নর্স মিথোলজি – নীল গেইম্যান
ভাষান্তর : সালাহ উদ্দিন
প্রথম প্রকাশ: একুশে বইমেলা- ২০২৪
প্রকাশক : মো. আমিনুর রহমান, প্রাপ্ত প্রকাশন
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সজিব আহম্মেদ
.
উৎসর্গ
সকল অনুপ্রেরণার উৎস
আমার প্রয়াত পিতা আল্লামা আবুল হাসেম মাদানীকে
ভূমিকা
রূপকথার গল্পের প্রতি আমার ঝোক ছোটবেলা থেকেই। আব্বা ছোটদের গল্প শোনাতে পছন্দ করতেন। বাচ্চারা সবসময় আব্বার কাছে বায়না ধরত গল্প শোনানোর জন্য। তাদের গল্প শোনানোর জন্য আব্বা কিনে এনেছিলেন বাচ্চাদের আরব্য রজনীর বই। আরব্য রজনীর কাহিনি শুনে, রূপকথার গল্প পড়ে আর কল্পনার জগতে বিচরণ করে আমার শৈশবটা রঙিন হয়েছিল
বড় হয়ে গল্প-উপন্যাস-নন ফিকশন সব পড়ে সর্বভূক পাঠক হলেও পৌরানিক কাহিনি আমার পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নেয়। পৌরানিক কাহিনিতো এক অর্থে রূপকথাই। রূপকথার আদলে বললে রূপকথা হয়, নতুবা গল্প-উপন্যাস যেকোনো আদল দেয়া যায়। দিনে দিনে রামায়ন-মহাভারত, গ্রিক পুরাণ, নর্স পুরাণ মনে দাগ কেটে যেতে শুরু করে।
মিথোলজি বা পুরাণের কাহিনি আমাদের এক ভিন্ন সময়ে নিয়ে যায়। আদিম মানুষরা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি, পৃথিবীর প্রাকৃতিক শক্তিগুলো নিয়ে কি ভাবত জানা যায়। জানা যায়, মানুষ সৃষ্টিজগতের ধ্বংস কীভাবে হবে সেটা নিয়ে কি ভাবত।
নিল গেইম্যানের নর্স মিথোলজি আমাদের নর্স পুরাণের দেব-দেবী, তাদের নানান কাহিনি, সৃষ্টিজগতের সৃষ্টি আর বিনাশ নিয়ে গল্প শোনায়। দেবতাদের প্রধান একচক্ষু বিশ্বপিতা ওডিন, মহাশক্তিশালী থর, বুদ্ধিমান আর চতুর লোকিকে ঘিরেই প্রধানত কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। বিশ্বজগৎ সৃষ্টি থেকে শুরু হয়ে নয় দুনিয়ার বর্ণনা দিয়ে বইয়ের শুরু হয়েছে। একে একে দেবতাদের নানান রত্ন প্রাপ্তি, এসগার্ডে প্রাচীর নির্মাণ, লোকির সন্তানদের গল্প, ফ্রেয়ার অস্বাভাবিক পরিণয়, কাব্যমদিরা, থরের দানব রাজ্য যাত্রার অ্যাডভেঞ্চার, অমরত্ত্বের আপেল, জার্ড আর ফ্রে’র গল্প দিয়ে বইয়ের কাহিনি এগিয়ে যায়। বাল্ডারের মৃত্যুর কাহিনি, লোকির শেষ দিনগুলোর কাহিনি দিয়ে গল্প সমাপ্তির দিকে এগোয়। সবশেষে দুনিয়ার ধ্বংসের ক্ষণ রাগনারকের গল্প দিয়ে শেষ হয় বইয়ের কাহিনি। নীল গেইম্যানের গল্প বলার ধরনে আর কাহিনি বিন্যাসে আপাতত ছোট ছোট গল্পগুলোও যেন এক উপন্যাসের রূপ নেয়।
কোভিড মহামারির সময়ে নীল গেইম্যানের নর্স মিথোলজি পড়ে হঠাৎই অনুবাদ করার ইচ্ছে জাগে। এর আগেও অনুবাদের ইচ্ছে আমার হয়েছে, কিছুটা অনুবাদও করেছি কিন্তু সমস্যা হলো, ধৈর্য্য নিয়ে অনুবাদের কাজটা শেষ করা হয় না। অনেকদিন ধরে ধীরে ধীরে একসময় এই বইয়ের অনুবাদ শেষ করেছি এটাই শেষ করা আমার প্রথম অনুবাদ। এতদিন নিজের কাছেই পড়েছিল। অবশেষে বই আকারে প্রকাশ। নিজের লেখা ছাপা বই আকারে দেখা একটা স্বপ্ন পুরনের মতো। তবে দিনশেষে আমার অনুবাদ পাঠকের ভালো লাগলেই নিজেকে স্বার্থক মনে করব।
সালাহ উদ্দিন
বইমেলা-২০২৪
কুশীলবগণ
নর্স মিথোলজিতে অনেক দেব-দেবীর নাম এসেছে। এই বইয়ে তাদের অনেকেরই দেখা পাওয়া যাবে। তবে এই বইয়ের বেশিরভাগ কাহিনি আবর্তিত হয়েছে দেবতা ওডিন, তার পুত্র থর আর ওডিনের ধর্মের ভাই দেবতাদের সাথে এসগার্ডে বাস করা দানবপুত্র লোকিকে ঘিরে।
ওডিন
দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন আর মর্যাদার আসনে আসীন দেবতা ওডিন।
ওডিন অনেক গোপন তত্ত্বকথা জানেন। তিনি জ্ঞানের জন্য তার একটা চক্ষু উৎসর্গ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, জ্ঞানের জন্য, শক্তির জন্য, জাদুবিদ্যা শেখার জন্য তিনি নিজের নিকট নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।
তিনি নয় রাত বিশ্ববৃক্ষ ইগড্রাসিল থেকে ঝুলে ছিলেন। তার শরীরের এক পাশ একটা বর্শা দ্বারা বিদ্ধ ছিল, যেটা তাকে খারাপভাবে আহত করেছিল। বায়ুরা তার চারপাশ ঘিরে ছিল, যেন তারা তার শরীর নিয়ে ভোজ করছে। নয় দিন তিনি কিছুই খাননি, এমনকি কিছু পানও করেননি। প্রবল যন্ত্রণায় একাকী তার প্রাণের আলো ক্রমশই নিভে আসছিল।
প্রচণ্ড ঠান্ডায় প্রবল যন্ত্রণায় মৃত্যুর মুখে তার আত্মত্যাগ ফল দিতে শুরু করল- প্রবল যন্ত্রণার চরম শিখরে পৌঁছে তিনি যখন নিচের দিকে তাকালেন, রান (ভাষা-জাদুবিদ্যা) এর রহস্য তার সামনে উন্মোচিত হলো। তিনি রানের রহস্য চিনতে-বুঝতে আর তাদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে অবগত হলেন। তখনই দড়ি ছিঁড়ে গেল, আর ওডিন চিৎকার করতে করতে বিশ্ববৃক্ষ থেকে নিচে পড়ে গেলেন। এখন তিনি জাদুবিদ্যা বুঝতে পারেন। বিশ্ব এখন তার হাতের মুঠোয়। ওডিনকে অনেক নামে ডাকা হয়। বিশ্বপিতা, মৃতদের সর্দার, ফাঁসির দেবতা। তিনি মালামালের দেবতা, বন্দিদেরও দেবতা। তাকে তৃতীয় গ্রিমনীর বলা হয়। তাকে নানা নামে বিভিন্ন দেশে পূজা করা হয় (বিভিন্ন রূপে আর ভাষায় তাকে পূজা করা হয়, কিন্তু সবসময় এই পূজা ওডিনকেই করা হয়।)
মানুষের চোখে পৃথিবী দেখার জন্য তিনি ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ান। আলখেল্লা আর টুপি পরে লম্বা এক মানুষের বেশে তিনি মানুষের মাঝে ঘুরে বেড়ান।
তার দুটি দাঁড়কাক আছে, নাম তাদের হুজিন আর মুনিন, যার মানে হচ্ছে ভাবনা আর স্মৃতি। তারা দুনিয়ার নানা প্রান্তে উড়ে বেড়ায় আর ওডিনকে সকল বিষয় সম্পর্কে জানায়। তারা তার কাঁধের ওপর বসে আর তার কানে কানে কথা বলে। তিনি যখন তার সুউচ্চ সিংহাসন লিসালফে বসেন, তিনি সবকিছু দেখতে পান, কোনোকিছুই তার কাছে গোপন থাকে না।
তিনি পৃথিবীতে যুদ্ধ নিয়ে এসেছেন। ওডিনের সম্মানে আর মৃতদের তার প্রতি উৎসর্গ করার জন্য শত্রুপক্ষের প্রতি বর্শা নিক্ষেপ করে সব যুদ্ধ শুরু করা হয়। তুমি যদি যুদ্ধ শেষে বেঁচে ফেরো, সেটা ওডিনের বদান্যতায়ই হয়েছে, আর যদি তুমি যুদ্ধে নিহত হও, বুঝবে ওডিন তোমার সঙ্গ ত্যাগ করেছে।
যদি তুমি বীরের মতো মৃত্যুবরণ কর, সুন্দরী যুদ্ধকুমারী ভ্যালক্যারিরা, তোমার আত্মাকে সংগ্রহ করে ভ্যালহালায় নিয়ে যাবে। ওডিন তোমার জন্য ভ্যালহালায় অপেক্ষা করবে। সেখানে তোমরা ভোজ করবে, পান করবে আর ওডিনের নেতৃত্বে যুদ্ধ করবে।
থর
ওডিনের পুত্র থর, বজ্রের দেবতা। ওডিন যতটা ধূর্ত, থর ততটাই সোজাসাপটা, ওডিন যদি হয় প্রতারণাপূর্ণ, থর সেখানে উত্তম স্বভাবের।
বিশালাকৃতি, শক্তিশালী ও লাল দাড়ির থর দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। তার একটা কোমরবন্ধনী আছে, মেজিনজর্ড নামে, যেটা পরলে তার শক্তি দ্বিগুণ হয়ে যায়।
থরের অস্ত্রের নাম মিওলনির, একটা হাতুড়ি, সেটা বামনরা তাকে বানিয়ে দিয়েছে। এটার গল্প সামনে তোমরা জানতে পারবে। ট্রোল, বরফ দানব আর পাহাড়ি দানবেরা মিওলনিকে দেখেই ভয় পেয়ে যায়, কারণ এর আঘাতে তাদের অনেক ভাই-বন্ধুর ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে। থর লোহার দস্তানা পরে, এতে হাতুড়ির হাতল ধরতে তার সুবিধা হয়।
থরের মা ছিল পৃথিবীর দেবী জর্ড। থরের দুই ছেলে, সদা রাগান্বিত মোদি, আর শক্তিশালী মাগনি। মেয়ে ক্ষমতাশালী থ্রাড।
থরের স্ত্রী সোনালি চুলের সিফ। থরের সাথে বিয়ের পূর্বে সিফের এক পুত্র ছিল, উলার। থর উলারের সৎপিতা। উলার তির ধনুক দিয়ে শিকার করে থাকে, সে আকাশ দেবতা।
থর এসগার্ড আর মিডগার্ডের রক্ষাকর্তা।
থর আর তার অ্যাডভ্যাঞ্চারের অনেক কাহিনি রয়েছে। এই বইয়ে তার কয়েকটা তোমরা জানতে পারবে।
.
লোকি
লোকি খুবই সুদর্শন। সে বিশ্বাসযোগ্য, পছন্দসই আর এসগার্ডের সকল দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে কৌশলী আর চতুর। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তার একটা অন্ধকার দিক আছে, সেখানে আছে ভয়ানক রাগ, প্রচণ্ড ঈর্ষা, প্রবল লালসা।
লোকি লাউফির ছেলে, লাউফিকে নাল নামেও ডাকা হয়, নাল মানে সুঁই। কারণ লাউফি ছিল সুন্দর, তীক্ষ্ণ আর পাতলা গড়নের। বলা হয় লোকির বাবা ছিল ফারবাউতি, একজন দানব। ফারবাউতি নামের অর্থ হলো ‘যে ব্যক্তি ভয়ানক আঘাত করতে পারে।’ ফারবাউতি তার নামের মতোই ভয়ানক ছিল।
লোকির জুতা তাকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। লোকি যেকোনো ব্যক্তি বা পশুর আকার ধারণ করতে পারে। কিন্তু লোকির সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো তার বুদ্ধি। সে যেকোনো দেবতা বা দানবের চেয়ে বেশি ধূর্ত, সূক্ষ্মবুদ্ধি আর কৌশলী। এমনকি ওডিনও লোকির মতো এত ধূৰ্ত নয়।
লোকি ওডিনের ধর্মের ভাই। লোকি কখন কীভাবে এসগার্ডে এলো অন্য দেবতাগণ সে সম্পর্কে কিছুই জানে না। সে থরের বন্ধু, একই সাথে থরের প্রতি বিশ্বাসঘাতী। দেবতারা তাকে সহ্য করে, কারণ তারা বিপদে পড়লে লোকির পরিকল্পনা আর কৌশলই তাদের রক্ষা করে।
লোকি দুনিয়াকে অনেকটা মজাদার করেছে, কিন্তু একই সাথে করেছে অনিরাপদও। লোকি দানবের পিতা, দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী ধুর্ত এক দেবতা।
লোকি প্রচুর পান করে, আর অতিরিক্ত পান করে মাতাল হলে তার ভাবনা-কথা- কাজের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। লোকি আর তার সন্তানেরা রাগনারকের সময় উপস্থিত থাকবে, কিন্তু তারা এসগার্ডের দেবতাদের পক্ষে যুদ্ধ করবে না।
Leave a Reply