রূপান্তর / দ্য মেটামরফসিস – ফ্রানজ কাফকা
অনুবাদ – কবীর চৌধুরী
.
দ্য মেটামরফসিস-এর ভূমিকা
আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ব্যতিক্রমী শিল্পী ফ্রানজ কাফকা জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৩ সালে, প্রাগে, এক সচ্ছল মধ্যবিত্ত ইহুদি ব্যবসায়ী পরিবারে। প্ৰাগ তখন ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রাগের জর্মন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের পাঠ সমাপ্ত করে ১৯০৬ সালে তিনি ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরবর্তী কয়েক বছর একটি বীমা কোম্পানিতে চাকরি করেন। কাফকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। জীবনের অনিশ্চয়তা, অর্থহীন বিষাদমাখা অযৌক্তিক কাণ্ডকারখানা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিঃসঙ্গতা তাঁকে পীড়িত করে। তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। মানসিক দিক থেকেও তিনি বিধ্বস্ত বোধ করলেন। তাঁর মনে হল এই জীবনের জন্য তিনি যথেষ্ট উপযুক্ত ও সক্ষম নন। তবে তাঁর হ্রস্ব জীবনের শেষ দিকে কাফকা এই বোধ বহুলাংশে কাটিয়ে উঠেছিলেন। ১৯২৩ সালে ডোরা ডাইমন্ট নামী এক প্রতিভাময়ী ইহুদি অভিনেত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। তিনি প্রাগ ত্যাগ করে ডোরাকে নিয়ে বার্লিনে বাস করতে শুরু করলেন। এই পর্বে তার অস্থিরতা ও মানসিক অশান্তি প্রায় অপসৃত। কিন্তু ততদিনে তার স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়েছে। দুরারোগ্য যক্ষ্মা শেষপর্যন্ত কাফকার জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দেয়। অনেক কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগের পর ১৯২৪ সালের মাঝামাঝি মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে ফ্রানজ কাফকা মৃত্যুবরণ। করলেন। কিন্তু তার পূর্বেই তিনি রচনা করে ফেলেছেন অসাধারণ কয়েকটি উপন্যাস ও ছোটগল্প।
কাফকার শ্রেষ্ঠ রচনাবলির মধ্যে রয়েছে তিনটি উপন্যাস : দি ট্রায়াল, দি কাসল এবং আমেরিকা। এগুলো প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯২৫, ১৯২৬ ও ১৯২৭ সালে। উপন্যাস ছাড়াও কাফকা বেশ কয়েকটি অত্যন্ত উন্নতমানের, শিল্পগুণসম্পন্ন, গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ-সমৃদ্ধ, আবেদনময় ছোটগল্প রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মেটামরফোসিস, এ হাঙ্গার আর্টিস্ট, এ্যান ওল্ড পেজ এবং দি হান্টার এ্যাকাস।মেটামরফোসিস অথবা রূপান্তরকে অবশ্য ছোটগল্প না বলে উপন্যাসিকাও বলা চলে। বিশ্বজুড়ে সাধারণ পাঠকের মনে ফ্রানজ কাফকার নামের সঙ্গে এই রচনাটি প্রায় অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। কেউ কেউ এর প্রারম্ভিক বাক্যটি সম্পর্কে বলেছেন যে এটা হল আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের সবচাইতে চমক-জাগানো অবিস্মরণীয় বাক্য।
রূপান্তর যথার্থই একটি অত্যাশ্চর্য গল্প, সেই সঙ্গে সঙ্গে কাফকার প্রতিনিধিত্বমূলক রচনাও বটে। কাফকা-সাহিত্যের সবগুলো প্রধান লক্ষণ এর মধ্যে বিদ্যমান। মানুষের জীবন, কর্ম ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা দুঃস্বপ্ন; মানুষের নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা ও অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থতা; নিজেকে অপরের কাছে স্পষ্ট করে তোলার অক্ষমতা; নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-ভাবনার কথা অন্যকে কিছুতেই বোঝাতে না-পারা; মানুষের চরম ঔদাসীন্য ও নিস্পৃহতা; বর্তমানের বিরাজমান পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে অতীতের স্নেহ-মমতা-সহানুভূতির অবলুপ্তি; তারুণ্যের কাছে তাৎক্ষণিক জীবনের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ এবং তার ফলে জীর্ণ-অসুস্থ-মৃতকে দ্রুত বিস্মৃত হওয়া—এই সবই কাফকা তার রূপান্তর গল্পে তুলে ধরেছেন। গল্পটি কাফকার অন্যান্য রচনার মতোই একাধিক স্তরে উপভোগ্য, বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ; এর মধ্যে ফ্যান্টাসি আছে, রূপক-প্রতীক আছে, আর তার আড়ালে আছে নির্মম সত্যের উদ্ভাসন। এখানে নাটকীয়তা আছে, নিখুঁত চরিত্র-চিত্রণ আছে, সর্বোপরি আছে বিশদ বাস্তববাদী বর্ণনার ঐশ্বর্য।
মেটামরফোসিস-এর কাহিনী সংক্ষেপে এই রকম। যুবক গ্রেগর সামসা এক মধ্যবিত্ত ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান। কঠিন তার জীবন-সংগ্রাম। বৃদ্ধ মা-বাবা আর তরুণী ছোটবোনকে নিয়ে সে থাকে। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব তার কাঁধে। নানা দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা, আনন্দহীন ক্লান্তিকর কাজের বোঝা, চাকরি-ক্ষেত্রে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ঔদাসীন্য প্রভৃতিতে সে বিপর্যস্ত। তবু এর মধ্যেও তার মনে একটা গোপন গর্ববোধও আছে। সে-ই সংসারটা চালাচ্ছে। ছোটবোনকে সে ভালোবাসে। তাকে সংগীতবিদ হবার সুযোগ করে দিতে সে দৃঢ়সংকল্প। এসব কথা অবশ্য আমরা গল্পের শুরুতেই জানতে পারি না। গল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নানা তথ্য আমাদের চেতনায় ধরা পড়ে। কাহিনী শুরু হয় অবিশ্বাস্য অদ্ভুত চরম নাটকীয় একটি বাক্য দ্বারা : একদিন নানা দুঃস্বপ্ন দেখার পর ভোরবেলা গ্রেগর সামসা যখন ঘুম ভেঙে জেগে উঠল তখন সে দেখল যে সে একটা বিশাল পতঙ্গে পরিণত হয়ে তার বিছানায় শুয়ে আছে। প্রথমে গ্রেগর ভেবেছিল যে এটা বোধহয় তার ঘুমের মধ্যে দেখা কোনো স্বপ্নেরই সম্প্রসারণ, কিন্তু না, এ কোনো স্বপ্ন নয়। সত্যিই সে বিরাট একটা আরশোলায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এই অবিশ্বাস্য ঘটনার পটভূমিতে কাফকা তার কাহিনীতে এক বিস্ময়কর বাস্তববাদী অনুপুঙ্খ বর্ণনার সমারোহ নিয়ে আসেন। আরশোলা হয়ে যাবার পর গ্রেগর। কীভাবে বিছানা থেকে উঠল, নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করার কৌশল ও রীতিনীতি কীভাবে আয়ত্ত করল, কীভাবে চলাফেরা করল, কী আহার করল ও কেমন করে—এসবের এমন বিশদ বর্ণনা কাফকা দিয়েছেন যে কাহিনীটি। পাঠকচিত্তে অবাস্তববাদীর পাশাপাশি একটা বাস্তববাদী মাত্রিকতাও গড়ে তোলে। এ-প্রসঙ্গে কারো কারো হয়ত মনে পড়তে পারে কোলরিজের দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতাড়িত অদ্ভুত এক কাহিনী বর্ণনা-করা বৃদ্ধ নাবিকের কথা।
মেটামরফোসিস গল্পটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য। আরশোলায় রূপান্তরিত গ্রেগর সামসা ধীরে ধীরে অনিবার্যভাবে তার চেনা জগৎ থেকে, তার স্নেহশীল পারিবারিক বন্ধন থেকে, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ট্র্যাজেডি আরও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে এই কারণে যে গ্রেগর নিজে সব বুঝতে পারে, অন্যের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তীক্ষ্ণ্ণ হয়ে তার চেতনায় ধরা পড়ে, কিন্তু প্রবল ইচ্ছা ও চেষ্টা সত্ত্বেও সে তার নিজের মনোভাব, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও আবেগ-অনুভূতি কাউকে বোঝাতে সক্ষম হয় না।
কাহিনীর মধ্যে গ্রেগরের মা, বাবা, ভাই-বোন, পরিচারিকা প্রভৃতি বিভিন্ন চরিত্র এসেছে। তাদের প্রতিক্রিয়া চিত্রায়নে এবং সেইসব প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেগরের মনোজগতে যে ঘাত-প্রতিঘাতের সৃষ্টি হয় তার রূপায়ণে কাফকা অসামান্য পর্যবেক্ষণ-শক্তি, মনোবিশ্লেষণ-দক্ষতা ও শৈল্পিক নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে ছোটবোনের আচার-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির যে ক্রম-বিবর্তন কাফকা পরিবেশন করেছেন তার মধ্য দিয়ে গ্রেগরের ট্র্যাজেডি তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে।
কাহিনীর গঠন-কাঠামোও লক্ষ করবার মতো। এর মধ্যে তিনটি সুস্পষ্ট বিভাগ আমাদের চোখে পড়ে। প্রতিটি বিভাগের শেষে ক্লাইম্যাক্স আছে। সব মিলিয়ে একটা প্যাটার্ন ও ছন্দ আমরা লক্ষ করি। গ্রেগর সামসা কাহিনীর শেষ পর্বে মারা যায়। কিন্তু তার মৃত্যু-পরবর্তী কিছু তথ্যও কাফকা পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। গ্রেগর মারা যাবার পর পরিবারের সবাই যে তাকে স্বল্পকালের মধ্যেই। বিস্মৃত হবে, একটা অসম্ভব ও অসহনীয় অবস্থার অবসানে তার মা-বাবা-বোনের জীবন যে আবার নতুনভাবে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে তার নির্ভুল ইঙ্গিত আমরা পাই কাহিনীর সর্বশেষ অনুচ্ছেদে।
একটি স্তরে গল্পটি অবিশ্বাস্য। কোনো মানুষই বাস্তব অর্থে আরশোলায় রূপান্তরিত হতে পারে না। সেদিক থেকে মেটামরফোসিস বাস্তবতাবিরোধী গল্প। কিন্তু আক্ষরিক বাস্তবতাকে অতিক্রম করে আমরা কি ভিন্ন ধরনের কোনো বাস্তবতার কথা ভাবতে পারি না? যদি পারি, তাহলে আমরা দেখব যে মেটামরফোসিস বা রূপান্তর আমাদের জন্য বিচিত্র ও ভয়ঙ্কর-সব অর্থে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই গল্প আমাদের জন্য এমন একটা জগতের ছবি তুলে আনে যা
পারম্পর্যহীন চরম নৈরাজ্যের, যেখানে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কিছুতেই অর্থবহ যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না, শুধু সীমাহীন নিঃসঙ্গতা ও চরম শূন্যতার মধ্যে হাবুডুবু খায়। সম্ভবত আধুনিক পাঠককুল মেটামরফোসিসসহ কাফকার সামগ্রিক সাহিত্যকর্মে এক নতুন আঙ্গিকে সমকালীন বিপর্যস্ত সমাজের নির্ভুল চিত্রকে প্রতিফলিত হতে দেখে বলেই, এর আপাত-উদ্ভটতা সত্ত্বেও, এর প্রতি প্রবল আকর্ষণ বোধ করে।
কবীর চৌধুরী
২৮ ফেব্রুয়ারি ৯০
ঝরোকা
বাড়ি নং ৫৬, সড়ক নং ২৮
গুলশান, ঢাকা
Leave a Reply