দ্য সেলফিশ জিন (স্বার্থপর জিন)
৪০ তম প্রকাশনা বার্ষিকী সংস্করণ অক্সফোর্ড ল্যান্ডমার্ক সায়েন্স হিসাবে (২০১৬)
মূল : রিচার্ড ডকিন্স / অনুবাদ : কাজী মাহবুব হাসান
.
৩০ তম প্রকাশনা বার্ষিকী সংস্করণের ভূমিকা
ভালো আর মন্দ মিলিয়ে ‘দ্য সেলফিশ জিন’ (The Selfish Gene) বইটির সাথে আমি আমার প্রায় অর্ধেক জীবন কাটিয়েছি, এই উপলদ্ধিটি আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। পরবর্তী বছরগুলোয় যখন আমার আরো সাতটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, প্রকাশকরা সেই বইগুলোর বিজ্ঞাপনের জন্যে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণে পাঠিয়েছিলেন। যে বইটাই হোক না কেন, আমার সেই বইটির প্রতি দর্শকরা সন্তোষজনক উদ্দীপনার সাথে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, বিনম্রতার সাথে তারা প্রশংসা করেছেন এবং বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। তারপর সেই বইটি কেনার জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছেনও, ‘দ্য সেলফিশ জিন’ বইটিতেই আমার স্বাক্ষর নেবার জন্য…। হয়তো খানিকটা বেশী বাড়িয়ে বলে ফেললাম, তাদের কেউ কেউ নতুন বইটিও কেনেন আর বাকীরা, আমার স্ত্রী আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন এই বলে যে, যখনই কেউ কোনো লেখককে নতুন করে আবিষ্কার করেন, তাদের সাধারণত লেখকের প্রকাশিত প্রথম বইটি দিয়ে শুরু করার প্রবণতা আছে। ‘দ্য সেলফিশ জিন’ পড়ার পর, নিশ্চয়ই তারা সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম এবং (এর স্নেহান্ধ পিতামাতার কাছে) প্রিয়তম বইটিও খুঁজে নেবেন পড়ার জন্য?
আমার জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ হতো যদি আমি দাবী করতে পারতাম, ‘দ্য সেলফিশ জিন’ সময়ের প্রেক্ষিতে খুব বেশী অচল এবং তার অধিকৃত জায়গাটি হারিয়ে ফেলেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ( একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে) আমি সেই দাবী করতে পারবো না। খুঁটিনাটি অনেক কিছু বদলেছে এবং বাস্তব তথ্যপুষ্ট উদাহরণগুলোও অনেক বেশী মাত্রায় বেড়েছে। কিন্তু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, যা আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোচনা করবো, এই বইটিতে খুব কম বিষয় আছে যেগুলো ফিরিয়ে নেবার জন্য আমি ব্যস্ত হতে পারি অথবা ক্ষমা চাইতে পারি। প্রয়াত আর্থার কেইন, লিভারপুলে প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ষাটের দশকে অক্সফোর্ডে আমাকে অনুপ্রাণিত করার মত টিউটরদের একজন, ১৯৭৬ সালে ‘দ্য সেলফিশ জিন’ বইটিকে ‘তরুণ লেখকের বই হিসাবে বর্ণিত করেছিলেন: তিনি খুবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ. জে. আইয়ারের ‘ল্যাঙ্গুয়েজ টুথ অ্যান্ড লজিক’ বইটি নিয়ে কোনো সমালোচকের এই মন্তব্যটি উদ্ধৃত করেছিলেন। অবশ্য আমি এই তুলনায় আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছিলাম, যদিও আমি জানি যে আইয়ার তার প্রথম বইটি থেকে বেশ অনেক অংশই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং কেইনের সেই সুচালো ইঙ্গিতটির আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া খুব কঠিন ছিল : অর্থাৎ সময় হলে আমিও তার (আহয়ার মত একই ভাবে আমার প্রস্তাবগুলোও প্রত্যাখ্যান করে নেবো।
বইটির শিরোনাম নিয়ে আমার কিছু দ্বিধার বিষয় ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে আমাকে এই আলোচনাটি শুরু করতে দিন। ১৯৭৫ সালে, বন্ধু ডেসমন্ড মরিসের মধ্যস্থতায় আংশিকভাবে সমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটি আমি প্রথম দেখিয়েছিলাম লন্ডনের প্রকাশকদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় টম মাশলারকে। জোনাথান কেপ প্রকাশনীর অফিসে তার কক্ষে আমরা আলোচনা করেছিলাম বিষয়টি নিয়ে। তিনি বইটি পছন্দ করেছিলেন তবে এর শিরোনামটিকে নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘সেলফিশ’ (স্বার্থপর) শব্দটি নেতিবাচক’ একটি শব্দ, কেন বইটির নাম দিচ্ছি না ‘দি ইমোর্টাল জিন’ (অমর জিন)? ‘ইমোর্টাল’ ইতিবাচক একটি শব্দ এবং ‘দ্য সেলফিশ জিনের’ মত ঠিক একই রকম কৌতূহলোদ্দীপকভাবেই অর্থবহ (আমার ধারণা, আমাদের তখন কারোরই মনে আসেনি নামটির সাথে অস্কার ওয়াইল্ড এর ‘দ্য সেলফিশ জায়ান্ট’ নামের একটি মিলও খুঁজে পাওয়া সম্ভব)। আমি এখন ভাবি মাশলার হয়তো ঠিক কথাই বলেছিলেন। অনেক সমালোচকই, বিশেষ করে উচ্চকণ্ঠ যারা, আমি পরে আবিষ্কার করেছি যারা দর্শনে পাণ্ডিত্যের দাবী করেন, তারা বইটিকে শুধুমাত্র এর শিরোনাম দিয়েই পড়তে আগ্রহী ছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই, ‘দ্য টেইল অব বেনজামিন বানি’ অথবা ‘দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব রোমান এম্পায়ার নামের বইগুলোর ক্ষেত্রে শুধু শিরোনাম পড়ে বই বিচার করা যথেষ্ট কার্যকর একটি উপায় হতে পারে, কিন্তু আমি খুব সহজেই দেখতে পাচ্ছি যে ‘দ্য সেলফিশ জিন’ শুধুমাত্র শিরোনাম হিসাবে একাকী, পুরো বই, সেই বিশাল পাদটীকাটি ছাড়া, হয়তো এর বিষয়বস্তু সম্বন্ধে অসম্পূর্ণ একটি ধারণা দিতে পারে। বর্তমানে সময়ে হলে, এই সব জটিলতা কাটাতে আমেরিকার প্রকাশকরা যেকোনো ক্ষেত্রেই একটি উপশিরোনাম দাবী করতেন। কোনো একটি শিরোনামকে ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে সেরা উপায় হলো, সেই শিরোনামে ব্যবহৃত শব্দগুলোয় ঠিক কোথায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেটি খুঁজে বের করা। যদি ‘সেলফিশ’ বা স্বার্থপর শব্দটির উপর জোর দেয়া হয়, আপনি হয়তো ভাববেন বইটির বিষয়বস্তু স্বার্থপরতা, অথচ, আর যদি কিছু নাও হয়ে থাকে, এই বইটি পরার্থবাদীতা বিষয়ে এর আলোচনায় অনেক বেশী সময় নিবেদিত করেছে। শিরোনোমে যে শব্দটিকে সঠিকভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ সেটি হচ্ছে ‘জিন’, এবং আমাকে সেই কারণটি ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেয়া হোক। ডারউইনবাদের অভ্যন্তরে একটি কেন্দ্রীয় বিতর্ক মূলত সংশ্লিষ্ট সেই ‘একক’কে নিয়ে, যা আসলেই প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়: এটি কি ধরনের ‘সত্তা’, প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার পরিণতিতে যা টিকে থাকে অথবা টিকে থাকতে পারেনা। সেই এককটি কম বেশী সংজ্ঞানুযায়ী স্বার্থপর একটি একক হিসাবে রূপান্তরিত হয়। আলট্রইজম বা পার্থবাদ হয়তো অন্য কোনো এক স্তরে বিশেষভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হতে পারে। প্রাকৃতিক নির্বাচন কি প্রজাতিদের মধ্যে বাছ বিচার করে? যদি তাই হয়, তাহলে আমরা প্রত্যাশা করবো একক জীব সদস্যরা তাদের প্রজাতির মঙ্গলের জন্য পরার্থবাদীতার সাথে আচরণ করবে। জনসংখ্যার অতি বৃদ্ধি ঠেকাতে তারা হয়তো তাদের জন্মহার সীমাবদ্ধ করতে পারে, অথবা
প্রজাতির জন্য ভবিষ্যতে শিকার করা যায় এমন প্রাণীদের মজুদ বাড়ানোর লক্ষ্যে তাদের শিকার করার আচরণকে সংযত করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে ডারউইনবাদে সর্বব্যাপী বিদ্যমান ভ্রান্তি মূলত আমাকে এই বইটি লেখার জন্যে প্ররোচিত করেছিল। অথবা, প্রাকৃতিক নির্বাচন– যেমন আমি এখানে যা দাবী করছি– কি জিনদের মধ্য থেকে নির্বাচন করে? এই ক্ষেত্রে আমরা খুব অবাক হবো না এমন কিছু দেখে যখন একক কোনো জীব সদস্য তাদের ‘জিনের কল্যাণের জন্যে পরার্থবাদীতার সাথে আচরণ করে, যেমন, আত্মীয়দের খাওয়ানো এবং সুরক্ষার করার মাধ্যমে, যারা তাদের মত একই জিনের প্রতিলিপি বহন করে। এই ধরনের ‘কিন’ আলট্রইজম বা জিনগত আত্মীয়দের প্রতি পরার্থবাদীতা শুধু একটি মাত্র উপায়, যার মাধ্যমে জিনের স্বার্থপরতা একক জীব সদস্যদের পরার্থবাদী আচরণের মাধ্যমে এর নিজেকে অনুদিত করতে পারে। এই বইটি ব্যাখ্যা করেছে কিভাবে এটি কাজ করে, প্রজননের সাথে, ডারউইনের তত্ত্বের যা আরেকটি (প্রজনন) প্রধানতম পরার্থবাদীতা সৃষ্টিকারী। যদি কখনো আমাকে এই বইটি আবার লিখতে হয়, জাহাভী/গ্রাফেনের ‘হ্যান্ডিকাপ প্রিন্সিপালের’ (মূল বইয়ের ৪০৬ ১২ পৃষ্ঠা, অধ্যায় নয়ের টীকা দেখুন) একজন বিলম্বে-রূপান্তরিত অনুসারী হিসাবে, আমোতস জাহাভীর ধারণাটিকে আরো কিছুটা জায়গা দেয়া আমার উচিৎ হবে, যেখানে তিনি প্রস্তাব করেছেন, পরার্থবাদী কোনো দান সম্ভবত ‘পটল্যাচ’ (১) ধরনের একটি প্রাধান্য বিস্তার করার (বা ডমিনেন্স) সংকেত: ‘দেখো আমি তোমার চেয়ে কত শ্রেষ্ঠ, আমি তোমাকে কোনো কিছু দান করার ক্ষমতা রাখি!”
শিরোনামে ব্যবহৃত ‘সেলফিশ’ শব্দটি ব্যবহারের যৌক্তিকতার বিষয়টি আমাকে পুনরায় ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেয়া হোক। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে জীবনের প্রাধান্য পরম্পরায় কোন স্তরটিকে অবশ্যম্ভাবীভাবে স্বার্থপর স্তর হিসাবে আমরা দেখতে পারি; যে স্তরে
প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে? স্বার্থপর প্রজাতি? স্বার্থপর গ্রুপ? স্বার্থপর একক জীব? স্বার্থপর ইকোসিস্টেম বা প্রাকৃতিক পরিবেশ? অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুক্তি দেয়া যেতে পারে এবং অধিকাংশ স্তরই কোনো গভীর পর্যালোচনা ছাড়াই প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজ করার একক হিসাবে কোনো না কোনো লেখক তাদের যুক্তিতে প্রস্তাব করেছেন, কিন্তু প্রত্যেকেই তাদের চিন্তায় ভ্রান্ত। যেহেতু ডারউইনীয় বার্তাটি খুব সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশিত করা সম্ভব হবে স্বার্থপর কোনো কিছু হিসাবে, সেই কোনো কিছুটি হচ্ছে ‘জিন’, এবং যুক্তিসঙ্গত কারণে এই বইটি যা প্রস্তাব করছে। আপনি সেই যুক্তির সাথে একমত পোষণ করেন কিংবা না করেন, এটাই আসলে শিরোনামটির মূল ব্যাখ্যা। আমি আশা করছি এটি আরো গভীর ভুল বোঝাবুঝির বিষয়গুলো বুঝতে সহায়তা করবে। তবে যাই হোক, এখন অতীত পর্যালোচনা করা সম্ভব এমন দৃষ্টির কারণে এই একটি বিষয়ে আমার নিজের কিছু ঘাটতি আমি লক্ষ করতে পারি। এইগুলো পাওয়া যাবে প্রথম অধ্যায়ে। যা বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে বৈশিষ্ট্যসূচক বাক্যটিতে, ‘আসুন দয়াশীলতা এবং পরার্থবাদীতা শিক্ষা দেবার জন্যে আমরা চেষ্টা করি, কারণ আমরা জন্মগতভাবে স্বার্থপর। অবশ্যই দয়াশীলতা আর পরার্থবাদীতা শেখানো দোষের কিছু নয়, কিন্তু আমরা ‘জন্মগতভাবে স্বার্থপর’ শব্দটি এখানে বিভ্রান্তিকর। আংশিক ব্যাখ্যা হিসাবে, ১৯৭৮ সালের আগে না যদিও, আমি ‘ভেহিকল বা বাহক’ (সাধারণত জীব) এবং “রেপ্লিকেটর বা অনুলিপনকারী’ যারা তাদের মধ্যে বাস করে, এই দুটির মধ্যে পার্থক্যগুলো (ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কার্যত তারা জিন, পুরো ব্যপারটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে তেরোতম অধ্যায়ে, দ্বিতীয় সংস্করণে যুক্ত করা হয়েছে) স্পষ্টভাবে ভাবতে শুরু করেছিলাম। দয়া করে মানসিকভাবে সেই সমস্যা সৃষ্টিকারী বাক্যটিকে এবং একই ধরনের অন্য বাক্যগুলোও মুছে
ফেলুন, এবং এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত ধারণাগুলো দিয়ে সেগুলো প্রতিস্থাপিত করুন। শৈলীর ভ্রান্তি সংক্রান্ত বিপদের কথা মাথায় রেখে, আমি খুব সহজেই দেখতে পাচ্ছি কিভাবে এবং কেন এই শিরোনামটিকে ভুল বোঝা হতে পারে। এবং এটি একটি কারণ, কেন আমার উচিৎ ছিল ‘দি ইমোর্টাল জিন’ নামটি নির্বাচন করা। ‘দি আলট্রইস্টিক ভেহিকল’ আরেকটি সম্ভাবনা হতে পারতো। হয়তো এটি বেশ রহস্যময় হতো, কিন্তু, যেকোনো ক্ষেত্রেই, প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী ইউনিট হিসাবে জিন এবং জীবের মধ্যকার আপাতদৃষ্টিতে বিদ্যমান। বিতর্কটির সমাধান হয়েছে (যে দ্বন্দ্বটি প্রয়াত আর্নষ্ট মেয়ারকে তার জীবনের শেষদিন অবধি ব্যস্ত রেখেছিল)। প্রাকৃতিক নির্বাচনের দুই ধরনের ‘একক’ আছে এবং তাদের মধ্যে কোনো ধরণের বিতর্ক নেই। জিন হচ্ছে ‘একক’ রেপ্লিকেটর বা অনুলিপনকারী অর্থে, অর্গানিজম বা জীব হচ্ছে ‘একক’, এর ‘বাহন’ অর্থে। দুটোই গুরুত্বপূর্ণ, কোনটাকেই অবমূল্যায়ন করা যাবে না। তারা দুটি সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের একককে প্রতিনিধিত্ব করছে এবং যদি আমরা এই পার্থক্যটি শনাক্ত করতে না পারি অযথাই নৈরাশ্যজনক সন্দেহের শিকার হবে। ‘দ্য সেলফিশ জিন’ শিরোনামের আরেকটি ভালো বিকল্প হতো ‘দ্য
কো-অপারেটিভ জিন’। এটি শুনতে ধাঁধার মতই মূল ধারণার বীপরিতার্থক মনে হয়, কিন্তু এই বইয়ের একটি কেন্দ্রীয় অংশের যুক্তি স্বার্থপর জিনগুলোর মধ্যে এক ধরণের সহযোগিতার ধারণাও প্রস্তাব করেছে। এটি খুব স্পষ্টভাবেই এমন কোনো অর্থ প্রকাশ করে
যে জিনদের গ্রুপগুলো সফল হয় তাদের সদস্যদের ক্ষতি করার। মাধ্যমে বা অন্য গ্রুপগুলোর ক্ষতি করে। বরং প্রতিটি জিনকে দেখা হয়েছে তাদের নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে জিন পুলে অন্যান্য বহু জিনের প্রেক্ষাপটে– কোনো একটি প্রজাতির মধ্যে যৌন সংমিশ্রণের প্রার্থীদের সেট। ঐসব অন্য জিনরা হচ্ছে:
সেই পরিবেশের অংশ, যেখানে প্রতিটি জিনকেই টিকে থাকতে হয়, ঠিক একই ভাবে, যেমন কোন আবহাওয়া, শিকারী প্রাণী এবং তাদের শিকার, সয়াহক উদ্ভিদ এবং মাটির ব্যাকটেরিয়া, সবাই যেভাবে পরিবেশের অংশ। প্রতিটি জিনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, প্রেক্ষাপটের জিনগুলো হচ্ছে সেই জিনগুলো যাদের সাথে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হবার জন্য এটি বাহন বা শরীর ভাগ করে নেয়। স্বল্পমেয়াদে, এর মানে হচ্ছে জিনোমের অন্যান্য সদস্যরা। দীর্ঘমেয়াদে, এর মানে কোনো একটি প্রজাতির জিন পুলে অন্য জিনগুলো। প্রাকৃতিক নির্বাচন সে-কারণে পারস্পরিক সামঞ্জস্যপূর্ণ জিনদের দল হিসাবে এদের দেখে– যাকে প্রায় বলা সম্ভব ‘সহযোগিতাপূর্ণ’– যারা সুবিধা পায় পরস্পরের উপস্থিতিতে। কোনো সময়েই এই সহযোগিতাপূর্ণ জিনদের বিবর্তন স্বার্থপর জিনের মৌলিক নীতিগুলো লঙ্ঘন করেনা। পঞ্চম অধ্যায়ে এই ধারণাটির ব্যাখ্যা প্রচেষ্টা আছে, নৌকাবাইচের নৌকাচালক বা রোয়ারদের দলের সমরুপ একটি উদাহরণ ব্যবহার করে। এবং তেরোতম অধ্যায় এই বিষয়টিকে নিয়ে আলোচনা আরো খানিকটা অগ্রসর করেছে।
এখন, যেহেতু সেলফিশ বা স্বার্থপর জিনগুলোর ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রবণতা আছে জিনদের মধ্যে সহযোগিতাকে বিশেষ সুবিধা দেবার, স্বীকার করতে হবে, কিছু জিন আছে তারা এই কাজটি করে না এবং তারা জিনোমের বাকী অংশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে। কিছু লেখক তাদের নাম দিয়েছেন ‘আউট-ল’ বা দস্যু জিন, কেউ কেউ ‘আল্টা সেলফিশ জিন, এবং অন্যরা শুধুমাত্র ‘সেলফি’ জিন– নিজেদের স্বার্থ রক্ষাকারী জিনদের একটি গ্রুপে যে জিনগুলো সহযোগিতা করে তাদের সাথে এর সূক্ষ্ম পার্থক্যটিকে তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। আল্টা সেলফিশ জিনের উদাহরণ যেমন, ‘মাইওটিক ড্রাইভ’ জিন যা এই (মূল) বইয়ের ৩০৪-৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে এবং ‘প্যারাসাইটিক (পরজীবি) ডিএনএ’, যা মূলত প্রস্তাব করা হয়েছে (মূল বইয়ের) পৃষ্ঠা ৫৬-৭ এ এবং আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে নানা লেখকদের রচনায়, সেই দৃষ্টি আকর্ষণকারী শব্দ-যুগল ‘সেলফিশ ডিএনএ’ শিরোনামের অধীনে। আল্টা-সেলফিশ বা অতি-স্বার্থপর জিনদের নতুন আর আরো অনেক বেশী অদ্ভুত উদাহরণের আবিষ্কার এই বইটি প্রথম প্রকাশ হবার পরের বছরগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে (২)।
দ্য সেলফিশ জিন বইটিকে সমালোচনা করা হয়েছে। নরাত্বরোপমূলক ব্যক্তিকরণ দোষে এবং এটিও ব্যাখার দাবী রাখে, যদিও কোনো ক্ষমা প্রার্থনা না। আমি দুটি পর্যায়ে ব্যক্তিকরণ ব্যবহার করেছিঃ জিন পর্যায়ে এবং জীব পর্যায়ে। জিনের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিকরণের আসলেই কোনো সমস্যা করা উচিৎ না, কারণ কোনো সুস্থ মানুষই মনে করেন না যে, ডিএনএ অণুর সচেতন ব্যক্তিত্ব আছে। এবং কোনো কাণ্ডজ্ঞানপূর্ণ পাঠকই লেখকের উপর এ-ধরণের বিভ্রান্তিকর অভিযোগ আরোপ করবেন না। আমি কোনো এক সময় বিখ্যাত অণুপ্রাণবিজ্ঞানী জাক মনো’র (৩) একটি বক্তৃতা শুনেছিলাম, যেখানে মনো বিজ্ঞানের সৃজনশীলতা নিয়ে কথা বলছিলেন। আমি সঠিক সেই শব্দগুলো মনে করতে পারছি না ঠিকই, কিন্তু তিনি যা বলেছিলেন সেটি মোটামুটি এরকম, যখন কোনো একটি রাসায়নিক সমস্যা নিয়ে তিনি ভাবার চেষ্টা করেন, নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কি করতেন, যদি তিনি একটি ইলেক্ট্রন হতেন। পিটার অ্যাটকিনস তার অসাধারণ ‘ক্রিয়েশন রিভিজিটেড’ বইটিতে একই ধরণের ব্যক্তিকরণ কৌশল ব্যবহার করেছিলেন যখন তিনি আলোক রশ্মির প্রতিসরণের কথা বিবেচনা করেছিলেন, যা কিনা উচ্চ প্রতিসরাঙ্ক ইনডেক্সের কোনো মাধ্যম অতিক্রম করে, যা এর গতিকে শ্লথ করে দেয়: “রশ্মিটি এমনভাবে আচরণ করে যেন, এটি তার শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য অতিক্রান্ত দূরত্বকে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করছে। অ্যাটকিনস এখানে সমুদ্রের একটি বেলাভূমিতে কর্মরত লাইফগার্ড হিসাবে সেটি কল্পনা করেছিলেন, ডুবতে থাকা কেন সাঁতারুকে বাঁচানোর জন্য যে কিনা দৌড়াচ্ছে। সেকি সাতারু বরাবর সরাসরি দৌড় দেবে, না, কারণ সে সাঁতার কাটার চেয়ে অনেক বেশী জোরে দৌড়াতে পারবে, এবং তার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে শুকনো মাটিতে তার দৌড়ানোর অংশের সময়টি বাড়ানো, তার কি উচিৎ হবে তার নিশানার হুবহু বেলাভূমিতে বিপরীত বিন্দু অবধি দৌড়ে যেতে, যা তার সাঁতারের অংশের পরিমান কমাবে? উত্তম, তবে এখনও শ্রেষ্ঠতম নয়। পরিমাপ (যদি তার সেটি করার সময় থাকে) হয়তো সেই লাইফগার্ডকে দেখাবে সবচেয়ে সুবিধাজনক অন্তবর্তীকালীন কোন কি হবে। যা দ্রুত দৌড়ানো ও তারপর ধীর গতির সাঁতার এর একটি আদর্শ সংমিশ্রণ দেখাবে। অ্যাটকিন উপসংহার টানেন এভাবে:
‘কোনো একটি বেশী ঘনত্বের মাধ্যম দিয়ে আলোকরশ্মি অতিক্রম করার সময় তার আচরণ ঠিক এরকমই। কিন্তু আলো কিভাবে সেটি জানে, আপাতদৃষ্টিতে বেশ আগে থেকেই, কোনটি সবচেয়ে সংক্ষিপ্ততম পথ? এবং আর যাই হোক, কেনই বা এটি তা করার কথা ভাববে?’
চমৎকার একটি ব্যাখ্যার বিশ্লেষণে তিনি এই সব প্রশ্নগুলো করেছিলেন, যার অনুপ্রেরণা কোয়ান্টাম তত্ত্ব।
এই ধরণের ব্যক্তিকরণ আরোপ শুধুমাত্র পুরোনো শিক্ষাপ্রদান কৌশলই নয়। ভুল করার প্রতারণাপূর্ণ প্রলোভনের চ্যালেঞ্জের মুখে এটি পেশাগত বিজ্ঞানীদেরও সঠিক উত্তরটি খুঁজে বের করার জন্য সয়াহতা করে। পরার্থবাদীতা আর স্বার্থপরতা, সহযোগিতা, প্রতিশোধ বিষয়ক ডারউইনীয় হিসাব নিকাশগুলোএমনই একটি ক্ষেত্র, ভুল উত্তরে পৌঁছানো খুব সহজ। জিনকে ব্যক্তিকরণ আরোপ করার মাধ্যমে, যদি সঠিক সতর্কতা ও সংযমের সাথে সেটি করা হয়, প্রায়ই দেখা যায় এটি আসলেই জটিলতার মধ্যে ডুবতে থাকা কোনো ডারউইনীয় তাত্ত্বিককে বাঁচানোর সবচেয়ে সহজতম উপায়। এই সতর্কতাটি মনে রেখেই আমি ডাবলিউ. ডি, হ্যামিলটনের (৪) দক্ষ উদাহরণ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম, তিনি আমার এই বইয়ে উল্লেখ করা চার বীরোচিত চরিত্রের একজন। ১৯৭২ সালে। প্রকাশিত তাঁর একটি প্রবন্ধে (যে বছর আমি ‘দ্য সেলফিশ জিন’ লিখতে শুরু করেছিলাম) হ্যামিলটন লিখেছিলেন:
‘কোনো একটি জিন, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার দ্বারা সুবিধাপ্রাপ্ত হয়, যদি তাদের অনুলিপিদের সমষ্টি সামগ্রিক জিন। সম্ভারে ক্রমবর্ধিষ্ণু একটি অংশ গঠন করে। আমরা চিন্তিত হবো সেই জিনগুলো নিয়ে, তাদের বাহকের সামাজিক আচরণের উপর যাদের প্রভাব ফেলার কথা, সুতরাং, সাময়িকভাবে জিনগুলোর উপর বুদ্ধিমত্তা এবং স্বাধীনভাবে বাছাই করার কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আরোপ করার মাধ্যমে আসুন আমরা চেষ্টা করি এই যুক্তিটাকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলতে। কল্পনা করুন একটি জিন তার অনুলিপিগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি করার সমস্যাটি বিবেচনা করছে এবং কল্পনা করুন যে এটি বাছাই করে নিতে পারে…’
সত্যিকারভাবে এটাই সেই সঠিক মেজাজ যা দিয়ে ‘দ্য সেলফিশ জিন’ বইটির বেশীর ভাগ অংশ পড়া উচিৎ।
কোনো একটি জীবের উপর ব্যক্তিকরণ আরোপ করার প্রক্রিয়া সমস্যার কারণ হতে পারে। এর কারণ, কোনো জীবের, জিনের ব্যতিক্রম, মস্তিষ্ক আছে এবং সেকারণে তাদের স্বার্থপর বা পরার্থবাদী উদ্দেশ্য আছে, কিছুটা যেমন, ব্যক্তিক চিন্তা অর্থে, যা আমরা শনাক্ত করতে পারবো। দ্য সেলফিশ লায়ন বা স্বার্থপর সিংহ হয়তো আসলেই সংশয়ের কারণ হয়, এমন একটি উপায়ে, যে সংশয় দ্য সেলফিস জিন সেটি কখনো সৃষ্টি করে না। ঠিক যেমন করে কেউ পারে তার নিজেকে কাল্পনিক সেই আলোক রশ্মির অবস্থানে ভাবতে, যে কিনা বুদ্ধিমত্তার সাথে লেন্স আর প্রিজমের ধারাবহিক সারির মধ্যে তার উপযুক্ত পথটি বেছে নিতে পারে অথবা একটি কাল্পনিক জিন যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তারিত হবার জন্য সুবিধাজনক একটি পথ অনুসন্ধান করে। সুতরাং আমরা প্রস্তাব করতে পারি, দীর্ঘ মেয়াদী ভবিষ্যতে তার জিনের টিকে থাকার লক্ষ্যে একটি একক সিংহী, তার জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক আচরণের কৌশল হিসাব নিকাশ করতে পারে। জীববিজ্ঞানে হ্যামিলটনের প্রথম উপহার হচ্ছে সুনির্দিষ্টভাবে সেই নিখুঁত গাণিতিক ব্যাখ্যা, যা একজন সত্যিকারের ডারউইনীয় সদস্য, যেমন, কোনো সিংহ, কার্যত, তার কাজে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, যখন সে হিসাব নিকাশ করে সিদ্ধান্ত নেয় কিভাবে তার জিনের দীর্ঘদিন টিকে থাকার ব্যপারটি সর্বোচ্চভাবে সে নিশ্চিৎ করতে পারে। এই বইতে দুটি স্তরে আমি এধরনেরই হিসাব নিকাশের সমতূল্য নানা অনানুষ্ঠানিক মৌখিক শব্দাবলী ব্যবহার করেছি। (মূল বইয়ের) ১৬৮ পৃষ্ঠায় আমরা খুব দ্রুত এক স্তর থেকে অন্য স্তরে চলে গেছিঃ ‘আমরা সেই সব পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেছি, যখন তার দুর্বলতম সন্তানকে (বা রান্ট) মরতে দিলে কোনো একটি মায়ের জন্য আসলেই সুবিধাজনক হয়। আমরা হয়তো সহজাতভাবে মনে করতে পারি, এই দুর্বলতম সন্তানের নিজেরই উচিৎ টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখা, কিন্তু তত্ত্বটি আবশ্যিকভাবে এ-সম্বন্ধে কোনো পূর্বধারণা দেয়না। যখন কোনো একটি দুর্বলতম সন্তান এতই ছোট আর দুর্বল হয়ে যায় তার জীবনের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও হ্রাস পায় এমন একটি পর্যায় অবধি যখন তার প্রতি পিতামাতার বিনিয়োগের ফলে সৃষ্ট সুফল অন্য সন্তানদের প্রতি একই পরিমান সম্ভাব্য বিনিয়োগের ফলে প্রাপ্ত প্রত্যাশিত সুফলের অর্ধেকের চেয়ে কম হয়। সেই দুর্বল সন্তানের মরে যাওয়া উচিৎ স্বেচ্ছায় এবং সন্মানের সাথে। সে এভাবেই তার জিনের জন্যে সবচেয়ে উপকারী কাজটি করতে পারে।
এটি পুরোপুরিভাবে একক ব্যক্তি পর্যায়ে আত্মবীক্ষণের মত। এর মানে কিন্তু এমন কোনো ধারণা না যে দুর্বলতম শিশুটি সেটাই নির্বাচন করবে যা তাকে তৃপ্তি দেবে, বা যে কাজটি করলে সে ভালো অনুভব করবে। বরং একটি ডারউইনীয় পৃথিবীতে একক সদস্যরা মনে করা হয় এক ধরনের ‘এস-ইফ’ বা ‘এটা করলে কি হতে পারে বা না হতে পারে এ ধরনের হিসাব নিকাশ করে, যা কিনা তাদের বহন করা জিনদের জন্য সবচেয়ে ভালো পরিণতি নিশ্চিৎ করে।
এই বিশেষ অনুচ্ছেদটি আরো সুস্পষ্ট করে তোলে জিন পর্যায়ে ব্যক্তিকরণের ধারণাটি দ্রুত পরিবর্তন করার মাধ্যমে:
‘তার মানে হচ্ছে এমন কিছু বলা যে, একটি জিন যে কিনা এমন নির্দেশনা দেয়, “শরীর, যদি তোমার অন্য ভাইবোন থেকে তুমি যদি খুব বেশী ছোট হও, তাহলে বেঁচে থাকার সংগ্রামের জন্য হাল ছেড়ে দাও এবং মারা যাও’– জিন সম্ভারে তার সফল হবার সম্ভাবনা রাখে। কারণ তার এই আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাঁচানো তার প্রতিটি ভাই এবং বোনদের শরীরে সেই জিনটি থাকার ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা আছে। কোনো একটি দুর্বলতম সন্তানের শরীরে এই জিনটির টিকে থাকার সম্ভাবনা এমনিতে যথেষ্ট কম।
এবং এরপর অনুচ্ছেদটি তাৎক্ষণিকভাবে ফিরে আসে আত্মবীক্ষণরত দুর্বল সন্তানটির দিকে:
‘কোনো একটি দুর্বলতম সন্তানের জীবনের এমন কোনো মূহুর্ত আসে যা অতিক্রম করে গেলে ফিরে আসার আর কোনো উপায় থাকে না। এই অবস্থানে পৌঁছানোর আগ অবধি তার উচিত টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখা। কিন্তু যখনই সে সেখানে পৌঁছায় তার উচিৎ হাল ছেড়ে দেয়া এবং সম্ভব হলে তার নিজেকে তার সঙ্গী ভাইবোন কিংবা তার পিতামাতার খাদ্য হিসাবে বিসর্জন দেয়া।’ আমি আসলেই বিশ্বাস করি এইসব দুই স্তরের ব্যক্তিকরণ প্রক্রিয়া কোনো সংশয়ের কারণ না যদি আমরা এটি সেই প্রসঙ্গেই পুরোপুরিভাবে পাঠ করি। কি হলে কি হবে– এই ধরনের হিসাব নিকাশের দুটি স্তরই ঠিক একই উপসংহারে পৌঁছায় যদি সঠিকভাবে কাজটি করা হয়। আসলেই একটি মানদণ্ডের নির্ভুলতা প্রমাণের জন্য সেটি হচ্ছে। সুতরাং আমি মনে করিনা যে ব্যক্তিকরণ এমন কোনো কিছু আমি তা ফিরিয়ে নেবো যদি আজ বইটা আমি আবার নতুন করে লিখতে বসি।
কোনো একটি বই না লেখার পর সেটি আবার না লেখা একটি ব্যপার, আর পড়ার পর না সেটি পড়ার প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি প্রতিবর্তন করা ভিন্ন আরেকটি ব্যপার। নীচে উল্লেখ করা অষ্ট্রেলিয়ার কোনো এক পাঠকের প্রদত্ত রায়টির বিষয়ে আমরা কি বলতে পারি?
‘বিস্ময়কর, কিন্তু মাঝে মাঝে আমি ভাবি যদি বইটি পড়ার পর সেটি পড়ার মত করে মুছে ফেলতে পারতাম। একটি স্তরে, আমি অনুভব করতে পারি বিস্ময়ের সেই অনুভূতিকে, যা ডকিন্স এত সুস্পষ্টভাবে দেখেছেন এই সব জটিল প্রক্রিয়াগুলোর সমাধান করতে গিয়ে। কিন্তু সেই একই সাথে, আমি অনেকাংশে দ্য সেলফিশ জিনকেই এক দশকের বেশী সময় ধরে আমার বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার সেই ধারাবাহিক পর্বগুলো জন্য দায়ী করবো। কখনোই জীবনের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমি সুনিশ্চিৎ হতে পারিনি, কিন্তু চেষ্টা করেছি গভীর কোনো কিছু অনুসন্ধানের জন্য, কোনো কিছুর উপর বিশ্বাস করার চেষ্টায়, কিন্তু কখনোই সেটি করে উঠতে পারিনি পুরোপুরি– আমি অনুভব করেছি যে এই বইটি এই ধরণের কোনো চিন্তাধারা অনুসরণের সব অস্পষ্ট ধারণাই বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছে, তাদের কখনোই আর আমার মনে জমাট বাধতে দেয়নি। এটি কয়েক বছর আগে আমার জীবনের একটি ভয়ঙ্কর ব্যক্তিগত সমস্যার কারণ হয়েছিল।’
পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া এমন আরো দুটি প্রতিক্রিয়া আমি এর আগে বর্ণনা করেছিলাম।
‘আমার প্রথম বইয়ের একজন বিদেশী প্রকাশক স্বীকার করেছিলেন যে, এই বইটি পড়ার পর তিনি তিন রাত ঘুমাতে পারেননি, তার মতে বইটির শীতল, নৈরাশ্যবাদী বার্তায় তিনি এতটাই অস্থির হয়েছিলেন। অন্যরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে কিভাবে আমি সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার মত কাজটি সহ্য করি। অনেক দুরের একটি দেশের এক শিক্ষক আমাকে তিরষ্কারের সুরেই লিখেছিলেন, এই একই বই পড়ে তার এক ছাত্র তার সাথে দেখা করতে এসেছিল কাঁদতে কাঁদতে। কারণ এই বইটি তাকে প্ররোচিত করে বোঝাতে পেরেছে যে, জীবন হচ্ছে শূন্য এবং অর্থহীন। তিনি তাকে উপদেশ দিয়েছেন, সে যেন তার কোনো বন্ধুকে বইটি না দেখায়, কারণ শঙ্কা আছে এটি তাদের মনকে সংক্রমিত করতে পারে সেই একই নাস্তিবাদী নৈরাশ্যবাদ থেকে (Unweaving the raindbow) (৫)।
যদি কোনো কিছু আসলেই বাস্তব সত্য হয়ে থাকে, কোনো ধরণের ইচ্ছা প্রণোদিত ভাবনা সেটিকে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবেনা। এটি হচ্ছে প্রথম কথা যা বলতে পারি কিন্তু দ্বিতীয়টি প্রায় সমপরিমানেই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনটি আমি লিখেছিলাম:
‘সম্ভাবনা আছে যে আসলেই এই মহাবিশ্বের চূড়ান্ত নিয়তির কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই, কিন্তু আমরা কেউ কি সত্যি আমাদের জীবনের আশা-আকাঙ্খকে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতির সাথে সংযুক্ত করে এমন কোনো ভাবনায় জীবন কাটাই? অবশ্যই আমরা সেটি করিনা। যদি না আমরা নিজেদের মানসিকভাবে সুস্থ বলে দাবী করি। আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় বহু ধরণের নিকটবর্তী, উষ্ণতর মানবিক আকাঙ্খ আর অনুভূতির দ্বারা। জীবনের এই উষ্ণতা, যা। আমাদের জীবনকে বেঁচে থাকার জন্য যোগ্য করে তোলে, সেই উষ্ণতাকে ছিনিয়ে নেবার জন্য বিজ্ঞানকে অভিযুক্ত করা খুবই অযৌক্তিভাবে ভ্রান্ত, এত বেশী চূড়ান্তভাবে বিপরীত আমার নিজের এবং অধিকাংশ কর্মরত বিজ্ঞানীদের অনুভূতির সাথে, যা আমাকে গভীরভাবে হতাশ হতে বাধ্য করে। ভ্রান্তভাবে যে ভূলের অভিযোগ আমাকে করা হয়েছে।
অন্যান্য সমালোচককে মধ্যে বার্তাবাহককে গুলি করার একই ধরনের প্রবণতা দৃশ্যমান, যারা তাদের দৃষ্টিতে ‘দ্য সেলফিশ জিন’ বইটির মূল ধারণা যে ক্ষতিকর সামাজিক,রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, তার প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৭৯ সালে মিসেস থ্যাচারের নির্বাচনে (যুক্তরাজ্যে) জয়লাভ করার পর খুব শীঘ্রই, আমার বন্ধু স্টিফেন রোজ, নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকায় এই মন্তব্য করেছিলেন:
‘আমি ইঙ্গিত করছিনা যে, সাচ্চি অ্যান্ড সাচ্চি সামাজিক জীববিজ্ঞানীদের একটি টিমকে নিয়োগ করেছেন থ্যাচারের (৬) বক্তৃতা লেখার জন্য, এমনকি অক্সফোর্ড এবং সাসেক্সের কিছু পণ্ডিত এখন আনন্দ করতে শুরু করেছেন স্বার্থপর জিনের সরল সত্যের এমন ব্যবহারিক প্রকাশে, আমাদের যা বোঝাতে তারা সংগ্রাম করেছিলেন। চটকদার কোনো তত্ত্ব আর রাজনৈতিক ঘটনা কাকতলীয় যোগাযোগ সাধারণত এর চেয়ে জটিল হয়ে থাকে। আমি যদিও বিশ্বাস করি, যখন ১৯৭০ এর দশকের শেষে যখন ডানপন্থী মতবাদের উত্থানের ইতিহাস লেখা হবে, আইন শৃঙ্খলা থেকে মনেটারিজমের (৭) দিকে সরে আসা এবং (আরো বিতর্কিত) স্টেটিজমের (৮) উপর আক্রমণের সূত্রপাত, সেদিন বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ফ্যাশনে, শুধুমাত্র যদি বিবর্তনের তত্ত্বে গ্রুপ থেকে কিন সিলেকশন মডেলে সরে আসা বিষয়টি দেখা হবে সেই পরিবর্তনের অংশ হিসাবে, যা থ্যাচারপন্থীদের ও তাদের স্থির, উনবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতামূলক ও মানববিদ্বেষী অসহিষ্ণু মানবিক চরিত্রের ধারণাটি ক্ষমতা দখল করতে সহায়তা করেছে।
সাসেক্সের ডন হচ্ছেন প্রয়াত জন মেনার্ড স্মিথ (৯), যার গুণমুগ্ধ ছিলেন স্টিফেন রোস এবং আমি, দুজনেই। এবং বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে তিনি এর উত্তর দিয়েছিলেন। নিউ সায়েন্টিষ্টকে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে তিনি প্রতিমন্তব্য করেছিলেন: “আমরা তাহলে কি করা উচিৎ ছিল? কাঙ্খিত উত্তর পাবার আশায় সমীকরণগুলো প্রভাবিত করাই কি তাহলে উচিৎ ছিল আমাদের?’ ‘দ্য সেলফিশ জিন’ বইয়ের একটি প্রধানতম বার্তা হচ্ছে (এ ডেভিলস চ্যাপলিন’ বইয়ের শীর্ষ প্রবন্ধটি আরো জোরালো করে যা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিল) যে, ডারউইনবাদ থেকে নৈতিকতা আর মূল্যবোধ শেখা আমাদের উচিৎ হবে না, যদি না সেটি নেতিবাচক অর্থে হয়ে থাকে। আমাদের মস্তিষ্ক যথেষ্ট পরিমান বিবর্তিত হয়েছে, আমরা আমাদের স্বার্থপর জিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে সক্ষম। বাস্তব সত্যটি হচ্ছে, আমরা যে সেটি করতে পারি আমাদের জন্মনিরোধক ব্যবহারের আচরণটি সেটি সুস্পষ্ট করে। সেই একই মূলনীতি আরো বড় পরিসরে কাজ করতে পারে এবং সেটাই করা উচিৎ। ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় সংস্করণের ব্যতিক্রম, এই বার্ষিকী সংস্করণ এই ভূমিকাটি ছাড়া আর নতুন কোনো কিছু এই বইয়ে যুক্ত করা হয়নি এবং পর্যালোচনা থেকে কিছু অংশ নির্বাচন করেছেন আমরা তিনবারের সম্পাদক ও সমর্থক লতা মেনন। তা ছাড়া আর কেউই পারবেন না মাইকেল রজার্স এর জায়গা নেবার জন্য, অসাধারণ মেধাবী ‘কে (k) সিলেক্টেড’ (১০) সম্পাদক, যার অদম্য বিশ্বাস যে এই বইটি প্রথম সংস্করণের ট্রাজেক্টরীর জন্য বুস্টার রকেট হিসাবে কাজ করবে।
এই সংস্করণটি যদিও– এবং আসলেই আমার জন্য বিশেষ আনন্দের কারণও– এখানে রবার্ট ট্রিভার্স (১১) এর মূল প্রাককথনটি পুনপ্রতিষ্ঠিত করেছে তার মূল জায়গায়। আমি বলেছিলাম যে, বিল হ্যামিলটন হচ্ছেন এই বইয়ে চার বৌদ্ধিক বীরোচিত চরিত্রের একজন, রবার্ট (বব) ট্রিভার্স হচ্ছে আরো একজন। নবম, দশম এবং বারোতম অধ্যায়ে মূলত তার ধারণাই প্রাধান্য পেয়েছে। তার লেখাটি এই বইয়ের জন্য খুব যত্ন সহকারে সৃষ্ট ভূমিকাই শুধু না, তিনি এই মাধ্যমটিকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর আরেকটি অসাধারণ ধারণা সবাইকে জানাতে, আত্ম-প্রবঞ্চনার (সেলফ ডিসেপশন) বিবর্তন সংক্রান্ত তত্ত্বটি। বার্ষিকী সংস্করণের এই বইটিকে সম্মানিত করতে তার মূল ভূমিকাটি ব্যবহার করার অনুমতি দেবার জন্য আমি তার প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
রিচার্ড ডকিন্স,
অক্সফোর্ড, অক্টোবর ২০০৫
পাদটীকা:
১. পটল্যাচ হচ্ছে উপহার দান করার ভোজসভা যা প্রচলন আছে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর পশ্চিম উপকূলের আদিবাসীদের মধ্যে।
২. অস্টিন বার্ট এবং রবার্ট ট্রিভার্স (২০০৬) Genes in Conflict: The Biology of Selfish Genetic Element ( Harvard Univesity Press) বইটি প্রকাশিত হয়েছিল পরে, সেকারণে এই বইটিতে প্রথম সংস্করণ প্রকাশের পর সেখান থেকে তথ্য যুক্ত করা হয়নি। কোনো সন্দেহ নেই বইটি এই বিষয়ে চূড়ান্ত নির্ধারণী হিসাবে প্রমাণিত হবে।
৩. জ্যাক লুসিয়েন মনো (১৯১০-১৯৭৬) ফরাসী জীববিজ্ঞানী।
৪. উইলিয়াম ডোনাল্ড বিল’ হ্যামিলটন (১৯৩৬-২০০০) ইংরেজ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা তাত্ত্বিক জীববিজ্ঞানী হিসাবে যাকে মনে করা হয়ে থাকে।
৫. Unweaving the Rainbow (subtitled “Science, Delusion and the Appetite for Wonder”)– 1998; Richard Dawkins)
৬. মার্গারেট হিলডা থ্যাচার (১৯২৫-২০১৩) ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, যুক্তরাজ্যের প্রধান মন্ত্রী (১৯৭৯-১৯৯০)।
৭. মনেটারী অর্থনীতিতে মনেটারিজম হচ্ছে সেই মতবাদ যেখানে কি পরিমান অর্থ সঞ্চালন করবে অর্থনীতিতে সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
৮. রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্টেটিজম শব্দটি ব্যবহার করা হয় সেই মতবাদকে বোঝাতে যেখানে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক অথবা/এবং সামাজিক নীতি নির্ধারণ করবে।
৯. জন মেনার্ড স্মিথ ( ১৯২০-২০০৪) ব্রিটিশ তাত্ত্বিক বিবর্তন জীববিজ্ঞানী।
১০. কে সিলেক্টেড : এই ধারণাটি এসেছে দুই ধরনের প্রজনন কৌশলের একটি সাধারণ শ্রেণীবিন্যাস থেকে। যারা কে- সিলেক্টেড, তাদের জনসংখ্যা সেই পরিবেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা বা ক্যারিয়িং ক্যাপাসিটির কাছাকাছি থাকে। তারা অল্পকিছু প্রজন্মের জন্ম দেয়, তবে তাদের প্রজন্ম শক্তিশালী ও দীর্ঘজীবি হয়।
১১. রবার্ট লুডলো ‘বব’ ট্রিভার্স (জন্ম ১৯৪৩) যুক্তরাষ্ট্রের বিবর্তন জীববিজ্ঞানী ও সোসিওবায়োলজিস্ট।
.
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
‘দ্য সেলফিশ জিন’ বইটি প্রকাশের প্রায় বারো বছরের মধ্যেই এই বইটির কেন্দ্রীয় বার্তাটি পাঠ্যপুস্তকের মূলধারার একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটি বেশ ধাঁধার মতই, কিন্তু খুব সুস্পষ্টভাবে না। এটি সেই বইগুলোর মত কোনো বই ছিল না, যখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বৈপ্লবিক আখ্যা দিয়ে যে বইগুলোকে তীব্রভাবে তিরস্কৃত করা হয়েছে, এবং তারপরে যে বইটি পরে ধীরে ধীরে বিরোধীদের মত পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছিল, যতক্ষণ না অবধি এটি এত বেশী মূলধারার চিন্তায় তার জায়গা করে নিয়েছে যে, বইটি নিয়ে প্রথমে কেন এত সমালোচনার ঝড় উঠেছিল আমাদের পরে বিস্মিত হয়ে সেটি ভাবতে হয়। আমি বলবো দ্য সেলফিশ জিন বরং এর ব্যতিক্রমই। একেবারে শুরু থেকেই এটি বেশ সন্তোষজনক পর্যালোচনা পেয়েছে, এবং শুরুতে, এটিকে কেউই বিতর্কিত বই হিসাবে দেখেননি। তবে বিতর্কিত বিষয়বস্তু হবার তার এই কুখ্যাতিটি বাড়তে বেশ কিছু বছর লেগেছে, এবং এখন, ব্যাপকভাবে এটিকে মনে করা হয় পুরোপুরিভাবে বৈপ্লবিক, চরমপন্থী একটি কাজ। কিন্তু এই বছরগুলোতেই যখন এর চরমপন্থী বই হিসাবে কুখ্যাতি বেড়েছে, এর সত্যিকারের বিষয়বস্তু ধীরে ধীরে তার চরমপন্থী অবস্থান থেকে সরে এসেছে, এবং ক্রমান্বয়ে সাধারণ বৈজ্ঞানিক চিন্তায় স্বাভাবিক একটি অবস্থানে এর জায়গা করে নিয়েছে।
স্বার্থপর জিনের তত্ত্বই হচ্ছে ডারউইনের তত্ত্ব; এটি এমনভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যে, ডারউইন নিজে নির্বাচিত করেননি, কিন্তু তার যথার্থতা, আমি যেমন ভাবতে চাই, যদি তিনি এটি পড়তেন, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে এটি শনাক্ত করতে পারতেন এবং তৃপ্তিবোধ করতেন। এটি আসলে অর্থডক্স নিও-ডারউইনিজমের (মূলধারার নব্য-ডারউইনবাদ) একটি যৌক্তিক সম্প্রসারণ, কিন্তু নতুন দৃশ্যকল্পের অভিব্যক্তির মাধ্যমে এটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোনো একটি একক জীব সদস্যর উপর মনোযোগ না নিয়ে, এটি নজর দিয়েছে প্রকৃতির একটি জিন-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি। এটি ভিন্নভাবে দেখার একটি উপায়, ভিন্ন কোনো তত্ত্ব নয়। ‘দি এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ’ বইটির শুরুর পৃষ্ঠাগুলোয় আমি এটি ব্যাখ্যা করেছিলাম নেকার কিউবের একটি রুপক ব্যবহার করে।
এটি পাতায় কালি দিয়ে আকা একটি দ্বি-মাত্রিক প্যাটার্ন বা নকশা, কিন্তু এটিকে স্বচ্ছ, ত্রি-মাত্রিক কিউব হিসাবে অনুভূত হয়। এটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকুন, এটি বিভিন্ন দিক বরাবর তার মুখ পরিবর্তন করবে। তাকিয়ে থাকুন এবং এটি আবার মূল কিউবের রুপে ফিরে আসবে। উভয় কিউবই রেটিনায় দ্বি-মাত্রিক উপাত্তের সাথে সমানভাবে সঙ্গতিপূর্ণ, সুতরাং মস্তিষ্ক শুধু আনন্দের সাথে এই দুটি রুপ পালাবদল করে। কোনটাই অন্যটির চেয়ে বেশী সঠিক নয়। আমার মূল বক্তব্যটি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিষয়টি আমরা দুই ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি: জিনের দৃষ্টিকোণ থেকে, এবং একক জীব সদস্যদের দৃষ্টিকোণ থেকে। যদি অনুধাবনটি সঠিক হয় তারা সমার্থক। একই সত্যের দুটি দৃষ্টিভঙ্গি। আমি একটি থেকে অন্যটিতে অনায়াসে যেতে পারবেন এবং তারপরও এটি সেই একই নিও ডারউইনিজমই থাকবে।
আমি এখন মনে করি এই রুপক আসলে খুব বেশী সতর্ক রুপ ছিল। নতুন কোনো তত্ত্ব প্রস্তাব করার পরিবর্তে বা কোনো নতুন বাস্তব তথ্য উদঘাটন ছাড়াও একজন বিজ্ঞানী প্রায়শই পুরোনো কোনো তত্ত্ব বা বাস্তব সত্যকে নতুন কোনো উপায়ে দেখার পথ উদঘাটনের মাধ্যমে খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। নেকার কিউব মডেলটির উদাহরণ কিছুটা বিভ্রান্তিকর কারণ এটি প্রস্তাব করছে যে দুইটি উপায়ে কোনো কিছু দেখা আসলে সমানভাবে উত্তম। নিশ্চিভাবে, এই রুপকটি বিষয়টিকে বোঝাতে আংশিক সফল হয়: দৃষ্টিকোণ, যা তত্ত্বের ব্যতিক্রম, কোনো পরীক্ষা দ্বারা যাচাই করা সম্ভব না। এমন কোনো কিছুর সত্যতা নির্ণয় এবং মিথ্যা প্রমাণে আমরা আমাদের পরিচিত মানদণ্ডের আশ্রয় নিতে পারিনা। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, তার সবচেয়ে সেরা অবস্থানে, কোনো একটি তত্ত্বের চেয়ে বড় কিছু অর্জন করতে পারে। এটি চিন্তার জগতে সম্পূর্ণ নতুন কোনো পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে, যেখানে অনেক উত্তেজনা আর পরীক্ষাযযাগ্য তত্ত্বের জন্ম হয় এবং কল্পনা করা হয়নি এমন বাস্তব তথ্যও উন্মোচিত হতে পারে। নেকার কিউবের রুপকটি এই বিষয়টিকে পুরোপুরিভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। এটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ধারণাটি সঠিকভাবে উপস্থাপন করে, কিন্তু এর সত্যিকারের মূল্যটি উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। আমরা যে বিষয় নিয়ে কথা বলছি সেটি সমরুপ দৃষ্টিভঙ্গির অদল বদল নয়, বরং চূড়ান্ত ক্ষেত্রে একটি ট্রান্সফিগারেশন বা রূপান্তর। আমার এই সামান্য অবদানের জন্য এমন কোনো মর্যাদার দাবী দ্রুততার সাথে অস্বীকার করছি। তবে যাই হোক, এই ধরনের কারণে আমি বিজ্ঞান এবং জনপ্রিয়করণের মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি করা সপক্ষে নই। এ যাবৎ যে ধারণাগুলো শুধুমাত্র টেকনিকাল বা পেশাগত জার্নালেই আবির্ভূত হয়েছে, সেই ধারণাগুলোকে ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন একটি শিল্প। এর জন্য ভাষার দুরদর্শিতাপূর্ণ নতুন ব্যবহার এবং দৃষ্টি উন্মোচনকারী রুপক উদাহরণ প্রয়োজন।
আপনি যদি ভাষার নতুনত্ব আর রুপক যথেষ্ট পরিমান দূরে নিতে পারেন, আপনিও নতুনভাবে দেখার একটি উপায় খুঁজে পাবেন। এবং এই নতুনভাবে দেখা, যা আমি প্রস্তাব করেছিলাম, এর নিজের অধিকারেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রাখতে পারে। আইনস্টাইন নিজে সাধারণ মাপের জনপ্রিয়কারী ছিলেন না। এবং আমি প্রায়ই সন্দেহ করেছি তার উজ্জল রুপকের ব্যবহার আমাদের বাকী সবাইকে বুঝতে সাহায্য করার চেয়ে বেশী কিছু করেছিল। সেগুলো কি তার সৃজনশীল প্রতিভাকেও চালিত করেনি?
তিরিশের দশকে আর. এ. ফিশার (১) ও নব্য-ডারউইনবাদের অন্যান্য অগ্রদূতদের লেখার মধ্যে ডারউইনবাদের জিন-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত আমরা পাই। কিন্তু ষাটের দশকে ডাবলিউ ডি. হ্যামিলটন (২) এবং জি. সি. উইলিয়ামস (৩) তাদের লেখায় এটি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছিলেন। আমার জন্য তাদের অন্তর্দৃষ্টি একটি ভবিষ্যৎসূচক গুণাবলী বহন করে। কিন্তু তাদের অভিব্যক্তিকে আমার অনেক বেশী সংক্ষিপ্ত, স্বল্পভাষী মনে হয়েছে, যা যথেষ্ট উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করা হয়নি। আমি স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছিলাম যে, তাদের প্রস্তাবনাগুলোর একটি বিস্তারিত আর বিকশিত সংস্করণ জীবনের ইতিহাস ব্যাখ্যায় সর্বক্ষেত্রেই কার্যকরী হতে পারে, হৃদয়ে এবং মস্তিষ্কে উভয় ক্ষেত্রেই। বিবর্তনের জিনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিটির ব্যাখ্যা ও সমর্থনে আমি একটি বই লিখবো। এটি মূলত নজর ঘনীভূত করবে সামাজিক আচরণের উদাহরণের উপর, যার উদ্দেশ্য হবে জনপ্রিয় ডারউইনবাদিতায় সর্বব্যাপী অবচেতনে গ্রুপ সিলেকশনবাদের (গ্রুপ-নির্বাচন) ভ্রান্ত ধারণাটি সংশোধন করা। আমি বইটি শুরু করেছিলাম ১৯৭২ সালে যখন শিল্প কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের জন্যে দৈনন্দিন বিদ্যুৎ বিভ্রাট আমার ল্যবরেটরী নির্ভর গবেষণা ব্যহত করেছিল। দুঃখজনকভাবে (একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে) এই বিদ্যুৎ বিভ্রাট পরিস্থিতির পরিসমাপ্তি ঘটেছিল শুধুমাত্র দুটি অধ্যায় লেখার পরপরই। আমি পুরো প্রজেক্টটি, ১৯৭৫ সালে যখন দীর্ঘদিনের ছুটি বা সাবাটিকাল পাই, সেই সময়ের জন্য তুলে। রেখেছিলাম। ইতিমধ্যে বিশেষ করে জন মেনার্ড স্মিথ এবং রবার্ট ট্রিভার্সের কল্যাণে তত্ত্বটি অনেকটুকু সম্প্রসারিত হয়েছিল। আমি এখন সেই সময়টাকে দেখি সেই সব রহস্যময় পর্বগুলোর একটি হিসাবে যেখানে নতুন সব ধারণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমি একধরনের তীব্র উত্তেজনার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ‘দ্য সেলফিস জিন’ লিখেছিলাম।
যখন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস আমাকে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল, তারা জানিয়েছিলেন, সাধারণ প্রথাগত পন্থায় বেশ ব্যাপকভাবে বইটির প্রতিটি পাতা সংশোধন বা পরিমার্জন করার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কিছু বই আছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, যা আবশ্যিকভাবে বেশ কিছু ধারাবাহিক সংস্করণ হিসাবে প্রকাশিত হবার জন্য চিহ্নিত, তবে ‘দ্য সেলফিশ জিন তাদের একটি নয়। প্রথম সংস্করণ যে সময় লেখা হয়েছিলো, সেই সময়ের তারুণ্যময় একটি বৈশিষ্ট্য এটি ঋণ করেছিল। বিদেশের বাতাসে তখন বিপ্লবের ঝাঁপটা, ওয়ার্ডসওয়ার্থের তীব্র সুখের ভোরের একটি আলোকচ্ছটা অনুভূত হয়েছিল তখন। সেই সময়ের একটি শিশুকে পরিবর্তন করা, নতুন তথ্য যুক্ত করে তাকে স্কুল করা বা জটিলতা আর সতর্কবাণী ব্যবহার করে একে কুচকানো খুব দুঃখজনক কাজ হবে। সুতরাং মূল লেখ্য অংশ যেমন ছিল তেমনই থাকবে, সেই সব লিঙ্গবাদী সর্বনাম, অস্বস্তিকর অংশসহ সব কিছুই। বইটি এর শেষে উল্লেখিত নোটগুলো সব সংশোধন, প্রতিক্রিয়া, প্রত্যুত্তর এবং বিকাশ এই সব বিষয়গুলোর দিকে নজর দিবে। এবং পুরোপুরি নতুন অধ্যায় যুক্ত করা উচিৎ হবে, এমন কোনো বিষয়ে যার নিজের সময়ের নতুনত্ব, বৈপ্লবিক ঊষালগ্নের সেই মেজাজটি আরো সামনে অগ্রসর করে নিয়ে যাবে। এর ফলাফল হচ্ছে অধ্যায় ১২ এবং ১৩। এই দুটি অধ্যায়ের জন্যে আমি আমার অনুপ্রেরণা আহরণ করছি এই মধ্যবর্তী সময়ে প্রকাশিত একটি বই, যা সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক হিসাবে আমার মনকে নাড়া দিয়েছিল: রবার্ট অ্যাক্সেলরডের (৪) “দি ইভোলুশন অব কোঅপারেশন, কারণ এটি আমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমাকে এক ধরনের আশাবাদ দিয়েছিল; এবং আমার নিজের ‘দি এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ’, কারণ আমার জন্য এই বইটি সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল সেই বছরগুলোয়– এর প্রভাব যাই হোক না কেন– সম্ভবত এটাই আমার সর্বশ্রেষ্ট রচনা–যা আমি আর কখনো লিখতে পারবো।
‘নাইস গাইস ফিনিশ ফার্স্ট’ (বা ভালোরা সফল হয়) এই শিরোনামটি আমি ঋণ করেছি বিবিসি হরাইজন টেলিভিশন প্রোগ্রাম থেকে, যা ১৯৮৫ সালে সম্প্রচারিত হয়েছিল। এটি পঞ্চাশ মিনিট দীর্ঘ একটি প্রামাণ্যচিত্র, যার বিষয়বস্তু ছিল সহযোগিতা বা কোঅপারেশন বিবর্তনে গেম-তাত্ত্বিক (গেম থিওরি) দৃষ্টিভঙ্গি। জেরেমি টেইলর এটি প্রযোজনা করেছিলেন। এই প্রামাণ্য চিত্রটির একই প্রযোজকের আরেকটি কাজ, ‘দ্য ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার’ প্রামাণ্য চিত্রটির নির্মাণের সময় নতুন করে তার পেশাগত দক্ষতার প্রতি আমার শ্রদ্ধার জন্ম হয়েছিল। তাদের শ্রেষ্ঠ সময়ে হরাইজন প্রযোজকরা (তাদের কিছু প্রোগ্রাম আমেরিকাতেও দেখা যেতে পারে, যেখানে প্রায়ই নতুন করে তাদের প্যাকেজ করা হয়েছে ‘নোভা’ নামে) তারা যে বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করতেন সেই বিষয়ের কোনো অগ্রসর বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতেন। শুধুমাত্র অধ্যায় বারোরই শিরোনাম না, জেরেমি টেইলর ও হরাইজন টিমের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সেই অভিজ্ঞতার কাছেও আমি অনেক বেশী ঋণী এবং কতজ্ঞ।
আমি সম্প্রতি একটি অস্বস্তিকর বাস্তব তথ্যের কথা জেনেছিঃ কিছু প্রভাবশালী বিজ্ঞানীরা আছেন বিভিন্ন প্রকাশনার সাথে তাদের নিজেদের জুড়ে দেবার যাদের অভ্যাস আছে, যে প্রকাশনায় তাদের যখন কোনো অবদানই নেই। আপাতদৃষ্টিতে বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের বিজ্ঞানী একটি প্রকাশনার জন্য যৌথ লেখক হিসাবে স্বীকৃতি দাবী করেন, যখন সেখানে তাদের অবদান হয়তো ল্যাবের জায়গা যোগান দেয়া, গ্রান্টের অর্থ যোগাড় কিংবা পাণ্ডুলিপিতে সম্পাদনার দৃষ্টি বোলানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমি যা জানি, সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক সুখ্যাতি নির্মিত হয়েছে ছাত্র এবং সহকর্মীদের পরিশ্রমের দ্বারা! আমি জানি কিভাবে আমরা এই অসতোর সমাধান করতে পারি। হয়তো জার্নাল সম্পাদকরা কোনো একটি প্রবন্ধের প্রতিটি লেখকের কাছ থেকে সেখানে এককভাবে তাদের অংশগ্রহন কতটুকু সে বিষয়ে স্বাক্ষরিত হলফনামা দাবী করতে পারেন। কিন্তু এটি প্রসঙ্গক্রমে বলা, এই বিষয়টি এখানে উল্লেখ করার প্রধান কারণ হচ্ছে একটি পার্থক্যকে সুস্পষ্ট করা। হেলেনা ক্রোনিন (৫) অনেক কিছুই করেছেন প্রতিটি বাক্যকে উন্নত করার জন্য– প্রতিটি শব্দ– যেমনটি তার উচিৎ মনে হয়েছে, কিন্তু এই নতুন অংশের যৌথ লেখক হিসাবে খুব দৃঢ়ভাবে তিনি তার নিজের নাম সংযুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আমি গভীরভাবে তার প্রতি কৃতজ্ঞ, এবং দুঃখিত তার অবদানের প্রতি আমার এই স্বীকৃতি এখানে সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে। আমি আরো ধন্যবাদ জানাই মার্ক রিডলী, মারিয়ান ডকিন্স এবং অ্যালান গ্রাফেনের প্রতি, বিশেষ কিছু অনুচ্ছেদে তাদের উপদেশ এবং গঠনমূলক সমালোচনার জন্য। থমাস ওয়েবস্টার, হিলারী ম্যাকগ্লিন এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের অন্যান্যদের প্রতি আমার ধন্যবাদ, যারা হাসিমুখে আমার খেয়ালী ইচ্ছা ও দীর্ঘসূত্রিতা সহ্য করেছেন।
রিচার্ড ডকিন্স (১৯৮৯)
পাদটীকা:
১. রোনাল্ড আইলমার ফিশার (১৮৯০-১৯৬২) আর এ ফিশার নামে তিনি পরিচিত, ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ ও জীববিজ্ঞানী, যিনি গণিত ব্যবহার করেছিলেন মেন্ডেলিয় জিনতত্ত্ব ও ডারউইনী প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটিকে সংশ্লেষণ করার জন্য, যা সাহায্য করেছিলেন বিবর্তনের নব্য ডারউইনীয় সংশ্লেষণের যা এখন পরিচিত মডার্ন ইভোশনারী সিনথেসিস হিসাবে।
২. উইলিয়াম ডোনাল্ড ‘বিল’ হ্যামিলটন (১৯৩৬-২০০০) বৃটিশ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা বিবর্তন তাত্ত্বিক হিসাবে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়। হ্যামিলটনের সবচেয়ে বড় অবদান প্রকৃতিতে দৃশ্যমান কিন সিলেকশন ( একই জিন বহন কারীদের মধ্যে পারস্পরিক পরার্থবাদীতা) এবং অ্যালুটুইজিম বা পরার্থবাদেও জিনগত ভিত্তিটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা। এবং এই অসাধারণ অন্তর্দষ্টিটি পরবর্তীতে জিন-কেন্দ্রিক বিবর্তনীয় ধারণাটি সুসংগঠিত করেছিল। তাকে সোসিওবায়োজলজীর অগ্রদূত হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়, যে ধারণাটি পরে ই ও উইলসন জনপ্রিয় করেছিলেন। হ্যামিলটন সেক্স-রেশিও এবং বিবর্তন নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯৮৪ থেকে তার মৃত্যু অবধি তিনি অক্সফার্ডের রয়্যাল সোসাইটি রিসার্চ অধ্যাপক ছিলেন।
৩. জর্জ ক্রিস্টোফার উইলিয়ামস (১৯২৬-২০১০) আমেরিকার বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক অ্যাট স্টোনি ব্রুকের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি সুপরিচিত ছিলেন গ্রুপ সিলেকশন ধারণাটির ঘোরতর বিরোধী হিসাবে। তার গবেষণা ৬০ এর দশকে জিন-কেন্দ্রিক বিবর্তনের ধারণাটিকে সংগঠিত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
৪. রবার্ট মার্শাল আক্সেলরড (১৯৪৩) যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি সুপরিচিত তার সহযোগিতার বিবর্তন নিয়ে আন্তঃশাখা গবেষণায়।
৫. হেলেনা ক্রোনিন (১৯৪২): ডারউইনীয় দার্শনিক। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের ডারউইন সেন্টার ও সেন্টার অব ফিলোসফি অব ন্যাচারাল অ্যান্ড সোস্যাল সায়েন্স এর সহ-পরিচালক। তার সুপরিচিত দুই বই: The Ant and the Peacock: Altruism 998 Sexual Selection from Darwin to Today (1991)
.
প্রথম সংস্করণের প্রাককথন
শিম্পাঞ্জি এবং মানুষ তাদের বিবর্তনীয় ইতিহাসের ৯৯.৫ শতাংশই ভাগাভাগি করে, তারপরও বেশীর ভাগ মানুষই শিম্পাঞ্জিদের বিকৃত এবং অপ্রয়োজনীয় একটি অদ্ভুত ব্যতিক্রম হিসাবে মনে করেন, আর সর্বশক্তিমানের কাছাকাছি পৌঁছাবার সিঁড়ির একটি ধাপ হিসাবে নিজেদেরকে দেখেন। কিন্তু বিবর্তন বিশেষজ্ঞের কাছে কখনোই বিষয়টি এমন হতে পারে না। নৈর্ব্যক্তিক মানদণ্ডের কোনো অস্তিত্বই নেই, যার উপর ভিত্তি করে অন্য কোনো একটি প্রজাতির উপর আমরা আরেকটি প্রজাতির শ্রেষ্ঠত দাবী করতে পারি। শিম্পাঞ্জি এবং মানুষ, টিকটিকি এবং ছত্রাক, আমরা সবাই প্রায় তিন হাজার কোটি বছর ধরে প্রাকৃতিক নির্বাচন নামে পরিচিত একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছি। প্রতিটি প্রজাতির অভ্যন্তরে কিছু একক সদস্য অন্য সদস্যদের তুলনায় বেশী পরিমান সন্তান উৎপাদন করতে সক্ষম হয়, সুতরাং প্রজনন সফলদের বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যাবলী (জিনগুলো) পরবর্তী প্রজন্মে সংখ্যায় আরো বৃদ্ধি লাভ করে। এটাই প্রাকৃতিক নির্বাচন: জিনদের নন-র্যানডোম (বা নির্বিকার বা এলোমেলো নয়) বৈষম্যমূলক বা পার্থক্যসূচক প্রজনন। প্রাকৃতিক নির্বাচনই আমাদের তৈরী করেছে, এবং এই প্রাকৃতিক নির্বাচনকেই আমাদের বুঝতে হবে যদি নিজেদের পরিচয়কে আমরা বুঝতে চাই।
যদিও ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্বটি সামাজিক আচরণ সংক্রান্ত গবেষণায় একান্ত জরুরী (বিশেষ করে যখন এটি সংযুক্ত হয় মেন্ডেলিয় জিনতত্ত্বের সাথে), তা সত্ত্বেও খুব বেশী ব্যাপকভাবে এটি অবহেলিত হয়ে এসেছে। সমাজ বিজ্ঞানের একটি পুরো শিল্প প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠেছে, সামাজিক এবং মনোজাগতিক পৃথিবীর প্রাক-ডারউইনীয় এবং প্রাক-মেন্ডেলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের প্রতি নিবেদিত হয়ে। এমনকি জীববিজ্ঞানের অভ্যন্তরেও ডারউইনীয় তত্ত্বের অবহেলা ও অপব্যবহার বিস্ময়কর। এই ধরনের একটি অদ্ভুত পরিস্থিতির উদ্ভবের যে কারণই থাকুক না কেন, সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে এটি শেষ হতে চলেছে। ক্রমবর্ধিষ্ণু সংখ্যার জীববিজ্ঞানীরা ডারউইন এবং মেন্ডেলের অসাধারণ কাজগুলো সম্প্রসারিত করে চলেছেন, বিশেষ করে আর. এ. ফিশার, ডাবলিউ ডি, হ্যামিলটন, জি, সি, উইলিয়ামস এবং জে. মেনার্ড স্মিথ। এখন রিচার্ড ডকিন্স প্রথমবারের মত প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপর নির্ভরশীল সামাজিক তত্ত্বটির গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সরল এবং সহজপাঠ্য হিসাবে উপস্থাপন করেছেন।
সামাজিক তত্ত্বের এই সব নতুন গবেষণার মূল বিষয়গুলোকে ডকিন্স ক্রমান্বয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করেছেন: পরার্থবাদী এবং স্বার্থপর আচরণের ধারণাগুলো, আত্ম-স্বার্থের জিনতাত্ত্বিক সংজ্ঞা, আক্রমণাত্মক আচরণের বিবর্তন, কিনশিপ বা আত্মীয়তার তত্ত্ব (যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত পিতামাতা-সন্তান সম্পর্কগুলো এবং সামাজিক কীটপতঙ্গের বিবর্তন), লিঙ্গ অনুপাত তত্ত্ব, পারস্পরিক পরার্থবাদীতা, প্রবঞ্চনা বা ছলনা এবং লিঙ্গ বৈষম্যগুলোর প্রাকৃতিক নির্বাচন। মূল ভিত্তি নির্মাণ করা তত্ত্বটি সম্বন্ধে বিশেষ দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সৃষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে, ডকিন্স তার এই নতুন কাজটিকে উন্মোচন করেছেন প্রশংসনীয় সুস্পষ্ট স্বচ্ছতা এবং শৈলীর মাধ্যমে। জীববিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষিত হয়েও তিনি এই বইয়ের পাঠকদের সমৃদ্ধ আর মনোমুগ্ধকর সাহিত্যের স্বাদ দিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে যেখানে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেছেন (যেমন তিনি আমার নিজের একটি যৌক্তিক বিভ্রান্তির সমালোচনা করেছেন, তিনি সবসময়ই প্রায় সঠিক নিশানায় ছিলেন। ডকিন্স নিজেও যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন তার নিজের প্রস্তাবনার যৌক্তিক বিশ্লেষণটি সুস্পষ্ট করতে, যেন পাঠকরা, সেই প্রস্তাবিত যুক্তিগুলো প্রয়োগ করে তার যুক্তিগুলোকে আরো সম্প্রসারণ করতে পারেন (এমনকি ডকিন্সের বিরুদ্ধেও তার যুক্তিগুলো ব্যবহার করতে পারেন)। যুক্তিগুলো নিজেরাই সম্প্রসারিত বহু দিক বরাবর। যেমন, যদি ( যেমন, ডকিন্স যুক্তিটি ব্যবহার করেছেন) জীবদের পারস্পরিক যোগাযোগের মৌলিক বিষয়টি ‘ছলনা’ হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ছলনা শনাক্ত করার বৈশিষ্ট্যটি বিবর্তনের উপর শক্তিশালী নির্বাচনী চাপ থাকবে এবং এই কারণে এর উচিৎ হবে খানিকটা মাত্রার আত্ম-প্রবঞ্চনাকে নির্বাচন করা। যা কিছু বাস্তব তথ্য এবং উদ্দেশ্যকে অবচেতন করে দেয় যেন সেটি– আত্মজ্ঞানের সূক্ষ্ম সংকেত দ্বারা– ছলনার ব্যবহার বা চর্চা হওয়ার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনা। এভাবে, প্রথাগত সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই ধরনের স্নায়ুতন্ত্রকে বাছাই করে, চারপাশের পৃথিবী সম্বন্ধে যা আরো বেশী সুস্পষ্ট ধারণা দেবে, সেটি অবশ্যই মানসিক বিবর্তন সম্বন্ধে অতি সরলীকৃত একটি দৃষ্টিভঙ্গি।
সামাজিক তত্ত্ব সংক্রান্ত সাম্প্রতিক গবেষণার পরিমান এখন যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য, এটি প্রতি-বিল্পবী প্রতিক্রিয়ার একটি ছোট খাট কর্মতৎপরতার জন্ম দিয়েছে। যেমন, অভিযোগ আনা হয়েছে, সাম্প্রতিক এই অগ্রগতিগুলো, বাস্তবিকভাবে, সামাজিক প্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করতে চক্রাকারে চলমান একটি ষড়যন্ত্রেরই অংশ, এই ধরনের অগ্রগতিকে যা জিনগতভবে অসম্ভব বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। একই ধরনের দুর্বল চিন্তাগুলো একই সাথে গাথা হয়েছে এমন একটি ধারণা দেবার জন্য যে ডারউইনীয় সামাজিক তত্ত্ব এর রাজনৈতিক তাৎপর্যে প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু এই ধরণের কোনো অভিযোগ সত্য থেকে অনেক দূরে। ভিন্ন লিঙ্গের মধ্যে জিনগত সাম্যতা, প্রথমবারের মত, সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে ফিশার এবং হ্যামিলটনের গবেষণার মাধ্যমে। সামাজিক কীটপতঙ্গ গবেষণা থেকে সংগৃহীত তত্ত্ব এবং পরিমানবাচক উপাত্ত প্রদর্শন করছে যে তাদের সন্তানদের উপর প্রভাব বিস্তার করার পিতামাতাদের কোনো অন্তর্গত প্রবণতা নেই (এবং সন্তানদেরও সেই প্রবণতা নেই পিতামাতার প্রতি) এবং ‘প্যারেন্টাল’ বা পিতামাতার বিনিয়োগের ধারণা এবং স্ত্রী সদস্যদের চয়েস বা বাছাই একটি নৈর্ব্যক্তিক আর পক্ষপাতহীন ভিত্তি প্রদান করেছে লিঙ্গ বৈষম্যগুলো দেখার জন্য, বৃত্তিহীন জৈববৈজ্ঞানিক পরিচয়ের জলায় নিমগ্ন নারীর ক্ষমতা আর অধিকার সমর্থনের জনপ্রিয় আন্দোলনের চেয়ে যা একটি উল্লেখযোগ্য পরিমান অগ্রগতি। সংক্ষেপে ডারউইনীয় সামাজিক তত্ত্ব আমাদেরকে সামাজিক সম্পর্কগুলোর একটি অন্তর্নিহিত সাম্যতা ও যুক্তির আভাস দেয়; যখন আমরা আরো পুরোপুরিভাবে বুঝতে সক্ষম হব, সেটি অবশ্যই আমাদের আমার রাজনৈতিক বোধকেও নবায়ন করবে এবং মনোবিজ্ঞানের চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের প্রতি বৌদ্ধিক সমর্থন প্রদান করবে। এই পক্রিয়ায় এটি আমাদের দুঃখকষ্টের মূল কারণগুলো সম্বন্ধে গভীর উপলদ্ধিও প্রদান করবে।
রবার্ট এল. ট্রিভার্স,
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি,
জুলাই,১৯৭৬
.
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
এই বইটিকে প্রায় এমনভাবে পড়া উচিৎ হবে যেন এটি কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। আমাদের কল্পনার প্রতি আবেদন সৃষ্টি করবে, এমনভাবেই বইটি পরিকল্পিত। কিন্তু এটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়: এটি বিজ্ঞান। বহু ব্যবহৃত কোনো শব্দ হোক বা না হোক, ‘গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর’ শব্দটি সঠিকভাবেই প্রকাশ করে সত্য সম্বন্ধে আমি ঠিক কি অনুভব করি। আমরা হচ্ছি টিকে থাকার বা সারভাইভাল মেশিন– রোবোট বাহন, জিন নামে পরিচিত স্বার্থপর অণুটিকে সংরক্ষিত করার নির্দেশ অন্ধভাবেই অনুসরণ করতে যা প্রোগ্রাম করা আছে। যে সত্যিটা আজো আমাকে বিস্ময়ে আপ্লুত করে। যদিও আমি বহু বছর ধরে এই সত্যটা জানি, কিন্তু কখনোই ধারণাটির সাথে পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে পারিনি। আমার একটি আশা হচ্ছে, হয়তো অন্যদেরকেও বিস্মিত করার ক্ষেত্রেও আমি কিছুটা সফল হবো।
যখন আমি লিখছিলাম, তিনজন কাল্পনিক পাঠক আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে দেখছিলেন আমি কি লিখছি এবং এখন আমি এই বইটি তাদের প্রতি উৎসর্গ করছি। প্রথমেই সাধারণ পাঠক, যিনি এই বিষয়ে তেমন কিছুই জানেন না। তার জন্য কারিগরী শব্দগুলো আমি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছি প্রায় পুরোপুরিভাবেই এবং যেখানে আমি বিশেষায়িত কোনো শব্দ ব্যবহার করেছি, আমি সেটির অর্থও ব্যাখ্যা করেছি। আমি এখন ভাবছি কেন আমরা সব প্রতিষ্ঠিত পাণ্ডিত্যপূর্ণ জার্নাল থেকেও এই সব কারিগরী শব্দগুলোর অধিকাংশই নিষিদ্ধ করছি না। আমি ধরে নিয়েছি যে, সাধারণ পাঠকদের এই বিষয়ে বিশেষায়িত কোনো জ্ঞান থাকবে না। কিন্তু আমি তাকে নির্বোধ মনে করিনি। যে কেউই বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে পারেন যদি সে বিষয়টিকে অতিমাত্রায় সরলীকরণ করতে পারেন। আমি কিছু সূক্ষ্ম আর জটিল ধারণাগুলো অগাণিতিক ভাষায় এর মূলসারটিকে না হারিয়ে জনপ্রিয় সহজপাঠ্য হিসাবে উপস্থাপন করতে কঠোর পরিশ্রম করেছি। জানিনা আমি সেটি করতে কতটুকু সফল হয়েছি বা কতদূর আমি সফল হয়েছি আমার আরো একটি লক্ষ্য পূরণে: বইটার বিষয়বস্তু যেমন দাবী করে, তেমন চিত্তাকর্ষক আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারার মত করে উপস্থাপন করতে। আমি বহুদিন ধরেই অনুভব করে আসছি জীববিজ্ঞানকে মনে হওয়া উচিৎ কোনো রহস্য কাহিনীর মতই উত্তেজনাপূর্ণ। কারণ রহস্য কাহিনী হচ্ছে ঠিক জীববিজ্ঞানের মতই। আমি অবশ্য এমন কোনো আশা করারও সাহস প্রকাশ করছি না যে, এই উত্তেজনার সামান্য অংশও যা এই বিষয়টি আমাদের নিবেদন করে তা প্রকাশ করতে পেরেছি।
আমার দ্বিতীয় কাল্পনিক পাঠক হচ্ছেন একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি হচ্ছেন কঠোর সমালোচক, আমার কোনো কথার কথা বা রুপক উদাহরণ তার শ্বাসপ্রশ্বাসকে চঞ্চল করে তুলবে। তার প্রিয় বাক্য হচ্ছে– উইথ দি এক্সেপশন অব’ বা ‘এটি ব্যতিরেকে’; ‘বাট অন দি আদার হ্যান্ড’ বা ‘কিন্তু আবার অন্য দিকে’ এবং বিতৃষ্ণায় উচ্চারিত ধ্বনি “উফফ। আমি মনোযোগের সাথে তার কথা শুনেছি, এবং এমনকি একটি অধ্যায় পুরোপুরি ভাবেই পুনরায় লিখেছি তার সুবিধার কথা বিবেচনা করে। কিন্তু পরিশেষে আমাকে এই কাহিনীটি বলতে হবে আমার মত করে। বিশেষজ্ঞ এখনো পুরোপুরি খুশী নন, যেভাবে আমি বিষয়গুলো সাজিয়েছি। তারপরও আমার সবচেয়ে বড় আশা যে এমনকি তিনিও এখানে নতুন কিছু খুঁজে পাবেন। পরিচিত ধারণাগুলো দেখার একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো; হয়তো তার নিজের কিছু নতুন ধারণা সৃষ্টিতে এটি উদ্দীপনা যোগাবে। যদি এটি খুব বেশী বড় চাওয়া হয়ে যায়, তাহলে আমি কি নিদেনপক্ষে আশা করতে পারি যে, বইটি ট্রেনে পড়ার সময় তাকে আনন্দ যোগাবে?
তৃতীয় পাঠক, যে আমার মনে ছিল, তিনি হচ্ছেন শিক্ষার্থী, যিনি অবিশেষজ্ঞদের স্তর থেকে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার উত্তরণের কোনো পর্যায়ে আছেন। যদি এখনও তার মন স্থির না করে থাকেন তিনি কোন বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হবেন, আমি তাকে উৎসাহিত করবো আমার নিজের ক্ষেত্র প্রাণিবিজ্ঞানের দিকে আরো আরেকবার দৃষ্টি দেবার জন্য। শুধুমাত্র এর সম্ভাব্য উপযোগিতা বিচার করা, কিংবা প্রাণীদের সাধারণত খুব সব সহজেই পছন্দ আদায় করে নেবার মত সহজাত ক্ষমতা ছাড়াও প্রাণিবিজ্ঞান পড়ার আরো উত্তম। কারণ আছে। এই কারণটি হচ্ছে আমরা প্রাণীরা হচ্ছি আমাদের জানা এই মহাবিশ্বে সবচেয়ে জটিল এবং নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত যন্ত্র। এভাবে যদি বলা হয় তাহলে কিন্তু বেশ কঠিন বোঝা কেনই বা কেউ অন্য কিছু পড়বে! ইতিমধ্যে যে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তারা প্রাণীবিজ্ঞান পড়বেন, আমি আশা করছি আমার বইটি তাদের জন্য কিছু শিক্ষণীয় বিষয় উপস্থাপন করার ভূমিকা পালন করবে। তবে তাকে এই বইটিকে তথ্যাভিজ্ঞ করা মূল সব প্রবন্ধ আর পাঠ্যপুস্তকগুলো পড়তে হবে, যার উপর নির্ভর করে এই বইটি আমি সাজিয়েছি। যদি মূল প্রবন্ধগুলো বুঝতে তার সমস্যা হয়, হয়তো আমার অগাণিতিক ব্যাখ্যা তাকে সেই ক্ষেত্রে সাহায্য করবে, ভূমিকা এবং বাড়তি সংযুক্তি হিসাবে। তিনজন ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের প্রতি আবেদন সৃষ্টি করার প্রচেষ্টায় স্পষ্টতই কিছু বিপদ আছে। আমি শুধু বলতে পারি যে এইসব বিপদগুলোর ব্যপারে খুব সচেতন ছিলাম কিন্তু প্রচেষ্টা করার সুবিধাগুলো সম্ভবত তাদের খানিকটা গুরুত্বহীন। করেছে।
আমি নিজে একজন ইথোলজিষ্ট (১), এবং এটি প্রাণী-আচরণ বিষয়ক একটি বই। ইথোলজির ঐতিহ্যবাহী ধারার প্রতি আমার ঋণ খুব বেশী স্পষ্ট, যে বিষয়ে আমি নিজে প্রশিক্ষিত হয়েছি। বিশেষ করে, নিকো টিনবার্গেন (২) আমার উপর তার প্রভাবের ব্যাপ্তিটা আসলে কতটুকু ছিল তা তিনি কখনোই অনুধাবন করেননি, যখন অক্সফোর্ডে বারো বছর আমি তার অধীনে কাজ করেছিলাম। ‘সারভাইভাল মেশিন’ বাক্যটি, যদিও সত্যিকারভাবে তার নিজস্ব নয়, তবে তার হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইথথালজী সম্প্রতি নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে নতুন সব ধারণার আগ্রাসনে, এবং তারা এসেছে এমন কিছু উৎস থেকে যাদের প্রথাগতভাবে ইথথালজী সংক্রান্ত কোনো বিষয় মনে করা হয়না। এই বই অনেকাংশই সেই সব নতুন ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করে লেখা। এই ধারণাগুলো জন্মদাতাদের প্রতি বইয়ের লেখ্য অংশের যে জায়গায় প্রযোজ্য সেখানেই ঋণ স্বীকার করা হয়েছে। প্রধান সেই ব্যক্তিরা হলেন জি. সি, উইলিয়ামস, জে, মেনার্ড স্মিথ, ডাবলিউ. ডি. হ্যামিলটন এবং আর, এল, ট্রিভার্স।
বহু মানুষই এই বইয়ের শিরোনাম প্রস্তাব করেছেন, আমি কৃতজ্ঞতার সাথে যে নামগুলোকে বিভিন্ন অধ্যায়ের শিরোনাম হিসাবে ব্যবহার করেছিঃ ‘ইমোৰ্টাল কয়েলস’ (অমর কুণ্ডলী), জন ক্রেবস; ‘দ্য জিন মেশিন’(জিন যন্ত্র), ডেসমন্ড মরিস; ‘জিনম্যানশিপ’(জিন দক্ষতা), টিম ক্লাটন-ব্রক এবং জিন ডকিন্স, স্বতন্ত্রভাবে ক্ষমাপ্রার্থনাসহ স্টিফেন পটার। কাল্পনিক পাঠকরা বিনম্র আশা এবং আকাঙ্খার নিশানা হিসাবে কাজ করতে পারেন কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তারা সত্যিকার পাঠক ও সমালোচকদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম কাজে আসেন। পুনসংশোধন আর পরিমার্জনা করার প্রতি আমার আসক্তি আছে। এবং মারিয়ান ডকিন্স বাধ্য হয়েছেন প্রতিটি পাতার অসংখ্য সংশোধন এবং পুনসংশোধন পড়ার জন্য। জৈববৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ সম্বন্ধে তার সমীহ জাগানোর মত জ্ঞান এবং তাত্ত্বিক বিষয়গুলো অনুধাবন করার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা ছাড়াও, তার সার্বক্ষণিক বিরামহীন উৎসাহ এবং নৈতিক সমর্থন আমার জন্য অপরিহার্য ছিল। জন ক্রেবস যিনি এই বইটি খসড়া পাণ্ডুলিপি ড্রাফট হিসাবে পড়েছিলেন। তিনি এই বিষয় সম্বন্ধে আমার চেয়ে অনেক বেশী জানেন, এবং তিনি উদারতার সাথে অকৃপনভাবে আমাকে তাঁর উপদেশ এবং নানা প্রস্তাব দিয়েছেন। গ্লেনিস থমসন এবং ওয়াল্টার বড়মার জিনগত বিষয়গুলো নিয়ে আমার আলোচনা দয়ার সাথে তবে দৃঢ়ভাবে সমালোচনা করেছেল। আমি শঙ্কিত যে আমার পুনসংশোধন হয়তো তাদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারবে না। কিন্তু আমি আশা করি বইটি পড়ার পর তারা অন্তত মনে করবেন আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। তাদের সময় আর ধৈর্যের জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। জন ডকিন্সও তার নির্ভুল দৃষ্টি ব্যবহার করেছেন বিভ্রান্তিকর বাক্যগঠনের প্রতি এবং অসাধারণ কিছু গঠনমূলক প্রস্তাব করেছিলেন কিছু শব্দ পরিবর্তনের জন্য। ম্যাক্সওয়েল স্টাম্পের মত এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয় এমন কোনো বুদ্ধিমান মানুষ আমার পক্ষে আশা করা অসম্ভব। তার সতর্ক দৃষ্টির কারণে প্রথম ড্রাফটের শৈলীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ ভুল সংশোধন করা সম্ভব হয়েছিল যা চূড়ান্ত ড্রাফটটি সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অনেক কিছু করেছিল। অন্যরা যারা গঠনমূলক সমালোচনা করেছিলেন বিশেষ অধ্যায়গুলো নিয়ে অথবা যারা তাদের বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছিলেন, তারা হলেন জন মেনার্ড স্মিথ, ডেসমন্ড মরিস, টম মাশলার, নিক ব্লার্টন জোনস, সারা কেটলওয়েল নিক হাম্পফ্রে, টিম ক্লাটন-ব্রক, লুইস জনসন, ক্রিস্টোফার গ্রাহাম, জিওফ পার্কার এবং রবার্ট ট্রিভার্স। প্যাট সিয়ারলে এবং স্টেফানি ভেরহয়েভেন শুধুমাত্র দক্ষতার সাথে টাইপই করেননি, কাজটি আনন্দের সাথে করে দেখিয়ে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। পরিশেষে আমি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের মাইকেল রজার্সকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে চাই, পাণ্ডুলিপির প্রয়োজনীয় সমালোচনা ছাড়াও এই বই প্রকাশনার প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সতর্ক দৃষ্টি রেখে যিনি তার স্বাভাবিক। দ্বায়িত্বের বাইরেও অনেক পরিশ্রম করেছিলেন।
রিচার্ড ডকিন্স (১৯৭৬)
পাদটীকা:
১. প্রাণিবিজ্ঞানের যে শাখায় বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে প্রাণীদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করেন।
২. নিকোলাস ‘নিকো’ টিনবার্গেন (১৯০৭-১৯৮৮) : ডাচ প্রাণিবিজ্ঞানী ও ইথোলজিস্ট, কার্ল ভন ফ্রিশ এবং কনরাড লরেঞ্জ এর সাথে ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরষ্কার জিতেছিলেন।
Zeesan
অনেক অনেক ধন্যবাদ রিচার্ড ডকিন্সের বইগুলো দেওয়ার জন্য
Arijit Majumdar
রিচার্ড ডকিন্সের বইগুলি পি.ডি.এফ. আকারে পেতে চাই।