নতুন নতুন নাটক – সম্পাদনা: মনোজ মিত্র
নতুন নতুন নাটক / সম্পাদনা: মনোজ মিত্র / শিশু সাহিত্য সংসদ / প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০০৩
.
প্রকাশকের কথা
এই সংকলনটির নাটকগুলি নতুনদের জন্য নতুনভাবে নতুন দিনের দাবি মেনে লেখা। তাই এর নাম ‘নতুন নতুন নাটক’।
স্বপ্নাবিল শিশু-কিশোর মনের চিরন্তন চাহিদা নির্মল প্রকৃতির মতো সুন্দর ও সর্বজনীন। সময়ের পরিবর্তনেও তার মৌলিকত্বের অভাব হয় না। অকৃত্রিম ও অনাদি সেই বালার্কজ্যোতির কোমল স্পর্শ এই সংকলনের সব নাটকেই কম-বেশি উপস্থিত। আর অবশ্যই তা নতুনত্বের ভাস্বরতায় এক উজ্জ্বল উপস্থিতি।
নাটকগুলির উপজীব্য বিষয়বস্তুর এই সাধারণ অবস্থানটুকু ছাড়া এদের অন্য দিকও আছে। যেহেতু বড়োদের আধিপত্য প্রভাবিত পৃথিবী থেকে শিশু-কিশোরদের বস্তু পৃথিবীটা আলাদা করা যায় না, তাই সেই বড়োদের অপরিণামদর্শিতার অসংগতিও অনেক নাটকের বিষয়ীভূত হয়েছে। সেখানে তাদের উত্তরসূরিদের যন্ত্রণা, রুক্ষতাক্লিষ্ট মনের আকুতি প্রকট এবং বস্তু পৃথিবীর অবহেলায় করুণ। এসবের সঙ্গে আধুনিক মার্জনায় সংস্কৃত শ্লেষ ও কৌতুকের সংশ্লেষণও ঘটেছে নাটকগুলিতে।
এ সবকিছুর সমাহারে নাটকগুলি মঞ্চে আনন্দ দেবে যেমন, তেমনি দেবে এক ধরনের সামাজিক সচেতনতার প্রশিক্ষণ। এবং সর্বোপরি উদ্দাম দামাল সাহসী শিশু-কিশোদের জন্য কিছু করে দেখাবার খোরাকও হয়তো মিলতে পারে এই সংকলন থেকে।
দেবজ্যোতি দত্ত
কলকাতা
৬ জানুয়ারি ২০০৩
.
ভূমিকা
পথিক : মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?
ঝুড়িওয়ালা : জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এতো জলপাইয়ের সময় নয়। কাঁচা আম চান দিতে পারি-
অবাক জলপান। ছোটোবেলায় সুকুমার রায়ের অবাক জল একবারও পান করেনি, এমন নাট্যশিল্পী বাংলায় মিলবে না। রবীন্দ্রনাথ উপেন্দ্রকিশোর অবনীন্দ্রনাথ সুকুমার রায় আমাদের শৈশবের দিনগুলো রাঙিয়ে মাতিয়ে উজানে ভাসিয়ে দিয়ে গেছেন অবাক করা কত না দৃশ্যে কাব্যে। থিয়েটারের চিরবিস্ময়কর ভুবনে ঢুকতে বাংলার সবুজ কাঁচাদের সৌভাগ্য কারও চেয়ে কম নয়। রাজশেখর বসু স্বপনবুড়ো মৌমাছি শিবরাম চক্রবর্তী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লীলা মজুমদারদের হাতে ছোটোদের জন্যে মজার মজার ফুলঝুরি। আট থেকে ষোলো বছর বয়েসের বাল্যকালের অভিনয়োপযোগী নাটকের কোনো সংকলনে এঁদের আসন সবার আগে। তবু শিশু সাহিত্য সংসদ কিন্তু প্রথমদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রাচীন হীরামুক্তামাণিক্যে আরও একখানা মহামূল্যবান ঝাঁপি সাজানো নয়, এবারের সংকলনে থাকবে সব নতুন নাটক-নতুন নতুন নাটক।
বিশ্ব আজ নতুন রূপে দেখা দিয়েছে। অন্তরে বাহিরে তার বদল ঘটে গেছে, ঘটে চলেছে নিয়ত। আমরা যারা ছোটোবেলাটা ডিঙিয়ে অনেকটা দূরে চলে এসেছি, আজকের ছোটোদের দিকে চেয়ে আর কি খুঁজে পাই আমাদের সেই ফেলে আসা দিনগুলো, আমাদের ভালোলাগা মন্দলাগা, সুখদুঃখ আনন্দ উল্লাস ক্রোধ ঘৃণা বায়না-কোনোটাই কি মেলে আজকের ছোটোবেলার সঙ্গে? সেকালে আমাদের সামনে যে ভবিষ্যৎ ছিল, আজও কি সেই একই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে ছোটোরা, নাকি প্রয়োজন একরকম? জ্ঞানবুদ্ধি স্বপ্ন ও কল্পনার ক্ষেত্র-নক্ষত্র কত না বদলে গেছে এদের। শিশু সাহিত্য সংসদ তাই চেয়েছে একালের সন্তানদের মুখ চেয়ে নতুন করে কলম ধরুন লেখকেরা। বাল্যবেলা সবসময়ই সর্বাপেক্ষা উপদ্রুত অঞ্চল। ভূতপ্রেত রাক্ষসখোক্কস দস্যিদানোর অবাধ আনাগোনা সেখানে। কঁচিকাচা মগজ আর হৃদয়েকুঁড়িগুলোকে বিনষ্ট করার জন্যে কত না ভৌতিক ভোজবাজি চলছেই চারদিকে। চূড়ান্ত আত্মসর্বস্বতার পাঠে মারমুখী করে তোলা হচ্ছে তাকে। এই জটিলকুটিল সময়ে বাল্যকালটিকে সুরক্ষিত রাখতে তাই চাই নতুন নতুন হাতিয়ার। চাই নতুন নতুন নাটক, নতুন কথা, নতুনতর রূপকথা।
নতুন নতুন নাটক সংকলনের কোনো রচনাই দু-হাজার সালের আগের নয়। দু-একটি ছাড়া কোনোটাই অদ্যাবধি মঞ্চস্থ হয়নি। গ্রন্থের প্রথম লেখাটি প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের। প্রতাপচন্দ্রের নাট্যনুরাগ সর্বজনবিদিত। সংসদের আমন্ত্রণ পাওয়ার দশদিনের মধ্যে লেখা শেষ করে তিনি বীরপুরুষ নাটকটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সর্বাগ্রগণ্য নাট্যকার বাদল সরকার এবং মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতি সংকলনটিকে সমৃদ্ধ ও মর্যাদাপূর্ণ করেছে। ছোটোদের নাটক রচনা ও প্রয়োজনার সুবাদে শৈলেন ঘোষ এবং নির্মলেন্দু গৌতম ছোটোদের বড়ো আপনজন। সন্দেহ নেই, তাঁদের ছাড়া এ সংকলন সম্পূর্ণতা পেত না। দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত চন্দন সেন সৌমিত্র বসু উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় কি দত্তাত্রেয় দত্ত শুভংকর চক্রবর্তী প্রমুখ খ্যাতিমান নাট্যকারদের নাটক যে বেশিদিন মঞ্চের বাইরে থাকবে না, এতো আমরা জানি- কিন্তু সত্যিই ভাবতে পারিনি বাংলার দশজন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আমাদের কথায় নাটক লিখবেন। গল্পকার ঔপন্যাসিকেরা নাটক লেখেন না, লিখতে চান না, থিয়েটার না-বোঝার অজুহাত দেন, আবার এগিয়ে এসে বুঝতেও চান না-থিয়েটারের লোকজনের এ অভিযোগ বহুদিনের। এবার শৈবাল মিত্র সাধন চট্টোপাধ্যায় অভিজিৎ সেন তপন বন্দ্যোপাধ্যায় ভগীরথ মিশ্র কার্তিক ঘোষ শচীন দাশ অমর মিত্র স্বপ্নময় চক্রবর্তী কিন্নর রায়রা মিলে দেখালেন কথাসাহিত্যিকরা নাটক লিখলে থিয়েটারের কত পুরোনো ছক ভাঙা পড়ে এবং নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। লেখকবন্ধুরা কেউ তাঁর বিশ্বাসের জগৎ থেকে সরে যাননি। শুধু উন্মোচনের স্বরূপ বদলেছেন। গল্পকাহিনী লিখনের পদ্ধতি ছেড়ে সন্ধান করেছেন নাট্যের নিজস্ব ভাষার। দৃশ্যপট আলো-আধাঁর শব্দবাজনার এমন অনুপুঙ্খ সমাবেশ ঘটিয়েছেন, যার মধ্যে ছোটো ছোটো অনুভূতির শিশিরবিন্দুগুলোও অধরা থাকে না। যে সব বয়স্ক নাট্যকর্মীরা ছোটোদের দিয়ে নাটক করিয়ে থাকেন, তাঁরা দেখবেন কোনো কোনো নাটক বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে আবশ্যক আধুনিক থিয়েটারের উপস্থাপনাশৈলী আয়ত্বে রাখা। একটা কথা না বলে পারি না, প্রাইমারি ইসকুলের ন্যাড়া উঠোনে ছেঁড়া শতরঞ্চ বিছিয়ে ভরদুপুরে গলদঘর্ম মুখে তুলোর গোঁপদাড়ি সেঁটে বাচ্চাদের খেলনা-পুতুল সাজিয়ে অভিনয় নামক কর্মটি করালে, সেটা না হয় থিয়েটার, না হয় ছোটোবেলাটাকে সম্মান দেখানো। ছোটোদের থিয়েটার বলে তাকে অবহেলা কেন? ভোগ উপভোগের যা কিছু, সব কি বয়স্কদের জন্যে? অবহেলা কেউ সহজ করতে পারে না, বাচ্চারাও না-থিয়েটারও না। আবার বলি, এই সংকলনের যদি এতটুকু অভিনবত্ব কি স্বাতন্ত্র্য থাকে, তবে এতজন গল্পকারের রচনাই তা দিয়েছে।
নতুন নতুন নাটকের প্রকাশক, লেখক, চিত্রকর, মুদ্রণকর্মীর সঙ্গে সর্বপ্রকার সহযোগিতার জন্যে শ্রীমতী চন্দনা দত্ত এবং রমেন ভট্টাচার্য পঙ্কজ মুন্সী বাসুদেব গঙ্গোপাধ্যায় ও সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে একটি কথা সবিনয় স্মরণ করিয়ে দেব, কে কাকে জানাবে ধন্যবাদ বা অভিবাদন-বড়োরা ছোটোদের জন্যে যতটুকু যা করি আমরা, সবই করি আমাদের নিজেদের সেই পেরিয়ে আসা ছোটোবেলাটার মুখ চেয়ে।
মনোজ মিত্র
কলকাতা
২৬শে নভেম্বর ২০০২
.
ফ্ল্যাপের লেখা
মুখ্যত কিশোর-কিশোরীদের জন্য লেখা ২৪টি নাটকের এই সংকলনের প্রত্যেকটি নাটকই নতুন স্বাদের নতুন ভাবনার প্রতিচ্ছবি এবং নাটকগুলি কোনো না কোনো প্রথিতযশা আধুনিক সাহিত্যিক বা নাট্যসাহিত্যিকদের কুশলী হাতের কৃতি। এ ছাড়া এই সময়ের প্রসঙ্গ ও প্রভাব সব নাটকেই কমবেশি প্রতিফলিত এবং কোনো নাটকই ২০০০ সালের আগে লেখা নয়।
অনেক নাটকে পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট আধুনিক, কিন্তু তাতে বক্তব্যবিষয়ের চেয়ে মজার প্রাধান্য বেশি। যেমন ‘চশমা চোর’ কিংবা ‘বোল্ড আউট’। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আধুনিকতম সমস্যা বাস্তুসংস্থান নিয়ে সচেতনতা গড়ার প্রয়াশ রাখা হয়েছে ‘গাছের মা’ , ‘সবুজ পৃথিবী’ বা ‘আমরা যত বন্য’-এর মতো নাটকে। ‘একটা মেয়ে একা’, ‘রাজার হুকুম’, ‘মুড়কির হাঁড়ি’ প্রভৃতি নাটকে আছে নিটোল গল্প। অন্যদিকে ‘রূপকথার কেলেঙ্কারি’, ‘বুডঢার তরবারি’, ‘চমচমকুমার’ প্রভৃতি নাটকে গূঢ় কোনো তাৎপর্য নিহিত রেখে কিশোর-কিশোরীদের মনের অব্যক্ত কোনো মাত্রাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এইভাবে বিশুদ্ধ আনন্দ উপভোগ, আপাতগম্ভীর সুস্থ সচেতনতা গড়ার অনুশীলন এবং কিশোর কল্পনার বিকাশ সাফল্যের ক্ষেত্রে এই নাটকগুলি মঞ্চে জরুরি হয়ে উঠবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
.
মনোজ মিত্র
খুলনায় জন্ম ২২. ১২. ১৯৩৮ তারিখে। বিখ্যাত নট-নাট্যকার নির্দেশক। ছোটোবেলায় গল্পলেখার দিকে ঝুঁকেছিলেন, পরে নাটক ও থিয়েটারে আত্মনিয়োগ করেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে (১৯৫৯) একটি অসাধারণ ছোটো নাটক লেখেন ‘মৃত্যুর চোখে জল’, সুন্দরম প্রযোজিত ও পার্থপ্রতিম চৌধুরি নির্দেশিত সেই নাটকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। রানিগঞ্জ কলেজে তিনি কিছুদিন (১৯৬১-১৯৬৪) অধ্যাপনাও করেছেন। এরপর নিজের নাট্যদল গঠন করেন-ঋতায়ন (১৯৬৫-১৯৭০)। তিনি বহু নাটক লিখেছেন ‘সাজানো বাগান’, ‘শুকসারি’, ‘চাকভাঙা মধু’, ‘চোখে আঙুল দাদা’, ‘নরক গুলজার’, ‘পাহাড়ি বিছে’, ‘পুঁটি রামায়ণ’ প্রভৃতি। তাঁর অনেক নাটক বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত ও প্রযোজিত হয়েছে। স্বপ্রযোজিত ‘সাজানো বাগান’-এ বাঞ্ছারামের ভূমিকায় তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের জন্য তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এ ছাড়া তাঁর নাট্যরচনার জন্য পেয়েছেন প্রচুর সম্মান ও পুরস্কার গিরিশ পুরস্কার (১৯৭৮), সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৫), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরস্কার (১৯৮৩, ১৯৯০) প্রভৃতি। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্যও একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন (১৯৮০ ও ১৯৮২)। তাঁর সম্পাদিত নাট্য সংকলন ‘একাঙ্ক এপার ওপার’।
Leave a Reply