে একটি গ্রাম্য কিশোর তার পাখি নিয়ে ট্রেনে উঠেছিল, সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় চিররুগণা বালিকা টুকুনের। টুকুন সুবলের পাখির খেলা দেখে মুগ্ধ হয় এবং টুকুনের বাবা—মা জানতে পেরে সুবলকে ব্যান্ডেল স্টেশনে নামিয়ে দেয়। টুকুন যখন নার্সিংহোমে অনেক চিকিৎসার পরও ভালো হচ্ছিল না, তখন সুবলের সঙ্গে দেখা হয়। গ্রাম্য পাখিওয়ালা সুবল হয়ে ওঠে সেই বাওবাব গাছ, যার ভালোবাসার ছায়ায় টুকুন সুস্থ হয়ে ওঠে।
‘মানুষের হাহাকার’ (১৯৮১) উপন্যাসে অতীন সত্তর দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলনকে স্থাপন করতে চেয়েছেন মানুষের সামগ্রিক উত্থান—পতন এবং অগ্রগতির অন্তহীন প্রেক্ষিতে। ফলে আন্দোলনের তাৎক্ষণিক উগ্রতা এখানে অনুপস্থিত, তার পরিবর্তে রয়েছে অস্থির সময় ও মানুষের হাহাকারের এক দরদি প্রতিবেদন। কিন্তু মানুষ পরাজয় স্বীকার করে না, সে অপরাজিত থাকতে চায়, তার মধ্যে এই বলিষ্ঠ ব্যাপ্ত জীবনবোধও নিরন্তর ভাসমান। তাই বহু তাজা প্রাণের নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে নতুন জীবনের সূচনা, উপন্যাসে তার কথাও বলা হয়েছে।
সমুদ্রযাত্রা, সমুদ্রের জীবন এবং সমুদ্রকর্মীদের জীবন নিয়ে লেখা আখ্যান ‘নগ্ন ঈশ্বর’ (১৯৮৪)। চারটি পরিচ্ছদে সম্পূর্ণ এই উপন্যাসের প্রথম তিনটিকে লেখক বলেছেন, ‘আলো এবং উৎসর্গের গান’, শেষ পরিচ্ছদটিকেই লেখক বলেছেন মূল উপন্যাস। তিনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে তিন পরিচ্ছদের তিন জাহাজকর্মীর জীবনে তিনটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা ঘটে যায়। অবনীভূষণ, বিজন এবং সুমিত্র ভিন্ন ভিন্ন জাহাজে সমুদ্রযাত্রা করেছিল, বহু বন্দর ও সমুদ্র অতিক্রম করে তারা উঠে পড়েছিল এক স্থবির জাহাজে। চতুর্থ পরিচ্ছেদে রয়েছে একটি অপরাধের কথা, যাকে স্মরণ করে তিনজনই অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়েছে এবং তা স্খালনের জন্য তুষারঝড়ের ভিতর ঈশ্বর—সন্ধানের মতো জীবনের মানবিক কোনও কীর্তির কথা স্মরণ করেছে, অকপটে ভালোবাসার জন্য মৃত যুবতীটিকে তারা বরফ—ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু কিছুতেই সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে পারছিল না।
‘দুঃস্বপ্ন’ (১৯৮৫) উপন্যাসেরও কেন্দ্রে আছে এক নারী, সোমা। উদ্বাস্তু পরিবারের উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে সোমা। তার মা’র সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এক ধনী পুরুষের, সেই অপবাদ সহ্য করতে না পেরে তার বাবা আত্মঘাতী হয়। সোমা নিজেও খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও বহু পুরুষের কামনার বস্তু। কিন্তু মনে মনে সে চায় এমন এক স্বপ্নের নায়ককে, যে তার জীবনে এনে দেবে সুখ, আরাম, স্বচ্ছলতা। সব পুরুষ—বন্ধুর মধ্যে সোমা তাই বেছে নেয় ধনী ব্যবসায়ী মনীষকে, যার রয়েছে অগাধ ঐশ্বর্য এবং সেই ঐশ্বর্যের মূলে রয়েছে নানা দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপ। মনীষও সোমার রূপ ও শরীরের ভক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু সোমা ও মনীষের বন্ধুরা এক উদ্ভট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। চারপাশে যখন বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার তীব্র হয়ে উঠেছে, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে তাদের হত্যা করা হচ্ছে, সেইরকম বাস্তবতায় তারা সোমার চোখে মনীষের স্বরূপকে খুলে দিয়ে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। সোমা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, মনীষ কোনও স্বপ্নের নায়ক নয়, সে তার স্বপ্নের নায়কের জন্য মরীয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সোমাকে একটু একটু করে হারানোর যন্ত্রণায় মনীষ পাগলের মতো হয়ে ওঠে, এর সঙ্গে একের পর এক উড়ো চিঠি তাকে ভয়ার্ত ও তাড়িত করে চলে, আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কায় সে মানসিক ভারসাম্য হারায় এবং শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। মনীষকে এইভাবে তার ঈর্ষাপরায়ণ বন্ধুরা এক প্রবল ভয়ের ফাঁদে ফেলে বাধ্য করে মৃত্যুকে বেছে নিতে এবং এইভাবেই তারা সোমাকে না পাওয়ার শোধ তোলে।
‘নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি’ (২০০২) উপন্যাসেরও কেন্দ্রে রয়েছে এক আশ্চর্য নারী, যার নাম তিথি। পড়াশুনো করবে বলে নিজের বাড়ি ছেড়ে বাবার সঙ্গে চলে এসেছিল অরণি, সেখানেই তার সঙ্গে আলাপ হয় তিথির। গরিব, অভাবী পরিবারের মেয়ে তিথি, জমিদার বাড়ির দয়ার ওপর তাদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। কিন্তু আশ্চর্য প্রাণচঞ্চল তার মন, সতেজ, সংবেদনশীল, কল্পনাপ্রবণ তার হৃদয়। অরণিকে সে যেমন অসুস্থ হলে সেবা করে, তেমনই তার মনকে নিয়ে যায় এক কিংবদন্তীকে রাজ্যে। এভাবেই তার শরীর ও মনকে অধিকার করে নেয় তিথি। অরণির কাছে তার বাস্তবতা তুচ্ছ হয়ে যায়, তিথির সঙ্গে সে হারিয়ে যায় এক কল্পজগতে, লিপ্ত হয় নানা দুঃসাহসিক কার্যকলাপে। তারা একে অপরের কাছে অনিবার্য ও নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। তিথির সূত্রেই অরণি প্রথম যৌনতার স্বাদ পায়, নারী শরীরকে দেখে সে একেবারে অভিভূত হয়ে যায়। কিন্তু এভাবে বেশিদিন চলে না, তিথিকে বিয়ে দেওয়ার জন্য জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়, তাও আবার এমন এক পাত্রের সঙ্গে যার আগের পক্ষের দুটি স্ত্রী রয়েছে। তিথি কিন্তু স্টিমার থেকে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায়, আর সঙ্গে সে নিয়ে যায় অরণিকে। তিথি আর অরণি, দু’জনেই কিংবদন্তীর অংশ হয়ে যায়। লোকে বলে, তারা শুশুক হয়ে গেছে আর তাদের ঢেউয়ের মাথায় সাঁতার কাটতে দেখা গেছে।
এই বিপুলায়তন সংকলনটি প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ প্রাপ্য দীপ প্রকাশনের কর্ণধারশ্রী শংকর মণ্ডল, তাঁর সুযোগ্য পুত্র শ্রী দীপ্তাংশু মণ্ডল এবং তাঁদের কর্মসহযোগী শ্রী আশিস চৌধুরীর। সবশেষে বলা যায়, পাঠকদের হাতে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এক অতুলনীয় লেখকের ছ’টি উপন্যাসের এই স্মরণীয় সংকলন তুলে দিতে পারায় আমরা সকলেই গর্বিত। বাংলা উপন্যাসে এ এক গৌরবময় সংযোজন, বলা বাহুল্য, এ কথা অনস্বীকার্য।
Leave a Reply