দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কওয়াই – পিয়েরে বুল
০১.
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে যে অনতিক্রম্য ব্যবধান, অনেকের মতে সেটা স্রেফ দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রান্তি। যুগ যুগ ধরে এই ব্যবধানের কথা লেখা হচ্ছে। সেটা হয়তো নেহাতই প্রচলিত একটা জনপ্রিয় ধারণার সাথে লেখকদের একমত হবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। গত বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ এবং জাপানী দুই পক্ষের কাছেই মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারটা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাহ্যিকদৃষ্টিতে দুই শত্রুর চালচলন যথেষ্ট বিসদৃশ হলেও মানসিক দিক দিয়ে তারা সত্যিই পরস্পরের কাছাকাছি। জাপানী কর্নেল সাইতোর সাথে তাঁর বন্দী কর্নেল নিকলসনের মানসিকতার কোনও ব্যবধান আছে বলে মনে হয় না।
কথাগুলো দোলা দিচ্ছিল মেজর ক্লিপটনের মনে। যে পাঁচশো যুদ্ধবন্দীকে জাপানীরা কওয়াই নদীর তীরবর্তী ক্যাম্পে জড়ো করেছে, তিনি তাদেরই একজন। ইংরেজ, অস্ট্রেলিয়ান, ডাচ ও আমেরিকান মিলে ষাট হাজার যুদ্ধবন্দীকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে আনা হয়েছে বার্মা আর থাইল্যান্ডের এই জঙ্গলে অংশে। এখানে সভ্যতার ছোঁয়া নেই বললেই চলে। জাপানী সৈন্যদের যথেষ্ট মার, রাইফেলের কুঁদোর বাড়ি এবং অন্যান্য অকথ্য অত্যাচার কর্নেল নিকলসনের মর্যাদাসম্পন্ন চালচলনের কাছে ব্যর্থ হয়ে যায়। বন্দী হওয়া সত্ত্বেও কমান্ডিং অফিসারের এই ধরনের চালচলন মাঝে মাঝে ভীষণ রাগিয়ে তোলে মেজর ক্লিপটনকে। তখন সম্পূর্ণ ব্যাপারটা তিনি গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে বসেন।
কর্নেল নিকলসনের কর্তব্যপরায়ণতা, আচারপরায়ণতা, শৃঙ্খলা বজায় রাখার বদ্ধ-সংস্কারকে এককথায় বলা যায়–উন্নাসিকতা। সামরিক উন্নাসিকতার তার চেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত আর নেই।
ক্লিপটন বরাবরই বাস্তববাদী মানুষ। যে-কোনও সমস্যাকে সম্ভাব্য সবরকম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ক্ষমতা তার আছে। আর তাই সবদিক বিচার করার পর ধীরে ধীরে তার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। এরকম আচরণকে যদি উন্নাসিকতা বলা হয়, তা হলে মানুষের অনেক বড় বড় অনুভূতিও উন্নাসিকতার অন্তর্ভুক্ত। সত্যি বলতে কি, মায়ের অপত্যস্নেহ তা হলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্নাসিকতা।
আগে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে কর্নেল নিকলসনের শৃঙ্খলার প্রতি শ্ৰদ্ধার কথা লোকের মুখে মুখে ফিরত প্রবাদের মত। ১৯৪২ সালে মালয় আক্রান্ত হবার পর সেই শৃঙ্খলাপরায়ণতার প্রকাশ আবার দেখা গেল সিঙ্গাপুরে।–হেডকোয়ার্টারস থেকে যুদ্ধবিরতির নির্দেশ আসার পর তরুণ কিছু অফিসার ঠিক করল, উপকূলের দিকে গিয়ে একটা বোট দখল করে তারা পালিয়ে যাবে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে। তাদের উদ্দীপনা আর সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করলেন কর্নেল নিকলসন, কিন্তু তাদের কাজে বাধা দেয়ার কোনও চেষ্টাই বাদ দিলেন না।
প্রথমে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, তাঁর প্রতি যে নির্দেশ এসেছে, ব্যাপারটা হবে তার সরাসরি লন। যেহেতু কমান্ডার-ইন-চীফ পুরো মালয়েই আত্মসমর্পণ করেছেন, এখান থেকে যে-কোনও সৈন্যের পালিয়ে যাওয়াটা অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে। সুতরাং এখন যে যেমন আছে তেমনি থেকে জাপানী কোনও সিনিয়র অফিসারের কাছে আত্মসমর্পণ করাটাই হবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত।
অফিসারই যদি কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়, বললেন তিনি, তা হলে সাধারণ সৈন্যরা আর কী শিখবে!
যুক্তি দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলেন কর্নেল নিকলসন, সঙ্কটকালে যে কৌশল তিনি সবসময়ই ব্যবহার করেন। তাঁর দিকে একবার তাকালে পরিষ্কার বোঝা যায়, মানুষটিকে কখনও বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়নি। ভারত মহাসাগরের মত তার শান্ত একজোড়া চোখ, লালচে গোঁফ আর টকটকে চেহারা দেখলেই ক্লিপটনের মনে পড়ে যায় কিংবদন্তির কথা। কিন্তু ইদানীং প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও কর্নেলের অতি শৃঙ্খলা দেখে বুঝতে পারছেন না, তার উপর রাগ করা উচিত, নাকি শ্রদ্ধা।
তরুণ অফিসারদের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছেন ক্লিপটন। বিরক্ত হয়ে কর্নেল বলেছেন, তিনি ভাবতেও পারেন না, মাঝবয়েসী একজন অফিসার কী করে মাথাগরম ছেলেদের এরকম দায়িত্বহীন কাজে উৎসাহ জোগাতে পারে!
এরপর নিজের মনোভাব ব্যাখ্যা করে রীতিমত আদেশ জারি করেছেন কর্নেল। অফিসার, নন-কমিশন্ড-অফিসার, সাধারণ সৈন্য এরা সবাই জাপানীদের কাছে আত্মসমর্পণ করার আগ পর্যন্ত এখন যেমন আছে তেমনি থাকবে। ব্যাটালিয়নের যাবতীয় দায়দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিতে চান।
বেশির ভাগ অফিসারই তার আদেশ মেনে নিল। এর পরেও সামান্য যে কজন অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের মাঝে, তাদের ব্যবহারে মর্মাহত হলেন কর্নেল নিকলসন। এবং পরে ওই কজনকে তিনি টুকে রাখলেন পলাতক হিসেবে।
এবারে আত্মসমর্পণটা কীভাবে করবেন তার একটা প্রস্তুতি নিতে লাগলেন কর্নেল। অনেক ভেবেচিন্তে শেষমেশ ঠিক করলেন, আত্মসমর্পণের চিহ্নস্বরূপ রিভলভারটা তিনি দিয়ে দেবেন শত্রুপক্ষের কর্নেলকে। সহজ ভঙ্গিতে হোলস্টারসুদ্ধ রিভলভারটা বাড়িয়ে দেবেন কীভাবে, সেটাও ঠিক করলেন মহড়া দিয়ে দিয়ে। সবচেয়ে ভাল ইউনিফর্মটা পরলেন তিনি। লক্ষ রাখলেন, অন্য সবাই যেন যথাসম্ভব পরিপাটি থাকে। এরপর সৈন্যদের তিনি শেখালেন, কিভাবে স্তূপীকৃত করে রাখতে হবে অস্ত্রশস্ত্রগুলো।
সর্বপ্রথম শত্রুপক্ষের যে সৈন্যরা এল, তারা জাপানী ছাড়া অন্য কোনও ভাষাই জানে না। পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলেন কর্নেল নিকলসন। কিছুক্ষণ পর ট্রাকে করে এল এক নন-কমিশন্ড-অফিসার। অস্ত্রশস্ত্র ট্রাকে নিয়ে গিয়ে রাখার জন্যে সে ইশারা করল ব্রিটিশদের। সবাইকে চুপচাপ থাকতে বলে একজন সিনিয়র অফিসারের সাথে দেখা করতে চাইলেন কর্নেল। সিনিয়র বা জুনিয়র কোনও অফিসারই ছিল না জাপানীদের সাথে। উপরন্তু কথা বুঝতে না পেরে রেগে আগুন হয়ে গেল তারা। নন-কমিশন্ড অফিসারটি দাঁতমুখ খিচিয়ে আঙুল নির্দেশ করল ব্রিটিশদের রাইফেলগুলোর দিকে। কর্নেল আদেশ দিলেন যেন একজন সৈন্যও না নড়ে। এবারে সাবমেশিনগান তাক করল জাপানীরা, ধাক্কা দিল কর্নেলকে। নিজেকে সামলে আবার একই অনুরোধ জানালেন কর্নেল নিকলসন। মুখ শুকিয়ে গেল ব্রিটিশ সৈন্যদের। পরিস্থিতিটা ঘাবড়ে দিল ক্লিপটনকে, কর্নেল কি স্রেফ নিজের নীতির প্রতি অবিচল থাকার খাতিরে সবার মৃত্যু ডেকে আনতে চান! হঠাৎ বেশ কজন জাপানী অফিসারকে নিয়ে একটা কার এসে পৌঁছল। একজনের কাঁধে মেজরের ব্যাজ দেখে কর্নেল নিকলসন সিদ্ধান্ত নিলেন যে তার কাছেই আত্মসমর্পণ করবেন। নিজের সৈন্যদের অ্যাটেনশন হতে বলে স্যালুট করলেন তিনি, তারপর চোখের পলকে বেল্ট থেকে হোলস্টার খুলে বাড়িয়ে দিলেন সামনে।
চমকে উঠে প্রথমে এক ধাপ পিছু হটল মেজর, বিব্রত বোধ করল ভীষণভাবে, তারপর ফেটে পড়ল হিংস্র অট্টহাসিতে। দেখাদেখি হসিতে যোগ দিল অন্য অফিসারেরাও। কাঁধ ঝাঁকিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন কর্নেল নিকলসন, কয়েক মুহূর্ত পরেই সৈন্যদের আদেশ দিলেন অস্ত্রগুলো ট্রাকে নিয়ে গিয়ে জমা করতে।
সিঙ্গাপুরের বন্দী শিবিরে থাকার সময়েই কর্নেল নিকলসন সারাক্ষণ লক্ষ রাখতেন, সৈন্যদের ব্যবহারে যেন এতটুকু বিচ্যুতি না ঘটে। এবং ক্লিপটন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেননি, এই ধরনের মানুষকে কী দেয়া উচিত–প্রশংসা নাকি অভিশাপ।
মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক থেকে গরুর মাংসের দুএকটা টিন সগ্রহ করে আনত সৈন্যেরা। কর্নেল নিকলসন পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে এসব বন্ধ করতে হবে। কারণ, মর্যাদা হানিকর কোনও কাজ ব্রিটিশ সৈন্যদের মানায় না। শুধু আদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না কর্নেল, আদেশ পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্যে পরিদর্শন করতে লাগলেন নিয়মিত।
জাপানীরা এখনও নির্দিষ্ট কোনও কাজ করতে দেয়নি। শঙ্কিত হয়ে কর্নেল নিকলসন একদিন ভাবলেন, এভাবে বসে থাকলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়বে। সুতরাং কিংস রেগুলেশন ব্যাখ্যা করে বোঝাতে লাগলেন তাদের। আর সেই রেগুলেশন মোতাবেক যারা সবচেয়ে ভাল কাজ দেখাতে পারল, পুরস্কার হিসেবে তাদের মধ্যে বিতরণ করতে লাগলেন যহস্ত স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট। কর্নেল বোঝালেন, বন্দী শিবিরে থাকলেও নিখুঁতভাবে স্যালুট করাটা খুবই জরুরী। মহা মুশকিলে পড়ে গেল সাধারণ সৈন্যরা। এমনিতেই জাপানী যেকোনও সৈন্যকে স্যালুট করতে হয় তাদের, এখন আবার তার সাথে যোগ হলো ব্রিটিশ অফিসারদের স্যালুট করা। শুধু তা-ই নয়, জাপানী সৈন্যদের লাথি-চড়ঘুসির পাশাপাশি নিখুঁতভাবে স্যালুট করতে না পারার অপরাধে কপালে জুটতে লাগল কর্নেল নিকলসনের দেয়া শাস্তি।
শৃঙ্খলার এই বাড়াবাড়ি অবশ্য মুখ বুজেই মেনে নিল সৈন্যেরা। কারণ, কর্নেলকে তারা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। দৃঢ়তা, অসীম সাহসের পাশাপাশি শত্রুপক্ষের যে-কোনও ধরনের মার নিঃশব্দে হজম করার ক্ষমতা তাদের সে-শ্রদ্ধা আরও বাড়িয়ে তুলল। অবশ্য জাপানী সৈন্যদেরকেও কর্নেল ছেড়ে কথা কইলেন না। আন্তর্জাতিক ব্যবহারবিধি লঙ্ঘন করার সাথে সাথে তাদের মুখের সামনে দোলাতে লাগলেন হেগ কনভেনশন অনুসারে তৈরি ম্যানুয়াল অভ মিলিটারি ল। আর এইজন্যেই একদিন বিশ্রীভাবে মার খেলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর এক জাপানী প্রহরীর হাতে।
আসল ব্যাপার হলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে সৈন্যদের সাথে বোধ হয় একটু নরম ব্যবহার করা উচিত–ক্লিপটনের এই পরামর্শের জবাবে বললেন কর্নেল, আসল ব্যাপার হলো, আমি চাই যে ছেলেরা মনে করুক, এখনও তারা আমাদের নির্দেশেই চলছে, ওই বেবুনগুলোর নির্দেশে নয়। যতদিন ওরা এই ধারণাটা আঁকড়ে রাখতে পারবে, ততদিন তারা সৈন্যই থাকবে, ক্রীতদাসে পরিণত হবে না।
ক্লিপটন অনুভব করেছিলেন, এ ব্যাপারে কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু এখন বুঝতে পারলেন, সৈন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে কর্নেলের সদ্গুণাবলীই যথেষ্ট।
০২.
বন্দীরা এখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিঙ্গাপুরের সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে। থাইল্যান্ডের এই দুর্গম অঞ্চলের চেয়ে ওখানকার জীবন ছিল হাজার গুণে ভাল। মালয়ের মাঝখান দিয়ে প্রায় অন্তহীন এক ট্রেন যাত্রা শেষে দীর্ঘ পদযাত্রার পর তারা এসে পৌঁছেছে এখানে। বাতাসে গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে যে এখানে তাদের আনা হয়েছে একটা রেললাইন তৈরি করতে। এই গুজব তাদের পরিশ্রান্ত মনকে আরও ক্লান্ত করেছে।
কর্নেল নিকলসনের ইউনিট এখানে এসেছে অন্যদের চেয়ে একটু দেরিতে। আর এসেই টের পেয়েছে, সিঙ্গাপুরের তুলনায় এখানকার জাপানী প্রহরীরা কত বেশি নিষ্ঠুর। ওখানকার জাপানীরা ছিল সদ্য বিজয়ের আনন্দে ভরপুর, ওরা নিষ্ঠুর হত মাঝেসাঝে। কিন্তু এরা নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে মুহূর্তের মধ্যে। এবং নিয়মিত ভাবে।
ব্যাটালিয়নের সবাইকে প্রথমে নিয়ে আসা হয় বিরাট একটা রিসেপশন সেন্টারে। মাত্র দুদিন ওরা থাকে সেখানে, কিন্তু ওই স্বল্প সময়েই বুঝতে পারে, কেমন কাটবে এখানকার দিনগুলো। প্রত্যেকটা সৈন্যকে খাটানো হলো ভারবাহী পশুর মত। যে কাজ তাদের দেয়া হলো, সেটা হয়তো স্বাভাবিক ভাল স্বাস্থ্যের একজন মানুষের পক্ষে অসম্ভব নয়, কিন্তু গত একমাসে সৈন্যদের যে অবস্থা হয়েছে তাতে কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা, এমনকি মাঝরাত হয়ে গেল। তার ওপর আবার সামান্য ভুল চোখে পড়ার সাথে সাথে চলল অকথ্য গালাগাল আর যথেচ্ছ মার। টু শব্দও করল না সৈন্যরা, বরং আতঙ্কিত হয়ে রইল আরও ভয়ঙ্কর শাস্তির আশঙ্কায়। তাদের শারীরিক অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলেন ক্লিপটন। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে ম্যালেরিয়া, আমাশয় আর বেরিবেরি। ক্যাম্পের মেডিক্যাল অফিসার জানালেন, মহামারী শুরু হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়, কিন্তু তার কাছে কোনও প্রতিষেধক নেই। সগ্রহ যে করা যাবে, সে-সম্ভাবনাও সুদূরপরাহত।
ভ্রুকুটি ছাড়া এখন আর কিছুই করেন না কর্নেল নিকলসন। তিনি তো এই ক্যাম্পের দায়িত্বে নেই! জাপানীদের নির্দেশে ব্রিটিশ একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্যাম্পটা চালাচ্ছেন। কর্নেল শুধু একদিন জানতে চাইলেন, মেজর পদের নিচের সবাইকে মজুরের মত খাটানোটা কি ঠিক হচ্ছে? মাথা ঝুলে পড়ল লেফটেন্যান্ট কর্নেলের। শেষমেশ বললেন, ব্যাপারটা বন্ধ করার চেষ্টা তিনি করেছেন, কিন্তু শাস্তির ভয়ে তাকে বিরত থাকতে হয়েছে। মাথা ঝাঁকালেন কর্নেল নিকলসন, কিন্তু, ব্যাখ্যাটায় সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে মনে হলো না।
এরই মধ্যে একদিন এসে উপস্থিত হলেন জেনারেল ইয়ামাসিতা, কোমরে তরোয়াল, হাতে ফিকে-ধূসর দস্তানা। ব্রিটিশ সৈন্যদের তৈরি প্ল্যাটফর্মে উঠে তিনি জানালেন, এখন থেকে মহামান্য সম্রাটের ইচ্ছে অনুসারে সবাইকে তার নির্দেশ মেনে চলতে হবে। এরপর জেনারেল জানালেন, তাদের কাছ থেকে তিনি কি আশা করেন।
বক্তৃতা চলল দুঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। বন্দীদের জাতীয় গর্বকে এমনভাবে খাটো করা হলো, প্রহরীদের গালি বা বুটের লাথির চেয়ে সেটা কোনও অংশে কম বেদনাদায়ক নয়। তিনি বললেন, ব্রিটিশ বন্দীদের সাথে জাপানীদের কোনও বিরোধ নেই। কারণ, তাদের ভরাডুবি ঘটেছে সরকারের মিথ্যাচারের জন্যে। সুতরাং তারা যতদিন ভদ্রলোক হয়ে থাকবে, ততদিন ভদ্র ব্যবহার করা হবে তাদের সাথেও। মহামান্য ম্রাট যে তাদের বাঁচার একটা সুযোগ করে দিয়েছেন, সেজন্য তাদের উচিত সম্রাটের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং আপ্রাণ পরিশ্রম করা। তা ছাড়া যে কাজটা তাদের দেয়া হচ্ছে, সেটা সর্বসাধারণের উপকারের জন্যে। তাদের তৈরি করতে হবে একটা রেললাইন। এরপর জেনারেল ইয়ামাসিতা জানালেন, চুল পরিমাণ শৃঙ্খলা ভঙ্গ কিংবা অবাধ্যতা তিনি বরদাস্ত করবেন না। আলস্য বা কর্তব্যে অবহেলা অপরাধ বলে গণ্য হবে। আর পালাবার কোনওরকম চেষ্টা করলে তার একটাই শাস্তি–মৃত্যুদণ্ড। প্রতিটি সৈন্যের ব্যবহার এবং দক্ষতার জন্যে ব্রিটিশ অফিসারেরা জাপানীদের কাছে দায়ী থাকবেন।
অসুখ-বিসুখের কারণে কাউকে অব্যাহতি দেয়া হবে না, বললেন জেনারেল ইয়ামাসিতা। শারীরিকভাবে সমর্থ থাকার জন্যে পরিমিত কাজের কোনও বিকল্প নেই। আর মহামান্য সম্রাটের জন্যে যারা প্রতিদিন জীবন দিয়ে খাটবে, আমাশয় তাদের আক্রমণ করার আগে দুবার ভাববে।
সবশেষে যে-কথাগুলো বললেন জেনারেল, তা শুনে মাথায় যেন আগুন ধরে গেল প্রতিটি বন্দীর।
নিজের কাজ নিয়ে সুখে থাকো, বললেন তিনি, এটাই আমার আদর্শ। এই মুহূর্ত থেকে এটা তোমাদেরও আদর্শ করে নাও। যারা এই আদর্শ মেনে চলবে,আমার বা জাপানী গ্র্যান্ড আর্মির কোনও অফিসারের তরফ থেকে তাদের বিন্দুমাত্র ভয় নেই।
বক্তৃতাশেষে ইউনিটগুলো ভাগ ভাগ করে পাঠিয়ে দেয়া হলো নিজের নিজের সেক্টরে নিজের ইউনিট নিয়ে কর্নেল নিকলসন চলে এলেন বার্মা সীমান্তের কয়েকমাইল দূরবর্তী কওয়াই নদীর ক্যাম্পে। এখানকার কমান্ড্যান্ট হলেন কর্নেল সাইতো।
০৩.
কওয়াই নদীর ক্যাম্পে প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই ঘটে গেল বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনা।
কর্নেল সাইতো বললেন, সাধারণ সৈন্যদের পাশাপাশি অফিসারদেরও খাটতে হবে। সাথে সাথে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন কর্নেল নিকলসন। বললেন, মজুরদের মত খাটা নয়, সৈন্যদের আদেশ করতেই ব্রিটিশ অফিসারেরা অভ্যন্ত।
মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলেন সাইতো–লক্ষণটা ভাল মনে হলো কর্নেলের–সবশেষে বললেন যে ব্যাপারটা তিনি ভেবে দেখবেন। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর কর্নেল নিকলসন ফিরে এলেন তার বাঁশের কুটিরে। এখানে ক্লিপটনও থাকেন আর দুজন অফিসারের সাথে। সাইতোকে যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন, তার মোটামুটি একটা বর্ণনা দিলেন তিনি এই তিনজনের সামনে। তার মতে প্রত্যেকটা যুক্তিই নিখুঁত, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ যুক্তিটা হলো: মজুরদের মত কাজ করায় অফিসারেরা দক্ষ নয়, ফলে তারা যেটুকু কাজ করবে, তা একেবারেই তুচ্ছ। কিন্তু তারা যদি সাধারণ সৈন্যদের তদারকি করে, বাড়তি কাজ পাওয়া যাবে অনেকখানি। সুতরাং পুরো কাজটা ভালভাবে করার স্বার্থে অফিসারদের অব্যাহতি দেয়াটাই হবে জাপানীদের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ।
কথাগুলো ঠিক বলেছি, নাকি ভুল? কর্নেল জানতে চাইলেন মেজর হিউজেসের কাছে। তুমি তো শিল্পপতি। তুমি কি মনে করো দায়িত্ববান এক্সিকিউটিভ ছাড়া এরকম কাজে সাফল্য সম্ভব?
বর্তমানে অফিসার বলতে ক্লিপটন ছাড়া এই দুজনেই সম্বল। সিঙ্গাপুরে আসার পর থেকে কর্নেল এঁদের সবসময় কাছে কাছেই রাখেন। কারণ, যেকোনও বিষয় ব্যাখ্যা করে এদের সাথে খোলাখুলি আলোচনায় বসতে তিনি আগ্রহী। দুজনের কেউই রেগুলার অফিসার নন। মেজর হিউজেস মালয়ের একটা মাইনিং কোম্পানির ডিরেক্টর ছিলেন। ব্যাটালিয়নে যোগ দেয়ার পরপরই কর্নেল টের পেয়েছিলেন, এই লোকটির প্রশাসনিক সামর্থ্যের তুলনা হয় না। ক্যাপ্টেন রীভস প্রথমে ভারতে গিয়েছিলেন পাবলিক ওয়ার্কস এঞ্জিনিয়ার হয়ে। পরে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন স্যাপার হিসেবে। যুদ্ধের সময় নিজের ইউনিট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে রীভসকে তুলে নিয়ে কর্নেল অন্তর্ভুক্ত করেন তাঁর উপদেষ্টা পরিষদে। সামরিক বেশির ভাগ অফিসারের মত কর্নেল নিকলসন মাথামোটা নন। তিনি জানেন, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়াতে দোষেরক ইছু নেই। টেকনিশ্যান আর এক্সিকিউটিভদের প্রতি শ্রদ্ধাও আছে তার।
আমার মনে হয় আপনি ঠিকই বলেছেন, স্যার, জবাব দিলেন মেজর হিউজেস।
আমারও তাই মনে হয়, বললেন ক্যাপ্টেন রীভূস্। রেললাইন আর সেতু তৈরির বেলায় কাঁচা কাজ চলে না।
আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে এ-ব্যাপারে তুমি একজন বিশেষজ্ঞ, বললেন কর্নেল নিকলসন। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, কেন আমি আশাবাদী।
হ্যাঁ, সামান্য হলেও বোকাটার মাথায় যুক্তি ঢোকাতে পেরেছি।
তারপরেও যদি না বোঝে, কমান্ডিং অফিসারের চোখে চোখে তাকালেন ক্লিপটন, ম্যানুয়াল অভ মিলিটারি ল তো আছেই।
হ্যাঁ, সায় দিলেন কর্নেল নিকলসন। প্রয়োজন পড়লে ওটা দেখাতে হবে।
ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে কথা বলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে ক্লিপটনের। কর্নেলের চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হবে বলে তার মনে হয় না। রিসেপশন সেন্টারে থাকতেই সাইতো সম্বন্ধে অনেক কথা কানে এসেছে তার। স্বাভাবিক অবস্থায় লোকটা নাকি কখনও কখনও যুক্তিতর্ক মানে, কিন্তু মদ পেটে পড়লেই রূপান্তরিত হয় জানোয়ারে।
কর্নেলকে দেয়া কথামত ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসলেন সাইতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্দেহ দেখা দিল মনে, তাই মাথাটা পরিষ্কার করার জন্যে টেনে নিলেন মদের বোতল। ধীরে ধীরে মনে এই বিশ্বাস জন্মাল যে, যুক্তি দেখিয়ে কর্নেল তার। চরম সম্মানহানি করেছেন। তাঁর আদেশের পর কর্নেলের মুখ খোলাই উচিত হয়নি। রাগে অস্থির হয়ে উঠলেন কর্নেল সাইতো।
শেষমেশ ঠিক করলেন, একটা বক্তৃতা দেবেন সবার উদ্দেশে। একটু ক্ষমতা জাহির না করলে শয়তানগুলোকে সোজা করা যাবে না। বক্তৃতার প্রথম কয়েকটা শব্দ শুনেই বুঝতে কারও অসুবিধে হলো না যে অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়।
ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি…
এই বাক্যটি দিয়েই শুরু হলো তাঁর বক্তৃতা। এবং কিছুক্ষণ পরপরই বাক্যটি তিনি ব্যবহার করতে লাগলেন যতিচিহ্নের মত। বৃটেনের দখলকৃত কোনও এক রাজ্যে একসময় সামরিক অ্যাটাশে ছিলেন বলে তার ইংরেজি বেশ স্বাচ্ছন্দ। চাকুরিটা যায় অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্যে। তারপর বহাল হন বর্তমান পদে। এখান থেকে পদোন্নতির আর কোনরকম সম্ভাবনা নেই।
ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি, বললেন কর্নেল সাইতো। এখানে তোমাদের আনা হয়েছে আমার অধীনে একটা কাজ করার জন্যে। এই কাজ জাপানী গ্র্যান্ড আর্মির বিজয়ের পেছনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। আমি প্রথম ও শেষবারের মত তোমাদের সবাইকে বলে দিতে চাই যে আমার আদেশের ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন ভোলা একদম বরদাস্ত করা হবে না। ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি। কেউ দ্বিমত পোষণ করলে তার শাস্তি হবে ভয়ঙ্কর। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কেউ মনে মনে বাধাদানের চিন্তা করে থাকলে শুধু এ-কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে তোমাদের জীবন মৃত্যুর সর্বময় ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়েছে। আর প্রয়োজনে সে-ক্ষমতা ব্যবহার করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না। মহামান্য সম্রাট আমাকে যে-কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন, সে-কাজ আমি শেষ করব যে-কোনও মূল্যে। ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি। কয়েকজন বন্দীর বাঁচা বা মরায় আমার চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপবে না। তোমাদের সবার মৃত্যু জাপানী গ্র্যান্ড আর্মির একজন সিনিয়র অফিসারের কাছে নেহাতই তুচ্ছ।
জেনারেল ইয়ামাসিতার মতই তাঁর হাতে ফিকেধূসর একজোড়া দস্তানা, তরোয়াল ঝুলছে কোমর থেকে। দিনে সাধারণত তিনি পায়ে দেন ক্যানভাসের জতো, কিন্তু এখন তার পরিবর্তে শোভা পাচ্ছে চকচকে রাইডিং-বুট।
কথাগুলো চুপচাপ শুনতে লাগলেন ব্রিটিশ অফিসারেরা। নিজের অজান্তেই হাত দুটো কখনও কখনও মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠলেও মুখভাব রইল পুরোপুরি শান্ত। প্রতিকূল অবস্থাতেও এরকম থাকার কৌশলটা তারা শিখেছেন কর্নেল নিকলসনের কাছে।
হঠাই একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন কর্নেল সাইতো। হাবভাবে মনে হলো, এখন যে কথাগুলো বলবেন তাতে অন্তত সুস্থতার কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে।
এখন শোনো সবাই। ব্রিটিশ বন্দীদের কাছ থেকে মহামান্য সম্রাট কি কাজ আশা করেন, সেটা এতদিনে নিশ্চয় তোমাদের কানে এসেছে। থাইল্যান্ডের রাজধানীর সাথে বার্মার রাজধানীর একটা যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে আমাদের, যাতে জাপানী কনভয়গুলো এ-পথে স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে। এই রেলপথ ধরেই জাপানী সেনারা যাবে ভারতে, যাতে দ্রুত অবসান ঘটে যুদ্ধের। সুতরাং কাজটা আমাদের শেষও করতে হবে দ্রুত, ছমাসের মধ্যে। মহামান্য সম্রাটের এটাই আদেশ। অবশ্য এর সঙ্গে তোমাদের স্বার্থও জড়িত রয়েছে। যুদ্ধ শেষ হলে আমাদের সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তোমরা দেশে ফিরে যেতে পারবে।
আরও শান্ত হয়ে গেলেন কর্নেল সাইতো, যেন অ্যালকোহলের শেষ বিন্দুটুকুও রক্ত থেকে উবে গেছে।
এবার নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে হচ্ছে তোমাদের নির্দিষ্ট কাজ কোনটা। সেটা বলতেই আজ আমার এখানে আসা। ছোট্ট একটা রেলপথ তৈরি করতে হবে তোমাদের, যেটা গিয়ে যুক্ত হবে আরেকটা সেকশনের সাথে। কি তোমাদের মূল কাজ হলো কওয়াই নদীর ওপর একটা সেতু নির্মাণ করা। শুনে গর্ববোধ করতে পারো, পুরো পরিকল্পনার মধ্যে এই কাজটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বলা বাহুল্য, কাজটা হবে বিশেষজ্ঞ একজন জাপানী এঞ্জিনিয়ারের নির্দেশনায়। শৃঙ্খলার খাতিরে তোমরা সবাই থাকবে আমার এবং আমার অধস্তনদের অধীনে। ফলে প্রশাসনে কোনও ঘাটতি পড়বে না। আর সেজন্যেই ব্রিটিশ অফিসারদের আমি আদেশ দিয়েছি সাধারণ সৈন্যের পাশাপাশি কাজ করতে। আমি কাউকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না। যে আদেশ দিলাম, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে সবাইকে। নইলে…
মুহূর্তে আবার স্বরূপে ফিরে গেলেন কর্নেল সাইতো, হাত-পা ছুঁড়তে লাগলেন উন্মাদের মত।
নইলে আমাকে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি। অলসদের খাবার দেয়ার চেয়ে আমি বরং গুলি করে মারব। যদি প্রয়োজন হয়, সেতু তৈরি করব বন্দীদের মৃতদেহের ওপর। ব্রিটিশদের আমি ঘৃণা করি। কাজ শুরু হবে আগামীকাল ভোরে। বাশির শব্দ কানে যাবার সাথে সাথে সবাই হাজির হবে এখানে। অফিসারদের খাটতে হবে সাধারণ সৈন্যের মতই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে যথাসময়ে আর প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবেন জাপানী এঞ্জিনিয়ার। আমার আর কিছু বলার নেই। তবে সবশেষে মনে করিয়ে দিতে চাই জেনারেল ইয়ামাসিতার বাণী: নিজের কাজ নিয়ে সুখে থাকো। কথাটা সব সময় মনে রাখবে।
সাইতো ফিরে গেলেন হেডকোয়ার্টারসে। বন্দীরা ফিরে চলল নিজ নিজ লাইনের দিকে, মাথায় বাজছে সেই অসংলগ্ন বক্তৃতা।
আপনার যুক্তিগুলো বোধহয় ওর মাথায় ঢোকেনি, স্যার। সুতরাং ম্যানুয়াল অভ মিলিটারি ল দেখাতেই হচ্ছে, ক্লিপটন বললেন কর্নেল নিকলসনের উদ্দেশে।
তুমি ঠিকই বলেছ, ক্লিপটন, জবাব দিলেন গম্ভীর কর্নেল, অবস্থা খুব একটা সুবিধের মনে হচ্ছে না।
০৪.
অবস্থা যে সুবিধের নয়, সেটা ক্লিপটন দেখতে পেলেন পরদিনই। তবে যা ভেবেছিলেন, অবস্থা হলো তার চেয়ে অনেক মারাত্মক। মেডিক্যাল অফিসার বলে একমাত্র তাকেই যেতে হয়নি ইউনিটের সাথে। কিন্তু তথাকথিত হাসপাতালের বাঁশের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ঘটনাটা দেখে তার আতঙ্ক আরও বাড়ল।
অন্ধকার পুরোপুরি কাটার আগেই ঘুম ভাঙল বাশির শব্দ আর প্রহরীদের চেঁচামেচিতে। ইতোমধ্যেই অফিসার আর সৈন্যরা গিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে যথাস্থানে। নির্দেশ যা দেয়ার আগেই দিয়ে রেখেছেন কর্নেল নিকলসন।
মর্যাদা বজায় রেখে আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করব ওদের সাথে, বলেছেন তিনি।
ঠাণ্ডা, স্যাতসেঁতে আবহাওয়ায় দাঁড়িয়ে রইল সবাই। সূর্য ওঠার পর জুনিয়র অফিসার পরিবেষ্টিত হয়ে এঞ্জিনিয়ারের ঠিক আগে আগে হেঁটে আসতে দেখা গেল কর্নেল সাইতোকে। মেজাজ মোটেই ভাল মনে হলো না, কিন্তু কমান্ডিং অফিসারের পেছনে ব্রিটিশ অফিসারদের চোখে পড়তেই আকৰ্ণবিস্তৃত একটা হাসি দিলেন তিনি।
তাঁদের পেছনে পেছনে এসে পৌঁছুল যন্ত্রপাতি বোঝাই একটা ট্রাক। এঞ্জিনিয়ার সেগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন, হঠাৎ কর্নেল নিকলসন এক ধাপ এগিয়ে কথা বলতে চাইলেন সাইটের সাথে। কিছু বললেন না সাইতো, কিন্তু মেঘ জমল মুখে। মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে আরও এগিয়ে গেলেন কর্নেল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই তাঁকে ছোট্ট একটা বই দোলাতে দেখা গেল সাইতোর মুখের সামনে–নিশ্চয়ই ম্যানুয়াল অভ মিলিটারি ল-এর বিশেষ কোনও প্যারাগ্রাফের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চাইছেন। হতচকিত হয়ে পড়লেন সাইতো। গতকালের বক্তৃতার পরেও কেউ তাকে কোনও যুক্তি দেখাতে চাইবে, ব্যাপারটা যেন কল্পনাও করতে পারছেন না। রেগে আগুন হয়ে গেলেন তিনি। কর্নেল নিকলসন কিন্তু এসবের কিছুই টের পেলেন না। প্রত্যেক লাইনে আঙুল দিয়ে দিয়ে তিনি তখন বইটা পড়ছেন মাথা নিচু করে। চিৎকার করে কমান্ডিং অফিসারকে সাবধান করে দিতে চাইলেন ক্লিপটন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। থাবড়া দিয়ে বইটা উড়িয়ে দিলেন সাইতো, পরমুহূর্তেই চড় কষালেন কর্নেলের গালে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলেন সাইতো, চোখদুটো যেন যে-কোনও মুহূর্তে বেরিয়ে পড়বে কোর্টর ছেড়ে, সেইসাথে ইংরেজি আর জাপানী মেশানো অকথ্য গালি ছুটেছে ঝড়ের বেগে।
বিস্মিত হওয়া সত্ত্বেও–যেহেতু এরকম আচরণ আশা করেননি–মাথা ঠাণ্ডা রাখলেন কর্নেল নিকলসন। কাদা থেকে বইটা তুলে নিয়ে খুব শান্ত স্বরে তিনি ঘোষণা করলেন:
জাপানী কর্তৃপক্ষ যখন সভ্য পৃথিবীর কোনও আইন মেনে চলতে চায় না, সেক্ষেত্রে আপনাকে শুধু একটা কথাই জানাবার আছে, কর্নেল সাইতো, যে আপনার কথা মান্য করা আর আমাদের কর্তব্যের আওতায় পড়ে না। এবারে আমি ওদের কি আদেশ দিয়েছি, সেটা আপনাকে জানানো উচিত। ব্রিটিশ কোনও অফিসার মজুরের মত পরিশ্রম করবে না।
একটা কথাও না বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সাইতো, উন্মাদের মত ঘুসি চালাতে লাগলেন কর্নেলের মুখে।
পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। লাইন থেকে বেরিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলেন কজন ব্রিটিশ অফিসার। ক্রোধের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল পুরো ইউনিটে। চিক্কার করে নির্দেশ দিল জাপানী নন-কমিশনড়-অফিসারেরা; তৎক্ষণাৎ রাইফেল কক করল সমস্ত সৈন্য। কর্নেল নিকলসন তার অফিসারদের বললেন যথাস্থানে গিয়ে দাঁড়াতে, সৈন্যদের আদেশ দিলেন একচুলও না নড়ার। মুখ বেয়ে রক্ত ঝরছে, কিন্তু তার কতত্ত্ব এতটুকু টোল পায়নি।
কয়েক ধাপ পিছিয়ে হাপাতে লাগলেন কর্নেল সাইতো, যেন রিভলভারটা এখনই টেনে বের করবেন হোলস্টার থেকে। শেষ মুহূর্তে কি যেন ভেবে তিনি সামলে নিলেন নিজেকে, আদেশ দিলেন অত শান্ত কণ্ঠে। সাথে সাথে জাপানী প্রহরীরা ঘিরে ধরল বন্দীদের, এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল নদীর দিকে। ব্রিটিশ অফিসারেরা শুধু দাঁড়িয়ে রইলেন কর্নেল সাইতোর সামনে।
একেবারে স্বাভাবিক ভাবে আবার কথা বলতে লাগলেন সাইতো। লক্ষণটা খুব ভাল মনে হলো না ক্লিপটনের। ধারণা যে ভুল নয়, তার প্রমাণও পেলেন প্রায় হাতেনাতে। কয়েকজন সৈন্য চলে গেল এবং ফিরল দুটো মেশিনগান নিয়ে। সাইলোর দুপাশে মেশিনগান দুটো বসাতেই হিম একটা স্রোত নেমে গেল ক্লিপটনের মেরুদণ্ড বেয়ে। ওদিকে শয্যা ছেড়ে এসে তার চারপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রোগীরা। কর্কশ চিৎকার করে উঠল তাদের একজন।
ডাক্তার, ওরা নিশ্চয়…না, না, তা কি করে হয়? অতো সাহস হবে না হলুদ বেবুনটার! কি বুড়ো যে গো ধরে আছে!
ক্লিপটনের ধারণা, সাহস ঠিকই পাবে হলুদ বেবুন। সিঙ্গাপুর পতনের পর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। যন্ত্রপাতি নিয়ে অফিসারদের কাজ শুরু করার আদেশ দিলেন সাইতো।
সে-আদেশ মান্য করতে আবার অস্বীকৃতি জানালেন কর্নেল নিকলসন। এবারে আরেকটা আদেশ দিলেন সাইতো। গুলির বেল্ট পরানো হলো মেশিনগানে।
ডাক্তার, হাঁপাতে লাগল ক্লিপটনের পাশে দাঁড়ানো সৈন্যটা, ডাক্তার, বুড়ো কিছুতেই গো ছাড়বে না। আমাদের এই মুহূর্তে কিছু একটা করা দরকার।
সৈন্যটার কথায় যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন ক্লিপটন। হা, কিছু একটা করা দরকার। বুড়োকে বলতে হবে যে স্রেফ নিজের নীতির প্রতি অবিচল থাকার খাতিরে তিনি ইউনিটের সবাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারেন না। অন্যান্য ক্যাম্পের সিনিয়র অফিসারেরা ইতোমধ্যেই পশু শক্তির কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছেন। সুতরাং ওই কাজ করলে কর্নেল নিকলসনের মর্যাদা ক্ষুন্ন হতে পারে না। ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলেন মেজর ক্লিপটন।
এক মিনিট, কর্নেল; আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি!
ভ্রুকুটি হানলেন কর্নেল নিকলসন।
আর কিছু বলার নেই, ক্লিপটন। যা করছি সে-সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ সচেতন।
স্কোয়াডের কাছে অবশ্য ক্লিপটন যেতে পারলেন না। দুজন প্রহরী জাপটে ধরল দুদিক থেকে। কিন্তু তাঁর হাত-পা ছোঁড়া দেখে অ্যাকশন নিতে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলেন কর্নেল সাইতো। দ্রুত ইংরেজিতে কথা বলে চললেন ক্লিপটন, যাতে জাপানীদের অন্য কেউ বুঝতে না পারে।
সাবধান, কর্নেল, পুরো ঘটনাটাই আমি দেখেছি; সেই সাথে হাসপাতালের চল্লিশজন রোগী। আপনি কোনও ভাবেই পার পাবেন না।
মরিয়া হয়ে হাতের শেষ তাসটাই খেলে ফেললেন ক্লিপটন। এরকম অর্থহীন একটা হত্যাকাণ্ডের জাবাদিহি কর্নেল জাপানী কর্তৃপক্ষকেও দিতে পারবেন না। এখন বন্দীদের সাথে সমস্ত রোগী, এমনকি মেডিক্যাল অফিসারকেও মেরে ফেলতে হবে তার, নয়তো বাদ দিতে হবে প্রতিহিংসার চিন্তাটাই।
ক্লিপটন বুঝতে পারলেন, সাময়িক একটা বিজয় তার হয়েছে। রাগে কাঁপতে লাগলেন কর্নেল সাইতো, কিন্তু গুলি করার কোনও আদেশ দিলেন না।
আসলে কোনও আদেশই দিলেন না সাইতো। কারণ, সৈন্যদের চলে যেতে বললেও তার মর্যাদা হানি হবে। ফলে প্রায় দুপুর পর্যন্ত মেশিনগান নিয়ে বসে থাকতে হলো বেচারিদের।
ক্ষণস্থায়ী বিজয় অর্জন করেও খুশি হলেন ক্লিপটন। ভাগ্যে কি আছে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে, তবু আপাতত তো বন্ধ করা গেছে নশংস কাটা! অফিসারদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো বন্দী শিবিরের দিকে। সাইরে বিশালদেহী দুই কোরিয়ান দেহরক্ষী এক রকম হেঁচড়েই নিয়ে চলল কর্নেল নিকলসনকে। নিজের অফিসে বন্দীকে ঢুকিয়েই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন সাইতো। পরমুহূর্তেই প্রচণ্ড মারের শব্দে শিউরে উঠলেন ক্লিপটন।
০৫.
আধঘণ্টা পেটানোর পর কর্নেলকে বন্দী করা হলো বিছানা আর চেয়ারবিহীন একটা কুটিরে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও যখন আর রইল না, স্যাতসেঁতে মাটির ওপরেই শুয়ে পড়তে বাধ্য হলেন তিনি। খাবার বলতে তাকে দেয়া হলো মাত্রাতিরিক্ত লবণ দেয়া এক বাটি ভাত। সাইতো সাবধান করে দিনেল যে তার আদেশ মানতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত কর্নেলকে এখানেই আটকে রাখা হবে।
পুরো এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন শুধু গরিলার মত এক কোরিয়ান রক্ষীকে। শয়তানটা ভাতের সাথে আরও বেশি করে লবণ মেশায়। দাঁতে দাঁত চেপে কয়েক গ্রাস খেয়ে নেন তবু, তারপর গা এলিয়ে দেন মাটির ওপরে। কুটির ছেড়ে কোথাও যাবার অনুমতি নেই তার, ফলে নানারকম দুর্গন্ধে জায়গাটা পরিণত হয়েছে নরকে।
সপ্তাহ শেষে ক্লিপটনকে দেখা করতে দেয়া হয়। কিন্তু একটু আগে তাঁকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠান সাইতো।
এসবের জন্যে আমি মোটেই দায়ী নই, বললেন, তিনি ঠাণ্ডা গলায়। নদীর ওপরে সেতুটা আমাকে তৈরি করতেই হবে। ওকে বুঝিয়ে বলল যে হার মানার পাত্র আমি নই। ধন্যবাদ জানাবে ওকে, ওর অফিসারদেরও জানাচ্ছি ধন্যবাদ। এরপরেও যদি উনি সন্তুষ্ট না হন, ওঁর বোকামির জন্যে ভুগতে হবে সাধারণ সৈন্যদের। এখন পর্যন্ত তোমার কোনও কাজে আমি হস্তক্ষেপ করিনি। যারা সিক লিস্টে আছে, তাদের অব্যাহতি দিয়েছি কাজ থেকে। কিন্তু উনি যদি মনোভাব না বদলান, তা হলে ধরে নেব, আমার দয়াকে উনি বিবেচনা করেছেন দুর্বলতা হিসেবে।
এরপর ক্লিপটনকে নিয়ে যাওয়া হলো বন্দীর কাছে। গত কদিনে কমান্ডিং অফিসারের স্বাস্থ্যের যে অবনতি হয়েছে, তা দেখে রীতিমত আঁতকে উঠলেন তিনি। গলা এমন বসে গেছে যে তার কথা শোনা যায় কি যায় না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লিপটন বুঝতে পারলেন, পরিবর্তনটা শুধু বাইরে ঘটেছে। অন্তরের তেজ কর্নেলের এতটুকু কমেনি। যেসব যুক্তি তৈরি করে নিয়ে এসেছিলেন, সমস্ত তালগোল পাকিয়ে গেল। কর্নেল নিকলসন বললেন:
সবাইকে জানিয়ে দাও যে আমার মতে আমি অনডু আছি। কোনভাবেই ব্যাটালিয়নের একজন অফিসারকেও আমি মজুরের মত খাটতে দেব না।
কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন ক্লিপটন। আবার তিনি পড়ে গেছেন সেই পুরনো দোটানায়। বুঝে উঠতে পারছেন না, কী করবেন? মহাবীর হিসেবে পুজো করবেন লেকটিকে, নাকি মহামূখ হিসেবে বাতিল করে দেবেন?অধীর আগ্রহে তার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন সাইতো। দেখার সাথে সাথে চোখ নাচালেন:
কি খবর?
জবাব দেয়ার আগে কর্নেলের মানসিক অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করলেন ক্লিপটন। তারপর ভাবলেন, ব্যাপারটা খোলাখুলি বলাই ভাল।
কর্নেল নিকলসন আপনার আদেশ মেনে চলতে রাজি নন। আর তাকে যেভাবে রাখা হয়েছে, তাতে আদেশ মানার পরামর্শ দেয়ার কোনও ইচ্ছেও আমার হয়নি।
কর্নেল নিকলসনের মতই হেগ কনভেনশনের উদ্ধৃতিসহ প্রতিবাদ জানালেন ক্লিপটন। বললেন, বন্দীকে যেভাবে রাখা হয়েছে তা হত্যকাণ্ডের শামিল। এরপর বিষয়টা তিনি বোঝাতে লাগলেন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। যেমনটা ভেবেছিলেন ক্লিপটন, তেমন কোনও আচরণ করলেন না সাইতো। বরং বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, এসব কিছুর জন্যে কর্নেল নিকলসনই দায়ী। তারপর হঠাৎ করে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। ক্লিপটনের মনে হলো, সাইতো মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ নন। কিন্তু কাজগুলো তাকে করতে হচ্ছে ভয়ে। সিনিয়র অফিসারেরা চাপ দিচ্ছেন সেতু তৈরির জন্যে, ওদিকে জুনিয়র অফিসারদের পক্ষে দেখা দিয়েছে মর্যাদা হারানোর সম্ভাবনা।
পরের সপ্তাহে সাইতো গেলেন কর্নেলের সাথে দেখা করতে। ভাবে জানতে চাইলেন, তিনি স্বাভাবিক আচরণ করতে চান কিনা। কর্নেল বললেন, এ-বিষয়ে আলোচনার তার কিছু নেই। তৎক্ষণাৎ সংযম হারিয়ে সাইতো রূপান্তরিত হলেন জানোয়ারে। প্রচণ্ড মার লাগালেন বন্দীকে, প্রহরীটাও বাদ গেল না। উদ্যত রিভলভার হাতে পায়চারি শুরু করলেন সাইতো। বললেন, শৃঙ্খলা রক্ষার খাতিরে এটা ব্যবহার করবেন তিনি নির্দ্বিধায়।
নাক গলাতে গিয়ে কয়েকটা ঘুসি খেলেন ক্লিপটন। চলনশক্তিরহিত রোগী ছাড়া আর সবাইকে নিয়ে গিয়ে লাগিয়ে দেয়া হলো ভারবহনের কাজে। বেশ কয়েক দিন আবহাওয়া থমথমে হয়ে রইল কওয়াই নদীর ক্যাম্পে।
সাইতোর ব্যক্তিত্ব অনেকটা ডাক্তার জেকিল আর মি, হাইডের মত। এমনিতে তিনি মোটামুটি ডাক্তার জেকিলের মতই থাকেন, কিন্তু মাঝেমাঝে পেরে ওঠেন না মি. হাইডের সাথে। কয়েক দিন পর আবার তিনি ঢুকে পড়লেন ডাক্তার জেকিলের খোলসে। পূর্ণ রেশন বরাদ্দ করা হলো কর্নেল নিকলসনের নামে। চিকিৎসা করার অনুমতি পেলেন ক্লিপটন। শুধু তা-ই নয়, সাইতো তাকে সাবধান করে দিলেন যে রোগীর কিছু হলে তার পুরো দায়দায়িত্ব মেডিক্যাল অফিসারকে বহন করতে হবে।
এক সন্ধ্যায় বন্দীকে নিজের ঘরে ডেকে এনে প্রহরীদের বিদায় করে দিলেন কর্নেল সাইতো। ড্রয়ার থেকে বেরোল এক টিন আমেরিকান কর্নড় বীফ, কিছু সিগারেট আর এক বোতল হুইস্কি। বললেন, সৈনিক হিসেবে তার আচরণের প্রশংসা না করে তিনি পারছেন না। কিন্তু যুদ্ধ যুদ্ধই, এর জন্যে কাউকে দায়ী করা চলে না। তা ছাড়া নিকলসন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, সাইতোরও ওপরঅলা আছে। সেই ওপরঅলাদের নির্দেশ, যত শিগগির সম্ভব সেতুটা নির্মাণ করতে হবে। সুতরাং যত বেশি সম্ভব লোক নিয়োগ না করে তার কোনও উপায় নেই। কর্নড় বীফ, সিগারেট, হুইস্কি কিছুই নিলেন না কর্নেল নিকলসন, কিন্তু কথাগুলো শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। সবশেষে বললেন, এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ সম্পন্ন করার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা সাইতোর নেই।
এরপর তর্কবিতর্ক শুরু হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। হাবভাবে মনে হলো, এই তর্ক বুঝি আর শেষ হবে না। কিন্তু এক পর্যায়ে সাইতো চুপ করতেই কর্নেল বলে উঠলেন:
কাজের অগ্রগতি নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট, কর্নেল সাইতো?
বিদ্রুপাত্মক এই প্রশ্নে রাগে ফেটে পড়তে পারতেন সাইতো, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। বিড়বিড় করে কী সব বললেন তিনি। তারপর বন্দীর হাতে এক গ্লাস হুইস্কি ধরিয়ে দিয়ে, নিজের গ্লাসটা ভরে নিয়ে স্পষ্ট করলেন গলা:
দেখুন, কর্নেল নিকলসন, আমি কিন্তু আপনাকে কাজ করার আদেশ দিইনি।
অন্য অফিসারদের…
আমার কোনও অফিসারই কাজ করবে না, গ্লাসটা কর্নেল নামিয়ে রাখলেন টেবিলের ওপর।
বিরক্তি গোপন করে মুখে শান্ত একটা ভাব ফুটিয়ে রাখলেন কর্নেল সাইতো।
বললেন, গত কদিন যাবৎ এ-কথাটাই ভাবছি। মেজর থেকে ওপারের অফিসারদের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। শুধু জুনিয়র অফিসারদের একটু…।
কোনও অফিসারই মজুরের মত খাটবে না, বললেন কর্নেল নিকলসন। অফিসারের কাজ হলো সৈন্যদের আদেশ দেয়া।
আর সামলাতে পারলেন না কর্নেল সাইতো।
রক্তাক্ত দেহ অথচ প্রফুল্ল মন নিয়ে ফিরে এলেন কর্নেল নিকলসন। বুঝতে তার বাকি নেই, শক্রর আত্মসমর্পণ করাটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
০৬.
কাজের অগ্রগতির প্রশ্ন তুলে কর্নেল নিকলসন সাইতোর বড় নাজুক জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছিলেন। তার এ ধারণাও সঠিক যে, প্রয়োজনের কাছে জাপানীদের শেষ পর্যন্ত হার মানতে হবে।
কাজ তো মোটেই এগোয়নি, বরং প্রাথমিক প্রস্তুতির ব্যাপারগুলো সারতে গিয়ে বন্দীরা এমন সব কাণ্ড করে রেখেছে, যেগুলো সংশোধন করতেই লেগে যাবে বেশকিছু সময়।
কমান্ডিং অফিসারের প্রতি দুর্ব্যবহার রাগিয়ে তুলেছে বন্দীদের। সে-রাগ আরও বেড়েছে তাদের ক্রীতদাসের মত খাঁটিয়ে নেয়ায়। ফলে কাজে কে কতটা গাফিতি আর ভুল করতে পারে, তারই একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা যেন শুরু হয়ে গেছে তাদের মধ্যে।
কোনও শাস্তিই তাদের এসব করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ছোটখাট জাপানী এঞ্জিনিয়ার প্রচণ্ড হতাশায় কেঁদে ফেলেছেন মাঝেমাঝে। বন্দীদের ওপর নজর রাখার জন্যে যে প্রহরী নিয়োগ করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তা ছাড়া বন্দীদের অবহেলা ধরতে পারার মত যথেষ্ট বুদ্ধিও তাদের মাথায় নেই। একবার ছোট একটা গর্ত খুঁড়তে বলা হলো বন্দীদের, প্রহরীদের সামনেই তারা প্রায় একটা জ্বালামুখ কেটে ফেলল। এঞ্জিনিয়ার এসে এই কাণ্ড দেখে পাগলের মত পেটাতে লাগলেন প্রহরী আর বন্দীদের। প্রহরীরা বুঝতে পারল তাদের বোকা বানানো হয়েছে আরেকবার, কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে ততক্ষণে।
একবার বন্দীদের দেয়া হলো গাছ কাটার কাজ। বেছে বেছে সবচেয়ে। বাকাচোরা আর ভঙ্গুর গাছ কেটে আনতে লাগল তারা; অথবা অনেক পরিশ্রম করে এমন প্রকাণ্ড একটা গাছ কাটল, নদীতে পরে যেটা হারিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে; অথবা সারা জঙ্গল খুঁজে কেটে আনল পোকায় খাওয়া গাছ।
প্রত্যেকদিন অন্তত একবার তদারকি করতে আসেন সাইতো। এসব কাণ্ড দেখে রেগে আগুন হয়ে যান, আরেক দফা শাস্তির ব্যবস্থা হয় বন্দীদের। অকথ্য গালি খেয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় এঞ্জিনিয়ারের। পরিষ্কার জানিয়ে দেন, শয়তানের দল নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। ক্ষতি করার সময় যে বন্দীরা হাতেনাতে ধরা পড়ল, গাছের সাথে বেঁধে তাদের পেটানো হলো কাঁটার ডাল দিয়ে, তারপর ন্যাংটো করে ফেলে রাখা হলো প্রখর সূর্যের নিচে। সন্ধ্যায় তাদের বয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে ক্লিপটনের হাসপাতালে। সারা শরীর জুলে পুড়ে যাচ্ছে, অনেক জায়গা ফুলে উঠেছে পিপড়ের কামড়ে, পিঠে দগদগে ক্ষত। দুপায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তাদের আবার লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে কাজে।
সৈন্যগুলোর শাস্তি গ্রহণ করার ক্ষমতা দেখে যেমন বিস্মিত হলেন ক্লিপটন, তেমনি চোখে পানি এসে গেল তাদের দুর্দশা দেখে।
কোনও শাস্তিই তাদের দমাতে পারল না। কর্নেল নিকলসন তাদের সামনে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যার ফলে এসব শাস্তি তাদের কাছে যেন তুচ্ছ হয়ে গেছে।
শাস্তি দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে এবং নতুন শাস্তি উদ্ভাবন করতে ব্যর্থ হয়ে নানারকম প্রতিশ্রুতি দিতে লাগলেন সাইতো। কিন্তু সে-প্রলোভনে বন্দীরা ভুলল না।
একদিন বেশি খাটুনি হয়ে যাচ্ছে, এই দোহাই দিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ বন্ধ করে দিলেন সাইতো। সবার মধ্যে বিতরণ করা হলো চালের পিঠে আর ফল। সাইতো বললেন, অফিসাররা পাশাপাশি হাত লাগালে তাদের কাজ কত সহজ হয়ে যেত সেটা তিনি বোঝেন। আর এজন্যে অফিসারদের ওপর তাদের মনে কিরকম ঘৃণা জন্মেছে, সে-কথা জানতেও তাঁর বাকি নেই। তাই সবদিক বিবেচনা করে সহানুভূতিশীল হয়ে তিনি এসেছেন তাদের কাজের বোঝা কমিয়ে দিতে। এঞ্জিনিয়ার দেড় ঘনগজ বললেও আজ থেকে তাদের সবাইকে মাটি কাটতে হবে এক ঘনগজ করে।
এরকম ওকালতি করা সত্ত্বেও পরদিন দেখা গেল, মাথাপিছু দেড় ঘনগজ বা তারও কিছু বেশি মাটি কেটেছে বন্দীরা।
ক্রমাগত প্রতিরোধের মুখে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলেন কর্নেল সাইতো। অবশ্য ঘটনার একদিন আগেও কোণঠাসা জানোয়ারের মত তিনি ছুটে বেড়ালেন ক্যাম্পের আশেপাশে। এমনকি ক্যাপ্টেনের নিম্নপদস্থ তরুণ অফিসারদের বললেন তাদের ইচ্ছেমত কাজ বেছে নিতে, লোভ দেখালেন নানা সুযোগসুবিধে আর বাড়তি রেশনের। কিছুতেই কিছু না হওয়ায় এবং অচিরেই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। একটা জাপানী পরিদর্শক দল আসার কথা থাকায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনও পথ তিনি খুঁজে পেলেন না।
১৯৪২ সালের ৭ ডিসেম্বর কর্নেল নিকলসনের সাথে দেখা করে তিনি জানালেন, অফিসারদের আর মজুরদের মত কায়িক পরিশ্রম করতে হবে না, প্রতিদানে তারা নিশ্চয় সাধারণ সৈন্যদের কাজ ভালভাবে তদারক করবে।
কর্নেল নিকলসন জবাব দিলেন, যথাসাধ্য চেষ্টা তিনি করবেন। যেহেতু পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সংবিধান অনুসারে, শত্রুপক্ষের কর্মসূচীতে বাধা দেয়ার আর কোনও কারণ থাকতে পারে না। বলা বাহুল্য, পৃথিবীর সমস্ত সভ্য সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈন্যদের যাবতীয় কাজকর্মের জন্যে অফিসারেরা দায়ী থাকেন।
সেদিন রাতে বিজয়োৎসব পালিত হলো ব্রিটিশ ক্যাম্পে। ওই একই রাতে প্রতিদিনের চেয়ে অনেক আগে নিজের ঘরে ঢুকে চুপিচুপি কাঁদতে লাগলেন কর্নেল সাইতো, তারপর বোতলের মাঝে সান্ত্বনা খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে লুটিয়ে পড়লেন বিছানায়।
০৭.
কর্নেল নিকলসন তাঁর দুই উপদেষ্টা মেজর হিউজেস আর ক্যাপ্টেন রীকে নিয়ে গেলেন কওয়াইয়ের তীরে।
হাঁটছেন তিনি খুব ধীরে ধীরে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। কারণ, অন্যায় শাস্তি দেয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিজের এবং অফিসারদের জন্যে চার দিন ছুটি নিয়েছেন। আরও দেরির কথা ভেবে হাত মুষ্টিবদ্ধ করেছেন কর্নেল সাইতো, কিন্তু ছুটি দিয়েছেন শেষমেশ। শুধু তা-ই নয়, নির্দেশ প্রচার করেছেন যেন কেউ কখনও বন্দীদের সাথে দুর্ব্যবহার না করে।
শুধু শারীরিক শক্তি ফিরে পাবার জন্যেই ছুটি নেননি কর্নেল নিকলসন। কাজটা কিভাবে করা যায়, এই চারদিন সেটা ভাবতে চান ঠাণ্ডা মাথায়, পরামর্শ করতে চান উপদেষ্টাদের সঙ্গে। না ভেবেচিন্তে কোনও কাজ করার চেয়ে ঘৃণার আর কিছু নেই কর্নেলের কাছে।
সৈন্যরা ইচ্ছেকৃত যেসব ভুল করেছে, সেগুলো খুঁজে পেতে খুব একটা দেরি হলো না তার। হিউজেস আর রীভস সেগুলো দেখে চিৎকার করে উঠলেন নিজেদের অজান্তেই।
রেললাইনের উপযুক্ত একটা বাধই হয়েছে বটে! বললেন হিউজেস। সত্যি, স্যার, শয়তানগুলো যেসব কাণ্ডকারখানা করেছে তা বাঁধিয়ে রাখার মত। ওই রেললাইনের ওপর দিয়ে ভারী অ্যামুনিশন ট্রেন যাচ্ছে, ব্যাপারটা একবার ভাবুন তো!
গম্ভীর হয়ে রইলেন কর্নেল।
চমৎকার কাজ, স্যার, বললেন ক্যাপ্টেন রীভস। পাগল ছাড়া ওই আঁকাবাঁকা জায়গার ওপর কেউ রেললাইন বসাতে চাইবে না।
মুখভাবের কোনও পরিবর্তন হলো না, কর্নেল জানতে চাইলেন:
টেকনিশিয়ান হিসেবে তোমার কি মত, রীভস, ওটা কোনও কাজে লাগানো যাবে?
মনে হয় না, স্যার, জবাব দিলেন রীভস। জায়গাটা বাতিল করে দিয়ে লাইনটা সামান্য ওপরের দিকে নিয়ে যাওয়া উচিত।
মাথা নাড়াতে নাড়াতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন কর্নেল। কোনও মতামত প্রকাশ করার আগে পুরো জায়গাটা তিনি ঘুরে দেখতে চান।
জনা পঞ্চাশেক বন্দীর একটা দল কাজ করছে নদীর কাছে। কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে একজন প্রহরী পায়চারি করছে তাদের সামনে দিয়ে। কয়েকজন দূরে মাটি খুঁড়ছে, সেই মাটি বাঁশের ঝুড়িতে করে বয়ে এনে ফেলা হচ্ছে সাদা খুঁটি দিয়ে নির্দিষ্ট করা একটা রেখার দুপাশে। খুঁটিগুলো ছিল তীরের সমকোণে, কিন্তু বন্দীদের কল্যাণে এখন সেগুলো হয়ে গেছে সমান্তরাল। নদীর ওপারে আরেক দল বন্দীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি সহকারে কি যেন বোঝাচ্ছেন এঞ্জিনিয়ার।
খুঁটিগুলো কে পুঁতেছে? জানতে চাইলেন কর্নেল।
উনি, স্যার, লাফিয়ে উঠে এঞ্জিনিয়ারের দিকে আঙুল নির্দেশ করল ব্রিটিশ কর্পোরাল। তবে উনি চলে যাবার পর আমি ওখানে খানিকটা উন্নতি বিধান করেছি।
প্রহরী এদিকে তাকিয়ে না থাকায় চোখ পিটপিট করল কর্পোরাল, কিন্তু ইশারাটা কর্নেল খেয়াল করলেন না।
হুম, কণ্ঠ তার বরফের মত ঠাণ্ডা।
সামান্য এগিয়ে আরেকজন কর্পোরালের সামনে দাঁড়ালেন কর্নেল কয়েকজন বন্দীর সাহায্যে বড় বড় শেকড় বের করছে সে মাটি খুঁড়ে, কিন্তু সেগুলো তীরে নামিয়ে না দিয়ে তুপ করে রাখছে একটা ঢালের মাথায়।
আজ এই দলে কতজন কাজ করছে? জানতে চাইলেন কর্নেল।
হাঁ করে রইল প্রহরী। লাফিয়ে উঠে একটা জবাব দেয়ার চেষ্টায় তোতলাতে লাগল কর্পোরাল।
বিশ কিংবা পচিশজন, স্যার, আমি ঠিক বলতে পারছি না। আসার পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়ল একজন। কেন তা বলতে পারব না, স্যার। সকালে একদম সুস্থ ছিল। তিন-চারটে ছেলে আবার তাকে বিয়ে নিয়ে গেল হাসপাতালে। এখনও ফেরেনি। ও-ই দলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। ফলে আজকের জন্যে নির্ধারিত কাজ আমরা এখনও শেষ করে উঠতে পারিনি। মনে হয় এই রেললাইনটার ওপর কোনও অভিশাপ আছে।
একজন কর্পোরালের জানা উচিত, বললেন কর্নেল, তার অধীনে ঠিক কতজন লোক কাজ করছে। যাই হোক, মাথাপিছু কতখানি মাটি কাটতে হচ্ছে তোমাদের?
এক ঘনগজ করে, স্যার, সেগুলো আবার ফেলে দিয়ে আসতে হয় দূরে। কিন্তু এতসব শেকড়বাকড় থাকায়, স্যার, কাজটা খুব একটা সহজ নয়।
হুম, আরও ঠাণ্ডা শোনাল কর্নেলের কণ্ঠ। বিড়বিড় করতে করতে আবার পা বাড়ালেন তিনি। হিউজেস আর রীভূস্ পেছনে পেছনে।
ধীরে ধীরে তারা এসে পৌঁছুলেন একটা ঢিবির মাথায়। কওয়াই নদী এখানে একশো গজেরও বেশি চওড়া, দুদিকের তীর পানির প্রান্ত থেকে উঠে গেছে বেশ খানিকটা উঁচুতে। চারপাশ খুঁটিয়ে দেখে কর্নেল ফিরলেন তাঁর উপদেষ্টাদের দিকে।
এই জাপানীরা, কিছুদিন আগেও একেবারে বুনো ছিল। ওরা আমাদের পদ্ধতিগুলো নকলের চেষ্টা করছে, কিন্তু সে-পদ্ধতি বোঝার ক্ষমতা ওদের নেই। স্রেফ মডেলটা নিয়ে নাও, মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এই উপত্যকার কাজটা নিয়েই ওরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, অথচ এটা করতে খুব বেশি বুদ্ধির দরকার নেই। পরিকল্পনা করে কাজে নামলে যে অনেক সময় বাঁচে, এটুকুও বোঝে না ওরা। তোমার কি মনে হয়, রী? রেললাইন আর সেতুর কাজ তো তোমার আওতায় পড়ে, তাই না?
আপনি ঠিকই বলেছেন, স্যার, বললেন ক্যাপ্টেন। এই ধরনের অন্তত বারোটা কাজ আমি করেছি ভারতে। এখানে যেসব যন্ত্রপাতি এবং যত লোক আছে, তার সাহায্যে যোগ্যতাসম্পন্ন একজন এঞ্জিনিয়ার এরকম একটা সেতু তৈরি করে ফেলতে পারে ছমাসেরও কম সময়ে। ওদের বোকামি দেখে আমার রক্ত শুধু টগবগ করে ফুটছিল।
হ্যাঁ, সায় দিলেন হিউজেস। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমারও। ওদের প্রত্যেকটা বোকামি চোখে পড়তেই মনে হচ্ছিল চিৎকার দিয়ে উঠি। ভাবতে যত সহজ আসলে তো আর তত
আর আমি? বলে উঠলেন কর্নেল। ওদের কাজে খুশি হয়েছি ভেবেছ? আজ সকালে যা যা দেখলাম, তাতে আমি রীতিমত আতঙ্কিত।
তো, স্যার, হাসলেন রীভস, এই রেললাইনের ওপর দিয়ে যদি ওরা ট্রেন নিয়ে যাবার কথা ভেবে থাকে, তা হলে ভারতের জন্যে আমাদের উদ্বিগ্ন না হলেও চলে!
আবার চিন্তায় ডুবে গেছেন কর্নেল নিকলসন, কিন্তু নীল চোখজোড়া সঙ্গী দুজনের ওপর নিবদ্ধ।
অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এগোতে হবে আমাদের। প্রথমে সৈন্যদের আনতে হবে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। অযত্নে আর অবহেলায় এরা ব্রিটিশ সৈনিকের যোগ্যতা হরিয়েছে। কিন্তু সেজন্যে এরা দায়ী নয়–কথাটা মনে রাখা দরকার। অধৈর্য না হয়ে ধীরে ধীরে আবার এদের সুশৃঙ্খল করে তুলতে হবে। জাপানীদের আমরা দেখাব, মানুষকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
এক মুহূর্ত থেমে আবার বলে চললেন কর্নেল:
সৈন্যদের ব্যাপার আমরা যথাসাধ্য বিবেচনা করব, কিন্তু তাই বলে কখনোই দুর্বলতা প্রকাশ করব না। সৈন্যদের সাথে আমি নিজে কথা বলব। এত দিন যা করার করেছে, কিন্তু আজ থেকেই ওসব বাদ দিতে হবে। নামমাত্র ছুতো দেখিয়ে কেউ অনুপস্থিত থাকতে পারবে না। যে কোনও প্রশ্ন করলে চটপটু, পরিষ্কার জবাব দিতে হবে প্রত্যেক নন-কমিশনড়-অফিসারকে। কেউ অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করলে বা অযথা রোগের অজুহাত দেখালে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে তার বিরুদ্ধে। রেললাইন এগিয়ে যাবে দিগন্তবরাবর সোজা, বাকাচোরা হবে না মোটেও–খাঁটি কথাই বলেছ তুমি, রীভস…
০৮.
কলকাতায় বসে একটা রিপোর্ট পড়ছেন ফোর্স ৩১৬-এর কমান্ডার কর্নেল গ্রীন। রিপোর্টটার মার্জিনের নিচে মন্তব্য করেছে মিলিটারি আর প্যারা-মিলিটারির গোটা ছয়েক গুপ্ত সংস্থা। ফোর্স ৩১৬, দ্য প্লাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানি লিমিটেড নামেই বেশি পরিচিত। ইতোমধ্যেই তারা সক্রিয় আগ্রহ দেখিয়েছে অধিকৃত মালয়, বার্মা, থাইল্যান্ড আর চীনের জাপানী ওঅর এস্টাবলিশমেন্টগুলোর ব্যাপারে। তাদের সাজসরঞ্জমে যে ঘাটতি আছে, সেটা তারা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে দক্ষ এজেন্টের মাধ্যমে।
এই প্রথম ওদের সবাই একমত হলো আমার সাথে, বিড়বিড় করে বললেন কর্নেল গ্রীন। সুতরাং কিছু একটা করতেই হবে।
গুপ্ত সংস্থাগুলো ফোর্স ৩১৬-এর সহযোগী হলেও সবার স্বতন্ত্র কার্যপ্রণালী রয়েছে। ফলে তাদের সিদ্ধান্তে যে প্রায়ই আকাশ পাতাল ফারাক দেখা দেয়, তা চোখে পড়ার সাথে সাথে মাথায় আগুন ধরে যায় কর্নেল গ্রীনের। কারণ, যাবতীয় অপারেশনের পরিকল্পনার দায়িত্বে আছেন তিনি স্বয়ং। নিজস্ব কার্যপদ্ধতিতে ঝামেলা না পাকানো পর্যন্ত থিয়োরেটিক্যাল আলোচনা করতেও তিনি আগ্রহী নন। সমস্ত স্টাফেরই এসব জানা আছে, যেহেতু দিনে অন্তত একবার নিজের অভিমত ব্যক্ত না করলে তিনি সুখ পান না। এ ছাড়া দিনের সিংহভাগ সময় তাঁর কাটে এসব রিপোর্ট থেকে সত্য ঘেঁকে বের করার কাজে।
খাঁটি, মহান, বিখ্যাত, এক এবং অদ্বিতীয় ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলাকে কর্নেল গ্রীন দুচোখে দেখতে পারেন না। অপারেশনাল স্টাফের কোনও সাহায্যেই আসে না এরা। অতি গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে মহামূল্যবান দলিলপত্র এরা লুকিয়ে রাখে লোহার সিন্দুকে। বহু বছর পর যখন বের করা হয়, তখন সেগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে বসে আছে। দলিলগুলো প্রকাশও হয় অভিনবভাবে। মরার আগে আগে স্মৃতিকথা লেখার তাগিদ অনুভব করেন ইন্টেলিজেন্সের কোনও চাই। বিস্মিত হয়ে জাতি জানতে পারে, নির্দিষ্ট কোনও দিনের নির্দিষ্ট সময়ে তাঁদের সার্ভিস কী কাণ্ডটাই না ঘটিয়েছে। তা ছাড়া শক্রর পরিকল্পনা এবং আক্রমণের ব্যাপারে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, তার তো কোনও তুলনাই নেই।
বর্তমান পরিকল্পনাটা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হওয়ায় মহাখুশি কর্নেল গ্রীন আবার পড়তে লাগলেন রিপোর্টটা।
বার্মা-ভাইল্যান্ড রেলওয়ের কাজ এগিয়ে চলেছে। মিত্রবাহিনীর ষাট হাজার বন্দীকে জাপানী শ্রম শিবিরগুলোতে রেখে খাটানো হচ্ছে জঘন্য পরিস্থিতির মধ্যে। বর্তমানে, কয়েক মাসের মধ্যে সম্পন্ন হতে পারে, এই ধরনের এমন একটা কাজ তারা হাতে নিয়েছে, যা প্রভূত সাহায্য করবে শত্রুপক্ষকে। খসড়া একটা মানচিত্র দেয়া হলো।
মুচকি হেসে আবার পড়তে লাগলেন কর্নেল গ্রীন:
থাইল্যান্ডের জনসাধারণ বিজয়ী বাহিনীর ওপর মোটেই খুশি নয়। বিশেষ করে রেলওয়ের আশেপাশের কৃষকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। থাইল্যান্ড সেনাবাহিনীর অনেক সিনিয়র অফিসার এবং রাজপরিবারের কেউ কেউ সম্প্রতি যোগাযোগ করেছেন মিত্রবাহিনীর সাথে। বর্তমানে জাপানীদের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালানোর জন্যে তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। অসংখ্য কৃষক এব্যাপারে সাহায্য করতে এক পায়ে খাড়া। যত শিগগির সম্ভব অস্ত্রশস্ত্র আর কমান্ডার পাঠাবার অনুরোধ জানিয়েছে সবাই।
হ্যাঁ, একটা দল ওখানে অবশ্যই পাঠাব, সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন কর্নেল গ্রীন।
সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তিনি ভাবতে বসলেন, এরকম একটা অভিযানের কমান্ডার হতে গেলে তার কি কি গুণ থাকা দরকার। একের পর এক সম্ভাব্য প্রার্থীদের বাতিল করার পর তিনি ডেকে পাঠালেন মেজর সিয়ার্সকে। মাত্র যেকজন এজেন্টের জন্যে ফোর্স ৩১৬-এর সুনাম ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তাদের মধ্যে অশ্বারোহী বাহিনীর এই প্রাক্তন অফিসারটি অন্যতম। ইউরোপে বেশ কয়েকটা শক্ত মিশন শেষ করার পর ভারতে আসতেই লম্বা একটা ইন্টারভিউ নিয়ে তাকে ফোর্স ৩১৬-এর অন্তর্ভুক্ত করে নেন কর্নেল গ্রীন। সিয়ার্স আসার পর তাঁকে যাবতীয় তথ্য দিয়ে মিশনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলেন তিনি।
সাথে জিনিসপত্র কিন্তু খুব একটা নিয়ে যেতে পারবে না, বললেন গ্রীন, যা যা প্রয়োজন পাঠিয়ে দেয়া হবে যথাসময়ে। আর অপারেশন কীভাবে চালাতে হবে, সেটা তুমি ঠিক করবে স্পটে গিয়ে। তবে আমার মনে হয়, ছোট ছোট আক্রমণ চালিয়ে নিজেদের প্রকাশ করার ঝুঁকি না নিয়ে রেললাইন বসানো শেষ হবার পর কাজটা একবারে সারাই ভাল।
অপারেশনে কি জিনিস ব্যবহার করা হবে, সেটা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। দ্য গাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড নামটার মধ্যেই রয়েছে তার পরিচয়।
প্রথমে থাইল্যান্ডবাসীদের বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হবে সিয়ার্সকে। তারপর ট্রেনিং শুরু।
তিনজনের একটা দল হলেই চলবে তোমাদের, বললেন কর্নেল গ্রীন, অন্তত এখনকার মত। তোমার কি মনে হয়?
ঠিকই বলেছেন, সার, সায় দিলেন সিয়ার্স। আপাতত তিনজনই যথেষ্ট। বেশি লোক নিয়ে শত্রুর চোখে পড়ে যেতে চাই না।
তা হলে ওই কথাই রইল। সাথে কাকে নিতে চাও?
ওয়ার্ডেন হলে ভাল হয়, সার।
ক্যাপ্টেন ওয়ার্ডেন? মানে প্রফেসর ওয়ার্ডেন? তুমি নিশ্চয় ছোটখাট ব্যাপারে বিশ্বাসী নও, সিয়ার্স। তুমি আর ওয়ার্ডেনই আমাদের সবচেয়ে ভাল দুজন এজেন্ট।
মিশনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সার, নির্বিকারভাবে জবাব দিলেন মেজর সিয়ার্স।
হ্যাঁ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক দিক থেকে তো বটেই, এমনকী অপারেশনাল দিক থেকেও এই মিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আর এই কাজে ওয়ার্ডেনই সবচেয়ে উপযুক্ত, সার। প্রাচ্য ভাষার অধ্যাপক ছিল সে। থাই ভাষাটা ভাল জানা আছে তার। ওটা খুবই কাজে লাগবে ওখানে।
বেশ, ওয়ার্ডেনকে তুমি পাবে। তৃতীয় কাকে নিতে চাও?
একটু ভাবতে হবে, সার। সম্ভবত কেবল কোর্স শেষ করা তরুণদের কাউকে। ওদের বেশ কজনকে সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে আমার। কাল জানাব আপনাকে।
ফোর্স ৩৬১ একটা স্কুল স্থাপন করেছে কলকতায়, সেখানে ট্রেনিং দেয়া হয় তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের।
ঠিক আছে। এই নাও ম্যাপ! আমি সম্ভাব্য গুপ্ত আশ্রয়গুলো চিহ্নিত করে রেখেছি। থাইদের ধারণা, ওসব জায়গায় লুকিয়ে থাকলে মানুষ তো দূরের কথা, কাক-পক্ষীটিও টের পাবে না। আকাশ থেকে পরিদর্শনের কাজটাও ইতোমধ্যে সেরে রেখেছি আমরা।
সিয়ার্স ঝুঁকে পড়লেন ম্যাপ আর এরিয়াল ফটোগ্রাফগুলোর ওপর। প্রত্যেকবার নতুন অভিযানে অজানা ভূখণ্ডের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ার আগে বেশ উত্তেজনা অনুভব করেন তিনি। এবার সে-উত্তেজনা আরও বাড়ল জঙ্গলাবৃত্ত পাহাড়শ্রেণী দেখে। ফোর্স ৩১৬ যেসব মিশন নির্বাচন করে, তার ধাচই আলাদা।
আত্মগোপন করে থাকার উপযুক্ত বেশ কয়েকটা জায়গা আছে, বললেন কর্নেল গ্রীন। বার্মা সীমান্তের কাছাকাছি বিচ্ছিন্ন এই ছোট্ট গ্রামটার কথাই ধরো না, ট্রেন থেকে নামার পর দুই বা তিন দিনের পায়ে হাটা পথ। স্কেচ-ম্যাপ অনুসারে রেললাইন ওখানে একটা নদী অতিক্রম করেছে–কওয়াই নদী, অবশ্য ম্যাপটা যদি ঠিক থাকে। ওখানকার সেতুটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড়।
কমান্ডিং অফিসারের দেখাদেখি সিয়ার্সও হাসলেন এই চিন্তা করে যে, অসংখ্য সেতু ছড়িয়ে রয়েছে জায়গাটার আশেপাশে।
ওই সেতুটাই সবচেয়ে বড় কিনা, সেটা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, সার। তবে আপাতত আমার মনে হচ্ছে, হেডকোয়ার্টারস হিসেবে জায়গাটা হবে। নিখুঁত।
ঠিক। এখন ড্রপ করতে হবে তোমাকে। তিন বা চার সপ্তাহের মধ্যে সেব্যবস্থাও হয়ে যাবে আশা করি, যদি থাইরা রাজি থাকে। প্লেন থেকে ঝাঁপ দিয়েছ কখনও?
না, স্যার। আমি ইউরোপ থেকে আসার পর কোর্সে প্যারাশুটিং যোগ করা হয়। ঝপ বোধহয় ওয়ার্ডেনও দেয়নি।
একটু থাম। এক্সপার্টেরা তোমাদের জন্যে ট্রেনিং জাম্পের ব্যবস্থা করতে পারে কিনা দেখি।
টেলিফোনটা তুলে নিলেন কর্নেল গ্রীন। রয়াল এয়ারফোর্স অফিসে জানালেন, কি তার প্রয়োজন। চুপচাপ কিছুক্ষণ কথা শুনলেন তিনি। তার মুখ দেখে মনে হলো না, খুব একটা খুশি হয়েছেন।
এটাই তা হলে আপনাদের চুড়ান্ত মতামত? জানতে চাইলেন কর্নেল গ্রীন।
জবাব শুনে জ কুঁচকে গেল তার, নামিয়ে রাখলেন রিসিভারটা। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বললেন:
এক্সপার্টদের মতামত জানতে চাও? ওরা বলল: আপনি যদি আপনার ছেলেদের ট্রেনিং জাম্প করানোর জন্যে জেদ ধরেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমরা নিতে পারি। কিন্তু দুমাসের কোর্স করার আগে এ-পথে পা না বাড়ানোই ভাল। এই ধরনের দেশে ড্রপিং মিশনের ফলাফল হয়েছে এরকম: একটা জাম্প দিলে আহত হবার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। দুটো জাম্প দিলে সে-সম্ভাবনা দাঁড়াবে আশি ভাগে। আর তিনটে জাম্প দিলে দুর্ভাগ্য এড়ানোর কোনও উপায়ই থাকবে না। সুতরাং একটা জাম্প দিয়ে সবচেয়ে ভাল ফলের আশা করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সব খুলে বললাম। এখন সিদ্ধান্ত নেবে তুমি।
আধুনিক সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় সুবিধে হলো, একেবারে শান্তভাবে জবাব দিলেন সিয়ার্স, আমাদের সাহায্য করার জন্যে রয়েছেন বিভিন্ন ধরনের এক্সপার্ট। সুতরাং তাদের পরামর্শ নিয়ে একটা জাম্পই দেব আমরা, আর আশা করব সবচেয়ে ভাল ফলের।
০৯.
মেজাজ মোটেই ভাল নেই তোমার মনে হচ্ছে, রীভ? বললেন কর্নেল নিকলসন রয়াল এঞ্জিনিয়ারস-এর মুখ গোমড়া করে থাকা ক্যাপ্টেনের উদ্দেশে। ব্যাপারটা কি?
আর ব্যাপার! এভাবে কাজ করা সম্ভব নয়, স্যার। কোনওমতেই না। গতকালই এ-বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলব ভেবেছিলাম। আজ আবার আমাকে তাগাদা দিলেন মেজর হিউজেস।
ব্যাপারটা কি? কুটি করলেন কর্নেল নিকলসন।
রীভস-এর সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত, স্যার, বললেন হিউজেস। এভাবে চলতে পারে না।
কি চলতে পারে না?
অব্যবস্থা, সার। জীবনে এরকম চরম অব্যবস্থা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা অন্য কোথাও দেখিনি। একের পর এক পরস্পরবিরোধী আদেশ দিয়ে চলেছে সবাই। মানুষ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে এতটুকু ধারণাও জাপানীদের নেই। ওরা নাক গলালে এই কাজ কোনওদিনই শেষ হবে না।
বৃটিশ অফিসারেরা বন্দীদের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে সত্যি, কিন্তু সেটাকে কোনওভাবেই সন্তোষজনক বলা চলে না।
তোমাদের বক্তব্য ব্যাখ্যা করো। প্রথমে তুমি, রীভস।
সার, পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে বললেন ক্যাপ্টেন, আমি শুধু সবচেয়ে মারাত্মক ভুলগুলো নোট করেছি; নইলে এই তালিকা আর শেষ হত না।
বলে যাও। তোমাদের যে-কোনও যুক্তিসম্মত অভিযোেগ আমি শুনব, বিবেচনা করব যে-কোনও পরামর্শ। বুঝতে পারছি কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।
সেটা আমাকে জানানো তোমাদের কর্তব্য।
প্রথমত, সার, সেতুটা এই জায়গায় তৈরি করার চেয়ে বোকামি আর কিছু হতে পারে না।
কেন?
জায়গাটা পানি আর কাদায় ভরা, স্যার। এরকম জায়গার ওপর সেতু তৈরির কথা কেবল এদের মত বর্বরেরাই চিন্তা করতে পারে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, স্যার, ওপর দিয়ে একবার ট্রেন গেলেই পুরো সেতুটা ধসে পড়বে।
ব্যাপারটা সাংঘাতিক, রীভস, বললেন কর্নেল। খুব সাংঘাতিক, স্যার। আর এ-কথাই আমি বোঝাতে চাইছিলাম জাপানী এঞ্জিনিয়ারকে। এঞ্জিনিয়ারই বটে; ঈশ্বর! আনাড়িপনারও একটা সীমা থাকে! অবশ্য সয়েল রেজিস্ট্যান্স সম্বন্ধে যার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, প্রেশার টেবলের কথা শুনলে হাঁ করে থাকে, তার কাছে আর কি আশা করা যায়? তবু ধৈর্য ধরে বোঝাবার, সবরকম চেষ্টা আমি করেছি, স্যার। এমনকী ডেমনস্ট্রেশনও বাদ দিইনি। কিন্তু শুধু আমার সময়ের অপচয়। এই জলাভূমির ওপরেই সেতু বানাবে সে।
ডেমনস্ট্রেশন, রীভস? আগ্রহী হয়ে উঠলেন কর্নেল।
একেবারে সোজা, স্যার। একটা বাচ্চাও বুঝবে। পানির মধ্যে ওই পাইলটা দেখতে পাচ্ছেন, তীরের কাছে? ওটা আমি নিজ হাতে বসিয়েছি। অনেকখানি বসে গেছে ওটা, কিন্তু এখনও শক্ত তল খুঁজে পায়নি। অর্থাৎ ধীরে ধীরে আরও বসে যাবে। একটা ট্রেন এদিক দিয়ে গেলে বসে যাবে সমস্ত পাইল। এখানে দরকার কংক্রিটের ভিত, কিন্তু উপযুক্ত মালমশলা আমাদের হাতে নেই।
কর্নেলের কথায় ডেমনস্ট্রেশনটা আবার করে দেখালেন রীভূস্। মাথায় জেহ্যামার পড়তেই অনেকখানি বসে গেল পাইল।
দেখেছেন, স্যার, চেঁচিয়ে উঠলেন রীভ। যতবার মার মারবেন, বসে যেতেই থাকবে। শেষমেশ তলিয়ে যাবে পানির নিচে।
হ্যাঁ, বললেন কর্নেল। এখন কতখানি বসে গেছে পাইলটা?
নোটখাতা দেখে সঠিক জবাব জানিয়ে দিলেন রী। সেইসাথে বললেন, জঙ্গলের সবচেয়ে বড় গাছও তল খুঁজে পাবে না এখানে।
বঠিক, সন্তুষ্টির চিহ্ন ফুটে উঠল কর্নেলের মুখে। একটা বাচ্চাও বুঝবে, ঠিকই বলেছ তুমি। এই ডেমনস্ট্রেশনও এঞ্জিনিয়ারের মনে এতটুকু ছাপ ফেলেনি? আমার ফেলেছে–আর সেটাই সবচেয়ে জরুরী। তো এটার সমাধান কি?
সেতু তৈরির জায়গাটাই সরিয়ে ফেলা, স্যার। মাইলখানেক দূরে বোধহয় ভাল একটা স্পট আছে। দেখতে হবে
দেখো, বললেন কর্নেল, ভালভাবে দেখে খুঁটিনাটি জানাও আমাকে, যাতে ওদের সামনে বলতে পারি।
বিষয়টার একটা নোট নিয়ে জানতে চাইলেন কর্নেল:
আর কিছু, রীভস?
সেতুর কাজে লাগানোর জন্যে গাছ কাটা, স্যার। বড় গাছ চোখে পড়লেই কাটার নির্দেশ দিচ্ছে এঞ্জিনিয়ার। ভেবেও দেখছে না, গাছটা নরম না শক্ত, ভার বহন করার ক্ষমতা আছে কি না।
আবার নোট নিলেন কর্নেল নিকলসন।
তারপর, রীভস?
আপাতত আর কিছু নেই, স্যার। জায়গার ব্যাপারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিজেই একবার দেখুন না, নদী এখানে একশো গজেরও বেশি চওড়া। তীর দুপাশেই উঁচু। সুতরাং প্ল্যাটফর্মটা হতে হবে পানি থেকে একশো ফুটেরও বেশি ওপরে, তাই না? ব্যাপারটা ছেলেখেলা নয়। অনেকবার ওঅর্কিং প্ল্যানটা দেখাতে বলেছি এঞ্জিনিয়ারকে। কথা খুঁজে না পেলে যা করে জাপানীরা, মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেছে অন্যদিকে। হয়তো বিশ্বাস করবেন না, স্যার, আসলে তার কাছে কোনও প্ল্যানই নেই! তৈরির প্রয়োজনও বোধ করে না। তার ধারণা, গোটাকতক পাইল বসিয়ে ওপরে কয়েকটা তক্তা আটকে দিলেই সেতু হয়ে যাবে। এটা দাঁড়াতেই পারবে না, স্যার। এরকম অন্তর্ঘাতমূলক একটা কাজে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে ভেবে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার।
তার ক্ষোভ এতই খাঁটি যে সান্ত্বনা না দিয়ে পারলেন না কর্নেল নিকলসন।
অত ভেব না, রীভস। ভালই হলো, কথাগুলো বলে অনেকটা হালকা করে নিলে নিজেকে। তোমার ব্যাপারটা আমি সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারছি। নিজের কাজ নিয়ে গর্ববোধ সব মানুষের মধ্যেই আছে।
ঠিক বলেছেন, স্যার। এরকম উদ্ভট একটা কাজ করার চেয়ে যে কোনও শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি আমি।
তোমার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত, শেষ নোট নিলেন কর্নেল। এসব অনিয়ম চলতে দেয়া যেতে পারে না। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব খুব শিগগির, কথা দিচ্ছি। এবার তোমার পালা, হিউজেস।
অভিযোগ করতে এসেছেন হিউজেস, এটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। খুব সহজে বিরক্ত হবার পাত্র তিনি নন।
সার, কোনও কাজে শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। যতদিন পর্যন্ত জাপানী প্রহরীরা আমাদের আদেশের মধ্যে মাথা গলাবে, ততদিন গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ করা সম্ভব নয়। আপনি একবার তাকিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন, স্যার। যতসব অপদার্থের দল! আজ সকালে তিন ভাগে ভাগ করেছি আমার দলটাকে। এক দল মাটি খুঁড়বে, আরেক দল সেই মাটি ফেলে দিয়ে আসবে, তৃতীয় দল সমান করবে বাধটা। আমি, স্যার, সবার কাজের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করতে চাই।
হুঁ, আগ্রহী হয়ে উঠলেন কর্নেল। এক ধরনের স্পেশালাইজেশন সিস্টেম, তাই না?
ঠিক ধরেছেন, স্যার। নিজের সম্বন্ধে অন্তত এটুকু বলতে পারি যে মাটির কাজ আমার জানা আছে। ডিরেক্টর হবার আগে আমি ছিলাম ওঅকস ম্যানেজার। তিনশো ফুটের চেয়েও গভীর কুয়ো খোড়ার অভিজ্ঞতা আছে। যাই হোক, সকালে কাজ শুরু করল ওরা। নিয়মমাফিক কাজ এগোচ্ছে, হঠাৎ এসে হাজির হলো এক বেবুন। চিৎকার করে একত্র হতে বলল তিনটে দলকে, স্রেফ নজর রাখার সুবিধের জন্যে। তারপর যা হবার তা-ই হলো। বারোটা বেজে গেল কাজের। দেখুন না, কেমন গাদাগাদি করে রয়েছে সবাই। ওহ, চিন্তা করতেও মাথাটা ঘুরে যাচ্ছে।
যা, ঠিকই বলেছ, বন্দীদের লক্ষ্য করে সায় দিলেন কর্নেল। শৃঙ্খলার কোনও বালাই নেই।
আরও আছে, স্যার। মাথাপিছু প্রত্যেককে মাটি কাটতে বলা হয়েছে এক ঘনগজ করে। গাধাগুলো একবারও ভাবেনি যে বন্দীদের নিয়ে আরও বেশি মাটি কাটিয়ে নেয়া সম্ভব। এক ঘনগজ মাটি কাটার সাথে সাথে ছুটি দিয়ে দেয়া হচ্ছে ওদের। এ-অবস্থায় আমি যদি বেশি কাটতে বলি, ওরা কি ভাববে?
অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, কাজ কম হচ্ছে? জানতে চাইলেন কর্নেল নিকলসন।
খুবই কম, স্যার, মাঝখান থেকে বলে উঠলেন রীভস। ভারতে থাকতে কুলিদের অনায়াসেই দেড় ঘনগজ করে মাটি কাটতে দেখেছি, অথচ ওখানকার আবহাওয়া থাইল্যান্ডের মত হলেও মাটি অনেক শক্ত।
ব্যাপারটা আমিও ভাবছিলাম, বললেন কর্নেল। একবার একটা রাস্তা তৈরি করার দায়িত্ব পেয়েছিলাম আফ্রিকায়। ওখানে অনেক বেশি খাটছিল আমার লোকেরা। যাই হোক, একটা কথা পরিষ্কার, এসব অনিয়ম আর বরদাস্ত করা চলবে না। অভিযোগগুলো আমাকে জানিয়ে খুব ভাল করলে তোমরা।
নোটগুলো আরেকবার দেখে এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন কর্নেল, তারপরেই বলে উঠলেন আবার:
এখন শোনো, তোমরা দুজনেই। এতসব ঝামেলার মূলে কি আছে জানো? মাত্র একটা জিনিস: সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বলতে একেবারেই কিছু নেই। আমি জানি, দোষী আমিই হব সবচেয়ে আগে। কারণ, আমার চোখেই সবচেয়ে আগে পড়া উচিত ছিল ত্রুটিটা। সুতরাং এখন সেটার ওপরেই আমাদের জোর দিতে হবে সবচেয়ে বেশি।
জ্বী, স্যার, সায় দিলেন হিউজেস। তা না হলে এ-ধরনের কাজ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
একটা কনফারেন্স ডাকাই ভাল, বললেন কর্নেল নিকলসন। কথাটা আগেই ভাবা উচিত ছিল আমার। খোলাখুলি আলোচনা হবে আমাদের আর জাপানীদের মধ্যে। যাই, এখনই কথা বলে আসি কর্নেল সাইতোর সাথে।
১০.
কনফারেন্স বসল কয়েক দিন পর। সাইতো অবশ্য বুঝতে পারেননি ব্যাপারটা কি, তাই ব্যাখ্যা চেয়ে বোকা সাজতেও চাননি। জানিয়ে দিয়েছেন যথাসময়ে তিনি উপস্থিত থাকবেন সেখানে।
লম্বা যে কুটিরটাকে ডাইনিং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কনফারেন্সের আলোচ্য বিষয়সূচি নির্ধারণের পর অফিসারদের নিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন কর্নেল নিকলসন। সাইতো এলেন তার এঞ্জিনিয়ার, কয়েকজন দেহরক্ষী আর তিনজন ক্যাপ্টেনকে নিয়ে। ক্যাপ্টেন তিনজনকে আনা হয়েছে স্রেফ দল ভারী করার জন্যে, একবর্ণ ইংরেজিও বলতে পারে না তাদের কেউই। সাইতোকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন ব্রিটিশ অফিসারেরা। নিখুঁত এক স্যালুট দিলেন কর্নেল নিকলসন। শত্রুপক্ষের আদবকায়দা দেখে একটু দমে গেলেন সাইতো।
স্বাভাবিক ভদ্রতার খাতিরে অপেক্ষা করতে লাগলেন কর্নেল নিকলসন, যাতে উদ্বোধনী ঘোষণাটা সাইতো দিতে পারেন। একজন চেয়ারম্যান ছাড়া তো আর কনফারেন্স হতে পারে না। কিন্তু চেয়ারম্যান হবার কোনওরকম ইচ্ছে সাইতোর নেই। সভ্যজগতের রীতিনীতি সম্বন্ধে বিশেষ ধারণা তার নেই। তাই উল্টোপাল্টা কিছু একটা করে অধস্তনদের সামনে তিনি অপ্রস্তুত হতে চান না।
সাইতো উঠে শুধু বললেন যে কর্নেল নিকলসনের বক্তব্য তিনি শুনতে চান। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কর্নেল যখন বুঝলেন যে সাইতো আর আপাতত মুখ খুলবেন না, বাধ্য হয়ে তাকে দিতে হলো উদ্বোধনী ঘোষণা। তারপর খুব অল্প কথায় প্রস্তাব পেশ করলেন কর্নেল। কওয়াই নদীর ওপর সেতু তৈরির কাজে তিনি পুরোপুরি শৃঙ্খলা দেখতে চান এবং প্রত্যেকের দায়িত্ব বণ্টন করে দিতে চান পরিষ্কারভাবে। মেজর ক্লিপটনও উপস্থিত ছিলেন কনফারেন্সে। অবাক হয়ে তিনি লক্ষ করলেন, কমান্ডিং অফিসারের ব্যক্তিত্ব সাইতোকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।
সংক্ষিপ্ত একটা ভূমিকার পর মূল বক্তব্যে চলে এলেন কর্নেল।
অন্য কোনও প্রসঙ্গের আগে, কর্নেল সাইতো, আমাদের উচিত সেতুর অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা। আমার মতে, এ সিদ্ধান্তটা একটু তড়িঘড়ি করে নেয়া হয়েছে। মনে মনে ভাটির দিকে মাইলখানেক দূরের একটা জায়গা আমরা নির্বাচন করে রেখেছি। এর অর্থ আরও খানিকটা রেললাইন বসানো, ক্যাম্পটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া আর নতুন কোয়ার্টার তৈরি করা। কিন্তু এর অর্থ কোনওভাবেই কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়।
ঘোৎ করে উঠলেন সাইতো। ক্লিপটন ভাবলেন, যে-কোনও মুহূর্তে এখন মেজাজ খারাপ করে দানব হয়ে উঠবেন কর্নেল। তার মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এক মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে, কিন্তু কাজের কাজ বলতে কিছুই হয়নি এখনও। ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন সাইতো, মুঠি করে ধরলেন তরোয়ালের হাতল। কিন্তু তাঁকে কথা বলার সুযোগ দিলেন না কর্নেল নিকলসন।
এক মিনিট, কর্নেল সাইতো, বলে উঠলেন তিনি। এ-বিষয়ে আমার সহকর্মী, ক্যাপ্টেন রীভূস্-এর সাথে আলোচনা করেছি। সেতু তৈরির ব্যাপারে সে একজন বিশেষজ্ঞ। তার সিদ্ধান্ত হলো…
দুদিন আগে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জাপানী এঞ্জিনিয়ারের কাজ লক্ষ করার পর তাঁর অযোগ্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন কর্নেল নিকলসন। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে উপদেষ্টার বাহু ধরে তিনি বলেছেন:
শোনো, রীভ। যে আনাড়ি সেতু সম্বন্ধে আমার চেয়েও কম বোঝে, তাকে দিয়ে কিছু হবে না। তুমি একজন এঞ্জিনিয়ার, ঠিক তো? বেশ, পুরো কাজটার দায়িত্ব নিয়ে আমরা শুরু করব গোড়া থেকে। ওই এঞ্জিনিয়ারের ধ্যানধারণা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন নেই। প্রথমে একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করো, যেখানে সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে। তারপর দেখা যাবে…
কাজ পেয়ে খুশি হয়ে উঠলেন রী। সতর্কতার সাথে বিভিন্ন জায়গা পরীক্ষা করার পর একটা জায়গা পেলেন তিনি, যেটা সেতুর ভার বহনে সক্ষম।
নিজের বিরক্তি প্রকাশ করার জন্যে যথাযথ ভাষা সাইতো খুঁজে পাবার আগেই রীভসকে ডাকলেন কর্নেল। এগিয়ে গিয়ে তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে রীড়স বুঝিয়ে দিলেন যে এই জলাভূমির ওপরে সেতু নির্মাণ করলে সেটা ধসে পড়তে বাধ্য। বক্তব্য শেষ হতে সবার পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কর্নেল বললেন:
এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কর্নেল সাইতো, দুর্ঘটনা এড়াতে হলে সেতুর অবস্থান পরিবর্তন করতেই হবে। এ-বিষয়ে আপনার সহকর্মীর কিছু বলবার আছে?
এঞ্জিনিয়ারের কাছে মতামত জানতে চাইলেন সাইতো। কিছুক্ষণ রীভস-এর কাগজপত্র পরীক্ষার ভান করার পর এঞ্জিনিয়ার বললেন, কয়েক দিন আগে তিনি নিজেও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। রাগে কাঁপতে লাগলেন সাইতো। মুখে কিছু না বলে সম্মতি জানালেন মাথা ঝাকিয়ে। আবার বলতে লাগলেন কর্নেল:
তা হলে এ-বিষয়ে আমরা সবাই একমত হলাম, কর্নেল সাইতো। ফলে এপর্যন্ত করা কাজের আর কোনও মূল্যই রইল না। আবার শুরু করতে হবে একেবারে গোড়া থেকে।
যত সব রদ্দি শ্রমিকের দল, বললেন সাইতো। দুসেকশন রেললাইন বসানোর কাজ জাপানী সৈন্যরা সেরে ফেলত পনেরো দিনেরও কম সময়ে।
জাপানী সৈন্যের পক্ষে ভাল কাজ করাই স্বাভাবিক, যেহেতু তারা অফিসারদের আদেশ মেনে চলতে অভ্যস্ত। কিন্তু খুব শিগগির ব্রিটিশ সৈন্যদের যোগ্যতা আমি আপনাকে দেখাতে পারব বলে আশা রাখি, কর্নেল সাইতো। আপনাকে তো বলা হয়নি, ইতোমধ্যেই আমি আমার লোকদের মাথা পিছু কাজের পরিবর্তন করেছি।
পরিবর্তন করেছেন। চিৎকার করে উঠল সাইতো।
বাড়িয়ে দিয়েছি, শান্তভাবে জবাব দিলেন কর্নেল, এক ঘনগজ থেকে দেড় ঘনগজ। সবার স্বার্থেই এই পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করি আপনিও আপত্তি করবেন না এতে।
একেবারে বোকা বনে গেলেন কর্নেল সাইতো। সেই সুযোগে আবার কথা বলে উঠলেন কর্নেল নিকলসন।
এ-কথা আপনাকে বুঝতে হবে, কর্নেল সাইতো, যে প্রত্যেক সেনাবাহিনীরই নিজস্ব কার্যপদ্ধতি আছে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে আমরা সে-পদ্ধতির মূল্য প্রমাণ করে দেব। এ-ধরনের কাজের সাফল্য নির্ভর করে সাংগঠনিক শৃঙ্খলার ওপর। যেহেতু বিষয়টার ওপর আলোচনা শুরু হয়েছে, আমি কয়েকটা পরামর্শ দিতে চাই।
উপদেষ্টা পরিষদের সাহায্যে গত দুদিন খেটে তৈরি করা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিলেন কর্নেল নিকলসন। পুরো কাজটার মূল দায়িত্বে থাকবেন তিনি নিজে, এবং প্রত্যেকের জন্যে জাপানীদের কাছে দায়ী থাকবেন ব্যক্তিগতভাবে। প্রাথমিক ও তত্ত্বীয় কাজের পাশাপাশি টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারের দায়িত্ব পালন করবেন ক্যাপ্টেন রীভস। মেজর হিউজেস থাকবেন চীফ ফোরম্যান হিসেবে। ছোট ছোট দলে ভাগ করা সৈন্যদের দায়িত্বে নিয়োজিত প্লাটুন অফিসারেরা কাজ করবে তার অধীনে। এ ছাড়া থাকবে একটা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিপার্টমেন্ট, যার প্রধান হিসেবে নিয়োজিত করা হবে সেরা কর্পোরাল ক্লার্ককে। তার প্রধান দায়িত্ব যোগাযোগ রক্ষা, আদেশ যথাস্থানে পৌঁছে দেয়া, কাজ নির্ধারণ, যন্ত্রপাতি বন্টন এবং রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি।
এই বিভাগটি একান্তই জরুরী, ব্যাখ্যা করলেন কর্নেল। আমার পরামর্শ হলো, কর্নেল সাইতো, এক মাস আগে সরবরাহ করা যন্ত্রপাতিগুলো আপনার নিজের চোখে একবার দেখা উচিত। ওগুলোর অবস্থা কিন্তু সত্যিই খুব শোচনীয়…
এই পরিকল্পনা অনুমোদনের ব্যাপারে আমি জোরালভাবে সুপারিশ করছি, নতুন আরও কি কি যন্ত্রপাতি লাগবে, সে-বিষয়ে বিশদ বিবরণ দেয়ার পর আবার মাথা তুললেন কর্নেল নিকলসন। মোটামুটি যা বলার বললাম। এরপরেও যদি বোঝার কিছু থাকে, ডাকবেন, যে-কোনও সময়ে বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকব আমি। নতুন পরামর্শ থাকলে সেটাও দেখব বিবেচনা করে। তো, আমি যে পরামর্শগুলো দিলাম তার সাথে কি আপনি একমত?
সাইতো অবশ্য আরও ব্যাখ্যা আশা করেছিলেন, কিন্তু মুখে সেকথা না বলে আবারও সম্মতি জানালেন মাথা ঝাঁকিয়ে। মর্যাদাহানির ব্যাপার আর তার মাথায় নেই। এই কাজের ওপরে তাঁর জীবন-মরণ নির্ভর করছে। সুতরাং পাইলগুলো সেতুর ভার বহনে সক্ষম হয়েছে–এই দৃশ্যটি তিনি দেখতে চান যে-কোনও মূল্যে।
প্রাথমিক সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আবার বলে চললেন কর্নেল নিকলসন;
গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা বিষয় আছে, কর্নেল সাইতো–সময়। বুঝতেই পারছেন, নতুন রেললাইন বসাতে প্রয়োজন হবে অনেকখানি বাড়তি কাজের। তা ছাড়া নতুন ক্যাম্প তৈরির প্রশ্নটা তো আছেই।
নতুন ক্যাম্প আবার কেন? প্রতিবাদ জানালেন সাইতো। মাইল দুই রাস্তা বন্দীরা হেঁটেই যেতে পারবে।
আমার সহকর্মীরা বিষয়টা উভয় দিক থেকেই ভেবে দেখেছে, বললেন কর্নেল। তাদের সিদ্ধান্ত হলো…।
রীভস আর হিউজেস হিসেব করে দেখছেন যে প্রত্যেকদিন যাতায়াতে যত সময় ব্যয় হবে, তার চেয়ে অনেক কম সময়ে নতুন ক্যাম্প তৈরি করে ফেলা সম্ভব। এ-যুক্তির বিপক্ষেও কোনও কথা খুঁজে পেলেন না সাইতো। ফলে আবার মুখ খুললেন কর্নেল:
ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে এক মাসেরও বেশি সময়। আমার পরামর্শমত কাজ করলে অবশ্য সেতু তৈরিতে খুব বেশি দেরি হবে না। একটা দল গাছ কাটবে, আরেক দল রেললাইন পাতবে, এবং অন্য আরেকটা দল তৈরি করবে নতুন ক্যাম্প। কিন্তু এসব কাজের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মেজর হিউজেসের ধারণা, এত কিছু করার মত যথেষ্ট লোকবল আমাদের নেই।
অস্বস্তিকর নীরবতার মাঝে কেটে গেল কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর আবার কথা বলে উঠলেন কর্নেল নিকলসন:
তাই এ-ক্ষেত্রেও আমার একটা পরামর্শ আছে, কর্নেল সাইতো। বলছিলাম যে বেশির ভাগ ব্রিটিশ সৈন্য খাটুক সেতুর পেছনে। বাদবাকি যারা থাকবে তাদের সাথে জাপানী সৈন্য যোগ দিয়ে দ্রুত সেরে ফেলুক রেললাইন বসানোর কাজ। আর নতুন ক্যাম্প তৈরির দায়িত্ব সম্পূর্ণ থাকুক আপনার লোকেদের ওপর। বাঁশের কাজে আপনার সৈন্যেরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অভ্যস্ত।
কর্নেলের বক্তব্যের প্রথমদিকে গলা টিপে ধরার ইচ্ছে হলেও এখন তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারলেন না ক্লিপটন। গভীর একজোড়া নীল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হলো, আপাত সাধারণ ওই মানুষটির মাথায় রয়েছে সূক্ষ্ণ বুদ্ধির প্যাঁচ।
এবারে তিনি চাইলেন সাইতোর মুখের দিকে। সত্যিই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন জাপানী অফিসারটি।
জাপানী ভাষায় অত্যন্তু দ্রুত নিজের অফিসারদের কিছু নির্দেশ দিলেন সাইতো, যা তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ বুঝল বলে মনে হলো না। সাইতো থামার পর খুব সাবধানে শেষ প্রসঙ্গটা উত্থাপন করলেন কর্নেল নিকলসন।
আপনার লোকেদের মাথা পিছু কাজ নির্ধারণ করাটা বাকি আছে এখনও। যাতে বেশি ক্লান্ত হয়ে না পড়ে সেজন্যে এক ঘনগজের কথাই ভেবেছিলাম প্রথমে। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্যদের সমান মাটি কাটাটাই কি ভাল দেখাবে না? তা হলে দুদলই কাজ করতে পারবে প্রতিযোগিতামূলক একটা মনোভাব নিয়ে…
জাপানী সৈন্যেরা মাটি কাটবে দুঘনাজ করে, গলা চড়ালেন সাইতো। আমি তো আদেশ জারি করে ফেলেছি!
সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন কর্নেল নিকলসন।
তা হলে তো খুব দ্রুত অগ্রগতি হবে আমাদের। আর কিছু বলার নেই, কর্নেল সাইতো। কারও যদি কোনও প্রশ্ন না থাকে, কনফারেন্স শেষ করা যেতে পারে এখানেই। আগামীকাল সকাল থেকে আমরা কাজ শুরু করব আজকের আলোচনার ভিত্তিতে।
উঠে পড়ে আবার এক স্যালুট দিয়ে কর্নেল পা বাড়ালেন নিজের কুটিরের উদ্দেশে, পেছনে পেছনে ক্লিপটন।
ওরা কি দারুণ বোকা, স্যার! কর্নেলের চোখে চোখে চেয়ে বললেন তিনি। জলাভূমির ওপর সেতু তৈরি করলে ধসে পড়ে কী কেলেঙ্কারিই না হত!
কিন্তু কর্নেলের মুখ স্ফিংক্সের মতই নির্বিকার। ওই মুখের রহস্য ভেদ করার সাধ্য ক্লিপটনের নেই।
হ্যাঁ, ওরা বোকাই, শেষমেশ জবাব দিলেন কর্নেল নিকলসন। কিছুদিন আগেও ওরা বুনো ছিল। এরকম সেতু নির্মাণের ক্ষমতা ওদের নেই। ওরা বড়জোর তৈরি করতে পারে বুনো লতার সাঁকো।
১১.
পাশ্চাত্যের মানুষের সেতুর ধারণার সাথে জাপানীদের ধারণার কোনও মিল নেই। যোগ্যতাসম্পন্ন এঞ্জিনিয়ার যে তাদের নেই, তা নয়। কিন্তু তারা সব রাজধানীর বাসিন্দা। সামান্য কজন যে এঞ্জিনিয়ারকে থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে, দক্ষতা তাদের খুব কম। তা ছাড়া, সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসব এঞ্জিনিয়ারকে ঘোড়াই কেয়ার করে।
সৈন্যেরা প্ল্যান বা ডিজাইনের ধার ধারে না, তাদের কাছে প্রয়োজনটাই বড়। অর্থাৎ নিখুঁত জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায় না তারা, কাজ চললেই হলো।
হয়তো একটা সেতু তৈরি করল তারা, যার ফুটপাতের বালাই নেই, পার হতে হয় বীমে পা দিয়ে–আর এই কাজে জাপানীরা ওস্তাদ।
হোঁচট খেতে খেতে হয়তো একটা ট্রেন পার হলো তার ওপর দিয়ে, এখানেসেখানে সরে গেল দুএকটা কাঠ, সাথে সাথে জাপানী সৈন্যরা মেরামত করে ফেলল সে-জায়গা। পরের ট্রেনটাও পার হয় একই কায়দায়। এসব সেতু টেকে কয়েকদিন, কয়েক সপ্তাহ, কখনও বা কয়েক মাস, তারপর বন্যা এসে পুরোটাকেই নিয়ে যায় ভাসিয়ে। প্রবল উৎসাহে আবার সেতু তৈরির কাজে লেগে পড়ে জাপানীরা, অফুরন্ত কাঠ জোগাতে জঙ্গল তো আছেই।
কিন্তু এ-ধরনের কাঁচা কাজ করতে চান না ক্যাপ্টেন রীভ।
রেললাইন বসানোর জায়গা মেজর হিউজেসকে দেখিয়ে দিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন সেতুর প্ল্যান আর ডিজাইন নিয়ে।
দেখতে দেখতে ভারতে কাজ করার মতই আগ্রহী হয়ে উঠলেন রীভত্স। সেআগ্রহ আরও বেড়ে গেল কমান্ডিং অফিসারের আকস্মিক এক কথায়। _ এ-কাজের ব্যাপারে আমি তোমার ওপরেই সম্পূর্ণ ভরসা করে আছি, রীভস। এ-বিষয়ে তুমিই আমাদের একমাত্র বিশেষজ্ঞ বলে সবকিছুই ছেড়ে দিয়েছি তোমার হাতে। আমরা যে এই বুনোদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সেটা প্রমাণ করতেই হবে। অভিশপ্ত এই দেশে, যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায় না সেখানে কাজ করাটা যে কত কঠিন তা আমি জানি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারাটাই আসল যোগ্যতার চিহ্ন।
আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন, স্যার, বললেন রীভূস্। যেভাবে হোক রক্ষা করব আপনার মর্যাদা।
সারা জীবন ধরে এরকম একটা বড় কাজের জন্যে অপেক্ষা করে আছেন ক্যাপ্টেন রীভস, যেখানে বড় অফিসারদের চোখ রাঙানি বা হাস্যকর নাক গলানো থাকবে না। কমান্ডিং অফিসার হিসেবে কর্নেল নিকলসন একেবারে আদর্শ। বাজে খবরদারি তো দূরের কথা, এঞ্জিনিয়ারিং সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই–সেটা বলতেও দ্বিধাবোধ করেন না তিনি। সৃজনী প্রতিভা প্রকাশের জন্যে টগবগ করছেন রীভস। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব তিনি পূরণ করবেন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে।
প্রথমে কল্পনার চোখে দেখা একটা সেতুর স্কেচ করলেন। চার সারি পাইলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেতুটা–ওপর দিয়ে শুধু রেললাইনই যায়নি, পাশে রয়েছে যানবাহন চলাচলের রাস্তা আর ফুটপাথ।
এরপর শুরু হলো মূল ডিজাইন আর নানারকম হিসেব। মাঝেমাঝে পাশে বসে মুগ্ধ চোখে এসব কাজ দেখেন জাপানী এঞ্জিনিয়ার।
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত খেটে চলেন রীভস। এমনই ডুবে থাকেন কাজের মাঝে, দিন খুব ছোট মনে হয়। শেষমেশ সাইতোকে বলে একটা বাতি জ্বেলে রাখার অনুমতি আদায় করেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে যাবার পরেও চলে খুঁটিনাটি হিসেব, কখনও কখনও মধ্যরাত পর্যন্ত।
মনে রাখবার মত একটা সেতু তৈরি করার জন্যে নিজের সুখশান্তিকে বিসর্জন দেন ক্যাপ্টেন রীভস।
প্রস্তুতিমূলক এত খাটাখাঁটি প্রথমটায় বাড়াবাড়ি মনে হয় ক্লিপটনের কাছে। কিন্তু যখন মেজর হিউজেসের কাছে প্ল্যান হস্তান্তর করেন রীভস, তার মনে হয়, কোনও জিনিস না বুঝে হুট করে একটা ধারণার বশবর্তী হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
বু-প্রিন্টটা কর্নেল নিকলসনও পছন্দ করেন। শুধু বলেন, অতিরিক্ত খাটাটা উচিত হবে না।
ভাল থাকতে থাকতেই দেখবে, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছ একদিন। সেতুর কাজ পুরোপুরি নির্ভর করছে তোমার ওপর, কথাটা মনে রেখো, রীভূস্।
একটা ব্যাপার আমাকে খুব ভাবাচ্ছে, স্যার। বিষয়টার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল আমাদের। আপনি শুনে একটা মতামত দিলে ভাল হয়।
কি ব্যাপার, রীভস? জানতে চাইলেন কর্নেল।
কাঠগুলো এখনও স্যাতসেঁতে আছে, স্যার। এরকম কাজে কাঁচা কাঠ ব্যবহার করা উচিত নয়। গাছগুলো সদ্য কাটা হয়েছে তো, সুতরাং শুকোতে হবে রোদে।
কতদিন লাগবে ওগুলো শুকোতে?
কাঠের জাতের ওপর নির্ভর করে, স্যার। কোনও কোনওটার ক্ষেত্রে আঠারো মাস, এমনকী দুবছর পর্যন্ত লেগে যায় ভালভাবে শুকোতে।
এত দেরির তো প্রশ্নই ওঠে না, রীত! আমাদের হাতে মাত্র পাঁচ মাস সময় আছে।
মাথা ঝুলে পড়ল ক্যাপ্টেনের।
দুঃখিত, স্যার। আমি এটা জানি, আর জানি বলেই চিন্তা হচ্ছে।
কাচা কাঠ ব্যবহার করতে অসুবিধেটা কোথায়?
কোনও কোনও কাঠে চিড় ধরে, স্যার। কোনওটা আবার সংকুচিত হয়ে আসে। এলম কাঠের এসব বালাই নেই বললেই চলে। সেজন্যে অবশ্য এলম জাতীয় কাঠই বাছাই করেছি বেশি। লন্ডন ব্রিজের এলমের খুঁটিগুলো ছশো বছর ধরে টিকে আছে, স্যার।
ছশো বছর! বিস্ময় ফুটল কর্নেলের গলায়। নিজের অজান্তেই দৃষ্টি চলে গেল কওয়াই নদীর দিকে। ছশো বছর ধরে টিকে আছে! বলো কি, রীভস?।
ওটা অবশ্য ব্যতিক্রম, স্যার। এখানে আপনি বড়জোড় পঞ্চাশ বা ষাট বছর টেকার আশা করতে পারেন। কাঠ ভালভাবে না শুকোলে হয়তো তার চেয়েও কম।
ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হবে, রীভস, দৃঢ় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন কর্নেল। তাজা কাঠ দিয়েই কাজ চালাতে হবে তোমাকে। তা হলে কোনও ত্রুটি দেখা দিলে বলতে পারব, এতে আমাদের করার কিছু ছিল না।
ঠিক বলেছেন, স্যার। আর একটা কথা। ক্রিয়াজোট, ঘুণের হাত থেকে বীমগুলোকে বাঁচবার জন্যে…আমাদের বোধহয় ওটা ছাড়াই কাজ চালিয়ে নিতে হবে, স্যার। জাপানীদের কাছে ক্রিয়োজোট নেই। একটা বিকল্প অবশ্য তৈরি করা যায়…উড-অ্যালকোহল। এতে কাজ হবে, কিন্তু সময় লাগবে তৈরি করতে…না, থাক, তার চেয়ে বরং…
কেন, থাকবে কেন, রীভস? এসব খুঁটিনাটি প্রসঙ্গে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন কর্নেল।
এ-ব্যাপারে একটু মতভেদ আছে, স্যার। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কাঠ যথেষ্ট না শুকোলে ক্রিয়োজোট ব্যবহার না করাই ভাল। দ্রুত পচন ধরার একটা ঝুঁকি থাকে।
তা হলে ক্রিয়োজোট ছাড়াই আমাদের চালাতে হবে, রীভত্স। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেতু তৈরি করাটাই এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
এই বাধা দুটো ছাড়া, চমৎকার একটা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ আশাবাদী, স্যার।
এটাই তো চাই, রীভত্স, চমৎকার একটা সেতু। আর আগেই তো বলেছি, এব্যাপারে সম্পূর্ণ ভরসা করে আছি তোমার ওপর।
উপদেষ্টাকে পেছনে রেখে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোলেন কর্নেল নিকলসন।
১২.
ফোর্স ৩১৬-এর সিয়ার্স–থাইল্যান্ডের প্রতিরক্ষা বাহিনী যাকে বলে এক নম্বরখুব ধীরস্থির মানুষ। যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে তিনি কোনও আক্রমণ চালাতে চান না। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড প্রফেসর ওয়ার্ডেনের মাথাও ভীষণ ঠাণ্ডা। নিশ্চিত না হয়ে হঠাৎ একটা কিছু করে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলার একেবারে বিরুদ্ধে তিনি। দলের তৃতীয়জন–জয়েস। কোর্স সদ্য শেষ করলেও যুবকটির হাবভাব দেখে মনে হয় যেন তার জন্মই হয়েছে এ-ধরনের কাজের জন্যে। তাই সিয়ার্স তার মতামতও খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন।
থাইল্যান্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বর্তমানে তারা আসন গেড়েছেন দুঘর বিশিষ্ট একটা কুটিরে। এক সন্ধ্যায় সেখানেই তাঁরা বসেছেন একটা ম্যাপ নিয়ে আলোচনা করতে।
এটাই রেলওয়ের সম্ভাব্য গতিপথ, স্যার, বলল জয়েস। রিপোর্টগুলো যাচাই করে দেখেছি আমি।
কলকাতায় প্লাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির স্কুলে কোর্স করার আগে জয়েস ছিল একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনার। বার্মা-থাইল্যান্ড রেলওয়ের এই ম্যাপটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছে সে।
এখানে এসে নিরাপদে নামার পর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে নানারকম। স্থানীয় অধিবাসীদের ভালবাসা পেয়েছেন তারা অকৃপণভাবে। যোগাযোেগ রাখছে থাইল্যান্ডের এজেন্টরা। সিয়ার্স সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে চান না, কিন্তু তিনিও ধীরে ধীরে এদের বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে শুরু করেছেন।
মিশনের প্রথম ভাগ সাফল্যের সাথেই এগিয়ে চলেছে। অসংখ্য গ্রামের মোড়লের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে গোপনে। সাহায্য করার জন্যে স্বেচ্ছাসেবীরা এক পায়ে খাড়া। তাদের এখন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বিস্ফোরকের ব্যবহার সম্বন্ধে।
সেতু অনেক আছে, স্যার, বলে চলল জয়েস, কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য সেতু বেশি নেই। তথ্য অনুসারে এই হলো ব্যাঙ্কক থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত যাবতীয় সেতুর তালিকা।
এই স্যার সম্বোধন মেজর সিয়ার্সের প্রতি। যদিও ফোর্স ৩১৬-এর শৃঙ্খলা খুবই কড়া, এ-ধরনের মিশনে এত নিয়মকানুন চলে না। তাই স্যার বলতে বেশ কয়েকবার নিষেধ করেছেন সিয়ার্স, কিন্তু জয়েসের অভ্যেস বদলাতে পারেননি।
তবু এখন পর্যন্ত তিনি জয়েসের মধ্যে যা কিছু লক্ষ করেছেন তার প্রায় সবই প্রশংসারযোগ্য। গোলকধাধার মত রিপোর্টগুলো সে যেভাবে বিশ্লেষণ করে, ভাবা যায় না। প্রফেসর ওয়ার্ডেনও তার কাজকর্মে মুগ্ধ।
জয়েসকে দলে নেয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করেছিল শিক্ষকেরা। প্রথম তাকে দেখে সিয়ার্সেরও মনে হয়েছিল, এরকম একটা ছেলেকেই যেন খুঁজছিলেন তিনি।
এধরনের একটা অস্ত্র কি তুমি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারবে? একদিন জানতে চাইলেন সিয়ার্স।
তার হাতে একটা ক্ষুরধার ড্যাগার। স্পেশাল মিশনে গেলে ফোর্স ৩১৬-এর সবাই এই অস্ত্রটা সাথে রাখে। চোখের পাতাও কাঁপল না জয়েসের। বলল, অস্ত্রটার ব্যাপারে তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া অনুশীলনও চালাতে হয়েছে ডামির ওপর। সিয়ার্স পুনরাবৃত্তি করলেন প্রশ্নটার।
তুমি কেমন প্রশিক্ষণ নিয়েছ না নিয়েছ, সেটা আমি শুনতে চাইনি। আমি জানতে চাইছিলাম, অস্ত্রটা তুমি ঠাণ্ডা মাথায় ব্যবহার করতে পারবে কিনা। ব্যবহারের কায়দা অনেকেই জানে, কিন্তু প্রকৃত প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করতে পারে না।
এবার বুঝতে পারল জয়েস। চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত ভেবে জবাব দিল সে গম্ভীর হয়ে:
প্রশ্নটা আমি নিজেই নিজেকে অনেকবার করেছি, স্যার।
নিজেই নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছ? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল সিয়ার্সের দৃষ্টি।
জী, স্যার, সত্যিই। আর প্রশ্নটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। মাঝেমাঝে ভাবার চেষ্টা করেছি–
তা জবাব কি পেয়েছ?
ইতস্তত করল জয়েস, কিন্ত মাত্র এক মুহূর্তের জন্যে।
খোলাখুলি বলতে গেলে, স্যার, সেরকম প্রয়োজনের সময় আমি বোধহয় আপনাকে হতাশ করব না। কিন্তু নিশ্চিত হয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপ্রাণ চেষ্টা করব, স্যার।
অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, এখন পর্যন্ত ওটা ব্যবহার করার বাস্তব অভিজ্ঞতা তোমার হয়নি, তাই না?
ঠিক ধরেছেন, স্যার। তেমন প্রয়োজন পড়েনি এখনও, কথাটা জয়েস এমনভাবে বলল, যেন ক্ষমা চাইছে।
হেসে ফেললেন সিয়ার্স। ওয়ার্ডেন বললেন:
এই ছেলে বোধহয় ভাবছে, আমাদের পুরনো চাকুরি এ-ধরনের মিশনের পক্ষে খুব সহায়ক? প্রাচ্য ভাষার অধ্যাপক! আর আপনার কি মনে হয়–অশ্বারোহী বাহিনীর অফিসার!
আমি ঠিক তা বোঝাতে চাইনি, স্যার, চরম অস্বস্তিতে তোতলাতে শুরু করল জয়েস।
আমাদের এই ফোর্স ৩১৬ এমন একটা প্রতিষ্ঠান, বললেন সিয়ার্স, যেখানে অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট বা প্রাক্তন অশ্বারোহী অফিসারও মিশন নিয়ে যেতে পারে–সুতরাং যদি তারা পারে, একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনার পারবে না কেন?
ওকে নিয়ে নিন, ইন্টারভিউ শেষে জয়েস বিদায় নেয়ার সাথে সাথে বললেন ওয়ার্ডেন।
সুতরাং মিশনের প্রথম থেকেই সিয়ার্স মনে মনে খুশি। জয়েসের মত একজন বাস্তববাদী ছেলেরই প্রয়োজন ছিল তার। বেশির ভাগ মানুষ নিজেকে হয় ওভারএস্টিমেট নয়তো আভার এস্টিমেট করে। তাই জয়েসকে পেয়ে সত্যিই তিনি খুশি। আর, প্রফেসর ওয়ার্ডেনের যোগ্যতার তো প্রশ্নই উঠতে পারে না।
ম্যাপে প্রত্যেকটা সেতু দেখিয়ে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে শুরু করল জয়েস। মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন সিয়ার্স আর ওয়ার্ডেন। পাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন কোম্পানির সদস্য মাত্রেরই সেতুর ব্যাপারে একটা আলাদা আগ্রহ আছে।
এসব সেতুর বর্ণনা আমরা শুনতে চাইনি, জয়েস, বললেন সিয়ার্স। আমাদের প্রয়োজন সত্যিকারের বড় টার্গেট।
আমি শুধু ওগুলোর উল্লেখ করেছি, স্যার, স্মৃতিটা একটু ঝালিয়ে নেয়ার জন্যে। যতদূর মনে হচ্ছে, আমাদের প্রয়োজন মেটাবার উপযুক্ত টার্গেট এখানে আছে মাত্র তিনটে।
জয়েস ঠিকই বলেছে, মন্তব্য করলেন ওয়ার্ডেন। গুরুত্বপূর্ণ সেতু এখানে মাত্র তিনটেই আছে। একটা ক্যাম্প থ্রী-র কাছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ওটা আমাদের বাদ দিতে হবে, বললেন সিয়ার্স। সেতুটার আশপাশ একেবারে ফাঁকা। তা ছাড়া, অঞ্চলটা সমতল। নিচু তীর। সহজেই মেরামত করে নিতে পারবে আবার।
আরেকটা ক্যাম্প টেন-এর পাশে।
টার্গেট হিসেবে এটা মন্দ নয়। কিন্তু জায়গাটা বার্মায়, স্থানীয় অধিবাসীদের কোনও সাহায্য পাব না। তা ছাড়া…।
তৃতীয়টা, স্যার, বলে উঠল জয়েস, খেয়াল নেই যে ঢুকে পড়েছে তার কমান্ডিং অফিসারের কথার মধ্যে, তৃতীয়টা হলো কওয়াই নদীর ওপরে। এ জায়গাটা ঝামেলামুক্ত। আশেপাশে কোনও জনবসতি নেই। পুরো অঞ্চলটাই জলে। নদীটা চারশো ফুট চওড়া, দুপাশেই খাড়া পাড়। এখান থেকে দুতিন দিনের হাঁটা পথ। সবার চোখ এড়িয়ে কাছে গিয়ে পৌঁছনো সম্ভব। সমস্ত সেতুর মধ্যে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট, চার সারি পাইল আছে।
এজেন্টের রিপোর্টগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছ মনে হচেছ, বললেন সিয়ার্স।
ওগুলো খুব পরিষ্কার, স্যার। সেতুটা মনে হয়…।
হ্যাঁ, টার্গেট হিসেবে কওয়াই সেতু উল্লেখযোগ্য, ঝুঁকে পড়লেন সিয়ার্স ম্যাপের ওপরে। নতুন হিসেবে তোমার বিশ্লেষণ খুব একটা খারাপ নয়। এই সেতু সম্বন্ধে ইতোমধ্যেই আমার কথা হয়েছে কর্নেল গ্রীনের সাথে। কিন্তু আরও তথ্য জোগাড় করতে হবে আমাদের আরও সহজে আক্রমণ করা যায়, এমন সেতুর খোঁজ মিলতে পারে। তা কথা শুনে তো মনে হলো, তুমি যেন ওটা নিজের চোখে দেখেছ–কতখানি কাজ হয়েছে ওই চমৎকার সেতুটার?
১৩.
কাজ বেশ ভালই এগোচ্ছে। ব্রিটিশ সৈন্যেরা খুব পরিশ্রমী। অফিসারের ওপর আস্থা থাকলে তারা কাজ করে চলে মুখ বুজে। সকাল হবার সাথে সাথে কাজ শুরু হয়ে যায় কওয়াই নদীর ক্যাম্পে। কয়েক দিনের মধ্যেই তারা প্রমাণ করেছে, এতদিন ইচ্ছেকৃত শয়তানি করেছে বটে, কিন্তু পরিশ্রমেও তাদের তুলনা মেলা ভার। ভুল বোঝাবুঝি দূর করার জন্যে প্রথমেই সবার উদ্দেশে একটা বক্তৃতায় কর্নেল নিকলসন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে তিনি কী আশা করেন। তারপরেও যে দুএকজন উল্টোপাল্টা আচরণ করেছে, তাদের জন্যে হয়েছে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা।
একদিন ক্লিপটন আপত্তি জানিয়ে বললেন জানিয়ে যে, এমনিতেই বন্দীরা অপুষ্টিতে ভুগছে, এ-অবস্থায় এত খাঁটিয়ে নিলে তাদের স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি হবে।
তোমার চেয়ে আমি ওদের বেশি চিনি, জবাব দিলেন কর্নেল নিকলসন। গত তিরিশ বছর ধরে আমি দেখছিও ওদের। আলসেমি আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। আর আত্মবিশ্বাস নষ্ট হলেই ঘটে স্বাস্থ্যহানি। ওদের বসিয়ে রাখো, দেখবে, পুরো ইউনিট জুড়েই বেড়ে উঠছে একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিন্তু সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করিয়ে নাও, মন খারাপ করার সময়ই পাবে না, রাতে ঘুমোবে ভাল, স্বাস্থ্যও থাকবে চমকার।
নিজের কাজ নিয়ে সুখে থাকো! বিদ্রুপ ফুটল ক্লিপটনের গলায়। এটাই জেনারেল ইয়ামাসিতার আদর্শ।
আদর্শটা কিন্তু খারাপ নয়, ক্লিপটন। শত্রুরও কোনও আদর্শ যদি ভাল হয়, সেটা নির্দ্বিধায় আমাদের গ্রহণ করা উচিত। ওদের হাতে কাজ না থাকলে নতুন কাজ আমি আবিষ্কার করতাম। আপাতত আমাদের নির্মাণ করতে হবে সেতুটা।
কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে শেষমেশ ক্লিপটন বললেন:
হ্যাঁ, সেতুটা তো আমাদের নির্মাণ করতেই হবে।
জাপানী সৈন্যেরা এমনিতেই কঠোর পরিশ্রমী, তার ওপর কর্নেল সাইতো আবার হুমকি দিয়ে রেখেছেন যে শ্রমিক হিসেবে জাপানীরা বিট্রিশদের চেয়ে দক্ষ, যে কোনও মূল্যে এটা প্রমাণ করতে হবে। ফলে দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল নতুন রেললাইন বসানোর কাজ, বাসযোগ্য কুটির তৈরি হলো নতুন ক্যাম্পে। আর ঠিক এই সময়েই সূক্ষ্ম দুএকটা সংশোধন সেরে ফাইনাল প্ল্যানটা রীভত্স তুলে দিলেন মেজর হিউজেসের হাতে।
শ্রমিকদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে দিলেন হিউজেস। একদল গাছ কাটল, আরেক দল তক্তা বানাল, অন্য আরেকটা দল তৈরি করল বীম। সবচেয়ে বড়ো দলটা নিযুক্ত রইল পাইল পোঁতার কাজে। এ ছাড়াও কেউ কেউ ভারা বাঁধল, জিনিসপত্র জোগান দিল বা রক্ষণাবেক্ষণ করল যন্ত্রপাতির।
যাবতীয় কাজের মধ্যে পাইল পোতাটাই সবচেয়ে ক্লান্তিকর। দড়াম করে জেহ্যামার পড়ল, লোহার মত শক্ত মাটিতে পাইল ঢুকে গেল এক ইঞ্চির কয়েক ভাগের এক ভাগ, দড়ি বা পুলি দিয়ে টেনে তোলা হলো জেহ্যামার, আবার পড়ল দড়াম করে। জাপানীদের বিস্মিত চোখের সামনে চার সারি পাইল পানির ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল বাম তীরের দিকে।
হিউজেসের সযত্ন তত্ত্বাবধানে সেতুর কাজ এগোতে লাগল অঙ্কশাস্ত্রের নির্ভুলতায়।
কাজের অগ্রগতিতে কর্নেল নিকলসন সন্তুষ্ট। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হয়, সেটা যেন জন্ম নিচ্ছে প্রকৃতির কোল থেকে।
সেতুর দিকে তাকিয়ে গর্বিত বোধ করলেন ক্যাপ্টেন রীভস। থাইল্যান্ডের এই জঙ্গলের মাঝে অসাধারণ সেতুটাকে রূপ নিতে দেখে মনে হয়, তাঁর এতদিনের কঠোর পরিশ্রম তা হলে বৃথা যায়নি!
প্রতিদিনের অগ্রগতি দেখে অভিভূত হয়ে যান কর্নেল সাইতো। প্ল্যানের কিছুই বোঝেন না তিনি, ফলে অগ্রগতিটা মনে হয় জাদুর মত। অনেক বিতৃষ্ণা সত্ত্বেও মনে মনে ব্রিটিশ সৈনিকদের প্রশংসা না করে পারেন না।
ক্লিপটনও অভিভূত হন সেতুর কাজে। কর্নেল নিকলসনকে উপহাস করায় মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত হন তিনি, ক্ষমা চান নিঃশব্দে। নিজের সম্বন্ধে অযথা উচ্চ ধারণা পোষণ করেন তিনি, আসলে অনেক জিনিসের প্রায় কিছুই বোঝেন না। বন্দীদের স্বাস্থ্যহানি তো দূরের কথা, এমনকি যারা পাইল বসানোের মত বিশ্রী কাজ করছে, তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে রয়েছে উৎফুল্ল একটা ভাব। না, অযথাই প্রত্যেকটা জিনিস বোেঝার ভান করেন তিনি।
প্রতিদিন কওয়াই সেতু হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, সুন্দর থেকে সুন্দরতর। দেখতে দেখতে ওটা পৌঁছে গেল নদীর মাঝামাঝি, আরও এগিয়ে গেল একসময়। সবাই বুঝতে পারছে, জাপানী হাই কমাভের নির্ধারিত তারিখের আগেই শেষ হয়ে যাবে সেতুর কাজ। তারপর যথাসময়ে একদিন এগিয়ে যাবে বিজয়ী বাহিনী।
চোদ্দ ঢকঢক করে মদের গ্লাসটা সাবড়ে দিল জয়েস। দুঃসাধ্য অভিযানের চিহ্নমাত্র তার চেহারায় নেই। থাইদের ছদ্মবেশ সে এতই নিখুঁত নিয়েছে সিয়ার্স আর ওয়ার্ডেনের পক্ষেও তাকে চেনা কঠিন হয়ে উঠেছিল। এই মুহূর্তে অভিযানের বর্ণনা দেয়ার জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছে সে।
টার্গেটটা সত্যিই বড়, স্যার। ব্যাপারটা অবশ্য খুব সহজ হবে না, কিন্তু অসম্ভবও নয়–তবে টার্গেটটা সত্যিই বড়। চারপাশে ঘন জঙ্গল। নদীটাও চওড়া। তীরদুটো খাড়া সেতুর সাথে ট্রেন ধ্বংস করা হলে জায়গাটা পরিষ্কার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
প্রথম থেকে শুরু করো, বললেন সিয়ার্স। নাকি গোসল সেরে নিতে চাও আগে?
আমি ক্লান্ত নই, স্যার।
ওকে সুযোগ দিন, বললেন ওয়ার্ডেন। দেখছেন না ও কথা বলতেই চায়, বিশ্রাম নয়।
সিয়ার্স হাসলেন। বলার জন্যে যেমন ছটফট করছে জয়েস, তাঁর শোনার আগ্রহও সে-তুলনায় কম নয়। সুতরাং যথাসম্ভব আরাম করে তারা বসলেন ম্যাপটার সামনে। জয়েসকে আরেক গ্লাস মদ এগিয়ে দিলেন ওয়ার্ডেন। পাশের ঘরে গ্রামবাসী পরিবেষ্টিত হয়ে অভিযানের বর্ণনা শুরু করেছে থাই দুই গাইড।
যাত্রাটা অবশ্য বেশ কঠিন, বলতে লাগল জয়েস। পুরো তিন রাত এগোতে হয় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। কিন্তু গাইড দুজন তুলনাহীন। ওরা আমাকে ঠিক নিয়ে গেল কওয়াই নদীর বামদিকের পাহাড়ে। ওখান থেকে সম্পূর্ণ উপত্যকা, ক্যাম্প আর সেটা দেখা যায়। পর্যবেক্ষণের জন্যে পাহাড়টা নিখুঁত।
আশা করি কেউ তোমাকে দেখেনি?
কোনও সুযোগই ছিল না, স্যার। আমরা হেঁটেছি শুধু রাতের বেলায়। অন্ধকার ছিল এতই গাঢ়, আমাকে হাত রাখতে হত গাইডের কাঁধে। দিনের বেলা আমরা শুয়ে কাটয়েছি ঘন ঝোপের মাঝে। কিন্তু এত সাবধানতার বোধহয় কোনও প্রয়োজন ছিল না। ওখানে পৌছার আগ পর্যন্ত একটা মানুষও আমাদের চোখে পড়েনি।
চমৎকার, বললেন সিয়ার্স। তারপর?
জয়েসকে পাঠাবার পেছনে একটা উদ্দেশ্য ছিল সিয়ার্সের। তিনি দেখতে চাইছিলেন, কোনও কাজ সম্পূর্ণ ছেড়ে দিলে ছেলেটা কিভাবে করে। হাবভাবে মনে হচ্ছে, কাজটা সে ভালভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছে। তা ছাড়া গাইড দুজনকেও দেখা যাচেছ ছেলেটার ওপর খুব খুশি–এটা আরেকটা ভাল লক্ষণ।
থাই গাইডেরা ভুল বলেনি, স্যার। টার্গেটটা সত্যিই বিরাট।
ক্রমেই এগিয়ে আসছে জিরো আওয়ার। ম্যাপ দেখে দেখে বার্মা-থাইল্যান্ড রেলওয়ের কোথায় কতখানি অগ্রগতি হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে রাখছে জয়েস। কনস্ট্রাকশনের কাজগুলো চিহ্নিত করে রাখছেন ওয়ার্ডেন।
যতই তথ্য আসছে, ততই তাদের আগ্রহ বাড়ছে কওয়াই সেতুর প্রতি। সহজে আক্রমণ করা সম্ভব, এমন আরও অনেক সেতু নিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁরা। কিন্তু ক্রমে ক্রমে সমস্ত মনোেযোগ গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে কওয়াই সেতুর ওপর। বড় টার্গেট হিসেবে এতদিন যা ছিল স্রেফ আবছা একটা ধারণা, ধীরে ধীরে যেন তা রূপ নিচ্ছে চরম বাস্তবে।
এই কাজ রয়্যাল এয়ারফোর্সের নয়, একদিন বললেন সিয়ার্স। আকাশ থেকে কাঠের এত বড় একটা সেতু ধ্বংস করা কঠিন। বোমা পড়ে হয়তো বড়জোর দুতিনটে আর্চ নষ্ট হবে। সামান্য বেঁকে যাবে বাদবাকিগুলো। চোখের পলকে সেসব মেরামত করে ফেলবে জাপানীরা, এ-ধরনের কাজে তারা ওস্তাদ। কিন্তু বিস্ফোরক ব্যবহার করে আমরা পাইলগুলোকেই শুধু শুইয়ে দিতে পারব না, সেতুটাকে ধ্বংস করতে পারব ঠিক কোনও ট্রেন পার হবার সময়। হুড়মুড় করে ট্রেনটা পড়ে যাবে নিচে, প্রত্যেকটা বীম অকেজো হয়ে যাবে। এরকম কাও আমি আগেও ঘটতে দেখেছি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ বন্ধ থাকে রাস্তা। ভেবে দেখো, ক্রেন আনা সম্ভব এমন সভ্য জায়গাতেই যদি এই অবস্থা হয়, এখানে ব্যাপারটা কেমন হবে? পুরো সেতুটা নতুন করে তৈরি করা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না। তা ছাড়া বুঝতেই পারছ, যুদ্ধের সাজসরঞ্জামের ক্ষতিটা কী পরিমাণ হবে! আমি আর ভাবতে পারছি না! সমস্ত কিছু যেন দেখতে পাচ্ছি একেবারে চোখের সামনে…
ধ্বংসযজ্ঞটা কল্পনা করতে বাকি দুজনেরও কোনও অসুবিধে হলো না। জয়েস তো স্বপ্ন দেখতে লাগল ঘন ঘন। ট্রেনটা উঠে পড়েছে সেতুর ওপরে, নিচে চকচক করছে কওয়াই নদী। তার হাত প্লঞ্জারে আর দৃষ্টি সেতুর মাঝামাঝি একটা নির্দিষ্ট জায়গার ওপর নিবদ্ধ। ক্রমেই দুরত্ব কমে আসছে ট্রেন আর সেই জায়গার মধ্যে। মাত্র কয়েক ফুট, আর এক ফুট। চোখের সামনে বিশাল সেতু, নিজের অজান্তেই সে চাপ দিল প্লারে…।
একদিন উদ্বিগ্ন হয়ে সে বলল, আশা করি আমাদের আগেই এয়ারফোর্স এসে নাক গলাবে না, স্যার।
আমি তো ইতোমধ্যেই নিষেধ করে মেসেজ পাঠিয়েছি ওদের, বললেন সিয়ার্স। সুতরাং চিন্তার কিছু আছে বলে মনে হয় না।
কর্মহীন অলস দিনগুলোতে তথ্য আসে অজস্র। তার মধ্যে কোনটা সত্য আর কোনটা গুজব, বিবেচনা করতে হয় তিনজনে মিলে। কওয়াই নদীর অদূরে একটা পাহাড়ের ওপর থেকে নজর রাখছে থাই এজেন্টরা। এঞ্জিনিয়ারিংয়ের কিছুই তারা বোঝে না। কিন্তু সেটা যে সাধারণ নয়, এটা বোঝার ক্ষমতা তাদের আছে।
হায় ঈশ্বর! মাঝেমাঝে চেচিয়ে ওঠেন সিয়ার্স। এজেন্টদের কথা সত্যি হলে তো বলতে হবে, দ্বিতীয় একটা জর্জ ওয়াশিংটন সেতু তৈরি করছে ওরা। আমেরিকানদের সাথে পাল্লা দিতে চাইছে!
থাইরা বলছে, সেতুর ওপরে রেললাইনের পাশাপাশি নাকি একটা যানবাহন চলাচলের পথ আছে, দুটো ট্রাক এগোতে পারে অনায়াসে।
আগুনের মত গনগনে সূর্যের নিচে একটানা খাঁটিয়ে নেয়া হচ্ছে বন্দীদের, এবর্ণনা শুনে তিনজনের মনই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে স্বদেশীদের দুর্দশার কথা ভেবে।
ওরা যদি আমাদের কথা জানতে পারত, স্যার, বললেন জয়েস একদিন। যদি জানতে পারত এই সেতু জাপানীদের কোনও কাজেই লাগবে না, হয়তো বেড়ে যেত ওদের মনোবল।
হয়তো, জবাব দিলেন সিয়ার্স, কিন্তু ওদের সাথে যোগাযোগ আমরা করতে পারি না। প্রশ্নই ওঠে না, জয়েস। মিশনে নিরাপত্তার চেয়ে বড় আর কিছু নেই। যোগাযোগ করলে আমাদের সাহায্য করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠবে ওরা, নিজে থেকেই সেতু ধ্বংসের চেষ্টায় লেগে পড়াও বিচিত্র নয়। স্বাভাবিকভাবেই বিপদের গন্ধ পাবে জাপানীরা, যার ফলাফল হবে মারাত্মক। না, যোগাযোগের ঝুঁকি নেয়া কোনমতেই সম্ভব নয়। জাপানীদের সন্দেহের সম্ভাবনাও আমরা জাগাতে চাই না। একদিন হঠাৎ অবিশ্বাস্য তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাই করার ইচ্ছে হলো সিয়ার্সের।
আমাদের মধ্যে একজনকে যেতে হবে ওখানে। যে-কোনও দিন শেষ হয়ে যাবে ওদের কাজ, সুতরাং শুধু এজেন্টদের ওপর নির্ভর করে থাকা চলবে না। তুমিই যাও, জয়েস। আমি জানতে চাই সেতুটা ঠিক কেমন, বুঝেছ? কত বড়? পাইল কতগুলো আছে? সঠিক সংখ্যা চাই। কীভাবে পৌছা যাবে সেতুর কাছে? নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন? আক্রমণ করার সম্ভাবনা কতটুকু? তবে যা-ই করো, খুব সাবধানে। কিছুতেই যেন তোমার উপস্থিতি ফাঁস হয়ে না পড়ে। ঈশ্বরের দোহাই, সেতুটা সম্বন্ধে আমাকে কিছু দরকারী তথ্য এনে দাও।
১৫.
বিনকিউলার দিয়ে সেতুটা পরিষ্কার দেখেছি, স্যার, ঠিক এখন যেমন দেখছি আপনাকে।
প্রথম থেকে শুরু করো, অধৈর্য জয়েসকে বাধা দিলেন সিয়ার্স। কিভাবে রওনা দিলে তোমরা?
এক রাতে দুই গাইডের সাথে রওনা দিল জয়েস। আফিম আর সিগারেট চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকায় দুজনেই এরকম নৈশ অভিযানে পুরোপুরি অভ্যস্ত। ওদের মতে, যে পথটা ওরা ব্যবহার করবে, সেটা সম্পূর্ণ নিরাপদ কি সঙ্গে কোনও ইউরোপিয়ান থাকাটা মোটেই নিরাপদ নয়। তাই বিশেষভাবে তৈরি বাদামী একটা রঙ জয়েস মেখে নিল শরীরে।
জঙ্গলের আসল শত্রু হলো মশা আর সেঁক। যতবার সে হাত দিল শরীরে, দেখল, জোক লেপটে আছে যেখানে সেখানে। আপাতত এই যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাবার কোনও উপায় নেই ভেবে সে যথাসম্ভব ভুলে থাকতে চাইল ওগুলোর উপস্থিতি।
যাত্রাটা কঠিন ছিল?
বেশ কঠিন, স্যার। আগেই তো বলেছি, অন্ধকারের জন্যে একটা হাত রাখতে হত গাইডের কাঁধে। আর রাস্তা এতই খারাপ, নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব!
তিন রাত ধরে তারা কখনও পাহাড়ে উঠল, কখনও নামল, কখনও আবার এগিয়ে চলল পাথুরে নদীর তীর ধরে। মাঝেমাঝে পথরোধ করে দাঁড়াল পচা বুনো লতাপাতার গাদা, ওগুলোতে শরীর ঠেকা মাত্র ঝাপিয়ে পড়ল অজস্র জোক। হটা চলল একটানা। পুবের আকাশে ভোরের আলো ফুটতে তারা আত্মগোপন করল ঝোপে। ক্লান্তিমোচনের জন্যে কোনও গাছের নিচে বসে হুকো টানতে থাকল থাই দুজন রাত নামার আগ পর্যন্ত।
এত কষ্টের মধ্যেও শরীর চাঙ্গা রাখার খাতিরে ঘুম নষ্ট করল না জয়েস। ভোরে হাটা বন্ধ হবার সাথে সাথে তার প্রথম কাজ জোকগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়া। কিছু কিছু জোক এতই রক্ত খায় যে খসে পড়ে আপনাআপনি। বাদবাকিগুলোর গায়ে ঠেসে ধরতে হয় সিগারেটের আগুন, খুলে পড়লেই পাথরের বাড়ি। আেঁকমুক্ত হয়ে দ্রুত সেদ্ধ ভাত আর মাংসের তরকারি খেয়ে নেয় জয়েস, তারপর মাটিতে শতরঞ্জি পেতে সোজা ঘুম। কিন্তু শান্তি খুব বেশিক্ষণ অব্যাহত থাকে না, গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে পিপড়ের দল।
শরীর থেকে ফোটায় ফোটায় পড়ে যে রক্তগুলো জমাট বেঁধে যায়, তার আকর্ষণেই ওরা আসে কালো আর লাল লম্বা সারি ধরে। স্পর্শেই জয়েস বুঝতে পারে কোটা কোন্ জাতের পিপড়ে, চোখ মেলার প্রয়োজন পড়ে না। লালগুলো কামড় অসহ্য, উঠে অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়। কালোগুলো অত খারাপ নয়। কামড়ায় না, সুড়সুড়ি দেয় এখানে সেখানে।
দিন ফুরিয়ে একসময় আবার নামে রাত। পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে হঠাৎ মনে হয় জয়েসের, তার এই অভিযানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে পুরো অপারেশনের সাফল্য।
তারপর একদিন বড়, খাড়া একটা পাহাড় পেরোতেই হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কওয়াই সেতু। রাতে একটু দেরি করে রওনা দেয়ায় অবজারভেশন পোস্টের কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সূর্য উঠে পড়ল আকাশে। প্রথমটায় সেতু ছাড়া ক্যাম্প, জাপানী সৈন্য বা কর্মরত বন্দী–এসবের কোনও কিছুই জয়েসের চোখে পড়ল না।
সেতুটা পরিষ্কার দেখেছি, স্যার, ঠিক এখন যেমন দেখছি আপনাকে। থাইরা বাড়িয়ে বলেনি। টার্গেটটা সত্যিই বিরাট। গড়নটা নিখুঁত। জাপানী কোনও সেতুর সাথে ওটার মিল নেই। স্কেচ করে এনেছি কয়েকটা, এই যে।
স্বপ্নে যেমন দেখত জয়েস, তার সাথে খুব পার্থক্য নেই সেতুটার। পানি চকচকে নয়, বেশ ঘোলা। স্বপ্ন আর বাস্তবের এই দূরত্বে প্রথমটায় একটু আহত হলো সে। পরক্ষণেই ভাবল, ঘোলা পানি তাদের কাজে হয়তো বেশ কিছু সুবিধেই করে দেবে।
পুরো দুদিন ধরে বিনকিউলার দিয়ে চারপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সে। মনে মনে ঠিক করে নিল আক্রমণের সম্ভাব্য পরিকল্পনা। এ ছাড়া নোট নিল, স্কেচ করল ঝোপের মাঝে ছড়িয়ে থাকা পথ, ক্যাম্প, জাপানীদের কুটির, নদীর বাঁক, এমনকি এখানে-সেখানে মাথা উঁচিয়ে থাকা বড় বড় পাথরের।
স্রোত খুব তীব্র নয়, স্যার। পানি ঘোলা। ছোট একটা নৌকো নিয়ে কিংবা ভাল সাঁতারু হলে এই নদী অনায়াসে সাঁতরে পার হতে পারবে। মটর চলাচলের একটা পথ আছে ওপরে, পাইল আছে চার সারি। জেহ্যামার দিয়ে ওগুলো পুঁতছে ব্রিটিশ বন্দীরা পাইলগুলো পৌঁছে গেছে বাম তীরের কাছাকাছি। আমার মনে হয়, আর এক মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে সেতুর কাজ। মূল কাঠামোটা
এত তথ্য নিয়ে এসেছে জয়েস, গুছিয়ে বলা অসম্ভব হয়ে উঠল তার পক্ষে। কিন্তু সিয়ার্স কোনও বাধা না দিয়ে তাকে বলে যেতে দিলেন নিজের মত।
মূল কাঠামোটা দেখলেই বোঝা যায়, প্ল্যানটা ওস্তাদ লোকের কাজ। আমার মনে হয়, পানির নিচ দিয়ে পাইলগুলোর কাছে যাওয়াই ভাল। পানি ঘোলা থাকায় বিস্ফোরকগুলো কারও নজরে আসবে না। পুরো সেতুটাও ধসে পড়বে একসাথে।
চার সারি পাইল, বিড়বিড় করে বললেন সিয়ার্স। বুঝতেই পারছ, কাজটা খুব সহজ নয়। ওরা এই সেতুটা আবার অন্যগুলোর থেকে অত আলাদা করল কেন?
এক পাইল থেকে আরেকটার দূরত্ব কতখানি? সঠিক হিসেবটা জানতে চান ওয়ার্ডেন।
দশ ফুট।
এরপর সেতু ধ্বংসের জন্যে মনে মনে একটা হিসেব শুরু করে দিলেন সিয়ার্স আর ওয়ার্ডেন।
শেষমেশ ওয়ার্ডেন বললেন, যথেষ্ট সময় লাগবে।
কাজটা আমরা এক রাতেই সারতে পারব, স্যার, আমি নিশ্চিত। একবার সেতুর নিচে গিয়ে পৌঁছতে পারলে আর কোনও চিন্তা নেই। গা ঢাকা দেয়ার পক্ষে সেতুটা যথেষ্ট চওড়া। তা ছাড়া পানি যেভাবে আছড়ে পড়ছে পাইলগুলোর ওপর, তাতে অন্য সমস্ত শব্দ ঢাকা পড়বে। আমি ভালভাবেই জানি।
সেতুর নিচে গেলে কি হবে, সেটা তুমি জানলে কিভাবে? কৌতূহল ফুটে উঠল সিয়ার্সের চোখে।
এক সেকেন্ড, স্যার। পুরো গল্পটা এখনও শেষ হয়নি। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি।
নিচে গিয়েছিলে?
না গিয়ে উপায় ছিল না, স্যার। আপনি অবশ্য খুব কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্যে যেতেই হলো। অবজারভেশন পোস্ট থেকে ধীরে ধীরে গিয়ে নামলাম নদীতে। গাইড দুজন আমাকে নিয়ে গেল বুনো শুয়োর চলাচলের পথ ধরে…তিনজনকেই এগোতে হলো হামাগুড়ি দিয়ে।
কতক্ষণ লাগল পৌঁছুতে?
প্রায় তিন ঘণ্টা, স্যার। আমরা রওনা দিয়েছিলাম সন্ধ্যায়। আমি চেয়েছিলাম রাত নামার পরপরই জায়গামত পৌঁছুতে। বেশ ঝুঁকির ব্যাপার হলেও নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল…
সত্যিকারের প্রয়োজনে মাঝেসাঝে এরকম ইচ্ছে জাগা খুব খারাপ নয়, এক নম্বর তাকালেন ওয়ার্ডেনের দিকে। তুমি ওখানে পৌঁছুতে পেরেছ–এটাই বড় কথা।
কেউ আমাকে দেখেনি, স্যার। আমরা গিয়ে পৌঁছেছি সেতুর সিকি মাইল উজানে। ওখানে ছোট একটা গ্রাম আছে; কিন্তু সবাই ছিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গাইড দুজনকে বিদায় করে দিলাম। তারপর আস্তে পানিতে নেমে গা ভাসালাম স্রোতে।
রাতটা পরিষ্কার ছিল? জানতে চাইলেন ওয়ার্ডেন।
মোটামুটি। আকাশে চাঁদ ছিল না; তবে কোনও মেঘও ছিল না। সেতুটা অনেক উঁচু, একটা জিনিসও ওদের চোখে পড়বে না…।
গুছিয়ে বললো, বললেন সিয়ার্স। কিভাবে এগোলে সেতুর দিকে?
চিৎ হয়ে ভেসে গেলাম, স্যার, মুখ ছাড়া পুরো শরীরই ডুবে রইল পানিতে। আমার ওপরে…
একটা কথা জেনে রাখুন, সিয়ার্স, ওয়ার্ডেন সোল্লাসে বললেন, ভবিষ্যতে এমন মিশন আবার হাতে পেলে আমার কথা ভাবতে পারেন।
সবচেয়ে আগে ভাবব নিজের কথা, জবাব দিলেন সিয়ার্স।
জয়েসের বিবরণ এতই প্রাণবন্ত যে দুই সঙ্গীই আপসোস করতে লাগলেন নিজে না যাওয়ায়।
তিন রাতের ক্লান্তিকর পদযাত্রার পর অবজারভেশন পোস্টে পৌঁছেই কথাটা দোলা দিল জয়েসের মনে। এক মুহূর্ত নষ্ট করার উপায় নেই। সেতুটা যখন একেবারে নাগালের মধ্যে, কাছে গিয়ে ওটাকে ছুঁয়ে দেখতে হবে।
চিৎ হয়ে এগোতে লাগল সে। স্রোত যে অন্যদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সে-কথা মাথায় একবারও এল না। চোখের সামনে শুধু ফুটে রইল প্রকাণ্ড সেতুটা, যেন আকাশের গায়ে লেপটানো কালো একটা অবয়ব। যতই এগোল জয়েস, ততই সেতু হলো প্রকাণ্ড থেকে প্রকাণ্ডতর।
সেতুর নিচে গাঢ় কালির মত অন্ধকার। একটা পাইল জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ঝুলে রইল সে। পানি বেশ ঠাণ্ডা হলেও শরীর পুরোপুরি ঠাণ্ডা হয়নি এখনও। চোখ সয়ে আসতে জয়েস দেখল, চারপাশে মাথা উঁচিয়ে আছে শুধু পাইল আর পাইল।
টার্গেটটা সত্যিই বড়, স্যার। বিস্ফোরকগুলো একটা ভেলায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়াই সবচেয়ে ভাল। কেউ দেখতে পাবে না। আমরা থাকব পানিতে। একবার সেতুর নিচে গিয়ে পৌঁছুতে পারলে আর কোনও চিন্তা নেই। স্রোত খুব তীব্র নয়, ফলে অনায়াসেই সাঁতরানো যাবে পাইলগুলোর মধ্যে দিয়ে। তবু, যদি ভেসে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়, আমরা বেঁধে রাখতে পারব আমাদের। বীমগুলো খুব মোটা নয়, স্যার। আমি মেপে দেখেছি। পানির নিচে অল্প বিস্ফোরক ব্যবহার করলেই কাজ হবে। পানিও খুব ঘোলা, স্যার।
তবু বিস্ফোরক বসাতে হবে অনেকটা নিচে, বললেন ওয়ার্ডেন। আক্রমণের দিনে পানি পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় কোনও কাজই জয়েস বাদ দেয়নি। দুঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সে পরীক্ষা করেছে পাইলগুলোর গভীরতা, বেড় মেপে দেখেছে একটা ফিতা দিয়ে, পারস্পরিক দূরত্বের হিসেব করেছে, এ ছাড়া কোন কোন পাইল ধ্বংস করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে নোট নিয়েছে তার। মোটকথা, আক্রমণের পরিকল্পনায় সাহায্যে আসতে পারে, এমন প্রত্যেকটা কাজই সে করেছে। দুবার মাথার ওপর থেকে ভেসে এসেছে ভারী পদশব্দ। জাপানী এক প্রহরী হেঁটে গেছে প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে। একটা পাইলের গায়ে সেঁটে অপেক্ষা করেছে সে। নিয়মমাফিক যান্ত্রিকভাবে প্রহরীটা নদীর এদিকসেদিক পরীক্ষা করেছে একটা টর্চ দিয়ে।
টার্গেটের দিকে এগোবার সময় আমাদের মাথাব্যথার একটাই কারণ হতে পারে, স্যার, যদি ওরা কোনও বাতি জ্বালে। কিন্তু একবার সেতুর নিচে গিয়ে ঢুকতে পারলেই পদশব্দ শোনা যাবে অনেক দূর থেকে। পানিতে শব্দ ভেসে আসে। অনায়াসেই তখন কোনো যাবে প্রধান কোনও পাইলের আড়ালে।
নদীটা কি গভীর? জিজ্ঞেস করলেন সিয়ার্স।
ছফুটের বেশি, স্যার। ডুব দিয়ে দেখেছি।
তুমি কি পরিকল্পনা করেছ?
আমার মতে, স্যার, অটোমেটিক্যালি ডিটোনেটেড ফগ-সিগনালের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। চার্জগুলো লুকিয়ে রাহকা সম্ভব হবে না। সমস্ত কাজটা সারতে হবে পানির নিচে। লম্বা একটা তার নদীর পাশ দিয়ে নিয়ে গিয়ে তুলতে হবে তীরে–ডান তীরে, স্যার, আর লুকিয়ে রাখতে হবে ঝোপে। লুকোনোর পক্ষে আদর্শ একটা জায়গা বেছে রেখেছি। ওখান থেকে গাছপালার ফাঁক দিয়ে প্ল্যাটফর্মটাও নজরে আসে।
ডান তীর কেন? ভ্রুকুটি করলেন সিয়ার্স। ক্যাম্প তো ওদিকেই, অবশ্য রিপোর্টে যদি ভুল না থাকে। বাম তীরই তো সুবিধে, পাহাড়ের পাশে? তোমার রিপোর্ট অনুসারে, ওই তীরটা ঘন ঝোপঝাড়ে ঢাকা। তা ছাড়া আমাদের পালাতেও হবে এদিক দিয়েই।
তা ঠিক, স্যার। কিন্তু ম্যাপটা অনেক বার দেখুন। বিরাট একটা বাঁক নিয়ে সেতু অতিক্রম করার পরপরই বেড় দিয়ে নদীর পাশ দিয়ে রেললাইন চলে গেছে তার দিকে। লাইন আর তীরের মাঝখানে জঙ্গল পরিষ্কার করায় জাগাটা বেশ কাল। ফলে দিনের বেলা ওখানে লুকিয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। লুকোতে হলে যেতে হবে বাঁধের উল্টোদিকে, পাহাড়ের পাদদেশে। কিন্তু এতে অনেকটা তাকে প্রয়োজন পড়বে, স্যার। তা ছাড়া রেললাইন অতিক্রম করার সময় তারটা লুকোনোও কঠিন, যদি না প্রচুর কাঠখড় পোড়ানো হয়।
পরিকল্পনাটা খুব পছন্দসই নয়, বললেন এক নম্বর। বাম তীর নয় কেন, সেতুর উজানে?
তীরটা খুব উঁচু, স্যার, তা ছাড়া একদম খাড়া। আর সামান্য এগোলেই পাওয়া যাবে ছোট সেই গ্রামটা। সমস্ত জায়গাটা ঘুরে দেখে এসেছি আমি। নদী পার হয় অতিক্রম করেছি রেললাইন। তারপর প্রহরীর চোখে ধূলো দেয়ার জন্যে ফিরে এসেছি ফিরে এসেছি বাঁক নিয়ে। ওদিক দিয়ে কোনমতেই হবে না, স্যার। এ-কাজের জন্যে একমাত্র উপযুক্ত না হলে ডান তীর।
হায় ঈশ্বর! বললেন ওয়ার্ডেন। তুমি নিশ্চয় সারাটা রাতই সেতুর চারপাশে ধুরে বেড়িয়েছ।
তা ঠিক। কিন্তু প্রথম ঊষার আলো ফুটতেই ঢুকে পড়েছি জঙ্গলে আর ভোরে পৌঁছেছি অবজারভেশন পোস্টে।
যে ছেলেটে ডান তীরে থাকবে, তার কথা কিছু ভেবেছ? জানতে চাইলেন সিয়ার্স। সে পালবে কিভাবে।
ভাল একজন সাঁতারু তিন মিনিটেই পার হয়ে যাবে নদীটা। আমার তা-ই লেগেছে স্যার। তা ছাড়া বিস্ফোরণের শব্দ জাপানীদের মনোযোগ সরে যাবে অন্যদিকে। পাহাড়ের পাদদেশে একটা দল বসিয়ে দিলে ওকে সাহায্য করতে পারবে পালাবার ব্যাপারে ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে হয়ে রেললাইনের এপারে আসতে পারলেই ও সম্পূর্ণ নিরাপদ। কোনও সার্চ পার্টির ক্ষমতা নেই ওকে জঙ্গলের ভেতর থেকে খুঁজে বের করে।
জয়েসের ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সিয়ার্স।
প্ল্যানটা মন্দ নয়, বললেন তিনি অবশেষে। জায়গাটায় তুমি নিজে গেছ সুতরাং তুমিই সবকিছু ভাল বুঝবে। ঝুঁকি আছে, তবে ঝুঁকি নেয়ার মতই টার্গেট। এবার বলো, অবজারভেশন পোস্ট থেকে আর কি কি তুমি দেখলে।
১৬.
সারারাত না ফেরায় উদ্বিগ্ন হয়ে ছিল দুই পাউন্ড। অনেকক্ষণ হলো সকাল হয়েছে। এক ঘণ্টা বিশ্রাম নেবে বলে শুয়ে পড়ল জয়ে, কিন্তু ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়।
যতদূর মনে হয়, রাতটাও কাটিয়েছ ঘুমিয়ে? খুব ভাল করেছ। পরদিন সকালে আবার ফিরে গেলে তোমার বাছাই করা সেই বিশেষ জায়গাটার?
জ্বী, স্যার। আরেকটা দিন কাটালাম োখানে। আরও অনেক কিছু দেখার ইচ্ছে ছিল আমার।
এ-যাবৎ সেতুর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিল সে, এবার ব্রিটিশ সৈন্যদের অবস্থা দেখে ভার হয়ে উঠল মন। জাপানীরা যুদ্ধবন্দীদের সাথে কেমন ব্যবহার করে, সে বিষয়ে অনেক রিপোর্ট পড়েছে জয়েস।
অপ্রীতিকর কিছু দেখেছ? জানতে চাইলেন সিয়ার্স।
না, স্যার; অন্তত সেদিন তেমন কিছু চোখে পড়েনি। কিন্তু মাসের পর মাস ওরা ওভাবে খাটছে, একথা ভাবতেই বুকটা ভেঙে চেয়েছে আমার। অর্ধাহারে থাকা, ওরকম কুটিরে বাস করা যেখানে আরামের বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা নেই, তা ছাড়া শাস্তির ব্যাপারটা, স্যার, মানে–বুঝতে পারছেন নিশ্চয়!
বিনকিউলার দিয়ে প্রত্যেকটা বন্দীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে রীতিমত আতঙ্কিত হয়েছে সে।
আমাদের মন অত নরম হলে চলবে না, জয়েস, ভ্রূ কোঁচকালেন এক নম্বর।
জানি, স্যার। কিন্তু হাড় এবং চামড়া ছাড়া আর কিছুই নেই ওদের। বেশির ভাগ বন্দীর গায়েই দগদগে ঘা। কয়েকজন হাঁটতেই পারছে না প্রায়। কোনও সভ্য মানুষ এ-অবস্থায় কাউকে খাটানোর কথা কল্পনাও করতে পারে না। আপনি ওদের দেখলে কেঁদে ফেলতেন, স্যার। শেষ কয়েকটা পাইল পাইল বসানোর জন্যে স্লেজহ্যামারের দড়ি ধরে টানাটানি করছে একদল বন্দী–যেন জীবন্ত কঙ্কাল। ওরকম বীভৎস দৃশ্য আমি জীবনে দেখিনি। মানুষের সাথে এরকম ব্যবহার করা অপরাধ, স্যার, ভীষণ অপরাধ।
শান্ত হও, জয়েস, বললেন সিয়ার্স, শিগগিরই ওদের মুক্ত করব আমরা।
তবু ওদের প্রশংসা না করে পারিনি, স্যার। এত কষ্ট সত্ত্বেও সবার মনোযোগ অটুট রয়েছে। চালচলনের মধ্যে এমন একটা ভাব, যেন আশেপাশে জাপানীদের কোনও অস্তিত্ব নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যায় পর্যন্ত কাজ করছে, মাসের পর মাস, সম্ভবত একদিনও বিশ্রাম নেয়নি। কিন্তু ওদের মধ্যে হতাশার কোন চিহ্ন নেই। হাস্যকর পোশাক, স্বাস্থ্যের চরম অবনতি সত্ত্বেও মর্যাদাসম্পন্ন চালচলন ওদের ক্রীতদাসে পরিণত হতে দেয়নি।
তিনজনই ডুবে গেল নিজ নিজ চিন্তায়।
ইচ্ছে করলে ব্রিটিশ সৈন্যেরা সত্যিই দুঃসাহসী হতে পারে, শেষমেশ বললেন ওয়ার্ডেন।
আর কি দেখলে? জিজ্ঞেস করলেন সিয়ার্স।
অফিসারদের, স্যার, ব্রিটিশ অফিসার। তাদের খাটানো হচ্ছে না। নিজের লোকেদের তদারক করছেন তারা। পরনে পুরো ইউনিফর্ম?
ইউনিফর্ম!
জী, স্যার, ব্যাজসহ।
থাইয়েরা তা হলে ঠিকই বলেছে। আমিই বিশ্বাস করিনি। কোনও সিনিয়র অফিসার দেখেছ?
একজন কর্নেল, স্যার। সম্ভবত ইনিই সেই বিখ্যাত কর্নেল কিলসন, যার কথা আমরা বারবার শুনেছি। সারাদিন তিনি থাকছেন বন্দীদের সাথে, খুব সম্ভব জাপানীদের সাথে ব্রিটিশদের সংঘর্ষ এড়ানোর জন্যে। কর্নেল নিকলসনকে দেখলে মনে হয়, মানুষটির জন্মই হয়েছে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে।
তারই কারণে নিশ্চয় এখনও ভেঙে পড়েনি বন্দীরা, বললেন সিয়ার্স। হ্যাটস অফ টু হিম।
আবার জয়েস শুরু করল তার বিস্ময়কর গল্প।
একবার সেতুর অন্য পাশ থেকে এক বন্দী এল কর্নেলের সাথে দেখা করতে। রাইফেল উচিয়ে চিৎকার করতে করতে পেছন পেছন এল এক জাপানী প্রহরী। যতদূর মনে হয়, অনুমতি ছাড়া দলত্যাগ করেছিল বন্দীটা। কড়া চোখে কর্নেল তাকালেন প্রহরীর দিকে। তৎক্ষণাৎ সুড়সুড় করে কেটে পড়ল সে। অবিশ্বাস্য, তাই না? সন্ধ্যার আগে আগে সেতুর দিকে এলেন জাপানী এক কর্নেল। ইনিই সম্ভবত কর্নেল সাইতো, নিষ্ঠুরতার জন্যে যিনি কুখ্যাত। কর্নেল নিকলসনের কাছে আসতেই যেন বিনয়ের অবতার সাজলেন তিনি। কর্নেলই অবশ্য প্রথমে স্যালুট করলেন, এক মুহূর্ত দেরি না করে প্রত্যুত্তর দিলেন সাইতো। ওই একটা দৃশ্য আমার দুঃখ অনেকটা ভুলিয়ে দিল, স্যার।
তোমার গল্প শুনে আমার কিন্তু মোটেই দুঃখ হচ্ছে না, বিড়বিড় করে বললেন সিয়ার্স।
কর্নেল নিকলসনের উদ্দেশে, হঠাৎ হাতের গ্লাসটা ওপরে তুলে ধরলেন ওয়ার্ডেন।
ঠিকই বলেছ, ওয়ার্ডেন, কর্নেল নিকলসন এবং পাচ-ছশো হতভাগ্যের উদ্দেশে, সিয়ার্সও তুলে ধরলেন নিজের গ্লাস।
দুঃখের বিষয়, ওরা আমাদের কোনও সাহায্যে আসবে না।
উপায় নেই, ওয়ার্ডেন। যা কিছু করার আমাদেরই করতে হবে। কিন্তু–আবার ফিরে যাই সেতুর প্রসঙ্গে…
পুরো সন্ধ্যেটা তারা কাটালেন সেতু বিষয়ে কথাবার্তা বলে আর জয়েসের স্কেচম্যাপ দেখে। মাঝেমাঝে দুএকটা বিষয় জানতে চাইলেন, তৎক্ষণাৎ ব্যাখ্যা করল জয়েস। আক্রমণের প্রতিটা দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখলেন, যাতে শেষ মুহূর্তে অতি সামান্য কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। আলোচনার পর ওয়াকিটকিতে মেসেজ গ্রহণ করার জন্যে পাশের ঘরে গেলেন ওয়ার্ডেন।
স্যার, হঠাৎ বলে উঠল জয়েস, আমাদের দলের তিনজনের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ভাল সঁতারু, আর আমি নিজেই যেহেতু ওখানে গেছি…
সে-বিষয়ে পরে কথা হবে, বললেন এক নম্বর।
জয়েসকে টলতে টলতে বিছানার দিকে এগোতে দেখে সিয়ার্স বুঝতে পারলেন, ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে ছেলেটা। তিন দিন ঝোপের ভেতর শুয়ে শুয়ে পর্যবেক্ষণ শেষ করেই সে আবার রওনা হয়েছে ক্যাম্পের উদ্দেশে, খাবার সামান্য সময়টুকু ছাড়া কোথাও থামেনি। তা ছাড়া ফিরতি পথে সে এত জোরে হেঁটেছে, থাই দুই গাইডকে দৌড়োতে হয়েছে তার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্যে।
খানিকটা বিশ্রাম নেয়া উচিত তোমার, বললেন এক নম্বর। রওনা দেয়ার আগেই মারা পড়ার কোনও যুক্তি নেই। যথাসময়ে তোমাকে সুস্থ দেখতে চাই আমি। আর এত তাড়াহুড়ো করেই বা ফিরলে কেন?
সেতুর কাজ সম্ভবত এক মাসের আগেই শেষ হয়ে যাবে, স্যার।
দেখতে না দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল জয়েস, মেক-আপ তোলার কথাও খেয়াল রইল না। কাঁধ ঝাকিয়ে বসে পড়লেন সিয়ার্স! মনে মনে ভাবতে লাগলেন আর কদিনের মধ্যেই কওয়াই উপত্যকায় যে নাটক অভিনীত হতে যাচ্ছে, তাতে তাদের স্ব স্ব ভূমিকার কথা। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই ডিসাইফার করা কিছু মেসেজ হাতে ঘরে ঢুকলেন ওয়ার্ডেন।
হাবভাবে মনে হচ্ছে, বেলুন উড়তে আর দেরি নেই। হেডকোয়ার্টারস থেকে তথ্য এসেছে: রেলওয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাঁচ কি ছসপ্তাহের মধ্যেই হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সৈন্য আর ভিআইপি বোঝাই একটা ট্রেন আসবে। যুদ্ধের সাজসরঞ্জামও তাতে প্রচুর থাকবে হেডকোয়ার্টারস শুধু আপনার সমস্ত প্ল্যানই পাস করেনি, সর্বময় কর্তৃত্ব দিয়েছে। রয়্যাল এয়ারফোর্স নাক গলাবে না। এখন হেডকোয়ার্টারস থেকে প্রতিদিন তথ্য পাব আমরা। ছেলেটা ঘুমে তলিয়ে গেছে, তাই না?
হ্যাঁ। জাগিয়ো না ওকে। খানিকটা বিশ্রাম ওর প্রাপ্য। দায়িতুটা ভালভাবেই পালন করেছে ও। আচ্ছা, একটা কথা বলো দেখি, ওয়ার্ডেন, যে-কোনও জরুরী প্রয়োজনের সময় ওর ওপর ভরসা করা চলে?
জবাব দেয়ার আগে একটু ভেবে নিলেন ওয়ার্ডেন।
ওকে তো আমার উপযুক্তই মনে হচ্ছে। অবশ্য এসব ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। তবে আমি বুঝতে পারছি, আপনি ঠিক কি জানতে চাইছেন। আপনি জানতে চান, মুহূর্তের মধ্যে বা তারও কম সময়ে সে গুরুত্বপূর্ণ কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কি-না। কিন্তু আপনার এরকম চিন্তার কারণ?
কারণ, একটু আগেই ও বলেছে আমাদের দলের তিনজনের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ভাল সাঁতারু। কথাটা মিথ্যে নয়।
যখন আমি ফোর্স ৩১৬-তে প্রথম যোগ দিই, গলা চড়ালেন ওয়ার্ডেন, তখন কে জানত যে আমাকে একজন ওস্তাদ সাঁতারুতে রূপান্তরিত হতে হবে। অভ্যেসটা একটু ঝালাই করে নেব আগামী ছুটিতে।
আমার এই চিন্তার পেছনে একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। কোনও ব্যাপারে মাথা খাটাতে না দিলে নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে ও। তবে আগে থেকে কিছুই বলা যায় না, এটাই বাস্তব। সফল হতেও পারে। কয়েক দিনের মধ্যেই সব জানতে পারব। আগামীকাল থেকে এক কাজ করব আমরা। সেতুর প্রসঙ্গই আর তুলব না। আমি চাই না, বন্দীদের কথা ও বেশি ভাবুক। তুমি নিশ্চয় মানো, অনুভূতি মানুষের আচরণকে সবসময় প্রভাবিত করতে পারে না। কথাটা ঠিক। কিন্তু ছেলেটা একটু বেশি অনুভূতিপ্রবণ, এটাই যা অসুবিধে।
আমাদের কাজে কোনও বাধাধরা নিয়ম অনুসরণ করলে চলে না, বললেন ওয়ার্ডেন। কখনও কখনও অল্প চিন্তা, এমনকি অনুভূতিপ্রবণতাও ভাল ফল দিতে পারে। তবে সবসময় নয়, এটা ঠিক।
১৭.
বন্দীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে কর্নেল নিকলসনও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এব্যাপারে মেডিক্যাল অফিসারের সাথে আলোচন করার জন্যে একদিন তিনি এলেন হাসপাতালে।
এভাবে তো চলতে পারে না, ক্লিপটন, গম্ভীর গলায় প্রায় ধমকে উঠলেন কর্নেল। কেউ দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়লে কাজ করতে পারবে না, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা আছে। তুমি অর্ধেক লোককে সিকলিস্টের অন্তর্ভুক্ত করেছ, তা হলে সেতুর কাজ এক মাসের মধ্যে শেষ হবে কিভাবে? কাজ অনেকটা এগিয়ে গেছে সত্যি, কিন্তু টুকিটাকি অনেক কিছু এখনও বাকি। অর্ধেক লোক না থাকায় কাজ তো ঢিলে হয়ে পড়েছেই, এদিকে যতটা কাজ করা উচিত ততটাও করছে না বাদবাকি বন্দীরা।
ওদের দিকে ভালভাবে চেয়ে দেখুন, স্যার, রাগে নিজের ওপর প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন ক্লিপটন, অধস্তন অফিসারদের যে ব্যবহার কর্নেল মোটেই পছন্দ করেন না। পেশাগত বিবেকের ধার যদি ধারি, কিংবা স্রেফ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি দেখি, তা হলে অর্ধেক নয় বরং সবাইকে ঘোষণা করতে হবে আনফিট হিসেবে, বিশেষ করে এ ধরনের কাজের জন্যে তো বটেই!
প্রথম কয়েক মাস সেতুর কাজ এগিয়ে চলেছে চমৎকারভাবে। মাঝেমধ্যে শুধু মেজাজ দেখিয়েছেন সাইতো। তাঁর মনে হয়েছে, কর্তৃত্ব না ফলালে নিজের ওজন বজায় থাকছে না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে তার বাকি রইল না যে, নিষ্ঠুরতা শুধু কাজই ব্যাহত করবে। ফলে নাক গলানো তিনি একেবারেই ছেড়ে দিলেন। কাজও এগোতে লাগল তরতর করে। তবে মেজর হিউজেস এবং ক্যাপ্টেন রীভূস্-এর হিসেবের আগে আগে যে দৌড়োচ্ছিল কাজ, এর পেছনে জাপানী সৈন্যদের অবদান কম নয়, যদিও মাঝেমাঝে তাদের সংঘর্ষ বাধছিল ব্রিটিশ সৈন্যের সাথে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে বন্দীরা হয়ে পড়ল দুর্বল থেকে দুর্বলতর।
হঠাৎ আশেপাশে থেকে কিনে আনা চামড়াসর্বস্ব দুএকটা বুড়ো গরু ছাড়া মাংসের সাথে সাক্ষাৎ তাদের হলো না। মাখন বা পাউরুটি তো দূরের কথা, কখনও কখনও কপালে জুটল শুধুই ভাত। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে তারা পরিণত হলো জীবন্ত কঙ্কালে। যারা পাইল বসাল, সারাদিন তাদের সইতে হলো জেহ্যামারের কানফাটানো শব্দের যন্ত্রণা। অন্য দলগুলোও স্বস্তিতে রইল না। বিশেষ করে যারা ভারায় উঠে পাইল ধরে দাঁড়িয়ে রইল কোমরপানিতে, তারাও রেহাই পেল না এই শব্দের হাত থেকে।
তবুও মনোবল তাদের একরকম অটুটই রইল। দৃষ্টান্ত স্থাপন করল লেফটেন্যান্ট হার্পারের মত অফিসারেরা। সারাদিন ধরে সে সৈন্যদের শোনাল উৎসাহব্যঞ্জক কথা। দুর্বল কাউকে অব্যাহতি দেয়ার প্রয়োজনে নিজে জ্যোমারের দড়ি ধরতেও দ্বিধা করল না। মাঝেমাঝে র-প্রিন্ট এবং ফুট-রুল, স্পিরিট-লেভেল ইত্যাকার স্বহস্তনির্মিত যন্ত্রপাতিসহ জীর্ণ ভারা বেয়ে ক্যাপ্টেন রীস ওঠেন বিশেষ কোনও মাপ নেয়ার জন্যে, পেছনে থাকেন ছোটখাট জাপানী এঞ্জিনিয়ারটি। রীভস-এর পায়ে পায়ে হাঁটেন তিনি, অনুকরণ করেন প্রতিটি ভঙ্গি, গম্ভীর মুখে হিসেব লিখে রাখেন নোটখাতায়–আর এসব দেখে নির্মল আনন্দ উপভোগ করে বন্দীরা।
তবে সব অফিসারের আদর্শ নিঃসন্দেহে কর্নেল নিকলসন। কর্নেলও সেব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন। নেতৃত্বে একধরনের গর্ববোধ আছে তাঁর, ফলে যেকোনও রকমের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে তিনি পিছ-পা নন।
ক্রমেই লম্বা হতে থাকা সিক-লিস্টই তার উদ্বেগের একমাত্র কারণ। প্রতিদিন চোখের সামনে ধীরে ধীরে কমে আসছে তার কাজের লোকের সংখ্যা।
অন্যান্য ক্যাম্পের মত এখানেও কলেরা জাতীয় মারাত্মক কোনও মহামারী দেখা দিতে পারে ভেবে আতঙ্কিত হয়েছিলেন ক্লিপটন। কড়া নিয়মকানুন মেনে চলার জন্যে সেরকম কিছু না ঘটলেও রেহাই পাওয়া যায়নি ম্যালেরিয়া, আমাশয় আর বেরিবেরির হাত থেকে। প্রতিদিন বেশ কিছু লোককে আনফিট ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি, ফলে ক্রমেই বেড়ে চলেছে সিক-লিস্ট। রেড ক্রসের কিছু কিছু পার্সেল জাপানীদের কৌতূহলী হাত এড়িয়ে হাসপাতালে এসে পৌঁছুচ্ছে বলে রোগীদের তিনি মোটামুটিভাবে উপযুক্ত খাবার দিতে পারছেন। জেহ্যামারের শব্দ শুনতে শুনতে অস্থির হয়ে ওঠা বন্দীরা অবশ্য কদিনের বিশ্রামেই সেরে উঠছে।
কর্নেল নিকলসন তার লোকেদের খুবই ভালবাসেন। তাই প্রথমদিকে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যাপারে ক্লিপটনকে তিনি শুধু সাহায্যই করেননি, নাক গলানোর সাথে সাথে সামলেছেন কর্নেল সাইতোকে।
কিন্তু কয়েক দিন থেকে তার মনে হচ্ছে, ক্লিপটন কিছুটা বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্যে খোলাখুলিই মেডিক্যাল অফিসারকে অভিযুক্ত করেছেন কর্নেল নিকলসন। তার ধারণা, কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম এমন অনেক লোককে ক্লিপটন অন্তর্ভুক্ত করেছেন সিক-লিস্টে। আর এক মাসের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ করতে হবে; সুতরাং এখন অবহেলার সময় নয়। এবং তাই হাসপাতাল পরিদর্শন করতে এসেছেন তিনি স্বয়ং। সেই ফাঁকে ক্লিপটনের সাথে আলোচনাও সেরে নিতে চান এ-বিষয়ে। তবে যত রাগই হোক না কর্নেলের, এরকম নাজুক একটা বিষয় নিয়ে একজন স্টাফ অফিসারের সাথে যেভাবে আলাপ করতে হয়, সেই সৌজন্যবোধটুকু তিনি গুলিয়ে ফেলেননি।
এই ছেলেটার কি হয়েছে? একজন রোগীর সাথে কথা বলার জন্যে থামলেন কর্নেল নিকলসন। এই, তোর কি অসুবিধে হচ্ছে রে, বাবা?
দুসারি বাঁশের খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে বন্দীরা, কর্নেল হাঁটছেন মাঝখান দিয়ে। রোগীদের কেউ কাপছে প্রচণ্ড জ্বরে, কেউ বা স্থির হয়ে আছে জ্ঞান হারিয়ে। শতচ্ছিন্ন কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে আছে তাদের ফ্যাকাসে মুখগুলো।
১৪০ ডিগ্রী তাপ ছিল গত রাতে, স্যার, ম্যালেরিয়া।
হুঁ, তাই তো দেখছি, খানিকটা এগোলেন কর্নেল। আর এই ছেলেটার?
ঘা। গতকাল অপারেশন করেছি ওর পায়ে–সাধারণ একটা ছুরি দিয়ে; অন্য কোনও অস্ত্র নেই আমার। পায়ের ভেতর গলফ বলের সমান একটা গর্ত হয়ে গেছে, স্যার।
ও, তা হলে এই ব্যাপার, বিড়বিড় করে বললেন কর্নেল নিকলসন, গত রাতে একটা চিৎকার কানে এসেছে।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ওর চার বন্ধু ওকে ঠেসে ধরেছিল। ওর পা-টা হয়তো বাঁচাতে পারব, তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়, গলা নামালেন ক্লিপটন। আপনি কি সত্যিই চান, স্যার, আমি ওকে কাজে পাঠাই?
বাজে কথা বোলো না, ক্লিপটন। রোগীর ব্যাপারে তোমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া দরকার। অসুস্থ বা আহত কাউকে জোর করে বাটাবার কোনরকম ইচেছ আমার নেই। তবে বাস্তবের মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে। সেতু তৈরি শেষ করার জন্যে হাতে আছে এক মাসেরও কম সময়! জানি, কাজটা অতিমানবিক, কিন্তু ওই জানা পর্যন্তই সার। তার ওপর যতবার তুমি একটা করে তোক হাসপাতালে ভর্তি করাচ্ছ, সবার পক্ষে কাজটা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। এই কথাটা তোমাকে সারা দিন মনে রাখতে হবে, বুঝেছ? একজন মানুষ পুরোপুরি, কর্মক্ষম না থাকলেও টুকিটাকি অনেক কিছু করতে পারে, যেমন: জিনিসপত্র গোছগাছ, সেতু ধুয়ে দেয়া বা ব্রাশ মারা।
যতদূর মনে হচ্ছে, সেটা আপনি রঙ করাতে চান, তাই না, স্যার?
এই ধরনের আজেবাজে চিন্তা কোরো না, ক্লিপটন, বললেন কর্নেল। বড়জোর আমরা একবার চুন টানতে পারি-যাতে রয়্যাল এয়ারফোর্সের কাছে এটা পরিণত হয় চমৎকার একখানা টার্গেটে! যুদ্ধ চলছে, কথাটা ভুলে গেছ নাকি!
ঠিক বলেছেন, স্যার, যুদ্ধ চলছে।
ব্যস, ওই পর্যন্তই। আমি চাই না, এখন যুদ্ধ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাক। আপাতত আমরা চাই হাতের কাজটা সুন্দরভাবে শেষ করতে। আর সে-কথা তোমাকে বলতেই আজ আমার এখানে আসা। তুমি সবাইকে বোঝাও যে ওদের যথাসাধ্য খাটতে হবে। এই ছেলেটা…
বিশ্রীভাবে জখম হয়েছে হাত, আপনার বিখ্যাত সেতুর বীম তুলে ধরতে গিয়েই আজ ওর এই অবস্থা, স্যার, ফেটে পড়লেন ক্লিপটন। ওই একই অবস্থা
অন্তত আরও বিশজনের। ক্ষত সারা তো দূরের কথা, বরং আরও পেকে উঠছে। এদিকে চিকিৎসা করার মত কিছুই আমার কাছে নেই…
ভেবে পাই না, ক্লিপটনের অশোভন ভাষা এড়িয়ে গিয়ে জেদী সুরে বললেন কর্নেল নিকলসন, কিছুতেই ভেবে পাই না, মুক্ত আলো বাতাস গায়ে না লাগিয়ে এই কুটিরে চুপচাপ শুয়ে থাকলে ক্ষতের বেশি উপকার হবে কীভাবে! তা ছাড়া হাতে আঁচড় লাগলেই তাকে হাসপাতালে নিতে হবে–এটা আমাদের কার্যপদ্ধতির মধ্যে পড়ে না।
তা অবশ্য পড়ে না, স্যার।
ভীষণ হতাশায় হাতদুটো ওপরে তুললেন ক্লিপটন। কর্নেল তাকে নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে, যেটাকে সার্জারি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তারপর শুরু হলো বোঝানো। জোর তিনি খাটালেন না, কিন্তু একজন কমান্ডারের ঝুলিতে যতরকমের যুক্তি থাকে, তার কোনটাই প্রয়োগ করতে ছাড়লেন না। তারপরেও যখন দেখা গেল যুক্তি মানার কোনও সম্ভাবনা ক্লিপটনের নেই, শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলেন কর্নেল নিকলসন: মেডিক্যাল অফিসার যদি এমন জেদ ধরে থাকেন, জাপানীরা হাসপাতাল খালি করে দেবে।
কঠোর ব্যবস্থা নেবেন বলে আমাকে শাসিয়েছেন কর্নেল সাইতো, ব্যাখ্যা করলেন তিনি।
কথাটা নির্জলা মিথ্যে। হিংস্রতায় আর কোনও কাজ হবে না, এটা পরিষ্কার বুঝে সে-চেষ্টাই বাদ দিয়েছেন কর্নেল সাইতো। ব্রিটিশ বন্দীরা যেভাবে কাজ করছে সেতু নির্মাণের, শেষ পর্যন্ত সেভাবে চালিয়ে গেলেই তিনি খুশি। কথাটা বলতে অবশ্য বিবেকের দংশন অনুভব করলেন কর্নেল নিকলসন, কিন্তু যেখানে মাত্র একটা নিয়ম ভাঙলে কাজটা শেষ হতে পারে মসৃণভাবে, সেখানে আদর্শ আঁকড়ে বসে থাকা চলে না। তা ছাড়া তিনি তো জীবনে কখনও পরাজয় স্বীকার করেননি, শেষমেশ সম্মান হারাবেন বর্বর জাপানীদের কাছে? অসম্ভব! এই তো আর মাত্র কয়েকটা দিন কাজ শেষ হয়ে যাবে কওয়াই সেতুর।
মনে মনে কর্নেল নিকলসনকে অভিশাপ দিলেন ক্লিপটন, কিন্তু জেদটা আর বজায় রাখতে পারলেন না এই হুমকির মুখে। রোগীর সিকি ভাগ ছেড়ে দিলেন তিনি, অপরাধবোধে ভুগলেন রোগী বাছাইয়ের সময়। খোড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে চলল তারা। কোনমতে নিজেদের টেনে নিয়ে যেতে সমর্থ হলেও বেশির ভাগই ম্যালেরিয়ায় কাঁপছে থরথর করে।
একজন বন্দীও অভিযোগ করল না। কর্নেলের ওপর তাদের আস্থা এতই অগাধ, যেন তাঁর নির্দেশে হাসতে হাসতে তারা ঝাপ দিতে পারে মৃত্যুর মুখে। চুপচাপ গিয়ে হাজির হলো তারা নদীর তীরে। এক হাতে ব্যান্ডেজ সত্ত্বেও আরেক হাতে টেনে ধরল হোমারের দড়ি।
এই বাড়তি শক্তি যোগ হওয়ায় দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে গেল কওয়াই সেতু। আপাতদৃষ্টিতে কাজ শেষ হলেও অভিজ্ঞ চোখ ওদিকে তাকালে বুঝতে পারবে, এখনও বাকি রয়ে গেছে অতিক্ষুদ্র দুএকটা টুকিটাকি।
১৮.
সপ্তাহ দুই পর জয়েস যে পথে গিয়েছিল, ওই একই পথে অভজারভেশন পোস্টে পৌঁছলেন ক্যাপ্টেন ওয়ার্ডেন। সেতুটা তিনি স্বচক্ষে একবার দেখতে চান।
একবার চোখ বুলিয়েই ওয়ার্ডেন বুঝতে পারলেন, জয়েসের পর্যবেক্ষণ মন্দ নয়। শেষ হয়েছে কওয়াই সেতু নির্মাণের কাজ। সাথে আসা চার থাইকে তিনি জানিয়ে দিলেন, আপাতত তাদের কোনও প্রয়োজন নেই। ফলে চুপচাপ বসে তারা হুকো টানতে লাগল ওয়ার্ডেনের দিকে তাকিয়ে।
প্রথমে ওয়াকি-টকির এরিয়াল তুলে বিন্নি স্টেশনের সাথে যোগাযোগ কবুলেন ওয়ার্ডেন। শত্রু অধিকৃত এলাকার একেবারে ভেতরের একটা স্টেশন তাকে প্রতিদিন জানায় বার্মা-থাইল্যান্ড রেলওয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যে বিশাল ট্রেনটা ব্যবহৃত হবে, তার সংবাদ। আজকের সংবাদও যথারীতি খারাপ নয়, সব ঠিকঠাক আছে।
সংবাদ নেয়ার পর স্পঞ্জের একটা ব্যাগ খুলে শ্রীপিংব্যাগ আর মশারি বের বুলেন ওয়ার্ডেন। জয়েসের তুলনায় তিনি অনেক অভিজ্ঞই শুধু নন, দূরদর্শীও। তিনি জানেন, একজন শ্বেতাঙ্গের কাছে অনেক সময় টুব্রাশও কতখানি প্রয়োজনীয়। জানেন, সকালে স্রেফ এক কাপ চা-ও তাকে কতটা চাঙ্গা করে তুলতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, চূড়ান্ত অ্যাকশনের সময় সম্পূর্ণ কর্মক্ষম থাকা। নিজের সাজসরঞ্জামের কথা ভেবে বেশ আশ্বস্ত বোধ করলেন ওয়ার্ডেন। তারপর কিছু খেয়ে, শুয়ে পড়লেন তিনি। তিন ঘণ্টা পর ঘুম থেকে উঠে অবজারভেশন পোস্টে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে বসলেন মিশনের কথা।
জয়েসের প্ল্যান অনুসারেই অ্যাকশন নেয়া হবে–এক নম্বরের এই সিদ্ধান্তের পর ভাগ হয়ে গেছে ফোর্স ৩১৬-এর দল। দুজন থাই স্বেচ্ছাসেবক আর জয়েসকে নিয়ে সেতুর উজানে গেছেন সিয়ার্স, সাথে জিনিস বয়ে নেবার জন্যে কয়েকজন মুটে। যথাসময়ে ওই চারজন সেতুর কাছে নেমে আসবে ধ্বংসের জোগাড় করতে। জয়েস যাবে শত্রুপক্ষের তীরে। সিয়ার্স যোগ দেবেন ওয়ার্ডেনের সাথে। দুজন মিলে নিশ্চিত করবেন পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা।
অবজারভেশন পোস্টেই অবস্থান করবেন ওয়ার্ডেন। সেতুর আশেপাশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার পাশাপাশি রেডিও-যোগাযোগ রাখবেন তিনি। মিশনে তাকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছেন এক নম্বর।
অবস্থা বুঝে যে-কোনও ব্যবস্থা নিতে পারো তুমি, বলেছেন সিয়ার্স। শুধু খেয়াল রাখবে, ছোটখাট কিছু করতে গিয়ে আসল টার্গেটের সুযোগ যেন তালগোল পাকিয়ে না যায়। তোমার ওপর আমার পুরো ভরসা আছে।
এতখানি ক্ষমতা সিয়ার্স অযথা দেননি। ওয়ার্ডেনের যোগ্যতা তার বেশ ভালভাবেই জানা আছে।
সামান্য ভেবেই ওয়ার্ডেন ঠিক করলেন, দুটো হালকা মর্টার তিনি বসিয়ে দেবেন পাহাড়ের মাথায়, যার দায়িত্ব থাকবে দুই থাই স্বেচ্ছাসেবকের ওপর। এতে ট্রেন বিস্ফোরিত হবার পর তা থেকে পলায়মান সৈন্য এবং তাদের সাহায্যে ছুটে আসা সৈন্যেরা পড়ে যাবে অবিরাম গোলাবর্ষণের মুখে।
ওয়ার্ডেন যে সিদ্ধান্ত নিলেন, তা ফোর্স ৩১৬-এর নীতির বাইরে নয়। নীতিটা হচ্ছে: মূল লক্ষ্য অর্জিত হবার পরেও শক্রর যথাসাধ্য ক্ষতিসাধন করতে হবে। ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামা সৈন্যদের মাঝে মর্টারের গোলা আঘাত হানবে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। এতে মনোবল ভেঙে দিশেহারা হয়ে পড়বে তারা, সেই সুযোগে ধীরে-সুস্থে পালিয়ে যাবে জয়েস।
এবারে ফার্ন আর বুনো রডোডেনড্রনের মাঝখানে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে এমন কয়েকটা জায়গা খুঁজে বের করলেন ওয়ার্ডেন, যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র ফিট করা যায়। তারপর থাই স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে থেকে দুজনকে বেছে নিয়ে ভালভাবে বুঝিয়ে দিলেন, তাদের কি করতে হবে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো, পরিকল্পনাটা পছন্দ হয়েছে ওদের।
প্রস্তুতি শেষ হতে হতে বিকেল চারটে বেজে গেল। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে ভাবতে লাগলেন ওয়ার্ডেন, হঠাৎ কানে ভেসে এল বাদ্যযন্ত্রের শব্দ। অবজারভেশনে এসে বিনকিউলারে চোখ লাগালেন। সেতুর ওপরে কেউ নেই। নিশ্চয় কাজ শেষের আনন্দ উদযাপন করছে বন্দীরা। মাঝেসাঝে ওদের গানবাজনার অনুমতি দিয়েছেন মহামান্য সম্রাট, এ-রিপোর্ট অবশ্য তিনি পেয়েছেন কয়েকদিন আগে।
বাজনার প্রায় সাথে সাথেই ওয়ার্ডেন শুনতে পেলেন গান। কে যেন গাইছে পুরনো একটা স্কটিশ পল্লীগীতি। অবজারভেশনের একাকিতে করুণ ওই সুর শুনে ওয়ার্ডেনের চোখ প্রায় ভিজে উঠল। বিষণ্ণতা ভোলার জন্যে একমনে আবার তিনি ভাবতে লাগলেন মিশনের কথা।
সূর্যাস্তের আগে আগে মনে হলো, একটা ভোজ হতে যাচ্ছে। বন্দীরা গিয়ে ভিড় জমাল রান্নাঘরের পাশে। ওদিকে সাড়া পড়ে গেছে জাপানী কোয়ার্টারেও। ছুটোছুটি করছে ওরা, চিৎকার করছে, গড়িয়ে পড়ছে হাসিতে। কাজ শেষের আনন্দটা বোধহয় ওরাও উদ্যাপন করতে চায়।
হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল ওয়ার্ডেনের মাথায়। আজ অনেক কিছু করা সম্ভব। সাইতোর মত অ্যালকোহলিক যে দলের কমান্ডার, মাঝরাতের দিকে তারা সবাই যে পড় মাতাল হয়ে পড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং আজ রাতেই পাততে হবে অতিরিক্ত দু একটা ফাদ। শত্রুর বাড়তি ক্ষতি করার ব্যাপারে ফোর্স ৩১৬-এর সবারই একটা আলাদা টান আছে। কিন্তু ঝোকের মাথায় কিছু করে ফেলার পাত্র ওয়ার্ডেন নন। যুক্তিতর্ক দিয়ে বিষয়টা বিবেচনা করতে বসলেন তিনি। শেষমেশ ভাবলেন, এরকম একটা সুযোগ হাতছাড়া করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সুযোগ যখন এসেছে, তিনিই বা সেতুটাকে একবার কাছ থেকে দেখবেন না কেন?
মাঝরাতের খানিক আগে তিনি পৌঁছুলেন পাহাড়ের পাদদেশে। যা ভেবেছিলেন তা-ই হয়েছে জাপানীদের কোয়াটারে। ভেসে আসা বন্য চিৎকারে তিনি বুঝতে পারছেন ওদের অবস্থা। এখন অবশ্য বিরাজ করছে পরিপূর্ণ স্তব্ধতা। তবু দুই স্বেচ্ছাসেবকসহ রেল-লাইনের অদূরে গাছের সারির আড়ালে বসে শেষবারের মত কান পাতলেন ওয়ার্ডেন। না, কোনও শব্দ নেই কোথাও। সেতু অতিক্রম করে পর রেললাইন চলে গেছে নদীর পাশ দিয়ে। সঙ্গী দুজন থাইকে ইশারা করে তাদের সাথে নিঃশব্দে এগিয়ে চললেন ওয়ার্ডেন রেললাইন অভিমুখে।
পুরো অপারেশনটা নিরাপদে শেষ করার ব্যাপারে ওয়ার্ডেন সম্পূর্ণ নিশ্চিত। জঙ্গুলে এই অঞ্চলে বিপদের বোধ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে জাপানীরা। তবু এক থাইকে প্রহরী হিসেবে রেখে কাজে লেগে গেলেন তিনি।
মনে মনে ওয়ার্ডেন ভেবেছেন একটা টেক্সট-বুক অপারেশনের কথা। প্লাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির স্পেশাল স্কুলে এই পাঠটাই দেয়া হয় প্রথমে। লাইনের দুপাশের নুড়ি সরিয়ে প্রাস্টিক চার্জ পুরে দিতে হবে। ভেবেচিন্তে জায়গামত বসাতে পারলে দুপাউড চার্জই শক্তিশালী ইস্পাতের বারোটা বাজিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।
ডিটোনেটর থাকে প্লাস্টিকের মধ্যে; ওতে চাপ দেয়া মাখনের ভেতরে ছুরি চালানোর মতই সহজ। ডিটোনেটিং কর্ডের সাথে সংযুক্ত ছোট্ট একটা যন্ত্র পুরো ঘটনাটা ঘটায়। দুটো ফলা আছে যন্ত্রটায়, যাদের আলাদা করে রাখা হয় শক্তিশালী স্প্রিংয়ের সাহায্যে। ফলা দুটোর মাঝখানে থাকে প্রাইমার। একটা ফলাকে ঠেকিয়ে রাখা হয় লাইনে, আরেকটার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় পাথর। কর্ড থাকে মাটির নিচে। অভিজ্ঞ দলের পক্ষে এটা আধ ঘণ্টার কাজ। এবং সতর্কতার সাথে কাজ সারলে ফাদটা চোখে পড়ার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না।
এঞ্জিনের একটা চাকা যন্ত্রটার ওপর ওঠার সাথেসাথে ফলা দুটো আঘাত হানবে পরস্পরের গায়ে; প্রাইমার ঘটিয়ে দেবে ডিটোনেশন, সেকেন্ডে কয়েক হাজার ফুট গতিতে গ্যাস ছুটবে কর্ডের ভেতর দিয়ে, এবং বিস্ফোরিত হবে প্লস্টিক। চোখের পলকে পাউডার হয়ে যাবে একটা নির্দিষ্ট এলাকার লাইন। ট্রেন লাইনচ্যুত হবে, ভাগ্য ভাল থাকলে উন্টেও যেতে পারে এঞ্জিন। এই প্রক্রিয়ার একটা বিরাট সুবিধে হলো, যেহেতু ট্রেনের চাকাই যন্ত্র চালু করে দেয়, এজেন্ট সেসময় থাকতে পারে এক মাইল বা তারচেয়েও বেশি দূরে। আরেকটা সুবিধে এই, কোনও জন্তু-জানোয়ারের দ্বারা এটা অসময়ে বিস্ফোরিত হবার ভয় নেই। যন্ত্রটা চালু করতে সত্যিকারের ভারি ওজন, যেমন ট্রেনের এস্ক্রিন বা বগির প্রয়োজন।
মনে মনে ব্যাপারটা সাজাতে লাগলেন ওয়ার্ডেন: ব্যাঙ্কক থেকে আসা প্রথম ট্রেনটা সেতুর সাথেই উড়ে গিয়ে পড়বে নদীতে। অচল হয়ে যাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়ার জন্যে দানবের মত খাটতে শুরু করবে জাপানীরা। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, কিংবা মাসের পর মাস অবিরাম পরিশ্রমের পর আবার নির্মিত হবে সেতু। প্রথম ট্রেনটা নির্বিঘ্নেই পার হয়ে যাবে, কিন্তু বিস্ফোরিত হবে দ্বিতীয় ট্রেনটা। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি তারা অনুভব করবে মানসিক চাপ। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি চার্জ ব্যবহার করলেন ওয়ার্ডেন। এখন সবকিছু ভালয় ভালয় ঘটলে এঞ্জিনসহ কয়েকটা বগি গিয়ে পড়বে পানিতে।
এসব কাজে ওয়ার্ডেন ওস্তাদ। ফলে খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেল প্রাথমিক স্তর। নতুন হলেও ভালই সাহায্য করল স্বেচ্ছাসেবক দুজন। ঊষার এখনও দেরি থাকায় সেতুর কয়েকশো গজ উল্টোদিকে একটু ভিন্ন ধরনের আরেকটা ফাঁদ পাতলেন ওয়ার্ডেন। মিশনে এসে এরকম রাতের সুযোগ গ্রহণ না করাটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
এবারেও দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন ওয়ার্ডেন। একই সেক্টরে দু-দুবার ক্ষগ্রিস্ত হবার ফলে খুব সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়বে শক্ররা। কিন্তু দুবার সফল আক্রমণ চালানো গেলে তৃতীয় বারই বা যাবে না কেন? দ্বিতীয় ফাঁদটা ওয়ার্ডেন এমনভাবে লুকিয়ে রাখলেন যে প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা না খুঁজলে সেটা চোখে পড়া অসম্ভব। তা ছাড়া জিনিসটা কাজ করে একটু দেরিতে। প্রথম ট্রেনের ওজনে বিস্ফোরিত হবার বদলে স্রেফ চালু হয়ে যাবে যন্ত্রটা। দুদুবার এভাবে আঘাত পেলে প্রথম ট্রেনটা সাধারণত পাঠানো হয় পাথর বা অন্য কোনও বাজে জিনিসে বোঝাই করে। তো, প্রথম ট্রেনটা দিব্যি পার হয়ে যাবার পর হাঁপ ছেড়ে শত্রুরা ভাববে, শেষ হয়েছে তাদের দুর্ভাগ্যের সময়, আর তার পরপরই উড়ে যাবে দ্বিতীয় অর্থাৎ আসল ট্রেনটা।
মূল টার্গেটে আঘাত হানার সাথেসাথে কখনোই ধরে নেবে না যে অপারেশন শেষ হয়েছে, বরাবর এই শিক্ষাই দিয়ে আসছে পাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। বরং তারপরেও শক্রর যথাসাধ্য ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করবে। শিক্ষাটা মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন ওয়ার্ডেন। আর তাই দ্বিতীয় ফাদটা খুঁজে পাবার আর কোনও সম্ভাবনা নেই, সে-বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন শক্রর আরও কোনও ক্ষতি করার কথা।
অ্যান্টি-পার্সোনেল কিছু অস্ত্র তাঁর কাছে আছে। এর ভেতরে থাকে একটা বুলেট, যা ফোটাতে একজন মানুষের ওজনই যথেষ্ট। পায়ের চাপ পড়ার সাথে সাথে বুলেট ছুটে গিয়ে ফুটো করে ফেলে পা, কিংবা সৌভাগ্যক্রমে, সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটলে আঘাত হানে কপালে। ফাঁদ পাতা রেললাইনের আশেপাশে এগুলো পুঁতে রাখার ব্যাপারে পূর্ণ অনুমোদন আছে পাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির। বিস্ফোরণের পর টিকে থাকা গুটিকয় সৈন্য প্রাণভয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে পড়ে এই ফাঁদে।
সবগুলোই ছড়িয়ে রাখতে পারলে, খুশি হতেন ওয়ার্ডেন, কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন তিনি। স্রেফ সামান্য মজা পাবার খাতিরে মূল টার্গেটকে বিসর্জন দেয়ার ঝুঁকি নেয়া চলে না। হঠাৎ যদি কোনও প্রহরীর পা পড়ে ওখানে, তৎক্ষণাৎ চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করবে জাপানীরা।
প্রথম ঊষার আলো ফুটতে শুরু করেছে। ওয়ার্ডেন ফিরে চললেন অবজারভেশন পোস্টের দিকে।
১৯.
হঠাৎ চমকে উঠল এক স্বেচ্ছাসেবক। পাহাড়ের মাথায় যে ফার্নের জঙ্গল, সেখান থেকে একটা শব্দ ভেসে এসেছে তার কানে। চার থাই, একেবারে স্থির হয়ে রইল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। টমিগান আঁকড়ে ধরলেন ওয়ার্ডেন, আর ঠিক তখনই শোনা গেল নিচু তিনটে শিস। পাল্টা শিস দিল এক থাই, তারপর হাত নেড়ে ঘুরল ওয়ার্ডেনের দিকে।
এক নম্বর, বলল সে।
একটু পরেই স্থানীয় দুজন লোকের সাথে সিয়ার্স এসে হাজির হলেন অবজারভেশন পোস্টে।
জানতে চাইলেন, শেষ খবর কি?
সব ঠিক আছে। তিন দিন এখানেই আছি আমি। ঘটনা ঘটবে আগামীকাল। আজ রাতে কোনও এক সময় ট্রেনটা ব্যাঙ্কক ত্যাগ করে আগামীকাল বেলা দশটার দিকে এখানে এসে পৌছার কথা। আপনার খবর কি?
সব প্রস্তুত, বসে পড়লেন সিয়ার্স।
এতক্ষণে স্বস্তি পেলেন তিনি শুধু মনে হচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে জাপানীরা আবার প্রোগ্রাম পরিবর্তন করে না ফেলে। ওয়ার্ডেনও শান্তিতে ছিলেন না গত রাতে। জানতেন, বিস্ফোরক স্থাপন করা হবে সেতুতে। ক্ষীণতম শব্দ শোনার জন্যে উত্তর্ণ হয়ে ছিলেন তিনি। প্রার্থনা করছিলেন, কিছু যেন ওদের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। সুখের বিষয়, অস্বাভাবিক কোনও শব্দ কানে আসেনি। ভোরেই তার সাথে যোগ দেয়ার কথা ছিল সিয়ার্সের, কিন্তু দশটা পেরিয়ে গেছে।
তবু ভাল যে এলেন শেষমেশ। আমি তো রীতিমত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।
সারাটা রাত কেটেছে ওখানে।
ভালভাবে এবার ওয়ার্ডেন তাকালেন সিয়ার্সের দিকে। এক নম্বরের সারা শরীরে ক্লান্তির চিহ্ন। কাপড়-চোপড় এখনও স্যাতসেঁতে, চোখের নিচে কালি, মুখে খোচা খোচা দাড়ি। ব্র্যান্ডির ফ্লাস্কটা এগিয়ে দিলেন ওয়ার্ডেন। কাঁপা কাঁপা হাতে (সটা চেপে ধরলেন সিয়ার্স। দুহাতেই আচড় আর কাটার দাগ, আঙুলগুলো মড়ার মত সাদা। এবারে শুকনো একটা শার্ট আর হাফপ্যান্ট এগিয়ে দিলেন ওয়ার্ডেন।
তুমি শিওর। আজ আর নতুন কোনও খবর নেই? সিয়ার্সের উদ্বেগ পুরোপুরি দূর হয়নি।
সম্পূর্ণ নিশ্চিত। আজ সকালেও সঙ্কেত পেয়েছি।
এক ঢোক ব্র্যান্ডি খেয়ে ধীরে ধীরে হাত ম্যাসেজ করতে লাগলেন সিয়ার্স।
কঠিন কাজ, কেঁপে উঠল তার শরীর। ঠাণ্ডা ওই পানির কথা জীবনে ভুলব। তবে ভালয় ভালয় শেষ হয়েছে সবকিছু।
ছেলেটা কেমন আছে?
চমৎকার! এক মুহূর্তের জন্যে কাজে ঢিলে দেয়নি, তবু ক্লান্তির কোনও চিহ্ন নেই। ইতোমধ্যেই ডান তীরে পজিশন নিয়ে নিয়েছে। এখন থেকেই থাকতে চায় ট্রেনের অপেক্ষায়।
ওরা খুঁজে পাবে না তো?
মনে হয় না। ঝুঁকি অবশ্য আছে, কিন্তু সে-ঝুকি নেয়া যায় আমরা যা ভাবছি, ট্রেন তার চেয়ে অনেক আগে এসে পড়তে পারে অসতর্ক অবস্থায় অন্তত ধরা পড়ার কোনও সম্ভাবনা ওর নেই। যে ঝোপটায় ও আছে, নদী ছাড়া আর কোনওদিক থেকে সেখানে যাবার উপায় নেই। এখান থেকে সম্ভবত জায়গাটা দেখা যাবে। ঝোপের ভেতর থেকে সেতু ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না জয়েসের, কিন্ত এগিয়ে আসা ট্রেনের শব্দটা কানে যাবে ঠিকই।
আপনি সাথে গিয়েছিলেন? যা। পজিশনটা নিখুঁত। বিনকিউলার তুলে চোখে লাগালেন সিয়ার্স।
সঠিকভাবে ওর অবস্থান আন্দাজ করা অবশ্য কঠিন, বললেন তিনি। এখান থেকে সবকিছুই অন্যরকম লাগছে। তবে জায়গাটা খুব সম্ভব নদীর পানিতে ডাল ছুঁয়ে থাকা ওই বড় লাল গাছটার গজ দশেক পেছনে।
তার মানে, সব এখন নির্ভর করছে ওর ওপর।
হ্যাঁ। সব নির্ভর করছে ওর ওপর। এবং এ-ব্যাপারে পুরো আস্থা আছে আমার।
ছুরি সাথে নিয়েছে?
হ্যাঁ। এবং প্রয়োজনের সময় ওটা ব্যবহার করতে পারবে, সে-বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।
এসব ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না।
জানি। তবু আমি নিশ্চিত। পরে?
নদীটা পেরোতে আমার লেগেছে পাঁচ মিনিট। জয়েসের সঁতারের গতি আমার প্রায় দ্বিগুণ। তা ছাড়া সে সময় কাভার দেয়ার জন্যে আমরা তো আছিই।
এবারে নিজের নেয়া ব্যবস্থাগুলোর কথা সিয়ার্সকে জানালেন ওয়ার্ডেন। রাতের ওই কাজের আগে আঁধার নামার ঠিক আগেও একবার বেরিয়েছিলেন তিনি। হালকা মেশিনগান বসাবার উপযুক্ত একটা জায়গা নির্বাচন করেছেন
সেসময়, তা ছাড়া রাইফেলসহ কয়েকজন বাইকেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেছেন মনে মনে। দুই মর্টারের সাথে হালকা মেশিনগান আর রাইফেলগুলো যোগ হলে অনেকক্ষণ চলবে প্রতিরক্ষার কাজ।
ওয়ার্ডেনের পর নিজের কাজে বিবরণ দিতে শুরু করলেন সিয়ার্স। সব শুনে ওয়ার্ডেনের মনে হলো, ভাগ্যিস গত রাতে তিনি ওদের সাথে থাকেননি। আগামীকাল পর্যন্ত আর কিছুই করবার নেই। তা ছাড়া সব এখন নির্ভর করছে জয়েসের ওপর। এ-মুহূর্তে শত্রুপক্ষের তীরে ঝোপের ভেতরে শুয়ে থাকা নাটকের মুখ্য অভিনেতাটির ব্যাপারে উদ্বেগ ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন দুজনে।
প্ল্যানটা অনুমোদন করার পর অ্যাকশনে যার যার ভূমিকা বুঝিয়েই ক্ষান্ত হননি এক নম্বর। রীতিমত মহড়া দিয়ে নিয়েছেন, যাতে আসল কাজের সময় যেকোনও ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে তৈরি থাকে সবাই।
পাইলগুলোতে নম্বর দেয়াসহ সেতুর একটা ছবি এঁকে কোন কোন পাইলের গায়ে চার্জ বসানো হবে, সেটা পর্যন্ত বুঝিয়ে দিয়েছেন ওয়ার্ডেন।
কিন্তু শুধু পেপার-ওয়ার্কে সন্তুষ্ট হবার বান্দা এক নম্বর নন। ক্যাম্পের অদূরেই ছিল একটা সরু-নদী। তার ওপরের পরিত্যক্ত সেতুটাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল নৈশকালীন মহড়া। বিস্ফোরকের ভূমিকা পালন করল বালির বস্তা। বিস্ফোরক বসাবার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত–সিয়ার্স, জয়েস আর স্থানীয় দুজন স্বেচ্ছাসেবক বাঁশের একটা ভেলা ঠেলতে ঠেলতে ভেসে চলল ধীরে ধীরে। বিচারক হিসেবে ওয়ার্ডেন এতই নির্দয় যে মহড়া একশো ভাগ নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাউকে ছাড়েননি।
পুরোপুরি ওস্তাদ হবার পর রওনা দিয়েছে দলটা। গাইডেরা তাদের নিয়ে এসেছে সেতুর অনেকটা উজানে, যাতে নিরাপত্তা ব্যাহত হবার কোনও সম্ভাবনা না থাকে। স্থানীয় বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক সাথে এসেছে মুটে হিসেবে।
বারো পাউন্ড করে চার্জ দিয়ে তৈরি হলো একেকটা বিস্ফোরক। প্রত্যেকটা সারিতে পরপর ছটা অর্থাৎ মোট চব্বিশটা পাইলের গায়ে বসানো হবে সেগুলো। চব্বিশটা বিস্ফোরকের আঘাতে ধুলো হয়ে যাবে প্রায় তিরিশ গজ এলাকার বীম, ট্রেনের ভার বহনে অক্ষম সেতু সোজা নেমে আসবে নিচে। দুর্ঘটনার কথা বিবেচনা করে বারোটা অতিরিক্ত বিস্ফোরক এনেছেন সিয়ার্স। দুর্ঘটনা না হলে ওগুলোর সাহায্যে জ্বালা বাড়ানো যাবে শক্রর। শ্রেষ্ঠ এজেন্ট হয়ে তিনি তো আর ফোর্স ৩১৬-এর মূলমন্ত্র ভুলে যেতে পারেন না!
একেকটা বিস্ফোরকে কতখানি করে চার্জ ব্যবহৃত হবে, সেই সিদ্ধান্তও ঝোঁকের মাথায় নেয়া হয়নি। জয়েসের পর্যবেক্ষণ অনুসারে চুলচেরা হিসেব করে দেখা গেছে, যে-কোনও ধাতুতে তৈরি বীম ওঁড়ো করে দেয়ার পক্ষে দুপাউন্ডের চার্জই যথেষ্ট। আর আট পাউন্ড দিলে তো কোনও কথাই নেই। কিন্তু তার পরেও চার্জ বাড়াবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এক নম্বর।
সিদ্ধান্তটা নেয়ার পেছনে অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। প্লাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির আরেকটা নীতি হলো, টেকনিশিয়ানরা যে হিসেব দেয় সবকিছুই তার থেকে খানিকটা বাড়িয়ে ব্যবহার করা। স্কুলে থিয়োরেটিক্যাল ট্রেনিং শেষ হবার পর এ-বিষয়ে সংক্ষিপ্ত একটা ভাষণ দেন কর্নেল গ্রীন।
প্রয়োজনের সময়, বলেন তিনি, হিসেব মতই জিনিস নেবে, তারপর যোগ করবে সামান্য কিছু। শক্ত অপারেশনে প্রত্যেকটা বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া দরকার। যদি মনে কোনও সন্দেহ দেখা দেয়, এক পাউন্ড চার্চ কম দেয়ার চেয়ে একশো পাউন্ড বরং বেশি দেয়া ভাল। রাতের পর রাত ঘুম হারাম করে, নিজের এবং সঙ্গীদের জীবন ঝুঁকির মুখ ঠেলে দিয়ে ধ্বংসের যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়। সেটা যদি বানচাল হয়ে যায় কয়েক পাউন্ড চার্জ বাঁচাতে গিয়ে তার চেয়ে বিশ্রী ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। হয়তো ক্ষতিটা হলো আংশিক–খানিকটা বেঁকে গেল বীম, যা খুব সহজেই মেরামত করে ফেলল শত্রুর। কথাগুলো বললাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। আমার নিজেরই একবার এমনটা ঘটেছিল। মিশনে এটাই সবচেয়ে হতাশাজনক।
এরকম দুর্ঘটনার কথা সেয়ার্স পারেন না। তবে খুবই বেশি জিনিস সাথে নিয়ে নিজেদের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটানোও আবার কোনও কাজের কথা নয়।
জিনিস বইতে অবশ্য খুব একটা অসুবিধেয় পড়তে হয় না। প্লাস্টিকের একটা বিরাট সুবিধে হলো, এর ঘনত্ব পানির সমান। ফলে একজন সাঁতারু অনায়সেই অনেক চার্জ বয়ে নিয়ে যেতে পারে।
ঊষাকালে তারা পৌঁছেছে কওয়াই নদীর তীরে। মুটেদের বিনয় করে ঝোপে ঢুকে অপেক্ষা করেছে রাত নামার।
সময় কাটতে চাইছে না, হঠাৎ বলে উঠলেন ওয়ার্ডেন। ঘুম পাচ্ছে আপনার?
মোটেই না। কাল থেকেই ঘুম হারাম হয়ে গেছে। জানোই তো, জিরো আওয়ারের আগে মনের অবস্থা হয়? সারাটা বিকেল গল্প করেছি আমি আর জয়েস। আসলে সেতুর ওপর থেকে ওর মনটা সরিয়ে রাখতে চাইছিলাম। সারাটা রাতই ও পাবে ওসব চিন্তা করার জন্যে।
কি গল্প করলেন আপনারা? কৌতূহল অনুভব করলেন ওয়ার্ডেন।
সিভিলিয়ান জীবনের কিছু কথা বলল ও। ছোকরার ভেতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা আছে। কেরিয়ারটা মোটই উল্লেখযোগ্য নয়, অবশ্য সেরকম কোনও ভানও ও করেনি। বড় একটা এঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে ও ছল ড্রাফটম্যান—এরকমের উন্নতমানের অফিস বয় বলতে পারো। এ ধরনের চাকুরির ব্যাপারে আমার অন্তত সেরকমই ধারণা। ওয়ার্ক-রুমে সমবয়সী জনা চল্লিশেক ছোকরা সারাদিন ধরে ঝুঁকে আছে ড্রয়িং-বোর্ডের ওপর—দেখেননি? যখন আবার কাজ নেই, তখনও অঙ্ক কষা আছে। মোটকথা, উত্তেজনা বলতে কিছু নেই। কাজটায় ওর প্রাণও বাঁধা পড়েছিল বলে মনে হয় না, তাই যুদ্ধ শুরু হতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ডেস্কের জীবনে বন্দী একটা ছেলে ফোর্স ৩১৬-তে যোগ দিয়েছে, ভাবতে কেমন যেন অদ্ভুতই লাগে।
অদ্ভুত আর এমন কি, বললেন ওয়ার্ডেন, ফোর্স ৩১৬-তে ছোকরারাও আছে। হ্যাঁ, ওই ধরনের ছেলে আমি দেখেছি দুচারটে। খুব খারাপ নয় ওরা।
খুব ভালও নয়। আসলে খুব ভাল হওয়া ওদের সবার পক্ষে সম্ভবই নয়। তবে অতীতে জীবন নিয়ে ওর ভেতরে কোনও তিক্ততা নেই। খানিকটা বিষণ্ণতা অচ্ছে, এই যা।
জয়েস খুব ভাল ছেলে, আমি নিশ্চিত। তা কি ধরনের ড্রয়িং করত ও?
কাকতালীয় বলো আর যা-ই বলো, ফার্মটা কাজ করত সেতু নিয়। কাঠের সেতু নয়, অবশ্যই। আর কনস্ট্রাকশনের কাজও তারা করত না। ধাতুর তৈরি আর্টিক্যুলেটেড ব্রিজ। ভিন্ন ভিন্ন অংশ তৈরির পর তারা সরবরাহ করত কন্ট্রাক্টরকে–ঠিক মেকানো সেটের মত। অফিস থেকে ও বাইরে বেরোয়নি বললেই চলে। যুদ্ধের আগে দুবছর ধরে সে হাজার হাজার বার এঁকেছে একই অংশের ছবি। কাজটায় খুব কৌতূহল অনুভব করেছে ও, তা বলা যায় না। যে অংশটার ছবি আঁকত ও, সেটা খুব বড় নয়। ওর ভাষায়–গার্ডার। ওর ওপর ছিল এমন এক মডেল আঁকার দায়িত্ব, যা তৈরি হবে খুব হালকা ধাতুতে কিন্তু অনেকটা ভার বহনে সক্ষম। অন্তত ওর বর্ণনায় এমনটাই বুঝেছি আমি, তবে এ-ধরনের মডেলের কথা আগে কখনও শুনিনি। যাই হোক, এর সাথে জড়িত ছিল আর্থিক প্রশ্ন। উপকরণ নষ্ট করাটা ফার্ম একেবারেই পছন্দ করত না। তো, দুবছর ও কাটল এই করে–এই বয়সের একটা ছেলে! সেই গার্ডারের বর্ণনা তুমি যদি শুনতে! রীতিমত গলা কাঁপছিল ওর। আমার মনে হয়, ওয়ার্ডেন, সেই গার্ডারই ওকে এখনকার কাজটার প্রতি উৎসাহী করে তুলেছে।
হ্যাঁ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, বললেন ওয়ার্ডেন। সেতু ধ্বংসের ব্যাপারে এত উৎসাহী আমি আর কাউকে দেখিনি। আমার মনে হয়, সিয়ার্স এসব কাজে উৎসাহী মানুষের পক্ষে ফোর্স ৩১৬ একটা ঈশ্বর-প্রেরিত সুযোগ। অস্তিত্ব না না থাকলে আমরা বোধহয় এটাকে আবিষ্কার করতাম! আপনার কথাটাই ভাবুন না, নিয়মিত সেনাবাহিনীতে থাকতে থাকতে…
আরও তুমিও বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার দিতে দিতে… কারণ যাই হোক, যুদ্ধ শুরুর পরও গার্ডার নিয়েই রীতিমত ব্যস্ত হয়ে ছিল ও। দুবছর পরিশ্রমের পর দেড় পাউন্ড ধাতু বাঁচানো যায়, এমন একটা মডেল ও তৈরি করল। খুব খারাপ নয়, কিন্তু ফার্মের মতে, ও আরও ভাল করতে পারত। তারপর একদিন ফোর্স ৩১৬-এ খ কানে আসতেই অস্থির হয়ে উঠল ও। তবে আবার সেই কথাটাই মনে হচ্ছে আমার। গার্ডারের মডেল না আঁকলে এ-মুহূর্তে ও বোধহয় শত্রুর একশো গজ দূরে ঝোপের ভেতরে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে পারত না।
২০.
শুধু বিকেল নয়, আসলে সারাটা দিনই গল্প করেছিলেন সিয়ার্স আর জয়েস। থাই দুজন গলা নামিয়ে ছিল অভিযানের আলোচনা। মাঝেমাঝে দপ্ করে উঠছিল সিয়ার্সের মাথার ভেতরে। বুঝতে পারছিলেন না, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে ছেলেটাকে নির্বাচন করাটা সঠিক হয়েছে, নাকি তিনি স্রেফ হাল ছেড়ে দিয়েছেন তার আন্তরিক অনুরোধের মুখে।
যে-কোনও পরিস্থিতিতে আমার বা ওয়ার্ডেনের মত ঠাণ্ডা মাথায় মুহূর্তের মধ্যে কাজ করতে পারবে তো? জানতে চাইলেন তিনি শেষবারের মত।
নিশ্চয় পারব, স্যার। সুযোগটা দিয়েই দেখুন না!
সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন সিয়ার্স। এ-বিষয়ে কোনও প্রশ্নই আর করলেন না তিনি।
আঁধার নামার কিছু আগে রওনা দিলেন তারা। নদীর তীর সম্পূর্ণ নির্জন। এসব ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না বলে বাঁশের ভেলাটা তারা তৈরি করেছেন নিজেরাই। দুভাগে ভেলাটা বিভক্ত, তাই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে আনার সময় সুবিধেও হলো বেশ। আস্তে করে পানিতে নেয়ে দুভাগ একত্র করে বাঁধলেন তারা দড়ি দিয়ে। তারপর একটা প্ল্যাটফর্ম মত তৈরি করে বিস্ফোরকগুলো বাঁধলেন তার সাথে। এ ছাড়া দড়ির গোছা, ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক তার, জেনারেটর ইত্যাদির জন্যে রয়েছে আলাদা আলাদা পোঁটলা। ভঙ্গুর জিনিসপত্র মুড়ে নেয়া হলো ওয়াটারপ্রুফ কাগজে। একখানা অতিরিক্ত ডিটোনেটর নিয়ে এসেছেন সিয়ার্স। তাই দুজনে দুটো ডিটোনেটর বেঁধে ফেললেন কোমারে। তাবৎ জিনিসের মধ্যে এই দুটোই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
কোমরের পোঁটলাটা নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তি অনুভব করছিলেন নিশ্চয় কালেম ওয়ার্ডেন।
তুমি তো জানোই, এ-ধরনের জিনিস সাথে থাকলে, সে-কথা ভুলে থাকতে হয়। যাই হোক, নদীতে নামার পর ভেবেছিলাম, যাত্রাটা এখন সহজ হয়ে আসবে, কিন্তু না।
স্থানীয় অধিবাসীদের তথ্য অনুসারে সিয়ার্স হিসেব করছিলেন, সবসুদ্ধ সময় লাগবে আধ ঘণ্টারও কম। তাই পানিতে নেমেছিলেন চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাবার পর। কিন্তু লেগে গেল এক ঘণ্টারও বেশি। সেতুর কাছে ছাড়া কওয়াই নদী সব জায়গাতেই খরস্রোতা। ফলে যাত্রা শুরুতেই ভেসে যার উপক্রম হলো। ভেলা আঁকড়ে কোনওমতে রক্ষা পেল সবাই।
নদীটার কথা যদি ঠিকমত জানতে পারতাম, তা হলে হয়তো আসলাম অন্য পথ ধরে, আর অত দূরে না নেমে নামতাম সেতুর কাছেপিঠে কোথাও। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, ওই স্রোতের মধ্যে দিয়ে সাবমেরিন নিয়ে যেতে কি পরিমাণ অসুবিধে হচ্ছিল।
সাবমেরিন হলো ভেলাটার নাম.। দুপ্রান্তে দুখণ্ড লোহা বেঁধে দেয়া বেশির ভাগ সময় ওটার অর্ধেক ডুবে ছিল পানির নিচে। তা ছাড়া এমনই ভারসাম্যের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ভেলাটায়, যাতে স্রেফ আঙুলের চাপে ডুবিয়ে রাখা যায় পুরোপুরি।
ভীষণ গর্জন করছিল স্রোত। আমরা কখন কোনদিকে গেলাম তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। সামান্য নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সবাইকে যে-কোনওভাবে শুধু আঁকড়ে থাকতে বললাম, ভেলা যেদিকে খুশি যাক। তা-ই করল ওরা। ভেলা ভেসে চলল আপন ইচ্ছেয়। কখনও কখনও আমরা এটাও টের পাচ্ছিলাম না যে সামনে যাচ্ছি নাকি পেছনে। মানে, জানি না অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পারছ কিনা…
পারছি। ভেলায় দু অংশ একত্রে ছিল?
হ্যাঁ। অবিশ্বাস্য হলেও, মাত্র একবার ছাড়া আর কখনোই গোলমাল করেনি ওটা। পরিস্থিতিটা সামলেছে জয়েস। প্রথম বাঁক ঘোরার পর চোখে অন্ধকার যখন কেবল সয়ে আসছে, ভেলাটা ধাক্কা খেলো নদীর মাঝখানে মাথা উঁচিয়ে থাকা বিরাট এক পাথরের সাথে। শূন্যে উঠে গেলাম সবাই। ঢেউয়ের মাথায় উঠে পড়ে জয়েস আরেকটা ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে যাবার আগেই ধরে ফেলল ভেলাটা। পাথরটা আমার চোখে পড়েছিল মাত্র কয়েক ফুট দূরে থাকতে, যখন এড়াবার আর কোনও সময় নেই। আমি শুধু কয়েকবার পা ছুঁড়তে পারলাম, গোটাকতক বাঁশ ঢিলে হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হলো না। থাই দুজন ভেসে গেল। সৌভাগ্যক্রমে তাদের খুঁজে পেলাম খানিকটা ভাটিতে। কিন্তু ছেলেটা কি করল জানো? চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল ভেলার ঠিক নিচে। কেন তা জানো, ওয়ার্ডেন? ভেলার দুটো অংশ যেন আলাদা হয়ে না যায়। ধাক্কায় দড়িগুলো আলগা হয়ে খুলে যেতে শুরু করেছিল ভেলাটা। ভাবার জন্যে মাত্র একটা মুহূর্ত পেয়েছিল জয়েস। সুতরাং দ্রুত বিবেচনার ক্ষমতা আছে ওর, সেই সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস। বাঁশগুলো আঁকড়ে থাকা অবস্থায় ওকে নিয়ে পানির নিচ থেকে বেরিয়ে এল সাবমেরিন, ঠিক স্যামন মাছ যেমন লাফিয়ে ওঠে ঢেউয়ের মাথায়। হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল ডিটোনেটরের কথা। ওর শরীর এখন যে অবস্থায় আছে, ভয়াবহ কিছু ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। এই একবারই আমি সচেতন হয়েছি ব্বিক্ষোরক সম্বন্ধে। অই হোক, প্রায় সাথে সাখেই ঝেড়ে ফেললাম চিন্তাটা। ভয়ের কিছু নেই। ছেলেটা অসাধারণ, ওয়ার্ডেন। সফল ও হবেই।
নিখুঁত সিদ্ধান্ত আর চোখ ধাঁধানো রিফ্লেক্স-অ্যাকশনের চমৎকার উদাহরণ, সায় দিলেন ওয়ার্ডেন।
গলা নামিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন সিয়ার্স, সফল ও হবেই, ওয়ার্ডেন। কেউ ওকে ঠেকাতে পারবে না। বর্তমানে কাজটা ওর ওপর নির্ভরশীল, সেটা ও ভাল করেই জানে। আমরা দুজন এখন দর্শকমাত্র। তবে আমাদের উচিত কাজটা ওর পক্ষে যথাসম্ভব সহজ করে দেয়া।
ভেলার অংশদুটো ভালভাবে বেঁধে আবার রওনা দিল তারা। খানিকটা এগোতে চোখে পড়ল অনেকগুলো পাথর, যেখানে ধাক্কা খেয়ে সৃষ্টি হচ্ছে একটা ঘূর্ণিজ্ল। সেখানেও নষ্ট হলো মূল্যবান কয়েকটা মিনিট।
অবশেষে একসময় চওড়া হয়ে এল নদী। দলের সবার মনে হলো হঠাৎ যেন তারা এসে পড়েছে বিশাল কোনও শান্ত হ্রদে। দুএক মিনিট পরই দেখা গেল সেতুটা।
সিয়ার্স তাকালেন উপত্যকাটার দিকে।
এখান থেকে কী শান্তই না দেখাচ্ছে! অথচ রাতের বেলা ওখানে গেলে জায়গাটা লাগে সম্পূর্ণ অন্যরকম। কোথাও কোনও আলো নেই। ধীরে ধীরে আমরা গিয়ে পৌঁছুলাম সেতুর নিচে। তারপর প্রধান একটা পাইলের সাথে ভেলাটা বেঁধে লেগে গেলাম কাজে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাবার জোগাড়।
আর বিশেষ কোনও অসুবিধে? জানতে চাইলেন ওয়ার্ডেন।
না, তেমন কিছু নয়।
সম্মোহিতের মত সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন সিয়ার্স, যেন সেতু ছাড়া আর কিছুই তার দৃষ্টিপথে নেই।
সবকিছুই এখন মনে হচ্ছে স্বপ্নের মত। এরকম অনুভূতি আমার আগেও হয়েছে, ওয়ার্ডেন। সমস্ত প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন হয়ে যায়, তখন মনে দোলা দেয় অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা। চার্জগুলো যথাস্থানে আছে তো? ঠিক সময়ে চাপ পড়বে তো প্লঞ্জারে? ওখানে, গাছের পেছনে, শত্রুর একশো গজের মধ্যেই রয়েছে জয়েস। সেতুর দিকে চেয়ে চোখজোড়া স্থির। বাজি রেখে বলতে পারি, আমি আসার পর ও এক ইঞ্চিও নড়েনি। তবু ভেবে দেখো, ওয়ার্ডেন, কত কী-ই না ঘটতে পারে আগামীকালের আগে! সাপ তাড়াতে তাড়াতে একজন জাপানী সৈন্য ঢুকে পড়তে পারে জঙ্গলে…না, ওকে রেখে আসাটা বোধহয় আমার উচিত হয়নি। ওর পজিশন নেয়া উচিত ছিল আজ সন্ধ্যায়।
ওর কাছে ছুরি আছে, বললেন ওয়ার্ডেন। যা ভাল বুঝবে, করবে। তারপর কি হলো, বলুন।
দীর্ঘক্ষণ পানিতে ডুবে থাকলে মানুষের চামড়া এত নরম হয়ে যায় যে শক্ত কিছুর সংস্পর্শেই কালশিরা পড়ে যায়। শরীরের মধ্যে হাত আবার সবচেয়ে স্পর্শকাতর। ভেলার সাথে বাধা জিনিসগুলোর গায়ে দড়ি এমনভাবে বসে গিয়েছিল যে বেশ কষ্ট হলো খুলতে।
এখন হয়তো ব্যাপারটা তত কঠিন মনে হচ্ছে না, ওয়ার্ডেন, কিন্তু যে পরিস্থিতিতে আমরা ছিলাম…তা ছাড়া পানির নিচে যখন কাজ করতে হয় নিঃশব্দে…আমার হাতের দিকে দেখো জয়েসেরও একই অবস্থা।
আবার তিনি দৃষ্টি মেলে দিলেন উপত্যকার দিকে। শত্রুপক্ষের তীরে অপেক্ষমাণ ওই ছেলেটির কথা সিয়ার্স মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারছেন না। হাতদুটো তুলে ক্ষতগুলো পরীক্ষা করলেন তিনি, তারপর কাঁধ ঝাকিয়ে আবার ফিরে গেলেন বর্ণনায়।
দুজনের কাছেই ছিল তীক্ষ্ণধার ছুরি, কিন্তু অবশ হাতে সেটা ব্যবহার করাই হয়ে দাঁড়াল সমস্যা। সিয়ার্স টের পেলেন, থাই দুজন আর কোনও কাজেই আসবে না।
এ-ধরনের অসুবিধের কথা আমার মাথায় অনেক আগে এসেছে। তাই রওনা দেয়ার আগেই জয়েসকে বলেছিলাম, হাত আমাদেরই লাগাতে হবে। তো, থাই দুজনের অবস্থা একেবারে কাহিল। একটা পাইল জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপছিল ওরা। তাই আমার জন্যে পাহাড়ের নিচে অপেক্ষা করতে বলে পাঠিয়ে দিলাম দুজনকেই। ওরা যাবার পর সমস্ত দায়িত্ব চাপল আমাদের দুজনের ওপর। তুমি তো জানোই, ওয়ার্ডেন, এসব কাজ শুধু স্ট্যামিনা দিয়ে হয় না। ছেলেটা কাজ করল চমৎকার; আমি কোনওমতে। বোধহয় বুড়িয়ে যাচ্ছি।
প্যাকেট খুলে একটা একটা করে বিস্ফোরক বের করে বসালেন তারা প্ল্যান অনুসারে। সবসময় স্রোত তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। পায়ের আঙুল দিয়ে পাইল চেপে ধরে বিস্ফোরক নামাতে হলো অনেকটা নিচে, যাতে ওপর থেকে চোখে পড়ার সম্ভাবনা না থাকে। দড়ির বাধন শক্ত করতে গিয়ে হাতের তালুতে রক্ত ফুটে উঠল। শেষের দিকে কাজটা তাদের সারতে হলো দাঁত দিয়ে।
কাজের এই অংশেই সময় লেগে গেল বেশি। পরের অংশটুকু অতখানি শ্রমসাধ্য না হলেও করতে হলো খুব সাবধানতার সাথে। ডিটোনেটরগুলোতে এমনভাবে সংযোগ দিতে হলো, যাতে একসাথে ঘটে সমস্ত বিস্ফোরণ। বিস্ফোরকের সার্কিট অনেকটা বৈদ্যুতিক সার্কিটের মত। প্রত্যেকটা উপাদান আলাদাভাবে রাখতে না পারলেই ঘটে যাবে ভয়াবহ ব্যাপার। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে অনেকখানি বেশি তার ব্যবহার করলেন সিয়ার্স।
অবশেষে সবকিছু তৈরি হয়ে গেল। কাজ আমরা খুব একটা খারাপ করেছি বলে মনে হয় না। শেষবারের মত পাইলগুলোকে একনজর দেখব ভেবেছিলাম। কিন্তু জয়েস সাথে থাকায় সে-চিন্তাও বাদ দিলাম। কোনও জিনিসই স্থানচ্যুত হবে না, আমার বিশ্বাস।
হাতের প্রত্যেকটা আঙুল ক্ষতবিক্ষত, শরীর কাঁপছে থরথর করে, তবু কাজ সমাপ্তির দিকে এগোতে দেখার একটা উত্তেজনা পেয়ে বসল তাদের। সাবমেরিন খুলে বশ ভাসিয়ে দিলেন তারা একটার পর একটা। এখন কাজ ভাটির দিকে যাওয়া। ডান তীর অভিমুখে ধীরে ধীরে সাতরে চললেন দুজনে। একজনের হাতে ওয়াটারপ্রুফ কেসে মোড়া ব্যাটারি, আরেকজন চলল তার ছাড়াতে ছাড়াতে। তীরটা অত্যন্ত খাড়া, বুনো লতাপাতা নেমে এসেছে পানির কিনারায়। ঝোপে তার লুকিয়ে রেখে, গজ বারো পথ কেটে তারা প্রবেশ করলেন জঙ্গলে। ব্যাটারি আর জেনারেটর ফিট করল জয়েস।
ওই যে ওখানে, আবার বললেন সিয়ার্স, নদীর পানিতে ডাল ছুঁয়ে থাকা বড় লাল গাছটার গজ দশেক পেছনে। হ্যাঁ, ওখানেই, কোনও সন্দেহ নেই।
সবকিছুই এখন মনে হচ্ছে আমাদের নিয়ন্ত্রণে, বললেন ওয়ার্ডেন। আজকের দিনটিও প্রায় শেষ হয়ে এল, এখনও ওকে কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি। ওঁর ধারে-কাছে কেউ এলে এখান থেকে অবশ্যই দেখতে পেতাম আমরা। ক্যাম্পের আশেপাশেও খুব একটা যাতায়াত চোখে পড়ছে না। বন্দীরা তো গতকালই চলে গেছে।
বন্দীরা চলে গেছে।
অনেক বন্দীকে আমি ক্যাম্প ছাড়তে দেখেছি। ওরা নিশ্চয় কাজ শেষের আনন্দ উদযাপন করতে বেরিয়েছিল। তা ছাড়া জাপানীরাও নিশ্চয় চায় না, এতগুলো বন্দী হাত-পা গুটিয়ে স্রেফ বসে বসে খাক।
এটা তো খুব ভাল সংবাদ!
কিছু বন্দী রয়ে গেছে এখনও। ওরা খুব সম্ভব আহত, হাঁটার শক্তিও নেই। তা আপনি ওকে রেখে এসেছেন শত্রুপক্ষের তীরে, তাই না, সিয়ার্স?
হ্যাঁ, শত্রুপক্ষের তীরে রেখে এসেছি ওকে। আর কী-ই বা করার ছিল আমার? ভোর হয়ে আসছিল। আশা করি কেউ সন্ধান পাবে না ওর।
ওর কাছে ছুরি আছে, বললেন ওয়ার্ডেন। সবকিছুই ঘটে চলেছে চমৎকারভাবে। আলো কমে আসছে ধীরে ধীরে। ইতোমধ্যেই ছায়া ঘনিয়েছে কওয়াই উপত্যকায়। এখন আর কোনও দুর্ঘটনার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
দুর্ঘটনার সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে, ওয়ার্ডেন, বিশেষ করে কেউ যখন সেসম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়। কথাটা আমি যেমন জানি, তুমিও তেমনি জানো। এদুর্ঘটনা কেন ঘটে, তা বলতে পারব না। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন একটা মিশন পাইনি, যেখানে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনামাফিক সবকিছু ঘটেছে।
হ্যাঁ। আমিও লক্ষ করেছি ব্যাপারটা।
ভাবছি, এবার আবার কোন দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। ডান তীরে যখন পৌঁছি, সাথে ছিল ছোট্ট এক ব্যাগ চাউল আর এক ফ্লাস্ক হুইস্কি–ওগুলাকে আমি রেখেছি ডিটোনেটর রাখার মত সাবধানে। এক ঢোক করে খেলাম। আমরা, তারপর ফ্লাস্কটা দিয়ে দিলাম ওকে। আমার কাছে এখন আছে শুধু চাউলের ব্যাগটা। আসার সময় আবার বলল, নিজের ওপর ওর পুরো বিশ্বাস আছে। সুতরাং সব দায়িত্ব ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম আমি।
২১.
একমনে কওয়াইয়ের কলধ্বনি শুনছিলেন সিয়ার্স। হঠাৎ তাকে পেয়ে বসল অদ্ভুত এক অস্থিরতা।
অস্বস্তি নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। বুঝতে পারলেন না, তবে অনুভব করলেন, আশেপাশেই ঘটে গেছে কী যেন একটা।
ব্যাপারটা অস্পষ্ট, কিন্তু ক্রমেই যেন তা স্পষ্ট একটা রূপ নিতে চাইছে। আশেপাশেই ঘটে গেছে কিছু একটা, মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল আবার।
কিছু একটা হয়েছে… ফিসফিস করে বারবার বলতে লাগলেন সিয়ার্স। পরিস্থিতি আঁচ করতে তার কখনও ভুল হয় না। আর সেজন্যেই ব্যাপারটা ধরতে না পেরে তার অস্থিরতা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হলো সত্যিকারের উদ্বেগে। যুক্তি সাজাতে লাগলেন তিনি।
অবশ্যই কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনটা স্বাভাবিক। অবস্থান বিশেষে শব্দ ভিন্নরকমের শোনাতেই পারে। এখন আমি পাহাড়ের পাদদেশে, জঙ্গলের মধ্যে আছি। এখান থেকে প্রতিধ্বনি যেমন শোনা যাবে, পাহাড়ের মাথা বা পানির মধ্যে থেকে নিশ্চয় তেমন শোনা যাবে না। আমি বোধহয় একটু বেশি বেশি ভাবছি…।
আবার তিনি তাকালেন ডালপালার ফাঁক দিয়ে। অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না। ঊষার আলোয় নদীটা দেখা যায় কি যায় না। উল্টোদিকের তীর এখন নিরেট একটা ধূসর তৃপ। জোর করে মনটা তিনি ঘুরিয়ে দিলেন লড়াইয়ের প্ল্যান আর অ্যাকশনের জন্যে অপেক্ষমাণ বিভিন্ন দলের দিকে। জিরো আওয়ার প্রায় এসে পড়েছে। রাতেই তিনি আর চার থাই অবজারভেশন পোস্ট থেকে নেমে পজিশন নিয়েছেন ওয়ার্ডেনের পছন্দ করা জায়গায়। অন্য দুই থাইয়ের সাথে ওয়ার্ডেন নিজে আছেন মর্টারের কাছে। জয়েস এখন সিয়ার্সের ঠিক উল্টোদিকে। ট্রেনের জন্যে সে অপেক্ষা করে আছে চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। সঙ্কেত এসেছে, ট্রেনটা ব্যাঙ্কক ত্যাগ করেছে রাতে।
কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে… হালকা মেশিনগান নিয়ে থাকা থাইটার মধ্যেও এখন ফুটে উঠেছে অস্বস্তি। উবু হয়ে একদৃষ্টে সে চেয়ে রয়েছে নদীর দিকে।
অস্বস্তিটা সিয়ার্স কিছুতেই দূর করতে পারলেন না। ধরা দিতে চেয়েও দিচ্ছে ব্যাপারটা। ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে উঠলেন তিনি ওই রহস্যভেদের জন্যে।
শপথ করে সিয়ার্স বলতে পারেন, প্রভেদ ঘটে গেছে শব্দে। গতকালও যেরকম শব্দ তুলে বইছিল কওয়াই, আজ সেভাবে বইছে না। নাকি বইছে? তার কানে গোলমাল দেখা দেয়নি তো? অন্যরকম শুনতে পাচ্ছেন নাকি সবকিছু?
কিন্তু একইসাথে থাইটার কানেও গোলমাল দেখা দিতে পারে না। কিছু একটা হতেই হবে। হঠাৎ আরেকটা ব্যাপার অনুভব করলেন সিয়ার্স। শুধু শব্দই নয়, গন্ধও পরিবর্তন হয়েছে কওয়াই নদীর। কাদার মত একটা স্যাতসেঁতে গন্ধ ঝাপটা মারছে নাকে।
নদীর পানি কমে গেছে! আঁতকে উঠল থাইটা।
প্রায় একই সময়ে সিয়ার্সও বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। লাল গাছটার ডাল আর পানি ছুঁয়ে নেই। রাতের মধ্যেই নেমে গেছে কওয়াই নদী। কতখানি? এক ফুট?
যে মুহূর্তে বুঝতে পারলেন, একটা ভার যেন নেমে গেল বুকের ওপর থেকে। প্রবৃত্তি তা হলে তাকে ভুল বোঝায়নি। এখনও ঠিকই আছে মাথাটা। নতুন বের হওয়া মাটি জন্ম দিয়েছে ওই গন্ধের।
দুর্ভাগ্য একবারে বোঝা যায় না। প্রবৃত্তি সেগুলো মানুষকে অনুভব করাতে থাকে একে একে।
কথাটা মনে পড়ল বিদ্যমকের মত। তার! বৈদ্যুতিক তারটা! তড়িঘড়ি করে বিনকিউলারটা চোখে লাগালেন সিয়ার্স।
হ্যাঁ, ওই তো পড়ে আছে তার। বিনকিউলার দিয়ে তিনি আগাগোড়া অনুসরণ করলেন তারটাকে।
সহজে অবশ্য ওটা কারও চোখে পড়বে না। তিনি দেখতে পেয়েছেন, তারটা ঠিক কোথায় আছে জানেন বলেই। কিন্তু যে তীরটা দুর্গম ছিল, পানি কমে সেখানে সিঁড়ির মত একটা খাক বেরিয়ে পড়েছে। তবে, ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা জাপানীরা নিচয় নদীর তীরে পায়চারি কতে আসবে না। কপালের ঘাম মুছলেন সিয়ার্স।
তা হলে এখানেও ঘটল দুর্ঘটনা! এক রাত পরে নয়, দুরাত আগেও নয়! যত সতর্কতার সাথেই প্ল্যান করা হোক না কেন, এ-দুর্ঘটনা যেন ঘটবেই। কখনও তা অতি ক্ষুদ্র, কখনও মাঝারি, কখনও অ-ত, আবার কখনও বা এতই বড়, যা মাখা ঘুরিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। পানি কমার সম্ভাবনার কথাটা তাঁর ভাবা উচিত ছিল।
ঘাসবিহীন নদীতীরটা যেন সত্যের মতই নয়। পানি নিশ্চয় অনেকটা নেমে গেছে। এক ফুট দুফুট? আরও বেশি? হায়!
মাথাটা ঘুরে উঠল সিয়ার্সের। একটা গাছের ডাল চেপে ধরলেন তিনি, হাতপা যে কাপছে তা থাইটাকে দেখাতে চান না। এত হতাশ জীবনে তিনি আর একবারই হয়েছেন। হঠাৎ আরেকটা আবহ চিন্তায় ঠাস্ত হয়ে আসতে চাইল তার শরীর।
পানি কি দুকুট নেমে গেছে নাকি আরও বেশি হয় ঈর। বিস্ফোরক! সেতুর পাইলগুলোর গায়ে বসানো পাষ্টিকের বিস্ফোরক! ওগুলো যে দেখা যাবে!
২২.
সিয়ার্স চলে যাবার পর কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে রইল জয়েস। এখন আর কেউ নেই যার ওপর আসা এ চলে, যা-কিছু করার এখন করতে হবে নিজেকে–উপলব্ধিটা তার মগজের ভেতরে আলোড়ন তুলল অ্যালকোহলের মত।
মাথাটা পরিষ্কার হতে প্রয়োজনীয় কয়েকটা পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল সে। এই সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে প্লয়ারে হাত রেখে, গাছে হেলান দিয়ে, সে হয়তো বসেই থাকত সে দিকে চেয়ে।
উঠে পড়ে, কাপড়গুলো খুলে, ছুঁড়ে ফেলে ধীরে ধীরে সে ম্যাসেজ করতে লাগল জমে যাওয়া অঙ্গপ্রতঙ্গ। তারপর আবার জামা ও হাফপ্যান্ট পরে চাউল খেলো কয়েক মুঠা, লম্বা চুমুক দিল হুইস্কিতে। এখন আর পানি আনা সম্ভব নয়, আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। ক্ষতগুলো স্পিরিট দিয়ে ধুয়ে আবার সে বসে পড়ল গাছের পেছনে। সেদিন কিছুই ঘটল না। ঘটার কথাও নয়। পরদিন সকালের আগে আসবে না ট্রেন; কিন্তু ধীরে ধীরে ফিরে আসছে আত্মবিশ্বাস।
বেশ কয়েকবার সেতুর ওপর জাপানী সৈন্য দেখল সে। ওরা কোনও সন্দেহ করেনি, ফলে একবারও তাকায়নি এদিকে। ট্রেনটা সেল ঠিক কোন জায়গায় এলে ধ্বংসলীলা চালাবে, সেটা আন্দাজ করে নিয়ে, তার খুলে ফেলে, বারবার সে চাপ দিতে লাগল প্লারে। অনুশীলন শেষে পারিটা মুছে পরিষ্কার করে ফেলল সে। খুবই ভাল অবস্থায় আছে যন্ত্রটা। তার বিয়েও কাজ করছে চমৎকারভাবে।
বেশ দ্রুত কেটে গেল দিনটা। আঁধার নামতে চুপিচুপি ঢাল বেয়ে নেমে, কয়েক ঢোক ঘঘালা পানি খেয়ে, বোতলটা ভরে, আবার ফিরে এল সে গাছের কাছে। হেলান দিতে তন্দ্রামত একটা ভাব হলো। চিন্তার কিছু নেই। ট্রেনের শব্দ তার কান এড়াবে না, এ-বিশ্বাস আছে। কয়েকটা দিন জঙ্গলে কাটালে বুনো জানোয়ারের সতর্কতা ভর করে খানিকটা।
নানারকম স্বপ্ন তাকে চমকে তুলল বারবার, যেসব স্বপ্নে মিশে আছে তারই অতীত আর বর্তমান।
গার্ডারের সামনে ঝুঁকে পড়ে হিসেব কষছে সে। বিচিত্র ধরনের, একের পর এক। দুবছরের অবিশ্রাম খাটুনির পর ইস্পাত বাঁচল দেড় পাউন্ড।
একসময় তার ওপর ফুটে উঠল বাদামী রঙের চৌকো সব বাক্স, যেমনটা ওয়ার্ডেন এঁকেছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কীভাবে পাইলের গায়ে বসাতে হবে বিস্ফোরক।
মাঝেমাঝে ঘুম ভাঙছে। অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ছে কওয়াই সেতু। অবাস্তবকে সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে বাস্তব।
উষাকালে সিয়ার্সের মতই অস্বস্তি অনুভব করল জয়েস। চোখের সামনে শুধু সেতুর প্ল্যাটফর্ম, নদী অদৃশ্য। তবু মনে হলো, কী যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে কোথাও! ঝোপের ভেতর দিয়ে নদীতীরে আসতেই সে বুঝতে পারল অস্বস্তির কারণ। ঘাসের ফাঁকে এখানে সেখানে বেরিয়ে আছে তারটা।
সিয়ার্সের মত সেও অনুভব করল অপূরণীয় ক্ষতিটা। বিস্ফোরকগুলোর কথা মনে পড়তেই ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চাইল শরীর। এখান থেকে বোধহয় দেখা যাবে পাইলগুলো।
প্রথমে প্রকৃত ক্ষতি নিরূপণের একটা চেষ্টা করল সে। কিন্তু শুধুই তাকে দুলতে হলো আশানিরাশার দোলায়। অনেকক্ষণ পর খানিকটা আশার আলো জ্বলে উঠল তার ভেতরে। বিস্ফোরকগুলো এখনও পানির নিচেই আছে।
কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই সে আবার নিমজ্জিত হলো হতাশায়। এখান থেকে না হয় বিস্ফোরকগুলো দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ওপর থেকে? সেতুর ওপর থেকে? এখান থেকেই কি একেবারে অদৃশ্য? দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল সে। ঢেউ এসে ঝাপিয়ে পড়ল একটা পাইলের ওপর। ঢেউ সরে যেতেই তার মনে হলো, কাঠের হালকা রঙের পাশে বাদামী একটা পোচ। প্রায় সাথে সাথেই অবশ্য সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল। সে খেয়াল করে দেখল, কিছুক্ষণ পরপর ওটা ভেসে উঠছে মাছের পিঠের পাখনার মত। খুব সম্ভব বিস্ফোরকগুলো এখন অবস্থান করছে পানিপৃষ্ঠের ঠিক নিচে। অর্থাৎ, ভাল কোনও প্রহরী প্যারাপেট থেকে ঝুঁকে পড়লেই সব শেষ।
তা ছাড়া, পানি যদি আরও কমে যায়? ওগুলো দেখার জন্যে কাউকে আর কষ্ট করতে হবে না! এই চিন্তাটা তাকে একেবারে অবশ করে ফেলল। এখন কটা বাজে? সূর্য তো উঁকি দিতে চাইছে উপত্যকার পেছন থেকে। পানি আরও নেমে যেতে আর কতক্ষণ লাগবে? ট্রেন তত দশটার আগে আসার কথা নয়। প্রকৃতির একটামাত্র খেয়ালে তাদের এতদিনের ধৈর্য, পরিশ্রম, উদ্বেগ, কষ্ট, সব আজ ব্যর্থতার মুখোমুখি।
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকার পর জয়েসের মনে হলো, সবই এখন ভাগ্যের হাতে। চিন্তাটা কিছুটা হলেও শান্ত করল তাকে। প্রকৃতি যে দুর্ভাগ্যের সৃষ্টি করেছে, তা নিয়ে আশা বা নিরাশা, কোনওটাতেই দোলার কোনও মানে হয় না। বরং বিন্দুমাত্র উদ্যম ব্যয় না করে যত ক্ষুদ্র সম্ভাবনাই থাক, সেটুকু খতিয়ে দেখা ভাল।
বিস্ফোরকগুলো যদি জাপানীদের চোখে পড়ে, খানিকটা আগেই থেকে যাবে ট্রেন। সে ক্ষেত্রে শক্রর হাতে আবিষ্কৃত হবার অপেক্ষায় না থেকে সে চাপ দেবে পাঞ্জারে। সাফল্যটা আংশিক হবে জেনেও চুপ করে থাকা সম্ভব নয়।
তারটার কথা আলাদা। হাঁটতে হাঁটতে তীরের দিকে এলে ওটা যে-কারও চোখে পড়তে পারে। এক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নেয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে। সেসময় হয়তো সেতুর ওপর বা উল্টোদিকের তীরে কোনও সৈন্য থাকবে না। ফলে এখানে যে আসবে, কেউ তাকে দেখতে পাবে না। লোকটা তার দেখতে পাবার সাথেসাথে চিৎকার করে না উঠে দুএক মুহূর্ত নিশ্চয় চুপ করে থাকবে বিস্ময়ে। ওই সময়েই ব্যবস্থা নিতে হবে জয়েসকে, চোখের পলকে। এবং কাজটা করতে হলে একইসাথে নজর রাখা দরকার সেতু আর তীরের ওপর।
আগের জায়গায় ফিরে চিন্তা করতে বসল সে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। জামা আর হাফপ্যান্ট খুলে ফেলল জয়েস, পরনে থাকল শুধুই জাঙ্গিয়া। এ-অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে বন্দীদেরই একজন বলে ভুল করতে পারে। প্লারে আবার সংযোগ দিয়ে সে বের করল ছুরিটা। মিশনে গেলে প্রাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির সবাইকে সাথে রাখতে হয় এই অস্ত্র। আরও আরাম করে বসল জয়েস। এবারে অপেক্ষা।
সময় বয়ে চলল শম্বুক গতিতে, যেন কওয়াইয়ের স্রোতের সাথে তার একটা সম্পর্ক আছে। সূর্যের আলো যতই প্রখর হলো, ততই গন্ধ ছাড়তে লাগল হাতের ক্ষতগুলো। সে-গন্ধ আকৃষ্ট কবুল হরেক রঙের পিপড়ের দলকে। কিন্তু শারীরিক কষ্ট আর যন্ত্রণা এখন তার চিন্তার ধারাকে ব্যাহত করতে অক্ষম।
চিন্তা করতে করতেই একটা আতঙ্ক পেয়ে বসল তাকে। জাপানী কোনও সৈন্য যদি হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এসে পড়ে, উপযুক্ত ব্যবস্থা কি সে গ্রহণ করতে পারবে? তারটা চোখে পড়তেই বিস্মিত হয়ে থমকে দাঁড়াবে সৈন্যটা ঝুঁকে পড়ে তুলতে গিয়েও স্থির হয়ে রইবে দুএক মুহূর্ত। আর ঠিক তখনই আঘাত হানতে হবে জয়েসকে, বিদ্যুৎগতিতে।
প্রতিটা মাংসপেশী অসাড় হয়ে আসতে চাইল। এ কোন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হলো সে? পরীক্ষাটা একাধারে ঘৃণিত এবং আতঙ্কজনক।
স্কুলের নির্দেশগুলো সে মনে করল একে একে। কিন্তু এই আতঙ্ক তাকে ছেড়ে গেল না।
এতদিনে সে বুঝতে পারল, কমান্ডিং অফিসার কেন কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলেন সেই প্রশ্নটা: প্রকৃত প্রয়োজনের সময় এই অস্ত্রটা কি তুমি ঠাণ্ডা মাথায় ব্যবহার করতে পারবে? জটল সেই প্রশ্নের সঠিক কোন জবাব তার জানা নেই। প্রবৃত্তিগত প্রতিক্রিয়া আর ইচ্ছেশক্তির ওপর অবিশ্বাস এসে যাচেছ। বিস্ফোরক বসাবার জন্যে নদীপথে যাবার সময় সব ব্যাপারেই আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছিল সে, অথচ এখন সবকিছুতেই দেখা দিয়েছে ঘোর সন্দেহ। সন্তর্পণে জয়েস তাকাল দুরিটার দিকে।
ফলাটা বেশ লম্বা, ক্ষুরধার। ধাতব হাতলটা খাটো হলেও মুঠো করে ধরার পক্ষে যথেষ্ট।
এই অস্ত্র ব্যবহারের সবরকম কৌশলই শেখানো হয়েছে স্কুলে। শক্ত সামনে থেকে এলে কি করতে হবে, পেছন থেকে কাপিয়ে পড়লে কি করতে হবে, এমনকি কাউকে টু শব্দ কসুতে দিতে না চাইলে কানের পাশে ছুরি চালিয়ে কিভাবে ফাঁক কৃরে দিতে হবে গলাটা–কিছুই বাদ যায়নি। অনুশীলনগুলো এক, দুই, তিন করে বার বিশেক এল সে। তবু নিশ্চিত হতে পারল না নিজের সম্বন্ধে। সারা শরীরে দেখা দিল বিন্দু বিন্দু ঘাম।
বাইরে থেকে কোনও সাহায্য? চারপাশে তাকাল সে। না, কেউ নেই কোথাও। অদ্ভুত এই শব্দ পরিবেষ্টিত জায়গায় সে অষণ রকমের একা। সেতু এখন নিপ্রাণ, অর্থহীন একটা ক মাত্র। পুরো কওয়াই উপত্যকাটাই যেন এখন প্রাগৈতিহাসিক হিস্র জন্ত। সাহায্যের কোনও রকম আশা নেই। খাবার বা পানীয়ও নেই। চিবুনোর মত কিছু একটা পেলেও বোধহয় খানিকটা ভাল লাগত।
আবার তাকাল সে চারপাশে। না, কেউ নেই কোথাও। শিউরে উঠল জয়েস। অথচ দুদিন আগেও এ থাকার জন্যে সে মরে যাচ্ছিল প্রায়। চাইছিল কারও সাহায্য না নিয়ে নিজে কাজটা করতে। এমনকি অনুমতি না পেলে এক নম্বরের ওপর বোধ হয় এই হত সে।
চকিতে কথাটা মনে পড়ে গেল। যা, আতঙ্ক ভুলে থাকার একটা পথ আছে। বলা যায়, একমাত্র পথ। আত্মসোহন। ডুবে যেতে হবে আত্মসম্মোহনে।
চুড়ান্ত মনঃসংযোগ করে চোখের সামনে গার্ডারের মডেল ফুটিয়ে তুলল জয়েস। তারপর বসে পড়ল তার সামনে হিসেব কষার জন্যে। ফলে সেতুর পাশে এসে দাঁড়ানো কয়েকজন জাপানী সৈন্য তার বিস্ময় জাগাতে পারল না।
২৩.
সিয়ার্সের চোখেও পড়েছে জাপানী সৈন্যগুলো।
বিস্ফোরকের ভয়াবহ চিন্তাটা মাথায় আসার পর ঢাল বেয়ে খানিকটা ওপরে উঠেছেন তিনি, যেখান থেকে সেতু আর নদী দুটোই দেখা যায়। পাইলগুলোর চারপাশ বিনকিউলার দিয়ে টিয়ে টিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেবলেন, বাদামী একটা রঙ ঢেউয়ের তালে তালে উঁকি দিচ্ছে আর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। মাথায় চিন্তা চলল ঝড়ের গতিতে। ফোর্স ৩১৬-এর কর্মকর্তারা বলেন, যখন মনে হয় আর কোনও উপায় নেই, তখনও থাকে ছোটটি উপায়। কি জীবনে এই প্রথম বারের মত সত্যিই তিনি কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। অসহায়ত্বের জন্যে নিজের ওপরেই রেগে গেলেন সিয়ার্স।
তীর ছোঁড়া হয়ে গেছে। আরও ওপরে অবস্থানরত ওয়ার্ডেনের চোখেও নিশ্চয় পড়েছে কওয়াইয়ের এই বিশ্বাসঘাতকতা। জয়েস? পরিবর্তনটা কি ও টের পায়নি? কে বলতে পারে, এই দুর্ভাগ্য মোকাবেলার একটা বুদ্ধি ওর মাথায় খেলে যাবে কিনা!
ধীরে ধীরে কেটে গেল অতি দীর্ঘ দুটো ঘণ্টা। জাপানীদের অস্থায়ী কুটিরগুলোও দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। পুরো ইউনিফর্ম পরে ঘোরাফেরা করছে জাপানী কয়েকজন সৈন্য। নদী থেকে একশো গজ দূরে পুরো একটা কোম্পানি ট্রেনের জন্যে অপেক্ষমাণ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এখন ওদের মনোযোগ সম্পূর্ণ দখল করে আছে? সিয়ার্স তেমনটাই আশা করলেন। কিন্তু জাপানী প্রহরীদের একটা দল এ-মুহূর্তে এগিয়ে আসছে সেতুর দিকে।
একজন সার্জেন্টের নেতৃত্বে সেতুর ওপর দিয়ে ওরা এগিয়ে চলল দুটো সারিতে বিভক্ত হয়ে। ওদের কাজ ট্রেন আসার আগে একটা চুড়ান্ত পরিদর্শন করা। কয়েক ধাপ পরপর ওরা ঝুঁকে পড়ল প্যারাপেট থেকে। এ-কাজে ওদের মন নেই, নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন সিয়ার্স। ব্যাপারটা অনেকটা বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকার মত। কাজ সেরে নিজেকে সান্তনা দেয়া যে, দায়িত্বে ফাঁকি দেয়া হয়নি। ওরা তাকাচ্ছে কিন্তু দেখছে না, বললেন সিয়ার্স মনে মনে। ওদের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ যেন ধ্বনিত হচ্ছে তার মাথার ভেতরে। চোখ সরানোর সাহস তার হলো না। প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করার পাশাপাশি তিনি প্রার্থনা করে চললেন ঈশ্বর, শয়তান বা রহস্যময় অন্যান্য শক্তির উদ্দেশে। ইতোমধ্যেই ওরা চলে গেছে সেতুর মাঝ বরাবর। প্যারাপেটের ওপর ঝুঁকে পড়ল সার্জেন্ট, নদীর দিকে নির্দেশ করে কি যেন বলল সামনের লোকটাকে। চিৎকার করে ওঠা থেকে নিজেকে বিরত রাখার জন্যে হাত কামড়ে ধরলেন সিয়ার্স। সার্জেন্ট হাসল। সম্ভবত নদীর পানি কমা নিয়ে কিছু একটা বলেছে সে। আবার এগিয়ে চলল দুজনে। সিয়ার্স ঠিকই ভেবেছেন: ওরা তাকাচেছ কিন্তু দেখছে না। শেষ প্রহরীটাও একসময় চলে গেল। কিছুই ওরা খেয়াল করেনি।
এবার ওরা এগোল তীরের পাশাপাশি। হঠাৎ ঝুঁকে পড়ল এক প্রহরী। লাফ দিয়ে উঠল সিয়ার্সের হৃৎপিণ্ড। কিন্তু না, সোজা হয়ে প্রহরীটা রওনা দিল আবার।
ওরা কিছু দেখেনি, ফিসফিস করে নিজেকেই শোনালেন সিয়ার্স, যেন এ ছাড়া আশ্বস্ত হবার কোনও উপায় তার আর ছিল না। প্রহরীদের দলটা অপেক্ষমাণ কোম্পানির সাথে গিয়ে যোগ না দেয়া পর্যন্ত ওদের ওপর থেকে তিনি চোখ সরাতে পারলেন না।
আমি ওদের একজন হলে, বিড়বিড় করে বললেন তিনি, এতটা অসতর্ক কিছুতেই হতাম না। যে-কোনও ব্রিটিশ সৈন্য ব্যাপারটা অবশ্যই বুঝতে পারত। আহ! ট্রেন আসতে আর বেশি দেরি নেই।
কর্কশ স্বরে আদেশ দিল কে যেন। চমকে উঠে চোখ তুলতেই সিয়ার্স দেখলেন, দূর দিগন্তে কালো একরাশ ধোঁয়ার আভাস। জেনারেল, সৈন্য আর বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছে জাপানী কনভয়।
ভদ্রবীভূত হয়ে এল সিয়ার্সের হৃদয়। রহস্যময় সেই শক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতায় পানি গড়াল দুগাল বেয়ে।
আর কেউ আমাদের ঠেকাতে পারবে না, ফিসফিস করে বললেন তিনি। ভাগ্যের পরিহাস শেষ হয়ে গেছে। ট্রেনটা এসে পৌঁছুবে আর মিনিট বিশেকের মধ্যেই।
উত্তেজনা দমন করে ঢাল বেয়ে নেমে আসতে লাগলেন সিয়ার্স। তাই তিনি দেখতে পেলেন না, কর্নেলের পোশাক পরা একজন ব্রিটিশ উল্টোদিকের তীর ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছেন সেতুটার দিকে।
মাসের পর মাস কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে নির্মিত কওয়াই সেতুর ওপর দিয়ে কর্নেল নিকলসন একবার হাঁটতে চান।
বেশির ভাগ বন্দী এবং সমস্ত অফিসার চলে গেছে দুদিন আগে। প্রথমে তারা যাবে নির্দিষ্ট একটা স্থানে। সেখান থেকে হয় মালয় নয়তো জাপানে।
মহামান্য সম্রাটের আদেশে বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে কওয়াই সেতুর সমাপ্তি উৎসব। কিন্তু কওয়াই ক্যাম্পে যেটা হয়েছে, তার সাথে বুঝি কোনওটারই তুলনা চলে না।
প্রথমে ভাষণ দিলেন কর্নেল সাইতো। আনন্দের সঙ্গে কওয়াই সেতুর সমাপ্তি ঘোষণা করে, কাজের প্রতি বন্দীদের বিশ্বস্ততার উচ্চপ্রশংসা করলেন তিনি। তারপর কর্নেল নিকলসনের পালা। ব্রিটিশ সৈন্যদের আন্তরিক অভিনন্দন জানানোর পর তিনি বললেন, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়নি। প্রতিকূল পরিবেশে তারা যেরকম আচরণ করেছে, জাতির জন্যে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সবশেষে বললেন, এমন নিবেদিতপ্রাণ সৈন্যদের কমান্ডিং অফিসার হতে পেরে তিনি গর্বিত।
ভাষণ শেষে উৎসব। যে-কোনও ধরনের আনন্দ করার অনুমতিই শুধু দিলেন না, সে-আনন্দে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন কর্নেল নিকলসন। ফলে বেশ কয়েকটা কনসার্ট, কৌতক পরিবেশন, বিচিত্র পোশাক পরে যেমন খুশি সাজো, এমনকী ব্যালে নৃত্যও বাদ গেল না।
দেখেছ, ক্লিপটন, বললেন কর্নেল, একবার তুমি আমার সমালোচনা করেছিলে, কিন্তু আমি আদর্শ থেকে সরে যাইনি যেভাবেই হোক, আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে চেয়েছিলাম ইউনিটে। সেটা পেরেছি!
চারপাশে নজর বোলালেন ক্লিপটন। কর্নেল ঠিকই বলেছেন। শারীরিক অবস্থা করুণ হওয়া সত্ত্বেও বন্দীদের মধ্যে যেন ফুর্তির বান ডেকেছে।
পরদিনই পাঠিয়ে দেয়া হলো বন্দীদের। গুরুতর অসুস্থ আর পরাই কেবল রয়ে গেল ক্যাম্পে। কওয়াই সেতুর ওপর দিয়ে প্রথম ট্রেনটা পার হবার দৃশ্য দেখতে না পাবার জন্যে আপসোস করলেন রীভত্স আর হিউজেস। অসুস্থ বন্দীদের সাথে থেকে যাবার অনুমতি পেলেন কর্নেল নিকলসন।
সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কর্নেলের মুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির একটা হাসি। কওয়াই সেতু এখন আর কল্পনার বস্তু নয়। ব্রিটিশ প্রতিভার এই স্বাক্ষর এখন এক গৌরবময় বাস্তব। খানিকটা এগোতেই তিনি টের পেলেন, সেতুটার কোথাও কোনও খুঁত নেই। তবু একবার পরিদর্শন করা দোষের কিছু নয়। জাপানী পেট্রলের রিপোর্টে তার মোটেই আস্থা নেই। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন, একেবারে নিরাপদ পরিস্থিতিতেও শেষ মুহূর্তে উঁকি দেয় বিপদ।
প্রতি পাঁচ-ছধাপ অন্তর অন্তর তিনি ঝুঁকে পড়ছিলেন প্যারাপেটের ওপর। সেতুর মাঝ বরাবর গিয়ে প্যারাপেটের ওপর কুঁকতে তার চোখ গেল একটা পাইলের দিকে। এবং প্রায় সাথে সাথে থমকে দাঁড়ালেন বিস্ময়াভিভূত কর্নেল।
পাইলটার গায়ে ঢেউ ভাঙছে অন্যগুলোর চেয়ে একটু বেশি। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করতে তার মনে হলো, কাঠের গায়ে লেপটে আছে বাদামী একটা পোঁটলা। কয়েক ধাপ এগিয়ে আবার ঝুঁকে পড়লেন তিনি। হ্যাঁ, এই পাইলের গায়েও বাদামী পোটলা।
তাজ্জব কাণ্ড, আপন মনে বললেন কর্নেল নিকলসন।
এবারে তিনি ঝুঁকলেন সেতুর উল্টো পাশে গিয়ে। এখানেও বাদামী একটা পোটলা দেখা যাচ্ছে পানির ইঞ্চিখানেক নিচে। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন কর্নেল নিকলসন। শেষমেশ সেতুর ওপর থেকে নেমে এসে জাপানী প্রহরীদের মত তিনিও এগোলেন তীর ধরে। হাঁটছেন আর বিড়বিড় করে কথা বলে চলেছেন নিজের সাথে
দুদিন আগে ওগুলো দেখা যায়নি। পানি অবশ্য তখন অনেক বেশি ছিল। হয়তো ঢেউয়ে ভেসে আসা নোংরা কোনও জিনিস লেগে গেছে পাইলগুলোর গায়ে। তবে…
অদ্ভুত এক সন্দেহ দেখা দিল তার মনে। ব্যাপারটা বিশ্বাস করা কঠিন, তবু সুন্দর সকালটা মাটি হয়ে গেল কর্নেল নিকলসনের। আবার তিনি উঠলেন সেতুর ওপরে। একটু পরেই নেমে এলেন হতভম্ব হয়ে।
না, এটা হতে পারে না, বললেন তিনি বিড়বিড় করে। যদি না চীনের কম্যুনিস্ট কোনও দল…
অন্তর্ঘাতমূলক কাজ তাঁর মতে একমাত্র দুবৃত্তদেরই সাজে।
না, এটা হতে পারে না, বললেন আবার, কিন্তু মনের ফুরফুরে ভাবটা বজায় রাখা সম্ভব হলো না আর।
ট্রেনটা এখন দেখা যাচ্ছে, তবে এখানে এসে পৌঁছুতে আরও অন্তত দশ মিনিট লাগবে। সেতু আর কোম্পানিটার মাঝখানে পায়চারি করছেন সাইতো। হঠাৎই মনস্থির করে কর্নেল নিকলসন গিয়ে দাঁড়ালেন তার পাশে।
কর্নেল সাইতো, বললেন তিনি, ব্যাপার খুব একটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। ট্রেন যাবার আগে ভাল করে আমাদের বোধহয় একবার দেখা দরকার।
জবাবের অপেক্ষায় না থেকে নেমে এলেন তিনি পানির কিনারায়। ইচ্ছে, ওখানে বাধা ক্যান্টা নিয়ে যাবেন একেবারে পাইলগুলোর কাছে। কিন্তু নামতে না নামতেই তার চোখ পড়ল বৈদ্যুতিক তারটার ওপর। ঐ কুঁচকে কর্নেল নিকলসন এগিয়ে গেলেন সেই দিকে।
২৪.
ঢাল বেয়ে কর্নেল নিকলসনকে তীরের দিকে নামতে দেখে খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না সিয়ার্স। কিন্তু পেছনে কর্নেল সাইতোকে দেখার সাথে সাথে তিনি বুঝতে পারলেন, দুর্ভাগ্য এখনও তাদের পিছু ছাড়েনি। ওদিকে সেতুর ওপরে কর্নেলের ভাবভঙ্গি দেখে সতর্ক হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি জয়েস। কিন্তু কর্নেলের পিছুপিছু তীরে সাইতোকে দেখার সাথে সাথে তার হাত চেপে বসেছে। ছুরির হাতলে।
সিয়ার্সের মনে হলো, জাপানী অফিসারটিকে একরকম টেনে নিয়ে চলেছেন কর্নেল নিকলসন। বিড়বিড় করে আপনমনে কথা বলতে লাগলেন তিনি:
আমাদের কর্নেল ওঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন! ইস, ব্যাপারটা যদি তাকে বুঝিয়ে বলতে পারতাম! এক মিনিট সময়ও যদি পেতাম কথা বলার!
ভেসে আসছে এঞ্জিনের ভুশভুশ ধোঁয়া ছাড়ার শব্দ। জাপানী সব সৈন্য নিশ্চয় এখন প্রেজেন্ট আর্মের জন্যে তৈরি। কর্নেল নিকলসন এবং সাইতোকে এখন ক্যাম্প থেকে দেখা যাবে না। অস্থির হয়ে উঠলেন এক নম্বর। এরকম পরিস্থিতিতে কি করতে হয়, তা প্লাস্টিক অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশনস কোম্পানির সবারই জানা আছে। তিনিও কোমর থেকে খুলে নিলেন ছুরিটা। অবশ্য এটা ব্যবহারের কোনও ইচ্ছে তার নেই। বরং উল্টোপাশের জয়েসকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে চান এ-মুহূর্তের কর্তব্য।
তারের সামনে এসে থেমে গেলেন কর্নেল নিকলসন। পেছনে থপথপ করতে করতে এগিয়ে আসছেন সাইতা। সিয়ার্সের এ-মুহূর্তের অনুভূতি অবর্ণনীয়। মাথার ওপরে ছুরি ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি কথা বলতে লাগলেন জোরে জোরে।
ওই ছেলে এ-কাজ পারবে না! প্রত্যাশার একটা সীমা আছে। অফিসে মডেল একে জীবন কাটানো মানুষের পক্ষে এ-কাজ অসম্ভব! সুতরাং দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হবে। না, এ-কাজ ছেলেটা পারবে না!
সাইতো এসে পাশে দাঁড়াতেই ঝুঁকে পড়ে তারটা তুলে নিলেন কর্নেল নিকলসন।
ওই ছেলে এ-কাজ পারবে না। আর মাত্র তিন মিনিট, তা হলেই এসে পৌঁছুবে ট্রেনটা। না, ছেলেটা পারবে না!
এক থাই রাইফেলের পাশে গুড়ি মেরে বসে আতঙ্কিত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। ছুরিটা সামনে বাড়িয়ে পাথরের মত স্থির হয়ে আছেন সিয়ার্স।
না, ছেলেটা এ-কাজ পারবে না! সর্বশক্তিমান ঈশ্বর! ওর মাথাটা খারাপ করে দাও; রক্তের জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠুক ও – মাত্র দশ সেকেন্ডের জন্যে!
বন্য এই প্রার্থনা শেষ হতে না হতেই জঙ্গলের মাঝে একটা নড়াচড়া লক্ষ করলেন সিয়ার্স। ধীরে ধীরে ফাঁক হয়ে গেল একটা ঝোপ। ছুরি হাতে সন্তর্পণ ঢাল বেয়ে নামছে জয়েস। উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল তার।
সাইতো এখন জঙ্গলের দিকে পেছন ফিরে আছেন, এক হাতে ধরা তাবুটা ইংরেজী কয়েকটা কথা কানে এল সিয়ার্সের:
ব্যাপারটা সত্যিই ভয়াবহ, কর্নেল সাইতো!
ক্ষণিকের স্তব্ধতা। তার ধরে টানছেন জাপানী কর্নেল। অলক্ষিতে জয়ে গিয়ে হাজির হলো দুজনের পেছনে।
হায় ঈশ্বর! চেঁচিয়ে উঠলেন কর্নেল, সেতুতে মাইন বসানো হয়েছে, কর্নে সাইতো! পাইলে যে জিনিসগুলো দেখেছি, ওগুলো বিস্ফোরক! আর এই তারটা…
জঙ্গলের দিকে তাকালেন কর্নেল নিকলসন। সাইলোর হাবভাবে মনে হলো, কথাগুলো তিনি এখনও পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেননি। পলকে চে আছেন সিয়ার্স। ডান থেকে বামে হাত ঝাঁকিয়ে ইশারা করলেন তিনি, প্রা সাথেসাথেই ঝলকে উঠল শাণিত ইস্পাত। পরিচিত পরিবর্তন তৎক্ষণাৎ লন্থ করলেন তিনি জাপানী অফিসারের দেহে।
তা হলে কাজটা ও পারল? হ্যাঁ, এবং পেরেছে খুব ভালভাবেই! এক এদিকওদিক হয়নি ছুরি ধরা হাতটা। মৃত্যুকালীন-আক্ষেপ রু হয়ে গে, সাইােের। জয়েসের বাম হাতটা নেমে এল সদ্য ফাঁক হয়ে যাওয়া গলার পাশে মুমূর্ষু অফিসারটির শ্বাসরোধ করতে চায় সে, সেইসাথে থামাতে চায় নিজে শরীরে শুরু হয়ে যাওয়া কাঁপুনি।
সাইলোর শরীর ওপরে পড়ায় রক্তে ভিজে গেছে জয়েস। হত্যাকাণ্ডটার কম মনে পড়তেই অসাড় হয়ে গেল সে। ঝোঁকের মাথায় প্রথম রাউন্ডটা জিতে গেলে, বুঝতে পারল না, এখন কি করা উচিত। শেষমেশ একটা জোর ধাক্কা দিল সে আধপাক ঘুরে পানিতে গিয়ে পড়ল নিপ্রাণ দেহটা।
চারপাশে একবার দৃষ্টি বোলাল জুয়েস। দুই তীরে কেউ নেই। জয়। হয়েছে, কিন্তু আতঙ্ক এখনও দূর হয়নি। হাটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে সাধারণ দুচারটে টুকিটাকি এখনও বাকি। তার মধ্যে প্রথম হলো, এই ব্যাপার ব্যাখ্যা করা। তবে দুটো কথা বললেই সম্ভবত যথেষ্ট হবে! নিল দাড়ি আছেন কর্নেল নিকলসন, ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি হতভম্ব হয়ে গেছেন।
অফিসার! ব্রিটিশ অফিসার, সার! বিড়বিড় করে বলল জয়েস। সেতু ধ্বংস করা হবে। সরে দাঁড়ান!
নিজের কণ্ঠ অপরিচিত ঠেকল তার কাছে। প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণ করুন কষ্ট হলো ভীষণ। তবু ইনি যেন সে কথাগুলো শুনতে পর্যন্ত পাচ্ছেন না!–
ব্রিটিশ অফিসার, সার! বলল সে আবার। কলকাতা থেকে ফোর্স ৩১৬ কমান্ডাে। সেতু উড়িয়ে দেয়ার আদেশ।
সামান্য একটু নড়ে উঠলেন কর্নেল নিকলসন। অদ্ভুত এক আলোয় জ্বল লাগল তাঁর চোখজোড়া। দুএক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কঁাকা স্বরে বললেন:
সেতু উড়িয়ে দেবে?
চলে যান, স্যার। ট্রেন আসছে। নইলে ওরা ভাববে, আপনিও ঘটনার সাথে জড়িত আছেন।
স্থির হয়ে রইলেন কর্নেল নিকলসন।
আর কথা বলার সময় নেই। পরিষ্কার কানে আসছে এঞ্জিনের ধোঁয়া ছাড়ার শব্দ। জয়েসের মনে হলো, যে-কোনও মুহূর্তে এখন বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে পা দুটো। আসল কাজটা এখনও বাকি। ঝোপে ফিরে যাবার জন্যে হামাগুড়ি দিয়ে সে উঠতে লাগল ঢাল বেয়ে।
সেতু উড়িয়ে দেবে? আবার বললেন কর্নেল।
এক ইঞ্চিও নড়েননি তিনি। অগ্রসরমান জয়েসের দিকে তাকিয়ে যেন বুঝতে চাইছেন কথাটার অর্থ। হঠাৎ তিনি দ্রুত অনুসরণ করলেন জয়েসকে। ডালপালা সরিয়ে এগোতে এগোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল জয়েস জেনারেটরে ধাক্কা লেগে। তবু চোখের পলকে তার হাত চলে গেল প্লাঞ্জারের ওপর।
সেতু উড়িয়ে দেবে! আবারও বললেন কর্নেল।
ব্রিটিশ অফিসার, স্যার! তোতলাতে লাগল জয়েস প্রায় বিলাপের ভঙ্গিতে। কলকাতা থেকে ব্রিটিশ অফিসার…আদেশ…
কথাটা জয়েস শেষ করতে পারল না। চিৎকার ছেড়ে কর্নেল নিকলসন ঝাপিয়ে পড়লেন তার ওপর:
বাঁচাও!
২৫.
দুজন লোক মারা গেছে। কিছু ক্ষতি সাধিত হয়েছে, কিন্তু ব্রিটিশ কর্নেলের বীরত্বের জন্যে অক্ষত রয়েছে সেতুটা।
কলকাতায় সংক্ষিপ্ত এই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন ক্যাপ্টেন ওয়ার্ডেন, মিশনের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি।
রিপোর্টটা পড়েই কর্নেল গ্রীনের মনে হলো, অদ্ভুত এই ঘটনা সম্বন্ধে এখনও অনেক বিষয় জানার আছে। ফলে ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠালেন তিনি। ওয়ার্ডেন জবাব। দিলেন, তার আর কিছুই বলার নেই। এবারে কমান্ডিং অফিসার সিদ্ধান্ত নিলেন, ওয়ার্ডেনকে ওখানে রাখাটা আর মোটেই উচিত হবে না, সম্ভবত পুরো জঙ্গলে কভু তাশি চালাবে জাপানীরা। বাই স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে যোগাযোগ করার। জলে জল থেকে খানিকটা সরে ড্রপ করা হলো দ্বিতীয় একটা দল। তারপর বঙ্গোপসাগরের এক নির্জন দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া হলো একটা সাবমেরিন। দুসপ্তাহ হেঁটে সেখানে পৌঁছুলেন ওয়ার্ডেন। আরও তিন দিন পর তাঁকে দেখা গেল কলকাতায়।
কর্নেল গ্রীনের সামনে বসে প্রথমে আক্রমণের প্রস্তুতি সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত একটা বিণ দিলেন তিনি, তারপর এসে পড়লেন মূল অপারেশনে। সহজাত শান্ত গলায় বর্ণনা দিয়ে চললেন ওয়ার্ডেন, একটা ঘটনাও বাদ গেল না। কিন্তু গল্প যতই এগোল, পরিবর্তিত হলো তাঁর গলা। গত এক মাস থাই স্বেচ্ছাসেবকদের মাঝে তিনিই ছিলেন একমাত্র শ্বেতাঙ্গ। নাটকের প্রতিটি দৃশ্য তখন টুকরো টুকরো হয়ে আলোড়ন তুলেছে মগজের মধ্যে, যেন ওগুলোকে একত্র করা আর কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু তার যুক্তিবাদী মন সবসময় খুঁজে ফিরেছে ব্যাখ্যা।
মানসিক এই অস্থিরতার ফলেই সম্ভবত শুষ্ক সামরিক রিপোর্টে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইলেন না ক্যাপ্টেন ওয়ার্ডেন
ফোর্স ৩১৬-এর অফিসে বসে এই রিপোের্ট দেয়ার পাশাপাশি তিনি নিজের ভয়, উদ্বেগ, সন্দেহ আর ক্রোধও যেন প্রকাশ করতে চান। তবে কোনও অবস্থাতেই যুক্তিকে বিসর্জন দেয়ার ইচ্ছে নেই তার।
রিপোর্ট শুনতে শুনতে কর্নেল গ্রীন অনুভব করলেন, বিখ্যাত যুক্তিবাদী প্রফেসর ওয়ার্ডেনকে যেন ঠিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবু অসীম ধৈর্যের সাথে শুনে গেলেন তিনি, খুব একটা বাধা দিলেন না তাকে। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও যারা মিশনে চরম ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, তাদের মানবিক অনুভূতি প্রকাশের খানিকটা সুযোগ দেন ফোর্স ৩১৬-এর কমান্ডার।
আপনি হয়তো বলবেন, স্যার, ছেলেটা বোকার মত কাজ করেছে। হ্যাঁ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ওই অবস্থায় ওর চেয়ে ভাল করতেও পারত না আর কেউ। ওর প্রত্যেকটি কাজ আমি লক্ষ করেছি। চোখ সরাইনি এক মুহূর্তের জন্যে। ব্রিটিশ কর্নেলকে ও কি বলছে, তাও মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছিলাম। ট্রেন প্রায় পৌঁছে গেছে, ঠিক সেই সময় কর্নেল ঝাপিয়ে পড়ল ওর ওপর। একটা ব্যাপারই জয়েস বুঝতে পারেনি। জাপানী বুড়োটার গলা কেটে কোনও লাভ হয়নি। কাটতে হত আসল গলাটা। তাই না, স্যার?
একটা জিনিসের অভাব ছিল ওর–অন্তর্দৃষ্টি। ওই জিনিসটি থাকলেই ও বুঝতে পারত, আসল শত্রু কে। সেতুর ওপরে বুড়ো শয়তানটাকে হাটতে দেখলে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কোনও মানুষ সহজেই বুঝত যে, নিজের তত্ত্বাবধানে তৈরি চমক্কার সেতুটার ধ্বংসের কথা চিন্তা করাও বুড়োর পক্ষে অসম্ভব। বিনকিউলারের ভেতর দিয়ে বুড়োর পায়চারি দেখতে দেখতে আমার শুধু আপসোস হচ্ছিল, এটা রাইফেলের টেলিস্কোপ হলো না কেন! পায়চারি করতে করতে বুড়োর মুখে ফুটে উঠল প্রায় পবিত্র একটা হাসি। ফোর্স ৩১৬-তে আমরা যাকে ম্যান অভ অ্যাকশন বলি, স্যার, বুড়ো তার নিখুঁত উদাহরণ। স্রেফ দুর্ভাগ্য ভাকে ডুবিয়ে দেবে, এচিন্তাও বুড়ো করতে পারে না। হাল ছেড়ে দেয়া তার ধাতেই নেই। বুড়োই তো চিকার ছেড়েছিল জাপানীদের উদ্দেশে!
নীল-চোখো ওই বুড়ো শয়তান সম্ভবত সারা জীবন ধরে স্বপ্ন দেখেছে এমন দীর্ঘস্থায়ী কিছু একটা তৈরি করার। শহর বা ক্যাথিড্রাল তৈরির সুযোগ যেহেত নেই, অতএব লাগো সেতুর পেছনে। আর তাই এটা ধ্বংসের চিন্তা করাও তার পক্ষে কঠিন।
সারা জীবন ধরে এই লোকটা কর্তব্যপরায়ণতায় ছিল অটল। কোনও কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন হতে দেখার চেয়ে আনন্দের তার কাছে আর কিছু ছিল না। মোটকথা, সে ছিল অ্যাকশনের পাগল–ঠিক যেমন আপনি, স্যার, ঠিক যেমন আমরা। টাইপিস্ট থেকে আমাদের জেনারেলেরা পর্যন্ত অ্যাকশনের পেছনে ছুটেছে বুঝতে পারি না, এই অ্যাকশনপূজা শেষমেশ কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের। গত এক মাস ধরে আমি শুধু এসব কথাই ভাবছি, স্যার। ভাবছি, ওই বুড়ো গর্দভটা খুবই ভাল ছিল কি মানুষ হিসেবে? খাঁটি একটা আদর্শ ছিল তার? সে-আদর্শ আমাদের আদর্শের মতই পবিত্র? এবং একইরকম? এসব কথাই আমি ভাবছি, স্যার, গত এক মাস ধরে। অ্যাকশনের এই পাগলামি মানুষের বচারবুদ্ধিকে ভোঁতা করে দেয়, যার ফলাফল মারাত্মক হতে বাধ্য। যেমন, আমাদের মারাত্মক একটা ভুল হলো, প্রাচ্যের মানুষকে প্লাস্টিকের সাহায্যে ট্রেন আর সে ওড়াতে শেখানো। তো…
শেষে কি হলো, বলো, শান্ত গলায় বললেন কর্নেল গ্রীন। অ্যাকশন ছাড়া আর কিছুতেই আমার মাথাব্যথা নেই, কথাটা সবসময় মনে রাখবে।
অ্যাকশন ছাড়া আর কিছুই যখন শুনতে চান না, স্যার…গুপ্ত আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এল জয়েস। গতি সাবলীল। আঘাত হানল সে নিখুঁতভাবে। হ্যাঁ, একচুলও এদিকওদিক হয়নি। আরেকটু বিচারবুদ্ধির প্রয়োজন ছিল ওর। তা হলেই বুঝতে পারত, আসল শুক্র কে। বুড়ো এমন দ্রুতভাবে ছুটে গেল ওর দিকে, তারপর বুজনেই গড়াতে লাগল ঢাল বেয়ে। পানির কিনারে গিয়ে থামল। খালি চোখে দেখলে মনে হবে, দুজনেই বুঝি চুপচাপ পড়ে আছে। কিন্তু বিনকিউলার দিয়ে আমি দেখেছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কর্নেল ছিল জয়েসের ওপরে। কর্নেল ওকে পিষে ফেলতে চাইছিল ভারী শরীরের চাপে, ওদিকে জয়েসের দুহাত চেপে বসেছিল কর্নেলের গলায়। সবকিছুই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম পরিষ্কারভাবে। দুজনেই জাপটাজাপটি করছিল সাইতোর লাশের পাশে। হঠাৎই, সার, ও বুঝতে পারল নিজের ভুল। পরিষ্কার দেখতে পেলাম আমি। বুঝতে পারল, আঘাত হানা উচিত ছিল কর্নেল নিকলসনকে।
আমি দেখলাম, ওর হাত আঁকড়ে ধরল ছুরির হাতল। তারপর শক্ত হয়ে গেল ও। মাংসপেশীগুলোর নড়াচড়া পর্যন্ত যেন টের পাচ্ছিলাম আমি। মুহূর্তের জন্যে ভাবলাম, ও বোধহয় মনস্থির করে ফেলেছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে শক্তি বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ওর। আর কোনও কাজ করতে ও অক্ষম–অথবা বলা যায় অনিচ্ছুক। ছুরিটা পড়ে গেল ওর হাত থেকে। পুরোপুরি আত্মসমপর্ণ, স্যার। নিজেকে যেন নিয়তির হাতে সঁপে দিল ও। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল একটামাত্র শব্দ। কোনওদিন কেউ জানবে না, কী ছিল ওটা। শখ, প্রার্থনা, নাকি চরম হতাশার কোনও উচ্চারণ। রক্তের নেশা ওর ছিল না, স্যার, থাকলেও অন্তত বোঝা যায়নি কখনও। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সবসময় শ্রদ্ধা করুত ও আমার বা সিয়ার্সের সাথে কথা বলা শুরু করতেই অ্যাটেনশন হয়ে যেত। আমরা প্রায়ই নিষেধ করতাম। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, ওর উচ্চারিত শব্দষ্টা ছিল–স্যার। হাল ছেড়ে দেয়ার আগে নিশ্চয় ওর কথাটাই বলেছিল জয়েস। সবকিছুই নির্ভর করছিল ওর ওপর। সুতরাং বারোটা বেজে গেল কাজে।
তারপর একসাথে ঘটল অনেকগুলো ঘটনা। আমার মাথার ভেতরে সেসব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল, তবে পরে সেগুলো আলাদা করতে পেরেছি। এগিয়ে আসছে ট্রেন। প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলেছে এঞ্জিনের শব্দ। কিন্তু সে-শব্দ ওই উন্মাদের চিৎকার ছাপিয়ে উঠতে পারছে না। গলা ফাটাচ্ছে সে জাপানীদের উদ্দেশে; ঠিক যেমন গলা ফাটানো হয় প্যারেড গ্রাউন্ডে।
এ-সবই আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, স্যার, আর ওই দেখা পর্যন্তই। অবশ্য ওর জায়গায় থাকলে আমিও হয়তো ওরকমই করতাম। ওর চেয়ে ভাল কিছু করতে পারতাম না এটা নিশ্চিত; কেউই পারত না–শুধু, সম্ভবত, সিয়ার্স ছাড়া। সিয়ার্স! হ্যাঁ, হঠাৎ করেই টের পেলাম, কর্নেলের চিৎকারের পাশাপাশি অন্য একটা চিৎকার ভেসে আসছে। গলাটা সিয়ার্সের। সারা উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার তীব্র কণ্ঠস্বর। ঘোর উন্মাদের কণ্ঠস্বর, স্যার। দুটো শব্দই শুধু বোঝা যাচ্ছিল: ছুরি চালাও! ভুলটা তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন, এবং আমার আগেই। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে।
কিছুক্ষণ পর একজন মানুষকে দেখলাম পানিতে। তীরবেগে সাঁতরে চলেছে। শত্রুপক্ষের তীর অভিমুখে। চিনতে পেরে চমকে উঠলাম। সিয়ার্স! অ্যাকশনের জন্যে একেবারে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। আমার অবস্থাও তাই। সেদিন সকালের ঘটনাগুলোই ছিল আসলে মানুষকে পাগল করে দেয়ার মত। বুঝতে পারলাম, কোনও সুযোগই পাবেন না সিয়ার্স। মনে হলো, তখনই ছুটে যাই। কিন্তু অবজারভেশন পোস্ট থেকে তাঁর কাছে পৌঁছুতে লেগে যাবে দুঘণ্টারও বেশি।
কোনও সুযোগই ছিল না তার। অত জোরে সঁতরে যাওয়া সত্ত্বেও বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেল ওপারে পৌঁছুতে। ট্রেন তখন, স্যার, প্রায় উঠে পড়েছে কওয়াই সেতুর ওপরে! আর ঠিক সেসময় – ঠিক সেসময় আমি খেয়াল করলাম, চিৎকার শুনে ঢাল বেয়ে পড়িমরি করে ছুটে আসছে জাপানী সৈন্যেরা।
পানি থেকে উঠতেই ওরা ধরে ফেলল সিয়ার্সকে। ডানে বামে দুবার ছুরি চালালেন তিনি। তৎক্ষণাৎ খতম হয়ে গেল দুজন সৈন্য। সবকিছুই পরিষ্কার। দেখেছি আমি। জ্যান্ত অবস্থায় ধরা দেয়ার ইচ্ছে ছিল না সিয়ার্সের। কিন্তু রাইফেলের একটা কুঁদো এসে পড়ল তার মাথার পেছনে। সাথে সাথে লুটিয়ে পড়লেন জ্ঞান হারিয়ে। জয়েসও স্থির হয়ে শুয়ে আছে মাটিতে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল কর্নেল। সৈন্যেরা কেটে দিল তারটা। করার আর আমাদের কিছুই রইল না, স্যার।
যখন মনে হয় আর কোনও উপায় নেই, তখনও থাকে ছোটখাট উপায়, মন্তব্য করলেন কর্নেল গ্রীন।
জ্বী, স্যার, ছোটখাট উপায় তখনও থাকে…তারপর শোনা গেল একটা বিস্ফোরণের শব্দ। অদম্য ভঙ্গিতে ছুটে চলা ট্রেনটা উড়ে গেল অবজারভেশন পোস্টের ঠিক নিচে এসে। নিজের হাতে বসানো বিস্ফোরকটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম বেমালুম। লাইনচ্যুত হয়ে এঞ্জিন আর দুতিনটে বগি নদীতে গিয়ে পড়ল। ডুবে গেল কয়েকজন লোক। নষ্ট হলো বেশকিছু খাদ্য আর অস্ত্রশস্ত্র; তবে ক্ষতিগুলো কয়েক দিনেই সামলে ওঠা যাবে–সবসুদ্ধ এই আমাদের ফলাফল। কিন্তু এত অল্প ক্ষতি সত্ত্বেও উত্তেজনাটা ভালই সৃষ্টি হয়েছিল উল্টোদিকের তীরে।
নিশ্চয় চমৎকার জমে উঠেছিল দৃশ্যটা, সান্তনা দিলেন কর্নেল গ্রীন।
জ্বী, স্যার, খুব জমেছিল, বিশেষ করে ওসব দৃশ্য যারা দেখতে ভালবাসে তাদের জন্যে তো বটেই। তাই ভাবতে লাগলাম, কীভাবে আরও জমানো যায় দৃশ্যটা। ফোর্স ৩১৬-এর নীতি আমি ভুলিনি, স্যার। আর কি কি ক্ষতি করা সম্ভব, সে-সম্বন্ধে মাথায় টগবগ করে ফুটতে লাগল চিন্তা।
ইচ্ছে থাকলেই ক্ষতি বাড়িয়ে তোলা যায়, স্বপ্নাচ্ছন্ন কণ্ঠে ভেসে এল কর্নেল গ্রীনের মন্তব্য।
ইচ্ছে থাকলেই…সবাই যখন বলে, কথাটা নিশ্চয় সত্য। ওটাই ছিল সিয়ার্সের আদর্শ।
এক মুহূর্তের জন্যে থামলেন ওয়ার্ডেন; তারপর আবার বলে চললেন অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায়।
মাথাটা খাটাতে লাগলাম, স্যার। খাটাতে লাগলাম যতদূর সম্ভব। ওদিকে দলে দলে সৈন্যেরা তখন ঘিরে ধরেছে জয়েস আর সিয়ার্সকে। নিশ্চল পড়ে থাকলেও দুজনেই তখনও জীবিত।
অ্যাকশন নেয়ার সম্ভাব্য একটা পথই দেখতে পেলাম, স্যার। দুই থাই তখনও বসেছিল মর্টারের কাছে। খুব সহজেই তারা গোলাগুলি বর্ষণ করতে পারবে সেতু কিংবা সৈন্যের দলের ওপর। ওদের যা বলার বলে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি। ওদিকে দুজনকেই তুলে নিয়ে রওনা দিল সৈন্যেরা। জীবিত অবস্থায় ওদের ধরে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে খারাপ আর কিছুই হতে পারে না। পেছনে পেছনে চলেছে কর্নেল নিকলসন, মাথাটা ঝুলে পড়েছে গম্ভীর চিন্তায়। বুড়োটা কি ভাবছে, তাই ভেবে অবাক হচ্ছিলাম আমি, স্যার। তারপর হঠাৎ মনস্থির করে ফেললাম, যদিও তখনও যথেষ্ট সময় ছিল হাতে।
ফায়ারের নির্দেশ দিলাম। তৎক্ষণাৎ দুই থাই শুরু করল কাজ। প্রশিক্ষণ আমরা ওদের ভালই দিয়েছিলাম, স্যার। গোলাগুলির দৃশ্যটা সত্যিই ছিল দেখার মত। মর্টারের দায়িত্ব নিজেই নিলাম। এবং খুব একটা খারাপ হাত আমার নয়।
ভাল ফল পেয়েছিলে? জানতে চাইলেন কর্নেল গ্রীন।
খুব ভাল, স্যার। প্রথম কয়েকটা শেল গিয়ে পড়ল সৈন্যদের ঠিক মাঝখানে। টুকরো টুকরো হয়ে গেল জয়েস আর সিয়ার্স। বিনকিউলার দিয়ে স্পষ্ট দেখেছি আমি। বিশ্বাস করুন, স্যার, কোনও কাজ আধাআধি করার পক্ষপাতী আমি নই। টুকরো টুকরো হয়ে গেল আসলে তিনজন। কর্নেলের কিছুই অবশিষ্ট রইল না। এক ঢিলে তিন পাখি। খুব খারাপ নয় নিশ্চয়!
তারপর? তারপর, স্যার, শেলগুলো উজাড় করে দিলাম আমি। হ্যান্ডগ্রেনেডগুলোও। আমাদের পজিশন নির্বাচন ছিল নিখুঁত। স্বীকার করছি, একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। থাই দুজনও। বাছবিচারহীনভাবে শত্রু খতম করে চললাম আমরা। চারপাশ ভরে উঠল আহতের চিৎকার আর মুমূর্ষুর আর্তনাদে। ক্যাম্প থেকে অন্য জাপানী সৈন্যেরা ছুটে এল লাইনচ্যুত ট্রেন আর সেতুর কাছে। পাল্টা গুলি চালাতে লাগল। দেখতে দেখতে ধূসর-রঙা ধোঁয়ার মেঘ ছেয়ে ফেলল পুরো উপত্যকা। চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল কওয়াই নদী। গোলাগুলি সমস্ত ফুরিয়ে গেল। কুয়াশার মত সেই ধোয়ার আড়ালে পালিয়ে এলাম আমরা।
ওই ঘটনার পর সিদ্ধান্তটা নিয়ে প্রায়ই ভেবেছি আমি, স্যার। অবশেষে নিশ্চিত হয়েছি, আমার আর কিছুই করার ছিল না। অ্যাকশন হিসেবে একমাত্র ওটাই ছিল যথাযথ।
হ্যাঁ, একমাত্র যথাযথ অ্যাকশন, সায় দিলেন কর্নেল গ্রীন।
Leave a Reply