নদী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পরমস্নেহাস্পদ
শ্রীমান বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হস্তে
তাঁহার শুভপরিণয়দিনে
এই গ্রন্থখানি
উপহৃত
হইল ।
২২ মাঘ
১৩০২
.
নদী
ওরে তোরা কি জানিস কেউ জলে কেন ওঠে এত ঢেউ । ওরা দিবস – রজনী নাচে , তাহা শিখেছে কাহার কাছে । শোন্ চলচল্ ছলছল্ সদাই গাহিয়া চলেছে জল । ওরা কারে ডাকে বাহু তুলে , ওরা কার কোলে ব’সে দুলে । সদা হেসে করে লুটোপুটি , চলে কোন্খানে ছুটোছুটি । ওরা সকলের মন তুষি আছে আপনার মনে খুশি । আমি বসে বসে তাই ভাবি , নদী কোথা হতে এল নাবি । কোথায় পাহাড় সে কোন্খানে , তাহার নাম কি কেহই জানে । কেহ যেতে পারে তার কাছে , সেথায় মানুষ কি কেউ আছে । সেথা নাহি তরু নাহি ঘাস , নাহি পশুপাখিদের বাস , সেথা শবদ কিছু না শুনি , পাহাড় বসে আছে মহামুনি । তাহার মাথার উপরে শুধু সাদা বরফ করিছে ধু ধু । সেথা রাশি রাশি মেঘ যত থাকে ঘরের ছেলের মতো । শুধু হিমের মতন হাওয়া সেথায় করে সদা আসা – যাওয়া , শুধু সারা রাত তারাগুলি তারে চেয়ে দেখে আঁখি খুলি । শুধু ভোরের কিরণ এসে তারে মুকুট পরায় হেসে । সেই নীল আকাশের পায়ে সেথা কোমল মেঘের গায়ে সেথা সাদা বরফের বুকে নদী ঘুমায় স্বপনসুখে । কবে মুখে তার রোদ লেগে নদী আপনি উঠিল জেগে , কবে একদা রোদের বেলা তাহার মনে পড়ে গেল খেলা । সেখায় একা ছিল দিনরাতি , কেহই ছিল না খেলার সাথি । সেথায় কথা নাহি কারো ঘরে , সেথায় গান কেহ নাহি করে । তাই ঝুরু ঝুরু ঝিরি ঝিরি । নদী বাহিরিল ধীরি ধীরি । মনে ভাবিল , যা আছে ভবে সবই দেখিয়া লইতে হবে । নীচে পাহাড়ের বুক জুড়ে গাছ উঠেছে আকাশ ফুঁড়ে । তারা বুড়ো বুড়ো তরু যত তাদের বয়স কে জানে কত । তাদের খোপে খোপে গাঁঠে গাঁঠে পাখি বাসা বাঁধে কুটো – কাঠে । তারা ডাল তুলে কালো কালো আড়াল করেছে রবির আলো । তাদের শাখায় জটার মতো ঝুলে পড়েছে শেওলা যত । তারা মিলায়ে মিলায়ে কাঁধ যেন পেতেছে আঁধার – ফাঁদ । তাদের তলে তলে নিরিবিলি নদী হেসে চলে খিলিখিলি । তারে কে পারে রাখিতে ধরে , সে যে ছুটোছুটি যায় সরে । সে যে সদা খেলে লুকোচুরি , তাহার পায়ে পায়ে বাজে নুড়ি । পথে শিলা আছে রাশি রাশি , তাহা ঠেলে চলে হাসি হাসি । পাহাড় যদি থাকে পথ জুড়ে নদী হেসে যায় বেঁকেচুরে । সেথায় বাস করে শিং – তোলা যত বুনো ছাগ দাড়ি – ঝোলা । সেথায় হরিণ রোঁয়ায় ভরা তারা কারেও দেয় না ধরা । সেথায় মানুষ নূতনতর , তাদের শরীর কঠিন বড়ো । তাদের চোখ দুটো নয় সোজা , তাদের কথা নাহি যায় বোঝা । তারা পাহাড়ের ছেলেমেয়ে সদাই কাজ করে গান গেয়ে । তারা সারা দিনমান খেটে আনে বোঝাভরা কাঠ কেটে । তারা চড়িয়া শিখর -‘ পরে বনের হরিণ শিকার করে । নদী যত আগে আগে চলে ততই সাথি জোটে দলে দলে । তারা তারি মতো , ঘর হতে সবাই বাহির হয়েছে পথে । পায়ে ঠুনু ঠুনু বাজে নুড়ি , যেন বাজিতেছে মল চুড়ি । গায়ে আলো করে ঝিকিঝিক , যেন পরেছে হীরার চিক । মুখে কলকল কত ভাষে এত কথা কোথা হতে আসে । শেষে সখীতে সখীতে মেলি হেসে গায়ে গায়ে হেলাহেলি । শেষে কোলাকুলি কলরবে তারা এক হয়ে যায় সবে । তখন কলকল ছুটে জল — কাঁপে টলমল ধরাতল , কোথাও নীচে পড়ে ঝরঝর — পাথর কেঁপে ওঠে থরথর , শিলা খান্ খান্ যায় টুটে — নদী চলে পথ কেটে কুটে । ধারে গাছগুলো বড়ো বড়ো তারা হয়ে পড়ে পড়ো – পড়ো । কত বড়ো পাথরের চাপ জলে খসে পড়ে ঝুপঝাপ । তখন মাটি – গোলা ঘোলা জলে ফেনা ভেসে যায় দলে দলে । জলে পাক ঘুরে ঘুরে ওঠে , যেন পাগলের মতো ছোটে । শেষে পাহাড় ছাড়িয়ে এসে নদী পড়ে বাহিরের দেশে । হেথা যেখানে চাহিয়া দেখে চোখে সকলি নূতন ঠেকে । হেথা চারি দিকে খোলা মাঠ , হেথা সমতল পথঘাট । কোথাও চাষিরা করিছে চাষ , কোথাও গোরুতে খেতেছে ঘাস । কোথাও বৃহৎ অশথ গাছে পাখি শিস দিয়ে দিয়ে নাচে । কোথাও রাখাল ছেলের দলে খেলা করিছে গাছের তলে । কোথাও নিকটে গ্রামের মাঝে লোকে ফিরিছে নানান কাজে । কোথাও বাধা কিছু নাহি পথে , নদী চলেছে আপন মতে । পথে বরষার জলধারা আসে চারি দিক হতে তারা , নদী দেখিতে দেখিতে বাড়ে , এখন কে রাখে ধরিয়া তারে । তাহার দুই কূলে উঠে ঘাস , সেথায় যতেক বকের বাস । সেথা মহিষের দল থাকে , তারা লুটায় নদীর পাঁকে । যত বুনো বরা সেথা ফেরে তারা দাঁত দিয়ে মাটি চেরে । সেথা শেয়াল লুকায়ে থাকে , রাতে হুয়া হুয়া করে ডাকে । দেখে এইমতো কত দেশ , কে বা গনিয়া করিবে শেষ । কোথাও কেবল বালির ডাঙা , কোথাও মাটিগুলো রাঙা রাঙা , কোথাও ধারে ধারে উঠে বেত , কোথাও দুধারে গমের খেত । কোথাও ছোটোখাটো গ্রামখানি , কোথাও মাথা তোলে রাজধানী — সেথায় নবাবের বড়ো কোঠা , তারি পাথরের থাম মোটা । তারি ঘাটের সোপান যত , জলে নামিয়াছে শত শত । কোথাও সাদা পাথরের পুলে নদী বাঁধিয়াছে দুই কূলে । কোথাও লোহার সাঁকোয় গাড়ি চলে ধকো ধকো ডাক ছাড়ি । নদী এইমতো অবশেষে এল নরম মাটির দেশে । হেথা যেথায় মোদের বাড়ি নদী আসিল দুয়ারে তারি । হেথায় নদী নালা বিল খালে দেশ ঘিরেছে জলের জালে । কত মেয়েরা নাহিছে ঘাটে , কত ছেলেরা সাঁতার কাটে ; কত জেলেরা ফেলিছে জাল , কত মাঝিরা ধরেছে হাল , সুখে সারিগান গায় দাঁড়ি , কত খেয়া – তরী দেয় পাড়ি । কোথাও পুরাতন শিবালয় তীরে সারি সারি জেগে রয় । সেথায় দু – বেলা সকালে সাঁঝে পূজার কাঁসর – ঘণ্টা বাজে । কত জটাধারী ছাইমাখা ঘাটে বসে আছে যেন আঁকা । তীরে কোথাও বসেছে হাট , নৌকা ভরিয়া রয়েছে ঘাট । মাঠে কলাই সরিষা ধান , তাহার কে করিবে পরিমাণ । কোথাও নিবিড় আখের বনে শালিক চরিছে আপন মনে । কোথাও ধু ধু করে বালুচর সেথায় গাঙশালিকের ঘর । সেথায় কাছিম বালির তলে আপন ডিম পেড়ে আসে চলে । সেথায় শীতকালে বুনো হাঁস কত ঝাঁকে ঝাঁকে করে বাস । সেথায় দলে দলে চখাচখী করে সারাদিন বকাবকি । সেথায় কাদাখোঁচা তীরে তীরে কাদায় খোঁচা দিয়ে দিয়ে ফিরে । কোথাও ধানের খেতের ধারে ঘন কলাবন বাঁশঝাঁড়ে ঘন আম – কাঁঠালের বনে গ্রাম দেখা যায় এক কোণে । সেথা আছে ধান গোলাভরা , সেথা খড়গুলা রাশ – করা । সেথা গোয়ালেতে গোরু বাঁধা কত কালো পাটকিলে সাদা । কোথাও কলুদের কুঁড়েখানি , সেথায় ক্যাঁ কোঁ ক’রে ঘোরে ঘানি । কোথাও কুমারের ঘরে চাক , দেয় সারাদিন ধরে পাক । মুদি দোকানেতে সারাখন বসে পড়িতেছে রামায়ণ । কোথাও বসি পাঠশালা – ঘরে যত ছেলেরা চেঁচিয়ে পড়ে , বড়ো বেতখানি লয়ে কোলে ঘুমে গুরুমহাশয় ঢোলে । হেথায় এঁকে বেঁকে ভেঙে চুরে গ্রামের পথ গেছে বহু দূরে । সেথায় বোঝাই গোরুর গাড়ি ধীরে চলিয়াছে ডাক ছাড়ি । রোগা গ্রামের কুকুরগুলো ক্ষুধায় শুঁকিয়া বেড়ায় ধুলো । যেদিন পুরনিমা রাতি আসে চাঁদ আকাশ জুড়িয়া হাসে । বনে ও পারে আঁধার কালো , জলে ঝিকিমিকি করে আলো । বালি চিকিচিকি করে চরে , ছায়া ঝোপে বসি থাকে ডরে । সবাই ঘুমায় কুটিরতলে , তরী একটিও নাহি চলে । গাছে পাতাটিও নাহি নড়ে , জলে ঢেউ নাহি ওঠে পড়ে । কভু ঘুম যদি যায় ছুটে কোকিল কুহু কুহু গেয়ে উঠে , কভু ও পারে চরের পাখি রাতে স্বপনে উঠিছে ডাকি । নদী চলেছে ডাহিনে বামে , কভু কোথাও সে নাহি থামে । সেথায় গহন গভীর বন , তীরে নাহি লোক নাহি জন । শুধু কুমির নদীর ধারে সুখে রোদ পোহাইছে পাড়ে । বাঘ ফিরিতেছে ঝোপে ঝাপে , ঘাড়ে পড়ে আসি এক লাফে । কোথাও দেখা যায় চিতাবাঘ , তাহার গায়ে চাকা চাকা দাগ । রাতে চুপিচুপি আসে ঘাটে , জল চকো চকো করি চাটে । হেথায় যখন জোয়ার ছোটে , নদী ফুলিয়ে ঘুলিয়ে ওঠে । তখন কানায় কানায় জল , কত ভেসে আসে ফুল ফল । ঢেউ হেসে ওঠে খলখল , তরী করি ওঠে টলমল । নদী অজগরসম ফুলে গিলে খেতে চায় দুই কূলে । আবার ক্রমে আসে ভাঁটা পড়ে , তখন জল যায় সরে সরে । তখন নদী রোগা হয়ে আসে , কাদা দেখা দেয় দুই পাশে । বেরোয় ঘাটের সোপান যত যেন বুকের হাড়ের মতো । নদী চলে যায় যত দূরে ততই জল ওঠে পুরে পুরে । শেষে দেখা নাহি যায় কূল , চোখে দিক হয়ে যায় ভুল । নীল হয়ে আসে জলধারা , মুখে লাগে যেন নুন – পারা । ক্রমে নীচে নাহি পাই তল , ক্রমে আকাশে মিশায় জল , ডাঙা কোন্খানে পড়ে রয় — শুধু জলে জলে জলময় । ওরে একি শুনি কোলাহল , হেরি একি ঘন নীল জল । ওই বুঝি রে সাগর হোথা , উহার কিনারা কে জানে কোথা । ওই লাখো লাখো ঢেউ উঠে সদাই মরিতেছে মাথা কুটে । ওঠে সাদা সাদা ফেনা যত যেন বিষম রাগের মতো । জল গরজি গরজি ধায় , যেন আকাশ কাড়িতে চায় । বায়ু কোথা হতে আসে ছুটে , ঢেউয়ে হাহা করে পড়ে লুটে । যেন পাঠশালা – ছাড়া ছেলে ছুটে লাফায়ে বেড়ায় খেলে । হেথা যতদূর পানে চাই কোথাও কিছু নাই , কিছু নাই । শুধু আকাশ বাতাস জল , শুধুই কলকল কোলাহল , শুধু ফেনা আর শুধু ঢেউ — আর নাহি কিছু নাহি কেউ । হেথায় ফুরাইল সব দেশ , নদীর ভ্রমণ হইল শেষ । হেথা সারাদিন সারাবেলা তাহার ফুরাবে না আর খেলা । তাহার সারাদিন নাচ গান কভু হবে নাকো অবসান । এখন কোথাও হবে না যেতে , সাগর নিল তারে বুক পেতে । তারে নীল বিছানায় থুয়ে তাহার কাদামাটি দিবে ধুয়ে । তারে ফেনার কাপড়ে ঢেকে , তারে ঢেউয়ের দোলায় রেখে , তার কানে কানে গেয়ে সুর তার শ্রম করি দিবে দূর । নদী চিরদিন চিরনিশি রবে অতল আদরে মিশি ।
Leave a Reply